আরক্ত সুন্দর মুখ (কাব্যগ্রন্থ) – কোয়েল তালুকদার
প্রকাশকাল – একুশের বইমেলা ২০২৩
উৎসর্গ পত্র
কেন যে কিছু মুখে পৃথিবীর মায়া লেগে থাকে
কেন যে কিছু মুখে পাই শুকপাখির পালকের ঘ্রাণ
কেনই আবার দুঃখ কাতরতা দেখি সেই মুখখানিতে।
সেই মুখেই —
জীবন মৃত্যুর খেয়া পারাপার দেখি।
হ্যাপি কে।
১. আরক্ত সুন্দর মুখ
বহুবছর আগে কুসুমপুরে সেদিন হিমশীতল সন্ধ্যা নেমেছিল, অস্তমিত সূর্য ডুবে যাচ্ছিল অস্তাচলে
কোনও এক গৃহকোণে পিতলের কুপি জ্বলে উঠেছিল
সেই আলো দেখে এক নবজাতক কেঁদে উঠেছিল।
কত বড়ো পৃথিবীর কত প্রাসাদ কতখানে —
আর সে কী না এল একটি মাটির গৃহকোণে!
কাঁদবেই তো সে!
সেদিন দীপশিখার আলো কার মুখের উপর পড়েছিল?
কার মুখ দেখেছিল সে প্রথম? মা’র নাকি ধাত্রীমা’র?
কেন জানি মনে হয়, জননীকেই দেখেছিল পৃথিবীতে সে প্রথম।
নবজাতক সেদিনের প্রথম ভোরে হয়ত দোয়েলের
শিস শুনেছিল, পাখিটিকে সে কী দেখেতে পেয়েছিল?
জননী খুলে রেখেছিল জানালায়,
অতটুকুন ছোট দৃষ্টিতে দেখতে পেরেছিল কী সেদিনের নীল আকাশ?
তারপর কত পাখিদের কলতান শুনেছে সে শৈশবে
আকাশ ভেদ করে কত বৃষ্টি হয়েছে
খোকশা গাছে টুনটুনিদের বাসা বাঁধতে দেখেছে
বাঁশঝাড়ে বসে ডেকেছে ঘুঘু বিষণ্ণ দুপুরে
বর্ষার বকুল সুবাস বিলিয়েছে অকাতরে
ঝরেও পড়েছে সে ফুল মৃদুমন্দ বাতাসে।
বালক হেঁটেছে কত মেঠো পথে পথে
ধানের কচি সজল পাতা ছুঁয়েছে সে
ভিজিয়েছে পা ভোরের শিশিরে
কত রাত্রিদিন কেটে গেছে জননীর স্নেহ ছায়াতলে।
সে কী এপিটাফ লিখতে চেয়েছিল এমন করে কলাপাতার ছিন্ন পাতায় !
‘আমি কোয়েল তালুকদার, যার জন্ম শীতের এক মায়াবী সন্ধ্যায়,
সিরাজগঞ্জের যমুনার পাড়ে বড় হতে হতে…….
হতে চেয়েছিলাম নামযশহীন কবি।
মা আমার বাংলাদেশের মানচিত্রের মতো রাবেয়া খাতুন,
মাটি ও মানুষের আমার পিতা হারুন অর রশিদ তালুকদার।’
নাহ্!
সে কখনোই কবি হতে পারেনি এই বঙ্গের……..
এক চন্দ্রালোকিত শীতের রাতে কানের কাছে মুখ রেখে কানে কানে কেউ একজন বলেছিল —
আমি একটি ছেলেকে চিনি
সেই ছেলে
সন্ধ্যা আকাশের তারার আলো হতে চেয়েছিল
কিন্তু মেঘের ছায়ায় ঢেকে গেছে সেই তারা
নিভে গেছে সেই আলো।
ছেলেটি একটি অসম্ভব সুন্দর স্বপ্ন ছুঁতে চেয়েছিল
কিন্তু অলৌকিক ঝরনাধারায় ভেসে গেছে সেই স্বপ্ন
জীবনের ক্যানভাসে সেই স্বপ্ন সে আঁকতে পারেনি।
ছেলেটি চেয়েছিল একটি ঘর
আনন্দলোক থেকে সুখ কুড়িয়ে আনতে চেয়েছিল
ফুলের রেণু থেকে অমৃত
মাধুকর হতে চেয়ে হারিয়ে ফেলেছে তার মাধবীকে।
সে চেয়েছিল কেউ একজন চিরকালের হোক,
নিপবনের পাখির বাসার মতো ঘর হবে তার
পূর্ণিমা রাতের উদ্দাম জোছনার প্লাবন বইবে ভাঙা অলিন্দ দিয়ে।
ছেলেটি একটা অমল সুন্দর প্রিয়তমা চেয়েছিল
যার কাছে মন খুলে বলা যায় সব কথা
ইচ্ছে করলেই যাকে বুকে জড়িয়ে
চুমু খেয়ে নেওয়া যায় একটার পর একটা
চোখে চোখ রেখে স্বপ্ন দেখা যায়
হাতে হাত রেখে সব ধুলো ঝেড়ে উঠে পড়া যায়
কিন্তু সে পারেনি।
হাতের মুঠোয় সে ভরতে পারেনি প্রেম
চিরকাল যৌবনের মোহ ভেঙে খুঁজেছে তার শৈশব ,
ময়ুরাক্ষী দিনগুলো কখন যে চলে গেছে সে বুঝতেই পারেনি।
একটি গ্রাম্য অর্বাচীন ছেলে —
যে তার বুকের ভিতর রিমঝিম বৃষ্টি লুকিয়ে রাখে,
প্রদীপের আলোর বাইরে যে অনির্বচণীয় জোৎস্না থাকে,
তাও সে মুঠোর ভিতর ভরে রাখে
সে বুঝতে পারে এ আলোর নীচে কোনও আঁধার নেই
তারায় তারায় ভরা আকাশ তার
সে সবসময় ভাবে,
এই জগত শুধু মায়ার, এই মায়া থেকে কেউ বের হতে পারে না,
এই মায়া কেউ ছাড়তেও পারে না —
এই মায়াগুলোই কী মানুষের ভালোবাসা তবে?
এই ভালোবাসার মাঝেই থাকতে চায় সে।
এক একজন এভাবেই ভাবে
আর এভাবেই ভুল অঙ্কের খাতায় হারাতে থাকে
একের পর এক তার প্রিয়মুখ
দিনশেষে পড়ে থাকে শুধু অতৃপ্ত কিছু অভিমান।
নাহ্ কোনও অভিমান নেই ছেলেটির,
সে একটি আরক্ত সুন্দর মুখের দেখা পেয়েছিল — নাম তার মায়াবতী।
তপ্ত দুপুরবেলা কিংবা পরন্ত বিকেলে,
সন্ধ্যায়, কিংবা নিশীথ রাত্রিতে
যখনই ঘরে ফিরি না কেন,
দরজার কড়া নাড়লেই এই মায়াবতী এসে দরজা খুলে দেয়,
আমাকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না
টেবিলে খাবার রেডি পাওয়া যায়
পরিপাটি থাকে বিছানা —
ফুলদানিতে ফুলের সুবাস ঝরতে থাকে
শোবার সময় মশারিটাও টানাতে হয় না,
অথচ শুক্লপক্ষ কোনও জ্যোৎস্না রাতে
তার জন্য কখনও আনিনি একটি রজনী গন্ধার বৃন্ত! কিংবা নীলকন্ঠ পাখির
একটি পালক।
মায়াবতী,
তোমাকে নিয়ে একদিন কুসুমপুরের পথে পথে হাঁটবো, যে পথ চলে গেছে গগনশিরীষ বনে
যেখানে সন্ধ্যা রাতে জোনাকিদের মিটিমিটি আলো জ্বলে ওঠে
দোয়েলশিসের ভোরে দূর্বাঘাসের শিশিরে পা ধুয়ে নিও তুমি হেঁটে হেঁটে চলে যাবে ধনিদহ বিলে
সেখানে কাদার ভিতর মুক্তা লুকিয়ে থাকে
বসন্তের মধ্য দুপুরের রোদ্রে পুড়বে
ফুটে থাকা অজস্র আম্রমঞ্জরির গন্ধ মেখো,
বাঁশ ঝাড়ের নীচে পড়ে থাকা মরা পাতার মর্মর শুনো
হঠাৎ কোনও দূর্মর বাতাস এসে এলমেল করে দেবে তোমার মাথার চুল
পড়ন্ত বিকালে পাশাপাশি হাঁটবে তুমি
আমার ছায়া পড়বে তোমার উপরে
তুমি বলবে — ‘ছায়া নয় গো, তোমার পাঁজরে জড়িয়ে নাও, যেমন করে ইছামতী নদী জড়িয়ে গেছে মাঠ পেড়িয়ে গ্রাম ছাড়িয়ে দূরের মোহনায়।’
সেখানে রাতের আকাশ সামিয়ানার মতো ছাতা ধরে রাখে, কত নক্ষত্রবীথি জ্বলে —
কালপুরুষ, বিশাখা, অরুন্ধতীরা দেখবে তোমাকে
সে এক অনন্ত ভালোবাসাবাসির রাত্রি , স্বপ্ন মোড়ানো সে রাত্রি শেষ হয়না।
একদিন মনখারাপ হবে খুব,
অথচ কান্না নেই
সে মুখোমুখি এসে দাঁড়ানোর পর হয়ত কান্না এসে যাবে
বড্ড অচেনা লাগবে তখন পৃথিবী,
একদিন সবকিছু ফুরোবার আগেই আমিও হারিয়ে যাবো..
তখন কারও চোখে আমার কান্না
রয়ে যাবে।
কোন্ আলোয় দেখেছিলাম তার মুখখানি!
