ইনসাইড ‘র’ : ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার অজানা অধ্যায় – অশোকা রায়না
মূল : অশোকা রায়না
অনুবাদ ও সম্পাদনা : আবু রূদ
বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল পাবলিশিং
প্রকাশক – এ. আর. মো. শহিদুল ইসলাম – আবু রূদ
বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল পাবলিশিং
প্রথম সংস্করণ : ৭ নভেম্বর ১৯৯৩
প্রচ্ছদ : এম. হামিদুল হক মানিক
.
উৎসর্গ
আমার নানী মরহুমা আসিয়া খানম যিনি আমাকে লালন-পালন করেছেন, আমৃত্যু সুখে দুঃখে পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁর পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে-
.
চতুর্থ সংস্করণের কথা
পৃথিবীর প্রতিটি দেশেরই গুপ্তচরসংস্থা থাকে। কিন্তু এর খুব কমই আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিচরণের ক্ষমতা রাখে। আবার তার মধ্যে হাতে গোনা ক’টি সংস্থা সফলতার সাথে অপারেশন পরিচালনার রেকর্ড গড়তে পারে। ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা- ‘র’ এমনি একটি প্রতিষ্ঠান। আবার সব সাফল্যের মাঝে তাদের সবচেয়ে বড় ‘অর্জন’ হচ্ছে ১৯৭১ সালে পরিচালিত ‘অপারেশন বাংলাদেশ’।
গুপ্তচর সংস্থা নিয়ে পৃথিবীতে অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে। এর সবগুলোই পাঠকদের কাছে আকর্ষণীয় হিসেবে আদৃত। কারণ গুপ্তচর বৃত্তির রহস্য ও অজানা কথা জানার আগ্রহ সকলেরই রয়েছে। ভারতীয় সাংবাদিক অশোকা রায়নার লেখা ‘ইনসাইড র: ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার অজানা অধ্যায়’ এমনি একটি আকর্ষণীয় বই। ‘র’ এর ইতিহাস ও কর্ম তৎপরতা নিয়ে এই বইটিই প্রথম প্রকাশিত দলিল ।
আমি বইটি প্রথম অনুবাদ করি ১৯৯৩ সালে। এর মাঝে এর তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তবে দীর্ঘ দিন যাবত বইটির নতুন কোন সংস্করণ প্রকাশিত হয়নি। ভারতের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ভিকাস পাবলিশিং হাউস প্রাইভেট লিমিটেড ইংরেজিতে বইটি প্রথম প্রকাশ করে ১৯৮১ সালে। এটিই ‘র’ নিয়ে লিখিত প্রথম বই যাতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘র’ এর ভূমিকা ছাড়াও সিকিমের ভারতভুক্তকরণ সম্পর্কিত প্রামানিক দলিল উপস্থাপন করা হয়। সাংবাদিকতায় যোগ দেয়ার পর আমি ভিকাস পাবলিশিং হাউস প্রাইভেট লিমিটেড থেকে অনুমোদন নিয়ে বইটির বাংলা সংস্করণ প্রকাশ করি। চলতি সংস্করণে ভাষাগত বেশ কিছু সম্পাদনা করা হয়েছে। এছাড়া ‘র’- এর নতুন সাংগঠনিক ছক, গুপ্তচরবৃত্তির বৃত্তসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবি সংযুক্ত করা হয়েছে ওই সংস্থার পরিচালিত তৎপরতার দলিল হিসেবে।
আশা করি গুপ্তচরবৃত্তির রহস্যময়তায় অনুরক্ত পাঠক ছাড়াও ইতিহাস সচেতন পাঠকের কাছে বইটি আদৃত হবে।
আল্লাহ হাফেজ।
আবু রূশ্দ
ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪
অনুবাদকের অনুস্মৃতি
