ইসলামের উপর ৪০টি অভিযোগ এবং তার প্রমাণ ভিত্তিক জবাব – ডা. জাকির নায়েক
অনুবাদক – মোঃ আব্দুল কাদের মিয়া
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকা ।
ই-বুক নির্মাতা : জহুরুল ইসলাম
.
প্রশ্ন-১. সব মানবধর্মই ভালো জিনিসের শিক্ষা দেয়, তারপরেও কোনো ব্যক্তির ইসলামের অনুসরণ করতে হবে কেন? কেন তিনি অন্য কোনো ধর্মের অনুসরণ করতে পারবেন না?
উত্তর : মূল ভিত্তির দিক দিয়ে সকল ধর্মই মানুষ সঠিক পথে চলার এবং খারাপ পথ থেকে বেঁচে থাকার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। কিন্তু ইসলাম এসব থেকে বড় কিছু করে। ইসলাম আমাদের সোজা রাস্তার ওপর চলতে এবং নিজ একক ও সমষ্টিগত জীবনকে যাবতীয় খারাবি থেকে বাঁচার জন্য কর্মের দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকে। ইসলাম মানুষের প্রকৃতি ও সামাজিক সমস্যাকে সামনে রাখে। ইসলাম মূলত স্রষ্টার সৃষ্টির পক্ষ থেকে দিক-নির্দেশনা। এজন্য ইসলামকে প্রাকৃতিক ধর্ম’ বলা হয়।
ইসলাম এবং অন্য ধর্মের যে মৌলিক পার্থক্যগুলো, তা কয়েকটি বিষয় দ্বারা স্পষ্ট হবে। সকল ধর্মই এ শিক্ষা দেয় যে- চুরি, লুণ্ঠন এবং মারামারি খারাপ কাজ। ইসলামও এ কথাগুলো বলে, তাহলে ইসলামের সাথে অন্য ধর্মগুলোর পার্থক্য কী? পার্থক্য এই যে, ইসলাম চুরি ও লুঠতরাজ খারাপ কাজ, এটা বলার সাথে সাথে এ বিধানও দেয় যাতে লোকেরা লুঠতরাজ না করে। ইসলাম এজন্য নিম্নরূপ বিধান জারি করে :
১. ইসলাম মানবকল্যাণের জন্য যাকাতের বিধান প্রদান করে। ইসলাম বলে যে, যার সম্পদ পঁচিশ গ্রাম অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা তার সমপরিমাণ পৌছাবে সে প্রত্যেক বছর শতকরা আড়াই ভাগ আল্লাহর রাস্তায় (নির্ধারিত ৮টি খাতে) বণ্টন করবে। যদি প্রত্যেক ব্যক্তি ঈমানদারির সাথে যাকাত আদায় করতে থাকে, তাহলে দুনিয়া থেকে দারিদ্র দূর হতে বাধ্য, যা চুরি ও লুঠতরাজের মূল কারণ।
২. ইসলাম চোরের হাত কাটার শাস্তি প্রদান করে, যা কুরআনের ৫ নং সূরা মায়িদার ৩৮ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে এভাবে
অর্থ : চোর নারী হোক কি পুরুষ হোক তাদের কৃত কর্মের ফল স্বরূপ তাদের হাত কেটে দাও, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি। এ শাস্তির ওপর অমুসলিমরা একথা বলে যে, বিংশ শতাব্দীতে হাত কাটার শাস্তি! ইসলাম তো একটি জুলুম ও পশুত্বের ধর্ম। কিন্তু এরূপ বলা প্রকৃত ঘটনার বিপরীত। আমেরিকাকে বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশ মনে করা হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে এ অপরাধ সবচেয়ে বেশি। আবশ্যকীয়ভাবে যদি আমেরিকাতে ইসলামি আইন করে দেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী যদি আমেরিকার প্রত্যেক ব্যক্তি যাকাত আদায় করে, প্রত্যেক চুরির শাস্তি যদি হাত কাটা হয়, তাহলে আমেরিকায় চুরি-ডাকাতির অপরাধ কি বাড়বে, নাকি কমবে, নাকি এরূপই থাকবে? অবশ্যই কমবে এবং এ আইন দ্বারা চোরের চুরি করার প্রবণতা কমতে বাধ্য।
আমি এ কথার সাথে একমত যে বর্তমানে চোরের সংখ্যা দুনিয়াতে অনেক এবং যদি হাত কাটার আইন কার্যকর হয়, তাহলে লাখ লাখ চোরের হাত কাটা পড়বে। কিন্তু এ দিকটা মনে রাখতে হবে যে, যখনই এ বিধান কার্যকর হবে তখনই চোরের সংখ্যা কমে যাবে, তবে অবশ্যই তার পূর্বে যাকাতের বিধান কার্যকর করতে হবে। সমাজে সদকা, খয়রাত এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার প্রবণতা বাড়াতে হবে, দরিদ্রদের সাহায্য করার প্রবণতা বাড়াতে হবে। এরপর এ শাস্তি কার্যকর করতে হবে, তারপর চুরি করতে হলে চোর শত শত বার চিন্তা-ভাবনা করেই চুরি করবে। এরপরও যদি কেউ চুরি করে সে হবে স্বভাব চোর। কঠিন শাস্তির ভয় যা অন্যের শিক্ষা গ্রহণের বিষয় হবে, যা লুঠতরাজ থেকে বিরত রাখবে।
এরপর এ অপরাধ প্রবণতা একেবারেই কমে যাবে এবং একান্ত স্বভাব চোরদের হাত কাটা পড়ে যাবে। ফলে লুঠতরাজের হাত থেকে দুচিন্তামুক্ত হয়ে মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে থাকবে। ৩. সকল বড় বড় ধর্মে নারীদের সম্মান দেয় এবং তাদের ইজ্জত হরণকারীদের গুরুতর অপরাধী হিসেবে গণ্য করে। এ ব্যাপারে ইসলামে অন্য ধর্ম থেকে পার্থক্য কী? পার্থক্য এই যে, ইসলাম শুধু মহিলাদের সম্মান দেখানোর নির্দেশই দেয় না এবং তাদের ইজ্জত হরণকারীর অপরাধকে গুরুতরই গণ্য করে নি বরং এ সংক্রান্ত জঘন্য ঘটনার পূর্ণ তদারকি করে, সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ কীভাবে নির্মূল হবে ব্যবস্থা করে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামে পর্দার মতো একটি উত্তম বিধান চালু রয়েছে। আল কুরআন প্রথমে পুরুষকে পর্দা পালনের নির্দেশ দিয়েছে। ২৪ নং সূরা নূরের ৩০ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন
অর্থ : হে নবী! মুমিনদের বলুন! তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে ও নিজেদের লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে, এটা তাদের জন্য পবিত্রতর উত্তম পন্থা। কারণ তারা যা কিছু করে তা সম্পর্কে আল্লাহ ওয়াকিফহাল। ইসলাম বলে যে, কেননা ব্যক্তি অ-মুহরিম কোনো নারীকে দেখে ফেললে তার তৎক্ষণাৎ চোখ নিচু করা কর্তব্য। এরূপভাবে নারীদের জন্যও পর্দার হুকুম আছে। ২৪ নং সূরা আন নূর-এর ৩১ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন
অর্থ : হে নবী! আপনি মুমিন নারীদেরও বলে দিন তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিম্নগামী রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজত করে, তারা যেন তাদের সৌন্দর্যকে প্রদর্শন না করে। তবে শরীরের যে অংশ এমনিতেই খোলা থাকে তা ছাড়া, তারা যেন তাদের বক্ষদেশকে মাথার কাপড় বা চাদর দ্বারা আবৃত করে রাখে। তারা যেন তাদের স্বামী, তাদের পিতা, তাদের শ্বশুর, তাদের ছেলে, তাদের স্বামীর (আগের ঘরের) ছেলে, তাদের ভাই, তাদের ভাইয়ের ছেলে, তাদের বোনের ছেলে, তাদের নিজস্ব মহিলা, নিজেদের অধিকারভুক্ত দাসী, নিজেদের অধীনস্ত পুরুষ যাদের কাছ থেকে নারীদের জন্য কামনার কিছু নেই, অথবা এমন শিশু যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে কিছুই জানে না, তাদের ছাড়া অন্য কারোর সামনে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। চলার সময় তারা জমিনের বুকে এমনভাবে পা না মারে যাতে তাদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়ে পড়ে। হে ঈমানদার লোকেরা! ক্রটি-বিচ্যুতির জন্য তোমরা সবাই আল্লাহর দরবারে তওবা কর, আশা করা যায় তোমরা সফলতা অর্জন করতে পারবে।
পর্দা হলো নারীর জন্য সারা শরীর আবৃত থাকবে এবং কেবল চেহারা ও হাত খালি রাখা যাবে এবং মহিলারা যদি চায় তাহলে এগুলোকেও ঢেকে রাখতে পারবেন। অনেক আলেম (পণ্ডিত) গণের মতে, চেহারা ঢেকে রাখা আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা পর্দার হুকুম কেন দিলেন? এ সম্পর্কে আল কুরআনের ৩৩ নং নম্বর সূরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াতে ঘোষণা করেন
অর্থ : হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা ও মুমিন স্ত্রীদের বলে দিন তাদের চাদরের কিছু অংশ যেন তারা তাদের মুখমণ্ডলের ওপর টেনে দেয়। এতে (সম্মানিত মহিলা হিসেবে) তাদের চিনতে সুবিধা হবে। এতে তাদের কষ্টও দেওয়া হবে না। মহান আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আপন দুই বোন, দুজনই সুন্দরী, সুশ্রী এবং তারা এক গলি দিয়ে হেটে যাচ্ছে। একজন ইসলামি হিজাব পরিহিতা এবং দ্বিতীয় জন পাশ্চাত্য আধুনিক স্টাইলে মিনি স্কার্ট পরিহিতা। গলির মুখে এক বখাটে দাঁড়ানো আছে। এদের দুজনের মধ্যে কোন মেয়েকে বিরক্ত করার সম্ভাবনা, সে কার সঙ্গে এদিক ওদিক করবে? হিজাব পরিহিতা মেয়ে, নাকি মিনি স্কার্ট পরিহিতা, কার সঙ্গে? উত্তর হবে মিনি স্কাট পরা মেয়ের সঙ্গে। আর ঐ পোশাক যা শরীর ঢেকে রাখে তা তাকে।
বাঁচিয়েছে এবং এর বিপরীতকে বিরক্ত ও কুকর্মের আহ্বান জানাবে। এজন্য আল-কুরআন সঠিক বলেছে যে, হিজাব (পর্দা) নারীকে এ সকল থেকে সংরক্ষণ করে। ইসলামে ধর্ষণকারীর সাজা মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। (জেনার শাস্তি রজম অর্থাৎ পাথর মারা এবং বেত্রাঘাত করা।) অমুসলিমরা বলে থাকে যে, এটা একটা বড় শাস্তি। অনেক লোক ইসলামকে জালিম ও পাশবিক ধর্ম বলে থাকে। আসলে এটা ঠিক নয়। আমি অনেক অমুসলিমের নিকট এ প্রশ্ন করেছি যে, আল্লাহ না করুন কেউ আপনার স্ত্রী, মা অথবা আপনার বোনের সাথে বাড়াবাড়ি করল, এদের ইজ্জত হরণ বা শ্লীলতাহানী করল এবং এর বিচারের জন্য আপনাকে জজ বা বিচারক বানানো হলো এবং অপরাধীকে আপনার সামনে উপস্থিত করা হলো।
এক্ষেত্রে আপনি কোন শাস্তি প্রদান করবেন? সবাই উত্তর দিয়েছে, আমি একে হত্যা করব এবং কেউ কেউ এ পর্যন্ত বলেছে যে, আমি তার ওপর ততক্ষণ পর্যন্ত অত্যাচার চালাব যতক্ষণ পর্যন্ত তার জীবনপাত না ঘটে। যদি কেউ আপনার নিজ স্ত্রী, কন্যা, বোন অথবা মায়ের সঙ্গে ব্যভিচার করে তাহলে আপনি তাকে হত্যা করতে চান, অথচ অন্য কারো স্ত্রী, বোন, মায়ের সঙ্গে একই অপরাধ করলে একই ধরনের শাস্তি দিলে তাকে জুলুম এবং পাশবিক কাজ কীভাবে বলা যায়? এটা কি দ্বিমুখী নীতি নয়? আমেরিকা, যাকে বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে উন্নত রাষ্ট্র ধারণা করা হয়। এ দেশের ১৯৯০ সালের এফ.বি.আই. রিপোর্ট অনুযায়ী ধর্ষণের ১,০২,৫৫৫টি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে।
এ সকল মামলা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এগুলো অভিযোগের শতকরা ২১ ভাগ মামলা যা রেকর্ড করা হয়েছে। ১৯৯০ সালের মামলার সঠিক সংখ্যা জানতে উপযুক্ত সংখ্যাকে ৬.২৫ দিয়ে পূরণ করুন দেখবেন সংখ্যাটি ৬,৪০,৯৬৮ হবে। যদি এ সংখ্যাকে বছর থেকে দিনে পরিণত করতে চান, তাহলে ৩৬৫ দিয়ে ভাগ দিলে দৈনিক ১,৭৫৬ হবে। পরবর্তীতে আরেকটি রিপোর্ট এলো যাতে এ বছরের প্রতিদিনের ধর্ষণের ঘটনা ১৯০০-তে পৌঁছেছে।
আমেরিকার বিচার ইনসাফের ন্যাশনাল ক্রাইম সার্ভে ব্যুরো (N.C.S.B)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯২ সালে ধর্ষণের ৩,০৭,০০০টি ঘটনার রিপোর্ট করা হয়েছে যা মূল রিপোর্টের শতকরা ৩১ ভাগ ছিল। ধর্ষণের মূল ঘটনা ছিল ৯,৯০,৩৩২টি যা দশ লাখের কাছাকাছি। অর্থাৎ এ বছর আমেরিকায় প্রতি ৩২ সেকেন্ডে ধর্ষণের মত অপরাধের একটি ঘটনা ঘটেছে। আর আমেরিকা অপরাধের এক বড় ক্ষেত্র হয়েছে।
১৯৯০ সালের এফ.বি.আই. রিপোর্ট মোতাবেক ওখানে ধর্ষণের যে ঘটনাবলির রিপোর্ট করা হয়েছে তাদের মাত্র শতকরা ১০ ভাগ অপরাধী গ্রেফতার হয়েছে যা মোট সংখ্যার মাত্র শতকরা ১.২ ভাগ ছিল। এ ধরনের অপরাধে গ্রেফতারকৃত লোকদের শতকরা ৫০ ভাগকে মামলা রেকর্ডভুক্ত হবার পূর্বেই ছেড়ে দেয়া হয়। অর্থাৎ মাত্র শতকরা ৮০ ভাগ লোককে মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এখন বুঝুন যদি কোনো ব্যক্তি ১২৫ বার ধর্ষণের অপরাধ করে, তাহলে তাকে মাত্র ১ বার শাস্তি লাভ করতে হতে পারে। অন্য আরেকটি রিপোর্ট অনুযায়ী শতকরা ৫০ ভাগ লোক যাদেরকে এ ধরণের মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের এক বছরেরও কম সময়ের জন্য জেল খাটার শাস্তি হয়েছে।
আমেরিকাতে এ ধরনের অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। কিন্তু প্রথম বারের মতো জজ (বিচারক) অপরাধীর সাথে নম্র আচরণ করে লঘু শাস্তি দিয়ে থাকেন। একটু বুঝুন যে, এক ব্যক্তি ১২৫ বার ধর্ষণের মত অপরাধ করল, যাকে অপরাধী সাব্যস্ত করার সম্ভাবনা শতকরা ১ ভাগ, যার সঙ্গে শতকরা ৫০ জন জজ নরম ব্যবহার করবে এবং এক বছরের কম সময়ের জেল দেবে। ধরুন, আমেরিকায় যদি ইসলামি শরিয়াতের বিধান বাস্তবায়ন করা হয়, যে আইনে কোনো লোক যদি কোনো নারীর দিকে দৃষ্টি দেয়, তাহলে সে দৃষ্টি নিচু করে নিবে, প্রত্যেক নারী পর্দার মধ্যে থাকবে, যার সারা শরীর (হাত ও চেহারা ব্যতীত) আবৃত থাকবে। এ অবস্থায় যদি কেউ ধর্ষণের মত অপরাধ করে এবং অপরাধীকে শরিয়াতের বিধান অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হয়, এখানে প্রশ্ন হলো এ অবস্থায় কি অপরাধ বৃদ্ধি পাবে, নাকি ঐরূপই থাকবে, নাকি কমতে থাকবে?
অবশ্যই এ ধরণের অপরাধ কমতে থাকবে এবং এটা ইসলামি শরিয়াত বাস্তবায়নের ফলেই হবে। ইসলাম এক সর্বোত্তম জীবন বিধান। কেননা এর শিক্ষা কেবল তত্ত্বগত নয় বরং এটা মানবসভ্যতার বাস্তব সমস্যার সঠিক সমাধানও পেশ করে। এ কারণে ইসলাম ব্যক্তি ও সামষ্টিক পর্যায়ে সর্বোত্তম ফলাফল লাভ করে। ইসলাম বিশ্বজনীন কর্মোপযোগী এক ধর্ম যা, কোনো এক সম্প্রদায় বা জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এজন্য অন্য কোনো ধর্মমতের মোকাবেলায় ইসলাম একমাত্র এমন ধর্ম যাকে অবলম্বন করে মানুষ নিজ জিন্দেগীর রাস্তা সোজা করে নিবে এবং নিজের আখিরাতের জিন্দেগীতে সফলতা অর্জন করবে। আর আখিরাতের জিন্দেগীর সফলতাই আসল সফলতা।
প্রশ্ন-২. ইসলাম মূর্তি পূজা নিষিদ্ধ করে, তবে মুসলমানগণ নিজেদের ইবাদতের ক্ষেত্রে কা’বাকে সামনে রাখে কেন এবং কা’বার পূজা কেন করে?
উত্তর : কা’বা মুসলমানদের কিবলা বা নির্দিষ্ট স্থান। অর্থাৎ তা এমন স্থান যার দিকে মুখ করে নামায পড়তে হয়। মূলকথা এই যে, মুসলমান যদি নামাযে কাবার দিকে মুখ করে, সে কা’বার পূজা করে না, তার ইবাদতও করে না। মুসলমান কেবল আল্লাহকে সামনে রাখে এবং একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে। আল-কুরআনের ২নং সূরা বাকারার ১৪৪ নং আয়াতে মহান রব ইরশাদ করেন
অর্থ : আমি দেখতে পেয়েছি আপনি কিবলা পরিবর্তনের জন্য আকাশের দিকে বারবার তাকাতেন সুতরাং আমি আপনার পছন্দমতো কিবলা বানিয়ে দিচ্ছি। এখন থেকে মসজিদে হারামের দিকে কাবার দিকে ফিরে নামায আদায় করুন। ইসলাম একতার ধর্ম। ইসলাম মুসলমানদের মধ্যে একতা ও একমত সৃষ্টির জন্য একটি কিবলা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে এবং এ নির্দেশ দিয়েছে যে, যেখানে থাকুন না কেন নামাযের সময় কিবলার দিকে মুখ রাখতে হবে।
যে কা’বার পশ্চিমে থাকবে সে পূর্বদিকে এবং যে কা’বার পূর্ব দিকে থাকবে সে পশ্চিম দিকে মুখ করবে। মুসলমানগণ সর্বপ্রথম দুনিয়ার মানচিত্র তৈরি করেন এবং তাদের মানচিত্রে দক্ষিণ ওপরের দিকে এবং উত্তর নিচের দিকে ছিল এবং এর ফলে কা’বা মধ্যখানে পড়েছিল। এরপর যখন পশ্চিমারা মানচিত্র তৈরি করল তারা উত্তরকে ওপরে এবং দক্ষিণকে নিচের দিকে দেখালো, যেরূপ মানচিত্র আজ দেখা যাচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ। কা’বা শরীফ প্রায় সেই মধ্যখানেই পড়েছে।
যখন মুসলমানগণ মসজিদে হারামে যায় সে তার তাওয়াফ করে এবং এ আমল এক এবং সত্য মাবুদের ইবাদতের এবং ঈমানের প্রতিরূপ বা ছায়া। যার প্রত্যেক চক্করের একই কেন্দ্র থাকে। এভাবে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তাআলাও একজন। যিনি মাবুদ। যার সাথে হাজরে আসওয়াদের সম্পর্ক, যার সম্পর্কে, ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর একটি হাদীস আছে যে, তিনি হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর)-কে চুম্বন খেলেন এবং বললেন, ‘আমি জানি যে, তুমি শুধুই এক খণ্ড পাথর, তুমি কোনো উপকার অথবা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখো না, যদি আমি নবী করীম -কে তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না।’ নবী করীম এর সময়ে সাহাবিগণ কা’বার ওপর চড়ে আযান দিতেন। যে ব্যক্তি এ অভিযোগ উত্থাপন করে যে, মুসলমানগণ কাবা শরীফের পূজা করে। এর নিকট প্রশ্ন, এমন কোনো পূজারী আছে কী, যে কিনা কোনো মূর্তির পূজা করে, আবার তার ওপর আরোহণ করে, খাড়া হয় তার ওপর যার সে পূজা করে?
প্রশ্ন-৩ মুসলমানগণ কীভাবে ইসলামকে শান্তি ও নিরাপত্তার ধর্ম বলে অথচ ইসলাম তরবারির দ্বারা প্রসার লাভ করেছে?
উত্তর : কিছু অ-মুসলিম এ অভিযোগ উত্থাপন করে যে, মুসলমানদের সংখ্যা এতো বেশি হতো না যদি মুসলমানরা তরবারির দ্বারা বিজয়ী না হতো। নিচের কয়েকটি বিষয় উক্ত কথাটিকে খণ্ডন করে স্পষ্ট করে দেবে যে, ইসলাম তরবারি বা শক্তির জোরে প্রসারিত হয়নি বরং এটা নিজস্ব বিশ্বজনীন সত্য এবং জ্ঞানভিত্তিক প্রমাণের কারণে ছড়িয়ে পড়েছে। ইসলাম’ শব্দ সালাম) থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে, যার অর্থ শান্তি ও নিরাপত্তা।
এই রকম অর্থও আছে যে, নিজেকে আল্লাহর সামনে পেশ করবে অর্থাৎ আত্মসমর্পণ করবে। ইসলাম শান্তি ও নিরাপত্তার ধর্ম যা আল্লাহর সামনে আনুগত্যের প্রমাণ স্বরূপ মস্তক অবনতির মাধ্যমে পালন করা হয়। দুনিয়ার সকল লোক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক হতে পারে না। কারণ এমন অনেক লোক আছে যারা নিজ জাতির স্বার্থের জন্য কাজ করে এবং শান্তি নষ্ট করে। এখানে শান্তি বজায় রাখার জন্য শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
এ কারণে অপরাধ দমনের জন্য পুলিশ বাহিনীর প্রয়োজন হয়, যারা অপরাধী এবং এ ধরনের লোকদের দমনের জন্য শক্তি প্রয়োগ করে থাকেন। সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত থাকে। ইসলাম সব সময় নিরাপত্তার প্রত্যাশী এবং শান্তির পক্ষে কাজ করে, তবে অনুসারীদের ওপর জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করার অনুমতিও প্রদান করে। কোনো কোনো স্থানে জুলুমকে শেষ করার জন্য শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে।
শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জুলুম উৎখাত করে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন পড়ে।এ ধরনের দৃষ্টান্ত নবী করীম ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগ থেকে আমরা নিতে পারি। উক্ত অভিযোগের জবাব এই যে, ইসলাম তলোয়ার অর্থাৎ শক্তির দ্বারা প্রসার লাভ করেছে এটি সঠিক নয়। এক ইংরেজ ঐতিহাসিক ডি, লিসী নিজ কিতাব ‘Islam at the Cross Road’ এ সম্বন্ধে বর্ণনা দিয়েছেন। পৃষ্ঠা-৮-এ তিনি বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এ সত্য প্রকাশ্য, ইসলাম সম্পর্কে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা হয়েছে যে, ইসলাম তরবারির দ্বারা প্রসার লাভ করেছে।
কারণ, অধিকাংশ ঐতিহাসিকই ছিলেন বিধর্মী, তাই এ ধরনের অভিযোগ কম বুদ্ধি ও ধীসম্পন্ন ঐতিহাসিকদের বক্তব্য। মুসলিমগণ স্পেনে প্রায় আটশো বছর রাজত্ব করেছেন এবং সেখানকার লোকদের মুসলমান করতে কখনও তরবারির ব্যবহার করেন নি। এরপর যখন খ্রিস্টানগণ শক্তিশালী হয়েছে ও ক্ষমতা দখল করেছে তখন মুসলমানদেরকে তরবারি দ্বারা এমনভাবে খতম করা হয়েছে যে, স্বাধীনভাবে আযান দেবার জন্য একজন মুসলমানও সেখানে বাকি ছিল না। পুরো আরব দেশ মুসলমানগণ ১৪০০ বছর যাবত শাসন কার্য পরিচালনা করে আসছেন। এ আরবে এখনো ১৪ মিলিয়ন অর্থাৎ ১ কোটি ৪০ লক্ষ লোক কেপটিক খ্রিস্টান এমন রয়েছে যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে খৃস্টানই রয়েছে। যেমন মিসরের কুতবী খ্রিস্টান এবং অন্যরা। যদি ইসলাম তরবারির জোরে প্রসার লাভ করতো তাহলে একজন খ্রিস্টানও অবশিষ্ট থাকত না। ভারত বর্ষে মুসলমানগণ এক হাজার বছর পর্যন্ত শাসন কার্য পরিচালনা করেছে। যদি তারা চাইত তাহলে তারা তলোয়ার দ্বারা প্রত্যেক অমুসলিমকে মুসলমান বানাতে পারতো।
অথচ আজকের ভারতের দিকে তাকালে দেখা যায় অমুসলিম জনসংখ্যার হার সেখানে কত বেশি। এ সকল জনসংখ্যা কি এটা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয় যে, ইসলাম তরবারির দ্বারা প্রসার লাভ করে নি। সারা দুনিয়ার মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় মুসলমানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মালয়েশিয়ায়ও ইসলামের সংখ্যাধিক্য রয়েছে। এখন আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, কোন্ মুসলিম সৈন্য বাহিনী ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় গিয়েছিল? বরং ইসলামের বিধি-বিধান ও ন্যায় নীতিইএরূপভাবে বড়ই গতির সাথে আফ্রিকা পূর্ব উপকূলে প্রসার লাভ করেছিল। অমুসলিম ঐতিহাসিকগণ বলবেন কি কোন্ ইসলামি সৈন্য বাহিনী আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে গিয়েছিল? এর সঠিক কোন জবাব নেই। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক থামাস কার্লাইল নিজ পুস্তক ‘Hero and Hero Warship’-এ ইসলাম প্রসারের ক্ষেত্রে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে লিখেছেন
ইসলাম প্রসারের ক্ষেত্রে তরবারির ব্যবহার এটা কোন ধরনের তরবারি। এই তরবারি এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি যা অন্যান্য সকল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভিন্ন, যা একজনের মগজে জন্ম লাভ করেছে এবং সেখানেই তা প্রতিপালিত হয় এবং এ দৃষ্টিভঙ্গির ওপর মাত্র একজন বিশ্বাস রাখতেন। যার সাথে সারা পৃথিবীর মানুষের চিন্তা-ভাবনার পার্থক্য। যদি ঐ ব্যক্তি তার হাতে তরবারি নিয়ে এ মতবাদ প্রসারের চেষ্টা করে, তাহলে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, এ তরবারির ধারকের নিজস্ব শক্তির পতন নিজে নিজেই ঘটে যাবে। এ কথা ভুল যে, ইসলাম তরবারির শক্তির দ্বারা প্রসার লাভ করেছে। যদি মুসলমানরা এটা করতে চাইতেনও তবু করতে পারতেন না। কারণ আল-কুরআনের ২ নং সূরা বাকারার ২৫৬ নং আয়াতে নির্দেশ রয়েছে
অর্থ : দ্বীনের ক্ষেত্রে কোনো জবরদস্তি নেই, ভ্রষ্টতা থেকে সঠিক পথ পৃথক হয়েছে। ইসলাম মূলত জ্ঞান বা হিকমতের তরবারি দ্বারা প্রসার লাভ করেছে এবং এটা এমন এক তরবারি যা হৃদয় ও মনকে জয় করে। যা আল-কুরআনের ১৬ নং সূরা নাহলের ১২৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ : ডাকো তোমার প্রভুর পথে প্রজ্ঞার সাথে এবং উত্তম নসিহত দিয়ে ও তাদের সাথে বিতর্ক কর উত্তম পন্থায়। ১৯৮৬ সালে রিডার্স ডাইজেস্ট’ পত্রিকায় ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর বড় বড় ধর্মের অনুসারীদের গণনা করে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাতে ধর্ম বর্ধনশীলদের গণনাও লেখা হয়েছে। এ প্রবন্ধ ‘The plain truth’ নামে প্রচারিত হয়। এর মূল সূচিতে ছিল ইসলাম। যার অনুসারীদের তালিকায় শতকরা ২৩৫ ভাগ বৃদ্ধি ঘটেছে এবং খ্রিস্টধর্মে মাত্র ৪৭%।
এখন আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, এ পাঁচ দশকে কোন ধর্মীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল যার কারণে লাখ লাখ মানুষ মুসলমান হয়েছে? আজকের ইতিহাসে আমেরিকাতে সবচেয়ে বর্ধনশীল ধর্ম হলো ইসলাম। এটা কোন্ তলোয়ারের মাধ্যমে ঘটছে? যার কারণে বেশির ভাগ লোক মুসলমান হতে বাধ্য হচ্ছে এ তরবারি ইসলামের সত্য শিক্ষার তরবারি। ডা. জোসেফ অ্যাডাম পিটার্সন ঠিকই বলেছেন যে, যে লোক এ বিষয়ে চিন্তিত যে আণবিক অস্ত্র একদিন আরবের লোকদের হাতে পড়বে। সে একথা জানে না যে, ইসলামি বোমা তো বহু পূর্বেই পতিত হয়েছে এবং তা তখনই পতিত হয়েছে। যখনই মুহাম্মদ (সাঃ) জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
প্রশ্ন-৪ মুসলমানদের অধিক হারে মৌলবাদী ও একমুখী দেখা যায় কেন?
উত্তর : এই প্রশ্ন বেশিরভাগ ধর্মমতের বিতর্ক ও বিশ্ব বিষয়াবলির বিষয়ে ওঠানো হয়। কঠিন ধর্ম বিশ্বাস ও মৌলবাদের সাথে মুসলমানদের উল্লেখ বিশ্বব্যাপী বারবার করা হচ্ছে। এর সাথে সাথে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ করে দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচার প্রপাগান্ডার চূড়ান্ত করা হচ্ছে যা তাদেরকে বিরুদ্ধ বৈশিষ্ট্যের কাঠিন্যের প্রবক্তা হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কোথাও বোমা ফাটানো হলে আমেরিকার মিডিয়াগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায় এবং মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের এ কাজের জন্য উৎসাহদাতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। অথচ যেখানকার অপরাধী ছিল এক আমেরিকার সৈন্য। এখন আমরা এ সকল অভিযোগের অসারতা প্রমাণ করব।
মৌলবাদী ঐ লোককে বলা হয়, যে ব্যক্তি নিজ বিশ্বাস বা দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা মূল কথাগুলোকে সবচেয়ে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে এবং তার ওপরে আমল করে। যদি কোনো ব্যক্তি উত্তম ডাক্তার হতে চায় তাহলে তাকে মেডিকেলের মৌলিক কথাগুলোর জ্ঞানার্জন করতে হবে এবং তার উপর আমলের নিষ্ঠাও থাকতে হবে। যদি কেউ উত্তম ব্যায়ামবীর হতে চায় তাকেও ব্যায়ামের মৌলিক কথা-বার্তা জানতে হবে। দ্বিতীয় কথায়, একজন ডাক্তারকে অনুরূপভাবে এবং একজন ব্যায়ামবীরকে নিজস্ব বিষয়ে মৌলবাদী (Fundamentalist) হতে হবে। ঠিক এরূপভাবে একজন বৈজ্ঞানিক প্রথমত বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ জানতে হবে এবং দ্বিতীয় যুক্তিতে তাকে বৈজ্ঞানিক বিষয়াবলিতে মৌলবাদী হতে হবে। এরূপভাবে একজনকে দ্বীনি বিষয়েও মৌলবাদী হতে হবে। মূলত সকল মৌলবাদী এক রূপ নয় এবং সকল মৌলবাদীকে এক রকম সংজ্ঞায় ফেলে বিচার করা যাবে না।
মৌলিকভাবে মৌলবাদকে খারাপ বা ভালো এরূপ গ্রুপে ভাগ করা যাবে না। কারো মৌলবাদী হওয়া এ কথার ওপর সীমাবদ্ধ যে সে কোন ধরনের বিষয়ের মৌলবাদী। একজন মৌলবাদী ডাকাত বা চোর নিজ পেশায় মৌলবাদী হয়, যে মানুষের জন্য কষ্টের কারণ হয়। এ কারণে তাকে অপছন্দ করা হয়। এর বিপরীত একজন (মৌলবাদী) ডাক্তার মানুষের জন্য যথেষ্ট কল্যাণকর এবং সম্মানেরই হয়ে থাকেন। আলহামদুলিল্লাহ আমি একজন মৌলবাদী মুসলমান, ইসলামের মৌলিক বিষয়াদি জানি এবং তার ওপরে আমল করার চেষ্টারত আছি। কোনো মুসলমানের মৌলবাদী হওয়া লজ্জার কোনো বিষয় নয়। আমি মৌলবাদী মুসলমান। এ জন্য গৌরববোধ করি। কেননা আমি জানি ইসলামের মৌলিক নীতিমালা শুধু মানবতার জন্যই নয়, সারা বিশ্বের জন্য উপকারী। ইসলামের এমন কোনো মৌলিক নীতি নেই যা মানবতার কল্যাণ করে না বা তার ভেতরে কোনো ক্ষতি আছে। অনেক লোক ইসলাম সম্পর্কে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। ইসলাম সম্পর্কে তাদের অনেক জ্ঞান সঠিক নয় এবং তা ইসলামের ভিত্তির ওপরেও নেই।
এ ধরনের বুঝ ইসলাম সম্পর্কে ভুল ও অসম্পূর্ণ জ্ঞান থেকে হয়। যদি কোনো ব্যক্তি খোলা মন-মগজ থেকে ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে জানে, তাহলে এ সত্য গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না যে, ইসলাম ব্যক্তি ও সামাজিক দিক দিয়ে উপকারী। ওয়েবস্টার-এর ইংরেজি ডিকশনারি অনুযায়ী Fundamentalism ছিল এমন এক আন্দোলন যা বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার প্রোটেস্ট্যান্টরা আরম্ভ করে। এ আন্দোলনে নতুনত্বের প্রতিবাদ ছিল এবং এ সকল লোকেরা আকিদা ও আখলাকের ভিত্তিতে নয় বরং ঐতিহাসিক রেকর্ডের ভিত্তিতে বাইবেলের ভুল থেকে পবিত্র করার ওপর জোর দান করতে থাকেন।
তারা এও বলতে থাকেন যে, বাইবেলের মূলে বহু খোদার বাক্য আছে। ‘মৌলবাদ’ এমন এক পরিভাষা যা প্রথমে খ্রিস্টানদের এক দল সম্পর্কে ব্যবহার করা হয় যারা বিশ্বাস করে যে, বাইবেলের প্রত্যেকটি অক্ষর আল্লাহর বাণী এবং এর মধ্যে কোনো কম বেশি বা ভুল নেই। কিন্তু আজ অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী মৌলবাদ হলো কোনো বিশেষ ধর্ম, বিশেষ করে ইসলামের মূল বা ভিত্তির ওপরে আমল করা। পশ্চিমা পণ্ডিতগণ এবং তাদের মিডিয়াগুলো মৌলবাদের অভিযোগ থেকে খ্রিস্টানদের অব্যাহতি দিয়ে মুসলমানদের ওপর বিশেষভাবে এ অভিযোগ চাপাচ্ছে। আজ ‘মৌলবাদ’ পরিভাষা যখনই ব্যবহৃত হয় তখনই ব্যবহারকারীর মগজে তৎক্ষণাৎ এমন এক মুসলমানের চিত্র ভেসে ওঠে, যে এদের দৃষ্টিতে নিষ্ঠাবান। সকল মুসলমানেরই নিষ্ঠাবান হওয়া জরুরি।
নিষ্ঠাবান এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যে তার আকিদাকে প্রচার করে। যদি কোনো ডাকাত কোনো পুলিশ দেখে তাহলে তার দ্বারা সে ভীত হয়। দ্বিতীয় ভাষায় পুলিশ ডাকাতের জন্য ভীতি উদ্রেককারী। এভাবে সকল মুসলমান চোর-ডাকাত এবং ব্যভিচারী এবং সাধারণের শত্রুদের জন্য ভীতি উদ্রেককারী হতে হবে এবং এ ধরনের লোক যখন কোনো মুসলমানকে দেখবে তখন তার মধ্যে ভীতির সঞ্চার করবে।
এটা বৈধ যে, এ শব্দ সাধারণভাবে এ ধরনের লোকের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে যে ব্যক্তি সাধারণ লোকদের জন্য ভীতিপ্রদ। কিন্তু একজন ভালো মুসলমান যিনি বিশেষ কিছু লোক যারা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তাদের জন্য ভীতির কারণ হবে, বরং সাধারণ লোকদের জন্য নয়। মূলকথা হলো একজন মুসলমান নিরপরাধ জনসাধারণের জন্য নিরাপত্তা ও শান্তির প্রতীক হবেন।
হিন্দুস্তানের স্বাধীনতার পূর্বে ইংরেজ শাসনামলে কিছু কিছু মুজাহিদ যারা তার সাহায্যকারী ছিলেন না, যাদেরকে ইংরেজরা রাষ্ট্রসন্ত্রাসী বলতো। কিন্তু সাধারণ লোকজনের নিকট তারা জনগণ ও দেশের বন্ধু ছিল। এ সকল লোকদের দু’রকমের নাম ছিল। যারা মনে করতো ইংরেজদের হিন্দুস্তান শাসন করার অধিকার ছিল, তাদের নিকট তারা ছিল সন্ত্রাসী। যারা মনে করতো ইংরেজদের হিন্দুস্তান শাসন করার কোনো অধিকার নেই তারা তাদেরকে দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী যোদ্ধা বলতো।
এজন্য এটা খুবই জরুরি যে, কোনো ব্যক্তির কোন কর্মের ব্যাপারে ফায়সালা করার পূর্বে তার অবস্থান শুনতে হবে। উভয় পক্ষের প্রমাণাদি শোনার পর সুরতহাল নিয়ে এ ব্যক্তির দলিল ও উদ্দেশ্য দেখে তার সম্পর্কে রায় দেয়া যাবে। ‘ইসলাম’ শব্দটি সালাম’ শব্দ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। যার অর্থ শান্তি।
এটা শান্তি ও নিরাপত্তার ধর্ম। যা অনুসারীদের দুনিয়ায় শান্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করার শিক্ষা প্রদান করে। এজন্য সকল মুসলিমের মৌলবাদী হবার দরকার। এই দ্বীন, যা নিরাপত্তার ধর্ম তার মূল ভিত্তির ওপর আমল করা দরকার এবং সে সমাজের দুশমনদের জন্য ভীতি সৃষ্টিকারী হওয়াও দরকার। এ জন্য যে, সমাজে শান্তি, নিরাপত্তা, ন্যায় ও ইনসাফের জয়-জয়কার থাকে।
প্রশ্ন-৫. ইসলাম এক ব্যক্তিকে একের অধিক বিবাহ অর্থাৎ একের অধিক স্ত্রী রাখার অনুমতি কেন দিয়েছে?
