উভয় বাঙলা
উভয় বাঙলা– রিপ ভান উইঙ্কল
হুস করে দুটো মাথার উপর দিয়ে পঁচিশটি বছর কেটে গেল। উভয়েই তন্দ্রাতুর, নিদ্রামগ্ন। কিন্তু ন্দ্রিাভ্যাস রিলেটিভ– কোনও কোনও ক্ষেত্রে। গীতাও বলেছেন, যা নিশা ইত্যাদি। পুব বাঙলা এবং পশ্চিম বাঙলা দু জনাই ছিলেন একে অন্যের সম্বন্ধে অচেতন সুষুপ্তি-দুঃস্বপ্ন মিশ্রিত ন্দ্রিাতুর অবস্থায়। অথচ যে যার আপন কাজকর্ম করে গিয়েছে আপন মনে। পঁচিশ বৎসর ধরে।
ঘুম ভেঙেছে। রিপ ভান উইঙ্কলের ঘুম ভেঙেছিল এক মুহূর্তেই কিন্তু তার ঘরবাড়ি আত্মজন এবং গোটা গ্রামকে চিনে নিতে তার সময় লেগেছিল অনেকটা। কিন্তু তার বিচরণক্ষেত্র ছিল সীমাবদ্ধ। যতটা সময়ই লাগুক সেটা ছিল মাত্র একজনের সমস্যা।
দুই বাঙলা বিরাট দেশ। জনসংখ্যা প্রচুরতম। একে অন্যের চেনবার জানবার জিনিস বিস্তর! সুতরাং সে কর্ম সমাধান করতে ক বৎসর লাগবে সেটা বলা কঠিন। এবং সেটাও যে রুটিনমাফিক মসৃণ পন্থায় অগ্রসর হবে সে সত্যও শপথ গ্রহণ করে বলা চলে না। আমরা প্রতিবেশী। খ্রিস্ট আদেশ দিয়েছেন, প্রতিবেশীকে ভালোবাস।
কারণ তিনি জানতেন, প্রতিবেশীকে ভালোবাসতে পারাটা দূরে থাক, বহু ক্ষেত্রে সহ্য করাটাই সুকঠিন। দূরের জন আমার বাড়ির শখের বাগানটাকে ডিমের খোসা কাঁঠালের ভূতি ফেলে ফেলে তার প্রাইভেট আঁস্তাকুড়ে রূপান্তরিত করতে পারে না, আমার অর্ধাঙ্গিনীর দ্বিপ্রহরাধিক স্বতশ্চল বিকট বেতারের উৎকট চিৎকার দূরজনের পরীক্ষার্থী পুত্রের অধ্যয়ন প্রচেষ্টাকে লণ্ডভণ্ড করতে পারে না। প্রতিবেশীর ঝি পারে, গৃহিণীর বেতার পারে। অতএব গোড়ার থেকেই কিঞ্চিৎ সচেতন সমঝোতা মেনে নিয়ে পুনঃপরিচয়ের ভিত্তিস্থাপনা করতে হবে। আর এ-ও তো জানা কথা।
নূতন করে পাবো বলে
হারাই ক্ষণে ক্ষণ।
এক্কেবারে সর্বক্ষেত্রে যে হারিয়েছিলুম তা নয়। এখানকার বিশেষ সম্প্রদায় এই পঁচিশ বৎসর ধরে যে কোনও সময়ে বলে দিতে পারতেন নারায়ণগঞ্জে এই মুহূর্তে শেয়ারবাজারে জুট মিলের তেজিমন্দির গতিটা কোন বাগে। এ-পারের বিশেষ সম্প্রদায়ও তদ্বৎ বলতে পারতেন এ-পারে টেপাতার চাহিদা রফতানির ওজনটা কোন পাল্লায় বেশি।
কিন্তু হায়, দেশ পত্রিকার সম্পাদক, ১০০% পাঠককুলের ৯৯% পাট ও টেণ্ড সম্বন্ধে উদাসীন। বহু গুণীন তাই বলেন বাঙালির এই উদাসীনতাই তার ভবিষ্যৎ ঝরঝরে করে দিয়েছে।
যতদিন সে শুভবুদ্ধির উদয় না হয় ততদিনও কিন্তু বর্তমান সত্যকে অস্বীকার করা যায় না। দেশ পত্রিকার পাঠক চায় জানতে ওদেশে উত্তম উত্তম উপন্যাস গল্প কী বেরুল এই পঁচিশ বৎসরে? যদিও তারা লেখে বাঙলাতেই তবু তাদের সুর ভিন্ন, সেটাতে নতুন কিক থাকে, বীরভূমের খোয়াইডাঙা গরুর গাড়ি, ওদিককার নদী-বিল নৌকো দুটোর রঙ তো এক হতে পারে না। এক রবীন্দ্রনাথে ব্যত্যয়। তাঁর জীবনের প্রথমাংশ কাটে জলচরের দেশে নদীপাড়ে, শেষাংশ কাকড়ধুলোর দেশে খোয়াইয়ের পাড়ে। কিন্তু তিনি তাঁর অলৌকিক প্রতিভা দিয়ে করেছেন দুটোরই সমন্বয়। অন্য লেখকদের বেলা দুটোর রঙ আলাদা আলাদা থাকে।
অন্যরা চান ওপারের কাব্য নাট্য ও বিভিন্ন রসসৃষ্টি। পণ্ডিতরা চান প্রাচীন কবিদের ছাপাতে প্রথম আত্মপ্রকাশ, ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারো জিনিস যা পুস্তকের মাধ্যমে জ্ঞান ও তথ্য বিতরণ করে। বললে পেত্যয় যাবেন না, কলকাতারই এক যুবা আমাকে একদা জিগ্যেস করছিল, পুব বাঙলায় যে ইরি (ইন্টারনেশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটুট না কী যেন পুরো নাম) ধান ফলানো হচ্ছে সে সম্বন্ধে আমার কাছে মুদ্রিত কোনও কিছু আছে কি না? (এস্থলে যদিও অবান্তর তবু একটা খবর অনেককেই রীতিমতো বিস্মিত করবে : বাংলাদেশের একাধিক বিশেষজ্ঞজন বলছেন, বর্ষাকালের আউশ ধান আমাদের বৃহত্তম পরিমাণে উৎপন্ন খাদ্য। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল অতিবৃষ্টি বন্যা এবং অনাবৃষ্টির ওপর। পক্ষান্তরে হেমন্তের আমন যদিও আউশের তুলনায় উৎপাদন অনেক কম তবু তার একটি মহৎ গুণ যে পূর্বোক্ত ওইসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর নির্ভর করে না। অতএব আমাদের উচিত আউশের তুলনায় প্রচুরতম আমন ফলানো– এককথায় পূর্ব ব্যবস্থাটা সম্পূর্ণ পাল্টে আমন হবে আমাদের প্রধান চাষ ও আউশ নেবে দ্বিতীয় স্থান। অবশ্য তার জন্য দরকার হবে লক্ষ লক্ষ ট্যুবওয়েল। শেষ পর্যন্ত তাই যদি হয়, তবে হাজার হাজার বৎসরের প্রাচীন প্রাকৃতিক ব্যবস্থা মানুষ দেবে পাল্টে– সেটাতেই জাগে আমাদের মতো অজ্ঞজনের বিস্ময়!)
বাংলাদেশের লোক কী পড়তে চায়, তার ফিরিস্তি অবশ্যই দীর্ঘতর।
যে ক মাস ঢাকায় কাটালুম তার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সে দেশে সবচেয়ে বেশি কাটতি দেশ পত্রিকার। তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলে রাখা ভালো যে, বিশাধিক বৎসর কাল তারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় সর্বাবদে বিচ্ছিন্ন ছিল বলে দেশ-এর গল্প উপন্যাস ভ্রমণকাহিনী আধুনিক কবিতা, কিছুটা খেলাধুলোর বিবরণ এবং এদিক-ওদিক দু-একটি হালকা লেখা ছাড়া অন্যান্য রচনা, বিশেষ করে গবেষণামূলক প্রবন্ধের প্রতি নবীনদের চিত্তাকর্ষণ অপেক্ষাকৃত কম। তার প্রধান কারণ বাংলাদেশেই খুঁজতে হয়। এই বিশাধিক বৎসর ধরে তাদের আপন দেশেই সিরিয়াস রচনা গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে অত্যল্প। কাজেই এসব বিষয়ে নবীনদের রুচি সৃষ্টি ও অভ্যাস নির্মিত হবে কোথা থেকে? যুবজনের জন্য দেশ-এর মতো একটি পাঁচমেশালি পত্রিকা তাদের ছিল না যাতে করে কথাসাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো সাময়িক কৌতূহলবশত দু-একটি তথ্য ও তত্ত্বপূর্ণ প্রবন্ধাদি পড়ে ধীরে ধীরে ওদিকে রুচি বৃদ্ধি পেত এবং শেষ পর্যন্ত দু পাঁচজন প্রবন্ধ-পাঠক অবশেষে নিজেরাই গবেষক হয়ে যেত।… দেশ পত্রিকার প্রবন্ধ-পাঠক একেবারেই নেই সে ধারণা ভুল। কিন্তু যারা পড়েন। তাঁদের বয়স ৫০/৫৫-র উপরে। এঁরা কলেজে, পরে পূর্ণ যৌবনে তাদের চিন্তার খাদ্য আহরণ করেছেন প্রবাসী, ভারতবর্ষ ও পরবর্তীকাল থেকে পার্টিশেনের পরও কয়েক বৎসর দেশ থেকে। এঁরা আবার নতুন করে পশ্চিম বাঙলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঝালিয়ে নিচ্ছেন। আশা করা যায় যুবক-যুবতীরা ধীরে ধীরে এ দলে ভিড়বেন।
বলা একান্তই বাহুল্য রঙ্গজগৎ অংশটি তরুণ-তরুণীরা গেলে গোগ্রাসে এবং ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতুষ্ণ্য তাদের মনস্তাপ– হায় কবে আসবে সে সুদিন যখন এ ফিল্মগুলো দেখব? যেসব স্টার গান গাইতে পারেন এবং প্লে-ব্যাক গাইয়েদের নাড়ি-নক্ষত্র তারা নিজেদের হাতের চেটোর চাইতে বেশি চেনে– কলকাতা বেতারের কল্যাণে।
বস্তুত বলতে গেলে ঢাকা ও কলকাতা বেতার এই দুটি প্রতিষ্ঠান মাত্র দুই বাঙলাকে একে অন্যের খবর দিয়েছে, গল্প গান কথিকা শুনিয়েছে নানাপ্রকার ব্যানের ওপর দিয়ে, হাওয়ায় হাওয়ায় পঁচিশটি বছর ধরে।
তার পূর্ণ ইতিহাস লিখতে গেলে পুরো একখানা কেতাব লিখতে হয়।
.
উভয় বাঙলা– বিসমিল্লায় গলদ
গত পঁচিশ বত্সর ঢাকা এবং কলকাতা কে কতখানি রসসৃষ্টি করেছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের পুস্তক প্রকাশ করেছে সে নিয়ে তুলনা করা নিতান্তই অসঙ্গত। এই পঁচিশ বছর ধরে পূর্ব বাঙলাকে একসঙ্গে চালাতে হয়েছে লড়াই এবং পুস্তক লেখন। অদ্ভুত সমন্বয় বা দ্বন্দ্ব। সেপাই কলম জিনিসটাকে বিলকুল বেফায়দা জানে বলে টিপসই দিয়ে তনখা ওঠায়, আর কবি, যদিও-বা তিনি বীররস সৃষ্টি করার সময় তরবারি হস্তে বিস্তর লম্ফঝম্প করেন তবু তিনি জানেন, ও জিনিসটা একদম বেকার– ওটা দিয়ে তার পালকের কলম মেরামত করা যায় না। বাংলাদেশের লেখক, চিন্তাশীল ব্যক্তি, এমনকি পাঠককেও লড়াই করতে হয়েছে অরক্ষণীয়া বাঙলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে, এবং প্রথম দুইশ্রেণির লোককে সঙ্গে সঙ্গে লিখতে হয়েছে পাঠ্যপুস্তক থেকে আরম্ভ করে হিউ এন সাঙ বর্ণিত ময়নামতি-লালমাই সম্বন্ধে গবেষণামূলক পুস্তক পূর্ব পাকিস্তান জন্ম নেবার প্রথম প্রভাত থেকে। একই ব্যক্তি কভু রণাঙ্গণে, কভু গৃহকোণে।
প্রথম দিন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান শ্লোগান তুলেছে, এক রাষ্ট্র, এক ভাষা, এক প্রভু (কাঈ-ই-আজম = জিন্নাহ)। অর্থাৎ পুব বাঙলায় চালানো হবে উর্দু এবং বাঙলাকে করা হবে নিমূল। আমেরিকার নিগ্রোরা যেরকম তাদের মাতৃভাষা ভুলে গিয়ে ইংরেজি গ্রহণ করেছে, পূর্ব বাঙলার তাবল্লোক হুবহু সেইরকম বাঙলা সর্বার্থে বর্জন করে উর্দু গ্রহণ করবে। জানিনে, পুব বাঙলার মাঝির প্রতি তখন পশ্চিম পাক থেকে কী ফরমান জারি হয়েছিল– তারা ভাটিয়ালি সুরে উর্দুভাষায় গীত গাইবে, না কিসুদ্দ উর্দু গজল কাসিদা গাইবে উর্দু ঢঙে
কিন্তু মাঝির উর্দুই হোক, কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যানসেলারের উর্দুই হোক, সে উর্দু শেখাবে কে? নিশ্চয়ই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু কই?
বাঙালি পাঠক এস্থলে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হবেন। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে আমি বেশ বুঝতে পারছি, পুব বা পশ্চিম পাকের এসব ইতিহাসের প্রতি আমার নিত্যদিনের সরল পাঠকের বিশেষ কোনও চিত্তাকর্ষণ নেই। কিন্তু তবু আমাকে বেহায়ার মতো এসব রসকষহীন কাহিনী শোনাতেই হবে। (যতদিন-না সম্পাদক মহাশয়ের মিলিটারি হুকুম আসে হ-লু-টদীর্ঘ বাইশ বছর ধরে তিনি এ-ফরমান কখনও জারি করেননি, কিন্তু তাঁরও ধৈর্যের সীমা আছে, তিনি হট হুঙ্কার ছাড়া মাত্রই আমি হুস করে আমার জীবনব্যাপী সাধনার ধন গাঁজা-গুল কেচ্ছার ঊধ্বস্তরে পুনরপি উড়তে আরম্ভ করব)। কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস : দুই বাঙলা ক্রমে ক্রমে একে অন্যের কাছে আসবে। পঁচিশ বৎসরের বিচ্ছেদের পর নতুন করে একে অন্যকে চিনতে হবে। এই দীর্ঘকালব্যাপী তারা যে দুঃখ-দুর্দৈবের ভিতর দিয়ে গিয়েছে তার কাহিনী আমাদের জানতে হবে। নইলে ব্যাপারটা হবে এই : আমার যে বাল্যবন্ধু পঁচিশ বৎসর ধরে আমার অজানাতে অর্থাভাবে অনাহারে অম্লাহারে অকালবৃদ্ধ হয়ে গিয়েছে, তাকে পথমধ্যে হঠাৎ পেয়ে যতই-না দরদি গলায় শুধোই, তবু শোনাবে নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের মতো, হা রে, আদ্দিন ধরে স্বাস্থ্যের কী অবহেলাটাই-না করেছিস? একবার ঘুরে আয় না দার্জিলিং। ঠিক তেমনি হবে, আজ যদি বাংলাদেশের কোনও সাহিত্যসেবীকে বলি, কী সায়েব, পঁচিশ বৎসর পাঞ্জাবিদের সঙ্গে দোস্তি দহরম মহরম করে বাঙলা ভাষাটাকে করলেন বেধড়ক অবহেলা। এইবারে শুরু করে দিন বাঙলার সেবা কোমর বেঁধে। গোটা দুই সাহিত্য পরিষদ গড়ে তুলতে আর ক মাস লাগবে আপনাদের? গোটা তিনেক দেশ— একটাতে আপনাদের হবে না। আর আনন্দবাজারের বিক্রি-সংখ্যা ছাড়িয়ে যেতে পারেন আপনারা তুড়ি মেরে। আপনাদের দেশ বিরাট, জনসংখ্যা এন্তের।
.
পূর্বেই প্রশ্ন করেছি, পশ্চিম পাকে উর্দু কই? এটার উত্তর দফে দফে বয়ান করি।
পুব বাঙলার বেদনা আরম্ভ হয় পয়লাই জিন্না সায়েবকে নিয়ে। স্বাধীনতা পাওয়ার কয়েক মাস পরে তিনি স্বয়ং এলেন বাংলাদেশে, ওই বেকার; বরবাদ বাংলা ভাষা আন্দোলনকে ঠেকাবার জন্য সেটি তখনও অঙ্কুরে। ঢাকার বুদ্ধিজীবীরা তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে করতে তাদের চক্ষু স্থির হতে স্থিরতর হতে লাগল। ভাষা বাবদে এ-হেন বেকুব (কটু বাক্যার্থে নয় : ওকিবহালের বিপরীত শব্দ বেকুবহাল বা বেকুব) তাঁরা উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে কস্মিনকালেও দেখেননি। বাংলা ভাষা ক্রমবিকাশের পথে কতখানি এগিয়ে গিয়েছে, বাংলাভাষা কতখানি সমৃদ্ধ, ওই ভাষা ও সাহিত্য দিয়েই পুব বাংলার মুসলমানের হাড়মজ্জা মগজ হিয়া নির্মিত হয়েছে এবং এর বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি মুসলমান এখন পূর্ণ যুবক– এ সম্বন্ধে জিন্নার কণামাত্র ধারণা নেই। তিনি ধরে নিয়েছেন, ভাষা ও সাহিত্য বাবদে বাঙালি মুসলমান ছ মাসের শিশু; তাকে নিয়ে যদৃচ্ছ লোফালুফি করা যায়। তাঁর চোখের সামনে রয়েছে মার্কিন নিগ্রোদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায় স্বয়ং জিন্নার এবং তার পরিবারে ভাষা বাবদে কোনওপ্রকারের পটভূমি বা ঐতিহ্যের ছিটেফোঁটাও নেই। তাঁর পরিবারের মাতৃভাষা কাঠিওয়াড়ি– সে উপভাষা গুজরাতির বিকৃত উপচ্ছায়া। তাঁর বাল্যকাল কাটে করাচিতে। সেখানকার ভাষা যদিও সিন্ধি তবু রাস্তাঘাটের ভাষা বহুভাষা মিশ্রণে এক বিকট জগাখিচুড়ি। তদুপরি করাচিবাসী কাঠিওয়াড়ি গুজরাতি, খোঁজা, বোরা, মেমনরা পঠন-পাঠনে সিন্ধিকে পাত্তাই দেয় না। জিন্না ছেলেবেলা থেকেই তাই দেখে আসছেন এই বত্রিশ জাতের যে কোনও ছেলেকে যে কোনও স্কুলে পাঠিয়ে যে কোনও ভাষা শেখানো যায়। যেরকম কলকাতার যে-কোনও মারওয়াড়ি বাচ্চাকে তামিল স্কুলে পাঠিয়ে দিব্য তামিলাদি শেখানো যায়। ভাষাগত ঐতিহ্য সম্বন্ধে পরিষ্কার ছবি এ হেন পরিস্থিতিতে জিন্নার চোখের সামনে ফুটে উঠবে কী করে? সর্বোপরি তিনি বুদ্ধিমান; কিশোর বয়সেই সম্যক হৃদয়ঙ্গম করে ফেলেছিলেন, তাঁর ভবিষ্যৎ যে-ভাষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী বিজড়িত সে-ভাষা ইংরেজি। তিনি মনপ্রাণ ওতেই ঢেলে দিয়েছিলেন এবং সে-ভাষায় নৈপুণ্য লাভ করেছিলেন।
ছেলেবেলায় করাচির আর পাঁচটা মুসলমান ছেলের মতো তাঁরও খানিকটে উর্দু শেখার কথা। কিন্তু তিনি কট্টর শিয়া, খোজা-পরিবারের ছেলে। উর্দুর প্রতি খোঁজাদের কোনও চিত্তদৌর্বল্য নেই। কাজেই বলতে পারিনে ছেলেবেলায় অন্তত কিছুটা উর্দু শিখেছিলেন কি না। তার পরিণত বয়স কাটে বোম্বাইয়ে। বলা বাহুল্য, কি করাচি, কি বোম্বাই উভয় জায়গারই উর্দু সাতিশয় খাজা মার্কা।
বেতার মারফত তার একটি উর্দু ভাষণ আমি শুনি পাকিস্তান জন্মের পর। সেটা শুনে আমি এমনই হতবুদ্ধি বিমূঢ় হই যে আমি তখন শে-শক-খাওয়া সেপাইয়ের মতো নিজের আপন মাতৃভাষা ভুলে যাই যাই, সে-হেন অবস্থায় এমনেজিয়া অর্থাৎ আচম্বিতে স্মৃতিভ্রংশতা রোগে। শেষটায় বিস্ময় বোধ হয়েছিল, যে লোক এতখানি ইংরেজি শিখতে পেরেছেন তিনি মাত্র ছ মাস চেষ্টা দিলেই তো অল্পায়াসে নাতিদ্ৰ চলনসই উর্দু শিখে নিতে পারেন। ইনি এই উর্দু নিয়ে উর্দুর প্রপাগান্ডা করলে বাংলাপ্রেমী মাত্রই বলবে, উর্দু এদেশে চালানোর বিপক্ষে আরেকটি সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল। উর্দুপ্রেমী পশ্চিমা পূরবীয়া উভয়ই তখন লজ্জায় অধোবদন হয়েছিলেন।
ঢাকা, সিলেট সর্বত্রই তাঁর উর্দু ভাষণের ফল হল বিপরীত।
ঢাকা, সিলেটের লোক অত্যুত্তম উর্দু জানে না, মেনে নিচ্ছি। পাঠক, রাগ কর না, আমি যদি ধরে নিই, তুমি অক্সফোর্ডের ইংরেজি অধ্যাপকের মতো সর্বোচ্চাঙ্গের ইংরেজি জানো না; কিন্তু যদি ধরে নিই, তুমি এদেশের ক্লাস সিক্সের ছোকরার ইংরেজি আর অক্সফোর্ড অধ্যাপকের ইংরেজিতে তারতম্য করতে পার না তবে নিশ্চয়ই তুমি উম্মাভরে গোসসা করবে। ন্যায়ত, ধৰ্মত ॥
.
