এ্যাডভেঞ্চার অব ইবন বতুতা – এইচ. এ. আর. গিব
ইবনে বতুতার সফরনামা / অনুবাদ : মোহাম্মদ নাসির আলী
ইবনে বতুতার সফরনামা একখানা মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল স্বরূপ। এ গ্রন্থের প্রকৃত মূল্য নিরূপণ করতে ইবনে বতুতার জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয় । মধ্যযুগের মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে ইবনে বতুতার চরিত্র সব চাইতে জীবন্ত । তিনি তার সফরনামার মধ্যে দোষে-গুণে মণ্ডিত নিজের এবং সমসাময়িক যুগের যে চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, তা সে যুগের অবক্ষয় থেকে উদ্ধারপ্রাপ্ত পূর্ণাঙ্গ যুগ-মানুষেরই প্রতিচ্ছবি। তবে একথা ঠিক যে, ইবন বতুতার সফরনামায় তার ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে খুব অল্প কথাই জানা যায়। তাঁর গ্রন্থের সম্পাদক ইবন সুজায়ী লিখেছেন যে, ইবন বতুতা ১৩০৪ খ্রীষ্টাব্দে তানজানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু পরবর্তী কালে লিখিত ইবন বতুতার একখানি সংক্ষিপ্ত জীবনী গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি ১৩৬৮ খ্রীষ্টাব্দে অথবা তার পরবর্তী বছরে মরক্কোর ইনতিকাল করেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিলো মুহম্মল-বিন আবদুল্লাহ।
— ড. কাজী দীন মুহম্মদ
.
‘IBNE BATUTAR SAFARNAMA” (The Adventures of Ibn Battuta). Bengali translaed by Mohammad Nasir Ali. 1st Published: Bangla Academy, 1968. This New Edition Published by : Shosovon Eftakher Sawon on be-half of Drupad Sahityangan. 46 Banglabazar, Dhaka-1100. Drupad First Published: February 2014.
.
প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক মোহাম্মদ নাসির আলীর জন্ম ১০ জানুয়ারি ১৯১০ সালে বিক্রমপুরে। পড়াশোনা করেছেন তেলিরবাগ কালীমোহন দূর্গামোহন ইনস্টিটিউশনে। এন্ট্রান্স পাস করেছেন ১৯২৬ সালে স্বর্ণপদক সহ। পরবর্তীতে পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
চাকরি জীবনের শুরু অবিভক্ত ভারতের কোলকাতা হাইকোর্টে। ‘৪৭ পরবর্তী সময়ে একই সাথে প্রকাশনা ও ঢাকা হাইকোর্টে চাকরি করেছেন। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নওরোজ কিতাবিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা অংশীদার।
শিশু সাহিত্যের উপর প্রবর্তিত প্রায় সবগুলো পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এরমধ্যে ইউনেস্কো, বাংলা একাডেমী, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, ইউনাইটেড ব্যাংক, লাইব্রেরী অব কংগ্রেস, যুক্তরাষ্ট্র, ইসলামিক ফাউন্ডেশন উল্লেখযোগ্য।
অধুনালুপ্ত দৈনিক আজাদ পত্রিকার ‘মুকুলের মহফিল’ শিশু বিভাগের প্রধান হিসেবে ‘বাকবান’ নামে সমধিক পরিচিত। ফটোগ্রাফি, সেলাইকর্ম, রবীন্দ্র-নজরুল সংগীতের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ৩০ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
.
বাংলা একডেমীর প্রাক্তন পরিচালকের প্রসংগ কথা
ইবনে বতুতার সফরনামা একখানা মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিলস্বরূপ। এ গ্রন্থের প্রকৃত মূল্য নিরূপণ করতে হলে ইবনে বতুতার জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা থাকা বাঞ্চনীয়। মধ্যযুগের মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে ইবনে বতুতার চরিত্র সব চাইতে জীবন্ত। তিনি তার সফরনামার মধ্যে দোষে-গুণে মন্ডিত নিজের এবং সমসাময়িক যুগের যে চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, তা সে যুগের অবক্ষয় থেকে উদ্ধার প্রাপ্ত পূর্ণাঙ্গ যুগ-মানসেরই প্রতিচ্ছবি। তবে এ কথাও ঠিক যে, ইবনে বতুতার সফরনামায় তার ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে খুব অল্প কথাই জানা যায়। তাঁর গ্রন্থের সম্পাদক ইবনে জুজায়ী লিখেছেন যে, ইবনে বতুতা ১৩০৪ খ্রীষ্টাব্দে তানজিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে লিখিত ইবনে বতুতার একখানি সংক্ষিপ্ত জীবনী গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি ১৩৬৮ খ্রীষ্টাব্দে অথবা তার পরবর্তী বছরে মরোক্কয় ইন্তিকাল করেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিলো মুহম্মদ-বিন-আবদুল্লাহ্।
ইবনে বতুতার চরিত্রে প্রকৃত ইসলামী বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছিল। ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধও ছিলো অপরিসীম। ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের প্রতি তার আকর্ষণ ছিলো বলেই বাইশ বছর বয়সে তিনি সফরের উদ্দেশ্যে জন্মভূমি তাঞ্জির ত্যাগ করেন। সফরকালে তিনি বিভিন্ন দেশের ভৌগলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি বিষয়ে যে সব মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করেন তারই ফলশ্রুতি ইবনে বতুতার সফরনামা। তবে এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নাই যে, চতুর্দশ শতাব্দীর মুসলিম সমাজ সম্বন্ধে একটা বিস্তৃত বিবরণ প্রদান করাই ছিলো গ্রন্থখানা রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য। ইবনে বতুতার এ উদ্দেশ্যও সফল হয়েছে। বাংলা ভাষাভাষী পাঠক সাধারণও ইবনে বতুতার সফরনামা পাঠ করে নিজেদের কৌতূহল মেটাতে সক্ষম হবেন মনে করে বাংলা ভাষায় গ্রন্থখানির অনুবাদ প্রকাশ করা হলো।
ড. কাজী দীন মুহম্মদ
পরিচালক, বাংলা একাডেমী
৭ই অক্টোবর ১৯৬৮
.
ধ্রুপদ মুদ্রণ প্রসংগ কথা
‘ইবনে বতুতার সফরনামা’ একটি মূল্যবান এবং ঐতিহাসিক দলিল গ্রন্থ। গ্রন্থটি একবার মাত্র প্রকাশিত হয়েছিলো পাকিস্তানি শাসনামলে–বাংলা একডেমী থেকে। আমরা বিভিন্ন সময় একাডেমীর পরিবর্তনশীল পদ মহাপরিচালকের কাছে গ্রন্থটির খোঁজ চেয়েছি-মুদ্রণের অনুরোধ করেছি কিন্তু ওখানে যা হয় তাই হয়েছে। অনেক নামী-দামী লেখক, গবেষক শুধুমাত্র দাপ্তরিক জটিলতার জন্য তাঁদের বই তুলে নিয়েছেন এবং বেসরকারী প্রকাশকদের দিনে মুদ্রণের জন্য।
গ্রন্থটি প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক মরহুম মোহাম্মদ নাসির আলী’-র পরিবারের পক্ষ বাংলা একাডেমী থেকে তুলে জ্যোৎস্না পাবলিশার্সের স্বত্বাধিকারী সুহৃদ স্বপন দত্তকে মুদ্রণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে–খুব কম সময়ে এতো বিরাট বিশাল গ্রন্থটি প্রকাশ করে স্বপন দত্ত আমাদের কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করলেন।
অতি অল্প সময়ের মধ্যে ‘ইবনে বতুতার সফরনামা’ প্রথম মুদ্রণ পাঠকপ্রিয়তায় শেষ হয়ে যাওয়ায় আমরা পাঠক ও প্রকাশকের কাছে কৃতজ্ঞ।
আজ গ্রন্থটি ধ্রুপদ সাহিত্যাঙ্গন থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। আমি বলি, কথাটা আত্মঅহমিকা হলেও বলি-বাজারে ২/৪টি ‘ইবনে বতুতার সফরনামা’র ভারতীয় গ্রন্থের পাইরেট মুদ্রণ পাওয়া যাচ্ছে–তবে বাংলা অনুবাদ যা-কিছু তার মধ্যে এটিই সবচাইতে সহজ-সরল উত্তম এবং পূর্ণাঙ্গ-পাঠকবৃন্দ সেটি বুঝতে পারায় আমরা আবারও কৃতজ্ঞতা জানাই।
আশাকরি ভ্রমণ পিপাসু ইতিহাস-প্রিয় ও স্বশিক্ষিত পাঠকবৃন্দের কাছে বইটি ভালো লাগবে।
জর্জ
০১-০১-২০১৪
.
অবতরণিকা
বর্তমান দুনিয়ার কাছে মধ্যযুগীয় খ্রীস্টান সভ্যতার সময়কার মানুষকে মনে হয় অতি দূরবর্তী ও একান্ত অবাস্তব বলে। তাদের নাম ও কার্যকলাপের কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে আমাদের ইতিহাসের পাতায়, তাদের গঠিত স্মৃতিসৌধ আজও আমাদের নগরসমূহ সুশোভিত করছে। তবু তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কসূত্র আজ এত ক্ষীণ যে কিছুটা কল্পনার সাহায্য ব্যতীত তাদেরকে বুঝবার উপায় নেই। সে তুলনায় বিরাট মুসলিম সভ্যতার প্রভাব সম্যক উপলব্ধি করতে হলে কল্পনার সহায়তা যে বহুগুণ বেশি প্রয়োজন তা বলাই বাহুল্য। যদিও সে যুগের মুসলিম সভ্যতা মধ্যযুগীয় ইউরোপের উপর প্রভাব বিস্তার করে তার অস্তিত্বকেই সঙ্কটাপন্ন করে তুলেছিল এবং শত বন্ধনে জড়িত থেকেও যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ভয়-ভীতি অগ্রাহ্য করে শত রকমে তার সঙ্গে গ্রন্থিবদ্ধ ছিল, তবু তা আজ আমাদের কল্পনার বিষয়বস্তু। যে সকল ভাগ্যবান লোক দেশভ্রমণে সক্ষম তারা আজও মুসলিম সভ্যতার স্মৃতিসৌধ সমূহ পরিদর্শন করতে পারেন; কিন্তু সে যুগের মানুষ ও তাদের আচার-ব্যবহার আজ আমাদের কাছে হয়তো সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অথবা মানসপটে ওঠা আরব্যরজনীর রহস্যময় দৃশ্যের মতই তা ক্ষীণ। এমনকি বিশেষজ্ঞদের পক্ষেও সে যুগের মানুষের জীবনযাত্রার প্রকৃত আলেখ্য উদ্ধার করা একটি সুকঠিন কাজ। ইতিহাস ও জীবনচরিত্রের বিশেষত্ব এবং অতীত যুগের নরনারীদের পুনরায় চোখের সামনে রূপায়িত করা সহজসাধ্য নয়। কিন্তু সুদূর অতীতের চরিত্র ও ঘটনাগুলিকে নিবিড় স্পর্শে জীবন্ত করে তোলার ভিতরেই রয়েছে ইবনে বতুতার বৈশিষ্ট্য।
মধ্যযুগের মুসলিম সভ্যতার পটভূমিতে জনমানুষের যে দৃশ্য আমাদের দৃষ্টির সামনে ভেসে ওঠে তার ভেতর ইবনে বতুতার নিজের চরিত্রটিই সবচেয়ে মূর্ত ও জীবন্ত। তার বর্ণনায় তিনি যে আমাদের চোখের সামনে নানা দোষ-গুণে মণ্ডিত নিজের একটি অবিকল প্রতিকৃতি তুলে ধরেছেন তা নয়, বরং মনে হয়, অতীতের পূর্ণাঙ্গ একটি যুগই যেন মৃতের জগৎ থেকে উদ্ধার পেয়ে জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠেছে আমাদের সামনে। ইবনে বতুতার এ সফরনামা ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিকগণের দ্বারা অফুরন্তভাবে ব্যবহৃত হয়েছে; কিন্তু তার এ গ্রন্থটি যে প্রধানতঃ মানবচরিত্রের একটি রোজনামচা বিশেষ এবং এতে যে ঘটনাবলীর বিবরণ দান বা তথ্য সগ্রহের স্পৃহার চেয়ে রোজনামচা লেখক ও তার শ্রোতাদের পছন্দ-অপছন্দকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বেশি এ কথাটি যে সমালোচনায় স্থান পায়নি সে সমালোচনা এখছের প্রকৃত মূল্য নিরূপণে আদৌ সক্ষম হয়েছে বলা যায় না। ইবনে বতুতার চরিত্রের যে রূপটি এ গ্রন্থের মাধ্যমে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে তার প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ-বোধ না করে পারা যায় না। তার চরিত্র ছিল বদান্যতার আতিশয্য। জীবনের মূল্যবোধ যে যুগে ছিল ন্যূনতম সে যুগেও তিনি ছিলেন মনুষ্যোচিত ভাবপূর্ণ দয়ালু নির্ভীক (মধ্যযুগের সফরকারীরা কি সমুদ্রকে কম ভয় করতেন?) আমোদপ্রিয় এবং কিছুটা স্ত্রৈণ। এসব সত্ত্বেও তার চরিত্রে পরিস্ফুট রয়েছে অটল ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মানুরাগ। মানবসুলভ পাপাচারের স্বাভাবিক বাসনা অন্তরে নিহিত থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একান্ত সদাচারী।
ইবনে বতুতার নিজের বর্ণনার বাইরে তার বাহ্যিক জীবন সম্বন্ধে আমরা খুবই কম জানতে পারি। তার সফরনামার সম্পাদক ইবনে জুজায়ী (Juzayy) লিখেছেন : ১৩০৪ খ্রীস্টাব্দের ২৪শে ফেব্রুয়ারী ইবনে বতুতা তানজিয়ারে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে লিখিত একখানা সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত গ্রন্থে দেখা যায় সফর হতে মরক্কোয় প্রত্যাবর্তনের পরে তিনি মরক্কোর কোন-কোন নগরে কাজী বা বিচারক নিযুক্ত হন। এবং পরলোক গমন করেন ১৩৬৮ খ্রীস্টাব্দে অথবা পরবর্তী বছরে। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মুহম্মদ বিন আবদুল্লাহ। ইবনে বতুতা ছিল তাঁর বংশগত পদবী যা আজও মরক্কোয় প্রচলিত দেখা যায়। তাদের এ বংশ কয়েক পুরুষ পূর্ব থেকেই তানজিয়ারে বসবাস। করছিলেন এবং তারা লুবাতার বারবার সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। এ সম্প্রদায়ের নাম প্রথমে ইতিহাসে স্থান পায় সাইরেনাইকা ও মিসরের সীমান্তবর্তী একটি যাযাবর জাতি হিসাবে।
