এবং ইনকুইজিশন – অভীক সরকার
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০২০
উৎসর্গ
সঙ্ঘমিত্রা সরকারকে
প্রাককথন
দু-হাজার সতেরো সালের অাগস্ট মাসের এক মশকবহুল সন্ধে। পরম সুহৃদ গৌতম চক্রবর্তীদা-র বাড়িতে বসে আড্ডা দিচ্ছি, সঙ্গী বলতে নবীন প্রকাশনা সংস্থা ‘দ্য কাফে টেবিল’-এর কর্ণধার শ্রীমান অরিজিৎ ভদ্র এবং অগ্রজতুল্য সাহিত্যিক শ্রীরাজা ভট্টাচার্য। আমাদের চারজনের মুখেই চিন্তার ছায়া। যেন কোনো এক অতি জটিল, গভীর এবং গোপন ষড়যন্ত্র রচনা করতে করতে শেষ পর্যায়ে এসে পুরো প্ল্যানের একটা মস্তবড়ো ফাঁক খুঁজে পেয়েছি।
গলাটা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলাম, ‘আমার মত ওই দেড়-শো থেকে তিন-শো মতো, বুঝলে তো?’
অরিজিৎ কোল্ড ড্রিঙ্কসের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে উদাস গলায় বলল, ‘পাঁচ-শো-র কমে তো খরচায় পোষাবে না গুরু। তবে তুমি যদি তোমার বলো তিন-শো-র ওপরে বিক্রি হওয়া প্রতিটা পিসে তোমার কোনো ইয়ের দাবি থাকবে না, তাহলে অবশ্য আলাদা কথা।’
বলেই ছোকরা মনীষী রাজাদা-র দিকে তাকিয়ে একটা আলতো চোখ মারল, স্পষ্ট দেখলুম। গৌতমদা তাঁর বিশাল চেয়ারে কিঞ্চিৎ রসস্থ মুডে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি সামান্য নড়ে ঈষৎ স্খলিত স্বরে বললেন, ‘ভা ভা ভালোই তো, বা বা বাকিগুলোর টাকায় আ আ আমরা না হয় পি পি পিকনিক করব?’
সেই শুনে রাজাদা যে প্রসন্ন উদার হাসিটা বিলিয়ে দিলেন, তার দামই লাখ টাকা!
ব্যাপারটা খোলসা করে বলার আগে কিছু প্রাক্ কথন আবশ্যক।
এই কাহিনিরও আরও বছর দুয়েক আগেকার ঘটনা, তখন এই অর্বাচীন কর্ম সূত্রে মুম্বাইতে পোস্টেড। ফেসবুকে চাট্টি স্বভাবসুলভ ‘ফাইZলামি কইরা’ দিন কেটে যাচ্ছিল। মাঝেমধ্যে লিখি, তাতে কেউ কেউ পরম করুণাবশত লাইক মেরে যান। ভবের হাটে আমি এক স্বীকৃতিবুভুক্ষু নাদান, সেটাকেই স্বষ্কন্ধোপরি ‘শাবাশ বেটা’ মার্কা থাবড়ানো বলে মেনে নিই। এমত অবস্থায় ঋতবাক ব্লগজিনের সম্পাদিকা শ্রীময়ী সুস্মিতা বসু সিং আমাকে ধরে বসলেন একটা ‘অন্যরকম’ গল্প লিখে দেওয়ার জন্য।
আমি অশিক্ষিত মানুষ, সাহিত্যশাস্ত্রে অদীক্ষিতও বটে। কিন্তু সুস্মিতা দেবীর অনুরোধ কিছুতেই ফেলতে পারলাম না। কারণ একে ভদ্রমহিলা অতি জাঁদরেল সম্পাদিকা, তার ওপর রোজ দু-বেলা ফোনে ‘লেখাটা কবে দিচ্ছেন’ মার্কা তাগাদা পেলে কেই-বা সুস্থ থাকে বলুন?
সে যাই হোক। কোনোমতে একটি ছোটোগল্পের প্লট বানালুম, মনে হল হাজার তিনেক শব্দের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু শাস্ত্রে স্পষ্ট লেখা আছে যে সম্পাদক প্রপোজেস, লেখক ডিসপোজেস। শেষমেশ ঠগি, পুনর্জন্ম, শবসাধনা ইত্যাদি নিয়ে লেখা গল্পটির আকার দাঁড়াল প্রায় দশ হাজার! গল্পটির নাম দিলাম ‘শোধ’।
ঋতবাক ব্লগে গল্পটি প্রকাশিত হয়, কথঞ্চিৎ সুখ্যাতিও জোটে। সুস্মিতা বোধ হয় এতটা আশা করেননি, তিনি ধরে বসলেন আরেকটি গল্প লিখে দেওয়ার জন্য। মাথা থেকে হাঁটু, এই দুর্বল শরীরে যা যা খাটানো যায়, সেসব খাটিয়ে আরেকটি গল্প লিখলাম। একটি যুবকের গল্প, বন্ধুর কিউরিও শপ থেকে এক অচেনা তিব্বতি মূর্তি কিনে বিপদে পড়ার গল্প। গল্পের প্রসঙ্গে এল তিব্বত, তন্ত্রসাধনা, বন্ধুর সন্তানের প্রতি এক প্রফেসরের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর রাস্তা থেকে ঘর অবধি উঠে আসা এক পিশাচী। তার নাম দিলাম ডামরী।
আর গল্পের নাম দিলাম ‘ভোগ’।
বলতে নেই, গল্পটি বেশ খানিক জনপ্রিয় হয়। ফেসবুকে, মেসেঞ্জারে, হোয়্যাটসঅ্যাপে দু-চারটে ‘আগে বঢ়ো নওজোয়ান, অউর থোড়া হেঁইসা’ পেয়ে-টেয়ে ধারণা হল যে গল্পটা বোধ হয় খুব একটা খারাপ লিখিনি। ধারণাটা আরও পোক্ত হল যখন পরম সুহৃদ মৌপিয়ালি দে সরকার এবং আমার পার্টনার ইন ক্রাইম শ্রীময়ী অনুষ্টুপ শেঠ ফোন করে নিতান্ত নৈর্ব্যক্তিক স্বরে জানালেন যে ‘ভোগ’ গল্পটা মোটের ওপর ভালোই। তবে আশা করা যাচ্ছে যে লিখতে থাকলে হয়তো একদিন এর থেকেও ভালো গল্প লিখতে পারব।
ইত্যবকাশে একদিন ‘দ্য কাফে টেবিল’-এর কর্ণধার অভিজিৎ ভদ্রর ফোন। ভদ্রলোক তাঁর নামের সঙ্গে মানানসই ভদ্র এবং অতীব শীতল স্বরে জানালেন যে গল্প দুটি নিয়ে তাঁরা বই করতে ইচ্ছুক। তবে আরও অন্তত দুটি বড়ো গল্প চাই, নইলে বইয়ের সাইজ ঠিকঠাক দাঁড়াচ্ছে না। আমি তো হতভম্ব, বইয়ের সাইজ লেখকের আকারের সমানুপাতিক হতে হবে, এ কেমন অন্যায় দাবি, প্রিয়ে?
