উজান-যাত্রা – বাণী বসু
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০০৬
‘লোকসেবায়তন’ নিমডির ঁবাসুমাসি (বাসন্তী রায়)কে
স্মরণ করে শ্রদ্ধার্ঘ্য
১) আমি তিনি ও সে
শুনেছি ওঁর বাবা গুজরাতের কটন কিং। ছিলেন, না এখনও আছেন, গত না জীবিত, অতশত জানি না। নিতাইদা পাঠিয়েছেন, ওঁকে নিতে এসেছি। হাওড়া-আমেদাবাদ এক্সপ্রেস পাক্কা সাত ঘণ্টা লেট। খোঁজখবর করে জানতে পারি নাগপুর পার হয়ে থেকেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসছে। ঠিক কী গোলমাল ওরা বলল না। সম্ভবত যান্ত্রিক। ভাল বাবা, খোঁড়াতে খোঁড়াতেই আসুক, দুর্ঘটনায় পড়ার চেয়ে ভাল। চারপাশে থিকথিক করছে লোক। অনেকেই এক্সপ্রেসটার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে খেপে যাচ্ছে। মুখ-খারাপ করছে খুব। কাজল সাধারণত চুপচাপ থাকে। তবে আজ ওর ভুরুতে কোঁচ ধরেছিল। পাশের ভদ্রলোককে বলল, আপনার কে আসছেন, জানতে পারি!
আরে আর বলবেন না— মেয়ে জামাই-বিয়ের পরে ফার্স্ট টাইম। এখন এই খচড়া দেশের খচড়া রেল তো কোনও কাজই টাইমে করে না!
কাজল ওঁর আপাদমস্তক ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, সময়ে আসাটা ইমপর্ট্যান্ট? না গোটা আসাটা?
মানে? কী বলতে চাইছেন?
যান্ত্রিক গোলযোগকে অগ্রাহ্য করলে যে-কোনও সময়ে অ্যাকসিডেন্ট ঘটে যেতে পারে, জানেন তো?
ভদ্রলোক কটমট করে চেয়ে ওর থেকে কয়েক গজ দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। মুখখানা কালো হয়ে রয়েছে।
অলুক্ষুণে কথা বলিস কেন রে? আমি বিরক্ত হই।
কাজল উত্তর দিল না, একটু পরে বলল, একটা বাজল, চল কিছু খেয়ে আসি।
রেলওয়ে রেস্তোরাঁটা সুবিধের নয়। তবু অনেক ডেলি প্যাসেঞ্জার, কাছাকাছি অফিস-টাইমের লোক এখানে খেতে আসে। আমরা মশলা ধোসার অর্ডার দিয়ে বসি। সেফেস্ট, যদি-না আলু পেঁয়াজের পুরটা অলরেডি গেঁজে গিয়ে থাকে। কাজলের ভুরুর কোঁচ ফিকে হয়েছে কিন্তু এখনও পুরোপুরি যায়নি। কাপড়টাপড় ইস্ত্রি করতে গেলে পয়লাবার ইস্ত্রি চালাবার পর যেমন হালকা একটা অমৃসণ ভাব থেকে যায়, তেমন।
বলল, দেশটা কার? রেলটা কার?
বুঝি, সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে ঝগড়ার দ্বিতীয় দফাটা আমায় শুনতে হবে।
নোংরা, লেট, চোর, ঘুষখোর, অরাজক হলেই ‘এই দেশ’। কিন্তু হরগোবিন্দ খোরানা, অর্মত্য সেন, অরুন্ধতী রায় হলেই দেশটা আমাদের হয়ে যায়, ‘আমাদের ছেলে, আমাদের মেয়ে।’
তুই ওঁকে বললি না কেন ‘আমাদের এই খচড়া দেশ’ বলতে? তা হলেই তো আর কোনও ব্যাকরণের ভুল থাকত না। মুচকি হাসি আমি।
থাকত। ও গম্ভীরভাবে বলল, বলা উচিত ছিল ‘আপনাদের মতো খচড়াদের দিয়ে তৈরি দেশ।’
সর্বনাশ, খুব বেঁচে গেছি। তুই তো আর. ডি. এক্স-রে! সঙ্গে ঘোরা বিপজ্জনক! কখন ফাটবি, নিজেও যাবি, আমাকেও উড়িয়ে দিবি! ডেঞ্জারাস!
কথাটা তোর মনে হয় না? সোশাল সার্ভিস করিস তো? চেতনা বাড়াবার জন্যে কিছু করতে পারিস না? জাস্ট নাগরিক চেতনা! রাস্তায় ময়লা ফেলতে নেই, বাসে স্মোক করতে নেই, গাঁক গাঁক করে লাউডস্পিকার চালাতে নেই, কিউ ভাঙতে নেই, নিজের কাজটা করতে হয়।…
বাস, বাস, তোর ‘নেই’ আর ‘হয়’-এর লিস্টটা পরিষ্কার হয়ে গেছে আমার কাছে।
রিয়ালি? তো করিস না কেন কিছু?
করব, করব, শিগগিরই করব ভাবিসনি।
বিরক্ত মুখে ধোসার ওপর ছুরি চালাল কাজল। যেন আমজনতা, অর্থাৎ ওই ‘নেই’ আর হয়’গুলো যারা মানে না, তাদের ওপর দিয়ে। আমিও বাদ যাচ্ছি না। একে কিচ্ছু করি না, তার ওপর আবার ফাজলামি।
ছবিগুলো আর একবার ব্যাগ থেকে বার করে দেখি। একগাদা ভিড়ের মধ্যে কখনও আধা মুখ কখনও সিকি মুখ, কখনও দু’-দুটো মাইক্রোফোনের পেছনে বক্তৃতারত ভ্যাটকা মুখ। দুর! এভাবে একটা মানুষকে শ’য়ে শ’য়ে যাত্রীর মধ্যে থেকে চিনে নেওয়া অসম্ভব। নিতাইদা তো ফোটোগুলো দিয়েই খালাস। কাজল ফট করে ওর ঝোলা থেকে একটা লম্বাচওড়া চার্ট পেপারের রোল বার করল। বলল, ‘তোর হাতের লেখাটা তো ছাপা হরফের মতো, লিখে ফেল দেখি নামটা। বড় বড় করে।’ একটা বেগুনি রঙের ফেল্ট পেনও বার করে দিল। সুতরাং হাতের লেখার সুনাম রাখতে আমি বড় বড় করে লিখি KASTURI BEN। লেখার সময়েই খেয়াল হয়েছিল ওঁর পদবিটা আমরা জানি না। সত্যি কথা বলতে কি এই গুজরাতিদের ভাই আর বেন-এর জ্বালায় পদবিটা উবেই যায়। ভুলাভাই, শরদভাই, নমিতা বেন, নীলম বেন। তবে আমরা কেউই স্বপ্নেও ভাবিনি উনি একটা সাধারণ স্লিপার বা শয়নযান থেকে কাঁধে একটি ঝোলা, আর হাতে একটা মাঝারি ক্যারি-অন নিয়ে নেমে আসবেন। উনি গটগট করে আসছিলেন একটা সচল গাছের মতো। আমাদের প্ল্যাকার্ডের দিকে। অর্থাৎ স্টেশনের উলটোমুখো। কেননা আমরা ওঁকে সামনের দিকে এ.সি. ফার্স্ট ক্লাস কোচগুলোয় খুঁজছিলাম। কিন্তু যেই দূর থেকে দেখলাম, এক লহমায় আবছা, আধা-সিকি ফোটোগ্রাফগুলোর খাপে খাপে বসে গিয়ে উনি জ্যান্ত হয়ে উঠলেন। দেখলে কে বলবে কটন-কিং-এর মেয়ে! স্মার্ট খুব, কিন্তু ড্যাশিং টাইপ লাগছিল না। খুব কেজো মহিলা। প্র্যাকটিক্যাল, শান্ত কিন্তু দৃঢ়। এরকমটাই আমার প্রথম মনে হল। সাদা ধবধবে মিলের শাড়ি পরেছেন। সাদা লেসের পাড়। শাড়িতে ছোট ছোট সাদা চিকনের ফুল। ভদ্রমহিলা ময়দার মতো সাদা ফরসা। মজবুত ফিগার। দারুণ একটা ব্যক্তিত্বের আঁচ পাচ্ছিলাম। থাকবেই। নইলে আর কাজগুলো করেন কী করে! ফোটোর চেয়ে অনেক কম বয়স, বেশি অ্যাট্রাকটিভ লাগে। তবে মাঝবয়সি তো নিশ্চয়ই। এবং গুজরাতি কটন কিং-এর মেয়ের নাকে কানে হিরে নেই। আশ্চর্য!
প্ল্যাকার্ড এবং পেছনে আমাদের দেখে উনি থেমেছিলেন, একটু টানযুক্ত বাংলায় বললেন নিতে এসেচ আমায়? কেন? সেকী? আমি ঠিক চলে যেতে পারতুম। —চলছেন আমাদের সঙ্গে সমান তালে। কিছুক্ষণ ওঁর সঙ্গে গটগট করে চলতে চলতে ভাল লাগে খুব। যেন আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।
আপনি এত ভাল বাংলা বলেন! —বিগলিত হয়ে জিজ্ঞেস করি। কস্তুরী বেন চলতে চলতে বললেন, কেনো? নিতাই বোলেনি আমার ছুটবেলা কেটেছে কলকাতায়। জোন্মো থেকে।
একথাটা অবশ্য আমরা জানতাম না। শুধু জানতাম এখানে ওঁদের কিছু সম্পত্তি আছে। থাকতেই পারে। গুজরাতি মিলের শাড়ি ধুতি চাদর তো এখানকার বাজার ছেয়ে আছে।
সেই থেকে এতদিন পরেও মনে রেখেছেন? —আমি না বলে পারি না। একটু গম্ভীর অন্যমনস্ক গলায় উনি বললেন, ছুটোতে মানুষ যা শিকে আর ভুলে না। ছুটোবেলাই সব বেলা।
শেষ কথাটা ভাল বুঝলাম না! ছোটবেলাই সব বেলা? কী অর্থে? এই যে আমাদের উৎসাহ-ছটফট যৌবন, ওঁর এত কেজো সফল প্রৌঢ়ত্ব, এগুলো? এগুলোর চেয়েও ছোটবেলার গুরুত্ব বেশি? কাজলের সঙ্গে চোখাচোখি করি। মিটিমিটি হাসছে। মানে আমার ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা উপভোগ করছে। ভাল বাবা, কর। তুই সব কথার মানে বুঝিস, কখনও ভ্যাবাচ্যাকা খাস না, তোর কাছে প্রশ্ন কম, উত্তর বেশি। সে উত্তরগুলো দিতেও তোর যথেষ্ট কার্পণ্য। তোর উইজডম- এর চড়া দাম। আমি বাবা একটু অভিভূত ধরনের মানুষ। যারা বশংবদ থাকে, দূর থেকে পুজো করে, নিজেকে অন্যের তুলনায় সামান্য মনে করে, শেখবার জন্য, নতুন কিছু করবার বা দেখবার জন্যে যারা উন্মুখ হয়ে থাকে। এটা কিন্তু আত্মবিশ্বাসের অভাব জাতীয় জিনিস নয়। এটা আমি কাজলকে বোঝাতে পারি না। ও বলে ‘হম কিসিসে কম নহি, কম নহি’ মন্ত্র জপ করতে থাক, ঠিক হয়ে যাবি।
মন্ত্র জপ করলেই সব্বার থেকে তালেবর হয়ে যাব? এত সোজা!
তা তো বলিনি! ব্যাপারটা হল এই যে, তুমি হতে পারো নামকরা সেতারি কি সরোদিয়া, লাখ লাখ কামাও, ডিজাইনার জামাকাপড় পরে আসরে বসো, আংটি থেকে হিরে ঝলকায়, কিন্তু আমিও একটা পূর্ণাঙ্গ মানুষ। আমার কাজটা আমি ষোল আনা সৎভাবে করি। আমি জীবনের প্রতিটি ধাপ জানতে জানতে, বুঝতে বুঝতে, লড়াই করতে করতে এইখানে পৌঁছেছি।
আমি বলি, কার কথা বলছিস? তোর কথা?
ভীষণ রাগ করে কাজল, ইয়েস, আমার কথা। কিন্তু তোরও কথা। যে ছেলেগুলো খেত-মজুরি করে বই ভাগাভাগি করে পড়ে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করে, জয়েন্টে চান্স পায়, তাদেরও কথা, যে ভদ্রলোক এই কাপুরুষের দেশে সাহস করে কোনও মেয়ের অপমানের জবাব দেন তাঁরও কথা, যে কুলি সারাদিন ঠেলায় লোহার রড বয়ে বয়ে রাত এগারোটায় রাস্তার কল থেকে জল নিয়ে ছাতু ভিজিয়ে খাচ্ছে, তারও কথা।
ওকে বোঝানো মুশকিল। তাঁর নিজের ক্ষেত্রে একজন সেতারি কি সরোদিয়া যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, একজন সমাজকর্মী হিসেবে আমি বা অন্য যে সব সৎ আন্তরিক মানুষদের কথা ও বলল— আমরা কি আমাদের কাজের জায়গাতেও সেইখানে দাঁড়িয়ে আছি?
সততার, সিনসিয়ারিটির, স্ট্রাগল-এর কোনও ফার্স্ট সেকেন্ড হয় না মিঠু, কোনও সেলিব্রিটি স্টেটাস হয় না। ধান্দাবাজির সমাজসেবা তো আর করিস না!
কোথা থেকে কোথায় চলে গেল— যাঃ। এই হল কাজল।
ওর যুক্তি-তর্ক সত্ত্বেও কিন্তু আমার বীরপূজার বাতিক কমে না। আমি আমার দেবতাদের থেকে অটোগ্রাফ নিতে নিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি, বিহ্বল হয়ে যাই— সে গায়ক, বাদক, লেখক যিনিই হন না কেন। আমি তো কাজলেও মুগ্ধ, অভিভূত। একজন ট্রাইব্যাল ছেলে যতই কেন সুযোগ-সুবিধে পাক, এমন করে সব কমপ্লেক্স ঝেড়ে ফেলবে গা থেকে ময়লা ঝাড়ার মতো, তথাকথিত মূল স্রোতের ছেলেমেয়ের সঙ্গে সহ-ও প্রতিযোগিতা করে এইখানে এসে দাঁড়াবে এবং নিজের পদবি বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করবে, এটা মোটের ওপর অভাবনীয়। বাংলা ইংরেজি দুটোই বলে অবলীলায়, জলের মতো। নাক-উঁচুদের সঙ্গে যখন মেশে তখন ওর ব্যক্তিত্ব থাকে সবাইকে ছাড়িয়ে অন্য উচ্চতায়, যদিও সেভাবে বোঝা যায় না কথায়, পোশাকে, ব্যবহারে বা আদবকায়দায়। একদম সহজ। আলাদা হয়ে থাকে শুধু সামান্য একটু উন্নাসিকতা আর ওর কষ্টিপাথরের চকচকে চেহারাটা। একটু থ্যাবড়া নাক, পুরু ঠোঁট, চৌকো মতো মুখ, বডিবিল্ডিং না করেও প্রায় এক বডি-বিল্ডারের মতোই সৌষ্ঠব। ওকে পুজো করব না তো কী? ওর চেনাশোনা অনেক, জানি তারাও ওকে প্রশংসা সম্রমের চোখে দ্যাখে। কাজল! ওহ, ও তো একসেপশন্যাল। কিন্তু তারা ওকে কাজল বলে মনে রাখে, মুণ্ডাটা ভুলে যায়। ইচ্ছে করেই কি না, জানি না। চেহারার আদিবাসী মহিমা অবিকৃত রেখে ত্বকের দ্যুতি ছড়িয়ে, বিদ্যাবুদ্ধি ঝলমলিয়ে যখন একমুখ বিরল হাসির ফোয়ারা ছুড়ে বলে, ওহ নো, নট মুন্দ্রা, মুণ্ডা। কাজল মুণ্ডা। গট ইট? আমাদের কোনও এক কমন ফ্রেন্ডের একদিন কী দুর্মতি হয়েছিল, বলেছিল দ্যাখ, লোকে সরকারি সুবিধে পাবার জন্যে পদবি বদলে এস.সি. এস.টি. হয়ে যায়। গ্রামের দিকে বিশেষত। ভাবতে পারবে না, আমাদের বাবার কালের কাজের লোক শিডিউলড কাস্টে নাম লিখিয়ে রজক দাস হয়ে এল, শুনতে পাই সরকারি নিয়মের ফাঁকফোকর দিয়ে জমিজমা, ছেলেদের চাকরিফাকরি সব বাগিয়েছে। তা কাজল, তুমি তো উলটোটাও করতে পারো, কারও সাধ্য নেই বোঝে তুমি সাত পুরুষে শিক্ষিত নও। কাজল রাগ করেনি, শান্ত, হাসি ছিল চোখে, বলল, তো মরা চট করে রং বদল করতে পারো। আমি পারি না— নাকের ওপর হাত রেখে বলেছিল— আমার পরিচয় এইখানে দাগা আছে, অনাস। সেই ঋগ্বেদের যুগ থেকে। তা ছাড়া করব কেন? আমি ইতিহাস। ৭০০০ বছরের ইতিহাস। ব্রোঞ্জ যুগ থেকে বর্তমান স্যাটেলাইট, কম্পিউটারের যুগে মানুষের উৎক্রান্তির ইতিহাস। রেয়ার স্পেসিমেন। হোয়াই শুড আই ডেসট্রয় ইট!
হাওড়া স্টেশনে একটা মেল বা এক্সপ্রেস ট্রেন এলে ট্যাক্সির লাইন আদি-অন্তহীন হয়ে যায়। তবে কিছু কালোবাজারি ট্যাক্সি থাকে, তারা প্রি-পেড ট্যাক্সির মতো আগে থেকে ভাড়া ঠিক করে নিয়ে চুপিচুপি প্যাসেঞ্জার নিয়ে আউট অব টার্ন চলে যায়। অবশ্যই ভাড়া দেড়া, কি ডবল। এইরকম একটা ট্যাক্সি ধরবার চেষ্টায় ছিলাম, কস্তুরীবেন বললেন, কিউটা কীসের?
কিউয়ে দাঁড়ালে ভীষণ দেরি হয়ে যাবে দিদি— কাজল বলল।
আমরা অন্য ট্যাক্সি ধরার চেষ্টা করছি। —আমি তাড়াতাড়ি বলি, এখানে এরকম না করে কোনও উপায় নেই।
—কিউয়েতে দাঁড়াতে অসুবিদে কী? তোমাদের পায়ে বেথা বা তাড়া কিছু?
আমি বলি, না। আসলে আপনি এতটা ট্রেন জার্নি করে এলেন, সাত ঘণ্টা লেট।
আমাকে থামিয়ে উনি বললেন, লেট তো হচ্ছেই। এতো জার্নি তো শেষ হোয়নি এখনও। এখনও কি ঠিক অ্যাড্রেসে পৌঁছোতে পেরেছি?
এমনভাবে কথাটা বললেন যে, মনে হল ‘ঠিক অ্যাড্রেস’ বলতে উনি মোটেই তিনের এক ফার্ন রোডের বাড়িটাই বোঝাচ্ছেন না। আরও কিছু, তারও অতীত, তারও অতীত। এত দূর, দৃষ্টির অগোচর কোনও ঠিকানার দিকে চোখ রেখে কোনও মানুষ পথ চলতে পারে? সন্দেহ নেই, ইনিও আমার এক অটোগ্রাফ-হিরো বা হিরোইন হতে যাচ্ছেন।
কাজল বলল, আমি এখানে থাকা সত্ত্বেও আপনাকে কষ্ট করতে হবে কেন?
কস্তুরীবেন এতক্ষণে মিটিমিটি হেসে বললেন, সেটা এনডিওরেন্স ওয়াইজ বুঝতে হবে। তুমাকে হাটকাট লাগছে— খুব বেয়াম ওয়েটলিফটিং করো নাকি?
হাটকাট মানে হাট্টাকাট্টা আর কী!
কাজল বলল, সামান্য। অ্যাথলিট হিসেবেও মন্দ না। আপনাকে কাঁধে করে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারি।
বোটে!—উনি হাসিহাসি চোখে বললেন।
আধ ঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি পাওয়া গেল। জ্যামট্যাম, লাল-বাতিটাতি পেরিয়ে যখন তিনের এক ফার্ন রোডে পৌঁছোলাম তখন সন্ধে হয়ে গেছে। বাড়িটা বেশ বড়, তিনতলা। একটু তেধেড়েঙ্গে-টাইপ, আজকালকার আর্টিটেকচার নয়। কেয়ারটেকার রামলাখনের কাছ থেকে চাবি নিয়ে উঠতে উঠতে আমাদের ওপরে ডাকলেন, দরজা খুললেন উনি। এই তেতলাতেই উনি থাকেন মনে হল। জানি ওঁরা ধনী। কিন্তু ফ্ল্যাটটা বা বলা ভাল তিনতলাটা, যত বিরাট তত সাজানো-গোছানো কিছু নয়। একটা ঘরে দেখলাম তক্তপোশ পাতা, ওপরে সাধারণ একটা তোশকের ওপর সাধারণ হ্যান্ডলুমের বেডকভার। একটা গোদরেজের আলমারি, একটা গদিঅলা হাতলহীন চেয়ার। সাধারণ টেবিল, দেওয়ালে লাগানো তাকে কিছু বই। এ ঘরে মালপত্র রেখে উনি আর একটা ঘর খুললেন— বৈঠকখানা, তক্তপোশ, গদি, গোটা চার তাকিয়া, নিচু টেবিল, গদি দেওয়া কাঠের বেঞ্চি। পুরনো দিনের কিছু সুন্দর মোড়া। দেওয়ালে প্রচুর ছবি, যেমন সরকারি অফিসে টাঙানো থাকে— গাঁধীজি, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্রকে চিনতে পারলাম। অন্যদের নামগুলো জ্বলজ্বল করে লেখা না থাকলে আমি অন্তত চিনতে পারতাম না—স্বীকার করাই ভাল। গোখেল, সুরেন ব্যানার্জি, বিপিন পাল, উল্লাসকর দত্ত, সূর্য সেন, লালা লাজপৎ রায়, বালগঙ্গাধর তিলক। ক্ষুদিরামকে চিনলাম ওঁর ফাঁসির গানের সঙ্গে সঙ্গে চেহারাটাও খুব পাবলিসিটি পায় তো! প্রফুল্ল চাকী আর সূর্য সেন বোধহয় এই প্রথম দেখলাম। কস্তুরীবেন দেখি ঘরটাতে দাঁড়িয়েই আছেন, দাঁড়িয়েই আছেন, যেন বাহ্যজ্ঞানশূন্য।
এই পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আমরা চলে যাব কিনা ভাবছিলাম। একটু অস্বস্তিও লাগছিল, মানুষটি এখন স্মৃতির রাস্তা দিয়ে পেছনে চলেছেন, বুঝতে পারি। কিন্তু উনি বেশ আদেশপূর্ণ গলায় বললেন, বসো।
কাজল দাঁড়িয়েই রইল, কিছু খাবারটাবার আনি দিদি!
সোব হোচ্ছে, সোব হোচ্ছে, ইমপেশেন্ট হোবে না। বসো।
অসহায়ের মতো বসে রইলাম দু’জনে। আর কী আমাদের করণীয় আছে কে জানে! নিতাইদা বলে দিয়েছেন, ওঁর দেখাশোনা করতে, কথা শুনতে। তো বসি। বৈঠকখানার ফাঁক দিয়ে একটা লাইব্রেরি মতো দেখা যাচ্ছিল। দেওয়ালে দেওয়ালে আঁটা আলমারিতে বই। টেবিল চেয়ার, একটা আরাম-চেয়ারও। সামনের দিকে তাকালে দেওয়ালে বিবেকানন্দ ও শ্রীঅরবিন্দর ফোটো চোখে পড়ে। এই ছবি দুটো অর্থাৎ ওঁর শোওয়ার ঘরে স্থান পেয়েছে।
উনি ব্যস্ত হয়ে একবার ঘুরে গেলেন, চুপ বসে কেনো? গোল্পো কর, গোল্পো করতে বাধা নেই। ইস্কুল নয়, কি জেলখানা।
কাজল আমার দিকে তাকায়। অর্থাৎ কী আর করা! অপেক্ষা করো, কী দুরূহ ডিউটি এবার পড়বে, এবং ইতিমধ্যে গোল্পো কোরো।
আমি গভীর কৌতূহলে লক্ষ করি গত শতাব্দীর এইসব সাজসজ্জা। উঁচু সিলিং, পুরু দেওয়াল, গরাদের জানলা, চার ব্লেডের ফ্যান, রদ্যাঁর থিংকারের একটা রেপ্লিকা রয়েছে, এতক্ষণ দেখিনি। উনি এঘর থেকে ওঘর ব্যস্তভাবে ঘোরাফেরা করছিলেন আর মাঝে মাঝে— রামলাখন, রামলাখন বলে হাঁক পাড়ছিলেন। রামলাখনের ‘হাঁ জি, হাঁ জি’ও শোনা যাচ্ছিল। কাজলও মনের মধ্যে সব টুকে রাখছে বুঝতে পারছি। তবে ব্যাটা মহা চালাক। জানতে দেবে না।
এমন সময়ে চানটান করে ফ্রেশ জামাকাপড় পরা কস্তুরীবেন ঢুকে বললেন, রাত হয়ে যাচ্ছে। এসো আমরা তিনজুনে এইখানে বসে খাওয়া সেরে নিই।
আমরা দু’জনেই হাঁ হাঁ করে উঠি। উনি এবার গম্ভীর চোখে চেয়ে বললেন, কেনো? বাড়িতে মাংস আছে? না ইলিশ রান্না হোচ্ছে, পাতুরি, কেলাপাতা মোড়া? তিনজনেই হেসে ফেলি।
রামলাখন তিওয়ারি খাবার দিয়ে গেল। গরম গরম মোটা মোটা আটার রুটি, তুলতুলে নরম, অড়হর ডাল, আর রসগোল্লা।
বাথরুম থেকে হাতমুখ অগত্যা ধুয়ে আসতে হয়। ন্যাপথলিনের গন্ধঅলা কবেকার সবুজ বর্ডার দেওয়া সাদা টার্কিস তোয়ালেতে হাত মুছে এসে বসি। উনি বললেন, কোতো সোকালে গেছ। কোতো কোষ্ট হয়েছে আমার জন্যে! দুপুরবেলা কী খেয়েছেন— মিষ্টি? বেচারা!
আমাদের যে তেমন কোনও অসুবিধে হয়নি, অভুক্ত নেই— এসব বলে কোনও লাভ হল না। চামচ করে মাখন লাগিয়ে দিলেন রুটিতে। আমার ফিগারের বারোটা বাজল।
খাবার সময়ে উনি একটাও কথা বললেন না। কোনও নিয়ম মানেন? না কী? ওঁর মতো আধুনিক মনের মানুষ কোনও পুরনো নিয়মে আটকে আছেন ভাবতে ভাল লাগল না। কী আর করা যাবে! তবে ক্রমশই ওঁকে খুব আত্মমগ্ন লাগছিল। ঠিক চিন্তাগ্রস্ত নয়। কিন্তু কিছু একটা জরুরি বিষয় আছে যা নিয়ে উনি ভাবছেন। রসগোল্লার রস টিপে খাচ্ছি দেখে হঠাৎ যেন সংবিতে ফিরে এলেন।
—ফিগার কনশাস?
আমি চমকে উঠি। একটু লজ্জা পেয়ে বলি, মিষ্টি বেশি খেতে পারি না।
—রসই যদি ফেলে দিলে তোবে আর রসগোল্লা কী? দিস ইজ আওয়ার স্পেশ্যাল ফেভারিট ইন আমদাবাদ। আগে জানলে তুমাকে তিত গোল্লা খাওয়াতে পারতুম।
—কোত্থেকে? আছে আপনার কাছে? —কাজল হেসে জিজ্ঞেস করল।
উনি বললেন, আছে। জড়িবুটি দিয়ে বানানো গোলি। আমি রোজ সোকালে একটা করে খাই। কুনও রোগ কাছে ঘেঁষতে পারে না।
—কোথায় পাওয়া যায়? —আমাকে আমার স্বাস্থ্যবাতিকে বাবা-মায়ের জন্য অনেক কালমেঘ খেতে হয়েছে, তেতোকে আমি ভয় পাই না।
—কুত্থাও পাবে না। এ আমাদের ফেমিলির নিজস্ব ফরমুলা। আমরা সোব বাড়িতেই বানাই তো! আচার, মিষ্টি, ওষুধ— সোব।
—আপনাদের তা হলে ডাক্তার লাগে না বলুন।
—ফাংশন্যাল ডিজিজের জন্যে খুব কম। কোনও অর্গ্যান খারাপ থাকলে বেচারি কী করছে?
এ ভাবেই শেষ হয় কস্তুরীবেনের সঙ্গে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ।
২) আমি ও ওরা
সমাজসেবা আজকাল আর চ্যারিটি ওয়র্ক নেই। রীতিমতো পেড জব। তবে হ্যাঁ, খাটতে হয়। সময়েরও ঠিক-ঠিকানা নেই, কোন জবেই বা আছে! আমি পাশ করার এক বছরের মধ্যেই ভাগ্যক্রমে একটা এন.জি.ও-তে কাজ পেয়ে গেছি। টাকাপয়সা অনিয়মিত। সুতরাং আমিও একটু আধটু অনিয়মিত হতেই পারি। সাহিত্য নিয়ে পড়েছিলাম, কেননা বিজ্ঞানে চান্স পাইনি। তবে বিজ্ঞানে আমার ন্যাক নেই এটা সেন্ট পারসেন্ট সত্যি কথা। না পেয়ে আমার কোনও দুঃখ হয়নি। বাবা বলেছিল— তুই তোর যা ইচ্ছে পড়। বাবা নাকি সাহিত্য ভালবাসত। লিটল ম্যাগট্যাগ করেছে এককালে। বড়রাই বাবাকে জোর করে মেকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ার বানালেন। তখন, ষাটের দশকে এঞ্জিনিয়ার উদ্বৃত্ত হতে শুরু করে। অনেকেই চেষ্টা-চরিত্র করে বিদেশ, বিশেষত, আমেরিকা চলে যায়। ওখানে তখন যথেষ্ট চাহিদা। আমার বাবা চাকরি পেল, কিন্তু সুদূর জামনগরে। দাদু ছিলেন, ঠাকুমা খুব রুগ্ণ, তার ওপরে মায়ের একটা খুব ভাল স্কুলে চাকরি ছিল। মাকে থেকে যেতে হয়। সারা জীবন বাবার একলাই কাটল। যা-ই হোক। এত কথা বলা— যা পড়তে চাই, যা করতে চাই— আর যা চাই না কিন্তু করতে হয়— এই বাধ্যবাধকতা যে কত বিরক্তিকর তা বোঝাতে। এতদিন যা পড়েছি শিখেছি তা সরাসরি প্রয়োগ করার তেমন সুযোগ নেই আমার জবে। কিন্তু এই বদলটা আমার মন্দ লাগে না।
কলেজ-ইউনিভার্সিটি জীবন আর তারপরে চাকরি বা বিয়ে যা-ই হোক, সে জীবনটার কেমন একটা সূক্ষ্ম তফাত হয়ে যায়। বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু বদলে যায়। পোশাক দ্যাখো সেই একই, জিনস্ আর টি-শার্ট, চটি কিংবা হিল, চট করে বাস-ট্রাম মেট্রোর হাতল পাকড়ে উঠে যাওয়া যায়। গোঁত্তা খেতে খেতে আঁচল-চুন্নি এসব সামলাতে কি ভাল লাগে! দেখে কেউ বুঝবে না কে ছাত্রী, কে কম্পিউটারবাগীশ, কে অফসর, কে বা অভিসারে যাচ্ছে। আমাদের এই পোশাক নিয়ে বড়দের মহলে একটু রি-অ্যাকশনারিপনা আছে। নীতা তো ওর কেমিস্ট্রি স্যারের বউয়ের কাছে হেভি ঝাড় খেয়েছিল। ওর অবশ্য একটু বেশি বাড়াবাড়ি! এত টাইট পরে যে মডেল, না ছাত্রী, বোঝা যায় না। স্যারের স্ত্রী বলেছিলেন—‘এখানে পড়তে আসতে হলে তোমাকে আর একটু আলগা পরতে হবে। যখন র্যাম্প ওয়াকিং করবে তখন যা খুশি পোরো।’ নীতা এক নম্বরের টেঁটিয়া মেয়ে। এরপরে ও সালোয়ার কামিজ পরে যেতে লাগল। নো ব্রা। স্যারের স্ত্রী বললেন— তুমি বরং অন্য কোনও টিউটর খুঁজে নাও। আমার বাড়িতে আমি বেয়াদপি সহ্য করব না। আর শোনো, অপরিণত আছ, তাই বুঝছ না, কিন্তু নিজের সম্মান নিজের হাতে।
ভোলেভালা স্যারকে নীতা খুব জোকস্ বলত, স্যারও হা-হা করে হাসতেন, তিনি ওর পোশাকের আঁটোমি খেয়াল করেছিলেন কিনা জানি না। তবে নীতা যখন বলে, স্যার আপনার বাড়ি পড়তে আসতে আমার অসুবিধে হচ্ছে, আমার বাড়ি আসবেন? গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে যাব। উনি বলেন, তোমার সাহস তো কম নয়!
নীতা গ্র্যাজুয়েশনের পরেই ফ্যাশন-ক্যাপিট্যাল মুম্বইতে চলে গেল। ঠিক কী করছে এখন জানি না। কে যেন বলছিল কল-সেন্টারে কাজ করছে। কোথায় সুপার মডেল হয়ে রাতারাতি ফ্যাশন-ক্যাপিট্যাল জয় আর কোথায় কল-সেন্টার!
ড্রেস নিয়ে কারও কারও বাড়িতে আপত্তি থাকলে আমাদের বন্ধুমহলে জোর আলোচনা হত। তখন আমরা কখনও আর্টস, কখনও সায়েন্স বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির ধাপে বসে তর্কাতর্কি করতাম। কেউ বসেছে সবচেয়ে নিচু ধাপে, তার ঠিক ওপরে হয়তো তিনজন। তারও ওপরে দু’জন। কেউই সোজা হয়ে নেই, একটু এঁকেবেঁকে। নইলে মুখোমুখি হব কী করে! আমি অবশ্য শোনার দলে, মাঝে মাঝে মধ্যস্থতাও করতে হয়, ‘বলি কম, ভাবি বেশি’— আমার এক্স-টিউটর দীপক শর্মার দেওয়া এই ভাবমূর্তিটা বজায় রেখে।
রাজদীপ হয়তো বলল, এই তোরা ফেমিনিন জেন্ডাররা চিরকাল কন্ট্রোভার্সি ক্রিয়েট করে যাচ্ছিস। ফর নাথিং। কী পরবি, কী পরবি না— এটা কি একটা ইস্যু হল?
রৌনক তখন বলবে, আরে ইয়ার, একটু তদন্ত কর, দেখবে এখানেও সেই কজ অ্যান্ড এফেক্টের খেলা।
আমার কৌতূহল হবে। আমি বলব, কী রকম?
জেনারেশন গ্যাপ কারও বাড়িতে কম, কারও বাড়িতে বেশি। এই ধর পিয়া, ওর মা ওর থেকে জাস্ট বিশ বছরের বড়, গ্যাপ কম।
সাড়ে উনিশ— পিয়া শোধরাবে।
হোয়াটেভার… বিশ বছরের গ্যাপ হল হাফ জেনারেশন। পিয়ার মা-ও পেন্টুল পরেছে একসময়ে; কী রে পিয়া?
পিয়া সিগারেট ধরিয়ে বলবে, পেন্টুল ঠিক নয়। প্যারালেলস পরত মা, ছবি আছে। তখন স্লিম ছিল। এখন যা মুটিয়েছে!
তবে? ঠিক বলেছি কিনা! —রৌনক মহা খুশি— কিন্তু এই ধর মধুমিতা। শি ইজ দা থার্ড চাইল্ড অব আ লেট ম্যারেজ। তোর সঙ্গে তোর মায়ের কত গ্যাপ রে মধু?
মধুমিতা মুখ ঝামটা দিয়ে বলবে, তাতে শালা তোর কী?
ওয়েল, আমি পয়েন্টটা এসট্যাবলিশ করতে চাইছি। তোদের পোশাকে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসে গেছে। এনিওয়ে, মধুর মা মাস্ট হ্যাভ বিন ফর্টিজ হোয়েন শি ওয়জ বর্ন। অর্থাৎ কিনা বিগ বিগ গ্যাপ। বাস, পুজোর সময়ে ফ্রি-সাইজ ঢোলকের মতো সালোয়ার কামিজ চলে এল। নববর্ষে টাঙ্গাইল শাড়ি। খিটিমিটি। জিন্স-ফিনস্গুলো কিনতে ওকে লাগাতার ফাইট করে যেতে হয়। কী রে মধু, ঠিক বলেছি?
তুই তো সব জানিস। শেয়াল-পণ্ডিত। টাঙ্গাইল বানান কর তো?
রৌনক খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে হাসতে তিন নম্বর সিগারেটটা ধরাবে।
বিন্দি বলবে, এ ছাড়াও একটা কারণ আছে।
—কী কারণ? কী কারণ?
—শুট ইয়ার।
কেউ হয়তো বলল, এ তো রীতিমতো সোশ্যাল স্টাডিজের রিসার্চ পেপার হয়ে যাচ্ছে! এম. ফিল-এর ডিসার্টেশন। কুইক শেষ কর, লাইনে আরও টপিক আছে বাবা!
বিন্দি বলবে, ইফ য়ু ডোন্ট মাইন্ড, ফ্যামিলি স্টেটাসটা একটা বিগ ফ্যাক্টর। যার বাবা বিগ বস, সে জিনস্ কেন সুট-প্যান্ট, মিনি-স্কার্ট সবেতেই ‘ইয়েস’ পাবে। যার বাবা মাস্টার, তার কেস খারাপ। স্কার্টের ঝুল বাড়াও শাড়ি ধরো। আঠারো বছর বয়স হয়ে গেল… ইটস শোয়িং…
মনীষার বাবা অধ্যাপক। সে তুমুল অট্টরব অগ্রাহ্য করে বাঁকা হেসে বলবে, হ্যাঁ সেটা নামেও মালুম। স্টেটাসে আবার রুচিও বিদায় নেয়। ফেয়ার ওয়েল টু রুচি। আইডেন্টিটি তো আগেই ভোঁ ভাঁ! কী নাম! আ হা হা হা—বিন্দি, জুহি, পিঙ্কি… হ্যাভ নো রেফারেন্স টু ওয়ান’স অরিজিন, ল্যাঙ্গোয়েজ…
—আর রিলিজনটা বললি না? —বিন্দির মুখে হাসি, চোখে ঝাঁঝ।
—তুই-ই বল না। আমি আর কেন কথা খরচ করি! সব তো জানিস!
—ইন্ডিয়ানিজম ইন্টারন্যাশন্যালিজ্ম্ ইয়ার! বঙ্গভাষা বঙ্গসংস্কৃতি বঙ্গসন্তান করতে করতে শেষ পর্যন্ত নির্ভেজাল বং! ওহ। তোরা কবে বুঝবি? এখন ভাষা, সংস্কৃতি, অরিজিন এসব ম্যাটার করছে না। ভুলতে হবে। না ভুললে পৃথিবীর সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে পারবি না। না পারলে পিছোতে হবে, পিছোতে পিছোতে মনু-যুগ-টুগে ফিরে যেতে চাস? নাকি ট্রাইব্যাল বেল্টে ফুড গ্যাদারার হান্টার স্টেজে! অ্যান্ড দেন? অবলিভিয়ন— কেউ আর তোকে চিনবে না, জানতে চাইবে না। শেষ পর্যন্ত জিরো।
এ কথাগুলো বিন্দিরই, না রৌনকের? মনে পড়ছে না।
—ওই তো কতকগুলো কথা শিখেছিস! হিরো। জিরো! যে যা ব্রেনে ইনজেক্ট করে যাচ্ছে, কপচে যাচ্ছিস। বস্তাপচা হয়ে গেছে, বুঝছিস না। ভাবনা-চিন্তা করতে শেখ নিজে নিজে, ফ্রি-থিংকিং। নইলে আমি নাহয় জিরো, কিন্তু তোদের মতো আইডেন্টিটিলেসদের আন্তর্জাতিক বাজারে মর্কট বলে ডাকবে।
মনীষা লাফিয়ে উঠে দাঁড়াবে, কারণ রৌনক বলতে শুরু করেছে, নো পার্সন্যালিটিজ ইয়ার। দিস ইজ নট ডান।
মনীষা চলে যেতে যেতে বলে যাবে, এই যে ‘ইয়ার’টা ধরেছিস রৌনক, এটাও টুকলি। দিল্লি-বম্বে থেকে। নিজেদের ডাক-টাকগুলোও ভুলতে চেষ্টা করছিস পাছে কেউ বং বলে। তবে কী জানিস! যাদের হিরোটিরো বলিস, ‘দাদা’ ডাকটা তাদের সৌজন্যে বেশ মর্যাদালাভ করেছে। অশোককুমার, কিশোরকুমার, হেমন্ত মুখার্জি এঁদের সবাই ‘দাদা’ বলত। এখনকার সৌরভ গাঙ্গুলিকেও টিমের সব ক্রিকেটাররা অঞ্চল-নির্বিশেষে ‘দাদা’ই বলছে। কই বং তো বলছে না! ডিফারেন্সটা কোথা থেকে হচ্ছে, কেন হচ্ছে, নেক্সট সেশনটা এই নিয়েই চালা। কাজে দেবে!
হেভি রেগেছে— বিন্দি বলবে।
মনীষা চলে যাচ্ছে, রৌনকের ইচ্ছে করছে এক লাফে গিয়ে ওকে আটকায়, মনীষা চলে গেলে অর্ধেক চার্ম চলে যাবে আড্ডার। ওর জন্যে।
শুনেছি কলেজে ওরা সব ফার্স্ট বেঞ্চে বসত। ছেলেগুলো পাশের জনকে এইসা ঠেলবে যে তাসের বাড়ির মতো একজন আর একজনের ঘাড়ে পড়তে থাকবে। এবার ঠেলাটা আসবে উলটো দিক থেকে। একদিকে রৌনক আর এক দিকে রাজদীপ, কিংবা পৃথ্বীরাজ। এগুলোই সবচেয়ে বিচ্ছু। মাঝখানে বিন্দি, জুহি, সম্পদ, রীতা সব হি হি হো হো করবে। প্রোফেসর এলেও থামবে না। পাস কোর্সের ক্লাস আবার ক্লাস!
একদিন ওদের প্রোফেসর দত্ত বলেছিলেন, বুঝতে পারছি— এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে যে, সে এখনও মাতৃগর্ভে। তবে পরস্পরের স্পর্শজনিত পুলকটাকে একটু সামলে যদি এদিকে একটু মন দাও তো ‘হিটলার-বধ’টা শুরু করতে পারি।
গল্পটা আমার মনীষার কাছেই শোনা।
ইউনিভার্সিটিতে স্বভাবতই একটু ম্যাচিওরিটি এল। বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড বদলে গেল। এ ওকে ডিচ করল, সে তাকে, তারপরে হাত ঝেড়ে বলল, যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে ইয়ার, হাতে হাত মেলাও। এ সময়ে ঠেলাঠেলির জায়গা নিল স-ধূম, স-তরল আড্ডা।
মজা হচ্ছে মনীষার পাশ করার বছরেই এক আমেরিকা-প্রবাসী হাইফাই ভদ্রলোকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল। এক বছর পরে যখন আমাদের আড্ডায় এল, দেখা গেল জিনস্ তো বটেই, টপটাও চোলিকাট। কানে বিশাল বিশাল রিং। ভুঁড়িতেও একখানা রিং লাগিয়ে এসেছে। বিন্দিটা একেন্নম্বরের বিচ্ছু, জিজ্ঞেস করে, কী রে আইডেন্টিটি, বাড়িতে কিছু বলছে না?
—আ’ অ্যাম ওল্ড এনাফ টু থিংক ফর মাইসেলফ— গম্ভীর জবাব।
—আর তোর বঙ্গালি আই ডি কার্ড?
—ঠুনকো নয় যে ভেঙে যাবে। আই ক্যান টেক কেয়ার অব ইট।
প্রস্থান।
আরও মজা হল, বিন্দি প্রেম করে বিয়ে করল এক প্রচুর পয়সাঅলা ভদ্রলোককে। যাকে বলে ম্যান অব প্রপার্টি। বাড়িতে জাঁদরেল শাশুড়ি, দিদিশাশুড়ি। ভদ্র মেয়েরা শাড়ি ছাড়া অন্য কিছু পরে, পান ছাড়া অন্য কোনও নেশা করে— ভাবতেই পারেন না। বিন্দির সিগারেট ঘুচে গেল, জিন্স ঘুচে গেল, হাতের মেহেন্দি ঘুচে গেল। নাম পালটে হল বিনীতা। বিন্দি আবার কী? ফোর্ড আইকনে ফরসা ধবধবে, কালো ঢেউতোলা চুল, বনেদি হাজব্যান্ডের পাশে বসে বিন্দি যায়। হুশ করে চলে গেলেও ওর মাথার সিঁদুর, কপালের ভেলভেট টিপ, শাঁখাসমেত গোছা গোছা সোনার চুড়ি পরা হাত দেখা যায়।
এখন রৌনক, রাজদীপ, আকাশের সঙ্গে দেখা হলে ওরা হাসাহাসি করে। বলে, তোরা কী জানিস? জলের জাত। যখন যে পাত্রে রাখা যাবে তখন সেরকম। হিউম্যান বহুরূপী। পিয়ার-প্রেশারে পেন্টল ধরেছিলি, সিগারেট ধরেছিলি। আবার ম্যারিট্যাল প্রেশারে শাঁখা-সিঁদুর ধরেছিস।
আমি বলি—অ্যাডজাস্টমেন্ট। একে বলে অভিযোজন। সার্ভাইভ করতে গেলে কখনও রোঁয়া গজাতে হয়, কখনও ঝরিয়ে ফেলতে হয়। আসল কথাটা দাঁড়াচ্ছে—সারভাইভ্যাল।
কে কী রকম সারভাইভ্যাল চাইছিস সেটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন— রৌনক দাঁতে নখ কাটে। ও কিছুতেই ভুলতে পারে না রুচি-পোশাক-কালচার এগুলোই মনীষার সঙ্গে ওর খেচাখেচির প্রধান কারণ ছিল।
আমি এসব ব্যাপারে দর্শক-শ্রোতার ভূমিকায়। ওদের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে আলাপ। আমি শুনি বেশি, বলি কম। আমার টিউটর দীপকদা বলতেন— তোমার টেম্পারামেন্ট একেবারে আদর্শ। ঝড়-জঞ্ঝা চট করে কাটিয়ে উঠতে পারবে। লোকে তোমাকে বিশ্বাস করবে, ভরসা করবে। সত্যি বলতে, কতকগুলো কথা সত্যিই মিলে গেছে। কার কী অবসেশন যাচ্ছে, কে কার জন্য দৌড়োচ্ছে— এগুলো আমি চট করে বুঝতে পারি। যার যা প্রবলেম, মনের-প্রাণের কথা, বন্ধুরা বেছে বেছে আমাকেই বলে।
রৌনক মনীষার জন্য ফিদা। বিন্দি বহুদিন ধরে রৌনককে চেজ করে যাচ্ছে, নাথিং ডুয়িং। অর্পিতার মায়ের অ্যাফেয়ার। বুল্টু নিজের চেয়ে পাঁচ বছরের বড় পাড়ার দিদির জন্য দিওয়ানা— এসব আমাকে শুনতে হয়। শুনি। মতামত চাইলে দিই। সে হিসেবে মেলা কাউন্সেলিং করতে হয় আমায়। শুধু প্রেম নয়। পার্থর বহুবার পড়া জিনিস পরীক্ষার সময়ে গুলিয়ে যায়, রমিতা ওয়ান টু ওয়ান কথা বলতে অসুবিধে বোধ করে না, কিন্তু দল হলেই আড়ষ্ট; আত্মসচেতন হয়ে যায়। কৃষ্ণার ভেতর নিজের বোনের ওপর কেমন একটা ঘৃণা, বিদ্বেষ জন্মাচ্ছে। মলয়ের ধারণা ওর বাবা-মা ওকে দেখতে পারেন না। হাজারখানা। সব বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে।
তবে সব ঝড়ঝাপটা আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। মায়ের মৃত্যু ভেতরে ভেতরে কোথাও আমাকে অবশ করে রেখে দিয়েছে। এবং দীপকদার বিশ্বাসঘাতকতা আমি ক্ষমা করতে পারিনি। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলেন। যখন এম-এসসি পড়তেন তখন ম্যাথস-সায়েন্সের জন্য আমাদের বাড়ি ঢোকেন। ওঁর বাড়ির অবস্থা ভাল ছিল না। প্রচুর পড়তেন, জানতেন। শুধু অঙ্ক বা বিজ্ঞান নয়, সাহিত্য, ইতিহাস সবই। আমি যা শিখেছি তার অর্ধেকের বেশি শিখেছি ওঁর কাছে। এরকম একজন টিচারকে টিন-এজ ছাত্রী হিরো-ওয়রশিপ করবেই। এক ধরনের ভালবাসাই তো! আমিও বেসেছিলাম। মুখে কখনও বলিনি। আসলে বাবা কর্মসূত্রে জামনগরে থাকতেন। আমি আর মা এখানে। আমার বোধহয় একটা ফাদার-ফিগার দরকার ছিল। দীপকদা কিন্তু ঠারে-ঠোরে বলতেন অনেক কিছু— বুঝলে মিঠু, আমি অনেককে পড়িয়েছি, পড়াই। জানোই তো, নইলে আমার চলে না। কিন্তু তুমি আলাদা। তুমি আমার গ্যালেশিয়া। তোমার ওই কচি কলাপাতা রঙের আঙুল আর শুকতারা কুচির মতো চোখগুলো ছাড়া বাকি তোমাকে আমিই তৈরি করেছি। তোমার ওপর আমার অধিকার আগে। কতজনের সঙ্গে পরিচয় হবে, কতজন মানে ইয়ে… কিন্তু ভুলো না।
আমি ভুলিনি। কিন্তু দীপক সেনশর্মা কোনও এক বড়লোক শ্বশুরের টাকায় ইংল্যান্ড যাবার লোভ সামলাতে পারলেন না। আমাকে তো ছাড়লেনই, কিন্তু যে বউয়ের বাবার পয়সায় বিলেতে গেলেন তাকেও রাম ঠকান ঠকালেন। মার্কিনি মেমসাহেবের সঙ্গে লিভ-টুগেদার, বাঙালি বউকে তালাক, আর এক মেমসাহেবকে বিয়ে করে মার্কিন নাগরিক, হুজ হু-তে নাম লেখানো, বিখ্যাত গবেষক, অধ্যাপক, ও বিখ্যাত দুশ্চরিত্র হতে ওঁর বছর তিনেকের বেশি সময় লাগেনি।
বাড়ি ফিরতে দশটা। বাবা বারান্দায় বসে ঢুলছিল। ভি. আর. এস নিয়ে অবধি পিতৃদেবের মনমেজাজ ভাল নেই। টিভিটাও তো দেখলে পারে, সময় কেটে যায়। গল্পের গোরু কীরকম তাল গাছে উঠে যায়, ঝানু ব্যাবসাদার না দেখে দলিল সই করছে, প্লাস্টিক সার্জারি করে খালি মুখ নয়, দেহের কাঠামো, কণ্ঠস্বর অবধি বদলে যাচ্ছে, ক্যাসেট করা দুষ্কৃতীর শয়তানি গলা শুনেও নিজেদের বাড়ির মা-বউকে লোকে বিশ্বাস করছে না, একজনের জায়গায় অন্য একজন বাড়ির বউ হয়ে বসে গেছে বন্ধুর কথা রাখতে, প্লাস্টিক সার্জারির হরেক ব্যবহার। প্রচুর চিঠি লেখে বাবা ইংরেজি-বাংলা কাগজে। কোথাও একটা অঘটন ঘটল— অমনি চিঠি। কেন অমুক খুনের কিনারা আজও হল না। ফিল্মি হিরো গাড়ি চাপা দিয়ে মানুষ মেরেও কী করে এখনও বিজ্ঞাপনে মাস্ল্ ফোলায়, হাসপাতালে কুকুর কেন…। ‘মিসেলেনি’তে বাবা দিব্য একটা প্রবন্ধ লিখতে পারত— ‘দা ডিফরেন্ট ইউজেস অব প্লাস্টিক সার্জারি ইন হিন্দি সিরিয়্যাল্স্! হাউ দে এনটারটেন অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপ্ল্!’ তা করবে না। খালি আমার পথ চেয়ে আর কাল গুনেই কাটিয়ে দেবে।
এদিকে, আমার যে প্রেম চটকে গেল, আইডলকে ক্রমশ একটি বিশুদ্ধ লম্পট ধাপ্পাবাজে বদলাতে দেখে আমার মধ্যে যে কতকগুলো টেকটনিক প্লেট সরে গেছে, আমার ভেতরের ভূগোলই পালটে গেছে; যতই বাবাকে ভালবাসি, আমি যে এখন এন্টায়ারলি লিবারেটেড ফিমেল, তা বাবা বুঝবে না। স্যরি মি. সেনশর্মা। আপনার সব রিডিংগুলো মিলল না। নিজের বাবাকেই বুঝতে চাইছি না।
বাবা নীচে নেমে দরজা খুলে দিল।
কী রে? এরপর পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকিস। এত রাত অবধি জেগে থাকা আমার পোষায়?
এত রাত! মোটে তো দশটা! এগারো-বারো হলে কী করবে?
—সে ভদ্রমহিলা পৌঁছোলেন? —আর কথা বাড়ায় না বাবা। মেয়েকে বেশ ভয় পায়।
—হ্যাঁ, ওঁকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এলাম। ট্রেন খুব লেট।
—তা একটা ফোন করে দিতে কী হয়েছিল? ভাবছি!
—শুধু কি ট্রেন লেট! উনি আবার আদর্শবাদী টাইপ। কিউয়ে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি নিলেন। জ্যাম-ফ্যাম পেরিয়ে যখন ফার্ন রোডের বাড়িতে পৌঁছে দিলাম, বাড়িময় ঘুরে ঘুরে রোমন্থন করলেন, তারপর আমাদের গলদঘর্ম বসিয়ে রেখে নিজে আচ্ছা করে চান করলেন, তারপর আবার না খাইয়ে ছাড়লেন না।
—প্রথম দিন এসেই? বাড়িতে লোকজন মজুত, না কী?
—কেয়ার-টেকার, হিন্দুস্থানি। ডাল, রোটি, রসগুল্লা…
—বেশ করেছ, এখন খাবারদাবারগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে শুয়ে পড়ো।
চানটান করে শুতে আমার একটু দেরি হল। জানলার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা আমার বহুদিনের প্রি-ঘুম অভ্যেস। লাল তারাটা জ্বলজ্বল করছে। মেঘের মতো ভেসে যাই আকাশপাতাল ভাবনায়। দীপক শর্মা সুট পরে এসে দাঁড়িয়েছে— এটা করালাম মিঠু, কেমন হয়েছে? মায়ের সঙ্গে ভোরে স্কুল যাচ্ছি। টিফিন বাক্সটা খুলে পড়ে গেল। যাঃ। কী মেয়ে রে তুই? মা পয়সা দিচ্ছে— আজকের দিনটা চালিয়ে দাও। আজেবাজে জিনিস খাবে না কিন্তু। হরেক রঙের একটা বিরাট তাঁবু, এত বড় যে গোটা পৃথিবীটাই বোধহয় তার ভেতরে ধরে যায়। একজন ক্লাউন নানা কসরত দেখাচ্ছে। আসল খেলোয়াড়রা পুরো জায়গাটা জুড়ে দেখাচ্ছে। ও দেখাচ্ছে এক পাশে। বাঁটুল, গালে হলদে, কপালে লাল, থুতনিতে নীল, আর নাকের ডগাটা কটকটে সাদা, বোধহয় নাকে একটা টুপিও পরেছে। এখন, জরির জামা গায়ে ওই খেলোয়াড়গুলোই আসল? নাকি ওই ক্লাউনটা? কাকে যেন জিজ্ঞেস করি, সে ঘাড় নেড়ে বলে, উঁহুঃ, বড় শক্ত প্রশ্ন। হালকা ঘুমের মধ্যে মেঘ ভেসে যায়, কে যেন বলে ওঠে— ছুটোবেলাই সব বেলা।
আমার অনেক কথা থাকে। কিন্তু আমি কাউকে বলি না। বাবাকে পর্যন্ত না। কেননা, সকলেই দেখি নিজের কথা বলতে ভালবাসে। আমি মৈত্রী, মিতু, অনেকেই মিঠু বলে। আমার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আমার কতকগুলো গবেষণা আছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমি যেন ওদের একটু আড়াল থেকে দেখি, চোখ রাখি। তাতে আমার একটা সুবিধে হয়। বলতে পারা যায়, এটা আমার হবি। যা দেখছি, তা থেকে যা ভাবছি, সেটা মনের মধ্যে রেকর্ড করা রইল। এবার ফলেন পরিচীয়তে। অদূর ভবিষ্যতে চরিত্র ও ঘটনা একটা নির্দিষ্ট দিকে বাঁক নিল, ধরুন। তখন আমার সিদ্ধান্তগুলো আমি যাচিয়ে নিতে পারি। কতকগুলো মেলে, কতকগুলো মেলে না। মনীষারটা যেমন একদম মেলেনি। ও কোনওদিন ভুঁড়িতে উলকি এঁকে, নাভি থেকে আংটা ঝুলিয়ে দেবে আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। রুচি, স্বদেশিয়ানা, একটু রক্ষণশীলতা, সীমাবোধ তো ওর ছিলই। আমি ওকে সোজাসুজি কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। রৌনকদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর ও-ই একদিন আমাকে ফোন করল। — মিঠু আসবি? আয় না রে। গেলাম। গিয়ে অবশ্য একটু কড়কানি দিলাম, নইলে মান থাকে না। —কী ভাবিস বল তো! আমার কাজ নেই?
বকিস না, বকিস না, দ্যাখ না তোকে কেমন পকোড়া আর আসলি বিন থেকে তৈরি কফি খাওয়াই!
হ্যাঁ, তোর কফি না খেলে তো আমার ঘুম হচ্ছে না!
রাগ করেছিস আমার ওপর? নারে?
তুই আমার কে, যে তোর ওপর রাগ করব?
মনীষা ওর পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লম্বা বডিটা আমার কোলের ওপর ফেলে দিল।
তুই বিশ্বাস করতে পারবি না এই ট্যাটু আর রিং ওখানে এখন কী রেটে চলছে! আমার বরের বন্ধুর বউরা, বান্ধবীরা সব কিছু-না-কিছু এসব করছেই।
খুব ভাল, এখানেও তো প্রেশার ছিল। তোকে তো কেউ কাত করতে পারেনি!
এখানে আমার পরিবেশ ছিল মিঠু। মা-বাবা ছিলেন, তাঁদের ভ্যালুজ ছিল। ওখানে কী আছে? কে আছে? আমার বর ছাড়া? সে বহুদিন ওখানে। এসব পছন্দ করে।
তা হলে তো আরও চমৎকার। নিজের ইচ্ছেয় কিছু করিস বুঝি। এতদিন নিরামিষ্যি খেয়েছিস এখন একটু কাঁকড়ার ঝাল খেতে সাধ গেছে। কিন্তু যাক গে আমাকে এত কৈফিয়ত দিচ্ছিস কেন?
একটু চুপ করে থেকে মনীষা বলল— হয়তো নিজেকেই দিচ্ছি। হয়তো নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করছি। মা-বাবার ইচ্ছে ছিল না এখানে বিয়ে দিতে। অমিত আমাকে প্রথম দেখেই কাত। —আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি, প্লিজ। তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। আইল গিভ য়ু হোয়াটেভার য়ু ওয়ন্ট। ভুলে তো বিয়ে করলাম। তারপর নতুন দেশ দেখার আনন্দে মাতোয়ারা। তারপরে আস্তে আস্তে প্যান্ট, টপ— এখনও শাড়ি আর টিপ দেখলে ওখানে বাচ্চারা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। একদিন আমার আঁচল এসক্যালেটরে আটকে গিয়েছিল জানিস! কী আতঙ্ক! তো তক্ষুনি একজন সুইচ বন্ধ তো করে দিলই। আমাকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিল। শাড়ি খুলে কোথায় চলে গেছে। পা মচকে গেছে, দিশাহারা, লজ্জায় হতভম্ব, ইন মাই ব্লাউজ অ্যান্ড পেটিকোট। ওরা যখন আমার বরের নম্বর চাইল, দিতে বাধ্য হলাম, অত কিছু ভাবিওনি। কিন্তু সেই থেকে ও গম্ভীর হয়ে গেল। ড্রেস পালটালাম। দিবারাত্র আনস্মার্ট বলে আমাকে, যেটা চাইবে সেটা না করলেই মুখ গোমড়া। আর করলে কী আদর, কী ভালবাসা। আদারওয়াইজ, কোনও পার্টিতে ও আমাকে জাস্ট ডাম্প করে দিয়ে চলে যাবে। কী করি বল— ড্রেস বড়, না স্বামী বড়?
বলতে পারতাম, ড্রেসটা নয়। কিন্তু তোমার বর তোমাকে এক ড্রেসে ভালবাসবে আর এক ড্রেসে বাসবে না, এটা… এটা কী করে মেনে নেওয়া যায়?
শুধু বললাম— তোর যা ইচ্ছে হয় কর না, কে কী বলল তাতে কী আসে যায়! তবে ও রকম আউট অব ক্যারেকটার ড্রেস করে বন্ধুমহলে না গেলেই পারতিস। ব্রাভাডো! না কি!
হতে পারে। নিজেকে নিজেই সব সময়ে বুঝে উঠতে পারি না।
বিন্দির ব্যাপারে আমার তেমন কোনও বিস্ময় হয়নি। ও মেয়ে অত্যন্ত ধড়িবাজ। যা চায় তার জন্য ভোল বদল ওর কাছে কিছুই না। ও-ই আস্তে আস্তে ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেদের, বিশেষত বরের রুচি পালটে দেবে। ধীরে ধীরে। জানি না। আমার ধারণা এই। ভবিষ্যৎই বলবে আমি ঠিক কিনা।
আমাদের এই বাড়িটা খুব অসুবিধেজনক হয়ে উঠেছে। যখন এদিকে ধুধু সব খালি জমি বেশ কম দামে বিক্রি হচ্ছিল, দাদু কিনে রেখেছিলেন। বোধহয় ষাটের দশকের গোড়ায়। দাদু যখন তিন কাঠার ওপর দোতলা বাড়িটা করলেন আশেপাশে গাছগাছালির জন্যে কিছুটা ফাঁকা রেখে, তখনও চারপাশ ধুধু। নারকেল, অশ্বথ, জারুল, অমলতাস ছিল চতুর্দিকে। গ্রামের মেয়েদের মতো অনেক গাছপালা চিনি আমি। পাকুড়, পুটুস, ঢোলকলমি, ভাঁটফুল। এই বাড়িতে আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল, এখান থেকেই রামকৃষ্ণ মিশন সেবাসদনে গিয়ে মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন। যখন চোখ ফুটল, তখনও অনেক ফাঁকা দেখেছি, আশেপাশে বাড়ি উঠছিল, আমাদেরই মতো দোতলা, দেড়তলা। পাশের প্লটটা ছিল বিরাট। একটা আমলকী গাছে এত আমলকী ফলত যে আমরা কাছাকাছি বয়সের সব ছেলেমেয়েরা আমলকী কুড়োতাম— শম্পা, অত্রি, দুর্জয়, সায়ন্তনী…। আমলকী কুড়িয়ে দুর্জয়ের ঠাকুমাকে দিতাম। উনি সেগুলো জিরে জিরে করে কেটে রোদে শুকিয়ে ছোট ছোট শিশিতে ভরে আমাদের দিতেন। ফুরিয়ে গেলেই আবার। দাদু বলতেন— আমলকীকে কবিরাজিতে কী বলে জানিস তো?— অমৃতফল। খেলে নীরোগ, দীর্ঘজীবন লাভ হয়। আমাকে রোজ একটা করে কাঁচা আমলকী ভাতে দিয়ো তো বউমা! সারা শীতকাল দাদু আমলকী ভাতে খেতেন। দাদু বেশ ফরসা ছিলেন। আমাদের লোভ দেখাতে বলতেন, এই দ্যাখ আমলকী খাই বলেই না রক্ত পরিষ্কার, রং পরিষ্কার। তবে ফরসা হবার লোভ দেখিয়েও আমলকী ভাতে তিনি আমাকে খাওয়াতে পারেননি।
ওই প্লটটাতে একটা মাল্টি-স্টোরিড কমপ্লেক্স হয়েছে এখন। জি প্লাস ফোর। হয়তো রোদ হাওয়া ততটা আড়াল করেনি, কিন্তু আমাদের গাছ, মাঠ, ফুল, খেলা, ছোটবেলা সবই কাটা পড়েছে। ভীষণ বাঁধা-বন্দি লাগে নিজেদের। অতটা অবাধ ছিলাম বলেই হয়তো। বাড়িটার নাম ‘মহানন্দা’, আমরা বলি ‘নিরানন্দা’।
‘নিরানন্দা’তে থাকে শুভজিৎ। কলেজে একসঙ্গে পড়েছি। তখন থেকেই ওর বিদঘুটেমির জন্যে সবাই ওকে শুভ থেকে অশুভ বানিয়ে দিয়েছিল। লোকের পেছনে কাঠি দিতে ওস্তাদ। নধর গোলগাল ভুঁড়িয়াল চেহারা, কিন্তু বেশ করিতকর্মা। আমি চান করে মাথায় তোয়ালে জড়িয়ে বারান্দায় গাছে জল দিচ্ছিলাম, নীচ থেকে হাঁক মারল, এই মিতু কাতুকুতু।
আমিও বলি, কী রে অশুভ! এই সাতসক্কালে মুখখানা দেখালি তো?
—নীচে নেমে আয় না একবার!
—দেখছিস না জাস্ট চান করে বেরিয়েছি!
—তো কী! কবে থেকে আবার পরদানশীন হলি? না কী বলে তোদের ওই সমস্কৃতে অসূর্য… অসূর্যম্….
—চেষ্টা করিসনি— বরং শোয়ার্ৎজনেগার কিম্বা ব্রবডিংনাগ বল, পেরে যেতেও পারিস।
—কী আমার পণ্ডিত এলেন রে, মাথায় টিকি কই? নর নরৌ নরাঃ।
—এই অশুভ, ব্যাপারটা কী জানিস, টিকি ইজ নট নেসেসারি, বিজ্ঞানে পণ্ডিত হলেও তাকে পণ্ডিত বলে, এমনকী গানবাজনায় হলেও— পণ্ডিত রবিশঙ্কর, পণ্ডিত ভীমসেন যোশী…. শুনেছিস নিশ্চয়ই। আমার মাথায় টিকি নেই। কিন্তু তোর মাথায় শিং থাকতে পারে, পাতলুনে ল্যাজ, জুতোয় ক্ষুর… পরশুরাম কোট করছি। বুঝতে পারছিস তো?
—চিনি না আবার। সেই ব্যাটা রাজাগুলোকে দা দিয়ে কেটে ফিনিশ করে দিয়েছিল, বাবার কথায় মাকে সুদ্ধু কেটে ফেলে।
—বাঃ, অনেক জানিস দেখছি। তবে এ পরশুরাম সে পরশুরাম নয়। ইনি রাজশেখর বসু, পরশুরাম ছদ্মবেশে দারুণ দারুণ লিখতেন। আর দ্যাখ নর নরৌ নরাঃ-টা যখন জানিস তখন গর্দভঃ গর্দভৌ গর্দভাঃ-টাও শিখে রাখ। দেখিস আবার, দ ভ পরপর উচ্চারণ করতে পারবি তো?
—না পারলে? —শুভ এখনও খুশমেজাজ।
—না পারলে? ‘চুনে জল দিলে চুন তাজা হয়’ তাড়াতাড়ি উচ্চারণ করবি। চুন মানে লাইম, জলটা ফর্চুনেটলি জানিস। আর তাজা হল তা যা।
ক্লাস লেকচার দিয়ে দিলি যে রে! এস. এম-কে মনে পড়ে যাচ্ছে। হাউ বোরিং!
এস. এম.-এর সঙ্গে আরেকটা এস যোগ কর। পাঠাচ্ছি মেসেজটা। নিয়ে নে— শ্যালো মোরোনিক শিপ।
লম্বা চুলে পনিটেল, মোটকা শুভ বলল, ওরে বাবা রেগে আগুন তেলেবেগুন হয়ে আছিস যে রে!
—রেগে আগুন তেলেবেগুনটা জানিস তা হলে? কোথায় আছে বল তো?
—হে হে।
—বলতে পারবি না। সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’-এ ‘গোঁফ চুরি’-তে। বেগুন কী জানিস তো? ব্রিঞ্জাল? না বাইগন? গন উইথ দা উইন্ড! আমি আর দাঁড়াই না। সত্যিই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।
শুভটাকে দেখলেই, বলা উচিত নয়, রাগে আমার গা জ্বলে যায়।
যেমন ফরসা, তেমন নাদুস, তার ওপর চুলে একটা পনিটেল। সব সময়ে আমাকে খোঁচাবে। অপরাধের মধ্যে বি.এ. পর্যন্ত আমার সংস্কৃত ছিল। কমপ্যারেটিভ লিটরেচারে এম.এ.-তে তার জন্যে এক্সট্রা সুবিধে তো কিছুই পেয়েছিই!
ওমা! শুভটা দেখি ভেতরে ঢুকে এসেছে। বললে, ভুলে গিয়েছিলাম বুঝলি, তুই হলি গিয়ে ‘নারী নারৌ নারঃ।’
—নারী, নার্যৌ নার্যঃ। আমি সংশোধন করে দিই। বলি, তুই কিন্তু জলম জলে জলানি।
—মানে আমি জল? আহ প্রাণটা ভরে গেল রে! জল দাও আমায় জল দাও।
—জলটা মিন করিনি। লিঙ্গটা মিন করেছি। নিউটার জেন্ডার। যাঃ যা দিকিনি।
—তুই আমাকে যা খুশি তাই বলবি তাই বলে, কালিন্দী? —শুভর গলায় ঝাঁজ।
—যা খুশিটুশি বলিস না। নিউটার জেন্ডারকে যা খুশি বলে দ্যাখ না ইন পাবলিক। তোকে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন পাঠিয়ে দেবে। দে আর অলসো হিউম্যান, রাইটস আছে আমাদের মতো।
—তা হলে আমাকে ‘নিউটার জেন্ডার’ বলে অপমান করলি কেন?
—স্যরি, এখন দেখছি ওদেরই অপমান করেছি। মানুষকে জানোয়ার বললে যেমন জানোয়ারদের অপমান করা হয়!
—তোর বড্ড বাড় বেড়েছে কালী। ভারী একটা চাকরি পেয়েছিস! এন. জি. ও-র চাকরি আবার চাকরি! ফরেন ফান্ডে ফুটানি। সমাজসেবার ছদ্মবেশে জোচ্চুরি!
—বাঃ বেশ ভাল বলে ফেলেছিস তো! না রে তোকে ক্ষমা করে দিলাম। এবার নিশ্চিন্ত মনে তোর সেলুনে যা, মানে ভ্যারেন্ডা ভাজ গে যা।
বাবা চৌকাঠের ওপর দাঁড়িয়েছিল। বলল, কী অসভ্যের মতন ঝগড়া করতে শিখেছ মিঠু! ছিঃ।
এইভাবে ঝগড়া করতে না শিখলে এদের সঙ্গে লড়ে বাঁচতে পারব না বাবা। প্লিজ, তোমার পুরনো ভদ্রতার কনসেপ্টগুলো আমার ওপর চাপিও না।
একটা জিনিস আমার অদ্ভুত লাগে। কত রকমের শ্রেণীবিভাগ আমাদের এই জেনারেশনের মধ্যেও! ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির তফাত তো হবেই। সেটা স্বাস্থ্যকর। যে মেয়েরা প্যান্ট পরে সিগারেট গাঁজা খায়। যারা অন্য কিছু পরে, ওসব খায় না। যাদের মায়েরা চাকরি করেন, যাদের মায়েরা করেন না। যারা সায়েন্স পড়ে, যারা আর্টস পড়ে, টেকনিক্যাল স্কুল, এঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি, ফ্যাশন ডিজাইনিং, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, এম. বি. এ., আই টি— সব কিছুর একটা অদৃশ্য গোপন রেটিং আছে। জেনারল সায়েন্স ও আর্টসের ছাত্র-ছাত্রীরা অচ্ছুৎ হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক সময়ে এই সমস্ত রেটিং সত্ত্বেও দু’জন আলাদা বৃত্তের কারও সঙ্গে কারও প্রবল বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তবে সবচেয়ে আকচাআকচি বাংলা মিডিয়াম ইংলিশ মিডিয়ামে। ইংলিশ মিডিয়াম ‘বাংলা স্কুল’কে দীনহীন পারিয়া, নিম্নশ্রেণী, ন্যুইসেন্স ইত্যাদি মনে করে। বাংলা’রাও ইংলিশদের ভাবে নাক-উঁচু, ক্রীতদাস মনোভাবাপন্ন, আপস্টার্ট নকলনবিশ, মৌলিকতাহীন। সিংহচর্মধারী গর্দভ। একই প্রজন্ম, শিক্ষাপদ্ধতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে উভয়েই, উচ্চাকাঙক্ষার ধরনটা আলাদা হতে পারে কিন্তু উভয়েই ভালভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়। নিশ্চয়, এখনও পর্যন্ত সৎভাবেই এই বাঁচতে চাওয়া। অথচ এত এত দূরত্ব! বাবা বলেন— আমাদের সময়ে গুটিকয়েক মিশনারি স্কুল ছাড়া ইংলিশ মিডিয়াম তো কই ছিল না! কিন্তু আমরা গোড়ার থেকেই ইংরেজি পড়তাম। ইংরেজি ক্লাসে গ্রামার, ট্রানস্লেশনের মধ্যে দিয়ে প্রচুর শিখতাম, উচ্চারণ হয়তো ফিরিঙ্গিদের মতন হত না। কিন্তু তাতে কোনও অসুবিধে হত না। অনেকে চমৎকার অ্যাকসেন্ট রপ্ত করেও নিতেন।
ইউনিভার্সিটিতে শিখরিণী বলে একটি দারুণ সুন্দরী মেয়ে পড়ত। কোনও মফস্সলি রাজপরিবারের মেয়ে, সম্ভবত রানাঘাট। মফস্সলের শুনেই অনেকের নাক বেঁকে গেল। রানাঘাটে পড়াশোনা করেছে? এহ্, মেয়েটার ইহকাল পরকাল দুই-ই গেছে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এটা অবশ্য ওপর ওপর। ভেতরে ভেতরে খুব উৎসাহ। চলাফেরা করে দুর্গাপ্রতিমার মতো। সরু কোমর, চমৎকার মসৃণ গলা, আর তার ওপরে একটা অপূর্ব মুখ, কোনওখানে কোনও খুঁত নেই। সে এদের একটু ঘা দিতে পেরেছিল। একদিন ক্যাম্পাস দিয়ে যাচ্ছে, আকাশ পেছনে থেকে ডাক দিল— শিখা, শিখা—
শিখরিণী যেমন চলছে চলতে লাগল। ধনেখালি শাড়ি পিন করে পরা। লম্বা চুলে মোটা বিনুনি। কপালে ছোট্ট টিপ, হাতে বালা, কানে কুণ্ডল, গলায় হার। একেবারে সালংকারা।
আকাশ ছুটে সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন থেকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছ না? শিখরিণী অবাক। কখন ডাকলে? কে যেন শিখাকে ডাকছিল!
