ইসলাম ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ – ড. এম উমর চাপরা
ইবুক নির্মাতা: মোঃ ইমরান
সৌজন্যে: ইসলামিক ইপাব ও মোবি ক্রিয়েটর টিম
.
মুখবন্ধ
সমাজতন্ত্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের কেন্দ্রীয় পরিকল্পিত অর্থনীতির পতনের পর সকলের কাছে মানবসভ্যতার মতাদর্শিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়। এটা কি ইতিহাসের যবনিকাপাত ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার চূড়ান্ত বিপর্যয় এবং পশ্চিমা পুঁজিবাদের সমর্থক অতি উৎসাহী লোকদের দাবি অনুযায়ী পাশ্চাত্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদারবাদের দ্ব্যর্থহীন বিজয়, না তা ইতিহাসের গতিধারায় ক্রমঃপতনশীল অবস্থার একটি পর্যায় মাত্র? যদি সমাজতন্ত্র তার নিজস্ব অসংগতি ও অসমতার ভারে ন্যুব্জ হয়ে থাকে তাহলে এটা কী প্রমাণ করে যে, পুঁজিবাদ তার ঐতিহাসিক অসংগতি, অবিচার ও ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে? যদি পুঁজিবাদের কতিপয় নির্দিষ্ট ব্যর্থতার জন্য আংশিকভাবে হলেও সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার পরে দ্রুত বিকল্প খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে। সমাজতন্ত্রের বিশাল সৌধ ভেঙে চুরমার হওয়ার প্রেক্ষাপটে মানুষের মন ও বিবেকের দুয়ারে জটিল প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে।
‘ইসলাম ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ’ বইটি এসব প্রশ্নের উপর আলোকপাত করার জন্য একটি সময়োচিত প্রচেষ্টা। এতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে যে, যথার্থ উত্তর খুঁজে বের করার জন্য পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার প্রয়োজন নেই, বরং অন্যান্য ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও এর সীমা বিস্তৃত হতে পারে। মানব জাতির সামনে একটি বৈপ্লবিক সুযোগ উন্মোচিত হতে পারে যদি কারো অনুসন্ধিৎসু মন আন্তরিকতা ও বস্তুনিষ্ঠতার সাথে মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্যকে পরীক্ষা করে দেখেন, যাতে তারা ইসলামী আদর্শের আলোকে এ যুগের অর্থনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের জবাব সন্তোষজনকভাবে দিয়েছেন। মানবজাতি পাশ্চাত্যের নেতৃত্বে বিগত তিনশ বছরে চারটি প্রধান অর্থনৈতিক মতাদর্শের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, সেগুলো পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদী-ফ্যাসিবাদ ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। এসব মতবাদই মৌলিকভাবে বৈশিষ্ট্যগতভাবে একই ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত যে, মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ধর্ম ও নৈতিকতা প্রাসঙ্গিক নয়; বরং অর্থনৈতিক বিষয়াদি অর্থনৈতিক আচরণের সূত্র দ্বারাই সমাধান করা যায় এবং নৈতিক সামাজিক বিধিবিধান এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। পুঁজিবাদ তার সৌধ নির্মাণ করেছিল বল্গাহীন ব্যক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, মুনাফার অভিপ্রায় ও বাজারব্যবস্থার নীতির উপর। সমাজতন্ত্র মানবজাতির জন্য সুখ-সমৃদ্ধি খুঁজেছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সামাজিক প্রণোদনা ও কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে। এ দু’য়ের সমন্বয়ে ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ও সামরিক উচ্চাভিলাসের জন্ম দেয়। কল্যাণমূলক পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের কিছু বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে মিশ্র অর্থনীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে এসব মতবাদের কিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য পরিলক্ষিত হলেও তা মানবজাতির প্রধান প্রধান অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে। সর্বশেষ পতিত দেবতা হচ্ছে সমাজতন্ত্র। এখন এটা ধারণা করা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক হবে যে, সমাজতন্ত্রের পতন পুঁজিবাদ ও কল্যাণ রাষ্ট্রের যথার্থতা প্রমাণ করে।
আমাদের সময়কালের অর্থনৈতিক সংকট এখনও আদের মতোই তীব্র ও বিপন্ন রয়ে গেছে। সকল মানবগোষ্ঠীর জন্য একই সঙ্গে একটি দক্ষ ও ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা খুঁজে বের করার লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে সার্বিক অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
ড. মুহাম্মদ উমর চাপরারর ‘Islam and Economic Challange’ গ্রন্থটি এ ক্ষেত্রে একটি অগ্রণী প্রয়াস। ড. চাপরা পেশাজীবী অর্থনীতিবিদ। তিনি করাচী ও মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। তিনি ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস ও সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ, পাকিস্তান এর মতো বিভিন্ন স্বনামধন্য শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন, প্লাটভাইল ও কেনটাকি, লেক্সিনটন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বিগত ২৬ বছর ধরে তিনি সৌদি অ্যারাবিয়ান মনিটারি এজেন্সির সিনিয়র অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। এ কারণে তিনি অর্থনীতির তত্ত্বগত জ্ঞান রয়েছে। বিগত ১৫ বছর ধরে তিনি অর্থনীতির ইসলামিক তত্ত্ব উন্নয়নের জন্য গভীর মনোনিবেশ সহকারে কাজ করছেন। এর আগে তিনি ‘টুওয়ার্ডস ও জাস্ট মনিটারি সিস্টেম’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ (ইসলামিক ফাউন্ডশন, লেস্টার, ১৯৮৫) রচনা করে মুসলিম বিশ্বের শিক্ষাবিদ মহলে প্রচুর সুনাম অর্জন করেন এবং এর মাধ্যমে ইসলামী অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তিনি ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক পুরস্কার লাভ করেন। এভাবে ড. চাপরা বর্তমান সময়কালের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অধিকতর মৌলিক ইস্যুগুলো সম্পর্কে সমাধান তুলে ধরার ক্ষেত্রে যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দেন।
‘Islam and Economic Challange’ শীর্ষক বইটি এক দশকের গবেষণা ও চিন্তার ফসল। তার এই শ্রেষ্ঠ গবেষণা কর্মে তিনি অত্যন্ত সূক্ষভাবে ও পাণ্ডিত্যের সাথে পাশ্চাত্যের প্রধান তিনটি অর্থব্যবস্থার বিশ্লেষণ করেছেন এবং সেগুলোর সাফল্য ও ব্যর্থতার একটি বাস্তবসম্মত ব্যালান্স শিট তৈরি করেছেন। তিনি অর্থনীতির ইসলামী তত্ত্ব ও তার সমস্যাসমূহ তুলে ধরে মুসলিম দেশগুলোর অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য সুনির্দিষ্ট পরামর্শ এবং কৌশলগত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়েনের লক্ষ্যে নতুন দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। ব্যাপক অর্থে তিনি মুসলিম বিশ্বে উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্যে যে উপাদান পেশ করেন তার মধ্যে রয়েছে বাজারব্যবস্থার জন্যে ব্যাপকভিত্তিক প্রনোদনা এবং একটি সহায়ক অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য মৌলিক কাঠামোগত সংস্কার।
ড. চাপরা একজন সুদক্ষ সমাজ বিজ্ঞানী ও বস্ত্তনিষ্ঠ ইসলামী শিক্ষাবিদ হিসেবে বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সমসাময়িক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও তার সমস্যাবলী সম্পর্কে তার ব্যাপক ও সূক্ষ্ম ধারণা রয়েছে; ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে তার উপস্থাপনা যথার্থ ও বিশ্বাসযোগ্য। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ব্যবস্থা ও সমসাময়িক মুসলিম সমাজের ভারসাম্যপূর্ণ সমালোচনা তিনি এমন সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন যাকে এক কথায় পাণ্ডিত্যপূর্ণ, সুস্পষ্ট ও নির্দেশনাত্মক বলা যেতে পারে। ‘Islam and Economic Challenge’গ্রন্থটি নিছক কোনো তত্ত্বীয় গ্রন্থ নয় বরং নীতি নির্ধারকদের জন্যেও অনেক প্রাসঙ্গিকতা এতে রয়েছে এবং তা শুধু মুসলিম বিশ্বের জন্যই নয়, সার্বিকভাবে সমগ্র বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য।
আমি মনে করি ‘Islam and Economic Challange’ গ্রন্থটি সমসাময়িক অর্থনেতিক ব্যবস্থার উপর একটি উন্নতমানের গ্রন্থ এবং তা সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে ইসলামী তত্ত্ব উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে।
