উপন্যাস সমগ্র ১ – শৈলেন ঘোষ
উৎসর্গ – আমার ছোট্ট বন্ধুদের
আমার কথা
ভাবতে ভালো লাগছে, আধুনিক প্রকাশনা জগতের একটি বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান পারুল প্রকাশনী আমার সমগ্র শিশু সাহিত্যসম্ভার গ্রন্থিত করার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। তাঁরা। কিছুকাল আগে আমার উপন্যাস, নাটক, অগ্রন্থিত ছোটোগল্প এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রবন্ধগুলি খন্ডে খন্ডে প্রকাশ করার আগ্রহ দেখান। আমিও সানন্দে সম্মতি দিই। এবং তারই ফলশ্রুতি আমার উপন্যাস সমগ্র এই প্রথম খন্ডটি।
সাম্প্রতিকালে বাংলা সাহিত্য-পুস্তক মুদ্রণে এবং শোভন-সজ্জায় অনেক প্রকাশকের যত্নের যথেষ্ট পরিচয় দেখতে পাই আমরা। নিষ্ক্রিয়ায় বলা যায়, পুস্তক-প্রকাশনার কাজে এখন আমরা আন্তর্জাতিক মানের যোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছি। পারুল প্রকাশনী এমনি মর্যাদাসম্পূর্ণ একটি প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে তাদের অনেক গুলি গ্রন্থবিষয়ে এবং গঠন-সৌকর্যে বিদগ্ধজনের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে। আশা করা যায়, আমার এই উপন্যাস সমগ্রও সকলের গ্রহণযোগ্য হবে।
আসলে, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ইস্কুলের পাঠ্যসূচির চাপে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আকর্ষণে ছোটোদের জন্য রচিত অনেক সুলিখিত সাহিত্য অপঠিতই থেকে যাচ্ছে। পাঠ্যসূচির চাপ এতই নির্মম যে, অভিভাবকরাও বিভ্রান্ত। একটি সুপাঠ্য সাহিত্য-পুস্তিকা ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দিয়ে সাহিত্য পড়ার উতসাহ জোগাতেও তাঁরা দ্বিধান্বিত। অথচ সুসাহিত্যে আনন্দ-পাঠ ছোটোদের মনোবিকাশের যে কত বড়ো বন্ধু, তার হাজার উদাহরণ আমরা পেয়ে যাই ছোটোদের মন নিয়ে গবেষনা করেন, এমন একাধিক বিদ্বজ্জনের মারফতে। সাহিত্য পাঠে ছোটোদের মেধা যে বাড়ে, এ বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত। মেধা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্মৃতি পুষ্ট হয় এবং বিচারবোধও। সুতরাং তাদের সাহিত্য পড়ায় উতসাহ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সকল সুযোগ-সুবিধা করে দেওয়া হবে আমাদের একটি অবশ্যই কর্তব্য কাজ। ফলে, দেখা যাবে তাদের মনের দৃষ্টি প্রসারিত হচ্ছে। দেখা যাবে, ধীরে ধীরে, বড়ো হওয়ার সঙ্গে সুচারু হচ্ছে তাদের জীবন। ইস্কুলের পাঠ্যসুচির ভারটা তাদের কাছে তখন আর চাপ নয়, ভালোবাসার বিষয়। এই প্রসঙ্গে আর একটি প্রয়োজনীয় কথা মনে রাখতে পারি আমরা, যারা এখনও পড়তে শেখেনি তাদের নিয়মিত ভাবে গল্প পড়ে শোনালে অথবা গল্প বলে শোনালেও শিশুকাল থেকেই সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ গড়ে উঠবে। আখেরে, সেটি তাদের ভবিষ্যৎ জীবন গঠনে সহায়ক রূপে প্রতিভাত হয়ে উঠতে পরে।
তবে, একথাও সত্যি যে, ছোটোদের একটা বেশ বড়ো অংশ মাতৃভাষাটাও ভোলার মুখে। বিস্ময়ের বিষয়, বাংলা গদ্যপাঠে অক্ষমতা প্রকাশ করতে তাদের দ্বিধা নেই। মুখে তাদের এমনও বলতে শুনি, বাংলা ভাষা ভারি কঠিন। পড়তে মন চায় না। বাংলা কঠিন ভাষা এই উক্তিটির সঙ্গে, আশ্চর্য, অনেক অভিভাবকও সহমত পোষণ করেন! এ যে কী দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি, ভাবলে শিহরণ জাগে। ছোটোদের জীবন গড়ার লক্ষ্যে মাতৃভাষাকে অবহেলা করার প্রবৃত্তি, বেঠিক চিন্তার ভয়ঙ্কর নজির এবং দুঃখের তো বটেই।
