আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র ২ / দ্বিতীয় খণ্ড
আরজ আলী মাতুব্বর
জন্ম : ৩ পৌষ, ১৩০৭, মৃত্যু : ১ চৈত্র, ১৩৯২
উৎসর্গ : মুক্তচিন্তা চর্চা ও প্রসারে উৎসাহী এবং যুক্তিপ্রবণ পাঠকের উদ্দেশে
প্রকাশনা
মানুষের পক্ষে
ঊনিশ শো চুয়াত্তর। নতুন স্বাধীন দেশে আপাতঅপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাধরদের উল্লাস তখনও ফুরিয়ে যায় নি, বরং তা এগিয়ে চলেছে পরবর্তী বছরে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে। একই সাথে এ ছিল সমান্তরাল শক্তির গণযুদ্ধের প্রস্তুতির, নব্য ধনীদের অসংযত ফুর্তিবিলাসের আর দেশব্যাপী দুঃর্ভিক্ষের বছর। একাত্তরের ডিসেম্বরে স্বাধীনতা থেকে পঁচাত্তরের আগস্টে রক্তাক্ত প্রাসাদ নিয়ে দানবীয় লোফালুফি খেলার শুরু পর্যন্ত এই মাটিতে ধর্মীয় মৌলবাদের ভারবাহী ও সওয়ারদের ছিল ঘোর দুর্দিন।
তবু এই চুয়াত্তরের এক দিনে বরিশাল শহরের এক খোলা সড়কের ওপর জনসমক্ষে অপরাধে তৎপর হয়ে উঠল একদল মাদ্রাসাকেন্দ্রিক মৌলবাদের ভারবাহী। সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ আরজ আলী মাতুব্বরকে অপহরণ করে নিতে চাইল। অনুমেয় উদ্দেশ্য –নির্যাতন করে তাদের মতে চলতে বাধ্য করা, অথবা তাতে ব্যর্থ হলে লোকটিকে সম্পূর্ণ নিখোঁজ করে ফেলা।
কোন্ আঘাতের যন্ত্রণায় দারুণ শীতের মাঝেও কুণ্ডলী ছেড়ে ফণা তুলে দাঁড়ালো এই ঘৃণিত সরীসৃপেরা?
মানবসন্তানটির অপরাধ –গেঁয়ো কৃষক হয়েও তিনি এক সুশিক্ষিত দার্শনিক। স্পর্ধা করেছেন ধৰ্মৰ্ধজীদের কুসংস্কারের বেসাতিকে চ্যালেঞ্জ করবার। চ্যালেঞ্জ করেছেন ধর্মের নামে মূর্খতার প্রচারণাকে, তার ‘সত্যের সন্ধান’ গ্রন্থ প্রকাশ আর তার ব্যাপক প্রচারের চেষ্টা করে। অসাধারণ পর্যবেক্ষণ, বিস্ময়কর যুক্তির নৈপুণ্য আর খাঁটি দার্শনিকের অটল সত্যনিষ্ঠায় সমৃদ্ধ এই বই।
লেবাসধারীদের প্রিয় পাকিস্তানী ইসলামী সরকার বইটি প্রকাশের আগেই নিষিদ্ধ করে রেখেছিল দীর্ঘ বিশ বছর। দেশ স্বাধীন হওয়াতে সে নিষেধাজ্ঞা আর কার্যকর নেই। কিন্তু বিশ বছরের ব্যবধানে সদ্যোজাত শিশুও হয়ে ওঠে পূর্ণ যুবা, টগবগে যুবক হারায় যৌবনের সমস্ত সম্পদ। প্রৌঢ় আরজ আলী রূপান্তরিত হয়েছেন সত্তরোর্ধ বৃদ্ধে।
কিন্তু প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তায় ফিরে গেছেন যৌবনের প্রথম দিনে। বইটি প্রকাশ করেছেন লেবাসী ভণ্ডদের সব ফতোয়া-নির্দেশ আর হুমকি উপেক্ষা করে। হয়তো এমন বই আরো লিখছেন।
