ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা
মূল: আল্লামা শাইখ মুহাম্মাদ আল আমীন বিন মুহাম্মাদ মুখতার শানক্বীতী (১৩০৫-১৩৯৩হি:)
অনুবাদ: মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ আল কাফী
প্রকাশক: জুবাইল দাওয়া এণ্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদী আরব।
প্রথম প্রকাশ: ১৪৩৭ হিজরী/ ২০১৬ ইং
ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি বিশ্বজগতের পালনকর্তা। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবায়ে কেরামের উপর এবং কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর পথে যারা মানুষকে আহবান জানিয়েছে তাদের উপর।
সম্মানিত পাঠক-পাঠিকা! এই পুস্তকটি মূলত: একটি বক্তব্য। মরক্কোর বাদশাহর আহবানে মসজিদে নববীতে এ বক্তব্যটি আমি পেশ করেছিলাম। তারপর শুভাকাংখী ভায়েরা লিখিত আকারে তা প্রকাশ করার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। তাদের আহবানে সাড়া দিয়েই এ পুস্তকের অবতারণা। আশা করি আল্লাহ এ দ্বারা মানুষকে উপকৃত করবেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম। আমার নেয়ামত পূর্ণরূপে প্রদান করলাম এবং তোমাদের জন্য মনোনিত করলাম ইসলামকে জীবন ব্যবস্থা হিসেবে।” (মায়েদা: ৩)
এ সম্মানিত আয়াতটি নাযিল হয়েছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর বিদায় হজ্জে আরাফাত ময়দানে শুক্রবার দিবসে। উমার বিন খাত্তাব (রা.)এর বর্ণনায় হাদীছটি বুখারী ও মুসলিমে আছে। (দেখুন, বুখারী, অধ্যায়: ঈমান, অনুচ্ছেদ: ঈমান বাড়ে ও কমে। মুসলিম, অনুচ্ছেদ: তাফসীর, হা/৩০১৭)
আয়াতটি নাযিল হওয়ার সময় সেই দিবসের বিকেলে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরাফাতে অবস্থান করছিলেন। এই আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ৮১দিন বেঁচে ছিলেন।
এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট বিবরণ দিয়েছেন যে, তিনি আমাদের দ্বীনকে এমনভাবে পরিপূর্ণ করেছেন, যাতে ত্রুটির কোন অবকাশ নেই। আর তাতে কখনো কোন কিছু সংযোজন করারও প্রয়োজন নেই। এ কারণেই তিনি আমাদের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে পাঠিয়ে নবী-রাসূল আগমণের ধারাবাহিকতার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন।
আল্লাহ আরো স্পষ্ট করেছেন যে, তিনি জীবন ব্যবস্থা হিসেবে আমাদের জন্য যা পছন্দ করেছেন তা হচ্ছে ‘ইসলাম’। অতএব এই ইসলামকে তিনি কখনোই অপছন্দ করবেন না। আর এই ইসলাম ব্যতীত মানুষের নিকট থেকে অন্য কিছুও তিনি গ্রহণ করবেন না। তাই তিনি অন্য স্থানে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন,
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
“যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা অনুসন্ধান করবে, তার থেকে তা কখনোই গ্রহণ করা হবে না। আর পরকালে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত।” (আল ইমরান: ৮৫)
তিনি আরো এরশাদ করেন,
إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ
“নিশ্চয় আল্লাহর নিকট মনোনিত দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা হচ্ছে ইসলাম।” (আল ইমরান: ১৯)
দ্বীনকে পরিপূর্ণ করার মাধ্যমে এবং তার যাবতীয় বিধি-বিধান বিশদরূপে বর্ণনা করার মাঝেই আছে ইহ-পরকালিন যাবতীয় কল্যাণ। এ জন্যেই আল্লাহ বলেন,
وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي
“আমার নেয়ামত তোমাদেরকে পূর্ণরূপে দান করলাম।” (মায়েদা: ০৩)
এই আয়াত সুস্পষ্ট প্রমাণ এ কথার যে,
দুনিয়া ও আখেরাতে যতকিছুর প্রয়োজন মানুষ তার জীবনে অনুভব করবে, তার কোন কিছুরই বিবরণ দিতে ও উল্লেখ করতে ইসলাম বাদ রাখেনি।
এ দাবীটিকে প্রমাণ করার জন্য আমি এ পুস্তকে মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও বড় বড় দশটি বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করবো। এর উপরেই আছে পার্থিব জীবনে সফলতার ভিত্তি। এমনকি দুনিয়া-আখেরাতে এ বিষয়গুলোই পৃথিবীবাসির জন্য অতিব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি বিষয় উল্লেখ করে কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতাও উল্লেখ করা হবে। বিষয়গুলো হচ্ছে:
প্রথমত: তাওহীদ
দ্বিতীয়ত: উপদেশ
তৃতীয়ত: সৎ আমল ও অন্যান্য আমলের মাঝে পার্থক্য
চতুর্থত: শরীয়তের আইনের কাছে সমর্পণ
পঞ্চমত: সামাজিক অবস্থা
ষষ্ঠত: অর্থনীতি
সপ্তমত: রাজনীতি
অষ্টমত: মুসলিম জাতির উপর কাফেরদের আধিপত্যের সমস্যা
নবমত: জনবল ও রসদ সামগ্রীতে কাফেরদের প্রতিহত করতে মুসলিমদের দূর্বলতা সমস্যা
দশমত: সমাজে মানুষের মাঝে বিভেদ
প্রতিটি সমস্যার জন্য কুরআন থেকে আমরা সমাধান উল্লেখ করব। ইন শা আল্লাহ।
প্রথমত: তাওহীদ
কুরআন গবেষণা করে জানা গেছে যে, তাওহীদ তিনভাগে বিভক্ত।
প্রথম প্রকার: তাওহীদ রুবুবিয়্যাহ। বা আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের একত্ববাদ।
এই তাওহীদকে মেনে নেয়ার জ্ঞান ও বিবেক দিয়েই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ
“তাদেরকে (কাফেরদেরকে) যদি জিজ্ঞেস কর যে, কে তাদেরকে সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ (আমাদের সৃষ্টি করেছেন)। (যুখরুফ: ৮৭)
তিনি আরো বলেন,
قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمَّنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ
“তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, “কে তোমাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে রিযিক দেয়? এই শোনার ও দেখার শক্তি কার কর্তৃত্বে আছে? কে প্রাণহীন থেকে সজীবকে এবং সজীব থেকে প্রাণহীনকে বের করে? কে চালাচ্ছে এই বিশ্ব ব্যবস্থাপনা?” তারা নিশ্চয়ই বলবে, এগুলো আল্লাহই করেন। বলো, তবুও কি তোমরা (সত্যের বিরোধী পথে চলার ব্যাপারে) সতর্ক হচ্ছো না? (ইউনুস: ৩১) এ ধরণের আয়াত রয়েছে আরো অনেক।
কিন্তু এ প্রকার তাওহীদকে ফেরাউন অস্বীকার করেছিল। আল্লাহ বলেন,
قَالَ فِرْعَوْنُ وَمَا رَبُّ الْعَالَمِينَ
“ফেরাউন বলেছিল, জগতের পালনকর্তা আবার কে?” (সূরা শুআরা: ২৩) কিন্তু তার এ প্রকার তাওহীদ অস্বীকারের কারণ ছিল অহংকার ও অজ্ঞতা। সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
قَالَ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا أَنْزَلَ هَؤُلَاءِ إِلَّا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ بَصَائِرَ
“তিনি (মূসা) বললেন, তুমি খুব ভাল করেই জানো এ প্রজ্ঞাময় নিদর্শনগুলো আকাশ ও পৃথিবীর পালনকর্তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নাযিল করেননি।” (বানী ইসরাঈল: ১০২)
আল্লাহ তার সম্পর্কে বলেন,
وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنْفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعُلُوًّا
“তারা একেবারেই অন্যায়ভাবে ঔদ্ধত্যের সাথে সেই নিদর্শনগুলো অস্বীকার করলো অথচ তাদের মন মগজ সেগুলোর সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল।” (নমল: ১৪)
এ জন্য পবিত্র কুরআন এ প্রকার তাওহীদকে প্রমাণ করার জন্য স্বীকারোক্তি মূলক প্রশ্নবোধক শব্দ দ্বারা উল্লেখ করেছে। যেমন:
أَفِي اللَّهِ شَكٌّ
“আল্লাহর অস্তিত্বে কি কোন সন্দেহ আছে?” (ইবরাহীম: ১০) আরো বলা হয়েছে:
قُلْ أَغَيْرَ اللَّهِ أَبْغِي رَبًّا وَهُوَ رَبُّ كُلِّ شَيْءٍ
“আপনি বলুন, আমি কি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করব; অথচ তিনিই সবকিছুর রব?” (আনআম: ১৬৪) আল্লাহ আরো বলেন,
قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ قُلِ اللَّهُ
“আপনি তাদেরকে বলুন! কে আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবীর অধিকর্তা? আপনি বলুন: তিনি তো আল্লাহ।” (রা’দ: ১৬) এরকম আয়াত আরো অনেক আছে। ওরা আল্লাহর এই ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে স্বীকার করতো।
কিন্তু এ প্রকার তাওহীদকে মান্য করা কাফেরদের কোন উপকার করেনি। কেননা তারা ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর একত্বকে মেনে নেয়নি; শিরক করেছে। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ
“তাদের অধিকাংশই আল্লাহর উপর ঈমান আনে কিন্তু মূলত: তারা মুশরিক।” (ইউসুফ: ১০৬) আল্লাহ আরো বলেন, তারা মূর্তি পুজা করে আর বলে,
مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى
“আমরা তো এদের পূজা এজন্যই করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিবে।” (যুমার: ৩) আল্লাহ আরো বলেন,
وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ
“তারা বলে এরা (মূর্তিরা) আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী। (হে মুহাম্মাদ!) ওদেরকে বলে দাও, “তোমরা কি আল্লাহকে এমন বিষয়ের খবর দিচ্ছো যার অস্তিত্বের কথা তিনি আসমানেও জানেন না এবং জমিনেও না!?” (ইউনুস: ১৮)
দ্বিতীয় প্রকার: তাওহীদুল উলুহিয়্যা বা আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে তাঁর একত্ববাদ।
এই তাওহীদকে কেন্দ্র করেই নবী-রাসূল এবং তাঁর উম্মতের মাঝে যত দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এই তাওহীদকে প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়ন করার জন্যই আল্লাহ নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। এই তাওহীদেরই মর্মবাণী হচ্ছে: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। এই কালেমাটি দুটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। একটি ভিত্তির মূল কথা হচ্ছে: ‘না-সূচক’ । দ্বিতীয় ভিত্তির মূল কথা হচ্ছে: ‘হ্যাঁ-সূচক’।
না-সূচকের অর্থ হচ্ছে: যে কোন ধরণের ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ ব্যতীত সকল প্রকার মা’বূদকে না করা, বর্জন করা।
হ্যাঁ-সুচকের অর্থ হচ্ছে: সব ধরণের ইবাদত এককভাবে শুধু আল্লাহর উদ্দেশ্যে হ্যাঁ করা তথা এমনভাবে আদায় করা, যেভাবে করার জন্য তিনি নিয়ম প্রণয়ন করেছেন।
কুরআনের অধিকাংশ নির্দেশনা এই প্রকার তাওহীদকে বাস্তবায়ন করার জন্যই এসেছে। আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
