উত্তরসুরি – ওয়েস্টার্ন সিরিজ / সেবা প্রকাশনী / প্রথম প্রকাশ: ২০০৮
এক
রুক্ষ ট্রেইল ধরে হেলে-দুলে এগিয়ে চলেছে ওয়্যাগনের সারি। ধীর গতির, বিরক্তিকর, একঘেয়ে যাত্রা। ওপরে সুনীল আকাশ, কিন্তু তপ্ত হলকা ছড়াচ্ছে সূর্য। চারপাশে যতদূর দৃষ্টি যায়, শুধু ধু-ধু প্রান্তর চোখে পড়ছে, যার বুক চিরে এঁকেবেঁকে চলে গেছে ট্রেইল। দূরে, বহুদূরে দিগন্তের সীমানায় চোখে পড়ছে খাঁজকাটা পাহাড়ের অস্পষ্ট অবয়ব; কিন্তু মাঝখানে ঢেউ খেলানো জমির বুকে জেগে থাকা বন্ধুর প্রকৃতির পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা রহস্য আর অনিশ্চয়তার কারণে মনে হচ্ছে পথটুকু যেন অসীম এবং দুরতিক্রম্য।
বারো দিন আগে কাউন্সিল ব্লাফ থেকে যাত্রা শুরু করেছিল দলটা। সেই থেকে টানা চলছে। খাঁজকাটা ওই পাহাড় ওদের আপাত গন্তব্য। এরপর, পাহাড় পেরিয়ে সল্ট লেক মরুভূমি পাড়ি দিয়ে পৌঁছবে ক্যালিফোর্নিয়ায়। বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে প্রতিটি দিন পার করছে মানুষগুলো- বসতি গড়বে, সোনালী ভবিষ্যৎ গড়বে।
পুব থেকে আসা কিছু ভাগ্যান্বেষী ওরা। পশ্চিমে নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে চাইছে—নতুন পরিবেশে, নতুন আঙ্গিকে
টানা দু’দিন ধরে রুক্ষ ট্রেইল পাড়ি দিচ্ছে ওরা। ধুলোর আস্তর জমেছে ওয়্যাগনের পর্দা আর ছাউনির ওপর। যাত্রীরা প্রত্যেকে কম-বেশি ক্লান্ত। শরীর এবং কাপড়ে ধুলোর ছাপ পড়েছে সবার। ওয়্যাগনের খচ্চর বা ঘোড়াগুলোও পা ফেলছে ধীর গতিতে।
ওয়্যাগন সারি থেকে কিছুটা দূরে দুলকি চালে ঘোড়া ছোটাচ্ছে এড ক্রেমার। ওর মতই আলাদা ভাবে স্যাডলে রাইড করছে আরও কয়েকজন, তবে প্রত্যেকেই ওয়্যাগনের কাছাকাছি থাকছে।
স্টীল-ডাস্ট স্ট্যালিয়নের রাশ টানল ক্রেমার, স্যাডলে বসেই ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল। ষোলোটা ওয়্যাগন, দীর্ঘ এক লাইনে শ্লথ গতিতে এগিয়ে আসছে। পশুগুলোর মতই ক্লান্ত, এবং দমের ঘাটতি পড়েছে মানুষগুলোর মধ্যে। আদৌ ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত পৌছতে পারবে এদের ক’জন, কে জানে! কারণ পশ্চিমের রুক্ষতার সঙ্গে পরিচয় নেই কারও। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে বাস করেছে এতদিন, এখন ভাগ্যান্বেষণে পরিবার আর শেষ সম্বল নিয়ে পাড়ি জমিয়েছে অনিশ্চিত পথে।
একমাত্র ব্যতিক্রম ও নিজে। এখানেই জন্ম, এখানেই মানুষ হয়েছে। তাই পশ্চিমের ধাত জানা আছে ওর। রুক্ষ ট্রেইলে ট্রেইলে কেটেছে জীবনের বেশিরভাগ সময়, আয়ত্ত করেছে সহিষ্ণুতা, ধৈর্য আর দৃঢ় মনোবল। অভিযাত্রীদের মত ক্লান্তি সহজে কাবু করতে পারে না ওকে, অভ্যস্ত বলে নিরুদ্যম বা অবসাদগ্রস্তও হয় না।
অন্যদের সঙ্গে আরও একটা পার্থক্য আছে ওর। এড জানে সামনে কী আছে, শেষপর্যন্ত কোথায় যাচ্ছে। অথচ এরা কেউই তা জানে না। জানে না অনিশ্চিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
বিকেল পর্যন্ত ক্লান্তির চরমে পৌছে গেল লোকগুলো। সকাল থেকে যাত্রা করার পর এ যাবৎ বারো মাইল এগিয়েছে, রুক্ষ ট্রেইলের কারণে শ্লথ হয়ে পড়েছে গতি। থামবে এরা, জানে এড। অনভ্যস্ত শরীর হাঁপিয়ে উঠেছে। কারও চেহারা না দেখলেও জানে এরা প্রত্যেকে ভয়ানক ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত এবং ক্ষুধার্ত। বিশ্রাম এবং খাবারই আবার চাঙা করে তুলতে পারে ওদের, আরও এমন কষ্টকর একটা দিন চলার উদ্যম যোগাতে পারে।
তবুও থামার লক্ষণ নেই। সোনালী ভবিষ্যতের কল্পনায় বিভোর মানুষ থামতে জানে না। পথচলায় শ্রান্তি থাকে না তাদের, ক্লান্তি ভুলে যায়; কোন ট্রেইলই অসীম দূরত্বের কিংবা কোন পাহাড়ের বাধাই দুরতিক্রম্য মনে হয় না। থাকে শুধু গন্তব্যে পৌঁছার মানসিক তাড়না। শারীরিক কষ্টও উপেক্ষা করতে শিখে ফেলে মানুষ।
এভাবেই রুক্ষ পশ্চিম আবাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। একটু একটু করে অচেনা জায়গায় বসতি করছে মানুষ। শহর তৈরি করছে, খামার করছে, সোনালী ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করছে। সবকিছুর মূলে আসলে শ্রম এবং নিষ্ঠা।
কিন্তু সবার স্বপ্ন পূরণ হয় না। অতিরিক্ত প্রত্যাশা আর বাস্তবতার হেরফেরে গোলমাল হয়ে যায়। লোভ, বিদ্বেষ ও ঈর্ষার শিকার হয় মানুষ। স্বপ্ন তখন ধূলিসাৎ হয়ে যায়, অশান্তি এবং অসন্তোষ থেকে সৃষ্টি হয় শত্রুতার।
পশ্চিমের মানুষ বলেই সম্ভাবনাকে যুক্তি দিয়ে বিচার করে এড ক্রেমার। প্রত্যাশা সব মানুষেরই থাকে, একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত থাকাই বাঞ্ছনীয়; সেটা পূরণ না হলে আশাভঙ্গের বেদনা মনকে পঙ্গু করে ফেলে। ওয়্যাগনযাত্রীদের সঙ্গে এখানেই ওর পার্থক্য।
এদের সঙ্গে ভিড়ে যাওয়ার কারণ শুধু কৃতজ্ঞতা বলা যাবে না। কিছুটা হলেও দায়িত্ব বোধ করছে ও। পশ্চিমের রুক্ষ জীবনে অভ্যস্ত এমন কেউ নেই দলে। জানে না এখানকার জীবন কত কঠিন, পদে পদে বিপদের সম্ভাবনা। ঠেকায় পড়ে আঁচ করতে পারছে এখন। সেজন্যেই চাইছে দলের সঙ্গে থাকুক এড। নিজের স্বার্থ সম্পর্কে ষোলোআনা সচেতন এরা।
এদের সঙ্গে থাকার আরও একটা কারণ আছে ওর ডরোথি হেডলিন। শেষ দিকের একটা ওয়্যাগনের আসনে বসে আছে মেয়েটি। ধুলোর অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি সেও। কিন্তু তারপরও উজ্জ্বল লাগছে মেয়েটিকে। রুক্ষ পরিবেশে কিংবা ক্লান্তিকর যাত্রার পরও কীভাবে সৌন্দর্য ধরে রাখে ডরোথি, প্রায়ই ভাবে এড। যাদু বোধহয়। নাকি ওর চোখটাই রঙিন?
পেছনে ওয়্যাগনের ভেতরে শুয়ে আছে টেড হেডলিন ডরোথির বাবা। সকালে কিওয়া ইন্ডিয়ান যোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল গোলাগুলি হয়েছে ওয়্যাগনযাত্রীদের। আহত হয়েছে হেডলিন, ঊরুতে একটা বুলেট ঢুকেছে। তেমন গুরুতর না হলেও অন্তত কিছুদিন ভোগাবে। জ্বরে আক্রান্ত সে এখন, ওয়্যাগন চালানোর দায়িত্ব তাই ডরোথিকে নিতে হয়েছে।
সবার সামনের ওয়্যাগনটা হিউ টেলরের। সে-ই দলনেতা। মাঝবয়সী পোড়-খাওয়া মানুষ, তবে পুবের জীবনে পোড়-খাওয়া। পশ্চিমের রুক্ষ জীবনে অন্যদের মতই অনভ্যস্ত। সাহসী সৎ লোক, কিন্তু তার বিচক্ষণতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে এডের। নিজে ভালমানুষ হলে যা হয়, অল্পতে যে- কাউকে বিশ্বাস করে ফেলে।
ক্ষণিকের জন্যে ওয়্যাগন থামাল টেলর, আসনের ওপর দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে মোড় ঘোরার নির্দেশ দিল অন্যদের। মিনিট কয়েকের মধ্যে ঘুরে গেল যাত্রাপথ। স্পার দাবিয়ে ঘোড়ার গতি বাড়াল এড, টেলরের ওয়্যাগনের পাশে চলে এল। ধুলোয় প্রায় সাদা হয়ে গেছে হিউ টেলরের দাড়ি-গোঁফ। এডকে দেখতে পেয়ে স্মিত হাসি ফুটল ঠোঁটে। লোকটার এই আরেক গুণ, অল্পতে সন্তুষ্ট হতে জানে এবং সারাক্ষণ হাসি মুখে থাকতে পারে।
‘মনে মনে তোমাকেই খুঁজছিলাম, এড,’ আন্তরিক স্বরে বলল সে। ‘খাবারের স্টক কিন্তু প্রায় ফুরিয়ে গেছে। কিছু একটা শিকার করতে না পারলে বিপদে পড়ব। তুমি যদি চেষ্টা করো…আমাদের মধ্যে তুমিই সেরা শিকারী….
‘ঠিক আছে, দেখি কী করা যায়, সামান্য কাঁধ ঝাঁকাল ও, টেলরকে কথা শেষ করতে দিল না। ‘আগে হেডলিনের ওয়্যাগনের ওদিক থেকে ঘুরে আসি।’
চড় কষেছে যেন এড, মুহূর্তে মলিন হয়ে গেল টেলরের মুখ। ‘একটা কথা না বলে পারছি না, এড, ডরোথির সঙ্গে তোমার গায়ে-পড়া ভাব পছন্দ হচ্ছে না আমার, প্রায় কর্কশ স্বরে বলল সে। ‘তোমার জায়গায় থাকলে মেয়েটার সঙ্গে মিশতাম না আমি। বিপদে পড়ে পশ্চিমে এসেছে বটে, কিন্তু উঁচু ঘরের শিক্ষিত মেয়ে। ভদ্র এবং সুন্দরী। কিছু মনে কোরো না, আসলে ওর উপযুক্ত নও তুমি। স্বীকার করছি, আমাদের অনেক উপকার করেছ। সত্যি কথা বলতে কি, তুমি না থাকলে আরও খারাপ হত অবস্থা। সেজন্যে সবাই কৃতজ্ঞ আমরা। কিন্তু ডরোথির ব্যাপারটা আলাদা। টেড অসুস্থ, তোমাকে সময় দিতে পারবে না।’
‘হেডলিনের খবর…’
‘অসুস্থ কোন লোকই অন্য কাউকে সময় দিতে পারে না।’
বিরক্ত হলেও নিজেকে সামলে নিল এড, নিরানন্দ চেহারায় হাসল ও। ‘দুনিয়ায় উপদেশই সবচেয়ে সস্তা জিনিস, কিন্তু তাও মুফতে নিচ্ছি না আমি ধন্যবাদ তোমাকে। নিশ্চই টেড এ ব্যাপারে বলেনি তোমাকে, নাকি ডরোথি বলেছে কিছু?’
খোঁচা খেয়ে ত্যক্ত হিউ টেলর, মুখ কঠিন হয়ে গেছে। ‘উঁহু, টেড কিছু বলেনি। ডরোথিও বলেনি। নিজের দায়িত্ব থেকে বলছি, কারণ আমি এই দলের নেতা।’
‘বেশ তো,’ গম্ভীর স্বরে খেই ধরল এড। ‘তাহলে নিজের চরকায় তেল দাও! পুরো ওয়্যাগন ট্রেনের দায়িত্ব নেয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়, কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নেতাদের নাক না গলালেও চলে। হেডলিনরা যে-কোন সময়ে আমাকে চলে যেতে বলতে পারে, হয়তো চলেও যাব, কিন্তু এটা ওদের নিজস্ব ব্যাপার।
অপ্রিয় সত্য শুনতে কারও ভাল লাগে না। হিউ টেলর আত্মবিশ্বাসী, অহঙ্কারী মানুষ। নিজের ব্যাপারে সচেতন। সূক্ষ্ম রাগ ফুটে উঠল চোখে, গাল লালচে হয়ে গেল, সেটা যে তপ্ত রোদের কারণে নয়, নিশ্চিত। ‘কথাগুলো বলতে তুমিই বাধ্য করছ, এড! নিজেকে কী মনে করো তুমি? আমার বিচারে তুমি স্রেফ একটা খুনী! তোমার সঙ্গে ডরোথির মত ভদ্র মেয়ের কোন সম্পর্কই থাকা উচিত নয়! তোমার মত নয় ও!’
‘ইন্ডিয়ানদের খুন করার কারণে বলছ তো? যদ্দূর মনে পড়ছে এ ব্যাপারে তুমিও কম যাওনি। অন্তত দু’জনকে মেরেছ।’
ইন্ডিয়ানরা আক্রমণ করার সময় এড ছিল পাশে, ও না থাকলে সত্যিই বিপদে পড়ত দলটা, ঠেকানো যেত না রেডস্কিনদের; পরোক্ষ ভাবে সেটাই মনে করিয়ে দিয়েছে এড। বুঝতে পেরে অস্বস্তি বোধ করল হিউ টেলর। বেয়াড়া এই যুবককে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না। ‘ইন্ডিয়ানদের কথা বলিনি আমি,’ স্রেফ তর্কের খাতিরে খেই ধরল ও। ‘ভুল বুঝো না আমাকে! স্বীকার করছি ইন্ডিয়ান হামলার সময় সাহায্য করেছ আমাদের। তুমি না থাকলে আদৌ ওদের তাড়িয়ে দিতে পারতাম কিনা সন্দেহ আছে আমার কিন্তু ইন্ডিয়ান মারা এক কথা আর সাদা চামড়ার মানুষ খুন করা আরেক কথা!’
‘চামড়া সাদা হলে মানুষ আর কালো বা রোদপোড়া হলে জানোয়ার, তাই না? বেশ তো, তুমি তোমার অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে থাকো। খুব বেশিদিন লাগবে না ধারণাটা পাল্টাতে। না বলে পারছি না,’ একটু আগে টেলরের সুর নকল করে বিদ্রূপ করল এড। ‘তোমার দাড়ি পেকেছে ঠিকই, হিউ, বুদ্ধি পাকেনি। পশ্চিমে নতুন এসেছ তো, তাই জানো না। কিন্তু শিগগিরই জেনে যাবে যে সাদা চামড়ার কিছু লোকও আছে যাদের দেখামাত্র খুন করা উচিত। তখন যেন আফসোস করতে না হয় সেই প্রার্থনা করো। ভেবে বলো তো, সকালে যে ইন্ডিয়ান হামলা হলো, এর পেছনে সাদা চামড়ার কোন লোক কি থাকতে পারে না?’
‘কী বলতে চাইছ?’ থমথমে মুখে জানতে চাইল টেলর।
‘এই ট্রেইলে না আসার জন্যে বলেছিলাম তোমাদের। অথচ আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছ। স্যাম ল্যামসন বলল: না, এদিকে কোন ইন্ডিয়ানের ভয় নেই। ওর কথাই শুনলে। অথচ আমার অনুমান সত্যি হলো। স্রেফ ল্যামসনের কথা শুনে বিপদে পড়লে তোমরা। সেজন্যে শুধু ল্যামসনকে দায়ী কোরো না আবার, নিজেদের দোষটাও খুঁজে দেখো-বোকা নও তোমরা, অথচ বোকা সেজে আছ সবাই!’
অভিযাত্রীদের দু’জন-প্যাট গ্যাভিন আর মাটি থ্যাচার এগিয়ে এল ওদের দিকে। এডের কথাগুলো শুনতে পেয়েছে ওরা, অন্তত শেষ কথাগুলো কান এড়ায়নি। মুহূর্তের মধ্যে রেগে উঠল রগচটা স্বভাবের মাটি থ্যাচার। ‘পুরানো কাসুন্দি ঘাঁটাঘাঁটি করছ আবার?’ স্পষ্ট বিদ্বেষ প্রকাশ পেল তার কণ্ঠে। ‘ল্যামসন কী ক্ষতি করেছে তোমার, বলো তো? আমাদের এত উপকার করল অথচ সারাক্ষণ ওর পেছনে লেগে আছ তুমি! ল্যামসন বলেছে এই ট্রেইল ভাল, শুরু থেকে নিশ্চিন্তে এগোতে পারছি আমরা। পাহাড়ী এলাকা পেরুতে হয়নি, এবং কাউন্সিল ব্লাফ থেকে যাত্রা করার পর, ছয় দিন কোন ঝামেলা ছাড়াই কেটে গেছে। পানি বা ঘাসের অভাব হয়নি, ট্রেইলও সমতল ছিল। এখন পথটা একটু রুক্ষ, এই যা। আর ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে সকালের ছোটখাট লড়াইটা বাদ দিলে কী এমন ঝামেলায় পড়েছি আমরা? আমার তো মনে হয়, ভালই আছি।’ ক্ষণিকের জন্যে থামল সে, মনে মনে বোধহয় স্যাম ল্যামসনের পক্ষে আর কী বলা যায় ভেবে নিল। ‘এই ট্রেইল বা ল্যামসনের সমালোচনা শুনতে শুনতে বিরক্তি ধরে গেছে আমার! অথচ ওর মত লোকই হয় না। হাসি-খুশি মানুষ, না চাইতেই ওর সাহায্য পাচ্ছে যে-কেউ। আমার কথাই চিন্তা করো না! স্ত্রী অসুস্থ, টাকা নেই হাতে, পর্যাপ্ত সাপ্লাইও ছিল না। অথচ বলার আগেই আমাকে ধার দিয়ে দিল।’
হয়তো আরও কিছু বলার ইচ্ছে ছিল থ্যাচারের, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল এড। ‘তোমার সঙ্গে কথা বলছি না আমি, এবং তোমার বলার ভঙ্গিটাও পছন্দ হচ্ছে না আমার। ল্যামসনের কাছে ধার করেছ, এ সম্পর্কে আমার ধারণাটা এবার শুনে নাও-নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, সময় হলে সুদাসলে ঠিকই টাকা আদায় করে নেবে সে।’
‘বেশ তো! মুফতে কারও কাছ থেকে কিছু নিই না আমি,’ সমান তেজে জবাব দিল থ্যাচার। ‘কিন্তু ভেবে দেখেছ, এসব বলার অধিকার তোমার আছে কিনা? স্রেফ একজন খুনী তুমি, অথচ জ্ঞান দিতে চাইছ আমাদের!’
তর্কটা কতদূর গড়াত, বলা মুশকিল। হিউ টেলরের জন্যেই বেশিদূর এগোল না। কর্কশ, কঠিন সুরে বাধা দিল সে। ‘বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, মার্টি। নিজেদের মধ্যে গোলমাল চাই না আমি। শত হলেও, আমাদের উপকার করেছে এড। ইন্ডিয়ান হামলার সময় ও না থাকলে সত্যিই বিপদে পড়ে যেতাম। কথাটা মনে রেখো, মার্টি। স্যাম ল্যামসনের ব্যাপারে সবার যে একই মত থাকবে, তাও ঠিক নয়। প্রত্যেকেরই নিজস্ব মত বা দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে, এবং সেটা প্রকাশ করারও অধিকার আছে সবার।’
থ্যাচারের উত্তর শোনার অপেক্ষায় থাকল না এড ক্রেমার। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে পাহাড়ের দিকে সরে এল ও। যুগপৎ বিরক্তি আর রাগ অনুভব করছে, নিজেরই ওপর। কী দরকার ছিল এদের সঙ্গে আসার? মতের মিল নেই, সমঝোতা বা পারস্পরিক সহানুভূতিও নেই। যেচে কাউকে পরামর্শ দেয়া আসলে নির্বুদ্ধিতা-এদের ক্ষেত্রে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে এড। কেউ পছন্দ করে না ওকে, দরকার ছাড়া কথাও বলে না; ওয়্যাগন ট্রেনের সদস্য বলা যাবে না ওকে। কিন্তু ঠিক ইচ্ছে করে এদের সঙ্গী হয়নি সে, পরিস্থিতির দাবিতে ব্যাপারটা ঘটেছে।
এল পাসো থেকে মাইল দশেক দূরে ছোট্ট একটা শহরে ওর সঙ্গে দেখা হয় দলটার। ও তখন ট্রেইলের পাশে পড়ে আছে, প্রায় মুমূর্ষু। ঘোড়াটা ক্লান্ত পর্যুদস্ত। ডরোথি হেডলিন নিজের ওয়্যাগনে তুলে নিয়েছিল ওকে। যেখানে এখন শুয়ে আছে টেড, কয়েকটা দিন সেখানেই কেটেছে এডের।
কীভাবে আহত হয়েছে, এ সম্পর্কে কিছুই বলেনি ও; আসলে প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলেনি তেমন। গম্ভীর নিঃসঙ্গ মানুষ সে, বাকপটু কিংবা মিষ্টভাষীও নয়। বেশিরভাগ সময় নীরবে মেয়েটিকে দেখত, আনমনে ডরোথির সৌন্দর্য আর আন্তরিকতা নিয়ে ভারত; কিন্তু মুখে কিছুই প্রকাশ করত না। সুস্থ হতে বেশি সময় লাগেনি, সেজন্যে ডরোথি হেডলিনের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই।
স্বাভাবিক ভাবেই দলটার প্রতি দায় অনুভব করল এড। শিকার বা আগুন জ্বালানোর সময় সাহায্য করা, আগে আগে গিয়ে ট্রেইল রেকি করা কিংবা যে-কোন কাজে কারও সাহায্য লাগলে এগিয়ে গেছে ও। পুরো দলের প্রতি এভাবেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চেয়েছে।
অথচ সাধারণত গায়ে পড়ে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে দারুণ অনিচ্ছুক ও। আবার এও ঠিক, একবার সম্পর্ক হয়ে গেলে, ভাঙা তো দূরের কথা সেটাকে অস্বীকারও করে না। তারপরও অভিযাত্রী দলটার সঙ্গে একাত্মতা গড়ে উঠছিল, শীতল অস্বস্তিকর সম্পর্ক ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল। দু’বার ডরোথি হেডলিনের সঙ্গে একান্তে কথাও বলেছে-হেডলিনদের ওয়্যাগনের পাশাপাশি রাইড করেছে কিছুক্ষণ, নিজের নিঃসঙ্গ জীবন আর বুনো পশ্চিমের গল্প করেছে এড। ঠিক তখনই এক রাতে উল্টে গেল পরিস্থিতি
ফোর্ট লারামির কাছাকাছি ক্যাম্প করেছিল ওরা। সন্ধে পেরিয়েছে তখন, আগুনের চারপাশ ঘিরে সাপার করছিল সবাই। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর গরম খাবারের সুগন্ধ আর চারিদিকে সুনসান প্রকৃতির নৈঃশব্দ্য উপভোগ করছিল, তখনই ক্যাম্পে উপস্থিত হলো দীর্ঘদেহী সুদর্শন এক লোক।
কালো একটা মেয়ারে চেপেছিল সে। চওড়া ব্রিমের হ্যাটের তলায় উঁকি দিচ্ছিল দীর্ঘ কালো চুল, ঘাড়তক নেমে গেছে। সরু গোঁফ নেমে এসেছে চিবুক পর্যন্ত। পরনে কালো সুট, দামী চকচকে বুটে গোঁজা ছিল সুতী ট্রাউজারের প্রান্ত। স্যাম ল্যামসনের বাহ্যিক চেহারায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল আত্মবিশ্বাসী, সচ্ছল এবং সমীহ কাড়ার মত একজন মানুষ সে।
স্যাডল ছেড়ে স্বতঃস্ফূর্ত পদক্ষেপে আগুনের দিকে এগিয়ে এল সে। ‘হাউডি, বন্ধুরা!’ নির্মল হাসিতে শুভেচ্ছা জানিয়েছে সবাইকে, আচরণ আর ভাবভঙ্গিতে যে-কারও চেয়ে শ্রেয়তর প্রমাণ করেছে নিজেকে। মাত্র দুটো শব্দে সবার মন জয় করে নিল, যে-কাজটা দুই সপ্তাহেও করতে পারেনি এড ক্রেমার। সেই মুহূর্ত থেকে ওদের একজন হয়ে গেল ল্যামসন।
‘ক্যালিফোর্নিয়া যাচ্ছ তোমরা?’ নিছক ভদ্রতাবশত জানতে চাইল সে। ‘ব্যাপারটা ওরকমই,’ জবাব দিয়েছে হিউ টেলর। ‘নির্দিষ্ট কোন জায়গা ঠিক করিনি আমরা, তবে ওদিকেই যাচ্ছি। আসলে বুঝতে পারছি না পাহাড় পেরুনোর আগে কোথাও থামব, নাকি মোড় ঘুরে উত্তরে অরিগনের দিকে যাব।’
‘কিন্তু এরচেয়েও ঢের ভাল জায়গা আছে,’ সহজ সুরে বলেছে ল্যামসন। ‘দক্ষিণে যেতে পারো তোমরা। ট্রেইলটাও চমৎকার বিশেষ করে, মেয়েরা যেহেতু সঙ্গে আছে, ঝামেলা পোহাতে হবে কম। আড়চোখে ডরোথি হেডলিনকে দেখল সে, সপ্রশংস চাহনি ফুটে উঠল দৃষ্টিতে। ‘পর্যাপ্ত পানি বা ঘাস আছে, ট্রেইলও মোটামুটি সমতল। উঁচু পাহাড় বা চড়াই পেরুতে হবে না।’
উৎসাহী হয়ে উঠল হিউ টেলর। ‘তাই নাকি? এরকম জায়গা আছে নাকি? শুনিনি তো! ট্রেইলটা কেমন, বিস্তারিত বলতে পারবে?’
‘ক্যাপ মূলহল্যান্ড নামে এক লোক আবিষ্কার করেছে ট্রেইলের কিছু অংশ, বাকিটা আমি নিজে আবিষ্কার করেছি। কিছুটা দক্ষিণে সরে যেতে হবে তোমাদের। আশা করি কয়েক মাসের মধ্যে এই ট্রেইল ব্যবহার করতে শুরু করবে সবাই। গেলেই প্রমাণ পেয়ে যাবে সত্যি বলেছি কিনা-এরচেয়ে সহজ এবং নিরাপদ ট্রেইল আর হয় না! সামান্য কিছু জায়গা খারাপ, দুটো দিন হয়তো ধুলোর অত্যাচার সইতে হবে; কিন্তু বাকি অংশে ঘাস বা পানির কোন অভাব নেই। ইন্ডিয়ানদের হামলার ভয়ও নেই, কারণ এখান থেকে উত্তরের ট্রেইলগুলোতেই সচরাচর রেইড করে ওরা।
‘কিন্তু, ক্ষণিকের জন্যে থেমে কী যেন ভাবল সে, পরমুহূর্তে খেই ধরল। ‘যাবে কি যাবে না, সেটা অবশ্যই তোমাদের ব্যাপার। যোগ্য লোক নেতৃত্ব দিচ্ছে তোমাদের। যে-ট্রেইল ধরে যাচ্ছ, নিশ্চয়ই জেনে-শুনে যাচ্ছ-নিদেনপক্ষে কিছু খোঁজখবর নিয়েছ?’
ওয়্যাগনের চাকার সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে নীরবে খাচ্ছিল এড ক্রেমার, চোখ তুলে একবার দেখেছে স্যাম ল্যামসনকে। আগন্তুকের সহজ স্বতঃস্ফূর্ত অকপট পরামর্শে হয়তো যে-কেউ আকৃষ্ট হবে কিংবা উৎসাহ বোধ করবে, কিন্তু এডের মত পোড় খাওয়া মানুষ এ ধরনের মিষ্টি কথায় ভুলল না।
দ্রুত সময় কেটে গেল, টেরই পেল না কেউ। ল্যামসনের মনোমুগ্ধকর বক্তৃতায় মজে গেল পুরুষরা। মেয়েদের উদ্দেশে মিষ্টি হাসি উপহার দিচ্ছে সে। আশ্চর্য দ্রুততায় সবার মন জয় করে নিল। সবচেয়ে সাবধানী কিংবা মোটামুটি হিসেবী লোকগুলোও প্রভাবিত হয়ে পড়ল ল্যামসনের চাটুকারিতায়, ওর প্রস্তাবিত ট্রেইল আর সেটার সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কেউ কেউ ট্রেইলটার কথা অন্যদের চেয়ে আগে জানতে পেরেছে ভেবে সন্তুষ্টিও বোধ করতে শুরু করল।
ভোটাভুটির প্রস্তাব উঠল তখন, তবে সকাল পর্যন্ত মুলতবি রাখা হলো ব্যাপারটা। অভিযাত্রীদের উৎসাহ তাতে এতটুকু কমল না। এতক্ষণ পর্যন্ত নীরব ছিল এড, কিন্তু ভরাডুবি হওয়ার আগেই সরল মানুষগুলোকে নিরুৎসাহিত করতে চাইল। ‘টেলর, যে-ট্রেইল ধরে চলছ তোমরা, সেটা ধরে যাওয়াই বোধহয় ঠিক হবে।’
ঝট করে ওর দিকে ফিরে তাকাল ল্যামসন, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। ‘যে-ট্রেইলটার কথা বলেছি আমি, কখনও ওদিকে গেছ তুমি, বন্ধু?’
‘কিছুটা। কিছু অংশ।
‘তাহলে বলো ওই অংশটা কেমন-ষাঁড় বা ঘোড়ার জন্যে সহজ? অন্য ট্রেইলের চেয়ে খারাপ নাকি ভাল? যথেষ্ট পানি আর ঘাস আছে?’
‘তা আছে। ঘাস বা পানি সবই আছে। কিন্তু তারপরও ওদিকে যাওয়া ঠিক হবে না।
‘এ কেমন কথা! বলছ ট্রেইলটা ভাল, অথচ ওদিকে যাওয়া নাকি ঠিক হবে না?’ অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে অন্যদের দিকে তাকাল ল্যামসন, ক্ষীণ বিদ্রূপের হাসি ঝুলছে ঠোঁটের কোণে। ‘মজার কাণ্ড! ওর কথার কোন মানে হয়? ওই ট্রেইলের শেষপর্যন্ত গেছি আমি, এবং নিশ্চিত বলতে পারি, এরচেয়ে নিরাপদ বা সহজ ট্রেইল খুঁজে পাবে না তোমরা। তাছাড়া, একটা ম্যাপও দিতে পারব তোমাদের-ওঅটর হোল বা পানির উৎস…সবকিছুর অবস্থান বিশদ ভাবে দেখিয়ে দিতে পারব। কি জানো, তোমরা কোন্ ট্রেইল ধরে যাও, তাতে কিছুই যায় আসে না আমার, কিন্তু ইন্ডিয়ানদের এড়াতে চাইলে…’ শ্রাগ করে থেমে গেল সে।
‘বাফেলো হাইডের ব্যাপারে কি জানো তুমি?’
আড়ষ্ট হয়ে গেল স্যাম ল্যামসনের চোয়াল। অপেক্ষাকৃত অন্ধকার জায়গায় বসে থাকা এড ক্রেমারের মুখ নিরীখ করার চেষ্টা করল সে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। ‘বাফেলো হাইড? জানব না কেন! ওর ঘাঁটি তো আরও উত্তরে।’ এডের ওপর দিকে দৃষ্টি সরিয়ে হিউ টেলরের দিকে ফিরল। ‘এই লোক কে? বাফেলো হাইড সম্পর্কে জানতে চাইছে ও, দেখে বিস্মিত হচ্ছি আমি। অথচ সাদা চামড়ার কেউই বাফেলো হাইডের কথা জানে না, যদি না সে আউট-ল বা দস্যু হয়ে থাকে। বুঝতে পারছি না সহজ নিরাপদ ট্রেইল বাদ দিয়ে কেন বিপজ্জনক একটা ট্রেইলে যাওয়ার জন্যে তোমাদের উৎসাহ দিচ্ছে ও! ও কি তোমাদের কেউ?’
মুখিয়ে ছিল মার্টি থ্যাচার। প্রথম দিন থেকেই এড ক্রেমারকে অপছন্দ করছে সে, এবং এডের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এখনও সন্দিহান। ‘উঁহুঁ, আমাদের কেউ নয় ও,’ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল সে। ‘তবে আমাদের সাথেই যাচ্ছে। ওয়্যাগন নেই ওর, আসলে কিছুই নেই…ওই ঘোড়াটা ছাড়া।
‘অ, এই ব্যাপার!’ তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল ল্যামসনের চোখে, এডের প্রভাব কিংবা গুরুত্ব কম বুঝতে পেরে যেন স্বস্তি বোধ করল ভেতরে ভেতরে। ‘কিছু মনে কোরো না, বন্ধু, তোমার নামটা কী? এই ট্রেইলে যাতায়াত করে এমন সব লোককে চিনি আমি, তা ছাড়া কর্নেল মেলবি কয়েকজনের ব্যাপারে আমাকে সতর্ক করে দিয়েছে। যাকগে, বুঝতেই পারছ, সতর্ক থাকতে দোষ নেই। সাদা চামড়ার লোকজনও খারাপ হয়ে গেছে, এদের অনেকেই ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করছে আশপাশে।
‘আমার নাম এড ক্রেমার।’
পরস্পরের ওপর চেপে বসল ল্যামসনের ঠোঁট, কিছুটা হলেও চিন্তিত দেখাল তাকে। মুহূর্তের জন্যে অবশ্য, তারপরই উজ্জ্বল হয়ে গেল চোখ। ‘ক্রেমার? ওহ, মনে পড়েছে! লারামিতে মাসখানেক আগে এক লোককে খুন করেছ তুমি, তাই না?’
‘ওই লোকটাই আগে পিস্তলে হাত দিয়েছিল,’ শুধু এই বলল এড, টের পেল আচমকা স্থবির হয়ে গেছে ক্যাম্পের পরিবেশ, শীতল গাম্ভীর্য নেমে এসেছে সবার মধ্যে। আড়চোখে দেখতে পেল প্রবল বিস্ময় নিয়ে ওকে দেখছে ডরোথি হেডলিন, মেয়েটির চোখে হতাশা।
সবে পুব থেকে এসেছে এরা। কেবল হিউ টেলরেরই পশ্চিমে আসার কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে, তাও প্ল্যাটে নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত এসেছিল। মাত্র একবার। এখানকার জীবনযাত্রার ধরন জানে না ওরা। শান্তিপ্রিয় নিরীহ লোক। খুনোখুনির কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবে না। জানে না নিজের প্রাণ বাঁচাতে অস্ত্র ধরতে হয়, কিংবা আরেকজনের প্রাণও হরণ করতে হয়।
নিজের সাফল্য বা সম্ভাবনা আঁচ করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হলো না স্যাম ল্যামসনের। ‘দুঃখিত, ক্রেমার, প্রসঙ্গটা তোলা বোধহয় ঠিক হয়নি, অন্তত ওদের সামনে,’ আন্তরিক শোনাল তার কণ্ঠ। ‘কিন্তু নিতান্ত বাধ্য হয়ে তুলতে হলো। কেউ যখন কোন কারণ ছাড়াই বিপজ্জনক একটা ট্রেইলে নিরীহ কিছু মানুষকে যাওয়ার উপদেশ দেয়, তখন তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেয়ার প্রয়োজন আছে বৈকি!’
উঠে দাঁড়াল এড। দীর্ঘদেহী মানুষ সে। সরু কোমর, প্রশস্ত কাঁধ। সুঠামদেহী। ফ্ল্যাট-ব্রিমের হ্যাটের ছায়া পড়েছে ওর মুখে, স্থির দৃষ্টিতে দেখছে ল্যামসনকে। ‘আমি এখনও মনে করি তোমার প্রস্তাবিত ট্রেইলে যাওয়া বোকামিই হবে,’ শান্ত নিরাবেগ কণ্ঠে বলল ও। ‘এটা এমন এক অঞ্চল যেখানে ইচ্ছে করলেই এদিক-সেদিক যাওয়া যায় না। দক্ষিণের ট্রেইল ধরে গেলে ড্যান স্পেন্সারের এলাকা পেরিয়ে যেতে হবে। মূলহল্যান্ডের কথা বললে না? ওই লোকই তো দক্ষিণের ট্রেইল ধরে যেতে বলেছিল হ্যামলিনের দলকে।
কথা শেষ করে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না এড। অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ওর পদশব্দ। তখনও স্থির বসে আছে অভিযাত্রীরা, টু শব্দ করেনি কেউ। অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এসেছে। এডের শেষ কথায় তাদের সমস্ত উৎসাহ ফিকে হয়ে এসেছে। গল্পটা জানে ওরা। বহুদিন আগের ঘটনা, কিন্তু এখনও ট্রেইলের কিনারে ক্যাম্পে বসে গল্প করে মানুষ, নিজে সতর্ক হওয়ার জন্যে, অন্যকে সতর্ক করার জন্যে। ট্রেইল হারিয়ে পাহাড়ী এলাকায় উপস্থিত হয় মাইক হ্যামলিনের দলটা, তুষারে আটকা পড়ায় দুর্বিষহ অবস্থা নেমে আসে। পানি নেই, খাবার নেই। আশ্রয় নেই। ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর শীতে অসহায় মানুষগুলো সঙ্গীদের খুন করে সেই মাংস খেয়েছে জীবন বাঁচানোর জন্যে।
সেই গল্পের বিভীষিকা অস্বস্তির হালকা চাদরের মত যেন ছেয়ে আছে ক্যাম্পে, নিশ্চুপ অনড় বসে থাকল লোকগুলো। সবার আগে স্যাম ল্যামসনই নীরবতা ভাঙল। ‘মানছি মূলহল্যান্ডের নির্দেশ অনুযায়ী যাত্রা শুরু করেছিল ওরা,’ শ্রাগ করে বলল সে। ‘কিন্তু মূল ট্রেইল থেকে সরে পড়ে ওরা। আমি যে-পথের হদিশ জানি, সেখানে উঁচু পাহাড়ের কোন বালাই নেই। সবার ওপর ঘুরে গেল ওর দৃষ্টি, একটু আগের মতই সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেল ল্যামসন। কথার তুবড়ি ছুটিয়ে নিরীহ মানুষগুলোর দ্বিধা ভুলিয়ে দিল সে, ভয় বা আশঙ্কা দূর করল-মিথ্যে আশা এবং প্রতিশ্রুতি শুনিয়ে, মরুভূমির তপ্ত বালি বা ধুলোর বদলে ঘাস আর পানির কথা শুনিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে হ্যামলিনের দল, কিওয়া চীফ বাফেলো হাইডের দুর্ধর্ষ যোদ্ধাদের কথা বেমালুম ভুলে গেল সবাই।
সকালে, ল্যামসনের নির্দেশিত পথ ধরে এগোল ওয়্যাগন ট্রেন। ফোর্ট ত্যাগ করার ঘণ্টাখানেক পর বামে মোড় নিয়ে দক্ষিণে এগোল। ওয়্যাগন সারি থেকে কিছুটা দূরে ছিল স্যাম ল্যামসন, কেউই খেয়াল করেনি তাকে। চতুর হাসি খেলে গেল তার ঠোঁটে। মনে মনে এদের সাফল্য কামনা করল, ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ফোর্টের পথ ধরল ও। একটা মেসেজ এসেছে ফোর্ট থেকে। হিউ টেলরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে হাতের কাজ শেষ হওয়া মাত্র যাত্রা করবে সে, ঘোড়া ছুটিয়ে ধরে ফেলবে দলটাকে।
দলের সঙ্গেই যাচ্ছে এড ক্রেমার, হেডলিনদের ওয়্যাগনের কাছাকাছি রাইড করছে। চোখ তুলে ওর দিকে তাকাল ডরোথি। আগের রাতে মেয়েটিকে দেখেছে ও, খেয়াল করেছে সপ্রশংস দৃষ্টিতে ল্যামসনকে দেখছিল ডরোথি।
‘ব্যাপারটা অনুমোদন করছ না তুমি, তাই না?’ কাছাকাছি আসতে জানতে চাইল ডরোথি।
মাথা নাড়ল এড। তারপর কিছুটা বিষণ্ন ভঙ্গিতে হাসল। রোদপোড়া চেহারার মোটামুটি সুদর্শন মানুষ সে; সবুজ চোখে সবসময়ই খানিকটা খামখেয়ালিপনা লেগে থাকে। আমার পছন্দ-অপছন্দে কী যায় আসে? তোমাদের কেউ নই আমি।
‘থ্যাচারের বলা উচিত হয়নি কথাটা,’ মন্তব্য করল ডরোথি। ‘অদ্ভুত মানুষ ও। ভাল কিন্তু অকপট এবং সন্দেহপ্রবণ।’
‘সঠিক লোককে সন্দেহ করে না অবশ্য।’
জ্বলে উঠল ডরোথির নীল চোখ। ‘মি. ল্যামসনের কথা বলছ নিশ্চয়ই? ওকে কেন সন্দেহ করব আমরা? সে তো আমাদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছে কেবল!’
‘কিন্তু সন্দেহ আছে আমার।’
‘আমার তো মনে হয়, তীক্ষ্ণ স্বরে বলল ডরোথি। নিজের ওপর এবার সন্দেহ করা উচিত তোমার, মি. ক্রেমার! তুমি নিজেই স্বীকার করেছ যে ট্রেইলটা ভাল!’
‘এখনও ড্যান স্পেন্সারের সঙ্গে দেখা হয়নি তোমাদের। কিংবা বাফেলো হাইডের সঙ্গেও হয়নি।’
‘মি. ল্যামসন বলেছে আরও উত্তরে থাকে ইন্ডিয়ানরা। আচ্ছা, গতরাতেও ড্যান স্পেন্সারের কথা বলেছ। লোকটা কে?’
‘ইন্ডিয়ান এলাকায় বাথান করেছে সে। ও যখন প্রথম এসেছিল ওখানে, সবাই পাগল ভেবেছিল ওকে, কিন্তু বছর ঘোরার আগেই দেখা গেল সত্তর মাইল এলাকা ক্লেইম করেছে স্পেন্সার, ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে কীভাবে যেন। জমিতে গরু-ঘোড়া চরাচ্ছে। ওর রেঞ্জ পেরিয়ে যেতে হবে আমাদের।’
‘তাতে দোষের কী আছে?’
‘শান্তিপূর্ণভাবে যদি জায়গাটা পেরিয়ে যাও, তাহলে হয়তো কিছুই ঘটবে না। কিন্তু স্পেন্সার একটু অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ, কখন ওর মনে কী চিন্তা আসবে আগে থেকে বলা মুশকিল। নিজের এলাকায় অচেনা লোকদের দু’চোখে দেখতে পারে না সে। তোমাদের দেখেই সন্দেহ করবে: কেন এত দক্ষিণে যাচ্ছ। ওকে সন্তুষ্ট করতে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হবে।’
‘হোক না সন্দেহ!’ উত্তেজিত দেখাল ডরোথিকে, গ্রীবা উঁচাল বিদ্রোহী বাচ্চার মত। ‘তার পরোয়া করি না, কিংবা ওকে বিরক্তও করব না আমরা। সে কি মনে করে পুরো দেশটাই ওর একার?’
হু, তাই মনে করে সে এবং তার কারণও আছে। সত্তর মাইল দীর্ঘ জমি, এর প্রতিটি ইঞ্চি ওকে শ্রম আর রক্তের বিনিময়ে অর্জন করতে হয়েছে। আজ যা দেখতে পাবে সেটা একদিনে হয়নি। এজন্যে বহু ঘাম ঝরাতে হয়েছে
‘একটা মানুষ কীভাবে উপত্যকা তৈরি করে?’ প্রতিবাদ করল ডরোথি। ‘পুরো দেশটাই মুক্ত এলাকা, যে-কেউ যেখানে ইচ্ছে বসতি করতে পারে। যাকগে, ড্যান স্পেন্সারকে বিরক্ত করার ইচ্ছে নেই আমাদের।’
ওয়্যাগনের কাছ থেকে সরে এল এড। আলাপটা তেমন এগোবে না, জানে ও। ডরোথি হেডলিনের আচরণে স্পষ্ট বোঝা গেছে লারামিতে ওর খুনের ব্যাপারটা ভুলতে পারেনি। সেদিনের পর আরও কয়েকবার আলাপ করার চেষ্টা করেছিল ও, কিন্তু স্পষ্ট অনীহা প্রকাশ করেছে মেয়েটা। এরপর থেকে মেয়েটিকে একরকম এড়িয়ে চলল এড। একা একা, ওয়্যাগন ট্রেন থেকে যথেষ্ট দূরে রাইড করল ও। একা ক্যাম্প করল, এমনকী খাওয়ার সময়ও অন্যদের সঙ্গে যোগ দিল না। কেউ কথা বলল না ওর সঙ্গে, ওর খোঁজও নিল না।
দুই
ছয় দিন এভাবেই কেটে গেল। সবার মুখে কেবল স্যাম ল্যামসনের নাম। বিস্তৃত সবুজ উপত্যকা ধরে এগোচ্ছে ওরা, কচি ঘাসে ছেয়ে আছে পথ, বাতাসে দুলছে ঘাসের গালিচা। একনজর দেখেই বোঝা যায় অব্যবহৃত ট্রেইল-না আছে ওয়্যাগনের চাকার দাগ কিংবা দেবে যাওয়া ক্ষত-বিক্ষত মাটি। পানির অভাব নেই। ল্যামসনের দেয়া ম্যাপে প্রতিটি উপত্যকা, নিচু পর্বত কিংবা ওঅটর হোলের অবস্থান পরিষ্কার দেয়া আছে। কোথাও এতটুকু ভুল নেই। ফোর্ট থেকে রওনা দেয়ার ছয় দিনের মাথায় প্রথম আক্রমণ করল ইন্ডিয়ানরা।
ভোরের উন্মেষে হলো হামলাটা। ওয়্যাগনের কাছ থেকে আধ-মাইল দূরে একটা ঝর্নার কাছাকাছি ক্যাম্প করেছিল এড ক্রেমার, আচমকা ঘুম ভেঙে গেল ওর। পুবাকাশে তখন ভোরের রঙ ধরতে শুরু করেছে, অজানা অস্বস্তি বোধ করল সে। দ্রুত উঠে বসল, বেডরোল গুটানোর ঝামেলায় গেল না। ঝোপ এড়িয়ে দ্রুত পায়ে এগোল ওয়্যাগন সারির দিকে।
খোলা জায়গায় ক্যাম্প করেছে অভিযাত্রীরা। দূর থেকে প্রহরী লোকটাকে দেখতে পেল এড। উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। একটু এগোতে গাট্টাগোট্টা প্যাট গ্যাভিনকে চিনতে পারল এড। ভাল মানুষ, কথা বলে কম, তবে যেটা বলে ওজন রেখেই বলে। এডকে দেখে ক্ষীণ হাসল সে।
‘কী হে, এই সাত-সকালে চলে এলে যে?’ হালকা চালে জানতে চাইল সে। ‘মনে হচ্ছে ল্যামসনের কথাই ঠিক। একেবারে নিরাপদ ট্রেইল। ইন্ডিয়ান আক্রমণের কোন ভয়ই নেই। ঠিক না?’
‘না, তীক্ষ্ণ স্বরে বলল এড। ‘সবাইকে জাগাও, তৈরি হতে বলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে হামলা করবে ওরা!’
‘বলো কী! নিশ্চয়ই…’
‘জলদি, ম্যান, কাজ দেখাও!’ প্রায় খেঁকিয়ে উঠল ও। তারপর ঘুরেই ওয়্যাগনের দিকে চলে গেল। প্রতিটা ওয়্যাগনের ক্যানভাসের পর্দায় হাতের রাইফেল দিয়ে চাপড় মারতে শুরু করল। ওঠো, জলদি উঠে পড়ো সবাই! ইন্ডিয়ানরা এসে পড়েছে!’
ওয়্যাগন থেকে বেরিয়ে আসতে থাকল অভিযাত্রীরা, কেউ কাপড় ঠিক করছে, কেউ রাইফেল বা অস্ত্র তুলে নিচ্ছে হাতে। ‘ওয়্যাগনের চারপাশ ঘিরে অবস্থান নাও,’ দ্রুত বলল এড। ‘আমাদের দক্ষিণে পাহাড় আর ড্র-টার মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছে ওরা।
নিজের ওয়্যাগন থেকে ছুটে বেরিয়ে এল হিউ টেলর, চারপাশে চকিত দৃষ্টি চালাল। ধূসর হয়ে গেছে পুবের আকাশ, আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে সবকিছু। প্রেয়ারির অস্পষ্ট আলোয় কোন নড়াচড়া চোখে পড়ল না। খেপে গিয়ে প্রতিবাদ করার জন্যে এডের দিকে এগোতে শুরু করেছিল সে, ঠিক তখন বুনো একটা চিৎকার শুনতে পেল। চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল সে, প্রায় দু’শো গজ দূরে রেডস্কিনদের দীর্ঘ লাইন দেখতে পেল। উদ্দাম গতিতে ছুটে আসছে ইন্ডিয়ানরা।
সবচেয়ে কাছের ইন্ডিয়ান তীক্ষ্ণ স্বরে রণহুঙ্কার ছাড়ল-বুনো, প্রলম্বিত সুরে। রক্ত হিম করা সেই হুঙ্কার অনুকরণ করল অন্যরা।
হেডলিনদের ওয়্যাগনের গায়ে হেলান দিয়ে পজিশন নিল এড। রাইফেল তুলেই গুলি করল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল একটা ঘোড়া। আবার গুলি করল এড। বুনো চিৎকার করে আকাশে দু’হাত মেলে দিল এক ইন্ডিয়ান, স্যাডল থেকে খসে পড়ল। পেছনের ঘোড়াগুলো মাড়িয়ে গেল তাকে।
এবার অভিযাত্রীরা গুলি শুরু করল।
টানা গুলি করছে এড, ইন্ডিয়ানরা বৃত্তের কিনারে পৌছার আগেই গুলি শেষ হয়ে গেল রাইফেলের। ছুটন্ত অবস্থায় ঝুঁকে একটা তীর নিক্ষেপ করল এক ব্রেড, হেডলিনদের ওয়্যাগনের ক্যানভাসে বিধল সেটা। তিরতির করে কাঁপছে শলাকাটা। অল্পের জন্যে মিস্ হয়েছে এডের মাথা। দ্বিতীয় সুযোগ পেল না ইন্ডিয়ান, চোখের পলকে ওর হাতে বেরিয়ে এসেছে ভয়ালদর্শন কোল্ট। প্রথম গুলিতেই স্যাডলচ্যুত হলো সে, কিন্তু রেকাবে আটকে গেছে এক পা। সে-অবস্থাতেই তাকে ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে ছুটতে থাকল ঘোড়াটা। লোকটার পরিণতি দেখার অবস্থায় নেই এড, কোত্থেকে একটা তীর এসে, মাথা থেকে তুলে নিয়েছে ওর হ্যাটটা!
বাম হাত তুলে তীরের শলাকাটা চেপে ধরল এড, তারপর মোচড় দিয়ে ক্যানভাস থেকে খুলে আনল। ব্যাটা ব্রেভ তীরের সঙ্গে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ভাগ্যিস, ক্যানভাসে আগুন ধরেনি! নিশ্চিন্ত মনে এবার সমানে গুলি শুরু করল ও-একের পর এক, কিছুক্ষণ পিস্তল দিয়ে, এবং পিস্তলের গুলি শেষ হয়ে গেলে রাইফেল দিয়ে।
আচমকা যেভাবে শুরু হয়েছিল, সেভাবেই রণে ভঙ্গ দিল ইন্ডিয়ানরা।
পানির ব্যারেলের পেছনে হাঁটু গেড়ে বসে ছিল টেড হেডলিন, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ। রীতিমত অসুস্থ দেখাচ্ছে তাকে। রাইফেলে হাত ভালই তার, কিন্তু খুনোখুনির সঙ্গে অভ্যস্ত নয়। চোখ তুলে এডের দিকে তাকাল সে, চাহনিতে অস্বস্তি। ‘কখনও মানুষ খুন করিনি আমি!’ দুর্বল, প্রায় রুগ্ন স্বরে বলল সে।
‘এখানে এসেছ যখন, কিছুদিনের মধ্যে অভ্যস্ত হয়ে যাবে,’ নির্লিপ্ত স্বরে বলল এড। চোখ তুলে কাছাকাছি দাঁড়ানো ডরোথির দিকে তাকাল।
‘আমাদের ওয়্যাগনটা বাঁচিয়েছ তুমি!’ বলল মেয়েটি।
‘যে-কারও ওয়্যাগন হতে পারত এটা,’ সোজাসাপ্টা বলল ও, তারপর ঘুরে দাঁড়াল। খোলা প্রেয়ারিতে দৃষ্টি চালাল, সাতটা ইন্ডিয়ান লাশ পড়ে আছে। দীর্ঘ ঘাসের আড়ালে আরও দু’একজন থাকতে পারে। কয়েকটা মৃত পনিও রয়েছে। আগুন সহ তীর নিক্ষেপ করেছিল যে-ব্রেভ, ডজনখানেক দূরে পড়ে আছে সে। বুক-পেটের মাঝামাঝি বিধেছে বুলেটটা, লোকটার পড়ে থাকার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে।
চারপাশে দৃষ্টি চালাল ও, অভিযাত্রীদের দেখল নিস্পৃহ দৃষ্টিতে। কিছুটা হলেও সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে হিউ টেলরকে, কিন্তু বরাবরের মতই দৃঢ় মনোবল ধরে রেখেছে। প্যাট গ্যাভিন ধীর-স্থির ভাবে একের পর এক গুলি করেছে, নিপুণ নিশানার স্বাক্ষর রেখেছে। ছোটখাট লোকটির দিকে তাকাল এড। ‘দারুণ দেখিয়েছ তুমি!’ সহাস্যে মন্তব্য করল ও।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল গ্যাভিন, শেষে ক্ষীণ হাসল। এডের প্রশংসায় ভেতরে ভেতরে খুশি হয়েছে উপলব্ধি করে নিজের ওপর লজ্জিত হলো সে।
মানুষগুলো একেবারে মন্দ নয়, উপসংহারে পৌঁছল এড। রাইফেল রিলোড করছে গ্যাভিন, এড যখন ওকে পাশ কাটিয়ে গেল, মুখ তুলে তাকাল, কিন্তু কিছুই বলল না। হেডলিনদের ওয়্যাগনের কাছে ফিরে এল এড। ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে হিউ টেলর, ডান বগলের খাঁজে রেখেছে রাইফেলটা।
‘আবার আসবে নাকি ওরা?’ জানতে চাইল সে।
নড করল এড। ‘সম্ভবত কয়েকবারই আসবে। বাফেলো হাইডের দল এটা। ওর নিজের যোদ্ধা এরা।
‘কিন্তু ল্যামসন বলেছে…’ প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল ডরোথি।
চারপাশে দৃষ্টি চালাল এড, আঙুল তুলে মৃত ইন্ডিয়ানদের লাশগুলো দেখাল। ‘প্রমাণ তো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছ, কর্কশ স্বরে বলল ও। ‘এবার ভেবে দেখো স্যাম ল্যামসনের কথায় এরপরও বিশ্বাস রাখা ঠিক হবে কিনা। এরা ব্ল্যাকফুট গ্রামের যোদ্ধা। মোকাসিন দেখেই বোঝা যাচ্ছে।’
পরেরবার চারদিক থেকে একইসঙ্গে হামলা করল ইন্ডিয়ানরা, ঝাঁকে ঝাঁকে জ্বলন্ত তীর ছুটে এল ওয়্যাগন লক্ষ্য করে। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ধরে গেল দুটো ওয়্যাগনে। ওয়্যাগন সারির একেবারে শেষের দিকে দাঁড়িয়ে আছে এড ক্রেমার, স্থির নিষ্কম্প হাতে নির্ভুল নিশানায় একের পর এক গুলি করে যাচ্ছে। একটা বুলেটও অযথা খরচ করার ইচ্ছে নেই ওর।
প্রবল আলস্য ভরে পুবাকাশের বিছানায় আড়মোড়া ভাঙল সূর্য, কোমল লাল আলোয় উদ্ভাসিত হলো প্রেয়ারি। ওয়্যাগনের পর্দায় রঙের ছোপ লেগেছে, উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ধূলিধূসর ক্যানভাস। শীতল বাতাস বইছে, কিন্তু বাতাস ভারী হয়ে গেছে ইন্ডিয়ানদের বুনো চিৎকার আর গানপাউডার এবং পোড়া ক্যানভাসের কটু গন্ধে।
আরও তিন পশলা হামলা চালিয়েছে রেডস্কিনরা, সর্বক্ষণই ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে এড ক্রেমারকে। তপ্ত সীসার ফুলঝুরি ছুটিয়ে দিচ্ছে ইন্ডিয়ানদের লক্ষ্য করে।
হঠাৎ করেই ছিটকে পড়ল টেড হেডলিন, ঊরুতে গুলি লেগেছে। মাইক হেলবির গলা ফুঁড়ে চলে গেল একটা তীর, ঘোড়া থেকে ঝাঁপ দিয়ে টিম কার্টিসের ওয়্যাগনে ঢুকে পড়ল এক ব্রেভ। গুলি করতে ব্যস্ত কার্টিসকে চেপে ধরল পেছন থেকে। ব্রেভের হাতে তীক্ষ্ণধার ছুরি বেরিয়ে এসেছে। তুমুল হাতাহাতি বেধে গেল দু’জনের মধ্যে। ছুরির পোঁচে কার্টিসের বগলের নিচে গভীর জখম তৈরি হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে।
ঝটিতি ওয়্যাগনের দিকে ঘুরল এড, কোমরের কাছ থেকে কেশে উঠল ওর কোল্ট। নিশানা ছাড়াই ট্রিগার টিপেছে। শেষ আঘাত করার জন্যে ছুরি তুলেছিল ব্রেড, হাতটা শূন্যে স্থির হয়ে গেল। ধীরে ধীরে ঢলে পড়ল তার শরীর, গড়িয়ে ওয়্যাগনের পাদানি হয়ে মাটিতে পড়ে গেল একটু পর।
আচমকা থেমে গেল গোলাগুলি। এবারের মত রণে ভঙ্গ দিয়েছে ব্রেভরা। পুব আকাশে গড়াগড়ি দিয়ে বিছানা ছাড়ল সূর্য, যেন উজ্জ্বল আলো যাদু দেখিয়েছে—মুহূর্তের মধ্যে পালিয়ে গেছে ইন্ডিয়ানদের দল। সুনসান নীরবতা নেমে এল চারপাশে, কেবল আহতদের ক্ষীণ স্বরের ককানি শোনা যাচ্ছে। হাতের চেটো দিয়ে কপাল থেকে ঘাম মুছল এড, প্রেয়ারি ধরে তাকাল পাহাড়ের দিকে। প্রচুর লোক হারিয়েছে বাফেলো হাইড, অন্তত বিশজন হবে। ব্ল্যাকফুট গ্রামে আজ রাতে মৃতদের আত্মার উদ্দেশে প্রশস্তি গান গাওয়া হবে।
দুটো ঘোড়া আর একটা ষাঁড় মারা গেছে। সবাই জড়ো হলো ওরা। মৃত দুই অভিযাত্রীকে কবর দেয়া হলো, ষাঁড়টাকে জবাই করা হলো। একটা ওয়্যাগনের জোয়ালের ওপর একা বসে ছিল এড, ওর দিকে এগিয়ে এল হিউ টেলর। লোকটার চেহারায় অস্বস্তির ছাপ।
‘আমাদের সবার জীবন বাঁচিয়েছ তুমি, এড,’ আন্তরিক স্বরে বলল সে। ‘জানি না কীভাবে ধন্যবাদ জানাব তোমাকে!’
উঠে দাঁড়াল এড। মৃত দুই অভিযাত্রীকে কবর দেয়ার ফাঁকে নিজের রাইফেল পরিষ্কার করে গুলি ভরে নিয়েছে। ‘দরকার নেই,’ নিস্পৃহ স্বরে বলল ও।
জেফ অ্যালেন যোগ দিল ওদের সঙ্গে। এগিয়ে এসে একটা হাত বাড়িয়ে দিল। ‘মনে হচ্ছে আমাদের সম্পর্কটা পাকাপোক্ত হয়নি তেমন—তোমাকে আপন ভাবতে পারিনি কেউ,’ সত্যি সত্যিই লজ্জিত দেখাল তাকে। ‘কিন্তু ইন্ডিয়ানদের ব্যাপারে সত্যি কথাই বলেছ তুমি।’
হঠাৎ করেই হেসে উঠল এড, স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণবন্ত হাসি। ভুলে যাও এসব, জেফ! রাইফেল হাতে ভালই লড়েছ তুমি!’
