আলোগুলো জ্বালিয়ে দাও (মুক্তগদ্য কবিতাগ্রন্থ) – কোয়েল তালুকদার
প্রকাশকাল – ফেব্রুয়ারি’ ২০২৪ ইং
উৎসর্গ –
আমার দাদাজান ও দাদীমা কে।
যাদের আমি চোখে দেখিনি কিন্তু তাদের আশীর্বাদ আমার উপর আছে।
.
১. মাধুরী
মাধবী নামটির সাথে মাধুরী জড়ানো আছে। একদিন মাধবী বলেছিল, পৃথিবীতে দুটো জিনিসেই মাধুরী আছে-
এক. বাগদাদের ফুল, আর দ্বিতীয়- রাজস্থানের মীরা বাঈ-এর গান। আমি এর কোনোটাই নই। তাই আমার ভিতরে কোনো মাধুরী খুঁজো না।
২. অনুজ্জ্বল তারা
তোমার কখনও মনখারাপ হয় ? মনখারাপ খুব ভালো। কান্নাও ভালো। চোখের জল চোখ পরিস্কার করে। অশ্রু শুকিয়ে ফেলো না যেন।
আমাকে যেতে হবে এবার, একটি নির্জন বাবলাফুলতলা দিয়ে, ধনিদহ বিল পার হয়ে ফাঁকা মাঠের উপর বটতলা ছাড়িয়ে অনেক দূর…ওই যে নদীর ঘাট দেখছ, ওইখানে আমার জন্য ছোট একটি খেয়ানৌকা বাঁধা আছে।
তোমার মাথার উপর পড়বে অনন্ত আকাশের ছায়া।
আমি সেই আকাশেই থাকব একটি অনুজ্জ্বল তারা হয়ে। আর তুমি থাকবে জগতের যত আনন্দের ভিতর।
৩. একবার সাধ হয়
আর একবার জন্ম নিতে সাধ হয়।
স্কুল ফেরা পথে ধুধু প্রান্তরে সেই আমগাছটির জন্য । তার শীতল ছায়ার জন্য। গাব ফুল কুড়ানো আকুল করা ভোরের জন্য। বর্ষার পাট শুকানো গন্ধের দুপুরের জন্য।
জন্ম কী হবে আবার!
শুধু আর একবার…
৪. একা
আমি সবার হতে পারি, পূর্ণ সূর্যকিরণের মতো আলো ছড়িয়ে দিতে পারি । কিন্তু কেউ-ই আমার হতে পারে না। দিনশেষে এই আমি মৌন সন্ধ্যার মতো একা।
৫. শূন্যতা
কেউ কাছে চলে আসে কেউ দূরে চলে যায়। যে চলে যায় তার পায়ের চিহ্ন পড়ে থাকে। পাখি উড়ে চলে গেলে যেমন পড়ে থাকে দু’একটা পালক। আলনায় এলমেল হয়ে থাকে কিছু পরিধেয় কাপড় । রান্না ঘরে চুলার ধূয়া উড়তে থাকে কিছুক্ষণ, কথার প্রতিধ্বনিও মিলিয়ে যায়।
আর শূন্যতা? যে নতুন করে এলো — সেই ভরিয়ে দেয়।
৬. চেনা অচেনা
জীবনের দৃষ্টিপাত একজায়গায় কেন? কত গান আছে জীবনের। আরো কত স্পন্দন আছে হৃদয়ে এবং আত্মায়। সেসবও কিছু শুনতে হয়।
খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। মনে হয় সারাজীবন ছুঁয়ে থাকি। জীবনের পরেও।
এই পৃথিবীতে অনেক ভালো মানুষ আছে। তাদের চিনে নিতে হয়। তাদের ধরে রাখতে জানতে হয় যত্ন করে।
এই হাওয়ার রাতে কত হাসনাহেনার গন্ধ ভাসে। কত মনখারাপের কথা লুকিয়ে থাকে অন্ধকারে! কেউ কেউ গল্পের বই নিয়ে বিছানায় শোয়, আর কেউ কেউ জীবনের শেষ পাতা লিখতে বসে যত্ন করে….
৭. নিঃসঙ্গ আকাশ
কবিতার মধ্যে তুমি লুকিয়ে থাকো, সামনে আসতে পারো না দুরন্ত সাহস নিয়ে। ভাঙ্গতে পারো না, অচলায়তন, অবাধ্য হতে পারো না নিষিদ্ধ নিষেধাজ্ঞার। তোমার এলমেল চুল বাতাসে উড়ে, চোখ দুটো মেলে থাকে, তপ্ত দুপুরে পথিকহীন উড়োখুরো পথের ধুলোয়। যেখানে কোনও বসন্ত সন্ধ্যা বেলায় ভুল করে আমি কখনই হাঁটিনি।
আমাকে টানে মধ্যরাত্রির উতলা হাওয়া, নক্ষত্রহীন নিঃসঙ্গ আকাশ। আমি গাঢ় অন্ধকারের ভিতর তোমাকে খুঁজি। স্বপ্নহীন ঘুমে তখন তুমি ঘুমিয়ে থাকো। আমার কবিতার শব্দে তোমার ঘুম ভাঙ্গে না। কী উষ্ণতা চাও, আমার কবিতার কাছে। আমি সমর্পণের জন্য সারারত্রি জেগে থাকি।
শুধু তোমার জন্য আমি কবিতার কাছে দেউলিয়া হয়েছি। ভুল করে কবিতা নির্মাণ করেছি এক রাখাল বাঁশির উদাসীন দুপুরে। কবিতার সারা অঙ্গে পরিয়েছি অর্থহীন উপমা উৎপ্রেক্ষা। ক্ষরণ করেছি রক্ত কবিতার দেহে, তোমার আত্মায়। আমি যশ চাইনি। আমি কবি হতে চাইনি। আমি কবিতায় তোমাকে চেয়েছি।
এই গাঙে, এই জল ভূমিতে কত বান এল, বিবর্ণ এই গিরি উদ্যানে কত অগ্নুৎপাত হলো। শুধু তোমার জন্য আমি অথৈ জলে ভাসতে চেয়েছি, দহন দাহে আমাকে পুড়ে ছারখার করতে চেয়েছি। তবুও কিছু পাওয়া হলো না, না কবিতাকে, না তোমাকে।
৮. আমার মৃত্যু দ্রষ্টব্য
আমার দায়ভার যখন শেষ হবে, তখন অপেক্ষাই বা কেন করব? সেই উদ্দাম, আনন্দময় জীবন যদি আর নাই থাকে, অক্ষম আর বোঝা হয়ে থাকা এই সুন্দর পৃথিবীর কাছে গ্লানিকর। সব সু্ন্দর শেষ হবার সন্ধিক্ষণেই ঘরের জানালা দরজা সব খুলে রাখতে চাই। আত্মার প্রস্থানের সাথে মানুষের সকল দুঃখের নাকি পরিসমাপ্তি ঘটে। পৃথিবী থেকে চলে যাবার আনন্দটাই তখন অন্যরকম হয় ।
৯. পরিপাটি
তুমি সুন্দর করে ঘর দুয়ার গোছাও, ঝকঝকে রাখো ঘরের মেঝে। পরিপাটি রাখো আলনা। বারান্দায় ঝুল পড়েনা। আসবাবপত্রে জমে না ধূলো। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি না থাকলে তুমি এমনি করেই কি ঘরদুয়ার গোছাবে ? ফুলদানিতে সাজাবে ফুল ? কিংবা জ্বালাবে সন্ধ্যা বাতি ঠিক আগের মতো করেই ?
