আশার ছলনে ভুলি – মাইকেল-জীবনী – গোলাম মুরশিদ
আশার ছলনে ভুলি – মাইকেল-জীবনী – গোলাম মুরশিদ
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ১৯৯৫
তৃতীয় সংস্করণ: আগস্ট ২০০৬
উৎসর্গ
আমার পুত্র
(অন্তু) পাণিনি মুরশিদ
এবং
কন্যা
(অমিতা) বিপাশা গার্গী মুরশিদ
তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকা
১৯৮৬ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে আবিষ্কার করার যে-কাজ শুরু করেছিলাম কুড়ি বছর পরে বর্তমান সংস্করণের মাধ্যমে তা শেষ করতে পেরে স্বস্তি বোধ করছি। তবে এ সংস্করণে নতুন তথ্য সামান্যই যোগ করতে পেরেছি। কিন্তু যা বেশ ব্যাপকভাবে করতে পেরেছি, তা হলো: সংশোধন এবং পরিমার্জন। অনেক জায়গাই নতুন করে লিখেছি। তা ছাড়া, আগের সংস্করণে পাদটীকায় অনেক ভুল ছিলো। বর্তমান সংস্করণে পাদটীকা নির্ভুল এবং সম্পূর্ণ করতে পেরেছি বলে ধারণা করি। বংশ- লতিকায় কিছু নতুন তথ্য আছে। তা ছাড়া, অনেক ছবির মানও আগের তুলনায় উন্নত করা সম্ভব হয়েছে। গ্রন্থশেষে একটি বিস্তৃত গ্রন্থপঞ্জীও জুড়ে দিতে পেরেছি। এর ফলে বইটি আগের তুলনায় পূর্ণতা লাভ করেছে।
এর পরেও দুটি জায়গায় কিছু ফাঁক থেকে গেলো। রেবেকা টমসনের ধর্মপিতা ডুগান্ড ম্যাকট্যাভিশের সঠিক এবং পুরো পরিচয় এখনো পুরোপুরি উদ্ধার করা যায়নি। অবশ্য কবির জীবনের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। সুতরাং এ পরিচয় অনুদঘাটিত থাকলেও কিছু যায়-আসে না। তা ছাড়া, গুরুত্বপূর্ণ যা অজানা থেকে গেলো, তা হলো রেবেকার সঙ্গে কবির সম্পর্ক কখন এবং কিভাবে ছিন্ন হলো। আর, হেনরিয়েটার সঙ্গে কবির প্রণয়ের সম্পর্ক কিভাবে গড়ে উঠলো এবং তা শেষ পর্যন্ত পরিণয়ে পরিণত না-হলেও পরিণতি লাভ করলো। রেবেকা এবং হেনরিয়েটা উভয়ই এতো সাধারণ পরিবারের সন্তান ছিলেন যে, তাঁদের সম্পর্কে লিখিত কোনো সূত্র থেকে এ ধরনের তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
ড. রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত বিদ্যাসাগরকে লেখা মাইকেলের চিঠিগুলো দিয়ে এবং উইলিয়াম র্যাডিচি ও কিস্টন সীলি তাঁদের কয়েকটি মূল্যবান প্রবন্ধ দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন। ড র্যাডিচির সঙ্গে আলোচনা করেও উপকৃত হয়েছি।
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা
প্রথম সংস্করণের পর আরও অনেক নতুন তথ্য পেয়েছি। বিশেষ করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে লেখা মাইকেল মধুসূদন দত্তের ৩৫ খানা মূল চিঠি পেয়েছি ডক্টর রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের কাছ থেকে। এসব চিঠির প্রায় সবগুলো আগেই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু অনেকগুলো চিঠির পুরো পাঠ প্রকাশিত হয়নি। পুরো চিঠি থেকে অনেক অজানা তথ্য জানা যায়। যেমন, মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে টাকাপয়সার হিশেব এসব চিঠি থেকে বেশ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এ চিঠিগুলো ব্যবহার করতে দিয়ে ড দাশগুপ্ত আমাকে