—তুমিই তো শিখা? অত বড় নামে কাউকে ডাকা যায়!
—তাহলে ডেকো না!
—কী আশ্চর্য, আমরা তো সবাই সবাইকে শর্ট নামে ডাকি— রণজয়কে বলি রনি, রোহিতকে রোহু, আমাকে ওরা বলে আক।
—রোহু মানে রোহু ফিশ, রুই মাছ, আর আক কি আখ? না চন্দ্রবিন্দু দিয়ে চেঁচাবার?
প্রথমে বেচারি বুঝতে পারেনি, তারপরে বলল—কী আশ্চর্য! এইটুকু শর্টনিং অ্যালাও করবে না? ক্রিকেট টিমে তো সব টিমমেটের এরকম একটা শর্ট নেম থাকে। থাকত চিরদিনই। সুনীল গাভাসকরকে সানি। বীরেন্দ্র সহবাগকে বীরু। হরভজনকে ভাজ্জি, যুবরাজ সিংকে যুবি। শিখরিণী দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল, চোখে কোনও ভাবান্তর নেই।
—এইটেই এখন চলছে।
শিখরিণী বলল, আমার নামটার মানে জানো?
—শিখ শিখ শিখর—আই সি, পিক—ইট মিনস পাহাড়।
—রং। শিখরিণী মানে প্রথমত খুব সুন্দরী। দ্বিতীয়ত, আমার মনে হয় মানেটা শিখরচারিণী, ঝরনা। একটা ছন্দেরও নাম। সংস্কৃত ছন্দ অবশ্য। রোহিত রুই মাছ হয়ে আনন্দলাভ করতে পারে। তুমি আখ হয়ে সুমিষ্ট আহ্লাদ অনুভব করতে পার। রনি ডাকলে রণজয়ের মনে হতে পারে সে কোনও নীলচোখ সাহেবছানা। কিন্তু আমি শিখরিণী। শিখরিণী থাকতেই ভালবাসি। পিওর অ্যান্ড সিম্পল শুদ্ধ তৎসম— তার ছন্দত্ব ও ঝরনাত্ব নিয়ে। বড় নামে যদি ডাকতে না পারো ডাকবে না। আমি কি তোমাকে বলেছি ডাকতে?
শিখরিণী চতুর্দিকে চোখ ধাঁধানো রূপ ছড়িয়ে চলে গেল। আমি মনে মনে হাসি। বলি, জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী/অভয়াশক্তি বলপ্রদায়িণী, তুমি জাগো।
এইসব অসুরদের দলনের জন্য এইরকম দুর্গাই দরকার ছিল।
পরে শিখরিণীর সঙ্গে আমার বেশ আলাপ হয়ে যায়। শুনি ও নাকি মিস রানাঘাট, পরে একেবারে মিস নদিয়া হয়েছিল। আশ্চর্য নয়। এখন মিস ক্যালকাটা হয়ে যেতেই পারে। তবে নেংটি পরে স্টেজে দাঁড়িয়ে আগ-গলুই পাছ-গলুই দেখাতে বোধহয় ও রাজি হবে না। কিন্তু আসল কথাটা হল ও বাংলা আর সংস্কৃত দুটোই সাংঘাতিক ভাল জানে। ওর দাদু ছিলেন সংস্কৃতে স্কলার। রীতিমতো গবেষক। নাতনিকে পড়িয়েছেন ছোট থেকে। শব্দতত্ত্ব নিয়েই তাঁর কারবার। ভাষার ভিতটা নাতনির উনিই করে দিয়েছেন।
শিখরিণী বলছিল, সাধারণ বাংলা-মাধ্যম স্কুলে, বিশেষ করে সরকারি স্কুলে সত্যিই আজকাল কিচ্ছু হয় না। কিচ্ছু শেখানো হয় না, না ইংরেজি, না বাংলা, না সংস্কৃত, না ডিসিপ্লিন— বিশেষ করে ভাষা আর সাহিত্য জ্ঞান ভীষণ অশুদ্ধ। জার্মানিতে বলছে সংস্কৃত সবচেয়ে যুক্তিশীল ভাষা, কম্পিউটারের উপযুক্ত, এরা তাকে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছে। বাংলা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। এখন স্কুলে স্কুলে বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে বাংলা কোনও কাজে আসে না, ও না শিখলেও চলে এবং অন্যান্য প্রদেশের খুদে পড়ুয়ারা বাঙালি বাচ্চাদের বলে— এ বঙ্গালিবাবু রসগুল্লা খায়গা, চাবল বন জায়গা, মছলি খায়গা, বদবু নিকালেগা। বাচ্চাগুলো নিজেদের বাঙালি বলতে লজ্জা পায়। —এই হল আমাদের স্বাধীন ভারত।
আমি বলি, তুমি এত কী করে জানলে? রানাঘাটেও এরকম ঘটছে নাকি?
—ঘটেনি, ঘটবে। আমি এখানে আমার মামার বাড়ি আছি তো! লোক্যাল গার্জেন। ছোটমামার ছেলের মুখ থেকে শুনি। মামিমারাও তো ভীষণ বাংলাবিরোধী। বলেন— বাংলা চাকরি দেবে? স্মার্টনেস দেবে? লড়াই করবার প্রতিযোগিতা বাড়ার শক্তি দেবে? বাংলা পড়লে পিছিয়ে পড়তে হয়।
—যা ব্বাবা। একেবারে পড়লেই পিছিয়ে পড়তে হবে? তা তুই কী বলিস?
কী বলব? প্র্যাকটিক্যাল দিক থেকে দেখতে গেলে কথাগুলো তো সত্যি। যে সময়টা বাংলার পেছনে দেবে সে সময়টা বিদেশি ভাষার পেছনে দিচ্ছে। সাহিত্যে সময় না দিয়ে সায়েন্সে দিচ্ছে। তুমি লীলা মজুমদারের ‘পাকদণ্ডী’ পড়েছ?
আমি অপ্রতিভ। না রে, পড়া হয়ে ওঠেনি, তবে নামটা জানি।
—‘পাকদণ্ডী’তে লীলা মজুমদার লিখছেন— ইংরেজি নিয়ে কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন। সুবিখ্যাত অধ্যাপক পি. সি ঘোষের নাম শুনেছ তো? আমাদের দাদুরা পড়েছেন।
—হ্যাঁ হ্যাঁ ঈশানচন্দ্র ঘোষের ছেলে। ঈশান স্কলারশিপ যাঁর নামে। শুনেছি বলতে পেরে আমি হাঁফ ছাড়ি।
—সেই পি. সি. ঘোষের ক্লাসে গিয়ে লীলা মজুমদারের প্রথমটা নাকি খুব অশ্রদ্ধা হয়েছিল, কেননা তিনি শিলং পাহাড়ে খাস মেমসাহেবদের থেকে ইংরেজি শিখেছিলেন। পি. সি ঘোষের সেই উচ্চারণ ছিল না। উনি তো কনভেন্টে পড়েননি!
—তাতে কী? লীলা মজুমদার তো অদ্ভুত!
শোনো না, তারপর পি. সি. ঘোষের পাণ্ডিত্যে, তাঁর পড়ানোয় একেবারে মুগ্ধ হলে গেলেন ক্রমশ। ব্যাপারখানা এই। ওঁদের কোনও অসুবিধে হত না। আমাদের জেনারেশনের হচ্ছে। কেননা, ইংরেজিটা আর শেখানো হচ্ছে না। ইংরেজি পড়াবার টিচারও আর নেই। টেলিভিশনে ভাষাটাকে আরও বিকৃত করে দিচ্ছে। ‘এনিওয়েজ’ শুনেছ কখনও?
—যা বলেছিস। ‘এনিওয়ে’ই তো জানি ভাই। এখন হয়তো বহুবচন সিদ্ধ হয়ে গেছে।
—আর্ষ প্রয়োগ। বুঝলে না! টেলিভিশন যা বলবে তা-ই ঠিক, যা দেখাবে তা-ই ঠিক।
—স্ট্রিট-স্মার্ট আধুনিকরা বানিয়েছে কিনা দ্যাখ আবার! হয়তো খোদ আমেরিকা থেকেই আমদানি।
শিখরিণী এইরকম। দারুণ সিরিয়াস। অনেক পড়াশোনা করেছে। রোজ খবরের কাগজ পড়ে, কোনও সমালোচনা বা গায়ে-পড়াটড়া পাত্তা দেয় না। প্রয়োজন বুঝলে কথার চাবুক মারে। ও শেষ দিকটা ভীষণ আনপপুলার হয়ে গিয়েছিল। একা। ভাব দেখাত কিছুই এসে যায় না ওর। ওর কথা উঠলে তখন অনেকেই বলত ওরে বাবা তর্কবিশারদ, পণ্ডিত ভার্গব, জ্যোতিষার্ণব, শ্রীল-শ্রীযুক্তা মডার্ন খনা। বেশ কিছু অধ্যাপকও ওর কাছ থেকে চাবুক খেয়েছেন। ও বলে না, শুনেছি। বুড়ো ভাম জি. কে-কে বলেছিল— আপনার লজ্জা করে না, আমার বয়সি আপনার মেয়ে আছে! ছিঃ!!
জি. কে. হকচকিয়ে গিয়ে রেগে বলেন, এত বড় অপমান! কন্যার মতো দেখি বলেই, তোমার পিঠে হাত বুলিয়েছি? খারাপ অর্থ করলে! পরীক্ষার খাতায় টের পাবে।
দ্যাট ইজ জাস্ট লাইক য়ু, য়ু পিপল। আপনি যদি পারেন, কম নম্বর দেবেন, আমি রিভিউ করাব। আপনি আমাকে চেনেননি। কেস করব।
আর কোন স্যার যেন পূর্বরাগে ভুগছিলেন। চুল ঝামরে আছে। দাড়ি কামান না। তিনি সবসময়ে পেছনে পেছনে ঘুরতেন। তাঁকে বলেছিল, যা বলবার সোজাসুজি বলুন না স্যার। আপনি তো আর কলেজের খোকা নন! এনিওয়ে, আপনার কথা আমি বুঝতে পেরেছি। এইসব পেছন পেছন ঘোরা গুজগুজে প্রেমে আমার বিশ্বাস নেই। আপনার প্রতি কখনও আমার কোনও ফিলিং জন্মাবে না। স্যরি।
আরও নিশ্চয় অনেক গল্প আছে। ও তো বলে না, বলে অন্যরা। মেয়েরা অনেকেই বলে, যাই বলিস, প্রিন্সেস ডায়নারও এত চার্ম ছিল না।
হিংসা আর মুগ্ধতা কি একই অনুভূতির এপিঠ ওপিঠ?
আমি শিখরিণীতেও অভিভূত। যদিও সেটা কক্ষনও জানতে দিই না। জানলে ও বিরক্ত হবে। ও বলে থাকে, আমি জানি আমি দেখতে খুব সুন্দর। সেইজন্যে অনেকে খুব কদর দেখায়। কিন্তু আজ যদি আমার মুখটা পুড়ে যায়, কোনও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অসুখেবিসুখে নষ্ট হয়ে যায়, কোথায় থাকবে এই কদরদারেরা? চরিত্র, ভেতরের চেহারাটার প্রতি যদি কেউ আকৃষ্টও হয়, সেটা থাকে বাইরের চেহারার সঙ্গে জড়িয়ে। সুতরাং একা। কেউ আর তখন চারুপাঠ করবে না তোমার কানের কাছে। ফিরেও তাকাবে না। বড়জোর করুণা করবে।
—তাই বলে তুই বন্ধু-বান্ধবকে বিশ্বাস করবি না? প্রতি মুহূর্তে মাপতে থাকবি কে তোকে কিসের জন্য পছন্দ করছে? বাঁচবি কী করে? কী নিয়ে?
—কেন? বই নিয়ে, গান নিয়ে, আর সেই তাকে নিয়ে— যে আমারে দেখিবারে পায়/ অসীম ক্ষমায়/ ভালো মন্দ, মিলায়ে সকলি।
—তাই বল, তোর নোঙর তাহলে বাঁধা হয়ে গেছে!
—দুর, যদি ভাগ্যে থাকে পাব, নইলে পাব না। আর, না পেলেও সবার ওপরে তো একজন আছেনই যার কাছে সুন্দর-অসুন্দর ভালমন্দ বিচার নেই।
—কার কথা বলছিস? দাদু?
শিখরিণী হাসতে লাগল, বলল, তোমরা পারোও মৈত্রী। তোমাদের মতো নাস্তিক হয়ে বাঁচতে হলেই আমার হয়েছিল আর কী! কূল পেতাম না!
শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর! হায় কপাল! সে ভদ্রলোককে আমরা স্মরণ করি পরীক্ষার আগে, মাথার যন্ত্রণা হলে, কনস্টিপেশনে, চাকরির ইন্টারভিউয়ে। পুরোপুরি তৈরি থাকলেও ডেকে থাকি। ডাকটা আসে ভেতর থেকে। কেননা ডাকছি সেই অজানা অজ্ঞাতপরিচয় রহস্যময় এক্স-ফ্যাক্টরকে যা না কি সমান-সমানের মধ্যেও তফাত গড়ে দেয়। কিংবা নিচুকে উঁচু করে, উঁচুকে নিচু করে। তাই বলে, প্রাগৈতিহাসিক বুড়ো-ঠাকুরদাদের ঈশ্বর? কে বলছে? না গটগট চলে, কটকট বলে, চটপট নম্বর পায়, বেগুনি, নীল, মেরুন শাড়ি পরে রূপের বান ছোটায় সেই শিখরিণী পালচৌধুরী? ভাল।
বেশ গয়নাগাঁটিও পরে, বদলে বদলে। খায়দায়ও ভাল—ফুচকা, চাট, চটপটি কিছুতেই অভক্তি নেই। বিন্দির বিয়েতে গিয়ে তো মুরগি মাটন দুটোই সাঁটাল। কোনওটা বাদ দিল না। দহি-বড়া, ফিশ-তন্দুরি, আমিষ নিরামিষ…. এমনকী জিলিপি পর্যন্ত। ওরা সদ্য ভেজে ভেজে দিচ্ছিল।
একদিন বলেছিলাম, তোর ঈশ্বরের সঙ্গে কিন্তু এই গয়নাগাঁটি, মুরগি, মাট্ন, ফুচকা-চাট ঠিক যায় না। ঠিক যেন শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ ম্যাচ করেনি।
শুনে বেশ কিছুক্ষণ হাসল। সিরিয়াস হলেও রসিক বেশ, হাসতে ওস্তাদ। বলল, তুমি কি আমাকে মীরাবাইটাই ঠাওরালে নাকি? ম্যয়নে চাকর রাখ জি! তোমাকে হতাশ করতে হল। আসলে আমাদের পুরনো দিনের ঠাট-বাট সব গেছে। তবু তো বনেদি রক্ষণশীল বাড়ির মেয়ে। এইসব গয়নাটয়না পরার অভ্যাস ছাড়তে পারি না। আর, বাড়িতে আমাদের খাওয়া দাওয়ার কী তরিবৎ ধারণা করতে পারবে না। চলো, তোমাকে নিয়ে যাব একবার। তবে ধরনটা একটু আলাদা। গরমকালে আম-কাঁঠাল দিয়ে ঘন দুধ, শীতে ক্ষীর কমলা, ফলের পাহাড় বাড়িতে। মাংস মানে রেওয়াজি পাঁঠা। মাঝে মাঝে। মুরগির চল নেই। প্রচুর মাছ। কোনটা চাও বল না। তবে এই মুখরোচক কুপথ্যগুলো বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে নেই। সুযোগ পেয়ে তাই এগুলোর সদ্ব্যবহার করছি। বলতে বলতে ও বারোতম ফুচকাটা মুখের মধ্যে চালান করে দিল। ফুচকা-গদগদ গলায় বলল, দুর তুমিও যেমন। আমি সাধিকা-টাধিকা নই। বেশ রসেবশে আছি। একদম সাধারণ। প্লিজ মৈত্রী। আমার সম্পর্কে অনর্থক উচ্চ ধারণা কোরো না। পস্তাবে, মানে পছতাওগি।
তবে, ও যে ভীষণ ভাগ্যবাদী সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
আমি যত জনের সঙ্গে আজ অবধি মিশেছি তাদের মধ্যে শিখরিণী একেবারে আলাদা। যতই যা-ই বলুক ও আমাকে জীবন সম্পর্কে বদ্ধমূল ধারণাগুলোকে, কম্বিনেশনগুলোকে ভাঙতে শিখিয়েছে। মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ যাকে বলে। যেমন হাই-হিল, টপ-জিনসের সঙ্গে নোলক চলতে পারে, ধনেখালি শাড়ির সঙ্গে শালা। পাতাখোর দেখলেই মনে করার কারণ নেই—ছেলেটা/মেয়েটা বড় দুঃখী, জীবনে প্রচুর সমস্যা, পরীক্ষায় ফেল ইত্যাদি। পাতার সঙ্গে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্টও চলে, যদিও কতদিন চলবে বলা যায় না।
কাজলের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ‘ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল স্টাডিজ’-এ। রাধিকাদি অর্থাৎ রাধিকা কৃষ্ণানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। পরীক্ষা হয়ে গেছে। কেন যেন সাহিত্যটাহিত্য আর ভাল লাগছিল না। ফরাসি, জার্মান, সংস্কৃত, ইংরেজি, বাংলার পাথর টপকে টপকে চলমান সাহিত্যের সঙ্গে ঘর করেছি দু’ বছর। মনটা ‘হেথা নয়, হেথা নয়’ করছে। সেই সময়ে রাধিকাদির সঙ্গে আমার পরিচয় একটা সেমিনারে। প্রান্তিক মানুষের সংস্কৃতি নিয়ে একটা দারুণ পেপার পড়েছিলেন উনি। আমাদের কত পুজো, বারব্রত, উৎসব, শুভকাজের আনুষ্ঠানিকতা যে আসলে আদি-সংস্কৃতি থেকে এসেছে, তার কথা বলছিলেন উনি। আমার অনেক প্রশ্ন ছিল। যথাসম্ভব উত্তর দিলেন, তারপর দেখা করতে বললেন ইনস্টিটিউটে। ওঁর ঘরেই একটি ছেলে মানে যুবক বসেছিল কম্পিউটারের সামনে। খুব মন দিয়ে কাজ করছিল।
আমি ঢুকেই বলি, রাধিকাদি আমাকে আজ আসতে বলেছিলেন। আমি—
—বসুন।
দশ মিনিট হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম উনি কি আজ আসবেন?
—এসেছেন। একটা জরুরি কাজে গেছেন। এসে পড়বেন।
আরও দশ মিনিট পেরিয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম এ কি হাসপাতাল না কর্পোরেট হাউস বাবা যে জরুরি কাজে চলে গেলেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট অগ্গেরাহ্যি করে?
একটু পরে নিঃশব্দে চলে আসছি। কম্পিউটারের দিক থেকে গলা ভেসে এল, আর দশ মিনিট।
পেছন ফেরেনি। মাথার পেছনে চুলে লুকোনো দুটো চোখ আছে না কি রে বাবা! না কি কম্পিউটার-স্ক্রিনে কোনওভাবে আমার ছায়া পড়েছে? জিজ্ঞেস করলাম, আর দশ মিনিটে এসে যাবেন?
—বোধহয়।
বলতে বলতেই রাধিকাদি ঢুকলেন। দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমার বায়োডেটা আনতে বলেছিলেন। কেন কে জানে! —হিসট্রির সঙ্গে তো কোনও সম্পর্ক নেই দেখছি। —বললেন।
আমি বলি—গ্র্যাজুয়েশন অবধি হিসট্রি ছিল। খুব ইনটারেস্ট ছিল জানেন। ওদিক থেকে যুবক বলল— এটা কী বললেন ম্যাডাম, হিসট্রির সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন মানুষ আছে?
উনি হাসলেন— ঠিকই। একরকম ঠিকই বলেছ— মৈত্রী, এ আমার রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট কাজল। তবে কে কার অ্যাসিস্ট্যান্ট সবসময়ে বোঝা যায় না।
খানিকটা মৃদু হাসি। কাজল চেয়ার ছেড়ে এদিকে এসে বসেছে। চা এল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, আর মুণ্ডাটা বললেন না ম্যাডাম? কাজল সিং মুণ্ডা।
পরে আমি বলেছিলাম, তুই এত কমপ্লেক্সে ভুগিস কেন রে? ও বলেছিল— ভুগি না। কিন্তু কমপ্লেক্স আছে। থাকবেই। নিজে ব্যানার্জি হয়ে মুণ্ডা অভিজ্ঞতা বোঝা যাবে না।
তা হলে অ্যাফিড্যাভিট করে পাল্টে নে পদবিটা।
তাহলে আর কী করলাম জীবনে?
এ-ই কাজল। কী যে করতে চায়— বোঝা যায় না পরিষ্কার।
৩) তিনি
রাত্রে গভীর ঘুম হয়েছে। সারাদিনের ক্লান্তি, চমৎকার একটি চান, এবং একটা নিশ্চিন্ততা। যেন অনেক অনে-ক দিন নির্বাসিত ছিলেন। এত দিনে বাড়ি ফিরলেন। এই বাড়ির প্রতিটি কোণ তাঁর প্রিয়, খুঁটিনাটি সব চেনেন, মনে আছে। একটাই অসুবিধে। তিনি ঘুমিয়েছেন ছ’ বছরের একটি বালিকার মতো, পঞ্চান্ন বছরের অভিজ্ঞ এক বয়স্ক মানুষের মতো নয়। এরকমটা যে হতে পারে তা কি তাঁর ধারণায় ছিল? ছিল না। কেননা যতক্ষণ তিনি আমদাবাদে, সুরতে, ততক্ষণ তিনি কস্তুরীবেন, কস্তুরী মেহতা। কিন্তু কলকাতায় পৌঁছোবার সঙ্গেসঙ্গে টাইম-মেশিন তাঁকে সঙ্গে নিয়ে পেছনের দিকে ছুটেছে। সত্যি বলতে কি ঘুমের মধ্যে তাঁর যেটুকু চেতনা ছিল সেটা কিকির চেতনা, কস্তুরীর নয়। ঘুমটা যখন ভাঙব-ভাঙব করছে, কেমন একটা অস্বস্তি লাগছিল। যেন অনেকখানি জায়গা জুড়ে শুয়ে আছেন। পাটা যেখানে শেষ হয়েছে তার পরেই শূন্য। তা ছাড়া, কই পাশেও তো কেউ নেই! তার পরেই খেয়াল হল এ সবরমতীর তীরে শাহিবাগের নতুন শ্বেতপ্রাসাদ নয়। শাহপুরের দুর্গবাড়িও নয়। অন্য কিছু। দপ করে মনে পড়ে গেল।
ভোরবেলাগুলো আগের মতো আছে কিনা বোঝবার জন্যে তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়েই সজাগ হয়ে রইলেন। চোখ বুজে। বোজা চোখের জগৎ আর খোলা চোখের জগৎ একেবারে আলাদা। তাঁর ব্লাইন্ড স্কুলের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সঙ্গে থাকবার ফলেই হয়তো ভিন্ন ভিন্ন ইন্দ্রিয়ের নিজস্ব কার্যকারিতা সম্পর্কে তাঁর এমন একটা পরিষ্কার ধারণা হয়ে গেছে। দৃশ্য নেই, ধ্বনি আছে, গন্ধ আছে, স্পর্শও আছে। খড়খড় করে কিছু একটা যাবার শব্দ। কী এটা! হাতে-ঠ্যালা গাড়ি নিয়ে জমাদার হতে পারে, কর্পোরেশনের গাড়ি যায় ছড়ছড় করে জল ফেলতে ফেলতে, রাস্তা ধুয়ে যায়। আবার এ-ও দেখেছেন সাইকেলে একগাদা দুধের ক্যান নিয়ে দুধওলা চলেছে। ভেতরে দুধ ছলকাচ্ছে তার আওয়াজ। সাইকেলে বাহিত হয়ে যাবার ফলে একটা অনির্দেশ্য শব্দময় গতির আওয়াজ। কোনটা? জানতে হলে বারান্দায় গিয়ে ভোরের কলকাতার প্রাচীন, বালিকা রাস্তায় চোখ রাখতে হবে। কেমন একটা রোমাঞ্চ হল। কোনটা হলে তাঁর ভাল লাগবে? খুব আশ্চর্য হয়ে দেখলেন জমাদারের গাড়ির আওয়াজটাই তিনি শুনতে চাইছেন। কেন? কেননা স্মৃতির রাস্তায় ওই আওয়াজটাই রয়ে গেছে। এ মহানগর জঞ্জাল পরিষ্কারে ধ্যান দিচ্ছে কিনা জানতে তাঁর আগ্রহ নেই। হঠাৎ তিনি নির্ভুল ঘ্রাণ পেয়ে যান— গন্ধরাজের। আবারও গায়ে কাঁটা দিল। ওটা কি সত্যিই আছে? না, স্মৃতির অতলে যেখানে মাটি পেয়েছে সেখানেই শেকড় গাছটার? তার ঘন সবুজ পাতা, শুভ্র থোকা থোকা ফুল, হৃদয় মন আর্দ্র করা সুগন্ধের।
আর থাকতে পারলেন না। কাল রাতে অত খেয়াল ছিল না, তখন ভিড়, ঘাম, ময়লা, রুদ্ধগতি, গাড়ির কালো ধোঁয়া, বাড়ি পৌঁছোবার তাড়া, দুটি নতুন সময়ের নতুন মুখ এবং ক্লান্তিও। নিশ্চয়! কে বলেছে তাঁর ক্লান্তি নেই! তবে হ্যাঁ, চট করে প্রকাশ করেন না। সহ্য করবার ক্ষমতা, মনোবল এসব তাঁর উত্তরাধিকার।
শাড়ির আঁচলটা গায়ে টেনে তক্তপোশ থেকে নামলেন, চটিজোড়া পায়ের আন্দাজে পরতে গিয়ে পেলেন না। খালি পায়েই বারান্দার দরজা খুললেন আর অমনি ‘হ্যালো’ বলে অভ্যর্থনা জানাল হাওয়া। হাওয়ার কোনও নতুন পুরনো নেই। গ্রাম-শহরের চেহারা বদল হয়। সভ্যতার চালচলন বদলে যায়। হাওয়া বদলায় না। সেই চির-পুরাতন, চির-নতুন হাওয়া তাঁকে দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল। হাওয়ার বুকের মধ্যে স্থির হয়ে রইলেন তিনি যেন বহুদিন পরে ধরা পড়েছেন প্রিয়জনের আলিঙ্গনের মধ্যে। কিন্তু তারপর গন্ধ তাঁকে আবার উতলা করে দিল। বারান্দার রেলিংপটিতে হাত রেখে তিনি ভয়ে ভয়ে ডান দিকে তাকালেন। আশ্চর্য! ঠিক মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে গন্ধরাজ বৃক্ষ। পাতাগুলো ঘন সবুজ, ফুলে ভরা। ঠিক যেন ছোট ছোট পাখির ছানা পড়েছে গাছটাতে। পরিযায়ী বকেদের সদ্যোজাত ছানাদের সঙ্গে অল্প দূর থেকে দেখা ওই ফুলগুলোর আপাতদৃষ্টিতে কোনও তফাত নেই। কিন্তু কী যে সুবাস বয়ে আনছে—টাটকা। হাস্নুহানার মতো তীব্র নয়। কেমন মগ্ন করা। গন্ধরাজের সুবাস-সায়রে এক ডুব, দুই ডুব দিয়েই দুঃখিনী কিকি পৌঁছে যায় বাহান্ন-তিপ্পান্নর-চুয়ান্নর কলকাতায়। তখনও ছিল এই গভীর সুবাস, ভোরবেলার ওই খড়খড় শব্দ!
একটু আগেই ধোয়া হয়ে গেছে রাস্তা, জমাদার চলেছে। সন্ধেবেলা কর্পোরেশনের যেসব বাতিওলা গ্যাসের আলো জ্বেলে দিয়ে গেছে, এখন তারা লম্বা মই কাঁধে বাতি নিবোতে নিবোতে যাচ্ছে। গাছে গাছে ভরা রাসবিহারী। সন্ধেবেলা বাসা-ফিরতি পাখির কাকলিতে ঝরনার মতো একটা আওয়াজ হচ্ছে। ছেড়ে ছেড়ে বাড়ি। ট্রামরাস্তা চলে গেছে ভীষণ একটা বিস্ময়ের পথ হয়ে। কোথায় গেছে পথটা? দিল্লি? ‘দিল্লি চলো’ কথাটা মাঝে মাঝেই শোনা যেত কিনা! দিল্লি একটা লক্ষ্যস্থল। আবার পথটা বিলেতেও গিয়ে থাকতে পারে। যেখানে বিলিতি সাহেবরা সব তাড়া খেয়ে চলে গেছে। মাঝে যে সমুদ্র আছে, অতশত মনে পড়ত না। সমুদ্রটা কী, তাই-ই জানা ছিল না তো!
ফার্ন রোড চিরকালই সরু। সরু সরু শাখাপ্রশাখায় ছড়িয়ে গেছে বলেই কি নাম ফার্ন রোড? ভোরবেলা বাবা-মা’র সঙ্গে লেকে যাওয়া একটা মস্ত আনন্দের ব্যাপার! বাবা-মা পেছনে পেছনে। সামনে লাফাতে লাফাতে চলেছে কিকি। ওইখানেই সে পাটকিলে রঙের কুকুর কুৎরাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। ধুঁকছিল ছানাটা। একটু বড় হয়েই অবশ্য তার বিরাট বন্ধুবান্ধবের দল হয়ে গিয়েছিল। বখা কুকুরগুলোর ডাকে সে হুড়মুড় করে বেরিয়ে যেত। কিকির বকুনিতে কান না দিয়ে। তবে রাস্তায় তাদের কাউকে দেখলেই এমন বাঁইবাঁই লেজ নাড়ত যে মনে হত লেজটা উপড়েই যাবে বুঝি বা! খাওয়ার সময়েও তিনের একের সামনে ঘুরঘুর করত। তবে তিনতলার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার তার উপায় থাকত না। দারোয়ান দুরদুর করে তাড়িয়ে দিত। বাচ্চাবেলার কুৎরার ডাকটা তিনি ক্ষীণস্বরে শুনতে পেলেন। কত দূর থেকে ডাকছে কুৎরা? কাকে ডাকছে?
সেই ডাকেই কি বেবি-ফ্রক পরা বালিকাটি বেরিয়ে এল? বাবা তো হুশ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। পাশে বসে শরদকাকা। ওটা ছিল একটা পুরনো মরিস মাইনর। বাবা কিকিকে বলেছেন এর পরে একটা স্টুডিবেকার, তারপরে? তারপরে একটা ডেমলার। রোলস রয়েস রাক্ষুসে তেল খায়, দেখতেও কেমন বিদঘুটে মতো। বাবার পছন্দ নয়। কিকিরও পছন্দ নয়। সে অবশ্য ডেমলার বা রোলস রয়েস কিছুই দ্যাখেনি, তবু বাবার যা পছন্দ, তারও তাই-ই পছন্দ। বাবা তাকে চুপিচুপি বলেছেন, আমদাবাদে দুটো গাড়ি আছে— একটা বুইক আর একটা স্টুডিবেকার। বাড়িটা অনেক বড়, সুন্দর। কত আসবাবপত্র!
মা বেরিয়ে এলেন। ডুরে শাড়ি, মাথার ঘোমটা খসে পড়ে গেছে। সরু সিঁদুরের রেখা; মায়ের হাতে পল কাটা কাটা সোনার চুড়ি, হাত নাড়লেই ঝিকঝিক করত। ঘুমোবার সময়ে সে চুড়িগুলো নিয়ে খেলা করত। তবে গলার হারটার ওপরই বেশি লোভ ছিল কিকির। সেটাও চিকমিক করত। মায়ের মুখটা মনে করতে গিয়ে শুধু সোনার চুড়ির ঝকমকানিটাই মনে পড়ল! চুড়ি, হার, দুল। তবে কি সোনাই মাকে হারিয়ে দিল?
গান্ধী-টুপি খদ্দরের ধুতি পরা বা না পরা কত লোক আসছেন বিকেল হতে না হতেই। সুধাকাকা, রবিজ্যাঠা, অজিতবাবু, নিবেদিতা মাসি আর মেসো, রমাপিসিমা, স্নেহকাকিমা, আত্রেয়ীদিদি, রবিনদাদা। কত। কত! মা একটা বিরাট ডেকচিতে চা চাপিয়েছেন। একটা পেল্লাই অ্যালুমিনিয়মের কেটলিতে সেই চা ছাঁকা হল। সবাইকার মাঝখানে মা বসিয়ে দিলেন কেটলিটা। অনেক মাটির ভাঁড়। বাইরে থেকে আলুর চপ কি বেগুনি, কিংবা কচুরি এসেছে। এক গামলা মুড়ি। খেতে গিয়ে কিকি দেখে উঃ কী ঝাল! কী ঝাল! মা বলছেন, তোমার মুড়ি আলাদা বাটিতে মেখেছি সোনা। এই যে! গমগম করে আলোচনা চলছে। বাবা আর শরদকাকাও আছেন। একটু পরেই দু’জনে বেরিয়ে গেলেন। কারবার আছে। কুৎরাকে নিয়ে কিকি খেলা করছে। বল নিয়ে, ছোটবেলাকার ঝুমঝুমি নিয়ে। ঝুমঝুমিটা মুখে করে আনছে ছোট্ট মিষ্টি মতন কুৎরা। ঝুমঝুম, ঝুমঝুম করে শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ কস্তুরীর মনে হয় তাঁর জগৎ প্রধানত গন্ধময়। তারপরেই আসে শব্দ; তারপরে স্পর্শ, শেষে রূপ। কেননা তিনি তাঁদের দ্বিতীয় গাড়ি বুইকটার চেহারা মনে করতে পারছেন না। মায়ের মুখটাও না। কিন্তু মাতৃগন্ধ এখনও কোনও কোনও সময়ে তাঁকে উতলা করে। স্পর্শটা রয়েছে আরও গভীরে, ঘুমের মধ্যে পান, আঁকড়ে ধরতে গেলে উবে যায়। কুৎরার ডাকটা শুনতে পাচ্ছেন, মনে পড়ছে তার পাটকিলে রংটা, এবং যেহেতু সে অতি সাধারণ গড়পড়তা একটা নেড়িকুকুর যাদের রাস্তায়-ঘাটে দেখাই যায়, তাই হয়তো এখনকার কোনও পথকুকুরের আদলের ওপর পাটকিলেটা চাপিয়ে তিনি কুৎরাকে গড়ে নিচ্ছেন। তার হয়তো আলাদা কোনও ব্যক্তিত্ব ছিল, স্বরূপ ছিল, তিনি বুঝতে পারেননি। সুধাকাকা, রবিজ্যাঠা, নিবেদিতা মাসি এঁরাও সব যেন জল পড়ে ধেবড়ে যাওয়া ছবি। কতকগুলো অদরকারি তথ্য মনে পড়ছে, কে কীভাবে শাড়ি পরতেন, কার আসা-যাওয়ার ভঙ্গিটা কেমন।
খালি অজিতবাবুকে দপ করে পুরোটা মনে পড়ে গেল। কাঁচা পাকা দাড়ি বুক অবধি। তিনি সেটাতে প্রায় সবসময়ে হাত বোলাতেন। একটা মুদ্রাদোষ। সে জিজ্ঞেস করত— অজিতবাবু, দাড়িটা কি তোমার কুৎরী?
কেন? কেন?
সবসময়ে আদর করো যে!
গোঁফদাড়ির মধ্যিখানে অজিতবাবুর কালচে লাল ঠোঁট হাসছে। গেরুয়া পাঞ্জাবি সমেত মোটাসোটা শরীরটা দুলে দুলে উঠছে। সবাই হাসছে। কিকি একটুও অপ্রতিভ নয়। বাবা বললেন, কিকি এখন তুমি ওপরে গিয়ে ছবির বই দেখো। হ্যাঁ আরও ছবির বই এনে দেব তোমাকে।
সে বুঝতে পারে, তার অজিতবাবু ডাকটা বাবা পছন্দ করছেন না। মা- ও দু-একবার শোধরাতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আর সবাই ডাকটাতে খুব মজা পেত। অজিতবাবু নিজে তো বটেই। ঘরসুদ্ধ সবাই ভীষণ আপত্তি করে ওঠে। কিকির বাচ্চা গলার ‘অজিতবাবু’ ডাক প্রতিদিনের সভায় একটা কমিক রিলিফ।
রামলাখন দোকান থেকে ধোকলা কিনে এনেছে। দুধ ফুটিয়ে এনেছে। এই বাড়িতে রান্নাঘর আছে, কিন্তু উনুন নেই। শুকনো খাবারদাবার কিছু কিনে আনতে হবে। ফলটল। কিন্তু রান্না খাবারের জন্য রামলাখনের ওপরই নির্ভর করতে চাইছেন তিনি। কেরোসিন স্টোভ একটা কিনে এনে, কেরোসিনটিন দিয়ে রেডি রাখতে বলেছেন। তবে সেটা হঠাৎ কোনও দরকার পড়লে। এমনিতে এই-ই বেশ!
খাওয়া শেষ করে রামলাখন বাসন নিয়ে বেরিয়ে গেলে একটা পুরনো ডায়েরি বার করলেন তিনি ব্যাগ থেকে। মহামূল্যবান ডায়েরি। বহুব্যবহারে জীর্ণ। কিন্তু বাবার হাতে, মায়ের হাতে লেখা অজস্র নাম ঠিকানা টেলিফোন নম্বর লেখা। যেগুলো বিশেষ করে চাইছেন, দরকার, সেগুলোতে ফোন নেই। কবেকার ঠিকানা সব। কে জানে এখনও এই ঠিকানায় ঠিক লোক থাকে কিনা। থাক বা না থাক, তাঁকে তো চেষ্টা করতেই হবে। তাড়াতাড়ি চানটান সেরে তৈরি হয়ে নিলেন তিনি। একবার মনে হল—ওই ছেলেটি? কী যেন নাম? কাজল? কাজলকে সঙ্গে নেবেন? সুবিধে হত। নাঃ, কালকে অতক্ষণ সময় নিয়ে নিয়েছেন ছেলেটার। আজ ডাকলে ওর কাজের ক্ষতি হবে। কোথাও নিশ্চয় কাজটাজ করে। তিনি ডাকলে না করতে পারবে না। ঠিক হবে না। তা ছাড়া কস্তুরী মেহতা কবেই বা কার সাথ সঙ্গতের পরোয়া করেছেন!
রামলাখনকেই জিজ্ঞেস করলেন, বোসপাড়া লেন কীধর হোগা মালুম হ্যায়?
বাউস পাড়হা? জরুর মাজি! গড়িয়াহাট সে এক ট্যাক্সি লে লিজিয়ে, উসকো বোস পুখখর জানে কো বোল দিজিয়ে। পতা আপ কি পাস হ্যায় তো উধার হি মিল জায়েগা। উও যো বিজুয়ান পুল হ্যায় না? উস কি বগল মে।।
সত্যি কথা বলতে কী কীভাবে কোথায় পড়বেন তাঁর এইবার একটু গুলিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির দরজায় ট্যাক্সিটা এসে দাঁড়ালে কোনও অসুবিধে ছিল না। কিন্তু রামলাখন পরম আস্থাভরে তাঁকে গড়িয়াহাট দেখিয়ে দিয়েছে, কোন না কোন বিজুয়ান পুল দেখিয়ে দিয়েছে। কী করেন? রাস্তায় বেরিয়ে এক মিনিট ভাবলেন। কাল বাড়ি আসবার সময়ে রামকৃষ্ণ মিশনের মস্ত বিল্ডিংটা চোখে পড়েছিল, ওই দিকেই চললেন। মিষ্টির দোকান রয়েছে। গোলপার্ক।
মোড়ে বেরিয়েই চোখে পড়ল বিল্ডিংটা। রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার। সামনে একটা পুতুলের মতো বিবেকানন্দর মূর্তি। অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন। বিবেকানন্দর মূর্তির মধ্যে বিবেকানন্দকে দেখতে পেলেন না। ইনস্টিটিউটটা তার লম্বাচওড়া ভারিক্কি চেহারা নিয়ে তাঁকে বলতে লাগল— বোসপুকুর চেনো না? গড়িয়াহাট রোড চেনো না। শ্যামবাজার চেনো না, বিজন সেতু চেনো না, আমাকে চেনো না, বিবেকানন্দকে চিনতে চাও? জান না, যত বয়স হয় মানুষ ছোট্ট থেকে আরও ছোট্ট হয়ে যায়! দেড়শো বছরের কাছাকাছি বয়স হল না ভদ্রলোকের? রবীন্দ্রনাথের থেকে মোটে দু’ বছরের ছোট। তার ওপর বিংশ শতাব্দী দেখতে না দেখতে কেটে পড়েছেন। আর থাকেন? এ তো তবু পুতুল!
একটা মিষ্টির দোকানে জিজ্ঞেস করলেন, বোসপুকুর কোথায়?
ট্যাক্সিকে বলুন দিদি, বিজন সেতু পার হয়ে কসবা, তারপর বোসপুকুর। সবাই চেনে, দারুণ ঠাকুর হয়— শিশি-বোতল, শনের দড়ি…দেশলাই…বিস্কুট…।
কেমন অবাক হয়ে তিনি একটা ট্যাক্সি ধরলেন। শিশি বোতল, শনের দড়ি…দেশলাই?
—চিনো? বোসপুকুরে বোসপাড়া লেন? যেতে পারবে?
—কেন পারব না, কলকাতা আমার হাতের পাতার মতো চেনা। বোসপুকুর যখন আছে তখন বোসপাড়াও থাকবে। একটু খুঁজে নিতে হবে আর কী!
আরে! এই তবে বিজন সেতু? বাঁয়ে একডালিয়া পড়বে না? কর্নফিল্ড রোড? ডাইনে বালিগঞ্জ স্টেশন! কী চমৎকার গাছগুলো! রাধাচূড়ায় এখনও ফুল আছে। কৃষ্ণচূড়ার ঝিরিঝিরি পাতাগুলো চমৎকার সবুজ। কাঁপছে। দুদিকে বড় বড় বাড়ি!
বললেন, বাঃ, এসব তো নতুন নতুন বাড়ি দেখছি!
ড্রাইভার বলল, আপনি নতুন, না? এসব জায়গা নতুন ডেভেলপ করছে। সব তো জলজঙ্গল ছিল। এখনই কী দেখছেন, বাইপাসে গিয়ে মিশবে রাস্তা। কত বড় বড় হাসপাতাল। একেবারে যেন বিলেত আমেরিকার মতো। হাসপাতাল, কী হোটেল, বুঝতে পারবেন না দিদি!
কিন্তু কলকাতা হাতের পাতার মতো চেনা ড্রাইভারটি কোনও বোসপাড়া লেন খুঁজে পেল না। পুকুরের পাশ দিয়ে, খোলা জমির পাশ দিয়ে দিয়ে সরু সরু রাস্তা, ঝকঝকে নতুন বাড়ি, কিন্তু না আছে রাস্তার নাম, না কোনও হদিশ! অনেককে জিজ্ঞেস করেও কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না।
শেষ পর্যন্ত আর এক ট্যাক্সি-ড্রাইভারই বলল, বোসপাড়া লেন তো নর্থে, বাগবাজারে, বুদ্ধু আর কাকে বলে?
বেচারি ডাইভার অপ্রস্তুত। —যাবেন দিদি? এখান থেকে অনেক ভাড়া পড়ে যাবে কিন্তু। তারপরে…মানে…আমি তো চিনি না ঠিক। এইরকম ঘুরব আবার।
তুমার ঘুরতে ইচ্ছা করলে চোলো, আমার অসুবিধা নাই। —বলে কস্তুরী সিটে হেলান দিয়ে দীর্ঘযাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। একটা ট্যাক্সি, তার থেকে আবার আর একটা ট্যাক্সি, এত ঝামেলায় কাজ কী! পৌঁছোনো নিয়ে কথা।
বাগবাজার! তার মানে তিনের একে পরস্পরের সঙ্গে আলোচনার জন্য সুদূর উত্তর থেকে অজিতবাবুরা আসতেন। একদিন দু’দিন ছাড়াই সভা বসত। কয়েকটা ঠিকানা দেখে তিনি বুঝতে পারছেন কোন অঞ্চলে। যেমন বেহালা, শিবপুর, হাওড়া, কিন্তু কলকাতা ৫, ৬, ১২—দেখে তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। তখন এই একডালিয়াই ছিল দক্ষিণের শেষ সীমানা। কসবা অঞ্চলে নিশ্চয়ই মানুষের বসবাস ছিল, কিন্তু সে কেমন তাঁর জানা নেই। জামির লেন মনে আছে খুব। জাদুকর পি. সি. সরকারের বাড়ি। বাবার সঙ্গে গিয়েছিলেন একবার। উনি তাসের ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এই মেয়েটি যেখানে গেল—লেক গার্ডনস, ছেলেটি যেখানে গেল— সল্টলেক করুণাময়ী—এসব তাঁর জ্ঞানের বাইরে। পরে হয়েছে। ছোটবেলার সেই কলকাতাকে সবচেয়ে ভাল চেনা যায় তার ট্রামে। আর তার লেকে। ছুটির দিনে সারাদিনের টিকিট কিনে বাবা কয়েকবার কলকাতা ঘুরিয়েছিলেন। ময়দানের পাশ দিয়ে চলেছে ট্রাম। একদিকে অথই সবুজ। অনেক জায়গাও চিনিয়ে দিয়েছিলেন। টিপু সুলতানের মসজিদ, পার্ক স্ট্রিটের কবরখানা। জোড়া গির্জা, কলেজ স্কোয়্যার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ। অনেক কিছুই মনে নেই। বউবাজার, শেয়ালদা, শামবাজার। মা বলতেন, আসলে বহুবাজার, হু লিখতে শেখা হল, শিয়ালদহ, শ্যামবাজার, য-ফলা শেখা হল। এগুলো কিছুই ভোলেননি।
হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল কলকাতার গন্ধটা কেমন বদলে গেছে। আবারও সেই গন্ধ দিয়ে চেনা। একটা কেমন বিশ্রী পোড়া পোড়া গন্ধ জ্বলজ্বলে রোদের ঝাপটার সঙ্গে নাকে আসছে। জ্বালা করছে নাক-চোখ। চারপাশে ঠিক দুর্গাপুজোর মতো ভিড়। বড় বড় উড়ালপুল, আকাশছোঁয়া বাড়ি সব। খুব আধুনিক, জায়গায় জায়গায় গ্ল্যামারাস! হঠাৎ যেন কলকাতার খুব টাকাপয়সা হয়ে গেছে। আশ্চর্য! তাঁর ছোটবেলার দেখা দিল্লি কেমন আমূল পালটে গেল, পালটে গেল আমদাবাদ। ওল্ড আমদাবাদের দেওয়াল ক্রমে ভেঙে ভেঙে মিশে গেল মাটির সঙ্গে। নতুন নতুন ব্রিজ হল সবরমতীর ওপর, প্রীতম নগর, উসমানপুরি, বিদ্যাপতনগর কত এলাকা গড়ে উঠল। তিনি কি আশা করেছিলেন কলকাতা পঞ্চাশ বছর আগে থমকে থাকবে? এক প্রৌঢ়ার মনের শৈশবস্মৃতির ফসিল! গাছের ছায়ায় স্নিগ্ধ গলি। ঝকঝকে ধোয়া রাস্তা, খালি জায়গায় জায়গায় বাড়ির জঞ্জালের ছোট ছোট স্তূপ, যেগুলো জমাদার রাস্তা পরিষ্কার করে যাবার পরে পড়ত। মা খুব রাগারাগি করতেন। ঢং ঢং ভোরের ট্রামের শব্দ।
মনে হল কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়ে থাকেন। স্মৃতির শহর স্মৃতিতেই থাক। নতুন ছবি দেখলে যদি পুরনোটা মুছে যায়! মুছে গেলে স্মৃতি-সত্তার বড় ক্ষতি! কিন্তু এটুকু ক্ষতি তো তাঁকে সইতেই হবে। তিনি তো কোনও ছবি ঝালিয়ে নেবার বিলাস নিয়ে আসেননি! বাস্তবকে জানতে, সত্যের মুখোমুখি হতে এসেছেন। পুরনো ছবির ওপর দাগা বোলানো তাঁকে সাজে না। তবু চক্ষুষ্মান হয়ে চলতে চলতে তাঁর মনে হল পুরনো ছবিটা ঠিক মুছে যাচ্ছে না। তার ওপর এখনকার ছবিটা সুপার-ইমপোজড হয়ে একটা কীরকম পরাবাস্তব ছবি হয়ে যাচ্ছে। এবং যতই উত্তরে যাচ্ছেন সার্কুলার রোড ফিরে আসছে তার চেনা চেহারায়। যেন গভীর জলের মধ্যে থেকে ঘাই-মেরে উঠে এল বসু বিজ্ঞান মন্দির, ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়। এই বাড়িগুলো তিনি একদা চিনতেন।
আরে! ওই গোলাপি বাড়িটা ডান দিকে! বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ!!! মায়ের সঙ্গে এখানে তো তিনি অনেকবার বক্তৃতা শুনতে এসেছেন! বক্তৃতা শুনতে কিকি একদম ভালবাসত না। কিন্তু মা-বাবারা এসেছেন অতএব আসতেই হত। অখিলজেঠু বলতেন, আহা হা, ছোট্ট মেয়েটাকে কেন কষ্ট দেওয়া! আমি না হয় ওকে নিয়ে একটু গড়ের মাঠে বেড়িয়ে আনি। বাস, নীল সবুজ কাঠি আইসক্রিম, কুলফি, বেলুন…মজা…।
অনেক ঘোরাঘুরির পর বোসপাড়া লেন খুঁজে পেয়ে তিনি এবং তাঁর ড্রাইভার যেন ডাইনোসরের কঙ্কাল আবিষ্কারের গর্বে উল্লসিত হয়ে উঠলেন। তবে গলিতে গাড়ি ঢুকবে না। তিনি ড্রাইভারকে ছেড়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু ছেলেটি বলল—আপনার কি খুব দেরি হবে? কলকাতার তো কিছুই চেনেন না দিদি! আমি বরং একটু দাঁড়াই। মিটার ডাউন করে দিচ্ছি, যা উঠবে তাই দেবেন।
এখন যা উঠেছে তা হলে দিয়ে দিই? —কস্তুরী বুঝলেন না ড্রাইভারটি তাঁর সঙ্গে এত ভদ্রতা করছে কেন। ওয়েটিং চার্জটাও নিতে চাইছে না!
আমার কিন্তু দেরিও হতে পারে। কী নাম তোমার?
আমেদ।
ঠিক আছে। আমি টাকাটা দিয়ে দিই। যদি বেশি দেরি হয় চলে যেয়ো।
ঠিক আছে— বলে, দিব্যি সিটে হেলান দিয়ে ঘুমোবার তোড়জোড় করল ছেলেটি।
গোলকধাঁধার মতো গলি ঘুরে পাঁচের বি-র সামনে যখন দাঁড়ালেন, ততক্ষণে আবারও বহুকাল আগেকার কোনও সুগন্ধপ্রবাহ তাঁকে একেবারে অধিকার করে নিয়েছে। স্মৃতির ঘরে অনেক জমা-খরচের স্তূপের তলায় এতদিন চাপা পড়ে ছিল। কড়হি, খেপলার গন্ধ ভেদ করে এখন ছোটবেলা তার মুসুর ডালে কালো জিরে ফোড়নের সুগন্ধ ছড়াচ্ছে, মাছের ঝোল হচ্ছে কোথাও, ধনে জিরে হলুদ— তিনি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। ভেটকি মাছ তাঁর গন্ধ লাগত বলে মা লেবু দিয়ে গন্ধ কাটিয়ে নিতেন, বলতেন নে গরম গরম খেয়ে নে… নইলে আবার… প্রত্যেক বাড়িই যেন তার রান্নাঘরের জানলা এই সরু গলিপথের মধ্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছে শুধু তাঁরই জন্য। যাতে তিনি কিকির কলকাতায় পৌঁছতে পারেন। এক ধরনের সুগন্ধ অভ্যর্থনা।
বেল নেই। ভাল করে খুঁজেও পেলেন না। কে জানে চোখে এখন ঠিকঠাক নজর আছে কিনা! কড়া নাড়লেন ঠকঠক। নিচু দরজা খুলে চৌকাঠের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে একটি ফরসামতো বউ—তিনি নিৰ্ণিমেষে চেয়ে রইলেন। সেইভাবেই শাড়ি পরা, গলায় হার, হাতে চুড়ি, কানে দুল, কিন্তু সে নয়। এ সবই খাঁচা, খাঁচা ছেড়ে পাখি উড়ে গেছে, সঙ্গে নিয়ে গেছে তার যাবতীয় নিজত্ব। এই যে সময়ের বিপুল তফাত এটা যেন এই বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি বুঝতে পারছেন না।
—কাকে চাইছেন?
—ওজিতমোহন বোস কি এখানে থাকছেন?
বউটি একবার ভেতরের দিকে তাকাল— শুনছ! কে একজন কী বলছেন, একবার এদিকে শোনো না।
খুব আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন কস্তুরী, যতক্ষণ না প্যান্টের ওপর একটা পাঞ্জাবি চাপিয়ে, হাতে দাড়ি কামানোর ক্ষুর, এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন।
—কে? কাকে চান?
—অজিতমোহন বোসকে খুঁজছেন উনি—বউটি বলল।
—আহ, তুমি চুপ করো না। আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলছি। আপনি কে?
কী অদ্ভুত! তিনি কে না বললে কি এঁরা অজিতমোহন সংক্রান্ত কোনও খবরই তাঁকে দেবেন না?
—আমি আমদাবাদ থেকে কলকাতা এসেছি কাল, উনি আমার বাবার বন্ধুলোক ছিলেন। তাই…
—আপনি ভেতরে আসুন, নমস্কার। অজিতমোহন বোস আমার দাদু ছিলেন, দীর্ঘদিন রোগ ভোগ করবার পর এই মাস কয়েক হল ওঁর দেহান্ত হয়েছে। অনেক বয়স হয়েছিল।
—তা হলে আমি যাই!
—না, যাবেন কেন? একটু বসে যান— ভদ্রলোক দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন আপ্যায়নের ভঙ্গিতে।
একটু ইতস্তত করলেন কস্তুরী। তারপর তাঁর সংকোচের ওপর স্মৃতি, কৌতূহল জয়ী হল। তিনি ভেতরে ঢুকলেন।
চৌকো উঠোনে রোদ, কয়েকটা কাক ছোট্ট কিছুর টুকরো নিয়ে ঝগড়া করছে। দৃশ্যটা তাঁর চোখ যেন শুষে নিচ্ছে। এরকম চৌকো উঠোন থাকত, সেখানে রোদ-হাওয়া। ভেতর-উঠোন যাকে বলে। তিনি দেখেছেন, কারও বাড়িতে দেখেছেন। ডান দিকের প্রথম ঘর। ভদ্রলোক বললেন—আসুন। এবং ঢোকবামাত্র অজিতবাবুর গন্ধ পেলেন। নির্ভুল। গাটা কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল। সামনের দেওয়ালে একটা ফটো। এনলার্জ করা, এখনও চন্দনের ফোঁটা লেগে আছে। বেশ বৃদ্ধ, দাড়ি চুল সব সাদা হওয়ায় কেমন অসংসারী-অসংসারী ছাপ পড়েছে। যেন সৌম্য বিবাগী সন্ন্যাসী। গুরুটুরু জাতীয়।
ছবিটার তলায় একটা দেরাজ। তার ওপর একটি পালিশ করা ছড়ি শোয়ানো। আর একটা চমৎকার গজদন্তর কৌটো। আরও কতকগুলো রয়েছে—কোনটা শাঁখের কোনটা কাঠের।
তাঁর দৃষ্টি লক্ষ করে ভদ্রলোক বললেন, দাদুর এই নেশাটি জব্বর ছিল। এক ঘনিষ্ঠ গুজরাতি বন্ধু ওঁকে প্রত্যেক উপলক্ষে একটা করে নস্যদান প্রেজেন্ট করতেন। দেরাজের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছি। এই ছড়িটা ওঁর শেষজীবনের অবলম্বন। অন্ধের নড়ি।
—আন্ধা? উনি কি আন্ধা হয়েছিলেন নাকি?
—না, না, তা নয়। ওটা একটা বলবার ধরন ম্যাডাম— ইনডিসপেন্সেবল, আর কি!
কাঠের চেয়ারের ওপর আসন পাতা, তার ওপরে বসালেন ভদ্রলোক কস্তুরীকে।
—চা খাবেন ম্যাডাম!
—না, আপনি এখন বোধহয় অফিস বেরোচ্ছেন, আমি আর…
—ঠিক আছে, আমি বেরোব, প্রায় রেডি, আপনি একটু বসে যান না। চা?
—না।
—কেন? খান না?
—খায়, তবে বিশি না।
—তা হলে শরবত দিই। কিছু মুখে না দিয়ে যেতে পারবেন না। ওগো শুনছ, একটু শরবত! আচ্ছা…আপনার বাবা?
বউটি দু গ্লাস শরবত এনে রাখল।
কস্তুরী বললেন—নরেন্দ্র মেহতা। এই দু’মাস আগে গোতো হয়েছেন।
আরে তবে তো ঠিকই ধরেছি! এই নরেন্দ্রভাই-ই তো খুব বন্ধু ছিলেন দাদুর। গল্প শুনেছি অনেক। উনি বলতেন নরেন্দ্রর কাছে যে আমি কতভাবে ঋণী! আপনি ওঁরই মেয়ে?
খুবই কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালেন ভদ্রলোক। উনি কী জানেন, কতটা জানেন ভেবে অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন কস্তুরী। হয়তো তিনি যা জানেন, অজিতবাবুর এই নাতিটি তার চেয়েও বেশি জানেন।
শরবতে চুমুক দিয়ে বেশ আরাম পেলেন তিনি। ছ্যাঁক করে তেলে পাঁচফোড়নের শব্দ হল। দু’টি ছেলে এসে দাঁড়াল—বারো থেকে চোদ্দোর মধ্যে বয়স।
আমার দুই ছেলে—অমিত আর অরিন্দম। অসিত… আমি অসিতমোহন। এই তোমরা প্রণাম করো এঁকে। একজন দিদা হন।
না না, শরবতের গ্লাস রেখে দিয়ে তিনি পা ঢাকলেন। ছেলে দুটি দ্বিধা না করে একরকম ছুটে বেরিয়ে গেল।
তাদের বাবা হেসে বললেন, আজ ইনটার স্কুল খেলা আছে। দু’জনেই ফুটবল। আজকালকার ছেলেরা… বুঝলেন তো! রোনাল্ডো, বেকহ্যাম, জিনেদিন জিদান সব রোল মডেল।
বা বেশ ভাল— কস্তুরী উঠে দাঁড়ালেন।—ওঁর কাছে বন্ধুরা কেউ আসতেন না?
আসতেন কেউ কেউ কিন্তু তাঁরা লোক্যাল লোক, আপনি চিনবেন কি? সুরেশ আচার্যি মশাই, বৃন্দাবন দাশ। রামমোহন লাইব্রেরির এগজিকিউটিভ কমিটিতে ছিলেন সব। ওঁরাই…।
এঁদের কাউকে চেনেন বলে মনে করতে পারলেন না কস্তুরী।
—আচ্ছা যাই, নমস্কার। পালটে বললেন ‘আসি।’
—যদি কিছু মনে না করেন ম্যাডাম, দাদুর একটা ছোট্ট স্মৃতি নিয়ে যান না! এই অজস্র নস্যিদানি রয়েছে, হয়তো সবই আপনার বাবার দেওয়া। দাঁড়ান, আমি বেছে দিচ্ছি।
ড্রয়ার থেকে ভারী সুন্দর একটা কাঠ-খোদাইয়ের কৌটো বার করলেন অসিতবাবু—এইটা পছন্দ হয়! এত দূর থেকে দাদুকে মনে করে এসেছেন!
এইবার কৌটোটা যেন সাড়ে চার দশক লাফিয়ে কস্তুরীর হাতে উঠে এল।
—অজিতবাবু এটা কী?
—এটা? আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের গল্প শুনেছিস তো? এটা হল তেমনই একটা আশ্চর্য কৌটো।
—এটা যদি মাজি, দৈত্য আসবে?
—দুর পাগলি, এটা তো আর পেতল তামা নয় যে মাজবি! এটার মধ্যে একটা ঝোড়ো দৈত্য থাকে, তার সঙ্গে খালি আমার ভাব।
—আমার কাছে আসবে না?
—আসবে। তবে সে তো নাক দিয়ে ফুঁসে বেরোয়, তোর ছোট্ট নাকখানা না ভেঙে দিয়ে যায়। বল, নিবি?
—ন্ না! —যে দৈত্য কিছু দেবে না, মাঝখান থেকে নাক ভেঙে দিয়ে যাবে, তাতে কিকির দরকার নেই।
কিন্তু কৌটোটার ওপর তার ভীষণ লোভ ছিল। ওইটা পেলে সে ওর ভেতর ভাজা মৌরি কি লেবু জোয়ান রাখতে পারে। ইচ্ছে হল একটু খেয়ে নিল। আজ নাতির হাত দিয়ে সেই কৌটো অজিতবাবু দিচ্ছেন কিকিকে।
—দাদুই দিচ্ছেন ধরুন— কেমন একটা রহস্য স্বরে বললেন অসিতবাবু। অজিতমোহন কি নাতিকে বলে গিয়েছিলেন— যদি কোনওদিন নরেন্দ্রর মেয়ে আসে তাকে এই কৌটোটা দেবে!
হাসিমুখে কৌটোটা নিলেন কস্তুরী, খুললেন— আর সঙ্গে সঙ্গে নাক সুড়সুড় করে জ্বালা করে ঝোড়ো দৈত্য তাঁর নাক দিয়ে আপসে বেরিয়ে এল।
ইশ্শ্ আপনার নাক তো ভারী সেনসিটিভ ম্যাডাম, কিছু মনে করবেন না। ছি। ছি। কবেকার…কৌটো…
কস্তুরী লাল চোখে, নাকে রুমাল চেপে রুদ্ধস্বরে বললেন—ইটস ও.কে!
অসিতমোহন জানেন না, তাঁর দাদু কিকির কাছে ছোট্ট একটা পুরনো রহস্য ভেদ করলেন। চমৎকার একটা ঠাট্টা হয়ে গেল একজন পরলোকবাসীর সঙ্গে একজন জীবিতের। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের! ডিব্বাটা হাতে চেপে ধরে তিনি বললেন—থ্যাংকিউ ফর দিস। আচ্ছা আসি।
শুনছ—ভদ্রলোক আবার হাঁক পাড়লেন—ইনি যাচ্ছেন যে! ফরসা বউটি তাড়াতাড়ি এসে দাঁড়াল। কী মনে করে তাঁকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করল। তিনি মাথায় হাতটা ছোঁয়ালেন।
আমেদ নিশ্চিন্তে গাড়ির মধ্যে বসে। চোখ বন্ধ। গান শুনছে। ‘সিসা হো ইয়া দিল হো, টুট জায়েগা!’ দরজা খুলে ধরল। ক্যাসেট বন্ধ করে দিচ্ছিল, কস্তুরী বললেন, থাক, গান চলুক না!… সিসা টুটে যায়, কিন্তু দিল কি টুটে?
কী মনে করে তিনি একটা বড় দেখে দোকানের সামনে দাঁড়ালেন। —রসগুল্লা আছে? স্পঞ্জ মতোন! বাগবাজারের?—দু’ হাঁড়ি কিনলেন। ধবধবে সাদা। রসের ভেতর টুবটুব করছে। বাড়িতে নামবার সময়ে এক হাঁড়ি আমেদকে দিলেন। ওয়েটিং চার্জ কিছুতেই নেবে না। যদি রসগোল্লা নেয়, তাহলে ওয়েটিং চার্জ নয়। অনেক কষ্টে তাকে দুটোই নেওয়ালেন কস্তুরী। খুশিখুশি মুখে চলে যেতে, মনে মনে বললেন, স্মৃতিসত্তা তোমায় দিলাম। আটপৌরে, আন্তরিক, অতিথিবৎসল পুরনো কলকাতা— তোমায় দিলাম।
৪) তিনি স্মৃতি ও মাসি
কাঠের নস্যিদানিটা হাতে করে বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে রইলেন কস্তুরীবেন। এক টুকরো অতীত বা ছুটোবেলা। সে সময়ে শরদকাকাকে শরদকাকা বলেই জানতেন। বাবার ছোট ভাই। পরে, দুজনের মধ্যে যখন কোনও সম্পর্কই আর রইল না, তখন জিজ্ঞাসাবাদ করে আস্তে আস্তে জানলেন শরদকাকা বাবার ছোট ভাই নন। বন্ধু। আদর্শবন্ধু। দু’জনেরই তখন এক মন, এক প্রাণ, দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে, দেশকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ না হোক উত্তম আসন দিতে হবে। হরিপুরা কংগ্রেসে সভাপতি সুভাষচন্দ্রকে দেখে, তাঁর ভাষণ শুনে তখন বাবা বাংলায় আসবেন বলে ঠিক করেন। বিয়াল্লিশের আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে প্রেসিডেন্সি জেলে থাকাকালীন দু’জনের ঠিকঠাক আলাপ। যখন জেল ছেড়ে বেরোলেন কোথায় সুভাষ? তখন সুভাষ-পন্থার সঙ্গে গাঁধী-পন্থার ঘোর তর্ক। তাঁরা বলতেন গাঁধীর অনশন এক ধরনের ইমোশন্যাল ব্ল্যাকমেল, গুরুতর কোনও বিপদ ঠেকাতে, প্রতিবাদ হিসেবে ভাল। কিন্তু উনি সে অস্ত্র যথেচ্ছ ব্যবহার করেন। যুদ্ধের সময়ে ইংরেজ শাসকের সঙ্গে যে চুক্তি তিনি করেছিলেন তার চেয়ে মূর্খামি আর হয় না। আর শেষ পর্যন্ত তো দ্যাখাই গেল তিনি আসল সময়েই অস্ত্রটা ব্যবহার করলেন না। জিন্নাকে শত্রুতে পরিণত করেছিলেন নেহরু-গাঁধীই। তারই অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে যখন পার্টিশন হল, গাঁধী তো কোনও অনশনে গেলেন না আর! অথচ কথা দিয়েছিলেন নাকি তাঁর মৃতদেহের ওপর দিয়ে পার্টিশন হবে! সুভাষচন্দ্র ছিলেন যাকে বলে কমপ্লিট লিডার। পূর্ণ নেতা, পূর্ণ মানুষ। তাঁর পরিকল্পনা ছিল স্বাধীনতার পর ঠিক কীভাবে দেশের মানুষ ও দেশকে গড়তে হবে। তাঁর আশা ছিল যে-মুহূর্তে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে ভারতের মাটিতে পা দেবেন, পুরো ভারত তাঁর সঙ্গে যোগ দেবে।
জেল থেকে বেরোনোর পর দু’জনে ঠিক করেন, কিছু করতে গেলে অর্থের প্রয়োজন। সুতরাং দু’জনে মিলে নানারকম ব্যাবসা আরম্ভ করলেন। বাবার পৈতৃক জুয়েলারির ব্যাবসা ছিল। সেই ব্যাবসাই ঠাকুরদার সাহায্যে কলকাতায় শুরু করলেন তাঁরা। তারপর বিজনেস এমন একটা জায়গায় চলে গেল যে দুজনেরই মনের তিন-চতুর্থাংশ চলে গেল সেদিকেই। বাড়িতে যেসব সভা বসত তাতে প্রায়ই গরহাজির থাকতে হত। অজিতবাবুই ছিলেন বোধহয় সবচেয়ে নিবেদিতপ্রাণ। কস্তুরীর কখনওই মনে হয়নি অজিতবাবুর নিজস্ব সংসার, ছেলেমেয়ে থাকতে পারে। ভাবতেন, শিশুমনে যতদূর ভাবা সম্ভব, যে, অজিতবাবু বোধহয় অকৃতদার। সন্ন্যাসী ধরনের মানুষ। যে-কোনওদিন উনি হিমালয়ে চলে যেতে পারেন, একমাত্র দেশের জন্যই পারছেন না। সন্ন্যাসী ধারণাটা মজবুত করেছিল দাড়ি। ঘাড় অবধি কাঁচাপাকা চুল, গেরুয়া খাদির পাঞ্জাবি। রবীন্দ্রনাথ মানেই যেমন দাড়ি। ওইরকম দাড়ি গোঁফওলা লোক হলেই বলা হয় রবীন্দ্রনাথের মতো। শুধু দাড়ি দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে চেনা— হাস্যকর!
অজিতবাবু তা হলে মারা গেছেন! অতি বৃদ্ধ বয়সে? একটা পাতা শূন্য হয়ে গেল। পূর্ণ করা গেল না। কত কী জানবার ছিল, বোঝবার ছিল! — অজিতবাবু আপনারা কী চেয়েছিলেন? কীরকম দেশ ও দেশবাসীর কল্পনা ছিল আপনাদের? তাকে সাকার করতে কোন পথে চেষ্টা করেছিলেন আপনারা? আচ্ছা, দেশের কাজের সঙ্গে কি বিবাহ করা যায় না? বিবাহিতকে অবিবাহিতের জীবন কাটাতে হয়? বা ভান করতে হয়? আপনাদের এক আইকন গাঁধীজি কিন্তু এন্ডস অ্যান্ড মিনস-এর শুদ্ধতার ওপর জোর দিয়েছিলেন। অজিতবাবু, আমার বাবা কিন্তু জানতেন না আপনি বিবাহিত। কেন এই ছলনা! লজ্জা! আপনার নাতির বয়স যদি আজ ৩৪/৩৫ হয় তাহলে আপনার ছেলের কম করে হলেও ষাট। তাহলে সে সময়ে আপনি বিবাহিত। পিতা। অথচ পুরোটাই চেপে গিয়েছিলেন, কেন? অজিতবাবু আপনার জীবন আপনাদের দেশপ্রেমের চরিত্র সম্পর্কে একটা নতুন দিক উদঘাটন করছে আমার কাছে। প্রাচীন ভারতের সব রকম ধর্মদর্শনে ব্রহ্মচর্য-সাধনাকে সবার ওপর স্থান দেওয়া হত। তাই কি আপনাদের এরকম সংস্কার হয়েছিল? এখনও পুরো জিনিসটার তাৎপর্য আমি বুঝতে পারছি না। মিথ্যে দিয়ে শুরু করলে কি কিছু সত্য দিয়ে শেষ হয়?
কীরকম হতভম্ব মতো হয়ে ডিব্বাটা হাতে বসে রইলেন কস্তুরীবেন। ছোট্ট একটু মিথ্যা আবিষ্কার দিয়ে যে যাত্রা শুরু হল তাকে কি আরও দীর্ঘ করা উচিত! ভাবতেই লাগলেন। ভাবতেই লাগলেন। তিনি সত্য জানতে এসেছিলেন, তথ্যও। একজন ছোট্ট মেয়ে তার নিজস্ব ছেলেমানুষি চোখ দিয়ে যা বুঝেছিল, তাকে প্রাপ্তবয়স্কর চোখ দিয়ে যাচাই করে নেওয়া চাই। কত মোহভঙ্গ হবে, হতেই পারে, সেটুকুর জন্য তাঁকে প্রস্তুত থাকতেই হবে। তিনি তো স্বপ্নে বাঁচেন না তাঁর বাবা-মাদের জেনারেশনের মতো। কঠিন বাস্তব নিয়ে তাঁর কারবার। চতুর্দিকে দেখেন ঈশ্বরের উপেক্ষিত প্রাণ সব—অন্ধ, মূক, বধির—তাদের হেলেন কেলার হবার প্রতিভা নেই, পরিবেশ নেই, জড়বুদ্ধি, স্প্যাস্টিক, অটিস্ট—এদের পুরো জীবনটা দুর্বহ বোঝার মতো নিজেদের কাছে, পরিবার-পরিজনের কাছে, আছে অত্যাচারিত স্ত্রী, মেয়ে, পথের শিশু—এদের সঙ্গে দেশ, তার নেতা, তার রাজনীতি, ধর্ম, উন্নয়ন— এসবের কোনও সম্পর্ক নেই। অর্থহীন জীবন, তবু বেঁচে থাকতে হয়। এক অক্ষম ঈশ্বর এদের সৃষ্টি করেছেন, তার দায় বইতে হয় তাঁদের মতো মানুষদের, যাঁরা নিরপেক্ষ নিরাবেগ কিন্তু সস্নেহ, মমতা দিয়ে দেখতে পারেন সব। উদাসীন ঈশ্বরের জায়গায় মমতাময় মানুষ, যার হাতে কোনও দৈব ক্ষমতা নেই।
নিবেদিতা মাসিই ছিলেন বোধহয় ওঁদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। কেননা তিনি মাকে দিদি বলতেন। মা-ও তো নিবেদিতাই বলতেন।
উঠে গিয়ে পুরনো ছাতাপড়া নোটবইটা নিয়ে এলেন তিনি। হাওড়া-৪৪৬। এ কবেকার ফোন নম্বর? এ বোধহয় অপারেটরের যুগের। তারপর গঙ্গা সবরমতী দিয়ে কত জল বয়ে গেছে। স্যাম পিত্রোদা টেলি কমিউনিকেশনকে ঢেলে সাজিয়ে দিয়ে গেছেন। ফোন করে, চেক ইয়োর নাম্বার শুনলেন, ওয়ান নাইন ফাইভ ওয়ান করে—‘হমে খেদ হ্যায়, ইয়ে নাম্বার মজুত নহি’ শুনলেন। কিছু হবার নয়। ঠিকানা পাঁচ নম্বর ব্যাপটিস্ট বেরিয়্যাল গ্রাউন্ড রোড, শালকিয়া, হাওড়া। এক কাজ করলে হয়। একটা গাড়ি ভাড়া নিলে হয়, সেক্ষেত্রে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে চলাফেরা করতে পারবেন। রামলাখনকে ডাকলেন।
—জরুর মায়ি, উও রেন্টাল তো বগলমেই হ্যায়, ম্যয় আভি জাতা হুঁ।
রামলাখনই ঠিক করে দিল।
দই চিঁড়ে খেয়ে বেরোচ্ছেন। জগদ্দল অ্যামবাসাডরটার ভেতরে সবে গুছিয়ে বসেছেন। মোবাইলটা বাজল। — হ্যালো দিদি, আপনি কেমন আছেন? সব ঠিকঠাক চলছে তো?
কাজল।
—হ্যাঁ, টিকই আছে।
—‘ই’ টা কেন? কোনও দরকার হলেই আমাকে জানাবেন কথা দিয়েছিলেন!
—কুনও ‘ই’ নাই। কোথার কোথা। আমি একটু দোরকারে বেরোচ্ছি।
—কোথায়?
—হাওড়া।
—হাওড়া? নতুন ব্রিজ দিয়ে যাচ্ছেন তো?
—নয়া ব্রিজ? কওন সা নয়া ব্রিজ?
—নতুন ব্রিজ আছে দিদি, বিদ্যাসাগর সেতু, ড্রাইভারকে বলুন বিদ্যাসাগর সেতু দিয়ে যেতে। জিটি রোডে পড়বে। কোনদিকে যাবেন?
—সালাকিয়া।
—সালা…ও শালকিয়া। তার মানে আপনাকে হাওড়া ময়দানের পরও সোজা চলে যেতে হবে। রাস্তার নাম বলুন!
