আরব জাতির ইতিহাস
মূল : ফিলিপ কে. হিট্টি
অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ
ভূমিকা
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, প্রাচ্য ভাষা ও ইতিহাসের বিদগ্ধ পণ্ডিত স্যার ফিলিপ কে হিট্টি (১৮৮৬-১৯৭৮)-র মশহুর গ্রন্থ History of the Arabs। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে হিট্টির এই হৈৎ গ্রহের একটি সংক্ষিপ্ত (Abridged) সংস্করণ ‘দ্য আরবস : এ শর্ট হিস্ট্রি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় নিউ ইয়র্ক থেকে। প্রিন্সিপ্যাল ইবরাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৮) সেই সংক্ষিপ্ত সংস্করণটির বাংলা অনুবাদ করেন “আরব জাতির ইতিকথা” শিরোনামে। ঢাকাস্থ ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশন্সের সহযোগিতায় ইসলামিক একাডেমী কর্তৃক অনুবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। পরবর্তীকালে বাংলা একাডেমী কর্তৃক ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত এবং মৎসম্পাদিত ইবরাহীম খাঁ রনোবলীর দ্বিতীয় খণ্ডে অনুবাদগ্রন্থটি সংস্থিত হয়। প্রকাশনা সংস্থা ‘জ্ঞান বিতরণী’ ‘আরব জাতির ইতিকথা’কে ‘আরব জাতির ইতিহাস’ শিরোনামে পুণঃমূদ্রণের উদ্যোগ নেয়ায় এবং তার ভূমিকা লেখার জন্য আমাকে অনুরোধ রাখায় বিশেষ সাধুবাদ আর ধন্যবাদ জানাই। গ্রন্থের মূল লেখক এবং অনুবাদককেও এ সুবাদে সর্বাগ্রে স্মরণ করি বিম্র শ্রদ্ধায়, মাগফিরাত কামনা করি তাঁদের বিদেহী আত্মার। তাঁদের পরিশ্রম আর আন্তরিকতার একান্ত ফসল ভাবীকালের পাঠকেরা যুগ যুগান্তরে উপভোগ করে চলেছেন ও চলবেনও। অগণিত পাঠকের করকমলে এই অমর সৃষ্টি পৌঁছানোর যে কোন উদ্যোগ একই সাথে ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকল।
স্যার ফিলিপ খৃরী হিট্টি (Sir Philip Khuri Hitti) অটোমান সিরিয়া (বর্তমান লেবানন)-র শিমলানে ম্যারোনাইট খ্রীস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৬ সালে। তিনি লেবাননের সাক আল গারব এলাকার আমেরিকান প্রেবিটারিয়ান মিশনারী স্কুলে পড়াশুনা করেন এবং ১৯০৮ সালে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুত থেকে গ্রাজুয়েশন লাভ করেন। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতেই কিছুদিন অধ্যাপনার পর তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, সেখানে সিমেটিক ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভসহ ১৯১৫ সালে পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে হিট্টি আবার বৈরুত বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন এবং ১৯২৬ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনায় কাটান। ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তাকে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ চেয়ার দেয়া হয় এবং ১৯৫৪ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য ভাষা ও ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি হার্ভার্ড-এ অতি সম্মানজনক পদে এবং ইউটা ও ওয়াশিংটন ডিসির জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে সামার স্কুলে অধ্যাপনা করেন। এ সময় ইউনিভার্সিটি অব মিনোসোটাতে গবেষণা পর্ষদেও সংযুক্ত হন। সমগ্র মার্কিন মুলুকে হিট্টি একক হাতে আরবী ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি চর্চার প্রবর্তন ঘটান (‘Philip Hitti almost single handedly created the discipline of Arabic Studies in the United States.’ Wikipedia) ১৯৪৫ সালে সান ফ্রানসিসকোতে যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জাতিসংঘের জন্ম হয় সেই সম্মেলনে হিট্টি আরব প্রতিনিধিদলের উপদেষ্টা ছিলেন। ম্যাগনাম অপাস ‘হিস্ট্রি অব দ্য আরবস’ ছাড়াও তার অন্যান্য প্রধান কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে–The Syrians in America (1924); The Origins of the Druze People and Religion : with extracts from their sacred writings (1928); An Arab-Syrian Gentlemen in the Period of the Crusades : Memoirs of Usamah ibn Munqidh (1929); History of Syria : Including Lebanon and Palestine (1957); The Arabs (1960); Lebanon in History (1967); Makers of Arab History (1968); The Near East in History (1961); Islam and the West (1962); Islam : A Way of Life (1970); Capital Cities of Arab Islam (1973).