সে যাই হোক। ততদিনে আমি বৌদ্ধ বজ্রযান নিয়ে ঘোরতর পড়াশোনায় ডুবে আছি। মাথায় উঁকি দিচ্ছে হিন্দুধর্মের দেব-দেবীদের সঙ্গে কয়েক জন বৌদ্ধ দেব-দেবীর আশ্চর্য সাদৃশ্য। হয়তো সেই চিন্তাই ফুটে উঠল আমার পরের গল্প, ‘রক্তফলক’-এ। আমদানি করলাম একটি প্রকৃত ভিলেইন ক্যারেক্টারকে, টেনিয়া। মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম পালযুগে রচিত এক ভয়ংকর অভিশাপের সঙ্গে আধুনিক কলকাতার এক নেশাসক্ত, নারী পাচারকারীর জীবনের গল্পকে। আর সারা গল্পের পটভূমিকা জুড়ে রইলেন এক বৌদ্ধ দেবী, বজ্রবারাহী; যাঁর সঙ্গে অসম্ভব মিল দশমহাবিদ্যার সবচাইতে ভয়ংকরদর্শন দেবী, ছিন্নমস্তার।
আর এই তিনটি গল্প জুড়ে রইলেন বাংলার এক ঐতিহাসিক চরিত্র, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ।
কৃষ্ণানন্দ যখন ‘শোধ’ গল্পে প্রথম আবির্ভূত হন, তখনই আমি একটি অতি গর্হিত কালানৌচিত্য দোষ ঘটিয়ে ফেলেছি। ‘শোধ’ গল্পটি যে সময়ের, কৃষ্ণানন্দ তার শ-দুয়েক বছর আগেকার মানুষ। কিন্তু বাংলার এই মহান তন্ত্রবিদকে গল্পে আনা ছাড়া আমার আর উপায় ছিল না। আমি চেয়েছিলাম এমন একজন ঐতিহাসিক চরিত্রকে আমদানি করতে যিনি তন্ত্রশাস্ত্রে অতি পারঙ্গম এবং একইসঙ্গে যিনি অপশক্তির বিপ্রতীপে সমস্ত শুভশক্তির প্রতীক হিসেবে দাঁড়াবেন। তাই আমি বাংলার তন্ত্রজগতের সবচেয়ে বিখ্যাত নামটিই বেছে নিয়েছিলাম।
‘শোধ’ প্রকাশিত হওয়ার পরেই আমাকে কেউ বলেছিলেন যে কৃষ্ণানন্দকে টাইম ট্রাভেলার হিসেবে দেখাতে; যিনি বিপদাপন্ন মানুষের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন, প্রকট হন যাবতীয় পরাশক্তির প্রতীক, সমস্ত শুভত্বের দ্যোতক হয়ে। যেমন লর্ড অফ দ্য রিংস-এর জাদুকর গ্যান্ডাল্ফ। যেমন হ্যারি পটারের প্রফেসর ডাম্বলডোর।
আর সেই হ্যারি পটারের ‘লাভ ইজ দ্য বিগেস্ট ম্যাজিক’-এর সূত্র ধরেই উঠে এল ‘এবং ইনকুইজিশন’-এর সারবাক্য বা পাঞ্চলাইন, ভালোবাসাই হল সবচেয়ে বড়ো তন্ত্র, সবচেয়ে বড়ো জাদু।
‘এবং ইনকুইজিশন’ নামকরণ হয়েছে অবশ্য চতুর্থ উপন্যাসটি থেকে, যার নাম ‘ইনকুইজিশন’। এর সূত্রপাত প্রায় বছর পাঁচেক আগে গোয়া বেড়াতে গিয়ে। সেখানে গিয়ে আমি বম জিসাস দেখে ভারি বিমোহিত হই। আর কোনো কিছু নিয়ে মোহিত বা বিমোহিত হলেই সেই নিয়ে আমি কিছু জানার চেষ্টা করে থাকি। হাতের কাছে এই বিষয়ে কোনো বই ছিল না বটে, তবে হোটেলে ফ্রি ওয়াই-ফাই ছিল। সেই রাতেই হোটেলের রুমে শুয়ে উইকিপিডিয়াতে বম জিসাস তথা গোয়ার ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে অবগত হই গোয়ার ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়ের, ইনকুইজিশন!
মনটা বিক্ষিপ্ত হয়েই ছিল। পরের দিন সপরিবার যাই গোয়ার মিউজিয়াম ঘুরতে। সেখানেই একটি অতি বিচিত্রদর্শন মূর্তি দেখি। মূর্তির পরিচয়জ্ঞাপক প্লেটে লেখা ছিল যে এটি ভারতের একমাত্র বেতালমূর্তি যার পুজো করা হয়। আর এই মূর্তি এসেছে আমোনা গ্রাম থেকে, ভারতে একমাত্র গ্রাম যেখানে বেতালকে গ্রামদেবতা হিসেবে পুজো করা হয়।
সেই রাতেই আমার মাথায় জন্ম নেয় ইনকুইজিশন-এর গল্পের অবয়ব।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। আমি সবসময়ই গল্পের ক্লাইম্যাক্স বা শেষ অংশটা ভেবে তবেই গল্প লেখায় হাত দিই। যতক্ষণ না শেষ দৃশ্যটি মাথায় সম্পূর্ণ রূপ নিচ্ছে, ততক্ষণ আমি লেখা শুরু করতে পারি না। এক্ষেত্রে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে ইনকুইজিশন-এর শেষ দৃশ্যটি, যেখানে কোনো এক মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে একটি কৃষ্ণবর্ণা বালিকা, যার পরনে লাল কালো শাড়ি আর সিঁড়ির শেষ ধাপ পেরিয়ে সে ডান হাত তুলে বলছে, ‘তিষ্ঠ’, এই দৃশ্যটি আক্ষরিক অর্থেই স্বপ্নাদ্য। বাকি পুরোটাই স্বকপোলকল্পিত।
এইখানেই আমদানি করেছি একটি পর্তুগিজ চরিত্রকে, যার নাম মার্টিনেজ ভাজ; যিনি ইউরোপের যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ সুপারকম্যান্ডো। ঘনিষ্ঠ বৃত্তে লোকে তাঁকে ডাকে ‘ইউরোপের ইস্পাত’ বলে। তাঁর সাহস, কর্মদক্ষতা, নেতৃত্বগুণ সবই ইস্পাতকঠিন। আর্তের প্রয়োজনে তিনি একা হাতে জনা দশেক ক্রিমিনালের সঙ্গে মহড়া নিতে দ্বিধাবোধ করেন না। এই উপন্যাসে আমি দেখাতে চেয়েছি যে মানুষের উত্তরণ তার কর্মে, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্তব্য কোনো অর্জিত সম্পদে নয়। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চেয়েছি যেমন পুণ্যের কোনো ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স থাকে না, তেমনই পাপের উত্তরাধিকার বলেও কিছু হয় না। প্রত্যেককেই তার জীবনের যাবতীয় পাপ ও পুণ্যের হিসেব এই জীবনেই চুকিয়ে যেতে হয়। মানুষের সাহায্য করলে মানুষই সাহায্য করবে, সে সাহায্য যতই ঐশী হোক না কেন! তাই গল্পের শেষ বাক্যে মার্টিনেজ তাঁর ছেলে তিয়াগোকে বলেন, ‘বি গুড টু দিস ওয়ার্ল্ড, দিস ওয়ার্ল্ড উইল বি গুড টু ইউ। তারজন্য ম্যাজিক শিখতে হবে না সোনা, ভালোবাসতে শিখলেই হবে। সবসময়ে মনে রাখবে ভালোবাসাই হল সবচেয়ে বড়ো ম্যাজিক, সবচেয়ে বড়ো জাদু।’
আশা রাখি, একদিন আমার অন্য কোনো উপন্যাসে মার্টিনেজ ভাজকে আমি আবার ফিরিয়ে আনতে পারব। ইওরোপের ইস্পাত ফিরবেন, ফিরবেনই।
আপাতত ফিরে আসি প্রথম কাহিনিতে। গৌতমদা-র বাড়িতে সেদিন আমি অরিজিৎকে বলেছিলাম ‘এবং ইনকুইজিশন’ যেন তিন-শো কপির বেশি ছাপা না হয়। আমার ঘোর সন্দেহ ছিল এই বই তিন-শো কপির বেশি বিক্রি হবে কি না। আমার পরম সৌভাগ্য যে সেদিন অরিজিৎ আমার পরামর্শ শোনেনি, প্রথম প্রিন্টেই হাজার কপি ছাপাবার ঝুঁকি নিয়েছিল। আজ স্বীকার করতে বাধা নেই, ওর সিদ্ধান্তই ছিল ঠিক। আজ অবধি ‘এবং ইনকুইজিশন’ বিক্রি হয়েছে প্রায় তিন হাজার কপি।
