আরেকবার ক্ষুধিত পাষাণ – রবীন্দ্রনাথের প্যাশটিশ – মলয় রায়চৌধুরী
আমি এবং আমার আত্মীয় বিদেশ ভ্রমণ সারিয়া দিল্লি বিমানবন্দর হইতে কলিকাতায় ফিরিয়া আসিতেছিলাম, এমন সময়ে দিল্লি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের লাউঞ্জে সহযাত্রীটির সহিত পরিচয় হয় ; তিনি লণ্ডনে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে বক্তৃতা দিয়া স্বদেশে ফিরিতেছিলেন । তাঁহার বেশভূষা শ্মশ্রুকেশ দেখিয়া প্রথমটা তাঁহাকে পশ্চিমদেশীয় মুসলমান বলিয়া ভ্রম হইয়াছিল । তাঁহার কথাবার্তা শুনিয়া আরো ধাঁধা লাগিয়া যায় । আলোকচিত্র বিষয়ে তো অবশ্যই, এতদ্ব্যতীত পৃথিবীর সকল বিষয়েই এমন করিয়া আলাপ করিতে লাগিলেন, যেন তাঁহার সহিত প্রথমে পরামর্শ করিয়া বিশ্ববিধাতা সকল কাজ করিয়া থাকেন । বিশ্বসংসারের ভিতরে ভিতরে যে এমন সকল অশ্রুতপূর্ব নিগূঢ় ঘটনা ঘটিতেছিল, রুশিয়ানরা যে এতোদূর অগ্রসর হইবার পরও আত্মধ্বংসের পথে চলিয়া গিয়াছে, চিনারা চেয়ারম্যান মাওয়ের বিশাল তৈলচিত্র টাঙাইয়া সাম্যবাদের পুঁজিবাদী পরীক্ষায় সফল হইয়াছে, পেটরল লইয়া আমেরিকানদের যে এমন সকল গোপন মতলব আছে, দেশীয় রাজনৈতিক নেতাদের অধঃপতন এবং বপুর স্ফীতি সীমা অতিক্রম করিয়াছে, গণতন্ত্র যে এমন খিচুড়ি পাকিয়া উঠিয়াছে, টাকার এভারেস্টে না উঠিলে নির্বাচনের শৃঙ্গ জয় অসম্ভব, এ সমস্ত কিছুই না জানিয়া আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত হইয়া ছিলাম ।
বাবুটি প্রকৃত কৃষ্ণবর্ণ, তাই বলিয়া তাঁহার গায়ে ভ্রমর বসিলে যে দেখা যাইবে না, অথবা কালি মাখিলে জল মাখিয়াছেন বোধ হইবে, কিংবা জল মাখিলে কালি মাখিয়াছেন বোধ হইবে, এমন নহে । যেরূপ কৃষ্ণবর্ণ আপনার ঘরে থাকিলে শ্যামবর্ণ বলি, পরের ঘরে হইলে পাতুরে কালো বলি, বাবুটির ত্বক সেইরূপ কৃষ্ণবর্ণ । তাঁহার চক্ষুদুটি এরূপ যেন সদাসর্বদা অগ্নিস্ফূলিঙ্গ নির্গত হইতেছে । দারপরিগ্রহে জ্ঞানোপার্জনের বিঘ্ন ঘটে আশঙ্কায় নিতান্ত নিরুৎসাহে অদ্যাবধি বাবুটি দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন নাই, বসতবাটী হইতে দূরে রাজস্হানি মারোয়াড়ি অধ্যুষিত আকাশচুম্বী অট্টালিকায় একটি দুই কামরার আবাস ভাড়া লইয়া কম বয়সী যুবতীর সহিত একত্রে বসবাস করিতেছেন, সে তথ্য স্বয়ং স্বীকার যাইলেন ।
আলোকচিত্র-বিশেষজ্ঞ আমাদের নবপরিচিত আলাপিটি ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন : There happen more things in haven and earth. Horatio, than are reported in your newspapers. আমরা বহুকাল ইউরোপ আমেরিকায় সময় অতিবাহিত করিয়া স্বগৃহে ফিরিতেছি, সুতরাং আলোকচিত্র-বিশেষজ্ঞ লোকটির রকমসকম দেখিয়া অবাক হইয়া গেলাম । লোকটা সামান্য উপলক্ষে কখনো বিজ্ঞান বলে, কখনো বেদের ব্যাখ্যা করে, কখনো ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায় স্লোগানের বোমাবাজদিগের বহুরূপীস্বভাবের গল্প বলে, পাকিস্তানের দাবি করিয়া যে উচ্চবর্ণ বাঙালিরা নিম্নবর্গদিগকে ফেলিয়া পূর্ববঙ্গ হইতে ভারতে পলাইয়া আসিয়াছিল এবং সিংহাসনে বসিয়া পরমানন্দে আখের গোছাইয়া লইয়াছে তাহাদের গোপন কাহিনি শোনায় , আবার কখনো কোয়ান্টাম ফিজিক্স ও উত্তরাধুনিকতা আওড়াইতে থাকে । বিজ্ঞান, বেদ, মার্কসবাদী পুঁজিবাদ, জাতিপ্রথা-নির্ভর গান্ধিবাদ এবং কোয়ান্টাম ফিজিক্সে আমাদের কোনোরূপ অধিকার না থাকাতে, তাঁহার প্রতি আমাদের ভক্তি উত্তরোত্তর বাড়িতে লাগিল।
আমার সমাজবাদী ঠিকেদার আত্মীয়টির মনে দৃঢ় বিশ্বাস হইল যে, আমাদের এই আলোকচিত্র-বিশেষজ্ঞ সহযাত্রীর সহিত কোনো-এক রকমের অলৌকিক ব্যাপারের কিছু একটা যোগ আছে — কোনো-একটা অপূর্ব চৌম্বকত্ব অথবা দৈবশক্তি, অথবা সূক্ষ্ম শরীর, অথবা ঐ ভাবের একটা-কিছু । তিনি এই অসামান্য মানুষটির সমস্ত সামান্য কথাও ভক্তিবিহ্বল মুগ্ধভাবে শুনিতেছিলেন এবং গোপনে নোট করিয়া লইতেছিলেন । আমার ভাবে বোধ হইল, অসামান্য ব্যক্তিটিও গোপনে তাহা বুঝিতে পারিয়াছিলেন এবং কিছু খুশি হইয়াছিলেন ।
আমার সমাজবাদী ঠিকেদার আত্মীয়টির কার্যকলাপ স্বচক্ষে দেখিয়া ভূমিসংস্কারক নেতা বিনয় চৌধুরী একদা বলিয়াছিলেন যে বঙ্গদেশের গণতন্ত্র বাই দি ঠিকেদার ফর দি ঠিকেদার অফ দি ঠিকেদার হইয়া গিয়াছে । আত্মীয়টি সিন্ডিকেট নামক একটি যুবক-সমবায় স্হাপন করিয়া প্রচুর কাঁচা টাকা একত্র করিয়াছিলেন এবং বিদেশভ্রমণের সাধ মিটাইবার ও বিখ্যাত মণীষীদের সাক্ষাৎ পাইবার জন্য রক্তপিপাসু জোঁকের ন্যায় আমার সঙ্গ লইয়াছিলেন । বিদেশে আমরা আলবার্ট আইনস্টাইন, রমাঁ রোলাঁ, এইচ জি ওয়েলস, ডাবলিউ বি ইয়েটস, এজরা পাউণ্ড, রবার্ট ব্রুজেস, আরনেস্ট রাইস, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, আগা খাঁ, রেজা শাহ পহলভি, হেনরি বার্গসঁ, রবার্ট ফ্রস্ট, টমাস মান, জর্জ বার্নার্ড শ, বেনিতো মুসোলিনি প্রমুখের সহিত দেশ ও দশের কল্যাণের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সারিয়ে ফিরিতেছিলাম ।
সমাজবাদী ঠিকেদার আত্মীয়টির প্রপিতামহ অভিবক্ত বঙ্গের স্বনামধন্য মানুষ ছিলেন, সেই সময়ের বঙ্গে, বর্তমানে যাহা ভারতীয় বঙ্গ ও বাংলাদেশ নামে দুইটি পৃথক দেশ, উভয় অংশেই তাঁহার প্রভূত জমিদারি জমিজমা ছিল এবং আফিম ও নীল চাষ হইত । চিনদেশে আফিম রপ্তানি করিয়া এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গগণকে নিয়মিত রৌপ্যমুদ্রা উপঢৌকন দিয়া কলিকাতায় একখানি বৃহৎ পারিবারিক অট্টালিকা নির্মাণ করিয়াছিলেন । কথিত আছে যে বিলাতে তাঁহার আকস্মিক মৃত্যু হয় এবং তথায় তাঁহাকে সমাধিস্হ করা হইয়াছিল, যদ্যপি তাঁহার বঙ্গদেশীয় হৃৎপিণ্ডখানি কর্তিত করিয়া স্বদেশে আনিয়া ধর্মমতে কলিকাতায় অন্ত্যষ্টি করা হইয়াছিল । কিন্তু আত্মীয়টির পিতামহ খ্রিস্টধর্মাবলম্বীগণের ধর্মাচরণ ও ধর্মগ্রন্হে আকৃষ্ট হইয়া তদৃশ একটি ধর্মস্হাপনের প্রয়াসে আত্মনিযুক্ত হইবার ফলে প্রপিতামহের ব্যবসায় এবং জমিদারির চাষবাস এতোই অবহেলিত হয় যে ক্রমে তাঁহাদের সন্তান-সন্ততি ধর্ম ও বিদ্যাশিক্ষায় আগ্রহান্বিত হইয়া প্রপিতামহের ব্যবসায়কে অতল জলরাশিতে নিমজ্জিত করিয়া দেন । পরবর্তী প্রজন্মের বংশধরগণ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন নাই যে ঐশ্বর্যের নিজের কোনো লজ্জাবোধ নাই । যাহাই হউক, সমাজবাদী ঠিকেদার আত্মীয়টি তাহা বুঝিতে পারিয়াছেন এবং উত্তরঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ধনবৈভবের পূজারীরূপে প্রতিষ্ঠা পাইয়াছেন ।
আমি যখনই বিদেশযাত্রা করি, অথবা স্বদেশেও কোথাও ভ্রমণে যাইলে সঙ্গী লইয়া যাইতে পছন্দ করি, এই জন্য যে তাঁহারা পরবর্তীকালে আমাকে লইয়া স্মৃতিকথা লিখিয়া কিঞ্চিদধিক রোজগারপাতি করিবেন, এবং তাঁহাদের স্মৃতিকথার উপর নির্ভর করিয়া অধ্যাপকবৃন্দ আমাকে লইয়া ইচ্ছামতো গল্প ফাঁদিতে পারিবেন ও ছাত্রছাত্রীদিগকে পিএইচ ডি পাইতে পথনির্দেশ করিতে পারিবেন । একই কারণে আমি গুণগ্রাহী তরুণ-তরুণী এবং আত্মীয়-অনাত্মীয় পরিচিত-অল্পপরিচিত ব্যক্তিগণকে নিয়মিত চিঠি লিখিয়া থাকি, যাহাতে তাঁহারা আমার মৃত্যুর পর চিঠিগুলি ভাঙাইয়া খাইতে পারেন, আমার আলোকে কিঞ্চিদধিক অন্ধকারের বাহিরে আসিবার সুযোগ লইতে পারেন, আমার জীবনের দুঃখজনক ঘটনাবলী ফেনাইয়া কেচ্ছা লিখিয়া কোটিপতি হইতে পারেন ।
লণ্ডনের হিথরো বিমানবন্দর হইতে আসিয়া আমাদের বিমানটি দিল্লিতে নামাইয়া দিল, আমরা দমদমগামী বিমানের অপেক্ষায় লাউঞ্জে সমবেত হইলাম। তখন রাত্রি সাড়ে দশটা । কলকাতায় সার্বিক ধর্মঘট অথবা ব্রিগেড সমাবেশ জাতীয় একটা-কী ব্যাঘাত হওয়াতে বিমান অনেক বিলম্বে আসিবে শুনিলাম । আমি সন্ধ্যার পান-ভোজন সারিয়া ইতিমধ্যে মখমলশোভিত সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমাইব স্হির করিয়াছি, এমন সময়ে আলোকচিত্র-বিশেষজ্ঞ অসামান্য ব্যক্তিটি নিম্নলিখিত গল্প ফাঁদিয়া বসিলেন । যৎসামান্য সিঙ্গল মল্ট পান সত্ত্বেও সে রাত্রে আমার আর ঘুম হইল না :—
ইন্টারন্যাশানাল জিওগ্রাফিক পত্রিকার পক্ষ হইতে বিদেশে কয়েকটি অভিশপ্ত প্রাসাদ ও গৃহাদির গোপন কাহিনি ও আলোকচিত্রের কর্মটি সুসম্পন্ন করিবার পর পত্রিকা কর্তৃপক্ষ ভারতের শরিফাবাদে অবস্হিত অভিশপ্ত অট্টালিকাটির আলোকচিত্র তুলিয়া একটি নিবন্ধ লিখিবার প্রস্তাব দিলে আমি তৎক্ষণাত রাজি হইয়া গিয়াছিলাম । আলোকচিত্র হইল আমার মাদকীয় আধ্যাত্মিকতা ।
তখন দেশ অরাজক । ইংরাজ শাসক স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন । ইংরাজ শাসকের পর যাহারা গদিনশীন হইল তাহারা দেশকে ছারখার করিয়া দিবার খেলায় মত্ত হইয়া গেল । যাহারা গদিনশীন হইবার প্রয়াস করিতেছিল, তাহাদের অত্যাচারে বরেন্দ্রভূমি ডুবিয়া যাইতেছিল । অনেকেই কেবল খাইতে পায় না তা নয়, গৃহে পর্যন্ত বাস করিতে পারে না । যাহাদের খাইবার নাই তাহারা পরের কাড়িয়া খায় । কাজেই গ্রামে গ্রামে দলে দলে চোর-ডাকাত । কাহার সাধ্য শাসন করে । পারস্পরিক হত্যা, গ্রাম হইতে বিতাড়ন, জলচল বন্ধ, পাকা ফসল ও খামারে অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদির মাধ্যমে শাসক ও বিরোধী সম্প্রদায় জনগণকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস করিতেছিল ।