উত্তর : Polygamy অর্থাৎ অনেক বিবাহের অর্থ এমন বৈবাহিক নিয়ম যেখানে এক ব্যক্তি অনেকের সাথে অংশীদার ভিত্তিতে জীবনযাপন করবে? এটা দু প্রকার। ১. যেখানে একজন পুরুষ একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করবে। ২. যেখানে একজন নারী একাধিক স্বামী গ্রহণ করবে। ইসলাম সীমিত সংখ্যক স্ত্রী রাখার পক্ষে অনুমতি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু এক স্ত্রীকে একই সময়ে একাধিক স্বামী রাখার অনুমতি প্রদান করা হয় নি। মূল প্রশ্ন এখানেই যে, ইসলাম একজন স্বামীকে একাধিক স্ত্রী রাখার অনুমতি কেন দিল?
একমাত্র আল-কুরআনই হলো এমন একখানা ধর্মীয় কিতাব যাতে বলা হয়েছে, এক স্ত্রী বিয়ে কর। দ্বিতীয় অন্য কোনো ধর্মীয় কিতাবে একথা বলা হয় নি যে শুধু এক স্ত্রী রাখতে হবে। তা সে হিন্দুদের বেদ, মহাভারত বা গীতাই হোক, অথবা ইহুদিদের তালমুদ অথবা খ্রিস্টানদের বাইবেলই হোক না কেন। এ সকল ধর্মগ্রন্থের বিধান অনুসারে একজন পুরুষ যত ইচ্ছে বিয়ে করতে পারবে এবং এ প্রথাই চলে আসছিল কিন্তু বহু শতাব্দী পরে হিন্দু পুরোহিত পণ্ডিতগণ এবং খ্রিস্টান পাদ্রিগণ স্ত্রীদের সংখ্যা একের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। বহু হিন্দু ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের যাদের উল্লেখ হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থে আছে তাদের একের অধিক স্ত্রী ছিল। রামের
পিতা রাজা দশরথের একের অধিক স্ত্রী ছিল। এভাবে কৃষ্ণেরও বহু স্ত্রী ছিল। প্রথম প্রথম খ্রিস্টানদেরও এ অনুমতি ছিল যে, যত ইচ্ছে স্ত্রী রাখতে পারে। এ জন্য বাইবেলে কোনো সংখ্যা নির্দিষ্ট করা ছিল না। মাত্র কয়েক শ’ বছর পূর্বে পাদ্রিগণ স্ত্রীদের সংখ্যা এক এ সীমাবদ্ধ করে দেয়। ইহুদি ধর্মেও একের অধিক স্ত্রী রাখার অনুমতি আছে। ইহুদিদের ধর্মীয় গ্রন্থ তালমূদের বন্দনা মতে ইবরাহীম আলাইহি সাল্লাম এর তিন স্ত্রী এবং সুলাইমান আলাইহি সাল্লাম-এর ৯৯ জন স্ত্রী ছিলেন।
একের অধিক স্ত্রীর অনুমতি গরশুম বিন ইহুদা যার রাজত্ব ৯৬০ থেকে ১০৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। তার এক আদেশের ভিত্তিতে একের অধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু ইসলামি সাম্রাজ্যের প্রতিবেশী সিফার্দী ইহুদি ১৯৫০ সাল পর্যন্ত একাধিক স্ত্রীর ওপর অটল থাকেন। এমনকি ইহুদিদের প্রধান রাববীনেই (Chief Rablonate) একাধিক স্ত্রীর ওপরও অটল থাকেন। পরিষ্কার কথা এই যে, ১৯৭৫ সালে ভারতে এক পরিসংখ্যানের ফল এই দাঁড়ায় যে, হিন্দুরা মুসলমানদের তুলনায় অধিক বিবাহ করে। ইসলামের নারীদের মুকাম কমিটির রিপোর্ট যা ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় পৃষ্ঠা নম্বর ৬৬, ৬৭-তে বলা হয়েছে।
যে, ১৯৬১ থেকে ১৯৯১ এর পরিধিতে হিন্দুদের মধ্যে একাধিক বিয়ের শতকরা, হার ৫,০৬% যেখানে মুসলমানদের একাধিক বিয়ের শতকরা হার ৪.৩১ ছিল। ভারতের আইন মোতাবেক মুসলমানদের একাধিক বিয়ে করা বৈধ। পক্ষান্তরে হিন্দুদের একাধিক বিয়ে সিদ্ধ নয়। বেআইনি হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুদের একাধিক বিবাহ মুসলমানদের চেয়ে বেশি। প্রথমে ভারত বর্ষে একাধিক স্ত্রী রাখার ব্যাপারে কোনো আইন ছিল না।
১৯৪৫ সালে যখন ভারতে ম্যারেজ অ্যাক্ট পাস হয় তখন হিন্দুদের একাধিক স্ত্রী রাখা বেআইনি করা হয়। স্মরণ রাখা দরকার যে, একথা আইনি বিধানে আছে, হিন্দুদের ধর্মীয় গল্পে নয়। আসুন আমরা দেখি ইসলাম কেন একাধিক স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছে? যেমন আমি ইতিপূর্বে বলেছি যে, পৃথিবীতে কুরআনই একমাত্র ধর্মীয় কিতাব যাতে এক স্ত্রী গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। আল-কুরআনের সূরা নিসার ৪নং এবং ৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ : তোমরা তোমাদের পছন্দমতো বিয়ে কর দুই দুই, তিন তিন অথবা চার চার জন।
অর্থ : যদি তোমরা ভয় পাও যে, সুবিচার করতে পারবে না তাহলে মাত্র একজন। কুরআন নাযিলের পূর্বে বিয়ের সংখ্যা সীমাবদ্ধ ছিল না এবং বহু পুরুষ বহু স্ত্রী গ্রহণ করত, এমনকি কারো কারো শত স্ত্রীও থাকত। কিন্তু ইসলাম স্ত্রীদের সংখ্যা চার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করে দেয়। ইসলাম একজন পুরুষকে দুই দুই, তিন তিন, অথবা চার চার স্ত্রী গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছে। তবে শর্ত হলো ন্যায়বিচার করতে হবে। এ সূরা নিসার ১২৯ নং আয়াতে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন
অর্থ : তোমরা কখনো একাধিক স্ত্রীদের মাঝে ইনসাফ করতে পারবে না, যদি তোমরা তা করতে চাও-ও। এজন্য একাধিক বিয়ে কোনো নিয়ম নয়। বরং এটা ভিন্ন এক কথা। অনেক লোক একথা বুঝে নিয়েছে যে, এটা আবশ্যকীয় যে এক মুসলমান একাধিক বিয়ে করবে। (এ ব্যাপারে বুঝতে হলে নিচের বিষয়গুলো বুঝতে হবে।) হালাল হারামের দিক দিয়ে ইসলামের বিধান পাঁচ ভাগে বিভক্ত। যথা
১. ফরজ : এটা আবশ্যকীয় এবং পালনীয়। এর ওপর আমল না করলে আযাব ও শাস্তি দেয়া হবে। ২ মুস্তাহাব : এর নির্দেশ আছে এবং এর ওপর আমল করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। ৩. মুবাহ : বৈধ, এটা করার অনুমতি আছে। তবে করা না করা সমান। ৪. মাকরূহ : এটা বৈধ নয়, এর ওপর আমল করা অপছন্দনীয়। ৫. হারাম : এটাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর ওপর আমল করা নিষিদ্ধ এবং এ কাজ পরিত্যাগ করা সওয়াবের কাজ। একের অধিক বিয়ে করা এ সকল বিধানের অন্তর্ভুক্ত। এ কাজ করার অনুমতি আছে, তবে একথা বলা যাবে না যে, যে ব্যক্তির একাধিক স্ত্রী আছে, সে তার চেয়ে উত্তম যার স্ত্রী মাত্র একজন। এটা আল্লাহর কুদরতি নিয়ম যে, নারী পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। তবে একজন বালিকা একজন বালকের চেয়ে অধিক শক্তি রাখে। একজন বালিকা একজন বালকের চেয়ে অধিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রাখে। এজন্য জন্মের শুরুতে মেয়ে শিশুর চেয়ে ছেলে শিশুর মৃত্যু হার বেশি। এভাবে যুদ্ধে নারীর চেয়ে পুরুষ অধিক হারে মৃত্যুবরণ করে। দুর্ঘটনা ও রোগ-ব্যাধির কারণে নারীর চেয়ে অধিক হারে পুরুষ মৃত্যুবরণ করে। নারীদের মধ্যে বেঁচে থাকার বয়স গড় পুরুষের চেয়ে বেশি আবার বিপত্নীক স্বামীদের চেয়ে বিধবা স্ত্রীদের সংখ্যা অধিক। ভারত এবং তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহ সে সকল রাষ্ট্রের
অন্তর্ভুক্ত, যাদের নারীদের সংখ্যা পুরুষের তুলনায় কম। এর কারণ হলো অভিশপ্ত যৌতুক প্রথা। ভারতে নারী শিশুদের অনেককে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্ব থেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। মূলত এখানে লাখ লাখ নারী গর্ভবতী অবস্থায় ডাক্তারি পরীক্ষায় কন্যা শিশুর ভ্রুণকে চিহ্নিত করে হত্যা করে। এজন্য প্রতি বছর দশ লাখের অধিক কন্যা শিশুকে মৃত্যুর দরজায় পাঠানো হয়। যদি এ ধরনের অপকর্ম বন্ধ করা হতো, তাহলে ভারতেও নারীদের সংখ্যা নিঃসন্দেহে বেড়ে যেত। আমেরিকায় পুরুষের তুলনায় নারীদের সংখ্যা ৫৮ লাখের মতো বেশি। শুধু নিউইয়র্কে নারীদের তুলনায় পুরুষের সংখ্যা ১০ লাখ বেশি এবং এ তথ্য ওখানকার এক পরিসংখ্যান Gender ভিত্তিক ছিল।
আমেরিকায় নপুংসক ভিত্তিক সামগ্রিক সংখ্যা আড়াই কোটি। সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য এই যে, এ সব লোকের নারীদের বিয়ে করার কোনো ইচ্ছেই নেই। এরূপ অবস্থা বৃটেনেও। সেখানে নারীদের তুলনায় পুরুষদের সংখ্যা ৪০ লাখ বেশি। – জার্মানিতে নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় ৫০ লাখ বেশি। – রাশিয়ায় নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় ৯০ লাখ বেশি।
আদম শুমারি অনুপাতে, বর্তমানে বাংলাদেশেরও নারীদের সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় সাত ভাগ বেশি। আসল সংখ্যা তো আল্লাহই ভালো জানেন যে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা কত বেশি। যদি একজন পুরুষ একজন নারীকে বিয়ে করে, তাহলে আমেরিকাতে ৩ কোটি নারী স্বামীবিহীন থাকবে। এটাও মনে রাখতে হবে যে, আড়াই কোটি লোক আমেরিকাতে নপুংসক (হিজড়া)। এরূপভাবে বৃটেনে ৪০ লাখ, জার্মানিতে ৫০ লাখ, রাশিয়াতে ৯০ লাখ নারীর জন্য কোনো স্বামী মিলবে না।
ধরুন, আমার বোন আমেরিকায় থাকে এবং সে অবিবাহিত নারীদের একজন। আবশ্যকীয়ভাবে আপনার বোনও ওখানে থাকতে পারে। এদের জন্য দুটি অবস্থার মধ্যে একটি সমাধান বেছে নিতে হবে১. হয়তো সে এমন এক লোকের সঙ্গে বিয়ে বসবে যার পূর্বে থেকে স্ত্রী আছে, অথবা ২. তাকে পাবলিক প্রপার্টি বা বেশ্যা হয়ে যেতে হবে। এ দু’পথের বাইরে কোনো পথ নেই। যে নারীর কল্যাণময় গুণ আছে সে অবশ্যই প্রথম পথ অবলম্বন করবে। অনেক নারী নিজ স্বামীর সঙ্গে অন্য নারীর সঙ্গ বরদাশত করে না। কিন্তু যখন ইসলামি সমাজে অবস্থা এতোদূর নাজুক ও সঙ্কটময় হয় তখন একজন ঈমানদার নারী এধরনের ক্ষতি স্বীকার করে নেবেন এবং তিনি চাইবেন না যে তারই বোনেরা পাবলিক প্রপার্টি বা বেশ্যা হয়ে থেকে যাবে।
প্রশ্ন-৬. যদি ইসলামে পুরুষকে একের অধিক বিবাহ (স্ত্রী রাখার) করার ‘ অনুমতি দেয়, তবে কেন একজন স্ত্রী একাধিক স্বামী (একত্রে) গ্রহণ করতে পারবে না?
উত্তর : প্রথম কথা এই যে, আপনাকে প্রথমে খেয়াল রাখতে হবে যে, নারীর তুলনায় পুরুষের সেক্স পাওয়ার (যৌন সক্ষমতা) বেশি। দ্বিতীয় বিষয় হলো পুরুষ জৈবিকভাবে (Biologicaly) একাধিক নারীর সাথে শৃঙ্খলার সাথে সম্পর্ক রাখতে পারে। অপর দিকে একজন নারী শৃঙ্খলার সঙ্গে একাধিক স্বামী ম্যানেজ করতে সক্ষম হবে না।
চিকিৎসা বিজ্ঞান আমাদের বলে যে, Ministration Period এ (মাসিক চলাকালীন) একজন নারী শারীরিক ও মেধাগত পরিবর্তনের মাঝে কাটায় এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বেশিরভাগ লড়াই ঝগড়া এই বিশেষ সময়ে ঘটে থাকে। আমেরিকার ক্রাইম রেকর্ড (অপরাধ তথ্য) অনুযায়ী আমেরিকার নারীরা যে অপরাধ করে তার বেশিরভাগ মাসিক চলাকালীন সময়ে করে থাকে। যদি নারীদের একাধিক স্বামী থাকত তাহলে মেধার ওপর অধিক চাপ পড়ত এবং খাপ-খাওয়াতে সমস্যা হতো।
চিকিৎসা বিজ্ঞান আমাদের এটাও বলে যে, যদি একজন স্ত্রীর একাধিক স্বামী থাকে তাহলে জীবের মধ্যে ক্ষতিকারী স্থানান্তরকারী ভাইরাস বেশিরভাগ জন্ম লাভ করে এবং সাথে সাথে এ জীবাণুগুলো অন্য স্বামীর মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটে থাকে। (যেমন এইডস এর জীবাণু) যেটা এক ব্যক্তির একাধিক স্ত্রী থাকা সত্বেও ঘটে না। ধরুন, একজনের একাধিক স্ত্রী আছে এবং তাদের সন্তানাদি থাকে তাহলে মায়েদের সনাক্ত করা এক্ষেত্রে সম্ভব।
পিতা ও মাতাকে সনাক্ত করা যায়। দ্বিতীয় ঘটনায় যদি স্ত্রীর একাধিক স্বামী থাকত তাহলে সন্তানদের মাতাকে সনাক্ত করা যেত পিতাকে নয়। ইসলাম হসব-নসব (বংশধারা)-এর সনাক্ত করার ওপর বিশেষভাবে জোর দেয়। মনোবিজ্ঞানীরা আমাদের বলেন যে, যদি সন্তানেরা পিতার পরিচয় না পায় তাহলে তারা মানসিক সমস্যাতে ভোগে। একথার মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই যে, এ ধরনের বাচ্চারা খুবই দো-টানার মধ্যে জীবনযাপন করে। বাচ্চাকে যদি স্কুলে ভর্তি করার প্রয়োজন হয় এবং এর পিতার নাম জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে তাকে একাধিক নাম দিতে হবে এবং আপনি জানেন এদেরকে কী বলা হয়।
এরূপ বহু কারণ আছে যার ভিত্তিতে বহু স্বামী গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয় নি। এর বিপরীতে যে সমস্ত কারণে বহু স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনা করব।
উদাহরণস্বরূপ, স্বামী যদি বন্ধ্যা হয় সেক্ষেত্রে স্ত্রী দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করতে পারবে
কেননা কোনো ডাক্তার এ বিষয়ে ১০০% গ্যারান্টি দিতে পারে না যে স্বামী ১০০% বন্ধ্যা, এমনকি কেস বন্ধী করানোর পরও কোনো ডাক্তার আপনাকে একথা বলতে পারবে না যে, ঐ ব্যক্তি কখনো পিতা হতে পারবে না। এ কারণে এ অবস্থায়ও বাচ্চাকে সনাক্ত করার মধ্যে সন্দেহ এসে যায়। দ্বিতীয় কেস এরূপ যে, যদি স্বামী কোনো দুর্ঘটনায় পতিত হয় অথবা তার কঠিন পীড়া হয়, তাতেও কি স্ত্রী দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করতে পারবে না? একথার বিশ্লেষণ করা যাক। যদি স্বামী অসুস্থ থাকে সে প্রয়োজনীয় কাজ সরঞ্জাম দিতে না পারে এবং নিজ বংশ রক্ষার দায়িত্বও পালন করতে অক্ষম হয় এবং স্ত্রীকে পরিতুষ্টি দিতে অক্ষম হয়।
প্রথম অবস্থায় যদি বাচ্চা এবং বিবির প্রয়োজন পূরণ করতে না পারে, সে যাকাত গ্রহণ করতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞান আমাকে বলে যে, স্ত্রীর শারীরিক বিষয়ে স্বামীর প্রয়োজন ততটা নয়। এরপরও যদি সে সন্তুষ্ট না হয় তাহলে খুলা তালাক গ্রহণ করতে পারে। এখানে স্ত্রীর জন্য খুলা তালাক গ্রহণ করাই উত্তম। কেননা যখন স্ত্রী তালাক নেয় তখন সে স্বাস্থ্যবতী হয়ে থাকে। দ্বিতীয় অবস্থায় যদি সে মায়ুর বা রোগী হয় এ অবস্থায় সে যদি তালাকও নেয় তাহলে কে তাকে বিয়ে করবে?
প্রশ্ন-৭. ইসলাম নারীদের পর্দায় রেখে এদেরকে কি খাটো করে নি?
উত্তর : ধর্মনিরপেক্ষ মিডিয়াগুলোতে ইসলামে নারীদের মর্যাদাকে বেশিরভাগ খাটো করার টার্গেট বানায়। পর্দা অর্থাৎ ইসলামি পোশাকের ব্যাপারে বলা হয় যে, নারীরা ইসলামি শরিআতের দ্বারা নির্যাতিত এবং তাদের দাবিয়ে রাখা হয়েছে। আমরা ইসলামে পর্দার বিষয়টা পরে বিশ্লেষণ করি। আমরা ইসলাম পূর্ব যুগের নারীর মর্যাদা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিই। ইতিহাস একথার সাক্ষ্য যে, ইসলাম পূর্ব সংস্কৃতিগুলোতে নারীর কোনো অবস্থান ছিল না। এদেরকে শুধুই যৌন তৃপ্তির মাধ্যম মনে করা হতো।
এমনকি এদেরকে মানবতার মূল ভিত্তির সম্মান ও মর্যাদা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করা হতো না। বাবেলের সংস্কৃতিতে নারীদের খুঁটি মনে করা হতো এবং তাদের আইনে সে সকল প্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। যদি কোন পুং কাউকে হত্যা করতো তাহলে তার শাস্তির সাথে সাথে স্ত্রীকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো। গ্রিক সংস্কৃতি যাকে পুরাতন সংস্কৃতির মধ্যে সবচেয়ে উঁচু ও মর্যাদাবান মনে করা হয়। এতেও নারীদের সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল এবং তাদেরকে তুচ্ছ মনে করা হতো। গ্রিক দেউ মালায় এক খেয়ালি নারী ছিল যাকে ‘পান্ডুরা’ বলা হয়, যাকে মানুষের দুর্ভাগ্যের মূল মনে করা হয়। এ লোকেরা নারীদের পুরুষের
চেয়ে কম মর্যাদাসম্পন্ন মনে করতো। একথা ঠিক যে, দেশীজোগী মতে নারীদের অনেক মর্যাদাবান মনে করা হতো এবং এ ব্যাপারে তারা বিশেষ গুরুত্বারোপ করতো। পরবর্তীতে এ সংস্কৃতিতেও আমিত্ব ও জাতিভেদ শুরু হয় এবং এদের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়। রোমের সংস্কৃতি যখন উচ্চ মার্গে আরোহণ করছিল তখন একজন পুরুষের তার স্ত্রীর জীবন হরণের অধিকার ছিল। বৈষম্য ও উলঙ্গপনা এ সভ্যতায় সাধারণ ব্যাপার ছিল। মিসরীয় সভ্যতায় নারী দেহকে খারাপ মনে করা হতো এবং তাদেরকে শয়তানের আলামত মনে করা হতো।
ইসলাম পূর্ব আরবে নারীদের খুবই তুচ্ছ করা হতো এবং সাধারণভাবে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ পিতা ও বংশের জন্য এতোই। অমর্যাদাকর মনে করা হতো যে, তাদেরকে জীবন্ত দাফন করা হতো। ইসলাম নারীদের সম মর্যাদা দান করেছে এবং ১৪০০ বছর পূর্বে তাদের অধিকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। ইসলাম এতো গুরুত্ব দিয়েছে যে, নারীকে তার মর্যাদায় রেখেছে। সাধারণভাবে পর্দা শুধু নারীদের জন্য, এরূপ ভাবা হয় অথচ কুরআন মাজীদে পর্দার প্রথম নির্দেশ পুরুষের জন্যই দিয়েছে। যেমন ২৪ নং সূরা নিসা’র ৩০ নং আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ : হে নবী! আপনি মুমিন (পুরুষদের) বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে। এটা তাদের জন্য পবিত্রতর। তারা যা কিছু করছে আল্লাহ সে সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। এ আয়াতের আলোকে যখন কোনো পুরুষ কোনো গায়রে মুহরিম নারীর ওপর দৃষ্টি দিবে তখনই দৃষ্টিকে নামিয়ে নিবে। এর পরের আয়াতে বলা হয়েছে। ২৪ নং সূরা নিসা’র আয়াত ৩১-এ
অর্থ : হে নবী! আপনি মুমিন নারীদের বলুন তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিম্নগামী রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহকে হেফাজত করে, তারা যেন তাদের সৌন্দর্যকে প্রদর্শন করে না বেড়ায়। তবে শরীরের যে অংশ এমনিতেই খোলা থাকে সেগুলোর কথা আলাদা। তারা যেন তাদের বক্ষদেশকে মাথার কাপড় (ওড়না) বা চাদর দ্বারা আবৃত করে রাখে, তারা যেন তাদের স্বামী, তাদের পিতা, তাদের শ্বশুর, তাদের ছেলে, তাদের স্বামীর আগের ঘরের ছেলে, তাদের ভাই, তাদের ভাইপো, তাদের বোনপো, তাদের নিজেদের মহিলা, অধিকারভুক্ত দাস-দাসী নিজেদের অধিকারভুক্ত এমন পুরুষ যাদের মহিলাদের নিকট থেকে কোনো কিছুই কামনার নেই। কিংবা এমন শিশু যারা মহিলাদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে কিছুই জানে না।
এদের ছাড়া। এ ধারাবাহিকতায় ছয়টি শর্ত রয়েছে। তাহলো১. পুরুষ নিজ নাভী থেকে টাখনু পর্যন্ত ঢেকে রাখার পোশাক পরবে। নারীদের
শরীর ঢেকে রাখবে। যদি হাত ও চেহারা ঢেকে রাখতে পারে তাহলে আরো ভালো। তবে এটা তার জন্য আবশ্যকীয় নয়। সারা শরীর আবৃত রাখা দরকার। শুধু হাতের কজি পর্যন্ত ও চেহারা দেখা যায় তবে দেখার শর্ত পুরুষ
ও নারীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন। ২. সে এমন পোশাক পরতে পারবে না যাতে ভেতরের দৃশ্য চোখে পড়ে। ৩. এমন আঁটসাঁট পোশাক পরতে পারবে না যা দ্বারা অঙ্গের ভাঁজগুলো দেখা যায়। ৪. সে এমন কাপড় পরতে পারবে না যা দ্বারা বিপরীত লিঙ্গকে আকৃষ্ট করা হয়। ৫. এমন পোশাক পরা যাবে না যা বিপরীত লিঙ্গের জন্য নির্দিষ্ট এবং তাদের
সাদৃশ্য রাখে। যেমন পুরুষের জন্য ছায়া, ব্লাউজ অথবা শাড়ি পরা। ৬. এমন পোশাক পরা যাবে না যাতে আপনাকে বিধর্মী বা কাফির ধারণা করা হয়।
(যেমন : পৈতা পরা, সিদুর লাগানো ইত্যাদি।)। আসুন! দ্বিতীয়বার প্রশ্নের সুযোগ হতে পারে যে, ইসলাম পর্দার এবং বিপরীত জাতির পার্থক্যের মধ্যে বিশ্বাস করে কেন? আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মুসলিম সমাজ যে পর্দার সহযোগী আবার কোনো সমাজে পর্দার বিপরীতও আছে। আমেরিকা এমন এক রাষ্ট্র যেখানে সবচেয়ে বেশি অপরাধ হয়। এফ. বি. আই. এর ১৯৯০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ১০ হাজার ২৫৫ নারীর সঙ্গে ব্যভিচার করা
হয়েছে। এ হলো ঐ সকল মামলা যেগুলো দায়ের করা হয়েছে। অন্য রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, এ হলো সকল অপরাধ ঘটনার শতকরা ১৬ ভাগ মাত্র। যদি আপনি সঠিক চিত্র পেতে চান তাহলে ১০,২৫৫-কে ৬.২৫ দিয়ে পূরণ করুন, দেখবেন শুধু ১৯৯০ সালে ৬,৪০,০০০ নারীর সঙ্গে ব্যভিচার করা হয়েছে। যদি আপনি বছরের দিনগুলো দিয়ে এ সংখ্যাকে ভাগ করুন তাহলে দৈনিক ব্যভিচারের সংখ্যা পাবেন ১,৭৫৬। অর্থাৎ তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিদিন ১,৭৫৬ নারীর সঙ্গে ব্যভিচার করা হয়েছে এবং ১৯৯১ সালে প্রতিদিন ১৯০০ নারীর সঙ্গে ব্যভিচার করা হয়েছে এবং ১৯৯৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ১.৩ মিনিটে একটি ব্যভিচারের কেস রেকর্ড করা হয়েছে। আপনি কি জানেন, কেন আমেরিকাতে নারীদের অধিকার বেশি প্রদান করা হয়েছে এবং সেখানে নারীদের ধর্ষণও বেশি হয় এবং এ সকল কেসের শতকরা ১৬ ভাগের মাত্র শতকরা ১০ ভাগ এর শাস্তি হয়।
অর্থাৎ মাত্র ১.৬% এর কিছুটা শাস্তি হয়। (কাস্টডিতে যায়)। সকল অভিযোগের মাত্র ০.৮%-এর মোকদ্দমা তৈরি হয়। অর্থাৎ কোনো লোক যদি ১২৫ বার ব্যভিচার করে তাহলে তার একবার মাত্র কাস্টডিতে যেতে হয়। ব্যভিচারের শাস্তি হলো বন্দি করা যেটা আমেরিকার আইনে রয়েছে, অথচ সে বলে যে, সে মাত্র এই প্রথম বার ব্যভিচার করেছে এবং পাকড়াও হয়েছে। একে একবার সুযোগ দেয়া হয় এবং এক বছরের কম শাস্তি দেয়া হয়।
এমনকি ভারতেও National Crime Bureo (Nc B১-এর রিপোর্ট মোতাবেক যা ১৯৯২ সালের ১ ডিসেম্বরের এক খবরে প্রকাশিত হয় যে, প্রতি ৫৪ মিনিটে ভারতে একটা মামলা দায়ের হয়। প্রত্যেক ২৬ মিনিটে উত্যক্ত করার মামলা, ১ ঘণ্টা ৪৩ মিনিটে যৌতুকের কারণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। যদি আপনি এ দেশের সকল ঘটনা একত্র করেন তাহলে প্রতি ২ মিনিটে একটা ব্যভিচারের মামলা পাওয়া যেত। যদি আপনি আমেরিকার সকল নারীকে হিজাব পরতে বলেন, তাহলে এ সকল ঘটনা বাড়বে না বরং কমবে?
প্রশ্ন-৮. ইসলামে দু’জন নারীর সাক্ষ্য একজন পুরুষের সমান কেন?
উত্তর : ইসলামে সর্বদা দু’নারীর সাক্ষ্য একজন পুরুষের সমান নয় এটার ব্যতীক্রম আছে। কুরআন মাজীদে তিন স্থানে নারী-পুরুষের পার্থক্য ব্যতীত সাক্ষীর কথা বর্ণনা করা হয়েছে। উত্তরাধিকার প্রশ্নে ওয়ারিশ-এর ব্যাপারে ওসিয়তের সময় দু’জন ন্যায়বিচারক লোকের সাক্ষ্যদানের প্রয়োজন। যেমন ৫ নং সূরা মায়িদার ১০৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কারো যখন মৃত্যুর সময় এসে উপনীত হয়, ওসিয়ত করার এ মুহূর্তে তোমরা তোমাদের মধ্য থেকে দু’জন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী বানিয়ে রাখবে, আর যদি তোমরা প্রবাসে থাকো এবং এ সময়ে তোমাদের ওপর মৃত্যুর বিপদ এসে পড়ে, তাহলে বাইরের লোকদের মধ্য থেকে দুজন ব্যক্তিকে সাক্ষী বানিয়ে নেবে। তালাকের ব্যাপারে দু’জন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী বানানোর নির্দেশ আছে। ৬৫ নং সূরা তালাকের ২নং আয়াতে আল্লাহ বলেন
অর্থ : তোমাদের মধ্য থেকে দু’জন ন্যায়পরায়ণ লোককে তোমরা সাক্ষী বানিয়ে রাখবে। তোমরা শুধু আল্লাহর জন্যই এ সাক্ষ্য প্রদান করবে। এরূপভাবে সতী-সাধ্বী স্ত্রীলোকের ব্যাপারে চারজন সাক্ষীর প্রয়োজন। যেমন ২৪ নং সূরা নূর -এর ৪ নং আয়াতে মহান রব ঘোষণা করেন
অর্থ: যারা (খামাখা) সতী-সাধ্বী নারীদের ওপর (ব্যভিচারের) অপবাদ আরোপ করে। অতঃপর চারজন সাক্ষী আনতে পারে না, তাদেরকে আশিটি দোররা মারো, আর তাদের সাক্ষ্য কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না, এরাই অপকর্মকারী। একথা সমীচীন নয় যে, দু’মহিলার সাক্ষ্য সব সময় এক পুরুষের সমান। এ শুধু বিশেষ কয়েকটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ। কুরআন শরীফে পাঁচটি আয়াত এরূপ আছে যাতে নারী-পুরুষের সাক্ষ্যের ব্যাপারে কোনো পার্থক্য করা হয় নি। আর একটি আয়াত এমন আছে যাতে বলা হয়েছে দু’নারীর সাক্ষ্য একজন পুরুষের সমান। এটা ২ নং সূরা বাকারার ২৮২ নং আয়াতে বলা হয়েছে। যে আয়াত সম্পদের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে কুরআন শরীফের সবচেয়ে বড় আয়াত। যেমন- মহিয়াসের নিম্নোক্ত বাণী
অর্থ : হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা যখন পরস্পরের সাথে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ঋণের চুক্তি কর তখন অবশ্যই তা লিখে রাখবে। তোমাদের মধ্যকার যেকোন একজন লেখক সুবিচারের ভিত্তিতে (এ চুক্তিনামা) লিখে দিবে যাকে আল্লাহ তাআলা লেখা শিখিয়েছেন, তাদের কখনো লেখার কাছে অস্বীকৃতি জানানো উচিত নয়। ঋণ গ্রহীতা লেখককে বলে দিবে কী শর্ত সেখানে লিখতে হবে। এ বিষয়ে লেখককে তার আল্লাহ তাআলাকে ভয় করা উচিত। কিছুই যেন সে বাদ না দেয়। যদি ঋণ গৃহীত অজ্ঞ ও মূর্খ হয় এবং সব দিক থেকে দুর্বল অথবা (শর্তাবলি) বলে দেবার ক্ষমতাই সে না রাখে, তাহলে তার পক্ষ থেকে তার কোনো ওলী ন্যায়ানুগ পন্থায় বলে দেবে কী কথা লিখতে হবে। আরো দু’জন পুরুষকে এ চুক্তিনামায় সাক্ষী বানিয়ে নিও।
যদি দু’জন পুরুষ না পাওয়া যায় তাহলে একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা। যাতে করে তাদের একজন ভুলে গেলে দ্বিতীয় জন মনে করিয়ে দিতে পারে। কুরআনে কারীমে এ আয়াত শুধু মালের লেনদেনের জন্য, আর ঐ প্রকারের লেনদেনের মধ্যে একথা বলা হয়েছে যে, এ চুক্তিনামা দুই দলের মধ্যে লিখে নিতে হবে। এজন্য দু’জন সাক্ষী বানিয়ে নিতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে যেন শুধু পুরুষই হয়, যদি পুরুষ না পাওয়া যায়, এ অবস্থায় একজন পুরুষ ও দু’জন নারী যথেষ্ট।
ইসলামে সম্পদের লেনদেনে দু’জন পুরুষকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। ইসলাম পুরুষের ওপর এ আস্থা রাখে যে, সে বংশীয় দায়িত্ব রক্ষা করবে। যেহেতু অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব পুরুষের ওপর, এজন্য এটা বুঝা যায় যে, সে সম্পদের লেনদেনের ক্ষেত্রে নারীর তুলনায় অধিক সম্পর্ক রাখে। দ্বিতীয় অবস্থায় একজন পুরুষ ও দু’জন নারীর সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে এবং যদি একজন নারী ভুলে যায়, অথবা ভুল করে তাহলে দ্বিতীয় জন মনে করিয়ে দেবে। কুরআনে ব্যবহৃত L.
শব্দের অর্থ ইচ্ছেকৃত ভুল করা অথবা অনিচ্ছেকৃত ভুলে যাওয়া। শুধু সম্পদের লেনদেনের ক্ষেত্রে দু’জন নারীর সাক্ষ্য একজন পুরুষের সমান নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বিপরীতে কিছু লোক একথা বলে যে, হত্যার ক্ষেত্রেও নারীর সাক্ষ্য দ্বিগুণ করতে হবে অর্থাৎ দু’জন নারীর সাক্ষ্য একজন পুরুষের সমান হবে। এ ধরনের কাজ-কর্মে একজন নারী পুরুষের তুলনায় বেশি ভীতু হয় এবং সে নিজের আবেগী অবস্থার কারণে অস্থির হয়।
এজন্য অনেক (পণ্ডিত) লোকের মতে হত্যার মতো কাজে দু জন নারীর সাক্ষ্য একজন পুরুষের সমান। কিছু কিছু আলেমের মতে, সকল ক্ষেত্রে দুজন নারীর সাক্ষ্য একজন পুরুষের সমান। এ ব্যাপারে। সকলে একমত হতে পারেন নি। কারণ ২৪ নং সূরা আন-নূরের ৬ থেকে ৯ নং আয়াতে একজন নারীর সাক্ষ্য একজন পুরুষের সমান এ ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশ আছে। যেমন
অর্থ : যারা নিজেদের স্ত্রী (কিংবা স্বামী)-র ওপর (ব্যভিচারের) অপবাদ আরোপ করে অথচ নিজেরা ছাড়া তাদের কাছে অন্য কোনো সাক্ষী না থাকে। তারা আল্লাহর নামে চারবার শপথ করে বলবে যে, অবশ্যই সে নিজে সত্যবাদী। পঞ্চমবার বলবে, যদি সে মিথ্যাবাদী হয়, তাহলে তার ওপর যেন আল্লাহ তাআলার গযব নাযিল হয়। স্ত্রীর ওপর থেকে এ ধরনের আনিত অভিযোগের শাস্তি রহিত করা হবে যদি সেও চারবার আল্লাহর নামে কসম করে বলে যে, এই পুরুষ লোকই আসলেই মিথ্যাবাদী। পঞ্চমবার বলবে, পুরুষটি সত্যবাদী হলে আল্লাহর গযব যেন তার ওপর নেমে আসে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু যিনি আমাদের নবী করীম এর স্ত্রী ছিলেন, তাঁর নিকট থেকে কম বেশি ২ হাজার ২১০টির কাছাকাছি হাদীস বর্ণিত আছে। যা তার একার সাক্ষ্যের ওপরে ভিত্তি করে সনদভুক্ত হয়েছে। এটা এ কথার সাক্ষী যে, একজন নারীর সাক্ষ্যও গ্রহণযোগ্য। অনেক আলেম এ ব্যাপারে একমত যে, চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে একজন নারীর সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য। আপনি আন্দাজ করতে পারেন যে, রোযা যেটা ইসলামের মৌলিক ইবাদতের একটি, এ ব্যাপারেও একজন নারীর সাক্ষ্য
গ্রহণযোগ্য এবং তার সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে গোটা মুসলিম সমাজ রোযা রাখবে। আলেমদের মতে রোযা শুরু করার জন্য এক এবং শেষ করার জন্য দু’জনের সাক্ষ্য প্রয়োজন এবং এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই যে, সে সাক্ষী পুরুষ হোক কিংবা নারী। কিন্তু এমন বিষয়ও রয়েছে যাতে শুধু একজন নারীর সাক্ষ্যই জরুরি যেমন নারীদের মাসআলার ব্যাপারে, মহিলাদের দাফনের জন্য গোসল দেয়া, এ ধরনের বিষয়ে পুরুষের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। সম্পদের লেনদেনের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের যে পার্থক্য করা হয়েছে যা অসমতার ভিত্তিতে নয় বরং সমাজে তাদের দায়িত্বের পার্থক্যের কারণে করা হয়েছে। যে দায়িত্ব ইসলাম উভয়কে (ভাগ করে দিয়েছে।
প্রশ্ন-৯. ইসলামে উত্তরাধিকারে নারীর অংশ পুরুষের অর্ধেক কেন?