আঙ্গিনার ধূলোবালি মুছতে যেয়ে আমার পায়ের চিহ্নগুলিও একদিন মুছে ফেলবে। আমার জন্যে কে্ঁদে থাকা তোমার চোখের অশ্রুবি্ন্দুগুলিও একদিন শুকিয়ে যাবে, মুখে ভাসবে হয়তো তখন তোমার করুণ কোনো হাসি।
১০. এই জীবন
ঘর হতে বেরিয়ে আলোতে এসে দাঁড়াই। বাইরে এত আলোর ছ্বটা। ঝলমল করছে বৃক্ষরাজি, অ্ট্টালিকা, পশু, পাখী, পাহাড়, নদী, সাগর। মনে হচ্ছে এই আলো মেখে পরিপূর্ণ করি জীবন। আমাদের স্বপ্ন দেখা শেষ হয় নাই, জীবন পরিপূর্ণ হয় নাই। আমার সাথে তো একজন সাথী আছে, সে এখনও আমার হাত ধরে আছে। যে আলো আজ দেখছি সে আলোয় দু’জনে মিলে পথ চলে যেতে পারব অনেক দূর। জীবন কোথাও শেষ করতে চাই না। পথ চলাও না। এই জীবন, ‘এই পথ চলা যেন কোনো দিন শেষ না হয়।’
১১. নিকষিত হেম
সৃষ্টিকর্তা পরম যত্ন সহকারে আমাকে অতি ক্ষুদ্র সময়ের জন্য একটি জীবন দিয়েছে। সেই জীবনে তুমিই আমার একমাত্র সহচরী হলে। যার এলমেল চুলে মুখ লুকিয়ে নিঃশ্বাস নেই প্রাণ ভরে। যার বুকের পাঁজরে লেগে থাকে মহাকালের যত সুখ দুঃখ। আমি তার কাছ থেকেই চলে যেতে চাই জীবন নদীর ওপারে — তাকেই ভালো বাসতে বাসতে।
১২. কবিতার সাথে কথা
কখনও যদি নিজেকে খুব একা লাগে, যদি তোমার কাছে কেউ না থাকে, যদি নিঃসঙ্গতার ধূপ আগুনে পুড়তে থাকো সারাক্ষণ । তবে তুমি লেখার কাছে চলে যেও। তখন তুমি কবিতার সাথে কথা বলো , গল্পের সাথে গল্প করো।
১৩. খোঁজ
খুব ইচ্ছা করে আবার একদিন কুসুমপুরে যেতে। যেখানে সন্ধ্যা রাত্রিতে অলকানন্দার ঝোপে জ্বলে জোনাকির নীল আলো। আম্র মুকুলের গন্ধে আকুল হয়ে ওঠে প্রাঙ্গণ।
তারা ভরা আকাশের নীচে লুকাবে তুমি।
চোখ থেকে চোখে, বুক থেকে বুকে ভালোবাসায় খুঁজে নেবো তোমাকে।
১৪. ঝিনুকে মুক্তা খুঁজি
আজ বিকালে সান্তা মনিকা সাগর বেলায় গিয়েছিলাম। একাকীই গিয়েছিলাম। সাথে আর কেউ না। হুমায়ূন আহমেদ কোথায় যেন বলেছিল, সাগরে একা যেতে হয় না। দুজন যেতে হয়। আমি তো এখানে একা। আর কেউ নেই। যে আছে, সে তো প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারে। সেখানে তার কাছে বঙ্গোপসাগরও নেই। কাছেই বয়ে গেছে শীর্ণ তুরাগ নদী। সেখানেই হয়ত হাঁটছে সে এলমেল পা ফেলে বিষণ্নতায়।
প্রিয় তুমি, যেখান থেকে লিখছি, সেখান থেকে সমুদ্রকে খুব সুন্দর, খুব মিষ্টি ও আপন মনে হয়। কাছে গেলে অনুভব হয়, কত যে ভালোলাগা অতলান্ত জল জুড়ে। কাছাকাছি থাকলে উন্মোচিত হয় এর আসল সৌন্দর্য। দূর থেকে ‘নোনতা’ভাব বোঝা যায় না। জীবনের স্বাদও খানিকটা এমনই।
তোমার সঙ্গ পাওয়ার জন্য কত ঝিনুকে মুক্তা খুঁজেছি। তোমাকে দেখবার জন্য চেয়ে থেকেছি দূরের রূপালি ঢেউয়ের নীচে। লিখেছি নাম বালুকাবেলায়। স্বপ্ন বুঁনতে থাকা মন হয়ে উঠেছে দিশেহারা। কিন্তু তোমার দেখা মেলেনি কোথাও। অথচ তুমিই হৃদয়ে বাসা বেঁধে রেখেছ চিরকালের। অন্য আর চাওয়া-পাওয়া নেই। অন্য আর কেউ নেই। যেখানে আর কোনো কাঁটালতার ঝাড় বাসা বাঁধতে পারেনি
১৫. দেখা হয় নাই
জীবনের কত অফুরন্ত ভালোবাসা এখনও পাওয়া হয়নি, এখনও হাঁটা হয়নি হেমন্তের শিশির ভেজা দূর্বাঘাসের পথে, এখনও শোনা হয়নি কোজাগরী পূর্ণিমা রাতের গান, বোষ্টুমিদের কীর্তন। এখনও দেখা হয়নি চন্দ্রাহত কোনও প্রেয়সীর জীবনের সুখ দুঃখের আলেখ্য চিত্র ।
এই সব আকুলতাগুলো আছে দেখেই এখনও পৃথিবীর পথে পথে ঘুড়ে বেড়াই।
১৬. নীল নীল- নীল আকাশ
দিনের বেলায় অনেকটা অসময়ে ঘুমিয়ে যাই। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি ছেলেবেলার। সাবানের ফেনায় ফু্ঁ দিয়ে শত শত বেলুন উড়িয়ে দিচ্ছি আকাশের দিকে। উড়ে যাওয়া বেলুন দেখতে দেখতে — ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভেঙ্গে শুনতে পাই ঘরের কার্নিশে বসে একটি কাক কা-কা করে ডাকছে। ডাকটা কর্কশ মনে হলো না। ও তো পাখি। এটি ওর কথা। কান্নাও হতে পারে।
খোলা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাই। নীল মেঘে ঢাকা নীল আকাশ দেখতে পাই। আহা ! পাখি কিংবা মেঘ হয়ে যদি উড়ে যেতে পারতাম। মনে মনে ভাবি — আকাশের ঐ নীল মেঘ হয়ে থাকা অনেক ভালো ! নীল মেঘেই যেন জীবনের সৌন্দর্যগুলি লুকিয়ে আছে !
