উইংস অব ফায়ার – এ পি জে আবদুল কালাম অরুণ তিওয়ারি সহযোগে
অনুবাদ : প্রমিত হোসেন
.
আমার মা-বাবার স্মৃতিতে
.
আমার মা সাগরের ঢেউ, সোনালি বালু, তীর্থযাত্রীর বিশ্বাস, রামেশ্বরম মস্ক স্ট্রিট, সমস্তই মিশে আছে একের মধ্যে, আমার মা! তুমি আমার কাছে স্বর্গের সযত্ন বাহুর মতো। যুদ্ধদিনের কথা আমার মনে পড়ে যখন জীবনে ছিল প্রতিবন্ধকতা আর ফাঁদ মাইলের পর মাইল হাঁটা, সূর্যোদয়ের আগে কত ঘন্টা, হেঁটে যাওয়া শিক্ষা নিতে মন্দিরের নিকটবর্তী সাধুসুলভ শিক্ষকের কাছ থেকে। আবারও মাইলের পর মাইল আরব টিচিং স্কুল, রেলওয়ে স্টেশন রোডে বালুর পাহাড়ে চড়া, খবরের কাগজ সংগ্রহ করে মন্দির নগরীর বাসিন্দাদের কাছে বিতরণ, সূর্যোদয়ের কয়েক ঘন্টা পর, স্কুলে যাওয়া। সন্ধ্যা, রাতের পড়ার আগে ব্যবসার সময়। এই সব যন্ত্রণা এক বালকের, আমার মা তুমি রূপান্তরিত হয়েছিলে তপস্বী শক্তিতে পাঁচবার নত হয়ে সর্বশক্তিমানের মহিমার জন্য কেবলই, আমার মা। তোমার ধর্মনিষ্ঠা তোমার সন্তানদের শক্তি, তোমার সেরা জিনিস তুমি ভাগ করে নিতে যার বেশি প্রয়োজন হতো তার সঙ্গেই, তুমি সর্বদা দিয়েছ, আর দিয়েছ তার প্রতি বিশ্বাস নিয়ে। আমার মনে পড়ে সেদিনের কথা যখন বয়স ছিল দশ, ঘুমাচ্ছিলাম তোমার কোলে বড়ো ভাই আর বোনদের ঈর্ষা জাগিয়ে সেটা ছিল পূর্ণিমার রাত, আমার বিশ্ব শুধু জানতে তুমি মা! আমার মা! যখন মাঝরাতে জেগে উঠি অশ্রু ঝরে পড়ছিল আমার হাঁটুর ওপর
তুমি জানতে তোমার সন্তানের বেদনা, আমার মা। তোমার সযত্ন হাত, কোমলভাবে মুছে দিচ্ছিল যন্ত্রণা। তোমার ভালোবাসা, তোমার যত্ন, তোমার বিশ্বাস আমাকে শক্তি দিয়েছিল। তার শক্তি নিয়ে বিশ্বের মুখোমুখি দাঁড়ানো নির্ভীক। শেষ বিচারের দিন আবার আমাদের দেখা হবে, আমার মা!
এ পি জে আবদুল কালাম
.
গৌরচন্দ্রিকা
এমন এক সময়ে এই বইটি প্রকাশিত হচ্ছে যখন সার্বভৌমত্ব আর নিরাপত্তা নিশ্চিত ও জোরদার করতে ভারতের উদ্যোগ বিশ্বে অনেকের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। ঐতিহাসিকভাবেই, লোকেরা সবসময় নিজেদের মধ্যে এটা-ওটা নানা বিষয় নিয়ে যুদ্ধ করেছে। প্রাগৈতিহাসিকভাবে, যুদ্ধ হয়েছে খাদ্য আর আশ্রয় নিয়ে। সময়ের প্রবাহে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছে ধর্ম নিয়ে, মতাদর্শগত বিশ্বাস নিয়ে; আর এখন চলে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত আধিপত্যের যুদ্ধ। ফলস্বরূপ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত আধিপত্য রাজনৈতিক ক্ষমতা ও বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের সমার্থক হয়ে উঠেছে।
গত কয়েক শতাব্দী ধরে প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশ নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে দুনিয়াকে মুচড়ে ধরেছে। এই বৃহৎ শক্তিগুলো পরিণত হয়েছে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার স্বঘোষিত নেতায়। এই পরিস্থিতিতে ভারতের ন্যায় একশ কোটি মানুষের একটা দেশ কী করতে পারে? প্রযুক্তির দিক থেকে শক্তি অর্জন করা ছাড়া আমাদের তো আর কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ভারত কি প্রযুক্তি ক্ষেত্রের নেতা হতে পারে? আমার উত্তর হলো একটা জোরাল হ্যাঁ। আমার জীবনের কিছু ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে এই উত্তরটিকে সিদ্ধ করা যাক।
