উটকো সাংবাদিকের ডায়েরি – অশোক দাশগুপ্ত
Utko Sangbadiker Diary By Asoke Dasgupta
প্রথম প্রকাশ – কলকাতা বইমেলা জানুয়ারি ১৯৯৫, মাঘ-১৪০১
প্রচ্ছদ – দেবব্রত ঘোষ
প্রকাশক – জ্যোতিপ্রকাশ খান
আজকাল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
.
উৎসর্গ
‘ক্যাপটিভ অডিয়েন্স’
.
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা
দেখতে দেখতে আঠাশটা বছর কেটে গেল সাংবাদিকতায়। প্রথম ইনিংসটা দশ বছরের। কেন জানি না, শুরুতেই ঠিক করে ফেলেছিলাম, এটা দশ বছরই হবে। ১৯৮৬ সালে, ঠিক দশ বছরের মাথায় ক্রীড়া সাংবাদিকতা থেকে বিদায় নিতে পেরে ভাল লেগেছিল। যাক, নিজের কাছে নিজের কথা রাখা গেল। পরের ইনিংসটাও দশ বছরের হলে ভাল হয়, ভেবেছিলাম। হল না। আঠারোটা বছর কেটে গেল। কোনও কোনও শুভানুধ্যায়ী বলেন, এখন আমি সাংবাদিকতার বৃহত্তর জায়গায়। না। খেলার চেয়ে বড় কোনও জায়গা নেই। প্রথম ইনিংসটা এত লম্বা ছিল না, ছিল ঝোড়ো, উড়ো। সেই দিনগুলোর স্মৃতির গুঁড়োই কোনওরকমে জমাট বাঁধার চেষ্টা করেছে এই ডায়েরিতে। এবারও পরামর্শ ছিল, যদি প্রয়োজনমতো ‘সংশোধন’ করি। কেন করব? ডায়েরির আবার সংশোধন কীসের? হ্যাঁ, কোথাও কোথাও হয়ত বোঝার একটু ভুল ছিল, একটু হলেও ছিল। যাক। লেখার প্রুফ নিজে দেখি, ছাপা হওয়ার পর আর নয়। বই হিসেবে পড়া হয়নি ‘উটকো সাংবাদিকের ডায়েরি’। দ্বিতীয় ইনিংসটা শেষ হলে, যদি বেঁচে থাকি, যদি ইচ্ছে হয়, একবার পড়ব। এবং বলা যায় না, হয়ত একটা গ্রন্থ সমালোচনাও লিখে ফেলব!
অশোক দাশগুপ্ত
কলকাতা
২৫ ডিসেম্বর ২০০৪
উটকো কৈফিয়ত
কথার কথা নয়, এই ডায়েরির সাংবাদিক যে ‘উটকো’ তা তো ঘটনাই। ‘খেলা’ পত্রিকায় বহুবার নিজের লেখাকে চিহ্নিত করেছি ‘তুচ্ছ’ হিসেবে। মনের মধ্যে কিন্তু একটু ‘তবু’ ছিল। ‘তবু’ তেমন তুচ্ছ হয়ত সব সময় নয়— এই রকম আর কি। এবার আজকাল প্রকাশনের সহকর্মীদের চাপাচাপিতে ডায়েরিকে বই বানাতে গিয়ে বুঝলাম, সতিই তুচ্ছ, সবটাই। কম্পোজ হয়ে গেছে, প্রুফ দেখা সারা, প্রচ্ছদ তৈরি, তবু ছাপার মুখে, শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসলাম: না। বই করার মানে হয় না। আবার সেই চাপ, চাপ খেলার ঘরেরও, জীবনে আরও একটা খুচরো আপস।
প্রথম দিকে ইচ্ছা ছিল, এখনকার মতো করে একটু-আধটু পাল্টে নেব। পরে দেখলাম, অসম্ভব। তাহলে নতুন করে লিখতে হয়। তা ছাড়া, যুক্তি খাড়া হল, ডায়েরি আবার পরে পাল্টানো চলে নাকি! ভাল আর মন্দ অভিজ্ঞতা রয়েছে পাশাপাশি, মাখামাখি। পড়তে গিয়ে দেখলাম, ভাল মনে আছে অনেক, মন্দটা ভুলেছি প্রায় সবটুকু। তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা যেন নতুন পড়লাম। যেন অন্য কেউ লিখেছিল! ১৯৮২ থেকে ১৯৮৭— ‘খেলা’ পত্রিকার প্রথম পাঁচ বছরের শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত ডায়েরি। ধরা রয়েছে তার আগের পাঁচ বছরেরও কথা, বাংলা খেলার পত্রিকা আন্দোলনের বিক্ষিপ্ত কাহিনী। খেলার লেখা শুরুর সময়েই সিদ্ধান্ত ছিল, চিরকাল নয়। লিখেও জানিয়েছিলাম, বড় জোর দশ বছর। সত্যিই খেলা থেকে বিচ্ছেদ দশ বছর পর। এবং তারও পরে তো কেটে গেল প্রায় দশ বছর। এ বই শুধু তাঁদেরই জন্য যাঁরা এই উটকো সাংবাদিকের প্রশ্রয়দাতা পাঠকপাঠিকা ছিলেন ওই দশটা বছর। ১৯৭৭—১৯৮৬।
