আলীবর্দী ও তার সময় – কালিকিঙ্কর দত্ত
আলীবর্দী ও তার সময় – কালিকিঙ্কর দত্ত – বইটির তথ্যসূত্র ও পরিশিষ্ট অংশ যোগ করার মত সময় ও ধৈর্য্য ছিল না। দুঃখিত।
বাংলা অনুবাদ – আল মারুফ রাসেল
প্রচ্ছদ – ধ্রুব এষ
মূল লেখকের উৎসর্গ
বাবাকে
রূপান্তরকারীর উৎসর্গ
অভয়া অপ্তি, একদিন বড় হয়ে ইতিহাস খুঁজে বেড়াবে
.
অনুবাদকের কৈফিয়ত
আলীবর্দী। বাংলার ইতিহাসের নায়ক, আবার খলনায়কও। তার ক্ষমতা দখল করার প্রক্রিয়া নিয়ে যেমন প্রশ্ন ওঠে, একই সঙ্গে রুস্তম জং, মারাঠা বা বিদ্রোহী আফগানদের সঙ্গে অসম লড়াইয়ে তার রণকৌশল আর প্রশাসনিক দক্ষতার প্রশংসা না করে পারাও যায় না। মুঘল অভিজাত হওয়ার কারণে প্রথম জীবনে বেশ ভালোভাবেই কর্মজীবনের শুরু করতে পেরেছিলেন। কারণ দাদা ছিলেন আওরঙ্গজিবের বৈমাত্রেয় ভাই। তাই পিলখানার (হাতিশালা) দায়িত্ব বা জার্দোজখানার (জরিদার বস্ত্রের গুদাম) তত্ত্বাবধানের কাজ পেতে খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি। মির্জা মুহাম্মাদ আলীর সংগ্রামের জীবন শুরু হয় ১৭০৭ সালে, সিংহাসনের জন্য আওরঙ্গজিবের দুই ছেলে শাহ আলম আর আযম শাহের মধ্যে লড়াইয়ের পর থেকে। তার পৃষ্ঠপোষক আযম শাহ আগ্রার কাছে জাজুর যুদ্ধে পরাজিত আর নিহত হন তার তিন সন্তানসহ। ফলে বেশ কিছুকাল তিনি কর্মহীন থাকেন। ১৭২০ সালের দিকে তিনি বাংলায় আসেন। বাংলায় তাকে অনাহূত ভেবেছিলেন মুর্শিদ কুলি খান। ফলে বিশেষ সুবিধে করতে না পেরে তার পরবর্তী গন্তব্য হয় কটক। উড়িষ্যায় বিদ্রোহীদের দমন আর প্রশাসনিক কাজে বিশ্বস্ততায় মির্জা মুহাম্মাদ আলী, মুর্শিদ কুলি খানের জামাতা ও পরবর্তী নবাব সুজাউদ্দিনের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। একটা সময়ে তিনি আর তার ভাই হয়ে ওঠেন নবাবের মূল মন্ত্রণাদাতা। ১৭২৭ সালের ৩০ জুন, শ্বশুরের মৃত্যুর পর তিনি বাংলার মসনদে বসেন এই দুই ভাইয়ের চেষ্টাতেই। পরের বছর পুরস্কার হিসেবে আকবরনগর চাকলার ফৌজদারির সঙ্গে আলীবর্দী উপাধি দেওয়া হয় তাকে। এভাবে এরপর বিহারের প্রশাসক হওয়া, পাঁচহাজার মসনবদারি হওয়ার মতো ঘটনাগুলো স্বাভাবিকভাবেই ঘটতে শুরু করে কাজের পুরস্কার হিসেবে। ১৭৩৯ সালে সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর সুজাউদ্দিনের অনুগত এই আলীবর্দীই হয়ে ওঠেন বাংলার মসনদ দখলের মূল ষড়যন্ত্রকারী। পারস্যের সম্রাট নাদির শাহের দিল্লি লুটও অবশ্য পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে আলীবর্দী ও তার ভাই হাজী আহমাদের এই পরিকল্পনায়। ১৭৪০ সালের ১০ এপ্রিল বিশ্বাসঘাতকতার এক লড়াইয়ে পরাজিত হন সুজাউদ্দিনের ছেলে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব সারফারাজ খান। আর তার জায়গায় মুর্শিদাবাদের কালোরঙা পাথরের মসনদে বসেন আলীবর্দী। যার মাধ্যমে তার এত সমৃদ্ধি, তার সন্তানকেই এভাবে বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে হত্যা করা কতটা সমীচীন, পবিত্র কুরআন ছুঁয়ে আগের দিন নবাবের নিরাপত্তার শপথ নিয়ে তা ভঙ্গ করা কতটা বিবেকসম্পন্ন কাজ—তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়, আর সে-কারণেই ইতিহাসের ধারাভাষ্যকার কালীকিঙ্কর দত্ত প্রশ্ন তুলেছেন। আর এই ঘটনার ১৭ বছর পর পলাশীর যুদ্ধে মীর জাফর ও সিরাজ-উদ-দৌলার