প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকদের অকুণ্ঠ আনুকুল্য পেয়েছে এই বইটি। এই সামান্য, অতি নগণ্য কলমচি ভেসে গেছে পাঠকদের অপার ভালোবাসায়। অনেক সাহিত্যগ্রুপে এর উচ্চপ্রশংসিত রিভিউ বের হয়। প্রচুর পাঠক আমাকে তাঁদের ভালোলাগা ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছেন। তাঁদের কাছে আমি সবিশেষ কৃতজ্ঞ।
খুব সম্ভবত সেই আশীর্বাদের ফল হিসেবেই ‘ভোগ’ গল্পটি নির্বাচিত হয় রেডিয়ো মির্চির সানডে সাসপেন্সে পঠিত হওয়ার জন্য। এর পেছনে পরম সুহৃদ, বন্ধুবর শ্রীসন্ময় দে-র ভূমিকা আমি কোনোদিনই ভুলব না। ভুলব না রেডিয়ো মির্চির দীপ, এখন যে দীপ আমার কাছের বন্ধু, তার কথাও। রেডিয়ো মির্চির টিমের বাকিদের সঙ্গে অয়ন্তিকা এবং গোধূলির যথাক্রমে ডামরী এবং মাতঙ্গীর অভিনয় শ্রোতাদের মন জিতে নেয়। শেষ অবধি পাওয়া খবর অনুযায়ী প্রায় বারো লাখ লোক গল্পটি ইউটিউবে শুনেছেন। আজ অবধি সানডে সাসপেন্স-এর সর্বাধিক শ্রুত গল্প হচ্ছে ‘ভোগ’।
তবে রোমাঞ্চর আরও বাকি ছিল। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে কল্যানী থেকে কাজকর্ম মিটিয়ে ফিরে আসছি, আমার ফোনে একটি কল আসে। ভদ্রলোক নিজের নাম বলেন রাজর্ষি দে, পেশায় তিনি একজন পরিচালক। তিনি জানান আমার বইয়ের তিনটি গল্প নিয়ে একটি সিনেমা বানাতে চান। বলা বাহুল্য, প্রথমে শুনে ভদ্রলোককে আমি স্রেফ হাঁকিয়ে দিই, ব্যাপারটাকে ঠাট্টা মনে হয়েছিল। পরে বুঝতে পারি যে ভদ্রলোক সত্যিই ‘এবং ইনকুইজিশন’-এর প্রথম তিনটে গল্প নিয়ে সিনেমা বানাতে চান। তাঁকে আমি আমার অফিসে আসতে বলি এবং প্রথম আলাপেই আপাদমস্তক নিরীহ এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দিব্যি দোস্তি হয়ে যায়। একদিন প্রযোজক সুচন্দ্রা ভানিয়ার বাড়িতে গিয়ে আলাপও করে আসি।
তারপর কাস্ট সিলেকশন, শুভ মহরত, শুটিং এসবই শুরু হয়ে যায় জোরকদমে। আমি মাঝে মাঝেই রাজর্ষি এবং সুচন্দ্রার টিমের ফেসবুক পেজ থেকে আপডেট পেতাম। অবশেষে গতকাল, অর্থাৎ বাইশে নভেম্বর রিলিজ করেছে রাজর্ষি দে-র পরিচালিত এবং সুচন্দ্রা ভানিয়া প্রযোজিত চলচ্চিত্র ‘পূর্ব পশ্চিম দক্ষিণ, উত্তর আসবেই।’ সারা শহর ছেয়ে গেছে পোস্টার, হোর্ডিং আর ব্যানারে। আমার নিজের কাছেও ফেসবুক থেকে সিনেমা হল পর্যন্ত উত্তরণের পর্যায়টি স্বপ্নের মতো লাগছে বই কী!।
ইতিমধ্যেই অবশ্য আরেক বদল ঘটে গেছে ‘এবং ইনকুইজিশন’-এর জীবনে। দু-হাজার উনিশ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে এই বইটির দায়িত্ব নিতে চলেছেন ‘বুক ফার্ম’ নামের সুপরিচিত প্রকাশনা সংস্থা। বুক ফার্মের শান্তনু ঘোষকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনি তার ব্যতিক্রমী প্রয়াস এবং তুখোড় মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির জন্য। তা ছাড়া বইয়ের ব্যাপারে শান্তনু-র যত্ন, চিন্তাভাবনা সবই খুব চমকপ্রদ এবং অন্যদের থেকে আলাদা। যে যত্নের সঙ্গে এঁরা একটি বইয়ের বিপণন করেন সেটা শেখার মতো।
‘বুক ফার্ম’ যেভাবে এই বইটিকে প্রচুর ইলাস্ট্রেশন সহ সাজিয়েছেন তারজন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। বুক ফার্ম টিমের জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা রইল। ইলাস্ট্রেশনের সঙ্গে রইল তন্ত্রের ইতিহাসের ওপর আমার লেখা একটি ছোটো প্রবন্ধ।
কৃতজ্ঞতা জানানো বাকি রয়ে গেল আরও তিন জনের কাছে। প্রথম সংস্করণের কভার এঁকেছিলেন বন্ধুবর শান্তনু মিত্র। এবং শত অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি একটিও পয়সা নেননি। এই ভালোবাসার কোনো দাম হয় না।
এর পরের কভারটি আঁকেন স্বর্ণাভ বেরা। ছোকরাকে আমি বইটা উপহার হিসেবে দিয়েছিলাম। রাত আটটায় তার কাছ থেকে আমার মোবাইলে একটি বার্তা ভেসে আসে, ‘দাদা, পড়া শুরু করলাম।’ পরের দিন সকাল ন-টা নাগাদ যে রাফ স্কেচটি ছোকরা আমাকে পাঠায় তা দেখামাত্রই আমি চমকে যাই। প্রথম কভার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং একইরকম চিত্তাকর্ষক সেই কভার বহুদিন যাবৎ ‘এবং ইনকুইজিশন’-এর অঙ্গশোভা বর্ধন করেছে।
বুক ফার্মের পক্ষ থেকে এই কভারটি এঁকেছেন কামিল দাস, অলংকরণে গৌতম কর্মকার। ক্যালিগ্রাফিটি করেছেন আমার স্নেহভাজন স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়। সম্পূর্ণ অন্যধরণের আঙ্গিকে আঁকা একটি অতীব ভয়াল কভার, আশা করি পাঠকদের ভালো লাগবে।
আমি চিরকালই বিশ্বাস করে এসেছি যে পাঠকই আসল সম্রাট। তাঁরা পড়েন বলেই লেখকেরা লেখেন। আশা করি যে অনাবিল ভালোবাসায়, অকুণ্ঠ আশীর্বাদে তাঁরা ‘এবং ইনকুইজিশন’-এর অদ্যাবধিকালের যাত্রাপথ ভরিয়ে দিয়েছেন, তার থেকে এই নবকলেবরায়িত, পরিমার্জিত এবং পরিবর্ধিত সংস্করণটি বঞ্চিত হবে না। আপনাদের সেই আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে এখানেই শেষ করছি। অলমিতি।
অভীক সরকার
কলকাতা
২৩ নভেম্বর, ২০১৯
.
তন্ত্র
এই শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে প্রথম যে অনুভূতিটি জাগ্রত হয় তার নাম ভয়। কোনো এক অশরীরী ভয়, দুর্নিবার রহস্যের ভয়, সর্বগ্রাসী সর্বনাশের ভয়। কারণ তন্ত্র বলতে আমরা শুধুমাত্র একটি জিনিসই বুঝি, কোনো এক অতিলৌকিক পৈশাচিক প্রক্রিয়া বা শক্তি, যার সঙ্গে কোনো এক অশরীরী রহস্যের ইঙ্গিত রয়ে গেছে।
বলা বাহুল্য, এর পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। তন্ত্রবিদ্যা বলতে আমরা এখন বুঝি শ্মশানে বা কোনো গুপ্তস্থানে আচরণীয় কিছু ভৌতিক অলৌকিক প্রক্রিয়া, যার দ্বারা কারো ক্ষতিসাধন করা হয় বা কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। আর যাঁরা এইসব ক্রিয়াকর্মে সিদ্ধ, তাঁদের বলে তান্ত্রিক। একে তো এসবই ভূতপ্রেত অপদেবতা সংক্রান্ত ব্যাপার। তার ওপর এঁদের বেশভূষা অশন বসন কথাবার্তা আচার-আচরণ এতই বিচিত্র, যে সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষের মনে তা যুগপৎ কৌতূহল এবং ভয়মিশ্রিত সম্ভ্রমের উদ্রেক করে। তাঁদের একটি হ্রীংক্লীংফটফটস্বাহা শুনলেই মনে হয় এই রে, ওই বুঝি কোনো বীভৎসদর্শন প্রেত ভয়ংকর মুখব্যাদান করে তেড়ে এল বলে!