১৭. একটি অসম্পূর্ণ কবিতা
যখন এই পৃথিবীকে ভালো লাগছিল না আর, যখন চলে যেতে ইচ্ছা করছিল পৃথিবী ছেড়ে। ঠিক তখনই তোমার দেখা পেলাম। আর তখনই কী না আমার চলে যাবার সময় হলো।
আমি চলে গেলে পড়ে রইবে আমার ছায়া। তখন বাজাবে না বাঁশি,
গাইবে না কেউ কোনও গান নাগিনী সুরে ! তখন আমার স্বপ্নগুলো তুমি দেখে নিও তোমার স্বপ্নের ভিতর।
১৮. সুবাস ছড়িয়ে দাও
হিমালয় থেকে শৈত্য প্রবাহ আসছে। শীতের রৌদ্রে যতটুকু উত্তাপ পাও, তাই দিয়ে উষ্ণতা দাও। যদি কোথাও চন্দ্রমল্লিকা ফুটে থাকে, যদি কোনও চম্পাবকুল গন্ধ বিলিয়ে যায় — তাই দিয়ে দয়িতের দেহ মনে সুবাস ছড়িয়ে দাও।
দেখতে পাবে কেমন করে মাতাল হয় হিম বাতাস। কেমন করে উতলা হয় প্রাণসখার দেহ মন।
১৯. আলোর অপেক্ষায়
রাতের নির্জনতার মধ্যেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। এখনও সকাল হওয়ার বাকি। চোখ বন্ধ করে রাতের শব্দ শুনছি। চারিদিকের অন্ধকার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করছে, যেন গ্রাস করছে আমার সমস্ত সত্ত্বাকে। বুকের ওপর দুটো হাত রেখে চেষ্টা করি চোখ খুলতে, তখনই চোখ চলে যায় জানালার ওপারে আকাশের দিকে। একঝাঁক তারা সেখানে মিটমিট করে জ্বলছে। তারাদের আলোতে অন্ধকার কিছুটা কেটে আসে। এখন শুধু অপেক্ষা, এই রাত শেষ হওয়ার, অপেক্ষা করছি ভোরের আলোর জন্য!
২০. সাঁতার
আজ রুপালি সমুূ্দ্রে সাঁতার কাটলাম। ঝলাৎ ঝলাৎ ঢেউয়ের শব্দ। ভেঙ্গে পড়ছিল দুপাড়। এত ভাঙ্গন আর এত উথাল পাথাল ! সে এক অবিস্মরণীয় জলপতনের খেলা।
২১. পরিভ্রমণ
দুহাতে খু্ঁজেছিলাম পাহাড়ের চূড়া। ঠিক উঠতে উঠতে। আবার নামতে নামতে। দেখি মনিমুক্তা খচিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। একবার চূড়োয়। একবার তার পাদদেশে। একবার হিমাদ্রিতে। কী যে আনন্দময় পরিভ্রমণ ছিল !
২২. একাকীত্ব
যে ছেড়ে চলে যায়, সে জানে সে চলে যাবে। তাই সে প্রস্তুতি নেয় আগে থেকেই। তার ভিতর কোনও আক্ষেপ থাকে না। বিদায়কালীন সময়ে চোখ থেকে একবিন্দু জলও ঝরে না।
কিন্তু যাকে ছেড়ে গেল সেই জানে হঠাৎ এই শূন্যতার হাহাকার কী? সেই প্রাণপাত করে। সেই জলশূন্য নদীর মাছের মতো ছটফট করে….