ক্ষণকালের দেখায় চিরকালের ভালোবাসা হলো
তার সেই আরক্ত সুন্দর মুখ।
কেন যে কিছু মুখে পৃথিবীর মায়া লেগে থাকে
কেন যে কিছু মুখে পাই শুকপাখির পালকের ঘ্রাণ
কেনই আবার দুঃখ কাতরতা দেখি সেই মুখখানিতে।
সেই মুখেই —
জীবন থেকে মৃত্যুর খেয়া পারাপার দেখি।
২. যদি বলো চলে যাও
যদি বলো চলে যাও –
আমি চলে যাব ভোরের কমলা রোদ্দুর
তপ্ত কাঠপোড়া হয়ে ওঠার আগেই।
যদি বলো চলে যাও –
আমি চলে আসব নৈঋতে জমে থাকা মেঘের জলস্রোতে, ঈষাণের বায়ুর মতো দ্রুত বেগে,
ঘাসের উপর ভোরের শিশির শুকিয়ে যাবার
আগে।
যখন চলে আসব –
কোথাও আমার শরীরের ঘ্রাণ রাখব না
ধুয়ে রেখে যাব বিছানাপত্তর, আমার গায়ের ছোঁয়া লাগা তোমার কাপড়ও।
মুছে দিয়ে যাব সারা বাড়িতে আমার ফেলে রাখা পায়ের চিহ্ন, নামিয়ে ফেলব দেয়াল থেকে যুগল প্রতিকৃতি।
যদি বলো চলে যাও —
ব্যবহৃত তোয়ালে, টুথব্রাশ, পারফিউমের শিশি, তোমার দেওয়া অঙ্গুরীয়, হাতঘড়ি, ব্রেসলেট সব ছুড়ে ফেলে দেবো, সরিয়ে ফেলব এ্যালবাম থেকে সমস্ত প্রণয় ছবি,
কোথাও কোনও অভিজ্ঞান রাখব না।
তুমি চলে যাও বললেই –
ল্যাপটপে ডাউনলোড করা আমাদের প্রিয় গানগুলি ডিলিট করে দিয়ে যাব, যে গানগুলো শুনতাম মৌনতার কোনও বিকেলে ও সান্ধ্য অন্ধকারে।
পুরনো একটি চিঠিও তোরঙ্গে রাখব না, সব ছিঁড়ে ফেলে রেখে যাব।
আমাদের খুনসুটি, বিরাগ, অভিমান, আমাদের অপেক্ষা, প্রণয় উম্মাদনা, মধুময় আলিঙ্গন, কোনও কিছুই মনে গেঁথে নিয়ে যাব না,
সব এই ঘরে তোমার কাছে দগ্ধ ক্ষত করে রেখে
যাব।
এই ঘরে রেখে যাব খাঁ-খাঁ শূন্যতা, উঠোনে পড়ে থাকবে ঝরা পাতা,
তুমি জীর্ণ পাতা মাড়িয়ে হেঁটে হেঁটে খুঁজবে আমাকে,
কোথাও পাবে না আামার অস্তিত্ব, আমার ঘ্রাণ, আমার উপস্থিতির ছায়া।
যদি কখনও ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামে, থইথই জলের উঠোনে দাঁড়িয়ে তুমি একাকী ভিজবে, স্মৃতিরা ফিরে আসবে তোমার কাছে, কিন্তু আমি আসব না। মানুষ চলে গেলে মানুষ আর ফিরে আসে না।
৩. বছর দুই
একবার আমাদের লম্বা ছাড়াছাড়ি হয়েছিল —
বছর দুই কেউ কারোর মুখ দেখিনি…বছর দুই কেউ কাউকে ছুঁয়ে দেখিনি , শুয়ে থাকিনি দুজন পাশাপাশি … তারাখচিত কত রাত কেটেছে নির্ঘুমে,
কত রজনী হয়েছে পার আমরা কেউই ঠিকমতো
ঘুমুতে পারিনি।
স্মৃতিরা রাক্ষুসীর মতো ধেয়ে আসত,
মনে পড়ত কত কথা —
আমরা পার্কে ঘাসের উপর বসে থাকতাম, পাতা ঝরে পরত বসন্ত বাতাসে,
চৈত্র দুপুরে হাঁটতাম নদীর কূল ধরে , শরীরে এসে লাগত শীতল হাওয়া,
সময়ে অসময়ে চলে যেতাম লং ড্রাইভে শালবনে ,
রেস্তোরায় বসে খেতাম ভাত,
সিনে কমপ্লেক্সে সিনেমা দেখতাম, নবীন প্রেমিক প্রেমিকার মতো ডার্কটাচে মেতে উঠতাম
অন্ধকারে।
দুবছরে কোনই ভালোবাসাবাসি হয়নি, চোখে চোখ রেখে কথা বলিনি চুপিসারে , চুলে তার মহুয়ার সুবাস, স্নান শেষে ভেজা কুন্তল থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ত জল, এসবের কোনই উপভোগ করিনি —
বুক ছোঁয়নি বুক, প্রেমহীনতায় কেটেছে দিনের পর দিন !
কতদিন বাড়ি ফেরা হয়নি , ট্রেনে উঠে চলে যেতাম দূরের কোনও স্টেশনে, রাত কাটাতাম ওয়েটিং রুমে,
কতদিন জ্বরে পুড়েছে কপাল,
মলিন হয়ে থাকত মুখ, এলমেল বহিমিয়ান জীবন ছিল ,
সিগারেট পুড়তে পুড়তে ছাই হয়ে যেত
সময়ের খাবার সময়ে খাইনি, কতদিন কেবল
জল খেয়ে শুয়ে পড়েছি…
কত কথা বলতে ইচ্ছে করত, কত মর্মব্যথা বলার জন্য
আকুল হয়ে উঠত মন,
হাত ধরে হাঁটতে ইচ্ছে করত চাঁদের রাতে উঠোনে,
ভিজতে ইচ্ছে করত বৃষ্টিতে,
কতবেলা চলে গেছে মেঘে মেঘে… সন্ধ্যাদীপ নিভে গেছে আঁধারে ঢেকে।
যত্নহীনতায় রুক্ষ হয়ে থাকত মাথার চুল, কী এক সন্ন্যাস জীবন হয়ে উঠেছিল আমার ,
ঘর ছিল বৈরাগ্যের.. টান ছিল না ফিরে আসার ..
জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছিল,
চাইতাম না কিছু কারোর কাছে থেকে,
মনে হতো অধিকার নেই , মায়া নেই , রাগ করার কেউ নেই …
ভুলে যেতাম জন্মদিনের কথা, বিয়ে বার্ষিকীর কথা … খুব ইচ্ছে করত ঝগড়া করে রাগ করে আবার চলে যাব কোথাও … আসলে যেতাম না কোনখানেই,
গেলেও সন্ধ্যার আগে ফিরে এসে বলতাম —
আমি তোমার কাছেই ফিরে এলাম।
দূরে থেকে বুঝেছি —
আমরা কতটা অপরিহার্য একে অপরের জন্য,
কতটা নির্ভরশীল দুজন দুজনের জন্য, কী উম্মাদ হয়ে থাকতাম চোখের দেখা দেখার জন্য !
সংসার একজনে হয় না, সন্তান একজন দিয়ে হয় না..
এই সত্য জেনেছি বিচ্ছেদ থেকে —
দূরে চলে গেলে বোঝা যায় শরীরের গন্ধের কী টান,
এক বিস্ময়কর পরিভ্রমণের জন্য উন্মুখ হতো মন
কী যে পাগলকরা ভালোবাসা তৈরি হয়!
ফিরিয়ে আনতে আকুল হয় মনের মানুষকে নিজের একান্ত ভুবনে।
ঠিক বছর দুই পর ফিরে পেলাম দুজন দুজনকে — তারপর সব মণিকাঞ্চনের সিঞ্চন, তারপর আলোয় আলোয় ঝলমল হয়ে উঠল গৃহকোণ।
৪. স্বপ্ন ভঙের গল্প
একটু বসো, একটি গল্প বলব, শোনো।
আমার একটি নদী ছিল — সেই নদী পাহাড়ের কোল পেরিয়ে, যোজন যোজন মাঠ পেরিয়ে, বালি নুড়ি পলিমাটি ভেঙে এসে পৌঁছেছিল আমার আঙিনার কাছে।
সে এসেছিল হিমবাহ থেকে ব্রহ্মপুত্র নামে
তারপর আরও কত নাম হলো তার,
আমি তাকে চেয়েছিলাম — কিন্তু সে চলে যেতে চাইল
মহাসমুদ্রের কাছে।
সে আর আমার কাছে রইল না —
সে বদলে গেল, অন্য একটি নদীর কাছে লীন হয়ে
চলে গেল সাগর মোহনার দিকে।
পৃথিবীর রমণীগুলো মনে হয় এমনই নদীর মতো হয়,
ওরা বদলে যায়, ওরা লীন হয়ে যায়, বাহুলগ্না হয়ে
চলে যায় অন্য দয়িতের কাছে!
নদীর চেয়ে পাহাড় ভালো, ওরা স্থির থাকে এক জায়গায়। আকাশও ভালো — রাতভর তারা জ্বেলে রাখে। মেঘমালাও কত সুন্দর! ওরা বৃষ্টি হয়ে শীতল করে পৃথিবী । বৃক্ষও ভালো, ছায়া হয়ে থাকে।
যদি শোনো, আরও কিছুক্ষণ বসো —
আরও অনেক কথা আছে বলার, ভালোবাসাহীনতার সে কথা, বঞ্চনার সে কথা।
যদি বসো, বনকুঞ্জে জ্বলে থাকা অজস্র জোনাকির আলোয় তোমাকে দেখব আর আমার গল্প
শোনাবো ।
রাজপুত্তুরদের প্রেমের কোনও রূপকথা নয়, শোনাবো আমারই স্বপ্ন ভাঙার গল্প, নৈসঙ্গের গান।
তুমি না শুনতে চাইলে অন্য কাউকে শোনাবো —
সে হয়তো প্রেমময়ী প্রেয়সী কেউ নয়,
নিতান্তই সে ঘাস ফড়িং হবে , তাকেই শোনাবো আমার স্বপ ভঙের গল্প।
৫. শেফালিকার গন্ধ
এখন ভোরবেলা জেগে দেখতে পাই পাশের মানুষটি পাশেই শুয়ে আছে,
যদি এমন দিন আসে — ঘুম ভাঙার পর তাকে যদি
আর দেখতে না পাই।
এখন পাশ ফিরলেই তাকে ছুঁতে পারি,
নিঃশ্বাসে নেই তার শরীরের গন্ধ, চুলের সুবাস নিয়ে ঘুমিয়ে যাই —
তখন কে দেবে এমন অমৃত মাধুর্য! কে এনে দেবে ঘুম, কে দেখাবে স্বপ্ন!
এখন জোছনা রাতে জানালা খুলে রাখি,
চাঁদের আলোর সাথে হাওয়া এসে আমাদের দোলা দেয়,
যদি এমন হয় — পাশের মানুষটি আর নেই, জানালা আর খুলে রাখি না , জোছনা আর আসে না।
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঘরে ফিরে এখন তাকেই
দেখতে পাই, তার সাথেই কথা বলি,
যদি কোনদিন বাড়ি ফিরে এসে তাকে আর না
দেখতে পাই —
তখন কার সাথে কথা বলব, কার সাথে কাটাব সময়, কে জ্বালাবে সন্ধ্যা প্রদীপ!
আমি দূর্ভাবনায় মরি —
কেমন করে শূন্যতা ভরবো, কেমন করে পথ চলবো ,
কেমন যেন অনন্ত বেদনা প্রাণে বাজে — কোনদিন কোনও প্রভাতে সে আর থাকবে না!
আমার চৈতন্য জুড়ে সেই আমার অস্তিত্ব,
সেই আমার অফুরান ভালোবাসা,
যদি কোনদিন চলে যায় সে অন্য ভুবনে —
তাকে খুঁজব সন্ধ্যা অন্ধকারে, রাতের শেফালিকার নিবিড় গন্ধে,
দূর আকাশে নিষ্প্রভ নক্ষত্রে।
৬. অন্য আমি
একদিন এক অদ্ভুত কাণ্ড হলো – আমার ভিতর দুটো ‘আমি’র অস্তিত্ব দেখলাম। আমার এই আমি নিয়ে আজ কোনও কথা নয়। আজ কথা বলছি সেই —
অন্য আমি
বাড়ি থেকে পথে নামলাম, দেখলাম মাঠ, প্রান্তরের পর প্রান্তর হাঁটলাম , তারপর দেখি — বনভূমি, বন পেরিয়ে নদী। নদী পার হয়েই পোড়ামাটির মসজিদ,
তারপর তিল ক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখি — টিনের চালার স্কুল, স্কুল ঘর পেরুলেই পুরনো ভাঙা রথ ঘর, এর কিছু দূরেই পদ্মরানীর দিঘি। আমি সেখানেই চলে এলাম ত্রিশ বছর পর–
এই দিঘির পাড় আমার অনেক চেনা। এখানেই মাধবী এসে বলেছিল — মহাকাল কত কোটি কোটি বছরের। আর আমাদের জীবন সেই তুলনায় একটি বিন্দু মুহূর্ত মাত্র। এই ক্ষণ মুহূর্তকালের জন্য তুমি আমাকে সঙ্গী করে নাও।
সেদিন ছিল আষাঢ়ের মেঘের দিন।
আমরা বসেছিলাম — পদ্মরানীর দিঘির পাড়ে।
হঠাৎ বৃষ্টি নামলো, কোনও ছায়াতলে যাইনি আমরা, ভিজছিলাম দিঘির পাড়েই….