অভিশপ্ত প্রবন্ধশৃঙ্খলা লিখিবার নিমিত্ত প্রথমে গিয়াছিলাম ক্যাম্বোডিয়াস্হিত তুয়োল স্লাঙ গণহত্যা প্রদর্শশালায় । এই গৃহটি তৎকালীন একাধিপতি পল পটের গুপ্তচরগণ, যে নাগরিকদিগকে সন্দেহ করিত তাহাদের তুলিয়া আনিয়া যৎপরোনাস্তি যন্ত্রণা দিয়া হত্যা করিত । চিকিৎসক অধ্যাপক শিক্ষক প্রযুক্তিবিদ বিজ্ঞানী প্রমুখ ব্যক্তিগণকে চাষবাসে নিযুক্ত করিয়াছিলেন পল পট, এবং তাঁহার বশংবদগণ সন্মানীয় ব্যক্তিগণকে খেতে-খামারে অকর্মণ্যতার জন্য চাবুক দ্বারা পিটাইত, বন্দুকের গুঁতা দিয়ে অষ্টপ্রহর খাটাইত, যে কারণে তাঁহারা প্রায় সবাই মৃত্যু বরণ করেন । প্রদর্শশালায় বর্তমানে সতেরো হাজারেরও বেশি নিহত মানুষের চিৎকার শুনিতে পাওয়া যায় ; পল পট যে কতো লক্ষ মানুষকে যাতনা দিয়া হত্যা করিয়াছিল তাহার হিসাব মেলে নাই, কিন্তু সেই নিহত মানুষগুলির ছায়াশরীর এখনও যাতনাদানকারীদিগের বংশধরদের পিছু ধাওয়া করে । আমি আমার শব্দধারকযন্ত্রে চিৎকারের কিয়দংশ ধরিয়া রাখিয়াছি, লিখিবার সময়ে ক্রন্দনাশ্রুর অনুনয়-বিনয় শুনিলে বাক্যাদি স্বাবলীলতায় কলমের সূচ্যাগ্রে চলিয়া আসে । বিস্ময়ের ব্যাপার হইল যে বামপন্হীগণ তিরিশ বৎসরেরও বেশি পশ্চিমবঙ্গে পলপটিয় সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস করিলেও অদ্যাপি কেহই পল পট সম্পর্কে কোনো কথা বলা সমিচীন মনে করেন নাই, তাহাঁদের মৌনতা একটি হুডিনি রহস্য ।
স্কটল্যাণ্ডের এডিনবরায় মেরি কিংস ক্লোজ নামে একটি অভিশপ্ত অঞ্চলের আলোকচিত্র লইবার নির্দেশ পাইয়া কয়েক দিন কাটাইবার পর এক পক্ককেশ বৃদ্ধা ও একটি কম বয়সি মেয়ের ছায়াশরীরের অস্তিত্ব জানিতে পারি ; ভ্রমণকারীগণও অনেকে তাহাদের উপস্হিতি, পদধ্বনি ও হাসাহাসি শুনিতে পায় । আপনারা ইউনাইটেড কিংডম ভ্রমণে যাইলে অবশ্যই মেরি কিংস ক্লোজ দেখিয়া আসিবেন । সন্ধ্যার পর পর্যটকগণের প্রবেশ নিষেধ । দুর্ভাগ্য যে আমার আলোকচিত্রগুলিতে সেই বৃদ্ধা ও তাহার নাতনির মৃত্যুপরবর্তী ছায়াশরীরের কোনও আভাস ভাসিয়া উঠে নাই । আমার যন্ত্রে তাঁহাদের কন্ঠস্বরও ধরিয়া রাখিতে পারি নাই ।
আমাদিগের দেশে রাজস্হান রাজ্যের আলওয়ারে ভাঙ্গার দুর্গে অবশ্যই যাইবেন । কথিত আছে যে জনৈক স্বাস্হ্যবান তন্ত্রসাধনাকারী যুবক প্রাসাদনিবাসিনী এক সুন্দরী রাজকন্যার প্রেমে আক্রান্ত হইয়া জাদুটোনার মাধ্যমে যুবতীটিকে বশীভূত করিবার প্রয়াসে বিফল হইবার পর আত্মহত্যা করিয়া লয় এবং মৃত্যুশয্যায় অভিশাপ দিয়া যায় যে দুর্গস্হিত সকলেই কয়েক দিবসের ভিতর উন্মাদ হইয়া যাইবে । কেহ উন্মাদ হইয়াছিল কিনা তাহার কোনো প্রমাণ নাই, তথাপি সন্ধ্যার পর দুর্গটিতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করিয়া দেয়া হইয়াছে । বহু ভ্রমণার্থী মস্তিষ্কবিকারে আক্রান্ত হইয়াছেন । সন্ধ্যার পর দুর্গটিতে উন্মাদ অপচ্ছায়াদের চিৎকার এবং তান্ত্রিকের অট্টহাস্য শোনা যায় । এক্ষেত্রে আমার আলোকচিত্রে যদিও প্রমাণ পাই নাই, কন্ঠস্বর ধরিয়া রাখার যন্ত্রে উন্মাদ মানুষের চিৎকার ও তান্ত্রিকের অট্টহাস্য ধরা পড়িয়াছিল । ইন্টারন্যাশানাল জিওগ্রাফিকের সম্পাদক মহাশয় বলিয়াছিলেন যন্ত্রটি বহু পুরাতন বলিয়া অমন আওয়াজ হইতেছে, বিজ্ঞানীগণ শুনিলে বিশ্বাস যাইবেন না।
তাহার পর গিয়াছিলাম সিংগাপুরের পুরাতন চাঙ্গি চিকিৎসালয় ভবনে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপানি সৈন্যগণ ভবনটিতে শত্রুসেনাগণকে অকথ্য যন্ত্রণা দিত এবং দেহগুলি এলাইয়া পড়িলে হত্যা করিত । বহু ভারতীয় সৈন্যকে তাহারা যাতনা দিয়া হত্যা করিয়াছে । পর্যটকগণ যন্ত্রণাকাতর মানুষের ক্রন্দন শুনিতে পান, মৃতদেহ ছুঁড়িয়া ফেলিবার শব্দ শুনিতে পান, ভারতীয় সৈন্যগণের হিন্দুস্তানি ভাষায় ক্রন্দন শুনিতে পাওয়া যায়, জাপানি সেনার বুটজুতার পদশব্দ শোনা যায় । আমিও শুনিয়াছি কিন্তু আলোকচিত্রগুলিতে সেই ক্রন্দন ও মৃতদেহ ফেলিয়া দিবার আভাস ধরিতে পারি নাই ।
মেক্সিকোয় জোচিমিলকো নামে একটি স্হানের জনহীন দ্বীপে গিয়াছিলাম । দ্বীপটি এতোই অভিশপ্ত যে জলযানগুলি ভ্রমণকারীদের লইয়া দ্বিপ্রহরেই ফিরিয়া চলিয়া আসে । তথায় একদিন যে সময়ে মেঘপূঞ্জ স্বর্ণমালাবৎ পশ্চিম গগনে বিরাজ করিতেছিল, তৎসময়ে একটি বালিকা তাহার ডলপুতুল সামলাইতে গিয়া জলমগ্ন হইয়া মারা যায় । বালিকাটির আত্মার শান্তির জন্য জনৈক ব্যক্তি প্রচুর ডলপুতুল লইয়া গিয়া দ্বীপটিতে রাখিয়া আসিত । একদিন সেই ব্যক্তিটি সেই একই স্হানে জলে ডুবিয়া মারা যায় যেস্হানে বালিকাটি জলমগ্ন হইয়া অপঘাতে মারা গিয়াছিল । দিবাদ্বিপ্রহরেও বালিকার খিলখিল হাসি শুনিতে পাওয়া যায়। দ্বীপের যত্রতত্র রক্ষিত ডলপুতুলগুলি পর্যটকদিগের পানে তাকাইয়া থাকে এবং বহু ভ্রমণার্থী সেই দৃষ্টি এবং খিলখিল হাসি হইতে সারা জীবনেও মুক্তি পায় নাই । সৌভাগ্যবশত আমাকে কোনও ডলপুতুল বশীকরণ করিতে পারে নাই ।
এক্ষণে একটি অভিশপ্ত অরণ্যের কথা বলিব । ঘন অরণ্যটি জাপানের আকিগাহারায় স্হিত । বহু জাপানি যুবক-যুবতী এমনকী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাগণও সেই জঙ্গলে গিয়া আত্মহত্যা করিয়াছেন । অরণ্যে প্রবেশ করিবার পর তাঁহাদিগকে আর খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই । আজও অনেক হতাশ্বাস মানুষ চুপি-চুপি অরণ্যটিতে প্রবেশ করিয়া হারাইয়া যান, এবং আত্মীয়গণ অনুমান করেন যে তাঁহারা আত্মহত্যা করিয়া লইয়াছেন । অরন্যটির ভিতর দিবাবসানে বহু মানুষের হাহাকার ও বক্ষ-চাপড়ানি শুনিতে পাওয়া যায় । কর্তৃপক্ষের নির্দেশ আছে যে ভ্রমণের জন্য অরন্যটিতে প্রবেশ করিলে পথে পথে সীতার অলঙ্কারের ন্যায় চিহ্ণাদি রাখিয়া যেন অগ্রসর হন । অত্যন্ত ঘন জঙ্গল, আমি স্হানীয় এক অরণ্যপ্রদর্শক লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়াছিলাম, সবুজের বিভিন্নপ্রকার পার্থক্যসমাবেশে আলোকচিত্রগুলি চমৎকার ফুটিয়া উঠিয়াছিল, এবং একাধিক বৃক্ষের শাখা হইতে যেন গলায় রজ্জু বাঁধিয়া মানুষ ঝুলিয়া আছে এমত ইশারা চাক্ষুষ করিয়াছিলাম ।
এইবার স্বদেশের একটি অট্টালিকার ঘটনা বলিব । ইন্টারন্যাশানাল জিওগ্রাফিক নির্দেশ দিয়াছিল যে এবার যেন ভারতের শরিফাবাদের বহুল প্রচারিত অবহেলিত ও অতিঅভিশপ্ত খণ্ডহরটির আলোকচিত্রসহ ছায়াশরীরগণের চিৎকার ও ক্রন্দন ও তথ্যাদি সংগ্রহ করিয়া পাঠাই । অর্ধশতকাধিক পূর্বে যে উগ্রক্ষত্রিয় পরিবার খণ্ডহরটিতে বাস করিতেন, তাঁহাদের পরিবারের জনৈক জীবিত সদস্য একজন তত্ত্ববধায়ক নিযুক্ত করিয়াছেন যিনি তাঁহাদের ভগ্নপ্রায় নিবাসটিতে দিবাবসান পর্যন্ত থাকেন । শরিফাবাদ নিবাসী আমার শ্যালক, অর্থাৎ মৃত স্ত্রীর বৃদ্ধ ভ্রাতা, অভিশপ্ত অট্টালিকাটির বিষয়ে তথ্যাদি দিবার পর আমি সেই অট্টালিকাটিকে কেন্দ্র করিয়া আলোকচিত্রের কর্ম আরম্ভ এবং তথ্যাদি সংগ্রহ করা মনস্হ করি। শ্রীমতী ঝুমা চট্টোপাধ্যায় নামক এক প্রথিতযশা লেখিকা-আলোকচিত্রী অভিশপ্ত অট্টালিকাটির কাহিনি ও আলোকচিত্র সংগ্রহ করিয়া আমাকে এতদ্বিষয়ে সম্যক অবহিত করিয়াছিলেন, আমি তাঁহার অবদানের জন্য কৃতজ্ঞ ।
শরিফাবাদস্হ খণ্ডহরের অভিশপ্ত দ্বিতল অট্টালিকাটির কেয়ারটেকার অর্থাৎ তত্ববধায়ক মহাশয়ের সহিত আমার শ্যালকের বহুদিনের পরিচয় ছিল । সহৃদয় তত্ববধায়ক মহাশয় আমাকে সেই অট্টালিকারই একটি অব্যবহৃত পরিত্যক্ত ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করিয়া খাট-বিছানা পাতিয়া, মশারির ব্যবস্হা করিয়া, টেবিল-চেয়ার আনিয়া দিয়া থাকিবার ব্যবস্হা করিয়া দিলেন । প্রথম দর্শনেই স্পষ্ট হইয়া গিয়াছিল যে আমার পূর্বে ঘরটি কেহ বহুকাল ব্যবহার করে নাই, অর্ধশতাধিক কাল চুনকাম হয় নাই । একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত অট্টালিকা যে অভিশপ্ত তাহা আলোকচিত্রে ধরিয়া রাখিবার জন্য তথায় দুই-তিন দিন রাত্রিবাস প্রয়োজন, মনে করিয়াছিলাম, যেমন নামিবিয়ার জীবজন্তুর আলোকচিত্র লইবার সময়ে জঙ্গলের ভিতরেই তাঁবু খাটাইয়া রাত্রিবাস প্রয়োজন ছিল।
যে সময়ে শরিফাবাদের দ্বিতল অট্টালিকাটি অভিশপ্ত হয় নাই, সেসময়ে বিজলি ব্যবস্হা ছিল, যত্রতত্র বিজলির তার ভাঙা টিউবলাইট ঝুলিতে দেখিয়া অনুমান করিলাম, এখন তত্ববধায়ক মহাশয় কেরোসিন লন্ঠন এবং মোমবাতি জ্বালাইয়া সন্ধ্যাপর্যন্ত এই গৃহে থাকেন । সন্ধ্যা হইলে নিজ বাসভবনে চলিয়া যান ।
প্রথম দিবসেই মাথার উপরে শব্দতরঙ্গে আকাশমণ্ডল ভাসাইয়া পাপিয়া ডাকিয়া গেল । অনুমান করিলাম শুভলগ্নেই অট্টালিকাটিতে প্রবেশ করিয়াছি ।
তৎকালে জায়গাটি বড়ো রমণীয় ছিল । নির্জন পাহাড়ের নিচে বড়ো-বড়ো বনের ভিতর দিয়া দক্ষিণ-পশ্চিমে দ্বারকেশ্বর ও দামোদর নদী দুটি, পূর্বপ্রান্ত ভাগিরতী ও উত্তরে অজয় নদী উপলমুখরিত পথে নিপুণা নর্তকীর মতো পদে পদে বাঁকিয়া বাঁকিয়া দ্রুত নৃত্যে চলিয়া গিয়াছে । ঠিক সেই নদীর ধারেই পাথরবাঁধানো বহুসোপানময় অত্যুচ্চ ঘাটের উপর একটি প্রাচীন স্হাপত্যের অট্টালিকা শৈলপদমূলে একাকী দাঁড়াইয়া আছে — নিকটে কোথাও লোকালয় নাই । খণ্ডহরের তত্ত্ববধায়ক মহাশয় বলিয়াছিলেন দ্বিতল অট্টালিকাটিতে একদা একটি উগ্রক্ষত্রিয় জমিদার পরিবার থাকিত, তাঁহাদের প্রচুর জমিজমা খেত-খামার ছিল । বাড়িটি অভিশপ্ত হইবার পূর্বে জমিদারের খেতগুলি ও ফসলের আড়ত এই স্হান হইতে কিয়ৎক্রোশ দূরে ছিল । সে সময়ে এই অঞ্চলে জোতদারেগণ সংখ্যায় শতাধিক, তখনও জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয় নাই ।