মধ্যে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিকে ইতিহাসের বিচার বলেই মত দিয়েছেন। তবে এখানে বলে রাখা ভালো, আমরা যে-সময়ের কথা বলছি, সে-সময়টা বাবার সঙ্গে ছেলের, ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের লড়াই। ব্যতিক্রম যে একেবারেই ছিল না তা নয়, ইতিহাস কিন্তু আমাদের বৈরাম খানের জীবনের পাঠও দেয়, যে কিনা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আকবরকেই সবসময় তুলে ধরেছেন। এই বইয়ে লেখক একটু বেশিই তৎপর ছিলেন ইতিহাসের মধ্যে নীতিগত আদর্শ খোঁজার ব্যাপারে। ফলে ১৭৪০ সালের বাংলার বিদ্রোহের পরিণতি তিনি দেখেছেন ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের ফলাফলে। সেই সময়ের বিচারে হয়তো আলীবর্দীকে বড়জোর সুযোগসন্ধানী বলা যেতে পারে। অতীতের অনেক কার্যকলাপ ভালো না ঠেকলেও, হয়তো তখনকার সময়ে এটাই টিকে থাকার টোটকা ছিল। তাই বর্তমানের নীতি- নৈতিকতার ছাঁচে সে সময়কে বিচার না-করাটাই হয়তো ভালো হবে।
কালীকিঙ্কর দত্তের এই বই নিঃসন্দেহে তাঁর সেরা কাজগুলোর একটি। আরবি, ফার্সি, ফরাসি, ইংরেজি, বাংলা ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন রকমের তথ্যসূত্র দিয়ে পরিপূর্ণ। অষ্টাদশ শতকের বাংলা কাব্যগুলোকে ইতিহাসের আতশিকাচের নিচে ফেলে সম্ভবত এটাই প্রথম কাজ। বাংলা কাব্যগুলো আফগান ও মারাঠা বিদ্রোহ, সে-সময়কার বাংলার আর্থ-সামাজিক জীবন, ধর্মীয় জীবন, জীবনযাত্রার মানের পরিচায়ক হিসেবে এই বইয়ে উঠে এসেছে। লেখক মোটামুটিভাবে আলীবর্দীর সিংহাসনে আসার আগেকার প্রেক্ষাপট, আর তার মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় সিকি যুগের ইতিহাস বলে গেছেন সহজবোধ্যভাবে। তার লেখনী থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায় যে, বাংলা সে-সময় কতটা সবল ছিল বা দুর্বল ছিল। আর মারাঠা বা বর্গি আক্রমণে বাংলা কতটা বিধ্বস্ত হয়েছিল, আফগান বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট ও পরিণাম – তার সবই উঠে এসেছে।
বইয়ে লেখক কিছু ব্যাপার অতিসরলীকরণ করে ফেলেছেন, যার কিছু আবার পুরো বইয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মূল লেখক কয়েকবার পারস্য আর তুরানের থেকে আসা ভাগ্যান্বেষীদের দায়ী করেছেন মুঘল সাম্রাজ্যে বিভাজনের কারণ হিসেবে। শুরুতে এ-ধরনের বক্তব্য কয়েকজনের কাছে আকর্ষণীয় মনে হলেও বইয়ের ভেতরে কোথাও এর ব্যাখ্যা নেই, আর ইতিহাস এ-ধরনের বক্তব্যকে শতভাগ সমর্থনও দেয় না। দিল্লির প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে বা বাংলার প্রশাসক হিসেবে আলীবর্দীর যোগ্যতা প্রশ্নাতীত, হয়তো সারফারাজের থেকেও যোগ্যতর ছিলেন। কিন্তু সারফারাজ খুব বেশি সময় পাননি মসনদে, তাই দুজনের মধ্যকার তুলনা অর্বাচীনের কাজ হবে। লেখক বলেছেন ১৬১১ সাল থেকে অর্থাৎ জাহাঙ্গীরের সময় থেকে মুঘলদের অধীনে বিভিন্ন পদে ইরানি আর মধ্য বা পশ্চিম এশিয়ার লোকেরা রাজপুতদের স্থলাভিষিক্ত হতে শুরু করে, যেটা মসনবদারের সংখ্যা আর ঐতিহাসিক তথ্য সমর্থন তো করেই না বরং উল্টোটার দিকেই পাল্লাটা ভারী হয়।