কিছু আবেশ মাখা স্মৃতি তৈরি হয়েছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণে, জলের নুপুর টপটপ করে ভিজিয়েছিল দুজনকে… আমরা বৃষ্টির কাছে প্রার্থনা করেছিলাম — বৃষ্টি তুমি থেমে যেওনা।
এক অনির্বচনীয় ভালোবাসায় অঙ্গীকার করেছিলাম — দুজন দুজনকে চিরদিনের করে নেব। কিন্তু সে আর নেয়া হয়নি। মানুষের জীবনে অনেক সময়ে কিছু অমোঘ দূর্ঘটনা ঘটে যায়। সেই সব ঘটনা চূর্ণ করে দেয় সব অঙ্গীকার, ভেঙে দেয় স্বপ্নসৌধ।
আজ ত্রিশ বছর পর, এখানে এলাম। আজও আষাঢ়ের দিন। শুধু সেদিনের মতো মেঘ নেই। বৃষ্টি নেই। আছে দিঘির শান্ত জল। আজও মাধবীও এসেছে এই পদ্মরানীর দিঘির পাড়ে। এত বছরেও ও একটুও বিগত যৌবনা হয়নি — সেই কাজলমাখা চোখ, সেই এলো কুন্তল, সেই ভ্রু যুগল, সেই রক্তকুচ ঠোঁট। হাতে এক গুচছ চন্দ্রমল্লিকা নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে।
মাধবী- কেন জানি মন বলছিল তুমি আসবে আজ এখানে। তাই চলে এলাম।
আমি – আমারও মন বলছিল তুমি আসবে। তাই আমিও চলে এলাম।
মাধবী — কোনও অনুযোগ নেই আর। নেই অভিমানও। এই ফুলগুলো নিয়ে এসেছি। তোমার সাথে আমার বিয়ে হলে আজ ত্রিশতম বিয়ে বার্ষিকী হতো। নাও ফুলগুলো হাতে নাও। পরিয়ে দাও আমার বেনী খোঁপায়।
আমি ফুলগুলো হাতে নিয়ে মাধবীর খোঁপায় পরিয়ে দিতে দিতে বললাম — আজ যদি সেই ত্রিশ বছর আগের দিনের মতো বৃষ্টি নামতো! কী যে ভালো লাগতো! ইচ্ছেমতো ভিজতাম !
মাধবী — মানুষের দুটো করে সত্তা থাকে। একটি থাকে মুক্ত। সবাই তাকে দেখে। আর একটি থাকে গোপন। সেটা কেউ দেখে না। আমি আমার সেই গোপন সত্তার ভালোবাসা দিয়ে এতবছর তোমাকে লালন করে রেখেছি বুকের ভিতর। এই জন্য কখনোই আমি আমার স্বামীকে বঞ্চনা করিনি। তাকে দিয়েছি সব উজার করে। যখন যা চেয়েছে সব।
আমি — আমারও তাই মনে হয়। দেখো — তোমার সাথে আমার কত অন্তরের মিল। আমিও এলাম। তুমিও এলে। জানো, আমি একটি ‘আমি’ কে আমার স্ত্রীর কাছে রেখে এসেছি। তোমার কাছে যে আমি এখন সে ‘অন্য আমি ‘।
মাধবী — কেন জানি, মনে হচ্ছে — আমাদের দেখতে পাচ্ছে অন্য কেউ। খুব ভয় হচ্ছে আমার! যদি বদনাম হয় তোমার আমার!
আমি — বদনাম হোক। ত্রিশ বছর পর তোমাকে কাছে পেলাম। আর কী না, একটু কাছাকাছি হবো না? তাই কী হয়! এই পদ্মরানীর দিঘির পাড়ের ঘাসও মন খারাপ করবে। চলো — ঐ হাস্নাহেনার ঝাড়ের আড়ালে। আমরা ফুল ছুঁয়ে দেখব ওর সৌন্দর্য । পাতা ছুঁয়ে দেখব, ওর সবুজ। তোমাকে ছুঁয়ে অনুভব করব পার্থিব যত
মাধুর্য!
মাধবী — না গো — আমি মরে যাবো। আমার দ্বিতীয় সত্তাকে তুমি মেরে ফেল না। আমার কাছে তোমার স্থান পুণ্যতায় বেঁচে থাক জন্ম জন্মান্তর!
আমি — আচ্ছা, তাই হোক। আবার কবে আসবে এখানে এই পদ্মরানী দিঘির পাড়ে?
মাধবী — আর কী আসার সৌভাগ্য হবে! ত্রিশ বছর আর কী বেঁচে থাকব? মহাকাল কেড়ে নেবে। যদি বেঁচে থাকি — আসবো।
পদ্মরানীর দিঘির টলটলে জল হঠাৎ আষাঢ়ের দমকা হাওয়া লেগে আলোড়িত হয়ে ছোট ছোট ঢেউয়ে পরিনত হলো। ঢেউগুলো আবার স্তব্ধও হয়ে গেল। আমি তাকিয়েছিলাম জলের দিকে। তারপর পিছনে ফিরে দেখি — কোথাও মাধবী নেই।
যে আমার পাশে — সে আমার মায়াবতী। আমি তখন আমার আমিতে মগ্ন।
৮. মনে রবে কী আমারে
কেউ যখন দূরে চলে যায় —
তখন তার সাথে কাটানো সমগ্র আখ্যানের মধ্যে বেদনার সুর বেজে ওঠে
সে তার অবিনাশ স্মৃতিগুলো রেখে যায়
তখন শুধু তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলি–
‘যেখানে যাচ্ছ ভালো থেকো, আনন্দে থেকো’।
তখন তাকে কী নামে ডাকব, সে তো সম্পর্কহীন –
তবুও ডাকব তাকে — দোলনচাঁপা।
সে তো চলেই যাবে দূর কোনও অশ্রু নদীর তীরে –
আশা লতার ঝোপঝাড় পেরিয়ে, আমলকির ছায়াতল দিয়ে, বেতস ফুলের গন্ধ মেখে
দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত ছুঁয়ে, নীল আকাশের নীচ দিয়ে হেঁটে হেঁটে সে চলে যাবে …
সে চলে গেলে কামিনী ফুলগাছটিতে কেউ আর
জল দেবে না, লতাগুল্মে ভরে উঠবে উঠোন —
বারান্দায় রাখা কাঠের বেঞ্চে জমবে ধূলো,
টিনের চাল ছুঁয়ে বেড়ে ওঠা হাস্নাহেনার গাছটি ম্রিয়মান হবে দিনের পর দিন, বৃষ্টির মাদল বাজবে না ঝুমঝুম শব্দে, পুকুরে পদ্মপাতা আর দুলে উঠবে না তার স্নানের ঢেউ লেগে …
সে চলে যাওয়ার পর দেখব না আর প্রেমসাজ,
আনমনা বিকালে আমাকে মনে করে কেউ পরবে না কপালে টিপ, মেঘভাঙা অপরাহ্ন বেলায় দুয়ারে দাঁড়িয়ে কেউ অপেক্ষায় থাকবে না
শুনবে না গৃহে ফেরার আমার পায়ের শব্দ!
অনিত্য কালস্রোতে সব ভাসিয়ে শূন্য করে দিয়ে
সে চলে যাবে…
আমি ভুলতে পারব না তার কুসুমগন্ধী দেহখানি– দেখতে পাব না পটচিত্রে তুলির স্পর্শে আঁকা তার অম্লান পার্থিব কায়া–
ভ্রম করে প্রসারিত করব না দুইবাহু তাকে জড়িয়ে ধরবার, বাহুডোরে সেও লুটিয়ে দেবে না তার কনকচাঁপার মতো কোমল বক্ষখানি।
মর্মরিত হাহাকার নিয়ে বহুকাল পর্যন্ত তাকে মনে
রাখব, স্রোতবক্ষে খুজব তার উপস্থিতি।
কোনও ধূপগন্ধ সান্ধ্য অন্ধকারে সে কী মনে করবে তখন আমার কথা!
৯. তোমাকে ভুলতেই হবে
তোমাকে ভুলে যেতে পারলে হৃদপিণ্ডটা ভালো থাকত, ভয় থাকত না রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার, কাছে রাখতে হতো না ইকোসপ্রিন, এ্যাটোভা, বিসলল কিংবা নিঃশ্বাস নেবার জন্য নেবুলাইজার।
তোমাকে ভুলে যেতে পারলে হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত না, সন্তর্পণে দুয়ার খুলে বাইরে বের হতে হতো না, দেখতে হতো না রাতভর জেগে থাকা ভাঙা চাঁদ আর নিভু নিভু তারা, দেখতে হতো না নির্জীব ঝিমিয়ে থাকা বৃক্ষরাজি।
কেন যে তোমাকে মনে পড়ে !
মধ্য রাত্রিরে প্রায়ই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে কালো এক ঘোড়া , আমি সোয়ার নিয়ে বের হই, দূরন্ত এক অশ্বারোহী হয়ে উঠি, ছুটে চলি দিগ্বিদিক,
অচেনা প্রান্তর ছাড়িয়ে দ্রত চলতে থাকি,
দিগন্ত ভেদ করে ছুটে যাই — যেখানে তুমি অন্ধকারের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছ।
কেন যে তোমাকে ভুলতে পারি না,
ব্যথায় চিনচিন করে বুক, হুহু করে তেড়ে আসে উত্তরের হাওয়া, ঝরো বাতাসে উড়ে যায় ঝরা পাতা, গোপন স্রোতে ভেসে যায় লুকানো স্মৃতিরা
খড়কুটোর মতো…
তোমাকে আমার ভুলতেই হবে,
কেমন এলমেল হয়ে যাচ্ছে সাজানো সংসার,
অন্যমনষ্কতায় ভুলে যাই কখন যেতে হবে অফিসে,
ভুলে যাই ছোট মেয়ের স্কুল ছুটি হওয়ার সময়ের কথা, প্রিয়তম মানুষটির ঔষধ কিনতে ভুলে যাই,
তাকে খেয়াল করিনা সময়মতো…
তোমাকে মনে পড়লেই,
ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় জীবনজীবিকার সব পরিকল্পনা, ঘুমের প্রহরগুলো বিনিদ্র হয়ে যায়,
কর্কশ হুইসেল বাজিয়ে ছেড়ে চলে যায় ট্টেন
আমি ঘুমুতে পারি না, ঘুম আসে না…
হায়! এইভাবে কী জীবন চলে, তোমাকে যে আমার ভুলে যেতেই হবে।
১০. ফাগুনের আগুন কবিতা
আজ এই সভায় আমি একুশের কবিতা পড়তে এসেছি। কবিতায় বলতে এসেছি সেদিন কী হয়েছিল? কিন্তু কীভাবে বলব সেই কথা? কীভাবে পড়ব সেই কবিতাখানি? আমি তো বায়ান্নর রক্তক্ষরণ দেখিনি।
এই কবিতাটি যিনি লিখেছেন, তিনিও দেখেনি
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। সেও কীভবে লিখবে একুশ নিয়ে অমর কোনও কবিতা? আমাদের দুজনেরই জন্ম বায়ান্নের সেই রক্ত ঝরার পরে…
আজকের এই সভার যিনি সভাসদ, এই অনুষ্ঠানের যারা শ্রোতা, যারা দর্শক আছেন — সবাইকে বিনয়ের সাথে বলছি —
আমরা একুশ দেখিনি, কিন্তু আমরা কিংবদন্তি থেকে জেনেছি – একুশ কী?