উত্তর : কুরআন মাজীদে এমন অনেক আয়াত আছে যাতে উত্তরাধিকার বণ্টনের ব্যাপারে বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন২ নং সূরা বাকারা, আয়াত নং ১৮০ ও ২৪০ ৪ নং সূরা নিসা, আয়াত নং ৭, ৯, ১৯ ও ৩৩ ৫ নং সূরা মায়িদা, আয়াত নং ১০৬ থেকে ১০৮ কুরআন মাজীদের তিন আয়াতে নিকটাত্মীয়দের উত্তরাধিকারে অংশ পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যার মধ্যে দু’আয়াত এরূপ ৪ নং সূরা নিসা আয়াত নং ১১ ও ১২
অর্থ : আল্লাহ তাআলা উত্তরাধিকারে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে তোমাদের জন্য বিধান জারি করছেন যে, এক ছেলের অংশ হবে দুই কন্যা সন্তানের মতো। কিন্তু কন্যারা যদি দুয়ের অধিক হয় তাহলে তাদের জন্য সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ আর কন্যা যদি একজন হয় তাহলে তার অংশ হবে অর্ধেক। মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকলে তার পিতামাতার প্রত্যেকের জন্য থাকবে ছয় ভাগের একভাগ, মৃত ব্যক্তির যদি কোনো সন্তান না থাকে এবং শুধু পিতা-মাতা থাকে তাহলে মায়ের অংশ হবে তিন ভাগের এক ভাগ, যদি মৃত ব্যক্তির কোন ভাই-বোন বেঁচে থাকে তাহলে তার মায়ের অংশ হবে ছয় ভাগের এক ভাগ, তার ওসিয়ত পূরণ ও ঋণ আদায়ের পরই এসকল ভাগ হবে।
তোমরা জানো না তোমাদের পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্তুতির মধ্য থেকে উপকারের দিক থেকে কে তোমাদের বেশি নিকটবর্তী। এ হচ্ছে আল্লাহর বিধান অবশ্যই আল্লাহ তাআলা সকল কিছু সম্পর্কে ওয়াকিফহাল এবং তিনিই হচ্ছেন মঙ্গলময়। তোমাদের স্ত্রীদের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে তোমাদের অংশ হচ্ছে অর্ধেক, যদি তাদের কোনো সন্তানাদি না থাকে, আর যদি তাদের সন্তান থাকে, তাহলে তোমাদের অংশ হবে চার ভাগের একভাগ। তাদের কৃত অসিয়ত পূরণ ও ঋণ
পরিশোধের পর। তোমাদের স্ত্রীদের জন্য তোমাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ, যদি তোমাদের সন্তান না থাকে। যদি তোমাদের সন্তান থাকে, তাহলে তারা পাবে রেখে যাওয়া সম্পত্তির আট ভাগের একভাগ, অসিয়ত পূরণ ও ঋণ পরিশোধ করার পর। যদি কোনো পুরুষ কিংবা নারী এমন হয় যে, তার কোনো সন্তানও নেই, পিতা-মাতাও নেই, তার শুধু এক ভাই এক বোন আছে, তাহলে তাদের সবার জন্য থাকবে ছয় ভাগের এক ভাগ, তারা যদি এর চেয়ে বেশি হয়, তাহলে সকলে মিলে পাবে এক-তৃতীয়াংশ, মৃত ব্যক্তির অসিয়ত পূরণ ও ঋণ পরিশোধের পর। কোনোরূপ ক্ষতি ছাড়াই। এ হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহ তাআলা সর্বজ্ঞানী ও পরম ধৈর্যশীল।
৪ নং সূরা নিসার ১৭৬ নং আয়াতে মহান রব আরো বলেন
অর্থ : (হে নবী!) তারা আপনার নিকট ফতোয়া জিজ্ঞেস করে। আপনি বলুন, আল্লাহ তাআলা সেই ব্যক্তির (উত্তরাধিকারের ব্যাপারে তোমাদের তার সিদ্ধান্ত অবহিত করছেন। যার পিতা-মাতা কেউ-ই নেই আবার নিজেরও কোনো সন্তান নেই, এ ধরনের কোনো সন্তানহীন ব্যক্তি যদি মারা যায় এবং তার একটি বোন থাকে, তাহলে বোনটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক হবে। অপরদিকে সে যদি নিঃসন্তান হয় তাহলে সে তার বোনের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে। যদি তারা দু’জন হয় তাহলে তারা দুই বোন সেই পরিত্যক্ত সম্পত্তির তিন ভাগের দুই ভাগের মালিক হবে। যদি ভাই-বোনেরা কয়েকজন হয় তাহলে মেয়েদের একভাগ ও পুরুষের দুই ভাগ (১:২)।
আল্লাহ তাআলা উত্তরাধিকারের এ আইন-কানুনকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তোমাদের জন্য বলে দিয়েছেন যাতে করে তোমরা (কোনোরূপ) বিভ্রান্ত হয়ে না পড়, আল্লাহ তাআলা সবকিছুর ব্যাপারেই পূর্ণ জ্ঞান রাখেন। বেশিরভাগ নারীদের অংশ পুরুষের অর্ধেক তবে সর্বদা এমন নয়। যদি মৃতের মাতা-পিতা এবং ছেলে-মেয়ে না থাকে কিন্তু মায়ের পক্ষ থেকে ভাই-বোন থাকে তা হলে উভয়ে ৬ ভাগের ১ অংশ করে পাবে।
যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকে তাহলে পিতা-মাতা উভয়ে ৬ ভাগের ১ অংশ করে লাভ করবে। কয়েকটি ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারী দ্বিগুণ সম্পত্তি পাবে। যদি মৃতা স্ত্রী হয় এবং তার সন্তান এবং ভাই-বোন না থাকে এবং তার স্বামী এবং মা-বাপ থাকে তাহেল স্বামীকে অর্ধেক এবং মাকে ১ চতুর্থাংশ অংশ এবং পিতাকে ৬ ভাগের ১ অংশ দিতে হবে। এ অবস্থায় মায়ের অংশ পিতার দ্বিগুণ ঐ কথা ঠিক যে, সাধারণভাবে নারীদের পুরুষের তুলনায় অর্ধেক অংশ মিলে। যেমন কন্যার অংশ অর্ধেক। স্ত্রীদের ৮ ভাগের ১ অংশ যেখানে স্বামীদের ৪ ভাগের ১ অংশ। মৃতের সন্তান
থাকলে তাহলে স্ত্রীর ৪ ভাগের ১ অংশ এবং স্বামীর ২ ভাগের ১ (অর্ধেক) অংশ। মৃতার সন্তান না থাকে এবং মৃতের মা-বাপ বা সন্তান না থাকে এবং মৃতের মা-বাপ বা সন্তান না থাকে, তাহলে বোন ভাইয়ের অর্ধেক অংশ লাভ করবে। বেশিরভাগ স্থানে নারীর
অংশ পুরুষের তুলনায় অর্ধেকই। যখন স্ত্রী এবং কন্যার কথা বলা হবে। কিন্তু এর উত্তর এই যে, যেহেতু পুরুষের ওপর বংশ রক্ষার বোঝা চাপানো হয়েছে। এজন্য পুরুষের ওপর অবিচার না হয়, আল্লাহ নারীর তুলনায় পুরুষকে বড় অংশ প্রদান করেছেন। আমি এখানে একটি উদাহরণ দিতে চাই। এক লোকের মরণোত্তর তার সম্পদ বণ্টন করা হচ্ছে। তার দু’সন্তান ছিল। এক ছেলে ও এক মেয়ে। দুজনের দেড় লাখ রুপি।
ছেলে এক লাখ এবং মেয়ে ৫০ হাজার রুপি পেল ইসলামি আইন মোতাবেক। কিন্তু যে ছেলের এক লাখ রুপী মিলল তার অধিকতর অংশ নিজের পরিবারের দায়ভারের পেছনে খরচ করতে হলো। সম্ভবত ৮০ হাজার ৮৫ হাজার অথবা এক লাখ রুপি। এর বংশীয় দায় দায়িত্বের জন্য খরচ করতে হয়। কিন্তু সেই বোন যে, ৫০ হাজার রুপি পেল তার বংশীয় বা পারিবারিক ব্যয় বাবদ এক পয়সাও খরচ করার প্রয়োজন হয় না। যে এক লাখ রুপি নিল তার পরিবারের (অপরের) জন্য ৮০ হাজার বা তার চেয়ে অধিক খরচ হয়ে গেল। এদিকে যিনি ৫০ হাজার পেলেন তার নিকট সারা জীবন তা থেকে যাবে।
প্রশ্ন-১০. ইসলামে মদকে কেন হারাম করা হয়েছে?
উত্তর : প্রাচীনকাল থেকে মদ মানব সমাজের জন্য বিপদ ও হয়রানির কারণ হয়ে আছে। আজো সারা দুনিয়ায় বহুলোক এ পাপের মূল (মদ) এর কবলে পড়ে এবং লাখ লাখ লোক এর কারণে নানা ধরনের সমস্যার শিকার হচ্ছেন। সমাজের বহু সমস্যার মূল এ জিনিস। এর দ্বারা অপরাধ বৃদ্ধি পায়, মস্তিষ্কে রোগ এবং মদের ধ্বংসের শিকারে বহু পরিবার ভেঙ্গে যায়। আল-কুরআনে এর নিষিদ্ধকারী আয়াত হলো ৫ নং সূরা মায়িদার ৯০ নং আয়াত, এরূপ এসেছে
অর্থ : হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা জেনে রাখো মদ, জুয়া, পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক তীর হচ্ছে ঘৃণিত শয়তানের কাজ। তোমরা তা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ কর তাহলে তোমরা সফল হবে। বাইবেলেও মদকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আহাদ নামা আতীকের দৃষ্টান্ত ধর্ম গ্রন্থে আছে, মদ হলো একটি ধোকাবাজ পানীয়। যে এর নিকট দিয়ে গমন করে, তাকে পাগল বানিয়ে ছাড়ে। আহাদনামা আতীকে আছে- এবং মদের নেশায় নিমগ্ন হয়ো না।
মানুষের মস্তিষ্কে খারাপ থেকে ফেরানোর একটি পদ্ধতি আছে যাকে নফসে লাওয়ামাহ’ বলা হয়। এটা মানুষকে ভুল (নিষিদ্ধ কাজ) থেকে বিরত রাখে। উদাহরণস্বরূপ, সাধারণভাবে একজন মানুষ মাতা-পিতা এবং বড়দের সঙ্গে কথা বলার সময় ভুল বা খারাপ ভাষা ব্যবহার করে না। এভাবে যখন তার পায়খানা পেশাবের চাপ আসে তখন সাধারণত তা চাপিয়ে রাখে এবং মানুষ টয়লেটে চলে যায় এবং সেখান থেকে পৃথক হয়ে প্রয়োজন পূর্ণ করে পবিত্র হয়।
যদি মদ পান করে তখন মানুষের স্বভাবগত শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যায় এবং সে এমন আচরণ করে যে, যা সাধারণত তার স্বভাবের বাইরে। সে মদের নেশায় ভুল এবং বিশ্রী ভাষা ব্যবহার করে। কিন্তু এতে তার অনুভূতি হচ্ছে না যে, সে তার পিতা-মাতাকেও সম্বোধন করছে। বেশিরভাগ মদ্যপ নিজ পোশাকেই পেশাব করে দেয়। সে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে না। স্বাভাবিকভাবে চলতেও পারে না। কথাও বলতে পারে না।
এমনকি মারপিটের দ্বারাও স্বাভাবিক হয় না। আমেরিকার বিচার বিভাগের এফ জেস্ট-এর এক ব্যুরো রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে আমেরিকায় ২ হাজার ৭১৩টি ধর্ষণ দৈনিক সংঘটিত হয়েছে। গণনায় ধরা পড়েছে যে, এ ধর্ষকদের অধিকাংশই নেশাগ্রস্ত ছিল। পরিসংখ্যানে এ তথ্যও পাওয়া গেছে যে, ৮% আমেরিকান মুহরিমাদের সাথে যৌন আচরণ করে। অন্য কথায়, প্রত্যেক ১২ জনের মধ্যে একজন এ ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত। এ সকল ঘটনার সিংহভাগ একজন অথবা উভয়ের নেশাগ্রস্ততার মধ্যে ঘটে। মরণব্যাধি এইডস-এর ছড়িয়ে পড়ার এক বড় কারণ হলো নেশা।
বহুলোক একথা বলে যে, সে অস্থায়ী নেশাকারী অর্থাৎ কখনো কখনো সুযোগ পেলে মদ পান করে। সে আরো বলে, সে নেশায় বুদ হয়ে যায় না, ২/১ কাপ পান করে মাত্র এবং তার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে এবং তার নেশা হয় না। বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, শুরুতে সকলে হালকা ও অস্থায়ী মদ্যপ হয়। একজনও একথা চিন্তা করে মদপান শুরু করে না যে, সে মূল মদ পানকারী হবে। কোনো কোনো অস্থায়ী মদ্যপ এটাও বলে যে, আমি কয়েক বছর যাবত মদ পান করছি এবং আমি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখি। আমার একবারও নেশা হয় নি। ধরুন, একজন অস্থায়ী মদ্যপ যদি মাত্র একবার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায়।
সে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ধর্ষণ করল অথবা নিজের কোনো মুহরিমার সঙ্গে ব্যভিচার করে বসল। পরবর্তীতে অনুভূতি তার ওপর সারা জীবন থাকবে। ব্যভিচারকারী এবং এর শিকার নারীর এতো বড় ক্ষতি হয় যে, তার পরিসংখ্যান অসম্ভব। সুনানে ইবনে মাজার ‘পান অধ্যায়’ এর বাবু ওমর (মদ অধ্যায়) হাদীস নং ৩,৩৭১ এ মদের হারাম হবার বিষয়টি আছে। প্রিয় নবী করীম : এরশাদ করেন, মদ পান করো না, নিঃসন্দেহে এটি সকল অপরাধের চাবি (মূল)’। ৩,৩৯২ নং হাদীসে বলা হয়েছে
সকল নেশা এবং নেশাদ্রব্য হারাম। সামান্য পরিমাণ নেশার উদ্রেক করলে সামান্য পরিমাণও হারাম। অর্থাৎ মদের এক ঢোক বা এক চামচও হারাম যে ব্যক্তি মদপান করে তার ওপর আল্লাহ তাআলার অভিশাপ এবং ঐ সকল লোকের ওপরও আল্লাহর অভিশাপ যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদের লেনদেনের সাথে যুক্ত। সুনানে ইবনে মাজার (৩৩৮০) আনাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর বর্ণিত হাদীসে ইরশাদ হলোআল্লাহ তাআলা মদের ওপর দশ প্রকারের অভিশাপ দিয়েছেন। তাহলো১. মদের সঞ্চয়কারীর ওপর। ২. মদ প্রস্তুতকারক। ৩. যার জন্য মদ প্রস্তুত করা হয়।
৪. মদের বিক্রেতা। ৫. যে মদের ক্রেতা হয়। ৬, মদের জন্য গমনকারীর ওপর। ৭. যার নিকট মদ নিয়ে যাওয়া হয়। ৮. মদের মূল্য আদায়কারীর ওপর। ৯. মদের পানকারীর ওপর। ১০. মদের পরিবেশনকারীর ওপর। মদ এবং যাবতীয় নেশাদ্রব্য ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞার বহু বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে। দুনিয়ায় মদের কারণে বহু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যেক বছর মদের কারণে লাখ লাখ লোক মারা যায়। আমি এর সকল পরিসংখ্যান একত্র করতে চাই না। তবে কয়েকটি উল্লেখ করতে চাই১. পাকস্থলীর ক্যান্সার এক বহু প্রসিদ্ধ রোগ যা মদের কারণে হয়ে থাকে। ২. পাকস্থলীর অন্ত্রের ক্যান্সার এবং বৃহৎ অন্ত্রের ক্যান্সার।
Cardiomyopatry অর্থাৎ হৃদয়ের অঙ্গে এর প্রভাব পড়ে রক্তচাপ এবং Coronary Artherosclerosis অর্থাৎ হৃদয়ের শিরাগুলো নষ্ট হয়ে যায়।
এনজায়েনা এবং হার্ট এর চলার সকল রোগ মদের প্রভাবে হয়। ৪. মগজের নড়াচড়া এবং তার যাবতীয় বিষয়ের সম্পর্ক নেশার সাথে।
বিভিন্ন প্রকার মস্তিষ্কের রোগ যেমন- Cortical, Peripheral, Neuropathy, Cerebellar Atrophy, Atrophy এসব বেশিরভাগ মদ পানের কারণে হয়। স্মৃতিশক্তির কমতি ঘটে। বেরিবেরি রোগ এবং দন্ত সম্পৰ্কীয় সকল রোগ মদ পানের কারণে হয়। ডিলিরিম রিমিনন ও বারবার মদ পানের কারণে হয় যা এক ধরনের মারাত্মক রোগ অপারেশনের পরে হয় এবং অনেক সময় এটা মৃত্যুর কারণও হয়। এর লক্ষণ হলো মেধার কমতি, ভীতি, ঘাবড়ানো ও ধারণা করা। এড়ো কারায়েন গজ রোগ যেমন Myoxodema, Florid Cushing, Hyperthyroidism ইত্যাদি।
১০. রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ততার রোগগুলো, রক্ত স্বল্পতা, এর কারণে Mycirocytic Anemia, এনিমিয়া, এরকান ইত্যাদি মদপান ও নেশাগ্রস্ততা থেকে জন্ম নেয়। ১১. রক্তের সাদা কণিকার স্বল্পতা এবং এ সংক্রান্ত সমস্যাবলি দেখা দেয়। ১২. সাধারণ ব্যবহার্য ওষুধ মেট্রো নিডাজল (ফ্লাজিল) মদের সাথে খুবই মারাত্মক রিঅ্যাকশন করে। শরীরের ইনফেকশন থেকে বারবার প্রভাবিত হয় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি কমে যায় অতিরিক্ত মদ পানের কারণে। সীনার ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, ফুসফুসের জালা Emphysena এবং ফুসফুসের টিবি, (যক্ষ্মা), মদের কারণে জন্মলাভকারী সাধারণ রোগ। মদে অভ্যস্থকারী নেশার অবস্থায় বেশিরভাগ সময় বমি করে। এছাড়া যে সকল বিষয় শ্বাশনালীকে সংরক্ষণ করে তা নষ্ট করে দেয়। যার কারণে সাধারণত বমি ফুসফুসের মধ্যে চলে যায়, ফলে নিউমোনিয়া এবং ফুসফুসের
ক্ষতি হয় এবং অনেক সময় দম বন্ধ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে থাকে। ১৬. মহিলাদের মধ্যে মদের বেশি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। পুরুষের তুলনায় মদ্যপ নারীর হার্টবিট বেশি হয়। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের বাচ্চার ওপর খুব বেশি প্রভাব পড়ে। ১৭. চর্মের রোগ-বালাইও মদপানের কারণে হয়ে থাকে। ১৮. চর্মের রোগগুলোর মধ্যে Atopecia অর্থাৎ গাঞ্জাপন, নখগুলো ভেঙ্গে যাওয়া,
নখের ইনফেকশন ইত্যাদি রোগ মদপানের কারণে হয়ে থাকে। এখন ডাক্তার মদের ব্যাপারে স্বাধীন চিন্তা করে এবং মদকে রোগের চেয়েও বেশি নাম দিয়ে থাকে। ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন একটি পোস্টার প্রচার করে। যাতে একথা বলা হয়েছিল যে, যদিও মদ একটি রোগ, যা অনেক রোগের মূল। যা১. বোতলে বিক্রি করা হয়। ২. এর প্রসার, প্রচার রেডিও টিভিতে হয়। ৩. এর প্রচারের লাইসেন্স দেয়া হয়। ৪. এটা রাষ্ট্রের পক্ষে এক নম্বরী দুর্নীতি করে।
বড় বড় শহরে ভয়ানক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর কারণ। ৬. ঘরোয়া জীবনকে ধ্বংস করে এবং অপরাধের বৃদ্ধি ঘটায়। ৭. জীবাণু ও ভাইরাস ব্যতীতই মানুষদের ধ্বংসের কারণ হয়। মদ শুধু একটি রোগই নয় বরং এটা শয়তানের এক মারাত্মক হাতিয়ার। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নিজ সীমাহীন হিকমতের কারণে আমাদেরকে শয়তানের
জাল থেকে বাচানোর জন্য খবরদার (সাবধান করে দিয়েছেন। এটা মানুষের প্রকৃতির ধর্ম। এর যে ধরনের বিধান আছে তা মানুষের মূল ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে সমান রাখার জন্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু মদ মানুষ ও সমাজের স্বাভাবিক প্রকৃতি থেকে পৃথক করে দেয়। এটা মানুষকে পশুর চেয়েও নিচে নামিয়ে দেয়। যদিও সে আশরাফুল মাখলুকাত হবার দাবি করে। এ সকল কারণে মদকে হারাম করা হয়েছে।
প্রশ্ন-১১. ইসলামে শূকরের গোস্তকে কেন নিষিদ্ধ করা হলো?
উত্তর : ইসলামে শূকরের গোশতকে কেন হারাম বা নিষিদ্ধ করা হলে এর কয়েকটি স্পষ্ট কারণ রয়েছে। আল কুরআনে শূকরের গোশত খাওয়ার ব্যাপারে কম-বেশি পাঁচ স্থানে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন২ নং সূরা বাকারার আয়াত নং ১৩৭ ৫ নং সূরা মায়িদার আয়াত নং ০৩ ৬ নং সূরা আনআম-এর আয়াত নং ১৪৫ এবং ১৬ নং সূরা নাহল-এর আয়াত নং ১১৫। ৫ নং সূরা মায়িদার ৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ : তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে, মৃত জিনিস রক্ত ও শূকরের গোশতকে। এটা মুসলমানদের জন্য যথেষ্ট যে, শূকরের গোশত কেন হারাম করা হয়েছে। এবং খ্রিস্টানরাও তাদের নিজেদের ধর্ম গ্রন্থের তথ্য দিয়ে বলেন। যেমন : বাইবেলের আহাদনামা আতীক-এর ধর্ম গ্রন্থ Leviticus অর্থাৎ পাদ্রী বলেনএবং শূকর খেও না। কেননা এর পা খণ্ডিত এবং পৃথক, অবস্থা এই যে, তা পরিষ্কার থাকে না।
তা তোমাদের জন্য নাপাক, তোমরা তার গোশত ভক্ষণ কর না, এবং তার লাশের ওপর হাত লাগিও না, কেননা তা তোমাদের জন্য নাপাক। এভাবে বাইবেলের Deuteronomy অর্থাৎ এস্তেননামীতেও শূকরের গোশতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এবং শূকর তোমাদের জন্য এ কারণে নাপাক যে, এর পা বিচ্ছি কিন্তু সে পরিষ্কার হয় না। তোমরা এ গোশত খেও না এবং এর লাশ স্পর্শও কর না। এরূপভাবে বাইবেলের ইসাইয়াহ ধর্ম গ্রন্থের অধ্যায় ৬৫ শ্লোক র ১ থেকে ৫ পর্যন্ত শূকরের গোশতের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। বাকি অমুসলিম এবং খোদাকে অমান্যকারীকে প্রশান্তি দিতে তাদের সামনে আমি জ্ঞানগত ও বৈজ্ঞানিক
ভিত্তিতে একথা বলব যে, শূকরের গোশত বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৭০ প্রকারের রোগ-ব্যাধির জন্ম দেয়। এর ভোক্তার পাকস্থলী ও অন্ত্রের মধ্যে কয়েক প্রকারের কীড়া (জীবাণু) জন্ম লাভ করে, যেমন ওয়ান্ডওয়ার্ম, পেন ওয়ার্ম, হুক ওয়ার্ম ইত্যাদি। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক Taenia Soluim যাকে সাধারণভাবে কাদু দানা বলা হয়।
এটাকে অন্ত্রের মধ্যে পাওয়া যায় এবং অনেক লম্বা হয়। এরপর ডিম্বাণু রক্তের মধ্যে মিশে শরীরের প্রায় সকল অঙ্গে পৌছে যায় এবং যদি তা মগজের মধ্যে পৌছে তাহলে স্মৃতির ওপর প্রভাব ফেলে। যদি হৃদয়ের মধ্যে পৌছে তাহলে হার্ট এ্যাটাক হতে পারে। যদি চোখে চলে যায়, তাহলে নাবিনাপেন জন্মগ্রহণ করে। যদি এটা জঠরে পৌছায় তাহলে জঠর এর ক্ষতির কারণ হয় এবং এটা শরীরের প্রায় সকল অঙ্গের ক্ষতি সাধন করে থাকে।
এ ধারণা করা সম্পূর্ণরূপে ভুল যে, শূকরের গোশত উত্তমরূপে পাকানো হলে ক্ষতিকর কৃমির ডিম্বাণ ধ্বংস হয়ে যাবে। আমেরিকার এক গবেষণায় পাওয়া গেছে যে, এদের চব্বিশ জন লোক যাদের Trichura Tichurasis রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এদের মধ্যে ২২ জন লোক শূকরের গোশত খুবই উত্তমরূপে পাক করতেন। এজন্য একথা প্রমাণিত হয় যে, শূকরের গোশতের মধ্যে বিদ্যমান জীবাণুও তাদের ডিম্বগুলো খুব বেশি পরিমাণ উত্তাপেও মরে না। শূকরের গোশতের চেয়ে এর চর্বির মূল্য বেশি এবং চর্বি অত্যধিক পরিমাণে হয়।
এর গোশত ভক্ষনে অবশ ও হার্ট অ্যাটাকের মতো রোগ হয় এবং এটা আশ্চর্যের কথা নয় যে, আমেরিকার শতকরা ৫০ ভাগ লোক উচ্চ রক্তচাপের রোগী। শূকর এ দুনিয়ার গাঢ় নাপাক প্রকৃতির জানোয়ার। যা গোবর, পায়খানা এবং ময়লা-আবর্জনার ওপর জীবন-যাপন করে। এবং একে আল্লাহ তাআলা সবচেয়ে অধিক নিকৃষ্ট জিনিসে ভোক্তা এবং ময়লা আবর্জনার ওপর লালিত-পালিত প্রাণী বানিয়েছেন।
গ্রামে সাধারণভাবে ল্যাট্রিন নেই, যার কারণে লোকেরা খোলা স্থানে তাদের প্রয়োজন পূরণ করে থাকে। এবং এ ধরনের ময়লা বেশির ভাগ শূকরেরা খতম করে। এক লোক বলেন যে, উন্নত দেশ যেমন অস্ট্রেলিয়া বা এ ধরনের দেশে শূকরদের পাক-সাফ স্থানে জীবন-যাপন করার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু এদের কীভাবে পরিষ্কার স্থানে রাখা নিজেদের পায়খানাই নয় বরং সমস্ত সঙ্গীদের বর্জ ভক্ষণ করে।
দুনিয়াতে প্রাপ্ত সকল প্রাণীর মধ্যে লজ্জহীন এবং এটা একমাত্র প্রাণী যে, অন্য সঙ্গীকে নিজ স্ত্রী শূকরী সঙ্গিনীর সঙ্গে জৈবিক চাহিদা পূরণের আহ্বান জানায়। আমেরিকার অধিকাংশ লোক এর গোশত ভক্ষণ করে এবং কয়েক বার ড্যান্স (Dance) পার্টির পরে নিজ স্ত্রীদের বদল করে এবং বলে তুমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে শয়ন কর এবং আমি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে শয়ন করব। এটা পরিষ্কার যে ব্যক্তি এদের গোশত ভক্ষণ করে এদের দ্বারাই এরূপ কাজ সম্ভব।
প্রশ্ন-১২. পশু হত্যা অত্যাচারী কাজ তবে মুসলমানরা গোশত ভক্ষণ করে কেন অর্থাৎ পশু হত্যা করে কেন?
উত্তর : ভেজিটেরীন অর্থাৎ সবজি ভক্ষণ সারা পৃথিবীতে এক প্রকার আন্দোলনে রূপলাভ করেছে। কিছু লোক একে প্রাণীদের অধিকারের সাথে মিলায় এবং যথেষ্ট বড় সংখ্যক লোক গোশত এবং অন্য যাবতীয় অবৃক্ষীয় জিনিসকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করাকে প্রাণী অধিকারের বিপরীত বুঝে থাকেন। ইসলাম এসব প্রাণীর সঙ্গে উত্তম আচরণের নির্দেশ দান করে। এর সাথে ইসলামের একথাও আছে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পৃথিবীর বুকে সবজি এবং প্রাণী মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন।
তবে এ সীমা মানুষের জন্য রয়েছে যে, সে সকল কিছু নির্দিষ্ট পন্থায় ইনসাফের সাথে আল্লাহ তাআলার নিয়ামত ও আমানতকে বুঝে ব্যবহার করবে। আসুন আমরা এর দ্বিতীয় পন্থায় বুঝার চেষ্টা করি। একজন মুসলমান সবজি খেয়েও একজন উত্তম মুসলমান হতে পারেন। তার জন্য জরুরি নয় যে, সে গোশত ভক্ষণ করবে। কুরআনের আলোকে মুসলমানদের গোশত খাবার অনুমতি আছে। আল-কুরআনের ১৪ পারার ১৬ নং সূরার ৫ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন
অর্থ : তিনি চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন, তোমাদের জন্য ওতে শীতবস্ত্রের উপকরণসহ আরো অনেক ধরনের উপকার রয়েছে। তাদের কিছু অংশকে তোমরা আহারও করে থাকো। আরো আছে ১৮ পারার ২৩ নং সূরা মমিনুন-এর ২১ নং আয়াতে মহান রব ইরশাদ করেন
অর্থ : তোমাদের জন্য এই চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় আছে তার পেটের মধ্যে যা কিছু আছে তার মধ্য থেকে তোমাদের (দুধ) পান করাই। তোমাদের জন্যে তাতে আরো অনেক উপকারিতা রয়েছে- তার গোশতও তোমরা খাও। অতৃণী খাবার (আমিষ জাতীয় খাবার) যেমন : ডিম, মাছ এবং গোশতের মধ্যে উত্তম পরিমাণে প্রোটিন রয়েছে। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রোটিন অর্থাৎ অতি প্রয়োজনীয় ৮ প্রকারের আময়েনভেস্ট আছে। যা আমাদের দেহ তৈরি করতে পারে না তা এখান থেকে অর্জন করতে হয়। গোশতের মধ্যে ফাওলাদ, ভিটামিন বি-ওয়ান এবং নিয়াসিন (Niacin)ও আছে। এছাড়াও যদি আপনি সবজি ভক্ষণকারী প্রাণী যেমন : গাভী, ভেড়া, বকরী ইত্যাদির দাঁত দেখেন তাহলে এদের আপনি দেখে হয়রান হবেন।
এ সকল প্রাণীর দাঁত চ্যাপ্টা যা সবজিজাতীয় খাবারের জন্য উত্তম এবং আপনি যদি গোশত ভক্ষণকারী প্রাণীদের দেখেন, যেমন : চিতাবাঘ, সিংহ, কুকুর ইত্যাদি, এদের দাঁত সুচালো যা গোশত ভক্ষণের জন্য উত্তম। যদি আপনি মানুষের দাঁত দেখেন তা ধারালো ও চ্যাপ্টা এ দু রকমের হয়। এজন্য এদের দাত গোশত ও সবজি উভয় প্রকার খাবার গ্রহণের মতো করে করা হয়েছে। অর্থাৎ এরা সব জিনিস খেতে পারবে। এখানে এ প্রশ্ন ওঠানো যেতে পারে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মানুষকে যদি সবজি ভোগী বানাবেন তাহলে এ সুচালো দাঁতগুলো কেন দিলেন? একথা অবশ্যই যে, তিনি জানতেন মানুষের দুই প্রকার খাবারের আবশ্যক রয়েছে। প্রাণীদের হজম প্রক্রিয়া শুধু পাতাযুক্ত খাবার হজম করে থাকে এবং মাংশাসী প্রাণীর হজম প্রক্রিয়া গোশতকে হজম করতে পারে। কিন্তু মানুষের হজম প্রক্রিয়া সবজি এবং গোশত এ উভয় প্রকার খাদ্য হজম করে থাকে।
যদি আল্লাহ চাইতেন আমরা শুধু সবজিভোজী হবো,তাহলে কেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা উভয় প্রকারের হজম প্রক্রিয়া দিলেন? অনেক হিন্দু এমন আছেন যারা সবজি ভক্ষণের ওপর অটুট থাকেন। তাদের ধারণা এই যে, আমিষ জাতীয় খাদ্য যেমন গোশত ইত্যাদি ভক্ষণ তাদের ধর্ম বিরোধী হবে। কিন্তু হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থে তাদের ধর্মের অনুসারীদের গোশতের অনুমতি প্রদান করে।
এগুলোর মধ্যে লেখা আছে যে, হিন্দু মুনি ঋষীরা গোশত ভক্ষণ করতেন। হিন্দুদের ধর্ম গ্রন্থ মনু স্মৃতির ৫ম অধ্যায়ের ২৩তম লাইনে বলা হয়েছেযে ব্যক্তি এ সকল প্রাণীর গোশত ভক্ষণ করে, যার গোশত ইচ্ছা এর মধ্যে কোনো খারাবি নেই। যদিও সে প্রতিদিন এরূপ করে, কেননা আল্লাহ কিছু জিনিস খাওয়ার জন্য তৈরি করেছেন, আর কিছুকে ঐ জিনিস খাওয়ার জন্যও সৃষ্টি করেছেন।
এরূপভাবে মনু স্মৃতির ৫ম অধ্যায় এর ৩৯ ও ৪০ লাইনে এটাও লেখা রয়েছে আল্লাহ কুরবানীর জানোয়ারগুলো স্বয়ং কুরবানীর জন্য সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং কুরবানীর জন্য তাদের হত্যা করা, হত্যা করা (ধ্বংস করা) নয়। মহাভারত অনুশাসন প্রভা অধ্যায় নং ৮৮-তে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ও পিতিম-এর মধ্যে কথোপকথনের উল্লেখ আছে যে, শরধার নিয়মে পেতরীকে কোনো খোরাক উপঢৌকন করা উচিত। যাতে এর কারণে নরদের শান্তি মিলে। যুধিষ্ঠির বলেনহে মহাশক্তি! আমি আমার বাপ-দাদাদের জন্য কী জিনিস দিতে পারি যা কখনো শেষ না হয়, সেটা কোন জিনিস যা সবসময় থাকে, সেটা কোনো জিনিস যা অমর হয়ে যায়।
ভীষণ উত্তর দিল, হে যুধিষ্ঠির শোন! উহা কোন জিনিস যেগুলো শরধা জান্তার নিকট এ ধরনের নিয়মের জন্য উপযোগী। হে মহারাজ! তার মধ্যে বীজ, চাল, যব, মাশকলাই, পানি এবং এ জাতীয় ফল হলো এমন বস্তু থাকবে। মাছ দিলে তাদের আত্মা দু’মাস পর্যন্ত শান্তিতে থাকবে, ভেড়ার গোশতে তিন মাস, খরগোশের গোশতে চার মাস, বকরীর গোশতে পাচ মাস, শূকরের গোশতে ছয় মাস, পাখিদের গোশতে সাত মাস, ডোরাকাটা হরিণের গোশতে আট মাস, কৃষ্ণসার হরিণের গোশতে নয় মাস, গাভীর গোশতে দশ মাস, মহিষের গোশতে এগারো মাস, নীল গাভীর গোশতে এক বছর। ঘি মেশানো পেঁয়াজও সে গ্রহণ করে। ধর্মীয় নাম (বড় মহিষ) এর গোশতে বারো মাস পর্যন্ত। গণ্ডারের গোশত যা চান্দ্র মাসের হিসেবে পরোক্ষ বর্ষার ওপর দেয়া হয় তা কখনো শেষ হবে না।
ক্লাসিক বুটি, কাঞ্চনের ফুল, পৈতা এবং লাল ছাগলের গোশতও দেয়া যাবে, তবে তাও কখনো শেষ হবে না। এজন্য এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কথা যে, যদি আপনি আপনার পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তি করতে চান তাহলে লাল ছাগলের গোশত এ সুযোগে পেশ করুন। হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থে গোশত ভক্ষণ করতে নিষেধ করা হয় নি।
অনেক হিন্দু শুধু সবজি ও ডাল ইত্যাদি খায়। অপর ধর্মের প্রভাব থেকে গ্রহণ করেছেন, যার মধ্যে সর্বপ্রথম হলো জৈন মত। কিছু কিছু ধর্ম সবজি এবং ডালকে পরিপূর্ণ খাবার হিসেবে এজন্য গ্রহণ করেছেন যে, তা প্রাণী হত্যার বিপরীত ধর্ম। যদি কেউ প্রাণী হত্যা ব্যতীত জীবিত থাকতে পারে, তাহলে আমিই হব প্রথম সেই ব্যক্তি। কিন্তু এরূপ সম্ভব নয়। অতীতে লোকদের ধারণা এই ছিল যে, বৃক্ষ জীবনহীন। কিন্তু আজ এটা এক গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বব্যাপী মত যে, বৃক্ষেরও জীবন আছে।
আজ এ ধরনের লোকদের কথাও হালকা হয়ে গেছে যারা সবজি ভক্ষণ করে এবং জীব হত্যা করে না, এজন্য যে, বৃক্ষ ও সবজি কাটা ও জীব হত্যা করা। একটি প্রমাণ এরূপ দেয়া হয় যে, বৃক্ষের অনুভূতি নেই। এজন্য বৃক্ষও সবজি কাটা প্রাণী হত্যার চেয়ে কম অপরাধ। কিন্তু আজ বিজ্ঞান আমাদের একথা বলে দিচ্ছে যে, বৃক্ষও কষ্ট অনুভব করে। তবে হ্যা তাদের চিৎকার ও কান্নার আওয়াজ মানুষ শুনতে পায় না।
মানব কর্ণ এদের আওয়াজ শুনতে পায় না। কারণ মানব কর্ণের শ্রুতি শক্তি ২০ ডিবি থেকে ২০ হাজার ডিবি পর্যন্ত। বৃক্ষের ডিবি এর বাইরে। যদি কোনো আওয়াজ এর চেয়ে কম হয় অথবা বেশি, তাহলে মানুষের কান তা শুনতে সক্ষম নয়। কুকুর ৪০ হাজার ডিবি পর্যন্ত আওয়াজ শুনতে পায়। যে শব্দের ডিবি ১০ হাজারের ওপরে এবং ৪০ হাজারের কম তা শুধু কুকুরই শুনতে পায়। মানুষ শোনে না। কুকুর নিজের মালিকের বাঁশির আওয়াজ শোনে এবং তার নিকট চলে আসে। একজন আমেরিকার বিজ্ঞানী গবেষণার পর এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন যে, যা দ্বারা
বৃক্ষের চিৎকারও এভাবে পরিবর্তন করতে পারে যে, মানুষ তা শুনতে পায়। এর দ্বারা এতে তৎক্ষণাৎ বার্তা পৌঁছে যায় যে, কখন বৃক্ষ পানির জন্য চিৎকার করছে। আধুনিক গবেষণায় এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, বৃক্ষ খুশি ও কষ্ট অনুভব করে এবং চলতেও পারে। একজন বিজ্ঞবান সবজিভোজীর সঙ্গে আমার বিতর্ক হলো। তিনি বললেন, আমি জানি বৃক্ষের জীবন আছে এবং কষ্টও অনুভব করে, কিন্তু বৃক্ষ প্রাণীর চেয়ে দুটি অনুভূতি কম রাখে, এজন্য বৃক্ষ হত্যা প্রাণী হত্যার চেয়ে কম অপরাধ। কিন্তু সাধারণ সমাজকে জিজ্ঞেস করি, ধরুন! আপনার একজন ভাই যে জন্ম থেকে বোবা ও বধির এবং তার দুটি অনুভূতি অন্য লোকের চেয়ে কম এবং যখন সে বড় হলো কেউ তাকে হত্যা করল। আপনি কি বিচারককে বলবেন যে, আপনি হন্তারককে শাস্তি কম দিন কারণ সে দু অনুভূতি কমকে হত্যা করেছে। না, বরং আপনি বিচারককে বলবেন যে, একে অধিক শাস্তি দিন কারণ আমার ভাই নির্দোষ ছিল। আল-কুরআনের ২ নং সূরা বাকারার ১৬৮ নং আয়াতে মহান রব ইরশাদ করেন
অর্থ : তোমরা খাও জমিনের বুকে যা হালাল ও পবিত্র তা থেকে। যদি দুনিয়ার সকল লোক নিরামিষভোজী হতো, তাহলে দুনিয়ায় প্রাণীর সংখ্যা সীমা ছাড়া বেশি হয়ে যেতো। কেননা এদের জন্ম ও বৃদ্ধি খুব দ্রুত হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বিজ্ঞতার সাথে নিজ সৃষ্টির মধ্যে এক বিশেষ ভারসাম্য রক্ষা করেছেন এবং এর মধ্যে কোনো হয়রান হবার কারণ নেই যে, তিনি আমাদেরকে প্রাণী ভক্ষণের অনুমতি প্রদান করেছেন। আমি তাকে খারাপ মনে করি না যিনি নিরামিষভোজী। পক্ষান্তরে যিনি আমিষ ভক্ষণ করতে প্রাণী হত্যা করেন তাকেও জালিম বা নির্দয় বলা যাবে না।
প্রশ্ন-১৩. মুসলমানগণ প্রাণীদের জালেমি পদ্ধতিতে হত্যা করে কেন?