উভয় বাংলা– বর্বরস্য পূর্বরাগ
পূর্ব-পাক পশ্চিম-পাকের কলহ যখন প্রায় তার চরমে পৌঁছেছে তখন পশ্চিম-পাকের জনৈক তীক্ষ্ণদ্রষ্টা বলেছিলেন, আমি পাকিস্তান রাষ্ট্রের পুব-পাক পশ্চিম-পাক দুই উইংই দেখেছি কিন্তু গোটা পাখিটাকে এখনও দেখতে পাইনি।
এরই সঙ্গে একই ওজনে তাল মিলিয়ে আরেকটি পরস্পর-বিরোধী নিত্য ব্যবহারযোগ্য প্রবাদপ্রায় তত্ত্বটি বলা যেতে পারে :
উভয় পাকেরই রাষ্ট্রভাষা উর্দু। কোনও পাকেই, এমনকি পশ্চিম পাকেরও কোনও প্রদেশবাসীর মাতৃভাষা উর্দু নয়।
পাঠকমাত্রই অন্তত বিস্মিত হবেন। কথাটা গুছিয়ে বলার প্রয়োজন আছে।
পশ্চিম পাকের চারটি প্রদেশের বেলুচিস্তানের ভাষা বেলুচ, ফ্রন্টিয়ার প্রদেশের ভাষা পশতু (বা পখতু), সিন্ধু প্রদেশের ভাষা সিন্ধি। সিন্ধি ভাষা উচ্চাঙ্গের সাহিত্য ধারণ করে।
বেলুচ ও পশতু ভাষায় ছাপা বই বা/এবং পাণ্ডুলিপি শতাধিক হবে না। কারণ এর অধিকাংশই আছে, লোকগীতি। শুধুমাত্র লোকগীতি দিয়ে একটা সম্পূর্ণ সাহিত্য তৈরি হয় না। এবং এগুলোও ছাপা হয়েছিল ইংরেজি নৃতত্ত্ববিদ-ঘ্যাঁষা অফিসারগণ দ্বারা কৌতূহলের সামগ্রীরূপে। মধ্য ও উচ্চশিক্ষিত বেলুচ, পশতুভাষী পাঠান এগুলোকে অবহেলা করে, বেশিরভাগ এসব সংকলনের অস্তিত্ব সম্বন্ধে অচেতন। নিতান্ত পাঠশালার পড়ুয়া পড়ে কি না বলতে পারব না। আমাদের বটতলার সঙ্গে এদের কোনও তুলনাই হয় না। বটতলা শতগুণ বৈচিত্রধারী ও সহস্রগুণ জনপ্রিয়।
তাই ফ্রন্টিয়ার বেলুচিস্তানের নিম্ন ও মধ্যস্তরের রাজকার্য ব্যবসাদি হয় উর্দুতে। সেই কারণে উভয় প্রদেশের মাতৃভাষা উর্দু, এ বাক্য বদ্ধ উন্মাদও বলবে না। পাঠানকে শুধু প্রশ্নটি মাত্র শুধোলে তার মাতৃভাষা উর্দু কি না, সে রীতিমতো অপমানিত বোধ করবে, মোকা পেলে রাইফেল তুলবে। বেলুচের বেলাও মোটামুটি তাই। তবে বেলুচ জাত অপেক্ষাকৃত স্র এবং শান্ত। লোকমুখে শুনেছি ১৯৭১ সালে পুব বাঙলায় যে পাশবিক অত্যাচার হয়েছিল তাতে পাঞ্জাবি-পাঠানের তুলনায় বেলুচরা ছিল অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ। পশ্চিম-পাক বর্বরতার প্রধান পুরোহিত টিক্কা খান একবার বা একাধিকবার বেলুচিস্তানে শান্ত জনতার উপর প্লেন থেকে বোমা ফেলেছিলেন বলে তিনি লোকমুখে যে উপাধি পান সেটা টিক্কাজাতীয় অফিসারকুলের পক্ষে সাতিশয় শ্লাঘার খেতাব মার (বহুবার) অব বেলুচিস্তান। পরবর্তীকালে বাংলাদেশে তিনি পান লক্ষগুণে উচ্চ পর্যায়ের খেতাব বুচার অব বেঙ্গল।
এছাড়া বেলুচিস্তানের একটা ক্ষুদ্র অংশের লোক ব্রুহি উপভাষা বলে থাকে। ভাষাটি জাতে দ্রাবিড়। সুদূর দ্রাবিড়ভূমি থেকে এ ভাষার একটা পকেট এখানে গড়ে উঠল কী করে এ নিয়ে ভাষাবিদরা এখনও মাথা ঘামাচ্ছেন। এরা উর্দু শেখে ঢাকাবাসীর চেয়েও শতাংশের একাংশ।
সিন্ধিদের কথা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাদের ভাষা বিকশিত, সাহিত্য-সমৃদ্ধ। উত্তর ভারতের উর্দুর সঙ্গে সে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারে। তাই উর্দু শেখার জন্য তারা কখনও কোনও প্রয়োজন বোধ করেনি– নিতান্ত কয়েকজন মোল্লা মৌলবি ছাড়া এবং যেহেতু বহুকাল পূর্বে আরবদের সঙ্গে সিন্ধুবাসীর সমুদ্রপথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল ও ইসলাম গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সিন্ধি ভাষা সোজাসুজি বিস্তর আরবি শব্দ গ্রহণ করেছিল (পক্ষান্তরে উর্দুতার তাবৎ আরবি শব্দ গ্রহণ করেছে ফারসি মারফত, অতএব কিছুটা বিকৃতরূপে) তাই মোল্লামৌলবিরাও উর্দুর নামে অযথা বে-এক্তেয়ার হতেন না– গুজরাতি, মারাঠি, এমনকি কোনও কোনও বাঙালি মুসলমান যেরকম হয়ে থাকেন।
আমি মুক্তকণ্ঠে বলতে পারি, নাতিবৃহৎ পশ্চিম পাকিস্তানের ভিতর ওই সিন্ধিরাই একমাত্র ভদ্র, বিদগ্ধ, আপন ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি।
এই যে ১৯৭১ নয় মাসব্যাপী পশ্চিম-পাকের সেপাই অফিসার রাজকর্মচারী পুব বাংলাকে ধর্ষণ করে গেল এর ভিতরে কোনও সিন্ধি ছিল বলে আমি শুনিনি। বিস্তর পূর্ববঙ্গবাসীদের আমি এ প্রশ্ন শুধানোর পরও। বস্তুত গত পঁচিশ বৎসর ধরে আমি প্রায়ই রাজশাহী, ঢাকা, সিলেট, চাটগাঁ, যশোর, খুলনা গিয়েছি কিন্তু কোনও সিন্ধি আর্মি অফিসার দূরে থাক, ছোট বা বড় কোনও চাকুরের সঙ্গে পরিচয়তক হয়নি। পুব বাঙলাকে সিন্ধিরা কস্মিনকালেও কলোনির মতো শোষণ করেনি।
সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল এবং এখনও আছে পাঞ্জাবিরা।
ব্যত্যয় নিশ্চয়ই আছে, তথাপি মুক্তকণ্ঠে বলব, এরকম তথাকথিত শিক্ষিত অথচ বর্বর জাত বহুদেশ ভ্রমণ করার পরও আমি কোথাও দেখিনি।
এদের সবাই বলবে তাদের মাতৃভাষা উর্দু। বরঞ্চ আমি যদি বলি আমার মাতৃভাষা ঋগ্বেদের ভাষা তবু আমি ওদের চেয়ে সত্যের অনেক কাছাকাছি থাকব।
উর্দু ভাষা জন্মগ্রহণ করে উত্তর প্রদেশের আগ্রা ও তার সংলগ্ন দিল্লিতে। ওই সময়কার পাঞ্জাবের বৃহৎ নগর লাহোর বা অমৃতসর উর্দুর কোনও সেবা করেনি। এবং এস্থলে এ তথ্যটাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত যে উর্দুতে হরিয়ানা অঞ্চলের দিল্লির প্রাধান্য, সেটা রাজধানী ছিল বলে। সর্বোত্তম উর্দু এখনও উত্তর প্রদেশের মলিহাবাদ অঞ্চলে উচ্চারিত হয় এবং সাহিত্য গড়ে উঠেছে দিল্লি এবং লক্ষ্ণৌয়ের প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতার ফলে। পরবর্তীকালে এলাহাবাদ উর্দুর অন্যতম পীঠভূমি হয়ে দাঁড়ায় এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পিতামহ উর্দু সাহিত্যের যে সেবা করে গিয়েছেন সেটা অবিস্মরণীয়।
উর্দু জন্ম নেয় উত্তর প্রদেশের প্রাকৃত মায়ের কোলে। পাঞ্জাবে যে প্রাকৃত প্রচলিত সে এ প্রাকৃতের অনেক দূরের। লাহোর অঞ্চলে সে প্রাকৃতকে সম্পূর্ণ ভিন্ন নামে ডাকতে হয়। সিলেটি বাঙলা এবং রাঢ়ের বাঙলা একই প্রাকৃত থেকে। তাই সিলেটি উপভাষা সাধু বা চলিত বাঙলার ডায়লেক্ট। লাহোরের আচণ্ডাল নিজেদের মধ্যে যে পাঞ্জাবি বুলিতে কথা বলে সেটা উর্দুর ডায়লেক্ট নয়।
লাহোর অমৃতসর অঞ্চলগত প্রাকৃতের প্রকৃত মূল্য দিয়েছিলেন মাত্র একটি মহাজন। উত্তর প্রদেশে যে যুগে হিন্দি রীতিমতো উন্নত সাহিত্য ধারণ করত, উর্দুর কুচিৎ জাগরিত বিহঙ্গকাকলি আরম্ভ হয়ে গিয়েছে, সেই যুগে আমাদের এই মহাত্মা এসব কিছু সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আপন পাঞ্জাবের প্রাকৃত দৃঢ়ভূমির উপর নির্মাণ করলেন অজরামর গ্রন্থসাহেব।
তাবৎ পাঞ্জাবভূমি, পাকিস্তানি পাঞ্জাব হিন্দুস্থানি পাঞ্জাব সব মিলিয়ে দেখি যে এখানে মাত্র একটি সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য আছে। শিখ সম্প্রদায়। আপন মাতৃভাষায় রচিত হয়েছে তাদের শাস্ত্রগ্রন্থ। শুনে বিস্মিত হয়েছি, শিখদের প্রতি বিরূপ বাদশা ঔরঙ্গজেব নাকি গ্রন্থসাহেব থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারতেন।
মোদ্দা কথা : পশ্চিম পাঞ্জাববাসীর মাতৃভাষা উর্দু তো নয়ই, তাদের মধ্যে যে ভাষায় কথাবার্তা হয় সেটা উর্দুর ডায়লেকটও নয়। অর্থাৎ তাদের মাতৃভাষা এখনও সাহিত্যের পর্যায়ে ওঠেনি। বরঞ্চ মার্কিন নিগ্রোদের অবস্থা ঢের ভালো, ইংরেজি ভিন্ন অন্য কোনও ভাষা বা উপভাষা তারা আদৌ জানে না, নিজেদের মধ্যেও ইংরেজি বলে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে বাধ্য হয়ে বলতে হয়, মাতৃভাষাহীন সদম্ভস্ফীত, অজ্ঞতামদমত্ত এই একটা বর্বর জাত রাজত্ব করার ছলে শোষণ করতে এসেছিল পুব বাঙলায় এমন একটা জাতকে যার ভাষা ও সাহিত্য সমৃদ্ধ এবং সম্পূর্ণ অবান্তর নয় বলে উল্লেখ করি, সে সাহিত্যের স্বীকৃতি দিয়েছে নোবেল প্রতিষ্ঠান যাকে বিশ্বস্বীকৃতিও বলা যায়।
.
উভয় বাঙলা– পুস্তকসেতুভঙ্গ
বঙ্গভূমিতে যদি কস্মিনকালেও সংস্কৃতের কোনও চর্চা না থাকত, তবে আজ বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য, বিশেষ করে গদ্য-সাহিত্য, নিশ্চয়ই এতখানি বিকাশ ও সমৃদ্ধি লাভ করতে পারত না। রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র হয়ে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সর্ব গদ্যলেখকই অত্যুত্তম সংস্কৃত জানতেন এবং ওই সাহিত্য থেকে কী যে গ্রহণ করেননি, তার নির্ঘণ্ট দেওয়া বরং সোজা। বস্তুত এ শতাব্দীর গোড়ার দিকে দ্বিতীয় শ্রেণির লেখকও মধ্যম শ্রেণির সংস্কৃত জানতেন। এবং একালেও একাধিক সাহিত্যিক অনায়াসে সংস্কৃতের অধ্যাপক হতে পারেন। এবং বঙ্গসাহিত্যসেবী সংস্কৃত অধ্যাপকদের কথা তোলাই বাহুল্য। সংস্কৃতের সাহায্য না নিয়ে বাঙলা গদ্যের ক্রমবিকাশ আমরা কল্পনাই করতে পারিনে।
উর্দু ঠিক সেইরকম নির্ভর করেছে প্রধানত অতিশয় সমৃদ্ধ ফারসি সাহিত্য ও অল্পবিস্তর আরবির ওপর। তাই উর্দুর লীলাভূমি উত্তরপ্রদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে পাক-ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ দুটি মাদ্রাসা বহুকালের ঐতিহ্য নিয়ে, ও প্রধানত ধর্ম ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা ও শিক্ষাদান করেছে। এদের আরবি-ফারসি চর্চা উর্দুর জন্মকাল থেকে সে সাহিত্যকে পরিপুষ্ট করেছে। মাইকেল যেরকম অত্যুত্তম সংস্কৃত জানতেন, গালিবও তদবৎ উচ্চাঙ্গের ফারসি জানতেন। এমনকি পাঞ্জাবের সবেধন নীলমণি কবি ইকবালও ফারসি দিয়ে আপন ঈষৎ কষ্টসাধ্য উর্দুকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।
কিন্তু তাবৎ পাঞ্জাবের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত অবধি, এমনকি যে লাহোর পাঠান-মোগল আমল থেকে সমৃদ্ধিশালিনী নগরী, পাঞ্জাবের মুকুটমণি, মুসলমানদের সংখ্যাগুরুত্ব যেখানে অন্যান্য সম্প্রদায়কে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছিল সেখানেও কস্মিনকালেও পূর্ণাঙ্গ একটি মাদ্রাসা ছিল না– উর্দুকে রসদ-খোরাক যোগাবার জন্য, কারণ পূর্বেই বলেছি, পাঞ্জাবির মাতৃভাষা উর্দু নয়। পার্টিশেনের সঙ্গে সঙ্গে যেসব মৌলবি-মৌলানা উত্তর প্রদেশ থেকে শরণার্থীরূপে লাহোর পৌঁছলেন তাঁরা লাহোরের মাদ্রাসাটি দেখে বিস্ময়ে নৈরাশ্যে মূক হয়ে গেলেন। তুলনা দিয়ে বোঝাতে গেলে বলি, সে মাদ্রাসাটি ক্লাস সিক্স্ অবধি পড়াতে পারে, অর্থাৎ মাইনর স্কুলের মতো মাইনর মাদ্রাসা! সম্পূর্ণ অবান্তর নয়, তাই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিবেদন করি, পাঞ্জাবের তুলনায় যদিও পুব বাঙলা অতিশয় দীন, তবু সেই পুব বাঙলাতেই আছে, বহুকাল ধরে তিনটি পূর্ণাঙ্গ মাদ্রাসা ফের তুলনা দিয়ে বলি, পিএইচডি মান পর্যন্ত! ওদিকে মাইনর স্কুল এদিকে ডকটরেট! মাদ্রাসার সিস্ অবধি কতখানি ইসলামি শাস্ত্রচর্চা হওয়া সম্ভবে! উর্দুর সেবাই-বা করবে কতখানি? তারই ফলে পাঞ্জাবিদের কোনও দিক দিয়ে কোনও প্রকারের বৈদগ্ধের ঐতিহ্য নেই।
তারই দ্বিতীয় বিষময় ফল, যে পাঞ্জাবে মাদ্রাসার অভাবে শাস্ত্রীয় ইসলামের কোনও আবহাওয়া নেই। সেখানকার পাঞ্জাবি সিভিল, মিলিটারি অফিসাররা, তিনটে সমৃদ্ধশালী মাদ্রাসা এবং অগুণিত মাইনর মাদ্রাসার ওপর দণ্ডায়মান, ইসলামি আবহাওয়া দ্বারা পরিবেষ্টিত পুব বাঙলায় এসে দম্ভভরে সর্বত্র দাবড়াতে দাবড়াতে প্রচার করতে লাগল, তারাই পাক-ভারতের ইসলামি ঐতিহ্যের সর্বোত্তম মুসলমান, পুব বাঙলার মুসলমানরা মেরেকেটে আধা-মুসলমান কিংবা মুসলমানি নাম এরা ধরে বটে, কিন্তু আসলে কাফির! গত যুদ্ধের সময় পাঞ্জাবি-পাঠান সেপাইদের লাহোর পেশাওয়ারে শেখানো হয়েছিল, পুব পাক-এ মসজিদের ঢঙে নির্মিত এমারত দেখতে পাবে। সেগুলো একদা মসজিদ ছিল। পরবর্তীকালে ওদেশের লোক ইসলাম বর্জন করে, এবং বর্তমানে নামাজের অছিলা ধরে ভারতাগত কাফের এজেন্টদের সঙ্গে ওইসব এমারতে মিলিত হয়ে ইসলামি রাষ্ট্রের সর্বনাশ। সাধনের জন্য ষড়যন্ত্র করে।
এসব তথ্য তত্ত্ব আমার মূল বক্তব্যের পক্ষে কিছুটা অবান্তর কিন্তু এগুলো থেকে বিশেষ করে হিন্দুপাঠকের বিস্ময় কঞ্চিৎ প্রশমিত হতে পারে মুসলমান সেপাই কী করে তাদেরও ধর্মালয় মসজিদে ঢুকে নামাজরত তাদের ধর্মভ্রাতা নিষ্ঠাবান মুসলমানদের মেশিনগান চালিয়ে মারল? নিশ্চয়ই কলকাতার বিস্তর হিন্দু স্বচক্ষে দেখেছেন পাঠান, পাঞ্জাবি, কাবুলি, বাঙালি সর্বদেশের মুসলমান চিৎপুরের একই নাখুদা মসজিদে ঢুকছে।
কিন্তু আমার মূল বক্তব্য : পুব বাঙলায় পশ্চিম বাঙলার বই ব্যান হল কীভাবে? তার অবতরণিকাতেই যদি বলি, লাহোরের ওই যে ক্ষুদে মাদ্রাসাটি লিকলিক করছিল, সে-ই এ লড়াইয়ের পয়লা বুলেট ফায়ার করেছিল, তবে বাঙালি পাঠকমাত্রই বিস্মিত হবেন, সন্দেহ কি!
উত্তর প্রদেশ থেকে লাহোরাগত মৌলবি-মৌলানারা নিজের স্বার্থেই হোক- মাইনর মাদ্রাসার তনখা তাঁদের পক্ষে হাস্যাস্পদ কিংবা ইসলামি চর্চা উচ্চতর পর্যায়ে তোলার জন্যই হোক, তাঁরা উঠেপড়ে লেগে গেলেন পুঁচকে ওই মাদ্রাসাটিকে উচ্চমানে তোলার জন্য।
উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক কোথায়? এস্থলে স্মরণে আনি, সুইটজারল্যান্ড দেশের বের্ন শহরে সর্বপৃথিবীর লেখকদের স্বার্থ রক্ষার্থে সমাগত বিভিন্ন দেশ কপিরাইট সম্পর্কে কতকগুলি আইন প্রণয়ন করেন। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল, যেসব দেশ এসব আইনে (সংক্ষেপে বের্ন কনভেনশন) দস্তখত দেবেন তারা একে অন্যের কপিরাইট মেনে চলবেন। যেমন কোনও ভারতীয় প্রকাশক বিনানুমতিতে গত মাসে লন্ডনে প্রকাশিত, সর্বস্বত্বরক্ষিত কোনও পুস্তক ছাপতে পারবেন না। কত বৎসর পরে মূলগ্রন্থ, কত বৎসর পরে তার অনুবাদ বিনানুমতিতে ছাপতে পারা যায়, সে বিষয়ে মূল আইনকে কিঞ্চিৎ সীমাবদ্ধ, প্রসারিত, সংশোধিত করা হয়েছে।
পাকিস্তান বের্ন কনভেনশনের মেম্বার হল না। বাংলাদেশ হয়েছে কি না, জানিনে।
তার কারণ অতি সরল। পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু বই না হলে পাঞ্জাবের চলে না। সেগুলো ছাপা হয় ভারতে, কপিরাইট ভারতীয় লেখকের। কাড়ি কাড়ি ফরেন কারেনসি চলে যায় ভারতে, এগুলো কিনতে গিয়ে। সে বইগুলো যাতে নির্বিঘ্নে, ভারতীয়দের কোনওপ্রকারের রয়েলটি না দিয়ে লাহোরে ছাপানো যায় সেই মতলব নিয়ে পাকিস্তান বের্ন কনভেনশনের মেম্বার হয়নি।
কিন্তু বললেই তো আর হয় না। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, লাহোর কোনওকালেই উর্দুর পীঠস্থান ছিল না। তাই ফাউন্ডারি ছাপাখানা, কাগজ নির্মাণ, প্রুফ রিডার ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারো রকমের জিনিস এবং মানুষ লাহোরে আছে অতি অতি অল্প, বহু বস্তু আদৌ ছিল না। এগুলো তো আর রাতারাতি গড়ে তোলা যায় না।
ঢাকাও সঙ্গে সঙ্গে সেই বিপদেই পড়ল। কিন্তু লাহোরের তুলনায় সে কিছুই নয়। কারণ ঢাকার ভাষা বাংলা, সাহিত্য বাংলা। লাহোরে বাস করে যদি একজন উর্দু লেখক, তবে ঢাকায় অন্তত দশজন বাঙলা লেখক। বর্ধমান যেমন কলকাতার আওতায় ছিল, ঢাকাও তাই ছিল। লাহোর সেরকম উর্দুভূমির আওতায় কোনও কালেই ছিল না। গোড়ার দিকে ঢাকার কুমতলব ছিল না, বেন কনভেনশনের পুটায়ে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের ফাঁকি দিয়ে তাদের বই ছাপানো। তাদের প্রধান শিরঃপীড়া ছিল, আপন পাঠ্যপুস্তক রচনা করা, ছাপানো ইত্যাদি। তদুপরি পাঠ্যপুস্তকে প্রবন্ধ কবিতা সঞ্চয়নে ঢাকার ভাবনা অনেক কম। রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিম, মাইকেল, হেমচন্দ্র ইত্যাদি বিস্তর ক্লাসিক লেখকের কপিরাইট ততদিনে শেষ হয়ে গিয়েছে কিংবা যাব যাব করছে। বের্ন থাক আর না-ই থাক– ঢাকা তার পাঠ্যপুস্তকে এঁদের লেখা তুলে ধরলেই তো যথেষ্ট। উপস্থিত না-ই বা থাকলেন শরৎচন্দ্র বা তারাশঙ্কর। উঠেপড়ে লেগে গেল ঢাকা পিছনে কবি, গল্পলেখক অসংখ্য না হলেও নগণ্য নয়, তদুপরি ঢাকা বিরাট পূর্ব পাকের রাজধানী। লাহোর পশ্চিম পাকের রাজধানী তো নয়ই, যে পশ্চিম পাঞ্জাবের প্রধান নগর সে-ও তেমন কিছু বিরাট প্রদেশ নয়।
লাহোর কোনও উন্নতি করতে পারছে না দেখে তাকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে উৎসাহিত করার জন্য এক ঝটকায় ব্যান করে দেওয়া হল তাবৎ ভারতীয় পুস্তকের আমদানি। পাঞ্জাবি কর্তাদের অনুরোধে করাচির বড় কর্তারা অবশ্য ব্যান করার সময় ভেবেছিলেন উর্দু বইয়ের কথা। কিন্তু ফাঁদে পড়ে গেল পশ্চিম বাঙলার বইও। অর্ডারটা অবশ্য খুব খোলাখুলি দেওয়া হয়েছিল কি না জানিনে।
কিন্তু সেটা ফাঁস হয়ে গেল সেই যে ছোট্ট মাদ্রাসাটির কল্যাণে। তারা পড়ল সমূহ বিপদে। তাদের আরবি-ফারসি পাঠ্যপুস্তক ছাপবার জন্য আরবি অক্ষরের ফাউন্ডারি, প্রেস, প্রুফরিডার কোথায়? যে উত্তর প্রদেশের সর্বোচ্চ মাদ্রাসায় প্রচুর আরবি বই কিনত সেই উত্তর প্রদেশে মাত্র একটি আরবি প্রেসের নাম সর্বভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। নওলকিশোর প্রেসের মালিক ছিলেন আরবি-ফারসি-উর্দুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল জনৈক হিন্দু। এ অধম শৈশবে ঈশ্বর নওলকিশোরের ছাপা পুরাণ দিয়েই পাঠারম্ভ করে। খুদ মক্কাশরিফে একদা তাঁরই কুরান বিক্রি হত।
আরবি পুস্তক ব্যান করার বিরুদ্ধে মোল্লারা করলেন তীব্র প্রতিবাদ। সেটা প্রকাশিত হল এক উর্দু সাপ্তাহিক-এ। করাচির ইংরেজি ডন করল সেটার অনুবাদ। সেটা খবর হিসেবে প্রকাশিত হল কলকাতায়। তখন আমরা জানতে পারলুম, পশ্চিম বাংলার বই কেন ঢাকা যাচ্ছে না।
ইতোমধ্যে জুট-চা একসপ্লয়েটকারী লাহোরের চা-ব্যবসায়ীরা চিন্তা করছে, পুব বাঙলার বুক-মার্কেট কীভাবে একসপ্লয়েট করা যায়। সে-ও এক মজাদার কেচ্ছা।
.