“আমি প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি এই আদেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাগূতকে বর্জন করবে।” (নাহাল: ৩৬) আল্লাহ আরো বলেন,
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ
“আপনার পূর্বে যে রাসূলই আমি প্রেরণ করেছি, তার কাছে এই নির্দেশ দিয়েই ওহী করেছি যে, “আমি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই, অতএব তোমরা আমারই ইবাদত করো।” (আম্বিয়া: ২৫)
আল্লাহ আরো বলেন,
فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى
“যে ব্যক্তিই তাগূতকে (আল্লাহ ব্যতীত যত মাবূদ আছে তা) অস্বীকার করবে ও বর্জন করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনয়ন করবে (এবং শুধু তাঁরই দাসত্ব করবে), সেই সুদৃঢ় হাতল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ)কে আঁকড়ে ধরবে।” (বাকারা: ২৫৬)
আল্লাহ আরো বলেন,
وَاسْأَلْ مَنْ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رُسُلِنَا أَجَعَلْنَا مِنْ دُونِ الرَّحْمَنِ آلِهَةً يُعْبَدُونَ
“তোমার পূর্বে আমি যত রসূল পাঠিয়েছিলাম তাঁদের সবাইকে জিজ্ঞেস করে দেখো, আমি ইবাদত ও দাসত্বের জন্য রহমান আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নির্দিষ্ট করেছিলাম কিনা?” (যুখরুফ: ৪৫)
তিনি আরো এরশাদ করেন, এদেরকে বলো,
قُلْ إِنَّمَا يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَهَلْ أَنْتُمْ مُسْلِمُونَ
“আমার কাছে যে অহী আসে তার মূল আদেশ হচ্ছে এই যে, কেবলমাত্র এক ইলাহই তোমাদের ইলাহ (একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে), তারপর কি তোমরা আনুগত্যের শির নত করছো?” (আম্বিয়া: ১০৮)
এ অর্থবোধক আয়াত কুরআনে আছে অসংখ্য-অগণিত।
তৃতীয় প্রকার তাওহীদ: আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে একত্ববাদ:
এ প্রকার তাওহীদ দুটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত: যেমনটি আল্লাহ নিজেই বর্ণনা করেছেন।
প্রথম ভিত্তি: সৃষ্টি জগতের গুণাবলীর সাথে তুলনা করা থেকে আল্লাহকে পবিত্র করা।
দ্বিতীয় ভিত্তি: যে সকল গুণাবলী আল্লাহ নিজের জন্য নির্ধারণ করেছেন বা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্ধারণ করেছেন, তা প্রকৃত অর্থেই; রূপক অর্থে নয়- একথার প্রতি ঈমান আনা। আল্লাহর কামালিয়্যাত তথা পূর্ণতা ও মহত্মের সাথে যেভাবে গুণাবলীগুলো উপযুক্ত হয় সেভাবেই তিনি গুণাম্বিত। একথা নিশ্চিত যে আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে আল্লাহ ব্যতীত কেউ বেশী জ্ঞান রাখে না। এবং আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে (তাঁর পরে) তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত কেউ বেশী জ্ঞান রাখে না।
মহান আল্লাহ নিজের সম্পর্কে বলেন,
أَأَنْتُمْ أَعْلَمُ أَمِ اللَّهُ
“তোমরা কি বেশী জ্ঞান রাখো, না আল্লাহ?” (বাকারা: ১৪০)
তিনি তাঁর রাসূল সম্পর্কে বলেন,
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى
“তিনি নিজের খেয়ালখুশী মতো কথা বলেন না। তিনি যা বলেন তা তাঁর কাছে নাযিলকৃত অহী ছাড়া অন্য কিছুই নয়।” (নাজম: ৩-৪)
আল্লাহ তায়ালা তাঁর সাথে কোন কিছুর তুলনাকে নাকচ করে দিয়ে এরশাদ করেন:
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ
“তাঁর সমতুল্য কোন কিছু নেই।” একই সাথে তাঁর প্রকৃত গুণাবলীকে সাব্যস্ত করেছেন। তিনি বলেন,
وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
“তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।” (শূরা: ১১)
এই আয়াতটি আল্লাহর গুণাবলীকে অস্বীকার করাকে প্রতিহত করছে। আয়াত থেকে একথা সুস্পষ্ট হচ্ছে যে, আল্লাহর সিফাত বা গুণ সমূহকে প্রকৃত অর্থে সাব্যস্ত করা ওয়াজিব। কোন প্রকার দৃষ্টান্ত বা উপমা নির্ধারণ করা যাবে না। আর কোন কিছুর সাথে তুলনাও করা যাবে না এবং অস্বীকারও করা যাবে না। একই সাথে এই আয়াতে সৃষ্টিকুল যে আল্লাহ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভে অপারগ তাও সুস্পষ্ট করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا
“তিনি লোকদের সামনের পেছনের সব অবস্থা জানেন এবং তারা তাঁর সম্পর্কে পুরো জ্ঞান রাখে না।” (ত্বাহা: ১১০)
দ্বিতীয় বিষয়: উপদেশ
বিদ্বানগণ একথায় একমত যে, আল্লাহ তায়ালা ‘জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণে’র চেয়ে বড় কোন উপদেশ ও সতর্কতা আকাশ থেকে পৃথিবীবাসী মানব জাতির জন্য প্রেরণ করেননি। মানুষ খেয়াল রাখবে যে তার প্রভু মহান আল্লাহ সর্বদা তাকে পর্যবেক্ষণ করেন। তার গোপন-প্রকাশ্য সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন।
সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ এই উপদেশদাতার বিষয়ে বিদ্বানগণ এমন একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন যে বিবেকের বিচারে বিষয়টি বাস্তবতায় ফুটে উঠে। তাঁরা বলেন, ধরুন আমরা একজন বাদশাহকে চিনি সে খুন-খারাবী করে, মানুষ হত্যা করে, প্রজাদের কঠিন শাস্তি দেয়, ভয়ানক নির্যাতন করে। জল্লাদরা সর্বদা তার হুকুম তামিল করার জন্য তরবারী হাতে উদ্দ্যোত থাকে। তাদের তরবারী থেকে মানুষের খুনের রক্ত যেন প্রবাহিত হতেই থাকে। এই বাদশার আছে স্ত্রী ও কন্যারা। এখন কোন মানুষ কি তার এই স্ত্রী ও কন্যাদের প্রতি কুনজরে তাকানো বা তাদের সাথে কোন অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার দু:সাহস করতে পারবে; অথচ বাদশাহ তাদেরকে দেখছেন ও জানছেন? না, কখনই নয়। সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত আল্লাহর জন্যই। বরং বাদশার দরবারে উপস্থিত সকল মানুষ থাকবে ভীত-সন্ত্রস্ত, থাকবে বিনয়ী, তাদের দৃষ্টি থাকবে অবনমিত। তাদের অঙ্গ-ভঙ্গি হবে ভদ্রতা সূলভ নীরবতাপূর্ণ। সবচেয়ে বড় কামনা থাকবে তাদের নিরাপদ জীবন-যাপন। সন্দেহ নেই সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত আল্লাহর জন্যই। কেননা দুনিয়ার ক্ষমতাবান যে কোন রাজা-বাদশাহর চেয়ে মহান আল্লাহর দৃষ্টি ও জ্ঞান সীমাহীন – সুপ্রশস্ত। সন্দেহ নেই তিনি কঠিন শাস্তি প্রদানকারী, ভয়ানক পাকড়াওকারী, দৃষ্টান্ত মূলক দণ্ড প্রদানকারী। পৃথিবীতে আল্লাহর সীমারেখা হচ্ছে, তাঁর হারামকৃত নিষিদ্ধ বিষয়গুলো। দেশের মানুষ যদি জানত যে রাতের বেলাতেও তারা যা করে, সে সম্পর্কে তাদের আমির বা শাসক জ্ঞান রাখেন, তবে অবশ্যই তারা ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় রাত কাটাতো এবং তার ভয়ে সবধরণের গর্হিত কাজ বর্জন করত।
আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন যে, কোন উদ্দেশ্যে তিনি মানব-দানব সৃষ্টি করেছেন। আর তা হচ্ছে, তিনি তাদেরকে পরীক্ষা করেন।
أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا
“তিনি দেখতে চান তাদের মধ্যে কে সবচেয়ে উত্তম আমল করে।” (কাহাফ: ৭)
সূরা হূদের প্রথমে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন:
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا
“তিনিই আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, যখন এর আগে তাঁর আরশ পানির ওপর ছিল, যাতে তোমাদের পরীক্ষা করে দেখেন তোমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে ভালো কাজ করে।” (হূদ: ৭)
আল্লাহ আরো বলেন,
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ
“তিনিই সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন। এ উদ্দেশ্যে যে, কর্মের দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে উত্তম তা পরীক্ষা করে দেখবেন। আর তিনি পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীলও।” (মুলক: ২)
এই আয়াত দুটি আরেকটি আয়াতের উদ্দেশ্যকে ব্যাখ্যা করছে। যেখানে আল্লাহ বলেন,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
“আমি তো জিন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি।” (যারিয়াত: ৫৬) যখন কিনা মানব-দানবকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য ইবাদতের ক্ষেত্রে তাদেরকে পরীক্ষা করা, তাই জিবরীল (আ.) চাইলেন মানুষের সামনে সফলতার পথকে বিকশিত করতে। তাই তিনি প্রশ্ন করলেন নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে, ইহসান কি? অর্থাৎ যে বিষয়ের পরীক্ষা নেয়ার জন্য আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিষয়টির ব্যাখ্যা দিলেন যে ইহসানের পথই হচ্ছে এই মহান উপদেশদাতা ও বড় সতর্ককারী। তিনি বললেন, ইহসান হচ্ছে: তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পাও, তবে একথা অনুভব করবে যে অবশ্যই তিনি তোমাকে দেখছেন। (আবু হুরাইরা রা. হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। দেখুন, বুখারী, অধ্যায়: ঈমান, অনুচ্ছেদ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিবরাইলের ঈমান সম্পর্কে প্রশ্ন, ১/১৮। মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান, হা/৯। হাদীছটি ইমাম মুসলিম উমার বিন খাত্তাব রা. থেকেও বর্ণনা করেছেন, অধ্যায়: ঈমান, হা/৮)
এই জন্য আপনি যখনই পবিত্র কুরআনের কোন পাতা উল্টাবেন সেখানেই দেখতে পাবেন এই মহান উপদেশদাতাকে। আল্লাহ বলেন,
إِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِينِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ7 مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ
“আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি আর তাদের মনে যেসব কুমন্ত্রণা উদিত হয় তা আমি জানি। আমি তার ঘাড়ের রগের চেয়েও তার বেশী কাছে আছি। (আমার এ সরাসরি জ্ঞান ছাড়াও) দু’জন লেখক তার ডান ও বাঁ দিকে বসে সবকিছু লিপিবদ্ধ করছে। এমন কোন শব্দ তার মুখ থেকে বের হয় না যা সংরক্ষিত করার জন্য একজন সদা প্রস্তুত পর্যবেক্ষক উপস্থিত থাকে না।” (ক্বাফ: ১৬-১৮)
فَلَنَقُصَّنَّ عَلَيْهِمْ بِعِلْمٍ وَمَا كُنَّا غَائِبِينَ
“তারপর আমি নিজেই পূর্ণ জ্ঞান সহকারে সমুদয় কার্যবিবরণী তাদের সামনে পেশ করবো। আমি তো আর সেখানে অনুপস্থিত ছিলাম না!” (আরাফ: ৭)