এ বইয়ের সব ঘটনার স্মৃতিচারণ প্রথম যখন শুরু করেছিলাম, তখন আমি অনিশ্চিত ছিলাম আমার কোন স্মৃতিটা বর্ণনা করা উচিৎ কিংবা তার আদৌ কোনো প্রাসঙ্গিকতা আছে কি না। আমার শৈশব অবশ্যই আমার কাছে মূল্যবান, কিন্তু তা কি কারো কাছে চিত্তাকর্ষক হবে? একটা ছোট্ট শহরের বালকের দুঃখ-দুর্দশা আর বিজয় সম্পর্কে জানার বিষয়টা পাঠকের কাছে কি মূল্য রাখে? আমার স্কুলের দিনগুলোর টানাপোড়েন, স্কুলের আর কলেজের ছাত্র থাকাকালে আংশিকভাবে আর্থিক কারণে আমার নিরামিষভোজীতে পরিণত হবার সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের কাছে চিত্তাকর্ষক হবে কেন? অবশ্য পরে আমি বুঝতে পারি এগুলো আসলে প্রাসঙ্গিক, অন্য আর কিছু
হলেও অন্তত এর মধ্যে রয়েছে আধুনিক ভারতের কিছু গল্প, ব্যক্তি মানুষের নিয়তি হিসাবে এবং যে সামাজিক আধেয়র মধ্যে তা নিহিত তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। বিমান বাহিনীর পাইলট হবার আমার ব্যর্থ চেষ্টা আর আমি কালেক্টর হবে বলে বাবা যে স্বপ্ন দেখতেন তার সেই স্বপ্ন সত্ত্বেও কেমন করে রকেট ইঞ্জিনিয়ার হলাম-এসব কথা এখানে যোগ করাটা সঙ্গত বলেই আমি মনে করি।
চুড়ান্তভাবে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, যারা আমার জীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন তাদের কথা আমি বর্ণনা করব। তাছাড়া এই বইয়ের মাধ্যমে আমি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছি আমার মাবাবা ও নিকট পরিজনদের, আর আমার শিক্ষক ও গুরুদের, যাদের আশীষ পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল যেমন শিক্ষার্থী হিসাবে তেমনি পেশাগত জীবনেও। এটা আমার সহকর্মীদের নিরলস উদ্যম ও প্রচেষ্টার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনও, যারা আমাদের যৌথ স্বপ্ন সফল করতে সহায়তা করেছিলেন। দানবের কাঁধের ওপর দাঁড়ান সম্পর্কে আইজাক নিউটনের সেই বিখ্যাত উক্তি সকল বিজ্ঞানীর জন্যও প্রযোজ্য এবং আমি অবশ্যই জ্ঞান ও অনুপ্রেরণার জন্য স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ভারতীয় বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাই, সতীশ ধাওয়ান, ব্রহ্ম প্রকাশ প্রমুখের কাছে ভীষণভাবে ঋণী। আমার জীবনে আর ভারতের বিজ্ঞান ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা পালন করেছেন তারা।
১৯৯১ সালের ১৫ অক্টোবর আমার বয়স হয়েছিল ষাট বছর। আমি অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সামাজিক পরিষেবার ক্ষেত্রে নিজের কর্তব্য বলে বিবেচিত বিষয়গুলো পূরণ করার উদ্দেশ্যে। তার বদলে একসঙ্গে দুটো ব্যাপার ঘটল। প্রথমত, আরও তিন বছর সরকারি চাকরি করতে সম্মত হলাম, এবং দ্বিতীয়ত, তরুণ সহকর্মী অরুণ তিওয়ারি অনুরোধ করলেন তাকে আমার স্মৃতিকথা শোনানোর জন্য, যাতে সেগুলো তিনি রেকর্ড করে নিতে পারেন। ১৯৮২ সাল থেকে আমার গবেষণাগারে কাজ করছিলেন তিনি, কিন্তু ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের আগে খুব ভালোভাবে তাকে আমি চিনতাম না সেই সময় তাকে আমি হায়দারাবাদের নিজামস ইন্সটিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস-এর ইনটেনসিভ করোনারি কেয়ার ইউনিটে দেখতে গিয়েছিলাম। তার বয়স ছিল বড়োজোর ৩২ বছর, কিন্তু জীবনের জন্য দারুণ লড়াই করছিলেন। আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি যা চান আমার তেমন কোনো কিছু করার আছে কিনা। আমাকে আপনার আশীর্বাদ দিন, স্যার, তিনি বললেন, যাতে করে আমি একটু লম্বা জীবন পাই আর আপনার একটা প্রকল্প অন্তত সম্পূর্ণ করতে পারি। এই তরুণের আত্মনিবেদন আমাকে আলোড়িত করেছিল। আমি সারারাত তার রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করেছিলাম। প্রভু আমার প্রার্থনায় সাড়া দিয়েছিলেন। তিওয়ারি কাজে ফিরে এলেন এক মাসের মধ্যে। তিন বছরের সংক্ষিপ্ত পরিসরের মধ্যে খন্ডিত অংশ থেকে আকাশ মিসাইল ফেম গড়ে তুলতে অপূর্ব কাজ করেছিলেন তিনি। তারপর তিনি আমার স্মৃতিকথা নিতে শুরু করলেন। ধৈর্যের সঙ্গে টুকরো ও খন্ড অংশগুলো একত্রিত করে বর্ণনার ধারাবাহিকতায় রূপ দিলেন। আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি হাতড়ে সে সব কবিতার টুকরো বের করে আনলেন যেগুলো পড়ার সময় আমি চিহ্ন দিয়ে রেখেছিলাম, আর তা যোগ করে দিলেন এই বইয়ে।