আমরা একুশ দেখিনি, কিন্তু আমরা ইতিহাস পড়েছি, ইতিহাসের পাতার পর পাতা উল্টিয়ে পড়ে জেনেছি — একুশ কী? একুশ আমাদের কী দিয়েছিল? একুশে কী হয়েছিল!
সেই সময়ের এক টগবগে তরুণ আবদুল গাফফার চৌধুরী রাত জেগে কালজয়ী একটি গান লিখেছিলেন–
‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি?…
একুশ এলে এই গানটি আমরা সমস্বরে কোরাস করে গাই!
ভাটির দেশের এক যুবা আল মাহমুদ লিখেছিলেন —
‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ?
বরকতের রক্ত।
হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে ….! ‘
মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর মতো আমাকেও আজ বলতে হচ্ছে —
‘এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে
রমনার উর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়
যেখানে আগুনের ফুলকির মতো
এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ
সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।’
আমি আজ শোনাতে এসেছি এই সভায় রক্তমাখা শব্দগুচ্ছের অজস্র রক্তপাতের ধ্বনি।
এখানে যারা ছাত্র আছেন
কারখানার শ্রমিক আছেন
কৃষক আছেন,
আছেন শিক্ষক
গৃহিণী, তরুণ তরুণী সবাই শুনুন — রক্তমাখা একুশে ফেব্রুয়ারির সেই আখ্যান।
এখানে যারা নেই তারাও শুনবে, তারাও জানবে
এই কবিতার কিছু শব্দগুচ্ছ-
যা বাংলা বর্ণমালায় লিখেছেন কবি।
কবিতার শব্দ হোক আগুনের ফুলকি!
সেদিনও কবিতা হয়েছিল প্রজ্জ্বলিত উত্তপ্ত লেলিহান,
লেলিহানের সেই আগুনবাণে সেদিন দগ্ধ হয়েছিল তৎকালীন শাসকদের প্রজ্ঞাপন, ফ্যাসিস্তদের কুৎসিত মুখ, তাদের দম্ভ!
আজ এখানে এই সভায় দাঁড়িয়ে বেদনাভরে স্মরণ করে বলছি —
প্রতিবছর আটই ফাগুনের প্রভাতবেলায় সব পথ এসে মিলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে রাস্তাটির উপর ,
এই ফাগুনেই শহরের শোকার্ত মানুষেরা খালি পায়ে হেঁটে এসে জমায়েত হয় পথের পাশে খালি জায়গাটির উপর —
যেখানে মৌনতায় দাঁড়িয়ে আছে আমাদের গর্বিত স্পন্দিত ভাষাশহীদদের মিনার।
ফাগুনের এই দিনে লক্ষ মানুষ কেন এসে ফুল দেয় এর বেদীতে? কী হয়েছিল বায়ান্নের সেই ফাগুন দিনে?
সত্তর বছর আগে এমনই ঝকঝকে ফাগুন দিন ছিল সেদিন —
সেদিনও পলাশ শিমুল কৃষ্ণচূড়া ফুটেছিল আগুন রঙে পথের ধারে , রোদ্রে উজ্জ্বল ছিল সেদিনের ঢাকার আকাশ।
কী হয়েছিল সেদিন রোদ্দুর আর পলাশ ফোটা সেই ফাগুন দিনে?
ওরা যে আমার মায়ের কণ্ঠকে রোধ করতে চেয়েছিল, ওরা আমাদের বাংলা ভাষাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল! ওরা বলেছিল — একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্র ভাষা।
সেদিন গর্জে উঠেছিল ছাত্ররা —
ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, জগন্নাথ কলেজ সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শত শত ছাত্র,
তারা নেমে এসেছিল রাস্তায় —
১৪৪ ধারা ভেঙে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে শ্লোগানে শ্লোগানে বলেছিল তারা —
“রাষ্ট্রভাষা, রাষ্ট্রভাষা- বাংলা চাই, বাংলা চাই।”
সেদিন শাসকরা গুলি চালিয়েছিল আমার ভাইদের বুকের উপর, শহীদ হয়েছিল সালাম জাব্বার বরকত শফিকসহ আরও কত নাম !
পথের উপর যেন পলাশ শিমুল রক্তাক্ত হয়ে ঝরে পড়ছিল একএক করে।
মুহূর্তেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে হাজার হাজার জনতা,
বন্ধ হয়ে যায় দোকানপাট, অফিস আদালত , প্রেক্ষাগৃহ, গনপরিবহন —
মুলতবি করে দেয়া হয় বর্ধমান হাউজে অনুষ্ঠিত গনপরিষদ সভা,
দাবানলের মতো আগুন জ্বলে উঠে সারাদেশে।
ধর্মঘট ডেকে অচল করে দেয়া হয় কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, , বিচারালয়সহ সমস্ত সরকারি বেসরকারি অফিস আদালত . ..
তারপর সব ইতিহাস —
তারপর রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলো। তারপর থেকেই কথা বলছি আমরা বাংলায়, এ যে অনেক দাম দিয়ে পেয়েছি আমাদের এই বাংলা ভাষা।
১১. দিন যাপনের গল্প
আমি কারোর ভালোবাসা নিতে চাই না
নিতে চাই না বিষণ্ণতাও
কেউ আমাকে উষ্ণতা দিক ভালোবেসে
হরিণী কবোঞ্চ তুলতুলে বুকে ভরে নিক আদর
কিংবা উদ্দাম নদীর মোহনায় সাঁতার কাটুক
এসব জলভৈরবীর রাগ আমি শুনতে চাই না।
আমি কাউকে বিষাদে জড়াতে চাই না
যতই ফুটে থাকুক কাঁঠালিচাঁপা তার উঠোনে
মৌমাছি হয়ে গুণগুণ করতে চাই না রোদ্র স্নানে
উত্তরের হাওয়ার বেগ নিয়ে উড়োতে চাই না কারোর বুকের আঁচল কিংবা তার উদ্ভ্রান্ত চুল।
আমি কাউকে কষ্ট দিতে চাই না
সবাই ভুলে যাক তাদের ভুল প্রেমিককে
ভুল রাগে বেজে ওঠা পিয়ানোর সুরকে
সবার গান হোক সঠিক সুরে সাধা
অহেতুক কোনো দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতম না হোক।
আমি কাউকে বিপণ্ণ করতে চাই না
হেমন্ত চাঁদনী রাতে সবাই প্রেমে পড়ুক
চরাচর জুড়ে গানে ভাসুক
দোতারায় তাল তুলুক কোনো বিরাগী বোষ্টুমী।
আমি কাউকে গ্লানি দিতে চাই না
অন্তরের গহীন থেকে উড়ে যাক একাকীত্ব
হৃদয় মন পুষ্পমঞ্জরীত হোক।
কিছু কিছু কথা কবিতার শব্দে হেঁটে যায়
তাদের ওপরে আলো ফেলে আরো আলো খুঁজি।
তবুও দিন চলে যায় পুরোনো পাতা ঝরে মর্মরে,
বিষণ্ণ হয়ে পথের উপর হাঁটতে থাকি
চলে যেতে চাই অজ্ঞাতে দূরে বহুদূরে —
আমি যে অচেনা পথের পথিক একজন ।
১২. গানের দেশ কবিতার দেশ
(“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।।”)
কোথায় পাবে এমন বাঁধনহারা
চৈতালি হাওয়া
কোথায় শুনবে এমন বাঁশের বাঁশির
গান গাওয়া
কোথায় নদী এমন স্রোতবক্ষে
ভরে ওঠে উথলিয়া
কাজল সেই নদীর জলে অবগাহন করা হলো না।
কোথায় শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ পাতায়
পাতায় হাসে
কোথায় হাস্নাহেনার কুঞ্জে মৌমাছি
গুঞ্জরিয়া ভাসে
কোথায় বৌষ্টুমী কীর্তন গায় তার
দয়িতের আশে
তারার আলো জ্বেলে পূর্ণিমার চাঁদ তো উঠল না।
পথে প্রান্তরে কত ফুল ফুটে থাকে
বিমুগ্ধ অনুরাগে
কত যে রোদ্দুর হারিয়ে যায় মৌন
সন্ধ্যার অস্তরাগে
শ্রাবণ রাতভর কত মেঘ বৃষ্টি ঝরায়
ভৈরবী রাগে
তোমার আমার বাসর শয্যায় কদমফুল ফুটল না।
খেলাঘরের খেলা সখীরা কেউ আর
রাখেনি মনে
আর কী কখনও দেখা হবে যমুনার
ঐ পুলিনে
কত যে ঝরে জল মর্মরিত বেদনায়
দুই নয়নে
বুকের তলার গভীর দুঃখগুলো আর হাসল না ।
( ”ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।।” )
১৩. তারপর
(করোনাকালীন কবিতা)
তারপর আমাদের আর হাঁটতে যাওয়া হয়নি
সব পথ অচেনা হয়ে গেছে
পথের উপর থেকে মুছে গেছে আমাদের
সব পায়ের চিহ্ন।
তারপর
তারপর কলোনির রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকা ফুসকাওয়ালা রফিক মিয়া হয়ত আর আমাদের চিনতে পারবে না
কোঁকড়াচুলের সেই বালক মন্টু আর এসে বলবেনা- ‘স্যার, চুইংগাম, চকলেট লাগবে?’
তারপর
তারপর রেললাইনের পাশে পুকুরে ভেসে থাকা হাঁসগুলো আর দেখা হয়নি
পালকের পানি ঝেড়ে ওরা এখনও হয়ত
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে যায়।
তারপর
তারপর আর শোনা হয়নি ট্রেনের হুইসেল
শুন্য স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে এখনো কী মারফতি গান গেয়ে যায় উদাসীন সেই গায়েন?