চিরঋণী করেছেন। এসপিজি এবং জেমস লঙের কাগজপত্র থেকেও নতুন তথ্য পেয়েছি। এই প্রসঙ্গে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা ইন্দ্রাণী চট্টোপাধ্যায়ের কাছে ক্ষমা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ক্ষমা এই জন্যে যে, আগের সংস্করণে তাঁর নাম উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। আর কৃতজ্ঞতা এই জন্যে তিনি গল্পচ্ছলে একদিন বলেছিলেন যে, রোডস লাইব্রেরিতে মাইকেলের একখানা চিঠি দেখেছেন। রোডস লাইব্রেরিতে মাইকেলের লেখা কোনো চিঠি না-থাকলেও সেখানেই বিশপস কলেজের কাগজপত্র দেখার সুযোগ পাই। এই কাগজপত্রের মাধ্যমেই বিশপস কলেজের আমলে কবির এ যাবৎ অজ্ঞাত জীবনের এবং খৃস্টধর্মের প্রতি তাঁর আন্তরিক আগ্রহের কথা জানা সম্ভব হয়েছে।
প্রথম সংস্করণের সঙ্গে বর্তমান সংস্করণের একটা বড় পার্থক্য এই যে, প্রথম সংস্করণে ইচ্ছে করেই কোনো পাদটীকা অথবা উল্লেখপঞ্জী রাখিনি। কিন্তু বর্তমান সংস্করণে পাদটীকা দেওয়া হয়েছে। পাদটীকা রাখবো না — গোড়া থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ায়, সব সময়ে দলিলপত্র অথবা বই থেকে তথ্যাদি টুকে আনার সময়ে পৃষ্ঠাসংখ্যা লিখে রাখিনি। এখন সেসব দলিলপত্র অথবা বই আবার খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে অল্প সংখ্যক পাদটীকা পূর্ণাঙ্গ হলো না।
দেশ পত্রিকায় এই রচনাটির শেষ কিস্তি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে এ বই-এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিলো। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ছাপার অসংখ্য ভুল, অনবধানতাজনিত ভাষার ত্রুটি, এবং কোনো কোনো জায়গায় পুনরাবৃত্তি থেকে গিয়েছিলো। এ জন্যে আন্তরিকভাবে লজ্জিত এবং দুঃখিত হয়েছি। প্রথম সংস্করণ যাঁরা কিনেছেন, তাঁদের কাছেও ক্ষমাপ্রার্থী। বর্তমান সংস্করণ প্রায় নির্ভুল হয়েছে। এই কাজে সাহায্য করেছেন বন্ধুর অধ্যাপক শফি আহমদ আর স্নেহভাজন ডক্টর স্বরোচিষ সরকার। দুজনকেই আন্তরিক ধন্যবাদ। এই লেখাটি দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর এ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি চিঠি এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো। তার মধ্যে বিশেষ করে স্বপন বসু এবং দীনেশচন্দ্র সিংহের চিঠি থেকে উপকৃত হয়েছি। তাঁদেরও ধন্যবাদ।
গোলাম মুরশিদ
নভেম্বর ১৯৯৬
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত মারা যান এক শো কুড়ি বছরেরও আগে। বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর অসাধারণ অবদান সত্ত্বেও তাঁর কোনো প্রামাণ্য জীবনী প্রকাশিত হয়নি। এ পর্যন্ত তাঁর যে-সব জীবনী প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তাঁর জীবনের কোনো কোনো অধ্যায় সম্পর্কে যথেষ্ট অথবা অভ্রান্ত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। এর কারণ, তাঁর সন্তান এবং বন্ধুরা তাঁর সম্পর্কে সামান্যই জানতেন। তা ছাড়া, তিনি জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সাড়ে