আ মনস্টার কল্স – প্যাট্রিক নেস
ভাষান্তর – আমিনা মীম, এম এস আই সোহান
প্রকাশকাল – অক্টোবর ২০২০
.
লেখকের কথা
সিয়োভান ডড-এর সাথে আমার কখনও সাক্ষাৎ হয়নি। আমি তাকে আপনাদের মতোই তার দারুণ বইগুলোর মাধ্যমে চিনি। সেই চারটি চমৎকার প্রাপ্তবয়স্ক উপন্যাসের মাধ্যমে, যার মধ্যে দুটি তিনি বেঁচে থাকতে প্রকাশিত হয়েছিল আর বাকি দুটি তাঁর অকালমৃত্যুর পর। সেগুলো যদি পড়ে না থাকেন, তবে খুব শীঘ্রই পড়ে নেবেন!
এটা তাঁর পঞ্চম বই হতো। তাঁর কাছে চরিত্র, প্রেক্ষাপট আর গল্পের শুরুটা তৈরি ছিল। ছিল না কেবল সময়।
আমাকে যখন তাঁর বইটা শেষ করতে বলা হলো, তখন ইতস্তত করেছিলাম। তাঁর হুবহু নকল করে একটি উপন্যাস লিখতে চাইনি আমি। সেটা তাঁর প্রতি, পাঠকের প্রতি আর সবচেয়ে বেশি এই কাহিনির প্রতি অন্যায় করা হতো। আমার মনে হয় না ভালো একটি রচনা সে-রকম হওয়া উচিত।
কিন্তু ভালো আইডিয়ার একটা গুণ হলো সেটা থেকে অন্য অনেক আইডিয়া জন্ম নিতে পারে। আমি নিজে কিছু ভাবার আগেই সিয়োভানের আইডিয়াগুলো আমার মাথায় নতুন আইডিয়ার উৎপত্তি ঘটায় এবং আমি একটি গল্প বলতে উদ্বুদ্ধ হই। এটা করার জন্যে যে-কোনো লেখকই মুখিয়ে থাকেন।
আমি অনুভব করেছি, এবং করছি, আমাকে যেন একটি ব্যাটন দেওয়া হয়েছে, যেন একজন চমৎকার লেখক আমাকে তাঁর একটি গল্প দিয়ে বলেছেন, ‘যাও। একে নিয়ে অভিযানে বের হও।’ আর আমি তা-ই করেছি। এই কাজটিতে আমি কেবল একটি নিয়ম মেনেছি, আর তা হলো এমন একটি বই লেখা, যেটা সিয়োভান পছন্দ করবেন। অন্য কিছুতে তেমন একটা যায়-আসে না।
আর এখন এই ব্যাটনটা আপনাদেরকে সমর্পণ করছি। লেখকের মৃত্যুর সাথে সাথেই তার লেখনী শেষ হয়ে যায় না। এটা সিভোয়ান আর আমার লেখনী।
অভিযানে নেমে পড়ুন একে নিয়ে।
প্যাট্রিক নেস
লন্ডন, ফেব্রুয়ারি ২০১১
.
উৎসর্গ
শিভন’কে
.
বলা হয়, তারুণ্য জীবনে মাত্র একবারই আসে। কিন্তু তা কি পর্যাপ্ত সময়ের জন্য আসে না? একজন যতটা বয়ে বেড়াতে পারে তারচেয়েও বেশি সময়ের জন্যই আসে।
–হিলারি ম্যান্টেল, অ্যান এক্সপেরিমেন্ট ইন লাভ
.
এক দানবের আহ্বান
যেমনটা হয়ে থাকে, দানবটি মাঝরাতেই এলো।
তখন কনর পুরোপুরি সজাগ।
একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে সে। অবশ্য এই দুঃস্বপ্নটা এখন সে প্রায়ই দেখে। দুঃস্বপ্ন জুড়ে থাকে অন্ধকার, বাতাস আর চিৎকার। সেখানে হাজার চেষ্টার পরও তার হাত কোনো কিছু আঁকড়ে ধরতে পারে না। প্রতিবারই স্বপ্নটা শেষ হয়–
‘চলে যাও।’ কনর তার অন্ধকার শোবার ঘরে শুয়ে ফিসফিসিয়ে বললো। হাত নাড়িয়ে দুঃস্বপ্নটা তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো। বাস্তবে যেন এমন দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করতে না পারে।
‘এখনই চলে যাও।’
টেবিলের ওপর ওর মা যে ঘড়ি রেখেছেন, সেটাতে রাত ১২:০৭ বাজে। মধ্যরাত পার হয়ে গেছে ৭ মিনিট আগে। রবিবারের হিসেবে অনেক রাত।
এই দুঃস্বপ্নের কথা সে কাউকে বলেনি। মাকে এখনও জানানো হয়নি। অবশ্যই অন্য কাউকে সে বলতে যাবে না। বাবাকেও ফোনে বলেনি, আর নানুকে বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। স্কুলের কাউকেও বলা হয়নি।
দুঃস্বপ্নে তার সাথে কী হয়েছে, সেসব অন্য কারো জানার কোনো মানে নেই।
কনর চোখ পিটপিট করে রুমের চারপাশটায় তাকালো। মনে হচ্ছে কিছু একটা নেই। সে উঠে বসে। দুঃস্বপ্নটা চলে যাচ্ছে। কিন্তু তার সাথে আরও কী যেন চলে যাচ্ছে, সে ঠিক বুঝতে পারছে না। জিনিসটা যে কী…
নিস্তব্ধতায় কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করলো সে। খালি বাসায় রাতে যেমন শব্দ হয়ে থাকে, সে-সব ছাড়া নতুন কিছু শোনা গেল না। সিঁড়ির নিচ থেকে মাঝেমধ্যে আসা টুকিটাকি শব্দ আর মায়ের রুম থেকে বেডিং-এর শব্দ পাওয়াগেল।
নাহ্, আর কিছু না।
ঠিক তখনই মনে হলো, কেউ একজন তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে।
কেউ একজন তাকে ডাকছে।
‘কনর।’
আতঙ্ক কনরকে গ্রাস করে ফেললো। পেটের ভেতরটা বারবার মোচড় দিয়ে উঠছে। ওটা কি তার পিছু নিয়েছে? দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এসেছে?
‘বোকার মতো ভেবো না।’ নিজেকেই বললো সে, ‘এখন তো তুমি আর ছোটো
আ মনস্টার কলস-১১
বাচ্চা না।’
গত মাসেই সে তেরোতে পা দিয়েছে। ছোটো বাচ্চারা দানব দেখতে পারে, ছোটো শিশুরা…
‘কনর।’
আবার! কনর ঢোক গেলে। অক্টোবরের উষ্ণ রাত, তাই জানালা এখনও খোলা । সম্ভবত বাতাসে পর্দা নড়ায় এমন শব্দ…
‘কনর।’
এটা বাতাস হতেই পারে না, কারো কণ্ঠই হবে। কিন্তু কণ্ঠটা তার চেনা কারও না। তার মায়ের গলা এমন না, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। কণ্ঠটা কোনো মহিলারও না। এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো তার বাবা বুঝি আমেরিকা থেকে হুট করে চলে এসেছে–
‘কনর।’
না, এটা তার বাবা না। কণ্ঠটা দানবীয়, বুনো আর ভীষণ অশান্ত। বাইরে কাঠ মোচড়ানোর শব্দ পাওয়া গেল। যেন কোনো বিশাল কিছু কাঠের মেঝেতে উঠে দাঁড়িয়েছে।
ওখানে গিয়ে জিনিসটা দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। আবার মনে মনে উঁকি দেওয়ার কৌতূহলও থামাতে পারছে না।
আপাতত সে পুরোপুরি জেগে আছে। গায়ের কাঁথা সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গেল। জোছনার আবছা আলোতে সে বাড়ির পেছন দিকের পাহাড়ের ওপরে থাকা চার্চটা পরিষ্কার দেখতে পায়। চার্চের পাশেই আঁকাবাঁকা পুরোনো ট্রেন- ট্র্যাক। দুটো লোহার লাইন আলোতে চকচক করছে। চাঁদের আলোতে চার্চের নিকটস্থ গোরস্থানটাও দেখা যাচ্ছে। এতদিনে সমাধিফলকগুলোর লেখা সব মুছে গেছে।
পাশের ইয়ো গাছটাও দেখতে পাচ্ছে কনর। গোরস্থানের একদম মাঝামাঝি গাছটার অবস্থান। গাছটা সম্ভবত এই চার্চ তৈরি করার আগ থেকেই এখানে আছে। সে জানে এটা ইয়ো গাছ, কারণ ছোটোবেলায় তার মা এটা বলে দিয়েছিলেন যে সে যেন ভুলেও এ গাছের ফল না খায়। ফলগুলো না-কি বিষাক্ত।
আবার কেউ ডাকছে তাকে।
‘কনর।’
যেন এইমাত্র তার কানে ফিসফিসিয়ে ডাকলো ।
‘কী?’ কনর অধৈর্য হয়ে বলে। ওর বুক ধুকপুক করছে।
চাঁদের সামনে মেঘ জমে চারপাশ আরও অন্ধকার হয়ে গেল। পাহাড় থেকে এক পশলা দমকা বাতাস ভেসে আসে তার ঘরে। কাঠ মোচড়ানোর অদ্ভুত সব শব্দ হচ্ছে। যেন পৃথিবীর আজ ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে, তার ক্ষুধার্ত পাকস্থলীর রাগী গর্জন।
আস্তে আস্তে মেঘ সরে যেতেই আবার চাঁদ দেখা গেল। ইয়ো গাছের ওপর চাঁদের আলো পড়েছে। গাছটি এখন তার বাসার পেছনের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে।
এই সেই দানব
কনর দেখলো গাছের ওপরের দিকের শাখা-প্রশাখাগুলো মিলে ভয়ানক একটা চেহারার অবয়ব নিয়েছে, সেখানে মুখ, নাক আর একজোড়া চোখ দেখা যাচ্ছে যা সোজা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। বিশাল বড়ো বড়ো দুটো শাখা মিলে সেটার হাতের আকার নিয়েছে। গাছের বাকি অংশ থেকে মেরুদণ্ড, বুক আর শরীরের অন্যান্য অংশগুলো গড়ে উঠেছে। গাছের চিকন পাতাগুলো চামড়ার কাজ করছে। দানবটা এমনভাবে শ্বাস নিচ্ছে যেন ওর সত্যিকারের ফুসফুস আছে।
কনরের জানালার চেয়েও লম্বা দানবটার আকৃতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওটার গায়ে প্রচণ্ড শক্তি। কনরের দিকে তাকিয়ে আছে সেটা, নিঃশ্বাসের সাথে তীব্র বাতাসের শব্দ। হাত দুটো জানালার দুই পাশে রেখে সেটা নিচু হয়ে ঝুঁকে কনরের দিকে তাকায়। এর বিশাল ওজনে তার ঘরটা দুলছে।
দানবটা কথা বললো,
‘কনর ও’ম্যালি।’ একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল তার নিঃশ্বাসের সাথে। কর্কশ আর ভয়ানক শব্দটায় কনরের বুক কেঁপে উঠলো।
‘আমি তোমাকে নিতে এসেছি কনর ও’ম্যালি।’ বলেই দানবটা পুরো বাড়িটাকে ঝাঁকুনি দেয়। কনরের দেয়ালের ছবিগুলো মাটিতে খসে পড়ে। শেলফের বই, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট আর পুরোনো গন্ডারের পুতুলটাও মাটিতে আছড়ে পড়ে।
একটা দানব–কনর ভাবে। সত্যিকারের দানব। পুরোটাই বাস্তব, স্বপ্ন না। ওর জানালার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
ওকে নিয়ে যেতে এসেছে। কিন্তু কনর ভয় পেয়ে দৌড় দেয় না। সত্যি বলতে কি, তার একটুও ভয় করেনি। বরং সে কিছুটা হতাশ। কারণ সে এমন দানব আশা করেনি।
‘তাহলে এসে আমাকে নিয়ে যাও।’ সে বললো।
চারপাশে অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে।
‘কী বললে তুমি?’ দানবটা জিজ্ঞেস করে।
‘আমি বলেছি, আমাকে নিয়ে যাও।’
দানবটা এক মুহূর্ত চুপ থেকে গর্জে উঠে জানালায় বিশাল হাত দুটো দিয়ে আঘাত করলো। কনরের বাসার ছাদ এই আঘাতে বাঁকলের মতো উঠে এলো। দেয়ালের মধ্যে বড়ো বড়ো ফাঁটল দেখা দিলো। ঘরের ভেতর দমকা বাতাস ছুটোছুটি করছে। দানবের ঘুসির কারণে বাতাস ঝড়ের মতো বয়ে যাচ্ছে।
‘যতই চেষ্টা করো, আমি ভয় পাবো না। এর চেয়ে বাজে জিনিস আমি দেখেছি।’
দানব আরও জোরে গর্জে ওঠে। জানালা আর দেয়ালের মধ্য দিয়ে দানবটা হাত ঢুকিয়ে দেয়ায় সবকিছু ভেঙে পড়তে শুরু করে। কনর বুঝতে পারে আঁকাবাঁকা শিকড়বাকর তাকে আঁকড়ে ধরেছে। ওকে বের করেই দানব সাঁই করে ঘুরে দাঁড়ায়। যেন চাঁদের সাথে ওকে আঁটকে ফেলেছে দানবটি। ওটা কনরকে এমনভাবে ধরে রেখেছে যেন যে-কোনো মুহূর্তে ওর বুকের পাঁজর ভেঙে যাবে। শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দানবটি মুখ হাঁ করতেই কনর ওর শিকড় দিয়ে পাকানো দাঁতগুলো দেখতে পায়। দানবের নিঃশ্বাসের সাথে উষ্ণ বাতাস বের হয়ে আসছে।
দানব এবার থেমে যায় ।
‘তুমি আসলেই আমাকে ভয় পাচ্ছ না?’
‘না।’ কনর বলে, ‘তোমাকে ভয় পাবো কেন?
দানবটা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়।
‘তুমি আমাকে ঠিকই ভয় পাবে।’ দানবটি বলে, ‘শেষে ঠিকই ভয় পাবে।’
শেষ দৃশ্যটায় কনর যা দেখতে পেল-দানবটি তাকে জীবিত খেয়ে ফেলার জন্য হাঁ করে এগিয়ে আসছে।
সকালের নাস্তা
‘মা।’ কনর রান্নাঘরে ঢুকেই ডাক দেয়।
সে জানে এখন মাকে এখানে পাওয়া যাবে না। কেটলিতে পানি গরম করার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মা রান্নাঘরে এলে সবার আগে এই কাজটাই করে। আজকাল যে কোনো ঘরেই মাকে পাওয়া যায়। বাড়ির যে-কোনো জায়গায় মা ঘুমিয়ে পড়ে। তাই এখন কোনো ঘরে প্রবেশ করার আগে সে নিশ্চিত হয়ে নেয় মা আছে কি না।
আপাতত মা রান্নাঘরে নেই। তার মানে সে নিশ্চয়ই নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে। অর্থাৎ কনরকে এখন সকালের নাস্তা নিজেই বানিয়ে নিতে হবে। এই ব্যাপারটার সাথে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। যাক, ব্যাপার না। অন্তত আজকের সকালে তার কিছুটা ভালো লাগছে।
সে দ্রুত ময়লা পরিষ্কারের কাজে লেগে পড়ে। রুম থেকে নিয়ে আসা প্লাস্টিকের ব্যাগভর্তি ময়লা আরেকটা বড়ো পলিথিনের ব্যাগে ভরে নেয়। তারপর ওটার ওপর আরও ময়লা ঢেলে দেয় যাতে কেউ বুঝতে না পারে নিচে কী আছে।
‘এই তো হয়ে গেছে।’ আনমনে বলে সে, ‘এখন নাস্তা।’
টোস্টারে সে কয়েকটা রুটি গরম করে নিলো। এরপর একটা বোলে সিরিয়াল ঢেলে গ্লাসে জুস ঢেলে নেয়। রান্নাঘরের টেবিলে বসেই নাস্তা সেড়ে নেয়। মায়ের জন্যে আলাদা সিরিয়াল আর সুপের ব্যবস্থা আছে। শহরের হেলথ ফুড শপ থেকে মা ওগুলো আনানোর ব্যবস্থা করে। ভাগ্য ভালো কনরকে ওসব খাবার খেতে হয় না, স্বাদহীন অসুখী কিছু খাবার।
তারপর সে ঘড়ির দিকে তাকায়। স্কুলের জন্যে আরও পঁচিশ মিনিট পর বের হতে হবে। ইতোমধ্যে সে স্কুলের জামাও পরে নিয়েছে। দরজার কাছে স্কুলের ব্যাগটাও গুছিয়ে রাখা। এখন সে সবকিছু নিজে নিজেই করতে পারে।
রান্নাঘরের টেবিলে বসে জানালা দিয়ে চার্চটার দিকে তাকালো কনর। ওই তো ইয়ো গাছ।
সে সিরিয়াল খায় আর ভাবে-ওটা একটা স্বপ্ন, এছাড়া আর কিই-বা হতে পারে!
সকালে উঠে প্রথমেই জানালা দিয়ে পেছনের উঠোন দেখেছে সে। নাহ্, কোনো ক্ষয়ক্ষতি নেই। অবশ্যই কোনো ক্ষয়ক্ষতি থাকবে না। কেবল একটা ছোটো বাচ্চাই ওসব কিছু সত্যি বলে ভেবে নেবে। ভাববে যে একটা ইয়ো গাছ– একটা গাছ পাহাড় থেকে নেমে এসে তাকে আক্রমণ করেছিল।
ভাবতেই ওর হাসি পায়। কী বোকার মতো ভাবনা। তারপর সে বিছানা থেকে নেমে আসে। তখনই পায়ের নিচে মর্মর শব্দ তার মনোযোগ আকর্ষণ করে।
পুরো ঘরজুড়ে ইয়ো গাছের পাতা।
আরেক চামচ সিরিয়াল সে মুখে নেয়। একবারও ময়লার ব্যাগের দিকে তাকালো না। সকালেই সে পাতাগুলো তুলে পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিয়েছে।
রাতের বেলা নিশ্চয়ই অনেক বাতাস ছিল। হয়তো এ কারণে পাতাগুলো উড়ে
তার ঘরে এসেছে।
এটাই হবে।
সিরিয়াল আর টোস্ট শেষ করে সে জুসের গ্লাসে চুমুক দেয়। খাওয়া শেষ করে সে থালাবাসনগুলো ধুয়ে ডিশওয়াশারে রেখে দিলো। এখনও বিশ মিনিট বাকি। ভাবলো– ব্যাগটা বাইরে বড়ো ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসবে। যাচ্ছেই যেহেতু, ময়লার ব্যাগটাও নিয়ে যাবে। ওগুলো বাইরে রেখে এসে দেখলো, এখনও দশ মিনিট আছে। এখনও–
‘কনর?’ সিঁড়ির ওপর থেকে ডাকটা ভেসে আসে।
আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস ফেললো সে।
‘নাস্তা করেছ?’ মা জিজ্ঞেস করে।
‘হ্যাঁ মা।’ কনর উত্তর দিলো।
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ মা।’
মা তার দিকে একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন। কনর চোখ পাকিয়ে বললো, ‘টোস্ট, সিরিয়াল আর জুস খেয়েছি। থালাবাসনগুলো ডিশওয়াশারে রেখে দিয়েছি আমি।’
‘আর ময়লাগুলোও ফেলে দিয়েছো।’ পরিষ্কার রান্নাঘর দেখে মা বললেন ।
‘আর ওয়াশিং মেশিনটাও চলছে।’
‘বাহ, গুড বয়।’ মুখে হাসি থাকলেও বিষণ্নতা লুকাতে পারলেন না মা, ‘সময়মতো উঠতে পারলাম না আজকে, সরি।’
‘ঠিক আছে।’
‘নতুন একটা রাউন্ডের—’
‘ব্যাপার না।’
মা কথা থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসেন। আজ তিনি মাথায় স্কার্ফ বাঁধেননি, চুলবিহীন মাথাটা কেমন দুর্বল আর ভঙ্গুর দেখাচ্ছে। যেন একটা শিশুর মাথা। দেখে কনরের কষ্ট হচ্ছে।
‘কাল রাতে কি তুমি শব্দ করছিলে?’ মা জিজ্ঞেস করলেন।
কনর থমকে দাঁড়ালো। ‘কখন?’
‘মাঝরাতের পর। প্রথমে তো ভেবেছিলাম আমার মনের ভুল। কিন্তু স্পষ্ট তোমার কণ্ঠ শুনলাম।’
‘মনে হয় ঘুমের ঘোরে কথা বলছিলাম।’ নির্লিপ্তভাবে উত্তর দেয় কনর।
‘হয়তো। ও হ্যাঁ, তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, তোমার নানু আসছেন আগামীকাল।’
কনর বিরক্ত হলো, ‘উফ, মা।’
‘আমি জানি, কিন্তু তোমাকে এভাবে প্রতি সকালে একা একা নাস্তা বানাতে দেওয়া উচিত না।’
‘প্রতি সকালে? সে কয় দিন থাকবে?’
‘কনর–’
‘আমাদের তাকে দরকার নেই।’
‘কনর, চিকিৎসার এই পর্যায়ে আমার কী অবস্থা হয় তা তো তুমি জানোই– ‘
‘আমরা এতদিন পর্যন্ত ভালোভাবেই কাটাচ্ছিলাম না?’
‘কনর!’ মা রেগে গেলেন। মায়ের কণ্ঠ এতটাই রুক্ষ হয়ে ওঠে যে দুজনেই চমকে যায়। অনেকক্ষণ দুজনের মধ্যে নীরবতা কাজ করে। মা শেষমেশ হেসে ফেললেন।
‘আমি চেষ্টা করবো যেন খুব তাড়াতাড়িই এসব শেষ হয়, ঠিক আছে?’ মা বললেন, ‘আমি জানি নিজের ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও ঘুমাতে অনেক খারাপ লাগে আর আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। দরকার না পড়লে তো আমি তাকে ডাকতাম না, তাই না?’
নানু এলে সবসময় কনরকে সোফায় ঘুমাতে হয়। কিন্তু সমস্যা সেটা না। নানু যেভাবে তার সাথে কথা বলে, সেটা কনরের পছন্দ না। মনে হয় যেন কোনো কর্মচারীকে সিধা করার চেষ্টা করছেন তিনি। মহিলার মন জোগানোর কোনো পথ সে খুঁজে পায় না। এতদিন তো দুজনের ভালোভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। হ্যাঁ, মায়ের ট্রিটমেন্টই এমন যে অবস্থা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু সুস্থ হওয়ার জন্য মাকে কষ্ট সহ্য করতে হবেই। তাহলে?
‘কেবল কিছুদিনের জন্যে, ঠিক আছে?’ মা বললেন।
কনর কিছু না বলে স্কুলের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিতেই প্লাস্টিকের ব্যাগের কথা মনে পড়লো।
ওর ঘরের দখল নানুর কাছে যাওয়াকে খুব একটা মন্দ কিছু মনে হচ্ছে না এখন। ‘এই তো, এই হাসিটাই আমি ভালোবাসি।’ মা একটু ঠাট্টা করে বলেন, ‘মা নাকি আমার জন্যে উইগ আনছে কতগুলো। আমাকে তো জম্বি মার্গারেট থেচারের মতো দেখাবে।’
‘আমার ফিরতে দেরি হবে।’ কনর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো।
‘ঠিক আছে, সোনা।’ মা কনারের কপালে চুমু খেলেন, ‘তুমি খুব লক্ষ্মী। মাঝেমধ্যে মনে হয় এত লক্ষ্মী না হলেও খুব একটা সমস্যা ছিল না।’
স্কুলে যাওয়র আগে মায়ের চায়ের কাপটা সিংকের ওপর রেখে বের হওয়ার সময় মাকে নিজের সাথেই কথা বলতে শুনলো, ‘ওই তো পুরোনো ইয়ো গাছ।’
স্কুল
উঠে দাঁড়াতে গিয়ে কনর তার মুখে রক্তের নোনা স্বাদ পেল। মাঠে পড়ে যাওয়ার সময় তার ঠোঁট ভেতর দিকে কেটে গেছে। রক্তের এই ধাতব স্বাদ খুবই জঘন্য, থুথু ফেলে সাথে সাথে মুখ থেকে দূর করতে ইচ্ছা হয়–এমন একটা স্বাদ।
থুথু না ফেলে সে গিলে ফেললো। তার মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে একথা জানতে পারলে হ্যারি আর ওর সাঙ্গপাঙ্গরা খুশি হয়ে উঠবে। পেছন থেকে সালি আর অ্যান্টন হাসছে। হ্যারিকে না দেখেও কনর তার চেহারার ভঙ্গিটা আন্দাজ করতে পারছে। সে জানে এখন হ্যারি আমুদে গলায় কী বলবে। ও বড়োদের গলা খুব ভালোভাবে নকল করতে জানে।
‘দেখেশুনে চলো, নাহলে তো পড়ে যাবে।’ হ্যারি বললো।
হ্যাঁ, এটাই বলবে!
কিন্তু আগে এমনটা ছিল না।
হ্যারি সব শিক্ষকদের পছন্দের ছাত্র, সোনালি চুলের দারুণ এক ছেলে। ফুটবল পিচের সবচেয়ে দ্রুতগামী খেলোয়াড়। কিন্তু কনরের কাছে সে তার ক্লাসের আর অন্য দশটা ছেলের মতোই। দুজনকে ঠিক বন্ধু বলা চলে না। হ্যারির আসলে কোনো বন্ধু নেই, কেবল কিছু ভক্ত আছে। সে যাই করে না কেন অ্যান্টন আর সালি কেবল তার পেছনে দাঁড়িয়ে হাসে তাদের সাথেও কনরের শত্রুতা নেই। হ্যারি হয়তো ঠিকমতো কনরের নামও জানতো না।
গত বছরের মাঝামাঝির দিকে সবকিছু বদলে যায়। কনর হ্যারির নজরে পড়ে। তখন থেকে যেন সে হ্যারির বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
কনরের মায়ের ব্যাপারটার সাথে সাথেই এসব শুরু হয়নি। আরও পরের ঘটনা। দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই হ্যারির ফাজলামো শুরু হয়। ওই বৃক্ষদানবের স্বপ্ন না। আসল দুঃস্বপ্ন, যার কথা কনর কখনও কাউকে বলবে না। সেই দুঃস্বপ্ন শুরুর পর থেকেই হ্যারি তাকে লক্ষ করা শুরু করে। যেন কনরের গায়ে এমন কোনো দাগ লেগে আছে যেটা হ্যারিই দেখতে পায়।
সম্ভবত এই দাগই হ্যারিকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে।
নতুন বছরের শুরুর দিন হ্যারি ইচ্ছে করে কনরকে মাঠে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। সেখান থেকেই এসবের শুরু।
তার পর থেকে এমনটা প্রতিদিনই হয়।
অ্যান্টন আর সালির হাসি শুনেও কনর ঘুরে দাঁড়ালো না। জিভ দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো, ঠোঁট বেশি কাটেনি। তখনই আরেকটা ব্যাপার ঘটে গেল।
‘ওকে ছেড়ে দাও।’ কনর শুনতে পেল।
ঘুরে দেখলো, লিলি এন্ড্রুস হ্যারির মাথায় জোরে ঠোকর মারছে। তাতে যেন সালি আর এন্টনের হাসি আরও বেড়ে গেল।
‘তোমার ছোটো কুকুরটা তোমাকে বাঁচাতে ছুটে এসেছে।’ অ্যান্টন বললো।
‘কারে। সাথে লাগতে এলে এইভাবে কেন আগাবে?’ লিলি চিৎকার করলো। কোঁকড়ানো চুলগুলো ঝাঁকাতে লাগলো।
‘তোমার তো রক্ত পড়ছে ও’ম্যালি।’ লিলিকে উপেক্ষা করে হ্যারি শান্ত কণ্ঠে বলে।
কনর মুখে হাত দিয়ে দেখলো, ঠোঁটের কোণ দিয়েও রক্ত পড়ছে।
‘ওর টেকো মা চুমু দিয়ে দিলেই এটা ঠিক হয়ে যাবে।’ সালি ব্যঙ্গ করলো।
কনরের মনে হলো তার মাথার ভেতরে বুঝি আগুন লেগে গেছে, রাগে পাগল হয়ে কিছু করার আগেই লিলি গর্জে উঠে সালিকে জোরে ধাক্কা মেরে কাদামাটিতে ফেলে দিলো ।
‘লিলিয়ান এন্ড্রুস।’ মাঠের ওপাশ থেকে একটা রাগী গলা গর্জে ওঠে।
সবাই থমকে গেছে, এমনকি উঠতে যাওয়া সালিও। তাদের শিক্ষক মিস ওয়ান রেগেমেগে তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। মহিলার মুখ রাগে জ্বলজ্বল করছে।
‘ওরাই এসব শুরু করেছিল মিস।’ লিলি বললো।
‘আমি এসব শুনতে চাই না।’ মিস ওয়ান বললেন, ‘তুমি ঠিক আছো সালিভান?’ সালি একবার লিলির দিকে তাকিয়ে ব্যাথা পাবার ভান করে। ‘আমি জানি না মিস, মনে হচ্ছে বাসায় চলে যেতে হবে আমার।’
‘এত ঢঙের দরকার নেই।’ মিস ওয়ান বললেন, ‘আমার অফিসে চলো, লিলিয়ান।’
‘কিন্তু মিস, ওরা…’
‘এখনই চলো, লিলিয়ান।’
‘ওরা কনরের মাকে নিয়ে ঠাট্টা করছিল।’
আবারও সবাই থমকে গেল, কনরের পেট মোচড় দিয়ে উঠলো।
…আর তার চোখে দুঃস্বপ্নটা ভেসে উঠলো, বাতাসের গর্জন, তীব্র অন্ধকার…
ভাবনাটা দ্রুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো সে।
‘কনর, এটা কি সত্যি?’ মিস ওয়ান গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন।
মুখে রক্তের স্বাদে বমি চলে আসছে কনরের। হ্যারিদের দিকে তাকালো সে, অ্যান্টন আর সালিকে চিন্তিত দেখালেও হ্যারি নির্লিপ্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
যেন কনরের মুখ থেকে আসল কথা জানার জন্যে অপেক্ষা করছে।
‘না মিস, এটা সত্যি না। আমি পড়ে গিয়েছিলাম, ওরা আমাকে উঠতে সাহায্য করছিল।
লিলির চেহারায় আহত ছাপ ফুটে উঠে ক্রমেই সেটা বিস্ময়ের রূপ নিলো।
‘যার যার ক্লাসে ফিরে যাও। লিলিয়ান আমার সাথে চলো।’
লিলি মিস ওয়ানের সাথে চলে যাওয়ার সময় কনরের দিকে তাকালো। কিন্তু কনর সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
‘ভালো করেছ, ও’ম্যালি।’ হ্যারি বললো।
কনর কিছু না বলে ব্যাগটা তুলে নিলো। তারপর ভেতরে চলে গেল।
গল্প
গল্প। বাড়ি ফেরার সময় গল্পের কথা ভাবছে কনর।
স্কুলে সারাদিন সে হ্যারি আর তার চ্যালাপ্যালার থেকে দূরেই ছিল, পাছে আবার কোন ‘দুর্ঘটনা’ ঘটে যায়। এদিকে কেঁদেকেটে চোখ লাল করে ক্লাসে আসা লিলিকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলেছে সে। ছুটির ঘণ্টা বাজতেই সে একপ্রকার ছুটে বেরিয়ে গেছে। এখন বাসায় যেতে যেতে যেন হ্যারি, লিলি আর স্কুলের ভারে কাঁধটা ভারী লাগছে তার।
গল্প। কনর আবারও ভাবলো।
‘তোমাদের গল্প।’ মিসেস মার্ল ইংলিশ ক্লাসে বলেছিলেন, ‘এমন ভেবো না যে তোমাদের জীবনে বলার মতো কোনো গল্প নেই।’
জীবনগাথা নামে উনি নতুন অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন। এবার না-কি ওদের জীবনের গল্প লিখতে হবে। নিজেদের পরিবার, বাসা, ছুটিতে ঘুরতে যাওয়া বা ভালো কোনো স্মৃতির ব্যাপারে ।
নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোই লিখতে হবে।
কনর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা মনে করতে পারছে, কিন্তু সে-সব লিখার ইচ্ছা তার নেই। বাবার চলে যাওয়া, বিড়ালটা ঘুরতে বেরিয়ে গিয়ে আর ফিরে না আসা–সে-সব কথা।
অথবা এক বিকেলে ‘জরুরি কিছু কথা আছে’ বলে মায়ের তাকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার স্মৃতি।
এই কথাটা ভাবতেই সে কেঁপে উঠে। তবু হাঁটা থামায় না।
সেদিনের আগে সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। মা তাকে তার পছন্দের রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছেমতো ভিন্ডালু খেয়েছিল কনর সেদিন। তার দেখাদেখি মাও। বাসায় ফেরার সময় গাড়িতে তাদের সে কী হাসাহাসি।
এসব ভাবতে ভাবতে কনরের ঠোঁটের কোনায় হাসি উঁকি দিলো। সেদিন স্কুল থেকে আসার সময় মা তাকে সারপ্রাইজ দিয়েছিল। ওরা আসলে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল না। বরং মা ওকে একটা সিনেমা দেখতে নিয়ে গিয়েছিল। মা অসুস্থ হওয়ার পর কনর এই ছবি অনেকবার দেখেছে। তারপরেও ওরা ছবিটা দেখেছিল। পপকর্ন আর কোক খাওয়ার সময় দুজনের হাসি যেন বাঁধ মানছিল না।
কনার বোকা না। পরদিন যখন মা তাকে ওসব বলেছিল, তখনই সে বুঝে গিয়েছিল আগের দিন মা এত মজা কেন করেছে। কিন্তু এ কারণে সেদিনের আনন্দের রেশটুকু হারিয়ে যায়নি, সেদিনের হাসিগুলো হারিয়ে যায়নি।
তবে কনর এসবের কথাও লিখবে না।
‘এই!’ পেছন থেকে একটা কণ্ঠ শুনতে পেল কনর, ‘এই কনর, দাঁড়াও।’
লিলি।
‘এই!’ লিলি দৌড়ে তার কাছে এলো। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। বোঝাই যাচ্ছে প্রচণ্ড রাগে ফুঁসছে, ‘তুমি আজ এমনটা করলে কেন?’
