ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস – তীর্থংকর রায়
প্রথম আনন্দ সংস্করণ: নভেম্বর ২০১৩
ষষ্ঠ মুদ্রণ: জানুয়ারি ২০২২
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
.
বিভাস সাহা-কে
.
নিবেদন
বর্তমান বই একটি ইংরেজি বইয়ের অনুবাদ অবলম্বনে লেখা হয়েছে। বইয়ের নাম ‘East India Company: The World’s Most Powerful Corporation ‘ (অ্যালেন লেন, ২০১২)। ‘অবলম্বনে’ অর্থ অনুবাদ ঠিকই, তবে আক্ষরিক নয়। অনেক জায়গায় অদল বদল হয়েছে, এবং দু’-একটা প্রসঙ্গ এখানে আলোচনা হয়েছে যা মূল ইংরেজিতে আলোচিত হয়নি, যেমন সিপাহি বিদ্রোহ। অসীম কুমার নন্দ পাণ্ডুলিপি যত্ন সহকারে সংশোধন করে দিয়েছেন। তাঁর এডিটিং ও মূল্যবান পরামর্শের জন্যে আমি বিশেষভাবে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
.
মুখবন্ধ
ভারতের ইতিহাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরনো ও নতুন কালের মধ্যে যোগস্থাপনকারী সেতুর মতো। সেই সেতু পার হতে চাইলে এই বইটি কাজে লাগবে। তীর্থংকর রায়ের মূল্যবান আলোচনার পুনরাবৃত্তি না করে আমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির (সংক্ষেপে কোম্পানির) সুদূরপ্রসারী ফলাফল নিয়ে কিছু বলতে চাই, বিশেষ করে কর্পোরেট সংগঠন, ব্যবসায় চুক্তির ব্যবহার, কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার ও অ্যাডাম স্মিথের চিন্তার উপরে একচেটিয়ার প্রভাব, চিনের বাণিজ্যে কোম্পানির ভূমিকা, আর সবশেষে, আজকের যুগে কোম্পানির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে
কোম্পানি ও কর্পোরেট ব্যাবসার ইতিহাস
আধুনিক কালের কর্পোরেট সংস্থা কোম্পানিরই সন্তান বলা যায়, কাজেই জন্মদাত্রী মায়ের সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে কর্পোরেট সংস্থার ভালমন্দ নিয়ে আমরা কিছু শিক্ষা পেতে পারি। যুগে যুগে ব্যবসায়ীদের যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে— অস্বাভাবিক ঝুঁকি নেওয়া, ক্রেতা ও বিক্রেতার বিশ্বাস অর্জন করা, কর্মচারীদের উৎসাহ দেওয়া, শেয়ারহোল্ডারদের খুশি রাখা ও দেশের সমাজে সুনাম বজায় রাখা— কোম্পানির ইতিহাস সেই চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই করার কাহিনি।
কোম্পানি যৌথ উদ্যোগের পথিকৃৎ। প্রথমদিকের যৌথ উদ্যোগ হওয়ার সুবাদে কিছু সুবিধা কোম্পানি ভোগ করেছে, যাতে করে অনেক টাকা লগ্নি করা ও অনেক বড় পরিধিতে ব্যাবসা করা সম্ভব হয়েছে। মালিক ও ম্যানেজারের দায়িত্ব আলাদা হয়ে যাওয়ায় ম্যানেজারের কাজে যোগ্যতার সদ্ব্যবহার হয়েছে। ব্যক্তিগত মালিকানা বা পার্টনারশিপ ব্যাবসার সঙ্গে তুলনায় যৌথ ব্যাবসায় মালিকের দায় শুধু পেইডআপ ক্যাপিটাল বা প্ৰদত্ত পুঁজির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, ফলে বিশাল ঝুঁকি সত্ত্বেও লগ্নিকারীর অভাব হয়নি। আবার আইনত স্বাধীন সত্তা হওয়ায় কোম্পানিকে কেবল লগ্নিকারীদের তাৎক্ষণিক স্বার্থেই কাজ করে যেতে হয়নি। ব্যাবসায় কর্পোরেট মডেলের বহুল ব্যবহার পশ্চিম ইউরোপের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর আধুনিকীকরণের একটা বড় কারণ হিসেবে মনে করা হয়। এবং অনেকের মতে এই মডেলের বিরল ব্যবহার ইসলামিক মধ্যপ্রাচ্যের পিছিয়ে পড়ারও একটা কারণ।