বারো বছর বঙ্গদেশ থেকে অনেক দূরে বাস করেছিলেন। সে সময়কার তথ্য খুব কমই জানা ছিলো। কিন্তু তাঁর জীবনীর অনেক উপকরণ লন্ডনে থাকতে পারে –আট বছর আগে একথা বলেছিলেন অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়। তিনি তখন লন্ডনে একটি সেমিনারে অংশ নিতে এসেছিলেন। এর সপ্তাহ খানেক পরে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে গিয়ে প্রথম দিনই এমন কয়েকটি তথ্য খুঁজে পাই, যা কবির অন্য কোনো জীবনীতে লক্ষ্য করিনি। তারপর থেকে কতো যে উপকরণ পেযেছি এই অসাধারণ গ্রন্থাগারে — মধু-রসিক পাঠক এ বই পড়লে তা টের পাবেন। তবে খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভার্সাই-এর সরকারী এবং মিউনিসিপাল আর্কাইভস, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রেজ ইন লাইব্রেরি, ব্যর্মিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং এডিনবরার পাবলিক রেকর্ডস অফিসেও পেয়েছি। অধ্যাপক রায়ের কাছে আমার ঋণ অনেক।
দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হবার সময়ে এ লেখাটি পড়ে আমার শিক্ষক অধ্যাপক আহমদ শরীফ এবং অধ্যাপক আনিসুজ্জামান অনেক মূল্যবান মন্তব্য করেছেন। তাঁদের কাছে আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। মাইকেল মধুসূদনকে নিয়ে খুব মূল্যবান কাজ করেছেন ড. রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত এবং ড. সুরেশচন্দ্র মৈত্র। তাঁরা দেশ পত্রিকায় আমার লেখা দেখে উৎসাহ এবং পরামর্শ দিয়েছেন। বিদ্যাসাগরকে লেখা কবির কয়েকটি চিঠির পূর্ণতর পাঠ ড. দাশগুপ্তের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন ড. উইলিয়াম র্যাডিচি। এই চিঠিগুলো এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন ও সাহিত্য বিষয়ে তাঁর ডিফিল অভিসন্দর্ভ ব্যবহার করতে দিয়ে ড. র্যাডিচি আমাকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা করেও উপকৃত হয়েছি। বায়রনের চিঠির সঙ্গে মাইকেলের চিঠির অত্যাশ্চর্য মিলটি তিনিই লক্ষ্য করেছিলেন।
অধ্যাপক সনৎকুমার সাহা তিন দশক ধরে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। কিন্তু আমরা ক্বচিৎ একমত হই। অক্সফোর্ডে তিনি সম্প্রতি ন মাস ছিলেন। তাঁর সঙ্গে তর্ক করে চিন্তার অনেক খোরাক পেয়েছি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার লেখা পড়ে তিনি আমাকে অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। এ বই লেখার ব্যাপারে অন্য কারো কাছ থেকে এতোটা সাহায্য পাইনি। তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব এতোই আন্তরিক যে, ধন্যবাদ দিয়ে তাঁকে খাটো করতে চাইনে।
দেশ পত্রিকায় এ লেখাটি প্রকাশ করে শ্রীসাগরময় ঘোষ আমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন বললে কিছুই বলা হয় না। তিনি যেভাবে আমাকে নিরন্তর উৎসাহ দিয়েছেন, তা তুলনাহীন। একজন সম্পাদক একটা রচনার কতোটা সমাদর করতে পাবেন এবং লেখকের কাছ থেকে কিভাবে একটা রচনা বের করে নিতে পারেন, তিনি তার অত্যাশ্চর্য নিদর্শন। এ লেখাটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের ব্যাপারেও তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন। এ বই-এ প্রকাশিত কোনো কোনো চিত্রও তিনি সংগ্রহ করে দিয়েছেন।