‘আমাকে একা থাকতে দাও।’ কনর তাকে উপেক্ষা করে চলে যেতে লাগলো।
‘তুমি মিস ওয়ানকে সত্যি কথা বলোনি কেন?’ লিলি তার পেছন পেছন আসতে লাগলো, ‘আমাকে এভাবে ভেজালে ফেললে কেন?’
‘তুমি অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে এসেছিলে কেন?’
‘আমি তোমাকেই সাহায্য করছিলাম।’
‘তোমার সাহায্যের আমার দরকার নেই। আমি একাই বেশ আছি।’
‘মোটেও না, তোমার মুখ থেকে রক্ত পড়ছিল।’
‘তাতে তোমার কী?’ কনর একবারও থামলো না ।
‘আমাকে শাস্তি দিয়েছে, পুরো সপ্তাহ স্কুলের পর থাকতে হবে আমাকে। আর আমার বাবা-মায়ের কাছেও বিচার গেছে।’
‘এটা আমার সমস্যা না।’
‘কিন্তু এটা তোমার দোষ। ‘
কনর থেমে লিলির দিকে ঘুরলো। তাকে এতটাই রাগান্বিত দেখাচ্ছে যে লিলি কিছুটা পিছিয়ে গেল, যেন সে খানিক ভয় পেয়েছে।
‘এটা তোমার দোষ।’, কনর বললো, ‘সব তোমার দোষ।’
রেগেমেগে চলে যেতে যেতে লিলির কণ্ঠ শুনতে পেল সে। ‘আমি জানতাম আমরা ভালো বন্ধু।’
‘ছিলাম, এখন নেই।’ পেছনে না তাকিয়েই কনর উত্তর দিলো।
লিলিকে ছোটোবেলা থেকে চেনে সে। কনর আর লিলির মা বান্ধবী ছিল। লিলি তার কাছে অনেকটা আপন বোনের মতো। ওরা খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এছাড়া আর কিছু না। স্কুলের অনেক ছেলেমেয়ে ওদের খেপায়, কিন্তু কনর তো লিলিকে একটা মেয়ে হিসেবেই ভাবতে পারে না। ভাববেই-বা কীভাবে? ছোটোবেলা থেকেই তো তাকে দেখে এসেছে, একসাথে খেলা করেছে, সবকিছুই জানে। এটা কেবলই বন্ধুত্ব, আর কিছু না
কিন্তু তার মায়ের সাথে ওই কথোপকথনের পর হুট করেই ব্যাপারটা হয়ে গেল। লিলির মা জানলো, আর সেখান থেকে লিলি, আর তার থেকে বাকি সবাই। এক দিনের মধ্যেই কথাটা ছড়িয়ে গেল। এটার জন্য লিলিকে সে কখনও মাফ করবে না।
আরেকটা মোড় ঘোরার পর নিজের বাড়ি দেখতে পেল সে। ছোটো, কিন্তু নির্জন। ডিভোর্সের পর মা এখানে থাকারই দাবি করেছিল। বাবা তার নতুন বউ স্টেফানির সাথে আমেরিকায় চলে যায়। এসব ছয় বছর আগের ঘটনা, কনর এখন ভুলেও গেছে যে বাবা থাকলে কেমন লাগে।
তার মানে কিন্তু এই না যে সে কখনও বাবার কথা ভাবে না ।
বাসার পেছনের পাহাড়ের চূড়ায় থাকা চার্চের দিকে তাকালো সে। ইয়ো গাছটা গোরস্থানে ঘুমন্ত দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
কনর নিজেকে একরকম জোর করে আশ্বস্ত করলো যে এটা কেবল একটা গাছ। অন্য দশটা গাছের মতোই সাধারণ একটা গাছ।
একটা গাছ। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর মনে হলো, গাছটা সূর্যের আলোতেও ভয়ানক একটা মুখের আকৃতি নিয়ে গর্জে উঠলো, ‘কনর।’
তাড়াহুড়ো করে দৌড়ে ঘরে ঢুকতেই সে আবার সেদিকে তাকালো। ওটা কেবল একটা গাছ।
তিনটি গল্প
ওইদিন রাতেও কনরের ঘুম আসছিল না। বিছানার পাশে রাখা ঘড়িটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল।
সন্ধেটা যেন পার হতেই চাচ্ছিল না। লাজানিয়া রান্না করতে গিয়ে মা এতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে ‘ইস্টেন্ডার’ শো শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে সোফায় ঘুমিয়ে গেছে। এই শো-টা কনর একেবারেই পছন্দ করে না। তবু মায়ের জন্য রেকর্ডার অন করে দেয়। তারপর মায়ের শরীরে কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে থালাবাসন ধুতে চলে যায়।
ফোন বাজার শব্দেও মায়ের ঘুম ভাঙেনি। কনর দেখেছিল লিলির মা ফোন করেছে, কিন্তু সে ধরেনি। তিনি একটা ভয়েস মেইল পাঠাবেন এমনিতেও। রান্নাঘরের টেবিলে বসে হোমওয়ার্ক করে নিলো সে। মিসেস মার্লের জীবনগাথা হোমওয়ার্ক করেনি। সে কিছুক্ষণ ইন্টারনেটে সার্ফ করে। এরপর কিছুক্ষণ ইন্টারনেট চালিয়ে, দাঁত ব্রাশ করে নিজের ঘরে চলে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। বাতি বন্ধ করার একটু আগেই তার ক্লান্ত মা এসে তাকে চুমু খেয়ে ‘শুভরাত্রি’ বলে গেছে।
এর কিছুক্ষণ পর পাশের ঘর থেকে বমি করার শব্দ পাওয়া গেল।
‘তোমার কোনো সাহায্য লাগবে?’ কনর বিছানা থেকেই বললো।
‘না সোনা। আমার তো প্রায়ই এমন হয়।’
সেটাই, এখন কনরও অভ্যস্ত হয়ে গেছে। চিকিৎসার দুই-তিন দিন পরই মা এমন অসুস্থ হয়ে যায়। এসব এখন নিত্যদিনের ব্যাপার।
একটু পর বমির শব্দগুলো থেমে গেল। বাথরুমের লাইট আর দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পাওয়া গেল।
এসব দুই ঘণ্টা আগের ঘটনা। তখন থেকে সে শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছে।
কীসের জন্য?
ঘড়িতে এখন বারোটা পাঁচ বাজে।
এখন ১২টা বেজে ৬ মিনিট। ঘরের জানালাটা এখন শক্ত করে বন্ধ করা। ১২টা বেজে ৭ মিনিট।
সে উঠে জানালা খুলে বাইরে তাকালো। দানবটা উঠোনে বসে আছে। কনরের দিকেই তাকিয়ে আছে।
তাকে দেখতে পেয়েই দানবটা উঠে দাঁড়ায়। ওর কথাগুলো কনর স্পষ্ট শুনতে পায়। যেন দুজনের মাঝখানে কোনো জানালাই নেই। ‘আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই।’ দানবটা বললো।
‘হ্যাঁ অবশ্যই।’ কনর চাপা গলায় বলে, ‘দানবেরা তো কথাই বলতে চায়।’ দানবটা হাসে। ওকে ভীষণ কুৎসিত দেখায়। ‘যদি জোর করে ভেতরে ঢুকতে হয়, তবে আমি সানন্দে তাই করবো।’ দানবটি জানায়।
এরপরই দানবটা কনরের ঘরে আঘাত করার জন্যে তার হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে উঁচিয়ে তুললো।
‘না।’ কনর বললো, ‘আমি মার ঘুম ভাঙাতে চাই না।’
‘তাহলে বাইরে এসো।’ ঘরের ভেতর থাকার পড়েও কনর মাটি, আর বাকলের সোঁদা গন্ধ পাচ্ছে।
‘তুমি আমার কাছে কী চাও?’
‘আমি কী চাই সেটা মূল কথা নয়, তুমি আমার কাছে কী চাও সেটাই আসল, কনর ও’ম্যালি।’
‘আমি তোমার থেকে কিছু চাই না।’
‘এখনও চাও না, কিন্তু তোমাকে চেয়ে নিতে হবেই।’
‘এটা একটা স্বপ্ন।’ কনর উঠানে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রবোধ দেয়। দানবটার পেছনে চাঁদ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। সারা শরীর সে হাত দিয়ে চেপে ধরে। না, বাইরে ঠান্ডা বলে এমনটা সে করেনি। কনরের বিশ্বাসই হচ্ছে না সে চুপিচুপি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে দরজা খুলে বের হয়ে এসেছে।
কনর এখনও শান্ত বোধ করছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত। এই দুঃস্বপ্নটা… এটা দুঃস্বপ্নই। আর কিছু না… কিন্তু আগের সেই দুঃস্বপ্নের চেয়ে ভিন্ন।
এই দুঃস্বপ্নে কোনো ভয় নেই, কোনো অন্ধকার নেই।
কিন্তু এখানেও একটা দানব আছে, তার থেকে প্রায় দশ থেকে পনেরো ফুট উঁচু একটা দানব। রাতের বাতাসে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে।
‘এটা কেবল একটা স্বপ্ন।’ সে আবার বলে ।
‘কিন্তু কোনটা একটা স্বপ্ন, কনর ও’ম্যালি?’ তারপর কনরের দিকে নুইয়ে আসে যেন ওর চেহারাটা দেখা যায়। ‘তোমাকে কে বলেছে এটা স্বপ্ন?’
দানবটা একটু নড়তেই কনরের কানে কাঠ মোচড়ানোর শব্দ আসে। দানবের বিশাল বাহুর ক্ষমতাটাও তার চোখে পড়ে। অসংখ্য শাখা-প্রশাখা মিলে ওর বাহুতে পেশির সৃষ্টি করেছে। সেগুলো বারবার নড়ছে। শক্তিশালী এক বুক যার উপরে ভয়ানক একটা মুখ যাতে ধারালো দাঁতের সারি। চাইলে দানবটা কনরকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারবে।
‘তুমি আসলে কী?’ কনর গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘আমি ‘কী’ না। জিজ্ঞেস করো আমি কো
‘আচ্ছা, তাহলে তুমি কে?’
‘আমি কে?’ দানবটা গর্জে ওঠে, ‘আমি কে?’
কনরের চোখের সামনে দানবটা আরও লম্বা ও বিশাল হয়ে উঠতে শুরু করে। ওদের মাঝে হুট করে দমকা বাতাস বইতে শুরু করে। দানবটা নিজের অতিকায় বাহু দুটি দুপাশে মেলে ধরে। হাত দুটো এতটাই ছড়িয়ে দিয়েছে যেন দিগন্ত ঢেকে দিতে পারে। বলা যায় না, পুরো পৃথিবীটাই ঢেকে ফেলার ক্ষমতা আছে ওর বাহুতে।
‘পৃথিবীতে আমার অসংখ্য নাম। এত নাম যে তুমি গুণেও শেষ করতে পারবে না।’ দানবটা গর্জন করে উঠলো, ‘আমি হান্টার হার্নি। আবার আমিই কার্নানোস। আমি এটারনাল গ্রিন ম্যান। ‘
লতাপাতায় আচ্ছাদিত হাত দিয়ে দানবটি কনরকে খপ করে ধরে উঁচুতে মেলে ধরলো। দানবটার আশেপাশে বাতাস খেলে বেড়াচ্ছে। তাতে বরং ওর পাতাগুলো নড়ছে। মনে হচ্ছে ও রেগে গেছে।
‘আমি কে? আমি সেই মেরুদণ্ড যার ওপর পর্বত দাঁড়িয়ে থাকে। আমি নদীর অশ্রু। আমি সেই ফুসফুস যে বাতাসে পৃথিবী শ্বাস নেয়। আমি সেই নেকড়ে যে হরিণ শিকার করে, সেই বাজপাখি যে ইঁদুর শিকার করে, সেই মাকড়সা যে পোকা শিকার করে। আমি সেই হরিণ, সেই ইঁদুর, সেই পোকা। আমি জগতের সেই সাপ যে তার নিজের লেজ খেয়ে ফেলে। আমি অশান্ত, আমাকে কেউ বাগে আনতে পারে না।’ দানব কনরকে তার চোখের কাছে নিয়ে আসে। ‘আমি এই বুনো পৃথিবী। এখানে আমি শুধু তোমার জন্যে এসেছি কনর ও’ম্যালি।’
‘কিন্তু তুমি দেখতে একটা গাছের মতো।’ কনর বললো ।
দানব তাকে জোরে চেপে ধরে।
‘এত সহজে আমার দেখা পাওয়া যায় না বোকা ছেলে।’ দানবটা বললো, ‘জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আমি উপস্থিত হই। আমার কথা অন্যেরা শুনবে, এর সাথেই আমি অভ্যস্ত।’
দানব তার মুষ্টি শিথিল করলে কনর কিছুটা শ্বাস নিতে পারলো। ‘তো তুমি এখন কী চাও আমার কাছে?’
দানবের মুখে কুটিল হাসি। বাতাসও থেমে গেছে।
‘এমন কিছু ঘটেছে যার কারণে আমাকে এখানে আসতে হয়েছে।
এখন কী হবে সেটা ভেবে কনর একটু ভয় পেয়ে গেল।
‘এখন যা হবে কনর ও’ম্যালি, আমি আবারও রাতের বেলা তোমার কাছে আসবো।’
কনরের পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। সামনে অশুভ কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য।
‘তোমাকে আমি তিনটা গল্প শোনাবো। আমার জীবন্ত হয়ে ওঠার তিনটা গল্প।’
কনর অবাক হলো, ‘তুমি আমাকে গল্প শোনাবে?’
‘অবশ্যই।’ দানব উত্তর দেয়।
‘এহ্!’ কনর নিজের কানকে বিশ্বাসই করতে পারছে না, ‘কী আজব দুঃস্বপ্ন রে বাবা।’
‘পৃথিবীতে গল্পের চেয়ে ভয়ংকর ও অদ্ভুত জিনিস আর দ্বিতীয়টি নেই।’ দানবটি আমুদে স্বরে বলে, ‘গল্প একজন মানুষকে আজীবন তাড়া করে বেড়ায়। বারবার আঘাত করে।’
‘এইগুলো স্কুলের টিচাররা সবসময় বলে।’ কনর জবাব দেয়, ‘এইসব কথা কেউ বিশ্বাস করে না।’
‘আমার তিনটা গল্প শেষ হলে’ যেন কনরের কথা শুনতেই পায়নি এমন ভঙ্গিতে দানবটি বললো, ‘চতুর্থ গল্প তুমি শোনাবে।’
‘আমি ভালো গল্প বলতে পারি না।’
‘তুমি আমাকে চতুর্থ গল্প বলবে, এবং সেটা হবে সত্যি কথাটা।’
‘সত্যি কথাটা?’
‘কেবল সত্যি না। তোমার সত্যি।’
‘আচ্ছা। কিন্তু তুমি তো বললে সবকিছু শেষ হলে আমি প্রচণ্ড ভয় পাবো। আমার তো ভয় করছে না।’
‘কনর ও’ম্যালি, তুমি কিন্তু সত্যি কথাটা বলছো না।’ দানবটা বলে, ‘তুমি সত্য কথাটা লুকিয়ে রেখেছো। কারণ তুমি তোমার নিজের মনের ভেতর লুকিয়ে রাখা সত্যি কথাটাকে অনেক ভয় পাও!’
কনর নড়াচড়া থামিয়ে দেয়।
তার মানে কি….
এটা তো দানবের জানার কথা না…
না না। আসল দুঃস্বপ্নের কথা সে কখনোই বলবে না। কখনও না।
‘তুমি বলবে, আমাকে এজন্যেই ডেকেছো তুমি।’
কনর দ্বিধায় পড়ে গেল, ‘আমি তোমাকে ডাকিনি।’
‘তুমি আমাকে চতুর্থ গল্প বলবে। তোমার সত্যিটা বলবে।’
‘আর যদি না বলি?’
দানবের মুখে ভয়ংকর একটা হাসি খেলে গেল, ‘তাহলে আমি তোমাকে খেয়ে ফেলবো।’
এবার দানব হাঁ করে। সেই বিশাল গহ্বরে পুরো পৃথিবীই নিমেষে হারিয়ে যেতে পারে। কনরও চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে।
চিৎকার করে সে নিজের বিছানায় জেগে ওঠে।
তার বিছানা। সে ফেরত চলে এসেছে।
অবশ্যই এটা একটা স্বপ্ন ছিল। অবশ্যই। আবারও একই দুঃস্বপ্ন। ।
প্রচণ্ড রাগে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রোজ রোজ এমন হলে কি ঘুমানো যায়? আর প্রতিবার এত ক্লান্ত লাগে যে বিশ্রাম নেয়াই হয় না ।
এক গ্লাস পানি খেতে হবে। এভাবেই রোজ ঘুম থেকে জেগে উঠতে হবে। আবার একইভাবে রাত কাটাও। এই স্বপ্ন ভুলে যাওয়ারও কোনো উপায়…
পায়ের নিচে কিছু একটা চাপা পড়ে গলে গেল।
বাতি জ্বালতেই মেঝেতে বিষাক্ত লাল বেরিগুলো দেখতে পেল।
জানালা বন্ধ করার পরেও ওগুলো কোনোভাবে ঘরে ঢুকে পড়েছে।
নানু
‘মায়ের সাথে ভালো হয়ে চলছো তো?’
কনারের নানু তার গালে এত জোরে চিমটি কাটলেন যেন রক্ত বেরিয়ে যাবার উপক্রম।
‘ও খুব ভালো ছেলে, মা।’ কনরের মা নানুর পেছন থেকে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো। মাথায় তার পছন্দের নীল স্কার্ফটা বাঁধা, ‘সুতরাং এতটা শাসনের দরকার হবে না।’
‘কী যে বলো না!’ নানু কনরের দুই গালে ঠাট্টা করে থাপ্পড় দিয়ে বললো, ‘আমাদের জন্যে চায়ের পানি বসাতে পারবে?’ নানু এমনভাবে বললো যে এটাকে প্রশ্ন না ভেবে আদেশ ভাবাই শ্রেয়।
কনর যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সে দ্রুত ওখান থেকে বের হয়ে এলো। ওদিকে নানু কোমরে হাত দিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। ‘এখন বলো লক্ষ্মীটি’ কনর রান্নাঘর থেকে শুনতে পেল, ‘তোমাকে নিয়ে কোন কূলে যাই?’
কনরের নানু অন্যান্য নানুদের মতো না। লিলির নানুকে কনর কতবার দেখেছে। সব নানু যেমন হয়, সাদা চুলের হাসিখুশি মানুষ। ক্রিসমাসের সময় সবার জন্য আলাদা করে সেদ্ধ সবজি রান্না করে আর মাথায় কাগজের টুপি পরে খালি হাসাহাসি করে।
আর কনরের নানু সুট পরে, চুল ধূসর রাখার জন্যে কালার করে। মহিলার কথাবার্তাও অদ্ভুত, কোনো মানে খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘ষাটের দশক মানে আধুনিক পঞ্চাশের দশক’ বা ‘গাড়ির রং হওয়া উচিত খুব দামি’–এসব কথার মানেই-বা কী? জন্মদিনের কার্ড মেইল করে, ওয়াইন নিয়ে ওয়েটারের সাথে ঝগড়া বাঁধায়। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, মহিলার এখনও একটা চাকরি আছে। নানুর বাসা তো আরও জঘন্য। দামি আর পুরোনো জিনিসপত্র গাদাগাদি করে রাখা। সেগুলোতে কেউ কখনো হাত দিতে পারে না। যেমন–ঘড়ির কথাই ধরা যাক। ঘর ঝাঁট দেয় যে মহিলা, তাকেও হাত দিতে দেবে না! এটাও একটা চিন্তা বিষয়। কোনো নানুর বাড়িতে কেউ কখনও ঘর ঝাঁট দেওয়ার মহিলা দেখেছে?
‘দুই চামচ চিনি, কোনো দুধ দেবে না।’ চা বানাতে বানাতে কনর নানুর কণ্ঠ শুনতে পায়। সে বুঝি এসব আগে থেকে জানে না ।
‘ধন্যবাদ, মাই বয়।’ নানু চা নিয়ে বললো।
‘ধন্যবাদ, সোনা।’ মা হাসতে হাসতে বললো। প্রত্যুত্তরে কনর হাসলো।
‘তো, স্কুল কেমন লাগে?’ নানু জিজ্ঞেস করলো।
‘ভালোই।’ কনরের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
আসলে স্কুলের অবস্থা ভালো না। লিলি এখনও রেগে আছে, হ্যারি তার ব্যাগের ওপর কলমের কালি ফেলে দিয়েছে। আর মিস ওয়ান তাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গেছে সবকিছু ঠিক আছে কি না জানার জন্য।
‘তুমি জানো’ নানু বললো, ‘আমার বাসার আধমাইল দূরেই একটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট বয়েজ স্কুল আছে। ওখানে খোঁজ নিয়েছিলাম। ওদের একাডেমিক স্ট্যান্ডার্ড খুব ভালো। এজন্যই ওদের রেজাল্টও খুব ভালো হচ্ছে। আমি নিশ্চিত।’
কনর তার দিকে তাকালো। নানু আসায় রাগ করার এটা আরেকটা কারণ। সে এখন আসলে বলতে চাচ্ছে, এখানকার স্থানীয় স্কুল তার পছন্দ না।
অথবা অন্য কিছুও হতে পারে, ভবিষ্যতের একটা ইঙ্গিত।
কনরের পেটে রাগ দুমড়ে-মুচড়ে উঠতে শুরু করে।
‘ও যেখানে আছে, সেখানেই খুশি আছে মা।’ মা তাড়াতাড়ি উত্তর দিলো, ‘তাই না, কনর?’
কনর চমৎকার হাসি দিয়ে বললো, ‘আমি এখানেই ঠিক আছি।’
ডিনারে আজ চাইনিজ খাবার। নানু আসলে রান্না করতে পারে না। কনর যতবারই তার সাথে থেকেছে, নানুর ফ্রিজে একটা ডিম আর অর্ধেক এভোকাডো ছাড়া আর কিছু পায়নি। কনরের মা অসুস্থ, তাই তার পক্ষে কিছু রান্না করা অসম্ভব। অবশ্য কনর নিজেও রান্না করতে পারে; কিন্তু নানু বোধহয় সেটা ভেবেও দেখেনি।
রান্নাঘর পরিষ্কারের কাজটা তাকেই করতে হলো। একটা পলিথিনের ব্যাগে সে ফয়েলগুলো ভরছিল। এই ব্যাগেই সে আজকে রুমে থাকা বিষাক্ত বেরি ফলগুলো ঢুকিয়ে রেখেছে। রাবিশ বিনে যখন ময়লাগুলো ফেলে দিচ্ছে, তখনই নানু তার পেছনে এসে দাঁড়ায়।
‘এই ছেলে, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।’
‘আমার একটা নাম আছে, তুমি জানো তো?’ কনর ব্যাগটা হাত থেকে নামিয়ে বললো, ‘আর নামটা ‘ছেলে’ না।’
‘গলা নামিয়ে কথা বলো।’ নানু হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। সরাসরি ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কনর নিজেও মহিলার দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকে মিনিটখানেক। ‘আমি তোমার শত্রু নই কনর, আমি তোমার মাকে সাহায্য করতে এসেছি।’
‘আমি জানি তুমি কেন এসেছো।’ কনর একটা কাপড় বের করে পরিষ্কার টেবিলটা আবার পরিষ্কার করতে লাগলো।
নানু এগিয়ে এসে কাপড়টা তার হাত থেকে নিয়ে নিলো, ‘আমি এসেছি, কারণ তেরো বছরের একটা বাচ্চার এত তেজ ভালো না।’
কনর রেগেমেগে তার দিকে তাকালো, ‘তাহলে কি এটা তুমি করবে এখন?’
‘কনর–’
‘তুমি চলে যাও। আমাদের তোমাকে লাগবে না। ‘
‘কনর!’ নানু গম্ভীর হয়ে বললো, ‘সামনে যা হতে যাচ্ছে তা নিয়ে কথা বলতে হবে আমাদের।’
‘না হবে না । চিকিৎসার দুই-তিন দিন পর থেকে তার এমন অবস্থাই হয়। কালকে আবার ঠিক হয়ে যাবে, তখন তুমি চলে যেতে পারো।’
ওর নানু সিলিং-এর দিকে তাকায়। তারপর হাত দিয়ে মুখ মুছতে শুরু করে। কনর নানুকে রাগতে দেখে ভীষণ অবাক হলো।
আরেকটা কাপড় বের করে আবার মোছামুছি শুরু করলো কনর, যেন নানুর দিকে আর তাকাতে না হয়। একদম সিংক পর্যন্ত পরিষ্কার করতে করতে সে একবার জানালার সামনে উঁকি দেয়।
দানবটা তার পেছনের উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। পড়ন্ত সূর্যের মতোই বিশালাকৃতির লাগছে ওটাকে।
তাকে দেখছে।
‘কাল হয়তো সে ভালো হয়ে যাবে।’ নানুর কণ্ঠ এখন ভারী হয়ে উঠেছে, ‘কিন্তু সব সময় হবে না, কনর।’
এটা একটা ভুল কথা। কনর আবার তার দিকে ঘুরলো, ‘চিকিৎসায় সে ঠিক হয়ে যাচ্ছে, এজন্যই এখনও সেটা চলছে।’
নানু তার দিকে লম্বা সময় ধরে তাকিয়ে রইলো যেন সে কী বলবে বুঝতে পারছে না, ‘তোমাকে তার সাথে এসব নিয়ে কথা বলতে হবে, কনর।’ যেন নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, ‘তোমার সাথে এসব নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন।’
‘কোন সব নিয়ে?’ কনর জিজ্ঞেস করলো।
‘তুমি যে আমার সাথে এসে থাকবে, সেটা নিয়ে।’
কনর ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ঘরটা যেন আরও অন্ধকার লাগছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো ঘরটা বুঝি কাঁপছে। এখনই ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে।
নানু উত্তরের অপেক্ষা করছে।
‘আমি তোমার সাথে থাকবো না।’ কনর বললো।
‘কনর–’
‘আমি তোমার সাথে কখনোই থাকবো না।’
‘হ্যাঁ, তুমি থাকবে।’ নানু বললো, ‘আমি দুঃখিত, কিন্তু তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। তোমার মা তোমাকে বলতে চাইছে না, কারণ তুমি কষ্ট পাবে। কিন্তু আমার মনে হয় তোমার জানা দরকার যে যখন এসব শেষ হয়ে যাবে, তখন তোমার একটা বাসা আছে, ছেলে। সে বাসায় তোমার আপন কেউ থাকবে।’
‘যখন এসব শেষ হবে, তখন তুমি চলে যাবে এবং আমরা নিজেরাই ভালো থাকবো।’
‘কনর–’
এরপর বসার ঘর থেকে কণ্ঠ শোনা গেল, ‘মা? মা?’
নানু এত দ্রুত রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল যে কনর চমকে উঠলো। বসার ঘর থেকে কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে আর নানু বলছে, ‘কিছু হয়নি সোনা, কিছু হয়নি, শসসসস’। কনর ঘরে আসার সময় রান্নাঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিলো।
দানবটা চলে গেছে।
নানু সোফায় বসে মাকে ধরে রেখেছে। বারবার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আর মা পাশের ছোটো বালতিতে বমি করছে।
নানু কনরের দিকে তাকালো। কিন্তু ঐ কঠোর আর ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি দেখে কিছু ঠাহর করা গেল না ।
গল্পের বন্যতা
পুরো বাড়িজুড়ে অন্ধকার। নানু অবশেষে মাকে ঘুম পাড়িয়ে কনরের শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘুমাতে চলে গেল। কনরের সাথে আর কোনো কথা হয়নি ।
কনর সোফায় শুয়ে আছে, তার ঘুম আসছে না। মনে হচ্ছে না আসবে। মাকে দেখে আজ তেমন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু নানুর কথা বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ তিন দিন হয়ে গেল মায়ের চিকিৎসা করানো হয়েছে। এর মধ্যে মায়ের সুস্থ হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু মাকে দেখে মনে হলো সে আরও ক্লান্ত। বমি করেই যাচ্ছে। এ-রকম তো হওয়ার কথা না…
কনর চিন্তাগুলো মাথা থেকে সরিয়ে দিলেও সেগুলো বারবার চলে আসছে। ধীরে ধীরে তন্দ্রার ভাব এসে গেল। দুঃস্বপ্নটা যখন এলো, তখন সে বুঝতে পারল যে সে ঘুমিয়ে গিয়েছিল।
গাছের স্বপ্নটা নয়। অন্য দুঃস্বপ্নটা।
যেখানে বাতাসের গর্জন হচ্ছে আর মাটি কেঁপে কেঁপে উঠছে এবং এর মাঝে সে শক্ত করে হাত ধরে রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু তবুও সে হাত ছুটে যাচ্ছে। কনর তার সমস্ত শক্তি উজাড় করে দিলেও তা যথেষ্ট নয়। হাত বারবার ছুটে যাচ্ছে আর এরপর সেই গগণবিদারি চিৎকার…
‘না!’ কনর চিৎকার করে। জেগে ওঠার পরেও আতঙ্কটা তাকে চেপে ধরে বসে আছে। মনে হচ্ছে যেন শ্বাস আটকে গেছে তার। কেবলই দম বন্ধ হয়ে আসছে। তার চোখে পানি চলে এলো।
‘না।’ খুব আস্তে করে বললো এবার।
বাসাটা এখন নিস্তব্ধ আর অন্ধকার। চুপ করে এক মুহূর্তের জন্য কান পাতে সে। না, কোনো শব্দ নেই। অন্ধকারে সে ঘড়ির দিকে তাকালো।
১২টা বেজে ৭ মিনিট। অবশ্যই, তাই তো হবে।
নিস্তব্ধ বাসায় আরও কিছু শোনার জন্য কান পাতলো সে। কেউ ‘কনর’ বলে ডাকছে না, কোনো কাঠ মচকানোর শব্দ নেই।
আজ রাতে সেটা আসবে না হয়তো।
১২টা ৮ মিনিট। ঘড়িতে সে সময় দেখে।
১২টা ৯ মিনিট।
কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে কনর উঠে রান্নাঘরে চলে আসে। সেখান থেকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।
দানবটা তার পেছনের উঠানে দাঁড়িয়ে আছে।
‘এত সময় কেন লেগেছে তোমার?’ সেটা জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমাকে এখন প্রথম গল্প বলার সময় হয়ে গেছে।’
কনর বাইরে গিয়ে বাগানের চেয়ারে বসলো, পাগুলো বুকের কাছে উঠিয়ে মাথাটা হাঁটুর ওপর দিয়ে রেখেছে। ওখান থেকে একটুও নড়েনি।
‘তুমি শুনছো?’ দানবটা জিজ্ঞেস করলো।
‘না।’ কনর বললো।
চারপাশে বাতাস তীব্র গর্জন করে উঠলো।
‘আমার কথা শুনতে হবে।’ দানবটা গর্জে উঠলো, ‘এই যে চারপাশে যা কিছু দেখছো, সেগুলো যত দিন ধরে এ জগতে আছে, তত দিন আমিও ছিলাম। তাই আমাকে যথেষ্ট সম্মান দেখাবে তুমি…..
