ঈশ্বর যখন বন্দি – দেবারতি মুখোপাধ্যায় (রুদ্র-প্রিয়ম সিরিজ ১)
প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর ২০১৬
যাদের হাত ধরে চিনতে শিখেছি সবুজ পাতা,
শুনতে শিখেছি শিশিরের শব্দ…
বাবা ও মাকে
.
ভূমিকা
ঈশ্বর যখন বন্দি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে।
তারপর প্রকাশিত হয়েছে আমার অনেক বই, কোনোটা উপন্যাস, কোনোটা গল্প সংকলন, কোনোটা আবার নন—ফিকশন।গঙ্গা দিয়েও গড়িয়েছে অনেক জল।
ঈশ্বর যখন বন্দি শুধুমাত্র আমার প্রথম উপন্যাস নয়, আমার সর্বপ্রথম রচনা। অস্বীকার করব না, ছোটোবেলার বালখিল্য সাহিত্যচর্চার কথা বাদ দিলে আমি কেরিয়ারের মই বেয়ে ওঠার নেশায় আর ইঁদুরদৌড়ে শামিল হতে গিয়ে লেখার ধারেকাছে যাইনি। সাহিত্যপ্রীতি তখন সীমাবদ্ধ ছিল অবসর সময়ে পড়াশুনোর মধ্যেই।
তাই ভবিষ্যতে যতই লিখি না কেন, ঈশ্বর যখন বন্দি থাকবে সবার চেয়ে আলাদা এক বিশেষ অবস্থানে, মরসুমের প্রথম ফুলের মতোই।
কোনো সৃষ্টি, তা সে সাহিত্য হোক, সিনেমা হোক, ভাস্কর্য হোক বা যেকোনোরকম শিল্পকলা হোক, শিল্পী একাই কি তা তৈরি করেন? ভুল। কোনো সৃষ্টিই শুধুমাত্র শিল্পীর নিজের হাত দিয়ে পূর্ণতা পায় না। তাঁর সেই স্বপ্ন সফল হওয়ার পেছনে থাকেন অনেক, অনেক জন যাঁদের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা, ক্রমাগত সহায়তা ছাড়া সেই সৃষ্টি সফল হয় না। আমিও এর ব্যতিক্রম নই।
ঈশ্বর যখন বন্দি লেখার কাজ যখন বছর দুয়েক আগে দুরুদুরু বক্ষে শুরু করেছিলাম, মনে ছিল একরাশ উদবেগ। একে তো আমার প্রথম উপন্যাস, তার ওপর তথাকথিত প্রেম বা রোমান্স, যার ‘বাজারে কাটতি’ অবশ্যই অনেক ভালো, তেমন কিছু এতে নেই।
প্রায় দেড় হাজার বছর আগের এক রহস্যময় মানুষ, যাঁর সম্পর্কে বিশেষ খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য ইতিহাসে পাওয়া যায় না, তাঁর জীবনের উপর ভিত্তি করে কাল্পনিক একটা মিথ, যা যুগ যুগ ধরে মানুষের কল্পনায় বেঁচে রয়েছে, সেই মিথের একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাই এই উপন্যাসের মূল উদ্দেশ্য। সেইদিক থেকে বলতে গেলে এটা গতানুগতিক গোয়েন্দা উপন্যাস নয়, একটা সুপারন্যাচারাল থ্রিলার বলা যেতে পারে, যেখানে ইতিহাস—পুরাণ—বিজ্ঞানের মেলবন্ধনের সঙ্গে সঙ্গে সমবয়সি স্ত্রী—স্ত্রী, তাঁদের ভালোবাসা, তাঁদের জীবনকে কেন্দ্র করে ঘটা আপাতদৃষ্টিতে অলৌকিক মনে হওয়া কিছু রোমাঞ্চকর সত্য এবং অশুভের বিনাশ করে শুভ শক্তির জয়ের কথা বলা হয়েছে।