ইংল্যান্ডে যৌথ উদ্যোগের ধারণা এসেছে রোমান আইন থেকে। রোমান আইনে উদ্যোগকে মালিকদের থেকে স্বতন্ত্র করে দেখা হয়েছে। সীমাবদ্ধ দায় আর পরিবর্তনশীল শেয়ারহোল্ডিং ব্যাপারগুলিও এই আইনের ধারণায় ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইটালিয়ানরা যৌথ সংস্থার কাঠামো নিয়ে কিছু পরীক্ষা চালায়। ফ্লোরেন্সে মেদিচির মতো বহুদেশীয় প্রতিষ্ঠানে নতুন ভাবনার প্রয়োগ হয়। জেনোয়া শহরেও জনসাধারণের কাছ থেকে ধার নিয়ে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে সরকারি সনদপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলিতে অনেক বণিক-নাবিক-রাজনীতিক একজোট হয়ে ব্যাবসায় উদ্যোগী হয়েছে। আরও আগে মধ্যযুগের গিল্ডগুলিতে অনেকের পুঁজি একত্র করার প্রচেষ্টা হয়। সনদপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলি বিশাল ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে জাহাজ পাঠাত। এক একটা অভিযান গন্তব্যে পৌঁছতে দু’বছর সময় নিত। আমদানি প্রধানত দামি বিলাসদ্রব্য আর রপ্তানি সোনা ও রুপো। ঝড়ে পড়ে একটা জাহাজ ডুবলেই কোম্পানি লাটে উঠবে। কাজেই অনেক মালিকের মধ্যে ঝুঁকি বেঁটে দিতে পারলে সকলেরই সুবিধা। রাজার সহযোগিতাও একই কারণে প্রয়োজন।
কর্পোরেশন হওয়ার সুবাদে কোম্পানির ভিতরে পার্সোনেল ম্যানেজমেন্ট ও ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট অনেকটা আধুনিক ধাঁচে, অর্থাৎ এ যুগের বহুজাতিক কোম্পানিগুলির মতো করে গড়ে ওঠে। কোম্পানি চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য রাখত হাজার হাজার রাইটার বা কেরানিদের দিয়ে হিসেব লিখিয়ে। আজ একই কাজ করা হয় মার্কেটিং ম্যানেজারকে দিয়ে ও সফটওয়্যার কাজে খাটিয়ে। কোম্পানির ডিরেক্টরদের দুশ্চিন্তা ছিল হেড অফিসের কর্তৃত্ব আর ব্রাঞ্চ অফিসের স্বাধীনতার মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা নিয়ে। আজকের বহুজাতিক সংস্থাও একই সমস্যার সমাধান খুঁজে চলেছে।
কোম্পানি এবং আধুনিক কর্পোরেশনের মধ্যে প্রধান পার্থক্য, কোম্পানি সরকারের তৈরি একচেটিয়া ব্যাবসা। সেই অধিকার প্রথমে রাজা ও পরে পার্লামেন্টের সনদ বা চার্টার দ্বারা স্বীকৃত, কারণ ব্যক্তিগত ব্যাবসা হলেও দেশের অর্থনীতিতে এই প্রতিষ্ঠানের যে বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে সেটাও মেনে নেওয়া হয়েছে। এই ধরনের চার্টার্ড কোম্পানি আজ প্রায় বিলুপ্ত যে কয়েকটা টিকে আছে তার মধ্যে বি বি সি উল্লেখযোগ্য— কারণ আধুনিক যুগ একচেটিয়া বিরোধিতার যুগ। আজকের দিনে যে-কোনও ব্যক্তি শেয়ার বাজারে নাম লিখিয়ে টাকা তুলে কোম্পানি শুরু করতে পারেন। সেই কোম্পানির শেয়ারের দাম প্রতিযোগিতার নিয়ম দ্বারা স্থির হবে। অন্যদিকে চার্টার্ড কোম্পানির শেয়ারের দাম নির্ভর করত সরকারি সুযোগসুবিধার উপরে।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ধীরে ধীরে সরকারি মদতে তৈরি একচেটিয়ার বিপক্ষে জনমত জোরালো হয়ে ওঠে, কিছুটা কোম্পানিরই কাজকর্মের প্রতিক্রিয়ায়। শিল্পবিপ্লবের কারণে যে নতুন প্রতিযোগিতার পরিবেশ গড়ে ওঠে তার সঙ্গেও একচেটিয়ার স্বভাবে মিল ছিল না। কোম্পানি হয়ে দাঁড়ায় আজকের ভাষায় ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা স্বজনপোষক ক্যাপিটালিজমের প্রতিভূ। ১৮৭৪ সালে কোম্পানির অবসান চার্টার্ড কর্পোরেশনের যুগেরই অবসান।