দিল্লী নগরীতে কাজীর পদে নিযুক্ত হওয়ার কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন: তাঁদের বংশে বহুসংখ্যক কাজী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পরে তার বর্ণনার এক জায়গায় স্পেন দেশের রনদাহ নামক নগরে তার এক জ্ঞাতিভ্রাতার কাজী-পদে অধিষ্ঠানের উল্লেখ করেছেন। এসব দেখে তিনি উচ্চবংশীয় মুসলিম ধর্মানুরাগী সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন বললে অত্যুক্তি হবে না। তাছাড়া তিনি সাহিত্য ও ধর্মবিষয়ক বিশেষ শিক্ষায়ও নিশ্চয় শিক্ষিত ছিলেন। একস্থানে তিনি স্বরচিত একটি কবিতা উদ্ধৃত করেছেন, যদিও অন্যান্য স্থানে তার উদ্ধৃত কবিতাগুলি আরবী ভাষার উৎকৃষ্ট কবিতার নিদর্শন বলে গণ্য হবার যোগ্য নয়। তাঁর গ্রন্থের প্রায় প্রতি পৃষ্ঠায় ধর্মপ্রাণ মানুষ ও বিষয়ের প্রতি তাঁর অসামান্য আকর্ষণ আমরা লক্ষ্য করি। এ আকর্ষণ আরও পরিস্ফুট হয় তার ভ্রমণ পথের প্রতি শহরে বন্দরে তিনি যে সব কাজী ও ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ লোকের সঙ্গে দেখা করেছেন শুধু তাদের ফিরিস্তি দেখে (সময় সময় অন্য সব কিছুর বর্ণনা বাদ দিয়েও) এবং বিশেষ করে তার ভ্রমণপথের সর্বত্র প্রসিদ্ধ শেখ ও তাপসদের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ দেখে ও তাঁদের অলৌকিক অবদানের উচ্ছ্বাসপূর্ণ বর্ণনা শুনে।
সুতাং কতিপয় ইউরোপীয় পণ্ডিতের মতানুসরণ করে ইবনে বতুতাকে মুসলিম তাপস ও তত্ত্বজ্ঞানীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়া বা মুসলিম ধর্ম শাস্ত্রজ্ঞদের প্রতি ‘নির্বোধের’ মত আকৃষ্ট হওয়া এবং সফরকালে দৃষ্ট শহর ও স্থানের বিশদ বিবরণ দানে অবহেলার দোষে দোষারোপ করার প্রশ্ন একান্ত অপ্রাসঙ্গিক। ধর্ম বিষয়ক এসব পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণীতে তাঁর ও তাঁর শ্ৰেণীমণ্ডলীর প্রবল আগ্রহ ছিল। এমন কি আজ আমাদের কাছেও সে সব নিরর্থক বা মূল্যহীন নয়। অধিকন্তু এ সব বিবরণী থেকেই আমরা তার সবচেয়ে প্রাণবন্ত বর্ণনার পরিচয় পাই। কোয়েল (আধুনিক আলীগড়) হতে পলায়ন এবং শরীফ আবু ঘুররার বিবরণ এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।
এ কথা আমাদের স্মরণ রাখতেই হবে যে, তিনি নিজে একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন এবং ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল বলেই তিনি দেশভ্রমণে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এবং জীবনে তা সমাপনও করেছিলেন। মাত্র একুশ বছর বয়স্ক এক যুবক স্বল্প সম্বলের উপর নির্ভর করে চিত্তে যেদিন তার জন্মভূমি ত্যাগ করে সেদিন তার মনে একমাত্র অদম্য আকাঙ্ক্ষা ছিল মক্কায় হজব্রত পলন করা এবং অন্যান্য তীর্থস্থান দর্শন করা। সাধ্যায়ত্ত হলে সারাজীবনে অন্ততঃ একবার মক্কায় গিয়ে হত পালনের যে পবিত্র কর্তব্য প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর উপর ন্যস্ত রয়েছে তাই হল সর্বযুগে মুসলিমদের দেশ ভ্রমণের স্পৃহার চেয়ে বহুগুণে প্রবল। তার ফলে প্রত্যেক দেশের প্রত্যেক শ্রেণীর মুসলিমগণ যাতে তীর্থ ভ্রমণের এ পবিত্র কর্তব্য সম্পাদন করতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ কালে-কালে গড়ে উঠেছে। হজযাত্রীরা উটের কাফেলা নিয়ে যাত্রা করতেন এবং মঞ্জিলে-মঞ্জিলে যাত্রীর সংখ্যা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেত। যাত্রী তার যাত্রাপথের সর্বত্র এবং বিশ্রাম স্থানে সকল ব্যবস্থা পূর্বাহেই সম্পন্ন দেখতে পেত। যাত্রাপথ বিপদসঙ্কুল দেশের মধ্য দিয়ে হলে উটের কাফেলাগুলিকে সশস্ত্র বাহিনীর পাহারাধীনে জায়গায় পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা ছিল। সমস্ত বৃহৎ কেন্দ্রে এবং মধ্যবর্তী ক্ষুদ্রতর কেন্দ্রগুলিতে বিশ্রামাগার এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানাদির খরচে প্রতিষ্ঠিত মুসাফিরখানা ছিল। সে সব স্থানে তীর্থযাত্রীরা সাদর অভ্যর্থনা এবং বিনাব্যয়ে আহার ও সাময়িক আশ্রয় লাভ করত। এসব মুসাফিরখানার ব্যয় নির্বাহ হত দানশীল ব্যক্তিগণের বংশ-পরম্পরা দান করা সম্পত্তির আয় হতে। সাধারণ হজযাত্রীদের জন্যই যখন এসব সুব্যবস্থা ছিল তখন ধর্মতত্ত্বজ্ঞানী লোকদের জন্য ছিল আরও বিশেষ ব্যবস্থা। প্রত্যেক। শহরে তার মুসলিম ভ্রাতৃগণ তাকে আপনজন বলে সাদরে গ্রহণ করত, তার অভাব অভিযোগ পূরণ করত এবং পরবর্তী মঞ্জিলের লোকদের কাছে তার জন্য সুপারিশ করে পাঠাতে। এরূপ অনুকূল পরিস্থিতিতে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের–যার ভেতর বংশগত বা শ্ৰেণীগত কোন প্রভেদ নেই, পরাকাষ্ঠা সাধিত হয় এবং দেশ ভ্রমণের স্পৃহা জাগায়–তার তুলনা অন্য কোন যুগে কোন জাতির ইতিহাসে পরিলক্ষিত হয়নি।
একমাত্র হজযাত্রার মাধ্যমে যে দেশভ্রমণের পথ সুগম হত তা নয়। মধ্যযুগের প্রায় সব সময়েই এশিয়া ও আফ্রিকার বাণিজ্য পথসমূহ এবং ভারত মহাসাগরের সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রায় সবটাই ছিল মুসলিম ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের করতলগত। মুসলিম বণিকদের কর্মতৎপরতা যে কিরূপ ব্যাপক ছিল তা জানবার বহুবিধ উপায়ের মধ্যে ইবনে বতুতার সফরনামাও একটি উপায় মাত্র। অরাজকতার সময় সওদাগরদের পণ্যবাহী উটের কাফেলাগুলি হজযাত্রীদের কাফেলার চেয়ে অধিকতর বিপদের সম্মুখীন হলেও সাধারণ পথিকদের জন্য তাদের কাফেলা ছিল কিছুটা নিরাপদ। আমাদের। বিবরণী হতেই প্রমাণিত হয় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুসলিমদের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে সব সময়ে যে দয়া-দাক্ষিণ্যের পরিচয় পাওয়া যায় এ সব সওদাগরও তার ব্যতিক্রম ঘটতে দিতেন না। প্রয়োজনের সময় তারা তাদের সহযাত্রীদের সঙ্গে। নিজেদের খাদ্যসম্ভার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ভাগাভাগি করে নিতেন। পরবর্তীকালে ইবনে বতুতা এ-সকল মুসলিম বণিকের বদান্যের কথা একাধিকবার উল্লেখ করেছেন; কিন্তু যাত্রার শুরুতে নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তাঁর কোন ধারণাই ছিল না।
ইবনে বতুতা যখন মিসরে উপনীত হন তার মন আকৃষ্ট ছিল মক্কার পূণ্যভূমির দিকে, এখানে এসেই তিনি সর্বপ্রথম নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে পূর্বাভাস পান দু’জন তাপসের নিকট থেকে। এ-সময় থেকেই তার অস্পষ্ট ও ক্ষীণ অভিলাষগুলি স্পষ্টতর রূপ। পরিগ্রহ করে সুনির্দিষ্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়। যদিও সময়-সময় তিনি ইতস্ততঃ করতেন তবু সাধু ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে তার মনের সহজতা খোদাভক্তির উৎস সজাগ হয়ে উঠত। পশ্চিম থেকে হজযাত্রীদের সাধারণ পথ ছিল উত্তর মিসরের মধ্য দিয়ে। সে পথে সরাসরি মক্কা গমণের প্রথম ইচ্ছা ব্যর্থ হওয়ায় তিনি মত পরিবর্তন। করেন এবং দামেস্কের হজযাত্রী কাফেলার সঙ্গে মক্কা রওয়ানা হতে মনস্থ করেন। দামেস্ক যাবার পথেই সর্বপ্রথম তিনি দেশ ভ্রমণের অনাবিল আনন্দের আস্বাদ গ্রহণ করেন। সময়ের কোন অপ্রতুলতা ছিল না বলে দামেস্কে এসে হজযাত্রীদের সঙ্গে মিলিত হবার পূর্বেই তিন নিশ্চিত মনে সমগ্র সিরিয়া দেশ পরিভ্রমণ করে এশিয়া মাইনরের সীমান্ত পর্যন্ত অগ্রসর হন।
মক্কায় প্রথম বার হজ যাপনের সঙ্গে-সঙ্গে তিনি পুনরায় যাত্রা করেন ইরাক পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে; কিন্তু বাগদাদ পৌঁছবার পূর্বেই অন্য পথ ধরে খুজিস্তানের মধ্যে তিনি দীর্ঘপথ পরিভ্রমণ করেন। তিনি বলেছেন, এ সময়ে তিনি যতটা সম্ভব এক জায়গায় একাধিকার গমন করবেন না বলে স্থির করেন। তাঁর মনে তখনও পুনর্বার। হজব্রত পালনের আকাঙ্ক্ষা প্রবল ছিল এবং তিনি স্থির করেন বছরের শেষে পুনরায় মক্কায় প্রত্যাবর্তনের পূর্বাকাল পর্যন্ত তিনি দেশভ্রমণেই কাটাবেন। এ-সময়ে তিনি তিন বছর কালের জন্য দেশভ্রমণ স্থগিত রাখেন এবং বিদ্যাচর্চায় ও ধর্মালোচনায় লিপ্ত থেকে মক্কায় বাস করেন। ধর্ম শাস্ত্রজ্ঞদের কাছে হজব্রত পালন যে মুসলমানদের অন্যতম অবশ্য পালনীয় কর্তব্য শুধু তাই নয়, বরং তারা হজের মাধ্যমেই ইসলাম ধর্মের প্রাণকেন্দ্রের বহুবিধ কর্মতৎপরতার সঙ্গে নিবিড় পরিচয়ের সুযোগ লাভ করেন। তখনকার মক্কা ছিল জ্ঞানী ও সুধীজনের সংস্রবে বাস করে জ্ঞানচর্চার একটি আদর্শ। কেন্দ্রস্থল। এ সকলের চিন্তা যে ইবনে বতুতার মনেও ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এছাড়া অন্য উদ্দেশ্যের কথাও আমরা ভাবতে পারি। মক্কায় অবস্থানকাই তিনি ভাগ্যান্বেষণে ভারতবর্ষের দিকে রওয়ানা হবেন বলে স্থির করেন। তখনকার দিল্লীর সুলতানের অসীম বদান্যতা স্বভাবতঃই বিভিন্ন দেশের পণ্ডিত ও শাস্ত্রজ্ঞ লোকদের আকর্ষণ করত। মক্কায় কয়েক বছর অবস্থানের ফলে তার পদমর্যাদা বৃদ্ধি পাবে, সাধারণভাবে যে পদ তিনি পেতে পারেন তার চেয়ে উচ্চপদ লাভ করবেন এই ছিল ইবনে বতুতার মনের আকাঙ্ক্ষা।
মক্কায় কয়েক বছরের অধ্যয়নকাল কাটিয়ে তিনি সঙ্গী-সাথী সহ আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের বাণিজ্যকেন্দ্রগুলি ভ্রমণ করতে বের হন এবং পূর্বের মতই মক্কায় ফিরে আসেন। অতঃপর পবিত্র মক্কা নগরী পশ্চাতে রেখে তিনি ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন; কিন্তু প্রথমে তিনি যেরূপ অনুমান করেছিলেন তার যাত্রাপথ তার চেয়ে দীর্ঘতর ও বিপদ সঙ্কুল হয়। জেদ্দা পৌঁছে তিনি দেখতে পান সেখানে ভারত গমনের জন্য কোন জাহাজ প্রস্তুত নেই। ফলে কোন এক অদৃশ্য শক্তির তাড়নায়ই উত্তরাভিমুখে চলতে আরম্ভ করেন এবং এখান থেকেই আরম্ভ হয় তাঁর বিখ্যাত ভ্রমণ। এশিয়া মাইনরের বিভিন্ন শহরের মধ্য দিয়ে ভ্রমণকালে তিনি বিপুল সমাদর লাভ করেন স্থানীয় মুসলমানগণের দ্বারা। অতঃপর কৃষ্ণসাগর পার হয়ে তিনি প্রবেশ করেন মঙ্গল খাঁর রাজ্যে। কনস্টান্টিনোপল দেখবার সুযোগ লাভ করে এবং মধ্যএশিয়া তৃণভূমি অঞ্চল পাড়ি দিয়ে তিনি খোরাসান পৌঁছেন। এ-সময় হতে তার খ্যাতি-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে পরিচিত হন। তাঁর শিষ্য ও অনুগামীদের সংখ্যা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তার ধন-সম্পদ ও এ-সময়ে এত বৃদ্ধি পেতে থাকে যে, তিনি এক। জায়গায় বলেছেন : আমার সঙ্গে আমার অশ্বের সংখ্যা এত বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, তা উল্লেখ করতে আমি সাহস করতাম না– পাছে সন্দেহপ্রবণ লোকেরা আমার কথা অবিশ্বাস করে।