কনর চেয়ার থেকে উঠে রান্নাঘরের দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
‘কোথায় যাচ্ছ তুমি?’
কনর রেগেমেগে ঘুরে এমনভাবে তাকালো যে দানবটা চমকে উঠলো, দ্রু কুঁচকালো।
‘তুমি কী জানো? কোনো কিছুর ব্যাপারে তুমি কীই-বা জানো?’ কনর
তেতোভাবে বললো।
‘আমি তোমার ব্যাপারে জানি, কনর ও’ম্যালি।’
‘না, তুমি জানো না। যদি জানতে, তাহলে বুঝতে যে কাল্পনিক বিরক্তিকর একটা গাছের কাছ থেকে বিরক্তিকর গল্প শোনার সময় আমার নেই।’
‘ওহ্? তোমার ঘরে পড়ে থাকা ঐ বেরিগুলো তাহলে কাল্পনিক ছিল?’
‘তাতে কী আসে যায়? বিরক্তিকর বেরিগুলো, ইশ কী ভয়ানক, কেউ বাঁচাও আমাকে এই বেরিগুলো থেকে!’
দানবটা তার দিকে অবাক হয়ে তাকালো।
‘অদ্ভুত ব্যাপার, তুমি বলছো যে তুমি বেরিগুলোকে ভয় পাচ্ছ। কিন্তু তোমাকে দেখে তো মনে হয় না ভয় পাচ্ছ।’
‘তুমি হাজার বছর ধরে বেঁচে আছো, কিন্তু কখনো ব্যঙ্গ করার কথা শোনোনি?’ কনর জিজ্ঞেস করলো।
‘ও হ্যাঁ, আমি শুনেছি।’ দানবটা কোমরে হাত দিয়ে বললো, ‘কিন্তু আমার সাথে কথা বলতেই লোকজন ভয় পায়, ব্যঙ্গ করা তো দূরের কথা। ‘
‘তুমি আমার পিছু নিয়েছো কেন?’
দানবটা মাথা নাড়লো, কিন্তু তা কনরের প্রশ্নের উত্তরে না। ‘ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত। আমি এতকিছু করলাম, তাও তুমি ভয় পাচ্ছ না।’
‘তুমি একটা গাছ।’ কনর বললো। হ্যাঁ, গাছটা কথা বলতে পারে, হাঁটাচলা করতে পারে। চাইলে কনরকে গিলে খেয়ে ফেলতে পারবে। গাছটা ওর বাড়ির চেয়েও বড়ো। কিন্তু হাজার হোক, ওটা তো একটা গাছ। সামান্য ইয়ো গাছ। কনর তো দূর থেকে ওর গায়ে লেগে থাকা বেরিও দেখতে পাচ্ছে।
‘তোমার নিজের কাছে ভয় পাওয়ার মতো তাহলে অনেককিছু ইতোমধ্যেই আছে।’ দানবটা কিন্তু এবার প্রশ্ন করেনি।
কনর একবার মাটির দিকে তাকিয়ে উপরে চাঁদের দিকে তাকালো। দানবের দিকে সে তাকাতে চায় না। দুঃস্বপ্নটা যেন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ভাবনাচিন্তা এলোমেলো করে দিচ্ছে। সবকিছুই কেমন দুর্বোধ্য আর অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। তাকে এতটা ভারী করে দিচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন কাঁধের ওপর বিশাল এক পর্বতসমান বোঝা।
‘আমি ভেবেছিলাম।’ কনর একটু কেশে বললো, ‘আমি যখন নানুর সাথে ঝগড়া করছিলাম, তখন তুমি এসেছিলে, আর আমি ভেবেছিলাম–’
‘কী ভেবেছিলে?’ কনরের কথা শেষ হওয়ার আগেই দানবটা জিজ্ঞেস করলো। ‘থাক বাদ দাও।’ বলে কনর ঘরের দিকে হাঁটা শুরু করলো।
‘তুমি ভেবেছিলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি।’ দানবটা উত্তর দিলো।
কনর থেমে গেল।
‘তুমি ভেবেছো আমি তোমার শত্রু বধ করতে এসেছি, রূপকথার ড্রাগনগুলো মেরে ফেলতে এসেছি।’
কনর ভেতরেও গেল না, ফিরেও তাকালো না।
‘তোমাকে বলেছিলাম না আমি তোমার ডাক শুনেই এসেছি? কথাটা সত্য বলেই তুমি মেনে নিয়েছো। তাই না?’
কনর এবার ঘুরলো, ‘কিন্তু তুমি তো আমাকে কেবল গল্প শোনাতে চাও।’ তার কণ্ঠে যেন অসন্তুষ্টি ঝরে পড়ছে। আসলেই সে ওটা ভেবেছিল।
দানবটা হাঁটু ভেঙে কনরের কাছাকাছি চলে এলো, ‘সে-সব গল্প–যখন আমি শত্ৰু বধ করেছিলাম, রূপকথার ড্রাগনগুলো মেরে ফেলেছিলাম।’
চোখ পিটপিট করে দানবের চোখের দিকে তাকালো কনর।
‘গল্প জিনিসটাই বুনো।’ দানবটা বলতে শুরু করে, ‘একবার গল্পের বাঁধ ছুটে দিলে কোথায় কী হবে বলা যায় না।’
দানবটা দাঁড়িয়ে কনরের ঘরের দিকে তাকালো, যেখানে নানু ঘুমিয়ে আছে এখন।
‘তোমাকে আমার একটা গল্প বলবো। ওই সময় আমি এভাবেই জেগে উঠেছিলাম।’ দানব বলে, ‘সেবার এক জঘন্য রানিকে শায়েস্তা করেছিলাম।’
কনর ঢোক গিলে দানবের চেহারার দিকে তাকালো, ‘ঠিক আছে। শোনাও তোমার গল্প।’
প্রথম গল্প
‘অনেক বছর আগের কথা।’ দানব তার গল্প বলতে শুরু করলো, ‘তখন এখনকার মতো গাড়িঘোড়া ছিল না। চারপাশে কেবল গাছগাছালি ছাড়া আর কিছুই দেখা যেত না। তখন গাছই সীমানায় পাহারার কাজ করে দিতো। প্রতিটি রাস্তা গাছে ঢাকা ছিল। প্রতিটি ঘর গাছে ঢাকা ছিল। এমনকি ঘরবাড়িও গাছ আর পাথর দিয়ে বানানো হতো।
তখন জায়গাটাকে একটা রাজ্য বলা হতো।
‘কী?’ কনর ঘুরে তার পেছনের উঠোনের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এখানে?’
দানবটা কৌতূহলী হয়ে তার দিকে তাকায়, ‘তুমি জানো না কিছু?’
‘কোনো রাজ্যের কথা শুনবো কীভাবে! এখানে তো ম্যাকডোনাল্ড’সও নেই।’
‘যাই হোক।’ দানবটা বলতে লাগলো, ‘এখানে ছোটো কিন্তু সুখের একটা রাজ্য ছিল। রাজা ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক। তাঁর স্ত্রী চারটি শক্তিশালী পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু তাঁর শাসনামলে রাজ্যের শান্তিরক্ষার জন্য রাজাকে নানান যুদ্ধে যেতে হতো। দৈত্য আর ড্রাগন, লাল চোখের কালো নেকড়ে, আর জাদুকরদের বিশাল সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যুদ্ধ করেই রাজ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হতো, এবং পুরো রাজ্যেই শান্তি ছিল। কিন্তু জয়ের বিনিময়ে রাজাকে মূল্য দিতে হয়। একে একে তাঁর চারটি পুত্র সন্তানই মারা যায়। হয়তো কোনো ড্রাগনের আগুনে পুড়ে বা কোনো দৈত্যের হাতে বা কোনো নেকড়ের কামড়ে অথবা কোনো মানুষের বর্ষার আঘাতে। একে একে চার যুবরাজ মারা যাওয়ার পর তার শিশু নাতি বাদে আর কোনো উত্তরাধিকারী জীবিত ছিল না।’
‘কী বাচ্চাদের মতো গল্প! রুপকথা না-কি!’ কনর কিছুটা সন্দেহ নিয়ে বলে।
‘বর্শার আঘাতে কিংবা নেকড়ের কামড় খেলে মানুষ কত জোরে চিৎকার দেয়— সেটা তো তুমি কখনো জানবে না। জানলে এই কথা বলারই সাহস হতো না। এখন আমার গল্প মন দিয়ে শোনো।’ দানব বলে।
একে একে রাজার স্ত্রী ও শিশু যুবরাজের মা শোকে ভেঙে পড়েন এবং একসময় মারা যান। এরপর রাজা শিশু যুবরাজকে নিয়ে একা হয়ে পড়েন। এই একাকিত্বের সাথে মানিয়ে নেওয়া খুব কঠিন।
‘আমাকে আবারও বিয়ে করতে হবে।’ রাজা সিদ্ধান্ত নেন, ‘আমার জন্য না হলেও আমার যুবরাজ এবং আমার রাজ্যের উপকারের জন্য এটা করতে হবে।’
তাই পার্শ্ববর্তী রাজ্যের এক রাজকুমারীকে বিয়ে করে তিনি দুই রাজ্যেরই শক্তিবৃদ্ধি করেন। রাজকুমারীর বয়স কম এবং দেখতে-শুনতেও মন্দ না। তবে সে যা বলে, সরাসরি বলে ফেলে। মুখ সামলে কথা বলে না। রাজাকে দেখে মনে হলো, রাজকুমারীকে পেয়ে তিনি খুশিই হয়েছেন।
এভাবেই ধীরে ধীরে সময় কেটে যেতে লাগলো। শিশু যুবরাজ এখন একজন যুবক। আর দুই বছর পরেই সে রাজসিংহাসনের দায়িত্ব মাথা পেতে নিতে পারবে। কারণ দুই বছর পরেই যুবরাজের বয়স আঠারো হয়ে যাবে। সেই সময়টা রাজ্যের জন্য সুখের ছিল। এত দিনের যুদ্ধ-বিবাদ নেই বললেই চলে। রাজ্যের সুখশান্তি যে সাহসী যুবরাজের হাতে ন্যস্ত হবে, তা নিয়ে কারও মনে সন্দেহ নেই।
কিন্তু রাজা একদিন হুট করেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। গুজব ছড়াতে শুরু করে, নতুন রানি রাজাকে গোপনে বিষ দিয়েছেন। অবশ্য আগে থেকেই অনেকে সুন্দরী রানিকে খুব একটা পছন্দ করতো না। তার সুন্দর চেহারার আড়ালে যে একজন ডাকিনি লুকিয়ে আছে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিলো না অনেকের। মহিলা না-কি নিজের রূপ ধরে রাখার জন্য যাদুবিদ্যার আশ্রয় নিতেন। রাজা জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে প্রজাদের অনুরোধ করেন রানিকে যেন দোষারোপ করা না হয় ।
একদিন রাজা মারা যান। যুবরাজের সিংহাসনে বসার উপযুক্ত হতে আরও এক বছর বাকি। সে পর্যন্ত রানিসাহেবই তার হয়ে রাজ্যের দেখভাল করবেন।
কিছুদিনের মধ্যে সবাই অবাক হয়ে লক্ষ করলো, রানির শাসনাধীনে রাজ্যে শান্তি বজায় রয়েছে। অনেকটা মৃত রাজার মতোই সুনিপুণভাবে তিনি রাজ্য পরিচালনা করে যাচ্ছেন।
আর এদিকে আমাদের যুবরাজ প্রেমে পড়ে গেলেন।
‘আমি জানতাম।’ কনর গজগজ করে উঠলো, ‘এসব গল্পে সব সময় কোনো একটা বোকা যুবরাজ প্রেমে পড়ে যায়।’ বলে সে বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করলো, ‘আমি ভেবেছিলাম গল্পটা ভালো হবে।’
দানবটা হুট করে কনরের পা ধরে তাকে উল্টো করে বাতাসে ঝুলিয়ে ধরলো, ‘তো যা বলছিলাম আমি।’
যুবরাজ যার প্রেমে পড়েছিল, সে সামান্য কৃষকের মেয়ে। কিন্তু কৃষকের মেয়ে হলে কী হবে, অসম্ভব রূপবতী ও বুদ্ধিমতী। কৃষক পরিবারের মেয়েদের একটু চালাক হতেই হয়। এই ব্যাবসাটাই ঝামেলার। রাজ্যের অনেকেই ওদের প্রেমের কথা জানতে পেয়ে হেসেছিল।
রানি খুশি হতে পারেননি। রাজ্যের ওপর এতদিনের একচ্ছত্র আধিপত্য ছেড়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছে তাঁর ছিল না। তাঁর মতে, রাজ্যের দায়ভার রাজবংশের মধ্যেই থাকা সবচেয়ে ভালো হবে। আপাতদৃষ্টিতে রাজকুমার যদি রানিকে বিয়ে করে তবে সবচেয়ে ভালো হয় ।
‘ছিহ!’ উলটো ঝুলে থাকা অবস্থাতেই কনর বলে, ‘রানি তো ওর দাদি হয়!’
‘সৎ দাদি।’ দানবটা কনরের ভুল সংশোধন করে দেয়, ‘তাদের মাঝে রক্তের সম্পর্ক ছিল না এবং রানির বয়সও তখন খুব বেশি না।’
কনর মাথা নাড়লো, ‘তাও এটা ঠিক না।’ একটু থেমে বললো, ‘তুমি কি আমাকে নামাবে?’
দানবটা তাকে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে বাকি গল্প বলতে শুরু করলো।
যুবরাজও ভেবেছে যে রানিকে বিয়ে করাটা ভুল হবে। সে মরে যাবে, তাও এমন কিছু করবে না। প্রতিজ্ঞা করলো যে সে কৃষকের মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাবে এবং তার আঠারো বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথেই প্রজাদেরকে রানির শোষণ থেকে বাঁচাতে ফিরে আসবে। এভাবেই এক রাতে যুবরাজ ও কৃষকের মেয়ে ঘোড়ায় চড়ে পালিয়ে যায়। রাত হয়ে গেলে বিশাল এক ইয়ো গাছের নিচে রাত কাটানোর জন্য নেমে পড়ে।
‘তুমি?’ কনর বললো।
‘আমি।’ দানবটা উত্তর করলো, ‘আমার কেবল একটি অংশ। আমি যে-কোনো আকার ধারণ করতে পারি, কিন্তু ইয়ো গাছের আকারটা সবচেয়ে আরামদায়ক।‘
গভীর রাতে যুবরাজ এবং তার সঙ্গিনী একে অপরকে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে। তারা কথা দিয়েছিল পাশের রাজ্যে গিয়ে বিয়ে না করা পর্যন্ত তারা সংযম বজায় রাখবে। কিন্তু আকর্ষণ সে-সবকে ছাপিয়ে গেল এবং ভোর হওয়ার আগেই তারা একে অপরের বাহুডোরে উলঙ্গ হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
তারা সারাদিন আমার ছায়ায় ঘুমালো। রাত নামতেই যুবরাজের ঘুম ভাঙলো। ‘ওঠো প্রিয়তমা।’ কৃষকের মেয়েকে বললো সে, ‘আজ আমরা স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হবো।’
কিন্তু ‘প্রিয়তমা’ জাগলো না। যুবরাজ তাকে ধরে ঝাঁকাতেই চাঁদের আলোয় রক্ত দেখতে পেল।
‘রক্ত?’ কনর জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু দানবটা উত্তর দেওয়ার জন্য থামলো না।
যুবরাজের হাতেও রক্ত ছিল, তাদের পাশে গাছের মূলের ওপর একটা রক্তমাখা ছোরা। কেউ তার প্রিয়তমাকে মেরে ফেলেছে আর এমনভাবে সাজিয়েছে যেন মনে হয় যুবরাজই এই অপরাধটা করেছে।
‘রানি!’ যুবরাজ কেঁদে উঠলো, ‘এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে রানি দায়ী।’
দূর থেকে গ্রামবাসীদের এগিয়ে আসার শব্দ শোনা গেল। তারা যদি এসে এই রক্তমাখা ছোরা দেখে, তাহলে যুবরাজকে খুনি ভাববে এবং বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেবে।
‘আর রানী তখন সানন্দে রাজ্য শাসন করতে পারবে।’ কনর একটা বিরক্তিকর শব্দ করে বললো, ‘গল্পের শেষটায় যেন ওর মুণ্ডু কাটা হয়।’
যুবরাজের পালিয়ে যাবার জায়গা ছিল না। আশেপাশে তার ঘোড়াটাও নেই। আপাতত এই ইয়ো গাছটাই তার শেষ আশ্রয়। আর কেবল এখানেই সে সাহায্য পেতে পারে। তখন তরুণ পৃথিবীর সবকিছুর মধ্যে বাধা খুবই পাতলা ছিল, খুব সহজেই যা ভেঙে ফেলা যায়। যুবরাজ এ কথা ভালোমতোই জানতো। সে ইয়ো গাছের দিকে মাথা তুলে তাকায়। তারপর কথা বলতে শুরু করে।
দানবটা থেমে গেল।
‘কী বলেছিল সে?’ কনর জিজ্ঞেস করলো।
‘যা বলেছিল, আমাকে জাগিয়ে তোলার জন্য তা যথেষ্ট।’ দানবটা বললো, ‘আমি অন্যায় বুঝতে পারি।’
যুবরাজ গ্রামবাসীদের দিকে দৌড়ে গেল, ‘রানি আমার প্রেমিকাকে মেরে ফেলেছে, তাকে থামাতেই হবে।’
রানির যাদুটোনার কথা সবাই আগে থেকেই জানতো। তাছাড়া যুবরাজকে প্রজারা খুবই ভালোবাসততা। এজন্য সত্যিটা চোখের সামনে থাকলেও কেউ সেটা দেখতে চাইলো না। যুবরাজের পিছনে এক বিশাল সবুজ মানুষকে প্রতিশোধ নিতে আসতে দেখে তাদের বিশ্বাসটা আরও শক্ত হলো।
কনর দানবের বিশাল হাত-পা আর ধারালো দাঁতওয়ালা মুখের দিকে তাকালো। সবকিছুই দানবিক। না জানি রানি একে আসতে দেখে কী ভেবেছিল!
সে হাসলো।
রেগেমেগে রানির প্রসাদে পাথর ছুঁড়ে মারলো প্রজারা। পাথরের আঘাতে প্রাসাদ আস্তে আস্তে ভেঙে পড়তে শুরু করলো। আগুনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার জন্য তারা রানিকে ধরে নিয়ে গেল।
‘একদম ভালো হয়েছে।’ কনর হেসে বললো, ‘যেমন কর্ম তেমন ফল।’ বলে সে ওপরে নিজের ঘরের দিকে তাকালো যেখানে তার নানু ঘুমিয়ে আছে, ‘আমার মনে হয় না তুমি নানুর ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারবে, তাই না? মানে, আমি তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে চাই না; কেবল–’
‘গল্পটা এখনও শেষ হয়নি।’ দানবটা বললো।
প্রথম গল্পের বাকি অংশ
‘হয়নি?’ কনর বললো, ‘কিন্তু রানিকে তো সিংহাসন ছাড়তে হয়েছে?’
‘হয়েছিল, কিন্তু আমার কারণে নয়।’ দানবটা বললো ।
কনর ইতস্তত করলো, ‘কিন্তু তুমি বলেছিলে, রানিকে আর দেখা যায়নি।’
‘আমি বলেছিলাম–যখন গ্রামবাসীরা তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল, তখন আমি সেখানে পৌঁছে যাই এবং রানিকে বাঁচিয়ে ফেলি।’
‘কী করেছো?’ কনর বললো।
‘আমি রানিকে নিয়ে অনেক দূরে রেখে এসেছিলাম, যেখানে গ্রামবাসীরা তাকে কখনও খুঁজে পাবে না। সাগরের অপর প্রান্তে সেই রাজ্যে, যেখানে তাঁর জন্ম হয়েছিল। ওখানে যেন তিনি শান্তিমতো জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে পারেন, সে ব্যবস্থা করে আসি।’
কনর উঠে দাঁড়ায়। ওর কণ্ঠে অবিশ্বাস ঝড়ে পড়ছে, ‘কিন্তু সে কৃষকের মেয়েকে মেরে ফেলেছে! তুমি কীভাবে একটা খুনিকে বাঁচাতে পারলে? তুমি আসলেই একটা দানব।’
‘আমি কখনও বলিনি যে রানি কৃষকের মেয়েকে খুন করেছে।’ দানবটা বললো, ‘আমি কেবল বলেছি যে যুবরাজ এমনটা বলেছে।’
‘তাহলে তাকে কে মেরেছে?’
দানবটা তার বিশাল হাত প্রসারিত করলে তাদের চারপাশে বাতাস বয়ে যেতে থাকলো। তার সাথে কুয়াশা দিয়ে চারপাশ ছেয়ে গেল। কুয়াশায় কনরের বাসা ঢাকা পড়ে গেল। এখন তারা একটা মাঠে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে বিশাল এক ইয়ো গাছের নিচে একটা মেয়ে আর একটা ছেলে শুয়ে আছে।
‘তাদের ভালোবাসাবাসির পর যুবরাজ তখনও জেগে ছিল।’ দানব বললো । যুবরাজ উঠে ঘুমন্ত কৃষকের মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কনর নিজেই বুঝতে পারলো মেয়েটা রূপবতী। যুবরাজ কিছুক্ষণ তাকে দেখে তার গায়ে একটা কম্বল দিয়ে তাদের ঘোড়ার কাছে চলে গেল। সেটার থেকে কিছু একটা বের করে ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিলো যেন সেটা পালিয়ে যায়। তারপর সে জিনিসটা হাতে তুলে ধরলো।
চাঁদের আলোয় বোঝা গেল এটা একটা ছোরা।
‘না!’ কনর বললো।
দানবটা হাত গুটিয়ে নিতেই কুয়াশা সরে গেল। এর মাঝেই দেখা গেল যুবরাজ ছোরা হাতে ঘুমন্ত কৃষকের মেয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
‘তুমি বলেছিলে–যখন মেয়েটা ঘুম থেকে ওঠেনি, তখন যুবরাজ অবাক হয়েছিল।’ কনর বললো।
‘সে কৃষকের মেয়েকে খুন করে’ দানবটা বলতে থাকলো, ‘তার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে গেল। যখন সে জেগে উঠলো, তখন ভান ধরে ছিল যেন সে কিছুই জানে না। শুনে অবাক লাগবে, কিন্তু সে বিশ্বাস করেছিল যে সে আসলেই কিছু জানে না। কখনো কখনো মানুষকে নিজের কাছেই মিথ্যে বলতে হয়।’
‘তুমি বলেছিলে–সে তোমার কাছে সাহায্য চাইছিল, আর তুমি সেটা করেছো।’
‘আমি কেবল বলেছি, সে আমাকে জাগানোর মতো যথেষ্ট কিছু বলেছিল।’ কনর বিস্ময়ের সাথে একবার দানবের দিকে তাকিয়ে আবার উঠোনের দিকে লক্ষ করলো, যেখানে কুয়াশা আবার ফিরে আসছে, ‘সে তোমাকে কী বলেছিল?’
‘বলেছে যে সে এটা রাজ্যের ভালোর জন্য করেছে। এই নতুন রানি আসলেই একটা ডাইনি, যুবরাজের দাদা সেটা আগেই সন্দেহ করেছিলেন, কিন্তু তার সৌন্দর্যের করণে সেটা উপেক্ষা করে যাযন। যুবরাজ একা এত শক্তিশালী একটা ডাইনির মোকাবেলা করতে পারবে না। এজন্য তার গ্রামবাসীদের ক্ষোভের সাহায্য নিতে হবে। কৃষকের মেয়ের খুনের মধ্য দিয়েই সেটা সম্ভব হয়েছিল। যুবরাজও অনুতপ্ত ছিল। কিন্তু রাজ্যের রক্ষার্থে তার বাবা মারা গিয়েছেন এবং তার প্রেমিকাও মারা গেল। এই মৃত্যুগুলো যেন বৃথা না যায়; এদের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। যখন সে বলেছিল যে রানি তার প্রেমিকাকে মেরে ফেলেছে, সে নিজের কাছেই মিথ্যা বলেছিল যেটা সে বিশ্বাস করেছে।’
‘যত্তসব!’ কনর চিৎকার করে উঠলো, ‘মেয়েটাকে মারার কোনো দরকার ছিল না, গ্রামবাসী তাকে এমনিতেই সাহায্য করতো।’
‘যে মানুষ খুন করে, তার নিজেকে নির্দোষ দাবি করার ব্যাপারটিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে হয়। আমি অন্যায় দেখে জেগে উঠেছি। যুবরাজের অন্যায় না। রানির প্রতি হওয়া অন্যায় দেখে।’
‘যুবরাজকে কেউ ধরতে পেরেছিল? কেউ তাকে শাস্তি দিয়েছিল?’
‘সে প্রজাদের প্রিয় রাজা হয়ে উঠেছিল।’ দানবটা বললো, ‘মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে রাজ্য শাসন করেছে।’
ওপরে তাকিয়ে কনর নিজের শোবার ঘরের জানালার দিকে তাকালো, ‘তাহলে ভালো যুবরাজ আসলে খুনি ছিল এবং ডাইনি রানিটা আসলে খারাপ ছিল না। এখান থেকে তাহলে কী শিক্ষা পাওয়া যায়? এই শিক্ষা যে আমাকে তার সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে?’
অদ্ভুত একটা গর্জন শোনা গেল, বুঝতে একটু সময় লাগলো যে দানবটা আসলে হাসছে।
‘তুমি কি ভাবছো আমি তোমাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য গল্প শোনাচ্ছি?’ দানবটা বললো, ‘তোমাকে সামান্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমি জেগে উঠেছি–এটা মনে করছো তুমি?’
দানবটা আরও জোরে হেসে উঠলো। তার হাসির শব্দে মনে হলো যেন আকাশ পাতাল কাঁপছে।
‘হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।’ কনর যেন একটু লজ্জা পেয়েছে।
‘না না।’ দানবটা বললো, ‘রানি আসলেই ডাইনি ছিল এবং সেও নিষ্পাপ ছিল না। কে বলতে পারে? সে তো যেভাবেই হোক ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করছিল।’
‘তাহলে তুমি তাকে বাঁচিয়েছিলে কেন?’
‘কারণ সে কোন খুনি ছিল না।’
কনর উঠোনে একটু হেঁটে বেড়ালো, ‘আমি বুঝতে পারছি না, এখানে ভালো কে?’
‘কেউ সব সময় ভালো থাকে না, আবার সব সময় খারাপও থাকে না। ভালো খারাপের মিশ্রণ নিয়েই মানুষ। ‘
কনর মাথা ঝাঁকালো, ‘এটা খুবই বাজে একটা গল্প। ধোঁকাবাজি।’
‘এটা একটা সত্যি গল্প। অনেককিছুই ধোঁকাবাজির মতো মনে হয়। রাজ্য তাদের যথার্থ যুবরাজ পায়, কৃষকের মেয়েরা কোনো কারণ ছাড়াই মারা পড়ে, আর কখনো কখনো ডাইনিদেরকে বাঁচাতে হয়। এসব যে কত প্রায়শই হয় তা জানলে তুমি অবাক হবে।’
ওপরে তাকিয়ে তার নানুর কথা ভাবলো কনর, ‘তো এসব কীভাবে আমাকে তার হাত থেকে বাঁচাবে?’
দানবটা পুরোপুরি উঁচু হয়ে দাঁড়ালো।
তোমাকে তার হাত থেকে বাঁচানোর কোনো প্রয়োজন নেই।
কনর সোফায় উঠে বসলো, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো।
ঘড়িতে ১২টা বেজে ৭ মিনিট।
‘ধেত্তেরি! আমি কি স্বপ্ন দেখছি?’
রেগেমেগে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে তার পায়ে কিছু বাধলো।
‘এখন আবার কী?’
বাতি জ্বালতেই দেখলো মেঝেতে লম্বা একটা গাছের মূল গজিয়ে আছে, কিছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে সেটা ওঠানোর জন্য রান্নাঘর থেকে একটা চাকু আনতে গেল।
বোঝাপড়া
‘আমি তোমাকে মাফ করে দিয়েছি।’ কনরের সাথে হাঁটতে হাঁটতে লিলি বললো।
‘কীসের জন্য?’ তার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো কনর। দানবের গল্পটা নিয়ে সে এখনও বিরক্ত হয়ে আছে। মেঝে থেকে ওই মূলটা ওঠাতে প্রায় আধা ঘণ্টা সময় লেগেছে. এরপর যখনই তার ঘুম এসেছে, তখনই মনে হয়েছে যেন সকাল হয়ে গেছে। দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার জন্য নানু তাকে বকাবকিও করছে। এমনকি মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিতেও দেয়নি। বলেছে–মায়ের না-কি সারারাত খুব কষ্ট হয়েছে, এখন তার বিশ্রাম প্রয়োজন। সেটা শুনে কনরের খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল নানু নয়, তারই উচিত ছিল রাতের বেলা মায়ের পাশে থাকা। তাড়াহুড়ো করে নানু তাকে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছে।
‘আমাকে বিপদে ফেলার জন্য, বোকা কোথাকার।’ লিলির কণ্ঠে খুব একটা রাগ নেই।
‘তুমি নিজে নিজেই বিপদে পড়েছিলে।’ কনর বললো, ‘তুমি তো সালিকে ধাক্কা মেরে ফেলেছো।’
‘আমি তোমাকে তোমার বলা মিথ্যার জন্য মাফ করে দিলাম।’
কনর কিছু না বলে কেবল হাঁটতে থাকলো।
‘তুমি কি পালটা কিছু বলবে না?’
‘না।’
‘কেন না?’
‘কারণ আমি এসবের জন্য দুঃখিত নই।’
‘কনর–’
‘আমি দুঃখিত নই এবং আমি তোমাকে মাফ করবো না।’
কনর আর লিলি একে অপরের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
‘আমার মা বলেছে তোমাদেরকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে হবে, তোমাদের চলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।’
এক মুহূর্তের জন্য সূর্যটা মেঘের পেছনে ঢাকা পড়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য কনর কেবল বিদ্যুৎ চমকানো দেখতে পেল, যেন আকাশ থেকে বাজ তার হাতের ওপর এসে পড়ছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো যেন লিলিকে সে মেরে ফেলবে
‘কনর?’ একটু চমকে উঠে বললো লিলি।
কনর খুব দ্রুত তাকে রেখে চলে গেল ।
মাত্র এক বছর আগে লিলি তার বন্ধুদেরকে কনরের মায়ের খবরটা জানিয়েছিল। সে-সব বন্ধু তাদের বন্ধুদেরকে বলেছে, এবং তারা তাদের বন্ধুদেরকে বলেছে। এভাবে কনরের আশপাশের সবাই জেনে গেছে। ব্যাপারটা এমন যেন কনর এমন এক বৃত্তের কেন্দ্রে আছে যার ভেতরে সবাই আসতে ভয় পায়। কনর যখন আসে, তখন হুট করেই যেন সবাই চুপ হয়ে যায়। যদিও লিলি ছাড়া এমন কোনো বন্ধু তার নেই, কিন্তু তারপরও সে তার আশপাশে অনেক ফিসফিসানি শুনতে পায়। এমনকি শিক্ষকেরাও তাকে দেখে অন্যরকমভাবে তাকাতে শুরু করলো।
ধীরে ধীরে বন্ধু-বান্ধবের মাঝে যাওয়া বন্ধ করে দিলো, ফিসফিসানি শুনে ও তাকানো বন্ধ করে দিলো।
কেউ হয়তো খেয়াল করেনি, কিন্তু সে ধীরে ধীরে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।
গত বছরের মতো স্কুলের এমন কষ্টের বছর তার আর কখনও যায়নি। তার মায়ের চিকিৎসা চলছিল, যেটা খুবই কষ্টকর ছিল তাদের জন্য। নতুন বছর শুরু হবার সময় তারা ভেবেছিল–এখন নতুন কিছু শুরু হবে, আগের সবকিছু পেছনে ফেলে তারা এগিয়ে যাবে।
কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। তার মায়ের চিকিৎসাগুলো যেন আরও দীর্ঘতর হতে লাগল। নতুন বছরের শিক্ষকেরা যেন তাকে কেবল তার মায়ের ব্যাপারটার জন্যই চিনতে পারে, আর অন্য ছেলেমেয়েরা তার সাথে এমন আচরণ করে যেন সে নিজেই অসুস্থ; হ্যারি আর তার চেলারা তো এখন তার পিছু ছাড়ে না।
এখন বাসায় তার নানু চলে এসেছে, আর সে স্বপ্নে গাছ দেখে বেড়াচ্ছে।
অথবা এটা কোনো স্বপ্নই না, যেটা আরও খারাপ ব্যাপার।
রেগেমেগে স্কুলের দিকে হাঁটতে লাগলো সে। এসবের বেশিরভাগই লিলির দোষ, তাই না?