অপহরণচেষ্টার পর আরজ আলী মাতুববরের একা চলাফেরা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সীমিত হয়ে আসে নিজ এলাকার শহরে যাওয়া আসা। এর পরে প্রকাশিত বই ‘সৃষ্টি রহস্য’তে ধর্মীয় কুসংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে তিনি আলোচনা রেখেছেন নিজ সম্প্রদায়ের মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিদ্বেষের সম্ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে। এক্ষেত্রে কোনো ধর্ম, সম্প্রদায় বা ধর্মগ্রন্থের প্রতি অনুরাগ বিরাগ কাজ করেনি, বিবেচক পাঠক মাত্রই তা বুঝতে পারবেন। বরং এ থেকে উপলব্ধি করা যায়, আপন পরিপার্শ্বের কতখানি প্রতিকূলতার শিকার ছিলেন তিনি।
দুর্বলদেহ বিনীত এক বৃদ্ধের শরীর ও সম্মানের ওপর সরাসরি আক্রমণের হুমকি বজায় ছিল আরও এক যুগ। তার মৃত্যু পর্যন্ত।
আরো অনেক আরজ আলী আসবেন। তারাও কি একইভাবে বাধ্য হবেন নিঃসঙ্গ যোদ্ধার জীবন যাপন ও মৃত্যু বরণে?
মানুষ সহায় হোক মানুষের। মানুষ মানুষ হয়ে উঠতে পারে শুধু এই পথে।
রাকি ইউসুফ
১. ১. ১৯৯৫
.
নিবেদন
স্তব্ধতা-মৌনতার মাঝে নাড়া দেবার আয়োজন লাগে। ঘা দেবার বুদ্ধিনিষ্ঠ উদযোগও চাই। সেজন্য প্রসার দৃষ্টিসম্পন্ন প্রজ্ঞাবান মানুষের প্রয়োজন। আমাদের এই ভু-খন্ডের মানুষ উত্থিত হয়। আপনার জীবন,পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে বদলে ফেলে উত্তরণের সম্ভাবনা সূচিত করার প্রয়াস চালায়। মোটামুটি দুই দশক অন্তর উত্থান ঘটেছে এ দেশের মানুষের! সর্বাত্মকভাবে স্বপ্নতাড়িত মানুষ মাঠে, পথে নেমেছে। ত্যাগ-ক্ষয়ের অকুণ্ঠ মনোভঙ্গিতে অগ্রগামী। বিনিময়ে যে অর্জন, যে প্রাপ্তি তা স্থায়িত্ব লাভ করে না। এগিয়ে যায় না বহুদূর। দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিপ্রাপ্ত হয় না।
এই না এগোনোর কারণটা বস্তুত শেষোক্ত। দর্শন ও সংস্কৃতির প্রশ্নটা অত্যন্ত গুরুতপূর্ণ। দারিদ্র আছে আমাদের সার্বিকভাবেই। অর্থনীতি, রাজনীতি, চিন্তা, বিবেক, চেতনা, মানবতাবোধ সর্বত্রই ছেয়ে আছে দারিদ্র। তবে অই যে দর্শনের দারিদ্র, সংস্কৃতির দারিদ্র সেটাই আসলে উৎস সকল দীনতার। দর্শনহীনতার কারণে জিজ্ঞাসাহীন আমরা। কাল, পরিবেশ, পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন উদ্রেক করে না। সংশয় জন্ম নেয় না। পরিচ্ছন্ন হবার জন্য অনুসন্ধানী হতে শেখায় না। জিজ্ঞাসার জাল বিস্তার করে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে তৎপর হয়ে উঠি না।
এ কারণেই আমাদের উত্থানগুলো সুদূরপ্রসারী ফলযোগে ব্যর্থ হয়। অর্জনগুলো স্থবির হয়, মুখ থুবড়ে পড়ে। অচিরে উবে যায় জনগোষ্ঠীর মানসরাজ্য থেকে। মূল্যবোধ পরিপূর্ণতা লাভ করে না। সংস্কৃতি হয় দিগদর্শনহীন, অসংলগ্ন। জ্ঞান বিস্তার ও মনন চর্চার প্রবণতা স্বভাবত নিরুৎসাহিত হতে থাকে।