২২. এসো মহুয়া বনে
ভৈরবী রাগের যে গানটি আমি লিখলাম, সেই গানে তোমার কথা লেখা আছে।
তোমার প্রাণে যে অনুরাগ
আমার গানে যে সুর,
তা আজ তোমার চরণধ্বনি হয়ে বাজছে।
এখন শুধু গানের মুহূর্ত। এখন শুধু গান শোনাবার কাল। এসো, শিশির তলে। এসো, মহুয়া বনে। গান শোনাব আজ।
২৩. ভালোবাসা
ভালোবাসার প্রথম পাঠ নিয়েছিলাম কোনও নদীর কাছে, খোলা আকাশের নীচে, মূর্তে-বিমূর্তে, গ্রীষ্মের প্রখর দীপ্তিতে, বর্ষার ধারায়, শীতের উষ্ণতায়, প্রাণখোলা বসন্তবাতাসে, শরতের ঔদার্যে, হেমন্তের পেলবতায়, সৌন্দর্যে আর বীভৎসতায়, উৎস আর মোহনায়, নগ্নতায় এবং আড়ালে, ধূসর সাম্রাজ্যে নিষিদ্ধ সেই সব শব্দগুলির সাথে তোমার নামটিই জড়িয়ে আছে।
২৪. বেলা শেষের কথা
জীবনের অনেক আশা মেটে নাই। অনেক চাওয়া পাওয়া মিটবেও না আর এ জীবনে। কত অতৃপ্তি রয়ে গেল। তারপরও ভালো লাগে জীবনকে। মায়া করি এই পৃথিবীকে। আক্ষেপ করি না তাই কোনো অপ্রাপ্তির। অনুশোচনাও নেই কোনো গ্লানির ।
কাল তুমি বললে — ‘কোনো ঐশ্বর্য নাই পেলাম। তোমার কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি, সেইটিকে যদি ঐশ্বর্য বা দৌলত মনে করি, তার পরিমান ও মূল্যও অনেক।’
আমাকে তুমি এই ভাবেই কৃতজ্ঞতায় বাঁধো —-
‘আমারে তুমি অশেষ করেছ,
এমনি লীলা তব–
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ
জীবন নব নব।।’
২৫. আমারই আনন্দ যত
বছরের শেষ কয়েকটি দিন খুব মন খারাপ করে কাটে। বেদনাহত হই এই ভেবে যে, একটি গাছ থেকে সবগুলো সবুজ পাতা ঝরে চৌচির হয়ে গেল। পিছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, একটা বছর নিতান্তই ক্ষণকাল ছিল। একটা একটা করে পাতা ঝরল, একটা একটা করে দিন চলে গেল। একটু একটু করে আয়ু ফুরিয়ে গেল। আহারে জীবন, কেমন ক্ষয়িষ্ণু তুমি!
দিন ফুরিয়ে যাওয়ার এই অবসাদ বেলায় কত কথা মনে জাগে, কত জোছনা বেলায় কত গানের কথা মনে পড়ে। কত বাউল, ভাটিয়ালি, টপ্পা, কীর্তনিয়া… এই জীবনে কোনো আশই মিটিল না।
জীবনতৃষ্ণা বড় বেশি করে তেষ্টা পায়। কত নদীর ঘাটে কত জল তুলতে ইচ্ছা করে!
সেই কবে মেঠো পথ দিয়ে স্কুল ফেরার পথে এক পাতার বাঁশিওয়ালার বাঁশি বাজানোর সুর আজও শুনতে পাই। কত গান ছিল আকাশে —
কত কথা ভেসে গেছে বাতাসে, কত অস্তবেলার সূর্য ডুবে গেছে অস্তাচলে।
২৬. অসমাপ্ত কথোপকথন
তখন ছিল শিশির ঝরার ক্ষণ। আযানের সুর ভেসে আসছিল। পাখিরা কলরোল তোলেনি তখনও।
শরীরের এক মায়াবী গন্ধ পাচ্ছিলাম তার। পাশ ফিরে পাঁজরে হাত রেখে বলেছিল–
‘ কোথাও নিয়ে যাবে আমাকে? সন্ধ্যায় তুরাগ নদীর তীরে ! লাল আভা ছড়ানো সূর্যাস্ত দেখতে ইচ্ছে করছে।
যদি কোথাও থেকে শীতল বাতাস আসে। যদি নিঃশেষিত অস্ত দিনের মর্মর ধ্বনি শুনতে পাই!’
বলেছিল —
‘ফেরার পথে রেলপুকুর পাড়ে গফুর মামার দোকান থেকে ফুসকা খাওয়ায়ে নিয়ে আসবে।’
সত্যি তো রাত নামবে সেখানে। নিশীথের আকাশ থেকে যদি দু-একটি তারা খসে পড়ে! যদি গল্পের তরে হয় জোনাকির আয়োজন!
২৭. অপূর্ণতা
সারাটা জীবন একটা ঘোরের মধ্যেই কাটিয়ে দিলাম। জীবন যেন একদিন আর এক রাত্রির সমান। দিন শেষে ঘুমালাম, ঘুম ভেঙ্গে দেখি– জীবনই শেষ। কতো স্বপ্ন ছিল, সে সব আর দেখা হলো না। সব স্বপ্নই কি এক রাত্রিতে দেখে শেষ করা যায় ? সব চাওয়া পাওয়া অপূর্ণই রয়ে গেল।
২৮. প্রতিক্ষা
প্রতিক্ষায় থাকি তুমি আসবে, তাই ঘরের দরজা খুলে রাখি। উঠানের কাছে এসে থেমে গেলে তুমি। মনে হলো পথ ভুল করেছ। না চিনেই চলে গেলে। তুমি না আসো।আমার দেহ এক সময় নীল হবে। নীল পাথরের দ্যূতি ছড়াবে তোমার ঘরের পথ পর্যন্ত । সে আলোয় তুমি পথ খু্ঁজে পাবে আমাকে খু্ঁজে পাবার। তখন এসে পাথরে লিখ তোমার নাম।
২৯. অপরাজিত
রোদ্রে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে হেঁটেছি দুজন পথে পথে। চলতে চলতে পথে ক্লান্তি আসেনি কখনও।
এই জীবনে ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্য যেমন পেয়েছি, আবার দুঃখ ও বঞ্চনাকেও ফিরিয়ে দেইনি। আমরা ভালোবাসা বিলিয়ে দিয়ে জিতেছি যেমন,
আবার হেরেছিও মানুষের ভালোবাসার কাছে।
৩০. আমাকে ফিরিয়ে নাও
ভালোবাসাহীন পৃথিবী দেখলেই মন অস্থির হয়ে ওঠে। কেমন যেন একাকী লাগে। মনে হয় দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে কেউ নেই। সামনে সুউচ্চ পাহাড়, না হয় কোনো উদ্দাম জলরাশি। সেখানেই নিজেকে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করতে চাই, তাকে বলতে চাই – তুমি আমাকে ফিরিয়ে নাও। আমার আত্মাকে তুমি গ্রহণ করো।
৩১. ভাবনা
যে আমাকে সারাক্ষণ ভাবে তাকে আমি একটুও ভাববো না, তাই কি হয়?