সরকারি একচেটিয়া ব্যাবসার অবশ্য এখানেই শেষ ঘটেনি। সারা বিশ্বে সমাজতন্ত্রের যখন রমরমা, সরকারি মনোপলি তখন অনেক দেশেই যথেষ্ট জনপ্রিয় মডেল। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে লাইসেন্সরাজ আমলে, মোটামুটি ১৯৫৬ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সময়, অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনায় ব্যক্তিগত ব্যাবসাকে হেয় করে দেখা হয়েছে ও সরকারি মনোপলির সমর্থন করা হয়েছে। অ্যাডাম স্মিথ যেসব পয়েন্টে মনোপলির সমালোচনা করেছেন, ব্যয়বহুলতা, ঢিলেঢালা কাজকর্ম, উদ্ভাবনীশক্তির অভাব ইত্যাদি, স্বাধীন ভারতের কর্পোরেশনগুলির ক্ষেত্রেও সেগুলি প্রযোজ্য।
ব্যাবসা ও বিশ্বাস
তীর্থংকর রায়ের আলোচনার পিছনে একটা ধারণা কাজ করেছে, তা হল, ব্যাবসার ভিত্তি পারস্পরিক বিশ্বাস। ভারতীয় ও ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা পরস্পরের বন্ধু না হলেও স্বার্থের খাতিরে চলনসই একটা সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছে। কোম্পানির কেনাবেচার পরিধি যত বেড়েছে, ততই বাজারে খুচরো কেনাবেচার জায়গায় দীর্ঘস্থায়ী চুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। এইসব চুক্তির পিছনে কোনও আইন-আদালতের জোর ছিল না। পারস্পরিক বিশ্বাসের উপরে নির্ভর করত চুক্তি মেনে কাজ হবে কি না। বলাই বাহুল্য, কখনও কখনও কথার খেলাপ হত।
আবার কখনও এই সম্পর্কের উপরে রাজনীতির ছায়া পড়েছে, যেমন সুরাটের বণিকরা মোগল সাম্রাজ্যের পতনের আগে আরও বেশি ক্ষমতাশালী ছিল। তবে কোম্পানির সব থেকে বিচক্ষণ অফিসাররা মোটামুটি বুঝতেন যে ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্যে আস্থা অর্জন করা খুব জরুরি, অনেকটা আজকের দিনে সুনাম বা ব্র্যান্ড-নেম রক্ষা করার মতো। একই নিয়মে ভারতীয় এজেন্ট ও বণিকরাও চেষ্টা করেছে নিজেদের সুনাম বজায় রাখার। তাদের মধ্যে কয়েক জন যেসব প্রতিষ্ঠান তৈরি করে দিয়ে গেছে সেগুলির পরিধি বিশাল ও অস্তিত্ব বহুপ্রজন্মব্যাপী।
বিশ্বাস ছিল বলে বিশাল পরিমাণ টাকা হুন্ডির সাহায্যে দূর দেশে পাঠানো সম্ভব হয়েছিল। বিশ্বাসের আদি জমি হয়তো একান্নবর্তী পরিবার বা স্বজাতি, কিন্তু ব্যাবসার পরিধি বাড়লে অচেনা বা অল্পচেনাকেও বিশ্বাস করা দরকার। বৈদেশিক ব্যাবসা মানেই অচেনা বিদেশি বণিকদের সঙ্গে কারবার। বছর বছর অচেনা লোকের সঙ্গে কারবার-লেনদেন চললে শেষে হয়তো পার্টনারশিপ ব্যাবসা শুরু করার মতো সম্পর্ক তৈরি হতে পারে।
কর্পোরেট সংগঠন বিশ্বাস অর্জন করার জন্যে উপযোগী, কারণ সংগঠন চলে কতগুলো নিয়ম মেনে, ব্যক্তিবিশেষের খেয়ালখুশিতে নয়। যারা কোম্পানির চাকরিতে যোগ দেয় তারাও নিজেদের পেশাদারি সংস্থার কর্মচারী হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়। দায় সীমাবদ্ধ হওয়ায় শেয়ারহোল্ডারদের নিশ্চিন্ত রাখা সম্ভব। রাজনৈতিক-সামরিক শক্তির উপরে কিছুটা নির্ভরশীল হলেও কোম্পানির সবথেকে বড় সম্পদ ছিল ক্রেতা-বিক্রেতা- শেয়ারহোল্ডারদের বিশ্বাস ধরে রাখার ক্ষমতা, দুশো বছর ধরে তাদের ব্যবসায় টিকে থাকার পিছনে মূল মন্ত্র এটাই।
তীর্থংকর রায় দেখিয়েছেন যে ভারতীয় ও ইউরোপীয় বণিকরা সাধারণত পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি। ব্যাবসার জন্যে পারস্পরিক আস্থা যতটা দরকার বন্ধুত্ব ততটা নয়, তবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সুবিধাজনক। ঐতিহাসিক মারিয়া মিশ্রের মতে ১৯২০ বা ১৯৩০-এর দশকে ভারতের পুরনো ব্রিটিশ কোম্পানিগুলির যখন পড়ন্ত অবস্থা, তখন আধুনিক বহুজাতিক বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলির রমরমা, কারণ এদের সঙ্গে ভারতীয়দের সম্পর্ক আরও বন্ধুত্বপূর্ণ।