বইয়ের অনুবাদ করতে গিয়ে মুযাফফারনামাহ, সিয়ার-উল-মুতাখখারিন, রিয়াজ-উস-সালাতিন তিনটি বইয়েরই সুলভ সবধরনের সংস্করণের সাহায্য নেওয়া হয়েছে মূলত বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদের। বলা বাহুল্য ফার্সি, বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদের বেশ কয়েকটি সংস্করণ রয়েছে। আর ভিন্ন ভিন্ন পাণ্ডুলিপি থেকে অনূদিত হওয়ার কারণে সেগুলোর বেশকিছু তারতম্য সহজেই চোখে পড়ে। প্রথমে সেগুলোর তুলনামূলক আলোচনা করার ইচ্ছে থাকলেও পরে সেটার আয়তন এতই বেশি হয়ে পড়ছিল যে সেটা দিয়ে আরেকটি ঢাউস আকারের বই বের করা সম্ভব। তাই এখানে মূল লেখকের উদ্ধৃত সংস্করণটির আলোচনাই রাখা হয়েছে কেবল, পাদটীকায়। বাংলা কাব্যগুলোর পাদটীকাগুলো অনুসরণ করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে বেশকিছু জায়গায় সংখ্যার মাধ্যমে ভুল-পঙ্ক্তিকে নির্দেশ করা হয়েছে, সে-কারণে সংখ্যা দিয়ে পক্তিগুলো নির্দেশ করার পরিবর্তে সরাসরি পঙ্ক্তিগুলো উল্লেখ করে দিয়েছি। কারণ পুরনো কাব্যগুলো বেশ দুষ্প্রাপ্য, আর উৎসাহী পাঠকদের কষ্ট করে সেই বইগুলো খুঁজে বের করতে হবে না। অবশ্য তিন-চারটি স্থানে আমার সংগ্রহে থাকা মূল বইয়ের পৃষ্ঠা না-থাকায় (বহু পুরনো, উইপোকায় কাটা বই সংগ্রহ করেছিলাম নীলক্ষেত থেকে) উল্লেখ করতে পারিনি, আর করোনার এই ক্রান্তিকালে কোনো পাঠাগার থেকে সাহায্যও নেওয়া সম্ভব হয়নি—সেই আক্ষেপটা রয়েই গেল। তবে আশা করি, যদি পরবর্তী মুদ্রণ হয় (পাঠকদের কল্যাণে!) তবে সেগুলো ঠিকঠাক করে দেওয়া হবে।
এই বইয়ের অনুবাদ করতে গিয়ে আরো নানা বইয়ের সাহায্য নিতে হয়েছে আমাকে। ইতিহাসের পাঠক হিসেবে একটা ব্যাপার বেশ ভালো বুঝি, যে ব্যাপারটা নিজে বুঝি না সেটা অন্যকে বোঝানোর কোনো অধিকার আমার নেই। এরকমই একটা ব্যাপার ছিল এই বইয়ে উল্লেখ করা সুপ-নৌকা। এই ধরনের নৌকাগুলোর ব্যবহার এখন দুই বাংলার আর কোথাও হয় না। ফলে সাহায্য নিতে হয়েছে ভারতের বিখ্যাত নৌকা-গবেষক স্বরূপ ভট্টাচার্যের। তিনি বরাবরই স্নেহপ্রবণ আমার প্রতি। তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। বেশ কয়েকবার বিরক্ত করেছি ভারতের বিখ্যাত ইতিহাসলেখক বিশ্বেন্দু নন্দকে। আর যেখানেই আটকে গেছি, বা মনে হয়েছে কথা বলা দরকার কোনো বিষয়ের দ্বিধা দূর করতে – ঢাকার ইতিহাসে মগ্ন গবেষক রিদওয়ান আক্রাম আর ভারতীয় ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো পর্যটক রেজওয়ান পরাগ ও পর্যটক-লেখক মাহবুবুর নূর সবসময়েই কান পেতে দিয়েছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপচারিতা চালিয়ে মতামত দিয়েছেন। কেবল কৃতজ্ঞতা দিয়ে কেটে পড়ার ধৃষ্টতা দেখানো রীতিমতো অপরাধ হবে।
মূল বইয়ে উল্লেখ করা কিছু ছবির সঙ্গে নিজের সংগ্রহে থাকা কিছু ছবি জুড়ে দিয়েছি। ২০১৯ সালে মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে গিয়ে খোশবাগে নবাব আলীবর্দী খানের সমাধিতেও গিয়েছিলাম, সেটার দুটো ছবিও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সলভিন্সের আঁকা স্লুপ-নৌকার একটা ছবিও জুড়ে দিয়েছি, আশা করি কালীকিঙ্করবাবু এতে কোনো অপরাধ নেবেন না।
