ইহুদিকথা – অমিতাভ সেনগুপ্ত
Ehudi Khata by Amitava Sengupta
A Study of the Socio-Cultural history of the Jeus
প্রকাশ : ২০১৫
প্রচ্ছদ : সৈকত মুখোপাধ্যায়
ফ্ল্যাপের লেখা : দার্শনিক, গণিতজ্ঞ ব্লেজ পাস্কালের কাছে ঈশ্বরের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ চাইলেন ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুই। পাস্কাল বললেন ‘জাঁহাপনা, কেন ওই যে ইহুদি ওই ওরা’। রোমান অত্যাচার, ক্রুসেডের নির্মমতা, হিস্পানি ইনক্যুইজিশন, জারের রাশিয়ার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, নাৎসি মৃত্যু শিবিরের বিভীষিকা পেরিয়ে নিজেরই চিতাভস্ম থেকে প্রাণের অফুরান স্পর্ধায় ফিনিক্স পাখির মতো বারবার জেগে ওঠা ইহুদিকে ঈশ্বরের জলজ্যান্ত প্রমাণ বলি চাই না বলি ডারউইনবাদের বিশিষ্ট নমুনা বলতে আপত্তি হবার কথা নয়। ‘চোজেন পিপল’ তমকায় সমর্থনে অনিঃশেষ প্রাণশক্তি ইহুদির সেরা অভিজ্ঞান। রাষ্ট্রহীন একটি জনগোষ্ঠী আড়াই হাজার বছর এক দেশ থেকে আর-এক দেশ ঘুরে ফিরেছে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে। আশ্রয়দাতার মর্জিমাফিক নির্যাতন, বিতাড়ন, গণহত্যার শিকার হয়েছে। শতেক উপল্লব উপেক্ষা করে তার ভাষা, কৃষ্টি, ধর্মীয় সংস্কৃতি, দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা বহুমাত্রিক, পল্লবিত হয়েছে ব্যাবিলন, তুরস্ক, গ্রিক দ্বীপপুঞ্জে, ইটালি, আলেকজান্ড্রিয়া, স্পেন, জার্মানি, পোল্যান্ডের জলহাওয়ায়। সে নিয়েছে, দিয়েছেও দুহাত ভরে। একদা খ্রিস্টীয় গাথায় অভিশপ্ত ‘ওয়ান্ডারিং জু’ ভবঘুরে ইহুদি অকল্যাণ, অশুভের প্রতীক ছিল গোটা ইউরোপে। বস্তুত আড়াই হাজার বছর গৃহহীন, রাজনৈতিক সীমান্তহীন ইহুদি নিজেকে হুতাশনে জ্বালিয়ে সভ্যতার অনুপম অনুঘটক হয়ে ওঠে।
.
ভাবনা থেকে বই। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার অনেক ধাপ।… তার কিছু লেখাজোখা হয়। কিছু রয়েই যায় কলম নাগাল এড়িয়ে। পাণ্ডুলিপি পাঠ, সংশোধন, ইন্টারনেট সহযোগিতা, মুছে যাওয়া তথ্য উদ্ধার সহায়তা, প্রিন্টআউট, জরুরি পরামর্শ— এতগুলো জটিল ও মহাগুরুত্বের কাজ ছাড়াও এ লেখার আশৈশব আদ্যন্ত সজাগ— মঞ্জুকে।
.
