ইহুদি রাষ্ট্র – থিওডর হার্ৎজেল : ইসরায়েল গঠনের ঐতিহাসিক প্রস্তাবনা
অনুবাদ – ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ
প্রথম প্রকাশ – মে ২০২৩, বৈশাখ ১৪৩০
.
মুখবন্ধ
এই পুস্তিকায় আমি যে ধারণাটি প্রস্তুত করেছি তা অনেক পুরোনো। এটি ইহুদি রাষ্ট্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিয়ে। বিশ্ব ইহুদিদের বিরুদ্ধে মুহুর্মুহু চিৎকারে মুখর এবং এই চিৎকারগুলো ঘুমন্ত ধারণাকে জাগ্রত করেছে। আমি আশা করি, শুরুতেই এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে আমার যুক্তির কোনো অংশেই নতুন কোনো আবিষ্কারের ব্যাপার নেই। আমি ইহুদিদের ঐতিহাসিক অবস্থা বা উন্নতির উপায় আবিষ্কার করিনি। আসলে প্রত্যেকে নিজে থেকেই দেখতে পাবে যে আমি যে কাঠামোটির নকশা এখানে উপস্থাপন করছি তার উপাদানগুলো কেবল বিদ্যমান নয়, একেবারে তাদের হাতেই রয়েছে। তাই, ইহুদি সমস্যা সমাধানের এই প্রয়াসটি যদি একটি শব্দে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তবে এটি উড়ন্ত কল্পনা নয়, বরং এটিকে বলতে হবে একটি অনিবার্য সিদ্ধান্তের পরিণাম।
আমি অবশ্যই প্রথমে আমার পরিকল্পনাকে পাতলা সমালোচকদের ইউটোপীয় হিসেবে বিবেচনার হাত থেকে রক্ষা করব। সতর্ক না করলে তারা ত্রুটিপূর্ণ রায় দিয়ে দেবে। কোনো ইউটোপিয়াকে মানবহিতৈষী উপায়ে বর্ণনা করলে আমার লজ্জা পাওয়ার কিছু ছিল না; এবং একটি রোমান্টিক গল্পের দায়িত্বজ্ঞানহীন ছদ্মবেশে আমার পরিকল্পনাটি তুলে ধরলে, পুরোপুরি সম্ভাবনা ছিল, আরও সহজে সাহিত্যিক সাফল্য পাওয়ার; কিন্তু এই ইউটোপিয়া স্যার টমাস মোর এবং তার অসংখ্য পূর্বসূরি ও উত্তরসূরিদের দ্বারা চিত্রিত যেকোনো একটির চেয়ে অনেক কম আকর্ষণীয়। আমি বিশ্বাস করি যে, অনেক দেশে ইহুদিদের পরিস্থিতি এই ধরনের প্রাথমিক তাচ্ছিল্যকে বাড়াবাড়ি হিসেবে নেওয়ার মতো যথেষ্ট গুরুতর।
কয়েক বছর আগে প্রকাশিত ডক্টর থিওডর হার্টজকার আকর্ষণীয় বই ‘ফ্রিল্যান্ড’ আমার ধারণা এবং ইউটোপিয়ার মধ্যে হয়তো পার্থক্য করতে পারবে। রাজনৈতিক অর্থনীতির ঘরানায় পুরোদস্তুর শিক্ষিত একটি আধুনিক মনের প্রতিভাধর উদ্ভাবন তিনি, তার স্বপ্নের রাজ্য বাস্তবতা থেকে ততটাই দূরে যতটা দূরে নিরক্ষীয় পর্বত। ‘ফ্রিল্যান্ড’ হলো পরস্পরের সাথে লেগে থাকা অসংখ্য দাঁতাল চাকাযুক্ত একটি জটিল কলকব্জার সমাহার; কিন্তু তা আদৌ গতিময় হবে কি না, তা প্রমাণের সুযোগ নেই। এমনকি ‘ফ্রিল্যান্ড সোসাইটিগুলোর’ সচল হওয়ার কথা ভাবলেও পুরো ব্যাপারটিকে আমার একটি রসিকতা হিসেবে দেখা উচিত
অন্যদিকে বর্তমান প্রকল্পটি একটি বিদ্যমান চালিকাশক্তিকে নিয়োজিত করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে। আমার নিজের অক্ষমতার বিবেচনায় এক্ষেত্রে আমি যন্ত্রের চাকা ও চাকার দাঁতের নির্মাতা হিসেবে নিজেকে ইঙ্গিত দিয়ে সন্তুষ্ট থাকব এবং আমি মেশিনের যন্ত্রপাতি এক করে তাকে সচল করার ক্ষেত্রে অধিকতর দক্ষ মেকানিশিয়ানদের ওপর নির্ভর করব।