ড. চাপরার এই অনুপম অবদানের পেছনে রয়েছে তার চিন্তা ও ধ্যান ধারণার বাস্তব প্রয়োগ। তিনি সমস্যাগুলোকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন; বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাফল্যকে নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করেছেন এবং একই সঙ্গে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন বা কৃত্রিমতা পরিহার করে সম্পূর্ণ নিখুঁভাবে ইসলামিক বিকল্প ব্যাখ্যা করেছেন।
ড. চাচরা দ্ব্যর্থহীভাবে প্রমাণ করেন যে, শুধু বস্তুগত সম্পদের পিছনে ছুটলে মানুষের কল্যাণ অর্জিত হয় না, দক্ষতা ও সমতার বিষয়টি কেবল তখনই প্রয়োগিক ধারণা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে যদি বিষয়টিকে নৈতিক মূল্যবোধ ও আর্থসামজিক কাঠামোর প্রেক্ষিতে পুনঃ সংজ্ঞায়িত করা হয়। তিনি মানুষকে অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা ও প্রয়াসের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পুনঃ আবিষ্কারের কৈফিয়ত দিয়েছেন। তিনি পাশ্চাত্যের একজন দক্ষ অর্থনীতিবিদের মতোই অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের জন্য বিভিন্ন উপকরণ যথাসম্ভব কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছেন। তবে তার সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে অর্থনীতির ক্ষেত্রে উন্নত চিন্তাধারা সমৃদ্ধ একটি নতুন সৌধ নির্মাণ করা যা নৈতিক ভিত্তি থেকে বিচ্ছিন্ন নয় এবং যেখানে এমন একটি আর্থসামাজিক কাঠামোর আওতায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় এবং একই সঙ্গে দক্ষ ও ন্যায়ভিত্তিক বণ্টন ব্যবস্থা সমাজের বিশেষ কোনো শ্রেণীর জন্য নয় বরং সমগ্র মানবতার জন্য নিশ্চিত করা হয়। নৈতিক চেতনা সঞ্জাত এবং কয়েক শতাব্দীর প্রায়োগিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি অর্থনীতিকে বিবর্তনের মাধ্যমে পরবর্তী এমন একটা পর্যায়ে উন্নীত করার চেষ্টা করেছেন যা মানুষের সাধারণ প্রত্যাশা পূরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে, পারে। যদি তা নিছক সুবিধাভোগীদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হয়ে থাকে, তাহলে মানুষের কল্যাণের জন্যই সে অর্থনীতির হারানো গতিপথ পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন। আগামী দিনের সেই লক্ষ্যেই ‘Islam and Economic Challange’ গ্রন্থটি একটি পদক্ষেপ।
খুরশীদ আহমদ
লেস্টার
৩ জানুয়ারি ১৯৯২
২৭ জামাদা আল-সানী ১৪১২
প্রারম্ভিক কথা
প্রায় সকল মুসলিম দেশেই চলমান ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রেক্ষিতে একটি সমন্বিত কর্মসূচি রূপায়ণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। মানব জাতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, যে সংকট মোকাবিলা করেছে তা উত্তরণে ইসলামকে একটি কল্যাণমুখী ব্যবস্থা উপতার দিতে হবে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশই এখন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বহির্দেশীয় ভারসাম্যহীনতা মোকাবিলা করছে। এজন্য এমন একটা বিশেষ কৌশল গ্রহণ করতে হবে যাতে এ দু’য়ের ব্যবধানকে নিয়ন্ত্রণসাধ্য সীমার মধ্যে সামনে আনা যায় এবং এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য দূরীকরণ, মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং আয় ও সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য হ্রাস করা যায়। মুসলিম দেশগুলো কি পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র এবং কল্যাণ রাষ্ট্রের বিশ্ববিপণনের আওতায় কোনো কৌশল প্রণয়ন করতে পারে? ইসলাম কি তাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে পারে? এ গ্রন্থে এসব বিষয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রশ্নের জবাব দেয়ার প্রয়াস চালানো হয়েছে।
পাণ্ডুলিপি প্রথম খসড়াটি ইসলামী ও প্রচলিত অর্থনীতির প্রায় ডজনখানেক পণ্ডিতের কাছে প্রেরণ করা হয়। এদের মধ্যে রয়েছেনঃ সৌদি আরবের ড. ফাহীম খান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রফেসর কেনেথ বোল্ডিং, প্রফেসর ইভার্ট হেগেন, প্রফেসর ফ্রাংক ভোগেল এবং যুবায়ের ইকবাল, যুক্তরাজ্যের প্রফেসর রুডনী নীনহাস এবং পাকিস্তানের প্রফেসর খুরশীদ আহমদ।
সকলেই তাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে যত্নসহকারে আমার পাণ্ডুলিপিটি পাঠ করেছেন এবং মূল্যবান মন্তব্য ও পরামর্শ দিয়ে উপকৃত করেছেন, এজন্য আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তাদের পরামর্শের আলোকে আমি পাণ্ডলিপিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছি। ফলশ্রুতিতে মূল অভিসন্দর্ভ অপরিবর্তিত থাকলেও তাদের মতামতের আলোকে সম্পাদনার ফলে এটি আরো সমৃদ্ধ হয়েছে।
আমি বিশেষ করে ড. জারকা, ড. মুনাওয়ার ইকবাল এবং প্রফেসর কেনেথ বোল্ডিং এর তীক্ষ্ম সমালোচনা থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছি এবং তা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করছি। প্রথমোক্ত তিনজন সৌদি আরবে বসবাস করার সুবাদে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য আমাকে মূল্যবান সময় দিয়েছেন। এরূপ আলোচনার ফলে বিষয়গুলো সম্পর্কে আমার জ্ঞানের পরিধি যেমন সম্প্রসারিত হয়েছে, তেমনি ইসলামী নীতি কৌশলের যুক্তিকে জোরদার করতেও সহায়ক হয়েছে।
সুতরাং পাঠকগণ যদি বইটিকে মূল্যবান বলে বিবেচনা করে তাহলে এর কৃতিত্বের উল্লেখযোগ্য অংশ উপরে উল্লিখিত পণ্ডিতজনদের প্রাপ্য হবে। অবশ্য তাদের কেউই চূড়ান্ত খসড়াটি দেখেননি। ফলে যদি কোনো ত্রুটি থেকে থাকে সেজন্য আমাকেই দায়ী করতে হবে। বইটির কলেবর যাতে বৃদ্ধি না পায় এবং কৌশলগত পরিভাষায় ভারাক্রান্ত না হয় সেজন্য তাদের পরামর্শ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বিব্রত ছিলাম। এ বইতে প্রকাশিত মতামত আমার নিজস্ব, আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি আমার মতামতের সাথে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
ক্ল্যাসিকাল ও ইসলামী অর্থনীতির চলতি গ্রন্থাবলীর কাছে আমি এতটাই ঋণী যে, পাদটীকায় বিপুলসংখ্যক তথ্যসূত্রের উল্লেখ করা সত্ত্বেও দায়িত্ব শেষ হয় না। অধিকন্তু অর্থনীতির উপর বর্তমানে প্রকাশনার সংখ্যা এত বেশি যে, ব্যাপকভাবে তথ্যসূত্রের নির্দেশ সম্ভব নয়, বিশেষত এ ধরনের একটি বইতে, যেখানে তিনটি বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা ও ইসলাম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এমতাস্থায় আমাকে বেছে বেছে তথ্যসূত্র নির্বাচন করতে হয়েছে। অবশ্য এমন কিছু তথ্যসূত্র বাদ পড়ে যেতে পারে যা অন্যদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বইটির কলেবর বৃদ্ধির বিষয়টি পরিহার করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেই কেবল অন্য ভাষার বর্ণান্ত ব্যবহার করা হয়েছে। আমি ইসলামের বাণীকে বিশেষভাবে বুঝানোর জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরবি শব্দ ব্যবহার করেছি; ইংরেজি অনুবাদ করা হলে ইসলামী পরিভাষায় মূল ভাবার্থটি প্রস্ফুটিত হতো না।
এই বইটি রচনা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে আরো অনেকে আমাকে সহযোগিতা করেছেন, আমি তাদের কাছেও ঋণী। এদের মধ্যে আমার স্ত্রী ও আমার সন্তানদের আমার প্রতি নৈতিক সমর্থন প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। আমার ভ্রাতৃদ্বয় আবদুর রহমান ও মুহাম্মদ আমাকে অব্যাহত উৎসাহ দেন। আমি আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী, টি.বি. ইরভিং ও মুহাম্মদ আসাদের পবিত্র কোরআনের অনুবাদ থেকে বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছি, যদিও তাদের অনুবাদ উদ্ধৃত করা হয়নি। ফিকাহ্, হাদিস ও অন্যান্য আরবি গ্রন্থের অনুবাদ আমার নিজস্ব। আমার মেয়ে সুমাইয়া অনুবাদের কতকগুলো জটিল সমস্যার সমাধানে সহায়তা করেছে। পাণ্ডলিপি পরীক্ষা ও প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে মুদ্রণ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আমি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ড. এম.এম. আহসান ও অন্যান্য ভাইদের সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। বইটি রচনাকালে গবেষণা ও দাপ্তরিক সহায়তা প্রদানে দক্ষতার সাথে সাহায্য করার জন্য আমি জনাব মবিন আহমদের কাছে ঋণী রইলাম। আল্লাহতায়াল এদের সবাইকে তাদের অবদানের জন্য পুরস্কৃত করুন!