তন্ত্র সম্বন্ধে আরও একটি আকর্ষণীয় এবং আগ্রহোদ্দীপক দিক হচ্ছে এর সরল, প্রকৃতি অভিমুখী জীবনযাত্রা এবং নারী পুরুষের যৌন স্বাধীনতার ধর্মীয় বিধান। এই বিষয়ে বিদেশিরা অধিক উৎসাহী। বিদেশিদের কাছে কামসূত্রের পর প্রাচ্যদেশীয় যৌনতার সবচাইতে বেশি আকর্ষক এবং উত্তেজক অভিজ্ঞান হল তান্ত্রিক সেক্স!
বলা বাহুল্য, এসবই তন্ত্র নামক বিশাল জ্ঞানবারিধির অতীব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নখণ্ড, বরং বলা উচিত অপতন্ত্রের ক্লেদময় অংশবিশেষ। তন্ত্র বলতে যাঁরা একমাত্র মারণ উচাটন বা তান্ত্রিক যৌনাচার বোঝেন, তাঁরা খুব সম্ভবত ইলেকট্রিসিটি বলতে ইলেকট্রিক চেয়ার বোঝেন, মাতৃভূমি বলতে মাতৃভূমি লোকাল।
অথচ আমরা খেয়াল করি না যে বর্তমান হিন্দুসমাজের স্মার্ত প্রথা ও ধার্মিক পূজা পদ্ধতির অধিকাংশই তান্ত্রিক কৃত্য। যেমন ষটকর্ম, দীক্ষাদান, বীজমন্ত্র, দশবিধ সংস্কার, ধারণী, মুদ্রা, ঘটস্থাপন, যন্ত্রাঙ্কন– সবই তান্ত্রিক ধর্মাচার। এবং এর ওপর শুধু বৈদিক নয়, বৌদ্ধ এবং জৈনতন্ত্রেরও প্রবল প্রভাব রয়েছে। বস্তুতপক্ষে, বর্তমান হিন্দুধর্মের পূজা প্রকরণ যতটা না বৈদিক তার থেকে অনেকাংশে বেশি তান্ত্রিক!
তন্ত্র একটি এতই বিশাল শাস্ত্র যে তার প্রকৃতি, প্রকরণ, চর্চা, দর্শন, ইতিহাস এইসব নিয়ে নমস্য ভারততত্ত্ববিদেরা অজস্র বই লিখে গেছেন। সংক্ষিপ্ত পরিসরে তার পূর্ণ পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে আমি তন্ত্রচর্চার ইতিহাসের ওপর একটি অত্যন্ত অতিসাধারণী বা সুপারফিশিয়াল ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব মাত্র।
তন্ত্র শব্দের অর্থ নিয়ে পণ্ডিতমহলে বিস্তর বাদানুবাদ আছে। কেউ বলেন তনুকে যা ত্রাণ করে তাই তন্ত্র। কেউ বলেন তন্ মানে ছড়িয়ে দেওয়া, তানেত্ মানে জ্ঞানবৃদ্ধি। তন্ত্র শব্দের অর্থ তাই জ্ঞানের বিস্তারসাধন করা— ‘তনোতি বিস্তারং করোতি’, অথবা, ‘তন্যতে বিস্তার্যতে জ্ঞানং অনেন ইতি তন্ত্রম্।’ কেউ-বা বলেন তন্ত্র হল সেই শাস্ত্র যা তত্ত্ব ও মন্ত্রকে যুক্ত করে, ‘মননাৎ ত্রায়তে ইতি মন্ত্রঃ।’
বস্তুতপক্ষে যেকোনো শাস্ত্রকে বোঝাতেই তন্ত্র শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যেমন সাংখ্যদর্শনের অন্য নাম কাপিলতন্ত্র, ন্যায়দর্শনের নাম গোতমতন্ত্র, মীমাংসা দর্শনের নাম পূর্বতন্ত্র। আমাদের মনে রাখতে হবে যে সুপ্রাচীন কাল থেকেই বেদ বা শ্রুতির সঙ্গে তন্ত্র সমান মর্যাদার অধিকারী। মনুসংহিতার ব্যাখ্যায় হারীতঋষির যে প্রসিদ্ধ বচনটি কুল্লুকভট্ট উদ্ধৃত করেছেন তা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য, ‘শ্রুতিশ্চ দ্বিবিধা— বৈদিকী তান্ত্রিকী চ।’ অর্থাৎ শ্রুতি, বা অপৌরুষেয় বেদশাস্ত্র দুই প্রকারের, বৈদিকী ও তান্ত্রিকী।
তন্ত্র শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া ঋগ্্বেদের দশম মণ্ডলে, ৭১.৯ সূক্তে। এই দশম মণ্ডলেই ১৪৫ এবং ১৫৯ নং সূক্তে যে সপত্নীবিনাশ এবং পতিবশীকরণের মন্ত্রের কথা উল্লিখিত আছে তা বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক। যেমন, ‘এই যে তীব্র ওষধিযুক্ত লতা…ইহাদ্বারা সপত্নীকে ক্লেশ দেওয়া যায়, ইহাদ্বারা স্বামীর প্রণয় লাভ করা যায়। …হে ওষধি, তুমি প্রধান; আমি যেন প্রধানেরও প্রধান হই। আমার সপত্নী যেন নীচেরও নীচ হইয়া থাকে। …হে ওষধি, তোমার বিলক্ষণ ক্ষমতা… আইস আমরা উভয়ে ক্ষমতসম্পন্ন হইয়া সপত্নীকে হীনবল করি। …আমি ইহা বুঝিয়াছি, সকল সপত্নী আমার নিকট পরাস্ত। আমি স্বামীকেও বশ করিয়াছি। …আমার শত্রু জীবিত থাকে না, শত্রুদিগকে আমি বধ করি, জয় করি, পরাস্ত করি।… আমি এইসকল সপত্নীদিগকে জয় করিয়াছি, পরাস্ত করিয়াছি। সে কারণে আমি এই বীরের ওপর প্রভুত্ব করি, পরিবারবর্গের ওপরেও প্রভুত্ব করি।’
শুধু তাই নয়। তৈত্তিরীয় সংহিতায় (২/৩/৯/১) সাংগ্রহণী নামে একটি ইষ্টির বিবরণ পাওয়া যায়। এই সাংগ্রহণী ইষ্টি এবং বশীকরণের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে উল্লেখ আছে যে সোমকে বশীভূত করার জন্য প্রজাপতিদুহিতা সীতা আভিচারিক ক্রিয়ার সাহায্য নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ঐতরেয় আরণ্যকে (৪/২৭) এমন একটি মন্ত্রের উল্লেখ আছে যা সায়নাচার্যের মতে অভিচার কর্মে প্রযুক্ত হয়।