উত্তর : যবেহ করার পদ্ধতি, যেভাবে মুসলমানগণ প্রাণীদের জবাই করে অধিকাংশ অমুসলিমের নিকট সমালোচনার বিষয়। যদি নিচের বিষয়গুলো জানা যায় তাহলে বুঝা যাবে যে, জবাই করার পদ্ধতি নিঃসন্দেহে দয়াশীল ও বৈজ্ঞানিক দিক দিয়েও উত্তম পদ্ধতি। ইসলামি পদ্ধতিতে প্রাণীদের হত্যা করার সময় নিম্নলিখিত কিছু শর্তাবলির দিকে খেয়াল রাখতে হয়প্রাণীদের তীক্ষ্ণ ধারালো চাকু অথবা ছুরি দিয়ে জবাই করা। তীক্ষভাবে জবাই করতে হবে যাতে প্রাণীর কষ্ট সবচেয়ে কম হয়।
ইসলামের উপর ৪০টি অভিযোগ এবং তার প্রমাণ ভিত্তিক জবাব ১৯৩ যবেহ’ শব্দটি আরবি। যার অর্থ রক্ত প্রবাহিত করা। প্রাণীদের জবাই করার সময় এদের গলা, শ্বাসনালী এবং ঘাড়ের মধ্যে পাওয়া যাওয়া রক্তনালী কেটে এদের হত্যা করতে হবে। প্রাণীদের মাথা পৃথক করার পূর্বে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পরিমাণ সকল রক্ত বের করা উচিত। রক্ত বের করার কারণ এই যে, জীবাণুগুলো খুব দ্রুত রক্তের মধ্যে প্রতিপালিত হয়। হারাম মগজ না কাটা উচিত কেননা এরূপ করলে হার্টের দিকে প্রবাহিত রগগুলো কাটাতে হার্টের রগ বাধাগ্রস্ত হয় এবং এরূপ করাতে রক্তনালীর মধ্যে জমে যায়। রক্ত বহু প্রকারের জীবাণু ব্যাকটেরিয়া এবং টক্সিনের স্থানান্তর করার মাধ্যম।
এ সকল কারণে ইসলামি পদ্ধতিতে জবাই করা অধিকতর নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যসম্মত। এবং যেহেতু রক্তের মধ্যে সকল প্রকারের জীবাণু পাওয়া যায় এজন্য বেশির চেয়ে বেশি রক্ত প্রবাহিত হওয়া প্রয়োজন। ইসলামি পদ্ধতিতে জবাই করা গোশত বেশি। সময় পর্যন্ত তাজা থাকে, কারণ প্রাণীর রক্ত শরীরের মধ্যদিয়ে বের হয়ে যায় এবং তীক্ষ্ণতার সাথে কাটার কারণে নার্ভ এর নিকট রক্ত প্রবাহিত হয় যা ব্যথার অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং প্রাণী ব্যথা অনুভব করে না। যবেহ করার জন্য প্রাণী যে, তড়পাতে থাকে এবং পা ছুটোছুটি করে তা ব্যথার জন্য নয় বরং রক্ত কমে যাওয়ার কারণে। এ ছোটাছুটিতে রক্ত শরীর থেকে বের হবার ব্যাপারেও সহযোগিতা হয়ে থাকে।
প্রশ্ন-১৪. বিজ্ঞান অনুযায়ী মানুষ যা ভক্ষণ করে তা তার ওপর প্রভাব ফেলে। ইসলাম নিজ অনুসারীদের কেন আমিষজাতীয় খাদ্য যেমন : গোশত ইত্যাদি খাবার অনুমতি দিয়েছে, প্রাণীর গোশত মানুষকে কি কঠিন ও জালেম বানায় না?
উত্তর : আমি একথা মানি যে, মানুষ যা ভক্ষণ করে তার প্রভাব তার নিজের ওপর পড়ে। এজন্য ইসলাম হিংস্র এবং ফেড়ে ছিড়ে ফেলায় অভ্যস্ত প্রাণীর গোশত ভক্ষণ করতে নিষেধ করে এ তাদের খাওয়া হারাম করে দিয়েছে। যেমন : বাঘ, চিতা ইত্যাদি যা ছিড়ে ফেড়ে ফেলা প্রাণী এবং রক্তখেকো প্রাণী। এদের গোশত ভক্ষণের ফলে মানুষ কঠিন ও জালিম হয়। যদিও ইসলাম শুধু পাখি অথবা তৃণ ভোজী প্রাণীর গোশত খাওয়ার অনুমতি প্রদান করেছে। মুসলমান সোজা চলা নিরীহ প্রাণীদের গোশত খায়। কেননা সে নিরাপত্তা এবং মিলমিশ ও পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করে। নবী করীম এ সকল জিনিস খেতে নিষেধ করেছেন যা ভালো নয়। কুরআন বলে ৭ নং সূরা আরাফ-এর ১৫৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন
অর্থ : নবী তাদের ভালো কাজের আদেশ দেয়, ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে, যিনি তাদের জন্য যাবতীয় পাক জিনিসকে হালাল ও নাপাক জিনিসসমূহকে তাদের জন্য হারাম ঘোষণা করেন। এবং সূরা হাশর ৫৯ নং সূরার ৭ নং আয়াতে তিনি ইরশাদ করেন
অর্থ : রাসূল তোমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো। একজন মুসলমানের জন্য নবী করীম এর এই নির্দেশ যথেষ্ট যা আল্লাহ চান যে, মানুষ সে গোশত খাবে যা তার জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং সেগুলো খাবে না যেগুলোর অনুমতি প্রদান করা হয় নি।
ছহীহাইনের হাদীস যা ছহীহ মুসলিমের হাদীস নং ১৯৩৪, ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, যাতে যবাই করার ব্যাপারে বর্ণনা করা হয়েছে এবং ইবনে মাজার হাদীস নং ৩২৩২, ৩২৩৩ এবং ৩২৩৪ ইত্যাদিতে দু ধরনের প্রাণী হারাম করার কথা বলা হয়েছে। ১. নখরধারী। অর্থাৎ ঐ বুনোপ্রাণী যাদের দাঁত সুচালো এবং তা গোশতভোজী,
এবং বিড়াল প্রজাতির সাথে সম্পর্ক রাখে। যেমন : বাঘ, সিংহ, চিতা, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি। পুঁজি করে খাওয়া প্রাণী যেমন- ইঁদুর ইত্যাদি। বিষাক্তপ্রাণী যেমন- সাপ ইত্যাদি। ২. পাঞ্জা দ্বারা শিকারধারী পাখি, যেমন : চিল, শকুন, কাক ইত্যাদি এবং এমন কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই যে, আমিষ ভোজন যেমন গোশত খাবার দ্বারা মানুষের কাঠিন্য পছন্দ হয় বা এ ধরনের স্বভাব গঠিত হয়।
প্রশ্ন-১৫. মুসলমান এক কুরআনকে অনুসরণ করে। এরপরও তাদের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে এতো পার্থক্য কেন? এও বলতে পারি যে, ইসলামে এতে ফিরকা বা দল কেন?
উত্তর : আজ মুসলমান বিভক্ত হয়ে গেছে, যদিও ইসলামে এ ধরনের সুযোগ নেই। ইসলাম নিজ অনুসারীদের মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠার ওপর বিশ্বাস রাখে। আল-কুরআনের ৩ নং সূরা আলে ইমরানের ১০৩ নং আয়াতে রয়েছে
অর্থ : তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।
এখানে আল্লাহর কোন্ রশির উল্লেখ হয়েছে? উত্তরে বলা যায়- এটা আল্লাহর রশি, যা সকল মুসলমান মজবুতভাবে ধারণ করবে। এ আয়াতে দুটি নির্দেশ আছে১. সবাই মিলে শক্তভাবে ধারণ কর এবং ২. পৃথক হয়ে যেও না, বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আল-কুরআনে এটাও বর্ণিত আছে ৪ নং সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতের মহান রব ইরশাদ করেন
অর্থ : হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। এ কারণে সকল মুসলমানকে কুরআন ও হাদীসের ওপর আমল করা জরুরি। এবং নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যাওয়া চলবে না। আল-কুরআনে মহান রব ইরশাদ করেন। ৬ নং সূরা আনআম, আয়াত নং ১৫৯
অর্থ : যারা নিজেদের দ্বীনকে টুকরো টুকরো করে নিজেরাই নানা দল উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছে, তাদের কোনো দায়িত্বই তোমার ওপর নেই। তাদের ব্যাপারটা আল্লাহ তাআলার হাতে। তখন তিনি তাদের জানিয়ে দিবেন তাদের কৃতকর্ম যা তারা করে। এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা এ ধরনের লোকদের মুসলমানদের থেকে পৃথক রাখার নির্দেশ দিয়েছেন যারা দ্বীনকে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত করে। যখন মুসলমানদের জিজ্ঞেস করা হয়, তোমরা কোন মুসলমান? তখন সাধারণত উত্তর দেয়া হয় আমরা সুন্নী বা আমরা শিয়া। এভাবে কিছু লোক নিজেদেরকে ‘হানাফী’, মালেকী, শাফেয়ী’ অথবা হাম্বলী বলে।
কেউ কেউ বলে আমরা দেওবন্দী” অথবা “ব্রেলভী’। এ লোকদের নিকট একথা জিজ্ঞেস করা দরকার যে, আমাদের নবী করীম কোন্ (মাযহাবের অনুসারী) ছিলেন? তিনি কি হাম্বলী, শাফেয়ী, মালেকী না হানাফী ছিলেন? একেবারেই না, তিনি আল্লাহর সকল নবী যেমন মুসলমান ছিলেন যা তিনি প্রথমে ছিলেন। কুরআনে বর্ণনা করে ঈসা আলাইহি সাল্লাম মুসলমান ছিলেন এবং নিজ হাওয়ারি (সঙ্গী)-দেরও সেরূপ নির্দেশ প্রদান করেছেন। ৩ নং সূরা আলে ইমরানের ৫ নং আয়াতে রয়েছে : কে আছো আল্লাহর পথে আমার সাহায্যকারী?
উত্তরে হাওয়ারিগণ বলেছেন
অর্থ : আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছি। আপনি সাক্ষী থাকুন আমরা সবাই মুসলমান। এ শব্দাবলি বর্ণনা করে যে, ঈসা আলাইহি সাল্লাম এবং তাঁর অনুসারিগণ মুসলমান ছিলেন। এরূপভাবে ৩ নং সূরা আলে ইমরানের ৬৭ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে
অর্থ : (সঠিক ঘটনা হলো এই যে,) ইবরাহীম না ছিলেন ইহুদি, না ছিলেন খ্রিস্টান, বরং তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম। তিনি মুশরিকদের দলভুক্তও ছিলেন না। ইসলামের অনুসারীদের এ কথার ওপর আনুগত্য রয়েছে যে, তারা নিজেদের মুসলমান পরিচয় দেয়। যদি এক ব্যক্তি নিজেকে মুসলমান মনে করে, তাহলে তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, আপনি কে? তাহলে উত্তর দেয়া উচিত ‘আমি মুসলমান।’এভাবে নিজেদের ‘হানাফী, শাফেয়ী’ এরূপ বলা উচিত নয়। কুরআনের ৪১ নং সূরা হা-মীম আস-সিজদার ৩৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ : তার কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয় এবং সৎ আমল করে এবং বলে যে, আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় ভাষায়, আপনাকে এটা বুঝে নেয়া দরকার যে, আল্লাহ এ আয়াতে একথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমি মুসলমান। নবী করীম এই ৭ হিজরীতে অমুসলিম শাসকদের ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য চিঠি লিখিয়েছিলেন। যার মধ্যে, রোম, সিরিয়া, হাবসী খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি সূরা আলে ইমরানের শব্দাবলি লিখিয়েছিলেন
অর্থ : তোমরা সাক্ষী থাকো আমরা মুসলমান। আমি মুসলিম উম্মাহকে সম্মান করতে চাই, যাদের মধ্যে ইমাম আবু হানীফা (র), ইমাম আবু ইউসুফ (র), ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) ইমাম মালেক (র) এবং
অন্যান্য উলামায়ে কিরাম শামিল আছেন। এঁরা সবচেয়ে বড় আলেম ও ফকীহ ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাদের গবেষণা ও শ্রমের প্রতিদান তাঁদের দিন। যদি কোনো ব্যক্তি ইমাম আবু হানীফা (র) অথবা ইমাম শাফেয়ী (র)-এর আকিদা অথবা দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাদের গবেষণার সাথে একমত হন, তবে তার ওপর কোনো অভিযোগ থাকা উচিত নয়। কিন্তু যদি কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করে আপনি কে? উত্তরে বলা উচিত আমি মুসলমান। কিছু লোক আবু দাউদ শরীফের হাদীস নং ৪৫৯ যা মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বরাত দেয়অর্থ : নিঃসন্দেহে আমার উম্মত ৭৩ কাতারে বিভক্ত হবে, ৭২ দল দোযখে যাবে এবং এক দল জান্নাতে যাবে, যেটা হবে আল জামাআত।
হাদীস থেকে একথা বের করার চেষ্টা করা হয় নবী করীম ৭৩ দল হওয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু আপনি তো একথা বলছেন না যে মুসলমান বিভক্ত হবার চেষ্টা করছে। কুরআন দলে দলে বিভক্ত হওয়ার পথকে রুদ্ধ করতে চায়। যে লোক কুরআন ও হাদীসের ওপর আমল করে এ দল তৈরি করে না এবং লোকদের বিভক্ত করে না, সে সোজা রাস্তায় রয়েছে। তিরমিযীর হাদীস নং ২৬৪১ যা আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম আমার বর্ণনা করেছেনআমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে, এ সকল দল জাহান্নামে যাবে এক দল ছাড়া। জিজ্ঞেস করা হলো, সেটা কোন্ দল? তিনি বললেন : ঐ দল, যে আমার ও আমার সাহাবীদের রাস্তার ওপর চলবে।
কুরআনের বহু আয়াত একথা বলে যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। একজন মুসলমানের কুরআন এবং ছহীহ্ হাদীসের ওপর আমল করা উচিত। তার কোনো আলেম বা ইমামের ততক্ষণ পর্যন্ত একমত হওয়া উচিত যতক্ষণ পর্যন্ত তার আকিদা ও দৃষ্টিভঙ্গি কুরআন এবং ছহীহ্ হাদীস মুতাবিক হবে। যদি তার আকিদা ও দৃষ্টিভঙ্গি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার বিধান ও নবী করীম এর সুন্নাতের বিপরীত হবে, তবে তার কোনো গুরুত্ব নেই। যদি সকল মুসলমান কুরআনকে বুঝে এর অধ্যয়ন করে এবং বিশুদ্ধ হাদীসের ওপর আমল করে, তবে ইনশাআল্লাহ সকল মতানৈক্য শেষ হয়ে যাবে এবং মুসলমানগণ এক ঐকমত্যে উম্মত হয়ে যাবে।
প্রশ্ন-১৬. যদি ইসলাম একটি সুন্দর ধর্মই হয়ে থাকে, তাহলে অগণিত মুসলমান বেঈমান কেন? ধোঁকা দেয়া, ঘুষ খাওয়া এবং নিষিদ্ধ কার্যাবলির সাথে কেন জড়িত?
উত্তর : এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, ইসলাম এক সুন্দর ধর্ম, কিন্তু মিডিয়া পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণে, যারা ইসলামের ব্যাপারে ভীতু। এই মিডিয়া ধারাবাহিকভাবে ইসলামের বিপরীত ভুল পদ্ধতির সংবাদ এবং তথ্য প্রচার করে।
এটা ইসলামের ব্যাপারে ভুল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং ভুল বরাত দিয়ে থাকে, মূল ঘটনাকে বড় সড় করে প্রচার করে। যদি কোথাও বোমা ফাটে তাহলে বিনা প্রমাণে মুসলমানের ওপর অভিযোগ চাপিয়ে দেয়া হয়। খবরে এ ধরনের অভিযোগ বড় ধরনের কভারেজ পায়। আবার যখন বিশ্লেষণের পর অ-মুসলমানের কারসাজি প্রমাণিত হয়, তখন সংবাদ সামান্য কভারেজে প্রকাশিত হয়। যদি ৫০ বছরের কোনো মুসলমান ১৫ বছরের কোনো বালিকাকে বিবাহ করে, তবে পশ্চিমা সংবাদপত্রে এ খবরকে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপিয়ে প্রচার করে কিন্তু যদি কোনো ৫০ বছরের অমুসলিম ৬ বছরের কোনো বাচ্চাকে ধর্ষণ করে, তাহলে এ খবর সাধারণ সংবাদের সাথে সাধারণ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়। আমেরিকায় প্রতিদিন ২ হাজার ৭ শত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে কিন্তু এ খবরগুলো প্রচার করা হয় না।
কেননা এ ঘটনা আমেরিকানদের জন্য সাধারণ ব্যাপার, তা জীবনের অঙ্গে পরিণত হয়েছে। আমি এটা জানিয়ে দিতে চাই এমন মুসলমান অবশ্যই মজুদ আছে, যে দ্বীনদার নয়, ধোঁকা দেয়, এবং অন্য প্রকারের গুনাহের কাজে লিপ্ত আছে। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়া এমন প্রভাব সৃষ্টি করে যেন মনে হয়) এ শুধু মুসলমানরাই করে। অবস্থা হলো এমন লোক দুনিয়ার সকল দেশ ও সকল জাতির মধ্যে পাওয়া যায়। আমার জানা আছে যে, অনেক মুসলমান মদপান করে এবং অমুসলিমদের সাথে মিলে। মুসলিম সমাজেও এরূপ লোক আছে, তবে অবশ্যই সর্বতোভাবে মুসলিম সমাজ উন্নততর সমাজ। ইসলামি সমাজই হলো সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য যে, মদপানের বিরোধিতা করে এবং ভিন্ন কথায় সাধারণভাবে মুসলমান মদপান করে না।
সামগ্রিকভাবে এটা ঐ সমাজ যা সম্পূর্ণ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কল্যাণ করে এবং যার পর্যাপ্ত লজ্জা, চিন্তা-ভাবনা, চরিত্র গঠন ও মানবতার সম্পর্ক আছে। দুনিয়ার কোনো সমাজ এরূপ দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে পারবে না। বসনিয়া, ইরাক এবং আফগানিস্তানের মুসলমান বন্দিদের সাথে খ্রিস্টানদের অত্যাচারী আচরণ এবং বৃটেনের মহিলা সাংবাদিকদের সাথে তালেবানদের আচরণ এর মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে যায়। যদি আপনি জানতে চান মার্সিডিজ-এর নতুন মডেলের গাড়ি কেমন এবং যে ব্যক্তি ড্রাইভিং সম্পর্কে জানে না, তিনি যদি স্টিয়ারিং-এর ওপর গিয়ে বসেন এবং গাড়িকে নষ্ট করেন তাহলে এ দোষ কার ওপর দিবেন? গাড়িকে নাকি ড্রাইভারকে পরিষ্কার আপনি ড্রাইভারকে দোষ দেবেন। এটা জানার জন্য যে গাড়ি কীরূপ তাহলে ড্রাইভার নয় বরং গাড়ির বৈশিষ্ট্য এবং তার বিভিন্ন পার্টস এর যাচাই প্রয়োজন। এটা কী গতিতে চলে? কোন প্রকারের ইঞ্জিন ব্যবহার করে? এটা কী পরিমাণ সংরক্ষিত ইত্যাদি। যদি একথা মানা হয় যে, মুসলমানগণ সঠিক নেই, তদুপরি আমি
ইসলামের অনুসারীদের পরীক্ষা করতে বলব না। যদি আপনি জানতে চান যে, ইসলাম কী পরিমাণ ভালো ধর্ম তাহলে এর মূল জিনিসগুলো পরীক্ষা করা কর্তব্য। অর্থাৎ কুরআন এবং ছহীহ্ হাদীস। যদি আপনি আমলের দিক দিয়ে এটা দেখতে চান যে, গাড়ি কেমন তাহলে স্টিয়ারিং-এর ওপর এমন কাউকে বসান যিনি দক্ষ ডাইভার। এরূপভাবে যদি এটা জানতে চান যে, ইসলাম কেমন দ্বীন, তাহলে এর উত্তম পদ্ধতি হলো আল্লাহর সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সাঃ) কে সামনে রাখুন।
মুসলিম ছাড়াও এমন অনেক উদারপন্থী অমুসলিম ঐতিহাসিকগণ প্রকাশ্যে এ ঘোষণা দিয়ে বলেছেন যে, মুহাম্মদ (সাঃ) সর্বোত্তম মানব ছিলেন। মাইকেল এইচ, হার্ট ‘১০০ শত বড় বড় ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব’ নামক বই লিখেছেন। তাতে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নাম সর্ব প্রথম রয়েছে। বইটিতে অনেক অমুসলিম ব্যক্তিত্ব আছে, যাদের মধ্যে মুহাম্মদ (সাঃ) এর অনেক বেশি প্রশংসা করেছেন।
প্রশ্ন-১৭. অ-মুসলিমদের মক্কা ও মদিনায় প্রবেশাধিকার নেই কেন?
উত্তর : একথা সত্য যে, আইন মুতাবেক অমুসলিমদের মক্কা-মদিনায় প্রবেশাধিকার নেই। এর অনেক কারণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমি ভারতের একজন নাগরিক। এ সত্ত্বেও ভারতের বহু স্থানে যাওয়ার অনুমতি নেই। যেমন : ক্যান্টনমেন্ট ইত্যাদি। প্রত্যেক রাষ্ট্রে এমন কিছু এলাকা থাকে যেখানে কোনো সাধারণ নাগরিক এর প্রবেশের অনুমতি থাকে না। এবং যে ব্যক্তি সৈন্য বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত থাকে অথবা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পর্ক থাকে কেবল তাদের জন্য অনুমতি থাকে। এরূপভাবে ইসলাম সমগ্র পৃথিবীল লোকদের নিয়ে এক বিশ্বব্যাপী ধর্ম। ইসলামের ক্যান্টনমেন্ট বা নিষিদ্ধ এলাকা হলো মাত্র দুটো। এক, মক্কা শরীফ এবং দুই. মদিনা শরীফ।
এর মধ্যে কেবল ঐ লোক প্রবেশ করতে পারবে যে ইসলাম কবুল করেছে বা ইসলামের রক্ষক। একজন বিধর্মী বা সাধারণ লোকের জন্য ঐ এলাকায় প্রবেশ করা অযৌক্তিক এবং তার ছাউনীর মধ্যে প্রবেশ করা আনুগত্যের বিরোধী। এরূপভাবে অমুসলিমদের এ অভিযোগ তোলা সম্পূর্ণ ভুল যে কেন তাদের মক্কা মদিনায় প্রবেশে বাধা প্রদান করা হচ্ছে যখন কোনো ব্যক্তি কোনো দ্বিতীয় দেশে যেতে চায় তখন তাকে সর্বপ্রথম ঐ দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রবেশের অনুমতি চেয়ে দরখাস্ত করতে হয়। যা ঐ দেশে প্রবেশের অনুমতিপত্র। প্রত্যেক রাষ্ট্রের নিজ বিধান, শর্তাবলি ও ভিসা চালু করার সুনির্দিষ্ট শর্তাবলি রয়েছে, যে তা পূর্ণ করতে পারবে না তার পক্ষে অনুমতি হবে না।
ভিসার ব্যাপারে সবচেয়ে কঠোর বিধান হলো আমেরিকার। বিশেষ বিশ্বের লোকদের জন্য। ভিসার ব্যাপারে তাদের অনেক শর্ত পূরণ করতে হয়। যখন আমি সিঙ্গাপুর যাবার ব্যাপারে একমত হলাম, তখন তাদের ইমিগ্রেশন ফর্মে নিয়ম ছিল যে, সেখানে নেশাদ্রব্য নিয়ে প্রবেশকারীর জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। এরূপ প্রত্যেক দেশ কিছু নিয়ম করে থাকে। আমি একথা বলব না যে, মৃত্যুদণ্ড পশুতু।
যদি আমি এ সকল শর্তের সাথে একমত হই এবং এদের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হই, তাহলে ওখানে যাবার অনুমতি প্রদান করা হবে। কোনো ব্যক্তিকে মক্কা-মদিনায় প্রবেশের মৌলিক শর্ত বা ভিসা হলো সে নিজ মুখের কথা স্বীকার করে নিবে যে, যার উদ্দেশ্য হলো এই যে, আল্লাহ ব্যতীত ইবাদতের উপযুক্ত আর কেউ নেই এবং মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল।
প্রশ্ন-১৮. অমুসলিমদের কাফির বলা কি গালি নয়?
উত্তর : কাফির তাকে বলে, যে অস্বীকার করে বা মিথ্যা মনে করে। এ শব্দ: থেকে এসেছে, যার অর্থ মিথ্যারোপ করা বা গোপন করা, ঢেকে দেয়া। ইসলামের মতে কাফির’ তাকে বলা হয়, যে ইসলামের শিক্ষা এবং তার সত্যতাকে গোপন করে অথবা তাকে মিথ্যা মনে করে এবং যে ব্যক্তি ইসলামকে অস্বীকার করে। যদি কেউ অমুসলিম, নিজেকে অমুসলিম অথবা কাফির বলাকে গালি মনে করে, এর উদ্দেশ্য একই।
এটা তার ভুল। তার উচিত ইসলাম এবং এর পরিভাষাগুলো বুঝে নেয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত বুঝে না নিবে ততক্ষণ পর্যন্ত একে গালি মনে না করা। কাফির’ গালি নয়। বরং মুসলমান এবং অন্য ধর্মের মধ্যে পরিভাষাগত পার্থক্য। এ শব্দের মধ্যে অপমান বা এ ধরনের কোনো নিচুতার বিষয় নেই। একে গালি মনে করা কম জ্ঞান ও কম বুঝের চিহ্ন।
প্রশ্ন-১৯. একথা কি সত্য নয় যে, উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু কুরআনের অনেক কপি যা ঐ সময় পর্যন্ত ছিল, তিনি জ্বালিয়ে দেবার নির্দেশ দান করেন এবং মাত্র এক কপি বাকি ছিল। এভাবে একথা কি সত্য নয় যে, বর্তমান কুরআন ঐ কপি যার তরতীব (ক্রমধারা) ও সংকলন উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর এবং প্রকৃতপক্ষে তাকে ঐ কুরআন ছিল যা আল্লাহ তাআলা নাযিল করেছেন?
উত্তর : আল-কুরআন সম্পর্কে এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এক ধারণা, ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ঐ সকল কপি জ্বালিয়ে দেন যা একরূপ ছিল না এবং এক কপির সংকলন ও তার ওপর জোর দেন। প্রকৃতপক্ষে যে কুরআন দুনিয়ার মানুষের বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু, উহা ঐ কুরআন যা মুহাম্মদ (সাঃ) এর ওপর অবতীর্ণ হয়।
যা তিনি স্বয়ং লিখিয়েছেন এবং তিনি স্বয়ং তাকে জোর দিয়েছেন। আমি এ ভিত্তিহীন ধারণার প্রত্যুত্তর করব যার আলোকে এ ধারণা করা হয় যে, কুরআনের সংকলন উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু করিয়েছিলেন। যখন নবী করীম এর ওপর অহী নাযিল হতো, প্রথমে তিনি মুখস্থ করতেন। পরে তার সাহাবীদের শোনাতেন এবং এ নির্দেশনা দিতেন, যে ব্যক্তি তা মুখস্থ করবে আল্লাহ তাআলা তার ওপর সন্তুষ্ট হবে।
তিনি অহী লেখকদের নির্দেশ দিতেন যে এ আয়াতগুলো লিখে নাও। আর তিনি নিজে শুনে এগুলোর সত্যায়ন করতেন। নবী করীম নিরক্ষর ছিলেন এবং লেখা-পড়া জানতেন না। এজন্য প্রত্যেকবার অহী নাযিলের পর সাহাবীদের সামনে তা পড়তেন যাতে তারা তা লিখে নিতে পারেন। আবার নবী করীম তার নিজ থেকে শুনতেন এবং এর মধ্যে কোনো ভুল হলে তা চিহ্নিত করে ঠিক করতেন।
আর দু’বার তা শুনতেন ও নিশ্চিত করতেন। এভাবে সারা কুরআনের লেখনি নবী করীম এর নিজের তত্ত্বাবধানেই হতো। পূর্ণ কুরআন সাড়ে বাইশ বছর ব্যাপী প্রয়োজন অনুযায়ী অল্প অল্প করে অবতীর্ণ হয়েছে। মুহাম্মদ (সাঃ) কুরআনের সংকলনের ক্ষেত্রে অবতীর্ণের সময়কাল এর বিন্যাস অনুযায়ী করান নি। আয়াত এবং সূরার অহীর বিন্যাস এর পেছনে তা করতেন এবং এটা আল্লাহ তাআলার নির্দেশের মাধ্যমে জিবরাঈল আলাইহি সাল্লাম মুহাম্মদ (সাঃ) কে তা বলে দিতেন।
যখন নাযিলকৃত আয়াত সাহাবাদের সামনে পড়তেন তখন মুহাম্মদ (সাঃ) এর আয়াত কোন্ সূরায় কোন্ আয়াতের পরে হবে তাও বলে দিতেন। প্রত্যেক রমজানে মুহাম্মদ (সাঃ) কুরআনের অবতীর্ণ অংশের আয়াতের বিন্যাস দোহরাতেন এবং জিব্রাঈল আলাইহি সাল্লাম তাঁকে নিশ্চিত করতেন।
মুহাম্মদ (সাঃ) এর ইনতিকালের পূর্ব রমজানে কুরআনের প্রত্যয়ন দুবার হয়েছে। এ কারণে একথা সম্পূর্ণ পরিষ্কার যে, মুহাম্মদ (সাঃ) নিজ জীবদ্দশায় স্বয়ং কুরআনের সংকলন, প্রত্যয়ন এবং তাঁর লেখনি ও সাহাবা কিরামদের মুখস্থ করানো দুদিক থেকেই হয়েছে। মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবদ্দশায় পূর্ণ কুরআন আয়াতের সঠিক বিন্যাস এবং এর পূর্বাপরের সঙ্গেই মজুদ ছিল। হ্যা, এর আয়াতগুলো পৃথক পৃথক চামড়ার টুকরো, হালকা পাথর, গাছের পাতা, খেজুরের ডাল এবং উটের ধারালো হাড় ইত্যাদির ওপর লেখা হয়েছিল।
তাঁর ওফাতের পর ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর নির্দেশে বিভিন্ন জিনিসের ওপর লিখিত কুরআনের অংশগুলো একস্থানে লিপিবদ্ধ করে পাতার আকার দিলেন। এ পাতাগুলোকে ডোর দ্বারা বাধা হয়েছিল যাতে এর কোনো অংশ ধ্বংস না হয়ে যায়। এ কপি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এর জীবদ্দশায় তাঁর নিকট ছিল এবং তাঁর ওফাতের পর উমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর শাসনামলে তার নিকটে ছিল। এরপর রাসূলের স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন হাফসা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা-এর নিকট রাখা হয়। কিন্তু তার প্রচার পর্যন্ত হয় নি।
তৃতীয় খলিফা উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর আমলে আল কুরআনের কিছু শব্দ লেখা ও উচ্চারণের ক্ষেত্রে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়। এ মতানৈক্যে যদিও অর্থের দিক দিয়ে কোনো পার্থক্য হতো না, তবুও নও মুসলিম অনারবীদের নিকট এরও অনেক গুরুত্ব ছিল। কিছু লোক নিজেদের পাঠকে সঠিক এবং অন্যদের পাঠকে ভুল বলতেন। এজন্য উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু উম্মুল মুমিনীন হাফসা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা-এর কাছ থেকে কুরআনের মূল কপি চেয়ে নেন, যার মতন (মূল)-এর নিশ্চয়তা মুহাম্মদ (সাঃ) স্বয়ং করেছিলেন।
হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু মুহাম্মদ (সাঃ) এর নির্দেশে কুরআনের চার লেখক সাহাবী যাদের প্রধান ছিলে যায়িদ বিন ছাবিত। তাঁদেরকে দায়িত্ব দিয়ে আল-কুরআনের নকল কপি লেখার নির্দেশ দিলেন।
এ নকল কৃত কপিগুলোকে মুসলমানদের বড় বড় কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন। কিছু লোকের নিকট আল কুরআনের কিছু কিছু অংশ তাদের এক আকৃতিতে মওজুদ ছিল। এটা সম্ভব ছিল যে, এর মধ্যে কিছু (আঞ্চলিক হরফে বা উচ্চারণে) অশুদ্ধ ছিল, এমন কি অসম্পূর্ণ ছিল। এজন্য উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এ সকল লোকদের নিকট আবেদন করেন যেন তারা ঐগুলো জ্বালিয়ে দেন যেগুলো মূল কপির অনুরূপ নয়। যাতে কুরআনের আমল মতন (মূল) সংরক্ষিত হয়ে যায়। মুহাম্মদ (সাঃ) এর কঠিন সত্যায়িত মূল কুরআনের মতন অনুযায়ী তৈরি করা কুরআনের দুটি নকল আজো দুনিয়ার মধ্যে মওজুদ আছে। যার মধ্যে এক কপি উজবেকিস্তান-এর তাসখন্দ শহরের যাদুঘরে এবং দ্বিতীয় কপি তুরস্কের ইস্তামবুলের তোপকাপি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। (রাসূল-এর অনুকূলে কৃত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু কর্তৃক মূল আট কপির একটির ফটোকপি ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে ঢোকার সময় ডান দিকে কাঁচ দিয়ে ঘিরে রাখা আছে।
পাশেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কপি হাতে লেখা কুরআন মজিদ (মূল))- অনুবাদক। কুরআনের মূল কপিগুলোতে এবং হরকতের ইরাব তিনটি চিহ্ন যাকে উর্দুতে ‘যের’, যবর’, ‘পেশ’ ও আরবিতে ফাতহা, দম্মা’ এবং কাসরা’ বলা হয়। এছাড়াও তাশদীদ’, মদ’ এবং ‘জযম’ ইত্যাদি আছে। আরবি ভাষীদের জন্য উপযুক্ত উচ্চারণে পড়ার জন্য এ চিহ্নগুলোর প্রয়োজন হতো না।
কেননা আরবি তাদের মাতৃভাষা ছিল। অনারবিদের জন্য এ ইরাব ব্যতীত কুরআন শরীফের সঠিক উচ্চারণ সহজ ছিল না। এ জন্য এ সকল চিহ্ন বনু উমাইয়ার পঞ্চম খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের যুগে ৬৬ থেকে ৮৬ হিজরি মুতাবেক ৬৮৫ থেকে ৭০৫ খ্রি. অন্তর্ভুক্ত হয় এবং হাজ্জাজ বিন ইউসুফের আগ্রহে আল-কুরআনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিছু কিছু লোক একথাও বলে যে, কুরআন শরীফের বর্তমান রূপ যার মধ্যে ইরাব ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত আছে মুহাম্মদ (সাঃ) এর সময়কার মূল কুরআন নয়। কিন্তু তারা এ
মূল কথাটি বুঝতে সক্ষম হন নি যে, কুরআনের শাব্দিক অর্থ বার বার পড়া, অর্থাৎ তিলাওয়াত করার জিনিস। এজন্য লেখার নিয়ম কিছুটা ভিন্ন অর্থাৎ এর মধ্যে হরকত ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মূলকথা এই যে, কুরআনে করীমে বিশুদ্ধ তিলাওয়াত যদি আরবি মতন এবং তার উচ্চারণ ওটাই থাকে যা শুরুতে ছিল তাহলে আবশ্যকীয় কথা এই যে, এটার অর্থ তা-ই আছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনের সংরক্ষণের দায়িত্ব নিজেই গ্রহণ করেছেন। ১৫ নং সূরা হিজর-এর ৯ নং আয়াতে মহান রব বলেন
অর্থ : আমিই উপদেশ (সম্বলিত কুরআন) নাযিল করেছি, আমিই উহার সংরক্ষণকারী।
প্রশ্ন-২০. কুরআনে আল্লাহ তাআলা যখন কোনো কথা বলেন তখন অর্থাৎ আমরা ব্যবহার করেছেন। এতে কি একথা বুঝা যায় না যে, ইসলামে অনেক খোদার ওপর ঈমান রাখা যায়?