তত্তববধায়ক মহাশয়ের কাছে শুনিয়াছিলাম, তৎকালে যাহারা শরিফাবাদের প্রাচীন নিবাসী ছিলেন না, অন্যত্র হইতে আসিয়া তথায় ঘর বাঁধিবার প্রয়াস করিতেছেন, বিশেষ করিয়া দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান হইতে আশ্রয়প্রার্থীর দল, তাঁহারা কলহাস্যমুখর পরিবারের সেই দ্বিতল অট্টালিকা, যাহার মধ্যস্হলে একটি সুন্দর উদ্যান ছিল, তাহা দেখিয়া হিংসায় ও বিদ্বেষে জ্বলিয়া পুড়িয়া মরিতেন এবং মনে-মনে ষড় করিতেন যে কখনও সুযোগ পাইলে প্রাসাদটিকে আক্রমণ করিয়া বিদ্ধস্ত করিয়া দিবেন, ভূস্বামীর বৈভব প্রদর্শনের গর্বের জন্য নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে উগ্রক্ষত্রিয় গৃহনিবাসীদের উচিত শিক্ষা দিবেন । এই সংবাদ আমি পরবর্তীকালে অট্টালিকার তত্ত্ববধায়কের নিকট পাইয়াছিলাম, তৎসত্ত্বেও এই গৃহের নিবাসীগণের প্রতিই যে কেন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শীগণ বিদ্বিষ্ট হইয়াছিলেন তাহা তিনি ব্যাখ্যা করিতে পারেন নাই, আরও বহু ধনী জোতদারগৃহ তো শরিফাবাদে ছিল। সে যাহাই হউক, ভগ্নপ্রায় অট্টালিকাটি আলোকচিত্র লইবার উপযুক্ত ছিল ; এই প্রকার আরও অভিশপ্ত পরিবার ও গৃহাদি অন্যত্র খুঁজিয়া পাইব কিনা নিশ্চিত ছিলাম না । রাজনৈতিক মতাদর্শীগণ প্রকৃতই তাঁহাদের রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন কিনা, তদ্বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল এবং পরবর্তীকালে তাঁহাদের কার্যকলাপ, চরিত্রদূষণ, হিংসা, প্রতিশোধস্পৃহা ও লোভ দেখিয়া আমার সন্দেহ আরও দৃঢ় হইয়াছে, তাঁহারা বহুলাংশে মতাদর্শ জলাঞ্জলি দিয়া লোভের আবর্তে নামিয়া ভিন্নমতাদর্শীগণের অনুচররূপে দাসখৎ লিখিয়া দিয়াছেন । ইহা মানবসমাজের উত্তর-সত্যের যুগ, নাগরিকগণ ক্রীড়নক মাত্র ।
####
১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রশাসনের সহিত জমিদার জোতদার তালুকদারদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্হায় তাঁহারা ভূসম্পত্তির নিরঙ্কুশ অধিকারী হন ; স্বত্বাধিকারের সুবিধার সাথে চিরস্হায়ীভাবে অপরিবর্তনীয় এক নির্ধারিত হারের রাজস্বের জমিদারিস্বত্বও তাঁহারা লাভ করেন।
সেই সময়ের এক উগ্রক্ষত্রিয় জমিদার মহাশয় এই দ্বিতল অট্টালিকাটি নির্মাণ করাইয়াছিলেন । তখন স্নানশালার ফোয়ারার মুখ হইতে গোলাপগন্ধি জলধারা উৎক্ষিপ্ত হইতে থাকিত এবং সেই শীকরশীতল নিভৃত গৃহের মধ্যে মর্মরখচিত স্নিগ্ধ শিলাসনে বসিয়া, কোমল নগ্ন পদপল্লব জলাশয়ের নির্মল জলরাশির মধ্যে প্রসারিত করিয়া, তরুণী বাঙালি রমণীগণ চুলে জবাকুসম তেল মাখিয়া, স্নানের পূর্বে দীর্ঘ কুঞ্চিত কৃষ্ণকেশ মুক্ত করিয়া দিয়া, রবীন্দ্রসঙ্গীত অথবা অতুলপ্রসাদী গান করিতেন । খণ্ডহরটিতে আজও সেই গানের আবছা রেশ ক্বচিৎ-কখনও বাতাসে ভাসিয়ে বেড়ায় ।
লাহোরে শাহজাদা সেলিমের প্রেমিকা আনারকলিকে যেভাবে সম্রাট আকবরের নির্দেশে ইষ্টক গাঁথিয়া জীবন্ত সমাধিস্হ করা হইয়াছিল, সেই পদ্ধতিতেই এই অভিশপ্ত অট্টালিকাটির সদর দরজার সন্মুখভাগ ইষ্টক গাঁথিয়া বন্ধ করিয়া দেয়া হইয়াছে, গৃহস্হিত উদ্যানটির চতুর্দিকে অবিন্যস্ত অনিয়ন্ত্রিত ঝোপঝাড়, নামহীন লতা সুযোগ পাইয়া সরিসৃপের ন্যায় আঁকিয়া-বাঁকিয়া অন্দরে-কন্দরে প্রবেশ করিয়াছে, দ্বিতলের সিঁড়ি বাহিয়া উপরের ঘরগুলিতে নিজস্ব নৃত্যছন্দে হস্তপদ মেলিয়া দিয়াছে ।
এখন আর সে ফোয়ারা খেলে না, সে গান নাই, সাদা পাথরের উপর শুভ্র চরণের সুন্দর আঘাত পড়ে না — এখন ইহা আমাদের মতো নির্জনবাসপীড়িত সদাভ্রাম্যমান পেশাদার আলোকচিত্রীর অতিবৃহৎ এবং অতিশুন্য সাময়িক বাসস্হান । কিন্তু তত্ত্ববধায়ক এবং আমার শ্যালক উভয়েই আমাকে এই অট্টালিকার একটি পরিত্যক্ত বিজলিহীন ঘরে বাস করিতে বার বার নিষেধ করিয়াছিলেন ; বলিয়াছিলেন, “ইচ্ছা হয় দিনের বেলা থাকিবেন, কিন্তু কখনো এখানে রাত্রিযাপন করিবেন না ; স্পেনের ইনকুইজিশনের কাহিনি শুনিয়াছেন তো, ভিন্নবিশ্বাসী স্ত্রী-পুরুষকে জীবন্ত দগ্ধ করা হইত ? এই অট্টালিকায় দিন নাই রাত্রি নাই সেই অতিনিষ্ঠুর লুন্ঠন-অভিলাষী অগ্নিসংযোগকারীদের উল্লসিত কন্ঠস্বর ধোঁয়ার ন্যায় জাগিয়া উঠে, ছায়াশরীরেরা লুন্ঠনকারীর ন্যায় আমোদনৃত্য করে, আপনি বারুদের গন্ধ পাইলে অবাক হইবার কিছু নাই ।”
আমি হাসিয়া উড়াইয়া দিলাম । তত্তবধায়ক বলিলেন, তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার সঙ্গে থাকিবেন, কিন্তু রাত্রে এখানে থাকিবেন না, স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করিবেন । আমি বলিলাম, “তথাস্তু” । এই অভিশপ্ত খণ্ডহরের এমন রহস্য ও কিম্বদন্তি ছিল যে, রাত্রে দলীয় মাস্তানগণও এখানে আসিয়া গঞ্জিকা সেবনের আড্ডা দিতে সাহস করিত না , এবং পুলিশও জেল পলাতক কয়েদির অনুসন্ধানে এ-মুখো হইত না। সন্মুখের দ্বার ইষ্টক গাঁথিয়া বন্ধ করিয়া কর্তৃপক্ষ সম্রাট আকবরের ন্যায়ই এই গৃহের জীবনালোক নির্বাপিত করিয়া নিশ্চিন্ত ছিলেন বলিয়া অনুমান করি । একদা এই অট্টালিকা উৎফুল্লকমলজালশোভিত, বিহঙ্গমাক, স্বচ্ছ বারিবিশিষ্ট শান্তিনিকেতন ছিল, তাহা অনুমান করিতেও কষ্ট হয় ।
প্রথম প্রথম গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া লতাগুল্মে আচ্ছন্ন এই পরিত্যক্ত ভগ্নপ্রায় অবহেলিত অট্টালিকার বিজনতা আমার বুকের উপর যেন একটা ভয়ংকর ভারের মতো চাপিয়া থাকিত, সূর্যোদয় এবং দ্বিপ্রহরে খণ্ডহরটির বিবিধ স্হানের আলোকচিত্র তুলিয়া আমি যতটা পারিতাম দ্বিপ্রহরের ভোজনের পর বাহিরে থাকিয়া, শরিফাবাদের অন্যান্য স্হানের আলোকচিত্র তুলিয়া ঘরে ফিরিয়া এক পাঁইট মদ্য সেবন করিয়া শ্রান্তদেহে নিদ্রা দিতাম এবং রাত্রিকালের অপেক্ষা করিতাম ।
দ্বিতল অট্টলিকাটি বন্যলতার ঠাসবুনোটে বসবাসের অযোগ্য হইয়া গিয়াছে, দেয়াল ও গৃহের মাটিতে গুলঞ্চ, পাটেঙ্গা, কালকাসুন্দা, বিছুটি, শেয়ালকাঁটা, ভাটফুল, আলকুশি ইত্যাদি বিস্তার করিয়াছে নিজেদের স্বেচ্ছাচারী গণতন্ত্র । নিবিড় বন নহে, স্হানে স্হানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিদ মণ্ডলাকারে কোনো কোনো ভূমিখণ্ড ব্যাপিয়াছে । উদ্যান হইতে উইপোকাগণ তাহাদের রানিমার নির্দেশে সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িয়াছে, দেয়ালে এবং সিঁড়িতে তাহাদের স্বেদ-লালার উত্তরাধুনিক অঙ্কনমালা ।
আলোকচিত্রের ফিল্ম স্হানীয় বিপণীতে রসায়নে মুদ্রণ করিতে দিলে দোকানিটিও আশ্চর্য হইত কিন্তু ইন্টারন্যাশানাল জিওগ্রাফিকের একটি সংখ্যা তাহাকে দিবার পর একটি পৃষ্ঠায় আমার হাস্যময় মুখ মুদ্রিত দেখিয়া আমাকে সে শ্রদ্ধাপূর্বক সাহায্য করিতে আত্মনিবেদিত হইয়াছিল ।
একদিন না যাইতেই অবহেলিত ভগ্নপ্রায় অট্টলিকাটির এক অপূর্ব নেশা আমাকে ক্রমশ মোহাবিষ্ট করিয়া ধরিতে লাগিল। আমার সে অবস্হা বর্ণনা করাও কঠিন এবং সেকথা লোককে বিশ্বাস করানোও শক্ত । সমস্ত অট্টালিকা একটা সামুদ্রিক অক্টোপাসের ন্যায় আমাকে তাহার আলিঙ্গনের বেগুনি ফুৎকারে ও তীব্র মোচড়ে জঠরোস্হ মোহরসে অল্পে অল্পে যেন নেশাগ্রস্ত করিতে লাগিল ।
বোধহয় এ অভিশপ্ত বাড়িতে পদার্পণমাত্রেই, পরিত্যক্ত ঘরটির খাটে বিছানা পাতিবার ও মশারি টাঙাইবার পর এ প্রক্রিয়ার আরম্ভ হইয়াছিল — কিন্তু আমি যেদিন সচেতনভাবে প্রথম ইহার সূত্রপাত অনুভব করি, সেদিনকার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে ।
তখন গ্রীষ্মকালের কারণে উর্ধাঙ্গের পোশাক খুলিয়া বৈকালিক বাতাসের অপেক্ষা করিতেছিলাম । সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে আমি সেই নদীতীরে ঘাটের নিম্নতলে একটা আরাম কেদারা লইয়া বসিয়াছি । দামোদর নদী শীর্ণ হইয়া আসিয়াছে ; ওপারে অনেকখানি বালুতট অপরাহ্ণের আভায় রঙিন হইয়া উঠিয়াছে, এপারে ঘাটের সোপানমূলে স্বচ্ছ অগভীর জলের তলে নুড়িগুলি ঝিক ঝিক করিতেছে । সেদিন কোথাও বাতাস ছিল না । দ্বিতল অট্টালিকাটির খণ্ডহরের ঝোপঝাড় হইতে বনতুলসী পুদিনা কালকাসুন্দা গুলঞ্চ ভাটফুল আলকুশি ও বন্যঘাসের একটা ঘন বনগন্ধ উঠিয়া স্হির আকাশকে ভারাক্রান্ত করিয়া রাখিয়াছিল ।
আকাশে শাদা মেঘ রৌদ্রতপ্ত হইয়া ছুটিতেছে, তাহার নিচে কৃষ্ণবিন্দুবৎ পাখি উড়িতেছে, নারিকেল গাছে চিল বসিয়া, রাজমিস্ত্রির মতো চারিদিক দেখিতেছে, কাহার কিসে ছোঁ মারিবে । বক ছোটোলোক, কাদা ঘাঁটিয়া বেড়াইতেছে । ডাহুক রসিক লোক, ডুব মারিতেছে । আর আর পাখি হালকা লোক, কেবল উড়িয়া বেড়াইতেছে। হাটুরিয়া নৌকা হটর হটর করিয়া যাইতেছে — আপনার প্রয়োজনে । খেয়া নৌকা গজেন্দ্রগমনে যাইতেছে — পরের প্রয়োজনে । বোঝাই নৌকা যাইতেছে না — তাহাদের প্রভূর প্রয়োজন মাত্র ।
দিনমণি অস্তাচলগামী, সূর্য যখন দিগন্তের অন্তরালে অবতীর্ণ হইল, তৎক্ষণাৎ দিবসের নাট্যশালায় একটা দীর্ঘ ছায়াযবনিকা পড়িয়া গেল — এখানে সূর্যাস্তের সময় আলোআঁধারির সম্মিলন অধিকক্ষণ স্হায়ী হয় না । সাইকেল সঞ্চালন করিয়া অথবা সাইকেল-রিকশ ভাড়া করিয়া একবার অঞ্চলটির পথে-পথে বেড়াইয়া আসিব মনে করিয়া উঠিব-উঠিব করিতেছি, কালধর্মে নিশারম্ভেই প্রবল ঝটিকাবৃষ্টি আরম্ভ হইয়া গেল, মস্তকোপরি বৃষ্টির ইলিশগুঁড়ি ধারাপাত হইতেছিল, নিশার সেই ঘোরতর অন্ধকারে দিগম্ত যখন স্হিত হইতেছে, এমন সময়ে সিঁড়িতে একাধিক পায়ের শব্দ ও বহু মানুষের আক্রমণাত্মক “মারো, মেরে ফ্যাল শালাদের, বড়ো বাড় বাড়িয়েছে, জমিজমার মালিক বইল্যা ধরাকে সরা জ্ঞান করতাসে, ধড় থিকা মাথা উড়ায়ে দে, চোখ খুবলাইয়া নে, আগুন ধরাইয়া দে” ইত্যাদি সমবেত কন্ঠস্বরের চিৎকার শুনিতে পাইলাম । আক্রান্ত পুরুষের অস্ফূট আতর্নাদ কর্ণে প্রবেশ করিল, যেনবা কাহারও প্রাণবায়ু নির্গত হইয়া গেল । পিছনে ফিরিয়া দেখিলাম, কেহ নাই । মনের চাঞ্চল্যহেতু একই স্হানে বসিয়া থাকিতে পারিলাম না ।