যে আমাকে এতখানি ভালোবাসে তাকে আমি একটুও ভালোবাসবো না, তাই কি হয়?
যে আমাকে এত করে মনে রাখে, তাকে আমি একটুও মনে রাখবো না, তাই কি হয়?
কেউ ভালোবাসা দিলে তার প্রতি এমনিতেই একধরনের মায়া এসে যায়। তুমি আমাকে ভালোবাসো– তাই তোমাকে আমি মায়া করি।
তাই তোমাকে আমি ভালোবাসি।
৩২. স্পন্দন যেন থেমে না যায়
চলে যেতে হবে এ কথা মনে হলেই কলম থেমে যায়, হাত পা অবশ হয়ে আসে। মন খারাপ শুরু হয়। মনে হয় তুমি থাকো পাশে। আমাকে শক্তি দাও, চেতনা দাও, প্রেরণা দাও। আমি লিখতে চাই। কবিতায় বলতে চাই- তোমাদের কথা। আমি বেঁচে থাকতে চাই, চলতে চাই পথ আরো অনেক দূর। জীবনের স্পন্দন এখনই যেন থেমে না যায়।
৩৩. জ্যোৎস্নার সুখদুঃখ
যেদিন জ্যোৎস্নার রাত থাকে সেদিন কোনো দুঃখ থাকে না আমার। তুমি জ্যোৎস্না থেকে আমার দুঃখগুলো তোমার দু’হাতের আজলায় ভরে তোমারই চোখে মুখে মেখে ফেলো কিন্তু আরেক অন্ধকার রাতে সব দুঃখগুলো এসে আমার হৃদয় বেদনায় পূর্ণ করে তোলে।
৩৪. পার্শ্ববর্তিনী
যখনই নিজেকে খুব একাকী মনে হয়েছে, তখনই প্রসন্নময়ী কেউ না কেউ নীরব পদধ্বনিতে এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। সে আর কেউ নয়, সে তুমি।
৩৫. পথের প্রান্তে
পলাতকেরা পথের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে এক পথিকের জন্য। চোখ আমার চেয়েই ছিল সারা বিকেল সুদূরের প্রান্তে। একদল বালক বাঁশি বাজিয়ে চলে গেল পাশ দিয়ে। সন্ধ্যা হলে পৃথিবী অন্ধকার হবে, না শিখা জ্বলে উঠবে? বুঝতে পারছিনা কিছুই। কাল ঘরে ফেরার পথে রেল লাইনের ধারে এক পাগলির অট্টহাসি শুনে এসেছিলাম। সেই থেকে মনটা কেমন যেন থেমে থেমে যাচ্ছিল বেহালার ছেঁড়া তারের মতো। জীবনের সবকিছুই এলমেল। সবকিছুই ছন্নছাড়া।
এত বোহেমিয়ান হলে চলবে কী করে এই বয়সে। যতই পথের উপর দাঁড়িয়ে কেউ অপেক্ষা করুক। আমার যখন সময় হবে চলে যাব, অন্ধকার থাক্ অথবা শিখা প্রজ্জ্বলিত থাকলেও।
৩৬. পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ
ঈশ্বরকে বলব — অনন্ত মহাকালের দু’একটি মুহূর্তের জন্য কেন আমাকে এখানে পাঠিয়েছে ? আমি মানুষের প্রেম ভালোবাসাকে ছাড়তে পারছি না। পারছি না আত্মজার মুখ মলিন করে দিয়ে কোথাও চলে যেতে। এখানে নদী আছে, নীল আকাশ আছে, পাখি আছে, দোলনচাঁপা আর চামেলী ফুলের সুবাস আছে। স্বর্গের প্রতি কোনো আসক্তি নেই। পৃথিবীর রূপ রস গন্ধের কাছেই আমি থেকে যেতে চাই।
৩৭. উপস্থিতি
এত নিঃশব্দ চরণে হেঁটে তোমার কাছে চলে আসি যে, তুমি মুখ না ফিরিয়েই বুঝতে পারো, আমি এসেছি। এত সন্তর্পণে তোমার পাশে থেকে উঠে চলে যাই যে, তুমি বুঝতে পারো, আমি চলে যাচ্ছি।
আমার শরীরের গন্ধ নাকি তোমাকে বলে দেয়, আমি আছি কী নেই।
৩৮. অভিনিত ভালোবাসা
বেশি করে ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে অনেক সময় অভিমান করি। অভিনয় করি। অনুযোগ করি। মুখ ঘুরিয়ে রাখি। আর তুমিও বুঝতে পারো আকাশে মেঘ হচ্ছে। বৃষ্টি নামবে। ছাতা খুঁজো তখন। ছাতাটি মাথার উপরে মেলে ধরার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠো।
হোক না হয় বৃষ্টি। ছাতা ধরো না। রাশি রাশি জল ঝরুক। এসো ভিজে নিই। ছুঁয়ে নিই। জড়িয়ে নিই। কাছে না এলে অভিমান আরো প্রগাঢ় হবে যে। আর তোমাকে হারিয়ে ফেললে নিজের উপর অনেক অভিমান হবে যে……
৩৯. অপার আনন্দধারায়
তুমি আমার কাছে এসেই ত্রস্ত হরিণীর মতো ছটফট করো, তাড়া করো চলে যাবার। দ্রৌপদীও এমন করে না দেবতার সাথে মিলন পর্বে। তোমার অম্লান দেহখানিি ধূসর ধূলায় মিশিয়ে দাও। আমি পেতে চাই সৃষ্টির সুখের উল্লাস। ভালোবাসার আকুলতায় কোনো কান্না রাখতে নেই। তুমি থেকে যাও এখানেই, আমার বাহু লগ্নে, এই অপার আনন্দধারায়।
৪০. প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি
একটুখানি চেয়ে দেখাতে সমগ্র পৃথিবীর মানচিত্রকে দেখে নেয়া যায়।
একটুখানি ছুঁয়ে দেখাতে কারোর সারা জীবনের প্রাণ স্পন্দন অনুভব করা যায়।
কিছু প্রাপ্তি আসে, জীবনের পরম পাওয়া হয়ে থাকে। কোনো আফসোস ব্যাতিত এই জগৎ জীবন থেকে চলে যাওয়া যায়।
৪১. জলস্রোতের কান্না
কেমন করে তোমাকে এত ভালোবাসি। কেমন করে তোমাকে বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখি। তুমি তো ভেসে যাবে কোনো নদীর মতো জলস্রোতে একদিন। কত কথা হয়েছিল, কত স্বপ্ন দেখা হয়েছিল আমাদের চার চোখ মিলে। সব কথা, সব স্বপ্ন দেখা কী শেষ হয়ে যাবে? তুমি চলে গেলেই কী ভালোবাসার মৃত্যু হবে? জানিনা মৃত্যু কী, জানিনা বিচ্ছেদ কী?