উত্তর : ইসলাম সর্বশক্তি দিয়ে তাওহীদের নির্দেশদাতা ধর্ম এবং এ ব্যাপারে অকাট্যভাবে কোনো শিথিলতা প্রদর্শন করে না। ইসলামের বিধান অনুযায়ী আল্লাহ শুধুই এক এবং তিনি নিজ গুণাবলিতে সম্পূর্ণ সাদৃশ্য বিহীন, অর্থাৎ কেউ তার সমকক্ষ নেই। কুরআন শরীফে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বেশির ভাগ স্থানে নিজের জন্য অর্থ ‘আমরা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, কিন্তু এর উদ্দেশ্য এই নয় যে, মুসলিমগণ বহু খোদার ওপর বিশ্বাস রাখবেন। বহু ভাষায় বহুবচনের জন্য দু রকম (শব্দ) ব্যবহৃত হয়। এক. সংখ্যাগত জমা বা বহুবচনে যার দ্বারা কোনো বস্তু বা ব্যক্তি সম্পর্কে এর সংখ্যা প্রকাশ করা হয় এটা একের অধিক।
দুই, বহুবচনের দ্বিতীয় প্রকার হলো যা সম্মানার্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ইংরেজিতে যুক্তরাজ্যে নিজের জন্য আই (I) এর স্থলে ‘উই’ (We) শব্দ ব্যবহার করে। এ ধরনের সম্বোধনকে Royal Plural (রাজকীয় বহুবচন) বলা হয়। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী হিন্দিতে বলতেন ৯ (হাম) আমি দেখব’, এ ধরনের শব্দ দ্বারা একথা বলা যায় যে, উর্দু এবং হিন্দিতে = (হাম) Royal Plural এ ধরনের আরবি ভাষায় যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনে নিজের উল্লেখ করেন তখন বেশিরভাগ স্থানে আরবি ১ (নাহনু) শব্দ ব্যবহার করেন এবং এটা সংখ্যাগত বহুবচন নয় বরং সম্মানজনক বহুবচনের শব্দ। তাওহীদ ইসলামের মূল ভিত্তিগুলোর একটি। এক এবং কেবল প্রকৃত এক মাবুদের অস্তিত্ব
এবং তার সাথে কারো সমকক্ষ হওয়া ঐ কথা যার উল্লেখ কুরআনের বহু স্থানে .এসেছে। যেমন : ১১২ নং সূরা ইখলাছের ১ নং আয়াতে মহান রব বলেন-
বলুন! ঐ আল্লাহ এক।
প্রশ্ন-২১. মুসলমানগণ আয়াতের মানসুখ হওয়ার ওপর বিশ্বাস রাখে। অর্থাৎ তাদের বিশ্বাস এই যে, কুরআনের কিছু প্রাথমিক আয়াত পরবর্তীতে অবতীর্ণ হওয়া আয়াতের দ্বারা মানসুখ (রহিত) করা হয়েছিল। এর দ্বারা কি এটা বুঝায় না যে, আল্লাহ (নাউযুবিল্লাহ) তাআলা ভুল করেছিলেন, পরবর্তীতে সেটা শুধরে নিয়েছেন?
উত্তর : আল-কুরআনের এ কথাকে এ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। যা ২ নং সূরা বাকারার ১০৬ নং আয়াতে। মহান রব ইরশাদ করেন
অর্থ : কিছু আয়াত যাকে আমি রহিত করি, একে আমি ভুলিয়ে দিই, তার স্থলে তার চেয়ে উত্তম অথবা তার সমমানের আয়াত নিয়ে আসি। আপনি কি জানেন না যে, আল্লাহ সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। আরবি শব্দ ‘আয়াত’ শব্দের অর্থ চিহ্ন, নিদর্শন, অথবা বাক্য এবং এর দ্বারা অহীও উদ্দেশ্য নেয়া হয়। এ আয়াতের তাশরী’ ও ‘পথ’ দ্বারা কী বুঝায়। প্রথমত, হলো এ সকল আয়াত যা রহিত হয়ে গেছে এর দ্বারা উদ্দেশ্য ঐ সকল অহী যা কুরআনের পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছে। যেমন : তাওরাত, যাবুর এবং ইঞ্জিল-এর মূল আকৃতি যার পরিবর্তে অহী নাযিল করা হয়েছে।
এ আয়াতের উদ্দেশ্য হলো অতীতের অহীগুলো সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে যায় নি বরং এর চেয়ে উত্তম কালাম তার পরিবর্তে দেয়া হয়েছে এবং এর দ্বারা একথা প্রতিষ্ঠিত হয় যে, তাওরাত, যাবুর এবং ইঞ্জিলের পরিবর্তে কুরআনে আজীম এসে গেছে। দ্বিতীয়ত, যদি আমরা এ আয়াতের আরবি শব্দ ‘আয়াত দ্বারা কুরআনের আয়াত বুঝি এবং পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর অহী না বুঝানো হয়।
তাহলে এর এই অর্থ হবে যে, কুরআনের কোনো আয়াত ততক্ষণ পর্যন্ত মানসুখ হয় নি যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তদুস্থলে তার চেয়ে উত্তম বা অনুরূপ আয়াত দ্বারা পরিবর্তন করেননি। এর দ্বারা একথা বলা যায় যে, কুরআনের কিছু আয়াত যা প্রথমে অবতীর্ণ হয়েছিল তা পরবর্তীতে অবতীর্ণ শক্ত আয়াত দ্বারা পরিবর্তন করা হয়েছিল। আমি এ উভয় পদ্ধতির সাথে একমত। কিছু মুসলিম এবং অমুসলিম দ্বিতীয় পদ্ধতির সাথে
এ ভুল উদ্দেশ্য বের করে যে, কুরআনের কিছু প্রাথমিক আয়াত মানসুখ করা হয়েছিল যা আজ আমাদের ওপর প্রয়োগ হতো না। এজন্য পরবর্তীতে অবতীর্ণ নাসিখ (রহিতকারী) আয়াতগুলোকে সে স্থানে নেয়া হয়েছে। এ দলের এ দৃষ্টিভঙ্গিও আছে যে, এ আয়াতগুলো পরস্পর বিপরীত। আমরা এর উত্তরও দিব। কিছু মুশরিক এ অভিযোগ করতো যে, মুহাম্মদ (সাঃ) কুরআন নিজে তৈরি করেছেন। আল্লাহ তাআলা এ আরব মুশরিকদের ১৭ নং সূরা বনী ইসরাঈলের ৮৮ নং আয়াতে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন
অর্থ : বলুন! যদি সকল জ্বীন ও ইনসান এ কুরআনের সমতুল্য কোনো কিতাব বানিয়ে আনার জন্য একত্র হয়, তাতেও তারা এ রূপ করে আনতে সক্ষম হবে না, যদি তারা পরস্পরের সাহায্যকারীও হয়। এরপর চ্যালেঞ্জকে আরো হালকা করে পেশ করা হয়েছে ১১ নং সূরা হুদ-এর ১৩ নং আয়াতে
অর্থ : তারা কি বলে মুহাম্মদ (সাঃ) কুরআন নিজে রচনা করে নিয়ে এসেছে। আপনি বলুন! তোমরা স্বরচিত মাত্র ১০টি সূরা তৈরি করে নিয়ে আসো, আর আল্লাহ ছাড়া যে সাহায্যকারী পাও তাকে ডাকো, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো। আল্লাহ এ পরীক্ষা আরো সহজ করে ১০ নং সূরা ইউনূসের ৩৮ নং আয়াতে বলেছেন
অর্থ : তারা কি বলে, ইনি (মুহাম্মদ) এটি রচনা করে নিয়ে এসেছেন। আপনি বলুন, তোমরা এমন মাত্র ১টি সূরা রচনা করে নিয়ে আসে এবং আল্লাহ ছাড়া আর যে সাহায্যকারী পাও তাকে ডাক যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো। এরপর সবচেয়ে সহজ চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন সূরা বাকারার ২৩ ও ২৪ নং আয়াতে
অর্থ : আমার বান্দার প্রতি আমি যে কিতাব নাযিল করেছি তার সত্যতার ব্যাপারে যদি তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকে তাহলে যাও, সেই একটি সূরার মতো সূরা রচনা করে নিয়ে এসো। আল্লাহ ছাড়া তোমাদের যেসব বন্ধু-বান্ধব রয়েছে তাদেরকেও ডাকো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। যদি তোমরা না পারো আসলে কখনোই তোমরা তা পারবে না, তাহলে তোমরা ভয় কর সেই জাহান্নামকে যার ইন্ধন হচ্ছে মানুষ এবং পাথর, যা নির্ধারণ করা হয়েছে অস্বীকারকারীদের জন্য। এভাবে আল্লাহ তাআলা নিজ চ্যালেঞ্জকে খুবই সহজ করে দিয়েছেন। এরপর নাযিল হওয়া আয়াতের দ্বারা প্রথমে তো মুশরিকদের এ চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল যে, উহা ঐ কুরআন যার মতো কোনো কিতাব তৈরি করে দেখাও।
এরপর বলা হলো এর মাত্র দশটি সূরার অনুরূপ রচনা করে দেখাও এবং সর্বশেষ এ চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে যে, কুরআনের সূরাগুলোর যেকোনো একটির মতো রচনা করে দেখাও। এর অর্থ এটা কখনো সম্ভব নয়। সূরা বাকারার ২৩ ও ২৪ নং আয়াত প্রথম তিন আয়াতের বিপরীত এবং বিপরীত বলা হয় এমন দু’জিনিসের একত্রে উল্লেখ করা যা একত্রে থাকা সম্ভব নয়, এক সঙ্গে অস্তিত্বে আসা সম্ভব নয়। কুরআনে করীমের প্রথম অবতীর্ণ আয়াত যেগুলোকে মানসুখ’ বলা হয় ঐগুলো। আল্লাহর কালামের অংশ এবং ঐগুলোতে বর্ণিত বিধানগুলো আজো সত্য। যেমন কুরআনের এ চ্যালেঞ্জ যে, রচনা করে নিয়ে এসো কুরআনের মতো একখানা গ্রন্থ, অথবা তার মাত্র ১০টি সূরার অনুরূপ সংস্করণ, অথবা মাত্র একটি ক্ষুদ্রতম সূরার অনুরূপ একটি সূরা।
এ চ্যালেঞ্জগুলো আজো বহাল আছে। পরবর্তী চ্যালেঞ্জ পূর্ববতী চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় সহজ, তবে বৈপরিত্য নেই। যদি শেষের চ্যালেঞ্জের জবাব দেবার যোগ্যতা না থাকে তাহলে বাকি চ্যালেঞ্জগুলোর জবাব দেবার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ধরুন, আমি এক ব্যাপারে বললাম, সে এমন মেধাহীন যে, স্কুলে মেট্রিক পাস করার যোগ্যতাও নেই। এরপর আমি এটা বলব যে, সে পঞ্চম শ্ৰেণীও পাস করবে না। এরপর আমি এটাও বলব যে সে, তো প্রথম শ্রেণী পাস করবে না। সর্বশেষ আমি একথাও বলব যে সে কে.জি.তেও পাস করতে পারবে না।
যেহেতু স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য কে. জি, অর্থাৎ কিন্ডারগার্টেন পাস করা জরুরি। অন্য ভাষায় আমি একথা বলব যে, এ ব্যক্তি এমন মেধাহীন যে, সে কে,
জিও পাস করবে না। আমার চার পদ্ধতির কথা অন্য কথার বিপরীত নয়। যদি কোনো ছাত্র কে.জি. পাস না করে তবে সে প্রথম, পঞ্চম অথবা দশম শ্রেণি কীভাবে পাস করবে? এর তো প্রশ্নই আসবে না। এ সকল আয়াতের অধিক দৃষ্টান্ত ঐ সকল আয়াত দ্বারা দেয়া যায় যা নেশার নিষিদ্ধতার ব্যাপারে পর্যায়ক্রমে অবতীর্ণ হয়েছে। এ ধারাবাহিকতার প্রথম আয়াত ২ নং সূরা বাকারার, ২১৯ নং আয়াত
অর্থ : তারা আপনাকে মদ ও জুয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করছে। বলুন, উভয়ের মধ্যে বিরাট গুনাহ ও মানুষের জন্য উপকারিতা রয়েছে। উভয়ের উপকারিতার চেয়ে গুনাহ অনেক বেশি। মাদক এবং অন্যান্য জিনিস সম্পর্কে পরবর্তী আয়াত ৪ নং সূরা নিসার ৪৩ নং আয়াতে মহান রব বলেন
অর্থ : হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা কখনো নেশাগ্রস্ত হয়ে নামাজের কাছে যেও না।
যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা যা কিছু বলো তা ঠিক ঠিক বুঝতে পারো। নেশাদ্রব্য সম্পর্কে সর্বশেষ অবতীর্ণ আয়াত ৫ নং সূরা মায়িদা, আয়াত নং ৯০ এ বলা হয়েছে
অর্থ : হে ঈমানদার লোকেরা! মদ, জুয়া, পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর হচ্ছে ঘৃণিত শয়তানের কাজ। তোমরা তা সম্পূর্ণরূপে বর্জন কর। আশা করা যায় যে, তোমরা সফলকাম হবে। আল-কুরআন সাড়ে বাইশ বছর পর্যন্ত অবতীর্ণ হয় আর সমাজের প্রচুর সংশোধনী ধীরে ধীরে সংঘটিত হয়েছে। এজন্য যে, নতুন বিধানের ওপর লোকদের আমল করতে সুবিধা হয়, কেননা কোনো সমাজে এক সাথে পরিবর্তন বিরোধিতা ও বাড়াবাড়ির কারণ হয়।
মাদকদ্রব্যের অবৈধতা তিনটি স্তরে সংঘটিত হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রথম অহীতে শুধু বলা হয়েছে, মাদকদ্রব্যের ব্যবহার বড় অপরাধ এবং তার মধ্যে কিছু উপকারিতাও রয়েছে তবে তার অপরাধই বেশি। এরপরের অহীতে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সালাত আদায় করতে নিষেধ করা হয়েছে। এ আয়াতে এ কথাও পরিষ্কার হলো যে, কাউকে মুসলমান হতে হলে, কিছু নেশাদ্রব্য তার জন্য নিষিদ্ধ এজন্য যে, মুসলমানের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ কর হয়েছে। এ আয়াতে এ কথা নেই যে, রাতে যদি কেউ সালাত না আদায় করে তাহলে নেশা করতে পারবে। এর অর্থ সে চাইলে নেশা করতেও পারে, না চাইলে নাও করতে পারে। এর পরে কুরআন শরীফে কোনো প্রকারের শিক্ষণীয় বিষয়ের চাপ নেই।
যদি এ আয়াতে এ কথা বলা হতো যে, যখন নামাজ না পড়বে তখন মদপান করবে, তাহলে এটা সরাসরি বৈপরীত্য হতো। মহান রাব্বল আলামীন বড়ই মাপা বাক্য ব্যবহার করেন। সর্বশেষ ৫ নং সূরা মায়িদার ৯০ নং আয়াতে সব সময়ের জন্য মাদক নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এ দ্বারা এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এ আয়াতগুলো পরস্পর বিরোধী নয়। যদি এগুলোর মধ্যে বৈপরিত্য হতো তাহলে একই সঙ্গে এ সকলের ওপর আমল করা সম্ভব হতো না। সকল মুসলমানকে এ তাকীদ করা হয়েছে যে, সে আল-কুরআনের সকল আয়াতের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করবে।
এ জন্য যখন সে সূরা মায়িদার ৯০ নং আয়াতের ওপর আমল করবে তখন সকল আয়াতের ওপর আমল করা হয়ে যাবে। ধরুন, আমি বললাম যে, আমি লজ এঞ্জেল্স-এ নেই, এরপর আমি বললাম যে, আমি ক্যালিফোর্নিয়াতেও নেই। সর্বশেষ বললাম যে, আমি ইউনাইটেড স্টেট অভ আমেরিকাতে নেই। একথা দ্বারা এটা বুঝায় না যে, এ তিন বক্তব্য পরস্পর বিরোধী। যেহেতু প্রত্যেক পরবর্তী কথা পূর্ববর্তী বক্তব্যের কার
বক্তব্যের ব্যাখ্যা বা অতিরিক্ত তথ্য প্রদান করে। অতএব যদি বলা হয় যে, আমি ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকাতে নেই একথা নিজেই নিজেই প্রকাশ করে যে, আমি লজ এঞ্জেলস-এও নেই, ক্যালিফোর্নিয়াতেও নেই, এরূপভাবে যখন মদের পরিপূর্ণ নিষেধাজ্ঞা এসে গেল তখন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সালাত আদায়ের নিষেধাজ্ঞা এবং বড় গুনাহ থেকেও আত্মরক্ষা একবারেই হয়ে গেল।
আয়াতের মানসুখ হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ ফলাফল বের হলো যে, কুরআনে বৈপরীত্য নেই এজন্য যে, এক সময়ে কুরআনের সকল আয়াতের ওপর আমল করা সম্ভব নয়, যদি এর মধ্যে বৈপরীত্য হয় তাহলে এ আল্লাহর কালাম হতে পারে না। মহান রব ৫ নং পারা ৪ নং সূরা নিসার ৮২ নং আয়াতে ইরশাদ করেন
অর্থ : এরা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে না? এ গ্রন্থ যদি আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে আসতো, তাহলে তাতে অবশ্যই তারা অনেক গরমিল দেখতে পেতো।
প্রশ্ন-২২. কুরআনের কিছু সূরা … ইত্যাদি দ্বারা কেন আরম্ভ করা হয়েছে? এর গুরুত্ব কী?
উত্তরঃ ১, ৮ এবং ১- যে হরফগুলোকে হরফে মুকাত্তায়াত’ বলা হয়। আরবি অ্যালফাবেট এই হরফে তাহাজ্জীতে ২৯টি হরফ রয়েছে এবং কুরআনের ২৯টি সূরা এ সকল হরফ দ্বারা আরম্ভ হয়েছে। তিন সূরার শুরু শুধু এক হরফ দ্বারা হয়েছে।
১. ৩৮ নং সূরা ছদ, হরফ দ্বারা
।
২. ৫০ নং সূরা ক্বফ হরফ দ্বারা
।
৩. ৬৮ নং সূরা কলম হরফ দ্বারা
।
১০ সূরার শুরুতে ২টি করে হরফে মুকাত্তায়াত দ্বারা শুরু হয়েছে।
১. ২০ নং সূরা ত্বহা দ্বারা আরম্ভ হয়েছে
।
২. ২৭ নং সূরা নামল দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
৩. ৩৬ নং সূরা ইয়াসীন দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
৪. ৪০ নং সূরা মুমিন দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
৫. ৪১ নং সূরা হামীম আস-সাজদা দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
৬. ৪২ নং সূরা শূরা দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
৭. ৪৩ নং সূরা যুখরুফ দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
৮. ৪৪ নং সূরা দুখান – দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
৯. ৪৫ নং সূরা জাসিয়াহ – দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
১০. ৪৬ নং সূরা আহকাফ দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
১৪টি সূরা তিন হরফ দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
১. ২ নং সূরা বাকারা দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
২. ৩ নং সূরা আলে ইমরান দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
৩. ২৯ নং সূরা আনকাবুত দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
৪. ৩০ নং সূরা রূম দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
৫. ৩১ নং সূরা লুকমান দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
৬. ৩২ নং সূরা আস-সাজদা দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
৭. ১০ নং সূরা ইউনূস দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
৮. ১১ নং সূরা হুদ দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
৯. ১২ নং সূরা ইউসূফ দ্বারা আরম্ভ হয়েছে
।
১০. ১৪ নং সূরা ইবরাহীম দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
১১. ১৫ নং সূরা হিজর দ্বারা আরম্ভ হয়েছে
।
১২. ২৬ নং সূরা শুয়ারা দ্বারা আরম্ভ হয়েছে
।
১৩. ২৮ নং সূরা কাসাস দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
দটি সুরা চার হরফে মুকাত্তায়াত দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
১. ৭ নং সূরা আরাফ দ্বারা আরম্ভ হয়েছে
।
২. ১৩ নং সূরা রায়াদ দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
দুটি সূরা পাঁচ হরফে মুকাত্তায়াত দ্বারা আরম্ভ হয়েছে।
১. ১৯ নং সূরা মারইয়াম দ্বারা আরম্ভ হয়েছে
।
২. ৪২ নং সূরা শূরা দু রকম দ্বারা আরম্ভ হয়েছে
।
এ সকল হরফের উদ্দেশ্য লক্ষ্য সম্পর্কে জোর দিয়ে কোনো কিছু বলা হয় নি। মুসলিম পণ্ডিতগণ বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। নিচে এ সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো:
১. এ হরফগুলো কিছু বাক্য বা শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। এ এর উদ্দেশ্য আল্লাহ সবচেয়ে বেশি জানেন এ হরফগুলো সংক্ষিপ্ত রূপ নয় বরং আল্লাহ তায়ালা অথবা অন্য কোন ব্যক্তি বা নাম অথবা চিহ্ন
।
২. এ হরফগুলো কাফিয়া বন্দী (শুরুর বর্ণমালা) করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।
৩. এ হরফগুলো সংখ্যাগত মূল্য রাখে, কেননা সিরিয়ার ভাষায় অক্ষর সংখ্যার
মর্যাদা রাখে।
৪. এ হরফগুলো মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর পরবর্তী শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।
৫. এ হরফগুলোর অর্থ ও গুরুত্ব সম্পর্কে কয়েক খণ্ড (কিতাব) লেখা যায়।
কিতাবের বিভিন্ন পণ্ডিতগণ যে, তাশরীআত বর্ণনা করেছেন এর মধ্যে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা যার গুরুত্ব ইমাম ইবনে কাছীর, আল্লামা জামাখশারী এবং ইবনে তাইমিয়াহ্ দিয়েছেন তা নিম্নরূপএক, মানুষের দেহ দুনিয়ার বিভিন্ন অংশ দ্বারা গঠিত, মাটি এবং গারা ও তার মৌলিক গঠনের উপাদান। কিন্তু একথা বলা ঠিক হবে না যে, মানুষ সম্পূর্ণ মাটির মতো। আমরা মানুষ যে সকল উপাদান দ্বারা তৈরি তা সম্পর্কে জ্ঞাত। আমরা যদি এ সকল উপাদান একত্র করি এবং তার মধ্যে কয়েক গ্যালন পানি ঢালি যার দ্বারা
মানব দেহ গঠিত হয়েছে কিন্তু আমরা এর মধ্যে জীবন দিতে পারবো না। আমাদের জানা আছে যে, মানবদেহে কোন কোন উপাদান রয়েছে এ সকল বস্তু থাকা সত্ত্বেও আমরা যখন জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবো তখন হয়রান হওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। এরূপভাবে যখন কুরআনে ঐ সকল লোকদের সম্বোধন করা হয়েছে যারা আল্লাহর বিধানকে মানে না, তখন কুরআন তাদের বলে যে, এ কিতাব তোমাদের মাতৃভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং এটা ঐ ভাষা যার বাগ্মীতার ব্যাপারে অহংকার জাহির করতো।
আরবীরা নিজ ভাষার ব্যাপারে অনেক বড়াই করতো এবং যখন কুরআন নাযিল হয় তখন আরবি ভাষা উচ্চ মার্গে অবস্থান করছিল। হরফে মুকাত্তায়াত যেমন : … ইত্যাদি ব্যবহার করে মানুষদের চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে যে, যদি এ কুরআন সঠিক এবং আল্লাহর কিতাব হওয়ার ব্যাপারে তোমরা সন্দেহ পোষণ কর, তাহলে এর মতো বা এর এক সূরার মতো একটি লিখে পেশ কর।
প্রথমে কুরআন সকল জ্বীন ও ইনসানকে চ্যালেঞ্জ করেছিল যে, তুমি কুরআনের মতো কালাম এনে দেখাও, এরপর পুনরায় বলেছে তোমরা একে অপরের সহযোগিতা করেও কখনো এ কাজ করতে পারবে না। এ চ্যালেঞ্জ ১৭ নং সূরা বনী ইসরাঈলের ৮৮ নং আয়াত ৫২নং সূরা তুর-এর ৩৪ নং আয়াতে প্রদান করা হয়েছে। অতঃপর এ চ্যালেঞ্জ ১১ নং সূরা হুদ-এর ১৩ নং আয়াতে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে এরূপ ১০টি সূরা বানিয়ে দেখাও। এরপর ১০ নং সূরা ইউনুস-এর ৩৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, এরূপ একটি সূরা নিয়ে আসে এবং সর্বশেষ ২ নং সূরা বাকারার ২৩ ও ২৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ : আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকলে তোমরা এর অনুরূপ কোনো সূরা আনয়ন কর তোমরা যদি সত্যবাদী হও। তবে আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সকল সাহায্যকারীকে আহ্বান কর। আর যদি তোমরা আনয়ন না কর এবং কখনোই তা করতে পারবে না, তবে সে আগুনকে ভয় কর, মানুষ ও পাথর হবে তার জ্বালানি, কাফিরদের জন্য যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। দুই, হিজাজবাসীর দক্ষতার মোকাবিলা করার জন্য এ নমুনা পেশ করেছেন এবং একই সঙ্গে এ দুটির উত্তর দিয়েছেন। আরবি ভাষার সকল কিছু এ হরফে
মুকাত্তায়াত-এর মধ্যেই। কুরআনের স্বাভাবিক মুজিজা শুধু এই নয় যে, তা আল্লাহ তাআলারই বাণী বরং এর মহত্ত্ব এও যে, এ সকল ঐ হরফ যার ওপর মুশরিকরা অহংকার করতো। কিন্তু তারা এর মোকাবিলায় কোনো বাক্য পেশ করতে সক্ষম হয় নি। আরবিরা নিজেদের বাগ্মিতা ভাষার অলঙ্কার এর ওপরে পণ্ডিত হওয়ার ব্যাপারে অনেক প্রসিদ্ধ ছিল, যেরূপভাবে আমরা জানি দেহের উপাদান কোন কোন জিনিস, আমরা তা জোগাড় করতে পারি।
এরূপভাবে কুরআনের অক্ষর -ও তারা জানতো এবং শব্দ তৈরির ক্ষেত্রে তারা তা ব্যবহারও করতো, কিন্তু যেরূপভাবে দেহের উপাদানসমূহ জানা থাকা সত্ত্বেও আমরা তার মধ্যে জীবনপ্রবাহ করতে সম্পূর্ণ অক্ষম, এরূপভাবে আমরা কুরআনের বাগ্মীতা ও তার বাণীর সৌন্দর্যের বিষয়াদি আয়তে আনত্তে সক্ষম নই। সুতরাং আল-কুরআন স্বয়ং এ কথার প্রমাণ যে, এটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার বাণী এবং এজন্যই সূরা বাকারার প্রথমে হরফে মুকাত্তাআত (বিচ্ছিন্ন হরফ) এরপরে তৎক্ষণাৎ যে আয়াত তাতে কুরআনের মুজিযা হওয়ার এবং তা গ্রহণযোগ্য হওয়ার বর্ণনা রয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ইরশাদ হচ্ছে
অর্থ : এই সেই কিতাব যার মধ্যে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এটা মুত্তাকীদের জন্য হেদায়াত।
প্রশ্ন-২৩. কুরআনে এসেছে যে, জমিনকে তোমাদের জন্য বিছানারূপ বানানো হয়েছে। এ থেকে একথা বুঝা যায় যে, জমিন (ভূমি) চ্যাপ্টা এবং সমতল। একথা কি গ্রহণীয় আধুনিক বিজ্ঞানের মূল সত্তার সাথে বৈপরত করে না?
উত্তর : প্রশ্নে ৭১ নং সূরা নূহ-এর ১৯ নং আয়াতের বরাত দেয়া হয়েছে, যাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইরশাদ করেন
অর্থ : আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্যে এ জমিনকে বিছানাস্বরূপ বানিয়েছেন। কিন্তু এ আয়াতে বাক্য পূর্ণ হয় নি। এ আয়াত পরবর্তী আয়াতে আছে যা এর পরবর্তী আয়াতে পরিষ্কার করা হয়েছে। ৭১ নং সূরা নূহ-এর ২০ নং আয়াতে মহান রব ইরশাদ করেন
অর্থ : যেন তোমরা এর বুকে উন্মুক্ত ও প্রশস্ত পথ ধরে চলতে পারো।
এরূপভাবে এ কথা ২০ নং সূরা ত্বহার ৫৩ নং আয়াতে একে পুনরায় বলা হয়েছে
অর্থ : যিনি তোমাদের জন্য জমিনকে বিছানা বানিয়ে দিয়েছেন, তাতে তোমাদের জন্য বহু ধরনের পথ-ঘাটের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেছেন। জমিনের উপরিস্তরের পুরুত্ব তেইশ মাইলেরও কম এবং এর তুলনা জমিনের অর্ধাংশের ওপর ধরা হয় যার দৈর্ঘ্য মোটামুটিভাবে ৩,৭৫০ মাইল। তাই জমিনের পুরুত্ব খুবই পাতলা মনে হবে। জমিনের অভ্যন্তরে প্রচণ্ড গরম, তরল এবং যে কোনো প্রকারের জীবনযাপনের জন্য অসম্ভব স্থান।
জমিনের উপরিস্তর গোলাকৃতির ঐ গোলকের ন্যায় যার ওপরে আমরা জীবন নিয়ে আছি। এজন্য কুরআন এটাকে সম্পূর্ণ সঠিকরূপে বিছানা অর্থাৎ কালীন’ এর সাথে তুলনা করেছে। যাতে আমরা ‘ এর রাস্তা এবং পথের ওপর চলাফেরা করি। কুরআনের মধ্যে এমন কোনো আয়াত নেই যাতে একথা বলা হয়েছে যে, জমিন চ্যাপ্টা অথবা সমতল। কুরআন শুধু জমিনের উপরিস্তরকে সমতল কালীন এর সাথে তুলনা করেছে।
বুঝা যায় যে, কিছু লোকের নিকট ‘কালীন’ (বিছানা) কেবল সমতল ভূমির ওপর বিছানো হয়। যদিও পাহাড়ি ভূমি যেমন বড় পাথরের ওপরও বিছানা বিছানো সম্ভব এবং এর অভিজ্ঞতা ভূমির গ্লোব-এর আকারের বড় নমুনা নিয়ে তার ওপর বিছানা বিছিয়ে আরাম করা যায়। বিছানা সাধারণভাবে এমন ছাদের ওপর বিছানো হয়, যার ওপর আরামে চলা যায়। কুরআনে জমিনের উপরিস্তরের উল্লেখ বিছানার ওপর করেছে যার নিচে গরম, তরল এবং জীবনের জন্য অসম্ভব পাওয়া যায়। বিছানা জমিনের ওপর বিছানো, ‘কালীন ব্যতীত মানুষের পক্ষে জীবন-যাপন করা সম্ভব নয়। এজন্য কুরআনের এ বক্তব্য শুধু যুক্তির আলোকেই নয় বরং এর মধ্যে এমন এক সত্য বর্ণিত হয়েছে যা ভূমি বিষয়ক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকেরা বুঝতে পারে। কুরআনের অসংখ্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, জমিনকে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। ৫১ নং সূরা যারিয়াত-এর ৪৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে –
অর্থ : আমি এই জমিনকেও তোমাদের জন্য বিছিয়ে দিয়েছি, আমি কত সুন্দরই না বিছিয়ে থাকি। এমনভাবে কুরআনের বহু আয়াতে জমিনকে খোলা বিছানা বা ফেরাশ বলা হয়েছে। যেমন : ৭৮ নং সূরা নাবার ৬, ৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ : আমি কি জমিনকে বিছানা ও পাহাড়কে পেরেকস্বরূপ বানাই নি? কুরআনের এ আয়াতে কোনোরূপ ইঙ্গিতও করা হয় নি যে, আমি জমিনকে চ্যাপ্টা বা সমতল বানিয়েছি। শুধু এটা পরিষ্কার হয় যে, জমিন খোলা ও প্রশস্ত এবং এর কারণও বর্ণনা করা হয়েছে। ২৯ নং সূরা আনকাবুতের ৫৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ : হে আমার বান্দারা যারা আমার ওপর ঈমান এনেছো, আমার জমিন অনেক প্রশস্ত। সুতরাং তোমরা একমাত্র আমারই ইবাদত কর।
প্রশ্ন-২৪. একথা কি ঠিক নয় যে, মুহাম্মদ (সাঃ) কুরআনকে বাইবেল থেকে নকল করেছেন?