বিভিন্ন সময়ে আমার লেখা থেকে যাঁদের পড়ে শুনিয়েছি তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ড. কেতকী কুশারী ডাইসন এবং আবদুল গাফফার চৌধুরী। তা ছাড়া ছিলেন বিবিসিতে আমার সহকর্মীরা। তাঁরা যে ধৈর্য ধরে শুনেছেন এবং নানাভাবে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, তার জন্যে তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ। একবার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর লেখাটি পড়ে অনেকে অযাচিতভাবে উৎসাহ এবং উপদেশ দিয়েছেন। এঁদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
লাইব্রেবি-কর্মীদের কাছ থেকে অসামান্য সহায়তা পেযেছি। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির কর্মীরা, বিশেষ করে গ্র্যাহ্যাম শ এবং শ্রীমতী দীপালি ঘোষ, গ্রেজ ইনের লাইব্রেরিয়ান মিসেস টেরিজা টম, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রোডস লাইব্রেরিব কর্মীরা, ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরির একজন কর্মী, ভার্সাই মিউনিসিপাল আর্কাইভসের কিউরেটর এবং ব্যর্মিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরল গ্রন্থ শাখার কর্মীরা নানাভাবে সাহায্য করেছেন। এঁদের সবার সহযোগিতা ছাড়া আমার পক্ষে এ কাজ শেষ করা অসম্ভব হতো। রেবেকার সঙ্গে কবিব বিয়ের দলিলের আলোকচিত্রটি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি বিনা মূল্যে সরবরাহ করায় লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের কাছে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
এলগিন স্কুলের সংগ্রহ থেকে একটি ছবি জোগাড় করে দিয়েছেন ড. ক্লিন্ট সীলি। কবির সমাধির আলোকচিত্রগুলো জোগাড় করে দিয়েছেন শ্রীবাদল বসু।
যখনই এই লেখাটির কোনো অংশ পড়ে শুনিয়েছি, তার প্রায় প্রতিটি আসরে আমার স্ত্রী এলিজা হাজির থেকেছেন। তা ছাড়া, তিনি আমাকে প্রুফ দেখার ব্যাপারে এবংনির্ঘণ্ট তৈরি করতে সাহায্য করেছেন।
গোলাম মুরশিদ
কিংসবেরি
লন্ডন
বড়ো দিন, ১৯৯৪
তথ্যনির্দেশ
মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটি পূর্ণাঙ্গ এবং প্রামাণ্য জীবনী লেখার জন্য যেসব উপকরণ দরকার, তার অনেকটাই চিরকালের জন্যে লুপ্ত হয়েছে। যেসব উপকরণ লুপ্ত হয়নি অথচ এ পর্যন্ত যার সন্ধান পাওয়া যায়নি, এখানে তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতে চেষ্টা করবো।
সবচেয়ে রহস্যাবৃত ছিলো তাঁর পরিবারের পরিচয় – তিনি যে-দুই মহিলার সঙ্গে জীবন কাটিয়েছিলেন এবং তাঁদের সন্তানাদির। রেবেকা টমসন ম্যাকট্যাভিশের সঙ্গে তাঁর বিয়ে এবং তাঁদের চার সন্তানের ব্যাপটিজম এবংসমাধিস্থ করার তথ্য ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে রক্ষিত এক্লেসিয়াস্টিক্যাল পেপারেব এন/২ সিরিজে আছে। তাঁর দুই কন্যা এবং পুত্রের প্রথম বিবাহের খবর আছে সিভিল ম্যারেজের নথিতে। এক কন্যা এবং পুত্রের দ্বিতীয় বিবাহ এবং সেই পুত্রের সন্তানদের তথ্য আছে এক্লেসিয়াস্টিক্যাল পেপারে। কিন্তু বিয়ের সময়ে রেবেকার বংশ-নাম বদল করা হয়েছিলো বলে তাঁর জন্ম-বৃত্তান্ত সরাসরি পাওযা যায় না। তাঁর নাম খুঁজতে হয় ম্যাকট্যাভিশের বদলে টমসনের অধীনে।