আমি কী তোমাকে, আমার দুঃখ বেদনাকে কুড়িয়ে এনেছিলাম কোনো মর্মরিত জীবনের উঠান থেকে বস্তুবৃক্ষের ঝরা ফুলের মতো।
৪২. আবার যদি…
যে জীবন চলে গেছে — সে জীবনে হারিয়েছি অনেককে। আহা! আবার যদি দেখা পেতাম তাদের কোনো শীষ ডাকা দোয়েল ভোরে, আমলকী ঝাড়ের পাশে কিংবা বসে আছে কেউ ছলাৎ ছলাৎ কোনো জলছবির নদীর কূলে….
৪৩. রহস্যময়তা
সবার জীবনেরই কিছু রহস্যময়তা আছে। আছে গোপন অলিন্দ। নিঝুম রাত্রি দুপুরে জোৎস্না এসে গায়ে লাগে সেই অলিন্দ দিয়ে। ঘুম ভেঙে গেলে বসে চেয়ে দেখে সে, বহু বছর আগের কোনো দীপ জ্বলা আলো। আবার অন্ধকারও কখনও তাকে গ্রাস করে।
না, এসব কোনো ভ্রান্তি নয়। এই সবই রহস্য। এই সবই দূর অতীতের কোনো মায়া।
৪৪. পথসঙ্গী
ঘরের দুয়ারে বসন্তের পদধ্বনি শুনতে পাই। যে বাতাস বইবে আসন্ন বসন্ত দিনে, তা কি আমার জীবনের পূর্ণতাকে ধুলো বালিতে ঢেকে দিবে ? আমার জীবন পূর্ণ হয়ে উপচে পড়ছে। তোমার কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি, তার শক্তি দিয়ে জীবনের বাকী পথ চলে যেতে পারব। আর যদি না পারি তুমি তো আছোই আমার পাশে।
৪৫. নতুন পৃথিবী
তুমি আমার জীবনকে জ্যোতির্ময় করেছো। সূর্য চন্দ্র গ্রহ তারা আলোকিত হয়েছে। এই ব্রহ্মাণ্ডের সব পাহাড় নদী সাগর, বন্দর লোকালয়- মহাপ্রলয়ে একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের দেহ আত্মা অবিনশ্বর থাকবে। আমাদের প্রেম ধ্বংসস্তুপের উপর জন্ম দেবে আর একটা গোলাপের। যে গোলাপ সৌরভ ছড়াবে নতুন আরেক পৃথিবীতে।
৪৬. সুপ্রভাত
জীবন কাটে না এ জীবনে আর, জীবন ভরেও না এক জীবনে। একি তৃষ্ণা আমার । একি ক্লান্তি নিয়ে বসে থাকি। অনেক কাছে থেকে দেখি অনেক দূরের আশার বিন্দু! আজ দক্ষিণের দুয়ার খোলা আছে। আসুক বাতাস আজ দক্ষিণ থেকেই।
সবাইকে সুপ্রভাত।
৪৭. ফিরে যেতে চাই
আমি শৈশবের কাছে চলে যেতে চাই। যেখানে কাশবনে হাসে শরতের রোদ্র। যমুনার পাড় ধরে হাঁটব, আর হাঁটতে থাকব যতক্ষণ না রমণীর এলো চুলের মতো সন্ধ্যা নেমে না আসে। চরে ফুটে থাকা কাশফুলের ঝাড়ে শুনব ঝিঁঝি পোকাদের গান। রাতের মধ্য প্রহরে খু্ঁজব দূর আকাশে লুব্ধক, স্বাতি, অরুন্ধতী, কালপুরুষ। বালিকার বেণী বাঁধা চুলের সুবাস নেব। আর দাদীমা’র আচঁলতলায় বসে শুনব পিতামহের পু্ঁথি পাঠ ।
৪৮. ক্ষণিকের অতিথি
চলার পথে মানুষের জীবনে কখনো কখনো হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো এমন কেউ এসে পড়ে— যা মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায়। কেউ কেউ সেই মানুষটিকে মনে রাখে আজীবন, যা হয়তো ওই মানুষটিও কোনোদিন জানতে পারে না। এ ধরনের অনুভূতি বা সম্পর্কের নাম কী? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় হয়তোবা এরা ‘ক্ষণিকের অতিথি’। কিন্তু ক্ষণিকের অতিথি হয়েও কেউ কেউ সারাজীবন জুড়ে থাকে। যেমন ‘বনলতা সেন’ সেই রকমই একজন অসাধারণ নারী।
কবি তাই লিখেছিলেন :
‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।’
সবার জীবনেই এরকম কেউ না কেউ ক্ষণিকের অতিথি আছে। বুকে হাত দিয়ে বলুন, অস্বীকার করতে পারবেন কি? বুকের তলায় খুঁজে দেখুন, এরকম অতিথি আপনার জীবনেও এসেছিল।
৪৯. বিদর্ভ নগরীর রাজপুত্র
একদিন সন্ধ্যা রাতে রুমের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ি। ভাবলাম অসময়ই একটা ঘুম দেব। কিন্তু ঘুম আর এল না। মনে হলো রুমটা যেন একটা বিদর্ভ নগরী। আমি যেন এর রাজপুত্র। বনলতা সেনের কথা খুব মনে হচ্ছিল। যদি সে আসতো রাজকুমারী হয়ে এই রাতে, যদি পাখির বাসার মতো চোখ তুলে দু’দণ্ড কথা বলতো ! সেই কবে ক্লাসে ডঃ মনিরুজ্জামান স্যার পড়িয়েছিলেন বনলতা সেন। স্যার হাসির স্থলে কৌতুক করে বলেছিল, এ এক রহস্যময়ী নারী। একে বুঝতে হলে এক জীবন লাগবে। স্যার তার এক জীবন শেষ করে পরপারে চলে গেছেন। আমারও এক জীবন শেষের দিকে। কিন্তু এই বনলতা সেনকে আজও বোঝা হলো না। যাকে বুঝতেই পারলাম না, তাকে পাব কি ভাবে !
৫০. নিরুদ্দেশ
আমি অনেক ঘুরেছি এই বাংলার পথে ঘাটে প্রান্তরে। কত বনবাদর, কত উপকূল, কত বালিয়ারির পথ হেঁটেছি। কত নদী, কত দীঘি, কত ঘাট দেখেছি, কিন্তু একটি ঘাটই আমাকে টানে — সে আমাদের যমুনার ঘাট। কোনো একদিন সন্ধ্যাবেলায় এই ঘাটে দাঁড়িয়েই দূরের সোনালি মেঘের আকাশে নিরুদ্দেশ হয়ে যাব। আর কখনই ফিরে আসব না এই পৃথিবীতে।
আমার ছেলেবেলায় ধানক্ষেতের আলপথ দিয়ে, ইছামতী নদী পেরিয়ে, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, কত দুপুর সন্ধ্যায় এই নদীর কূলে কাটিয়েছি। তখন ভেঁপু বাজিয়ে স্টিমার চলত। গয়না নৌকাগুলো সারি করে চলে যেত, দূরের কোনও বন্দরে।
মনে হয় যেন, আমি আজও দূরাগত স্টিমারের ভেঁপুর শব্দ শুনতে পাই। আরো শুনতে পাই, যমুনার জলের ছলাৎ ছল শব্দ। বালুরচরে কাশবনের কাশফুল গুলো হেমন্ত হাওয়া লেগে দুলে উঠতে দেখি। আর দেখি — সন্ধ্যার সোনালি মেঘের আকাশ। আর ঐ মেঘের আকাশেই যে অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছা করে।
৫১. হেমন্ত
হেমন্তের শীত এখনও জেঁকে আসেনি পৌষের শীতের মতো। সন্ধ্যা রাতের আঁধারও তেমন প্রগাঢ় হয়নি। বিকাল থেকে পাঁজরের নীচে তীব্র ব্যথাটি ওর ছিলনা। তবুও হাত ধরে উঠোনে নিয়ে যেয়ে নারিকেল গাছ তলায় কাঠের চেয়ারে যেয়ে দুজন বসি। আঙ্গিনায় নিয়ন বাতি জ্বালানো ছিলনা। নির্লিপ্ত চোখে আকাশ দেখছিলাম। দেখি, কোথাও চাঁদ নেই।
রাত্রির নিভৃত আকাশও চেয়ে দেখছিল যেন আমাদের। কোনও কথা নেই। কেমন নির্জন নিরবতা। খুব বলতে ইচ্ছা করেছিল ওকে। কোনও মিনতি করেও নয়। এমনি কপালে কপাল রেখে —
‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ তেমনি করে গাও গো। আজ যেমন করে চাইছে আকাশ তেমনি করে চাও গো।’
৫২. আত্ম প্রকৃতি
আমি সবসময় উদাসীন প্রকৃতির একজন মানুষ। নিজেকে কখনো যাযাবর, কখনো স্বার্থপর, কখনো ক্রুর, কখনো পলাতক মনে হয়। আমি চিনতে পারিনা নিজেকে। কে ভালবাসে,কে বাসেনা। তাও জানিনা । জীবন কোথা থেকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। কেমন তার পথচলা, কেমন তার প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, সে হিসাবও কখনো করি নাই ।
যমুনার চরে উথাল পাথাল ঢেউ খায় কাশবনের ঝাড়ে। কেমন তার জীবনকথা, কেমন তার দিন লিপি। কেউ প্রাণ খুলে কখনো তা জানতে চায়নি।
৫৩. ক্লান্তি
তুমি উঠতে বসতে শুইতে আমার খুঁত ধর। নানান খুঁত ধরে তুমি চলে যেতে চাও। কিন্তু একসময় কী নিখুঁত ভাবে তুমি আমার হাতটি ধরেছিলে।
তখন বলতে কী সুন্দর সন্ধ্যা তারা! কী ঝলমল ময়ুরাক্ষী বৃষ্টির ফোঁটা, কী অপূর্ব দেখতে ঘাসফড়িং, কী মায়াবী এই হেমন্ত রাত।
এখন স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নের মনে কর। তারার আকাশে তারা খুঁজে পাও না। হাওয়ার রাতে শব্দ শুনতে পাও না। সোনালি রোদ্দুরে পথে বের হও না। গান গাও না। গল্প শোনাও না।
যে চোখ দেখত পরম বিস্ময়ে! সে চোখে আর কোনো মায়া নেই, জল নেই, ঘুম নেই। যে বুক টেনে নিত স্মিত আলিঙ্গনে, সে বুকে এখন ক্লান্তি। শান্তি নেই। আদর নেই। কাছে টানতে অনিহা। কেমন অবহেলা। অনাদর ছুঁয়ে আছে……….
৫৪. চাওয়া পাওয়া
কখন যে চাওয়া আর পাওয়ার মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। বুঝতে পারি না। কেউ না চেয়ে পায়। কেউ চেয়েও পায় না। আবার কেউ আছে কোনো দিন কিছু চায় না।
যারা জীবনে কারো কাছে কিছু চায় না, তাদের জন্যই মমত্ববোধটা বেশি হয়। তাদেরকে নিজে থেকে কিছু দেওয়ারও দায় হয়ে যায়। আর এই কিছু দেওয়াটা যদি কোনো অবহেলায় না দেওয়া হয়, তখনই নিজের প্রতি অপরাধবোধটি চলে আসে।
আমি কোনো অলক্ষ্যে এমনই কোনো অপরাধ করছি না তো? বুঝতে পারছি না। কিংবা আমি জ্ঞাত হয়ে কাউকে এমন বঞ্চনা কি করতে পারি?