তারপর
তারপর কখনোই আর ল্যাম্পপোস্টের আলোর নীচে ফুটপাত ধরে হেঁটে যাইনি কফিশপে
আকাশের দিকে চেয়ে দেখিনি আর হাজার তারা।
তারপর
তারপর আামাদের ছোট মেয়ে ঐশ্বর্যময়ী কখনও
আর বলেনি–‘বাবা, আমাকে তুমি কেএফসির চিকেন এনে দাও।’
প্রতিদিন দেখি ওর মনখারাপের মায়াবী মুখ।
তারপর
তারপর পার্কের কড়ই গাছের পাতাগুলো মর্মর করে ঝরে পড়ে গেছে, শালিকগুলো উড়ে গেছে
পড়ে রয়েছে সেখানে বৈশাখের চৌচির রোদ।
তারপর
তারপর আমরা আর ভুল করেও একসাথে
পথ চলিনি ,
যে পথে চলতাম সেপথে পায়ের ছাপ খুঁজিনি
এক মায়া জড়ানো স্মৃতি বাড়ির উঠোনে ুপদপৃষ্ট করেছি।
তারপর
তারপর নিজেকেই সান্ত্বনা দেই , বাড়ি হয়ে গেছে মসজিদ, সৃষ্টিকর্তার কাছে মুখ ফিরে দুহাত তুলে প্রার্থনা করি, যদি বেঁচে থাকি জীবন মরণের মাঝখানের সময়টটকু সুন্দর করে রাখব।
তারপর
তারপর আবার একদিন দিয়াবাড়ির বালির প্রান্তরে
নুয়ে পড়া শুকনো কাশবন দেখতে যাব,
সেখানে হয়ত এখন বৃষ্টিতে জন্মেছে সবুজ ঘাস,
হয়ত ফুটে আছে অজস্র ঘাসফুল।
তারপর
তারপর যমুনা সিনে কমপ্লেক্সে একদিন সিনেমা দেখতে যাব, একটি খোলা অটোরিকশা করে
তিনশত ফুট রাস্তা দিয়ে নীল আকাশ দেখতে দেখতে চলে যাব পূর্বাচল
তারপর
তারপর আবার একদিন একটি বড়ো লঞ্চে করে মেঘনা নদীতে ভাসতে যাব, ঝাঁকে ঝাঁকে রুপালি ইলিশ ধরতে দেখব জেলেদের জালে
তারপর
তারপর কোনো এক বিকেলে তুরাগ নদীর পাড়ে
গিয়ে দাঁড়াব, দেখব পশ্চিমের দিগস্তবেলার লাল আভার স্বপ্নীল আকাশ
সন্ধ্যার কথাকলিরা তখন রূপকথা হবে, কূলায় ফিরে আসতে চাইব না আর
তারপর
তারপর আমাদের সবকথা পৃথিবীর গান হবে
এত সুন্দর এই ভূবনে কোরাস করে গাইব তখন — আমাদের হবে জয় একদিন।
১৪. আমার সকল একাকীত্বে
একদিন এক নিরাভরণ আয়োজনহীন বিকালে আমরা হেঁটেছিলাম,
পিচ ঢালা নির্জন সেই পথ, পাশে দূর্বা ঘাসের উপর দুপুরের এক পশলা বৃষ্টির মুক্তো লেগেছিল। তখন আকাশ ছিল ধূসর নীল।
শ্রাবণে কাশফুল ফোঁটার কথা না। সন্তান সম্ভাবা রমণীর মত শেফালিকাও কোথাও নেই। পিচের পথ ছেড়ে দূর্বা ঘাসের উপর আমাদের চরণ পড়ে দূর্বাও রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল।
যে পাশে ছিল সে ছিল আমার আনন্দময়ী, আমার প্রাণাধিকা। বিকালের রোদ্র মেখে স্বর্ণপ্রভা হয়ে উঠেছিল সে। কতকালের পরিচিত মুখশ্রী। দেখেছি কত সন্ধ্যার ছায়ায়, কত চন্দ্রালোকিত নিশীথে। সে প্রকৃতিভৈরবী হয়ে আমাকে ঘর থেকে কত যে বের করে নিয়ে গেছে।
কতদিন পর আজকে এই বিকালে এখানে এসেছি। পশ্চিম দিগন্তে আলো নেভে নাই, তখনও দিগন্তে কমলা রঙে ছেয়েছিল..
আমরা হেঁটে চলেছি ……..
এমন কত পথ পাশাপাশি হেঁটেছি
হাঁটতে হাঁটতে কত দূর চলে গেছি
কত কথা বলেছি, কত কথা বলতে ইচ্ছা করত!
পথের পাশে অখ্যাত ঘাসফুলের দিকে চেয়ে
কত প্রাণের ছোঁয়া যে তাকে দিতে চেয়েছি।
আমি দেখেছি তার মাথার চুল উড়ছে আসন্ন সন্ধ্যার ধূপগন্ধ বাতাসে,
তাকে একাকার করে নিতে ইচ্ছা করত আমার সকল একাকীত্বে..
অন্তরের ভিতর তখন অন্য তরঙ্গ —
‘জানি না কোথা অনেক দূরে বাজিল গান গভীর সুরে,
সকল প্রাণ টানিছে পথপানে
নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।’
১৫. এসো দু’জনে
হাতখানি বাড়িয়ে দাও
চুড়ির রিনঝিন শব্দ বাজে যে মেহেদি পরা হাতে
এসো সে হাতে অঙ্গুরী পরিয়ে দেই।
মাথাটি বাড়িয়ে দাও
কুচবরণ কেশে বেঁধেছ যে রাজকুমারীর খোঁপা
এসো সে খোঁপায় গোলাপ পরিয়ে দেই।
মুখখানি বাড়িয়ে দাও
কপালে পরেছ যে টিপ চোখে মেখেছ যে কাজল
এসো সে মুখে লোধ্ররেণু লাগিয়ে দেই।
কোমড় বাড়িয়ে দাও
পরেছ যে মোঘল নর্তকী আনারকলির বিছা
এসো নাভীপদ্মে চারুকলার কারুকাজ এঁকে দেই।
পা দুটি বাড়িয়ে দাও
নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গের পদধ্বনি বাজে যে পায়ে
এসো আলতা রাঙ্গা ঐ পায়ে নুপুর পরিয়ে দেই।
বুকখানি বাড়িয়ে দাও
আতরের গন্ধ আর চন্দনের সুবাসে ভরে আছে যে বুক
এসো সেই বুকখানি আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেই।
ভালোবাসা ভরিয়ে দাও
পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় আকুল হয়ে আছে আজ চারিদিকে
এসো দু’জনে এই রাতে প্রেমের ফল্গুধারা বইয়ে দেই।
১৬. যদি দূরে যাই
তোমার আছে জোনাকজ্বলা রাত্রি , আমার আছে পুষ্পিত ভোর
যদি কখনও দূরে চলে যাই, বন্ধ করো না তোমার বাহু ডোর
সেই অতল রাত্রিতে যদি খুঁজে না পাও আমার গন্ধ ভরা বুকের
ভোরের আলোয় জানালা খুলে সুবাস নিও তুমি অলকানন্দের
তুমি থাকবে আকাশ নীলে, আমি রয়ে যাব দূরের কোনও মেঘে
যদি মেঘেও তুমি দেখতে না পাও, কেঁদে ভাসিও না আকুল আবেগে
একলা তুমি অলিন্দে বসে দেখো তারা, দেখো চাঁদ, দেখো অন্ধকার —
যেথায় আমি থাকি না, আমার প্রেম চিরকাল কাছে রবে তোমার।
১৭. এক সন্ধ্যার গল্প
তোমার সাথে আবার যদি দেখা হয় মেঘ মেদুর
কোনো সন্ধ্যায়, চিনতে পারবে কী আগের মতোই – কথা বলবে কী? নাকি চেয়ে দেখবে শুধু দূর থেকে দাঁড়িয়ে।
অচেনা লাগবে তোমাকেও, আগে সত্যবদ্ধ সব জেনে নিতাম, তুমি ঠিক কোন্ শাড়িটি পরে আসবে,
বাতাসে ভাসবে কোন্ পারফিউম,
কোন ফুল লাগিয়ে আসবে খোঁপায়, বেলী, শিউলি, নাকি চন্দ্রমল্লিকা।
সেই সন্ধ্যায় হয়ত মন খারাপের চোখ দিয়ে দেখতে পাবে আমার মলিন মুখ, শুকিয়ে যাওয়া শরীর!
সন্ধ্যার মৌনতায় চেয়ে দেখতে পারবে কী ঠিক আগের মতো প্রেম মমতায়…
প্রতিশ্রুতি ভেঙেছিলে তুমি, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারীরও
চোখে মায়ার আবেশ থাকে, আমিও সেদিন ঠিকই দেখতে পাব তোমার সিক্ত চোখ , হয়ত মেঘ ঝরঝর করে বৃষ্টি ঝরবে আকাশ ভেঙে।
জানো, সেই কতো রাত্রি ধরে এলমেল ঘুম আমার!
কোনো কোনো দিন সারারাত জেগে জেগে
সকালে জানালা খুলে দেখি — অনুজ্জ্বল শুকতারা তখনও আকাশে জ্বলছে।
আচ্ছা, তুমি কী এখনও আমার দেওয়া উত্তরীয়টি
গায়ে জড়িয়ে রাখো, নাকি অন্য কারোর দেয়াটা পরো!
তুমি টিপ পরো কী আমাকে মনে করে এখনও কপালে?নাকি কেউ পছন্দ করে না দেখে আর কপালে টিপই পরো না।
যদি দেখা হয়, সেই সন্ধ্যায় তুমি কী আগের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরবে? আগের মতোই ভালোবাসতে পারবে? নাকি কোনও অনুভবই তৈরি হবে না আর শরীরে ও মনে।
তুমি সিগারেট খাওয়া পছন্দ করতে না, তাই সিগারেট ছেড়েছিলাম। এখন সিগারেট খাই, তাও চুপিচুপি। যদি তুমি দেখে ফেল এই ভয়ে! যদি তুমি রাগ হও…
চাকরির আবেদনপত্র আর পাঠাই না কোথাও । সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছিলে আমার কর্মহীনতার জন্য,
তাই কর্মহীনভাবেই ঘুরে বেড়াই আমাদের চরণচিহ্ন পড়া জায়গাগুলোতে।
পার্কের ঘাস চিরসবুজ হচ্ছে আরও দিনে দিনে —
কড়ই গাছ থেকে মরা পাতা ঝরে পড়ে আজও মৃদু মন্দ বাতাসে, মুখর হয়ে থাকে এখনও রেস্টুরেন্ট, চায়ের দোকান…
আচ্ছা, আমার কথা কী মনে পড়ে তোমার ?
সত্যি করে বলো — তোমার সত্য কথাটা কোনদিনই আর শোনা হবে না।
আসলে কোনও সন্ধ্যায়ই তুমি আসবে না আর। শুধু দেখব আকাশ ভরা মেঘ, সেই মেঘ থেকে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি ঝরছে…..
১৮. লীলাকুচি
দূর বহুদূরে বাতাবি লেবুর ছায়ার সেই উঠোনে
আজও হয়তো দুপুরের রোদ লুকোচুরি খেলে
দুটো শালিক সেইবার চঞ্চু মিলেছিল ছায়া ছায়া আলোয় মাটির টালির রান্না ঘরের চালে —
আমি বুঝিনি তখন ঐটি ছিল ওদের ভালোবাসাবাসির এক বহিঃপ্রকাশ।
আর একবার পুকুরপাড়ে দুটো ঢোঁড়া সাপের জড়াজড়ির করা দৃশ্য দেখেছিলাম,
ঘাসের ফাঁকফোকর দিয়ে দুপুরের রোদ্দুর এসে পড়েছিল ওদের উপর ,
তখনও বুঝিনি এটা ছিল ওদের রতিক্রিয়া,..
তারপর দেখলাম — ক্লান্ত ঋজু ভঙ্গীতে জলে গা ডুবিয়ে দিয়ে ওরা ভেসে চলে গেল।
আর একবার কালিজিরা ধানক্ষেতের পাশে
কাঁকড়মাটির গর্তের ভিতর থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শামুক তুলে এনেছিলাম, ভেঙে ফেলেছিলাম কাঁচের আবরণের মতো রঙিন খোলস, কেমন রক্তপাত হলো,
আমি স্তব্দবাক হই ! কেন হন্তারক হয়েছিলাম আমি! তখনও জানতাম না শামুকেও প্রাণ থাকে, ঝিনুকেও মুক্তা থাকে…
সেই থেকে আমি মুক্তা খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত নিঃসাড় এক ব্রাজক , কত জীবনকাল পাহাড়ের ঝর্নাধারায় নুড়ি কুড়িয়েছি , দুই হাত দিয়ে পাথর সরিয়েছি,
ভরা দিঘির জলের তল থেকে ঝিনুক তুলে এনেছি ডুবুরির মতো ,..
কিন্তু, আমলকির ছায়াতলের সেই উঠোন,
মাটির টালির চালে শালিকজোড়ার ওষ্ঠচুম্বন, পুকুর পাড়ে ঝাঁঝাঁ দুপুরে সর্পযুগোলের লীলাখেলা, আহত শামুকের আর্তি — আমার দেহমনকে এখনও আকণ্ঠ নীল করে রাখে।
এই জীবনে কত রহস্য উন্মোচন করেছি, অমৃত ভেবে কত বিষের পাত্রে দিয়েছি চুমুক, কত লীলাকুচি চূর্ণ বিচূর্ণ করেছি অবলীলায় – কোথাও থেকে কোনও মুক্তা খুঁজে পাইনি আজও।
১৯. মায়া
চাঁদ আছে কী নেই, তারা জ্বলছে কী জ্বলছে না
কে দেখবে তা আজ আলোহীন এই ছায়ার নীচে দাঁড়িয়ে?