কলকাতায় মাইকেল এবং হেনরিয়েটার যে-দুটি সন্তান হয়েছিলো, সে খবর আছে এন/১ সিরিজে। তাঁদের তিন সন্তানের মৃত্যু এবং দুজনের বিয়ের তথ্য এবং উত্তর-পুরষের জন্ম, মৃত্যু এবং বিয়ের খবর এন/১ সিরিজে পাওয়া যায়। তবে ১৯৩৫ সালের পর থেকে দলিলপত্রে নামের সংখ্যা দ্রুত কমে এসেছে। সে জন্যে, এই সময়ের পর কবির বংশাবলীর হদিস করতে পারিনি (কবির জীবনী লেখার জন্যে তার কোনো দরকারও নেই)।
অসুবিধা দেখা দেয় হেনরিয়েটার পরিচয় নিয়ে। কবির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়নি। সুতরাং কলকাতা অথবা মাদ্রাস সিরিজের কাগজপত্র থেকে তাঁর কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। তাঁর পরিচয়-রহস্য উদ্ঘাটন করার জন্যে ভার্সাই-এর মিউনিসিপ্যাল আর্কাইভসের সাহায্য দরকার। সেখানে তাঁর যে-দুটি সন্তান হয়েছিলো, তাদের একজনের কন্যার — মৃত্যুর এবং অ্যালবার্ট নেপোলিয়নের জন্মের তথ্য এই আর্কাইভসে আছে। এই কন্যা সমাধিস্থ করার এবং জন্মসংক্রান্ত দলিলে বংশ-নামসহ হেনরিয়েটার পুরো নাম দেওয়া আছে। একবার সে নাম জানার পর মাদ্রাসের এক্লেসিয়াস্টিকাল পেপার থেকে তাঁর বাকি পরিচয় আবিষ্কার করা শক্ত হয় না। ভার্সাইতে কবি যে-বাড়িতে বাস করতেন তার খবর এবং সেই বাড়িতে একটি স্মৃতিফলক লাগানোর তথ্যও এই আর্কাইভসে আছে। এই বাড়ির যে-বাসিন্দারা দাতব্য তহবিল থেকে সাহায্য পেয়েছিলেন, তাঁদের খবর আছে ভার্সাই-এর সরকারী আর্কাইভসে।
রেবেকার পিতা বলে কথিত ডুগান্ড ম্যাকট্যাভিশের পরিচয় পাওয়া শক্ত। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে রক্ষিত সৈন্য বিভাগের নথিতে খুব সম্ভব তাঁর ছোটো ভাই কলিন ম্যাকট্যাভিশের পরিচিতি এবং এডিনবরার পাবলিক রেকর্ডস অফিসের এক্লেসিয়াসটিক্যাল রেকর্ডসে তাঁর নিজের পরিচিতি আছে।
হিন্দু কলেজ এবং মাইকেলের বৃত্তি ও পদক লাভের অনেক তথ্য সরকারী রিপোর্টে আছে। এজুকেশন কাউন্সিল অথবা ডিপিআই-এর বার্ষিক রিপোর্টেও অনেক তথ্য পাওয়া যায়। এজুকেশন কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত আলাদা করে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির বেঙ্গল প্রসিডিংসে পাওয়া যায়। তাঁর বিশপস কলেজে অধ্যয়ন সম্পর্কিত তথ্যাদি এ পর্যন্ত একেবারে অজ্ঞাত ছিলো। এই কলেজ থেকে লন্ডনের সোসাইটি ফর দ্য প্রোপ্যাগেশন অব গসপেলস (এসপিজি)-এ যে-সব কাগজপত্র পাঠানো হতো তার একটি বড়ো সংগ্রহ আছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রোডস লাইব্রেরিতে। এখানে মাইকেল সম্পর্কে তাঁর শিক্ষকদের কয়েকটি চিঠি, প্রতিবেদন এবং অন্য অনেক প্রাসঙ্গিক কাগজপত্রও আছে।