ইন্দ্রিয়ের ভ্রম মনে করিয়া পুনরায় ফিরিয়া বসিতেই, একেবারে অনেকগুলি পায়ের শব্দ শোনা গেল — যেন বিদ্বেষ ও ঈর্ষায় আক্রান্ত অনেকে মিলিয়া ছুটাছুটি করিয়া তিন-চারিজনকে ধরিবার নিমিত্ত নামিয়ে আসিতেছে । ঈষৎ ভয়ের সহিত এক অপরূপ বিস্ময় মিশ্রিত হইয়া আমার সর্বাঙ্গ পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল । যদিও আমার সন্মুখে কোনো মূর্তি ছিল না তথাপি স্পষ্ট প্রত্যক্ষবৎ মনে হইল যে, এই গ্রীষ্মের সায়হ্ণে ভয়ে কন্ঠাগতপ্রাণ তিন-চারিটি রক্তাক্ত পুরুষ দামোদরের জলের মধ্যে লুকাইতে নামিয়াছে । জলের তলায় লুকাইয়া তাহারা যেন বিভিন্ন তরঙ্গবিন্যাসে কাঁদিয়া কন্ঠরুদ্ধ আর্তচিৎকার করিতেছিল । এমনই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া গিয়াছিলাম যে খেয়াল করি নাই বৃষ্টিতে ঈষৎ ভিজিতেছি ।
যদিও সেই সন্ধ্যাকালে নিস্তব্ধ প্রায়ান্ধকারে, নদীতীরে, নির্জন অট্টালিকায় কোথাও কিছুমাত্র শব্দ ছিল না, তথাপি আমি যেন স্পষ্ট শুনিতে পাইলাম বর্ষাকালের পর্বতের পাথর নামিবার মতো সকৌতুক কলহাস্যের সহিত পরস্পরের দ্রুত অনুধাবন করিয়া ভয়ার্ত ও রক্তাক্ত পুরুষ তিন-চারিটির সন্ধানে আমার পার্শ্ব দিয়া মশাল বহনকারীরা তীর-ধনুক টাঙ্গি দা কাটারি লাঠি কুড়াল পেটরলের ও অ্যাসিডের জেরিক্যান লইয়া দৌড়াইতে দৌড়াইতে চলিয়া গেল, তাহাদের পশ্চাতে উৎসাহ দিবার নিমিত্ত খোল করতাল মৃদঙ্গ ডুগডুগি ঢোলক খঞ্জনি বাদকের দল । আমাকে যেন লক্ষ্য করিল না । তাহারা যেমন আমার নিকট অদৃশ্য, আমিও যেন সেইরূপ তাহাদের নিকট অদৃশ্য । মনে হইল বৃষ্টিও তাহাদের ভয়ে আতঙ্কিত হইয়া মেঘগুলিকে মাথার উপরের আকাশ হইতে নদীর ওই পারে লইয়া চলিয়া গেল ।
নদী পূর্ববৎ স্হির ছিল, কিন্তু আমার নিকট স্পষ্ট বোধ হইল, স্বচ্ছতোয়ার অগভীর স্রোত অনেকগুলি বলয়শিঞ্জিত বাহুবিক্ষেপে বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে ; জনৈক দলপতির নির্দেশে সমবেত যুবকগণ হাসিয়া হাসিয়া অগ্নিসংযোগের জন্য তীরগুলিকে কেরোসিন তেলে চুবাইয়া এই অট্টালিকার দিকে ছুঁড়িয়া মারিতেছে, এবং স্লোগানকারীগনের উৎসাহদানে উগ্রক্ষত্রিয়-গৃহমুখী যুবকগণ হোমারের মহাকাব্যে বর্ণিত গ্রিক সৈন্যগণের ন্যায় ট্রয়ের মানুষদের ধ্বংস করিতে উদ্যত হইয়াছে, কিন্তু তাহাদের পোশাক গ্রিক সৈন্যগণের ন্যায় নহে, তাহারা এতদ্দেশীয় পোশাক শার্টপ্যান্ট, লুঙ্গি, গামছা পরিয়া, হস্তে তীর-ধনুক দা কাটারি টাঙ্গি লাঠি কুড়াল মশাল জেরিক্যান লইয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল । আপনারা নিশ্চয়ই অবগত যে দলপতিগণ মতাদর্শের উত্তরাধিকারী হইয়া জন্মায়, মানবসন্তান রূপে নহে ।
যদ্যপি কে যে ইহাদের দলপতি তাহা সম্যক বুঝিয়া ফেলা দুষ্কর, কেননা যেখানে সবই কাঁটাবন, সেখানে পুষ্পচয়ন দুঃসাধ্য, তথাপি হইহইকারীদিগকে যে নির্দেশ দিতেছিল, সেই দলপতি কহিল, এতকাল শৃগাল কুক্কুরের মাংস ভক্ষণ করিয়াছি, ক্ষুধায় প্রাণ যায়, আজ নরমাংস খাইব । এই বলিয়া প্রেতবৎ ছায়াসকল অন্ধকারে খলখল হাস্য করিয়া হাততালি দিয়া নৃত্য করিতে লাগিল । চক্ষে চশমা পরিহিত দলপতির বাম হস্তে একটি ক্ষৌরকর্মের পেটিকা ঝুলিতে ছিল, মনে হইল তাহা একটি পুস্তক, বৈদ্যগণের সমাজ-চিকিৎসার বিদেশি গ্রন্হ । বৈদ্যগণের উৎসের সন্ধান মনুস্মৃতিতে নাই । উহারা বর্ণসংকর বলিয়া অনুমান করি, এবং সেহেতু জারজ ও প্রত্যেকের প্রতি বিদ্বিষ্ট । সম্ভবত, দুর্ভাগ্যবশত উগ্রক্ষত্রিয় পরিবারটি বৈদ্য দলপতির ঈর্ষার কেন্দ্র হইয়া উঠিয়াছিল । দলপতি মহাশয় এই জগৎ পবিত্র করিবার জন্য কোন কালসময়ে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল, তাহার পিতামাতাই বলিতে পারিবে, ইতিহাস তাহা লিখে নাই, ইতিহাস এইরূপ বদমায়েশদের লইয়া অনেকপ্রকার বদমাইশি করিয়া থাকে ।
ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে লিখিয়া গিয়াছেন, “অবস্হাবিশেষে মনুষ্য হিংস্র জন্তু মাত্র।” ছায়াশরীরগণ অট্টালিকাটিতে আয়োজিত অন্নপ্রাশনের শিশুটিকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করিলে ঋষির বাণীর অমোঘ সত্যতা উপলব্ধি করিলাম ।
আমার বক্ষের মধ্যে একপ্রকার কম্পন হইতে লাগিল, আতঙ্কে ললাটে স্বেদস্রুতি হইতে লাগিল; সে উত্তেজনা উদ্বেগের কি উৎকন্ঠার কি কৌতূহলের, ঠিক বলিতে পারি না । বড়ো ইচ্ছা হইতে লাগিল ভালো করিয়া দেখি, কিন্তু সম্মুখে দেখিবার কিছুই ছিল না ; মনে হইল ভালো করিয়া কান পাতিলেই উহাদের কথা সমস্তই স্পষ্ট শোনা যাইবে ; কিন্তু একান্তমনে কান পাতিয়া কেবল ধ্বংসপ্রাপ্ত অট্টালিকার ঝিল্লিরব শোনা যায় । মনে হইল, পঞ্চাশ বৎসরের অধিক কৃষ্ণবর্ণ যবনিকা ঠিক আমার সম্মুখে আপন মাদকে দুলিতেছে — ভয়ে ভয়ে একটি ধার তুলিয়া ভিতরে দৃষ্টিপাত করি — সেখানে বৃহৎ সালিশি-সভা বসিয়াছে, কিন্তু গাঢ় অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না । সন্দেহ হইল যে এই বায়বীয় অপচ্ছায়াগুলির উপস্হিতির জন্যই হয়তো অট্টালিকাটিকে অভিশপ্ত তকমা দেয়া হইয়াছে ।
হঠাৎ গুমোট ভাঙিয়া হু হু করিয়া একটি বাতাস দিল — দামোদরের স্হির জলতল দেখিতে দেখিতে অপ্সরীর কেশদামের মতো কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, এবং সন্ধ্যাছায়াচ্ছন্ন সমস্ত বনভূমি এক মুহূর্তে একসঙ্গে মর্মরধ্বনি করিয়া যেন দুঃস্বপ্ন হইতে জাগিয়া উঠিল । স্বপ্নই বলো আর সত্যই বলো, অর্ধশতাধিক বৎসরের অতীত ক্ষেত্র হইতে প্রতিফলিত হইয়া আমার সম্মুখে যে-এক অদৃশ্য মরীচিকা অবতীর্ণ হইয়াছিল তাহা চকিতের মধ্যে অন্তর্হিত হইল । যে আক্রমণকারীগণ আমার দেহের উপর দিয়া শরীরহীন দ্রুতপদে শব্দহীন উচ্চ ক্রোধে ছুটিয়া আসিয়াছিল, তাহারা অট্টলিকাটিতে তীর ও মশাল সংযোগে অগ্নিকাণ্ড ঘটাইয়া দিল । বাতাসে যেমন করিয়া গন্ধ উড়াইয়া লইয়া যায়, বসন্তের এক নিঃশ্বাসে তাহারা তেমনি করিয়া উড়িয়া অদৃশ্য হইয়া গেল । অগ্নিকাণ্ডের তাপের পরিবর্তে আমার ত্বকে শীতস্বেদের বিন্দু ফুটিয়া উঠিতে লাগিল ।
তখন আমার বড়ো আশঙ্কা হইল যে, হঠাৎ বুঝি নির্জন পাইয়া ঠাকুমার ঝুলির রাজকন্যা, রাজপুত্র, রাক্ষস ও দানবগণ আমার স্কন্ধে আসিয়া ভর করিলেন ; আমি বেচারা নানাবিধ আলোকচিত্র তুলিয়া ব্যাখ্যা ও বিক্রয় করিয়া খাই, ঠাকুমার ঝুলির ঠাকুমাটি ঝুলি হইতে রাক্ষস-খোক্কোস ছাড়িয়া দিয়া এইবার বুঝি আমার মুণ্ডপাত করিতে আসিলেন । ভাবিলাম, ভালো করিয়া আহার করিতে হইবে ; শূন্য উদরেই সকল প্রকার দূরারোগ্য ব্যধি আসিয়া চাপিয়া ধরে । অট্টালিকার তত্ত্ববধায়ক মহাশয়কে ডাকিয়া বলিলাম স্বগৃহে যাইবার পূর্বে প্রচুর ঘৃতপক্ক মসলা-সুগন্ধি রীতিমত মোগলাই খানা স্হানীয় খ্যাতনামা রেস্তরাঁ হইতে আনাইয়া দিতে ।
তত্ববধায়ক মহাশয় বিদায় লইলে, পথের দিকের গবাক্ষের কপাট খুলিয়া দেখিলাম, সন্মুখের পথ দিয়া যাইবার কালে এক পথচারী, দেখিতে অনেকটা হিন্দু পুরোহিতের ন্যায়, ব্রা্হ্মণ হইবেন বলিয়া মনে হইল, অতি দীর্ঘাকায় পুরুষ, শরীর শুস্ক, আয়ত মুখমণ্ডলে শ্বেতশ্মশ্রু বিরাজিত, ললাট ও বিরলকেশ তালুদেশে অল্পমাত্র বিভূতিশোভা, ব্রাহ্মণের কান্তি গম্ভীর ও কটাক্ষ কঠিন, আমাকে এই অভিশপ্ত অট্টালিকায় দেখিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল, “তফাত যাও, তফাত যাও, সব সত্য সব সত্য সব সত্য।” অনুমান করিলাম, বৃদ্ধ পুরোহিত হয়তো পাগল হইয়া গিয়াছেন, অথবা গলায় শালগ্রামশিলা ঝুলাইয়া হাঁটিবার সময়ে অমন চিৎকার করিয়া থাকেন । তৎসত্তবেও তিনি কলেজফেরত জিনস ও টপ পরিহিতা যুবতীগণের প্রতি অলক্ষ্যে চাহিয়া লইতেছেন ।
রাত্রিশেষে ঘোরতর কুজ্ঝটিকা দিগন্ত ব্যাপ্ত করিয়াছিল, দিনমণি দিগন্তে উদিত হইলে, প্রাতঃকালে সমস্ত ব্যাপারটি পরম হাস্যজনক বলিয়া বোধ হইল । অদ্য আবহাওয়া মনোরম ছিল, প্রদোষকালে যৎসামান্য ঝটিকাবৃষ্টি হইয়া গিয়াছে । আনন্দ মনে শহরের বড়ো কোম্পানির আধিকারিকের মতো শার্ট ও গ্যালিসদেয়া প্যাণ্ট পরিয়া, সাইকেল সঞ্চালন করিয়া, দ্রুতবেগে আপন দৈনন্দিন কার্যে, অর্থাৎ পোস্টাপিসে গিয়া আলোকচিত্রগুলি অনুমোদনের নিমিত্ত পাঠাইয়া দিলাম, প্রবন্ধটির খসড়া লিখিবার জন্য একপ্রস্হ ফুলস্কেপ কাগজ কিনিলাম । সেই দিন প্রবন্ধটি আরম্ভ করিবার জন্য অট্টালিকায় নিজ ঘরে ফিরিয়া একাগ্রচিত্তে লিখিবার কথা । কিন্তু সন্ধ্যা হইতে না হইতেই আমাকে দ্বিতল ভগ্নপ্রায় অট্টালিকাটির রহস্য চুম্বকের ন্যায় টানিতে লাগিল । কে টানিতে লাগিল বলিতে পারি না ; কিন্তু মনে হইল, আর বিলম্ব করা উচিত হয় না । মনে হইল, অট্টালিকাটিতে কোনো পূজা অথবা শিশুর নামকরণের অনুষ্ঠান আরম্ভ হইতেছে, ধুপ-ধুনা চন্দন ও ফুলমালাদির সুগন্ধ ভাসিয়া আসিতেছে । সেই সন্ধ্যাধূসর তরুচ্ছায়াঘন নির্জন পথ সাইকেল সঞ্চালনের শব্দে সচকিত করিয়া অন্ধকার ভগ্নপ্রায় অবহেলিত নির্জন নিস্তব্ধ অট্টালিকাতে গিয়া উত্তীর্ণ হইলাম ।
সিঁড়ির উপরে সম্মুখের ঘরটিতে মনে হইল দুটি ভাই-বোন গৃহশিক্ষকের নিকট পড়াশুনা করিতেছে, গৃহশিক্ষকের তিরস্কার ও কিশোর কিশোরীর কথাবার্তা কানে আসিতেছিল । সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া দেখিলাম কেহই নাই, ঘরটিতে টিকটিকি , গিরগিটি , চামচিকা ও উইপোকাগণ আশ্রয় লইয়াছে, বন্য লতাও সুযোগ পাইয়া সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া প্রবেশ করিয়াছে । যেন শুনিলাম কিশোর কন্ঠ যাতনায় চিৎকার করিয়া উঠিল, “মাথা ফাটিয়ে দিলো ওরা আমার মাথা ফাটিয়ে দিলো” । সিঁড়ি দিয়া কয়েকজনের দ্রুত নামিবার পদশব্দ শুনিতে পাইলাম কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না । সম্ভবত নিজের পদশব্দকেই ভয়ে অন্যের পদশব্দ বলিয়া ভ্রম করিতেছি । তথাপি কয়েকজনের উচ্চকিত কন্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম, “এই, মাস্টারটা পাঁচিল ডিঙিয়ে পালাচ্ছে, ধর ধর, পালাতে দিসনি।” শীতের সময়ে নতুন লেপ তৈয়ারির জন্য ধুনিরি লেপের উপর ছড়ি পেটাইয়া খোলের তুলাকে সর্বত্র ছড়াইয়া দেয়, সেই প্রকার শব্দ এবং আর্তচিৎকার, “মরে গেলুম মরে গেলুম মেরে ফেললে মেরে ফেললে”, কর্ণকুহরে প্রবেশ করিতে লাগিল । অথচ কাহাকেও কোথাও দেখিতে পাইলাম না ; অভিশপ্ত অট্টালিকাটি যেন আমাকেই অভিশপ্ত করিয়া তুলিতেছে এমত প্রতীয়মান হইল ।