সবকিছুই নির্ভর করে আমাদের চালিকাশক্তির ওপর। কী সেই চালিকাশক্তি? ইহুদিদের দুর্দশা? কে তা অস্বীকার করবে? আমরা ইহুদি- বিদ্বেষ অধ্যায়ে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
গরম পানির বাষ্পের শক্তির সঙ্গে সবাই পরিচিত। এই বাষ্প ক্যাটলির ঢাকনাকে ঠেলে ফেলে দিতে পারে। ইহুদিবিদ্বেষ যাচাইয়ে জন্য চায়ের ক্যাটলির এই ধরনের ব্যাপার হচ্ছে জায়নবাদী এবং সমতুল্য সংগঠনগুলোর প্রচেষ্টা। আমার বিশ্বাস, সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে এই শক্তি যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে এবং একটি বৃহৎ ইঞ্জিনকে চালিত করার জন্য যথেষ্টই সক্ষম। ইঞ্জিন যে আকারেরই হোক না কেন, মানুষ তা বেছে নিতে পারে।
আমি যে সঠিক এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই, যদিও আমার সন্দেহ রয়েছে যে এর প্রমাণ দেখার জন্য আমি বাঁচব কি না। যারা এই আন্দোলন শুরু করবেন তাদের খুব কম লোকই এর গৌরবময় পরিসমাপ্তি দেখার জন্য বেঁচে থাকবেন। তবে এই আন্দোলনের সূচনাই তাদের গৌরবের অনুভূতি এবং আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার আনন্দ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
আমি আমার প্রকল্পের বিস্তারিত শৈল্পিক বিবরণ দেওয়ার ব্যাপারে সৌখিন হব না। পাছে কেউ সন্দেহ করে, ইউটোপিয়ার চিত্র আঁকছি, এই ভয়ে আমি তা করব না। আমি আগে থেকেই বুঝতে পারছি যে নির্বোধ উপহাসকারীরা আমার আঁকা এই চিত্র নিয়ে ব্যঙ্গ করবে এবং এভাবে তারা এটির প্রভাবকে দুর্বল করার চেষ্টা করবে। একজন ইহুদি, অন্যান্য বিবেচনায় যে নাকি বুদ্ধিমান, তার কাছে আমি আমার পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেছি। তার অভিমত ছিল, ‘ইউটোপিয়াও একটা প্রকল্প ছিল, যেটির ভবিষ্যৎ বিবরণ বিদ্যমান আছে বলেই উপস্থাপন করা হয়েছিল।’ এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। রাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তরের প্রত্যেক আচার্যই ধার্যকৃত অর্থের অঙ্কের সঙ্গে মিলিয়ে বাজেট করে। এটা শুধু গত বছরের গড় রিটার্ন কিংবা অন্যান্য রাষ্ট্রের আগের রাজস্বের হিসাবের ভিত্তিতেই করা হয় না, কখনো কখনো এমন অঙ্কের হয় যে সেটির কোনো নজির আগে নেই। উদাহরণ হিসেবে এক্ষেত্রে নতুন করনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রের কথা বলা যায়। যারা বাজেট অধ্যায়ন করেন তারা এই ব্যাপারটি জানেন। এমনকি এটা যদি জানাও থাকে যে, অনুমিত যে অঙ্ক বসানো হয়েছে, তা খুব দৃঢ়ভাবে মেনে চলা হবে না, তাই বলে কি এই ধরনের আর্থিক খসড়াকে আমরা ইউটোপীয় বলব?