উপন্যাসটা লিখতে শুরু করার আগে থেকেই একটা ব্যাপার মাথায় ছিল, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখতে গেলে নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে না এগোলে সেটা থিসিস হয়ে যাবে, উপন্যাসের রস তাতে থাকবে না। যেহেতু একটি বিশেষ ধর্মের খুব সংবেদনশীল একজন চরিত্র আমার এই উপন্যাসে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন, যতটা সম্ভব তাঁর সম্পর্কে জেনে লেখার চেষ্টা করেছিলাম।
বলতে দ্বিধা নেই, আমার প্রচুর আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার দুই পাঠকমহল একজন আনকোরা লেখিকার এই উপন্যাসকে যেভাবে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন, তা আমাকে পরবর্তী সময়ে আরও লিখতে উদবুদ্ধ করেছে, ক্রমাগত অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
‘রুদ্র—প্রিয়ম’ সিরিজ এখন দুই বাংলাতেই সমাদৃত হয়ে চলেছে।
‘রুদ্র—প্রিয়ম’ সিরিজের অন্যান্য উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পরেও যে বিপুল আগ্রহ এবং উন্মাদনা পাঠকমহলে দেখা গেছে, সেই প্রেরণাতে ভর দিয়েই ‘দীপ প্রকাশন’ এই সিরিজের প্রথম উপন্যাস ঈশ্বর যখন বন্দি প্রকাশ করতে চলেছে সম্পূর্ণ নতুনভাবে, নতুন আঙ্গিকে।
রচয়িতা হিসেবে আমার এই আনন্দে অনুঘটকের কাজ করেছে সম্মানীয় শিল্পী শ্রীবিশ্বনাথ দে—র অসাধারণ অলংকরণগুলি, যেগুলি উপন্যাসটিকে এক আলাদা মাত্রা দিয়েছে।
যাদের ছাড়া সাহিত্যচর্চা তো দূর, আমি এক পা—ও চলতে পারি না, আমার পরিবারের সমস্ত শুভাকাঙ্ক্ষীদের জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা।
পরিশেষে বলি, পরিমার্জিত রূপে আমার প্রথম উপন্যাস পড়ে আপনার ভালো লাগা, খারাপ লাগা, মতামত জানালে খুব আনন্দ পাব।
দেবারতি মুখোপাধ্যায়
.
প্রাককথন
আনুমানিক ৭৫০ সাল, তিব্বতের কোনো এক রুক্ষ তুষারপ্রান্তরে
লোকটা প্রথমে খুব জোরে হাঁটছিল তারপর এক সময় ছুটতে শুরু করল। যতদূর দেখা যায় রুক্ষ পাহাড়ি অঞ্চল, কোথাও একটুকরো সবুজ নেই। মাঝে মাঝে কিছু শুকনো গাছের কঙ্কাল দেখলে বোঝা যায় একসময়ে এই জায়গাটা বসবাসযোগ্য ছিল।
কিন্তু বরফ মৃত্যুদূতের মতো থাবা বসিয়েছে সবুজ শ্যামল এই উপত্যকায়। কয়েক মাসের একটানা প্রবল তুষারঝড়ে গাছপালা, গবাদি পশু, মানুষজন সবই প্রায় মারা পড়েছে একে একে। চাষবাস বহুদিন বন্ধ, কী করে বাঁচবে মানুষ!