বিস্তীর্ণ দালান ও তাহার পার্শ্ববর্তী ঘরগুলি বিশাল ছাদ ধরিয়া রাখিয়াছে । এই প্রকাণ্ড দালান ও তৎপার্শ্ববর্তী ঘরগুলি যেন আপনার বিপুল শূন্যতাভারে অহর্নিশ নিজস্ব আতঙ্কে ছম ছম করিতে থাকে । সেদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে তখনও লন্ঠন জ্বালানো হয় নাই । দরজা ঠেলিয়া আমি একতলার একটি ঘরের কপাট ঠেলিয়া যেমন প্রবেশ করিলাম অমনি মনে হইল ঘরের মধ্যে যেন ভারি একটা বিপ্লব বাঁধিয়া গেল — যেন হঠাৎ সভা ভঙ্গ করিয়া চারিদিকের দরজা জানালা ঘর পথ বারান্দা দিয়া কে কোন দিকে পলাইল তাহার ঠিকানা নাই । আমি কোথাও কিছু না দেখিতে পাইয়া অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম । শরীর এক প্রকার আবেশে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল । যেন বহুদিবসের লুপ্তাবশিষ্ট বিড়ি-সিগারেট ও নস্যের গন্ধ আমার নাসার মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল । আমি সেই দীপহীন জনহীন প্রকাণ্ড ঘরের প্রাচীন ইষ্টকপ্রণালীর মাঝখানে দাঁড়াইয়া শুনিতে পাইলাম — ঝর্ঝর শব্দে দুইটি পাশাপাশি চৌবাচ্চায় কেহ স্নান করিতেছে । মনে হইল ট্রানজিসটারে সঙ্গীত বাজিতেছে, কী সুর বাজিতেছে বুঝিতে পারিতেছি না, কোথাও বা গৃহিনীগণের স্বর্ণভূষণের শিঞ্জিত, কোথাও বা কিশোরীর নূপুরের নিক্বণ, কখনোবা পুজার ঘণ্টাধ্বনি বাজিবার শব্দ, অনতিদূরে সানাইয়ে নহবতের আলাপ, বাতাসে দোদুল্যমান ঝাড়ের স্ফটিকদোলকগুলির ঠুন ঠুন ধ্বনি,বারান্দা হইতে খাঁচার বুলবুলের গান, বাগান হইতে পোষা পাখির ডাক আমার চতুর্দিকে একটা প্রেতলোকের রাগিণী সৃষ্টি করিতে লাগিল ।
আমার এমন একটা মোহ উপস্হিত হইল, মনে হইল, এই অস্পৃশ্য অগম্য অবাস্তব ব্যাপারই জগতে একমাত্র সত্য, আর সমস্তই মিথ্যা মরীচিকা । আমি যে আমি — অর্থাৎ আমি যে শ্রীযুক্ত মলয় রায়চৌধুরী, শ্রীযুক্তরঞ্জিত রায়চৌধুরীর কনিষ্ঠপুত্র, আলোকচিত্র তুলিয়া জগতে কিঞ্চিদধিক সুনাম অর্জন করিয়াছি, আমি যে শার্ট-প্যাণ্ট ও বুটজুতা পরিয়া কাঁধে একাধিক ক্যামেরা ঝোলাইয়া আলোকচিত্র লইয়া থাকি, লেন্সের ভিতর দিয়া দৃশ্যাবলীকে অনুপুঙ্খ যাচাই করি, এ-সমস্তই আমার কাছে এমন অদ্ভুত হাস্যকর অমূলক মিথ্যা কথা বলিয়া বোধ হইল যে, আমি সেই বিশাল অন্ধকার ভগ্নপ্রায় অট্টালিকার বন্য ঝোপঝাড়ের মাঝখানে দাঁড়াইয়া হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিলাম ।
নিজ ঘরে প্রত্যাবর্তন করিয়া গবাক্ষের কপাট খুলিয়া দেখিলাম, সেই বৃদ্ধ পুরোহিত, লাল শালুতে মোড়া শালিগ্রামশিলা তাঁহার বুকে ঝুলিতেছে, এই ভগ্নপ্রায় অট্টালিকা ছাড়িয়া আমি চলিয়া যাই নাই দেখিয়া সম্ভবত অবাক হইলেন, এবং পূর্বেকার তুলনায় আরও তারস্বরে চিৎকার করিয়া উঠিলেন, “ তফাত যাও, তফাত যাও, সব সত্য সব সত্য সব সত্য ।” তাঁহার শ্লেষপূর্ণ ঘোষণা আমাকে সত্যই গৃহটি সম্পর্কে আরও আগ্রহান্বিত করিয়া তুলিল। আমার ভ্রুকুঞ্চন ও প্রশ্নময় চাহনি দেখিয়া পুরোহিতটি আমার প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া কহিলেন, “অবস্হাবিশেষে মনুষ্য হিংস্র জন্তু মাত্র, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ ।” বুঝিলাম যে তিনি বহুবিধ দেবী-দেবতার সেবক, আমার পক্ষে তাঁহার বক্তব্যের নিহিতার্থে প্রবেশ সম্ভব নহে ।
তখনই মোমের আলো নিভিয়া গেল এবং কিয়ৎক্ষণ পর তত্ত্ববধায়ক মহাশয় প্রজ্বলিত কেরোসিন ল্যাম্প হস্তে ঝুলাইয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন এবং টেবিলের উপর রাখিয়া চুপচাপ চলিয়া গেলেন । তিনি আমাকে পাগল মনে করিলেন কিনা জানি না, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আমার স্মরণ হইল যে, আমি শ্রীযুক্ত রঞ্জিত রায়চৌধুরীর কনিষ্ঠপুত্র শ্রীযুক্ত মলয় রায়চৌধুরী, একজন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী ; ইহাও মনে করিলাম যে, জগতের ভিতরে অথবা বাহিরে কোথাও অমূর্ত ফোয়ারা নিত্যকাল উৎসারিত ও অদৃশ্য অঙ্গুলির আঘাতে কোনো মায়া সেতারের অনন্ত রাগিনী ধ্বনিত হইতেছে কি না তাহা আমাদের মহাকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবিবর জীবনানন্দ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও বিনয় মজুমদার বলিতে পারেন, কিন্তু এ-কথা নিশ্চয় সত্য যে, আমি দেশ-বিদেশের আলোকচিত্র বিক্রয় করিয়া এবং তদ্বিষয়ে প্রবন্ধ লিখিয়া জীবন নির্বাহ করিয়া থাকি । তখন আবার আমার পূর্বক্ষণের অদ্ভুত মোহ স্মরণ করিয়া কেরোসিন-প্রদীপ্ত ক্যাম্পটেবলের কাছে খবরের কাগজ লইয়া আনন্দসংবাদ-এর দায়িত্ব হইতে রুপালিচুল মালিকের আকস্মিক পদত্যাগের খবরটি পড়িয়া সকৌতুকে হাসিতে লাগিলাম ।
সংবাদপত্র পড়িয়া এবং মোগলাই খানা খাইয়া আলো নিবাইয়া দিয়া এই ভগ্নপ্রায় গৃহের পুরাতন খাটে বিছানায় গিয়া শয়ন করিলাম, পুরাতন খাটটির দুর্বল স্বাস্হ্যও এমন ভুতগ্রস্ত যে পাশ ফিরিলে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ উঠে । আমার সম্মুখবর্তী খোলা জানালার ভিতর দিয়া উর্ধ্বদেশের একটি অত্যুজ্বল নক্ষত্র সহস্র কোটি যোজন দূর আকাশ হইতে এই অতিতুচ্ছ ক্যাম্পখাটের উপর শ্রীযুক্ত আলোকচিত্রীকে একদৃষ্টে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতেছিল, ইহাতে আমি বিস্ময় ও কৌতুক অনুভব করিতে করিতে এবং চিন্তা করিতে করিতে কতক্ষণ যে তন্দ্রাভিভূত হইয়া পড়িয়াছিলাম বলিতে পারি না । মশকগণের সঙ্গীত ও অত্যাচার হইতে আত্মরক্ষার জন্য মশারি খাটাইয়া কতক্ষণ ঘুমাইয়া ছিলাম তাহাও জানি না । সহসা এক সময় শিহরিয়া জাগিয়া উঠিলাম ; ঘরে যে কোনো শব্দ হইয়াছিল তাহা নহে, কোনও যে লোক প্রবেশ করিয়াছিল তাহাও দেখিতে পাইলাম না । আকাশে অনিমেষ নক্ষত্রটি অস্তমিত হইয়াছে এবং কৃষ্ণপক্ষের ক্ষীণচন্দ্রালোক অনধিকারসংকুচিত ম্লানভাবে আমার বাতায়নপথে প্রবেশ করিয়াছে । যখন নিদ্রাভঙ্গ হইয়াছে তখন রজনী গভীর ।
কোনো লোককেই দেখিলাম না । তবু যেন আমার স্পষ্ট মনে হইল, জরিপাড় ধুতি ও গরদের পাঞ্জাবি পরিহিত একজন পুরুষমানুষ মশারির একপাশ তুলিয়া আমাকে আস্তে আস্তে ঠেলিতেছে, তাহার পাঞ্জাবির সোনার বোতাম অন্ধকারে জ্বলজ্বল করিতেছে । আমি জাগিয়া উঠিতেই সে কোনো কথা না বলিয়া কেবল যেন তর্জনীর ইঙ্গিতে অতি সাবধানে তাহার অনুসরণ করিতে আদেশ করিল । তাহার দুইটি চোখে যেন সদ্য অ্যাসিড ঢালিয়া উপড়াইয়া তোলা হইয়াছে, এবং দরদর করিয়া রক্ত গড়াইতেছে । তাহাকে দেখিয়া আমি কি যে করণীয় তাহা নির্ণয় করিতে পারিলাম না, ভয়ে-ভয়ে তবু তাহার পিছু লইলাম । কাহারা এই ব্যক্তির চোখ উপড়াইয়া লইয়াছে, এবং তৎসত্ত্বেও সে কীরুপে আমাকে পথনির্দেশ করিতেছে তাহা জিজ্ঞাসা করিবার মতো আত্মপ্রত্যয় হইল না।
আমি অত্যন্ত চুপিচুপি উঠিলাম । যদিও সেই ভগ্নকক্ষপ্রকোষ্ঠময় প্রকাণ্ড শূন্যতাময়, নিদ্রিত ধ্বনি এবং সজাগ প্রতিধ্বনিময় দ্বিতল অট্টালিকায় আমি ছাড়া আর জনপ্রাণীও ছিল না, তথাপি পদে-পদে ভয় হইতে লাগিল, পাছে আরও কেহ জাগিয়া উঠে । অট্টালিকার একতলার দালানের দুই পাশের অধিকাংশ ঘরের কপাট রুদ্ধ এবং সে-সকল বন্ধ ঘরে আমি কখনো রাত্রিবেলায় প্রবেশ করি নাই , আমার সাহসে কুলায় নাই। উঁকি দিয়া দেখিলাম একটি ঘরে, যাহার দ্বার রুদ্ধ করা হয় নাই, অথবা দিনের বেলায় রুদ্ধ দেখিয়াছিলাম, সেই ঘরে পূজার উপাচার সাজানো হইয়াছে, অন্নপ্রাশনের নিমিত্ত আসন পাতা হইয়াছে এবং একজন পুরোহিত মন্ত্রপাঠ করিতেছে । পুরোহিতটির শ্মশ্রু নাই, তবু মনে হইল পথে চিৎকারকারী পুরোহিতটির সহিত এনার মুখাবয়াবের যথেষ্ট মিল রহিয়াছে ।
চোখ ওপড়ানো ব্যক্তিটি যেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল সেটি একটি উঠান, সেখানে নিমন্ত্রিত অতিথিগণকে খাওয়াইবার জন্য ভিয়েন বসানো হইয়াছে, থালায় থালায় অন্ন ব্যঞ্জন প্রভৃতি সাজানো, দেখিলাম হইহই করিয়া পঞ্চাশ-ষাটজন মানুষ, যাহাদের সহিত উৎসাহদানকারী খোল করতাল মৃদঙ্গ ডুগডুগি ঢোলক খঞ্জনিবাদকেরা ছিল, টাঙ্গি কাটারি দা শড়কি লাঠি অ্যাসিডের বোতল মশাল ইত্যাদি লইয়া দুইজন যুবকের পিছু ধাওয়া করিতেছে, তাহাদের একজন পাশের বাড়িতে পলাইবার প্রয়াস করিতে সেখান হইতে টানিয়া আনিয়া, দুইজন যুবককেই মাটিতে ফেলিয়া চাপিয়া ধরিল, এবং আমার সন্মুখেই দুইজনের গলায় কোপ মারিয়া ধড় হইতে মাথা পৃথক করিয়া দিল । স্পষ্ট অনুভব করিলাম আমার দেহে তাহাদের রক্ত ছিটকাইয়া আসিয়া লাগিল, মনে হইল বমন করিয়া ফেলিব । উঠানে আজানো থালা হইতে ভাত তুলিয়া সদ্যমৃত যুবকদিগের রক্ত তাহাতে মাখিয়া এক প্রৌঢ়াকে জোর করিয়া খাওয়াইবার চেষ্টা করিতে লাগিল আক্রমণকারীগণ । মহিলাটি যে বিধবা, তাঁহার পরিধেয় হইতে বুঝিতে পারিলাম, তিনি উন্মাদিনীর ন্যায় চিৎকার করিতেছিলেন, নিজেকে ছাড়াইয়া যুবকদ্বয়ের নিকটে যাইবার প্রয়াস করিতেছিলেন ; তাঁহার ঐ রুপ আচরণে তাঁহাকে যুবকদ্বয়ের মাতা বলিয়াই মনে হইল । একটি কিশোরী সিঁড়ি দিয়া নামিতে নামিতে বলিতে লাগিল, “এতো রক্ত কেন ? এতো রক্ত কেন ? এতো রক্ত কেন?”