বললেন।
—এঃ, চিনি বলে তো মনে হচ্ছে না। তবে পিলখানা বলে একটা জায়গা আছে, ওটাই মোটামুটি শালকিয়ার শুরু। ওইখান থেকে জিজ্ঞেস করতে করতে যেতে হবে। একটা রেন্টাল গাড়ি নিলে পারতেন।
—নিয়েচি।
—বেশ, আপনার কোনও অসুবিধে হলেই আমাকে ফোন করবেন। ঠিক হাজির হয়ে যাব।
—টিক আছে। ওত ভেবো না।
পাঁচ মিনিটও যায়নি আবার মোবাইলটা বাজল। নাহ্, এই তথাকথিত প্রগতিশীল কলকাতিয়ারা তাঁকে লেডিজ সিটে না বসিয়ে ছাড়বে না। মেয়ে গলা। মৈত্রী।
দিদি, আমি স্নেহলতা ঘোষের ঠিকানা বার করতে পেরেছি। —খুব উত্তেজিত গলা মৈত্রীর।
—পেরেচো? তাঁর গলাও কম উত্তেজিত নয়। স্নেহলতা ঘোষের ফোন নম্বরও তিনি খোঁজ করেছিলেন। কোনও হদিশ পাননি। ঠিকানাটা ধেবড়ে গেছে, বোঝা যাচ্ছে না। জিজ্ঞেস করলেন, কী করে? কুথায়?
উনি তো ফ্রিডম-ফাইটার। বাবার এক বন্ধু সেন্ট্রাল গভমেন্ট সার্ভিসে আছেন। উনি বললেন পেনশনার হলে আমি বার করতে পারব। পেয়ে গেছেন। আমি আপনাকে ওঁর কাছে নিয়ে যাব। আমারও খুব ইচ্ছে ওঁকে দেখি। আমি কখনও ফ্রিডম-ফাইটার দেখিনি দিদি।
টিক আছে।
মোবাইল বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে রইলেন কস্তুরী। কখনও ফ্রিডম-ফাইটার দেখিনি—কীভাবে বলল মৈত্রী। ফ্রিডম-ফাইটার যেন এক আজব চিজ। ম্যমি। কলকাতা মিউজিয়ামে এসেছে। দেখবার জন্যে লাইন দিতে হবে। না না, তিনি বায়াসড হয়ে যাচ্ছেন। এভাবে ভাবা ঠিক নয়। ওর গলায় উত্তেজনার সঙ্গে একটা সন্ত্রমও ছিল। কিন্তু কেন যেন একটা দুর্নিবার তিক্ততা তাঁর মনকে প্রায় আচ্ছন্ন করে। তখন বিদ্যাসাগর সেতুর মুখে এসে পড়েছে গাড়ি। অ্যাপ্রোচটা ধরে শাঁশাঁ করে যাচ্ছে। পথ বদলাচ্ছে, দৃশ্য বদলাচ্ছে, তিনি লক্ষ করলেন না। এদের সঙ্গে তাঁদের জেনারেশন গ্যাপটা অদ্ভুত চরিত্রের। বড়র ভাবনার জগৎ আর ছোটর ভাবনার গ্যাপ নয়। আরও বেশি কিছু। তাঁরা ইতিহাসে বেঁচেছেন। তাঁদের বাবা-মা, দাদা-দিদিরা ইতিহাস তৈরি করেছিলেন— সেই চেতনা চুঁইয়ে চুঁইয়ে প্রবেশ করেছিল তাঁদের মগজে। তাঁদের কখনও কল্পনাতেও ছিল না, রাজনীতিকে শুধু একটা বৃত্তি হিসেবে কেউ নিতে পারে। রাজনীতি মানেই দেশ, দেশের জন্য ভাবনা। এরা বোধহয় পোস্ট-ইতিহাস। স্বদেশ-সচেতনতাহীন। মাত্র অর্ধ শতাব্দীর সামান্য বেশি স্বাধীনতা পেয়েছে। এখনও কলোনিয়্যাল প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি, এ বোধই নেই। সবচেয়ে বড় কথা— দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ নেই, ভালবাসা নেই। এরা … এরা বাইরের লোক, অন্য কোনও জগতের ছেলেমেয়ে। রাস্তাঘাটে এদের দেখে তিনি চিনতে পারেন না। যেমন মুম্বই, তেমন দিল্লি, এখন এই কলকাতা! আগের চেয়ে সাধারণভাবে সপ্রতিভ, কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবোধহীন। নৈতিকতার ধার ধারে না। হয়তো তাদের আগের প্রজন্মই শেখাচ্ছে এসব। কে বলতে পারে! যদি তাঁর স্বামী একদম অকালে চলে না যেতেন, যদি ছেলেমেয়ে থাকত, তা হলে হয়তো বুঝতে পারতেন কোন পথ ধরে তারা এই অচেনা গুহায়, গোলকধাঁধায় এসে ঢুকেছে। কিন্তু আপাতত কোনও সূত্রই পাচ্ছেন না।
তবে, কাজল ছেলেটিকে তাঁর ভাল লাগছে। আধুনিক, সপ্রতিভ অথচ খুব সহজ, কোনও কৃত্রিমতা নেই। এক এক সময়ে মনে হয় ওর সঙ্গে তিনি সমবয়সি বন্ধুর মতো ব্যবহার করে ফেলবেন। কাজলের মতো ছেলেরা আবহমান। স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত তার প্রাসঙ্গিকতা বদলায়নি। ওর বাবা-মাকে বাহবা দেবেন, না বাহবাটা ওকেই দেবেন— বুঝতে পারলেন না। নিজের ভাবনার ধারায় নিজেই অবাক হয়ে গেলেন কস্তুরী। তিনি সম্পূর্ণ কর্মজগতের লোক। পরিকল্পনা করেন, মগজ এখন এমনভাবে কাজ করে যে অনেক সময়েই পরিকল্পনাটা আপনাআপনি হয়ে যায়। যেমন হয়েছিল এবারের দাঙ্গার সময়ে। হয় ছোটখাটো দাঙ্গা, কিন্তু সেটা সাধারণত দরিদ্র সুন্নিদের পাড়ায়, এবার শিয়া, বোহরা, ইসমায়েলি কেউ বাদ যায়নি। বড়-ছোট ব্যাবসাদারের বাড়িঘর লুঠ হয়ে গেছে। দোকান থেকে ইলেকট্রিক্যাল গ্যাজেটস, কসমেটিকস নিয়ে হরির লুঠ হয়েছে। বলির পাঁঠার মতো কাঁপতে কাঁপতে যখন তাড়া-খাওয়া এক দঙ্গল মানুষ তাঁর বাড়িতে ঢুকে পড়ে, সেই ভুলে যাওয়া পঞ্চাশ রক্তের মধ্যে, পেটের মধ্যে গুলিয়ে উঠেছিল। তাঁর বাবা, কাকা, মা, মামিদের মতো নির্ভীকচিত্তে তিনি তাঁর গ্রিল, ডবল কোল্যাপসিবল সব বন্ধ করেন। ওদের তিনতলায় চলে যেতে বলে হাতে নিয়েছিলেন রিভলভার, কোল্যাপসিবলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে দিয়েছিলেন জাতীয় পতাকা। কার সাহস আছে এর ওপর পা দিয়ে দাঁড়া, দেখি কত বড় দেশদ্রোহী তোরা! মরবার জন্যে প্রস্তুত থাক।
গালাগালের হররা। অকথ্য। একটা গুলি বিঁধে গিয়েছিল তাঁর বাঁ হাতের কবজিতে। গ্রেনেড ফাটল, অন্ধকার, ধোঁয়া, তিনি পেছোননি। তাঁর বাড়ির লোকেরা, দোতলার বারান্দা থেকে ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করেছিল। ফুটন্ত গরম জল ঢেলে দিয়েছিল। সাত-আটদিন এইভাবে কাটে। তাঁর বাড়ি গিজগিজ করছে, মেয়ে পুরুষ শিশু। আরও আসছে। আরও। আকবরনগর, কাপুরনগর, হিম্মতনগর। পক্ষকাল কেউ ঘরে ফিরতে পারেনি। ঘরে খিচুড়ি হচ্ছে, চাটনি, আর অফুরন্ত দুধ। তারপর চারদিকে শ্মশানের স্তব্ধতা। তাঁর বাড়িতে জন্ম হচ্ছে। জন্ম হচ্ছে। মানবশিশু তিনটি। কিন্তু অনেক বরাভয়, সাহস, আস্থাও কি জন্মায়নি? নিশ্চয় জন্মেছে। তিনি প্রাণপণ করেছেন। তাতেও যদি আস্থার গর্ভপাত হয়ে যায়, তিনি কেন বাঁচবেন আর?
টোল দেবেন দিদি— দশ টাকা— ড্রাইভার বলল।
এইবার চোখ চেয়ে দেখলেন কস্তুরী, দু’ দিকে ত্রিকোণ তৈরি করে চমৎকার স্টিলের দড়ির ওপর ঝুলছে বিদ্যাসাগর ব্রিজ। দুপাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঘোলা জলের গঙ্গা। তাতে নৌকো। জেটির কাছ থেকে তেরছা গতিতে যাতায়াত করছে স্টিমার। গাছ, বড় বড় উঁচু উঁচু প্রাসাদ। তিনি মনে মনে বললেন, বেশ দ্যাখাচ্ছে, হঠাৎ দেখলে ভারত বলে মনে হয় না। যেন কোনও সমৃদ্ধতর দেশ, কিন্তু তোমরা মাটির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ কোরো না, গজদন্ত-মিনারে থেকো না। এ তোমাদের বিবেকের প্রশ্ন শুধু নয়, নিরাপত্তারও প্রশ্ন। খরা, দুর্ভিক্ষ, বন্যা, অনাহার-অর্ধাহার মানুষ সয়, কিন্তু চিরদিন সয় না। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি অর্ধনগ্ন মানুষ যদি গর্জন করতে করতে ঢুকে পড়ে তোমাদের ঘরে ঘরে, কতজনকে মারবে তোমার ওয়াচম্যান, তোমার রিভলভার! তোমার পুলিশ আর তোমার কানেকশনস! তবু, কস্তুরী মেহতা তোমার চিন্তা, বেদনা দু-এক নিমেষের জন্য সরিয়ে রাখো। জীবনে, দৃশ্যে কিছু সুন্দরও আছে, অবকাশও আছে। ক্ষণিক বিরতির, বিস্মৃতির সুযোগ আছে। দু’হাত পেতে নাও।
সংকীর্ণ জি.টি. রোডের মধ্যে ইটকাঠ, বহুতল, বাজার, দোকানের সারি, ভিখারি এবং ইত্যাদি ইত্যাদি দেখতে দেখতে মনটা আবার খিঁচড়ে গেল। তা হলে কি পূর্বাঞ্চলের রাস্তাঘাট এত বছর পরেও সেই একই কুশ্রীতায় ভরে আছে! একই রকম দুঃখের আঁচড় কাটা, তার চেয়েও বেশি, শৃঙ্খলাহীন, কদর্য। তিনি শুধু প্রসাধন দেখে সমালোচনা করছিলেন বা মুগ্ধ হচ্ছিলেন। তাঁরই যদি ভুল হয় তাহলে আর সবার হবে না কেন? হয়তো বা এই দুঃখের আঁচড়ও সত্য। প্রসাধনও সত্য। দুই মেরুকে কি কোনওভাবেই কোনও মধ্যপথে মেলানো যায় না! রাজধানী এক্সপ্রেস নিউ দিল্লি স্টেশনের দিকে এগোচ্ছে। কামরার ভেতর থেকে দেখা যায় অকথ্য আবর্জনার স্তূপ, অসহ্য দুর্গন্ধ, চতুর্দিকে ছেঁড়া ন্যাকড়া-কানি ঝুলছে, মানুষেরই পরিধেয়। আর সেইসব শহরতলিতে যেসব বাড়ি দ্যাখা যায়, তাদের কুশ্রীতারও কোনও তুলনা নেই। দেশের রাজধানীই যদি এই হয়, তা হলে অন্যত্র আর ভাল কী হবে!
এইরকম ক্রোধ-শান্তি, আশা-হতাশার মধ্যে দুলছিল মেজাজ, ড্রাইভার বলল, এই আমরা পিলখানা দিয়ে চলেছি দিদি।
জিজ্ঞেস করো, জিজ্ঞেস করো, ব্যাপটিস্ট বেরিয়্যাল গ্রাউন্ড রোড কোথায়।
কেউ বলতে পারল না।
জেলেপাড়ার কথা বলছেন?
জেলেপাড়া, মেছোপাড়া, তাঁতিপাড়া কিছুই তিনি জানেন না। তাঁর ড্রাইভারও না। একবার মনে হল ট্যাক্সি করলেই বোধহয় ভাল হত। ওরা রাস্তাঘাট অনেক ভাল জানে।
অবশেষে একজন বৃদ্ধ লোক বললেন, ও রাস্তাটার নাম এখন শৈলেন্দ্র বসু রোড মা, অনেকটা চলে এসেছেন। একটু পিছিয়ে ডান দিকে বেঁকে যান বেরিয়্যাল গ্রাউন্ডটা দেখতে পাবেন। পাঁচ নম্বর? ও তো নিবেদিতা মুখার্জির বাড়ি। নামকরা স্বাধীনতা সংগ্রামী।
ওঁকে, ওঁকেই তো খুঁজছি— উত্তেজনায় কস্তুরীর চোখ ছলছল করতে লাগল। অবশেষে …।
ছোট একটা দোতলা বাড়ি। বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে বাগান। তার একদিকে প্রচুর গার্ডেন চেয়ার পরপর ডাঁই করা, কিছু টেবিলের লম্বা লম্বা কাঠ। এই রে! কোনও বিয়েবাড়ি-টাড়িতে এসে পড়লেন না কি?
দরজা খুলল একটি ফ্রক-পরা মেয়ে, তাঁকে দেখেই বলল— মেনু কার্ড আনছি। একটু দাঁড়ান। ভেজ, নন-ভেজের রেট সব লেখা আছে।
তিনি বললেন— এটা কি নিবেদিতা মুখার্জির বাড়ি?
এবার ফ্রকের পেছনে একটি শাড়ি দেখা গেল, মুখে রুক্ষতা।
—কাকে চাইছেন?
—নিবেদিতা মুখার্জি—
—আমার ঠাকুমা— মেয়েটি বলল।
—তুই চুপ কর, বউটি বলল। কী দরকার আপনার? জানতে পারি? কী নাম?
—কস্তুরী মেহতা, আমদাবাদে থাকি। এখানে এসেছিলাম। ছোটবেলায় চিনতাম ওঁদের। দেখা করতে এসেছি। —বলতে বলতেই কস্তুরী বুঝতে পারছিলেন একটু বেশি কৈফিয়ত দেওয়া হয়ে যাচ্ছে। এমনই রুক্ষতা বউটির যে তাঁর মতো কিছুই পরোয়া-না-করা মানুষের মুখ থেকেও জবাবদিহি বেরিয়ে এসেছে।
আবার প্রশ্ন এল— উনি কি আপনাকে চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন?
—কেন বলুন তো? —এবার একটু চড়া হলেন কস্তুরী— আপনার কিছু অসুবিধে আছে? আমার ঠিকানাই ওঁর জানা নাই। চিঠি কী?
—না, তা নয়। বয়স হয়েছে তো, একটু সাবধান হতে হয়— জোঁকের মুখে নুন পড়েছে।
—আমার কোনও ইনফেকশাস ডিজিজ নাই— বিরক্ত সুরে বললেন তিনি।
—না, না, সে কী— আসুন …।
দোতলার উত্তর-পশ্চিমের একটা ছোট ঘরে পাত্তা পাওয়া গেল নিবেদিতা মাসির। রাস্তায় দেখলে চিনতে পারতেন না। হায় নিবেদিতা মাসি, আগুনের মেয়ে, আগুনের বউ, কোথায় তোমার সে উজ্জ্বল উচ্ছ্বাস! চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে আছে। বেশ শীর্ণ চেহারা, সাদা সবুজ পাড় একটা মিলের শাড়ি পরা। একটা কাঠের চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর ঝুঁকে কাজ করছিলেন।
বউটি দাঁড়িয়ে রইল। কস্তুরী নিজের নাম পরিচয় বললেন। নিবেদিতা ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। চিনতে পারছেন না। কস্তুরী মেহতা? কিকি? কে? —বউটির দিকে তাকিয়ে বললেন— আবার কোনও নতুন চালাকি ধরেছ নাকি? মহিলা এনে আমাকে মিসগাইড করবার চেষ্টা করছ? —গলা বেশ কড়া।
দেখছেন তো কী রকম মাথা খারাপ … ওই জন্যেই …
মাথা খারাপ? আমার না তোমাদের? ওই ফুলচাঁদ একেবারে জোচ্চোর। ওর সঙ্গী-সাথী লাড্ডু, খোকন, বাচ্চু, সুবীর সব্বাই। ওরা পার্টির গুন্ডা তোমরা জানো না? নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়ুল মারছ?
আপনি বকুন, আমি নীচে যাচ্ছি, কাজ আছে। বউটি পড়পড়িয়ে পালিয়ে গেল। তার গতিপথের দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন উনি। উঠলেন, বাইরে গেলেন, সিঁড়ি কয়েক পা নামলেন, হাঁটুতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠলেন। তারপর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন— যা আড়ি-পাতা স্বভাব! কিকি আজ আমার সঙ্গে খেয়ে যাবে। বুঝলে?
অবাক হয়ে মুখ তুলে চাইলেন কস্তুরী— আপনি আমায় …
নরেন্দ্র ভাইয়ের মেয়ে— চিনব না! কী যে বলো? সমস্ত মুখটা হাসিতে ভরে গেল। —কেমন আছ? তোমার কাজকর্মের খবর কিছু কিছু রাখি। অনেক ধন্যবাদ কিকি, মাসির কাছে আসার জন্যে।
—এরকম কেন? এঁরা! এসব কী?
—হবে না! ফ্রিডম-ফাইটার্স পেনশন পাই। তা দিয়ে নিজের খরচ পুরোপুরি চালাই। কেটারিং বিজনেস করে, তার ক্যাপিট্যালও অর্ধেক আমি দিয়েছি। এরা সব আমার মাসতুতো ভাইয়ের সংসার, আশ্রয় দিয়েছি। এরকম করবে না! কৃতঘ্নতাই মানবজাতির মূল চরিত্র কিকি, অকৃতজ্ঞতা নয়… একেবারে কৃতঘ্নতা। যে উপকার করেছে করো তার সর্বনাশ! কষে করো।… আমার তো নিজের সংসার নেই … নিশ্চয় জানো …
—আপনি বললেন তাই জানলাম … নইলে …
—তোমার মনে আছে কি মেসোমশাই কমিউনিস্ট পার্টিতে ছিলেন! পুলিশের গুলিতে মারা যান। ফিফটিজ-এর গোড়াতেই। তখন খুব ধরপাকড় চলছে। দু’জনেই নিজেদের মতো করে দেশসেবা করেছি, ছেলেমেয়ে হবার আর সুযোগ আসেনি। —চুপ করে রইলেন নিবেদিতা মাসি— এদের ডেকে আশ্রয় দিলাম, প্রোমোটারের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বাড়িটি হাতাতে চাইছে। তবে তোমাকে নিশ্চিন্ত করার জন্য জানিয়ে রাখি, আমি বাড়িটি উইল করে ভারত সেবাশ্রম সংঘকে দান করেছি। উইল ওঁদের কাছে। দ্যাখো কিকি, সেবা ছাড়া তো আমাদের আর কিছুই করবার নেই। আমাদের নেতারা তো একটা দুর্ভিক্ষ-খরা-বন্যাপীড়িত দেশ ছাড়া কিচ্ছু দিয়ে যেতে পারেননি। পেটে খেতে পাবে, আশ্রয় প্রতি বছর ভেসে যাবে না, তবে তো তাকে বলতে পারি — শেখো, পড়ো, পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে যোগ করো। তাই আমার দিক থেকে, সেবাতেই আমি সবচেয়ে কৃত্য কাজ দেখি। আর্তত্রাণ। একটা বন্যা হল, চতুর্দিক থেকে কোটি কোটি টাকা এল, কেউ জানে না, সেসব কোথায় গেল! তার চাইতে যারা নিঃসংশয়ে কাজ করে, তাদের কাছেই আমার সামান্য টাকা যাক— থানায় ডায়েরি করে রেখেছি। এরা আমার ওপর মানসিক অত্যাচার করছে, মেরে ফেলতে পারে।
—একটু শিউরে উঠে কস্তুরী বললেন, সত্যিই কি সে ভয় আছে?
আছে। তবে কিকি, তোমার মাসি মরতে ভয় পায় না। দুঃখ কী জানো? দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে যেতে পারতাম তো দুঃখ ছিল না। যাদের স্বাধীন করেছি, তারা ষড়যন্ত্র করে আমাদের নিঃস্ব করতে চায়, মারতে চায়— এটাই অসহ্য লাগে। কী পরিহাস বিধাতার! ভাবো! আমরা কিছু নিইনি, যথাসম্ভব সাধারণ খেয়েছি, পরেছি। জেল খেটেছি, মিছিল করেছি, দিনে-রাতে কোনও অবসর ছিল না। আর এরা? আমাদের ত্যাগের ওপর সংগ্রামের ওপর ডিজনেস্ট ভোগের প্রাসাদ তুলতে চায়। এই আয়রনি সহ্য করতে পারছি না। আহত বাঘিনীর মতো ভয়ানক হয়ে উঠছি ক্রমশ! গড নোজ, হয়তো একদিন আমি এদের ফাঁসাব, সবাইকে …
—মাসি যা করবার তো করে রেখেছেন। আর কেন এইসোব …
—তুমি জানো না কিকি, আমি এমনভাবে আত্মহত্যার কৌশল বানাচ্ছি, যাতে এই ভাইপো, তার বউ, ওই প্রোমোটার, ওদের সবগুলো ফেঁসে যাবে।
—মাসি, এসব করবেন না, ভাববেন না প্লিজ।
কস্তুরী এগিয়ে এসে তাঁর শীর্ণ পিঠটাতে হাত রাখলেন, এবং নিবেদিতা সেই হাতটা তাঁর সামনে বুকের কাছে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন। এবং এই সময়ে এই দৃশ্যে বউটি আবার এসে দাঁড়াল।
কস্তুরী মাসির মুখটা হাতের ওপর নরম করে চেপে রেখে বললেন, শেষ পর্যন্ত উনি আমাকে চিনতে পেরেছেন। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে যেতে পারেন। যদি হাতে সময় থাকে তো বসুন না। ওনেক ওনেক সত্যি গল্প শুনাব। সেই সোময়কার।
—কোন সময়কার?
—সেই যোখন দেশ সোবে স্বাধীন হয়েছে, এই এঁরা কোতভাবে লড়েছেন … স্যাক্রিফাইস করেছেন।
মুখ বেঁকিয়ে বউটি বলল— এ বাড়িতে এসে ইস্তক তো শুনছি।
নিবেদিতা মুখ তুললেন, রাগে ও চোখের জলে মাখামাখি মুখ। বললেন, শুনেছ তো! কিন্তু বুঝেছ কি? মুখ্খু! তো যাও, সেইসব বোরিং গল্পই আমরা মাসি-বোনঝিতে করব আজ। ভাতে ভাত চাপাচ্ছি, যাও, রান্নার সময়ে অশুচিতা আমি সইতে পারি না।
মুখ কালো করে বউটি চলে গেল। কোনও কথা না বলে চাল ধুতে লাগলেন নিবেদিতা।
কিছুক্ষণ সব চুপ। তারপর শান্ত স্নেহমাখা গলায় বললেন, ভাতে ভাত খাবে তো কিকি?
—হ্যাঁ, খুব ভালবাসি। একটু দই আনব মাসি!
—ও তোমরা আবার দই ছাড়া খেতে পারো না। নিয়ে এসো।
কস্তুরীর মনে হল মাসির মেজাজ এখনও ঠিক হয়নি। তাঁর নিরাড়ম্বর জীবনযাত্রার সরলতা বুঝি একটু দইয়ের আঘাতে ভেঙে যাবে। তিনি বললেন, আমার কোনও ওসুবিদা নাই মাসি। কিন্তু আপনাকে আমার একটু খাওয়াতে ইচ্ছে করছে। কিচুমিচু, একটু সোন্দেশ, একটু দই। কোতদিন পোরে দেখা।
—আনো, তবে ভদ্রতা করে আবার পুরো ফ্যামিলির জন্য এনো না।
—কেন মাসি? ওঁরা কুশি হোবেন।
—ওরা খুশি হলে আমার কিছু সুবিধে হবে না কিকি। ওরা যেমন তেমনই থাকবে। মাঝ থেকে তোমার ভদ্রতা অপাত্রে নষ্ট। অপাত্রে নষ্ট’টা বুঝলে তো?
—বুঝেচি— আসলে কস্তুরী নষ্টটা বুঝেছিলেন। অপাত্রেটা আন্দাজে বুঝে নিয়েছিলেন। মোট কথা মাসি চান না তাঁর ভাইপো-ভাইপো বউয়ের সঙ্গে তিনি কোনওরকম ভদ্রতা করুন। আর তাঁর চাওয়ার ওপর তো কথাই নেই! কস্তুরীও সে রকম আপ্যায়নকেন্দ্রিক সামাজিকতার ধার ধারেন না। ট্যাক্সি-ডাইভারকে ভাল লাগলে রসগোল্লা কিনে দিতে পারেন। কিন্তু যে-কোনও আত্মীয় বা পরিচিতকে লাড্ডুর বাক্স উপহার দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তিনি স্বীকার করেন না। অতএব তিনি স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করে দই আর ভাল সন্দেশ কিনলেন, বেশ কিছু ফল। একটু দেরিই হল ফিরতে। ততক্ষণে মাসির রান্নাও শেষ।
গলা ভাতের ওপর মাখন ছড়িয়ে দিয়ে আলু কাঁচালঙ্কা-ডালভাতের ভোজ চমৎকার হল। দইটাও চমৎকার। কিন্তু নিবেদিতা মাসি এত মিষ্টি আর ফল দেখে ভীষণ রাগ করলেন। সত্যি রাগ।
দ্যাখো কিকি, আমার ভাগ্য আর আমার সরকার আমাকে যেটুকু খেতে দিচ্ছে তার বেশি আমার দরকার নেই।
—বেশ এগুলো তা হলে আমি নিয়ে যাচ্ছি— কস্তুরী গম্ভীর, অভিমানী মুখে বললেন।
—ওই দ্যাখ অমনি রাগ হয়ে গেল। আচ্ছা আচ্ছা বাবা, রাখছি, ফল মিষ্টি সব তোমার রাখছি।
কস্তুরী মনে মনে একটু হেসে নিলেন। যাই বলো আর তাই বলো নিবেদিতা মাসি, তুমি আর সেই তুমি নেই। আগুনের মেয়ে, আগুনের বউ, তাতে অভিমানের নোনা জল পড়ছে, একটু একটু করে নিবছ। অত সম্ভ্রমের বাড়াবাড়িও এক ধরনের আগুন, কিন্তু সে-ই পুরনো উদ্দীপনার ইতিবাচক আগুন নয়। ডিপ্লোম্যাসি দিয়ে তোমাকে ভোলাতে হয়। বড়রা ছোটদের ভোলায়, যেমন একদিন তোমরা আমায় ভুলিয়েছিলে, আজ আমার পালা। আমি তোমাদের ভোলাব।
—নরেন্দ্রভাই কেমন আছেন? নিবেদিতা মাসি ঘরের তক্তপোশটার ওপর বসে বললেন।
সামনে একটা লাল রঙের মোল্ডেড চেয়ার। কস্তুরী সেখানে। এতক্ষণে খবরাখবরের পুঙ্খানুপুঙ্খ।
—তোমার কী মনে হয় মাসি, বাবা কেমন থাকতে পারেন!
অন্যমনস্ক স্বরে মাসি বললেন— ভালই। বয়স হয়েছে, কিন্তু যৌবনের ব্যায়াম করা শরীর, বাজে নেশা-ভাঙ নেই, অর্থ-কষ্ট নেই, কাজের চাপ আছে অবশ্য বেশ। এবং কিকিকে নিয়ে দুশ্চিন্তা। এইগুলোয় কাটাকুটি হয়ে শরীর ভাল আছে, মন ভাল নেই।
—আমার জন্য আবার চিন্তা কী?
—এই, কিকিটা বিয়ে করল না। হাঙ্গাম-হুজ্জুতে জড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ।
কস্তুরী বাবার প্রয়াণের খবর ভাঙলেন না। তাঁর স্বামী যে দু’বছরের মধ্যে মারা যান, সে খবরও না। বললেন, মাসি, তোমরা যারা সোর্বস্ব পোণ করেছিলে তাঁদের মুখে এমোন কথা মানায় না।
মাসি হাসলেন, বললেন, কিকি, তুমি কি এখনও বোঝে না, মানুষ কিন্তু আদতে স্বার্থপর, তার চেয়েও বেশি আত্মপর। পাবলিক ক্যালামিটি ইজ এ মাইটি লেভেলার। তাই গোটা দেশের মানুষের ওপর যখন সংকটের খাঁড়া নেমে এসেছিল, তখন কিছুদিনের জন্য তারা একত্র হয়েছিল। খাঁড়া সরে গেল, সব আবার যে যার ছোট্ট গর্তে। কেউ আর তার বাইরে দেখতে পাচ্ছে না। চাইছেও না। আমার ছেলে কেন লাখ টাকা উপার্জন করবে না, আমার মেয়ে কেন একটা ভাল বিয়ে করে ঘর-সংসার করবে না, কেন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে …
শেষ দুপুরের জানলা দিয়ে হঠাৎ দমকা হাওয়া হুটোপাটি করে ঢুকে পড়ল। এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল কাগজপত্তর। মাসি তাড়াতাড়ি উঠলেন।
—কাগজগুলো ড্রয়ারে ঢোকাও, ড্রয়ারে ঢোকাও, জানলা বন্ধ কোরো না। মাসি চেঁচিয়ে উঠলেন। জানলার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিবেদিতা মাসি ঈষৎ ভাঙা গলায় গেয়ে উঠলেন …
আয়রে আমার শুকনো পাতার ডালে ডালে
ঝড় নেমে আয় আয় …
দমকা মনে পড়ে গেল হারানো সুর। দোতলার বড় ঘর। শতরঞ্চি পাতা, কয়েকটা তাকিয়া। জড়ো হয়েছেন অনেক চেনা, আধো-চেনা মুখ। এগুলো সাধারণ সভা, অনেক সময়ে ঘর ছাড়িয়ে বাইরের দালানে, সিঁড়িতে পর্যন্ত লোক জমে যায়।
তোমার বাঁধন যতই শক্ত হবে, মোদের বাঁধন টুটবে।
সেটা বোধহয় তেইশে জানুয়ারি— সুভাষচন্দ্রের জন্মদিন ছিল। গান হল।
কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো
সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো, পাগল ওগো ধরায় আসো।
আরও কত গান কত সুর মনের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে আছে। তাদের এই আধো-স্মরণে কী যে একটা অদ্ভুত সুগন্ধ। যেন কোথা থেকে, কত দূর থেকে, কত কাল আগে থেকে ভেসে আসছে এই সুরভিত সুর। শুধু তাঁদের ছোঁবে বলে। ছুঁয়েই তার কাজ শেষ। আর সে দাঁড়াবে না। বয়ে যাবে, উধাও হয়ে যাবে। এখন তুমি যদি তার মানে বুঝলে, তো সে চিরদিনের মতো তোমার মধ্যে বসে গেল। ভেতর থেকে ঠেলা দিতে লাগল মাঝে মাঝে, মাঝে মাঝে আবার বুঁদ করে রাখল, যেমন নিবেদিতা মাসিদের ক্ষেত্রে হয়েছে। ‘আয়রে আমার শুকনো পাতার ডালে ডালে ঝড় নেমে আয় আয়—’ এ শুধু গান নয়, গানের মধ্যে দিয়ে এখনও সেই যৌবনের বিশুদ্ধ ঝড়কে উনি ওঁর বয়সের শুকনো ডালে আহ্বান করে চলেছেন। সম্ভবত আমৃত্যু চলবেন। ঝড়ের জন্য তাঁর প্রার্থনা ছড়িয়ে যাবে আরও কত মানুষের মধ্যে যাঁরা এখনও শুদ্ধ আছেন, সত্য আছেন, কিন্তু ঝড় জানেননি, কাকে বলে প্রণোদনা এখনও বোঝেননি।
আর তুমি যদি শুধু মুগ্ধ হও, তাকে চলে যেতে দাও, তাহলে সেই অলস মুগ্ধতার দাম তোমাকে দিতে হবে সারা জীবন ধরে। গানকে যাঁরা শুধু সাময়িক বিলাস বলে নেন, তাঁদের এই দাম দিতে হয় সারাজীবনের অচেতনায়। কস্তুরী খুবই আবেগবর্জিত, কেজো মানুষ। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর মনে হয় আগুন যদি তাঁর আহুতি নিত! যদি দিতে পারত সেই যজ্ঞফল যার জন্য একদিন সংকল্প করে আসনে বসেছিলেন তাঁর পিতৃপুরুষেরা!
আমার মা কোথায় মাসি? —এতক্ষণে হয়তো ওই সাধক, প্রেমিক, পাগলের ‘প্রোচোদনা’তে, ‘ওই ঝড় নেমে আয়’-এর প্রার্থনাতেই তিনি প্রশ্ন করলেন।
নিবেদিতা মাসি চুপ করে রইলেন। অনেক পরে বললেন…
আমি তো আর কল্যাণী মেহতার খবর রাখি না, সেই থেকেই …
কেমন যেন একটা খটকা! আমি তো আর কল্যাণী মেহতার খবর রাখি না। কল্যাণী মেহতা? নিবেদিতা মাসি মাকে কল্যাণীদি বলতেন না? খবর ‘রাখি না’? ‘জানি না’ নয়?
৫) সে
এত সবুজ সত্ত্বেও গ্রীষ্মকালে সল্ট লেক ফার্নেস হয়ে থাকে। সন্ধের পর একটা মিনি কালবৈশাখী হল। চড়বড় করে একটু শিলাবৃষ্টি। যত না জল তার চাইতে বেশি শিলা। সকলেই বলছিল, রাতটা ঠান্ডা হবে। পার্কের পাশে একটা গাছ পড়েছে। এইগুলো খুব গোলমেলে ব্যাপার। কোন গাছটার মূল আলগা হয়ে গেছে, কোনটার ভেতর ফোঁপড়া, চট করে বাইরে থেকে বোঝা যায় না। গাছটা পুরো রাস্তা জুড়ে আড়াআড়ি পড়েছিল। ভাগ্যিস ঝড়-বৃষ্টির সময়ে কেউ ধারেকাছে ছিল না! পড়ার সামান্য আগেই কাজল বাড়ি ফিরেছে। যাঁদের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকে সেই অধিকারী মাসিমা খবরটা দিলেন।
ঝড়-বৃষ্টির সময়ে বাইরে থাকাটা খুব অনিরাপদ হয়ে যাচ্ছে, বুঝলে কাজল? ঝড় দেখলেই কোনও না কোনও শেড-এ দাঁড়িয়ে পড়বে।
অধিকারী দম্পতি তার একদা অধ্যাপক রমেন সান্যালের পরিচিত। ওঁর সূত্রেই এখানে ও জায়গা পেয়েছে। ঠিক যে ধরনের মধ্যশ্রেণীর জন্যে বিধান রায় সল্ট লেক সিটির পরিকল্পনা করেছিলেন এঁরা একদম সেই জাতের। সচ্ছল কিন্তু তার জন্য পরিশ্রম করতে হয়। হিসেব করে চলতে হয়। ওঁদের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, সে বিদেশে থাকে। সাগরপার। ঠিক কোথায় কাজল জানে না। তার কৌতূহল নেই। আর ছেলেটি বাঙ্গালোরে পড়াশোনা করছে। ছেলেটির খরচের জন্যই বোধহয় ওঁদের পেয়িং গেস্ট দরকার পড়েছিল। জমানো টাকা প্রায় নিঃশেষ করে ছেলেকে পড়ানো! ও পেয়েছে মেজানিনটা। একতলায় দু’টি ঘর ও একটা কলঘর শেয়ার করে থাকে আরও তিনটি ছেলে। অধিকারীদের ছেলে যেমন পড়তে গেছে বাঙ্গালোর, এরা তেমন চাকরি করতে এসেছে কলকাতায়। একজন বোধহয় কম্পিউটার-বিশারদ, কাছাকাছি সল্ট লেকেই অফিস। অন্য দুজন দক্ষিণী—এরা মুম্বই থেকে বেসরকারি কোম্পানিতে এসেছে। আবার হয়তো মুম্বই ফিরে যাবে। কম্পিউটারের ফেরার কোনও নির্দিষ্ট টাইম নেই। অফিসেই বোধহয় খাওয়া-দাওয়া করে। দক্ষিণীরাও বাইরে। ওদের খাওয়াদাওয়া আলাদা। তবু তিনজনকেই ব্রেকফাস্ট পাঠান মাসিমা। কাজলের সঙ্গে তিনবেলারই বন্দোবস্ত। কোনওদিন বাইরে আটকে গেলে, কোথাও খেয়ে নিতে হলে—ও মাসিমাকে ফোন করে দেয়। যদিও কাজল কারও সঙ্গেই খুব ঘনিষ্ঠতা করতে চায় না, তবু এঁদের সঙ্গে তার একটা চমৎকার সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে। ছেলের মতোই স্নেহ করেন তাকে। ওঁদের খাবার সময় কাঁটায় কাঁটায় ন’টা। তার মধ্যে কাজল না ফিরলে ওর ঘরে ক্যাসেরোলে খাবার এসে যায়।
শেডে দাঁড়ানো সম্পর্কিত পরামর্শটা দিয়েই ওঁরা রাতের মতো বিদায় নিলেন। কাজল আগে চান করল ভাল করে। এই ঝরঝর চানটা তার একটা বাতিক। সব সময়েই মনে হয় কোথাও কোনও ময়লা রয়ে গেল। বড্ড বেশি ঘাম, দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে বোধহয়। বোধহয়। সত্যি নয় সবসময়ে। তাই এটাকে বাতিক বলাই ভাল। কোথায়, কোন অভিজ্ঞতায় এই বাতিকের মূল! শাওয়ারটা ছেড়ে সে ঊর্ধ্বমুখে চোখ বুজে দাঁড়ায়। কাজল কখনও উলঙ্গ হতে পারে না। একটা না একটা কটিবস্ত্র চানের সময়ে তার চাই-ই। একটা মেরুন রঙের মাদ্রাজি গামছা পরে সে শাওয়ার অনুভব করে। যেন সে বৃষ্টিতে ভিজছে। ভিজতে চাইছে। সব বৃষ্টি একরকম নয়, শাওয়ারের নবটা পুরোপুরি ঘুরিয়ে দেবার পর যখন ফিনকি দিয়ে জল ছোটে তখনও সেটা বর্ষার বৃষ্টি হয় না। বর্ষার বৃষ্টির ধারা কী মোটা এবং বল্লমের মতো ফলাঅলা। তেমন তেমন হলে তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। চামড়ার তলায় হাড়ের কাঠামোসুদ্ধ ভিজে যাবে। অন্য দুই ঋতুর বৃষ্টির স্বাদ মোটের ওপর শাওয়ারে বোঝা যায়— ফাগুনের বৃষ্টি, শালমঞ্জরীর গন্ধ মাখানো। আশ্বিনের হালকা বৃষ্টি, হাসির মতো। উচ্চরবে হাসছে কে আড়ালে, চট করে আকাশ নীল, তাতে কাশঝাড় ভেসে যাচ্ছে। উদোম, একেবারে উদোম একটা ছোট ছেলে ভিজছে, সপাটে ভিজছে, হি হি করে কাঁপছে ঠান্ডায়। তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে। বৃষ্টির তোড় তাকে ক্রমেই পেছনে ঠেলে দিচ্ছে, আবার কখনও কখনও পেছন থেকে দমকা হাওয়া এসে সামনে হুমড়ি খাইয়ে দিচ্ছে প্রায়। কিন্তু তার পলকা শরীর, পড়ে গেলেও সে উঠে দাঁড়াতে অসুবিধে বোধ করে না। ছুটছে, সে ছুটছে। হঠাৎ খেয়াল হয়, বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু আকাশ দেখা যাচ্ছে না। কী হল? এত জল সে রাতবিরেতে ব্যবহার করে ফেলেছে যে ট্যাঙ্কের জল শেষ?
মোছামুছি শেষ করে, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে সে। পায়জামা শার্ট পরে নেয়। চোরের মতো চুপিচুপি নীচে চলে যায়। পাম্প ঘরে রাত্তিরের তালা লাগানোটা তারই কাজ। তালা লাগানো, নীচের সব কোল্যাপসিবল, গ্রিল চেক করা। সে পাম্পটা চালিয়ে দেয়। রাত্তিরে জল দরকার হলে কেউ পাবে না। একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে পাম্প চলতে শুরু করে। ভীষণ লজ্জা পায় কাজল। যদি ওঁদের ঘুম ভেঙে যায় শব্দে! কী মনে করবেন? কাজল মুণ্ডা সব জল শেষ করে দিয়েছে। ওঁরা এসব ব্যাপারে খুব সতর্ক। দু’বারের বেশি পাম্প চলে না। ছি, ছি, কী করল? কেন, কাজল কেন? কী এমন করেছ যে তোমার এত সংকোচ! হতেই পারে, একদিন হয়ে যেতেই পারে। ঈশ্বরের দেওয়া জলে, হাওয়ায়, ভূমিতে ও ভূমিজ উদ্ভিদে সকলের অধিকার। সেই অধিকার একটার পর একটা কেড়ে নেবে তারপরে কৈফিয়ত চাইবে? না কাজল। এ শুধু ঈশ্বরের দেওয়া জল নয়, এর ওপর মানুষের যান্ত্রিক হাত পড়েছে। ইলেকট্রিসিটি পোড়ে, খরচ বেশি হয়, বাঙ্গালোরে ছেলেটির জন্যে কত লাখ টাকা গুনে দিতে হয়েছে কে জানে? কম্পিউটার পড়ছে। পাশ করে বেরোলে অমন কত লাখ টাকা উশুল হয়ে যেতে পারে, আবার না-ও পারে। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। উপেন্দ্র, লখাই, গমস্তাপ্রসাদ, সুন্দরী, বুধুয়াদের থেকেও অনিশ্চিত? দূর, ভুল হল। ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই দুনিয়ায়, কে ভাবতে যাচ্ছে ভবিষ্যতের কথা? বর্তমানটাকে কোনওক্রমে টিঁকিয়ে রাখা। মরে গেছে? মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে তেষট্টির বার্ধক্যে পৌঁছে মরে গেছে? পেট এসে পিঠে ঠেকেছিল! ভবিষ্যৎ আবার কী! বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, ভীষণ শব্দে অদূরে বাজ পড়ল। উদোম ছেলেটা দেখল সেই উদোম বাজ— একটা যমজ নারকেল গাছ তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও জ্বলছে, জ্বলে যাচ্ছে। আবার পেছন দিকে দৌড়োনো, আবার পাশ কাটিয়ে সামনে। ভবিষ্যতের ভয়হীন। অথচ ভবিষ্যতের সন্ধানে অন্ধ দৌড়োনো।
ক্যাসেরোলের ঢাকা খুলতেই চমৎকার একটা গন্ধ নাকে আসে, দৃশ্যটাও চমৎকার। আজ বৃহস্পতিবার। এঁরা নিরামিষ খান। নিরামিষের সৌজন্যে ভাল ভাল কিছু পদ খাওয়া হয়ে যায়। বড় বাটিতে পোলাও। ছোট বাটিতে ছানার ডালনা। অধিকারী মাসিমা! এভাবে পোলাও টোলাও দেবার দরকার নেই। কেন কষ্ট করে করতে যান? ভাত— শুধু গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, সঙ্গে একটু আলু পেঁয়াজ লঙ্কা— বিশ্বাস করুন— এই আমার রাজভোগ। এখনও। ছোটবেলায় মানুষ যা শেখে, আর কখনও ভোলে না।
খেতে খেতে সুস্বাদে স্বাস্থ্যবান জিভ লালায় ভরে যায়। একই সঙ্গে কাঁটা ফুটতে থাকে, মাছের কাঁটা, ক্যাকটাসের কাঁটা … ক্যাকটাস ঝাড়ে ঝাড়। বিস্তৃত টাঁড়ভূমি, ক্রমাগতই বৃক্ষচ্ছেদ, ভূমিক্ষয়, এবং মরুভূমি। তাতে ক্যাকটাস।
কাজল জানে আজকের এই অপরিমিত চান ও ঠাকুরের প্রসাদের মতো খাওয়ার পরে, কাজ করতে করতে তার চোখের ঝাঁপ পড়বে, ঝাঁপ পড়ে যাবে কন্টকময় মরুবালুতে, সে নিবিড় ঘুমোবে। সুস্থ শরীরের, স্বাস্থ্যবান মানুষের নিশ্ছিদ্র ঘুম। ঈষদুষ্ণ উদ্দীপ্ত আলস্যে ভরে থাকবে কালকের দিন। আলস্য ঠিক নয়— শান্তি। শরীরটা যেন ধ্যানমগ্ন কিন্তু অফুরন্ত কাজ করবার ক্ষমতা। মিঠু তার চকচকে চোখে কৌতুক ও বিস্ময় মাখিয়ে জিজ্ঞেস করে— তুই তো অদ্ভুত! দেখে তো মনে হচ্ছে শান্তস্য শান্ত, কিন্তু বেশ তো দুটো উচিত কথা শুনিয়ে দিলি। এমন করে দিলি আবার কিছু মনে করতেও পারবে না লোকটা। দেখে মনে হচ্ছে ঘুমন্ত পুলিশ, কিন্তু গুচ্ছেরখানিক ইনফর্মেশন, আর্টিকল ডাউনলোড করে ফেলেছিস। রাধিকাদির পেপারটা পুরো হয়ে গেল? চব্বিশ পাতা, ওই খুদি খুদি হাতের লেখায়! নমস্য বাবা তুই।
মিঠুকে কাজল ঠাট্টা করে বলে— হিরো-হান্টার। সবসময়ে নমস্য করার খোঁজে রয়েছে। ‘ভক্তিমতী বালিকা’ বলেও সে ডাকে ওকে। বেশি কথা কী, মিঠুর লাল-নীল সবুজ-হলুদ-গোলাপি হ্যান্ড-মেড পেপারের অটোগ্রাফ খাতায় জ্বলজ্বল করছে তার সই। এত চালাক যে অটোগ্রাফ বলে চায়নি। বলেছিল তুই বেশ সুন্দর সুন্দর বাণী জানিস, একটা লিখে দে না রে, তলায় বেশ তোর নাম লিখে দিবি।
তার মানে? অন্য লোকের বাণী দেব, তলায় লিখব আমার নাম!
তাতে কী হয়েছে? তুই কি কারও বাণী চুরি করছিস? তাঁর নামটাও লিখে দে, সোর্সটা জানতে আমার সুবিধে হবে, তোর কাছ থেকে পেয়েছি সেটাও জানা থাকবে। ভুলভাল লিখলে ক্যাঁক করে ধরব।
কী ব্যাপার বল তো!
তাড়াতাড়ি মিঠু বলে, ব্যাপার তেমন কিছু নয়। আই জাস্ট ওয়ন্ট টু লার্ন। বাণী জমাচ্ছি। ভীষণ দরকার হয়, আমাকে পপুলার আর্টিকল লিখতে হয় তো গুচ্ছের! জানিসই তো সব!
কাজলের ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ হয়নি মিঠু এইসব ভ্যানতাড়া করে তার অটোগ্রাফ নিচ্ছে। এ পর্যন্ত কেউ তার অটোগ্রাফ নেয়নি, ভবিষ্যতেও নেবে না। বাণী চাই? আরে! মানুষের কত বাণী দলে দলে/ অলক্ষিত পথে উড়ে চলে/ অস্পষ্ট অতীত হতে অস্ফুট সুদূর যুগান্তরে …। বাণীর অভাব কী? অভাব সেইসব মানুষের যারা সেইসব বাণী অনুযায়ী কাজ করবে। হঠাৎ কিছু না ভেবেই সে লিখে ফেলেছিল— লুক অ্যাট দা লিলিজ হাউ দে গ্রো— দি বাইবেল। নিউ টেস্টামেন্ট, সাপোজে্ডলি আটার্ড বাই জিশাস। পরে নিজের নামটা কীভাবে দেবে ভেবে না পেয়ে অবশেষে লিখেছিল— কোটেশন কার্টসি কাজল মুণ্ডা।
সে কী খুশি মিঠু! যেন হাতে স্বর্গ পেয়েছে!
কেমন কায়দা করে তোর অটোগ্রাফটা নিয়ে নিলাম বল!
অটোগ্রাফ! আমার? তা বলতে হয়! লিখে দিতুম একটা লাগসই বাণী, যেটা তোর পক্ষে লাগসই হত!
মিঠু বিমর্ষ হয়ে বলেছিল, এ মা! তাহলে তো কায়দাটা বৃথাই গেল। এত বুদ্ধি খাটালাম। দে না রে নিজস্ব একটা বাণী!
আর হয় না। কাজল মুণ্ডা ইজ নট দ্যাট অটোগ্রাফ ফ্রেন্ডলি!
আচ্ছা, কেন খ্রিস্টের কথাগুলো সর্বপ্রথম তার কলমে উঠে এসেছিল! স্মৃতির খাতায় কীভাবে কী ক্রম অনুযায়ী কথারা সাজানো থাকে? নিজের কোনও বিশ্বাসের ক্রম? ভাল লাগার ক্রম? না কি প্রথমে ও বারে বারে শোনার ক্রম? ফাদার মরিসন তাদের মুণ্ডাদের সম্পর্কে কথাগুলো প্রায়ই বলতেন। সাঁওতাল, মুণ্ডা, লোধা, শবর! তিনি আরও বলতেন— ব্লেসেড আর দা মিক, ফর দেয়ার্স ইজ দা কিংডম অব হেভন। এখন, তিনি কি সত্যিই এই সারল্য পছন্দ করতেন, না তাদের খোশামুদি করতেন সে জানে না। ফাদার মরিসন তার জীবনের প্রথম মানুষ যাঁকে সে শ্রদ্ধা করেছে, বিশ্বাস করেছে। কিন্তু সারল্যই যদি কাম্য, তাহলে কেন শিক্ষা? কেন আপামর মানুষ ও সমাজের সঙ্গে মানিয়ে চলার ট্রেনিং? ঈষৎ তিক্ততার সঙ্গে মনে হল— হ্যাঁ স্বর্গের দরজা তো গরিবদের জন্যে বটেই। তাড়াতাড়ি চলে যায়।
ফাদার যাই বলুন, লিলির মতো সহজে গজিয়ে উঠে অপরের চিত্তবিনোদন করার বিন্দুমাত্র সাধ তার নেই। থাকা উচিত নয় কারও। শিক্ষা মানুষের সহজাত নয়। বুদ্ধি খানিকটা, স্মৃতি খানিকটা। কিন্তু তাদেরও অভ্যাসে অভ্যাসে বাড়াতে হয়। এবং সেই বুদ্ধি দিয়ে মনন হয়, আবিষ্কার হয় নতুন নতুন চিন্তাপথ। এটা সহজাত আহার-নিদ্রা-আমোদ-মৈথুনের বাইরে। সুতরাং খ্রিস্টের উক্তি নেহাতই কবিতার পঙ্ক্তি তার কাছে। লিলিজ? —অর্ধভুক্ত নেংটি পরা অকালবৃদ্ধ শরীর, যেটুকু বা টাঁড়জমি, মহাজনের গর্ভে গেছে। বনের কাঠকুটো, কন্দমূল, ইঁদুর, সাপ, ব্যাঙ ভরসা। ফসল ওঠার সময়ে নামালে যাওয়া, ইট-ভাটার হাড় ভাঙা খাটুনি, পরব বলতে কতকগুলো জটিল আচারের মিশ্রণ, ঠাকুরের ভোগে হাঁড়িয়া, আমোদে হাঁড়িয়া, বৃদ্ধ-বৃদ্ধরা শুধু হাঁড়িয়া খেয়েই ঢুলতে থাকে সন্ধ্যা হলে। এখন সে বোঝে মানুষ হয়ে জন্মে কোথাও কোনও সার্থকতার আনন্দের উপায় নেই, তাই এইভাবে হাঁড়িয়ায় ভুলে থাকা। দূরদেশি কোন রাখাল ছেলে …, রাখাল, বাগাল, বেগার, —দূর থেকে কী চমৎকার পল্লিদৃশ্য! লিলিজ?
আজ সে ছুটি নিয়ে নিয়েছে। ব্যায়াম সেরে ইডলি দিয়ে প্রাতরাশ সেরে সে কম্পিউটার নিয়ে বসে পড়ল। আজ সে সাড়ে তিনটের সময়ে কস্তুরীবেনের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে। ভদ্রমহিলা সেই এসে থেকে কই একবারও তার সাহায্য টাহায্য চাননি। অথচ তারই ওপর ওঁর ভার দিয়েছেন কানাইদা। সে অবশ্য প্রায় প্রতিদিনই খবর নেয়। উনি সোব সময়েই ভালো আচেন, আর ওঁর কিছুতেই অসুবিদা হচ্ছে না। বললে হবে? উনি এখন একজন নামকরা মহিলা। চিরকালই ছিলেন। কিন্তু কে, কোথায়, কী ধরনের কাজ করছেন, সবসময়ে তো জানা সম্ভব হয় না! গুজরাত কাণ্ডের পর উনি ভারতবিখ্যাত হয়ে পড়েছেন। নিজের প্রাণ বিপন্ন করে কীভাবে উনি বন্দুক নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তিয়াত্তর জন মহিলা-পুরুষকে কীভাবে বাঁচান, সেসব এখন গল্প কথা। মিডিয়ার কল্যাণে মুখে মুখে ফেরে। সে সুদূর গুজরাতের হলেও। নিজের কী ব্যক্তিগত কাজে উনি একেবারে চুপিচুপি কলকাতায় আসছেন এবং সেই সূত্রেই কানাইদাকে চিঠি দিয়েছিলেন। কানাইদা কাজে গেছেন জলপাইগুড়ির দিকে ফালাকাটা সেন্টারে। তাকে এবং মিঠুকে ওঁর দেখাশোনার ভার দিয়ে গেছেন। তা ওরা ওঁর ভার নেবে কী? উনিই ওদের ভার নিলে ভাল হয়। তার ওপর তো ওঁর সারা ছোটবেলাই নাকি কলকাতায় কেটেছে। কলকাতার অনেক কিছুই ওঁর জানা। কলকাতা যে কত পাল্টে গেছে, এপাশ ওপাশ ঘিরেছে, উনি হয় সেগুলো জানেন না বা মানতেই চান না। —ও, এই সেই রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার। এখানে কতকগুলো কদমগাছ ছিল। খুব ফুল দিত। এইখানে তো বাঁকতে হোবে। আরে এ ড্রাইভারজি হমকো ফার্ন রোড জানা। ছটফট করে সারাক্ষণ কলকাতা সম্পর্কে নিজের জ্ঞান প্রমাণ করতে করতে আসছিলেন। তবে এখানে ওঁর যে যথেষ্ট ভাল একটা বাড়ি আছে, তার দারোয়ানও মজুত, অতশত ওরা জানত না। উনি না আসলে কী হবে? ওঁর চেনাশোনা বহু লোক কলকাতায় এলে সেই বাড়িতে ওঠে। অর্থাৎ একটা চালু ব্যবস্থা আছে। কী ব্যক্তিগত কাজে উনি এসেছেন তা তারা জানে না। কিন্তু এইরকম মজবুত ব্যাকগ্রাউন্ড যাঁর তাঁকে দেখাশোনার কাজটা বাহুল্য ছাড়া কী! সে ওঁকে খানিকটা বুঝতে পারে, জানে, স্বাধীনচেতা মানুষরা নিজেদের স্বাধীনতা স্বাবলম্বিতা সম্পর্কে অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর, হয়তো ভেতরে কোথাও বশ্যতা আছে বলেই। কিংবা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অসম্ভব বলেই। সে নিজেও তো এই চরিত্রের। কত জন তাকে নির্ভরযোগ্য, দারুণ সাহসী, একেবারে অচল-অটল বলে মনে করে। সে তো জানে কত সাবধানে নিজের ভেতরের শূন্যতা, ক্ষতগুলোকে লুকিয়ে রাখতে হয়। আপাতদৃষ্টিতে সে মিশে গেছে এই জনস্রোতে। এদেরই একজন, নিজের কাজ নিয়ে থাকে। কিন্তু অনেক সময়ে সে সকালে ঘুম ভেঙে পারিপার্শ্ব চিনতে পারে না। এটা কি বাঁকুড়া মিশন? নাকি দেওঘর? নাকি মধ্য কলকাতার সেই নয়ানজুলির মতো সংকীর্ণ রাস্তাটার লাল বাড়ির অন্ধকার একতলায়? কী যেন নাম? ডিকসন লেন। তা হলে এত আলো কীসের? রোদ কেন এত?
মহুল পিয়াশালের পাতার মধ্য দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে জোছনা। লাল-কাজল মাটি জোছনায় মাখামাখি, তার সঙ্গে মাখামাখি হাঁডিয়ার তীব্র গন্ধ! মা-টা মাতাল হয়ে লাচছে? কে মা? কোন মা? বাবা? আপা নাই তার? আছে বটেক! দু’সন আগে নামাল খাটতে গেল আর আসলো নাই। তো কী? আমি তোর বাপ বটেক!
উঁহু না না, সে প্রাণপণে মাথা ঝাঁকিয়ে নেয়, সেই প্রাগৈতিহাসিক ছন্ন জোছনার মদগন্ধময় রাতে সে আর ফিরবে না। কোনও মোহ, মায়া নেই তার। এই বিরাট জঙ্গম পৃথিবীতে প্রকৃতির খেয়ালে— না, না, মানুষেরই ষড়যন্ত্রে সামান্য কিছু মানুষ আটকে গেছে মজা দঁকে, তাদের মাচায় তাদের মাদল ধামসায় এবং হাঁড়িয়ায় মহুলমদে। মিউজিয়াম-পিস। প্রাপ্য কী? অবহেলা, বড় জোর করুণা, ভাতের জন্যে ট্রাইব্যাল আইনের দোরে দোরে ভিখ মাঙা। নিজের মাটি হল ঝাড়খণ্ড। চৈতন্যচরিতের ঝারিখণ্ড। বুঝি ফিরে এল সেই ছত্রিশগড়ের স্বরাজের দিনগুলো। চাম্পাগড়। কত দূর থেকে ভাঙতে ভাঙতে আসছে! সেই হারাপ্পার কাছ থেকে এই সিংভূম, ধলভূম, মেদিনীপুরে। কোথায় সেই নতুন দিনের নতুন চাম্পাগড়? নিজের মাটিতে নিজের সরকার। সরেন, হেমব্রম, মুণ্ডা, হাঁসদা, মুর্মু … যে আসছে তার ঘরে ধনদৌলত উপছে যাচ্ছে। মানুষগুলি যে কে সেই। পরনে ত্যানা, অবিশ্রান্ত খাটুনির দড়িপাক শরীরে, ঝড়ে-জলে রোদে ঘামে! প্রতি বসন্তে এক একখানা গাছ নতুন হয়ে ওঠে। মানুষের জীবনবৃত্তে এরকম কোনও প্রাকৃতিক নিয়ম নেই। এই নিয়ে আবার শিল্পী মানুষগুলির চূড়ান্ত ন্যাকামি। কতজন যে ধরে তাকে ওই জোছনারাতের মাতাল নাচ দেখাবার জন্যে। নাচের পেছনে অবশ্য আছে নাচনিও।
সে স্পষ্ট বুঝতে পারে। ওরা সোজাসুজি বলে না কেননা কাজল মুণ্ডাকে তারা চেনে। ভয় পায়। কিন্তু কাজল এ-ও বোঝে না টিভির পরদায় নিতুই যেসব লোভনীয় আধখোলা, সিকিখোলা নারী-শরীর দেখায় তার থেকেও অশ্লীল, আদিরসগন্ধী শরীর কি তার মুণ্ডানি সাঁওতালনিদের? আবৃত হবার কাপড় পায় না, সিনেমার নাচে তো লাল পাড় শাদা ধবধবে শাড়ি দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। আদতে কি তা আছে? নেই। খাটেখোটে, অত দরকারও মনে করে না, ধান রোয়া থেকে কাঠ কুড়োনো, খেতমজুরি, কুলিগিরি, খনির কামিন— ‘মেঝেন’ সর্বত্র পুরুষের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অবিশ্রান্ত খেটে যাচ্ছে। দেহ দেখাবার জন্যে কি তারা দেখায়? তাদের সংস্কৃতির নিয়ম বা বলা উচিত সংস্কার আলাদা। তবে কেন টিভিনিদের ছেড়ে মুণ্ডানিদের দিকে লোভের দৃষ্টি হানছে ওরা? তারা সরল বলে? সহজলভ্যও না কি?
কাজলের রক্তে আগুন ঝলসে ওঠে এসব ভাবলে। সে যে ভাবতে চায় তা-ও না। কিন্তু কমলি ছোড়ে না। ঘুমের মধ্যে, ঘুম ভাঙার অসতর্ক মুহূর্তে অতর্কিতে হানা দেয়।
সে কি তবে এত করেও একলা রয়ে গেছে? কোনও দুঃখের কথা নয়। একটা জ্বলজ্যান্ত সত্য। যাদের ছেড়ে এসেছে তারা তাদের মূল ছড়িয়ে রেখেছে তার দেহে, মনে। শালপাতার দোনায় করে খুদ সেদ্ধ আর বামলা আলু, যা নাকি তার মা বন থেকে তেড়ে নিয়ে আসত সে কি ভুলতে পারে! প্রত্যেকটি গ্রাসে এখনও তার যন্ত্রণাময় স্বাদ। সে কি ভুলতে পারে উপোসি বালক ছেঁড়া জামা গায়ে পাঁচ মাইল হেঁটে নিম্ন বিদ্যালয়ে যাচ্ছে— রাস্তায় হোঁচট খেয়ে গোড়ালি থেকে গলগল রক্ত বেরিয়ে এল। পঞ্চা মাস্টার ঠিক সেইখানটাতে খুঁচিয়ে দিল। উঃ! শয়তানি হাসি হাসছে, তারপরেই ক্রোধে চোখ লাল। বই আনিসনি কেন? আঁক কষিসনি কেন? লাঠির ডগা দিয়ে হেঁড়া জামাটা আরও ছিঁড়ে বলল— জামা কিনতে পারিস না! নোংরা ছোটলোক, বজ্জাত। অন্ধ আক্রোশে সে ঘুসি চালাচ্ছে। ছোট ছোট হাতে ঘুসি। তারপর তার জ্ঞান নেই। কেননা চতুর্দিক থেকে ইট পাটকেলের মতো মার পড়ছে। পিঠে বুকে মাথায়, মুখে। ফাঁকা মাঠে মাঝরাত্তিরে জ্ঞান এল। এ কোথায় সে? ওই তো চেনা চাঁদ! না। ও চাঁদ আমার নয়, ও আকাশ, এ বাতাস, এ মাটি আমার নয় তো! ভোরবেলা বৃষ্টি এল। মুষলধারে বৃষ্টি। ভিজছে। বৃষ্টির ঠান্ডা লাগছে শরীরের ফোলা জায়গাগুলোয়, কাটা ঠোঁটে, থ্যাতলানো কানে, ব্যথায় ভেঙে পড়া হাড়ে। সাদা পোশাক পরা একজন সাহেব খুব আসেন তাদের বস্তিতে। শুনো, তুমরা লিখাপঢ়া শিখবে? হস্টেল, থাকিবে, খাইবে, পড়িবে, কোনও ব্যয় নাই।
মুখিয়া বললে, তা সাহেব মাঙনা দিবে সব? টিপছাপ লাগবে নাই?
না, তুমরা শিখবে, মহাজন ও দুষ্ট রিসিভার কিছু করতে পারবে না। ঠকিবে না।
মুণ্ডাবস্তি লোধাবস্তি ভেঙে পড়েছে— রাজকোঠিতে থাকছি এ মাস। যে কেহ পড়িতে চাইবে, পড়িবে। আমরা দিব। ক্রাইস্ট দিবেন। —উনি বললেন।
চলে গেলে জল্পনা-কল্পনা। এ বোধহয় ছোট ছেলেগুলোকে খাদানে নিয়ে যাবার ষড়। নইলে আর কী হতে পারে!
ব্যথা ভুলে, দপদপে যন্ত্রণা বৃষ্টি সব অগ্রাহ্য করে সে ছুটছে, ছুটছে, ডুলুং নদীর পুল পার হয়ে যাচ্ছে, কনকদুর্গা পার, রাজকোঠি তুমি আর কত্তদূর।
রাজনীতিতে যাবার ডাক সে অনেকবার পেয়েছে। এতটা উচ্চশিক্ষিত, শিক্ষিত সমাজের সঙ্গে এমন অঙ্গাঙ্গী মিশে গেছে এমন ট্রাইব্যাল ক’জন আছে? সে শুধু কতকগুলো প্রশ্ন রাখে:
—দাঁড়াতে বলছেন? নির্বাচনে? বেশ, কোন দল? আমার কোনও দল নেই। ঢুকতে ইচ্ছা করি না।
বেশ তো, নির্দল হয়ে দাঁড়াবে।
নির্দল মানে কি সত্যি নির্দল? কারও সঙ্গে যোগ দেব না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে বোঝাপড়ায় যাব না ‘রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা’র জন্যে। নিজের বিকেক মতো চলব!
তাহলে তো কোনও কাজ-কাম করতে পারবে না, উন্নয়ন তো করতে হবে।
উন্নয়ন বলতে?
ইস্কুল-কলেজ হবে, হাসপাতাল হবে, দেশের ধন দেশে থাকবে। আম-মানুষ খেতে পরতে পাবে, কামকাজ পাবে।
তা এ সবই তো ভাল কাজ। নির্বাচন বুঝি। কিন্তু এই কাজগুলো করবার জন্য দলে না ভিড়লে কাজ করতে পারব না? মানে?
নির্বাচনওয়ালারা এই ‘মানে’র মানেটা বলতে পারেনি।
কাজল বলেছিল, আমার নিজস্ব কাজ আছে। কারও স্বার্থে লাগলেই মিথ্যে অপবাদে ফাঁসা কিংবা খুন হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।।
আমি সমাজ-সংস্কারক নই, রাজনৈতিক আদর্শ নামে সোনার পাথরবাটিতে বিশ্বাস করি না। আমি গবেষক। তবে হ্যাঁ, যথাসম্ভব মানুষের কাজে লাগা; আপাদমস্তক সৎ ও যুক্তিশীল থাকা— এগুলো আমার দায়। একটা জীবনে মানুষ আর এর চেয়ে বেশি কী করতে পারে? —নতুন ওয়েবসাইট হচ্ছে ইনস্টিটিউটের, সে কাজে মগ্ন হয়ে গেল। খেয়াল হল তিনটেয়। লাফিয়ে উঠে সে প্রায় ছুটতে লাগল। গড়িয়াহাটের বাস ধরল। উলটোডাঙায় পড়তে না পড়তে হঠাৎ আকাশ কালো করে মেঘ জমল। এবং সে বুঝল নামবার সময়ে সম্ভবত তাকে প্রবল বারিপাতের মধ্যে পড়তে হবে। বাসে এক ভদ্রলোক আর একজনকে বলছিলেন ছাতা নিয়ে না বেরোলে বৃষ্টি হবেই। একরকম গ্যারান্টি, বুঝলেন দাদা। কিন্তু যদি ইচ্ছে করে ছাতা না নিয়ে বেরোন, তুকটা কাজ করবে না। তুক, তুকতাক এইসব শব্দ শুনলেই তার মনে পড়ে যায় আরও অনেক তুকের কথা। ছোট ছেলেমেয়ের কপালে ভুষো কালির টিপ। নজর লাগলে কয়লা আর ঠুঁটো ঝাঁটার কাঠি এক নিশ্বাসে দু’বার ‘আহা’ অর্থাৎ নজর লাগা লোকটির গায়ে বুলিয়ে নিজের পায়ের নীচ দিয়ে গলিয়ে বাস্তুতে ফেলে দেওয়া। আচ্ছা এই যে নজর লাগা মানুষটাকে ‘আহা’ বলে, বাংলার ‘আহা রে— বেচারা’ এর সঙ্গে কি কোনও সম্পর্ক আছে?
আর এক ভদ্রলোক বললেন, লোক্যালাইজ্ড্ রেন, শুরু হয়েছে তা ধরুন গত দশ বছর তো হবেই। নর্থ বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে দক্ষিণ খটখটে। দক্ষিণে হাঁটুজল, খিদিরপুরে ফার্স্টক্লাস কাজকর্ম হচ্ছে। মাল্টিস্টোরিড আর ডিজেল মিলে ওয়েদারের মেজাজ বিগড়ে দিয়েছে। আরও কত কী দেখতে হবে কে জানে!
বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল কাজল। প্রবল হাওয়ার তোড়ে চলার গতি কমছে। কিন্তু বৃষ্টি মুক্তি এক অন্ধকার জীবনের কারাগার থেকে। দূরে বজ্রপাত হয়। যমজ তালগাছ জ্বলে যায়। জ্বলে চিত্তের গভীরে, এক ভয়ংকর দৃশ্য অভিজ্ঞান হয়ে থাকে মুক্তির। গতকাল রাতে শাওয়ার ছেড়ে কীরকম আলুনি লেগেছিল মনে পড়ল। প্রতিদিনই লাগে, খেয়াল করে না। কাল করেছিল বলেই কি বৃষ্টি তার নিজস্ব স্বাদ দিয়ে গেল তাকে? তবে হ্যাঁ, ভেবে-চিন্তে যদি খেয়ালটা করো তাহলে তুকটা খাটবে না। বাসের ভদ্রলোকটির যেমন বিশ্বাস।
৬) তিনি ও সে
কস্তুরী দেখলেন কালো পাথরের একটি ভাস্কর্য তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। ছাট আসছে বলে জানলা বন্ধ, ঘর আধো-অন্ধকার। যতক্ষণ পেরেছেন জানলা খুলে রেখে বৃষ্টিকে আসতে দিয়েছেন, কিন্তু একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছিল, বৃষ্টি তক্তপোশের বিছানার দিকে হাত বাড়াতে জানলা বন্ধ করতেই হয়েছে। একটা পুরনো তোয়ালে দিয়ে ঘরখানা নিবিষ্ট মনে মুছছিলেন তিনি। দুষ্কর্মটি নিজেই করেছেন, তার শাস্তি তাঁকেই ভোগ করতে হবে। টপটপ করে ঘরের মধ্যে জল পড়ছে কোনও অজানা উৎস থেকে। ছাত ফুটো হল নাকি? মুখ তুলে দেখলেন কালো পাথরের ভাস্কর্য। বৃষ্টিভেজা কালো জিনস ব্রাউন শার্ট, সব গায়েই লেপটে, সেঁটে গেছে একেবারে। সেইসব ভাঁজও আদি অকৃত্রিম পাথরের। চুলগুলো মাথা থেকে নেমে এলোমেলোভাবে কী চমৎকার লেপটে আছে কপালে, কানে। তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল— বাঃ!
তাঁর প্রশংসাবাক্য বুঝতে পারে নি কাজল। সে ভেবেছিল ওটা ধমক। একেই ঘর ভরতি জল মুছতে হচ্ছে ওঁকে। তার ওপর সে একখানা মুর্তিমান জলস্তম্ভ হয়ে হাজির হয়েছে। কিন্তু কী করবে? রামলাখন নামে দারোয়ানটি দরজা খুলে খুব নিস্পৃহভাবে তাকে সিঁড়ি দেখিয়ে দিল। সে বাথরুমের কথা জিজ্ঞেস করেছিল।
রামলাখন বলে, পতা নেই।
আচ্ছা তো! থাকিস এই বাড়িতে। বাথরুম কোথায় জানিস না! তারপর মনে হল ও টয়লেট কথাটা ব্যবহার করেছিল। রামলাখন বোধহয় বুঝতে পারেনি।
—গোসল-কামরা নেই হ্যায়?
রামলাখন আবারও ওপরে দেখিয়ে দিল।
আশ্চর্য। এদের একতলায় কি কোনও কলঘর নেই? এ দারোয়ানপ্রবর যায় কোথায়? মাঠে-ঘাটে!
দু’-চার কদমে সিঁড়ি টপকে সে তিনতলার ঘরে হাজির হয়েছিল। উনি নিপুণ বাইয়ের মতো ঘর মুছছেন। নিংড়ে একটা বালতিতে ফেলছেন আবার মুছছেন। যেন এটাই ওঁর একমাত্র কাজ। এ বাড়িতে ঠিকে কাজ নিয়েছেন, ঘর মোছামুছি করছেন তাই। আধো-অন্ধকারে ওঁর সাদা শাড়ি চমকাচ্ছে। মুখের সাদাও, সেটাকে এখন জ্যোতি-জ্যোতি দেখাচ্ছে। উনি বললেন— বাঃ। অর্থাৎ বেশ! আমি ঘর শুকনো করছি, তুমি এমনি বে-আক্কিলে যে দিলে তার বারোটা বাজিয়ে। কাজ দুনো করে দিলে।
সে অসহায় অপ্রস্তুতের মতো একটা বোকা হাসি দিল। উনি ন্যাতা ফেলে উঠে দাঁড়ালেন ইস্স্ এতো ভিজেচো? যাও বাথরুমে যাও, আমি তোয়ালে দিচ্চি।
বিনা বাক্যব্যয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল সে। হাত বাড়িয়ে একটা তোয়ালে নিল। কিন্তু তোয়ালের সঙ্গে সঙ্গে একটি শাড়িও এল। সাদা চিকনের কাজ করা শাড়ি। কাজল খুব খানিকটা হেসে, ভাল করে গা-হাত পা মুছে, শার্ট প্যান্ট নিংড়ে জল ঝরিয়ে পরে ফেলল। বেরিয়ে দেখল ঘরের কোণে স্টোভ জ্বলছে— চা তৈরি হচ্ছে।
চা চিনি দুধ তেজপাতা গরমমশলা আদা দিয়ে ফোটানো জলের মার্কামারা গুজরাতি চা। একটা কাঁসার মোটা চাদরের পেটমোটা ঘটিতে চা-টা তৈরি করে দুটো মোটা মোটা কাচের গেলাসে ঢাললেন উনি। এক দিকের জানলা খুলে দিলেন, বৃষ্টির ধার কমেছে। বললেন, শাড়িতে ওপোমান হোলো?