নিজে ভোজনরসিক হওয়ার সুবাদেই সে-সময়কার খাবার-দাবার নিয়েও বেশ আগ্রহ রয়েছে আমার। সে-কারণে শেষ অধ্যায়টি আমার নিজের লেখা, মুর্শিদাবাদের রাজকীয় খাবার নিয়ে। মুর্শিদাবাদের নবাবি খাবার-দাবার নিয়ে জানা যায় খুবই অল্প। তাই দ্বারস্থ হয়েছিলাম মুর্শিদাবাদের এখনকার পোশাকি নবাব সৈয়দ রেজা আলী মির্জার, তিনি মীর জাফরের নবাবি বংশের পঞ্চদশ প্রজন্ম। তাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপের বিবরণও দেওয়া হয়েছে শেষ অধ্যায়টিতে। তিনি ফোনে অনেক খাবারের বিবরণ দিয়েছেন, যেগুলোর সঙ্গে দিল্লির চেয়ে বরং ঢাকার সংযোগটাই বেশি পাওয়া যায়। তাই মুর্শিদাবাদের নবাবি খাবারের অংশটুকু যতটা-না মুর্শিদাবাদের খাবারের, তার থেকেও বেশি ঢাকা থেকে নতুন রাজধানীতে বয়ে নিয়ে যাওয়া খাদ্য-সংস্কৃতির। এটা নিয়ে হয়তো ভবিষ্যতে গবেষকরা আরো অনেক কাজ করবেন। এই সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য মিলিয়ে দেখার জন্য সহায়তা করেছেন আন্তর্জাতিক রন্ধনশিল্পী সজীব মোহাম্মদ। কলকাতার অনেক খাদ্য-সাংবাদিক সাহায্য করার আশা দিয়েও শেষপর্যন্ত আর করতে পারেননি। করোনার এই ক্রান্তিকালে তা ঠিক প্রত্যাশার বাইরেও ছিল না। বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় দুজনকে–পাঞ্চালি দত্ত, কলকাতার বিশিষ্ট রসনা-লিখিয়ে, যাঁকে রাত-বিরাতে ফোন দিয়ে বিরক্ত করলেও হাসিমুখে এই অত্যাচারকে প্রশ্রয় দিয়েছেন আর বিখ্যাত শেফ কুনাল কাপুরকে, যাঁকে ইমেইল করতেই একগাদা তথ্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাংলায় বসত গড়া রাজস্থানি জৈন- শেহেরওয়ালিদের খাবার-দাবার নিয়ে। সুশীল চৌধুরী তাঁর নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ বইয়ে জগৎশেঠ পরিবার, কলকাতার অমিচাঁদ আর হুগলির আর্মেনীয় খোজা ওয়াজিদকে স্বাধীন বণিকরাজা বলে অভিহিত করেছেন। সে হিসেবে ঔপনিবেশিক আমলের বণিকরাজা ছিলেন এই শেহেরওয়ালিরা। আর স্বাভাবিকভাবেই তারা তাদের রাজস্থানের রুক্ষ জীবনযাত্রাকে বাংলার সবুজে মিশিয়ে তৈরি করেছিলেন নিজেদের এক সংস্কৃতি – শেহেরওয়ালি। তাদের খাবার নিয়েও খানিক আলোচনা রয়েছে। কফির সঙ্গে এই বইয়ের এক অদ্ভুত সংযোগ রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কফি পছন্দ করি। এই বই অনুবাদের প্রস্তাব দেন প্রকাশক মঈনুল আহসান সাবের ভাই ধানমণ্ডির এক ক্যাফেতে বসেই। এই বই লেখার সময় হিসেব রাখতে শুরু করেছিলাম কতটুকু কফি লাগল বইটি শেষ করতে বের হল মূলত ১৫৩ দিন সময়ে (মার্চ থেকে জুলাই)। ১৫৩ লিটারের কিছু বেশি রাতের মতো কালো, মৃত্যুর মতো তিক্ত আর দোযখের মতো গরম কফি আমার সঙ্গী হয়েছে। ফলে যখন দেখা গেল আলীবর্দী প্রতিদিন সকালে কফি পান করতেন, তখন সেটাকে আরেকটু ইতিহাসের কষ্টিপাথরে ঘষে দেখলাম। বেরিয়ে এল অষ্টাদশ শতকের দিল্লির সিভিল সোসাইটির ক্যাফেতে জমায়েত হওয়ার গল্প, কাব্যচর্চার গল্প। আরও বেরিয়ে এল ১৬৮২ সালে ঢাকায় সুবাহদারদের কফিপানের রীতির কথা। সেটারও উল্লেখ করেছি শেষ অধ্যায়ে।
পরিশেষে, ধন্যবাদ দিতে হয় পরিবারকেও। আমার পাঁচ বছরের মেয়ে এই বইটা লিখতে লিখতেই সাড়ে পাঁচ বছরের হয়েছে। বুঝে নিয়েছে বাবা প্রায়ই তাকে রাতে গল্প না-শুনিয়ে, বা ঘুম পাড়িয়েই কম্পিউটারে লিখতে বসে রাতের বেলা। আমার বউও বুঝে নিয়েছে লেখালেখির প্রতি আমার অন্য ভালোলাগার ব্যাপারটা। তাদের অকৃত্রিম সহযোগিতা ছাড়া কি আর এই কাজ করা সম্ভব হয়? ধন্যবাদ জানাতে হয় প্রকাশককেও, এমন একটি ইতিহাসের বই আমার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য, বিশ্বাসটুকু করার জন্য।
বাকিটুকু পাঠকদের হাতে।
আল মারুফ রাসেল
২৯ জুলাই ২০২১
.