ঘর্মাক্ত কলেবরে খাটের উপর উঠিয়া বসিয়া বুঝিতে পারিলাম দুঃস্বপ্ন দেখিতেছিলাম, অথবা হয়তো ইহাই এই গৃহকে অভিশপ্ত করিয়া তুলিবার বিস্মৃত ঘটনাবলী, যাহা সেই অচেনা পুরোহিত, লাল শালুতে মোড়া শালিগ্রাম শিলা বুকে ঝুলাইয়া, সতর্ক করিয়া দুইবার বলিয়া গিয়াছেন “তফাত যাও, তফাত যাও, সব সত্য সব সত্য সব সত্য।” পুরোহিত মহাশয় ঘটনাবলীর কথা না জানিলে কেনই বা বার বার বলিবেন, “সব সত্য সব সত্য সব সত্য।” গবাক্ষ খোলা ছিল এবং বৃষ্টির ছাট আমার দেহের উপর পড়িবার ফলে আমি তাহাকে রক্তের ঝাপটা মনে করিয়াছিলাম । বৃষ্টিধারা ও ঝটিকার প্রবেশ রোধার্থ গবাক্ষের কপাট দুটি যোজিত করিলাম। আকাশে বারিধারার ভৈরব কল্লোল উথ্থিত হইয়াছে । নিজের অজ্ঞতায় নিজেই হাসিয়া উঠিলাম । প্রায়ান্ধকারে দেখিলাম বাদলা বাতাস ঘরে প্রবেশ করিয়া আমার আলোকচিত্রগুলিকে টেবিলের উপর হইতে উড়াইয়া মেঝেতে ফেলিয়া দিয়াছে । সেগুলি তুলিয়া একত্রিত করিয়া টেবিলের উপর ক্যামেরা চাপা দিয়া রাখিলাম । বৃষ্টির ছাটে কয়েকটি আলোকচিত্র ভিজিয়া গিয়াছিল।
প্রদোষকালে ঝটিকাবৃষ্টি নিবারণ হইয়া গিয়াছিল ।
জানি না স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন একত্রে কেমন করিয়া মস্তিষ্কে ক্রীড়া করে, কেমন করিয়াই বা বুঝিব তাহারা সত্য নহে, তাহারা অবাস্তব । রক্তমাংসের মনুষ্যই কি কেবল সত্যের অধিষ্ঠাতা ? দুঃস্বপ্নের অপচ্ছায়ারা নহে ? দুঃস্বপ্নকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা পাগলের যুক্তির ন্যা্য় সন্দেহজনক । ঘুমাইলে সুখস্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন মস্তিষ্কে আশ্রয় লইবে । সেকারণে মনুষ্য কি ঘুমাইবে না ? অনুমান করিলাম অন্ধকার অশান্ত ঘৃণায় নিমজ্জিত অভিশপ্ত খণ্ডহরটিই আমাকে দুঃস্বপ্নের চরিত্রগুলির সহিত সমঝোতা করিতে শিখাইতেছে, যেনবা অট্টালিকাটির গোপন কাহিনি মেলিয়া ধরিবার প্রয়াস করিতেছে। দুঃস্বপ্ন যেন একখানি আতঙ্কের কবিতা, যাহার প্রভাব সারা জীবন অন্তরজগতে সুপ্ত থাকিবে, এবং ক্বচিৎকখনও তাহার বিস্ফোরণের সুযোগ খুঁজিবে, যেমন আজ আপনাদের সন্মুখে মেলিয়া ধরিতেছি, নতুবা সদ্য পরিচিত দুইজন সহযাত্রীর নিকট কেনই বা অকস্মাৎ অভিজ্ঞতাখানি বাখান করিবার ধৃষ্টতা করিব ।
সকালে, কুজ্ঝটিকার অন্ধকাররাশি হইতে দিঙমণ্ডল বিমুক্ত হইলে তত্ববধায়ক মহাশয়ের সশঙ্কচিত্ত আহ্বানে ঘুম ভাঙিবার পর রাত্রের দুঃস্বপ্নের ঘটনাবলী তাঁহাকে শোনাইলে, বারেক কথাবার্তা স্হগিত করিয়া তিনি ভয়কাতর কন্ঠস্বরে কহিলেন, “অদ্যই আপনার উচিত এই অট্টালিকা ছাড়িয়া কোনো হোটেলে রাত্রিবাস করিতে চলিয়া যাওয়া, নতুবা শ্বেতশ্মশ্রু পুরোহিতটির মতো আপনারও মস্তিষ্কবিকৃতির সম্ভাবনা আছে ।”
পৃথিবীর এতো দেশ ভ্রমণ করিয়াছি, বহু অভিশপ্ত স্হানের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছি, দুর্গম স্হানে রাত্রিবাস করিয়াছি, সিংহের গর্জন শুনিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছি, ইত্যাদি গল্প তত্ববধায়ক মহাশয়কে শোনাইবার পর তিনি কহিলেন, ‘যা ভালো বোঝেন তাই করুন, তবে অন্যত্র রাত্রিবাসই মঙ্গলকর’ । তাঁহাকে আমার মনের কথা বলিলাম না যে, এই গৃহের আলোকচিত্রাদির প্রতি আগ্রহ আমাকে রাত্রিবেলায় এক ভিন্ন জগতে লইয়া যায় এবং আমি সেই বর্ণনাতীত অদৃশ্য মনুষ্যগুলির নিয়তির প্রতি মাদকসেবকের ন্যায় আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়াছি ।
তত্ববধায়ক মহাশয় চলিয়া যাইবার পর টেবিল হইতে কল্যের আলোকচিত্রগুলি তুলিয়া প্রবন্ধের জন্য নির্বাচন করিব মনস্হ করিয়া এক এক করিয়া যাচাই করিতেছি, দেখিলাম তিনটি আলোকচিত্র কল্য দিনের বেলায় যেমন দেখিয়াছিলাম, তেমন নাই, আবছা হইয়া গিয়াছে । মনে হইল উঠানের কোণের লতাপাতাকীর্ণ প্রায়ান্ধকারের ছবিগুলিতে ধোঁয়ার ন্যায় দুটি যুবকের রক্তাক্ত ধড় দেখা যাইতেছে, তাহাদের উপর টাঙ্গি কুড়াল ইত্যাদি স্বয়ং বর্ষিত হইতেছে, কেহই সেগুলি ধরিয়া নাই, যুবক দুইটির দেহে যেন পেটরল ঢালিয়া জ্বালাইয়া দেয়া হইয়াছে। হয়তো কল্য আলোকচিত্রগুলি ঠিকমতো অনুধাবন করি নাই, আরেকবার আলোকচিত্রের বিপণীতে গিয়া মুদ্রণের জন্য দিতে হইবে ।
পুনরায় মুদ্রণের জন্য আলোকচিত্রের বিপণীতে দিলে দোকানি যুবকটি কহিল, মুদ্রণ তো নিয়মমতোই করিয়াছিলাম, আপনি নিজেও তা যাচাই করিয়া লইয়াছিলেন, তথাপি এইরূপ বিকৃতি কেন ঘটিল জানি না । ওই গৃহ অভিশপ্ত, হয়তো প্রকৃত ঘটনা আপনার আলোকচিত্রে প্রেতের ন্যায় প্রবেশ করিয়া গিয়াছে, প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে কেহই ওয়াকিবহাল নহেন । এইরূপ অভিজ্ঞতা ইহার পূর্বে এক সাংবাদিকের হইয়াছিল, সে আতঙ্কে উৎকন্ঠায় বাধ্য হইয়া সংবাদপত্রের চাকুরি ত্যাগ করিয়া টিভিতে কুতর্ক-সঞ্চালকের কর্ম করিতেছে, আয়ও ভালো হইতেছে । দোকানিকে বলিলাম, উচিত কথাই বলিয়াছ, চক্ষে ঠুলি বাঁধিয়া হস্তিকে বর্ণনা করা কঠিন, একমাত্র হস্তিই জানে তাহার চারটি পা, একটি শুঁড় এবং দুইটি দীর্ঘ দন্ত রহিয়াছে । দেখি, যদি সম্পূর্ণ হস্তিটির আলোকচিত্র তুলিতে পারি ।
আলোকচিত্রগুলিতে গোলমাল ঘটিতে দেখিয়া আমি নূতন যে লেন্স ইউরোপ হইতে আনিয়াছিলাম তাহা ক্যামেরায় পরাইয়া একের পর এক বহু আলোকচিত্র লইলাম । ইষ্টক দ্বারা সদর হইতে প্রবেশ নিষিদ্ধ হইলেও পাঁচিলের ভাঙনের ভিতর দিয়া প্রবেশ করিয়া প্রতিটি ঘরের অন্ধকারের ও আলোর খেলার, সিঁড়ির ও সিঁড়ির উপরের ঘরের, দুটি পাশাপাশি চৌবাচ্চার, একটি জলকূপের এবং উঠানময় যে আগাছা সবুজ-হলুদ পত্রাবলী মেলিয়া ছড়াইয়া পড়িয়াছে, প্রতিটি বস্তুর আলোকচিত্র লইয়া নিশ্চিত হইবার প্রয়াস করিলাম যাহাতে পুনরায় গোলমাল হইবার অবকাশ আর না থাকে ।
আলোকচিত্রের বিপণীতে গিয়া মুদ্রণের জন্য নির্দেশ দিয়া আসিলাম ।
তত্ববধায়ক মহাশয় টিফিন ক্যারিয়ারে আমার সন্ধ্যার খাবার একটি কিশোরের হাতে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন । সে অবাক দৃষ্টি মেলিয়া প্রশ্ন করিল, ‘আপনি এই ঘরে থাকেন ?’ আমি মস্তক নাড়াইয়া হ্যাঁ বলিবার পর কিশোরটি অভিভাবকের ন্যায় বলিল, ‘এখানে থাকিবেন না, এই গৃহে একাধিক ভুত-প্রেত আছে, পুরোহিত মহাশয়কে দেখিয়াছেন তো ? পাগলের ন্যায় “তফাত যাও তফাত যাও, সব সত্য সব সত্য সব সত্য” চিৎকার করিতে করিতে পদযাত্রা করেন, উনি অন্নপ্রাশনের দিন ছিলেন, সবকিছু নিজ চক্ষে দর্শন করিয়া পাগল হইয়া গিয়াছেন । আপনিও এই গৃহে থাকিলে পাগল হইয়া যাইবেন ।’
বালকটিকে মাথায় হাত বুলাইয়া একটি মুদ্রা দিয়া কহিলাম, ‘আমি যৎসামান্য পাগলই, আর পাগল হইবার সম্ভাবনা নাই ।’ সে আমার প্রতি কৌতূহলমিশ্রিত দৃষ্টি মেলিয়া পিছন ফিরিয়া বার বার আমাকে নিরীক্ষণ করিতে করিতে দ্রুত পলাইয়া গেল, যেন আমিও এই খণ্ডহরের অপচ্ছায়া-সমাবেশের সদস্য ।
জল পান করিয়া পুনরায় ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম । মনে হইল চতুর্দিক হইতে অট্টালিকাটি লক্ষ্য করিয়া ইষ্টকবৃষ্টি হইতেছে । ইষ্টকবৃষ্টির পাশাপাশি আগুনের মশাল ও তীরে আগুন ধরাইয়া গৃহটির ভিতর নিক্ষেপ করা হইতে লাগিল । উঠিয়া বসিলাম এবং পুনরায় দুঃস্বপ্নে আক্রান্ত হইবার কারণে লজ্জিত হইলাম । কী আর করিব, স্বপ্নই হউক অথবা দুঃস্বপ্ন, তাহাদের উপর তো কোনো নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নহে, তাহারা যুক্তি তর্কের তোয়াক্কা করে না, যেনবা নানা প্রকার ব্যথা-যন্ত্রণার আমোদ-আহ্লাদে অভিষিক্ত করিবার জন্যই চুপিসাড়ে মস্তিষ্কে আশ্রয় লইয়াছে।
সুটকেস হইতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিত গ্রন্হ লইয়া কেরোসিনের আলোয় তাঁহার ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটি পড়িতে পড়িতে ঘুম পাইতে লাগিল । গ্রন্হটি বিছানার শিয়রে রাখিয়া দিলাম ।
নিশ্চিন্ত হইবার নিমিত্ত ঘুমের একটি ট্যাবলেট খাইয়া শুইয়া পড়িলাম । বেলায় উঠিলেও চলিবে । বহু আলোকচিত্র ক্যামেরাবন্দি করিয়াছি ।
বেশ ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম, মনে হইল কে একজন আমার কানের কাছে মুখ নামাইয়া আনিয়া নাম ধরিয়া ডাকিতেছে, সে পুরুষ না নারী অনুমান করিতে অক্ষম রহিলাম । আমি জাগিয়া উঠিতেই সে কোনো কথা না বলিয়া অতি সাবধানে তাহার অনুসরণ করিতে আদেশ দিল । আমি অত্যন্ত চুপি চুপি উঠিলাম । যদিও সেই অট্টালিকার প্রকাণ্ডশূন্যতাময়তায়, নিদ্রিতধ্বনি এবং এবং সজাগ প্রতিধ্বনিময় ভগ্নপ্রায় বাড়িটিতে আমি ছাড়া আর জনপ্রাণীও ছিল না, তথাপি পদে পদে ভয় হইতে লাগিল, পাছে কোনো মৃত মনুষ্য প্রাণ পাইয়া উঠিয়া দাঁড়ায়, আক্রমণকারীগণ টাঙ্গি তীর-ধনুক লাঠি দা কুড়াল প্রজ্বলিত মশাল লইয়া আমার দিকে ছুটিয়া আসে ।
সে রাত্রে নিঃশব্দপদবিক্ষেপে সংযতনিঃশ্বাসে সেই অদৃশ্য আহ্বানছায়াকে অনুসরণ করিয়া আমি যে কোথা দিয়া কোথায় যাইতেছিলাম, আজ তাহা স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারি না । কত সংকীর্ণ অন্ধকার পথ, কত দীর্ঘ বারান্দা, কত গম্ভীর নিস্তব্ধ সুবৃহৎ সভাগৃহ, কত রুদ্ধবায়ু ক্ষুদ্র গোপন কক্ষ পার হইয়া যাইতে লাগিলাম তাহার ঠিকানা নেই ।
আমার অদৃশ্য মায়ার ছায়াটিকে যদিও চক্ষে দেখিতে পাই নাই, তথাপি তাহার মূর্তি আমার মনের অগোচর ছিল না । আমার মনে হইল, আরব্য উপন্যাসের একাধিক সহস্র রজনীর একটি রজনী আজ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসলোক হইতে উড়িয়া আসিয়াছে । আমি যেন অন্ধকার নিশীথে মহাকবি বাল্মীকির রামায়ণস্হ রাজা দশরথের সুপ্তিময় অযোধ্যার রাম-লক্ষ্মণ-সীতাহীন নির্বাপিতদীপ সংকীর্ণ পথে সংকটসংকুল পঞ্চবটীর বনবাসে যাত্রা করিয়াছি ।
অবশেষে আমার মায়াপথিক একটি ঘননীল পর্দার সম্মুখে সহসা থমকিয়া দাঁড়াইয়া যেন নিম্নে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইল । নিম্নে কিছুই ছিল না, কিন্তু ভয়ে আমার বক্ষের রক্ত স্তম্ভিত হইয়া গেল । আমি অনুভব করিলাম, সেই পর্দার সম্মুখে ভূমিতলে সাতজন উলঙ্গ খোজা কোলের উপর খোলা ভোজালি ও চাপাতি লইয়া দুই পা ছড়াইয়া দিয়া বসিয়া ঢুলিতেছে, স্বপ্নে যে জনগণ গৃহটিতে অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করিতেছিল, সেই ভিড়ে ইহাদেরও দেখিয়াছিলাম । বহুদেশ ঘুরিয়াছি কিন্তু ইতোপূর্বে খোজা দেখি নাই, জানি না সম্রাট অথবা শাসক একজন পুরুষকে কেমন করিয়া খোজা করিয়া তোলেন, তাহা কি খাসি করিবার পদ্ধতিতেই করা হইয়া থাকে !