শুধু এ দু’জন মুখ ফুটে স্বীকার করল ওর অবদান। কারও কাছ থেকে ধন্যবাদ পাওয়ার আশায় সাহায্য করেনি এড, কিংবা এখন প্রশস্তিতে শরীর ঢিলে করার মানসিকতাও নেই ওর; কিন্তু ওকে নিজেদের একজন মনে করবে-এটুকু ঠিকই আশা করেছে ওর অবচেতন মন। যদিও জানত ঠিক এটাই ঘটবে। এদের বেশিরভাগ লোকের কাছে ও একজন খুনী, মানুষ হত্যায় নিপুণ এক কারিগর, যার পিস্তল বা রাইফেলের গুলি বলতে গেলে ফস্কায়ই না।
টেড হেডলিনকে ওয়্যাগনে নিয়ে যেতে সাহায্য করল ও। তারপর ষাঁড়গুলো জুড়ল জোয়ালের সঙ্গে। কাজ শেষে প্রায় পাহাড়ের কাছাকাছি চলে এসেছে, স্টীল-ডাস্টের স্যাডলে চড়তে যাবে, ঠিক এসময় ওকে ধন্যবাদ দিতে এগিয়ে এল ডরোথি। কিন্তু এড়িয়ে গেল এড। দূর থেকে এডকে চলে যেতে দেখল মেয়েটি, অদ্ভুত এক নিঃসঙ্গতা আর হতাশা ঘিরে ধরল ওকে।
বিকেল নাগাদ শুকনো এলাকায় পৌঁছে গেল ওরা। ধুলো ওড়ার আগ পর্যন্ত অভিযাত্রীদের কেউই প্রাকৃতিক পরিবর্তনটা টের পেল না, এ ধরনের ট্রেইলে সাধারণত ব্যাপারটা সহজে চোখে পড়েও না-ঘন সবুজ ঘাস দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে চোখ, তারপর ঘাসের সবুজত্ব কমতে থাকে। ঘনত্ব কমে যায়।
মাইল খানেক এগোতে ধূলিময় এলাকায় প্রবেশ করল ওরা। যতদূর দৃষ্টি যায়, একই দৃশ্য চারপাশে কেবল শুকনো মাটি, কদাচিৎ কিছু ঘাস দেখা যাচ্ছে, তাও শুকনো কিংবা রোদপোড়া। লাগাতার ধুলো উড়ছে এখন, এতটাই যে দৃষ্টিপথ ঢেকে দিচ্ছে। দম আটকে আসছে ওঁদের, নাক ঝেড়ে অস্বস্তি প্রকাশ করছে ঘোড়া আর ষাঁড়গুলো।
তপ্ত রোদ এবং তাপও ভোগাচ্ছে ওদের।
মরুভূমি নয় জায়গাটা, মরুভূমির কয়েক মাইল আগে দীর্ঘ রুক্ষ প্রান্তর। জমিনে পানির অভাব, তাই ঘাস বা গাছের সংখ্যাও কম। প্রায় পুরোটা দিন রুক্ষ ট্রেইল পাড়ি দিল ওরা, ধুলোর চাদর সারাক্ষণ মাথার ওপর ছায়ার মত ঘিরে থাকল। ধুলোর পরিমাণ এতই বেশি যে শুরুতে হিউ টেলরের ওয়্যাগন থেকে শেষ ওয়্যাগনটাও চোখে পড়ল না।
টেলরের পাশে রাইড করছে এড। মুখ তুলে ওর দিকে তাকাল সে ‘ল্যামসন অবশ্য আগেই বলেছে যে কিছু জায়গা খারাপ, প্রায় কৈফিয়তের সুরে বলল সে।
কিছু বলল না এড। সামনে যে আসলে কী আছে, সেটা কেবল ও-ই জানে। ট্রেইল যে কতটা দুর্গম হয়ে উঠবে, এ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই এদের। কাউকে সতর্ক করার ইচ্ছে নেই ওর, কারণ তাতে কোন লাভ হবে না। ঠেকে শিখুক ওরা, জানুক কী ভুল করেছে—
অবশেষে, কয়েকদিন পর জানল ওরা। কিন্তু বহু তিক্ততা আর দুর্ভোগ পোহানোর পর। রুক্ষ বিরান প্রান্তর ধরে চলছে পুরো পাঁচ দিন। পানির ব্যারেলগুলো শূন্য হয়ে গেছে। পুরু বালির ওপর দিয়ে কোন রকমে চলছে ওয়্যাগনগুলো, এতটাই ধীর গতিতে যে সারাদিনে মাত্র কয়েক মাইল এগোতে পারছে। এরচেয়ে দুর্বিষহ যাত্রা বোধহয় আর হতে পারে না।
ইতোমধ্যে অভিযাত্রীদের ছেড়ে পাহাড়ে চলে গেছে এড। হিউ টেলর শিকারের কথা বলেছিল ওকে। দুটো অ্যান্টিলোপ নিয়ে ফিরে এল ও। প্যাট গ্যাভিনও শিকার করেছে একটা। হেডলিনদের ওয়্যাগনের কাছাকাছি এসে স্যাডল ছাড়ল এড। আগুন জ্বালিয়ে রান্নার আয়োজন করছিল ডরোথি, মুখ তুলে তাকাল ওর দিকে।
‘হ্যালো!’ উজ্জ্বল হলো মেয়েটির মুখ। ‘ইদানীং তোমাকে দেখতেই পাচ্ছি না!’
কালো ফ্ল্যাট ব্রিমের হ্যাট খুলে হাতে নিল এড। ঘামের কারণে ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল লেপ্টে আছে খুলির সঙ্গে। এখানে অনেকেই আছে যারা চায় না তোমার সঙ্গে কথা বলি আমি,’ শুকনো স্বরে বলল ও। ‘সৎ সঙ্গে সহবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ!’
এরকম কিছু তো বলিনি আমি!’ প্রতিবাদ করল ডরোথি। হাত চালিয়ে কপাল ছুঁয়ে চোখের ওপর এসে পড়া চুল সরিয়ে দিল। ‘বরং তুমি আমাদের কাছাকাছি রাইড করলেই ভাল লাগে আমার…স্বস্তি বোধ করি। নিরাপদ মনে. হয় নিজেকে।’
মুহূর্তের জন্যে সরাসরি ডরোথির চোখের দিকে তাকাল এড, তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ‘তোমার বাবা কেমন আছে?’
‘একটু ভাল। যা গরম পড়ছে, এটাই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে! আচ্ছা, এই রুক্ষ এলাকা পার হতে ক’দিন লাগবে আর?’
‘এভাবে চলতে থাকলে হয়তো কাল রাতের দিকে পেরিয়ে যাব। সবচেয়ে খারাপ জায়গাটা অবশ্য পেরিয়ে এসেছি।
‘শুনে স্বস্তি পেলাম! যাক, এরকম কোন জায়গা আর পেরুতে হবে না। স্যাম অবশ্য তাই বলেছে-মাত্র একটা জায়গাই খারাপ।’
ডরোথির সম্বোধনে ল্যামসনের নামের প্রথম অংশ কান এড়ায়নি এডের, ব্যাপারটা কেন যেন ত্যক্ত করে তুলল ওকে। ‘ভুল বলেছে ও। সল্ট লেকের কাছাকাছি আরও একটা জায়গা খারাপ, এবং এরচেয়েও খারাপ ওটা। ওটাই সত্যিকার মরুভূমি। পিছিয়ে গিয়ে ট্রেইল পরিবর্তন করে পাইলট পীকের দিকে যাত্রা না করলে এ পথে কখনোই গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে না তোমরা।’
‘কিন্তু ও বলেছে… প্রতিবাদ করতে উদ্যত হলো ডরোথি।
ক্লান্ত দেহে বালির ওপর বসে পড়েছে এড, একটু দূরে। ‘জানি কী বলেছে ও। ওর সব কথাই শুনেছি। সেজন্যেই ভাবছি ওর মতলবটা কী! যে- ট্রেইল ধরে এসেছ তোমরা, বিপদে না পড়লে এদিকে আসে না কেউ। সল্ট লেক পাড়ি দেয়া যে-কোন সময়ই বিপজ্জনক -আর সঙ্গে ওয়্যাগন থাকলে তো নিশ্চিত মৃত্যু। অথচ তোমরা স্রেফ অচেনা একজন লোককে বিশ্বাস করে নিশ্চিন্তে বসে আছ!’
‘কিন্তু মিথ্যে বলেনি সে, এড। প্রথম ছয় দিনে এমন কোন কষ্ট হয়নি আমাদের। আশা করি আগামীকাল থেকে আবারও ভাল ট্রেইল পাব।’
‘মরুভূমির শুরু পর্যন্ত পথটা অবশ্য ভালই,’ স্বীকার করল এড। ‘যদি না তার আগেই থামতে হয় তোমাদের…’
‘থামতে হয় মানে?’ একটা থালায় খাবার তুলে ওর দিকে এগিয়ে দিল ডরোথি, তারপর কাপে কফি ঢালতে শুরু করল। ‘কেন এ কথা বলছ?’
‘কাল স্পেন্সারের এলাকায় ঢুকব আমরা,’ গম্ভীর স্বরে বলল ও, মুখ নির্বিকার।
‘তোমার কথায় সবসময়ই মনে হয়েছে আউট-ল বা ওরকম কিছু সে!’
‘তা নয়। তুমি যদি ওর বন্ধু বা অতিথি হও, ওর চেয়ে ভাল মানুষ আর পাবে না। কিন্তু যদি শত্রু হও কিংবা ওর কাছ থেকে কিছু কেড়ে নিতে চাও-মুহূর্তের মধ্যে নিষ্ঠুর হয়ে উঠবে সে।’
হেডলিনকে খাওয়ানোর জন্যে ওয়্যাগনের ভেতরে চলে গেল ডরোথি। মিনিট কয়েক পর ফিরে এল, জোয়ালের ওপর এডের পাশে বসল। সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে, গোধূলির লালিমায় লালচে ছোপ লেগেছে দিগন্তে 1 ধুলো থিতিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। কাছাকাছি ম্যান্ডোলিন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে লিও কারভার, নিচু স্বরে গাইছে সে।
বাতাস শীতল হয়ে এসেছে। বাতাসে পোড়া কাঠের ধোঁয়ার গন্ধ। মাঝে মধ্যে পা ঠুকছে ঘোড়াগুলো, কিংবা গা ঝাড়া দিচ্ছে কোন ষাঁড়। দূরে পাহাড়সারির চূড়ায় গোধূলির আভা লেগেছে, আলো-আঁধারি পরিবেশে নীলচে-বেগুনি দেখাচ্ছে ওগুলোর শরীর। দীর্ঘ ক্লান্তিকর ধূলিময় ট্রেইলের যাত্রার শেষে পাহাড়ের ছায়ায় যেন শীতল প্রশান্তির প্রতিশ্রুতি
পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আনমনে স্যাম ল্যামসনের কথা ভাবছে এড। মতলবটা কী তার? আসলে কে সে? মার্টি থ্যাচারকে টাকা ধার দিয়েছে, অথচ কখন বা কীভাবে সেই টাকা আদায় করবে জানতেও চায়নি; এমনকী জিজ্ঞেসও করেনি ঠিক কোথায় যাচ্ছে ওরা! পুরো ব্যাপারটাই অস্বাভাবিক। তাছাড়া ইচ্ছে করেই রুক্ষ একটা ট্রেইল ধরতে এদের প্ররোচিত করেছে সে। সবকিছুর পেছনে হয়তো নির্দিষ্ট কারণ আছে, সেটা ভাল কিছু নয়- অন্তস্তল থেকে টের পাচ্ছে এড; এবং আশঙ্কাও হচ্ছে ওর।
‘কী ভাবছ, এড়?’ মৃদু স্বরে নীরবতা ভাঙল ডরোথি। ‘সবসময় এত চুপচাপ থাকো তুমি! কী নিয়ে যেন ভাবো, বুঝি না তোমার মাথায় এত কীসের চিন্তা!’
‘তেমন কিছু না,’ ল্যামসনের প্রসঙ্গ ফের তোলার ইচ্ছে নেই ওর। এই অঞ্চলটার কথা ভাবছিলাম।
‘জায়গাটা পছন্দ করো তুমি, তাই না?’
‘পছন্দ?’ মুখ তুলে তাকাল ও, চোখের চাহনি বদলে গেছে। ক্ষীণ হাসল, হাসিতে মুখের কাঠিন্য দূর হয়ে গেল মুহূর্তের জন্যে। ‘পছন্দ করি কিনা? শুধু পছন্দই নয়, বরং ভালবাসি! জায়গা বটে একটা! যদি পুরোটা দেখতে। স্পেন্সার ভ্যালির কথাই ধরো-মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ সবুজ উপত্যকা, ক্রীক আর নদী এঁকেবেঁকে চিরে গেছে জায়গাটাকে। কোথাও পানির অভাব নেই, ছায়ার অভাব নেই। দারুণ সুন্দর জায়গা।
‘স্পেন্সার, ভ্যালি দেখলেই বুঝবে! হয়তো একটা গিরিপথ ধরে চলছ, ঠিক পাশে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা পাহাড়ী নদী। ওখান থেকে কয়েক হাজার ফুট উঁচু ক্লিফের অংশ চোখে পড়বে। আচমকাই গিরিপথ প্রশস্ত হয়ে যাবে, সামনে বিস্তীর্ণ এক উপত্যকা দেখতে পাবে যেটা লম্বায় পঞ্চাশ মাইল আর চওড়ায় অন্তত পাঁচ মাইল। উপত্যকার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত পুরোটা চোখে পড়বে। দেখার মত দৃশ্য বটে! সবুজ ঘাস বিছিয়ে আছে জমিতে, ঠিক যেন ঘাসের গালিচা। বাতাসে নুয়ে পড়ে যখন, নদীতে ঢেউ খেলে যায় যেন!
‘দু’পাশে উঁচু পাহাড়ের সঙ্গে রয়েছে অসংখ্য ক্লিফ আর পাহাড়ী ঝর্না গিরিপথ বা ছোট ছোট উপত্যকা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। প্রতিটি পাহাড়ে ঘন বন-পাইন, ম্প্রস, কটনউড এবং ফারের ঝাড়। সত্যিই অপূর্ব!’
স্থির দৃষ্টিতে এডকে দেখছে ডরোথি, তন্ময় হয়ে পড়েছে গল্পে। এভাবে কখনও এড ক্রেমারকে কথা বলতে শোনেনি। সবুজ উপত্যকা, পাহাড়সারি এবং শিকারের গল্পে মশগুল হয়ে পড়ল ও হরিণ, এল্ক, ভালুক, পাহাড়ী ছাগল…অসংখ্য শিকার মেলে এখানে। কাঠবিড়ালী আর অসংখ্য নাম না’ জানা পাখি দাপাদাপি করে বার্চের বনে। আচমকা নিজের অবস্থান ও পরিচয় ভুলে গেল ডরোথি, ভুলেই গেল কোথায় আছে, কার সঙ্গে কথা বলছে—
‘এই জায়গা এত ভালবাস তুমি, অথচ চলে গেলে কেন?’ অস্ফুট স্বরে জানতে চাইল ডরোথি।
‘ঘুরতে বেরিয়েছিলাম, রুচি বদল বলতে পারো। তবে, এসবের মালিক একজন লোক-ড্যান স্পেন্সার, এতক্ষণ যেন ঘোরের মধ্যে সেও ছিল, বরাবরের মত নিস্পৃহ আর নিরাবেগ শোনাল এডের কণ্ঠ। ‘ছোটখাট একটা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে সে এখানে। বহু আগে, সাদা মানুষ যখন সোনার সন্ধানে ক্যালিফোর্নিয়ায় ছুটত, তখন এখানে আসে স্পেন্সার। অন্যদের চেয়ে একটু ভিন্ন ধাতে গড়া মানুষটা। সবাই তখন শুধু ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার স্বপ্ন দেখত—কীভাবে খনি থেকে সোনা তুলে আখের গুছিয়ে নেবে। শকুনের পালের মত এদিকে আসতে শুরু করে তারা, হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই দখল করে নিয়েছে, কিছুই তৈরি করেনি। স্বল্প সময়ে বড়লোক হতে চেয়েছে ওরা, এবং কেউই এখানে স্থায়ী ভাবে থাকতে চায়নি।
‘কিন্তু স্পেন্সার মানুষটা একটু ভিন্ন ধাতের। তরুণ বয়সে একবার শিকার করতে এখানে এসেছিল সে, তখন চলে গেলেও ওই উপত্যকার কথা ভুলতে পারেনি স্পেন্সার। কয়েক বছর পর এক পাল গরু নিয়ে আসে সে। এই এলাকায় তখন গবাদি পশু ছিল না। গরু চরানোর সাহসও করত না কেউ। অথচ তাই করেছে স্পেন্সার। বছরের পর বছর ইন্ডিয়ান আর আউট-লদের সঙ্গে লড়েছে সে। বাঁধ তৈরি করেছে, বসতি করেছে, সেচ দেয়ার জন্যে নালা তৈরি করেছে, জমিতে ফসল ফলিয়েছে, উপত্যকায় গাছ লাগিয়েছে।
‘অদ্ভুত সুন্দর এই উপত্যকা ওর নিজের হাতে তৈরি। স্পেন্সার যদি এটা নিজের করে রাখতে চায়, তাহলে কি দোষ দেয়া যাবে ওকে?’
প্রশ্নটার উত্তর অবশ্য চায়নি এড, ডরোথি জবাবে কিছু বললও না। কিন্তু মেয়েটির চোখে নীরব সম্মতি দেখে উত্তরটা জেনে গেল এড। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল ও, তারপর শুভরাত্রি জানিয়ে অন্ধকারে মিশে গেল।
সে-রাতে ঘুমানোর আগে কেবলই এডের কথা ভাবল ডরোথি। দারুণ লম্বা সে! আশ্চর্য লোক! আচমকা উঠে দাঁড়িয়েছিল সে, তারপর কোন কিছু না বলে চলে গিয়েছিল। ঘোর কাটার আগেই এডের ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পেয়েছে ডরোথি, বুঝেছে ক্যাম্প ছেড়ে চলে গেছে সে।
ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসা খুরের শব্দের পাশাপাশি দূরাগত খুরের শব্দ শুনতে পেয়েছিল ও। ক্রমশ কাছিয়ে আসছিল রাইডাররা। লোকগুলোর পরিচয় জানার কৌতূহল হয়েছে বটে, কিন্তু খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি, বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছিল রান্না করার জন্যে। এখন, শুয়ে থেকে ঘটনাটা মনে পড়তে সন্ধের মতই আগ্রহী হয়ে উঠল ডরোথি। ওদের ক্যাম্পে আসা লোকগুলো কে হতে পারে ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ল…
ভোরে সবে যাত্রা করেছে ওরা, এমন সময়ে উদয় হলো স্যাম ল্যামসন কালো মেয়ারে চেপেছে। ‘সুপ্রভাত,’ ডরোথির উদ্দেশে বো করার পর প্রসন্ন স্বরে শুভেচ্ছা জানাল সে। ভেবেছিলাম খারাপ জায়গাটা পেরুনোর আগেই ধরে ফেলব তোমাদের। পথে খানিক দেরি হয়ে গেল। যাকগে, কালই সবুজ এলাকায় প্রবেশ করবে তোমরা!’
‘জানি।’
চট করে ওর দিকে তাকাল ল্যামসন, কিছুটা বিস্ময় লেগে আছে দৃষ্টিতে। ‘জানো? কার কাছ থেকে জানলে?’
‘এড ক্রেমার বলেছে।
আড়ষ্ট হয়ে গেল তার মুখ। ল্যামসনের মুখে বিরক্তি আর অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট পড়তে পারল ডরোথি।
‘তাই? তাহলে এখনও তোমাদের সঙ্গে আছে ও? আমি তো ভেবেছি অনেক আগেই কেটে পড়েছে! হারামী লোক, এক নম্বর হারামী!’
‘এ কথা বলছ কেন? এড তো বরাবরই সাহায্য করছে আমাদের। শ্রাগ করল সে। ‘বলা উচিত নয় বোধহয়, তবু না বলে পারছি না। জানোই তো লারামিতে একজনকে খুন করেছে ও। কিন্তু ওটাই সব নয়। আরও ব্যাপার আছে। অন্তত পাঁচ-ছয়জনকে খুন করেছে ক্রেমার। যেখানেই যায়, তুচ্ছ কারণে ঝামেলা বাধাতে অভ্যস্ত। তোমাদের অবশ্য অত চিন্তা না করলেও চলবে। থ্যাচার বা অন্যরা ঠিকই ওকে হাড়ে হাড়ে চিনে ফেলেছে। তাতে লাভ হয়েছে এটা, ইচ্ছে করলেও এখানে ঝামেলা বাধাতে পারবে না ও।
উজ্জ্বল হাসি দেখা গেল ল্যামসনের সুদর্শন মুখে। ‘তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে! মনেই হয় না এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছ। সামনে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে, খানিকটা হয়তো কষ্ট হবে তোমার। আমি অবশ্য ধারে-কাছে কোথাও বসতি করার চিন্তা করছি;’ আঙুল তুলে সামনের পথ দেখাল সে। ‘ভারী সুন্দর জায়গা, খোদ ক্যালিফোর্নিয়ায়ও এমন সুন্দর জায়গা মিলবে না।
ক্যাম্প ছাড়ার সময় এড ক্রেমারও ঘোড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছিল সে- রাতে। ক্যাম্প থেকে কিছুদূর এসে পাহাড়ের কাছাকাছি ঘোড়া থামিয়েছিল ও, লোকগুলোর ক্যাম্পে উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। ক্যাম্পের আলোয় তাদের চিনতে অসুবিধে হয়নি-ল্যামসনকে একনজর দেখেই চিনেছে। আরও দু’জন ছিল সঙ্গে। হালকা-পাতলা একজন, লম্বা নাক আর কঠিন মুখ তার। অন্যজন ছোটখাট হলেও গাট্টাগোট্টা। চলাফেরা বেশ ক্ষিপ্র, অন্তত ভারী শরীরের তুলনায়। সাই ড্রানানকে চিনতে পেরে অজান্তে পরস্পরের ওপর চেপে বসল ওর ঠোঁট। হাফ-ব্রীড এই লোকটা গানফাইটার হিসেবে যতটা না পরিচিতি পেয়েছে, তারচেয়ে বেশি কুখ্যাতি পেয়েছে নীচ আর খুনে স্বভাবের জন্যে। পেছন থেকে খুন করতেও আপত্তি নেই লোকটার। অস্ত্রে নিপুণ, পেশাদার এবং দক্ষ। র্যাটলারের মত বিষাক্ত, ভয়ঙ্কর। ওয়্যাগন ট্রেনের কারোই জানা নেই এই তথ্যগুলো।
সারাদিন ওয়্যাগন ট্রেন থেকে দূরে দূরে থাকল এড। হিউ টেলরের ওয়্যাগন থেকে অন্তত মাইল খানেক আগে আগে রাইড করছে। একটা ঝর্না দেখে ঘোড়া থামাল ও, স্যাডল ছেড়ে নিজের আর ঘোড়ার তেষ্টা মেটাল। তারপর সুযোগ পেয়ে একটা অ্যান্টিলোপ শিকার করল। কিছুটা পিছিয়ে এসে পপলার সারির কাছে অপেক্ষায় থাকল ও, কিছুক্ষণের মধ্যে ওখানে পৌঁছে গেল ওয়্যাগনের সারি।
ইতোমধ্যে ড্যান স্পেন্সারের জমিতে পা রেখেছে ওরা। পপলার সারির কিছু দূরে দীর্ঘ ক্যানিয়নের শুরু, পপলার ক্যানিয়ন স্পেন্সার ভ্যালির সীমানা নির্দেশ করছে।
প্রথম ওয়্যাগন কাছাকাছি আসতে উঠে দাঁড়াল ও। অন্য যে-কারও চেয়ে ভাল জানে নিকট ভবিষ্যতে কী হতে পারে, কিংবা এদের ভাগ্যে কী ঘটতে পারে-অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক এক পথে পা রাখতে যাচ্ছে অভিযাত্রীরা। স্ট্যালিয়নের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকল ও, একে একে এগিয়ে আসছে ওয়্যাগনগুলো।
নির্মল ঝর্নার পানি আর সবুজ সতেজ ঘাস দেখে খুশি যাত্রীরা। বাচ্চারা ছুটে গেল ঝর্নার কাছে। শূন্য ব্যারেল ভরে নিল সবাই। ঘোড়া বা ঘাড়দের ইচ্ছেমত পানি খাওয়ার সুযোগ দেয়া হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে আনন্দমুখর হয়ে উঠল পরিবেশ। সবাই ভুলে গেল পুরো ছয়টা দিন অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহানোর পর রুক্ষ ট্রেইল পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছে। আগুন জ্বালিয়ে রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মেয়েরা।
হিউ টেলরের ক্যাম্পে স্যাম ল্যামসনকে দেখতে পেল এড, আগুনের পাশে একটা স্যাডলের ওপর বসে আছে সে। লম্বা নাকের দীর্ঘদেহী পিট ল্যাস্কার, জনি গ্যারেট আর প্যাট গ্যাভিনও যোগ দিয়েছে ওদের সঙ্গে। কোন ব্যাপারে পরামর্শ করছে ওরা। কিছুক্ষণ পর ওদের সঙ্গে যোগ দিল টেড হেডলিন।
ম্যান্ডোলিনের তার ঠিকঠাক করার ফাঁকে চারপাশে কৌতূহলী দৃষ্টি চালাল লিও কারভার, উইলোর নিচে দাঁড়ানো এড ক্রেমারকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল। বোধহয় একাই ভাল লাগে তোমার?’ সহাস্যে জানতে চাইল সে, তারপর এডের পাশে ঘাসের ওপর বসে পড়ল। ‘ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় দেখলাম কীভাবে অস্ত্র ব্যবহার করেছ। ওভাবে কাউকে অস্ত্র চালাতে দেখিনি আমি। মনে হচ্ছে ম্যান্ডোলিনে আমার হাত যতটা চলে, পিস্তলে তোমার হাত তারচেয়েও চালু!’
ক্ষীণ হাসল এড। ‘কিন্তু সুরটা শুনতে মোটেও ভাল লাগবে না কারও!’ প্রসঙ্গটা ওখানেই চাপা পড়ে গেল ওর প্রশ্নে। ‘কী করছে ওরা?’ আঙুল তুলে হিউ টেলরের ক্যাম্পের দিকে ইঙ্গিত করল ও।
নিস্পৃহ ভঙ্গিতে শ্রাগ করল কারভার। নিজের পরিকল্পনা সম্পর্কে ওদের বলছে ল্যামসন। বোঝাতে চাইছে এমন চমৎকার জায়গা থাকতে কেন বোকার মত আরও পশ্চিমে যেতে চাইছি আমরা।
ঝট করে উঠে দাঁড়াল এড, শঙ্কায় জ্বলে উঠল চোখজোড়া। ‘আচ্ছা, এই মতলব! আগেই বোঝা উচিত ছিল আমার!’
বেকুব বনে গেছে কারভার। ‘ব্যাপার কী? আমার তো মনে হয় বুদ্ধিটা খারাপ না। জায়গাটা চমৎকার। এরচেয়ে ভাল জায়গা চোখে পড়েনি আমার। ল্যামসন বলেছে ওই ড্রর পেছনে দারুণ সুন্দর একটা উপত্যকা আছে। যে-কেউ বসতি করতে পারে ওখানে, কোন বাধা নেই।’
কারভারের মতামত বা ল্যামসন কী বলেছে, শোনার অপেক্ষায় থাকল না এড, দ্রুত পা বাড়াল হিউ টেলরের ক্যাম্পের দিকে। ক্রীকের শাখা পেরিয়ে আগুনের কাছাকাছি চলে গেল, দূর থেকে স্যাম ল্যামসনের কণ্ঠ পরিষ্কার শুনতে পেল।
‘কেন নয়?’ বলছে ল্যামসন। প্রত্যেকেই বসতি করতে চাও তোমরা। এরচেয়ে ভাল জায়গা পাবে আর? মরুভূমির মত শুকনো জায়গাটা পেরিয়ে এসেছ, কিন্তু সামনে সত্যিকার মরুভূমি-সল্ট লেক। সে-তুলনায় এ জায়গা তো রীতিমত স্বর্গ! পাহাড়ের ওপাশে পপলার ক্যানিয়ন পেরিয়ে গেলে সারা জীবনে দেখোনি এমন সুন্দর সেই উপত্যকা দেখতে পারে। অথচ কেউ বসতি করেনি ওখানে। যার যার পছন্দমত জায়গা বেছে নিলেই হলো! পানির ঘাটতি নেই, বনে শিকারের অভাব নেই। সারা দুনিয়া খুঁজে এরচেয়ে ভাল তৃণভূমি দেখতে পাবে না। সবই পড়ে আছে অবহেলায়, এবং ভোগের অপেক্ষায়। স্রেফ দখল করে নিলেই হলো!’
‘কিন্তু ড্যান স্পেন্সারের ব্যাপারে কী বলবে?’ জানতে চাইল এড।
মুখ তুলে তাকাল ল্যামসন, বাধা পড়ায় খেপে গেছে। ‘আবার এসেছ? এরা কিছু একটা করতে গেলেই বাগড়া দিচ্ছ তুমি! এরা এখানে থামল কি সামনে এগোল, তাতে তোমার কিছু আসে যায়? কিংবা ক্যালিফোর্নিয়ায় গেলেই বা তোমার কী! কোন্ অধিকারে এদের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছ তুমি?’
উঠে দাঁড়িয়েছে মাটি থ্যাচার। মিসৌরিয়ানের মুখে এডের প্রতি পুরানো বিদ্বেষ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। অন্যরা বিতৃষ্ণার সঙ্গে দেখছে ওকে। কিন্তু কোন ব্যাপারেই পরোয়া করল না এড; টানা, পরোয়াহীন স্বরে বলে গেল: ‘নিজ হাতে এই উপত্যকা তৈরি করেছে ড্যান স্পেন্সার, এবং দুই হাজারেরও বেশি গরু চরাচ্ছে। তোমরা যদি এখানে বসতি করতে চাও, তাহলে বিপদ আর ঝামেলা ডেকে আনবে কেবল। কিছুতেই এটা সহ্য করবে না সে।’
‘তুমি যে আমাদের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে, এটাও সহ্য করব না আমরা!’ তড়পে উঠল মাটি থ্যাচার, হোলস্টারে বিশাল ড্রাগুন পিস্তলের বাঁট ছুঁয়েছে ওর ডান হাত। ‘যথেষ্ট হয়েছে, সান! অনেক বাগড়া দিয়েছ আমাদের কাজে। সবকিছুরই সীমা আছে। ব্যাপারটা এখানেই শেষ হোক! সাফ বলে দিচ্ছি, মুখটা বন্ধ রেখে ভালয় ভালয় কেটে পড়ো!’
‘আরে, করছ কী! দ্রুত ওদের মাঝখানে এসে দাঁড়াল জেফ অ্যালেন। ‘কোন কিছু করার আগে ভালমত চিন্তা-ভাবনা করে নাও। ইন্ডিয়ান হামলার ঠিক আগে আমাদের সতর্ক করেছিল এড, নইলে ভরাডুবি ঠেকানো যেত না। হয়তো সবাই মারা পড়তাম, এবং তুমিও সেই দলে থাকতে, মার্টি থ্যাচার! আমাদের যে-কারও চেয়ে ভাল লড়াই করেছে ও, আর এ পর্যন্ত ও যা বলেছে তাই সত্যি হয়েছে, উপদেশ বা পরামর্শ একটাও ভুল প্রমাণিত হয়নি। আমার মনে হয় ওর কথাই শোনা উচিত!’
নড করল লিও কারভার, এডের পিছু নিয়ে চলে এসেছে ক্যাম্পে। ‘বলে যাও, এড। আমি অন্তত শুনব!’
‘খুব বেশি কিছু বলার নেই,’ নিস্পৃহ স্বরে খেই ধরল এড। ‘যে-জায়গায় বসতি করার জন্যে তোমাদের পরামর্শ দিচ্ছে ল্যামসন, অন্তত ত্রিশ বছর আগে সেখানে বসতি করেছে ড্যান স্পেন্সার। লড়াই করে জায়গাটা দখলে রেখেছে সে, ইন্ডিয়ান আর আউট-লদের সঙ্গে লড়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এখন বুড়ো বয়সে তোমরা যদি ওর কাছ থেকে সেটা কেড়ে নিতে চাও, কোন ভাবেই বরদাস্ত করবে না সে। ওকে চিনি আমি। সেই জ্ঞান থেকে বলছি, তোমরা যদি ওই উপত্যকায় পা রাখো তাহলে বছর ঘোরার আগেই এই ওয়্যাগন ট্রেনের অনেক মহিলা বিধবা হয়ে যাবে।
‘কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। জানি না কেন তোমাদের এত উৎসাহ দিচ্ছে স্যাম ল্যামসন। এই ট্রেইলে আসার জন্যে সে-ই পরামর্শ দিয়েছে তোমাদের, নিশ্চয়ই কোন কারণ ছিল। হয়তো তার সঙ্গে স্পেন্সার উপত্যকার সম্পর্ক রয়েছে। জানি, স্থায়ী ভাবে এবং শান্তিতে থাকতে পশ্চিমে এসেছ তোমরা। কিন্তু নিজের ঘর করার জন্যে আরেকজনের সম্পত্তি কেড়ে নেয়ার অধিকার নেই তোমাদের, যেখানে সেই সম্পত্তি গড়তে এবং দখলে রাখতে লড়তে হয়েছে তাকে। পশ্চিমে অনেক জমি আছে, সবার জন্যে যথেষ্ট হবে। তোমরা বরং সেদিকে চলে যাও।’
‘যুক্তি আছে ওর কথায়,’ শান্ত স্বরে মন্তব্য করল অ্যালেন। ‘আমি আরও পশ্চিমে যাওয়ার পক্ষপাতী।
‘কিন্তু আমি রাজি নই!’ একগুঁয়ে স্বরে নিজের মতামত জানিয়ে দিল মার্টি থ্যাচার। ‘এই জায়গাই পছন্দ আমার। আমার বউও অমত করেনি। এ পর্যন্ত ধুলো, তাপ কিংবা ইন্ডিয়ানদের যথেষ্ট অত্যাচার সয়েছি। আর নয়! এখানেই থাকব আমরা!’
‘ওই উপত্যকা পঞ্চাশ মাইল দীর্ঘ, বন্ধুরা,’ বলল ল্যামসন। আমার তো ধারণা অনায়াসে সবার জায়গা হয়ে যাবে!’
‘ওর সঙ্গে একমত আমি,’ জানাল টেলর, ঘুরে টেড হেডলিনের দিকে তাকাল, একটা পোস্ট ধরে দাঁড়িয়ে আছে ডরোথির বাবা। টম, তোমার কী মত?’
‘থাকছি আমি। জায়গাটা মন্দ নয়।’
নড করল এড মুর। ‘কামারশালা বসাতে একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে আমার। ঘর-বাড়ি তৈরি করার জন্যে অনেক জিনিস দরকার হবে আমাদের, অথচ ধারে-কাছে কোন স্টোর বা দোকান নেই। ক্যালিফোর্নিয়া থেকেও আনা যাবে না।’
‘সেজন্যে তো আমি রয়েছি, স্মিত হাসি দেখা গেল ল্যামসনের সঙ্গী খাড়া নাকের মুখে। ‘আমার নাম ড্যান হয়েট। ছয়টা ওয়্যাগন ভরা মালপত্র আসছে এই ট্রেইল ধরে। আমাদের নতুন শহরে দোকান খুলব!’
নিঃশব্দে ঘুরে দাঁড়াল এড ক্রেমার। এদের সঙ্গে কথা বলে লাভ হবে না। হেডলিনদের ওয়্যাগনের দিকে তাকাতে ডরোথির সঙ্গে চোখাচোখি হলো ওর, কিন্তু স্যাম ল্যামসনের দিকে মনোযোগ মেয়েটির-নতুন বসতি, নতুন শহরের পত্তন নিয়ে বিশদ পরামর্শ দিচ্ছে সে, নিজের পরিকল্পনার কথা জানাচ্ছে মোহনীয় ভঙ্গিমায়।
ধীর পায়ে ঝর্নার কাছাকাছি নিজের ক্যাম্পে ফিরে এল এড। বুট পরেই কম্বলের নিচে ঢুকে পড়ল। পপলার পাতার মর্মর ধ্বনি আর ঝর্নার মৃদু কুলকুল শব্দ কানে আসছে। অনেকক্ষণ জেগে থাকল ও, এদিকে নতুন শহর নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা করল অভিযাত্রীরা। একসময় ক্যাম্পের আলো নিভু নিভু হয়ে এল, একে একে কম্বলের নিচে ঢুকে পড়ল ভাগ্যান্বেষী মানুষগুলো। বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে ঘুমাতে গেল ওরা। ঘুণাক্ষরেও জানে না অনিশ্চিত, নাটকীয় এবং সংঘাত আর বিদ্বেষপূর্ণ এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে।
তিন
বরাবরের মতই ভোরে ঘুম ভাঙল এড ক্রেমারের। গোসল সেরে স্যাডল সাজাল স্টীল-ডাস্টের পিঠে, তারপর সতর্কতার সঙ্গে নিজের অস্ত্রশস্ত্র পরীক্ষা করল। ক্ষীণ পদশব্দ শুনতে পেয়ে ঝর্নার দিকে তাকাল ও, দেখতে পেল একটা বালতিতে পানি সংগ্রহ করছে ডরোথি হেডলিন।
‘সুপ্রভাত,’ বলল ও। শেষপর্যন্ত থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছ তোমরা?’
‘হ্যাঁ,’ ওর দিকে দু’পা এগিয়ে এল মেয়েটি। ‘আচ্ছা, এড, আমরা যখনই কিছু করতে যাই, সেটার বিপক্ষে থাকো কেন তুমি? তুমিও তো থাকতে পারো আমাদের সঙ্গে, তাই না? আমি নিশ্চিত, স্যাম ল্যামসনও তাতে খুশি হবে। পরিকল্পনাটা দারুণ ওর, ও বলছে শহরটা গড়তে হলে সৎ এবং কর্মঠ মানুষ দরকার হবে। আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছ না কেন?’
‘না, এবার আর তোমাদের সঙ্গে থাকতে পারছি না। ওয়্যাগন ট্রেনের সঙ্গে ছিলাম এতদিন, কারণ আমি জানতাম কোথায় যাচ্ছিলে তোমরা, কী ধরনের বিপদে পড়তে যাচ্ছ। তোমাদের বিশেষ করে তোমার কথাই বোঝাচ্ছি-তোমাদের সাহায্য করতে চেয়েছি। কিন্তু পরিস্থিতি এখন এমন হয়েছে যে কেউই সাহায্য করতে পারবে না তোমাদের। তাছাড়া এতে আমার মনেরও সায় নেই।’
‘রগচটা ওই বুড়োকে ভয় পাচ্ছ তুমি?’ অবজ্ঞা ঝরে পড়ল ডরোথির কণ্ঠে। ‘ল্যামসন বলেছে আমাদের এখানে থিতু হতে দেখলে কিছুই বলবে না স্পেন্সার। বয়স হওয়ায় মেজাজটা একটু চড়া ওর, এই যা। তাছাড়া প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি জমি আছে ওর।’
ক্ষীণ হাসল এড। ‘ল্যামসন লোকটার ওপর দেখছি দারুণ আস্থা রেখেছ তোমরা! সে কি বলেছে যে স্পেন্সারের ক্রুরাও সবাই বুড়ো? এও কি বলেছে যে সঙ্গে সাই ড্রানানকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় কেন ও?’
‘সে আবার কে?’ চোখ তুলে তাকাল ডরোথি, কৌতূহলী হয়ে উঠেছে, একইসঙ্গে অসন্তুষ্ট মনে হচ্ছে ওকে।
‘আমাকে খুনী বলছ তোমরা, কারণ মানুষ খুন করেছি আমি। বেশ তো। প্রয়োজন হলে আরও খুন করব, যদিও তেমন ইচ্ছে নেই আমার। কিন্তু সাই ডানানের তুলনায় কিছুই নই আমি। জাত গোক্ষুর ও! ঠাণ্ডা মাথার খুনী, তুচ্ছ কারণেও মানুষ খুন করেছে লোকটা। কোন ভদ্রলোক ওর ছায়াও মাড়াবে না!’
জ্বলে উঠল ডরোথির চোখ। ‘স্যাম ল্যামসনকে ভদ্রলোক মনে করো না তুমি? ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ কথা বলতে পারবে?’
‘নিশ্চয়ই বলব, সময় এলে ঠিকই বলব,’ শুকনো স্বরে বলল এড। ‘এবং একবার নয়, হাজারবার বলতে পারব। কিন্তু ওর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার আগেই একবার ভাবো, নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো ল্যামসনের আসল উদ্দেশ্য কী? এসব থেকে কী লাভ হবে ওর? মুখে ভ্রাতৃত্বের কথা বলে বেড়ায় সে, অথচ সাই ডানানের মত বিষাক্ত র্যাটলারকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়!’
কথা শেষ করে এক মুহূর্তও দাঁড়াল না এড, ঘুরেই স্যাডলে চাপল। এগোতে গিয়েও লাগাম টেনে ধরল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল জেফ অ্যালেন এগিয়ে আসছে, সে-ই ডেকেছে ওকে।
‘এড! আমাদের সঙ্গে পশ্চিমে যাবে নাকি?’
‘পশ্চিমে যাচ্ছ তোমরা?’
‘হুঁ। ছয়টা ওয়্যাগন যাচ্ছে। ভেবে-চিন্তে দেখলাম যুক্তি আছে তোমার কথায়, এখানে থেকে অযথা ঝামেলায় পড়ার কী দরকার! তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যাব। তুমি সঙ্গে গেলে সত্যিই খুশি হব আমরা।’
সামান্য দ্বিধা করল এড। পদশব্দ শুনে বুঝতে পারল বালতি তুলে নিয়ে ক্যাম্পের দিকে চলে যাচ্ছে ডরোথি, মাথা উঁচু করে রেখেছে। অহঙ্কার! এডের মনে হলো ওর উত্তরটা শোনার জন্যে সামান্য দেরি করছে মেয়েটা, তবে নিশ্চিত হতে পারল না।
অ্যালেনের দিকে ফিরে শ্রাগ করল ও। ‘নাহ্, অন্য কাজ আছে আমার।’
.
ওয়্যাগনের পাশে রান্না চড়িয়েছিল ডরোথি হেডলিন। রান্নার ফাঁকে চোখ তুলে দেখল জেফ অ্যালেনের নেতৃত্বে ছয়টা ওয়্যাগন যাত্রা করল ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশে। এদের কেউই এখানে থাকতে ইচ্ছুক নয়। গতরাতে বিদায় সংবর্ধনার পালা চুকে গেছে, কিন্তু বিদায়ের সত্যিকার সময় যখন উপস্থিত, বিষণ্ণ দৃষ্টিতে দলটাকে এগিয়ে যেতে দেখল ও। কী এক অস্বস্তি দানা বাঁধছে মনে।
বেশ কয়েক বছর ধরেই অ্যালেনকে চেনে ও, একেবারে ছেলেবেলা থেকে। টেড হেডলিনের বন্ধু ছিল সে। মানুষটা ছোটখাট, কিন্তু নির্ভর করার মত। এখন চলে যাচ্ছে সে। তার সঙ্গে আরও পাঁচটা পরিবার যোগ দিয়েছে, এদের অনেকেই ডরোথির দেখা সবচেয়ে ভদ্র ও নিরীহ মানুষ।
স্যাম ল্যামসনের পরামর্শ শুনে কি ভুল করছে ওরা?
উইলো ঝাড়ের দিক থেকে এগিয়ে এল টেড হেডলিন, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বেতের একটা লাঠি ব্যবহার করছে ছড়ি হিসেবে। ক্যাম্পে এসে ডরোথির পাশে দাঁড়াল, গম্ভীর দেখাচ্ছে মুখ। দীর্ঘদেহী মানুষ সে, ল্যামসন বা ক্রেমারের মতই দীর্ঘ; কানের কাছে চুলে পাক ধরেছে। মুখে না-কাটা দাড়ি। সাহসী, স্বাধীনচেতা মানুষ সাধারণত নিজের পছন্দমত চলতে অভ্যস্ত; এবং নিজেকে নিয়ে থাকতেই পছন্দ করে।
ওদের দিকে এগিয়ে এল প্যাট গ্যাভিন। ‘এডও ওদের সঙ্গে গেছে নাকি? ওকে তো দেখলাম না।’
‘মনে হয় না ওদের সঙ্গে গেছে সে,’ বলল হেডলিন। ‘যদিও জেফ চাইছিল ওদের সঙ্গে যাক এড।’
‘উঁহু, যায়নি সে,’ জানাল পিট ল্যাস্কার, নিজের ওয়্যাগন ছেড়ে ওদের দিকে এগিয়ে এল। ইলিনয়সে থাকতে উকিল ছিল সে। ‘ঘণ্টাখানেক আগে ক্যানিয়নের ভেতর দিয়ে চলে যেতে দেখলাম ওকে।’
‘আচ্ছা, স্পেন্সার লোকটা ঝামেলা করবে মনে হয়?’ জানতে চাইল গ্যাভিন।
শ্রাগ করল ল্যাস্কার। ‘মনে হয় না। শুরুর দিকে পশ্চিমে এসেছে এমন কিছু মানুষকে চিনি আমি। নিজের আশপাশে নতুন বসতি গড়ে উঠতে দেখতে পছন্দ করে না ওরা, কিন্তু কিছুদিন পর মোটামুটি মেনে নেয়। ল্যামসন কোথায়?
‘দো-আঁশলা লোকটার সঙ্গে কোথায় যেন গেছে, জানাল গ্যাভিন ‘ভাগ্যিস, লিও চলে যায়নি ওদের সঙ্গে! ছোকরা ম্যান্ডোলিন বাজাতে জানে বটে! ও চলে গেলে গান শোনা হত না আর। প্রথমে অবশ্য চলে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল ওর, একেবারে শেষ মুহূর্তে কী মনে করে থেকে গেছে। ল্যামসন এবং হিউর সঙ্গে শহরের জন্যে জায়গা বাছাই করতে গেছে ও।’
‘যাক, একটা শহরও তাহলে পাচ্ছি আমরা!’ বলল হেডলিন। কোথায় হবে শহরটা?’
‘পপলার ক্যানিয়ন আর স্পেন্সার ভ্যালি যেখানে একসঙ্গে মিশেছে, আপাতত ওদিকে শহর গড়ার পরিকল্পনা করেছে ল্যামসন। খোলা প্রশস্ত জায়গা, দেখতেও সুন্দর। পানি বা ঘাসের অভাব নেই। ড্যান হয়েট একটা দোকান বসাবে। ভাবছি আমিও অফিস খুলব। এড মুর তো আগে থেকে ঠিক করে রেখেছে কামারশালা বসাবে।
‘বাবা, সাই ডানান নামের কোন লোকের নাম শুনেছ?’ চিন্তিত স্বরে জানতে চাইল ডরোথি। ‘সাই ড্যানান?
কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল হেডলিন। ‘কেন? উহুঁ, মনে পড়ছে না!’
‘এমনি, কিছু না।’
.
পরদিন সকালে ক্যাম্প গুটিয়ে পপলার ক্যানিয়নে চলে এল ওরা। এখানেই শহর গড়ে উঠবে। ধীরে ধীরে এগোচ্ছে দশটা ওয়্যাগন। ক্যানিয়নের উঁচু পাথুরে দেয়াল ক্রমশ প্রশস্ত হচ্ছে। সতেজ সবুজ ঘাস জমিনে, ষাঁড়গুলোর হাঁটু অবধি লম্বা। নদীর ধারে-কাছে উইলো আর পাইনের ঘন বন। ক্যানিয়নের আরও ওপরে এল্ডার, বার্চ, মেহগনি এবং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বেড়ে ওঠা লজপোল পাইনের শাখা দেখা যাচ্ছে।
ওয়্যাগন চালাচ্ছে টেড হেডলিন। নিজের সোরেল মেয়ারের পাশে রাইড করছে ডরোথি।
ক্যানিয়নের শেষ মোড় ঘুরতে সামনে বিস্তীর্ণ সবুজ উপত্যকা নজরে পড়ল। কিছু দূরে স্যাম ল্যামসনকে দেখতে পেল ডরোথি, কালো মেয়ারে চেপেছে। লিও কারভার, ড্রানান এবং হিউ টেলর রয়েছে সঙ্গে। শহরের রাস্তা আর দোকান-পাটের জন্যে জায়গা ঠিক করছে ওরা।
আলতো স্পার দাবাল ডরোথি, দুলকি চালে এগোল ঘোড়াটা। পেছনে হাওয়ায় উড়ছে ওর সোনালী চুল।
উপত্যকার ঢাল নেমে গেছে স্পেন্সার ভ্যালির তলায়। এগিয়ে চলল ডরোথি। আচমকা, একটা উঁচু টিলার মোড় ঘুরে সামনে তাকাতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল ওর।
বিস্তীর্ণ উপত্যকা বিছিয়ে আছে বিশাল চাদরের মত। সকালের সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে সবুজ ঘাস। দারুণ সুন্দর। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চরছে গরুর পাল। ঘাসগুলো এতই দীর্ঘ যে গরুর পেট পর্যন্ত ঢেকে ফেলেছে। বাতাসে দুলছে ওগুলোর ডগা, সবুজ বহতা সাগরের মত ঢেউ উঠেছে। অতুলনীয় সৌন্দর্য, নিঃশ্বাস আটকে রেখে ভাবল ডরোথি। কল্পনার চেয়েও সুন্দর এবং সমৃদ্ধ। দু’পাশে, একেবারে দিগন্তের শেষ সীমানা পর্যন্ত উপত্যকাকে ঢেকে রেখেছে ক্যানিয়নের দেয়াল, এখানে-সেখানে কিছু রীজের চূড়ায় উঠে গেছে ঢাল হয়ে। পর্বতের চূড়ায় শুভ্র বরফ জমেছে, সূর্যালোকে ঝিলিক মারছে ক্ষণে ক্ষণে। এমনকী ক্যানিয়নের পাথুরে দেয়ালেও রোদ ঠিকরে পড়ছে।
এটাই ড্যান স্পেন্সারের সাম্রাজ্য। সব অর্থেই সমৃদ্ধ। এই উপত্যকার কথাই ওকে বলেছে এড ক্রেমার। এড যে মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে কথা বলবে তাতে বিস্ময়ের কী আছে, কিংবা সারা পৃথিবীতে এটাই তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা, তাতেও বিস্ময়ের কিছু নেই।
খুরের শব্দে সংবিৎ ফিরে পেল ডরোথি, এতক্ষণ কী এক ঘোরের মধ্যে ছিল যেন, ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল। ঘোড়া দাবড়ে ওর পাশে এসে পৌঁছল স্যাম ল্যামসন, উজ্জ্বল দেখাচ্ছে মুখ।
‘দেখো, প্রাণ ভরে দেখে নাও!’ প্রায় চিৎকার করল সে। ‘অতুলনীয়, তাই না? সারা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য! ছিনিয়ে নেয়ার মত জিনিসই বটে!’
ঝট করে ফিরে তাকাল ডরোথি। ল্যামসনের চোখে সপ্রশংস চাহনি ছাড়াও আরও কী যেন আছে, নিশ্চিত হতে পারল না-হয়তো সন্তুষ্টি কিংবা লোভ! দৃষ্টি ফিরিয়ে উপত্যকার দিকে তাকাল ও, অনুভব করল অজানা এক অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে ওকে। ‘কী…কী বললে?’ নিচু স্বরে জানতে চাইল ডরোথি। ‘ছিনিয়ে নেয়ার মত জিনিস? এই উপত্যকার কথা বলছ?’
ওর দিকে তাকাল সে, হেসে উঠল এরপর। ‘আরে না! ড্যান স্পেন্সারের কথা ভাবছিলাম, এই উপত্যকার মালিক যে লোকটা। ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে এটা কেড়ে নিয়েছে সে, জোর করে। মানুষটা সে নিষ্ঠুর এবং দারুণ হিংসুটে, কোন কিছুতেই থামতে জানে না!’
‘তোমার কি মনে হয় আমাদের সঙ্গে ঝামেলা করবে সে?’ উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল ডরোথি
শ্রাগ করল ল্যামসন। ‘করতেও পারে। যদি করে, সামাল দেয়ার ক্ষমতা আছে আমাদের। এ ব্যাপারটা ঠিকই সামলাতে পারব আমরা। চলো, ফেরা যাক।’
ফেরার পথে প্রায় নীরব থাকল ডরোথি। বারবার এড ক্রেমারের একটা প্রশ্ন ভিড় করছে মনে। স্যাম ল্যামসনের মতলবটা কী? কী চায় সে? স্যাম ল্যামসনের চাটুকারি গল্পে মশগুল হয়ে ছিল ও, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের মোহে ঘোরের মধ্যে থাকায় ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল, প্রায় উপেক্ষা করেছে; কিন্তু এবার মনে পড়তে কিছুটা হলেও সন্দিহান হয়ে উঠল ডরোথি-সত্যিই তো, কী স্বার্থে ওদের এখানে নিয়ে এসেছে ল্যামসন?
অন্তত এখন আর প্রশ্নটা উপেক্ষা করা যাচ্ছে না।
.
পরের তিন দিন শহরের কাজে ব্যস্ত থাকল সবাই। নাম দেয়া হয়েছে ‘পপলার’। সবার আগে ড্যান হয়েটের দোকান তৈরি হলো, মালপত্র আর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসে ঠাসা দোকানের শেলফগুলো।
‘দেনা নিয়ে চিন্তা কোরো না,’ উদার হাসি উপহার দিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করছে সে। একসঙ্গে এখানে এসেছি আমরা। যার যা দরকার নিয়ে নাও, খাতায় লিখে রাখব আমি। ফার বা ফসল উঠলে শোধ করে দিয়ো।
ব্যাপারটা সহজ। অস্বাভাবিক ভাবে কিন্তু খুব সহজে মিটে গেল। কোন সমস্যাই থাকল না আর। ক্রীকের মোড়ে গাছের ছায়ায় বাড়ি তৈরি করল টেড হেডলিন। ডরোথির জন্যে নতুন পোশাক এবং নিজের জন্যে জিন্স কিনল। ময়দা, বেকন আর যন্ত্রপাতি, সবই এল ঘরে।
প্রথম তিনটে দিন টানা পরিশ্রম করতে হলো, সানন্দে করল সবাই-কষ্টকর কিন্তু আনন্দপূর্ণ ও ক্লান্তিহীন শ্রম। সবার মুখেই হাসি। বাড়ি তৈরি করার ব্যাপারটা বোধহয় বরাবরই নিখাদ আনন্দের, সেটা বসতবাড়ি হোক আর দোকানই হোক। তিন দিনের মধ্যে ড্যান হয়েটের স্টোর, মুরের কামারশালা, পিট ল্যাস্কারের অফিস, কলিন্সের স্যালুন আর থিয়েটার দাঁড়িয়ে গেল।
তারপর, একদিন হয়েটের স্টোর থেকে বেরিয়ে আসার পর রাস্তায় তিনজন আগন্তুককে দেখতে পেল ডরোথি হেডলিন। ঘোড়াগুলোকে হাঁটিয়ে নিয়ে আসছে ওরা, নিদারুণ বিস্ময় নিয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে।
হিউ টেলর বেরিয়ে এসে দাঁড়াল ডরোথির পেছনে। তাকে দেখে থামল তিন আগন্তুক। দীর্ঘ, সুঠামদেহী, কঠিন চেহারার লোকটাই কথা বলল। লালচে গোঁফ প্রায় চিবুক ছুঁয়েছে তার। ‘এই যে, তোমাকে বলছি!’ খানিকটা উৎসুক স্বরে ডাকল সে। হচ্ছে কী এখানে, বলো তো?’
‘শহর গড়ে তুলছি,’ নিস্পৃহ স্বরে উত্তর দিল টেলর। ‘আপত্তি আছে তোমাদের?’
বাঁকা হাসি দেখা গেল লোকটার মুখে। ‘আমার আপত্তি নেই, স্যর, কিন্তু বসের আপত্তি থাকতে পারে। আমার তো ধারণা শুনেই খেপে যাবে সে।’
‘বস্-টা কে?’ তাচ্ছিল্যের স্বরে জানতে চাইল টেলর। ‘কিংবা তার খুশি-অখুশিতেই বা কী যায় আসে? কারও বাপের জমি না এটা। খোলা জমি, যে-কেউ ইচ্ছে করলে বসতি করতে পারে, কিংবা শহরও তৈরি করতে পারে, তাই না?’
‘ড্যান স্পেন্সার আমাদের বস্, চারপাশে চকিত দৃষ্টি চালিয়ে বলল রেড। সপ্রশংস দৃষ্টিতে ডরোথিকে দেখল সে, চোখে খানিকটা কৌতুক ফুটে উঠল। ‘ঠিকই বলেছ, কারও বাপের জমি নয় এটা। মুক্ত এলাকা। যে-কেউ বসতি করতে পারে। ত্রিশ বছর আগে ঠিক এই কাজটা করেছিল ড্যান স্পেন্সার। বুঝতেই পারছ এখানে যেটা ধরে রাখা সম্ভব, তাই অর্জন করে মানুষ। ড্যান স্পেন্সার এখানে এসেছিল সেই তখন, যখন পুবে সুখে- শান্তিতে ছিলে তোমরা। বুনো একটা জায়গায় বসতি করেছে সে, এজন্যে ঘামও ঝরিয়েছে। শিকার করার পাশাপাশি কিছু সোনাও তুলেছিল সে, তারপর পুবে গিয়ে গরু কিনে ফিরে এসেছে আবার। অবস্থাটা চিন্তা করে দেখো, আজ থেকে দশ বছর আগে এই এলাকায় গরুর পাল নিয়ে আসা কতটা ঝক্কির আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল! কিন্তু সফল হয়েছে স্পেন্সার। সেই ছোট্ট পালটাই এখন দেশের সেরা আউটফিটের একটি। আমার মনে হয় না নিজের জমির চারপাশে তোমাদের ঘোরাঘুরি করতে দেখলে খুশি হবে সে।
‘স্বার্থপর মানুষ!’ অবজ্ঞার সুরে মন্তব্য করল ডরোথি। ‘কিন্তু এতটা স্বার্থপর হওয়ার কী আছে? এখানে এত জমি আছে যে অনায়াসে হাজার লোক বসতি করতে পারবে!’
ওর দিকে ফিরে তাকাল সে। ‘এটা শুধুই তোমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, ম্যা’ম। তুমি যেভাবে ব্যাপারটাকে দেখো। পুবের সামাজিক অবস্থা চিন্তা করলে হয়তো তোমার কথাই সত্যি মনে হতে পারে। কিন্তু পশ্চিমে এই ধারণা একেবারে অচল। যার যার বসতির পরিধি অনুযায়ী এখানে জায়গার পরিমাণ নির্ধারিত হয়। ড্যান স্পেন্সার ওর র্যাঞ্চে গরু পুষছে। হাজার হাজার লোককে গরু সরবরাহ করছে সে। এবং এজন্যে অনেক জমি দরকার। কি জানো, ম্যা’ম, হাজার হাজার লোক কখনও নিজের মাংসের যোগান নিজে করতে পারে না; তাদের হয়ে অন্য কেউ কাজটা করে এবং সেজন্যে তার দরকার হবে প্রচুর জমি। নিশ্চিত থাকো, স্পেন্সার এই জমি সৎ উপায়েই অর্জন করেছে।’
‘ইন্ডিয়ানদের খুন করে!’
চিন্তিত ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকাল সে। কেউ নিশ্চয়ই স্পেন্সার সম্পর্কে মিথ্যে বলেছে তোমাকে, ম্যা’ম। ডাহা মিথ্যে। এ পর্যন্ত অন্যায় ভাবে কোন ইন্ডিয়ানকে মারেনি ড্যান স্পেন্সার।’
‘হচ্ছে কী এখানে?’ রাস্তায় দেখা গেল স্যাম ল্যামসনকে, তার ঠিক পেছনে সাই ডানান আর মার্টি থ্যাচার। স্টোরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে জনি গ্যারেট।
‘কিছুই না, মিস্টার,’ আরও চিন্তিত দেখাল রেডকে। আচমকা তীক্ষ্ণ হয়ে এল চাহনি, ল্যামসনকে ছাড়িয়ে গেল তার দৃষ্টি, ডানানের ওপর স্থির হলো। সঙ্গে সঙ্গে আড়ষ্ট হয়ে গেল লোকটার দেহ-স্পষ্ট দেখতে পেল ডরোথি। ‘উপত্যকার মালিকানা সম্পর্কে আলাপ করছিলাম। ড্যান স্পেন্সারের হয়ে রাইড করি আমরা…
‘বেশ তো, এবার কেটে পড়ো, তীক্ষ্ণ স্বরে নির্দেশ দিল ল্যামসন। ‘জলদি!’
আগন্তুকদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে ডরোথি, দ্বিতীয়জনের নিচু স্বরের ফিসফিসানি ঠিকই কানে এল ওর: ‘রেড, সাবধান! ও সাই ড্যানান!’