মূল লেখকের ভূমিকা
অষ্টাদশ শতকের মাঝের দিকটায় ভারতের ইতিহাস যুগান্তকারী ঘটনার জন্ম দেয়। দিল্লির সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্বের কার্যত অবসান ঘটে, যার পরিণামে ভারতীয় আর অভারতীয় ভাগ্যান্বেষীরা তাদের ভাগ্য পরীক্ষা করতে থাকে কেন্দ্র থেকে দূরবর্তী এলাকাগুলোতে। এভাবেই এক কর্মঠ ভাগ্যান্বেষী, আলীবর্দী বাংলার সরকারের সিংহাসন ছিনিয়ে নেন ১৭৪০ সালের এপ্রিল মাসে। আর বাস্তবিকভাবেই পরের ১৬ বছর, ১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন স্বাধীনভাবে। দিল্লির সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের দুর্বলতার সঙ্গে দৈবক্রমে আরও কিছু সমস্যার উদ্ভব হয় যা সমস্ত সম্ভাবনা ধ্বংস করে দেয়— কার্যত স্বাধীন সুবাহ বাংলায় প্রগতিশীল ও শান্তিপূর্ণ সরকারের। এগুলোর মধ্যে সে-সময়ে বাংলা সুবাহর প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিল শক্তিশালী মারাঠা সাম্রাজ্যবাদের উত্তর- পূর্ব এলাকায় বিস্তৃতির উচ্চাশায়, একটি নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজে পাওয়া, আর এর ফলেই মারাঠাদের বাংলা সুবাহর প্রাণকেন্দ্রে আগমন। প্রায় এক দশক, মারাঠা- আক্রমণ বাংলায় চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বাংলা সরকারের জন্য। বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক জীবনকে ব্যাহত করে, ব্যাপক ধ্বংস আর আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল বাংলার মানুষের ভেতরে, আর এর ফলে বাংলার আর্থিক সম্পদের ক্ষতি নিতান্ত কম ছিল না। বৃদ্ধ নবাব আন্তরিক চেষ্টা করেছিলেন মারাঠাদের দরুন সৃষ্ট ক্ষততে প্রলেপ দেওয়ার, তবে সেখান থেকে বাংলাকে সারিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট সময় তিনি হাতে পাননি। এরপর এই জটিল সময়ে বাংলার প্রশাসনের দায়িত্বশীল পদে আসেন তার নাতি সিরাজ-উদ-দৌলা–সামরিক, ভূ-অভিজাত ও বণিক অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণে রেখে, দিনে দিনে উচ্চাভিলাষী হওয়া বিদেশি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধা দিয়ে, আর অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিছু প্রমাণ মেলে যে, সিরাজ এগুলোর ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন না। কিন্তু নবাব হিসেবে তার সময়কাল বড় ট্রাজেডির, অবশ্য সেটা হওয়া রই ছিল। সে- সময় নেওয়া তার উদ্যোগগুলো দুর্ভাগ্যজনকভাবে ব্যর্থ হয় সেই বাহিনীগুলোকে বাধা দিতে, যা তার পূর্ববর্তী শাসকদের সময়েই উপস্থিত হয়েছিল, আর তারা কৌশলে তা ব্যবহার করেছিলেন নিজেদের সুবিধার জন্য। তাই পলাশীর ঠিক আগে আলীবর্দীর শাসনামল বেশকিছু কারণে গুরুত্বপূর্ণ আর ঘটনাপ্রবাহের নির্দেশক। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লবগুলোর সূচনা ও গুরুত্ব বুঝতে এই সময়ের নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন, যা সে-সময়কার অন্য বিপ্লবগুলোর মতো নবযুগ সৃষ্টিকারী তো ছিলই আর শক্তিমত্তায়ও দুর্বল ছিল না।
এই সময়কার ইতিহাসের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের জন্য সুলভ মূলসূত্রগুলো থেকে পাওয়া বিভিন্ন ধরনের তথ্য এখনও গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হয়নি। আমি চেষ্টা করেছি আমার মতন করে দশ বছর ধরে নিচের সূত্রগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে[১]–
১. সে-সময়কার ফার্সিভাষায় রচিত বর্ণনাগুলো।
২. মুদ্রিত ও অপ্রকাশিত বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেকর্ড।
৩. চান্দেরনাগোর (চন্দননগর) কোহে(র)সপন্দন্স (করেসপন্ডেন্স) [ফরাসি ভাষায়]।