তবে পণ্ডিতদের মধ্যে অনেকের মতে অথর্ববেদের সৌভাগ্যকাণ্ড থেকেই ভারতে প্রাতিষ্ঠানিক তন্ত্রের উদ্ভব। একদা নয়টি ভাগে বিভক্ত অথর্ববেদের একটি শাখার নাম ‘পৈপ্পলাদসংহিতা’। ভারতের পূর্বাঞ্চলে এর খ্যাতি এবং প্রসার ছিল বিপুল। বলা বাহুল্য, ভারতের পূর্বাঞ্চলে তন্ত্রচর্চার যে বিপুল ও সুমহান ঐতিহ্য আছে, তার সঙ্গে পৈপ্পলাদসংহিতার জনপ্রিয়তার সাযুজ্য লক্ষণীয়।
পৈপ্পলাদসংহিতায় ভক্তিপ্রার্থনা এবং বিবিধ দার্শনিক আলোচনার সঙ্গে রয়েছে রোগমুক্তির জন্য বিবিধ তাবিজকবচের ব্যবস্থা এবং মারণ উচাটনের উল্লেখ। যেমন ‘স মে অস্তু ন্যাক্ষক’, সে যেন আমার থেকে হীনতর হয়। ‘শাসাই শ্বশুরা উভৌ’, অর্থাৎ শ্বশুর শাশুড়ির ওপর যেন আমার আধিপত্য জন্মে। ‘মৃধি অভিঘাতীর্ব্যস্য’, অনিষ্টকারীর সর্বনাশ হোক।
শুধু তাই নয়, অথর্ববেদে বিবিধ জাদুবিশ্বাসের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় হয়। এখানে উল্লিখিত একজাতীয় জাদুমন্ত্রকে বলা হয় ‘ভৈষজ্যানি’। প্রথম কাণ্ডে উল্লিখিত কয়েকটি মন্ত্রের নাম হল ‘মূত্রমোচনম’, ‘যক্ষ্মনাশনম’, ‘রুধিরস্রাবনিবৃত্তয়ে ধমনীবন্ধনম’ ইত্যাদি। অর্বাচীন কালের ঝাড়ফুঁকের সঙ্গে এর ব্যবধান সামান্যই। বোধকরি সেইজন্যেই নেপাল দরবার লাইব্রেরিতে খুঁজে পাওয়া ‘কালীকুলার্ণব’ পুঁথির প্রথমেই বলা আছে, ‘অথাত আথর্বণসংহিতায়াং দেব্যুবাচ।’ এমনকী রুদ্রযামলের ১৭শ পটলে স্বয়ং মহাদেবীকে বলা হয়েছে ‘অথর্ববেদশালিনী’।
এখান থেকেই ভারতবর্ষে তন্ত্রের আবির্ভাবের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে খানিকটা আভাস পাওয়া যায়। স্যার জন উডরফ এবং অধ্যাপক উইন্টারনিজের মতো কয়েক জনকে বাদ দিলে অধিকাংশ পাশ্চাত্যদেশীয় পণ্ডিতদের মতে তন্ত্রের উৎপত্তি ভারতের বাইরে। অধ্যাপক গ্রিয়ার্সনের মতে ভারতে আর্যদের অভিবাসনের সঙ্গে সঙ্গে আর্যাবর্তে তন্ত্রের প্রবেশ ঘটে। আর্যদের একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী বৈদিক ধর্মের সূচনা ঘটায়, তাদেরই বাকি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ভারতে তন্ত্রধর্মের প্রচলন করে। ডি বি স্পুনার থেকে শুরু করে অনেকেই বলেছেন যে পারসিক পুরোহিত বা মেজাইদের হাত ধরেই ভারতে তন্ত্রের প্রবেশ। হডসন আবার সেমেটিক জনজাতির ধর্মাচরণের সঙ্গে ভারতীয় তন্ত্রের মিল খুঁজে পেয়েছেন। বলা বাহুল্য এর বিরুদ্ধেও যুক্তি কম নেই। ‘ললিতসহস্রানাম’-এর ভাষ্যকার ভাস্কররায়ের মতে তন্ত্রের বিকাশ হয়েছিল উপনিষদের অংশরূপেই, – যেমন শ্রৌতসূত্রকে বৈদিক সাহিত্যের অংশরূপে গণ্য করা হয়। তা ছাড়াও অথর্ববেদ থেকে শুরু করে তৈত্তিরীয় আরণ্যক, বৈদিক সাহিত্যের এক বিশাল অংশ জুড়ে অপ্রধান ধর্মচেতনা হিসেবে তন্ত্রের উপস্থিতি কোনোমতেই উপেক্ষণীয় নয়।
এখানে বলে রাখা ভালো যে এই তর্কে দু-পক্ষের ভাষ্যই সমানভাবে বিচার্য এবং গ্রহণযোগ্য। বস্তুতপক্ষে তন্ত্রচর্চার যে বাহ্যিক কৃত্যগুলি আমাদের চোখে পড়ে, তার সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত আদিম ধর্মবিশ্বাসের প্রভূত মিল আছে। যেমন মন্ত্র বা জাদুক্রিয়ার মাধ্যমে আরোগ্যলাভ তথা শত্রুবিনাশ, উপাসনায় মদ্যাদির ব্যবহার, বলিদান, ইন্দ্রিয়াসক্তিমূলক কার্যকলাপ (যেমন দেবীস্থানে প্রকাশ্যে যৌনসংসর্গ, লিঙ্গপূজা), আপাত নিরর্থক শব্দসমষ্টির অলৌকিক শক্তির ওপর অন্ধবিশ্বাস, প্রভৃতি। ফলে একথা মেনে নিতে অসুবিধা নেই যে প্রাচীনতম ধর্মবিশ্বাসগুলির মধ্যেই তন্ত্রের আদিচিহ্নগুলি নিহিত। এবং সেইজন্যই তন্ত্রোপাসনার চরিত্র একান্তভাবেই লোকায়ত। শুধু যে লোকায়ত তা নয়, এই ধর্মাচার বহুধাবিস্তৃত, বহুবিচিত্র এবং সদাপ্রবহমাণ। মানুষের জাগতিক এবং বৈষয়িক জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তন্ত্রচর্চারও বিবর্তন ঘটেছে।
খুব সম্ভবত সেই কারণেই বৈদিকমত এবং তান্ত্রিকমতের মধ্যে বিরোধের ইতিহাস সুদীর্ঘ। যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিতে বলা আছে যে তন্ত্রদীক্ষায় দীক্ষিত ব্যক্তির পক্ষে বৈদিক শ্রাদ্ধাদি নিষিদ্ধ। কূর্ম্মপূরাণমতে পাঞ্চরাত্র ও পাশুপতদের সঙ্গে বাক্যালাপও পাপ। এ ছাড়াও বরাহপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, তন্ত্রশাস্ত্র সম্পর্কে এসব পুরাণের মর্মকথা হচ্ছে জনসাধারণকে প্রতারিত করার জন্য বা বেদবিরোধী জনগণের আশ্রয়স্থল হিসেবে তন্ত্রের উৎপত্তি। যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতির যে অনুবাদ অপরার্ক করেছেন, তাতে এও লেখা আছে যে কাপালিক, পাশুপত এবং শৈবদের দেখলেই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, ছুঁয়ে ফেললে তো স্নান করা অবশ্যকর্তব্য!