‘গুপ্তচর’ ও ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ নিয়ে আগ্রহ কম-বেশি সবারই আছে। বিখ্যাত ‘জেমস্ বন্ড’ বা ‘মাসুদ রানা’র ভক্ত এ দেশে বোধকরি কম নয়। (আমাদের দেশের প্রখ্যাত লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন একমাত্র অপ্রতিদ্বন্দ্বী লেখক যিনি তাঁর রচনায় গুপ্তচরবৃত্তি ও এসপায়োনজ নিয়ে বেশ কিছু লেখালেখি করেছেন)। ক্লান্তিময় একঘেয়ে জীবনে ক্ষণিকের জন্য কল্পজগতে ভেসে বেড়ানোর মধ্যে আছে এক ধরণের আলাদা রোমাঞ্চ। তবে বাস্তবতার নিরিখে বলতে হয়, এ সবই হচ্ছে ‘Spy Fiction’ বা ‘Spy Thriller’ কিন্তু ‘Real World of Spies’ নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে ইন্টেলিজেন্স জগত একটি রূঢ়, নিরামিষ, নিরানন্দময় কর্মক্ষেত্র হিসেবে গুপ্তরচরবৃত্তিতে নিয়োজিত পেশার লোকদের কাছে পরিচিত। সুপ্রিয় পাঠক, এতে অবশ্য আপনারা যারা ইন্টেলিজেন্স নিয়ে পড়াশোনা করতে আগ্রহী তাদের অজানা জগত আবিষ্কারের মজা মোটেই ক্ষুণ্ণ হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই বরং নিষিদ্ধ নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার মোহাচ্ছন্নতা আছে পুরোপুরি।
আধুনিক গুপ্তচরবৃত্তি অত্যন্ত ব্যাপক পরিসরে পরিচালিত হয়। এর প্রকৃত ধরণ ঘটনা সংঘটনের সময় বোঝা বা জানা না গেলেও পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তা আলোর মুখ দেখে। এ বইটির ক্ষেত্রেও এ কথাটি সর্বাংশে প্রযোজ্য। আজ থেকে ২০ বছর আগে সিকিম নিয়ে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার গৃহীত পদক্ষেপ ভারত অস্বীকার করলেও এখন নিজেরাই তা প্রকাশ করছে। আসলে ইন্টেলিজেন্সে ‘আজ যা মিথ্যে-কাল তা সত্য’ কিন্তু ততোদিনে ‘Operation is over’.
আমি অশোকা রায়নার লেখা “Inside RAW – The Story of India’s Secret Service” বইটি প্রথম পড়ি ১৯৮৫ সালে। তখন বইটি আমার অনুসন্ধিৎসু মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করলেও সামরিক বাহিনীতে কর্মরত থাকায় অনুবাদ কাজে অগ্রসর হতে পারিনি। পরবর্তীতে যখন হঠাৎ করে স্বাস্থ্যগত কারণে অবসর গ্রহণ করি তখন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রংপুর শাখা ছাত্রমৈত্রীর প্রাক্তন নেতা কাজী মাজিরুল ইসলাম লিটন আমাকে বইটি অনুবাদ করার জন্য বারবার তাগিদ দিয়ে এক প্রকার অতিষ্ঠ (!) করে তোলে। এরপর ঢাকায় চলে আসার পর দৈনিক সমাচারের’ সিনিয়র রিপোর্টার অগ্রজপ্রতিম খন্দকার গোলাম আজাদ বইটির তথ্যগত গুরুত্ব অনুধাবন করে আমাকে ‘কোমর বেঁধে’ অনুবাদকর্ম শেষ করার জন্য অনুরোধ করেন। বলতে গেলে ওনার ব্যক্তিগত উৎসাহে অসুস্থ শরীর নিয়েও আমি আরাধ্য কাজ শেষ করতে বাধ্য হই। এদিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিন্তিত ছিলাম যে, এরূপ একটি স্পর্শকাতর বই-এর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় প্রকাশনা সংস্থা ‘Vikas Publishing House’ অনুবাদের অনুমতি প্রদান করবে কিনা? কারণ বইটিতে প্রকাশিত অনেক তথ্য ও ঘটনা ভারতীয় বিশেষ করে ‘র’-এর স্বার্থের কিছুটা হলেও পরিপন্থী। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে উক্ত প্রকাশনী সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম সি চাওলা মাত্র এক মাসের মধ্যে অনূদিত বাংলা সংস্করণ প্রকাশের অনুমতি প্রদান করেন, যা আমার কাছে ভারতের দীর্ঘদিনের গণতন্ত্ৰ চর্চা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের স্বাধীনতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ বলে প্রতিভাত হয়েছে। এরপর আর বাধা কোথায়? প্রকাশক খোঁজার (!) কষ্টটুকু আমাকে করতে হয়নি, কারণ আমার ক্যাডেট কলেজের সহপাঠী বিশিষ্ট প্রকাশনী সংস্থা ‘মিলারস প্রকাশনী’র স্বত্বাধিকারী তারিক হাসান তো গত ক’মাস হলো একপায়ে খাড়া হয়েই ছিল। তাই দিনক্ষণ ঠিক করে মাঠে নেমে পড়তে ওর একটুও দেরি হয়নি।