কাজল একগাল হেসে বলল, মান-অপমানের কথা নয়। এই তো সব জল নিংড়ে নিয়েছি। আমি এরকম কত ভিজি! কিছু হয় না।
বেশ মহাশয়, বীরপুরুষ, চা খাও।
ওঁর কোনও জোরজারি নেই। তুমি ভিজে এসেছ, শুকনো তোয়ালে, কাপড় দিয়েছেন, তুমি তোয়ালে নিয়েছ, কাপড় নাওনি। বাস, মিটে গেল। —ও মা! গায়ে জল বসবে! শরীর খারাপ হবে। শিগগিরি শোনো, দিদির কথা শুনতে হয়। —এসব কিচ্ছু না। এইটাই ভালো, স্বস্তির।
এই যদি মিঠুর বাড়ি হত! বাবার পাজামা-পাঞ্জাবি নিয়ে এসে চরম আদিখ্যেতা করে তাকে জোরজুলুম করে পরাত। তারপরে দৈর্ঘ্যে ছোট পায়জামা পাঞ্জাবিতে তাকে মজার দেখাচ্ছে বলে হেসে হেসে চোখ থেকে জল বার করে ফেলত। এত জলও মেয়েদের টিয়ার-ডাক্টে থাকে। কাঁদলে জল, হাসলেও জল।
উনি বললেন, এই বৃষ্টিতে মৈত্রী কি আসচে? মোনে হচ্ছে না।
মৈত্রীর পারগতা অপারগতার সম্পর্কে কোনও পূর্ব-ধারণা করে না নেওয়াই ভাল, কাজল অভিজ্ঞতা থেকে জানে। সে জানলার কাছে গিয়ে বাইরেটা দেখল। ঘণ্টাখানেকের কাছাকাছি বৃষ্টি হয়েছে। এ গলিতে চট করে জল দাঁড়ায় না বোধহয়। কোলের দিকে জল বইছে। তবে বড় রাস্তায় যে গোড়ালি জল, তা সে দেখেই এসেছে। বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। বাঃ চা-টা চমৎকার লাগছে তো! সে মশলা-চা তো কোন ছার দুধ দেওয়া চাও পছন্দ করে না। লিকর। ইনফিউশন শুধু। চিনি দেয় না। কিন্তু আজকের এই বৃষ্টি এবং ভিজে জাব জামা-কাপড়ের আবহাওয়ায় চা-টা সত্যিই দারুণ লাগছে।
চা-টা ফার্স্টক্লাস হয়েছে দিদি।
উত্তর এল— রান্নায় আমি ওলওয়েজ ফার্স্ট। আমদাবাদে গেলে প্রমাণ পাবে, একানে যদি ভাবো খিচড়ি-ওমলেট করে খাওয়াব তো সে বালি গুড়ে।
কাজল হাসি চাপল, কারেক্ট করে দিল না মোটেই। বাচ্চাদের ভুলভাল এত মিষ্টি লাগে! এখন তুমি যদি ‘টু মেনি ব্ৰথস স্পয়েল দা কুক’ বল তাহলে ইংরেজদের কানে তা তো মিষ্টি লাগবেই না, আমাদের এদেশিরাও হাসাহাসি করেটরে তোমাকে অপাঙ্ক্তেয় করে দেবেন। অশিক্ষিত উজবুক— নিজেদের মধ্যে বলাবলি চলবে। এই এক যাত্রায় পৃথক ফলের প্রকৃত কারণ কী! ইংরেজি ভাষার কলোনি সূত্রে পাওয়া বিশাল বাজার, না আমাদের হীনম্মন্যতা, বলা মুশকিল। ইডিয়মে ভুল, উচ্চারণের অশুদ্ধতা রীতিমতো পদস্থ দক্ষিণী বা উত্তরপ্রদেশীয়দের মধ্যে খুবই দেখা যায়। সে নিয়েও আমরা প্রচুর ক্যারিকেচার করি। ওদের কিন্তু হেলদোল নেই। আমরাই লজ্জায় রেঙে যাই। অফ্ন বলব, না অফটেন বলব, ইডিওলজি বলব, না আইডিওলজি বলব, এ নিয়ে আমাদের চিন্তার শেষ নেই। অবশ্য এর মধ্যে একটা সঠিক জানা, সঠিক বলতে চাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাও আছে, শেখার আগ্রহ। এটা ভাল দিক।
সে কি বাঙালি? ঝাড়গ্রামে তাদের কত পুরুষের বাস! মানভূমের দিকেও তো তার পূর্বপুরুষেরা থেকে ছিল। সে বিহারি না বাঙালি বলা শক্ত। কোনও কোনও জায়গায় সীমান্তরেখা যে সত্যিই খুব ছায়াময়, তা স্বীকার করতেই হয়। তবে এসব নিয়ে সে ভাবলেও কাজল খুব সচেতন যে সে তার নিজস্ব আইডেন্টিটি তৈরি করেছে। শিক্ষাসূত্রে সে বাংলাটা খুব ভাল জানে। ইংরেজিও। এবং সংস্কৃতিসূত্রে সে তো বাঙালিই। এখন বাঙালি বলতে যদি শুধু কোঁচানো ধুতি, রসগোল্লা, আর ইলিশ-চিংড়ি বোঝায়, তবে তো মুশকিল। ঠিক আছে সে আদি-বাঙালি, ট্রাইব্যাল বাঙালি বেশ। এই জাতি-পরিচয়টা তাকে বেশ শান্তি-সন্তোষ দেয়।
কস্তুরীবেন বললেন, মৈত্রী যদি টাইম না রাখতে পারে আমরা চলে যেতেই হবে, কেন কী ওনাকে কথা দেওয়া আচে।
কাজল হাঁ হাঁ করে উঠল। এই মুষলধার বৃষ্টি যদি উত্তরেও হয়ে থাকে তা হলে এখন সেখানে মহাসাগর ও জ্যাম। শুনে কস্তুরীবেন বললেন, হ্যাঁ, পরানো কলকাতা তো বোটে! আমাদের শোহরটা লম্বা লেজের মতো, কিসের লেজ, কে জানে?
—আপনার শহর তো আমদাবাদ, সেখানে তো এ সমস্যা নেই।
টিক, আমদাবাদও আমার শোহর— পিতৃভূমি, বাপুল্যান্ড। কলকাতাও আমারই মা-ল্যান্ড, তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন— আমার জোন্মো তো একানেই।
কথাটা কাজল কয়েকবারই শুনল। উনি এখানে জন্মেছেন, ওঁর ছুটবেলা এখানেই কেটেছে, যে ছুটবেলা নাকি সব বেলা। এবং কলকাতার রাস্তাঘাটে উনি এমন বীরদর্পে হাঁটাচলা করেন যে এ শহরের ওপর ওঁর অধিকারে কোনও সন্দেহ থাকে না।
কস্তুরী বললেন, তা ছাড়া আমদাবাদে ট্র্যাফিক প্রবলেম নেই কে বললে! বৃষ্টির দেখা নেই, এটা একটা সোমস্যা বোটে। তবে যোখোন হোয় তোখন ছোট্ট খুকি সবরমতী উপচে সে এক কাণ্ড। তাপ্তী-নোর্মদাও আছেন— ফ্লাড। তুমি কোখনও যাওনি না?
সেভাবে কাজল কোথাওই যায়নি। ভ্রমণের শখ নেই। মানুষের বিশাল বিশাল কীর্তি তার কাছে একটা বিরাট ঠাট্টা বলে মনে হয়। কাজে গেছে। দিল্লি গেছে ইনস্টিটিউটের কাজে। তাজমহলটা পর্যন্ত দেখে আসেনি। রাধিকা কৃষ্ণান অবাক হয়ে বলেছিলেন, তুমি তাজমহলটা দেখলে না?
—কত দেখেছি, কত কতবার দেখেছি, ছবিতে, রেপ্লিকায়, তাজমহল লাইভ অন টিভি, তাই আর দেখতে হচ্ছে করল না।
—তুমি কি নিরাশ হবার ভয়ে গেলে না? জাস্ট টু কিপ ইয়োর ড্রিম ইনট্যাক্ট? কাজল হেসে ফেলেছিল— তাজমহল নিয়ে আমার কোনও স্বপ্ন নেই। পৃথিবীতে সুন্দর এবং আশ্চর্য সব মানুষের কীর্তি তো প্রচুর আছে! তো থাক না। আমি সব দেখে শেষ করতে পারব? দেখলে কি আমার দুটো ডানা গজাবে ম্যাডাম?
একটু চিন্তিত মুখে উনি বলেছিলেন, তা যদি বলো, ডানা গজাতেও পারে। গজানোটাই ইন ফ্যাক্ট আসল। লোক্যাল প্রবলেম নিয়ে সবসময়ে ডুবে থাকলে, হয়তো সংকীর্ণ হয়ে যেতে পারে মন, ক্ষমতা।
—আ অ্যাম ডেফিনিটলি নট আ ট্যুরিস্ট অন দিস আর্থ, ম্যাডাম, নর আ পরিব্রাজক।
—তা হলে তুমি কী?
—লেটস সি। তাছাড়া মন সংকীর্ণ হওয়ার প্রশ্ন নেই। ইট হ্যাজ টু বি কিন, ইনটেন্স।
ইউ মিন ইনটেনসিটি ইজ অল?
এগজ্যাক্টলি।
এখন এই ম্যাডাম, কস্তুরীবেনও পরিব্রজনে বিশ্বাসী কিনা কে জানে! দেশভ্রমণ, দেশে দেশে মোর ঘর আছে আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া। রবীন্দ্রনাথ বা বিবেকানন্দ, বা হিপি বা ইসকন…। মিঠু বলে— তোর মধ্যে একটা দম্ভ আছে। কারওর ওপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছিস না, বা মানহানি করছিস না, এই যা বাঁচোয়া।
ভুল বলছিস। ওটা জেদ, কোনও গোপন আকাঙ্ক্ষা, অ্যাসপিরেশন আছে আমার মনের মধ্যে তাই সেটাতেই ধ্যান দিয়ে থাকি, তাই আমাকে অ্যালুফ দেখায়, সেটাই তোরা দম্ভ ভাবিস। ভাব, আমি বারণ করছি না, কে কী ভাবল তা নিয়ে আমার কোনও ভাবনা নেই। আসে যায় না।
—তুই যখন নিজেকে এত ভাল পড়তে পারিস বলে মনে করিস তখন আর সামান্য একটু ইনভলভ্ড্ হবার চেষ্টা কর। লোককে ভুল ইমপ্রেশন দিয়ে কী লাভ! পাঁচজনের সঙ্গে একটু জড়ালে তোর মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
সামান্য একটু সেন্টিমেন্ট এখানে মিশিয়ে দিচ্ছে মিঠু, নির্ভুল বুঝতে পারে কাজল। ও হয়তো নিজেও জানে না। কিন্তু মিঠু জানে না, ওপর ওপর উদাসীন হলেও কাজলের ব্যারোমিটার কী নিখুঁত! পাঁচজন বলতে সাধারণভাবে মিঠু পাঁচজনকে বোঝাচ্ছে কিন্তু বিশেষভাবে বোঝাচ্ছে নিজেকে। নিশ্চিত।
—দি-দি। —ঠিক এই সময়ে বাইরে থেকে শোনা গেল। কাজল বলল, ওই তিনি এসে গেছেন।
হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গোটানো, একটা ওয়াটার প্রুফে ঠ্যাং ছাড়া সব ঢাকা। মাথায় ওয়াটারপ্রুফি বনেট— মিঠু বাইরে থেকে গলা বাড়িয়ে বলল— জলো জিনিসগুলো বাইরে রেখে, শুকনো আমি ভেতরে ঢুকছি দিদি। এখানে কি একটা হুকটুক আছে?
—বাম দিকে দেখো, ঠিক পেয়ে যাবে, পোর পোর হুক…
—পেয়েছি।
সানডাক খুলে ওয়াটার প্রুফ হুকে টাঙিয়ে শ্রীমতী পেল্লাই ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ঝাড়ন বার করে পা মুছলেন। তারপর আঙুলে ভর দিয়ে হাসি-হাসি মুখে ভেতরে ঢুকলেন।
—ওয়ান্ডারফুল— কস্তুরীবেন বললেন।
—কী হিসেবে? কাজল জিজ্ঞেস করল।
—শি ইজ আ ওয়েল-অর্গ্যানাইজড ইয়াং লেডি। তুমার মুতন ভিজে ভাত নয়।
—ভাত? ভাতকে আপনারা কী বলেন দিদি? এরকম ইডিয়ম আছে গুজরাতিতে? আমরা বলি ভিজে গোবর। মিঠু বলল।
—ভাত ইজ ভাত। তা ছাড়া তুমরা ভুলে যাচ্চো আমার ছুটবেলা কেটেচে কলকাতাতে।
অর্থাৎ কথাটা উনি ওদের ভুলতে দেবেন না। ভুলে গেলে আহত হবেন। যদি ছুটবেলা কলকাতাতেই কেটে থাকে তা হলে উচ্চারণের তফাত কেন? জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না কাজলের। যদি কিছু মনে করেন! নিজেকে অকৃত্রিম কলকাতিয়া ভেবে উনি খুব খুশি আছেন। আমদাবাদ যেমন ওঁর শোহোর কলকাতাও তেমনই ওঁর। ওঁর বাপু-ল্যান্ড আর মা-ল্যান্ড। কতটা কৌতূহল বা ঠাট্টা-তামাশা ওঁর সইবে— সে এখনও বুঝতে পারেনি।
মিঠু বলল, আমি একবার বেরিয়ে প্রচণ্ড ভিজে আবার ফিরে গেছি, জানেন? তারপর একটু অপেক্ষা করলাম, বৃষ্টিটা একটু ধরতে আবার চেঞ্জ করে ধড়াচূড়া পরে বেরোলাম। ঠিকই করেছি। আমাদের ওখানে জল নেই কিন্তু গোলপার্ক জলে জল। আবার দেখুন আপনাদের এখানেও তেমন কিছু নেই। নর্দমার দিকটা জমে আছে, ওখানটা লাফ মেরে পেরিয়ে এসেছি।
ঠিক করেচো— কস্তুরীবেন বললেন। —কাজল এবার কি যাওয়া যাবে? থ্রি মাস্কেটিয়ার্স!
বলতে পারছি না ম্যাডাম। দক্ষিণেশ্বর তো এখানে নয়, মাঝরাস্তায় গাড়ি যদি বিকল হয়ে যায়, বিপদে পড়বেন। মানে পড়ব। স্ট্র্যান্ডেড হয়ে যেতে পারি। এদিকেও আসতে পারব না, ওদিকেও যেতে পারব না।
দ্যাটস ব্যাড— কস্তুরীবেন খুব চিন্তিত হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। স্নেহলতা ঘোষের সঙ্গে দ্যাখা করা তাঁর খুবই দরকার। দরকারটা ব্যক্তিগত। কিন্তু সম্ভবত প্রথম দেখাতেই সেটা মিটবে না। দু’বার অন্তত যেতে হবে।
তা হলে কি আমরা চলে যাব? কাজল জিজ্ঞেস করল। হঠাৎ মিঠু একটু আবদেরে সুর ধরল। —এত দূর ভিজে টিজে কষ্ট করে এসেছি দিদি। মোটেই ফিরে যাব না। এই কাজল, তেলেভাজা মুড়ি নিয়ে আয় না।
ওই যে, মিঠুদেবীর পারগতা অপারগতা সম্পর্কে কোনও পূর্ব ধারণা করে নেওয়া ঠিক নয়! যা কাজল পারে না, মিতু তা অনায়াসেই পেরে যায়। এই ম্যাডাম বোঝাই যাচ্ছে কেমন অন্যমনস্ক, কিছু একটা প্রবলেম আছে ওঁর। কেউ ওঁর সঙ্গে ঘুরুক উনি চান না। নেহাত দক্ষিণেশ্বরের কাছে এই এঁড়েদ’ জায়গাটায় রাস্তা, বাড়ি ইত্যাদি খুঁজে পাওয়া খুব শক্ত, তাই ওদের কথায় রাজি হয়েছেন। এখন এই তেলেভাজা, ওঁর সময়ের মধ্যে অনধিকার প্রবেশ এসব ওঁর কত দূর বরদাস্ত হবে কে জানে!
কস্তুরী বললেন— কাজল, রামলাখনকে ডাকো। ও আনবে। তুমরা আরামসে বসো।
মিঠু তার আবদেরে ভঙ্গি অবিকৃত রেখে বলল, দিদি, আপনি আপনার দেশের গল্প বলুন। ছোটবেলার গল্পও তো আছে। প্লিজ দিদি…।
—তুমাদের মতুন আমাদের ছুটবেলা নয় মৈত্রী। আমরা খেলতুম কুকুর নিয়ে, বেড়াল নিয়ে, পুতুল নিয়ে, অ্যাসর্টেড ডলস— বেনেপুতুল, মুড়কি পুতুল, কাচের পুতুল, আলুর পুতুল…।
আলুর পুতুল? —মিঠু হেসে উঠল।
আলু নয়, সেলুলয়েডের ছিল, কিন্তু আলু বুলতো, কেন জানি না। তো আমরা খেলতে খেলতে পড়তে শিখে যেতুম, মেঝেতে চকখড়ি দিয়ে অ আ ক খ, এ বি সি ডি, যোগ বিয়োগ, গুণ, ভাগ— সমস্ত। পিঠে ক্রিশ্চানের পাপের বুঝা নিয়ে আমাদের স্কুল যেতে হত না। দুই চার পাতলা বই, খাতা, পেনসিল বক্স। বাস। হাতের লেখা করতে হত। চার পাঁচ ছে পাতা।
আমরাও করেছি দিদি, প্যাটার্ন ড্রয়িং দিয়ে কত ছোটতে শুরু করেছি। প্রিপেয়ারেটরিতে।
তাতে হাতের লেখা ভাল হয়েচে?
মিঠু অপ্রস্তুত হয়ে জিভ কাটল— এ মা! হ্যাঁরে কাজল, আমার হাতের লেখা ভাল!
—পাতে দেওয়া যায়— কাজলের চটপট জবাব, যদিও সে বলে থাকে মিতুর হাতের লেখা ছাপা হরফের মতো।
—তোরটা পাতে দেওয়াও যায় না।
কাজল বলল, একটু জড়ানো, পড়তে অসুবিধে হয়, তো আজকাল তো কম্পিউটারেই সব করি। আমার হাতের লেখা কেমন, ভুলেই গেছি।
আমারটা দেখবে? —উনি দারুণ উৎসাহে উঠে দাঁড়ালেন— ব্যাগ খুঁজে একটা কার্বন কপি বার করে নিয়ে এলেন।
—এই দ্যাকো, নিতাইবাবুকে যে চিটি দিই তার কপি। ওনার ই-মেল নেই। তা ছাড়া আমি যেসব মানুষের সঙ্গে করেসপন্ডেন্স করি, তাঁদের ই-মেল থাকে না।
চিঠিটা হাতে করে কাজল, মিঠু অবাক। ইংরেজি নয়, পরিষ্কার বাংলায় লেখা। গোটা গোটা। খানিকটা পুঁথির মতো লাইন টেনে টেনে লেখা।
সহযোগীবরেষু নিতাইবাবু,
আমি ষোলো অগস্ট কলকাতা যাচ্ছি, আমদাবাদ-হাওড়া এক্সপ্রেসে। বেশ কয়েকজন পুরাতন স্বাধীনতা-সংগ্রামীর সহিত দেখা করিব। নামধাম গিয়া বলিব। আমার কিছু শূন্য পাতা পূর্ণ করিবার প্রয়োজন। আপনার সহায়তা লাগিবে। আশা করি নিরাশ করিবেন না। সম্মানপূর্বক নিবেদনমিতি
কস্তুরী।
পড়ে ওরা অবাক হয়ে গেল। কতকাল আগেকার ভাষা-ভঙ্গি। সাধুভাষা আজকাল প্রায় উঠে গেছে। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ সাধু ক্রিয়াপদে লেখা বলে বাচ্চারা পড়তে চায় না। এরকম ভাষা দাদুর পুরনো চিঠিতে মিঠু দেখেছে। সযত্নে বাবা রেখে দিয়েছেন একটা কাঠের হাতবাক্সে। একগোছা চিঠি, একগোছা চাবি, দাদুর সোনার ফ্রেমের পড়ার চশমা, আর একটা হিসেবের খাতা। আধ সের খয়রা মাছ ১ পয়সা, একজোড়া শান্তিপুরী শাড়ি ৯২ টা ইত্যাদি।
কী সুন্দর হাতের লেখা দেখেছিস কাজল! ইস্স্। দিদি আমার হিংসে হচ্ছে!
স্পষ্টই দারুণ খুশি কস্তুরী। মুখে বললেন, হিংসা না করে প্র্যাকটিস করলে কাজে দিবে।
এখন এই বয়সে প্র্যাকটিস? দিদি? —মিঠু হেসেই আকুল।
কেনো? কোতো বোয়োস তুমার দিদিমোণি! যোতোদিন বাঁচে, ততদিন শিকে জানো না?
মিঠুর হাসি এবার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
পরিস্থিতি সামলাতে কাজল বলল, ম্যাডাম, কোন স্কুলে পড়তেন আপনি?
মুরুলিধোর চিনো?
হ্যাঁ। চিনি বই কী!
মুরুলিধোর কে ছিলেন জানো?
না, জানি না।
তুমরা কিছুই জানে না। শুনো মুরুলীধোর ছিলেন— বিখ্যাত আইনের লোক। উনি ওঁর তিন ছেলে সব আইন। অনেক দানধ্যান ছিল। আরও ছিলেন চারুচন্দ্র চ্যাটার্জি, সমাজসেবক, বিদ্বান লোক, সব এখানকার মানুষ।
হ্যাঁ দিদি ওঁর নামে একটা কলেজ হয়েছে এখন।
এখন কে বললে? সেই সাতচল্লিশ নাগাদই হয়েছে দিদিমোণি। মঙ্গিরাম বাঙ্গুর ছিলেন আরেক ধনী। বিড়লাদের থেকেও ধনী। ওঁর নামে তো হসপিট্যাল আছে। এঁরা সব এই সাউথ ক্যালকাটার গোড়ার দিকের লোক ছিলেন।
আপনি এত জানলেন কী করে দিদি? — অকৃত্রিম বিস্ময় মিঠুর গলায়।
বলেচি না আমার ছুটবেলা…
কাজলের ভীষণ হাসি পাচ্ছিল, হাসিটাকে প্রাণপণে সে প্রশ্নে পরিণত করল।
এই তো মিঠুরও ছোটবেলা কেটেছে কলকাতায়, আমার একটু বড়বেলা— আমরা তো জানি না!
এবার বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন কস্তুরীবেন— তুমরা জানতে চাও না, কেয়ার করো না। আমি পোস্ট-ইনডিপেন্ডেন্স জেনারেশন প্রচুর দেখেছি, নিজেদের নিয়ে মোত্ত। ডোন্ট কেয়ার আ ফিগ ফর দা পাস্ট। মোত্ত হও না কে বারণ করেচে? কিন্তু নিজের দেশের পাস্ট জানবে না?
—হিস্ট্রির লোকেরা জানে… খুব নার্ভাস গলায় মিঠু বলল।
—সে তারা কুঁটিনাটি জানুক, কিন্তু সাদারণভাবে য়ু সিম টু কেয়ার মোর অ্যাবাউট নোয়িং দা নেমস অব অ্যামেরিকান প্রেসিডেন্টস, দ্যান দ নেমস অব ইন্ডিয়ান ফ্রিডম ফাইটার্স।
—না দিদি, স্যরি।
—নো স্যরি, য়ু শুড বি অ্যাশেম্ড্, তুমাদের লোজ্জা কোরা উচিত।
তারপরই কস্তুরী যেন তাঁর ভেতরের কাঠিন্যকে গলে যেতে দিলেন, নরম প্রায় ভয় পাওয়া গলায় বললেন, না, না, আ অ্যাম স্যরি, এভাবে বোলা আমার উচিত করেনি। আই কান্ট ইকোয়েট য়ু উইথ আদার্স। টিক আছে, সাদারণ, খুব সাদারণভাবে জানবে, শুদু নেহরু, মহাত্মা, পাটেল, বোস জানলে হচ্চে না। আরও একটু, আরও এক-টু। একটু থেমে বললেন, তুমরা টিক কী কাজ করো বলো দিকি!
—আবার সেই কাজ? মিঠু কাতরায়।
—বা। কাজেই তো তুমার পরিচয়, নোয়?
অসহায়ের মতো মিঠু কাজলের দিকে চায়।
কাজল বলল, আমি লোকসংস্কৃতি নিয়ে রিসার্চ করছি দিদি। একটু ঘুরতে হয়। থিয়োরিটিক্যাল কাজও আছে।
তুমি মনভূম গেচো?
মানভূম? আজকাল তো আর মানভূম বলছে না। যে জায়গাটাকে সাঁওতাল পরগনা বলত—গালুডি, রিখিয়া, শিমুলতলা, মধুপুর, ও অঞ্চলের অনেক গ্রাম জানি। যাইনি। জাস্ট জানি।
—মঝিহিডা বলে কোনও জায়গা আছে?
—মাঝিহিড়া? অনেক রকম কাজকর্ম হয়। আপনি জানেন?
—কী ধোরোন? —জানা না জানার প্রসঙ্গ না তুলে উনি বললেন।
—এই ধরুন সর্ট অব গান্ধীয়ান বেসিক ট্রেনিং?
কাজলের থেকে হঠাৎ-ই মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে মিঠুর দিকে। তাকালেন উনি।
—বালো বালো বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, ফ্যাশন ডিজাইনিং সোব ছেড়ে তুমি সোশ্যাল সার্ভিসে এলে কেন দিদিমোণি? মিঠু সামান্য ঠোঁট উলটে বলল, দুর! কম্প্যারেটিভ লিটরেচার নিয়ে মাস্টার্স করেছি দিদি। খালি পাবলিক রিলেশন্স্ জব পাচ্ছিলাম আর টিচিং একদম বাজে। সবার মন রাখা আমার কর্ম নয়। পেয়ে গেলাম একটা এন.জি.ও-য়। ভ্যাগর্যান্টস্ নিয়ে ওদের কাজ।
আচ্চা! ইনটরেস্টিং!
—কিন্তু আমি শুধু ডকুমেন্টেশনটা করি। প্রত্যেকের হিস্ট্রি রাখি। সি.ডি. করি, হেড কোয়ার্টার্সে, আরও কিছু কিছু রিসার্চ অর্গ্যানাইজেশনে পাঠাতে হয়।
—বা। হিস্ট্রি! কেমন এই ভ্যাগর্যান্টসরা?
—দিদি আজব আজব ব্যাপার! আপনি ভাবতেই পারবেন না, ভাল সচ্ছল পরিবারের ছেলে ছিল। স্বভাবেই ভবঘুরে-টাইপ, এখন ধরুন বিয়াল্লিশ মতো বয়স। বাড়ি থেকে পালিয়েছে তেরো বছর বয়সে। একটা ভিখারির সঙ্গে কোনও তফাত ধরতে পারবেন না। পিকিউলিয়ার।
কস্তুরী বললেন, কেনো যে মানুষ পালিয়ে যায়! কোতা থেকে কোতায়। পালাবার জায়গা আচে? —একটু কি নিশ্বাস ফেললেন? — বাড়ির কোঁজ করোনি?
—করেছি। বলতে কি চায়? অন্যদের থেকে ভাসাভাসা মতন জেনে, আমাদের ডিরেক্টর খোঁজ করতে পাঠিয়েছিলেন। বর্ধমানের এক গ্রাম শ্রীরামপুর, ওদের যথেষ্ট জমি-জায়গা। উগ্র ক্ষত্রিয় বলে ওদের। প্রচুর টাকা থাকে ওদের। মা বাবা বেঁচে নেই। এক দাদা বললেন— দুর, ওর আশা আমরা ছেড়ে দিয়েছি। বেশ পড়াশোনা করছিল কিন্তু থেকে থেকেই পালাত। কেন? কী অসুবিধে? কোনও অসুবিধে নেই। ফেল করেনি, বাড়িতে অনাদর নেই। কে জানে, মন টেকে না, জাস্ট পালিয়ে গিয়ে কোনওরকমে খাবার জোগাড় করে কাটিয়ে দিত। তারপর হয় নিজেই ফিরে আসত। নয় বাড়ি থেকে খোঁজখবর করে ধরে নিয়ে আসত। শেষবার পালাল। তারপর ওই আমাদের থেকে ওর খবর পেলেন ওঁরা। দাদাটি বললেন— গিয়ে কোনও লাভ নেই। এমনিতেই ওর মন টিকত না, এখন তো মানাতেও পারবে না।
—তারাপদ টাইপ— কাজল বলল।
—তারাপদ কে? কস্তুরী জিজ্ঞেস করলেন।
—ও আপনি চিনবেন না। রবীন্দ্রনাথের একটা গল্পের…
—রাইট। ওতিথি নয়? কেনো চিনবো না—রবীন্দ্রনাথ আমার ওনেক পোড়া আচে। এই ফিল্মও আমি দেকেচি। বালো কাজ।
গল্পসল্প গড়াতে গড়াতে রাত ন’টা হয়ে গেল।
বেস্ট লাক দ্য নেক্সট টাইম! কাজল বিদায় নিল। মিঠু তখনও বসে। তার যাবার ইচ্ছে নেই। নিজেই নেই-আঁকড়ার মতো বলল— আর একটু থাকি দিদি, হ্যাঁ? কাজল তুই যা, কেমন? অধিকারী মাসিমা আবার মনে কষ্ট পাবেন।
এই হল মিঠুর মার্কামারা বিচ্ছুমি।
খোলা জানলা দিয়ে কস্তুরী দেখলেন— কাজল রাস্তা ক্রস করল। বাঁক ফিরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ফিরলেন মিঠুর দিকে। একটু ইতস্তত করে বললেন, দিদিমণি, এই চেলেটি মুণ্ডা মিনস সাঁওতাল, কোল, হো…
—হ্যাঁ দিদি। ও নিজেকে বলে আদি বাঙালি।
—মানে?
—আসলে বাঙালি তো সংকর জাতি দিদি। কাদের সঙ্গে কাদের মিশ্রণে বাঙালি হয়েছে বলা খুব শক্ত। সাদা কালো তামাটে সবকিছু মিশে গেছে পুবের এই মেল্টিং পটে। তাই ও নিজেকে আদি বাঙালি বলে।
—কিন্তু ও চোমৎকার বাংলা-ইংরেজি বোলে, সিম্স ভেরি ওয়েল এডুকেটেড!
—ওয়েল এডুকেটেড তো বটেই। ও হিস্ট্রির এম.এ দিদি— সোশিওলজিতেও। ডক্টরেট করছে এই আদিবাসীদেরই ওপর। তা ছাড়া ও খুব ছোট থেকে ব্যাপটিস্ট মিশনে মানুষ, পরে রামকৃষ্ণ মিশন। ভীষণ ট্যালেন্টেড।
—মিশনে মানুষ? মা-বাবা নাই?
—এসব কথা আমি জানি না দিদি। ও কখনও এ আলোচনার মধ্যে যেতে চায় না। আমি… আমি কখনও জিজ্ঞেস করিনি। তবে মিশনে মানুষ যখন, তখন ধরেই নেওয়া যায়— অনাথ। দিদি, আপনার কথা বলুন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। অবশ্য আপনার যদি আপত্তি না থাকে।
কস্তুরী চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, নিতাই তোমাদের বোলেনি?
—হ্যাঁ, আপনি খুব বড় বিজনেসম্যান ফ্যামিলির। আপনি সোশ্যাল ওয়র্ক করেন।
—এই তো জানো। আর কী!
—বাস? —এত নিরাশ গলায় মিঠু বলল যে কস্তুরী হেসে ফেললেন, তারপরে মিঠুর গাল টিপে আদর করে বললেন, দুঃখো করবে না। শুনো তোবে। আমার বাবার নাম নরেন্দ্র মেহতা। কাপড়ের ব্যবসায়ে প্রচুর কামিয়েছেন। আমি কুড়ি-একুশ থেকে ওঁর সঙে আছি। আই টূ হ্যান্ডল বিজনেস। কোতো নং সুতায় কুন মেশিনে কাপড় বুনলে আকাশের মতো নীল, বাতাসের মতো ফুরফুরে শাড়ি হোবে, রাজকুমারী একদিন পোরে ফেলে দিবে, জাহাজ জাহাজ সোনা দাম হোবে তার, চাঁদের মা চোরখায় সুতা কাটছে সুতা কাটছে, সোব আমি হাত পেতে নিতে জানি।
মিঠুর মুখচোখ ক্রমশই উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল, বিস্ময়ের গলায় বলল, দিদি, আপনি ক্ষীরের পুতুল, ঠাকুরমার ঝুলি— জানেন? পড়েছেন?
—তোবে? দিদিমণি তুমাকে কোতোবার বলতে হবে, আমার ছুটবেলা কেটেছে কোলকাতায়। জোন্মো একানে, কোর্মো— আমদাবাদে।
—চলে গেলেন কেন? কবে?
—সে কোতোকাল আগে কে জানে। বাবাকে চলে যেতে হল। আমাকেও যেতে হচ্ছে, না কী!
—কী ধরনের কাজ করেন আপনি দিদি? মানে সমাজসেবা!
—ছাইয়ের সোমাজসেবা। কিচ্চু করি না। সোব ছুটো ছুটো বাচ্চাদের পোড়ানো খেলানোর বন্দোবস্ত করি। দুঃখী বাচ্চা— হিন্দু, হরিজন, মুসলিম… ব্লাইন্ড, ডেফ অ্যান ডাম, —সাপোর্ট করি। গরিবের হাতের কাজ শিখানো চাই। সেসব বিক্রি করি। সোবোরমতী জানো?
—হ্যাঁ, গান্ধীজির আশ্রম।
—তোবে তো তুমি ভাল মেয়ে। জানো। সোবোরমতী জানে না কোতো! উনি তো লোবোন সত্যাগ্রহের পোর আর গুজরাত ফিরলেন না, ওয়ার্ধায় চলে গেলেন। জানো?
—ওয়ার্ধা নামটা চেনা চেনা লাগছে।
—চিনা চিনা যোথেষ্ট। ডিটেল জানার দোরকার কী!
মিঠু বুঝতে পারল না উনি তাকে তিরস্কার করলেন কিনা।
—তো সে যা হোক, সোবোরমতী প্রোডাক্টস মার্কেটিং কোরবার চেষ্টা করি। বাস।
—আর মানে ওই দাঙ্গা…
—ও তো সারা ভারতের জানা হয়ে গেচে। ওই বাস। গুন্ডা এলিমেন্ট ওস্ত্রশোস্ত্র নিয়ে কাটছে, ভাঙচে, মারচে, মার-খাওয়া লোক পিছনের দোরজা দিয়ে ঢুকাচ্চি। উরা চেঁচাচ্চে, আমায় মেরে ফেলে দিবে। লুঠ কোরবে। বাড়ি জ্বালিয়ে দিবে। আমি শুনচি না। চোপ্। কোরো কী কোরবার। বাস। সোবাই বলতে লাগল কস্তুরী মেহতা বহুৎ কিচু করেচেন। মুসলমান লোকের মেসায়া। মেসায়া কিচু নোয় দিদিমোণি। ওন্যায় দেখলে রুকতে হোয়। আমার টাকা ছে, ফোর্টের মুতুন বাড়ি ছে, সাহস ছে, আমি যদি না করি, কে করবে?
দিদি, কিছু মাইন্ড করবেন না, এটা আপনার আয়রনি মনে হয় না, গান্ধীজি মুসলমানদের জন্য এত করলেন, কলকাতায়, খুলনা, নোয়াখালি, দিল্লি— সব জায়গায়। আর ওঁর নিজের জায়গা গুজরাতেই…
কস্তুরী বললেন— হিস্ট্রি ইজ ফুল অব আয়রনিজ, জানো না দিদিমোণি?
৭) তিনি ও স্মৃতিসত্তা
মনটা খিঁচড়ে গেছে। বৃষ্টি সুস্বাগতম। কিন্তু এভাবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে না পারায় কস্তুরী উদ্ভ্রান্ত। ধরো যদি কালও এমনি বৃষ্টি পড়ে! ধরো পরশুও। হেসে ফেললেন— কী অধৈর্য! এত অধের্য হলে কোনও কাজ হয় না। দু’-তিনবার স্নেহলতা ঘোষের বাড়ি ফোন করেছেন, পিঁ পিঁ করে যাচ্ছে। তারপর খবরে শুনলেন বৃষ্টিতে অনেক জায়গাতেই টেলিফোন বিকল হয়ে গেছে। বাঃ! অতঃপর কী করণীয়? সময় অনন্ত নয়। নাঃ ঠিক হল না। সময় অবশ্যই অনন্ত। কিন্তু তাঁর সময় খুবই সীমিত। বাবা বেশ কয়েক বছর পলিয়েস্টার খাদি শুরু করেছিলেন, তার নানারকম বৈচিত্র্যও আসছে, রঙে টেক্সচারে। নানা রং আরম্ভ হয়েছে ইদানীং। ভীষণ পপুলার হয়েছে। সারা ভারতবর্ষে যাচ্ছে, এখন ভারতের বাইরেও প্রচুর চাহিদা। সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে তাঁর কাজ, ব্যস্ততা, কমেছে সময়। নিজের এলাকাতে ব্যাবসার দেখাশোনার বাইরে তাঁর যে কাজ তা-ও প্রচুর সময় দাবি করে। সবরমতী আশ্রমের উৎপাদন মার্কেটিং করা তাঁর কাছে একটা ব্ৰতর মতন। আছে ব্লাইন্ড স্কুল, মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য সংস্থা। দরিদ্র মেয়েদের উপার্জনের জন্য একটা বড় সংস্থাও রয়েছে, তার শাখা-প্রশাখা বিস্তারও শুরু হয়েছে। এই সবগুলোরই তিনি কর্ণধার। কলকাতায় এসে অনির্দিষ্টকাল বিনা কাজে বসে থাকার সময় বা মানসিকতা কোনওটাই তাঁর নেই। কিন্তু এই ভিজে গরম ও মুষলধার বৃষ্টির দেশে অধৈর্য হয়ে তো কোনও লাভ নেই!
ক্রমশ রাত হয়। তাঁর বরাদ্দের রুটি ভাজি দহি খাইয়ে যায় রামলাখন যত্ন করে। কস্তুরী বই পড়বার চেষ্টা করেন। বিক্ষিপ্ত মন শান্ত করার যা যা উপায় আছে সবই একটু একটু চেষ্টা করেন। কিন্তু মন শান্ত হয় না। শেষে দুরন্ত শিশুর মতো ছুটে যেতে চায় পাঁচের দশকের কলকাতায় যখন ভোরের রাস্তায় হাইড্রান্ট্রের মুখে পাইপ লাগিয়ে রাস্তা ধোয়ার শব্দে চোখ মেলছেন, আবার ঘুমিয়ে পড়ছেন, ছায়াময় রাস্তা দিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে, গান করতে করতে চলে যাচ্ছে প্রভাতফেরি, দৌড়ে এসেছেন বারান্দায়—‘হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর, হও উন্নতশির নাহি ভয়/ ভুলি ভেদাভেদ জ্ঞান হও সবে আগুয়ান সাথে আছে ভগবান, হবে জয়।
কী অমোঘ সব উচ্চারণ, কত সরল অথচ সত্য! তখন তো কথাগুলোর মানে বুঝতে পারতেন না। গানের সুরে শব্দ বিভাগও হয়ে যেত আলাদা। হও ধরো, মেতে ধীর, হও উন, নত শির, নাহি ভয়। হও এবং ধরো, কী ধরতে হবে ভেবে পেতেন না। মেতে আবার ধীর কী করে হওয়া যায়! নত শির, মানে বড়দের সামনে মাথা নিচু করে থাকতে হবে তা হলেই আর ভয়ের কারণ থাকবে না, চড়চাপড় পড়বে না। কিন্তু উন জিনিসটা কী, আর কী করেই বা তা হওয়া যায়! ভেদাভেদটাকে ছোট্ট মেয়েটি অভেদানন্দের সঙ্গে মিলিয়ে ধরত, অভেদ ও ভেদাভেদ, তবে এঁদের তো মনে রাখতেই বলা হয়। ভুলতে হবে কেন? বাকিটুকু সোজা, বুক ফুলিয়ে এগিয়ে গেলে যে দুষ্টু বন্ধুরা ঘাবড়ে যায় তা বেশ দ্যাখা আছে। একদিন একটা কী ছোট্ট প্রশ্ন করেছিল মাকে, তাইতেই মা বিদ্যের দৌড় বুঝে যান। খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দেন। ধরম বা ধর্ম মানে এইসব পুজো-অর্চনা করা নয়, নামাজ পড়াটড়া নয়, ধর্ম মানে ভারচু, অর্থাৎ কিনা মানুষের যে মৌলিক গুণ, মানবিকতা, সেই মনুষ্যত্বে ধীর থাকতে হবে, উন্নতশির। মাথা উঁচু করে চলতে হবে, মানে উদ্ধত নয়, কিন্তু আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। অস্পষ্টভাবে হলেও কেমন গভীরভাবে সে বুঝেছিল কথাগুলো, মুদ্রিত হয়ে গিয়েছিল এক দফা মূল্যবোধ। মানবধর্ম থেকে কখনও বিচ্যুত হবে না। আত্মসম্মান হারাবে না। মানুষে মানুষে ভেদজ্ঞান ভাল নয়, কে কৃষক, কে বণিক, কে ধনী, কে দরিদ্র, কে উচ্চবর্ণ কে নিম্নবর্ণ, কে মুসলমান কে শিখ, এই বিভেদ ভুলে একটি অখণ্ড সামাজিক একক হয়ে এগোতে হবে—জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, মন্ত্রসাধনে, ঐশ্বর্য আহরণে, কুসংস্কার দূর করতে, সুসংস্কার রক্ষা করতে। এত কথা আস্তে আস্তে অনুভব করেছেন। একটা টেক্সট-এর ব্যাখ্যা যেমন ক্রমেই প্রসারিত হতে থাকে, এই দুটি সরল পঙ্ক্তির অর্থও তাঁর মননে, চেতনায় তেমন হচ্ছে। ঝোঁকটা যখন ‘ধরম’ থেকে ‘ধীরে’র ওপর পড়ে, তিনি ভাবতে থাকেন। ধীর মানে কি শুধু স্টেডি? না। তোমার মানবিকতার ধর্মকে প্রয়োগ করার সময়ে তুমি শান্ত, ধীর থাকবে, মিলিট্যান্ট হবার দরকার নেই। কর্মে বীর হওয়া যে কত কঠিন তা তো তিনি হাড়েহাড়েই বোঝেন। সাহস, প্রচণ্ড সাহস প্রয়োজন হয়, ধ্যান দরকার হয় যে কোনও কর্ম সম্পন্ন করতে গেলে। অনেক খারাপ সময় এসেছে গেছে, শরদকাকার সঙ্গে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাবা এক সময়ে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন। তখন শরদ শার সঙ্গে কথাবার্তা তাঁকেই বলতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যখন দেখলেন তাঁদের পারিবারিক গুড-উইলের সুযোগ অন্যায়ভাবে নিয়েই চলেছেন কাকা, তখন তাঁকে একটা অত্যন্ত সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। জুয়েলারি থেকে তখন তিনি বাবাকে কাপড়ের ব্যবসায়ে আসতে পরামর্শ দিলেন। নরেন্দ্র অবাক হয়ে গিয়েছিলেন— বলিস কী, কিকি? এত দিনের ফ্যামিলি ট্র্যাডিশন…। নতুন ব্রাঞ্চ… আমি কি পারব?
—তুমি তো অনেক কিছুই পেরেছ বাবা, এটাও পারবে।
তখন তাঁর কত বয়স? বাইশ? তেইশ! সবে আইন পরীক্ষা দিয়েছেন।
তারপর কাগজে কাগজে ফলাও করে নোটিশ চলে গেল ‘ইট ইজ হিয়ারবাই নোটিফায়েড দ্যাট নরেন্দ্রভাই অব নরেন্দ্রভাই শরদভাই ইজ নো লঙ্গার উইথ দা মেহতা জুয়েলার্স। শরদকাকাকে নিজের অংশ যখন বেচে দিলেন অবলীলায়, তখন শরদকাকা খুব অনুনয়-বিনয় করেছিলেন। তিনি অন্যায় করেছেন, নরেন্দ্র যেন তাঁকে মাফ করেন।
নিজের ভাই-ই বিশ্বাসঘাতকতা করে শরদ, আর তুমি তো পাতানো ভাই। কোনও আদর্শই বিত্তলালসার ওপরে নয়—আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার অসুবিধে কীসের? গুড উইলটাই তো তোমাকে বেচলাম। আমাদের বাপ-বেটির চলে যাবে একরকম।
একেবারে চুপ শরদ শা। কোনও কথা বলতে পারেননি। উদ্ধত জবাব, অন্যায় অপমানজনক আচরণ, কিচ্ছু না। চলে গেলে বাবা বলেছিলেন, সত্যি চলে যাবে কিকি? সত্যি পারব?
—পারবে না কেন? আমি রয়েছি তো!
হঠাৎ নরেন্দ্র বলে উঠেছিলেন, হ্যাঁ, সে-ও একথাই বলত। আমি আছি তো!
—কে বাবা? আমার মা?
নিঃশব্দে মুখ নিচু করেছিলেন বাবা। কন্যা আর প্রশ্ন করেনি। কাপড়ের কারবার ফলাও করতে তাঁদের তিন বছরের বেশি সময় লাগেনি। প্রথমে নামী মিলের এজেন্সি নিলেন। তারপর মিলটাই কিনে নিলেন। এখন কোথায় শরদ শা’র জুয়েলারি আর কোথায় নরেন্দ্রর কটন সাম্রাজ্য।
বড্ড ছটফট করছে মনটা। বড্ড। ছেলেমেয়ে দুটো যতক্ষণ ছিল বেশ ছিলেন। বয়স হলে তরুণ-তরুণীদের সঙ্গ বোধহয় স্বাস্থ্যকর। অবশ্য তেমন তেমন তরুণ-তরুণী। চতুর্দিকে যাদের দ্যাখেন দেখে খুব আরাম পান না কস্তুরী। তাঁরা ছোটবেলায় কত অন্যরকম ছিলেন। কত সুন্দর ছোটবেলা কেটেছিল। বাড়িতে সর্বক্ষণই লোক। মাকে কম পেতেন। তাতেও কিন্তু কোনও অসুবিধে হয়নি। তাঁর নিজস্ব জগৎ ছিল, খেলাধুলো, পড়াশুনো, কুৎরী, বেড়াতে যাওয়া, গান শোনা, মায়ের হাতের মাছের ঝোল। আশ্চর্য! এখন আর মাছ মাংস খেতে পারেন না তিনি। গন্ধ লাগে। ঘিন্নাও লাগে। এখন খাকরা, কড়হি, পুরণপুরী, ধোকলা, গাঁঠিয়া খমণ্ড। বাবা যে বাবা দীর্ঘদিন মাছ ছাড়া অন্যান্য বাঙালি খাবার খেয়েছেন মায়ের হাতে, তিনি সুদ্ধ রোটলি, ভাকড়ি, মেথিলি ভাজি, চেওড়ো জলেবি—এসব ছাড়া খেতে পারতেন না। শেষ পাতে একটু দুধপাক তাঁর চাই-ই চাই।
শাহপুরের পুরনো বাড়ি। দাদা, দাদি। সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। একটা বিরাট উঁচু উঁচু ঘর। দালান। একটু উঁচু কিন্তু চওড়া চওড়া সিঁড়ি। জাফরির কাজ করা জানলা, আর ছোট ছোট ঝুলবারান্দা। একটু গম্ভীর, শান্ত। ছোট মেয়ের ভাল লাগার মতো নয়। কিন্তু আস্তে আস্তে ওই স্থাপত্যের গাম্ভীর্য থেকে শান্তি ছড়িয়ে গেল ছোট্ট মেয়েটির শরীরে, মনে। কেমন করে যেন বাবার বন্ধু হয়ে গেলেন। আগে তো বাবার সঙ্গে এত ভাব ছিল না! তাঁর আঠারো বছর বয়স থেকেই তো বাবা ব্যাবসার ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতেন। খাঁটি ব্যাবসাদারি রক্ত শরীরে, ঝলকে ঝলকে আসতে থাকত সমঝদারি, নতুন নতুন আইডিয়া। তাঁর, তাঁদের তারুণ্যও ছিল অন্য রকমের। এদের মতো নয়। শুধু নিজেকে নিয়ে কাটত না তো দিন! বাবা ছিলেন। ব্যাবসার চিন্তা ছিল, পড়াশোনা ছিল, সবরমতী আশ্রম ছিল, কত ছোট থেকে ছোট ছোট বাচ্চাদের ধরে এনে পড়াতেন। কস্তুরীর মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। মহাত্মা গাঁধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একটা মহৎ সংসারের মধ্যে ছিল তাঁদের বসবাস। মারা গেছেন। তো কী? হাওয়ায় ভাসছে তাঁদের সুবাস। ট্রাম চলেছে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের তালে। ‘মারের সাগর পাড়ি দেব গো’ গেয়ে উঠলেন নিবেদিতা মাসি— এই বিষম ঝড়ের বায়ে/ আমার হালভাঙা এই নায়ে!
নরেন্দ্র মেহতা ও শরদ শাহ আমদাবাদে সেবাদলে ছিলেন। হরিপুরা কংগ্রেসের অধিবেশনে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেছেন। তারপরে সুভাষচন্দ্রের ভাষণ, তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর সংকল্প আস্তে আস্তে সম্মোহিত করে ফেলল তাঁদের। না, এখানে আর নয়, সুভাষ, অরবিন্দ, রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথের পবিত্র চুম্বকী চতুষ্কোণে যেতে হবে পথ খুঁজতে। বাবাকে লুকিয়ে চলে এসেছিলেন। পরে কুইট ইন্ডিয়ায় যোগ দিয়ে প্রেসিডেন্সি জেলে গিয়ে দ্যাখেন, আরে, সেবাদলের সেই শরদ না? গুজরাতি সাহিত্য সম্মেলনে হাঁ করে যমনালাল বাজাজের দিকে তাকিয়েছিল?
পাত্তা করতে পেরে বাবাই কিনে দিলেন ফার্ন রোডের বাড়ি। জাত ব্যবসাদার, বললেন, দেশের সেবা তো করবে, যুব আন্দোলন করবে, আধ্যাত্মিক করবে, কবিতা-কাব্য করবে তো পয়সা লাগবে না? হগ মার্কেটে দোকান দাও। তোমার ধর্মভাইকে নিয়ে ব্যাবসা করো। পয়সা না হলে কিচ্ছু হবে না। গলা ফাটিয়ে খালি চেঁচালে মুখে রক্তই উঠবে।
বাবার কাছ থেকে এইসব শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে উঠতেন কস্তুরী।
—বাবা তুমি রবীন্দ্রনাথকে দেখেছ?
—একবার। অনেক দূর থেকে। জোড়াসাঁকোয়। জন্মদিন ছিল। অনেক লোক। এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলুম।
—কী দেখলে বাবা? কীরকম?
—তখন উনি বেশ বৃদ্ধ। পুরো মানুষটাই রুপোলি। সন্তের মতো মনে হচ্ছিল, যেন চারদিকে একটা প্রভা ছড়িয়ে যাচ্ছে।
—প্রভা, কিন্তু প্রভাব কি? বাবা? ওঁর মতো দূরদর্শী কর্মী এবং ভাবুক, অত হৃদয়বান। এ সবের কম্বিনেশন তো একসঙ্গে ঘটে না। তবু তো ওঁর দেশের লোকেরা শুনতে পাই ওঁর গান আর ডান্স ড্রামা নিয়েই মেতে রয়েছে।
—শান্তিনিকেতনও আর শান্তিতে নেই কিকি—বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন।
—তবে?
—কেউ প্রচার করল উনি মেয়েলি পুরুষ, কেউ বলল উনি সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গ ভালবাসেন, কেউ বলল নিজে নিজের ওপর গুরুদেব কথাটা উনিই আরোপ করেছেন। কেউ বলল উনি নিজের মান, যশ, খ্যাতি ছাড়া কিচ্ছু বুঝতেন না, কত রকম কথা, কিকি—কেউ দেখল না, জালিয়ানওয়ালা বাগের পর মহাত্মা যখন প্রতিবাদ করতে রাজি হলেন না, তখন একটি অতুলনীয় চিঠি দিয়ে কীভাবে তিনি নাইটহুড প্রত্যাখ্যান করলেন। এর মর্ম যে কী, আজকালকার ছেলেমেয়েরা বুঝবে না। একক প্রতিবাদ।
আজকালকার কেন বলছ বাবা! কোনওদিনই এর গুরুত্ব তেমন করে কেউ বোঝেনি। উনি তো কবি! রাজনৈতিক ব্যাপারে ওঁকে আন্ডারপাবলিসাইজ করাই বোধহয় সচেতন নীতি ছিল তখন।
রাইট। নরেন্দ্র হঠাৎ তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছিলেন। — কিকি, তুমি তার মতো করে ভাবো। কী করে শিখলে? উত্তরাধিকার?
রক্তেরও। শিক্ষারও। সেই পাঁচ-ছ’ বছর বয়সে তাঁর মধ্যে কতকগুলো আইডিয়া ঢুকে গিয়েছিল, পরে তিনি সেগুলোকে নিয়ে মনের ভেতর অনেক নাড়াচাড়া করে তাঁর নিজস্ব দর্শন তৈরি করেছেন।
পেছন ফিরে চেয়ে দেখলে কস্তুরীর মনে হয়, তাঁর সারা জীবনটা বাস্তব দিয়ে গড়া স্বপ্ন একটা। রূঢ়, কঠিন বাস্তব। তাঁকে একের পর এক কষ্ট ও সমস্যার মোকাবিলা করতে করতে বড় হতে হয়েছে। কিন্তু সবটাই স্বপ্নময়।
মা স্বল্পভাষী, অন্যমনস্ক। খেলাধুলোর ব্যাপারে কোনও বাধা দিতেন না। কিন্তু দুষ্টুমি বিশৃঙ্খলা সহ্য করতেন না একদম। বলতেন এই নাও ‘ক্ষীরের পুতুল’ পড়ো, তারপরে দশটা পর্যন্ত নামতা লিখবে, তারপর ‘আবোল-তাবোল’ থেকে যে কোনও একটা কবিতা মুখস্থ করবে। রাতে স-ব ধরব। বাস, আর একটা কথাও নয়। কত ছোটবেলায় পড়তে শিখেছিলেন ভুলেই গেছেন। মাকে দারুণ ভয় পেতেন, কিন্তু সেই ভয়ের অঙ্গে অঙ্গে দুর্মর ভালবাসা জড়িয়ে ছিল। কখন মা একবার তাকাবেন, চুড়ির আওয়াজ শোনা যাবে, কখন মা রান্নাঘরে ঢুকবেন এবং অপূর্ব সুগন্ধ বেরোবে। কখন মা সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান ধরবেন—
তবে বজ্ৰানলে
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা চলো রে।
এই গানটা হলেই মনে হত, বুকের ভেতর দারুণ শক্তি সাহস এসেছে। কিকি আর কিকি নেই। সে মা-বাবা-কাকা-পিসি-মাসিমাদের গানের আসরে বসে তার বাচ্চা গলা মেলাত। বজজানলে, আপন বুকে পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা চলো রে।
কত সময়ে সেসব আসরেও আলোচনার মধ্যে সবার অলক্ষ্যে বসে থাকতেন। সব বুঝতেন না, মনেও নেই সব। কিন্তু অহিংস পন্থা, আর সুভাষ পন্থার একটা তুলনামূলক আলোচনা প্রায়ই হত। এখন জানেন নরেন্দ্র ও শরদ মেহতা দু’জনেই গুজরাত ছেড়ে এসেছিলেন সুভাষের খোঁজে। সব উলটেপালটে গেল। কলকাতায় তখন সুভাষপন্থীদের সংখ্যা গাঁধীপন্থীদের থেকে অনেক বেশি। ওঁরা ভাবতেন— নিজেদের তৈরি করতে হবে, যে মুহূর্তে সুভাষ উত্তর-পূর্বে ভারত সীমান্তে এসে পৌঁছোবেন অমনি খুলে যাবে দ্বার। সমস্ত মণিপুর, আসাম, ত্রিপুরা, বাংলা তাঁকে স্বাগত জানাবে। তারপরে যোগ দেবে সমগ্র ভারতবর্ষ। ভেসে যাবে আজাদ-হিন্দ ফৌজ আর গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ইংরেজের সমস্ত প্রতিরোধ। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী সবই প্রস্তুত ছিল। তবু স্বপ্ন পূরণ হল না।
কিন্তু তখন তো ১৯৪৬, ৪৭, ৪৮-এর ৩১ জানুয়ারি সব পেরিয়ে গেছে। তখন এ ধরনের সভা-সমিতির কারণ কী?
—আমরা একটা সমন্বয় করতে চাইছিলাম, কিকি। কেউ কেউ ছিল কট্টর। কিন্তু সবাই মিলে চোখ রাখতাম নতুন নেহরু সরকারের ওপর, কীভাবে সুভাষের বলবীর্য, গাঁধীজির জনশিক্ষা ও নেহরুর আধুনিকতার একটা সুষ্ঠু মিশ্রণ হয় তারই জন্য আলোচনা করতাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল একটা সম্পূর্ণ নতুন দল গড়ব, যার মধ্যে এই সমন্বয় থাকবে। কী হতে পারে আমাদের কনস্টিটিউশন, আমাদের ম্যানিফেস্টো…এই নিয়েই আলোচনা হত।
—করতে পেরেছিলে দলটা?
—না কিকি, পারিনি। আলোচনার স্তরেই ছিল। কেননা অনেকেই ভিন্ন মত পোষণ করতেন।
—কে, কে? বাবা!
এইখানে বাবা একেবারে চুপ করে যেতেন। বেশি চাপাচাপি করলে বলতেন—মনে নেই। সে আজ অনেক যুগ হয়ে গেল। তাছাড়া শেষ দিকটাতে তো আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ব্যাবসা শুরু করলে আর থামা যায় না কিকি।
হঠাৎ মনস্থির করে ফেললেন কস্তুরী। কালকেই স্নেহলতা ঘোষের বাড়ি যাবেন। যাবেনই। একটা গাড়ি ভাড়া নেবেন। এই শহর আর শহরতলি তো! যতই বদল হোক সেই কলকাতাই তো! রাস্তা ভরতি পথচলতি মানুষ, দোকানদার, ট্যাক্সি-ড্রাইভার, রিকশাঅলা। খুঁজে বার করতে অসুবিধে হতে পারে, অসম্ভব কিছু নয়। স্থির করে নিয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেন।
হঠাৎ সরু মোটা গলায় নানান হাসি বাজে। সারারাত ধরে শুধু কথা, কথা আর কথা। কে কী বলছে ধরা যায় না। কিন্তু কেউ কেউ যেন খুব উত্তেজিত। রাগারাগি হচ্ছে নাকি? তোমরা হাসো, কথা বলো, গান করো। কিন্তু রাগারাগি কোরো না। কিকি ভয় পায়। তার বুকের মধ্যে থম ধরে যায়। বাবা মা যে বড্ড কথা কাটাকাটি করেন। বাবা খুব রেগে যান। মা’র মুখ থমথম করে। কী যেন একটা কঠোরভাবে বলেন, তারপর চলে যান। এই কস্তুরী তুই অ্যালিসের গল্প পড়েছিস? এই কস্তুরী কিতকিত খেলবি? এই কস্তুরী তোর আলুর পুতুলটাকে একটু পাড় না, জামা পরিয়ে দেব। জামা তো পরানোই আছে। নতুন জামা পরাব। দে না রে! ন্না, মা রাগ করবেন, ওই পুতুলটার অনেক দাম, বাবা কিনে দিয়েছে। কাউকে দেব না।
কিকি! তুতুল তোমার বন্ধু অত করে খেলতে চাইছে, পুতুলটা একটু দিতে পারছ না? ছিঃ! কে বলেছে আমি রাগ করব? যাও, টুলে ওঠো, পাড়ো, ওঠো বলছি! গোঁজ হয়ে বসে রইলে? ওঠো! নইলে…এই শিখেছ? বারবার বলেছি না সবার সঙ্গে সব ভাগ করে নিতে হয়! এত খারাপ হয়ে গেছ তুমি! কস্তুরী ফোঁপাতে ফোঁপাতে জেগে উঠলেন। একদম কিকির মতো। অনেকটা জল খেলেন, চোখ ভেঙে ঘুম আসছে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।
খুব নিবিড় গান হচ্ছে— সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং শস্য শ্যামলাং মাতরম। কী যে চমৎকার সুর এই গান, না স্তোত্রটার! না তো, মন্ত্র! ওঁরা সবাই বলেন এটা মন্ত্র। মন্ত্র কাকে বলে! পূজায় মন্ত্র লাগে, কার পূজা? দুর্গাঠাকুর? কালী? সরস্বতী— এইসব পূজার মন্ত্র সে কিছু কিছু জানে। যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ, নমস্তস্যৈ, নমস্তস্যৈ নমো নমহ৷ মা দুর্গাকে এইভাবে ডাকতে হয়। মহালয়াতে সব গায়ক মিলে রেডিয়োতে ডাকেন। গায়ক হলে তবেই ওইভাবে ডাকা যায়, অন্ধকার রাতে মন্ত্র মর্মে প্রবেশ করে যায়, মা বাবা উঠে বসে শুনছেন, এত সকালে ওঁদের চান হয়ে গেছে, দু’জনে মেঝেতে বসে পিঠ সোজা করে শুনছেন। কালী? কালীপূজার মন্ত্রও সে জানে। অত শক্ত নয়। গানই! —শ্যামা মা কি আমার কালো রে, শ্যামা মা কি আমার কালো/কালো রূপে জগৎ আলো… নির্ভুল বাণীতে সুরেতে মাখামাখি পঙ্ক্তিগুলো অবিশ্বাস্যভাবে বাজতে থাকে চেতনায়, একটুও ভুল হয় না। সরস্বতীরটা আর গান নয়, স্তব। শ্বেত পদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষ্পোপশোভিতা…এ তা হলে কোন দেবীর পুজোর মন্ত্র! অন্ধকার মনের গলিতে গলিতে খুঁজে বেড়াতে থাকে। ঝনঝন করে কে গেয়ে ওঠে— ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে, তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে ওগো মা!
চমকে জেগে উঠলেন কস্তুরী, স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষ যেন স্মৃতি ফিরে পেয়েছে। সুধাকাকা গাইছেন, দরাজ গলায়, ঘরের কড়িবরগা কাঁপিয়ে গাইছেন। বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/ তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!
তাই তো! সুধাকাকার গলা যেত সবার ওপরে। মা বলতেন, সুধা, তুমি যদি অত চড়ায় ধরো, কী করে গাইব?
স্নেহকাকিমা বলছেন, সব গান সবাইকে গাইতেই হবে তার কী মানে আছে কল্যাণী! ও একা গাক। আমরা মনে মনে গাইব। একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুইজনে/ গাহিবে একজন খুলিয়া গলা/ আর একজন গাবে মনে।
ওঁরা কথা বলতেন কবিতায়। অনর্গল, প্রত্যেকটি মানুষ। —বাংলা ছাড়া অন্য দেশের মানুষও আছে এখানে ভাবী— শরদকাকা বললেন— হ্যাভ সাম কনসিডারেশন ফর দেম!
মা অবাক চোখে চেয়ে আছেন— শরদভাই, বাংলাকে নিজভূমি মনে করেই এসেছিলেন না! বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ, সুভাষচন্দ্রের বাংলা।
শরদকাকা লজ্জিত —না, না, ওটা এমনি ঠাট্টা।
মা গাইতে আরম্ভ করলেন— পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ— কী শরদভাই, এটাও তো আছে। আর তা যদি বলেন, বাংলা সবাইকে বুকে টেনে নিয়েছে, কেউ বাংলার পর নয়। বাংলার কবি, বাংলার দার্শনিক, বাংলার বিপ্লবী ছিলেন সবার।
বাবা বলছেন— বাংলা ভারতবর্ষের সেই ভূমি সেখানে আর্য-অনার্য রক্ত মিশেছে সবচেয়ে বেশি। কে জানে বাংলায় ভারতের ভাগ্য গড়া হবে কিনা।
ছাতে একটা পুতুল কিংবা কাঠি নিয়ে ঘুরে বেড়াত কিকি আর তোতাপাখির মতো মুখস্থ বলে যেত যা যা শুনেছে সব। বাংলা ভারতবস্সের সেই ভূমি যেখানে আয্য, অনায্য রক্ত মিশেছে সবচেয়ে বেশি।
দপ করে মনে পড়ে গেল— কাজল মুণ্ডা। মৈত্রী বলছিল— আসলে বাঙালি তো সংকর জাতি দিদি। সাদা, কালো, ব্রাউন কীভাবে কখন মিশেছে কেউ বলতে পারে না। কাজল নিজেকে বলে আদি বাঙালি। …কখনও জিজ্ঞেস করিনি…ও বলতে চায় না… মিশনে যখন মানুষ হয়েছে তখন নিশ্চয়— অনাথ।
অনাথ! অরফ্যান! তাঁর অনেক কাজ কারবার আছে অনাথ নিয়ে। তারা কত রকমের আলাদা আলাদা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছে। কই, তাদের কাউকে তো এভাবে দাঁড়াতে, বসতে, কথা বলতে দ্যাখেননি। বেশি কথা বলে না ছেলেটা, কিন্তু গভীর চিন্তাশক্তির নির্ভুল ছাপ আছে ওর মুখে। আদিবাসীদের নিয়েই ওর রিসার্চ। শুধু একটা পিএইচ. ডি-র জন্য গবেষণা? না কৌতূহল? না ইতিহাসবোধ! নাকি এ ওর ব্যক্তিগত অন্বেষণ! নিজের শেকড় খুঁজছে। পরিষ্কার জানতে চায় সব।
তার মানে কাজল মুণ্ডা ঠিক তাঁর মতো। তিনিও তো তাঁর অতীত জানতে এত দূর এসেছেন। আটচল্লিশ বছর অভিমানে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন, তারপর আর পারলেন না, মনে হল নিজের উৎস না জানলে বৃথা জীবন। কোথাও কোনও রহস্য রেখে তিনি মরতে পারবেন না। বাবা পারলেন। কী করে যে রহস্যের ভার একা বইলেন, তিনিই জানেন, কিন্তু কস্তুরী তা পারবেন না।
চানটান করে পাও ভাজি আর চা খাচ্ছেন, ফোনটা এল।
—হ্যালো…
—দিদি আমি কাজল।
—হ্যাঁ বল।
—আজকের কাগজটা দেখেছেন? স্নেহলতা ঘোষ প্রাক্তন বিপ্লবী মারা গেছেন। বয়স হয়েছিল সাতাশি। দিদি আমি এক্ষুনি আসছি।
সঙ্গে সঙ্গে কাজল ফোন অফ করে দিল।
কস্তুরী স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।
৮) তিনি ও জেঠু
মৈত্রী যখন কাজলকে নিয়ে পৌঁছোল, কস্তুরী সেদিনের বাংলা কাগজ আর একটা পুরনো ডায়েরি হাতে করে বসেছিলেন। চুপচাপ। ওরা একবার সাবধানে চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। কাজল আবেগের সামনে অপ্রতিভ হয়ে থাকে। যদিও তার নিজের আবেগ যথেষ্ট এবং তা সে ভেতরে কোথাও লুকিয়ে রাখে। কিন্তু মৈত্রী সবকিছু সামলাতে পারে। সে এগিয়ে গিয়ে মাটিতে হাঁটু গেড়ে কস্তুরীর কোলে হাত রাখল।
দিদি যাবেন?
কোথায়?
স্নেহলতা ঘোষের বাড়ি, এঁড়েদ’! আমরা ঠিক নিয়ে যাব।
জানো মৈত্রী, একটা মাত্র বাংলা কাগজের ভেতরের পাতায় নীচের দিকে ছোট্ট করে খবরটা ছেপেছে। নো অবিচুয়ারি, নাথ্থিং । স্নেহলতা ঘোষ আরও কয়েকজনের মতো ছিলেন সুভাষপন্থী। উনি গাইতেন ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে— আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো।’ শুনেচ গানটা?
হ্যাঁ, শুনেছি দিদি।
—উনি অতি ওল্প বোয়েস থেকে সুভাষচন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবোক দোলে ছিলেন। আমার বাবার ধারণা ছিল উনি অতি গোপনে শোরৎচন্দ্র বসুর মারফত নেতাজির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ আসবে, তাদের অভ্যর্থনা জানাতে হবে বোলে উনি তোখনকার দিনে সাড়ে তিনশো মেয়ের একটি গুপ্তবাহিনী গোড়েছিলেন। কেউ জানত না। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ছাড়া। এমিলি শেঙ্কলের সঙ্গে বিয়ের খবরে যখন সারা বাংলা তোলপাড়, নেতাজিকে ধিক্কার দিচ্ছে, তখন উনি একা বিবৃতি দিয়েছিলেন— সুভাষচন্দ্র যদি কাউকে বিয়ে করে থাকেন, সে মহিলা নিশ্চিত তাঁর উপযুক্ত, তাঁর কর্মসঙ্গী। যদি উনি ব্রহ্মচারী থাকবেন বলে কখনও স্থির করে থাকেন সে তাঁর ইচ্চা। পোরে যদি তা ভেঙে থাকেন সেও তাঁর ইচ্চা। তার পেছনে সঙ্গত কারণ থাকবেই। আর বিবাহ বা অবিবাহ কিছুতেই তাঁর মহিমা যাবে না।
দুজনে চুপ করে আছে দেখে উনি বললেন, চিনো না, না! শোরৎচন্দ্র বসু— চিনো না।
—চিনি দিদি, সুভাষচন্দ্রের দাদা।
—মেজোদাদা। বাট হি ওয়জ আ গ্রেট স্টেটসম্যান ইন হিজ ওন রাইট। ওঁর সোম্পর্কে কিচু জানো না তো স্নেহলতা ঘোষকে কী বুঝবে? নেতাজিকে কী বুঝবে? ডু ইউ নো হাউ বেঙ্গল, অ্যান্ড হিজ ওন পার্টি রি-অ্যাক্টেড অ্যাট দা নিউজ অব হিজ ম্যারেজ!
—জানতাম না দিদি, এইমাত্র জানলাম, আপনি বললেন না তোলপাড়, ধিক্কার।
কাজল চুপ করে ওঁর উত্তেজনা দেখছিল। উনি এসেছেন ওঁর মা-ল্যান্ডে। ওঁর কথা অনুযায়ী। কিছু খুঁজছেন, অতীতের কিছু সূত্র। উনি অতীতকে জানতে চান। এই মানুষটি, প্রাক্তন বিপ্লবী স্নেহলতা ঘোষ ওঁর একটা সূত্র ছিলেন। খুব গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ ওঁর এই খোঁজ। তার থেকেও! হ্যাঁ, বোধহয় তার থেকেও। কেননা সে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে একটা ধারাবাহিক ইতিহাসের খোঁজ করছে। সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক তা বলা যায় না। কিন্তু এই প্যাশন তার নেই। নেই। সে ফিল্ডে যায় না এভাবে। এখনও যায়নি। সে প্রভূত রেফারেন্স বই নিয়ে কম্পিউটারে কাজ করে। ইন্টারনেট লাইব্রেরি …। কিন্তু কস্তুরীবেনের তাগিদ এতটাই যে উনি সোজা ফিল্ডে চলে এসেছেন। নিজের পুরনো ডায়েরি থেকে ঠিকানা বার করছেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে উনি অনেককে খুঁজেপেতে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। ওঁর রেফারেন্স হলেন জ্যান্ত মানুষেরা। কস্তুরী মেহতা ওঁর অতীতকে এত ভালবাসেন! কী নিদারুণ ভালবাসা! ছুটবেলাই সোব বেলা। কী জানি ম্যাডাম, কত সুন্দর, সুখের ছিল সে ছোটবেলা যে আপনি একজন সফল ব্যাবসাদার, প্রখ্যাত সমাজসেবিকা এভাবে এই বয়সে ছুটে আসতে পেরেছেন!
সে? সে তার অতীতের প্রতি বিতৃষ্ণা অনুভব করে। অজেয় বিতৃষ্ণা। কিন্তু সে একজন গবেষক, এই জনজাতিদের অতীত পরিচয় এবং তার ধারাবাহিকতা তাকে বার করতেই হবে, না হলে যেন সে, কাজল মুণ্ডা মিথ্যে হয়ে যায়। ওঁর যদি প্যাশন হয়, তা হলে তারটা হল মিশন।
মহেঞ্জোদড়ো হরপ্পা থেকে সে এই জনজাতিদের খুঁজতে খুঁজতে এসেছে। হিন্দিতে বলে— হড়প্পা। হড় মানে মানুষ, আদিবাসীরা সবাই হড়। শুধু বিরহড়রা নয়। তপা মানে সমাধি, হড়প্পা তা হলে মানুষের সমাধি। কোন বিস্মৃত অতীতে, বন্যা, ভূমিকম্প, কি অন্য দুর্যোগে একটা সভ্যতা মৃতের সমাধিতে পরিণত হয়েছিল। ‘মহে’র সঙ্গে ‘য়েন’ দিলে ‘মহেন’ হয়, যার মানে প্রস্ফুটিত। ‘জ’ মানে ফল, মুণ্ডারিতে দারে বা দারু হল বৃক্ষ। এ শব্দ মুণ্ডারি থেকেই তাহলে সংস্কৃতে ঢুকেছে!
মহেঞ্জোদড়ো মানে তা হলে দাঁড়াচ্ছে— প্রস্ফুটিত ফল, বৃক্ষ। দুটি সিল দেখে তাদের পূজা-অর্চনা, সাজপোশাকের কথা এবং সাত পূজারীর কথা যা পণ্ডিতরা অনুমান করেছেন, তা সাঁওতাল সংস্কৃতির সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়।
কস্তুরী বললেন, না। গিয়ে একটি হোতাশ বিফোল বৃদ্ধ মৃত মুখ দেখে আমারও কুনও লাভ না, ওঁরও না। তুমরা ভেবো না। শান্ত হও। শান্তি করে বস। যোদি ইচ্চা হয় আমরা তিনজনে প্রে করতে পারি। উনি যেন ওঁর চাওয়ার জিনিস একদিন পান। যেন কোনওদিন সোৎ, শ্রেণীহীন, সুশাসিত ভারতবোর্ষ দেখতে পান। এ তো আমাদেরও চাহত, কী না?
হ্যাঁ দিদি, আমি প্রে করব, নিশ্চয়ই।
কাজল কোনও পরজন্মে বিশ্বাস করে না। কিন্তু সে গোঁড়া নয়, চুপ করে বসে থাকলেই তো হয়। এ জন্ম যাঁর শেষ হয়ে গেল তাঁর দেহাবশেষ পুড়ে যাবে, সামান্য কিছু অস্থি আর নাভি যাবে নদীগর্ভে। সেখানকার মাখনের মতো মাটির সঙ্গে ক্রমশ মিশতে থাকবে জলতলের অজানা রসায়নে। আর দেহের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণবায়ু মিশে যাবে বাতাসের আবহমান দীর্ঘশ্বাসে। কেননা সে তো পৃথিবীরই বাতাস। মহাকাশের নির্লিপ্ততার সঙ্গে তার কোনও যোগ নেই। পৃথিবীর মানুষের প্রাণবায়ু নিয়ে সে যেমন ঋদ্ধ হয়, তেমনই বিষণ্ণও হয়। তবে হ্যাঁ, সৎ, শ্ৰেণীবৈষম্যহীন, সমৃদ্ধ, সুশাসিত, সুশিক্ষিত এক ভারতের স্বপ্ন সে দ্যাখে। তার জন্য প্রার্থনা করাই যায়। সে দেখতে পাবে না, ভোগ করতে পারবে না, কিন্তু ভবিষ্যতের মানুষ পারবে। কোনও সুদূর অপরিচিত ভবিষ্যৎ যেখানে সবই সম্ভব হতে পারে।
মিনিট দশেক নীরব প্রার্থনার পর কস্তুরীবেন উঠে পড়লেন— রামলাখন, রামলাখন!
—হাঁ মাজি, রামলাখন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। ছুটতে পারে না— একটু নোদল-গোদল করতে করতে আসে। উনি তাকে পাঁচশো টাকা গুনে গুনে দ্যান।
—গোলপার্ক সে ফুল লাও! মালা গুলাব, রজনীগন্ধা, অউর সোব।
মৈত্রী লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল— আমি যাচ্ছি দিদি, ও পারবে না।
তাহলে সোকালে খাওয়া এনো। রাধাবল্লভি আলুদম। অমৃতি, গোজা।
মৈত্রী হাসি-হাসি মুখ করে চলে গেল।
কস্তুরী উঠে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকটি ফটো খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। বাইরে এলেন। বাঁ দিকে সিঁড়ি বরাবর সমান ব্যবধানে হুক আছে। আপন মনেই বললেন— এইখানে যতীন সেনগুপ্তো ছিলেন, এইখানে যতীন দাস, বৈকুণ্ঠ শুকুলের রেয়ার ছবি বাবা-মা রেখেছিলেন। ক্যাপ্টেন সায়গল, ধীলন, ঝাঁসি রানি, লক্সমি স্বামীনাথন। এখন মিসেস সায়গল হয়েছেন। কী স্টুডেন্ট হাঙ্গামা হল সিক্সটিজে-সেভেনটিজে, ভেতরে ঢুকে পড়ে কিছু মানুষ সব ভেঙে দিলে, ওরা ভাল নয়, তারা ভাল। বিদ্যাসাগর বাজে, রাসবিহারী বসু বাজে, শ্যামাপ্রসাদ বাজে, আশুতোষ বাজে— তারা, তারা শুধু কাজের।
—ট্র্যাম পুড়াবে না তুমরা?