স্যাডলে আড়ষ্ট হয়ে গেল রেডের দেহ, স্থির হয়ে গেল লাগাম ধরা হাত। পমেল থেকে হাত সরিয়ে নিল সে ধীরে ধীরে, এতটা সতর্কতার সঙ্গে যাতে কেউ সেটাকে উস্কানি বলে ভুল করতে না পারে। দেহের পাশে নেমে এল তার হাত। একটা শব্দও খরচ করল না কেউ, ঘোড়া ঘুরিয়ে দ্রুত কেটে পড়ল।
‘এটা কেবল শুরু,’ সশব্দে নিঃশ্বাস ফেলল ল্যামসন, যেন আক্ষেপ করছে। ‘আমি নিশ্চিত পরেরবার এলে আমাদের এখান থেকে তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে ওরা।’
‘কিন্তু ওদেরকে দেখে তো মনে হলো না ঝামেলা করার তালে ছিল, ‘ দ্বিধান্বিত স্বরে মন্তব্য করল হিউ টেলর। ‘অন্তত কথাবার্তায় তো…’
‘বোকা বনে যেয়ো না!’ সতর্ক করল ল্যামসন। ‘ড্যান স্পেন্সার লোকটা স্রেফ আউট-ল। আউট-ল না হলে কি নির্জন জায়গায় এসে র্যাঞ্চ করে? যাকগে, লোকটা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। নিজেদের শেষ সম্বল নিয়ে এখানে এসেছি আমরা, বহু পথ পাড়ি দিয়েছি থিতু হওয়ার আশায়। একজন রগচটা মানুষের ইচ্ছেয় আমাদের চেষ্টা বিফলে যেতে পারে না, কিংবা সেটা বিসর্জন দেয়াও বোকামি হবে। দেখা যাক না, স্পেন্সার কী করে। ধৈর্য ধরব আমরা, আপাতত নীরব দর্শক হয়ে থাকব। মুক্ত এলাকা এটা। প্রয়োজনের চেয়েও বেশি জমি আছে স্পেন্সারের দখলে। আমাদের চাহিদা তো সামান্য। ড্যান স্পেন্সারের লোভ বা জেদের জন্যে নিশ্চয়ই নিজেদের স্বপ্ন বিসর্জন দিতে পারি না আমরা?’
জায়গাটা দারুণ পছন্দ হয়েছে টেড হেডলিনের। ইতোমধ্যে ক্যানিয়নের তলায় উর্বর জমিতে চাষ দিয়ে ফেলেছে সে। টেডের মনে হচ্ছে মনের মত জায়গায় বসতি করেছে। উপত্যকার মাটি সত্যিই উর্বরা, এমন এক জমি যেখানে কখনও লাঙলের আঁচড় পড়েনি। ক’দিন সকাল- বিকাল খেটে প্রায় কয়েক একর জমিতে চাষ দিয়ে ফেলল। প্রয়োজনীয় বীজ সংগ্রহ করেছে ড্যান হয়েটের স্টোর থেকে। লোকটার কাছে যেন কোন কিছুর ঘাটতি নেই! যার যা প্রয়োজন, দেখা যাচ্ছে সবই রয়েছে তার কাছে।
জমি চাষের পাশাপাশি অন্যদের বাড়ি তৈরির কাজেও সাহায্য করছে টেড হেডলিন। কেবল সাই ডানান এবং ড্যান হয়েটের যেন কোন কাজ নেই। স্টোরে পড়ে থাকে হয়েট, আর ড্যানান সারাক্ষণ তার আশপাশে জোঁকের মত লেগে থাকে।
স্যাম ল্যামসনও বসে নেই, প্রয়োজনে সেও সাহায্য করছে; কিন্তু ডরোথি খেয়াল করেছে কখনোই নিরস্ত্র থাকে না লোকটা, কোমরে জোড়া হোলস্টার বয়ে বেড়ায়, উপরন্তু রাইফেলটা সর্বক্ষণ হাতের নাগালের মধ্যে রাখে। প্রায় প্রতি রাতে সেলুনে পোকার খেলতে বসে সে, থ্যাচার গ্যারেট বা অন্যরা যোগ দেয় সঙ্গে। সুযোগ পেলেই খোঁজখবর নেয়ার জন্যে আসে সে, হয়তো মিনিট কয়েকের জন্যে, কিন্তু দিনে একবার আসবেই।
দরজার কাছাকাছি গাছের চারা বুনছিল ডরোথি, একদিন এল সে। মিনিট কয়েক নীরবে ওর কাজ দেখল, তারপর কাছে এসে দাঁড়াল। ‘ডরোথি, ছোটখাট কিন্তু শক্ত এসব কাজ না করলেও চলে তোমার,’ বলল সে। ‘এত সুন্দর তুমি! সুন্দর হাতে এসব কাজ মানায় না। তোমার দায়িত্ব আমাকে দিচ্ছ না কেন?’
চোখ তুলে সরাসরি ল্যামসনের দিকে তাকাল ডরোথি, সিরিয়াস হয়ে উঠেছে। ‘এটা কি কোন প্রস্তাব?’
খানিকটা অপ্রতিভ দেখাল ল্যামসনের চোখজোড়া, তারপর ক্ষীণ হাসল সে। ‘আর কী হতে পারে? আমার তো মনে হয় সত্যি সত্যিই এরকম কিছু ভাবার সময় হয়ে গেছে।
‘উঁহুঁ, আপাতত ওসব নিয়ে ভাবছি না,’ চিন্তিত স্বরে বলল ডরোথি। ‘তাড়াহুড়োর কিছু নেই, তুমি বরং অপেক্ষা করো। সামনে অনেক কাজ আমাদের, সবার বাড়ি তৈরি হোক, সবকিছু ঠিকঠাক হলে না হয়…’
‘বেশ তো,’ অনিচ্ছুক স্বরে বলল ল্যামসন। ‘কিন্তু তুমিও জানো, বাড়ি তৈরি হতে বেশি সময় লাগবে না।’
সে-রাতে খাওয়ার সময় হঠাৎ করেই প্রশ্নটা এল ডরোথির মনে। সবাই বাড়ি তৈরি করেছে, কিন্তু ল্যামসন তৈরি করেনি কেন? শেষ করা দূরে থাক, এমনকী বাড়ি তৈরির কাজও শুরু করেনি। সেলুনের পেছনে ছোট্ট একটা কামরায় থাকে সে, একেবারে ঘুপচির মত জায়গা, সম্ভবত কয়েকটা লিকারের পিপে আর জঞ্জালই থাকে ওখানে।
আগে মাথায় না এলেও ব্যাপারটা চিন্তিত করে তুলল ওকে, অজানা এক অস্বস্তি বোধ করছে সারাক্ষণ। ব্যাপারটা কি গোলমেলে নয়? সবাই যার যার বসতি তৈরিতে ব্যস্ত, কারও কারও স্বপ্ন শুধু বাড়ি বা জমি নিয়েই সীমাবদ্ধ নয়, বরং ফসল আর গবাদি পশু নিয়েও ভাবছে। ওর বাবার কথাই ধরা যাক, জমিতে ফসল ফলানোর চিন্তা-ভাবনা করছে টেড হেডলিন, নিজের পরিকল্পনার কথা সোৎসাহে বলে বেড়াচ্ছে।
পরদিন সকালে ডরোথি হঠাৎ করেই আবিষ্কার করল আশপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না ল্যামসনকে, এমনকী কালো মেয়ারটাও উধাও হয়ে গেছে। কোথাও গেছে বোধহয়। দুপুরের পর রাস্তায় দেখা গেল তাকে, শহরের দিকে আসছে। পেছনে ছয়টা ওয়্যাগন, নানা মালপত্রে বোঝাই। স্টোর আর সেলুনের সামনে এসে থামল ওয়্যাগন।
দূর থেকে ডরোথিকে দেখতে পেল ল্যামসন। হাঁটুর গুঁতোয় ঘোড়াকে আগে বাড়াল সে, হেডলিনদের বাড়ির সামনে চলে এল। ‘দেখেছ?’ স্মিত হাসার সময় একটা হাত নাড়ল সে। ‘সাপ্লাই নিয়ে এসেছি! পুরো এক বছরের সাপ্লাই। আরও যদি দরকার হয়, ফোর্টে লোক পাঠিয়ে আনিয়ে নেব।’
‘তারমানে ফোর্টে আগে থেকে ফরমাশ দিয়ে রেখেছিলে তুমি?’ জানতে চাইল ডরোথি। ‘বেশ দূরদর্শী লোক তুমি, মি. ল্যামসন।’
স্মিত হাসি ধরে রাখল ল্যামসন, তবে ভেতরে ভেতরে কিছুটা হলেও বিব্রত বোধ করছে। ‘ব্যাপারটা আসলে অন্যরকম, শুরুতে ভেবেছি ক্যালিফোর্নিয়ার মাইনিং ক্যাম্পে বেচে দেব এসব। এখন যখন এখানেই শহর তৈরি হয়ে গেছে, ক্যালিফোর্নিয়ায় পাঠাব কেন?’
খুঁতখুঁতে ভাবটা গেল না, মোটেও নিশ্চিন্ত হতে পারল না ডরোথি, যদিও স্যাম ল্যামসনের ব্যাখ্যার মধ্যে কোন খুঁত নেই। প্রায় সারাটা দিন কাজের ফাঁকে অসংখ্যবার মনে ঘুরপাক খেল ব্যাপারটা, কোথায় না জানি একটা ফাঁক রয়ে গেছে, ধরতে পারছে না। আবার এমন কিছুও চোখে পড়ছে না যা থেকে সন্দেহ নিরসন হতে পারে কিংবা ধারণাটা আরও পাকা হতে পারে। কেবলই মনে হচ্ছে ওই সাপ্লাইয়ের ব্যাপারে কোন গোলমাল আছে। স্যাম ল্যামসন মালভরা ওয়্যাগন নিয়ে আসায় এতটা অস্থির বোধ করছে কেন ও? ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশে ওয়্যাগন নিয়ে যাত্রা করবে কেউ, এতে অস্বাভাবিকতার কী রয়েছে?
ঝর্নার ধারে প্যাট গ্যাভিনের সঙ্গে দেখা হলো ওর, পানি নিতে এসেছে সে। ডরোথির উদ্দেশে ক্ষীণ হাসল, হ্যাট সরিয়ে দিয়ে কপালের ঘাম মুছল। ‘প্রচুর কাজ, তাই না, ম্যা’ম? তোমার বারা বোধহয় শিগগিরই লাঙল চালাবে জমিতে, আমরা কেউ শুরু করার আগেই জমিতে বীজ বুনে ফেলবে সে।’
জবাবে স্মিত হাসল ডরোথি, তারপর আচমকা জানতে চাইল: ‘আচ্ছা, প্যাট, তুমি কি জানো ক্যালিফোর্নিয়ার খনিগুলোতে কীভাবে সাপ্লাই পাঠানো হয়?’
ঝুঁকে পাত্রে পানি ভরছিল গ্যাভিন, সে-অবস্থায় ফিরে তাকাল ডরোথির দিকে, খানিকটা বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে তাকে। কেন, জাহাজে করে! সমুদ্র পথেই খরচা কম পড়ে। হঠাৎ এ কথা জানতে চাইলে যে, কোন ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করছ?’
‘ঠিক তা নয়। দুপুরে ওয়্যাগনগুলো আসার পর থেকে ভাবছি। ল্যামসন বলল সাপ্লাই ওয়্যাগনগুলো নাকি ক্যালিফোর্নিয়ায় পাঠানোর ইচ্ছে ছিল ওর, কিন্তু হাতের নাগালে যেহেতু বাজার মানে আমাদের শহরটা রয়েছে, তাই সিদ্ধান্ত পাল্টে এখানে নিয়ে এসেছে। সমুদ্র পথেই যদি ক্যালিফোর্নিয়ায় সাপ্লাই পাঠাতে খরচা কম হয়, তাহলে এভাবে ওয়্যাগনে করে পাঠাচ্ছিল কেন?
‘কী জানি, হয়তো অনেক টাকার ব্যাপার!’ পানি ভরা পাত্র তুলে নিয়ে দু’পা এগোল গ্যাভিন, একটা কাঁধ নাচিয়ে শ্রাগ করল। ‘আজব ব্যাপার তো! তবে, আসল কারণ যাই হোক, সেটা ল্যামসনই ভাল জানে!’
.
ডরোথি আশঙ্কা করেছিল ড্যান স্পেন্সারের পক্ষ থেকে হয়তো ঝামেলা হবে, কিন্তু এমন কিছুই ঘটল না। শহরের ধারে-কাছে কোন রাইডারকে দেখা গেল না, যদিও গভীর উপত্যকায় দু’একজন রাইডারকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেল শুধু। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে স্যাম ল্যামসনের কথাই ঠিক, গণ্ডগোল এড়িয়ে যাবে স্পেন্সার, ওদের সঙ্গে ঝামেলা করার সাহস করবে না।
তারপরও শহরের কাজকর্মে ছন্দপতন ঘটেছে। একটা ওয়্যাগনে কিছু লিকার নিয়ে এসেছে স্যাম ল্যামসন। বেশ কয়েকজন দিনের বেশিরভাগ সময় সেলুনের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে। প্রতি সন্ধেয় ওখানে চলে যায় মাটি থ্যাচার, যদিও দিনের বেলায় নিজের জায়গায় কাজ করে। অন্য কেউ না থাকলেও সেলুনের কাছাকাছি থাকে সাই ড্রানান, এমনকী তার নিজস্ব লোকজন থাকলেও। ড্যান হয়েটের স্টোরের জন্যে সাপ্লাই নিয়ে আসা লোকগুলো শহর ছেড়ে যায়নি, বরং এখানেই কাজ নিয়েছে কেউ কেউ; অন্যরা স্রেফ ঘোরাঘুরি করছে, কিছু না করলেও সর্বক্ষণ অস্ত্র থাকছে ওদের কাছে। একজন বারটেন্ডার হিসেবে কাজ নিয়েছে।
কাজের চাপে বাইরে বেরোনোর সুযোগ পেল না ডরোথি, বাড়ির মধ্যে ব্যস্ত থাকতে হলো ওকে। মাঝে মধ্যে হয়তো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়েছে, ক্রমশ গজিয়ে ওঠা বাড়ির কাঠামোগুলো দেখেছে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে। খুব দ্রুত গড়ে উঠছে পপলার টাউন। অজান্তে দৃষ্টি চলে যায় পপলার ক্যানিয়ন বরাবর, নির্দিষ্ট একটা ট্রেইলের দিকে-এই ট্রেইল ধরে পপলার ক্যানিয়নে এসেছিল ওরা।
কী দেখতে চাইছে, নিজের কাছেও স্বীকার করতে অনিচ্ছুক ডরোথি স্টীল-ডাস্ট স্ট্যালিয়ন কিংবা ওটার নিঃসঙ্গ সওয়ারীকে দেখতে পাবে? কোথায় গেছে এড ক্রেমার? পশ্চিমে যাবে না সে নিজের কানেই শুনেছে ও। তাহলে কোথায় গেল?
বাইরে ঘোড়ার খুরের শব্দ হতে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল ডরোথি। জেন গ্যাভিন এসেছে, প্যাট গ্যাভিনের মেয়ে। বাপের মতই শক্ত ধাতের মেয়ে জেন, সাহসী এবং ধৈর্যশীল।
‘ডরোথি, চলো, চারপাশে চক্কর দিয়ে আসি! সারাদিন বসে থাকতে থাকতে পায়ে খিল ধরে গেছে আমার, এভাবে টিকতে পারব না!’
সানন্দে রাজি হয়ে গেল ও। মিনিট কয়েকের মধ্যে শহর ছাড়িয়ে প্রেয়ারিতে চলে এল ওরা। ক্যানিয়নের দিকে এগোল।
‘সাই ড্যানানকে খেয়াল করেছ?’ আচমকা জানতে চাইল জেন। ‘কীভাবে মেয়েদের দিকে তাকায় লোকটা? দেখলেই গা ঘিনঘিন করে আমার!’
‘আমি তো শুনেছি লোকটা একজন বন্দুকবাজ।
‘কোন সন্দেহ নেই!’ হাসি-খুশি জেন গ্যাভিনের মুখে আনন্দের ছাপ। মোটামুটি সুন্দরী বলা চলে ওকে। ‘বাবা তো ওকে দেখতেই পারে না। বুঝি না, ওকে এত পাত্তা দেয় কেন স্যাম ল্যামসন।’
পপলার ক্যানিয়নের মুখের কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। আচমকাই ধারণাটা এল ডরোথির মাথায়। কোন কিছু না বলে পুরানো ক্যাম্পের দিকে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিল ও। দুলকি চালে ছুটল ঘোড়া দুটো। পপলারের সারি পেরিয়ে খোলা জায়গায় চোখ পড়তে বিষাদ আর নিরাশায় ভরে গেল মনটা। এখানেও পাত্তা নেই এড ক্রেমারের!
আরও মাইলখানেক এগোল ওরা, আচমকা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল জেন। ‘আরে, দেখো দেখো!’ আঙুল তুলে রুক্ষ মাটির ওপর কিছু দাগ দেখাল ও। ‘ক্যানিয়নের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে চাকার দাগ! আজব কাণ্ড! ক্যানিয়নে কারও ওয়্যাগন রাখার তো কথা নয়!’
দাগগুলো দেখল ডরোথি, তারপর ক্যানিয়নের দিকে তাকাল। প্রবেশ পথটা সঙ্কীর্ণ, রুক্ষ। চারপাশে ঝোপ আর গুল্ম জাতীয় গাছের ছড়াছড়ি, প্রায় ঢেকে রেখেছে পথ। ঘোড়ার পেটে মৃদু খোঁচা দিল ও, ক্যানিয়নের একেবারে কাছাকাছি চলে গেল ঘোড়াটা। কাছ থেকে ট্র্যাকগুলো দেখার সুযোগ হলো এবার। মিনিটখানেকের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেল: ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়ে এসেছে ওয়্যাগনগুলো, ভেতরে ঢোকেনি। চিন্তিত ভঙ্গিতে পাহাড়ের দিকে তাকাল ডরোথি, তারপর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে পিছু পিছু আসা জেন গ্যাভিনের দিকে ফিরল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে জেন, তবে নিজ থেকে কিছু জানতে চাইল না, বরং নীরবে অনুসরণ করল ডরোথিকে।
ওয়্যাগনের ট্র্যাক অনুসরণ করে নিজেদের ট্রেইলে ফিরে এল ওরা। বেশ পুরানো ট্র্যাক।
‘ব্যাপারটা কী, ডরোথি? বিস্মিত স্বরে জানতে চাইল জেন, ভুরু কুঁচকে আছে ওর। ‘কোন সমস্যা?’
‘ঠিক জানি না…আমরা যখন প্রথম এসেছিলাম, স্পষ্ট মনে আছে এখানে কোন ট্র্যাক ছিল না, অথচ নিজের চোখেই দেখলে ক্যানিয়ন থেকে ওয়্যাগনগুলো বেরিয়ে এসেছে।
বিস্ফারিত হলো জেনের চোখজোড়া। ‘বলতে চাইছ এগুলো ল্যামসনের সাপ্লাই ওয়্যাগনের দাগ? তারমানে ভিন্ন কোন ট্রেইল ধরে আগেই ওগুলো নিয়ে এসেছিল সে?’
ডরোথি অবশ্য ভিন্ন ভাবে চিন্তা করছে, কিন্তু জেনের প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়ল। ‘এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বোলো না,’ ফিরতি পথে এগোল ও, মনে মনে ক্যানিয়নের ভেতরে জায়গাটার কথা ভাবছে। ঝোপঝাড় আর নিরেট দেয়াল দেখে যা মনে হয়েছে, খুব বেশি জায়গা নেই, সুনির্দিষ্ট ট্রেইল না থাকারই কথা; কিন্তু গোপন কোন ট্রেইল যদি থেকে থাকে, কোথায় গেছে সেটা? যদি উত্তরে ওভারল্যান্ড ট্রেইলের সঙ্গে মিশে গিয়ে থাকে, ঘুরপথ বলে অনেক দূরত্ব পেরিয়ে আসতে হয়েছে ওয়্যাগনগুলোকে, ওরা যে-ট্রেইল ধরে এসেছে তার তুলনায় অন্তত দ্বিগুণ পথ পাড়ি দিয়েছে। এবড়োখেবড়ো আর রুক্ষ পথ, এরচেয়ে কঠিন কোন ট্রেইল চোখে পড়েনি ওর।
আচমকা চিন্তাটা খেলে গেল মাথায়। নির্ঘাত ওয়্যাগনগুলো আগে থেকে এনে রাখা হয়েছিল! ক্যানিয়নের ভেতরে, গোপন কোন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিল কেউ।
কিন্তু কেন রেখেছে? কাদের অপেক্ষায়? নতুন একটা শহরের পত্তনের অপেক্ষায়? চিন্তাটা ভালই এগোচ্ছিল, কিন্তু শহরের প্রসঙ্গ আসার সঙ্গে সঙ্গে ধারণাটা অবাস্তব মনে হলো ডরোথির কাছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও কেউ জানত না যে এখানে কোন শহরের পত্তন হবে। কারোই জানা থাকার কথা নয়, কেবল স্যাম ল্যামসন ছাড়া।
থালার মত বিছিয়ে থাকা চড়াই ধরে এগোচ্ছে ওরা। সবুজ ঘাসে ভরা পুরো উপত্যকা। নিটোল সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে চারপাশে। পাহাড়ের কোলে ব্লু-বনেট আর লাইলাকের ঝাড়। দূরে ক্লিফের দেয়ালে রোদ ঠিকরাচ্ছে, নগ্ন কিনারা বেরিয়ে আছে বাতাসে; পাহাড়ের খাঁজকাটা চূড়া আকাশ ছুঁয়েছে প্রায়। বিস্তীর্ণ পাহাড়ী ঢালে দীর্ঘ গাছের সারি-এল্ডার, বার্চ; মাঝে মধ্যে লজপোল পাইনের সুচাল মাথা উঁকি দিচ্ছে।
একেবারে নিচুতে, নিচু ড্রয়ে অ্যাসপেন, মেহগনি আর হথর্নের সারি। ঘন গাছের মাঝখান দিয়ে এগোচ্ছে ওরা। বনের কিনারার দিকে পপলারের সারি, কাছাকাছি আসতে দূর থেকে এক ঘোড়সওয়ারকে দেখতে পেল। প্রায় একইসঙ্গে লোকটাকে দেখতে পেল দু’জন, লোকটার ভঙ্গির মধ্যে এমন কিছু ছিল যে সঙ্গে সঙ্গে লাগাম টেনে ধরল ওরা। লোকটাকে চিনতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হলো না কারও।
‘ডরোথি, নিচু স্বরে বিস্ময় প্রকাশ করল জেন। ‘ওই যে, ওই লোকটাই সাই ডানান!’
‘শ্শ্শ্! চুপ করো, নইলে আমাদের কথা শুনে ফেলবে সে!’ নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে ডরোথি, আচমকা শীতল একটা অনুভূতি হলো ওর সাই ড্রানান ওদের এখানে দেখতে পেলে পরিণামে কী হবে ভাবতে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। সঙ্গে জেন গ্যাভিন আছে বটে, তারপরও দো-আঁশলার মুখোমুখি হওয়ার চিন্তা ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে মনে। যদিও ওদের উপস্থিতির ব্যাপারে মোটেও সচেতন নয় ড্রানান, সম্ভবত কাউকে আশাও করছে না; ধীর গতিতে রাইড করছে সে, বড়জোর পঞ্চাশ গজ দূরে, হাতে রাইফেল। লোকটার দৃষ্টি সেঁটে আছে নিচের উপত্যকায়, কিছু একটা দেখছে তীক্ষ্ণ মনোযোগের সঙ্গে; জিনিসটা ওদের দৃষ্টিসীমার বাইরে।
চলার মধ্যেই স্যাডল ছাড়ল সে, উপত্যকার কিনারে চলে গেল হালকা পায়ে। বিচ্ছিন্ন কয়েকটা নুড়িপাথর আর বোল্ডার রয়েছে ওখানে, তারই একটার আড়ালে গিয়ে অবস্থান নিল ড্রানান। রাইফেল তুলে নিশানা করল সে, এবং সেকেন্ড কয়েক পর ট্রিগার টেনে দিল।
টাশ্শ্!
‘কাকে গুলি করল লোকটা?’ ফিসফিস করে জানতে চাইল জেন। ‘শিকার করছে?’
‘কীভাবে বলব? সম্ভবত হরিণ শিকার করেছে। যাকগে, চলো, ফেরা যাক।’
ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ঘুরপথে ক্যাম্পের দিকে এগোল ওরা। আশপাশে গাছ থাকায় আড়াল পেতে সমস্যা হলো না। পঞ্চাশ গজ দূরে আসার পর কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত বোধ করল ডরোথি। ভাগ্যিস, ওদের দেখতে পায়নি সাই ড্রানান! চিন্তাটা মুহূর্তের জন্যে বিমূঢ় করে তুলল ওকে, এত ভয় পাওয়ার কী আছে? অযথাই আশঙ্কা করছে ও? ডানান নিঃসন্দেহে ভীতিকর একটা চরিত্র, কিন্তু তাকে শিকার করতে দেখার মধ্যে ভয়ের কী আছে?
হিসেবটা মিলবে না, যুক্তি-তর্ক দিয়ে সাই ডানানের উপস্থিতির সঙ্গে ওদের আশঙ্কার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না, জানে ডরোথি।
চার
পরের দিনের প্রায় পুরো সময় ক্যানিয়ন থেকে বের হওয়া ওয়্যাগনের ট্রেইল নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবল ডরোথি হেডলিন। বেশ কয়েকবার বাবার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু টেড হেডলিন বাড়ি তৈরির ব্যাপারে এতটা মনোযোগী যে অন্য কোন দিকে খেয়ালই করছে না। বাবাকে বিরক্ত করার ইচ্ছে হয়নি ওর। বিকেলে ওদের বাড়ি এল লিও কারভার। রেইলে ঘোড়া বেঁধে ভেতরে ঢুকল সে।
‘হাউডি, ডরোথি! দেখা হওয়ায় ভালই হলো। জেনের সঙ্গে একটা পার্টি দেয়ার ব্যাপারে কথা হচ্ছিল। পিট ল্যাস্কারের বাঁশির সঙ্গে নাচ হলে কেমন জমবে? সবাই কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত যে অন্য কিছু ভাবার ফুরসত পাচ্ছে না। খানিকটা চাঙা হওয়ার সুযোগ পেলে মন্দ হবে না বোধহয়, কী বলো?’
‘চমৎকার হবে, লিও!’ একমত হলো ডরোথি, তারপর হঠাৎ জানতে চাইল: ‘আচ্ছা, জেন কি ওয়্যাগন ট্রেইলের কথা কিছু বলেছে তোমাকে?’
তীক্ষ্ণ হয়ে গেল কারভারের নীল চোখজোড়া, চিন্তিত ভঙ্গিতে কালো চুলে আঙুল চালাল সে। ‘হ্যাঁ, বলেছে।’
‘সব শুনে তোমার কী মনে হয়েছে? আমি নিশ্চিত যে ওয়্যাগনগুলো আগে থেকে এনে রাখা হয়েছিল, স্রেফ আমাদের আসার অপেক্ষায় ছিল যেন। মনে হচ্ছে ওয়্যাগনের মালিক ঠিকই জানত যে এখানে থামব আমরা।’
‘স্যামের কথা বলছ তো? কিন্তু এসব করে ওর লাভ কী? আমরা যে এখানে আসব, সেটা তো ওর জানা থাকার কথা নয়। তোমার ধারণা যদি সত্যি হয়ে থাকে, অর্থাৎ আগে থেকে যদি সাপ্লাই এনে রাখেও, আমি এর মধ্যে কোন অসুবিধে দেখতে পাচ্ছি না। জায়গাটা দারুণ, এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই।’
‘হ্যাঁ, জায়গাটা সত্যি সুন্দর। কিন্তু তারপরও কেন যেন ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ হচ্ছে না আমার।’
প্যাট গ্যাভিন আর হিউ টেলরের সঙ্গে বাপকে দেখতে পেল ডরোথি, শহর থেকে আসছে। বরাবরের মত চওড়া হাসি লেগে আছে টেলরের মুখে, ভুরু কুঁচকে দু’জনকে দেখল সে, তারপর কারভারের প্রশস্ত কাঁধে আদুরে চাপড় মারল। ‘দু’জনে মিলে পরিকল্পনা করছ নাকি? শুনলাম নাচের পার্টি দিচ্ছ?’
প্রশ্নটা ঠিক কার উদ্দেশে করেছে সে, পরিষ্কার বোঝা গেল না, তবে উত্তরটা ওর কাছ থেকে প্রত্যাশা করছে-হিউ টেলরের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে তাই ধরে নিল ডরোথি।
কিন্তু উত্তর দেয়া হলো না ওর। আচমকা খুরের তীক্ষ্ণ শব্দে মনোযোগ সরে গেল সবার। চোখ তুলে তাকাতে ক্যানিয়নের ট্রেইলে তিনজন ঘোড়সওয়ারকে দেখতে পেল ডরোথি। তীব্র বেগে বাঁক ঘুরল ওরা, বাড়ির সামনে চারজনের দলটাকে দেখতে পেয়ে গতি কমাল। কাছাকাছি আসতে চেহারা দেখতে পেল ডরোথি। তিন অশ্বারোহীর একজন রেড কালাহান, গতকাল ওদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল সে। আরেকজন-নিঃশ্বাস আটকে এল রুথের-এড ক্রেমার!
‘হাউডি!’ চেঁচিয়ে শুভেচ্ছা জানাল রেড, তবে বিরস মুখে। দ্রুত সবার ওপর চোখ বুলাল সে, হিউ টেলরকে চিনতে পারল। ‘এদিকে কমবয়েসী এক যুবককে দেখেছ কেউ? বিশ-একুশ হবে বয়েস। একটা বে ঘোড়ায় রাইড করছিল।’
‘না, আসলে খেয়াল করিনি,’ নিরুত্তাপ স্বরে জবাব দিল টেলর। ‘ব্যাপার কী?’
‘ছেলেটার নাম ওয়েস বার্নেট, আমাদের ক্রু। গতকাল দলছুট গরু পাঞ্চিং করার জন্যে এদিকে এসেছিল, সন্ধের মধ্যে বাথানে ফেরার কথা, কিন্তু পাত্তাও নেই ওর। ভাবলাম কোন বিপদে পড়েছে নাকি।’
‘উঁহু, দেখিনি ওকে,’ জানাল হেডলিন।
‘তোমার ব্যাপারটা কী, এড?’ সহাস্যে এডের উদ্দেশে জানতে চাইল লিও কারভার। ‘আমরা তো ভেবেছি তল্লাট ছেড়ে চলে গেছ। এদের সঙ্গে তোমার আবার কোন্ চুলোর সম্পর্ক?’
পাল্টা উজ্জ্বল, স্বতঃস্ফূর্ত হাসি উপহার দিল এড। ‘ড্যান স্পেন্সারের হয়ে কাজ করি আমি। এখান থেকে সরাসরি ওর বাথানে গিয়েছিলাম।’
‘কী মনে করে বার্নেটকে খুঁজতে ঠিক এখানেই এসেছ?’ জানতে চাইল প্যাট গ্যাভিন, গম্ভীর দেখাচ্ছে তাকে। ‘সত্যিই কি এদিকে এসেছিল সে?’
‘সত্যি বলতে কি,’ জবাব এল রেড কালাহানের কাছ থেকে। ‘এখান থেকে কিছুটা উত্তর-পুবে কাজ করছিল ও। জায়গাটা বেশ রুক্ষ, শুধু একটা ক্যানিয়নে ঘাস বা পানি রয়েছে।
তৃতীয় লোকটা ছোটখাট, গাট্টাগোট্টা। কঠিন মানুষ। এত ভণিতা করছ কেন, রেড?’ নিস্পৃহ স্বরে অসন্তোষ প্রকাশ করল সে। ‘যা বলার সরাসরি বলে ফেলো!’
‘ঠিক আছে, হ্যান্স, বলছি ওদের,’ ঘাড় ফিরিয়ে সঙ্গীর দিকে তাকাল সে, কিছুটা বিব্রত বোধ করলেও চেপে গেল, চোখ নামিয়ে বাড়ির সামনে ছোটখাট জটলার দিকে তাকাল। ‘কি জানো, গতকাল সূর্যাস্তের পর বাথানে ফিরে গেছে বার্নেটের ঘোড়া, স্যাডলে রক্ত লেগে ছিল। ঘোড়াটাকে ব্যাক- ট্র্যাক করে ওয়েসকে খুঁজে পেয়েছি আমরা। খোলা যে উপত্যকার কথা বলছিলাম, ওখানেই পেয়েছি ওকে। মৃত। পিঠে গুলি করা হয়েছে ওকে। শুধু এতেই ক্ষান্ত হয়নি খুনী, ওয়েস ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার পর কাছে চলে গিয়েছিল লোকটা, ওর বুকে ছুরি চালিয়ে নিশ্চিত হয়েছে।
ড্যানান! বিস্ফারিত হলো ডরোথির চোখ, চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল ওর দিকে তাকিয়ে আছে লিও কারভার, ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে তার মুখ। গতকালের ঘটনাটাকে দুর্বোধ্য মনে হচ্ছিল, অথচ এখন একেবারে পরিষ্কার সবকিছু-সাই ড্যানানকে গুলি করতে দেখেছে ও!
নীরব হয়ে আছে সবাই। স্থির দৃষ্টিতে তিন অতিথিকে দেখছে ওরা। শেষপর্যন্ত এড ক্রেমারই নীরবতা ভাঙল। ‘ব্যাপারটা নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়ে গেছে তোমাদের কাছে? কন্তু নিচু স্বরে বলল সে। ওদের মত ঘনিষ্ঠ ভাবে ছেলেটাকে চিনতাম না আমি, তবে যতটা চিনেছি নিশ্চিত বলতে পারি সত্যিই ভাল ছেলে ছিল ও। ওকে নিষ্ঠুর ভাবে, কাপুরুষের মত পেছন থেকে খুন করা হয়েছে। ঝামেলা হলে এখন কেউই ঠেকাতে পারবে না।
‘কিন্তু আমাদের কাছে এসেছ কেন?’ প্রতিবাদ করল হিউ টেলর। ‘তুমি কি মনে করো আমরাই…’
‘মনে করাকরির কিছু নেই!’ অধৈর্য, কর্কশ স্বরে বাধা দিল হ্যান্স কোবার্ন। ‘নিশ্চিত জানি আমরা! পাহাড় থেকে এদিকে এসেছে এমন সব ট্র্যাক খুঁটিয়ে দেখেছি আমরা। তিনজন রাইডার এসেছে এখানে। তিনজনই কয়েক ঘণ্টা আগে পাহাড়ে গিয়েছিল। ওয়েস ছেলেটা আমার সঙ্গে থাকত, একসঙ্গে রাইড করতাম আমরা। দোষী লোকটাকে অন্তত আমি ছেড়ে দেব না।’
‘ঘুরে দাঁড়াও!’
শীতল এবং তীক্ষ্ণ স্বরের নির্দেশ। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল তিন রাইডার। বিশ কদম দূরে দাঁড়ানো সাই ড্যানানকে দেখতে পেল ওরা। পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে সে, কোমরে নিচু করে বাঁধা জোড়া পিস্তল। মুখ নির্বিকার, নীল চোখে চাপা বিদ্বেষ। ডানানের দু’পাশে আরও দু’জন করে অবস্থান নিয়েছে, প্রত্যেকের হাতে শটগান। দু’জন স্যাম ল্যামসনের সাপ্লাই ওয়্যাগনের সঙ্গে আমদানী করা ক্রু। অন্যরা, মাটি থ্যাচার আর জনি গ্যারেট। এদের ঠিক পেছনে, কিছুটা একপাশে দাঁড়িয়ে আছে স্যাম ল্যামসন। নিচু করে বাঁধা জোড়া পিস্তল ঝুলছে তার উরুতে।
‘জলদি কেটে পড়ো এখান থেকে!’ কর্কশ স্বরে নির্দেশ দিল ল্যামসন। ‘ফের ঝামেলা করার ইচ্ছে নিয়ে এসো না। প্রথম থেকে ঝামেলা পাকাতে চাইছ তোমরা, ছুতো খুঁজছ যাতে আমাদের এখান থেকে তাড়াতে পারো। কিন্তু এত সহজে হবে না। স্রেফ নিরীহ মানুষ আমরা, কারও সাতে-পাঁচে নেই বটে, তবে প্রয়োজনে কঠিন হতেও জানি। যাকগে, ফালতু প্যাচাল না পেড়ে মানে মানে কেটে পড়ো!’
এবার এডের দিকে ফিরল সে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল ওকে। ‘তোমাকে বলছি, ক্রেমার, বিদ্রূপ বা বিদ্বেষের চেয়ে বরং ল্যামসনের কণ্ঠে চাপা আক্রোশই প্রকাশ পেল বেশি। ‘তুমি একটা বেঈমান! সারাটা পথ আমাদের সঙ্গে এসেছ, অথচ এখন যোগ দিয়েছ ওদের দলে। আমার তো ধারণা, সব ঝামেলার মূলে আসলে তুমি। তোমাদের কোন ক্রু যদি খুন হয়ে থাকে, তাহলে সবার আগে তোমার ট্রেইল খুঁটিয়ে দেখা উচিত। যাও, এবার ভাগো এখান থেকে সবাই!’
‘ভুল করছ, ল্যামসন,’ শান্ত স্বরে বলল এড, বিন্দুমাত্র বিকার নেই মুখে। ‘সবার সামনে বলছি কথাগুলো,’ আঙুল তুলে বাড়ির সামনের জটলার দিকে ইঙ্গিত করল ও। ‘ড্যান স্পেন্সার মানুষটা যেমনই হোক, তোমাদের ব্যাপারে কিছুটা হলেও ছাড় দিতে চেয়েছিল। ও জানে তোমাদের দেখাদেখি আরও লোক আসবে, থাকতে চাইবে এখানে, তারপরও তোমাদের থাকতে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আমার অনুরোধে রাজি হয়েছিল সে, সেজন্যেই তাড়ায়নি তোমাদের। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সেধে দাবড়ানি খেতে চাইছ তোমরা।’
‘তোমার অনুরোধে রাজি হয়েছে সে? তাচ্ছিল্য প্রকাশ পেল ল্যামসনের বিস্মিত স্বরে। ‘আমাদের হয়ে ওকে অনুরোধ করেছ তুমি-চালচুলোহীন সামান্য এক ভবঘুরে?’
এডের দিকে চলে গেল রেড কালাহানের দৃষ্টি, কী যেন বলতে চেয়েছিল সে, কিন্তু একটা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল এড। ‘ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি আমরা, ল্যামসন, শান্ত স্বরে বললেও বিন্দুমাত্র আপসের সুর নেই ওর কণ্ঠে। ‘তবে ওই লোকটাকে চাই আমরা! আগামীকাল সূর্যাস্তের আগেই ওয়েস বার্নেটের খুনীকে আমাদের হাতে তুলে দেবে। স্বেচ্ছায় যদি না দাও, তাহলে আবার আসব আমরা, এবং নিজেরাই ওই লোকটাকে খুঁজে বের করব।’
আচমকা ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল ওরা, তারপর ফিরতি পথ ধরল। একইসঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল সাই ডানান, খপ করে এক সঙ্গীর হাত থেকে শটগান তুলে নিল। ‘ভাঁওতাবাজির আর জায়গা পেল না!’ সরোষে বিড়বিড় করল সে। ‘মজা দেখাচ্ছি ওকে!’
‘সামলে নাও!’ শীতল স্বরে নির্দেশ দিল প্যাট গ্যাভিন, সিক্সশূটারের নল উঁচিয়ে ধরেছে সাই ডানানের দিকে। ‘কাউকে পেছন থেকে গুলি করি না আমরা, কেউ গুলি করছে এই দৃশ্যও দেখতে অভ্যস্ত নই।
স্থির দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল ওরা। সাই ডানানের চোখে খুনের নেশা, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি তার, এবং এখন থেকে প্যাট গ্যাভিনকে ঘৃণা করবে সে। স্যাম ল্যামসনের গম্ভীর নিচু স্বরে নিরস্ত হলো গানম্যান। ‘হয়েছে, সাই! শটগানটা নামিয়ে রাখো, যেতে দাও ওদের।’ তারপর চারপাশে চকিত দৃষ্টি চালাল সে। ‘আজ রাতে সেলুনে একটা মীটিং হবে। জরুরী কিছু বিষয়ে আলোচনা করব। সময়মত চলে এসো সবাই।’
একে একে চলে গেল সবাই। ল্যামসনকে অনুসরণ করে শহরের দিকে গেল সাই ডানান আর তার লোকেরা।
দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলল টেড হেডলিন, আনমনে মাথা নাড়ল ‘বিপদ! সবকিছু আসলে ওই ক্রেমারের জন্যে ঘটেছে! ওকে ট্রেইলের পাশে রেখে আসলে ভাল হত, মরে পচে যেত এতদিনে!’
‘শুধু শুধু এডের দোষ দিচ্ছ তুমি, বাবা, প্রতিবাদ করল ডরোথি। ‘আমি অন্তত মনে করি, ঠিকই বলেছে ওরা। সাই ড্রানানকে গুলি করতে দেখেছি জেন আর আমি। তিনজনের ট্র্যাকের কথা বলেছে না? দু’জনের ট্র্যাক আমাদের। তৃতীয় লোকটা হচ্ছে সাই ড্যানান। ও যখন গুলি করছিল, বড়জোর পঞ্চাশ গজ দূরে ছিলাম আমরা। কাকে গুলি করেছে দেখতে পাইনি বটে, কিন্তু আমরা নিশ্চিত যে ওয়েস বার্নেটকেই গুলি করেছে সে।
ফ্যাকাসে হয়ে গেল হেডলিনের মুখ। ‘তুই নিশ্চিত, ডরোথি?’ কাঁপা স্বরে জানতে চাইল। ‘ঠিক দেখেছিস?’
‘নিশ্চয়ই।’
‘তাহলে অবশ্যই ড্রানানকে ধরিয়ে দেয়া উচিত,’ ধীরে ধীরে বলল সে। খুন করলে শাস্তি পাওয়া উচিত, সে যে-ই হোক। বিশেষ করে এভাবে কাপুরুষের মত পেছন থেকে যদি গুলি করে থাকে…’ কথাটা শেষ না করে উঠে দাঁড়াল হেডলিন, টেবিল থেকে হ্যাট তুলে নিল। ‘ব্যাপারটা ল্যামসনকে জানানো উচিত। ও নিশ্চয়ই জানে না এসব।
হাত বাড়িয়ে বাপের কাঁধ চেপে ধরল ডরোথি। ‘উহুঁ, এমন কিছু কোরো না, বাবা। আগে অন্যদের জানাও-গ্যাভিন বা টেলরকে বলো, ওরা যা ভাল বুঝবে তাই করবে না হয়। আমি সত্যিই ভয় পাচ্ছি।’
‘কীসের ভয়?’ বিভ্রান্ত দেখাল টেড হেডলিনকে, মেয়ের আপত্তির কারণ বুঝতে পারছে না। ‘স্যাম ল্যামসনকে খুলে বললে ক্ষতি কী? দারুণ মানুষ ও। আসল ঘটনা জানতে পারলে নিশ্চয়ই নিজেই কিছু একটা করবে। একটু আগে এসব জানত না সে, হয়তো সেজন্যেই কিছু বলেনি ড্রানানকে। এখন পরিস্থিতি অন্যরকম।’
মাথায় হ্যাট চাপিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল সে, শহরের দিকে এগোল। ইতস্তত ভাবে, কিন্তু দ্রুত তৈরি হচ্ছে শহরের বাড়িগুলো। দূর থেকে বিচ্ছিন্ন এবং কাঠামোহীন মনে হলেও, সময়ে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে শ্রীবৃদ্ধি হবে।
বাপকে নিরস্ত করতে না পেরে ক্ষণিকের জন্যে নিজেকে অসহায় মনে হলো ডরোথির, কী করবে বুঝতে পারল না; সামান্য দ্বিধার পর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল ও, নিজের ঘোড়ার দিকে ছুটল। দ্রুত স্যাডলে চেপে ঘোড়া ছোটাল গ্যাভিনদের বাড়ির দিকে। আশা করছে প্যাট গ্যাভিন ছাড়াও হিউ টেলরকে পাবে ওখানে।
অনুমান সঠিক হলো। তিনজনকেই টেবিলে দেখতে পেল ডরোথি।
‘দয়া করে আমার সঙ্গে এসো!’ সংক্ষেপে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করল ও। ‘এখুনি না গেলে হয়তো খারাপ কিছু ঘটে যাবে। সত্যি সত্যি ভয় পাচ্ছি আমি!’
দ্রুত, কোন বাক্যব্যয় ছাড়াই উঠে পড়ল ওরা, কোমরে গানবেল্ট জড়িয়ে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। সেলুন থেকে প্যাট গ্যাভিনের বাড়ি কয়েকশো গজ দূরের পথ, বেশি দেরি হলো না পৌঁছতে। মাত্র কয়েক মিনিট আগে এখানে পৌঁছেছে টেড হেডলিন।
‘স্যাম, আমার মেয়ে আর জেন গ্যাভিন গতকাল ড্যানানকে গুলি করতে দেখেছে,’ টেড হেডলিন বলছে তখন। ‘আমার তো মনে হয় ওকে ড্যান স্পেন্সারের হাতে তুলে দেয়া উচিত। অযথা ঝামেলায় গিয়ে কী লাভ? তাছাড়া, খুনোখুনির সঙ্গে নিজেদের জড়ানোর ইচ্ছে নেই আমাদের।’
মুহূর্তে কঠিন হয়ে গেল স্যাম ল্যামসনের মুখ, দৃঢ় চোয়াল চেপে বসল আরও। কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল সে, কিন্তু চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল দরজায় উকি দিয়েছে সাই ডানান, একটা হাত শিথিল ভঙ্গিতে পড়ে আছে হোলস্টারের ওপর। পাশ দিয়ে যাচ্ছিল সে, নিজের নাম শুনতে পেয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে।
ড্রানানকে দেখে, কিংবা নিজেকে সামলে নেয়ায়, কিছুটা কোমল হয়ে গেল ল্যামসনের চাহনি। ‘আমার তো মনে হয় তোমার মেয়ে ভুল দেখেছে,’ নিস্পৃহ স্বরে বলল সে। ‘অযথা উত্তেজিত হয়েছ, টেড। তোমার মেয়ের মতই ঘুরতে বেরিয়েছিল সাই, ঘুরতে ভালবাসে কিনা। কিন্তু কাউকে পেছন থেকে গুলি করবে? উহুঁ, এ কাজটা কখনও করবে না ও।’
‘কিন্তু তাই করেছে সে, তীক্ষ্ণ স্বরে দাবি করল লিও কারভার। ‘মেয়েরা সত্যি কথাই বলেছে।’
‘তুমি কি আমাকে মিথ্যুক বলছ?’ চরকির মত কারভারের দিকে ঘুরল ল্যামসন, রাগে জ্বলছে চোখ দুটো। .
‘না,’ দৃঢ় স্বরে জবাব দিল কারভার, মুখ কিছুটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ‘আমাদের সঙ্গে এতদূর পর্যন্ত এসেছে, এমন কাউকে মিথ্যেবাদী বলার ইচ্ছে নেই আমার। কিন্তু নিজের চোখে যা দেখেছি, তা তো অস্বীকার করতে পারব না।
‘জেন কালকের ঘটনা বলেছে আমাকে, ওর কথা শুনে মনে হলো কোথাও ঘাপলা আছে। সঙ্গে সঙ্গে ওদের ব্যাক-ট্রেইল করে উপত্যকায় চলে গেছি। তখনও জানতাম না খুনোখুনির কোন ব্যাপার জড়িত এতে, কিন্তু মেয়েদের ট্র্যাক অনুসরণ করে শেষে সাই ডানানের ট্র্যাক খুঁজে পেয়েছি আমি।
‘গুলি করার আগে অন্তত দুই মাইল বার্নেটকে অনুসরণ করেছে সাই ডানান, লোকটাকে সুবিধাজনক জায়গায় পাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরেছে। ওর ট্র্যাক প্রতিটি ইঞ্চি খুঁটিয়ে দেখেছি। খুন করাই ছিল ওর উদ্দেশ্য। ট্র্যাক ধরে মৃতদেহের কাছে চলে গেলাম। ঘাসের সঙ্গে রক্তাক্ত ছুরি মুছেছিল সে, রক্ত লেগে থাকা ঘাস ছাড়াও বাদামী রঙের কিছু সিগারের গোড়া চোখে পড়েছে আমার। দুটো নমুনা সঙ্গে নিয়ে এসেছি। সন্দেহ নেই, সাই ডানানই খুন করেছে স্পেন্সারের ওই কাউহ্যান্ডকে। আমার বেঁচে থাকা যেমন সত্যি, এটাও তেমনি নির্জলা সত্যি।’
নিঃশব্দ পায়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ড্রানান, তার উপস্থিতি টের পায়নি লিও কারভার। বিষ দৃষ্টিতে কারভারকে দেখছে গানম্যান। ‘আমার ট্র্যাক অনুসরণ করেছ, তাই না?’ খরখরে স্বরে হেসে উঠল সে, বিস্মিত কারভারকে কিছু করার সুযোগই দিল না। চোখের পলকে হাত বাড়াল হোলস্টারে, বিদ্যুৎ গতিতে উঠে এল কোল্ট, গর্জে উঠল। গুলির ধাক্কায় আধ-পাক ঘুরল কারভারের দেহ, তারপর মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে।
‘কী ব্যাপার, স্যাম?’ ছাইবর্ণ হয়ে গেছে টেড হেডলিনের মুখ, বিস্ময়ে এতটা বিমূঢ় হয়ে গেছে যে কথা যোগাচ্ছে না মুখে। এসবের মানে কী? আমি তো…’
‘তোমরা বরং বাড়ি ফিরে যাও,’ নির্বিকার স্বরে বলল ল্যামসন ‘ড্যানান যদি কাউকে খুন করে থাকে, যদিও এক মুহূর্তের জন্যেও স্বীকার করিনি আমি, তাহলে নিশ্চয়ই উপযুক্ত কারণ ছিল। এই মাত্র যা ঘটল, তাতেও দোষ দিতে পারবে না ওকে। সশস্ত্র ছিল লিও কারভার। ডানানের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ এনেছিল ও, মিথ্যের বিরুদ্ধে এভাবেই প্রতিবাদ জানায় পশ্চিমের লোকেরা। এটাই এখানকার রীতি। তোমাদের ভালর জন্যে আরও কয়েকটা কথা বলছি। এখানে থাকতে হলে চুপচাপ থাকতে হবে, অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো যাবে না। পশ্চিমে নাক উঁচু লোকের জায়গা নেই।’
পাথরের মত কঠিন হয়ে গেছে প্যাট গ্যাভিনের মুখ। চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল পোর্চে শটগান হাতে দাঁড়িয়ে আছে দুই টামস্টার। একটা আঙুল নাড়লে খুন হয়ে যাবে সবাই। ব্যস, ফয়সালা হয়ে গেল, শীতল দৃষ্টিতে ল্যামসনকে বিদ্ধ করল সে। এখানে আর থাকছি না আমি!’
‘আমিও চলে যাব,’ বিষণ্ন স্বরে বলল টেড হেডলিন।
‘উঁহুঁ, তুমি যেতে পারছ না, টেড,’ সোজাসাপ্টা বলল ল্যামসন, তার চোখের গভীরে আবছা আমোদ। ‘একটা কথা বোধহয় দিব্যি ভুলে বসে আছ। আমার বন্ধু ড্যান হয়েট টাকা আর সাপ্লাই দিয়েছে তোমাকে। দেনা শোধ করবে কীভাবে? ফসল ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। তুমি যদি চলে যাও, টাকা আদায় করার জন্যে সুদূর ক্যালিফোর্নিয়া যেতে হবে হয়েটকে, আমার মনে হয় না ব্যাপারটা পছন্দ বা উপভোগ করবে সে।
‘তাছাড়া, জানোই তো ইন্ডিয়ানরা আমাদের অনেক ঘোড়া চুরি করে নিয়ে গেছে। কথাটা তোমাদের এমনিতেও জানাতাম। বেশিরভাগ ষাঁড়ই নেই।’ শ্রাগ করল সে, নিরানন্দ মুখে একে একে দেখল সবাইকে। ‘এত উতলা হচ্ছ কেন? দুশ্চিন্তার কোন কারণ তো দেখছি না আমি। এখানেই থেকে যাও। এরচেয়ে ভাল জমি পাবে কোথায়? যে-কোন শহরের শুরুতে এরচেয়েও বেশি ঝামেলা হয়, শেষপর্যন্ত থাকে না এসব। কয়েক মাসের মধ্যে শান্ত হয়ে যাবে। একসময় দেখবে কী সুন্দর শহর গড়েছি আমরা। স্কুল হবে, গির্জা থাকবে, পার্ক থাকবে। আমাদের ঘরে নতুন সন্তান আসবে, নতুন প্রজন্মের জন্যে সুন্দর একটা শহর তৈরি করব আমরা…’
‘হয়েছে, তোমার বক্তৃতা পরে শুনব, ল্যামসন!’ প্রায় অধৈর্য কণ্ঠে বাধা দিল হিউ টেলর। ‘একজন মানুষ মারা যাচ্ছে, ওর শুশ্রূষা দরকার। তোমার খোশগল্প বা স্বপ্নের কথা শোনার চেয়ে ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করা অনেক বেশি জরুরী।
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল স্যাম ল্যামসন, চোখে স্পষ্ট বিদ্বেষ। শেষে নিজেকে সামলে নিল সে, মাথা ঝাঁকাল বারকয়েক। ‘ঠিক বলেছ, ভুলেই গিয়েছিলাম ওর কথা। যাও, নিয়ে যাও ওকে।’
.
মারা যায়নি লিও কারভার। ধরাধরি করে তাকে প্যাট গ্যাভিনের বাড়ি নিয়ে এসেছে ওরা, এ মুহূর্তে বাইরের কামরায় শুয়ে আছে সে। পাশেই বসে আছে জেন। পিট ল্যাস্কার অল্প-বিস্তর ছুরি-চাকুর কায়দা জানে, সেটাই কাজে লাগল। বুলেটটা বের করেছে সে। কাজ শেষে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকেছে ল্যাস্কার, কফি গিলছে আয়েশ করে।
‘আশা করা যায় সুস্থ হয়ে উঠবে ও,’ কফির মগ নামিয়ে রেখে মন্তব্য করল হাতুড়ে ডাক্তার। ‘ভালই সম্ভাবনা আছে ওর। আমি ডাক্তার নই, তবে মেক্সিকান যুদ্ধের সময় এক ডাক্তারের সঙ্গে কাজ করেছি কিছুদিন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সুস্থ হয়ে উঠবে লিও।’
টেবিলে উল্টোদিকে বসে আছে বিশালদেহী প্যাট গ্যাভিন। চওড়া গর্দান অনেকটা চেপে বসেছে কাঁধের ওপর, স্থির দৃষ্টিতে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে সে, চিন্তিত এবং শঙ্কিত। হঠাৎ দৃষ্টি ফিরিয়ে ল্যাস্কার আর হেডলিনের দিকে তাকাল। ‘যা পরিস্থিতি,’ নীরবতা ভাঙল গ্যাভিন। ভাল বলা চলে না। সংঘর্ষ এড়ানো গেল না। এখন আমরা চাই বা না-চাই, লড়াই করতেই হবে। ড্যান স্পেন্সার এতদিন চুপ করে ছিল, যদিও স্যাম ল্যামসন তাকে কম ত্যক্ত করেনি। কিন্তু বেজন্মা ওই দো-আঁশলাটা ওর এক ক্রুকে খুন করেছে, এটা সে সহ্য করবে কেন?’
‘ওই রেড লোকটা,’ বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করল পিট ল্যাস্কার। ‘কঠিন চীজ। ওর সঙ্গে যে ছিল, হ্যান্স না কী যেন নাম…এদের সঙ্গে লড়তে গেলে পরিণাম ভাল হবে না।’
‘আমি ভাবছি এড ক্রেমারের কথা,’ জানতে চাইল প্যাট গ্যাভিন। ‘ও আসলে কোন্ পক্ষে?’
‘নিজের কানে শুনেছ, ও বলেছে স্পেন্সারের হয়ে কাজ করছে। ধাঁধার কোন ব্যাপার তো নেই, এক্কেবারে নির্জলা সত্য যে আমাদের পক্ষে নেই ও।’
‘ওর কথা শুনলে বোধহয় এই ঝামেলা হত না!’ মন্তব্য করল জেন গ্যাভিন।
কেউই জবাব দিল না কথাটার। তিনজন পুরুষ স্থির দাঁড়িয়ে থাকল, মনোযোগ দিয়ে লিও কারভারের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছে, যেন এছাড়া আর কিছুই করার নেই। দরজায় হালকা পায়ের শব্দে চমকে উঠল সবাই, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে এড ক্রেমারকে দেখতে পেল।
বিস্ফারিত হয়ে গেছে ডরোথির চোখ, অজান্তে নিঃশ্বাস আটকে গেল। সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থাকল, দেখল ধীর ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকল এড, পেছনে আলতো ভাবে দরজা বন্ধ করে দিল। এক পা সরে গেল সে, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ তুলে দেখল সবাইকে, হাতে হ্যাট।
দারুণ লম্বা ও! ভাবছে ডরোথি। কাঁধ এতটা প্রশস্ত যে ঢোকার সময় মনে হচ্ছিল দরজার পুরোটাই ঢাকা পড়ে গেছে। বাকস্কিনের ট্রাউজার ওর পরনে, বুটের ভেতর নিচের প্রান্ত গোঁজা। বুটজোড়া বিশেষ ধরনের। চেক শার্টের ওপর বাকস্কিন জ্যাকেট চাপিয়েছে, মেক্সিকানদের ঢঙে। জোড়া ডাগুন কোল্ট শোভা পাচ্ছে নিচু করে বাঁধা হোলস্টারে।
‘ওর আঘাতটা কেমন?’ কারভার সম্পর্কে জানতে চাইল সে।
‘গুরুতর, তবে বেঁচে যাবে-পিট ল্যাস্কার তাই মনে করছে,’ জবাব দিল জেন।
এবার টেবিলের দিকে তাকাল এড ক্রেমার। ‘তো, একদিনের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার দেখা হলো আমাদের,’ মৃদু স্বরে বলল সে। ‘তোমরা জানো স্পেন্সারের হয়ে কাজ করছি আমি। এ পর্যন্ত যা ঘটেছে, তাতে নির্দ্বিধায় বলা যায় একটা লড়াই শুরু হলো বলে। তোমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন্ পক্ষে থাকবে। স্পেন্সার তোমাদের থাকতে দিতে চায়নি, কিন্তু আমার অনুরোধে রাজি হয়েছে। অথচ নিজের বিচার-বুদ্ধির ওপর ষোলোআনা আস্থা আছে ওর, সেটাকে অগ্রাহ্য করেছে আমার মতামতের মূল্য দিতে গিয়ে। যত দ্রুত সম্ভব তোমাদের তাড়িয়ে দেয়ার জন্যে মুখিয়ে ছিল সে, তোমরা ওর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে সেজন্যে নয়, বরং সেটলাররা শেষপর্যন্ত ওর সাম্রাজ্যে একটু একটু করে ভাগ বসাবে-এই ভয় পাচ্ছিল সে। সত্যি কথা বলতে কি, ওর আশঙ্কায় এতটুকু ভুল নেই।
‘যা হোক, আমাদের একজন লোক মারা গেছে। ক্রুদের ঠেকিয়ে রাখতে এমনকি ড্যান স্পেন্সারেরও সমস্যা হচ্ছে। ওদের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার, সবাই দোষী লোকটিকে চায়। অন্য কোন ব্যাপারে পরোয়া করছে না ওরা। একটা লড়াই হবেই। তোমাদের ঠিক করতে হবে কোন্ পক্ষে থাকতে চাও।
‘আমরা আলাদা ভাবে কিছু করতে পারব না,’ প্রতিবাদ করল প্যাট গ্যাভিন। ‘আমাদের মতামতের মূল্য যে আগের মত নেই, এটা আজ বোঝা গেছে। তবুও কাল এ নিয়ে ভোটাভুটি হবে, আমার মনে হয় না এ জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও সরে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেবে কেউ।’
‘ওসবে কোন লাভ হবে না,’ সোজাসাপ্টা বলল এড ক্রেমার। ‘স্যাম ল্যামসনের সঙ্গে দশজন এসেছ তোমরা। এদিকে ড্যান হয়েট এবং সাই জানান যোগ দিয়েছে ওর সঙ্গে। ওদের সঙ্গে আরও লোক এসেছে। ধরো, তোমরা তিনজন দোষী লোকটাকে ধরিয়ে দেয়ার পক্ষে ভোট দিলে, কিন্তু আর কেউ কি দেবে?
‘টেলর লোকটা ভাল, তবে ল্যামসনের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। হয়তো তোমাদের মতই ভাববে সে, কিন্তু শেষে দেখবে ল্যামসনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। জনি গ্যারেট আর মাটি থ্যাচারের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। যেভাবেই দেখো না কেন, ভোটে হেরে যাবে তোমরা। অর্থাৎ সাই ড্রানানকে কখনোই আপসে ধরিয়ে দেবে না ল্যামসন।
‘কিন্তু এত নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে?’ আপত্তি জানাল ল্যাস্কার। ‘ল্যামসন হয়তো সিদ্ধান্ত পাল্টাতেও পারে।’
ঘুরে দাঁড়াল এড, মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। ‘এই ট্রিপ থেকে কি কিছুই শেখোনি তোমরা? ল্যামসন ব্যবহার করছে তোমাদের। নিজের স্বার্থে তোমাদের এখানে নিয়ে এসেছে ও। স্পেন্সারের কাছ থেকে উপত্যকাটা ছিনিয়ে নেয়ার ইচ্ছে ওর, তোমরা হচ্ছ ওর দাবার ঘুঁটি। তোমাদের ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করবে!’