আমাদের দেশে ‘র’ সম্পর্কিত প্রচুর লেখালেখি হয়েছে ও হচ্ছে এবং এ ধরণের সব লেখাতেই ‘র’-এর বিভিন্ন কার্যক্রম বা সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়ে থাকে যা সত্য হলেও অনেকে তাঁদের নিজস্ব মতাদর্শগত কারণে সত্য বলে স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করেন। আমার এ বইটি অনুবাদ করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, উক্ত মতাদর্শীদের কাছে ভারতীয় লেখকের স্বীকারোক্তি পৌঁছে দেয়া, যেন তাঁরা কোনো অজুহাতে বলতে না পারেন যে, এ সব বাংলাদেশী লেখকের লেখা ‘ডাহা মিথ্যে’ বা ‘স্রেফ গালগপ্পো’।
যেহেতু, মূল বইটি ভারতীয় লেখকের লেখা তাই তথ্যগত সত্যাসত্য প্রমাণের দায়দায়িত্ব লেখকের কাছেই রয়ে গেছে, এখানে আমার নিজস্ব কোন মতামত প্রতিফলিত হয়নি ও সে সুযোগও আমার ছিল না।
শেষে আপনাদের কাছে আমার একটু প্রয়োজনীয় সাফাই (!) গাইবার আছে আর তা হ’লো আমি কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নই (যদিও কোনো একটি রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি আমি আকৃষ্ট এবং ভোটের সময় সে দলের প্রতীকেই ‘সিল ছাপ্পর মেরে থাকি) এবং কারো পুন্যস্মৃতি তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হোক বা শহীদ জিয়ারই হোক সেখানে আঘাত দেয়ার উদ্দেশ্যে আমি এ বইটি অনুবাদ করিনি এবং এটা সকল মতাদর্শের সচেতন পাঠকের জন্য অনূদিত হয়েছে।
সুতরাং আসুন, একবার অন্তত গুপ্তচরবৃত্তির চোরাগলিতে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।
আবু রূশদ
২৩ কার্তিক ১৪০০ বাংলা
৭ নভেম্বর ১৯৯৩ ইংরেজী
ঢাকা।
.
মুখবন্ধ
—লেখকের কথকতা
পৃথিবীর অন্য কোনো সংস্থা, ভারতের মন্ত্রী পরিষদ সচিবালয়ের অধীন বৈদেশিক গুপ্তচর সংস্থা ‘রিসার্চ এন্ড এ্যানালিসিস উইং’ অর্থাৎ ‘র’-এর মতো মাত্র বার বছর সময়কালের মধ্যে এতো শোরগোল ও সমালোচনার ঝড় তুলতে পারেনি।
জনগণের নিকট সিনেমা, বইপত্র, পত্র-পত্রিকার রিপোর্টের মাধ্যমে বন্যার ন্যায় ক্রমাগত প্রবহমান ‘বিকৃত তথ্যের উপস্থাপনা’ (ইন্টেলিজেন্স জগতের অর্থহীন অপভাষা প্রয়োগে) তাদের মনে একটি বিকৃত চিত্রের প্রতিস্থাপন ঘটায়। প্রকৃত সত্যের পরিবর্তে অজ্ঞানতার বিভিন্ন স্তর সাধারণ জনগণের নিকট উপস্থাপন করা হয়। সাধারণের মনে এ ধারণা জন্মে যে, ‘র’-এর ঝুলিতে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার সঞ্চয়ই বেশি। যে কোনো সরকার এমনকি আমাদের সরকারও ‘সাফল্যের তুলনায় অধিক ব্যর্থতার বোঝা’ বহনকারী এমন কোনো ‘প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ’ সংস্থাকে দীর্ঘদিন পুষতে পারেন না। ‘র’-এ কর্মরত ব্যক্তিবর্গ যারা ‘গুপ্তচর’ হিসেবে পরিচিত, তারা প্রতিবাদের কোনো বিশেষ সুযোগ না থাকায় মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে বাধ্য হন। এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার যে, কোথাও যখন ‘র’ বিরোধী প্রচারণা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তখন