লোকটা আর চলতে পারছিল না। পেটে তিনদিন কিছু পড়েনি। কাঁহাতক খালি পেটে হাঁটা যায়! পরনের আলখাল্লার ওপর ইয়াকের মোট চামড়া দিয়ে সেলাই করা জোব্বা, তবু উত্তুরে হিমেল হাওয়ায় শিরদাঁড়াটা কেঁপে যাচ্ছিল। মেরুন চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে মুখ, কান সব ঢেকে নিল ও। কাঁধের ঝোলায় কিছু শুকনো ফল আর বুদ্ধের একটা ছোট্ট মূর্তি ছাড়া কিছুই নেই। শেষ সম্বল ফলগুলোকে জমিয়ে রেখে এগোচ্ছিল, এখন খেয়ে নিলে পরে অনাহারে মরতে হবে অন্যদের মতো। হাতের লাল কাপড়ে মোটা জিনিসটা পরম যত্নে বুকে চেপে আবার হাঁটতে শুরু করল। দুরন্ত ঠান্ডা হাওয়ায় গাল, ঠোঁট সব ফেটে গেছে, মাঝেমধ্যেই রক্ত বেরোচ্ছে। তবু যে করেই হোক, সাংপো পেরিয়ে গঙ্গা নদীর উপত্যকায় ওকে পৌঁছোতেই হবে।
হাঁটতে হাঁটতে প্রভুর শেষ কথাগুলো মনে পড়ছিল ওর। শেষ নিশ্বাস ফেলার আগে বুদ্ধের নাম করে প্রভু বলেছিলেন, শুধুমাত্র কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে যারা আজ ওঁকে সমর্থন করল না, গৌতম বুদ্ধ যেন ওদের ক্ষমা করেন। কিন্তু ও নিজে জানে একদিন মানুষ ঠিক বুঝবে এই মহান কাজের যৌক্তিকতা। প্রভুর নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে।
কিন্তু তার জন্য হাতে ধরে থাকা এই জিনিসটাকে যত্নের সঙ্গে কোথাও নিরাপদে রাখা দরকার। কোথায় রাখা যায়? ও জানে কিছু মানুষের নজর আছে ওর গতিবিধির ওপরে, যারা প্রভু বেঁচে থাকতে প্রকাশ্যে কিছু বলতে সাহস করেনি, তারাই এখন নখ দাঁত বের করেছে এত মূল্যবান সম্পদটা ধ্বংস করার জন্য। এমনকী প্রভুর কিছু ছাত্রও এই দলে যোগ দিয়েছে।
কিন্তু প্রাণ থাকতে এই জিনিসটা ওদের হাতে তুলে দেবে না ও। তাই ও খুব সচেতনভাবে দিক ভুল না করে এগোচ্ছে। আরও একদিন হাঁটলেই আশা করা যায় সাংপোর তীরে পৌঁছে যাবে। নদীর ধারের গ্রামগুলোর অবস্থা এতটা খারাপ নয়। সেখানে গেলে খাবার অন্তত মিলবে। সাংপো নদী সোজা গিয়ে মিশেছে গঙ্গায়। তারপর গঙ্গার তীর বরাবর নালন্দা চলে যেতে পারলেই আর কোনো চিন্তা নেই। সেখানে গিয়ে আচার্য শান্তিদেবের সঙ্গে দেখা করে জিনিসটা ওঁর হাতে তুলে দিলেই ওর মুক্তি!
কিন্তু এই ঠান্ডায় এই বিশাল তুষারপ্রান্তর পেরোনো, যত দিন যাচ্ছে দুঃসহ মনে হচ্ছে ওর। তা ছাড়া মাঝে ভারত থেকে আসা এক পরিব্রাজকের সঙ্গে দেখা হতে ও জানতে পেরেছে সেখানে এখন খুবই অরাজকতা চলছে। রাজা হর্ষবর্ধন নিজে শৈব হলেও পরধর্মসহিষ্ণু ছিলেন। কিন্তু হর্ষের মৃত্যুর পর দক্ষিণের রাষ্ট্রকূট, পশ্চিমের মালবদেশের গুর্জর প্রতিহার আর বঙ্গদেশের পাল রাজাদের মধ্যে ত্রিকোণ সংঘর্ষে প্রায় পুরো দেশটায় ঐক্যের অভাব দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে সুদূর পার্সিয়া, আরব থেকে ভিনদেশি রাজাদের আক্রমণে ভারতবর্ষে শান্তি এখন দোদুল্যমান। এমনকী বিশ্বের সেরা পড়াশোনার কেন্দ্র নালন্দা মঠেও দেখা দিয়েছে এর প্রভাব।
হঠাৎ ও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তবে কি ও নালন্দায় যাবে না? অন্য কোনো অচেনা দেশে পাড়ি দেবে যেখানে ও নিশ্চিন্তে লুকিয়ে রাখতে পারবে জিনিসটা?
নিজের মনের দোলাচলে জেরবার হয়ে ও শুকিয়ে যাওয়া এক বিশাল গাছের নীচে বসে পড়ল। শরীরের প্রতিটা অঙ্গ—প্রত্যঙ্গ বিদ্রোহ ঘোষণা করছে, বিশ্রাম চাইছে। দু—তিনবার সমস্ত শক্তি একত্র করে ওঠার চেষ্টা করেও পারল না।
ক্লান্তিতে দু—চোখ বুজে আসছে।
Leave a Reply