কাজল হেসে ফেলল। —দিদি আমাকে কি হুলিগান-টাইপ মনে হচ্ছে?
—হুলিগান দোরকার নাই। ক্রাউডে সোব হুলিগান হোয়। য়ু হ্যাভ আ পাওয়ারফুল বডি।
—তো তাই আমি ট্র্যাম-বাস ভাঙব? কাজল ঈষৎ হেসে বলল, আমি তাহলে চললাম।
—এই এই তুমি ঠাট্টা বুঝো না! বোসো, একানে চুপ করে বোসো, যোতখন না ফুল, খাবার সোব আসে।
ঘণ্টাদেড়েক পরে মিঠু ও রামলাখন রাশি রাশি ফুল আর মালা নিয়ে এল। চারজনে মিলে সব ছবিতে মালা পরানো হল। যাঁদের মালা কুলোল না, কস্তুরী বড় বড় প্রাচীন ফুলদানি বার করে ফুল সাজিয়ে তাঁদের ফটোর তলায় রাখলেন। বিবর্ণ পেতলের ফুলদানে জ্বলতে থাকল লাল গোলাপ, হলুদ সূর্যমুখী, সাদা রজনীগন্ধা। মুহূর্তে ঘর ফুলের গন্ধে ভরে গেল। কস্তুরী বললেন, ফুলের মতুন জিনিস নাই। এসো এবার পেটপুজো কোরা চাই। … ও কী! তুমরা ওতো হাসচো কেন!
মিঠু কিছুতেই তার হাসি থামাতে পারে না।
কস্তুরী আস্তে আস্তে বললেন— হ্যাভ য়ু নোন ডেথ?
মিঠু মাথা নাড়ল। তার মুখ থেকে সব হাসি হারিয়ে গেছে।
কে?
আমার দাদু … আমার মা!
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে কাজলকে বললেন, তুমি, বীরপুরুষ?
খানিক ভেবে কাজল বলল, ফাদার মরিসন, মেদিনীপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন চার্চের। স্কুলটার উনি রেকটর ছিলেন।
—ডেথ যদি খুব বোয়েসে আসে যেমন স্নেহলতা ঘোষ, যেমন আমার বাবা, যেমন আই গেস, তুমার ফাদার মরিসন— ইয়াং ম্যান— তেমন ডেথ ইজ রিলিজ অ্যান্ড ইউনিয়ন উইথ ইনফিনিটি। কিন্তু যোখন ইয়াং পিপল ডাই! মৈত্রী! মা কী ওসুখ করেছিল?
—দিদি আমি এ প্রসঙ্গ চাই না, প্লিজ।
তাদের অপরিচিত স্নেহলতা ঘোষের মৃত্যুতে যে বিষাদ আসব আসব করেও হঠাৎ অসময়ের মেঘের মতো হারিয়ে গিয়েছিল, সে ফিরে এল হাসিখুশি, ছটফটে মিঠুর চোখেমুখে। সেখান থেকে আবহাওয়ায়। এবং কস্তুরীর গাম্ভীর্যে, কাজলের নিশ্চলতায়।
একটা কচুরি ছিঁড়েছিল মিঠু, একটু নাড়াচাড়া করে হঠাৎ বলল, দিদি, আমি আজ চলি।
—মৈত্রী, মৈত্রী প্লিজ বসো। স্যরি, আ’য়্যাম স্যরি মাই ডিয়ার।
—না না, স্যরি কেন … এমনি … মানে আমার কাজ … মিঠু মুহূর্তে লম্বা লম্বা পায়ে চৌকাঠ পেরিয়ে সিঁড়িতে নেমে গেল। কোনও শব্দ হল না। যেন সে চলে যাওয়ার কোনও চিহ্ন রাখতে চায় না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কস্তুরী খুব অভিমানী স্বরে বললেন— কাজল, তুমিও কি খাবে না?
কাজল একঝলক হেসে বলল—এই তো খাচ্ছি। সে কচুরিতে আলুর দম মুড়ে মুখে পুরল— আপনি খান!
—এই যে খাই।
নিঃশব্দে দু’জনে খাচ্ছেন। চারদিক থেকে ফুলের গন্ধ ডুবিয়ে দিয়েছে আর যা যা গন্ধ আছে, হাওয়া আছে সব।
কস্তুরী ছোট্ট গলায় বললেন, মৈত্রীর মা কতদিন চলে গেছেন? ওঁর কী হয়েচিল কাজল!
কাজল একটা অমৃতিতে কামড় বসিয়েছিল। রসটা সামলে নিয়ে বলল, আই হ্যাভ নো আইডিয়া!
—হোয়ট?
—আমি জানি না দিদি। সত্যি, কখনও জিজ্ঞেস করিনি।
—স্ট্রেঞ্জ! তুমরা খুব বন্ধু না?
—হ্যাঁ, নিশ্চয়ই!
—তোবে?
তবেটা কাজল কী করে বোঝাবে? তার নিজের কোনও পরিবার নেই। সে মনে করতে পারে না তার বাবার মুখ। তার ছ’ বছরে ছেড়ে-আসা মায়ের মুখ। ফ্যামিলি আপনজনহীন একটা সম্পূর্ণ একলা অস্তিত্ব সে। তার এসব সম্পর্কে কোনও কৌতূহল নেই। জিজ্ঞেস করার কথা মনেই হয়নি।
দেখেছে মিঠুর বাড়িতে ওর পাঞ্জাবি-পাজামা পরা গম্ভীর বাবা আরামকেদারায় শুয়ে শুয়ে ভগবদগীতা আর রাসেলের অটোবায়োগ্রাফি পড়ছেন। বাড়িতে আর কেউ নেই। মিঠু বলল—কী রে চা না কফি?
যেটা তোর সুবিধে!
কফিটাই করি তা হলে?
সুতরাং মিঠুর মা দৃশ্যমান নয়। নামাল খাটতে গিয়ে ফেরেননি? না কী? মিঠুর টেবিলে সিরিয়াস মুখ এক মহিলার ফোটো। কত বয়স হবে? চল্লিশের কোঠায় হবেন? চশমার কাচের আড়ালে ঝিলিক দিচ্ছে চোখ। ঠোঁটে হাসি নেই, কিন্তু চোখ হাসছে। প্রথম দর্শনেই যা নজর কাড়ে তা হল আলো। পরিপূর্ণ শিক্ষা মানুষের চেহারায় একটা অন্যতর আলো দেয়, সেটা কাজল যত তাড়াতাড়ি পড়তে পারে, আর কেউ পারবে কিনা সন্দেহ। মিতু চা-কফি করতে গেলে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফোটোটা দেখত। অস্পষ্ট একটা টান। নাঃ, তার চরিত্রে সেন্টিমেন্ট নেই। সে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে পৃথিবীর যাবতীয় রক্ত-সম্পর্কের দিক থেকে। তার ভয় করতে লাগল— এবার কি কস্তুরীবেন তার মা-বাবার কথা জানতে চাইবেন? তখন তো তাকেও বলতেই হবে— এ প্রসঙ্গ থাক দিদি, প্লিজ। মিঠু রূঢ়ভাবে বলেনি, কিন্তু তার গলায় নির্ঘাত রূঢ়তা এসে যাবে।
ফাদার মরিসন তাকে মাঝেমাঝেই জিজ্ঞেস করতেন— সে তার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে চায় কিনা। সে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলেছে, আমার কেউ নেই, ফাদার।
—আর ইউ শিয়োর?
—হ্যাঁ।
না, কস্তুরী কিচ্ছু জিজ্ঞেস করলেন না। হঠাৎ তাঁর মনে হল তাঁকে যদি কেউ এই ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ করে তিনি কী বলবেন? তাঁকেও হয়তো বলতে হবে— এ প্রসঙ্গ তিনি চান না। এভাবে বলবেন না, শুধু নিপুণভাবে প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দেবেন। এদের থেকে বয়স বলো, অভিজ্ঞতা বলো সবই তো তাঁর অনেক অনেক বেশি!
তিনি কাজলের অন্যমনস্ক ভাব লক্ষ করেছিলেন। গ্র্যানাইট না কষ্টিপাথরের ছেলেটি এখন তার ভাস্কর্য-অস্তিত্বে ফিরে গেছে। ও কি দেখেছে ইলোরার কৈলাস মন্দির? ও জানে না ও অন্য কোনও জায়গা নয়, ওই কৈলাস মন্দির টন্দির থেকেই বেরিয়ে এসেছে। সর্বত্র যোদ্ধা দ্বারপাল প্রভৃতির মূর্তিতে এই আদল। হঠাৎ ঈষৎ কৌতুকের সঙ্গে তাঁর মনে হল তিনি যদি যুবতী হতেন নির্ঘাত এর প্রেমে পড়তেন। সেক্ষেত্রে মেহতা আর মুণ্ডা, আমদাবাদ, আর সাঁওতাল পরগনায় কী উত্তাল অশান্তিই না হত! আচ্ছা, ওই চমৎকার বুদ্ধিমতী মেয়েটি, মৈত্রী, যে নাকি তার মায়ের মৃত্যুকে এখনও মেনে নিতে না পারার মতো সহৃদয় আছে, ওই মেয়েটির সঙ্গে কাজলের সম্পর্ক কী? শুধু কি বন্ধুত্ব? না প্রেম? আজকালকার ছেলেমেয়েদের বোঝা যায় না। তাঁর অল্প বয়সে ডাণ্ডিয়া নাচের সময়ে কত ছোটখাটো রোম্যান্স হত, এখন ছেলেমেয়েগুলো যেন ডাণ্ডিয়ার লাঠিটার মতোই শুষ্কং কাষ্ঠং হয়ে গেছে। যদি বা কিছু বোঝে তো সে আদৌ রোম্যান্স নয়, মন নয়।
কাজল বলল, আপনার লিস্টে আর কে কে আছেন, যদি জানতে পারি অঞ্চল হিসেবে একটা প্ল্যান ছকে ফেলতে পারি দিদি। আপনি অত সহজে পারবেন না। আমাকে বলেই দেখুন না। আমি জাস্ট আপনাকে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে চলে আসব। আপনার প্রাইভেসি আপনার থাকবে। ইউ নিড নট ওয়ারি অ্যাবাউট দ্যাট।
কিছু বললেন না উনি। গোজায় প্রচণ্ডভাবে মনোনিবেশ করলেন। ছেলেটার চোখ আছে।
আপনার নোটবুকটা বার করুন। আমাকে বলুন, দেখি একটা শর্ট লিস্ট করতে পারি কিনা।
কাজল অপেক্ষা করছে, দৃঢ় সংকল্প নিয়ে, মেহতা ম্যাডামকে সে হেল্প করবেই। কারণ ও স্পষ্ট বুঝতে পারছে, উনি অন্ধকারে হাতড়াচ্ছেন।
ধীরেসুস্থে খাওয়া শেষ করে পড়ার চশমাটা চোখে লাগালেন কস্তুরী, নোটবইটা বার করলেন। যেন তিনি কাজলের প্রবল ইচ্ছাশক্তি দ্বারা চালিত হচ্ছেন এই মুহূর্তে।
১। রবিপ্রসাদ বৰ্মন— ৪৫, শিকদারবাগান লেন, কলকাতা-৪।
২। রমা সরকার— ৩০/১/এ, গরচা ফার্স্ট লেন।
৩। যতীন মণ্ডল— ৫, শিমলা স্ট্রিট।
৪। স্বরূপচাঁদ রোহাদগি— ৩৩, নাগের বাজার, দমদম।
৫। সিরাজ আলি— ২৫এ, সার্কাস রো।
৬। তৃপ্তিকণা মজুমদার— বেহালা? একটা প্রশ্নচিহ্ন। নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই।
লিস্টটা পড়ে কীরকম বোকার মতো কস্তুরী চোখ তুললেন। যেন উদ্ভ্রান্ত।
দিদি, কতকগুলো নর্থ ক্যালকাটা, বেশ দূর। আপনি যদি এই সার্কাস রো আর গরচা আগে যান। অবশ্য আপনার প্রেফারেন্সটা কী বলবেন।
কাজল, আমি শিকদারবাগানে রবিজ্যাঠা মানে রবিপ্রসাদ বর্মনের বাড়ি যেতে চাই। আগে।
ঠিক আছে। আমরা তো এখনই যেতে পারি।
৯) ওরা, তিনি, জেঠু
মিঠু খুব ভারী পা ফেলে চলছিল। চারদিকে বাস-ট্যাক্সির আওয়াজ হঠাৎ যেন প্রবল বেড়ে গেছে। চারদিকে চলেছে অপরিচিত এমনকী বৈরী জনস্রোত। যে-কোনও মুহূর্তে এরা সব ভাঙবে চুরবে, গাড়িগুলো তাকে চাপা দেবার জন্যেই আসছে। সে একটা দোকানে ঢুকে বসে পড়ল। ঘামছে। মাথা ঘুরছে। একটা অন্ধ কষ্ট শরীর ছেয়ে ফেলছে ক্রমশ। কেন এরকম হল, হঠাৎ? সে কি প্রতিদিন একটু একটু করে ভুলছে না সেই কষ্ট, অসহ্য যন্ত্রণা দ্যাখার, কিছু করতে না পারবার সেই কষ্ট! একজন সদাব্যস্ত পুরো কর্মশক্তি ও স্বাস্থ্যসম্পন্ন মানুষকে হঠাৎ অমন ভেঙে যেতে দ্যাখার নিদারুণ কষ্ট! ভুলছে তো! সময়ের নিজস্ব নিয়মেই ভুলছে! কষ্ট চলে যাবে, স্মৃতি থাকবে। স্মৃতি পবিত্র, স্মৃতির মধ্যে এই দহনকারী শোক নেই। থাকবে না। বাবার মধ্যে স্মৃতির সঙ্গে সঙ্গে একটা শূন্যতাবোধ আছে— সে বোঝে। কিন্তু এ-ও বোঝে ওই শূন্যতার সঙ্গে মোকাবিলা বাবাকেই করতে হবে। সে সাহায্য করতে পারবে না। বাবার স্ত্রী আর তার মা তো এক ব্যক্তি হয়েও এক নয়! দু’জনের অভিজ্ঞতাও আলাদা, মোকাবিলা করার রীতিও আলাদা। সে কষ্ট দেখা যায় না, তবু সে সেঁটে থাকত। এক মুহূর্তও মাকে ছেড়ে নড়ত না, চাইত মার কষ্ট ভাগ করে নিতে। সেই ভগবানকে অনন্যমনে ডাকত, যাঁর অস্তিত্বে তার বিশ্বাস পোক্ত নয়। বাবাও ডাকতেন, বাবা বিশ্বাসও করতেন, কিন্তু বাবা দেখতে পারতেন না, পালিয়ে যেতেন। ওহ্, দিদি আমাকে কেন ওই ভয়ংকর প্রশ্নটা করলেন?
—মৈত্রী, মৈত্রী, কী হয়েছে? এত ঘামছ কেন? শরীর খারাপ করছে?
ক্যাসেটের দোকানটা, এখন গাঢ় সকাল, খরিদ্দার কম। শিখরিণী। সি.ডি. কিনছে। শিখরিণী উঠে এসেছে।
নিজের ব্যাগ থেকে ঠান্ডা ঠান্ডা টিস্যু বার করে তার কপালে চেপে ধরতে লাগল শিখরিণী। —আপনাদের কাছে একটু ঠান্ডা জল হবে? একজন কাছাকাছি দোকান থেকে ঠান্ডা পানীয় কিনে আনল। খানিক মুখেচোখে দিয়ে, বাকিটা আস্তে আস্তে খাওয়াচ্ছে তাকে শিখরিণী।
মিঠু এবার হাসে, জোর করে হাসা, তবু তো হাসি। ভাল জিনিসের ভানও ভাল। আর হাসির মতো তাপহর আর কী আছে?
—কী করলি দ্যাখ তো! কপাল-টপাল সব চটচট করছে।
—করুক, একটু তো ঠান্ডা হলে! যা গরম! এখন একটু ভাল বোধ করছ!
—হ্যাঁ, ঠিক আছি। শিখরিণী, আমাকে এক্ষুনি এক জায়গায় যেতে হবে। খুব অভদ্রতা করে চলে এসেছি।
—এক্ষুনি যাবার দরকার কী! পরে গিয়ে ক্ষমা-টমা যা চাওয়ার চেয়ো।
—না, না, আমার ডিউটি আছে।
—ঠিক আছে। মিঠু, ভাগ্যক্রমে আজ আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। চলো তোমায় পৌঁছে দিই।
তিনের একের সামনে এসে মিঠু বলল, শিখরিণী, এখানে একজন অন্যরকম মানুষ আছেন, তুমি যখন এতটাই এসেছ, চলো না আলাপ করিয়ে দিই।
—আলাপটা তত জরুরি নয় মিঠু। তোমার সঙ্গে যাওয়াটা জরুরি, এখনও তুমি ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছ।
—এসো তবে, এসো না!
কস্তুরী দরজার দিকে মুখ করে বসে ছিলেন। তাঁর পায়ের কাছে কাজল। শালপাতাগুলো সব জড়ো করছে। দেখলেন মিঠু উঠে আসছে, তার সঙ্গে— বাপ রে এ যে স্বয়ং দেবী অম্বিকা। তাঁকে কি বর দান করতে আসছেন? মা ভৈঃ, পারবে, পাবে! এই জাতীয় কোনও বর?
বিস্ময়ে তিনি প্রায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। মিঠু এসে মেঝেতে বসে পড়ল। মেয়েটিকে দেখে কাজল বলে উঠল, শিখরিণী! তুমি এখানে?
শিখরিণী কড়া চোখে কাজলের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি না মৈত্রীর বন্ধু! ওকে এমন অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছ, ও যদি গাড়ির ধাক্কা খেত, যদি অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে যেত … যদি …
কস্তুরী বললেন— সেকী! মৈত্রী!
হঠাৎ শরীরটা কেমন করে উঠল দিদি, প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।
মাইন্ড করব কী! আমি কি পাগল? এসো তো!
তিনি ওর মাথায় হাত দিলেন। —এঃ চটচট করছে যে!
হেসে মিঠু বলল, এই যে আমার বন্ধু শিখরিণী, ও ঠান্ডা জল না পেয়ে, কোল্ড ড্রিঙ্কস ঢেলেছে আমার মাথায়।
—দাঁড়াও। তখনই কলঘর থেকে জল নিয়ে এসে তোয়ালে দিয়ে তার মাথা, কপাল, ঘাড় সব মুছে দিলেন কস্তুরী। মিঠু চেষ্টা করেছিল ওঁকে নিরস্ত করতে। পারেনি।
নিজের কোলের ওপর ওর মাথাটা রেখে হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন কস্তুরী। প্রতিরোধহীন, মিঠু বসে থাকল ওইভাবে!
খুব খানিকটা আদর খেয়ে নিলি, হ্যাঁ! —কাজল মুচকি হেসে বলল।
শিখরিণী বলল, হ্যাঁ। তোমার যখন দরকার হবে, তখন তোমাকেও দেখব। কত আদর-যত্ন লাগে।
আমার প্রয়োজন খুব অল্প— কাজল অনমনীয়।
আচ্ছা, আচ্ছা হয়েছে। তুমি বীরপুরুষ, মৈত্রী একটু ভাল বোধ করছ?
মাথা হেলিয়ে জবার দিল মিঠু। তার মাথা এখনও কস্তুরীর কোলের ওপর। খুব নরম গদির মতো কোলটা। শাড়ি থেকে খুব শুভ্র একটা আভা আর সুগন্ধ তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করছে। মিঠু চোখ বুজল।
—কাজল তুমি এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও। কস্তুরী বললেন—
ও শিখরিণী, মিঠুর বন্ধু। খুব, মানে প্রাণের বন্ধু।
সে তো শুনলুম।, আর …
শিখরিণী বলল, আমি আর মৈত্রী এক ইউনিভার্সিটিতে পড়তুম দিদি। ও তুলনামূলক সাহিত্য মানে কমপ্যারেটিভ লিটারেচার, আমি বাংলা। সেই থেকে ভাব। ওর সঙ্গে আসলে আমার মতামতের মিল আছে। এখানে তো আমি মামার বাড়ি থাকি এখন। কলেজে পার্ট-টাইম পড়াই।
—কোন কলেজ?
—মুরলীধর।
—মুরুলিধর? তবে তো তুমি আমার বন্ধু।
—আমি এমনিই আপনার বন্ধু হতে পারি, মুরলীধরের সঙ্গে সম্পর্ক কী?
—আমি যে ছুটবেলায় মুরুলিধর স্কুলে পড়েচি।
কাজল বলল, উনি কস্তুরীবেন। কস্তুরী মেহতা। গুজরাতে থাকেন। সমাজসেবিকা। এখানেও সমাজসেবা করবার জন্য এসেছেন, দেখছ না মিঠুরূপ সমাজকে উনি কীরকম সেবা করছেন!
এবার মিঠু মাথা তুলে একটা মুঠো তুলে কাজলকে দ্যাখাল। তারপর সোজা হয়ে বসল।
ফিলিং ওয়েল?
শিখরিণী বলল, এরকম রুড বন্ধু হলে ভাল না হয়ে উপায় কী?
কস্তুরী এবার উঠে টেবিলের ওপর থেকে চ্যাঙারি-ভরতি কচুরি, ভাঁড়ে আলুর দম নিয়ে এলেন।
—স্যরি শিখরিণী, তুমাদের এই চ্যাংড়াতেই খেতে হবে।
—তাতে কী হয়েছে?
শিখরিণী তক্ষুনি উঠে শালপাতা আলাদা করে সাজাতে লাগল খাবারগুলো।
—না না। আমরা— আমি আর কাজল খেয়েচি। তুমাদের দু’জন বাকি আচে।
কাজল বলল, আমরা কি আজকে যাচ্ছি, দিদি?
—শিয়োর, আমার না গেলে চলবে না। মৈত্রীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আমরা যাব।
—না, না, আমি যাব দিদি। আমি কখনও স্বাধীনতা-সংগ্রামী দেখিনি।
—ওর্কম ততো নন ইনি, তবে হ্যাঁ জেল খেটেচেন, কুইট ইন্ডিয়া করেচেন।
—আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? —শিখরিণী জিজ্ঞেস করল।
কাজল বলল, শিকদারবাগান, রবিপ্রসাদ বর্মনের বাড়ি!
—শিকদারবাগান? আমিই তো আপনাদের পৌঁছে দিতে পারি। আমার মামার বাড়ি হাতিবাগান গ্রে-স্ট্রিট। ওদিকেই তো যাচ্ছি। কস্তুরীদি, আপনার যদি অসুবিধে না থাকে আমিও স্বাধীনতা-সংগ্রামী দেখে আসতে পারি।
কাজল বলল— আমরা তো রেন্টাল গাড়ির ব্যবস্থা করছিলাম দিদি।
—আমার গাড়িতে যেতে কোনও আপত্তি আছে? আমরা বরং গাড়িতে যাই। তুমি পেছন পেছন মেট্রোয় এসো, এখান থেকে অটোয় কালীঘাট যাবে। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ে নামবে, তারপর … কলুটোলা পার হয়ে, কলেজ স্ট্রিট থেকে ট্রাম নেবে। চমৎকার পৌঁছে যাবে।
কস্তুরী হাসতে লাগলেন— যেকর্ম একটা জার্নি বললে শিখরিণী, তাতে ও বেচারার আর এবার ফ্রিডম ফাইটার দেখা হল না।
—আমি গাড়িটা পুরো এবেলার জন্য পেয়েছি দিদি। কোনও ভাবনা নেই। আসলে আমি কলেজ আসি তো, পার্ট-টাইম; এগারোটায় আজ আমার ক্লাস শেষ।
সামনে কাজল, পেছনে তিনজন— পুরনো অ্যামবাসাডর, ভালই ধরে গেল।
—তুমার পার্ট-টাইম কেন শিখরিণী! সময় পাচ্ছে না?
—আরে আর বলবেন না। এখন তো কলেজের চাকরির জন্য নেট স্লেট পরীক্ষা চালু করেছে কলেজ সার্ভিস কমিশন, স্কুলের চাকরির জন্য আছে স্কুল সার্ভিস কমিশন। কখনও পাশ করবেন, কখনও করবেন না। কেন, এসব প্রশ্নের কোনও জবাব নেই। তার ওপরে আবার সব জায়গায় এস.সি-এস.টি সংরক্ষণ। হাজারে হাজারে পোস্ট খালি পড়ে রয়েছে। এস.সি-এস.টি পাওয়া যাচ্ছে না। পোস্টগুলোকে ফাঁকা কর! তা নয়, পড়েই রয়েছে। ভাল না! সরকারকে মাইনে দিতে হচ্ছে না। স্যরি কাজল, হঠাৎ থেমে গেল শিখরিণী, সে মিঠুর কাছ থেকে একটা চিমটি খেয়েছে।
আমাকেই শুধু দুঃখিত হতে হবে কেন— তোমরা দুঃখিত নয়, যে স্বাধীনতার ছাপ্পান্ন বছর পরেও উপযুক্ত এস.সি, এস.টি পাওয়া যায় না! কাজলের গলায় ঝাঁঝ নেই, খুব নির্লিপ্ত প্রশ্ন।
একটু পরে সে বলল, সংরক্ষণের একটা নীতি থাকা উচিত। স্পষ্ট নীতি। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং এসব পড়ার ক্ষেত্রে। সংরক্ষণ খুব বিপজ্জনক, গ্রেস দিয়ে তো ডাক্তারি পাস করানো যায় না। কিন্তু সকলের জন্য যে মিনিমাম শিক্ষা এখনও চালু হল না তার কী কৈফিয়ত?
শিখরিণী বলল, অফিসের নিচুতলার চাকরিতে সংরক্ষণ থাক। কিন্তু স্কুল-কলেজে পড়াতে হলে উপযুক্ত প্রতিযোগিতা করে আসাই উচিত, তুমি যাই বলো কাজল।
—তার পরেও আমার প্রশ্নটা একই থাকে— স্বাধীনতার এত বছর পরেও সকলের জন্য মিনিমাম শিক্ষা কেন চালু হল না!
কস্তুরী বললেন— মিনিমাম শিক্ষা বলতে তুমরা কী বুঝো জানি না। আমি মনে করি— কারু জন্যেই মিনিমাম শিক্ষা চালু হোয়নি। কী শিখে? ডিসিপ্লিন? নিজেরটা নিজে করে নেওয়া! অন্যকে সাহায্য করা! হিউম্যান ভ্যালুজ কিছু শিখছে, কেউ? যে শিখে সে আপনি শিখে। কাউকে শিখানো হয় না, ব্যবস্থা নাই। সহবত নাই, কনসিডারেশন নাই, রেসপেক্ট নাই, সংযম নাই, খালি লোভ, খালি জিনিস, জিনিসের পিছন ছুটতে শিখাচ্ছে। আর হোতাশায়, ডেসপ্যারেশন, ডাকাত চোর আত্মহত্যা।
রবিপ্রসাদ বর্মনের বাড়ির সামনে এসে শিখরিণী বলল, এ বাড়ি আমি চিনি। বর্মন বাড়ির একটি মেয়ের সঙ্গে আমার ছোটবেলায় খুব আলাপ ছিল। ওরই কি দাদু? রবিপ্রসাদ বৰ্মন? নামটা তো আমি শুনিনি। তবে একজন বুড়ো মানুষ এখানে থাকেন আমি জানি। অঙ্গনাদের দাদু, কি কী, আমি জানি না।
বাড়িটার সামনে এসে কাজল বলল, দিদি আপনি যান। আমরা ঘণ্টা খানেক পরে এসে ফ্রিডম-ফাইটার দেখব।
—না না তুমরা এসো না!
ওরা কিছুতেই এল না।
কস্তুরী সত্যি বলতে কি স্বস্তিই পেলেন। ছেলেমেয়েগুলির বিবেচনার প্রশংসা করলেন মনে মনে। এখন তিনি একা এবং অদূরে তাঁর অতীত। মোকাবিলা করতে যাচ্ছেন। মাঝখানে সময়ের সমুদ্র। তিনি জানেন না সেই সমুদ্রে ভাসতে জাহাজ লাগবে না নৌকো কি ভেলাই যথেষ্ট।
বাড়িটা বেশ পুরনো হলেও শক্তপোক্ত। লাল ইটের বাড়ি। মার্কামারা ব্রিটিশ সময়ের গাঁথিনি। সবুজ জানলা। সবুজ দরজা। একটা ছোট প্যাসেজ দিয়ে উঠোনে পড়লেন কস্তুরী। বড় বড় দরজা খোলাই ছিল।
উলটো দিকের ঘর থেকে এক বৃদ্ধ মানুষ বেরিয়ে এলেন। সাদা ফতুয়া, ধুতি, ভুরুগুলো পাকা। চোখের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। একহারা মানুষটি, বেশ মজবুত।
গলাটা একটু তুলে কস্তুরী বললেন, এখানে কি রবিপ্রসাদ বর্মন থাকছেন?
ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, আমিই। আপনাকে তো ঠিক…
আমি কস্তুরী মেহতা, কিকি, জ্যাঠামশায়। —উনি নিচু হয়ে প্রণাম করলেন। এত সহজে অতীতের মুখোমুখি হওয়া যাবে তিনি ভাবতে পারেননি। অজিতমোহন অন্য লোকে গিয়ে বসে আছেন। নিবেদিতা মাসির মধ্যে অতীতকে পাওয়া গেল, তবু আসল কেন্দ্রীয় প্রশ্নের উত্তর মিলল না। স্নেহকাকিমা এতদিন, সাতাশি বছর বেঁচে রইলেন। কিকির জন্য আর দু’এক মাস থাকতে পারলেন না। সব সময়েই তাই মনে হয় ফসকে গেল। বুঝি ফসকে গেল।
কিকি! কিকি! তুমি এখানে, এতদিন পরে … ভদ্রলোক বিস্ময়ে আনন্দে দিশাহারা হয়ে গেলেন।
একটু সামলে বললেন, যাক, একেবারে চলে যাবার আগে এমন কারও সঙ্গে দেখা হল যার সঙ্গে কথা বলা যায়। এসো মা। এসো এসো।
এটাই ওঁর ঘর। বেশ বড়। একদিকে শোবার খাট। আর একদিকে টেবিল চেয়ার। মাঝখানে দুটো মুখোমুখি সোফা। মনে হয় এগুলো যেন নতুন যোগ হয়েছে। কোণে টেলিফোন, তার পাশে আলমারি।
বুঝলে কিকি— এদের সঙ্গে কথা বলা যায় না। নোবডি নোজ এনিথিং। কেউ কথা বলতে জানে না। আক্ষেপে ফেটে পড়লেন রবি জ্যাঠামশায়। বৃদ্ধদের সেই চিরন্তন আক্ষেপ। ভুরু কুঁচকে বললেন— কী বিষয়ে কথা বলবে! জীবন সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে? জগৎ সম্পর্কে? এসব নিয়ে কখনও কিছু ভেবেছে? জিজ্ঞেস করলে বলে— দাদামশায়, বই লিখুন না, এখন আর মুখে মুখে ফিলসফি কেউ মানে চর্চা করে না। আরে বাবা, ফিলসফি কে চেয়েছে তোদের থেকে? ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং দুটোতেই চান্স পাচ্ছিস। ইঞ্জিনিয়ার হবার ইচ্ছে নেই। তবু তাইতেই ঢুকছে। ডাক্তারিতে এসট্যাবলিশ হতে সময় লাগে। তা ছাড়া ঝামেলা আছে। ডাক্তার পিটোচ্ছে, প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করে দিচ্ছে। আরে বাবা, অন্যায় করছিস তাই পিটছে। ভাল করে দরদ দিয়ে চিকিৎসা কর, মাথায় করে রেখে দেবে, তা না, দ্যাখাতে যাও চেম্বারে বসেই আছি, বসেই আছি। আরে আমার পরে এসে তিনটে টাই-পরা যুবক ছেলে ঢুকে গেল, হাতে ওই ব্রিফকেস। একেক জন কুড়ি মিনিট আধঘণ্টা নিচ্ছে। এ কী অন্যাই! কমপ্লেন করি, বলে কি ওরা নাকি মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। বোঝো! রুগি বসে আছে ঘর ভরতি। আমার মতো বুড়ো মানুষ, তা ছাড়া হয়তো কারও জ্বর, মাথা ঘুরছে, কারও বা পেটের যনতন্না। সব বসানো রইল, দেড় ঘণ্টা ধরে দেনা-পাওনার মিটিং হচ্ছে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের সঙ্গে। পিটুনি এরা খাবে না তো কে খাবে!
হঠাৎ ওঁর চৈতন্য হয়— এ হে হে, দ্যাখো তো তোমাকে বসিয়ে রেখেছি। বক বক বক। আমার ছেলেরা বলে— বাবা, এবার আপনাকে দেখলে লোকে পালাবে।— খুব হাসলেন উনি।— তা কিকি, কত বড়টা হয়ে গেছ মা। দেখতে দেখতে কত দিন কেটে গেল। সেই ছোট্ট কিকি, কোলে কুকুর নিয়ে ঘুরত, কাঁখে পুতুল।— নাঃ আমি ভাবতে পারছি না। চেনা যায় না। তবে নরেন্দ্রর মুখের আদলটা— হ্যাঁ এইবারে ধরতে পেরেছি। রংটা, চুলের ধরন, জ্বলজ্বলে চোখ দু’টি। সে কেমন আছে?
তিনি শান্তি পেয়েছেন জেঠু। আমার মা কোথায়, আপনার কাছে কোনও খবর আছে? —কস্তুরী আর ভণিতা করতে পারছেন না।
একদম চুপ করে গেলেন বৃদ্ধ মানুষটি। অনেকক্ষণ পরে বললেন, কেন জানতে চাও কিকি? জানলে যদি কষ্ট পাও!
—কষ্ট পাব না। কষ্ট সহ্য করা আমার অভ্যাস আচে। আপনি বলুন।
—সে যে আমাকে সত্যবদ্ধ করে গেছে মা! তা ছাড়া দরকারই বা কী! সে তো তোমার সত্যি মা নয়?
—নয়?
—না, সৎমা যাকে বলে। তুমি নরেন্দ্র ভাইয়ের প্রথম পক্ষের মেয়ে। তোমার বাবার খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। উনি তো আন্দোলন করতে কলকাতায় চলে এলেন। এখানে নরেন্দ্র কল্যাণীকে বিয়ে করলেন, মাঝেমাঝে দেশে যেতেন। কী জানো, সে আগুনের মেয়ে, যখন জানল আগের বিয়ের কথা নরেন্দ্র গোপন করেছেন, ক্ষমা করেনি। তারপর তোমার মা আমদাবাদে তোমার জন্মের সময়েই মারা গেলেন। কল্যাণীর জেদেই তুমি এখানে এলে মা। ছোট্ট এতটুকুনি পুতুলের মতো মেয়ে। তখনও কথা বলতে শেখোনি।
—তা হলে যাঁকে সৎ মা বলছেন, তিনিই তো আমার মা। বাবার যে আর একটা বিয়ে ছিল বাবা আমাকে বলেছিলেন, কিন্তু আমি যে তাঁর মেয়ে একথা বাবা কখনও বলেননি। আপনারা ঠিক জানেন না। আমি এই মায়েরই মেয়ে।
—বেশ মা। তাই। তুমি যা ভেবে শান্তি পাও। হয়তো তুমি শক পাবে বলেই নরেন্দ্র বলেনি। আর … কিকি … হয়তো … হয়তো তুমি নিজের মেয়ে নয় বলেই সে তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে পেরেছিল। ওভাবে কেউ যায়?…কোথায়? আমি ঠিকঠাক জানি না। তবে নানান জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে সে আর সুধা এখন মেদনিপুরের কোন গ্রামে সেটল করেছে শুনি।
মাঝিহিড়া?
না না, ওরকম অদ্ভুত নাম তো নয়! ট্রাইবাল বেল্টেই বোধহয়। কিকি, ছেড়ে দাও মা। যে গেছে তাকে যেতে দেওয়াই ভাল। তার বয়সও কি কম হল? পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর! হ্যাঁ … তা হবে। তার বেশিও হতে পারে…। আমারই তো হল নব্বুই কমপ্লিট।
কাজল, মিঠু আর শিখরিণী যখন এক ঘণ্টা পরে ঘুরে এল, বাড়ির ভেতর থেকে চিড়ে-বাদামভাজা চা সন্দেশ এসে গেল। রবিপ্রসাদ বর্মনের পুত্রবধূ নিয়ে এলেন সব, তাঁর এক পুত্রবধূর সঙ্গে। খাওয়াদাওয়া হতে লাগল। কস্তুরী এদের সঙ্গে রবিপ্রসাদ ও তাঁর বাড়ির লোকেদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। রসিকতা, পুরনো দিনের বহু কথা গল্প করতে লাগলেন রবিপ্রসাদ। তাঁকে চট করে থামানো যায় না। রাসবিহারী বসু পুলিশ এড়াতে কীভাবে জমাদার সেজে মলভাণ্ড মাথায় নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, সুভাষচন্দ্র কীভাবে আফগানের ছদ্মবেশ ধরেছিলেন, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’তে কীভাবে সুভাষের ছায়া পড়েছিল, বন্দেমাতরম জাতীয় সংগীত করা নিয়ে কত পলিটিকস হয়েছিল, জিন্না সাহেব কংগ্রেসের নেতাদের কাছ থেকে, বিশেষত মহাত্মাজির কাছে গুরুত্ব না পেয়ে শেষ পর্যন্ত মুসলিম লিগে যোগ দিলেন, তারপরে পাকিস্তানের জিগির তুললেন, তাঁর সাহেবি পোশাক-আশাককে মহাত্মাজি কীভাবে উপহাস করতেন। একবার গোসলখানা থেকে জিন্না সাহেবের জন্য কুরসি আনতে বলেছিলেন তাঁর আশ্রমে চেয়ারের ব্যবহার ছিল না বলে, সুইজারল্যান্ডে কমলা নেহরুর মৃত্যুশয্যায় সুভাষ কীভাবে তাঁর ও জেনিভাতে বিঠলভাই প্যাটেলের সেবা করেছিলেন। বিঠলভাইয়ের নাম আজ কেউ জানে না, তিনি বল্লভভাইয়ের বড় ভাই ছিলেন, প্রকৃতই উদার স্বভাবের, কীভাবে সুভাষের বিদেশি প্রচারের জন্য উইল করা তাঁর একলাখ টাকা থেকে ট্রাস্টিরা পলিটিকস করে সুভাষকে বঞ্চিত করেছিল, সরোজিনী নাইডু কীরকম চোখা চোখা কথা বলতেন, ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পরও কীভাবে সেই মন্ত্রীসভা আন্দামানের বন্দিদের মুক্ত করেনি, কেন ফজলুল হক লিগে যোগ দিলেন— এরকম অজস্র কথা দাঁড়ি-কমাহীন বলে যেতে লাগলেন। তাঁর পুত্রবধূ ও তাঁর পুত্রবধূ মুখ টিপে মুচকি হেসে চলে গেলেন, ওঁর এক নাতি এসে বলল, ওঃ দাদু, তুমি একটু থামবে, এইসব ইয়াং ছেলেমেয়েরা কী জানে! উনি বললেন, জানা উচিত, নাতি বললেন এইটুকু সময়ের মধ্যে এত আয়ত্ত করা যায় নাকি! ওরা বলল, না না। আমাদের ভাল লাগছে। কাজল বলল, আমি ইতিহাসের ছাত্র। আমার খুব ইনটারেস্টিং লাগছে, তাতে রবিপ্রসাদ উৎসাহিত হয়ে আরও বলতে লাগলেন, আরও আরও, কিন্তু মিঠু, কাজল এমনকি শিখরিণী পর্যন্ত অনুভব করল— পরিবেশের মধ্যে কোথাও অন্ধকার, কোথাও বেসুর এবং স্বভাব-স্নেহশীলা চটপটে ম্যাডাম চুপচাপ। গম্ভীর, অন্যমনা, নেই তাঁর প্রতিদিনকার কৌতুক, উৎসাহ, কস্তুরীবেন যেন এক ঘণ্টার মধ্যে আমূল পালটে গেছেন।
শিখরিণী নিজের বাড়ি অর্থাৎ মামার বাড়ি চলে গেল। যাবার সময়ে বলল, দিদি, যদি আমায় কোনও দরকার লাগে ডাকবেন প্লিজ। আমার আজকের দিনটা মনে থাকবে। মানিকতলায় নেমে গেল কাজল, নামবার সময়ে মিঠুর সঙ্গে একবার চোখাচোখি হল। তারপর ট্যাক্সি ছুটল পুরনো মারহাট্টা ডিচের ইতিহাসের ওপর দিয়ে মৌলালিতে বাঁক নিয়ে, আমির আলি অ্যাভেনিউ দিয়ে গোলপার্কের দিকে।
মিঠু খুব সন্তর্পণে বলল, দিদি আপনি কি খুব ক্লান্ত? আমি আপনার সঙ্গে থাকি একটু।
উনি তার হাতটা জড়িয়ে ধরে বললেন, সের্কম কিচু না, তুমি আসচ না। স্ট্রেট বাড়ি যাবে।
তিনের একে নামবার সময়ে উনি পুরো ট্যাক্সি ভাড়াটা দিয়ে দিলেন। তারপর হঠাৎ মিঠুর কপালে একটু হালকা চুমু খেলেন। বললেন, লক্ষ্মী মেয়ে, মিঠু দেখল ওঁর হাত, ওঁর ঠোঁট সব ঠান্ডা।
৯) তিনি ও পিসি
রাতটা আজকে যেন একটু বেশি আঁধার। ভেতরের অন্ধকার বাইরের অন্ধকার। কোনটা বেশি তিনি বুঝতে পারছেন না। কেমন একটা স্নায়বিক বিস্রস্ততা তাঁর শরীরে। গরম হওয়া সত্ত্বেও কেমন একটা তিরতির কাঁপুনি। কস্তুরী চান সেরে অন্ধকার বারান্দায় বসে রইলেন অনেকক্ষণ। বেশ গুমোট। তবে মাঝেমাঝে গুমোট ভেঙে হাওয়া দিচ্ছে। গন্ধরাজের দিন বোধহয় শেষ হয়ে গেল। আর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো গন্ধ পাওয়া গেলেও তিনি সইতে পারতেন না। প্রথম সন্তান-সম্ভাবনার সময়ে যেমন হয়েছিল! অনেকক্ষণ তাঁর মাথাটা অসাড় হয়ে রইল। কীরকম একটা ক্রোধ হতে লাগল প্রয়াত নরেন্দ্র মেহতার ওপর। সত্য, সত্য থেকে কাউকে কখনও দূরে রাখতে নেই। কেন? কেন বাবা এমন করলেন? কত দুঃখ পেতেন তিনি? মায়ের চলে যাওয়ায় ছোট্ট মেয়েটির যে মৃত্যুশোক হয়েছিল তার বেশি কি? ওই যে মেয়েটি মিঠু, ভারী চমৎকার মেয়ে, ওর মায়ের মৃত্যু কবে ঘটেছে জানেন না, কিন্তু এখনও সে কথা তুললে ওর বাহ্যজ্ঞান লোপ পায়, ওর চেয়ে বেশি কি? কী এসে যায় সৎমায়, তিনি যদি সত্যি মায়ের মতো হন! কিচ্ছু না। তিনি তো এখন এই উত্তর-পঞ্চাশেও সেই হাতের স্পর্শ, বুকের গন্ধ, চুড়ির টুংটাং, সব টের পান। দুঁদে ব্যাবসাদার, হাজার কাজের কাজি তিনি যে এখনও ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে তাঁকে দেখেই কেঁদে ওঠেন! নাঃ। তিনি পালিকা-মা হলেও কিছু এসে যায় না। আসলে ভয়ংকর ওই মন্তব্য— নিজের মেয়ে নয় বলেই বোধহয় চলে যেতে পারল! ওভাবে কেউ যায়! তা হলে তাঁর কাছে মা যতখানি, মায়ের কাছে তিনি কি কোনওদিনই ততখানি ছিলেন না? মাতৃহীন একটি শিশুকে মানুষ করছিলেন এই মাত্র! এবার ক্রোধ হতে লাগল রবিপ্রসাদ বর্মন নামে ওই বৃদ্ধের ওপর। ঠিক আছে বলুন না সত্য কথা, মন্তব্য করার দরকার কী! ওঁর কি একবারও মনে হল না মা-মেয়ে সম্পর্কের এমন বিচার শুনে ছোট্ট কিকির কেমন লাগতে পারে! নাঃ, তিনি তো আর সেই ছোট্ট কিকি নন। এক প্রৌঢ়া। অভিজ্ঞতা যাঁর মুখে নিজের ছাপ মেরে দিয়েছে। বৃদ্ধ বোধহয় মনে করলেন এ তো প্রায় বুড়ো হয়ে এল। এর আবার মা-সংক্রান্ত ফিলিং কী! উনি বোঝেননি। সম্ভবত কেউ বোঝে না একটা বড় বয়স্ক মানুষের মধ্যেও একটা শিশু বেঁচে থাকে, যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে পারে, যে … নিবেদিতামাসি তাঁকে পেয়ে কাঁদেননি! এই রবিজেঠু … রবিপ্রসাদও যে তাঁকে পেয়ে দেড় ঘণ্টা-দু’ঘণ্টা পুরনো দিনের কথা বকবকবকবক করে গেলেন সে-ও তো শিশুমিই। শিশু যেমন আপন মনে তার নিজের জগতের কথা নিজেই বলে।
আরও রাত্তিরে রামলাখন রুটি আর আলুভর্তা নিয়ে এল।
কস্তুরী বললেন, দুধ মিলেগা রামলাখন?
হাঁ জি!
তো দুধ লাও থোড়া।
কঠিন কিছু আজ তাঁর গলা দিয়ে নামবে না। বেচারি রামলাখন। ওকে তাঁর আগেই বলা উচিত ছিল। এত রাত্তিরে কোথা থেকে দুধ জোগাড় করবে? তাঁর বাড়িতে তো আর ফ্রিজ নেই! হয়তো নিজের জন্য রেখেছিল। সেটাই তাঁকে দেবে।
মাঝরাত্তিরে কস্তুরীর কোলাপসিবলে দমাদ্দম আওয়াজ। প্রচণ্ড শব্দে একটা গ্রেনেড ফাটল। ধোঁয়াধোঁয়া। একটু পরিষ্কার হতে তিনি দেখলেন তাঁর মা, হালকা নীল রঙের কালো দাঁতপাড় শাড়ি পরা ছিন্নভিন্ন হয়ে লুটিয়ে রয়েছেন। হাতে জাতীয় পতাকা, এক ভাঁজ হয়ে শুয়ে আছে। অশোকচক্রের আধখানা দেখা যাচ্ছে। কোলাপসিবল্ খুলে তিনি উন্মত্ত জনতার মধ্যে, বোমা বন্দুকের মধ্যে ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইছেন, কারা পিছন থেকে তাঁকে বাধা দিচ্ছে। এখনও আশা আছে। অ্যাম্বুলেন্স, অ্যাম্বুলেন্স, কোথায় জনতা? নির্জন রাস্তা দিয়ে তিনি তাঁর মায়ের দেহ নিয়ে কোন অদৃশ্য অনস্তিত্ব হাসপাতালের দিকে চলেছেন। অনেক দূর থেকে আবছা মুখ কারা যেন তাঁকে অনুসরণ করছে। জাতীয় পতাকাটা মা’র হাত থেকে খসে পড়ে গেল। কিকি আর কেয়ার করে না। মাতৃমুখ ছাড়া ওই পতাকা একটা কাপড়ের টুকরোর বেশি কী!
শেষ রাত্তিরের হালকা ছায়া। কস্তুরী ঘর্মাক্ত জেগে উঠে সদ্য দ্যাখা স্বপ্নের প্রতিটি পুঙ্খানুপুঙ্খ খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। সন্দেহ নেই, ২০০২ ফেব্রুয়ারির শাহপুরের সেই বিভীষিকা তাঁকে ছাড়ছে না। কিন্তু মা কেন ছিন্নভিন্ন? এ কি সেই দেশ যাকে তাঁদের বাবার জেনারেশনের লোকেরা মা বলত, মা বললেই কি সবচেয়ে বেশি ভক্তি, ভালবাসা, দায়বদ্ধতা আসত! তা হলে এই মা কেন তাঁর মায়ের বেশে! একটা প্রসঙ্গের সঙ্গে আর একটা প্রসঙ্গ কি জুড়ে গেছে? তবে কি তাঁর অসাবধানতা, তাঁর অবিচারই ছিন্নভিন্ন করছে মাকে?
সকালবেলা উঠে চানটান সেরে, নিয়মিত ব্যায়াম ও প্রাণায়ামের পর তিনি মুখে একটি হরিতকী আমলকির বড়ি ফেললেন। দুটো মর্তমান কলা ছাড়িয়ে খেয়ে ফেললেন এক বাটি মুড়ি গরম চায়ের সঙ্গে। এবং সংকল্প করলেন— না, এখানেই ছেদ টানা নয়। তাঁকে যেতে হবে সিরাজচাচুর কাছে। সম্ভব হলে রমা পিসিমার কাছেও। ক্রস-চেক করো কস্তুরী। সবসময়ে ক্রস-চেক করবে। দলিলপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়বে। অডিট দেখবে। স্টেটমেন্ট অব অ্যাকাউন্টস ঠিকঠাক ফাইলে আছে তো? সেক্রেটারির ওপর পুরো নির্ভর কোরো না। যতই যোগ্য হোক, মানুষই তো! ভুলভ্রান্তি হতে পারে। ক্রস-চেক করো, ভেরিফাই করো কস্তুরী।
তিনি ঘড়ি দেখলেন, রামলাখনকে বললেন— ঠিক দশটার সময়ে তিনি বেরোবেন। ভাড়ার গাড়ি চাই। সুখের বিষয়, কোনওটাই খুব দূরে নয়।
সার্কাস রোয়ে গিয়ে দেখলেন একটা জি-প্লাস ফোর নতুন বাড়ি। তার লেটার বক্সে কোনও আলির নাম দেখলেন না। তিনি এ-ও জানেন না সিরাজচাচুর এটা নিজের বাড়ি ছিল কিনা। কো-অপারেটিভের অফিস রয়েছে না? ভেতরে এক ভদ্রলোক ঢুকছেন তালা খুলে। কস্তুরী গিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ালেন— এক্সকিউজ মি। ভদ্রলোক ফিরে তাকালেন— আই ওয়ান্টেড সাম ইনফর্মেশন।
—ইয়েস! ভদ্রলোক শুনতে প্রস্তুত।
—আই ওয়জ লুকিং ফর আ সিরাজ আলি, হু ইউজড টু লিভ হিয়ার।
—ওয়াজ হি বাই এনি চান্স দা ওনার অব দা ল্যান্ড?
—আই হ্যাভ নো আইডিয়া।
—স্যরি ম্যাডাম, অ্যাজ ফার অ্যাজ আই নো, দিস প্রপার্টি ওয়জ বট বাই আস ফ্রম মহম্মদ আখতার। হি হ্যাজ এ ফ্ল্যাট হিয়ার, ইউ ক্যান আসক্ হিম!
মহম্মদ আখতার! আলিরা তো নিজেদের আলিই বলবে! মহম্মদ আখতার! ঠিক আছে, তিনি দেখবেন। সবচেয়ে ওপরের তলার দক্ষিণ কোণের ফ্ল্যাটটা। বেল টিপলেন। দরজা খুললেন এক ভদ্রমহিলা। সালোয়ার-কামিজ পরা। বয়স্ক।
কাকে চান?
সিরাজ আলি বলে কুনও বৃদ্ধ মানুষ একানে থাকেন?
সিরাজ আলি? এ তো আমাদের বাড়ি। প্রোমোটার বাড়ি ভেঙে করেছে।
আগে, কে থাকত একানে?
ভাড়া ছিল অনেকগুলো।
তাঁদের মধ্যে কেউ? সিরাজ আলি?
আমি মোটামুটি এঁদের সবাইকে চিনতাম। সিরাজ আলি বলে কেউ… ওহো রিয়াজদের কেউ হতে পারেন। তবে কোনও বুড়ো মানুষ আমি দেখিনি।
তার মানে সিরাজচাচু এই রিয়াজদের কেউ হলেও এই ভদ্রমহিলা তাঁর বিয়ের পর তাঁকে দ্যাখেননি, মানে তিনি নিশ্চয়ই গত হয়েছিলেন।
মানুষ কেন এত তাড়াতাড়ি মারা যায়! আরও আয়ু দরকার। চল্লিশ বছর থেকে মানুষ সত্যি সত্যি সচেতনভাবে বাঁচতে আরম্ভ করে। করে না? সিঁড়ি দিয়ে তিনি মন্থর পদক্ষেপে নেমে যাচ্ছিলেন, পিছনে দরজা আধখোলা, ভদ্রমহিলা কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখছেন। সাদা শাড়ি পরা এই মহিলাটি খুব হতাশ হয়েছেন, তিনি বুঝতে পারছেন।
দুরুদুরু বুকে গর্চা ফার্স্ট লেনে ঢুকলেন কস্তুরী। বেশ খানিকটা ঘুরেছেন। দোনামোনা করেছেন। সইবে তো? আরও আঘাত? তিনি কি এখানেই থামবেন? একটা ছন্ন গল্প নিয়ে ফিরে যাবেন? না, তা হয় না। সত্যের মুখোমুখি হবার সাহস তোমার আছে কস্তুরী, না হলে… পুরনো ধরনের বাড়ি তো রয়েছে, সভয়ে দেখতে লাগলেন কোনও বহুতল আছে কিনা।
এই বাড়ি ম্যাডাম— ড্রাইভার বলল। বেল বাজালেন। দরজা খুলল।
রমা সরকার এই বাড়িতে থাকেন?
মেয়েটি বোধহয় কাজের লোক। দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল, ওপরে যান। সিঁড়ির মাঝ থেকেই চটি দেখতে পেলেন কস্তুরী। চটি, নানা রকমের। ছেঁড়া, ধুলোমাখা। ওপরে দালান। একটি ঘরের পরদা হাওয়ায় দুলছে। ভেতর থেকে সুর করে নামতা পড়ার আওয়াজ আসছে শিশুকণ্ঠে।
দালানে দাঁড়িয়ে কস্তুরী একটু চেঁচিয়ে ডাকলেন, রমাপিসিমা! রমাপিসিমা!
পাশের ঘরের পরদা সরিয়ে দু’-তিনটি বালক-বালিকা এসে দাঁড়াল।— দিদু চান করতে গেছে, তুমি বসো।
—কোথায় বসব বাবা!
—এইখানে।
কস্তুরী ঘরের একমাত্র চেয়ারটিতে বসে অনন্তকাল অপেক্ষা করতে লাগলেন। নামতার পরে ওরা এখন স্লেট-পেনসিল বার করে লিখছে। নেহাতই বাচ্চা, কিন্তু মনে হল বেশ অখণ্ড মনোযোগে লিখছে। প্রথমে স্কেল দিয়ে স্লেটের ওপর পরপর দাগ কেটে নিল। একটি বাচ্চা তাঁকে জিজ্ঞেস করল— ধান্য বানান দন্ত্য নয়ে নয়ে হবে না য-ফলা হবে। তিনি উত্তর দিলেন। তারপর কৌতূহল হল, ছেলেটির কাছ থেকে স্লেট টেনে নিয়ে দেখলেন লিখেছে: ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা/ তাহার মাঝে আছে সে দেশ সকল দেশের সেরা।/ সে যে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
বাচ্চাটি বলল, এই গানটা আমরা রোজ গাই। তপু গাইতে পারে না, ওর গলায় সুর নেই। আমার পাশে দাঁড়িয়ে গায় তো! আমারও সুর ভুল হয়ে যায়।
তখন বেশ একটা গোলমাল পড়ে গেল। একজন বলল, তুইও গাইতে পারিস না, লিখতেও পারিস না, খালি নালিশ করতে পারিস।
একজন বলল, তপুর গলায় সুর নেই তো কী হবে! ভগবান দেননি। কিন্তু ও তো সবার আগে যোগবিয়োগ কষে ফেলে।
কী হচ্ছে তোমাদের? এত গোলমাল কেন? এক বৃদ্ধা এসে দাঁড়িয়েছেন। লাল পাড় শাড়ি পরা, মাথার চুলগুলি কাঁচাপাকা। মুখটি প্রশান্ত।
কস্তুরী উঠে দাঁড়ালেন। প্রণাম করলেন। তারপর উঠে বললেন, চিনো? দেখো তো!
হাঁ করে চেয়ে রইলেন রমাপিসিমা, তারপর বললেন, কিকি, না?
তিনি কস্তুরীকে একেবারে জড়িয়ে ধরলেন। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বললেন— তোমরা বসে বসে লেখা করো। আমি আসছি।
পাশের ঘরটি রমাপিসিমার শোবারঘর।
—বসো কিকি, পা মুড়ে বিছানায় ভাল করে বসো।
—তুমি কেমুন আছো পিসিমা!
—খুব ভাল। এই তো এদের নিয়ে চমৎকার কেটে যাচ্ছে। তুমি?
—অতটা ভাল বুলতে পারছি না।
কেন? নরেন্দ্রদাদা ভাল আছেন তো!
বাবা এই কো মাস আগে, ফেব্রুয়ারিতে চলে গেছেন।
রমাপিসিমা হাত জোড় করে নমস্কার করলেন, বললেন, দুঃখ কোরো কিকি। ওঁর যা বয়স হয়েছিল তাতে… একসময়ে প্রিয়জনদের ছেড়ে দিতে হয়।
—পিসিমা, আমার মা-ও কি…
—না না, কিছু হলে শুনতুম…
—কোথা থেকে শুনতে পিসিমা…
বৃদ্ধা ওঁর মুখের দিকে তাকালেন, বললেন, কল্যাণী তো অনেক দিন চলে গেছে, এত দিন তো কেউ খোঁজ করেনি কিকি? আজ এই অবেলায় কেন?
আমি এখন আর ছুট্ট কিকি নেই। আর আমি যে-কেউ নই, তাঁর মেয়ে। আমার কি জানবার অধিকার নেই?
—তোমার বাবা তোমাকে কিচ্ছু বলেননি?
—না।
—তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে?
—মায়ের প্রসোঙ্গ উঠলেই উনি চুপ করে যেতেন, মনে হত খুব কোষ্ট পাচ্ছেন তাই… আমার তো আর কেউ ছিল না।
—কেন তোমার ঠাকুরদা-ঠাকুমা?
—ওঁরা তো কোবেই চলে গেলেন।
—যাই হোক, ওই কদিনের জন্যও ছেলেকে নাতনিকে কাছে তো পেয়েছিলেন!
—তা তো পান। কিন্তু আমার মা কোথায় গেলেন, কেন গেলেন, যদি গেলেন তো আমায় নিয়ে গেলেন না কেনো? বোলে গেলেন না কেনো?
—এতদিন পরে এসব কথা তোমার মনে জাগছে কেন? কেউ কি তোমাকে বুঝিয়ে বলেননি?— দাঁড়াও তোমার জন্যে চা করে আনি।
—আমার চা হয়েছে। পিসিমা।
—আমার জন্যে। একটু বারবার চা না খেলে আমার চলে না কিকি।
কস্তুরীর মনে হল, চায়ের নাম করে রমাপিসিমা একটু সময় নিচ্ছেন। কিছুক্ষণ পরে উনি দু’কাপ চা আর গাঁঠিয়া নিয়ে ঢুকলেন, বললেন, আমাদের সেই বাঙালি খুকি তো আর নেই দেখছি। একেবারে গুজরাতি কিকি-ই হয়ে গেছে।
—বাঙালি, গুজরাতি, মারাঠি, পঞ্জাবিতে কী তফাত পিসিমা, সোবাই তো একই ভারতের!
—তুমি কি সত্যিই এখনও তাই মনে করো কিকি? তুমি কি এখনও আমাদের অতীতের মতো স্বপ্নে বাস করো? তাহার মাঝে আছে সে দেশ সকল দেশের সেরা!—রমাপিসিমা হাসলেন।
—একটু বুঝিয়ে বলুন কী বলছেন!
—তুমি অনুভব করো না এখন ভারত এক নয়, অনেক। গুজরাতি ভারত, মারাঠি ভারত, পঞ্জাবি, হরিয়ানি, বিহারি, অসমিয়া,… অজস্র ভারত। এক একটা রাজ্যেও আবার বহু ভারত, যাদব ভারত, জাঠ ভারত, ব্রাহ্মণ ভারত, আদিবাসী ভারত, জোতদার ভারত, মজুর ভারত। কোটিপতি ভারত, দারিদ্র্যসীমার নীচের ভারত, মুসলিম ভারত, হিন্দু ভারত এবং সবকিছু ছাপিয়ে ক্রমশ মাথা তুলছে মার্কিন ভারত। চারিদিকে মৃত্যু দেখতে পাই, দেহের মৃত্যু, মনের মৃত্যু, বুদ্ধি, যুক্তি, সততা, ভালবাসা, দেশপ্রেম… সবকিছুর মৃত্যু। তুমি পাও না? …পাবে না, কেননা কিকি তোমরা আমাদের বংশধর, কিন্তু সেই কথা আছে না?— এক পুরুষ খাটে, পরের পুরুষ গড়ে, তার পরের পুরুষ ভোগ করে, আর তার পরের জন নষ্ট করে সব। সমস্ত। তোমরা… তোমাদের গড়ার জেনারেশন ছিল, পারোনি, তারপরে ভোগীরা এসে গেল, আর তারপরে সব ছন্ন করা নষ্ট করার জেনারেশন উঠছে।
—এতটা হোতাশার কারণ নেই পিসিমা। বড় জটিল দেশ, জটিল। ফুল অফ ভ্যারাইটিজ। ভুল হোবে, শুধরাবে, ধীরে ধীরে হোবে।
—কীসের জটিল? ধর্মবিশ্বাস তো ব্যক্তির ঘরের ব্যাপার, তাকে লাউডস্পিকার দিয়ে সর্বজনীন করার কী দরকার? কীসের জটিল?— খাদ্য, পোশাক, রুচি, ভাষা আলাদা তো থাক না যে যার সম্মান নিয়ে আলাদা, একজন কেন বহুজনকে গ্রাস করে? এক ভাষা কেন অন্য সব ভাষাকে গ্রাস করে দাবিয়ে পুষ্ট হচ্ছে। যারা বনেজঙ্গলে বাস করে ফুড গ্যাদারার আর হান্টার থেকে ধীরে ধীরে কৃষিকে তাদের জীবিকায় স্থান দিয়েছিল, তাদের রুজি-রোজগারের উপায়গুলোও কেন তোমাদের স্বাধীন ভারত কেড়ে নিচ্ছে। আর তাদের নামে যেখানে আলাদা রাজ্য হচ্ছে, সেখানে আরণ্যক মানুষ এক নষ্ট সংস্কৃতির ছোঁয়াচে কোটি কোটি টাকার গাড়ি চড়ে বেড়াচ্ছে কেন? পাবলিক মানি লুঠ হয়ে যাচ্ছে, কেউ যদি তা থামাতে যাচ্ছে তো খুন হয়ে যাচ্ছে। যেখানে যে সৎ মানুষ আছে হয় তার বদনাম, নয় সাইড লাইনড আর নয় সরাসরি খুন— সে ডাক্তার হোক, আই এ এস অফিসার হোক, দলনেতা হোক, সাধারণ গৃহস্থ হোক, গরিব কৃষক মজুর হোক, কেরানি হোক। একটা স্বাধীন দেশের তরুণদের কেন ডাকাত হতে হয়! দাঙ্গাবাজ গুন্ডা না হয়ে বাঁচবার অন্য উপায় থাকে না কেন? …শোনো শোনো… বড় বড় অর্থনীতিবিদ আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের থিয়োরি আউড়িয়ো না। দে হ্যাভ নো ইম্যাজিনেশন। ধর্মনিরপেক্ষ? ওরা জানে ধর্মের মানে? ধর্ম হল মানুষের মানবধর্ম, তার বেসিক মনুষ্যত্ব। মুণ্ডারিতে ‘ধিরি’ মানে পাহাড় বা পাথর। ‘ধিরি’ থেকে স্যানসক্রিটাইজড হয়ে হল ‘ধৃ’। তার থেকে ‘ধর্ম’, যা পর্বতের মতো অচল অটল মূল প্রপার্টি মনুষ্যত্বের। সেই ধর্মই যদি না থাকল তা হলে কী রইল? হ্যাঁ, ধর্মমতনিরপেক্ষ বলা যেতে পারে বটে। শব্দগুলো সাবধানে চয়ন করা চাই।
দু’জনেই চুপ করে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর রমা ধীর গলায় বললেন, কল্যাণী চলে গেছে সেইখানে যেখানে তাকে প্রয়োজন। কেউ কেউ আসে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে, তারা দেশকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়। টাকা-পয়সা-বিলাস-ব্যসন— এমনকী নিশ্চিন্ত ঘরসংসারের বাঁধনও তাদের বেঁধে রাখতে পারে না। তোমার হয়তো দুর্ভাগ্যই। কিন্তু এ দেশের সৌভাগ্য কল্যাণী মেহতা সেইরকমের একজন মা। আগে মানুষ, পরে মা। বলছি না সবাইকেই তার মতো হতে হবে। কিন্তু দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি সবাইকার মিনিমাম কমিটমেন্ট থাকলে একজনকে এত আত্মত্যাগ করতে হয় না। কিকি ফিরে যাও, তার খোঁজ কোরো না। এতদিন যখন কেটে গেছে, বাকি দিনগুলোও যাবে। এখন এই বয়সে তোমাকে দেখলে ও বড় ব্যক্তিগত কষ্ট পাবে, তুমিই তো ওর একমাত্র বাঁধন। ছিঁড়তে যে কত দুঃখ পেয়েছে আমি জানি!
—রমাপিসিমা, মায়ের এখন বোধহয় আটাত্তর বছর পার হয়ে গেছে। দেশকে যা দেবার এতদিনে দেওয়া হয়ে গেছে। এখনও যা পারেননি তা আর কাউকে পারতে হবে। আমার মাকে আমি অন্তত দেখতে চাই। মিলতে চাই মা’র সঙ্গে। কুনোও ওজর আপত্তি আমি শুনবো না। সোবই যদি নোষ্ট মিথ্যা তো বাচ্চাগুলোকে স্বোপ্নো দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা শিখাচ্ছেন কেন? ইলিউশন নিয়ে বড় হলে, ওদের কী দোশা হবে? স্বোপ্নো মানেই তো স্বোপ্নোভঙ্গো। —কস্তুরীর গলায় এখন জেদ, তিনি তর্কের জন্য প্রস্তুত।
রমাপিসিমার মুখটা হঠাৎ হাসিতে ভরে গেল। উনি বললেন, বুঝতে পারলে না? আমাদের মতো আর একটা জেনারেশন তৈরি করতে চাইছি। যারা ভালবাসবে। স্বপ্নটা বড় নয়, ভালবাসাটা বড়। কিকি, ওরা স্ট্রিট চিলড্রেন, অনেকে আছে যাদের মায়েরা এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে। এদের জন্য ভাববার কেউ নেই। নাম-কা-ওয়াস্তে কর্পোরেশন স্কুল হয়। চক-ডাস্টার, বসবার জায়গার অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। স্নেহের অভাবে উপস্থিতি থাকে না। ওদের ভালবাসা দিচ্ছি। আর শেখাচ্ছি, শুধু অক্ষর পরিচয় নয়। —ভাল-মন্দের তফাত, ন্যায়-অন্যায়ের বিচার যেন ওরা করতে পারে। দ্যাখো কিকি, সবাই ভাবে লেখাপড়া শিখলেই একটা চাকরি করব আর একটা টিভি. কিনব। গ্রামে-গঞ্জে কিষানের ছেলে লেখাপড়া শিখে শহরে পিয়োন হয়। মাঠ পড়ে থাকে, মাটি কাঁদে। আমার লক্ষ্য পিয়োন বেয়ারা গড়া নয়। সেই মানুষ গড়া যে এদেশকে নিজের বলে জানবে, মায়ের মতো ভালবাসবে। আর স্বপ্নভঙ্গ বলে ওদের কিছু নেই। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। বাজে ধূপ, শ্মশান-সমাধির ফুল এইসব ওদের হাতে ধরিয়ে দেয় ওদের মালিকেরা, করুণ বাচ্চা মুখগুলো—তা-ও বিজ্ঞাপন। আর বাড়িতে সাত বাড়ি কাজ করা মা গালি দেবে, মারবে, এতে আর আশ্চর্য কী! এরাই আমার কুমোরের মাটি, ভদ্দরলোকরা নয়। স্বপ্ন কিছু নেই। স্বপ্ন মানে ইলিউশন নয় কিকি। স্বপ্ন মানে আশা। দুর্জয় আশা, আর দুর্মর ভালবাসা। যে কাজ ওরা করুক, আশা করি পথশিশু হয়ে ওদের আর থাকতে হবে না। আমার এখানকার অনেকেই অনেক কিছু করছে। এরাও করবে। আমি যত দূর পারি ওদের সাহায্য করব। এইভাবেই নিজের ক্ষুদ্র চেষ্টায় যত দূর পারি কল্যাণীর কাজ করছি। দেশের, ঈশ্বরের কাজ করছি। আমাদের মধ্যে যাঁরা ধনী তাঁরা তো মুখ ফেরালেন। একটু পরে উনি বললেন, কিকি, ভেবো না। আমি কস্তুরীবেনের কাজকর্মের কোনও খবর রাখি না। যে যেখানে আছে, নিজের সাধ্যমতো কাজ করে গেলে একদিন সমস্ত ভুলের সংশোধন হবে। হয়তো হাজার বছর পরে। হয়তো বা তারও পর। কোনও সময়সীমা নেই। আমাদের জীবনকালটাই আমাদের সময়সীমা। কিকি, তোমার মা অনেকদিন মেদিনীপুরে ছিলেন। এই মুহূর্তে কোথায় আমি বলতে পারছি না। পুরুলিয়ায় খুঁজে দেখতে পারো। গোড়ায় ঝাড়গ্রামে যাও।
১০) তিন থেকে চার
যাদবপুর কফিহাউজে ঢুকে মিঠু আর কাজল দেখল রৌনকদের পুরো দলটা মজুত।— হাই। হাই!
—এত হাই তোলবার কী আছে! আমরা তো হাতের কাছেই রয়েছি।— মিঠু বলল।
স্বরূপ বলল, কী জানি বাবা, তোরা চাকরি পাওয়ার দলে। একটু high না করলে কি পদধূলি দিবি? যে রকম ডুব মেরে আছিস!
বেশ অনেকদিন এই গ্রুপটার সঙ্গে দেখা হয়নি তাদের। কাজল অবশ্য নিয়মিত আড্ডার প্রয়োজনই অনুভব করে না। কিন্তু মিঠু করে, ভিন্ন ভিন্ন জলে সাঁতার কাটতে তার মজা লাগে। জীবনটা একঘেঁয়ে হয়ে যায় না হলে। আর সত্যিই তো, তার কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, নির্বাচনের সুযোগও বিশেষ নেই জীবনে। তাই যা ঘটছে, যা হাতের কাছে এসে যাচ্ছে, তাই নিয়েই সে যথাসাধ্য খুশি।
রৌনক এদের মধ্যে ধনীর সন্তান। একমাত্র তো বটেই। ওর আর্টস নিয়ে পাশ করাটা ওর বাড়ির একটা প্রচণ্ড দুর্ঘটনা। বাবা, মা দু’জনেই ব্যারিস্টার। ওঁরা এখন চেষ্টা করছেন রৌনকের যেন অন্তত একটা লিগ্যাল কেরিয়ার হয়। ও আইন পড়ছে। কিন্তু ওর মন শুধু টাকা ওড়ানোয়। বলল, যায্যাঃ, চাকরি করিস তো করিস— আয় এক প্লেট করে চিকেন বিরিয়ানি খাইয়ে দিচ্ছি। কোথায় যেতে চাস চল। এখানে যে কেন একটা বারও রাখে না বুঝি না। ঠান্ডা বিয়ার হলে জমত ভাল।
স্বরূপ কমার্সের ছেলে— ব্যাঙ্কের পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে, হয়ে যাবে একটা। কিন্তু রণজয় বা রণি তার ইংরেজির মাস্টার্স নিয়ে কিছুতেই স্লেটটা ধরতে পারছে না। সকলে বলছে স্কুল-সার্ভিসেও পরীক্ষা দে। রণির তাতে প্রচণ্ড অমত। সে এখন টিউশনি করে ভাল উপার্জন করে। ভাবছে অগত্যা ডাবলু বি সি এস-এ বসবে।
রিমি রীতা দুই বোন, খুবই ভাল ছিল সব দিক দিয়ে। এখন প্রচণ্ড ড্রাগ-অ্যাডিক্ট। কোথাও দু’দণ্ড স্থির হয়ে বসতে পারে না। এখন মিঠুদের দেখেই লাফ দিয়ে উঠে চলে গেল। বিশেষ করে কাজলের সঙ্গ ওরা সহ্য করতে পারে না। কে জানে কেন!
—কী রে কাজলদা, একটু হাল-হদিশ দে!
—কম্পিউটার শিখছ তো!
—ও তো ঘরের খেয়ে, গুচ্ছের খানেক ঢেলে শিখছিই।
—তা হলে কিছু একটা হয়ে যাবে।
অমিতাভ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। কোনও অজ্ঞাত কারণে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ে ও চান্স্ পায়নি। চুপ করে বসে ছিল।
রৌনক বলল, আসলে অমিতাভ বুঝলি তুই বাংলা-মিডিয়াম স্টাফ। অত ভাল ছেলে, কেরিয়ারটাই নষ্ট করলি, গড়বেতা না ফেতা ইস্কুলে। ফটাফট চলাফেরা করতে পারলে, বলতে পারলে— তোর চাকরি খায় কে?
অমিতাভ উঠে চলে গেল।
এই সময়ে শিখরিণী হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল।
তোদের কতগুলো বুথ থেকে কনট্যাক্ট করার চেষ্টা করছি। মিঠু শোন!
মিঠু আর কাজল দু’জনেই উঠে গেল। রৌনক চোখ নাচিয়ে মন্তব্য করল।— কারেন্ট খেয়ে গেল।
—কী ব্যাপার?
—কস্তুরীদির কাছে গিয়েছিলাম ক্লাসের পর। গিয়ে দেখি খুব জ্বর। তার ওপরে ধরেছেন কোথায় গ্রামের দিকে যাবেন। কালই। আমি ঘাবড়ে গেছি। আমাকে ওঁর ওখান থেকে কিছুতেই ফোন করতে দিলেন না। আমার তো মোবাইল নেই। আশা করিনি তোমাদের এখানে পাব।
ডাক্তার এসে বললেন ভাইর্যাল না-ও হতে পারে। তাঁর নির্দেশে শিখরিণী মাথা ধুয়ে দিল দিদির। মিঠু প্যারাসিটামল দিল।— দিদি কী খাবেন? সুপ করে দিই?