মূল ‘হিস্ট্রি অব দ্য আরবস’ রচনায় হিট্টি দশ দশটি বছর সময় নেন। ১৯৩৭ সালে প্রখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ম্যাকমিলান কর্তৃক লন্ডন ও নিউ ইয়র্ক থেকে এটি একযোগে প্রথম প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বে সাড়া পড়ে যায়। বলাবাহুল্য, হিট্টির এই আকর গ্রন্থটির মাধ্যমে আরব জাতি, তাদের জীবন সাধনা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং বিশেষভাবে ইসলাম ধর্মের বিকাশ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বহির্বিশ্বের অবগতির অবয়ব বৃদ্ধি পায়। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বদৌলতে বইটির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশিত হলে বহু ইউরোপীয় ও এশীয় ভাষায় এর অনুবাদে ধুম পড়ে যায়। ইবরাহীম খাঁ-র বাংলা অনুবাদ প্রকাশের প্রাক্কালে ১ এপ্রিল ১৯৫৭ তারিখে হিট্টি নিজে ‘গভীর আনন্দ প্রকাশ করে’ লিখেন যে, ‘এ বইয়ের একটা বাংলা সংস্করণও এখন আত্মপ্রকাশ করছে। বাংলা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপুঞ্জের ইন্দো আর্য উপ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত দূর প্রাচ্যের ভাষা সমষ্টির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ভাষা। ধর্মীয় ও সাহিত্যিক চিন্তাধারার বাহন হিসেবে এ ভাষার সুদীর্ঘ ও মহত্তম ঐতিহ্য রয়েছে।’
আরব জাতির ইতিহাস-এর প্রেক্ষাপট উন্মোচিত হয়েছে আরব উপদ্বীপের কোলে লালিত ব্যাবিলনীয়, আসিরীয়, কালদীয়, আর্মেনীয় এবং ফিনিশীয় জাতিনিচয়ের ইতিহাস ঐতিহ্য কালের করাল গ্রাসে বিলিন হওয়ার বয়ান দিয়ে। এরা সবাই এক কালে ছিল আজ আর নাই। আরবেরা ছিল আজো তারা আছে। আরব জাতি, মুসলিম ও সিমাইট–জাতি সম্প্রদায় আর তাদের সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে গভীর বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিতে। আদিম আরব বেদুইনদের জাত্যাভিমান, তাদের অন্তর্লীন ভাবনা ও জীব বৈশিষ্ট্যকে কাব্যিক ভাবধারায় তুলে আনা হয়েছে। রাসূল (দঃ)-এর অধ্যায়টি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্বলিত বিচার বিশ্লেষণে নির্মোহ দৃষ্টিতে রাহমাতুল্লিল আলামিনের শ্রেষ্ঠত্ব ও মানব জাতির ত্রাতা হিসেবে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা উঠে এসেছে। কিতাব ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক অনুসন্ধানে হিট্টি সংশ্লিষ্ট গোত্র বা সম্প্রদায়ের জীবনাচার ও সংস্কৃতির সাযুজ্য সাধনে আসমানী কিতাবসমূহের অবিসংবাদিত ভূমিকা ব্যাখ্যা করেছেন। অভিযান পথে ইসলাম শীর্ষক অধ্যায়ে হিট্রি তুলে ধরেছেন কিভাবে অসি নয় মশির জোরে, সাম্য ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ সূত্রে ইসলাম সাম্রাজ্যের সীমানা সম্প্রসারিত হয়েছিল। মুসলিম শাসনে খেলাফতের বৈশিষ্ট্য এবং ক্রমাবনতি ও পুনরুত্থানের পথ পরিক্রমা নির্দেশ করা হয়েছে খেলাফত অধ্যায়ে। মুসলমানদের স্পেন বিজয়কে ইসলামের ইতিহাসের অতি গৌরবময় অধ্যায় বলে সনাক্ত করেছেন হিট্টি। কেননা স্পেন বিজয়ের মাধ্যমেই ইউরোপে ইসলামের ঝাণ্ডা ওড়ে, ইসলামের সুশীতল ছায়ায় ইউরোপের অবগাহনের অভিষেক ঘটে। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে সামাজিক ও তামনিক জীবনের আরম্ভ, গৌরব যুগে বাগদাদ, জাতির জীবন, সাহিত্য ও বিজ্ঞান, চারু শিল্প প্রভৃতিতে ইসলামের অবদানকে হাই লাইট করা হয়েছে। জগতমনি কর্ডোভাকে বিশ্ব সভ্যতা বিকাশে ইসলামের অনন্য অবদানের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে হিট্টি পাশ্চাত্য জগতে আরবের অবদানের সালতামামী কষেছেন। এর পরে ক্রুসেড সংক্রান্ত পর পর দুটি লেখায় বিশ্লেষণে প্রয়াস পেয়েছেন কিভাবে ইসলামের গৌরব প্রাসাদ ষড়যন্ত্র আর অনৈক্যের অতলে তলিয়ে গিয়েছে। শেষ শাসক বংশ আর বর্তমানের আধুনিক আরব বিশ্ব শীর্ষক দুটি অধ্যায়ে ক্ষয়িষ্ণু শাসন আমল আর মুসলিম বিশ্বের হাল হকিকত তুলে ধরে হিট্টি এই ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন যে, আধুনিক শিক্ষা প্রযুক্তি ব্যবহার আর নিস্বার্থবোধ ও অয়োময় প্রত্যয়দীপ্ত ঐক্য চেতনা আরব তথা মুসলিম দেশ ও জাতির সার্বিক ও টেকসই উন্নয়নের অন্যতম উপায়।
হিট্টির ইতিহাস অনেকটা কাব্যিক ও প্রত্নতাত্তিক ভাষায় লিখিত। ইবরাহীম খাঁ অনুবাদে সে মেজাজ অক্ষুণ্ণ রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। আবার এ দেশীয় স্বল্প শিক্ষিত মুসলমান পাঠকের বোধগম্যকরণের দিকেও ছিল তাঁর সচেতন দৃষ্টি । ফলে এটি একটি অনবদ্য অনুবাদে পরিণত হয়। ১৯৫৯ সালে প্রথম প্রকাশের পর সমকালীন পত্র পত্রিকায় এই অনুবাদ কর্মটির বিশেষ প্রশংসাসূচক মূল্যায়ন প্রকাশিত হয় এবং এর বিভিন্ন অধ্যায় মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়। উচ্চতর পর্যায়ে এটি সহায়ক পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। যেহেতু এটি মূল History of the Arabs এর অনুবাদ ছিল না, এটি ছিল একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণের সরল অথচ ভাবানুবাদ প্রকৃতির সেহেতু ইবরাহীম খাঁ ‘আরব জাতির ইতিকথা’ শিরোনাম ব্যবহারের পক্ষপাতি ছিলেন প্রতীয়মান হয়। তখনকার সময় সাধারণ পাঠক সমাজে ইতিহাসের চেয়ে ইতিকথার সমাদর ছিল যেন বেশী। ইতিহাস পাঠ ও পঠন সে যুগে তখনো ততটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি যতটা হয়েছে ইদানিংকালে। সেকালে পাঠক ইতিকথাকে কৌতূহল উদ্দীপক বিষয় মানত, ইতিহাসের ভারিক্কির মধ্যে মাথা ঢোকানোটা সহজ ও জনপ্রিয় কাজ মনে করত না। পুনর্মুদ্রণ কালে প্রকাশক মোহাম্মদ সহিদুল ইসলাম তাঁর জ্ঞান বিতরণী’ মিশনের অংশ হিসেবে, যুগের রুচি ও বোধ-বুদ্ধির বিকাশ বিবেচনায় এনে ইতিকথায় ইতি টেনে ‘ইতিহাস’করণের যে আইডিয়া মাথায় এনেছেন তা আমার কাছে অসঙ্গত মনে হয়নি। তবে অনুবাদকের অনুমতি নিতে পারলে বেহেতর হত। ইবরাহীম খাঁ ছিলেন দরাজদিল ব্যক্তি, ষাড়ে সোলআনা শিক্ষাবিদ, রসে টইটম্বুর লেখক এবং অনুপম অনুবাদক। আমার বিশ্বাস তিনি দ্বিমত করতেন না; কিন্তু সেই ইবরাহীম খাঁ সাহেবকে পাই কোথায়? তিনি তো আমাদের সকল ধরা ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে। মূল লেখক স্যার ফিলিপ কে হিট্টি আর অনুবাদক ইব্রাহিম খাঁ তারা উভয়ে ১৯৭৮ সালে পরপারে পাড়ি জমান। আমরা তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
২৫ জুন, ২০০৯
বাংলো ৪৩, মিন্টু রোড, ঢাকা
.