কোম্পানির রাজনৈতিক ক্ষমতা যত বাড়তে থাকে, ইংরেজ শাসকরা নিজেদের এলাকায় বেশি সংখ্যায় কোর্ট-কাছারি প্রতিষ্ঠা করে। সেই কোর্টে ব্যবসায়িক আইন গ্রাহ্য। এই কোর্ট-পুলিশ-আইনব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যবসায়িক জগতে অনিশ্চয়তা, বিশেষ করে চুক্তিভঙ্গ হওয়ার ঝুঁকি কমে আসে। বম্বে, কলকাতা ও মাদ্রাজ শহরে অবিশ্বাস্য হারে ব্যাবসাবাণিজ্য বাড়ার পিছনে এটা একটা বড় কারণ নিঃসন্দেহে। দলে দলে বণিক-মহাজন যে এই তিন শহরে তাদের কারবার উঠিয়ে নিয়ে আসে তার একটা কারণ এই আইন ব্যবস্থা।
কোম্পানির আমলের আগে ভারতে কীভাবে ব্যবসায়িক চুক্তি স্থির হত ও কীভাবে তা বলবৎ করা হত তা নিয়ে আমাদের জ্ঞান সামান্য, কারণ সে যুগের প্রায় কোনও ভারতীয় সংস্থাই তাদের কাগজপত্র রেখে যায়নি। রায়ের মতে, প্রথাগত চুক্তি সাধারণত লেনদেনের ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহার হত, কেনাবেচায় ততটা নয়। ধর্মশাস্ত্রে ‘ব্যবহার’ নামে একটা অধ্যায় আছে যাতে ‘বিবাদ’ অর্থাৎ ব্যবসায়িক মামলা মেটানোর ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে, তার থেকে মনে হয় প্রাচীন কালে কেনাবেচা, পার্টনারশিপ বা মাইনে-মজুরি নিয়ে বিসংবাদে কোনও কোর্ট-কাছারির ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে। কিছু প্রধান বণিক সম্প্রদায়, যেমন গুজরাটের নগর শেঠদের ইতিহাস থেকেও এ রকম অনুমান করা যায়। মনে হয় ভারতের অন্যত্র অনুরূপ কিছু প্রতিষ্ঠান হয়তো ছিল।
সে যাই হোক, চুক্তি-সংক্রান্ত বিবাদের সম্ভাবনা সত্ত্বেও ব্যাবসার মূল ভিত্তি পারস্পরিক বিশ্বাস। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় এডওয়ার্ড ব্যানফিল্ডের বই—’দি মরাল বেসিস অফ এ ব্যাকওয়ার্ড সোসাইটি’। ব্যানফিল্ড দেখিয়েছেন যে উত্তর ইটালির তুলনায় দক্ষিণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কম হওয়ার পিছনে কারণ পরিবারের গণ্ডির বাইরে বিশ্বাসভাজন পার্টনারের অভাব। ছোটখাটো বিবাদের সমাধান খুঁজতে আইনের অবলম্বন একেবারে সর্বশেষ পন্থা। এ-কথা অতীতেও যেমন সত্যি আজকের বিশ্বায়নের যুগেও তেমনই প্রযোজ্য।
মনোপলি, অ্যাডাম স্মিথ, ‘কর্পোরেট গভর্নেন্স’
একচেটিয়ার প্রতি বিদ্বেষবশত স্মিথ তাঁর বিখ্যাত বই ‘ওয়েলথ অফ নেশনস’ লিখলেন, যাকে বলা যায় পুঁজিবাদের ম্যানিফেস্টো বা আকর গ্রন্থ। ১৭৭৬ সালে যখন বইটি প্রকাশিত হয় তখন এডমান্ড বার্ক, শেরিডান, লর্ড নর্থ এবং আরও অনেকে মিলে কোম্পানিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। স্মিথ বললেন যে মনোপলি ক্রেতা, বিক্রেতা, মালিক, শ্রমিক সারা সমাজের জন্যেই মন্দ, কারণ ব্যক্তিস্বার্থের সুস্থ ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের জন্যে প্রতিযোগিতা অপরিহার্য। আদর্শ সমাজব্যবস্থার ভিত্তি ব্যক্তিস্বাধীনতা বা ‘ন্যাচারাল লিবার্টি’, কিন্তু তার সঙ্গে চাই প্রতিযোগিতার ‘অদৃশ্য হাত’।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার স্মিথের মতে ‘ভোক্তা ও উৎপাদক দু’জনের উপরেই একরকম ট্যাক্স’। প্রকৃতপক্ষে কোম্পানিকে নিজের কর্মচারীদের সঙ্গেই প্রতিযোগিতায় লড়তে হয়েছে। কর্মীদের মাইনেকড়ি দেওয়ার ব্যাপারে একটা বড় গলদ বরাবরই ছিল, যার কারণে ব্যক্তিগত ব্যাবসা বরদাস্ত করে যেতে হয়েছে। আর ব্যক্তিগত ব্যাবসা চালিয়ে কোম্পানির অনেক অফিসার বড়লোকও হয়ে গেছে। আজকের দিনেও অনেক কোম্পানি অফিসারদের স্টক অপশন ইত্যাদি সুবিধা দিয়ে বড়লোক হবার উপায় করে দেয়। কিন্তু আজকের কোনও কোম্পানিই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রতিযোগিতা বরদাস্ত করবে না।