সরকার পর্যন্ত অনুরূপ ‘চুপচাপ’ থাকার নীতি অবলম্বন করেন। তবে প্রথমবারের মতো ১৯৮০ সালের ৯ই জুলাই নয়াদিল্লিতে সি আই ডি-র (Criminal Investigation Department) সম্মেলনের সমাপ্তি দিবসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পূর্ববর্তী সরকারের (জনতা সরকার-মোরারজী দেশাই) আমলে ‘র’-এর বিরুদ্ধে পরিচালিত কর্মকাণ্ডের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং উল্লেখ করেন, সংসদে ও বাইরে একটি ভুল ধারণার জন্ম হয়েছে যে, এ সংস্থা (‘র’) দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এ ধরণের গুজব সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
গুপ্তচরবৃত্তি সংক্রান্ত কোনো বই লেখার জন্য বিভিন্ন উৎস বা সূত্রের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ বিষয়টির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে দালিলিক তথ্য প্রমাণ গ্রন্থকারের নিকট হয়তো খুবই অল্পমাত্রায় অথবা একেবারেই সহজলভ্য হয় না। তবে স্পর্শকাতর সংবাদ প্রতিবেদন ও জনসমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘র’-এ কর্মরত ও পূর্বে কাজ করেছেন এমন অনেকে এ ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তান্বিত ছিলেন এবং তাদের কর্মকালের অনেক বিবরণ প্রকাশ করতে আগ্রহান্বিত হন। এর ফলে আমি তাদের অনেককে ‘কথা বলার’ মতো পরিস্থিতিতে পেয়ে যাই। এখানে আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই যে, ‘র’-এর কর্মরত কোনো ব্যক্তি আমার এ বইটির কোনো তথ্যে বা ঘটনার সরাসরি অনুমোদন দেননি বা তাদের কেউ পরোক্ষভাবে বা ইঙ্গিতেও বইটি লেখায় উদ্বুদ্ধ করেননি। আসলে আমি যখন ‘র’-এর সাবেক প্রধান আর এন কাও-এর সাথে যোগাযোগ করি তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, “এ বইটি কখনো লেখা উচিৎ নয়।” অবশ্য ততোদিনে বইটির প্রথম খসড়া তৈরি শেষে তা প্রকাশকের কাছে পাঠানো হয়ে গেছে। কাও গুপ্তচর জগতের প্রাচীন প্রবাদ “যার যতোটুকু জানা প্রয়োজন তার শুধু ওটুকুই জানা দরকার”-এ নীতিবাক্যের উল্লেখ করে আমাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেন।
বইটি লেখার প্রথম দিকে আমার বেশকিছু বন্ধু-বান্ধব আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আমি কীভাবে ‘র’ সম্পর্কে লিখতে পারি যেখানে আমি কখনো ওই সংস্থায় কর্মরত ছিলাম না? যারা এভাবে চিন্তা করতেন, তাদের কাছে আমার শুধু একটি কথাই বলার আছে। একজন সাংবাদিক যিনি যে কোনো বিষয়ের ‘তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদক’ হোন না কেন, তাকে কোনো বিষয়ে প্রতিবেদন লিখতে হলে তার ওই রূপ পরিস্থিতি বা পরিবেশে অবস্থানের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয় নয়। যাহোক, আমাকে প্রচুর তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ, পর্যালোচনা ও পড়াশোনা করতে হয়েছে।
আমি মনে করি, এ বইয়ে যে সব তথ্য ও ঘটনাই সন্নিবেশিত থাকুক না কেন তা ইতোমধ্যে ‘অন্যপক্ষের’ জানা হয়ে গেছে। পাকিস্তানী ইন্টেলিজেন্স, চীনা ইন্টেলিজেন্স, মার্কিন সি আই এ, বৃটিশ সিক্রেট সার্ভিস (এস আই এস) বা রাশিয়ান কে জি বি ও অন্যান্য দেশের ইন্টেলিজেন্স সংস্থা এ বইয়ে উল্লিখিত ঘটনাপঞ্জি ভালোভাবেই জানে এবং বর্ণিত এসব ঘটনা এরমধ্যে ঘটেও গেছে। সুতরাং ভারতীয় জনগণের এ সব ‘ব্যাপার স্যাপার’ জানায় কোনো বাধা থাকা উচিত নয় বরং এর যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণও নেই।