এভাবে অবশেষে তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পথে ভারতে এসে হাজির হন এবং বিশেষ শান-শওকতের সঙ্গে তাকে দিল্লীতে অভ্যর্থনা জানান হয়। দিল্লীতে তিনি বাদশাহের বিশেষ আগ্রহ ও সাহায্য লাভ করেন এবং উচ্চ বেতনে দিল্লীর মালিকাইত কাজীর পদে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু এতে তার বৈশিষ্ট্যের কিছুই প্রকাশ পায়নি। কারণ, অনেকের ভেতর তিনিও একজন কাজী মাত্র ছিলেন। কাজীর উক্ত পদে ইবনে বতুতা সুদীর্ঘ সাত বৎসর কাল অধিষ্ঠিত ছিলেন। দিল্লী অবস্থান কালে কখনও-কখনও তিনি বাদশাহের সমরাভিযানের সাথী হতেন, কখনও দরবারে নিজ কার্যে বহাল অবস্থায় পারিপার্শ্বিক অবস্থার খুঁটিনাটি বিষয়সমূহ মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করতেন। পরবর্তীকালে তাঁর সেই অভিজ্ঞতার যে বিচিত্র বর্ণনা দান করেন তা মধ্যযুগীয় যে কোন মুসলিম দরবারের বর্ণনার চেয়ে বহুগুণে গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন স্বয়ং সুলতান বা তার আমীর ওমরাহ্ কি ভাবতে পেরেছিলেন যে ষষ্ঠ শতাব্দী কাল পরে তাদের খ্যাতি-অখ্যাতি নির্ভর করবে পশ্চিম দেশীয় একজন অজ্ঞাতনামা অমিতব্যয়ী কাজীর ক্ষুদ্র স্মারকলিপি ও স্মৃতিকথার উপর? অবশেষে একদিন শাহী দরবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে ফাটল ধরল। রাজরোষের অশুভ ফলাফল স্বভাবতঃই হয় দ্রুত এবং মর্মান্তিক।
ইবনে বতুতা তাঁর সমস্ত ধন-সম্পদ ও চাকরি বর্জন করে শেষ অবলম্বন স্বরূপ বেছে নিলেন দরবেশের জীবন যাপন। পার্থিব জগতের প্রতি তার এ নির্লিপ্ততা ছিল অকৃত্রিম। মধ্যযুগের ধর্মতত্ত্ব-জ্ঞানিগণ জগতের প্রতি এ নির্লিপ্ততাকে বিশেষভাবেই পছন্দ করতেন। ঘটনাদৃষ্টে মনে হয়, সুলতান মুহম্মদ ইবনে বতুতাঁর অকৃত্রিম সততা ও ধর্মনীতির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। কেন না কিছুদিন পরেই যখন রাষ্ট্রদূত হিসাবে চীনে প্রেরণের জন্য একজন বিশ্বস্ত লোকের প্রয়োজন হল, তখন সুলতান ডেকে পাঠালেন ইবনে বতুতাকে। ইবনে বতুতা এক রকম অনিচ্ছার সঙ্গেই দরবেশী খেরকা পরিত্যাগ করে পুনরায় ‘পার্থিব জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন।’ কিন্তু এ-কাজে সম্মত করার জন্য যে উৎকোচ তাঁকে দেওয়া হয়েছিল তার মূল্যও কম ছিল না। প্রায় রাজকীয় জাঁকজমকের সহিত ১৩৪২ খ্রীস্টাব্দে সে আমলের পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক মুগল সম্রাটের দরবারে ইবনে বতুতাকে পাঠানো হল।
দিল্লী শহরের প্রাচীরের বাইরে পা বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় নানা রকম বিপদ আপদ। পলাতক বলে তাকে ধরবার জন্য ক্রমাগত আট দিন অবধি তার পশ্চাদ্ধাবন করা হয়। শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যদিও তিনি তার দলের সঙ্গে মিলিত হতে সমর্থ হন, তখন তার পরিধেয় বস্ত্র ও জায়নামাজ ছাড়া কালিকটের উপকূলে পৌঁছে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। এ অবস্থায় মিশনে যাওয়া সম্ভব পর নয়। এদিকে দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করলেও সুলতানের রোষে পতিত হবার সমূহ সম্ভাবনা। তার পরিবর্তে তিনি মালাবার উপকূলে দেশীয় স্বাধীন রাজদরবারে ভাগ্য পরীক্ষা করতে মনস্থ করলেন এবং মালদ্বীপপুঞ্জ উপস্থিত হয়ে অচিরেই সেখানকার কাজী পদে বহাল হয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য হলেন। প্রায় আঠার মাস কাল আলস্যে সময় কাটানোর পর সংস্কারমূলক কার্যে অতিরিক্ত উৎসাহ দেখাবার ফলে কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি বিরাগ ও সন্দেহভাজন হয়ে ওঠেন। তখন সে দ্বীপ ত্যাগ করে অন্যত্র যাওয়া তার পক্ষে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তার অন্তরে যে সর্বত্যাগী তাপসের মূর্তি ছিল সে যেনো আবার জেগে উঠল। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য হলো সিংহলের সর্বোচ্চ পর্বত শিখরে অবস্থিত আদমের কদম মোবারক জেয়ারত করা। সে কাজ সমাধা করে তিনি পুনরায় ফিরে এলেন করমণ্ডল ও মালাবার উপকূলে এবং স্বল্পকালের জন্য মালদ্বীপে পুনরায় গমন করে চীন যাত্রার জন্য একাগ্রভাবে প্রস্তুত হতে থাকেন।
সমুদ্র যাত্রার পথে অনুকূল আবহাওয়া শুরু হতে তখনও কিছু বিলম্ব ছিল। এ সময় তিনি সদ্র পথে বাংলাদেশ সফর করবেন, মনস্থ করলেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় তার। এ সফরের উদ্দেশ্য ছিল আসামবাসী একজন প্রসিদ্ধ শেখের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। অতঃপর তিনি সুমাত্রা থেকে চীনগামী জাহাজে আরোহণ করেন। এসব জাহাজের মালিক ছিলেন মুসলমান সওদাগরেরা। জাহাজের খালাসীরা ছিল মালয় ও চীনের অধিবাসী। ইবনে। বতুতার সফরনামা ব্যাখ্যাকারীদের মতে তিনি ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীর চীনের ‘সাংহাই’ অবধি গমন করেন। সাংহাই বন্দর তখন বিদেশী বণিকদের কাছে শওয়ান চৌ-ফু বা জয়তুন নামে পরিচিত ছিল। এই সফরকালে ইবনে বতুতা রাজদূতের ভূমিকা গ্রহণ করেন। আজ আমাদের কাছে অবশ্যই কিছুটা অদ্ভুত বলে মনে হবে যে দূতাবাস ও পরিচয়বিহীন এ রাজদূতকে কেউ কোন সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন নি। চীনের ভেতর দিয়ে তিনি যাতে অবাধে অগ্রসর হতে পারেন সেজন্য রাজদূতের ভূমিকা ছিল তাঁর একটি কৌশল মাত্র। অবশ্য চীনের বাণিজ্য বন্দরগুলিতে তার স্বধর্মী মুসলমানদের কাছে। ধর্মতত্ত্বজ্ঞ হিসাবে তার খ্যাতি এ-কাজে যথেষ্ট সহায়ক ছিল। পিকিং যাতায়াতের পথে প্রতি শহরে তিনি বিপুল সম্বর্ধনা লাভ করেন। কিন্তু পিকিং পৌঁছে সম্রাটের অনুপস্থিতির দরুন তার সাক্ষাতে বঞ্চিত হয়ে তিনি কিছুটা হতাশ হন।
জয়তুনে ফিরে তিনি পুনরায় সুমাত্রার জাহাজে আরোহণ করেন এবং সেখান থেকে যাত্রা করেন মালাবার। এবারে তিনি দিল্লীর মায়াময় শান-শওকতে পুনরায় প্রলুব্ধ হতে যাবেন না বলে স্থির করেন এবং পশ্চিমাভিমুখে অগ্রসর হতে থাকেন। ১৩৪৮ খ্রীস্টাব্দে প্রথমবার যখন সিরিয়ায় কালা মড়ক আরম্ভ হয় তখন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কয়েকটি মাত্র বাক্যে তিনি সে মড়কের ভয়াবহতার একটি পরিচয় ফুটিয়ে তুলেছেন। এ সময়ে ভবিষ্যতের জন্য তার কোন পরিকল্পনা স্থির করা ছিল না। তিনি তখন তাঁর। সপ্তম বারের হজ সমাপনের চিন্তাই শুধু করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি কারণে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন তা বুঝা যায় না। তার প্রত্যাবর্তনের কারণস্বরূপ নিজের। বিবরণে তিনি তদানীন্তন সুলতান আবু হাসান ও তার পুত্র আবু ইনানের অধীনে মরক্কোর দ্রুত উন্নতি ও শক্তিশালী হওয়ার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় তার প্রত্যাবর্তনের কারণ পরিজনের প্রতি আকর্ষণই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। সম্ভবতঃ অতিরঞ্জন ও চাটুকারিতার অংশ বাদ দিয়া তার কথায় আমাদের বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। কিন্তু তানজিয়ারে তাঁর স্বল্পকাল অবস্থিতি এবং যেমন ভাবলেশহীনভাবে তিনি সে বিষয় উল্লেখ করেছেন তাতে তিনি যে গৃহে প্রত্যাবর্তনের জন্য কিছুমাত্র কাতর ছিলেন তা আদৌ ভাবা যায় না। মধ্যযুগের ইসলামের সেই বিশ্বনাগরিক সমাজ বন্ধনের দিনে ইবনে বতুতার গৃহাভিমুখী হওয়ার বিশেষ কারণও ছিল না।
আলেকজান্দ্রিয়া থেকে রাব্বারি উপকূল অবধি সফর নিরাপদ ছিল না। দু’বার তিনি খ্রীস্টান সৈন্যদের কবলে পড়তে পড়তে কোনক্রমে রক্ষা পান এবং প্রায় ফেজের কাছাকাছি গিয়ে তার কাফেলা একদল দস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু তবু তার আকাভক্ষার নিবৃত্তি হয়নি। তখনও দুইটি মুসলিম রাষ্ট্র-আন্দালুসিয়া ও নাইজার নদীর তীরস্থ নিগ্রো দেশ তার সফর করা হয়নি। কাজেই পুনরায় তিনি তার ভ্রমণের যষ্টি হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লেন এবং তিন বছরকালের মধ্যে যে পর্যন্ত না ন্যায়ত ‘ইসলামের সফরকারী’ আখ্যায় আখ্যায়িত হলেন সে পর্যন্ত যষ্টি হাত থেকে নামালেন না। প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন মধ্যযুগের একমাত্র সফরকারী যিনি তৎকালীন মুসলিম শাসিত সব দেশ তো সফর করেছেনই, অধিকন্তু সফর করেছেন বিধর্মীদের দেশ কনস্টান্টিনোপল, সিংহল ও চীন। মিঃ ইউল নির্ণয় করেছেন, ইবনে বতুতা কমপক্ষে ৭৫ হাজার মাইল পরিভ্রমণ করেছেন। বাষ্পীয় যান আবিস্কারের আগে কারও পক্ষেই এত দীর্ঘপথ পরিভ্রমন সম্ভব হয়নি।
দুঃখের বিষয়, সেকালে সফরকালে যারা তাঁকে দেখেছেন এমন কারও বিবরণ, যতদূর জানা যায়, আজ পর্যন্ত আমরা পাইনি। তাঁর সমসাময়িক লেখকদের লেখায় মাত্র দু’টি স্থানে তার বিষয়ে উল্লেখ দেখা যায়। সে উল্লেখও আবার তার বক্তব্যের সত্যতা সম্বন্ধে বিতর্কতামূলক। ব্যক্তিগতভাবে ইবনে বতুতার প্রতি তাদের ধারণা কিরূপ ছিল তা আমরা জানতে পারি না; কিন্তু তাঁর নিজের অকপট বিবৃতি থেকে আমরা তার সম্বন্ধে একটা ধারণা করে নিতে পারি। আমরা দু’বার একবার দিল্লীতে এবং আরেকবার মালদ্বীপে, বিপুল সম্বর্ধনা পেয়েও– ইবনে বতুতাকে বিরাগ ও সন্দেহভাজন হতে দেখি। তার প্রথম কারণ ছিল তাঁর অসামান্য অপব্যয়িতা এবং দ্বিতীয় কারণ ছিল তার ক্রমবর্ধমান প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং স্বাধীনচেতা মতবাদ। এ-বিষয়ে কোন সন্দেহই। নেই যে, ইবনে বতুতা চাইতেন, রাজ-রাজড়া ও উজির হবেন অতিমাত্রায় দানশীল ও বদান্য। তাদের পক্ষে দিল-দরাজী ও দস্তদরাজীই হবে লোকের চোখে তাঁদের সম্মান লাভের যোগ্যতার মাপকাঠি। ইবনে বতুতা কোন সুলতান সম্বন্ধে যখন বলেছেন, তিনি ভাল সুলতান বা ভাল শাসনকর্তাদের একজন, তখনই বুঝে নিতে হবে, সে সুলতান ধর্মীয় বিধানসমূহ যথাযথ পালন করেন এবং বিশেষ করে ধর্মতত্ত্বজ্ঞ লোকদের প্রতি। তিনি মুক্তহস্ত। আমরা সহজেই বুঝতে পারি তাঁর এ মনোভাব তাঁর পৃষ্ঠপোষকদের বিরক্তির উদ্রেক করেছিল, ফলে অপ্রীতিকর ঘটনা অথবা পরস্পরের প্রতি বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করেছিল। এ ধরনের দু’একটি ঘটনা বাদ দিয়ে ইবনে বতুতা যেখানেই পদার্পণ করেছেন সেখানেই পেয়েছেন বিপুল সমাদর ও সম্মান।
ইবনে বতুতার সফরনামার প্রকৃত মূল্য নিরূপণ করতে গেলে অবশ্যই তাঁর গ্রন্থটির মোটামুটি বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন। যে-সব জায়গা তিনি পরিভ্রমণ করেছেন সে-সব জায়গার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হয়তো তিনি লিখে রেখেছিলেন। কিন্তু প্রমাণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, তেমন কিছুই তিনি করেননি। সুদীর্ঘ ভ্রমণ কাহিনীর মাত্র একটি স্থানে তার কিছু লিপিবদ্ধ করে রাখার উল্লেখ দেখা যায়। তিনি বলেছেন, বোখারা সফরকালে সেখানকার জ্ঞানী ব্যক্তিদের কবরের উপরস্থ প্রস্তর ফলকের লেখাগুলি তিনি নকল করে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে যখন ভারতীয় জলদস্যুরা তার যথাসর্বস্ব লুণ্ঠন করে তখন সেগুলিও হারিয়ে যায়। কবরের প্রস্তর ফলকে উত্তীর্ণ লেখাগুলি পণ্ডিত ও ধর্মপ্রাণ। লোকদের কাছে আকর্ষণের বন্ধু ছিল, কারণ, ঐগুলি ছিল পরলোকগত লোকদের লেখার তালিকা। ইবনে বতুতা নিজে লেখক ছিলেন না এবং তার অভিজ্ঞতার বিবরণী যে একটি গ্রন্থের বিষয়বস্তু হতে পারে তাও তিনি ধারণা করেননি। মনে হয় তিনি সেগুলি লিপিবদ্ধ করার কথাও চিন্তা করেননি।