আরে ডোন্ট বদার। আমার কিছু খেতে ইচ্ছে নেই।
তা বললে তো চলবে না। স্ট্রেংথ ঠিক রাখতে হবে— কাজল বলল।
সে ঘর থেকে বিনা বাক্যব্যয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। তার বেশ একটু পরে প্লেটের ওপর গরম কাচের গ্লাস নিয়ে ঢুকল। ধোঁয়া উঠছে সুপ থেকে। অর্থাৎ সে দোকানে গেছে, প্যাকেটের সুপ কিনে এনে তৈরি করেছে।
এক্ষুনি খান দিদি, একটু একটু করে, মিঠু, ওই ছোট কাপটা ধর তো, আমি ঢেলে ঢেলে দিচ্ছি। সে না-ছোড়। এবং গলায় বেশ কর্তৃত্বের সুর।
একটু পরেই রামলাখন গরম দুধ নিয়ে এল।
—তুমরা আমাকে কী ভাবচো বলো তো?— কস্তুরী প্রতিবাদ করে উঠলেন। তাঁর জ্বর কমতে শুরু করেছে। এখন গলায় একটু জোর এসেছে। ঠাট্টা করবার মেজাজও। বলে উঠলেন, কাজল য়ু নো হোয়াট, য়ু উইল মেক আ ফাইন হাজব্যান্ড! হেসে বললেন, সো কেয়ারিং অ্যান্ড কমপিটেন্ট।
—আমরা, আমরা বুঝি কিছু নই? মিঠু হইহই করে ওঠে। তার সঙ্গে শিখরিণী যোগ দেয়। কস্তুরী একটা হাত তার মাথার ওপর রাখেন, আর একটা হাত দিয়ে শিখরিণীকে খোঁজেন।
—তুমাদের তো প্রশ্ন উটচেই না। উইমেন আর ইনস্টিংটিভলি কেয়ারিং, এফিশিয়েন্ট, বাট মেন আর জেনার্যালি সাচ বাঙ্গলার্স। কাজল ইজ অ্যান এক্সেপশন।
কাজলের কোনও ভাবান্তর নেই। সে বলল, মিঠু, তোরা একটু পরে বাড়ি চলে যা। আমি আজ রাতটা এখানে থাকব।
কস্তুরী যথাসম্ভব প্রতিবাদ করলেন। কোনও ফল হল না। মিঠুও থাকতে চাইছিল, কিন্তু কাজল বা কস্তুরী কেউই তার কথায় কান দিলেন না।
ওরা দু’জন নামছিল। ক’দিন পরই নাকি কস্তুরী ঝাড়গ্রাম না পুরুলিয়ার দিকে যাবেন। মিঠু বলল, আমি যাবই। যেতেই হবে।
শিখরিণী হঠাৎ বলল, আমিও।
কাজল তো নিশ্চয়ই যাবে— মিঠু বলল, তুমি আবার কেন? দু’জনই যথেষ্ট না?
—এই স্টেপটাতে একটু বসবে মিঠু— শিখরিণী বলল— তোমার সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে। ভীষণ জরুরি।
একতলা-দোতলার মাঝের বড় ধাপটাতে বসে পড়ল শিখরিণী।
—কী এত জরুরি কথা! তোর বাড়িতে ভাববে না! কত দূর যেতে হবে এখন। যতই গাড়ি থাক।
—না না ঠিক চলে যাব। ভাবলে আর কী করতে পারি, চাকরি করি, সঙ্গে গাড়ি আছে, ড্রাইভার আছে, এর পরও ভাবলে কিছু করার নেই।
—বল কী বলবি!
শিখরিণী নিজের চুড়িগুলো একটু নাড়াচাড়া করল। তারপর বলল, তুমি জানো, কাজল ইংল্যান্ডে একটা অফার পাচ্ছে।
—তাই? কাজল আগেও পেয়েছে অনেকবার, নেয়নি। ওর পেপারগুলো ওরা খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করে।
—এটা আলাদা। অ্যামাউন্ট খুব ভাল। সব রকমের সুবিধে। ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ-এ। আমার ইচ্ছে এটা ও নিক।
—তোর ইচ্ছে? কাজল নিজের ছাড়া আর কারও ইচ্ছেকে পাত্তা দিলে তো! তা ছাড়া তুই কোত্থেকে জানলি? হঠাৎ ওর উপদেষ্টাই বা হতে যাচ্ছিস কেন?
—জেনেছি। কাজলের থেকেই। কথায় কথায় বলছিল। মিঠু, তুমিও ওকে একটু জোর করো। আর একটা কথা। ওর নাম তো কাজল সিং মুণ্ডা। মুণ্ডাটা ওকে বাদ দিতে বলো প্লিজ। জাস্ট কাজল সিং। সেটা সিংহর শর্ট ফর্ম বলে মনে হবে।
কেন?— মিঠু কখনও এমন আশ্চর্য হয়নি। তুই জানিস না পদবিটা ও কখনও গোপন করে না! ওটা ওর একটা স্যাটিসফ্যাকশন, গর্ব, জয়নিশান বলতে পারিস।
জানি, সবটাই জানি মিঠু। কিন্তু মানুষের মধ্যে অনেক সময়ে অনেক ছেলেমানুষি অহংকার, জেদ থেকে যায়, যেটা বর্তমান ও ভবিষ্যতের পক্ষে ক্ষতিকারক।
—তুই তা হলে ওকে ছেলেমানুষ মনে করিস!
—ও তো ছেলেমানুষই, ইম্যাচিয়োর।
—আর তুই?
—আমি ট্রাডিশন্যাল সমাজকে দেখতে পাই মিঠু, তাকে বদলাবার কথা যে ভাবি না, তা নয়। কিন্তু জোর করে বদলাতে গেলে উলটো ফল হয়। আমি সইয়ে সইয়ে, ভুলিয়েভালিয়ে বদলাবার পক্ষপাতী।
—তো তোর সেই যুক্তি তো কাজলের ক্ষেত্রেও খাটে! জোরজার করতে গেলে ওর জেদ চেপে যাবে।
—আমি তো জোর করতে বলছি না। সইয়ে সইয়েই করবে। কেননা ও তোমাকে বন্ধু বলে ভীষণ বিশ্বাস করে, মানে।
—আমি? তাই আমি বিশ্বাসঘাতকতা করব?
—প্লিজ মিঠু বোঝবার চেষ্টা করো, বিশ্বাস করে বলেই তোমার যুক্তিটা নিয়ে ও ভাববে। ভাবতে ভাবতে একসময়ে মেনে নেবে।
কিন্তু আমার তো কোনও যুক্তি নেই। ও যদি কাজল মুণ্ডা নাম নিয়ে মাথা উঁচু করে থেকে থাকতে পারে, যদি ও মিস্টার মুণ্ডা নামে ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ-এ স্কলারশিপ নিয়ে যায়, তাতে ক্ষতিটা কী! তোর কি পালচৌধুরী পদবি নিয়ে, আমার কি ব্যানার্জি পদবি নিয়ে কোনও আপত্তি আছে? থাকলেই অ্যাফিড্যাভিট করব!
একটু বিষণ্ণ হেসে শিখরিণী বলল, আমাদের অ্যাফিড্যাভিট করার দরকার নেই। এমনিতেই আলাদা পদবি হয়ে যাব।
মিঠু বলল, সেটাও কিন্তু আমাদের ইচ্ছাসাপেক্ষ। আমাদের ডিগ্রি টিগ্রি সবই বাবার পদবিতে। কর্মস্থলে পালটাবার অসুবিধে আছে। অনেকেই আজকাল পদবি পালটাচ্ছে না, যাই হোক শিখরিণী, কেন যে এই উদ্ভট প্রসঙ্গ তুললি। আর কেন যে এমন একটা কাজ যাতে আমার সায় নেই— আমাকে দিয়ে তা করাতে চাইছিস, আমি বুঝলাম না! আজ চলি, বাবা ভাববে, কাল কাজ আছে, এখানেও আসতে হবে।
—তোমাকে আমি পৌঁছে দিচ্ছি।
—ধ্যাত, তোকে উলটো দিকে যেতে হবে না? আমার কোনও দরকার নেই। আমি অটো নিয়ে চলে যাচ্ছি।
মিঠু উঠে পড়ল।
সত্যি কথা বলতে কী তার ভীষণ বিরক্ত লাগছিল। সমস্ত জিনিসটাই অর্থহীন। হঠাৎ কাজলের গোপন অভিভাবক হয়ে ওঠার অধিকার ওকে কে দিল? করবি করবি, নিজে কর। এখন ভেবে দেখলে শিখরিণীর সত্যিই একটু সর্দারি দিদিগিরির ভাব আছে। ও অনেক জানে, বোঝে, শুধু নিজেরটাই নয় অন্যেরটাও। মিঠু যখন এন. জি. ও-তে কাজ নিল, তখন কলেজ সার্ভিসে পরীক্ষা দেওয়াতেই যে মোক্ষ সেটা ও মিঠুকে বোঝাতে অনেক যুক্তি খরচ করেছিল। হঠাৎ এখন কাজলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে। ভাবুক। তাকে দিয়ে কেন?
বাড়ি ঢুকে আগেই সে চান করতে ঢোকে।
বাবা চেঁচিয়ে বলল, এ সময়ে চান কোরো না। একটু হাত পা ধুয়ে নাও ব্যস।
সে চেঁচিয়ে বলে ঠিক আছে। —কিন্তু গায়ে জল ঢালে ঠিকই। আফটার অল বাবা তো তার গোপন অভিভাবক নয়, আসল এবং খোলাখুলি। বাবার কথা সবসময়ে অমান্য করা তার একটা বিশ্রী অভ্যাস হয়ে গেছে। বাবা তো থাকত জামনগরে, বছরে খুব জোর দু’বার দেখা হত। মা-ই ছিল তার অভিভাবক। একটু বড় হওয়ার পরেই সে-ও মা’র। বাবাকে সে চিরদিনই অতিথি হিসেবে দেখেছে। মানছে যে— এই বিশ্বাসটুকু বেচারি বাবার থাক।
গায়ে জল ঢালতে ঢালতে হঠাৎ স্ক্রিনে ভেসে ওঠে শিখরিণীর সুন্দর মুখটা। কী এক দুশ্চিন্তায় মুখটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে। রোদ ঠিকই। কিন্তু বিকেলবেলার রোদ। এবং তখনই লাফিয়ে ওঠে কারণটা। মনের ওপর দিয়ে ভেসে যায় কস্তুরীদির মন্তব্য— ‘য়ু নো হোঅট কাজল, য়ু উইল মেক আ ফাইন হাজব্যান্ড্, সো কেয়ারিং অ্যান্ড কমপিটেন্ট।’ শিখরিণী কাজলকে ভালবাসে, ওকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু মুণ্ডা পদবিটা বোধহয় ওর পরিবারের সম্মতি পাবে না। তাই…। মুণ্ডাকে ও সিং, সিংহের এক সংস্করণ বলে চালাবে। অদূর ভবিষ্যতে কাজল দাঁড়াবে কাজল সিংহ আ ফাইন হাজব্যান্ড, কেয়ারিং অ্যান্ড কমপিটেন্ট, অব শিখরিণী সিংহ। বিয়ে করেই চলে যাবে লন্ডন। থেকে যাবে ওখানে। তারপর কে আর কার অতীত ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাতে যাচ্ছে!
এটা অনুমান। কিন্তু সঠিক অনুমান। অনুমানটা তাকে অনেকক্ষণ অসাড় করে রেখে দিল। মগে জল নিয়ে মিনিটের পর মিনিট বসেই আছে, বসেই আছে।
বাবা ডাকল আবার। বেচারি!
—যাই বাবা— সে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরোয়।
—সেই চান করলি?
—না তো!
বাবাই টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। ইলিশমাছ আজকে। খুব উৎসাহের সঙ্গে টেবিল সাজিয়েছে বাবা। খাবারগুলোও গরম করেছে। একটা কাঁটা ফুটে গেল তার মাড়িতে। আবার ওঠো, সাইলিসিয়া খাও। ধুত্, বাবার খাওয়াটাই মাটি করে দিল সে আজ। কিছুক্ষণ অন্তর অন্তরই জিজ্ঞেস করছে—গেছে! গেছে!
—আস্তে আস্তে যাবে বাবা।
—হ্যাঁ, বুঝতেই পারবি না কখন গলে গেছে।
তাই-ই তো বলছি। তুমি ব্যস্ত হচ্ছ কেন!
সে দেখল বাবা তার ঘরের দেওয়ালে মায়ের ছবিটার দিকে করুণ চোখে চেয়ে আছে। বাবা জানে— কেন মেয়ের এই অবাধ্যতা, কেন দু’জনের মধ্যে এই দূরত্ব!
সারারাত অজ্ঞাত অস্বস্তিতে ঘুম আসে না। ঘুম আসে না। নিজেই নিজেকে আয় ঘুম যায় ঘুম করতে থাকে সে। ভোরের দিকে দেখল মা বসে আছে একটা চেয়ারে। সামনে আর একটা চেয়ারে কস্তুরীদি। মায়ের পরনে সাদা চিকনের কাজ করা শাড়ি। কস্তুরীদির নীল শাড়ি। এই হালকা নীলটা মায়ের খুব প্রিয় ছিল। কেন যে এই শাড়ি বদলাবদলি সে বুঝতে চাইছিল না। কেমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারপর যেন নিজেই নিজের বোকামিতে লজ্জা পেল, একটা সোজা অঙ্ক না পারলে যেমন পায়। ঠিকই তো আছে! আরে!!
১১) যাত্রা শুরু
ভোরবেলা ইস্পাতে যাচ্ছি আমরা— আমরা চারজন— কস্তুরীদি, মিঠু, শিখরিণী ও আমি। গতকাল সকালে কস্তুরীদি খুব রহস্যময় ব্যবহার করছিলেন। দেখি ওঁর ক্যারি-অনটা গোছাচ্ছেন।— কী ব্যাপার দিদি, ফিরে চললেন?
প্রথমে জবাবই দেন না। তারপরে যখন মুখ তুললেন, দেখি মুখ থমথম করছে, বললেন, ফিরে যেতে তো আসতে চাইনি!
—তবে কোথায় চললেন?
—আমাকে একটু পশ্চিমবঙো বর্ডারে ঘুরতে হবে। কিছু খুঁজচি।
—তা বলবেন তো!
—তোমাকে বলব কেনো?
—কেননা, নিতাইদা আমার ওপর আপনার দেখাশোনার ভার দিয়েছেন।
—তো দেকাশোনা তো করলে। মাতায় জল, ওষুদ, গর্ম সুপ, রাত থাকা কিচু তো বাদ নেই।
—আপনি যদি আমদাবাদ, আপনার নিজের জায়গা ছাড়া আর কোথাও যেতে চান, আমাকে আপনার সঙ্গী হতে হবে দিদি। আপনাকে আমি একা ছেড়ে দিতে পারি না।
—কোতোবার বলবো এ-ও আমার নিজের জায়গা! জায়গা দিবে না, না কী! নিজের জায়গা পোরের জায়গা এ সোব কী! একটা এডুকেটেড ইয়াং ইন্ডিয়ান তো তুমি! না কী!
—ঠিক, দিদি— এ আপনারও নিজের জায়গা। কিন্তু সব কিছুর তো একটা পরিপ্রেক্ষিত থাকে।
—শোক্ত কোথা বলবে না।— অর্থাৎ ‘পরিপ্রেক্ষিত’ উনি বোঝেননি, এবং ওঁর মুড খারাপ।
একটু পরে, আমার দৃঢ় মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপাতত জাড়গ্রাম যাব। শোক্তো কিচু? ইস্পাত ধরব চলে যাব।
—ঝাড়গ্রাম!!!
—কেনো। পাণ্ডবরা যায়নি নাকি? টিক আচে যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন না গেলো, আমি যাব।
—না, তা নয়। আমাকে যেতে হবে। ঝাড়গ্রাম কেন বুঝতে পারছিলাম না।
সোব বুঝা সোজা নয়।
খুব মন্থর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মুখে দাঁড়ালাম। মিঠুকে ফোন করলাম কাল সকালের ইস্পাত ধরে ঝাড়গ্রাম যাচ্ছেন দিদি। বেজায় চটেছেন— কেন জানি না। তোর যাওয়া উচিত, নিতাইদাকে এক্সপ্ল্যানেশন তোকেও দিতে হবে। চট করে চলে আয়। আর শিখরিণীকে একটা ফোন করে জানিয়ে দে। আমাকে বলেছিল সব প্রোগ্রাম জানাতে।
—তুই-ই দে না।
—অসুবিধে আছে। কনজারভেটিভ ফ্যামিলি। কাজিয়া আমার ভাল লাগে না।
আধ ঘণ্টার মধ্যে মিঠু এসে পড়ল। অসম্ভব ফাস্ট। সবসময়ে এক পায়ে খাড়া। ওকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।
—তুমি! তুমিও যাবে!
—হ্যাঁ দিদি, যতদিন পারি আপনার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে দিন। আমার ভাল লাগছে।
সস্নেহে তার কাঁধে হাত রাখলেন দিদি।— টিক আচে। তুমি যতদিন আমার সঙে থাকতে চাও, থাকবে। কিন্তু কোস্টো হোবে!
—কী যে বলেন দিদি! আমি এন সি. সি করেছি, মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স নিয়েছি। দার্জিলিং থেকে সন্দকফু ট্রেকিং করেছি, তখন আমি কলেজও পেরোইনি।
বোলো কী? তুমার এতো বীর তা তো বুজিনি!
অর্থাৎ মিঠু চট করে পেয়ে গেল অনুমতিটা, যার জন্যে আমাকে যথেষ্ট কসরত করতে হয়েছে। মিঠুর অ্যাপ্রোচ আলাদা। সাংঘাতিক পাবলিক রিলেশনস সেন্স।
আমি টিকিট করতে যাচ্ছি, দেরি হতে পারে। ভাববেন না।— বললাম, চলে আসছি, মোবাইলটা বাজল।
মিঠু বলল, ধর, ওটা শিখরিণীর।
তাই তো দেখছি। শিখরিণী বলল, আমিও যাচ্ছি। আমার একটা টিকিট যেন থাকে।
বললাম— দিদিকে দিচ্ছি।
উনি বলছেন শুনছি— না না। তুমি পারবে না। কোষ্টো হোবে। এন সি. সি. করেচো? মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স নিয়েচো? সন্দকফু ট্রেকিং করেচো? আমি আর মিঠু ওঁর কথা শুনে হাসছি।
হাসিহাসি মুখেই বললেন, বেশ, রাজকন্যের যকন দেশ দেখার সাদ হয়েচে তো দেকবে। কিন্তু বিপদের জন্য রেডি থাকতে হোবে।
মোবাইলটা হাত দিয়ে চাপা দিয়ে বললেন, কাজল, দিস আই ডোন্ট লাইক। এতো জন গেলে আমার কাজটা না হোতে পারে। তারপোর ওতো সুন্দরী মেয়ের দায় নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ডিসকারেজ হার। দিদিমোণি!
মিঠু বলল, আমি পারব না দিদি। কাজলকে দিন।
মোবাইলটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিলেন উনি। কী আর করি! বললুম, শিখরিণী প্রবলেমটা বোঝো। বুঝতে চেষ্টা করো। এ একরকম নিরুদ্দেশযাত্রা। দিদি কোথায় কোথায় যাবেন, নিজেই ভাল করে জানেন না। তোমার মতো সুন্দরী মেয়েকে এরকম যাত্রায় নিতে উনি ভয় পাচ্ছেন। কানট ব্লেম হার। দেশকাল বড় খারাপ।
—শিখরিণী বলল, কেন তুমি তো আছ?
আমি বলি, আমি আছি ঠিকই। কিন্তু আমার সব শক্তি যদি তোমাকে প্রোটেকশন দিতেই চলে যায়, আমার আসল দায়িত্বটা পালন করব কখন?
—আমি নিজেই নিজেকে প্রোটেক্ট করতে পারব। প্লিজ কাজল, একঘেয়ে জীবনে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। আমাকে একটু চান্স দাও।
ওদের দিকে তাকিয়ে আমি বলি, নাথিং ডুয়িং। ও যাবেই, অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ।
ঈষৎ বিরক্ত হয়ে দিদি বললেন, ও জানল কী করে?
মিঠু খবর দিয়েছে বোধহয়— অম্লানবদনে আমি বললাম।
মিঠু কটমট করে আমার দিকে তাকাল একবার।
সুতরাং আমরা যাচ্ছি চারজন। দিদি, মিঠু, শিখরিণী ও আমি। শিখরিণী অবশ্য তার নিয়মভঙ্গ করে সালোয়ার কামিজ পরে এসেছে। অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে তৈরি। যাই হোক তবু একটু বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। বললাম, একটা কুকরি নিয়েছ?
—কুকরি? কুকরি কেন?
—ওই যে নিজেকে প্রোটেক্ট করবে।
—আমিই সবাইকে প্রোটেক্ট করব— একটু জেদি, গর্বের সুরে বলল ও। এইটা ওর অহঙ্কার আমি লক্ষ করেছি। নেত্রী-নেত্রী ভাব। নেতৃত্ব দেবার জোর ওর ভেতরে সত্যি-সত্যি আছে কিনা যাচাই না করেই ওর এমনি ভাব। মনে মনে হাসি।
১২) প্রথম পর্ব
কতকাল পরে ঝাড়গ্রাম দেখলাম। গাছ ঝুঁকে আসা লাল কাঁকুরে রাস্তা, রাজবাড়ি, ওই পুব দিয়ে বয়ে গেছে ডুলুং নদী। নদীর ধার দিয়ে দিয়ে সরু আঁকাবাঁকা রাস্তা। এই বুনো রাস্তা দিয়ে চললে কনকদুর্গার মন্দির। আরও গেলে গিধনি। দলমা-পাহাড়ের কোলে। হঠাৎ যেন টুরিস্টের চোখ দিয়ে দেখতে পাই। কত অন্যরকম এবং কী সুন্দর আমার জন্মভূমি! এই সৌন্দর্য কখনও দেখতে পাইনি। গাছপালা ভাল লাগত, কিন্তু সে আমার পাড়া বলে, আড়াল বলেও কতকটা। পরিষ্কার পোশাক পরিচ্ছদ পরা লোকগুলোকে দেখে আমরা খরগোশের মতো পালাতাম। ডাকলেও পেছন ফিরতাম না। ওরা অন্য গ্রহের জীব, আমাদের সঙ্গে কোনও মিল নেই।
লোক্যাল গাইডরা বিরক্ত করতে লাগল— মন্দির দেখবেন? সাবিত্রী মন্দির! সবিতা, সূর্যের মানুষ-মেয়ে তিনি। মূর্তি নেই, খালি কেশগুচ্ছ আর খড়গ আছে। চতুমুর্খ শিব আছেন দিদি, লোকেশ্বর বিষ্ণু, মনসা দেবী? আচ্ছা তবে চিড়িয়াখানা, হর্টিকালচারাল গার্ডেন? দিদি চুপ, কেমন টেন্স হয়ে আছেন। শুনছেনই না। একটি হোটেলে খাওয়াদাওয়া সারা হল, ওঁরা অনেক কষ্টে একটা জিপ জোগাড় করে দিলেন। রাজবাড়ির চত্বর গাড়িতে গাড়ি। এখানে ধনী লোকেরা গাড়িতেই আসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে, এখানে অ্যামবাসাডর থেকে টাটা সুমো সবই আছে। এক একটা গাড়ি থেকে নামছেন সুসজ্জিত, ভুঁড়িঅলা, টি-শার্ট প্যান্ট, পায়জামা পাঞ্জাবি, শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, টাইট জিনস্, হাতে মোবাইল, হাই হিল। সব গটগট করে চলে গেল। আমরা খাওয়ার জন্য প্রথম ওখানেই গিয়েছিলাম। ওখানে নাকি ঘণ্টা দুই-তিন আগে অর্ডার না দিলে কিছু পাওয়া যায় না। এই প্রথম ঝাড়গ্রামের মল্ল রাজবাড়ির ভেতর ঢুকলাম। চৌকোনা চত্বরে ফোয়ারা, ফুলের কেয়ারি, সিঁড়ি বেয়ে এই প্রথম উঠলাম রাজবাড়ির ডাইনিং হলে। এটাই নাকি সবচেয়ে রাজকীয়। পুরনো রাজবাড়ির এই ঘরটি সম্ভবত দরবার ছিল। বহু ঝাড়। ধবধবে চাদর পাতা টেবিল। পুরনো আমলের রাজকীয় সাইডবোর্ড। তবে আমাদের ভাগ্যে রাজভোগ হল না। দিদি হঠাৎ বললেন, গিধানি যাব।
গিধানি নয়, গিধনি— ড্রাইভার সংশোধন করে দেয়।
আমি কিছু বলিনি। এবার দিদির ইচ্ছা আর আমার ভবিতব্য।
তবে তাড়াতাড়ি ফোন করি ঝাড়গ্রামের ফরেস্ট অফিসারকে। যদি একটা ইন্স্পেকশন বাংলো বুক করা যায়।
এইভাবে বলি— আমদাবাদের বিখ্যাত কটন কিং নরেন্দ্র মেহতার মেয়ে বিখ্যত সমাজসেবিকা কস্তুরী মেহতা এসেছেন। গিধনিতে হয়তো দু’-তিন দিন থাকবেন। ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল। বললেন, নিশ্চয়ই, আমি খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি।
এসব কথা কস্তুরীবেনকে বলা ঠিক বিবেচনা করলাম না। জেদি মানুষ, হয়তো বলবেন আমি গাছতলায় বসে থাকব।
ক্রমশই পথের পাশে লম্বা লম্বা শাল দেখা দেয়। শালমঞ্জরীর গন্ধে ভারী বাতাস। মিঠু আর শিখরিণী দেখি বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে। —আ-হ! শুধু এই হাওয়া খেয়েই থাকা যায়। বিশুদ্ধ অক্সিজেন! তবে কি এই বিশুদ্ধ অক্সিজেন খেয়েই বেঁচে থাকে এখানকার মানুষ। কতকগুলো ছাগলছানা উলটোপালটা লাফাতে লাফাতে পথ পার হয়ে গেল। রাস্তায় থেকে থেকেই মস্ত চারকোনা মাদুরের মতো ধান শুকোচ্ছে। খুব কৌতূহলে দেখি, স্থানীয় মেয়ে-বউরা ধানগুলো উলটেপালটে দিচ্ছে। একটা বাচ্চা ছেলে গোরুর গলা ধরে ঝুলছিল। একজন মহিলা এসে তাকে তাড়া দিলেন। সে গোরু ছেড়ে দৌড়ে কোথায় চলে গেল। কালো কালো ছেলেটা কিন্তু বেশ পুষ্ট। গা খালি, পরনে একটা নীল রঙের ইজের।
আমি বললাম, এখানে যদি গাড়িটা একটু থামাই দিদি, অসুবিধে হবে?
তুমার দোরকার তো যাও—
আমি রাস্তা ছেড়ে ভেতর দিকে নেমে গেলাম। যত যাচ্ছি খড়ের ঘর, তার গায়ে বিচিত্র ছবি। একটা টালির চালওয়ালা পাকা একতলা। দেখি লেখা আছে সাধন মুর্মু নিম্নবিদ্যালয়। নামটা আলাদা, চেহারাটা আলাদা, কিন্তু মনে হচ্ছে এইখানেই আমার সেই স্কুল ছিল, যেখানে ঘায়ের ওপর বেতের খোঁচানি খেয়েছিলাম। ছাতার বাঁট দিয়ে ছেঁড়া জামাটা দু’ফালা করে দিয়েছিলেন মাস্টার। ভেতরে মনে হল ছেলেরা পড়ছে। রাস্তায় একটি লোক দুটো গোরু নিয়ে যাচ্ছিল। একগাল হেসে বলল— ইটা ছেল্যাদের, মেয়্যাদেরও আছে।
কোথায়?
কিছু দূরে দেখিয়ে দিল, বলল— চলুন যাচ্ছি। আপনি টুরিস্ট? দেখতে এসেছ?
আশা করি মাস্টারদের চরিত্র পালটেছে। লোধা বা সাঁওতাল বলে আর ঘেন্না করে না।
হেসে বলি, হ্যাঁ।
সুন্দরী মল্লিক নিম্নবিদ্যালয় দেখি। ভেতরে পড়ার কলরোল। লোকটি বলল, ঝাড়গ্রাম আদিবাসী সংস্কৃতি পরিষদ আর এই সাধন মুর্মু, সুন্দরী মল্লিক মিলে কর্যাছেন। ল হইছে নতুন নতুন। ওঁদের ঠেকাতে পারবেক নাই। গুরু লোক। সব জানে। রিসিভার ঘেঁষতে পারবে নাই।
রিসিভার হল সেইসব লোক যারা লোধাদের দিয়ে চুরিটা করায়। চোরাই মাল বহু দামে বেচে। লোধারা ফুটো কড়ি পায়, আর পুলিশের মার খায়।
আমি বলি, আচ্ছা এখানে আপনারা এখন কেমন আছেন?
—মোটের ওপর ভালই। এই গোরু, ছাগল, মুরগি করছি। আমার ছেল্যা পোলট্রি করেছে মিতের সঙে। এরকম আরও সব নূতন নূতন কাজকাম হইছে। ওই ইস্কুলে আমাদেরই লোক শিক্ষক আছে গ’। শবর, সর্দার, সরেন…।
—আচ্ছা এখানে একটা মুণ্ডাপাড়া ছিল না? খুব গরিব। মোহন সিং, বাসন্তী মুণ্ডা, লক্ষ্মণ… লোধা পাড়ার পাশেই…
লোকটি ভুরু কুঁচকোল। ভাবছে। এর বয়স কত হবে? পঞ্চাশের কাছাকাছি। একটু পরে বলল।— মুখিয়ার কথা বলছ্যান? একটা মুখিয়া ছিল, টিবি হয়ে মরে গেল। অনেকগুলি ছেল্যামেয়া। উদের মা ছেলেগুলি নিয়্যা কুথায় চল্যা গেল একদিন। আমি শুন্যাছি। নিজে দেখ্যি নাই। উঃ ত্যাখন উয়ারা সবসময়ে টং থাকত। সাঁঝ হল্যাই বসে গ্যালো।
এখন?
বাপ রে। সব নিজের নিজের ছেল্যার মাথায় হাত রেখে, মাকে কথ্যা দিয়্যাছি ছুঁব না। পাপ জিনিস।
কোন মায়ের কথা বলছে? কালী? এখানে একটা ছোট কালীমন্দির ছিল বটে।
হর্নের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। ড্রাইভার, সঙ্গে সঙ্গে দিদি আর তাঁর স্যাঙাতরা— সকলেই অধৈর্য।
আমি দৌড়োই। ছোটখাটো ঢিবি, গোবরের স্তূপ টপকে টপকে দৌড়োই।
শিখরিণী বলল, কোথায় গিয়েছিলে? এতক্ষণ লাগল?
এটা আমার ছোটবেলার চেনা জায়গা। দেখতে গিয়েছিলাম। মিঠু দেখি একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে আছে। ও বোধহয় আন্দাজ করেছে।
কস্তুরীবেন বললেন, আসোল কোথা, বুঝলে কাজল, ছুটবেলাই সব বেলা।
আপনি কী বলতে চাইছেন? মর্নিং শোজ দা ডে?
নো, নো। তা টিক নয়। ছুটবেলাই আমাদের গোড়ে। সোব কিচুর রুটস ছুটবেলায়।
যদি ধরুন ছোটবেলায় কেউ খুব সাফার করে, শিক্ষা-সংস্কৃতির স্বাদ না পায়?
সে তখন জিদ করবে। তুমার মতুন হবে।
দিব্যি বসে নাচতে নাচতে চলেছেন। মুখ দেখে কিছু বুঝতে পারলাম না, বুঝে বললেন, না না-বুঝে বললেন।
আমি আমার মুখ বাইরের রুক্ষ হাওয়ার দিকে ফিরিয়ে বসি।
….গোলমতো আলপনা দেওয়া হয়েছে, তাকে বলে ঘঁড়। চালের গুঁড়ি মেথি সিঁদুর সব দেওয়া হয়েছে। কিছু আতপচাল, দুর্বা ঘাস দিয়ে দিহরি পুজো শুরু করলেন। ঘঁড়ের ওপর একটা ধপধপে সাদা ডিম। ধরিত্রী মাতার প্রতীক। রাখালরা সব গোরু দিয়ে আসছে পুজোর থানে। যে বলদ বা গাভী এই ডিম ছোঁবে সেই উৎসবের মধ্যমণি। তাকে তেল-সিঁদুর মাখানো হবে। তার মালিককে সবাই কাঁধে করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্মণ মাঝি সবাইকে হাঁড়িয়া খাওয়াচ্ছে। প্রথম পুজো মারাংবুরুর। তাঁর ভাগে একটি সাদা মোরগ। তারপরে সব যে-যার বংশের দেব্তার পুজো দিচ্ছে। পাঁচ দিন ধরে পুজো। সহরায় উৎসব। শরতের পরে হেমন্ত এসেছে। মাঠে মাঠে ধান। চাষি খেটেছে, তার সঙ্গে সঙ্গে ভগবতীও তো খেটেছে সমানে। তাই গো-মহিষদের পুজো, সারহাও মানে প্রশংসা। গো-মহিষরাই কেন্দ্র এই উৎসবের
ও হি রে—
জাগো মা লখিনি
জাগো ভগবতী
জাগোই তো অমাবইসার রাতরে-এ-এ।
আতপচালের গন্ধ, বলির রক্তের গন্ধ, এই দিনের বেলায় শেষবেলার রোদের মধ্যে সহরায়-এর গান ভেসে আসে। আকণ্ঠ উৎকর্ণ শুনি। সাদা মোরগটির জন্য বড় কষ্ট, আমার নিজের মোরগ কিনা! মারাংবুরুর কি মোরগ না হলে চলে না? এই মোরগটা কঁক কঁক করে দৌড়োত… আমি ওর পেছনে ছুটতাম।
কী শিখরিণী। কেমন বুঝছ? গাড়ি কেমন কত্থক নাচছে?— হেসে জিজ্ঞেস করি।
উত্তরে সে বলে, যতখানি আতুপুতু আমাকে মনে করো ততখানি আমি নই হে!
তখন তো কিছু বুঝতাম না— সাদা ডিমটি যে পৃথিবীর প্রতীক সে কথা জানতাম না। জানতাম না, মারাংবুরু পশুপতি জঙ্গলপতি, যাঁকে এরা শিব বলে, জানতাম না সিংবোঙা সূর্য। প্রতিদিনের আধপেটা জীবনে গো-মহিষের কাঁধে ভর করে একটা আনন্দের দিন এসেছে, শুধু এটুকু বোঝাই যথেষ্ট ছিল। খিচুড়ি রাঁধা হবে বলির শুয়োর ভেড়া মরগি দিয়ে। ভাগ পাব নিশ্চয়। অনেক দিনের পর পেটভরে খেতে পাব। সাঁওতাল, মুণ্ডা, কুর্মি, ভূমিজ, লোধা সবার উৎসব সহরায়। যদিও লোধাদের জমিজমা সামান্যই, ওরা কাঠকুটো পাতা কুড়োয়, ইঁদুর পেলে পুড়িয়ে খায়, গোসাপ খেতে তো ওস্তাদ। আমার বন্ধু ছিল সমীর কটাল। চৌধুরী মাস্টার খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে বলত, সমীর, সমীরণ— ভদ্দর নাম নিতে সাধ হয়েছে! মরি মরি! কী ভদ্দর! চান করিস? সাবাং মাখিস? তেল তো বোধহয় জীবনে মাখিসনি। জামাকাপড়? এই ছেঁড়া ত্যানাগুলো পরেই হাগিস, মুতিস, খাস, ঘুমোস, আবার পড়তে এসেছিস? সমীরের আর আমার অনেক কষ্ট করে জোগাড় করা বইখাতা অন্য ছেলেরা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে রেখে দিত। শেষকালে সমীর একদিন মাস্টারের কাছে বেধড়ক মার খেয়ে, আবার ঘরে ফিরে গিয়ে বেধড়ক মার খেল বাপের কাছে।
লিখাপড়ার শক হঁইছে? ঘরে চাল নাই। মা, বুন শাক তুল্যা রাঁধছ্যে, তুমি বাবু হঁতে যাইছঁ? পরদিন গোঁজ মুখে আমাকে বলল— তুই যা, আমি আর যাবক নাই। লিখাপড়াতে মার, না লিখাপড়াতেও মার। আমি জঙ্গলে শিকার যাব। খরগোশ পেলে একা একা পুড়িয়ে খাবো। যাঃ।
কে জানে সমীর কী করছে এখন! এখন আমি ওই সমীর কটাল, লক্ষ্মণ মাঝি, বাসন্তী মুণ্ডাদের সঙ্গে একাত্ম বোধ করি না। দায়িত্বও বোধ করি না কি? আমার জগৎ উন্মুক্ত উদার, আমি সিংহবিক্রমে বিচরণ করি স্বনামে, স্বপরিচয়ে, গর্তের ইঁদুর বার করার কাজে উৎসর্গ করার জীবন আমার নয়। এইটুকু বুঝি। তরোয়াল দিয়ে ঘাস কাটার কাজ হয় না। ওই তো আদিবাসী সংস্কৃতি পরিষদ হয়েছে জায়গায় জায়গায়। স্কুল হয়েছে, ছেলেদের, মেয়েদের, ওখানে আমাদের সাঁওতাল, মুণ্ডা, মাস্টারমশাই। ওরা নিশ্চয় কারও ঘা খুঁচিয়ে দিয়ে মজা পায় না, ছেড়া জামা আরও ছিঁড়ে দেওয়ার নিষ্ঠুরতা নিশ্চয়ই ওদের নেই! আমি যে মুণ্ডা পরিচয়কে শিক্ষিত সমাজে সম্মানের যোগ্য করে তুলতে পারছি। এটাও তো অনেক।
হঠাৎ খেয়াল হল— কস্তুরীদি চুপ। আমিও চুপ। দু’টি মেয়ে, বিটি ছেল্যা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।
মিঠু বলছে, আমি মধুপুর এসেছি। গিরিডি যখন গেছি তখন উশ্রীর জল অমন শুকিয়ে যায়নি। তুই সাঁওতাল পরগনা একেবারে দেখিসনি? বাঙালির ছুটি মানেই তো হয় দিঘা, পুরী, দার্জিলিং আর নয়তো শিমুলতলা, মধুপুর, ঘাটশিলা।
শিখরিণী বলল, তা কেন? এখন যেখানে যাবে বাঙালি ট্যুরিস্টের ভিড়, একগাদা ট্রাভল এজেন্ট হয়েছে তারা তো অমরনাথ, কেদার, ছাঙ্গু লেক, সর্বত্র নিয়ে যাচ্ছে। জানো তো, গত বছর দক্ষিণ ভারত গিয়েছি। কন্যাকুমারীতে দেখি ছ’-সাতজন একেবারে গ্রাম্য বুড়ি হাত ধরাধরি করে ঘুরছে! হাত ধরাধরি কেন বলো তো? পাছে হারিয়ে যায়!— শিখরিণী হাসতে লাগল।
মিঠু বলল, ওরা কিন্তু তিন সমুদ্রের সঙ্গম দেখতে যায়নি। তীর্থযাত্রায় গেছে। যে কদিন থাকবে মন্দিরে দু’বেলা হাজিরা দেবে, আর ভারতীয় অন্তরীপের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে গুচ্ছের ফুলপাতা দিয়ে সমুদ্রপুজো করবে। উপরি পাওনা বিবেকানন্দ মন্দির। বিবেকানন্দ কে বলো তো? রামকৃষ্ণের শিষ্য, পরবর্তী গুরু। বাস।
অতটা আন্ডারএসটিমেট কোরো না। রামকৃষ্ণ লিটরেচার, বিবেকানন্দ রচনাবলী তো আজকাল অনেকেই পড়ে, অন্ততপক্ষে ধর্মগ্রন্থের মতো।
তা হলে বলো, এমন দশা কেন? কী রে কাজল! কিছু বলছিস না যে বড়!
আমার কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, তবু বললাম, গ্রেট মেন কাম অ্যান্ড গ্রেট মেন গো। বাট দা আমজনতা গোজ অন ফর এভার। সেই কবিতাটা মনে করতে পারো না, অনবরত পঠিত ও আবৃত্ত হয়ে চলেছে—ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে/ ক্ষমাহীন সংসারে।
মিঠু বলল, ক্লিশে হয়ে গেছে কাজল, ব্যবহৃত হতে হতে, ব্যবহৃত হতে হতে—ওর ভেতরের ম্যাজিক হারিয়ে গেছে। নতুন কবিকে নতুন বাণী দিতে হবে।
আমি হেসে বললাম, তুই এখনও বাণীতেই স্টিক করে আছিস তা হলে? গুড!
এটা কি উপহাস?— মিঠু জিজ্ঞেস করল।
যা বলিস!
১৩) দ্বিতীয় পর্ব
গিধনি এসে গেছে। কস্তুরী বুক ভরে শ্বাস নিয়ে জিপ থেকে নেমে দাঁড়ালেন। দলমা পাহাড় দেখা যাচ্ছে অদূরে, তবে নিশ্চয়ই খুব কাছে নয়। এ জায়গাটায় বেশ জঙ্গল আছে, খেতও যথেষ্ট। ইনস্পেকশন বাংলোটি খুব পুরনো পুরনো মতো। যেন অনেক দিন ব্যবহার হয় না। চৌকিদার হাত জোড় করে এসে দাঁড়াল— ডি এফ ও সায়েব ফোন করেছেন। আপনাদের দু’খান ঘর রেডি রেখেছি। কী খাবেন আজ্ঞা? মুরগি ভাত?
—আমি ভেজ, নিরামিষ খাই— যা হোক দেবে— কস্তুরী হুকুম করলেন, তুমার নাম কী?
—আজ্ঞা রতন, রতন কিস্কু।
—সাঁওতাল?
—যা বলেন মা।
—কেনো? যা বুলবো কেনো, তুমি যা তাই বুলবো!
ভয়েভয়ে লোকটি বলল— রান্না সব আমিই করি।
—করবে। লোকে তুমার হাতে খায় না, নাকি?
—খায় মা, আবার কারও কারও কদাচিৎ আপত্ত থাকে! তাই জিজ্ঞেস করে নিই। এই দিদিমণিরা, এখন কী খাবেন!
—এখন খাবার কী আছে রতন? শিখরিণী জিজ্ঞেস করল।
—রতনদা, চা পাওয়া যাবে তো? এই তোরা মুড়ি খাবি?
ঠিক হল মুড়ি আর চা-ই প্রশস্ত এখন। বিকেল মরে এসেছে। জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে, জামাকাপড় পালটাতে সময় লাগল।
কস্তুরী বললেন, আমি একটু বেরোব।
—এই অন্ধকারে?
—এখুনও তো আলো আছে। কেমন অদ্ভুত শোনাল ওঁর কথা। যেন উনি আর কিছু বলতে চাইছেন।
কাজল কিছু বলল না, খালি তার পাঁচ সেলের টর্চটা নিয়ে রেডি হল।
—তুমি কুথায় যাবে? কস্তুরী সন্দিগ্ধ স্বরে বললেন।
—আপনার যেমন কাজ আছে, আমারও তেমন একটু কাজ আছে দিদি।
—সে কাজ কী? আমার পিছন পিছন আসতে নিতাইদা বলে দিয়েচেন?
—না। আমার নিজস্ব কাজ। কৌতূহল। আপনি আলাদা যেতে পারেন। কিন্তু এই পাথুরে রুক্ষ জায়গায় যদি চোট পান, আপনার আসল কাজ তো হবে না দিদি।
বাংলোর বাইরে বেরিয়ে উনি বললেন, কী আমার আসল কাজ? তুমি আমার চে বেশি ভাল জানো মনে হচ্চে।
খুব অবভিয়াস দিদি যে আপনি কাউকে খুঁজছেন, আপনার অতীতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। এইসব জঙ্গলমহলে তেমন কাউকে যদি আপনি খুঁজতে চান, আমার সাহায্য ছাড়া পারবেন না। আমি আফটার অল লোক্যাল লোক, এদের নিজেদের লোক। আমার কাছে ওপন-আপ করবে, আপনাকে কিছুই বলবে না।
হঠাৎ সেই আধা-অন্ধকারে কাজল বুঝতে পারল কস্তুরী কাঁপছেন। তারপর ওই ব্যক্তিত্বময়ী দুঁদে সমাজসেবিকা, ঝানু ব্যাবসাদার, মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলেন।
—কাকে খুঁজছেন দিদি! আপনার ছোটবেলার চেনা কোনও প্রিয় বিপ্লবীকে? আমাকে বলুন। আমি কাউকে বলব না। যথাসাধ্য চেষ্টা করব খুব কোয়ায়েটলি পাত্তা করতে। য়ু ক্যান ট্রাস্ট মি।
বেশ কিছুক্ষণ সময় নিলেন উনি। তারপর নিজেকে সামলে ধরাধরা গলায় বললেন, য়ু নো হোয়ট কাজল! য়্যু ক্যান বি আ ফাইন ফ্রেন্ড, সো কেয়ারিং অ্যান্ড কমপিটেন্ট। অন্ধকারে কাজল হাসল, বলল, বুঝতে এত দিন সময় নিলেন দিদি? আমারই ভুল। সম্পূর্ণ একজন আউটসাইডারকে আপনি কী করে বিশ্বাস করবেন!
—না কাজল, ভুল আমারই। জেদ, বহোৎ জিদ্দি হুঁ ম্যয়। অ্যান্ড ইগো। আই সি আই হ্যাভ টেরিবল ইগো।
কাজল কিছু বলল না। অন্ধকার টর্চের আলোয় চিরে পথ ধরে দু’জনে খানিকটা এগোলেন, একটা শাল গাছের তলায় মোটামুটি বাঁধানো বেদি। কাজল বলল, এইখানে এদের গরাম দেবতার থান দিদি, শাল গাছের তলায় দেখছেন কত্ত আতপচাল পড়ে আছে? আরও কিছু থাকতে পারে, অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। এখানে একটু বসুন।
—না না, দেবতা আছেন। রাগ করলে?
—কে রাগ করবেন? দেবতা? দেবতারা রাগ করেন না, আপনি জানেন না দিদি? রাগ মানুষই করে। যাদের থান তারা এখন ওই মহুয়া শালের জঙ্গলের মধ্যে কোথায় তাদের ছোট্ট গ্রাম আছে সেইখানে ঘুমোনোর তোড়জোড় করছে। দেখতে আসছে না কে তাদের গরাম-থানে বসল, কি না বসল।
সে একটা বড় রুমাল বিছিয়ে দিল।
—তুমি?
—আমিও বসছি। আমার এই জিনস্ হল সর্বংসহা। জাস্ট একটু ঝেড়ে নিলেই হাঁসের পাখা থেকে জলের ফোঁটার মতো পড়ে যাবে। কাকে খুঁজছেন দিদি? আপনার মা?
চমকে উঠলেন কস্তুরীবেন।
—আপনার মা কি বাই এনি চান্স আদিবাসী ছিলেন?
—এ কোথা কেনো মনে হল?
—এই জায়গায় তাঁকে খুঁজতে এসেছেন বলে। এইসব জঙ্গলমহলে ট্রাইব্যালরা ছাড়া আর কেউ বাঁচতে পারে না দিদি। দু’বেলা পেটে অন্ন নেই। ইঁদুর, গোসাপ, ঢ্যামনা সাপ যা পায় জাস্ট পুড়িয়ে খায়। বনের মধ্যে কেঁদ পাতা তুলে বিক্রি করত। কেঁদ পাতায় বিড়ি হয় তো! তো সরকার তা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন তুললে বেচতে হবে সরকারকে, অনেক কম দামে। কাঠকুটো কুড়োয়, মাইল মাইল দূরে হাটে বিক্রি করে যেটুকু পয়সা পায় তেল নুন, কখনও কখনও চাল কিনে আনে। সন্ধেবেলা হয়তো পৌঁছোল তারপর কাঠকুটো জ্বেলে রান্না হবে। স্রেফ ভাত নুন, আর শাক পেলেই যথেষ্ট। তার ওপর বন থেকে খুঁড়ে কাঁটা আলু, চুড়কা আলু কি বাঁউল্যা আলু পেল তো রাজভোগ। সারাদিন পরিশ্রম। তারপর বাড়িতে বাড়িতে হাঁড়িয়া পচুই হয়, বড়রা সেই নেশায় মেতে যায়, সব-ভোলা নেশা, ছোটরা ঘুমিয়ে পড়ে। এর মধ্যে সভ্য জগতের কোনও মহিলা বাস করবেন— বিশ্বাস করা যায় না। সম্ভব নয়। তাই বলছিলাম…
—আমার মা বাঙালি, কাজল। আমার সমুস্ত শিক্ষা তাঁর কাছে। আমি তখন আবছা বুঝতে পারতুম, এখন পরিষ্কার দেখতে পাই শি ওয়জ অ্যান এক্সেপশন্যাল উওম্যান। ওঁরা, ওঁদের জেনারেশন। প্রি-ইনডিপেন্ডেন্স। ওঁরা বহু আশ্চর্য মানুষের কাছে কাছে এসেছিলেন। আমি যতদূর বুঝি, ওঁরা পথ খুঁজছিলেন, কী ওঁদের কাজ হবে স্বাধীনতার পোরে। আমি সেসব কোথা কিছুই বুঝতাম না। খালি আই ইমবাইবড দা অ্যাটমসফিয়ার। খুব হ্যাপি, উৎসাহ ছিল। মা ছিলেন সেন্টার, বাবার কাচে শুনেচি— ওঁরা পার্টিশন আর দাঙা দেখে এতো শকড হয়েছিলেন, যে প্রথমটা বুদ্ধি কাজ করেনি। তারপর দে ওয়েটেড ফর সুভাষচন্দর টু কাম ফর আ লং টাইম, ইভন আফটার দা রিউমর অব প্লেন ক্র্যাশ। ওঁরা নিজেদের রেডি করছিলেন এই পার্টিশন চলে যাবে আবার ভারতে শান্তি ফিরে আসবে। সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে… গাঁধীজি যে বলেছিলেন গ্রামে চলে যাও শিক্ষা বিস্তার করো—সেকথা কাজ করছিল, জওহরলাল যে ইনডাস্ট্রির কথা বলছিলেন, ওঁরা তাতে উৎসাহ পাচ্চিলেন, কিন্তু পুরা নয়। তারপর ফিফটিজ-এ আরও দাঙা হল। দে ওয়্যার ব্রোকন-হার্টেড। বাবা-মা’র মধ্যে কী হল জানি না, কিছুদিন ধরে হচ্চিল, টের পাচ্চিলাম। একদিন সকালে উটে মা দেখতে পেলাম না। কেউ খুঁজল না। বাবা দেখলাম খুব রাগ। আমাকে নিয়ে আমদাবাদ চলে গেলেন। ভেঙে গেল সোব আসর, ভাবনা-আদর্শ। …আমার জীবন। লেখাপড়া করলাম, বিজনেস। বাবাকে খুব ভাল বাসলাম। কিন্তু মা’র কোথা তুললে তিনি, আমার দাদা, দাদিমা সব খুব বিরক্ত হোতেন।
—এখন? এখন আপনার বাবা কিছু বললেন না?
—এখন? হি হ্যাজ পাসড অ্যাওয়ে।
—কোনও হিন্ট দেননি? কোথায় তিনি থাকতে পারেন? কেন বিচ্ছেদ হল?
—নাঃ, হি হ্যাড আ স্ট্রোক, আফটার দা ফার্স্ট স্ট্রোক উনি কীরকম হয়েছিলেন। ভাবনা করতেন, চুপিচুপি কাঁদতেন, আমি জিজ্ঞেস করেচি হোয়ট ওয়াজ বদারিং হিম। কিচু বলেন না। ডাক্তার বললেন সেরিব্র্যাল স্ট্রোকের পর এর্কম হয়। কন্ট্রোল থাকে না। সেকেন্ড স্ট্রোকের পর উনি চলে গেলেন। কাজল, দেন অ্যান্ড দেয়ার আই ডিসাইডেড, আই’ল প্রোব দিস মিস্ট্রি।
কাজল অবাক হয়ে রইল অনেকক্ষণ। একজন বাঙালি ভদ্রমহিলা হঠাৎ গৃহত্যাগ করলেন, তাঁর খোঁজ করল না কেউ, আজ এত বছর পর তাঁকে তাঁর মেয়ে খুঁজতে এসেছেন এই পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খণ্ড বর্ডারে? সে নিজেও একদিন পালিয়েছিল। কিন্তু সে ছিল বাচ্চা। যখন বড় হল, উন্নত জীবনের স্বাদ পেল, তখনও তার নিজের মানুষদের খোঁজে যাওয়ার সুযোগ ছিল, ফাদার মরিসন এবং পরে দেওঘরের হৃদয়াত্মানন্দজি যখন নিশ্চিন্ত হলেন যে সে আর আদিম জীবনে ফিরে যেতে চাইবে না, তখন তাকে একরকম আদেশই করেছিলেন— মায়ের সঙ্গে বাবার সঙ্গে দেখা করে আসতে। সে তখন কোনও পিছুটান অনুভব করেনি। মা বলতে তখন তার চেতনায় ঢুকে গেছে রাফেলের মেরি, রামকৃষ্ণ মিশনের সারদা মা, নিবেদিতা। সে নিজেকে হাঁড়িয়া খেয়ে চুরচুর, শেষের দিকে তো দিনে রাতে সব সময়ে, সেই বাসন্তী মুণ্ডার সঙ্গে নিজেকে সম্পর্কিত মনে করতে পারত না। আজও পারে না। একটা নৈর্ব্যক্তিক অনুভূতি আছে। সেই ট্রাইব্যাল গ্রাম। গরাম-থান, করম পূজা, শিকার খেলা, সেই হতদরিদ্র ও হতকুৎসিত পাড়া।
উন্নত জীবন থেকে কলকাতার সবচেয়ে ভাল জায়গার তিনের এক ফার্ন রোড স্বাচ্ছন্দ্য, আদর্শ, স্বামী এবং বন্ধুদের সঙ্গে মতামতের আদান প্রদান, ছোট্ট একটি মেয়ে এইসব ছেড়ে এই আদিম পৃথিবীতে?
সে বলল, কী করে আপনার ধারণা হল তিনি এদিকে এসেছেন? যাঁদের সঙ্গে দেখা করছিলেন, তাঁরাই বললেন?
উনি মাথা নাড়লেন, চাঁদ উঠছে, পরিষ্কার সামন্তভূমির চাঁদ। সেই আলোয় সে দেখল—ওঁর চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও পড়ল।
কস্তুরী বললেন, ওঁরা কেউ কেউ হিন্ট দিলেন মা আর সুধাকাকু একসঙে এসেচেন। তাইতে বাবার রাগ-অভিমান আমি বুঝতে পারি। আই কান্ট চেঞ্জ দা পাস্ট। কিন্তু মাকে এক্সপ্লানেশন দিতে হবে— তিনি একটা ছোট মেয়েকে ফেলে, স্বামীকে ফেলে এসেচিলেন।
এতক্ষণে ছবিটা স্পষ্ট হল কাজলের কাছে। সেই চিরন্তন ত্রিকোণ। তৃতীয় ব্যক্তি, কখনও পুরুষ, কখনও নারী। আদর্শ, মায়া, মমতা, প্রেম, বন্ধুত্ব সমস্ত কিছু শেষ পর্যন্ত এই ভয়ানক ত্রিকোণের সামনে এসে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে যায়। তাই এত ক্রোধ, এত জেদ, এত অশ্রু। এবং তাই সবকিছু এরকম জীর্ণ বাসের মতো ফেলে যাওয়া। সে নিরুত্তর বসে রইল। অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ। চাঁদ উঠল শালগাছের মাথায় মাথায়। সেদিকে তাকিয়ে তার মনে হল— এই ব্যাখ্যাতীত— এই-ই কি তবে প্রেম? যার জন্য সব ত্যাগ করা যায়! তার সমস্ত সত্তার মধ্যে একটা আলোড়ন যেন একটা প্রশ্নের মতো মাথা তুলল। সে কি এই প্রেম জানে না? কোনওদিন জানবে না? সে সত্যিই এখনও বোঝে না প্রেমের জন্য সব কিছু ত্যাগ করা যায়। ক্ষোভ, ঘৃণা, জিদ, কাজ, এখনও পর্যন্ত তার মনোলোক এই দিয়েই ভর্তি। কোনও রকম সেন্টিমেন্টের জায়গা সেখানে নেই। কিন্তু হঠাৎ সে পরিষ্কার বুঝতে পারল— পালচৌধুরী বাড়ির ওই সুন্দরী মেয়েটি কেন এই নিরুদ্দেশযাত্রায় শামিল হয়েছে। আসবার জন্য ও মরিয়া ছিল। ও কাজলকে চায়। এসব নিয়ে কাজল বাস্তবিকই কোনওদিন কিছু ভাবেনি, নিজের সমাজের কাউকে ও কোনওদিন চাইতে পারবে না। এটা নিশ্চিত। কিন্তু হিন্দুদের বাড়ির একটি সুন্দরী শিক্ষিত ব্যক্তিত্বশীল মেয়ে, তার জন্য এতটা ত্যাগ করতে প্রস্তুত হবে সে কখনও ভাবেনি।
তার অস্তিত্বই ছিল কাজের মধ্যে। সারা পৃথিবীর আদিবাসীদের ইতিহাস, ভূগোল, মনস্তত্ত্ব, পুরাণ, বঞ্চনা, কেন তারা আটকে গেল পাথরের ফাঁকে বহতা নদীর নুড়ির মতো? নদী বয়ে চলে গেল, পাথরের নুড়ি পড়ে রইল সেই এক জায়গায়। ক্রমে শ্যাওলা জমল। ঘন কালচে সবুজ শ্যাওলা, তার তলায় লুকিয়ে থাকতে থাকতে একদম ভুলে গেল নুড়ি তার জন্মকথা। তাকে কোথাও যেতে হবে, যাবার কথা ছিল। স-ব। এখন তার কাজ চলছে আমেরিকার আদিবাসীদের নিয়ে। অ্যাকোমা, থাকত নিউ মেক্সিকোয় গ্যালাস ও অ্যালবুকার্কের মাঝামাঝি ৬০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের ওপর। প্রাচীনতম জনবসতি। শহরটিকে ইস্পাহানিরা আশমান নগর বা স্কাই সিটি নাম দেন। তার মনে পড়ল অ্যালগনকুইয়ানদের কথা, উত্তর আমেরিকার বৃহত্তম গোষ্ঠী, যার মধ্যে বিভিন্ন উপজাতির মানুষ রয়েছেন। আটলান্টিক থেকে রকি পর্বতমালা পর্যন্ত এঁরা ছড়িয়ে রয়েছেন।
পশ্চিম ওরেগনের সিলেৎজ উপজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অ্যাপাচে ইন্ডিয়ানরা তো খুবই বিখ্যাত। ‘আপাচু’ মানে শত্রু। এঁরা কিন্তু নিজেদের ন’দে বা দিনেহ বলেন, যার অর্থ জনগণ। ঠিক যেমন তারা সবাই— সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওঁরাও, হো, লোধা, শবর সব্বাই নিজেদের ‘হড়’ অর্থাৎ মানুষ বলে— শুধু বিরহড় নয়। পুরাকালে ‘ঘেরওয়াল’ বা বনবাসী থাকার সময়ে সবাই ছিল হড়। কোনও সময়ে এদের মধ্যে কিছু বনচর হনুমান খেয়ে ফেলায় জাতিচ্যুত হয়। সম্ভবত শবর, খেড়িয়া, লোধারা। কুর্মিরা হিন্দু হয়ে গেল, সাঁওতালরা এঁদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রসর, মুণ্ডারাও পিছিয়ে নেই। কিন্তু তার জন্মপল্লিতে দারিদ্র, অশিক্ষা আর হাঁড়িয়া খাওয়ায় মুণ্ডারা লোধাদের মতোই তো ছিল। কথিত আছে এঁরাই নাকি রাবণরাজার বিরুদ্ধে রামচন্দ্রকে সাহায্য করেন। ফাঁকাতে থাকত এই হড় জাতি, পাহাড়ে জঙ্গলে, কিন্তু জমি পরিষ্কার করলেই দিকুরা নিয়ে নিত। দীর্ঘদিন পরস্পরের প্রতি তারা ঘৃণা জিইয়ে রেখেছে, প্রকৃতপক্ষে কে-ই বা তাদের বন্ধু, না সাদা চামড়া, না দিকু, না, তুড়ুকরা। সবারই লক্ষ্য তাদের পরিষ্কার করা জমির ওপর খাজনা বসানো, কিংবা একেবারে নিয়ে নেওয়া। হরপ্পার দিন থেকে তারা আছে এবং ক্রমাগত তাড়া খাচ্ছে। তিলকা মাঝি, বা বীরসা মুণ্ডাও কিছু করতে পারেননি। সিদু-কানহোও না।
আচ্ছা, কুর্মিরা হিন্দু হয়ে গেল। কিন্তু করম পূজা, বাধনা, সারহাও সবই তো ওদের আছে! সঙ্গে সঙ্গে কালীপুজোয় ফুটো ফুটো হাঁড়ির মধ্যে দীপ বসিয়ে আলোও তো জ্বালায়। ক্রিশ্চান হতে হলে অনুষ্ঠান লাগে, তুড়ুক বা মুসলমান হতে গেলেও, কিন্তু হিন্দু হতে গেলে কিছু লাগে না। কবে যে কে দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজাতে লেগেছে, কেউ খেয়ালই করে না। সঙ্গে সঙ্গে তুমি করম করো, পাঁচ বছর পরপর সিংবোঙার পুজো করো, কোনও অসুবিধে নেই। কোনও কোনও হাইওয়ের কাছে গরাম-থান তো বিখ্যাত। সবাই ওখানে মানত করে, মানে, পয়সা দেয়। সেখানে প্রধান পুরুত লোধা। ব্রাহ্মণ বসে লোধা পুরুতের নীচে।
শিখরিণী মেয়েটিকে সে হিন্দু বলল। কিন্তু নিজেকে তার থেকে কীভাবে আলাদা করবে ভেবে পেল না। তার গলায় ক্রস নেই, তার শুক্রবার নামাজ নেই। আসল কথা সে সম্পূর্ণ ধর্মমতহীন। শিখরিণী যদি চায়, তার সঙ্গে মিলিত হতে তার কোনও বাধা নেই। এবং হয়তো এমন মিলন ভাল। কেননা আর্য-অনার্য বিবাহের ফলে পরের প্রজন্ম আরও বুদ্ধিমান, আরও মৌলিক হয়ে জন্ম নেবে। দু’ধরনের জিন মিলবে উন্নততর জিন তৈরি করতে। সভ্যতা এগিয়ে যাক। উন্নততর মানুষ তৈরি হোক। আরও আরও মানবিক মানব, যেমন হবে তাদের উদ্ভাবন, মগজ, তেমনই হবে তাদের হৃদয়ের গুণ। আর দ্বিধাহীন মেশামেশির ফলে এক হয়ে যাবে সবাই। আলাদা করে এ আর্য, এ অনার্য ছাপ মেরে দেওয়া যাবে না। বাঙালিদের মধ্যে যেমন হয়েছে। শিখরিণী সম্পূর্ণ আর্য। খাড়া নাক, টানা চোখ, কাঞ্চনবর্ণ, পূর্বপুরুষের থেকে এই জিন পেয়েছে। তবে কোনও কোনও পরিবার অনেককাল ধরে মিশ্রণ থেকে নিজেদের সন্তর্পণে বাঁচিয়ে এসেছে। তাই সব গাঁই গোত্র, দক্ষিণ রাঢ়ি, উত্তর রাঢ়ি, তাই বৈদ্য, বারেন্দ্র। বৈদ্যরা যেমন অসম্ভব বুদ্ধিমান, ব্রাহ্মণ কায়স্থর মিশ্রণে হয়েছে। তাদের তো ব্রাহ্মণরা জাতিচ্যুতই করেছিল। শিখরিণীদের পরিবারেও হয়তো খুব গোঁড়া। কিন্তু মিঠুকে দেখলে বোঝা যাবেনা, শিখরিণী যদি বাঙালি হয় তো সে-ও বাঙালি। মিঠু কালো। নাক খুব উঁচু নয়, আবার তার মতো থ্যাবড়াও নয়, মিঠুর চোখ বড় নয়। কিন্তু কী উজ্জল! মিঠুর ঠোঁট পাতলা নয় একটু পৃথুল, কিন্তু ছোট। কপাল বড়, কোঁকড়া চুল, একটু তামাটে। মিঠু শিখরিণীর মতো না হলেও লম্বা। খুব সুগঠিত। কেননা, শরীরচর্চা খেলাধুলোর মধ্যে ও জীবন কাটিয়েছে। একেবারে বেতের মতো, স্প্রিঙের মতো লাফিয়ে ওঠে। কে জানে কী অতীত মিঠুর পরিবারের। ঊর্ধ্বতন তিন পুরুষ পর্যন্ত সাধারণত মানুষ জানে, তার আগে? তারও আগে? উত্তর ভারত থেকে আসা কোনও ব্রাহ্মণ এই বঙ্গভূমে কোনও সাঁওতালনি কি মুণ্ডানিকে ঘরে তুললেন। নিশ্চয়ই প্রচুর কোলাহল তুলেছিল সমাজ। তবে, তখন হয়তো পুরো বাংলাই জঙ্গলমহল ছিল। এখানে বুদ্ধ আসেননি, মহাবীর এসে তাড়া খেয়ে ফিরে গেছেন। সেই পাণ্ডববর্জিত মহলে একমাত্র ব্রাহ্মণ, কি সামান্য একদল ব্রাহ্মণ কী করেছিলেন না করেছিলেন ক্রুদ্ধ সমাজ-চোখ তার ওপর পড়েনি। তাই ব্যানার্জির ঘরে এমন কৃষ্ণা। তাদের নিজেদেরও তো স্বগোত্রে বিয়ে হয় না। স্বগোত্রের ছেলেমেয়ে ভাইবোনতুল্য। পারসিরা অন্তর্বিবাহ করেন, আজ তাঁদের লোকসংখ্যা এত কমে গেছে যে তাঁরাই ভয় পাচ্ছেন।
কস্তুরীবেন ভয়ে ভয়ে বললেন, কাজল, আমার মা যা-ই করে থাকুন, দেশকে, দেশের ভালবাসাকে ত্যাগ করেননি। তুমি নিউ জেনারেশনের ছেলে আমার মাকে ওল্ড ভ্যালুজ দিয়ে বিচার করবে না।
কাজল উঠে দাঁড়াল, কী বলছেন দিদি! তাই কখনও করতে পারি?
—তা হলে এতক্ষণ কোথা বলোনি। সিরিয়স মুখে ছিলে, কেনো?
—আসলে আপনি তো বোঝেনইনি, এইসব জায়গা আমার নিজের জায়গা, ছোটবেলা। আপনার ছোটবেলা যেমন কলকাতা। আপনাকে সেখান থেকে চলে যেতে হয়েছিল আমদাবাদ গুজরাতে। দুটোই আপনার জায়গা হয়ে গেল। আমি কিন্তু ছোটবেলায় সাংঘাতিক কষ্ট পেয়েছি। সে একট দুঃস্বপ্ন, আমি হয়তো জীবনেও ভুলতে পারব না। আমি নিজেই এখান থেকে পালিয়ে যাই, ক্রমে বাঁকুড়া ক্রিশ্চান মিশন হয়ে দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশন। তারপর কলেজে পড়তে কলকাতা। তাই কলকাতাও আমার নিজের জায়গা, এই জঙ্গলমহলও আমার নিজের। এইসব ভাবছিলাম।
তো তুমি কী খুঁজো!
আমি তো কিছু খুঁজতে আসিনি দিদি, আপনার বন্ধু হয়ে এসেছি। আমার খোঁজ বইয়ের পাতায়, www ডট কম-এ, নানান ওয়েবসাইট। আমি রিসার্চ করছি। খোঁজ করছি এইভাবে। তবে এখন বুঝতে পারছি নিজেকে খোঁজা আমার বাকি রয়ে গেছে। আসুন, আর দেরি করবেন না। পোকাটোকা কোথায় কামড়াবে।
১৪) তৃতীয় পর্ব
বাংলোর চত্বরে বসে ছিল মৈত্রী আর তার বন্ধু শিখরিণী। প্লাস্টিকের মোল্ডেড চেয়ার পেয়েছে দুটো। কিন্তু মশা না পোকার বেশ উৎপাত। অন্ধকারে চড়-চাপড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না। মিঠু মিটিমিটি হেসে বলল, দেখিস আবার আমাকে মেরে বসিসনি।
শিখরিণী চিন্তিত স্বরে বলল, তুমি শিয়োর যে আমি ইতিমধ্যেই তোমাকে মেরে বসিনি?
—রতনদা— মিঠু হাঁকল।
—তোমার বেশ দা-টা বলা অভ্যেস আছে, না মিঠু? ইউ রিয়্যালি হ্যাভ চার্মিং ওয়েজ!
মিঠু আবার জোর গলায় হাঁকল, রতনদা!
অন্ধকারের মধ্যে রতন কিন্তু এসে দাঁড়িয়েছিল ঠিকই। বলল, বলুন দিদিমণি!
—একটা লণ্ঠন দিতে পারবে? আর এই পোকার কী করি বলো তো!
—পোকার একটা তেল আমরা লাগাই। আপনি নিবেন?
—হ্যাঁ হ্যাঁ— নিশ্চয়ই। কী সুন্দর ছমছমে রাত, জোছনা, শালফুলের গন্ধ— ভাল লাগছে বসে থাকতে। কিন্তু এই পোকাদের জ্বালায়।…
একটু পরে রতন থালায় বসিয়ে দুটো ঢিবি ঢিবি কাপে চা-ও নিয়ে এল।
—চা আনলে কেন? দিদিরা এলে খেতাম!
—তখন আবার আনব— এখন বিস্কুট নিন– উঁরা এলে চেঁড় ভেজে দোব।
—এ কীসের তেল রতনদা, বিচ্ছিরি গন্ধ!
—করঞ্জার তেলে সব মশলা ভরা হইছে। মশলার গন্ধ দিদি।
—এ মাখলে কিছু হবে না?
—কিচ্ছু হবে না, আপনি মেখেই দ্যাখো না!
—চায়ে চুমুক দিয়ে শিখরিণী বলল, আমার কী যে ভাল লাগছে! এরকম অভিজ্ঞতা আমার আগে কখনও হয়নি। বাড়িসুদ্ধু সবাই দক্ষিণ ভারত ঘুরেছি গাড়িতে। কোনও জায়গাটার চরিত্র বুঝতে পারিনি সত্যি কথা বলতে। মন্দির-ভাস্কর্য দেখেছি, আর আবার গাড়িতে…
—এ জায়গাটার মতো চরিত্রও তুই সাউথের শহর বাজারে পাবি না। ওখানে ওই মন্দির আর বড়জোর সমুদ্রই দেখবার, বোঝবার। আমি তোকে বলছিলাম না— আমি মধুপুর, গিরিডি গেছি। জায়গাগুলোই একেকটা মানুষের মতো ব্যক্তিত্বঅলা। ধর—মধুপুর যেন এক পুরাকালের রাখাল, প্রকৃতির শোভায় বুঁদ হয়ে মেঠো সুরে গান গাইতে গাইতে চলেছে। গিরিডি হল ধর— বেশ একজন গাইড, তোকে একথা সেকথা বলতে বলতে হঠাৎ একটা রেভিলেশনের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে, তারপর লুকিয়ে পড়বে। হি হ্যাজ হিজ ওন মাইন্ড। আর এই গিধনির শালবন, মহুয়া, কুসুম… সব মিলিয়ে আমার কী মনে হচ্ছে জানিস?
—কী?
—তির ধনুক নিয়ে ‘রাজকাহিনী’র কোনও ভিল যোদ্ধা রাতপাহারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তোর কিছু মনে হচ্ছে না?
—হচ্ছে, তোমারই মতো অনেকটা, তবে ভিল যোদ্ধা নয়, কালপুরুষ। আমার ভাগ্য নির্ধারণ করছে।
—তুই তা হলে এই জায়গাটাকে নিজের জীবনের দিঙনির্দেশক বলে মনে করছিস?
—হ্যাঁ। কিন্তু মিঠু তুমি আমার আগের প্রশ্নটার জবাব দিলে না!
—কী প্রশ্ন? আমি মনেই করতে পারছি না।
—আমি তোমাকে কোথাও আঘাত করেছি কিনা! আজ কিছুক্ষণ আগে তোমাকে আমার অনেক কথা বললাম। তুমি চুপ করে ছিলে। আঘাত পেয়েছ?
—নাঃ। শিখরিণী, আমার সত্যি কথা বলতে কী আঘাত পাওয়ার মনই নেই। আমার মায়ের, একমাত্র প্রিয়জনের ক্যান্সারে তিল-তিল করে যন্ত্রণাময় মৃত্যু দেখেছি কত বছর বয়সে! সতেরো-আঠারো, হায়ার-সেকেন্ডারি মিস হয়ে গেল। নিজের হাতে সেবা করেছি। মায়ের সঙ্গে তখন আমার আর কোনও আড়াল ছিল না। কে মা, কে মেয়ে— বোঝা যেত না। তারপর থেকে আমি…আমার ধাতটাই শক্ত হয়ে গেছে। জীবনে কিছুতেই আমি ভয় পাই না, দুঃখ পাই না!
—দুঃখ পাবার মতো কিছু ঘটলে, সেটাকে হজম করে নাও এই তো?
বললাম যে দুঃখ পাওয়ার মনটাই নেই। স্যরি। তুমি ঠিক বুঝবে না বোধহয়। তোমার জীবন আমার জীবনে বিশাল ফারাক।
—সেটা তো সব মানুষের ক্ষেত্রেই সত্যি, মিঠু। আমি তোমার কষ্ট বুঝতে পেরেছি। জীবনটা ঠিক আরম্ভ হবার সময়েই তুমি মস্ত বড় আঘাতটা পেলে। তাতে করে তোমায় খানিকটা অসাড় করে দিয়েছে। আমি তুলনা দিতে চাইছি না, তুলনা হয়ও না। আমিও কিন্তু মাতৃহীন। আমার জ্ঞানের আগেই। বাবা আবার বিয়ে করেছেন। দ্বিতীয় মা খারাপ কিছু না, কিন্তু আমি মানুষ হয়েছি দাদুর হাতে। কিছুটা মামার বাড়িতেও। তুমি পরিষ্কার করে বলো মিঠু, কাজলের ব্যাপারে তুমি আঘাত পাবে না?
—হঠাৎ তোমার এ কথা মনে হচ্ছে কেন?
—তোমরা খুব বন্ধু। লাইক-মাইন্ডেড। তোমার ভেতরে ওর মতো একটা মানুষের জন্যে…
—হ্যাঁ। কাজল আমার খুব বন্ধু, ভরসাও বলতে পারো। কিন্তু সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নয়। প্রফেশনে। আইডিয়ায়।
যাক, আমার মনের ভেতর থেকে একটা ভার নেমে গেল মিঠু। আমি গভীরভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। জানি আমাদের ভাগ্য নির্দিষ্ট। কিন্তু কী সেই ভাগ্য তা তো জানি না। ইতিমধ্যে কারও কষ্টের কারণ হওয়ার চেয়ে ত্যাগ করা অনেক ভাল। আমি এরকম করেই ভাবি। আমার মন থেকে সত্যিই একটা ভার নেমে গেল আজ।
মিঠুর মন থেকে কিন্তু ভার নামল না। তার সঙ্গে কাজলের বন্ধুত্ব। সত্যিই প্রেম-ট্রেমের কথা তার মাথাতেই আসেনি। কিন্তু যবে থেকে রাধিকা কৃষ্ণানের অফিসে কাজলের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে, তখন থেকেই কাজল খুব দ্রুত তার জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। কেমন নিবিড় একটা সম্পর্ক, কোনও মান-অভিমান নেই, দু’জনে দু’জনের মেজাজ ও রসিকতা চট করে বুঝতে পারে, মোটামুটি ভাবনা-চিন্তার ধারাও একই রকম। কাজল যেন তারই পুরুষ-সংস্করণ, আরও অনেক পরিণত, আরও অনেক জ্ঞানী এবং কর্মী। কিন্তু দু’জনের চরিত্রের উপাদান একই। আশ্চর্য, তারা পরস্পরের অতীত নিয়ে কখনও কোনও খোলাখুলি আলোচনা করেনি অথচ, দু’জনেই জানে দু’জনের ভেতরে কোথাও একটা শূন্যতা আছে। একসঙ্গে কাজ করতে করতে পথ চলতে চলতে কী এক অদ্ভুত জাদুমন্ত্রে সেই শূন্যতা নিজেকে ভুলে যায়। সে জানে না এটা ভালবাসা কি না! তবে এর চেয়ে নিবিড় সম্পর্ক কি আর হয়! মিঠুর বুকের মধ্যে যেখানে সেই চিরস্থায়ী ক্ষতটা রয়ে গেছে, সেখানটা ব্যথা করতে লাগল। হঠাৎ তার মনে হল চিৎকার করে বলে ওঠে—মা, আজকে কিন্তু আমি টিফিন খাইনি, খাই নি-ই, খাব না …। কী অর্থহীন প্রতিক্রিয়া! কিন্তু তার ভেতরটা অজানা অচেনা, বা অনেক দিন আগেকার চেনা, এখন ভুলে যাওয়া অভিমানে থমথম করতে লাগল। এটা রৌনকের মনীষার জন্য ফিদা হওয়া নয়। বা বিন্দির রৌনকের জন্য দিওয়ানা হওয়া। এ অন্য কিছু। অন্যরকম। কিন্তু কাজল মুণ্ডা তার পাশে থাকবে না— এটা তার বুকের মধ্যে ক্রমশ লোহা পুরে দিচ্ছে। গৃহস্থ হয়ে গেলে কি আর মানুষ মানুষের বন্ধু থাকে?