৪. সমসাময়িক ও তার কিছুকাল পরের ইউরোপীয় লেখক, পর্যটক ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিভিন্ন চাকরিজীবীদের বর্ণনা, স্মৃতিকথা ও জার্নাল।
৫. সিলেকশনস ফ্রম দ্য পেশওয়া দাফতার ও ঐতিহাসিক পত্র-ব্যবহার
[মারাঠি ভাষায়]
৬. সমসাময়িক সাহিত্যকর্ম–বাংলা ও সংস্কৃত। [২]
কিছু সমসাময়িক ফার্সি সূত্র, যেমন ইউসুফ আলীর আহওয়াল-ই-আলীবর্দী খান, মুহাম্মাদ ওয়াফার ওয়াকাই ফা বাঙ্গালাহ, মুনশি বিজয়রামের দাস্তুর-উল-ইনশা, আর মুশি শেখ ইয়ার মুহাম্মাদ কালান্দারের দাস্তুর-উল-ইনশা এখানেই প্রথমবারের মতো ঐতিহাসিক কারণে ব্যবহৃত হয়েছে।
ঐতিহাসিক বর্ণনার মজুদখানা হিসেবে ইউসুফ আলীর বই অনন্য, যা লেখকের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ আর অভিজ্ঞতায় ভরা। বিহারের ইতিহাসবেত্তা গোলাম হোসেনের সিয়ার-উল-মুতাখখারিনও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বিশাল ঐতিহাসিক কর্ম হিসেবে। সালিমুল্লাহ্র তারিখ-ই-বাঙ্গালাহ, করম আলীর মুযাফফারনামাহ, গোলাম হোসেন সালিমের রিয়াজ-উস-সালাতিন থেকে প্রচুর তথ্য, বর্ণনা সংগ্রহ করেছি। কল্যাণ সিং-এর খুলাসাত-উত-তাওয়ারিখ, মুহাম্মাদ রাহাতের রাহাত-উল-আরওয়াহ ও গোলাম আলীর ইমাদ-উস-সাদাতও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি, যেগুলো খানিক পরে লেখা হয়েছিল আর পূর্ববর্তী লেখকদের অনুসরণ করেছিলেন এর লেখকেরা।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেকর্ডের ক্ষেত্রে, কিছু অপ্রকাশিত কাগজ আলোয় এনেছি, খুব সম্ভবত প্রথমবারের মতো। আর প্রকাশিতগুলোর ক্ষেত্রে কিছু বিদ্বান ব্যক্তিরা পাঠ-প্রতিক্রিয়া দিয়ে গেছেন, সেগুলো এখানে ব্যবহৃত হয়েছে আরও বিস্তৃত ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে। ইম্পেরিয়াল রেকর্ড ডিপার্টমেন্টের অপ্রকাশিত রেকর্ডগুলোর মূল্য, আধুনিক ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক পুনর্গঠনে অত্যন্ত মূল্যবান। এগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত সংস্কারের থেকে মুক্ত ছিল, যেগুলো দরবারি-লেখকদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এগুলোতে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা পাওয়া যায় যেগুলো ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই, পর্যায়ক্রমিকভাবেও নির্ভুল তথ্য সরবরাহ করে।
সমসাময়িক সাহিত্যও এ-সময়ের ইতিহাসের ফলপ্রসূ উপকরণ হিসেবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সম্ভবত এই প্রথম কোনো বইয়ে অষ্টাদশ শতকের সাহিত্য প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হয়েছে ইতিহাসের অন্যতম উপকরণ হিসেবে। আমি বাংলা সাহিত্যকর্মগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়েছি, এমনকি মহারাষ্ট্রপুরাণও, যার লেখক গঙ্গারাম ছিলেন ভাস্কর পণ্ডিতের হত্যার সময় পর্যন্ত বাংলায় মারাঠা আক্রমণের প্রত্যক্ষদর্শী। কিছু তথ্য কুড়নো হয়েছে বাংলা কবি ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল থেকে। ১৭৪৪ সালের নভেম্বর মাসে লেখা বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের একটি সংক্ষিপ্ত সংস্কৃত সাহিত্যকর্ম চিত্রচম্পু থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাই বর্ধমান জেলায় মারাঠা আক্রমণের ভয়াবহতা আর নৃশংসতার। এছাড়াও আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি সে সময়কার লেখকদের অন্যান্য বর্ণনা থেকে ঐ সময়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের একটি চিত্র খোঁজার।