وَمَا تَكُونُ فِي شَأْنٍ وَمَا تَتْلُو مِنْهُ مِنْ قُرْآنٍ وَلَا تَعْمَلُونَ مِنْ عَمَلٍ إِلَّا كُنَّا عَلَيْكُمْ شُهُودًا إِذْ تُفِيضُونَ فِيهِ وَمَا يَعْزُبُ عَنْ رَبِّكَ مِنْ مِثْقَالِ ذَرَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَلَا أَصْغَرَ مِنْ ذَلِكَ وَلَا أَكْبَرَ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ
“বস্তুতঃ হে নবী! যে কোন অবস্থাতেই তুমি থাক এবং কোরআনের যে কোন অংশ থেকেই পাঠ করা কিংবা তোমরা যে কোন কথা বল বা কাজ কর, অথচ আমি তোমাদের নিকটে উপস্থিত থাকি তোমাদের দেখতে থাকি এবং তোমাদের কথা শুনতে থাকি- যখন তোমরা তাতে আত্ননিয়োগ কর। আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে কোন অণু পরিমাণ বস্তুও এমন নেই এবং তার চেয়ে ছোট্ট বা বড় কোন জিনিসও নেই, যা তোমাদের রবের দৃষ্টির অগোচরে আছে এবং ঐ সকল বিষয় একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে।” (ইউনুস: ৬১) আল্লাহ আরো বলেন,
أَلَا إِنَّهُمْ يَثْنُونَ صُدُورَهُمْ لِيَسْتَخْفُوا مِنْهُ أَلَا حِينَ يَسْتَغْشُونَ ثِيَابَهُمْ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ إِنَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ “
“দেখো, এরা তাঁর কাছ থেকে আত্মগোপন করার জন্য বুক ভাঁজ করছে। সাবধান! যখন এরা কাপড় দিয়ে নিজেদেরকে ঢাকে তখন তারা যা গোপন করে এবং যা প্রকাশ করে তা সবই আল্লাহ জানেন। তিনি তো অন্তরের গোপন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন।” (হূদ: ৫)
এরকম আরো অনেক আয়াত কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় পাবেন।
তৃতীয় বিষয়: সৎকর্ম ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মাঝে পার্থক্য
কুরআন বিবরণ দিয়েছে যে, সৎকর্ম তাকেই বলে, যার মধ্যে ৩টি বিষয় পূর্ণ থাকবে। কোন একটি বাদ পড়লে ঐ সৎকর্ম কিয়ামত দিবসে কোন উপকারে আসবে না। বিষয় ৩টি হচ্ছে:
প্রথম: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে শরীয়ত নিয়ে এসেছেন সৎকর্মটি তার মোতাবেক হতে হবে।1 কেননা আল্লাহ বলেন,
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
“রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তোমরা তা গ্রহণ করো। আর যা নিষেধ করেন তা থেকে তোমরা বিরত থাকো।” (হাশর: ৭) তিনি আরো বলেন,
مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ
“যে রাসূলের আনুগত্য করলো সে আল্লাহরই আনুগত্য করলো।” (নিসা: ৮০) তিনি আরো বলেন,
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي
“তুমি বলো, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো তবে আমার অনুসরণ করো।” (আল ইমরান: ৩১) আল্লাহ আরো বলেন,
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ
“এসব লোক কি আল্লাহর এমন কোন শরীককে বিশ্বাস করে, যে এদের জন্য দ্বীনের মত এমন একটি পদ্ধতি নির্ধারিত করে দিয়েছে আল্লাহ যার অনুমোদন দেননি?” (শূরা: ২১)
তিনি আরো বলেন,
آللَّهُ أَذِنَ لَكُمْ أَمْ عَلَى اللَّهِ تَفْتَرُونَ
“আল্লাহ কি তোমাদের এ সকল কর্মকাণ্ডের অনুমতি দিয়েছেন, না তোমরা আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করছো?” (ইউনুস: ৫৯)
দ্বিতীয়: কর্মটি খালেস ও একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে। কেননা আল্লাহ বলেন,
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ
“তাদেরকে তো এছাড়া আর কোন হুকুম দেয়া হয়নি যে, তারা নিজেদের দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে একনিষ্ঠভাবে তাঁরই ইবাদাত করবে।” (বাইয়্যেনাহ: ৫)
তিনি আরো বলেন,
قُلْ إِنِّي أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ وَأُمِرْتُ لِأَنْ أَكُونَ أَوَّلَ الْمُسْلِمِينَ قُلْ إِنِّي أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّي عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ قُلِ اللَّهَ أَعْبُدُ مُخْلِصًا لَهُ دِينِي فَاعْبُدُوا مَا شِئْتُمْ مِنْ دُونِهِ
(হে নবী!) এদের বলো, আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে, যেন আমি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহরই দাসত্ব করি। আমাকে এ আদেশও দেয়া হয়েছে যেন আমি সবার আগে মুসলিম বা আত্মসমর্পণকারী হই। বলো, আমি যদি আমার পালনকর্তার অবাধ্য হই, তাহলে আমি একটি ভয়ানক দিনের আশংকা করছি। বলে দাও, আমি আনুগত্যসহ একনিষ্ঠভাবে আল্লাহরই দাসত্ব করবো। (এই আদেশের পর) তোমরা তাঁকে ছাড়া আর যাদের ইচ্ছা দাসত্ব করতে থাকো।” (যুমার: ১১-১৫)
তৃতীয়: কর্মটি সহীহ আকীদার উপর ভিত্তি করে হতে হবে। কেননা কর্ম হচ্ছে ছাদের মত আর আকীদা হচ্ছে ফাউণ্ডেশন বা ভিত্তির মত।
আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ
“আর যে ব্যক্তি সৎকাজ করবে- সে নারী হোক বা পুরুষ- এবং সেই সাথে সে মুমিনও হবে।” (নিসা: ১২৪) এখানে সৎ আমল করার জন্য ‘মুমিন হবে’ শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। এই জন্য ঈমান না রেখে সৎকর্ম করলে তার পরিণতি কি হবে সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন,
وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُورًا
“আর আমি তাদের সমস্ত কৃতকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করব; অত:পর তা (ঈমান বিহীন হওয়ার কারণে বা ঈমানে শিরক মিশ্রিত থাকার কারণে) উৎক্ষিপ্ত ধূলোর মতো উড়িয়ে দেবো।” (ফুরকান: ২৩) আল্লাহ আরো বলেন,
أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“কিন্তু এ ধরণের লোকদের জন্য আখেরাতে আগুন ছাড়া আর কিছুই নেই। (সেখানে তারা জানতে পারবে) যা কিছু তারা দুনিয়ায় বানিয়েছে সব বরবাদ হয়ে গেছে এবং এখন তাদের সমস্ত কৃতকর্ম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।” (হূদ: ১৬)
চতুর্থ বিষয়: শরীয়তের আইন ছাড়া অন্য আইন দ্বারা বিচার-ফায়সালা করা:
পবিত্র কুরআন এরূপ করাকে সুস্পষ্ট কুফরী ও আল্লাহর সাথে শিরক হিসেবে গণ্য করেছে।
একদা শয়তান মক্কার কাফেরদেকে পরামর্শ দেয় যে, তারা যেন আমাদের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর নিকট প্রশ্ন রাখে, কোন ছাগল যদি মারা যায়, কে তাকে মেরেছে? তিনি বললেন, আল্লাহ তাকে মেরেছেন। তখন সে পরামর্শ দিল যে, তারা তাঁকে প্রশ্ন করবে, তাহলে তোমরা নিজ হাতে যেটা জবেহ করছো, তা হালাল মনে করছো, আর আল্লাহ যেটা জবেহ করেছেন তোমরা তা হারাম মনে করছো? তবে তো আল্লাহর চেয়ে তোমরাই উত্তম? তখন আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেন,
وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَى أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ
“আর যে পশুকে আল্লাহর নামে জবেহ করা হয়নি তার গোশত খেয়ো না। এটা অবশ্যি মহাপাপ। শয়তানরা তাদের সাথীদের অন্তরে সন্দেহ ও আপত্তির উদ্ভব ঘটায়, যাতে তারা তোমাদের সাথে ঝগড়া করতে পারে। কিন্তু যদি তোমরা তাদের আনুগত্য করো তাহলে অবশ্যি তোমরা মুশরিক হয়ে যাবে।” (আনআম: ১২১)2
এই আয়াতে (إنكم لمشركون) এর মধ্যে لام অক্ষরটি কসমের অর্থে ব্যবহার হয়েছে। এই জন্যে যে (إنكم لمشركون) বাক্যে فاء ব্যবহার হয়নি। যা শর্তের জবাব হতে পারত। অতএব এ আয়াতে আল্লাহ কসম করে বলছেন, মৃত প্রাণীকে হালাল বলার ক্ষেত্রে যারা শয়তানের অনুসরণ করবে তারা মুশরিক। এই শিরক তাকে মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে দিবে। এ ব্যাপারে মুসলিম জাতি ঐক্যমত। এ ধরণের শিরককারীদের আল্লাহ কিয়ামত দিবসে যে ভয়ানক শাস্তির ধমকী দিয়েছেন, সে সম্পর্কে তিনি বলেন,
أَلَمْ أَعْهَدْ إِلَيْكُمْ يَا بَنِي آدَمَ أَنْ لَا تَعْبُدُوا الشَّيْطَانَ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ وَأَنِ اعْبُدُونِي هَذَا صِرَاطٌ مُسْتَقِيمٌ
“হে আদম সন্তানেরা! আমি কি তোমাদের এ মর্মে অঙ্গিকার নেইনি যে, শয়তানের বন্দেগী করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। এবং আমারই বন্দেগী করো, এটিই সরল-সঠিক পথ?” (ইয়াসীন: ৬০-৬১)
ইবরাহীম খলীল (আ:) স্বীয় পিতাকে যা বলেছেন আল্লাহ তায়ালা তা উল্লেখ করে বলেন,
يَا أَبَتِ لَا تَعْبُدِ الشَّيْطَانَ
“হে আমার পিতা! আপনি শয়তানের অনুসরণ করিয়েন না।” (মারইয়াম: ৪৪) অর্থাৎ শয়তানের কুফরী ও অবাধ্যতা পূর্ণ আইনের অনুসরণ করার মাধ্যমে তার ইবাদত করবেন না।
তিনি আরো বলেন,
إِنْ يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا إِنَاثًا وَإِنْ يَدْعُونَ إِلَّا شَيْطَانًا مَرِيدًا
“তারা আল্লাহকে পরিত্যাগ করে শুধু নারীর আরাধনা করে এবং শুধু অবাধ্য শয়তানের পূজা করে।” (নিসা: ১১৭) অর্থাৎ শয়তান ছাড়া কারো গোলামী করে না। আর এটাই হল তার আইনের অনুসরণ করা।
আল্লাহ আরো বলেন,
وَكَذَلِكَ زَيَّنَ لِكَثِيرٍ مِنَ الْمُشْرِكِينَ قَتْلَ أَوْلَادِهِمْ شُرَكَاؤُهُمْ
“এমনিভাবে অনেক মুশরেকের দৃষ্টিতে তাদের উপাস্যরা সন্তান হত্যাকে সুশোভিত করে দিয়েছে, যেন তারা তাদেরকে বিনষ্ট করে দেয় এবং তাদের ধর্মমতকে তাদের কাছে বিভ্রান্ত করে দেয়।” (আনআম: ১৩৭) আল্লাহর নাফরমানী করে সন্তান হত্যার ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্যকে শিরক বলা হয়েছে।
যখন আদী বিন হাতিম (রা.) নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে এই আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন:
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ
“তারা তাদের পাদ্রী ও সাধু-সন্যাসীদেরকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে।” (তাওবা: ৩১) তখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার জবাবে বলেছেন যে, আল্লাহ যা হারাম করেছেন তাকে পাদ্রী হালাল ঘোষণা এবং আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা তাদের হারাম ঘোষণায় তাদের অনুসরণই হচ্ছে তাদেরকে রব্ব বা প্রভু হিসেবে গ্রহণ করা। (তিরমিযী, অধ্যায়: কুরআনের তাফসীর, অনুচ্ছেদ: সূরা তাওবার তাফসীর হা/৩০৯৫)
নীচের আয়াতটি সম্পর্কে তো কোন বিতর্ক নেই। দেখুন আল্লাহ কি বলেছেন,
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا
“আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তার উপর এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তার উপর তারা ঈমান এনেছে। তারাই আবার বিরোধপূর্ণ বিষয়ের সমাধানের জন্য শয়তানের কাছে যেতে চায়, অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা শয়তানকে অমান্য করবে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়।” (নিসা: ৬০)
আল্লাহ আরো বলেন,
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
“যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের।” (মায়েদা: ৪৪)
তিনি আরো বলেন,
أَفَغَيْرَ اللَّهِ أَبْتَغِي حَكَمًا وَهُوَ الَّذِي أَنْزَلَ إِلَيْكُمُ الْكِتَابَ مُفَصَّلًا وَالَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْلَمُونَ أَنَّهُ مُنَزَّلٌ مِنْ رَبِّكَ بِالْحَقِّ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِينَ
“এমতাবস্থায় আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মীমাংসাকারী (বিচারক) সন্ধান করবো? অথচ তিনি পূর্ণ বিস্তারিত বিবরণসহ তোমাদের নিকট কিতাব নাযিল করেছেন। আর যাদেরকে আমি (তোমার আগে) কিতাব দিয়েছিলাম তারা জানে এ কিতাবটি তোমার রবেরই পক্ষ থেকে সত্য সহকারে নাযিল হয়েছে। কাজেই তুমি সন্দেহ পোষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।” (আনআম: ১১৪)
আল্লাহ আরো বলেন,
وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلًا لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
“সত্যতা ও ইনসাফের দিক দিয়ে তোমার রবের কথা পূর্ণাংগ, তাঁর ফরমানসমূহ পরিবর্তন করার কেউ নেই এবং তিনি সবকিছু শুনেন ও জানেন।” (আনআম: ১১৫) “সত্যতা” বলতে উদ্দেশ্য যাবতীয় সংবাদ (অতিত-ভবিষ্যত) সবই সত্য। আর “ইনসাফ” বলতে উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিয়ম-নীতি ও আইন-কানুনগুলো ইনসাফপূর্ণ।
আল্লাহ আরো বলেন,
أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ
(যদি এরা আল্লাহর আইন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়) তাহলে কি এরা আবার সেই জাহেলিয়াত যামানার বিচার-ফায়সালা চায়? অথচ যারা আল্লাহর প্রতি ইয়াক্বীন তথা দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারী, তাদের দৃষ্টিতে আল্লাহর চাইতে ভাল বিচারক ও ফায়সালাকারী আর কেউ নেই।” (মায়েদা: ৫০)
পঞ্চম বিষয়: সামাজিক অবস্থা
এ বিষয়েও কুরআন সকল পিপাসা নিবারণ করে দিয়েছে। সব পথকে আলোকিত করে রেখেছে।
দেখুন! সবচেয়ে বড় নেতা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে আল্লাহ সমাজের লোকদের সাথে কিরূপ আচরণের হুকুম দিয়েছেন:
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
“এবং তোমার অনুসারী মু’মিনদের সাথে বিনম্র ব্যবহার করো।” (শুআরা: ২১৫)
তিনি আরো বলেন,
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ
“(হে নবী!) এটা আল্লাহর বড়ই অনুগ্রহ যে, তোমার ব্যবহার তাদের প্রতি বড়ই কোমল। নয়তো যদি তুমি রুক্ষ স্বভাবের বা কঠোর চিত্ত হতে, তাহলে তারা সবাই তোমার চার পাশ থেকে সরে যেতো। তাদের ত্রুটি ক্ষমা করে দাও। তাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করো এবং দ্বীনের ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করো।” (আল ইমরান: ১৫৯)
আর দেখুন! সমাজের লোকেরা নেতার সাথে আচরণ কেমন হবে সে সম্পর্কে আল্লাহ কী আদেশ করছেন?
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
“হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রসূলের, আর সেই সব লোকের যারা তোমাদের মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী।” (নিসা: ৫৯)
দেখুন! এমনকি একজন মানুষ তার পরিবারের সাথে কি আচরণ করবে তার নির্দেশও কুরআন দিয়েছে। আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং নিজেদের পরিবার ও সন্তান-সন্ততিকে সেই আগুন থেকে রক্ষা করো যার জ্বালানী হবে মানুষ এবং পাথর। সেখানে রূঢ় স্বভাব ও কঠোর হৃদয় ফেরেশতারা নিয়োজিত থাকবে, যারা কখনো আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে না এবং তাদেরকে যে নির্দেশ দেয়া হয় তাই পালন করে।” (তাহরীম: ৬)
আরো দেখুন! মানুষকে তার পরিবারের বিষয়ে কিরূপ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। আর আদেশ করা হয়েছে যে তাদের দ্বারা অনুচিত কাজ হয়ে গেলে তাদেরকে ক্ষমা করে দিতে। প্রথমে তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে, পরে আবার ক্ষমা করে দিতে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ وَأَوْلَادِكُمْ عَدُوًّا لَكُمْ فَاحْذَرُوهُمْ وَإِنْ تَعْفُوا وَتَصْفَحُوا وَتَغْفِرُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
“হে সেই সব লোক যারা (আল্লাহ ও রাসূলের উপর) ঈমান এনেছো, তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাক। আর যদি তোমরা ক্ষমা ও সহনশীলতার আচরণ করো এবং ক্ষমা করে দাও তাহলে আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, অতীব দয়ালু।” (তাগাবুন: ১৪)
আবার দেখুন! সমাজের সাধারণ জনগণকে পরস্পরের মাঝে কী ধরণের আচরণ করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
“আল্লাহ তোমাদেরকে ন্যায়-নীতি, পরোপকার ও আত্মীয়-স্বজনদেরকে দান করার হুকুম দেন এবং অশ্লীল-নির্লজ্জতা ও দুষ্কৃতি এবং অত্যাচার-বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষালাভ করতে পারো।” (নাহাল: ৯০)
তিনি আরো বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا
“হে ঈমানদারগণ, মানুষের প্রতি বেশী বেশী কুধারণা ও খারাপ অনুমান করা থেকে বিরত থাকো, কারণ কোন কোন ধারণা ও অনুমান গোনাহ। দোষ অন্বেষণ করো না। আর তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত (অসাক্ষাতে সমালোচনা) না করে।” (হুজুরাত: ১২)
তিনি আরো বলেন,
لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَى أَنْ يَكُونُوا خَيْرًا مِنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِنْ نِسَاءٍ عَسَى أَنْ يَكُنَّ خَيْرًا مِنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوا أَنْفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
“হে ঈমানদারগণ, পুরুষরা যেন অন্য পুরুষদের উপহাস-বিদ্রূপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। আর মহিলারাও যেন অন্য মহিলাদের উপহাস-বিদ্রূপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং পরস্পরকে খারাপ নামে (বা নাম বিগড়িয়ে) ডেকো না। ঈমান গ্রহণের পর মন্দ নামে ডাকাটা অত্যন্ত জঘন্য ব্যাপার। যারা এ আচরণ পরিত্যাগ করেনি তারাই জালেম।” (হুজুরাত: ১১)
তিনি আরো বলেন,
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ
“নেকী ও আল্লাহভীতির সমস্ত কাজে সবার সাথে সহযোগিতা করো এবং গুনাহ ও সীমালংঘনের কাজে কাউকে সহযোগিতা করো না।” (মায়েদা: ২)
আল্লাহ আরো বলেন,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
“মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই। (হুজুরাত: ১০)
আল্লাহ আরো বলেন,
وَأَمْرُهُمْ شُورَى بَيْنَهُمْ
“এবং তারা নিজেদের সব কাজ পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে চালায়।” (শুরা: ৩৮)
এ ছাড়া আরো অসংখ্য আয়াত আছে।
সমাজের মানুষ সবাই কিন্তু একরকম নয়। মানুষ যেই হোক না কেন তার বিরোধী বা শত্রু জিন থেকে হোক বা মানুষ থেকে হোক থাকবেই। কেউ নিরাপদ নয়।
বিরোধী থেকে মুক্ত নয় কোন মানুষ, যদিও সে পাহাড়ের চুঁড়ায় গিয়ে বসবাস করে।
কিন্তু সকলেই আবার এই সমস্যার সমাধানও চায়। সমস্যাটি সমাজের সর্বক্ষেত্রে পরিলক্ষিত। এর সমাধানে মহান আল্লাহ তিনটি স্থানে আলোচনা করেছেন। বলেছেন যে বিরোধীতাকারী মানুষের অনিষ্ট থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে, তার দুর্ব্যবহারকে উপেক্ষা করা এবং বিনিময়ে তার সাথে ভালো আচরণ উপহার দেয়া। আর জিন শয়তানের শত্রুতা থেকে সমাধানের একটিই উপায়, তা হচ্ছে: তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় কামনা করা।
তিনটি স্থানের ১মটি হচ্ছে: মানুষের ব্যাপারে সূরা আরাফের শেষের দিকে আল্লাহ বলেন,
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ
“হে নবী! কোমলতা ও ক্ষমার পথ অবলম্বন করো। সৎকাজের উপদেশ দিতে থাকো এবং মূর্খদের সাথে বিতর্কে জড়িও না।” (আরাফ: ১৯৯)
আর জিন শয়তানের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন,
وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
“আর যদি কখনো শয়তান তোমাকে প্ররোচিত বা উত্তেজিত করে, তাহলে আল্লাহর শরণাপন্ন হও এবং তাঁর কাছে আশ্রয় চাও। নিশ্চয় তিনি সবকিছু শোনেন ও জানেন।” (আরাফ: ২০০)
২য় স্থান: সূরা মুমিনূনে মানুষের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন,
ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَصِفُونَ
“[হে মুহাম্মাদ!] মন্দকে প্রতিহত করো সর্বোত্তম আচরণ দ্বারা। তারা তোমার সম্পর্কে যেসব কথা বলে তা আমি খুব ভালো করেই জানি।” (মুমিনূন: ৯৬)
আর পরক্ষণেই জিনদের শত্রুতার ব্যাপারে আল্লাহ বলেন,
وَقُلْ رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَعُوذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَحْضُرُونِ
“আর আল্লাহর কাছে দুয়া করো, “হে আমার রব! আমি শয়তানদের উস্কানি ও প্ররোচনা থেকে তোমার আশ্রয় চাই। এবং হে পরওয়ারদিগার, তারা আমার কাছে আসুক এ থেকেও আমি তোমার আশ্রয় চাই।” (মুমিনূন: ৯৭-৯৮)
৩য় স্থান: সূরা ফুসসিলাতে আল্লাহ আরো বেশী কথা বলে এমন সমাধান প্রদান করেছেন যে, আসমানী এই সমাধান গ্রহণ করলে শয়তানী এই সমস্যা সমূলেই বিনাশ হয়ে যাবে। শত্রুতা সমাজ থেকে বিদায় নিবে এবং সবাই সংশোধন হয়ে যাবে। আর একথাও এখানে বলা হয়েছে যে, আসমানী এই সমাধান সব মানুষই পায় না। যারা পরম সৌভাগ্যের অধিকারী তারা ছাড়া কেউ তা হাসিল করতে পারে না।
মানুষের সাথে বিরোধ মিমাংসার জন্য আল্লাহ বলেন,
وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ
“তুমি অসৎ আচরণকে সেই ব্যবহার দ্বারা প্রতিহত করো যা সবচেয়ে ভাল। তাহলে দেখবে যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল সে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গিয়েছে। ধৈর্য্যশীল ছাড়া এ গুণ আর কারো ভাগ্যে জোটে না। এবং অতি ভাগ্যবান ছাড়া এ মর্যাদা আর কেউ লাভ করতে পারে না।” (সূরা হা-মীম সাজদাহ: ৩৪-৩৫)