এম. উমর চাপরা
রিয়াদ, সৌদি আরব
১১ জুমাদা আল-আখিরা ১৪১১, ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৯০
পুনশ্চঃ
এ বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ চূড়ান্ত হয়ে যাবার পর সোভিয়েত অর্থব্যবস্থার পতন ঘটে এবং ৫০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর সুইডিশ সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠত হারায়। এ ঘটনার ফলে এ পুস্তকের মূল প্রতিপাদ্যের যথার্থতা পুনরায় প্রমাণিত হলো, বিশেষ করে এখানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে, যেখানে সমাজতন্ত্র ও কল্যাণ রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
৯ রবিউল আউয়াল ১৪১২,
১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৯১
ভূমিকা
শরীয়াহর গূঢ় উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগনের কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে তাদের আকিদা- বিশ্বাস, বুদ্ধিবৃত্তি, সন্তান-সন্ত্ততি ও সম্পদের সংরক্ষন করা। যা কিছু এই পাঁচটি বিষয় সংরক্ষণের নিশ্চয়তা বিধান করে তাই জনস্বার্থ বলে গণ্য এবং সেটাই কাম্য। -আল গাজালী।
শরীয়াহর ভিত্তি হচ্ছে মানুষের জ্ঞান এবং পার্থিব জগত ও পরকালে জনগণের কল্যাণ সাধন। আর কল্যাণ নিহিত রয়েছে সার্বিক ন্যায়বিচার, দয়া, সুখ-সমৃদ্ধি ও জ্ঞানের মধ্যে। যেখানে ন্যায়বিচারের পরিবর্তে নির্যাতন, দয়ার স্থলে কঠোরতা, কল্যাণের পরিবর্তে কার্পণ্য এবং জ্ঞানের বদলে মূর্খতা স্থান পায়, সেখানে শরীয়াহর কিছু করণীয় নেই। -ইবন আল-কাইয়্যেম
চ্যালেঞ্জ
সকল সমাজেরই স্বীকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবকল্যাণ। অবশ্য কল্যাণের মৌলিক উপাদান কি এবং কিভাবে অর্জিত হয়, সে সম্পর্কে মতপার্থক্য রয়েছে। যদিও একমাত্র বস্তুগত অবস্থাই কল্যাণের উপাদান নয়, তথাপি আধুনিক সেকুলারতার ধারণায় প্রাথমিকভাবে ঐ সকল বিষয়ের উপর জোর দিয়ে বলা হয় যে, কতিপয় বস্তুগত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না করা পর্যন্ত কল্যাণ বা সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত হয় না। এসব লক্ষের মধ্যে রয়েছেঃ দারিদ্র্য দূরীকরণ, সকল ব্যক্তির বস্তুগত মৌলিক চাহিদা পূরণ, সৎ উপায়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রত্যেকের সুযোগের লভ্যতা এবং আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন। অবশ্য বিশ্বের ধণী-গরীব নির্বিশেষে এমন কোনো দেশ নেই, যে দেশ এসব বস্তুগত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
যে কেন্দ্রীয় পরিকল্পিত অর্থনীতিতে এ সকল বস্তুগত লক্ষ্য নিশ্চিত অর্জনের সক্ষমতা দাবি করা হয়, সেখানেও তা শুধু ব্যর্থই হয়নি, বরং মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটেরও সম্মুখীন হয়েছে, যাকে নিঃসন্দেহে ব্যবস্থাটির (system) ব্যর্থতা বলতে হবে। বাজার অর্থনীতির দেশগুলো গর্বের সাথে আত্মতৃপ্তি প্রকাশ করে যাচ্ছে যে, বাজারব্যবস্থা অতীতের যে কোনো সময়ের চাইতে উৎকৃষ্ট। তবে সামষ্টিক অর্থনীতির (Macroeconomic) ভারসাম্যহীনতা অর্থনীতির ঘনঘন ওঠানামা, উচ্চহারের মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব, অতিরিক্ত বাজেট ও বাণিজ্যিক লেনদেন ঘাটতি, এবং বৈদেশিক মুদ্রা, পণ্য ও শেয়ার বাজারের পরিবর্তনশীলতার মাধ্যমে তাদের ব্যর্থতা আরো সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। তদুপরি উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের জটিল বৈদেশিক ঋণ সমস্যায় মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় আক্রান্ত, যা শুধু তাদের ভবিষ্যতের উন্নয়নকেই নয় বরং আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থার কাঠামো ও অস্তিত্বকেও হুমকির সম্মুখীন করছে।
অধিকন্তু এসব সমস্যার সাথে সাথে বিশ্বের সকল দেশই বাস্তবে দেখতে পাচ্ছে যে, তাদের নবায়ন অযোগ্য (non-renewable) প্রাকৃতিক সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে এবং পরিবেশ দূষণ জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। মানুষের জীবনে ক্রমবর্ধমান চাপ, উত্তেজনা ও দ্বন্দ্ব–সংঘাত এবং তার সাথে অস্থিরতার ক্রমবর্ধিষ্ণু লক্ষণসমূহ, যেমন হতাশা, অপরাধ প্রবণতা, নেশা, মাদকাসক্তি, বিবাহ-বিচ্ছেদ, শিশু নির্যাতন, মানসিক অসুস্থতা ও আত্মহত্যা এসব কিছুই মানুষের ব্যক্তি জীবনে আত্মতৃপ্তির অভাবের পরিচায়ক।
এ গ্রন্থে প্রধানত যে মুসলিম দেশগুলোর উপর আলোকপাত করা হবে, সেগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়।এ দেশগুলোতেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মৌলিক চাহিদা অপূরণীয় রয়েছে; অপরদিকে ধনী ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণী বেশ স্বচ্ছলতার সাথে বাস করছে। বিত্তের পাশাপাশি দারিদ্র্যের অস্তিত্ব ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও সামাজিক সংহতিকে ক্রমশ ক্ষয় করে দিচ্ছে এবং তা অপরাধ প্রবণতা, হিংসাত্মক কার্যকলাপ, সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করছে। এসব দেশের অধিকাংশই চরম সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার (macroeconomic imbalance) সংকটে নিপতিত। মুসলিম দেশগুলোর ক্ষেত্রে এসব দুর্বলতা আরো মারাত্মক। কারণ মানব মর্যাদা, ভ্রাতৃত্ব ও আর্থ-সামাজিক সুবিচারকে ইসলাম আপসহীন গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত মানবকল্যাণের সকল অপরিহার্য উপাদানগুলো নিশ্চিত করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এসকল কথা অন্তঃসারশূন্য শ্লোগানে পর্যবসিত হবে।
দক্ষতা ও ন্যায়পরতা
এমন কেন হলো যে, বিশ্বের কোনো দেশই মানুষের সুখ-সমৃদ্ধির বস্তুগত উপাদানগুলো পর্যন্ত বাস্তবে উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়নি? এ ব্যর্থতার জন্য কি সম্পদের অপ্রতুলতাকে দায়ী করা যায়? অধিকাংশ অর্থনীতিবিদই নেতিবাচক জবাব দিতে চাইবেন, কারণ প্রকৃত বিচারে তারা সম্পদকে নিরঙ্কুশভাবে দুষ্প্রাপ্য বলে বিবেচনা করেন না। কেবল সম্পদের উপর দাবির প্রেক্ষিতেই আপেক্ষিক দুষ্প্রাপ্যতা রয়েছে। অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ স্বীকার করেন যে, সম্পদের আপেক্ষিক দুষ্প্রাপ্যতা সত্ত্বেও যদি লভ্য সম্পদ ’দক্ষতা’ ও ‘ন্যায়পরতা’র সাথে ব্যবহার করা যায় তাহলে বস্তুগত লক্ষ্য অর্জন এবং অস্থিতিশীলতা ও ভারসাম্যহীনতা দূর করা সম্ভব। এটা হচ্ছে মানবতার প্রতি সম্ভাব্য সেই চ্যালেঞ্জ যাতে লভ্য সম্পদ ‘দক্ষতা’ ও ‘ন্যায়পরতা’র সাথে ব্যবহার করার ফলশ্রুতিতে বিশ্বজনীনভাবে স্বীকৃত বস্তুগত সুখ-সমৃদ্ধির লক্ষ্য বাস্তবায়ন করবে এবং অস্থিতিশীলতা ও ভারসাম্যহীনতা দূর করবে। ‘দক্ষতা’ ও ‘ন্যায়পরতা’ এবং তার বাস্তবায়ন সম্পর্কিত বহু জটিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এসে যায়।