সে সময়ই হ্যারির ঘুসিটা তার পেটে লাগলো।
আঘাতে মাটিতে পড়ে যাওয়ায় কংক্রিটে লেগে তার হাঁটু ছিলে গেল। সাথে সাথে তার ইউনিফর্মও কিছুটা ছিঁড়ে গেছে। এটাই সবচেয়ে বাজে ব্যাপার এখন–সে সেলাই জানে না।
‘তুমি এভাবে চলো কেন ও’ম্যালি, প্রতিদিনই পড়ে যাও।’ সালি হাসতে হাসতে বললো।
‘তোমার হয়তো ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।’ এন্টনের কণ্ঠও শোনা গেল।
‘মনে হয় ও মাতাল।’ সালি হাসতে হাসতে বললো। তবে কনর বুঝতে পারল যে হ্যারি হাসছে না। ঘাড় না ঘুরিয়েই সে বুঝতে পারলো হ্যারি কেবল তার দিকে তাকিয়ে আছে, হাসছে না; ভাবছে–কনর এখন কী করবে।
উঠে দাঁড়াতেই কনর দেখলো, লিলি কিছু মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে; কথা বলছে না, কেবল দাঁড়িয়ে আছে। কনরের দিকে চোখ পড়তেই সে ভেতরে চলে গেল।
‘আজ তোমার কুকুরটা তোমাকে সাহায্য করতে এলো না।’ সালি হাসতে হাসতে বললো।
‘তোমার কপাল ভালো, সালি।’ হ্যারি এই প্রথমবারের মতো কথা বললো। কনর এবারও ঘুরে দাঁড়ালো না, কিন্তু বুঝতে পারলো যে সালির কৌতুকে হ্যারি হাসছে না। লিলির চলে যাওয়া পর্যন্ত কনর সেদিকে তাকিয়ে রইলো।
‘এই, আমরা যখন কথা বলছি, তখন আমাদের দিকে তাকাবে তুমি।’ এ কথা বলতে বলতেই সালি রেগেমেগে কনরের কাঁধে হাত রাখলো।
‘ওকে ছোঁবে না, ও’ম্যালি এবং আমার মাঝে একটা বোঝাপড়া আছে, কেবল আমি তাকে ধরতে পারবো, ঠিক আছে?’ হ্যারি বলে উঠলো।
কনর একটু চুপ থেকে আস্তে আস্তে মাথা নাড়লো। তাদের মাঝে আসলেই
কোনো বোঝাপড়া হয়ে গেছে যেন।
হ্যারি নির্লিপ্তভাবে কনরের চেহারার দিকে তাকিয়ে তার কাছাকাছি এসে পড়লো। এমনভাবে তাকালো যেন সে কোনো প্রশ্ন করবে, কিন্তু কীভাবে করবে তা বুঝতে পারছে না। কনর নড়লো না। বাকি সবাই ভেতরে চলে গেছে। এখন তাদেরকেও যেতে হবে।
কিন্তু কেউই নড়ছে না ।
হ্যারি তার মুঠি এমনভাবে তুলে ধরলো যেন এখনই কনরকে ঘুসি মারবে; কনর প্রস্তুত ছিল।
কিন্তু ঘুসিটা এলো না।
‘হ্যাঁ, আমি এমনটাই ভাবছিলাম।’ হ্যারি তার মুঠি নামাতে নামাতে বললো । ‘এই ছেলেরা!’ মিস ওয়ান রেগেমেগে সবাইকে ডেকে বললো, ‘ব্রেক তিন মিনিট আগেই শেষ হয়ে গেছে। তোমরা এখনও এখানে কী করছো?’
‘সরি মিস।’ হ্যারি হঠাৎ করে খুশি হয়ে বললো, ‘আমরা মিস মার্লের জীবনগাথার হোমওয়ার্ক নিয়ে কথা বলছিলাম।’ সে কনরের কাঁধে এমনভাবে হাত রাখলো যেন তারা বন্ধু, ‘কনরের মতো গল্প আর কেউ বলতে পারে না, আর এই গল্প নিয়ে কথা বলতে সে খুব পছন্দও করে।’
‘হ্যাঁ।’ মিস ওয়ান বললো, ‘বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এখানে কোনো সমস্যা হলে তোমরা সবাই শাস্তি পাবে বলে দিলাম।’
‘জি, মিস।’ অ্যান্টন আর সালি হ্যারির পেছন পেছন ভেতরে চলে গেল, তাদের কিছুটা পেছনে কনর।
‘একটু এদিকে এসো, কনর!’ মিস ওয়ান বললো ।
কনর দাঁড়ালো, কিন্তু তার দিকে তাকালো না।
‘আমি কিন্তু অন্ধ না এবং আমি জানি হ্যারি কেমন। সে যতই চটপটে হোক না কেন, তার স্বভাবের কথা আমি জানি।’
কনর কিছু বললো না। তাদের মাঝে কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা চলে এলো, যার সাথে কনর খুব ভালোভাবেই পরিচিত। মিস ওয়ানের অঙ্গভঙ্গি দেখে সে বুঝতে পারছে যে এখন সে কী বলবে; আর সেটা বুঝতে পেরেই কনর বিরক্ত হয়ে উঠলো।
‘আমি বুঝতে পারছি তোমার ওপর দিয়ে এখন কী যাচ্ছে, কনর।’ মিস ওয়ান ধীরে ধীরে বললো, ‘কিন্তু তুমি যদি কখনো কথা বলতে চাও আমার সাথে, বলতে পারো।’
কনর তার দিকে তাকাতে পারছে না, তার সামনে থাকতেও কাছে অসহ্য লাগছে।
কারণ এটা তার প্রাপ্য নয়।
দুঃস্বপ্নটা তার চোখের সামনে চলে এলো, সেই আতঙ্ক আর তীব্র চিৎকার, আর শেষমেশ যা হয়েছিল
‘আমি ঠিক আছি মিস, আমার ওপর দিয়ে কিছুই যাচ্ছে না।’
‘ঠিক আছে। এখন ভেতরে চলো।’ মিস তাকে ভেতরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
এক মুহূর্তের জন্য সে যেন পুরোপুরি একা বোধ করতে লাগলো। সে জানে সে যদি এখানে সারাদিন একা দাঁড়িয়ে থাকে, তারপরও তাকে কেউ কোনো শাস্তি দেবে না, যেটা তার কাছে শাস্তির চেয়েও কম কিছু না।
কথোপকথন
স্কুলের পর নানুকে সোফায় বসে তার জন্যে অপেক্ষা করতে দেখলো কনর।
‘কিছু কথা আছে তোমার সাথে।’ দরজা বন্ধ হতে না হতেই নানু বলে উঠলো। চেহারার অভিব্যক্তিটা একটু অন্যরকম। কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল কনর।
‘কী হয়েছে?’
নানু বড়োসড়ো একটা নিঃশ্বাস নিলো। যেন নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। বাজপাখির মতো দেখাচ্ছে তাকে।
‘তোমার মাকে আবার হাসপাতালে চলে যেতে হবে।’ নানু বললো, ‘তোমাকে কয়েকদিন আমার সাথে থাকতে হবে, ব্যাগ গুছিয়ে নাও।’
কনর নড়লো না, ‘কী হয়েছে তার?’
নানু এমনভাবে চমকে উঠলো যেন এমন বোকা একটা প্রশ্ন সে আশা করেনি, ‘তার খুব কষ্ট হচ্ছে, অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যথা হচ্ছে।’
‘সে-সবের জন্য তো ওষুধ দেওয়া আছে–’ কনর বলতে শুরু করলো, কিন্তু নানু তাকে থামিয়ে দিলো।
‘সে-সব কাজ করছে না, কনর।’ নানু তার দিকে না তাকিয়েই বিষণ্ন ভাবে বললো, ‘সে-সব কাজ করছে না।’
‘কোন সব কাজ করছে না?’
নানু যেন দুহাত চেপে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো, জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।
‘তোমার মা ওপরে, তোমার সাথে তার কিছু কথা বলার আছে।’
‘কিন্তু–’
‘তোমার বাবা রবিবারে আসবে।
সোজা হয়ে দাঁড়ালো কনর, ‘বাবা আসবে?’
‘আমাকে কিছু ফোন করতে হবে।’ নানু উঠে দাঁড়িয়ে তার মোবাইল নিয়ে বাইরে চলে গেল।
‘বাবা কেন আসছে?’ পেছন থেকে কনর জিজ্ঞেস করলো।
তোমার মা অপেক্ষা করছে।’ বলে নানু দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
কনর তার ব্যাগটা এখনও নামানোর সুযোগ পায়নি!
বাবা আসছে। তার বাবা আসছে, আমেরিকা থেকে। যে কি না গত ক্রিসমাসের আগের ক্রিসমাস থেকে এখানে আসে না, যার স্ত্রী একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে কোনো না কোনো অসুখে পড়ে যায় বলে সে আর আসতে পারে না। বাচ্চাটা হওয়ার পর থেকে তো আরও সুযোগ হয় না। সেই বাবা যাকে কনর বড়ো হওয়ার সময় পাশে পায়নি, কেবল ফোনকলই পেয়েছে।
তার বাবা আসছে।
কেন?
‘কনর?’ মায়ের কণ্ঠ শোনা গেল।
সে তার ঘরে নেই, সে এখন কনরের ঘরের বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরের চার্চ আর পাহাড় দেখছে।
এবং সেই ইয়ো গাছটা।
কেবলই একটা ইয়ো গাছ।
‘সোনামণি!’ কনরকে দেখে হাসলো, কিন্তু তার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে তার কষ্ট হচ্ছে। এমনটা কেবল আর একবারই দেখেছে কনর, যখন মা হাসপাতালে গিয়ে রাতের বেলা আর ফিরতে পারেনি। তখন ইস্টারের সময় ছিল, আর নানুর বাসায় থাকাটা যেন অসহ্য হয়ে উঠেছিল কনরের জন্যে।
‘কী হয়েছে? তুমি আবার হাসপাতালে যাচ্ছ কেন?’ জিজ্ঞেস করলো কনর।
মা ইশারায় তাকে নিজের পাশে এসে বসতে বললো। তার মাথায় এখন লাল গোলাপের স্কার্ফটা বাঁধা, কিন্তু সেটার নিচে মাথার চামড়াটা দেখা যাচ্ছে। নানুর আনা পরচুলা পরার কথা মনে হয় সে ভেবেও দেখেনি।
‘আমি ঠিক হয়ে যাবো।’ মা বললো, ‘সত্যিই ঠিক হয়ে যাবো।
‘তাই কি?’
‘এসব তো আগেও হয়েছে। ভয় পেয়ো না। আমি আগেও অসুস্থ হয়েছি এবং ঠিকও হয়ে গিয়েছি। এবারও তা-ই হবে। এসে মায়ের কাছে বসবে না?’
কনর কাছে গেল। মায়ের হাসিটা যেন অমলিন। যেন সত্যিকারের হাসি। সে মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে তার চোখের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দিলো, আর ঠিক তখনই কনর লক্ষ করলো তার মায়ের হাত কত চিকন, কেবল হাড্ডি আর চামড়া।
‘বাবা কেন আসছে?’
মা থেমে গেল। ‘অনেকদিন হয়ে গেছে সে আসে না, তাই না? তুমি খুশি হওনি?’
‘নানু খুশি হয়নি মনে হচ্ছে।’
‘তুমি তো জানোই সে তোমার বাবার ব্যাপারে কেমন বোধ করে। সে-সব নিয়ে ভেবো না। তুমি তোমার বাবার সাথে মজা কোরো।’
দুজন খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো, ‘আরও কিছু আছে, তাই না?’ কনর জিজ্ঞেস করলো।
মা সোজা হয়ে বসে বললো, ‘আমার দিকে তাকাও, বাবা।’
কনর যদিও চাচ্ছিল না, তবুও ঘুরে তার দিকে তাকালো।
‘সম্প্রতি চিকিৎসাগুলো ঠিকঠাকভাবে কাজ করছে না। এগুলোতে যদি কাজ না হয়, তাহলে অন্য কিছু চেষ্টা করতে হবে।’
‘এটুকুই?’
‘এটুকুই। আরও অনেক কিছু করা যেতে পারে, ভয় পেয়ো না।’
‘তুমি নিশ্চিত?’
‘আমি নিশ্চিত।’
‘কারণ,’ একটু থেমে নিচের দিকে তাকালো, ‘কারণ এখন তুমি আমাকে বলতে পারো।’
মা তাকে জড়িয়ে ধরলো, তার শরীরটা খুবই নরম। কিছু না বলে কেবল কনরকে জড়িয়ে ধরে রাখলো সে। দুজনে মিলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলো।
‘এটা একটা গাছ, তুমি জানো তো?’ মা বললো।
‘তুমি আমাকে কম হলেও একশোবার বলেছো এটা।’
‘আমি না থাকালে ভুমি একে দেখে রেখো, ঠিক আছে? আমি ফিরে আসতে আসতে যেন এটা এখানেই থাকে।’
কনরের মধ্যে বিশ্বাস জাগলো–মা এভাবে বলছে, সুতরাং সে ফেরত আসবে, আসতেই হবে। দুজন একসাথে বাইরে গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকলো ।
তারা যতই তাকিয়ে থাকুক না কেন, সেটা একটা গাছ হয়েই রইলো।
নানুর বাসা
পাঁচ দিন হয়ে গেছে, দানবটা আসছে না ।
হয়তো সেটা নানুর বাসা চেনে না, অথবা এখানে আসতে পারছে না। নানুর বাসা তাদের বাসার চেয়ে বড়ো, কিন্তু ওখানকার মতো কোনো বড়ো বাগান এখানে নেই। নানু তার বাগানের জায়গায় বিশাল এক অফিস রুম বানিয়ে নিয়েছে, যেখানে সে বেশিরভাগ সময়ে নিজের অফিসের কাজ করে। কী যেন এস্টেট এজেন্টের কাজ, যেটার কথা কনর কখনও শোনেনি। এখানে সবকিছুই ইটের তৈরি, আর যত্রতত্র ফুলের পট রাখা। বড়ো গাছ রাখার কোনো জায়গায় নেই, ঘাসও নেই।
‘ওখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন, ছেলে?’ নানু একটা কানের দুল পরতে পরতে বললো, ‘তোমার বাবা তাড়াতাড়ি এখানে চলে আসবে। আমি তোমার মাকে দেখতে হাসপাতালে যাচ্ছি।’
‘আমি হাঁ করে দাঁড়াইনি।’ কনর বললো।
‘যাই হোক, ভেতরে এসো।’
নানু দ্রুত ঘরের ভেতর ঢুকে গেল এবং আস্তে আস্তে কনর তাকে অনুসরণ করলো। আজ রবিবার, তার বাবা এয়ারপোর্ট থেকে এখানে আসবে। এখানে এসে কনরের সাথে কিছুক্ষণ থাকবে। এরপর তারা মাকে দেখতে যাবে।
বাবা আসার সময়টাতে নানু থাকবে না, এটা হয়তো সবার জন্যই ভালো।
‘সামনের হলো থেকে তোমার ব্যাগটা নিয়ে এসো প্লিজ।’ নানু তার হ্যান্ডব্যাগ নিতে নিতে বললো, ‘তোমার বাবা যেন এসে না ভাবে তোমাকে খামারে রেখে দেওয়া হয়েছে।’
‘তেমনটা হবার সুযোগই নেই।’ কনর ফিসফিসিয়ে বলে। নানু আয়নায় লিপস্টিক চেক করছে।
মায়ের হসপিটালের রুম থেকে নানুর বাসাটা বেশি পরিষ্কার। বুয়া মার্টা বুধবারে আসে, কিন্তু সে আসার কোনো কারণ কনর বুঝতে পারে না। নানু একদম সকালে ঘুম থেকে ওঠে। নিজেই নিজের লন্ড্রি করে নেয়, আর রাতে ঘুমানোর আগে বাথরুম পরিষ্কার করে রাখে। খাবারের সাথে সাথেই থালাগুলো পরিষ্কার করে ফেলে। একবার তো কনরের খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই প্লেট নিয়ে ডিশওয়াশারে রেখে দিয়েছিল মহিলা।
‘আমার বয়সী এক মহিলা যে কি না একা থাকে’ নানু দিনে কমপক্ষে একবার বলে, ‘আমিই যদি সবকিছু ঠিকমতো না রাখি, তাহলে কে রাখবে?’
সে যেন চ্যালেঞ্জের সুরে কথাটা বলে।
প্রতিদিন সকালে নানু তাকে স্কুলে দিয়ে আসে, কেবল পঁয়তাল্লিশ মিনিটের রাস্তা। আর স্কুল শেষ হওয়ার পরে তাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় বাইরে। তারা এরপর হাসপাতালে মাকে দেখতে যায়। সেখানে এক ঘণ্টার মতো সময় কাটিয়ে নানুর বাসায় চলে আসে তারা। কোনো কোনো দিন মা বেশি ক্লান্ত থাকলে ওরা আগেই ফিরে আসে। নানু তাকে আদেশ দিয়ে দিয়ে হোমওয়ার্ক করায়, আর বাইরে থেকে আনা খাবার খাওয়ায়।
অনেকটা কর্নওয়ালে কনর আর মা এক গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে গিয়ে যখন একই বিছানায় সব কাজ সারতে হয়েছিল, সে দিনগুলোর মতো। পার্থক্য হলো–এবার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হচ্ছে।
‘আর’ নানু সুট পড়তে পড়তে বললো, ‘তোমার বাবা হয়তো খেয়াল করবে না যে তোমার মা দিন দিন কতটা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, ঠিক আছে? সুতরাং তাকে বেশি দিন এখানে রাখা যাবে না।’ আজ রবিবার, কিন্তু তাও নানু হাসপাতালে যাওয়ারর জন্য সুট পরে বের হচ্ছে, হয়তো বাবাকে অপ্রীতিকর বোধ করানোর জন্যে এমনটা করছে।
‘এমন না যে সে থাকলে কোনো সমস্যা হবে আমাদের।’ নানু এবার ঘুরে তাকে বিদায় জানালো, ‘ভালো ছেলে হয়ে থেকো।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এখন কনর বাসায় একা।
কনর যে গেস্টরুমে ঘুমায়, সেখানে চলে গেল। নানু এটাকে কনরের নিজের রুম বলে, কিন্তু কনর কখনও এটাকে গেস্টরুম ছাড়া অন্য কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু নানু তাকে পইপই করে বলে এটাকে যেন সে কখনও গেস্টরুম না বলে ।
মহিলা কী চায়? এটা তো তার ঘরের মতো দেখতে না। এটা দেখতে কারো ঘরের মতোই না। সবগুলো দেয়াল খালি, কেবল তিনটা জাহাজের ছবি ঝুলানো, হয়তো নানু ভেবেছে ছেলেদের ঘর এ-রকমই হয়। এমন তিন পাশে ফ্যাকাশে সাদা রং কখনোই একটা ছেলের ঘরের না। পুরো ঘরটায় সাদা রং, বিছানার চাদরগুলোও সাদা, ফার্নিচার বলতে কেবল একটা ওক ক্যাবিনেট।
হয়তো এটা কারো ঘর হতে পারত, কিন্তু কনরের পছন্দ না। পারলে তো সে নানুর বাসা থেকে চলে যায়। ব্যাগটা রেখে বের হতেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।
কেবল পাথরের রাস্তা আর অফিসঘর।
আর কিছুই তার দিকে তাকিয়ে নেই।
বসার ঘরটা এমন একটা ঘর যেখানে আসলে কেউই বসতে যায় না। কনর সেখানে সব সময় যেতে পারে না। তাই এখন সে ওখানে বসে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। মেঝেটা কাঠের তৈরি, সোফার অপর পাশে একটা ক্যাবিনেট যার ওপর কিছু চায়ের কাপের সেট আর নানুর পছন্দের ঘড়িটা রাখা, যেগুলো কেউ ভুলেও ধরতে পারে না। এসব নানু তার নিজের মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। ঘড়িটার নিচে একটা পেন্ডুলাম ঝুলছে। প্রতি পনেরো মিনিট পরপর সেটা বেজে ওঠে।
এই ঘরটা একটা পুরনো জাদুঘরের মতো! কোনো টেলিভিশনও নেই। একটা রান্নাঘর আছে যেটার বাতি হয়তো কখনোই জ্বালানো হয় না।
কনর বসে বসে বই পড়তে লাগলো, আর কীই-বা করার আছে?
বাবা এসে পৌঁছানোর আগে তার সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তার নতুন স্ত্রীর অত্যাবশ্যকীয় মাইগ্রেনের ব্যথার কারণে তা কখনো সম্ভব হয় না। সামনাসামনি কথা বলতে হয় ।
কনর পেন্ডুলামের ঘড়ির দিকে তাকালো। ১২টা বেজে ৪২ মিনিট। আর তিন মিনিট পর পেন্ডুলামটা বেজে উঠবে।
তিনটি নিস্তব্ধ মিনিট।
কনর বুঝতে পারল সে একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছে। অনেক দিন হয়ে গেছে সে তার বাবাকে স্কাইপ ছাড়া দেখেনি। সে কি দেখতে অন্যরকম হয়ে গেছে? কনর কি দেখতে অন্যরকম হয়ে গেছে?
এবং সাথে আরও একটি প্রশ্ন আছে। সে এখনই কেন আসছে? তার মায়ের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, হাসপাতালে যাওয়ার পাঁচ দিন পরেও তার অবস্থার উন্নতি হয়নি। কিন্তু এখনও আশা আছে। ক্রিসমাস তো আরও অনেক মাস পরে আর কনরের জন্মদিন তো চলেই গেছে। তাহলে বাবা এখন কেন আসছে?
কনর মেঝের দিকে তাকালো যার মাঝামাঝি খুবই দামী একটা কার্পেট। সেটা উঠিয়ে নিচে দেখলো মেঝের পালিশ করা বোর্ডের মাঝে খানিকটা উঁচু হয়ে আছে।
‘তুমি কি এখানে আছো?’ কনর ফিসফিস করে বললো।
ডোরবেলটা বাজতেই সে চমকে উঠে দ্রুত বসার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সে
খুব উত্তেজিত অনুভব করছে, তাড়াতাড়ি সামনের দরজা খুললো।
তার বাবা এসেছে, দেখতে পুরোপুরি অন্যরকম। কিন্তু সেই বাবাই।
‘এই, বাবা!’ তার বাবা বললো। কণ্ঠে আমেরিকান একটা টান আছে।
এক বছরের মধ্যে এই প্রথম কনর এভাবে হাসলো।
চ্যাম্প
‘সবকিছু কেমন চলছে, চ্যাম্প?’ পিজ্জা আসার অপেক্ষা করতে করতে বাবা জিজ্ঞেস করলো।
‘চ্যাম্প?’ কনর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো।
‘সরি’ বাবা কাচুমাচু হয়ে বললো, ‘আমেরিকাতে ভাষা পুরোপুরি অন্যরকম।’
‘তোমার কণ্ঠ খুবই হাস্যকর শোনাচ্ছে।’
‘হ্যাঁ, তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।’
কনর তার কোকে চুমুক দিলো। আজ হাসপাতালে তার মায়ের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। শেষমেশ নানু মাকে টয়লেটে নিয়ে গেল। মা এতটাই ক্লান্ত ছিল যে কেবল কনরকে ‘সোনামণি’ আর বাবাকে ‘হ্যালো লিয়াম’ বলে ডাকতে পেরেছিল। এর পরেই মা আবার ঘুমিয়ে পড়ে। তখন নানু রাগী একটা চেহারা নিয়ে তাদেরকে চলে যেতে বলে। সেই চেহারা দেখে বাবাও তর্ক করতে চাইছিল না।
‘তোমার মা, তোমার মা আসলে একটা যোদ্ধা, তাই না?’
বাবা বললো।
‘তো তুমি সবকিছু কীভাবে নিচ্ছ, কনর?’
‘আসার পর থেকে প্রায় ৮০০ বার এই প্রশ্নটা করেছো আমাকে।’
‘সরি’
‘আমি ঠিক আছি। মাকে নতুন ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, তাতে করে মা ভালো হয়ে যাবে। তাকে দেখতে খুবই রোগা দেখাচ্ছে, কিন্তু এমন তো আগেও হয়েছিল। সবাই এবার এমন করছে-?
‘তুমি ঠিক বলেছো বাবা।’ বাবা বললো, ‘তুমি একদম ঠিক বলেছো।’ সে তার ওয়াইন-গ্লাসটা হাতে নিয়ে বললো, ‘তবু, তোমাকে আরও সাহসী হতে হবে, অনেক বেশি সাহসী হতে হবে, তোমার মায়ের জন্য।’
‘তুমি আমেরিকান টেলিভিশনের মতো কথা বলছো।’
বাবা হাসলো, ‘তোমার বোন খুব ভালো আছে, এখন হাঁটতে শিখেছে।’
‘সৎ বোন।’ কনর তাকে শুধরে দিলো।
‘তোমার সাথে কবে যে তার দেখা করাবো। তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা করতে হবে, ক্রিসমাস হলে কেমন হয়?’
কনর তার বাবার চোখের দিকে তাকালো, ‘তাহলে মা কোথায় থাকবে?’
‘তোমার নানুর সাথে কথা বলে নিয়েছি। সে বলেছে বুদ্ধিটা খারাপ না, স্কুলের নতুন টার্ম শুরু হওয়ার আগেই তুমি ফিরে আসতে পারবে।’
কনর টেবিলের কোনায় হাত বুলালো, ‘তার মানে, শুধু দেখা করবো?
‘মানে?’ বাবা একটু অবাক হয়ে বললো, ‘দেখা করা মানে হচ্ছে–’ কনর বুঝতে পারছে বাবা কী বলতে চাচ্ছে। ‘কনর–’
কিন্তু কনর তাকে কথাটা শেষ করতে দিলো না, ‘একটা গাছ আমার সাথে দেখা করতে আসে।’ কোকের বোতলের লেবেলটা খুলতে খুলতে হুট করে কথাটা বলে ফেললো সে, ‘রাতের বেলা বাসায় আসে, এসে আমাকে গল্প শোনায় । ‘
বাবা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে, ‘কী?’
‘আমি প্রথমে ভেবেছিলাম এটা একটা স্বপ্ন।’ কনর লেবেলটা তার আঙুল দিয়ে খোঁচাতে শুরু করে, ‘কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার ঘরের মেঝেতে ছোটো ছোটো গাছ উঠছে। আমি সেগুলো লুকিয়ে রাখি।’
‘কনর—’
‘সেটা এখনও নানুর বাসায় আসেনি। মনে হয় তার জন্য নানুর বাসাটা খুব দূরে–’
‘তুমি কি
‘কিন্তু তাতে কী আসে যায়। এটা তো কেবল একটা স্বপ্ন, তাই না? স্বপ্ন শহরের এক কোণ থেকে আরেক কোনায় কীভাবে যাবে? যদিও সেটা খুব বিশাল—’
‘কনর থামো—’
‘আমি নানুর বাসায় থাকতে চাই না।’ আচমকাই কনরের কণ্ঠ শক্ত হয়ে গেল। সে একদৃষ্টে কোকের বোতলের দিকে তাকিয়ে আছে, ‘আমি তোমার সাথে কেন থাকতে পারি না? আমেরিকাতে তুমি যেখানে থাকো। ‘
বাবা তার ঠোঁট চাটলো, ‘মানে যখন–’
‘নানুর বাসাটা একটা বয়স্ক মহিলার বাসা।’ কনর বললো।
বাবা ছোট্ট করে হাসলো, ‘তুমি তাকে বয়স্ক মহিলা বলেছো–এটা তো আমি অবশ্যই বলবো তাকে।
‘কোথাও বসা যায় না, কোনো কিছু ছোঁয়াও যায় না।’ কনর বলতে থাকলো, ‘দুই সেকেন্ডের জন্য কোথাও ময়লা রাখা যায় না, আর তার অফিস ছাড়া অন্য কোথাও ইন্টারনেট নেই।’
‘এসব ব্যাপারে হয়তো তার সাথে কথা বলা যেতে পারে। ওখানে তো অনেকগুলো ঘর আছে। তোমার জন্য ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে।’
‘আমি ওখানে আমার ব্যবস্থা করতে চাই না।’ কনরের গলার স্বর খানিক উঁচু হয়ে গেল। ‘আমি আমার নিজের বাসায় আমার নিজের ঘর চাই।’
‘আমেরিকায় তো তুমি তা পাবে না, কনর। আমাদের তিনজনের জন্যই যথেষ্ট জায়গা নেই। তোমার নানুর কাছে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জায়গা এবং টাকা আছে। তাছাড়া তোমার স্কুল এখানে, বন্ধু-বান্ধব এখানে, তোমার পুরো জীবনই এখানে। তোমাকে সে-সব থেকে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না।
‘কার জন্য ঠিক হবে না?’
‘আমি সেভাবে বলতে চাইনি, আমি বলতে চাচ্ছি যে তোমাকে সাহসী হতে হবে।
‘সবাই এটাই বলে, যেন এটা বললে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আমি দুঃখিত, এসব তোমার কাছে অন্যায় মনে হচ্ছে, কিন্তু আমি সত্যিই চাই যে এমনটা না হতো–’
‘আসলেই কি তা চাও?’
‘অবশ্যই’ বাবা টেবিলের দিকে ঝুঁকে বললো, ‘কিন্তু এভাবেই সবার জন্য ভালো হবে, তুমি পরে বুঝতে পারবে।’
কনর বাবার দিকে না তাকিয়েই বললো, ‘মা ঠিক হয়ে গেলে কি আমরা এসব নিয়ে কথা বলতে পারি?’
বাবা আবার তার চেয়ারে ঝুঁকে গেল, ‘অবশ্যই, বাড়ি। আমরা সেটাই করবো।’ কনর এবার তার দিকে তাকালো, ‘বাড়ি?’
‘সরি!’ বাবা হাসলো। গ্লাসটা নিয়ে আমোদে একটা চুমুক দিলো। এরপর কনরের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘গাছের ব্যাপারে কী বলছিলে?’
ঠিক তখনই ওয়েটার তাদের পিজা নিয়ে এলো।
‘আমেরিকানো।’ কনর ভ্রু কুঁচকে তাকালো, ‘এটা কথা বলতে পারলে হয়তো তোমার মতোই কথা বলতো।’
আমেরিকানরা খুব বেশি ছুটি পায় না
‘তোমার নানুর বাসার মতো দেখাচ্ছে না এখনও।’ বাবা রেন্টাল গাড়িটা নানুর বাসার সামনে পার্ক করতে করতে বললো।
‘আমি ঘুমিয়ে গেলে সে মাঝে মাঝে হাসপাতালে চলে যায়।’ কনর বললো, ‘নার্সরা তাকে চেয়ারে ঘুমাতে দেয়।’
‘সে হয়তো আমাকে পছন্দ করে না, কিন্তু তার মানে এই না যে সে খারাপ মহিলা।’ বাবা বললো ।
গাড়ির জানালা দিয়ে বাসাটার দিকে তাকালো কনর। ‘তুমি কত দিন আছো?’ সে জিজ্ঞেস করলো। এতক্ষণ জিজ্ঞেস করতে ভয় করছিল।
বাবা এমন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো যেন একটা দুঃসংবাদ আসছে, ‘মাত্র কয়েকদিন।’
কনর তার দিকে তাকালো, ‘এটুকুই?’