পরক্ষণেই জিন শত্রু
থেকে সমাধানের জন্য বলা হয়েছে,
وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
“আর যদি শয়তানের পক্ষ থেকে আপনি কোন প্ররোচনা বা কুমন্ত্রণা অনুভব করেন, তবে আল্লাহর শরণাপন্ন হোন- তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।” (সূরা ফুসসিলাত: ৩৬)
অন্য স্থানে বলেছেন যে, ঐ কোমলতা ও বিনয় শুধুই মুসলিমদের জন্য- কাফেরদের জন্য নয়। তিনি বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি দ্বীন থেকে ফিরে যায়, (তাহলে ফিরে যাক), আল্লাহ এমনিতর আরো বহু লোক সৃষ্টি করে দেবেন, যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসবেন এবং তারাও আল্লাহকে ভালোবাসবে, যারা মুমিনদের ব্যাপারে হবে কোমল ও বিনম্র এবং কাফেরদের ব্যাপারে হবে কঠোর।” (মায়েদা: ৫৪)
আল্লাহ মুমিনদের আরো পরিচয় উল্লেখ করে বলেন,
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ
“মুহাম্মাদ আল্লাহর রসূল। আর যারা তাঁর সাথে আছে তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর ও আপোষহীন এবং পরস্পর দয়া পরবশ।” (ফাতাহ: ২৯)
আল্লাহ আরো বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ
“হে নবী! পূর্ণ শক্তি দিয়ে কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করো ও মুনাফিকদের মোকাবিল করো এবং তাদের প্রতি কঠোর হও।” (তাওবা: ৭৩, তাহরীম: ৯)
নম্রতার স্থানে কঠোরতা করলে তা হবে নির্বুদ্ধিতা ও বোকামী। আর কঠোরতার জায়গায় নম্রতা দেখালে তা হবে দূর্বলতা ও ব্যক্তিত্বহীনতা।
যদি বলা হয় ধৈর্য, বলুন আছে ক্ষেত্র ধৈর্যের,
অপাত্রে ধৈর্য পরিচয় জাহেলের।
ষষ্ঠ বিষয়: অর্থনীতি
কুরআন সফল অর্থনীতির মূলনীতির বিবরণ দিয়েছে। যার উপর ভিত্তি করে অর্থনীতির সকল শাখা-প্রশাখায় বিচরণ করা সম্ভব। অর্থনীতির বিষয়গুলো দুটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত:
প্রথম: সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে সঠিক পন্থা অলম্বন।
দ্বিতীয়: সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সঠিক পন্থায় সঠিক খাত অলম্বন।
দেখুন কিভাবে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে মানুষের দ্বীন ও ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্য হয় এমন উপযুক্ত নিয়মে সম্পদ উপার্জনের রাস্তা উন্মুক্ত করেছেন এবং তা আলোকিত করেছেন। তিনি বলেন,
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“তারপর যখন নামায শেষ হয়ে যায় তখন ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তথা রিযিক অনুসন্ধান করো। আর অধিক মাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।” (জুমআ: ১০)
তিনি আরো বলেন,
وَآخَرُونَ يَضْرِبُونَ فِي الْأَرْضِ يَبْتَغُونَ مِنْ فَضْلِ اللَّهِ
“কিছু লোক আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে (হালাল ও বৈধ উপায়ে রুজি অর্জনের উদ্দেশে) ভ্রমণরত থাকে।” (মুযাম্মেল: ২০)
আল্লাহ আরো বলেন,
لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَبْتَغُوا فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ
“(আর হজ্জের কার্যাদী চালিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে) তোমরা যদি তোমাদের রবের অনুগ্রহ (ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে রিযিক) অনুসন্ধান করতে থাকো তাহলে তাতে কোন দোষ নেই।” (বাকারা: ১৯৮) (কেননা একজন আল্লাহ বিশ্বাসী ব্যক্তি যখন আল্লাহর আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে নিজেদের অর্থ উপার্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালায় তখন আসলে সে আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করে।)
সূরা নিসায় আল্লাহ বলেন,
إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ
“লেনদেন হতে হবে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে।” (নিসা: ২৯)
আল্লাহ আরো বলেন,
وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ
“আর আল্লাহ ব্যবসা হালাল করেছেন।” (বাকারা: ২৭৫)
তিনি আরো বলেন,
فَكُلُوا مِمَّا غَنِمْتُمْ حَلَالًا طَيِّبًا
“কাজেই তোমরা গণীমত (যুদ্ধলব্ধ) হিসেবে যা কিছু সম্পদ লাভ করেছো তা খাও, কেননা তা হালাল ও পাক-পবিত্র।” (আনফাল: ৬৯)
আবার দেখুন! সম্পদ ব্যয়ের কি সুন্দর নির্দেশনা দিয়ে অর্থনীতিকে মজবুত করা হয়েছে! আল্লাহ বলেন,
وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ
(অর্থ খরচের জন্য) নিজের হাত গলায় বেঁধে রেখো না (কৃপণ হয়ো না) এবং তাকে একেবারে খোলাও ছেড়ে দিয়ো না (অপব্যায় করো না)। (বানী ইসরাঈল: ২৯)
আল্লাহ প্রকৃত মুমিনদের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে বলেন,
وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا
“তারা যখন ব্যয় করে তখন অযথা ব্যয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না বরং উভয় প্রান্তিকের মাঝামাঝি তাদের ব্যয় ভারসাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে।” (ফুরক্বান: ৬৭)
তিনি আরো বলেন,
وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ
“আর তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, কী তারা ব্যয় করবে? বলে দাও, নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর যা বাঁচে তাই খরচ করবে।” (বাকারা: ২১৯)
আবার দেখুন! অবৈধ ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয় করার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আল্লাহ এরশাদ করছেন,
فَسَيُنْفِقُونَهَا ثُمَّ تَكُونُ عَلَيْهِمْ حَسْرَةً ثُمَّ يُغْلَبُونَ
“বস্তুতঃ এখন তারা (আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে ফেরানোর জন্য) অর্থ ব্যয় করবে। অত:পর এই অর্থ ব্যয় তাদের জন্য আক্ষেপের কারণ হয়ে এবং শেষ পরিণামে তারা পরাজিত হবে।” (আনফাল: ৩৬)
ষষ্ঠ বিষয়: রাজনীতি
কুরআন রাজনীতির মূলনীতি বিবৃত করেছে, তার নিয়ম-কানুন প্রকাশ করেছে এবং রাজনীতির সকল পথ সুস্পষ্ট করেছে।
রাজনীতি হচ্ছে, মানুষের কর্মকাণ্ডকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার পদ্ধতির নাম। এটা দু’ভাগে বিভক্ত: আভ্যন্তরীন ও বাইরের।
বাইরের রাজনীতি দু’টি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত:
প্রথমটি: শত্রুর মূলোৎপাটন ও তাকে পরাজিত করার জন্য উপযুক্ত শক্তি সঞ্চয় করা। আল্লাহ বলেন,
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ
“আর তোমরা নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী সর্বাধিক পরিমাণ শক্তি ও সদাপ্রস্তুত ঘোড়া তাদের মোকাবিলার জন্য যোগাড় করে রাখো। এর মাধ্যমে তোমরা ভীতসন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুকে ও তোমাদের নিজেদের শত্রুকে।” (আনফাল: ৬০)
দ্বিতীয়টি: ঐ শক্তিকে ঘিরে মজবুত ঐক্য গড়ে তোলা। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
“তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর এবং দলে দলে বিভক্ত হয়ো না।” (আল ইমরান: ১০৩) তিনি আরো বলেন,
وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ
“তোমরা পরস্পর ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তাহলে তোমরা ব্যর্থ হয়ে যাবে- তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেবে এবং তোমাদের শক্তি ও প্রতিপত্তি নষ্ট হয়ে যাবে।” (আনফাল: ৪৬)
কুরআন নিয়ম ব্যক্ত করেছে যে, এই রাজনীতি রক্ষা করার জন্য কি কি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে সন্ধি ও চুক্তি করতে হবে এবং তা মেনে চলতে হবে। আবার দরকার পড়লে শত্রুদের মুখের উপর চুক্তিপত্র ছিঁড়েও ফেলতে হবে।
আল্লাহ বলেন,
فَأَتِمُّوا إِلَيْهِمْ عَهْدَهُمْ إِلَى مُدَّتِهِمْ
“এ ধরণের লোকদের সাথে তোমরাও নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পালন করবে।” (তাওবা: ৪) তিনি আরো বলেন,
فَمَا اسْتَقَامُوا لَكُمْ فَاسْتَقِيمُوا لَهُمْ
“যতক্ষণ তারা তোমাদের জন্য সোজা-সরল থাকে ততক্ষণ তোমরাও তাদের জন্য সোজা-সরল থাকো।” (তাওবা: ৭)
আল্লাহ আরো বলেন,
وَإِمَّا تَخَافَنَّ مِنْ قَوْمٍ خِيَانَةً فَانْبِذْ إِلَيْهِمْ عَلَى سَوَاءٍ
“আর যদি কখনো কোন জাতির পক্ষ থেকে তোমাদের খেয়ানতের (চুক্তি ভঙ্গের) আশঙ্কা থাকে, তাহলে তার চুক্তি প্রকাশ্যে তার সামনে ছুড়ে দাও।” (আনফাল: ৫৮)
তিনি আরো বলেন,
وَأَذَانٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ أَنَّ اللَّهَ بَرِيءٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ وَرَسُولُهُ
“আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে বড় হজ্জের দিনে সমস্ত মানুষের প্রতি সাধারণ ঘোষণা হচ্ছেঃ “আল্লাহ এবং তাঁর রসূল মুশরিকদের থেকে দায়িত্বমুক্ত।” (তাওবা: ৩) অর্থাৎ তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দিচ্ছেন।
কুরআন আরো হুকুম দিচ্ছে যে, শত্রুদের ষড়যন্ত্র ও কুটচাল থেকে সতর্ক থাকতে হবে। তাদেরকে কোন প্রকার সুযোগ না দেয়া যাবে না। আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا خُذُوا حِذْرَكُمْ
“হে ঈমানদারগণ! শত্রুর ষড়যন্ত্র ও আক্রমণ থেকে সবসময় সতর্ক ও প্রস্তুত থাকো।” (নিসা: ৭১)
তিনি আরো বলেন,
وَلْيَأْخُذُوا حِذْرَهُمْ وَأَسْلِحَتَهُمْ وَدَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ تَغْفُلُونَ عَنْ أَسْلِحَتِكُمْ
“আর তারাও সতর্ক থাকবে এবং নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র বহন করবে। কারণ কাফেররা সুযোগের অপেক্ষায় আছে, তোমরা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্রের দিক থেকে সামান্য গাফেল হলেই তারা তোমাদের ওপর আকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়বে।” (নিসা: ১০২)
এরূপ আয়াত আরো অনেক রয়েছে।
আভ্যন্তরীণ রাজনীতি: এর মূল পয়েন্ট হচ্ছে সমাজের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অন্যায় প্রতিহত করা এবং অধিকার সমূহ ন্যায্য পাওনাদারের কাছে প্রত্যার্পণ করা।