ফেজ শহরে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি তাঁর অভিযানের বিষয় সুলতানের ও তার দরবারের লোকদের নিকট বর্ণনা করেন। ইবনে বতুতার সমসাময়িক বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে খলদুনের গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই, তাঁর বর্ণিত কাহিনীর অধিকাংশই অবিশ্বাস্য বলে গণ্য হয়েছিল। কিন্তু দরবারের ক্ষমতাশালী উজিরের সমর্থন তিনি পেয়েছিলেন এবং উজিরের পরামর্শ মতই সুলতান তার অন্যতম প্রধান কর্মাধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইবনে জুজায়ীকে সেগুলি লিপিবদ্ধ করে রাখতে আদেশ দেন। তখন ইবনে বতুতার বর্ণনানুযায়ী ইবনে জুজায়ী এ-গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তার ফলে বিভিন্ন উপাদানে সমৃদ্ধ এ-গ্রন্থখানা আমরা পেয়েছি। লেখক কিন্তু সর্বদা ইবনে বতুতার বর্ণিত বিষয় অবিকল লিপিবদ্ধ করে সন্তুষ্ট হননি। প্রতিটি বিদেশী নামের সঠিক উচ্চারণ তিনি বিশেষ যত্নে লিখে নিতেন। আরবী হরফের বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য করলে বিদেশী এই নামগুলির সঠিক উচ্চারণ লিপিবদ্ধ করা একটি গুরত্বপূর্ণ কাজ বলেই গণ্য হবে। কিন্তু অন্যান্য কয়েকটি ব্যাপারে ইবনে জুজায়ীর গ্রন্থ সম্পাদন পদ্ধতি সমালোচনার উর্ধ্বে নহে। তার নিজ উক্তি হতেই জানা যায় যে, গ্রন্থটি সংক্ষেপ করা হয়েছে। সম্ভবতঃ গ্রহের শেষ পর্যায়ে দু’একটি অংশ সংক্ষিপ্ত হবার এই কারণ। কোন-কোন স্থানে সামান্য পরিবর্তন ছাড়া ভ্রমণ বৃত্তান্তের অধিকাংশই বিবৃতি-দানকারীর কথা সরল ও সহজ। ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। যুগোপযোগী ও রুচিসম্মত করার উদ্দেশ্যে ইবনে জুজায়ী মার্জিত ভাষা ব্যবহার ও কবিতাংশ উদ্ধৃত করে বিবৃতিটিকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতে সফলকাম হননি। স্বীয় অভিজ্ঞতার বর্ণনা দান কালে ইবনে বতুতা যদি অন্য কোন বিষয়ের অবতারণা করে থাকেন তবে তা বরং ক্ষমার যোগ্য, কিন্তু অনন্যর বেলায় অনুরূপ কার্য সমর্থনযোগ্য নয়। প্রমণ বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করার সময় তার সম্মুখে ছিল দ্বাদশ শতাব্দীতে মিসর, হিজাজ ও সিরিয়া ভ্রমণকারী আন্দালুসিয়ার পণ্ডিত ইবনে জুবাইয়ের ভ্রমণ বিবরণী। পাশ্চাত্য জগতে সে গ্রন্থখানা বিশেষ সমাদর লাভ করেছিল। যে-সব স্থান ইবনে বতুতা ও ইবনে জুবাইর উভয়েই ভ্রমণ করেছেন সে-সব স্থানের বিবরণ করতে গিয়ে ইবনে জুজায়ী ইবনে জুবাইয়ের ভ্রমণ বিবরণী থেকে অকৃপণভাবে সংক্ষিপ্তাকারে নকল করেছেন। বিশেষ করে হজের সময় এবং বছরের অন্যান্য সময় যেসব অনুষ্ঠান পালন করা হয় তার বিবরণসমূহ ইবনে জুবাইয়ের গ্রন্থ হতে নেওয়া হয়েছে। সম্ভবতঃ ইবনে বতুতার অনুমোদন ক্রমেই এ-কাজ করা হয়েছে। কাজেই আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ইবনে বতুতার গ্রন্থের সম্পূর্ণটা তাঁর নিজের বর্ণনা নয়। বিশেষ করে পারস্য ভাষা থেকে অনূদিত বাক্যাংশ দেখে মনে হয় আমাদের সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থকার তাঁর গ্রন্থখানা পাঠ করে দেখেননি অথবা পাঠ করে থাকলেও যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেননি।
গ্রন্থখানা সমগ্রভাবে বিচার করে দেখলে আমরা অবশ্যই স্বীকার করব যে, চতুর্দশ শতাব্দীর দ্বিতীয় চতুর্থাংশের মুসলিম সমাজ সম্বন্ধে একটি বিস্তৃত বিবরণ দানই ছিল এ গ্রন্থ রচনার মূল উদ্দেশ্য। আমরা একাধিকবার লক্ষ্য করেছি যে, কোন বিশেষ স্থানের চেয়ে ব্যক্তিবিশেষের প্রতিই ইবনে বতুতার আকর্ষণ ছিল সমধিক। তাঁর বিবেচনায় ভূগোলের চেয়ে সব সময়েই মানুষ ছিল বড়। তাঁর ভৌগোলিক জ্ঞান বলতে ছিল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও দৈবক্রমে পরিচিত লোকদের কাছে সংগৃহীত সংবাদ। কোন বিষয়ের বিস্তৃত বিবরণ দিতে হলেই তিনি নির্ভর করতেন স্মৃতিশক্তির উপর। ধর্মতত্ত্ব শিক্ষার প্রচলিত সাধারণ পদ্ধতির মাধ্যমে তাঁর স্মৃতিশক্তিও বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করেছিল। বেশ কিছুসংখ্যক পুস্তক কণ্ঠস্থ করণই ছিল শিক্ষার পদ্ধতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইবনে বতুতার বর্ণনায় ভুলভ্রান্তির অবকাশও ছিল যথেষ্ট। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমনের ধারাবাহিক বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি পরের বিবরণ পূর্বে এবং পূর্বের বিবরণ পরে দিয়েছেন। দু’বার এমনও হয়েছে যে তিনি যেন নিজেকে হাওয়ার মধ্যে ছেড়ে দিয়েছেন- শত শত মাইল পরিভ্রমণের কোন বিবরণই তিনি দেননি। কোন-কোন স্থানে তিনি ভুল নাম উল্লেখ করেছেন, বিশেষ করে ভুল করেছেন অমুসলমান দেশের বিবরণ দিতে গিয়ে। কারণ, ঐ সব স্থানে তার আরবী ও ফারসী ভাষার জ্ঞান বিশেষ কার্যকরী হয়নি। তার ঐতিহাসিক বিবরণী সাধারণতঃ যাকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়, নির্ভুল নয়। অবশ্য তাঁর গ্রন্থে উল্লিখিত অসংখ্য ব্যক্তি ও স্থানের বিষয় বিবেচনা করলে ভুলত্রুটির সংখ্যা যে অতি নগণ্য তা অনস্বীকার্য। তারিখ সহ তার ভ্রমণ বিবরণী যে পর্যায়ক্রমে দেওয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে বুঝতে পারা এক প্রকার অসম্ভব বলেই চলে। অনেকগুলি তারিখ দেখে মনে হয় সম্ভবতঃ সম্পাদকের অনুরোধে সেগুলি যেখানে-সেখানে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে সব তারিখ পরীক্ষা ও সংশোধন করা এতই কষ্টসাধ্য যে, এ-গ্রন্থ প্রণয়নে সে চেষ্টাই করা হয়নি।
সর্বশেষ প্রশ্ন হচ্ছে ইবনে বতুতার বিবরণীর সত্যতা। এ-বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই যে, তার অতিশয়োক্তি ও ভুল বুঝার অংশ ছেড়ে দিয়ে মুসলিম দেশগুলি সম্বন্ধে। তিনি যা সত্য বলে বিশ্বাস করেছেন অকপটে তারই বর্ণনা দিয়ে গেছেন। কিছু সংখ্যক সমালোচক অবশ্য ইবনে বতুতার কনস্টান্টিনোপল ও চীন ভ্রমণের দাবী সন্দেহের চোখে দেখেন। কনস্টান্টিনোপল দর্শনের বিষয়ে প্রধান অসুবিধা হল ভ্রমণ পথের বিবরণের। অস্পষ্টতা এবং প্রাক্তন সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাতের উল্লেখ। কারণ ইবনে বতুতার নিজের দিনপঞ্জী অনুযায়ী দেখা যায় প্রাক্তন সম্রাট এক বছর আগেই পরলোক গমন করেছেন। পথের বিবরণের অস্পষ্টতার কারণ হয়তো অপরিচিত পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে আরবী ভাষাভাষী পরিব্রাজকের বুঝতে অসুবিধা বা অক্ষমতা এবং দ্বিতীয় অসঙ্গতির কারণ। সম্ভবতঃ তারিখের ভুল। শহরের বিবরণ কিন্তু এত বিশদ ও নির্ভুল যে, তা ইবনে। বতুতার মত সর্বপ্রকার সুবিধা সহায়তা লাভের অধিকারী প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তির হতেই পারে না। এমন কি, প্রাক্তন সম্রাটের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের। বিবরণের মধ্যেও সত্যের নির্ভুল ছাপ রয়েছে।
চীন যাত্রার পথের ও চীনের অভ্যন্তরে বিবরণীর ব্যাপারে একই ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। তার পূর্ণ বিবরণ যথাস্থানে দেওয়া হবে। এখানে এটুকু বললেই যথেষ্ট যে, ইবনে বতুতার চীনে যাওয়া ও চীন ভ্রমণের বিবরণ অস্বীকার করতে গেলে। অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় এবং একই রকম যুক্তি দ্বারা সহজে প্রমাণ করা সম্ভব হয়। যে, তিনি ভারতেও যান নাই, যদিও ভারতে তিনি অবশ্যই গিয়েছিলেন। ইবনে বতুতা। যখনই পরের নিকট হতে সংগৃহীত তথ্যের উপর নির্ভর করেছেন তখনই দেখা যায় তার বিবরণী সন্তোষজনক হয়নি। অথচ অন্যের দেওয়া তথ্যের কিছুটা না নিয়ে শুধু নিজের দেখা বিষয়ের উপর নির্ভর করে এত বড় গ্রন্থ রচনা করা প্রায় অসম্ভব। তার চীন ভ্রমণের স্বপক্ষে কতকগুলি জোরালো যুক্তিও রয়েছে। দিল্লীর সুলতানের দূত হিসেবে তার চীন গমণের যথেষ্ট কারণ আছে এবং চীনের অভ্যন্তরভাগে ভ্রমণের তার যে। সুযোগ-সুবিধা ছিল তা অন্য কোন সাধারণ সওদাগরের পক্ষে সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়ত: খানসা (হ্যাং চাও) অবস্থানকালীন কার্যকলাপের বিবরণের এক স্থানের অস্পষ্টতা আসামে শেখ জালাল উদ্দীন সন্দর্শনে গমনের বিষয়ে প্রদত্ত পূর্ববর্তী এক বিবরণীর দ্বারা। দূরীভূত হয়। তাঁর চীন ভ্রমণের সঙ্গে আসাম ভ্রমণের সম্পর্ক খুব নিবিড়। তৃতীয়ত: তার চীন ভ্রমণের দাবী যদি মিথ্যা হয় তবে তার ধরা পড়বার সম্ভাবনাও যথেষ্ট ছিল। উত্তর চীনে ভ্রমণ কালে তিনি যে সিউটা হতে আগত একজন সওদাগরের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন সে কথা জোর দিয়ে বলেছেন। উক্ত সওদাগর ছিলেন মরক্কোর অন্তর্গত সিজিল মাসার জনৈক অধিবাসীর ভ্রাতা। তার সঙ্গে পরবর্তীকালেও ইবনে বতুতার পুনরায় সাক্ষাৎ ঘটেছিল। সেকালেও মরক্কোর সঙ্গে উক্ত বণিকের যোগাযোগ ছিল তা অসম্ভব নয়। কারণ এক সময়ে ইবনে বতুতা নিজেও ভারত থেকে কিছু টাকা মেকুইনেজে পাঠিয়েছিলেন। অতএব ইবনে বতুতার চীন ভ্রমণ আমার কাছে মোটের উপর প্রকৃত বলেই মনে হয়, যদিও এ বিবরণ সংক্ষেপ করা হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। সম্ভবতঃ এর কারণ ছিল চীনের নামগুলি ইবনে বতুতা শিখে থাকলেও আরবী ফারসী নামের মত তা সঠিকভাবে স্মরণ রাখতে সক্ষম হননি কিংবা গ্রন্থ সম্পাদকই এ বিবরণটি সরাসরিভাবে সংক্ষেপ করেছেন। বস্তুতঃ আমাকে ইবনে বতুতার চীন সফরের বিবরণী বিশ্বাস করতে হয়, নতুবা ধরে নিতে হয় যে, ভারতে তিনি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন যে দরবেশের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন তারই সম্মোহন শক্তির প্রভাবে তিনি চীন সফর করেছেন বলে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
সর্বপ্রথম ইবনে বতুতার নাম সর্বসমক্ষে প্রচারিত হয় ১৮২৯ খ্রীস্টাব্দে ডা. স্যামুয়েল লি কর্তৃক অনূদিত একখানা সংক্ষিপ্ত পুস্তকের দ্বারা। তার ভ্রমণের পুর্ণাঙ্গ বিবরণীটি কয়েক বছর পরে আলজিরিয়ায় পাওয়া যায়। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের বহু সংখ্যক পাণ্ডুলিপি থেকে ডিফ্ৰিমারী ও সাইনেটির ব্যাখ্যাসহ উক্ত ভ্রমণ বিবরণীর একটি ফরাসী অনুবাদ প্রকাশিত হয়। পাণ্ডুলিপিগুলির একখানাতে ইবনে বতুতার বিবরণীর দ্বিতীয় অর্ধাংশ পাওয়া যায়। সে অংশটি ছিল মূল সফরনামা সম্পাদক ইবনে জুজায়ীর স্বহস্তলিখিত। ফরাসী অনুবাদটিকে মোটের উপর আরবী গ্রন্থের সঠিক অনুবাদ বলে গ্রহণ করা গেলেও তাতে ব্যাখ্যা সম্বলিত টীকার অভাব পরিলক্ষিত হয়। ফরাসী ভাষায় অনূদিত সফরনামার বিভিন্ন অংশে উল্লেখিত দেশগুলির বিষয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পণ্ডিতগণ এতে অনেক টীকাটিপ্পনী যোগ করেছেন, কিন্তু তা’হলেও বহুলাংশের টীকা এখনও বাকি রয়েছে। বর্তমান সংকলন গ্রন্থটি অনুদিত হয়েছে সরাসরি আরবী হতে। এ-গ্রন্থে ইবনে বতুতাকে ভূগোল রচয়িতা রূপে না দেখিয়ে পরিব্রাজকের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, এ-গ্রন্থে এবং টীকাটিপ্পনীতে এমন যথেষ্ট ইংগিত দেওয়া হয়েছে যার সাহায্যে যে কোন একটি বৃহদাকার মানচিত্রের মাধ্যমে ইবনে বতুতার ভ্রমণপথ সহজে অনুধাবন করা যাবে। অবশ্য এ বিবরণীর নানা ভৌগোলিক সমস্যা সম্বন্ধে নীরবতা অবলম্বন করা হয়েছে।
বর্তমান অনুবাদে এলিজাবেথের আমলের মার্জিত ভাষা বাদ দিয়ে ইবনে বতুতার মূল গ্রন্থের সহজ ভাষাই যতদূর সম্ভব রক্ষা করা হয়েছে। তাঁর মূল গ্রন্থের বর্ণনা ও কাহিনীর অফুরন্ত সম্পদ থেকে সংকলন করা সহজসাধ্য কাজ নয়। কাজেই বহু বিচিত্র অধ্যায়কে বাদ দিতে হয়েছে অথবা সংক্ষেপ করতে হয়েছে। তথাপি আশা করা যায়, যতদিন মূল গ্রন্থটির পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ (যা হাফলুইট সোসাইটির জন্য লেখক বর্তমানে তৈরী করেছেন।) প্রকাশিত না হয় ততদিন এ সংকলন গ্রন্থটিই ব্যাপকভাবে ইংরেজী। ভাষার পাঠকদের কাছে ইবনে বতুতার যুগের অথবা যে কোন যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিব্রাজককে পরিচিত করতে সহায়ক হবে।
.