খেলার মাঠের অনুরাগীরা মাঝে মাঝে দেখা হলে বলেন, আপনি নেই, তাই ‘খেলা’ আর তেমন জমছে না। ভুল। ‘খেলা’ আজও ভারতীয় ভাষায় প্রচারিত এক নম্বর খেলার কাগজ। কিন্তু, হ্যাঁ, আগের মতো ‘জমছে না’। বলতে চাই, এই উটকো সাংবাদিক থাকলেও জমত না। প্রথম কারণ, টেলিভিশন। সব কিছু এত ভালভাবে দেখার পর জানার খিদে অনেকটাই মরে। দ্বিতীয়, বাংলা খেলার কাগজের আসল ‘খেলা’ ছিল ফুটবল, কলকাতার ফুটবল। আন্তর্জাতিক ফুটবলের চেহারা দেখার পর সে আকর্ষণ কমতে থাকল। ব্যতিক্রম হয়ে থাকল কৃশানুর মতো ফুটবলার, মাঠে লোক টানার মতো খেলোয়াড় বলতে গেলে থাকলই না। এই দ্বিতীয় কারণটাকেও প্রথম কারণের মধ্যে ঢোকাতে পারেন, দায়ী ওই টেলিভিশন। তৃতীয়, খেলার পত্রিকার অপ্রতিহত জয়যাত্রার সময়ে একটা বড় জায়গা ফাঁকা ছিল। দৈনিকপত্রে প্রধানত থাকত খেলার খবর, মানে, খেলাটারই খবর।
বাইরের খবর থাকত কম, খুব কম। ক্রীড়ামোদীদের আগ্রহ ছিল আরও আরও জানার, ঠিক সময়ে ফাঁক ভরাট করতে এগিয়ে এসেছিল খেলার পত্রিকা। শুনতে অদ্ভুত লাগবে, খেলার পত্রিকার, আরও স্পষ্ট করে ‘খেলা’র বড় শত্রু হয়ে ওঠে আজকাল! সব খবর তুলে আনা শুরু হল দৈনিকপত্রের খেলার পাতায়। প্রথমে আজকাল, তারপর, কে আর এখন জায়গা ছেড়ে দেয়, সব কাগজে।
টেলিভিশন অনেক আগ্রহ শুষে নেওয়ায় নতুন এলাকার খোঁজে মরিয়া হতে হয় দৈনিকপত্রকে, সেই খিদে মেটার পর কী-ই বা পড়ে থাকে খেলার পত্রিকার জন্য। দুনিয়া জুড়ে খেলার কাগজের তাই ঘোর দুঃসময়। তবু যে ‘খেলা’ মোটামুটি চালু, এটাই যথেষ্ট।
আট বছর পর খেলার লেখার সঙ্গে ফের যোগাযোগ ঘটল এই বিশ্বকাপ ফুটবলে। হিং টিং ছট— আবার। এবং রোজ। যেন ছোটবেলার পাড়ায় ঘুরে আসা। ডায়েরিটা পড়ার সময় আরও দু-একটা কথা মনে হল, বলে ফেলি। খেলার পত্রিকার আন্দোলনে যে সহযোদ্ধারা সঙ্গে ছিল, কী আনন্দ, তারা এখনও সঙ্গে আছে। আমি খেলার ঘর ছাড়ার পর যারা এসেছে, তাদের মধ্যেও অনেকে রয়েছে। কিন্তু, বলতে চাইছি, যে কয়েকজন অন্যত্র তরী ভিড়িয়েছে তারা সকলেই এসেছে ছিয়াশির পর। যে গেছে সে গেছে। সবাই ভাল থাকুক। কিন্তু লড়াই-দিনের সঙ্গীরা অবিচ্ছিন্ন, ভাল লাগে।
এফ ডব্লু এ প্রসঙ্গ পড়তে পড়তে অনুতাপ এল, যতই ব্যস্ততা থাকুক, কেন একটু সময় দিইনি? কেন দেব না? আগে পড়তাম ‘খেলা’র সব চিঠি। এখন পড়ি আজকালের চিঠির এক শতাংশও নয়। অন্যায়, ঘোর অন্যায়।
দৈনিকপত্রের চিঠির সংখ্যা অনেক বেশি। কাজের চাপও। তবু, একবার চোখ বোলানো অসম্ভব, উটকো সাংবাদিক?
ভূমিকার শেষ কথা, একটাই প্রার্থনা, এ বই যেন বাইরের কারও হাতে না পড়ে। এ বই শুধু সেই দশ বছরের পাঠক-সঙ্গীদের জন্য। অন্যদের কাছে এর দাম তিরিশ পয়সাও নয়। এ বই উৎসর্গ করা হল ‘ক্যাপটিভ অডিয়েন্স’-কে। ওদেরই একজন ছিল ব্যারাকপুরের কিশোর চক্রবর্তী। ‘এক অখ্যাত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানের ডায়েরি’ নামের অকিঞ্চিৎকর লেখাটি পড়ে চিঠি দিয়েছিল, ‘অশোকদা, আপনার জন্য আমি জীবন দিতে পারি!’ দেড় বছর পর ওর জীবন গেল ক্যান্সারে! ক্যাপটিভ অডিয়েন্স, এমন ভালবাসার আরও একটু যোগ্য হয়ে উঠতে পারলাম না কেন?
Leave a Reply