মায়াপথিক লঘুগতিতে একজনের দুই পা ডিঙাইয়া পর্দার এক প্রান্তদেশ তুলিয়া ধরিল ।
ভিতর হইতে একটি ঘরের কিয়দংশ দেখা গেল । তক্তের উপরে কে বসিয়া আছে দেখা গেল না — কেবল রক্তপাড় ধুতির নিম্নভাগে কালো পামশু-পরা দুইটি পা ফুটরেস্টের উপর অলসভাবে স্হাপিত রহিয়াছে দেখিতে পাইলাম । মেজের একপার্শ্বে একটি বরফ-উপচানো মদিরার কাচপাত্রে শ্যাম্পেনের বোতল অতিথির জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে । ঘরের ভিতর হইতে অত্যন্ত পুরাতন নথিসমূহ ও কাগজপত্রের ধুলাধুসরিত গন্ধ আসিয়া আমাকে বিহ্বল করিয়া দিল । দেখিলাম সন্মুখবর্তী একটি বিশাল ঘরে সারি-সারি টেবিলের উপর নথিপত্রের পর্বত এবং টেবিলে মাথা রাখিয়া যুবক-যুবতীরা ঘুমাইতেছে ।
আমি কম্পিত বক্ষে লুঙ্গি পরিহিত জনৈক খোজার প্রসারিত পদদ্বয় যেমন লঙ্ঘন করিতে গেলাম, অমনি সে চমকিয়া জাগিয়া উঠিল — তাহার কোলের উপর হইতে লোহার চাপাতি পাথরের মেজেয় শব্দ করিয়া পড়িয়া গেল । খোজাটির মুখ দেখিয়া মনে হইল আমার কোনো একটি আলোকচিত্রে ইহার মুখ আবছা ফুটিয়া উঠিয়াছিল এবং আমি তাহাকে আলোকচিত্র মুদ্রণের ভুল অনুমান করিয়াছিলাম । চাপাতি পড়িবার শব্দে অন্যান্য খোজাগণ ও যে যুবক-যুবতীগণ টেবিলে মাথা রাখিয়া ঘুমাইতে ছিল তাহারা সকলেই সুপ্তাবস্হা হইতে ফিরিয়া আসিল। সেই বিশাল ঘরখানি হইতে গোলাপি রঙের একাধিক শূকর, যেগুলিকে চিনদেশে দেখিয়াছিলাম এবং কাষ্ঠের আগুনের ধোঁয়ায় সিদ্ধ মাংস রসনা তৃপ্ত করিয়াছিল, তাহারা দল বাঁধিয়া একের পিছনে আরেক ওয়িংক ওয়িংক ওয়িংক চিৎকার করিতে করিতে পলাইতে লাগিল ।
সহসা একটা বিকট চিৎকার শুনিয়া চমকিয়া দেখিলাম, আমার সেই ক্যাম্পখাটের উপরে ঘর্মাক্ত কলেবরে বসিয়া আছি, ভোরের আলোয় কৃষ্ণপক্ষের খণ্ডচাঁদ জাগরণক্লিষ্ট রোগির মতো পাণ্ডুবর্ণ হইয়া গেছে — এবং আমাদের পাগলা পুরোহিত গলায় লাল রঙের শালুতে শালিগ্রাম শিলা বাঁধিয়া প্রাত্যহিক প্রথা অনুসারে প্রত্যুষের জনশূন্য পথে “তফাত যাও তফাত যাও, সব সত্য সব সত্য সব সত্য” বলিয়া চিৎকার করিতে করিতে চলিয়াছে
এই রূপে আমার আরব্য উপন্যাসের এক রাত্রি অকস্মাৎ শেষ হইল — কিন্তু এখনো এক সহস্র রজনী বাকি আছে ।
আমার দিনের সহিত রাত্রের ভারি একটা বিরোধ বাধিয়া গেল । দিনের বেলায় শ্রান্তক্লান্তদেহে আলোকচিত্রগুলি সাজাইয়া প্রবন্ধটির খসড়া লিখিবার প্রয়াসে নাজেহাল হইতাম, শূন্যস্বপ্নময়ী মায়াবিনী রাত্রিকে অভিসম্পাত করিতে থাকিতাম, আবার সন্ধ্যার পরে আমার দিনের বেলাকার কর্মবদ্ধ অস্তিত্বকে অত্যন্ত তুচ্ছ মিথ্যা এবং হাস্যকর বলিয়া বোধ হইত ।
সন্ধ্যার পরে আমি একটা মাদকের ধুম্রময় জালের মধ্যে মৎস্যের ন্যায় বিহ্বলভাবে জড়াইয়া পড়িতাম । অর্ধশতাধিক বৎসর পূর্বেকার কোনো-এক অলিখিত ইতিহসের অন্তর্গত আর-একজন অপূর্ব ব্যক্তি হইয়া উঠিতাম, তখন আর শার্ট এবং গ্যালিসবাঁধা প্যাণ্টালুন আমাকে মানাইত না । শীতল কুয়োর জলে স্নান সারিয়া. লুঙ্গি পরিয়া, দেহে সুগন্ধি পাউডার মাখিয়া, যেন রাত্রে কোনো এক অপূর্ব ঘটনাসম্মিলনের জন্য পরমাগ্রহে প্রস্তুত হইয়া থাকিতাম ।
তাহার পর অন্ধকার যতই ঘনীভূত হইত ততই কী-যে এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিতে থাকিত তাহা আমি বর্ণনা করিতে পারি না । ঠিক যেন একটা চমৎকার গল্পের কতকগুলি ছিন্ন অংশ বসন্তের আকস্মিক বাতাসে এই খণ্ডহরপ্রতিম অট্টালিকার বিচিত্র ঘরগুলির মধ্যে উড়িয়া বেড়াইত । খানিকটা দূর পর্যন্ত যাওয়া যাইত তাহার পরে আর শেষ দেখা যাইত না । আমিও সেই ঘূর্ণমান বিচ্ছিন্ন অংশগুলির অনুসরণ করিয়া সমস্ত রাত্রি ঘরে ঘরে ঘুরিয়া বেড়াইতাম, যেগুলির কপাট দিনের বেলায় বন্ধ থাকিত ।
এই খণ্ডস্বপ্নের আবর্তের মধ্যে — এই ক্বচিৎ ধুপ-ধুনার গন্ধ, ক্বচিৎ অগ্নিময় তীর বর্ষণ ও অগ্নিকাণ্ডের শব্দ, ক্বচিৎ বন্যলতাপাতামিশ্র বায়ুর হিল্লোলের মধ্যে একাধিক ধাবমান খোজার আক্রমণাত্মক চিৎকার ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎশিখার মতো চকিতে দেখিতে পাইতাম । তাহাদেরই রক্তবর্ণ পোশাক এবং হস্তে অস্ত্রশস্ত্র লইয়া উগ্রক্ষত্রিয় অট্টালিকাটিকে চতুর্দিক হইতে ঘিরিয়া ফেলিয়া “মেরে ফ্যাল, কেটে ফ্যাল, আগুন লাগিয়ে দে, চোখ উপড়ে নে, পিটিয়ে থেঁতো করে দে” ইত্যাদি আক্রোশের উক্তিতে অন্ধকার মথিত হইয়া উঠিত ।
নৃশংস ঘটনাবলী আমাকে পাগল করিয়া দিয়াছিল । আমি প্রতি রাত্রে নিদ্রার রসাতলরাজ্যে স্বপ্নের জটিলপথসংকুল অট্টালিকাটির মধ্যে গলিতে গলিতে কক্ষে কক্ষে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইয়াছি ।
এক- এক দিন সন্ধ্যার সময় আয়নার দুই দিকে দুই মোমবাতি জ্বালাইয়া যত্নপূর্বক সাজ করিতেছি এমন সময় হঠাৎ দেখিতে পাইতাম, আয়নায় আমার প্রতিবিম্বের পার্শ্বে ক্ষণিকের জন্য অস্ত্রধারী খোজাগণের ছায়া আসিয়া পড়িল, তাহাদের পশ্চাতে একদল ছায়াশরীর ডুগডুগি খোল-করতাল ঢোলক ভেঁপু ইত্যাদি বাজাইতেছে — পলকের মধ্যে চাপাতি তুলিয়া আমার গর্দান লইবার জন্য তাহারা প্রস্তুত হইল এবং আমি তাহাদের প্রতিরোধ করিবার প্রয়াস করিতেই তাহারা চিন দেশের গোলাপি শূকরে পরিবর্তিত হইয়া বাতাসে মিলাইয়া গেল, হাজার হইলেও তাহারা অতীতের সম্রাট অথবা শাসকের খোজাবাহিনী, বর্তমানযুগের মনুষ্যের সহিত দ্বন্দ্বযুদ্ধ করা তাহাদের পক্ষে সম্ভব নহে।
একদিন অপরাহ্ণে আমি তত্ববধায়ক মহাশয়ের সাইকেল লইয়া বাহির হইব সংকল্প করিলাম — কে আমাকে নিষেধ করিতে লাগিল জানি না — কিন্তু সেদিন নিষেধ মানিলাম না । একটা কাষ্ঠদণ্ডে আমার শার্ট, গ্যালিসদেয়া ফুলপ্যাণ্ট দুলিতেছিল, পাড়িয়া লইয়া পরিবার উপক্রম করিতেছি, এমন সময় দামোদর নদীর বালি এবং নিকটবর্তী অঞ্চলের শুষ্ক পল্লবরাশির ধ্বজা তুলিয়া হঠাৎ একটা প্রবল ঘূর্ণাবাতাস আমার সেই শার্ট এবং গ্যালিস দেয়া ফুলপ্যাণ্ট ঘুরাইতে ঘুরাইতে লইয়া চলিল এবং একটা অত্যন্ত গম্ভীর আর্তনাদ সেই হাওয়ার সঙ্গে ঘুরিতে ঘুরিতে আতঙ্কের সমস্ত পর্দায় পর্দায় আঘাত করিতে করিতে উচ্চ হইতে উচ্চতর সপ্তকে উঠিয়া সূর্যাস্তলোকের কাছে গিয়া মিলাইয়া গেল ।
সেদিন আর সাইকেল সঞ্চালন করিয়া শরিফাবাদের পথে ভ্রমণে যাওয়া হইল না এবং তাহার পরদিন হইতে সেই শার্ট এবং গ্যালিসদেয়া ফুলপ্যাণ্ট পরা একেবারে ছাড়িয়া দিয়াছি ।
আবার সেইদিন অর্ধরাত্রে বিছানার মধ্যে উঠিয়া বসিয়া শুনিতে পাইলাম কাহারা যেন গুমরিয়া গুমরিয়া, বুক ফাটিয়া ফাটিয়া কাঁদিতেছে — যেন আমার খাটের নীচে, মেঝের নীচে এই খণ্ডহরের সিমেন্টভিত্তির তলবর্তী একটা আর্দ্র অন্ধকার উদ্যানের ভিতর হইতে কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতেছে, ‘তুমি আমাদের সত্য ঘটনাবলী পৃথিবীর জনগণের সন্মুখে স্পষ্টভাবে তুলিয়া ধরো — কঠিন মায়া, গভীর নিদ্রা, নিষ্ফল স্বপ্নের সমস্ত দ্বার ভাঙিয়া ফেলিয়া, তুমি আমাদিগকে রাজনীতির পঙ্কিল আবর্ত হইতে তুলিয়া, বনের ভিতর দিয়া, পাহাড়ের উপর দিয়া, নদী পার হইয়া তোমাদের সূর্যালোকিত বিশ্বের দরবারে আমাদিগকে লইয়া যাও । আমরা বিস্মৃতির অতলে চাপা পড়িয়া আছি।’
আমি কে ! আমি কেমন করিয়া উদ্ধার করিব ! আমি এই ঘূর্ণমান পরিবর্তমান স্বপপ্নপ্রবাহের মধ্য হইতে কোন মজ্জমান বিস্মৃত মনুষ্যদিগকে তীরে টানিয়া তুলিব । তোমরা কবে ছিলে, কোথায় ছিলে হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা কোন অগ্নিকুণ্ডের ভিতর নিক্ষিপ্ত হইবার পর ভস্মে রূপান্তরিত হইয়াছিলে ? তোমরা কোন মাতার কোলে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলে । তোমাদিগকে কোন বেদুইন দস্যু, বনলতা হইতে পুষ্পকোরকের মতো মাতৃক্রোড় হইতে ছিন্ন করিয়া, জগতসংসার হইতে নিশ্চিহ্ণ করিয়া দিয়াছে ?