এদিকে আবার তন্ত্রশাস্ত্রেও বৈদিক উপাসনা পদ্ধতির নিন্দামন্দ কম নেই। কাকচণ্ডেশ্বরীতে উল্লিখিত আছে, ‘বেদানাঞ্চ বয়োহর্থেন ন সিদ্ধিস্তেন জায়তে’, অর্থাৎ বেদের মতো একটি স্থবির শাস্ত্রের পক্ষে সিদ্ধিলাভ সম্ভবপর নয়। কুলার্ণবতন্ত্র কৌলমার্গের বিখ্যাত শাস্ত্র, সেখানে শাস্ত্রকার লিখছেন, ‘বেদস্মৃতিপুরাণানি সামান্যগণিকা ইব। ইয়স্তু শাম্ভবীবিদ্যা গোপ্যা কুলবধূরিব।’ স্পষ্টতই এখানে বেদ ও স্মৃতিশাস্ত্রসমূহকে সামান্য গণিকা এবং শাম্ভবীবিদ্যা, অর্থাৎ তন্ত্রবিদ্যাকে কুলবধূর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
এই বিরোধকে দু-ভাবে দেখা যায়। প্রথম মত হচ্ছে যে বৈদিক ধর্ম প্রথম থেকেই সমাজের মান্যগণ্য এবং প্রভাবশালী অংশের ধর্ম। অন্যদিকে তন্ত্র প্রথম থেকেই প্রকৃতিপূজক, অন্তেবাসী এবং প্রান্তিক মানুষদের আচরণীয় ধার্মিক এবং বৈষয়িক কৃত্য। ভারতীয় সমাজ যেহেতু অসংখ্য বৃত্তিজীবী জনগোষ্ঠীর দ্বারা গঠিত একটি বহুত্ববাদী সমাজ, তাই প্রতিটি বৃত্তি তথা জাতিভিত্তিক সমাজের নিজস্ব জীবনশৈলী এবং গোষ্ঠীগত বিশ্বাসের ছাপ পড়েছে ভারতীয় তন্ত্রদর্শনের ওপর। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন যে জাতিভেদপ্রথা আসলে কৌমসমাজের অসমাপ্ত বিলোপের পরিণাম। ফলে বিভিন্ন আদিম কৌমসমাজের এমন কিছু বিশ্বাস, আচার অনুষ্ঠান বা দার্শনিক ধারণা তন্ত্রে মিশে গেছে যেগুলো বৈদিক আদর্শের বিরোধী। সেই কারণেই তন্ত্রকে বেদবাহ্য আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় মত হচ্ছে যে এই সংঘাত আসলে পুরুষশাসিত ব্রাহ্মণ্যধর্মের সঙ্গে মাতৃতান্ত্রিক অনার্যধর্মবিশ্বাসের সংঘাত। বলা বাহুল্য এই মত প্রচারের পেছনে ঐতিহাসিক বা তাত্ত্বিক কারণের থেকে রাজনৈতিক এবং অন্যান্য কায়েমি স্বার্থের উসকানি রয়েছে বেশি। এই অতিসরলীকরণের ভাবার্থ হচ্ছে পূর্বদেশীয় (পড়ুন বঙ্গদেশীয়) মাত্রেই অনার্যবংশোদ্ভূত তথা মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার উত্তরাধিকারী, এবং উত্তরভারতীয় মাত্রেই কঠিন কঠোর নারীবিদ্বেষী বৈদিক আর্য। বলা বাহুল্য, ব্যাপারটা অত তরল ও সরল নয়।
একথা অনস্বীকার্য যে প্রতিটি আদিম কৃষিজীবী কৌমসমাজে মাটি বা ভূমির উৎপাদক শক্তির সঙ্গে নারীজাতির প্রজননশক্তিকে এক এবং অভিন্ন করে দেখার রীতি বর্তমান। সমস্ত পৃথিবীতে যাবতীয় জনজাতির মধ্যে এই আদিম বিশ্বাসচিহ্ন রয়ে গেছে। এই আদিম বিশ্বাসপুঞ্জ থেকেই একদিকে যেমন কুমারীবলির উদ্ভব, আরেক দিকে দেবীপূজার প্রচলন। এই একই কারণে (জননাত্মক শক্তিকে পরমতম শক্তির আধার হিসেবে দেখার ফলে) তন্ত্রপূজায় ইন্দ্রিয়ানুষ্ঠানের এত অবারিত প্রচলন। এখন যেভাবে প্রাচীন কৌমসমাজের রীতিনীতি আধুনিক তন্ত্রাচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে স্বীকৃত হয়ে গেছে, তাতে মনে করা কঠিন নয় যে এ হচ্ছে বহুবছর ধরে সহাবস্থিত দুইটি বিপরীতধর্মী অথচ পরিপূরক ধর্মমতের মিলনাত্মক মিথস্ক্রিয়ার ফল। তাই আজ বেদের রুদ্রের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যান দেবাদিদেব মহাদেব। পর্ণশবরী, চণ্ডিকা মতো অন্ত্যজজাতির আরাধ্য দেবীরা হিন্দুধর্মের প্রধানতম দেবীদের মধ্যে পরিগণিত হন। কিন্তু তাকে বঙ্গদেশীয় বনাম উত্তরভারতীয় বিদ্বেষের রূপদান করার এই যে হাক্লান্ত চেষ্টা, তার পেছনে একটি সুস্পষ্ট রিলিজিও-পলিটিক্যাল ষড়যন্ত্রের ছায়া স্পষ্ট।
এখানেই তার্কিকরা প্রশ্ন তুলবেন যে তাহলে পূর্বদেশে তন্ত্রমন্ত্রের এত প্রাদুর্ভাব কেন? কেনই-বা শাস্ত্রবচন বলে, ‘গৌড়ে প্রকাশিতা বিদ্যা, মৈথিলৈঃ প্রবলীকৃতা। ক্বচিৎ কচিন্মাহারাষ্ট্রে গুর্জরে প্রলয়ং গতা।’ শ্লোকটি অর্বাচীন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাতে এই প্রশ্ন রয়েই যায়, যে বিদ্যা গৌড়ে প্রকাশিত হয়ে মিথিলায় ( অধুনা মধুবনী দ্বারভাঙা অঞ্চল) প্রবলস্রোত ধারণ করে, কেনই-বা তা আরও পশ্চিমে গুর্জরদেশে গিয়ে লয়প্রাপ্ত হবে?
এর পেছনে কথঞ্চিৎ নৃতাত্ত্বিক কারণও আছে বই কী। ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ নামক সুবিখ্যাত বইটিতে অতুল সুর দেখিয়েছেন যে বাঙালি আসলে আলপাইন আর্য এবং প্রোটো অস্ট্রালয়েডদের থেকে উদ্ভূত একটি মিশ্রজাতি। বিস্তৃত আলোচনায় যাচ্ছি না, কারণ সে গুরুগম্ভীর বিষয়ের প্রবেশপথই যথেষ্ট বিজৃম্ভণক্লিষ্ট। তবে সেই আলোচনা থেকে অনুমিত হওয়া অসম্ভব নয় যে সেই প্রোটো অস্ট্রালয়েড বা আদি অস্ত্রাল রক্তের গুণে আমাদের সমাজে আদিম কৌমধর্মের প্রচুর প্রভাব রয়ে গেছে। আমাদের শাক্তসাধনা সেই আদিম মাতৃতান্ত্রিক অস্ট্রালয়েড জাতির প্রকৃতিপূজা এবং নারীজাতির ক্ষমতায়নের গর্বিত উত্তরাধিকার। তাই কৌমবিশ্বাসআশ্লিষ্ট তন্ত্রধর্মে বাঙালির রুচি কিঞ্চিৎ অধিক হবে, এতে আর আশ্চর্যের কী আছে?