দূরে টর্চের শক্তিশালী আলো দেখা দিল। আলোটা বাংলোর দিকে হেঁটে আসছে। শিখরিণী বলল, ওই যে বাবুদের এতক্ষণে আসা হচ্ছে।
মিঠু চেঁচিয়ে ডাকল, রতনদা!
—এই যে দিদিমণি।
—ওই ওঁরা আসছেন, চা নিয়ে এসো। সঙ্গে তোমার চেঁড় ভাজা।
হাওয়া দিচ্ছে না কোত্থাও। কিন্তু কেমন ঠান্ডা। গিধনির অন্ধকার আকাশে তারা ঝলমল করছে। দূরে গাছপালা ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তারা চুর শাল-মহুয়ার পাতায় পাতায় লেগে আছে।
লণ্ঠনটার দিকে এগোচ্ছে ওরা।
—তোরা এখানে?
—বাঃ অন্ধকারে কোথায় গেলি, বাঘ-ভালুকে খেল কিনা জানতে হবে না!
অল্পস্বল্প আলো পড়ে শিখরিণীকে কেমন অলৌকিক সৌন্দর্যসম্ভূত মনে হচ্ছে। কাজল আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইল। আগে তো তার এই মুগ্ধতা আসেনি। হ্যাঁ মেয়েটি খুব সুন্দর, কিন্তু তার মধ্যে এই বিস্ময়, আবেশ ছিল সে খেয়াল করেনি। কেন? দিকুদের মেয়ে। মুণ্ডাদের শত্রুপক্ষীয়। হয়তো তাই। কিন্তু মেয়েটি যে তাকে পছন্দ করছে সেটা হাবে-ভাবে প্রকাশ করতেই কী একটা বিপ্লব ঘটে গেল। অন্ধকারেও শিখরিণী তার দৃষ্টি বুঝতে পেরেছে। মোহ চোখে মেখে নিয়ে সেই দৃষ্টি সে ফিরিয়ে দিল।
—দিদি, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?
—একানে ওকানে। কাজলের জায়গা খুব সুন্দোর। চোমৎকার। মানুষকে একদম ঢেকে নিচ্চে।
মানে কী এ কথার কেউই বুঝল না। কিন্তু এর মধ্যে যে দারুণ একটা প্রশংসা লুকিয়ে আছে সেটা বুঝতে কারওই অসুবিধে হল না।
এই সময়ে রতন আর চিঁড়েভাজা-চা এল।
—খুব খিদে পেয়েছে, না কাজল? —কস্তুরী বললেন, তারপরে ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে বললেন, চেঁড়ো? চেঁড়োভাজা কোতোদিন খাইনি। ইস্স তুমাদের খেপলা খাওয়ালে আর ভুলতে পাচ্ছো না। মেহতা বাড়ির রান্নাঘরে তৈরি খেপলা। চলো, তোমাদের সবাইকে কলকাতায় ফিরেই খাওয়াব।
কাজল বলল, আপনি কিন্তু বলেছিলেন দিদি, আমদাবাদ না গেলে কিছুই খাওয়াবেন না। তার মানে আমদাবাদের নিমন্ত্রণটা আপনি ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
—তুমাদের যা হেল্পফুল, তাতে তুমরা আমার রান্নাঘর, আমার অফিসঘর সোব তচনচ করে দিচ্চো। হেল্প, হেল্প! তোখন কাকে ডাকব তুমাদের হেল্প থেকে বাঁচতে!
অর্থাৎ ঝাড়গ্রাম এবং সেখান থেকে গিধনি আসা পর্যন্ত পুরো পথটা যে মেজাজ খারাপ ছিল, তা আবার ভাল হয়ে গেছে। কী রহস্য আছে কস্তুরীবেনের এই ভ্রমণে! কাকে খুঁজছেন? কী খুঁজছেন? আজ সন্ধ্যায় অন্ধকারে গিয়ে কি তার কোনও হদিশ পেলেন? কাজলকে একা পেলে মিঠু নিশ্চয়ই জেনে নিত। কিন্তু এখন, এখানে অনেক জন। জিজ্ঞেস করা যাবে না। যা-ই হোক, তা ওঁর ছোটবেলার সঙ্গে জড়িত, বারেবারে যেভাবে বলছেন ছুটবেলাই সোব বেলা।
এবং কলকাতা নাকি ওঁর মাতৃভূমি— মা-ল্যান্ড। কলকাতার মেয়ে ছিলেন নাকি ওঁর মা? কলকাতা-প্রবাসী গুজরাতি বা অন্য কিছু? নাকি বাঙালি? এই স্বতন্ত্র চরিত্রের কস্তুরীবেনের-অর্ধেকটা বাঙালি— ভাবতে তার খুব ভাল লাগল। তবে নিজের কাছে নিজেই সে লজ্জিত হল এ ভাবনায়। ওঁর যে অর্ধেক গুজরাতি, তা-ও খুব ভাল লাগছে। গোটা মানুষটার জন্যই তার এমন একটা শ্রদ্ধা, এমন একটা টান আসছে যে উনি কয়েকদিনের মধ্যেই চলে যাবেন ভাবতে তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
শোবার আগে একটা বিদঘুটে ঘটনা ঘটল। রতন ওদের জন্য খিচুড়ি রেঁধেছিল, খিচুড়ির মধ্যে কিছু কিছু তরি-তরকারি দিয়েছে। কী তা বোঝা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে খেতে মন্দ লাগছে না। কাজল বলল, রতনদা এর মধ্যে আবার রাজ ব্যাং, কি মেঠো ইঁদুর দাওনি তো!
—কী বললে! ব্যাং? ইঁদুর? —শিখরিণী লাফিয়ে উঠে মুখ বিকৃত করে চলে গেল। ওয়াক তুলছে।
—ওয়াক, ওয়াক।
—রাজ বেং কী জিনিস? ইঁদুর বুঝলুম— কস্তুরী বললেন।
—কিছু না, ঠাট্টা করছিলুম। শিখরিণী-ই— গলা তুলে কাজল বলল— আমরা কিন্তু এরকমই খাই। ঢ্যামনা সাপ, বিষধর সাপও মাথা কেটে খাই, তারপরে গোসাপ। গোধিকা মনে আছে মিঠু, ফুল্লরা কালকেতুর উপাখ্যানে? সেই যে কিছু না পেয়ে অবশেষে গোধিকা পেল একটা—
—যেটা স্বর্ণগোধিকা হয়ে গেল?
—স্বর্ণগোধিকাই তো ছিল! আসলে দেবী চণ্ডী। কালকেতুর ঘরের দাওয়ায় নিজরূপ ধরে বসেছিলেন আর সেই সুন্দরী দেখে ফুল্লরা ভয়ে, হিংসায় একেবারে দিশেহারা হয়ে গেল। ভাবল— কালকেতু ওই সুন্দরীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে ঘরে নিয়ে এসেছে। ফুল্লরার লম্ফঝম্ফ কান্নাকাটি দেখে কালকেতু অবাক।
শাশুড়ি ননদী নাই, নাই তোর সতা
কার সঙ্গে দ্বন্দ্ব করি চক্ষু কইলি রতা!
—বলে কাজল হাসতে লাগল। আবার একবার হাঁক পাড়ল— শিখরিণী-ই। খিচুড়িতে আলু আর স্কোয়াশ ছাড়া কিচ্ছু নেই। খেয়ে নাও। রাতে খিদে পেলে কিছু জুটবে না কিন্তু।
কস্তুরী বললেন, আমার কাচে বিস্কুট আচে। লাড্ডু আচে। কুচি নিমকি আছে। তুমরা কবিতা করো, আমি প্যাকেট বার করি।
শিখরিণী এই সময়ে এসে বলল, দিদি, আমার এখন বমি পাচ্ছে, খেতে বলবেন না।।
সে রাগী চোখে কাজলের দিকে চেয়ে বলল, খাবার সময়ে বিশ্রী বিশ্রী কথা! ছিঃ!
কাজল বলল, বিশ্রী কথা কেন হবে? কলকাতার ভদ্রলোকেরা লালচে লালচে নরম মেঠো ইঁদুরের কাবাব দিব্যি খেতে ভালবাসেন। আর ব্যাং তো চিন, জাপান, কোরিয়া এসব জায়গায় ডেলিকেসি। ইউরোপীয়, আমেরিকানরাও দিব্যি খায়। হাঙর, কুড়কুড়ে করে ভাজা অক্টোপাস! কলকাতার হোটেলে মুরগির কাটলেট বলে তো ব্যাং কি পায়রাই দেয়। খাও তো!
—আচ্চা আচ্চা অনেক মেনু বলে ফেলেচ। একন একটু সামলাও। কস্তুরী হেঁকে উঠলেন।
—না, এরা সব সামন্তভূমিতে এসেছে। ট্রাইব্যাল-বেল্ট। আমরা কী খাই, কী পরি, কীভাবে বাঁচি—না-জেনে, না-দেখেই ফিরে যাবে?
—সামন্তভূমিটা কী?— মিঠু জিজ্ঞেস করল।
—আদিবাসীরা তো প্রাগৈতিহাসিক। তাদের নিয়ে অনেক রকম স্পেকুলেশন আছে। সামন্ত থেকে সাঁত। সাঁওতাল, সাঁওতাড়। এরকম একটা ধারণা আছে।
—তার মানে সাঁওতালরা সামন্ততন্ত্রে বাস করত? ফিউড্যাল সোসাইটি!
—হতে পারে ওরা সাদা মানুষদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় এসেছিল। সামন্ত হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখত। শেষ পর্যন্ত নিজেরাই নিজেদের পরিচয় ভুলে যায়। আবার উলটোটাও হতে পারে, সাঁওতাল থেকেই সামন্তভূমি, যেমন ধিরি থেকে ধৃ। তবে আদিবাসীরা সবাই নিজেদের ‘হড়’ বলে। ‘হড়’ মানে মানুষ।
—হড় কুথা থেকে এলো, তুমার শাস্ত্র কী বলে?
—সে এক গল্প। বাইবেলের জেনেসিসের সঙ্গে মিল আছে খানিকটা।
—কীকর্ম?
—দিদি, আমি যা পড়ে জেনেছি, তা হল, ঠাকুর আর ঠাকরান থাকতেন পুব দিকে। পৃথিবী তখন জলময়। মাটি অনেক নীচে। ঠাকুর জিউ কঁকড়া, হাঙর, কুমির, রাঘববোয়াল, কচ্ছপ সব সৃষ্টি করলেন। তারপর মাটি দিয়ে মানুষ গড়লেন কিন্তু আকাশ থেকে সূর্যের ঘোড়া সিঞ সাদম একটা রুপোলি সুতো— তড়ে সুগম দিয়ে নেমে এসে ভেঙে দিল। তখন নিজের বুকের ময়লা দিয়ে হাঁস আর হাঁসালি গড়লেন, ফুঁ দিলেন। তারা উড়ে বেড়াতে লাগল। তবে হাঁস হাঁসালি কিন্তু কণ্ঠার দু’দিকের দুটো হাড়েরও নাম। গড মেড ম্যান ইন হিজ ওন ইমেজ। আর আদমের পাঁজর থেকে ইভ তৈরির গল্পও তো আমরা সবাই জানি। বিয়ের সময়ে আমাদের কনেকে হাঁসুলি উপহার দেওয়া হয়, কণ্ঠার হাড়ের ওপর লেগে থাকে— তাই হাঁসুলি।
—আমাদের মঙ্গলসূত্রের মুতো! —কস্তুরী বললেন।
—তাই। এই হাঁস হাঁসালি থেকেই হাড়াম ও আয়ো বা পিলচু হাড়াম, আর পিলচু বুড়ি অর্থাৎ প্রথম মানব-মানবী জন্মাল। আদম-ইভের সঙ্গে সাদৃশ্যটা আরও স্পষ্ট হল— তাই নয়?
—সত্যিই তো! মিঠু অবাক হয়ে বলল।
শিখরিণী গুটিগুটি এসে বসেছিল তার ফেলে যাওয়া পাতে। ভীষণ খিদে পেয়েছে। এখানকার জল এত ভাল! সে এক গ্রাস মুখে দিল।
কস্তুরী বললেন, গুড গার্ল।
—আমাদের ব্রহ্মার বাহনও কিন্তু হাঁস। কোথাও একটা যোগাযোগ থাকতে পারে।— গুড গার্ল শিখরিণী বলল।
হতে পারে— কাজল বলল— হিহিরি পিপিড়ি দ্বীপে শ্যামা ঘাস আর সুন্তুবুকুচ ঘাসের বীজ ছড়িয়ে দিলেন ঠাকুরজিউ। ইতিমধ্যে লিটা তাদের বাখখর বা হাঁড়িয়া করতে শেখালেন। মারাং বুরুর নামে হাঁড়িয়া নিবেদন করে যে-ই না প্রসাদ খাওয়া অমনি হয়ে গেল বিপ্লব। হাড়াম আয়োর লজ্জা হল, বটপাতা পরলেন— কী দিদি, আদম ইভ আর শয়তানের গল্পের সঙ্গে মিলছে?
মিলছে তো বোটেই। এরকম কহানি তুমাদের মিশনারি শিখায়নি তো? সরল মানুষ নিজেদের মুতো করে নিজেদের ভাষায় তৈরি করে নিয়েছে?
—বোধহয় না। এগুলো ওর্যাল ট্র্যাডিশন, শ্রুতি, বহুকাল ধরে বংশপরম্পরায় চলে আসছে। তবে একটা বৈশিষ্ট্য বা তফাত— বাইবেলে শয়তান হল ভগবানের শত্রু, খারাপ লোক। কিন্তু এই লিটা বা মারাংবুরু আদিম জনগোষ্ঠীর একজন প্রধান দেবতা। মানে, জ্ঞানবৃক্ষের ফলকে সাদরে গ্রহণ করেছিল এরা। দুঃখের বিষয় জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে কিছু জাতি বিজ্ঞান, বিদ্যা, শাস্ত্র, সাহিত্য, ভাষাচর্চা করে কোথায় উঠে গেল! এদের জ্ঞান শুধু হাঁড়িয়ার ইনটকসিকেশনেই সীমাবদ্ধ রইল। হাঁড়িয়া উৎসবে, পূজায়— সর্বত্র ছড়িয়ে গেল।
শিখরিণী বলল, আমরা যে-সোমরসের কথা শুনি, তা-ও তো একরকম লতার নির্যাস। সুরা, ইনটকসিক্যান্ট। দেবতারা সোমরসের ভোগ খুব ভালবাসেন। কিন্তু সোমরসে তো তাঁদের বুদ্ধি লোপ হয়নি!
—মানে যোতো দিন মানুষ তোতো দিন নেশা— কস্তুরী বললেন। আসল কথাটা চাপা পড়ে গেল।
ওরা দেখেনি রতন কিসকু ওদের খেতে দিয়ে অন্ধকারে এক জায়গায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। এই সময়ে বলে উঠল, দাদাবাবু, পারিশ ভাগের কতা তো কই বুললেন না।
কাজল চমকে উঠল। আর সবাইও তারই মতো চমকেছিল। ঠিক যেন কোন অতীতের সামন্তভূমি এই অতিথিদের কাছে তার ইতিহাস অসম্পূর্ণ রয়ে যায় দেখে কথা কয়ে উঠল।
—তুমিই বলো না। সে আস্তে করে বলল।
—রতন বলল, ইঁদের ছেল্যা মেয়্যা হঁল। সাঁত জুড়ার সাঁত কুঠরি হঁল বিয়্যা হঁল। তবে না হড়হপন জাতি। ঠিক হঁল ভাই-বুনে বিয়্যা হবে না। তাই পারিশ ভাগ হঁল। সাঁত পারিশ। মুর্মুগণ পূজারী, কিসকু রাজা, হাঁসদা মার্ন্ডি ধন লিয়ে লাড়েচড়ে। হাঁসদা বড় ছেল্যাটি, হেমব্রম জাগিরদার, সরেন সৈন্য, যুদ্ধ করে। টুডু-বাজনদার, কামার, আর মার্তি— কন কঁরত্যান স্মরণ নাই।
তাঁর পর সব লক খারাপ হঁইয়া গেল। ঠাকুর সাত দিন সাত রাত্রি আগুন জল বর্ষা করিলেন। সব মরিল। শুধু হারাতা পর্বতের গুহায় যাঁরা বসত ছিলেন, তাঁরা বাঁচল। তারপর বর্ষা থামিলে সব বার হয়্যাঁ অনেক পশু-পক্ষী পাইলেন, আবার সব বসাল। সাঢ়াংবেডায় বাস করিল। সিখানে সাবেক সাত খুঁট বাদে আরও পাঁচ খুঁট হঁল— বাস্কে, বেশরা, পাঁউরিয়া, চঁড়ে, আর এক খুঁট হারাঁয়্যা গেছে বডয়া। বাস্কেরা ব্যাবসা বাণিজ্য করত্যাঁ থাকেন—এইটুক জানি।
—হারাতার সঙ্গে আরারাতের মিল দেখেছেন দিদি? —কাজল বলল।
—ঠিক বুলেচো তো! আমার চিনা চিনা লাগচিল। ডেলুজ, ক্রিশ্চান ও হিন্দুদের। প্রথমে সোব জোল ছিল, না? পুরা কাহিনীই এর্কম। জোলে পৃথিবী ভাসল, প্রথমে মৎস্য অবতার হল, তারপর কূর্ম অবতার, স্থোলে জোলে বিচরণ কোরে। তারপর স্থোলের জীব বরাহ। তারপোর পশু মানুষ মিলিয়ে নৃসিংহ। তারপোর বামন। ডোয়ার্ফ। প্রথম এক্সপেরিমেন্ট কোরতে গিয়ে ভোগোবান প্রোপোৰ্শন ঠিক রাখতে পারেননি। সোব গোল্পেই আদি-বস্তু জোল। তা থেকে ইভলিউশন! তুমাদের মিথ খুব সুন্দর।
উষা এসেছে দিগ-বিদিক আলোয় বিদীর্ণ করে। সরে গেছে সামন্তভূমির ঘনীভূত অন্ধকার। কস্তুরী উঠে পড়েছেন খুব সকাল সকাল। ভোর দেখছিলেন। রাত্রি কালো, সব ঢেকে দেয়, তাই সে রহস্যময়ী, অথচ দিবারই নিজের উল্টো পিঠ সে। প্রকৃতির দুই দিক। কেমন করে এই অমানিশা দিবায় এসে মেশে, সন্ধিলগ্নটা দ্যাখবার তাঁর বড় ইচ্ছে ছিল। জীবনে বহুবার দেখেছেন। কিন্তু ঠিক এই পটভূমিতে নয়। গত রাতে খুব ভাল ঘুমিয়েছিলেন কিন্তু হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। দেখলেন চাঁদ অস্ত গেছে। কিন্তু তারার কী জোরালো পেনসিল টর্চের মতো আলো! আশ্চর্য! নিঃশব্দে মশারি তুলে উঠে পড়লেন, মুখটুখ ধুয়ে সোজা বাইরের চত্বরে এসে দাঁড়ালেন, তখনও মনে হচ্ছিল দূরে যেন গুঁড়ি মেরে কে বা কারা দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে গলে যাচ্ছে। সিঞ সাদাম। সূর্যের ঘোড়া সব ছিঁড়েখুঁড়ে দিচ্ছে। শাল গাছের ফাঁক দিয়ে একটা তির্যক আলোর রেখা এসে পৌঁছে গেল লাল মাটিতে। ‘তড়ে সুগম’, ‘তড়ে সুগম’। পবিত্র সুতা— এই রশ্মিরেখা ধরেই মনুষ্যলোকে পৌঁছোয় সূর্যের ঘোড়া। কাল যেন কাজল কথাগুলো ব্যবহার করেছিল। মনে থাকেনি। এখন দিনের আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে— ‘সিঞ সাদম’ ‘তড়ে সুগম’।
কস্তুরী যেন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। এ যাত্রা এক তীর্থযাত্রার মতন। কেদার বা অমরনাথ যাত্রার চেয়েও দুর্গম। কিন্তু পথ ওই রকমই সুন্দর। যেমন পাহাড় তার ঐশ্বর্য— তুষার, ফুল, ঝরনা, রং ছড়িয়ে রাখে যাত্রাপথে, এই ভূমিও তেমনই উদার হাওয়ায়, শান্ত নীল সমুদ্রের মতো আকাশে, আশ্চর্য জ্যোতির্ময় সব জ্যোতিষ্কে এবং মানুষের মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গাছে গাছে সুন্দর করে রেখেছে পথ। কী তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে এই পথের শেষে!
মিঠু যে কখন এসে পাশে বসে আছে তিনি বুঝতেই পারেননি। কয়েক দিনের মধ্যেই এই মেয়েটির মধ্যে কী একটা পরিবর্তন এসেছে তিনি ধরতে পারছেন না। ওর চঞ্চল হরিণের মতো চোখে যেন এখানকার সমুদ্র-নীল আকাশের ছায়া পড়েছে। ও সাধারণত খুব উজ্জ্বল, স্মার্ট— মাউন্টেনিয়ারিং করেছে, হবে না? কিন্তু ও-ও যেন এই জায়গাটার সম্মোহনে পড়ে কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। অবশ্য এ-ও হতে পারে, এটাও ওর একটা রূপ। কাজের মধ্যে মেলামেশার মধ্যে একরকম। আবার কাজের বাইরে, শান্ত বনগন্ধঅলা ভোরবেলায় অন্য রকম। এর মধ্যে তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী ছেলেমেয়েদের দুর্বিনীত ডেভিল-মে-কেয়ার ধরনধারণ দ্যাখেননি ঠিকই। কিন্তু ইতিহাস নিয়ে কোনও মাথাব্যথাও দেখেননি।
দূর থেকে হঠাৎ চাপা পুরুষালি গলায় গান ভেসে এল।
হিহিড়ি পিপিড়ি রেবন জানামলেন,
খজ-খামান রেবন খজলেন
হারাতা রেবন হারালেন।
সাসাং বেডারবন জাতেনা হো।
হিহিড়ি পিপিড়ি … হিহিরি পিপিড়ি …
কেরোসিনের ঝাঁঝ পেলেন যেন। একটু পরেই রতন কিসকু, সামন্তভূমির পূর্বতন রাজবংশের সন্তান, মোটা মোটা কাচের গেলাসে চা অ্যালুমিনিয়মের থালায় বসিয়ে নিয়ে এল।
—আর দাদাবাবু দিদিমণি কখন আসবেন?
—একটু কাজ করবে রতন, আমাদের ঘরে কাপড়ের ব্যাগ আছে— একটু নিয়ে আসবে? কুচি নিমকি দিয়ে আমরা চা-টা খেতে পারি। —কস্তুরী বললেন।
—দিদিমুনি ঘুমাচ্ছেন— খুব সংকুচিত স্বরে রতন বলল।
—আমি নিয়ে আসছি দিদি— আবার সেই এন.সি.সি, ট্রেকার। টক করে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক লাফে বাংলোয় চলে গেল।
কয়েকটা লতাপাতার গোড়া, একদল ডেঁও পিঁপড়েকে পাশ কাটিয়ে লাফ দিয়ে পার হয়ে মিঠু উঠে গেল। ওর গায়ে এখনও কী রকম কাঁটা দিচ্ছে … ওই গানটা হিহিড়ি পিপিড়ি রেবন জানামলেন, হিহিড়ি পিপিড়ি। রতন কি ওদের জন্মের সময়কার গান গাইছিল? ‘জানামলেন’ কি জন্মালেন! হিহিড়ি পিপিড়িতে জন্মালেন! একটা শিশু জন্মালে যেমন তার জন্য নানা রকম আচার পালন হয়—আটকৌড়ে, ষষ্ঠীপুজো… ছড়া গান… একটা মানবগোষ্ঠীও তেমন তার জলের গান বেঁধেছে। হিহিরি গিগিড়ি…
ঘরের মুখে ঢুকতে গিয়ে সে একটা ধাক্কা খেল। শিখরিণীর বিছানা পরিপাটি করে গোছানো, অর্থাৎ সে উঠে পড়েছে। এবং পাশের ঘর অর্থাৎ কাজলের ঘর থেকে দু’জনের গলার আওয়াজ ভেসে আসছে।
শিখরিণী একটু উত্তেজিত— তোমার কাছ থেকে এটা আমি আশা করিনি কাজল, তোমার জানা উচিত আমার মতো একজন মেয়ে খাওয়ার সময়ে সাপ ব্যাঙের কথা বললেই রি-অ্যাক্ট করবে?
কাজল— কী করে জানব? বললামই তো আমার দেশে যখন এসেছ, আমাদের কথা তোমার জানা উচিত। বলিনি?
—কিন্তু তুমি তো এখান থেকে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে গেছ। নিশ্চয় আবার ফিরে আসতে চাও না?
—যদি চাই?
—শুধু শুধু আমাকে রাগাচ্ছ কাজল। ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে তোমার জন্য কত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে। ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল।
মিঠু আর শুনল না। দিদির পুঁতির কাজ করা গুজরাতি ঝোলাটা নিয়ে নিঃশব্দে চলে এল।
কুচো নিমকি দিয়ে রতনের কড়া চা মন্দ লাগছিল না।
কস্তুরী বললেন, দ্যাখো, রাজার জাত রাজার বংশ আজ চা করচে। টুরিস্টদের সেবা করচে।
—দিদি, আপনি কি সত্যিই মনে করেন চিরকালই যারা রাজা তারাই রাজা থাকবে? মিঠু চায়ের কাপটা পাশে নামিয়ে রেখে বলল, তাদের শিখতে হবে না, নিজের কাজ নিজের হাতে করে নেওয়া, অন্যের সেবা করা!
ফ্রেঞ্চ রেভলিউশন তো এই নিয়েই হয়েছিল! ড্রিঙ্কিং চকোলেটটা পর্যন্ত নফর জমিদারের মুখে ধরছে, তবে তিনি কোনওক্রমে খেয়ে নিচ্ছেন। খাওয়াটা তো আর অন্য কেউ করে দিতে পারবে না! জমিদারদের অত্যাচারে রাশিয়ার ভূমিদাসদের কী অবস্থা হয়েছিল মনে করুন। আজ সেই জমিদাররা কোথায়? ইংরেজ দুশো বছর ধরে আমাদের শাসন করে গেছে, মুঘল পাঠানরা তারও আগে ছশো বছর। কোথায় তারা? এরা তো তবু হালদার। দেশের মধ্যেই জাতির মধ্যেই কি ক্ষমতার হাতবদল হয় না? এটাই তো স্বাস্থ্যকর দিদি! এটাই তো ঠিক।
কেন যে মিঠুর গলায় একটু তার্কিক সুর— তিনি বুঝতে পারলেন না।
মিঠু বলল, বহু শতাব্দী ধরে বঞ্চিত— ঠিক কথাই। কিন্তু এখন যে নিজেদের রাজ্য হয়েছে, প্রাকৃতিক সম্পদে এত ধনী, ওই মার্ন্ডি, ওই হেমব্রম, সরেন, হাঁসদা যাদের কথা সাঁওতালি হিস্ট্রিতে শুনলেন— তারা কি পারছে সামলাতে! তারা কি ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের পেটমোটা করছে না! জাস্ট লাইক আদার্স? দিস ইজ ডিসগ্রেসফুল। আর ধরুন, যারা আধুনিক শিক্ষা পাচ্ছে, সুযোগ পাচ্ছে, তারা কি নিজের দেশের জন্য, নিজের মানুষদের জন্য কিছু করছে? করছে না। স্বার্থপরের স্বর্গে বাস করছে তারা।
কাদের কথা বলছিস রে মিঠু! পেছনে কাজল এসে দাঁড়িয়েছে, তারও পেছনে কালোর সঙ্গে চমকপ্রদ কনট্রাস্টে শিখরিণী।
হঠাৎ এক ঝলক হাসল মিঠু, রাগ ঝাল কিছু নেই। সে বলল, তোদের মতো লোকদের কথা ভাবছিলাম কাজল। আমি জানি না, কেন তুই তোর নিজের সমাজের জন্য কিছু করিস না!
—আগে কথাটা কখনও মনে হয়নি তোর?— কাজল একটু যেন উত্তেজিত।
—না হয়নি, কেননা তখন আমি এখানে আসিনি, রতনদাদের দেখিনি, হিস্ট্রিটা শুনিনি। কিছুই জানতাম না।
—তবু তো হিস্ট্রির কিছুই শুনিসনি। হড় জাতির এক্সোডাস শুরু হয়েছে সুদূর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে। সাসাংবেডা থেকে গোত্র ভাগ হয়ে জারপি দেশ, সেখানেও টিকতে পারা গেল না, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আসতে আসতে এক বিশাল পর্বত পথ আটকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মারাংবুরুর অর্থাৎ জঙ্গলের দেবতার পূজা করে সে পথ বা সিংদুয়ার খুলল। সেখান থেকে বাঁয়ে এসে ‘আয়রে’ দেশ, তারপর ‘কাঁয়ডে’ দেশ, তারপর ‘চাঁই’ দেশ — দুটো পথ ছিল চম্পাদুয়ার আর চাঁইদুয়ার। চাম্পাতে আমরা স্বাধীন ছিলাম, প্রত্যেক গোত্রের আলাদা গড় ছিল। তারপর সেই একই ইতিবৃত্ত। দিকুরা এসে সব কেড়ে নেয়। জঙ্গল পরিষ্কার করে বসত স্থাপন করলেই দিকুরা নিয়ে নেয়। চাম্পা পর্যন্ত আমাদের হড় জাতির এক ইতিহাস। তারপর মুণ্ডা, শবর, কুঁডবি ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে গেল। চাম্পা থেকে তড়েপুখুড়ি, আবার তাড়া তারপর বাড়িবারওয়া। তারপর শিরে দেশ বা শিকার দেশ। শিকার রাজার সমস্ত জঙ্গল পরিষ্কার করলাম কিন্তু দিকুরা সেখান থেকেও আমাদের তাড়াল। অজয় নদ পার হওয়া আমাদের পূর্বপুরুষের বারণ ছিল। কিন্তু পেটের দায়ে গুটিপোকার মতো এই সাঁওতাল পরগনায় চলে এসেছি। আর একদিন আর কোথাও চলে যাব। ঝাড়খণ্ড কি আর শেষ পর্যন্ত আমাদের আশ্রয় দিতে পারবে? মনে হয় না। ভারতের তাবৎ জাতি কাঙাল প্রকৃতির, বেসিক্যালি। কাঙালদের শাকের খেত দেখালে যা হয় আর কি!
কস্তুরী বললেন, তুমরা হিস্ট্রি নিয়ে এতো কী ঝগড়াচ্ছো! হিষ্ট্রি এক বিশাল আমাজন নদীর স্রোতের মুতো। সে তার নিজের ভেতরকার লুকুনো কারেন্টে বয়ে যায়। কেউ জানবে না কুথায় নিয়ে আমাদের ফেলবে!
—সবই যদি পূর্বনির্ধারিত দিদি, হিষ্ট্রি যদি তার নিজের দুর্বোধ্য পথেই চলে, তা হলে আর এত বিপ্লব, এত শিক্ষাসচেতনতা, এত লড়াই, সমাজসেবা কেন? —মিঠু দাঁতে নখ কাটছে।
—না দিদিমোণি, আমি বলতে চায়ছি কি এইসোব বিপ্লব, লোড়াই, সোব সেই ইতিহাসের ওঙ্গ, তার নিজের একটা গোতি আচে।
—তা হলে আপনি কেন, আপনারা কেন আপনাদের সময়ের স্বপ্ন পূর্ণ হল না বলে দুঃখ করেন? কেন গান্ধীজি অনশন করে পার্টিশন আটকালেন না, কেন সুভাষ রহস্যময়ভাবে মারা গেলেন, কেন জওহরলাল, বল্লভভাই, জিন্নাহ, মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে মাঝরাতের সমঝোতায় কেনা খণ্ডিত স্বাধীনতা অ্যাকসেপ্ট করলেন— এসব তো আজ ঘটে- যাওয়া ইতিহাস। সে নিয়ে দুঃখ করে তো লাভ নেই! ইতিহাসের নিজস্ব গতি!
আর দ্যাখ কাজল, হঠাৎ যে তুই এই দিকু-দিকু করে আমার সঙ্গে, শিখরিণীর সঙ্গে, হয়তো বা দিদির সঙ্গেও তাদের শত্রুদের ইকোয়েট করছিস— এটা কিন্তু ঠিক করছিস না। তুই হঠাৎ কেমন ক্যারেড অ্যাওয়ে হয়ে গেছিস। তোর আত্মপ্রত্যয়, সেলফ-পজেশন আমার শ্রদ্ধার জিনিস। তোর থেকে এটা আশা করিনি।
—তা হলে কী আশা করেছিলি? তোদের শ্রদ্ধার পাত্র হবার জন্যে যা যা ছকে দিচ্ছিস, তাই আমায় করতে হবে? হতে হবে? আ অ্যাম নট অ্যাফরেড টু লুজ ইয়োর রেসপেক্ট অ্যাজ লং অ্যাজ আ’অ্যাম মাইসেলফ।
কস্তুরীবেন বৃথাই ওদের কুচি নিমকি আর লাড্ডু নিয়ে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। কাজল দূরে গিয়ে বুকের ওপর হাত আড়াআড়ি করে দাঁড়িয়ে রইল। মিঠু চেয়ারে বসে রইল রাগত মুখে। আর শিখরিণী সমানে বলতে লাগল, এই মিঠু এত রেগে গেলে কেন? কী হল? দুর তুমি একেবারে ছেলেমানুষ। কবেকার কী হিস্ট্রি, সেটাকে এমন ব্যক্তিগতভাবে নিচ্ছ কেন? তুমিও আর সেই দিকু নেই, কাজলও আর সেই মুণ্ডা নেই।
কাজল পেছন ফিরে শান্ত গলায় বলল, য়ু আর রং শিখরিণী, আই’ল রিমেন আ মুণ্ডা অল মাই লাইফ। আমি কিছুর জন্যই আমার জাতি পরিচয় বিসর্জন দেব না। সে তাদের জন্য পলিটিকস বা পতিতোদ্ধার জাতীয় কিছু করি বা না করি।
কোথায় সুর কাটছে, কেন, কস্তুরী বুঝতে পারছেন না। এতদিন একটা পারস্পরিক ভাল লাগা, বিবেচনার, এমনকী বশংবদতার মধ্যে এদের পরিচয় পেয়েছেন। মিঠু ছেলেমানুষ, সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল, সবকিছু করতে তৈরি, আপাতদৃষ্টিতে চঞ্চল, কিন্তু ওর ভেতরে লুকোনো সমুদ্র আছে। হয়তো বা দুর্বিনীত ভয়ংকর ঘূর্ণিপাক। মাঝেমাঝে, চকিত দর্শন দিয়েই তা আবার ঢেকে যায়। নীল আকাশে হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি। শিখরিণী মেয়েটিকে তিনি এখনও ঠিক বুঝতে পারেননি। ও মিঠুর বন্ধু। কিন্তু কোনওভাবেই মিঠুর মতো নয়। অনেক শান্ত, মিঠুর মতো চটপটে নয়, চটপটে হতে ওর ইচ্ছেও যে আছে তা মনে হচ্ছে না। ওর ব্যক্তিত্বটা একেবারে তৈরি হয়ে গেছে। বেশ সমৃদ্ধ ব্যক্তিত্ব, কিন্তু সেটা আর পালটাবে না। ও জীবনকে যেভাবে বুঝেছে সেভাবেই বুঝবে, বুঝতে ইচ্ছুক। ওর নিজের পটভূমি কলকাতায় ও অনেক স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক, কিন্তু এই যাত্রাটাতে যেন ওর মহিমা ফুটছে না। ও প্রকৃতি উপভোগ করছে ঠিকই, কিন্তু কেমন বাইরে থেকে। ও অভিভূত হয় না। একটা দার্শনিক প্রকৃতিস্থতা আছে ওর মধ্যে। যেন কোনও লুকোনো অভিপ্রায়। সেই অভিপ্রায়ে ও অচল অটল।
কাজলকে তাঁর সবচেয়ে পছন্দ। কাজল সত্যি সত্যি এ যাত্রায় তাঁর যথার্থ যাত্রাসঙ্গী। কেননা দু’জনেই এক ধরনের অন্বেষণ-সূত্রে বাঁধা। তিনি খুঁজছেন তাঁর হারানো দিন, তাঁর মাকে। কাজল অবশ্য তার দেশ ও ইতিহাসকে খাতায়কলমে খুঁজছে, তবু জন্মস্থানে এসে হারানো শৈশব, হারানো আপনজনের প্রতি ওর কেমন একটা নৈর্ব্যক্তিক আগ্রহ। সেটাকে টান বলা যাবে না, তাঁরটা যেমন টান। কিন্তু … কিন্তু কী এক মমতা ছেলেটাকে এই মুহূর্তে অধিকার করে রেখেছে একটা মায়ার মতো সেটা তিনি টের পাচ্ছেন। ও বলছে ও পলিটিকসে জয়েন করবে না, এটাতে কিন্তু নিজের লোকেদের উন্নয়নের কিছু সুযোগ ছিল। ও সমাজসেবাও করতে চাইছে না। ও কী চায়? ও কি বিশুদ্ধ অ্যাকাডেমিক! ধাতটাই বিজ্ঞান-গবেষক, পণ্ডিতের?
—আমি ভিতরে গিয়ে চান করে নিচ্চি। আজ আমি ওই জঙ্গলের ইনটিরিয়রে যাব। তুমাদের যদি ঝোগড়া থাকে তো তাই করবে। আমি একা যাবো। ইন ফ্যাক্ট একা যেতেই আমার পোছন্দ হচ্ছে।
তিনি আর অপেক্ষা না করে পুঁতির কাজ করা লাল থলিটা চেয়ারের ওপর ফেলে রেখেই চলে গেলেন। ইয়াং পিপল মানেই ঝোগড়া আর ঝোগড়া, আর ওল্ডার পিপল মানেই সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি—তবে কোথায় যাবেন তিনি? কাউকে নিবেন না, ডাকা তো দুরের কথা। তিনি তাড়াতাড়ি করে নিজের ঘরের দিকে চলতে লাগলেন।
এখানকার জল কীরকম ঠান্ডা। কিন্তু ছ্যাঁক করে ওঠে না শরীর। রতন বলছিল কুয়ার জল কখনও বেশি ঠান্ডা, বেশি গরম হয় না। শীতল যাকে বলে। চান করে মনে হয় একটা নতুন জীবন পেলেন। পোশাক পরে একেবারে নীচে নেমে গেলেন। মনে মনে আবার বললেন—কাউকে নিব না। একা একা যাব। কারো তুমরা ইয়াং জেনারেশন তুমাদের ঝগড়া।
রোতন, আর একটু চা হোবে? —চা-টা প্রায় শেষ করে এনেছেন, হঠাৎ পেছন থেকে লাফ মেরে সামনে চলে এল মিঠু— দিদি পিলচু বুড়ি এসে গেছে। সে এখন রীতিমতো ট্রেকার, টাইটস আর টিশার্ট পরা, কোমরে বেল্ট, যেখানে টাকা পয়সার থলিটা থাকে সেখানটা দেখিয়ে বলল, কুকরি। পিঠেও একটা ছোটখাটো রুকস্যাক। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাজির কাজল— সে শুনতে পেয়েছে মিঠুর কথা। হাসছে, বলল, হাড়াম আয়ো সব হাজির দিদি।
পেছনে পেছনে শিখরিণীও হাজির। সে আজকে সবুজ পাতার রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পরেছে। দেখাচ্ছে খুব সজীব। বলল, আমরা কি এবার যাব, দিদি?
—হাড়াম আয়ো হড় হপন সোব যুদি রেডি তো ঠাকরান আর কী কোরে! মৃদু হেসে কস্তুরী বললেন।— সৃষ্টির আদি ওগাধ জোলে ভেসে পোড়া যাক। তুমরা চান করলে না?
—তা হলে ঠাকরান জিউকে ধরা যেত না। যেরকম মেলট্রেনের মতো ছুটছিলেন!—কাজল বলল— তা ছাড়া, কোথায় যাব, কত ময়লা, ধুলো, মাটি, ঘাম— এসে চান করাই ভাল।
তারও কাঁধে একটা ঝোলা। বলল, আপনার নিমকি লাড্ডুর থলিটা নিয়ে নিন দিদি। কাজে লেগে যেতে পারে।
শিখরিণীর কাঁধে একটা বড় চামড়ার ভ্যানিটি ব্যাগ।
চতুর্দিকে পুটুস ঝাড়। সাদা-হলুদ কুটিকুটি ফুল ফুটে আছে। বনতুলসীর ঝোপ এত দুর্ভেদ্য যে তার মধ্যে দিয়ে পথ বার করাই দুষ্কর। ঝাড়ের পর ঝাড় এড়িয়ে পথ বার করে কাজল। সার বেঁধে সবাই ঢোকে।— শিখরিণী, তোমার জুতো কিন্তু এই যাত্রার উপযুক্ত নয়, পোকামাকড় পিঁপড়ে … মিঠু ওকে বলে দিসনি স্নিকার কি কেডস পরে আসতে!
মিঠু বলল, আমার একদম খেয়াল ছিল না।
ক্রমে শালের চারা বড় হতে থাকে, মহুয়া আরও গাঢ় সবুজ। কেঁদ গাছ দেখিয়ে দিল কাজল— মহুয়ার সঙ্গে খুব একটা তফাত বুঝতে পারল না কেউই।
এর কাঠ দিয়ে তোদের ফার্নিচার হয়। শাল দিয়ে তো হয়ই জানিস নিশ্চয়। শালপাতায় করে হিঙের কচুরি— আহ স্বাদই আলাদা।
শিখরিণী আর মিঠু চোখাচোখি করে হাসল। এই খুনসুটিটা বোধহয় কাজল আজ সারাদিনই করে যাবে।
অনেকক্ষণ চলবার পর ওরা দু’-একজন মেয়ের দেখা পেল, তারা, শালপাতা ছিঁড়ে বোঝা করছে। ক্রমশই এরকম মেয়ে সংখ্যায় বাড়তে থাকে।
—কী করছ গ—কাজল একজনকে শুধোয়!
—তাতে তুমার কী? —মেয়েটি নিজের কাজে মগ্ন, উত্তর দেবার সময় নেই।
—এখানে কাঁচা শালপাতাও খুব চলে বুঝলেন দিদি! কাঁচা শালপাতায় করে যদি স্রেফ ভাত আর ডাল কিংবা শাক খান, আপনার আর কিচ্ছু লাগবে না, শালপাতার এমনই চমৎকার গন্ধ। তবে এই আমিষাশী শহুরে মেয়েদের কী লাগবে বলতে পারছি না!
—শালের গোন্ধও চোমৎকার, তা তুমার পিছনে কাটিও চোমৎকার। উত্তর এল দিদির কাছ থেকে।
আস্তে আস্তে ছাগলছানা, ছানাপোনা সমেত ছাগলি, একাবোকা রামছাগল একটু উঁচুতে দাঁড়িয়ে শিং বাঁকিয়ে দিগন্ত দেখছে। একটা-দুটো বাছুর হামলাচ্ছে। কচি গলা, শুনলেই বোঝা যায়। গোরু চলে গেল কয়েকটা, পেছনে পাচনবাড়ি হাতে একটি বয়স্ক লোক।
—ছুট ছেল্যা নাই, বাগালি কঁরছো? —কাজল আবার শুধোয়।
ছোট ছেলেমেয়েরা পড়তে গেছে ইস্কুলে— সোজা সরল বাংলায় বলল লোকটি।
একটু অবাক হয়ে মিঠু আবার শিখরিণীর দিকে তাকাল।
আর খানিকটা গিয়ে শস্যখেত। —জুনুর— মানে ভুট্টা— কাজল বলল। মনসাপুজো না হওয়া পর্যন্ত জুনুর খাওয়া বারণ। বুঝলেন দিদি?
শিখরিণী বলল, আমরা যেমন সরস্বতী পুজোর আগে কুল খাই না।
বাজরার খেত পড়ল। আলু, অড়হর ডাল। তারপর আস্তে আস্তে দুটো-একটা করে কুটির। একটি কুটিরের দাওয়ায় এক মা তার বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছিল, কৌতূহলী চোখে তাদের দিকে চেয়ে রইল, তারপর বুকের কাপড় টেনে, বলল—টুরিস্ট? আসেন না, বসেন না গ, —মহিলার বিস্মিত দৃষ্টি শিখরিণীর দিকে।
এক পা দু’পা করে এগিয়ে ওরা দাওয়ার বসছিল। মেয়েটি ভেতর থেকে পাতার মাদুর এনে দিল।— এই ঠেঁ বসেন। বাচ্চাটিকে বোধহয় ভেতরে শুইয়ে এল।
—এ কার ঘর?— কাজল জিজ্ঞেস করল।
—ইটা হারান মল্লিকের ঘর।
—লোধা হও?
—লোধা বলেন লোধা, মুণ্ডা বলেন মুণ্ডা। আমরা তো আর বনের জংলি নাই। আমারদের খেতিবাড়ি আছে। ছাগল পালি৷ মোরগ আছে।
—ছেলেপুলেরা সব কই?
—উরা সব ইস্কুলে পড়তে যাঁইছে।
—স-ব?
—স-ব! এ-লোধা, মুণ্ডা, কিসকু, হাঁসদা— স-ব ছেলেমেয়ে পড়ছেঁ।
—বাড়ির বড়রা?
—কাজ কঁরছে।— খেতি আছে, পশু-পক্ষী আছেন তাঁদের তো খাওয়া-চরা চাই! ওঁরা কজন পড়ছে। বয়স্ক বিদ্যালয় হঁইছে না?
—কোন দিকে স্কুল? ওই সাধন মুর্মু নিম্ন বিদ্যালয়?
—না না, সি তো উই দিকে। ওই আমাদের কুলি থে’ বরাবর, সিধা।
—আচ্ছা দেখি গে যাই, হ্যাঁ— আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
হঠাৎ শিখরিণী নিজের ব্যাগ খুলে এক মুঠো লজেন্স দিল মহিলার হাতে।— বাচ্চারা এলে দেবেন।
হাত পেতে নিল বউটি, তারপর বলল, উদের বলব অম্বিকা দেবীর প্রসাদ আছে!
—না, না, সেকী! সেকী! স্টেশনারি দোকান থেকে কেনা, কোনও প্রসাদ নয়।
বউটি মৃদু মৃদু হাসতে লাগল, কিছু বলল না।
কস্তুরী রাস্তায় উঠতে উঠতে বললেন, দেকো কাজল, আমি যেখান প্রথম শিখরিণীকে দেকি তোখন আমারও মনে হোয়— অম্বা, আমাদের ওকানে অম্বার পূজা হয় তো! ব্যাঘ্রবাহিনী দেবী। তুমাদের দুর্গারই মুতো। তবে এতো ছেলেমেয়ে নাই।— তিনি কাজলকেই বললেন কথাগুলো।
আপনাদের তো দুর্গাপুজো নেই, না দিদি!
—না, কিন্তু ও সোময় শুক্লা প্রতিপদ থেকে নওরাত্রি হয়, সে নয়দিন ধরে চণ্ডীপাঠ, ঘটপূজা, উপবাস। ডাণ্ডিয়া নাচ, দশেরার দিন পর্যন্ত। সেদিন রাবণও বধ হল। আমরাও মুক্তি পাচ্ছি।
বউটি যেমন বলেছিল— একটু দূরেই ব্যারাকবাড়ির মতো বিদ্যালয়। সুধীন্দ্রনাথ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। রাস্তা থেকেই দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকটি ঘরে ক্লাস হচ্ছে। একটা কোণের ঘর থেকে একজন বেরিয়ে এলেন। শার্ট প্যান্ট পরা। কিন্তু কাজলেরই মতো।
আপনারা দেখতে এসেছেন?
—হ্যাঁ। ভাল লাগছে। আপনি? …
—আমি বালিরাম ভুক্তা। হেড মাস্টার এ স্কুলের।
—বাঃ, চলুন আপনার অফিস ঘরে বসি।
—নিশ্চয়! আসুন। আসুন মা, দিদিরা।
হেডমাস্টারমশাইয়ের ঘরে একটি কাঠের বেঞ্চি, একটি টেবিল, দু’টি চেয়ার। চেয়ারগুলো প্লাস্টিকের। একটি আলমারিতে পরপর ফাইল রাখা।
দেখতে দেখতে মিঠু বলল— এরা মাধ্যমিক পড়ে কোথায়?
—এখানেই প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক সব।।
—অ্যাফিলিয়েশন আছে?
—নিশ্চয়ই। অনেক সংগ্রাম করে জোগাড় করেছি দিদি। কলেজটি এখনও করতে পারিনি। জিলায় জিলায় যেখানে পায় পড়তে পাঠিয়ে দিই। বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, কৃষ্ণনগর, হুগলি, বর্ধমান। যে যে-বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে পায়। এ পর্যন্ত ওরাই আমাদের স্কুলের টিচার। অনেকে কারিগরি শিখেছে। এখানে ডোম কমিউনিটি আজকাল দারুণ বাঁশ-বেতের কাজ করছে, কার্পেন্ট্রি আছে, আমাদের লোক্যাল চাহিদা সবই মিটে যায়। বেত-বাঁশ বিদেশে যাচ্ছে।
—মেয়েদের স্কুল নেই?
—ওই তো। এই স্কুলের পেছনে খানিকটা রাস্তা গেলেই, অনেকটা বাগান আছে। হঠাৎ একটু ইতস্তত করেন বালিরাম ভুক্তা—মা, একটি কথা সবিনয়ে নিবেদন করি।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন।
—মা, দিদি, দাদা আপনাদেরও কাছে প্রার্থনা— যা দেখে গেলেন কাগজে ছাপবেন না।
—আমরা কাগজ টাগজের লোক নই— কিন্তু কেন? শিখরিণী আশ্চর্য হয়ে বলল।
—কাগজে হইচই হবে। রিপোর্টার আসবে, শতেক ইন্টারভিউ নেবে, সরকারি লোক আসবে, সে খুব ঝামেলা। শান্তি নষ্ট হয়ে যাবে আমাদের। ছেলেমেয়েদের মন উচাটন হবে। লেখাপড়ার সময়টা খুব শান্তিতে অভিনিবেশে কাজ করতে হয়। এ শুধু আমার কথা নয়। আমাদের বাবার কথা!
—কার বাবা? কাজল শুধোয়।
—আমাদের সবার বাবা। প্রাণপাত করে যিনি এই গ্রাম গড়ে গেছেন। আমাদের পচুই ছাড়িয়েছেন, আলসে-কুঁড়েমি ছাড়িয়েছেন। নানান কাজে-কামে উৎসাহ দিয়েছেন। আমরা এ দেশের মানুষ, আর সবার মতো আমাদের সব অধিকার আছে, কর্তব্যও আছে, যিনি শিখিয়েছেন … দিকুরা আর আমরা আলাদা নই— একই দেশের …
—কে তিনি?
—সে অনেক দিন হবে। পঁচিশ তিরিশ বছর। শুনলাম কে আসছেন। দূর পাহাড় থেকে। ওঁরা নেমে এলেন আমাদের এখানে—এক হাঁটু কাদা মেখে, হাতে দু’টি বাক্স। কাঁধে ঝোলা, বললেন আশ্রয় দেবে? তা মা, আমরা আশ্রয় দেব কী? তাঁরাই আমাদের আশ্রয় হয়ে উঠলেন। সে সময়ে আমাদের বাবা-মা’রা বলতেন স্বয়ং ঠাকুর আর ঠাকরান আমাদের কষ্ট দেখে, কান্না শুনে, মানুষের বেশে নেমে এসেছেন। আস্তে আস্তে পাহাড় থেকে সব ট্রেনার নেমে আসতে লাগলেন, কত কিছু শিখলাম। মা যখন এখান থেকে পাহাড়ে চলে যাবেন বললেন, কেঁদে কেঁদে সব পথ আটকিয়ে ছিলুম। উনি বললেন— তোরা কি শেষ পর্যন্ত আমার মারাংবুরু হলি? সিংদুয়ার দিবি না? আমার কিরে কেটে বল— আর কোনওদিন হাঁড়িয়া খাবি না। আমি চলে যাচ্ছি আমার আরও অনেক সন্তান আছে, কাজ আছে। তোদের বাবা তো রইল।
কস্তুরী জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর নামেই এই বিদ্যাভোবোন?
—আজ্ঞে হ্যাঁ মা। কোথায় না কোথায় গেছেন তিনি আমাদের শিক্ষা, চাষবাস, আমাদের হাসপাতালের জন্যে। এই ভূমি এরকম ছিল না মা। রুক্ষ, পাথুরে, তিনি আমাদের দিয়ে এইসব পথ বাড়ি ঘর দুয়ার কুয়া সব করালেন। আমার বাল বয়সে আমি ছোট ছোট হাতে এই স্কুলবাড়ির নতুন শাখা গড়ার জন্য কড়াইয়ে সিমেন্ট-বালি মেখেছি। আমি তাঁর ছায়ে ছায়ে বড় হয়ে উঠেছি। কলেজে পড়েছি, টিচার্স ট্রেনিং নিয়েছি মেদিনীপুরে, তারপর এখানে।
—তিনি কোথায়?
—তিনি তো আর নেই মা। স্বদেহে নেই। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি তিনি সবসময়ে আমাদের দিকে চেয়ে আছেন। আমরা বাবার থান গড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু মা লিখে পাঠালেন। না। ভীষণ ক্রুদ্ধ। আর কত বোঙ্গা চাস তোরা? খবরদার বাবার থান গড়বি না। তাঁর আসল থান হল এই গ্রাম, এই রাস্তা, এই স্কুল, চিকিৎসালয়। সব পবিত্র। সব থানে তিনি। এই পবিত্রতা রক্ষা করবি।
কাজল বলল, তা আপনাদের কি আর এখন কোনও দেবতা নেই?
—তা কেন থাকবে না? এখনও মায়েবা তুলসী তলায় মড়লি দ্যান। মড়লি জানেন তো? গোবরের দু’টি গোলাকৃতি মণ্ডল। ভূমণ্ডল কল্পনা করে নেন। এখনও সহরায় পরবে মা ভগবতীর গুণ গাই, সারারাত নাচগান করি। গড়াম-থান তো আছেই। পাঁচ বৎসর বাদ বাদ সিং-বোঙার পূজা করি। আপনারাও যেমন দুর্গা, সরস্বতী, নারায়ণ পুজো করেন। কত দিনের আচার উৎসব চলে আসচে কিনা! কিন্তু নিজেদের কাজটুকু কোনও দেবতা করে দেবেন এ বুদ্ধি তো নাই? কী? আছে?
বালিরাম ভুক্তার মাথার কাছে বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র ও গাঁধীজির ছবি। উনি নমস্কার করে বললেন—এঁরা আমাদের সবার জন্য কত ভেবেছেন, খেটেছেন, নতুন-নতুন ভাবনা, প্রাণ দিয়ে গেছেন সবার জন্যে— আমরা জানি।
আরও কিছুক্ষণ কথা হল। তারপর মেয়েদের স্কুল হাসপাতাল দেখতে যাবেন বলে সবাই উঠলেন। পেছন ফিরে দাঁড়াতেই দরজার ওপরের দেওয়ালে কস্তুরী দেখলেন— স্থানীয় শিল্পীর হাতে আঁকা, কাঠকয়লার স্কেচ। তলায় লেখা—প্রতিষ্ঠাতা সুধীন্দ্রনাথ। আর কিছু না, পদবি না, কোনও ভক্তির কথা না, এঁরা যে তাঁকে ঠাকুর বা বাবা বলে মানেন, সে কথা পর্যন্ত না। শুধু প্রতিষ্ঠাতা— সুধীন্দ্রনাথ।
কীরকম আচ্ছন্নের মতো বেরিয়ে এলেন কস্তুরী। ভাল করে পথ দেখতে পাচ্ছিলেন না। হোঁচট খেলেন। কাজল এক দিক থেকে মিঠু এক দিক থেকে না ধরলে একেবারেই পড়ে যেতেন। মাঝখানে কস্তুরী। চোখ ঝাপসা, দু’পাশে কাজল আর মিঠু চোখাচোখি করল। কাজল জিজ্ঞেস করল, দিদি, আর কি আজ যাবেন? আজ এই পর্যন্ত থাক না! একটা বেজে গেছে। আবার কাল আসা যাবে!
কস্তুরী হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। দু’জনেই বুঝতে পারল সরল গাছের মতো সোজা এই মহিলার মধ্যে ঢেউ উঠছে। তিনি প্রাণপণে সে তরঙ্গ রোধ করতে চেষ্টা করছেন। তাঁকে আর একটা কথা বললেই হয়তো ভেঙে পড়বেন। সেটা তাঁর লজ্জার কারণ হবে। ব্যবসায়ী কন্যা ব্যবসায়িনী সমাজসেবিকাদের তো আবেগ থাকতে নেই! আমরা প্রত্যাশা করি তাঁরা সবসময়ে খুব ধীর স্থির আত্মস্থ হবেন। তাঁদের সমস্ত কাজের পেছনে একটা নৈর্ব্যক্তিক দর্শন থাকবে, যান্ত্রিক অনুভবশূন্য বাস্তববুদ্ধি দিয়ে তাঁরা কাজ করে যাবেন।
শিখরিণী তাকাল মিঠুর দিকে, মিঠু তাকাল কাজলের দিকে, চোখে চোখে ইশারা হয়ে গেল। কাজল বলে উঠল আমরা এগোচ্ছি দিদি, আপনি আস্তে আস্তে আসুন। আজকের এপিসোড এইখানেই শেষ কিন্তু। পেটের মধ্যে রাজব্যাং ঢুঁ মারছে। তিনজনে তাঁর অনুমতির অপেক্ষা না করে এগিয়ে যায়।
—কী সুন্দর গ্রাম রে তোদের! মিঠু বলল।
—আমি এরকম দেখিনি, কাজল সংক্ষেপে বলল।
শিখরিণী বলল, আমি বিশ্বাস করি না এরা ইঁদুর খায়। সাপ খায়…
কাজল হেসে বলল, দ্যাখো গোরু-শুয়োর খেতেও তো তোমাদের একদিন খুব আপত্তি ছিল। এখন খাচ্ছ। তো! সাপের মাংস অনেকেরই খুব প্রিয়। আর মেঠো ইঁদুর সত্যিই ফার্স্ট ক্লাস, তুলতুলে নরম।
—আঃ—
—তুমিই তো টপিকটা শুরু করলে বাবা।
—আমি জাস্ট বলেছি এদের ফুড-হ্যাবিট বদলে গেছে।
—আরে বাবা, তোমরা চাওমিন, হ্যামবার্গার খাও বলে তো আর চিংড়ি মাছের মালাইকারি খাওয়া ছাড়োনি, ছেড়েছ?
মিঠু বলল, ফিরে গিয়ে তো আবার রতনের শ্রীহস্তের খিচুড়ি খেতে হবে, মালাইকারি-টারি বলে আর মন খারাপ করে দিসনি।
—দ্যাখো আজকে তো দ্বিতীয় দিন। রতন হয়তো নতুন কিছু সারপ্রাইজ দেবে। বনমোরগের কালিয়া আর…
শিখরিণী ঝেঁঝে উঠে বলল, আমি এখানে নিরামিষ ছাড়া আর কিছু খাচ্ছি না।
সুধীকাকা! সুধীকাকা যিনি কল্যাণী মেহতার সঙ্গে ইলোপ করেছিলেন বলে তিনের এক ফার্ন রোডের আসর ভেঙে গেল, যার জন্য মেয়েকে নিয়ে নরেন্দ্র মেহতা আমদাবাদ ফিরে গেলেন, যার জন্য দাদা-দাদি কোনওদিন মাতৃপ্রসঙ্গ উঠতে দেননি, সেই সুধীকাকা! এদের বাবা। তাঁর জন্য এরা থান গড়তে চেয়েছিল।
গলার জোরে সবাইকে ছাপিয়ে সুধীকাকা গাইছেন— বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/ তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী। —মা বলছেন সুধা, তুমি অত চড়ায় ধরলে আমরা গাইব কী করে?
ছোট্ট কিকির মনে হচ্ছে— গাক না। সুধীকাকা একলাই গাক। চোখ বুজিয়ে বুজিয়ে সে বাংলাদেশের হৃদয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। বাংলাদেশ জানা আছে, হৃদয়ও মোটামুটি জানা, কিন্তু বাংলাদেশের হৃদয় একটা অদ্ভুত মমতাময় স্বপ্ন-দোলনা, সেই দোলনার গভীর আরামে বুঁদ হয়ে একটা অপরূপ ঘুম!
ছ’বছর বয়সে শেষ দেখা। তবু আজ চারকোল স্কেচটা দেখার পর হুবহু মনে পড়ে যাচ্ছে সুধাকাকাকে। স্কেচটা স্বভাবতই আরও অনেক বেশি বয়সের। কিন্তু সুধাকাকার মুখের কাঠামো একই রকম আছে। লম্বাটে। গালের হাড় সামান্য উঁচু, উজ্জ্বল শ্যাম, চোখ দুটো কেমন ঘোর-লাগা, নাকটা বেশ স্পষ্ট, সব মনে পড়ে যাচ্ছে। ধুতির ওপর শার্ট পরতেন সুধীকাকা। গোঁফদাড়ি কিছুই ছিল না। পরেও রাখেননি দেখা যাচ্ছে। একেবারে এক মুখ, শুধু তার ওপর বয়সের বদল। কতদিন মারা গেছেন সুধীকাকা! এদের মনে জীবন্ত আছেন এখনও। কতদিন থাকবেন? আমরা কি কেউ মনে রেখেছি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিকদের? তাঁরা কি ইতিহাসের পাতায়, কি সরকারি অফিসে, কি পুরনোপন্থী বাড়ির দেওয়ালে ছবি হয়ে নেই? শুধু ছবি। আর কিছু নয়। ওঁরা প্রাণপাত করেছেন, আমরা এ. সি. রুমে থাকব বলে, বিদেশি গাড়িতে করে শপিং মলে বিলিতি ফতুয়া কিনতে যাব বলে। ডবল দামে। উপার্জন বাড়লেই আস্তে আস্তে বাড়িতে ঢুকবে জিনিস, আরও জিনিস! ফিরে তাকিয়েও দেখব না রাস্তায় কুকুরের মতো ঘুরে বেড়ানো শিশুদের দিকে। কিশোর বয়স থেকে সংগ্রাম করতে করতে তাঁর বড় হওয়া বিবেকানন্দকে আদর্শ হিসেবে সামনে রেখে সারা জীবন ব্রিটিশের কারাগারে। অসুখ, অসুখের পরে আরও অসুখ, তারই মধ্যে লিখে যাচ্ছেন দেশবাসীর উদ্দেশে অমিত চিঠি, লিখছেন ‘ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ —দেশ, দেশ ছাড়া অন্য কোনও চিন্তা নেই। বিদেশে ইতালি থেকে অস্ট্রিয়া, সেখান থেকে জার্মানি, জাপান, রাশিয়া নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মানুষটি। প্রত্যেকটি সুধীজন, প্রত্যেকটি শক্তিমানের সঙ্গে দেখা করছেন বৈদেশিক সহানুভূতি ও সাহায্যের আশায়। কী মৃত্যু, কী অবসান ওই মহান জীবনসাধনার! এয়ার-ক্র্যাশ। যদি সত্যিই হয়ে থাকে! তাঁকে আমরা মনে রেখেছি? ২৩ জানুয়ারি কোনওক্রমে ছবিতে আর মূর্তিতে মাল্যদান, জাতীয় পতাকা উত্তোলন। কে চেয়েছে তাঁর কাজের ভার কাঁধে তুলে নিতে? তিনি হিন্দু মুসলমান, হিন্দিভাষী উর্দুভাষী, বাংলাভাষী, ধনী-দরিদ্র, বনেদি ঘর, সাধারণ ঘরে কোনও তফাত করেননি। আপামর ভারতবাসীর উন্নয়ন ছিল তাঁর লক্ষ্য। কোথায় এঁদের স্বপ্নের ভারত! যাঁরা সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁরাও কি প্রকৃত সমস্যা দেখতে পেয়েছিলেন? চেয়েছিলেন দেখতে? না নিজের মনগড়া কল্পমূর্তিকে রূপ দেওয়ার অহংয়ে সমস্ত বাস্তবতা বোধ বিসর্জন দিয়েছিলেন! যার ফলে আজ চতুর্দিকে ঘুষরাজ, কলঙ্করাজ, দুর্নীতিরাজ, ইঁদুরের গতিতে মানুষের বংশবৃদ্ধি হয়। ইঁদুরের মতোই খুঁটে খায়, মরে, মানুষের এ চরম অপমান কি কোনও দেশ-প্রেমিকদের গড়া দেশে হতে পারে? না, এখন দেশ-প্রেমিকরা গদিতে বসেন না, বসে রাজনীতি-ব্যবসায়ীরা— নরেন্দ্র বলতেন। কেননা তিনি রবীন্দ্র-সুভাষ-বিবেকানন্দ-অরবিন্দ এই জাদু চতুষ্কোণে চলে এসেছিলেন। তাঁর কাজ আরও সহজ হবে ভেবেছিলেন, এখানকার হাওয়ায় তাঁদের প্রতিভা, কল্পনা, দর্শন ও প্রেমের চূর্ণ হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসছে কিনা!
কী নিয়ে কল্যাণীর সঙ্গে নরেন্দ্রর মতভেদ এত সাংঘাতিক হয়ে উঠল? বাবা যখন নতুন স্টুডিবেকারটা কিনলেন, তখনই, বোধহয় তখন থেকেই। মা বললেন— এটার কি খুব দরকার ছিল?
বাবা— বিজনেসের ব্যাপার, বুঝবে না!
মা— পুরনো গাড়িটা কি খারাপ ছিল? আমাদের তো উদ্বৃত্ত দিয়ে ফান্ড গড়ার কথা ছিল?
—আমার একার উপার্জনে দেশ গড়বে? বাবার গলায় বিদ্রুপের সুর, হাসি।
—তোমার একার নয়, তোমার মতো অনেকের। এক একটা গ্রাম বা অঞ্চল ধরে যদি আমরা কাজ করতে যাই— এ টাকা তো কিছুই নয়! আর অন্য ব্যবসায়ীদের এতে শামিল করার দায়িত্বটাও তোমার আর শরদের। কস্তুরী বুঝতে পারলেন না এই সংলাপ তিনি নিজে এখন বানাচ্ছেন কিনা! অবিকল না হলেও ভাবটা যেন ছিল এই রকমই। নতুন গাড়ি নিয়ে কথা কাটাকাটি তাঁর মনে আছে। সোনার ভারী ভারী গয়নার একটা সেট মা বাবার হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছেন স্পষ্ট মনে আছে। হিরের নাকছাবি, কানের দুল ঝকঝক করছে, গলার মস্ত বড় চাঁদের মতো লকেট। মা’র ভুরু কুঁচকে উঠছে— এ তুমি কী করছ? এসব কী হবে? —কিকির মনে হচ্ছে এই হিরেগুলো তো মা তার জন্যেও রেখে দিতে পারতেন! সে বড় হয়ে পরত বেশ!
—ব্যক্তিগত কিছু থাকা দরকার, কল্যাণী, দুঃসময়ে কাজে লাগে।
—দুঃসময়ে? এর চেয়েও দুঃসময়? দেশ স্বাধীন হয়েছে, অথচ নির্দোষ মানুষের রক্ত চারদিকে, কার দেশ নরেন্দ্র? যে নিজের দেশ থেকে, জমি বসত থেকে উৎখাত হল, দেশটা তা হলে তার নয়! তোমাকে লোভ পেয়ে বসছে, লোভ আর স্বার্থচিন্তা, এখনও শোনো, এখনও ফেরো। চারদিকে মানুষের হাহাকার শুনতে পাচ্ছ? মেয়ে, বাচ্চা, পুরুষ সবার! শুনতে পাচ্ছ না, চতুর হাসি ধুরন্ধর সুযোগসন্ধানীদের? ঘোলা জলে যে ওরাই মাছ ধরবে এবার।
—দেশের লিডার, যাঁদের হাতে আসল ক্ষমতা, তাঁরাই যদি দুর্নীতি দেখতে না পান, চোখ বুজিয়ে থাকেন, আমি একা কী করব?
—একা কেন? তোমার মতো আদর্শবাদী ব্যবসায়ী কি আর কেউ নেই? আমরা, আমি, সুধী, অজিতবাবু, স্নেহদি, নিবেদিতা আমরা কি নেই?
—তোমরা? শুধু মনোবল নিয়ে কিছু করা যায় না কল্যাণী, স্রোতের মুখে কুটোর মতো ভেসে যাবে। সুধী? অজিতবাবু? কী করবে ওরা? টাকার দাম বোঝে? পাঁচ হাজার টাকা একসঙ্গে চোখে দেখেছে?
প্রশান্ত মহাসাগরীয় নীরবতা। ধুধু করছে গভীর জল। বিষ পান করে নীলকণ্ঠ।
না, তিনি বানাচ্ছেন না— গাড়ি, সোনা, হিরে এবং মায়ের বিরক্তি তাঁর মনে আছে। বাবার আক্ষেপ— লিডাররা কিছু করছেন না, তা-ও। আর ওই কথাটা খুব মনে আছে— পাঁচ হাজার টাকা একসঙ্গে চোখে দেখেছে?
পাঁ-চ হাজার! অত টাকা কেউ চোখে দেখে? একসঙ্গে? বাপ রে?
কিন্তু কস্তুরী কখনও হিরে ছোঁননি। তাঁর দাদির গহনা সব তোলা আছে। সোনার চুড়ি কিংবা বালা আর সামান্য মুক্তো শোভা পায় তাঁর অঙ্গে। এর চেয়ে বেশি কিছু হাজার চেষ্টা করেও তাঁকে পরাতে পারেননি দাদি। নাকছাবিতে ছিল রীতিমতো ঘৃণা। এখন দেখেন, ছোট ছোট মেয়েরাও নাকছাবি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কানে রাজস্থানিদের মতো দুটো-তিনটে ফুটো করে হাজারও গয়না পরছে। ভারী ভারী সোনার গহনা, কুন্দন অনন্ত হাঁসুলি পরছেন এমনকী প্রৌঢ়ারাও। চতুর্দিকে গয়নার দোকানের বিজ্ঞাপন। সুন্দরী মেয়েরা মাথা থেকে পা পর্যন্ত গহনা পরে স্বর্ণহাসি হাসছে। দেখলে তাঁর বড় বিতৃষ্ণা হয়, কেমন একটা বিরাগ, যা কল্যাণী মেহতা মাত্র ছ’বছরের মেয়ের মনে গেঁথে দিয়েছিলেন।
বাবা, তুমি এই সুধাকাকার ওপর তোমার নীরব ঘৃণা, আর কল্যাণী মেহতার ওপর তোমার আহত অভিমান কোনওদিন মেয়ের কাছ থেকে লুকোতে পারোনি। আজ স্পষ্ট দেখছি, এদের সুধীন্দ্র আর তোমার ঘেন্নার সুধী এক নয়। তুমি যেমন মাকে বুঝতে পারোনি, তেমনই আরও সুধীকাকাকেও পারোনি। সুধীকাকাই ছিলেন মায়ের আদর্শের সবচেয়ে কাছাকাছি। একসঙ্গে পড়াশোনা করেছিলেন, সুধীকাকা সবচেয়ে সুপুরুষ এবং গুণীও বটে, প্রবল উৎসাহ। একাই দশজনের মনে আলো জ্বালিয়ে দিতে পারেন, সেই চারণকবি মুকুন্দদাসদের মতো।
বাবা, তা হলে অনেকদিন থেকেই তুমি সুধীন্দ্র সম্পর্কে ঈর্ষা পোষণ করেছ? সেই ঈর্ষা-বিদ্বেষের ছোঁয়া লেগেছে রবি জ্যাঠাদের মনেও, নিবেদিতা মাসি! একই ধারণা। বাবা, আমি জানি না মা ও সুধীকাকার ইলোপমেন্টের মধ্যে বিবাহবহির্ভূত প্রেম ছিল কিনা। কিন্তু সৃষ্টিছাড়া দেশপ্রেম মানবপ্রেম যে ছিল সেটুকু জানাই তোমার মেয়ের পক্ষে যথেষ্ট।
অন্ধকার বাংলো চত্বরে ঝমঝম করে গান বাজতে লাগল। বহু মানুষের সম্মিলিত গান। স্পষ্ট করে মুখগুলো বোঝা যায় না, কিন্তু তারা আজকের নয়। অনেকদিন আগেকার, যখন ভারত নবীন ছিল, অসহ গর্ভযাতনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। স্নেহলতা ঘোষ এলো করে শাড়ি পরে আসতেন, রমা সরকারও, নিবেদিতা মাসি ঘুরিয়ে পরতেন, মা যখন বাড়িতে সভা হত, এলো করে, বাইরে যেতে হলে কুঁচি দিয়ে ঘুরিয়ে।
‘ব্যক্তিগত বা দলগত আত্মপরতা, অপরকে দাবিয়ে রাখার প্রবৃত্তি আর সাম্রাজ্যবাদে চরিত্রগত কোনও ফারাক নেই।’ সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন। কথাটা স্বাধীন ভারতবর্ষে বড্ড খেটে গিয়েছিল, গেছে। ব্যক্তিগত, দলগত আত্মপরতা—এই নিয়েই আমরা ঘর করছি। দেশপ্রেম আর নেই। দলপ্রেম। কমিটমেন্ট আর দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি নেই। কমিটমেন্ট দলের প্রতি। সবসময়ে ঘুরে-ফিরে আসত এই আক্ষেপ, বাবা কথাটা বলতেন— কারণে, অকারণে। কল্যাণীর থেকে দূরে গেলেও আকস্মিক আঘাতে তিনি বোধহয় স্থৈর্য ফিরে পেয়েছিলেন। তাই কটন-কিং-এর সাম্রাজ্য নানাবিধ সমাজ-সেবার সঙ্গে যুক্ত ছিল। মেয়েকে নিয়ে তিনি যথাসাধ্য অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন।
সমাজতন্ত্র একশ’বার। কিন্তু রাশিয়ার থেকে আলাদা। বাদ যাবে জড়বাদ, ঢুকবে জাতীয়তাবাদ’ সুভাষচন্দ্রের কথা— বাবা মন্ত্রের মতো জপ করতেন। গুজরাত-কাণ্ডের পর বাবার এক বন্ধু রমেশকাকা বললেন— জাতীয়তাবাদের পরিণাম তো এই নরেন্দ্র। স্বাধীনতার পর কতগুলো দাঙ্গা হল, কতগুলো রাজ্য বিচ্ছিন্ন হতে চাইল, দ্যাখো। সারা ভারত কোনওদিন এক জাতি হবে না, জাতীয়তাবাদ প্রচার করলে এইরকম উগ্র রূপই নেবে।
বাবা বলেছিলেন, ভারতকে সেভাবে এক জাতি হতে কে বলেছে? ইউরোপকে দূর থেকে আমরা এক জাতি বলে ভাবি, তুমি তো জানো, তা নয়। ইংরেজ চরিত্রে আর ফরাসি চরিত্রে আকাশপাতাল ফারাক। আমরা তেমনই আলাদা হয়েও পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুভাবে থাকব। আর দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি আমাদের ভালবাসা দায়িত্ববোধ আমাদের চালিত করবে।
অ্যাবস্ট্রাকশন, ভাবের কথা নরেন্দ্র। ভালবাসা? এক পরিবারে দম্পতির মধ্যে, বন্ধুতে ভালবাসা নেই, আনুগত্য নেই, তার এত বড় বিচিত্র দেশ!