উভয় বঙ্গে– আধুনিক গদ্য কবিতা
পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ পাঠক গদ্য কবিতা (গবিতা ও গবি বিপ্রকর্ষণ অসৌজন্যবশত নয়) সম্বন্ধে সবিশেষ কৌতূহলী না হলেও গবিকুল ও তাদের চক্র যে প্রচণ্ড উৎসাহের সঙ্গে গবিতা রচনা করেন, সাপ্তাহিক রবিবাসরীয় ছয়লাপে ভাসিয়ে দেন, সর্ববিধ ব্যঙ্গ কৌতুক চরম অবহেলাসহ উপেক্ষা করে এলিয়ট, পাউন্ড নিয়ে গভীর আলোচনা, তুমুল তর্কবিতর্কে মত্ত হন, এসব গ্র্যান্ডমাস্টারদের গবিতা বাংলায় অনুবাদ করেন এবং বহু ক্ষেত্রে কষ্টার্জিত কার্ষাপণ ব্যয় করে ওইসব মহামূল্যবান রত্নরাজি রসিক-বেরসিক সকলের সামনে তুলে ধরেন, এসব কাণ্ডকারখানা দেখে সবিস্ময়ে মন ধায় একাধিক সাহিত্যের ইতিহাস অনুসন্ধান করে তুলনীয় একটা বিরাট আন্দোলন আবিষ্কার করতে। বহুতর প্রচেষ্টার পর দেখি, পঞ্জিকার ভাষায় সর্বদিকে যাত্রা নাস্তি। বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় ঝাঁকে ঝাঁকে কবি জমায়েত হতেন, গজনির মাহমুদ বাদশাহ ধনদৌলত লুট করার সময় দু-চারটে কবি লুট করতে লুষ্ঠিত হতেন না, মঙ্গোলদের সর্বনাশা দিগ্বিজয়ের ফলে হাজার দুত্তিন ইরানি কবি মোগল দরবারে আশ্রয় পান। একসঙ্গে একই দরবারে দুই তিন হাজার কবি। তৎসত্ত্বেও পরিষ্কার দেখতে পাই, এঁরা স্থায়ী-অস্থায়ী কোনওপ্রকার আন্দোলনের সূত্রপাতটুকু পর্যন্ত করতে পারলেন না। পক্ষান্তরে এই দীন পশ্চিমবঙ্গ সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ, পাঠক-সাধারণ কর্তৃক অবহেলিত গবিকুল কী প্রচণ্ড তেজে নয়া এক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তস্মাৎ প্রণমা-প্রণিধায় কায়ং। অতিশয় সত্য যে ন তৎসমোস্তৎ ভ্যধিকঃ কুতোৎনো।
বাংলাদেশেও একই হাল। হয়তো পরিসংখ্যা বৃহত্তর। তবে তাঁদের চক্রটির পরিধি কতখানি বিস্তৃত সেটা জরিপ করা সুকঠিন কর্ম। অবশ্য একথা অতীব সত্য, ঢাকার অসংখ্য দৈনিকের প্রায় সব কটিই রবিবাসরীয় তথা সাহিত্য সংখ্যায় ভূরি ভূরি গবিতা ছাপে। যে কটি বিখ্যাত-অখ্যাত গবির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা, গবিতার তরে কলিজার খুন দিয়ে শহিদ হবার জোশ পশ্চিমবঙ্গের গবিকুলকে দস্তুরমতো ভেল্কিবাজি দেখাতে পারে। পুব বাঙলার বাজারে পশ্চিমবঙ্গের পুস্তক-মাসিকের নিদারুণ অনটন সত্ত্বেও ঢাকার গবি সম্প্রদায় এ বাঙলার গবিদের নাম জানেন, ও একাধিকজনের রচনা মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করেছেন, এঁদের সম্বন্ধে তত্ত্ব ও তথ্যসহ উচ্চাঙ্গের আলোচনা করতে পারেন এবং সহৃদয় পরিবেশ পেলে করেও থাকেন। এঁদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় যে তাঁরা আমাদের মতো গবিতাউদাসী এবং যারা আগাপাশতলা গবিতাবৈরী কাফের তাঁদের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য অবলম্বনে একাধিক গবির ন্যায় তাচ্ছিল্যি প্রকাশ প্রায় করেনই না এবং আমরা যে নিতান্তই হতভাগ্য গৈলানন্দ থেকে বঞ্চিত, অশিক্ষিত জড়ভরত সেকথা আভাসে-ইঙ্গিতে স্মরণ করিয়েও দেন না। কলকাতা ফিরে সবিস্ময়ে লক্ষ করলুম, এ বঙ্গের একাধিক গবিও ও-বাঙলার বেশকিছু গবি সম্বন্ধে ওকিবহাল এবং আশ্চর্যের বিষয় নানা বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে ও-বাঙলার গবিতার বই বেশ কিছু পরিমাণে এদেশে এসে পৌঁছেছে। আমার মনে হয়, কথাসাহিত্যের জনপ্রিয়তা স্মরণে রাখলে দেখা যাবে, গবিতার ন্যায্য হিসেবে যা পড়ার কথা তার চেয়ে ঢের বেশি গাব্য পুস্তিকা দুই বাঙলাই পাচার ও লেনদেন করেছে। অবশ্য গবিতার প্রতি কালাপাহাড়ি মনোবৃত্তিসম্পন্ন বিশ্বনিন্দুকরা বলে, এই গদ্য কবিতা বিনিময় নির্ভেজাল গাব্য রসাসক্তি বশত নয়, এর মূল কারণ অন্যত্র ও সন্তর্পণে লুক্কায়িত। উভয় বঙ্গের গবিকুলের অনেকেই কমুনিস্ট এবং তারা একে অন্যের সঙ্গে রাজনৈতিক ভাব বিনিময় লেনদেনের সময় গবিতা-রস এপিটাইজিং ফাউরূপে এস্তেমাল করেন।
বাংলাদেশের অপেক্ষাকৃত বয়স্ক গবিদের এ বাঙলার অনেকেই চেনেন- আমাদের মতো অপাঙক্তেয় অরসিকদেরও দু একজন। কবি আবুল হোসেনের শিক্ষা-দীক্ষা কলকাতায়। দেশ বিভাগের পূর্বেই তাঁর প্রতিভা উভয় বাঙলার অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভাষার ওপর দখল, স্পর্শকাতর হৃদয় দিয়ে বিষয়বস্তু চয়ন, অনাড়ম্বর পদ্ধতিতে সৃষ্ট রস পরিবেশন তাঁর অধিকাংশ রচনাতেই যেন আধা-আলোতে লুকিয়ে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি দক্ষিণপূর্ব-এশিয়ায়। সে যুদ্ধ তাঁর অন্যতম সংকলনে প্রকাশ পেয়েছে। নয়টি মাসের ইয়েহিয়া নৃত্য কিন্তু এখনও তাঁকে নব সৃষ্টির জন্য তাড়না লাগাতে পারেনি। কিংবা হয়তো তাঁর পিতার অকারণ, মর্মান্তিক পরলোকগমন তাঁর চৈতন্যলোকে ট্রাউমা হয়ে সেখানে সর্বরসধারা আসুরিক পদ্ধতিতে রুদ্ধ করে দিয়েছে। আশা রাখি, এ ট্রাউমা দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
রাজনীতির প্রতি পূর্ণ উদাসীন, আচারনিষ্ঠ বৃদ্ধ পিতা খবর পেয়েছিলেন যে, খানসেনা তাদের গ্রামে প্রবেশ করছে। হয়তো ভেবেছিলেন– সেইটেই স্বাভাবিক সর্বপ্রকারে রাজনৈতিক কর্মে সম্পূর্ণ অক্ষম এই অথর্ব বৃদ্ধের প্রতি কি খানসেনা, কি লীগ এমনকি পেশাদার খুনি গুণ্ডারও বৈরীভাব পোষণ করার মতো কোনও স্বার্থ, দ্বেষ বা অন্য হেতু থাকতে পারে না। গ্রামের সদর রাস্তা দিয়ে মার্চ করে যাবার সময় খানরা তাঁকে দেখতে পেল বৈঠকখানায়। বাক্যব্যয় না করে তাকে সেখান থেকে টেনে নিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারে।
আবুল হোসেনের সমসাময়িক আরও উত্তম উত্তম কবি আছেন। তাদের পরবর্তীকালের রচনা হাতে আসেনি–যোগাযোগ ছিল না বলে।
সর্বাধুনিক গবিদের ভিতর ব্যাহ্যত কিশোরসম, আমার তথা সর্ব বয়স্কজনের স্নেহের পাত্র মিঞা শন্সর রহমানের রচনা সরল ও সরস, ছত্রে ছত্রে যেন নতুন নতুন ডাক দিয়ে যায় বাঁকে বাঁকে, দেখায় অপ্রত্যাশিত বিচিত্র ছবি; যদিও একাধিকবার আমার মনের কোণে জেগেছে একটি ধারণা : মিঞা শমস্-এর গবিতার বিষয়বস্তু এত বেশি রোমান্টিক যে এগুলো সাবেক পদ্ধতির কবিতায় চিত্রাঙ্কন একাডেমিক স্টাইল নামে যে টেকনিক পরিচিত– রচিত হলে তাঁর বিচিত্র অনুভূতি সুডৌল নিটোল রূপে ব্যাপকতর আত্মপ্রকাশ করতে পারত।
মননশীল প্রবন্ধ, বিশেষত সাহিত্যের ইতিহাসবিষয়ক তথা পূর্ববঙ্গীয় লেখিকাদের সৃষ্টি নিয়ে তাঁর রচনা কয়েক বৎসর পূর্বেই বানু সালমা চৌধুরীকে তথাকার সাহিত্য জগতে সম্মানের আসন দিয়েছিল। সম্প্রতি তিনি একখানি চটি গবিতা পুস্তিকা প্রকাশ করে ইতোমধ্যেই তাঁর সৃষ্টির বহুমুখী ধারা, বহুবিচিত্র বিদগ্ধ তথা জানপদ শব্দ চয়নদ্বারা সমৃদ্ধ ভাষা-শৈলী, ঐতিহাসিক নয় মাসের বিভীষিকাময়ী সুদীর্ঘ লক্ষ যামা করাল রজনী, সর্বোপরি লেখিকার আম্মা, নানী, বৃদ্ধা মাতৃসমা পরিচারিকাটির ভিন্নেসহ আচারনিষ্ঠ, শান্ত, নম্র পঞ্চোপাসনান্তে লব্ধ অবকাশে নিত্য চারু-কলারত একটি মুসলমান পরিবারের যে চিত্রটি লেখিকা দরদি হৃদয় দিয়ে এবং প্রধানত ব্যঞ্জন ও সুনিপুণ পরিচালনা দ্বারা অঙ্কন করেছেন, সে ছবিটির বৈচিত্র্যগুণ রগ্রাহীজনের সপ্রশংস চিত্তাকর্ষণ করেছে। বস্তুত সদ্য প্রস্ফুটিত বুদ্ধিবৃত্তি তথা নীতি-বিকশিত স্পর্শকাতরতাসহ কিশোরীর প্রাগুক্ত সাহিত্যিক রচনার চেয়েও।
লেখিকার বড় মাসির সুফিতত্ত্বমূলক মারিফতি* গীতি (মিস্টি সস্) তাঁর অকালমৃত্যুর পর জনগণের স্বীকৃতি লাভ করে ও ঢাকা বেতার কয়েক বৎসর ধরে তাঁর সুফি পল্লিগীতি প্রচার করে আসছে। এই মাসির কনিষ্ঠপুত্র, লেখিকার অগ্রজ অক্লান্ত সাহিত্যসেবী, ভগ্নীর প্রতি সদা স্নেহশীল মরহুম অলির কাছ থেকে লেখিকা সাহিত্যের যাত্রাপথে পদার্পণের প্রথম উষাকাল থেকে অকুণ্ঠ উৎসাহ ও সর্বাধিক অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। অতিশয় নিরীহ, সত্যার্থে বিরলতম এই অজাতশত্রু অলিভাইকে খানরা গুলি করে মারে তাদের বর্বর অভিযানের সঙ্গে সঙ্গেই– চট্টগ্রামে। শোকাতুর লেখিকা তাঁর জনপদকল্যাণী মাসিকে স্মরণে এনে অশ্রুসিক্ত নয়নে পুস্তিকাটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর প্রিয় দাদাভাই সাহিত্যসখা অলিকে। কবিতাগুচ্ছের অনেকগুলোই অশ্রুশিশিরে সিক্ত।
[*সালমা চৌধুরী, ‘অংশীদার আমি’, সিলেট, ১৩৭৯।]
শতাধিক বৎসর পূর্বে এই চট্টগ্রামেরই আরেক নারী, রহিমুন্নেসা তার ভ্রাতার অকাল মৃত্যুতে কাতর হৃদয়ে বিশ্ববাসীকে শুনিয়েছিল :
নয়া সন নয়া মাস ফিরে বার বার,
মোর জাদু চলি গেল ফিরিল না আর।
.
উভয় বাঙলা– সদাই হাতে দড়ি, সদাই চাঁদ
গত শতকের শেষের দিকে, এবং এ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজ চিন্তামগ্ন ভারতবর্ষকে আর কোন কোন দ্রব্যে শোষণ করা যায়। একাধিক চতুর লোকের মাথায় খেলল বাঙলা মুল্লুকের মাছ। মৎস্যের প্রতি যে বাৎসল্য বাঙালির আছে, সেরকম উদাহরণ পৃথিবীর কোনও জাতের কোনও বস্তুর প্রতি আছে কি না সেটি গভীর গবেষণার বিষয়। অতএব ভারত সরকারের পুরো মদদ, পুলিশের কড়া শাসনের ছত্রচ্ছায়ায় দুই ইংরেজ মাছের ব্যবসা খুলতে গেল, দুটি কলের জাহাজ নিয়ে। কথিত আছে অস্মদেশীয় নমস্য ভেড়িওয়ালারা (শব্দটি আমি হরি, জ্ঞান রাজ কারও অভিধানে পাইনি- মৎস্য উৎপাদনকারী অর্থে যে অর্থে অর্বাচীন লেখক এস্থলে সভয়ে ব্যবহার করছে) মহুরতের পূর্বরাত্রে দুটি জাহাজ পুড়িয়ে দিলেন পুলিশকে বিশেষ অঙ্গুলি প্রদর্শন করত এবং সরকারকে উভয় হস্তের। অতঃপর আবার ইংরেজ চেষ্টা দিল দুশমনদের আওতার বাইরে চিল্কা হ্রদে। কথিত আছে, সর্ব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হবার প্রাক্কালে কে বা কাহারা চিল্কাপারের সরকারি বিশ্রামাগারে গভীর নিশীথে একাধিক ইংরেজ হনু মৎস্য ব্যবসায়ীকে পেঁদিয়ে লম্বা করে দিয়ে যায়। অবশ্য ভেড়িওয়ালাদের এহেন অপ্রশংনীয় আচরণের মধ্যে অন্তত একটি প্রশংসনীয় দ্ৰস্ততা ছিল : উভয় প্রচেষ্টার প্রারম্ভেই তাঁরা গোরারায়দের স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, এ ধরনের প্রচেষ্টা তাঁদের স্বাস্থ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক না-ও হতে পারে… অর্বাচীন বঙ্গীয় ইতিহাসে এর চেয়ে বিস্ময়জনক ঘটনা আমার জানা নেই; কোথায় তখন স্বদেশী, ক্ষুদিরাম, গান্ধী ইংরেজের সেই দোর্দণ্ডতম প্রতাপের মধ্যাহ্নে? যদি অনুমতি পাই তবে নির্ভয়ে নিবেদন, কম্যুনিজম ফ্যাসিজম সাংখ্যবেদান্ত মাকালী মৌলা আলি এঁদের কারওরই প্রতি আমার অখণ্ড বিশ্বাস নেই এবং সঙ্গে সঙ্গে সভয়ে নিবেদন আমার সাতিশয় অবিচল দৃঢ়তম বিশ্বাস, ভারত এবং কিংবা বাঙলা সরকার এমনকি প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মৎস্য রপ্তানির আশ্বাসে বলীয়ান হলেও তাঁরা কস্মিনকালেও আমাদের ভেড়িওয়ালাদের আয়ত্তে এনে মৎস্য মূল্য দ্রজনোচিত স্তরে আনতে পারবেন না, না, না। নিতান্তই যদি শিলা জলে ভেসে যায় ধরনের অসম্ভব কল্পনাবিলাস করতেই হয়, তবে বলি, যদি কখনও পারেন, তবে সেই সন্ধ্যায়ই ভারতের তাবৎ ট্রেড ইউনিয়ন করায়ত্ত হবে, আহমদাবাদি, অন্যান্য কোটিপতি তথা কালোবাজারিরা পড়িমরি হয়ে কিউ লাগাবেন গত পঞ্চাশ বছরের ঠকানো ইনকাম ট্যাক্স শোধ করতে, যাবতীয় কার্টেল মনপলিকে নিধন করতে সরকারের এক মাসও লাগবে না, গরিব চাষাকে দাদন দিয়ে তার সর্বনাশ সাধনরত সট্টাবাজার– এক কথায় এমন কোনও সংগঠনই তখন নির্বিঘ্নে আপন অসামাজিক আচরণে লিপ্ত থাকতে পারবে না। ভূমণ্ডল প্রদক্ষিণ না করেও সাধারণ পর্যটকের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের ভেড়িওয়ালাদের ঐক্য ও তজ্জনিত শক্তির সঙ্গে তুলনা দিতে পারি এমন কোনও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় সমন্বিত শক্তি আমি কোথাও দেখিনি, পড়িনি, শুনিনি। ঈশ্বর তাদের মঙ্গল করুন এবং আমাকে যেন পরজন্মে ভেড়িওয়ালাকুলে স্থান দেন।
বোহরা, খোজা তথা পাঞ্জাবিরা যখন পুব বাঙলার পাট, চা, চামড়া থেকে আরম্ভ করে বিদেশির সহায়তায় নির্মিত আলপিন তক তার মারফত তাদের রসাল কলনিটির আঁটিতে কামড়াতে আরম্ভ করেছেন তখন কতিপয় উদ্যোগী পাঞ্জাববাসীর মনে একটি অতিশয় মৌলিক অভিযানচিন্তা উদিত হল। পূরব পাকিস্তানের মর্দ-লোগ তো বটেই ঔরলোগভি বহু বহুৎ কিতাব পড়ছে। এই কিতাব-মার্কেটটাকে যদি কজাতে আনা যায় তবে কুলে পাকিস্তানে যে বাইশটি পরিবার দেশের অধিকাংশ ধনদৌলতের মালিক আমরা তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারব। মাছের বেলা যেরকম ইংরেজ উদ্যোগী পুরুষদের পশ্চাতে আপন সরকার দাঁড়িয়েছিল তাদেরই বা মদদ দেবে না কেন পিণ্ডি-ইসলামাবাদ? পূর্ববঙ্গে তখন পুস্তকোৎপাদনে ভেড়ি দূরে থাক, কটা এঁদোপুকুর ছিল, এক আঙুলে গুনে বলা যেত।
ব্যাপারটার গোড়াপত্তন কিন্তু এক নতুন পরিস্থিতি এবং তারই ফলে এক নতুন প্রয়োজনীয়তা থেকে। পুব বাঙলাকে যথারীতি শাসনশোষণ করার জন্য পশ্চিম পাক বিশেষত পাঞ্জাব থেকে নিরবচ্ছিন্ন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পর্যায়ের কর্মচারী পাঠাতে হলে মুশকিল এই যে তারা ন-পাক বাঙলা ভাষাটার সঙ্গে মোটেই পরিচিত নয় এবং যতদিন না সে ভাষা সম্পূর্ণ লোপ পায়– সে পুণ্যকর্ম করার জন্য সরকার অবশ্যই সদাজাগ্রত ও যত্নবান– ততদিন এদের তো কাজ চালাবার মতো বাঙলা শিখতে হবে। ওদিকে কলেজের ছাত্ররাও হৃদয়ঙ্গম করেছে, সিন্ধি বেলুচি বা পশতু শিখে বিশেষ কোনও লাভ নেই। সিন্ধু দেশে তো যথেষ্ট উচ্চশিক্ষিত সিন্ধিজন আছেই, তদুপরি অর্ধবর্বর পাঠানভূমি, বেলুচিস্তান এমনকি সিন্ধু প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় এতই ক্ষুদ্র যে সেখানে চাকরির সংখ্যা অতি অল্প। এবং এ কথাও সত্য বেলুচ-পাঠানের উপর ডাণ্ডা চালানো অতটা সহজ নয়। বেলুচিস্তানের উপর তো পরবর্তীকালের বুচার অব বেঙ্গল টিক্কা খান বোমা ফেলে বিমার অব বেলুচিস্তান খেতাব পেয়েছেন পূর্ব বাঙলার উপর এখনও বোমা ফেলতে হয়নি। অতএব শেখো বাঙলা প্রেমসে। করাচি, লাহোর এমনকি যে পাঠানের মাতৃভাষা পশতু, বলতে গেলে এখনও যে ভাষা লিখতে রূপ পায়নি সেই পাঠান উঠেপড়ে লেগে গেল পেশাওয়ার বিদ্যালয়ে বাঙলা শিখতে।
এ বড় মজার পরিস্থিতি। খুদ পশ্চিম পাকে বাঙলা শেখা হচ্ছে পূর্ণোদ্যমে, আর সেই বাঙলা ভাষাকে নিধন করার জন্য পুব পাকে গোপনে প্রকাশ্যে দমননীতির সঙ্গে সঙ্গে আইনকানুনও নির্মিত হল। তারই একটা ফরমান সম্পূর্ণ বেআইনি কায়দায় ঘোষণা করল পুব বাঙলা এলাকায় পশ্চিম বাঙলার জীবিত কি মৃত– মৃত লেখকের কপিরাইট তামাদি হয়ে গিয়ে থাকলেও কোনও লেখকের বই ছাপানো চলবে না এবং পশ্চিম বাঙলার প্রথম প্রকাশিত যে কোনও বই পুব বাঙলায় ছাপানো যাবে না। এর ফলে পুব পাকিস্তানের অধ্যাপক ও কবি জসীম উদ্দীনের কাব্য নক্সি কাথার মাঠ ইত্যাদি পূব বাঙলায় ছাপানো নিষিদ্ধ হল কি না স্মরণে আসছে না; কবির তাবৎ পুস্তকই তো কলকাতার ছাপাখানাতেই জন্ম নেয়, প্রথম প্রকাশ তো সেখানেই।
পশ্চিমবঙ্গের লেখকমণ্ডলী নিশ্চয়ই এ ব্যানের সংবাদ শুনে উল্লাস বোধ করতেন যদি তখন সেটা জানতে পেতেন। বিশেষ করে নীহার গুপ্তর মতো জনপ্রিয়, শঙ্করের মতো বহুদর্শী ও সমরেশের মতো নির্ভীক লেখক নিশ্চয়ই এ সংবাদ শুনে কথঞ্চিৎ শান্ত হতেন কারণ কালোবাজারের চোরাই সংস্করণের এঁরাই ছিলেন শিকারের প্রধান প্রধান বাঘসিঙি। কিন্তু ইতি গজটা এখনও বলা হয়নি। পশ্চিম বাঙলার বই পুব পাকিস্তানে ছাপানো ব্যান হল বটে কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে ছাপানো ব্যান হল না।
কী কারণে কার স্বার্থে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। পাঞ্জাবের উদ্যোগী পুরুষসিংহরা– যদিও সিংহগুলো কালোবাজারি পুস্তক ছাপানোর অনৈসর্গিক ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণে রঞ্জিত– যাতে করে পুব বাঙলার বুক-মার্কেট পরিপূর্ণরূপে গ্রাস করতে পারেন। বিধি বলুন, বিজ্ঞান বলুন তিনি/তারা এঁদের প্রতি অকস্মাৎ সদয় হলেন। ফটো-ফ্ল্যাশ নামক পদ্ধতি ততদিনে আবিষ্কৃত হয়েছে যার প্রসাদে সরাসরি যে কোনও বই সস্তায় পুনর্মুদ্রণ করা যায় নতুন করে কম্পোজ-প্রুফরিডিং ইত্যাদির ঝামেলা পোয়াতে হয় না। প্রাগুক্ত পশ্চিম পাকের বাঙলাভাষা অধ্যয়নরত ছাত্রদের জন্য এঁরা সর্বপ্রথম ছাপলেন তাঁদের বাঙলা পাঠ্যপুস্তক ব্যাকরণ ও অভিধান। চটসে প্রকাশিত হল চলন্তিকা। কিন্তু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ পশ্চিম পাকে বই বিক্রি হবে অল্প, পুব পাকের ভূমাতে শাস্ত্রসম্মত সুখম। ওদিকে উল্লেখ প্রয়োজন পশ্চিম পাক থেকে পুব পাক যে কোনও বই উর্দু হোক বাঙলা হোক, যে কোনও পরিমাণে আমদানি করতে পারে– তার ওপর কোনও ব্যান্ নেই। কাজেই পাঞ্জাবি উদ্যোগীরা ছাপতে লাগলেন, শরৎচন্দ্র থেকে আরম্ভ করে বটতলা পর্যন্ত। রবীন্দ্র শতবার্ষিকী কালে বা তার কিঞ্চিৎ পূর্বে কলকাতায় প্রকাশিত গীতাঞ্জলির একটি শোভন পকেট সংস্করণেরও অত্যুত্তম ফটোফ্ল্যাশ সংস্করণ তারা বাজারে ছেড়েছিলেন। সকণ্ঠে কাষ্ঠ হাসি হেসে বলি, গুণীজনের মনোরঞ্জনার্থে! বাজারটা কিন্তু খুব বেশিদিন বাঁচল না। ইতোমধ্যে লেগে গেল ১৯৬৫-র লড়াই। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় একাধিক প্রকাশক দুশমন মুল্লুকের তামাম মাল হালাল অর্থাৎ শাস্ত্রানুমোদিত এই অছিলায়। বেধড়ক ছাপতে শুরু করলেন পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রকারের পুস্তক। ইতোপূর্বে যে আদৌ করেননি তা-ও নয়, মি. ব্ল্যাক অনুচর স্মিথও অপাক্তেয় রইলেন না।… পুব পাক স্বাধীন হওয়ার পর এখনও কী পরিমাণ পাইরেটেড মুদ্রণের প্রচার ও প্রসার আছে তার অনুসন্ধান করিনি।
কী অদ্ভুত পরস্পর-বিরোধী পলিটিকস চালাল চব্বিশ বছর ধরে পশ্চিম পাকের দণ্ডধরগণ। পুব বাঙলায় পলিসি ছিল তার সাহিত্য ও ভাষার যথাসাধ্য বিনাশ করা এবং দ্বিতীয়ত পুব বাঙলা যেন পশ্চিম বাঙলার সঙ্গে কি সাহিত্যে কি সঙ্গীতে কোনও প্রকারের যোগসূত্র রক্ষা করতে না পারে। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকে হবে বাঙলা বড় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের জন্য ছাপাতে দিল বাঙলা বই, অভিধান। ওদিকে কলোনি শোষণনীতি অনুসরণ করে পশ্চিম বাঙলার প্রকাশিত পুস্তক পাঞ্জাবে যদৃচ্ছ ছাপতে ও পুব বাঙলায় বে-লাগাম বিক্রয় করতে বাধা দিল না।
.