কবির সঙ্গে পাদ্রি জেমস লঙের বেশ যোগাযোগ হয়েছিলো। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরিতে পাঠিযেছিলেন তাঁর হাত দিয়ে। জেমস লঙের স্বাক্ষর করা এবং “With the complements of the author” বাণী সংবলিত এই কাব্যের কপিটি এখনো ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে আছে। তাঁর লেখা চিঠিপত্র এবং অন্যান্য কাগজপত্র আছে চার্চ মিশনারি সোসাইটির কাগজপত্রে। এখন তা রক্ষিত হয়েছে ব্যর্মিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কবি মাদ্রাস স্কুল এবং মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলামে কাজ করতেন। এই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর একটি করে ছাপানো রিপোর্ট প্রকাশিত হতো। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে ১৮৪৫ থেকে ১৮৫৪ পর্যন্ত অরফ্যান অ্যাইলামের এবং ১৮৪১ সাল থেকে মাদ্রাস বিশ্ববিদ্যালয় ওরফে মাদ্রাস স্কুলের রিপোর্ট আছে। মাদ্রাসের অ্যাকাউন্টেন্ট জেন্রেলের বেতনের নথি থেকে মাদ্রাস স্কুলের শিক্ষকদের সম্পর্কে (১৮৫৭ সালের) বাড়তি খবর পাওয়া যায়। মাদ্রাসের স্পেক্টেটর এবং অ্যাথেনিয়াম পত্রিকার প্রায় পুরো নথিও এই লাইব্রেরিতে আছে। সেকালের মাদ্রাসের অন্য অনেক খবর পাওয়া যায় ম্যাড্রাস অ্যালম্যানাক আর অ্যাসাইলাম অ্যালম্যানাক থেকে। এতে তখনকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক তথ্য আছে।
কলকাতা থেকে যে-অ্যালমানাকগুলো প্রকাশিত হতো, তা থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। কলকাতার আদালতগুলোর এবং তাতে কারা কাজ করতেন,তাঁদের বেতন কতো ছিলো, এমন কি, কলকাতায় বসবাসকারী ইংরেজ, ফিরিঙ্গি এবং বিশেষ নাম-করা দেশীয়দের ঠিকানাও কোনো কোনো পঞ্জিকা দেওয়া হয়েছে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত অনেকগুলো পত্রিকাবনথিও আছে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। এসবের মধ্যে আছে: ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া, ইংলিশম্যান, স্টেটসম্যান, বেঙ্গল হরকরা আর ক্রিশ্চিয়ান হের্যান্ড।
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে দেওয়ানি আদালত এবং আইন বিভাগের সিদ্ধান্তের একটি আলাদা সিরিজ আছে। তবে তাতে রাজনারায়ণ দত্তের নাম অনেক খোঁজ করেও পাইনি। মাইকেলের নামও নয়। ইংলিশম্যান এবং সমসাময়িক পত্রিকায় মাইকেলের ব্যারিস্টারি-জীবনের খণ্ড খণ্ড পরিচয় পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য মামলার সংক্ষিপ্ত খবর আইনসংক্রান্ত সাময়িকপত্রিকায় (সাপ্তাহিক, ত্রৈমাসিক এবং বার্ষিক) আছে। তবে তাতে এম এম ডাটের নাম খুব কমই উল্লিখিত হয়েছে। বেঙ্গল ল রিপোর্টে জ্ঞানেন্দ্রমোহনের দুটি মামলার সূত্রে তাঁর নাম উল্লিখিত হয়েছে।
গোলাম মুরশিদ
কিংসবেরি৭
লন্ডন
বড়ো দিন, ১৯৯৪
দেবল দেব
অত্যন্ত মূল্যবান এবং সংবেদী প্রশ্রমের ফসল এই বই। এতখানি শ্রম ও দরদ ঢেলে এরকম কাজ বাঙালী গবেষকদের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বইটা একনিঃশ্বাসে পড়েছি, দুদিনে দুবার। সব বাঙালী প্রজন্মের উচিত – এ-বইখানি ঘরে রেখে পড়বার, পড়াবার।