তবে আমি আমার পাঠকদের কাছে আরও বেশি আশা করছি। যারা এ বিষয়ে আগে চর্চা করেছেন তাদের আমি আহ্বান জানাব তাদের পূর্বেকার ভিত্তিহীন পরিকল্পনাগুলো পুরোপুরি বাতিল করার জন্য। যারা ইহুদি সমস্যা সমাধানের জন্য এর আগে সবচেয়ে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছেন তাদের প্রচেষ্টাগুলো যে ভুল ও ব্যর্থ ছিল, তা বলতে আমি বরং আরও দূর যাব।
আমার ধারণাকে সামনে এগিয়ে নিতে অবশ্যই বিপদ সম্পর্কে আমি সতর্ক থাকব। তবে খুব বেশি সতর্কতার সাথে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি বর্ণনা করলে সেটির সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেবে। অন্য দিকে, খুব বেশি নিশ্চয়তা দিয়ে তাদের বাস্তবতা ঘোষণা করলে মনে হবে যে আমি একটি মিথ্যা কল্পনা তুলে ধরছি।
তাই আমি স্পষ্টভাবে ও দৃঢ়ভাবে বলব যে আমি আমার এই প্রকল্পের বাস্তব ফলাফলে বিশ্বাস করি, যদিও এটা শেষ পর্যন্ত কেমন আকার ধারণ করবে তা আমি আবিষ্কার করে ফেলেছি, এমন দাবি করব না। বিশ্বে ইহুদি রাষ্ট্র অপরিহার্য, তাই এটি তৈরি হবে।
পরিকল্পনাটি কেউ একা একা বাস্তবায়নের চেষ্টা করলে এটিকে অবশ্যই অযৌক্তিক বলে মনে হবে; কিন্তু একদল ইহুদি মিলে চেষ্টা করলে এটি পুরোপুরি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হবে এবং এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো বাধা নেই। এই ধারণাটি নির্ভর করছে কেবল এর সমর্থকদের সংখ্যার ওপর। সম্ভবত আমাদের উচ্চাভিলাষী তরুণরা, যাদের উন্নতির প্রতিটি রাস্তাই এখন বন্ধ, এই ইহুদি রাষ্ট্রকে স্বাধীনতা, সুখ ও সম্মানের এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা হিসেবে উন্মোচিত হতে দেখছে। তারাই এই ধারণার প্রচার নিশ্চিত করবে।
আমি মনে করি, এই পুস্তিকাটি প্রকাশের মাধ্যমে আমি আমার কাজটি সম্পন্ন করেছি। আমি আবার কলম ধরব না, যদি না বিরোধীদের উল্লেখযোগ্য আক্রমণ আমাকে তা করতে বাধ্য করে, কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো আপত্তির জবাব দিতে হয় এবং ভুল সংশোধনের প্রয়োজন হয়।
আমি কি ঘটনা ঘটার আগেই ঘটনার বিবরণ দিচ্ছি? আমি কি সময়ের আগে আগ বাড়িয়ে কিছু বলছি? ইহুদিদের দুর্দশা কি এখনো যথেষ্ট গুরুতর নয়? দেখা যাক।
রাজনৈতিক এই পুস্তিকাটি বর্তমানের জন্য একটি রাজনৈতিক রোমান্স হয়ে থাকবে কি না, তা ইহুদিদের নিজেদের ওপর নির্ভর করে। বর্তমান প্রজন্ম যদি সঠিকভাবে এটি বুঝতে অক্ষম হয়, তবে এটি বোঝার মতো সূক্ষ্ম ও উন্নত একটি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আসবে। ইহুদিরা, যারা একটি রাষ্ট্র প্রত্যাশা করে, তারা তা পাবে এবং তারা এটি পাওয়ার যোগ্য হবে।
Leave a Reply