‘তার কোন প্রমাণ আছে তোমার কাছে?’ জানতে চাইল হেডলিন।
‘নেই,’ স্বীকার করল এড। ‘তবে আমার চোখ দুটোই যথেষ্ট। যা দেখেছি ভুল দেখিনি, কিংবা আন্দাজেও ভুল করিনি। তোমরা প্রত্যেকে বিক্রি হয়ে গেছ ল্যামসনের কাছে, তোমাদের জান-মাল সবই ওর জিম্মায় শুনলাম হয়েটের কাছ থেকে টাকা আর মালপত্র ধারে কিনেছ তোমরা। তোমাদের কি একবারও মনে হয়নি যে এর সবই পরিকল্পিত? হয়েটের কাছে দায়বদ্ধ থাকা মানেই হচ্ছে, ল্যামসনের কাছে আটকা পড়া, ওদের দু’জনের মধ্যে আসলে কোন পার্থক্য নেই।’
দরজা খুলে গেল, ভেতরে প্রবেশ করল হিউ টেলর। একা আসেনি সে, সঙ্গে ডেভ মুর এসেছে। ভেতরে ঢুকে এডকে দেখা মাত্র চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল টেলরের, চাহনি দেখে বোঝা গেল না কতটা বিদ্বেষ বা অসন্তোষ আছে এর পেছনে। ‘তুমি বরং কেটে পড়ো,’ ধীর ভঙ্গিতে বলল সে, তবে বিন্দুমাত্র আন্তরিকতা নেই তাতে। ‘ডানান তোমাকে দেখতে পেলে ঠিক খুন করে ফেলবে।’
‘উঁহু, এত সহজ হবে না ব্যাপারটা,’ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল এড। ‘সব লোককে মারা এত সহজ নয়, কিংবা সব লোক মেকি হাসি আর চমৎকার কথাবার্তায়ও ভোলে না।’
স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে টেলর, এডের কথায় রীতিমত বিদ্বেষ বোধ করছে। ‘এখনও ল্যামসনের পা কামড়ে ধরার খায়েশ যায়নি তোমার?’ স্পষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ পেল কণ্ঠে। কিন্তু কার এমন কী ক্ষতি করেছে ও? বলেছিল দারুণ একটা জায়গায় নিয়ে যাবে আমাদের, যেখানে নিশ্চিন্তে নতুন জীবন শুরু করতে পারব। তাই তো এসেছি সবাই, তাই না? কোথাকার কোন্ স্পেন্সার ব্যাটা আসছে আমাদের তাড়াতে? এটা কি ওর একার সম্পত্তি? আসুক না সে, দরকার হলে লড়ব আমরা!’
‘এবং ল্যামসনের হয়ে লড়ে মরবে শেষে? তুমি কি মনে করো ল্যামসন এই উপত্যকার দখল হাতের মুঠোয় পেলে তোমাদের পাশে থাকতে দেবে? ফুটো পয়সাও পাবে না, স্রেফ কপর্দকহীন অবস্থায় তোমাদের উচ্ছেদ করবে এখান থেকে। তোমাদের তৈরি বাড়ি থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করবে। উপত্যকার দখল পাওয়া পর্যন্ত, তোমরা স্রেফ ওর দাবার ঘুঁটি। তোমাদের সম্বল করে ড্যান স্পেন্সারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাইছে সে। এখানে কখনও যদি আইনের লোক আসে, তাহলে ও বলতে পারবে খাঁটি আমেরিকান নাগরিকদের বসতি করতে দেয়নি ড্যান স্পেন্সার, জোর করে তাড়িয়ে দিয়েছে মুক্ত জমি থেকে।
‘তাই তো করছে সে!’ অসহিষ্ণু স্বরে বলল টেলর। ‘যুদ্ধই যদি চায় ও, তবে পেয়ে যাবে!’
‘তাহলে বরং চলে যাওয়াই উচিত আমার,’ বিষণ্ন স্বরে বলল এড। ‘এসেছিলাম শান্তির কথা বলার জন্যে। প্রস্তাবটা পছন্দ হয়নি তোমাদের। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সাই ড্র্যানানই তোমাদের হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তো, এবার স্যাম ল্যামসনের হয়ে লড়াই করো তোমরা!’
‘একসময় আমাদের সঙ্গে ছিলে তুমি,’ কিছুটা হতাশার সঙ্গে বলল প্যাট গ্যাভিন। ‘ট্রেইলে অনেক সাহায্য করেছ, তাহলে এখন করছ না কেন?’
চোখ তুলে তার দিকে তাকাল এড, তারপর দৃষ্টি সরে গেল ডরোথি হেডলিনের দিকে; ক্ষণিকের জন্যে দ্বিধা দেখা গেল ওর চোখে, দৃষ্টি সরিয়ে নিল সে। ‘কারণ তোমরা ভুল করছ, ভুল ঘোড়ার পক্ষে বাজি ধরেছ,’ সহজ, মৃদু স্বরে উত্তর দিল ও।
চোখ তুলে তাকাল ডরোথি, জ্বলছে ওর চোখজোড়া। একসময় তো আমাদের একজন ছিলে তুমি,’ তীক্ষ্ণ স্বরে প্রতিবাদ করল ও। ‘এখনও আমাদের সঙ্গে থাকা উচিত তোমার। বিশ্বস্ততা বা অধিকার কী জিনিস, তোমার কি জানা নেই? নাকি ওসবে বিশ্বাস করো না?’
‘স্যাম ল্যামসন আসার পর থেকে কখনোই তোমাদের একজন ছিলাম না আমি,’ ক্লান্ত, নিরুদ্যম স্বরে বলল এড। ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে বিব্রত বোধ করল ডরোথি। ‘আমি যা পেতে পারতাম, আমার পাওনাটুকু সে-ই পেয়েছে। গুছিয়ে কথা বলতে পারি না আমি, মনের ভাবনাগুলো মনে থেকে যায়, কখনও শিখিওনি কীভাবে ওগুলো প্রকাশ করতে হয়। হাত বাড়িয়ে দরজার হাতল চেপে ধরল ও। ‘আর বিশ্বস্ততা বা অধিকারের কথা যদি বলি, তাহলে বলতে হয় দুনিয়ায় আমার ওপর সবচেয়ে বেশি অধিকার যদি কারও থাকে তো সে হচ্ছে ড্যান স্পেন্সার।
‘কীভাবে?’ চেঁচিয়ে উঠল ডরোথি।
‘কারণ সে আমার বাবা, চাপা স্বরে বলল এড, পরমুহূর্তে মৃদু কিন্তু দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল।
‘ড্যান স্পেন্সার ওর বাবা?’ অস্ফুট স্বরে বিস্ময় প্রকাশ করল গ্যাভিন। ‘আশ্চর্য! এমন কিছু ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছে কেউ?’
‘তাতে কিছু যায় আসে না,’ একগুঁয়ে, কঠিন স্বরে বলল হিউ টেলর। ‘বাবা আর চাচাই হোক, আমাদের কী? এড ক্রেমারের মতামতেও কিছু যায়-আসে না আমাদের। আজীবন যেরকম জায়গার স্বপ্ন দেখেছি, এখানে এসে পেয়ে গেছি আমি। এখান থেকে কিছুতেই নড়ব না! ড্যান স্পেন্সার কেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এলেও আমাকে এখান থেকে নড়াতে পারবে না। ল্যামসন বলেছে আইন আমাদের পক্ষে, এমন কোন নিয়ম নেই যে আমাদের উৎখাত করতে পারে। প্রয়োজনের চেয়েও বেশি অস্ত্র আছে আমাদের, আছে পর্যাপ্ত লোকজন। জায়গাটাও মোটামুটি সুরক্ষিত, আক্রমণ করে সুবিধে করতে পারবে না কেউ। দেখেছ তো, ইন্ডিয়ানরা সুবিধে করতে পারেনি। শেষপর্যন্ত যে ব্যাপারটার ফয়সালা হচ্ছে, তাতে সত্যিই খুশি আমি। শো-ডাউন হয়ে যাক, শেষটা হয়তো ভালই হবে আমাদের জন্যে।
‘আমি বাপু কাজ-পাগল লোক, কাজ ছাড়া কিছু বুঝি না,’ একই সুরে বলল ডেভ মুর। ‘মনের মত জায়গা পেয়েছি, এখন কেবল গোছানো বাকি। ড্যান স্পেন্সার যদি আমাকে তাড়াতে আসে, হাড়ে হাড়ে টের পাবে…’
‘কিন্তু এড যে বলে গেল ল্যামসন আমাদের ব্যবহার করছে?’ অস্বস্তির সঙ্গে জানতে চাইল পিট ল্যাস্কার, অন্যদের মত ততটা নিশ্চিত্ত হতে পারছে না হাতুড়ে ডাক্তার। ‘ওর কথার মাথামুণ্ড কিছুই তো বুঝতে পারলাম না!’
‘ফালতু কথা!’ তপ্ত স্বরে বলল টেলর। এ পর্যন্ত আমাদের কোন্ কাজের পক্ষে সায় দিয়েছে ক্রেমার? শুরু থেকে কেবল বাধাই দিয়েছে! সত্যি কথাটা শুনে রাখো আমার কাছ থেকে, আসলে ল্যামসনকে মোটেই সহ্য করতে পারে না ও, সেজন্যেই ল্যামসন কিছু বললেই সেটার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে বারবার।
‘ওর কথাগুলো একেবারে ফেলনা নয় মনে হচ্ছে,’ মৃদু স্বরে নিজের ধারণা প্রকাশ করল ডরোথি।
ঝট করে ওর দিকে ফিরল হিউ টেলর, স্পষ্ট বিরক্তি তার চোখে। ‘কিছু মনে কোরো না, ডরোথি। এটা পুরুষদের ব্যাপার, তোমার মতামত না জানালেই খুশি হব!’
‘আমি কিন্তু তা মনে করি না,’ আরক্ত হয়ে গেল ডরোথির চোখ-মুখ, অপমানটা নীরবে হজম করল। ‘আমরা, মেয়েরা তোমাদের সঙ্গে এমনি এমনি আসিনি। অন্যদের কথা বাদ দিলেও, আমার কথাই বলি, লড়াই হলে বাবা মারা পড়তে পারে; সেক্ষেত্রে কী হবে আমার অবস্থা? সুতরাং লড়াইয়ের সিদ্ধান্তটা অন্তত আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তোমরা যদি মনে করো তোমাদের পক্ষ হয়ে লড়তে গিয়ে আমার ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার কিংবা উচ্ছেদ হওয়ার সুযোগ করে দেব, তাহলে ভুল করছ। লড়াইয়ের মত রক্তক্ষয়ী একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সবার কথাই ভাবা উচিত, শুধু নিজের কথা ভাবলে হয় না, কিংবা নিজের মতামত অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিলেও চলে না।’
কিছু বলতে চেয়েছিল টেড হেডলিন, কিন্তু বাধা দিল ডরোথি। এক পা আগে বেড়ে বাপের সামনে এসে দাঁড়াল। ‘ক্রেমার বলছিল আমাদের ব্যবহার করছে ল্যামসন। হয়তো করছে, হয়তো করছে না। তবে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর আমাদের সবারই জানা উচিত। গত কয়েকদিন ধরে ভাবছি প্রশ্নগুলো।
‘প্রথম কথা, আমরা কোথায় কোন্ দিক দিয়ে গেলে ভাল হয়, সেটা নিয়ে এত ভাবনা কেন স্যাম ল্যামসনের? এমনিতে, নাকি সহৃদয়তা? নাকি অন্য কিছু? এটা ওর সহৃদয়তা বলেই জানতাম, কিন্তু এখন আর বিশ্বাস করতে পারছি না। তারও আগে, নিজ থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে সে, কেউ ডেকে আনেনি ওকে। দ্বিতীয় প্রশ্ন, আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে ও, শহর তৈরি করেছে। বন্ধুর মাধ্যমে সবাইকে টাকা ধার দিয়েছে, বাকিতে সাপ্লাই দিয়েছে। এসবের মধ্যে কোন পূর্ব পরিকল্পনা নেই তো? কে প্রথম শহর তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে? ল্যামসন। স্বীকার করছি আমারও ইচ্ছে আছে এখানে থাকার, প্রায় সবারই একই ইচ্ছে; কিন্তু মনে হয় না ভবিষ্যতে আমাদের এখানে থাকতে দেয়ার পরিকল্পনা আছে স্যাম ল্যামসনের। তৃতীয় প্রশ্ন, একেবারে সঠিক সময়ে সাপ্লাই ওয়্যাগনগুলো এল কোত্থেকে?
‘কেন, ফোর্ট থেকে নিয়ে এসেছে স্যাম! আমাদের পরপরই এসেছে ওয়্যাগনগুলো,’ প্রতিবাদ করল টেলর।
‘সত্যি কি তাই ঘটেছে? সময় পেলে নিজেই ট্রেইল পরীক্ষা করে দেখো। আমি আর জেন পরখ করে দেখেছি, আমরা আসার পর ওই ট্রেইল ধরে কোন ওয়্যাগন আসেনি। ওই ট্রেইলে যদি না এসে থাকে, তাহলে কোন্ পথে এসেছে? তোমার কি ধারণা ইন্ডিয়ান এলাকার ভেতর দিয়ে ওয়্যাগন নিয়ে এসেছে ল্যামসন? অসম্ভব। এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করবে না সে, যেখানে গন্তব্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনা নেই বললে চলে। তারমানে, ওয়্যাগনগুলো আগে থেকে এখানে এনে রাখা হয়েছিল, আমাদের অপেক্ষায়। ট্রেইলের উত্তর-পুবে ক্যানিয়নে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।’
‘বিশ্বাস করি না!’ তীক্ষ্ণ স্বরে মন্তব্য করল ডেভ মুর।
‘তাহলে নিজের চোখে দেখে এসো!’
‘তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমিও পক্ষ বদল করেছ,’ চাঁছাছোলা স্বরে আপত্তিকর প্রশ্নটা করল হিউ টেলর। ‘সত্যি করে বলো তো, আসলে তুমি কোন্ পক্ষে?’
‘এখনও ওয়্যাগন ট্রেনের লোকজনের পক্ষে আছি আমি, তুমিও জানো সেটা,’ শান্ত স্বরে বলল ডরোথি। ‘যদিও নিশ্চিত ভাবে জানি দলের অনেকেই বোকামি করছে। এখানে আসার প্রথম দিন স্যাম ল্যামসনের সঙ্গে উপত্যকায় ঘুরতে গিয়েছিলাম আমি। কথা প্রসঙ্গে বেখেয়ালে এমন একটা মন্তব্য সে করেছিল যা এখনও বেখাপ্পা লাগছে আমার কাছে। বলছিল উপত্যকাটা নিজের জন্যে পেতে চায় ও।
‘বাজে বকছ, ডরোথি!’ একগুঁয়ে স্বরে অসন্তোষ প্রকাশ করল হিউ টেলর। ‘অবশ্য মেয়েমানুষ মাত্র মুখ চালায় বেশি, আগপাছ ভেবে দেখে না। এজন্যেই মেয়েলোকের কথার দাম নেই।’
এতক্ষণ পর্যন্ত ধৈর্য ধরে ছিল ডরোথি, এবার আর সম্ভব হলো না। মুহূর্তের মধ্যে রেগে গেল। জানে খেপে গেলে কাজের কাজ কিছু হবে না, বরং আরও জেদ ধরবে হিউ টেলর, কিন্তু নিজেকে সংবরণ করতে ব্যর্থ হলো ও। ‘তুমি তো এও ধরে নিয়েছিলে আসার পথে ইন্ডিয়ানদের হামলার শিকার হব না আমরা, স্যাম ল্যামসনের কথা বিশ্বাস করে বসে ছিলে। সেদিন এড ক্রেমার না থাকলে ঠিক মারা পড়তাম সবাই।’
কথা শেষ করে ঘুরে দাঁড়াল ডরোথি, দ্রুত বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। পোর্চের দু’প্রস্থ সিঁড়ি ভেঙে নেমে এল মাটিতে, রেইলে ওর ঘোড়া বাঁধা। লাগাম খুলে চটজলদি স্যাডলে চাপল, তারপর নিজেদের কেবিনের দিকে এগোল। বাইরে তখন অন্ধকার। দূরে সেলুনের আলো দেখা যাচ্ছে। আরও দূরে এবং কিছুটা বামে সেলুন ছাড়িয়ে ওপাশের পাহাড়ের কোলে ডেভ মুরের কেবিনের বাতি চোখে পড়ছে অস্পষ্ট ভাবে। বাচ্চাকে নিয়ে স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় পোর্চে দাঁড়িয়ে আছে মিসেস মুর।
এতটাই রেগে গেছে ডরোথি, চারপাশে কিছুই নজরে পড়ছে না ওর। বিক্ষিপ্ত মনে এগিয়ে চলেছে। আচমকা পাশে এক ঘোড়সওয়ারের গাঢ় অবয়ব চোখে পড়ল।
‘হাউডি!’ স্বাগত জানাল লোকটা। স্যাডলে মৃদু দুলছে। বদ্ধ মাতাল। কণ্ঠ আর আকৃতি দেখে তৎক্ষণাৎ তাকে চিনতে পারল ডরোথি। শর্টি টেবার। ওয়্যাগনের সঙ্গে আসা এক টীমস্টার, মাঝে মধ্যে ঠেকার সময় বারটেন্ডার হিসেবেও কাজ করে। মদে চুর হয়ে থাকে বেশিরভাগ সময়।
ঘোড়ার গতি বাড়ানোর প্রয়াস পেল ডরোথি, কিন্তু হাত বাড়িয়ে ওর কব্জি চেপে ধরল টেবার। ‘এত তাড়াহুড়োর কী আছে!’ মোলায়েম কিন্তু জড়ানো স্বরে বলল সে। ‘আমার সঙ্গে একটু আলাপ করে গেলে হত না?’
‘কীসের আলাপ?’ রাগে বিরক্তি প্রকাশ করল ডরোথি। ‘তোমার সঙ্গে কোন কথাই নেই আমার!’ ঝাঁকি দিয়ে কব্জি ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল ও, কিন্তু আরও দৃঢ় হয়ে গেল বাঁধনটা। পরমুহূর্তে টেনে ওকে নিজের দিকে আকর্ষণ করল টেবার, মুক্ত হাতে ওর কোমর চেপে ধরল। বাধা দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করল ডরোথি, ভড়কে গিয়ে একপাশে সরে গেল ঘোড়াটা, তৎক্ষণাৎ স্যাডলচ্যুত হলো ও।
ওকে ছেড়ে দিয়েছে টেবার, দ্রুত স্যাডল থেকে নেমে পড়ল। ডরোথি সরে যাওয়ার আগেই চেপে ধরল ওকে। ‘সুযোগ যখন পেয়েছি, দু’একটা বিদ্যে আজ শেখাব তোমাকে!’ খরখরে, কর্কশ স্বরে বলল সে। ‘তোমার মত সেটলারদের জানা উচিত আসলে কারা এই শহর পরিচালনা করছে!’
পরের কয়েক মুহূর্তে কী ঘটল, ঠিক বলতে পারবে না ডরোথি। আচমকা টেবারের বন্ধন থেকে মুক্তি পেল ও। একটা ঘুসির আওয়াজ শুনতে পেল, আবছা অন্ধকারে দেখতে পেল দু’পা পিছিয়ে গেল টেবার, তারপর পা হড়কে পড়ে গেল ঘাসের ওপর।
‘বাড়ির দিকে দৌড়াও!’ এড ক্রেমারের কণ্ঠ স্বস্তি ছড়িয়ে দিল ওর সারা দেহে। ‘জলদি!’
খিস্তি করতে করতে উঠে দাঁড়াল টীমস্টার, তারপর বুনো মোষের মত ক্ষিপ্র গতিতে তাকে ছুটে যেতে দেখতে পেল ডরোথি। আবছা অন্ধকারে ঝলসে উঠল এডের হাত, মাংসের সঙ্গে আঙুলের গাঁটের ভোঁতা তীক্ষ্ণ শব্দ হলো, তারপরই পিছিয়ে গেল টীমস্টার। দু’পা পিছিয়ে থমকে দাঁড়াল সে, জুত মত দাঁড়িয়ে দু’হাত ছড়িয়ে দিল, তীব্র খিস্তি আওড়াল আবার। এবার আর কোন নিয়ম বা রীতির ধার ধারল না কেউ।
আবছা অন্ধকারে বুনো পশুর মত লড়াই শুরু করল দু’জন, ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ল টেবার। বেছে বেছে তাকে মারল এড। কেশে উঠল টীমস্টার, সশব্দে শ্বাস নিল যেন হাপরের শব্দ হচ্ছে; তখনই ওজনদার একটা ঘুসি এসে পড়ল তার চিবুকে, মুহূর্তের মধ্যে ধরাশায়ী হলো সে। উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ল মাটিতে। ঝুঁকে শার্ট খামচে ধরে তাকে টেনে তুলল এড, এক হাতে গলা চেপে ধরেছে টেবারের। অন্য হাতে মুখে নির্দয় আঘাত হানল ও, বারবার, শেষ কয়েকটা ঘুসি চালাল বুকে আর পেটে আবারও ধরাশায়ী হলো টেবার। দূর থেকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডরোথি, বাড়ি যাওয়ার কোন নির্দেশ ওকে দেয়া হয়েছে বলে মনে হলো না।
‘বাড়ি যাও!’ তীক্ষ্ণ স্বরে ফের নির্দেশ দিল এড। ‘তোমার বাবাকে বোলো সবসময় যেন সশস্ত্র থাকে। এটা মাত্র শুরু।’
ছুটতে শুরু করল ডরোথি। চারপাশ থেকে লোকজন এগিয়ে আসছে ঘটনাস্থলের দিকে। ‘এই? হচ্ছে কী এখানে, অ্যা?’ জানতে চাইল একজন।
পেছনে খুরের শব্দ শুনতে পেল ডরোথি, আন্দাজ করল অল্প সময়ের মধ্যে কেটে পড়েছে এড ক্রেমার। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে, ছোটার মধ্যে স্যাডল ছাড়ল ও, স্যাডল-ব্রিডল খুলে ঘোড়াটাকে নিয়ে এল করালে। লিভিংরূমে ঢুকে লণ্ঠন জ্বালাল।
মিনিট কয়েক পর বাড়িতে ফিরে এল টেড হেডলিন। সবকিছু তাকে খুলে বলল ডরোথি।
মুহূর্তখানেক কিছুই বলল না সে, স্থির বসে থাকল, টেবিলের ওপর বিছিয়ে রেখেছে হাত দুটো। সশব্দে একটা নিঃশ্বাস ফেলে সিধে হলো টেড হেডলিন। ‘হানি, ভুল করেছি, সত্যিই বড় ভুল করে ফেলেছি! এখানে থামা ঠিক হয়নি আমাদের। জেফ অ্যালেন আর অন্যদের সঙ্গে চলে গেলেই ভাল করতাম! ওরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে ক্যালিফোর্নিয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ভয় লাগছে, সত্যিই ভয় লাগছে আমার! কী যে হয় শেষপর্যন্ত!’
পাঁচ
পপলার থেকে ছয় মাইল পশ্চিমে উপত্যকার একটা লাইন-কেবিনে রাত কাটিয়েছে এড ক্রেমার। সকালে হ্যারি রাউডি যখন ওখানে পৌঁছল, সবে ঘোড়ার পিঠে স্যাডল চাপিয়েছে ও। রাউডির সঙ্গে আরও দুই কাউহ্যান্ড এসেছে-জো মিলার আর জন ল্যাম্পর্ট। সশস্ত্র সবাই। পিস্তল ছাড়াও স্যাডল স্ক্যাবার্ডে কারবাইন শোভা পাচ্ছে।
সবক’টা দাঁত বের করে হাসল হ্যারি। ফ্রেডের থেঁতলানো ঠোঁট, মুখের কালসিটে দাগ, হাতের গাঁটে ছড়ে যাওয়া চামড়া চোখে পড়েছে। ‘অ্যাকশন শুরু করেছ মনে হয়?’
‘সামান্য,’ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করল এড। ‘তোমরাও সতর্ক থেকো, শেষে বলল ও। ‘একসঙ্গে থাকার চেষ্টা কোরো। ওই আউটফিটটা সত্যিই খারাপ। যে-কোন সময় গোলমাল বেধে যেতে পারে।’
‘বেশি কিছু চাই না আমি,’ কর্কশ স্বরে বলল হ্যারি। ‘দো-আঁশলা ওই নচ্ছারটার বুকে একটা গুলি করতে চাই। ব্যস, আর কিচ্ছু না!’
স্যাডলে চেপে উত্তরে র্যাঞ্চ হাউসের ট্রেইল ধরল এড। মনে মনে পরিস্থিতি বিচার করছে। ঝামেলা এড়ানোর কোন উপায়ই থাকল না। আশা করেছিল ওয়্যাগন ট্রেনের যাত্রীদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করাতে পারবে, স্যাম ল্যামসনের প্রভাব বা কর্তৃত্ব থেকে সরিয়ে আনতে পারবে তাদের। কিন্তু বৃথা চেষ্টা করেছে। ল্যামসনের স্বরূপ এখনও ধরতে পারেনি ওরা, কেউ কেউ যদি পেরেও থাকে, স্রেফ মুখ বুজে আছে।
আর কিছুই করার নেই ওর।
পরস্পরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গেছে দুটো পক্ষ, এদের উদ্দেশ্যও পরিষ্কার-একটা পক্ষ অবৈধ ভাবে জমি দখল করতে চাইছে, কিন্তু ড্যান স্পেন্সার কিছুতেই তাদের জায়গা দেবে না, যেখানে নিজের একজন লোক হারিয়েছে। এড জানে হিউ টেলর লোকটা সৎ, তবে মাথা-মোটা। ওর মর্ত অন্যরাও সৎ, স্যাম ল্যামসনের দুরভিসন্ধি ধরতে পারছে না। এদের কয়েকজন, যেমন জনি গ্যারেট আর মাটি থ্যাচার, ল্যামসনের সঙ্গে এতটাই জড়িয়ে গেছে যে প্রায় অন্ধের মত অনুসরণ করছে তাকে, তাছাড়া এডের প্রতি অকারণ অসন্তোষও তাদের ঠেলে দিয়েছে উল্টোদিকে। ল্যামসনকেই বিশ্বাস করে ওরা।
ড্যান স্পেন্সারকে ঠেকিয়ে রাখা কঠিন হবে এখন, কোন ভাবেই সেটলারদের এখানে থাকতে দিতে চাইবে না সে। বুড়ো কঠিন ধাতের মানুষ, নিজের উপত্যকায় একদল সেটলারকে পা রাখতে দিলে পরিণতিতে কী হতে পারে, জানে। কথায় আছে: খেতে দিলে বসতে চায়, বসতে দিলে শু’তে চায়। এটাই দুনিয়ার নিয়ম। ধীরে ধীরে নিজেদের সীমানা বাড়াবে সেটলাররা, এদিকে স্পেন্সারের সীমানা কমে যাবে; একসময় হয়তো কোণঠাসা হয়ে পড়বে সে। সাংঘাতিক জেদী এবং বদরাগী এই লোকটি শুধু এডের প্রতি গভীর ভালবাসার কারণে মুখ বুজে ছিল এতদিন, তাছাড়া ওর কথায় আরও একটা ব্যাপার আঁচ করেছে সে। ছেলের মনের কথা বুঝতে অসুবিধে হয়নি তার। ওয়্যাগন ট্রেনের এক মেয়ের কারণেই চরম কোন ব্যবস্থা নিতে ওকে নিরুৎসাহী করেছে এড।
বুড়োর দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাবনা পরিষ্কার জানে এড। বাইরে থেকে নিষ্ঠুর, একগুঁয়ে বা প্রচণ্ড জেদী মনে হলেও ভেতরে আসলে নরম একটা মন আছে তার। দেহের মত অন্তরটাও বিশাল স্পেন্সারের। ছয় বছর বয়স থেকে ওকে লালন-পালন করছে সে, দুর্গম অঞ্চলের এক ট্রেইলে অনাথ ছেলেটিকে খুঁজে পেয়েছিল-পাশেই পড়ে ছিল বাবা-মার মৃতদেহ। ইন্ডিয়ানরা ওদের ওয়্যাগনে হামলা করেছিল, বাবা-মা খুন হলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় এড।
সেই থেকে ড্যান স্পেন্সারের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়ায় এড ক্রেমার। বুড়োর জীবনে অপূর্ব সুন্দর র্যাঞ্চটার যতটা গুরুত্ব, ঠিক ততটাই গুরুত্ব এডের। এডের প্রতি হে ভালবাসায় ঘাটতি পড়েনি কখনও, বরং কেবলই বেড়েছে। সত্যিকার একজন পিতার মতই আশা করছে এবার থিতু হবে এড, বিয়ে করবে; বাকি জীবনটা ছেলের কাছাকাছি থেকে কাটিয়ে দেবে সে।
এড ক্রেমারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি ড্যান স্পেন্সার। কিছুদিন আগে ছেলে যখন কাউন্সিল ব্লাফে যেতে চাইল, আপত্তি করেনি স্পেন্সার, বরং মনে মনে প্রত্যাশা করেছে ফেরার সময় হয়তো বউ নিয়ে ফিরে আসবে এড। নির্জন এই উপত্যকায় কোন মহিলা নেই, মাঝে মধ্যে দু’একজন ইন্ডিয়ান স্কুঅ চোখে পড়ে। তাই এড যখন কাউন্সিল রাফে যেতে চাইল, এ নিয়ে বরং উৎসাহ বোধ করেছে স্পেন্সার। তবে ছেলে ‘ একা ফিরে আসায়, শুরুতে কিছুটা হলেও হতাশ হয়েছিল স্পেন্সার। পরে এড়ের কথাবার্তায় বোঝা গেছে। ওয়্যাগন ট্রেনের একটা মেয়েকে পছন্দ করে সে। অবশ্য সরাসরি কিছুই বলেনি এড, আভাসও দেয়নি; কিন্তু মেয়েটার কথা বলার সময় চোখের ঔজ্জ্বল্য, একই কথা দু’বার বলা-এসব থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে দেরি হয়নি স্পেন্সারের। খুশি হয়েছে সে।
ড্যান স্পেন্সার বিশালদেহী মানুষ। অন্তত তিনশো পাউন্ড হবে ওজন। যৌবনে আড়াইশো ছিল, তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও ভারী হয়েছে শরীর। চওড়া কোমরে বিশাল সাইজের ড্রাগুন কোল্টগুলোকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ দেখায়। ভারী শরীরেও যথেষ্ট ক্ষিপ্র সে, ড্র করতে পারে চোখের নিমেষে। হয়তো ছেলেকে হারাতে পারবে না, কিন্তু অন্য যে-কারও চেয়ে ক্ষিপ্র এবং নির্ভুল নিশানায় গুলি করতে সক্ষম।
গরুর চামড়ায় মোড়া আরামদায়ক চেয়ারে বিশাল শরীর এলিয়ে পাইপে তামাক ভরছিল স্পেন্সার, পদশব্দে দরজার দিকে তাকাল, এডকে ঢুকতে দেখে উজ্জ্বল হয়ে গেল মুখ। পলকের মধ্যে ছেলের মুখ খুঁটিয়ে দেখল সে-এডের থেঁতলে যাওয়া ঠোঁট, চোখের নিচে কালশিটে দাগ আর ছড়ে যাওয়া আঙুলের গাঁট চোখে পড়ল।
‘মারামারি করেছ বোধহয়,’ উষ্ণ আরামদায়ক কামরা ভরাট হয়ে গেল স্পেন্সারের স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য মেশানো কণ্ঠে, তবে প্রশ্ন করেনি সে, কিংবা নির্লিপ্তও মনে হলো না সুরটা। ‘সেটলারদের ওখানে গিয়েছিলে আবার? ভাবছ ওয়েস বার্নেটকে খুন করেছে ওরা?’
‘সেটলারদের কাজ নয় এটা,’ জানাল এড। ‘ওদের সঙ্গে ঝামেলাবাজ কিছু লোক আছে, তাদের একজনই খুন করেছে ওয়েসকে।’
লগের একটা গুঁড়ির ওপর বসল এড, সংক্ষেপে পুরো পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করল। ল্যামসন, ড্যানান আর টীমস্টারদের সম্পর্কে বলল। ‘পাহাড়ে সাপ্লাই ওয়্যাগনগুলো লুকিয়ে রেখেছিল ওরা,’ বলে গেল এড। কিছুদিন আগে হঠাৎ মাইক হ্যানলনের চোখে পড়ে ওগুলো। প্রায় দশ-বারোজন লোক ছিল, অথচ সাপ্লাই ছিল এরচেয়ে অনেক বেশি লোকের। দলটার ওপর নজর রেখেছিল মাইক, তবে সন্দেহজনক এমন কিছুই করেনি ওরা, তাই ওদের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে সে
‘আসলে ওরা স্যাম ল্যামসনের লোক। ওয়্যাগন ট্রেনের জন্যে অপেক্ষায় ছিল। সেটলারদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে ল্যামসন, সরকার যদি প্রশ্ন তোলে তাহলে বলতে পারবে নিরীহ এবং সৎ কিছু মানুষ এরা, পশ্চিমে বসতি করতে চাইছে। তেমন হলে সরকারের কিছুই বলার থাকবে না, বরং ওদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করবে। কিন্তু স্যাম ল্যামসনের উদ্দেশ্য স্পেন্সার ভ্যালি দখল করা!’
‘নিশ্চয়ই, চাইতেই পারে সে, দাঁত বের করে হাসল স্পেন্সার, চোখে কাঠিন্য ফুটে উঠল। ‘কিন্তু চাইলেই তো হয় না! ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে ন্যায্য দামে এই উপত্যকা কিনেছি আমি, বুড়ো ওয়ার ক্লাউডের দেয়া রসিদও আছে আমার কাছে। ওদের সঙ্গে কখনও তো কোন সমস্যা হয়নি আমার! এই ট্রেইলে ওয়্যাগন ট্রেন চলার পর থেকে যত ঝামেলার শুরু! মরমনরা ঠিকই বলে। ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে ভাল আচরণ করো, ন্যায্য ব্যবসা করো, তাহলে তোমাকে ঘাঁটাবে না ওরা; কিন্তু সাদা মানুষকে এক ফোঁটা বিশ্বাস নেই!
‘ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে এই পাহাড়ী এলাকা চষে বেড়িয়েছি আমি, ওদের সঙ্গে থেকেছি, শিকার করেছি, ওদের তাঁবুয় ঘুমিয়েছি। কখনও ওদের সঙ্গে ঝামেলা হয়নি আমার। ষোলো বছর বয়সে এসেছি এখানে, তারপর কত বছর কেটে গেল!
‘গরু আনতে দুটো বছর লেগে গেল আমার। আশপাশে শত মাইলের মধ্যে আমিই প্রথম গরু এনেছি! সান্তা ফে থেকে ছয়-সাতটা ড্রাইভে গরু আনতে হয়েছে, এরচেয়ে কঠিন ড্রাইভ আর হতে পারে না। ইন্ডিয়ানরাই ড্রাইভে সাহায্য করেছে আমাকে। ওরা আমাকে বলত পাগল, উন্মাদ। অসম্ভবকে কি সম্ভব করেছি আমি? নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছ, গরু চরছে এখানে। সবুজ উপত্যকার ঘাসে চরে হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছে ওগুলো। কোন একদিন পুবে ড্রাইভ নিয়ে যাব, পরিশ্রমের ফসল ঘরে তুলব…ধনী হয়ে যাবে তুমি। স্যাম ‘ল্যামসনের মত কিছু লোভী মানুষকে আমার উপত্যকার ভাগ দেব? অসম্ভব!’ অধৈর্য ভঙ্গিতে চিবুক ঘষল সে, হঠাৎ চোখ তুলে তাকাল এডের দিকে। ‘ওই মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়েছে? হেডলিন না যেন কী নাম?’
‘হয়েছে,’ স্বীকার করল এড।
‘ওকে এখানে নিয়ে এলে না কেন, সান? সময় হয়েছে, এড। সংসারী হওয়া উচিত তোমার। পুরুষ মানুষের বেশিদিন বাঁধন ছাড়া থাকতে নেই আমিও তাই করেছিলাম, কিন্তু বেশিদিন ধরে রাখতে পারলাম না মেয়েটাকে। আহ্, সত্যিই দারুণ মেয়ে ছিল ও!’
‘ড্যান,’ স্পেন্সারকে নাম ধরে ডাকতে অভ্যস্ত ও, সেই ছোটবেলা থেকে, যেদিন ওকে কুড়িয়ে পেয়ে ঘরে নিয়ে এসেছিল বিশালদেহী মানুষটা। ‘পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক, আমি চাই না সেটলারদের সঙ্গে কোন লড়াই হোক, যদিও ওদের ভাবগতিকে মনে হচ্ছে ওরা তাই চায়। হিউ টেলর লোকটার বুদ্ধি একটু কম, ল্যামসন নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে ওকে। ড্রানানকে একটা শিক্ষা দেয়া দরকার। আমিই তো ওর গতি করতে পারি! কাজটা উপভোগও করব। পরে না হয় লোকজন নিয়ে ওদের কাছে চলে যাব, দলবল সহ ল্যামসনকে খেদিয়ে দেব এখান থেকে।
‘ছাগলের পাল থেকে ভেড়া আলাদা করতে চাও?’ ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকাল ড্যান স্পেন্সার। ‘বেশ, তোমার ওপর আস্থা আছে আমার। ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে যাও, ল্যামসন আর ওর লোকদের লারামির দিকে খেদিয়ে দেবে।
‘ডানানের ব্যাপারে যা ইচ্ছে করতে পারো। অনেক বন্দুকবাজ দেখেছি জীবনে, কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে তোমার মত ক্ষিপ্র বা নির্ভুল নিশানায় গুলি করতে সক্ষম খুব কম লোকই দেখেছি। শত্রুর শেষ রাখতে নেই, সান। তোমার জায়গায় হলে আমি ওদের প্রত্যেককে ঝুলিয়ে দিতাম পপলারের ডালে।
ছেলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল স্পেন্সার, চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে পাইপ ধরাল। আলোচনা আপাতত শেষ।
.
হ্যারি রাউডি মানুষটা ধীর-স্থির, গম্ভীর প্রকৃতির। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে সে। যে-কোন কাজ করার নিজস্ব ধরন আছে ওর, পরিকল্পনা বা কাজের পদ্ধতি-একান্তই ওর নিজস্ব। এদিকে ড্যান স্পেন্সার বা এড ক্রেমারের প্রতি ওর বিশ্বস্ততাও প্রশ্নাতীত। দু’জনকেই পছন্দ এবং সমীহ করে। কিন্তু আরও একটা বিশ্বস্ততা বা দায়িত্ব বোধ করছে সে-ওয়েস বার্নেটের প্রতি।
অন্তরঙ্গ বন্ধু বললে কম বলা হয়, ওয়েস ছিল ঠিক তাই। একসঙ্গে রাইড করেছে, শিকার করেছে, ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে লড়াই করেছে ওরা। বয়সে কম ছিল ওয়েস, তাই নিজেকে একইসঙ্গে ছেলেটার বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী এবং অভিভাবক মনে করত রাউডি। ওয়েসের মৃত্যুর সঙ্গে বন্ধুত্বের মর্যাদা আর দায়িত্ব জড়িত, স্বভাবতই প্রতিশোধ নেয়ার দাবিও চলে আসে। অন্তত হ্যারি রাউডির কাছে। রক্তপাত দাবি করছে পরিস্থিতি।
জো মিলার আর জন ল্যাম্পর্টের মানসিকতাও অনেকটা ওরকম। দু’জনেই বয়সে তরুণ, কঠিন ও বিপজ্জনক জীবনে অভ্যস্ত। বিপজ্জনক এই জীবনে পিস্তলের ওপরই ভরসা করতে হয়। তাই সাই ডানানের মত মানুষকে হাড়ে হাড়ে চেনে ওরা। তিনজনের মধ্যে, কেবল আধা মেক্সিকান আধা আইরিশ হ্যারি রাউডিই দো-আঁশলা ডানানের সমকক্ষ। কিন্তু, সুযোগ পেলে ডানানের বিরুদ্ধে ড্র করতে দ্বিধা করবে না তিনজনের যে- কেউ।
ঝামেলা বা বিপদ আশঙ্কা করছে না ওরা, তবে তৈরি আছে। পপলার ক্যানিয়নের মুখ থেকে কিছু গরু উপত্যকার নিচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তিনজন। কেউই জানে না নিকট ভবিষ্যতে কী আছে ওদের ভাগ্যে, যদি জানত তাহলে নির্ঘাত পেছন ফিরে তাকাত…
.
সেলুনের পেছনে নিজের লিভিংরূমে দুশ্চিন্তায় অস্থির বোধ করছে স্যাম ল্যামসন। ঘটনা ওর পরিকল্পনা মাফিক ঘটছে না। ড্যান স্পেন্সারের মত কিছু মানুষ সে দেখেছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকে আঁচ করেছিল ওয়্যাগন ট্রেন আসার পর কিংবা সেটলাররা বসতি করার পর গোলমাল করবে স্পেন্সারের ক্রুরা। ভেবেছে আচমকা আক্রমণ করবে স্পেন্সার, তাতে সেটলারদের দু’একজন খুন হয়ে যাবে। কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি। অথচ সেটলারদের একাট্টা করতে এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটারই দরকার এখন! এমনিতে শান্তিপ্রিয় মানুষ এরা, প্রায় প্রত্যেকে সাহসী এবং যার যার ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সম-অধিকারে বিশ্বাসী। নিজেদের কেউ মারা গেলে ফুঁসে উঠত এরা, ঠিক দাঁড়িয়ে যেত ড্যান স্পেন্সারের বিরুদ্ধে।
সেটলারদের এবং ড্যান স্পেন্সারের চরিত্র বা দৃষ্টিভঙ্গি জেনে-শুনেই এই নীল নক্সা তৈরি করেছিল সে। বছরখানেক আগে স্পেন্সার উপত্যকা . চোখে পড়ে ওর, দেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজের মধ্যে অদম্য এক লিপ্সা আবিষ্কার করে ল্যামসন। সেদিন থেকে কেবল একটি জিনিসের জন্যে বেঁচে আছে সে যেভাবে হোক স্পেন্সার উপত্যকার দখল নেয়া চাই! বিনিময়ে যত ক্ষতিই হোক, কিছু যায় আসে না।
আইনের কোন অস্তিত্ব নেই এখানে। উপত্যকার খবর প্রায় কেউই জানে না। অথচ কী সুন্দর জায়গা! স্বপ্নের বসতি হতে পারে যে-কারও জন্যে। দেখে বোঝারও উপায় নেই যে আগেই বসতি করেছে কেউ। প্রথমে ও ভেবেছিল সীমান্ত-শহর থেকে একদল বেপরোয়া আউট-লকে ভাড়া করে উৎখাত করবে ড্যান স্পেন্সারকে
সময় বদলে গেছে, জানে সে। তাই সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে। ড্যান স্পেন্সারের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের খবর চলে যাবে সরকারের কাছে। তদন্ত হতে পারে, এমনকী একদল আর্মিও চলে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে আইনকে নিজের পাশে পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
ওয়্যাগন ট্রেনটা সুযোগ এনে দিল ওকে। ফোর্টে ভাগ্যান্বেষী দলটাকে দেখেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলে। ক্লান্তি, পথ চলার দুর্ভোগ আর অনিশ্চয়তায় কাবু হয়ে পড়েছিল লোকগুলো- মহিলারা ছিল উদ্বিগ্ন এবং বিষণ্ন, আর পুরুষদের চোখে ছিল হতাশা। নতুন বসতি খুঁজে পাওয়ার স্বপ্ন তখন অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে ওদের, অরিগনের পথ তখনও অনেক অনেক দূরে। স্পেন্সার ভ্যালির মত সমৃদ্ধ একটা জায়গার সন্ধানই যথেষ্ট ছিল ওদের হতাশা কাটানোর জন্যে, স্যাম ল্যামসনের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি আর আন্তরিকতায় কাজটা আরও সহজ হয়ে গিয়েছিল। হিউ টেলরকে পটাতে তেমন কোন সমস্যা হয়নি ওর। সহজ ট্রেইলের পথ বাতলে দিতে ওকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে সবাই। অরিগনের উদ্দেশে মূল ট্রেইলে না গিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার পথ ধরে এখানে চলে এসেছে দলটা।
ক্যাম্পে এসে ঘণ্টাখানেক কথা বলার পরই সেটলারদের সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা হয়ে গিয়েছিল ওর। টেড হেডলিন নিরীহ, ধৈর্যশীল, বন্ধুত্বপরায়ণ মানুষ; নিজের জন্যে এক টুকরো জমি আর একটা লাঙল পেলেই খুশি। প্যাট গ্যাভিন সমর্থ, কঠিন ধাঁচের মানুষ; কিন্তু নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা নেই তার, ইচ্ছেও নেই। নীরবে নিজের কাজ করতে পছন্দ করে।
মার্টি থ্যাচার আর জনি গ্যারেট সৎ, সমর্থ মানুষ; কিন্তু এড ক্রেমারের ব্যাপারে দু’জনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় একই—এডকে অপছন্দ করে। গ্যারেট অবিবাহিত, এড আসার আগ পর্যন্ত ডরোথির প্রতি উৎসাহী ছিল সে, যদিও ব্যাপারটা কখনও প্রকাশ করেনি।
এড প্রায় সারাক্ষণই ডরোথির কাছাকাছি ছিল, প্রথমে আহত থাকায় ওর শুশ্রূষা করেছে ডরোথি এবং পরে শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে প্রায়ই দেখা করত টেডলিনদের সঙ্গে। স্বভাবতই ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে গ্যারেট। এদিকে মাটি থ্যাচার বিবাহিত জীবনে অসুখী, খিটখিটে মেজাজের বউয়ের সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি লাগে ওর। ডরোথির প্রতি তারও আগ্রহ কম নেই। ডরোথির সঙ্গে এডের অন্তরঙ্গতা চরম বিদ্বেষী করে তোলে ওকে, তবে সেটার পরিমাণ গ্যারেটের চেয়েও বেশি, কারণ থ্যাচার উপলব্ধি করেছে ওর চেয়ে বরং এডেরই যোগ্যতা বেশি। তিক্ত ক্ষোভ আর ঘৃণা বোধ করে সে এডের প্রতি।
এই দু’জনকে দলে ভেড়াতে তেমন কোন সমস্যা হয়নি ল্যামসনের। ওদের সঙ্গে কথা বলেছে সে, ফুসলেছে, ড্রিঙ্ক খাইয়ে খাতির করেছে। থ্যাচারের টানাটানি চলছে জেনে কিছু টাকা ধারও দিয়েছে। আর গ্যারেটকে দিয়েছে ওর পছন্দের একটা পিস্তল।
অন্যদের সঙ্গে খাতির জমাতেও তেমন বেগ পেতে হয়নি ল্যামসনকে। ব্যর্থ বা ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া মানুষগুলোর কাছে ওর গুরুত্ব অনেক, কারণ ওদের স্বপ্নের বসতির সন্ধান দেবে সে এটাই সবাইকে দলে টেনে আনার জন্যে যথেষ্ট ছিল।
শুধু একটা জায়গায় সমস্যা দেখা দিল-এড ক্রেমার। লোকটাকে প্রথম দেখেই ল্যামসন বুঝে নিয়েছে শক্ত চীজ, ভবিষ্যতে এর কাছ থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হবে। বিপজ্জনক এবং ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ। সে এটাও টের পেয়েছে, থ্যাচার আর গ্যারেটই হতে পারে ওর তুরুপের তাস।
‘এ পর্যন্ত ভালই চলছিল, কোথাও কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু ড্যান স্পেন্সারের নিষ্ক্রিয়তা ক্রমশ উদ্বিগ্ন করে তুলছে ওকে, অথচ এটার ওপরই পুরো পরিকল্পনার সাফল্য নির্ভর করছে। সত্যিই কি সেটলারদের এখানে বসতি করতে দেবে বুড়ো? এ পর্যন্ত বেশ কিছু গরু মেরেছে মাংসের জন্যে, ইচ্ছে করে নমুনা রেখে এসেছে যাতে বুঝতে পারে স্পেন্সারের ক্রুরা। জবাই করা গরুর অবশিষ্টাংশ খুঁজে পাওয়ার পর ওগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলেছে এড ক্রেমার, অথচ সেও ব্যাপারটা উপেক্ষা করেছে ভীতু মানুষের মত। প্রত্যাশিত হামলা করেনি স্পেন্সার, অথচ এদিকে সেটলারদের আস্থা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
স্পেন্সার উপত্যকার দখল পাওয়ার একটাই উপায়: রক্তপাতের মাধ্যমে স্পেন্সারের লোকজনকে নির্মূল করতে হবে, শুধু তারপরই দখল নেয়ার সুযোগ হবে ওর। সেটলাররা ওর পক্ষ নেবে, তারাই হবে ওর তুরুপের তাস। প্রথম দিকে লোকগুলোকে ঠিকই জায়গা দেবে সে, পরে একে একে সবাইকে খেদিয়ে দেবে। বিশাল সমৃদ্ধ ওই উপত্যকার একচ্ছত্র মালিক বনে যাবে সে।
সাই ড্রানানকে খুনোখুনির নির্দেশ দেয়নি বটে, কিন্তু ওয়েস বার্নেট খুন হয়ে যাওয়ায় ব্যাপারটা শাপেবর হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর জন্যে। তবে বেশিরভাগ সেটলারই পছন্দ করতে পারেনি ঘটনাটা। টেডলিন এবং গ্যাভিনকে বুঝ দেয়া কঠিন হবে, বরং খেপে গেলে ওর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতে পারে এরা।
সেটলারদের ওর পক্ষে রাখতে হলে একটা কিছু ঘটানো চাই।
মওকা খুঁজছিল, হঠাৎই এসে গেল সুযোগ। সাই ডানান, শর্টি টেবার, মার্টি থ্যাচার, জনি গ্যারেট এবং ডেভ মুরের সঙ্গে উপত্যকার ঢালু পথের দিকে যাচ্ছে ল্যামসন, আচমকা হ্যারি রাউডির সঙ্গে আরও দু’জন স্পেন্সার ক্রুকে এগিয়ে আসতে দেখতে পেল। ট্রেইল ধরে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলে দুই পক্ষে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কারণ একটু পিছিয়ে আছে ক্রুরা, মিনিট কয়েক লাগবে তাদের এখানে পৌঁছতে, যাবেও সম্ভবত অন্য কোথাও।
ঘোড়ার রাশ টেনে অপেক্ষায় থাকল ল্যামসন।
বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে খানিকটা সতর্কতার সঙ্গে এগোল হ্যারি রাউডি; তবে বিপদ দেখে পিছিয়ে যাওয়ার মানুষ নয় সে। সঙ্গী জো মিলার আর জন ল্যাম্পটও তাই। হোলস্টারের ফিতা খুলে দিল ওরা, দৃঢ় ভঙ্গিতে এগিয়ে এল।
‘হাউডি!’ সম্ভাষণ জানাল রাউডি, সবাইকে একনজর দেখার পর সাই ডানানের ওপর স্থির হলো ওর দৃষ্টি। ‘কোথায় যাচ্ছ তোমরা?’
‘জানতে চাইছে কে, অ্যাঁ?’ ত্যক্ত স্বরে জানতে চাইল মার্টি থ্যাচার। ‘যেখানে খুশি যাব আমরা।’
‘এই রেঞ্জে অন্তত তা হবে না। উপত্যকার ওপাশে, নিজের জায়গায় থাকো তোমরা। এটা স্পেন্সারের জমি।
‘সবকিছুর মালিক নাকি সে?’ জানতে চাইল শর্টি টেবার। ‘যেখানে খুশি যাব, তাতে ওর কী?’
‘দেখে তো মনে হচ্ছে অন্যে খুশি হয়, এমন জায়গায় যাচ্ছ,’ সবক’টা দাঁত বের করে হাসল জো মিলার। ‘চাঁদমুখটা দেখেছ, হ্যারি, এক্কেবারে চষা জমির মত-কেউ যেন স্পাইকঅলা বুট দিয়ে আচ্ছামত মাড়িয়েছে!’
রাগে লাল হয়ে গেল টেবারের মুখ। ‘মাত্র তিনজন ওরা!’ স্পষ্ট বিদ্বেষের সুরে উস্কানি দিল সে। ‘মনে হচ্ছে স্পেন্সারের ক্রুদের খানিকটা শিক্ষা না দিলে নয়!’
‘বলতে চাইছ,’ নির্লিপ্ত সুরে বলল রাউডি। ওয়েসকে পেছন থেকে গুলি করে যেভাবে শিক্ষা দিয়েছে খুনী দো-আঁশলাটা, ওভাবে?’
ঝলসে উঠল ডানানের হাত, চোখের পলকে তালুয় উঠে এল পিস্তল হ্যারি রাউডি সে-তুলনায় খুব শ্লথ, তা বলা যাবে না। ডানানের ঘোড়া আচমকা লাফিয়ে সামনে বাড়ল, তাতেই বেঁচে গেল সে। ঘোড়া লাফিয়ে ওঠায় ডানানের ঘোড়ার মুখে লাগল গুলি। হুড়মুড় করে ঢলে পড়ল ওটা।
মুহুর্মুহু গোলাগুলি শুরু হলো সহসা, সুযোগটা নিতে ভুল করল না চতুর ল্যামসন। সিক্সশূটার বের করে ঠাণ্ডা মাথায় ডেভ মুরের পিঠে গুলি করল।
আচমকা, যেমন শুরু হয়েছিল তেমনি শেষ হয়ে গেল লড়াই। সাই ডানানের ঘোড়াটা পড়ে আছে, মৃত। ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার সময় হাত থেকে পিস্তল খসে পড়েছে বন্দুকবাজের, মুখ থুবড়ে ঘাসের ওপর পড়েছে সে, উঠে লড়াই করার কিংবা পিস্তলটা খুঁজে বের করার কোন ইচ্ছে দেখা গেল না তার মধ্যে।
লড়াইয়ের ফলাফল যা হওয়ার কথা, তাই হলো: পালাল স্পেন্সার ক্রুরা। এক পায়ে গুলি লেগেছে জন ল্যাম্পর্টের। এদিকে মার্টি থ্যাচারের গাল পুড়িয়ে চলে গেছে একটা বুলেট, টেবারের ঘোড়া ভূপতিত হয়েছে। সেকেন্ড কয়েকের লড়াই শেষে দেখা গেল দুটো ঘোড়া মারা গেছে এবং একজন লোক নিহত হয়েছে। প্রবল উত্তেজনার মধ্যে ডেভ মুরের দিকে মনোযোগ দেয়নি কেউ, কিন্তু যার কারণে অসহায় ভাবে খুন হলো হতভাগ্য মুর-সেই স্যাম ল্যামসন ঠিকই মৃত্যুর আগে মুরের চোখে প্রবল বিস্ময় আর ঘৃণা দেখতে পেয়েছে।
হতভাগ্য কামার মুখ খোলার সুযোগ পায়নি, ঘাসের ওপর পড়ে আছে মৃতদেহ। সেদিকে একবার তাকাল ল্যামসন, ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ঝুলছে। খেল্ জমে গা! বন্ধুদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় ছিল মুর, হাসি-খুশি শান্ত প্রকৃতির মানুষ। সবাই পছন্দ করত ওকে। সলতেয় আগুন দেয়া হয়ে গেছে, এবার বিস্ফোরণ শুরু হবে!
‘বিশ্বাস করতে পারছি না ও মারা গেছে!’ মুরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মার্টি থ্যাচার, বিষণ্ন হয়ে গেছে কঠিন মুখ। ‘বড় ভাল ছিল মানুষটা!’ ট্রিপের আগে থেকেই পরিচয় ছিল দু’জনের, একসঙ্গে যুদ্ধও করেছে ওরা।
‘চলো, কবর দিই ওকে,’ মেকি বিষণ্ণ সুরে বলল স্যাম ল্যামসন, ভেতরে ভেতরে পুলকিত। এবার কাজ না হয়েই যায় না! ডেভ মুরের মৃত্যুতে প্রায় সবারই থ্যাচারের মত প্রতিক্রিয়া হবে।
ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল থ্যাচার। ‘উঁহুঁ, ওকে বাড়ি নিয়ে যাব আমরা। ওর বউ হয়তো লাশ দেখতে চাইবে শেষবারের মত। বেচারীর জন্যে দুঃখই হচ্ছে আমার!’
সরু হয়ে গেল ল্যামসনের ঠোঁট, কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে নিবৃত্ত করে নিল। সন্দেহ হয় এমন কিছু না বলাই ভাল। নীরবে ফিরতি পথ ধরল ওরা। নিজের ঘোড়ার স্যাডলে মুরের লাশ তুলে নিয়েছে থ্যাচার, ঘোড়ার লাগাম ধরে হাঁটছে। পেছনে সাই ডানান আর শর্টি টেবার ওর মতই পায়ে হাঁটছে। নীরবে এগিয়ে চলল শোভাযাত্রা।
.
দুটো দিন একেবারে নীরব এবং ভূতুড়ে শহর হয়ে থাকল পপলার টাউন। যথাযোগ্য মর্যাদা আর গাম্ভীর্যের সঙ্গে কবর দেয়া হয়েছে ডেভ মুরকে। ফিউনারেলে আসা সেটলারদের মুখ দেখে পুলকিত হলো স্যাম ল্যামসন, ঠিকই আন্দাজ করেছে। কারও মধ্যে কোন দ্বিধা বা সংশয় নেই। নিজেদের কোণঠাসা ভাবছে ওরা। লড়াই আসন্ন। স্রেফ একটা অজুহাত দরকার, কিংবা সামান্য উস্কানি। কবরস্থান থেকে নিজের বাড়িতে ফেরার সময় মনে মনে উল্লাস বোধ করল ল্যামসন। মাত্র কয়েক দিনের ব্যাপার, তারপরই মরণপণ লড়াই শুরু করবে সে।
টেড হেডলিন ধীর-স্থির, শান্ত স্বভাবের লোক। কিন্তু ডেভ মুরের মৃত্যু তাকেও ব্যথিত এবং জেদী করে তুলেছে। গম্ভীর মুখে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির পথ ধরল সে। ‘তো, কেউ বলতে পারবে না রক্তপাত এড়ানোর চেষ্টা করিনি আমরা, কিন্তু এখন লড়াই করতে হবে!’ জেদের সুরে মন্তব্য করল হেডলিন। ‘আমার তো মনে হয়, যত তাড়াতাড়ি লড়াই শুরু হবে ততই মঙ্গল। অন্তত ডেভের বন্ধুরা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে মনে।’
কিছু বলল না ডরোথি, মন ভার হয়ে আছে পাথরের মত। কয়েকটা দিনের জন্যে মোহগ্রস্ত হলেও, এখন আর স্যাম ল্যামসনের কথা ভাবছে না ও। মোহটা কেটে গেছে, বুঝেছে ল্যামসন আসলে বাতিলযোগ্য একটা মাল। চকচকে, বাহারী চেহারা, অথচ ভেতরটা অন্তঃসারশূন্য। ওর মন জুড়ে রয়েছে কেবল একজন-দীর্ঘদেহী, সমর্থ কিন্তু স্বল্পভাষী এড ক্রেমার।
এ নিয়ে প্রায়ই ভেবেছে ডরোথি, বিস্মিত হয়েছে: একটা মানুষ কী করে এত কঠিন হতে পারে নিজের সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত, আত্মবিশ্বাসী- অনায়াসে অন্যদের মধ্যে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম; ঘোড়া সামলাতেও দারুণ দক্ষ, পিস্তলে চৌকস; অথচ মেয়েদের সঙ্গে সেই লোক দারুণ নম্র, লাজুক এবং সদয়। আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত এক ইন্ডিয়ান স্কুঅই ছিল এডের দেখা একমাত্র মেয়েমানুষ, সান্তা ফেয় যাওয়ার পর প্রথম কোন সাদা মেয়েকে দেখে সে। আর বিশ বছরের আগে কোন মহিলার সঙ্গে কথা বলেনি। এখন ওর বয়স সাতাশ, বড়জোর ছয়-সাতজন সাদা মহিলা বা মেয়ের সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে ওর।
অথচ এখন, তিক্ত বিষণ্ণতা এবং বেদনার সঙ্গে উপলব্ধি করছে ডরোথি, ডেভ মুরের মৃত্যুতে অবশ্যম্ভাবী লড়াই এড়ানোর আর কোন উপায় থাকল না। লড়াই হবে। নিজের বাবাকে ভাল করে চেনে ও। নির্ঝঞ্জাট, নির্বিরোধী মানুষ, কিন্তু একবার রোখ চেপে গেলে সহজে নিরস্ত হয় না। আগেও তাকে তেতে উঠতে দেখেছে ডরোথি। এমনিতে ঝামেলা বা গোলমাল এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে, কারও সাতে-পাঁচে থাকে না; অন্যের ভাল দিকটাই হিসেব করে আগে; কিন্তু লড়াই করতে হলে পিছ-পা হয় না কখনও। নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, সেটলারদের মধ্যে কেউ যদি শেষপর্যন্ত লেগে থাকে, তাহলে লোকটা হবে টেড হেডলিন।
ফিউনারেল থেকে ফিরতি পথে শুধু একজন মানুষ নীরব হয়ে আছে, একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি-লিও কারভার। ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে তাকে। দুর্বল শরীরে বেরিয়ে এসেছে এই প্রথম। দারুণ ক্লান্ত বোধ করছে সে, প্যাট গ্যাভিনের বাড়িতে ফিরে কিছুটা স্বস্তি বোধ করল।
দ্রুত বিছানায় শুয়ে পড়ল কারভার। সময়ের আগেই বিছানা ছেড়েছে সে, অনুচিত হয়েছে কাজটা, কিন্তু বন্ধুর ফিউনারেলে না গিয়েও উপায় ছিল না। এখন, নিঃসঙ্গ কামরার ঘনায়মান অন্ধকারে চুপচাপ শুয়ে থেকে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করছে ও, পাশের কামরায় অন্যদের মৃদু আলাপের শব্দ কানে আসছে। কিছুটা হলেও অনুতাপ করছে কারভার, ফিউনারেলে না গেলেই বোধহয় ভাল হত।
একটু আগে আগেই বেরিয়েছিল সে, ডেভ মুরের বাড়িতে গিয়েছিল বন্ধুকে শেষবারের জন্যে দেখার জন্যে। পিট ল্যাস্কারের সাহায্যে মিসেস মুর তখন শেষবারের মত মুরের শরীরে কাপড় পরিয়ে দিচ্ছিল। এমন একটা জিনিস ও দেখেছে যা সবার চোখ এড়িয়ে গেছে, এবং এর তাৎপর্য উপলব্ধি করে ভেতরটা আতঙ্কে হিমশীতল হয়ে গেছে ওর। পেছন থেকে, পিঠে গুলি করা হয়েছে মুরকে! কিন্তু শুধু এই নয়, আরও একটা জিনিস উদ্বিগ্ন করে তুলেছে ওকে।
মানুষটা সে হাসি-খুশি, নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে পছন্দ করে; তারচেয়েও বেশি পছন্দ করে ম্যান্ডোলিন বাজিয়ে গান গাইতে। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কেও যথেষ্ট ধারণা আছে ওর। মিসৌরি থেকে টেক্সাস পর্যন্ত বেশ কয়েকবারই যাতায়াত করেছে। নদী পেরিয়ে নিউ অর্লিয়েন্সেও গেছে। ওসব ট্রিপে অস্ত্র সম্পর্কে যথেষ্টরও বেশি ধারণা পেয়েছে।
বিভিন্ন রকমের গুলির ক্ষত দেখেছে ও, জখম দেখে বুঝতে পারে কোনটা কোন্ ক্যালিবারের গুলি। ড্রাগুন কোল্টের ভয়ঙ্কর ক্ষত দেখেছে ও, জানে কুঠারের কোপের মত তীব্র আঘাত করে গুলি, গর্তটা এত বড় হয় যে একটা মোষও চলে যেতে পারবে। এটা অবশ্য শোনা কথা, পশ্চিমের মানুষ এভাবেই তুলনা করতে পছন্দ করে। অথচ ডেভ মুরের দেহে যেখানে গুলি ঢুকেছে, ক্ষতটা তুলনামূলক অনেক ছোট, আর গুলিটা যেদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে, সেখানেও একটা ক্ষত রয়েছে-কুৎসিত এবং বিশাল।
লিভিংরূম এবং রান্নাঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল মার্টি থ্যাচার। সেকেন্ড কয়েক কারভারের পাণ্ডুর মুখটা জরিপ করল। ‘জলদি সুস্থ হয়ে ওঠো, লিও,’ বলল সে। ‘সবাইকে দরকার এখন আমাদের।’
‘সত্যিই কি পরিস্থিতি এত খারাপ, মার্টি?’ খানিকটা বিষণ্ণ, স্নান সুরে জানতে চাইল লিও কারভার, ঘরের আবছা আলোয় তার চোখের ভাষা পড়তে ব্যর্থ হলো থ্যাচার। ‘ঘটনাটা খুলে বলো তো।’
‘না, অন্তত আমার কাছে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি অত খারাপ নয়। গোলাগুলি তেমন হয়নি, স্রেফ কয়েকটা শট। এত দ্রুত ঘটে গেছে সবকিছু, পিস্তল বের করে দেখি লড়াই শেষ। স্পেন্সারের ওই ক্রু, হ্যারি রাউডি আর ডানানই ছিল সবচেয়ে ক্ষিপ্র, আমাদের আগেই পিস্তল বের করে ওরা। ড্রানান কিছুটা এগিয়ে ছিল, সেকেন্ডের কয়েক ভগ্নাংশ হয়তো, কিন্তু আচমকা ঘোড়াটা লাফিয়ে ওঠায় নিশানা নড়ে যায় ওর। যদিও তাতেই বোধহয় প্রাণ বেঁচেছে ওর, কারণ রাউডির গুলি ঘোড়াটার মাথায় লেগেছিল, একেবারে দুই চোখের মাঝখানে।
‘ঘোড়াটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় সাইকে, প্রায় আমার ওপর পড়তে যাচ্ছিল। তড়িঘড়ি করে ঘোড়াটাকে সরিয়ে নিলাম। স্পেন্সারের আরেক ক্রুর দিকে একটা গুলি করেছিল গ্যারেট, গুলিটা বিধেছে শরীরে। পালিয়ে যাওয়ার সময় লোকটার শরীরে রক্ত দেখেছি।
দীর্ঘ কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থাকল লিও কারভার, তারপর সতর্ক কণ্ঠে প্রশ্নটা করল: ‘মুরকে গুলি করেছে কে?