মানব জীবন যদি জিজ্ঞাসাবিযুক্ত হয়, হয় প্রশ্নহীন তবে তো ক্রমান্বয়ে ভর করে অন্ধ আবিলতা। যুক্তি-তর্ক ব্যতিরেক বিশ্বাস ও মূল্যবোধ গ্রাস করে সমাজকে। মূর্খতায়, অন্ধ আবেগে পরিচালিত হয় তাবত সামাজিক কর্মকান্ড ও আচরণ। জিজ্ঞাসা ছাড়া অর্থহীন জীবনযাপনের দিকে ধাবিত হয় অগণিত মানুষ। আমরা সমাজের পতনোন্মুখ পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করছি। মুক্তবুদ্ধি-মুক্তচিন্তার চর্চা রহিত হয়ে অনিশ্চিত অতলে নিমজ্জমান। ধর্মের নামে, জাতির নামে অধর্মীয় দুবৃত্তদের দৌরাত্ম বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাতিল ও বিগত ধ্যানধারণা পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টা ক্রিয়াশীল।
এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য বিজ্ঞানমনস্কতার অনুশীলন হওয়া দরকার অত্যন্ত জোরেশোরে। প্রয়োজন ইহজাগতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্র প্রসার করা। এ লক্ষ্যে আরজ আলী মাতুব্বরের দর্শনের দারস্থ হলে আমরা উপকৃত হবো। আরজ আলী মাতুব্বরের রচনা প্রকাশের উদযোগ সেজন্যই।
তিন খন্ড রচনা সমগ্রে ১৮টি পান্ডুলিপি প্রকাশিত হবে আরজ আলী মাতুব্বরের। প্রথম খন্ডে ৮টি, দ্বিতীয় খন্ডে ৬টি এবং তৃতীয় খন্ডে ৪টি পান্ডুলিপি থাকছে।
আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র’র প্রথম খন্ডে আমরা আটটি পাণ্ডুলিপি অন্তর্ভুক্ত করেছি। এগুলো হচ্ছে, সত্যের সন্ধান, অনুমান, স্মরণিকা, বেদ-এর অবদান, আমার জীবন দর্শন, না-বুঝের প্রশ্ন, টুকিটাকি ও ভাবী প্রশ্ন। এর মধ্যে সত্যের সন্ধান একটি বহুলপঠিত পুস্তক। জীবন, ধর্ম, প্রচলিত বিশ্বাস ও সংস্কার বিষয়ী জিজ্ঞাসা উদ্দীপক গ্রন্থ। তবে কোনো বিষয়েই লেখক চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছার চেষ্টা করেননি। আলোচনা-পর্যালোচনা করে পাঠককে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে তাঁর দায়িত্ব নিষ্পন্ন করেছেন। মীমাংসা করার দায়িত্ব বর্তে নেননি তিনি। পাঠকের ওপর সে কাজটির কর্তব্য অর্পণ করেছেন। পাঠককে বিষয়ের সাথে একাত্ম অথবা সংশ্লিষ্ট করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। পাঠক পড়ে, ভেবে, সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁর চিন্তার জগত প্রসারিত করুক-চেয়েছেন এমনটি।
কৌতুক উপাদানে, রস আহরণের মাধ্যমে ধর্মীয় বাহুল্য বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করেছেন অনুমান। নামক বইটিতে। গল্পচ্ছলে পাঠককে একটা সত্যে উপনীত করার আয়োজন আছে। যে অজ্ঞানতা ও মূর্খতা আরজ আলী দেখেছিলেন, অনুভব করেছিলেন অভিজ্ঞতার প্রায় সকল পর্যায়ে, তা থেকে পরিত্রাণের জন্য আরজ আলী শেষ জীবনে গড়ে তোলেন একটি পাঠাগার। আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরী নামের এই পাঠাগারটির উদ্বোধন, পরিচালনা, ভবিষ্যত কর্মকান্ড, ট্রাস্ট গঠন, দেহদান ইত্যাদি ব্যাপারে সবিস্তার লিপিবদ্ধ করেন স্মরণিকা পুস্তকে। ধর্মগ্রন্থ বেদ মানব জীবন বিকাশে যে সহায়ক ভূমিকা পালনে সক্ষম সে সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছেন বেদ-এর অবদান বই-এ। জীবনের শেষ পর্বে আরজ আলী যে পরিপূর্ণ বোধ অর্জন করেছিলেন তা নিয়ে একখানি গ্রন্থ রচনায় মনোযোগী হয়েছিলেন। জগত, জীবন ও সমাজ সম্পর্কে অর্জিত উপলব্ধিগুলোকে উপস্থাপন করেছেন আমার জীবন দর্শন নামক অসমাপ্ত পান্ডুলিপিতে। এর সাথে আরো দুটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। দর্শন ও ধর্ম এ দুটো বিষয় লিখে শেষ করার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। ফলে পান্ডুলিপিটি অসমাপ্ত থেকে যায়। এছাড়া প্রথম খন্ডে না-বুঝের প্রশ্ন, ভাবি প্রশ্ন ও টুকিটাকি শিরোনামের পান্ডুলিপি সংযুক্ত হয়েছে। মানব জীবন ও প্রচলিত বিবিধ যুক্তিবর্জ উপাদানগুলোকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে জর্জরিত করেছেন প্রথমোক্ত দুটি পান্ডুলিপিতে এবং শেষোক্তটি পটকা, বোমাবাজি তৈরির উপকরণ ও পদ্ধতি নিয়ে রচিত।
ছয়খানি পান্ডুলিপি সহযোগে রচিত বর্তমান খন্ডটি গঠিত হয়েছে। এগুলো যথাক্রমে কৃষকের ভাগ্য গ্রহ, জীবন বাণী, সীজের ফুল, ম্যাকগ্লেসান চুলা, সৃষ্টি রহস্য ও ভাষণাবলি। এরমধ্যে একখানি পান্ডুলিপি ইতিপূর্বে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। সেটি হচ্ছে সৃষ্টি রহস্য। অবশিষ্ট পাঁচটিই অপ্রকাশিত। আমাদের দেশের কৃষিজীবী ও কৃষি উৎপাদন মূলতঃ আবহাওয়া ও প্রকৃতি নির্ভর। তাপ, আলো, আকর্ষণ, বিদ্যুৎ ও চুম্বক শক্তির মাধ্যমে প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটে। মানব-নিয়ন্ত্রণ ঊর্ধ প্রাকৃতিক ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত আমাদের সম্পূর্ণ সেকেলে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা। প্রাকৃতিক ঘটনারাজী সৌরাকাশে অবস্থানরত ১০টি গ্রহ ও ৩০টি উপগ্রহের দ্বারা চালিত। গ্রহ-উপগ্রহের অবস্থানের হেরফের বা প্রভাব প্রতিক্রিয়ায় আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ হয়। সৌর ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের এ সকল জটিল অথচ জরুরী পাঠ কৃষক ও কৃষিবিজ্ঞানীদের অবগত করার প্রয়োজন অনুভব করে লেখক কৃষকের ভাগ্য গ্রহপুস্তকটি রচনা করেছেন।