উভয় বাঙলা– নীলমণি
বিস্তর বিদগ্ধ পাঠক স্বভাবতই শুধোবেন, ইকবাল? ইকবাল তো পাঞ্জাবি! কবি হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি আছে। তা হলে পশ্চিম পাঞ্জাবিদের সঙ্গে উর্দুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নেই, বলা যায় কী প্রকারে? তুলনা দিয়ে বলা যায়, জোসেফ কনরাডের মাতৃভাষা ছিল পোলিশ। তিনি ইংরেজিতে সাহিত্যসৃষ্টি করে বিখ্যাত হয়েছেন। তাই বলে পোল্যান্ডবাসীর সঙ্গে ইংরেজির অন্তরঙ্গতা আছে, একথা বলা যায় না।
হেমচন্দ্রের স্থান বাঙলা সাহিত্যের কোন শ্রেণির আসনে সে সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ বাক্যবিন্যাস করার অধিকার এ অর্বাচীন লেখকের আছে; আমার বিস্তর পাঠকের প্রভূত পরিমাণে থাকার কথা। কিন্তু উর্দু কাব্যের সঙ্গে আমার পরিচয় এতই সীমাবদ্ধ যে সে কাব্যে ইকবালের স্থান কোথায় সে সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য করবার মতো কাব্যাধিকার আমার অত্যল্পের চেয়েও কম। তথাপি বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধশ্রেণিকে সাধ্যানুযায়ী পূর্ণতর করার উদ্দেশ্যে সেটা অবর্জনীয়।
ইকবাল, আমার যতদূর জানা আছে, জর্মন কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুব সম্ভব মনিক থেকে দর্শন বিভাগে ডক্টরেট পান। কোনও কোনও পাঠকের কৃপাধন্য এ গর্দভও দর্শন বিভাগ থেকে ডক্টরেট পায়– জর্মনির অন্যতম বিখ্যাত বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এবং বললে পেত্যয় যাবেন নিশ্চিৎ মতুল্য এবং মদাপেক্ষা সহস্রগুণে খঞ্জতর ভূরি ভূরি গর্দভ-গর্দভী জর্মনি থেকে– জর্মনি কেন, সর্বদেশেই– নিত্যি নিত্যি ডক্টরেট পেয়েছে ও পাবে। অতএব ইকবাল ভক্ত মদোস্কট পঞ্চনদবাসী কবি ইকবালের ডক্টরেট নিয়ে যতই ধানাই-পানাই করুক, ঢক্কা-ডিণ্ডিম-নাদ ছাড়ুক তদ্বারা বিন্দুমাত্র বিচলিত হওয়ার কারণ নেই। বিশেষত আমরা যখন বিলক্ষণ অবগত আছি, উচ্চাঙ্গের কাব্য রচনার জন্য দর্শনশাস্ত্রের প্রয়োজন নেই, এবং ওই উদ্দেশ্যে মুনিক পানে ধাবমান হওয়াও বন্ধ্যাগমন। বস্তৃত কবি ইকবালের ঢক্কাবাদক পঞ্চনদ সম্প্রদায় তাঁর যেসব দার্শনিক কবিতার প্রশস্তিতে পঞ্চমুখ সেগুলো না দর্শন না কবিতা। অবশ্য আমার এই ধারণার মূল্য না-ও থাকতে পারে। তার বিশেষ ধরনের কবিপ্রতিভা ছিল, সে তথ্য সুবিদিত।
ইকবাল যেসব কবিতায় অতীতের মুসলিম সভ্যতা ও কৃষ্টির গুণ-কীর্তন করেছেন এবং তার যুগে মুসলিম জাহানের সর্বত্র সে-সভ্যতা ও কৃষ্টির অস্তমিত অবস্থার যে কারণ বর্ণনা দিয়েছেন সেগুলোই সবচেয়ে জনপ্রিয়। ইতিহাসের দৃষ্টিবিন্দু থেকে দেখলে সেগুলোতে ভুল-ত্রুটি নগণ্য এবং স্থলে স্থলে কবিজনসুলভ অতিশয়োক্তি নিশ্চয়ই গ্রহণযোগ্য।
এক-এক জলজ পর্বতপ্রমাণ।
সাগর করিবে গ্রাস হয় অনুমান ॥
যে সাগরে জলজন্তু বাস করে সেই গোটা সাগরকে যদি সেই জলজন্তু গ্রাস করতে পারে তবে ইউক্লিডের মুখে ছাই দিয়ে স্বীকার করব, কোনও বস্তুর খণ্ডিত অংশ সেই বস্তু থেকে বৃহত্তর হতে পারে! কিন্তু কাব্য বিজ্ঞান নয়, দর্শনও নয়। যদিও আলঙ্কারিক দুনি তাঁর কাব্যাদর্শে মত প্রকাশ করেছেন, এ জাতীয় অসম্ভাব্য বর্জনীয়।
একতায় হিন্দুরাজগণ
সুখেতে আছিল সর্বজন
সে ভাবে থাকিত যদি
পার হয়ে সিন্ধু নদী
আসিতে কি পারিত যবন?
রঙ্গলাল বঙ্গভূমে একদা এই শ্লোক ছন্দে প্রকাশ করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। ইকবালের শোকপ্রকাশশৈলী অপেক্ষাকৃত উচ্চাঙ্গের। কিন্তু যে মুসলিম কৃষ্টির ন্যায্য প্রশস্তি ইকবালের কাব্যে আছে তাতে পাঞ্জাবি মুসলিমদের অবদান সম্বন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন কি না, আমার মনে পড়ছে না। তবে একথা স্পষ্ট মনে আছে, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় প্রতি বৎসর একটা জব্বর ডিবেট হয়। বিষয় : কে শ্রেষ্ঠতর কবি?–ইকবাল না গালিব? এবং পাঞ্জাবিরা একদা দলে ভারী থাকত বলে ডিবেট শেষের ভোট-মারে গালিব প্রতি বৎসর মার খেতেন।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা সত্যই কবিতা কি না, এ নিয়ে যারা বক্তৃতা দেন কবি স্বয়ং তাঁদের নিয়ে মশকরা করেছেন। তদুপরি তাঁর কিংবা কোনও কবির কাব্য থেকে পছন্দমতো, যেটা লেখকের প্রতিপাদ্য বিষয়কে সাহায্য করে সেটা গ্রহণ, যেটা করে না সেটা বর্জন করে করে কবির জীবনদর্শন নির্মাণ করাটা তিনি নেকনজরে দেখতেন কি না, রসিকজন দেখেন কি না, সে বিষয়ে আমি শঙ্কা পোষণ করি। ইকবাল যখন গাইলেন, চীন ও আরব আমাদের হিন্দুস্থান আমাদের তখন এই আমাদের-এর আমরা খুব সম্ভব একমাত্র মুসলমানগণ, কারণ চীন ও আরবে হিন্দু আছেন বলে শুনিনি। পক্ষান্তরে তিনি যখন বলেন, হিন্দুস্থান সর্ব বিশ্বে শ্রেষ্ঠতম তখন নিশ্চয়ই তিনি আপন মাতৃভূমিকে (সে যুগে ভারত ইসলামের জন্মভূমি আরবের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর আসন দিচ্ছেন। অতএব তিনি প্রথমে মুসলিম তার পর ভারতীয়, না প্রথমে ভারতীয় তার পর মুসলিম এ সমস্যা থেকেই যায়– অন্তত আমার কাছে। সর্বশেষ প্রশ্ন, দেশ, ধর্ম, ভগবান ইত্যাদির প্রতি রচিত কবিতা আজ পর্যন্ত বিশ্বকাব্যে কতখানি সফল হয়েছে, কোন পর্যায়ে উঠতে পেরেছে, সেটাও পাঠক বিবেচনা করে দেখবেন।
রঙ্গলালের কবিতা বাঙালিকে অকস্মাৎ যবনবৈরী করে তুলেছিল বলে কখনও শুনিনি; ইকবালের কাব্য পাঞ্জাবি মুসলমানকে তার স্বধর্ম সম্বন্ধে শ্লাঘা অনুভব করতে সাহায্য করল। এটা প্রশংসনীয়। কিন্তু এই স্বধর্মাভিমান যখন অন্য ধর্মকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে এমনকি বৈরীভাবে দেখতে আরম্ভ করে বিশেষ করে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর তখন প্রতিবেশী ভারতীয় হিন্দুর প্রতি পাঞ্জাবিদের রাজনৈতিক আচরণও যে বৈরীভাবাপন্ন হবে সেটা নিতান্তই স্বাভাবিক। এমনকি পাঞ্জাবে প্রচলিত ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের পাঞ্জাবি মুসলিমও নিপীড়িত হয়। তবে এর মূলে আছেন ইকবাল– এ অপবাদ আমি কখনও শুনিনি।
দেশবিভাগের পর পাঞ্জাবিদের ভিতর দেখা দিল দুই প্রকারের আত্মম্ভরিতা। পাকিস্তান পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র অতএব পাকিস্তানিরা বিশ্ব মুসলিমের প্রতিভূ, এবং যেহেতু তারা প্রতিভূ, অতএব তারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলমান; বলা বাহুল্য, সেই সর্বশ্রেষ্ঠদের মুকুটমণি স্বভাবতই, অতি অবশ্যই পাঞ্জাবি মুসলমান। সূত্রটি সত্য কিন্তু তার থেকে যে দুতিনটি সিদ্ধান্ত হল সেগুলো যুক্তি ও ইতিহাসসম্মত নয়। কামাল আতাতুর্ক স্বদেশ তুর্কির কর্ণধার হওয়ার পূর্বে সে দেশের সুলতান ছিলেন বিশ্বমুসলিমের অধিনায়ক খলিফা। তুর্কির বর্তমান অধিবাসী সংখ্যা চার কোটির মতো। খলিফার আমলে মোটামুটি ওই ছিল। সেকালে একাধিক দেশে ঢের ঢের বেশি মুসলমান বাস করতেন। আর সংখ্যাগুরুত্বই যদি সর্বক্ষেত্রে স্পর্শমণি বা কষ্টিপাথর হয় তবে পাকিস্তানিরা খলিফার শূন্য আসনে তাদের রাষ্ট্রজনক জিন্নাসাহেব, বা পরে জাতভাই পাঞ্জাবি গুলাম মহম্মদ কিংবা মদ্যপ লম্পট ইয়েহিয়াকে বসাল না কেন? অক্সফোর্ডের অধ্যাপক সংখ্যা ৮৭০, ছাত্র ৬৯০০; মার্কিন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সংখ্যা ২১৭৪, ছাত্র ১০২৩৮। (এই অধ্যাপক-ছাত্র-শুমারি ১৯৫০-১৯৫২-এর) তারই জেরে হার্ভার্ড তো কখনও প্রাধান্য বা তার ছাত্রাধ্যাপক অক্সফোর্ডের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর এমনতরো দাবি করেনি! মানুষের মাথা একটা, সে মাথাতে যদি উকুন থাকে তবে সে উকুন অসংখ্য।
পাঞ্জাবি মুসলমানরা পাক-ভারতে শ্রেষ্ঠ সর্বশ্রেষ্ঠ না– যোদ্ধা হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। পঞ্চাশাধিক বৎসর ধরে আমি সিভিল-মিলিটারি উভয় শ্রেণির পাঞ্জাবিকে চিনি এবং কস্মিনকালেও এই খ্যাতিতে বিশ্বাস করিনি। ইউরোপের বিখ্যাত যোদ্ধা য়ুঙ্কের (Junker) গোষ্ঠীর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে এবং তাদের এক পরিবারে বেশ কিছুকাল আমি বাস করেছি, ফরাসি অফিসারদের স্যাঁ সির মিলিটারি অ্যাকাডেমির কয়েকজনকে আমি চিনতুম, এক ইংরেজ কর্নেলের কাছে প্র্যাকটিসহীন, পুস্তকে সীমাবদ্ধ অ্যামেচার রণনীতিতে আমার হাতেখড়ি হয়, আফগান অফিসারদের চিনতুম ঝাঁকে ঝাঁকে, আমারই এক ছাত্র বাচ্চা-ই-সকওয়ের আ মি তে হয়ে গিয়েছিল রাতারাতি কর্নেইল এবং এই সর্বাঙ্গ গোষ্ঠীর ভিতর সবচেয়ে দুর্দান্ত ডাকু অফিসার ছিল জারের ফৌজে– ডুয়েল লড়া সামান্য অসম্মানে আত্মহত্যা করাটা যাদের ছিল নিত্যদিনের তুচ্ছ আচরণ। মত্তাবস্থায় শেষরাত্রে অন্ধকার ঘরে চেয়ার-টেবিলের আড়াল থেকে একজন ডাকলে কু–উ– উ, অন্যজন ছুড়বে সেদিকে পিস্তলের গুলি, এটা যাদের সর্বপ্রিয় খেলা (!) রাসপাতিনহন্তা গ্র্যান্ড ডিউক ইউসপফ এদেরই একজন– এদের কয়েকজনকেও ভালো করেই চিনতুম।
যে নাৎসিরা ইহুদিদের পাইকারি হারে খুন করে, তাদের সঙ্গে সনাতন আর্মির কোনও যোগ ছিল বলে শুনিনি– ব্যত্যয়গুলো অন্যান্য অফিসার কর্তৃক তীব্রকণ্ঠে তিরস্কৃত হয়েছে; যাদের ছিল তারা হিটলারের স্বহস্তে নির্মিত, নাৎসি পার্টির সদস্য দ্বারা গঠিত, হিটলারের নিজস্ব আর্মি এসএস— ব্ল্যাক কোট পরিহিত। কি সনাতন আর্মি, কি এসএস কেউই ধর্ষণকর্মে লিপ্ত হয়নি। নরেনবের্গ মোকদ্দমায় অপরাধের দফাওয়ারি যে ফিরিস্তি পেশ করা হয় সেটাতে ধর্ষণ নেই।
ইয়েহিয়ার একাধিক সেপাই দ্বারা পরপর ধর্ষিতা অগণিত নারী সঙ্গে সঙ্গে প্রাণত্যাগ করেছে। অফিসারদের জন্য প্রতি কেন্টনমেন্টে নির্মিত হয়েছিল ব্রথেল– অনেক মেয়েকেই লুঠ করে আনা হয়েছিল মেয়ে-বোর্ডিং থেকে। ঢাকাস্থ সাধারণ পাঞ্জাবি সেপাই ঢাকার সামান্য বাইরে মুক্তিফৌজের ভয়ে এমনই মুক্ত-পাজামা হয়ে গিয়েছিল যে আমার নিকটতম সৈয়দ আত্মজনকে অনুরোধ করত, তারা যেন আল্লার কাছে প্রার্থনা করে ওদের যেন মফঃস্বলে বদলি না করা হয়। এবং পরাজয় অনিবার্য জানামাত্রই অফিসার গোষ্ঠী প্রাইভেটদের না জানিয়ে প্লেন, হেলিকপ্টার, লঞ্চ চুরি করে পালায় এগুলো অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ছিল আহত খান সৈন্যদের হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য। এদের আমি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা বলি কী করে?
.
উভয় বাঙলা- ‘হুজ্জৎ-ই-বাঙ্গাল’
হুজ্জৎ কথাটা ন সিকে খাঁটি আরবি এবং অর্থ যুক্তি, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যুক্তি, আপত্তি প্রকাশ করণ ইত্যাদি। শব্দটির কোনও কদৰ্থ আরবিতে আছে বলে আমার জানা নেই। ইরানবাসীরা যখন শব্দটি তাদের ভাষা ফারসিতে গ্রহণ করল তখন তার স্বাভাবিক অর্থ তো রইলই, উপরন্তু শব্দটির একটা কদৰ্থ গড়ে উঠতে লাগল। মানুষের স্বভাব এই যে, সে বিপক্ষের যুক্তিতর্ক স্বীকার করতে চায় না। তদুপরি বিপক্ষ যদি নিছক যুক্তি ভিন্ন অন্য কোনওপ্রকারের বিবেচনা না দেখায়, যেমন ধরুন প্রমাণ করা গেল যে, সমাজে বিশেষ কোনও রীতি বা অনুষ্ঠান বহুকাল ধরে বিনা আপত্তিতে সর্বজনগ্রাহ্য, এমনকি সম্মানিত হয়েছে, যদ্যপি সে রীতি যুক্তিবিরুদ্ধ এবং তখনও সে বার বার একই যুক্তির দোহাই দিতে থাকে, তবে মানুষ স্বভাবতই বিরক্ত হয় এবং ব্যঙ্গ করে তাকে তর্কবাগীশের স্থলে তর্কবালিশ, দ্বন্দ্বপ্রিয়, ঝগড়াটে ইত্যাদি কটুবাক্যে পরিচয় দেয়। এবং মানুষের এই স্বভাবই তখন কটু থেকে কটুতর হতে হতে মূল যুক্তি (হুজ্জৎ) শব্দটাকে অযথা তর্ক, ভণ্ডাচরণের অজুহাত কদর্থেও ব্যবহার করতে থাকে। বাঙলা এই শব্দটা ফারসি থেকে গ্রহণ করার সময় এটাকে অহেতুক তর্কাতর্কি অর্থে নেওয়ার দরুন সেটার ওই ঝগড়াটে অর্থটাই জনপ্রিয় হয়ে গেল। তাই কবি হেমচন্দ্র বাঙালি মেয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে রচেছেন হুজ্জতে হারিলে কেঁদে, পাড়া করে জয়।
এর সব কটা অর্থই আমি মেনে নিয়েছি, কিন্তু বাঙালি কোষকারগণ যদিও হুজুতে বলতে প্রধানত কলহপ্রিয় অর্থেই ধরে নিয়েছেন তবু বহুক্ষেত্রে যেখানে হুজুৎ শব্দ ব্যবহার হয়েছে এবং হয় তার বাতাবরণ, পূর্বাপর, প্রাসঙ্গিকতা বিচার করে আমার মনে হয়েছে, শব্দটার অর্থ ঝগড়াটের চেয়ে ঢের ঢের ব্যাপকতর। কোনও স্থলে মনে হয়েছে এর অর্থ জেদিএকগুয়ে অবস্টিনেট দুর্দমনীয়, কিছুতেই বশ মানতে চায় না। মূল আরবিতে লেখারম্ভে নিবেদন করেছি, শব্দটার একটা অর্থ আপত্তি প্রকাশ করা এবং দৃঢ় কণ্ঠে মতদ্বৈধ প্রকাশ করা। সরল বাংলায় সহজ অর্থ বিদ্রোহ করা, দীর্ঘতর অর্থ অন্যান্য দাবির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা।
হুতোম যখন তাঁর প্রাতঃস্মরণীয় নকশাতে একটি ফারসিপ্রবাদ আংশিক অনুবাদ করে লিখলেন সাধারণ কথায় বলেন, হুনরে চীন ও হুৰ্জ্জুতে বাঙ্গাল তখন তিনি হুজুতে কী বুঝেছিলেন বলতে পারব না, কারণ এই তুলনাহীন গ্রন্থখানার লেখক শ্ৰীতালাহুল ব্ল্যাক ইয়ারের অনুগত তাঁবেদার মোসাহেব এ অধম সে গ্রন্থখানা বটতলা থেকে শুরু করে অনবদ্য শোভন সংস্করণ পর্যন্ত কতবার যে কিনেছে এবং তার কাছ থেকে কতবার ধারের ছলে চুরি হয়েছে সেকথা স্মরণে আনলেই সে তৎক্ষণাৎ পরশুরামের মতো শপথ গ্রহণ করে, এই গৌড়ভূমিকে সে বার বার নিন্দুস্তক-চৌর করবে–আমৃত্যু, এবং জন্মনি জন্মনি, প্রতি জন্মে।… এস্থলে কিন্তু লক্ষণীয় প্রবাদটির ফারসি মূলরূপ হুনর-ই-চীন ওয়া হুজ্জৎ-ই-বাঙ্গাল। অস্যার্থ স্কিল অব চায়না অ্যান্ড রেবেঁলিয়াসনেস (অবসটিনেসি) অব বেঙ্গল। কাজেই হুজ্জই-ই-বাঙ্গাল-এর মধ্যবর্তী ইটি হুজুতে-এর একার হয়ে বিশেষণে পরিবর্তিত হয়নি, যেরকম চাষাড়ে, ঝগড়াটে, তামাটে। এস্থলে– ই- টির অর্থ অফ। যেরকম মরহুম ফজলুল হকের জনগণদত্ত উপাধি ছিল শের-ই-হিন্দ টাইগার অব বেঙ্গল। বাঙলায় লেখা হত শেরে হিন্দ। এই সূক্ষ্ম ব্যাকরণগত পার্থক্য না করলেও অর্থ দাঁড়ায়, চীন বিখ্যাত তার নৈপুণ্যের জন্য, বঙ্গদেশ তার পৌনঃপুনিক বিরোধিতার (একগুয়েমির) জন্য। নীচ ইতর অর্থে না নিয়ে ঝগড়াটেও বলা যেতে পারে। শান্তস্বভাব বিদ্যাসাগর যবে থেকে বিধবাবিবাহের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন, সেই থেকে বড় ঝগড়াটে হয়ে গেছেন বললে তো ঝগড়াটে শব্দটি এস্থলে উচ্চাঙ্গের প্রশস্তিসূচক।
অথচ সত্যার্থে বাঙালি বিদ্রোহী নয়– অর্থাৎ উচ্ছল, স্বেচ্ছাচারী অর্থে যদি সে শব্দ ব্যবহার করা হয়। পুনরায় দ্রষ্টব্য, বিদ্রোহী শব্দটি কে ব্যবহার করছে তার ওপর এর সদর্থ, কদৰ্থ দুই-ই নির্ভর করছে। মাদজিনিকে ইতালির তকালীন সরকার, দ্য গলকে ভিশি সরকার বিদ্রোহী, দেশদ্রোহী পদবি দিয়ে জনসমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা দিয়েছে। ঠিক ওই একইভাবে কবে, কবেকার সেই গুপ্তযুগ থেকে যুগ যুগ ধরে বলা হয়েছে। অতঃপর বঙ্গদেশ বিদ্রোহ করিল। পাঠান যুগের বঙ্গদেশ নিত্যনিয়ত বিদ্রোহ করে বলে দিল্লি সরকার দুটি শব্দে এদেশের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছেন। দুর্ভাগ্যবশত সে শব্দদ্বয় আমি ভুলে গিয়েছি কিন্তু সৌভাগ্যবশত প্রতিবারে যে অখণ্ড শ্লাঘা অনুভব করেছি সেটা ভুলিনি এবং অর্থটাও ভুলিনি; মোটামুটি বিদ্রোহী জনপদ উৎপাত-ভূমি জঙ্গিস্থান এই ধরনের কিছু একটা নিন্দাসূচক অধম গুষ্টিসুদু সে নিন্দা চন্দনের মতো শ্রীরাধার অনুকরণে সর্বাঙ্গে অনুলেপন করেছে। কিন্তু গভীর বিস্ময় ও ঘৃণা অনুভব করেছি এবং এখনও করি, যখন দেখি পাঠান-মোগল-ইংরেজ ঐতিহাসিকের দোহার গেয়ে বাঙালি আবার বলছি বাঙালি প্রখ্যাত বাঙালি ঐতিহাসিক অসঙ্কোচে মাছিমারা কেরানির মতো পুনঃপুন পুনরাবৃত্তি করেন, অতঃপর বঙ্গবাসী দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। পাঠান-মোগল ঐতিহাসিকের মুখে এহেন বাক্য স্বাভাবিক! তারা দিল্লীশ্বরের অনুগত দাস, দিল্লি সরকারের সঙ্গে তাদের একাত্মানুভূতি বিচিত্র নয়। কিন্তু বাঙালি ঐতিহাসিক আজ পর্যন্ত বাঙালির দৃষ্টিবিন্দু থেকে বরঞ্চ দৃঢ় প্রত্যয়সহ বলি বিশ্বমানবের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই বিদ্রোহটার রেজো দেত্র স্বতঃসিদ্ধ অস্তিত্ব হেতুটার অনুসন্ধান না করে নিন্দাসূচক বিদ্রোহ শব্দটা প্রয়োগ করেন কেন?