ভ্রূকুটি করল থ্যাচার। ‘ঠিক বলতে পারছি না। গোলাগুলির সময় যার যার ধান্ধায় ব্যস্ত ছিলাম আমরা। হয়তো বিপক্ষের কারও গুলিতে মরেছে ও। এ নিয়ে চিন্তা কোরো না। তিনজনকেই পাকড়াও করব আমরা, তাহলে দোষী লোকটা পার পাবে না।’
‘কী ধরনের অস্ত্র ছিল ওদের কাছে? চালু মাল ছিল নিশ্চয়ই!’
‘আমাদের মতই। ড্রাগুন কোল্ট। ওদের একজনের কাছে মান্ধাতা আমলের একটা ওয়াকার ছিল অবশ্য, বিশাল ওটা, দেখে মনে হলো যেন রাইফেল চালাচ্ছে।’
মাটি থ্যাচার চলে যাওয়ার পর অন্ধকার কামরায় নীরবে শুয়ে থাকল কারভার। ভাবছে সে। চিন্তাগুলো প্রায় অস্থির এবং আতঙ্কিত করে তুলল ওকে, অথচ এটাও সত্যি যে ওর এই দুরবস্থার জন্যে দায়ী সাই ডানান। স্বপক্ষের লোক সে।
পিঠে গুলি খেয়েছে ডেভ মুর, ব্যাপারটা কোন ভাবেই অগ্রাহ্য করার মত নয়।
জখমটা দেখেছে ও, শপথ করে বলতে পারবে ওয়াকার বা ড্রাগুন কোল্টের গুলির ক্ষত নয় ওটা। ক্ষতটা অতিরিক্ত ছোট, সন্দেহজনক। মুরের বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হাড়-মাংস গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে বুলেট, যেন একটা শটগানের গোলা লেগেছিল। কেউ কেউ বুলেটের আগা কেটে ফেলে, তাতে জখমের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়, দ্রুত মৃত্যু নিশ্চিত হয়। এ ধরনের জখমও দেখেছে কারভার। বুলেটে সামান্য কারিগরির কারণে ভয়াবহ এবং কুৎসিত মৃত্যু নেমে আসে টার্গেটের ভাগ্যে।
ছয়
ড্যান স্পেন্সারের অফিসরূমে বসে ছিল এড ক্রেমার, কথা বলছিল দু’জনে। উপত্যকার লড়াইয়ের খবর নিয়ে ওখানে এল জো মিলার। নীরবে সব শুনে গেল স্পেন্সার, কঠিন আড়ষ্ট হয়ে গেছে মুখ।
‘তো, শুনলে তো, এড? সময় এসে গেছে! অনেক সুযোগ দেয়া হয়েছে ওদের, আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা চলে না। এখন থেকে সরাসরি লড়াই হবে। থেমে মিলারের দিকে তাকাল উপত্যকার মালিক। ‘ছয়জন লোক নিয়ে যাও সঙ্গে। মন্টিকে বাকবোর্ড সহ যেতে বলো, জনকে র্যাঞ্চ হাউসে নিয়ে আসবে। এখানেই সঠিক যত্ন পাবে সে। মাইককে আমার সঙ্গে দেখা করতে বোলো, ফিরে গিয়ে দায়িত্ব নেবে ও।’
উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছে এড ক্রেমার। অস্থির ভঙ্গিতে কালো চুলে আঙুল চালাচ্ছে। কঠোর হয়ে গেছে মুখ। সেটলারদের একজন মারা গেছে। এর তাৎপর্য জানে ও। বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে লোকটা ডেভ মুর। ভালমানুষ। স্বভাবতই একাট্টা হয়ে যাবে সেটলাররা, ঘটনা তলিয়ে দেখবে না কেউ। লাশের বদলে লাশ ফেলতে চাইবে। যতই অনিচ্ছা থাকুক, এখন লড়তে হবে। ডরোথির দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে এখন?
দ্রুত, মনে মনে শহরের লোকজনের সংখ্যা হিসেব করল এড। স্পেন্সার ক্রুদের চেয়ে সংখ্যায় কম পপলারবাসী। কিন্তু ইন্ডিয়ান হামলার আশঙ্কা থাকায় এবং গরুর দেখ-ভাল করার জন্যে কিছু লোককে রেঞ্জে রাখতে হবে ওদের।
‘বাইরে যাচ্ছি আমি,’ শেষে বলল ও। ‘পপলারে যাব। এক ফাঁকে ক্যানিয়নেও যাব, ল্যামসন যেখানে ওয়্যাগন আর মালপত্র লুকিয়ে রেখেছিল, জায়গাটা দেখব।’
‘সতর্ক থেকো, বয়!’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ড্যান স্পেন্সার। ‘তুমিই এই র্যাঞ্চের মালিক হবে। ঝামেলাটা শেষ হলে তোমার হাতে সব দায়িত্ব তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাই আমি, এড।
দ্রুত পায়ে করালে চলে এল এড, দেখল ওর স্টীল-ডাস্টে স্যাডল সাজিয়ে বের করে আনছে জো মিলার।
‘জানতাম তুমিও বেরোবে,’ মৃদু হেসে বলল সে। ঘোড়ার লাগাম এডের হাতে তুলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েও এক পা পিছিয়ে গেল। ‘এড, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি! আমরা কেউ কিন্তু গুলি করিনি মুরকে।
চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল এড, থাবা দিয়ে কাউবয়ের কাঁধ খামচে ধরল। ইস্পাতের মত কঠিন হয়ে গেছে চোখ দুটো। ‘তারমানে? খুলে বলো সব, জলদি!’
‘আরে, আমাকে ব্যথা দিচ্ছ! রসো, এড, বলছি!’ এডের তাড়া আর অস্থিরতা উপলব্ধি করে হাসল সে। ‘ইশ্, তোমার হাতেও জোর যেমন! যেন ভালুকের ফাঁদ চেপে বসেছে!’ এড ছেড়ে দিতে কাঁধ ডলল সে। ‘ঘটনার পর থেকে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি কেবল। হ্যারির মনোযোগ ছিল ডানানের ওপর, একটা গুলিও করেছিল দো-আঁশলাকে, কিন্তু হতচ্ছাড়া ঘোড়াটা লাফিয়ে ওঠায় বেঁচে গেছে ডানান। আমি গুলি করেছি টেবারকে, যে-লোকটাকে পিটিয়েছ তুমি সেদিন। কিন্তু ওকে বেঁধাতে পারলাম না, ঘোড়াটা নিকেশ হয়ে গেল। পাহাড়ী লোকটার উদ্দেশে গুলি করেছিল জন, সম্ভবত গাল পুড়িয়ে দিয়েছে লোকটার, মাথায় গুলি করার ইচ্ছে ছিল ওর। আসলে, মুর লোকটার প্রতি আমরা কেউই মনোযোগ দিইনি।’
‘ঠিক বলছ তো?’
দ্রুত ভাবছে এড। স্পেন্সারের বিরুদ্ধে সেটলারদের খেপিয়ে তুলতে হলে সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে সেটলারদের কেউ যদি খুন হয়ে যায় ওদের হাতে। হতভাগ্য লোকটা যদি ডেভ মুরের মত জনপ্রিয় ভালমানুষ হয়, তাহলে সোনায় সোহাগা।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিলারের দিকে তাকাল এড। ‘মুরের কাছাকাছি ওদের কে ছিল?’
‘একেবারে সামনের দিকে ছিল মুর,’ জানাল মিলার। ‘পাশে মোটাসোটা দাড়িঅলা এক লোক ছিল। অন্য পাশে ছিল সাদা হ্যাট আর গাঢ় রঙের কোট পরা একজন।’
দাড়িঅলা নিশ্চয়ই জনি গ্যারেট, ভাবছে এড, আর সাদা হ্যাটঅলা লোকটা স্যাম ল্যামসন।
স্যাডলে চাপল ও। ‘জো, মাইককে তৈরি থাকতে বোলো। পপলারে যাচ্ছি আমি।’
‘আসব তোমার সঙ্গে?’ অধীর কণ্ঠে জানতে চাইল মিলার। ‘একা যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? আমার তো মনে হয় সঙ্গে কেউ থাকলে সাহায্য হবে। ওই লোকগুলো এখন খুন করছে, লড়াই উস্কে দেয়ার জন্যে বন্ধুর লাশ ফেলে দিচ্ছে।’
মাথা নাড়ল এড। ‘না, আমি একাই যাব। মাইককে কেবিনে অপেক্ষা করতে বোলো।’
ঘোড়া ঘুরিয়ে উপত্যকা ধরে এগোল এড। এখনও বোধহয় রক্তপাত এড়ানো সম্ভব, যদি সময়মত পপলারে পৌঁছতে পারে ও; যদিও অবচেতন মন বলছে এই সুযোগ ছাড়বে না স্যাম ল্যামসন – চটজলদি কাজে নেমে পড়বে। ডেভ মুরের মৃত্যুকে উসিলা হিসেবে ব্যবহার করবে, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধিয়ে দেবে। অজুহাতের অপেক্ষায় ছিল সে এতদিন, যেটা কাজে লাগিয়ে সমূলে বিনাশ করবে স্পেন্সারের ক্রুদের। সাম্রাজ্য দখল করবে।
উপত্যকার আধাআধি যাওয়ার আগেই নিচু একটা পাহাড়ের ঢালে ঘোড়া থামাল এড। দক্ষিণে কয়েক মাইল দূরে কয়েকজন ঘোড়সওয়ারকে দেখতে পাচ্ছে, লাইন-কেবিনের দিকে যাচ্ছে। আহত জন ল্যাম্পর্টের সঙ্গে ওখানে আছে হ্যারি রাউডি।
মাইক হয়তো দ্রুতই রওনা দেবে, কিন্তু পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে, তাই রাউডি বা ল্যাম্পর্টকে সাহায্য করতে পারবে না। আধ-ঘণ্টার মধ্যে হামলা করবে সেটলাররা। এখান থেকে লাইন-কেবিনে পৌঁছতে এরচেয়ে বেশি সময় লাগবে ওর। ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। স্ট্যালিয়ন ঘুরিয়ে ঢাল ধরে নামতে শুরু করল ও, আগুয়ান রাইডারদের কোণাকুণি এগোল।
দূরে, আকাশের জমিনের বিপরীতে শির উঁচিয়ে থাকা পাহাড়ের চূড়ার আশপাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মেঘের দল, ক্রমে ভারী হচ্ছে জটলা। আকাশ চিরে ঝিলিক মারল বিজলী। হারিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ, বজ্রপাতের দূরাগত গুড়গুড় শব্দ প্রতিধ্বনি তুলল ক্যানিয়নে, যেন ভূমিকম্প চলছে।
সবুজ ঘাসের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে ঘোড়াটা। অ্যাসপেন আর এল্ডারের সারির পাশ দিয়ে অপেক্ষাকৃত নিচু জমি ধরে এগোচ্ছে। ক্ষীণ একটা ক্রীক পেরিয়ে গেল ও, ঢাল ধরে নিচু পাহাড়ের দীর্ঘ মেসায় উঠে এল, ওপাশের ঢালে নেমে এসে ডানে বাঁক নিয়ে ড্রতে নেমে এল, কয়েকশো গজ দূরের সিডার বনের আড়ালে চলে যেতে চাইছে। প্রেয়ারি ধরে ধেয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাস চাবুকের মত ঝাপটা মারল মুখে, আর্দ্র বাতাসের স্পর্শে ভেজা স্যাঁতসেঁতে অনুভূতি হলো ওর, টের পেল অচিরেই ঝড় আসবে।
অনায়াস স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে ছুটে চলেছে দীর্ঘ ঘোড়াটা। ছুটতে ভালবাসে ওটা। স্যাডল হর্নের ওপর ঝুঁকে পড়ল এড, দুটো কারণে: ঠাণ্ডা বাতাসের স্পর্শ এড়ানো এবং ঘোড়ার ওপর নিজের ভার কমানো। মৃদু স্বরে বিড়বিড় করল। জানে ওর কণ্ঠস্বর পছন্দ করে ঘোড়াটা, সঙ্গ উপভোগ করে। একজন মানুষ আর ঘোড়ার মধ্যে তখনই অকৃত্রিম বন্ধুত্ব এবং সমঝোতা গড়ে ওঠে যখন একইসঙ্গে দীর্ঘদিন রাইড করার আনন্দ পায় দু’জন, একই ক্রীকের পানি পান করে কিংবা এমন খোলা প্রেয়ারি ধরে দীর্ঘক্ষণ ছুটতে থাকে।
সহসা একটা রাইফেলের গর্জন কানে এল ওর, পরপরই গর্জে উঠল অনেকগুলো পিস্তল।
‘হ্যারি, আশা করি তোমাকে চমকে দেয়নি ওরা!’ বিড়বিড় করল এড। ‘হয়তো কাভার নিতে পেরেছ!’
ঘোড়ার গতি খানিক কমাল ও, বলা যায় না যে-কোন সময়ে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়ে যেতে পারে। দলটার সঠিক অবস্থান জানা নেই ওর। স্ক্যাবার্ড থেকে রাইফেল তুলে নিল এড। এক ছুটে সিডার সারির ভেতরে ঢুকে পড়ল স্ট্যালিয়ন। গোলাগুলির শব্দ অনেক জোরাল শোনা যাচ্ছে এখন, অর্থাৎ কাছাকাছি চলে এসেছে ও। ঘোড়ার গতি কমিয়ে প্রায় হাঁটার পর্যায়ে নিয়ে এল, সতর্ক দৃষ্টি চালাল চারধারে। এখনও কিছু পথ বাকি রয়েছে। এদিকে সমানে গোলাগুলি চলছে, তারমানে কাভার নিতে পেরেছে রাউডি, অন্তত বেকায়দা অবস্থায় ওকে পেয়ে যায়নি সেটলাররা।
কিছু বোল্ডার আর পাথর রয়েছে একপাশে। পাথরের কাছে এসে দ্রুত স্যাডল ছাড়ল এড, সামনের পাহাড়ী ঢালে উঠে এল এক ছুটে। কয়েক গজ দূরে রিমের কিনারা, ওপাশে লাইন-কেবিনের ওপর প্রায় ঝুঁকে পড়েছে পাথুরে চাতাল। কঠিন শিলার ওপর শুয়ে পড়ল ও, কয়েক গজ এগোল, তারপর কিনারার কাছে এসে নিচের দিকে তাকাল। কেবিন আর আশপাশের এলাকা স্পষ্ট চোখে পড়ছে। কেবিন থেকে ত্রিশ-চল্লিশ গজ দূরের ঝোপের আড়ালে আছে সেটলাররা। ধোঁয়া উঠছে দু’একটা ঝোপের পেছন থেকে। রাইফেল বাগিয়ে ধরে অপেক্ষা করল ও, কমলা আগুন ওগরাতে জায়গা বরাবর একটা বুলেট পাঠিয়ে দিল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে, লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল লোকটা, বোল্ডারের পেছনে আড়াল নেয়ার উদ্দেশে ছুটল। রাইফেলের নল সামান্য ঘুরিয়ে, আবার গুলি করল এড। মুহূর্তে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল লোকটা, তারপর ক্রল করে এগোল বোল্ডারের দিকে।
নিচে গর্জে উঠল একটা রাইফেল। ওর পাশের পাথরে তুবড়ি ছোটাল গুলিটা, এডের মুখে এসে পড়ল পাথর-কুচি। খানিক পিছিয়ে এসে ঢাল ধরে কিছুদূর নেমে এল ও, সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে উপত্যকায়। মনে মনে পরিস্থিতি বিচার করল। অন্তত একজন আহত হয়েছে।
হঠাৎ ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল এক অশ্বারোহী। শুকনো ঝোপ দিয়ে একটা মশাল তৈরি করেছে, জ্বলন্ত মশাল হাতে ছুটে চলেছে কেবিনের দিকে। ব্যাপারটা হঠকারী হতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার, চট করে ধরে ফেলল এড। কেবিনের ওপাশে অন্যদের নিয়ে ব্যস্ত হ্যারি রাউডি, এদিকে নিশ্চিন্তে এগিয়ে যাচ্ছে লোকটা, মিনিট কয়েকের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দেবে কেবিনে, বাধ্য হয়ে বেরিয়ে আসতে হবে রাউডিকে।
রাইফেল তুলল এড, সময় নিয়ে অনুসরণ করল ছুটন্ত কাঠামোটা, তারপর ট্রিগার টেনে দিল। দু’হাত ছুঁড়ে দিল লোকটা, স্যাডলচ্যুত হলো। পিঠের নিচে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে মাটিতে পড়ল সে। তীক্ষ্ণ, গগনবিদারী চিৎকার বেরিয়ে এল লোকটার মুখ থেকে, গড়িয়ে সরে গেল আগুনের আওতা থেকে। উদ্ভ্রান্তের মত কাপড়ে লেগে যাওয়া আগুন নেভাতে ব্যস্ত, মাটিতে কয়েকটা গড়ান দিল। ঝোপের আড়াল থেকে এক লোক ছুটে এল তাকে সাহায্য করতে।
কাউকে গুলি করল না এড, অথচ ইচ্ছে করলে ফেলে দিতে পারে দু’জনকে।
আচমকা কান ফাটানো শব্দে বজ্রপাত হলো কাছাকাছি। চারপাশে তাকাল ও, দেখল নিচে নেমে এসেছে ভারী মেঘের পাহাড়, ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়েছে। একই মুহূর্তে ছুটন্ত ঘোড়ার শব্দ শুনতে পেল। ঝোপের দিকে একটা গুলি পাঠিয়ে দিল ও, শুনতে পেল চিৎকার করে সঙ্গীদের তাগাদা দিল এক সেটলার, তারপর একে একে ঝোপের আড়াল থেকে ছুটে বেরিয়ে এল লোকগুলো, স্যাডলে চেপে বসে উপত্যকা ধরে ঘোড়া ছোটাল তুমুল বেগে। পরমুহূর্তে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো।
ছুটে ঘোড়ার কাছে চলে এল এড, স্যাডলে চেপে ঢাল ধরে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। নিচে, করালের লাগোয়া বার্নে ঢুকে পড়ল। তখনই ছুটে এল জো মিলার।
‘ঠিক আছ তো?’
‘হ্যাঁ। হ্যারির খবর কী?’
‘জানি না। ভেতরে আছে ও। যাও, আমি তোমার ঘোড়ার ব্যবস্থা করছি।’
দৌড়ে কেবিনে ঢুকে পড়ল এড, পেছনে সশব্দে দরজা ভিড়িয়ে দিল। জানালার কাছে বসে থাকা হ্যারি রাউডি উঠে দাঁড়াল, সবক’টা দাঁত কেলিয়ে হাসল কাউবয়।
‘আহ্, গুলির শব্দ শুনেই বুঝেছি তুমি এসে পড়েছ! জানে যেন পানি এল আমার! তুমি না এলে আমাকে আজ শিকেয় তুলত ওরা! চারদিক থেকে কোণঠাসা করে ফেলেছিল। জনও যোগ দিতে চাইছিল, কিন্তু মানা করেছি ওকে। নড়াচড়া করলে জখম থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করবে আবার। তো, ঠিক তাড়িয়ে দিয়েছি ওদের!’
‘কাউকে ঘায়েল করেছ?’
‘একজন বোধহয়। তোমার গুলিতে মরেছে একজন। লোকটাকে পড়ে যেতে দেখেছি। অন্তত দু’জন ভাল চোট পেয়েছে। চারজনও হতে পারে। যাকগে, মনে হচ্ছে ব্যাটারা যারপরনাই হতাশ হয়েছে।’
‘পপলারের দিকে যাওয়ার সময় ওদের আসতে দেখলাম। ভয় হলো তুমি হয়তো বাইরে আছ, আর তোমাকে পেয়ে বসবে ওরা।’
থুথু ফেলল রাউডি। ‘আরেকটু হলে সাবাড় করে ফেলেছিল! পানি আনতে ঝর্নার দিকে যাচ্ছিলাম, তখনই ব্যাটারা এসে হাজির হলো।
আগুনের দিকে তাকাল এড, ভাবছে মনে মনে। প্রথম আক্রমণ ব্যর্থ হলেও উৎসাহে ভাটা পড়বে না ওদের। পরিস্থিতি বিচার করলে আসলে এর কোন গুরুত্ব নেই তেমন। বরং একজন লোক হারিয়েছে তারা, লোকটা যদি সেটলারদের কেউ হয়ে থাকে, তাহলে আরও খেপে যাবে মানুষগুলো, কোন ভাবেই আর নিরস্ত করা যাবে না তাদের।
তারপরও, যে-কোন মূল্যে এই রক্তপাত থামাতে হবে। চেষ্টা করতে দোষ কী! মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, বুনো উন্মত্ততায় কেবিনের ছাদে আছড়ে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। এমন ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ওকে আশা করবে না কেউ। যার যার বাড়িতে থাকবে ওরা, কারণ সেটাই স্বাভাবিক। সরাসরি যাওয়া যাবে না, নিশ্চয়ই উপত্যকার দিকে নজর রাখবে ওরা। ক্যানিয়ন পাড়ি দিয়ে ঘুরপথে যেতে হবে, তাহলে কেউ টের পাবে না…
.
বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ডরোথি, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামতে দেখতে পেল ও। বৃষ্টি হবে জেনেই বাইরে এসেছে, ঠাণ্ডা বাতাস উপভোগ করছে। উপত্যকার ওপাশে দূরের পাহাড়ে তীক্ষ্ণ শব্দে বাজ পড়ল, বিদ্যুৎ চমকের আলোয় মুহূর্তের জন্যে ঝিলিক খেলে গেল দিগন্তে। ঝড় শুরু হয়েছে, দমকা বাতাস বইছে। পরিপূর্ণ ঝড় বলা চলে।
একা ও, এবং একাকীত্বই উপভোগ করছে। জেন চেয়েছিল ওদের বাড়িতে থাকুক ও, বেশ কয়েকজন মহিলাই ঝড়ের আগে আগে একত্র হয়েছে গ্যাভিনদের বাড়িতে; কিন্তু ডরোথি জানে ওখানে লোকজনদের মধ্যে টিকে থাকা ওর জন্যে কঠিনই হত। অস্থির এবং উদ্বিগ্ন ও। সেটলারদের সঙ্গে আজকের লড়াইয়ে গেছে ওর বাবা। অথচ যতই সাহস আর আন্তরিকতা থাকুক, টেড হেডলিনকে কখনোই লড়াকু মানুষ বলা যাবে না। এড ক্রেমারের মত মানুষ নয় সে।
অদ্ভুত হলেও, এখন আর এড ক্রেমারকে নিয়ে খুব একটা উদ্বেগ বোধ করছে না। দৃঢ়চেতা মানুষ সে, এতটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে মনে হয় কোন ভাবেই ওর ক্ষতি করা অসম্ভব। এখন হয়তো উপত্যকার ওপাশে আছে সে। হয়তো এই মুহূর্তে ওর বাবাকে খুন করছে, কিংবা ওর বাবাই গুলি করছে এডের উদ্দেশে। বারোজন লোক গেছে। এদের আটজন সেটলার। ডেভ মুর মৃত, লিও কারভার এখনও রাইড করার মত সুস্থ হয়ে উঠতে পারেনি। অন্যদের কেউই বসে থাকেনি। হিউ টেলর, ল্যাস্কার, গ্যাভিন, গ্যারেট, থ্যাচার, ওলসেন এবং গ্রীন। আর ওর বাবা।
হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। প্রথমে বড় বড় কয়েক ফোঁটা পড়ল এদিক- ওদিক, তারপরই তুমুল বেগে পড়তে শুরু করল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল ডরোথি। বাড়িটা তাড়াহুড়ো করে তৈরি করা হয়েছে বলে ছাতের কয়েক জায়গায় ফুটো রয়ে গেছে। পানি চুইয়ে পড়ছে। বাতি জ্বালিয়ে জানালার কাছাকাছি টেবিলের ওপর রাখল ও, তারপর পাত্র এনে বসিয়ে দিল চুইয়ে পড়া পানি জমার জন্যে। বাবার জন্যে দুশ্চিন্তা হচ্ছে ওর। আগের মত বয়স নেই, তাছাড়া শরীরও পুরোপুরি সুস্থ নয়, তারপরও সবার সঙ্গে বেরিয়ে গেছে সে।
ঘরের কোণের আয়নায় ক্ষণিকের জন্যে চোখ পড়ল ওর, দীর্ঘদেহী ডরোথি, বড়সড় চোখ, এক মাথা লালচে-সোনালী চুল মাথায়। দু’পাশে বেণি করে রাখা। চেহারা খানিকটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে, সম্ভবত উদ্বেগের কারণেই।
খুরের দূরাগত শব্দ শুনতে পেয়ে জানালার কাছে চলে এল ডরোথি, ক্যানিয়নের কাছাকাছি আগুয়ান রাইডারদের দেখতে পেল। দল থেকে সরে পড়ল একজন, স্যাডলে অতিরিক্ত ক্লান্ত এবং অবসন্ন দেখাচ্ছে তাকে, সরাসরি বাড়িগুলোর দিকে এগোল, অন্যদের মত শহরের দিকে গেল না। বাড়ির কাছাকাছি আসার আগেই টেড হেডলিনকে চিনতে পারল ডরোথি, একটু পর পোর্চে বাবার সাড়া পেল। সশব্দে পা ঝেড়ে বুট থেকে কাদা ছাড়াল সে, বর্ষাতি খুলে ভেতরে ঢুকল। ধূসর রঙের হ্যাট ভিজে যাওয়ায় কালো দেখাচ্ছে এখন। বাপের হাত থেকে হ্যাট নিয়ে আগুনের আঁচে শুকাতে দিল ডরোথি। ইতোমধ্যে কফি তৈরি করে ফেলেছে, কাপে ঢেলে বাপকে দিল, তারপর রান্নাঘরে ঢুকল সুপ আনার জন্যে।
ভেতরে ঢুকে সরাসরি টেবিলে গিয়ে বসেছে টেড হেডলিন, সারা মুখে ক্লান্তির ছাপ। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ভেঙে পড়েছে শরীর, যে-উৎসাহ আর জেদ নিয়ে রওনা দিয়েছিল, তার কিছুই অবশিষ্ট নেই মানুষটার মধ্যে বয়স্ক দেখাচ্ছে তাকে। হয়তো ক্লান্তির কারণে, কিন্তু পরাজয়ের সূক্ষ্ম ছাপও রয়েছে তার চেহারায়। ডরোথির সঙ্গে চোখাচোখি হতে ক্ষীণ, দুর্বল হাসি হাসল টেড হেডলিন।
‘আমি আসলে দুর্বল মানুষ, ডরোথি,’ ম্লান কিন্তু আক্ষেপহীন স্বরে বলল সে। ‘আমাকে দিয়ে লড়াই হবে না। একটা লোকের গায়ে আগুন ধরে গেল আজ, দেখেই মনটা দমে গেল। ওহ্, কী বীভৎস দৃশ্য!
‘লোকটা কে?’ দ্রুত জানতে চাইল ডরোথি। ‘আমাদের কেউ?
‘নাহ্, ল্যামসনের ক্রু। টীমস্টার। বেশিরভাগ সময় সেলুনের আশপাশে ঘোরাফেরা করত লোকটা। নাম অসবার্ন। বাড়িটা ঘিরে ফেলেছিলাম আমরা, কিন্তু ভেতর থেকে গুলি শুরু করে এক লোক। একজন আহত হয়ে পড়ে লোকটার গুলিতে। এদিকে বাড়িটা ঘিরে ফেললেও, ক্লিফের ওপর থেকে হঠাৎ আমাদের ওপর হামলা করল কেউ। ওই লোক না থাকলে ঠিকই কেবিনের লোকগুলোকে কায়দা করে ফেলতে পারতাম।
‘আমি নিশ্চিত এড ক্রেমারই হবে লোকটা। প্রথম গুলিতে শর্টি টেবারকে ফেলে দিল। কীভাবে যে শর্টিকে দেখতে পেল, কেবল খোদা আর ও-ই জানে। পিট ল্যাস্কারও আহত হলো ওর গুলিতে, পায়ে লেগেছে। তারপরই অসবার্ন একটা জ্বলন্ত মশাল নিয়ে ছুট দিল কেবিনের উদ্দেশে…’ বলে চলেছে টেড হেডলিন, কিন্তু কিছুই শুনছে না ডরোথি বাবা সুস্থ দেহে বাড়ি ফিরে এসেছে, এটাই বড় স্বস্তির বিষয় ওর কাছে; এছাড়া অন্য সবকিছুই গুরুত্বহীন।
অনর্গল বকবক করার পর থেমে গরম সুপে চুমুক দিল হেডলিন।
‘এডের কী হলো? গুলি লাগেনি তো ওর গায়ে?’ জানতে চাইল ডরোথি।
‘না। ওর সঙ্গে সুবিধা করতে পারিনি আমরা, বরং একাই আমাদের সবাইকে কোণঠাসা করে ফেলেছিল সে। শক্ত ধাঁচের মানুষ ও, ডরোথি, আমাদের চেয়ে ঢের কঠিন মানুষ।’
‘কিন্তু ভালমানুষ ও, বাবা! হঠাৎ মন্তব্য করল ডরোথি। ‘সত্যিকারের ভাল লোক। ওহ্, পরিস্থিতি অন্যরকম হলে বোধহয় ভাল হত, অথচ আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়েছে ওকে!’
‘ভুল করছিস তুই, ডরোথি, কঠিন স্বরে, মাথা নেড়ে বলল টেড হেডলিন। ওর চিন্তা ঝেড়ে ফেল মাথা থেকে। তোর যোগ্য নয় সে। বেপরোয়া নিষ্ঠুর মানুষ ক্রেমার। অস্ত্রের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে ওর মত লোক। তাছাড়া পরিস্থিতিও অন্যরকম। ডেভ মুর মারা গেছে ওদের হাতে, ক্রেমার নিজে না মারলেও ওর বন্ধুদের হাতেই খুন হয়েছে মুর। এখন যা পরিস্থিতি, ওরা যেমন হাল ছেড়ে দেবে না তেমনি আমরাও পিছিয়ে আসতে পারব না। মরণপণ লড়াই হবে।’
‘কিন্তু কেন, বাবা? কেন?’ অধৈর্য সুরে জানতে চাইল ডরোথি। ওহ, আরও পশ্চিমে চলে গেলেই বোধহয় ভাল হত, তাহলে এত রক্তারক্তি ঘটত না! এতক্ষণে হয়তো অরিগনে থাকতাম আমরা। মাঝে মধ্যে আমার মনে হয় স্যাম ল্যামসন সম্পর্কে বলা এডের প্রতিটি কথাই সত্যি। দারুণ কৌশলে এখানে আনা হয়েছে আমাদের, ফাঁদে আটকা পড়েছি আমরা। একে একে সব হারিয়েছি। হালের দুটো বলদ ছাড়া আর কী আছে আমাদের? অথচ ঘাড়ে দেনার বোঝা!’
‘জানি,’ অস্থির বোধ করছে হেডলিন, চেয়ারে নড়েচড়ে বসল ‘পশ্চিমে গেলেই যে ভাগ্য ফিরত, তার নিশ্চয়তা কী? হয়তো ওখানে গেলেও একই বিপদে পড়তাম। ব্যাপারটা বুঝতে হবে তোকে। হয়তো স্যামকে অযথাই ভুল বুঝছি আমরা। যদ্দূর সম্ভব করেছে, আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছে সে।’
চিমনি দিয়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার সংস্পর্শে হিসহিস শব্দে ঝলসে উঠল আগুন, জানালা দিয়ে ছুটে আসা বাতাসে কেঁপে উঠল লণ্ঠনের শিখা। আগুনের কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল ডরোথি, উষ্ণ মেঝের স্পর্শ অনুভব করছে হাঁটুতে, ভাল লাগছে ওর। ওখানেই বসে থাকল, আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে আছে। টালির ছাদে বৃষ্টির ফোঁটার বিরামহীন ছন্দময় শব্দ আনমনা করে তুলল ওকে, মনে পড়ল এড ক্রেমারকে। কোথায় এখন ও?
এর শেষ কোথায়? একটু একটু করে হিংস্র সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষগুলো। প্রথমে পাহাড়ে খুন হলো ওয়েস বার্নেট। তারপর ডেভ মুর, আর এখন শর্টি টেবার। আহত হয়ে বিছানায় পড়ে আছে লিও কারভার। পিট ল্যাস্কারও আহত। পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়ে উঠছে ক্রমশ। এর শেষ যে শান্তিপূর্ণ হবে, এমন কোন নমুনা দেখা যাচ্ছে না।
আচমকা খুলে গেল দরজা। ঝট করে উঠে দাঁড়াল ডরোথি, চোখ বিস্ফারিত। অবচেতন মন থেকে আশা করেছিল এড ক্রেমারকে দেখতে পাবে, কিন্তু সাই ড্রানানকে দেখে প্রথমে হতাশা এবং পরমুহূর্তে রীতিমত শঙ্কা বোধ করল ও।
এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাসের পেছন পেছন ঘরে ঢুকল সাই ডানান। পেছনে দরজা ভিড়িয়ে দিল সে, সরাসরি তাকাল ডরোথির দিকে। শয়তানি ভরা মুখ বৃষ্টিতে ভিজে আছে, বিদ্রূপের ভঙ্গিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল সে। র্যাটলারের মত শীতল, সতর্ক চাহনি বুলাল সারা ঘরে। ‘আসেনি তাহলে?’ কর্কশ স্বরে বিড়বিড় করল সে। এসে যাবে, শিগগিরই হাজির হবে এখানে।
‘কে-কার কথা বলছ?’ ঢোক গিলে জানতে চাইল ডরোথি।
চেয়ারে পিঠ টানটান করে বসেছে ওর বাবা, দো-আঁশলার ওপর স্থির হয়ে আছে দৃষ্টি। নিতান্ত অবজ্ঞা আর অবহেলার দৃষ্টিতে তার দিকে একবার তাকাল ডানান, তারপর শ্রাগ করল। ‘কে? ওই ক্রেমার হারামজাদা! মিনিট কয়েক আগে ক্যানিয়ন থেকে নেমে আসতে দেখেছি ওকে, হয়তো আশপাশে কোথাও লুকিয়ে আছে। কে জানে কোন্ ধান্ধায় এসেছে, কিন্তু এখানে যে আসবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তখন…’ হাসল সে, পুরু ঠোঁটের মাঝখানে হলদেটে নোংরা দাঁত বেরিয়ে পড়ল ‘খবরদার! কেউ ওকে সতর্ক করার চেষ্টা করবে না, স্রেফ খুন হয়ে যাবে তাহলে! যে-ই চিৎকার করবে, অন্যজনকে খুন করব আমি। বুঝেছ?’
বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে ডরোথি, ভয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে, জিভে জোর পাচ্ছে না। ধীরে ধীরে, আগুনের দিকে ঘুরে দাঁড়াল ও। ঠিকই বলেছে ডানান, ভাবছে ডরোথি, এখানে আসবে এড ক্রেমার। পপলারে এলে ওর সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যাবে না সে। যে-কোন মুহূর্তে এসে পড়তে পারে।
চিন্তা করো, মরিয়া হয়ে নিজেকে বলল ডরোথি, একটা উপায় বের করতেই হবে! যেভাবে হোক সতর্ক করে দিতে হবে ওকে।
.
ক্যানিয়নের ঢালে অগভীর গুহায় থেমেছে এড ক্রেমার। ভেতরে আবছা অন্ধকার। জায়গাটা পছন্দ হয়েছে স্টীল-ডাস্ট স্ট্যালিয়নের, কিন্তু একা থাকতে আপত্তি করছে-এডকে এগোতে দেখে নিচু স্বরে গুঙিয়ে উঠল, ভয়মিশ্রিত হ্রেষাধ্বনি করল; কিন্তু ফিরে এসে এড নিচু স্বরে কথা বলতে শান্ত হলো ওটা।
দ্রুত পা চালাল এড, গাছের আড়াল আর ছায়ায় থাকার চেষ্টা করছে; প্যাট গ্যাভিনের বাড়ির দিকে এগোচ্ছে ক্রমশ। জানে না কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। কিন্তু সেটলারদের মধ্যে প্যাট গ্যাভিনকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মানুষ মনে হয়েছে ওর, এবং যথেষ্ট দৃঢ়চেতাও বৈকি কেউ যদি স্যাম ল্যামসনকে ঠেকাতে চায়, তাহলে সে-ই ঠেকাতে চেষ্টা করবে। টেড হেডলিনের আন্তরিকতা বা সাহস আছে বটে, কিন্তু ল্যামসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মত দৃঢ়তা নেই। তাছাড়া মাতৃহীন ডরোথিও তার দ্বিধার কারণ। চাইলেও ল্যামসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না হেডলিন।
আরও একটা ব্যাপার, গ্যাভিন জানে যে ল্যামসনের লোকের গুলিতে আহত হয়েছে লিও কারভার। এটাই তাকে স্যাম ল্যামসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে উৎসাহিত করতে পারে। মেয়ের জন্যে নিজে পুরুষ পছন্দ করেনি গ্যাভিন, বরং জেন নিজেই পছন্দ করেছে কারভারকে; তবে এরচেয়ে যোগ্য কাউকেও পাবে না গ্যাভিন। লিও মানুষটা হাসি-খুশি, পরিশ্রমী, দৃঢ়চেতা, সমর্থ এবং সৎ। এদিকে স্যাম ল্যামসনের ব্যাপারে কখনোই পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হতে পারেনি প্যাট গ্যাভিন। মনের একটা অংশে সবসময়ই দাগ কেটে গেছে এড ক্রেমারের কথাগুলো, যদিও ল্যামসনের বাগাড়ম্বরে বিশ্বাস করে অন্য সবার মতই তাল মিলিয়ে গেছে।
কাকভেজা হয়ে, ক্লান্ত দেহে ঘরে ফিরেছে গ্যাভিন। টেড হেডলিনের মতই, মনে-প্রাণে নিরীহ মানুষ সে, খুনোখুনি দারুণ অপছন্দ করে। কাপড়ে আগুন লাগার পর উন্মত্ত হয়ে ওঠা অসবার্নকে দেখেছে সে, টেবারকে মরতে দেখেছে। লোকটার মৃত্যুতে এতটুকু আফসোস হয়নি ওর, মাতাল অবস্থায় ডরোথির ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনাটা জানে সে; জানে শর্টি টেবারের মত ঝামেলাবাজ এবং উচ্ছৃঙ্খল লোক সমাজে না থাকাই ভাল। দু’একটা লাশ যদি পড়েই, তাহলে টেবারের মত লোকগুলো খুন হয়ে যাওয়াই মঙ্গল। স্বস্তিকর। যদিও কাউকে খুন হতে দেখার মধ্যে আসলে কোন আনন্দ নেই। শর্টি টেবারের সঙ্গে একেবারে অন্তরঙ্গ ছিল না, তাও বলা যাবে না।
সাহস, আগ্রাসী মনোভাব আর লড়াই করার প্রবণতা আসলে সম্পূর্ণ আপেক্ষিক ব্যাপার, অন্তত কিছু কিছু মানুষের জন্যে। সঙ্গীদের হঠাৎ মরতে দেখলে সাহস উবে যায়। নিজেকে রক্ষা করার মত মনোবল বা দৃঢ়তা রয়েছে প্যাট গ্যাভিনের, কিন্তু শুরু থেকে এ লড়াইয়ে মত ছিল না ওর। স্রেফ হুজুগে পড়ে তাল মিলিয়েছে। আজকের ঘটনার পর, স্যাম ল্যামসনের ভূমিকা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠেছে।
কয়েকদিন ধরে লক্ষ করেছে কোন একটা ব্যাপারে বেশ চিন্তিত লিও কারভার। মেয়েরা ধারে-কাছে থাকছে বলে খোলাখুলি আলাপ করার সুযোগ হয়নি। কিন্তু আর দেরি করা ঠিক হবে না বোধহয়, ভাবল প্যাট গ্যাভিন।
পাশের ঘরে চলে এল সে। বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, ঠাণ্ডা এক ঝলক বাতাস আঘাত করল ওকে এবং স্ত্রীর বিস্ময় মেশানো অস্ফুট স্বর শুনতে পেল।
পিস্তল হাতে দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াল প্যাট গ্যাভিন।
ধীর ভঙ্গিতে দরজার একপাশে সরে দাঁড়াল এড ক্রেমার, কবাট ভিড়িয়ে দিল। পলকের জন্যে গ্যাভিনের হাতের পিস্তলের দিকে তাকাল, উদ্বেগহীন মুখে হাসি ফুটল।
‘মনে হচ্ছে আমাকে পিস্তলের মুখে পেয়ে গেছ, প্যাট। তো, কী করবে এখন?’
‘কী চাও এখানে?’ চাঁছাছোলা স্বরে জানতে চাইল গ্যাভিন। ভুলে গেছ তোমাকে দেখতে পেলে নির্দ্বিধায় খুন করবে ওরা?’
‘কিন্তু তুমি করবে না,’ মৃদু হেসে বলল এড। সেজন্যেই এসেছি, তোমাকে বন্ধু হিসেবে জানি আমি।’
হোলস্টারে পিস্তল ফেরত পাঠাল গ্যাভিন। ‘ভেতরে এসো। নিশ্চয়ই কোন ব্যাপারে আলাপ করতে এসেছ?’
মহিলারা- জেন আর ওর মা প্রবল শঙ্কা নিয়ে তাকিয়ে আছে এডের দিকে। পাশের কামরায় জড়সড় ভঙ্গিতে হাঁটছে কেউ, একটু পর দুই কামরার দরজায় দেখা গেল লিও কারভারকে। চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে।
‘হাউডি, এড!’ নিচু স্বরে বলল সে। ‘দেখামাত্র তোমাকে খুন করবে ওরা। ড্রানানকে নিজ মুখে বলতে শুনেছি এরপর নাকি তোমাকে খুন করবে।’
‘বেশ তো, একটা চেয়ারে বসল এড, ডান হোলস্টারটা উরুর ওপর আর ডান হাত আইভরি বাঁটের পিস্তলের কাছাকাছি শিথিল ভঙ্গিতে পড়ে আছে। গাঢ় নীল শার্ট গলার কাছে উন্মুক্ত, চামড়ার জ্যাকেটের সবক’টা বোতাম খোলা। মোমবাতি আর ফায়ারপ্লেসের আলোয় ঝিলিক মারছে গানবেল্টের উজ্জ্বল কার্তুজের খোল।
ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে লিও কারভারের মুখ, কিন্তু চোখে স্বস্তি। এড ক্রেমারকে দেখে একইসঙ্গে সন্তুষ্ট এবং নিশ্চিন্ত বোধ করছে। ভাল লাগছে তার, এবং কারভারের আন্তরিকতায় সহজ হয়ে গেল পরিবেশ। গম্ভীর মুখে অপেক্ষায় আছে গ্যাভিন, চোখজোড়া স্থির হয়ে আছে এডের ওপর, আশা করছে এডই শুরু করবে। ফায়ারপ্লেসে কাঠ পোড়ার শব্দ আর নিঃশ্বাস নেয়ার আওয়াজ ছাড়া পুরো কামরা নীরব হয়ে আছে। চিমনি দিয়ে এক ফোঁটা পানি পড়ল আগুনে, হিসহিস শব্দে ঝলসে উঠল আগুন।
ঝুঁকে আগুনে কিছু কাঠ যোগ করল জেন, উজ্জ্বল আগুনের বিপরীতে ফ্যাকাসে মুখে বুটিদার কয়েকটা দাগ প্রকট হয়ে ফুটে উঠল।
‘প্যাট,’ ধীর ভঙ্গিতে বলল এড। ‘কখনোই লড়াই চাইনি আমি। এও জানি তুমিও চাওনি, হেডলিন বা লিও-ও চায়নি। টেডের সঙ্গে কথা বলে লাভ হবে না এখন। মানুষটা সে ভাল, নিজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন, কিন্তু বয়স বা ডরোথির কারণেই হোক, স্যাম ল্যামসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না। তোমাদের মধ্যে কেবল একজনই দাঁড়াতে পারে, সে লোক তুমি, প্যাট গ্যাভিন।
‘ল্যামসন আমার বন্ধু,’ নির্লিপ্ত স্বরে বলল গ্যাভিন। ওকে ছাড়া এখান পর্যন্ত আসতে পারতাম না আমরা। এই লড়াই এখন শুধু ওর নয়, আমাদের সবার ‘
‘নিজেকেই বোকা বানাচ্ছ, প্যাট, কথাটা তুমি নিজেও বিশ্বাস করো না। মুখে বলছ ঠিকই, কিন্তু তোমার মনে দিন কিছু। ডেভ মুরের মতার কারণে খেপে গেছ সবাই, তাই না? সেজন্যেই তুমি বা হেডলিনের মত লোক মনের সায় না পেয়েও লড়াই করতে গেছ। সত্যি কথা হচ্ছে, তুমি শান্তিপ্রিয় লোক, নির্ঝঞ্ঝাট একটা বসতি দরকার তোমার। তোমার স্ত্রী বা জেনও তাই চাইছে। ডরোথিও তাই চায়, কিংবা হিউ টেলরও। অন্যরা সবাই এই চায়।
‘কিন্তু স্যাম ল্যামসন চায় জমি আর আধিপত্য। এই উপত্যকার একচ্ছত্র মালিকানা। যেভাবে হোক এই উপত্যকার মালিক হতে চাইছে ও, সেজন্যে কে কখন কীভাবে মরল, তাতে কিছুই যায় আসে না ওর। আগেও তোমাদের সতর্ক করার জন্যে এসেছি আমি, ঝামেলা যাতে না হয় সেজন্যে চেষ্টা করেছি। আজও এসেছি।
‘প্রথমে আমাদের একটা ছেলে মারা গেল, একজন ভালমানুষ খুন হলো। এটা খুন, প্যাট, এবং খুনী ওয়্যাগন ট্রেনের কেউ নয়। আমার তো ধারণা কোন ইন্ডিয়ানকে খুন করারও ইচ্ছে নেই তোমাদের। থ্যাচার বা গ্যারেট আমাকে পছন্দ করে না। হিউ টেলর তোমাদের নেতা, কিন্তু ল্যামসনের কথামত চলছে ও ‘
‘ওর কথায় সবাই চলছি আমরা,’ বলল কারভার। ‘আমিও ওর কথা শুনেছি। অন্তত কিছু সময়ের জন্যে।’
এগিয়ে গিয়ে এডের পাশে দাঁড়াল জেন, কাঁধে হাত রাখল। দ্রুত চোখ তুলে তাকাল এড, মেয়েটিকে মৃদু হাসতে দেখতে পেল।
‘আসল কথায় আসো!’ দ্রুত তাগাদা দিল প্যাট গ্যাভিন। সে জানে এড ক্রেমারের প্রতিটি কথা সত্যি, এক বর্ণ মিথ্যে বলেনি। স্যাম ল্যামসনের পরামর্শ মত কাজ করেছে বটে, কিন্তু এডের কথা একেবারে উড়িয়েও দিতে পারেনি, মাঝে মধ্যেই সন্দেহ হয়েছে। এই ট্রেইলের ব্যাপারে শুরু থেকে সন্দিহান ছিল। এখনও হয়তো বেরিয়ে যাওয়ার একটা উপায় রয়েছে, কিন্তু ইতোমধ্যে অনেক কিছু হারিয়ে বসেছে ওরা। ষাঁড় নেই, নগদ টাকাও নেই সঙ্গে। নতুন করে কোথাও যাত্রা করাও সম্ভব নয়। এখানে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে চাইলেও চলে যাওয়া যাবে না।
হাঁটুর ওপর এক হাতের ভর রেখে ঝুঁকে এল এড। ‘গ্যাভিন, আমার লোকেরা দাবি করছে ডেভ মুরকে খুন করেনি ওদের কেউ!’
সশব্দে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল লিও কারভার, সন্দেহ আর উদ্বেগ থেকে মুক্তি পেলে বুকের ভার যেমন নেমে যায়। শঙ্কিত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল জেন।
‘কী বললে তুমি?’ নিচু স্বরে জানতে চাইল গ্যাভিন, বিস্মিত।
‘আমার কোন লোক খুন করেনি মুরকে। ওদের সঙ্গে কথা বলেছি আমি। আমার এক ক্রু, হ্যারি রাউডির কাছে শুনলাম শুধু সাই ড্রানানকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল ও, আর জো মিলার বা জন ল্যাম্পার্ট কেউই মুরের দিকে মনোযোগ দেয়নি। এমনকী মুরের সামনাসামনিও ছিল না ওরা। গুলি ছোঁড়া দূরে থাক, মুরের দিকে মনোযোগও দেয়নি কেউ।’
‘কয়েক দফা গোলাগুলি হয়েছে ওখানে,’ নিরাসক্ত স্বরে বলল গ্যাভিন। ‘যে-কোন কিছুই ঘটতে পারে।’
‘ঠিক,’ একমত হলো এড। ‘কিন্তু আমার ছেলেরা নিশ্চিত যে ওরা কেউই মুরকে গুলি করেনি। তাতে কী দাঁড়াল ব্যাপারটা, বড়সড় একটা খটকা থেকে যাচ্ছে না?’
‘আমার কাছে অন্তত কোন খটকা লাগছে না!’ উত্তেজিত স্বরে বলল লিও কারভার, প্রায় খেপে গেছে হঠাৎ। ‘ডেভ মুরের দেহে ক্ষতটা দেখেছি আমি! পেছন থেকে গুলি করা হয়েছে ওকে!’
থমথমে হয়ে গেল প্যাট গ্যাভিনের চেহারা। মেঝেয় স্থির হয়ে আছে দৃষ্টি, আড়ষ্ট হয়ে গেছে চোয়ালের পেশী। এরচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা আর কী হতে পারে? নির্ভর করার মত আর কিছু কী বাকি আছে? কীভাবে এই ঝামেলায় নিজেকে জড়াল সে? কী করা উচিত এখন?
‘তোমার কী ধারণা?’ শেষে জানতে চাইল গ্যাভিন। ‘ড্রানানই খুনী?’
প্রত্যেকের চোখ স্থির হয়ে আছে এডের ওপর। উদ্বিগ্ন অপেক্ষায় আছে সবাই।
‘না,’ বলল এড। ‘কাজটা ল্যামসনের, অন্তত আমার ধারণা। উঠে দাঁড়াল ও, অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি শুরু করল।
‘পাগল হয়েছ নাকি?’ ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছে গ্যাভিন, প্রায় বেকুব বনে গেছে এবং খেপেও গেছে। ‘কী উদ্দেশে মুরকে খুন করবে সে? নিজের দলের লোককে খুন করবে কেন?
‘উত্তরটা আমার মত তুমিও জানো। ও চাইছে তোমরাও লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ো, এবং শুধু ওই একটা উপায়ে তোমাদেরকে খেপিয়ে তোলা সম্ভব ছিল ওর পক্ষে। থ্যাচার আর গ্যারেট স্রেফ হুজুগে লোক। ল্যামসনের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কিন্তু শুধু ওরাই যথেষ্ট নয়, তোমাদেরও জড়াতে চেয়েছে ল্যামসন। নিজের পক্ষে তোমাদের মত ভদ্র, নিরীহ, পরিশ্রমী এবং মর্যাদাবান লোক দরকার ওর। এমন লোক দরকার অতীতেও যাদের সুনাম ছিল, কখনও সেনাবাহিনী এসে তদন্ত করলে দেখবে এরা প্রত্যেকেই সৎ, শান্তিপ্রিয় মানুষ।’
‘মুরের ক্ষতটা খুঁটিয়ে দেখেছি আমি,’ আবারও বলল কারভার। ‘ছোটখাট হালকা অস্ত্র থেকে গুলি করা হয়েছে ওকে। নাক-ভোঁতা বা কাটা নাকের বুলেট ব্যবহার করেছে খুনী।’
‘এরকম পিস্তল কার আছে?’ জানতে চাইল গ্যাভিন। ‘সবাই জানে ল্যামসনের কাছে একটা ড্রাগুন রয়েছে, আমাদের প্রায় সবার কাছেও তাই।’
‘কোমরের হোলস্টারে ড্রাগুন আছে বটে, কিন্তু লুকানো পিস্তল থাকতে পারে।’ বাতলে দিল এড, থেমে পা ফাঁক করে দাঁড়াল ও। ‘যাগে, এখান থেকে চলে যেতে হবে আমার, এবং যত দ্রুত সম্ভব। মনে হয় না এমন ঝড়বৃষ্টির মধ্যে বাইরে বেরোবে কেউ, তবে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। এটাই আমার শেষ আসা। বহুদিন ধরে স্যাম ল্যামসনের ব্যাপারে সতর্ক করে আসছি তোমাদের। আবারও বলছি, ওর গ্রাস থেকে মুক্তি পাওয়ার এটাই শেষ সুযোগ। কারণ, তোমরা যদি ওকে বাধা না দাও তাহলে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে এই শহর ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দেব আমি।’
ঝট করে ওর দিকে ফিরল গ্যাভিন। ‘এটাই কি চূড়ান্ত?’
‘বাজি ধরতে পারো!’ সোজাসাপ্টা স্বরে বলল এড। স্পেন্সারকে যদি ঠেকিয়ে না রাখতাম, তাহলে অনেক আগেই এখান থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দিত সে। ওয়েস বা মুরও তাহলে বেঁচে থাকত এখন, লিও বা ল্যাম্পর্ট আহত হত না। স্পেন্সারকে ঠেকিয়ে না রাখলে চল্লিশজন কঠিন ক্রুকে এখানে পাঠিয়ে দিত, শহর গড়া দূরে থাক মাটিতে একটা খুঁটিও পুঁততে দিত না।
‘স্পেন্সারের ক্রুরা লড়াই করার জন্যে মুখিয়ে আছে। ল্যামসনের লোকদের ঘৃণা করে ওরা, ড্রানানকে নাগালের মধ্যে পাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। খুনী আউট-ল লোকটা, এবং ক্রুরা সবাই জানে এটা।’
‘কিন্তু কী করতে পারি আমি?’ প্রতিবাদ করল প্যাট গ্যাভিন ‘ড্রানানকে আমরাও পছন্দ করি না। ওর মত আর যারা আছে, স্রেফ ল্যামসনই ঠেকিয়ে রেখেছে ওদের, নইলে হয়তো আমাদের বাড়ি দখল করে নিত ওরা, মেয়েদের অসম্মান করত।
দরজার দিকে এগোল এড ক্রেমার, হাতলে হাত রেখে ঘুরে দাঁড়াল, গায়ে বর্ষাতি চাপাল। ‘সরে আসবে তোমরা, স্যাম ল্যামসনকে সমর্থন দিয়ো না। ব্যস, দেখবে ল্যামসন, ড্যানান বা ওর একটা লোকও নেই আশপাশে। নিশ্চিহ্ন করে দেব ওদের। কিন্তু নিরীহ বা ভাল কোন লোককে খুন করতে চাই না আমরা, তোমরা সরে আসলে কাজটা করতে সুবিধে হবে আমাদের। স্রেফ যার যার বাড়িতে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকো। কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। আগের মতই থাকবে সবাই, থাকবে তোমাদের শহর।’
ঘুরে বৃষ্টিাত রাতের উদ্দেশে বেরিয়ে গেল সে। পোর্চে এসে ক্ষণিকের জন্যে দ্বিধা করল, অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিল। তেরছা পর্দার মত নামছে বৃষ্টি, ক্ষুদ্র শিলাখণ্ডের মত আঘাত করছে নাকে-মুখে আর ঝাপটা মারছে অয়েলস্কিনের বর্ষাতির ওপর, যেন টিনের ছাতে পড়ছে। মাটিতে জায়গায় জায়গায় বৃষ্টির পানি জমেছে। এগোতে গাছ থেকে বড়সড় কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়ল ওর পিঠে
গাছের গুঁড়ির কাছাকাছি থামল ও, দাঁড়িয়ে থাকল। সতর্ক দৃষ্টি চালাল চারপাশে। হেডলিনদের বাড়ির একটা জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে। অনড় দাঁড়িয়ে থাকল ও, ভেতরে ভেতরে সংশয়ে পুড়ছে যেহেতু জানে সামান্য সময় বেশি থাকাও বিপজ্জনক; কিন্তু ডরোথিকে একনজর দেখার লোভ সামলাতে পারছে না। মেয়েটিকে নিজের বাহু বন্ধনে পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
এই সৌভাগ্য হয়নি ওর। মেয়েটিকে কখনও চুমো খায়নি, এমনকী হাতও ধরেনি। সম্পর্কটা কেবল চোখের চাহনিতে সীমাবদ্ধ, কিন্তু এড উপলব্ধি করে ডরোথি এ ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন; হয়তো সাড়াও দেবে।
সেলুনে বাতি জ্বলছে। স্যাম ল্যামসনের বেশিরভাগ লোক ওখানে আছে, তাস পিটছে, হুইস্কি গিলছে দেদার। ইশ্, সঙ্গে দু’একজন থাকলেই হত, নিশ্চিন্তে হানা দিতে পারত সেলুনে সবক’টাকে শেষ করে দিতে পারত! স্বস্তি বোধ করতে পারত সেটলাররা।
বিদ্যুৎ চমকাল। ক্ষণিকের জন্যে নীলচে আলোয় এক চিলতে ফাঁকা জায়গার পর হেডলিনদের ভেজা স্যাঁতসেঁতে দালানের কাঠামো ফুটে উঠল দৃষ্টিসীমায়।
পা বাড়াল ও, গাছের আড়াল থেকে খোলা জায়গা ধরে এগোল। উপত্যকা ছাড়িয়ে দূরের পাহাড়ে বজ্রপাতের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনতে পেল, ক্লিফ আর বোল্ডারের সারিতে গম্ভীর প্রতিধ্বনি তৈরি হলো, যেন ঘুমন্ত মানুষ বিড়বিড় করছে।
বর্ষাতির বোতাম আটকায়নি ও, বাম হাতে দুই প্রান্ত ধরে রেখেছে; ডান হাত পকেটে। ভেজা মাটিতে নিঃশব্দে পা চালাচ্ছে। হ্যাটের ব্রিম কিছুটা নিচু করে রেখেছে বৃষ্টির ছাঁট এড়াতে, এদিকে অদম্য আক্রোশে বর্ষাতির ওপর হামলা চালাচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটা। কঙ্কালসার আঙুল দিয়ে টোকা মারছে যেন।
আরেক সারি গাছের নিচে এসে থামল ও, ইতস্তত করার ফাকে বাড়ির ওপর নজর চালাল। ধারে-কাছে কোন ঘোড়া নেই। হঠাৎ, বাড়ির চিমনি দিয়ে আগুনের শিখা ঝলসে উঠল, বোধহয় আগুনে কাঠ যোগ করেছে কেউ। এগোতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল ও, চিমনিতে একই ঘটনা ঘটতে দেখতে পেল আবার। এটা কি কোন সঙ্কেত? কিন্তু কে জানবে যে ধারে- কাছে আছে ও?
