আরোগ্য-নিকেতন – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
[আরোগ্য-নিকেতন – উপন্যাস – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। আরোগ্য-নিকেতন তারাশঙ্করের এক এপিকধৰ্মী উপন্যাস। এই উপন্যাসখানি ১৯৫৫-য় রবীন্দ্র পুরস্কার ও ১৯৫৬-য় আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়।]
***
আরোগ্য-নিকেতন অর্থাৎ চিকিৎসালয়। হাসপাতাল নয় দাতব্য চিকিৎসালয়ও নয়—দেবীপুর গ্রামের তিন পুরুষ চিকিৎসা-ব্যবসায়ী মশায়দের চিকিৎসালয়।
স্থাপিত হয়েছিল প্রায় আশি বৎসর পূর্বে। এখন ভাঙা-ভগ্ন অবস্থা; মাটির দেওয়াল ফেটেছে, চালার কাঠামোটার কয়েকটা জায়গাতেই জোড় ছেড়েছে মাঝখানটা খাজ কেটে বসে গেছে কুঁজো মানুষের পিঠের খুঁজের মতো। কোনো রকমে এখনও খাড়া রয়েছে, প্রতীক্ষা করছে তার সমাপ্তির; কখন সে ভেঙে পড়বে সেই ক্ষণটির পথ চেয়ে রয়েছে।
অথচ যেদিন স্থাপিত হয়েছিল সেদিন স্থাপন-কর্তা জগদ্বন্ধু কবিরাজ মহাশয় তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু ঠাকুরদাস মিশ্রকে বলেছিলেন, বুঝলে ঠাকুরদাস, যাবৎ চন্দ্ৰাক মেদিনী বলব না তবে … আমাদের বংশের বসতি এখানে যতকাল থাকবে ততকাল এ আটন, এ পাট পাকা হয়ে রইল। হেসে বলেছিলেন দম্ভ মনে করি না ভাই, দম্ভ নয়। হাত দুখানি জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলেছিলেন, অক্ষয় লাভের কারবার। যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে। পুরনো ঘিয়ের মতযত দিন যাবে তত দাম বাড়বে। বলতে গেলে সংসারে শ্রেষ্ঠ লাভের কারবার। দেনা-পাওনা দেওয়া-নেওয়া দুই দিকেই শ্ৰেষ্ঠ লাভ মিলবে এখানে, অথচ দুই পক্ষের কেউ ঠকবে না।
জগদ্বন্ধু মহাশয়ের বন্ধু ঠাকুরদাস মিশ্র ছিলেন একেবারে হিসেবনবিশ বিষয়ী লোক, পেশায় জমিদারের গোমস্তা। তিনি বড় বড় অঙ্ক বুঝতেন, মামলা মকদ্দমা বুঝতেন, দলিল আরজি জবাব বুঝতেন, কিন্তু এইসব তত্ত্ব বুঝতেন না। তিনি বক্রভাবেই বলেছিলেন নাড়ি টিপে আর গাছগাছড়া তুলে এনে হেঁচে পিষে শুকিয়ে পাঁচন-বড়ি দিলেই পয়সা। টাকায় অন্তত চোদ্দ আনা লাভ তোমার বাধা সে বুঝলাম। কিন্তু রোগীর লাভ? ওটা কী করে বললি জগ? তোর লাভ, রোজকার রোগীর খরচ, সে দেনা করেও করতে হবে। তার তো ধনে-প্রাণে মরণ।