কে আকাশের গায়ে লিখে গেল —
‘চলে যে যায়, সে চলে যায় দূরে বহু দূরে, নিস্প্রভ পদচিহ্ন ফেলে,
কে কোথায় ক্রন্দনধ্বনি মিশিয়ে দিচ্ছে এই শহরে
অযুত গাড়ির হুইশেলের শব্দ তরঙ্গে ….’
কোথায় কার ছায়া পড়ে থাকলো,
কোথায় কোন্ পাতা মর্মর শুষ্ক হাওয়ায় কার দীর্ঘশ্বাস মিলিয়ে গেল…
শুধু মায়াগুলো তার পড়ে থাকলো, লুকানো গেল না কোথাও।
২০. কুর্চিবনের গান
এখনও তুমি আছ,
এখনও তোমাকে ছুঁয়ে দেখি তোমার হাতের এপিঠ ওপিঠ, স্পন্দিত আঙুল —
বারান্দায় রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে তুমি শুকাও মাথার চুল
বাতাসে ভেজা চুলের গন্ধ ভেসে আসে
এখনও হৃদয়ে স্রোত বয় মদিরার মোহনায়।
এখনও ছুঁয়ে দেখি
তোমার চোখের পাতা, ললাটে চুম্বনের দাগ, শরীর জেগে ওঠে পলল মাটির ঘ্রাণে,
এখনও ঘুমঘোরে স্বপ্ন দেখি — কুর্চিবনে ফুটে আছে ফুল, অদূরে বইছে জল ছ্বলাৎছল,
এখনও নদীর মতো জড়িয়ে থাকো বাহুডোরে।
এই তো সে-দিন
তুরাগ নদীর পাড়ে কাশবনে লুকিয়েছিলাম আমরা,
বিকালের অস্তরাগের সোনালি আলো পড়েছিল তোমার মুখের উপর, বাবলা ফুলের গন্ধে নেমেছিল মৌন সন্ধ্যা–
ঘাসের উপর উড়ছিল ফড়িং, উড়ছিল হলুদ প্রজাপতি রঙবেরঙে।
ঘন রাত্রি নেমেছিল, তারা উঠেছিল আকাশে , জোনাকিরা আলো জ্বেলে ধরে বলেছিল — ‘‘তোমরা থেকে যাবে নাকি?’
আমরা তখন কুর্চিবনের গানের মতো বিভোর
কী এক অচিন বিমুগ্ধ উত্তেজনায় সেই রাত্রিতে বাড়ি ফেরার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
২১. তুমি এসো
আমি কী একেবারেই শুকনো জলহীন নদী হয়ে গেছি? কোনও কী স্রোত নেই জলে?
পা নামাও তুমি জলে,
বুদবুদ করে জল উথলে ভরে উঠবে নদী।
যতবার ডুবতে চাও ডুববে
যতবার মরতে চাও মরবে
সাঁতরাবে রাজহংসের মতো, ভেসে ভেসে
চলে যাবে অথৈ গহীনে।
আমি কী কেবল বালিয়াড়িতে পড়ে থাকা নিষ্প্রাণ ঝিনুক? তুমি কী তাই মনে করো?
ছুঁয়ে দাও, স্পর্শ করো আমাকে,
দেখবে — এক এক করে সব ঝিনুক ফুল হয়ে ফুটে উঠবে, তুমি সেই প্রস্ফুটিত ফুলের সুবাস নিতে পারো,
হৃদয়ের ফুলদানিতে সাজাতে পারো,
গন্ধে মাতাল হয়ে পাপড়িগুলো ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে পারো।
আমি কী সেই চন্দন, যে পুড়ে ছাই ভস্ম হয়ে গেছি? তুমি কী পোড়া ছাই মনে করো আমাকে ?
কোনই কী উত্তাপ নেই?
ছুঁয়ে দেখো আমাকে–
দাউদাউ করে লেলিহান হয়ে জ্বলে উঠব,
তুমি সেই আগুনে পুড়তে পারো, জ্বলতে পারো,
ছাইভস্ম হয়ে উড়ে যেতে পারো কোনও
অমরাবতীর দেশে।
তুমি কী আমাকে নিষ্প্রভ ধ্রুবতারা মনে করো?
কোনই কী ঔজ্জ্বল্য নেই আমার ?
কক্ষপথে এসো, এসো দ্রাঘিমাতে —
আমার ছায়াপথ আলোয় আলোয় ভরা,
আমরা দুজনই সেই আলোয় পুণ্য করব আমাদের দেহমন, জ্যোতির্ময় করব প্রেম, তুমি এসো।
আমি যে এখনও পূর্ণতোয়া নদী,
প্রস্ফুটিত ফুল, সুবাসিত চব্দন ও উজ্জ্বল ধ্রুবতারা।
২২. দাঁড়াও সুন্দর
যেদিন শেষবারের মতো চলে যাব,
সেদিন পথ ডেকে বলবে —
দাঁড়াও তুমি– ধূলি মেখে যাও পায়ে।
শূন্য নীল আকাশ বলবে —
এসো তোমাকে নীলাদ্রি করে দেই।
রাতের তারা মন্ডল বলবে —
কোথায় আর যাবে?
তারা হয়ে জ্বলে থাকো আমাদের পাশে।
দখিনা সজল বাতাস দোলা দিয়ে বলবে —
তোমার আতর মাখা শরীরের গন্ধ ছুঁয়ে দাও।
ফুল বলবে —
আজ তোমার জন্য ফুটেছিলাম, সুবাস নিয়ে যাও।
পাখি বলবে —
যাবেই যখন আমার একটি পালক পরে নাও।
নদী বলবে —
এসো আর একবার, অবগাহন করো, পুণ্য হয়ে যাও।
নারী বলবে —
প্রেম দিব তবু তুমি যেও না।
খরতাপে চোখ পুড়ে তপ্ত মাঠ পেরিয়ে চলে যাব।
ধুনো ধূপের গন্ধ পাব আকুল করা আশ্বিন সন্ধ্যায়।
হাঁটব যতক্ষণ না তারা ফুটে উঠবে আকাশে।
চলব যতক্ষণ না আলো নিভে মেঠো পথে।
অন্ধকারে যতক্ষণ না দেখতে পাব জোনাকিরা উড়ছে, পড়ছে, জ্বলছে, নিভছে।
২৩. যাবার বেলায় ওগো তুমি একবার শুনে যেও —
চরাচরের ধাঁধানো রোদ্র থেকে
পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘরাশি থেকে
অমাবস্যার নিগুঢ় অন্ধকার থেকে
শরতের নীল আকাশ থেকে —
পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য কুড়িয়ে এনে
আমরা যে জীবন শুরু করেছিলাম
এই ভূবনের বুক চিরে যে ভালোবাসা দুজনের যৌথ হাতের আঁজলায় ভরে তুলে নিয়েছিলাম
অশ্রুতে দীর্ঘশ্বাসে স্বর্ণচ্ছ্বটা যে ভবিষ্যৎ আমরা নির্মাণ করেছিলাম —
সেই সব সুন্দর, সেই সব আলোকিত রোশনাই
তুচ্ছ করে দিয়ে তুমি একাই চলে যাবে
তা হয় না।
২৪. একাত্মা
তুমিও জানো আমিও জানি– নদী কীভাবে আকুল হয়ে সাগরে মেশে
সাগরও জানে নদীও জানে– কীভাবে কাছে টানতে হয় ভালোবেসে।
তারাও জানে চাঁদও জানে — কীভাবে আলো ঢালতে হয় পৃথিবীর উপরে
রাত্রিও জানে ভোরও জানে — কীভাবে শিশির ঝরাতে হয় ঘাসের ‘পরে।
আকাশ জানে মেঘও জানে — কীভাবে বৃষ্টি নামাতে হয় শীতল জলধারায়
মুক্তাও জানে শুক্তিও জানে — কীভাবে ঝিনুকের বুকে জড়িয়ে থাকতে হয়
রূপকথা জানে গল্পও জানে — কীভাবে লেখা হয়ে যায় অমর প্রেম কাহিনি
হৃদয়ও জানে শরীরও জানে — কীভাবে একাত্মা হতে হয় মদিরায় মোহিনী।
কেউ না জানুক আমরা জানি — কে কাকে কতটুকু চির মমতায় ভালোবাসি
তুমিও জানো আমিও জানি — একজন ছাড়া আরেক জন অকূলে ভাসি।
২৫. কোথায় সে জন
কোথায় সেই ভাঁটফুল, ভেরেন্ডার পাপড়ি, আকন্দের ঝোপঝাড়। কোথায় হিজলের বন, মহুয়া মাতাল নদীর কূল। যে নারীকে নদী মনে করতাম, সেই একদিন পরিবর্তনের স্রোতে হারিয়ে গেল।
দিনের অন্তিম সায়াহ্নবেলায় আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে নক্সীকাঁথার পথ ধরে। যেখানে অসংখ্য দূর্বাঘাসের উপর অপরাহ্ণের রোদ্দুর পড়ে ঝিকিমিকি করে। দূর্বা ঘাস পায়ে মারিয়ে হেঁটে চলে যাব, নদীর কাছে। বলব– ‘তোমার কাছে থেকে কিছুই নেব না, সব ফিরিয়ে দিতে এসেছি।’
যখন চাঁদ উঠবে, যখন রাতের আঁধার জুড়ে ফুটে উঠবে থোকা থোকা তারা, তখন ফিরে আসব জীবনের উপত্যকায়। জ্যোৎস্নায় নেশাচ্ছন্ন পায়ে নগ্ন হয়ে নেমে পড়ব মৃত্যুনদীর জলে। আর উঠব না।
তুমি একাকী দাঁড়িয়ে তখন খুঁজো আমাকে, শীর্ণা নদীর কূলে বসে তার জলে।
২৬. সেই
কতদিন ধরে কত বিকেল হাঁটতে যাওয়া হয়না
তোমার হাত ধরে……
কেমন আছে শিয়ালডাঙার নির্জন পথের দুপাশের ঘাস? কেমন আছে মনুষ্যহীন রেল স্টেশন?
কাওলার নিবিড় আম বাগানের কস্তরি পুকুর? ফুল কী ফুটে থাকে জলে?
আহা!
কতদিন ধরে অস্তাচলে ডুবে যাওয়া সূর্যাস্ত দেখিনা!
এখন কেবলই,
অন্তিম সন্ধ্যায় জানালা খুলে দুজন চোখ মেলে সময় করছি পার!
শব্দহীন নিস্ফল চেয়ে থাকি, কত আঁধার নামতে দেখি এই ঘরে এই আঙিনায়!