‘আমেরিকানরা খুব একটা বন্ধ পায় না।’
‘কিন্তু তুমি তো আমেরিকান নও।’
‘কিন্তু আমি আমেরিকায় থাকি।’ বাবা হাসছে, ‘তুমি নিজেই তো সারা রাত আমাকে আমার কথার ভঙ্গির জন্য খেপালে।’
‘তুমি তাহলে কেন এসেছো? আসার দরকারই-বা কী?’
বাবা উত্তর দেওয়ার আগে একটু চুপ করে রইলো, ‘আমি এসেছি, কারণ তোমার
মা আমাকে আসতে বলেছে।’ মনে হলো বাবা আরও কিছু বলবে, কিন্তু বললো না।
কনর নিজেও কিছু বললো না।
‘আমি আবার আসবো’ তার বাবা বললো, ‘যখন প্রয়োজন হবে। আর তুমি ক্রিসমাসে আমাদের ওখানে আসবে, খুব মজা হবে।’
‘তোমার সেই গাদাগাদি করা বাসায় যেখানে আমার জন্য জায়গা নেই?’ কনর বললো।
‘কনর–’
‘আর তারপর আমি স্কুলের আগেই চলে আসবো’
‘কনর–’
‘তুমি কেন এসেছো?’ কনর গলার স্বর নিচু করে আবার জিজ্ঞেস করলো। এবার বাবা উত্তর দিলো না। গাড়ির ভেতরজুড়ে নিস্তব্ধতা। যেন তারা কোনো ক্যানিয়নের অপর পাশে বসে আছে। বাবা এক হাত বাড়িয়ে কনরের ঘাড়ে হাত রাখলো। কিন্তু কনর দরজা খুলে বের হয়ে গেল ।
‘কনর, দাঁড়াও।’
কনর দাঁড়ালো, কিন্তু ফিরে তাকালো না।
‘তুমি কি চাও তোমার মা সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরা পর্যন্ত আমি তোমার সাথে থাকি?’
‘আমি নিজে নিজেই ঠিক আছি।’
বাসায় ঢোকার পর বাসাটা খুব চুপচাপ মনে হলো। হবেই না কেন? সে তো একা।
দামি সোফাটায় ধরাম করে বসে পড়তেই একটা শব্দ হলো। শব্দটা তার ভালো লেগেছে, সে উঠে আবার ধরাম করে বসলো। এবার উঠে সেটার ওপর লাফাতে থাকলো, সোফার কাঠের পায়াগুলো মচমচ করছে, মেঝেতে সেগুলোর দাগ পড়ে যাচ্ছে।
নিজে নিজে হাসলো কনর। এমন করতে ভালো লাগছে।
সে সোফা থেকে নেমে সেটাতে একটা লাথি মারলো। তার নিঃশ্বাস দ্রুত হচ্ছে তা সে বুঝতে পারছে না। কপাল গরম হয়ে গেছে। সম্ভবত জ্বর এসেছে। আরও একটা লাথি মারলো সোফাটায়।
এবার ঘড়ির দিকে তাকালো। তার নানুর দামি ঘড়ির পেন্ডুলামটা আপন মনে এদিক-ওদিক দুলছে। যেন কনরকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না।
সে আস্তে আস্তে সেটার দিকে এগিয়ে গেল। একটু পরেই বংবং শব্দ করে ৯টা বাজবে ঘড়িতে। এক সেকেন্ড অপেক্ষা করে ঘড়ির কাঁটাকে বারোর ঘরে যেতে দেখলো। বং শব্দটা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই সে পেন্ডুলামটা হাত দিয়ে ধরে ফেললো।
ঘড়ির ভেতরের মেকানিজমগুলো শোনা যাচ্ছে। কনর হাত বাড়িয়ে মিনিট আর সেকেন্ডের কাটা-দুটো বারো থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। কাঁটাগুলো নড়তে না চাইলেও সে আরও জোর দিয়ে কাঁটাগুলোকে ঘোরাচ্ছে। একটা ক্লিক শব্দ হলো। ঘোরানো এখন শক্ত হয়ে যাচ্ছে। বং শব্দটাও এখন যেন অদ্ভুতভাবে হচ্ছে, আর বারবার ক্লিক শোনা যাচ্ছে।
কনর বুঝতে পারলো তার কপালে ঘাম জমে গেছে।
-একেবারে দুঃস্বপ্নের মতো, সেই দুঃস্বপ্ন যেখানে পুরো জগত হারিয়ে যায়, কিন্তু যেই দুঃস্বপ্নে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যেখানে সে নিজেই একটা দুঃস্বপ্ন-
সেকেন্ডের কাঁটা ভেঙে ঘড়ি থেকে পড়ে গেল।
কনর পেন্ডুলামটা ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গেল। সেটা আর দুলছে না, ঘড়িটাও আর শব্দ করছে না। যেন পুরোটাই জমে গেছে।
হায় হায়।
কী করেছে তা বুঝতে পেরে তার পেট মোচড় দিয়ে উঠলো।
হায় হায়! সে ভাবলো!
সে এটা ভেঙে ফেলেছে।
ঘড়িটার দাম হয়তো তার মায়ের গাড়ির চেয়েও বেশি। নানু তাকে খুন করে
ফেলবে। মহিলা তাকে আসলেই মেরে ফেলবে।
কিছুক্ষণ পর সে বুঝতে পারলো।
ঘণ্টার কাঁটা ও মিনিটের কাঁটা একটা নির্দিষ্ট সময়ে আটকে গেছে।
১২টা বেজে ৭ মিনিট।
‘ধ্বংস’ দানবটা তার পেছন থেকে বললো, ‘খুবই পীড়াদায়ক।’
কনর ঘুরে তাকালো। কোনোভাবে দানবটা তার নানুর বসার ঘরে চলে এসেছে। সে এখনও বিশালাকৃতির। তাই ঝুঁকে থাকতে হচ্ছে। শাখা-প্রশাখা আর পাতাগুলো কুঁচকে আছে। পুরোটা ঘর তার শরীর দখল করে রেখেছে।
‘ছোটো একটা ছেলের কাছ থেকে এই ধরনের ধ্বংসই আশা করা যায়।’ দানবটার নিঃশ্বাসে কনরের চুল উড়ছে।
‘তুমি এখানে কী করছো?’ কনর জিজ্ঞেস করলো। হুট করে যেন তার মনে আশা দানা বেঁধে উঠলো, ‘আমি কি ঘুমিয়ে আছি? এটা কি কোনো স্বপ্ন?’
‘আমি তোমাকে দ্বিতীয় গল্প শোনাতে এসেছি।’ দানবটা বললো।
কনর ঘুরে ভাঙা ঘড়িটার দিকে তাকালো, ‘এই গল্প কি আগের গল্পের মতোই বাজে হবে?’
‘এটা পুরোপুরি ধ্বংসের মধ্য দিয়ে শেষ হবে।’
কনর ঘুরে দানবটার দিকে তাকালো। অভিব্যক্তিটা দেখে মনে হলো দানবের মুখে শয়তানি হাসি।
‘এটাও কি কোনো ধোঁকাবাজির গল্প?’ জিজ্ঞেস করলো, ‘শুরুতে মনে হবে এক রকম আর শেষ হবে একদম অন্যরকমভাবে, সেরকম কিছু?’
‘না।’ দানবটা বললো, ‘এটা এমন এক লোকের গল্প যে কেবল নিজের ব্যাপারে ভাবতো।’ দানবটা আবারো হাসছে। এবার তাকে আরও বেশি ভয়ানক দেখাচ্ছে, ‘এবং তাকে খুব খুব খারাপভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।’
কনর এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ভাঙা ঘড়িটার কথা ভাবলো। সোফার নিচে দাগ পড়ে যাওয়া মেঝের কথা ভাবলো, দানবের গা থেকে ঝরে পড়া বিষাক্ত বেরির কথা ভাবলো।
নিজের বাবার কথা ভাবলো।
‘আমি শুনছি।’ কনর বললো।
দ্বিতীয় গল্প
‘একশ পঞ্চাশ বছর আগের কথা’ দানব বলতে শুরু করলো, ‘এই দেশটা তখন ব্যবসায়ীদের দেশ হয়ে গিয়েছিল। তামাক চাষের মতো কলকারখানার চাষ হতে শুরু করেছিল। গাছ কাটা হচ্ছিল, মাঠ ভরে ফেলা হচ্ছিল আর নদীগুলো ছোটো হয়ে আসছিল। আকাশে তখন ধোঁয়ার ছড়াছড়ি, আর মানুষ তখন কাশতে কাশতে দিন কাটাতো। তাদের চোখ জ্বরের কারণে লাল হয়ে থাকতো। গ্রাম শহরে পরিণত হলো, আর শহরগুলো আরও বড়ো শহরে পরিণত হতে থাকলো। আর এদিকে মানুষ তখন পৃথিবীতে নয়, বরং পৃথিবীর উপরে বসবাস করতে লাগলো।
কিন্তু দেখার মতো চোখ থাকলে তখনও সবুজ দেখা যেত।
দানব আবার তার বিশাল হাত মেলে ধরায় নানুর বসার রুম কুয়াশায় ছেয়ে গেল। যখন কুয়াশা সরে গেল, তখন কনর এবং দানবটা একটা সবুজ মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে দূরে ইট আর লোহার নানান স্থাপনা দেখা যাচ্ছে।
‘আমি তাহলে ঘুমাচ্ছি।’ কনর বললো।
‘চুপ।’ দানবটা বললো, ‘এই যে সে আসছে।’ কনর দেখতে পেল একটা তেতো মুখের ভারী কালো জামা পরা একটা লোক ভ্রু কুঁচকে পাহাড় থেকে নেমে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
এই সবুজের মাঝে একটা লোক থাকতো। তার নাম জানা জরুরি নয়, কারণ সে নামে তাকে কখনও কেউ ডাকেনি। গ্রামবাসীরা তাকে এপথকেরি নামে ডাকত ।
‘কী নামে?’ কনর জিজ্ঞেস করলো।
‘এপথকেরি নামে।’ উত্তর দিলো দানবটা।
‘কী?’
এপথকেরি মানে হচ্ছে গিয়ে একজন রসায়নবিদ। আদিম যুগে এটাই ডাকা হতো তাদের।
‘ওহ্, তো এভাবে বললেই তো হয়।’ কনর বললো।
নামের সার্থকতা ছিল কারণ এপথকেরিরা ঔষধ বানানোর জন্য পুরোনো পদ্ধতি অবলম্বন করতো। গাছের ছালবাকল আর বেরির রস দিয়ে নানান ওষুধ বানাতো।
‘বাবার নতুন বউ এটাই করে।’ লোকটাকে একটা গাছের মূল কর্তনরত অবস্থায় দেখতে দেখতে কনর বললো, ‘তার ক্রিস্টালের দোকান আছে।’
দানবটা ভ্রু কুঁচকালো, ‘দুটো এক জিনিস নয়।’
এপথকেরি মাঝেমধ্যেই ঔষধি গাছ সংগ্রহ করর জন্য বনের মধ্যে যেত। কিন্তু কিছু সময় পরেই বনগুলো ছোটো হতে শুরু করে। কলকারখানাগুলোও বৃদ্ধি পেতে লাগলো। এপথকেরি তাই দরকারি জিনিসপত্র ঠিকমতো খুঁজে পেত না, ফলে তার চিকিৎসাপদ্ধতির অবনতি হতে থাকলো। এমন একটা সময়ে এলো যখন সামান্য বেলা রোজা খুঁজে পাবার জন্য তার সারা দিন চলে যেত।
পৃথিবী বদলে যাচ্ছিল, আর এপথকেরি আরও তেতিয়ে উঠছিল। অথবা এমনও হতে পারে যে সে সব সময়ই একজন তেতো লোক ছিল। লোকটা ছিল খুবই লোভী, মাঝেমধ্যে সে রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করতো। যাই হোক, গ্রামবাসীরা তাকে পছন্দ করতো না দেখে সে খুব অবাক হতো। হয়তো ভাবছো–সে তাদেরকে চিকিৎসা প্রদান করছে, তার বিনিময়ে এতটুকু সম্মান তার প্রাপ্য। তার ব্যবহারের কারণেও রোগীরা তাকে পছন্দ করতো না এবং এমন একটা সময় এলো যখন রোগীরা চিকিৎসার জন্য আধুনিক পদ্ধতি এবং আধুনিক চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে শুরু করলো। ফলস্বরূপ এপথকেরি আরও বেশি তেতিয়ে উঠলো।
তাদেরকে চারপাশ থেকে আবারও কুয়াশা ঘিরে ধরলো। এখন তারা একটা ছোটো পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে বিশাল এক ইয়ো গাছের নিচে একটা লোক বসে আছে।
এপথকেরির গ্রামে আরও একটা লোক থাকতো
‘এটা তো আমার বাসার পেছনের পাহাড়।’ দানবের কথার মাঝেই কনর বললো চারপাশে তাকিয়ে দেখলো কোনো রেললাইন নেই এখনও, কোনো বাসা নেই, কেবল কিছু ফুটপাত আর নদী।
‘এই লোকটার দুটো মেয়ে ছিল।’ দানবটা বলে যেতে লাগলো, ‘মেয়ে দুটোই ছিল তার জীবনের আলো।’ দুটো মেয়ে দৌড়ে লোকটার কাছে চলে এলো, তারা হাসছিল আর খেলছিল। ইয়ো গাছের আশেপাশে তারা লুকোচুরি খেলছিল।
‘এটা তো তুমি।’ কনর গাছের দিকে আঙুল তুলে বললো।
হ্যাঁ, লোকটার বাসার উঠানে বিশাল একটা ইয়ো গাছ ছিল।
‘আর খুবই সুন্দর একটা গাছ ছিল সেটা।’ দানব বললো।
‘নিজের ঢোল নিজেই পেটাচ্ছ।’ কনর বললো।
যাই হোক, এপথকেরি গাছটা চাচ্ছিল।
‘কেন?’
দানবটা অবাক হয়ে তাকালো, ‘ইয়ো খুব ভালো একটা ঔষধি গাছ, এরা হাজার হাজার বছর বাঁচে। এদের বেরি, ছাল-বাকল, পাতা সবকিছুই ঔষধের কাজ করে থাকে । প্রায় সব রকম রোগের চিকিৎসা করা যায় এই গাছ দিয়ে। একজন সঠিক এপথকেরি জানে তা কীভাবে করতে হয়।’
‘বানিয়ে বলছো না তো?’
দানবের চেহারায় অন্ধকার নেমে এলো, ‘তুমি আমাকে সন্দেহ করার সাহস দেখাচ্ছ, মুর্খ ছেলে?’
‘না।’ কনর দানবের রাগ দেখে পিছিয়ে গেল, ‘আমি এমন কিছু কখনো শুনিনি তো, তাই বললাম।’
এসব করার জন্য এপথকেরিকে গাছটা কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু সেই লোকটা অনুমতি দিচ্ছিল না। চার্চ হবার অনেক আগে থেকেই গাছটা এখানে আছে। পাশের কবরস্থানটা এখন লোকজন ব্যবহার করা শুরু করেছে, আর নতুন চার্চ ভবনও বানানো হচ্ছে। ইয়ো গাছটা সেগুলোকে বৃষ্টি আর কঠিন আবহাওয়া থেকে বাঁচাবে এবং ওই লোকটা-এপথকেরি যতই বলুক না কেন–গাছ কাটার অনুমতি সে দিতে নারাজ। সে তাকে গাছের আশপাশেও আসতে দিত না।
লোকটা দয়ালু ছিল, সে গ্রামবাসীদের ভালো চাইতো, চাইতো যেন তারা কুসংস্কার আর যাদুবিদ্যার কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। সে এপথকেরির পুরোনো পদ্ধতিগুলোর বিরোধিতা করতে লাগলো। তাছাড়া এপথকেরির লোভ আর খারাপ ব্যবহারের কথা ছড়িয়ে পড়ার কারণে এপথকেরির ব্যাবসায় আরও ভাটা পড়তে শুরু হয়।
কিন্তু একদিন এই লোকের মেয়েগুলো অসুস্থ হয়ে পড়লো। পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়া এক রোগের কারণে প্রথমে তার এক মেয়ে এবং পরে অন্য মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
আকাশ কালো হয়ে এলো এবং কনর সেই লোকের মেয়েদের কাশির শব্দ শুনতে পেল, তার সাথে লোকটার স্ত্রীর জোরে জোরে কান্নার এবং প্রার্থনার শব্দও শুনতে পাওয়া গেল।
লোকটা কোনোভাবেই মেয়েগুলোকে সাহায্য করতে পারছিল না। কোনো প্রার্থনা কাজে আসছিল না, কোনো আধুনিক চিকিৎসা কাজে আসছিল না, এমনকি লুকিয়ে লুকিয়ে ওষধি গাছ থেকে সংগ্রহ করা ঔষধও কাজে আসছিল না। আস্তে আস্তে মেয়েগুলো মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে আর কোনো উপায় না পেয়ে লোকটা নিজের আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিয়ে এপথকেরির দ্বারস্থ হলো এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলো।
‘আপনি কি আমার মেয়েদেরকে সাহায্য করবেন না?’ লোকটা হাঁটু মুড়ে এপথকেরির দরজার সামনে বসে বললো, ‘আমার জন্য যদি নাও হয়, তবে আমার নিষ্পাপ মেয়েগুলোর কথা ভাবুন।’
‘কেন ভাববো?’ এপথকেরি বললো, ‘তোমার বিরোধিতার কারণে আমার ব্যাবসা নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি আমাকে ও গাছটা দাওনি, যেটা আমার চিকিৎসার খুব মূল্যবান বস্তু ছিল। তুমি গ্রামবাসীদেরকে আমার নামে আজেবাজে কথা বলেছো।
‘আপনি ওই গাছটা নিয়ে যান।’ লোকটা বললো, ‘আমি আপনার সম্মান ফিরিয়ে আনবো, গ্রামবাসীকে বোঝাবো। আপনি যা চান তাই করবো, কিন্তু আমার মেয়েদেরকে সারিয়ে তুলুন।’
এপথকেরি অবাক হলো, ‘তুমি তোমার বিশ্বাসকেও বিসর্জন দিয়ে দেবে? ‘যদি তাতে আমার মেয়েরা সেরে ওঠে, আমি যে-কোনো কিছু করতে রাজি।’
‘তাহলে’ এপথকেরি বললো, ‘আমি তোমাকে সাহায্য করার মতো কিছুই করতে পারবো না।’
‘কী?’ কনর বললো।
সেই রাতে ওই লোকের মেয়ে দুটো মারা যায়
‘কী?’ আবারও বললো কনর।
এবং সেই রাতে আমি আবার জীবন্ত হয়ে উঠি।
‘বেশ!’ কনর চিৎকার করে উঠলো, ‘এখন ওই হাঁদারামটা তার যোগ্য শাস্তি
পাবে।’
‘আমিও তেমনটাই ভেবেছিলাম।’ দানব বললো।
মাঝরাতের কিছুক্ষণ পরেই আমি সেই লোকটার বাড়িঘর ভেঙে চুরমার করে দিই।
দ্বিতীয় গল্পের বাকি অংশ
‘লোকটার?’ কনর একেবারে অবাক হয়ে গেছে।
‘হ্যাঁ।’ দানবটা বললো, ‘আমি তার ঘরের চাল ছুঁড়ে ফেলে দিই এবং বাসার প্রতিটা দেয়াল নিজহাতে গুঁড়িয়ে দিই।’
লোকটার বাসা এখনও তাদের সামনে, আর কনর দেখতে পেল জীবন্ত ইয়ো গাছ দানবটা হিংস্রভাবে লোকটার বাসায় আঘাত করছে। প্রথম আঘাতে চাল আর সামনের দরজা উড়ে গেল, আর লোকটা ও তার স্ত্রী ভয় পেয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো। দানবটা ঘরের চালা যখন ছুঁড়ে মারলো, তখন ওরা দৌড়ে পালাচ্ছে। অল্পের জন্যে দুজন রেহাই পেলো।
‘তুমি কী করছো?’ কনর বললো, ‘ওই এপথ–না কী যেন নাম, ওই তো আসল খারাপ লোক।’
‘তাই নাকি!’ দানবটা তার পেছন থেকে বললো।
দানবের হাতে লোকটির বাসার সামনের দেয়াল গুঁড়িয়ে পড়লো।
‘অবশ্যই!’ কনর চিৎকার করে বললো, ‘সে ওই লোকের মেয়েগুলোকে সাহায্য করতে মানা করে দিয়েছিল! আর ওরা এজন্যে মারা যায়!’
‘লোকটা এপথকেরির চিকিৎসায় বিশ্বাস করতে অস্বীকার জানিয়েছিল।’ দানবটা বললো, ‘সুসময়ে লোকটা এপথকেরিকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছিল, কিন্তু যখন দুঃসময় এলো তখন সে তার মেয়েদেরকে বাঁচানোর জন্য নিজের সকল বিশ্বাসকে বিসর্জন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল।’
‘তো?’ কনর বললো, ‘সেটা যে-কেউ করবে! সবাই করবে! তুমি কী চাচ্ছিলে, সে কী করুক?’
‘আমি চাচ্ছিলাম এপথকেরি যখন প্রথম ইয়ো গাছটা চেয়েছিল, তখনই লোকটা তাকে সেটা দিয়ে দিত।’
এটা শুনে কনর থেমে গেল। লোকটার বাসার দেয়াল ধ্বসে পড়ার আরও শব্দ আসছিল, ‘তুমি নিজেকে মেরে ফেলতে চাচ্ছিলে?’
‘আমি কেবল একটা গাছ নই।’ দানবটা বললো, ‘কিন্তু হ্যাঁ, আমি চাইছিলাম ইয়ো গাছটা কাটা পড়ুক, তাতে করে সেই লোকের মেয়েগুলোকে বাঁচানো যেত এবং একইসাথে আরও অনেককে বাঁচানো যেত।’
‘কিন্তু তাতে করে গাছটা মারা যেত, আর সে ধনী হয়ে যেত।’ কনর চিৎকার করলো, ‘সে একটা খারাপ লোক।’
‘সে লোভী ও ইতর ছিল, কিন্তু তাও সে একজন চিকিৎসক। আর ওই লোকটা, সে কী ছিল? সে তো কিছুই ছিল না। বিশ্বাস চিকিৎসার একটি অংশ। ঔষধে বিশ্বাস রাখলে তা কাজে দেয়। কিন্তু সে এমন একটা মানুষ যার বিশ্বাস আছে, কিন্তু দুঃসময়ে সে নিজের বিশ্বাসকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকে। তার বিশ্বাস কেবল স্বার্থপরতার, আতঙ্ক থেকে বাঁচার। এই কারণেই তার মেয়েরা মারা পড়েছিল।’
কনর আরও রেগে উঠলো, ‘তুমি বলেছিলে এটা কোনো ধোঁকাবাজির গল্প নয়।’
‘আমি বলেছিলাম এই গল্পে একটা লোক তার স্বার্থপরতার জন্য শাস্তি পাবে, এবং সেটাই হয়েছে।
কনর দ্বিতীয় দানবটাকে লোকটার ঘর ভাঙতে দেখছে, বিশাল এক দানব তার পা দিয়ে সিঁড়িগুলোকে ভেঙে ফেলছে। তার বিশাল একটা বাহু শোবার ঘর টুকরো টুকরো করে ফেলছে।
‘বলো তো, কনর ও’ম্যালী’ দানবটা পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি
আমার সাথে যোগ দেবে?’
‘যোগ দেবো?’ কনর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
‘এটা খুবই সন্তোষজনক, এটুকু বলতে পারি তোমাকে।’
দানবটা এগিয়ে গিয়ে দৃশ্যের দানবের সাথে যোগ দিলো, বিশাল পা দিয়ে নানুর সোফার ওপর সজোরে লাথি মেরে ভেঙে ফেললো, এরপর কনরের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করলো।
‘এরপর আমি কী ধ্বংস করবো?’ দানবটা দ্বিতীয় দানবের সাথে যুক্ত হয়ে গেল, একত্রে যুক্ত হয়ে তারা আরও বিশাল একটা দানবে পরিণত হলো।
‘আমি তোমার আদেশের অপেক্ষা করছি।’ সেটা বললো।
কনর বুঝতে পারলো তার শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুতগামী হয়ে উঠছে। তার বুক ধকধক করছে। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো এবং এরপর সে বললো, ‘ফায়ারপ্লেসটা গুঁড়িয়ে দাও।’
দানবের ঘুসিটা তৎক্ষণাৎ ফায়ারপ্লেসের ওপর গিয়ে পড়লো, আর সাথে সাথেই চিমনি থেকে ইট ভেঙে সশব্দে নিচে পড়ে গেল।
শ্বাস-প্রশ্বাস আরও দ্রুতগামী হচ্ছে কনরের, যেন এই ধ্বংসটা সে নিজে করছে।
‘বিছানাগুলো ছুঁড়ে ফেলে দাও।’ সে বললো।
দানব বিছানাগুলো তুলে ছুঁড়ে ফেললো।
‘ফার্নিচারগুলো ভেঙে ফেল!’ কনর এখন রীতিমতো চিৎকার করছে, ‘সবকিছু ভেঙে ফেলো!’
দানবটা পুরো বাড়ির সবগুলো ফার্নিচার তছনছ করে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলে দিলো । ‘পুরো বাসাটাই ভেঙে ফেল!’ গর্জে উঠেছে কনর, আর তার সাথে সাথে দানবটাও গর্জন করে উঠলো। দেয়াল ঘুসি মেরে ভেঙে ফেললো, জানালাগুলো তছনছ করে দিলো।
কনর এত জোরে গর্জে উঠছে যেন সে ঠিকঠাকভাবে চিন্তা করতে পারছে না, ধ্বংসের মাঝে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে, চারপাশে কেবল ধ্বংস ধ্বংস আর ধ্বংস।
দানবটা ঠিকই বলেছিল, তার মন সন্তুষ্ট হচ্ছে।
ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কনর চিৎকার করলো। যখন সে থামলো তখন দেখতে পেল, দানবটা এই ধ্বংসস্তূপের বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। কনর হাঁপাতে হাঁপাতে হেলান দিয়ে কোনোমতে দাঁড়ালো।
‘এভাবেই’ দানবটা বললো, ‘ধ্বংস করতে হয়।’
এবং হুট করেই, যেন তারা কনরের নানুর বসার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। কনর দেখতে পেল সে এই ঘরটার প্রতিটা অংশ ধ্বংস করে ফেলেছে।
ধ্বংস
সোফাটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।
প্রতিটা কাঠের পা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে, কাঠের মেঝেতে অসংখ্য দাগ। ভাঙা ঘড়ি আর তার সাথে দেয়ালের ভাঙা অংশ পড়ে আছে। ল্যাম্প আর ছোটো টেবিলটা ও সোফার মতো টুকরো টুকরো হয়ে আছে। বইয়ের তাক ভেঙে জানালার ওপাশে পড়ে আছে, প্রতিটা বই ছেঁড়া। এসবকিছুর মাঝে কেবল ডিসপ্লে ক্যাবিনেটটা বেঁচে গেছে।
কনর অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। সে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেখানে রক্ত আর আঁচড়ের দাগ, নখগুলো ভেঙে গেছে।
‘হায় ঈশ্বর!’ সে ফিসফিস করে বললো।
সে ঘুরে দানবটার দিকে তাকাতে গিয়ে দেখলো সেটা আর নেই।
‘তুমি কী করেছো!’ নিস্তব্ধতার মাঝে সে চিৎকার করে উঠলো। এই ধ্বংসের মধ্য থেকে সরে দাঁড়ানোর শক্তিও পাচ্ছে না।
সে এসব নিজে করতে পারে না। অবশ্যই না ।
‘হায় ঈশ্বর, হায় ঈশ্বর!’ সে আবারও বললো।
‘ধ্বংস সন্তুষ্টি এনে দেয়।’ শুনতে পেল কনর। কেবল শান্ত বাতাসের মাঝে কণ্ঠটা মিলিয়ে গেল যেন।
তার পালিয়ে যাওয়ার জায়গা নেই। পালিয়ে যাওয়ার সময় নেই
তার নিজের বাবাও এখন এসব দেখলে তাকে নিজের সাথে নিতে চাইবে না। যে বাসায় একটা বাচ্চা আছে, সেই বাসায় এমন একটা ছেলেকে কেউই নিয়ে যেতে চাইবে না–
‘হায় ঈশ্বর!’ বুকের ধুকপুকানি এতই বেড়ে গেছে যেন তার হৃদপিণ্ড বেরিয়ে চলে আসবে।
সামনের দরজা খুলে নানু ঘরে এলো।
ব্যাগ থেকে চাবি বের করতে করতে আশপাশে তাকিয়ে সবকিছু বুঝতে তার কিছু সময় লেগে গেল। কনর তার চেহারায় ক্লান্ত ভাব দেখলো। অন্যরকম কিছু নেই সেই চেহারায়, কেবল অন্যান্য দিনের মতোই একটা ক্লান্তিভাব।
‘এসব কী–’ বাক্যটা শেষ করতে পারলো না সে।
নানু থমকে দাঁড়িয়েছে। কেবল তার চোখ দুটো ঘরের এই ধ্বংসস্তূপের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন তারা বিশ্বাস করতে পারছে না এখানে কী ঘটে গেছে। কনর নানুর শ্বাস-প্রশ্বাসও শুনতে পেল না।
নানু হাঁ করে তার দিকে তাকালো। রক্তমাখা হাতে সে দাঁড়িয়ে আছে।
এবং এরপরই নানু গুঙিয়ে উঠলো।
শব্দটা যেন খুবই পীড়াদায়ক। কনরের মনে হলো হাত দিয়ে দু-কান চেপে ধরে।
নানু আবার শব্দটা করলো, এবং আবারও এবং আবারও, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা বিভীষিকার শব্দ হয়ে উঠলো। সে হাত দিয়ে মুখ চেপে কেঁদে উঠলো। শব্দগুলো থামানোর চেষ্টা করতে থাকলো, কিন্তু পারলো না।
‘নানু?’ কনর নিজেই আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠলো।
এরপর নানু চিৎকার করে উঠলো।
চিৎকার করে কেঁদে উঠলো সে। এত জোরে চিৎকার করলো যে এবার কনর সত্যিই তার কান দু-হাতে চেপে ধরলো। নানু তার দিকে তাকাচ্ছে না। কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। শুধু চিৎকার করে কাঁদছে।
এরপর সে ঘরে ঢুকে ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে এগিয়ে এলো। কনর দুই হাত দিয়ে যেন নিজেকে বাঁচাতে চাইলো।
কিন্তু নানু তাকে মারতে আসছে না।
সে দ্রুত কনরের পাশ কাটিয়ে ডিসপ্লে ক্যাবিনেটের সামনে চলে গেল। তার চোখে অশ্রু, আর সে চিৎকার করে কাঁদছে এখনও। ক্যাবিনেট থেকে জিনিসগুলো বের করলো।
তারপর সেগুলো মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো।
নানু একবারও কনরের দিকে তাকালো না। শেষবারের মতো একটা চিৎকার দিয়ে উপরে চলে গিয়ে তার শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো কনর, সে বুঝতে পারছে না তার এখন কী করা উচিত।
যেন অনন্তকাল পর সে সেখান থেকে নড়ে রান্নাঘর থেকে কিছু প্লাস্টিকের ব্যাগ এনে ঘরের জিনিসগুলো সেটাতে ভরে ফেলতে লাগলো। সব পরিষ্কার করতে প্রায় পুরো রাত লেগে গেল। ভোর হয়ে যাচ্ছে, সে আর পেরে উঠছে না।
ময়লা আর শুকিয়ে যাওয়া রক্তগুলো না ধুয়েই কনর সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগলো। যাওয়ার সময় নানুর ঘরের দিকে তাকালো, সেখানে এখনও বাতি জ্বলছে।
নানুর কান্না শোনা যাচ্ছে।
অদৃশ্য
কনর স্কুলমাঠে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
কিছুক্ষণ আগে সে লিলিকে দেখেছে। যে-সব মেয়েকে লিলি এমনিতে পছন্দ করে না, তাদের সাথেই দেখেছে। ও তাদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিল। কনর তার চোখে পড়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু লিলি তার দিকে তাকায়নি। যেন সে কনর কে দেখতে চাচ্ছে না।
এসব কারণে কনর একা একা দাঁড়িয়ে আছে। অন্য ছেলেমেয়েরা হাসাহাসি করছে। নিজেরা খেলাধুলা করছে, আর নিজেদের ফোন দেখছে। যেন এ জগতে যাই হোক না কেন, তা থেকে তারা মুক্ত।
এমন সময় কনর হ্যারি আর তার চ্যালাপ্যালাকে দেখতে পেল। তারা কনরের দিকেই আসছে। হ্যারির চোখে একটা উৎসুক দৃষ্টি
এই তো তারা আসছে।
কনর যেন স্বস্তি পেল।
-০-
এই সকালে সে দুঃস্বপ্নটা দেখার জন্যই ঘুমিয়ে ছিল। সেই দুঃস্বপ্নটা, সেই আতঙ্ক আর পড়ে যাওয়া, যার শেষে ভয়ানক এক সমাপ্তি। সে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিল।
সাহস জুগিয়ে নিচে গিয়ে দেখলো তার বাবা নানুর রান্নাঘরে সকালের নাস্তা বানাচ্ছে। নানুকে কোথাও দেখা গেল না।
‘ডিম ভাজি খাবে?’ বাবা জিজ্ঞেস করলো।
কনর মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললো, যদিও তার মোটেও ক্ষুধা নেই। বাবা তাকে ভাজা ডিম আর মাখন দিয়ে টোস্ট বানিয়ে দিলো। এরপর তারা একসাথে সকালের নাস্তা করলো। ওদের মাঝে এমন নীরবতা নেমে এলো যে কনরের দমবন্ধ হয়ে আসতে
লাগলো।
‘ভালোই ধ্বংসযজ্ঞ করেছো তুমি। তোমার নানু আমাকে সকালে ফোন করেছে, অনেক সকালে।’ বাবা বললো।
কনর চুপচাপ তার ডিমটা খেয়ে নিলো।
‘তোমার মায়ের অবস্থার কিছুটা বদল হয়েছে, কনর। তোমার নানু হসপিটালের ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেছে। আমি তোমাকে স্কুলে দিয়ে আসবো এখন।’
‘স্কুল?’ কনর জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি মায়ের কাছে যাবো!’