বাধা দিয়ে জগদ্বন্ধু মশায় বলেছিলেন—তুই বাঁকা পথে হাঁটিস ঠাকুরদাস। পয়সার কথাটা পরের কথা। যে লাভ বললাম সে লাভ পয়সার নয়, অথচ এইটাই সংসারে শ্রেষ্ঠ লাভ। একপক্ষের লাভ আরোগ্যলাভ, অন্যপক্ষের লাভ সেবার পুণ্য। জানিস? বিশ্ব সংসারে আরোগ্যলাভই হল শ্রেষ্ঠ লাভ। যক্ষরূপী ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে যেসব প্রশ্ন করেছিলেন তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল—লাভানামুত্তমং কি? সংসারের লাভের মধ্যে সর্বোত্তম লাভ কী? যুধিষ্ঠির বলেছিলেন—লাভানাং শ্ৰেয় আরোগ্যম অর্থাৎ আরোগ্যলাভই সংসারের শ্রেষ্ঠ লাভ।
সেদিন ঠাকুরদাস মিশ্ৰ হেসেছিলেন। বলেছিলেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না জগ। তা সে গঙ্গার চরের নালতের শাক হলেও না। ও তোর ধম্মপুত্ত যুধিষ্ঠিরের সংস্কৃত শোলোকেও কবরেজদের টাকার লাভের হিসেব ধরা পড়বে না। কথা শেষ করে জগদ্বন্ধুকে বেশ এক হাত নেওয়ার আনন্দে হো-হো করে হেসেছিলেন তিনি। কিন্তু কিছুদিন পরই হঠাৎ বাত-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মাস তিনেক পঙ্গু হয়ে থেকে ওই জগদ্বন্ধু মশায়ের চিকিৎসাতেই আরোগ্যলাভ করে। বলেছিলেন—তুই ভাই আমাকে জীবন দান করলি, তুই জেনে রাখিস ভাই যে, যদি কোনোদিন। দরকার হয় আমি তোর জন্যে জীবন দেব।
হেসে জগদ্বন্ধু মশায় বলেছিলেন—তা হলে—লাভানাং শ্ৰেয় আরোগ্যম্-কথাটা স্বীকার করলি আজ?
মিশ্ৰ হেসেই বলেছিলেন–হ্যাঁ, তা করলাম।
পরদিন মিশ্র নিজে জগদ্বন্ধু মশায়ের আরোগ্য-নিকেতনে এসে একটা কাঠির ডগায় ন্যাকড়া জড়িয়ে তেল-সিঁদুরের লালরঙে নিজের হাতে দেওয়ালে মোটা হরফে লিখে দিয়েছিলেন লাভানাং শ্ৰেয় আরোগ্যম্।
আরোগ্য-নিকেতন নামকরণ তখন হয় নাই। তখন এ অঞ্চলের লোকেদের কতক বলত মশায়ের হোথা, কতক বলত–মশায়ের কোবরেজখানা।
আরোগ্য-নিকেতন নামকরণ হয়েছিল পুরুষান্তরে জগদ্বন্ধু মশায়ের ছেলে জীবন মশায়ের আমলে। তখন কালান্তর ঘটেছে। একটি নতুন কাল শুরু হয়েছে। দেশের কেন্দ্রস্থল নগরে নগরে তার অনেক আগে শুরু হলেও এ অঞ্চলে তখন তার প্রারম্ভ। জীবন মশায় তাদের চিকিৎসালয়ের নামকরণ করে বড় একটি কাঠের ফালির উপর কালো হরফে আরোগ্য-নিকেতন নাম লিখে বারান্দার সামনে টাঙিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়—জগদ্বন্ধু মশায় যে ঘরখানি করেছিলেন সে ঘরেরও অনেক অদলবদল করেছিলেন। তক্তপোশর উপর ফরাসের ব্যবস্থা যথাযথ রেখে তার সঙ্গে চেয়ার টেবিল বেঞ্চি জুড়ে দিয়েছিলেন।
আজও দেখতে পাবেন। নড়বড়ে টেবিল, হাতলভাঙা চেয়ার এখনও আছে। বেঞ্চিখানা শক্ত। সেটা আজও নড়ে না।
আরোগ্য-নিকেতনের জীৰ্ণ পতনোন্মুখ ঘরখানিওই নাম লেখা কাঠের ফলক—এমনকি জীবনবন্ধু মশায়কেও দেখতে পাবেন, সেখানে গেলে।