তবুও,
প্রাপ্তি তো আছে! তুমি স্নানঘর থেকে সদ্য স্নান করে আসো, মেলে ধরো ভেজা চুল, টপটপ করে ঝরে পড়ে জল, যদিও জড়িয়ে ধরতে পারিনা তোমাকে, শুধু গন্ধ নেই দূর থেকে।
এখনও,
আমাদের স্বপ্নগুলি স্বযত্নে রেখে দিয়েছি বুকের ভিতর, আবার একদিন প্রথম ভালোবাসার মতো শুরু করব আমাদের দিন
২৮. পৃথিবীর অসুখ
চোখের ভিতর অনেক জল ছপ ছৃপ করছে। কিন্তু সব জল স্থির করে রেখেছি। কারোর জীবন দীপ নীভে গেছে, এমন কোনো আঁধার হওয়ার করুণ-সুধারসের কথা আজ বলব না।
রাতভোর নাকি বৃষ্টি হয়েছে। অন্য কোনো দিন হলে
জানালা খুলে বৃষ্টির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বৃষ্টির ছাটে ভিজে শীতল হত বক্ষ। এক অদ্ভুত ভালোলাগার আবেশে ভরে উঠত শরীর মন।
কী যেন ভাবনা এল। খুব চেনা এক দীঘিতে ছোট ছোট সাদা, লাল, নীল কাগজের নৌকা ভাসছে। কৃষ্ণচূরার রক্তিম ফুল সব ঝরে ঝরে পড়ছে । সেই ফুলগুলো শ্যাওলার মতো করে জ্বলে ভাসছে। পানিপোকা ছুটোছুটি করছে। ওরাও নাকি জলের কানে কান লাগিয়ে জলের গান শোনে।
কী যে ইচ্ছে করে বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ নিতে। কতকাল সাদা টগর ফুল স্পর্শ করিনি। উন্মুখ হয়ে আছি রাধাচূড়ার তলে যেয়ে হাঁটতে। মৌ মৌ গন্ধ ভাসবে বাতাসে। অনেকদিন রাধিকার পাপড়ি ছুঁয়ে দেখিনি। ভিতরটা কেমন চঞ্চল হয়ে আছে।
এই পৃথিবী দূষণ মুক্ত হলেই আমি পথে পথে হাঁটব। যদি পথে বৃষ্টি নামে, নামুক। আকাশ কালো করে মেঘ হয়, হোক। তুমুল ঝড় উঠুক। উদ্দাম বৃষ্টি ঝরুক। আমি বেশি কিছু চাইনা। শুধু দুহাত খুলে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখতে চাই।
হায়! পৃথিবীর এই অসুখ কবে সেরে উঠবে!!
৩০. একজন মায়াবতী
অফিসে পরিশ্রম করে বাসায় আসলে রাতে পাশে থেকে জড়িয়ে ধরে কেউ যখন বলে – ‘খুব কষ্ট করো!’
এমন একজন মানুষ
মনখারাপের সময় স্মিত হেসে পাশে বসে যখন কেউ
বলে ‘ তোমার কী হয়েছে? আমাকে বলো,না!’
এমন একজন মানুষ
১০৪ ডিগ্রি জ্বরের সময় সারারাত সিয়রে বসে নির্ঘুম চোখে মাথায় যে জলপট্টি দেয়,
এমন একজন মানুষ
ঘুম ভেঙে গেলে যখন চেয়ে দেখি — হাসি মুখে চা হাতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে,
এমন একজন মানুষ
ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার পর ছোট ভাই মারফত যে চিরকুট লিখে পাঠায়, ‘ তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, এসে নিয়ে যাও’
এমন একজন মানুষ
শতবার রাগ করে মুখ ঘুরিয়ে রাখে, কিন্তু পরক্ষণেই রাগ ভেঙে সহস্রবার এসে যে জড়িয়ে ধরে,
এমন একজন মানুষ
রাস্তায় হাঁটার সময় তুমুল বৃষ্টি নামলে নিজের শাড়ির আঁচলখানি যে আমার মাথায় বিছিয়ে দেয়,
এমন একজন মানুষ
অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে যে আমাকে সারা জীবন আগলে রাখে গভীর মমতায়,
এমন একজন মায়াবতী আমার জীবনে হোক ।
৩১. মানুষ রবে না স্বপ্ন রবে না
আমি সূর্যকে
ছুঁইতে পারিনি রৌদ্র আমাকে ছুঁয়েছে
আমি চাঁদকে
ছুঁইতে পারিনি জোছনা আমাকে ছুঁয়েছে
আমি আকাশকে
ছুঁইতে পারিনি মেঘ আমাকে ছুঁয়েছে।
আমি তোমার
দেহকে ছুঁবো না প্রেমকে আমি ছুঁয়েছি
তোমার ঠোঁটকে
আমি ছুঁবো না লাল শিমুল আমি ছুঁয়েছি
তোমার চোখের
কাজলে আমার চোখের পাতাকে ছুঁবো না
আমার চোখের মণি
তোমার অন্তরকে আলোকিত করেছে।
ধরো, আমি তোমাকে ছুঁবো না আর,
কীভাবে হবে জন্ম, প্রজন্ম
কোনো নব শিশুর জন্ম চিৎকার কেউ শুনবে না
একদিন এই পৃথিবী হবে মনুষ্যহীন —
পাখি, পতঙ্গ, ব্যাঙ, সরীসৃপ, গিরগিটি, পিঁপড়া, বন্যপ্রাণী সবই থাকবে,
থাকবে ডলফিন, গাঙচিল, হাঙর ও কচ্ছপ…
বৃক্ষ থাকবে , সাগর, নদী, পাহাড় থাকবে , প্রোতাশ্রয়, ঝরনা থাকবে —
জ্বলবে সূর্য, আলো দিবে চাঁদ, নিভবে তারা……
কিন্তু মানুষ থাকবে না কোথাও,
মানুষ থাকবে না তাই স্বপ্ন থাকবে না।
কিন্তু,
মানুষই স্বপ্ন দেখে, হাঙর কচ্ছপ’রা দেখেনা…
৩২. তুমি
চোখ খুলে দূরের যে মেঘ দেখি সেখানে তুমি
সে মেঘের ছায়াপথে আমার যে চোখের তারা
সে তারায়ও মিটিমিটি জ্বলছো তুমি।
ঝিরিঝিরি যে বৃষ্টির ধারা বইছে ভূবন জুড়ে
সে জলপতনের শব্দেও তুমি
জলে জলে ভরে যায় যে নদী সেই স্রোতধারাও তুমি।
সকালে পাখিদের যে গান বাজে সেই গানে তুমি
অলিন্দে বসে ডাকে যে কাকাতুয়া তার সুরেও তুমি
সেই কাকাতুয়ার বিষন্ন চোখের মায়াতেও তুমি।
বুকের গভীরে তুমি মিশে গেলেই নির্জনতা বাড়ে, আকুল হয়ে ওঠে যে বিন্দু বিন্দু রক্ত কণিকা–
স্তব্ধ হয়ে যায় যে শ্বাস প্রশ্বাস সেই দীর্ঘশ্বাসেও তুমি।
এলোমেলো যে স্বপ্ন আসে রাত্রির গভীরে থেকে
হৃৎপিণ্ডের দু’পাশে যে স্পন্দন শুনি —
যে ঝড় আসে বুকের অতল থেকে সে ঝড়েও তুমি।
জীবন আর কালের কপোলের যে অন্ধকার,
সে অন্ধকারের ওপাশে দেখি যে আলোর ছ্বটা —
সেই নিঃশেষিত আলোক বিন্দুতেও তুমি।
৩৩. যেদিন প্রথম এলে
আমার বাড়ির আঙিনায় যেদিন তুমি
প্রথম পা ফেলেছিলে
কোথা থেকে সেদিন শুকপাখিরা উড়ে এলো দলে দলে
সাদা মেঘের মতো গন্ধরাজ ফুলগুলো ফুটে উঠল
মেঘ ভেঙে বৃষ্টিও হলো অঝোরে ।
কবিতার খাতার সাদা পাতায় কত অজস্র
কবিতা লেখা হলো– লেখা হলো তোমার কত নাম,
কত মধুবন্তী গানের চরণে খাতা ভরে গেল,
ভরে গেল কত সঞ্চারীতে ….
লিখে রাখা হয়ছিল মেহেদী মাখা তোমার হাতের কথা
মায়াবী রাতের কথা, চাঁদের কথা–
চাঁদমুখী কুঞ্চিত মুখের কথা, কত যে আরও রূপকথা!
৩৪. আমার নামে কাজল দিও চোখে
পার্ক রোড ধরে হাঁটতে হাটঁতে আজ যখন বাসায় ফিরছিলাম, তখন মনে মনে কয়েক লাইন কবিতা লিখেছিলাম।
লিখেছিলাম চমৎকার কিছু পংক্তি !
বাসায় এসে যখন খাতায় লিখতে বসি, তখন সেই পঙক্তিগুলি আর মনে করতে পারছিলাম না।
কী লিখেছিলাম আমার মনের সেই খাতায়?
একদিন তপ্ত দুপুরবেলায় তুমি আগুন পলাশ বনে এসে দাঁড়াবে। রাঙা পলাশের আবীর মাখবে তোমার গালে। তোমার বুক দুরুদুরু। আমার নামে কাজল দিবে চোখে, আদর মেখে নেবে তোমার ঠোঁটে। জুঁই ফুল দিয়ে তুমি চুলের বিনুনি গাঁথবে, খোঁপায় গুজবে হলুদ গোলাপ।
এই কথাগুলো তখনকার কবিতার নয়। মন থেকে সেই অপূর্ব সুন্দর কথাগুলি মুছে গেছে।
আমি কবিতার খাতা বন্ধ করে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াই। কী আশ্চর্য! দেখি, তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছ। বেনীতে জুঁই, খোঁপায় তোমার হলুদ গোলাপ, মুখে পলাশ রেণু।
এ যে সত্যি!
বসন্ত যে এসে গেছে। আগুন পলাশ ফুটে আছে আমারই দরজার সামনে।
৩৫. তুমি উদ্বাস্তু নও
তুমি উদ্বাস্তুও নও, গৃহহীনাও নও তারপরও বললে– ঠাঁই দাও তোমার গৃহকোণে।
আমি বললাম, স্থান নেই, ঘর পরিপূর্ণ।
তুমি বললে — দিগন্ত পেরিয়ে, মাঠ পেরিয়ে, ঐ দূরে
অশ্বত্থ ছায়াতল আছে, নদীর কূল আছে, ভাঙা নাটশালা আছে,
লতা গুল্মের ছায়া আছে, তারার আচ্ছাদনের আকাশ আছে , আকুল করা জোছনা ধারা আছে… …
সেথায় দাও স্থান।
এইসবের কাছে আমাকে নিওনা, উন্মাতাল হই,
লোভ হয়! পরিপাটি সব ফেলে এই গৃহত্যাগ করে চলে যেতে ইচ্ছে করে।
পাহাড়, টিলা, মহুয়াগাছ, ঘেঁটুফুলের গন্ধ, শান্ত জলের নদী, সবাক জারুল বৃক্ষ, বসন্তের পাতা মর্মর, এইসবই আনন্দ দেয়,….. আমাকে ঘরের বাহির করে…
৩৬. এমন একজন মানুষ
সবার জীবনে এমন একজন মানুষ থাকা দরকার, যে তাকে বেলা করে ঘুমিয়ে থাকলে বলবে — ‘ওঠো। ঘুমিওনা। অফিসের সময় হয়ে গেছে।’
তপ্ত দুপুরের রোদে হাঁটলে বলবে — ‘রোদে হাঁটবে না, শরীর পুড়বে’। বৃষ্টিতে ভিজলে বলবে — ‘বৃষ্টিতে ভিজো না, ঠান্ডা লাগবে, জ্বর আসবে।’
আর জ্বর আসলে বলবে — ‘মনে করে ঔষুধটা খেয়ে নিও।’
রাতে মশারীটা ঠিক করে দিতে দিতে বলবে — ‘হাতটা যেন বাইরে না থাকে, মশা কামড়াবে।’
বলবে — মোবাইলটা অফ করে ঘুমাইও। ঘুুম না এলে বলবে — চোখ বন্ধ করে রাখো।’
বাইরে যাবার সময় বলবে — ‘সাবধানে রাস্তা পার হইও।’ বিপদে পড়লে সবসময় আল্লাহ কে স্মরণ করবে।
তেষ্টা পেলে — পানি খেয়ে নিও । আর, খিদা লাগলে, কিছু খাবার কিনে খেয়ো।
আরও বলবে — ‘কখনোই সিগারেট খাবে না।
হাতখানি টেনে নিয়ে তার মাথায় দিব্বি নিয়ে বলবে — শুনবে তো আমার সব কথা? বলো, দিব্বি!’