ঐতিহাসিক পটভূমি
চতুর্দশ শতাব্দীর মুসলিম জাহান তার বিস্তৃত ও বাহ্যিক জাক জমকের দিক দিয়ে অষ্টম শতাব্দীর দামেশক ও বাগদাদের খলীফা শাসিত বিশাল সাম্রাজ্যের সঙ্গে তুলনায় বিশেষ নগণ্য ছিল না। পশ্চিম দিকে স্পেন ও সিসিল থেকে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তার সঙ্কুচিত হলেও ভারত ও মালয়েশিয়ার দিকের বিস্তৃতির দ্বারা সে ক্ষতির পূরণই শুধু হয়নি, অতিরিক্ত বিস্তৃতিও ছিল। ধর্মযুদ্ধেরত ফ্রাঙ্কদের হস্তে পরাজয়ের গ্লানির শেষ চিহ্ন মুসলিম জাহান সম্প্রতি অপনোদনে সক্ষম হয়েছিল। এবং ইউরোপে তুরস্কের তরবারি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশোধ গ্রহণেও উদ্যত হয়েছিল। তথাপি একথাও সত্য যে, আপাতঃ দৃষ্টিতে এ সকল উন্নতির চিহ্ন বর্তমান থাকা সত্ত্বেও ইসলামের রাজনৈতিক কাঠামো মারাত্মক ভাবে ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। কালের প্রভাবে ইসলামের বিরাট সৌধে জীবনীশক্তির অতীব অপচয় ঘটেছিল এবং তখনও যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েও তার মূলে আঘাত লেগেছিল।
সিরিয়ার উপকূল থেকে সর্বশেষ জেহাদীদের অবশ্যই বিতাড়িত করা হয়েছিল, কিন্তু সে বিতাড়নের জন্য কি উচ্চমূল্যই না দিতে হয়েছিল । জেহাদের প্রারম্ভে পূর্বপুরুষের যোদ্ধাগণ যাকে সীমান্তের সামান্য সংঘর্ষ বলে মনে করেছিল তাই প্রতিহত করতে পূর্ণ দুই শতাব্দীব্যাপী যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রয়োজন হয়েছিল। নমনীয় আরব ও কৃষ্টির অধিকারী পারসিকদের হস্ত থেকে রাজশক্তি চলে গিয়েছিল কঠোর ও অনুদার তুর্কীদের হস্তে। খ্রীষ্টীয় ১০০০ শতাব্দীর পর প্রায় দুইশত বছর ধরে ক্ষমতালোভী তুর্কী সৈন্যাধ্যক্ষদের আক্রমণে মুসলিম জাহান ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। তাদের আক্রমণ ও কুশাসনের ফলে দেশের যে পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয়েছিল তা কোন বিদেশী শত্রুর দ্বারাও সম্ভব হয়নি। আলোড়নের পর আলোড়ন চলতে থাকে, অতঃপর মধ্য এশিয়ার বর্বর মঙ্গোলগণ এসে তুর্কী সিংহকে পরিণত করে মেষশাবকে। তারা ১২৫৮ খ্রীস্টাব্দে ইসলামের পরিত্যক্ত ভুখণ্ডকে তাদের বিরাট সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত করে।
এ ঘটনা মুসলমানদের কাছে রোজকেয়ামতের খোদাই গজবের মত প্রথমে মনে হলেও পরবর্তী কালে এ ঘটনার অভিশাপই আর্শীবাদে পরিণত হয়েছিল। পুনরায় পূর্বাঞ্চলের মুসলিম প্রদেশগুলি সুদৃঢ় শাসনাধীনে থেকে নিরাপত্তা উপভোগ করতে লাগল। ফলে কৃষি ও বাণিজ্যের উন্নতির যে আশা চিরতরে বিলুপ্ত হয়েছে বলে মনে হয়েছিল তাও পুনরায় আশাপ্রদ হয়ে উঠল। সেই সঙ্গে মিসর ও সিরিয়া মঙ্গোল আক্রমণের মুখে যারা অস্তিত্ব বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছিল পর পর কয়েকজন ক্ষমতাসম্পন্ন ও উপযুক্ত শাসকের অধীনে শান্তিতে ও নিরাপদে থেকে ক্রমশঃ বিশেষ উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছিল। তুর্কী সিপাহীসালারগণ একদিন শুধু মধ্য প্রদেশগুলির ছিন্নবিচ্ছিন্ন টুকরাসমূহ নিয়ে হানাহানি করেছিলেন। এবার তারা বিতাড়িত হলেন সীমান্তের দিকে। অতঃপর তারা বিধর্মী ও কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করে সমরলিন্স মিটাতে লাগলেন। এ উপায়ে পার্থিব সম্পদের কিছুটা অংশ অধিকার করতে সমর্থ হয়েছিলেন ও জেহাদী’র খ্যাতি অর্জন করে নিজেদের জন্য পরলোকে সম্মানজনক আসন। শাস্ত্রে ব্যবস্থা করেছিলেন। মঙ্গোল বিজয় এভাবে ভারতের ও তার কয়েক বছর পরে প্রেস ও বলকান উপদ্বীপে ইসলামের বাহু সম্প্রসারণে সহায়তা করে। এ সফলতা পুষ্ট হয়েছিল ইসলাম প্রচারক ও দরবেশদের কর্মতত্রপতার দ্বারা।
ফলে ইবনে বতুতা যখন ১৩২৫ খ্রীস্টাব্দে সফরে বের হন তখন মুসলিম শাসিত ভূখণ্ডে রাজনৈতিক অবস্থা ছিল বিশেষভাবে অনুকূল। আসওয়ান থেকে সাইলিসিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত মিসরের সুলতানের হুকুম ছিল অপ্রতিহত। খ্রীস্টান ধর্মযোদ্ধাদের স্মৃতির তিক্ততা মাত্র অবশিষ্ট ছিল এবং মঙ্গোলদের সঙ্গে সম্পর্ক হৃদ্যতাপূর্ণ না হলেও ১৩০৩ খ্রীস্টাব্দে দামেশকে পরাক্রমশালী নাসিরের শেষ বিজয়ের সময় হতে আর কোন যুদ্ধবিগ্রহই দেখা দেয়নি। ইরাক ও পারস্য তখনও মঙ্গোল খানদের শাসন মেনে চলত। খানগণ অবশ্য পুরোপুরি ইসলাম ধর্মাবলম্বী। অবশেষে অল্পদিনের ভেতরেই মঙ্গোল খানদের প্রভুত্বের পরিসমাপ্তি ঘটল। উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে সুবর্ণ দলের (Golden herde) ও জাগহাটের (jaghatay) মঙ্গোল খানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। অপরদিকে অসমসাহসিক ও প্রবল পরাক্রান্ত সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক ভারত উপমহাদেশের অধিকাংশের উপর প্রভাব বিস্তার করছিলেন। বিশাল রাজ্যগুলির প্রান্তভাগে, আনাতোলিয়া ও আফগান প্রভৃতি দূরবর্তী অংশগুলিতে এবং ভারত মহাসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় এমন বহু সংখ্যক ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র সুলতান ও আমীর ছিলেন যারা অপরের প্রভুত্ব স্বীকার করতেন না। বাণিজ্য অথবা জলদস্যুবৃত্তিলব্ধ অর্থে তারা তাঁদের বিপদসঙ্কুল মসনদ টিকিয়ে রাখতেন। ইচ্ছা করলেও তারা সাধারণ মুসলিম সম্প্রদায়ের কোন ক্ষতিসাধনের ক্ষমতা রাখতেন না। মুসলিম জাহানের সীমান্তের ভেতরে ও বাইরে ব্যবসায় বাণিজ্য অবাধ গতিতেই চলছিল, যদিও কর দিতে হত অত্যধিক হারে এবং সময়-সময় অন্যবিধ অসুবিধাও দেখা দিত। স্থানীয় শিল্পাদির যদিও অবনতি ঘটেছিল বা বিলুপ্তি হয়েছিল তবু ইউরোপীয় বাজার খুলে যাওয়ায় ব্যবসায়-বাণিজ্যের অপ্রত্যাশিত উন্নতি এসেছিল। কারণ, ঐ সকল ব্যবসায়কে তখনও প্রাচ্য সমুদ্রে ইউরোপীয় বণিকদের প্রবল প্রতিযোগিতার মোকাবিলা করতে হয়নি।
পরবর্তী যুগের মুসলিম সভ্যতার প্রকৃত দুর্বলতা দেখা যায় বিভিন্ন ইসলামিক রাষ্ট্রের মধ্যকার কৃষ্টির অসামঞ্জস্যে। পুরাতন সাম্রাজ্যের পক্ষে ধ্বংস ও বিচ্ছিন্নকারী। শক্তির মোকাবিলা করার অক্ষমতার ভেতরেই এই কৃষ্টিগত বৈষম্যের সন্ধান পাওয়া যায়। দশম শতাব্দীতে মুসলিম কৃষ্টি যখন মধ্যাহ্ন গগনে তখন আটলান্টিক থেকে মধ্য এশিয়ার পর্বতমালা অবধি বিস্তৃত ভূভাগের সর্বত্র মুসলিম কৃষ্টি প্রায় সমভাবে বিরাজমান ছিল। কিন্তু আমরা ইবনে বতুতার পূর্বাঞ্চলের দিকে অগ্রগতির অনুসরণ করলেই দেখতে পাই, কৃষ্টিগত ভূমি তখন কত অনুবর এবং কৃষ্টির মূল কতই না দূর্বল। অথচ এক সময়ে এই কৃষ্টিই মুসলিম সামাজিক জীবন বাঁচিয়ে রেখেছিল এবং বজায় রেখেছিল চতুর্দশ শতাব্দীর রাজ্যগুলির শান-শওকত। আরবদের নিকট উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা পরিচিত ছিল মাগরীব বা পশ্চিম নামে। দ্বাদশ শতাব্দীতে এই মাগরীব মুসলিম অধিকৃত স্পেন সহ একত্র করা হয়েছিল আমোরাভিস (Almoravids) ও আলমোহাদ (Almohads) রাজ্যের সঙ্গে। কিন্তু ব্রয়োদশ শতাব্দীতে এ রাজ্যই ভাগাভাগি হয়েছিল তিনটি বিভিন্ন বংশের মধ্যে। সুদূর পশ্চিমে ছিল মারি নিডস (marinids) অথবা মরক্কো; মধ্য পশ্চিমে ছিল জিয়া নিডস (Ziyanids) যার রাজধানী ছিল লেমসেন (Tlemsen); তিউনিস পড়েছিল হাফসিডসদের (Hafids) অংশে যার ইফরিকিয়া (Ifnqiya) প্রদেশ বিস্তৃত ছিল আলজিয়ার্স থেকে ত্রিপলী পর্যন্ত।
এভাবে সাম্রাজ্য বিভক্ত হবার ফলে যে বিপদ দেখা দিয়েছিল তা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক হিংসা ও বিদ্বেষের দরুন। একদিকে ছিল রাজ্যের চাষোপযোগী ভূমিখণ্ডের উপর যাযাবর আরব ও বারবারদের উৎপাত, অন্যদিকে নৌশক্তির অধিকারী খ্রীস্টান রাষ্ট্রগুলির ক্রমবর্ধমান আক্রমণ ভীতি । রাজ্যের শাসকগোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে নিষ্ফল হানাহানির ফলে বিপদের মোকাবিলা করার উপযোগী শক্তিসামর্থ্য তারা হারিয়ে ফেলেন। উপরি-উক্ত তিনটি রাজবংশের ভিতর সর্বাপেক্ষা উন্নত ছিল তিউনিসের হাফসিডগণ। এমন কি তাদের কর্তৃত্ত্বেও অনবরত এসে বাধার সৃষ্টি করত রাজ্যের সীমান্তবর্তী প্রদেশ সমূহের শাসনকর্তাগণ। যদিও তারা ১২৭০ খ্রীস্টাব্দে সেন্ট লুইর ক্রুসেড প্রতিহত করতে সমর্থ হয়েছিলেন তথাপি অনধিক বিশ বছরের মধ্যেই তারা সিসিলিয়ানদের কবলে জেবরা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। পরে ১৩৩৪ খ্রীস্টাব্দে জেবরা পুনরুদ্বারে সমর্থ হন নিয়াপলিটান ও জেনোইসদের সহায়তায়। প্রকৃতপক্ষে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল কেবল সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় এবং অভ্যন্তর ভাগে ছিল মাত্র কয়েকটি সুরক্ষিত শহর। তিউনিসের সমৃদ্ধির মূলে ছিল তার সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থান। অভ্যন্তর ভাগ থেকে প্রসারিত প্রধান বাণিজ্যপথগুলির মুখে ছিল তিউনিসের অবস্থান এবং তার ফলেই তিউনিস হয়েছিল মাগরিবের প্রধান বাণিজ্য শহর। ভূমধ্য সাগরাঞ্চলের মুসলিম বন্দরগুলির মধ্যে আলেকজান্দ্রিয়ার পরেই ছিল তিউনিসের স্থান। মাগরিবের অন্যান্য অংশের ন্যায়। তিউনিসের কৃষ্টি ও তমদুন রক্ষিত হয়েছিল স্পেন হতে বিতাড়িত মুসলিম মোহাজেরদের দ্বারা।
মরক্কোর মারিনিদ (Marindi) রাজবংশ ছিল অধিকতর সমৃদ্ধিশালী ভূখণ্ডের অধিকারী। তা সত্ত্বেও তাদের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। তাদের ইতিহাস খুন জখমের রক্তে রঞ্জিত ইতিহাস। শাসকবর্গের খুব কম সংখ্যকই তাদের উচ্চাভিলাষী। আত্মীয়গণের বিদ্রোহ ও চক্রান্তের হাত থেকে রেহাই পেতে সমর্থ হতেন। যারা রেহাই পেতেন তাঁরাও নিজেদের অবসর সময় কাটাতেন প্রতিবেশী রাজ্যের অথবা স্পেনের খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান করে। এ রাজবংশ উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে আবুল হাসানের (১৩৩১-৪৮) ও তৎপুত্র আবু ইনানের (১৩৪৮-৫৮) অধীনে। তাদের নাম ইবনে বতুতার সফরনামার শেষাংশে বারবার উল্লিখিত হতে দেখা যায়। আবুল হাসান সিজিল মাসা ও লেমসেন অধিকার করতে সমর্থ হন এবং ১৩৪০ খ্রস্টাব্দে তারিফায় এক রক্তাক্ত যুদ্ধে স্পেনবাসীদের দ্বারা পরাজিত হবার পরেও ১৩৪৭ খ্রীস্টাব্দে তিউনিসে প্রদেশটি স্বরাজ্যভুক্ত করেন। কিন্তু অল্পকাল পরেই তিনি তিউনিস ও তার সিংহাসন–উভয়ই হারাতে বাধ্য হন নিজের বিদ্রোহী পুত্র আবু ইরানের হস্তে। ১৩৫৭ খ্রীস্টাব্দে লেমসেন ও তিউনিস পুনরাধিকারের পর আবু ইনান তার সৈন্যবাহিনী কর্তৃক পরিত্যক্ত হন এবং ফেজে প্রত্যাবর্তনের পর নিহত হন। তার ফলে রাজ্যটি এক ভয়াবহ অরাজকতার শিকার হয়ে পড়ে। তা হলেও উক্ত দুই ব্যক্তির রাজত্বকালে মরক্কো বিশেষ সমৃদ্ধিলাভ করে, তার নগরগুলি বহু সরকারী সৌধমালায় শোভিত হয়। তখনকার দিনে সে সৌধমালা মিসর ও ভারতের স্মৃতিসৌধাবলীর প্রায় সমকক্ষ ছিল বললেই চলে। কাজেই আবু ইমানের শাসনকাল সম্পর্কে ইবনে বতুতা যে প্রশংসা করেছেন তার সমর্থন এখানে পাওয়া যায়। বিশেষ করে তিনি তখনকার প্রাচ্য যে অরাজক অবস্থা দেখে এসেছেন তার সঙ্গে তুলনা কালে ইবনে বতুতার বিবরণীর সত্যতা সহজে প্রমাণিত হয়।
.