আবার ঘটল ব্যাপারটা। তিনবার মানেই সঙ্কেত, সতর্ক হওয়ার তাগিদ। রাইফেলের তিনটা শট, তিনবার আগুনের ঝলক-সঙ্কেতটা কী হতে পারে? কে জানবে যে ও বাইরে আছে? ব্যাপারটা প্রায় অসম্ভব, কিন্তু অস্বস্তিতে খুঁতখুঁত করছে মন।
আবারও চিমনিতে আগুনের ঝলক দেখা গেল। পরপর, দ্রুত তিনবার। তবে আগের মত উজ্জ্বল না হলেও ম্লান শিখা ঝলসে উঠল, স্ফুলিঙ্গ উঠল চিমনি দিয়ে। এবার আগুনে কাঠ যোগ করেনি, বরং জ্বলন্ত কয়লা নাড়াচাড়া করছে কেউ।
চুলোয় যাক সব! যাবে সে হেডলিনদের বাড়িতে। ঠাণ্ডা লাগছে ওর, উষ্ণ কামরার আকর্ষণ এড়ানো কঠিন মনে হচ্ছে। লাইন-কেবিনের উদ্দেশে যাত্রা করার আগে শরীর একটু চাঙা করে নিলে মন্দ হবে না। ঘুরপথে, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে ওকে, কারণ বিস্তীর্ণ উপত্যকা পেরিয়ে সরাসরি ক্যানিয়নের দিকে যাওয়া হঠকারিতা হবে এখন।
সরাসরি বাড়ির দিকে এগোল ও। কাদায় সামান্য প্যাচপ্যাচ শব্দ হচ্ছে বুটের। বিদ্যুৎ চমকাল আবার, মসৃণ বোর্ডে তৈরি ভেজা দরজায় প্রতিফলিত হলো নীলচে আলো। নক্ করা উচিত, কিন্তু নিখাদ সতর্কতার খাতিরে ভদ্রতাবোধ চুলোয় পাঠিয়ে দিল এড। দরজার বাম পাশে এসে দাঁড়াল, বাম হাত বাড়িয়ে আস্তে করে কবাটে ঠেলা দিল। হাট হয়ে খুলে গেল দরজা।
প্রচণ্ড শব্দে গর্জে উঠল একটা পিস্তল। ফায়ারপ্লেসের পাশ থেকে কমলা আগুন ওগরাতে দেখতে পেল এড। দরজার কবাটে বিধল বুলেটটা, পরমুহূর্তে এক ছুটে ভেতরে ঢুকে পড়ল ও।
পলকের জন্যে ডরোথিকে দেখতে পেল, মেয়েটির চোখে সীমাহীন আতঙ্ক, ছুটে ফায়ারপ্লেস থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এল সাই ডানান, ক্রূর হাসি তার মুখে, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে খুনের নেশায়। ফের আগুন ওগরাল তার পিস্তল, টান পড়ল এডের জ্যাকেটে। পরমুহূর্তে গুলি করল ও।
পেটে যেন লাথি কষেছে একটা ষাঁড়, টলে উঠল ডানানের বিশাল দেহ। টলমল পায়ে দু’পা পিছিয়ে গেল সে। এডকে এক পা আগে বাড়তে দেখে ভেতরের দিকের দরজার উদ্দেশে ঝাঁপ দিল। কিন্তু শূন্যে থাকতে এডের দ্বিতীয় গুলি বিধল দো-আঁশলার শরীরে। চটের পর্দা ঝোলানো জানালায় হুড়মুড় করে পড়ল আউট-লর দেহ।
চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল এড, তারপর দ্রুত বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। ফের গর্জে উঠল সাই ডানানের পিস্তল। উরুতে তপ্ত ছোঁয়া দিয়ে চলে গেল বুলেটটা। ডান পাশে খানিক ঘুরল এড, দেখতে পেল বন্দুকবাজকে-উঠে দাঁড়াচ্ছে সে। ঝটিতি গুলি করল ও।
কেশে উঠল দো-আঁশলা। থপ করে কাদায় লুটিয়ে পড়ল পিস্তল। যন্ত্রণাকাতর, কাঁপা হাতে বাড়তি পিস্তল ড্র করার প্রয়াস পেল সে। সাদা শার্টের বুকে গাঢ় একটা বিন্দু বড় হয়ে উঠতে দেখতে পেল এড, ফের গুলি করল। হুড়মুড় করে পড়ে গেল বন্দুকবাজ, মাটি খামচে ধরল।
সশব্দে খুলে গেল একটা দরজা, চিৎকার করল কেউ। ঘুরে দাঁড়িয়ে ডরোথিকে দেখতে পেল এড। ‘চলে যাচ্ছি আমি,’ দ্রুত বলল ও। ‘গ্যাভিনের সঙ্গে কথা বোলো। কথা বলতে বলতেই ছুটে গাছের সারির দিকে এগোল ও।
গর্জে উঠল একটা রাইফেল, আরও একটা। তারপর ক্রমাগত গুলি হতে লাগল। প্রবল আতঙ্ক নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকল ডরোথি হেডলিন, শঙ্কা আর উদ্বেগে গলা বুজে গেছে প্রায়। বুকে ড্রাম পেটাচ্ছে সীমাহীন আতঙ্ক। কালিগোলা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে ও। বিদ্যুৎ চমকে উঠতে, বৃষ্টির ধোঁয়াটে পর্দা ভেদ করে ক্ষণিকের জন্যে এড ক্রেমারের ছুটন্ত কাঠামো চোখে পড়ল। গর্জে উঠল একটা রাইফেল, পরমুহূর্তে গাছের আড়ালে চলে গেল সে। মুহূর্ত কয়েক পর ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পেল ডরোথি।
‘ওই ঘোড়ায় চড়েছে যখন, ওকে ধরতে পারবে না কেউ!’ পাশে টেড হেডলিনের উপস্থিতি টের পেল ডরোথি। ‘ঠিকই পালিয়ে যাবে সে!’ ঘুরে বাপকে হাসতে দেখতে পেল ডরোথি। ‘হ্যাঁ, বাছা। ও পালাতে পেরেছে বলে খুশি হয়েছি আমি। আরও খুশি হয়েছি যে খুনীটাকে মেরেছে ও।’
‘ওহ্, বাবা!’ খুশিতে বাপকে জড়িয়ে ধরল ডরোথি।
ছুটন্ত পায়ের শব্দ। বেশ কয়েকজন ছুটে আসছে ওদের বাড়ির দিকে। মেয়েকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল হেডলিন, দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিল।
একটু পরই দড়াম করে খুলে গেল দরজা। স্যাম ল্যামসনকে দেখা গেল দরজায়, পেছনে আরও চারজন, কঠিন নিষ্ঠুর মুখ সবার। হাতে পিস্তল।
‘এখানে কী জন্যে এসেছিল ও?’ জানতে চাইল ল্যামসন। ‘ওই লোকটা একটা খুনী! আমাদের শত্রু ও। এখানে কেন আসবে সে?’
‘জানি না কেন এসেছে!’ শীতল স্বরে বলল হেডলিন। ‘বলার সুযোগ পায়নি ক্রেমার। সন্ধে থেকে ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল ড্রানান। ওত পেতে ছিল। কীভাবে যেন টের পেয়ে গিয়েছিল যে এখানে আসবে। ক্রেমার। ওকে দরজায় দেখেই গুলি করেছে সে, কিন্তু লাগাতে পারেনি। তবে এডের গুলি মিস হয়নি।’
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ল্যামসন, দু’চোখে হিংস্র আক্রোশ। ‘তাতে বোধহয় খুশি হয়েছ তুমি!’
‘আলবৎ! ওই ড্রানান লোকটাই আসলে খুনী। এরকম কিছু পাওনা ছিল ওর।
‘আমিও খুশি হয়েছি,’ চিবুক উঁচু করে, সরাসরি ল্যামসনের চোখে চোখ রেখে বলল ডরোথি। ‘খুশি হয়েছি যে ড্রানানকে খুন করে ঠিকই পালিয়ে যেতে পেরেছে এড।’
রাগে ফুঁসছে ল্যামসনের লোকেরা, নিচু স্বরে পরামর্শ দিল বকে। দু’জন খেপে গিয়ে এগিয়ে যেতে উদ্যত হতে হাত বাড়িয়ে তাদের বাধা দিল ল্যামসন। ‘মনে হচ্ছে বিদ্রোহ করার খায়েশ হয়েছে ওদের। যাকগে, এ ব্যাপারটা কখনও সহ্য করব না আমরা। তোমার ব্যাপারে অনেক ধৈর্য ধরেছি, ডরোথি, কিন্তু সবারই ধৈর্যের সীমা আছে। অনেক তো হলো, আর সহ্য করব না।’
‘সহ্য করতে বলল কে?’ রাগে জ্বলে উঠল ডরোথির চোখজোড়া। ‘তোমার চটুল কথাবার্তা বা মিথ্যেয় আর কাজ হবে না, এক ফোঁটা বিশ্বাস করাতে পারবে না কাউকে। সব ষাঁড় ফেরত চাই আমরা, কালকের মধ্যে! কালই এই জায়গা ছেড়ে চলে যাব আমরা, দরকার হলে পায়ে হাঁটব, তবুও এখানে থাকতে রাজি নই!’
‘না, কোথাও যাচ্ছ না তোমরা,’ ঘুরে দাঁড়াল স্যাম ল্যামসন। চলে এসো, বয়েজ। কাজ আছে আমাদের।’
‘ওদের কিছু উচিত শিক্ষা দিলে হত না, বস্?’ প্রস্তাব করল একজন,
‘পরে!’ রাগে ফুলে উঠল ল্যামসনের নাকের পাটা। ‘এরচেয়ে কাজ আছে আমাদের!’
ল্যামসনরা চলে যেতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ডরোথি, তাকিয়ে দেখল ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ওর বাবার মুখ। ‘তো, বাছা,’ শান্ত স্বরে বলল টেড হেডলিন। ‘ভাল-মন্দ যাই ঘটুক, সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে। কাল হয়তো লড়াই করতে হবে আমাদের। বহু আগে, ইন্ডিয়ানদের বিরুদ্ধে লড়ার সময় তোর মা সাহায্য করেছিল আমাকে। তুই কি পারবি?’
স্মিত হাসল ডরোথি। জিজ্ঞেস করার দরকার আছে কি, বাবা?’
‘না,’ উত্তরে পাল্টা হাসল হেডলিন, তার চোখে উজ্জ্বল চাহনি দেখতে পেল ডরোথি, যেন সাই ডানানের মৃত্যু আর ল্যামসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার মধ্যে প্রাণ আর দৃঢ়তা ফিরে পেয়েছে মানুষটা, বয়স যেন কমে গেছে। ‘নাহ্, জিজ্ঞেস করার দরকার নেই,’ পুনরাবৃত্তি করল সে। —তুই বরং খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে নে। রাইফেলগুলো পরিষ্কার করে ফেলি এই ফাঁকে।’
সাত
ক্যানিয়ন ধরে তুফান বেগে ছুটছে এড ক্রেমারের স্টীল-ডাস্ট স্ট্যালিয়ন। এড জানে, ওকে অনুসরণ করতে পারে ল্যামসনের ক্রুরা; সুতরাং যতটা সম্ভব এগিয়ে যেতে পারলেই মঙ্গল। এলাকায় বেশ কিছু দিন ধরে আছে এরা, কেউ কেউ আশপাশে ঘোরাঘুরি করেও কাটিয়েছে; তবে ওর চেয়ে বেশি তো কেউ চেনে না! একবার লিন্ডলে নদীর তীরবর্তী বুনো অঞ্চলে চলে যেতে পারলে ওকে ধরার সাধ্য হবে না কারও।
ছয়-সাতজন খুনীর সঙ্গে গোলাগুলি করে বিষয়টা নিষ্পত্তি করার কোন ইচ্ছে নেই ওর, এড জানে স্যাম ল্যামসনের সঙ্গের প্রায় প্রতিটি লোক কম- বেশি খুনে টাইপের।
প্রায় মিনিট ত্রিশেক টানা ছোটার পর গতি কমাল এড, ঘোড়াকে খানিক দম ফেলার ফুরসত দিল।
পপলার ক্যানিয়ন ছেড়ে এসে উত্তর-পুবে বাঁক নিল ও, গভীর একটা ড্র ধরে এগিয়ে শেষপর্যন্ত বিস্তৃত এক উপত্যকায় পৌছল। ড্রর তলায় পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি রয়েছে, প্রবল বেগে বইছে স্রোত, তবে কয়েক ফুটের বেশি গভীর হবে না। দূরে, ড্র থেকে উৎপন্ন ক্ষীণ ক্রীক লিন্ডলে নদীর সঙ্গে মিশে গেছে। দূর থেকে নদীর গর্জন শোনা যাচ্ছে। বৃষ্টির কারণে হারানো যৌবন ফিরে পেয়েছে নদীটা।
আশপাশের ক্যানিয়নগুলো হয়ে উঠেছে একেকটা মৃত্যুফাঁদ। বিপুল বিক্রমে পানির প্রবাহ বইছে ওগুলোয়, ফাঁকফোকর দিয়ে নেমে আসছে নিচের জমিতে। উন্মত্ত আক্রোশ নিয়ে ছুটছে পানির স্রোত। সামনে যা কিছু পাচ্ছে, ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কয়েকগুণ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে এখন জলঝড়। টানা বৃষ্টি চলছেই, সেই যে শুরু হয়েছে, এখনও থামার লক্ষণ নেই।
যে-ট্রেইল ধরে এসেছে ও, সেটা ধরে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না এখন। সঙ্কীর্ণ ক্যানিয়নের আনাচে-কানাচে বিক্ষুব্ধ পানির স্রোত, সুতরাং নতুন পথ খুঁজে বের করতে হবে। অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা কিন্তু আপাতত দারুণ বিপজ্জনক এই জায়গা ছেড়ে অচিরেই উপত্যকায় পৌঁছতে হবে, যেখানে মারা গিয়েছিল ওয়েস বার্নেট; তারপর পাহাড়সারি অতিক্রম করে পৌঁছতে হবে বাথানে
গ্র্যানিটের একটা চাতালে ক্ষণিকের জন্যে বিশাল স্ট্যালিয়নকে দাঁড় করাল এড। চাতালের কারণে কিছুটা হলেও ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাচ্ছে। ঘোড়ার দম যতটা সম্ভব টিকিয়ে রাখতে হবে, জানে ও, স্যাডল ছেড়ে গ্র্যানিটের দেয়ালের সঙ্গে কাঁধ ঠেকিয়ে বসে পড়ল, তারপর মনে মনে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করল।
পপলার থেকে বেরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়েছে ও, কোন্ দিকে যাচ্ছে বাছ-বিচার করেনি। উত্তর-পুবের অপেক্ষাকৃত রুক্ষ বুনো অঞ্চলে চলে এসেছে। স্যাম ল্যামসনের ক্রুদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে নিতান্ত বাধ্য হয়ে ছুটতে হয়েছে। দক্ষিণে যাওয়ার কথা ছিল ওর, তাহলে এতক্ষণে স্পেন্সার ভ্যালির প্রবেশমুখ ধরে প্রেয়ারিতে চলে যেতে পারত, ঘোড়াটার গতি আর দমের ওপর নির্ভর করতে হত ওকে। কিন্তু ততটা ভরসা করতে পারেনি এড, তাই সরে এসেছে অপেক্ষাকৃত বন্ধুর ট্রেইলে; কারণ তাহলে সহজে ওকে অনুসরণ করতে পারবে না ল্যামসনের ক্রুরা।
বাথানে থাকা দরকার। উত্তরে বাঁক নিয়ে এগোলে হয়তো শত্রুর মুখোমুখি হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু তারচেয়েও বড় সমস্যা: সামনের কয়েক হাজার ফুট উঁচু পাহাড়শ্রেণী পাড়ি দিতে হবে, এবং ওপাশে যেতে হলে একটা পথ খুঁজে পেতে হবে। কাজটা সহজ হবে না।
ড্যান স্পেন্সারের চেয়ে বেশি কেউ চেনে না এই এলাকা। স্পেন্সারের পরই এড। মোটামুটি জানে ও, কিন্তু নিজের জ্ঞানের ওপর ভরসা করতে পারছে না তেমন। বিস্তৃত পাহাড়শ্রেণীর খুঁটিনাটি জানা সম্ভবও নয়। দুর্গম চড়াই, ঢালু সঙ্কীর্ণ ট্রেইল, বিপজ্জনক তীক্ষ্ণ বাঁক, খাঁজকাটা চূড়া কিংবা গ্র্যানিটের মেসা, মাঝে মধ্যে অতল গহ্বর—অথচ সামগ্রিক ভাবে দেখা ছবিটা অনেক সহজ-অবিশ্বাস্য দুর্গম রীজ, ক্যানিয়ন, পাহাড়ী চাতাল আর শৃঙ্গের সমাহার অসংখ্য গোলকধাঁধা তৈরি করেছে। ওপাশে, উপত্যকার কিনারে তিন হাজার ফুট গভীর গিরিখাত, সঙ্কীর্ণ ট্রেইল ধরে এগোতে সবচেয়ে সাহসী লোকটারও বুক কেঁপে উঠবে 1
মুহূর্তের অসচেতনতায় মৃত্যু নেমে আসতে পারে।
সুরক্ষিত স্পেন্সার ভ্যালিতে পৌছানোর বেশ কয়েকটা পথ রয়েছে। একটা একটা করে মনে করল এড, আর বাতিল করে দিল। বেইলি ক্ৰীক এখন ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, কোন ভাবেই পার হওয়া যাবে না। ট্রেপার গাশের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার, অন্য দুটো পথও প্রায় পনেরো-বিশ ফুট গভীর পানিতে তলিয়ে গেছে এখন, না দেখেও দিব্যি অনুমান করতে পারছে এড।
বৃষ্টি পড়ছে এখনও। চিন্তিত দৃষ্টিতে অটল পাহাড়ী দেয়ালের দিকে তাকাল এড ক্রেমার। তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ, বৃষ্টির ধোঁয়াটে পর্দা ভেদ করে গাঢ় অন্ধকার আর দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড়ী রীজ ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়ল না। প্রতিটি পাস, গিরিখাত, ড্র বা ক্রীক পানিতে তলিয়ে গেছে, উন্মত্ত স্রোত বইছে ওগুলোয়। বাথানে যাওয়ার এখন একটাই উপায়: দুর্গম পাহাড়শ্রেণী পাড়ি দিতে হবে। চিন্তাটা মাথায় আসা মাত্র অজান্তে ঢোক গিলল এড, শীতল অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল সারা দেহে।
দুরূহ ট্রেইল ধরে আগেও যাতায়াত করেছে ও, কিন্তু এখনকার কথা আলাদা। দিনের বেলায়, আবহাওয়া ভাল থাকলে সম্ভব হত। বৃষ্টি আর আলোর স্বল্পতা ছাড়াও বজ্রপাত, বিদ্যুৎ চমক এবং রীজের গায়ে জমে থাকা কালো মেঘের আনাগোনার কারণে কাজটা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে 1
নিজেকে যতই নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করুক, বারবার চিন্তাটা উকি দিচ্ছে মনের দরজায়। এটাই একমাত্র উপায়। ড্যান স্পেন্সার একা রয়েছে বাথানে, বড়জোর দু’একজন ক্রু থাকবে। মাইক হ্যানলনকে লাইন-কেবিনে পাঠিয়ে দিয়েছে ও, ওখানেই আছে বেশিরভাগ ক্রু। উপত্যকার ওপাশে রয়েছে অন্যরা, বহু মাইল দূরে। কৃক ছাড়া মাত্র দু’জন আছে বাথানে।
শত্রুকে খাটো করে দেখা ধাতে নেই ওর। স্যাম ল্যামসনের বুদ্ধি আর পরিকল্পনার তারিফ করতেই হয়। দারুণ ধূর্ততার সঙ্গে পরিকল্পনা করেছে লোকটা। সবকিছু জেনে-শুনে কাজে হাত দিয়েছে। জানে লাইন-কেবিনে ক’জন থাকতে পারে। সামান্য মাথা খাটালে বুঝে ফেলবে র্যাঞ্চ হাউসে একা থাকবে ড্যান স্পেন্সার, যে মানুষটা বিশাল স্পেন্সার সাম্রাজ্যের মধ্যমণি-শক্তি, সামর্থ্য আর ক্ষমতার উৎস
রীজ ছাড়াও পাহাড়ের ওপর দিয়ে ভিন্ন একটা পথ রয়েছে। একবার ওটা দিয়ে র্যাঞ্চে গেছে এড, দিনের বেলায়। দারুণ বিপজ্জনক ট্রেইল, চোখের ভুরুর মত বাঁকা এবং সঙ্কীর্ণ পথ ধরে যেতে হবে, একপাশে ক্লিফের খাড়া দেয়াল আর অন্যপাশে কয়েকশো ফুট গভীর গিরিখাত। দীর্ঘ চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, দুটো পর্বতশৃঙ্গের মাঝামাঝি পিচ্ছিল গ্র্যানিটের পথ ধরে এগোতে হবে; তারপর ঢালু ট্রেইল ধরে নেমে যেতে হবে তৃণভূমির লাগোয়া বনে।
সব মিলিয়ে অন্তত বিশ মাইল পথ, বেশিও হতে পারে। এমনকী দিনের বেলায়ও কাজটা বিপজ্জনক এবং ধীর গতির। যে-কোন মুহূর্তে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। অতীত জীবনের সমস্ত দক্ষতার পরও, ভাগ্যের সহায়তা দরকার হবে ওর।
‘ঠিক আছে, বাছা,’ মৃদু স্বরে ঘোড়ার উদ্দেশে বিড়বিড় করল এড। ‘বাধ্য হয়ে এই পথে যেতে হবে আমাদের। জানি পছন্দ হবে না তোর, তবে আমারও পছন্দ নয়। যাকগে, দেরি করে লাভ কী!’ স্যাডলে চেপে চাতাল থেকে নেমে এল ও।
গ্র্যানিটের চাঙড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টি হামলা চালাল ওর ওপর। বাতাসের দাপট দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার অনুভূতি দিল ওকে, এদিকে বর্ষাতি ও পোশাকের ওপর বৃষ্টির ফোঁটার খোঁচা অনুভব করছে। ঘোড়ার গতিমুখ বদলে ক্যানিয়নের দিকে এগোল এড, সঙ্কীর্ণ পথ ধরে এগোবে একটু পর। পথটার কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করছে।
ক্রমশ চেপে এসেছে ক্যানিয়নের দেয়াল, একসময় বিশাল একটা জলপ্রপাতে রূপ পেল। কয়েকশো ফুট নিচে আছড়ে পড়ছে উন্মত্ত জলরাশি, যেন আরেক নায়াগ্রা। কিনারার সঙ্কীর্ণ পথ ধরে যেতে হবে ওকে। নাক সিটকে অসন্তোষ প্রকাশ করল ঘোড়াটা, গতি কমে এসেছে। এগোতে চাইছে না।
স্টীল-ডাস্টের ঘাড়ে হাত রেখে মৃদু স্বরে ওটাকে আশ্বস্ত করার প্রয়াস পেল এড। কিছুটা হলেও শান্ত হলো ঘোড়াটা, সতর্ক কিন্তু ত্রস্তহীন পা ফেলে এগোল। পাথুরে খাঁজ থেকে হঠাৎ গড়িয়ে পড়ল স্রোতধারা, আছড়ে পড়ল ঘোড়া আর সওয়ারীর ওপর; চমকে লাফিয়ে উঠল স্টীল-ডাস্ট লাগাম টেনে ওটাকে শান্ত করল এড, তারপর রাশ ঢিলে করল, এগোতে দিল ওটাকে। সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ও।
বজ্রপাত আর পানির তোড়ে ভেসে আসা বিশাল বোল্ডারের সঙ্গে পাহাড়ী দেয়ালের সংঘর্ষের শব্দ একাকার হয়ে গেছে। গম্ভীর প্রতিধ্বনি তৈরি হয়েছে নিচের গিরিখাতে। কদাচিৎ বিজলী চমকে ওঠায় নীল কিন্তু অস্পষ্ট আলোয় সামনে গোলকধাঁধার মত সঙ্কীর্ণ ট্রেইল আর তীব্র বেগে ছুটতে থাকা পানির ঘূর্ণি দেখতে পাচ্ছে ও। ভেজা পাহাড়ী দেয়াল কুচকুচে কালো এবং চকচকে দেখাচ্ছে, দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর পথে। গিরিখাতের তলায় ঘূর্ণিস্রোতের ফেনিল জলরাশি গর্জে উঠছে উন্মত্ত আক্রোশে
ধীর গতিতে টানা এগিয়ে চলেছে স্টীল-ডাস্ট। বাতাসের ঝাপটা এড়ানোর জন্যে মাথা নিচু করে রেখেছে। গিরিখাতের দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে কর্কশ গর্জন তুলছে বাতাস। বুনো আক্রোশে গোঙাচ্ছে যেন কোন পশু। বৃষ্টি আর বাতাসের দুর্ভোগ উপেক্ষা করে মাথা নিচু করে এগিয়ে চলেছে এড ক্রেমার-ক্লান্ত, পর্যুদস্ত; প্রকৃতি এবং পরিবেশের উন্মত্ততার কাছে প্রায় পরাস্ত একজন মানুষ। দু’হাত দূরের জিনিসও ঠিকমত দেখতে পাচ্ছে না, স্রেফ দুর্গম ট্রেইলে চলতে অভিজ্ঞ ঘোড়াটার সহজাত প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করছে।
একবার, বিজলী চমকে ওঠায় সামনে বিস্তীর্ণ খোলা জায়গা চোখে পড়ল ওর। দৃশ্যটা দেখেই গায়ে কাঁটা দিল, অজান্তে শিউরে উঠল। গুঙিয়ে উঠল অস্ফুট স্বরে, শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল শীতল স্রোত। সামনের ভয়াবহ দৃশ্য জীবনে আর কখনও দেখতে না পেলেই খুশি হবে ও।
একটা বাঁকের মুখে চলে এসেছে স্ট্যালিয়ন, আর দু’পা এগোলে পাশের গভীর খাদে পতন হত ওদের!
মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা করল ও, শক্ত হাতে চেপে ধরেছে লাগাম। ধীর গতিতে ঘোড়ার গতিমুখ পরিবর্তন করল, ঘোড়াকে পিছিয়ে আনল দুই কদম, তারপর বামে মোড় নিয়ে এগোল। বিদ্যুৎ চমকে ওঠায় ডানে ঢালু পথটা দেখতে পেল, ইচ্ছে না থাকলেও তাকাল এড-বৃষ্টিতে ভেজা পিচ্ছিল ঢালু পথ নেমে গেছে কয়েকশো ফুট নিচে, পাহাড়ী খাজ থেকে নেমে আসা জলস্রোত আছড়ে পড়ছে ওখানে। সাদা ফেনার সমুদ্র তৈরি হয়েছে স্রোতের মাঝখানে, মোচড় খাচ্ছে পানি। আস্ত একটা সিডার উপড়ে নিয়ে এসেছে স্রোত, খেলছে ওটাকে নিয়ে।
বিদ্যুৎ চমকাল আবার, বজ্রপাতের শব্দ ক্লিফের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল, এবং ঝপ করে নিকষ কালো অন্ধকার নেমে এল চারপাশে। ধীর গতিতে, সন্তর্পণে এগোল ঘোড়াটা, চড়াই বেয়ে উঠছে এখন।
মিনিট কয়েক পর, যেন ভোজবাজির মত, হঠাৎ গিরিখাত থেকে বেরিয়ে এল ওরা। সরু একটা খাঁজে চলে এসেছে, ঘোড়ার পায়ের নিচে পানির স্রোত, তবে কয়েক ইঞ্চির বেশি নয় গভীরতা। বিপুল বিক্রমে গিরিখাতের দিকে ছুটে যাচ্ছে পানির ধারা। সামান্য পা হড়কালে বা ভুল পদক্ষেপে গড়িয়ে না পড়লেও আছাড় খেতে পারে ঘোড়াটা, তবে নিরাপদে পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে এল স্টীল-ডাস্ট-ধীর নিশ্চিত পদক্ষেপে। আচমকা পাহাড়ী একটা ঢালে নিজেকে আবিষ্কার করল এড ক্রেমার
গিরিখাতের ভেতরের দৃশ্যের সঙ্গে সামনের জমির আকাশ-পাতাল পার্থক্য। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের পর্দা বিছিয়ে আছে সামনে, নীল বজ্রের আলোয় চিরে গেল কালো মেঘের জমিন, পাহাড়ী ঢালের ওপর নুয়ে পড়া মেঘের দলেও তার ছোঁয়া লেগেছে। স্বল্প আলোয় বিস্তৃত জমি আর বজ্রপাতে মৃত পাইনের কঙ্কালসার শাখা-প্রশাখা আকাশের দিকে উঁচিয়ে আছে নিখাদ আড়ষ্টতা ও স্থবিরতা নিয়ে।
ঝড় অগ্রাহ্য করে এগিয়ে চলেছে স্ট্যালিয়ন, বোল্ডারের ফাঁকফোকর দিয়ে ঢালু পথ ধরে ক্রমে নিচে নামছে। স্যাডলে নির্জীব হয়ে পড়ে আছে এড, বাতাসের নিরন্তর ঝাপটা অনুভব করছে পুরো দেহে। বজ্রপাতে ডিনামাইটের মত বিস্ফোরিত হলো সামনের একটা গাছ, জ্বলন্ত কয়েকটা শাখা খসে পড়ল মাটিতে, বাতাস তাড়িয়ে নিয়ে গেল রিকোশেটের বুলেটের মত। জ্বলছে গাছের গুঁড়ি, দমকা বাতাসে ঝলসে উঠল শিখা, পোড়া কটু গন্ধে ভারী হয়ে গেল বাতাস।
অনেক পরে, পাহাড় আর এড ক্রেমারের পেছনে ভোর হলো একসময়। অন্ধকার দিগন্ত ধূসর হয়ে এল, তারপর রক্তলাল হয়ে উঠল পুবাকাশ। রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে পর্বতশৃঙ্গের গায়ে। অবসন্ন দেহে এগিয়ে চলেছে এড; অস্থির, উদ্বিগ্ন এবং নিদারুণ ক্লান্ত। পেছনে মরচে ধরা রঙ বদলে গিয়ে জ্বলন্ত কয়লার রূপ পেয়েছে উঁচু ক্লিফের সারি, কিন্তু ফিরে তাকানোর গরজ অনুভব করল না ও। ক্লান্ত বিধ্বস্ত ঘোড়াটা অবিচল পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে, ঢালের শেষ মাইল পাড়ি দিচ্ছে এখন। সামনে বৃষ্টিাত সবুজ তৃণভূমি।
শূন্য উপত্যকা। রক্তলাল চোখে চারপাশে নজর চালাল এড, দক্ষিণে তাকাল। কোন রাইডার বা নড়াচড়া চোখে পড়ল না। তারমানে এখনও পৌছায়নি ল্যামসনের লোকেরা। ঠিকই তাদের আগে পৌঁছতে পেরেছে ও। কিছুক্ষণের মধ্যে বাথানে পৌঁছে যাবে। বাপের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে এড, একসঙ্গে ঝামেলাটা ঢুকিয়ে ফেলৰে
আসুক স্যাম ল্যামসন। উচিত শিক্ষা পাবে। লড়াই কাকে বলে জানবে ব্যাটা। ড্যান স্পেন্সারের ক্রুরা কেউই বেপরোয়া খুনী নয়, একেকজন একেকরকম, রক্তের সম্পর্ক নেই ওদের মধ্যে, কিন্তু দায়িত্ব আর আন্তরিকতা একই কাতারে সামিল করেছে ওদের, ইস্পাতদৃঢ় মনোবল তৈরি করেছে-প্রত্যেকের মধ্যে। অস্ত্রের ব্যবহার জানে ওরা। কিংবা শক্তির আধিপত্য সম্পর্কেও অবগত। নীতি বা সততার প্রশ্নে নির্ভীক, নিজের বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে মরতেও দ্বিধা নেই এদের।
এসব ভাবছে না এড। আসলে কিছুই ভাবছে না। স্রেফ পথ চলছে। একসময় র্যাঞ্চ ইয়ার্ডে পৌঁছল স্টীল-ডাস্ট। স্যাডল থেকে নামার সময় হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল ও, ব্রুস সীমস নামে এক ক্রু ছুটে এল সাহায্য করতে। ঠেকার সময় হসল্যারের দায়িত্বও পালন করে সে।
‘এড!’ বিস্ময়ে কপালে গিয়ে ঠেকেছে সীমসের ভুরু। ‘খোদা! কীভাবে এলে এখানে?’
‘পাহাড় পেরিয়ে,’ হেঁটে বাড়ির দিকে এগোনোর সময় বলল এড
বিহ্বল চোখে ছয় হাজার ফুট উঁচু রীজের দিকে তাকাল কাউবয়। ‘পাহাড় পেরিয়ে,’ বিড়বিড় করল সে। ‘পাহাড় পেরিয়ে!’ ক্লান্ত ঘোড়ার পিঠ থেকে স্যাডল খসিয়ে করালের দিকে নিয়ে চলল ঘোড়াকে, তারপর ছুটে ঢুকে পড়ল বাঙ্কহাউসে। ‘পাহাড় পেরিয়ে এসেছে ও!’ বলল আরেক কাউবয়, বিল লিয়েস্টকে।
অফিসেই ছিল ড্যান স্পেন্সার। চেয়ারে বসে সিগার টানছে। চোখ তুলে এডকে ঢুকতে দেখল সে, মুহূর্তে তীক্ষ্ণ হয়ে গেল চাহনি। হাত তুলে তাকে প্রশ্ন করতে নিষেধ করল এড, হাঁটার মধ্যে ভেজা কাপড় খসাল গা থেকে। নিজের কামরায় ঢুকে গেল ও। বিছানায় বসে একটা বুট খুলল, তারপর নরম বিছানায় বিছিয়ে দিল শরীর, দেহ শিথিল হয়ে গেল, বাম স্পারটা কম্বলের কিনারা ছুঁয়েছে প্রায়।
পিছু নিয়ে কামরায় ঢুকল স্পেন্সার, নীরবে তাকিয়ে থাকল এডের দিকে। গম্ভীর, চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। এগিয়ে এসে একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। সমালোচনার দৃষ্টিতে তাকাল ঘুমন্ত ছেলের দিকে, শেষে সমীহ আর সন্তুষ্টি ফুটে উঠল চোখে। আহ্, ছেলে হলে এমনই হওয়া উচিত! যুগপৎ অহঙ্কার এবং আনন্দ বোধ করল সে। এই ছেলে ছাড়া আর কে আছে তার?
সেই কবে বুড়ো জন লিন্ডলের সঙ্গে এই উপত্যকায় এসেছিল! তারপর কত বছর চলে গেল। কোন ট্রেইল বা পথ জানা ছিল না, পাহাড় পেরিয়ে এসেছিল দু’জনে; এখানে যে নয়ন জুড়ানো এক উপত্যকা রয়েছে, সেটা দেখার আগপর্যন্ত বুঝতে পারেনি। উপত্যকার সবুজ ঘাসে ভরা জমি, দিগন্তের সঙ্গে মিশে থাকা পাহাড়শ্রেণী, সুনীল আকাশ…বুনো পশ্চিমে এমন অনেক জায়গাই ছিল তখন; আপাত শান্ত স্থবির ছবির আড়ালে ছিল ভয়ঙ্কর রক্তপিপাসু ইন্ডিয়ানদের হামলার আশঙ্কা। এমন নির্জন অঞ্চলে পারতপক্ষে বসতি করে না কেউ, কিন্তু বুনো এই উপত্যকায় স্বর্গের অস্তিত্ব টের পায় সে।
পশ্চিমে তখন অনেক লোকই আসছে। বেশিরভাগই বীভার কিংবা মোষ শিকার করতে। পাহাড়ে পাহাড়ে কেটেছে এদের দিন, ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে ব্যবসা করেছে, আবার সময়ে সময়ে লড়াইও করেছে; এভাবেই বুনো এই দেশে টিকে থাকার সামর্থ্য অর্জন করেছে। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এরা, অ্যাডভেঞ্চার আর নতুন জায়গা জয় করার নেশায় আরও পশ্চিমে পাড়ি জমায়, যেখানে এর আগে কোন সাদা মানুষ পা রাখেনি।
স্পেন্সার ভ্যালি তেমনই একটা জায়গা।
জন কোল্টারের কথা না বললেই নয়, দুঃসাহসী এই মানুষটা প্রথম পা রাখে ইয়েলোস্টোন অঞ্চলে। জিম বেজার যেভাবে পশ্চিমকে চেনে, সম্ভবত আর কেউ তেমন ভাবে চেনে না, চিনতে পারবেও না। বুড়ো জন লিন্ডলে, স্মিথ, হোবাক, উইলবার প্রাইস হান্ট, কিট কার্সন বা রবার্ট স্টুয়ার্ট…অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় কিছু মানুষ; নতুন জায়গা দেখার, নতুন জিনিস জানার নেশা ছিল যাদের রক্তে। এদের অনেকেই সোনার খোঁজে এসেছিল পশ্চিমে, কেউ বসতি করতে, থাকতে এসেছিল। কিন্তু ড্যান স্পেন্সারই প্রথম, সে-ই প্রথম থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বুনো এই এলাকায়।
ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে জমি কিনে এখানেই থেকে গেছে সে, ব্যবসা করেছে। শত মাইলের মধ্যে কেবল সে-ই ছিল একমাত্র সাদা লোক। পুরো বছরে হয়তো একজন বা দু’জনকে দেখতে পেত, অন্য সময়ে কোন শিকারীকেও দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
কিওয়াদের সঙ্গে সম্পর্কটা মন্দ ছিল না ওর, কিন্তু একেবারে দা- কুমড়া সম্পর্ক ছিল ক্রোদের সঙ্গে। ব্ল্যাকফুটের রেইডিং পার্টি প্রায়ই হামলা চালাত, উত্তর দিক থেকে আচমকা আসত ওরা। মাঝে মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবও দেখা গেছে এদের মধ্যে। আসলে, ইন্ডিয়ানরা যা চেয়েছে, তাই পেয়েছে ড্যান স্পেন্সারের কাছ থেকে-বন্ধুত্ব বা শত্রুতা। ব্যবসা করেছে, গল্প করেছে, ইন্ডিয়ান গ্রামে গেছে সে; আবার ইন্ডিয়ানরা হামলা করায় লড়াইও করেছে। কিছুদিন পর ক্রোরাও ওকে আর ঘাঁটাল না, বুঝে নিল মৃত্যু বা ঝামেলার চেয়ে বন্ধুত্বই শ্রেয়, কারণ ড্যান স্পেন্সারের হাতে ওদের অনেক সঙ্গী খুন হয়েছে…
সামনে দুঃসময়! চামড়ায় মোড়ানো চেয়ারে বসে নিকট ভবিষ্যৎ দিব্যি আঁচ করতে পারছে ড্যান স্পেন্সার। প্রতিপক্ষ হিসেবে ইন্ডিয়ানদের চেয়ে সাদা মানুষ সবসময়ই ভয়ঙ্কর এবং কঠিন। কূটকৌশল, ভাড়াটে গানম্যান, আধুনিক অস্ত্র, নিজেদের তৈরি আইন-এসব হচ্ছে সাদাদের বাড়তি অস্ত্র। যে-কোন নীতি বিসর্জন দিতে পারে এরা, অথচ ইন্ডিয়ানরা লড়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও সততা নিয়ে।
সেটলারদের সঙ্গে ভিড়ে যাওয়া দলটাকে ঠেকানো কঠিন হবে, জানে স্পেন্সার, অবচেতন মন থেকে টের পাচ্ছে, কারণ একাধারে নিষ্ঠুর, বেপরোয়া এবং খুনে স্বভাবের মারকুটে লোক ওরা, লক্ষ্য অর্জন না করা পর্যন্ত থামবে না। থামিয়ে দিতে হবে ওদের, কিংবা থামতে বাধ্য করতে হবে।
এড ক্রেমারের ওপর সন্তুষ্টি বোধ করছে স্পেন্সার। প্রথমেই রক্তারক্তি চায়নি ছেলেটা, বরং শান্তি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। তাই বলে মোটেও দুর্বল বলা যাবে না ওকে। বিদ্যুৎ গতির ড্র, নিখুঁত নিশানা, যে-কোন অবস্থান থেকে গুলি করার দক্ষতা—পিস্তলে এড ক্রেমারের সামর্থ্য প্রশ্নাতীত।
মাথা তুলে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল সে, চোখ পিটপিট করছে। দৃষ্টিশক্তি ওর বরাবরই ভাল, খালি চোখে দেখতে পায় অনেকদূর। এমনকী ইন্ডিয়ানরাও এজন্যে সমীহ করে ওকে। সমতল পাথরের ওপর দিয়ে এগিয়ে যাওয়া একটা সাপকে ট্র্যাক করতে সক্ষম ড্যান স্পেন্সার, বলে ইন্ডিয়ানরা, কিংবা ঘোলাটে ক্রীকের পানি ধরে সাঁতরানো হাঁসকেও অনুসরণ করতে পারবে।
একজন অশ্বারোহী এগিয়ে আসছে র্যাঞ্চের দিকে। বসার ভঙ্গিটা কেমন যেন!
আরও একটু কাছে আসতে কারণটা বুঝতে পারল স্পেন্সার। আরোহী লোক নয়, একটা মেয়ে সাদা মেয়ে। চেয়ারে দোল খেতে শুরু করল সে। পুরো দশ বছর পর সাদা কোন মহিলাকে দেখতে পেল! ধীর পায়ে দরজার দিকে এগোল সে, রাইফেল তুলে নিল হাতে, যদি দরকার হয়ে পড়ে-সাবধানের মার নেই।
সূর্যের আলোয় আগুনের লেলিহান শিখার রঙ পেয়েছে মেয়েটির সোনালী চুল। নরম হয়ে এল ড্যান স্পেন্সারের তীক্ষ্ণ চাহনি। সরাসরি র্যাঞ্চ হাউসের দিকে আসছে মেয়েটি। চোখের কোণ দিয়ে বাঙ্কহাউসের দরজায় বেকুবের মত দাঁড়িয়ে থাকা দুই কাউবয়কে দেখতে পেল ড্যান স্পেন্সার, চোখ বিস্ফারিত ওদের।
কালো মেয়ারে চেপেছে মেয়েটি। দূরে থাকতে স্যাডল ছাড়ল, তারপর লাগাম হাতে ঘোড়াকে হাঁটিয়ে এগিয়ে এল স্পেন্সারের দিকে। ট্রাউজার আর ছেলেদের শার্ট ওর পরনে, কিন্তু তারপরও অতুলনীয় সৌন্দর্য ঢাকা পড়েনি। সহজ লাজুক হাসি উপহার দিল মেয়েটা মেয়ে বটে একখানা!
প্রবল বিস্ময় নিয়ে স্পেন্সারের দিকে তাকাল ডরোথি। ওর ধারণা ছিল বিশালদেহী মানুষ সে, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি প্রায় দৈত্যাকার একজন লোককে দেখতে পাবে। সাড়ে ছয় ফুটেরও বেশি লম্বা, তিনশো পাউন্ড ওজন। ঘন চুলে পাক ধরেছে, মরচে ধরা লোহার মত বাদামী দেখাচ্ছে মাঝে মধ্যে। থামের মত বিশাল ভারী বাহু পুরোপুরি ঢাকতে পারেনি শার্টের আস্তিন।
‘এসো! এসো!’ গুরুগম্ভীর শব্দে গর্জে উঠল ড্যান স্পেন্সার। তুমি নিশ্চয়ই ডরোথি হেডলিন! শুনেছি তোমার কথা, বিস্তর শুনেছি!’ মেয়েটিকে দ্বিধান্বিত পায়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে দেখে চারপাশে তাকাল সে। কী হলো? বুড়ো একজন মানুষকে নিশ্চয়ই ভয় পাচ্ছ না? এসো, ভেতরে এসো!’ ‘ভয় পাচ্ছি, তা নয়। যেভাবে এখানে এসেছি আমরা-এবং এই জমি আমাদেরও নয়, আর-
‘ব্যাখ্যা করার দরকার নেই,’ মাথা নাড়ল উপত্যকার অধিপতি। ‘ভেতরে এসে বসো। এই প্রথম সাদা কোন মেয়ে আমার বাড়িতে পা রাখল। যাকগে, নিশ্চয়ই এডের কাছে এসেছ? অঘোরে ঘুমাচ্ছে ও, একেবারে মড়ার মত।’
‘ওহ্, তারমানে নিরাপদে ফিরতে পেরেছে ও?’ স্বস্তির সুরে জানতে চাইল ডরোথি। ‘যা ভয় পেয়েছিলাম! লোকজন ওর পিছু নিয়েছিল।
‘ঝামেলাটা কীসের?’ আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকাল ড্যান স্পেন্সার। ‘সবকিছু খুলে বলো আমাকে।’
সাই ডানানের খুন হওয়া এবং পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে বলল ডরোথি ‘সেজন্যেই এখানে এসেছি আমি,’ শেষে যোগ করল। ‘এক হিসেবে শান্তির জন্যে। সবকিছু জানতাম না আমরা, অন্তত শুরুতে। এডের কথা না শুনে বোকামি করেছি সবাই। স্যাম ল্যামসন সম্পর্কে আমাদেরকে সতর্ক করেছিল ও।
‘আমার বাবা বা সেটলাররা এখন শান্তি চাইছে, মি. স্পেন্সার। জনি গ্যারেট বা মাটি থ্যাচার সম্পর্কে বলতে পারব না, কিন্তু অন্যদের পক্ষ হয়ে তোমাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি আমি।’
নড করল স্পেন্সার। ‘কাজটা তাহলে এড করেছে? অবশ্য যাওয়ার সময় এমন আভাস দিয়েছিল ও। খবরটা শুনে খুশি হবে ছেলেরা।’ মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাল সে। ‘ডেভ!’ গর্জে উঠল র্যাঞ্চার।
ছুটে এসে দরজায় দাঁড়াল কৃক। উষ্কখুষ্ক চুল মাথায়, মুখে দাড়ির জঙ্গল, চোখে ব্ৰিত চাহনি
‘কফি আর কেক নিয়ে এসো আমাদের জন্যে! আজ এই উপত্যকার ইতিহাসে অভূতপূর্ব একটা দিন, একজন লেডি আমাদের মেহমান হয়েছে। খোদার কসম…’ লাল হয়ে গেল স্পেন্সারের মুখ। ‘কিছু মনে কোরো না, ম্যা’ম। আমার কথাবার্তা বা আচরণ হয়তো বেখাপ্পা লাগতে পারে। পুরুষ মানুষের জায়গা তো, হরহামেশা গালিগালাজ করি আমরা। এটা তো স্বর্গ বা পুবের কোন ভদ্রলোকের বাড়ি নয়! আমাকে পাপী মানুষ বলতে পারো, কিন্তু সেজন্যে অনুতাপ নেই আমার। মনে হচ্ছে, নরকের ফটক কিছুটা চওড়া করতে হবে, আমার মত দানবকে ওখানে ঢোকানো সহজ হবে না।’ সবক’টা দাঁত কেলিয়ে হাসল সে, তাকিয়ে আছে ডরোথির দিকে। তাহলে তুমিই সেই মেয়ে যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে এড?’
ঝট করে উঠে দাঁড়াল ডরোথি, মুখ-চোখ লাল হয়ে গেছে। ‘কেন! কে…’
‘মন খারাপ কোরো না, ম্যাম! আমি আসলে মোটা মাথার ঠোঁট পাতলা এক লোক। কি জানো, এ ব্যাপারে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি এড, কিন্তু ওর চোখের ভাষা পড়ার ক্ষমতা তো আছে আমার, নাকি? এবার যখন বেরিয়ে গেল, আশায় ছিলাম পছন্দের মেয়েকে খুঁজে পাবে সে। তা, ওকে কেমন লাগে তোমার?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ডরোথিকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল র্যাঞ্চার, চাহনিতে চাপা কৌতুক খেলা করছে। ‘ওকে বিয়ে করছ তো?’
‘ওহ্, আমি কীভাবে জানব…’ প্রতিবাদ করল ডরোথি। ‘আমি তো এও জানি না যে সত্যিই আমাকে ও চায় কিনা।’
‘দেখো, মেয়ে, মিষ্টি কথায় ভোলাতে পারবে না আমাকে! চ্যাংড়া ছেলেদের হয়তো এভাবে পটাতে পারবে, কিন্তু আমার বেলায় কাজ হবে না। আমার মত তুমি নিজেও জানো, সুন্দরী কোন মেয়ে যদি একজন পুরুষকে মনে-প্রাণে চায়, মনে হয় না এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে লোকটির। আসলে কিছুই করার থাকে না, স্রেফ দৌড়ে যদি পালিয়ে যেতে পারে। শুধু এই! হার মেনে নিয়ে মেয়েটাকে বিয়ে করতে হবে, নয়তো তল্লাট ছেড়ে নিরুদ্দেশ হতে হবে, পেছনে ঠিকানা বা কোন চিহ্ন রেখে যাওয়া যাবে না!
‘কই, আমাকে তো জিজ্ঞেস করেনি!’—এ ধরনের কথা বলে হয়তো কমবয়েসী কাউকে ভোলাতে পারবে, কিন্তু আমাকে পারবে না। অনেক ইন্ডিয়ান যুবককে দেখেছি। জানো তো, যে-মেয়েকে বিয়ে করতে চায় তার বাড়ির সামনে ঘোড়া বা গরু রেখে আসতে হয় ওদের? পশুর সংখ্যা পছন্দ হলে বিয়েতে মত দেয় মেয়েটা। অনেক ইন্ডিয়ান যুবককে দেখেছি বিশটা গরু বিসর্জন দিতে, অথচ দশটা দিলে ওই মেয়ের চেয়ে সুন্দরী স্কুঅ জোটাতে পারত সে। এর কারণ জানো? মেয়েটা চায় নিজের পছন্দের যথার্থতা প্রমাণ করুক যুবক, একইসঙ্গে প্রমাণ করতে চায় দামটা আসলে সস্তা নয়। না, মোটেই না! এমন কিছুই করব না আমি। আমি বরং একটা ভালুকের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ লড়তে রাজি আছি, কিন্তু কোন মেয়েকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্যে পটাতে পারব না!’
ড্যান স্পেন্সারের হেঁয়ালিপূর্ণ তর্কের ধারে-কাছেও গেল না ডরোথি হেডলিন, বরং কাজের কথা পাড়ল ও। ‘তাহলে তাহলে শান্তি আসবে এখানে, স্যর? আমরা যদি ল্যামসনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করি, তাহলে লড়াই করবে না তুমি, এখানে থাকতে দেবে আমাদের?’
‘লড়াই? কেন লড়ব! আমার তো মনে হয় কয়েকজন প্রতিবেশী হলে মন্দ হবে না,’ উজ্জ্বল হলো তার চোখজোড়া, পরমুহূর্তে কঠিন হয়ে গেল চাহনি। ‘কিন্তু তোমরাই শেষ, অন্য কাউকে জায়গা দিতে পারব না! তোমরাই শেষ, বুঝেছ? আর কেউ নয়!’
‘তাহলে সত্যিই নিজস্ব জমি হবে আমাদের? অবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্নটা করল ডরোথি।
‘নিশ্চয়ই, যে-যেখানে আছ থাকবে তোমরা। স্যাম ল্যামসনের লোকজন চলে গেলে ওদের জায়গাও দখল করে নিতে পারো ইচ্ছে করলে। যদিও কাগজ-কলমে তোমাদের জমি লিখে দিতে পারব না আমি। কখনও লিখতে শিখিনি, ম্যা’ম। সত্যি কথা! মিথ্যে বলছি না। কীভাবে লিখতে বা পড়তে হয়, জানি না আমি, শিখিওনি। কিন্তু সিক্সটারের গুলি চালিয়ে বাড়ির দেয়ালে নিজের নাম লিখতে পারব। খোদার কসম, চাইলেই কাজটা করতে পারি! কিন্তু কলম? আমার হাতে সবসময়ই জিনিসটা খুব ছোট মনে হয়েছে। না, ছাপানো লেখা পড়তে জানি না, কিন্তু যে-কোন চিহ্ন পড়তে পারি। আমার বাথান থেকে ঘোড়া চুরি করেছিল এক ইন্ডিয়ান, ষাট মাইল ট্র্যাক করেছি ওকে। মিথ্যে বলছি না, ম্যা’ম, ঘোড়া আর ইন্ডিয়ান লোকটার চাঁদির চামড়া নিয়ে ফিরে এসেছি আমি। খোদ ওর গ্রামে গিয়ে চামড়া ছিলেছি।’
বিস্ময় বা বিহ্বলতা প্রকাশ করার সুযোগ হলো না ডরোথির। বাইরে চিৎকার করে উঠল কেউ, একটু পর ছুটে দরজায় এসে দাঁড়াল এক কাউবয়।
‘বস্! বস্! আসছে ওরা! ওহ্, জলদি করো! চলে এসেছে ওরা… ব্রুস সীমসের কণ্ঠ চাপা পড়ে গেল গুলির প্রচণ্ড শব্দে। এক লাফে চেয়ার ছেড়ে দরজার দিকে এগোল ড্যান স্পেন্সার, পোর্চের দিকে ছুটে আসছে লোকজন।
বাঙ্কহাউস থেকে ছুট লাগিয়েছে বিল লিয়েস্ট, কিন্তু ছুটন্ত অশ্বারোহীরা ধরে ফেলল তাকে। প্রথম ঘোড়ার ধাক্কায় মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে, পেছনের ঘোড়াগুলো নিষ্ঠুর ভাবে মাড়িয়ে গেল ওকে। ভেতর থেকে হতভাগ্য কাউবয়ের তীক্ষ্ণ, যন্ত্রণাকাতর চিৎকার শুনতে পেল ডরোথি। ড্যান স্পেন্সারকে পিস্তল বের করতে দেখেনি ও; কিন্তু খেয়াল করল সমানে আগুন ওগরাচ্ছে বুড়োর দুই কোল্ট। দরজায় এসে দাঁড়ানো এক লোক থমকে দাঁড়াল গুলির ধাক্কায়, বুক চেপে ধরল, গলগল করে বের হওয়া রক্ত হাত ভিজিয়ে দিয়েছে তার।
এক বুটঅলা ভূতুড়ে একটা অবয়ব ছুটে এল পাশের কামরা থেকে। দ্রুত হাতে কোমরে গানবেল্ট জড়াচ্ছে। পরমুহূর্তে এড ক্রেমারকে গুলি করতে দেখতে পেল ডরোথি।
পেছনের জানালায় ক্ষীণ শব্দ হলো। ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল এড, কোমরের কাছ থেকে গুলি করল। জানালার চৌকো কাঠামো ঢেকে দেয়া গাঢ় অবয়বটা অদৃশ্য হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। এদিকে তুমুল বেগে ছুটে এল গুলির তুবড়ি, অন্তত সাত-আটটা রাইফেল গর্জে উঠেছে বাইরে।
চট করে র্যাক থেকে একটা হেনরি তুলে নিল এড ক্রেমার। আরেকটা তুলে নিয়ে, ছুটে গিয়ে ড্যান স্পেন্সারের হাতে ধরিয়ে দিল।
জানালার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বুড়ো। ‘এত দ্রুত এসেছে ওরা যে কিছুই টের পাইনি!’ খানিকটা বিব্রত স্বরে বলল সে। মেয়েটার সঙ্গে গল্প করছিলাম…’
চট করে ডরোথির দিকে তাকাল এড, বিস্ময় আর মেয়েটিকে দেখার আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। দ্রুত গম্ভীর হয়ে গেল মুখ। প্রবল আতঙ্ক নিয়ে এড ক্রেমারের চোখে সন্দেহ ফুটে উঠতে দেখতে পেল ডরোথি।
বাইরে চিৎকার করল কয়েকজন, পরপরই জানালা লক্ষ্য করে গর্জে উঠল বেশ কয়েকটা অস্ত্র। ঝুলন্ত লণ্ঠনটা মুহূর্তে শত টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল পুরো কামরায়, রান্নাঘরে খিস্তি আওড়াল কেউ, একটা বাফেলো বন্দুকের গর্জন শোনা গেল পরপরই।
‘ক’জনকে দেখেছ?’ জানতে চাইল এড
‘বারো-তেরোজন বোধহয়,’ বলল ড্যান স্পেন্সার। প্রথম চোটে দু’- তিনজনকে শেষ করে দিয়েছি!’
‘বারো-তেরোজন?’ চরকির মত ঘুরে দাঁড়িয়ে ডরোথির মুখোমুখি হলো এড। ‘সেটলাররা এসেছে নাকি? এখনও লড়াই করার ইচ্ছে আছে ওদের?’
‘না, হতেই পারে না,’ বলল স্পেন্সার, র্যাঞ্চ ইয়ার্ডের ওপর দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে তার। করালটা তন্নতন্ন করে খুঁজল। ‘প্রশ্নই আসে না। সেটলারদের পক্ষ থেকে শান্তির প্রস্তাব নিয়ে ও-ই এসেছে। এতক্ষণ এ নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা।’
‘তোমরা কথা বলছ, ঠিক তখনই হামলা করল ওরা, তাই না?’ সন্দিহান সুরে ক্ষোভ প্রকাশ করল এড।
উঠে দাঁড়াল ডরোথি, বিস্ফারিত হয়ে গেছে দুই চোখ। ‘ওহ্, তুমি নিশ্চয়ই কথাটা বিশ্বাস করো না! করতেই পারো না! আমি…’
কথা শেষ করতে পারল না ও। লগের তৈরি বাড়ির দেয়াল কাঁপিয়ে তুলল অসংখ্য বুলেট। মুহুর্মুহু গর্জে উঠছে কয়েকটা রাইফেল। ইন্ডিয়ানদের মত ক্ষিপ্রতায় এক জানালা থেকে অন্য জানালায় ছুটে যাচ্ছে এড ক্রেমার। এক ফাঁকে অন্য বুট পায়ে গলিয়ে নিয়েছে।
দরজার কাছাকাছি রাখা একটা ওলা* চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল বুলেটের আঘাতে। গুলি করল এড। করালের কোণে হুমড়ি খেয়ে পড়ল এক লোক, তারপর চিৎপাত হয়ে পড়ল শক্ত মাটির ওপর, কয়েক হাত দূরে পড়ে রয়েছে হতভাগ্য বিল লিয়েস্টের বিকৃত লাশ।
[ওলা (Olla) : মাটির কলসী, পানি ঠাণ্ডা করার জন্যে ব্যবহার করা হয়।]
এবার ছুটে এসে হামলা করবে ওরা,’ হঠাৎ বলল এড, কোল্ট দুটো লোড করছে। ‘জুত করে বসো, ড্যান! এই ঠেলায় আমাদের শেষ করে দেয়ার চেষ্টা চালাবে ওরা।’
‘আসুক না ব্যাটারা! লড়াই করার খায়েশ মিটিয়ে দেব ওদের! চোর, ডাকাত, লুটেরার দল! আসুক, যতজন আসবে ততজন ফিরে যেতে পারবে না!’
আচমকা, বিক্ষিপ্ত ভাবে ছুটে এসে আক্রমণ চালাল আউট-লরা। ছুটে দরজার কাছে চলে গেল বুড়ো, কোল্ট থেকে সমানে গুলি করছে।
চিৎকার করে পেট চেপে ধরল এক লোক, এলোমেলো কয়েক পা ফেলল, তারপর সশব্দে আছড়ে পড়ল মাটির ওপর। আরও একজন পড়ে গেল। হঠাৎ গর্জে উঠল একটা কোল্ট, কেঁপে উঠল ড্যান স্পেন্সারের দেহ, এক পা আগে বাড়ল সে, তারপর চিৎ হয়ে পড়ে গেল মেঝেয়।
দু’চোখ ভরা আতঙ্ক নিয়ে বুড়োর দিকে তাকিয়ে থাকল ডরোথি, তারপর গোলাগুলি উপেক্ষা করে ছুটে গেল, ড্যান স্পেন্সারের পাশে বসল। বিহ্বল দেখাচ্ছে মানুষটাকে। ‘আমাকে গুলি লাগিয়েছে ওরা! হাহ্, এর মজা টের পাওয়াব ওদের! আমার পিস্তলটা দাও তো, ম্যা’ম। গুবরে পোকার মত পিষে মারব ওই হারামজাদাকে!’