আপনার জীবনাভিজ্ঞতার নির্যাস খুব সীমিত পরিসরে লিপিবদ্ধ করে তার নাম দিয়েছেন জীবন বাণী। এ সম্পর্কে লেখক বিনয়ের সাথে বলেছেন, ভিখারী দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে পেটের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য। জানি উহা নিতান্ত জঘন্য কাজ। তথাপি আমি উহা করিয়াছি মনের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য। কিন্তু সফল হইতে পারি নাই। যেহেতু (একাধিক ভাষায় অধিকার না থাকায়) আমি পঙ্গু, যথেচ্ছাগমনে বঞ্চিত, তথাপি চেষ্টা যা করিয়াছি তারই সামান্য আলোচনা করিয়াছি আমার ক্ষুদ্র জীবন বাণীতে।
৪৩টি কবিতার একটি পান্ডুলিপির নাম সীজের ফুল। সীজ গাছে ফুল ধরে না। ফুল-ফলহীন সীজ গাছ যেমন তেমনি এ পান্ডুলিপিভুক্ত কবিতাগুলো যে বাণী ও নৈতিকতা বহন করে আছে তা যে ফলপ্রদায়ী তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। ত্যাগ শিরোনামের একটি ছোট্ট কবিতায় বড় উপদেশ আহরণ করা যায়–
বংশের মঙ্গল হেতু কড়ি কর দান
গ্রামের মঙ্গল হেতু দাও যশ মান
স্বার্থ করিবে ত্যাগ দেশের কারণ
জগতের জন্য কর মৃত্যুকে বরণ।
শিক্ষকতা কালে শিক্ষার্থীদের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে অভিনব কবিতা রচনায় আরজের প্রতিভার সাক্ষর মেলে। কবিতার প্রথম দ্বিতীয় বা শেষ অক্ষরে নাম ও চিত্তাকর্ষক কবিতা গঠনের কৌশলে তার নিরিক্ষাপ্রবণ মনের পরিচয় পাই আমরা। কবিতার গঠনশৈলী আঙ্গিক বা ছন্দ প্রকরণ পুরনো হলেও একই সাথে উপভোগ্য ও জ্ঞানলোক সন্ধানী।
ইক্ষু চাষ অঞ্চলে ইক্ষু মাড়াই করে আহরিত রস চুলায় জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। পদ্ধতিটি প্রাচীন। আরজ আলী আখ জ্বাল দেবার চুলাটির ব্যয় হ্রাস ও অধিক তাপ উৎপাদনের জন্য নয়া এক ধরনের চুলা প্রচলনের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন কৃষকদের। জনৈক ম্যাকগ্লেসান সাহেব এই চুলার। ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করে এই চুলা আবিষ্কার করেছিলেন। তার নাম অনুসরণ করে নাম রাখা হয়েছে। ম্যাকগ্লেসান চুলা। পরিকল্পিত, বেশ উন্নত ও সকলের জন্য ব্যবহারোপোযোগী। এই চুলার গঠনকাঠামো ও উপকরণ বর্ণনা করেছেন ম্যাকগ্লেসান চুলা শীর্ষক রচনায়। বিশ্বব্রহ্মান্ড ও জীবজগৎ সৃষ্টি, প্রণোদনা, পৃথিবীর বিবর্তন, ইত্যাদি বিষয়ে রচিত গ্রন্থের নাম সৃষ্টি রহস্য। জীবজগতের সমস্ত বিষয়কে বিজ্ঞানের আলোকে, অত্যন্ত সাদামাটা বর্ণনায় তুলে ধরেছেন লেখক এ বইতে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ, সভ্যতা বিকাশের বিভিন্ন কালপর্ব থেকে বর্তমান পর্যন্ত ঘটনাগুলোকে স্তরে স্তরে তুলে এনেছেন। অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে আদিম মানবদের সৃষ্টিতত্ত্ব, ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্ব, বিজ্ঞানমতে সৃষ্টিতত্ত্ব, বংশগতি, সভ্যতা বিকাশ, সভ্যতা বিকাশের কয়েক ধাপ ইত্যাদি। প্রাণ ও পৃথিবী সৃষ্টির প্রচলিত সকল মতই বর্ণনা করেছেন লেখক। যুক্তি বিচারে পাঠকের সঠিক মতটি সহজে অনুধাবন করতে বেগ পেতে হবে না।