বিষয়টিকে সামাজিক দিক থেকেও দেখা যায়। বাঙালির তন্ত্রবিশ্বাস যতটা লৌকিক হিন্দুধর্মের অনুসারী, ঠিক ততটাই বজ্রযানী বৌদ্ধতন্ত্রদ্বারা অনুপ্রাণিত। দীর্ঘস্থায়ী বৌদ্ধপ্রভাবের ফলে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় এখানে হিন্দুদের জাতিগত সংস্কার অনেক শিথিল। তাই যে ধর্ম ব্রাহ্মণ্য সংস্কার অমান্য করতে বলে, বা নীচ জাতির মানুষদেরও সাধনায় সিদ্ধ হলে গুরুপদে বরণের বিধান দেয় তাতে আমাদের উৎসাহ থাকবে সে তো স্বাভাবিক।
বাঙালির শাক্তধর্মে আসক্তিও আসলে তন্ত্রমতে নারীশক্তির আরাধনার উদ্্যাপন। শাক্তধর্ম অনুযায়ী নারীমাত্রেই মহামায়া, তিনি পেশায় গণিকা হলেও। তন্ত্রমতে নারী কখনো অধঃপতিত হতে পারেন না, সাধনায় সিদ্ধি ঘটলে তিনিও পুরুষের মতো দীক্ষাদানের সমান অধিকারী। বহুদিন ধরে অসংখ্য লাঞ্ছিতা, পরিত্যক্তা, অপমানিতা নারীদের বাঙালির তান্ত্রিক বিশ্বাস আশ্রয় দিয়েছে, তাঁদের ভৈরবী, সাধিকা, যোগিনী বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে হয়তো ফেরানো যায়নি, কিন্তু অন্তত মর্যাদার আসন দেওয়া সম্ভবপর হয়েছে।
তন্ত্র কোথা থেকে এল, এই কূটপ্রশ্নটির মতো আরেকটি বিতর্ক এখনও প্রবলভাবে জীবিত। তা হচ্ছে হিন্দুতন্ত্র হতে বৌদ্ধতন্ত্রের উৎপত্তি নাকি তার বিপরীতটাই ঠিক? এ প্রসঙ্গে মহা মহা পণ্ডিতদের মধ্যে বিপুল মতদ্বৈধতা আছে। একপক্ষে যদি মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী থাকেন তো অন্যদিকে আছেন গোপীনাথ কবিরাজ বা নগেন্দ্রনাথ বসু-র মতো প্রাচ্যবিদ্যার্ণবমণ্ডলী। সে কূটতর্কের মধ্যে গিয়ে আমাদের কাজ নেই। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য আমরা আজকে তন্ত্রের যে রূপ বা প্রকরণটিকে জানি ও চিনি, তার ওপর বজ্রযানী বৌদ্ধতন্ত্রের বিপুল প্রভাব আছে৷ এবং এর পেছনে বৌদ্ধধর্মের ভাঙাগড়ার ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
করুণা ও নির্মাণের ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বিতীয় বৌদ্ধ মহাসংগীতির সময়েই বৌদ্ধসঙ্ঘ দুইভাগে ভেঙে যায়। প্রথম দলের নাম হীনযান, দ্বিতীয় দলের নাম হয় মহাযান। মহাযানপন্থা অনেক ভারতখ্যাত দার্শনিক উপহার দিয়েছেন, যেমন নাগার্জুন, অসঙ্গ, বসুবন্ধু, আর্যদেব, দিঙনাগ, ধর্মকীর্তি ইত্যাদি। এঁদের মধ্যে অসঙ্গ এবং বসুবন্ধুর প্রবর্তিত যে দার্শনিক ধারা, সেই বিজ্ঞানবাদের হাত ধরেই বৌদ্ধদের মধ্যে তন্ত্রাচারের প্রবেশ শুরু। আবার ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস অনুযায়ী এই একই সময়ে ভারতে গুপ্তযুগের উত্থান, এবং গুপ্তদের হাত ধরে পৌরাণিক হিন্দুধর্মের অপ্রতিহত জয়যাত্রা শুরু। এই সময় থেকেই বৌদ্ধধর্ম ক্রমশ পূর্বাভিমুখী হতে হতে শেষমেষ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা এবং কামরূপে এসে আশ্রয় লাভ করে। রাজশক্তির অনুগ্রহলাভে বঞ্চিত হয়ে বৌদ্ধধর্ম হীনবল হয়ে পড়লে যে উচ্চ আদর্শ নিয়ে মহাযানপন্থার বিকাশযাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আর ততটা দৃঢ় রইল না। এর মধ্যে প্রবেশ করল বিভিন্ন বিকার ও অসদাচরণ। শূন্যতা ও নির্বাণ, বা প্রজ্ঞা ও উপায়ের উপমার বদলে উদ্ভব ঘটল ‘মহাসুখবাদ’-এর। অবাধ যৌনাচার, স্ত্রীসঙ্গ, চক্রানুষ্ঠান, এসবই বোধিলাভের পরম উপায় বলে প্রচারিত হতে লাগল। বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা বলে বেড়াতে লাগলেন, ‘কর্মণা যেন বৈ সত্ত্বাঃ কল্পকোটিশতান্যপি/ পচ্যন্তে নরকে ঘোরে তেন যোগী বিমুচ্যতে।’ অর্থাৎ যে সমস্ত কর্মের দ্বারা মানুষ শতকোটিকল্প নরকে পচে মরে, যোগীরা সেসব কর্মের সহায়তাতেই মোক্ষলাভ করেন। এই মতবাদ যে মানুষের কাছে আকর্ষক হয়ে উঠবে তাতে আর সন্দেহ কী?
এর ফলে জন্ম নিল বৌদ্ধধর্মের শেষ পর্যায়, বজ্রযান।
বজ্রযানের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধধর্ম সম্পূর্ণভাবে একটি তান্ত্রিক আচারসর্বস্ব ধর্ম হয়ে উঠল। শাস্ত্রপাঠের স্থান নিল ধারণী (একটি পুঁথির মূল বক্তব্য বা ভাবকে একটি শ্লোকে ব্যক্ত করা)। বৌদ্ধাচার্যরা প্রচার করতে লাগলেন শাস্ত্রপাঠে যা প্রজ্ঞা লাভ হয়, ধারণী উচ্চারণ করলেই তার সমতুল পুণ্যফলের প্রাপ্তি ঘটে। গোপন চক্রানুষ্ঠান, তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে শুরু হয়ে যায় মূর্তিপূজা। পৌরাণিক হিন্দুধর্মের হাত ধরে ইতিমধ্যেই অনেক রমণীয় এবং মনোহর দেব-দেবীর মূর্তিকল্পনা শুরু হয়ে গেছে। অনেক বৌদ্ধধর্মী স্বধর্ম ত্যাগ করে হিন্দুমন্দিরে শান্তি খুঁজে পেতে শুরু করেছেন। এসব দেখে-শুনে বৌদ্ধরাও পিছিয়ে থাকার বদলে মহাসমারোহে বিভিন্ন দেবদেবীদের মূর্তিপূজা শুরু করে দিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁদের শ্রেণিবিভাগও করা হল। আদিবুদ্ধ হলেন সৃষ্টির আদি কারণ, সর্বব্যাপী, সর্বশক্তির আধার। আদিবুদ্ধ থেকে আবার পঞ্চধ্যানীবুদ্ধের উদ্ভব, যথা বৈরোচন, রত্নসম্ভব, অমিতাভ, অমোঘসিদ্ধি এবং অক্ষোভ্য। তাঁদের আবার একেকজন শক্তি আছেন, আছেন পৃথক পৃথক বোধিসত্ত্ব। আর প্রতিটি বুদ্ধকুলে রয়েছেন অসংখ্য দেব এবং দেবী। কত বিচিত্র তাঁদের নাম, ষড়ক্ষরী লোকেশ্বর, উচ্ছুষ্মজম্ভল, মঞ্জুশ্রী, তারা, অবলোকিতেশ্বর, বসুধারা, হেরুক, বজ্রসত্ত্ব আরও কত কী! বৌদ্ধপণ্ডিতেরা সব মূর্তিকে আবার শূন্যের প্রতিমূর্তি বলে ব্যাখ্যা করলেন, ‘স্ফূর্তিশ্চ দেবতাকারা, নিঃস্বভাবা স্বভাবতঃ। যথা যথা ভবেৎ স্ফূর্তি, সা তথা শূন্যাত্মিকা।’ অর্থাৎ এসব মূর্তি শূন্যেরই বহিস্ফূর্তি মাত্র, আসলে এঁদের অন্তরাত্মা পরম শূন্যতায় লীন।