প্রথম দুই অধ্যায়ে আমি চেষ্টা করেছি আলীবর্দীর প্রাথমিক জীবন, সেখান থেকে সুবাদার পদে উত্থান, আর বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় তার শক্তি দৃঢ়ীকরণের ইতিহাস বের করার। তৃতীয় অধ্যায়ে বাংলায় মারাঠা আক্রমণের বিস্তারিত বিবরণ আর বাংলার ইতিহাসে তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়টি সমসাময়িক ফার্সি, ইংরেজি, বাংলা ও সংস্কৃত সূত্র থেকে নেওয়া হয়েছে আর যত্ন করে লেখা হয়েছে ১৯২৯ সালের মার্চের শেষদিকে। তখনই এটি বোম্বের ইন্ডিয়ান হিস্ট্রিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক রেভারেন্ড এইচ হেরাস, এসজেএম (রেভারেন্ড এনরিক এরাস দি সিকাহ)-এর কাছে পাঠানো হয়, আর তিনি ধারাবাহিকভাবে জার্নাল অফ দ্য বোম্বে হিস্ট্রিক্যাল সোসাইটির জার্নালে ছাপতে থাকেন সেপ্টেম্বর ১৯৩০ থেকে, কয়েক কিস্তিতে। আমি দ্য সোশ্যাল ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল ইফেক্টস অফ দ্য মারাঠা ইনভ্যাশনস ইন বেঙ্গল নামের সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ উপস্থাপন করি ১৯৩০ সালের ডিসেম্বরে পাটনায়, অল ইন্ডিয়া সিক্সথ ওরিয়েন্টাল কনফারেন্সে। এরপর পুরো প্রবন্ধ উপস্থাপন করি ১৯৩১ সালের অক্টোবরে, পাটনা কলেজের হিস্ট্রিক্যাল অ্যান্ড আর্কিওলজিক্যাল সোসাইটির দুটি সম্মেলনে। এরপর থেকে এটা সময়ের সঙ্গে উন্নত হয়েছে, আরও ভালোমতো বললে কিছু মারাঠি সূত্র, ফরাসি চিঠিপত্র আর স্যার যদুনাথ সরকারের প্রশংসনীয় কাজ–ফল অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার-এর তথ্য ব্যবহারে।
চতুর্থ অধ্যায়ে বিহারে আফগান-বিদ্রোহের বর্ণনা দিয়েছি আর সুবাহ বাংলায় ও উত্তর-ভারতে তার প্রভাবের কথাও উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। পঞ্চম অধ্যায়ে নবাব আলীবর্দীর সঙ্গে বাংলার ইউরোপীয় বণিকদের সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে, বিশেষত ইংরেজদের। ষষ্ঠ অধ্যায়ে আলীবর্দীর জীবনের শেষ অধ্যায়টুকু আলোচনাশেষে তার চরিত্র আর প্রশাসনের গঠনমূলক আলোচনার চেষ্টা করেছি। সপ্তম অধ্যায়ে বাংলার বাণিজ্যের এশীয়, আন্তঃপ্রাদেশিক ও ইউরোপীয় প্রেক্ষাপট আলোচিত হয়েছে। তিনটি আলাদা ভাগে ভাগ করে এগুলো আলোচিত হয়েছে—ক. এশীয় বাণিজ্য, খ. আন্তঃপ্রাদেশিক বাণিজ্য ও গ. ইংরেজ কুঠি ও বিনিয়োগ। অষ্টম অধ্যায়ে বাংলার সাধারণ অর্থনৈতিক অবস্থার বিভিন্ন দিক, যেমন কৃষিপণ্যের বাজার ও মূল্য এবং উৎপাদন শিল্প নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিস্তৃত ও সংযুক্তভাবে আলোচনা করা সম্ভব হয়নি সে-সময়কার ভারতীয় অর্থনৈতিক জীবন নিয়ে দলিল আর পরিসংখ্যানের অভাবে। কিন্তু আমার ধারণা আমি প্রত্যেকটি বর্ণনার মূল সংস্করণ নিজে পড়ে তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছি।
নবম অধ্যায়ে আমি চেষ্টা করেছি বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রের সাহায্যে বাংলার সঠিক সামাজিক জীবন ও রীতিনীতির একটি চিত্র ফুটিয়ে তুলতে, যদিও সেটা অসম্পূর্ণ। বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা নিয়ে আরও বিস্তারিত লিখেছি হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল সুবাহ, ভলিউম ১-এ। আর শেষ অধ্যায়ে আমি চেষ্টা করেছি সেই সময়কার গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করতে।
এই বইয়ের সঙ্গে দেওয়া মানচিত্র আমি তৈরি করেছি প্ল্যাইস্টেড স জার্নালস, রেনেল স বেঙ্গল অ্যাটলাস, আধুনিক জরিপ মানচিত্র ও ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারগুলোর ম্যাপ পর্যবেক্ষণের পর। শহর, শহরতলি, গ্রাম ও নদীর স্থান বিবরণের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব নিখুঁত থাকার চেষ্টা করেছি। পশ্চিম বাংলা ও বিহারের কিছু এলাকা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত জ্ঞানের পাশাপাশি মানচিত্র তৈরির সময়ে প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বন্ধুবান্ধবদেরও সহায়তা নিয়েছি।