সেকালের কোম্পানিও এই ব্যবস্থায় অস্বস্তিতে ভুগেছে ও মাঝেমাঝে এটা বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের সবথেকে সফল অফিসারদের অনেকে, যেমন অক্সেন্ডেন, অঞ্জিয়ের, ডে, বা ইয়েলকে ব্যাবসার অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। রায় দেখিয়েছেন যে, সবথেকে কুখ্যাত কর্মী- তথা প্রতিযোগী টমাস পিট অনেক সম্পত্তির মালিক হয়ে দেশে ফিরেছিলেন। সেই সম্পত্তির মধ্যে ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম হিরে যা মারি আন্তোয়ানেতের মুকুট ও নেপোলিয়নের তলোয়ারের খাপে শোভা পায়। পিট অনেক টাকায় পার্লামেন্টে সিট কিনে সেই চেয়ারে বসে কোম্পানির একচেটিয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালান।
স্মিথ অবশ্য একেবারে আলাদা একটা দুর্বলতা নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন। তাঁর বিশ্লেষণে কর্মীদের ব্যক্তিগত ব্যাবসার অর্থ হল ম্যানেজমেন্ট ও মালিকদের স্বার্থ পরস্পরবিরোধী হয়ে ওঠা। ম্যানেজমেন্ট অত্যধিক স্বাধীনতা পেলে কোম্পানির কাজে গাফিলতি অবশ্যম্ভাবী। এ ব্যাপারে স্মিথ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। আজকের দিনেও যে-কোনও বড় কোম্পানির অডিট কমিটির প্রধান মাথাব্যথা কী করে অফিসারদের দিয়ে শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থে কাজ করানো যায়। মালিক-ম্যানেজার শ্রমবিভাজন অনেক দিক দিয়ে সুবিধাজনক। একটা বড় সুবিধা হল মালিকের অকর্মণ্য সন্তানদের জায়গায় পেশাদারি ম্যানেজারদের হাতে কোম্পানির দায়িত্ব থাকে। কিন্তু এর কারণে ম্যানেজারদের দিক থেকে অসদাচরণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়, বিশেষ করে যদি মালিকরা কোম্পানির কাজকর্ম থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। আজকের দিনে এই সম্ভাবনা এড়ানোর কিছু উপায় রয়েছে ঠিকই। কিন্তু সম্ভাবনাটা এখনও রয়েছে, যেমন ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে।
স্মিথ-পরবর্তী আমলে কোম্পানির একচেটিয়া বারবার সমালোচিত হয়েছে, অনেক সময়ে স্মিথের মতামত উল্লেখ করে। বাংলা বিজয়ের পরে, ১৭৬৬ সালে কোম্পানির শেয়ারের দাম চড়তে থাকে, আবার বাংলায় অপশাসনের খবর পৌঁছতে থাকলে বাজার পড়ে যায়। পার্লামেন্টের অনেক সদস্য শেয়ারহোল্ডার। বলাই বাহুল্য তারা এই ওঠানামায় খুশি হয়নি। তাদেরই মাধ্যমে যেভাবে কোম্পানি পুনর্গঠিত হয় তাতে একচেটিয়া ব্যাবসার ভিত্তি দুর্বল হতে থাকে।
১৮০০ শতকের গোড়ায় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোম্পানির পড়ন্ত অবস্থা। তার একটা কারণ পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ, দ্বিতীয় কারণ শিল্পবিপ্লব। ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষ আর ভারত থেকে আমদানি কাপড় চায় না, নিজেদের মিলের কাপড়েই তারা খুশি। ভারতের তাঁতিরা মেশিনে তৈরি কাপড়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছু হঠছে। চিনের চা ও আফিম রপ্তানির ব্যাবসায় জড়িয়ে না গেলে কোম্পানিকে তখনই দেউলে হতে হত। ১৮২০ থেকে ১৮৫৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভারতে কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থ শেষ, রাজনীতিই একমাত্র উদ্দেশ্য।