এ বই, আমি মন করি, শুধুই আমার ব্যক্তিগত অর্জন ও দুঃখদুর্দশার কাহিনি নয়, বরং আধুনিক ভারতে বিজ্ঞানের সাফল্য আর বাধাবিপত্তিরও কাহিনি, যে ভারত প্রযুক্তিগত অগ্রগামিতায় নিজেকে যুক্ত করার সংগ্রাম চালাচ্ছে। এ কাহিনি জাতীয় উচ্চাকাঙ্খা ও সমবায়ী প্রচেষ্টার। আর আমি যেভাবে দেখি, ভারতের বৈজ্ঞানিক স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য অনুসন্ধানের গাথা এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আমাদের কালের এক রূপক কাহিনি।
এই সুন্দর গ্রহের প্রতিটা প্রাণীকে খোদা সৃষ্টি করেছেন এক একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা পালনের জন্য। জীবনে যা কিছু আমি আর্জন করেছি তা তারই কৃপায়, আর তা তারই ইচ্ছার প্রকাশ। তিনি কয়েকজন অনন্য সাধারণ শিক্ষক ও সহকর্মীর মাধ্যমে আমার ওপর নাজিল করেছেন অশেষ রহমত, আর আমি এই চমৎকার ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে উর্ধে তুলে ধরছি তার মহিমা। কালাম নামে একটা ক্ষুদ্র মানুষের মাধ্যমে করা এসব রকেট আর মিসাইল আসলে তারই কাজ। ভারতের কোটি কোটি মানুষকে কখনও ক্ষুদ্র আর অসহায়বোধ না করতে বলার জন্যই। আমরা প্রত্যেকেই ভেতরে ঐশ্বরিক আগুন নিয়ে জন্মাই। আমাদের চেষ্টা করা উচিৎ এই আগুনের ডানা যুক্ত করার এবং এর মঙ্গলময়তার আলোয় জগৎ পূর্ণ করা।
খোদা আপনাদের মঙ্গল করুন!
এ পি জে আবদুল কালাম।
.
উইংস অব ফায়ার অনুবাদ প্রসঙ্গে
অরুণ তিওয়ারি এক দশকেরও বেশি সময় ড. এ পি জে আবদুল কালামের অধীনে ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট ল্যাবরেটরিতে কাজ করেছেন। ফলে এ বই লেখনির মাধ্যমে প্রকাশ করায় আবদুল কালামের সহযোগী হিসাবে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে উপযুক্ত। অরুণ তিওয়ারির মাধ্যমে আবদুল কালাম ও প্রকাশনা সংস্থা ইউনিভার্সিটিজ প্রেস-এর অনুমতি সাপেক্ষে উইংস অব ফায়ার-এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করা হলো। বইটির এই বাংলাদেশ সংস্করণ অনুবাদকের অনুকূলে কপিরাইটকৃত। সুতরাং অন্য অনুবাদকের নাম ব্যবহার করে এই বইটি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করলে তা অবৈধ হিসাবে বিবেচিত হবে এবং তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়টির ওপর আমি গুরুত্ব আরোপ করতে চাই আরও একটি কারণে। আমার প্রকাশক মনির হোসেন পিন্টু এই বই থেকে কোনো মুনাফা অর্জন করছেন না, আমিও কোনো রয়াল্টি নিচ্ছি না। প্রকাশক ও অনুবাদক হিসাবে আমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছি যে, এই বই বিক্রি থেকে অর্জিত সমস্ত অর্থ ব্যয় করা হবে ঢাকা মহানগরীর অনাথ পথশিশুদের কল্যাণে। এই শিশুদের জন্যে আরও বড়ো আকারে কল্যাণকর কিছু করার দিকে এটা হচ্ছে আমাদের প্রথম পদক্ষেপ। এ উদ্দেশ্যেই ১৫ অক্টোবর আবদুল কালামের ৭২ তম জন্মদিনে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বইটি প্রকাশ করা হলো। আমি আশাবাদী, এ ব্যাপারে পাঠকেরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন।
প্রমিত হোসেন
অক্টোবর ২০০২
Leave a Reply