‘দক্ষতা’ ও ‘ন্যায়পরতা’ কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে। এ আলোচনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযুক্ত সংজ্ঞা হবে সেটি, যা বিশ্বজনীন স্বীকৃত বস্তুগত লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বলা যেতে পারে যে, একটি অর্থনীতি কাম্য দক্ষতা অর্জন করতে পারে, যদি লভ্য মোট কার্যক্রম জনশক্তি ও বস্তুগত সম্পদকে কর্মসংস্থানে এমনভাবে নিয়োজিত করা যায়, যাতে যুক্তিসংগত পর্যায়ের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সংরক্ষিত (reserved) হারে ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিসহ সর্বাধিক সম্ভাব্য পরিমাণ চাহিদা পূরণকারী পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয়। সামষ্টিক অর্থনীতিতে দীর্ঘায়িত অথবা পৃথিবীতে মানুষের জীবন বিপন্ন করে এরূপ পরিবেশ নষ্ট না করে সমাজের নিকট অধিকতর গ্রহণযোগ্য সুফল অর্জনে ব্যর্থ হলে সে ক্ষেত্রে দক্ষতার প্রশ্ন এসে যায়।
একটি অর্থনীতি সমতা (equality) অর্জন করতে পারে, যদি তার উৎপাদিত পণ্য ও সেবা এমনভাবে বণ্টন করা হয়, যাতে সকল মানুষের চাহিদা পর্যাপ্তভাবে পূরণ করা যায় এবং কাজের প্রেরণা, সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও উদ্যোগকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন করা যায়। যেহেতু দক্ষতা ও সমতার বিষয়টি বাস্তবে রূপদান করার কাজটি মূলত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কাজ, সেহেতু সবচেয়ে যুক্তিসংগত পন্থা হবে এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করা যা ঐ দুটো জিনিসকেই কার্যকর করতে সাহায্য করবে।
তিনটি প্রশ্ন
দক্ষতার সাথে সম্পদের বরাদ্দ এবং ন্যায়পরতার সাথে তার বণ্টন করতে হলে প্রতিটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অবশ্যই তিনটি সুপরিচিত মৌলিক অর্থনৈতিক প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। যেমন কি, কিভাবে ও কার জন্য উৎপাদন করা হবে? অর্থাৎ কি পরিমাণ কোনো বিকল্প পণ্য ও সেবা উৎপাদন করা হবে? কি কি সম্পদের সমন্বয়ে ও কি প্রযুক্তির সাহায্যে সেগুলো উৎপাদন করবে? এবং উৎপাদিত সেবা কে কতটুকু ভোগ করবে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর শুধুমাত্র একটি অর্থনীতিতে সম্পদের বরাদ্দই নয় বরং ব্যক্তি মানুষের মধ্যে তার বণ্টন এবং বর্তমান (ভোগ) ও ভবিষ্যতের (সঞ্চয় ও বিনিয়োগ) মধ্যকার বণ্টনকেও নির্ধারণ করে দেয়। বরাদ্দ ও বিতরণ অর্থনীতির প্রধান অংশ দখল করে আছে এবং এগুলোই অবশেষে নির্ধারণ করে দেয় সকল ব্যক্তির চাহিদা পূরণ হয়েছে কিনা, অন্যান্য সকল কাঙ্ক্ষিত আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়েছে কিনা এবং জনগণকে তাদের পূর্ণাঙ্গ কর্মশক্তিকে কর্মে নিয়োজিত করার জন্য যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করা হয়েছে কিনা? একটি অর্থনীতির চূড়ান্ত পরীক্ষা তার ঘোষিত লক্ষ্যে নয়, বরং তার বাস্তবায়ন কতটুকু হলো তার উপর নির্ভরশীল।
বিশ্ববীক্ষণ (World View) ও কৌশলের ভুমিকা
আপাত দৃষ্টিতে যদিও তিনটি প্রশ্নই সোজাসাপটা, কিন্ত তা গভীর মূল্যবোধসঞ্জাত, শূন্যের উপর তার উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। এর একটি বিশ্ববীক্ষণ (world view) অথবা ভিত্তিমূল দর্শন এবং কৌশল থাকা প্রয়োজন। প্রতিটি সমাজব্যবস্থা তার নিজস্ব বিশ্ববীক্ষণ দিয়ে প্রভাবিত এবং বিশ্বজাহানের উৎপত্তি এবং মানব জীবনের প্রকৃতি সম্পর্কে এক প্রকার অন্তর্নিহিত ও প্রকাশমান ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। আর্থার লোভেজয়ের (Arthur Lovejoy) মতে এই বিশ্ববীক্ষণ ‘প্রায় যে কোনো বিষয়ের উপর মানব প্রকৃতির প্রতিফলনকে নিয়ন্ত্রণ করে’। মানব প্রকৃতি সম্পর্কে মতপার্থেক্যের ফলশ্রুতিতে মানব জীবনের তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য, মানুষের আওতাধীন সীমাবদ্ধ সম্পদের চূড়ান্ত মালিকানা ও উদ্দেশ্য, অধিকার ও দায়িত্বের ক্ষেত্রে মানুষের পারস্পারিক সম্পর্ক, পরিবেশ এবং দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতার মানদণ্ড সম্পর্কে চূড়ান্ত ধারণারও পার্থক্য ঘটে। একটি ভবনের ভিত্তির মতোই এরূপ একটি বিশ্ববীক্ষণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ও একই রকম ভূমিকা রাখে, এমনকি সহায়ক ভিত্তিমূল সর্বদা একইভাবে অদৃশ্য ও অনুল্লেখ্য হওয়া সত্ত্বেও তা নিরবচ্ছিন্নভাবে সিদ্ধান্তকারী ভূমিকা পালন করে থাকে। পদ্ধতিগত কৌশল এই বিশ্ববীক্ষণের একটি যৌক্তিক ফলশ্রুতি। বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে পদ্ধতিকে পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর করার জন্য কৌশল হিসেবে থাকতে হবে কতগুলো অপরিহার্য উপাদান। এতে থাকতে হবে একটি পরিশোধন পদ্ধতি (filter mechanism), যার ভেতর দিয়ে সকল দাবি অদৃশ্য বা দৃশ্যমান হাত দিয়ে অতিক্রান্ত হবে, যাতে সম্পদ ও তার উপর দাবির মধ্যে একটা ভারসাম্য বিধান এবং কাম্য দক্ষতা ও সমতা বাস্তবায়িত করা যায়। এতে এমন একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে ব্যক্তি তাদের নিজেদের এবং সমাজের স্বার্থে সাধ্যানুযায়ী কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হবে। এতে আরো থাকতে হবে আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠনের জন্য একটি কার্যকর পন্থা, যাতে করে যতক্ষণ সর্বাধিক দক্ষতা ও সুষম বরাদ্দ ও বণ্টন অর্জিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এক হাত থেকে অন্য হাতে সম্পদের হস্তান্তর দ্রুততর হয়।