বার্ধক্যজনিত ভারবহনক্ষম বিদ্রোহী স্মৃতিদৌর্বল্যের ওপর নির্ভর করে নিবেদন, বাদশাহ জাগির যখন শেষ বিদ্রোহী বাঙালি পাঠানরাজ ওসমানকে আত্মসমর্পণ করার জন্য আদেশ পাঠালেন তখন ওসমান অতিশয় ভদ্রভাষায় উত্তরে যা লেখেন তার সারমর্ম : আপনি ভারতেশ্বর, আপনার রাজ্য সুবিস্তৃত, আপনার ক্ষমতা অসীম। আমি পড়ে আছি ভারতের এক কোণে। আমার স্বাধীনতা আপনার কোনওপ্রকারের ক্ষতিসাধনে সম্পূর্ণ অক্ষম। জঙ্গলের চিড়িয়াটাও স্বাধীন থাকতে চায়।
ওসমান বলতে চেয়েছিলেন, বনের পাখির স্বাধীনতা একান্তই স্বভাবজাত, নৈসর্গিক। সে স্বাধীনতা কারও প্রতি বৈরীভাব পোষণ করে না, পরধনলোভ সে স্বাধীনতার অন্তর্নিহিত স্বধর্ম নয়। কিন্তু তার চেয়েও মোক্ষম সত্য প্রকাশ করেছেন যখন বললেন, আমি ভারতের এককোণে পড়ে আছি। তার পূর্ণ অর্থ কী?
আর্যজাতি তার সর্বপ্রাচীন আদিবাস কেন্দ্র থেকে নির্গত হয়ে উত্তর দক্ষিণ পশ্চিম দিকে সঠিক কোন জায়গায় এসে আর অগ্রসর হল না সে বিষয়ে মতভেদ থাকতে পারে কিন্তু পূর্বদিকে বঙ্গদেশই যে তার সর্বশেষ অভিযান সীমান্ত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পূর্বদিগন্তে বাঙলাই শেষ আর্যভাষা।
এ বঙ্গদেশ ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা দ্বারা চিরকাল নিরুদ্ধ নিশ্বাস। উত্তরে হিমালয়, পূর্বে আরাকান, দক্ষিণে সমুদ্র। অথচ পশ্চিম থেকে যুগ যুগ ধরে শক হুণ তুর্ক পাঠান মোগল ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে হানা দিয়েছে দলে দলে। তাদের চাপ পড়েছে পাঞ্জাবের ওপর, সে দেশের লোক চাপ দিয়েছে উত্তর প্রদেশের ওপর করে করে সর্বশেষ চাপ পড়েছে বাঙলার ওপর। সে হতভাগা উত্তর, পূর্ব, দক্ষিণ কোনও দিকেই চাপ দিতে পারে না, পালাবার পথ পর্যন্ত তার নেই। সে তখন রুখে দাঁড়াবে না তো কী করবে? সেটা বিদ্রোহ নয়– এমনকি সেটাকে স্বাধীনতা সংগ্রাম আখ্যা দিলেও মোক্ষমতম তত্ত্বটি প্রকাশ পায় না। প্রতিবারেই তার রুখে দাঁড়ানোটা নিতান্তই, একান্তভাবে আপন জীবনরক্ষার্থে– ওসমানের সেই কোণঠাসা ছোট্ট চিড়িয়াটিকে ধরতে গেলে সে-ও ঠোকর মারত। এ প্রচেষ্টাকে স্বাধীনতা সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ দেশাত্মবোধজাত আত্মাহুতি ইত্যাদি গম্ভীর অম্বরে যথা নাদে কাদম্বিনী সদৃশ উচ্চনামে ডাকুন আর না-ই ডাকুন, ওটাকে কাশ্মির কান্যকুজ পাঠান মোগল রাজন্যবর্গের মুখপাত্র হয়ে বিদ্রোহী নাম নিয়ে স্পর্শকাতর জনকে বিড়ম্বিত করবেন না। বলা বাহুল্য, সে পরাজিত হয়েছে একাধিকবার। সে তখন দেখেছে বিজয়ী বীরবৃন্দ তার পুত্র-ভ্রাতাকে হত্যা করেছে, অবলাদের ধনষ্ট করেছে, তার ক্ষেত ফসল কেড়ে নিয়েছে, তার শেষ রক্তবিন্দু শোষণ করার পর ক্রীতদাসরূপে তাকে বিদেশের হট্ট-পণ্যালয়ে নির্বাসিত করেছে।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে হল বিলকুল একটা নয়া খেল। হঠাৎ কোথা থেকে হাজার হাজার বিহারি দারওয়ান, মিস্ত্রি বাবুর্চি ঢুকল তাদের দেশে। এদেশে তারা যুদ্ধে জয় করে ঢুকলে সেটা অভূতপূর্ব অস্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে হত না। তার ওপর এল পাঞ্জাবি, পাঠান সুদূর পশ্চিম ভারত থেকে, খোঁজাবোরা অতিদূর বোম্বাই-করাচি থেকে। স্বাভাবিক পদ্ধতিতে আসতে হলে এদের যুদ্ধে পরাজয় করতে হত প্রথম হরিয়ানা, রাজধানী দিল্লি, তার পর উত্তরপ্রদেশ, তার পর বিহার, সর্বশেষ বঙ্গদেশ। এহেন স্ববীর্যে করায়ত্ত সমুদ্রে সেতু নির্মাণ না করে দুর্ধর্ষ রাবণ, ইন্দ্রজিৎ, মেঘনাদ অজেয় জগতে বীরগণকে আত্মনাশা সর্বনাশা সংগ্রামে পর্যদস্ত না করে হনুমান এক লক্ষে বসে গেলেন রাবণের রাজসিংহাসনে!
বিনা যুদ্ধে যারা এল, এরা এক-একটা আস্ত হনুমান অবশ্যই ভিনার্থে অর্থাৎ মর্কটার্থে। না, মাফ চাইছি। মর্কটকুলকে অপমান করতে যাব কেন আমি? ওরা যারা এসেছিল তাদের যা বর্বর আচরণ তারা দেখাল কোনও মর্কট তো কস্মিনকালেও সে বর্বরতার সহস্র যোজন নিকটবর্তী হতে পারেনি। পরবর্তীকালে জঙ্গিলাটের পদ অলঙ্কৃত করেনি।
.
উভয় বাঙলা– শত্রুর তূণীর মাঝে খোঁজো বিষবাণ
গভীর বনানীর ভিতর দিয়ে যাচ্ছে এক কাঠুরে। হাতে একটা কুড়োল। সদ্য কিনে এনেছে গভীর বনের ওপারের গায়ে, কামারবাড়ি থেকে। তাই কুড়োলে এখনও কাঠের লম্বা হাতলটা লাগানো হয়নি। জল্লাদের হাতে তলোয়ার দেখলে যার মুণ্ডু কাটার বাদশাহি হুকুম হয়ে গিয়েছে, সে যেরকম কাঁপতে থাকে, লম্বা লম্বা আকাশছোঁয়া গাছগুলোও কাঠুরের হাতে নয়া কুড়োলের ঝকঝকে লোহা দেখে তেমনি দারুণ ভয় পেয়ে শিউরে উঠল। সেটা প্রকাশ পেল তাদের বাতাসহীন আবহাওয়াতে। অকারণে ডাইনে-বাঁয়ে দোলা লাগানো থেকে। মর্মরধ্বনি জেগে উঠল শাখায় শাখায়, পাতায় পাতায়। এই এল এই পড়ল কালবৈশাখী যখন বেগে ধেয়ে আসে বনস্পতিকে লণ্ডভণ্ড করে দেবার জন্য তখন যেরকম প্রথম সবচেয়ে উঁচু গাছগুলো আসন্ন কালবৈশাখীর আভাস পেয়ে মর্মর রবে কিশোর গাছগুলোকে হুশিয়ারি দেয়, তারা কচিগাছগুলোকে ঠিক তেমনি বলে খবরদার, বিনা বাতাসে বনে বনে ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে মর্মরে মর্মরে আসমানে মাথা হেনে হেনে কাঠুরের হাতে যে কুড়োল সেটা একে অন্যকে দেখিয়ে দিল এবং তারা যে এত শত বৎসর ধরে শান্তিতে দিন কাটিয়েছিল তার যে সমাপ্তি আসন্ন সেটাও বুঝিয়ে দিল।
তখন এক অতি বৃদ্ধ সুদীর্ঘ, ঈষৎ নজদেহ তরুরাজ চিন্তাপূর্ণ গম্ভীর মর্মরে সবাইকে বললে, বৎসগণ! আস্ত কুড়োলের ওই লোহার অংশটুকু মাত্র আমাদের বিশেষ কোনও ক্ষয়ক্ষতি করতে পারবে না। হয়তো সামান্য একটু আঁচড়-জখম আমাদের গায়ে লাগতে পারে– তাতে করে কাঠুরের কোনও লাভ নেই খামোখা সে মেহনত করতে যাবে কেন সে? মরণ আসবে আমাদের সেই কুক্ষণে যেদিন আমাদেরই একজন কাঠ হয়ে ওই লোহার টুকরোটিতে ঢুকে হাতল হয়ে তাকে সাহায্য করবে। তখন ওই কুড়োল হবে বলবান। কাঠুরের কঠিন পেশির সুপ্ত বল আমাদেরই একজনের মিতালিতে তৈরি হাতলের ভিতর দিয়ে সঞ্চারিত হয়ে আমাদের দ্বিখণ্ডিত করবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশে পুব পাকে নিযুক্ত পাঞ্জাবি-বেহারিরা উঠেপড়ে লেগে গেলেন পুব পাকের বাঙালি মুসলমান হাতলের সন্ধানে। এই পাঞ্জাবি বুদ্ধ ও বেহারি বিচ্ছেদের জন্য কুঠার-লৌহদণ্ড হয়ে এলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানি চিফ সেক্রেটারি তার প্রাতঃভসনীয় গোধূলি কর্তনীয় নাম মি, আজিজ আহমদ। এঁকে রাজধানী পাঠিয়েছিল পূর্ব পাকে অখণ্ড পাকিস্তানের দৃঢ় ভিত্তি নির্মাণের জন্য; তিনি পুঁতে গেলেন লক্ষাধিক টাইম-বম, সেগুলো ফাটল চব্বিশ বছর পর।
তার কীর্তিকাহিনী দীর্ঘ। আজ যেরকম পুব পাকের সেবা করে টিক্কা খান জঙ্গিলাটের আসন পেয়েছেন, ঠিক তেমনি ইনিও একদিন পুব বাঙলার বাঙালি সিভিলিয়ানদের সর্বনাশ করে ও পশ্চিমাদের সর্বানন্দ দিয়ে অখণ্ড পাকের ফরেন মিনিস্টার অ্যাডভাইজার আরও কত কী হন। সেসব থাক। আমার উদ্দেশ্য শুধু দেখানো পার্টিশন সত্ত্বেও উভয় বাঙলাতে যে চিন্ময়-বন্ধন ছিল সেটার সত্তানাশ মহতী বিনষ্টি কী প্রকারে করা যায় সেইটেই ছিল চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের গুরসম রাজধানী-দত্ত সাধনার চিন্তামণি। স্বদেশী আন্দোলনবৈরী পুলিশ কর্মচারী শামসুল (আলম? হুদা? হক) বন্দি দেশপ্রেমিকদের সঙ্গে প্রথম দোস্তি জমিয়ে বিস্তর গোপন তথ্য বের করে ওইগুলো দিয়ে নির্মাণ করেন সরকার পক্ষের মারণাস্ত্র। তাই আসামিরা তার উদ্দেশে বলত, ওহে শামসুল! তুমিই আমাদের শ্যাম তুমিই আমাদের শূল। আজিজের বেলা অতখানি টায় টায় ব্রিামীয় পান তৈরি হল না বটে, তবু আজিজ-এর অর্থ প্রিয় মিত্র; আহমদ-কে আমেদ, ইংরিজিতে ডি অক্ষরযোগে আমেডও লেখা হয়। দি ফ্রেন্ড আমেড– Ah! mad! কারণ প্রবাদ আছে, মূর্খ মিত্রের চেয়ে জ্ঞানী শক্র ভালো। এস্থলে মূৰ্থ মিত্র না, পুব বাঙলার উন্মাদ মিত্র।
তাঁর প্রথম উদ্দেশ্য ছিল বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা বিনাশ করা।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য : পুব বাঙলার লোক এ চর্চাতে অনুপ্রেরণা প্রায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে : বাঙলা সাহিত্যের ঐতিহ্য বহুলাংশে পশ্চিমবঙ্গে গঠিত হয়েছে। অতএব উভয় বাঙলার মাঝখানে নির্মাণ করতে হবে অভেদ্য লৌহ যবনিকা।
তৃতীয় উদ্দেশ্য : ওই রবীনদরনাথ নামক লোকটির ইমেজ সম্পূর্ণ বিনষ্ট করতে হবে; সেস্থলে জাজ্বল্যমান করতে হবে পাঞ্জাবি কবি ইকবালকে, তার ইসলামি জোশসহ।
কিন্তু তিনি সেই কাষ্ঠখণ্ড পান কোথায় যেটা দিয়ে তিনি কুঠারটি নির্মাণ করতে পারেন? উচ্চপদের বাঙালি মুসলমান সিভিলিয়ানদের সেক্রেটারিয়েট থেকে খেদিয়ে তাদের পাঠানো হল ডিস্ট্রিকটগুলোতে এঁদের বেশিরভাগ এসেছিলেন শিলঙ সেক্রেটারিয়েট থেকে, সিলেটের লোক, হেথাকার রাইটারস বিল্ডিং থেকে উচ্চপদস্থ গিয়েছিলেন অল্প পরিমাণ ছিলেনই। অত্যল্প। পাঞ্জাবি-বেহারিদের আধা ভজন প্রমোশন দিয়ে দিয়ে ভর্তি করা হল সেক্রেটারিয়েট যতদূর সম্ভব। কিন্তু বাঙলার ক অক্ষর দেখলেই এরা সামনে দেখে করালী। তদুপরি এদের যুক্তি বাঙলাকো জড়সে উখাড়নেকে লিয়ে (উৎপাটন করতে) আমরা এসেছি জিহাদ লড়তে, আর বলে কি না, শেখো বাঙলা!… আজিজ দেখলেন, এরা সরকারি কাজই চালাতে অক্ষম, এদের দ্বারা সূক্ষ্ম প্রপাগান্ডা, রবীন্দ্রনাথের ইমেজ নাশ অসম্ভব। চাই বাঙালি।
মক্তবের মোল্লা, মাদ্রাসার নিম্নমানের মৌলবি ও ছাত্র এলেন এগিয়ে। এঁরা বাঙলা প্রায় জানেনই না। উর্দুজ্ঞান যৎসামান্য বললেও বাড়িয়ে বলা হয়। এঁরাই ছিলেন উর্দুকে পুব পাকের রাষ্ট্রভাষারূপে চাপিয়ে দেবার তরে সবচেয়ে সরব। কলকাতা বা ঢাকার বিএ এমএ একবর্ণ উর্দু জানেন না। অতএব উর্দু চালু হলে মাদ্রাসার ম্যাট্রিক মানের পড়ুয়া হয়ে যাবে কমিশনার, ক্লাস সিসের ছোঁড়া হবে ডিএম! উর্দু জবান জিন্দাবাদ!
এরা দিল পয়লা নম্বরি ধাপ্পা আজিজ এবং তার প্যারা উর্দুভাষী ইয়ারদের। এরা কতখানি বাঙলা জানে, সে বাঙলা দিয়ে বাঙলা কৃষ্টি-ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে কি না সেটা বোঝবার মতো বাঙলা এলেম তো আজিজ গোষ্ঠীর নেই। এদেরই অনেকে পরবর্তীকালে অল-বদরে দাখিল হয়ে দক্ষতার সঙ্গে খান অফিসারদের খবর যোগায়, কোথায় কোন বুদ্ধিজীবী বাস করে, কাকে কাকে খুন করতে হবে। আত্মসমর্পণের দিন অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর সকালবেলা যখন যুদ্ধ সমাপ্তি তথা আত্মসমর্পণের দলিলাদি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। বলে আমারই পরিচিত দু জন বাঙলা-প্রেমী বুদ্ধিজীবী, এতদিন পালিয়ে পালিয়ে থাকার পর নিশ্চিন্ত মনে আপন আপন পরিবারে ফিরে এসে স্বস্তিতে ঘুমুচ্ছিলেন, তখন এই অল বদররাই মা, স্ত্রী, শিশু পুত্রকন্যার সামনে দুই হতভাগ্যকে বন্দুকের সঙ্গিন দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে চোখে পট্টি বেঁধে কোনও এক অজানা জায়গায় নিয়ে যায়। সেখানে নিষ্ঠুর অত্যাচারের পর তাদের গুলি করে মারে।
ওদিকে বাঙালি মুসলমান উঠেপড়ে লেগেছে, ভাষা আন্দোলন নিয়ে। তারা এটা চায় ওটা চায়, সেটা চায়। মারা গেল কিছু প্রাণবন্ত তেজস্বী ছেলে বন্দুকের গুলিতে। আন্দোলন তীব্রতর রূপ ধারণ করতে লাগল প্রতিদিন।
অতিশয় অনিচ্ছায় পাক সরকার দুধের ছলে কিঞ্চিৎ পিটুলি-গোলা পরিবেশন করলেন বাঙলা অ্যাকাডেমী নাম দিয়ে। তার ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেন গোটা কয়েক বিচ্ছ– বিসমিল্লাতেই। এরা সেই মোল্লা মুনসির মতো যাদের কথা এইমাত্র নিবেদন করেছি– অত্যল্প শিক্ষিত নন। এঁরা বেশ কিছুটা শাস্ত্র জানেন, অল্পবিস্তর বাঙলাও লিখতে পারেন।
সরকার দিয়েছে টুইয়ে। এরা ধরলেন জেদ অ্যাকাডেমীর সর্বপ্রথম কর্তব্য রূপে স্বীকৃত হয়ে গিয়েছে (কে কখন স্বীকৃতি দিল, জানিনে) বাঙলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে হবে আরবি ভাষায় লিখিত বিবিধ শাস্ত্রগ্রন্থের বাঙলা অনুবাদ করে! প্রতিবাদ করেছ কী মরেছ! তদ্দণ্ডেই তোমার নামে কাফির ফৎওয়া জারি হয়ে যাবে। অথচ ভেবে দেখনি আমাদের সাহিত্য পরিষদ যদি জন্ম নেবার সঙ্গে সঙ্গে মেতে উঠত বেদ থেকে আরম্ভ করে ঘেরন্তসংহিতা আর খট্টাঙ্গ পুরাণের বাংলা অনুবাদ করতে, তবে লুপ্তপ্রায় বাঙলা পাণ্ডুলিপি থেকে অমূল্য গ্রন্থরাজি উদ্ধার করে খাস বাঙলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করত কে? কোন পাষণ্ড অস্বীকার করবে সংস্কৃত এবং আরবি প্রচুর গ্রন্থ বাঙলাতে অনুবাদ করা অতিশয় কর্তব্যকর্ম? কিন্তু প্রশ্ন, সেইটেই কি সাহিত্য পরিষদ বাঙলা অ্যাকাডেমীর সর্বপ্রধান ধর্ম?