উত্তর : অধিকাংশ সমালোচনাকারীরা এ কথা বলে যে, মুহাম্মদ (সাঃ) এ কুরআন নিজে লেখেন নি বরং সকল মানবীয় উৎস থেকে অথবা পূর্বের খোদা প্রদত্ত কিতাব থেকে নকল করেছেন। তারা এ ধরনের অভিযোগ করে। কিছু মুশরিকরা মুহাম্মদ (সাঃ) -এর ওপর এ অভিযোগ আরোপ করে যে, তিনি কুরআনকে মক্কার মুযাফাতে অবস্থানকারী এক রোমীয় ধর্মবিদের নিকট থেকে শিখেছিলেন, যিনি খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। মুহাম্মদ (সাঃ) বেশিরভাগ তার কাজ-কর্ম দেখতে যেতেন। কুরআনের একটি আয়াতই একথা মিথ্যা প্রমাণিত করার জন্য যথেষ্ট। ১৬ নং সূরা নাহল-এর ১০৩ নং আয়াতে মহান রব ইরশাদ করেন –
অর্থ : হে নবী! আমি ভালো করেই জানি যে, এরা বলে এ কুরআন তো একজন মানুষ এসে এ ব্যক্তিকে পড়িয়ে দিয়ে যায়, যে ব্যক্তিটির দিকে এরা ইঙ্গিত করে এর ভাষা আরবি নয়, আর কুরআন হচ্ছে বিশুদ্ধ আরবি ভাষা। ঐ ব্যক্তি যার নিজ ভাষা কোনো ভিনদেশী। যে আরবি বিশুদ্ধভাবে বলতে পারে না,
যে টোটা ফোটা আরবি বলতে পারে তিনি কীভাবে কুরআনের উৎস হতে পারেন যা বিশুদ্ধ, সুন্দর বর্ণনা, মিষ্ট ভাষা উচ্চতম আরবি ভাষায়। একথা বলা যে, মুহাম্মদ (সাঃ) কোনো বিদেশী থেকে কুরআন শিখেছেন এটা এমন যে, কোনো You জানাওয়ালা এক ব্যক্তি যে বিশুদ্ধভাবে ইংরেজি ভাষাও জানে না সে সেক্সপিয়ারকে লেখা-পড়া শিখিয়েছে। এটাও বলা হয় যে, মুহাম্মদ (সাঃ) খাদীজা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা-এর আত্মীয় ওরাকা বিন নওফেল থেকে এটা শিক্ষা লাভ করেছেন।
যেহেতু মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সম্পর্ক ইহুদি ও খ্রিস্টান পন্ডিতদের সাথে যথেষ্ট সীমাবদ্ধ ছিল। মুহাম্মদ (সাঃ) যে খ্রিস্টানের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ যোগাযোগ রাখতেন তিনি একজন প্রবীণ ব্যক্তি ওরাকা বিন নওফেল ছিলেন। যিনি মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রথমা স্ত্রী খাদীজা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা-এর চাচাতো ভাই ছিলেন। যদিও তিনি আরবি ভাষাভাষী তবুও তিনি নিজে খ্রিস্টীয় ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি নতুন ধর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখতেন। মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে তাঁর দুবার সাক্ষাৎ ঘটে। প্রথম বার যখন ওরাকা বাইতুল্লায় ইবাদত করছিলেন, তখন তিনি মুহাব্বতের টানে মুহাম্মদ (সাঃ) এর কপালে চুম্বন খেয়েছিলেন। দ্বিতীয় বার যখন মুহাম্মদ (সাঃ) এর ওপর অহী অবতীর্ণ হওয়ার পরে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান।
এর তিন বছর পর ওরাকার ইন্তিকাল ঘটে। অথচ কুরআনের অবতরণ প্রায় তেইশ বছর পর্যন্ত চলতে থাকে। এজন্য একথা বলা যায় যে, ওরাকা বিন নওফেল ওহীর কারণ সম্পূর্ণ হাস্যকর এবং মূল্যহীন। একথা সম্পূর্ণ সঠিক যে, মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের তর্ক-বিতর্ক হয়েছে কিন্তু এসব তো ওহী অবতীর্ণ হওয়ার তেরো বছরেরও অধিক পরে মদিনায় হয়েছে।
একথা বলা যায় যে, ইহুদি এবং খ্রিস্টানরা কুরআনের উৎস সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভুল এবং বিরক্তকর অভিযোগ এসেছে এজন্য যে, মুহাম্মদ (সাঃ) ঐ সব বিতর্কে একজন শিক্ষক ও মুবাল্লিগের ভূমিকায় অংশগ্রহণ করতেন এবং তাদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতেন। তাদের বলতেন তাওহীদের জন্য তোমরা দ্বীনের দিকে ফিরে এসো। তাদের মধ্যে যথেষ্ট ইহুদি-খ্রিস্টান পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ পর্যন্ত সর্বতোভাবে ঐতিহাসিক সত্য এটাই যে, নবুওয়তের ঘোষণার আগে মুহাম্মদ (সাঃ) মাত্র তিনবার মক্কার বাইরে সফরে গিয়েছিলেন। নয় বছর বয়সে তিনি মদিনায় নিজ মাতার ঘর যাকে তখন ইয়াসরিব বলা হতো সেখানে গিয়েছিলেন। নয় বছর থেকে বারো বছর বয়সের মধ্যকালীন নিজ চাচা আবু তালিবের সঙ্গে
ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া সফর করেন। খাদীজা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা এর ব্যবসায়িক মালপত্র নিয়ে ২৫ বছর বয়সে সিরিয়া যান।
এ তিনটি সফরে ইহুদি-খ্রিস্টানদের সঙ্গে সাধারণ প্রকারের কথা-বার্তা ও সাক্ষাৎ হয়েছে। এর মাধ্যমে কুরআনের অস্তিত্বে যে কথা বলে আসলে এর মতো ভিত্তিহীন এবং অসম্ভব চিন্তা আর কী আছে। মুহাম্মদ (সাঃ) ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের কাছ থেকে কখনোই কুরআন শেখেন নি। মুহাম্মদ (সাঃ) এর পূর্ণ জীবন একটি খোলা কিতাবের মতো এবং প্রকৃত ঘটনা এই যে, মুহাম্মদ (সাঃ) কে নিজ ঘরে পরবাসীর স্থান দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ৪৯ নং সূরা হুজুরাত এর ৪ ও ৫ নং আয়াতে বলেন
অর্থ : নিশ্চয়ই যারা আপনাকে কক্ষের পেছন থেকে ডাকে তাদের অধিকাংশই অনুধাবন করে না। যদি আপনি স্বেচ্ছায় বের হওয়া পর্যন্ত তারা ধৈর্যধারণ করতে তাহলে তাদের জন্য ভালো হতো। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়। যদি মুহাম্মদ (সাঃ) ঐ লোকদের সঙ্গে মিলতেন কাফিরদের মতে যারা মুহাম্মদ (সাঃ) কে শেখাতেন, অহীর যে ধারা তাতে একথা বেশিদিন গোপন থাকতো না। কুরাইশদের অনেক স্বনামধন্য সরদার যারা মুহাম্মদ (সাঃ) কে অনুসরণ করে, ইসলাম কবুল করেছিলেন। তাদের মেধা এতোই তীক্ষ্ণ ও প্রখর ছিল যে, মুহাম্মদ (সাঃ) যে অহী পেশ করতেন তার মধ্যে যদি সন্দেহের অবকাশ থাকত, তাহলে সহজেই তারা চিনে ফেলতে পারতেন এবং এতে কোনো সামান্য সময়ের ব্যাপার ছিল না।
রাসূল -এর দাওয়াত ও আন্দোলন ২৩ বছর পর্যন্ত চলতে থাকে। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কারোরই সামান্য সময়ের জন্য সন্দেহ জাগে নি। রাসূল -এর এ দাওয়াতের বিরোধীরা সবসময় তার পেছনে লেগেছিল যে, মুহাম্মদ (সাঃ) কে মিথ্যা প্রমাণিত করবে কিন্তু তারা এ ব্যাপারে একটি সাক্ষ্যও পেশ করতে পারে নি যে, তিনি বিশেষ ইহুদি বা খ্রিস্টানদের সাথে গোপন সাক্ষাতে মিলিত হয়েছেন। এ কথারও ধারণা করা যায় না যে, কোনো ব্যক্তি একথা মেনে নিবে যে, সে কুরআনের মতো একটি গ্রন্থ বানাবে অথচ তার কৃতিত্ব নিজে নিবেন না। এজন্য যুক্তি এবং ঐতিহাসিকভাবে একথা মানা যায় না যে, কুরআন মানবসৃষ্ট। একথা বলা যে, মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে কুরআন লিখেছেন অথবা অন্য কোনো উৎস থেকে নকল করেছেন। একথা ঐতিহাসিকভাবে এজন্য ভুল যে, মুহাম্মদ (সাঃ) একাডেমিক লেখা-পড়া জানতেন না। আল্লাহ সুবহানাহু স্বয়ং কুরআনে এ কথার সত্যায়ন করেছেন ২৯ নং সূরা আনকাবুতের ৪৮ নং আয়াতে
অর্থ : আপনি ইতিপূর্বে কোনো কিতাব পড়েন নি, আপনি নিজ হাতে লিপিবদ্ধও করেনি যে, বাতিলপন্থীরা সন্দেহ পোষণ করবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা একথা জানতেন যে, বহু লোক কুরআনের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ করবে এবং তাকে মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে সম্পৃক্ত করবে। এজন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর সার্বক্ষণিক প্রজ্ঞা দ্বারা এক নিরক্ষরকে তার সর্বশেষ নবী করে পাঠালেন যাতে বাতিল পূজারীদের মুহাম্মদ (সাঃ) এর ওপর সন্দেহের আদৌ কোনো অবকাশ না থাকে।
মুহাম্মদ (সাঃ) এর বিরোধীদের একথা বলা যায় না যে, তিনি অন্য উৎস থেকে কুরআনের বিষয় অর্জন করে একে সুন্দর আরবিতে রূপান্তর করে নিয়েছেন, মনে হয় একথার মধ্যে কিছু বিশেষত্ব বা তাৎপর্য হালকা রয়েছে। কিন্তু এ ধরনের আপত্তি এই অবিশ্বাসী ও সন্দেহ পোষণকারীদের ওপর উল্টে দেয়া হয়েছে। মহান রব ৭ নং সূরা আরাফ-এর ১৫৭ নং আয়াতে এ কথার সত্যায়ন করে বর্ণনা করেন
অর্থ : যারা এই বার্তাবাহক উম্মী নবীর অনুসরণ করে চলে, যার উল্লেখ তাদের (কিতাব) তাওরাত ও ইঞ্জিলেও তারা দেখতে পায়। উম্মী নবীর আগমনের বার্তা বাইবেলের ইয়াসইয়াহ পুস্তকের ২৯ নং অধ্যায়ের ১২ নং শ্লোকে উল্লেখ আছে : পুনরায় ঐ কিতাব তাকে দিব যিনি লেখা-পড়া জানেন না, তাকে বলা হবে পড়ো, তিনি বলবেন, আমি লেখা-পড়া জানি না। কুরআন শরীফে কমপক্ষে চার স্থানে এ কথার সত্যায়ন করা হয়েছে যে, মুহাম্মদ (সাঃ)
একাডেমিক লেখা-পড়া জানতেন না। এর উল্লেখ ৭ নং সূরা আরাফের ১৫৮ নং আয়াত, ৬২ নং সূরা জুমুয়ার ৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে। মুহাম্মদ (সাঃ) এর সময়ে আরবিতে বাইবেল ছিল না। আহাদনামা আতীকের সর্বপ্রথম যে আরবি অনুবাদ তা পাদরি R. Saadeas Gaon ৯০০ খ্রিস্টাব্দে করেছেন। এ কাজ মুহাম্মদ (সাঃ)
এর ইন্তিকালের ২৫০ বছর পরের যখন নিউ টেস্টামেন্টের সর্বপ্রথম আরবি অনুবাদ আরপানিয়াস (Erpenius) রাসূল -এর বিদায়ের প্রায় এক হাজার বছর পর ১৬১৬ খ্রি. করেছেন। কুরআন এবং বাইবেলের একটি এমন বক্তব্যও নেই যা
দ্বারা বুঝা যায় যে, বাইবেল থেকে কুরআন নকল করা হয়েছে। মূলত এটা এ কথা প্রমাণ যে, এই উভয় কোন তৃতীয় শক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সকল আসমানী সহীফার উৎস স্থল একটি সত্তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যিনি সকল সৃষ্টির প্রভু। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কিতাব এবং তার পূর্ববর্তী আসমানী ছহীফাগুলোতে মনুষ্য হস্তক্ষেপের কারণে কিছু অংশ তা থেকে সংরক্ষিত আছে এবং তা বেশিরভাগ ধর্মের সাথে মিল আছে। একথাও সঠিক যে, কুরআন এবং বাইবেলের মধ্যে কিছু বিষয়ের মিল আছে, কিন্তু এ ভিত্তিতে মুহাম্মদ (সাঃ) এর ওপর এ অভিযোগ আরোপের কোনো সুযোগ নেই যে, তিনি বাইবেল থেকে কিছু নকল করেছিলেন। অথবা এখান থেকে গ্রহণ করে কুরআনের বিন্যাস সাধন করেছেন।
যদি এ অভিযোগ সত্য হয় তাহলে এ অভিযোগ ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ওপরও ফিরে আসে এবং ভুলের ওপর এ দাবিও করা যায় যে, ঈসা মসীহ আলাইহি সাল্লাম সত্য নবী ছিলেন না এবং তিনি ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে নকল করেছিলেন। কুরআন এবং বাইবেলে পাওয়া একটা কথাই সঠিক যে, মূলত এর উৎস এক, তাহলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা।
এটা তাওহীদের পয়গামের ধারাবাহিকতা, এ সত্ত্বেও একথা বলার সুযোগ নেই যে, পরবর্তী নবিগণ পূর্ববর্তী নবিগণ থেকে নকল করেছেন। যদি কোনো ছাত্র পরীক্ষায় নকল করে তাহলে নিশ্চয়ই সে নিজ শিক্ষকের নিকট একথা লিখবে না যে, আমি আপনার কাছে বসে অমুক ছাত্রের কাছ থেকে নকল করেছি। যেহেতু মুহাম্মদ এ তাঁর পূর্ববর্তী সকল নবীর সম্মান ও তাদের বর্ণনা করেছেন এবং কুরআনেও একথা বলা হয়েছে যে, বিভিন্ন নবী ও রাসূলগণের ওপর আল্লাহ তাআলা ছহীফা নাযিল করেছেন।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে প্রধান চার কিতাবের উল্লেখ করেছেন এবং মুসলমানগণ এ সব কিতাবের ওপর ঈমান রাখে। এগুলো হলোতাওরাত : মুসা আলাইহি সাল্লাম-এর ওপর অবতীর্ণ হয় যা তক্তার আকৃতিতে। যাবুর : দাউদ আলাইহি সাল্লাম-এর ওপর অবতীর্ণ হয়। ইঞ্জিল : ঈসা আলাইহি সাল্লাম -এর ওপর অবতীর্ণ হয়। কুরআন : সর্বশেষ কিতাব যা সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ এর ওপর অবতীর্ণ হয়। সকল নবী এবং আল্লাহ প্রদত্ত সকল আসমানি কিতাবের ওপর ঈমান আনা প্রত্যেকটি মুসলমানের ওপর আবশ্যক।
কিন্তু বিদ্যমান বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের পাঁচ কিতাবকে মুসা আলাইহি সাল্লাম-এর দিকে সম্পৃক্ত করা হয় এবং Psalms অথবা মামীর দাউদ আলাইহি সাল্লাম এর প্রতি সম্পৃক্ত করা হয়, এছাড়াও ওল্ড টেস্টামেন্টে এর চার ইঞ্জিল ও তাওরাত, যাবুরও ইঞ্জিল নয় যার উল্লেখ কুরআনে কারীমে করা হয়েছে। আজকের বাইবেলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার বাণী কিছু থাকতে
পারে। তবে নিশ্চিতরূপেই তা মূল অবস্থায় নেই। এটা সার্বিকভাবে নেই এবং এর মধ্যে নবীদের ওপর অবতীর্ণ হওয়া বাণীও নেই। কুরআন সব নবীর ওপর এক ধারার নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং একথা বলে যে, এদের নবুওয়াতের একই উদ্দেশ্য ছিল এবং একই মৌলিক বাণী ছিল। এ ভিত্তির ওপর কুরআন এ কথাকে প্রমাণ করে যে, বড় বড় ধর্মের মৌলিক শিক্ষা পরস্পর বিরোধী নয়, যদিও নবীদের কালের অনেক পার্থক্য পাওয়া যায়। এর কারণ এই যে, এদের সকলের উৎস একই এবং তিনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যিনি সকল জিনিসের ওপর ক্ষমতাবান। এজন্য কুরআন এটা বলে যে, বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে যে পার্থক্য পাওয়া যায়, তার দায়িত্ব নবীদের ওপর বর্তায় না, বরং তার দায়িত্ব তাদের অনুসারীদের ওপর বর্তায়, যারা শিখিয়ে দেয়া এক অংশ ভুলে গিয়েছেলেন, এছাড়াও তারা আল্লাহর কিতাবে ভুল ধারণার সৃষ্টি করেছিল এবং এর মধ্যে পরিবর্তন সাধন করেছিল।
অতএব একথা কুরআন সম্পর্কে বলা যাবে না যে, এটা এমন কিতাব যা মূসা, ঈসা এবং অন্যান্য নবীর শিক্ষার মোকাবিলায় অবতীর্ণ হয়। এর বিপরীত এই কিতাব পূর্ববর্তী নবীদের পয়গামকে জোরদার ও সত্যায়ন করে এবং তাকে পরিপূর্ণ করে এবং তাকে পূর্ণতায় পৌছায় যা নিজ উম্মত দ্বারা করিয়েছেন। কুরআনের নাম ‘ফুরকান’। যার অর্থ সত্য-মিথ্যার মধ্যে প্রভেদ সৃষ্টিকারী দাড়ি বা মাপকাঠি। কুরআনের ভিত্তির ওপর আমরা এটা জানতে পারি পূর্বের আসমানী কিতাবগুলোর মধ্যে কোন কোন অংশ আল্লাহ তাআলার বাণী।
কুরআন এবং বাইবেলের ওপর অধ্যয়নের পর আপনারা এমন অনেক বিষয় পাবেন যাতে উভয়ের মধ্যে মিল দেখা যাবে। কিন্তু আপনি যখন এগুলোকে যাচাই করবেন তখন বুঝা যাবে যে তার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। শুধু ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এমন কোনো ব্যক্তির পক্ষে যিনি খ্রিস্টান ও ইসলাম এর কোনো শিক্ষার ওপর গভীর জ্ঞান রাখেন না, সেক্ষেত্রে ফয়সালা করা শক্ত সমস্যা হবে উভয় কিতাবের মধ্যে সঠিক কোনটা। হা আপনি যদি উভয়ের গ্রহণের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের পর পরখ করেন তবে আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, মূল কোনটা। কয়েকটি উদাহরণ আপনার সামনে সত্যকে প্রকাশ করে দিবে। বাইবেলের সৃষ্টি কিতাবের প্রথম অধ্যায়ে একথা লেখা আছে যে, পৃথিবী সৃষ্টিতে ছয় দিন লেগেছে এবং প্রত্যেক দিন চব্বিশ ঘণ্টার ছিল। কুরআনেও একথা বলা হয়েছে যে, পৃথিবী ছয় দিনে (1)-এ সৃষ্টি করা হয়েছে, কিন্তু কুরআন অনুযায়ী এ
যুগ (বারো বছর) এর ওপর শামিল এবং অন্য কথায় এর দ্বারা এক ধারা বা এক দাওরা/চক্র অথবা এক যুগ। যা যথেষ্ট দীর্ঘকাল। যখন আল কুরআন বলে এ পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি হয়েছে এর দ্বারা উদ্দেশ্য আসমানসমূহ এবং জমিনকে ছয়টি দীর্ঘ চক্কর বা যুগে সৃষ্টি করা হয়েছে। বিজ্ঞানীদের একথার ওপর কোন অভিযোগ নেই। সৃষ্টি জগৎ তৈরিতে বহু বছর লাগে এবং একথা বাইবেলের চিন্তার বিপরীত। যাতে বলা হয়েছে সৃষ্টিজগত মাত্র ছয় দিনে তৈরি হয়েছে বা অস্তিত্বে এসেছে যে দিন মাত্র ২৪ ঘন্টায়। বাইবেলের সৃষ্টি কিতাবে একথা লেখা আছে যে, আলো, দিন এবং রাত সৃষ্টি জগতের প্রথম দিনে তৈরি করেছেন।
আল্লাহ সবার আগে জমিন ও আসমান সৃষ্টি করেছেন, জমিন বিরান ও শূন্য ছিল, তার উপরে অন্ধকার ছিল এবং আল্লাহর রূহ পানির ওপর ছিল এবং আল্লাহ বললেন, আলো হয়ে যাও এবং আলো হয়ে যায় এবং আল্লাহ দেখলেন আলো সুন্দর হয়েছে এবং আল্লাহ আলোকে অন্ধকার থেকে পৃথক করলেন, আল্লাহ আলোকে দিন ও অন্ধকারকে রাত করলেন, সন্ধ্যা হলো এবং ভোর হলো এরূপে প্রথম দিন শুরু হলো। আধুনিক বিজ্ঞান এ কথা বলে যে, সৃষ্টি জগতের ঘূর্ণনের যে আলো যা তারকাগুলোর মধ্যে এক প্রকারের পেচাননা প্রকারের আলোকের কারণে ছিল।
যেহেতু বাইবেল বলে যে, সূর্য, চাঁদ এবং তারকাগুলোর জন্ম চতুর্থ দিনে হয়। আল্লাহ দুটি বড় বড় আলোদানকারী সৃষ্টি করেন। এক হলো বড় যে দিনের ওপর হুকুম চালায়, অন্য হলো ছোট যে রাতের ওপর হুকুম চালায় এবং তিনি তারকাগুলোকে সৃষ্টি করেন এবং এদের আসমানের ওপর রাখেন, যাতে এগুলো জমিনের ওপর আলো ফেলতে পারে। রাত ও দিনের ওপর হুকুম চালায় এবং আলোকে অন্ধকার থেকে পৃথক করে এবং আল্লাহ দেখলেন যে সুন্দর সকাল শুরু হলো এবং সন্ধ্যা হলো, ভোর হলো এভাবে চতুর্থ দিন হলো।
এটা যুক্তি বিরোধী যে, আলো দানকারী সূর্য তিন দিন পর সৃষ্টি হলো এবং দিন রাতের ধারাবাহিকতা যা সূর্যের আলোর কারণে হয়, প্রথমে দিন সৃষ্টি করলেন আরো এই যে, দিনের অঙ্গ অর্থাৎ ভোর ও সন্ধ্যার ধারাবাহিকতা সূর্যের পূর্বে জমিনের ঘূর্ণনের পরে সম্ভব, কিন্তু বাইবেলের বক্তব্য অনুযায়ী সূর্যের সৃষ্টির তিন দিন পূর্বে ভোর ও সন্ধ্যার সৃষ্টি হয়েছিল। অপরদিকে আল-কুরআনে সৃষ্টি জগতের সৃষ্টির মধ্যে কোনো অবৈজ্ঞানিক কালের বিন্যাসের বর্ণনা নেই। এজন্য একথা বলা হয় যে, মুহাম্মদ (সাঃ) এ বিষয়ে বাইবেল থেকে কিছু নকল করেছিলেন, বরং এ ধরনের অযৌক্তিক, আশ্চর্য ও দূর সম্পর্কের বক্তব্য প্রদান করা সম্পূর্ণ ভুল ও হাস্যকর।
বাইবেল একথা বলে যে, সূর্য ও চন্দ্র উভয়ে আলো বের করে, যেমন সৃষ্টি কিতাবের পরের বরাতে একথা প্রমাণিত এবং সেখানে বড় আলো দানকারী ও ছোট আলো দানকারী হিসেবে বলা হয়েছে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান অনুযায়ী চাদের নিজের কোন আলো নেই। সে শুধু সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে। একথা আল কুরআনে সত্য বলে প্রমাণ করে।
যে চাঁদ (মুনীর) অর্থ আলোকে প্রতিবিম্বকারী এবং সে যে আলো দেয় তা প্রতিবিম্ব দ্বারা আসে। এটা বুঝা তো অনেক দূরের কথা যে, মুহাম্মদ (সাঃ) বাইবেলের এ বিজ্ঞানের ভুলকে সংশোধন করে কুরআনের ইবারতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বাইবেলের সৃষ্টি কিতাবের ১ অধ্যায়ের ১১ থেকে ১৩ নং শ্লোকে রয়েছে যে, সবজি, খবীস, বীজ বহনকারী গাছ এবং ফলদায়ক বৃক্ষ তৃতীয় দিনে সৃষ্টি হয়েছিল এবং ঐ অধ্যায়ে ১৪ থেকে ১৯ নং শ্লোকে বলা হয়েছে যে, সূর্যকে চতুর্থ দিনে সৃষ্টি করা হয়েছিল। বিজ্ঞানের নীতি অনুযায়ী এটা কীভাবে সম্ভব যে, সূর্যের উত্তাপ ব্যতীত গাছপালা জন্ম লাভ করল? বাইবেলে যেভাবে বলা হয়েছে। অভিযোগ উত্থাপনকারী অমুসলিমদের কথা অনুযায়ী যদি মুহাম্মদ (সাঃ) বাস্তবে কুরআনের লেখক হতেন এবং তিনি যদি বাইবেল থেকে কিছু বিষয় নকল করতেন তাহলে এটা কীভাবে সম্ভব হলো যে, তিনি অবৈজ্ঞানিক অংশ বাদ দিলেন?
এবং কুরআনে এমন কোনো কথাই নেই যা বিজ্ঞানের সত্য বিরোধী। বাইবেলে বর্ণনা করা হয়েছে যে, ঈসা আলাইহি সাল্লাম থেকে ইবরাহীম আলাইহি সাল্লাম পর্যন্ত যেসব এ জমিনের প্রথম মানব আদম আলাইহি সাল্লাম পর্যন্ত বর্ণনাকৃত বংশধারা অনুযায়ী আদম আলাইহি সাল্লাম আজ থেকে ৫৮০০ বছর পূর্বে পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁর এবং ইবরাহীম আলাইহি সাল্লাম এর মাঝে ১৯৪৮ বছরের পার্থক্য। ইবরাহীম এবং ঈসা আলাইহি সাল্লাম এর মাঝে প্রায় ১৮০০ বছরের ব্যবধান এবং ঈসা আলাইহি সাল্লাম থেকে আজ পর্যন্ত ২০০০ বছরের ব্যবধান।
এ সময়ের রাজ ইহুদি ক্যালেন্ডারও প্রায় ৫৮০০ বছরের পুরাতন যার শুরু সৃষ্টির শুরু থেকে। পুরাতন চিহ্ন এবং Anthropology-এর ভিত্তির ওপর বলা হয় যে, প্রথম মানব যখন পৃথিবীতে পা রাখেন তিনি আজ থেকে দশ হাজার বছর পূর্বে জন্ম নিয়েছিলেন। আল কুরআন মোতাবেকও যিনি পৃথিবীতে প্রথম পা রাখেন আদম আলাইহি সাল্লাম-ও (তখন এসেছিলেন) কিন্তু বাইবেলের বিপরীত এতে কোনো তারিখ বর্ণনা করা হয় নি এবং একথা বর্ণনা করে না যে, তিনি পৃথিবীতে কত দৈর্ঘ্য পর্যন্ত ছিলেন।
বাইবেলের বর্ণিত বিষয়াবলি বৈজ্ঞানিক বিষয়াবলির সম্পূর্ণ বিপরীত। বাইবেলের সৃষ্টি কিতাবের ৬, ৭ ও ৮ অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, নূহ আলাইহি সাল্লাম-এর প্লাবন বিশ্বব্যাপী ছিল যা জমিনে থাকা সকল জীবন্ত জিনিসকে শেষ করে দিয়েছিল, তারা ব্যতীত যারা নূহ আলাইহি সাল্লাম-এর কিশতিতে বা নৌকায় আরোহণ করেছিলেন। তা মানুষ বা প্রাণী যাই হোক না কেন পা বিশিষ্ট প্রাণী বা পা বিশিষ্ট পাখি, সব খতম হয়ে গিয়েছিল, শুধু নূহ আলাইহি সাল্লাম-এর আরোহীরা জীবিত থাকে। বাইবেলের বর্ণনা মোতাবেক এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এ ঘটনা আদম আলাইহি সাল্লাম-এর জন্মের ১৬৫৬ সাল পরে অথবা ইবরাহীম আলাইহি সাল্লাম-এর জন্মের ২৯২ বছর পূর্বে যখন নূহ আলাইহি সাল্লাম-এর বয়স
২০০ বছর ছিল। অর্থাৎ এ প্লাবন ঈসা আলাইহি সাল্লাম-এর ২১ অথবা ২২ শতক পূর্বে হয়েছিল। বাইবেলের বর্ণিত ঘটনা অতীত ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য প্রমাণের বিপরীত। যাতে এ কথা প্রমাণিত যে, এ সকল শতকে মিশরের ১১তম রাজবংশ ও ব্যাবিলনের ২য় রাজবংশ, কোনরূপ বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই চলছিল। এ ধরনের প্লাবন সেখানে হয় নি। বাইবেলে বর্ণিত বিশ্বব্যাপী প্লাবনের তথ্যের বিপরীতে কুরআনে নূহ আলাইহি সাল্লাম-এর প্লাবনের ব্যাপারে যে ঘটনা বলা হয়েছে তা বৈজ্ঞানিক তথ্য ও প্রত্নতত্ত্বের বিপরীত নয়। ১. আল কুরআন এ ঘটনার ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট তারিখ বা বছর উল্লেখ করে নি। ২. আল কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী এ প্লাবন বিশ্বব্যাপী ছিল না। যার দরুন সকল
প্রকারের প্রাণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। এ জন্য একথা বলা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক যে, এ প্লাবনের ঘটনা মুহাম্মদ (সাঃ) বাইবেল থেকে গ্রহণ করেছিলেন এবং এ
ঘটনাকে কুরআনে বর্ণনা করার সময় ভুলগুলোও সংশোধন করে নিয়েছিলেন। আল কুরআন এবং বাইবেলে মূসা আলাইহি সাল্লাম এবং ফিরাউনের যে ঘটনাবলি বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমের সাথে দ্বিতীয়টির বহু মিল রয়েছে। উভয় কিতাবের এ কথা পর্যন্ত মিল রয়েছে যে, ফিরআউন মূসা আলাইহি সাল্লাম-এর পেছনে অনুসরণ করে এবং মূসা আলাইহি সাল্লাম এরপর রাস্তা পার হবার চেষ্টা করার সময় ডুবে যায় এবং মূসা আলাইহি সাল্লাম বনী ইসরাঈল লোকদের সাথে পার হয়ে যান। আল-কুরআনের ১০ নং সূরা ইউনূসের ৯২ নং আয়াতে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে যে
অর্থ : আজ আমি শুধু তোমার লাশকেই বাঁচিয়ে রাখবো যাতে তুমি (লাশ) তোমার পরবর্তীদের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকতে পারো। ড. মরিস বুকাইলির পরিপূর্ণ বিশ্লেষণের পর একথা প্রমাণ করেছেন যে, ফিরআউন দ্বিতীয় রামসীস এজন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন, সে বাইবেল অনুযায়ী বনী ইসরাঈলের ওপর জুলুম করেছে, কিন্তু মূলত সে ঐ সময় খতম হয়ে যায় যখন মূসা আলাইহি সাল্লাম মাদইয়ানে আশ্রয় নেন।
দ্বিতীয় রামসীসের পুত্র মুনফাহের স্থলাভিষিক্ত হয় এবং সে ইহুদিদের মিসর থেকে বের হওয়ার সময় বাহীরা কলমে ডুবে যায়। ১৮৯৮ খ্রি. মিসরের ওয়াদী মুলুকে মুনফাতাহের লাশের প্রদর্শনী হয়। ১৯৭৫ সালে ডা. মরিস বুকাইলি সকল বিজ্ঞবানদের সঙ্গে মিলে এর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অনুমতি প্রাপ্ত হন। এর যে ফলাফল তিনি লাভ করেন তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুনফাতাহ ডোবা অথবা কঠিন আঘাতে মৃত্যুবরণ করে, যা তার ওপরে মৃত্যুর কিছু আগে ঘটে। এজন্য এটা কুরআনের আয়াতের অনেক বড় অবদান যে, আমি শিক্ষার
জন্য তার লাশকে রক্ষা করব। ফিরআউনের লাশ পাওয়ায় প্রমাণিত হয়, যে লাশ আজ মিসরের জাদুঘর কায়রোতে আছে। এ কুরআনের আয়াত ড. মরিস বুকাইলিকে, যিনি তখন খ্রিস্টান ছিলেন, কুরআন অধ্যয়ন করতে বাধ্য করে। পরবর্তীতে তিনি বাইবেল, কুরআন বিজ্ঞান’ এ শিরোনামে কিতাব লেখেন এবং এ কথাকে স্বীকার করেন যে, কুরআন আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কিতাব নয়। ড. বুকাইলি পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এ সকল দলিল এ কথাকে প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, কুরআন বাইবেল থেকে নকল করা হয় নি। বরং কুরআন তো ফুরকান’ অর্থাৎ এ দাঁড়িপাল্লা যা দ্বারা হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করা যাবে। এ দ্বারা এ উপকারিতা অর্জন করা যাবে যে, বাইবেলে কোনো কোন অংশ আল্লাহর বাণী তা চিহ্নিত করা যাবে। কুরআন স্বয়ং একথার সাক্ষ্য দিচ্ছে। ৩২ নং সূরা সাজদা ১ থেকে ৩ নং আয়াতে
অর্থ : আলিফ-লাম-মীম। সৃষ্টিকুলের মালিক আল্লাহ তাআলার কাছ থেকেই এই কিতাবের অবতরণ, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তারা কি একথা বলতে চায় যে, এ কিতাব সে ব্যক্তি রচনা করে নিয়েছে (না) বরং এ হচ্ছে তোমার প্রভুর নিকট থেকে সত্য (অবতারিত) যাতে এর দ্বারা তুমি এক জাতিকে ভীতি প্রদর্শন কর যাদের প্রতি তোমার পূর্বে কোনো ভীতি প্রদর্শনকারী আসে নি। আশা করা যায় তারা হেদায়েত লাভ করতে পারবে।
প্রশ্ন-২৫. কুরআন আল্লাহর কালাম নয় বরং এটা শয়তানের কাজের বিবরণ।
উত্তর: গোড়া প্রকৃতির পশ্চিমা লেখক ও পাদরী এ ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগ দেয়। এ ধরনের অভিযোগ মক্কার কাফিররাও দিত যে, মুহাম্মদ (সাঃ) শয়তানের পক্ষ থেকে ইলহাম পায়। এ ব্যপারে সহীহ্ বুখারীর তাফসীর অধ্যায়ের সূরা আদদুহা-এর হাদীস নং ৪৯৫০ জুনদুব ইবনে সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিতএকবার মুহাম্মদ (সাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়েন এ জন্য তিনি দু:তিন রাত কিয়াম (সালাতে তাহাজুদ) আদায় করেন নি। এ সময়ে এক মহিলা এসে রাসূলকে বলল, ‘হে মুহাম্মদ! আমার মনে হয় তোমার শয়তান তোমার কাছে আসা ছেড়ে দিয়েছে।
আমি দু’তিন রাত তাকে তোমার কাছে আসতে দেখি না। এর উত্তরে আল্লাহ তাআলা এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ করলেন
অর্থ : শপথ পূর্বাহ্নের এবং রাতের কসম যখন তা ছেয়ে যায়, আপনার প্রভু আপনাকে ছেড়েও যান নি, আপনার ওপর অসন্তুষ্টও হন নি। এরপরে ৫৬ নং সূরা ওয়াকিয়া আয়াত নং ৭৭ থেকে ৮০ পর্যন্ত অবতীর্ণ হয়। মহান রব ইরশাদ করেন
অর্থ : অবশ্যই কুরআন এক মর্যাদাবান গ্রন্থ। এটি সযত্ন রক্ষিত গ্রন্থে লিখিত, পূত পবিত্র ব্যতিরেকে কেউ তা স্পর্শ করে না। সারা বিশ্বের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতারিত। “কিতাব মাকনুন’ এমন কিতাব যা সংরক্ষিত ও নিরাপদ এবং এ দ্বারা আসমানের ওপর লাওহে মাহফুজ’-এর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর ওপর পবিত্রগণ ছাড়া কেউ হাত লাগায় না। এর অর্থ সকল প্রকার নাপাকি এমনকি বদ জ্বীনও তাকে স্পর্শ করতে পারে না। শয়তান কুরআনকে স্পর্শ করতে পারে না। এমনকি তার কাছেও আসতে পারে না। এতে এ প্রশ্নই ওঠে না যে, সে কুরআনের আয়াত লিখেছে। ২৬ নং সূরা শোয়ারার ২১০ থেকে ২১২ নং আয়াতে মহান রব বলেন
অর্থ : এ কুরআন কোনো শয়তান নাযিল করে নি। ওরা এ কাজের যোগ্যও নয়, না তারা তেমন ক্ষমতা রাখে, তাদের তা শোনারও অধিকার নেই। বহুলোক শয়তানের ব্যাপারে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি রাখে। তাদের ধারণায় শয়তান সকল কাজ করে শুধু আল্লাহর জিম্মায় যে কাজ থাকে তা ছাড়া, তাদের ধারণায় স্বাধীনতা ও ক্ষমতায় শয়তান আল্লাহর থেকে কম নয়। এ লোকেরা একথা মানতে রাজি নয় যে, আল কুরআন মুজিযা এবং রূহানি এ কারণে তারা বলে যে এটা শয়তানের কাজ। আপনি চিন্তা করুন, যদি শয়তান কুরআন লিখত তা হলে এর মধ্যে ১২ নং সূরা নাহলের ৯৮ নং আয়াতে এর উল্লেখ থাকতো না
অর্থ : অতঃপর তোমরা যখন কুরআন পড়তে শুরু করবে তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও। আপনার এরূপ ধারণা যে, শয়তান এটা লিখেছে? সে কি একথা বলেছে যে, আমার। কিতাব পড়ার পূর্বে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাকে ডাকো যাতে তিনি তোমাকে আমার থেকে আশ্রয় দান করেনএবং এই কুরআনের এমন কোনো আয়াত থাকবে যাতে প্রমাণ থাকবে যে, এ কিতাব শয়তানের নয়। ৭ নং সূরা আরাফের ২০০ নং আয়াতে বলা হয়েছে, মহান রব ইরশাদ করেন
অর্থ : কখনো যদি শয়তান কুমন্ত্রণা দেয়, সাথে সাথেই আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাও, অবশ্যই তিনি সব কিছু শোনেন, সবকিছু জানেন। শয়তান নিজ অনুসারীদের কীভাবে বলে যে, যখন তাদের মগজে কোনো কুমন্ত্রণা আসে, তখন সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে পানাহ চাইবে, যে তার প্রকাশ্য দুশমন। ৩৬ নং সূরা ইয়াসীনের ৬০ আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইরশাদ করেন
অর্থ : হে আদম সন্তান আমি কি বলি নি তোমরা শয়তানের বন্দেগী করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন। শয়তান মেধাবী এ কারণে এটা কোনো হয়রানির কথা নয় যে, সে কিছু লোকের মাথায় এ কথা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, শয়তান কুরআন লিখেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নিঃশর্ত শক্তির মোকাবিলায় শয়তানের কোনো সাহস নেই এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা অনেক জ্ঞান ও হিকমতের অধিকারী। তিনি শয়তানকে অপছন্দ করেন, এজন্য তিনি কুরআন অধ্যয়ন করার সময় এমন ভূমিকা রাখতে বলেছেন যাতে প্রমাণ হয় যে, এটা কুরআন আল্লাহর কালাম এবং কখনো শয়তানের লিখিত নয়। ইঞ্জিল এর মিরাকস এ আছে যদি কোনো রাজত্বে ফুট (সমস্যা) পড়ে তাহলে তা কায়েম থাকবে না, যদি কোনো ঘরে ফুট পড়ে তাহলে সে ঘরও টিকে থাকবে না। যদি শয়তান নিজের বিরোধিতায় ফুট নিয়ে নেয় তাহলে সেও কায়েম থাকবে না বরং সে শেষ হয়ে যাবে।
এ কারণে এটা কখনোই সম্ভব নয় যে, শয়তান নিজের বিপরীতে এমন কিতাব লিখবে যা নিজের মূল কেটে দেবে এ কারণে কুরআনের ব্যাপারে মক্কার কাফির, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের এ অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মূলের বিরোধী।
প্রশ্ন-২৬. কুরআনের কয়েক স্থানে একথা বলা হয়েছে যে, আল্লাহ অত্যন্ত দয়াশীল ও ক্ষমাশীল। আবার এর সাথে একথাও বলেছেন যে, তিনি কঠিন শাস্তিদাতা। আসলে তিনি কি ক্ষমাশীল নাকি শাস্তিদাতা?