‘কিন্তু’ বাবা মাথা নাড়লো, ‘সেখানে এখন কোনো বাচ্চার যাওয়া উচিত নয়, আমি তোমাকে স্কুলে দিয়ে এখন হাসপাতালে যাবো আর স্কুল শেষ হলেই তোমাকে নিতে আসবো। এরপর তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো। দরকার পড়লে আগেই চলে আসবো।’
কনর তার কাটা চামচ আর ছুরিটা নামিয়ে রাখলো, খেতে ইচ্ছে করছে না আর। হয়তো আর কখনও ইচ্ছে করবে না।
‘এই’ বাবা বললো, ‘মনে আছে, আমি তোমাকে বলেছিলাম তোমাকে সাহসী হতে হবে? তোমাকে সেটা এখনই করতে হবে।’ বাবা বসার ঘরের দিকে তাকালো, ‘আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, তোমার নানুরও হচ্ছে।’
‘আমি এসব করতে চাইনি, আসলে কী হয়েছে তা নিজেই বুঝতে পারছি না।’
‘ঠিক আছে।’ তার বাবা বললো ।
‘ঠিক আছে?’ কনর ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
‘এসবের ব্যাপারে ভেবো না, এর চেয়েও খারাপ কিছু হয়।’
‘মানে কী?’
‘এর মানে, আমরা এ সবকিছু ভুলে যাবো। যেন এসব কখনও হয়নি, যেমনভাবে অন্য সবকিছু উপেক্ষা করে যাচ্ছি।’
‘অন্য সবকিছু বলতে মাকে বোঝাচ্ছো?’
‘তোমার নাস্তা শেষ করো।’
‘তুমি আমাকে শাস্তি দেবে না?’
‘তাতে লাভ কী, কনর?’ বাবা মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘তাতে কীই-বা লাভ হবে?’
-০-
কনর তার ক্লাসে কিছুই শুনছে না, অথচ শিক্ষকেরা তাকে এসবের বিপরীতে কিছুই বলছে না।
ম্যাডাম তো তাকে জীবনগাথা হোমওয়ার্কের কথা আর জিজ্ঞেস করেনি। একটা বাক্যও লেখেনি কনর। তাও সে কিছু বলেনি।
যদিও তাতে কিছু আসে যায় না।
তার বন্ধুরা তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে, যেন তার শরীরে দুর্গন্ধ। সকাল থেকে এ পর্যন্ত কারো সাথে সে কথাও বলেনি। তার মানে, সকালে বাবা তাকে নামিয়ে দেওয়ার পর থেকে এখনও সে কারো সাথে কথা বলেনি।
এমন কিছু কীভাবে হতে পারে?
কিন্তু অবশেষে, হ্যারি, সালি আর অ্যান্টন তার দিকে এগিয়ে আসছে। এটাই তার কাছে স্বাভাবিক।
‘ও’ম্যালি!’ হ্যারি বললো। তার পেছন পেছন সালি ও অ্যান্টন হাসছে।
কনর দেয়াল থেকে উঠে দাঁড়ালো। নিজেকে একটা ঘুসির জন্য প্রস্তুত করলো।
কিন্তু সেটা এলো না।
হ্যারি দাঁড়িয়ে আছে। অ্যান্টন আর সালিও দাঁড়িয়ে আছে। তাদের হাসি আস্তে আস্তে থেমে যাচ্ছে।
‘কীসের অপেক্ষা করছো?’ জিজ্ঞেস করলো কনর।
‘হ্যাঁ’ সালি হ্যারিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কীসের অপেক্ষা করছো?’
‘মারো ওকে।’ অ্যান্টন বললো।
হ্যারি নড়লো না। কেবল কনরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। কনরও তাকিয়ে আছে। যেন এই জগতে এখন তারা ছাড়া আর কেউ নেই। কনরের হাত-পা ঘেমে যাছে।
‘করে ফেল।’ কনর জোরে বললো।
‘কী করবো, ও’ম্যালি?’ হ্যারি শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী করতে বলছো আমাকে?’
‘ওকে পিটুনি দিতে বলছে।’ সালি বললো।
‘ঘুসি মেরে নাক ফাটিয়ে দিতে বলছে।’ অ্যান্টন বললো।
‘তাই না-কি? তুমি কি তাই চাও ও’ম্যালি?’
কনর কিছু বললো না। কেবল হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে রইলো।
অপেক্ষা করছে।
এরপরই বেল বেজে গেল, আর মিস ওয়ান আরেকজন শিক্ষকের সাথে কথা বলতে বলতে মাঠে চলে এলো, আড়চোখে তাকালো হ্যারি আর কনরের দিকে।
‘হয়তো কখনোই জানা যাবে না’ হ্যারি বললো, ‘ও’ম্যালি আসলে কী চায়।’ অ্যান্টন আর সালি হেসে উঠলো, যদিও তারা কিছুই বোঝেনি।। কনরকে একা রেখে ওরা তিনজন ভেতরে চলে গেল।
যেন সে পুরো জগতের কাছে অদৃশ্য।
ইয়ো গাছ
‘হ্যালো সোনামণি।’ কনরকে দরজা দিয়ে আসতে দেখে মা বিছানায় উঠে বসলো ।
কনর বুঝতে পারলো উঠে বসতে মায়ের খুব কষ্ট হচ্ছে।
‘আমি বাইরে আছি।’ বলে নানু তার দিকে না তাকিয়েই বাইরে চলে গেল।
‘আমি দেখি ভেন্ডিং মেশিন থেকে কিছু পাই কি না, স্পোর্ট।’ বাবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে বললো, ‘তুমি কিছু চাও?’
‘আমি চাই তুমি আমাকে স্পোর্ট বলা বন্ধ কর।’ কনর তার মায়ের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বললো। মা হাসতে লাগলো।
‘একটু পরে আসছি,’ বলে বাবা কনরকে ওর মায়ের সাথে একা ছেড়ে চলে গেল। ‘এদিকে এসো।’ মা তার বিছানার পাশে বসতে ইশারা করলো। কনর খুব সাবধানে মায়ের নাক থেকে বের হওয়া দুটো টিউবকে এড়িয়ে সেখানে গিয়ে বসলো।
‘আমার কনর কেমন আছে তাহলে?’ তার মাথায় হাত বুলিয়ে মা জানতে চাইলো। কনর দেখলো তার মায়ের কনুইয়ের দিকের জায়গাটা বেগুনি হয়ে গেছে। ওখানেই দুটো টিউব ঢোকানো হয়েছে। মা অবশ্য হাসছে। ক্লান্ত, কিন্তু হাসছে।
‘আমি জানি আমাকে খুব বাজে দেখাচ্ছে।’
‘না, দেখাচ্ছে না।’ কনর বললো।
মা আবার তার আঙুল দিয়ে কনরের চুলে হাত বুলিয়ে দিলো, ‘এ-রকম দয়ালু মিথ্যাকে মাফ করে দেওয়া যায়।’
‘তুমি ঠিক আছো?’ কনর জিজ্ঞেস করলো, যদিও সে জানে এটা খুব বাজে একটা প্রশ্ন। কিন্তু মা জানে সে কী জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছে।
‘সোনামণি, তারা কিছু নতুন জিনিস চেষ্টা করে দেখেছে, সেগুলো এখনও কাজ করছে না। অতিশীঘ্রই করবেও না হয়তো। এসবের কোনো মানে আছে?’
কনর মাথা নাড়লো।
‘আমারও মনে হয়, নেই।’ কনর দেখলো মা জোর করে হাসার চেষ্টা করছে। বড়ো একটা শ্বাস নিতেই যেন মায়ের বুক কেঁপে উঠলো।
‘আমি যা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে হয়তো এখন দ্রুতই হবে সব।’ মায়ের কণ্ঠটা খুব ভারী, এতটাই ভারী যে কনরের পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। সকালে নাস্তা না খেয়ে এখন মনে হচ্ছে ভালোই করেছে সে।
‘কিন্তু’ মায়ের গলা এখনও ভারী, তারপরও সে হাসছে, ‘তারা আরও একটা জিনিস চেষ্টা করতে পারে, একটা ঔষধ যেটার ফলাফল খুব ভালো হয়।’
‘তারা সেটা আগে চেষ্টা করেনি কেন?’ কনর জিজ্ঞেস করলো।
‘মনে আছে, আমার সব চিকিৎসায় কীভাবে আমার চুল পড়ে যেত, আর খালি বমি হতো?’
‘অবশ্যই।’
‘সে-সবে কাজ না হলে এটা চেষ্টা করা হয়। একটা সম্ভাবনা সব সময়ই থেকে যায়, তবে তারা চাচ্ছে যেন ওটা একদম শেষেই করা হয়।’ মা মেঝের দিকে তাকালো, ‘তারা চাচ্ছিল যেন শেষ চেষ্টাটা এত দ্রুত না করতে হয়।
‘মানে কী? খুব দেরি হয়ে গেছে?’ কনর বুঝে ওঠার আগেই প্রশ্নটা করে ফেলল। ‘না, কনর।’ মা খুব তাড়াতাড়ি উত্তর করলো, ‘এভাবে ভেবো না, খুব দেরি হয়ে যায়নি। কখনোই খুব দেরি হয়ে যায় না।’
‘তুমি নিশ্চিত?
মা আবার হাসলো, ‘আমি তাই বিশ্বাস করি।’ এবার তার কণ্ঠটা একটু দৃঢ়।
কনরের দানবটার কথা মনে হলো, বিশ্বাসেই অসুস্থতা অর্ধেক কেটে যায় ।
তার মনে হলো যেন সে শ্বাস নিতে পারছে না, কিন্তু তবু নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। সেটা বুঝতে পেরে মা তার বাহুতে হাত বুলিয়ে দিলো।
‘আর খুব মজার একটা বিষয় আছে। মনে আছে, আমাদের বাসার পেছনে পাহাড়ে একটা ইয়ো গাছ আছে?’
কনরের চোখ বড়ো হয়ে গেল।
‘বিশ্বাস করবে কি না জানি না, তবে এই ওষুধটা সেই ইয়ো গাছ থেকে বানাবে।
‘ইয়ো গাছ?’
‘হ্যাঁ, আমি প্রথম দিকেই এর ব্যাপারে পড়েছিলাম।’ মা একটু কাশলো, ‘মানে, আমি ভাবিনি কখনো এতদূর আসতে হবে, কিন্তু এখন ভাবতে অবাক লাগছে যে এত দিন আমরা আমাদের বাসা থেকে যেই ইয়ো গাছ দেখতাম সেটাই এখন আমাকে সারিয়ে তুলতে সাহায্য করবে।’
কনরের চিন্তাভাবনা যেন ঝড়ের বেগে দৌড়াতে শুরু করেছে। এত জোরে যে তার মাথা ঘুরে উঠলো।
‘এ জগতের সবুজ জিনিসগুলো খুব দারুণ, তাই না?’ মা বলতে লাগলো, ‘আমরা সেগুলোকে কীভাবে ধ্বংস করে ফেলি! কিন্তু সেই জিনিসগুলোই মাঝে মাঝে আমাদেরকে বাঁচিয়ে তোলে।’
‘এটা তোমাকে বাঁচাবে?’
মা আবার হাসলো, ‘আমার সেটাই বিশ্বাস। ‘
এমন হতে পারে?
কনর হাসপাতালের করিডোর দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল, তার চিন্তাগুলো যেন ঝড়ের বেগে ছুটছে। ইয়ো গাছ দিয়ে বানানো ওষুধ, এমন ওষুধ যেটা রোগ সারিয়ে তুলতে পারে। এমন ওষুধ যেটা বানাতে এপথকেরি সেই লোকটাকে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। যদিও কনর এখনও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছে না যে ওই লোকের বাসাটা কেন ভেঙে ফেলা হয়েছিল।
হয়তো দানবটা এখানে কোনো একটা কারণে এসেছে। হয়তো সে কনরের মাকে বাঁচানোর জন্য জীবন্ত হয়েছে।
আশা করতেও যেন ভয় পেল কনর।
না।
অবশ্যই না। এটা সত্যি হতে পারে না। দানবটা একটা স্বপ্ন, এ সবকিছুই একটা স্বপ্ন।
কিন্তু সেই পাতাগুলো, সেই বেরিগুলো, মেঝেতে ফুলে ওঠা মূলগুলো আর নানুর বসার ঘরের সেই ধ্বংসযজ্ঞ!
হুট করে কনরের খুব হালকা অনুভব হলো, যেন সে হাওয়ায় ভাসতে শুরু করেছে।
এমনটা হতে পারে? এমনটা সত্যিই কি হতে পারে?
করিডোরের শেষ মাথায় শব্দ শোনা গেল। তার বাবা আর নানু ঝগড়া করছে। কী বলছে তা শোনা যাচ্ছে না, তবে নানু বাবার দিকে রেগেমেগে আঙুল তুলে কথা বলছে।
‘তো তুমি আমাকে কী করতে বলো?’ তার বাবা বললো। আশপাশের মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নানুর উত্তর শুনতে পেল না কন। রেগেমেগে নানু করিডোর থেকে তার মায়ের রুমের দিকে চলে গেল, একবারের জন্যও সে কনরের দিকে তাকায়নি।
একটু পরেই বাবা এগিয়ে এলো।
‘কী হয়েছে?’ কনর জিজ্ঞেস করলো।
‘তোমার নানু আমার ওপর রেগে আছে, নতুন কিছু না।’
‘কেন রেগে আছে?’
‘কিছু খারাপ খবর আছে, কনর। আমাকে আজই চলে যেতে হবে।’
‘আজই? কেন?’
‘বাচ্চাটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’
‘ওহ্! কী হয়েছে?’
গুরুতর কিছু না, কিন্তু স্টেফানি পাগলামি করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, আর বলছে যেন আমি এখনি ফেরত যাই।’
‘আর তুমি চলে যাচ্ছো?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি আবার আসবো। পরের রবিবারে, দুই সপ্তাহ লাগবে না, আমাকে তার চেয়ে বেশি বন্ধ দিয়েছে।’
‘দুই সপ্তাহ!’ কনর যেন নিজেকেই বললো, ‘কিন্তু ঠিক আছে। মাকে নতুন ওষুধ দেওয়া হবে যেটা তাকে সুস্থ করে তুলবে, তত দিনে তুমি যদি ফেরত আসো
বাবার চেহারার অভিব্যক্তি দেখে সে কথা বলা থামিয়ে দিলো।
‘চলো, আমরা একটু হেঁটে আসি।’ বাবা বললো ।
হসপিটালের পাশেই একটা পার্ক আছে। কনর আর তার বাবা একটা খালি বেঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হসপিটালের গাউন পরা কিছু রোগীকে হাঁটাহাঁটি করতে দেখলো। এছাড়াও রোগীদের আত্মীয়-স্বজনদেরও হাঁটাহাঁটি করতে দেখা যাচ্ছে। পার্কটাকে এখন হসপিটালের মতোই মনে হচ্ছে।
‘আমরা এখন কথা বলবো, তাই না?’ বসতে বসতে বললো কনর, ‘সবাই যেন আমার সাথে আজকাল কথাই বলতে চায়।’
‘কনর, এই নতুন ওষুধটা–’
‘এটা তাকে সারিয়ে তুলবে।’ জোর দিয়ে বললো কনর।
‘না কনর, হয়তো করবে না।’
‘না, করবে।’
‘এটা শেষ চেষ্টা, বাবা। আমি খুবই দুঃখিত, কিন্তু দ্রুতই সব এগিয়ে যাচ্ছে।’
‘এটা তাকে সুস্থ করে তুলবে, আমি জানি।’
‘কনর, তোমার নানু আরও একটা কারণে আমার ওপর রেগে আছে। তার ধারণা,
আমি বা তোমার মা কেউই তোমাকে আসল কথাটা বলছি না।’
‘নানু এসব ব্যাপারে কতটুকু জানে?’
বাবা তার কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘কনর, তোমার মা–’
‘ঠিক হয়ে যাবে।’ কনর হাতটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো, ‘এই নতুন ওষুধটা গোপনীয়। এর একটা কারণ আছে, আর আমি সেটা জানি।’
‘কীসের কারণ?’
‘তুমি আমেরিকায় তোমার আরেক পরিবারের কাছে ফেরত যাও, আমরা তোমাকে ছাড়াই ঠিক থাকবো। কারণ এটা কাজ করবে।’
‘কনর, না–’
‘হ্যাঁ, এটা করবে।’ বলে কনর হাঁটতে শুরু করলো।
‘বাবা, সব গল্পের সব সময় সুখের সমাপ্তি হয় না। ‘
এটা শুনে সে থেমে গেল। আসলেই? এই একটা জিনিসই দানবটা তাকে শিখিয়েছে। গল্প বুনো জিনিস, কখন কোথায় চলে যায় সেটা আগে থেকে ঠাহর করা যায় না।
‘তোমার ওপর দিয়ে অনেককিছু যাচ্ছে, আমি জানি। এসব অন্যায়, খুব কষ্টকর। এমনটা হওয়া উচিত ছিল না।’
কোনো উত্তর দিলো না কনর।
‘আমি এক সপ্তাহের মধ্যে চলে আসবো, সেটা মনে রেখো। ঠিক আছে?’ কনর উপরে সূর্যের দিকে তাকালো, অক্টোবরের হিসেবে উষ্ণ একটা দিন। ‘কত দিন থাকবে?’ সে জিজ্ঞেস করলো।
‘যত দিন থাকা যায়।‘
‘আর এরপর আবার চলে যাবে।’
‘যেতেই হবে, আমার–‘
‘আরও একটা পরিবার আছে।’ কনর বাক্যটা শেষ করলো।
বাবা তার হাত ধরার চেষ্টা করলো, কিন্তু তার আগেই কনর হাসপাতালের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে।
এটা করবে, এটা কাজ করবে, এই কারণেই দানবটা জীবন্ত হয়েছে। দানবটা যদি
সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে এটাই আসল কারণ।
কনর হাসপাতালের ঘড়ির দিকে তাকালো।
বারোটা সাত বাজতে আরও আট ঘণ্ট বাকি।
কোনো গল্প নেই
‘তুমি তাকে সারিয়ে তুলতে পারবে?’ কনর জিজ্ঞেস করলো।
‘ইয়ো একটা ঔষধি গাছ।’ দানবটা বললো, ‘আমি এই রূপেই চলাফেরা করতে পছন্দ করি।’
কনর ভ্রু কুঁচকালো, ‘এটা কোনো উত্তর না।‘
দানবের মুখে শয়তানি হাসি ।
মা ডিনার না করে ঘুমিয়ে পড়ার পর নানু তাকে নিজের বাসায় নিয়ে এসেছে। বসার ঘরের ধ্বংসযজ্ঞ করার পর থেকে এখন পর্যন্ত নানু তার সাথে কথা বলেনি। একেবারেই না।
‘আমি ফেরত যাচ্ছি।’ কনর গাড়ি থেকে বের হতেই নানু বললো, ‘কিছু খেয়ে নিয়ো, এতটুকু নিশ্চয় নিজে নিজে করতে পারবে।’
‘বাবা কি এতক্ষণে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে?’ কনর জিজ্ঞেস করলো।
নানু কোনো উত্তর দেয়নি। সে চলে যেতেই কনর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। ভেতরে আসার পর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত সে কোনো ফোন করেনি। কনর ভেবেছে নিজেই ফোন করবে, কিন্তু নানুর রিংটোনে মায়ের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ইতোমধ্যেই একবার বকা খেতে হয়েছে।
এসবে কিছু আসে যায় না। আসলে এতে ভালোই হয়েছে। অন্তত ঘুমাতে যাওয়ার অভিনয় করতে হচ্ছে না। এখন বসে বসেই বারোটা সাত বাজার অপেক্ষা করতে পারে সে। এরপর সে ঘর থেকে বের হয়ে বললো, ‘কোথায় তুমি?’
দানবটা উত্তর দিলো, ‘আমি এখানে।’ এ কথা বলেই সহজ ভঙ্গিতে নানুর অফিসের মধ্যে ঢুকে পড়লো ।
‘তুমি তাকে সারিয়ে তুলতে পারবে?’ কনর আবার জিজ্ঞেস করলো। দানবটা নিচে কনরের দিকে তাকালো, ‘সেটা আমার হাতে নয়।’
‘কেন নয়? তুমি বাসাবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দাও, আর ডাইনিদের উদ্ধার করো। তুমি বলেছিলে যদি মানুষ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে, তবে তোমার ছালবাকল পাতা সবকিছুই রোগ সারানোর ক্ষমতা রাখে। ‘
‘তোমার মা যদি সুস্থ হতে পারে, তবে ইয়ো গাছ সেটা করবে।’
‘এর মানে কি ‘হ্যাঁ’ বলছো?’
দানবটা এমন কিছু করলো যেটা সে আগে কখনও করেনি।
সে বসে পড়লো।
দানবের শরীরের ভরে নানুর পুরো অফিসটা দুলে উঠলো। কাঠের মেঝে মচমচ করে উঠলো। খানিক ভয় পেয়ে গেল কনর। এটা যদি এখন অফিস ধ্বংস করে ফেলে, তাহলে না জানি নানু তাকে কী করবে। হয়তো জেলে পাঠিয়ে দেবে, অথবা বোর্ডিং স্কুলে।
‘তুমি এখনও জানো না যে তুমি আমাকে কেন ডেকেছো, তাই না?’ দানবটা জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি এখনও জানো না আমি কেন জীবন্ত হয়েছি। এসব আমি হরহামেশাই করে থাকি না, কনর ও’ম্যালি।’
‘আমি তোমাকে ডাকি নি।’ কনর বললো, ‘যদি না এটা স্বপ্ন হয়ে থাকে। আর যদি ডেকেও থাকি, সেটা আমার মায়ের জন্য।’
‘তাই না-কি?’
‘তা না হলে আর কী?’ কনর আরেকটু উঁচু গলায় বলে উঠলো, ‘অবশ্যই কোন ফালতু গল্প শোনার জন্য ডাকিনি।’
‘তোমার নানুর বসার ঘরের কথা কী ভুলে গেছ?’
ঠোঁটের কোণে একটা হাসি চলে এলো কনরের!
‘তেমনটাই ভেবেছিলাম।’ দানব বললো।
‘আমি সিরিয়াস।’
‘আমিও, কিন্তু আমরা এখনও তৃতীয় গল্পের জন্য প্রস্তুত নই। খুব শীঘ্রই হয়ে যাবো। এরপর তুমি আমাকে তোমার গল্প বলবে, কনর ও’ম্যালি। তুমি আমাকে সত্যিটা বলবে।’ দানবটা এগিয়ে এলো, ‘আর তুমি জানো আমি কোন সত্যির কথা বলছি।’
তাদেরকে চারপাশ থেকে কুয়াশা ঘিরে ধরলো, নানুর বাগান হারিয়ে গেল। পৃথিবীটা যেন ধূসর আর একাকিত্বে ছেয়ে গেল। কনর জানে সে এখন কোথায়, আর পৃথিবীটা কীসে পরিণত হয়েছে।
সে তার দুঃস্বপ্নের মাঝে আছে।
-০-
সেটা এমনই ছিল, যেন জগৎ গুলিয়ে যাচ্ছে আর কনর কারো হাত ধরে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু তবু যেন হাত ছুটে যাচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে সে
‘না!’ কনর চিৎকার করে উঠলো, ‘না এটা না!’
কুয়াশা সরে যেতেই নানুর বাগান আবার দেখা গেল, দানবটা এখনও অফিসে বসে আছে।
‘এটা কোনো সত্যি না।’ কনর কাটা কাটা গলায় বলে, ‘এটা একটা দুঃস্বপ্ন।’
‘যাই হোক’ দানবটা বললো, ‘তৃতীয় গল্প বলার পর এটাই হবে।’
‘দারুণ।’ কনর বললো, ‘জরুরি কাজের মাঝে আরও একটা বিরক্তিকর গল্প।’
‘গল্পও জরুরি, কখনো কখনো অন্য যে-কোনো জিনিসের চেয়ে জরুরি, যদি তারা সত্যিটা বহন করে থাকে।’
‘জীবনগাথা।’ তেতো কণ্ঠে বললো কনর।
দানবটা একটু চমকে উঠলো, ‘ঠিক বলেছো।’ চলে যেতে গিয়ে একবার দাঁড়ালো সেটা, ‘শীঘ্রই আমার দেখা পাবে।’
‘আমি জানতে চাই, আমার মায়ের কী হবে?’ কনর বললো।
‘তুমি কি সেটা ইতোমধ্যেই জানো না?’
‘তুমি বলেছিলে তুমি একটা ঔষধি গাছ, রোগ সারিয়ে তোলো। আমি চাই তুমি
এখন রোগ সারাও। ‘
‘এবং আমি সেটাই করবো।’ এ কথা বলেই দানবটা বাতাসের ঝাঁপটায় মিলিয়ে গেল।
তোমাকে আর দেখতে পাই না
‘আমিও আজ হাসপাতালে যাবো।’ কনর সকালে গাড়িতে বসে নানুকে বললো, ‘আজ স্কুলে যাবো না।’
নানু কেবল গাড়ি চালালো, কোন কথা বললো না। হয়তো আর বলবেও না।
‘কাল রাতে তার কেমন অবস্থা ছিল?’ জিজ্ঞেস করলো কনর। দানবটা চলে যাওয়ার পরও সে অনেকক্ষণ জেগে ছিল, কিন্তু নানু আসার একটু আগেই তার চোখ লেগে এসেছিল।
‘আগের মতোই।’ নানুর চোখ রাস্তার ওপর
‘নতুন ওষুধটা কি কাজে দিচ্ছে?’
অনেকক্ষণ চুপ থেকে তারপর নানু বললো, ‘এত শীঘ্রই কিছু বলা যাচ্ছে না।’
একটু পর কনর জিজ্ঞেস করলো, ‘তাকে কবে বাসায় আনা যাবে?’
নানু এই প্রশ্নের উত্তর দিলো না। আধা ঘণ্টার মধ্যে তারা স্কুলে পৌঁছে গেল।
ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে কোনো লাভ নেই। আর তাছাড়া এতে কিছু যায় আসে না, কারণ শিক্ষকেরা কখনোই তাকে কোনো প্রশ্ন করবে না। ক্লাসমেটরাও না। লাঞ্চব্রেকের সময় হয়ে গেল, এখন পর্যন্ত সে কারো সাথে একটা কথাও বলেনি।
ডাইনিং হলের এক কোনায় সামনে খাবার নিয়ে বসে রইলো সে। ঘরটা তার ক্লাসমেটদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে ভরপুর। কনর সে-সব উপেক্ষা করার চেষ্টা করলো।
দানবটা তাকে সারিয়ে তুলবে, অবশ্যই সারিয়ে তুলবে। তা না হলে সেটা এসেছেই-বা কেন? এটাই একমাত্র কারণ। ঔষধি গাছের রূপে এসেছে, যে গাছ থেকে তার মায়ের ওষুধ বানানো সম্ভব।
‘প্লিজ’, খাবার প্লেট সামনে নিয়ে প্রার্থনা করলো সে, ‘প্লিজ।’
খাবার প্লেটের ওপর দুটো হাত জোরে আঘাত করলো, যার কারণে কনরের ওপর অরেঞ্জ জুস এসে পড়লো।
কনর সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো। তার ট্রাউজার ভিজে গেছে।
‘ও’ম্যালি তো নিজেকে ভিজিয়ে ফেলেছে।’ সালি ইতোমধ্যেই চিৎকার করে বলছে, তার পাশে অ্যান্টন হাসছে।
‘এই নাও!’ অ্যান্টন থালা থেকে কিছু জেলি তার দিকে ছুঁড়ে মারলো, ‘কিছু রয়ে গেছে।’
সব সময়ের মতো সালি আর অ্যান্টনের মাঝে হ্যারি আমুদে একটা দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কনরও তাকালো।
বেশ খানিকটা সময় তারা কেউই নড়লো না। সালি আর অ্যান্টন থেমে গেছে। তারা সম্ভবত এখন অপ্রস্তুত বোধ করছে। কী করবে বুঝতে পারছে না ।
কনর নিজেও সেটা ভাবছে।
‘তোমাকে এখন আমি বুঝি, ও’ম্যালি।’ হ্যারি অবশেষে বললো, ‘আমি জানি তুমি কী চাচ্ছ।’
‘আর তুমি সেটা এখন পাবে।’ বলেই সালি ঘুসি দেখালো।
কনর আড়চোখে দেখলো কোনো শিক্ষক আছে কি না। নেই। হ্যারি এমন একটা সময় বেছে নিয়েছে যখন কোনো শিক্ষক তাদেরকে দেখতে পাবে না।
কনর এখন একা।
হ্যারি শান্তভাবে এগিয়ে এলো।
‘সবচেয়ে খারাপ মার হবে এটা, ও’ম্যালি।’ হ্যারি বললো, ‘এর চেয়ে খারাপ কিছু আমি তোমাকে করতে পারবো না।’
হ্যারি তার হাত হ্যান্ডশেকের জন্য এগিয়ে দিলো।
কনর যেন স্বভাবতই হাতটা এগিয়ে দিলো, আর হ্যারির সাথে হ্যান্ডশেক করলো। যেন দুজন ব্যবসায়ীর মতো হাত মেলালো তারা।
‘বিদায় ও’ম্যালি।’ হ্যারি কনারের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমি
তোমাকে আর দেখবো না।’
এরপর সে কনরের হাত ছেড়ে দিয়ে হেঁটে চলে গেল। সালি আর অ্যান্টন খুব অবাক হলো। এক সেকেন্ড পরে তারাও হ্যারির পেছন পেছন চলে গেল।
কেউ আর কনরের দিকে তাকালো না।
দেয়ালে বিশাল বড়ো একটা ডিজিটাল ঘড়ি। লাঞ্চ ১১টা ৫৫ মিনিটে শুরু হয়, আর ১২টা ৪০ মিনিটে শেষ হয়।
ঘড়িতে এখন ১২টা বেজে ৬ মিনিট।
হ্যারির কথাগুলো কানে বাজছে কনরের, ‘আমি তোমাকে আর দেখবো না।’ হ্যারি চলে যাচ্ছে।
‘আমি তোমাকে আর দেখবো না।’
ঘড়িতে এখন বারোটা সাত বাজে।
‘তৃতীয় গল্পের সময় হয়ে গেছে।’ দানবটা পেছন থেকে কনরকে বললো ।
তৃতীয় গল্প
‘একদা এক অদৃশ্য মানুষ ছিল’–কনর হ্যারিকে চলে যেতে দেখছে—’যার মন অদৃশ্য থাকতে থাকতে বিষিয়ে উঠেছিল।’
কনর হাঁটতে শুরু করলো।
হ্যারির পেছন পেছন
‘এমনটা নয় যে আসলেই সে অদৃশ্য।’ দানবটা কনরের পেছনে আস্তে আস্তে বলছে, তাদের চলার সাথে সাথে ঘরের শব্দগুলোও যেন কমে আসছে, ‘মানুষ তাকে দেখতে পেত না।’
‘এই!’ কনর ডাকলো, হ্যারি পেছনে তাকালো না। কনর একটু দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো।
‘আর, যদি কেউ তোমাকে না দেখতে পারে’ দানবও তার গতি বাড়ালো, ‘তাহলে কি তুমি আসলেই সেখানে আছো?