যদি একটি ব্যবস্থার (system) বিশ্ববীক্ষণ ও কৌশল তার লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তাহলে লক্ষ্যও বাস্তবায়ন করা যায় না। একটি আমগাছ জন্মাবার জন্য একটি আমের বীজ দরকার, এজন্য একটি লেবুর বীজ তা যত ভালোই হোক না কেন কোনো কাজে দেবে না। যে ব্যবস্থায় তার লক্ষ্য এবং বিশ্ববীক্ষণ ও কৌশলের মধ্যে অন্তর্নিহিত অসামঞ্জস্যতা বিদ্যমান তা তার অর্থনীতির কাঠামো ও সংগঠন এবং জীবনধারার মধ্যে মৌলিক বিন্যাস ঘটাতে সক্ষম নয়। সুতরাং সেগুলো হয় সংকটপ্রবণ। এরূপ ব্যবস্থায় বসবাসকারী জনগণ মিথ্যা প্রতিশ্রুতির শিকার হয় যা পূরন করা যায় না এবং এতে কিছু ছোট ধরনের সমন্বয় করা হলে তা কোনো ব্যাপারই নয়। এরূপ ছোটখাট সমন্বয় সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। এগুলো নিছক সামঞ্জস্যহীনতার লক্ষণগুলোকে প্রতিরোধ করে। কিন্তু বিশ্ববীক্ষণ ও কৌশল এবং লক্ষ্যের মধ্যে সামঞ্জস্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। ফলে সমস্যাগুলো প্রতিবারে ভিন্ন অবয়বে অধিকতর মারাত্মক এবং আরো অবনতিশীলভাবে পুনরায় আবির্ভূত হয়।
প্রচলিত ব্যবস্থাসমূহ
সৃষ্টিজগত ও প্রকৃতি সম্পর্ক ব্যাখ্যা এবং মানব জীবনের তাৎপর্য সম্বন্ধে বিভিন্ন ধারণা রয়েছে। এ সকল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ফলশ্রুতি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের জীবন ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা তার নিজস্ব বিশ্ববীক্ষণ ও অন্তর্নিহিত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং প্রতিটি ব্যবস্থাই অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য আলাদা কৌশল গ্রহণ করে থাকে। বর্তমান বিশ্বে তিনটি প্রধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে-পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও তাদের যুক্তফল সেকুলারিজম। এ সকল ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রেই সময়ের বিবর্তনে বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করার কারণে তার মূল বক্তব্যেও উল্লেখযোগ্য সংশোধন এসেছে এবং সমস্যা সমাধানের জন্যই পরিবর্তন আনতে হয়েছে। এসবের বর্তমান অবস্থা তার মূল থেকে দূরে সরে এসেছে। বিভিন্ন ব্যবস্থার সংশোধনী সত্ত্বেও এসব ব্যবস্থার ফলে ঐ সকল দেশে যে বিপুল সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে এবং আপেক্ষিকভাবে তাদের যে সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে এবং আপেক্ষিকভাবে তাদের যে সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে তারপর এদেশগুলো তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্নভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এদের মধ্যে আবার অনেকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা মোকাবিলা করেছে। তাদের সমস্যা অব্যাহতভাবে বেড়েই চলেছে। সামাজিক অস্থিরতা ও অপরাধ বাড়ছে এবং সাধারণ লোক এসব সংকটজনক পরিস্থিতির মোকাবেলা করছে।
এ গ্রন্থে যে সমস্যাগুলোর উপর আলোকপাত করা হবে, সেগুলো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপরিকাঠামোর সম্ভাব্য অথচ অকস্মাৎ ঘটনা (contingent event) নয়। বরং সেগুলো ঐ ব্যবস্থাসমূহের নিজস্ব অন্তর্নিহিত কাঠামোগত দুর্বলতার সহজাত ও মোটামুটি অপরিহার্য পরিণতি। এসব দুর্বলতা হচ্ছে তাদের লক্ষ্যের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতি, যার উৎস নিহিত রয়েছে তাদের বিশ্ববীক্ষণ ও কৌশলে। এগুলো সেকুলারিজমের ফল এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের সাথে বৈসাদৃশ্যের প্রতিফলন। অতএব ব্রুটের ভাষায় বিদ্যমান ব্যবস্থাগুলোর নিজেদের যেখানে ‘মানুষের শুদ্ধ দর্শন সম্পর্কে পুনঃচিন্তা’ প্রয়োজন, সেখানে তাদের পক্ষে এমন কোনো আদর্শ (model) দেয়া সম্ভব নয় যা মুসলিম দেশগুলো অনুকরণ করতে পারে এবং অপেক্ষাকৃত অনুসরণকারী দেশগুলোকে যেখানে পৌঁছেছে তার কাছাকাছি পৌঁছতেও মুসলিম দেশগুলোর কয়েক দশক লেগে যাবে।
বিকল্প ইসলামী ব্যবস্থা
ইসলাম এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ধারণা পোষণ করে যা বিদ্যমান ব্যবস্থাগুলো থেকে মৌলিকভাবে আলাদা। এর উৎস হচ্ছে শরীয়াহ এবং এর থেকে তার বিশ্ববীক্ষণ, লক্ষ্য ও কৌশলের উদ্ভব হয়েছে। বর্তমান প্রভাবশালী সেকুলার ব্যবস্থার মতো ইসলামের লক্ষ্য (মাকাসিদ আল-শরীয়াহ) মৌলিকভাবে জড় ও বস্তুগত বিষয় নয়। বরং এর ভিত্তি হচ্ছে মানবকল্যাণ (ফালাহ) ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন (হায়াতে তাইয়্যেবা) যাতে ভ্রাতৃত্ব ও আর্থ-সামাজিক সুবিচারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং প্রয়োজন হয় সকল মানুষের জন্য একটি বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থার। এর কারণ হলো, সেই ঈমান, যাতে বলা হয়েছে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি এবং তার উপর নির্ভরশীল হিসেবে সকল মানুষই সমান এবং আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত চাহিদা পূরণের মাধ্যমে সকলের প্রকৃত কল্যাণ সাধন না করা পর্যন্ত তারা মনের প্রকৃত সুখ ও প্রশান্তি লাভ করে না।
মাকাসিদ আল-শরীয়াহ
‘মাকাসিদ আল-শরীয়াহ’ (এ পুস্তকে সংক্ষেপে ‘মাকাসিদ’ ব্যবহার করা হবে) হচ্ছে শরীয়াহর সীমার মধ্যে থেকে ‘ফালাহ’ ও হায়াতে তাইয়্যেবা বাস্তবায়নের জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন তার সব কিছুই। শুরুতে গাজালীর যে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে তাতে দেখা যায়, মাকাসিদ হচ্ছে ঈমান, জীবন, বু্দ্ধিবৃত্তি, বংশধর ও সম্পদের সংরক্ষণ ও উন্নতি সাধনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবই।
গাজালী বিজ্ঞতার সাথেই মাকাসিদের তালিকায় ঈমানকে শীর্ষে রেখেছেন। কারণ ইসলামী বিষয়বস্তুতে ঈমান হচ্ছে মানবকল্যাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ঈমান মানুষের সম্পর্ককে একটি যথার্থ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে এবং মানুষের সকল কল্যাণ নিশ্চিত করতে সহায়তা করার জন্য পরস্পরের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ ও সযত্ন মিথস্ক্রিয়ায় সক্ষম করে তোলে। এতে আরো রয়েছে একটি নৈতিক পরিশোধন পদ্ধতি (moral filter) যাতে ভ্রাতৃত্ব ও আর্থ-সামাজিক সুবিচারের মানদণ্ড অনুসারে সম্পদের বরাদ্দ ও বিতরণ করা হয়। এছাড়া একটি উদ্বুদ্ধকরণ ব্যবস্থায় (motivating system) চাহিদা পূরণ এবং আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টনের লক্ষ্যের সাথে তাকে সম্পৃক্ত করে। মানবীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তথা গৃহস্থালী, সংস্থার বোর্ড মিটিং, বাজার অথবা কেন্দ্রিয় রাজনৈতিক পরিষদ ইত্যাদি নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রে ঈমানকে অনুপ্রবিষ্ট করা না গেলে সম্পদের বরাদ্দ ও বণ্টনের ক্ষেত্রে দক্ষতা ও ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না এবং সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা অথবা অপরাধ, বিবাদ-বিসংবাদ, উত্তেজনা ও অস্থিরতার বিভিন্ন লক্ষণসমূহ দূর করা যাবে না।