আরজ আলী মাতুব্বর কতটা সুসংগঠিত জীবনাচরণের অনুশীলন করতেন তার এক অসামান্য উদাহরণ তার প্রদত্ত বক্তৃতাগুলোর সঙ্কলন। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে ডাক পড়তো তার বক্তৃতার জন্য। তাঁর সংশয় ছিল, শিক্ষিত লোকজনের সামনে তাঁর বক্তৃতা মূর্খতা বা অর্বাচীন দোষে দুষ্ট হয়ে না যায়। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য গোছগাছ করে লিখে তা পাঠ করতেন অনুষ্ঠানে। প্রতিটি বক্তৃতাই আবার ৪/৫ বার পরিমার্জন করেছেন। এগুলো যথাযথ সংরক্ষণও করেছেন। আমাদের প্রাপ্ত বক্তৃতার পান্ডুলিপি.সংখ্যা ১৭। আর এক বা দু’টি পান্ডুলিপি আমরা পাইনি বলে তা এর সাথে সংশ্লিষ্ট করা গেল না। পূর্ববর্তী খন্ডের স্মরণিকা পুস্তকের মধ্যেকার কয়েকটি বক্তৃতা এখানে ছাপা হয়েছে। তবুও আমরা সবগুলো একত্রে সঙ্কলনের জন্য পুনরায় ছাপছি। আরজ আলী মাতুব্বরের মানস অনুধাবনের জন্য ভাষণগুলো পাঠককে সহায়তা করবে বলে আমাদের ধারণা।
মোট তিন খন্ডে সমাপ্য আরজ আলী রচনা সমগ্র’র তৃতীয় খন্ডে থাকবে চারখানি পান্ডুলিপি। এগুলো হচ্ছে-ভিখারীর আত্মকাহিনী, অধ্যয়ন সার, সরল ক্ষেত্রফল ও সাক্ষাৎকার।
আরজ আলী মাতুব্বর একটা সুদীর্ঘ সংগ্রামী জীবন অতিবাহিত করেছেন। শৈশবকাল থেকে সংগ্রামের সূত্রপাত হয়। প্রায় অভিভাবকহীন, প্রতিকূল পরিবেশে আরজ আলী বেড়ে উঠেছেন। ঘাত সংঘাত, পীড়ন, আক্রমণ-নিত্য সহচর ছিল এগুলো। অন্ধ সংস্কারপন্থি ধর্মীয় মোড়ল, দুবৃত্ত এমনকি রাষ্ট্রিয় শক্তিও তাঁর বিরুদ্ধে উদ্যত হয়েছে পেশীশক্তি নিয়ে। তিনি সংগ্রামের পথ বেয়ে, সত্যনিষ্ঠতার পথ ধরে অফুরান জিজ্ঞাসা বুকে নিয়ে কল্যাণের পথে এগিয়েছেন। অবিচল ছিলেন তিনি, স্থিরস্থৈর্যে তিনি অনুসন্ধানে রত থেকেছেন। সংগ্রামে-আঘাতে-নির্যাতনে জর্জর হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সেসাথে ঋদ্ধও হয়েছেন। উন্নত উত্তরণে সহায়তা করেছে মূলত এগুলোই। আপনার জীবন কাহিনী বিবৃত করে আরজ আলী মাতুব্বর প্রস্তুত করেছিলেন একখানি পান্ডুলিপি। ভিখারীর আত্মকাহিনী নামে এ রচনাটি কয়েকটি খন্ডে সমাপ্ত! রচনা সমগ্র’র তৃতীয় খন্ডে আত্মজীবনীমূলক এই গ্রন্থটি সন্নিবেশিত হয়েছে। তাঁকে জানার জন্য, পরিচয়টা গাঢ় করার জন্য ভিখারীর আত্মকাহিনী খুব প্রয়োজনীয় একখানি বই।