উত্তরঃ আল কুরআনের কোনো অবস্থায় একথা বলা হয়েছে যে, আল্লাহ খুবই দয়াশীল। আল কুরআনের ৯ নং সূরা তাওবা ব্যতীত সকল সূরা এ সুন্দর বাণীপরমদাতা ও দয়ালু আল্লাহর নামে- দ্বারা আরম্ভ হয়েছে। আল কুরআনের ৪ নং সূরা নিসা’র ২৫ নং আয়াতে ৫ নং সূরা মায়িদা’র ৭৪ নং আয়াতে এবং আরো বহু স্থানে সংশ্লিষ্ট অবস্থায় ; অর্থ : আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়।
বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ক্ষমাশীল ও দয়াময়। এর সাথে তিনি অনেক কঠোরও। যে লোক শাস্তির উপযুক্ত তাকে শাস্তিও দেন। আল কুরআনে কয়েক স্থানে স্বঅবস্থায় আল্লাহ এটাও বলেছেন আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বেদ্বীন ও কাফিরদের কঠিন শাস্তি দিবেন। তিনি তাদের শাস্তি দিবেন যারা তাঁর নাফরমানি করবে। কয়েকটি আয়াতে বিভিন্ন প্রকারের শাস্তির কথা বর্ণিত আছে যা দোযখে নাফরমানদের দেয়া হবে। ৪ নং সূরা নিসার ৫৬ নং আয়াতে মহান রব ইরশাদ করেন
অর্থ : যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে তাদের অচিরেই আমি জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো, অতঃপর যখন পুড়ে চামড়া গলে যাবে, তখনই আমি তার বদলে নতুন চামড়া গজিয়ে দিব, যাতে তারা আযাব ভোগ করতে পারে। অবশ্যই আল্লাহ তাআলা মহান পরাক্রমশালী, বিজ্ঞ কৌশলী। প্রশ্ন হলো, আল্লাহ তাআলা ক্ষমাশীল নাকি শাস্তি দানকারী? এ বিষয়ের ওপর মনোযোগ জরুরি যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ক্ষমাশীল, দয়াময় সাথে সাথে শাস্তির যোগ্য, খারাপ আমলকারী এবং খারাপ লোকদের জন্য কঠিন শাস্তিও দিবেন তিনি ন্যায়বিচারক। ৪ নং সূরা নিসার ৪০ নং আয়াতে মহান রব ইরশাদ করেন
অর্থ : নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা এক অণু পরিমাণ জুলুমও করেন না।
২১ নং সূরা আম্বিয়ার ৪৭ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে
অর্থ : কিয়ামতের দিন আমি ন্যায় বিচারের জন্য একটি মানদণ্ড স্থাপন করব, অতঃপর সেদিন কারো ওপরই কোনো রকম জুলুম করা হবে না। যদি সামান্য সরিষা দানা পরিমাণ আমলও থাকে আমি এনে হাজির করব। হিসাব নেবার জন্য আমিই যথেষ্ট। কোনো শিক্ষক কি ঐ ছাত্রকে ছেড়ে দেবেন যে পরীক্ষায় নকল করে কোনো ছাত্রকে যদি পরীক্ষায় নকল করা অবস্থায় পায় এবং পরীক্ষক হাতে হাতে ধরে ফেলেন তাহলে কি শিক্ষক একথা বলেন যে, সে বড়ই দয়ার যোগ্য এবং পুনরায় তাকে নকল করার অনুমতি দিয়ে দেয়? যদি এরূপ করে তাহলে তাকে পরিশ্রমী ছাত্ররা (শিক্ষককে) রহমদীল ও দয়াময় বলবে না বরং অবিচারক বলবে।
শিক্ষকের এমন কাজ অন্য ছাত্রদেরও নকল করার প্রতি উৎসাহিত করবে। যদি শিক্ষকগণ এরূপ করেন এবং দয়াশীল হোন এবং ছাত্রদের নকলে অনুমতি দান করে তাহলে কোনো ছাত্রই পরীক্ষার জন্য পড়াশুনা করবে না এবং তারা নকল করে পরীক্ষায় উন্নতমানে পাস করবে। দৃশ্যত সকল ছাত্রই এ গ্রেডে বিশেষ মানে উত্তীর্ণ হয়ে যাবে এবং কর্মজীবনে ব্যর্থ হয়ে যাবে আর পরীক্ষার সব উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে। ৬৭ নং সূরা মূলক-এর ২ নং আয়াতে মহান রব ইরশাদ করেন
অর্থ : যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য, কে আমলের দিক দিয়ে উত্তম হতে পারে? যদি আল্লাহ তাআলা সব মানুষকে ক্ষমা করে দেন এবং কাউকে শাস্তি না দেন, তাহলে মানুষ আল্লাহ তাআলার আনুগত্য কীভাবে করবে? আমি একথা মানি যে, এ অবস্থায় কোনো লোক জাহান্নামে যাবে না, তবে এর ফলে অবশ্যই পৃথিবীটা জাহান্নামে পরিণত হবে।
যদি একথা প্রচার হয়ে যায় যে, সব মানুষই জান্নাতে যাবে, তাহলে মানুষের এ দুনিয়ায় আগমনের উদ্দেশ্য আর কী থাকলো? এ অবস্থায় দুনিয়ার জীবন আখিরাতের জন্য আর পরীক্ষাগার হিসেবে থাকলো না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা শুধু তওবাকারীকেই ক্ষমা করবেন না, বরং তাকে ক্ষমা করবেন যে নিজ কর্মের ওপর অনুতপ্ত হয়েছে এবং তওবা করেছে। ৩৯ নং সূরা যুমার-এর ৫৩ থেকে ৫৫ নং আয়াতে মহান রব ইরশাদ করেন
অর্থ : বলুন! হে আমার বান্দারা, তোমরা যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছো, আল্লাহর তাআলার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দেবেন, তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। অতএব, তোমরা তোমাদের মালিকের দিকে ফিরে এসো এবং তার নিকট আত্মসমর্পণ কর, তোমাদের ওপর আল্লাহ তাআলার আযাব আসার পূর্বেই।
কেননা আযাব এসে গেলে) অতঃপর তোমাদের আর কোনো সাহায্য করা হবে না। তোমাদের অজান্তে তোমাদের ওপর অতর্কিত আযাব নাযিল হবার পূর্বেই তোমাদের মালিকের নাযিলকৃত গ্রন্থের অনুসরণ কর। অনুতপ্ত হওয়ার ও তওবার শর্ত চারটি। তাহলো১. এ কথার ওপর একমত হওয়া যে, একটি খারাপ কাজ করে ফেলেছে। ২. এ কাজ থেকে তৎক্ষণাৎ ফিরে আসা। ৩. পরবর্তীতে কখনো এ পাপ না করা। ৪. যদি এ কাজের দ্বারা কোনো ক্ষতি হয়ে থাকে তার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা।
(এভাবে তওবা করলে কঠিন অপরাধীকেও আল্লাহ মাফ করে দেন।)
প্রশ্ন-২৭. আল কুরআনে বলা হয়েছে মায়ের গর্ভে যে বাচ্চা তার সম্পর্কে শুধু আল্লাহই জানতে পারেন। কিন্তু আজ বিজ্ঞান যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছে এবং আমরা সহজেই আলট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে বাচ্চার ছেলে-মেয়ে হওয়া সম্পর্কে জেনে ফেলছি। কুরআনের আয়াত কি চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিপন্থী নয়?
উত্তর : আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত ও খবর রাখেন। তিনি কিছু বিষয়ের জ্ঞান মানুষকে দিয়েছেন কিন্তু সকল দৃশ্য অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান কেবল তারই। কিছু লোক এটা বুঝেছেন যে, আল কুরআন এ দাবি করে যে, আল্লাহ তাআলাই শুধু মায়ের উদরে যে সন্তান আছে তার ছেলে-মেয়ে সম্পর্কে জানেন। আল কুরআনের ৩১ নং সূরা লুকমানের ৩৪ নং
আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ : অবশ্যই আল্লাহ তাআলার কাছে কিয়ামতের আগমন জ্ঞান আছে, তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন, তিনিই জানেন যা গর্ভাশয়ে বিদ্যমান আছে। কোনো মানুষই বলতে পারে না আগামিকাল সে কি অর্জন করবে এবং কোথায় মৃত্যুবরণ করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সবকিছু জানেন। আজ বিজ্ঞানের উন্নতি সাধিত হয়েছে এবং আন্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে মায়ের উদরের সন্তানের লিঙ্গ (নারী-পুরুষ) সম্পর্কে সহজে নির্ধারণ করা যাচ্ছে।
একথা ঠিক যে, এ আয়াতের বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও অনুবাদের মধ্যে একথাও বলা হয়েছে যে, শুধু আল্লাহই জানেন মায়ের গর্ভে অবস্থিত বাচ্চা ছেলে না মেয়ে। কিন্তু আপনি এ আয়াতের আরবি মতন (মূল) বিশ্লেষণ করে দেখতে পাবেন যে, ইংরেজি শব্দ Sex-এর কোনো আরবি শব্দ ব্যবহৃত হয় নি। মূলত কুরআনে যা বলেছে তাহলো গর্ভে যা আছে তার জ্ঞান কেবল আল্লাহ তাআলারই আছে।
অনেক তাফসীরকারকদের ভুল হয়েছে, তারা এর অর্থ এটা বুঝেছেন যে, আল্লাহ তাআলা মাতৃগর্ভের বাচ্চার Sex সম্পর্কে জানেন। একথা ঠিক নয়, এখানে লিঙ্গের দিকে ইঙ্গিত করা হয় নি। বরং ইঙ্গিত এ দিকে যে, মাতৃজঠরের বাচ্চার প্রকৃতি কী হবে। সে কি স্বীয় পিতা-মাতার জন্য বরকত ও সৌভাগ্যের কারণ হবে নাকি দুর্ভাগ্যের। সে কি সমাজের জন্য করুণার কারণ হবে নাকি শাস্তির। সে কি সৎ হবে নাকি অসৎ, সে জান্নাতে যাবে না জাহান্নামে। এ সকল বক্তব্যের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলারই। দুনিয়ার কোনো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এ পর্যায়ে উন্নতি হয়নি যার দ্বারা এ সকল প্রশ্নোত্তর বা সমাধান করতে পারে।
প্রশ্ন-২৮. কুরআনে আছে যে, আল্লাহ তাআলার নিকট একদিন এক হাজার বছরের সমান। অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে একদিন পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। কুরআনের এ সকল বক্তব্য কি পরস্পর বিরোধীর দিকে ইঙ্গিত করে না?
উত্তর : কুরআনের ৩২ নং সূরা সাজদা, ২২ নং সূরা হাজে এ কথা বলা হয়েছে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নিকট যে দিন আমাদের হিসাবে এক হাজার বছরের সমান। যেমন ৩২ নং সূরা সাজদার ৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ : আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত সব কিছুকে তিনিই পরিচালনা করেন, তারপর সবকিছুকে তিনি ওপরের দিকে নিয়ে যাবেন একদিন যার পরিমাণ তোমাদের গণনায় হাজার বছর। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন যে, একদিন তোমাদের পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। ৭০ নং সূরা মায়ারেজ-এর ৪ নং আয়াতে
অর্থ : ফেরেশতাগণ ও রূহ আল্লাহর দিকে আরোহণ করবে এমন একদিন যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর। এ সকল আয়াতের সাধারণ অর্থ এই যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সময়ের পরিমাণ জমিনের মতো নয়, এর দৃষ্টান্ত জমিনের এক হাজার অথবা পঞ্চাশ হাজার বছর দ্বারা দিয়েছেন। অন্য কথায় আল্লাহ তাআলার নিকট যে একদিন তা জমিনের হাজার হাজার দিন অথবা তার চেয়েও অধিক হতে পারে। এ সকল আয়াতে আরবি
শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ একদিন এবং এ ছাড়াও দীর্ঘ সময়, এ ছাড়াও যুগও হয়। যদি : -এর অর্থ যুগ বা Period করেন তাহলে এর দ্বারা কোনো সন্দেহ জাগবে না। ২২ নং সূরা হাজ্জের ৪৭ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে
অর্থ : এরা তোমার নিকট আযাবের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করে, আল্লাহ কখনো তার ওয়াদার খেলাপ করেন না, তোমার প্রভুর নিকট একদিন তোমাদের গণনার হাজার বছরের সমান। যখন কাফিররা বলতে থাকল যে, আযাব কেন বিলম্ব হচ্ছে এবং তা কেন শীঘ্রই আসছে না? তখন কুরআন জবাব দিয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা স্বীয় ওয়াদা পূর্ণ করার ব্যাপারে ব্যর্থ নন। তোমাদের নিকট সময়ের যে ব্যাপ্তি এক হাজার বছরের, তা আল্লাহর নিকট মাত্র এক দিনের। সূরা সাজদায় বর্ণনা করা হচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলার নিকট সবকিছু পৌছাতে আমাদের হিসেবে এক হাজার বছরের সময় লাগে। সূরা মায়ারিজের বর্ণনা অনুযায়ী বুঝা যায় ফেরেশতা রূহুল কুদস এবং সকল
রূহের আল্লাহ তাআলার নিকট পৌছাতে পঞ্চাশ হাজার বছরের সময় লাগে। এটা আবশ্যক নয় যে, দু’ধরনের কাজের ব্যবস্থা করতে এক রকম সময় লাগবে। যেমন আমরা এক স্থানে যেতে এক ঘণ্টা সময় লাগে, আবার অন্যত্র যেতে পঞ্চাশ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এ দ্বারা কখনো একথা বুঝায় না যে, আমি বিপরীতমুখী কথা বলছি। এভাবে আল কুরআনের আয়াতগুলো একে অপরের বিপরীত নয় বরং এটা বিজ্ঞানের মূলের সাথে মিল রাখে।
প্রশ্ন-২৯. কুরআনের এক স্থানে বলা হয়েছে মানুষকে বীর্য থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যত্র বলা হয়েছে মানুষকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। আপনি বৈজ্ঞানিকভাবে কীভাবে প্রমাণ করবেন যে, মানুষকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে?
উত্তর : কুরআনে করীমে মানুষকে তুচ্ছ শুরুর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে এবং একে একথা বলা হয়েছে যে, সে এক ফোঁটা বীর্য থেকে সৃষ্ট। একথা বহু আয়াতে বলা হয়েছে। যার মধ্যে ৭৫ নং সূরা কিয়ামাহর ৩৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ : সে কি এক ফোটা স্থলিত শুক্রবিন্দু ছিল না? কুরআনের বহু স্থানে একথাও বলা হয়েছে যে, মানবজাতিকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। ২২ নং সূরা হাজ্জ এর ৫ নং আয়াতে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে
অর্থ : হে মানুষ, পুনর্জীবন সম্পর্কে যদি তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকে তাহলে (ভেবে দেখ) আমি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। আজকের এ সময়ে আমরা জানি যে, মানব দেহের উপাদান যার মাধ্যমে অস্তিত্বে এসেছে সবই কম-বেশি কিছু পরিমাণ মাটি অন্তর্ভুক্ত আছে। এ কারণে এ কুরআনের আয়াতের বৈজ্ঞানিক ইঙ্গিত আছে যাতে বলা হয়েছে যে, মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
আল কুরআনের কিছু আয়াতে বলা হয়েছে যে, মানুষকে বীর্যের ফোঁটা দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং অপর আয়াতে এটাও বলা হয়েছে যে, মানুষকে মাটি থেকে পয়দা করা হয়েছে। তো এ উভয় কথার মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। বৈপরীত্য তাকে বলে যা পরস্পর বিরোধী অর্থাৎ এক সময়ে দুটি সত্য হতে পারে না। এমন কিছু স্থানে কুরআনে মানুষকে পানি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে বলা হয়েছে। যেমন ২৫ নং সূরা ফুরকানের ৫৪ নং আয়াতে
অর্থ : তিনিই সেই সত্তা যিনি মানুষকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন। বিজ্ঞান এ তিন কথারই সত্যায়ন করে। মানুষকে বীর্য, মাটি ও পানি এ তিন জিনিস দিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছে। ধরুন, আমি বললাম, এক কাপ চা তৈরি করতে পানি ব্যবহৃত হয়। এতদসত্ত্বেও চায়ের পাতা এবং দুধ অথবা পাউডারও চাই। এ দুই বক্তব্য বিপরীত নয়। কারণ চা তৈরির জন্য পানি এবং চায়ের পাতি দুই-ই প্রয়োজন। এর অতিরিক্ত যদি আমি মিষ্টি চা বানাতে চাই তাহলে চিনিও লাগবে। এজন্য কুরআন যখন বলে মানুষকে ধাতু, মাটি অথবা পানি থেকে বানানো হয়েছে, তো এর মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই বরং তিন কথার মধ্যেই বৈশিষ্ট্য চালু আছে।
Contradistinction বা বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, এক বিষয়ের ওপর এমন দু’ধারণার বিষয়ে কথা বলা যা পরস্পর বিপরীত নয়। উদাহরণস্বরূপ, আমি যদি বলি মানুষ সর্বদা সত্য কথা বলে এবং এর স্বভাব মিথ্যার। তবে এটা বিপরীত বক্তব্য হবে। তবে যদি বলি মানুষ দ্বীনদার, দয়ালু এবং ভালোবাসাসম্পন্ন, তাহলে এর দুই বিভিন্ন গুণের বৈশিষ্ট্য বর্ণনাকারীর বর্ণনা হবে।
প্রশ্ন-৩০. কুরআনে কয়েক স্থানে একথা বলা হয়েছে যে, জমিন এবং আসমান ছয় দিনে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু সূরা ফুসসিলাত বা হামীম আস সিজদায় বলা হয়েছে জমিন এবং আসমান ৮ দিনে সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা কি কুরআনের বৈপরিত্য নয়? এ আয়াতে এটাও বর্ণনা করা হয়েছে যে, জমিন ছয় দিনে তৈরি হয়েছে পুনরায় আসমান দু’দিনে তৈরি করা হয়েছে। এরূপ বলা Big Bang-এর বিপরীত। যার কথা হলো আসমান জমিন এক সময়ে অস্তিত্বে এসেছিল।
উত্তর : আমি একথার সাথে একমত যে, আল কুরআনের বর্ণনানুযায়ী আসমান এবং জমিন ছয় দিনে দ্বিতীয় কথায় ছয় চক্করে সৃষ্টি করা হয়েছে। এর উল্লেখ আল-কুরআনের নিচের আয়াতগুলোতে এসেছে
৭ নং সূরা আরাফ, ৫৪ নং আয়াত
১০ নং সূরা ইউনুস, ৩ নং আয়াত
১১ নং সূরা হুদ,৭ নং আয়াত
২৫ নং সূরা ফুরকান, ৫৯ নং আয়াত
৩২ নং সূরা সাজদা, ৪ নং আয়াত
৫০ নং সূরা ক্বফ, ৩৮ নং আয়াত
৫৭ নং সূরা হাদীদ, ৪ নং আয়াত
কুরআনের ঐ আয়াতগুলো যেগুলোর ব্যাপারে আপনার ধারণা হলো যে, আসমান ও জমিন আট দিনে সৃষ্টি হয়েছে, তা হলো সূরা ফুসসিলাত বা হামীম আস সাজদা, যার সূরা নং ৪১, আয়াত নং ৯ থেকে ১২ তে বলা হয়েছে
অর্থ : বলুন! তোমরা কি তাকে অস্বীকার করতে চাও, যিনি দু’দিনে পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা অন্য কাউকে কি তারই সমকক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে চাও? অথচ ইনিই সারা সৃষ্টির পালনকর্তা। তিনিই এ জমিনের মাঝে ওপর থেকে পাহাড়সমূহকে স্থাপন করে দিয়েছেন এবং তাতে বহুমুখী কল্যাণ রেখে দিয়েছেন এবং তাতে সবার আহারের পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন চার দিন সময়ের ভেতর। অনুসন্ধানীদের জন্য সবই সমান।
অতঃপর তিনি আসমানের দিকে মনোনিবেশ করলেন যা ছিল ধূম্রকুঞ্জ বিশেষ। এরপর তিনি তাকে ও জমিনকে আদেশ করলেন, তোমরা উভয়েই এগিয়ে এসো ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, তারা উভয়েই বলল, আমরা অনুগত হয়েই এসেছি। অতঃপর তিনি দুই দিনের ভেতর এ (সেই ধূম্রকুঞ্জ)-কে সাত আসমানে পরিণত করলেন এবং প্রতিটি আকাশে তার আদেশনামা পাঠালেন।
পরিশেষে আমি নিকটবর্তী আসমানকে তারকারাজি দ্বারা সাজিয়ে দিলাম এবং (জ্বীন ও শয়তান থেকে) সুরক্ষিত করলাম। এ সকলই পরাক্রমশালী ও সুবিজ্ঞ মহা-মহিমের নির্ধারণ। আল কুরআনের এ আয়াতগুলো প্রকাশ্যে এটাই বলে যে, আসমান-জমিন আট দিনে সৃষ্টি হয়েছিল। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এ আয়াতগুলোর শুরুতে বর্ণনা করেন যে, ঐ লোক এ সকল বাক্যের অংশের বর্ণনাকৃত তথ্যের এবং সত্যতার
ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টির জন্য ভুল অনুমান পেশ করে, আসলে সে কুফরী প্রচারের ইচ্ছে রাখে এবং আল্লাহর একত্ববাদকে অস্বীকার করে। আল্লাহ তাআলা এর সাথে আমাদের এটাও বর্ণনা করেন যে, কিছু কাফির এমনও আছে যে, এই প্রকাশ্য বৈপরীত্যের ভুল অনুমান পেশ করবে। যদি আপনি মনোযোগ ও সুবিবেচনার সাথে এ আয়াতগুলোর বিশ্লেষণ করেন তাহলে আপনার কাছে পরিষ্কার হবে যে, এখানে জমিন এবং আসমানের দুই পৃথক সৃষ্টির উল্লেখ করা হয়েছে। পাহাড় ব্যতীত জমিনকে দুই দিনে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং চার দিনে পাহাড়গুলোকে জমিনের ওপর শক্ত করে স্থাপন করা হয়েছে এবং জমিনে বরকত রাখা হয়েছে এবং একে লেপন করা ও এতে রিযক দেয়া হয়েছে।
এজন্য ৯ এবং ১০ নং আয়াত অনুযায়ী পাহাড়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে জমিনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করা হয়েছে। ১১ ও ১২ নং আয়াতে আছে যে, অতিরিক্ত দিনগুলোতে আসমান সৃষ্টি করা হয়েছে। ১১ নং আয়াতের শুরুতে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য আবার অথবা উহা ব্যতীত। কুরআনের কিছু তরজমায় এর উদ্দেশ্যে ‘অতঃপর লেখা হয়েছে এবং এরপর ব্যতীত’ উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে।
যদি এর অনুবাদ ভুল অনুমানে ফেরানো হয় তাহলে আসমান ও জমিনের সৃষ্টিতে সব মিলে আট দিন গণ্য হবে এবং একথা কুরআনের দ্বিতীয় আয়াতের বিপরীত হবে। যাতে বলা হয়েছে যে, আসমান জমিন ছয় দিনে সৃষ্টি করা হয়েছে। এছাড়াও এ আয়াত ২১ নং সূরা আম্বিয়ার ৩০ নং আয়াতেরও বিপরীত হবে। যাতে এটা বলা হয়েছে যে, জমিন ও আসমানকে এক সময়ে সৃষ্টি করা হয়েছে।
এ কারণে এ আয়াতে এ শব্দটি সঠিক তরজমা এটা ব্যতীত অথবা এর সাথে সাথে হবে। আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী সঠিক অনুবাদ Moreover’ করেছেন, যাতে এটা পরিষ্কারভাবে স্পষ্ট হয় যে, যে সময়ে পাহাড় ও জমিন ইত্যাদি সমেত ছয় দিনে জমিন সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে একই সময়ে এর সঙ্গে দুদিনে আসমানগুলোকেও সৃষ্টি করা হয়েছে। এ জন্য সকল কিছুর সৃষ্টি আট নয় ছয় দিনে হবে।
ধরুন, একজন রাজমিস্ত্রি বললেন যে, দশ তলা বিল্ডিং এবং তার চার দেওয়াল ছয় মাসের মধ্যে সম্পন্ন করবে এবং এর সমাপ্তির পরে এর অতিরিক্ত তাফসীর বর্ণনা করতে গিয়ে একথা বলল, বিল্ডিং এর মূল কাঠামো দু’মাসের মধ্যে হয়েছে এবং দশ তলার গঠন চার মাসে হয়েছে এবং যখন কাঠামো ও মূল বিল্ডিং এক সাথে সমাপ্ত করল সেই সাথে বিল্ডিং এর চার দেয়ালের কাজও শেষ করেছে যা দু মাসের দৈর্ঘ্য সময় লেগেছে। এ কথার মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ণনার মধ্যে বৈপরীত্য নেই। বরং দ্বিতীয় বর্ণনায় বিল্ডিং এর বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। আল কুরআনের কয়েক স্থানে সৃষ্টিকুলের পয়দার উল্লেখ রয়েছে। কোথাও বলা হয়েছে। কোথাও বলা হয়েছে ও
শব্দাবলিও ব্যবহার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ২১ নং সূরা আম্বিয়ায় ৩০ নং আয়াতে Big Bang-এর উল্লেখ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, আসমান ও জমিনকে এক সময়ে সৃষ্টি করা হয়েছে।
অর্থ : এ কাফিররা কি দেখে না যে, আসমানসমূহ ও জমিন (এক সময়) ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল। অতঃপর আমিই এদের উভয়কে আলাদা করে দিয়েছি, আমি প্রাণবন্ত সবকিছুকেই পানি থেকে সৃষ্টি করেছি। এসব জানার পরও কি তারা ঈমান আনবে না? ২ নং সূরা বাকারার ২৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ : তিনি সেই মহান সত্তা যিনি এ পৃথিবীর সবকিছুকে তোমাদের জন্য তৈরি করেছেন। সাথে সাথে তিনি আসমানের দিকে মনোনিবেশ করলেন এবং সাত আসমান তৈরির কাজকে সুষম করলেন। তিনি সকল কিছু সম্পর্কে অবগত। এ আয়াতে – -এর অনুবাদ ‘অতঃপর করি, তাহলে এ আয়াত আল কুরআনে অন্য কিছু আয়াতের এবং Big Bang এর বিপরীত হয়ে যায়, এজন্যই -এর সঠিক তরজমা সাথে সাথে অথবা একই সাথে করতে হবে।
প্রশ্ন-৩১. আল কুরআনে একটি আয়াত রয়েছে যাতে একথা এসেছে যে, আল্লাহ দুই মাশরিক ও দুই মাগরিব-এর মালিক। আপনি এ কুরআনের আয়াতের কী বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পেশ করবেন?
উত্তর : আল কুরআনে এটা রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা দুই মাশরিক ও দুই মাগরিবের রব। কুরআনের ৫৫ নং সূরা আর রহমানের ১৭ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে
অর্থ : দুই মাশরিক ও দুই মাগরিবের রব। আরবিতে ১-২ এবং ১ শব্দদ্বয়ের দ্বিবচন ব্যবহার করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা দুই মাশরিক ও দুই মাগরিবের রব। ভূগোল ও বিজ্ঞান থেকে আমরা এ
তথ্য জানতে পারি যে, সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয়। কিন্তু এর উদয়স্থল সারা বছর পরিবর্তন হতে থাকে। বছরে দুবার ২১ মার্চ এবং ২৩ সেপ্টেম্বর যা (বসন্ত ও শরতের মাঝে) এর নামে প্রসিদ্ধ এবং তারিখও আছে যখন সূর্য সম্পূর্ণ পূর্ব দিক থেকে উদয় হয় অর্থাৎ মধ্য ক্রান্তির ওপর ভ্রমণ করে। বাকি দিনগুলোতে সম্পূর্ণ পূর্ব থেকে কিছুটা উত্তর বা দক্ষিণ দিকে থেকে উদয় হয়। গ্রীষ্মের মওসুমে ২২ জুন সূর্য পূর্বের এক প্রান্ত থেকে কর্কটক্রান্তির ওপর পরিভ্রমণ করে বের হয়।
শীত মওসুমেও একদিন ২২ ডিসেম্বর পূর্বের দ্বিতীয় প্রান্ত মকরক্রান্তির ওপর পরিভ্রমণ করে বের হয়। এভাবে সূর্য গ্রীষ্মে ২২ জুন এবং শীতে ২২ ডিসেম্বর পশ্চিমের দুভিন্ন স্থানে অস্ত যায়। প্রকৃতির এ দৃশ্য কোনো শহরের লোক সহজে দেখতে পারে অথবা কেউ উঁচু বিল্ডিং থেকে উদয় ও অস্তের এ দৃশ্য দেখে থাকে। আপনি দেখবেন যে, সূর্য গরমে ২২ জুন পূর্বের এক প্রান্ত থেকে বের হয় এবং ঠাণ্ডায় ২২ ডিসেম্বর অন্য প্রান্ত থেকে বের হয়।
সংক্ষেপে এই যে, সূর্য সারা বছর পূর্বের বিভিন্ন স্থান থেকে বের হয় এবং পশ্চিমের বিভিন্ন স্থানে অস্তমিত হতে থাকে। এজন্য আল কুরআনে যখন আল্লাহ তাআলার উল্লেখ দুই পূর্ব ও দুই পশ্চিমের রব হিসেবে করে তখন তার এ উদ্দেশ্য হয় যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পূর্ব-পশ্চিমের দুই প্রান্তের সংরক্ষক ও মালিক। আরবিতে বহুবচনের দুটি সীগাহ (শব্দ ও ওযন) এক হলো তাসনিয়ার জমা অর্থাৎ দুই এর জন্য। দ্বিতীয় হলো দু’এর অধিক এর জন্য। সূরা আর রহমানের ১৭ নং আয়াতে এবং শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যা দ্বি-বহুবচনের শব্দ। এর উদ্দেশ্য দুই মাগরিব ও দুই মাশরিক। ৭০ নং সূরা মায়ারিজের ৪০ নং আয়াতে আছে
অর্থ : কখনোই নয়। আমি উদয়াচল ও অস্থাচলসমূহের মালিকের শপথ করছি। নিশ্চয়ই আমি সক্ষম। এ আয়াতে পূর্ব ও পশ্চিমের জন্য,ও শব্দদ্বয় ব্যবহৃত হয়েছে এবং দুয়ের অধিক প্রকাশ করছে। এ থেকে আমরা এ ফলাফল বের করতে চাই যে, আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালার উল্লেখ সকল পূর্ব-পশ্চিমের স্থানগুলোর প্রতিপালক (১) ও মালিক হওয়ার সাথে সাথে পূর্ব-পশ্চিমের দুই শেষ প্রান্তের মালিক এবং রব।
প্রশ্ন-৩২. ইসলামে কি কাঠিন্য, খুন, খারাবি এবং পশুত্বের সুযোগ দেয়? আল কুরআন মুসলমানদের বলে যে, যেখানে কাফিরদের পাও হত্যা কর।
উত্তর : কুরআনের কিছু বিশেষ আয়াত যা ভুল আন্দাজে এজন্য বরাত দেয়ার উদ্দেশ্যে পেশ করা হয় যে, এর দ্বারা এমন ভুল ধারণার সৃষ্টি হয় যে, ইসলাম শক্তি প্রয়োগকে সাহায্য করে এবং নিজ অনুসারীদের বলে যে, ইসলামের বাইরের লোকদের হত্যা কর। এ ধারাবাহিকতায় সমালোচকরা ৯ নং সূরা তাওবার ৫ নং আয়াতের বরাত দেয়, যাতে এর দ্বারা এটা প্রমাণ করা যায় যে, ইসলাম শক্তি প্রয়োগ, খুন-খারাবি এবং পশুত্বের সুযোগ দেয়।
অর্থ : তোমরা মুশরিকদের যেখানে পাও সেখানেই হত্যা কর। মূলত ইসলামের ওপর দোষারোপ করার এ আয়াতের বরাত আসল এবাদত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আয়াতের মূল বিষয় বুঝার জন্য আবশ্যক হলো সুরার অধ্যয়ন প্রথম আয়াত থেকে করা। এতে বলা হয়েছে যে, মুসলমান এবং মুশরিকদের মাঝে যে নিরাপত্তা চুক্তি ছিল তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। এ চুক্তি শেষ করার জন্য আরবে শিরক এবং মুশরিকদের অস্তিত্ব কার্যত আইন বিরুদ্ধ এ স্বীকৃতি লাভ করে। কেননা রাজ্যের অধিকাংশের ওপর ইসলামের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এজন্য এছাড়া আর কোনো পথ ছিল না যে, হয়তো লড়বে নয়তো রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে। এ দ্বারা ইসলামের রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা শক্ত ও মজবুত করার প্রয়োজন ছিল। মুশরিকদের নিজের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য চার মাসের জন্য সময় দেয়া হয়েছিল। ৯ নং সূরা তাওবার ৫ নং আয়াতে রয়েছে
অর্থ : অতঃপর যখন নিষিদ্ধ চার মাস অতিবাহিত হয়ে যাবে, তখন মুশরিকদের যেখানে পাবে সেখানেই তোমরা হত্যা করবে। তাদের বন্দি করবে, তাদের অবরোধ করবে এবং তাদের ধরার জন্যে তোমরা প্রতিটি ঘাঁটিতে ওঁৎ পেতে বসে থাকবে, তবে এরা যদি তওবা করে (দ্বীনের পথে ফিরে আসে) এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে, তাহলে তোমরা তাদের পথ ছেড়ে দাও, অবশ্যই আল্লাহ তাআলা ক্ষমাশীল ও বড় দয়াময়।
আমার জানা আছে যে, এক সময় আমেরিকা ভিয়েতনামের সঙ্গে যুদ্ধরত ছিল। ধরুন! আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অথবা আমেরিকার জেনারেল যুদ্ধের মধ্যে আমেরিকার সৈন্যদের বললেন, যেখানেই ভিয়েতনামীদের পাও তাদের হত্যা কর। আমি এ কথাকে বরাত হিসেবে উপস্থাপন করার সময় যদি আজ এই বুঝ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বলি যে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অথবা জেনারেল একথা বলেছেন যে, যেখানে ভিয়েতনামীদের পাও সেখানে তাদের হত্যা কর, তাহলে এমন লাগে যে, আমি কোনো কসাই এর কথা উল্লেখ করছি। কিন্তু আমি যদি এ কথাকে। উপযুক্ত বুঝ মোতাবেক বর্ণনা করি তাহলে এটা যৌক্তিক মনে হবে। কেননা আসলে যুদ্ধের দিনে তিনি নিজ সৈন্যের সাহস বাড়ানোর জন্য এক হুংকারের মতো নির্দেশ দিচ্ছিলেন যে, যেখানে শত্রু পাও তাদের হত্যা কর।
যুদ্ধ সমাপ্তির পর এ নির্দেশ রহিত হয়ে গেছে। এরূপ ৯ নং সূরা তাওবার ৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, তোমরা মুশরিকদের যেখানে পাও হত্যা কর।’ এ নির্দেশ যুদ্ধের অবস্থায় অবতীর্ণ হয় এবং এর উদ্দেশ্য মুশরিক সৈন্যদের উদ্দীপনা বাড়ানো ছিল। কুরআন মূলত মুসলমান সৈন্যদের একথা বলছিল যে, সে যেন ভীত না হয় এবং যখনই তাদের সামনে শত্রু পড়বে তাদের হত্যা করবে। অ্যারুন শৌরী ভারতে ইসলামের কঠিন সমালোচক হিসেবে গণ্য। সেও নিজ পুস্তক ‘ফাতওয়া দুনিয়া’-এর ৫৭২ পৃ. সূরা তাওবার ৫ নং আয়াতের বরাত দিয়েছে। এ আয়াতের বরাত দেবার পর সে হঠাৎ ৭ নং আয়াতে পৌছে গেছে। সকল প্রজ্ঞাবান মানুষই এটা অনুভব করতে পারে যে, সে জেনে বুঝে ৬ নং আয়াত থেকে লাফ দিয়েছে। ৬ নং আয়াতে এ অভিযোগের সান্ত্বনাদায়ক উত্তর দিয়েছে যাতে বলা হয়েছে ইসলাম কঠিন, পশুত্ব এবং খুন-খারাবির সুযোগ দেয়। এ আয়াতে ইরশাদ হয়
অর্থ : যদি মুশরিকদের মধ্য থেকে কোনো ব্যক্তি আপনার নিকট আশ্রয় চায় তাকে আপনি আশ্রয় দিন, যাতে আল্লাহর বাণী সে শুনতে পায়। অতঃপর তাকে নিরাপদ স্থানে পৌছে দিন। কারণ তারা অজ্ঞ সম্প্রদায়। আল কুরআন শুধু এটাই বলে না যে, যদি কোনো মুশরিক যুদ্ধকালীন আশ্রয় চায় তাকে আশ্রয় দাও বরং তাকে নিরাপদ স্থান পর্যন্ত পৌছে দেবার নির্দেশও দান করে। এটা সম্ভব যে, আজকে যুদ্ধরত কওমের মধ্যে একজন দয়াবান এর নিরাপদকামী একজন জেনারেল যুদ্ধ চলাকালীন শত্রু সৈন্যদের নিরাপত্তা চাওয়ার
কারণে জীবন বাঁচাবে কিন্তু এমন কোনো সৈন্যের জেনারেল কি আছেন যিনি নিজ সৈন্যদের একথা বলবে যে, যুদ্ধ চলাকালীন কোনো সৈন্য নিরাপত্তা চাইলে তাকে শুধু ছেড়েই দেবে না বরং নিরাপদ স্থান পর্যন্ত পৌঁছে দেবে?