নৈতিক পরিশোধনের পথ অবলম্বন ব্যতীত দক্ষতা ও ন্যায়পরতার সংজ্ঞা নির্ণয় সম্ভব নয়। ফ্রাঙ্ক নাইট যথার্থ বলেছেন, ভৌত বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হলো ‘বস্তু না সৃষ্টি করা যায়, না ধ্বংস করা যায়’। ভৌত মাপকাঠিতে মোট আউটপুট (output) সর্বদাই ও ইনপুটের (inupt) সমান হবে। অতএব দক্ষতার সঠিক সংজ্ঞা আউটপুট ও ইনপুটের অনুপাতের মধ্যে নির্ণীত হবে না, বরং তা হবে কার্যকর আউটপুট (useful output) এবং মোট আউটপুট অথবা ইনপুটের অনুপাতের ভিত্তিতে। এর অর্থ হচ্ছে দক্ষতা পরিমাপের জন্য দরকার এর প্রয়োজনীয়তার (usefulness) পরিমাপ। পরবর্তীতে এ গ্রন্থে যুক্তি উপস্থাপিত হবে যে, যদি সকলের কল্যাণ সাধন উদ্দেশ্য হয়, তা হলে ব্যক্তিগত অগ্রাধিকার ও মূল্য কোনো পরিমাপক হতে পারে না। পরিপূরক হিসেবে সমাজসম্মত নৈতিক পরিশোধন পদ্ধতি প্রয়োজন। যদি নৈতিক মানদণ্ড ছাড়া দক্ষতা সংজ্ঞায়িত করা কঠিন হয়, তাহলে এসব ব্যতীত ন্যায়পরতার (equity) সংজ্ঞা নির্ণয় করা আরো কঠিন হবে।
গাজালী সম্পদকে তালিকার সর্বনিম্নে স্থান দিয়েছেন, কারণ তা নিজেই চূড়ান্ত বিষয় নয়; বরং সেটি হচ্ছে একটি মাধ্যম মাত্র যা মানবকল্যাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সম্পদ নিজে কোনো সাহায্য করতে পারে না, যদি না তার বরাদ্দ দক্ষতার সাথে এবং বণ্টন ন্যায়পরায়ণতার সাথে করা হয়। অভীষ্ট সম্পদ অর্জন এবং কেন্দ্রিয় রাজনৈতিক সংস্থা পরিচালনার জন্য কতিপয় নৈতিক মানদণ্ড প্রয়োজন, যার ইঙ্গিত আগেই দেয়া হয়েছে। যদি সম্পদ নিজেই একটি চূড়ান্ত বিষয় হয়, তাহলে তার পরিণাম হবে অবিচার, ভারসাম্যহীনতা ও পরিবেশগত অনাচার, যা অবশেষে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের অধিকাংশের কল্যাণকে সংকুচিত করবে। মধ্যবর্তী তিনটি লক্ষ্য-জীবন, বুদ্ধিবৃত্তি ও বংশধর-মানুষের নিজের সাথে সংশ্লিষ্ট, আর এসবের কল্যাণ সাধনই শরীয়াহর উদ্দেশ্য।
এ তিনটি বিষয়ের উন্নতির লক্ষ্যে যে নৈতিক প্রতিশ্রুতির সুস্টষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা সম্পদের বরাদ্দ ও বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। কিন্তু তা সেকুলের পরিবেশে কেবলমাত্র মূল্য ও বাজারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ সম্ভব নয়। কেবল মাত্র ধনী ও উচ্চবিত্তদের নয়, বরং সকল মানুষের জীবন, বুদ্ধিবৃত্তি ও বংশধরদের সংরক্ষণ ও উন্নতি বিধান করতে হবে। সকলের ক্ষেত্রে এ তিনটি জিনিসের উন্নতির জন্য যা কিছু করা দরকার, তা একটি ‘প্রয়োজন’ (need) হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তা পূরণ করার জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করতে হবে। যেমন-পর্যাপ্ত পুষ্টি, বস্ত্র, আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির জন্য যথাযথ পরিচর্যা ও শিক্ষা, বাসস্থান, একটি সুষ্ঠু ও ভৌত পরিবেশ (ক্রমহাসমান উত্তেজনা, অপরাধ ও দূষণ), চিকিৎসা সুবিধা, আরামদায়ক পরিবহন, সকল আবশ্যকীয় পারিবারিক ও সামাজিক বাধ্যবাধকতা পূরণের জন্য যথেষ্ট অবকাশ এবং সৎ পন্থায় উপার্জনের সুযোগ থাকতে হবে। সম্পদের বরাদ্দ ও বণ্টনের অবশ্যই একটা নির্দেশনা থাকতে হবে, যা এতসব বিষয়ে ও অন্যান্য আবশ্যকীয় প্রয়োজন পূরণে সাহায্য করবে। এ সকল প্রয়োজন পূরণের ফলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উভয়ই শান্তিপূর্ণ, স্বস্তিকর, সুস্থ ও দক্ষ হিসেবে গড়ে উঠবে এবং ‘ফালাহ’ ও ‘হায়াতে তাইয়্যেবা’ বাস্তবায়ন ও তাকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হয়ে উঠবে। যে বরাদ্দ ও বণ্টন ‘ফালাহ’ ও ‘হায়াতে তাইয়্যেবা’ বাস্তবায়নে সাহায্য করে না, যা উপরে উল্লিখিত ইবন আল কাইয়্যেমের উদ্ধৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং যা বিজ্ঞতার পরিচায়ক নয়, তাকে দক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ বলে বিবেচনা করা যায় না।
বিস্তীর্ণ ব্যবধান
দুর্ভাগ্যবশতঃ কতকগুলো ঐতিহাসিক কারণে শরীয়াহ ও মুসলিম দেশগুলোর বাস্তব অবস্থার মধ্যে বিস্তীর্ণ ব্যবধান রয়েছে। এর মধ্যে দুটো কারণ হচ্ছেঃ মুসলমানদের অধঃপতন এবং পরবর্তীতে পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী উভয় সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক শাসন-শোষণ। বর্তমান মুসলিম সমাজ ইসলামের আধ্যাত্মিক শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটায় না। সত্যি বলতে কি, সমাজের বিশাল অংশের মধ্যে ইসলামী সমাজের জন্য যে আবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন, সে সম্পর্কেও তাদের সচেতনতা নেই। মুসলিম দেশগুলোতে প্রধান আদর্শ ইসলাম নয়, বরং সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের সমন্বয়ে গঠিত সেকুলারিজম। ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মুসলিম বিশ্বের কোনো অংশেই প্রচলিত নেই। মুসলিম দেশগুলো বিদ্যমান ব্যবস্থাসমূহের সেকুলার মতাদর্শের পরিপ্রক্ষিতে রচিত নীতির মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের সমস্যার আরো অবনতি ঘটেছে এবং মাকাসিদের উপলদ্ধি থেকে তারা বহুদূরে সরে যাচ্ছে। দেশের মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও দারিদ্র্য কমেনি, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। আয় ও সম্পদে বৈষম্যের আরো অবনতি ঘটেছে এবং তাদের জনগণের মৌলিক চহিদা এখনো অপূরণীয় রয়ে গেছে। সরকারি খাতে বাজেট ঘাটতি এবং একইভাবে লেনদেনের ভারসাম্যে (balance of payment) ঘাটতি এবং বৈদেশিক ঋনের বোঝা বৃদ্ধি পেয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির হুমকি তো রয়েছেই। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মাদ বলেছেন, তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্য দূরীকরণের ধারণা দৌড়ে পালিয়েছে। উন্নত অর্থনীতির সাথে আলোচনার মধ্যে সমাধান খোঁজ করার বিষয়টি বাস্তবে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তৃতীয় বিশ্বের কর্মকর্তারা এখন স্ফীত ঋণগ্রস্ততার মধ্য থেকে দরিদ্র দেশগুলোকে টেনে তোলার জন্য নতুন ধারণা উদ্ভাবনের মতো নিরুৎসাহমূলক কাজে নিয়োজিত। কেন এরকম হলো? ইসলামীকরণ (ইসলামী শিক্ষার আলোকে মুসলিম দেশগুলোর অর্থনীতির পুনর্গঠন) কি এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে না?