‘এই!’ কনর এবার চিৎকার করে উঠলো।
পুরো ডাইনিং হলটা চুপ হয়ে গেছে। কনর আর দানব হ্যারির দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
হ্যারি এখনও পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে না।
কনর এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে তাকে পেছনে ঘোরালো।
‘একদিন অদৃশ্য মানুষটা সিদ্ধান্ত নিলো’ দানবের কণ্ঠটা কনরের কানে বাজছে, ‘আমি ওদের আমাকে দেখতে বাধ্য করবো।’
দানবটা বিশাল অতিকায় এক হাত বাড়িয়ে হ্যারিকে ধাক্কা মারলো, উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল হ্যারি ।
হলে সবাই চিৎকার করে উঠলো। অ্যান্টন আর সালির চেহারায় আতঙ্কের ছাপ সুস্পষ্ট। তারা প্রথমে হ্যারির দিকে তাকিয়ে পরে কনরের দিকে দৃষ্টি ফেরালো।
কনর তাদের দিকে আরও এক পা এগিয়ে গেল, তার পেছনে দানবটার উপস্থিতি বুঝতে পারছে সে।
সালি আর অ্যান্টন দৌড়ে পালিয়ে গেল।
‘তুমি কী করছো ও’ম্যালি?’ হ্যারি মেঝে থেকে উঠতে উঠতে বলল। তার মাথা ফেটে গেছে, সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। রক্ত দেখে বাকি সবাই আরও চিৎকার করে উঠলো।
এখনও সামনে এগিয়ে আসছে কনর, তার সামনে থেকে মানুষজন চিৎকার করে সরে যাচ্ছে। পেছন পেছন আসছে তার দানব।
‘তুমি আমাকে দেখ না?’ কনর চিৎকার করে, ‘তুমি আমাকে দেখ না?’
‘না, ও’ম্যালি।’ হ্যারিও চিৎকার করে বলল, ‘দেখি না, কেউই তোমাকে দেখে না।‘
কনর থেমে গিয়ে আশেপাশে তাকালো। সবাই এখন তাদেরকে দেখছে, অপেক্ষা করছে সামনে কী হবে সেটা দেখার জন্য।
কনর তাদের দিকে তাকাতেই তারা চোখ নামিয়ে নিলো, যেন তার দিকে সোজাসুজি তাকাতে তাদের কষ্ট হচ্ছে। কেবল লিলি তার চোখের দিকে তাকালো, ওর চেহারায় উদ্বিগ্নতা।
‘তুমি কি ভাবছো আমি ভয় পেয়ে গেছি, ও’ম্যালি?’ হ্যারি তার কপালের রক্তে হাত দিয়ে বললো।
‘তুমি কি ভাবছো আমি তোমাকে ভয় পেয়ে যাবো?’
কিছু না বলে আরও এগিয়ে এলো কনর।
হ্যারি পিছিয়ে গেল।
‘কনর ও’ম্যালি।’ হ্যারি বললো, তার কণ্ঠে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, ‘সবাই তোমাকে সহমর্মিতা দেখায় কেবল তোমার মায়ের জন্য। তুমি এমন ভাব করে থাকো যেন তুমি অন্যদের চাইতে আলাদা, যেন কেউ তোমার সম্পর্কে জানে না।
কনর হাঁটতে থাকলো। সে হ্যারির কাছাকাছি পৌঁছে গেল।
‘কনর ও’ম্যালি, যে শাস্তি পেতে চায়’ হ্যারি সরাসরি কনরের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কনর ও’ম্যলি, যার শাস্তি পাওয়া উচিত, কেন তাকে তুমি লুকাচ্ছো?’
‘তুমি চুপ করো।’ কনর চেঁচিয়ে উঠলো।
দানবটাও যেন তার সাথে সাথেই একই কথা বলছে।
হ্যারি আরও এক পা পিছিয়ে গেল, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তার। পুরো স্কুল যেন অপেক্ষা করছে কনর হ্যারিকে কী করে তা দেখার জন্য। বাইরে থেকে শিক্ষকদের কথা শোনা যাচ্ছে, অবশেষে তারা বুঝতে পেরেছে যে ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে।
‘কিন্তু তুমি কি জানো আমি তোমার দিকে তাকিয়ে কী দেখতে পাই, ও’ম্যালি?’ হ্যারি বললো।
কনর মুঠি শক্ত করে ফেললো।
‘আমি শূন্যতা দেখতে পাই।’ হ্যারি বললো।
কনর না ঘুরেই দানবটাকে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি অদৃশ্য মানুষটাকে কীভাবে সাহায্য করেছিলে?’
দানবটার কণ্ঠ যেন তার মাথার ভেতরে বাজছে, ‘আমি তাদেরকে দেখিয়েছি।’ এরপর দানবটা হ্যারিকে দেখানোর জন্য সামনে এগিয়ে গেল।
শাস্তি
‘আমি বুঝতে পারছি না তোমাকে কী বলা উচিত।’ হেডমিস্ট্রেস কনরকে বললেন, ‘তোমাকে কীই-বা বলা যেতে পারে, কনর?’
কনর কার্পেটের দিকেই সোজাসুজি তাকিয়ে। কার্পেটে কেউ ওয়াইন ফেলে দিয়েছিল, রং লেগে আছে সেটার। মিস ওয়ানও আছে সেখানে। কনরের পেছনে বসে আছে যেন সে পালাতে না পারে। হেডমিস্ট্রেস মিস ওয়ানের চেয়েও বয়সে বড়ো এবং বেশি ভয়ানক।
‘তুমি ওকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছো, কনর।’ তিনি বললেন, ‘তুমি তার হাত আর নাক ভেঙে দিয়েছো, আমি হলফ করে বলতে পারি তার দাঁতগুলো আর আগের মতো সুন্দর দেখাবে না। তার বাবা-মা পুরো স্কুলকে হুমকি দিচ্ছে আর বলছে, তোমার বিরুদ্ধে ফাইল চার্জ করবে।’
‘তারা এখন খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে আছে, কনর।’ মিস ওয়ান পেছন থেকে বললো, ‘আর এটা তাদের দোষ না। আমি তাদেরকে সবকিছু বুঝিয়ে বলেছি। হ্যারি কীভাবে তোমাকে প্রতিদিনই জ্বালাতন করতো আর তোমার অবস্থাটাও কেমন–নাজুক।’
শব্দটা পছন্দ হলো না কনরের
‘এই জ্বালাতনের কথাটা শুনেই তারা দমে গেছে। আজকাল এসব রেকর্ড থাকলে ভালো ইউনিভার্সিটিতে ঢোকা যায় না।’
‘কিন্তু মোদ্দা কথা সেটা নয়!’ হেডমিস্ট্রেস এত জোরে বললেন যে কনর আর মিস দুজনেই লাফিয়ে উঠলো, ‘কী হয়েছে তা আমি বুঝতেই পারছি না। একটা ছোটো ছেলে কীভাবে একা একা এতটা ক্ষতি করতে পারে!’
কনর বুঝতে পারছিল যে তার নিজের হাত ব্যবহার করেই দানবটা হ্যারিকে মারছিল। দানবটা হ্যারির শার্ট ধরে তাকে ঘুসি মেরেছে, কনর নিজের হাতেই সেটা অনুভব করেছে। হ্যারি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু একটা ছোটো ছেলে কীভাবে একটা দানবের মোকাবেলা করবে?
কনর সেই ছোটাছুটি আর চিৎকারগুলো মনে করতে পারছে। মনে করতে পারছে যে অন্য ছেলেমেয়েগুলো ছুটে গিয়ে শিক্ষকদের নিয়ে এসেছে। তার মনে আছে কীভাবে সবাই গোল হয়ে তাকে দেখছিল। তার মনে আছে কীভাবে দানবটা তাকে অদৃশ্য মানুষের গল্প বলেছে।
একটা সময়ে হ্যারি মোকাবেলা করা বন্ধ করে দিয়েছিল। দানবটা তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী আর দ্রুতগামী, একের পর এক ঘুসি মেরে চলেছিল।
‘আর কখনও অদৃশ্য নয়।’ শেষমেশ বলেছিল দানবটা।
কনরের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
‘কিন্তু অদৃশ্য হওয়ার চেয়েও কঠিন জিনিস আছে।’
আর এরপর কনরকে রক্তাক্ত হ্যারির সামনে রেখে সেটা মিলিয়ে যায়।
ডাইনিং হলের সবাই তখন কনরকেই দেখছিল। সবাই দেখতে পাচ্ছিল। রুমে পিনপিতন নিস্তব্ধতা। তারপর মুহূর্তেই শিক্ষকেরা সেখানে এসে পড়ে কোথায় ছিল তারা এতক্ষণ? দানবটা কি তাদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল? এত দ্রুতই কি সবকিছু হয়ে গেছে?
এর পর তারা কনরকে নিয়ে চলে যায়।
‘তুমি কি নিজের জন্য কিছু বলবে?’ হেডমিস্ট্রেস জিজ্ঞেস করলেন।
কনর কিছু বললো না।
‘আমার উত্তর চাই, তুমি তাকে গুরুতরভাবে আঘাত করেছো।’
‘আমি করিনি।’
‘কী বললে?’
‘আমি করিনি, দানবটা করেছে।’
‘দানব!’ হেডমিস্ট্রেস বললেন।
‘আমি হ্যারিকে হাতও লাগাইনি।’
হেডমিস্ট্রেস মিস ওয়ানের দিকে তাকালেন।
‘পুরো ডাইনিং হলে সবাই দেখেছে তোমাকে, কীভাবে তুমি হ্যারিকে মারছিলে।’ মিস ওয়ান বললো, ‘তারা তোমাকে দেখেছে হ্যারিকে ধাক্কা দিতে, তুমি তাকে টেবিলে ফেলে দিয়ে তার মাথাটা চেপে চেপে ধরছিলে, তুমি চিৎকার করছিলে অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপারে।’
কনরের হাত ব্যথা করছে, নানুর বসার ঘর ধ্বংসের পরেও এমন মনে হচ্ছিল তার।
‘আমি তোমার রাগের কারণ বুঝতে পারছি।’ মিস ওয়ান নরম স্বরে বললেন, ‘মানে, আমরা তোমার কোনো অভিভাবককেও খুঁজে পাচ্ছি না।’
‘বাবা আমেরিকায় চলে গেছে, আর নানু সব সময় ফোন সাইলেন্ট করে রাখে যেন মা ঘুম থেকে না উঠে যায়। নানু আপনাকে আবার ফোন করবে।’
হেডমিস্ট্রেস তাঁর ভারী চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘স্কুলের নিয়ম অনুসারে তোমাকে এখনই বের করে দেওয়ার কথা ।‘
পেট মোচড় দিয়ে উঠলো কনরের। মনে হচ্ছে তার শরীর থেকে বাড়তি কিছু ওজন কমে গেছে। এরপর সে বুঝতে পারলো কমে গেছে, কারণ তার ওপর থেকে ভারটা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভাবনাটা যেন তাকে স্বস্তি এনে দিলো। তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। অবশেষে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। এখন সবকিছু আবার অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে। শাস্তি আসছে তার।
ধন্যবাদ ঈশ্বর। ধন্যবাদ ঈশ্বর।
‘কিন্তু সেটা কীভাবে করি?’ হেডমিস্ট্রেস বললেন।
কনর জমে গেল।
‘এটা করলে আমি নিজেকে একজন শিক্ষক বলে কীভাবে ভাববো? তোমার এমন অবস্থায় তোমাকে বের করে দিতে পারি না। হ্যারির ব্যাপারে আমরা আগে থেকেই জানি। একদিন আমাদের এসব নিয়ে কথা বলতে হবে, কনর ও’ম্যালি। বলতেই হবে।’ তিনি ডেস্কের ওপর থেকে কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে থাকলেন, ‘কিন্তু সেই দিনটা আজকে নয়।’ শেষবারের মতো কনরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমাকে এর চেয়েও গুরুতর জিনিস নিয়ে ভাবতে হবে।’
কনরের এক মুহূর্ত লাগলো এটা বুঝতে যে এখন আর কিছু হবে না। এটুকুই। ‘আপনি আমাকে শাস্তি দেবেন না?’
হেডমিস্ট্রেস একটা বিষণ্ন হাসি হাসলেন, খুব দয়ালু ভঙ্গিমায় বাবার মতো করেই বললেন, ‘তাতে কীই-বা হবে?’
মিস ওয়ান তাকে ক্লাস পর্যন্ত এগিয়ে দিলো।
সে ক্লাসে আসতেই সবাই চুপ হয়ে গেল। এমনকি শিক্ষকও কোনো কথা বললো না। নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়েই সে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলো। তার পেছনে ডেস্কে বসা লিলিকে দেখে মনে হলো সে কিছু বলবে, কিন্তু বললো না।
বাকি সারা দিন কেউ কিছু বললো না তাকে।
‘অদৃশ্য হওয়ার চেয়েও কঠিন কিছু আছে।’ দানবটা বলেছিল। ওটা সঠিক কথাই বলেছিল।
এখন আর অদৃশ্য নেই কনর। সবাই তাকে দেখছে।
কিন্তু এখন যেন সে আরও বেশি হারিয়ে গেছে।
একটি চিঠি
কিছু দিন গেল। এরপর আরও কিছু দিন গেল। কত দিন গেছে তা বলা শক্ত, সবগুলো দিনই কনরের কাছে ধূসর দিন। সে সকালে ওঠে। নানু তার সাথে কথা বলে না, এমনকি হেডমিস্ট্রেসের ফোনের ব্যাপারেও কিছু বলেনি। সে স্কুলে যায় এবং সেখানেও কেউ তার সাথে কথা বলে না। সে মাকে দেখতে হাসপাতালে যায়, কিন্তু মা এতই ক্লান্ত থাকে যে কথা বলতে পারে না। বাবা ফোন করে, কিন্তু তাকে বলার মতো কিছু নেই।
দানবটাও আর আসছে না, হ্যারির ঘটনার পর থেকে আর আসছে না। যদিও এখন কনরের গল্প বলার সময় হয়ে গেছে। প্রতিরাতে কনর অপেক্ষা করে, কিন্তু সেটা আসে না। হয়তো সেটা বুঝে গেছে যে কনর সত্যি বলবে না, সত্যিটা জানলেও বলতে অস্বীকার যাবে।
এসব ভাবতে ভাবতে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ে, আর দুঃস্বপ্নটা দেখে। এখন যেন প্রতিবারই ঘুমানোর পর দুঃস্বপ্নটা আসে। আগের চেয়েও খারাপভাবে। এক রাতে প্রায় তিন-চারবার সে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। এত জোরে চিৎকার করে যে নানু দৌড়ে এসে দেখে যায় সব ঠিক আছে কি না ।
সপ্তাহের ছুটিগুলো হাসপাতালে কাটে। মায়ের নতুন ওষুধগুলো কাজ করতে সময় লাগছে, আর সেই সময়ের মধ্যে তার ফুসফুসে ইনফেকশন হয়ে যাচ্ছে। তার ব্যথাগুলো বেড়ে যাচ্ছে, বেশিরভাগ সময় তাকে ঘুমিয়ে কাটাতে হচ্ছে।
মাঝে মাঝে লিলি আর তার মা আসে, কিন্তু তারা আসার পুরোটা সময় কনর গিফট শপে বসে ম্যাগাজিন পড়ে কাটিয়ে দেয়।
এরপর সে আবারও স্কুলে যাওয়া শুরু করে। সবকিছু যেন নিজস্ব গতিতেই চলছে। পৃথিবীর কোনো কিছুই থেমে নেই।
মিস মার্ল সবাইকে জীবনগাথা হোমওয়ার্কের খাতা ফিরিয়ে দিচ্ছিল, যাদের প্রত্যেকের জীবন আছে। কনর কেবল তার ডেস্কে বসে থাকে, ঘড়ির দিকে তাকায়। বারোটা সাত বাজতে এখনও আরও আড়াই ঘণ্টা বাকি। যদিও তাতে কিছু আসে যায় না। দানবটা হয়তো চিরতরে চলে গেছে।
আর কেউ তো তার সাথে কথা বলবে না।
‘এই!’ কেউ যেন ফিসফিসিয়ে তাকে বলছে।
লিলি তার পাশের ডেস্কে বসে আছে। বারবার মিস মার্লের দিকে লক্ষ রাখছে। তার হাতে একটা চিঠি।
কনরের জন্য একটা চিঠি।
‘এটা নাও।’ লিলি লাজুকভাবে বললো।
কনর দেখে নিলো মিস মার্ল দেখছে কি না। মিস মার্ল এখন সালির জীবনগাথা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করতে ব্যস্ত। কনর চিঠিটা নিলো।
মনে হচ্ছে এটাকে একশোবার ভাঁজ করা হয়েছে। সে লিলির দিকে একটা বিরক্তিকর চাহনিতে তাকালো; লিলি অবশ্য এখনও টিচারকে দেখার অভিনয় করছে।
কনর চিঠিটা পুরোপুরি মেলে ধরলো। কেবল চারটা বাক্য লেখা।
চারটা বাক্য, আর যেন পুরো পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেল।
‘সবাইকে তোমার মায়ের কথা বলে দেওয়ার জন্য আমি দুঃখিত।’ প্রথম বাক্য।
‘তোমার বন্ধুত্বটা আমার খুব মনে পড়ে।’দ্বিতীয় বাক্য।
‘তুমি ঠিক আছো?’তৃতীয় বাক্য।
‘আমি তোমাকে দেখি।’চতুর্থ বাক্য।
লেখাগুলো বারবার পড়লো কনর।
আবার লিলির দিকে তাকালো। মিস মার্ল তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কিন্তু কনর বুঝতে পারলো তার মুখের এই চাপা হাসিটা মিস মার্লের প্রশংসার কারণে নয়।
মিস মার্ল চলে গেলে লিলি তার দিকে তাকালো, একেবারে চোখের দিকে। সে সত্যি কথাই বলেছে। লিলি তাকে দেখতে পায়, সত্যিই দেখতে পায়। কনর ঢোক গিলে বলতে শুরু করলো, ‘লিলি-’ কিন্তু দরজা খুলে স্কুলের সেক্রেটারি এলো, সঙ্গে মিস মার্লও আছে।
তারা দুজনেই কনরের দিকে তাকালো।
একশো বছর
নানু মায়ের হসপিটালের রুমের সামনে এসে থেমে গেল।
‘তুমি ভেতরে আসবে না?’ কনর জিজ্ঞেস করলো ।
নানু মাথা নাড়লো, ‘আমি ওয়েটিং রুমে থাকবো।’ বলে সে কনরকে একা রেখে চলে গেল।
ভেতরে কী দেখবে তা ভেবে কনরের পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। এর আগে কখনোই তাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হয়নি, এমনকি ইস্টারের সময়ও না।
প্রশ্নের বন্যা বয়ে যাচ্ছে তার মাথায়।
প্রশ্নগুলো সে উপেক্ষা করে গেল।
মনে আতঙ্ক নিয়ে দরজাটা খুললো সে।
কিন্তু তার মা জেগে আছে, বিছানায় বসে আছে। সে হাসছে। এক মুহূর্তের জন্য কনরের বুক ধক করে উঠলো। চিকিৎসা মনে হয় কাজ করেছে। ইয়ো গাছ তাকে সারিয়ে তুলেছে। দানবটা কাজ করেছে
তারপরই সে দেখলো মায়ের হাসিটা তার চোখে প্রতিফলিত হচ্ছে না। সে কনরকে দেখে খুশি হয়েছে, কিন্তু নিজেও ভয় পাচ্ছে। এখনও অনেক বেশি ক্লান্ত।
‘হ্যালো, বাবা।’ তার গলার কণ্ঠটা ভারী।
কনর বুঝতে পারছে সে ধীরে ধীরে রেগে উঠছে।
‘এদিকে এসো।’ মা বিছানায় বসে ইশারা করে বললো।
কনর সেখানে বসলো না, পাশের একটা চেয়ারে বসলো।
‘কেমন আছো, সোনামণি?’ গতকালের চেয়েও তার কণ্ঠ বেশি ক্লান্ত। আজ যেন একটু বেশিই টিউব লাগানো হয়েছে। তার মাথায় স্কার্ফটা নেই। ঘরের আলোতে মাথার চামড়াটা চকচক করছে। কনরের ইচ্ছা করলো কিছু একটা দিয়ে সেটা ঢেকে দেয়।
‘কী হয়েছে? নানু আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে এলো কেন?’
‘আমি তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম। আর যেভাবে ওষুধের কারণে আমাকে বারবার ঘুমিয়ে পড়তে হচ্ছে, তাতে আমি পরে আর সুযোগ পাবো কি না তা বুঝতে পারছিলাম না।’
‘তুমি সন্ধ্যাবেলা মাঝে মাঝে জেগে ওঠো, আমাকে তো রাতের বেলায় দেখতে পারতে।’
কনর জানে সে একটা প্রশ্ন করছে, সে এটাও জানে যে মাও তা জানে।
‘আমি তোমাকে এখনই দেখতে চেয়েছিলাম, কনর।’ মা বললো। সাথে সাথেই তার চোখ ভিজে উঠলো।
‘কথা বলার সময় হয়েছে, তাই না?’ কনর ধারালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা কি—’
বাক্যটা শেষ করতে পারলো না সে।
‘আমার দিকে তাকাও।’ কনর মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিল, এবার সে চোখ তুলে তাকালো। মায়ের মুখে প্রচণ্ড ক্লান্ত এক হাসি। বালিশগুলো মাথার দিকে এমনভাবে রাখা যেন মা নিজে মাথা তুলে রাখতে পারে। বিছানাটাও এমনভাবে বাঁকানো যেন সে কনরের দিকে তাকাতে পারে।
মা বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো, ‘আমি আজ সকালে ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি।’ তার কণ্ঠ খুবই দুর্বল, ‘নতুন চিকিৎসাটা কাজ করছে না, কনর। ‘
‘ইয়ো গাছেরটা?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন কাজ করছে না?’
‘সবকিছু খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল, আশাটাও খুব কম ছিল, আর এখন ইনফেকশনের জন্য–‘
‘কিন্তু কেন কাজ করছে না?’ কনর যেন অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করলো।
‘আমি জানি, প্রতিদিন গাছটা দেখে আমার মনে হতো সে আমার দুঃসময়ের বন্ধু। ‘
‘কিন্তু সে সাহায্য করলো না।’
মা মাথা নাড়লো। তার চেহারায় একটা উদ্বিগ্নতার ছাপ। কনর বুঝতে পারলো এই উদ্বিগ্নতা আসলে কনরের জন্য।
‘তো এখন কী হবে?’ কনর জিজ্ঞেস করলো, ‘এখন আর কী চিকিৎসা দেবে?’ মা উত্তর দিলো না। এই নীরবতা নিজেই যেন একটা উত্তর।
কনর কিছুটা জোরেই স্বগতোক্তি করলো, ‘আর কোনো চিকিৎসা নেই।
‘আমি দুঃখিত, বাবা।’ মায়ের চোখে পানি, ‘জীবনে কখনও আমার এতটা খারাপ লাগেনি।’
পুনরায় মেঝের দিকে তাকালো কনর। মনে হচ্ছে তার শ্বাস যেন আটকে গেছে, ‘তুমি বলেছিলে, এটা কাজ করবে।’ তার গলা ভেঙে আসছে।
‘আমি জানি।’
‘তুমি বলেছিলে, তোমার বিশ্বাস–এটা কাজ করবে।’
‘আমি জানি।’
‘তুমি মিথ্যা বলেছো, তুমি পুরোটা সময় মিথ্যা বলে এসেছো।’
মা তার দিকে হাত বাড়ালো, কিন্তু কনর সরে গেল।
‘তুমি মিথ্যা বলেছো।’
‘আমার মনে হয়, অন্তরের গহিনে তুমি সব সময় এটা জানতে, তাই না?’ মা জিজ্ঞেস করলো।
কনর কোনো উত্তর দিলো না ।
‘তোমার রাগ ঠিক আছে সোনামণি, সত্যিই ঠিক আছে।’ মা মৃদু হাসলো, ‘আসলে আমিও খুব রেগে আছি। কিন্তু আমি তোমাকে সত্যি বলতে চাই, মন দিয়ে শোনো। তুমি কি শুনছো?’
তার দিকে হাত বাড়ালো মা। কনর তার হাতে হাত রাখলো, রাখতেই বুঝতে পারলো তার হাতটা খুবই দুর্বল।
‘তোমার যত ইচ্ছা তুমি রাগ করতে পারো, যে যাই বলুক না কেন। তোমার বাবা, তোমার নানু–কারও কথাই শুনবে না। কোনো কিছু ভাঙতে ইচ্ছে করলে ভেঙে ফেলো। কারও কথা শুনবে না।’
কনর তার দিকে তাকাতে পারছিল না।
‘আর যদি কোনো দিন’ এবার মা কেঁদে উঠলো, ‘মনে হয় যে এতটা রাগ করা ঠিক হয়নি, যদি কোনো দিন মনে হয় যে তুমি আমার সাথে আর কথা বলতে পারবে না, কনর, তাহলে তুমি জেনে রেখো যে সেটাই ঠিক। আমি জানতাম। ঠিক আছে? তুমি না বললেও আমি সব জানতাম, ঠিক আছে?’
কনর এখনও তার দিকে তাকাতে পারছে না, মাথা তুলতে পারছে না, খুব ভারী লাগছে।
সে কেবল হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লো।
কনরের এ মুহূর্তে নিজেকে বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে। ‘দুঃখিত সোনা, আমার এখন পেইনকিলার লাগবে।’ মা বললো।
তার হাত ছেড়ে দিলো কনর। মা ওষুধগুলো নিয়ে নিলো।
‘আমার কাছে যদি একশো বছর থাকতো’ মা বললো, ‘যদি একশো বছর থাকতো আমার কাছে, তবে আমি তা পুরোটাই তোমাকে দিয়ে দিতাম।’
কনর উত্তর দিলো না। কয়েক মুহূর্ত পরেই মা ঘুমে ঢলে পড়লো।
তাদের কথা হয়ে গেছে।
আর কিছু বলার নেই।
‘কনর?’ নানু দরজার সামনে এসে ডাকলো ।
‘আমি বাসায় যাবো।’ কনর উত্তর দিলো।
‘কনর–’
‘আমার বাসা।’ কনর মাথা তুলতেই দেখা গেল তার চোখগুলো লাল হয়ে আছে, দুঃখে, লজ্জায়, ক্ষোভে, ‘যে বাসায় ইয়ো গাছ আছে।’
তোমার প্রয়োজন কী আর?
‘আমি আবার হসপিটালে যাছি, কনর।’ তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে নানু বললো, ‘আমার তাকে এভাবে একা রেখে আসতে ভালো লাগে না, তোমার এত কী প্রয়োজন ছিল বাসায়?’
‘একটা দরকারি কাজ আছে আমার।’ কনর তার বাসার দিকে তাকিয়ে আছে, যে বাসায় সে তার পুরোটা জীবন কাটিয়েছে। খুব বেশিদিন হয়নি এখান থেকে চলে যাওয়ার, কিন্তু এটাকে এখন আর আগের মতো আপন লাগছে না ।
হয়তো এটা আর কখনও তার নিজের বাসার মতো মনে হবে না ।
‘আমি এক ঘণ্টা পর এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।’ নানু বললো, ‘তারপর আমরা ডিনার করবো।’
কনর সে-সব কিছুই যেন শুনলো না, গাড়ির দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল সে।
‘এক ঘণ্টা।’ নানু আবার বললো, ‘আজ রাতে তোমার সেখানে থাকা দরকার।‘
কনর তার বাসার দিকে হেঁটে যাচ্ছে।
‘কনর?’ পেছন থেকে ডাকলেও নানুর দিকে সে ফিরে তাকালো না ।
সে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
বাসার ভেতরে বদ্ধ বাতাসের গন্ধ। ভেতরে ঢুকে দরজাও বন্ধ করলো না কনর। সোজা রান্নাঘরে গিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি মারলো।
পাহাড়ের ওপর চার্চটা, আর তার পাশের কবরস্থানে ইয়ো গাছটা।
পেছনের উঠান পেরিয়ে দেয়াল টপকে বেরিয়ে এল সে। রেললাইনের কাঁটাতারের ভেতর দিয়ে বের হওয়ার সময় তার শার্ট ছিঁড়ে গেল, কিন্তু কনর সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করলো না। কোনো ট্রেন আসছে কি না সেটাও দেখে নিলো না। আরও একটা বেড়া পেরোনোর পর সে চার্চে এসে পড়লো। এরপর সোজা চলে গেল কবরস্থানে, চোখটা এখনও গাছের ওপর স্থির।
সেটা এখনও একটা গাছ হয়েই আছে।
কনর এবার ছুটতে শুরু করলো।
‘ওঠো!’ সেখানে পৌঁছানোর আগেই কনর চিৎকার করে উঠলো, ‘ওঠো!’
মূলের কাছে এসে লাথি কষতে শুরু করলো, ‘আমি বলছি জেগে ওঠো! সময় হয়েছে কি না তাতে কিছু যায় আসে না, জেগে ওঠো!’
আরও জোরে লাথি কষতে থাকলো কনর।
আরও একবার ।
ইয়ো গাছটা এত দ্রুত সরে গেল যে কনর তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল।
‘এমন করতে থাকলে তুমি নিজেরই ক্ষতি করে ফেলবে।’ দানবটা বলে উঠলো।
‘সেটা কাজ করেনি!’ কনর উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলো, ‘তুমি বলেছিলে সেটা কাজ করবে, কিন্তু করেনি।’
‘আমি বলেছিলাম যদি তোমার মাকে সুস্থ করা যায়, তবে ইয়ো গাছ তা করবে। বোঝা যাচ্ছে তোমার মাকে সুস্থ করা যাবে না।’
রাগে যেন কনরের বুক কেঁপে উঠলো। সে দানবটার পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, খামচে তার ছালবাকল তুলে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলো, ‘সুস্থ করো, সুস্থ করে তোলো তাকে!
‘কনর!’ দানবটা বলে উঠলো।
‘আর প্রয়োজন কী তোমার, যদি তাকে সুস্থই না করতে পারো?’ কনর সরে গিয়ে বললো, ‘বিরক্তিকর গল্প শোনাও আর আমাকে বিপদে ফেল। সবাই আমার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন আমার কোনো রোগ হয়েছে—’
দানবটা তাকে হাতে তুলে নিতেই সে থেমে গেল।
‘তুমি আমাকে ডেকে জীবন্ত করেছো কনর, ও’ম্যালি। এসব প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেই দেবে।’
‘আমি যদি তোমাকে ডেকে থাকি’ কনরের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে, যেন তার চোখ বেয়ে রাগ গড়িয়ে পড়ছে, ‘তবে সেটা আমার মাকে সুস্থ করে তোলার জন্য।’
‘আমি তাকে সুস্থ করতে আসিনি, আমি তোমাকে সুস্থ করতে এসেছি।’
‘আমাকে?’ কনর হাত-পা ছোঁড়া বন্ধ করে দিলো, ‘আমাকে সুস্থ করতে হবে না, আমার মা–’
কথাটা বলতে পারলো না সে। যত যাই হয়ে থাকুক না কেন, সে বলতে পারবে না। সে নিজে আগে থেকে জেনে থাকলেও না। হ্যাঁ, সে জানতো, সে আগে থেকেই জানতো, কিন্তু তাও সে বলতে পারবে না ।
কনর কাঁদছে, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে কেউ বুঝি তার শরীর কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলছে।
সে দানবের দিকে তাকালো, ‘আমাকে সাহায্য করো!’ খুব আস্তে করে বললো কথাটা।
‘এখন সময় হয়েছে, চতুর্থ গল্পের।’
কনর চিৎকার করে উঠলো, ‘না! এখন এসবের চেয়েও জরুরি কিছু আছে!’