ধর্মীয় পটভূমি
সাধারণতঃ মুসলিম জগতের কাছে রাজনৈতিক ব্যাপার একেবারে নিরর্থক না হলেও গুরুত্বের দিক দিয়ে অধিঞ্চিকর। মধ্যযুগের মুসলিম সমাজ ছিল সর্বাগ্নে একটি ধর্মীয় সমাজ। এ সমাজের অস্তিত্বই ছিল ধর্মের উপর, কারণ ইসলাম ধর্মই ছিল মুসলিম সমাজের একতার একমাত্র বন্ধন। ধর্মের নিকট থেকেই ঐ সমাজ পেয়েছিল তার ভাবের আদান-প্রদানের জন্য সাধারণ ভাষা, কারণ ইসলাম আরবী ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষায় রূপান্তরিত হওয়ার ব্যাপারে সব সময় বাধা দান করত। মুসলিম সমাজ পারসিক ও তুর্কীদের বাধ্য করেছিল আরবী শিখতে। সাহিত্যের উত্তরাধিকারের জন্যও তারা ধর্মের কাছেই ঋণী, কারণ একমাত্র কবিতা ছাড়া সাহিত্যের অন্যান্য বিষয় অধ্যয়নের প্রেরণা তারা ধর্মের মধ্যেই পেয়েছে। সমগ্র সামাজিক কাঠামো এবং আইন-কানুনগুলি ছিল ধর্মভিত্তিক। অন্ততঃ সভ্য দেশগুলি থেকে পুরাতন সমাজ-ব্যবস্থা এবং সামাজিক অসমতা মুছে ফেলে ইসলাম এক নতুন আইন-ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। ধর্মের কাছেই মুসলিম সমাজ পেয়েছে একত্ববোধের ধারণা, কারণ ইসলাম প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসীর অন্তরে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ববোধের অপূর্ব অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল। বস্তুতঃ ধর্ম শুধু মুসলিম সমাজের কৃষ্টিগত পটভূমি ও মনস্তাত্ত্বিক গঠনই সৃষ্টি করেনি বরং স্বসমাজের সভ্যদের জন্য একটা জীবনদেহ দান করেছে এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অতি সাধারণ কর্মতৎপরতাগুলিও নিয়ন্ত্রিত করেছে।
ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব আরোপ করে সমগ্র আরবী সাহিত্য এ সকল সামাজিক অবস্থা প্রতিফলিত করে এবং ধর্মসংক্রান্ত ব্যাপারে যে বিশেষ উৎসাহ দেখানো হয়েছে তা আধুনিক পাঠকদের ধৈর্য ও জ্ঞানের উপরে চাপ দেয়। ইবনে বতুতার গ্রন্থ সম্পর্কে একথা বিশেষ উৎসাহ দেখানো হয়েছে তা আধুনিক পাঠকদের ধৈর্য ও জ্ঞানের উপরে চাপ দেয়। ইবনে বতুতার গ্রন্থ সম্পর্কে একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। কারণ, সে গ্রন্থের কোন ব্যাখ্যাই ধর্মীল্প বিষয়ের উল্লেখ বাদ দিতে পারে না। এ কারণে ইসলামের অনুষ্ঠানাদি এবং মুসলিম ভূখণ্ডের উপর গঠিত প্রতিষ্ঠানাদি সম্বন্ধে একটা বিবরণ দিলে ইংরেজ পর্যটকদের পথ কিছুটা আলোকিত হতে পারে।
ইসলাম যে সব নীতিতে বিশ্বাসী তার কোন ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। মূল বিশ্বাসের ভিত্তি হল : আল্লাহ এক; তিনি মহাশূণ্য ও পৃথিবীর স্রষ্টা; একমাত্র উপাস্য; তাঁর সমৃদ্ধ সৃষ্টির তিনিই একমাত্র সর্বশক্তিমান প্রভূ, যিনি তাদের সকলের জীবন নিয়ন্ত্রিত করেন তার অসীম প্রেম ও জ্ঞানের দ্বারা। শেষ বিচারের দিনে তিনিই বিচার করবেন। তাঁর সৃষ্ট জীবনের পথনির্দেশের জন্য তিনি পর-পর সৃষ্টি করেছেন পয়গম্বর যার শুরু হজরত আদম থেকে হজরত নূহ, হজরত ইব্রাহিম, হজরত মূসা, হজরত দাউদ, হজরত সুলেমান, হজরত ঈসা ও বহুসংখ্যক অনামী পয়গম্বর সহ, হজরত মোহাম্মদের পর যার পরিসমাপ্তি। এসব পয়গম্বর যে ধর্ম প্রচার করে গেছেন, স্থান ও কাল ভেদে তার সামান্য রদবদল হলেও মূলতঃ তা এক এবং তাই ইসলাম অথবা আল্লার ইচ্ছার উপর পূর্ণ আত্মসমপর্ণ। এ ধর্ম আল্লাহ কর্তৃক ফেরেস্তার মাধ্যমে কয়েকজন পয়গম্বরের নিকট উদঘাটিত হয়। তাওরাত গ্রন্থ (পেন্টাটিক) প্রেরিত হয় হজরত মুসার নিকট; জব্দুর (সমান্) হজরত দাউদের নিকট; ইঞ্জিল (ইভাঞ্জেল-যা’ নিউ টেস্টামেন্টের গসপেলের অনুরূপ নয়) হজরত ঈসার নিকট এবং সর্বশেষে পবিত্র কোরআন আল্লার বাণীর চুড়ান্ত এবং ক্ৰটী-বিহীন আধার হিসাবে নাজেল হয় হজরত মোহাম্মদের উপর। এ সকল ঐশী বাণী পয়গম্বরদের নিকট সরাসরিভাবে প্রেরিত না-হয়ে প্রধান ফেরেস্তা জিবরাইলের। মাধ্যমে প্রেরিত হয়েছে। মানুষ ও ফেরেস্তা ব্যতীত তৃতীয় এক শ্রেণীর জীব রয়েছে। তারা জী নামে পরিচিত। জীনের সৃষ্টি অগ্নি হতে, কাজেই মানুষের দেহের চেয়ে তাদের দেহের উপাদান সূক্ষ্ম এবং তারা অমানুষিক শক্তির অধিকারী কিন্তু মহা বিচারের দিনে তাদেরও হিসাব-নিকাশ দিতে হবে মানুষের মতই।
কিন্তু ‘ইসলাম’ অর্থে কতিপয় ধর্মবিশ্বাসের স্বীকৃতি ছাড়াও অনেক বেশি কিছু বুঝায়। ধর্মীয় নির্দেশানুযায়ী আরোপিত কতকগুলি কর্তব্য নিয়মিতভাবে পালন না-করা পর্যন্ত কেউ প্রকৃত মুসলমান বলে পরিগণিত হতে পারে না। ধর্মবিশ্বাসের প্রধান স্তম্ভ চারটি; (১) দৈনিক পাঁচবার নামাজ পড়া বা উপাসনা করা; প্রত্যেকবার নামাজের। সময় কিবলা অর্থাৎ কাবার দিকে মুখ করে নির্ধারিত সংখ্যক একই ধরনের শারীরিক প্রক্রিয়াসহ কোরআনের শ্লোক বা সুরা আবৃত্তি করতে হয়। নির্ধারিত সময়ে জমাতে অথবা একা নামাজ আদায় করবার নিয়ম; ঠিক সূর্য উদয়ের পূর্বে; দ্বিপ্রহরের পর; বিকালের মাঝামাঝি সময়ে; সূর্যাস্তের ঠিক পরে এবং রাত্রির দু’ বা তিন ঘন্টা অতিবাহিত হবার পরে। জামাতের নামাজ সাধারণতঃ পড়া হয় মসজিদে। এ নামাজের। পেশ-ইমাম মোতাদিদের মধ্যে যে কেউ হতে পারে। মসজিদে কোন মূর্তি বা তসবির রাখা হয় না। এক আল্লার নিষ্ঠাবান উপসনাকারীদের চিত্তবিভ্রম ঘটাতে পারে এমন কিছুই মসজিদে রাখা হয় না। খুব বেশি কিছু থাকলে মসজিদের দেওয়ালে জ্যামিতিক নকশা দ্বারা এভাবে অলঙ্কৃত থাকতে পারে যাতে বাহ্যদৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে আধ্যাত্মিক অনুভূতি গভীরতর হয়। সাপ্তাহিক প্রধান জামাত শুক্রবার মধ্যাহ্নে জুমা মসজিদ গুলিতে আনুষ্ঠানিক সাধারণ নামাজ ব্যতীত মিম্বর বা বেদীর উপর দাঁড়িয়ে পেশ-ইমাম সাপ্তাহিক খোত্বা পাঠ করেন। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ক্ষমতায় আসীন বাদশাহ বা শাসকের জন্য মঙ্গল কামনান্তে উপস্থিত জনগণের উদ্দেশে ধর্মীয় উপদেশ প্রদান করা হয়। পবিত্র রজমান মাসের পরদিন এবং জিলহজ্ব মাসের ১০ই তারিখে দুটি প্রধান উৎসবের দিনেও অনুরূপ খোত্বা পাঠ হয়ে থাকে। প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাজের পূর্বে প্রার্থনাকারী বা নামাজীকে মসজিদের কুয়ার পানিতে মুখ, হাত ও পা ধুয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পবিত্র হতে হয়। (২) সমগ্র সম্পত্তির মূল্যের উপর হিসাব করে শতকরা আড়াই টাকা জাকাত দিতে হয়। (৩) রজমান মাসে বাৎসরিক রোজা বা উপবাব্রত উদযাপন করা অর্থাৎ রমজানমাসের সম্পূর্ণ চন্দ্র মাস ধরে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অবধি আহার, পান ও ধূমপানে বিরত থাকা। (৪) বয়স্ক ও সঙ্গতিপন্ন লোকদের জন্য জীবনে অন্ততঃ একবার মক্কায় হজ্জব্রত পালনের জন্য গমন করা।
ধর্মীয় অনুশাসন ও অনুষ্ঠান ছাড়াও ইসলামের কোরআন ও হাদিস অর্থাৎ হজরত মোহাম্মদের বাণী ও কার্যের উপর ভিত্তি করে একটি আইন ও সমাজ-ব্যবস্থা বর্তমান রয়েছে। হিজরীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে মুসলিম আইন বিশারদ পণ্ডিতদের চারটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এই মুসলিম আইনের ব্যাখ্যা করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানগুলি কেবল ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বিষয়ের ব্যাখ্যায় ভিন্ন-ভিন্ন মত পোষণ করে কিন্তু নিষ্ঠার দিক দিয়ে সবগুলিই সমান গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম বিচারপতি বা কাজী আইনের কাজ পরিচালনা করতেন এবং প্রাচ্যের প্রধান নগরগুলিতে প্রত্যেক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য একজন করে প্রধান কাজী থাকতেন। কার্যতঃ ফৌজদারী মামলাগুলির বিচারকার্য প্রায়ই সুলতান স্বয়ং কিংবা তার উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের দ্বারাই সম্পন্ন হত এবং কোন-কোন সময়ে উক্ত কার্যাদি কাজীর অনুমোদনক্রমে আইনসিদ্ধ করে নেওয়া হত। ইউরোপীয় সমাজ-ব্যবস্থা হতে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার মূল পার্থক্য হল বিবাহ এবং বিচ্ছেদ বা তালাকের ক্ষেত্রে। সকলেই। জানে যে একজন মুসলিম একই সময়ে একই সঙ্গে চারিটি স্ত্রী এবং সে সঙ্গে খরিদা বাদীও রাখতে পারে এবং আইনের কতকগুলি সাধারণ রক্ষাকবজের শর্তাধীনের স্ত্রীদিগকে ইচ্ছানুযায়ী তালাক দিতে পারে এবং খরিদা বাদীদের ভেতর যাদের কোন পুত্র সন্তান হয়নি তাদের বিলি-ব্যবস্থা করে দিতে পারে। ভ্রাম্যমাণ জীবনের পক্ষে এরূপ ব্যবস্থা বিশেষ উপযোগী ছিল এবং ইবনে বতুতা তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছেন। একজন খ্রীস্টান পাদ্রী তো দূরের কথা একজন ইউরোপীয় যা করতে অক্ষম ইবনে বতুতা তা সম্ভব করেছেন। সহজ ও সাবলীল ভাষায় তিনি সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। শুধু তাই নয়- যেহেতু তার আলোচনার বিষয়বস্তু নৈতিক জীবনের বাইরে অবস্থিত সেহেতু তিনি এগুলিকে দৈনন্দিন জীবনের পানাহারের সমপর্যায়ভুক্ত বিষয় হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এজন্যই তার এসব বর্ণনা এত সুন্দর ও স্বাভাবিক। এছাড়াও অনেক সময় ইবনে বতুতা তাঁর ভার্যাগণকে কেন্দ্র করে অনেক উক্তি করেছেন কিন্তু সে সব উক্তি উপলক্ষ্য করে কারও পক্ষেই সহসা কোন অসংলগ্ন মন্তব্য করা সঙ্গত হবে না। সাধারণতঃ একজন মুসলমানের পক্ষে সামাজিক কথাবার্তা বা আচরণের মধ্যে নারীজাতির উল্লেখ করা নীতিবিগর্হিত, কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে ইবনে বতুতা এ নিয়ম ভঙ্গ করেছেন। তবে স্মরণ রাখতে হবে যে, তিনি শুধু একটি নির্দিষ্ট ব্যাপারকে যথার্থ ব্যাখ্যা করবার জন্যই এই চিরাচরিত প্রথা ভঙ্গ করেছেন।
মুসলিম সামাজিক কাঠামোর দ্বিতীয় দিক হচ্ছে তার দাসপ্রথা। অবশ্য একথা আমাদের ভুললে চলবে না সে একজন দাস সাধারণতঃ তার প্রভুর ভৃত্য অথবা বিশেষ। অনুচর মাত্র ছিল। সেদিক থেকে বিচার করলে কোন অবস্থায়ই দাসপ্রথা মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ছিল না। কাজেই মুসলিম সমাজব্যবস্থায় প্রভু-দাস সম্পর্ক রোমী জমিদার বা আমেরিকান ঔপনিবেশিকদের দাস ব্যবসার চেয়ে অনেক মানবিক ও পারস্পরিক লেনদেনের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কাজেই মুসলিম সমাজে দাসপ্রথা খুব বেশি নিন্দনীয় ছিল না। মুসলিম সমাজের সমতুল্য দাসপ্রথা তঙ্কালীন কোন সমাজেই বিদ্যমান ছিল না। এমন কি শ্বেতকায় দাসগণ একটি বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত গোষ্ঠিতে পরিগণিত হয়েছিল এবং তাদের মধ্য হতেই উচ্চ-ক্ষমতাবিশিষ্ট রাজকর্মচারী সেনানায়ক শাসনকর্তা এমন কি সুলতান পর্যন্ত নিয়োজিত হতেন।
খ্রীস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে জনৈক ধর্ম-তত্তোপদেষ্টা কর্তৃক বর্ণিত নিম্নলিখিত উপখ্যানটি প্রণিধানযোগ্য। বিভিন্ন আরবী সাহিত্যে আমরা প্রভু-ভার্যা দাস সম্পর্কের যে। পরিচয় পাই তার নির্ভুল প্রতিফলন দেখা যাবে এ উপাখ্যানে।