যাবেন, মহানগরী থেকে শতাধিক মাইল। চলে যাবেন বড় লাইনের ট্রেনে … জংশনে নেমে পাবেন একটি অপরিসর শাখা-রেলপথ। মাইল দশেক গিয়ে পাবেন একটি সমৃদ্ধ গ্রামের স্টেশন। চারিদিকে দেখতে পাবেন কালান্তরের সুস্পষ্ট পরিচয়। দেখতে পাবেন একখানা ট্যাক্সি, একখানা মোটর বাস, সাইকেল রিকশা, গরুর গাড়ি। স্টেশন থেকে এই আরোগ্য-নিকেতন দূর পথ নয়, সামান্য পথ, এক মাইলের কিছু উপর প্রয়োজন হলে গরুর গাড়ি একখানা নেবেন। কিংবা সাইকেল রিকশা। কিন্তু তার চেয়ে হেঁটে যাওয়াই ভাল। দেখতে পাবেন ভাঙাগড়ায় বিচিত্র গ্রামখানিতে পুরাতন-নূতনের সমাবেশ।
পাকা লাল কাঁকরে তৈরি সড়ক ধরে যাবেন। দেখবেন প্রাচীন কালের জমিদারদের বড় বড় নোনাধরা পাকা বাড়ি। ভাঙা বাগান। ধসেপড়া পাঁচিল। শ্যাওলা-পড়া মন্দির। পুকুরের ভাঙা ঘাট। পুরনো মন্দির। চারিদিকেই দেখবেন ধূলি-ধূসরতা; আবর্জনার স্তুপ। পতিত জায়গায় আগাছার জঙ্গল। এরই মধ্যে এক জায়গায় পাবেন এক পুরনো বৃদ্ধ বট; শাখা-প্রশাখা জীর্ণ; গোড়াটা বাঁধানো; তাতেও দেখবেন অনেক ফাটল। এটি গ্রামের ষষ্ঠীতলা। এর পরই এই রাস্তাটি শেষ হয়েছে, মিশেছে প্রশস্ত একটি পাকা সড়কের সঙ্গে। লাল মাটি ও মুড়ি জমানো রাস্তা, রাস্তার দুপাশে দোকান। এইটিই হল বাজারপাড়া। প্রাণস্পন্দনে মুখরিত। মাল-বোঝাই গরুর গাড়ির সারি চলেছে, মানুষ চলেছে, কোলাহল উঠছে, গন্ধও এখানকার বিচিত্র। বাজারটা দিন দিন বেড়ে চলেছে। চা-মিষ্টানের দোকান পাবেন; ক্ষুধা তৃষ্ণা অনুভব করলে এখানে ঢুকে। পড়বেন। নবগ্রাম মেডিকেল স্টোর্সের পাশেই আছে সবচেয়ে ভাল চা-মিষ্টির দোকান। খুব খুঁজতে হবে না, নবগ্রাম মেডিকেল স্টোর্সের ঝকঝকে বাড়ি, আসবাব, বহু বর্ণে বিচিত্র বিভিন্ন ওষুধের বিজ্ঞাপন আপনার দৃষ্টি অবশ্যই আকর্ষণ করবে। বুশশার্ট-প্যান্ট-পরা হরেন ডাক্তারকে গলায় স্টেথোসকোপ ঝুলিয়ে বসে থাকতেও দেখতে পাবেন। ভাল চায়ের দোকানটা ঠিক এর পাশেই।
এখান থেকেই আবার উত্তরমুখী একটি শাখাপথ পাবেন। রাস্তাটি খুব পরিসর নয়; একখানি গাড়ি যায়, দুপাশে দুসারি তোক বেশ স্বচ্ছন্দে চলতে পারে।
একটু, বোধহয় সিকি মাইল, চলবেন ছায়াচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে; দুপাশে চার-পাঁচটি পুষ্করিণী। পুষ্করিণীর পাড়ের উপর আম, জাম, শিরীষ, তেঁতুলের গাছগুলি দুপাশ থেকে পল্লব বিস্তার করে পথটিতে ছায়া ফেলেছে। একটি পুকুরে একটি ছোট বাধা ঘাট পাবেন। এখান থেকে বের হলেই পাবেন উন্মুক্ত প্রান্তর। এখানে দেখবেন বিচিত্র দৃশ্য। নতুন বাড়িঘর, একেবারে