এখানে যা বিধৃত হয়েছে তা আমার তিন বছরাধিককালের পরিশ্রমের ফসল। অবশ্য এরমধ্যে খণ্ড খণ্ডভাবে পত্র-পত্রিকায় ছিটেফোঁটা কিছু লিখেছি। অনুমতিসাপেক্ষে কারো দেয়া তথ্য ছাড়া যাদের নাম লেখনীর ধারাবাহিকতায় সংযোজিত হয়েছে তারা কোনো উপায়েই আমাকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনো তথ্য উপাত্ত সরবরাহ করেননি। ঘটনার সত্যাসত্য নির্ধারণে অতীতে ‘র’-এ কর্মরত ও বর্তমানে কর্মরত কেউ কেউ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের নাম তদীয় ইচ্ছানুসারে প্রকাশ করা সম্ভব হলো না। আমি তাদের প্রতি একান্তভাবে কৃতজ্ঞ। তাদের বছরের পর বছর অসচেতনভাবে বর্ণিত ঘটনাপঞ্জির সাহায্য ছাড়া, কল্পিত ঘটনা ও বাস্তবের মধ্যে সীমারেখা টেনে ‘র’ সম্পর্কিত পরিপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন সম্ভব ছিল না। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ‘র’-এর কার্যক্রম নিয়ে এটি একটি পরিপূর্ণ বই ও সম্ভবত এখানে উল্লিখিত ঘটনাসমূহের বর্ণনার বাইরে এ সংক্রান্ত নতুন কিছু যোগ করার নেই এবং তা করলেও সত্যের অপলাপ হবে মাত্র। তবে আমি দাবি করছি না যে, এ সবই সর্বাংশে সত্য ও নিখুঁত। যখন আমি বিভিন্ন অপারেশনের বর্ণনা দিয়েছি তখন অনেক ক্ষেত্রে ঘটনা বর্ণনায় ও এর সাথে সংশ্লিষ্টদের নাম পরিবর্তন করেছি মাত্র। কিছু কিছু ঘটনা উল্লেখ করায় অনেকেই আমার শত্রুতে পরিণত হতে পারেন বলে কাউকে ব্যক্তিগত আঘাত দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধুমাত্র ‘র’-এর প্রয়োজনের দিকটিই ভেবেছি।
এ বইয়ে বর্ণিত বিষয়াবলী আমার নিজস্ব সংগ্রহ, ‘বেনামি’ ব্যক্তিবর্গের গৃহীত সাক্ষাৎকার, সংবাদপত্রের রিপোর্ট, সাময়িকী ও বইপুস্তক থেকে নেয়া হয়েছে। আমি স্বনামে ও বেনামে উল্লিখিত সবার নিকট ও প্রকাশকের কাছে তাদের সহযোগিতার জন্য বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
অনেকেই সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও তথ্য সংগ্রহে সহৃদয় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন 1 আমি বিশেষ করে মিসেস ইন্দিরা লাউল যিনি পাণ্ডুলিপিটি পড়ে দিয়েছেন ও আমার পিতা লে. কর্ণেল বি এল রায়না যিনি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়ে আমাকে ধন্য করেছেন তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। সবশেষে আমার স্ত্রী নীরা, যে এ বিষয়টিকে পুরোপুরি ‘সতীনের’ মতো মনে করেও যথেষ্ট শ্রম দিয়েছে ও দু’পুত্র রজত ও রাজীব যারা হৈ- হট্টগোল না করে আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটায়নি (!) তাদের কথাও এখানে স্মরণ করতে হয়। যখন বইয়ের সব কাজ শেষ হলো তখন দশ বছর বয়সী রাজবী তার এক বন্ধুকে ব্যাখ্যা করে বলছিল যে, “আমার আব্বা, ‘র’-নিয়ে একটি বই লিখেছে। এটা গুপ্তচরদের গল্প নিয়ে লেখা, যা বড়রা বুঝতে পারে না, উনি তাদের বোঝাতে চাচ্ছেন, আসলে ব্যাপারটা কি।” আমি মনে করি না এর চেয়ে ভালোভাবে অন্যকিছু বলার আর প্রয়োজন আছে।
অশোকা রায়না
নয়া দিল্লি
Leave a Reply