উপাখ্যানটি হল : একদা আমি দেখলাম একটি বালক দাসকে নিলামে বিক্রি করা হচ্ছে। নিলামে ডাক উঠল মাত্র ত্রিশ দিনার। অথচ এ বালকটির ন্যায্য মূল্য হওয়া উচিত ছিল তিনশ’ দিনার। সুতরাং আমি বালকটিকে খরিদ করে নিয়ে এলাম। সে সময়ে আমি একটি গৃহনির্মাণ করছিলাম। একদিন শ্রমিকদের দেবার জন্য বালককে আমি বিশটি দিনার দিলাম। সে বিশ দিনারে দশটি দিনার দিয়ে নিজের জন্য একটি জামা কিনে নিয়ে এল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ তোমার কেমন কাজ। তাতে সে বলে উঠল, ‘হঠকারিতা করবেন না। কোন ভদ্রলোক কখনো তার ক্রীতদাসদের গালাগাল করে না।’
তখন আমি মনে-মনে বললাম, ‘আমি নিজের অজান্তে, আজ স্বয়ং খলিফার একজন শিক্ষককে কিনে এনেছি।’ পরে আমার প্রথমা স্ত্রীকে (সে ছিল আমার জ্ঞাতি বোন) না জানিয়ে একজন স্ত্রীলোককে বিয়ে করব স্থির করলাম। এ ব্যাপারে গোপনতা রক্ষা করতে বালকটিকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করলাম এবং তাকে কিছু ‘হাজিবা’ নামক মাছ ও অন্যান্য জিনিস কিনে আনতে একটি দিনার দিলাম । কিন্তু সে তা না কিনে অন্যান্য জিনিস কিনে নিয়ে এল। তখন তার উপর রাগান্বিত হওয়ায় সে বলল, আমি দেখলাম হিপোক্রেটিস হাজিবা মাছ পছন্দ করে না।
আমি বললাম, তুই একটা অপদার্থ মুখ। আমি বুঝতে পারিনি যে আমি একটা ‘গ্যালেন, (galen) কিনে নিয়ে যাচ্ছি।’ এই বলে তাকে চাবুক দিয়ে দশটি ঘা দিলাম। কিন্তু সে আমাকে ধরে চাবুকের সাতটি ঘা মেরে বলে উঠল, হুজুর শান্তির জন্য তিন ঘা মারাই যথেষ্ট। কাজেই সাত ঘা মেরে আমি প্রতিশোধ নিলাম।
এ-কথা শুনে আমি তার দিকে ছুটে গিয়ে মাথায় আঘাত করতেই মাথা জখম হয়ে গেল। তাতে সে আমার প্রথমা স্ত্রীকে গিয়ে বলল, সততা রক্ষা করা আমাদের একটি ধর্মীয় কর্তব্য। যে সত্যের অপলাপ করে সে অধার্মিক। আমার মনিব পুনরায় একটি বিয়ে করেছেন এবং আমাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছেন সে কথা গোপন রাখতে। কিন্তু আমি যখন বলেছি যে, আমাদের বিবি সাহেবাকে একথা নিশ্চয়ই জানাতে হবে তখন তিনি মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন।
অতঃপর যে পর্যন্ত না আমি সেই স্ত্রীলোকটিকে তালাক দিই সে পর্যন্ত আমার স্ত্রী আমাকে ঘরেও ঢুকতে দেয়নি এবং ঘরের কোন জিনিস বের করতেও দেয়নি। তারপর থেকে আমার স্ত্রী তাকে বলত, ছেলেটি সৎ। অথচ আমি তাকে কিছুই বলতে পারতাম না। সুতরাং আমি মনে-মনে বললাম, ছেলেটাকে আজাদ না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।
ইসলামী ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় তার ধর্মীয় সংস্থার । ধর্মীয় সংস্থা দুটি এবং তা কিছুটা পরস্পর বিরোধী। ইসলামের ধর্মীয় বিধানে কোন পুরোহিতের স্থান নেই, ফলে পৌরহিত্যের শাসনও নেই, ইসলামে সংস্থার বা কোন গুপ্ত রহস্যের প্রতীকও নেই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সকল মুসলমানেরই সমান অধিকার। সমাজের সম-অধিকার নেই এমন কোন প্রাধান্য কেউ দাবী করতে পারে না। বাস্তবক্ষেত্রে এরূপ সমতা রক্ষা করে চলা অবশ্য অনেক সময় অসম্ভব ছিল। যে সমাজ ধর্মীয় ব্যবস্থা, যাজক বিধান রচনাকারী বিচারক প্রভৃতি অংশে বিভক্ত সে সমাজের কোন একটি অংশ অপর অপেক্ষাকৃত অজ্ঞ অংশের উপর অপরিহার্যরূপেই কিছু-না কিছু নৈতিক প্রভাব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিস্তার করে। বাহ্যত কোন প্রকার আইনগত সমর্থন না থাকায় একে অত্যাচার বা স্বেচ্ছাচারিতাও বলা চলে। শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস পালনের ফলেই একটি ধর্মীয় অভিজাত শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছিল। ইসলাম ধর্মের এই বিশেষ শ্রেণী অবশ্য খ্রীস্টান ধর্মীয় যাজকশ্রেণী হতে পৃথক ছিল। কারণ, ইসলাম ধর্মে কোন নির্দিষ্ট বা লিখিত শ্রেণীবিভাগ ছিল না অথবা আধ্যাত্মিক ব্যাপারে কোন বিশেষ সুবিধা বা একাধিপত্য ছিল না। এ ছাড়া ইসলাম একটি সার্বজনীন ধর্ম। উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে ইসলামের দ্বার সকল মানুষের জন্যই উম্মুক্ত। অপরপক্ষে দেখা যায়, ইসলামের ধর্মীয় ব্যবস্থার গুণাগুণ অনেকাংশে খ্রস্টীয় পৌরহিত্যের সমতুল্য। একথা সত্য যে, ইসলাম ধর্মোপদেষ্টাগণ খ্রীস্টীয় যাজকগণের ন্যায় রাজ্য শাসনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতেন না এবং একটি বিশেষ স্বকীয় মতবাদকেই তারা পছন্দ করতেন কিন্তু তাদের এ মনোভাব পরবর্তীকালে গীর্জা ও প্রশাসনিক উভয় ব্যবস্থার জন্যই ধ্বংস ডেকে এনেছিল । রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব বলতে কিছুই ছিল না। ধর্মবিশ্বাস কায়েম রাখবার দায়িত্বভার ন্যস্ত ছিল সমগ্র সমাজের উপর। ধর্মোপদেষ্টারা সমাজেরই একটি অঙ্গ বলে তারা নিজেদের প্রকৃত গুরুত্ব নতুন করে উপলব্ধি করলেন। তারা দেখলেন যে জনমত গঠনের জন্য নিজেদের প্রভাব তারা সহজেই কাজে লাগাতে পারেন এবং জনমত গঠিত হলে হাতিয়ার স্বরূপ তা ব্যবহার করতে পারেন আইন ভঙ্গকারী ও স্বেচ্ছাচারীদের বিরুদ্ধে। কারণ, প্রবল। পরাক্রমশালী কোন শাসকও যে কদাচিৎ জনমতের বিরোধিতা করতে সাহস করেন তার প্রমাণ আমরা পাই ইবনে বতুতা বর্ণিত কতিপয় কাহিনীতে। পক্ষান্তরে দিল্লীর ম্রাট সুলতান মোহাম্মদের দৃষ্টান্তই যথেষ্ট যে তিনি একদিকে ধর্মতত্ত্বজ্ঞদের সন্তুষ্ট রাখতে সচেষ্ট থাকতেন কিন্তু অপর দিকে যা করতেন তার কৈফিয়ত তলবের সাহস কারও ছিল না।
এমন আরও একটি কর্তব্যভার সমগ্র সমাজের উপর ন্যস্ত ছিল যে ভার কোন। পেশাদার ধর্মোপদেষ্টার উপর দেওয়া সম্ভব নয়। সে কর্তব্য হল তরবারীর দ্বারা ইসলামের ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য রক্ষা করা। কতিপয় ব্যবহার-শাস্ত্রজ্ঞ জেহাদ’কে নামাজ ও রোজার সমপর্যায়ের অবশ্যকরণীয় অনুষ্ঠান বলে গণ্য করেছেন এবং ইসলামের প্রথম যুগে প্রতিটি মুসলমান জেহাদকে আত্মরক্ষার পরিবর্তে আক্রমণাত্মকভাবেই সর্বক্ষণের পেশা বলে গ্রহণ করেছেন । ক্রুসেডের যুদ্ধের দ্বারা এবং খ্রীস্টানদের স্পেন বিজয়ের দ্বারা জেহাদ পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। অবশ্য। ইসলামের রক্ষার্থে প্রতি মুসলমানের অস্ত্রধারণ করা কর্তব্য, এ ধারণা অতঃপর বেশি দিন বজায় থাকেনি। সিরিয়া ও আন্দালুসিয়া রক্ষার ভার তখন দেশের অধিবাসীদের উপরই ন্যস্ত হয়। এতৎসত্ত্বেও ধর্মযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে স্বর্গপ্রাপ্তির লোভ স্বেচ্ছাসেবীদের বরাবরই যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে আকর্ষণ করেছে, বিশেষতঃ সে যুদ্ধ যদি খ্রীস্টানদের বা বিধর্মীদের বিরুদ্ধে হয়। এসব স্বেচ্ছা সেবক সীমান্তবর্তী দূর্গ বা ‘রিবাত’ নামক সুরক্ষিত স্থানে বাস করত এবং এরা পরিচিত ছিল ‘গাজী’ বা ‘মুজাহিদ’, নামে যার কাছাকাছি ইংরেজী প্রতিশব্দ হওয়া উচিত ‘অশ্বরোহী সীমান্ত সেনা’। সম্ভবতঃ এই অতীত ঐতিহ্য একমাত্র আন্দালুসিয়াতেই যথাযথভাবে বজায় ছিল। অন্যান্য স্থানে জেহাদ দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। একদিকে মুসলিম সাম্রাজ্যের দুর্ধর্ষ লোকেরা ঝুঁকে পড়ল যুদ্ধবিশ্রহের দিকে এবং গাজীরা দ্রুত গ্রহণ করতে লাগল তস্করবৃত্তি যার ফলে বিধর্মীদের চেয়ে মুসলিম শাসকদেরই অধিক বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল এসব গাজী।
অপর দিকে ইসলামের আধ্যাত্মিকতা ও কৃস্ট্র সাধনার সঙ্গেও ইহা যুক্ত ছিল। প্রথম দিকে নরকবাসের ভীতিই মুসলমানদের কৃস্ট্র সাধনায় নিয়োজিত করতঃ জেহাদ স্বর্গলাভের একমাত্র নিশ্চিত উপায় ভেবে ইসলামের অধিকাংশ কৃচ্ছু সাধকই সীমান্ত যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অংশ গ্রহণ করত। পরবর্তীকালে জেহাদের ব্যাখ্যা করা হয়েছে পার্থিব লালসার বিরুদ্ধে যুদ্ধরূপে এবং সূফীরা (অধ্যাত্মবাদীদের আধুনিক নাম) ধর্মীয় যুদ্ধ থেকে নিজেদের বিরত রাখলেও তারা পূর্বের নামেই পরিচিত হতে থাকেন। এ সময় বিবাতগুলি পরিণত হয়েছিল ভজনালয় বা মঠে যেখানে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা একত্র বসবাস করতেন। কালক্রমে এসব পুরাতন দলই বিশেষ একটি যাজকশ্রেণীতে পরিণত হন। এঁদের সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা বাদ দিয়ে আমরা চতুর্দশ শতাব্দীর সূফী বা দরবেশদের কার্যক্রমের প্রতি মনোযোগ দিতে পারি।
এ সময়ে অধ্যাত্মবাদীরা সাধারণতঃ বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বা জমাতে বিভক্ত হয়ে কোন প্রসিদ্ধ শেখের নামে পরিচিত হতে থাকে, তখন শেখকেই গণ্য করা হয় তরিকা, বা বিধানের প্রতিষ্ঠাতা রূপে। ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী বা জমাতের জিকিরও ছিল ভিন্ন, এক জমাত থেকে অপর জমাতকে চিন্বার উপায়ই ছিল তাদের জিকির। প্রতিষ্ঠাতার ধর্মশালাকে বেষ্টন করে কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিক্ষালয় গড়ে উঠে কারণ এ জমাতের। শিষ্যরা তখন সারা মুসলিম জগতে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিষ্ঠাতার বংশধর বা উত্তরাধিকারীকে (ইসলামে চিরকৌমার্যের কোন বিধান নেই) নিজেদের দলপতি মনে করে। ব্যক্তি-কেন্দ্রিক বা একক কৃ সাধন মুসলিম জগৎ থেকে এখনও নিমূল হয়নি। বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা ও সাউথ লেবাননে এমন এক শ্রেণীর সংসারত্যাগী লোক দেখতে পাওয়া যায় যারা দরবেশ না হলেও নিজেদের সূফী সাধকের বংশধর বলে দাবী করে। তাদের চেয়েও অবাধে ধর্মশালার বাইরে বিচরণ করে শতচ্ছিন্ন খিরকা পরিহিত দণ্ডধারী এক শ্রেণীর দরবেশ বা ফকির। তারা অন্নসংস্থানের জন্য খোদার উপর এবং ইমানদার লোকদের উপর নির্ভর করে থাকে। তারা ধার্মিক ভিক্ষুক না-হয়েও এসব পেশাদার দরবেশের চেয়ে বেশি ধৃষ্ঠতা প্রকাশ করে।
সূফী মতবাদের মূল আদর্শ হচ্ছে মানবসমাজকে পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের প্রভাবমুক্ত করে। ঐশ্বরিক চিন্তায় নিয়োজিত করা এবং খোদার সাহচর্যলাভে তাদের সাহায্য করা। প্রার্থনা, ধ্যান, উপবাস ও কৃন্তু সাধনায় তারা অহোরাত্র কাটাত। কিছু দিন পর-পর ধর্ম শালার অধিবাসীরা বা তরিকার সভ্যরা একত্র মিলিত হয়ে নিজেদের রীতি অনুযায়ী জিকির করত। তারা অনেক সময় মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ত এবং ক্ষণিকের জন্য খোদার সহিত পুনর্মিলনের আনন্দ উপভোগ করত। ইবনে বতুতার বিভিন্ন বর্ণনায় দেখা যায়, প্রাচ্য জীবনাদর্শের ধারা অনুযায়ী এসব জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান এক অবাস্তব ও ঐন্দ্রজালিক কৌশল-প্রদর্শনীতে পর্যবসিত হত। কেহ-কেহ একই স্থানে দাঁড়িয়ে একাদিক্রমে ঘন্টার পর ঘন্টা তাণ্ডব নৃত্য করত, কেউ বা সর্প ও কাঁচ-চর্বণ করত; আগুনের উপর হাঁটত অথবা নিজের কোন অঙ্গ দুরকাবিদ্ধ করত এবং তার ফলে সাময়িক ক্লান্তিবোধ ছাড়া আর কোন অসুবিধার লক্ষণ দেখা যেত না।