নতুন কালের ফ্যাশন, নতুন কালের ইঞ্জিনিয়ারিঙের নিদর্শন। ক্যানেল আপিস তৈরি হয়ে গেছে। আশেপাশে ছোট ছোট কোয়ার্টার। এ দিকে নতুন ক্যানেল তৈরি হচ্ছে। এর পরই পাবেন আর একদফা বাড়ির সারি; গুটিকয়েক ছোট ইমারতকে ঘিরে বড় বড় ইমারত তৈরি চলেছে। চারিদিকে ভারা বাধা, রাজমজুর খাটছে, মজুরনীরা গান গাইছে আর ছাদ পিটছে। হ্যাটকোট-প্যান্ট-পরা ইঞ্জিনিয়ার ঘুরছে সাইকেল হাতে নিয়ে। ওই ছোট বাড়িগুলি এখানকার হাসপাতাল। ছোট হাসপাতালটি, ডাক্তার-কম্পাউন্ডারের ছোটখাটো দুটি কোয়ার্টার; আরও ছোট কয়েকটি কাচাবাড়ির বাসা, এখানে থাকে নার্সেরা। একটু দূরে একটি ছোট ঘর দেখবেন সেটি মোতিয়া ডোমের বাড়ি। আর ওই অর্ধসমাপ্ত বড় ইমারতটিওটিও হাসপাতালের ইমারত, এ অঞ্চলের স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে।
এসব দেখে থমকে দাঁড়াবেন না। নতুন গঠনের মধ্যে আশা আছে, ভবিষ্যৎ গড়ছেসুতরাং মনে মোহের সঞ্চার হবে, স্বপ্ন জেগে উঠবে মনশ্চক্ষুর সম্মুখে; সেই স্বপ্নে ভোর হয়ে পড়বেন, আরোগ্য-নিকেতন পর্যন্ত যেতে আর মন উঠবে না।
চলে যাবেন এগিয়ে, এইসব নতুন কালের ঝকঝকে ইমারতগুলিকে বায়ে রেখে চলে যাবেন। আরও মাইলখানেক পথ যেতে হবে। দুধারে শস্যক্ষেত্র; মাঝখানে লাল কাকর-দেওয়া ওই একখানি গরুর গাড়ি যাওয়ার মতো আঁকাবাকা পথটি। মাইলখানেক পর গ্রাম দেবীপুর; এই গ্রামেই আছে পুরাতন আরোগ্য-নিকেতন।
শ্ৰীহীন গ্রাম দেবীপুর, দারিদ্র্যের ভারেই শুধু নিপীড়িত নয়, কালের জীৰ্ণতাও তাকে জীর্ণ করে তুলেছে। লক্ষ্য করে দেখবেন গ্রামের বসতির উপরে যে গাছগুলি মাথা তুলে পল্লব বিস্তার করে রয়েছে তার অধিকাংশই প্রবীণ প্রাচীন, নতুন গাছের লাবণ্যময় শোভা কদাচিৎ চোখে পড়বে। জীবনের নবীনতার ধ্বজা হল নতুন সতেজ গাছের শ্যাম-শোভা। প্রথমেই চোখে পড়বে—ঝড়ে—শুয়ে-পড়া শূন্যগর্ভ বকুলগাছতলায় ধর্মঠাকুরের আটন। তার পরেই পাবেন। একটি কামারশালা; অবশ্য কামারশালাটির অস্তিত্ব অনেক আগে থেকেই অনুভব করবেন আপনি। কামারশালার ঠং-ঠং শব্দ দেবীপুরের দক্ষিণে–এই নতুনকালের বসতি স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে উঠছে যে প্রান্তরে—সেই প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। ইমারতের দেওয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে।
কামারশালে দেখবেন চাষীদের ভিড়, গলিত লোহার ফুলকি। তারপরই গ্রম শুরু। শান্ত ছোট গ্রাম। বাঁশের বনে শিরীষগাছের মাথায় পাখি ডাকে। নানা ধরনের পাখি।
কুহু কুহু-কুহু!