পাঠক, তুমি বড় সরল। বিলকুল ঠাহর করতে পারনি কার ঘুমন্ত হাত দিয়ে কে, কোন তৃতীয় ব্যক্তির তামাক চুপসে– না ভুল বললুম– সগর্বে খেয়ে গেল।
অ্যাকাডেমী পয়লা ধাক্কাতেই স্থির করলেন–একদম পয়লা ধাক্কাতে কি না আমার সঠিক মনে নেই কোনও একাদশ ভলুমি আরবি কেতাব (হয়তো অত্যুত্তম গ্রন্থ) বাঙলায় বেরুবে বিশ ভলুমি কলেবর নিয়ে। খাস বাঙালি সাহিত্যিক দল তদ্দণ্ডেই হয়ে গেলেন অপাঙক্তেয় খারিজ বাতিল ডিসমিস। কারণ তারা তো আরবি জানেন না। কোনও এক মৌলবি সাহেব অনুবাদকর্মের জন্য দক্ষিণা পাবেন ষাট না সত্তর হাজার টাকা!
বেচারি ডিরেক্টর! সে আপ্রাণ লড়েছে। শেষটায় বোধহয় মৌলবিরাই তার চাকরিটি খান।
আমি হলপ করতে পারব না বিশ ভলুমের অনুবাদ সমাপ্ত হয়েছিল কি না। ক-ভলুম এ তাবৎ বেরিয়েছে তা-ও বলতে পারব না। এ প্রতিবেদনে আরও ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের মতলব কী ছিল সেটা বুঝিয়ে বলাটাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।
.
উভয় বাঙলা– গজভুক্ত পিণ্ডিবৎ
বড় বড় শহরের লোক বাইরের পৃথিবী সম্বন্ধে বড়ই বে-খবর। তাদের ভাবখানা অনেকটা যেন কুল্লে দুনিয়ার মেয়েমদ্দে যখন হুমড়ি খেয়ে আমাদের এই হেথায় জমায়েত হচ্ছে, তখন তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, আমরাই ইন্ট্রস্টিং, আমরাই ইমপর্টেন্ট। মা-কালী তো কালীঘাট ছেড়ে ধাক্কাধাক্কি খেয়ে ট্রামে-বাসে আসেন না আমার বাড়িতে, কিংবা মহরমের তাজিয়া-তাবুদ তো লাটবাড়ির বৈঠকখানায় বসে হা-পিত্যেস করেন না হুজুরকে একনজর দেখবার তরে।… এ বাবদে সবচেয়ে বেশি দেমাক ধরে প্যারিস। আর ধরবেই না কেন? যে মার্কিন মুলুক দুনিয়ার যে দেশকে খুশি রুটিটা-আণ্ডাটা বিলিয়ে দেয় মতলবটা কী সবসময় মালুম তক হয় না– সেই দেশের লোক হদ্দমুদ্দ হয়ে ছোটে ছুটি কাটাতে, প্যারিসের তাজ্জব তাজ্জব এমারত-তসবির দেখতে, কুল্লে জাতে ভর্তি নানান রঙের নানা ঢঙের খাপসুরৎ খাপসুরৎ পটের বিবিদের মোলায়েম-সে-মোলায়েম হাত থেকে সাকির ভরা-পেয়ালা তুলে নিতে আর তারই সঙ্গে খাপ খাইয়ে খৈয়ামের স্মরণে বেখাপ্পা খাদে গান জুড়তে–
বিধি-বিধানের শীত-পরিধান
প্যারিস-আগুনে দহন করো।
আয়ু বিহঙ্গ উড়ে চলে যাবে
হে সাকি, পেয়ালা অধরে ধরো। (অনুবাদক?)
এ বাবদে আমরা, কলকাত্তাইয়ারা ঘোড়ার রেসে মোটেই ব্যাড থার্ড নই, অলসো র্যান বললে তো আমরা রীতিমতো মানহানির মোকদ্দমা রুজু করব।
আমরা তাই ঢাকা তথা পুব বাঙলার সাহিত্যচর্চা সম্বন্ধে চিরকালই কিঞ্চিৎ উদাসীন ছিলুম– দেশবিভাগের পর তো আর কথাই নেই। আর হবই না কেন- রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, শরৎচন্দ্র সবাই তো শেষ পর্যন্ত কলকাতাতেই থানা গেড়েছেন। এস্তেক যশোরের বাঙাল মাইকেল।
পার্টিশনের পরে অবস্থাটা খারাপ হল। কবি জসীম উদ্দীন, চিত্রকর জয়নুল আবেদিন, উদীয়মান কবি/সাহিত্যিক আবুল হোসেন, শওকত ওসমান, গোলাম মুরশিদ, পণ্ডিত শহীদুল্লা– বোধহয় পূর্বেই চলে গিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের শতাত্ত্বিক আবদুল হাই যাঁর অকালমৃত্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, একাধিক মহিলা কবি আরও বহু বহু সাহিত্য-সঙ্গীত-কলাসেবক চলে গেলেন পুব বাঙলায়। এবং এঁরা যে পেনসেন নেওয়ার পর এবং/অথবা বার্ধক্যে, বিশেষ করে যাঁদের জন্মভূমি পশ্চিম বাঙলায় তারা যে সেসব জায়গায় বা কলকাতায় ফিরে এসে, মহানগরীর সুযোগ-সুবিধে নিয়ে বাঙলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতর সেবা করতে পারবেন সে আশাও রইল না!…বলা বাহুল্য আমার দেওয়া সাহিত্য সেবীদের এ ফিরিস্তি লজ্জাকর অসম্পূর্ণ।
পুব-বাংলার যেসব লেখক ও অন্যান্য কলাকার এখানে রয়ে গেলেন ও ওপার বাঙলা থেকে যারা এলেন, তাদের অধিকাংশই হিন্দু। কেউ কেউ পাঞ্জাবি-কণ্টকিত পাক সরকার কর্তৃক লাঞ্ছিত হয়ে পুব বাঙলা ত্যাগ করতে বাধ্য হন, কিন্তু এঁদের সকলেই আপন আপন সহকর্মীদের প্রতি এবং মাতৃভূমি পুব বাঙলার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা পোষণ করেছেন। ৭১-এর নয় মাসে সেদেশে বুদ্ধিজীবী নিধনে এদের অনেকেই ভ্রাতার চেয়ে প্রিয়তম আত্মজন হারিয়েছেন। দার্শনিক গোবিন্দবাবু এবং তারই মতো একাধিক অধ্যাপকের নিষ্ঠুর হত্যা আমাকে ও তাঁদের অগণিত অনুরক্তজনকে কী গভীর বেদনা দিয়েছে, তা প্রকাশ করার ক্ষমতা বিধি আমাকে দেননি।
পূর্বোক্ত দুই পক্ষই এ বাঙলা থেকে যারা ও-বাঙলা গেলেন এবং ওদিক থেকে এদিক এলেন, এঁরাই ছিলেন উভয় বঙ্গের সর্বপ্রধান চিন্ময় বন্ধন, মূর্তিমান সেতু, পিণ্ডির পাশবিক বৈরী ভাব ছিল প্রধানত এঁদেরই প্রতি। তাই সে নির্মাণ করেছিল লৌহ্যবনিকা প্রস্তর-প্রাচীর।
অতীতেও নির্মিত হয়েছিল নিশ্চয়ই, নইলে নিউটন আক্ষেপ করলেন কেন–
হায়রে মানুষ।
বাতুলতা তব
পাতাল চুমি :–
প্রাচীর যত না
গড়েছো, সেতু তো
গড়োনি তুমি!
এই দুই পক্ষই সবচেয়ে বেশি খবর নিতেন উভয় বাঙলার সাহিত্যচর্চার। এদের কেউ কখনও অপর বাঙলায় যাবার দুরূহ অতএব বিরল সুযোগ পেলে সেখানে রাজমর্যাদায় আপ্যায়িত হতেন। পুববাঙলা স্বাধীন হওয়ার পূর্বে আমি ১৯৭০-এ যাই ঢাকা। মরহুম শহীদুল্লাহ তখন হাসপাতালে। ঢাকায় প্রকাশিত পুস্তক ও কলকাতায় প্রকাশিত একাধিক পুস্তিকা তিনি ৬৯-এই মমাগ্রজের গৃহে সেই বৃদ্ধ বয়সে স্বয়ং এসে আমাকে সস্নেহ আশীর্বাদসহ উপহার দিয়ে যান। (তাঁর কৃতী পুত্রেরও একাধিক পুস্তক তিনি তার সঙ্গে যোগ দেন) আঞ্চলিক অভিধানের প্রথম খণ্ড, হাফিজের অনুবাদ, চর্যাপদের আলোচনা কী না-ছিল তাঁর ত্রিপিটকপূর্ণ সওগাতে! গুণী আবদুল কাদের যে কী পরিশ্রম, অন্বেষণ ও অধ্যয়নান্তে কাজী নজরুল ইসলামের সম্পূর্ণ গদ্য-পদ্য সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন, সেটা বর্ণনাতীত। অনবদ্য এই মণিমঞ্জুষা। সম্প্রতি কাগজে দেখলুম, বাংলাদেশে প্রকাশিত তাবৎ পুস্তক বিক্রয়ের জন্য এখানে একাধিক কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। ত্বরা করুন, ত্বরান্বিত হোন, গৌড় সাহিত্যামোদীগণ! সর্বশেষে অঙ্গবস্ত্রটি অকাতরে চক্রবৃদ্ধিহারে কুসীদার্পণ প্রতিশ্রুতিসহ সমর্পণ করে প্রয়োজনীয় কার্ষাপণ সংগ্রহ করুন– অমূল্য এই গ্রন্থাবলি ক্ৰয়ার্থে। বিলম্বে হতাশ হইবেন– বিজ্ঞাপনের অতিরঞ্জিত অত্যুক্তি নয়, সকল শাস্ত্ৰবিচারদক্ষের অব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী।
মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে, বিজ্ঞানের রাজ্যে এমন একখানা পুস্তক ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে, যার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে এমন বই উভয় বাঙলায় পূর্বে বেরোয়নি, আগামী শত বৎসরের ভিতর বেরুবে কি না সন্দেহ। পণ্ডিত আব্দুল জব্বর রচিত এই তারা পরিচয় গ্রন্থখানিকে শতাব্দীর গ্রন্থ বলে তর্কাতীত দার্চসহ পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়। এ গ্রন্থের উল্লেখ আমি পূর্বেও করেছি, ভবিষ্যতে সবিস্তর বর্ণনা দেবার আশা রাখি। …কাজী কবির গ্রন্থাবলি ও এ গ্রন্থ উভয়ই প্রাগুক্ত আব্দুল কাদের যখন বাঙলা উন্নয়ন বোর্ডের কার্যাধ্যক্ষ ছিলেন, তখন তাঁরই উৎসাহে বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত হয়।
এতক্ষণে পাঠক নিশ্চয়ই সম্যক হৃদয়ঙ্গম করে ফেলেছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার আপ্রাণ চেষ্টা দিয়েছিলেন, বাঙলা অ্যাকাডেমি, বাঙলা উন্নয়ন বোর্ড জাতীয় কোনও প্রতিষ্ঠানই যেন জন্মগ্রহণ না করতে পারে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গোড়াতে ক্ষীণ কণ্ঠে বাঙলার ভাষা ও সাহিত্যের জন্য যেসব দাবি উত্থাপন করা হয়, সেটাকে ঠেকাবার জন্য স্বয়ং মি. জিন্না ঢাকায় তশরিফ আনেন এবং ছাতির খুন বেকার বেফায়দা ঠাণ্ডা পানিতে বরবাদ অথবা শীতল জলে অপচয় করলেন– যেটা বরফের বেশি কাছাকাছি সেইটেই বেছে নিন– সেই দাবি প্রতিদিন কঠিনতর ভাষায় এবং সর্বশেষে রুদ্ররূপ ধারণ করল। আমরা এ বাঙলায় বসে তার কতটুকু খবরই-বা রাখতে পেরেছি। শুধু জানি, কয়েকটি তরুণ দাবি জানাতে গিয়ে নিরস্ত্র অবস্থায় নিহত হল– শহিদের গৌরব লাভ করল।
কিন্তু সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন অ্যাকাডেমি, বোর্ড, এমনকি এশিয়াটিক সোসাইটি অব ইস্ট পাকিস্তান, জাদুঘর (এরই নবীন হর্মের প্রস্তর স্থাপনাকালে গবর্নর মোনায়েম খান জাদু শব্দটা সংস্কৃত মনে করে তীব্র কণ্ঠে উম্মাভরে গোসসা জাহির করেন) সর্ব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা, ভিতর থেকে, সরকারের তথাকথিত ইসলামি মদুন (ইসলামি সভ্যতা–শব্দার্থে নাগরিকতা) দ্বারা অনুপ্রাণিত নির্দেশ সাবোটাজ করেছেন অমান্য করে, টালবাহানা দিয়ে ফন্দিফিকির মারফত বানচাল করে দিয়ে। এ সগ্রামের কাহিনী খুদ ঢাকাবাসীদের মধ্যেই জানেন অল্প লোক।
প্রাগুক্ত রাজমর্যাদায় আপ্যায়নের ফলে আমার মতো অকিঞ্চন জন পরিচিত, সম্পূর্ণ অপরিচিত লেখকদের কাছ থেকে প্রায় ষাটখানা পুস্তক-পুস্তিকা উপহার পায়। আমাকে (এসব সজ্জন) ভ্রমবশত পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যচর্চার অন্যতম প্রতীকরূপে ধরে নিয়েছিলেন, এবং সে চর্চার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ছিল। দেশ পত্রিকার সম্পাদক মহাশয় বলতে পারবেন, কত না দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর, লৌহযবনিকার ছিদ্র দিয়ে তার কাছে পৌঁছেছে পুব বাঙলার বই সমালোচনার জন্যে– চব্বিশটি বৎসর ধরে। পশ্চিম বাঙলার স্বীকৃতি ছিল তাঁদের হার্দিক কামনা।
লৌহযবনিকাপ্রান্তে পুস্তকগুলো বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবার ভয় তো আছেই, তদুপরি পুস্তক স্মাগলিং নামক পাপাচার প্রচেষ্ট ব্যক্তির যে ন্যূনতম শাস্তি– সেটা অর্থদণ্ড। সীমান্ত অতিক্রম করবার সময় যে বিংশতি মাত্র পাকিস্তানি মুদ্রা আইনত অনুমোদিত, সে মুদ্রা কটি অবশ্যই ওই অর্থদণ্ড পরিশোধ করার জন্য অপ্রচুর। ফলং শ্রীঘর বাস।
কিন্তু আল্লা মেহেরবান। সীমান্তেও কিছুসংখ্যক বঙ্গসন্তান ছিলেন যারা পূর্বোক্ত রাষ্ট্ৰাদেশ লনকারীদের ন্যায় সুচতুর এবং সদৃশ পাপী-তাপীদের প্রতি সদয়। তাই মমগ্রজদের লিখিত দু-চারখানা পুস্তক বৈতরণীর এ কূলে আনতে সক্ষম হয়েছি– প্রতিবার।
.
উভয় বাঙলা– স্বর্ণসেতু রবীন্দ্রসঙ্গীত
এ বিষয়ে কণামাত্র সন্দেহ নেই, যে এক বাঙলা আরেক বাঙলা থেকে যদি পাকেচক্রে কোনওদিন স্নেহপ্রীতির ভুবনে দুই দিনান্ত চলে যায়, এস্তেক ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে মোহনবাগানের ফুটবল খেলা বন্ধ হয়ে যায়, ঘটিমাত্রই ইহসংসারে বাঙাল নামক যে একটা প্রাণী আছে সে তত বেবাক ভুলে গিয়ে তাকে হাইকোর্টটা পর্যন্ত দেখাতে রাজি না হয়, এবং পদ্মার ওপারে কুটির সঙ্গে ঘটির ভাড়া নিয়ে দর কষাকষি শুনে ঘোড়াটা যদি না হাসে, তবু একটি বেরাদরি রেওয়াজ দুই বাঙলা থেকে কিছুতেই লোপ পাবে না।
কেন্দ্রীয় পাক রবীন্দ্রসঙ্গীত।
সরকার উভয় বাঙলায় চলাচলের পথ প্রতিদিন দুর্গমতর করতে লাগল– আন্তর্জাতিক জনসমাজের নিতান্ত হাস্যাস্পদ হবে বলে বনগাঁ-যশোরের সঙ্কীর্ণ পথটিকে কণ্টকাকীর্ণ অগম্য করার জন্য দু-কান-কাটার মতো বে-আব্রু বে-হায়া হতে তার বাধল– খবরের কাগজ, বইপত্র, গ্রামোফোন রেকর্ড এমনকি আমাদের পরম শ্লাঘার ট্রপিকাল স্কুলের গবেষণাজাত অমূল্য তত্ত্ব তথ্য যেগুলো পূর্ব বাঙালির পক্ষে নিরঙ্কুশ অর্জনীয় যার স্থান নেবার মতো দম্ভাধিকার প্রাচ্য-প্রতীচ্যের কোনও প্রতিষ্ঠানই করতে গিয়ে বিশ্ব-বৈদ্য-সমাজে হাস্যাস্পদ হতে চাইবে না, সবকিছুরই আদানপ্রদান নিরন্ধ্র বন্ধ করে দিল তখনও কিন্তু কলকাতার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পুব বাঙলার যোগসূত্র ছিন্ন করতে পারল না। দিনের পর দিন, গভীর রাত্রি অবধি কলকাতা বেতার, পরে এক্কেবারে খিড়কিদরজার গোড়ায় জুটল আরেক বৈরী, আগরতলা-কেন্দ্র রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, যন্ত্রে সুর শোনায়, রেকর্ড বাজায়, পণ্ডিত পঙ্কজ সে সংগীত শেখান, অনুরোধের আসরে অকাতরে আমার পাপমনে কেমন যেন একটা সন্দ আছে পুব বাঙালির অনুরোধের প্রতি কলকাতা বেতারের একটু বিশেষ চিত্তদৌর্বল্য ছিল– একই রেকর্ড দশবারের স্থলে বিশবার বাজিয়ে কলকাতা বেতার যে প্রতিহিংসা-বিষে জবজবে হৃদয় দিয়ে বিঘ্নসন্তোষীর কৈবল্যানন্দ, বিজয়ী বীরের আত্মপ্রসাদ অনুভব করে নিজকে কৃতকৃতার্থ চরিতার্থ মনে করত। কারণ কলকাতা বেতার অবগত ছিল, পিণ্ডি-ভাতারের হুকুমে ঢাকা বেতারের রাধারানির তরে তখন রবীন্দ্রসঙ্গীত কানুর পীরিতির মতো নিষিদ্ধ পরকীয়া প্রেম। কলকাতা বেতার তখন বললে, বটে! আচ্ছা দেখা যাবে, তুমি কালাচাঁদের বাঁশির সুরটি ঠ্যাকাও কী কৌশলে?
ধ্বনি মাত্রই ঠেকানো বড় কঠিন। কারণ ধ্বনির আসন আত্মন-ব্ৰহ্মণের পরেই।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে রাজর্ষি জনক ও ব্রহ্মর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য-সংবাদে আছে, জনক শুধোলেন, মানুষের জ্যোতি কী? অর্থাৎ তাদের বেঁচে থাকা, কাজকর্ম করা কিসের সাহায্যে নিষ্পন্ন হয়? যাজ্ঞবল্ক্য : সূর্য। জনক : সূর্য অস্ত গেলে? চন্দ্রমা। সূর্যচন্দ্র উভয়ই অস্তমিত হলে? অগ্নি। সূর্যচন্দ্র অস্তমিত, অগ্নি নির্বাপিত তখন কোন জ্যোতি পুরুষের সহায়ক হয়?
অস্তমিত আদিত্যে, যাজ্ঞবল্ক্য-চন্দ্রনসস্যস্তমিতে শাঞ্জেগ্নৌ কিং জ্যোতিরেবায়ং পুরুষ?
ধ্বনি। এই জন্যই যখন নিজের হাত পর্যন্ত ভালো করে দেখা যায় না, তখন যেখানে কোনও শব্দ হয়, মানুষ সেখানে পৌঁছতে পারে।
কলকাতা বেতারের ধ্বনি-তরঙ্গ সমস্ত পুব বাঙলায় দিনযামিনী সে দেশের বাতাবরণে সঞ্চারিত ছিল। সে ধ্বনি-তরঙ্গকে যন্ত্র সাহায্যে কোনও অবস্থাতেই বিকৃত অবোধ্য করা যে যায় না, তা নয়। যাজ্ঞবল্ক্যও জনকের শেষ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন শব্দও যদি নিরুদ্ধ হয়ে যায় তবে আত্মাই তখন তার জ্যোতি; আত্মজ্যোতি প্রসাদাৎ সে তখন সর্ব কর্ম সমাধান করে। কিন্তু ধ্বনিতরঙ্গ সংগ্রামে পিণ্ডি নামতে সাহস করেনি। কারণ পুব বাঙলার চতুর্দিকে ঘিরে রয়েছে আমাদের যথেষ্ট বেতার-কেন্দ্র। আমাদের ভাণ্ডারে আছে প্রচুরতর। পিণ্ডি পুব বাঙলা থেকে আমাদের একটা কেন্দ্র জ্যাম করতে না করতেই আমরা তাদের ছটা কেন্দ্রকে। সম্পূর্ণ অবোধ্য করে দিতে পারব। ফলে পুব বাঙলা করাচি-পিণ্ডি থেকে প্রেরিত সংবাদ তো পুনঃপ্রচার করতে পারবেই না, তদুপরি নিজের দেশের সংবাদ সরকারি হুকুম কিছুই বেতার মারফত বিকিরণ করতেও পারবে না। এমনকি মিলিটারির গোপন বেতারে ফরমান আলির ফরমান পর্যন্ত অনায়াসে রুদ্ধশ্বাস করা যেত।
.