কোম্পানি ও চিন
কোম্পানির দ্বিতীয়বার ভাগ্য ফিরে যায় চিনের সঙ্গে ব্যাবসায়। রায়ের বইয়ে প্রধানত ভারতে কোম্পানির ব্যাবসা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চিন প্রসঙ্গে আমি কিছু আলোচনা জুড়ে দিতে পারি। চিনের চায়ের প্রতি ইংরেজদের আকর্ষণ ১৭৮৪ সালে পিটের কম্যুটেশন আইন প্রবর্তনের পর থেকে বাড়তে থাকে, কারণ তার পরে চা আমদানির উপরে বাধানিষেধ কমে যায়। চা খাওয়ার চল হু হু করে বাড়তে থাকে। ১৮৩৩ সালের চা নিলামে কোম্পানির লাভ হয় দশ লক্ষ পাউন্ড। চা প্রথমে রুপোর বিনিময়ে কেনা হলেও পরে আফিম বিক্রি করে সংগ্রহ করা হয়।
চিং সম্রাটের দরবার বিদেশিদের পছন্দ করত না। ইউরোপীয়দের সঙ্গে সমানে সমানে ব্যাবসা করাকে মনে করত অসম্মানজনক। কোম্পানি লেগে থাকে ও পার্ল নদীর মোহনায় ক্যান্টন বন্দরে ব্যাবসার সুবিধা অর্জন করে। সেখানে কো-হং নামে বণিক সম্প্রদায় তাদের অনবরত হয়রান করে চলে। চিন ছাড়া চা পাওয়ার উপায় নেই। লাভের গন্ধে কো-হং ও কোম্পানি, এই দুই মনোপলি শেষ পর্যন্ত পরস্পরের আস্থাভাজন হয়ে উঠল।
লক্ষ লক্ষ পাউন্ড চা ক্যান্টনে কোম্পানির গুদামে জমা পড়তে লাগল। চার রকমের কালো চায়ের চাহিদা সবথেকে বেশি, বোহেয়া, কঙ্গো, সূচং ও পিকো; আর তিনটে সবুজ চা, সিংলো, হেসন ও বিং। কোম্পানির জাহাজে চেপে এই চা যেত ব্রিটেনে ও আরও দূর দেশে। ফেরত পথে জাহাজ তুলে নিত রুপো, যা দিয়ে চা কেনা হবে। এত বিশাল পরিমাণ রুপো রপ্তানি ব্যালান্স অফ পেমেন্ট বা বাণিজ্যের ভারসাম্য রক্ষায় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। ভারতের সঙ্গে ব্যাবসায় প্রথমে ক্লাইভ ও পরে শিল্পবিপ্লব রুপো আমদানির প্রয়োজন কমিয়ে দেয়। কিন্তু চিনে?
এখানে চা কিনতে গিয়ে কোম্পানিকে ড্রাগের চোরাকারবারির ভূমিকায় নামতে হয়। বিহার ও বাংলায় চাষিদের উৎপন্ন আফিম কোম্পানি স্মাগলারদের সাহায্যে চিনে পাঠাতে থাকে। চিনে এই ব্যাবসা নিষিদ্ধ হওয়ায় কোম্পানি নিজেদের জাহাজ ব্যবহার না করে মাথেসন ডেন্ট কোম্পানি আদি এজেন্টদের জাহাজে পাঠায়। অনেক টাকা ঘুষ দিয়ে এই এজেন্টরা চিনের শুল্ক অফিসারদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাত। আফিম বিক্রির টাকা জমা পড়ত ক্যান্টনে কোম্পানির আড়তে। ১৮২৫-এর কাছাকাছি চায়ের দাম প্রায় পুরোটাই আফিম বিক্রির টাকা থেকে উঠছে। আফিমের চাষ কোম্পানির কাছে এতই লাভজনক হয়ে ওঠে যে মধ্য ও পশ্চিম ভারতে, বিশেষ করে মারাঠা অধিকৃত মালোয়ায়, চাষ ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে বম্বে হয়ে আফিম রপ্তানি হত ম্যাকাওতে। ইংরেজ-মারাঠা যুদ্ধের অনেকগুলি কারণের একটা মালোয়ায় উৎপন্ন আফিমের দখল।
১৮৩৮ সালে চিনে আফিম আমদানির বছর ১৪০০ টনে পৌঁছলে আফিমের চোরাকারবারিদের জন্যে মৃত্যুদণ্ড ধার্য হল। লিন জেশু নামে এক অফিসার নিযুক্ত হলেন আফিমের ব্যাবসা বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে। চিন ও ব্রিটেনের মধ্যে প্রথম আফিম যুদ্ধ (১৮৩৯-৪০) বাধল, চিনের পরাজয় হল, ও নানকিঙের শান্তিচুক্তির শর্তানুযায়ী হং কং হস্তান্তরিত হল। ১৮৫৬ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে আবার আফিম নিয়ে যুদ্ধ বাধে, এই যুদ্ধেও চিনের হার হয়।