বাংলা সংস্করণ সম্পর্কে
এ বইয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আরবী ভাষা-ভাষী মানুষদের কাহিনী ও তাদের মহান সংস্কৃতির গৌরবময় অবদানের বিবরণ দেয়া হয়েছে। আরবদের বিচিত্র জীবনালেখ্য ও তাদের বিস্ময়কর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আজ আমাদের সামনে ইতিহাসের একটি মহিমোজ্জ্বল ও দিক-নির্দেশক যুগ-পরিক্রমার তোরণ-দ্বার খুলে দিয়েছে। লেখকের ‘হিট্টি অব্ দি এ্যারাস’ নামক বৃহদায়তনের বই হতে এ বইয়ের তথ্যাবলী সংযোজিত হয়েছে। প্রথমে গ্রন্থ-প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ম্যাকমিলান লন্ডন ও নিউ ইয়র্ক হ’তে মূল বইটি প্রকাশ করেন। সংক্ষিপ্ত আকারের বইটি (দি এ্যারাবৃসঃ এ শর্ট হিস্ট্রি’) প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় হতে বের হওয়ার পর বহু সংস্করণে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর বহু ইউরোপীয় ও এশীয় ভাষায় এর অনেকগুলো অনূদিত সংস্করণ বেরিয়েছে। এ ভাষাগুলোর মধ্যে ফরাসী, স্পেনিশ, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, আরবী, উর্দু ও ইন্দোনেশীয় ভাষা উল্লেখযোগ্য।
গভীর আনন্দের কথা যে, এ বইয়ের একটা বাংলা সংস্করণও এখন আত্মপ্রকাশ করছে। বাংলা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপুঞ্জের ইন্দো-আর্য উপ-গোত্রের অন্তর্ভুক্ত দূর প্রাচ্যের ভাষা সমষ্টির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ভাষা। ধর্মীয় ও সাহিত্যিক চিন্তাধারার বাহন হিসেবে এ ভাষার সুদীর্ঘ ও মহত্তম ঐতিহ্য রয়েছে।
ফিলিপ কে. হিট্টি
১লা এপ্রিল ১৯৫৭
.
গ্রন্থকার-পরিচিতি
ইতিহাসবেত্তা হিসেবে ডক্টর ফিলিপ কে, হিট্টি আজ বিশ্ব-বিশ্রুত। আরব জাতির ইতিহাস সম্পর্কে মৌলিক গবেষণা এবং বিশ্ব-সভ্যতায় আরবদের যুগান্তকারী অবদান আর তাদের উত্থান-পতনের বৈচিত্র্যময় জীবনালেখ্যের ওপর নতুন দৃষ্টিভঙ্গীতে আলোকপাত করে এই শক্তিমান জাতি সম্পর্কে বিশ্ববাসীর কাছে তিনি নব পরিচয়ের দ্বার উদ্ঘাটন করেছেন। শুধু তাই নয়, আরব জাতির ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান এবং সুদূর অতীতের বেলাভূমিতে তাদের পূর্বপুরুষদের বলিষ্ঠ পদ-চিহ্ন খুঁজতে যেয়ে ইতিহাসের যে বৈজ্ঞানিক জিজ্ঞাসায় হিট্টি উদ্বুদ্ধ হয়েছেন আজ ইতিহাস সাধনার ক্ষেত্রে তা একটি নব জাগ্রত চেতনার সৃষ্টি করেছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য ভাষা ও ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে হিট্টি অবসরগ্রহণ করেন। গত তিন দশক থেকে আরবী এবং ইসলামী ভাষা ও সভ্যতার গবেষণায় তিনি আমেরিকার শ্রেষ্ঠতম মনীষীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। তার মহত্তর প্রচেষ্টার ফলেই প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় আজ আরবী পাণ্ডুলিপির একটি অমূল্য সহ-ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ হয়েছে। এ দিক থেকে প্রিন্সটন সমগ্র আমেরিকায় শ্রেষ্ঠতম গৌরবের অধিকারী। ১৯৫২ সালে তাঁরই উদ্যোগে প্রিন্সটন ইসলামী সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি বৃহৎ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। ডক্টর হিট্টির ব্যাপক প্রভাব এবং পথ-নির্দেশের ফলে আমেরিকার বহুসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ে (কমপক্ষে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটি) আরবী ভাষা, নিকট প্রাচ্য ও আরব ভূমির ইতিবৃত্ত, ইসলামী ইতিহাস, দর্শন, কৃষ্টি ও সভ্যতা সংক্রান্ত বিষয়াদি পাঠ্যতালিকাভুক্ত হয়েছে।
১৮৮৬ সালের ২৪ জুন লেবাননে হিষ্টির জন্ম হয়। ১৯০৮ সালে বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় হতে তিনি বি. এ. ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯১৩ সলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ১৯২০ সালে নিয়মিতভাবে মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হতে তিনি পি. এইচ. ডি. ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯০৯ হতে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক পদে কাজ করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিটিক সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯৪৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য ভাষা ও ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান পদে অভিষিক্ত হন।
বর্তমানে তিনি ইরানী শিল্প ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কিত আমেরিকান ইন্সটিটিউটের জাতীয় উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য, সমাজ-বিজ্ঞান বিশ্বকোষের সম্পাদনা বিভাগের উপদেষ্টা, ‘বাইজেনটিয়ন’-এর সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য। লেবানন সরকার তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৪৬ সালে “লা মেডেইলে দ্য অনার দু’ মেরিটে লিবানাইজ ইন ভারমেইল, অফিসার দ্য ওয়ান; অর্ডার দু সেডরে” নামক প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ মর্যাদার পদক দ্বারা তাকে সম্মানিত করেন। ১৯৪০ সালে আমেরিকান বিশ্ব প্রদর্শনীতে আমেরিকায় নাগরিকত্ব প্রাপ্ত প্রখ্যাত মনীষীদের নামের সাথে তার নাম প্রস্তর ফলকে উল্কীর্ণ করা হয়। শিলা-গাত্রে কীর্তিমান এই মনীষীদের প্রতিভার অবিস্মরণীয় স্বাক্ষর অঙ্কিত করে লেখা হয় যারা আমাদের জাগ্রত ও ক্রমপ্রসারণশীল গণতন্ত্রকে অক্ষয় অবদানে সমৃদ্ধ করেছেন।
ডক্টর হিট্টির ‘আরব জাতির ইতিকথা’ বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় গ্রন্থসমূহের অন্যতম। লন্ডন ও নিউইয়র্ক হতে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত এর বহু সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এবং ইউরোপ ও এশিয়ার বহু প্রভাবশালী ভাষায় অনুবাদ সংস্করণ আত্মপ্রকাশ করেছে। শুধু মূল ইংরাজী সংস্করণেরই লক্ষাধিক কপি বিক্রয় হয়েছে।
বর্তমানে ডক্টর হিট্টি তাঁর পত্নী ও কন্যাসহ প্রিন্সটনে বাস করছেন।
.