চোখ গেল! চোখ গেল!
কৃষ্ণ কো-থা হে!
বউ কথা কও!
কা-কা-কা! ক-ক্ ক-ক্ ক-ক্!
মধ্যে মধ্যে বড় অর্জুনগাছের মাথার উপরে ছিল ডেকে ওঠে–চি-লো! চি-লো! পথের উপর শালিকের ঝাকের কলহ-কলরব–ক্যা-ক্যা করকর কিচিরমিচির কটকট কটকট তারপরই লেগে যায় ঝাপটাঝাপটি।
মানুষের দেখা পাবেন কদাচিৎ। যা দু-একজন পাবেন তারা দেহে জীর্ণ, মনে ক্লান্ত, দৃষ্টিতে সন্দিগ্ধ। আপনাকে দেখেও কথা বলবে না। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে যাবে, কিছুদূর গিয়ে পিছন ফিরে আবার তাকাবে। কে? বামপন্থী না দক্ষিণপন্থী? ভোট চায়? না চাঁদা?
সেকালে অর্থাৎ যখন আরোগ্য-নিকেতন প্রথম স্থাপিত হয়েছিল তখন ধারা ছিল অন্যরকম। দেশের অবস্থাও ছিল আর-এক রকম। গোলায় ধান ছিল, গোয়ালে গাই ছিল, ভাঁড়ারে গুড় ছিল, পুকুরে মাছ ছিল। লোক এক হাতে পেট পুরে খেত—দু হাতে প্রাণপণে খাটত। দেহে ছিল শক্তি, মনে ছিল আনন্দ। সে মানুষেরাই ছিল আলাদা। একালের মত জামা জুতো পরত না; হাঁটু পর্যন্ত কাপড় পরে অনাবৃত প্রশস্ত বক্ষ দুলিয়ে চলে যেত। ধবধবে কাপড় জামা চকচকে জুতোপরা আপনাকে দেখলে হেঁট হয়ে নমস্কার করে বলত কোথা থেকে আসা হচ্ছে বাবুমহাশয়ের? কোথায় যাওয়া হবে প্ৰভু?
আপনি বলতেন—আরোগ্য-নিকেতন।
—ওঃ! তা নইলে আপনাদের মত মনুষ্য আর কোথা যাবেন ই গেরামে। তা চলে যান। ওই সামনেই দেখছেনমা কালীর থান, বায়ে চন্দ মশায়ের লটকোনের দোকান-ডাইনে ভাঙবেন—দেখবেন বাঁধানো কুয়ো; সরকারি কুয়ো, তার পাশেই জীবন মশায়ের কবরেখানা, অর্থাৎ আরোগ্য-নিকেতন। লোকে লোকারণ্য। গাড়ির সারি লেগে আছে। চলে যান।
আজ কিন্তু সেখানে মানুষজন পাবেন না। লোকারণ্য কথাটা আজ অবিশ্বাস্য, এমনকি হাস্যকর বলেই মনে হবে। সকালের দিকে দুজন বড়জোর ছ-সাত জন রোগী আসে, হাত দেখিয়ে চলে যায়; আরোগ্য-নিকেতনে আজ আর কোনো ওষুধ পাওয়া যায় না; ওষুধের। আলমারিগুলি খালি পড়ে আছে। বার্নিশ চটে গেছে, ধুলোয় সমাচ্ছন্ন। দুটো-তিনটের কজা ছেড়ে গেছে। যারা হাত দেখাতে আসে তারা হাত দেখিয়ে ওষুধ লিখে নিয়ে চলে যায়, তারপর বাকি সময়টা স্থানটা প্রায় খাঁখাঁ করে।