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর এবং পালবংশের শাসন শুরু হওয়ার আগের এক-শো বছর ধরে বাংলায় যে মাৎস্যন্যায় চলেছিল বাংলার বুকে, তাতে বৌদ্ধধর্মকে অনেকটাই গুপ্ত বা আন্তর্ভৌম ভাব ধারণ করতে হয়েছিল। সদ্ধর্মের পতাকা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন সিদ্ধাচার্যরা, যাঁদের প্রায় প্রত্যেকে নিম্নবর্গীয় এবং অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ। অনুমান করা অসংগত হবে না, তখনই বিভিন্ন প্রান্তিক জনজাতির ধর্মকৃত্যগুলি বৌদ্ধধর্মাচরণের মধ্যে প্রবেশ করে। তার ওপর ইতিমধ্যেই ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম তিব্বতীয় পোন ধর্মের সংস্পর্শে এসেছে। আচার্য পদ্মসম্ভবের মধ্যস্থতায় বিভিন্ন পোন দেব-দেবীদের বৌদ্ধধর্মের মধ্যে অঙ্গীভূত করে নেওয়ার প্রচলন শুরু হল। বৌদ্ধতন্ত্রে প্রবেশ করল আরও ভয়ংকর সব মূর্তি, বিচিত্র সব পূজা পদ্ধতি! বাংলার রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে পালবংশের উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন উদ্যমে আরও বিচিত্র সব তান্ত্রিক প্রথা, তান্ত্রিক পূজা, তান্ত্রিক মূর্তি এবং তন্ত্রশাস্ত্র রচনা শুরু হয়ে গেল।
কালের নিয়মে এই বজ্রযানের থেকে উদ্ভূত হল আরও দুটি শাখা, কালচক্রযান এবং সহজযান। তাদের কথা আর অধিক বিস্তারে লিখছি না, তাতে এই প্রবন্ধ বিপুল কলেবর ধারণ করার সমূহ সম্ভাবনা।
পালবংশীয় শাসনের অবসানে কর্ণাটদেশাগত ব্রহ্মক্ষত্রিয় সেনবংশের শাসন শুরু হয়। তার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলায় বৌদ্ধধর্মের দ্রুত অবক্ষয়ের পালা চালু হয়ে যায়। ইতিমধ্যেই তন্ত্রের নামে, সহজিয়া কায়াসাধনের নামে বিপুল অনাচার, কদর্য বিকৃতি বৌদ্ধধর্মের যথেষ্ট মূলক্ষয় করেছিল। সেনবংশের পতনের সময় ইসলামিক আক্রমণের ফলে ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। আর তার তন্ত্রচর্চার অবশিষ্টাংশ যা ছিল, তা রয়ে গেল পৌরাণিক হিন্দুধর্মের মধ্যে। অন্তত হাজার বছরের প্রতিযোগিতার ফলে উভয় পক্ষেরই একে অন্যকে চিনে নিতে আর বিশেষ বাকি ছিল না।
ফলে তন্ত্র যখন এত পথ ঘুরে শেষমেষ সেই হিন্দুধর্মের কাছেই ফিরে এল, তখন তার মধ্যে রয়ে গেল বিপুল পরিমাণে বৌদ্ধ এবং নিম্নবর্গীয় উপাদান। সঙ্গে রয়ে গেছে তার বৈদিক অন্তঃকরণটি, তৎসহ পৌরাণিক আচার ও প্রকরণের বহিরঙ্গ। এই সব মিলিয়েই গঠিত হল বর্তমান তন্ত্রের অবয়ব ও বাহ্যিক আকার।
আর বৌদ্ধতন্ত্র? তার সহজিয়া সাধনার ধারা? তা কি একেবারেই বিলীন হয়ে গেল?
না। অন্ত্যজ নিম্নবর্গের বৌদ্ধ সহজিয়ার ভাব ও ভাবনা নিয়ে নির্মিত হল বাংলায় জন্ম নেওয়া এক বিপুল সামাজিক বিপ্লবের অবয়ব। ‘বাঙালির হিয়া, অমিয় মথিয়া’ জন্ম নিল শ্রীচৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্মান্দোলন। নিত্যানন্দ সহজিয়া নেড়ানেড়িদের স্থান দিলেন বৈষ্ণব ভাবান্দোলনের মাঝে।
যাই হোক, আপাতত আমরা ফিরে আসি যা নিয়ে এই প্রবন্ধ শুরু করেছিলাম সেখানে। তন্ত্র বলতেই মানুষ সচরাচর বোঝে অন্যের অনিষ্টসাধন, বিভিন্ন ভৌতিক অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ। তন্ত্রের এই অংশটিকে বলে অভিচারক্রিয়া। ছ-ধরনের অভিচারক্রিয়া হয় বলে একে ষটকর্মও বলা হয়। এগুলি হল মারণ, উচাটন, বশীকরণ, স্তম্ভন, বিদ্বেষণ এবং স্বস্ত্যয়ন। এর প্রথম পাঁচটি অন্যের ক্ষতির উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হয়, শেষেরটি অনুষ্ঠিত হয় নিজের অথবা পরিবারের শান্তি ও সমৃদ্ধিকামনায়।
কী মনে হচ্ছে? যে শাস্ত্রের ছ-টি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে পাঁচটিই অন্যের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে, তার প্রতি একটা বিদ্বেষভাব জন্মাচ্ছে না? একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে না?
তাহলে শুনুন, এই ছয়টি অভিচারক্রিয়াকে একত্রে বলে কৃষ্ণষটকর্ম। আপনি কি জানেন, ঠিক এইরকমই ছ-টি শুক্লষটকর্ম আছে, যা মানুষের কল্যাণের জন্য, শুভকর্মের জন্য প্রযুক্ত হয়? জানেন না, তাই তো? তাহলে জানুন, এগুলি হল যজন (পূজা বা যজ্ঞাদিকর্ম), যাজন (পৌরোহিত্য), অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, দান এবং প্রতিগ্রহ (যথাযোগ্য দান গ্রহণ করা)।
বিস্মিত হচ্ছেন? হওয়ারই কথা। যে শাস্ত্রকে, যে চর্চাকে আপনি চিরকালই ভৌতিক অপচ্ছায়া হিসেবে দেখে এসেছেন, তারই যদি একটি অত্যন্ত শুভ দিক থাকে যেখানে মানুষকে জ্ঞানচর্চায়, পূজা আরাধনায় উৎসাহ দেওয়া হয়, সে-কথা জেনে আপনার বিস্মিত হওয়া স্বাভাবিক।
এখন আপনার প্রশ্ন হতেই পারে এসব আপনি জানেননি কেন এতদিন? আপনি তাহলে কেনই-বা তন্ত্রকে অমঙ্গলের সূচক হিসেবে দেখেছেন?
এর উত্তর দেওয়ার বদলে এই অধম একটি বিনীত প্রশ্ন করতে চায়। আপনাকে যদি একটা ছুরি দেওয়া হয়, তাহলে আপনি সেই ছুরি দিয়ে ফল কেটে দেবতার প্রসাদ নিবেদন করবেন না মানুষের গলায় বসাবেন সেটা কার সিদ্ধান্ত, আপনার না ওই ছুরিটির? একই রকম ভাবে আপনার দেশজ ধর্মীয় শাস্ত্রচিন্তাকে যদি আপনি অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন তাহলে তা আপনার মনোগত কামনার চরিত্রকেই প্রকাশ করে, নাকি শাস্ত্রচিন্তাটিকে qualify করে, সেটা ভেবে দেখতে অনুরোধ করি। মনে রাখবেন আপনার উদ্দেশ্য, আপনার চিন্তা, আপনার ক্রিয়াই আপনার ধর্ম, কোনো বাহ্যিক আচার বা আড়ম্বর নয়। মানুষের কল্যাণ, মানুষের প্রতি বিশ্বাস, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, এর থেকে বড়ো ধর্ম আর হয় না, তন্ত্র আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। কারণ আপনি তো জানেনই, ভালোবাসাই হল সবচেয়ে বড়ো তন্ত্র, সবচেয়ে বড়ো জাদু!
সূচিপত্র
তথ্যঋণ
ঠগী— শ্রীপান্থ
পৃথিবীর মাতৃসাধনা— নিগূঢ়ানন্দ
নরবলির ইতিহাস— দুর্গানন্দ চট্টোপাধ্যায়
বৌদ্ধদের দেবদেবী— বিনয়তোষ ভট্টাচার্য
চুরাশি সিদ্ধর কাহিনী— অলকা চট্টোপাধ্যায়
তান্ত্রিক সাধনা ও তন্ত্রকাহিনী— তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী
তিব্বতের রহস্যময় যোগ ও তন্ত্র— দেবদীপ
বিষয় বৌদ্ধধর্ম— হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
বৃহৎ তন্ত্রসার— কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ
ষটকর্ম্মদীপিকা— রসিকমোহন চট্টোপাধ্যায়
Confessions of a Thug— Philip Meadows Taylor
বিবিধ সহায়তা— Google
Leave a Reply