খ্রিস্ট বলেছেন, মানুষের পক্ষে রুটিই যথেষ্ট নয়। তার হৃদয়-মনেরও ক্ষুধা-তৃষ্ণা আছে।
বহু অভিজ্ঞতার পর আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, পুব বাঙলার তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী আমাদের তুলনায় আজ বেশি রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। এদের এবং আমাদের অনেকের কাছেই হয় তো কবির ছোটগল্প প্রিয়তর। কিন্তু পুব বাঙলায় একদিন এমন দুঃসময় এল যখন কবির কোনও পুস্তকই সগ্রহ করা তাদের পক্ষে ছিল অসম্ভব। শুনেছি, কোন এক হিন্দু কবি মুসলমান রমণী বিয়ে করার পর জন্মভূমি কাশীতে যখন ফিরলেন তখন পূজারি-পুরোহিত সমস্ত মন্দিরের দ্বার বন্ধ করে দিল। কবি নিরাশ হলেন না। মা গঙ্গার উদ্দেশে বললেন, তোমাকে মা রুদ্ধদ্বার করতে পারে এমন লোক আজও জন্মায়নি। কবি তাঁরই উদ্দেশে স্তোত্র রচনা করলেন।
হুবহু রবিতীর্থে যাত্রা করার জন্য সর্বপন্থা যখন রুদ্ধ হয়ে গেল তখন রইল শুধু কলকাতা বেতারের রবীন্দ্রসঙ্গীত। সেই হয়ে গেল তাদের সুরধুনী (যতদূর জানি ধুনী শব্দের অর্থ নদী), গঙ্গা। কবির গানেও আছে,
হাটের ধুলা সয় না যে আর
কাতর করে প্রাণ।
তোমার সুর-সুরধুনীর ধারায়
করাও আমায় স্নান।
হুবহু একই পদ্ধতিতে হয়ে গেল সমস্যার সমাধান– আংশিক, কিন্তু মধুর। পিণ্ডির রাজা রাজর্ষি জহ্ন নন যে সে-সুর-ধুনী পান করে নিঃশেষ করবেন।
আরও একাধিক কারণ, যোগাযোগ, জনপদসুলভ সহজাত হৃদয়াবেগ রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি পুব বাঙলায় আসক্তি নিবিড়তর করে তুলেছে, যেমন ধরুন সঙ্গীতজগতে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠতম উপহার– তাঁর বর্ষার গান। শান্তিনিকেতন বীরভূমে দীর্ঘ গ্রীষ্মের খরদাহনে দগ্ধপ্রায় বিবর্ণ জীবন্ত আতাম্র তৃণপত্র যখন মুহ্যমান বিষণ্ণ বিশ্ব যখন নির্মম গ্রীষ্মের পদানত, শুষ্ক কানন শাখে ক্লান্ত কপোত ডাকে, এবং রজনী নিদ্রাহীন দীর্ঘ দগ্ধ দিন, তুষাতপ্ত জনপদবধূ কাতর কণ্ঠে রুদ্রকে অনুনয় জানায়, সম্বররা এ চক্র তব, একচক্রা রথের ঠাকুর! রক্তচক্ষু অগ্নি-অশ্ব মূৰ্ছি পড়ে, আর তারে ছোটাবে কতদূর সে সময়কার শুষ্ক কালবৈশাখীর নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ, তার দু-তিন দিন পরেই যখন নামে প্রবল বেগে বারিধারা, আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে যখন বৃষ্টি নামল, সকালে উঠে দেখি, এ কী! কখন বাদল-ছোঁওয়া লেগে মাঠে মাঠে ঢাকে মাটি সবুজ মেখে মেখে–অকস্মাৎ এই কল্পনাতীত পরিবর্তন পুব বাঙলায় রাজশাহী বারোঞ্চল, আরও দু চারটি জায়গা ছাড়া অন্যত্র বিরল। কিন্তু পূর্ব বাংলার লোক বর্ষার যে রূপের সঙ্গে সুপরিচিত– ছাড়ল খেয়া ওপার হতে ভাদ্রদিনের ভরা স্রোতে, দুলছে তরি নদীর পথে তরঙ্গবন্ধুর, কিংবা হয়তো কে ডাকিছে বুঝি মাঝি রে, খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে, কারণ দুই কূল আকুলিয়া অধীর বিভঙ্গে যখন পদ্মা তরঙ্গে তরঙ্গে মেতে ওঠে তখন কী করে গাই, পথ চেয়ে তাই একলা ঘাটে বিনা কাজে সময় কাটে, পাল তুলে ওই আসে তোমার সুরের তরী– খেয়া ঘাট, ভরা পাল তুলে পাগল-পারা ছুটেছে তরী তার সঙ্গে কত না সুখ কত না দুঃখের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়– সে খেয়ার কর্ণধার তোমারে নিয়েছে সিন্ধু পারে আষাঢ়ের সজল ছায়ায়, তার সাথে বারে বারে হয়েছে আমার চেনা সঙ্গে সঙ্গে যেন এক কঠোর আঘাতে বুকের স্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়, কবি কী সামান্যতম ইঙ্গিতে স্মরণ করিয়ে দিলেন তিনি তাঁর কত না প্রিয়জনের অকারণে-অকালে তার পড়ল যখন ডাক তখন তাকে খেয়ায় একান্ত একাকী উঠতে দেখেছেন শোকাতুর চিত্তে, অশ্রুহীন শুষ্ক নয়নে। এখন তিনি সে খেয়ার সঙ্গে বেদনা বেদনায় এতই সুপরিচিত যে তিনি যেন প্রস্তুত হয়ে আছেন, ভাবছেন– নিয়ে যাব ইহার উত্তর নিজ হাতে করে আমি ওই খেয়া পার করি ভয়!
রবীন্দ্র-স্পেশালিস্ট আমি নই, কাজেই শপথ করতে পারব না, কবির বর্ষাগীতিতে পুব বাঙলার অধিকতর বর্ণনা আছে। কিন্তু একথা সত্য খেয়াঘাট, ভাসাও তরণী হে কর্ণধার, হে বিরাট নদী, এসব মোতিফ ভাটিয়ালি গীত মারফত বহুকাল ধরে পূর্ববঙ্গীয়ের নিত্যদিনের সখা। কভু বা পার্থিবার্থে চিন্তামণির সন্ধানে সে ওপারে যেতে চায়, কভু-বা সে নদীকে দেখে বৈতরণী রূপে। গহীন গাঙের নাইয়া, তুমি যদি হও গো নদী, তুমি কেবা যাও রে, লাল নাও বাইয়া, একখানা কথা শুনা যাও নীল বৈঠা তুল্যা, মানিকপীর ভবনদীপার হইবার লা– এসব দিয়ে গড়া তার হৃদয়। সেইখানেই তো রবির প্রথম আলোর চরণধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে তারা জেগে উঠে সাড়া দেবে– এতে আর কিমাশ্চর্যম?
.
উভয় বাঙলা– ফুরায় যাদেরে ফুরাতে
মেদিনীপুর, বাঁকুড়ায় অর্থাৎ রাঢ়ভূমির পশ্চিমতম প্রান্তে, অতএব উভয় বাঙলারই অস্তাচলে বসবাস করার সৌভাগ্য থেকে আমি বঞ্চিত, কিন্তু বাল্যে রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ সেবক ঈশ্বর রাজেন বন্দ্যো, নন্দলাল, অবন ঠাকুরের শিষ্য ওই পরিবারের চিত্রকর শ্ৰীযুত সত্যেন, শান্তিনিকেতন লাইব্রেরির আজীবন একনিষ্ঠ সেবক ঈশ্বর সত্য, পরবর্তীকালে তাঁর কন্যা উভয় বঙ্গে গণমোহিনী গায়িকা, স্বয়ং পূর্ববঙ্গের প্রতি সবিশেষ অনুরক্তা শ্রীমতী কণিকা মোহর, এদের সান্নিধ্য ও সাহচর্য লাভ করেছি কয়েক বৎসর ধরে। শ্ৰীযুত সত্যেনকে কলাজগতের বিস্তর রসগ্রাহী চেনেন সরল, নিরলঙ্কার, দৈনন্দিন জীবনের সহজ চিত্রকর রূপে, কিন্তু তাঁকে আমি পেয়েছিলুম উপগুরুর ছদ্মবেশে। আমার খাজা বাঙলা উচ্চারণ তিনি মেরামত করার চেষ্টা দিতেন কথাচ্ছলে, আমাকে অযথা আত্মসচেতন না করে দিয়ে। এবং একটু মৃদু হাস্য যোগ দিয়ে বলতেন, বাঁকড়োয় আমরা কিন্তু বলি…।
পূর্বতম প্রান্ত সিলেট-কাছাড় আমি ভালো করেই চিনি। দুই অঞ্চলে নিশ্চয়ই নানা বিষয়ে পার্থক্য আছে। বস্তুত প্রথম দর্শনে অনভিজ্ঞজনের চোখে পার্থক্যগুলোই ধরা পড়বে বেশি। কিন্তু একটু গভীরে তলালেই চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রই হৃদয়ঙ্গম করে ফেলবেন যে সাদৃশ্যটাই ঢের বেশি। এবং এত বেশি যে ঠিক ওই কারণেই পার্থক্যগুলো আরও যেন স্পষ্টতর হয়। সাদৃশ্যের স্বচ্ছ জলে পার্থক্যের একটিমাত্র কালো চুল চোখে পড়ে। আবিল আবর্তে বৃহৎ প্রস্তরখণ্ড লুকিয়ে থাকে। গুণীরা তাই বলেন, সাধুজনের অতি সামান্য পদস্খলন নিয়ে পাঁচজন সমালোচনা করে, অসাধুর পর্বতপ্রমাণ পাপাচার সম্বন্ধে মানুষ অপেক্ষাকৃত উদাসীন।
কথাপ্রসঙ্গে দুই বাঙলার পার্থক্যের প্রতি যদি আমি ইঙ্গিত করি তবে উভয় বাঙলার পাঠক যেন সাদৃশ্যের মূল তত্ত্বটা ভুলে গিয়ে অনিচ্ছায় আমার প্রতি অবিচার না করেন।
মহানগরী কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের সুদূরতম প্রান্তে, এমনকি পুব বাঙলারও কিয়দংশে যে প্রভাব বিস্তার করে সে তুলনায় মফঃস্বলের ওপর ঢাকার প্রভাব যৎসামান্য। তদুপরি কলকাতা যে শুধু ঢাকার তুলনায় বহুলাংশে বৃহত্তম তাই নয়, বোম্বাই মাদ্রাজ দিল্লিকেও অনায়াসে বহু বিষয়ে অপায়ে রেখে সে চীন-জাপানের সঙ্গে পাল্লা দেয়। কিন্তু সে আলোচনা আরেকদিন হবে। উপস্থিত আমার বক্তব্য, যদিও কলকাতা পরশুদিনের আপস্টার্ট নগর তবু ধীরে ধীরে তার একটা নিজস্ব নাগৰ্য বা নাগরিকতা গড়ে উঠছে। নাগরিক বলতে একটা শিষ্ট, ভদ্র, রসিক এবং বিদগ্ধজনকে বোঝাত। এমনকি চলতি কথাও নাগরপনা, নাগরালি এবং শহরবাসী অর্থে নগুরে, আজকাল বলি শহুরে, এককালে খুবই প্রচলিত ছিল। উর্দুতে কৃষ্টি, বৈদগ্ধ্য অর্থে ইদানীং তমদুন শব্দ ব্যবহার করা হয়। তারও মূল মদিনা বা শহর– আমরা মদিনা বলতে যে নগর বুঝি সেটার পূর্ণ নাম মদিনাতুন নবী অর্থাৎ নবীর (প্রেরিত পুরুষের) নগর।
উন্নাসিক নাগরিক জনের কত্রিম আচার-ব্যবহার সর্বদেশেই সুপরিচিত। তাই ইংরেজিতে সফিসটিকেটেড শব্দের অর্থে যেমন কৃত্রিমতার কদৰ্থ আছে তেমনি উচ্চাঙ্গের সার্থক জটিলতার সদর্থও আছে। ১৯৭১-এ আমরা প্রায়ই বিদেশি রিপোর্টারের লেখাতে পড়েছি, সাদামাটা রাইফেল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা কী করে লড়বে পশ্চিম পাক আগত সর্বপ্রকারের সফিসটিকেটেড হাতিয়ার, যেমন রাডার, স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান ইত্যাদির বিরুদ্ধে?… তাই হাফবয়েলড, অর্ধসিদ্ধ আসিদ্ধ সাফিসটিকেটেড জন, প্রাচীনার্থে নাগরিক যদি তার নাগরিমায় সত্যকার বৈচিত্র্য, উদ্ভাবনশীলতা না দেখাতে পারে তবে সে নিছক নতুন কিছু কর প্রত্যাদেশ মেনে নিয়ে অর্থহীন উদ্দেশ্যহীন উদ্ভাবনায় লেগে যায়।
প্রাক্তন বেতার মন্ত্রী শ্ৰীযুত কেশকার একদা ফরমান দিলেন, যার ভাবার্থ : আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভূরি ভূরি রাগ-রাগিণী অনাদরে অবহেলায় লোপ পেয়ে যাচ্ছে। আকাশবাণী যেন অচলিত রাগ-রাগিণী যারা আজও গাইতে পারেন তাদের পরিপূর্ণ মাত্রায় উৎসাহিত করে।
একথা অবশ্যই সত্য, গণতন্ত্রের যুগে গানের মজলিসে আসে হরেক রকমের চিড়িয়া। তাই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে পারদর্শী শ্ৰীমতী অর্চনা রীতিমতো বিহ্বল বিভ্রান্ত হয়ে শুধিয়েছেন হাবিজাবি লোকের কথা বাদ দিলেও তিনি আদৌ বুঝতে পারেন না, সঙ্গীতের প্রতি যাদের কণামাত্র আকর্ষণ নেই সেসব হোমরাচোমরারা শাস্ত্রীয় উস্কৃষ্টতম সঙ্গীতের আসরে আদৌ আসেন কেন?
তাদের আসাটা অর্থহীন নয়, উভয়ার্থে। কিন্তু ক্ষতি যেটা হয় সেটা সুস্পষ্ট। কর্মকর্তাগণ, এবং তাদের চাপে পড়ে আকছারই ওস্তাদরাও অতি প্রচলিত হালকা, এমনকি তার চেয়েও নিরেস গানেই নিজেদের সীমাবদ্ধ করে রাখেন, হোমরাদের প্রত্যর্থে। অচলিত দূরে থাক, অপেক্ষাকৃত বিদগ্ধ কিন্তু বহুজনপ্রিয় রাগ-রাগিণীও অবহেলিত হয়।
কিন্তু শ্ৰীযুত কেশকারের ফরমান আনল বিপরীত ফল। সরকারি প্রতিষ্ঠানমাত্রই ডেকে আন বললে বেঁধে আনাটাই প্রশস্ততম পন্থা বলে সমীচীন মনে করেন জাসট টু বি অন দি সেফ সাইড। তাবৎ ভারতের কুল্লে স্টেশন থেকে মার মার শব্দ ছেড়ে বেরুলেন কর্মচারীরা অচলিতের সন্ধানে। হাওয়ার গতি ঠাহর করে যতসব আজেবাজে গাওয়াইয়ারা অচলিত রাগ-রাগিণীর স্থলে বাঘ-বাঘিনীর লম্বা লম্বা ফিরিস্তি পাঠাতে লাগলেন বেতারের কেন্দ্রে কেন্দ্রে। তাঁরা গাইলেন সেগুলো, বহু ক্ষেত্রে কেন্দ্রেরই কর্মচারী রচিত নাতিদীর্ঘ বাগাড়ম্বর সমৃদ্ধ ভূমিকাসহ; সে অবতরণিকায় বোঝানো হল, এই ভয়ঙ্কর রাগটি কী প্রকারে যুগ যুগ ধরে অবহেলিত জীবন্ত থাকার পর অদ্য রজনীতে ওস্তাদস্য ওস্তাদ অমুক তাকে সগরসন্তানবৎ প্রাণদান করলেন। আমার মতো ব্যাক-বেঞ্চারের কথা বাদ দিন আমার কান ঝালাপালা– একাধিক বিদগ্ধজনকে দেখলুম, বেতারের কান মলে সেটাকে বন্ধ করতে।
কেউ শুধাল না, যুগ যুগ ধরে এসব রাগ জীবন্মুত ছিলই বা কেন আর মরলই-বা কেন?
একটা কারণ তো অতি সুস্পষ্ট। রসিক বেরসিক কারওরই মনে রসসঞ্চার করতে পারেনি বলে।
তুলনাটা টায় টায় মিলবে না, তবু সমস্যাটা কথঞ্চিৎ পরিষ্কার হবে। ঋতুসংহার নাকি টোলের ছাত্রেরা পড়তে চায় না; সর্বনাশ, ওটা অচলিত ধারায় পৌঁছে যাবে। বন্ধ কর মেঘদূত। চালাও ঋতুসংহার, জগদানন্দ জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেললেন বলে! বন্ধ কর চণ্ডীদাস, অষ্টপ্রহর গাও, ভনয়ে জগদানন্দ দাস। কী বললে, কবিগুরুর প্রথম কাব্য কবি-কাহিনী অনাদৃতা। বন্ধ কর পূরবী। চালাও দশ বছর ধরে কবিকাহিনী।
এইবারে আমি মোকামে পৌঁছেছি।
জানেন আল্লাতালা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই অচলিতের সন্ধান কী প্রকারে কখন মহানগরীর বিদগ্ধ সফিসটিকেটেড রবীন্দ্রসংগীত গায়ক-গায়িকার ভিতর সঞ্চারিত হয়ে গেল– আচম্বিতে। তাদের চেলারা লেগে গেলেন শতগুণ উৎসাহে। শুনেছি সেসব প্রাচীন গানের অনেকগুলিরই স্বরলিপি নেই এমনকি সামান্যতম রাগ-রাগিণীরও নির্দেশ নেই। খোঁজো খোঁজো অথর্ব বৃদ্ধবৃদ্ধাদের যারা হয়তো-বা কোনও দিন ব্ৰহ্মমন্দিরে ওইসব অচলিত গানের দু-চারটে শুনেছিলেন এবং কষ্ট করলে হয়তো-বা স্মরণে আনতে পারবেন। অবশেষে এই প্রচণ্ড অভিযানের ফলে এমন দিন এল যখন কেউ এস নীপবনে বা আমি পথ ভোলা এক পথিক এসেছি গান ধরল আর সবাই,
কেহ বা তোলে হাই, কেহ বা ঢোলে,
কেহ বা চলে যায় ঘরে—
হয়তো-বা ফিসফিসিয়ে একে অন্যকে শুধোয়, এর চেয়ে হ্যাঁকনিড গান কি খুঁজে পেল না মেয়েটা?
প্রথম যুগের গানে উত্তম গান নেই এহেন প্রগলভ বচন বলবে কে?
আনন্দের দিনে, গানের মজলিশ শেষ হয়ে গিয়েছে, কবিও চলে গিয়েছেন, কিন্তু দীনেন্দ্রনাথ, ভীমরাও শাস্ত্রী, উৎসব উপলক্ষে কলকাতা থেকে আমন্ত্রিত দু চার জন প্রবীণ গায়ক, অপেক্ষাকৃত নবীনদের ভিতর নুটুদি, হয়তো অনাদিদা– পরে হয়তো এসে জুটবেন কাঙালীচরণ– এরা তখন সবেমাত্র তেতে উঠেছেন। এঁদের মুখে তখন শুনেছি কিছু কিছু প্রাচীন দিনের গান। প্রধানত সুরের বৈশিষ্ট্য, অজানা কোনও বৈচিত্র্যের জন্য বা আমার অজানা অন্য কোনও কারণে, কিন্তু তারা বার বার ফিরে আসতেন প্রচলিত গানে। কিন্তু ভুললে চলবে না, এঁদের সকলেরই ছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অপর্যাপ্ত অধিকার। ১৯১৯ সালে সিলেটে কবিগুরুর কণ্ঠে শুনেছিলুম, বীণা বাজাও হে মম অন্তরে। তার কয়েকবছর পরে শুনলুম আরেক ওস্তাদের গলায়। মাত্র তিনটি ছত্র— গেয়েছিলেন প্রায় আধঘণ্টা ধরে … কিন্তু অচলিত গানের তরে এই উৎসাহেরও একটা মাত্রা থাকা উচিত। অবশ্য জানিনে অধুনা এ সফিসটিকেশন কোন সপ্তকে গিটকিরির টিটকিরি দিচ্ছে, বা অন্য কোনও সফিসটিকেশনে মেতে উঠেছে।
পুব বাঙলায় এ হাওয়া কখনও রয়েছে বলে শুনিনি! খুদ ঢাকা-ই সফিসটিকেটেড নয়– ছোট শহর গ্রামাঞ্চলের তো কথাই ওঠে না। একটা কথা কিন্তু আমি বলব, এ বাঙলার রসিকজন আমার ওপর যতই অপ্রসন্ন হন না কেন, পুব বাঙলার তরুণ-তরুণী যখনই রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রোগ্রাম তৈরি করে বা প্রাণের আনন্দে গান গায় তাদের নির্বাচন প্রায় ব্যত্যয়হীন চমৎকার। তারা লিরিকাল শব্দের সঙ্গে সুরের সামঞ্জস্য হৃদয় দিয়ে চিনে নেয় অক্লেশে, গান গায় অতি সহজ ভঙ্গিতে। মাস কয়েক পূর্বে টেলিভিশনে দেখলুম, শুনলুম, এক বিলিতি পাদ্রি সাহেব বরীন্দ্রসঙ্গীতে ব্যাপ্তিস্ম হয়ে গাইলেন, বাঙালের সরল ভঙ্গিতে : ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর, প্রভু। অপূর্ব! অপূর্ব!!
.