প্রশ্ন-৩৩. হিন্দু পণ্ডিত অ্যাণ শৌরী এ দাবি করেছে যে, আল-কুরআনে হিসাবে একটি ভুল রয়েছে। তার বক্তব্যে সূরা নিসার ১১ ও ১২ নং আয়াতে উত্তরাধিকারের অংশগুলো যদি যোগ দেয়া হয় তাহলে সংখ্যা একের অধিক হয়। এজন্য কুরআনের রচয়িতা গণিত জানে না।
উত্তর : উত্তরাধিকারের বিধান কুরআনে বহু স্থানে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন : ১. ২ নম্বর সূরা বাকারার ১৮০ নম্বর আয়াত। ২. ২ নম্বর সূরা বাকারার ২৪০ নম্বর আয়াত। ৩. ৪ নম্বর সূরা নিসার ৭ নং থেকে ৯ নং আয়াত। ৪. ৪ নম্বর সূরা নিসার ১৯ এবং ৩৩ নং আয়াত। ৫. ৫ নম্বর সূরা মায়িদাহ্-এর ১০৫ এবং ১০৮ নং আয়াত। তবে অংশীদারের অংশের ব্যাপারে ৪ নং সূরা নিসার ১১, ১২ এবং ১৭৬ নং আয়াতে সম্পূর্ণ পরিষ্কার বিধানাবলি বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা সূরা নিসার আয়াত নং ১১ এবং ১২ কে বিশ্লেষণ করবো। যার বরাত অরুন শৌরী দিয়েছে। কুরআন বলেছে
অর্থ : আল্লাহ তাআলা তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে এই মর্মে তোমাদের জন্যে বিধান জারি করেছেন যে, এক ছেলের অংশ হবে দুই কন্যা সন্তানের মতো, কিন্তু উত্তরাধিকারী কন্যারা যদি দুয়ের বেশি হয়, তাহলে তাদের জন্যে (থাকবে) রেখে যাওয়া সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ। আর সে কন্যা সন্তান যদি এক হয় তাহলে তার (অংশ) হবে (পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধেক। মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকলে তার
পিতা-মাতার জন্যে থাকবে (সে সম্পদের) ছয় ভাগের এক ভাগ, (অপরদিকে) মৃত ব্যক্তির যদি কোনো সন্তান না থাকে এবং পিতা-মাতাই যদি হয় তার একমাত্র উত্তরাধিকারী, তাহলে তার মায়ের (অংশ) হবে তিন ভাগের এক ভাগ, যদি মৃত ব্যক্তির কোনো ভাই-বোন (বেঁচে) থাকে, তাহলে তার মায়ের (অংশ) হবে ছয় ভাগের এক ভাগ। (মৃত্যুর) আগে সে যে ওসিয়ত করে গেছে এবং তার (রেখে যাওয়া) ঋণ আদায় করে দেওয়ার পরই (এসব ভাগ বাটোয়ারা করতে হবে) তোমরা জানো না তোমাদের পিতা-মাতা তোমাদের সন্তান-সন্ততি এর মধ্যে কে তোমাদের জন্যে উপকারের দিক থেকে বেশি নিকটবর্তী, (অতএব) এ হচ্ছে আল্লাহর বিধান। অবশ্যই আল্লাহ তাআলা সকল কিছু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং তিনিই হচ্ছেন মঙ্গলময়।
অর্থ : তোমাদের স্ত্রীদের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে তোমাদের অংশ হচ্ছে অর্ধেক যদি তাদের কোনো সন্তানাদি না থাকে, আর যদি তাদের সন্তান থাকে, তাহলে (সে সম্পত্তিতে) তোমাদের অংশ হবে চার ভাগের এক ভাগ। তারা যে ওসিয়ত করে গেছে কিংবা (তাদের) ঋণ পরিশোধ করার পরই (কিন্তু তোমরা এ অংশ পাবে।) তোমাদের স্ত্রীদের জন্যে (থাকবে) তোমাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ, যদি তোমাদের কোনো সন্তান না থাকে। যদি তোমাদের সন্তান থাকে, তাহলে তারা পাবে রেখে যাওয়া সম্পদের আট ভাগের এক ভাগ। মৃত্যুর আগে তোমরা যা ওসিয়ত করে যাবে কিংবা যে ঋণ তোমরা রেখে যাবে তা পরিশোধ করে দেয়ার পরই (এই অংশ তারা পাবে)। যদি কোনো পুরুষ কিংবা নারী এমন হয় যে, তার কোনো সন্তানও নেই, পিতা-মাতাও নেই, শুধু আছে তার এক ভাই ও এক বোন, তাহলে তাদের সবার
জন্যে থাকবে ছয় ভাগের একভাগ। ভাই-বোন মিলে তারা যদি এর চেয়ে বেশি হয়, তবে (মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদের এক-তৃতীয়াংশে তারা সবাই সমান অংশীদার হবে। অবশ্য এ সম্পত্তির ওপর মৃত ব্যক্তির যা ওসিয়ত করা আছে কিংবা কোনো ঋণ পরিশোধ, এরপরই এই ভাগাভাগি করা যাবে। তবে কখনো উত্তরাধিকারীদের অধিকার পাওয়ার পথে তা যেন ক্ষতিকর হয়ে না দাঁড়ায়। সে কথাও খেয়াল রাখতে হবে, (উত্তরাধিকার বণ্টনের ব্যাপারে) এই হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ। আর আল্লাহ তাআলা সর্বজ্ঞানী ও পরম ধৈর্যশীল।
ইসলামে উত্তরাধিকার আইন খুবই বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছে। কুরআন এক পরিপূর্ণ এবং ভিত্তিশীল মূল বর্ণনা করা হয়েছে এবং মুহাম্মদ (সাঃ) এর হাদীসে বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। এটা এতো পরিপূর্ণ ও বিস্তারিত যে, যদি কোনো অংশীদাররা বিভিন্ন কৌশল ও বিন্যাসের সাথে এর ওপর দক্ষতা অর্জন করতে চায় তাহলে তাকে এজন্য সারাজীবন ব্যয় করার প্রয়োজন হবে। ১. অ্যারুন শৌরী আছে যে কুরআনের দুআয়াত দ্রুত ও উপরি উপরি অধ্যয়ন থেকে এবং শরয়ী মাপকাঠি না জেনেই এ বিধান জানার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লো। এর দৃষ্টান্ত হলো তার মতো যে, বীজগণিতের এক সরল সমাধান করার সখ রাখে; কিন্তু গণিতের মূল নিয়মের আগাও নয়। যা অনুযায়ী এ কথা আবশ্যকীয়ভাবে জানা থাকতে হবে যে, গণিতের কোন্ চিহ্ন আগে আসবে, প্রথমে তো মৌলিক নিয়ম সমাধান করার প্রয়োজন।
২. প্রথমে আপনাকে ব্র্যাকেটের কাজ করতে হবে। দ্বিতীয় অবস্থায় যোগ ও বিয়োগের কাজ করতে হয়। যদি অ্যারুন শৌরী হিসাব সম্পর্কে অজ্ঞ হয় এবং সরল অংকের প্রথমে গুণন দিয়ে শুরু করে, এরপর বিয়োগ করে, এরপরে ব্র্যাকেট করে, এরপর ভাগের দিকে আসে এবং সর্বশেষে যোগের কাজ করে তাহলে নিশ্চিতই এর উত্তর ভুল হবে। এরূপভাবে ৪ নং সূরা নিসার ১১ ও ১২ নং আয়াতে উত্তরাধিকারের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে, তবে যদিও প্রথমে সন্তানদের অংশের উল্লেখ করেছে এরপরে পিতা-মাতা এবং স্বামী-স্ত্রীর অংশের উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামের উত্তরাধিকার আইনে সবার আগে ঋণ এবং কর্তব্য আদায় করতে হবে। এরপরে পিতা-মাতা এবং স্বামী-স্ত্রীর অংশ দিতে হবে যা ভিত্তির ওপর হবে যে, মৃত তার পেছনে সন্তান রেখে এসেছে কিনা? এরপরে বাকি অংশ ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে নির্ধারিত অংশ মোতাবেক বণ্টন করতে হবে। এভাবে করলে বেশি হবার প্রশ্ন আবার কোথায় থাকল? (যেমন আ: করিম- পিতা-মাতা, স্ত্রী ও দুই ছেলে এক মেয়ে রেখে মারা গেল। বিধি মোতাবেক পিতা ১ + মাতা ২ + স্ত্রী ২ = (৪ + ৪ + ৩)/২৪ = ১৯ এবং বাকি ২৪ অংশ পাঁচ ভাগ হবে এবং প্রত্যেক
ছেলে প্রত্যেক মেয়ের দ্বিগুণ হিসেবে পাবে। অংশ বাকি থাকার বা যোগফল ১ এর অধিক হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।) এজন্য আল্লাহ তাআলা গণিত জানেন না তা নয় বরং অ্যারুন শৌরী গণিতের জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ এবং অনভিজ্ঞ।
প্রশ্ন-৩৪. যদি আল্লাহ তাআলা কাফিরদের দিলে মোহর মেরে থাকেন তাহলে ইসলাম গ্রহণ না করার কারণে তাকে অপরাধী কীভাবে মেনে নেওয়া যায়?
উত্তর : আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সূরা বাকারার ৬-৭ নং আয়াতে ইরশাদ করেন
অর্থ : নিশ্চয়ই যারা অস্বীকারকারী, তাদের তুমি ভীতি প্রদর্শন কর আর না কর উভয়টাই সমান। এরা কখনো ঈমান আনবে না। (ক্রমাগত কুফরী করার কারণে) আল্লাহ তাআলা তাদের মন, মগজ ও শ্রবণশক্তির ওপর মোহর মেরে দিয়েছেন। এদের দৃষ্টিশক্তির ওপরও আবরণ পড়ে আছে। তাদের জন্য রয়েছে (পরকালের) প্রচণ্ড শাস্তি। এ আয়াতগুলো সাধারণ কাফিরদের জন্য নয়, যে ঈমান আনে নি। আল কুরআনে এজন্য শব্দাবলি ব্যবহৃত হয়েছে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য ঐ সকল লোক যারা সত্যকে মিথ্যা প্রমাণের জন্য উঠে পড়ে লেগে আছে।
মুহাম্মদ (সাঃ) কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে তুমি তাদের ভয় দেখাও বা না দেখাও সব সমান তারা ঈমান আনবে না। আল্লাহ তায়ালা এদের হৃদয়ের ওপর মোহর মেরে দিয়েছেন এবং এদের কান ও চোখের ওপর পর্দা দিয়েছেন। তাদের অন্তরের ওপর মোহর ও চোখের ওপর পর্দা দেয়ার কারণে তারা ঈমান আনেনি ব্যাপারটা তা নয় বরং ব্যাপারটা এর উল্টো। এর কারণ এই যে, এ কাফির সকল অবস্থায় সত্যকে মিথ্যা প্রমাণের জন্য লেগে থাকে এবং আপনি তাদের ভয় দেখান আর নাই দেখান তারা ঈমান আনবে না, এজন্য এর দায়িত্ব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নয় বরং কাফির নিজের। ধরুন! এক শিক্ষক ফাইনাল পরীক্ষার আগে বলল, অমুক ছাত্র পরীক্ষায় ফেল করবে, এজন্য যে, সে খুব দুষ্ট, পড়ার দিকে মনোযোগ নেই, নিজ চিন্তা ও
মনোযোগ পরিপূর্ণ করে না। যদি এ ছাত্র পরীক্ষায় ফেল করে তাহলে এ দোষ কার ওপর পড়বে শিক্ষকের ওপর নাকি ছাত্রের ওপর শিক্ষক তো এর ব্যাপারে অগ্রিম কথা বলেছেন, এজন্য তাকে দোষারোপ করা যাবে না। এরূপ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলারও প্রথম থেকে জানা আছে যে, কিছু লোক এমনও আছে যারা সত্যকে মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টারত এবং আল্লাহ তাআলা তাদের হৃদয়ের ওপর মোহর মেরে দিয়েছেন এজন্য অমুসলিমদের ঈমান এবং আল্লাহ তাআলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার দায়িত্ব তাদেরই।
প্রশ্ন-৩৫. আল-কুরআনে রয়েছে আল্লাহ তাআলা কাফিরদের দিলে মোহর মেরে দিয়েছেন। সে কখনো ঈমান আনবে না। অথচ বিজ্ঞানের দ্বারা জানা যায়, জ্ঞান ও বুঝ এবং ঈমান কবুল করার কাজ দেমাগের (মস্তিষ্কের)। তাহলে কুরআনের এ দাবি কি বিজ্ঞানের বিপরীত নয়?
উত্তর : আল-কুরআনের ২ নং সূরা বাকারার ৬ ও ৭ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে
অর্থ : নিশ্চয়ই যারা অস্বীকারকারী তাদের আপনি ভীতি প্রদর্শন করুন আর নাই করুন উভয়ই সমান, তারা কখনো ঈমান আনবে না। (ক্রমাগত কুফরী করার কারণে) আল্লাহ তাদের মন, মগজ ও শ্রবণশক্তির ওপর মোহর মেরে দিয়েছেন। এদের দৃষ্টিশক্তির ওপরও আবরণ পড়ে আছে। তাদের জন্য (পরকালের) প্রচণ্ড শাস্তি। আরবি শব্দ দ্বারা অন্তর এবং মেধা ও উদ্দেশ্য। এ সকল আয়াতে যে! শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য অন্তর ও মেধা উভয়ই।
এজন্য এ সকল আয়াতের অর্থ এটাও যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কাফিরদের অনুধাবন শক্তির যোগ্যতার ওপর মোহর মেরে দিয়েছেন। এজন্য সে বুঝে না এবং ঈমানও আনে না। আরবি ৮ দ্বারা জ্ঞান ও বুঝের কেন্দ্র ও উদ্দেশ্য নেয়া হয় এবং এটা জ্ঞান ও বুঝের অর্থেও ব্যবহৃত হয়। ইংরেজিতেও এরূপ শব্দ প্রচুর আছে। যা শাব্দিক অর্থ থেকে অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন Lunatic যার শাব্দিক অর্থ “চান্দ্রিক’, চাঁদের সাথে সম্পৃক্ত। আজ সকল লোক এ শব্দটিকে ঐ লোকের জন্য ব্যবহার করে যে পাগল অথবা মস্তিষ্কের সমস্যার শিকার। এ কথা সকলেই জানে যে, কোনো পাগল কিংবা মস্তিষ্কের রোগী চান্দ্র পীড়িত বা এরূপ নয়। এ সত্ত্বেও ডাক্তারও এ শব্দ ব্যবহার করে। এটা কোনো ভাষার সাধারণ পরিবর্তনের একটা
উদাহরণ। এ পরিভাষা এ ভুল ধারণার সাথে চালু হয়ে গেছে যে, চাঁদের পরিবর্তনগুলো বিরাট প্রভাব ফেলে। কবি মহোদয়গণ চাঁদের সঙ্গে প্রেম ও পাগলামির সৃষ্টির উল্লেখ বেশিরভাগ করে থাকেন। Disaster এর উদ্দেশ্য হলো একটি কুলক্ষণে তারকা। কিন্তু আজ সকলে এ শব্দ হঠাৎ করে অবতীর্ণ হওয়া দুর্ভাগ্য অথবা বিপর্যয়ের জন্য ব্যবহার করে থাকে। যদিও আমাদের সকলের জানা আছে যে, দুর্ভাগ্যের সাথে কুলক্ষণে তারকার কোনো সম্পর্ক নাই। Sunrise 972 Sunset : Sunrise অর্থ সূর্যোদয়। আজ যখন এ শব্দ বলা হয়, অথচ লোকেরা এ বিষয়ে অজ্ঞ নয় যে, পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরে।
জ্ঞানবানদের জন্য এ তথ্য জানা আছে যে, সূর্য কখনো উদয় হয় না। এতদ্সত্ত্বেও আকাশ বিজ্ঞানীরাও এ শব্দ ব্যবহার করে। এরূপভাবে Sunset বা সূর্যাস্ত সম্পর্কে আমরা জানি যে, সূর্য কখনো অস্তমিত হয় না, তা সত্ত্বেও একথা বলা হয়ে থাকে। ইংরেজিতে ভালোবাসা ও আবেগের স্থান হলো দিল বা অন্তর। অন্তর দ্বারা উদ্দেশ্য শরীরের ঐ অংশ যা রক্তকে পাম্প করে। এ শব্দ অন্তরের খেয়াল, ভালোবাসা এবং আবেগের কেন্দ্রের অর্থে ব্যবহৃত হয়। আজ আমরা জানি যে, খেয়াল, ভালোবাসা ও আবেগের কেন্দ্র হচ্ছে দেমাগ বা মস্তিষ্ক।
এ সত্ত্বেও যখন কোন লোক নিজের আবেগ প্রকাশ করে তখন বলে আমি তোমাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে চাই’। কিছুটা বুঝুন যে, এক বিজ্ঞানী যখন নিজ স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ করতে একথা বলবে যে, তুমি তো বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব সম্পর্কে অবগত নও যে, আবেগের কেন্দ্র হলো মস্তিস্ক, অন্তর নয়- সে কি এ কথা বলবে যে, তুমি একথা বলবে ‘আমি তোমাকে মস্তিষ্কের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসি। সে এরূপ বলবে না বরং স্ত্রীর বক্তব্যই গ্রহণ করবো শব্দ ধারণার কেন্দ্র এবং জ্ঞান ও বুঝের ওপর বলা হয়। কোনো আরব একথা কখনো বলবে না যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কাফিরদের দিলে বা অন্তরে কেন মোহর মারলেন? এ কারণে যে, সে একথা ভালভাবে জানে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য মানুষের ধারণা, চিন্তা এবং আবেগের কেন্দ্র।
প্রশ্ন-৩৬. আল কুরআন একথা বলে যে, যখন কোনো পুরুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে সে হুর অর্থাৎ সুশ্রী সঙ্গিনী পাবে। কোনো নারী জান্নাতে গেলে সে কী পাবে?
উত্তর : ‘হুর’ শব্দটি কুরআনে কমপক্ষে চার স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে ৪৪ নং সূরা দুখান এর ৫৪ নং আয়াতে
অর্থ : এরূপভাবে আমি তাদেরকে আয়তলোচনা হুরদের সঙ্গী বানাব। ৫২ নং সূরা তুর এর ২০ নং আয়াতে
অর্থ : আমি তাদের জুড়ে দিব বড় বড় চক্ষুবিশিষ্ট হুরদের সঙ্গে। ৫৫ নং সূরা আর রাহমান-এর ৭২ নং আয়াতে
অর্থ : এই হুররা তাঁবুর মধ্যে সীমাবদ্ধ। ৫৬ নং সূরা ওয়াকিয়াহ্ ২২ ও ২৩ নং আয়াতে
অর্থ : সুন্দরী সুনয়না তরুণ দল, তারা যেন একেকটি সযত্নে ঢেকে রাখা মুক্তা। কুরআনের অনুবাদকারীরা শব্দের অনুবাদ বিশেষ করে উর্দু অনুবাদকারীরা সুশ্রী সুন্দরী’ অর্থাৎ বালিকা করেছেন। এ অবস্থায় তারা শুধু পুরুষের জন্যই, তবে নারীদের কী হবে? শব্দটি মূলে ১ অথবা উভয় বহুবচনের শব্দ। এটা ঐ সকল লোকের দিকে ইঙ্গিত করে যাদের চোখগুলো যেমন হয়, যা জান্নাতে প্রবেশকারী পুরুষ বা নারীদের রূহ প্রশান্ত করবে। যা বিশেষ গুণ এবং এটা আত্মিক চোখের সাদা অংশের প্রান্ত রংকে প্রকাশ করে। কুরআনের অনেক আয়াতে একথা বলা হয়েছে যে, জান্নাতে তোমাদের জন্য। অর্থাৎ জুড়ি হবে এবং তোমাদের জোড়া বা পবিত্র সঙ্গী মিলবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ২নং সূরা বাকারা ২৫ নং আয়াতে বর্ণনা করেন
অর্থ : অতঃপর যারা (এর উপর) ঈমান এনেছে এবং ভালো কাজ করেছে, তাদের সুসংবাদ দিন এমন এক জান্নাতের, যার নিচ দিয়ে ঝরনাধারা প্রবাহিত হতে থাকবে। যখনি তাদের এ জান্নাতের কোনো একটি ফল দেওয়া হবে, তারা বলবে,
এ ধরনের ফলতো ইতিপূর্বেও আমাদের দেয়া হয়েছিল। তাদের এমনি ধরনের জিনিসই সেখানে দেয়া হবে। তাদের জন্যে আরো সেখানে থাকবে পবিত্র সহধর্মী ও সহধর্মিণী এবং সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। ৪ নং সূরা নিসার ৫৭ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে
অর্থ: যারা ঈমান এনেছে, সৎ আমল করেছে, আমি তাদের প্রবেশ করাবো এমন এক জান্নাতে যার নিচ দিয়ে ঝর্ণা বয়ে যাবে, তারা সেখানে চিরদিন থাকবে। সেখানে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্র সঙ্গী ও সঙ্গিনীরা। আমি তাদের প্রবেশ করাবো চিরন্তন স্নিগ্ধ ছায়ায়। এজন্য শব্দ কোনো বিশেষ জাতির জন্য খাস নয়। আল্লামা মুহাম্মদ আসাদ ১৮-এর অনুবাদ Spouse স্বামী/স্ত্রী করেছেন। যেখানে আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী এর অনুবাদ (Companion) সাথী করেছেন। অনেক আলেমের মতে, জান্নাতে কোনো পুরুষের যেমন হুর মিলবে।
তাদের বড় বড় চমক সৃষ্টিকারী চোখবিশিষ্ট সুশ্রী বন্ধু হবে তখন জান্নাতী নারীদের যে সাথী মিলবে তাদেরও বড় বড় উজ্জ্বল চোখবিশিষ্ট হবে। অনেক আলেম এটাও বলেন, কুরআনে যে শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এর দ্বারা নারীই বুঝানো উদ্দেশ্য। কেননা এদের বিষয়ে উল্লেখ পুরুষের সাথে করা হয়েছে।
এর উত্তর যা সকলের গ্রহণযোগ্যতা হাদীসে দেয়া হয়েছে। মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে এ প্রশ্ন এলো যে, যদি পুরুষদের জান্নাতে হুর দেয়া হয়, তাহলে নারীদের কী দেয়া হবে। তিনি ইরশাদ করেন, নারীদের এ জিনিস মিলবে যা তাদের মনে কখনো উদয় হয় নি, তাদের কানে কখনো শ্রবণ করে নি, তাদের চোখ কখনো তা দেখেনি। অন্য কথায়, নারীদের জান্নাতে কোনো বিশেষ কিছু দেয়া হবে। কোনোরূপ চাহিদা বা অভাব থাকবে না।)
প্রশ্ন-৩৭. কুরআনের কয়েক স্থানে বলা হয়েছে যে ইবলিস একজন ফেরেশতা ছিল, কিন্তু সুরা কাহফে এটা বলা হয়েছে যে, ইবলিস জ্বীন ছিল। এ দ্বারা কুরআনের বৈপরীত্য কি প্রমাণিত হয় না?
উত্তর : আল-কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আদম ও ইবলিসের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। ২নং সূরা বাকারার ৩৪ নং আয়াতে রয়েছে
অর্থ : আমি যখন ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর, ইবলিস ছাড়া সবাই সিজদা করল। সে অস্বীকার করল এবং অহংকার করল। এছাড়াও কুরআনে উল্লেখ রয়েছে
১. ৭নং সূরা আরাফের ১১ নং আয়াতে।
২. ১৫ নং সূরা হিজরের ১৩ ও ২৮ নং আয়াতে।
৩. ১৭ নং সূরা বনী ইসরাঈলের ৬১ নং আয়াতে।
৪. ২০ নং সূরা ত্বহার ১১৬ নং আয়াতে।
৫. ৩৮ নং সূরা ছদ এর ৭১ ও ৭৪ নং আয়াতে। কিন্তু ১৮ নং সূরা কাহফের ৫০ নং আয়াতে রয়েছে
অর্থ : (স্মরণ কর) যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলিস ছাড়া সবাই সিজদা করল। সে ছিল জ্বীনদের অন্তর্ভুক্ত এবং সে তার প্রভুর নাফরমানি করল। সূরা বাকারার বর্ণিত কয়েক আয়াতের প্রথম অংশ থেকে আমরা জানলাম যে, ইবলিস একজন ফেরেশতা ছিলেন। কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। আরবি ভাষায় একটি সাধারণ কায়েদা আছে যাতে, যদি অধিকাংশকে সম্বোধন করা হয়, তাহলে অল্পসংখ্যক নিজে নিজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। যেমন : আমি ১০০ ছাত্রের এক শ্রেণিতে বক্তা যার মধ্যে ৯৯ জন ছাত্র এবং ১ জন ছাত্রী। আমি আরবিতে যদি বলি সকল ছাত্র দাড়িয়ে যাও, তা হলে এর প্রয়োগ ছাত্রীর উপরও পড়বে।
আমাকে আলাদাভাবে এ ছাত্রীকে সম্বোধন করা আবশ্যক নয়। এরূপভাবে কুরআন অনুযায়ী যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যখন ফেরেশতাদের সম্বোধন করেছেন তখন ইবলিস সেখানে ছিল এবং এটা আবশ্যক ছিল না যে, তার উল্লেখ আলাদা করতে হবে, এজন্য সূরা বাকারা এবং অন্যান্য সূরায় ইবলিস ফেরেশতা হোক বা না হোক তাকে পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয় নি। তবে সূরা কাহফের ৫০ নং আয়াত মোতাবেক ইবলিস একজন জ্বীন ছিল। কুরআনের কোথাও একথা বলা হয় নি যে, ইবলিস একজন ফেরেশতা ছিল, এজন্য আল কুরআনে এ ব্যাপারে কোনো বৈপরীত্য নেই। এ ব্যাপারে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে, জ্বীনদের স্বাধীনতা ও ইচ্ছে প্রদান করা হয়েছে। সে চাইলে আনুগত্য অস্বীকার করতে পারে। তবে ফেরেশতাদের স্বাধীনতা ও ইচ্ছে দেয়া হয় নি এবং তারা সর্বদা আল্লাহর আনুগত্য করে থাকে।
এজন্য এ প্রশ্নের সৃষ্টি হয় না যে, কোনো ফেরেশতা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নাফরমানি করবে। একথা থেকে এ জিনিস প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল যে, ইবলিস একজন জ্বীন ছিল, ফেরেশতা নয়।
প্রশ্ন-৩৮. কুরআনে একথা বলা হয়েছে যে, মারইয়াম আলাইহি সাল্লাম হারুন আলাইহি সাল্লাম এর বোন ছিলেন। মুহাম্মদ (সাঃ) যাদের দিয়ে কুরআন লিখিয়েছিলেন (নাউযুবিল্লাহ) একথা জানতো না যে, হারুন আলাইহি সাল্লাম-এর বোন মারইয়াম আলাইহি সাল্লাম ঈসা মসীহ-এর মাতা Mary থেকে ভিন্ন মহিলা ছিলেন। এবং এ দুজনের মধ্যে প্রায় ১০০০ (এক হাজার বছরের ব্যবধান ছিল।
উত্তর : আল-কুরআনের ১৯ নং সূরা মারইয়ামের ২৭ ও ২৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ : অতঃপর সে তাকে নিজের কোলে তুলে নিজের জাতির কাছে ফিরে এলো, লোকেরা বলল। হে মারইয়াম! তুমি তো সত্যিই এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসেছ। হে হারুনের বোন! তোমার পিতা তো কোনো অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না, তোমার মাতাও তো কোনো খারাপ মহিলা ছিল না।
খ্রিস্টীয় মসীহ একথা বলছে যে, মুহাম্মদ (সাঃ) -এর ঈসা মসীহ-এর মাতা মেরী ও হারুনের বোন মারইয়ামের মধ্যে পার্থক্যের জ্ঞান ছিল না। অথচ দুজনের মধ্যে ১০০০ (এক হাজার বছরের ব্যবধান। কিন্তু সে জানে না যে, আরবিতে এর অর্থ বংশধরও হয়, এজন্য লোকেরা মারইয়ামকে হারুনের : (বংশধর) বলে।
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হারুন আলাইহি সাল্লাম-এর বংশধর। বাইবেলে ‘বেটা’ শব্দটাও বংশধরের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন মথির ইঞ্জিল প্রথম অধ্যায়ের প্রথম বাক্যে রয়েছেঈসা মসীহ দাউদের বেটা (বংশধর)। লুক-এর ইঞ্জিল-এর ৩য় অধ্যায়ের ২৩ নং শ্লোকে বলা হয়েছেযখন ইচ্ছা স্বয়ং শিক্ষা দিতে লাগলো, ঐ সময়ে তিনি ৩০ বছরের ছিলেন এবং ইউসুফের বেটা (বংশধর) ছিলেন। এক ব্যক্তির দুজন পিতা হতে পারেন না। এজন্য যখন একথা বলা হয় যে, ঈসা মসীহ দাউদ আলাইহি সাল্লাম-এর বেটা ছিলেন তখন এর অর্থ হবে, মসীহ আলাইহি সাল্লাম দাউদ আলাইহি সাল্লাম-এর বংশধরদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বেটা দ্বারা বংশধর উদ্দেশ্য। এ ভিত্তির ওপরে আল কুরআনের ১৯ নং সূরা মারইয়ামের ২৮ নং আয়াতের ওপর অভিযোগ
সম্পূর্ণ মূল্যহীন। কেননা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে (হারুনের বোন) এর দ্বারা উদ্দেশ্য হারুনের বোন নয় বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য মারইয়াম আলাইহি সাল্লাম এর মাতা যিনি হারুন আলাইহি সাল্লাম-এর আওলাদ অর্থাৎ তার বংশধরদের মধ্যে ছিলেন।
প্রশ্ন-৩৯. কুরআনে কি একথা বলা হয় নি যে, ঈসা মসীহ আল্লাহর কালিমা ও আল্লাহর রূহ। এতে কি খোদায়িত্বের শান প্রকাশ পায় না?
উত্তর : কুরআন অনুযায়ী মসীহ আলাইহি সাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে কালিমা : ‘আল্লাহর কালিমা’ নয়। ৩ নং সূরা আলে ইমরানের ৪৫ নং আয়াতে রয়েছে
অর্থ : অতঃপর ফেরেশতারা বলল, অবশ্যই আল্লাহ তার পক্ষ থেকে একটি কালিমার সুসংবাদ দিচ্ছেন, তার নাম হবে মসীহ ইবনে মারইয়াম। দুনিয়া-আখিরাতের উভয় দিকেই তিনি সম্মানিত হবেন। তিনি আল্লাহর নৈকট্য হাসিলকারীদের মধ্যে একজন। কুরআনে মসীহ আলাইহি সাল্লাম-এর উদ্দেশ্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক কালিমা’-এর দিক থেকে করা হয়েছে।
আল্লাহর কালিমা’-এর দিক থেকে না। আল্লাহর এক কালিমা অর্থ হচ্ছে আল্লাহর পয়গাম বা সংবাদ। কারো ব্যাপারে যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে এক কালিমা’ বলা হয়, তবে তার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তিনি আল্লাহর পয়গম্বর বা নবী। বিভিন্ন নবীকে বিভিন্ন উপাধিতে সম্মানিত করা হয়েছে।
যখন কোনো নবীকে কোনো উপাধি দেওয়া হয়, তবে এর দ্বারা আবশ্যকীয়ভাবে এ উদ্দেশ্য হয় না যে, অন্য কোনো নবীর মধ্যে এ গুণ পাওয়া যাবে না। যেমন ইবরাহীম আলাইহি সাল্লাম-কে কুরআনে খলীলুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর বন্ধু বলা হয়। এর দ্বারা এ উদ্দেশ্য নয় যে, অন্য নবী আল্লাহর বন্ধু নয়। মূসা আলাইহি সাল্লাম-কে কলিমুল্লাহ’ বলা হয়, যার দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তার সঙ্গে কথা বলছেন।
এর উদ্দেশ্য এই নয় যে, আল্লাহ তাআলা অন্য সকল নবীদের সঙ্গে কথা বলেন নি। এভাবে মসীহ আলাইহি সাল্লাম-কে কালিমাতুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর কালিমা’ বলা হয়। এর উদ্দেশ্য এই নয় যে, অন্যান্য নবী আল্লাহর কালিমা বা পয়গম্বর নন। ইয়াহইয়া আলাইহি সাল্লাম যাকে খ্রিস্ট ইউহোন্না সিবাগ (রঞ্জিত) (John the Baptist) বলেন এর মধ্যেও ঈসা আলাইহি সাল্লাম-কে কালিমাতুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে কালিমা বলা হয়েছে। ৩ নং সূরা আলে ইমরানের ৩৮ ও ৩৯ নং আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে
অর্থ : সেখানে দাঁড়িয়েই যাকারিয়া তার রবের নিকট দোআ করলেন, হে আমার রব, তুমি তোমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহের প্রতীক হিসেবে একটি নেক সন্তান দান কর, নিশ্চয়ই তুমি দোআ শ্রবণ করো। ফেরেশতারা তাকে ডাক দিল- এমন সময় যখন ইবাদতের কক্ষে নামায আদায় করছিল, আল্লাহ তাআলা তোমাকে ইয়াহইয়া সম্পর্কে সুসংবাদ দিচ্ছেন, আল্লাহর কালিমার সত্যতা প্রমাণ করবে, সে হবে নেতা, সততার প্রতীক, নবী এবং সৎকৰ্মশীল ব্যক্তিদের একজন। কুরআনে মসীহ আলাইহি সাল্লাম-এর উল্লেখ রুহুল্লাহ’ হিসেবে নয় বরং সূরা নিসায় রুহুম মিনাল্লাহ’ অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রূহ বলা হয়েছে। আল্লাহ ইরশাদ করেন ৪ নং সূরা নিসায় ১৭১ নং আয়াতে
অর্থ : হে আহলে কিতাব! নিজেদের দ্বীনের ব্যাপারে তোমরা বাড়াবাড়ি করো না এবং ঈসা আলাইহি সাল্লাম-এর বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে সত্য ছাড়া কোনো মিথ্যা বলো না। মারইয়ামের পুত্র ঈসা আলাইহি সাল্লাম ছিলেন আল্লাহর রাসূল এবং মারইয়ামের ওপর প্রেরিত আল্লাহর বাণী। তিনি ছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো এক রূহ। অতঃপর তোমরা আল্লাহ ও রাসূলদের প্রতি ঈমান আনো। তিন (মাবুদ) বলো না। এ থেকে তোমরা দূরে থাকো, এতেই তোমাদের কল্যাণ। নিশ্চয়ই আল্লাহ তিনি একক মাবুদ, তিনি সন্তান হওয়া থেকে পবিত্র। আসমানসমূহ ও জমিনের মধ্যে যা কিছু আছে সবই তাঁর। অভিভাবক হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।
আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রূহ ফুঁকে দেয়ার উদ্দেশ্য এ নয় যে, ঈসা আলাইহি সাল্লাম (নাউযুবিল্লাহ) মাবুদ। আল-কুরআনে কয়েক স্থানে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মানুষের মধ্যে নিজের রূহ ঠুকে দেন। যেমন ১৫ নং সূরা হিজর-এর ২৯ নং আয়াতে
অর্থ : অতঃপর আমি যখন তাকে সুঠাম করবো এবং আমার রূহ থেকে ফুকে দেব, তখন তোমরা তার সামনে সিজদাবনত হয়ে যাবে। ৩২ নং সূরা সাজদার ৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ : পরে তিনি তাকে ঠিকঠাক করলেন এবং তার মধ্যে তিনি তার নিজের কাছ থেকে রূহ ফুকে দিলেন। তোমাদের জন্যে তাতে কান, চোখ ও অন্তঃকরণ দান করলেন। তোমাদের কম লোকই কৃতজ্ঞতা আদায় করে।
প্রশ্ন-৪০. একথা কি সঠিক নয় যে, কুরআনের সূরা মারইয়ামের ৩৩ নং আয়াতে একথা বলা হয়েছে যে, ঈসা মসীহ ইন্তেকাল করলেন অতঃপর জীবিত করলেন এবং উঠিয়ে নিলেন?
উত্তর : আল কুরআনে একথা কখনো বলা হয় নি যে, ঈসা আলাইহি সাল্লাম ফওত হয়ে ছিলেন বরং তাঁর সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে তাতে ভবিষ্যতের শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯ নং সূরা মারইয়ামের ৩৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ : আমার ওপর শান্তি যেদিন জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন মৃত্যুবরণ করবো, যেদিন পুনরায় উথিত হবো। কুরআনে একথা বলা হয়েছে যে, শান্তি আমার ওপর যেদিন আমি জন্মলাভ করেছি। যেদিন আমি মরবো।’ একথা বলা হয় নি যে, যেদিন আমি মরে গিয়েছিলাম। এখানে ভবিষ্যতের শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অতীতকালের নয়, আল কুরআনের ৪ নং সূরার ১৫৭ ও ১৫৮ নং আয়াতে আরো কিছু বাড়িয়ে বলা হয়েছে
অর্থ: তাদের উক্তি যে আমরা অবশ্যই মারইয়ামের পুত্র ঈসাকে হত্যা করেছি। তারা কখনোই তাকে হত্যা করে নি। তারা তাকে শূলবিদ্ধও করে নি। তাদের নিকট এমন কিছু একটা মনে হয়েছিল। তারা মতবিরোধ করেছিল, তারাও এতে সন্দেহে পড়ে গেল। এ ব্যাপারে অনুমানের অনুসরণ ছাড়া তাদের কোনো জ্ঞানই ছিল না।
এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করে নি। বরং (মূল ঘটনা হলো) আল্লাহ তাআলা তাঁকে তাঁর নিজের কাছেই তুলে নিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। মূলত আল্লাহ তাআলা ঈসা আলাইহি সাল্লাম-কে ইহুদিদের নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচিয়ে জীবন্ত আসমানে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে তিনি পৃথিবীতে অবতরণ করবেন। এ সময় তিনি দাজ্জালের ফিতনা শেষ করবেন এবং সারা পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলার দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী করে ইন্তিকাল করবেন।
সমাপ্ত
Leave a Reply