এই প্রেক্ষিতে, আমাদের ছাত্র জীবনের কথা মনে পড়ে যায়। আমাদের মাতৃভূমি ছিল তখন ব্রিটিশের অধীন। বিজ্ঞান তখনও আজকের এই উন্নত চেহারাই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেনি আমাদের পড়াশোনার ভারও তখন সহ্যের সীমা ছাড়ায়নি। ফলে, বলা যাবে না। আদর্শ-শিক্ষার অভাব ঘটেছিল। বলতে গেলে, পরাধীন ভারতের যে-মাপের শিক্ষকের সান্নিধ্যে আমরা এসেছি, সে ছিল আমাদের পরম সৌভাগ্য। তাঁদের সেই মমতা, স্নেহ এবং সঙ্গে আদর্শের প্রেরণা সে যে ভোলার নয়। অথচ আজকের সংবাদে প্রায়ই দেখি শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকের নির্মম ব্যবহারের নানান অভিযোগ। শিক্ষকদের স্নেহের ছায়ায় আমাদের যেমন খেলাধুলোর হাতেখড়ি হয়েছে, আনন্দের আসরে যেমন মুক্তির স্বাদ। পেয়েছি, তেমনি সাহিত্যের প্রতিও ভালোবাসা নিবিড় হয়েছে তাদের উতসাহ-সঞ্চারে। ইস্কুল ম্যাগাজিনের লেখা শুরু ক্লাসের বন্ধুরা মিলে হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ। পত্রিকার আশির্বাণী সংগ্রহের জন্য কাজি নজরুল ইসলাম, দক্ষিনারঞ্জন মিত্রমজুমদার, প্রেমেন্দ্রমিত্র, সুনির্মল বসু প্রমুখের দ্বারস্থ হওয়া এবং আমার লেখা নাটক সকল বন্ধু মিলে অভিনয় করার উতসাহ, সবই তো শিক্ষকদের প্রেরণার ফসল।
সেই প্রেরণার শক্তিতে বলীয়ান হয়েই আমি রচনা করতে পেরেছি ‘অরুন-বরুণ কিরণমালা’ নাটকটি। যেটি ১৯৬৩ সালে আকাঁদেমি পুরুষ্কারে ভূষিত হয়। রচনা করতে পেরেছি ‘মিতুল নামে পুতুলটি’। যেটি জাতীয় পুরষ্কার পেল ১৯৬৮ সালে।
ইস্কুল ম্যাগাজিনের বাইরে, ছাপা অক্ষরে, আমার প্রথম প্রকাশিত একটি কবিতা, অধুনালুপ্ত ছোটোদের একটি বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা ‘মাসপয়লা’য়। পরবর্তীকালে ‘মৌমাছি’ পরিচালিত আনন্দবাজার পত্রিকার ‘আনন্দমেলা’ বিভাগের আমার একটি গল্প প্রকাশিত হয়: ‘মা’। মৌমাছি, ছদ্মনামধারী এই মানুষটি আমার সাহিত্যজীবন গড়ার কাজে প্রভূত প্রেরণা দিয়েছেন। এই উপন্যাস সমগ্র ‘টুইটুই’ নামে প্রথম যে উপন্যাসটি মুদ্রিত হয়েছে, সেটি রচিত হয়েছে তাঁরই উতসাহদানে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক রূপে আনন্দমেলায়। প্রকাশিতও হয়েছিল ১৯৬২ সালে। সাপ্তাহিক আনন্দমেলায় আমার যেমন নিয়মিত গল্প প্রকাশিত হয়েছে, তেমনই আনন্দবাজার পত্রিকার পূজাবার্ষিকী ও দোল সংখ্যায় সংযোজিত মোলাপাতার ‘আনন্দমেলা’য় প্রায় প্রতি বছর আমার গল্প লেখার সুযোগ ঘটেছে। অধুনা ‘আনন্দমেলা’ যখন বই আকারে প্রকাশিত হলো, তখনই তার পূজাবার্ষিকীতে নিয়মিত ভাবে উপন্যাস লেখার সুযোগ ঘটল।
এক্ষেত্রে আরও দুটি মানুষের কথা উল্লেখ করতে হয়। একজন হলেন একটি বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংগঠক শ্ৰীবাদল বসু এবং অন্যজন বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক শ্রী নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। উভয়েই অফুরন্ত উতসাহে আমাকে উদ্দীপিত করেছেন। ‘মৌমাছি’র অবসরের পর আনন্দমেলার প্রভূত পরিবর্তন দেখা গেল। শ্রী নীরেন্দ্রনাথ। চক্রবর্তীর উপর সম্পাদনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁর সময়ে আমার নিয়মিত গল্প লেখা সুযোগ যেমন ঘটলো ‘আনন্দমেলা’য়, তেমনই সুযোগ ঘটলো নাটক লেখার। সেই সঙ্গে প্রতি বছর পূজাবার্ষিক ‘আনন্দমেলা’য় প্রকাশ হতে থাকল আমার উপন্যাস। সেই উপন্যাসের কোনোটি রূপকথার অনুরূপ, এবার কোনোটি রূপকথাধর্মী বাস্তব জীবনের অ্যা। ডভেঞ্চার। রূপকথার রূপ পরিবর্তনের সে আমার মৌলিক সৃষ্টির পরীক্ষামূলক প্রয়াস। পারুল প্রকাশিত আমার এই উপন্যাস সমগ্রের প্রতি খন্ড ক্রমানুসারে মুদ্রিত হবে। আশা করা যায়, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং গ্রন্থাগারের সহযোগিতায় এই উপন্যাস সমগ্র। ছোটো-বড়ো সকলের মনের সঙ্গী হয়ে উঠবে। সারা জীবন এই সাধনার ব্রতী থেকে এর বেশি আমি আর কী আশা করতে পারি। ধন্যবাদ পারুল প্রকাশনীর কর্ণধার গৌরদাস সাহাকে। ভালোবাসা দুই নবীন বন্ধু শুভঙ্কর আর ময়ূখকে।
–শৈলেন ঘোষ
Leave a Reply