আভ্যন্তরীণ রাজনীতি যে ৬টি বড় মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত তা হচ্ছে,
প্রথমত: দ্বীন বা ধর্মকে হেফাজত করা। ইসলামী শরীয়ত দ্বীনকে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করতে তাগিদ দিয়েছে। এই জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ”যে মুসলিম তার দ্বীনকে পরিবর্তন করবে, তাকে তোমরা হত্যা কর।”3এই আইনের উদ্দেশ্য, দ্বীনকে ইচ্ছামত পরিবর্তন ও তা নিয়ে খেলা করার পথ চুড়ান্তভাবে রোধ করা।
দ্বিতীয়ত: জীবন রক্ষা করা। এই কারণে আল্লাহ মানুষের জীবন রক্ষার উদ্দেশ্যেই কিসাস তথা হত্যার বদলে হত্যার বিধান চালু করেছেন। তিনি বলেন,
وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ
“কিসাসের মধ্যে আছে তোমাদের জন্য জীবন।” (বাকারা: ১৭৯) তিনি বলেন,
كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاصُ فِي الْقَتْلَى
“কাউকে বিনা কারণে হত্যা করা হলে তার কিসাস নেয়ার বিধান আল্লাহ তোমাদের উপর আবশ্যক করে দিয়েছেন।” (বানী ইসরাঈল: ৩৩)
তিনি আরো বলেন,
وَمَنْ قُتِلَ مَظْلُومًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِيِّهِ سُلْطَانًا
“আর যে ব্যক্তি মজলুম অবস্থায় তথা বিনা কারণে নিহত হয়েছে তার অভিভাবককে আমি কিসাস দাবী করার অধিকার দান করেছি।” (বানী ইসারঈল: ৩৩)
তৃতীয়ত: আকল বা বিবেক রক্ষা। মানুষের বিবেক রক্ষা করার তাগিদ দিয়েছে পবিত্র কুরআন। আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শরসমূহ এ সমস্তই হচ্ছে ঘৃণ্য শয়তানী কার্যকলাপ। এগুলো থেকে তোমরা দূরে থাকো, আশা করা যায় তোমরা সফলতা লাভ করবে।” (মায়েদা: ৯০) কেননা এগুলো- বিশেষ করে মদ-জুয়া মানুষের বিবেক লোপ করে দেয়।
হাদীছে এসেছে: “নেশা জাতীয় সকল দ্রব্য হারাম। যে বস্তু বেশী পরিমাণ সেবন করলে নেশা হয়, তার অল্পও হারাম।”4
আর মানুষের বিবেককে রক্ষার স্বার্থেই মদপানকারীকে দণ্ডিত করার আইন করা হয়েছে।
চতুর্থত: বংশ রক্ষা। বংশের ধারাকে সংরক্ষণ করার জন্য আল্লাহ ব্যভিচারের দণ্ড প্রণয়ন করেছেন। তিনি এরশাদ করেন,
الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ
“ব্যভিচারী নারী হোক বা পুরুষ, প্রত্যেককে একশত করে বেত্রাঘাত করো।” (নূর: ২)
পঞ্চমত: মান-ইজ্জত রক্ষা। মানুষের মান-সম্মানকে রক্ষা করার জন্য অপবাদ প্রদানকারীকে আশি বার বেত্রাঘাত করার হুকুম দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِينَ يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَأْتُوا بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاءَ فَاجْلِدُوهُمْ ثَمَانِينَ جَلْدَةً
“আর যারা সতী-সাধ্বী নারীর ওপর অপবাদ লাগায়, তারপর চারজন সাক্ষী না আনতে পারে, তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত করো।” (নূর: ৪)
ষষ্ঠত: সম্পদ। ধন-সম্পদের সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই আল্লাহ চোরের হাত কাটার আইন করেছেন। আল্লাহ বলেন,
وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا جَزَاءً بِمَا كَسَبَا نَكَالًا مِنَ اللَّهِ
“চোর- পুরুষ বা নারী যেই হোক না কেন, উভয়ের হাত কেটে দাও। এটা তাদের কর্মফল এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।” (মায়েদা: ৩৮)
অতএব সুস্পষ্ট হলো যে, কুরআনের অনুসরণই মানুষের আভ্যন্তরীন ও বাইরের সকল স্বার্থ ও কল্যাণকে নিশ্চিত করার জিম্মাদার।
অষ্টম বিষয়: মুসলিমদের উপর কাফেরদের বিজয় বা কর্তৃত্ব:
মুসলিমদের উপর কাফেরদের কর্তৃত্বের বিষয়টি অনেক পুরাতন। সাহাবায়ে কেরাম বিষয়টিকে খুবই কষ্টকর মনে করেছেন; অথচ তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদের মাঝেই বিদ্যমান ছিলেন। এই সমস্যায় আল্লাহ নিজেই আসমান থেকে এমন ফতোয়া পাঠিয়েছেন, যার মাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর মিলে গেছে। উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের উপর কঠিন বিপদ নেমে এসেছিল। ফলে সাহাবীগণ ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, কিভাবে মুশরিকরা আমাদের উপর এভাবে চড়াও হতে পারে এবং আমাদের উপর বিজয় লাভ করতে পারে; অথচ আমরা হকপন্থী আর তারা বাতিল পন্থী?5 মহান আল্লাহ তাদের এই প্রশ্নের জবাব দিয়ে আয়াত নাযিল করে বলেন,
أَوَلَمَّا أَصَابَتْكُمْ مُصِيبَةٌ قَدْ أَصَبْتُمْ مِثْلَيْهَا قُلْتُمْ أَنَّى هَذَا قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِكُمْ
“তোমাদের ওপর যখন বিপদ এসে পড়লো তোমরা বলতে লাগলে, এ আবার কোথা থেকে এলো? তোমাদের এ অবস্থা কেন? অথচ (বদরের যুদ্ধে) এর দ্বিগুণ বিপদ তোমাদের মাধ্যমে তোমাদের বিরোধী পক্ষের ওপর পড়েছিল। হে নবী! ওদের বলে দাও, তোমরা নিজেরাই এ বিপদ ডেকে এনেছো। (তোমরা রাসূলের আদেশ লঙ্ঘণ করে গণীমত আহরণ চলে গেছিলে)।” (আল ইমরান: ১৬৫)
“তোমরা নিজেরাই এ বিপদ ডেকে এনেছো।” একথার ব্যাখ্যা অন্য আয়াতে আল্লাহ এভাবে দিয়েছেন:
وَلَقَدْ صَدَقَكُمُ اللَّهُ وَعْدَهُ إِذْ تَحُسُّونَهُمْ بِإِذْنِهِ حَتَّى إِذَا فَشِلْتُمْ وَتَنَازَعْتُمْ فِي الْأَمْرِ وَعَصَيْتُمْ مِنْ بَعْدِ مَا أَرَاكُمْ مَا تُحِبُّونَ مِنْكُمْ مَنْ يُرِيدُ الدُّنْيَا وَمِنْكُمْ مَنْ يُرِيدُ الْآخِرَةَ ثُمَّ صَرَفَكُمْ عَنْهُمْ لِيَبْتَلِيَكُمْ
“আল্লাহ তোমাদের কাছে (সাহায্য ও সমর্থনদানের) যে ওয়াদা করেছিলেন, তা পূর্ণ করেছেন। শুরুতে তাঁর হুকুমে তোমরাই তাদেরকে হত্যা করেছিলে। কিন্তু যখন তোমরা দুর্বলতা দেখালে এবং নিজেদের কাজে পারস্পরিক মতবিরোধে লিপ্ত হলে আর যখনই আল্লাহ তোমাদের সেই জিনিস দেখালেন যার প্রতি তোমাদের ভালোবাসা ছিল (অর্থাৎ গনীমতের মাল), তখন তোমরা নিজেদের নেতার হুকুম অমান্য করে বসলে, কারণ তোমাদের কিছু লোক ছিল দুনিয়ার প্রত্যাশী আর কিছু লোকের কাম্য ছিল আখেরাত, তখনই আল্লাহ কাফেরদের মোকাবিলায় তোমাদেরকে পিছিয়ে দিলেন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। (আল ইমরান: ১৫২)
অতএব আসমানী এই ফতোয়া দ্বারা পরিস্কার হয়ে গেল যে, তাঁদের উপর কাফেরদের বিজয় লাভের মূল কারণ ছিল তারা নিজেরাই। আর তা হচ্ছে, নবীজীর নির্দেশ বুঝতে ব্যর্থতা ও মতানৈক্য। কিছু লোকের রাসূলের নির্দেশ লঙ্ঘণ এবং দুনিয়ার প্রতি লোভ। বিষয়টা এরকম ছিল যে জাবালে রুমাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদল তীরন্দাজ নিয়োগ করেছিলেন। যাতে করে কাফেররা পিছন দিক থেকে মুসলিমদের উপর আতর্কিত হামলা করতে না পারে। কিন্তু মুসলিমদের প্রাথমিক আক্রমণে মুশরিকরা পরাজিত হয়ে পালাচ্ছিল। তা দেখে তীরন্দাজদের অনেকে ভেবেছিল যুদ্ধে তাদের জয় এসে গেছে, তাই নেতার আদেশ অমান্য করে গণীমত আহোরণের লোভে তারা পাহাড় ছেড়ে নেমে পড়ে। অর্থাৎ দুনিয়ার সম্পদের মোহে তারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) নির্দেশকে লঙ্ঘণ করে।6
নবম বিষয়: কাফেরদের তুলনায় মুসলিমদের সার্বিক দূর্বলতা- জনবল ও রসদ সামগ্রীর স্বল্পতা
এই সমস্যার সমাধানও আল্লাহ তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন যে, তিনি যদি বান্দাদের অন্তরের মধ্যে যথাযথ ইখলাস ও একনিষ্ঠতা দেখতে পান, তবে সেই একনিষ্ঠতার প্রতিফল হবে তাদের চেয়ে শক্তিশালীদের পরাজিত করা ও তাদের উপর বিজয় লাভ। এই জন্যে হুদায়বিয়ার প্রান্তরে বাইয়াতে রিযওয়ানে আল্লাহ যখন সাহাবীদের অন্তরে ইখলাসের উপস্থিতি যথাযথ দেখতে পেলেন, তাদের ঐ ইখলাসকে ইঙ্গিত করে তিনি এরশাদ করেন,
لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ
“আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন ঐ মুমিনদের প্রতি যারা তোমার হাতে হাত রেখে বৃক্ষের নীচে বাইয়াত করেছে। তাদের অন্তরে কি আছে তিনি তা জেনেছেন।” (সূরা ফাতাহ: ১৮) তখন এই ইখলাসের প্রতিফল ঘোষণা দিলেন যে, যে কাজে সফল হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, অচিরেই তারা তা করতে সক্ষম হবে। তিনি বললেন,
وَأُخْرَى لَمْ تَقْدِرُوا عَلَيْهَا قَدْ أَحَاطَ اللَّهُ بِهَا
“এছাড়া তিনি তোমাদেরকে আরো গনীমতের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, যা তোমরা এখনো পর্যন্ত লাভ করতে পারনি। কিন্তু আল্লাহ তা পরিবেষ্টন করে রেখেছেন।” (ফাতাহ: ২১) তিনি বিবৃত করেছেন যে তারা তা লাভ করতে সক্ষম ছিল না। আল্লাহ সেটা তাঁর কাছে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন, এই জন্যে যে তিনি তাদের অন্তরে ইখলাস জেনেছেন। এই কারণে আহযাব (বা খন্দকের) যুদ্ধে কাফেররা যখন বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে মুসলিমদের ঘেরাও করেছিল, তখন মুসলিমদের মনের অবস্থা কি হয়েছিল সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
إِذْ جَاءَتْكُمْ جُنُودٌ فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا وَجُنُودًا لَمْ تَرَوْهَا وَكَانَ اللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرًا إِذْ جَاءُوكُمْ مِنْ فَوْقِكُمْ وَمِنْ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَإِذْ زَاغَتِ الْأَبْصَارُ وَبَلَغَتِ الْقُلُوبُ الْحَنَاجِرَ وَتَظُنُّونَ بِاللَّهِ الظُّنُونَا هُنَالِكَ ابْتُلِيَ الْمُؤْمِنُونَ وَزُلْزِلُوا زِلْزَالًا شَدِيدًا
“যখন তারা ওপর ও নিচে থেকে তোমাদের ওপর চড়াও হলো, যখন ভয়ে চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গিয়েছিল, প্রাণ হয়ে পড়েছিল ওষ্ঠাগত এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা প্রকার ধারণা পোষণ করতে শুরু করেছিলে। তখন মু’মিনদেরকে নিদারুণ পরীক্ষা করা হলো এবং ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয়া হলো।” (আহযাব: ১০, ১১)
কিন্তু যেহেতু তাদের অন্তরে ছিল ইখলাস তথা আল্লাহকে পাওয়ার উদগ্র বাসনা এবং ঈমানী দৃঢ়তা, তাই শত্রুকে সামনে দেখে ঘাবড়ে না গিয়ে তারা যা বলল সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
وَلَمَّا رَأَى الْمُؤْمِنُونَ الْأَحْزَابَ قَالُوا هَذَا مَا وَعَدَنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَصَدَقَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَمَا زَادَهُمْ إِلَّا إِيمَانًا وَتَسْلِيمًا