‘হ্যাঁ, আছে।’
দানবটা তার খোলা হাত মেলে ধরলো।
সাথে সাথে তাদের চারপাশটা আবার কুয়াশায় ছেয়ে গেল।
এবং আরও একবার, তার সেই দুঃস্বপ্নে এসে পড়লো।
চতুর্থ গল্প
দানবের বিশাল ভারী হাতটা কনরকে জাপটে ধরে রাখার পরও আতঙ্ক তাকে ঘিরে ধরলো। অন্ধকারটা যেন তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে আর তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে—
‘না!’ কনর চিৎকার করে সরে যেতে চাইলো, কিন্তু দানবটা তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে, ‘না, প্লিজ!’
পাহাড়, চার্চ, কবরস্থান সবই হারিয়ে গেছে, কেবল একটা ঠান্ডা অন্ধকার। এই অন্ধকারটা আগেও কনর অনুভব করেছে, যখন মাকে প্রথমবারের মতো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এর আগে যখন চিকিৎসার কারণে মায়ের চুল পড়ে যেত, তারও আগে যখন মায়ের ফ্লু সারতোই না, এর আগে যখন মা ক্লান্ত হয়ে পড়তো, তারও আগে। তারও অনেক আগে যেন চিরকাল ধরে এই অন্ধকার অনুভব করে আসছে সে। দুঃস্বপ্নটা কখনোই তার পিছু ছাড়েনি, তাকে একা করে দিয়েছে এটা।
এই দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু সে বুঝি কখনো দেখেইনি।
‘আমাকে এখান থেকে বের করো।’ সে চিৎকার করে উঠলো, ‘প্লিজ!’
‘এখন সময় হয়েছে, চতুর্থ গল্পের।’ ইয়ো দানবটা বললো ।
‘আমি কোনো গল্প জানি না!’ কনর ভীত হয়ে বললো।
‘যদি তুমি না বলো, তাহলে তোমার হয়ে আমাকেই বলতে হবে।’ কনরকে নিজের মুখের সামনে তুলে ধরে বললো, ‘আর বিশ্বাস করো, আমি বললে তুমি সেটা মোটেও পছন্দ করবে না।’
‘প্লিজ, আমাকে মায়ের কাছে যেতে হবে।’
‘কিন্তু’ দানবটা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘সে তো ইতোমধ্যেই এখানে আছে।’
এ কথা বলেই হুট করে দানবটা তাকে নামিয়ে দিলো।
পায়ের নিচের ঠান্ডা মাটিটা তার পরিচিত। সে একটা পাহাড়ের ঢালে আছে, তার তিন দিক কালো জঙ্গলে ঘেরা, আর এক দিক ঢালের প্রান্ত যার পর কেবল অন্ধকার।
সেই ঢালের কাছে তার মা দাঁড়িয়ে আছে।
কনর তার পেছন দিক দেখতে পাচ্ছে, ঘাড়ের ওপর দিয়ে সে কনরের দিকে তাকিয়ে হাসছে। হাসপাতালে থাকার সময়টার মতোই দুর্বল দেখাচ্ছে তাকে।
‘মা!’ চিৎকার করে উঠলো কনর, প্রচণ্ড ভারী লাগছে তার, যেমনটা এই দুঃস্বপ্নে সব সময়ই হয়, ‘ওখান থেকে সরে যাও।’
কিন্তু মা নড়লো না ।
কনর কোনোমতে নিজেকে টেনে-হিঁচড়ে সামনের দিকে নিয়ে যেতে থাকলো, ‘মা, তোমাকে দৌড়ে পালাতে হবে।’
‘আমি ঠিক আছি সোনা, চিন্তা করতে হবে না।’
‘মা, দৌড়াও! প্লিজ দৌড়াও!’
‘কিন্তু সোনা এখানে
যেন কিছু একটা শুনে মা ঢালের নিচের দিকে তাকালো।
‘না।’ নিজে নিজেই বলে উঠলো কনর। সে টেনে-হিঁচড়ে আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু মা যেন অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে, অনেক সময় লেগে যাবে সেখানে পৌঁছতে, তার নিজেকে এত ভারী লাগছে
ঢালের নিচ থেকে চাপা একটা শব্দ এলো, গর্জন।
যেন বিশাল কিছু সেখানে হেঁটে বেড়াচ্ছে। পৃথিবীর চেয়েও বিশাল কিছু।
আর সেটা ঢাল বেয়ে উপরে উঠছে।
‘কনর?’ মা আবার কনরের দিকে তাকালো।
কিন্তু কনর জানে, অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আসল দানব চলে আসছে।
‘মা!’ কনর চিৎকার করলো, কোনো এক অদৃশ্য ওজন যেন তাকে মাটিতে চেপে ধরেছে, ‘মা!’
গর্জনটা আরও তীব্র হচ্ছে, আরও তীব্র।
‘মা!’
সে জানে, সে সময়মতো সেখানে পৌঁছবে না ।
বিশাল এক গর্জন করে অতিকায় দুটো হাত ঢালের নিচ থেকে উপরে এগিয়ে এলো। মা ছুটে পালাতে চাইলো।
কিন্তু সে খুব দুর্বল, খুব বেশি দুর্বল।
হাত দুটো ভয়ানকভাবে আছড়ে পড়ে মাকে খপ করে ধরে ফেললো, আর টেনে নিচে নিয়ে যেতে থাকলো।
অবশেষে কনর উঠে দৌড় লাগালো, একটা চিৎকার করে ঢালের দিকে লাফিয়ে পড়লো।
নিজের হাত দিয়ে মায়ের হাত ধরতে পেরেছে সে।
এই ছিল তার দুঃস্বপ্ন। যে দুঃস্বপ্নের কারণে সে প্রতি রাতে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠতো। সেটা এখন হচ্ছে, এই তো, সেটা এখনই হচ্ছে।
ঢালের পাশে সে কোনোমতে তার মায়ের হাত ধরে আছে, সমস্ত শক্তি দিয়ে, যেন মা এই গাঢ় অন্ধকারে হারিয়ে না যায়, যেন এই দানবটা তাকে টেনে নিয়ে যেতে না পারে।
সে এখন দানবটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।
আসল দানবটা, যে দানবটাকে সে সত্যিই ভয় পায়। যার কারণে সে ইয়ো দানবকে ভয় পায়নি। কালো মেঘ আর ছাইয়ের দানব। অসীম শক্তি আর লাল চোখ যা সোজাসুজি তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, ভয়ানক ধারালো দাঁত যেটা তার মাকে জীবন্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।
‘আমি এর চেয়েও খারাপ কিছু দেখেছি।’ প্রথম রাতে কনর ইয়ো গাছকে বলেছিল।
আর এই সেই খারাপ জিনিসটা।
‘সাহায্য করো, কনর। আমাকে ছেড়ে দিও না।’ মা চিৎকার করে উঠলো।
‘আমি ছাড়বো না।’ কনরও চিৎকার করে বললো, ‘কথা দিচ্ছি।’
দুঃস্বপ্নের দানবটা গর্জে উঠে আরও জোরে তার মাকে টানতে লাগলো।
মা যেন ক্রমে পিছলে যাচ্ছে কনরের হাত থেকে।
‘না!’ মা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো, ‘প্লিজ, কনর! আমাকে ধরে রাখো।’
‘রাখবো!’ কনর চিৎকার করে পেছনে ঘুরে ইয়ো গাছের দিকে তাকালো, যে কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছে, ‘আমাকে সাহায্য করো! আমি ধরে রাখতে পারছি না!’
কিন্তু তা হলো না, ইয়ো গাছটা কেবল দেখতে লাগলো।
‘কনর!’ মা চিৎকার করে উঠলো।
তার হাত পিছলে যাচ্ছে।
‘কনর!’
‘মা!’ কেঁদে উঠলো কনর, আরও শক্ত করে ধরে রাখার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু তার হাত ছুটে যাচ্ছে, মা যেন আরও ভারী হয়ে গেছে, দুঃস্বপ্নের দানবটা তাকে টেনে চলেছে।
‘আমি পড়ে যাচ্ছি!’ মা চিৎকার করে উঠলো।
‘না!’
কনর তাকে ধরে রাখতে গিয়ে নিজেই মুখ থুবড়ে পড়লো।
মা যেন অস্বাভাবিক রকম ভারী হয়ে গেছে।
‘প্লিজ!’ কনর নিজেকেই বললো,’ প্লিজ!’
ঠিক এ মুহূর্তে পেছন থেকে ইয়ো গাছটা বলে উঠলো, ‘চতুর্থ গল্পটা।’
‘চুপ করো, আমাকে সাহায্য করো!’
এটাই সত্যিটা, কনর ও’ম্যালি।
মা চিৎকার করছে, হাত পিছলে যাচ্ছে।
‘তোমাকে এখন ওই সত্যিটা বলতে হব।’ ইয়ো গাছ বললো।
‘না!’ কনরের গলা ভেঙে যাচ্ছে।
বলতেই হবে।
‘না!’
এরপর যেন সত্যিটা হুট করেই চলে এলো।
দুঃস্বপ্নটা যেন তার উপযুক্ত সময়ে পৌঁছে গেল
‘না!’
মা নিচে পড়ে গেল।
চতুর্থ গল্পের বাকি অংশ
এই সময়টাতে তার ঘুম ভেঙে গেল।
যখন মা চিৎকার করে তার হাত পিছলে নিচে গাঢ় অন্ধকারে পড়ে গেল, হারিয়ে গেল। এমন সময়ে সে জেগে ওঠে, ঘামে ভিজে, বুকের ধুকপুকানি নিয়ে
কিন্তু সে জেগে উঠলো না।
দুঃস্বপ্নটা এখনও তাকে ঘিরে রেখেছে। ইয়ো গাছ এখনও তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
‘গল্পটা শেষ হয়নি। সেটা বলে উঠলো।
‘আমাকে এখান থেকে বের করো।’ কনর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমাকে মায়ের কাছে যেতে হবে।’
‘সেখানে আর কেউ নেই, কনর।’ আসল দানবটা বলে উঠলো, ‘তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছো।’
‘এটা কেবল একটা দুঃস্বপ্ন। এটা সত্যি না।’
‘এটাই সত্যি।’ দানবটা বললো, ‘তুমি জানো, তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছো।’
‘সে পড়ে গেছে।’ কনর বললো, ‘আমি তাকে ধরে রাখতে পারিনি, খুব ভারী হয়ে উঠেছিল।’
‘তাই তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছো।’
‘সে পড়ে গিয়েছে!’ চিৎকার করে উঠলো কনর। সেই ভয়ানক দানবটা এখন ঢাল বেয়ে উপরে উঠে এসেছে, তার গা থেকে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে যে ধোঁয়ায় কনরের শ্বাস আটকে যাচ্ছে। যেন শ্বাস নিতেও যুদ্ধ করতে হচ্ছে তার।
‘তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছো।’ দানবটা আবার বললো ।
‘আমি তাকে ছাড়িনি’ কনর কেঁদে উঠলো, ‘সে পড়ে গেছে!’
‘তোমাকে সত্যি কথাটা বলতে হবে, তা না হলে তুমি এই দুঃস্বপ্ন থেকে বের হতে পারবে না।’ দানবটার কণ্ঠ এখন যে-কোনো সময়ের চাইতে বেশি ভয়ানক শোনাচ্ছে, ‘তুমি আজীবন এখানে আটকে থাকবে।’
‘আমাকে ছেড়ে দাও প্লিজ!’ কনর পিছিয়ে গেল। দানবের তৈরি কুয়াশা তার পা পেঁচিয়ে ধরেছে, তাকে বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। ‘আমাকে সাহায্য করো!’
‘সত্যিটা বলো! সত্যিটা বলো, নাহয় সারাজীবন এখানে থাকো।’
‘কোন সত্যি?’ চিৎকার করে উঠলো কনর, ‘আমি জানি না তুমি কীসের কথা বলছো।’
‘তুমি জানো।’ হুমকির মতো শোনালো কথাটা
এরপর সব চুপ।
কনর জানে।
সে সব সময়ই জানতো।
সত্যিটা। দুঃস্বপ্নের সত্যিটা।
‘না, আমি পারবো না।’
‘তোমাকে পারতেই হবে।’
‘আমি পারবো না।’
‘তুমি পারবে, দানবের কণ্ঠ এখন দয়ালু শোনাচ্ছে।
চোখ ভিজে এলো কনরের। গাল বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে, নিজেকে সে থামাতে পারছে না।
‘প্লিজ আমাকে এটা বলতে বোলো না।’
‘তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছো।’ দানবটা বললো।
‘প্লিজ–‘
‘তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছো।’ দানবটা আবার বললো ।
এবার সে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লো।
‘তুমি তাকে আরও ধরে রাখতে পারতে, কিন্তু তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছো। তুমি
তাকে পড়ে যেতে দিয়েছো।’
আবার মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ করলো কনর। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে।
‘তুমি চাচ্ছো যেন সে পড়ে যাক। ‘
‘না!’ ভারী অশ্রুর মধ্য দিয়ে বললো কনর।
‘তুমি চেয়েছো যেন সে চলে যায়।’
‘না!’
‘তোমাকে এখন সত্যিটা বলতেই হবে, কনর ও’ম্যালি।’
কনরের বুক যেন জ্বলে যাচ্ছে। যেন কেউ জ্বলন্ত একটা সূর্য রেখে দিয়েছে তার
বুকের ভেতর। ভেতর থেকে সেটা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
‘এমনটা করলে আমি মরে যাবো।’
‘এমনটা না করলেই তুমি মরে যাবে, তোমাকে বলতেই হবে।’
‘আমি পারছি না।’
‘তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছো, কেন?’
অন্ধকার চোখে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে, তার নাক-মুখ দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে, দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার, যেন মরে যাচ্ছে সে
‘কেন, কনর? বলো, কেন? দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই বলো।’
বুকের ভেতরের আগুনটা যেন তাকে দ্রুত গ্রাস করে ফেলবে তাকে। এটাই সত্যি, সে জানতো এটাই সত্যি। তার মুখ দিয়ে গোঙানি বেরিয়ে এলো, সবকিছু যেন আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে। কনর যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলো
আর এরপর সে সত্যিটা বললো।
চতুর্থ গল্পের বাকি অংশ।
‘কারণ আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না।’ চিৎকার করে যেন তার ক্ষোভটা বেরিয়ে এলো, ‘সে চলে যাবে, এটা আমার সহ্য হচ্ছিল না! আমি চাচ্ছিলাম এসব শেষ হোক, কেবল শেষ হয়ে যাক!’
আর এরপর যেন আগুনে পৃথিবী ছেয়ে গেল। সবকিছু মুছে দিয়ে গেল। তাকেও যেন শেষ করে দিচ্ছে। কনর এই শাস্তিকে আমন্ত্রণ জানালো, অবশেষে সে তার পাওনা শাস্তিটা পাচ্ছে।
মৃত্যুর পরের জীবন
কনর চোখ মেলে দেখলো সে তার বাসার পেছনের পাহাড়ের ঘাসের ওপর শুয়ে আছে।
সে এখনও বেঁচে আছে।
‘এটা আমাকে মারেনি কেন?’ কনর গুঙিয়ে উঠলো, ‘সবচেয়ে খারাপটা আমার প্রাপ্য।’
‘তাই না-কি?’ দানবটা দাঁড়িয়ে আছে।
‘আমি লম্বা সময় ধরে সেটাই ভেবে এসেছি।’ বলতেও কষ্ট হচ্ছে কনরের, ‘আমি সব সময়ই জানতাম সে সেরে উঠবে না, শুরু থেকেই সব জানতাম। সে বলেছে সে সুস্থ হয়ে উঠবে, কারণ আমি সেটা শুনতে চেয়েছিলাম। আমি তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু আসলে করিনি।’
‘না।’ দানব বললো।
‘আর আমি ভাবতে শুরু করলাম যে আমি এসবের সমাপ্তি চাই। এ সমস্ত ভাবনার সমাপ্তি চাই। আমার আর সহ্য হচ্ছিল না।’
কনর এবার কাঁদতে শুরু করলো। সে হয়তো কখনও এত কাঁদেনি, প্রথমবার মায়ের রোগ ধরা পড়ার সময়ও এতটা কাঁদেনি।
‘আর মনের গহীনে কোথাও তুমি আশা করছিলে যেন এসব শেষ হয়ে যায়।।’ দানবটা বললো, ‘এর বিনিময়ে তাকে হারিয়েই-বা ফেলতে হোক না কেন।
কনর মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
‘আর এরপর থেকেই দুঃস্বপ্নের শুরু, যার শেষ হয় সব সময়—’
‘আমি তাকে যেতে দিয়েছি। আমি ধরে রাখতে পারতাম, কিন্তু তাকে যেতে দিয়েছি।’
‘এবং এটাই হচ্ছে সেই সত্যিটা।’ দানবটা বললো।
‘আমি এমনটা চাইনি! আমি তাকে ছেড়ে দিতে চাইনি! এখন সে মারা যাবে। সব দোষ আমার।’
কনরের এখন শারীরিকভাবে কষ্ট হচ্ছে। পেশী টানটান হয়ে যাচ্ছে। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, মাটিতে ঢুকে যেতে চাইলো সে আজীবনের জন্য।
দানবের বিশাল হাতটা তাকে দয়ালুভাবে তুলে নিলো, শাখা-প্রশাখা আর পাতা দিয়ে তাকে কিছুটা আরাম দেওয়ার চেষ্টা করলো ।
‘এটা আমার দোষ, আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি, এটা আমার দোষ। ‘
‘এটা তোমার দোষ না।’ দানবের কণ্ঠটা যেন বাতাসের মতো তার চারপাশে ভাসতে লাগলো।
‘এটা আমারই দোষ । ‘
‘তুমি কেবল এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাচ্ছিলে, তোমার নিজের যন্ত্রণা থেকে। একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকে। এটা সামান্য মানবিক একটা ব্যাপার।’
‘আমি এমনটা চাইনি।’
‘তুমি চেয়েছো, আবার চাওনি।’
‘দুটোই একসাথে কীভাবে সত্যি হতে পারে?’
‘কারণ মানুষ খুবই জটিল বস্তু। রানি কীভাবে একইসাথে ভালো এবং খারাপ হয়েছিল? যুবরাজ কীভাবে খুনি এবং উদ্ধারকারী হলো? এপথকেরি কীভাবে রাগী এবং সঠিক দিক-নির্দেশনাকারী হয়েছিল? কীভাবে লোকটা ভালো হৃদয়ের, কিন্তু ভুল চিন্তার লোক ছিল? অদৃশ্য মানুষটা কীভাবে দৃশ্যমান হওয়া সত্ত্বেও আরও একাকি হয়ে গেল?’
‘আমি জানি না’ কনরের ক্লান্ত লাগছে, ‘তোমার গল্পের আগামাথা আমি কখনোই বুঝিনি।’
‘উত্তরটা হচ্ছে–তুমি যতই ভাবো না কেন, তোমার চিন্তাভাবনা নিজেই নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তুমি তাকে ছেড়ে দিতে চেয়েছো, আবার একইসাথে তাকে বাঁচানোর জন্য পাগল হয়ে গিয়েছো। তোমার মন শান্তিদায়ক মিথ্যাকে বিশ্বাস করছিল, কিন্তু এটাও জানতো যে একটা যন্ত্রণাদায়ক সত্যি এই মিথ্যেগুলোকে ধুলোয় মিশিয়ে দেবে। তোমার মন তোমাকে সত্য-মিথ্যা দুটোই বিশ্বাস করার জন্য শাস্তি দিচ্ছে।’
‘কিন্তু এসবের মোকাবেলা কীভাবে করবো? ভেতরের চিন্তার মোকাবেলা কীভাবে করা যায়?’
‘সত্যি বলে, যেভাবে তুমি এইমাত্র বলেছো।’
কনর আরও একবার ভাবলো কীভাবে তার মায়ের হাত ছুটে যাচ্ছিল—’
‘এসব ভাবনা থামাও, কনর ও’ম্যালি।’ দানবটা খুব নরমভাবে বললো, ‘এ কারণেই আমি জীবন্ত হয়েছি, তোমাকে এসব বলতে যেন তুমি সেরে উঠতে পারো, তোমাকে শুনতে হবে।’
‘আমি শুনছি।’
‘কেবল কথা বলে জীবনগাথা বানাতে পারবে না, তোমাকে করে দেখাতে হবে। তুমি কী ভাবছো সেটা জরুরি না, তুমি কী করছো সেটা জরুরি।’
কনর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।
‘তাহলে আমি কী করবো?’
‘যেটা তুমি এইমাত্র করেছো, সত্যিটা বলা।’
‘এটুকুই?’
‘তোমার মনে হচ্ছে এটা খুব সহজ? তুমি সেটা বলার চেয়ে মরে যেতে পছন্দ করেছিলে।’
কনর মাটির দিকে তাকালো, ‘আমি ভেবেছিলাম আমার চিন্তাটা খুবই ভুল।’
‘এটা ভুল নয়।’ দানব বললো, ‘এটা কেবল একটা চিন্তা, লাখ লাখ চিন্তার মধ্যে একটা।’
কনরের নিঃশ্বাস এখনও ভারী, তবে আগের মতো দম বন্ধ হয়ে আসছে না। দুঃস্বপ্নটা তাকে কাবু করতে পারছে না।
সত্যি বলতে, তার মনে হলো দুঃস্বপ্নটা আর নেই ।
‘আমি খুব ক্লান্ত, খুব ক্লান্ত।’ সে তার মাথাটা হাত দিয়ে চেপে ধরলো।
‘তাহলে ঘুমিয়ে যাও, এখনও সময় আছে।’
‘সত্যিই আছে?’ কনর ফিসফিস করে বললো, চোখ খুলে রাখতেও তার কষ্ট হচ্ছে।
দানবের হাতটা কনরের জন্য আরামদায়ক একটা জায়গা হয়ে গেল ।
‘আমি মাকে দেখতে যাবো।’
‘যাবে, কথা দিচ্ছি।’
কনর চোখ মেললো, ‘তুমি তখন থাকবে?’
‘হ্যাঁ।’ দানবটা বললো, ‘আমার জীবন্ত হওয়ার শেষ কিছু সময় হবে সেটা।’
কনর গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো।
তলিয়ে যাওয়ার আগে একটা প্রশ্ন করলো সে, ‘তুমি সবসময় ১২টা ৭ মিনিটেই আসো কেন?’
উত্তর দেওয়ার আগেই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
আমাদের মধ্যে মিল
‘ধন্যবাদ ঈশ্বর।’
ঘুমের মধ্যেই কনর শুনতে পেল।
‘কনর!’ কণ্ঠটা আরও তীব্র হচ্ছে, ‘কনর!’
নানুর কণ্ঠ।
কনর চোখ মেলে উঠে বসলো। রাত হয়ে গেছে। সে কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল? আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে এখনও বাসার পেছনের পাহাড়ে আছে, ইয়ো গাছের মূলের ওপর শুয়ে আছে। ওপরে তাকিয়ে দেখলো এটা এখন কেবল একটা গাছ।
‘কনর!’
নানু তার দিকে চার্চের ওপাশ থেকে ছুটে আসছে। তার গাড়ি পার্ক করা, ইঞ্জিনটা এখনও চলছে। কনর বিরক্তি আর স্বস্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
‘ওহ, ধন্যবাদ ঈশ্বর!’ নানু তার দিকে আসতে আসতে চিৎকার করে বললো।
এরপরই সে অবাক করার মতো একটা কাজ করলো।
সে ছুটে এসে কনরকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলো যেন আরেকটু হলেই তারা পড়ে যাবে। কোনোমতে সামলে দাঁড়িয়ে থাকলো কনর। নানু চিৎকার করা শুরু করলো, ‘তুমি কোথায় ছিলে, কনর? আমি পাগলের মতো তোমাকে খুঁজছি। কয়েক ঘণ্টা হয়ে গেছে, কী ভাবছিলে তুমি?’
‘আমার একটু কাজ ছিল।’ কনর বলতে শুরু করলো, কিন্তু নানু তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকলো ।
‘সময় নেই, আমাদের এখন যেতে হবে, এখনই।’
নানু তার হাত ছেড়ে দিয়ে গাড়ির দিকে ছুটলো, কনরও ছুটলো পেছন পেছন। গাড়িতে উঠতেই জোরে গাড়ি ছোটালো নানু। কনর এসবের কারণ জিজ্ঞেস করার মতো সাহস জোগাতে পারলো না ।
‘কনর!’ দ্রুত গাড়ি ছোটাতে ছোটাতে নানু বললো। কনর তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো যে সে কাঁদছে। ‘কনর তুমি–’ নানু স্টিয়ারিং হুইলটা খামচে ধরে রেখেছে।
‘নানু–’ কনর বলতে শুরু করলো।
‘না, কিছু বলবে না।’
তারা চুপচাপ চললো।
‘নানু?’ কনর কিছুক্ষণ পর আবার বললো।
নানু কিছু বললো না।
‘আমি দুঃখিত।’ কনর আস্তে করে বললো।
নানু যেন খুব কষ্ট করে হাসলো, ‘তাতে কিছু আসে যায় না, তাতে কিছু আসে যায় না।’
‘তাই?’
‘অবশ্যই।’ নানু আবার কাঁদতে শুরু করলো, কিন্তু সে তো কান্না করার মতো নানু না। ‘তুমি জানো, কনর, তুমি আর আমি, আমাদের একসাথে জমে না, তাইনা?’
‘না, আমার মনে হয় না।’
‘আমারও মনে হয় না, কিন্তু আমাদের সেটা শিখতে হবে।’
‘আমি জানি।’
‘তুমি জানো, তাই না? অবশ্যই তুমি জানো।’
নানু কাশতে কাশতে একটা ট্রাফিক লাল বাতি উপেক্ষা করে গাড়ি ছুটিয়ে চললো। কনর আন্দাজ করার চেষ্টা করলো রাত কতটা হয়েছে। রাস্তায় তেমন ট্রাফিক নেই এখন।
‘কিন্তু নাতি, তুমি জানো কি, আমাদের মধ্যে একটা মিল আছে।’
‘আছে?’ কনর এখন হাসপাতাল দেখতে পাচ্ছে।
‘হ্যাঁ।’ নানুর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে।
‘কী সেটা?’ জিজ্ঞেস করলো কনর।
হাসপাতালের সামনে গাড়িটা থামিয়ে নানু তার দিকে সোজা তাকিয়ে বললো,
‘তোমার মা। আমাদের মাঝে এই একটা জিনিসই মিল আছে।’
কনর কিছু বললো না।
সে জানে, নানু কী বলতে চাইছেন। মা নানুর মেয়ে, নানুর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আর সে কনরের মা।
এই মিলটা খুব বড়ো একটা মিল।
ইঞ্জিন বন্ধ করে নানু দরজা খুললো, ‘আমাদের জলদি যেতে হবে।’
সত্য
নানু তার আতঙ্কিত চেহারায় একটা প্রশ্ন নিয়ে হাসপাতালের রুমে ঢুকল। নার্স তাকে দেখে সাথে সাথেই বলে দিলো, ‘সবকিছু ঠিক আছে, আপনারা সময়মতো এসেছেন।’
নানু যেন স্বস্তিতে কেঁদে উঠলো।
‘আপনি ওকে নিয়ে আসতে পেরেছেন তাহলে!’ নার্স কনরকে দেখে বললো।
‘হ্যাঁ।’ কেবল এটুকুই বললো নানু।
কনর আর নানু মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরটা অন্ধকার, কেবল মায়ের বিছানার ওপরে আলো পড়ছে। তার চোখ বন্ধ, নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে মনে হচ্ছে যেন তার বুকের ওপর ভারী কিছু বসে আছে। নার্স তাদের রেখে চলে গেল। নানু বিছানার পাশের চেয়ারে বসে মায়ের একটা হাত তুলে নিলো। হাতে একটা চুমু খেল সে।
‘মা?’ কনর শুনতে পেল। মা তার নিজের মাকে ডাকছে, এত আস্তে ডাকছে যেন শোনাই যায় না।
‘আমি এসে পড়েছি, সোনা!’ নানু মায়ের হাত ধরেই বললো, ‘কনরও এসে গেছে।’
‘এসেছে?’ চোখ না খুলেই বললো মা।
নানু তার দিকে তাকালো। কিছু একটা ইশারা করলো।
‘আমি এসেছি, মা।’ কনর বললো।
মা কিছু বললো না, কেবল হাতটা বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। যেন হাতটা ধরতে বলছে, কখনও যেন সে হাতটা ছেড়ে না দেয় ।
‘এখানে এই গল্পের সমাপ্তি হবে।’ পেছন থেকে বললো দানবটা।
‘আমি কী করবো?’ কনর ফিসফিসিয়ে বললো
সে অনুভব করলো দানবটা তার কাঁধে হাত রেখেছে।
‘কেবল সত্যিটা বলতে হবে তোমাকে।’
‘আমার ভয় করছে।’
নানু তার মেয়ের হাত ধরে বসে আছে। মা তার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে, অপেক্ষা করছে কখন কনর হাতটা ধরবে।
‘অবশ্যই তুমি ভয় পাবে, কিন্তু তবু তোমাকে করতে হবে।’ দানবটা তাকে ঠেলে এগিয়ে দিলো।
দানবটা কনরের হাত তার মায়ের দিকে এগিয়ে দিতেই ঘড়িটা কনরের চোখে পড়লো। এখন ১১টা বেজে ৪৬ মিনিট।
১২টা ৭ বাজার আরও বিশ মিনিট বাকি ।
দানবকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে–এরপর কী হবে? কিন্তু সাহস পেল না।
কারণ তা সে নিজেই জানে।
‘তুমি যদি এখন সত্যি বলো, তাহলে সামনে আর যাই আসুক না কেন, তুমি তার মোকাবেলা করতে পারবে।’
কনর তার মায়ের হাতের দিকে তাকালো, চোখে পানি চলে এসেছে তার। সে দুঃস্বপ্নে ডুবে যাচ্ছে না, কিন্তু তারপরও তার কষ্ট হচ্ছে।
সে মায়ের হাত ধরলো।
মা খুব কষ্টে চোখ খুলে তাকে দেখলো আর পরক্ষণেই বন্ধ করে ফেললো।
কনর জানে, অন্তিম সময় উপস্থিত। এখনই হবে এটা। সে যাই ভাবুক বা করুক না কেন, এখনই সেটা হতে যাচ্ছে।
আর সে এটাও জানে, এসব এখন সে সহ্য করতে পারবে।
যন্ত্রণা হবে, ভীষণ যন্ত্রণা হবে, কিন্তু সে বাঁচতে পারবে।
এ কারণেই দানবটা এসেছে। কনরের তাকে প্রয়োজন ছিল, আর সেই কোনোভাবে তাকে ডেকেছে। এরপর সেটা জীবন্ত হয়ে এসেছে, কেবল এই মুহূর্তের জন্যে।
‘তুমি থাকবে?’ কনর দানবকে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘তুমি ততক্ষণ থাকবে যতক্ষণ–’
‘আমি থাকবো।’ দানব কনারের কাঁধে আবার হাত রাখলো, ‘তোমাকে এখন কেবল সত্যিটা বলতে হবে, আর কিছু না।’
এবার কনর তা-ই করলো।
অবশেষে সে সত্যিটা বললো।
‘আমি চাই না তুমি চলে যাও।’ তার চোখ থেকে বন্যার মতো অশ্রু ঝরছে।
‘আমি জানি, সোনামণি’ মা ভারী কণ্ঠে বললো, ‘আমি জানি।’
কেবল এটুকুই বলার ছিল তার।
এগিয়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো সে।
সে জানে সময়টা হয়ে গেছে, হয়তো ১২টা ৭ বেজে গেছে, যে মুহূর্তে মা তার হাত পিছলে চলে যাবে, চিরতরে।
‘কিন্তু এখনও সেই সময় হয়নি।’ দানবটা ফিসফিসিয়ে বললো, ‘এখনও সময় হয়নি।’
কনর মাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে রাখলো ।
আঁকড়ে ধরেই সে তাকে চলে যেতে দিলো।
Leave a Reply