অপরাহ্নের দিকে গেলে দেখতে পাবেন জীবনবন্ধু মশায় একা বসে আছেন। দেখতে পাবেন। উত্তর-দক্ষিণে প্রায় পঁচিশ হাত লম্বা একখানা খোড়ো কোঠাঘর। প্রস্থে আট-দশ হাত। সামনে একটি সিমেন্ট-করা বারান্দা, সেটা এখন ফেটে প্রায় ফুটিফাটা হয়ে গিয়েছে, মধ্যে মধ্যে খোয়াও উঠে গিয়েছে, তিন পাশের স্বল্পগভীর ইটের ভিত ঠাঁই ঠাঁই বসে গিয়েছে। ধুলো জমে আছে চারিদিকে। শুধু বারান্দার দুই কোণে দুটি রক্তকরবীর গাছ সতেজ সমারোহে অজস্র লাল ফুলে সমৃদ্ধ হয়ে বাতাসে দুলছে। ওই গাছ দুটির দিকে চেয়ে বসে আছেন বৃদ্ধ মশায়। প্রায় সত্তর বছর। বয়স;—স্থবির, ধূলিধূসর,দিক-হস্তীর মত প্রাচীন। এককালের বিশাল দেহের কাঠামো কুঞ্চিত দেহচর্মে ঢাকা; বক্ষপঞ্জর প্রকট হয়ে পড়েছে, মোটা মোটা হাততেমনি দুখানি পা, সামনে দেখবেন প্রকাণ্ড আকারের অতিজীর্ণ একজোড়া জুতো, পরনে থান-ধুতি-তাও সেলাই-করা; শোভা শুধু শুভ্ৰ গজদন্তের মত পাকা দাড়ি-গোঁফ; মাথার চুলও সাদা—কিন্তু খাটো করে ছাঁটা।
পুরনো আমলের একখানা খাটো-পায়া শক্ত তক্তপোশের উপর ছেঁড়া শতরঞ্জি বিছিয়ে বসে থাকেন। ফুলে-ভরা গাছ দুটির দিকে চেয়ে শুধু ভাবেন নানা ভাবনা। বিচিত্র এবং বহুবিধ।
ভাবেন-মানুষের চেয়ে গাছের আয়ু কত বেশি! ওই করবীর কলম দুটি তার বাবা লাগিয়েছিলেন—সে প্রায় ষাট বৎসর হল! আজও গাছ দুটির জীবনে এতটুকু জীৰ্ণতা আসে নাই।
ভাবনায় ছেদ পড়ে যায় তাঁর। কে যেন কোথায় অস্বাভাবিক বিকৃতস্বরে কী যেন বলছে। চারিদিকে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পান না। পরক্ষণেই হাসেন তিনি। হাটকুড়ো জেলের পোষা শালিক পাখিটা আশেপাশে কোনো গাছে বসে আছে, গাছতলায় পথে কাউকে যেতে দেখে কথা বলছে। বলছে-মাছ নাই! মাছ নাই! মাছ নাই!
পাখিটা সাধারণ পাখি থেকে খানিকটা ব্যতিক্রম। পোষমানা পাখিছাড়া পেয়ে উড়ে গেলে। আর ফেরে না। প্রথম প্রথম বাড়ির কাছে আসে–উড়ে বেড়ায়–চালে বসে–উঠানেও নামে কিন্তু খাঁচাতে আর ঢোকে না। এ পাখিটা কিন্তু ব্যতিক্রম। ওকে সকালে ঘঁচা খুলে ছেড়ে দেয়, পাখিটা উড়ে যায়, আবার সন্ধ্যার সময় ঠিক ফিরে আসে। খাঁচার দরজা খোলা থাকলে একেবারে খাঁচায় ঢুকে পড়ে। না থাকলে–খাঁচার উপর বসে ডাকে–মা-মা-মা! বুড়ো, বুড়ো, অ-বুড়ো!