আধুনিক পর্যটকদের মধ্যে যারা হজরত ইমাম হোসেনের মৃত্যুকে উপলক্ষ করে। শিয়া সম্প্রদায়ের শোক-কান্নার দৃশ্য দেখেছেন অথবা পরলোকগত লর্ড কার্জনের মত উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার দরবেশ সম্মেলন দেখেছেন, তাঁরা এ অস্বাভাবিক আত্মপীড়ন এবং তা সত্ত্বেও শারীরিক কোন ক্ষত পরিলক্ষিত না হওয়ার বিষয় অবগত আছেন। ইবনে বতুতার ভ্রমণ-বিবরণের ইউরোপীয় ব্যাখ্যাকারীদের সবাই ইবনে বতুতার অতি বিশ্বাসপ্রবণতা ও প্রখ্যাত শেখ বা সাধুপুরুষদের অতি প্রাকৃত বা অলৌকিক কার্যকলাপের প্রতি অস্বাভাবিক আসক্তির বিষয় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ইবনে বতুতার বিশ্বাসপ্রবণতা যে সীমাহীন ছিল না তার প্রমাণ রয়েছে তার বর্ণনার একাধিক স্থানে; অলৌকিক ব্যাপারের কাহিনী তিনি অন্যের কাছে শুনে বর্ণনা করেছেন। সে-সবের জন্য তাকে দায়ী করা যায় না। মুসলিম জনসাধারণ ফকির দরবেশদের কেরামতি বা অলৌকিক ক্রিয়াকলাপে আগে যেমন বিশ্বাস করত এবং ঐসব অলৌকিক কার্যকলাপের। সঙ্গে নিজেকে জড়িত করছেন বা নিজেকে দেখেছেন বলে দাবী করেছেন সে সব স্থানে। তার বর্ণনার সত্যতার বিষয়ে অবশ্যই প্রশ্ন জাগে। কৈফিয়তস্বরূপ বলা যেতে পারে যে ঐসব ঘটনা হিপনোটিজম বা সম্মোহন বিদ্যার সাহায্যে ঘটেছিল। অনুরূপ একটি ঘটনার বিষয় মুসলিম ধর্মোপদেষ্টা উল্লেখ করছেন হ্যংটো শহরে একজন চীনা যাদুগীরের ভোজবিদ্যার কৌশল প্রদর্শন প্রসঙ্গে। অন্ততঃ ব্যাপারগুলিকে আমরা। যাদুগীরের হাতের কলাকৌশল বলেই মনে করতে পারি। কিন্তু তাতেই এ ব্যাপারের পরিসমাপ্তি ঘটে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা তার ভারত-ভ্রমণের সময় কোয়েল হতে। পলায়নের বিষয় এখানে উল্লেখ করতে পারি। আমরা এ অলৌকিক কার্যকলাপ পুরোপুরি বিশ্বাস করব নতুবা পর্যটককে অসত্য ভাষণের দোষে দোষী করব। উনবিংশ শতাব্দীর বাস্তববাদী ও যান্ত্রিক মানব মন সহজে কিছুই বিশ্বাস করতে চায় নি, কারণ তখনও ইবনে বতুতার ভ্রমণ-বিবরণকে তারা পুরোপুরি কল্পনাপ্রসূত বলতেও কসুর করেনি। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর পাঠকের মনে খোদা ও মানুষের শক্তির উপর বিশ্বাস প্রবলতর। সে তাই সমালোচনা করতে পারে কিন্তু অলৌকিক ক্রিয়াকলাপকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করতে পারে না। কঠোর শারীরিক মানসিক পরিশ্রমের দ্বারা একজন দরবেশ যে পার্থিব বন্ধন ছিন্ন করে অসাধারণ মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব লাভ করতে পারে তাতে কোন সন্দেহ নেই। অতিপ্রাকৃত এই মানসিক ক্ষমতার প্রথমাবস্থাকে বলা যায়– টেলিপ্যাথি (পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্য ছাড়া কোন অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা বলে মানসিক যোগাযোগ)। সন্দেহপ্রবণ পাঠকের জন্য প্রফেসার ডি. বি. ম্যাকডোনাল্ডের আসপেক্টস অব ইসলাম Aspects of Islam P. 170) গ্রন্থখানার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। একজন ভূতপূর্ব দরবেশ খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষা নিবার পরেও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। সে বিবরণই তিনি উক্ত গ্রন্থে বিবৃত করেছেন বিস্তৃতভাবে। এমতাবস্থায় আমাদের পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে রায় মূলতবী রাখা এবং ইবনে বতুতা সত্য বলে বিশ্বাস করে যা কিছু লিখে গেছেন তার কৃতিত্ব স্বীকার করা।
অবশ্য ইবনে বতুতা যে দরবেশ ও সুফীদের প্রতি একটু অতিরিক্ত অনুরাগী সহানুভূতিশীল হবেন তাতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। মোটামুটি প্রায় সব ধর্মোপদেষ্টাই এসব দরবেশের প্রতি বিরোধভাবাপন্ন না হলেও সন্দেহপ্রবণ। এর মূলে ধর্মীয় ও পার্থিব উভয়বিধ একাধিক কারণ রয়েছে। পক্ষান্তরে ‘মিষ্টিক বা অতীন্দ্রিয়বাদে বিশ্বাসী ব্যক্তিরাও এ সমস্ত ধর্মতত্ত্বজ্ঞানীদের অহরহ অবজ্ঞার চোখে দেখতেন বিশেষ শ্রেণীর ধর্মমতকে তারা আঁকড়ে ধরে থাকতেন বলে। ধর্মীয় শিক্ষার প্রকারভেদই এদের মধ্যে। বিরোধের প্রথম কারণ ছিল। ধর্মতত্ত্বাপদেষ্টাদের জন্য সত্যোপলব্ধির পথ ছিল মাত্র একটি এবং তা ছিল ইলম বা ধর্মতত্ত্ব বিজ্ঞান–যার অঙ্গীভূত রয়েছে যথারীতি কোরআন ও হাদিসের চর্চা। পক্ষান্তরে দরবেশদের মতে সত্যদর্শনের উপায় ছিল মারিফা। তারা বরং বাধার সৃষ্টিই করে। সূফী মতবাদ ছিল প্রচলিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিপন্থী। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে যারা আস্থাবান তারা সূফীমতবাদ মেনে নিতে পারেন না। কারণ তারা ছিলেন ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলার একান্ত পক্ষপাতী। অধিকন্তু শেখের শিষ্যগণ যেভাবে জীবিতাবস্থায় তাঁদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করত এবং সাধুর পর্যায়ে উন্নীত করার চেষ্টায় তাদের নামে খোত পর্যন্ত পাঠ করত, ধর্মতত্ত্বজ্ঞানীদের কাছে তা ছিল ধর্মীয় অমঙ্গলের চিহ্নস্বরূপ, এমনকি একেশ্বরবাদের বিরোধী, ইসলামের দৃষ্টিতে যা ঘোর পাপ বলে পরিগণিত। প্রথমাবস্থায় সূফী এবং ধর্মোপদেষ্টাদের মধ্যে বিরোধে। ফাটল প্রশস্তই ছিল কিন্তু কালক্রমে তা সংকীর্ণ হয়ে আসে। কারণ, সূফীমতবাদ কিছুটা জনপ্রিয়তালাভ করে এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধর্মতত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিপূজার ব্যাপারে আপোষ মীমাংসায় আসতে বাধ্য হয় ধর্মীয় ক্ষেত্রের বাইরেও সূফীমতবাদের যথেষ্ট প্রাধান্য ছিল। এবং সে প্রাধান্যই সূফীমতবাদ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিল। দেখা যাচ্ছে, তারা একটি পৃথক ধর্মীয় গোষ্ঠীর সৃষ্টি করেছিল। জনপ্রিয়তা লাভের প্রচেষ্টায় এ উভয় মতবাদের মধ্যেই একটা প্রতিযোগিতার ভাব বিদ্যমান ছিল। অতঃপর ইসলামের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে তুর্কীদের অনুপ্রবেশের সঙ্গে-সঙ্গে সূফীমতবাদই জনপ্রিয়তালাভে সমর্থ হয়। তার ফলস্বরূপ ধর্ম তত্ত্বজ্ঞানীরা এতদিন যা মানেনি তার অনেক কিছুই মেনে নিতে বাধ্য হয় এবং চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যেই তাদের এ আত্মসমর্পণ চূড়ান্তভাবে পরিসমাপ্তি লাভ করে সূফীমতবাদবিরোধীদলের পুরোধা ইবনে তায়মিয়ার আত্মবিলুপ্তির সঙ্গে-সঙ্গে। ইবনে বতুতা দামেশকে ইবনে তায়মিয়ার সাক্ষালাভ করেন। কিন্তু উভয় মতবাদের এ বৈরীভাব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে চলতেই থাকে। অন্যান্য জায়গার তুলনায় উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় এভাব ছিল কম। সম্ভবতঃ বারবার জাতির স্বধর্মের প্রতি জন্মগত আনুগত্যই ছিল তার মূল কারণ। ধর্ম ও ধর্মপ্রাণ পূণ্যাত্মা ব্যক্তিদের প্রতি তাদের আনুগত্য বা ‘মুরাবিত’ আজও বিদ্যমান আছে। ইবনে বতুতা নিজে একজন শিক্ষাপ্রাপ্ত ধর্ম তত্ত্বোপদেষ্টা হয়েও কেন যে বারবারদের মত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের প্রতি বিশেষ অনুগত ছিলেন তার জবাব আমরা সম্ভবতঃ এখানেই পেতে পারি।
সূফী এবং ধর্মশাস্ত্রানুসারী দলের ভেতর যে বৈরীভাব ছিল তা শিয়া ও সুন্নীগোত্রের বিরোধের তুলনায় একান্ত নগণ্য ছিল বলতে হবে। ইসলামের প্রথম শতাব্দীতে উমাইয়া বংশের খলিফাদের বিপক্ষে রসুলুল্লাহর জামাতা হজরত আলীর পক্ষে যে প্রচারণা চলে তাকে কেন্দ্র করেই শিয়াগোত্রের উৎপত্তি। এ-সময়ে প্রচলিত ধর্মমতে যারা বিশ্বাসী তাদের সঙ্গে শিয়া মতাবলম্বীদের বিরোধিতা প্রবল রূপ ধারণ করে। তার ফলে জনসাধারণ শিয়া-দর্শনের ঐতিহাসিক মূল্যবোধ উত্তমরূপে উপলব্ধি করে নিন্দিত। উমাইয়া বংশের মূলোৎপাটনে সহায়তা করে। কিন্তু প্রকারান্তরে জনসাধারণ অধিকতর স্বৈরাচারী শাসনের কবলে নিপতিত হল আব্বাসীয় আমলে। এই সময়ে শিয়া মতবাদ ভিন্ন একরূপ পরিগ্রহ করল। তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, প্রচলিত রীতিতে খলিফা নির্বাচন বাদ দিয়ে তারা খোদা কর্তৃক নিযুক্ত নিষ্পাপ ও অপ্রতিদ্বন্ধী একজন ধর্মীয় নেতা বা ‘ইমাম’ নিয়োগ করল। তারা বংশানুক্রমে হজরত আলীর গোষ্ঠী হতেই ইমাম। গ্রহণের পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু কতিপয় উপগোষ্ঠীর বিরোধিতায় শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হল না। এসব গোষ্ঠীর প্রধান ছিল দ্বাদশী দল। ইরাক ও ইরানের শিয়া সম্প্রদায় আজও এ-গোষ্ঠীভুক্ত বলে নিজেদের পরিচয় দেয়। তাদের বিশ্বাস, ৮৭৩ খ্রীস্টাব্দে দ্বাদশ ইমাম হিল্লার নিকটবর্তী এক পর্বতগুহায় অন্তর্ধান করেন, আজও তিনি তাঁর অনুসারীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আত্মিক ও পার্থিব কার্যের পথপ্রদর্শকরূপেই আছেন। অধিকন্তু তিনিই একদিন প্রতিশ্রুত ইমাম মেহদীরূপে আবির্ভূত হয়ে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটাবেন। লুক্কায়িত ইমামের–যাঁকে ‘যুগশ্রেষ্ঠ’ আখ্যাও দেওয়া হয় অপূর্ব মতবাদ স্মরণীয় করা হয় হিল্লার পাদদেশে আয়োজিত উৎসবের নানা রকম অনুষ্ঠানে। ইবনে বতুতা এ উৎসবের একটি হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে।
শিয়া মতবাদ বরাবরই গোঁড়া বা প্রচলিত মতাদর্শ অপেক্ষা অধিকতর উগ্র সাম্প্রদায়িকতার পরিবাহক। পূর্ব হতেই শিয়া মতবাদের প্রভাবে শিয়াগোষ্ঠীর শাখা প্রশাখার জন্য বিভিন্ন মতবাদের প্রভাব শিয়াগোষ্ঠীর শাখা-প্রশাখা কালে হজরত আলী ও তার বংশধরদের প্রতি এক চরম মত পোষণ করতে থাকে, এমন কি তাদের অবজ্ঞার দৃষ্টিতেও দেখতে আরম্ভ করে। এই চূড়ান্ত পন্থীরা (ghulat) সিরিয়ায় আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হয়েছিল বলে মনে হয়। আজও সেখানে বাস্তবিক পক্ষে ড্রস (Druse) ও নুসাইরিন (অধুনা আলাবিস) নামক সর্বশ্রেষ্ঠ গোত্র দু’টির পাশাপাশি দেখতে পাওয়া যায় দ্বাদশী দলের অধিকাংশকে যারা স্থানীয় লোকদের কাছে মোতাওয়াল্লি নামে পরিচিত। এই সহ-অবস্থানের ফলেই তাদের ভেতর এ অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি। শিয়ারা যেখানে ঘৃণার চোখে দেখে সুন্নীরা সেখানে অপছন্দ মাত্র প্রকাশ করে। শিয়াদের ঘৃণা যে কেবল অমুসলমানদের প্রতি তা নয়, ভিন্ন পথাবলম্বী মুসলমানদের–বিশেষ করে সুফিদেরও তারা ঘৃণা করে। কারণ, সূফিরাও শিয়া মতবাদ অনুমোদন করে না। এক সম্প্রদায়ের প্রতি অপর সম্প্রদায়ের এ-ধরনের বিরূপ মনোভাবের দরুনই মামলুক শাসনামলেও সেখানে দলাদলি ও বিভেদ মাথা তুলে আছে। ইবনে বতুতার ভ্রমণ-বিবরণীতে শিয়া সুন্নীর শক্রতার কথা একাধিক বার উল্লেখিত হয়েছে। অবশ্য যদিও ইবনে বতুতা শিয়া বা আলবিন এর স্থলে কুখ্যাত ‘রাফিজ’ বা প্রত্যাখ্যানকারী শব্দ ব্যবহার করেছেন তবু তার ব্যক্তিগত মতামত বা বিদ্বেষ মূল বক্তব্যকে কোন অংশে বিকৃত করেনি। ইমাম বা ধর্মীয় নেতা নিয়োগে শিয়া সম্প্রদায় যে নীতি অনুসরণ করত তাতে পরোক্ষভাবে এসব নামের উদ্দেশ্য ও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। শিয়া সম্প্রদায় মনে করত যে একমাত্র হজরত আলীই তাঁর জাতি ভ্রাতা হজরত মোহাম্মদের (দঃ) স্থলাভিষিক্ত হবার যোগ্য ছিলেন এবং পূর্বে যে তিন জন খলিফা রাজ্য চালনা করে গেছেন তাদের শিয়ারা বিশ্বাসঘাতক ও পরস্পাপহারী বলে আখ্যায়িত করেছে। ধর্মপ্রাণ সুন্নী মুসলমান হজরত মোহাম্মদের (দঃ) নিকট-অনুচর বা আস্হাব হিসাবে উক্ত খলিফাদের নামের পরে সম্মানসূচক আশীবাণী উচ্চারণ করে কিন্তু তৎপরিবর্তে শিয়ারা করে অভিশাপ। শিয়াদের বিভিন্ন বিরোধী রীতি-নীতি ও মতামত অপেক্ষা খলিফাদের প্রতি তাদের অপমানসূচক আচরণই সুন্নী মুসলমানদের ক্রোধ ও বিদ্বেষের উদ্রেক করেছে বেশি।
এইচ. এ. আর. গিব
Leave a Reply