এ গ্রন্থ প্রসঙ্গে
এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার একটি প্রয়াস এ গ্রন্থ। এর দুটি ভাগ রয়েছে। প্রথম অংশে ব্যর্থ মতবাদসমূহের আলোচনা করা হয়েছে। মুসলিম দেশসমূহ আর্থ-সামাজিক লক্ষ্যসমূহ অর্জন করতে চাইলে তদেরকে ঐসব মতবাদ পরিত্যাগ করতে হবে। এ অংশের প্রথম তিনটি অধ্যায়ে বিদ্যমান ব্যবস্থাসমূহের বিশ্ববীক্ষণ ও কৌশণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে; কিন্তু তা নিছক সমালোচনার জন্য নয়, বরং ঐ সকল ব্যবস্থার লক্ষ্য, তার বিশ্ববীক্ষণ ও কৌশলের মধ্যে যে অসংগতি রয়েছে তার কারণ, ধরন ও ফলাফল সনাক্ত করাই আসল উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে পাঠকরা উপলদ্ধি করতে পারেন যে, সে সকল ব্যবস্থার অনুসারী দেশগুলোতে দুষ্প্রাপ্য সম্পদের দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে বরাদ্দের বিষয়টি কিভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও একই পরিণতি হবে। চতুর্থ অধ্যায়ের আলোচনায় দেখা যাবে যে বিদ্যমান ব্যবস্থাগুলোর প্রেক্ষিতে যে নীতিমালা প্রণয়ন হয়েছে, তা কিভাবে অর্থনৈতিক নীতি কৌশলের সাথে অসংগতিপূর্ণ হয়ে পড়েছে এবং তার প্রভাব উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও পড়েছে। এর ফলে সামষ্টিক অর্থনীতি ও বহির্দেশীয় ভারসাম্যহীনতা পরিস্থিতির শুধু অবনতিই ঘটাচ্ছে না, বরং ন্যায়পরতা আনয়নের লক্ষ্যকেও বানচাল করে দিয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে সাতটি অধ্যায় যাতে ইসলামের জবাব তুলে ধরা হয়েছে। এ অধ্যায়গুলোর প্রথমটিতে অর্থাৎ পঞ্চম অধ্যায়ে বিশ্ববীক্ষণ ও ইসলামের কৌশল এবং মাকাসিদের সাথে অন্তর্নিহিত সংগতির বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ষষ্ঠ অধায়ে মুসলিম বিশ্বের অস্থিরতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে পাঁচটি নীতির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ভারসাম্যহীনতা দীর্ঘায়িত না করে মাকাসিদ বাস্তবায়নের জন্য ইসলামী আদর্শের আলোকে মুসলিম দেশগুলোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এ সকল নীতি কৌশলের উপর প্রতিটি আলাদা অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এগুলো একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যবস্থার জন্য এতটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, সকল আর্থ-সামাজিক সংস্কার এবং দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এগুলো কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে স্থান করে আছে। অষ্টম অধ্যায়ে সম্পদের পুঞ্জিভূতকরণ হ্রাস করার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে যা আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য দরকারি এবং ইসলাম এ মূল্যবোধ ব্যবস্থার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেছে। নবম ও দশম অধ্যায়ে ইসলামের আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য হাসিলের জন্য অর্থনৈতিক ও আর্থিক পুনর্গঠনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। একাদশ অধ্যায়ে ইসলামী আদর্শের নীতিগত বিষয়াদি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কৌশলগত নীতি পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
উপসংহারে সমগ্র বইয়ের ১১টি অধ্যায়ের আলোচনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে। এর ফলে পাঠকরা সার্বিক বিষয়গুলোর সারমর্ম দেখতে পারবেন। যেহেতু এ গ্রন্থে মৌলিকভাবে অর্থনৈতিক সমস্যার আলোচনা করা হয়েছে, সেহেতু এতে ফালাহ ও হায়াতে তাইয়্যেবার অর্থনৈতিক সমস্যা সংক্রান্ত সংশ্লিষ্টতা ব্যতীত আধ্যাত্মিক দিকগুলোর উপর আলোকপাত করা হয়নি।
একটি মাত্র পুস্তকে সকল মুসলিম দেশের সমস্যার আলোচনা অযৌক্তিক। অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে উচ্চ আয়, মধ্যম আয় ও নিম্ন আয়ের দেশগুলো বিভিন্ন ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করছে। অবশ্য এটা সত্য যে, তাদের সমস্যাগুলোর বৈশিষ্ট্য একই ধরনের, পার্থক্য শুধু তাদের মাত্রায়। তারা সবাই সম্পদের আপেক্ষিক দুষ্প্রাপ্যতায় ভুগছে। এসব সত্ত্বেও বিদ্যমান ভারসাম্যহীনতা আর দীর্ঘায়িত না করে ‘মাকাসিদ’ হাসিলের লক্ষ্যে কাজ করা মুসলিম দেশগুলোর অলঙ্ঘনীয় নৈতিক দায়িত্ব। সুতরাং তারা সবাই বিভিন্ন মাত্রায় এ আলোচনা থেকে উপকৃত হতে পারেন। এ গ্রন্থে অবশ্য প্রধানত দরিদ্রতর ও মধ্য আয়ের অধিকতর সমস্যা সংকুল দেশগুলো সম্পর্কেই আলোচনা করা হয়েছে।
নোট ও তথ্যসূত্র (ভূমিকা)
১. আল গাজালী, al-Mustafa (১৯৩৭), পৃষ্ঠা ১৩৯-৪০।
২. ইবন কাইয়্যেম আল-জাওজিয়াহ, I’lm al-Muwaqqi’in (১৯৫৫), খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৪।
৩. মানুষের বস্তুগত চাহিদা নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের প্রথমেই নির্ধারণ করতে হবে যে, মানুষের অস্তিত্ব, স্বাচ্ছন্দ্য ও মানবীয় উন্নয়নে কী কী বিষয় সত্যিকারভাবে অবদান রাখে। এ কাজ কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।