উভয় বাঙলা– অকস্মাৎ নিবিল
দেউটি দীপ্ততেজা রক্তস্রোতে
এ বাঙলার পুস্তক প্রকাশকরা অবশ্যই পাকিস্তানি ব্যান দ্বারা অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হন। দেশবিভাগের পূর্বে পশ্চিম বাঙলায় প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তক, তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রেফারেনস পুস্তক, কথাসাহিত্য, মাসিক, সাপ্তাহিক ইত্যাদি ইত্যাদি বিস্তর পুস্তক পুব-বাঙলায় নিয়মিত বিক্রি হত। একদা সাধনোচিত ধামে গত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে বলেন, কলকাতার পরই জেলা হিসেবে ধরলে সিলেটে তার কাগজ প্রবাসী সবেচেয়ে বেশি বিক্রি হত। প্রকাশক সম্পাদক ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের চেয়েও বেশি বিপদে পড়ে লেখক। তখন কিছু লেখক বিক্রি বাড়াবার জন্য আরও জনপ্রিয় হতে গিয়ে লেখার মান নামিয়ে দেন। একাধিক সম্পাদক প্রকাশক পাণ্ডিত্যপূর্ণ পুস্তক, জটিল সামাজিক রাজনৈতিক সমস্যাময় কথাসাহিত্য ছাপতে দ্বিধাবোধ করেন। পক্ষান্তরে হুজুগে বাঙালি কোনওকিছু একটা নিয়ে মেতে উঠলে সঙ্গে সঙ্গে বিস্তর প্রকাশক সেটা নিয়ে একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাশি রাশি ফরমাইশি বই রাতারাতি ঝপাঝপ বাজারে ছাড়তে আরম্ভ করেন। তড়িঘড়ি লেখা ফরমাইশি কেতাব অধিকাংশ স্থলেই নিম্নমানের হতে বাধ্য। পাঠকের রুচিকে এরা নিম্নস্তরে টেনে নামায় এবং তথাকথিত গ্রেশামের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উচ্চমানের পুস্তক সম্মান হারায় ও মুক্ত হট্ট থেকে বিতাড়িত বা অর্ধ-বহিষ্কৃত হয়।
পশ্চিম বাঙলার প্রকাশক লেখক ওই নিয়ে অত্যধিক প্রতিবাদ আর্তনাদ করেছিলেন বলে মনে পড়ে না। না করে ভালোই করেছেন। একে তো তাতে করে কণামাত্র লাভ হত না, উল্টো পিণ্ডি সেগুলো বিকৃতরূপে ফলাও করে পশ্চিম পাকে প্রপাগান্ডা চালাত– যে পশ্চিমবঙ্গ পুস্তকাদির মারফত পূর্ববঙ্গীয় মোহাচ্ছন মুসলমানদের ওপর তার সনাতন কাফিরি হিন্দু প্রভাব প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে আছে, তারা কিছুতেই বাঙালি মুসলমানকে খাঁটি মুসলমান হতে দেবে না। সম্পাদকরা অবশ্য তাঁদের মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন– সেটা করা তাদের কর্তব্যও বটে। পিণ্ডি তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার তখন করেছে। এখনও মি. ভুট্টো নানা কৌশলে এদেশের খবর, সম্পাদকীয় মন্তব্যের কদৰ্থ নিত্য নিত্য করে যাচ্ছেন।
আইয়ুব-ইয়েহিয়ার জন্টার জতো মি. ভুট্টো পরে নিয়েছেন- এইটকই সামান্য পার্থক্য। এমনকি জুন্টা পুব বাঙলার সম্মানিত নাগরিক মওলানা ভাসানী, শেখ সায়েবকেও প্রপাগান্ডা থেকে নিষ্কৃতি দেয়নি- ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর আগেও। ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে মওলানা ভাসানী কল্পনাতীত বিরাট এক জনসভাতে তুমুলতম হর্ষধ্বনির মধ্যে পূর্ব বাঙলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন– অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও মওলানাকে সমর্থন জানান। শেখ তখনও আপ্রাণ চেষ্টা দিচ্ছেন পশ্চিম পাকের সঙ্গে দেশের মর্যাদা রক্ষা করে একটা সমঝোতার আশায়। ভাসানীর ঘোষণা যেন ছাপ্পর ফোড় কর অপ্রত্যাশিতভাবে কিস্মতের কারণহীন বখশিশের মতো জুন্টার মস্তকে বর্ষিত হল। পিণ্ডি, লাহোর, করাচিতে তখন দিনের পর দিন ভাসানীর আপন দেশের অবিরল বারিধারার মতো, লাহোর পিণ্ডি ক্লাব-কাবারের উচ্ছ্বসিত মদিরাধারাকে পরাজিত করে চলল কুৎসা প্রচার : ভাসানী আসলে হিন্দু ভারতের এজেন্ট। ভারতেরই প্ররোচনায় লোকটা হাটের মাঝখানে হাঁড়ি ফাটিয়েছে। শুধু তার দলই যে পূর্ণ স্বাধীনতা চায় তাই নয়, ভাসানীর (একদা) সহকর্মী অনুগামী শেখও ঠিক এইটেই চায়, সমঝোতার নাম করে শুধুমাত্র ভণ্ডামির মুখোশ পরে আপন ন্যায়সঙ্গত সামান্যতম দাবির একটা কেস (আলিবি) খাড়া করতে চায় বিশ্ববাসীর সামনে, শেষটায় যাতে করে পাকিস্তানের নিতান্ত ঘরোয়া মামুলি মতভেদটাকে এক ভীষণ প্রলয়ঙ্কর আন্তর্জাতিক সঙ্কটময় রূপ দিয়ে ইউএন ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে, দু-একটা অর্বাচীন পকু-নিতম্ব ছোটাসে ছোটা দেশের দরদভি হাসিল করতে পারে। মোদ্দা কথা : ভাসানী যা শেখও তা।… যতদূর জানি আচারনিষ্ঠ মওলানা আপন সম্প্রদায়কে ভালোবাসেন, কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষবশত (যদি সে বিদ্বেষ তিনি পোষণ করেন। তিনি বিশেষ বিশেষ নিরপরাধ হিন্দুর প্রতি না-হক নির্দয় হবেন এটা চট করে মেনে নিতে মন চায় না। যা হোক, তা হোক– তাকে ভারতপ্রেমী আখ্যা দিলে তিনি খুব সম্ভব মৌল ইদের মতো তুর্কি নাচন আরম্ভ করবেন না, আত্মো পূর্ববৎ এটা চট করে গলতল করতে পারব না। কিন্তু এহ বাহ্য।
এদিকে কিন্তু ঢাকার প্রায় তাবৎ পাবলিশার মিশ্রিত উল্লাস বোধ করলেন বটে কিন্তু পশ্চিম বাঙলার কোনও বই-ই ছাপাতে পারবেন না– সে লেখক ভারতচন্দ্রই হোন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমই হোন। যাদের পুস্তকে কোনও কপিরাইট নেই, কাউকে কোনও রয়েলটি দিতে হবে না– সেইটে হল তাদের প্রধান শিরঃপীড়া। কিছু কিছু লেখক অবশ্য অবিমিশ্র আনন্দ উপভোগ করলেন। তাঁদের ধারণা : পশ্চিম বাঙলার সরেস বই গায়েব হয়ে গেলে তাদের নিরেস বই হু-হু করে, গরমকালে ডাবের মতো, শীতের সঝে চায়ের মতো বিক্রি হবে। এই কিছু-কিছুদের অনেকেই কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাস করেন, তাঁদের সৃষ্টি আদৌ নিরেস নয়, বিশেষত যারা ইসলামি মদুন– সভ্যতা বৈদগ্ধ্য সম্বন্ধে কেতাব রচনা করতেন। একজন কথাসাহিত্যস্রষ্টা আমাকে বলেন, পূর্ব বাঙলার লোক যে কলকাতার বই পড়ে সেটা একটা বদঅভ্যাস মাত্র। সেই কফি হোঁস, গড়ের মাঠ, কলেজ স্ট্রিট, ট্রামগাড়ি, বোটানিকাল কিংবা ছেরামপুরী পাদ্রি, হেস্টিংসের কেলেঙ্কারি ওসব ছাড়া অন্য পরিবেশের বই, যেমন বুড়িগঙ্গা, রমনা মাঠ, নবাববাড়ি, মোতিঝিলের কর্মচঞ্চলতা, নারায়ণগঞ্জের জাত-বেজাতের বিচিত্রতা– এদের গায়েতে এখনও সেই রোমান্টিক শ্যাওলা গজায়নি, ব্রোনজ মূর্তির গায়ে প্ল্যাটিনার পলেস্তরা পড়েনি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললুম, পুব বাঙলার পরিবেশ, পূব বাঙলার জীবন নিয়ে যদি একটা সার্থক সাহিত্য গড়ে ওঠে তবে পশ্চিম বাঙলার কাছে সেটা হবে নতুন একরকমের রোমান্টিক সাহিত্য। পাঠক হিসেবে বলছি, আমার মতো বহু সহস্র লোক সেটা সাদরে গ্রহণ করবে। আর এই তো হওয়া উচিত। অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ডের এক বৃহৎ অংশ আর খাস জর্মনি তিন ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রে জর্মন সাহিত্যের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধারা বয়ে আসছে বহুকাল ধরে পরিপূর্ণ সহযোগিতাসহ। টমাস মান-এর জন্ম-উত্তর জৰ্মনিতে অথচ জীবনের বেশিরভাগ কাটালেন সসম্মানে সুইটজারল্যান্ডে। সঙ্গীতে দেখি, বেটোফেনের জন্ম বন শহরে অথচ জীবন কাটালেন ভিয়েনাতে। পূর্ব বাঙলা যে একদিন নতুন গানের ঝরনা-তলা রসের ধারা নির্মাণ করবে সে বিষয়ে আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই।
কিন্তু কার্যত দেখা গেল ঢাকার প্রকাশকমণ্ডলী খেয়ালি পোলাও খাওয়ার জন্য অত্যুৎসাহী হতে চান না।
নগদ যা পাও হাত পেতে নাও।
বাকির খাতায় শূন্য থাক!
দূরের বাদ্য লাভ কী শুনে।
মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।
— (কান্তি ঘোষ)
ওদিকে আবার আছে তাদের দেদার নিউজপ্রিন্ট, নেই কিন্তু যথেষ্ট বই ছাপাবার কাগজ, এটা ওটা সেটা বিস্তর জিনিস। এবং টেকসট বই যে সর্বাধিকার পাবে সে তত্ত্ব তো তর্কাতীত।
এবং যে নিদারুণ সত্য পুব বাঙলায় তো বটেই, পশ্চিম বাঙলারও ভুলতে সময় লাগবে সেটা যখন ঠেকাবার শত চেষ্টা সত্ত্বেও স্মৃতিতে আসে তখন দেহমন যেন বিষিয়ে যায় : শহিদ হয়েছেন যেসব অগ্রণী পথপ্রদর্শক লেখক তাদের সংখ্যা আদৌ নগণ্য নয়, প্রতিভাবান উদীয়মান লেখক অনেক, ছাত্রসমাজের উজ্জ্বল উজ্জ্বল মণিরাশি, অসংখ্য গুণগ্রাহী পাঠক, বিত্তশালী পৃষ্ঠপোষক, আমার ভাগ্নের মতো শত শত যুবক-যুবতী যারা সাহিত্যিকদের সেবা করত সগর্বে সানন্দে, সাহায্য করত তাদের অতিশয় ক্ষীণতম বটুয়া থেকে যা বেরোয় তাই দিয়ে, বই কিনত সিনেমা জলখাবারের পয়সা বাঁচিয়ে, বাঙলা ভাষার কণ্ঠবোধ করার জন্য পিণ্ডির হীন খল প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে যারা সম্পাদককে পাঠাতে স্বনামে তীব্রতম তীক্ষ্ণতম ভাষায় বেপরোয়া প্রতিবাদ– যার অধিকাংশ ছাপা হলে সম্পাদক লেখক গয়রহ নিঃসন্দেহে হতেন। গবর্নর মোনায়েম খানের রাজসিক মেহমান। এরাই ছিল পূর্ণার্থে সর্বার্থে স্পর্শকাতর। তাই এরাই ছিল সব প্রগতিশীল আন্দোলনের পুরোধা, এরাই মুক্তিযুদ্ধে আহ্বায়ক, সহায়ক এবং নায়করূপে প্রথমতম শহিদ। এদের অনেকেই বেরিয়েছিল বিচ্ছিন্নভাবে একা একা, বর্ষ তখনও হয় নাই শেষ, এসেছে চৈত্রসন্ধ্যা কিন্তু হায়, চৈত্রদিনের মধুর খেলা খেলতে নয়, সেই চৈত্র মুসলিম গণনায় ছিল মহরমের মাস, আদর্শের জন্য শহিদ মাস–
আমারে ফুটিতে হল
বসন্তের অন্তিম নিঃশ্বাসে
বিষণ্ণ যখন বিশ্ব
নির্মম গ্রীষ্মের পদানত,
রুদ্র তপস্যার বনে
আধো ত্রাসে আধেক উল্লাসে
একাকী বহিরি এনু
সাহসিকা অপ্সরার মতো।
—(সত্যেন দত্ত)*
পিশাচের দাবানলে ভস্মীভূত হবার জন্য।
[*উদ্ধৃতিতে ভুল থাকাটা আদৌ অস্বাভাবিক হবে না। ৫০/৫৫ বছর হল চম্পা কবিতাটি প্রথম পড়ি, তার পর এটি দৃষ্টিগোচর হয়নি। চম্পার প্রথম দর্শনেই কবিগুরু এমনি মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, সেটি তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। আমার বাসনা যায় জানতে আর কোন কোন বাঙালি কবির কবিতা তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। বহুকাল ধরে আমার আন্তরিক প্রার্থনা ছিল, সত্যেন দত্তের সম্পূর্ণ গ্রন্থাবলি সম্পাদন করার।]
.
উভয় বাঙলা– বাঙলা দেশের প্রধান সমস্যা
মাতৃভাষার ইতিহাস অধ্যয়ন, মাতৃভাষাকে জনসমাজে উচ্চাসন দান, সে ভাষাকে পূত-পবিত্র করার জন্য তার থেকে বিদেশি শব্দ লৌহ-সম্মার্জনী দ্বারা বিতাড়ন নানারূপে নানা দেশে বার বার দেখা দিয়েছে এবং দেবে। এ সঙ্গে অনেক স্থলেই রাজনীতি জড়িয়ে পড়ে, কিংবা বিদেশি রাজার প্রতাপে যখন প্রপীড়িতজনের আপন বলে ডাকবার আর কোনও কিছুই থাকে না তখন অনেক ক্ষেত্রেই নিছক আত্মানুভূতির জন্য আমি আছি, আমার কিছু একটা এখনও আছে সে তার শেষ আশ্রয় অবহেলিত মাতৃভাষার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে, তাকে পরিপুষ্ট করার জন্য দেশে আন্দোলন চালায়, চরমে পৌঁছে কভু বা মাতৃভাষা থেকে তাবৎ বিদেশি শব্দ ঝেটিয়ে বের করে, কভু বা মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষার মাধ্যমে যে বিদ্যালয়ে শিক্ষাদান করা হয় তাকে বয়কট করে, ২১শে ফেব্রুয়ারি সাড়ম্বরে উদযাপন করে, সেদিনটাকে বড়দিনের মতো সম্মানিত করার জন্য হয় হরতাল করে, নয় সরকারের ওপর চাপ আনে সেটাকে যেন হোলি ডে রূপে স্বীকার করা হয় ও হলি ডে রূপে অনধ্যায় দিবস বলে গণ্য করা হয়। আন্দোলন জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাতৃভাষা বাবদে এযাবৎ উদাসীন সুবিধাবাদী পলিটিশিয়ানরা (সুবিধাবাদী বলাটা নিষ্প্রয়োজন– অমাবস্যার অন্ধকার রাত্রির বর্ণনাতে অন্ধকার না বললেও চলে) গুঁড়ি গুঁড়ি দলে ভিড়তে থাকেন এবং যারা সত্য সত্য মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগতবশত বহু বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে আন্দোলনটাকে শক্তিশালী করে তুলেছিল তাদের হাত থেকে আন্দোলন পরিচালনা করার ক্ষমতা কেড়ে নেন।
এরপর যদি ধীরে ধীরে স্বরাজ আসে তবে মাতৃভাষার প্রতি অনুরক্ত তথা সে ভাষায় সুশিক্ষিত জন কিছুটা অবকাশ পান ভাষাটাকে গড়ে তোলার জন্য, যাতে করে স্বরাজ লাভের পর মাতৃভাষার সাহায্যেই সব শিক্ষাদীক্ষা রাষ্ট্রের সর্ব দৈনন্দিন কাজকর্ম সমাপন করা যায়। এ জাতীয় গঠনমূলক কর্মের জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনা খবরের কাগজে ফলাও করে আত্মপ্রশস্তি গাওয়ার সুযোগ নেই, স্বরাজ লাভের পর তো আরও কম।
জনপ্রিয়, শ্রদ্ধেয় লেখক শঙ্কর মাস দুই পূর্বে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখ উপলক্ষে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, বাংলা ভাষা আজ ওপার বাংলাতেও তেমন প্রাণোচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে না, যা কিছুদিন আগেও দেখা গিয়েছে। বাংলা ভাষাকে একাদশ কোটি মানুষের ভাবপ্রকাশের সার্থক মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে যে বিরাট কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন, তার সূচনা কোথায়?
পশ্চিম বাঙলা বাবদে তার ক্ষোভ : এক শ্রেণির উচ্চশিক্ষিত বাঙালি আবার মাতৃভাষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।… ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে, ইংরেজি গান শুনে… এঁরা অজান্তে নিজ বাসভূমে পরবাসী সৃষ্টি করছেন। এঁদের ধারণা সন্তানদের বাংলা শিখিয়ে লাভ নেই। চাকরির জন্য প্রয়োজন ইংরেজি ইত্যাদি।
এর সঙ্গে শ্রীযুক্তা উমা চট্টোপাধ্যায় যোগ দিয়েছিলেন, কোনও কোনও স্বনামধন্য লেখক আজও ইট পাটকেলের মতো অযথা ইংরেজি শব্দের ব্যবহার করেন।
অনায়াসে বোঝা যাচ্ছে উভয় বাঙলার সমস্যা এক নয়। যদিও চিরন্তন সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে উভয় বাঙলার সমস্যা প্রায় একই, বিশ্বসাহিত্যেও প্রায় তাই-ই। উভয় বাংলার সার্থক সাহিত্য সৃষ্টিতে পার্থক্য থাকবে অত্যল্প এবং সেগুলো রসের বিচারে গৌণ। পুব বাঙলার অধিকাংশ লেখক মুসলমান তাঁদের সৃষ্টিতে মুসলিম সমাজ চিত্রিত হবে অপেক্ষাকৃত বেশি। পশ্চিম বাঙলায় চিত্রিত হবে হিন্দু সমাজ। এ স্থলে সম্পূর্ণ অবান্তর নয় বলে উল্লেখ করি, একশো বছর পূর্বে যখন বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমস্ত ভারতে ছড়িয়ে পড়ছিলেন তখন বাঙলা দেশের অনেকেই আশা করেছিলেন এঁরা তাঁদের সাহিত্য সৃষ্টিতে ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ নগরের আলেখ্য অঙ্কন করবেন, অন্ততপক্ষে দূর দেশে বাঙালির জীবনধারা তাঁদের নির্মিত অশ্রুজলে বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপগুলো রসের মাধ্যমে কিছুটা চিনতে শিখবে। সে আশা সম্পূর্ণ নিষ্ফল হয়নি ঠিক, সেইরকম পুব বাঙলা থেকে আমরা সার্থক সাহিত্য তো আশা করিই। তদুপরি সে সাহিত্যে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু অজানা অচেনা নয়া নয়া ছবি দেখতে পাবেন নিছক ফাউ হিসেবে গ্রেস মার্কের মতো। জয় বাঙলা।
কিন্তু উপস্থিত পুব বাঙলার মোট সর্ববৃহৎ সমস্যা এবং একদিন সে সমস্যা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সে সত্যও জানি– সেটা বাংলাদেশের তাবৎ সরকারি বে-সরকারি কাজকর্ম বাঙলারই মাধ্যমে সম্পন্ন করা যায় কী প্রকারে? যেমন ধরুন, খাদ্য-সমস্যা। ঢাকায় খবর এল চাটগাঁয়ে চাল বড় আক্রা, রংপুরে ভালো ভালো ফসল হয়েছে। সে চাল তড়িঘড়ি ট্রেনে করে পাঠাতে হবে চাটগাঁ। ইতোমধ্যে ঢাকাতে টেলিফোনের নামকরণ হয়ে গেছে দূরালাপনী বা দূর-আলাপনী–দূরালাপী বোধ হয় নয়। আমি অবশ্য দূর-বাকী, দূর-বাচনী নাম দিতে চেয়েছিলুম, কারণ প্রয়োজন হলে উম্মা প্রকাশার্থে সন্ধি করে নিলেই হল, দুর্বাকী দুর্বাচী যা খুশি। কিন্তু কী দরকার। দীর্ঘ ঊ-কেহ করে দিলেই হল। দুরাশয়গণ অহরহ দুরালাপ করে, এই অর্থে দুরালাপনী বললে চলে যেতে পারে। কিন্তু অনপনেয় কালি দিয়ে নাম সই করবেন সত্যি প্রথম দর্শনে আমার মুখ কালিমাখা করে দিয়েছিল। কিন্তু ইনডেলবি-এর অন্য কী বাঙলা শব্দ হতে পারে? দূরপনেয় কলঙ্ক বাঙলাতে খুবই চলে। সে কলঙ্ক কষ্টসহ মুছতে হয় সেই ওজনে যে কালি কিছুতেই মোছা যায় না। অবশ্য উন্নাসিক সম্প্রদায় আপত্তি তুলতে পারেন। অনপনেয় কালিতে গুরুচণ্ডালি দোষ বিদ্যমান। বলা উচিত ছিল অনপনেয় মসি। তদুত্তরে বক্তব্য, ইহলোক ত্যাগ করার তিন বৎসর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ চলতি বাঙলা ভাষার একটা খতিয়ান নেন বা সিংহাবলোকন (সার্ভে) করেন; ইতোপূর্বে কবি বাঙলা ভাষা শব্দ-ধ্বনিতত্ত্ব ব্যাকরণ নিয়ে অজস্র রচনা প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু সেগুলো প্রধানত বা সর্বত সাধুভাষা নিয়ে। কিন্তু চলতি ভাষা এনে দিয়েছে নতুন নতুন সমস্যা। সে সমস্ত আদ্যন্ত আলোচনা করার পর বাঙ্ময় সম্রাট দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে রাজাদেশ প্রচার করেন।
সাহিত্যিক দণ্ডনীতির ধারা থেকে শুরুচণ্ডালি অপরাধের কোঠা উঠেই গেছে।
.
অপিচ
অমুকের কণ্ঠে গানে দরদ লাগে না বললে ঠিক কথাটি বলা হয়। গুরুচণ্ডালির শাসনকর্তা যদি দরদের বদলে সংবেদনা শব্দ চালাবার হুকুম করেন তবে অমান্য করলে অপরাধ হবে না। (বাংলা ভাষা পরিচয়, র র ২৬ খণ্ড পৃ. ৩৯৫ ও প.)
কিন্তু এহ বাহ্য। তবু যে এই সঙ্কটের কথাটা উল্লেখ করলুম, তার কারণ পুব বাঙলার লোক গুরুচণ্ডালি পত্তপ্রকর্ষতা দোষ সম্বন্ধে পশ্চিম বাঙলার চেয়ে ঢের বেশি সচেতন।
মোদ্দা কথা এই ফোন যন্ত্রটির পরিভাষা কী হল না হল তার চেয়ে ঢের বেশি মারাত্মক রেলের এঞ্জিনচালক, সিগনেল ম্যান, গার্ড সাহেব, বিজলির মিস্ত্রি ইত্যাদি ইত্যাদি অসংখ্য লোক তাদের তরো-বেতরো যন্ত্রপাতি কলকজার কী পরিভাষা নির্মাণ করছে। সামান্য ভুল বোঝাবুঝির ফলে দুর্ঘটনা ঘটাটা মোটেই অকল্পনীয় নয়।
ওদিকে প্রাচীন দিনের ব্যরোক্রেটরা রাতারাতি বাঙলাতে জটিল জটিল সমস্যার বিশ্লেষণ তাদের টীকা, প্রস্তাবের মুসাবিদা লিখবেন কী প্রকারে? সিকিশিক্ষিত এক ইমাম সাহেব। খামোখা বেমক্কা আমাকে বলেন, আপনি তো বাঙলা বাঙলা বলে চেল্লাচ্ছেন কবে সেই বাবা আদমের কাল থেকে– যদিও এ বাবদে আমাদের ইটের মান দিকধিড়িঙ্গে প্রামাণিক গ্রন্থে আপনার উল্লেখ নেই। আমি হাতজোড় করে বললুম, রক্ষে দিন, ইমাম সাহেব! আপনার পরবর্তী ইস্টিশন বেহেশতে ফিরিশতাদের বাঙলা বলতে হবে এহেন ফতোয়া তো আমি কখনও দিইনি। জানি, জানি। কিন্তু ওই যে আপনাদের সংবিধান না কী যেন তৈরি হল তার দুটো তসবির। একটা বাঙলাতে অন্যটা ইংরেজিতে। এবং সাফ জবানে বলা হয়েছে, অর্থ নিয়ে মতবিরোধ যদি হয়, তবে ইংরেজি তসবিরই প্রামাণিক আপ্তবাক্য। আমি বিশ্বাস করিনি এবং হলেও আমার কণামাত্র ব্যক্তিগত আপত্তি নেই।
কিন্তু এ বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই যে, স্বয়ং শেখজি থেকে বিস্তর লোক হরহামেশা বাঙলার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করেছেন। কিন্তু তাঁদেরও তো মাঝে মাঝে ধোকা লাগে, কোনও ইংরেজি শব্দের সঠিক বাংলা পরিভাষা কী। তখন ফোন করা হয়, কিংবা ডাক পড়ে প্রবীণ সাহিত্যিককে বা সাহিত্যিকদের। তারাই বা কজন সর্বসাকুল্যে বেঁচে আছেন তখনও টিক্কা, অল-বদর, শান্তি কমিটি, বেহারিদের টেলিস্কোপ মাইক্রোস্কোপ সংযুক্ত ডবল জালের ছাঁকনি এড়িয়ে! দেশের কাজকাম যদি বন্ধ হয়ে যায় হবে না, আমি জানি তবে,
কাগজ কলম মন
লেখে তিন জন।
এর প্রথম দুটি বস্তু আসবে কোথা থেকে? কিছুদিন পূর্বে বাংলাদেশের সদরে সে দেশের মোস্ট ইমিডিয়েট নির্ঘণ্টের যে বয়ান শুনলাম, জনৈক করিতকর্মা ব্যক্তির কাছ থেকে, তার থেকে আমার মনে হল, উভয় বাঙলার যেসব সাহিত্যিক, শব্দতাত্ত্বিক পরিভাষা নিয়ে কিঞ্চিৎ চিন্তা করেছেন তাদের প্রত্যেকের কুইন্টপ্লেট থাকলেও মোটামুটি চলনসই কিন্তু অতি অবশ্য দেশ শাসনের সর্ব শাখা-প্রশাখা পরিব্যাপ্ত পরিভাষা নির্মাণ শেষ হবে না। এবং যেটুকু হবে, তাতেও থাকবে প্রচুর অসম্পূর্ণতা, বিস্তর অনূদিত ইংরেজি লাতিন শব্দ পুব বাঙলার শস্যশ্যামল দেশে সঙ্গিনের মতো খোঁচা খোঁচা খাড়া দাঁড়িয়ে স্পর্শকাতরা শ্রদ্ধেয়া উমা চট্টোপাধ্যায়ের মতো একাধিক নর-নারীকে পীড়া দেবে, যদিও তারা প্রধানত সাহিত্যেই এ অনাচারে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কিন্তু উপায় কী? একমাত্র আশা ওই অসম্পূর্ণ দুর্বল পরিভাষা দিয়েই কোনও গতিকে কাজ চালিয়ে যাবে।
বারান্তরে সমস্যাগুলো নিয়ে আরও আলোচনা করার আশা রাখি।
Leave a Reply