বুড়ো হল হাটকুড়ো জেলে। হাইকুড়োর স্ত্রী ওকে বুড়ো বলে ডাকে। সেইটা পাখিটা শিখেছে। ওই পাখিটা বোধহয় কাছেই কোথাও বসেছে, জীবন দত্তকেই দেখে ডেকে কথা বলছে। মানুষের দর্শনে পাখিটা জীবনে সাৰ্থকতা লাভ করেছে। অন্তত লোকে তাই বলে। বলে পূর্বজন্মের সাধনা কিছু আছে। কেউ বলে—মানুষই ছিল পূর্বজন্মে, কোনো কারণে শাপগ্রস্ত হয়ে পক্ষী হয়ে জন্মেছে।
জীবন মশায় দাড়িতে হাত বোলান। সঙ্গে সঙ্গে হাসেন। জীবন জন্মান্তর সম্পর্কে বিশ্বাস এ যুগে উলটে-পালটে গেল। তাই তিনি কোনো ভাবনাই ভাবেন না। ঘন ঘন হাত বোলান। তিনি দাড়িতে। এক-একবার খুব ছোট করে ছাটা মাথার চুলের উপর হাত বোলান, বেশ লাগে। হাতের তালুতে সুড়সুড়ি লাগে।
সঙ্গে সঙ্গে ভাবেন, মুখুজ্জে তো এখনও এল না!
সে এলে যে দাবা নিয়ে বসা যায়। কালসমুদ্রের খানিকটা অন্তত রশিখানেক কাগজের নৌকায় পরমানন্দে অতিক্রম করা যায়। সেদিন শ্রাবণের অপরাহ্ব। মশায় পথের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। আকাশে মেঘ জমে রয়েছে। ঘুনি-ঘুনি বৃষ্টি পড়ছে, উতলা হাওয়া বইছে; অপরাহ্লােই ছায়া এমন গাঢ় হয়েছে যে সন্ধ্যা আসন্ন মনে হচ্ছে। কিন্তু সেতাবের সাদা-ছাউনি-দেওয়া ছাতা এর মধ্যে বেশ দেখা যাবে; বয়স হলেও জীবন মশায়ের চোখ বেশ তাজা আছে। ইদানীং সুচে সুতো পরাতে চশমা সত্ত্বেও একটু কষ্ট হলেও দূরের জিনিস বিশেষ করে কালোর গায়ে সাদা কি সাদার মধ্যে কালো ছাতার মত বড় জিনিস—চিনতে কোনো কষ্ট হয় না তার। দেহ সম্পর্কে ভাল যত্ন নিলে এটুকু দৃষ্টিহানিও বোধহয় হত না। সেতাবের দেহও ভাল আছে। মধ্যে মধ্যে সেতাবের নাড়ি তিনি পরীক্ষা করে দেখেন। বুড়োর যেতে এখনও দেরি আছে। নাড়ির গতি কী?