বিজ্ঞান, অংক, সমাজ, দর্শন, ইতিহাস এবং ধর্ম বিষয়ে তার প্রচুর গ্রন্থপাঠ হয়েছিল। অত্যন্ত উৎসাহের ব্যাপার হচ্ছে, পঠিত গ্রন্থাবলির সারাৎসার অত্যন্ত মনোযোগর সাথে লিখে রেখেছিলেন। এভাবে অসংখ্য পড়া বই-এর ওপর অসংখ্য সারবস্তুর সমন্বয়ে রচিত পান্ডুলিপির নাম অধ্যয়ন সার। আমাদের দেশে ভূমি পরিমাপের যে পদ্ধতি ছিল তাকে বলা হতো কালিকষা। জমি মাপের বিভিন্ন একক ও পদ্ধতি সহজ ভাষায় লিখে একটি বই লিখেছেন আরজ আলী। এর নাম সরল ক্ষেত্রফল। আর একটি সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকারসহ বেশকিছু সাক্ষাৎকার বিভিন্ন খ্যাত,অখ্যাত বা অঞ্চলভিত্তিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। আমরা সবগুলো সাক্ষাৎকার বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করে একত্রিত করে একসঙ্গে পরিবেশন করবো। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটিতে অনেক অকথিত, অজ্ঞাত কথা ও মত জানিয়েছেন অত্যন্ত অন্তর্ভেদী প্রশ্নবাণের জবাবে।
প্রথম খন্ড রচনা সমগ্র প্রকাশের ঠিক এক বছরের মাথায় দ্বিতীয় খন্ড বেরুচ্ছে। তবে মাঝখানে প্রথম খন্ডের দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশ পেয়েছে। মাত্র তিন মাসের মধ্যে প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হওয়াটা একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনাই বটে। বিশেষ করে দর্শন ও মননধর্মী আলোচনা পুস্তক এতো দ্রুত পাঠকের হাতে পৌঁছে যাওয়া আরজ আলী ও তার দর্শনের প্রতি অপার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আগ্রহের কথা জানান দেয়। এই ঘটনা প্রবলভাবে প্রাণিত করেছে আমাদের। জিজ্ঞাসাবিমুখ একটি সমাজে মুক্তবুদ্ধি, বিজ্ঞানমনস্ক ও বস্তুতান্ত্রিক চেতনা চর্চার যে দিকনির্দেশনা আরজ আলী দিয়ে গেছেন তা সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। এই প্রবণতা অতিশয় স্বস্তিকর, প্রত্যাশা-সঞ্চারক। এমন অব্যাহত থাকলে, সমাজের যাবতীয় অকল্যাণ ও অহিত দূর হবে। মানুষ ক্রমশ প্রশ্নপরায়ণ হবে, সত্যসন্ধানী হবে। যাবতীয় অন্ধ আবিলতা ও যুক্তিহীন মত, চিন্তা ও আচরণ হ্রাস পাবে অন্তত। আরজ আলী মাতুব্বরের রচনার চর্চায় আমরা যতটাই নিয়োজিত করবো নিজেদের ততটাই প্রগতিমুখী হবে সমাজটা। কাম্য তো আমাদের সেটাই।
দেশব্যাপী বিপুল মানুষের সোৎসাহ আগ্রহের পাশাপাশি রচনা সমগ্র প্রকাশে যারা সহায়তা করেছেন বিভিন্নভাবে তাঁদের উষ্ণ অভিনন্দন জানাই। এঁদের মধ্যে আছেন কবি শামসুর রাহমান, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আ.ন.স হাবিবুর রহমান, মো. আব্দুর রব, শরীফ হারুন, সোহরাব হাসান, রফিকুর রশিদ, সুমন সরদার, খালেকুজ্জামান পিকলু ও বেলাল হোসেন। পাঠক সমাবেশের সাহিদুল ইসলাম বিজু রচনা সমগ্র প্রকাশে অক্লান্ত ও আন্তরিক প্রচেষ্টা নিয়ে সর্বদাই তৎপর। সবাইকে অভিনন্দন জানাই।
—আইয়ুব হোসেন
Leave a Reply