প্রাক্কথা
১৯৭৮ সালে আমেরিকান ইহুদি ঔপন্যাসিক নোবেলজয়ী সল বেলো’র ‘হারজগ’ উপন্যাসটি পড়ি। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হারজগের পৃথিবী অনেকাংশে লেখকের স্মৃতিমন্থিত আত্মকথন। হারজগের মতোই সল বেলো ইহুদি উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান। রাশিয়ার সেন্ট পিটারবার্গ থেকে কানাডার মনট্রিয়েলে ১৯১৩-র ইহুদি শরণার্থী বেলো’র বাবা আব্রাহাম বেলো। ‘বুটলেগিং’ বা মদ চোরাচালান, পেঁয়াজ বিক্রি, বেকারি শ্রমিক, নানা পেশায় জীবননির্বাহ তাঁর। কানাডাতে জন্ম সলের। তিনি যখন দশ বছরের মনট্রিয়েল ছেড়ে শিকাগোয় চলে আসে বেলো পরিবার। শিকাগো বস্তির দাঙ্গাবাজ, মারকুটে ছোকরা হয়ে বেড়ে ওঠা সলের। অচেনা শহরে উদ্বাস্তু ইহুদি পরিবারের দিন গুজরানের স্মৃতি হারজগ পত্রগুচ্ছে। পড়তে গিয়ে সাতচল্লিশের দেশভাগে উদ্বাস্তু আমার চেনা পরিবারগুলির ছবি আশ্চর্য মিলে যাচ্ছিল। আইজ্যাক সিঙ্গার, বার্নার্ড মালামুড, ফিলিপ রথ প্রমুখ আমেরিকান ইহুদি ঔপন্যাসিকের লেখার সঙ্গে ক্রমে পরিচয়। ছিন্নমূলের একাকিত্ব, অস্তিত্ত্ব সংকটের ছাপ এঁদের রচনাতেও। ইহুদি ছিন্নমূল মনস্তত্ত্বের মর্মোদ্ধারে তার পুরাবৃত্ত, সমাজ ও সংস্কৃতি ইতিহাসের খোঁজ আবশ্যিক হয়ে ওঠে। নেবুকাডনেজারের বন্দী ইহুদিরা ব্যাবিলনে নির্বাসিত হয়েছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে। সেই সময়কে বিভাজিকা ধরে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হওয়া অবধি আড়াই হাজার বছর একটা প্রাচীন জনগোষ্ঠী দেশে দেশে আশ্রয় খুঁজে বেড়িয়েছে। তাদের স্বভূমি ছিল না। অফুরান প্রাণশক্তি ইহুদির। রোমান নৃশংসতা, স্প্যানিশ ইনক্যুইজিশন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ‘পগ্রম’, ষাট লক্ষ ইহুদি খুনের ‘অন্তিম সমাধান’ নাৎসিদের, কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করে না। লাঞ্ছিত, রক্তাক্ত ইহুদি এরপরেও আইনস্টাইন, নিলস বোর, ফ্রানৎস কাফকা, এলিজাবেথ টেইলর, স্টিভেন স্পিলবার্গ উপহার দিতে পারে। তার রহস্য রসায়ন ব্যাখ্যা করেছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর বিশিষ্ট খ্রিস্টান দার্শনিক, গণিতজ্ঞ, ব্লেজ পাস্কাল। সে ব্যাখ্যা আমাদের মনঃপূত হোক চাই না হোক সেটাই এখানে উল্লেখ করি। ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুই গণিতজ্ঞ পাস্কালের কাছে ঈশ্বরের দ্ব্যর্থহীন প্রমাণ চেয়ে বসেন একবার। পাস্কাল চটজলদি জবাব দিলেন ‘জাঁহাপনা, কেন ওই যে ইহুদিদের দেখছেন, ওই ওরা!