নবাব আলীবর্দীর ছবি, তার ব্যবহৃত বন্দুক ও তরবারির ছবি আমি পেয়েছি মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর, আমির-উল-ওমরাহ, নাইট কমান্ডার অফ দ্য স্টার অফ ইন্ডিয়া, নাইট কমান্ডার অফ দ্য ভিক্টোরিয়ান অর্ডার-এর প্রাসাদ থেকে, তার ম্যানেজারের বদৌলতে, যার কাছে এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।
আমি জানি আমার অনেক চেষ্টার পরও এই বই ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। এজন্য বিজ্ঞ পাঠকদের কাছ থেকে যে-কোনো পরামর্শ আমি সাদরে গ্রহণ করতে আগ্রহী, যেন ভবিষ্যতে এই বইটির আরও উন্নত সংস্করণ প্রকাশ করা যায়।
এই বইয়ের প্রস্তুতির জন্য স্যার যদুনাথ সরকার, নাইট, কম্প্যানিয়ন অফ দ্য অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার-এর কাছে ঋণী, তিনি কেবল তার কিছু দুষ্প্রাপ্য বই ধারই দেননি, বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েও সহায়তা করেছেন। আমি পাটনা কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডক্টর এসসি সরকার, এমএ, ডি.ফিল. (অক্সফোর্ড)-এর কাছেও চিরঋণী, যিনি উৎসাহ ও ভালোবাসা দিয়ে দিনের পর দিন আমাকে পথ দেখিয়েছেন। আমি এই সুযোগে ধন্যবাদ দিতে চাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদার ও স্নেহশীল শিক্ষকদের, অধ্যাপক ডক্টর এসএন সেন বিলিট (অক্সফোর্ড), এমএ, পিএচডি (বর্তমানে রক্ষক, রেকর্ডস অফ দ্য গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া); ডক্টর এইচসি রায়চৌধুরী, এমএ, পিএইচডি; ডক্টর এনসি ব্যানার্জি, এমএ, পিএইচডি ও শ্রীযুত ত্রিপুরারি চক্রবর্তী, এমএ – যাদের ক্রমাগত সহযোগিতা-উৎসাহ আমার প্রেরণার উৎস ছিল লেখালেখির পুরোটা সময়জুড়ে। আমি আমার বন্ধু ও সহকর্মীদের কাছেও কৃতজ্ঞ। অধ্যাপক এসএইচ আসকারি, এমএ, বিএল, ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপক, পাটনা কলেজ ও শ্রীযুত শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, ডিপ্লোমা ইন জিওগ্রাফি (লন্ডন), পাটনা সায়েন্স কলেজ – প্ৰথমজন আমাকে মূল ফার্সি পাণ্ডুলিপি ব্যবহার করতে দিয়েছেন আর শেষোক্ত মানুষটি মানচিত্র তৈরিতে সাহায্য করেছেন। বন্ধু ও সহকর্মী পাটনা কলেজের অধ্যাপক জগদীশ নারায়ণ সরকার, এমএ আমার আন্তরিক ধন্যবাদার্হ — জরুরি কিছু পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করার জন্য, বিশেষত মানচিত্রের ব্যাপারে। আমি আরও কৃতজ্ঞ ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, এমএ, বিএল, ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল, ডিলিট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য; শ্ৰীযুত যোগেশচন্দ্র চক্রবর্তী, এমএ, রেজিস্ট্রার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ও কলকাতা ইউনিভার্সিটি প্রেসের নিয়ন্ত্রক ডি. গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে, যার সদয় সহায়তা ছাড়া এই বই মুদ্রণ সম্ভব হত না। আমি আরও ধন্যবাদ দিতে চাই জনাব এএফএম আবদুল আলী, এমএ, এফআরএসএল, রেকর্ডস অফ দ্য গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়ার সাবেক রক্ষক ও তার কর্মকর্তাদের, আমাকে তাদের দলিল-দস্তাবেজ পড়তে দেওয়ার জন্য। আমার বন্ধু ও সুহৃদেরা,
এইচআর ঘোষাল, এমএ, বিএল; পাটনা কলেজের গবেষক ডিবি ত্রিবেদী, এমএ ও একে মিত্র, বিএ, আমাকে ইনডেক্স তৈরিতে সহায়তা করেছেন, যার জন্য তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
কালীকিঙ্কর দত্ত
পাটনা কলেজ, পাটনা
বিহার, ১৯৩৯
Leave a Reply