জীবন মশায়, নাড়ির মধ্যে, কালের পদধ্বনি অনুভব করতে পারেন। এটি তার পিতৃপিতামহের বংশগত সম্পদ। তাঁরা ছিলেন কবিরাজ। তিনি প্রথম ডাক্তার হয়েছেন।
কবিরাজি অবশ্যই জানেন। প্রয়োজনে দুই মতেই চিকিৎসা করে থাকেন। তবে এই নাড়ি দেখাই তাঁর বিশেষত্ব। নাড়ির স্পন্দনের মধ্যে রোগাক্রান্ত জীবনের পদক্ষেপ থেকে রোগীর রোগের স্বরূপ এবং কালের দ্বারা আক্রান্ত জীবনের পদক্ষেপ থেকে কাল কতদূরে তাও তিনি বুঝতে পারেন।
নিদান হকায় জীবন মশায়ের নাম ছিল—আজও আছে।
নাড়ি দেখে বহুজনের মৃত্যু তিনি পূর্বাহ্নেই ঘোষণা করেছেন তার চিকিৎসক জীবনে। একের পর এক রোগীর কথা পলকে পলকে মনে উঠে মিলিয়ে যায়। এই মনে পড়াটার গতি অতি অস্বাভাবিক রকমের দ্রুত। থেমে গেল এক জায়গায়। সুরেন মিশ্রের ছোট ছেলে শশাঙ্কের মৃত্যু ঘোষণার কথায়। মনে পড়ল শশাঙ্কের ষোড়শী বধূর সেই বিচিত্র দৃষ্টি; তার সেই মর্মান্তিক কথাগুলি।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন তিনি।
কত মৃত্যু, কত কান্না, কত নীরব মর্মান্তিক শোক তিনি দেখেছেন। রোগীর জীবনান্ত ঘটেছে–তিনি ভারী পায়ে স্থির পদক্ষেপে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা তিনি করেছেন, কিন্তু জেনেই যে, চেষ্টা ব্যর্থ হবে। মনকে প্রস্তুত রেখে করেছেন; এমন রোগীর বাড়ি থেকে চলে আসতেন—ভাবতে ভাবতেই পথ চলতেন। তখন পথে অতি অন্তরঙ্গ-জনও চোখে পড়ত না। রোগের কথা, চিকিৎসার কথা ভাবতেন; কখনও কখনও মৃত্যুর কথাও ভাবতেন। মশায়ের ভাবমগ্ন চিত্ত তখন বিশ্বলোক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাতার পর পাতা উলটে যেত। তাই বাইরের দৃষ্টিপথে মানুষ পড়েও পড়ত না। বহু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে দূরের গ্রামে, রোগীর মৃত্যুর পর বাধ্য হয়েই সেখানে প্রতীক্ষা করতে হত; শোকবিহ্বল পরিবারটির মধ্যে বসে থাকতেন অঞ্চল হয়ে, গুমটে ভরা বায়ুপ্রবাহহীন গ্রীষ্ম-অপরাহ্নের স্থির বনস্পতির মত। লোকে এইসব দেখে ডাক্তারদের বলে থাকে-ওরা পাথর। খুব মিথ্যে বলে না তারা। পাথর খানিকটা বটে ডাক্তারেরা। মৃত্যু এবং শোেক দেখে চঞ্চল হবার মত মনের বেদনাবোধও নষ্ট হয়ে যায়। মনে ঘটা পড়ে; সাড় হারিয়ে যায়। শশাঙ্কের মৃত্যু-রোগে মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ঘোষণা করতে গিয়ে আঘাত তিনি পেয়েছেন কিন্তু চিকিৎসকের কর্মে কর্তব্যে ত্রুটি তিনি করেন নি। তাঁর নিজের পুত্র–।
আবার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বিষণ্ণ হাসি হাসলেন। নিজের পুত্রের হাত দেখেও তিনি তার মৃত্যু ঘোষণা করেছিলেন। তিন মাস আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। একথা তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন। ছেলে ছিল ডাক্তার, তাকেও ইঙ্গিতে বুঝিয়েছিলেন। আজ ভাবেন–কেন বলেছিলেন এ কথা?
চিকিৎসাবিদ্যায় পারঙ্গমতার দম্ভে।
তাই যদি না হবে, সত্যকে ঘোষণা করে মনের কোণে আজও এমন বেদনা অনুশোচনা সঞ্চিত হয়ে রয়েছে কেন? ওই স্মৃতি মনের মধ্যে জেগে উঠলেই একটি ছি-ছি-কার সশব্দে মৰ্মস্থল থেকে বেরিয়ে আসে কেন? পরমানন্দ মাধবকে মনে পড়ে না কেন? উদাস দৃষ্টি তুলে মশায় তাকিয়ে থাকেন আকাশের নীলের দিকে। অথচ জানাতে হয়, বলতে হয়। তার বিধি আছে। চিকিৎসকের কর্তব্য সেটা। তার ক্ষেত্র আছে।
Leave a Reply