সেখানে সে কী ইতিহাস । সেই খোজাবাহিনীর চিৎকার, বাদ্যকরদিগের শ্রুতিকটূ বাজনা, এবং শাসকের সুবর্ণমদিরার মধ্যে মধ্যে ছুরির ঝলক, বিষের জ্বালা, চাপাতির উপর্যুপরি আঘাত, অন্তহীন গোলাপি শূকরদের সারি । কী অসীম বিস্মৃতি, কী অনন্ত কারাগার । শাসক বাদশার রক্তপাড় ধুতি ও পামশুর কাছে লুটাইতেছে তোমাদিগের ইতিহাস; বাহিরের দ্বারের কাছে যমদূতের প্রতিনিধিগণ ভোল পালটাইয়া দেবদূতের মতো সাজ করিয়া, খোলা ভোজালি ও চাপাতি হাতে দাঁড়াইয়া । তাহার পরে সেই রক্তকলুষিত ঈর্ষাফেনিল ষড়যন্ত্রসংকুল ভীষণোজ্বল ঐশ্বর্যপ্রবাহে ভাসমান হইয়া, তোমরা কোন নিষ্ঠুর মৃত্যুর মধ্যে অবতীর্ণ অথবা কোন নিষ্ঠুরতর মহিমাতটে উৎক্ষিপ্ত হইয়াছিলে !
এমন সময়ে, দেখিতে পাইলাম, সেই পাগলা পুরোহিত, গলায় লাল শালুতে শালিগ্রাম শিলা বাঁধিয়া বুকের মাঝে ঝোলাইয়া, চিৎকার করিয়া উঠিলেন, “তফাত যাও, তফাত যাও , সব সত্য সব সত্য সব সত্য।” চাহিয়া দেখিলাম, সকাল হইয়াছে ; তত্ববধায়ক মহাশয় ডাকের চিঠিপত্র লইয়া আমার হাতে দিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, আজ কিরূপ ভোজন প্রস্তুত করিতে হইবে ।
আমি কহিলাম, না, আর এ অট্টালিকার খণ্ডহরে থাকা হয় না ।
সেই দিনই আমার জিনিসপত্র তুলিয়া হোটেলে গিয়া উঠিলাম, বৃদ্ধ শ্যালকের গৃহে আশ্রয় লইলে ইয়ার্কি করিত । হোটেলের রিসেপশানিস্ট যুবতীটি আমাকে দেখিয়া ঈষৎ হাসিল । আমি তাহার হাসিতে বিরক্ত হইয়া কোনো উত্তর না করিয়া লিফ্টে চাপিয়া নির্দিষ্ট ঘরে চলিয়া গেলাম ।
যত বিকাল হইয়া আসিতে লাগিল ততই অন্যমনস্ক হইতে লাগিলাম — মনে হইতে লাগিল, এখনই কোথায় যাইবার আছে — আলোকচিত্রের কাজটা নিতান্ত অনাবশ্যক মনে হইল, ইন্টারন্যাশানাল জিওগ্রাফিকের দায়িত্বও আমার কাছে বেশি-কিছু বোধ হইল না — যাহা-কিছু বর্তমান, যাহা-কিছু আমার চারিদিকে চলিতেছে ফিরিতেছে খাটিতেছে খাইতেছে সমস্তই আমার কাছে অত্যন্ত দীন অর্থহীন অকিঞ্চিৎকর বলিয়া বোধ হইল ।
আমি লিফ্ট দিয়া নামিয়া একটি রিকশ ভাড়া করিয়া রিকশঅলাকে কোনো নির্দেশ ব্যতিরেকে সিটে বসিলাম । দেখিলাম, রিকশঅলা ঠিক গোধূলিমুহূর্তে আপনিই সেই ভগ্নপ্রায় খণ্ডহরের ইষ্টকদ্বারা বন্ধ দ্বারের কাছে গিয়া থামিল । ভাড়া মেটাইয়া দ্রুতপদে নিজের পূর্বের ঘরে প্রবেশ করিলাম।
আজ সমস্ত নিস্তব্ধ । অন্ধকার ঘরগুলি যেন রাগ করিয়া মুখ ভার করিয়া আছে । অনুতাপে আমার হৃদয় উদবেলিত হইয়া উঠিতে লাগিল, কিন্তু কাহাকে জানাইব, কাহার নিকট মার্জনা চাহিব খুঁজিয়া পাইলাম না । আমি শূন্য মনে অন্ধকার ঘরে অবহেলিত উদ্যানের লতাপাতার জঙ্গলে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম । ইচ্ছা করিতে লাগিল এককখানা সঙ্গীতযন্ত্র হাতে লইয়া অদৃশ্য ছায়াশরীরদের উদ্দেশ করিয়া গান গাহি ; বলি, ‘হে প্রেতাত্মাগণ, যে আলোকচিত্রী তোমাদের কাহিনি উদ্ঘাটন করিতে না পারিয়া পলাইবার চেষ্টা করিয়াছিল, সে তোমাদিগের নিকট ক্ষমা প্রার্থনার জন্য আসিয়াছে । এবার তাহাকে মার্জনা করো, তাহার দুই পক্ষ দগ্ধ করিয়া দাও, তাহাকে ভস্মসাৎ করিয়া ফেলো।’
হঠাৎ উপর হইতে আমার কপালে দুই ফোঁটা অশ্রুজল পড়িল । সেদিন শরিফাবাদের সন্ধ্যাকাশে ঘনঘোর মেঘ করিয়া আসিয়াছিল । দামোদরের মসীবর্ণ জল একটি ভীষণ প্রতীক্ষায় স্হির হইয়াছিল । জলস্হল আকাশ সহসা শিহরিয়া উঠিল ; এবং অকস্মাৎ একটা বিদ্যদ্দন্তবিকশিত ঝড় শৃঙ্খলছিন্ন উন্মাদের মতো শরিফাবাদের ভিতর দিয়া আর্ত চিৎকার করিতে করিতে ছুটিয়া আসিল । খণ্ডহরের শূন্য ঘরগুলো সমস্ত ভগ্নদ্বার আছড়াইয়া তীব্র বেদনায় হু হু করিয়া কাঁদিতে লাগিল ।
আজ এখানে আলো জ্বালাইবার কেহ ছিল না । সেই মেঘাচ্ছন্ন অমাবস্যার রাত্রে খণ্ডহরের ভিতরকার নিকষকৃষ্ণ অন্ধকারের মধ্যে আমি স্পষ্ট অনুভব করিতে লাগিলাম — তিনচারিজন মানুষ উঠানে উপুড় হইয়া পড়িয়া আছে এবং একজন প্রৌঢ়া দুই দৃঢ়বদ্ধমুষ্টিতে আপনার আলুলায়িত কেশজাল টানিয়া ছিঁড়িতেছে, তাহার গৌরবর্ণ ললাট দিয়া রক্ত ফাটিয়া পড়িতেছে, কখনো সে শুষ্ক তীব্র অট্টহাস্যে হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিতেছে, কখনো ফুলিয়া ফুলিয়া ফাটিয়া ফাটিয়া কাঁদিতেছে । মুক্ত বাতায়ন দিয়া বাতাস গর্জন করিয়া আসিতেছে এবং মুষলধারে বৃষ্টি আসিয়া তাহার সর্বাঙ্গ অভিষিক্ত করিয়া দিতেছে ।
সমস্ত রাত্রি ঝড়ও থামে না, ক্রন্দনও থামে না । আমি নিষ্ফল পরিতাপে গৃহের অন্ধকারে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম । কেহ কোথাও নাই ; কাহাকে সান্ত্বনা করিব । এই প্রচণ্ড অভিমান কাহার । এই অশান্ত আক্ষেপ কোথা হইতে উথ্থিত হইতেছে ।
শুনিতে পাইলাম, পুরোহিত চিৎকার করিয়া উঠিল, “তফাত যাও, তফাত যাও । সব সত্য সব সত্য সব সত্য ।”
দেখিলাম ভোর হইয়াছে এবং পুরোহিত মহাশয় এই দুর্যোগের দিনেও গলায় লাল শালুতে শালিগ্রাম শিলা ঝোলাইয়া যথানিয়মে খণ্ডহরের সন্মুখে দাঁড়াইয়া তাহার অভ্যস্ত চিৎকার করিতেছেন । হঠাৎ আমার মনে হইল, হয়তো ওই পুরোহিতও আমার মতো এক সময় এই প্রাসাদে বাস করিয়াছিলেন, এখন পাগল হইয়া বাহির হইয়াও এই খণ্ডহরের বিস্মৃত ইতিহাসের মায়াজালে আকৃষ্ট হইয়া প্রত্যহ প্রত্যুষে স্মৃতি জাগরিত করিতে আসেন ।
আমি তৎক্ষণাৎ সেই বৃষ্টিতে পুরোহিতের নিকট ছুটিয়া গিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “পণ্ডিত মহাশয় , কোন ঘটনাকে আপনি প্রতিদিন সত্য বলিয়া ঘোষণা করিয়া চলিয়া যান ?”
তিনি আমার কথায় কোনো উত্তর না করিয়া আমাকে ঠিলিয়া ফেলিয়া অজগরের কবলের চতুর্দিকে ঘুর্ণমান মোহাবিষ্ট পক্ষীর ন্যায় চিৎকার করিতে লাগিলেন । যেন প্রাণপণে নিজেকে সতর্ক করিবার জন্য বারংবার বলিতে লাগিললেন, “তফাত যাও, তফাত যাও, সব সত্য সব সত্য সব সত্য ।”
আমি সেই ঝড়জলের মধ্যে পাগলের মতো শ্যালকের গৃহে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “ইহার অর্থ কী আমায় খুলিয়া বলো।”
শ্যালক যাহা কহিল তাহার মর্মার্থ এই : একসময় শরিফাবাদের ঐ অট্টালিকায় ফুলে-ফলে ভরা উগ্রক্ষত্রিয়দের বৈভবশালী পরিবার বাস করিত । তাহাদের আত্মগর্বী বৈভব ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি দেখিয়া বহু মানুষ বিদ্বেষ ও হিংসায় আলোড়িত হইত — সেই সকল চিত্তদাহে, সেই সকল ক্রোধোন্মত্ত জনগণের ঈর্ষায় এই অট্টালিকার প্রত্যেক নোনালাগা ইষ্টক ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত হইয়া আছে, সজীব মানুষ পাইলে তাহাকে বিস্মরিত স্মৃতিতে মুড়িয়া ফেলিতে চায় । যাহারা ঘটনার দিন ওই খণ্ডহরে ছিল , তাহাদের মধ্যে কেবল পুরোহিত মহাশয় পাগল হইয়া বাহির হইয়া আসিয়াছেন, এ পর্যন্ত আর কেহ তাহার গ্রাস এড়াইতে পারে নাই । রাত্রির পর রাত্রি, শীতল উদাসীনতায় আচ্ছন্ন গৃহনিবাসীগণ পাতালের ভুতগ্রস্ত দ্বারগুলি খুলিয়া, তাহাদের অপূরণীয় শোকে আক্রান্ত চক্ষু হইতে অগ্নির অশ্রুবর্ষণ করে, প্রতিশোধস্পৃহার উন্মাদ নৃত্যে অবর্ণনীয় অপচ্ছায়াদের সহিত রহস্যময় বার্তালাপ করে, অপরাধীগণ নিজদিগের আত্মায় কলঙ্ক ও শিরায় বরফপ্রবাহ লইয়া অচেনা ভয়ে মুখহীন দেহ লইয়া পলাইয়া বেড়ায় ।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমার বিস্মৃতির কি কোনো পথ নাই ।”
শ্যালক কহিল, “একটিমাত্র উপায় আছে, তাহা অত্যন্ত দুরূহ । তাহা তোমাকে বলিতেছি — কিন্তু তৎপূর্বে এতদ্দেশের জনৈক রক্তপাড় সম্রাটের পুরাতন ইতিহাস বলা আবশ্যক । তাঁহার স্কন্ধের উপর মস্তক ছিল না বলিয়া কিংবদন্তি প্রচলিত । তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া রাত্রিবেলায় কঙ্কালেরা নৃত্য করিত এবং উর্দ্ধমুখ শৃগালেরা অমাবস্যার অন্ধকারে ক্রন্দন করিত । তেমন আশ্চর্য এবং তেমন সন্দেহজনক ও শাসন ব্যবস্হায় সম্পূর্ণ উদাসীন মনুষ্যের আয়েশি জীবনের ঘটনা সংসারে আর কখনো কোথাও ঘটে নাই । ইতিহাসে তাঁহাকে একপ্রকার ভ্যামপায়ার হিসাবে চিহ্ণিত করা হইয়াছে”
এমন সময়ে বিমানবন্দরে ঘোষণা হইল দমদমগামী বিমান আসিতেছে , যাত্রীগণ সিকিউরিটি চেক করাইয়া লউন । এত শীঘ্র ? একজন চিনা বৃদ্ধ ইলেকট্রনিক বোর্ডে বিমানের গন্তব্য ও সময় পড়িবার চেষ্টা করিতেছিল, আমার সহযাত্রী বন্ধুটিকে দেখিয়াই ‘নি হাও’ বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল এবং জড়াইয়া ধরিল । আমরা সিকিউরিটি চেকের জন্য নির্দিষ্ট দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলাম । কৃষ্ণত্বক বাবুটি যে কে, খবর পাইলাম না, গল্পেরও শেষ শোনা হইল না । নিজের নাম বলিতেছিল মলয় রায়চৌধুরী, যেন তিনি জাদুকর পি সি সরকার, জগতসংসারে মানব মাত্রেই নামটির সহিত পরিচিত ।
আমি বলিলাম, লোকটা আমাদিগকে বোকার মতো দেখিয়া কৌতুক করিয়া ঠকাইয়া গেল, গল্পটা আগাগোড়া বানানো ।
এই তর্কের উপলক্ষে আমার সমাজবাদী ঠিকেদার আত্মীয়টির সহিত আমার জন্মের মতো বিচ্ছেদ ঘটিয়া গিয়াছে । ক্বচিৎ-কখনও সংবাদপত্রে তাঁহার সম্পর্কে পড়িয়া জানিতে পারি সরকারি ঠিকেদারির মাধ্যমে প্রভূত সম্পত্তি করিয়াছেন, শহরের পেজ থ্রি সুন্দরীগণের কোমরবেষ্টিত হস্তে ছিটকাপড়ের জামা পরিহিত তাঁহার হাস্যময় মুখ দেখা যায় ।
Leave a Reply