আরবদেশে সন্তু কাকাবাবু – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (অসম্পূর্ণ)
[বইটি অসম্পূর্ণ। আমরা সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি, কিন্তু সব জায়গায় ‘আউট অফ প্রিন্ট’ দেখাচ্ছে। বইটি পাওয়া গেলে পুরোটা দেয়া হবে।]
.
আরবদেশে সন্তু ও কাকাবাবু – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১.
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “সন্তু, তুই এই শহরটার নাম আগে শুনেছিস?”
সন্তু দু’ দিকে মাথা নেড়ে বলল, “না!”
কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, “ভূগােল বইতেও পড়িসনি?”
সন্তু কপাল কুঁচকে একটু চিন্তা করে বলল, “না বােধ হয়। মনে তাে পড়ছে না।”
কাকাবাবু হেসে বললেন, “আমিও জানতুম না যে, এই নামে একটা শহর আছে। কালকেই ম্যাপে দেখেছি।”
গাড়িটা ছুটছে ঘণ্টায় একশাে কুড়ি কিলােমিটার গতিতে। চমৎকার, মসৃণ রাস্তা। খুব চওড়া। দু’ দিক দিয়ে গাড়ি যাওয়া আর আসার আলাদা পথ, মাঝখানে ডিভাইডার। গাড়িতে কোনও জায়গায় একটুও ঝাঁকুনি লাগে না।
দামাস্কাস থেকে বেরিয়ে প্রথমে এই রাস্তা দেখে কাকাবাবু বলেছিলেন, “আগে আমরা এরকম রাস্তা দেখলে বলতুম, ‘সাহেবদের দেশের মতাে! কিন্তু এখন আমাদের দেশেও ভাল-ভাল রাস্তা তৈরি হয়েছে। কলকাতা থেকে আমার বন্ধু ডেভিডসনকে কয়েক মাস আগে শান্তিনিকেতন নিয়ে গিয়েছিলুম। সে তাে কানাডার লােক। যেতে-যেতে সে বলেছিল, এই রাস্তা তাে আমাদের দেশের চেয়েও ভাল!”
সন্তু বলল, “কানাডার রাস্তায় কি গােরু থাকে?”
কাকাবাবু বললেন, “হ্যা, এই একটা তফাত ঠিকই। আমাদের দেশের রাস্তা যতই ভাল হােক, হঠাৎ-হঠাৎ গােরু কিংবা কুকুর ঢুকে পড়ে। তা আর কী করা যাবে!”
সন্তু বলল, “এ দেশে কিন্তু এতক্ষণে রাস্তার দু ধারে একটাও জন্তু-জানােয়ার দেখা গেল না। আমি ভেবেছিলুম, দু-একটা উট অন্তত দেখতে পাব।”
কাকাবাবুর বললেন, “সত্যিই। জন্তু-জানােয়ার একদম নেই। এক সময় এসব তাে ছিল মরুভূমির পথ। উট ছাড়া দূরে কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না। বেদুইনরা যাতায়াত করত উটের পিঠে। চড়েই।”
সন্তু বলল, “কিন্তু…মরুভূমি…বালি তাে দেখতে পেলুম না কোথাও।”
কাকাবাবু বললেন, “সেটাও ঠিক। তবে, এও এক ধরনের মরুভূমি। ভাঙা-ভাঙা পাথুরে মাঠ যত দূর দেখা যায়, দূরে-দূরে ছােট-ছােট পাহাড়ও রয়েছে। একে বলা যেতে পারে ঊষর, বন্ধুর পথ। বন্ধুর পথ’ কথাটা বেশ মজার তাই না? তার মানে কিন্তু বন্ধুর বাড়ির দিকে যাওয়ার রাস্তা নয়, খারাপ রাস্তা।”
সন্তু বলল, “খারাপ রাস্তাকে ‘বন্ধুর পথ’ বলে কেন?”
কাকাবাবু বললেন, “সেটা আমিও ঠিক জানি না। ডিকশনারি দেখতে হবে। অবশ্য এখানে বাংলা ডিকশনারি পাবই-বা কোথায় ? এ দেশের উটগুলােই-বা কোথায় গেল?”।
সন্তু আর কাকাবাবু বসে আছেন পিছনের সিটে। সামনে যিনি গাড়ি চালাচ্ছেন, তাঁর নাম হাসান। তাঁর পাশে যিনি বসে আছেন, তাঁর নাম পারভেজ। তিনিই কাকাবাবুদের এখানকার সর্বক্ষণের সঙ্গী আর গাইড।
হাসানকে সাধারণ ড্রাইভার বলা যায় না, তাঁর ব্যবহারে ও পােশাকে বেশ একটা বিশেষত্ব আছে, কিন্তু তিনি একবর্ণও ইংরেজি জানেন না। কিছু বলতে গেলে হাসেন আর হাত নেড়ে জানান যে, তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। আর পারভেজ একটু-একটু ইংরেজি জানেন। তাতে আরও মুশকিল। এক কথার অন্য মানে বােঝেন। তিনি অবশ্য প্রথমেই বলেছিলেন, অর্থাৎ কোনওক্রমে বুঝিয়ে ছিলেন, এক-এক দেশের লােক এক-এক রকম ইংরেজি উচ্চারণ করে। ভারতীয়দের ইংরেজি বুঝতে তাঁর অসুবিধে হয়, তবে ইজিপশিয়ানদের ইংরেজি তিনি ভাল বুঝতে পারেন।
কাকাবাবু তাঁর কাঁধে একটা টোকা মেরে জিজ্ঞেস করলেন, “পারভেজ, আপনাদের দেশে তাে এক সময় অনেক ক্যামেল ছিল। সেই সব ক্যামেল গেল কোথায়?”
দু’বার এই একই প্রশ্ন করার পর পারভেজ বললেন, “ক্যামেল? আপনি সিগারেট চান? আচ্ছা, পরের কোনও বাজার থেকে কিনে দিচ্ছি। ক্যামেল ব্র্যান্ড সিগারেট তাে?”
কাকাবাবু বললেন, “না, না। আমি সিগারেট খাই না। ব্যাপারটা আপনাকে পরে বুঝিয়ে দেব, এখন থাক।”
এসব অনেকক্ষণ আগের কথা। এখন দূরে একটা শহর দেখা যাচ্ছে। | কাকাবাবু বললেন, “এই শহরটার নাম তারতুফ। পৃথিবীতে এরকম কত ছােট-ছােট সুন্দর শহর আছে, অথচ আমরা তার নামই জানি না। সন্তু দেখবি, এই শহরে একটা দারুণ চমক আছে।”
সন্তু পিছন দিকে তাকিয়ে ছিল। ভাল করে এ কথা শুনল না। সে একটু চাপা গলায় বলল, “কাকাবাবু, ওই কালাে গাড়িটাকে দ্যাখাে, সব সময় আমাদের পিছন পিছন আসছে।”
Leave a Reply