আফিমের ব্যাবসা চিনের বিরাট ক্ষতিসাধন করে। একটা সূত্র অনুযায়ী ১৮৭০ নাগাদ পূর্ণবয়স্ক চিনা পুরুষদের ২৭ শতাংশ আফিমে আসক্ত, ১৯০৫ নাগাদ প্রত্যেক পাঁচ জনের মধ্যে একজন আফিমখোর। ঊনবিংশ শতাব্দীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ নেশা করে মারা গেছে বা অসুস্থ হয়েছে। চিনের ইতিহাসে এই শতাব্দীর পরিচয় ‘অপমানের শতক’ নামে। ১৯০৭ সালে ব্রিটেন ভারত থেকে চিনে আফিম রপ্তানি বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয় এবং ১৯১১ সালে বিহারে আফিমের চাষ বন্ধ হয়। ১৯৪৮ সালে মাওয়ের বিপ্লব আফিমের নেশা বরাবরের মতো নিষিদ্ধ করে দেয়।
কোম্পানির প্রাসঙ্গিকতা
ইংরেজ ঐতিহাসিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উল্লেখ করেছিলেন ‘বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্পোরেশন’ নামে। আজকে আমরা হয়তো এই বিশেষণ প্রয়োগ করব না। তবে সবথেকে ক্ষমতাশালী কর্পোরেশন বললে ভুল বলা হবে না। ২৭৫ বছরের ইতিহাসে, যে ইতিহাস বাণিজ্যবাদ বা মার্কেন্টাইলিজমের যুগ থেকে শিল্পবিপ্লবের যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত, কোম্পানি অবশ্যই পৃথিবীর সবথেকে ক্ষমতাশালী কর্পোরেশন। সেই ক্ষমতার ব্যবহার হয়েছে সম্পদ সৃষ্টির কাজে। আবার অপব্যবহারও হয়েছে নানাভাবে। কোম্পানির কাহিনি থেকে আমরা একচেটিয়ার কুফল সম্বন্ধে সচেতন হই। আবার কোম্পানিই আধুনিক কালের অনেক ব্যবসায়িক সংগঠনের উৎসস্বরূপ।
তীর্থংকর রায়ের ভাষা ব্যবহার করে বলতে পারি, সৌভাগ্যক্রমে আজকাল আর বহুজাতিক সংস্থা রাজ্যজয়ে নেমে পড়ে না। ১৬১২ সালে সুরাটের উপকূলে পর্তুগিজ নৌবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ জিতে মোগলদের কাছ থেকে ব্যাবসার অনুমতি আদায় করে নেওয়ার যুগ থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। আইনসংগত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানদের নিজস্ব ফৌজ গড়ে তুলতে হয় না। তাদের ড্রাগের ব্যাবসায় নামারও দরকার হয় না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হিংসা, ড্রাগের ব্যাবসা, ঘুষ দেওয়া ইত্যাদি নানারকম অপকর্মে লিপ্ত ছিল বরাবর, এটাই কোম্পানির ইতিহাসের অন্ধকার দিক।
আবার সাংগঠনিক ক্ষেত্রে কোম্পানির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। কোম্পানির মাধ্যমে যৌথ উদ্যোগের ধারণাটা প্রাক-আধুনিক থেকে আধুনিক যুগে চলে এসেছে। পেশাদারি ম্যানেজমেন্টের ধারণাও এসেছে কোম্পানির কাজের পদ্ধতি থেকে। পুরস্কারের লোভে বা অন্যভাবে প্রেরণা পেয়ে অনেক প্রতিভাবান যুবক কোম্পানির চাকরিতে যোগ দিয়েছে। রায় দেখিয়েছেন যে অক্সেন্ডেন, অঞ্জিয়ের বা চার্নকের মতো তাঁদের অনেকে সামান্য অবস্থা থেকে উঠে এসে স্বদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূর দেশে অসাধারণ কীর্তি রেখে গেছেন। প্রতিভাবানকে সুযোগ দেওয়া নিশ্চয়ই আকস্মিক ঘটনা নয়। অ্যাডাম স্মিথ মালিক-ম্যানেজারদের মধ্যে বিভেদ নিয়ে আক্ষেপ করেছেন সংগত কারণেই। কিন্তু প্রতিভার বিকাশের পিছনেও এই শ্রমবিভাজনই প্রধান কারণ। স্মিথ ম্যানেজারদের অবিশ্বাস করলেও মালিকরা করেনি। এই সমস্যা আজও রয়েছে, আবার পেশাদারি ম্যানেজমেন্টের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। দুই দিকেই কোম্পানি পথপ্ৰদৰ্শক।