‘শ্শ্শ্! চুপচাপ শুয়ে থাকো!’ ফিসফিস করল ও। বিশাল বুকের ছাতির ওপর থেকে শার্ট সরিয়ে ক্ষতটা খুঁজে বের করার প্রয়াস পেল ডরোথি, শার্ট ছিড়ে ফেলল।
পালাক্রমে দুটো পিস্তল ব্যবহার করছে এড। অদ্ভুত একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে, কেন যেন অনিশ্চয়তায় ভুগছে হামলাকারীরা। কারণটা কী? স্পেন্সার সাম্রাজ্যের অধিপতি আহত হয়েছে, কিন্তু উল্টোদিকে নিজেদের চারজন লোক খুন হয়েছে, সম্ভবত আরও কয়েকজন আহত হয়েছে। সেজন্যেই লড়াই করার উৎসাহে ভাটা পড়েছে?
বাইরে শ্যেনদৃষ্টি রেখেছে ও। করাল-ট্রাফের পেছনে ক্ষীণ নড়াচড়া চোখে পড়ল। রাইফেল খানিক তুলল, নজর রেখেছে একইসঙ্গে, তারপর সযত্নে নিশানা করল। ফের মাথা তুলল লোকটা, অর্থাৎ নড়াচড়া চোখে পড়া মাত্র ট্রাফের তলার একটু নিচ বরাবর ট্রিগার টেনে দিল এড।
চিৎকার করল লোকটা, একইসঙ্গে পুরোপুরি উঠে দাঁড়াল; তারপর ট্রাফে লুটিয়ে পড়ল লাশটা।
‘বেশ তো, কার শখ আছে এখনও!’ চিৎকার করে আহ্বান করল এড। ‘সাহস থাকলে ধরতে এসো আমাকে! আমাকেই তো চাও, তাই না? দেরি কোরো না। উত্তরের ক্যাম্প থেকে শিগগিরই চলে আসবে ছেলেরা, ওরা এলে আমার মজায় ভাগ বসাবে নির্ঘাত! কই, জলদি এসো!’
ওর কথা বিশ্বাস করবে না কেউ, কিন্তু দ্বিধান্বিত হয়ে পড়বে নিশ্চয়ই। কিছুক্ষণ পরই নিচু স্বরের তর্ক শুনতে পেল এড। মিনিট কয়েকের নীরবতা নেমে এল এবার, এই ফাঁকে সব অস্ত্র রিলোড করে নিয়েছে ও, স্পেন্সারের দুই কোল্ট বা হেনরিটাও বাদ যায়নি। প্রায় মাঝ বিকেল এখন, প্রচণ্ড গরম লাগছে। রাত পর্যন্ত যদি অপেক্ষা করে শত্রুপক্ষ, কপালে সত্যি দুর্ভোগ আছে ওর।
ওর ভাঁওতায় কাজ হতে পারে, হয়তো বিশ্বাস করবে ওরা; কিংবা এও ভাবতে পারে কাছাকাছি অন্য কোন রাইডার গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেয়েছে, সুতরাং সাহায্য নিয়ে আসার জন্যে লাইন-কেবিনে চলে যাবে সে। যেভাবে হোক, বাইরে থেকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকছেই। এমনও হতে পারে, হয়তো দুই লাইন-কেবিন থেকে চলে আসবে দুটো দল। সেক্ষেত্রে দুই দলের মাঝখানে পড়ে কচুকাটা হয়ে যাবে এরা।
পুরো এক ঘণ্টা কেটে গেল, সামান্য শব্দও হলো না কোথাও।
‘এড!’ পেছনে ডরোথির উপস্থিতি টের পেল এড ক্রেমার। ‘একটু হাত লাগাবে? মি. স্পেন্সারকে বিছানায় তুলে নিলে ভাল হত।’
ডরোথির দৃষ্টি এড়িয়ে গেল এড, রাইফেল রেখে উঠে দাঁড়াল। ড্যান স্পেন্সারের বিশাল দেহ তুলতে রীতিমত যুদ্ধ করতে হলো ওদের, বয়ে নিয়ে গিয়ে ঘরে তৈরি চারপেয়ে একটা বিছানায় শুইয়ে দিল র্যাঞ্চারকে। দ্রুত ব্যস্ত হয়ে পড়ল ডরোথি, মনোযোগ দিয়েছে স্পেন্সারের ক্ষতের শুশ্রূষায়। এদিকে জানালার কাছে সরে এল এড।
খাঁচায় বন্দী চিতার মত অনুভূতি হচ্ছে ওর, এক জানালা থেকে আরেক জানালায় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে এড। বাইরে সবকিছু নীরব হয়ে আছে। র্যাঞ্চ ইয়ার্ডের শক্ত মাটির ওপর পড়ে আছে মৃতদের লাশ। দমকা বাতাস উঠল প্রেয়ারিতে, ঘূর্ণি তুলল হাঁটু সমান উঁচু ঘাসের গালিচায়, ছুটে এল র্যাঞ্চ ইয়ার্ডের দিকে, বাতাসে নড়ে উঠল বিল লিয়েস্টের চুল।
মারা গেছে লিয়েস্ট। বুড়োর সঙ্গে প্রথম থেকে ছিল সে। পরিবারের একজনের মত। ব্রুস সীমসও মারা গেছে। আচমকা, কোন কিছুই বুঝতে পারেনি বেচারা। নিজের একটা র্যাঞ্চ হবে কোন একদিন, এই স্বপ্ন কখনোই পূরণ হবে না সীমসের। বেশ, দেখা যাবে, এর মাশুল দিতে হবে ওদের! একজনও ছাড় পাবে না!,
করাল থেকে বেরিয়ে ক্রীকের কাছাকাছি চলে গেছে স্টীল-ডাস্ট স্ট্যালিয়ন। কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রাফের কাছাকাছি পড়ে থাকা এক লোকের দিকে, সতর্ক, ভড়কে যাওয়া যাত্র ছুট লাগাবে। কাছে গিয়ে মানুষটার শরীর শুঁকল, রক্তের গন্ধ পেতে ছিটকে পিছিয়ে এল কয়েক পা, নাকের পাটা ফুলে গেছে ওটার, চোখ বিস্ফারিত।
দৃষ্টিসীমায় নেই কেউ। দৃশ্যত, পালিয়ে গেছে হামলাকারীরা। ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি র্যাঞ্চে প্রবল বাধার সম্মুখীন হবে, কিংবা এড ক্রেমারের উপস্থিতিও প্রত্যাশা করেনি। বুড়ো ড্যান স্পেন্সার এভাবে লড়তে সক্ষম, ধারণার অতীত ছিল তাদের।
স্পেন্সার বাথানে হামলা করতে এলে উচিত শিক্ষা পেতে হয়, ইন্ডিয়ানদের মতই উচিত মূল্য দিয়ে জেনেছে ওরা।
আরও এক ঘণ্টা অপেক্ষা করল এড। ধীরে ধীরে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির ভেতর আপাতত নিরাপদ ওরা। বেরিয়ে যাওয়ার আগে এখানকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মাঝে মধ্যে বেডরূমে গেছে স্পেন্সারের খোঁজ নেয়ার জন্যে, কোন প্রশ্ন করেনি, নিজের চোখে যা দেখার দেখেছে। অজ্ঞান কিংবা অঘোরে ঘুমাচ্ছে সে, পাশে বসে আছে ডরোথি হেডলিন।
ভুলেও মেয়েটির দিকে তাকায়নি এড, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিক্ততা ছড়িয়ে পড়ছে ওর, নির্জলা আসিডের মত ক্রিয়া করছে। ভুলতে পারছে না শান্তির কথা বলতে এখানে এসেছে ডরোথি, এই সুযোগে ল্যামসনের লোকেরা হানা দিয়েছে র্যাঞ্চে। ড্যান স্পেন্সার সম্পর্কে জানে এড, জানে যে সজাগ থাকলে তার অগোচরে এখানে পৌঁছানো কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না।
স্যাম ল্যামসনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এখানে ডরোথির আগমন? পরিস্থিতি অন্তত তাই নির্দেশ করছে, কিন্তু মেয়েটি সম্পর্কে ওর সমস্ত ধারণা সেটাকে ভুল প্রমাণ করতে চাইছে বারবার। তারপরও নিশ্চিত হতে পারছে না, সম্ভাবনাটা উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। এরকম দৈবাৎ যোগাযোগ বড় অস্বাভাবিক!
সবচেয়ে বড় কথা, বিকল্প চিন্তা করবে কেন? স্যাম ল্যামসনের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি মেয়েটা? সাই ডানান কি ওর অপেক্ষায় হেডলিনদের বাড়িতে ওত পেতে ছিল না? হয়তো আগুনে কাঠ যোগ করে ওকে সতর্ক করতে চেয়েছিল মেয়েটা, কিংবা স্রেফ কাকতালীয়ও হতে পারে ব্যাপারটা। আসল কথা হচ্ছে, মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে যেয়ে নিখুঁত একটা ফাঁদে পা রেখেছিল ও, আরেকটু হলে ওকে নিকেশ করে ফেলেছিল সাই ড্যানান। আর একটু আগে, ড্যান স্পেন্সারের সঙ্গে যখন শান্তি ও সহযোগিতার কথা বলছিল ডরোথি, রেইড করেছে স্যাম ল্যামসনের লোকজন। স্রেফ সৌভাগ্যের কারণেই মারা যায়নি ওরা দু’জন, সেজন্যে দোষ দেয়া যায় না ডরোথিকে।
এড জানে মাঝে মধ্যে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা, একবার কিছু বলতে মুখ খুলেছিল, কিন্তু তখনই ঘুরে দাঁড়িয়ে ডরোথিকে এড়িয়ে গেছে ও।
জানালার কাছাকাছি ঝুঁকে বসেছে ও, বাইরে চোখ রেখেছে। হঠাৎ খুরের দূরাগত শব্দ শুনতে পেল। উঠে দাঁড়িয়ে প্রেয়ারি ধরে তাকাল। হ্যারি রাউডি। একটা বাকস্কিনে চেপেছে কাউবয়। ইয়ার্ডে ঢুকেই ভড়কে গেল ঘোড়াটা, লিয়েস্টের মৃতদেহ দেখতে পেয়েছে।
স্যাডল ছেড়ে দ্রুত বাড়ির দিকে এগিয়ে এল রাউডি।
‘লাইন-কেবিনে সবকিছু ঠিক আছে তো?’ দ্রুত জানতে চাইল এড।
‘একই প্রশ্ন তো আমারও! বিস্ফোরিত হলো রাউডি। ‘কী হয়েছে বলো তো?’
‘আক্রমণ করেছে ওরা। রান্নাঘর থেকে পাল্টা গুলি করেছে ডেভ। আমি আর স্পেন্সার ছিলাম এখানে। আহত হয়েছে ও, আঘাতটা মারাত্মক। লিয়েস্ট এবং সীমসের লাশ তো নিজের চোখে দেখলে।
‘মিনিট কয়েক আগে উপত্যকার আড়াআড়ি পপলারের দিকে ছুটতে দেখেছি ওদের। ছেলেরা সবাই অস্থির হয়ে আছে, এড। ঝামেলাটা চুকিয়ে ফেলতে চায়। এখানে বসে আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে পপলারে গিয়ে ওদের চেপে ধরলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়!’
‘আমারও সহ্য হচ্ছে না আর!’ ত্যক্ত স্বরে বলল এড। ‘হ্যাঁ, যাচ্ছি আমরা। শহরটা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে তবে ফিরব।’
‘ওহ্, না! শহরে গিয়ে নির্বিচারে খুন করতে পারো না তোমরা!’ পেছনে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে ডরোথি। ‘প্লীজ, এড! এমন একটা জঘন্য কাজ করতে পারো না তুমি! সেটলারদের কেউই এখন লড়াই করতে ইচ্ছুক নয়। র্যাঞ্চে যারা আক্রমণ করেছে, সবাই ওরা ল্যামসনের লোক।
‘হয়তো, কিন্তু সেটলারদের উৎসাহে ভাটা পড়ার কোন নমুনা চোখে পড়েনি আমার। দলে অন্তত বারোজন লোক ছিল। এত লোক কোথায় পেল ল্যামসন? বারোজন আমারও চোখে পড়েনি কখনও। ড্যানান মারা গেছে, টেবারও নেই। তাহলে কোত্থেকে এল এত লোক?’
ঘুরে রাউডির দিকে ফিরল ও। ‘কিছু খাবার নিয়ে লাইন-কেবিনে ফিরে যাও, হ্যারি। আমিও আসছি, দেরি হবে না পৌঁছতে। সবাই মিলে উপত্যকা পেরিয়ে পপলারে যাব। যদি সেটলারদের মুখোমুখি হয়ে পড়ি, যা চায় তাই পাবে ওরা-লিয়েস্ট আর সীমসের মতই পরিণতি হবে ওদের! যথেষ্ট ছাড় দিয়েছি, আর নয়!’ ঘুরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল ও।
ফ্যাকাসে মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল ডরোথি। ‘তাহলে আমাকে বিশ্বাস করছ না?’ প্রতিবাদ করল ও। ‘পপলারে গিয়ে নিরীহ লোকজনকে খুন করবে তুমি?’
‘লিয়েস্ট আর সীমস খুন হলো কী কারণে, বলতে পারবে? কী দোষ ছিল ওদের?’ তীক্ষ্ণ স্বরে জানতে চাইল এড। পপলারবাসীর কোন্ ক্ষতি করেছে ওরা? বলছিলে নিরীহ লোকজন রয়েছে পপলারে। আমি অন্তত কথাটা বিশ্বাস করি না। সময় থাকতে বহুবার সতর্ক করেছি তোমাদের, বলেছি কী পরিণতি হতে পারে; কিন্তু আমার কথা কানে তোলোনি কেউ। তো, হামলা করতে এখান পর্যন্ত এসেছে ওরা। দু’জন নির্দোষ মানুষকে খুন করেছে। খুনের দায় তো ওদের নিতেই হবে। মাশুলও দিতে হবে।
‘চেষ্টা কম করিনি আমি। ছেলেদের সঙ্গে গায়ের জোরে তর্ক করেছি, শান্ত রেখেছি ওদের। স্পেন্সারের সঙ্গে তর্ক করেছি যাতে সেটলারদের একটা সুযোগ দেয়। কিন্তু কী হলো শেষে? সুযোগটা ঠিকই লুফে নিয়েছে ওরা, তবে হামলা করার সুযোগ। বারোজন লোক হামলা করেছিল আজ। অন্তত বারোজন! কয়েকজন মারা গেছে বটে, কিন্তু আমার মত তুমিও জানো ল্যামসনের এত লোক নেই, স্বর্গ থেকেও আসেনি কেউ। বড়জোর হয়তো আটজন হবে ওর নিজস্ব লোকজন। এখানে এসে তাজা দুটো প্ৰাণ কেড়ে নিয়েছে ওরা, স্পেন্সারকে আহত করেছে। ওই লোকটা আমার কাছে বাবার মত। অনেক বাবার চেয়েও বেশি সদয় সে আমার প্রতি। আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, শিক্ষক, গাইড—যাই বলো। যা কিছু আমি শিখেছি, তা ওর কাছ থেকে। ধুঁকে ধুঁকে মারা যেতে পারে সে। যদি সত্যিই মারা যায় স্পেন্সার, তাহলে দোষটা আমার ঘাড়ে পড়বে, কারণ ঝামেলাবাজ সেটলাররা এখান পর্যন্ত আসার সুযোগ আমার দুর্বলতার কারণেই পেয়েছে।’
প্রবল হতাশায় আড়ষ্ট হয়ে গেছে ডরোথির শরীর। ‘প্লীজ, এড!’ অনুনয় ঝরে পড়ল ওর কণ্ঠে। ‘এমন একটা কাজ করতে পারো না তুমি! তোমার ক্রুদের বেশিরভাগই সেটলারদের চেনে না, লড়াই করুক বা না- করুক মারা পড়বে ওরা। ওদের বাড়ি পুড়িয়ে দেবে, শহরটা ধ্বংস হয়ে যাবে।’
‘ওরা যদি লড়াই না করে, তাহলে কাউকে গুলি করব না আমরা,’ সোজাসাপ্টা সুরে বলে গেল এড। ‘ল্যামসন যদি আবার আক্রমণ করে, হয়তো সবাই শেষ হয়ে যাব আমরা। যাকগে, সেটলারদের সম্পর্কে একটা কথা না বললেই নয়, অন্তত আমার কাছে মনে হয়েছে ল্যামসনের কোটের ঝুল ধরে থেকে নগদ যা পায়, তাই লুফে নেয়ার পক্ষপাতী ওরা।’
‘সত্যি নয় এটা!’ তপ্ত স্বরে প্রতিবাদ করল ডরোথি। ‘যেটা করা উচিত তাই করতে চেয়েছে ওরা। স্যাম ল্যামসনকে সৎ ও উদার মনে করত, তাই একসময় ওর কথা বিশ্বাসও করেছে। কিন্তু এখন অনেকের ধারণাই পাল্টে গেছে।’
বাকস্কিন কোট গায়ে চাপিয়ে হ্যাট তুলে নিল এড। থমথমে দেখাচ্ছে ওর মুখ, চোয়ালের পেশী আড়ষ্ট। সযত্নে ডরোথিকে এড়িয়ে যাচ্ছে, জানে চোখাচোখি হওয়া মাত্র দুর্বল হয়ে পড়বে ওর মন। মনে মনে কিছুটা হলেও আফসোস করছে, অনেক আগেই অস্ত্র তুলে নিলে হয়তো অমূল্য কয়েকটা প্রাণ ঝরে পড়ত না। লিয়েস্ট বা সীমস যেমন বেঁচে থাকত, তেমনি ডেভ মুরের মত নিরীহ সেটলারকেও মৃত্যুবরণ করতে হত না।
রেখে যাওয়া রাইফেল তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোল ও।
‘এড,’ পেছন থেকে বলল ডরোথি। ‘তুমি যদি পপলারে যাও, তবে আমিও যাব। তোমার দলের কোন লোক সেটলারদের বাড়িতে হাত রাখা মাত্র আমি নিজে গুলি করব তাকে।’
প্রথমবারের মত, মেয়েটির দিকে তাকাল এড, বেদনা আর রাগে জ্বলতে দেখতে পেল ডরোথির আয়ত চোখজোড়া। ‘যাও তাহলে!’ কর্কশ স্বরে বলল ও। ‘কিন্তু ঘটে যদি সামান্য বুদ্ধি থাকে, তাহলে বন্ধুদের নিয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেবে তুমি। যাও! কিছু সময় দেব তোমাকে। চাইলে ল্যামসনকে সতর্কও করে দিতে পারো। কিন্তু সেটলারদের যদি রক্ষা করতে চাও, তাহলে পপলার থেকে বের করে আনো ওদের। সবকিছু চুকে যাওয়া পর্যন্ত পাহাড়ে থেকে যেয়ো… আমরা যখন শহরে ঢুকব, একজনও যেন না থাকে ওখানে!’
বেরিয়ে গেল এড। তাকে করালে যেতে দেখতে পেল ডরোথি, ল্যাসো নিয়ে স্টীল-ডাস্টে স্যাডল চাপাবে। এক ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল ও, তারপর কালো মেয়ারে চেপে বসল। বাড়ির কোণের রেইলে বাঁধা ছিল ঘোড়াটা। স্পার দাবিয়ে সর্বোচ্চ গতি তুলল ডরোথি, ব্যক্তিগত বেদনা আর হতাশা ছাপিয়ে উঠেছে শঙ্কা, উদ্বেগ এবং সংশয়। সময়মত পৌঁছতে পারবে তো?
উপত্যকা ধরে তুফান বেগে ছুটল মেয়ার।
চোখ তুলল না এড ক্রেমার, কিংবা ঘাড় ফিরিয়েও তাকাল না, কিন্তু মনে ঝড় বইছে ওর-মেয়ারের খুরের শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়েছে ওর হৃৎপিণ্ড-হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে যেন, ক্রমাগত বেড়েই চলেছে; তারপর খুরের শব্দ মিলিয়ে যেতে ওর অস্থিরতাও কমে এল।
গ্রের পিঠে স্যাডল চাপাল ও, হ্যারি রাউডি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে স্যাডলে চেপে তার দিকে ঘুরল। ‘ডেভ!’ কৃকের উদ্দেশে চিৎকার করল ও। স্পেন্সারের দিকে খেয়াল রেখো। ফিরতে দেরি হবে না আমাদের।’
ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে দক্ষিণে ছোটাল ও। পাশাপাশি আসছে রাউডি, মাঝে মধ্যে আড়চোখে দেখছে এডকে। শেষপর্যন্ত, অধৈর্য কণ্ঠে বলে উঠল: ‘এড, ঠিকই বলেছে মেয়েটা। আমার কোন সন্দেহ নেই।’
‘কী বললে?’ না তাকিয়েই সাড়া দিল এড। ‘হবে হয়তো। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে রাজি নই!’
আট
নিঃসঙ্গ গম্ভীর প্রকৃতির লোক মার্টি থ্যাচার। সকালে, স্পেন্সার বাথানে হামলা করতে যাওয়ার আগেই ডেভ মুরের রহস্যময় মৃত্যু সম্পর্কে ওকে বলেছে লিও কারভার, বুলেটের ক্ষত আর সম্ভাব্য খুনী সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছে।
ব্যাপারটা নিয়ে দুশ্চিন্তা এবং অস্বস্তিতে ভুগছে সে। স্যাম ল্যামসনের সঙ্গে হামলায় যোগ দিয়েছে বটে, কিন্তু লিও কারভারের কথাগুলো ভুলতে পারছে না। আক্রমণের সময় মনটা অন্য কোথাও পড়ে ছিল, উৎসাহ বোধ করেনি তেমন, স্রেফ কয়েক রাউন্ড গুলি খরচ করেছে। সত্যি কথা বলতে কি, সে আর জনি গ্যারেটই সবার আগে পিঠটান দিয়েছে। স্যাম ল্যামসনের ওপর আস্থা আগের মত নেই এখন। ওরা হামলা করেছে অপরিকল্পিত ভাবে এবং বড্ড তাড়াহুড়োর মধ্যে। নিজেকে নেতৃত্ব দেয়ার মত যোগ্য লোক মনে করে না থ্যাচার, কিন্তু মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে সে নিজে স্যাম ল্যামসনের জায়গায় থাকলে এরচেয়ে ভাল করত।
মনটা বিষিয়ে ওঠার আরেক কারণ লড়াইয়ের ফলাফল। প্রচুর লোক মারা গেছে। অতিরিক্ত। মানুষটা সে একগুঁয়ে প্রকৃতির, কোন জিনিস একবার বিশ্বাস করলে সেটা থেকে টলানো কঠিন। লিও কারভারের কাছ থেকে ডেভ মুরের মৃত্যুর কারণ জানার পর থেকে ভুলতেই পারছে না ব্যাপারটা। সন্দেহটা নিরসন করা সম্ভব। উচিতও। থ্যাচার জানে সেদিন ডেভ মুরের পেছনে ছিল স্যাম ল্যামসন। চিন্তাটা ত্যক্ত করছে ওকে, দুর্বল নেতৃত্বের কারণে ল্যামসনের প্রতি ওর বিশ্বস্ততা এমনিতে কমে গেছে; আর এখন লোকটার প্রতি রীতিমত অসন্তোষ বোধ করছে।
স্পেন্সার ভ্যালি থেকে পপলারে ফিরতি পথে তেমন কোন কথাই হলো না। বোধহয় কেউই ভুলতে পারছে না পেছনে কয়েকটা লাশ ফেলে এসেছে। বন্ধুর লাশ। বিক্ষুব্ধ মনে এগিয়ে চলেছে ওরা। গাম্ভীর্যে ভরা মুখ প্রত্যেকের, ভেতরে ভেতরে রাগ আর অসন্তোষে পুড়ছে। আকস্মিক হামলা করেও কাজের কাজ কিছু হয়নি, ড্যান স্পেন্সার এবং এড ক্রেমারের গুলির তোপে সুবিধে করতে পারেনি ওরা। ছয়টা লাশ ফেলে এসেছে পেছনে। হয়তো দু’জনকে খুন করতে সক্ষম হয়েছে ওরা, কিন্তু কোন ভাবেই ক্ষতিটা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। ড্যান স্পেন্সার আহত হয়েছে বটে, তবে জখম কতটা গুরুতর দলের কেউই জানে না।
হিউ টেলরও যোগ দিয়েছিল দলে। খুনোখুনির ব্যাপারে কখনোই আগ্রহ বোধ করে না সে, আজকের লড়াইয়ে তাই তেমন উৎসাহ বোধ করেনি। আকর্ষণটা আরও কমে গেছে এখন। আচমকা তিক্ত মনে উপলব্ধি করল জীবনে আর কখনও স্যাম ল্যামসনের সঙ্গে দেখা হলো বা না-হলো এ নিয়ে বিন্দুমাত্র পরোয়া করে না সে।
‘এবার পাল্টা হামলা করতে আসবে ওরা, নিকট ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করল হিউ টেলর।
‘চুপ করো!’ ক্ষোভ আর তিক্ততায় ফেটে পড়ল জনি গ্যারেট সেটলারদের মধ্যে একমাত্র সে-ই মনে-প্রাণে সমর্থন করে স্যাম ল্যামসনকে, কিন্তু অভিজ্ঞতাটা সুখকর মনে হচ্ছে না অন্তত এখন। নিজের বোকামির জন্যে অনুতাপ হচ্ছে। পরাজয় আর সংশয় ল্যামসন বাহিনীর মনোবলে চিড় ধরাচ্ছে। ‘বাড়ির ভেতরে কিছু দেখতে পেয়েছ? তোমরা চোখ বুজে থাকলে কী হবে, আমি ঠিকই দেখেছি। হেডলিনের মেয়েটা ছিল। ও নিজে স্পেন্সারের দেহ টেনে নিয়ে গেছে ভেতরে। নিজের চোখে দেখেছি আমি!’
ঝট করে ফিরে তাকাল ল্যামসন। ‘মিথ্যে বলছ তুমি!’
ল্যামসনের চোখে চোখ রাখল গ্যারেট। ‘স্যাম,’ সোজাসাপ্টা, অবিচল স্বরে জানতে চাইল: ‘মিথ্যুক বলছ আমাকে? আবার বলো কথাটা!’
শ্রাগ করল ল্যামসন। ঠিক আছে, হয়তো সত্যিই ডরোথি ছিল ওখানে। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাস করতে আপত্তি আছে আমার। কীভাবে আমাদের আগে স্পেন্সার বাথানে পৌছল ও?’
‘ক্রেমারই বা আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে কীভাবে গেল?’ ক্ষুব্ধ স্বরে পাল্টা জানতে চাইল গ্যারেট। ‘অথচ পাহাড়ে হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল ওর!’
‘নিশ্চয়ই পাহাড় টপকে গেছে,’ বাতলে দিল রজিটার। ল্যামসনের নিজস্ব ক্রুদের একজন। ‘যেভাবেই হোক একটা পথ খুঁজে পেয়েছিল বোধহয়।
‘দূর!’ থুথু ফেলল স্যাম ল্যামসন। ‘এমন ঝড়বৃষ্টির মধ্যে, তাও রাতের বেলা, কারও পক্ষে ওই পাহাড় পাড়ি দেয়া সম্ভব নয়। পাগল না হলে কেউ চেষ্টাও করবে না।
‘কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ঠিকই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে ক্রেমার, গম্ভীর স্বরে বলল মার্টি থ্যাচার। ‘আমি খুব ভাল করেই জানি কাল রাতে ক্যানিয়নের ধারে-কাছেও যায়নি সে। সুতরাং পাহাড়ই পাড়ি দিয়েছে ও। কেউ যদি পারে, তো সেই লোক হচ্ছে এড ক্রেমার।’
কঠিন চাহনিতে থ্যাচারকে বিদ্ধ করল ল্যামসন। ‘মনে হচ্ছে ওর ব্যাপারে প্রচুর চিন্তা-ভাবনা করছ ইদানীং?’ স্পষ্ট তাচ্ছিল্য প্রকাশ করল সে।
‘আমি ওকে ঘৃণা করি,’ কর্কশ স্বরে জবাব দিল থ্যাচার। ‘ওর চেহারা দেখতেও ঘেন্না লাগে আমার, কিন্তু স্বীকার করতে দোষ নেই যে এমন আত্মবিশ্বাসী, ধীর-স্থির লোক সারা জীবনেও দেখিনি।’
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ল্যামসন, চাহনিতে অসন্তোষ আর স্পষ্ট বিদ্বেষ। এগিয়ে চলেছে থ্যাচার, কিছুই দেখতে পায়নি, কিংবা ভ্রূক্ষেপ করছে না।
পপলারে পৌঁছে নিজের কেবিনে গেল না মাটি থ্যাচার। যে-কোন ব্যাপারে অন্ধকারে থাকা পছন্দ করে না সে। ওর একটা যোগ্যতা-বিশ্বস্ততা, যেটা ওর সাহসের চেয়েও বেশি। লিও কারভারের গল্প এখনও খুঁচিয়ে চলেছে ওর মন। সত্যিই কি ল্যামসনের কাছে হালকা কোন পিস্তল আছে?
আচমকা মনে পড়ল ওর। হ্যাঁ, আছে! পপলারে আসার পরের ঘটনা এটা, পিস্তলটা দেখেছিল স্যাম ল্যামসনের কাছে। পয়েন্ট থ্রি-ফোর প্যাটার্সন, বিছানার পাশে রেখেছিল ল্যামসন, কী একটা বিষয়ে আলাপ করতে গিয়ে দেখেছে থ্যাচার।
সেলুনে ঢুকল সে। ল্যামসন নেই এখানে, কোথাও গেছে বোধহয় ফাঁকা সেলুন। ভেতরে ঢুকে চারপাশে তাকাল থ্যাচার, তারপর ল্যামসনের কোয়ার্টারে চলে এল। পরিচ্ছন্ন গোছানো কামরা, সবকিছু পরিপাটি সাজিয়ে রাখা। চারপাশে নজর চালিয়ে নিশ্চিন্ত হলো সে, কামরার ওপাশে একটা কাঠের বাক্সের কাছে চলে এল। তালা নেই। ঢাকনা তুলে ভেতরে উঁকি দিল থ্যাচার। প্রথমেই গানবেল্টে সাজানো পয়েন্ট থ্রি-ফোর কার্তুজ চোখে পড়ল, কার্তুজের প্রতিটির নাক কাটা!
একটা কার্তুজ তুলে নিয়ে পিছিয়ে এল সে। গম্ভীর মুখে দরজার দিকে এগোল। দু’পা এগোতেই স্যাম ল্যামসনকে দেখতে পেল সেলুনের পোর্চে।
সন্দেহ খেলা করছে ল্যামসনের চোখে। ‘এখানে কী করছ তুমি?’
‘হুলো বেড়ালের পায়ের ছাপ খুঁজছিলাম,’ কৌতুকের স্বরে বলল থ্যাচার। ‘পেয়েও গেছি!’ পকেট থেকে কার্তুজটা বের করে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেলল সে।
দারুণ একটা ভুল করেছে থ্যাচার, জীবনের শেষ ভুল। ডান হাতে কার্তুজ বের করতে যাওয়ায় হাতটা সাময়িক ভাবে অকেজো হয়ে গেছে তার, পিস্তলের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।
মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা। বিদ্যুৎ গতিতে স্যাম ল্যামসনের হাতে পিস্তল উঠে এল, তুলনায় অনেক অনেক শ্লথ মনে হলো থ্যাচারকে। একেবারে শেষ মুহূর্তে বিপদ টের পেয়ে ড্র করেছে সে। বুলেটটা যখন তার বুকে বিধল, তখন সবে পিস্তলের বাঁটে হাত রেখেছে হতভাগ্য থ্যাচার। গুলির ধাক্কায় পিছিয়ে গেল সে, টলমল কয়েক পা ফেলল, ঘৃণায় জ্বলে উঠল চোখজোড়া; তারপর মুখ থুবড়ে পড়ল শক্ত মেঝেয়।
হাল ছাড়ল না মানুষটা। পিস্তলের দিকে হাত বাড়িয়েছে, কষ্টেসৃষ্টে বের করে আনল। ফের গুলি করল স্যাম ল্যামসন। স্থির হয়ে গেল মার্টি থ্যাচারের দেহ।
দীর্ঘদেহী থ্যাচারের লাশের দিকে তাকিয়ে নিকট ভবিষ্যৎ আঁচ করতে অসুবিধে হলো না স্যাম ল্যামসনের। খতম হয়ে গেছে পপলারের ব্যবসা! এভাবেই কি শেষ হয়ে যাবে সবকিছু? স্বপ্ন আর উচ্চাশার এত করুণ ও দুঃখজনক সমাপ্তি-কোন প্রাপ্তি ছাড়াই? পশ্চিমে বিশাল এক র্যাঞ্চের মালিক হবে সে, একচ্ছত্র অধিপতি হবে একটা সাম্রাজ্যের-মিথ্যে আশাই করেছিল এতদিন?
মার্টি থ্যাচারের প্রতি বিতৃষ্ণা আর অবজ্ঞা বোধ করছে ল্যামসন। কী ভীমরতিতে পেয়েছিল লোকটাকে? অথচ মার্টির কারণেই সেটলারদের নিজের পক্ষে টানতে সক্ষম হয়েছিল। ভেড়ার পালের মত দখলদারি করেছে সে, কিন্তু এখন নিজেরই টিকে থাকা কঠিন হবে। হয়তো ঘণ্টাখানেক বা মিনিট কয়েকের ব্যাপার। নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, দলবল নিয়ে চলে আসবে এড ক্রেমার। ধ্বংস হয়ে যাবে পপলার। কিচ্ছু বাকি থাকবে না এখানে!
ঘোড়ার খুরের শব্দে সংবিৎ ফিরে পেল ল্যামসন। দরজার কাছে এসে বাইরে চোখ রাখল, ডরোথি হেডলিনকে তুফান বেগে ছুটে আসতে দেখতে পেল।
উঁহুঁ, সব হিসেব চুকে যায়নি। কিছু দেনা-পাওনা রয়ে গেছে। সব গেলেও ডরোথি তো আছে! এড ক্রেমারের কাঙ্ক্ষিত নারী। সান্ত্বনার একটা বিষয় বটে ওর জন্যে! অন্তত ডরোথিকে যাতে না পায় ক্রেমার, সেই ব্যবস্থা করবে সে।
দ্রুত পায়ে নিজের কোয়ার্টারে ঢুকল সে, খুঁটিনাটি কয়েকটা জিনিস প্যাক করল। তারপর বেরিয়ে এসে বার্নে চলে এল। তাজা একটা ঘোড়ায় স্যাডল চাপাল, যতটা সম্ভব বার্নের দেয়ালের আড়ালে থাকছে। জিনিসপত্র গুছিয়ে স্যাডলে চাপল ও, শেষে ক্যানিয়নের ঢালে তৈরি হেডলিনদের বাড়ির দিকে এগোল।
হিউ টেলর যেতে দেখল ওকে, জানে না কী ঘটছে। গ্যাভিনদের বাড়ি থেকে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেয়েছে লিও কারভার, দ্রুত পায়ে ভেতরের কামরায় চলে গেল নিজের অস্ত্র নেয়ার জন্যে। ল্যামসনকে হেডলিনদের বাড়ির সামনে থামতে দেখতে পেল সে, স্যাডলে বিভিন্ন রসদপত্র খেয়াল করেনি। ল্যামসনকে নামতে দেখে একটুও বিস্মিত হলো না।
আসার পথে পিট ল্যাস্কারের সঙ্গে দেখা হয়েছে ডরোথির, সংক্ষেপে জানিয়ে দিয়েছে এখনই বাড়ি ছেড়ে পাহাড়ের দিকে সরে পড়া উচিত সবার। শুনেই গ্যাভিনদের বাড়ির উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করেছে ল্যাস্কার, প্রায় দৌড়াচ্ছে। বাবার খোঁজে বাড়িতে ঢুকল ডরোথি, কিন্তু তাকে মাঠে দেখতে পেল। একটা মুহূর্তও নষ্ট করা যাবে না। ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল ও, অপেক্ষমাণ ঘোড়ার স্যাডলে চাপতে পোর্চের গোড়ায় দেখতে পেল স্যাম ল্যামসনকে। বিড়বিড় করে ঘোড়ার উদ্দেশে কথা বলছে ডরোথি, টেরই পেল না ওর যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ল্যামসন।
‘ডরোথি!’ বলল সে। ‘এক্কেবারে মোক্ষম সময়ে এসেছ তুমি!’
থমকে গেল ডরোথি। ‘মানে?’ শীতল স্বরে জানতে চাইল ও।
দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল ল্যামসন, উত্তেজিত দেখাচ্ছে। এখান থেকে চলে যাচ্ছি আমরা! এখনই যাত্রা করব। শুধু তুমি আর আমি! স্পেন্সারের লোকজন চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে, শহর বা বসতির নমুনাও রাখবে না ওরা! নিরাপদে সরে পড়ার সময় এখনও আছে আমাদের হাতে।’
‘বাবার কাছে যাচ্ছি আমি। বাবাকে নিয়ে পাহাড়ে চলে যাব।’
‘অত সময় পাবে না। যাকগে, টেড নিজেই চলে যেতে পারবে। তুমি আমার সঙ্গে এসো!’ উত্তেজিত এবং মরিয়া হয়ে উঠেছে ল্যামসন, ডরোথির চোখে বিপদ টের পাওয়ার অস্বস্তি দেখতে পেল না।
‘কোথায় যাব?’ জানতে চাইল ডরোথি।
অধৈর্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকল সে। ‘আসল কথা হচ্ছে এখানে থাকছি না আমরা! যে-কোন জায়গায় সরে পড়তে পারলেই হলো! অন্তত কিছু সময়ের জন্যে। পরে না হয় একসঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যাব, তারপর…’
‘একটু তাড়াহুড়ো আর বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?’ হাত বাড়িয়ে ব্রিডল চেপে ধরল ডরোথি। ‘স্যাম, তোমার সঙ্গে কোথাও যাচ্ছি না আমি-কোথাও না!’
বেকুব বনে গেছে ল্যামসন। অবিশ্বাস এবং অধৈর্য অসহায়ত্ব নিয়ে তাকিয়ে থাকল। ‘বোকার মত কথা বোলো না!’ শেষে ধমকে উঠল সে। ‘এখানে কী আছে তোমার? আমাকে প্রতিশ্রুতি দাওনি? বিয়ে চাও তুমি, এই তো? অসুবিধে নেই। ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে বিয়ে সেরে ফেলব আমরা।’
‘হ্যাঁ, স্বীকার করছি, বিয়ে চাই আমি, কিন্তু তোমার সঙ্গে নয়, স্যাম। কখনোই এমন কোন ইচ্ছে হয়নি আমার। কিছুদিন অন্য সবার মতই বোকা আর হুজুগে ছিলাম, তোমাকে বিশ্বাস করেছি। তারপর তোমার সঙ্গীদের দেখে টনক নড়ল, দেখলাম নিজের স্বার্থে আমাদের এখানে নিয়ে এসেছ তুমি। না, স্যাম। তোমাকে বিয়ে করছি না আমি, এবং তোমার সঙ্গে কোথাও যাবও না।’ অবজ্ঞা অনুভব করছে ডরোথি, সেটা চেপে রাখার কোন চেষ্টাই করল না। তুমি যদি ভয় পেয়ে থাকো, তাহলে সময় থাকতে রওনা দাও, হয়তো এড়িয়ে যেতে পারবে ওদের। আমি বাবার কাছে যাচ্ছি।’
আচমকা শান্ত, দারুণ শান্ত হয়ে গেল স্যাম ল্যামসন। বিপজ্জনক রকমের শান্ত। স্থির চাহনিতে ডরোথিকে বিদ্ধ করল। ‘অ, তাহলে এড ক্রেমারকে বিয়ে করতে চাও তুমি? আমার কাছে কিন্তু কখনোই মনে হয়নি অশিক্ষিত ওই কাউহ্যান্ডকে সিরিয়াসলি নিয়েছ। কিংবা,’ পাল্টা অবজ্ঞা ছুঁড়ে মারল সে এবার। ‘হয়তো এভাবেই স্পেন্সার ভ্যালি দখল করতে চাইছ তুমি!’
‘দূর হও! এখনই দূর হও আমার সামনে থেকে! বাবা আর গ্যাভিন চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। তুমি যা বলেছ, ওরা যদি জানতে পারে, নির্ঘাত তোমাকে খুন করবে ওরা।
‘খুন করবে, আমাকে? ওই পুঁচকে লোক দুটো? কলজে বলতে কিছু আছে নাকি ওদের? খরখরে স্বরে হেসে উঠল সে, আড়ষ্ট হয়ে গেছে মুখ। ‘বেশ। যাচ্ছি আমি, কিন্তু তুমিও আমার সঙ্গে আসছ!’
এত দ্রুত সক্রিয় হলো ল্যামসন, কী থেকে কী হলো বুঝতেই পারল না ডরোথি, কিংবা বাধা দেয়ার বা নিজেকে রক্ষা করার সুযোগই পেল না। আচমকা দু’পা এগিয়ে এল সে, ল্যামসনের হাত উঠে যেতে দেখতে পেল কেবল। মারের তীব্রতার চেয়ে বিস্ময়টাই বেশি মনে হলো ডরোথির কাছে। চোখে একরাশ শর্ষে ফুল দেখতে পেল ও, একটু পর টের পেল স্যাডলে আড়াআড়ি ভাবে ফেলে ওকে বাঁধছে ল্যামসন। বাঁধন থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করল ও, কিন্তু যথেষ্ট মজবুত বাঁধন; এদিকে তুফান বেগে ছুটছে ঘোড়াটা।
পিট ল্যাস্কারের ডাকে ফসলের জমি ছেড়ে বাড়ির দিকে এগোল টেড হেডলিন। ক্যানিয়নের কিনারে খোলা উপত্যকার একেবারে শেষের দিকে, স্পেন্সার রাইডারদের দেখে ছুটতে শুরু করল সে। টেবিলে রাখা রাইফেল তুলে
নিয়ে ডরোথিকে ডাকল। ঠাণ্ডা মাথায় চারপাশে দৃষ্টি চালাল হেডলিন, চোখে পড়ল শুধু ডরোথিই নয়, বরং ওর কালো মেয়ারটাও উধাও হয়ে গেছে।
বাড়িতে নেই যখন, শহর থেকে দূরে আছে, এটাই হচ্ছে স্বস্তির বিষয়, ভাবল হেডলিন। পিট ল্যাস্কারের সঙ্গে দৌড়ে জমিতে চলে এল সে, ওখানেই মিলিত হলো গ্যাভিনদের সঙ্গে স্ত্রী আর মেয়ে ছাড়াও লিও কারভার রয়েছে প্যাট গ্যাভিনের সঙ্গে।
অন্যরাও আসছে। পালাচ্ছে সবাই। পাল্টা হামলা করার বা প্রতিরোধ করার সময় নেই এখন, কিংবা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও সরিয়ে নেয়ার উপায় নেই। যার হাতে যা আছে, তাই নিয়ে সরে পড়তে হচ্ছে। হিউ টেলরও বউকে সঙ্গে নিয়ে যোগ দিয়েছে ওদের সাথে। বিষণ্ণ, পরাজিত দেখাচ্ছে তাকে। ওলসেন এবং গ্রীনও পিছু নিয়ে আসছে।
সবাই মিলে পপলার সারির দিকে এগোল ওরা, আপাতত পাহাড়ে আশ্রয় নেবে।
সেটলারদের মধ্যে কেবল জনি গ্যারেটই রয়ে গেছে। সে জানে না যে স্যাম ল্যামসন পালিয়ে গেছে। নিজের স্টোরে রয়েছে ড্যান হয়েট, যাই ঘটুক দেখে যাওয়ার পক্ষপাতী সে। ল্যামসনের সঙ্গে আগেও কাজ করেছে, জানে শেষপর্যন্ত কোন না কোন ভাবে ঠিক সামলে নেবে ধুরন্ধর লোকটা।
প্রায় সবই শেষ হয়ে গেছে। স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা বাকি। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে শহরের দীর্ঘ দালানগুলোর দিকে তাকাল গ্যারেট। ক্যালিফোর্নিয়ার কোন খনিতে গেলে হয়তো ভাগ্য ফিরে যেত, মানতে নারাজ সে। প্রতিদিন বেগার খেটে ভাগ্যের পরিবর্তনে বিশ্বাস বা আস্থা নেই তার। মার্টি থ্যাচার সৎ কিন্তু অপরিণামদর্শী, সহজে প্রভাবিত হয়। গ্যারেটও সেরকম। সেটলারদের নিয়ে স্যাম ল্যামসনের পরিকল্পনায় অসৎ উদ্দেশ্য ঠিকই টের পেয়েছে সে, কিন্তু গ্রাহ্য করেনি।
নিজের ওপর আস্থা আছে ওর, নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে গ্যারেট। যতক্ষণ পর্যন্ত লাভের সম্ভাবনা রয়েছে, যত বিপদই থাকুক, থাকতে আপত্তি নেই ওর; কিন্তু ভাগ্য ফিরে গেলে সঙ্গে সঙ্গে গা-ঢাকা দিতে অভ্যস্ত। স্যাম ল্যামসনের পরিকল্পনার মধ্যে নিজস্ব লাভ দেখতে অসুবিধে হয়নি ওর, বিশাল ওই উপত্যকার মালিকানা পাওয়ার মানে সে জানে।
সবই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে এখন। থ্যাচারের সঙ্গে সম্পর্কটা ভালই ছিল ওর, একসঙ্গে কাজ করেছে; কিন্তু থ্যাচারের মৃত্যুতে কোন আফসোস বা দুঃখ বোধ করছে না। বহু আগেই আঁচ করতে পেরেছে কোন একদিন ওকে খুন করার চেষ্টা করবে ল্যামসন। সমস্ত সেটলারদের মধ্যে কেবল গ্যারেটই ল্যামসনের ধাত চিনে নিতে সক্ষম হয়েছিল, সম্ভবত দু’জনে একই মানসিকতার লোক বলেই।
সবকিছুর পরও, একটা ব্যাপার অগ্রাহ্য করার নয়। জনি গ্যারেট মূলত বিদ্বেষী মানুষ। বিদ্বেষ, ঘৃণা বা অসন্তোষ পুষে রাখা ধাতে নেই তার। ল্যামসন কাউকে ঘৃণা করলে তার বিরুদ্ধে লড়াই করবে, পরিকল্পনা করবে, অপেক্ষা করবে এবং একটা র্যাটলারের মত সুযোগ বুঝে ছোবল হানবে। কিন্তু গ্যারেটের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পিছিয়ে যাওয়া ধাতে নেই তার, ঘৃণা আর বিদ্বেষ ওকে তাতিয়ে তোলে; ঠিক এজন্যেই পালিয়ে যায়নি। অপেক্ষা করছে সে, খুব ভাল করে জানে নিকট ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে।
ডরোথি হেডলিনের সঙ্গে এড ক্রেমারের অন্তরঙ্গতাই ওর ঘৃণার কারণ। স্রেফ মেয়েঘটিত ব্যাপার থেকে ক্রমে ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে ব্যাপারটা, দু’জন সমর্থ লড়াকু লোকের পৌরুষের লড়াই এটা। দু’জনেই ওরা জানে অন্যজন সমর্থ ও বিপজ্জনক মানুষ।
স্যাম ল্যামসনকে পড়তে কখনোই অসুবিধে হয়নি গ্যারেটের। সেটলার বা নিজস্ব ক্রুদের মধ্যে শুধু গ্যারেটকে কিছুটা সমীহ বা ভয় করে ল্যামসন। দুর্ধর্ষ সাই ড্যানানও সমঝে চলত ওকে। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলত না, ভাল করেই জানত যে পপলারবাসীদের মধ্যে শুধু গ্যারেটেরই সামর্থ্য আছে ওর মুখোমুখি দাঁড়ানোর। জানত আগাগোড়া বিপজ্জনক লোক সে, প্রয়োজন হলে ঠিকই সামনাসামনি দাঁড়িয়ে যাবে।
ক্রেমারের মতই দীর্ঘদেহী মানুষ জনি গ্যারেট, বিশ পাউন্ড বেশি ওজন। প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে হাঁটে সে, মোটা ভুরুর নিচে ফ্যাকাসে নীল চোখে তাকায় সারা দুনিয়ার দিকে। প্রশস্ত কাঁধ আর বাহুতে অসুরের শক্তি ধরে। শারীরিক সামর্থ্যের কারণেই অন্যদের অবজ্ঞার চোখে দেখে সে, পিস্তলের দক্ষতা সেই অবজ্ঞাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারী চোয়ালের মতই কর্কশ চেহারা তার, ফ্যাকাসে চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
খিটখিটে মেজাজের কারণে, জীবনে খুব কম লোক গ্যারেটের সত্যিকার বন্ধু হতে পেরেছে। ঈর্ষাকাতর এবং ঝগড়াটে মার্টি থ্যাচারের মধ্যে বন্ধু নয়, বরং স্রেফ একজন সঙ্গীর ছায়া খুঁজে পেয়েছিল সে। বিশ্বস্ত মানুষ নয় বলেই থ্যাচারের মৃত্যুতে কিছুই যায় আসে না ওর। এখন এড ক্রেমারের জন্যে অপেক্ষায় আছে, পরাজিত মানুষ জয়ীর প্রতি যে তীব্র ঘৃণা অনুভব করে, তাই অনুভব করছে।
পেছনের ঘটনা চিন্তা করল গ্যারেট, বিশ্লেষণ করল কীভাবে যেন সব ব্যাপারে জিতে যায় এড ক্রেমার, ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে লোকটা! হারতে জানে না। পারিপার্শ্বিকতা আর পরিস্থিতিও ওর পক্ষে। ড্যান স্পেন্সারের আত্মীয় সে, জানত এখানে কী ঘটতে পারে। তাছাড়া, প্রথম থেকে স্যাম ল্যামসনের উদ্দেশ্য ঠিকই আঁচ করতে পেরেছে সে।
শুরু থেকেই, থ্যাচারকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেছে গ্যারেট, ওয়্যাগন ট্রেনের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিল কারণ তাতেই সুবিধে হবে; ল্যামসনের সঙ্গে নির্দ্বিধায় হাত মিলিয়েছে কারণ নিজের আখের গোছানোর মওকা দেখতে পেয়েছে। এসবের মধ্যে, মাত্র একজন লোককে কিছুটা হলেও সমীহ করেছে সে-যাকে খুন করার জন্যে এখন অপেক্ষা করছে গ্যারেট।
শূন্য বারের কাছাকাছি ডেস্কে বসে আছে সে, ঘোড়ার দূরাগত খুরের শব্দ শুনতে পেয়ে একটা গ্লাসে ড্রিঙ্ক ঢালল। আশপাশে হয়তো বড়জোর তিন-চারজন আছে, কিন্তু অন্যরা কেটে পড়েছে। হোলস্টারে পিস্তল পরখ করল জনি গ্যারেট, তারপর হেঁটে দরজার কাছে চলে এল। পোর্চে এসে দাঁড়াল।
স্টোরের জানালায় ড্যান হয়েটের ফ্যাকাসে মুখ দেখতে পেল গ্যারেট। ‘স্যাম কোথায়?’ শঙ্কিত স্বরে জানতে চাইল স্টোর-মালিক। ‘স্পেন্সারের লোকেরা আসছে!’
সবক’টা দাঁত বের করে হাসল গ্যারেট, থুক করে থুথু ফেলল। কয়েকদিনের না কামানো দাড়ির জঙ্গলে হাত চালাল, খসখসে শব্দে চুলকাল, তারপর তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাল হয়েটের দিকে। ‘মনে হয় আশপাশে আছে। আবার পালিয়ে গিয়েও থাকতে পারে,’ খিকখিক করে হাসল গ্যারেট, আমোদ পাচ্ছে নিজের কথায়। অন্যরাও নেড়ি কুত্তার মত পালিয়ে গেছে!’
নিখাদ আতঙ্ক ফুটে উঠল স্টোর-মালিকের মুখে। ‘পালিয়েছে? হতেই পারে না! নিশ্চয়ই অ্যাম্বুশ করতে গেছে ওরা! স্পেন্সারের লোকদের তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে…’
‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার!’ অবজ্ঞা ঝরে পড়ল গ্যারেটের কণ্ঠে। ‘খেল খতম, ড্যান! তুমিও জানো সেটা। ওই ক্রেমার কুত্তাটা আসছে,. ওরা যখন এখান থেকে চলে যাবে, একটা কাঠিও খাড়া থাকবে না এই শহরে।’
‘কিন্তু সেটলাররা গেল কোথায়? ওরাই থামাবে ক্রেমারকে!’
খরখরে স্বরে হাসল গ্যারেট। ‘পাহাড়ে চলে গেছে ওরা। পালিয়েছে! শুধু আমি আছি। এড ক্রেমারের জন্যে অপেক্ষা করছি। ওকে খুন করব! তারপর ওর লোকদের হটিয়ে দিতে পারলে আমিও পালাব।’
রাস্তায় দেখা গেল আগুয়ান দলটাকে, ঘোড়া হাঁটিয়ে ধীর ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে। সবার সামনে এড ক্রেমার, স্যাডলের ওপর আড়াআড়ি ভাবে পড়ে আছে রাইফেল। ওর ডান দিকে হ্যারি রাউডি, এডের গায়ের সঙ্গে প্রায় ঠেকে আছে, নীল রঙের পনিতে চেপেছে কাউবয়। দু’জনের পেছনে, প্রায় লাইন বেঁধে এগিয়ে আসছে ডজন খানেক সশস্ত্র কঠিন চেহারার মানুষ। টেক্সাসের উত্তরে প্রথম গরুর পাল ড্রাইভ করে আনার সাফল্য রয়েছে এদের।
স্টোরের পেছনের কেবিন থেকে হঠাৎ গর্জে উঠল একটা রাইফেল। মুহূর্ত খানেক পর আবার গুলি করল লুকিয়ে থাকা লোকটা। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল একটা ঘোড়া। ঝটিতি ঘোড়া ঘুরিয়ে স্টোরের মুখোমুখি হলো হ্যারি রাউডি, আরও চারজন সহ ছুটে গেল কেবিনের দিকে। অবস্থা বেগতিক দেখে সাহস হারিয়ে ফেলল লোকটা, বেরিয়ে এসে পড়িমরি করে ছুট লাগাল।
মেক্সিকান জ্যাকেট পরা ছিপছিপে দেহের এক ব্লন্ড রাইডার ধাওয়া করল লোকটাকে, একটা ল্যাসোর ফাঁস ঘুরাচ্ছে সে। দূর থেকে ছুঁড়ে মারল। নিপুণ হাতের কাজ, মুহূর্তের মধ্যে ফাঁসে আটকা পড়ল বিশালদেহী টীমস্টার। তুমুল গতিতে ক্যাকটাসের সারির দিকে ছুটে গেল ঘোড়াটা, পেছনে ছেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে ফাঁসবিদ্ধ টীমস্টারের দেহ। ক্যাকটাসের গায়ে আছড়ে পড়ল, অনুচ্চ ঢিবি বা পাথরে ঠোকর খেল, কিন্তু থামল না কাউবয়। প্রায় ষাট গজ গিয়ে ঘোড়া ঘুরিয়ে টীমস্টারের মুখোমুখি হলো, এবার ফিরতি পথে সেলুনের দিকে ছুটল।
রাইডাররা ছড়িয়ে পড়েছে শহরের চতুর্দিকে। যেখানে গেল তারা, সমানে গোলাগুলি চলতে থাকল। আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে বাড়িগুলোয়।
সেলুনের পোর্চে জনি গ্যারেটকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল এড ক্রেমার। ‘গুলি কোরো না কেউ!’ নির্দেশ দিল সে সঙ্গীদের। স্টীল- ডাস্টকে হাঁটিয়ে সেটলারের বিশ গজের মধ্যে পৌছে গেল ও। পোর্চের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে গ্যারেট, দুটো হোলস্টার ঝুলছে কোমরে। টকটকে লাল রঙের নোংরা শার্টের ওপরের দুটো বোতাম খোলা থাকায় বুকের ঘন লোম উঁকি দিচ্ছে।
‘হাউডি, এড!’ ধুলোয় থুথু ফেলল গ্যারেট। ‘পাওনা নিতে এসেছ?’
‘উহুঁ, পাওনা মিটিয়ে দিতে এসেছি,’ শীতল সুরে বলল এড। ‘কীভাবে নিতে চাও?’
‘কেন, আমরা দু’জনেই তো পিস্তলে চালু, তাই না?’ উস্কানির সুরে বলল গ্যারেট। ‘সুতরাং পিস্তলেই ফয়সালা হোক। অবশ্য খালি হাতে তোমাকে পেটাতে পারলে খুব খুশি হতাম, খায়েশ ছিল কিনা, কিন্তু তাহলে সবাই আবার বলবে তোমাকে সমান সুযোগ দেয়া হয়নি।
‘তাই?’ স্যাডল থেকে আলগোছে নেমে পড়ল এড। ‘কি জানো, কারও ইচ্ছে অপূর্ণ রাখা ঠিক না। যদি মনে করো খালি হাতে পেটাতে পারবে আমাকে, তাহলে পিস্তল ফেলে এগিয়ে এসো। তোমার খায়েশ অপূর্ণ রাখা উচিত নয়, কী বলো?’
অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে গ্যারেট। ‘বুঝে-শুনে বলছ তো?’ উজ্জ্বল হয়ে গেছে সেটলারের চোখ, ক্রমশ খুনের নেশা চেপে বসছে চাহনিতে।
‘দস্তানা আর জামা খুলে এসো, কয়োট!’ তপ্ত স্বরে আহ্বান করল এড ক্রেমার। ‘তাহলে তোমার চামড়া ছিলে নিতে সুবিধে হবে আমার! আঙুলের ট আর মাথার খুলি এবং খালি হাত-যদি এই নিয়ম পছন্দ হয় তোমার!’
‘খালি হাত!’ বিকৃত এবং কুৎসিত আনন্দ ফুটে উঠল জনি গ্যারেটের চোখে। খালি হাতেই তোমাকে পিটিয়ে তক্তা বানাব আজ!’
‘সতর্ক থেকো, বস্!’ নিচু স্বরে বলল মাইক হ্যানলন। ‘মনে হচ্ছে চালু মাল। গায়ে জোরও আছে বেশ!’