ব্যক্তিগত সমস্যা সব দেশেই আছে রমেশ। কিন্তু নিজের দেশের শিশুদের ফুডে, রোগীদের ওষুধে ভেজাল মিশিয়ে দিচ্ছে, সদ্য সদ্য স্বাধীন হয়ে— এ আর কোথাও পাবে না। নিজের রাস্তা নোংরা করছে, ট্রাম-বাস পোড়াচ্ছে যা নাকি নিজেদের টাকা দিয়েই কেনা—এ-ও তুমি আর কোথাও পাবে না। কোটি কোটি টাকা তছরুপ করছে সরকারি দফতর, নেতাদের কথা তো বলাই বাহুল্য, এ-ও তুমি কোথাও পাবে না। সততা দেখাতে গেলে অবধারিত মৃত্যু… স্বাধীন চিন্তা প্রকাশ করলে কণ্ঠ চেপে ধরবে… এ জিনিসও অচিন্তনীয়।
বুশ— পিতা-পুত্র তো বাকি পৃথিবীর কাছে শয়তান— কস্তুরীর মনে হল—কিন্তু নিজের দেশের ছেলেদের আফগানিস্তানে ইরাকে পাঠাতে তাদের বুক কেঁপে যায়, জবাবদিহি করতে হয় পাবলিকের কাছে— আমাদের ছেলেরা কেন এত মরবে? আর আমাদের এখানে কী হল? কারগিল। জয় এবং চিরদিনের জন্য কারগিল থামাবার জন্য যখন সেনাধ্যক্ষরা অনুমতি চাইলেন, রাজনীতি সে অনুমতি দিল না। একটার পর একটা জাতীয় পতাকা-মোড়া কফিন আসছে। মিলিটারি স্যালুট পাচ্ছে, দূরদর্শনে প্রচারিত হচ্ছে—বীরের এই সম্মান। কেন প্রাণটা দিল ওরা জানে না, প্রাণ দিয়ে যদি কিছু পাওয়া যেত, তার মানে থাকত। কিন্তু অর্থহীন এই প্রাণদান। জয়ের দোরগোড়া থেকে পিছু হঠে যারা, তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিরর্থক প্রাণদান। মানে এই নীতিকাররা জনসাধারণকে আসলে মানুষ বলে গণ্যই করেন না। শহিদ মৃত্যু গ্ল্যামারাইজ করে আরও কিছু হতাশ বেকার সংগ্রহ করা, তারপর তাদের উদ্দেশ্যহীন মৃত্যুর মুখে পাঠানো। একটা প্রতিবাদ উঠেছে এত বড় দেশের কোনও কোণে! বিধবা মা, পত্নীদের দিয়ে বলানো হয়েছে— তাঁরা নাকি দেশের জন্য তাঁদের প্রিয় মানুষটির আত্মত্যাগে গর্বিত। কোন দেশের জন্য? যে-দেশ তাদের বন্দুকের খাদ্য ছাড়া আর কিছু মনে করে না? নগণ্য? আর রাজনীতিকরা? তাঁরা এত দামি যে একটার পর একটা লজ্জাকর অপরাধ-চুরি-জোচ্চুরি ধরা পড়লেও বুক ফলিয়ে জেলের মধ্যে দরবার বসান। যদি অ্যাট অল জেলে যেতে হয়! সাধারণ চোর জোচ্চোরদের যখন জেলে পোরে ওদের মুখে তোয়ালে টোয়ালে চাপা থাকে, অর্থাৎ এতর পরেও তাদের মুখ দেখাতে লজ্জা করছে। কিন্তু মহান রাজনীতিকরা, নেতারা? তাঁদের সহাস্য, সদম্ভ, পারিষদবেষ্টিত মুখের ছবি কাগজে বেরোয়। ছিঃ!!
কস্তুরীর শরীরে তিরতির করে ছড়িয়ে যাচ্ছে উত্তেজনা। লাল হয়ে যাচ্ছেন, অন্ধকারে। কী করেছেন? কতটুকু করেছেন— এতদিনে? কিচ্ছু না। কাউকে স্বাবলম্বী করতে পারেননি। কোনও গোষ্ঠীকে সপ্তদশ শতক থেকে বিংশ শতকে এনে ফেলতে পারেননি। ব্লাইন্ডদের জন্য, অসহায়দের জন্য সামান্য কিছু চেষ্টা, কুটিরশিল্পকে বাজারজাত করবার প্রচেষ্টা। আর উন্মত্ত গুন্ডাদের থেকে কিছু অসহায় মানুষকে রক্ষা করা। বাস। এতেই তাঁর এমন ভারতজোড়া নাম যে চুপিচুপি, খুব চুপিচুপি পশ্চিমবঙ্গে আসতে হয়েছে। জানতে পারলেই সাংবাদিকরা ছেঁকে ধরবে। বাণী দিন কিছু। বাইট, জাস্ট ওয়ান, ম্যাডাম। নিতাই নস্কর তাঁর জন্য এই গুণী ছেলেমেয়েগুলিকে তাদের কাজকর্ম ফেলে আসতে আদেশ দিয়েছে। তারাও এই অকিঞ্চিৎকর মানুষটির সঙ্গলাভ করে নিজেদের ধন্য মনে করছে।
দিদি, শুতে যাবেন না? —খুব মৃদুস্বরে কে বলল। ফিরে দেখেন মিঠু।
অনেক রাত হল।
চলো, যাচ্ছি—খুব নরম গলায় মেয়েটিকে বললেন তিনি। তুমি ঘুমিয়ে পড়োনি?
না, আপনি আসছেন না দেখছি, যদি বাইরে ঘুমিয়ে পড়েন, ভাবনা হচ্ছিল।
কস্তুরী জানেন না, ওরা তিনজনেই যে যার বিছানায় শুয়ে মিনিট গুনছিল। কতক্ষণে দিদি হুঁশে আসেন, কতক্ষণে তাঁর এই বাহ্যজ্ঞানহীন দশা শেষ হয়। ওঁকে যে একলা থাকতে দেওয়া উচিত— সেটা তো ওরা বুঝছিলই। খাবার সময়ে কী খাচ্ছেন, কতটা খাচ্ছেন ওঁর কোনও হুঁশ ছিল না। অথচ আজকে রতন বেশ ভাল ব্যবস্থা করেছিল। আলুভাতে মাখন, মটর ডাল, আর হলুদ জিরে দেওয়া পোস্তর ঝোল। শিখরিণী তার সেই অদ্ভুত ব্যাগের ভেতর থেকে আচারের শিশিও বার করেছিল।
রাত দশটা এখানে অনেক রাত। শেয়াল টেয়াল বেরোতে পারে। বুনো শুয়োর। কাজল বলল, তোরা যা! ডেকে নিয়ে আয়!
শিখরিণী বলল, তুমিই যাও, উনি তোমাকেই সবচেয়ে মানেন।
মিঠু উঠে দাঁড়াল। আর কোনও অনুরোধ-উপরোধ তর্ক-বিতর্কের মধ্যে গেল না।
সারা সন্ধে ওদের মধ্যে নানান জল্পনা হয়েছে। কাজল সাধারণত কারও গোপন কথা বলে না, হয়তো মিঠুকে বলত, শিখরিণী না থাকলে। কিন্তু কস্তুরীবেন-এর ব্যাপারে শিখরিণী একেবারেই বাইরের লোক।
শিখরিণী বলেছিল, এত অভিভূত হবার কী আছে? আজকাল আদিবাসী উন্নয়নের জন্য সরকার কতরকম প্রকল্প নিচ্ছে। তার সুফল তো কেউ কেউ পাচ্ছেই। এই ভদ্রলোক সুধীন্দ্র খুবই করিতকর্মা লোক, সমস্ত সুবিধাগুলো আদায় করেছেন ওদের জন্য। এইভাবেই সেনসিবল মানুষ কাজ করে থাকে।
মিঠু ভাবছিল, এই কি সেই প্রিয়জন যাঁকে কস্তুরীবেন খুঁজছেন? তিনি আর নেই। মারা গেছেন। তাই মৃত্যুশোকটা ভয়ানক লেগেছে! কত দশকের ব্যবধান কে জানে? এই সুধীন্দ্র ওঁর বাবা নয়, তবে কে? ইনি গুজরাতি নন, বাঙালি মনে হচ্ছে। ওঁর খুব আপনজন কী? কাকাটাকা? ভাই? নাকি কোনও বাঙালি বিপ্লবীই যাঁকে উনি সেই ছোট্টবেলাতেই ‘গুরু’ বলে মেনেছিলেন? একজন ছোট্ট মেয়ে যাঁকে হারিয়েছিল, একজন প্রৌঢ়া কি তাঁর শোকে মূহ্যমান হতে পারেন? সময় চলে যায়, সময়ের ও জীবনের বহু স্তর যা পার হতে গেলে অনেক কিছুই ধুলোর তলায় চাপা পড়ে যায়। তবু মনে থাকে। মনে রাখে মানুষ।
উঠতে গিয়ে কস্তুরী দেখলেন— তাঁর পায়ে প্রচণ্ড ঝিঁঝি ধরে গেছে, নাড়াতে পারছেন না। এক একটা পা ফেলেন আর ঝনঝন করে ওঠে পা দুটো। উঠে দাঁড়িয়ে রইলেন আর পায়ের ভেতর দিয়ে যেন বিদ্যুতের কারেন্ট বইতে লাগল।—কী হল দিদি?
কিকি বলল, ভীষণ ঝিনঝিন ভূত ধরেছে।
ঝিনঝিন ভূত? সে আবার কী? মা চোখ বড়বড় করে বললেন, মাসি পাশ থেকে বললেন—কে তোকে বললে রে ঝিনঝিন একটা ভূত?
দীপ্তি বলেছে, আমার বন্ধু। ও সব জানে!
খুব জানে! মা হেসে ফেলেছেন— ঠিক আছে, বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা চেপে ধর তো!
—ঝিঁঝি ধরেছে? দিদি? হঠাৎ মিঠু নিচু হয়ে তাঁর দুই পায়ের বুড়ো আঙুল চেপে ধরল। তবু একটু সময় লাগল ঠিক হতে।
দু’হাত জুড়ে নমস্কার করলেন কস্তুরী। প্রণাম করাই উচিত ছিল। মা পায়ে হাত দিয়েছেন। কিন্তু বড্ডই ছোট হয়ে এসেছেন যে মা!
আস্তে আস্তে শুয়ে পড়লেন। মিঠু চারপাশ থেকে মশারি গুঁজে দিল। তখন দক্ষিণ কলকাতায় বেশ মশা ছিল। সন্ধে হলে ধুনো দেওয়া তো হতই। মশারি টাঙাতে হত। কিকিকে শুইয়ে দিয়ে মা বলতেন— আমি মশারি গুঁজে দিচ্ছি কিকি, ঘুমিয়ে পড়ো। —তাই তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন।
সে এক হইহই কাণ্ড। কল্যাণী মেহতা মিঠু ব্যানার্জিকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন—দেখছিস কিকি! এই আমার মেয়ে।
অজিতবাবু ভারী গলায় বললেন—ও কেন তোমার মেয়ে হতে যাবে— এক টিপ নস্য নিলেন অজিতবাবু— মেয়েটি আমার, তোমার ছেলে কালো বলে তাকে ডিজওন করছ নাকি?
যে ঢুকল সে সুধীন্দ্র, কিন্তু কিকি দেখলেন সে কাজল মুণ্ডা। সুধীকাকা এইরকম পালটে গেছেন! বুড়ো হলে কি লোকে পালটে যায়? কিন্তু বুড়োবুড়ো তো লাগছে না!
রবি জ্যাঠা বললেন— হয়েছে ভাল। তোমরা কি আমাকে কাউন্ট করছ না!
নিবেদিতা মাসি বললেন— তেলেভাজা আরও আনতে গেছে। আপনি খান না। খেতে খেতেই আরও এসে যাবে।
চা-টি দিব্যি—সিরাজ চাচু বললেন। কাকে ফুল আনতে দিলে? রমা সরকার বললেন—আনতে তো দিইনি। ওরাই পাঠিয়ে দেবে। ধুতি চার বান্ডিল, শাড়ি পাঁচ, ছোট বড় দু’সাইজের ফ্রক আছে। জাঙিয়াও। দু’সাইজের শার্ট প্যান্ট। আপাতত এই তো বলেছে।
যদি কম পড়ে?
আরও এসে যাবে— কে দেবে? আকাশ থেকে পড়বে— সিলিঙের দিকে তাকিয়ে বসে থাকব, পড়বে।
থপ থপ করে শব্দ করে বাণ্ডিল পড়তে লাগল। কী বোঝা যায় না। খালি বোঝা যায় ওগুলো ব্যাঙ। কুনো ব্যাঙ, সোনা ব্যাঙ। রাজ ব্যাঙ?
শরদ তোমার কাজটা ভুলো না।
না ভাবী— শরদ শাহ সাইকেলের চাকার মতো ঘুরতে ঘুরতে চলে যাচ্ছেন। সিঁড়ি দিয়ে গড়াচ্ছেন, শাঁ শাঁ করে আকাশে চলে গেলেন। বাঁইবাঁই করে ঘুরছে আগুনের চাকা।
কল্যাণী, ও যে একেবারে আকাশে চলে গেল। উপায় কী! কাউকে না কাউকে তো যেতেই হবে!
এইসময় খুব ম্লান মুখে ঘরে ঢুকে শিখরিণী বলল— মা আমি যাব? আমার তো কোনও কাজ নেই।
কল্যাণী মেহতার মুখ ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছে। আবছা হতে হতে টুকরো টুকরো কাচের মতো এর মুখ ওর হাত তার পা সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। তখন একটা ক্যালাইডোস্কোপ হাতে নিয়ে কাজল বলল— দেখুন দিদি, কী সুন্দর নকশা সব। কী চমৎকার।
এখনও ভোর হয়নি। কাক ডাকেনি। চরাচর স্তব্ধ। কস্তুরী মশারি গুটিয়ে আস্তে আস্তে নামলেন। পা টিপে টিপে পাশের ঘরে গেলেন— কাজল! কাজল!
—কে? তুই ভাবিস না। সব ঠিক করে দেব। ও কিছু নয়।
—কাজল, আমি দিদি।
—ওহ্ হো, বলুন দিদি, এত রাতে! ঘুমোননি?
—রাত আর কই? কাজল, কাল ওঁদের কাছ থেকে আমার মায়ের হোয়্যারঅ্যাবাউটস তোমায় আনতে হবে।
১৫) চতুর্থ পর্ব
টাটা সুমোয় বলরামপুর। মাঠটা পেরিয়ে ড্রাইভার অর্জুন সিং বললেন, এবার আপনারা একটু বিশ্রাম করে আহার করে নিন। এই দুকানে আমরা খাই। মা, আপনারা খেতে পারেন।
শালের খুঁটির ওপর পাতার ছাউনি। ভেতরে দু’-চারখানা বেঞ্চি। নিচু আর উঁচু।
কীসে দেব? থালি না শালপাতা? দোকানে পাতা মাটির উনুনের পাশে বসা লোকটি বলল।
শালপাতা শালপাতা— কলরব করে উঠল দুই মেয়ে। কাঁচা শালপাতায় ভাত আর শাক!
এত লোক!— কস্তুরী ভাবলেন, বারোমাসই কি এদের রথযাত্রা? কে জানে কে কোথায় যাচ্ছে! কাজে, নিজের বাড়ি, আমোদ-প্রমোদের সন্ধানে, বিশুদ্ধ প্রকৃতি দেখতে ভ্রমণ-পিপাসুরা। তাঁর মতো কি কেউ আছে? এমন পাগল? আতুর?
বুঝলি, বিভূতিভূষণ এসব জায়গা চষে ফেলেছিলেন।
তখন এসব আরও দুর্গম ছিল, জঙ্গল ঘন, জন্তু-জানোয়ার ছিল অনেক। এখন কী আছে জিজ্ঞেস করবে ওই অর্জুন সিংকে?— শিখরিণী ভয়ে ভয়ে বলল।
আমার মনে হয় এইসব বনে-জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতেই প্রথম ‘চাঁদের পাহাড়’-এর কল্পনা ওঁর মাথায় আসে।
হতে পারে। একেবারে জঙ্গল-খ্যাপা লোক। অথচ দ্যাখো বাংলার ঝোপ-ঝাড় থেকে শুরু করে সাঁওতাল পরগনা, সিংভূম, পালামৌ, ছোটনাগপুর— জাস্ট একজন মার্কামারা ডাল-ভাত খাওয়া মানুষ এসব গহন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তুমি ওঁর ডায়েরিগুলো পড়ো— অভিযাত্রিক, বনে পাহাড়ে, তৃণাঙ্কুর…।
কথা হচ্ছিল মিঠু আর শিখরিণীর মধ্যে। মাঝেমাঝে ওরা বিভূতিভূষণ ও তাঁর অরণ্য-প্রেমের কথা পাশে বসা অন্যমনস্ক কস্তুরীর কাছে ব্যাখ্যা করছিল। একবার উনি বললেন হ্যাঁ, হ্যাঁ, ‘পথের পাঞ্চালি’ আমি জানি।
সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’।— শিখরিণী বলল।
সত্যি কীভাবে যে একজন মহৎ লেখক একজন মহৎ পরিচালকের আড়ালে অস্ত গেলেন। সবাই জানে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী।’
কস্তুরী বলে উঠলেন, আমি জানি— বিভূতিভূষোণ ব্যানার্জির। মিঠু, তোমার মতো ব্যানার্জি। তোমার গোর্ব কোরা উচিত।
মিঠু জিভ কাটল— এ মা, ব্যানার্জি পদবির যে কত চোর, জোচ্চোর, বদমাশ, স্বার্থপর লোক আছে কে জানে দিদি! সবাই কি আমরা বিভূতিভূষণের বংশধর? কয়েক জন্ম ঘুরে আসতে হবে।
কাজল খাচ্ছিল কি খাচ্ছিল না, খালি স্থানীয় লোক খুঁজে খুঁজে আলাপ করছিল। —এখানে কি কোথাও মা… মানে মা থাকেন?
মা? সবার ঘরেই তো মা রয়েছেন।
না, অন্যরকম মা! ধরুন কেন সবাই মা বলে তাঁকে।
কীরকম! কথা বাড়ায় না লোকটি, বলে, আপনি খুঁজে দেখুন না। তারপর তাকে আর দেখতে পায় না। এরকম দু’-তিন বার হল। চতুর্থ লোকটির বেলায় একটু কাজ হল।
আপনার নাম কী?
নিরঞ্জন মাহাতো, আপনি?
কাজল মুণ্ডা।
আচ্ছা! আচ্ছা! আপনি কি পলিটিকসের লোক?
না, না, আমি কলকাতায় থাকি, গবেষণার কাজ করি।
লোকটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল— গবেষণা! গবেষণা কথাটা সে কখনও শোনেনি।
হ্যাঁ ধরুন, এখন আমি ট্রাইব্যালদের ইতিহাস নিয়ে কাজ করছি।
ট্রাইব্যাল? এস. টি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তা হলে… আপনি যদি মুণ্ডা হন, যদি কী বললেন? ইতিহাস লেখেন? তো বাগমুণ্ডিতে মাধব মুণ্ডার কাছে যান, দাদা, উনি অনেক জানেন।
তা-ই? আচ্ছা এখানে কাছাকাছি কোনও মহিলা নেই, যিনি…ধরুন শিক্ষা-সংস্কৃতির কাজ করেন!
ট্রাইব্যাল ওয়েলফেয়ারের কথা বলছেন?
না। সরকারি কিছু নয়।
আপনি মাধব মুণ্ডার কাছে যান, উনি অনেক খবর রাখেন। আমি তো পুরুলিয়া শহরে কম্পাউন্ডারি করি, এসেছি লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে, অত জানা নাই।
বালিরাম ভুক্তা বা ও অঞ্চলের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ কানাই সরেন কেউই ঠিকঠাক মায়ের ঠিকানা বলতে পারেননি। পারেননি, না চাননি কাজল খুব ভাল বুঝতে পারেনি।
কানাই সরেন বললেন, তিনি বিহান হতে না হতে চলে যান। যাবার কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কবে কখন তো বলেননি! একদিন উঠে চারদিকে শোর পড়ল— মা নাই, মা নাই। তখন বাবাই আমাদের বুঝালেন, শান্ত করলেন। কেউ না কেউ কখনও না কখনও আমাদের খবর ঠিক নিয়ে যায়। কিন্তু তিনি পুরুলিয়া জিলার কোথাও আছেন এ বাদে আর কিছুই বলতে পারব না।।
—এখানে উনি কী করতেন?
—ওঁর ছিল সব মেয়্যাঁদের নিয়ে কাজ। নার্সিং, ফেমিলি প্ল্যান, মেয়েদের লেখাপড়া শিক্ষা, বিশ্বের কথা জানানো, গান শিখানো। কত বড় বড় মানুষদের কথা বলতেন। সন্ধেবেলা আমরা সব স্কুল বাড়িতে কি বাগানে জড়ো হতুম। কত গান, গল্প, ট্র্যানজিস্টর রেডিও চলত। খবরাখবর জানতুম। তারপর যেদিন ওঁর মনে হল কাজ শিখে গেছি, চলে গেলেন। তবে কাজ চলছে। এখনও! ছড়াচ্ছে কম। লোকপাড়া থেকে একটু দূর দূর।
—মাধব মুণ্ডা মশায়ের ঘর কোথায় বলতে পারবেন?
—ওস্তাদ? কেন পারব না? ওই যো লইতন খড়ের চাল ছাওয়া ঘরটি? সামনে দুটা ঝিঙা খেলা করে। লোকটি স্নেহের হাসি হাসল।
—মাধব মুণ্ডা মশায়, ওস্তাদজি! ঘরে আছেন হে!
—কে?
নিচু চালের তলা দিয়ে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। মাথায় টোপরের মতো সাদা চুল, পাকা দাড়ি গোল করে কাটা।
—কে বটে?
—আমি কাজল মুণ্ডা, কলকাতার কলেজ থেকে আসছি।
—কাজল মুণ্ডা? চিনতে লারলাম। কার ছেল্যা? বাপ কে? মা কে?
—বাপ মনোহর মুণ্ডা, সাকিন জামবনী, ঝাড়গ্রাম। মা বাসন্তী মুণ্ডা।
—দূর থেকে আসা হচ্ছে?
—আজ্ঞে ।
—এঁরা কাঁরা?
—ওঁরাও সব আমার সঙ্গে এসেছেন।
—ইন্টারভিউ লিবেন? টিবি পগ্রাম?
—না দাদু, টিভি নয়। আমি ইতিহাস গবেষণা করি। রিসার্চ।
—অ। টেপ-ক্যাসেট আনছো?
—আছে দাদু।।
—তো বসতে আজ্ঞা হোক মায়েরা। বুঢ়ার দোষ লিবেন নাই। বুঢ়ার সব স্মরণ থাকে না। লিন, শুরু করুন।— মাধব মুণ্ডা সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত। কাজলও রেডি। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন—
—আচ্ছা দাদু, এই যে আমাদের নামের সঙ্গে একটা করে সিং জুড়ে আছে— এটা কেন?
টেপ চালিয়ে দেয় সে। বৃদ্ধের মনে যেন কোনও সন্দেহ না জাগে।
একগাল হেসে মাধব মুণ্ডা ইন্টারভিউ দিতে শুরু করেন। একেবারে মহড়া দেওয়া, তৈরি। ভাঙা সুরে বলেন—
কে বলে বুঢ়া মরলো
কে বলে আছে
ঝাড় কোলে বসিয়া
রাঙ্গা মাটি মাখিয়া
বুঢ়া কুরমুরে গ
বুঢ়া কুরমুরে
না মা এ বুঢ়া মরে নাই। কুরমুরায় নাই। রাগঝাল নাই। এই কথাটো জানবেন। কথাটো হল সকল ঘেরওয়াল তো একসময়ে এক ঘরই ছিল। কিন্তু শবর মানুষ ঠেলু মারলো, খেলো— ঠেলু আপনারা যারে বানর বলেন, উ তো আমাদেরই আগের জাতি কিনা। বানর মারা বারণ আছে। শুনলো নাই, খিদা লাগলো, কাঁড় মেরে দিল। তো সেই হতেই তারা আর মোদের জাত না। সাঁওতাল, মুণ্ডা, কুঁড়বি সব আলাদা আলাদা হল। কুঁড়বি তো হিন্দুদের সঙ্গে লেনাদেনা খানাপিনা— হিন্দুই হঁয়ে গেল। মুণ্ডাগণও হিন্দু সিং-দের সঙ্গে খানাপিনা করায় তাঁদের ছেল্যারা অনেকে সিং হইল। পুরাতন দেশে মুণ্ডা সিং এখনও রাজা আছে। সেই রাজ্য আর নাই। কিন্তুক রাজা এখনও থাকে। বলি শুনো মা-বাবাগণ, পূর্বকালে একজন সিং-এর কিসকু রাজার মেয়ের সঙ্গে পিরিত হয়। একটি সন্তান হয়, তাকে বনে পেয়ে কুড়িয়ে আনে এক মারাণ্ডি। টাকাপয়সাঅলা লোক। সে ছেলের নাম হয় মান্দো সিং। মস্ত বীর ছেল্যা, তেমন বুদ্ধি। দেওয়ান হইল। তো বিহার বয়স হইল। কেহ বিহা দেয় না। বলে কী জারজ। জন্মের ঠিকা নাই। মান্দো কুপিত হইল। বলে কী, সকল মেয়্যাঁর কপালে সিন্দুর ঘষিব। সব লন্ডভন্ড করিব। ভয়ে অনেক পলাইয়া যায়।
কিছু লোক আবার বলে— মান্দো বড় বীর, তুড়ুকদের সঙ্গে এমন যুদ্ধ করলো, যে সূর্য ঢাকা পড়ে যায়। লাদলুদ লাদলুদ কর্যাঁ তুড়ুক পলাইয়া গেল।
এইসব রাতকহানি আছে কতক। শুনছি কতদিন বুঢ়া-বুঢ়িদের থেকে। রাতের বেলা পিড়িতে বসে। আরও বলি শুনো— পুঞ্চা থানার ন’পাড়ায় হইল কৈড়া মৌজা। তার নির্ভয়পুর গ্রাম। উত্তরে কংসাবতী লদী। ওই ঠেঁ দুই দেবদেবী আছেন। বাঁইড়্যার থান বলে। হাজার বসর পূর্বে মুণ্ডারা প্রতিষ্ঠা করেন।
—আচ্ছা! মুণ্ডারা বেশ প্রভাবশালী ছিল, বলুন— মিঠু একটু ভরসা পেয়ে কথা বলে।
যত সময় যায় কস্তুরীবেনের মুখ শুকনো হয়ে যেতে থাকে। বুঢ়ার চোখ এড়িয়ে কাজল তাঁকে ধৈর্য ধরতে ইশারা করে। শিখরিণী চমৎকৃত হয়ে ভাবে পুরাকালে মুণ্ডারা রাজা ছিল? বহুদিন স্বাধীন রাজা হিসেবে বাস করেছে। সেই ‘আরণ্যক’-এর রাজকন্যা ভানমতীর কথা মনে পড়ে যায় তার। সেইজন্যে?— সে আপন মনে হাসে।
কাজল বলল, আচ্ছা দাদু, এই ধরুন নতুন নতুন রাত কহানি তৈরি হয় না আপনাদের? প্রাচীন কথা নয়, এই ধরুন পঞ্চাশ বছরের মধ্যে কী হয়েছে না হয়েছে।
বুঢ়া শুনতে পেল বলে মনে হল না।
—আদিনারায়ণ সিং, বিহারের রাজা— সে হঠাৎ দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে শুরু করে— তাঁরার পুত্র দেবনারায়ণ সিং শ্রীজগন্নাথ দরশনে পুরী যাচ্ছেন, লক-লশকর, রানি, বান্দি সব। চলতে চলতে রানির প্রসব বেদনা হল। কিছু লক, লশকর, ব্রামহন, রেখে তাঁরা সব চলে গেলেন। জঙ্গলে রানির চাঁন্দের মতো ছেল্যা জন্মায়। দিনের পর দিন যায় কেহ আসে না, খাবার নাই, রানি বিপদে পড়ল্যান। ওই রাজ্যটি ছিল মহাবীর সিং মুণ্ডার। ছোটনাগপুর— গ্রাম — উলিডি। রাজা এঁরার কথা জানতে পারলেন। বাগিচা বাড়িতে আশ্রয় দিলেন। সে ছেল্যার নাম হয় নিরঞ্জন সিং মুণ্ডা। মহাবীর তাঁকে খুব ভালবাসতেন, রাজ্যের ভার দিল্যান। রাজ্য সব মেনে যায়, মুণ্ডা কিনা রাজা! রাজার কন্যা শক্তিশ্বরীর সঙ্গে বিহা হল। সুখে থাকেন। রাজ্য সুখে থাকে। ওঁরাদের সাত ছেল্যা। ক্রমে মহাবীরের ছেল্যাদের সঙ্গে বিবাদ হল। তাঁরা এঁরাদের তাড়াই দিলেন। কৈড়া গ্রামের রাজাকে হারিয়ে ওইখানে এঁরা বাস- বসত করলেন। নিরঞ্জন সিংয়ের ছেল্যারা আর সঙ্গে কুলের দেবতা। ছয় ভাই ক্রমে চারদিকে চলে যান। কিন্তু পাঁচ বসর পরপর সব কৈড়াতে মিলা হয়। বড় ভাই একদিন দ্যাখেন— কাঁড় হাতে, শিরে পুষ্প এক পরম সুন্দরী শিকারিণী দাঁড়িয়ে আছেন।
পেরনাম করে বলেন, কে মা তুমি?
উনি বললেন, আমি তোমারদের দেবী দুর্গা, কিরাতিনী বেশে শিকার করছিলাম। এখানেই আমার পূজা করিবে।
সব মূর্খ লক কিরাতিনী বলতে পারে না, বলে কিয়াইসনি। এই যেমন এই মা, দশটি বাহু নাই, কাঁড় নাই, কিন্তু কিয়াসিনি বটে।
বুঢ়া অপলকে চেয়ে থাকে অপ্রতিভ শিখরিণীর দিকে। হাত জোড় করে নমস্কার করে। তারপর ঘুরে ঘুরে সবাইকে নমস্কার করে, বলে— নিরঞ্জনের বড় পুত্র যখন কুলদেবতা বাঁইড়্যাকে আনতে গেলেন, দেবতা বললেন— আমি লকালয়ে যাবো নাই। নিরালায় থাকবো।
সেই বাঁইড়্যার থান। বড় জাগরূক দেবতা। আর কিয়াইসিনী। নদীর দক্ষিণ কিনারে পূজা হয়। সিখানে শবরদের কুলি উঠেছে। কিয়াইকচা। ঘাটের নাম হয় কিয়াইসিনির ঘাট।
আচ্ছা দাদু— কাজল বলল, এই যেমন বনের মধ্যে রানি, কি হঠাৎ কিরাতিনী বেশে মা দেখা দিলেন। তেমন আপনাদের কালে আপনারা দেখেননি!
উত্তরে বুঢ়া বলল, বাঘরাই সিং মুণ্ডা ওই বংশের পূজারী। কিন্তু খুব বীর। পঞ্চকোট রাজদরবারে অঁরার কাজ হল। বাঘরাইয়ের এমন দাপুট যে রাতের পাহারা সব নিদ্রা গেলে বাঘরাই একাকীই প্রাসাদ পাহারা দিতেন। মানবাজারের রাজার সহিত লড়াই হল। সে রাজা ভাল লক নয়, তাঁকে ভুলিয়ে ডেকে এনে খুন করলেন। তো তাঁরার ভূতপ্রেত বিরাট মূর্তি যুদ্ধ করতেই লাগল। তখন রাজা হার মানলেন— তাঁর মন্দির গড়লেন। প্রতি মঙ্গলবার হাট হয়। এ যদি ইতিহাস লিখো তো ছেল্যা ওইখানে যাবে। ছোট ডুংরিতে দেবতার থান। বাঁইড়্যা কি বানর, লেজ নাই। কোনও মূর্তি নাই, মাটির ঘোড়া, সিন্দূর, আতপ চাল, তুলসী, ধূপ, দীপ সব দিয়া পূজা হয়। যা মানসিক করবে পেয়েঁ যাবেক। কংসাবতী সেকালে ছিল সোঁতা। এখন নদী বটে। আপনারা পৌষ সংক্রান্তি, কি ফালগুন মাসে সাত তারিখে আসবেন, দেখবেন ভারী মেলা, মোরগ লড়াই।
শিখরিণী কাজলের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বলল, তাই বলি! এমন বীরপুরুষদের বংশধর তো বীরই হবে!
কাজল হেসে বলল, তাই বলি! এমন শিকারিণী দেবীর বংশধর তো শিখরিণীই হবে।
বুঢ়া বলল, আপনারা এই সময়ে আসছেন। না পাবেন শিকার পরব দেখতে, না পাবেন ছো-নাচ। জাঁত গানও তো হইয়াঁ গেলঁ। এ বসরের মতো মা মনসার পূজা শেষ।
আপনি তো ছো নাচেরই ওস্তাদ, দাদু?— কাজল বলল।
আমি আর তেমন ওস্তাদ কী। ওস্তাদ হইলেন প্রহ্লাদ সইস, যাঁর ঠেঁ আমি শিখেছি।
কখন হয় ছৌ নাচ?— শিখরিণীর খুব দেখবার ইচ্ছে।
মার্চ মাসের পয়লা তারিখ আখ্যান যাত্রার দিন থেকে আখড়ায় মহড়া লিতে হয়। চৈত সংক্রান্তির দিন থেকে নাচ শুরু হয়। রহিন-এর দিন পর্যন্ত চলে। রহিন হল্য পয়লা জ্যৈষ্ঠ। রহিন ফল খায় সব। সাপে কাটে না। তবে এখন কেউ সময়কাল মানছে না। বারো মাসই নাচ করছে। আপনারা দেখবেন মা?
হঠাৎ কস্তুরী বললেন, আপনার দোল আছে? কারা কোরে নাচ?
ই সব সিং, মড়ল, মাহাতো, হাড়ি, মুচি, কামার, কুমার, রাজুয়াড়— এরা বারো মুনিস খাটে, ভাতুয়া খাটে, কি হয়তো তাদের কিছু জমি আছে। আজকাল বড় লোকেরাও করছে। পুরুষ মানুষের নাচ মা। দল আমার আছে। হাঁক দিলেই সব জড়ো হবে। দূর দূর থেকে চলে আসবে। পাহাড় থেকে নামবে, ইদিক উদিক। ছো-র বাজনা অসুরা বাজনা। বাজনা একেবারে চঁ করে লিবেই। বিশ-পঁচিশ লোকের নাচ!
কস্তুরী কাজলকে একান্তে ডেকে বললেন, উনি বলছেন দূর দূর থেকে সব আসে। কাজল, তাদের কাছে খোঁজ পাবে না?
অন্যমনস্কভাবে কাজল বলল, পেতে পারি। খারাপ আইডিয়া না।। আসলে সে ভাবছিল— কেমন একটা গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। সে টের পাচ্ছে। বালিরাম ভুক্তা বলেছিলেন সাংবাদিকরা এসে বিরক্ত করে, ইন্টারভিউ …, অভিনিবেশ নষ্ট হয়।— যত এদিকে আসা যাচ্ছে— সেই গোপনীয়তা যেন বেড়ে যাচ্ছে। সে একদম নিশ্চিত যে এই মাধব সিং একবার-দু’বার তার প্রশ্নের জবাব দেননি। কথা ঘুরিয়ে নিয়েছেন।
অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে। হ্যাজাক জ্বলছে চারদিকে। ঢোল, মাদল, ধামসা বেজে উঠল। অসুরা বাজনাই বটে। লোক জড়ো হয়েছে খুব। মাঝখানে চমৎকার সব মুখোশ পরা নাচিয়ের দল। শিঙা হাতে এক বাজিয়ে তুড়ুক করে লাফিয়ে উঠল।
মাধব সিং মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন।
শোনেন সব— ভাই, বুন, মা, যে যিখানে আছেন। ছো হল কি খাটিয়ে লকদের ডান্স। সারাবছর খাটেখুটে, কখন কখন নাচ করে। এক আনন্দ ফুর্তির নাচ।
চড়িদা থেকে ভাল মুখোশ আছে ওস্তাদের ঘরে। সানাই, ঝাঁঝ স-ব আছে। সিবার একাডেমি টাকা দিয়েছিল। সাজ-বাজনা কিনেছি মা।।
—আমার কথা কী— রাজনীতি করে দলগুলি ভাঙেন না। মানুষের ফুর্তি আনন্দ লষ্ট করেন না। আমি দেখছি— সব ভাঙছে, দলাদলি বাড়ছে। ছো-এর মধ্যে কোনও পার্টি নাই। এ একবার নষ্ট হয়ে গেলে পরে পস্তাবেন।
ওরা বসেছে সামনে। কতকগুলো প্লাস্টিক চেয়ারে। কাজল সবার অলক্ষ্যে উঠে অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গেল।
—কোথাত্থে আসছেন গ!
—অযোধ্যা পাহাড় থে।
—জোর নাচ, না? বাজনা একবার বাজলে হল।
—যা বলিছেন— লোকটি সাদা দাঁত বার করে হাসল।
—পাহাড় এখন কেমন?
—পাহাড় আর আগের পাহাড় নাই। ম্যালেরিয়ার মশা খুব।
—ওখানে আপনাদের ইস্কুল— পাঠ কিছু হয়েছে। তেমন!
—তা হঁয়েছে, তবে তেমন তেমন হল্যেঁ …
গণেশ-বন্দনা শুরু হল। লোকটি মুখে কুলুপ আঁটল।
সিঁদুর বরণ অঙ্গ
মূষিকবাহন
সর্ব আগে পূজা করি
হর-গৌরীর নন্দন
নমঃ নমঃ নারায়ণ
গুড় গুড় গুড় করে বাজনা আরম্ভ হল। মাদল ধামসা ক্রমেই উত্তেজক হয়ে উঠছে — ঝাগিন গেঝাগিন, একজিন, গেজাগিন, গেজাগিন ঝাঁ।
গণেশের নাচ শুরু হল বাজনার সঙ্গে।
—কী বলছিলেন তেমন … তেমন!
লোকটি উত্তর দিল না। একমনে নাচ দেখছে, তালে তালে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। কাজল আস্তে আস্তে সরে যায়। একদম অন্য দিকে চলে যায়। ভিড়ের সঙ্গে মিশে সে-ও তালে তালে মাথা ঝাঁকায়। আলগাভাবে বলে, ওস্তাদ ঠিক বলিছে, এমন নাচ-ফুর্তি রাজনীতিতে সব লষ্ট করি দিল। তাই তো মা বলেন— আর যা করিস করিস — হাঁড়িয়া ছুঁবি নাই। রাজনীতি করবি নাই।
পাশের লোকটি বলল, ঠিক। রাজনীতিটি কেমন হল জানেন? আরেক নাচ, আরেক বাজনা। অসুরা বাজনা। চঁ করে টেনে লিবে।
আর একজন বলল, মা যেমন পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরেন, উখানে রাজনীতি ঘিঁষতে পারবেক নাই। কিন্তু যখন টান্ডিতে আসেন, খুব বলেন— নিজের পড়া কর, চাষ কর, তাঁত বুন, ঘট গড়, আর আনন্দ কর। হাঁড়িয়া-আনন্দ নয়।
আর একটি গলা, রাজনীতিও এক রসি জিনিস।
কার্তিক আসছে, কার্তিক আসছে, শোর উঠল।
আসিছে যে জন ময়ূর বাহন
চড়া দিয়া ধনুর্বাণেতে
ও ভাই আজ কী হইবে রণেতে।
গেড়েন, ঝাঁ ঝাঁ গেজাঘেন— বাজনা বাজে— ঔর তা তেরে কেটে তা
ঝাঁ-গেঁজাগেন, ঝাঁ-গেঁজাগেন, তাক্, তাক্ তাক্
—মার উখানে কুনও রাজনীতি নাই, দলাদলি নাই— কাজল বলল
—কুন সেন্টারের কথা বলছেন? —নিমডি?
—হাঁ, উখানেই তো উঁর কথা শুনেছি … কাজল বলল। ভিড়ের ধার ঘেঁষে ঘেঁষে আর এক দিকে চলে গেল— দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল।
অনেক রাত হল— মাধব সিং আবার মাঝখানে চলে এলেন— আপনারা সব চলি যাবেন না। ইখানে আজ পরব— দিনের খাওয়া। এক মা এসেছেন গুজজর পদেশ থেকে। নাচ দেখছেন, পরব দেখছেন, আমাদের হিস্ট্রি শুনছেন— বড় পণ্ডিত আছেন মায়ী—সঙ্গে তেনার ছেল্যা ছুলা। উনি আপনাদের সব ভোজ দিবেন।
একটা বিরাট শোর উঠল। সঙ্গেসঙ্গে চত্বর পরিষ্কার হয়ে গেল, পাতা পড়ে গেল। বিরাট বিরাট ডোলে কড়ায় খাবার হয়েছে। আর্টিস্ট, দর্শক, আচার্য, অতিথি, সব বসে গেলেন। খিচুড়ি, লাবড়া, মাছভাজা, চাটনি আর বোঁদে। এখানে কোনও মতেই ভাল রসগোল্লা জোগাড় করা গেল না।
—উনি আমিষ খান না। মাকে আলাদা দাও। মা, আলুভাজা খাবেন তো? বেগুনভাজা?
—হাঁ, নিশ্চয়ই।
—আমিও মাছ খাব না— কাজল গিয়ে একটু দূরে বসে পড়ল কস্তুরীর পাশে। খেতে খেতে বলল, দিদি, কাজ হয়ে গেছে।
চমকে উঠলেন কস্তুরী।
—একসাইটেড হবেন না। জায়গাটার নাম বার করতে পেরেছি। তবে ওঁর একাধিক সেন্টার আছে। দেখি কী করতে পারি!
মাধব সিং বললেন, ছেল্যা। শেষ পালাটি বুঝলেন তো? মায়েরা বুঝেছেন?
কাজল তেমন মন দিয়ে কিছু দেখেইনি।
শিখরিণী বলল, ওটা তো মা-দুর্গার মহিষাসুর বধ মনে হল, কী মিঠু? তাই না? মিঠু মাথা নাড়ল।
চারদিকে একটা হো-হো মতো শব্দ উঠল। মাধব সিং এক হাত তুলে সবাইকে থামালেন। বললেন, না মায়েরা ওইটি মহিষাসুর নন, উনি হলেন দৌরদণ্ডপ্রতাপ হড়দের রাজা—হুদুড়-দুর্গা। আর্য-মানুষদের সর্দার ইন্দ্র তাঁর সঙ্গে রণে এঁটে উঠতে লারছিলেন। তখন একটি কৌশল করিলেন। এক পরমাসুন্দরী আর্য কন্যাকে হুদুড়-দুর্গার সকাশে ভেট পাঠাইলেন। এই হইল রাজার কাল। তিনি আর কিছু চক্ষে দেখেন না। সমরকালে মন পড়ে থাকে যুবতীতে। শেষে মহারণ হইল। হুদুড় জিততে লারলেন। পরাজিত হয়্যাঁ মৃত্যুবরণ করলেন। হড় জাতি চাম্পা রাজ্য থেকে তাড়া খেয়ে অন্যত্র চলে গেল। লককথা বলে কী এই সুন্দরীর জন্য হুদুড়কে জয় করেন তাই ইন্দ্রর আজ্ঞাক্রমে এঁরই নাম হয়ে গেল দুর্গা। পূজা পেতে লাগলেন। দুর্গা বলেন আপনারা, কিন্তু দুর্গা শব্দে সাঁওতালিতে ছেল্যা বুঝায়। বিটিছেল্যা হলে হবে— দুর্গী।
আশ্চর্য হয়ে কাজল বলল, এমন গল্প তো কখনও শুনিনি ওস্তাদজি!
ওস্তাদ বলেন, লককথায় আছে। এ দেশ মাটি তো ঘেরওয়াল হড়হপনদেরই ছিল বাবা। সেই ঠাকুরজিউ যবে থেকে সৃষ্টি করলেন। আর্য মানুষ এসে তাদের ক্রমেই তাড়ায়, ক্রমেই তাড়ায়। এরা তো পূর্বে জংলিও ছিল না। শহর বাজার ছিল, জমি-মাটি, গড়, সেনা স-ব। স-ব যাঁইছে। তারপর তুড়ুক এল, তারপর গোরা সাহেব এল, ব্যস, সব শেষ হইয়্যাঁ গেল।
১৬) পঞ্চম পর্ব
গর্তের মধ্যে পড়ে প্রচণ্ড লাফিয়ে উঠল গাড়ি। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। যাত্রা শুরুর সময়ে মেঘে-ছাওয়া ছিল আকাশ। কিন্তু এমন বৃষ্টি হবে ড্রাইভারজিও ভাবতে পারেননি। না হলে হয়তো একটা দিন থেকে আসতেই হত।
চান্ডিল থানার ছোট্ট গ্রাম নিমডিতে যাচ্ছি আমরা। রাস্তা খুব খারাপ, আশেপাশে কিছু নেই, খালি ধুধু লাল ডাঙায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু কিছু গাছ। গর্ত এড়াবার প্রাণপণ চেষ্টায় এক এক সময় গাড়ি একদিকে বিশ্রীভাবে হেলে যাচ্ছে। শিখরিণী পড়ছে আমার গায়ে, আমি নিজেকে প্রাণপণে সামলাচ্ছি, পাছে দিদির ঘাড়ে পড়ে যাই। সবসময়ে যে সামলাতে পারছি তা-ও না। কাজল যেহেতু সামনে বসেছে ওর কোনও হেলদোল নেই। দু’পাশ থেকে ছিটকে উঠছে কাদা। গাড়ির কাচ বন্ধ করে আমরা ঘামছি।
আপনি ঠিক যাচ্ছেন তো ড্রাইভারজি! কাজল জিজ্ঞেস করল।
ঠিকই তো! চিনা জায়গা।— বলে বেশ নিশ্চিন্তে স্টিয়ারিংয়ের ওপর হাত রাখেন অর্জন সিং।
এসব ফাঁকা জায়গায় বাজ পড়লে খুব বিপদ! কাজল আরও নিশ্চিন্ত গলায় বলল।
কস্তুরীবেন বসে আছেন একদম নিশ্চুপ। তিনি কিছু শুনছেন, গাড়ির লাফানি টের পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। একবার আমাকে বললেন, তুমি তো মাউন্টেনিয়ারিং করেছ দিদিমোণি। দার্জিলিং থেকে সন্দকফু ট্রেকিং। তুমি কেন ঘাবড়াচ্ছো?
আমি ঘাবড়াইনি দিদি, আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে।
আমার কুনও কোষ্ট নাই। তুমি ওতো এমব্যারাস্ড হচ্ছো কেন? ঠেসো, যত খুশি ঠেসো আমাকে। কিচ্ছু হোবে না। দিদি ট্রেকিং না পারে, পাহাড় চড়া না পারে, কিন্তু দুবলা নোয়, স্ট্যামিনা আচে।
বাগমুন্ডি থেকে উনি আমাদের দু’জনকে ফিরে যেতে বলছিলেন।
ওনেক অ্যাডভেঞ্চার তো হল, এবার অগাস্ট গরম, বৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তা ভাল নোয়। তুমরা ফিরে যাও। কাজলও ফিরে যেতে পারে।
কাজল কোনও মন্তব্যই করেনি। কোনও জোরজার, যুক্তি দেখানো কিচ্ছু না। খুব পরিষ্কার যে সে তার দায়িত্ব পালন করবেই। শিখরিণীর বোধহয় ফেরবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমি ফিরছি না বলে ও-ও ফিরবে না। হয়তো বাধোবাধো ঠেকছে। কিংবা হয়তো অন্য কোনও কারণ আছে। যাক, স্পেকুলেট করে লাভ নেই। আমি যাচ্ছি, দায়িত্ব আছে বলে, আবার ভাল লাগছে বলেও। কত নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হল। সাধারণত আমি যখনই বেরোই একটা ডায়েরি রাখি। এবারেও রেখেছি। তবে মাধব সিং মুণ্ডার উচ্চারণ বুঝতে আমার একটু অসুবিধে হয়েছে। পরে কাজলকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে। উনি আবার ভাল ভাল শব্দ ব্যবহার করছিলেন, মাঝখানে মাঝখানে স্থানীয় উচ্চারণে ক্রিয়াপদ। আমাদের কথা ভেবেই বোধহয় আবার কখনও কখনও উচ্চারণটা শুদ্ধ করবার চেষ্টা করছিলেন। হইয়্যাঁ আবার হয়ে। একটা অনুনাসিক টান আছে। খুব অদ্ভুত লাগছিল। গ্রাম, গাছপালা, স্থানীয় মানুষ, ছো নাচ সব কিছু মিলিয়ে খুব চমৎকার মানিয়ে গিয়েছিল এই অনুনাসিকতা। আমি ছৌ আগে দেখেছি, কিন্তু সে শহুরে আবহাওয়ায়, খুব জাঁকজমকের মধ্যে। এরকম বৃষ্টিহীন ভাদুরে সন্ধ্যার ফিকে আকাশের তলায়, হ্যাজাকের আলোয় নয়। আলো পড়ে মুখোশের ঘামতেল জ্বলজ্বল করছিল। তাইই, এখন মনে করে দেখলুম শেষের পালাটাতে অসুরকেই প্রধান করে দেখাল। জনা দশেক সঙ্গী-সাথী, কালো মুখোশে সাদা চোখ লাল ঠোঁট। তামাটে বাবরি চুল, ওদের হাতে ছিল বল্লম, কাঁধে ধনুক, বাণ। আরও জনা দশেক ছিল— সাদা মুখোশ, কালো চুল, লাল ঠোঁট। তার মানে কালোরা হচ্ছে অসুর বা হড় জাতি, যারা মহেঞ্জোদড়ো থেকে সরতে সরতে মেদিনীপুর পর্যন্ত এসেছে। এরপর কোথায় যাবে জানে না। আর সাদারা হচ্ছে সুর বা আর্য জাতি। দুর্গার মুখোশ সবচেয়ে সুন্দর। চাঁপা রঙের মুখোশ। কুঁচি কুঁচি চুল। টানা টানা চোখ, ভ্রূ। হাতে একটা ছোট ঢাল আর বল্লম ছিল ঠিকই। কিন্তু দুর্গা দুই দলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে যেন খেলাখেলা লড়াই করছিলেন। অন্যদের লড়াইয়ের প্রচণ্ডতা নেই। তা হলে এ সবই সেই আর্যকুমারীর ছলনা।।
দুর্গা-অসুরের এই সাঁওতালি মিথ আমাকে স্তম্ভিত করেছে। এক পক্ষের কাছে যিনি দেবী, অন্য পক্ষের কাছে তিনি মায়াবিনী! এক পক্ষের কাছে যিনি বীর, অন্য পক্ষের কাছে তিনি দস্যু। এই ‘মোহিনী’ ব্যাপারটা তো আরও আছে আমাদের পুরাণে। শিখরিণীকে বললাম। ও এসব ভাল জানে। ও বলল, সুন্দ-উপসুন্দর গল্পেও তো এমনই তিলোত্তমাকে সৃষ্টি করলেন দেবতারা! আর শুম্ভ নিশুম্ভ জানিস তো? কৌশিকী নামে এক অপূর্ব সুন্দরী নারী বা চণ্ডিকা সৃষ্টি হল। তবে এবারে ওদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নয়। যুদ্ধে হারলে তবে কৌশিকীকে পাবে এই শর্ত হয়েছিল। কৌশিকী-চণ্ডীই ওদের মারেন। প্রতিবারেই মোহিনী নারীর দরকার পড়েছে, আর দেবতারা তাকে বানিয়ে নিয়েছেন। এমনকী অমৃত ভাগের সময়েও অসুরকে কী অন্যায়ভাবে ঠকাল দেখ দেবতারা! বিষ্ণু নিজে ‘মোহিনী’ সেজে অসুরদের মোহিত করে অমৃতের বাটি সরিয়ে নিলেন! অথচ দুই পক্ষ মিলেই সমুদ্র মন্থন করেছিল। তবে কী জানো মিঠু! পুরাণের অসুর— অশুভ শক্তির প্রতীক, আর দেবতা— শুভ শক্তির।
কিন্তু প্রতীক হলেও তো তাকে এথিকস্টা মানতে হবে!— আমি বলি। আসলে আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম— আমরা কে? হুদুড় দুর্গাদের? না অভয়া বরদা মহিষাসুরমর্দিনীর। যিনি অতুল রূপলাবণ্যের সঙ্গে সঙ্গে আবার প্রত্যেক দেবতার কাছ থেকে অস্ত্র-শস্ত্রও পেয়েছিলেন।
দেবতারা অমৃতভাণ্ড চুরি করে নিয়েছিলেন, সেই থেকে অসুররা হাঁড়িয়া খাচ্ছে। এই আর কী! নাকের বদলে নরুন।— সামনের সিট থেকে কাজল বলল। তার গলায় সামান্য হাসির ছোঁয়া।
আমি বললাম— তুই এই সাঁওতালি মিথটা জানতিস?— আমার খুব কৌতূহল হচ্ছিল জানতে যে ও জানে কিনা।
না। এখন জানলাম।
তা হলে তুই কীসের গবেষণা করছিস?
সামহাউ ওটা আমি মিস করে গেছি।
ছৌ তো আরও দেখেছিস, এই পালাটা দেখেছিস?
নাঃ! এই প্রথম। আমি এতদিন তেমন ফিল্ড-ওয়ার্ক করিনি মিঠু। স্যরি। ভেরি স্যরি।
মা, বাঁদিক বরাবর রেললাইন গেছে। ওই দেখুন দূরে ট্রেন যাচ্ছে। আদ্রা-চক্রধরপুর ধরে এলে আপনাদের আর এত কষ্ট করতে হত না। অর্জুন সিং বললেন।
আমরা তো কলকাতা থেকে সোজা আসিনি, কাজল বলল— ঘুরতে ঘুরতে এসেছি।
এবার আমরা একেবারে মাটির রাস্তা দিয়ে যাব— সতর্ক করলেন অর্জুন সিং। আর বলতে না বলতেই গাড়িটা ঝপাং করে একটা গাড্ডায় পড়ে গেল। বৃষ্টি থেমে গেছে, জানলার কাচ খুলেছিলাম, একগাদা কাদাজল ছিটকে এসে শিখরিণী আর আমাকে ভিজিয়ে দিল। এমা!! শিখরিণী প্রায় কেঁদে ফেলে আর কী!
কাজল তার অবস্থা দেখে বলল— দিদি তো বলেইছিলেন— তোরা ফিরে যা। দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার— সে অ্যাডভেঞ্চার কি আর শখের অ্যাডভেঞ্চার থাকে শেষ পর্যন্ত?
কিন্তু গাড়ি চলছে না। গাড়া থেকে তুলতে হবে। আমাদের দিকটাই কাত হয়েছে। কাজল লাফ মেরে নামল। অর্জুন সিংও কাজলের পেছন পেছন। দু’জনেই কাদা-মাখা।
এ দু’জনের কাজ নয়। —কাজল বলল। তারপর ওরা দু’জনে পরস্পর কী আলোচনা করে সামনের দিকে এগোতে থাকল। মেঘে-ঢাকা সাদাটে আকাশের তলা দিয়ে ওরা ছোট হতে হতে একটা বাঁক ফিরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমি বললাম, আমরাও একটু নামতে পারলে ভাল হত।
শিখরিণী রাগ করে বলল, আমাদের আর নামতে হবে না। গাড়ি তো অর্ধেকটা নামিয়েই দিয়েছে, বাকিটুকুও দেবে।
দিদির দিকটা উঠে আছে। উনি খুব অসুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছেন।
মিনিট দশেক এইভাবে কেটেছে। হঠাৎ দেখি আমাদের গাড়ি ঘিরে এক গাদা ছেলে। প্যান্ট গুটিয়ে পরা, পায়ে গামবুট। সবজে মতো জামা, হাতে সরু সরু বন্দুক না কী! স্থানীয় ছেলেই হবে মনে হয়।
—কে আপনারা?
—কোথায় যাচ্ছেন?
—কোথা থেকে এসেছেন?
—ড্রাইভার কোথায়?
একটার পর একটা বুলেটের মতো প্রশ্ন ছুটে আসছে। শিখরিণী ভয়ে কাঁপছে। দিদি বললেন, তুমরা কে? কোথায় যাচ্ছো? কোথা থেকে এসেচো?
কথার উত্তর দিন। কঠিন গলায় নির্দেশ এল।
—নিমডি যাব— আমি বলি।
—এটাই তো নিমডি!
—একানে কি কুনও সোশ্যাল সার্ভিস সেন্টার আচে? দিদি বললেন।
—তাতে আপনার দরকার?
—আমরা সেকানে যাবো। গাড্ডায় পড়েচি। গাড়িটা তুলে দিলে যেতে পারবো— দিদি অমায়িকভাবে বললেন।
হঠাৎ একটি ছেলে দরজা খুলে তড়াক করে লাফিয়ে গাড়িতে উঠল। শিখরিণী আঁক করে উঠেছে।
এই চোপ— ছেলেটি রাগত চোখে পেছন ফিরে বলল।
শিখরিণী আমার হাত দুটো এমন খামচে ধরেছে যে আমার রীতিমতো লাগছে। ওর হাত সাপের গায়ের মতো ঠান্ডা। আমি প্রাণপণে আমার তাপ থেকে ওকে ধার দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিপদে পড়লে আমার শরীর দিয়ে হলকা ছোটে। চরম সর্বনাশের জন্য আমরা প্রস্তুত। অন্ততপক্ষে আমি। এরকমই হয়। জীবনটা এক গিয়ারে চলেছে। তিরিশ-চল্লিশ সাবধানী স্পিড রেখে যাচ্ছে। হঠাৎ কিছুর মধ্যে কিছু না স্পিড বেড়ে গেল। ষাট সত্তর আশি নব্বই শ’ একশ চল্লিশ ক্র্যাশশ্।
বাবা, তুমি হয়তো কাগজে পড়বে পুরুলিয়া জেলার নিমডি গ্রামের রাস্তায় দু’টি তরুণী ও একজন প্রৌঢ়ার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সম্ভবত খুন হবার আগে এঁরা প্রত্যেকেই ধর্ষিত হয়েছিলেন। বডি পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। রুটিন খবর। তুমি আজকাল এইরকম খবর পড়তে চাও না। তবু বাবা, এইটুকু যদি পড়ে ফেলো, হয়তো তোমার চোখে পড়বে নীচে তিনটে ছাপকা ছাপকা ছবি। তুমি সেভাবে আমাকে আইডেন্টিফাই করতে পারবে না, কেননা বন্দুকের গুলিতে, বাঁটে, ছুরি দিয়ে ওরা আমাদের মুখ তো ফালাফালাই করে দেবে। আরও কিছু! হয়তো যোনিদ্বারে গুলি করবে ধর্ষণের প্রমাণ লোপ করতে। মণিপুরে জওয়ানরা মনোরমাকে যেমন করেছিল। আমি জানি না এরা কারা। কিন্তু যে-কোনও দলের হাতে মেয়েদের এখন এই-ই নিয়তি! তাই প্রস্তুত হচ্ছি। এই কাদাজল এবড়ো-খেবড়ো মাটির ওপর দিয়ে ওরা টানতে টানতে আমাদের নিয়ে যাবে। শিখরিণী, ইসস্, তোকে কত বারণ করেছিলাম, কেন এলি? আর দিদি, দিদি! সেই সুদূর উত্তর-পশ্চিমে অত প্রাণ-বাঁচাবার পর এই হতভাগ্য দক্ষিণ-পূর্বে প্রাণটা দিতে এলেন! কী খুঁজতে এসেছিলেন দিদি! কী কুক্ষণে!
হঠাৎ শুনতে পেলাম একটা গলা বলছে, আমি এস্টার্ট দিচ্ছি, তোরা জোরসে ঠ্যাল। দু’পাশেও থাক। পেছনেও যা। অনেকগুলো হ্যান্ড লাগবে।
তারপর স্টার্ট দেবার শব্দ। হড়হপন হড়হপন করে গাড়িটা গাড্ডা ছেড়ে রাস্তায় উঠে এল।
একটু শ্বাস নেওয়ার সময়। ওরা আপাতত গাড়িটাও চুরি করছে। এই জঙ্গলের মধ্যে চট করে কেউ খুঁজতে আসবে না। এলেও গ্রেনেড, ল্যান্ডমাইন সব রেডি আছে।
দিদি বললেন, ইউ হ্যাভ ডান আ গুড জব। ভাল কাজ করেচো। থ্যাঙ্কিউ। আমাদের ড্রাইভারজি আসছেন বোধহয়। হ্যাঁ ওই তো! তুমাদের আর কোষ্টো করতে হোবে না। ব্লেস ইউ বয়েজ, আশিস করছি তুমাদের।
দূর থেকেই অর্জুন সিং হেঁকে বলছেন শুনছি, কাজলবাবু, গাড়ি উঠে গেছে। উঠে গেছে। আসুন।
ছেলেগুলি বলাবলি করছিল, ওহ্, অর্জুন! অর্জুন সিং।
ওরা একটু দৌড়ে গেল। অর্জুন সিং ও কাজলের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল। তারপর যেমন এসেছিল তেমনই উবে গেল আশপাশের বনবাদাড়ে।
ওরা দু’জনে গাড়িতে উঠলে দিদি বেশ খুশিখুশি গলায় বললেন— তুমরা এত দূর গেলে, চেষ্টা করলে, পারলে না। দ্যাকো আমি এইকানে বসে বসে লোক জোগাড় করে ফেললুম।
কাজল বলল, ভালই হল, ঠিকঠাক ডিরেকশনটাও পেয়ে গেলাম। এবার স্ট্রেট চলে যাব। কী রে ভয় পেয়েছিলি নাকি মিঠু, শিখরিণী? কথা বলছিস না কেন?
আমাকে আর জবাব দিতে হল না। দিদিই বললেন, ট্রেকিং করেচে দার্জিলিং থেকে সন্দকফু, মাউন্টেনিয়ারিং শিকেচে, তুমার মুন্ডু ভয় পেয়েচে।
ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সরু পথ। কোনওক্রমে গাড়িটা দুলতে দুলতে যাচ্ছে। অনেকগুলো বাঁক নিল। এইবার বুঝতে পারছি আস্তে আস্তে কমছে বন, বাড়ছে খোলা জায়গা। একটা বিশেষ এলাকায় ঢুকছি। দিগন্তে মেঘমেঘ পাহাড়। ধানের খেত। মাঝখান দিয়ে পেটা সুরকির রাস্তা। বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু জলে ছলছল করছে চারদিক। শুরু হল দু’ধারে শাল, মহুয়া, সেগুন, ছাতিম ছাওয়া পথ। দু’ধারে দুটো বিশাল অশত্থগাছের মধ্য দিয়ে আমরা ঢুকলাম। এখনও বীথিকা ফুরোয় না। কাজল হেঁকে বলল, দিদি, দেখুন দু’পাশে পলাশ, কুসুমগাছ। বসন্তকালে এই গাছগুলোতে আগুন জ্বলে। দেকোরা দলে দলে দেখতে আসে, বুঝলি মিঠু?
মোড়ের মাথায় বাঁক নিল গাড়ি। রে রে করে দু’পাশ থেকে ছুটে এল কিছু লোক। হাঁটু অবদি ধুতি পরা। চকচকে গা। ঝাঁকড়া চুল, হাতে লাঠি।
কে? কে? কোথায় যাচ্ছেন?
অর্জুন সিং মুখ বাড়িয়ে বললেন, সেন্টার।
ভোটের লোক আনোনি তো? সেবারের মতো টিভির লোক?
না না—অর্জুন সিং পেছন ফিরে আমাদের দিকে তাকালেন।— কী দিদি আপনারা টিভি-র লোক নন তো! ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে এসেছেন?
দিদি বললেন, কখুনোই না।
আপনি যদি ডিরেকশন সব জানতেনই আমাদের এত ভোগালেন কেন?— কাজল জিজ্ঞেস করল।
বাপ রে! মেরে ফেলে দিবে—অর্জুন সিংয়ের নিজস্ব বুলি বেরিয়ে এল। তাঁর মুখে চাপা হাসি।
দু’দিকেই টালি ছাওয়া খড়ে ছাওয়া বেশ বড় বড় কুটির। পাকা ছাদঅলা একতলা বিল্ডিংও দেখা গেল। কী অদ্ভুত এক গন্ধে ভরপুর জায়গাটা। গাছের, ফুলের, ভেজা মাটির।
দিদি থামতে বললেন অর্জুন সিংকে। তারপর কেউ কিছু বোঝবার আগেই অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। হাঁটছেন গটগট করে, যেন এতক্ষণ একভাবে বসে আসেননি, পা ধরে যায়নি, যেন গাড়ি গাড্ডায় পড়ে যায়নি, যেন বন্দুকের সামনে পড়তে হয়নি। আমরাও নামলাম। কাদায় ভিজে জামাকাপড়, পাঁক লেগেছে দু’জনের মুখে। হাতের তালু দিয়ে মুছে নেবার চেষ্টা করলাম। লোকগুলি পেছন পেছন আসছে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে গড়গড় করে এগিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। শুধু আমরা কেন, কাজলও পেছনে পড়ে যেতে লাগল।
মেঘ ভেঙে এবার নীল আকাশ বেরিয়ে এসেছে। সেই ঝাড়গ্রাম থেকেই এই অদ্ভুত উজ্জ্বল নীলমণি আকাশ আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আসছে। তবু যেন আজকের আকাশ আরও নীল। পৌরাণিক নীল। গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। দূরে পাহাড়গুলোর মাথা কমলা, গোলাপি, বেগুনি। একটা মস্ত দাওয়া-অলা কুটির। দু’পাশ থেকে ভিজে মাধবীলতা জড়ানো। মাঝখানে একটা চেয়ারে লাল পাড় গেরুয়া রঙের শাড়ি পরা ঠাকরান। বেশি পাকা কম কাঁচা চুলের চালচিত্রের মাঝখানে একটা ঝলমলে হাসিমুখ ফুটে রয়েছে।
কস্তুরীদি বললেন, মিঠু, কাজল, শিখরিণী, ওই দ্যাখো আমার মা।
আমরা ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছি। দিদি এগিয়ে যাচ্ছেন, উনি দু’ হাত বাড়িয়ে বলছেন— আয় কিকি। জানব না কেন? রমাই তো খবর পাঠিয়েছিল।
আমরা বুঝতে পারছি দিদির ভেতরে ঢেউ। প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে দ্যাখা। এক হারানো জেনারেশনের সঙ্গে এক সন্ধানী জেনারেশনের। কখনও পাঁচজনের সামনে আবেগ প্রকাশ করেননি। ভীষণ যুঝছেন নিজের সঙ্গে।
পরস্পরকে চোখের ইশারা করি। ঘাসজলের ওপর দিয়ে ছপছপ করে হাঁটতে থাকি পেছন ফিরে। আশেপাশে ছেলে, মেয়ে, ছোট বড়, ওদের জিজ্ঞেস করতে থাকি। — কোথায় কী? কেন? কী ভাবে?
ওই যে তাঁতঘর। ওখানে আমাদের কাপড় বোনা হয়। ওই দেখুন টিচার্স ট্রেনিং সেন্টার। দোতলা বাড়িটা স্কুল। না, ওই একটাই, কো-এডুকেশন। না, কলেজ সেভাবে নেই, হায়ার এডুকেশনের জন্যে আমরা বাইরে যাই। ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল, আরও যা যা টেকনিক্যাল ট্রেনিং। এখানে বৃত্তিশিক্ষা। অ্যাগ্রিকালচার, পিসিকালচার, দূর দূর থেকে ট্রেনিং নিতে আসে। ধরুন বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুর, ওদিকে রাঁচি, হাজারিবাগ… আমাদের সেন্টার তো একটা নয় দিদি। অযোধ্যা পাহাড়ে আছে, পুঞ্চায় আছে। দলমার ওপর ঘন জঙ্গলের মধ্যে আছে। সারা পুরুলিয়ায় কুয়ো কাটছি, রাস্তা গড়ছি আমরা। এই যেসব বিল্ডিং দেখছেন— সব করেছে সেন্টারের লোক। … মা তো দলমাতেই থাকেন। বর্ষায় নিমডি কি আর কোথাও নেমে আসেন। নিমডিতেই বেশির ভাগ। হ্যাঁ— ফুলের চাষও হয়, এখন বেল, জুঁই, কামিনী… হ্যাঁ ওটা গন্ধরাজেরই বাস। মা এনে পুঁতেছিলেন। কী জানি আমাদের এখানে সারা গ্রীষ্ম, সারা বর্ষা ফোটে। ফুটে ফুটে হদ্দ হয়ে যায় ভাই। তবে হ্যাঁ, ফুল দেখতে হয় শীতকালে। একেবারে রঙিন। সেসব ফুল মার্কেটিং হয়। আমাদের মৌ, ছাতু এসব নিয়মিত বাজারে যায়। মুরগি চাষ হয়, দুধ প্রচুর। আমাদের খেয়েও প্রচুর থাকে। ঘি, মাখন, ক্ষীর হয়, বাজারে যায়।
ওঁরা দেখান— ওই যে দেখছেন পাহাড় সব— তিল্লা, ভাঙ্গাট, দলমা, চাণ্ডিল পাহাড়। পাহাড়ের দিকে এগোলে দেখতে পাবেন ঘাঘরা নদী। এখন তো খুব জল। এ বছর বৃষ্টি হচ্ছে খুব। আমরা বড় বড় চৌবাচ্চায় ধরে রাখি। কাল ঘাঘরা দেখিয়ে আনব। তবে আমাদের সীমানার মধ্যেও একটা নদী আছে। ঠিক নদী নয়, ঝরনা। আমরা বলি কপিলা। সেটাতে বাঁধ দিয়েছেন আমাদেরই পুরনো ছাত্র— এক ইঞ্জিনিয়ার। নিশ্চয়ই! যাঁরা ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বা অন্য কোনও টেকনিশিয়ান হয়েছেন তাঁরা সাহায্য করেন, নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন। এখন হাসপাতালে আছেন ডক্টর বীরেন্দ্রনাথ বাস্কে। নার্সিং সেন্টার আছে, অ্যাম্বুলেন্স আছে। তবে কী জানেন— এখানকার জলহাওয়া এত ভাল, আর আমাদের জীবনযাত্রা এত স্বাস্থ্যকর, যে নার্সরাই বেশির ভাগ সামলে দিতে পারেন। ওই তো কপিলা। বর্ষার জল আর তার আওয়াজ শুনেছেন? কাছেই ওটা আমাদের আর্ট স্কুল। সামনের মূর্তিটি আমাদের বাবার। গড়েছে এখানকার ছাত্র সুধন্বা কোটাল। এখন দিল্লির ললিতকলায় আছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদের এখানে আটকে থাকার দরকার নেই তো! বহু দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছেন আমাদের লোকেরা। মা তো তা-ই চান। যাক। কত দূর থেকে এসেছেন সব, কী কষ্ট করে, এই আমাদের অতিথিনিবাস। সব রেডি আছে। গরম জল, সাবান— আসুন আপনাদের ঘর দেখাই। চানটান করে নিন। খাওয়াদাওয়া করুন।
সময়ের ব্যবহার কী অদ্ভুত! কত কাল আগের ঘটনা, মনে হয়, এই তো কাল ঘটল! আমার মাত্র দু মাস আগের কথা মনে হয় কত দিন! মায়ের যন্ত্রণা, মায়ের চলে-যাওয়া, প্রতিদিনকার খুঁটিনাটি কথাবার্তা সমস্ত এখনও আমার মনের মধ্যে টাটকা। এখনও সেই তীব্র কষ্ট পাকিয়ে উঠতে থাকে নাভি থেকে চোখ পর্যন্ত, ছড়িয়ে যায় মাথার তন্তুতে তন্তুতে। মানি নি, মানব না। মা একটা জলজ্যান্ত সত্য আমার জীবনে। মায়ের কষ্ট একটা জলজ্যান্ত সত্য। কিন্তু কস্তুরীদির সঙ্গে ক’ মাস, ঝাড়গ্রাম, জামবনি, গিধনি, পুরুলিয়া, নিমডি… রতনদা.. মাধব মুণ্ডা… নির্ভয়পুর…?
এই তো সেদিন পুরো জেলা সার্ভে করে মোটা মোটা খাতা নিয়ে ফিরলাম! রীতিমতো ফিল্ড-ওয়ার্ক, মানুষ নিয়ে, মানুষের দশা তাদের গল্পকথা সমস্ত নিয়ে। অথচ মনে হয় কতদিন! এই তো সেদিন কস্তুরীদিকে হাওড়া-আমদাবাদের ফিরতি ট্রেনে তুলে দিয়ে এলাম! তাঁকে আসতেই হল। ফিরতেই হল। কিন্তু সে যেন আরেকবার মায়ের নাড়ি ছেঁড়ার কষ্ট। আমাদেরই তো ছিঁড়ে নিয়ে আসতে হল। নিঃসংকোচে কাঁদছিলেন। এই তো সেদিন! অথচ মনে হয় কত কত দিন আগে! হয়তো বা স্বপ্ন দেখেছিলাম। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কাজ সেরে রাসেল স্কোয়্যারের পেভমেন্ট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা বলাবলি করি।
—কী রে, স্বপ্ন হলেও সত্যি, না?
—কিংবা সত্যি হলেও স্বপ্ন!
বলি, পাহাড়টার নাম ভাঙ্গাটই তো? ভাঙা ঘাট! আর ঝরনাটা? কপিলা, না কলকল্লোলা!
আর যারা তোদের ধরেছিল? কী করে ভাবলি ওরা রেপিস্ট? ওরা কি পুলিশ? জওয়ান?
—স্যরি। কিন্তু এনকাউন্টার উইথ মাও-গেরিলা, বেঁচে ফিরেছি— বিশ্বাসই হয় না। এখনও নিজেকে নিজে চিমটি কাটি।
—তা যদি বলিস তুই ইনকরিজিবল স্কেপটিক একটা। তোকে কিছুই বিশ্বাস করানো যায় না। আমাকে বিশ্বাস করিসনি। আমরা যেটা করছি সেটা যে মূল্যবান কিছু, নিছক পণ্ডিতি গজল্লা নয়, সেটাও বিশ্বাস করিস না।
—বলি, আর তুই!
—তুইই বল।
—অ্যান ইনকরিজিবল রোম্যান্টিক!
জনবহুল লন্ডনের রাস্তা দিয়ে কপিলা কলকল্লোলে বইতে থাকে। মেঘের ওপারে দলমা … তিল্লা … ভাঙ্গাট …। জল ছলছল ঘাসের ওপর দিয়ে আমরা স্বপ্নের দিকে সম্ভবের দিকে হেঁটে যাই।
Leave a Reply