এ বিষয়ে কেইনস এর মতামত সহায়ক হতে পারে। তিনি বলেন, যদিও “মানুষের চাহিদা দৃশ্যতঃ অপূরণীয়….; সেগুলো দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত। আমাদের চারপাশে মানব সমাজের অবস্থা যাই হোক না কেন, এক প্রকার চহিদা সুনিশ্চিতভাবে আমরা অনুভব করি, আর অপর এক প্রকার চহিদা পূরণ আমাদের চারপাশের মানুষের তুলনায় সৌভাগ্যের অধিকারী করে বা শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি দান করে। দ্বিতীয় শ্রেণীর যে সকল চাহিদা শ্রেষ্ঠত্বের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে, সেগুলো হয়ত সত্যিই অপূরণীয়। কারণ অবস্থান যত উপরেই হোক, আরো উপরে ওঠার সুযোগ থেকেই যায়। কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে অনুভূত হয় এমন চহিদার ক্ষেত্রে একথা সঠিক নয়। (J. M. Keynes, The Collected Writtings of John Maynard Keynes, vol. IX, Essays in Persuasion, the essay on “Economic Possibilities for our Grandchildren”, ১৯৭২ পৃষ্ঠা ৩২৬)। এই শ্রেণীবিভক্তির কারণ থেকে বোঝা যায় যে,সুনিশ্চিত চাহিদাগুলো মানুষের নিজের মধ্যেই সৃষ্টি হয় এবং মানবীয় অবস্থার কারনেই আবশ্যক হয়। মানুষের অস্তিত্ব, স্বাচ্ছন্দ্য ও মানবীয় উন্নতির জন্য এগুলোর প্রয়োজন। পক্ষান্তরে যে সকল চাহিদা আপেক্ষিক সে সকল চাহিদা, Galbraith এর ভাষায়, তার নিজের কারণেই উদ্ভাবিত (Galbraith, The Affluent Society: পৃষ্ঠা ১৫২)। তারা মর্যাদা বৃদ্ধিকারী সামগ্রী ও অন্য এমন সকল দ্রব্য ও সেবাকে চাহিদার অন্তর্ভূক্ত করে ফেলে, যেগুলো তাদের কল্যাণ বাড়ায় না। প্রথমটিকে বলা যায় চাহিদা এবং অপরটিকে অভাব। এই অভাব পূরণ করার আকাঙ্ক্ষা প্রচারণা ও অন্যের সমতুল্য হওয়ার সামাজিক চাপ থেকে কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি হয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তির নিজের সম্পদ দ্বারা নিজের ও তার উপর নির্ভরশীল লোকদের বস্তুগত চাহিদা পূরণ করার অবমতাকে দারিদ্র্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তবে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও চাহিদা পূরণ করা এক বিষয় নয়। এক ব্যক্তির চাহিদা অপর কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের সহায়তায় পূরণ যায় যেতে পারে। তবে ব্যক্তিকে নিজের প্রচেষ্টায় স্বীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সক্ষম করে তোলাই হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। তবে ব্যক্তির শারীরিক বা মানসিক অবমতা অথবা উপযুক্ত কর্মসংস্থান যোগাড়ে অসুবিধার কারণে এ লক্ষ্য সর্বদা সফল নাও হতে পারে।
৪. মুহাম্মদ বাকির আল সদর এ বিষয়ে ইসলামের অবস্থান যথার্থই বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন যে, অ-সুষম বণ্টন এবং ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে মানবীয় সম্পের্কের নৈতিক কাঠামোর অনুপস্থিতির ফলেই দারিদ্র্য ও বঞ্চনার জন্ম হয়েছে ( মুহাম্মদ বাকির আল সদর, Iqtisaduna (১৯৮১), পৃষ্ঠা ৩৪৩।
৫. এ বিষয়ে প্রচলিত অর্থনীতিবিদগণের উপস্থাপনা সুস্পষ্টভাবে জানার জন্য দেখুন Milton Rose Friedman, Free to Choose (১৯৮০), পৃষ্ঠা ৯-৩৭ এবং P.A. Samuelson, Economics (১৯৮০), পৃষ্ঠা ১৫-১৮।
৬. Arthur Lovejoy, The Great Chain of Being (১৯৬০), পৃষ্ঠা ৭।
৭. এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন Edward S. Greenberg, serving the Few: Corporate Capitalism and the Bias of Government Policy (১৯৭৪) এবং সেকুলার কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখুন Claus Offe, Contradictions of the Welfare State, ed., John keane (১৯৮৪) সম্পাদিত।
৮. আম ও লেবু বীজের দৃষ্টান্ত সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী’র Islami Riyasat গ্রন্থের (১৯৮২), পৃষ্ঠা ৬৯৫ থেকে নেয়া হয়েছে।
৯. Edwin A. Burtt, The Metaphysical Foundations of modern Science (১৯৫৫), পৃষ্ঠা ২৭।
১০. ‘ফালাহ’ (কল্যাণ) শব্দটি আল কোরআনে অন্তত চল্লিশবার বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রতিদিন পাঁচবার মসজিদের মিনার থেকে কল্যাণের দিকে ডাকা হয়। এ ভাষা আজানে দু’বার উচ্চারণ করা হয়, “কল্যাণের দিকে আস”। ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মিক উন্নতি হলো মানুষের কল্যাণের অপরিহার্য উপাদান। আত্মিক উন্নয়ন ব্যতীত কল্যাণের যে কোনো প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।’হায়াতে তাইয়্যেবা’ ভাষ্যটি কোরআনের এ আয়াত থেকে এসেছে: “যে সকল পুরুষ ও নারী সৎকর্ম করে ও ঈমান আনয়ন করে, তাদেরকে নিশ্চয়ই ‘হায়াতে তাইয়্যেবা’ দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের (পরকালে) শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।” (১৬:৯৭)
১১. দেখুন, M. Anas Zarqa, “Capital Allocation, Efficiency and Growth in an Interest-free Islamic Economy, নভেম্বর ১৯৮২, পৃষ্ঠা ৪৯ এবং Islamics: An Approach to Human Welfare, K. Ahmed, Studies in Islamic Economics (১৯৮০), পৃষ্ঠা ৩-১৮। আরো দেখুন Benjamin Ward, What is Wrong with Economics? (১৯৭২), পৃষ্ঠা ২১১।
১২. দেখুন W. Breit এর Readings in Microeconomis (১৯৮৬) গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৪) উল্লিখিত Frank H.Knight, The Economic Organisation এর পুন:মুদ্রিত Social Economic Organisation পৃষ্ঠা ৩-৩০. আমি (লেখক) ড. আনাস জাকরার নিকট কৃতজ্ঞ। তিনি এ প্রযুক্তির প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
১৩. Arab News, ২ মার্চ ১৯৮৮।
১৪. এখানে Gottfried Haberler- কে উদ্ধৃত করা প্রাসঙ্গিক হবে। তিনি বলেন, “কতিপয় উন্নয়ন অর্থনীতিবিদগণ যাকে ‘monoeconomics’ বলেন অর্থাৎ যে সকল নীতি উন্নত ও অনুন্নত দেশে একইভাবে প্রযোজ্য- আমি তাতে বিশ্বাস করি। কিন্তু monoeconomics অনুসরণ করলেও সকল দেশের নীতি নির্ধারণের পরিপ্রেক্ষিত এক হবে এমন কথা নেই।” (M. Meier সম্পাদিত. Pioneers in Development, দ্বিতীয় সিরিজ (১৯৮৭), পৃষ্ঠা ৫৩ এ উল্লিখিত Gottfried Haberler, Liberal and Illiberal Development Policy).
Leave a Reply