‘তাহলে মালের খানিকটা চামড়া ছিলে সেলুনের সামনে টানিয়ে দেব আমরা! আর চামড়াহীন মালটাকে লাথি মেরে খেদিয়ে দেব এখান থেকে!’ হালকা সুরে বলল এড, ঊরু থেকে হোলস্টার খুলে স্যাডল হর্নের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিল। এদিকে সেলুনের কোণে গিয়ে অবস্থান নিয়েছে হ্যারি রাউডি।
ধূলিমলিন রাস্তায় মুখোমুখি হলো ওরা। সত্যি সত্যিই শার্ট খুলে ফেলেছে জনি গ্যারেট, বিশালদেহী ভালুকের মত দেখাচ্ছে তাকে, রোদপোড়া ত্বক যেন র-হাইডের চামড়া। ইস্পাতদৃঢ় হাতের পাঞ্জা শিথিল ভঙ্গিতে পড়ে আছে দেহের পাশে। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বেঁকে গেছে ঠোঁটের কোণ, নিজের সাফল্য সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী। ভেতরে ভেতরে উল্লাসে ফেটে পড়ছে সে-না চাইতেই জল! পিটিয়ে ছাতু বানাবে আজ এড ক্রেমারকে। সব জায়গায় সব ক্ষেত্রে জিততে পারে না কেউ।
‘আয়, ব্যাটা, আজ তোর কি আমার একদিন!’ চাপা স্বরে গরগর করে উঠল জনি গ্যারেট।
কিন্তু এডের জন্যে অপেক্ষা করল না সে, বরং নিজেই ছুটে এল। দারুণ জোরে ঘুসি হাঁকাল ডান হাতে। মাঝপথে দানবের মুখোমুখি হলো এড, ক্ষিপ্র বেগে ডান হাত চালাল। গ্যারেটের চেয়ে ক্ষিপ্র ওর গতি, ঘুসির চোটে মাঝপথে থেমে গেল বিশালদেহী, মুখে লাগল আঘাতটা। থমকে গিয়ে তাকাল সে প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে। মুখে আসা রক্ত থোক করে ফেলল মাটিতে, তারপর বিশাল দুই বাহু বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল এডের ওপর।
এডকে বেচাল অবস্থায় পেয়ে গেল সে। সাঁড়াশির মত দুই বাহুতে চেপে ধরল, দড়াম করে বালিতে আছড়ে পড়ল এড। নির্দয় ভাবে নিজের ওজন ওর ওপর চাপিয়ে দিয়েছে গ্যারেট। ধুলো উড়ল দুটো শরীরের পতনে।
কিন্তু বেশিক্ষণ সুবিধে ধরে রাখতে পারল না জনি গ্যারেট। চট করে গড়ান দিয়ে সরে গেল এড, অল্পের জন্যে গ্যারেটের বুটের লাথি মিস্ হলো। ওর কানের পাশ দিয়ে চলে গেল লাথিটা। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ও, মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
এগিয়ে এল গ্যারেট। দু’হাত দূরে আসা মাত্র, এবং গ্যারেট আক্রমণ করার আগেই, এক পা আগে বেড়ে বিশালদেহীর বুকে দুই হাতের তালু দিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা মারল। টলমল পায়ে পেছনে দু’পা সরে যাওয়ার আগে বুড়ো আঙুল চালাল গ্যারেট, এডের একটা চোখ টার্গেট করেছে; কিন্তু দ্রুত মাথা সরিয়ে নিল ও, একইসঙ্গে বাম হাত চালাল দানবের থুতনি বরাবর। মুহূর্ত খানেক পর ডান হাতে জোরাল ঘুসি বসিয়ে দিল গ্যারেটের কানে।
গড়িয়ে নেমে এল রক্ত।
লাফিয়ে আগে বাড়ল গ্যারেট, নিজের রক্ত দেখে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। পরপর দুটো ঘুসি হাঁকাল সে, এডের মাথায় লাগল। প্রবল যন্ত্রণায় অস্ফুট স্বরে গুঙিয়ে উঠল এড, অনুভব করল ঝিমঝিম করছে মাথা, ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে ক্ষণিকের জন্যে। এখন যা করা উচিত, তাই করল ও-দু’পা আগে বেড়ে গ্যারেটের দুই বাহুর মধ্যে ঢুকে বুনো আক্রোশে একের পর এক ঘুসি হাঁকাতে শুরু করল, শরীরের সমস্ত শক্তি ঢেলে দিচ্ছে প্রতিটি ঘুসিতে।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকল ওরা, এখন আর পরস্পরকে এড়ানোর কোন চেষ্টা করছে না; বরং অন্যের মার উপেক্ষা করে যতটা সম্ভব পাল্টা মার দেয়ার চেষ্টা করছে। অপেক্ষাকৃত বিশাল শরীরের বাড়তি সুবিধা নিচ্ছে গ্যারেট, প্রতিটি ঘুসিতে দানবের জোর, কিন্তু অনেক শ্লথ হয়ে এসেছে গতি। সমানে চলতে থাকল লড়াই, চারটে হাতই ঘুসি হাঁকাচ্ছে। ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে, হাপরের মত ওঠা-নামা করছে বুকের ছাতি। মাথা নিচু করে এখন বিক্ষত মুখ বাঁচানোর চেষ্টা করছে গ্যারেট, দু’পা এগিয়ে এল সে, বিশাল শরীর আর শক্তির বাড়তি সুবিধে নিয়ে ভূপতিত করতে চাইল এডকে।
বিদ্যুৎ গতিতে আক্রমণ চালাল এড। ডান হাতের ঘুসি মিস্ হলো, গ্যারেটের কাঁধের ওপর দিয়ে বাতাস কেটে চলে গেল ওর মুঠি। ঘুসি মিস্ হলেও অন্য ভাবে সুযোগটা নিল ও। ডান হাতে দানবের গলা পেঁচিয়ে ধরল, অন্য হাতে নিজের কব্জি চেপে ধরল। শরীরের ওজনকে ব্যবহার করে, পা তুলে চাপ দিল সর্বশক্তিতে, গ্যারেটের ঘাড় মটকে দেয়ার ইচ্ছে।
কিন্তু দানবটা সব কৌশলই জানে। এডের পা উঠে যাওয়া মাত্র সামনের দিকে, এবং কিছুটা বামে শরীর নুইয়ে দিল সে, এডকে নিয়েই মাটিতে পড়ল। গড়িয়ে আলাদা হয়ে গেল সে। উঠে দাঁড়ানো মাত্র, এডের মাথার উদ্দেশে লাথি চালাল গ্যারেট।
গড়িয়ে সরে গেল এড, গড়ানোর সময় পা চালাল দাঁড়িয়ে থাকা গ্যারেটের হাঁটুর নিচে। আঁক করে গুঙিয়ে উঠল দানব, ঝুঁকে মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। ব্যথায় কুঁচকে গেছে রক্তাক্ত মুখ।
একটু পর উঠে দাঁড়াল জনি গ্যারেট। দু’হাত দূরে অপেক্ষায় ছিল এড। প্রতিদ্বন্দ্বী উঠে দাঁড়ানো মাত্র পরপর দুটো ঘুসি হাঁকাল মুখ বরাবর, মুহূর্তে দীর্ঘ গভীর কাটা দাগ পড়ে গেল গ্যারেটের ডান গালে, ঠোঁট ফেটে গেছে কয়েক জায়গায়।
রক্তাক্ত এবং বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে শরীর, কিন্তু তারপরও আসুরিক শক্তি আর জেদ নিয়ে এগিয়ে আসছে লোকটা, ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে নিঃশ্বাসের সঙ্গে। বাম হাতে তার মুখে জোরাল ঘুসি বসিয়ে দিল এড, ডান হাতে একটা আপারকাট ঝাড়ল। বাতাসের অভাবে খাবি খেল সেটলার। ঘুরে এক পা পিছিয়ে এল এড, অপ্রকৃতিস্থ গ্যারেট এগিয়ে আসা মাত্র ডান হাতে আরেকটা ঘুসি চালাল বুক আর পেটের মাঝামাঝি, তারপর আরও কয়েকটা। চোয়াল ঝুলে পড়েছে গ্যারেটের, ক্ষত-বিক্ষত মুখ থেকে রক্ত ঝরছে। দূর থেকে তাকে নিরীখ করল এড, এগিয়ে এসে চিবুকে মারল পরের ঘুসি। পরবর্তীতে বিরাশি শিক্কার দুটো ঘুসি বসিয়ে দিল লোকটার পেটে। টলে উঠল দানব, নিজেকে খাড়া রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করল, কিন্তু সেকেন্ড দুই পর দড়াম করে আছড়ে পড়ল ধূলিময় মাটিতে।
স্থির দৃষ্টিতে জনি গ্যারেটের ভূলুণ্ঠিত শরীর দেখল এড ক্রেমার, তারপর যখন নিশ্চিত হলো লোকটা উঠে দাঁড়াতে পারবে না, ঘুরে ওঅটর ট্রাফের দিকে এগিয়ে গেল। মুখ ডুবিয়ে দিল পানিতে। জ্বালা করে উঠল কয়েক জায়গায়। মাথা তুলে দু’হাত দিয়ে পানি ছিটিয়ে দিল মুখ আর শরীরে, ছেঁড়া শার্টটা টেনে ছিড়ে ফেলে দিল শরীর থেকে।
‘সবক’টা খতম, বস্,’ জানাল মাইক হ্যানলন। ‘সেটলারদের পিছু নেবে নাকি এখন?’
‘না। ওদের বাড়ির কোন ক্ষতি কোরো না। হয়েট কোথায়?’
‘স্টোরকীপার? ভেতরে বোধহয়।’
জোড়া হোলস্টার কোমরে জড়াল এড, স্টোরের পোর্চে উঠে এল। ওর পিছু নিয়েছে হ্যানলন আর রাউডি। কাউন্টারের পেছনে পাওয়া গেল ড্যান হয়েটকে, রক্তশূন্য হয়ে গেছে মুখ।
‘হয়েট, সেটলারদের কাছে বাকিতে যেসব জিনিসপত্র বিক্রি করেছ তার রসিদগুলো কোথায়?’ জানতে চাইল এড।
‘রসিদ?’ দ্বিধা দেখা গেল হয়েটের শঙ্কিত চোখে, পরক্ষণে সন্দেহ ফুটে উঠল। ‘কেন? আছে, আমার কাছেই আছে।’
‘জলদি বের করো!’
কাঁপা হাতে ড্রয়ার থেকে রসিদ বের করল সে। ওগুলো নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল এড, তারপর কাউন্টারের ওপর রেখে দেয়াশলাই বের করল। একটা কাঠি জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল রসিদের স্তূপে।
হাত বাড়াল হয়েট। ‘কী করছ তুমি?’
‘বদমাশদের সঙ্গে হাত মেলানোর খেসারত দিচ্ছ তুমি, সহাস্যে বলল এড, দেখল স্টোর-মালিককে আটকে রেখেছে হ্যারি রাউডি। ঘোড়া আছে তো তোমার?’
‘আছে একটা। কিন্তু…’
‘হ্যারি,’ ঘুরে দাঁড়াল এড। ‘এই লোকটাকে কিছু কার্তুজ, একটা রাইফেল, ক্যান্টিন আর দু’দিনের খাবার দিয়ে দাও। তারপর ওকে ঘোড়ার স্যাডলে বসিয়ে রওনা করিয়ে দেবে। ও যদি রাইফেলে কার্তুজ লোড করার চেষ্টা করে কিংবা এখান থেকে চলে যেতে না চায়, পপলারের ডালে ঝুলিয়ে দিয়ো ওকে।’
‘ইন্ডিয়ানরা মেরে ফেলবে আমাকে!’ প্রতিবাদ করল হয়েট। ‘আমার দোকানেরই বা কী হবে?’
‘কীসের দোকান? এখন আর কোন দোকান নেই তোমার। বাঁচলে আরেকটা তৈরি করে নিয়ো, যদি নিজের চেষ্টায় ইন্ডিয়ানদের সামাল দিয়ে এখান থেকে ফোর্ট পর্যন্ত যেতে পারো।
‘বস্,’ এডের কাঁধে হাত রাখল রাউডি। ‘তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায় এরা।’
ঘুরে দাঁড়াল এড। স্টোরের পোর্চে দেখতে পেল টেড হেডলিন, প্যাট গ্যাভিন আর লিও কারভারকে
‘এড,’ বলল হেডলিন। ডরোথিকে নিয়ে পালিয়ে গেছে ল্যামসন। লিও নিজে দেখেছে। স্যাডলের সঙ্গে ডরোথিকে বেঁধেছে হারামজাদা!’
প্রথমে ফ্যাকাসে, তারপর থমথমে হয়ে গেল এডের মুখ। ‘তাতে কী? ওকেই তো চায় ডরোথি, তাই না? সেদিন আমাকে ফাঁদে ফেলার জন্যেই তো ড্রানানকে কেবিনে জায়গা দিয়েছিল, আবার শান্তির ভুয়া প্রস্তাব নিয়ে স্পেন্সারের বাথানে গেছে হামলার সময়।
‘উঁহু, ভুল করছ তুমি, এড। এমন কিছু করেনি ডরোথি,’ বলল গ্যাভিন। স্পেন্সার র্যাঞ্চে হামলার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই এখান থেকে রওনা দিয়েছিল ডরোথি। আর ডানানের ব্যাপারে—
‘জোর করে কেবিনে ঢুকে পড়েছিল ডানান, আমাদের দু’জনকে চুপ করে থাকতে বাধ্য করেছে,’ জানাল হেডলিন। স্বেচ্ছায় কেন ল্যামসনের সঙ্গে যাবে ডরোথি? ও তো তোমাকে ভালবাসে।’
‘ঠিকই বলেছে ও,’ সমর্থন করল প্যাট গ্যাভিন। ‘জেনের কাছ থেকেও তাই শুনেছি আমি। ডরোথি নিজেই বলেছে জেনকে।’
‘বেশ,’ কাউন্টার থেকে একটা শার্ট তুলে নিয়ে ঘোড়ার দিকে এগোনোর ফাঁকে গায়ে চাপাল এড। ডরোথিকে নিয়ে আসব আমি।’
‘তোমার সঙ্গে যাবে কে?’ অধীর স্বরে জানতে চাইল হ্যারি রাউডি।
‘আমি একাই যাব।’
নয়
ট্রেইলে দারুণ স্বচ্ছন্দ স্টীল-ডাস্ট স্ট্যালিয়ন। দীর্ঘ যাত্রা মানে মাইলকে মাইল পথ পেছনে ফেলে এগোনো, যেখানে দিগন্তের পরিধি কেবলই বাড়তে থাকে। পথ চলা কখনও শেষ হয় না। ঘোড়াটা টের পেয়ে গেছে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে, এড ক্রেমারের কণ্ঠ আর স্যাডলে বসার সহজ ভঙ্গিতে বুঝে নিয়েছে। তাগিদ দিতে হলো না, দ্রুত কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত বেগে ছুটতে থাকল ওটা।
পপলার সারির ফাঁক গলে ট্রেইলে উঠে এল এড, এখানেই শেষবার থেমেছিল ওয়্যাগন ট্রেন। চলার ফাঁকে ক্ষত-বিক্ষত ট্রেইল জরিপ করল ও, জায়গায় জায়গায় ইতোমধ্যে কচি ঘাস গজিয়ে উঠেছে। দেখে মনে হবে বহুদিন পেরিয়ে গেছে সেটলাররা আসার পর, যদিও মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনা এটা।
পাহাড়ে উঠে আসার আগে শেষবারের মত শহরের দিকে তাকাল এড, তারপর ঘোড়া ছোটাল ঘেসো উপত্যকা ধরে।
সামনে দীর্ঘ উপত্যকা, এখানেই খুন হয়েছিল ওয়েস বার্নেট। স্যাম ল্যামসনের ট্রেইল ধরে এ পর্যন্ত আসতে সমস্যা হয়নি, কারণ ট্র্যাক লুকানোর কোন চেষ্টা করেনি লোকটা। এখন পর্যন্ত পালানোর ব্যাপারেই মনোযোগী ল্যামসন, কিন্তু একটু পরই ট্র্যাক মুছে ফেলার চেষ্টা করবে। তাই ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে এড, আঁচ করতে চাইছে লোকটার পরিকল্পনা।
লিন্ডলে নদীর আশপাশের অঞ্চল পুরো আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে রুক্ষ এবং দুর্গম এলাকা। কেউই ভাল করে চেনে না জায়গাটা, কাজ চালানোর মত জ্ঞান খুব কম লোকের আছে। ট্রেইল নির্বাচনে একটু অসতর্ক হলে কানা ক্যানিয়নে গিয়ে উপস্থিত হতে হবে, কিংবা পাহাড়ী খাদের কিনারে বা নিরেট বোল্ডারসারির সামনে গিয়ে উপস্থিত হবে- যেখান থেকে ফিরে আসা ছাড়া উপায় থাকবে না। এখানকার অনেক ট্রেইলই আসলে গোলকধাঁধার মত।
তবে ট্রেইল রয়েছে ঠিকই, ইন্ডিয়ানরা যাতায়াত করে। পাথরের গায়ে পূর্বপুরুষদের আঁকা চিহ্ন ধরে পথ চিনে নেয় ওরা। দুর্বোধ্য ওসব চিহ্ন, অন্তত সাদাদের জন্যে। কোন কোন চিহ্ন এমন দুর্গম জায়গায়, দুঃসাহসী লোকও যেখানে যাওয়ার সাহস করে না।
এখানকার অনেক জায়গার ইতিহাস এখনও অনাবিষ্কৃত, এমনকী ওই লেখাগুলোর চেয়েও বেশি রহস্যময় বালিময় ক্রীকে পাওয়া যাবে বহু পুরানো তলোয়ার, ক্যানিয়নের দেয়ালে রয়েছে অদ্ভুত রহস্যময় আঁকিবুকি আর সন-তারিখ। মাইল কয়েক দূরে এক জায়গায় ‘১৬৪২’ খোদাই করা, কিছু নামও আছে। এগুলোর অর্থোদ্ধার আজও করা সম্ভব হয়নি। তাই জানা হয়নি এগুলো কার লেখা কিংবা কীভাবে এই এলাকায় এসেছিল সে বা তারা।
গ্রাস ক্যানিয়ন থেকে ঘোড়া দুটোর ট্র্যাক একটা ড্রর দিকে চলে গেছে। পাশে খাড়া ঢাল কয়েকশো ফুট নিচে খাদের তলায় গিয়ে মিশেছে। ঢালে বার্চ, বালসাম আর কটনউডের ঘন সারি। রাইফেল হাতের কাছাকাছি রেখেছে এড, যদিও এ মুহূর্তে বিপদের আশঙ্কা নিতান্তই অল্প। টানা এগিয়ে চলল ও।
পাহাড়ী এলাকার শুরুতে শেষ হলো ড্র। সামনে অসংখ্য রীজ, গর্জ, ক্লিফ আর মেসার সমারোহ। ঝর্নার লাগোয়া উপত্যকার পাশ ঘেঁষে ক্ষীণ ট্রেইল ধরে এগোল স্ট্যালিয়ন। কয়েকটা টীল* সাঁতার কাটছে ছন্দহীন পানিতে, সম্ভবত মাছের খোঁজে। বীভার*-ও রয়েছে। পানিতে বীভারের ডানা ঝাপটানোর ছলাৎ শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেল এড।
[* টীল (Teal) : মিঠে জলে সঞ্চরণশীল ক্ষুদ্র হংসবিশেষ
* বীভার (Beaver) : বীবর]
দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী সঙ্কীর্ণ উপত্যকা ধরে এগিয়েছে ট্রেইল, ক্রমশ নিচু হয়ে গেছে। একপাশে পাথুরে চাঙড়, গ্র্যানিটের মতই কঠিন এবং দৃঢ়, অন্যপাশে উজ্জ্বল কমলা রঙের মার্বেলের চাঙড়, ক্রমশ ফিকে হয়ে এসেছে রঙ। পুরো ট্রেইলের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ছোট ছোট বোল্ডার, এগোনো কঠিন হয়ে পড়েছে। এক জায়গায় পাহাড়ী চাতাল থেকে ঝুলে পড়েছে গ্র্যানিটের চাঁই, তলার পাথুরে মাটি ছুঁয়েছে প্রায়। দূরে সামনের ট্রেইল চোখে পড়ল, ক্রমশ উঠে গেছে চড়াই হয়ে, পাহাড়ী দেয়ালও সরে গেছে দু’দিকে।
এখান থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে স্যাম ল্যামসন, সন্দেহ করেছে কেউ পিছু নিয়ে আসতে পারে-ট্রেইল আর দুই ঘোড়ার ট্র্যাক দেখে অনুমান করল এড। দ্রুত এগিয়েছে সে। ল্যামসন যদি ইতোমধ্যে অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে না থাকে এবং যদি পেছনের ট্রেইলে নজর রেখে থাকে, তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যে টের পেয়ে যাবে তাকে ধাওয়া করে আসছে কেউ। সুউচ্চ পাহাড়ী ঢালে চলার সময় দূর থেকে অনায়াসে চোখে পড়বে যে-কোন রাইডারকে।
বন্ধুর ট্রেইল ধরে এগিয়ে চলল এড ক্রেমার, সতর্ক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছে চারপাশে। ক্লিফের মুখে পড়ে থাকা পাথরসারি এড়িয়ে এগোল ও, বাঁক নিয়ে নিচু একটা চাতালে পৌঁছল, তারপর সঙ্কীর্ণ পথ ধরে চড়াইয়ে ওঠা শুরু করল।
‘বিগ ট্র্যাকের দিকে যাচ্ছে ও,’ বিড়বিড় করল এড। ‘বিগ ট্র্যাক হলৌয় যাচ্ছে নির্ঘাত!’
জায়গাটা চেনে এড। স্যাম ল্যামসনের জন্যে এটাই স্বাভাবিক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয় হাজার ফুট উঁচু জায়গাটা, সবুজ সতেজ ঘাস আছে ওখানে, পানি বা জ্বালানিরও অভাব হবে না। আর যাওয়ার পথে ট্র্যাক লুকানোও সহজ। পিছু নেয়া যে-কোন রাইডারকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব।
শত মাইলের মধ্যে এটাই আদর্শ জায়গা। অন্তত কিছুদিনের জন্যে নিশ্চিন্তে লুকিয়ে থাকা যাবে। বহু আগে, ওখানে একটা কেবিন তৈরি করেছিল কেউ, বেসিনের দেয়ালে কিছু প্রাকৃতিক গুহাও রয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক ডায়নোসরের পাওয়া ছাপ থেকে বিগ ট্র্যাক হলৌর অদ্ভুত নামকরণ।
বেশ কিছু সুবিধে পাবে স্যাম ল্যামসন। চারটে ভিন্ন ভিন্ন রুট রয়েছে পালানোর জন্যে, প্রতিটাই আলাদা-বেসিন থেকে ক্রমশ দূরে সরে গেছে, কোনটার সঙ্গে কোনটার যোগাযোগ নেই। ভুল ট্রেইল ধরে কেউ অনুসরণ করলে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হবে সে, শুরুর জায়গা থেকে আবার নতুন করে ট্র্যাকিং করতে হবে। শেষপর্যন্ত যদি সঠিক ট্রেইল খুঁজেও পায়, ততক্ষণে যে সময় পেরিয়ে যাবে তাতে নিশ্চিন্তে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে পারবে ল্যামসন।
চিন্তিত দৃষ্টিতে ট্রেইলে ছাপগুলোর দিকে তাকাল এড। শিি যাত নামবে, নিশ্চয়ই থামবে ওরা, যদিও এডের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে যেতে পেরেছে; রাতে চললেও ওদের ধরে ফেলার সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ, তাছাড়া অসংখ্য ক্যানিয়নের গোলকধাঁধায় ট্রেইল হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনাই বেশি।
নিতান্ত অনাগ্রহ বোধ করছে এড, বুঝতে পারছে কিছুক্ষণের মধ্যে থামতে হবে ওকে। চারপাশে কেবলই পাথর আর গ্র্যানিটের চাঙড় চোখে পড়ছে, আকাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে অটল পাথুরে দেয়াল, ক্যাথেড্রাল আকৃতির বাট আর সঙ্কীর্ণ চাতালে ভরা। ঢালু উরাই ধরে নামতে শুরু করল ও, অপেক্ষাকৃত অন্ধকার জায়গা বরাবর এগোচ্ছে; ক্যানিয়নের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে ঘোড়ার খুর। নিরেট পাথরের একটা হলওয়ে ধরে নেমে যাচ্ছে যেন, শূন্য এবং নির্জন। নিঃসঙ্গ, একঘেয়ে রাইডিং
খুরের শব্দ ছাড়া চারপাশ একেবারে নীরব। মাঝে মধ্যে স্যাডলের খসখস শব্দ হচ্ছে। আবছা অন্ধকারে ধীর গতিতে এগোল ও, ছায়াময় পরিবেশে ভূতুড়ে মনে হলো ওর উপস্থিতি, যেন অপার্থিব এক জগতের বাসিন্দা; কিন্তু মনে সীমাহীন উদ্বেগ আর শঙ্কা নিয়ে এগিয়ে চলেছে এড ক্রেমার, যেহেতু জানে যে-কোন মুহূর্তে হয়তো থেমে ওকে অ্যাম্বুশ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে স্যাম ল্যামসন।
চড়াই ধরে উঠছে ও এখন, দু’পাশে কয়েক ফুট দূরে নিরেট পাথুরে দেয়াল, ঘোড়ার খুরের নিচে বন্ধুর রুক্ষ মাটি। আচমকা চূড়ায় উঠে এল ও, দশ হাত দূরে রিমরকের কিনারা দেখতে পেল।
দূরে, কিছুটা নিচে মাইলকে মাইল রুক্ষ এবড়োখেবড়ো জমি। তবে উপত্যকায় ঘাস আর গাছপালা রয়েছে। ডানদিকে ঘোড়ার গতিমুখ পরিবর্তন করল এড, তারপর রাশ টেনে ধরল। নুড়িপাথর এবং ছোট ছোট বোল্ডারপূর্ণ একটা ট্রেইল চোখে পড়েছে। খুঁটিয়ে জরিপ করল ও, তারপর সন্তুষ্ট হয়ে এগোল মিনিট কয়েক পর।
ট্র্যাকিং করা কঠিন হয়ে পড়েছে এখন। একে তো আলোর স্বল্পতা, তায় রুক্ষ পাথুরে মাটি। ছাপ দেখার জন্যে বাধ্য হয়ে স্যাডল থেকে নেমে ঘোড়ার পাশাপাশি হাঁটছে এড, হাতে রাইফেল। ক্রমশ নিচে নামছে। কিছুক্ষণ পর সামনে ছোট একটা জলাশয় দেখতে পেল, পানির কিনারে অপেক্ষাকৃত নরম মাটির ওপর কিছু চিহ্ন চোখে পড়ল, দেখে মনে হচ্ছে কেউ পানি পান করার জন্যে ঝুঁকে পড়েছিল।
স্ট্যালিয়নের পিঠ থেকে স্যাডল খসাল ও, ঘাসের ওপর ছেড়ে দিল ওটাকে। কিছু শুকনো ডালপালা যোগাড় করে বোল্ডারের আড়ালে আগুন ধরাল, খুব ছোট রাখল আগুন, যাতে দূর থেকে কারও চোখে না পড়ে। আগুন জ্বালার পর কফি তৈরি করল, তারপর কাছাকাছি উঁচু একটা জায়গায় উঠে এসে চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চালাল।
কেবলই অন্ধকার।
এখন প্রতিটি পদক্ষেপই বিপজ্জনক। পালাচ্ছে স্যাম ল্যামসন, কোণঠাসা ইঁদুরের মত লড়াই করবে-সময়, স্থান এবং পদ্ধতিটা সে-ই নির্বাচন করবে।
ভোর হওয়ার পরপরই বেডরোল ছেড়ে উঠে পড়ল এড ক্রেমার, গিয়ার গুছিয়ে স্ট্যালিয়নে স্যাডল চাপাল। চারিদিক ফর্সা হতে শুরু করতে যাত্রা করল ও, কিন্তু ট্রেইলে কোন ছাপ চোখে পড়ল না। সেক্ষেত্রে, সম্ভবত ক্রীক ধরে এগিয়ে গেছে ল্যামসন, সুতরাং ক্রীক ধরে এগোল ও, সঙ্কীর্ণ দুই পাড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছে।
শেষে, নিরন্তর খোঁজাখুঁজিতে ক্লান্ত ও নিরুদ্যম হয়ে পড়েছে প্রায়, এসময় জায়গাটা খুঁজে পেল। পাথুরে এক জায়গায় ক্রীক থেকে পাড়ে উঠে গেছে ওরা। কিছুক্ষণ এগোনোর পর কোথাও ট্র্যাক চোখে পড়ল না, কিন্তু দুমড়ে যাওয়া ঘাস দেখতে পেল, খুরের চাপে পিষে গেছে।
মাইল চারেক যাওয়ার পর ক্যাম্পটা খুঁজে পেল ও। দুটো বিছানা, একটা পাথুরে দেয়ালের লাগোয়া, ট্রেইলের ওপাশে বেশ কিছু দূরে আরেকটা। ঝুঁকি নেয়নি স্যাম ল্যামসন। এমন কোন চিহ্ন রেখে যায়নি যাতে সুবিধে হতে পারে ওর।
ক্যাম্প পেরিয়ে কয়েক গজ এগিয়ে গেল এড, তারপর ঘোড়া থামিয়ে স্যাডলে বসে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। সময় নিয়ে, খুঁটিয়ে প্রতিটি জিনিস দেখল, সম্ভবত দূর থেকে দেখার কারণেই ঝোপের নিচে স্যাতস্যাতে মাটিতে একটা জিনিস চোখে পড়ল।
ফিরে এসে, হাঁটু গেড়ে বসে ঝোপ সরিয়ে নিরীখ করল ও। মাটিতে কিছু আঁকিবুকি চোখে পড়ল, বেশ তাড়াহুড়ো করে লেখা হয়েছে কয়েকটা শব্দ।
সতর্ক থেকো। সম্ভবত বিগ ট্র্যাকে যাচ্ছি আমরা।
ওর অনুমানই ঠিক। বিগ ট্র্যাক হলৌতে যাচ্ছে ল্যামসন। এখান থেকে জায়গাটা বেশ দূরে, অন্তত একদিন রাইড করতে হবে। পরবর্তী রীজে ওঠার সময় ব্যাপারটা নিয়ে ভাবল এড। রীজের চূড়া থেকে সামনের জমি নিরীখ করল, তারপর ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল আচমকা।
সেই মুহূর্তে কানের পাশ দিয়ে শিস কেটে চলে গেল তপ্ত সীসা।
ঝটিতি সক্রিয় হলো এড। খাবলা মেরে স্ক্যাবার্ড থেকে রাইফেল তুলে নিল, পরমুহূর্তে স্যাডল থেকে পিছলে নেমে এল ওর শরীর, দুটো গড়ান দিয়ে সরে এল মেসার ভেতরের দিকে। পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে মিশিয়ে ফেলল দেহ। উবু হয়ে শুয়ে পড়ল ও, দেহের সামনে রাইফেল টেনে এনে অপেক্ষায় থাকল।
রীজের ওপাশের জমি অপেক্ষাকৃত খোলামেলা, তবে প্রচুর ঝোপ আর বোল্ডার রয়েছে। নেমে যাওয়ার চেষ্টা করা নির্বুদ্ধিতার শামিল হবে, কারণ রাইফেলে ওকে অসহায় অবস্থায় পেয়ে যাবে লোকটা, তাছাড়া স্যাম ল্যামসন রাইফেলে দারুণ দক্ষ। আত্মহত্যা করাই হবে শুধু। একটু আগে আচমকা ঘোড়া ঘুরিয়ে নেয়ায় বেঁচে গেছে ও, নইলে ঠিক বিধত বুলেটটা।
পাথুরে চাঁইয়ের আড়াল থেকে সরে এল ও, ঢালের দিকে এগোল ধীরে ধীরে। গজ কয়েক দূরে দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়াটা। গ্র্যানিটের শরীর আড়াল করেছে রীজের ওপাশের জমি থেকে। কিছু পথ ক্রল করে এগোল ও, তারপর আড়ালে এসে উঠে দাঁড়াল। দ্রুত স্যাডলে চাপল, অদৃশ্য নাইপার আর নিজের মধ্যে রীজটাকে রেখে পুব দিকে এগোল। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, ঝুঁকি বা জুয়া, যাই হোক নেবে।
এভাবে অনুসরণ করতে থাকলে, ক্রমে পিছিয়ে পড়বে ও, এতে কোন সন্দেহ নেই। বারবার ওকে রাইফেলে নিশানা করবে স্যাম ল্যামসন, গুলিবিদ্ধ করতে না পারলেও কিছু সময় নষ্ট করবে ওর। প্রতিবার হামলার পর সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিতে পারবে না এড, সুতরাং প্রচুর সময় নষ্ট হবে। এই ফাঁকে দূরত্ব বাড়িয়ে নিতে পারবে লোকটা। তাছাড়া ট্রেইলেও যে সবসময় ছাপ থাকবে, তাও নিশ্চিত নয়। ল্যামসন যদি ওর আগে বিগ ট্র্যাক হলৌতে পৌঁছতে সক্ষম হয়, যে-কোন একটা ট্রেইল ধরে এগিয়ে যাবে সে, অথচ নির্দিষ্ট ট্রেইলটা খুঁজে নাও পেতে পারে এড। ভুল হলে চরম মাশুল গুনতে হবে ওকে।
বিগ ট্র্যাকে পৌঁছার কোন শর্টকাট আছে কিনা, জানা নেই ওর, তবে এ মুহূর্তে ও কোথায় আছে, সেটা জানে। আর জানে বিগ ট্র্যাকের সঠিক অবস্থান। সুতরাং সরাসরি বিগ ট্র্যাকের দিকে এগোল ও। সামনে একটা ড্র, তুফান বেগে সেদিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল, ড্রতে আসার পর গতি খানিকটা কমিয়ে আনল। দুলকি চালে এখন ছুটছে স্টীল-ডাস্ট। সামনে, বহু দূরে সুচাল পাথরের মত আকাশের বুকে জেগে আছে পাহাড়ের চূড়া, ওটাই ওর পথ নির্দেশক হিসেবে কাজ করছে।
ক্রমশ বন্ধুর হয়ে আসছে অঞ্চল, কিন্তু একের পর এক ড্র, সমতল- জমি, ন্যাড়া চূড়া আর পাহাড়ী উপত্যকা পেরিয়ে চলল এড ক্রেমার। একবার লাভা অঞ্চল পেরুল, কালো কুৎসিত দেখাচ্ছে লাভার ধারাল চাঙড়, দূরে হামলে পড়েছে লালচে ক্লিফ, দৃষ্টিসীমা ঢেকে রেখেছে। কিন্তুত আকৃতির একটা নচ দেখা যাচ্ছে, সম্ভবত ওই পথে বেরিয়ে যাওয়া যাবে। বোল্ডারসারির ফাঁকফোকর গলে এগিয়ে চলল ওর স্ট্যালিয়ন। ছিটকে ট্রেইল থেকে সরে গেল একটা গিরগিটি, অল্পের জন্যে স্টীল-ডাস্টের খুরের তলায় চাপা পড়েনি। ধীর গতিতে আকাশে চক্কর মারছে একটা বাজার্ড।
দুপুরের রোদে পিঠ তাতাচ্ছে এখন, বাতাস নেই এক ফোঁটা। পাথরে ঠিকরে যাচ্ছে রোদ আর তাপ। তাপ শুষে নিয়ে জমিনের ওপর কয়েকগুণ ফিরিয়ে দিচ্ছে। অ্যালকালি ভরা একটা লেকের পাড় ধরে এগিয়ে চলেছে এড, স্ট্যালিয়নের খুরের নিচে ধূসর নোংরা ক্ষারের আস্তরণ পড়েছে। সঙ্কীর্ণ পাহাড়ী একটা খাঁজে পৌঁছল ও।
এক জায়গায় ট্রেইল এত সরু যে বাধ্য হয়ে এক পা স্টিরাপ থেকে তুলে নিতে হয়েছে ওকে, স্টিরাপটা টেনে নিয়েছে স্যাডলের ওপর। প্রায় ত্রিশ গজের মত এভাবে এগোতে হলো। তারপর খোলা সবুজ এক উপত্যকায় পৌঁছল, উপত্যকার সীমানা বরাবর ঘন অ্যাসপেনের বন। একপাশে ক্রীকে স্বচ্ছ টলটলে ঝর্নার পানি জমেছে। ঘোড়া থামিয়ে স্যাডল ছাড়ল ও, ক্ষণিকের বিরতির সুযোগে ঘোড়াকে পানি পান করাল।
প্রচণ্ড খরতাপ উপেক্ষা করে রুক্ষ জমি পাড়ি দিয়ে এসেছে ওরা, কিন্তু তারপরও বেশ সতেজ দেখাচ্ছে স্টীল-ডাস্টকে। হোলস্টারে পিস্তল আর রাইফেল পরখ করল ও। যেভাবেই হোক স্যাম ল্যামসনের আগে আগে বিগ ট্র্যাক হলৌতে পৌঁছতে হবে ওকে, ঘোড়াটার দম আর গতির ওপর ভরসা করছে। সময়মত পৌঁছতে না পারলে আর কখনও ডরোথি হেডলিনকে দেখতে পাবে কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আগে না হোক, অন্তত একই সময়ে পৌঁছতে হবে ওকে।
ডরোথিকে মনে পড়ল ওর। মেয়েটির স্বতঃস্ফূর্ত চলাফেরা, কথা বলার ভঙ্গি, সুরেলা কণ্ঠ…মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও বেপরোয়া করে তুলছে ওকে। মেয়েটি ওর, কাঙ্ক্ষিত একজন নারী, সবসময়ই তাই ছিল-প্রথম দেখার পর থেকেই আবিষ্কার করেছে এড। অনুরাগটা একতরফা নয়, এখন অন্তত জানে ডরোথিরও একই মানসিকতা। জানত স্যাম ল্যামসন লোক হিসেবে কেমন। ডরোথিকে সন্দেহ বা অবিশ্বাস করা মোটেও ঠিক হয়নি। ব্যাপারটা এ মুহূর্তে বিস্ময়কর লাগছে যে ক্ষণিকের জন্যে হলেও ডরোথিকে অবিশ্বাস করেছিল।
তীব্র রোদ আর উত্তাপ উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছে ও, ঘোড়ার খুরের নিচে তপ্ত সীসার মত তেতে উঠেছে মাটি। পাহাড়গুলো ক্রমে আরও রুক্ষ এবং দুর্গম হয়ে উঠেছে। ট্রেইলে লাভার চাঙড় পেরিয়ে যেতে হলো আবার, নিরাপদে পেরিয়ে গেল ভয়ঙ্কর এবড়োখেবড়ো জমি, তারপর ক্ষারীয় মরু অঞ্চলে পৌঁছল। চারদিকে সাদা চাদরের মত বিছিয়ে আছে ক্ষার, রোদে তাতাচ্ছে। চোখে অস্বস্তি ধরিয়ে দিচ্ছে। টানা আট মাইল এভাবে এগোতে হলো ওকে।
ধুলো, রোদ আর রাইডের ক্লান্তিতে প্রায় অস্থির বোধ করছে এড।
দুপুর পেরিয়ে গেছে কখন, অথচ মনে হচ্ছে কয়েক ঘণ্টা হলে। চলছে। আসলে ভোর থাকতে থাকতে রওনা দেয়ার কারণে অনেক পথ পেছনে ফেলে এসেছে। মাত্র একবার থেমেছে কয়েক মিনিটের জন্যে, এবং এখনও একই গতিতে এগিয়ে চলেছে।
মরুভূমির একেবারে শেষ সীমানায় পানির একটা উৎস খুঁজে পেল এড। দেখতে পচা চটকানো ডিমের মত, খনিজ পানি। খানিকটা পান করল ও, র্যাবিট ঘাস দিয়ে ঘোড়ার ঘাড় আর মাথা ডলে দিল, তারপর ক্ষণিকের জন্যে ঘাসে চরতে দিল স্ট্যালিয়নকে। মিনিট বিশেক পর আবারও স্যাডলে চেপে বসল, চড়াই ধরে উঁচু পাহাড়ের দিকে এগোল।
বিগ ট্র্যাক বেশি দূরে নেই আর। সুচাল চূড়াটা দেখা যাচ্ছে, প্রায় স্পষ্ট এখন। ঘামে জবজব করছে ওর সারা মুখ, ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে শার্ট। নোনা ঘাম গড়িয়ে পড়ে চোখে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করল ও, বিগ ট্র্যাকের শুরুতে বিশাল ঢাল, কয়েক মাইল দূরে শুরু হওয়া পাহাড়ের কোলে গিয়ে মিশেছে।
এগোল ও।
তাবৎ চিন্তা বিস্মৃত হয়েছে এখন এড ক্রেমার, শুধু একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে- পরিস্থিতির বিচারে যেটা জরুরী, তীব্র জেদ শক্তি যুগিয়ে চলেছে ওকে, চরম একটা মুহূর্তের জন্যে-স্যাম ল্যামসনের মুখোমুখি হওয়া। দেনা-পাওনা চুকিয়ে দিতে হবে। সামনে কোথাও অপেক্ষায় আছে লোকটা, শিগগিরই মুখোমুখি হবে দু’জন।
প্রচণ্ড তাপে সেদ্ধ হওয়ার দশা, সুস্থির ভাবে চিন্তা করতে পারছে না এড, বিকারগ্রস্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। ওয়্যাগন ট্রেনের সঙ্গে পপলারে আসার দীর্ঘ রাইডের কথা মনে পড়ল ওর, ডরোথির শুশ্রূষার কথা মনে পড়ল, মমতা এবং সহানুভূতির হাতে ওর জখমের পরিচর্যা করেছে মেয়েটা, গুরুতর ক্ষত নিয়েও মেয়েটির আন্তরিক শুশ্রূষার কারণেই সুস্থ হয়ে উঠেছিল ও। একঘেয়ে ক্লান্তিকর যাত্রার স্মৃতি ফিরে এল ওর মনে, মনে হলো এখনও ধূলিধূসর, রুক্ষ ট্রেইল ধরে ঢিমে তালে এগিয়ে চলেছে ওয়্যাগনের সারি-পশ্চিমে নতুন বসতির খোঁজে।
এত দেরি করল কেন ও? মেয়েটিকে কেন মনের কথাটা আগেই জানিয়ে দেয়নি? শুধু এই একটা ব্যাপারে আনাড়ি সে, জানে এড, কথার খই ফোটাতে পারে না মুখে, মেয়েদের সামনে আড়ষ্ট এবং বিব্রত বোধ করে। নিজের অনুভূতি মুখে প্রকাশ করা ওর জন্যে সবচেয়ে কঠিন কাজ। অথচ মেয়েরা সবসময় মুখের কথাই বেশি পছন্দ করে, নির্ভর করে, কারণ শুনতে পেলে খুশি হয় ওরা।
দীর্ঘ সময় পর স্যাডল ছাড়ল এড, পায়ে হেঁটে এগোল। স্ট্যালিয়নটা যথেষ্ট শক্তিশালী ঘোড়া, কিন্তু ওটারও সামর্থ্যের শেষ আছে। বুনো, রুক্ষ প্রান্তর জুড়ে রয়েছে ছড়ানো-ছিটানো চোখা বোল্ডার, লাভার চাঙড়। কিছু পাইনও রয়েছে, তবে করুণ দশা ওগুলোর। বাতাস আর রোদের অত্যাচারে জীর্ণ প্রায়।
তারপর হঠাৎ সুচাল চূড়াটা প্রায় মাথার ওপর দেখতে পেল এড। পেছনে বিগ ট্র্যাকের সবুজ বেসিন চোখে পড়ছে। স্যাডলে চেপে জামার আস্তিনে মুখ মুছল ও। ক্লান্ত দেহে এগিয়ে চলেছে বিশাল ঘোড়াটা, কিন্তু ঠিকই গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। হোলস্টারের ফিতা ঢিলে করে দিল এড ক্রেমার, গম্ভীর, সতর্ক। প্রাকৃতিক একটা ট্রেইল ধরে এগোল ও, এই ট্রেইল ধরে সম্ভবত এই প্রথম কোন মানুষ চলছে। বিগ ট্র্যাক হলৌর নয়ন জুড়ানো তৃণভূমিতে পা রাখল স্টীল-ডাস্ট স্ট্যালিয়ন।
অবিশ্বাস্য হলেও বাতাসে ঘাসের সোঁদা গন্ধ টের পেল এড। পাখির কলরব কানে এল, তারপর পাখা ঝাপটানির আওয়াজ শুনতে পেল। পানির কুলকুল ধ্বনি কানে আসছে, পানির উপস্থিতি টের পেয়ে গতি বেড়ে গেছে ঘোড়ার, অ্যাসপেন ঝাড় ছাড়িয়ে এগোল ওটা। ঘেসো উপত্যকায় ছড়িয়ে- ছিটিয়ে জন্মেছে অসংখ্য গোলাপী আর বেগুনী এস্টার, সাদা সেগো লাইন এবং লাল বেনবেরি।
দূর থেকে পানি চোখে পড়ল ওর, গতি বাড়িয়ে দিল স্ট্যালিয়নের।
লাফিয়ে স্যাডল ছাড়ল ও, চারপাশে সতর্ক নজর চালাল। চারিদিক সুনসান নীরব, অস্বাভাবিক কোন শব্দ নেই। হালকা ঝিরঝিরে আর্দ্র বাতাস প্রশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে শরীরে। পানির কিনারায় উবু হয়ে শুয়ে পড়ল ও, তারপর পান করল। ওর ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে তেষ্টা মেটাচ্ছে ঘোড়াটা।
হঠাৎ, আচমকা সজাগ হয়ে উঠল ঘোড়াটা, কান খাড়া হয়ে গেল ওটার। সঙ্গে সঙ্গে দেহের প্রতিটি মাংসপেশী টানটান হয়ে গেল এডের। প্রায় জোর করে শিথিল করল শরীর। ঘোড়াটা কিছু একটা দেখেছে, এদিকে পাখির কলরবও থেমে গেছে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল ও সতর্ক, জানে আচমকা নড়াচড়া করলে যে-কারও চোখে পড়ে যাবে; অথচ সমস্ত চেতনা দিয়ে অনুভব করছে ওর ওপর নজর রাখছে কেউ! সন্তর্পণে ঘুরে দাঁড়াল ও, প্রায় নির্লিপ্ত অসচেতন ভঙ্গিতে।
সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আছে স্যাম ল্যামসন। একটা পিস্তল রয়েছে হাতে। কিছুটা শীর্ণ দেখাচ্ছে তাকে, রোদ আর বাতাসের অত্যাচারে মলিন হয়ে গেছে মুখ; নেকড়ের মত হিংস্র এবং শয়তানি দৃষ্টি চোখে। সুদর্শন চেহারা বা চটপটে কথাবার্তার আড়ালে লুকিয়ে থাকা সমস্ত বিদ্বেষ, কুৎসিত আকাঙ্ক্ষা এবং প্রতিহিংসা বেরিয়ে পড়েছে-চেহারায় তারই ছাপ। ভয়ের শীতল অনুভূতি স্পর্শ করল এডকে।
‘হাউডি,’ দারুণ শান্ত স্বরে বলল ও। ‘দেখা যাচ্ছে ঝুঁকি নিতে রাজি নও তুমি, স্যাম। জায়গামত নিশানা করেছ পিস্তলটা। একেবারে মোক্ষম সময়ে, যখন প্রতিদ্বন্দ্বী বিন্দুমাত্র সুযোগ পাবে না।’
ক্ষীণ হাসল সে, দাঁত বেরিয়ে পড়ায় যে-কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি হিংস্র আর ধূর্ত দেখাচ্ছে ল্যামসনকে। এর মানেটা বলছ না কেন? আমার মত তুমিও জানো। একটু পরই একটা লাশ হয়ে যাবে এড ক্রেমার।
‘আমি কিন্তু তোমার মত অতটা নিশ্চিত নই,’ শ্রাগ করে বলল এড। ‘এরকম বেকায়দা অবস্থা থেকেও বেঁচে যায় মানুষ। আমি হয়তো তেমনই ভাগ্যবান একজন ‘
‘উঁহুঁ, সেই সৌভাগ্য হবে না তোমার, ক্রেমার,’ সবক’টা দাঁত কেলিয়ে হাসল স্যাম ল্যামসন। ‘তোমাকে খুন করব আমি, পিস্তলের সবক’টা বুলেট ঢোকাব তোমার শরীরে। আচমকা জ্বলে উঠল তার চোখ- প্রতিহিংসা আর ঘৃণা ফুটে উঠল। কিন্তু তার আগে, একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে-এখানে এলে কী করে?’
‘ভেবে দেখলাম এলাকাটা সম্পর্কে যেহেতু ধারণা আছে তোমার, সুতরাং বিগ ট্র্যাকে আসবে। তাই সরাসরি এখানেই চলে এলাম।’
‘অসম্ভব, অন্য কোন ট্রেইল তো নেই! আমার অন্তত জানা থাকার কথা। উঁহুঁ, হতেই পারে না!’
শীতল চাহনিতে তাকে বিদ্ধ করল এড ক্রেমার। ‘ট্রেইল থাকুক বা না- থাকুক, প্রয়োজন হলে নিজেই ট্রেইল তৈরি করে নিই আমি, ল্যামসন কোন কিছু আটকাতে পারে না আমাকে। অন্য কাউকে অনুসরণ করি না আমি, কিংবা কারও সাফল্যে ভাগও বসাই না।’
এডের কথার তাৎপর্যে হেসে উঠল ল্যামসন। ‘আমার অত বাছ-বিচার নেই। আসল জিনিসটা কিন্তু ঠিকই কব্জা করেছি। জমি হারিয়েছি, তাতে কী, তোমার মেয়েমানুষ এখন আমার হাতের মুঠোয়! ওকে পেয়েছি যখন, রাখবও নিজের সঙ্গে! হয়তো তোমাকেই ভালবাসে ও, তাতে কী! কিছুদিন গেলে ঠিকই আমাকে মেনে নেবে ও। মেয়ে মাত্রই ফুর্তি করার জিনিস, তাই না? এখান থেকে চলে যাওয়ার আগেই আমাকে মেনে নেবে ও, নয়তো খুন হয়ে যাবে।
‘ওকে এমন জায়গায় রেখেছি, কিছুতে খুঁজে পাবে না কেউ। ধুঁকে ধুঁকে মরবে মেয়েটা। তবে ডরোথি বেঁচে থাকুক বা না-থাকুক, তাতে কিছু যাবে-আসবে না তোমার, কারণ একটু পর খুন হয়ে যাবে তুমি।’
‘সারা জীবন কেবল জোর খাটিয়ে গেছ তুমি, চুরি করেছ অন্যের জিনিস। কখনও ভাল কোন চিন্তা তোমার মাথায় এসেছে কিনা সন্দেহ আছে আমার। সস্তায় নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস পেতে চেয়েছ, অন্যকে ঠকিয়ে জয়ী হতে চেয়েছ, অন্যের পরিশ্রমের ফসল মেরে দিয়েছ, সেজন্যে নিজেকে ভেবেছ দারুণ করিৎকর্মা লোক। হঠাৎ হাসল ও। ‘বেশ, বুঝলাম, আমাকে খুন করবে তুমি। তো, মরার আগে একটা সিগারেট ধরাতে পারি?’
‘মনের আয়েশ মিটিয়ে টানো!’ অবজ্ঞা ঝরে পড়ল ল্যামসনের কণ্ঠে ‘ধূমপান করো আর যাই করো, হাত তুলে রেখো, নইলে ঠিক ফুটো করে দেব তোমাকে! ভয়ে কলজে কাঁপছে নাকি? নাহ্, তোমাকে নিয়ে পারা গেল না। যাও, ধরাও সিগারেট, নিশ্চিন্তে টানো। কথা দিচ্ছি ওটা শেষ হওয়ার আগে গুলি করব না।
‘তোমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সত্যিই ভাল লাগছে আমার! আহ্, বেচারা এড ক্রেমার! কেমন বেকায়দা অবস্থায় পড়েছে। সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি-স্যাম ল্যামসন। চূড়ান্ত বিজয়ী। আমার কপালে আছে বিজয় আর সুন্দরী ললনার সঙ্গে ফুর্তি করার সুযোগ, তোমার জন্যে রয়েছে নরক!’ মুখ দিয়ে দুঃখসূচক চুকচুক শব্দ করল সে, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বেঁকে গেছে ঠোঁটের কোণ।
বুক-পকেট থেকে সতর্কতার সঙ্গে কাগজ আর তামাক বের করল এড। হাত বেশ উঁচু এবং পিস্তল থেকে যথেষ্ট দূরে রেখে সিগারেট রোল করতে শুরু করল।
‘অবস্থাটা দারুণ লাগছে তোমার, তাই না, ল্যামসন? চুটিয়ে উপভোগ করছ। পানি খাওয়ার সময় আমাকে অনায়াসে খুন করতে পারতে, জানতেও পারতাম না কার গুলিতে বা কীভাবে মারা গেলাম। কিন্তু তাহলে মজাটা নষ্ট হয়ে যেত, তাই না? এখন আমি জানি কার গুলিতে মারা যাচ্ছি, আর এতেই তোমার যত আনন্দ! দারুণ লাগছে, তাই না, স্যাম?’
দেয়াশলাই বের করার জন্যে পকেট হাতড়াল এড, বের করল। একটা কাঠি জ্বালাল, বারুদের স্পর্শে ফশ করে জ্বলে উঠল আগুন। ঠোঁটে সিগারেট ঝুলছে ওর, এ অবস্থায় স্মিত হাসল, দু’হাতের দশ আঙুলে জ্বলন্ত কাঠি আড়াল করল বাতাস থেকে, সরাসরি স্যাম ল্যামসনের দিকে তাকাল ও।
‘বেশ উপভোগ করছ, তাই না? শান্ত স্বরে জানতে চাইল এড। ডরোথিকেও লুকিয়ে রেখে এসেছ নিরাপদ জায়গায়। উপভোগ করারই কথা! ওকে খুঁজে পাব না আমি। নাহ্, কোন ঝামেলাই পোহাতে হবে না আমাকে, স্যাম। তোমার মন ঠিকই পড়তে পারছি। যে-কোন জায়গায় তোমাকে ট্রেইল করতে পারব আমি। বরফের ওপর দিয়ে উড়ন্ত বাজার্ডকে যদি ট্রেইল করতে পারি, তোমার ক্ষেত্রে পারব না কেন…’ কাঠি জ্বলে শেষ হয়ে গেল, আগুনের ছোঁয়া লাগল ওর আঙুলে, সঙ্গে সঙ্গে কাঠিটা ফেলে দিল এড। যন্ত্রণায় অস্ফুট স্বরে ককিয়ে উঠল ও, হাত ঝাড়া মারল। হাতটা নিচু হলো এবং উঠে এল বিদ্যুৎ গতিতে-তারপরই টাশ্ করে একটা শব্দ হলো!
এডের হাত ঝাড়া মারা আর অস্ফুট চিৎকারে মনোযোগ কিছুটা হলেও সরে গিয়েছিল স্যাম ল্যামসনের, সেটাই কাল হলো তার। একটু দেরি হয়ে গেল সক্রিয় হতে। একইসঙ্গে গর্জে উঠল দুটো পিস্তল। পরমুহূর্তে যন্ত্রণা আর বিস্ময়ে টলে উঠল ল্যামসনের দেহ, এক পা পিছিয়ে গেল সে, চোখে উদ্ভ্রান্ত চাহনি।
সতর্কতার সঙ্গে একটু পাশে সরে গেল এড ক্রেমার, নিশ্চিত হওয়ার জন্যে মুখোমুখি পেতে চাইছে ল্যামসনকে। এবারও একইসঙ্গে গুলি করল ওরা। এড অনুভব করল উরুতে তীব্র টান পড়েছে, একটা হাঁটু বাঁকা হয়ে গেছে ওর, কিন্তু ভ্রূক্ষেপ করল না। পরপর, আরও দু’বার গুলি করল ও। পিস্তল বদল করল হাতে, তারপর পঞ্চম গুলি করল।
হাঁটু ভেঙে পড়ে গেছে স্যাম ল্যামসন, ফ্যাকাসে এবং কুঁচকে গেছে মুখ। কয়েক পা এগিয়ে গেল এড, লাথি মেরে ল্যামসনের হাত থেকে খসিয়ে দিল পিস্তলটা। দশ হাত দূরে গিয়ে পড়ল ওটা।
‘ডরোথি কোথায়?’ জানতে চাইল ও। ‘জলদি বলো!’
ঘৃণায় কুঁচকে গেল ল্যামসনের মুখ। ‘শয়তানের কাছে যা, ব্যাটা!’ কর্কশ যন্ত্রণাকাতর স্বরে বলল। ‘নরকে যা!’ কেশে উঠল সে, মুখে রক্ত উঠে এল। ‘ন-নরকে যাও, এড কে-ক্রেমার!’ বলল সে আবারও, আচমকা মুখ হাঁ হয়ে গেল এবং মরিয়া হয়ে শ্বাস নেয়ার প্রয়াস পেল, কিন্তু সফল হলো না। শেষে মুখ থুবড়ে পড়ল ল্যামসন, হাতের আঙুলে ঘাস খামচে ধরল, রক্তে সয়লাব হয়ে গেছে মুখের কাছাকাছি সমস্ত ঘাস।
ঘোড়ার কাছে ফিরে এল এড, স্যাডল হর্ন চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। দুর্বল এবং ক্লান্ত লাগছে ওর, যদিও ওর মনেই হলো না গুরুতর কোন জখম হয়েছে। বাম ঊরুর কাছে পা চটচটে লাগছে, শার্ট সরিয়ে দেখল অগভীর একটা ক্ষত তৈরি হয়েছে চামড়ায়-কোমরের ঠিক ওপরে।
স্যাডলব্যাগ হাতড়ে প্রয়োজনীয় জিনিস বের করল, যতটা সম্ভব ক্ষতের যত্ন নিল। রক্তক্ষরণ বন্ধ হলেই নিশ্চিন্ত। এমনিতে ক্ষতটা তেমন গুরুতর নয়। স্রেফ পা নিয়েই ওর দুশ্চিন্তা এখন। সামান্য হাঁটাহাঁটি করল, তারমানে ঠিকই আছে। ভাঙা স্পারটা চোখে পড়ল। গুলির তুবড়িতে ভেঙে গেছে জ্যাংলার, স্রেফ পা হড়কে গেছে তাতে। ব্যস, আর কোন ক্ষতি হয়নি।
সতর্কতার সঙ্গে হোলস্টারে পিস্তল ফেরত পাঠাল এড। তারপর চিৎকার করে ডাকল ডরোথিকে। কোন সাড়া নেই। আবার ডাকল, এবারও উত্তর এল না। ধীর গতিতে, পুরো জায়গাটাকে ঘিরে চক্কর দিতে শুরু করল ও, ক্রমশ চক্রের পরিধি বড় হচ্ছে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করছে বিস্তৃত উপত্যকার জমি। সতর্কতার সঙ্গে এগিয়েছে স্যাম ল্যামসন, কোন ট্র্যাকই পড়েনি। মিনিট কয়েক পর নিজের ঘোড়ার কাছে ফিরে এল এড, স্যাডলে চেপে আবারও তল্লাশি শুরু করল।
কোথাও নিশ্চয়ই ঘোড়াটাকে রেখেছে ল্যামসন। ডরোথিও ধারে-কাছে থাকবে। সুতরাং আগে ঘোড়াটাকে খুঁজে পেতে হবে। তবে মাঝে মধ্যে ডরোথির নাম ধরে ডাকছে ও।
দু’ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। কখনও স্যাডলে বসে, কখনও পায়ে হেঁটে ঘোড়াকে লীড করে তল্লাশি চালাচ্ছে ও। প্রতিটি খাঁজ, ঝোপ, বোল্ডারের আড়াল খুঁটিয়ে দেখছে।
নিস্তরঙ্গ তপ্ত বাতাসে গুনগুন করছে মৌমাছি। মাঝে মধ্যে ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। হাঁটছে ও, শরীরের বাম পাশ কিছুটা অসাড় লাগছে, বুট পরা বাম পা ভারী ভারী ঠেকছে হাঁটার সময়। আচমকা মুখ তুলল ঘোড়াটা, চিঁহি স্বরে চেঁচাল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে, অন্য একটা ঘোড়ার জবাব শোনা গেল।
স্যাডলে শরীর বাঁকিয়ে ফিরে তাকাল এড, বোল্ডারসারির সঙ্কীর্ণ ফাকে ঘোড়াটাকে দেখতে পেল। হাঁটুর গুঁতোয় স্টীল-ডাস্টকে এগোনোর নির্দেশ দিল ও।
ডরোথিকেও দেখতে পেল। একটা বোল্ডারের ওপর হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে ওকে, নিচ থেকে ওর বুটের গোড়ালি ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না। মুখে নেকারচিফ গোঁজা। স্যাডল ছেড়ে দৌড়ে গেল এড, মুক্ত করল ডরোথিকে।
‘ওহ্, এড!’ ফুঁপিয়ে উঠল ডরোথি, দু’হাতে এডের গলা জড়িয়ে ধরেছে। দীর্ঘক্ষণ ওভাবেই থাকল ওরা। অনেকক্ষণ পর মুখ তুলে তাকাল ও। ‘তোমার ঘোড়ার শব্দ শুনে এত জোরে চিৎকার করেছি যে রুমালটা গলায় আটকে গিয়েছিল, নিঃশ্বাসই নিতে পারছিলাম না! আমার ঘোড়াটা যখন চিৎকার করল, বুঝলাম আমাকে খুঁজে পাবে।’
হাত বাড়িয়ে ডরোথিকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল এড। কিন্তু ডরোথি ওকে আঁকড়ে ধরে থাকল, বিপদ-মুক্তির স্বস্তি মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল মুখ থেকে। ‘এড! ল্যামসন কোথায়? দেখামাত্র তোমাকে খুন করবে শয়তানটা!’
‘হারার জন্যেই জন্ম হয়েছিল ওর,’ নির্লিপ্ত স্বরে বলল এড। ‘বড় বড় পরিকল্পনা করত ঠিকই, কিন্তু লেজেগোবরে করে ফেলত শেষে। ওর ঘৃণা এত বেশি ছিল যে প্রয়োজনের সময় দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ খুনটাও করতে পারেনি।’
পানির কাছে চলে এল ওরা। হাত-মুখ ধুচ্ছে ডরোথি, এই ফাঁকে সংক্ষেপে পপলারের পুরো ঘটনা জানাল এড। এতক্ষণে লোকজন নিশ্চয়ই যার যার বাড়ি ফিরে গেছে,’ শেষে বলল ও। ‘কি জানো, সবকিছুর পরও বলব জনি গ্যারেটই সেটলারদের মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য লোক। নেতা হিসেবে ওকেই মানায়। লড়াকু, সাহসী এবং পরিশ্রমী মানুষ। ষাঁড়ের মত জোর ওর গায়ে। সর্বশক্তি দিয়ে লড়েছি আমি, যতটা সম্ভব ওকে কাবু করতে চেয়েছি, কিন্তু ব্যাটা যেন ময়দার বস্তা, স্রেফ উঃ আঃ করেছে, উল্টো আমার প্রতিটা ঘুসি সমান জোরে ফিরিয়ে দিয়েছে।
ঘাসের গালিচায় পাশাপাশি বসল ওরা, অ্যাসপেনের ছায়া প্রশান্তি বিলিয়ে দিচ্ছে।
‘লিও আর জেন শিগগিরই বিয়ে করবে,’ হঠাৎ বলল ডরোথি।
ধীরে ধীরে লালচে হয়ে গেল এডের রোদপোড়া মুখ, হাত বাড়িয়ে এক মুঠো ঘাস তুলে নিল ও। ‘হুঁ,’ মৃদু স্বরে বলল। ‘মনে হচ্ছে পপলারে দুটো বিয়ে হবে!’
হেসে উঠল ডরোথি, পাশ ফিরে তাকাল এডের দিকে। ‘ওহ্, তারমানে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছ তুমি?’
‘না,’ দাঁতাল হাসি উপহার দিল এড ক্রেমার। ‘ওসব প্রস্তাব-টস্তাব দিতে পারব না। শেষে যদি ফিরিয়ে দাও! নির্দেশ দিচ্ছি তোমাকে, এবং হুকুমটা মানবে তুমি!’
সরু চোখে এডের দিকে তাকাল ডরোথি, মিটিমিটি হাসি খেলা করছে ঠোঁটের কোণে, আয়ত চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক। ‘অ! বুঝেছি, কথা ফুটেছে মুখে। কিন্তু এমন অসভ্য লোক বলে তো চিনতাম না তোমাকে! আরে, এটা কেমন অভদ্রতা? একটা মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব না দিয়েই হুকুম করছ?’
‘এটা আমার দাবি!’ গম্ভীর স্বরে বলল এড।
দু’হাত বাড়িয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরল ডরোথি, কানের কাছে মুখ নিয়ে এল। নিশ্চিন্তে প্রস্তাব দাও,’ ফিসফিস করল ও। ‘কথা দিচ্ছি, রাজি হয়ে যাব। প্রস্তাব ছাড়া বিয়ে করলে কী ভাববে সবাই? পপলারে ফিরে গিয়ে অন্যদের আমি বলতে চাই আমাকে প্রস্তাব দিয়েছ তুমি। অন্যরা কথাটা শুনে আনন্দ পাবে-এই দৃশ্যটা দেখতে চাও না তুমি?’
‘বিয়ে করবে আমাকে, ডরোথি?’
‘না!’
এক টানে ওকে বুকে নিয়ে এল এড ক্রেমার। ‘তো, বিয়েটা এখানে সেরে ফেলাই ভাল মনে হচ্ছে!’
Leave a Reply