একচেটিয়া একটা জন্মগত ত্রুটি নিঃসন্দেহে, কিন্তু এই অধিকার কখনই পুরোপুরি হয়নি। একচেটিয়া কর্পোরেট কালচারে একটা বিকার নিয়ে আসে, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত স্বার্থের মধ্যে সংঘাত তৈরি করে। অফিসারদের মাইনে কম এই যুক্তি মেনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যক্তিগত ব্যাবসার [আঠারো]
অনুমতি দিত। কিন্তু আবার ব্যক্তিগত ব্যাবসা বেশি বাড়লে দমন করার জন্যে উঠেপড়ে লেগে যেত। আজকের দিনের কোম্পানিরা কর্মীদের ঝুঁকি নেওয়ার জন্যে নানাভাবে উৎসাহ দেয়, কিন্তু আরও খোলাখুলিভাবে বোনাস বা স্টক অপশনের মাধ্যমে, যাতে ব্যক্তিস্বার্থ আর কোম্পানির স্বার্থে সংঘাত না লাগে। কিছু ব্যবসায়িক সম্প্রদায় বিশেষ করে মারোয়াড়ি ও জৈনদের মধ্যে ব্যক্তিগত ব্যাবসার অনুমতি দিয়ে কর্মীদের উৎসাহিত করার নজির দেখা যায়। অবশ্য অনেক সময়ে সেই সুযোগ যুবকদের শিক্ষানবিশির কাজ করে।
ক্লাইভ ও কোম্পানি যে অসাধু উপায়ে ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধ জিতে বাংলা দখল করল সে গল্প শুনে আজও ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। কাজেই ভারতীয়রা যে ব্যাবসা, বণিক, আর বিদেশি কোম্পানিদের ব্যাপারে এখনও সন্দেহপ্রবণ তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুগ ফিরে আসছে— বিদেশি বিনিয়োগ বা বিশ্বায়নের পরিধি বাড়লেই সভাসমিতিতে এই স্লোগান এখনও শোনা যায়। কিন্তু স্বাধীনতার ষাট বছর পরে আজ ভারত পৃথিবীর সবথেকে দ্রুত পরিবর্তনশীল উন্নয়নশীল দেশগুলির একটা। অনেক অল্পবয়সি পাঠকের মন থেকে উপনিবেশবাদের ছায়া কেটে গেছে। হয়তো কোম্পানির ইতিহাস নতুন করে চর্চা করার সময় এসেছে।
স্বাধীনতার পরে স্বদেশি চিন্তাভাবনার যুগে কোম্পানির ইতিহাস যে ভাবে দেখা হত তার প্রভাবে বিদেশি ব্যাবসার ব্যাপারে অহেতুক ভয় বেড়ে গিয়েছিল। তার প্রভাবেই আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে আত্মনির্ভরতার অর্থনীতি চালু করা হয়। ১৯২০-র দশকে মহাত্মা গাঁধী সেই ইতিহাসভাবনাকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করেছিলেন। স্বাধীনতার পরে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থে তার ব্যবহার করেছে বিদেশি প্রতিযোগিতার রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে। ১৯৯০-এর অর্থনৈতিক সংস্কার সেই মনোবৃত্তি থেকে সরে আসার পথে জোরালো পদক্ষেপ। এই রাস্তায় হাঁটার স্বপক্ষে তখনও ‘বম্বে ক্লাব’ আদি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও রাজনীতিকদের সমর্থন ছিল না।
তীর্থংকর রায়ের বই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাস চর্চায় একটা নতুন মাত্রা নিয়ে আসবে বলে আমার মনে হয়। এই ইতিহাস দীর্ঘদিন ধরে রাজদরবারের কেচ্ছাকাহিনি হয়ে রয়েছে। রায়ের বই সেই ক্লান্তিকর [উনিশ]
ঘটনাবলীর মধ্যে নিয়ে এসেছে দুঃসাহসিক জাহাজিদের গল্প, অসাধারণ দক্ষতাসম্পন্ন কারিগরদের গল্প, এমন কোটিপতি মহাজনদের কথা যারা অস্বাভাবিক ঝুঁকি নিয়ে ফতুর হয়ে গেছে এবং এমন রাজাদের প্রসঙ্গ যারা বুঝেছে যে দরবারের স্বার্থ ও বিদেশি বণিকদের স্বার্থের মধ্যে কোনও অসংগতি নেই।
গুরচরণ দাস
Leave a Reply