‘ভ্রমণ আড্ডা’র বিপ্লব বসু ফরমাস করলেন জেরুজালেম শহরের বৃত্তান্ত লিখতে। সম্পাদক অবধ্যই শুধু নয় অবাধ্যও বটে। যাহা বলিবেন একবারই বলিবেন। আমি তাঁকে বোঝাবার ক্ষীণ চেষ্টা করি ক্রমান্বয় রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক পালাবদলের ঝাপটা হজম করা চার হাজার বছরের বেশি পুরনো একটা শহরের সাংস্কৃতিক বহুত্ব যত আকর্ষক হোক স্টপ-ওয়াচ বাঁধা তার ঝাঁকিবর্ণন আমার পক্ষে না খুব অনায়াসসাধ্য, না খুব সত্যনিষ্ঠ হয়। জেরুজালেম বলতে পৃথিবীর তিন বৃহৎ ধর্মের সুতিকাঘর। জেরুজালেম বলতে মোজেস, যিশু, মহম্মদ। জেরুজালেম বলতে দুশো বছরের ক্রুসেড। জেরুজালেম বলতে আরব ইজরায়েল সংঘর্ষ। জেরুজালেম বোঝাতে ইনটিফাডা, হামাস, প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ, আরব লিবারেশন ফ্রন্ট, ইরগানের রক্তচোখ। অবশেষে অম্বল চাপা দেওয়া মুষ্ট্যান্নের মতো আমার লেখার শুখা তথ্য সর্বস্বতা পত্রিকা সম্পাদকমণ্ডলীর ক্লান্তি ও হতাশা বাড়ায় মাত্র। এহেন লেখার পাণ্ডুলিপি বিপ্লব বসু রেখে দিলেন ভিন্নতর অভিপ্রায়ে। বেশ কিছুদিন বাদে, ‘রূপালী’ প্রকাশনার সূর্যেন্দু ভট্টাচার্য ফোনে জানতে চান সংশ্লিষ্ট বিষয়টিকে আর একটু বর্ধিত কলেবর উপরন্তু জলবৎ তরলং করে একটি বইয়ের আকার দেওয়া যায় কি না। ‘ইহুদিকথা’র সেটাই জেনেসিস পর্ব।
যাকে পরিভাষায় বলে ‘কম্প্রিহেনসিভ অ্যাকাউন্ট’ সে দাবিদার আদপেই নয় এ বই। আমি চেষ্টা করেছি আব্রাহাম থেকে উত্তর আধুনিককালের ইহুদি সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা সারৎসার হাজির করতে মাত্র। তা অবশ্যই পূর্ণাবয়ব নয়। ইহুদি পরম্পরা গড়েছে দেশে দেশে, কালে কালে। মানব ইতিহাসের অলিগলি রাজপথে ছড়ান তার বহুমুখী বিস্তার। বহু সহস্রাব্দ প্রাচীন একটি জনগোষ্ঠীর কাহিনি পল্লবগ্রাহিতায় বহুজাতিক, বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে। তার সব শাখা-প্রশাখায় অনায়াস বিচরণ আমার সাধ্যাতীত একথা খোলাখুলিই মেনে নিচ্ছি। পাঠক কখনও সাধারণ নন। দু’ধরনের পাঠ হয়। সাধারণ ও অসাধারণ। আমি হেন উলুখাগড়া লেখককেও উতরে দেবে যে অসাধারণ পাঠ অগত্যা তারই প্রত্যাশী ‘ইহুদিকথা”।
তথ্য সাহায্য নিয়েছি সিসিল রথ, হাওয়ার্ড ফাস্ট, পল জনসন, Lucy S.Dawidowicz, উইল ডুরান্ট, আর্থার কোয়েসলার, Leo W. Schwarz এবং অন্যান্য কিছু লেখকের রচনা থেকে। সাহায্য নিয়েছি জুইশ ভার্চুয়াল লাইব্রেরি, উইকিপিডিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, কেম্বরিজ হিসট্রিস অনলাইন লিঙ্কগুলির, আন্তর্জাল থেকে পাওয়া অন্যান্য কিছু গবেষণাপত্রর। ব্যবহৃত বইয়ের নাম এবং লিঙ্কগুলি সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ের শেষে পাদটীকায় উল্লিখিত হয়েছে। বিদেশি নামের লিপ্যন্তরে উচ্চারণ-সহায় আন্তর্জাল লিঙ্কগুলির অনুসরণ করেছি। যেখানে সেটাও অপর্যাপ্ত মনে হয়েছে সেখানে মূল ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছি। চারপর্বে বিভক্ত ‘ইহুদি কথা’। আব্রাহাম থেকে হিব্রুদের ব্যাবিলন নির্বাসন (খ্রিস্টপূর্ব ১৮১৩-৫৮৭)। রাজা সাইরাস থেকে সিমন বার কখবা বিদ্রোহ, যিশুর আবির্ভাব, খ্রিস্টধর্মের বিকাশ (খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮-খ্রিস্টীয় ১৩২)। সম্রাট কনস্টান্টাইন থেকে ফরাসি বিপ্লব ও নাপোলিয়ন (খ্রিস্টীয় ৩১২-১৭৮৯)। কলম্বাসের আমেরিকা থেকে ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তি (খ্রিস্টীয় ১৪৯২-১৯৭৮)। পাঠকের সুবিধার্থে খ্রিস্টপূর্ব ১৮১৩ থেকে খ্রিস্টীয় ২০০৮ পর্যন্ত ইহুদি ইতিহাসের একটি সময়পঞ্জীও দেওয়া হয়েছে। আড়াই হাজার বছর ছিন্নমূল দেশে দেশে ভ্রাম্যমাণ ইহুদি কৃষ্টি ও জীবনচর্চায় সমকালীন সমাজ, রাজনীতি, ধর্মবিশ্বাসের প্রভাব দূরপ্রসারী হয়েছে। ইহুদি আখ্যান স্বাভাবিকভাবেই মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয় ইতিহাসের চলনে অচ্ছেদ্য জড়ানো।
আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞ মাস্টারমশাই ডক্টর অমিতাভ রায়ের কাছে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি স্নাতোকত্তর বিভাগে ছাত্রাবস্থা থেকে যাঁর কাছে দুহাত পেতে নিয়েছি। পরে যখন দুর্বুদ্ধি চাপল আমেরিকান ইহুদি নিয়ে গবেষণার উপন্যাস, সদাহাস্য তিনি এক কথায় রাজি হয়ে যান পথ-প্রদর্শক হতে। সময়ের নির্মম দেওয়ালে প্রতিহত বিকলাঙ্গ আমার সে দুঃসাহস মরিয়াও না মরে। এই বই তার নমুনা। আমি তাঁর হাত ছাড়িয়ে নিলেও মাস্টারমশাই আজও ধরে রাখেন আমার হাত।
এই লেখা চলাকালীন যাঁরা উৎসাহ জুগিয়েছেন, ভরসা দিয়েছেন অকৃপণ যখন নানা পারিপার্শ্বিক চাপে নুয়ে পড়ে রণেভঙ্গ দেওয়ার বাসনা প্রবল মাথাচাড়া দিয়েছে সে দুই অকৃত্রিম বন্ধু বিপ্লব বসু, অভিষেক ভট্টাচার্যর কাছে অপরিমেয় ঋণী আমি। বইটির অনবদ্য প্রচ্ছদ করে, পাণ্ডুলিপি খুঁটিয়ে দেখে অমূল্য পরামর্শ দিয়েছেন অনুজপ্রতিম সৈকত মুখোপাধ্যায়। পাণ্ডুলিপি নির্মাণে সাহায্য পেয়েছি দীর্ঘদিনের সহকর্মী স্নেহভাজন পার্থ বসুর। এদের দুজনের কাছে আমি সমান ঋণী। সূর্যেন্দু ভট্টাচার্য’র ব্যক্তিগত আগ্রহ ছাড়া ‘ইহুদি কথা’ এগোয় না। প্রায় বছর দেড়েক অজস্রবার পাণ্ডুলিপি সংশোধন নিয়ে তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করেছি। তিনি আমার সব আবদার মেনেছেন। এ বই প্রকাশে যাবতীয় কৃতিত্ত্ব তাঁরই প্রাপ্য।
বাংলা ভাষায় ইহুদিদের নিয়ে এযাবৎ কোনো চর্চা হয়নি এমন অহং-পীড়িত চিন্তাবিলাস নেই। সাগরে জল-অর্ঘ দানে লাভ পূণ্যার্থীর। ইতিহাসের অন্ধগলি ক্রমাগত হাতড়ে ক্লান্ত, বিরক্ত পাঠক যদি সামান্যও আনন্দ পান তবে আমার শ্রম সার্থক জানব।
অমিতাভ সেনগপ্ত
Leave a Reply