‘আকাশের তারায় তারায় বিধাতার যে হাসিটি জ্বলে
ক্ষণজীবী জোনাকি এনেছে সেই হাসি এ ধরণীতলে। ‘
নজরুলের সেই গানের কথা —
‘পথে পথে ঝুরিতে
নগ্ন দিনের আলোকেতে
চাহি না তোমায় ব’ক্ষে পেতে
তুমি ঘুমের মাঝে স্বপনেতে
হৃদয়-দুয়ার খুলিও।’
৫৫. প্রাপ্তি
প্রত্যন্ত ভোরবেলা আদর শেষে সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আর জেগে উঠে দেখবে আমার নিশ্চিন্ত মুখ। দূর থেকে ভেসে আসবে রাগ-ভৈরবীর সুর, শিউলির গন্ধ।
এই মূহুর্তটাই তার পরম পাওয়া। এমন নিশ্চিন্ত মুখ দেখা জীবনের সেরা প্রাপ্তি। তাই তার আর কোনো গ্লানি নেই। কোনো আক্ষেপ নেই। আর কোনো চাওয়া পাওয়া নেই।
কেউ কেউ সুখ মূল্যবান ধনদৌলত প্রাপ্তির মধ্যে অনুভব করে। কেউ কেউ জীবনের সাধারণ কোনো অনুভবের মাঝেও খুঁজে পায় ।
৫৬. আক্ষেপ
অনেক আগে একটি ছোট্ট নীল প্রজাপতিকে ধরতে যেয়ে সে উড়ে চলে গিয়েছিল। তারপর কত মহুয়া বনে তাকে খুঁজেছি। কিন্তু দেখা পাইনি। এই সামান্য বিষাদটুকু নিয়ে কোনও কবিতার চরণ হয় না। তারপরও কয়েকটি শব্দে লিখে রাখলাম, ছোট্ট সেই আক্ষেপের কথা।
৫৭. উথলে নয়ন বারি
_ আমি নিরুদ্দেশ হয়ে চলে গেলে কী হবে?
_ দূর থেকেও তো ভালবাসা যায়।
_ অন্ধকার রাতে যাব না। চাঁদের রাতে যাব।
_ ট্রেনে উঠে বসব। ট্রেন চলতে থাকবে।
_ চলতে চলতে কোনো সন্ন্যাসীর আখরা পড়বে।
_ গেরুয়া পোশাক সব।
_ জায়গাটা অমরাবতী হতে পারে।
_ মানস সরোবরের নাম শুনেছ?
_ পাহাড় না। পর্বতমালা।
_ পর্বতগুহায় রাত কাটাব।
_ মাথার উপরে মাটি। নাকি পাথর।
_ সন্ন্যাসীদের কীর্তন শুনব।
_ মাজার কিংবা ফকিরের আখরায়ও যেতে পারি।
_ কাওয়ালি শুনব। তালে তালে মাথা নাড়ব।
_ তোমার কথা মনে পড়বে।
_ কী বিশ্বাস হয়না?
_ আচ্ছা, মরে পড়ে থাকলে কেউ বুঝবে কেমনে। আমি কোন্ ধর্মের?
_ কী আমি যে বলছি বিশ্বাস হয়না?
_ যখন ঘুমে থাকবে, তখন যাব।
_ একটা অভিজ্ঞান ফেলে রেখে চলে যাব।
_ তখন বিশ্বাস হবে।
_ তুমি বুঝতেও পারবে না শেষ চুম্বনটি কখন, কোনটি হবে।
উপরের এই একক কথাগুলো সে শুধু শুনছিল। দেখলাম — তার হৃদয়ের এ কুল ও কুল দু কুল ভেসে গিয়েছে। উথলে উঠেছে নয়ন বারি।
৫৮. অশেষ করেছ
হঠাৎ করেই শরীর কেঁপে জ্বর আসে। দুই দিন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। কী বোর্ডে আঙ্গুল চালানও সম্ভব হয়নি। কাউকে কিছুু বলিনি। কেমন যেন লাগত। মনে হতো, সৃষ্টিকর্তা বুঝি আমাকে নিয়ে যাবে।
নাহ্ নিয়ে যায়নি।
তার সুশ্রষাগুলো নব প্রাণ দিল। ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব–. ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।’
৫৯. প্রেমময়ী তুমি
হঠাৎই খুব মন খারাপ লাগলে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি। এমনি মনখারাপ নিয়ে শুয়ে থেকেছিলাম আজকেও। কত হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মুখচ্ছবি চোখের সামনে এসে ভাসতে থাকে। কেমন যেন বিপন্ন লাগছিল নিজেকে। পাশে টেবিলের উপরে রাখা ধর্মগ্রন্থটি এনে পড়তে থাকি। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাই।
কার যেন পায়ের মৃদু শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায়। চেয়ে দেখি — চিরদিনের প্রসন্ন মুখের সেই তুমি। বুকের উপর রাখা ধর্মগ্রন্থটি সযত্নে টেবিলের উপর রেখে তোমাকে বুকে টেনে নেই। কী শান্তি! কী অনন্ত প্রেমময়ী তুমি! আমার সকল মন খারাপ দূর হয়ে গেল।
৬০. আলোগুলো জ্বালিয়ে দাও
ধরুন আপনি মৃত্যু শয্যায় শুয়ে আছেন। আপনার শেষ বাক্যটি কি হতে পারে? কিংবা আপনি কি বলতে চান? আমি যে কথাটি বলব বা ঐসময় উচ্চারিত হবে আমি কি তখন তা বুঝতে পারব- সেইটি আমার শেষ বাক্য? আমি যতোটুকু জানি , মানুষ সেই সময়ে জীবনেও থাকে না, মরণেও থাকে না। সে এক বিষাদময় সন্ধিক্ষণ! আসলে কিছু কি বলতে পারব তখন? কিংবা তারও কিছু আগে? হয়ত শেষ কথাটি হবে — ‘আলোগুলো এক এক করে নিভে যাচ্ছে কেন? সব আলো জ্বালিয়ে দাও। ‘
হয়ত কোনো কথাই বলা হবেনা। তার চেয়ে বরং সেই সময়ে কেউ যেন আমার চোখের সামনে আমার মায়ের একখানা ছবি মেলে ধরে। সেই ছবিটি দেখতে দেখতেই আমার দুই চোখ যেন বন্ধ হয়ে যায়।
Leave a Reply