“আর সাচ্চা মু’মিনদের অবস্থা সে সময় এমন ছিল, যখন আক্রমণকারী সেনাদলকে দেখলো তারা চিৎকার করে উঠলো, “এতো সেই জিনিসই যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ ও তাঁর রসূল আমাদের দিয়েছিলেন, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কথা পুরোপুরি সত্য ছিল।” এ ঘটনা (শত্রুদের উপস্থিতি) তাদের ঈমানকে আরো দৃঢ় করে দিল এবং আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকে আরো বেশী বাড়িয়ে দিল।” (আহযাব: ২২)
এবার তাদের এই ইখলাস বা একনিষ্ঠতা ও দৃঢ় ঈমানের ফল কি হল তা ঘোষণা করে আল্লাহ এরশাদ করেন,
وَرَدَّ اللَّهُ الَّذِينَ كَفَرُوا بِغَيْظِهِمْ لَمْ يَنَالُوا خَيْرًا وَكَفَى اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ الْقِتَالَ وَكَانَ اللَّهُ قَوِيًّا عَزِيزًا (25) وَأَنْزَلَ الَّذِينَ ظَاهَرُوهُمْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ مِنْ صَيَاصِيهِمْ وَقَذَفَ فِي قُلُوبِهِمُ الرُّعْبَ فَرِيقًا تَقْتُلُونَ وَتَأْسِرُونَ فَرِيقًا (26) وَأَوْرَثَكُمْ أَرْضَهُمْ وَدِيَارَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ وَأَرْضًا لَمْ تَطَئُوهَا وَكَانَ اللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرًا
“আল্লাহ কাফেরদের মুখ ফিরিয়ে দিয়েছেন, তারা বিফল হয়ে নিজেদের অন্তর্জ্বালা সহকারে এমনিই ফিরে গেছে এবং মু’মিনদের পক্ষ থেকে লড়াই করার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে গেছেন। আল্লাহ বড়ই শক্তিশালী ও পরাক্রান্ত। তারপর আহলি কিতাবদের মধ্য থেকে যারাই এর আক্রমণকারীদের সাথে সহযোগিতা করেছিল। তাদের দুর্গ থেকে আল্লাহ তাদেরকে নামিয়ে এনেছেন এবং তাদের অন্তরে তিনি এমন ভীতি সঞ্চার করেছেন যার ফলে আজ তাদের একটি দলকে তোমরা হত্যা করছো এবং অন্য একটি দলকে করছো বন্দী। তিনি তোমাদেরকে তাদের জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পদের ওয়ারিস করে দিয়েছেন এবং এমন এলাকা তোমাদের দিয়েছেন যাকে তোমরা কখনো পদানত করতে সক্ষম হওনি। আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতা সম্পন্ন।” (আহযাব: ২৫-২৭)
আল্লাহ এই যুদ্ধে কিভাবে তাদেরকে সাহায্য করেছেন, তা তাদের ধারণাতেই ছিল না। আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতা এবং ঝড় প্রেরণ করে কাফেরদের পরাজিত করেছেন এবং মুসলিমদের বিজয় দান করেছেন। আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ جَاءَتْكُمْ جُنُودٌ فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا وَجُنُودًا لَمْ تَرَوْهَا
“হে ঈমানদারগণ স্মরণ করো আল্লাহর অনুগ্রহ, যা (এই মাত্র) তিনি করলেন তোমাদের প্রতি, যখন কাফের সেনাদল তোমাদের ওপর চড়াও হলো, তখন আমি পাঠালাম তাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ধুলিঝড় এবং রওয়ানা করলাম এমন সেনাবাহিনী (ফেরেশতা) যা তোমরা চোখে দেখোনি।” (আহযাব: ৯)
এই কারণে দ্বীন ইসলামের সত্যতার একটি উজ্জল প্রমাণ হচ্ছে, ঈমান-ইখলাসে সুদৃঢ় মুসলিমদের একটি ছোট্ট দূর্বল দল, কাফেরদের বিশাল শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করে। যা বাস্তবতার নিরিখে কখনই সম্ভব নয়। আল্লাহ বলেন,
كَمْ مِنْ فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ
“অনেক বারই দেখা গেছে, স্বল্প সংখ্যক লোকের একটি দল আল্লাহর হুকুমে একটি বিরাট দলের ওপর বিজয় লাভ করেছে। আর আল্লাহ সবরকারীদের সাথে থাকেন তাদেরকে সাহায্য করেন।” (বাকারা: ২৪৯)
এই জন্য বদর যুদ্ধের ঘটনাটিকে আল্লাহ “নিদর্শন” “প্রমাণ” এবং “পার্থক্যকারী” এরূপ বিভিন্ন নামে আখ্যা দিয়েছেন। যাতে প্রমাণ হয় যে ইসলাম ধর্ম সত্য ও সঠিক। তিনি বলেন,
قَدْ كَانَ لَكُمْ آيَةٌ فِي فِئَتَيْنِ الْتَقَتَا فِئَةٌ تُقَاتِلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَأُخْرَى كَافِرَةٌ
“তোমাদের জন্য সেই দু’টি দলের মধ্যে একটি শিক্ষার নিদর্শন ছিল যারা (বদরে) পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। একটি দল আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছিল এবং অন্য দলটি ছিল কাফের।” (আল ইমরান: ১৩) এই নিদর্শন ছিল ‘বদর দিবস’।
আল্লাহ আরো বলেন,
إِنْ كُنْتُمْ آمَنْتُمْ بِاللَّهِ وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَى عَبْدِنَا يَوْمَ الْفُرْقَانِ
“যদি তোমরা ঈমান এনে থাকো আল্লাহর প্রতি এবং ফায়সালার দিন অর্থাৎ উভয় সেনাবাহিনীর সামনা-সামনি মোকাবিলার দিন আমি নিজের বান্দার ওপর যা নাযিল করেছিলাম তার প্রতি।” (আনফাল: ৪১) (অর্থাৎ যে সাহায্য-সমর্থনের মাধ্যমে তোমরা বদর প্রান্তরে বিজয় অর্জন করেছো।)
তিনি আরো বলেন,
وَلَكِنْ لِيَقْضِيَ اللَّهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولًا لِيَهْلِكَ مَنْ هَلَكَ عَنْ بَيِّنَةٍ وَيَحْيَى مَنْ حَيَّ عَنْ بَيِّنَةٍ
“কিন্তু যা কিছু সংঘটিত হয়েছে তা এ জন্য ছিল যে, আল্লাহ যে বিষয়ের ফায়সালা করে ফেলেছিলেন তা তিনি কার্যকর করবেনই। যাতে করে যে ধ্বংস হবে সে সুস্পষ্ট প্রমাণ সহকারে ধ্বংস হবে এবং যে জীবিত থাকবে সে সুস্পষ্ট প্রমাণ সহকারে জীবিত থাকবে।” (আনফাল: ৪২) এটা ছিল বদর দিবসের কথা।
নি:সন্দেহে মুমিনদের দূর্বল ও অল্প সংখ্যক বাহিনীর শক্তিশালী ও বিশাল কাফের বাহিনীর উপর বিজয় লাভ একথাই প্রমাণ করছে যে, মুমিনদের দলটি হক বা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। আর আল্লাহই তাদেরকে এই বিজয়লাভে সাহায্য করেছেন। যেমন তিনি বদর যুদ্ধে করেছিলেন। আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللَّهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ
“এর আগে বদরের যুদ্ধে আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছিলেন (বিজয় দান করেছিলেন) অথচ তখন তোমরা অনেক দুর্বল ছিলে। (আল ইমরান: ১২৩)
আল্লাহ আরো বলেন,
إِذْ يُوحِي رَبُّكَ إِلَى الْمَلَائِكَةِ أَنِّي مَعَكُمْ فَثَبِّتُوا الَّذِينَ آمَنُوا سَأُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُوا الرُّعْبَ
“আর সেই সময়, যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে ইঙ্গিত করেছিলেন এই বলেঃ “আমি তোমাদের সাথে আছি, তোমরা ঈমানদারদেরকে দৃঢ়-অবিচল রাখো, আমি এখনই এ কাফেরদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে দিচ্ছি।” (আনফাল: ১২)
যে মুমিনদেরকে আল্লাহ সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং তাদের গুণাবলী কিরূপ তা ব্যক্ত করেছেন এবং তাদের বৈশিষ্টকে অন্যদের থেকে আলাদা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,
وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ
“আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকেই সাহায্য করবেন, যারা তাঁকে সাহায্য করবে। আল্লাহ বড়ই শক্তিশালী ও পরাক্রান্ত।” (সূরা হাজ্জ: ৪০)
তারপর অন্যদের তুলনায় তাদের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট কিরূপ তা উল্লেখ করে এরশাদ করেন,
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ
“এরা এমন সব লোক যাদেরকে আমি যদি পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দান করি তাহলে এরা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং খারাপ কাজে নিষেধ করবে। আর সমস্ত বিষয়ের পরিণাম আল্লাহর হাতে।” (সূরা হাজ্জ: ৪১)
এখানে যে সমাধানটি আমরা কুরআন থেকে উল্লেখ করলাম তা হচ্ছে সেনাবাহিনী কর্তৃক অবরোধ সমস্যা। এই একই সমাধানের প্রতি সূরা মুনাফিকুনে আল্লাহ ইঙ্গিত করেছেন শত্রুদের অর্থনৈতিক অবরোধের বিষয়ে। আর তা হচ্ছে:
هُمُ الَّذِينَ يَقُولُونَ لَا تُنْفِقُوا عَلَى مَنْ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ حَتَّى يَنْفَضُّوا
“এরাই তো সেই সব লোক (মুনাফিক) যারা বলে, আল্লাহর রসূলের সাথী-সাহাবীদের জন্য খরচ করা বন্ধ করে দাও, তাহলে তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে এবং মুহাম্মাদকে ছেড়ে দিবে।” (মুনাফিকুন: ৭)
এখানে মুনাফিকরা যে কাজটি করতে চেয়েছিল, সেটাই মূলত: আধুনিক যুগের অর্থনৈতিক অবরোধ হিসেবে পরিচিত। এই সমস্যার সমাধানের জন্য আল্লাহ যে ইঙ্গিত করেছেন তা হচ্ছে “তাঁর প্রতি দৃঢ় ঈমান এবং একনিষ্ঠভাবে তাঁরই স্মরণাপন্ন হওয়া”। তিনি বলেন,
وَلِلَّهِ خَزَائِنُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَا يَفْقَهُونَ
“অথচ আসমান ও জমীনের সমস্ত ধন ভাণ্ডারের মালিকানা একমাত্র আল্লাহরই। কিন্তু এই মুনাফিকরা তা বুঝে না।” (মুনাফিকুন: ৭)
কেননা যার হাতে আকাশ ও পৃথিবীর ধনভাণ্ডারের দায়িত্ব, তিনি কখনো এমন আবেদনকারীকে বিফল করবেন না যে একনিষ্ঠভাবে তাঁর আশ্রয় কামনা করবে এবং তাঁরই আজ্ঞাবহ হবে। তাই তিনি সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এরশাদ করেন:
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا (2) وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
“যে ব্যক্তিই আল্লাহকে ভয় করে (তাঁর হুকুম-আহকাম মেনে) চলবে, আল্লাহ তার জন্য কঠিন অবস্থা (যে কোন বিপদ ও সমস্যা) থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সৃষ্টি করে দেবেন। এবং এমন পন্থায় তাকে রিযিক দেবেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না।” (তালাক: ২, ৩) বিষয়টি আরো ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে,
وَإِنْ خِفْتُمْ عَيْلَةً فَسَوْفَ يُغْنِيكُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ إِنْ شَاءَ
“আর যদি তোমাদের দরিদ্রতার ভয় থাকে, তাহলে আল্লাহ চাইলে তাঁর নিজ অনুগ্রহে শীঘ্রই তোমাদের অভাব মুক্ত করে দেবেন।” (তাওবা: ২৮)
দশম বিষয়: পরস্পর বিভেদ অন্তরের দূরত্ব
সূরা হাশরে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন যে পরস্পর বিভেদের মূল কারণ হচ্ছে বিবেককে কাজে না লাগানো। আল্লাহ বলেন,
تَحْسَبُهُمْ جَمِيعًا وَقُلُوبُهُمْ شَتَّى
“আপনি মনে করবেন তারা ঐক্যবদ্ধ, কিন্তু মূলত: তাদের অন্তরগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন- বিভেদে ভরা।” এর কারণ কি?
ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَعْقِلُونَ
“কারণ হচ্ছে তারা এমন সম্প্রদায় যারা বিবেককে কাজে লাগায় না।” (সূরা হাশর: ১৪)
বিবেকের দূর্বলতার চিকিৎসা হচ্ছে ওহীর আলোয় তাকে আলোকিত করা। কেননা ওহী মানুষকে এমন কল্যাণের পথে পরিচালিত করে যা বুঝতে মানুষের সাধারণ বিবেক অপারগ। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
أَوَمَنْ كَانَ مَيْتًا فَأَحْيَيْنَاهُ وَجَعَلْنَا لَهُ نُورًا يَمْشِي بِهِ فِي النَّاسِ كَمَنْ مَثَلُهُ فِي الظُّلُمَاتِ لَيْسَ بِخَارِجٍ مِنْهَا
“যে ব্যক্তি প্রথমে (বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার মধ্যে) মৃত ছিল, পরে আমি তাকে (অন্তরে ঈমান দিয়ে) জীবন দিয়েছি এবং তাকে এমন আলো (হেদায়াত, রাসূলের আনুগত্য করার ক্ষমতা) দিয়েছি যার উজ্জ্বল আভায় সে মানুষের মধ্যে জীবন পথে চলতে পারে, সে কি এমন ব্যক্তির মতো হতে পারে, যে (বিভ্রান্তি ও প্রবৃত্তির) অন্ধকারের বুকে পড়ে আছে এবং কোনক্রমেই সেখানে বের হয় না?” (আনআম: ১২২)
এ আয়াতে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন যে, ঈমানের আলো দ্বারা এমন লোককে জীবিত করা হয় যার অন্তর বিভ্রান্তির কারণে মৃত ছিল। ঈমান তার চলার পথকে উজ্জল ও আলোকিত করে, ফলে সে সঠিক ভাবে জীবন চালাতে সক্ষম হয়।
আল্লাহ আরো বলেন,
اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ
“আল্লাহ ঈমানদারদের বন্ধু, তিনি তাদেরকে (কুফরী ও বিভ্রান্তির) অন্ধকার থেকে (ঈমান ও আনুগত্যের) আলোর পথে বের করেন।” (বাকারা: ২৫৭) তিনি আরো বলেন,
أَفَمَنْ يَمْشِي مُكِبًّا عَلَى وَجْهِهِ أَهْدَى أَمَّنْ يَمْشِي سَوِيًّا عَلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
“ভেবে দেখো তো, যে ব্যক্তি মুখ নিচু করে পথ চলছে সে-ই সঠিক পথপ্রাপ্ত, না যে ব্যক্তি মাথা উঁচু করে সোজা হয়ে সমতল পথে হাঁটছে সে-ই সঠিক পথপ্রাপ্ত?” (মুলক: ২২)
মোটকথা মানব জাতির স্বার্থ ও কল্যাণ নিহিত আছে তিনটি বিষয়ে। আর তিনটি বিষয়ই হচ্ছে পৃথিবী রক্ষার মূলনীতি।
১) প্রথমত: অকল্যাণ বা সমস্যা প্রতিরোধ। উসূলবিদদের নিকট এটা হচ্ছে অত্যাবশ্যক ৬টি বিষয়ের ক্ষতি প্রতিহত করাকে বুঝায়। আর তা হচ্ছে, দ্বীন (ধর্ম) প্রাণ, আকল (বিবেক বা বোধশক্তি), বংশ, ইজ্জত ও সম্পদ।
২) দ্বিতীয়ত: কল্যাণ সাধন বা স্বার্থ রক্ষা। উসূলবিদদের নিকট এটা হচ্ছে সাধারণ দরকারী বিষয় সমূহ। যেমন, বেচাকেনা, ভাড়া নেয়া-দেয়া… এরূপ সমাজে পরস্পরের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় সমূহ। যা শরীয়তের মানদণ্ড অনুযায়ী হয়ে থাকে।
৩) উত্তম চরিত্রে নিজেকে ভূষিত করা এবং সমাজের উত্তম অভ্যাস সমূহের উপর চলা। উসূলবিদদের নিকট এটা উত্তমতা ও পূর্ণতা নামে পরিচিত। যেমন: ফিতরাতী বা স্বভাবজাত অভ্যাস সমূহ মেনে চলা।- দাড়ি ছেড়ে দেয়া, মোচ কাটা… ইত্যাদি।
আরো যেমন, কুরূচীপূর্ণ বস্তু বর্জন করা। গরীব আত্মীয়-স্বজনের জন্য অর্থ ব্যয় করা, সমাজকল্যাণ মূলক কাজ করা… ইত্যাদি।
এ সকল স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় হেকমতপূর্ণ সঠিক নিয়মে একমাত্র ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য কোন পন্থায় বা অন্য কোন ধর্ম দ্বারা সংরক্ষিত হওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ বলেন,
الر كِتَابٌ أُحْكِمَتْ آيَاتُهُ ثُمَّ فُصِّلَتْ مِنْ لَدُنْ حَكِيمٍ خَبِيرٍ
“আলিফ-লাম-র। এই কিতাব একটি ফরমান। এর আয়াতগুলো (আদেশ-নিষেধ সমূহ) পাকাপোক্ত এবং বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়েছে, এক পরম প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞ সত্তার পক্ষ থেকে।” (হূদ: ১)
ওয়া সাল্লাল্লাহু আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ ওয়া আলিহি ওয়া সাহবিহি আজমাঈন।
Notes
. আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেন, مَنْ أحْدَثَ فِيْ أمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ “যে ব্যক্তি আমার এই দ্বীনের মাঝে নতুন কিছু সৃষ্টি করবে যা তার অন্তর্ভূক্ত নয়, তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত”।
(বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুস সুলহ, অনুচ্ছেদঃ যদি অন্যায়ভাবে মীমাংসা করে, তবে সেই মীমাংসা প্রত্যাখ্যাত। হাদীছ নং- ২৪৯৯।)
অন্য বর্ণনায় এসেছে
, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُناَ فَهُوَ رَدٌّ “যে ব্যক্তি এমন আমল করবে যার পক্ষে আমার শরীয়তের কোন নির্দেশ নেই, তবে তা প্রত্যাখ্যাত।” (মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল আকজীয়া, অনুচ্ছেদঃ অন্যায় হুকুম এবং নব আবিস্কৃত বিষয়সমূহ প্রত্যাখ্যাত হওয়া প্রসঙ্গে, হাদীছ নং- ৩২৪৩।)
. (হাদীছটি ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, আবু দাউদ, অধ্যায়: কুরবানী, অনুচ্ছেদ: আহলে কিতাবের জবেহ খাওয়া যাবে কি না, হা/২৮১৮। তিরমিযী, অধ্যায়: তাফসীর, অনুচ্ছেদ: সূরা আনআমের তাফসীর, হা/৩০৬৯। নাসাঈ, অধ্যায়: কুরবানী, হা/৪৪৩৭। ইবনে মাজাহ, অধ্যায়: পশু জবেহ, অনুচ্ছেদ: জবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ.. বলা, হা/৩১৭৩)
. (বুখারী, ইবনে আব্বাস (রা.) অধ্যায়: জিহাদ, অনুচ্ছেদ: আল্লাহর শাস্তির অনুরূপ কাউকে শাস্তি না দেয়া ৪/২১)
. ইবনে মাজাহ, অধ্যায়: খাদ্য-পাণীয়, অনুচ্ছেদ: যে বস্তু বেশী পরিমাণ সেবন করলে নেশা হয়, তার অল্পও হারাম। হা/৩৩৯২।
এই হাদীছের প্রথম অংশ “নেশা জাতীয় সকল দ্রব্য হারাম।” বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী, আবু মূসা রা. থেকে, অধ্যায়: মাগাযী, অনুচ্ছেদ: বিদায় হজ্জের পূর্বে আবু মূসা ও মুয়াযকে ইয়ামান প্রেরণ, হা/৩৯৯৭। মুসলিম, অধ্যায়: পাণীয়, অনুচ্ছেদ: প্রত্যেক নেশা জাতীয় দ্রব্যই মদ, হা/ ২০০১।
. একথা ইবনু আবী হাতেম সূরা আল ইমরানের তাফসীরে হাসান বাসরী রহ. থেকে বর্ণনা করেছেন, হা/১৮২২।
. দেখুন, বারা বিন আযেব রা. থেকে বর্ণিত। বুখারী, অধ্যায়: জিহাদ, অনুচ্ছেদ: যুদ্ধের সময় বিভেদ করা এবং নেতার আদেশ লঙ্ঘণ করা অন্যায়, ৪/২৬।
Leave a Reply