অগ্র-লেখা
মুসলমানদের গৌরবের স্বর্ণোজ্জ্বল যুগ খৃস্টীয় অষ্টম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ হতে নবম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত একশো বছরকে বলা হয়, তরজমার যুগ। এ সময় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নব জাগ্রত মুসলিম মনীষীগণ গ্রীক, ল্যাটিন, পাক-ভারতীর প্রভৃতি ভাষার বহু মূল্যবান জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থের তরজমা করেন। তাদের এই মহত্তর প্রচেষ্টার ফলে আরবী সাহিত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচিত্রতর সম্ভারে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির এই অগ্রগতির ক্ষেত্রে জ্ঞানসাধক খলিফাগণ ও তাদের ওমরাহদের অবদানও অনেকখানি। এঁদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা ও ঐকান্তিক আগ্রহের ফলে মুসলিম মনীষীদের সাধনার পথ সুগম হয় এবং বিশ্বের বিভিন্ন জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তাধারার সাথে মুসলমানদের পরিচয় ঘনিষ্ঠত হয়। সে সময় এদের প্রচেষ্টায় উন্নত ধরনের যে সব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে, যে সব মূল্যবান গ্রন্থ রচিত হয়–আর যে সব বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়, তা চিরকালই মানুষের মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করবে এবং মানব জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় কীর্তি হয়ে বেঁচে থাকবে।
মুসলমানদের অভ্যুত্থান ও অভূতপূর্ব অগ্রগমন পৃথিবীর ইতিহাসে একটা বিপ্লব–একটা বিস্ময়। কেবল রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সামরিক শৌর্য ও নৈপুণ্যের ক্ষেত্রেই নয়–জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও তাদের দান অতুলনীয়। আমাদের এই গরীয়ান পূর্বপুরুষদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। আর এর প্রধান কারণ হচ্ছে, এ সম্পর্কীয় অধিকাংশ বই-ই আরবী-ফার্সী ভাষায় লিখিত। এ বিষয়ে আমাদের মাতৃভাষায় রচিত গ্রন্থাবলীর সংখ্যা অতিনগণ্য। আজ আমাদের জাতীয় ক্রমবিকাশের তাগিদে এ সম্পর্কে অধিক সংখ্যক নির্ভরযোগ্য ও নিরপেক্ষ বইয়ের প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে। মহান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে গৌরবদীপ্ত আমাদের জাতির এই ইতিহাসের সাথে নিবিড় সংযোগ ও পরিচয় ঘটলে নিশ্চিতভাবে আমরা নব প্রেরণা লাভ করবো এবং এর ফলে আমাদের অগ্রগতিও অনেকখানি তুরান্বিত হবে।
এ দিক দিয়ে ঢাকার ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশান্সের উদ্যম নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তাঁদের প্রচেষ্টায় খ্যাতনামা ইতিহাসবেত্তা ফিলিপ কে. হিষ্টির প্রখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ “দি হিস্ট্রি অব এ্যারাস’-এর বাংলা তরজমা প্রকাশিত হয়েছে। আরব জাতির আবদান সম্পর্কে গবেষণামূলক তথ্য-চিত্র এবং তাদের জীবনালেখ্য হিসেবে বইখানি বিশ্বের সুধী সমাজের বিস্ময়দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কৃতীয় সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ জনাব ইব্রাহীম খা বইখানি তরজমা করেছেন। এ দিক দিয়ে ফ্রাঙ্কলিন উপযুক্ত লোকই বেছে নিয়েছেন বলা চলে।
এ পর্যন্ত লিখিত অধিকাংশ আধুনিক ইতিহাসেই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভংগীর পরিচয় কমই পাওয়া গেছে। এর মূলে হয়তো রয়েছে, ইতিহাসের পটভূমি সম্পর্কে যথার্থ তথ্যানুসন্ধানে ব্যর্থতা অথবা ইতিহাসের সাথে সংশ্লিষ্ট জাতি সম্পর্কে ইতিহাসকারের অনুদার মনোভাব বা এক দেশদর্শিতা। মুসলমানদের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এই সংকীর্ণ মনোভাব অনেক ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে, তাদের সম্পর্কে নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস পাওয়া দুস্কর। এ দিক দিয়ে হিট্টির ইতিহাসকে অপেক্ষাকৃত অধিক নির্ভরযোগ্য ও নিরপেক্ষ মনে করা হয়। তা সত্ত্বেও তার ইতিহাসের সব কিছুই যে নির্ভুল ও নিখুঁত, এ কথা জোরের সাথে বলা চলে না। এ বিষয়ের প্রতি আমাদের ইতিহাসবিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আলোচ্য গ্রন্থের তথ্যে কোন ভুল-ভ্রান্তি সম্পর্কে অবহিত করানো হলে, আশাকরি পরবর্তী সংস্করণে কর্তৃপক্ষ তা সংযোজন করার ব্যবস্থা করবেন।
‘আরব জাতির ইতিকথা’ প্রকাশিত হওয়ার ফলে পূর্ব-পাকিস্তানের সাহিত্যের ঐশ্বর্য ভাণ্ডার নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধতর হয়েছে। আশাকরি, জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন পূর্ব-পাকিস্তানের পাঠক সমাজে বইখানি ব্যাপক সমাদর লাভ করবে।
(মওলানা) মুস্তাফিজুর রহমান
মাদ্রাসা-ই-আলীয়া, ঢাকা
১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৫৮
Leave a Reply