বলব — জ্বী, শুনব তোমার সব কথা। দিব্বি।
৩৭. মনেই পড়ে না
আজ হয়ত তোমার মনেই পড়ে না, একবার সাত রাস্তার মোড়ে মারাত্মক ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়াতে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়েছিল, আর এজন্য তুমি রেগে ভূত হয়ে গিয়েছিলে। ভেবেছিলে, আমি বুঝি অন্য কারোর সাথে ডেটিং করেছি।
আজ হয়ত তোমার মনেই পড়ে না, আমাদের ঝগড়া ও খুনসুটি করার কথা। তুমি রাগ করে বাক্স পেটরা গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে যেতে। পরে খোঁজ নিয়ে জানতাম, তুমি বাপের বাড়ি না যেয়ে আমার বড়ো বোনের বাসায় চলে গেছ এবং আমার বিরুদ্ধে দুনিয়ার নালিশ করেছ।
আমার বোন তোমাকে যখন বুঝিয়ে আমার কাছে রেখে যেত, তখন তুমি নতুন করে আমার প্রেমে পড়তে। কী সব নতুন নিয়মের মধুর প্রেমে বাঁধতে আমাকে!
আজ কতো কথা মনে পড়ে, পাড়ার ইট বিছানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম রেল স্টেশনে। অকারণে ট্টেনের হইসেল শুনতাম প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে।
কিংবা পার্কের সেই ঘাসের কোণ্। কোনো কথা না বলে অহেতুক বসে থাকতাম সারা দুপুর। গেটে দাঁড়িয়ে ফুচকার দোকানে ফুচকা খেতাম। অসময়ে কোকিলের ডাক শুনেছি পার্কের বেঞ্চে বসে। আর ওদিকে মরা পাতা ঝরে পড়ত তোমার চুলের উপর।
মনে কী পড়ে বই মেলার কথা। প্রাঙ্গণে হাঁটতে হাঁটতে নিঃশ্বাস নিতে নতুন বইয়ের। স্টলে ঢুকে খুঁজেে খুঁজে বের করতে হুমায়ুন আহমেদের একজন মায়াবতী। জানো, আজ অনেকেই কোথাও নেই।
কেউ আর ডাকে না। মনে রাখেনি কেউ। তোমার মতো কেউ আর ভালোবাসে না। আজ এমন হয়েছে দিন, কারোরই কোনো দায়ভার নেই ভালোবাসার! যারা হাত ছেড়ে দিয়ে চলে যায় , তারা কেউ আার ফিরে আসে না।
৩৮. তোমাকে খুঁজি আমি—
স্বপ্নের ভিতর নয় স্মৃতি হাতড়িয়েও নয়
পুরনো শ্যাওলা পরা প্রাচীরের গায়ে তোমার নাম লেখা খুঁজি, যে নামটি আগাছায় ঢেকে গেছে।
বহুকাল আগের ছেঁড়া কবিতার খাতায় কেঁপে কেঁপে লেখা পঙক্তিমালায় তোমার রূপ লাবণ্য খুঁজি,
খুঁজি উদ্বেগ হয়ে অ্যালবামে রাখা ধুসর মলিন তোমার সাদাকালো ছবি।
এই শহর দিনে দিনে অচেনা হয়ে যায়, চেনা নদী দূরে সরে যায়
অপরাহ্ণ বেলায় অকাল সন্ধ্যা নেমে আসে, অসময়ে দুচোখ ভরে ঘুম চলে আসে।
কেউই ফিরিয়ে দিতে পারেনা আর ভোরের আকাশ
নিঝুম দুপুরের বিমুগ্ধ কথকতা
নিশুতি রাতের সুখ প্রণয় কথা,
ক্লান্ত অবসাদে জড়িয়ে ধরা সেই অনিঃশেষ শান্তি।
রাত্রির মধ্যাহ্নে ঘুম ভেঙে যায়, জেগে দেখি প্রিয় মুখ,
মায়া করা সেই চোখ, সেই আনত চেয়ে থাকা,
শহরের রুক্ষ বৃক্ষরাজি বলে- সেই ছায়া-মায়া তুমি
আজ পাইবে কোথায়?
আমার জাগরণে, আমার চৈতন্যে দূর বহুদূর থেকে পায়েলের শব্দ শুনতে পাই, সন্তর্পণে তুমি হেঁটে আসো,
যাকে দেখি– সে তোমাকে চিনিতে পারি না যে!
যারে খুঁজি দেখিতে আমি পাই না তারে!
৩৯. রাগ মধুবন্তী
যে রাত গানের হবে সে রাতে কোনো ক্রন্দন করো না
হাহাকারও করো না, প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখ,
যদি তারার আকাশে হঠাৎ তারা নিভে যায়।
পাখিরা পালক ঝরে ফেলে যায়,
তুমিও খুলে ফেলো রাত্রিবসন, যেমন করে মেঘ সরে যায় চাঁদের উপর থেকে।
কান থেকে ঝুমকা খুলে যায় ঝনঝন করে,
খোপা থেকে খুলে পড়ে চুলের কাঁটা, এলমেল চুল এসে ঢেকে দেয় তোমার কাজল ফোঁটা, কাঁকন বাজে হাতে, কাঁচের চুড়ি ভেঙে যায়, পুড়ে যায় গতরের সুগন্ধী।
ভেষজ সুবাস ভেসে আসে দূর্বার গন্ধের মতো,
কোন্ নদীর স্রোত ছুঁয়ে বহে সমীরণ, ঘরেই তুমি হয়ে ওঠো রুপালি নদী।
বিষাক্ত বৃশ্চিক কামড় দেয় বারংবার,
নীল হয়ে যায় রাতের রং, ঝর্নার মতো ঝরে পড়ে সফেদ জল, জোছনা দ্যূতি ছড়ায় রত্নমঞ্জুষার মতো।
কত রাত্রি এমন ধ্রুপদী গান হয়, কত গান শুনি মধুবন্তী রাগে, কত সুর বাজে, কত সুর থেমে যায়।
৪০. ঐ চাঁদ ঐ জোছনা
তুমি কি অফিসে যাবার সময় প্রিয় মানুষটিকে চুমু খেয়ে বের হও?
তাকে বুকে জড়িয়ে ধরো ?
একাকী দুপুরে সে খেয়েছে কী না? খোঁজ নাও?
তুমি কী ভাবো? ঘরে আর তুমি ফিরে নাও আসতে পারো।
বিকালবেলা বাসায় এসে তুমি কি হাটঁতে বের হও তাকে নিয়ে?
সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করো কি, খোলা দিগন্তে কমলা রঙের অস্তগামী সূর্য দেখতে?
তুমি কী ভাবো? এইটি তোমার শেষ সন্ধ্যা হতে পারে।
রাতের নির্জনে তুমি কতটুকু কাছে টেনে নাও তাকে?
কতটুকু ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে পারো নিজেকে খালি করে?
তুমি কী জানো? আজকের এই রাতে —
ঐ চাঁদ, ঐ জোছনা শেষ কিরণে ভিজিয়ে দিতে পারে তোমাকে!
৪১. নদীতমা
যদি একদিন কোনো পাথুরে রাস্তায় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি নামে, ভিজবে পথের পাশের অতসী ফুল,
ভিজবে সোনালের ঝাড়, ভিজবে শালিক ও লাবণ্য দোয়েল।
কোনো বসন্ত পূর্ণিমা রাতে
যদি জ্যোৎস্নায় ভিজে শাল পিয়ালের বন,
যদি দিগন্তে ভাসে পলাশ শিমুলের গন্ধ
যদি উতলা হয় দখিনা বাতাস।
যদি কোনো হেমন্ত সন্ধ্যায়
পথ চলতে চলতে পথ হারিয়ে ফেলো পথে
কোনো দিশা খুঁজে আর না পাও
কোনো অচেনা পথিক যদি তোমার হাত ধরে
তুমি কী কুঞ্চিত করবে তোমার চোখ?
চৈত্রের রোদে পুড়ে চলে যাবো ভূবনডাঙ্গার মাঠে,
তুমি কী আসবে সেখানে?
তোমার খোঁপা খুলে সারা চুলে রোদ্র মেখে দেব
নিয়ে যাবো যমুনা কূলে সেখানেই তুমি আমার নদীতমা হবে।
৪২. সুন্দর চোখ
কোনো কোঁকড়া চুলের মেয়েকে চুল খুলে রাখতে দেখলে মনে হয়, ও কেন চুল বেঁধে রাখে না,
কেমন কাকের বাসার মতো মাথার চুল!
ঐ কালো মেয়েটি
কেমন গাঢ় রঙের শাড়ি পরে থাকে
ও কেন হালকা নীল রঙের শাড়ি পরে থাকেনা,
কেমন কিম্ভূত ওর কৃষ্ণ কালো শরীর!
আর ঐ মেয়েটি অরক্ষণীয়া,
যত ছেলে দেখতে আসে বিয়ে হয়না তার
মেয়েটির পায়ে আলতা পরা হয় না
হাতে মেহেদি দেয়া হয় না, কপালে দেয় না টিপ!
আচ্ছা যদি এমন হয়,
ঐ কোঁকড়া চুলের মেয়েটিকে বনলতা সেনের মতো অসাধারণ লাগছে!
ওই শ্যামলা মেয়েটাকে গাঢ় শাড়িতে মোহময়ী
লাগছে!
আর ঐ অরক্ষণীয়া মেয়েটিকে কোনো এক রাজপুত্র এসে ‘রাজরানী’ করে ঘরে তুলে নিয়ে গেছে।
চাই শুধু দেখার জন্য সুন্দর চোখ!
৪৩. ফেরা
একবার এক অস্তরাগের সন্ধ্যাবেলায় খুব কাছে থেকে সন্ধ্যা মালতী ফুলের গন্ধ নিয়েছিলাম
তারপর কত সন্ধ্যা অন্ধকারে ডুবে গেছে
আর কোনো সন্ধ্যা মালতীর গন্ধ নেওয়া হয়নি।
আর একদিন এক চন্দ্রালোকিত রাত্রি দুপুরে
জোছনা ভেজা কামিনীর সুবাস গায়ে মেখেছিলাম,
তারপর কত জোছনা বুভুক্ষু রাত্রি চলে গেছে
আর কোনো কামিনীকে ছুঁয়ে দেখা হয়নি।
তারও বহুদিন পরে এক অষ্টাদশীর মাথা ভর্তি কালো কুন্তলের গন্ধ নিয়েছিলাম,
আর একবার কুড়ি বয়সের এক রমণীর বুকের গন্ধ নিয়েছিলাম হেমন্ত গোধূলির ধূসরে ,
অষ্টাদশীর চুলের গন্ধ আর সেই রমণীর বুকের গন্ধের সাথে,
সন্ধ্যা মালতী ও কামিনী ফুলের গন্ধের কোনো পার্থক্য খুঁজে পাইনি।
পথ চলতে চলতে একবার পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম,
চেনা সেই পথ দিয়ে আর বাড়ি ফেরা হয়নি…
ক্লান্ত পথিকের মতো পথের মধ্যে একাকী বসে থেকেছি বহুদিন,
আর একবার আমার মানিব্যাগটা হারিয়ে ফেলেছিলাম
সেই ব্যাগে ছিল প্রেমিকার পুরোনো চিঠি,
একথা শুনে সেই প্রেমিকা চিরতরে মুখ ফিরিয়ে যে চলে গেল, তারপর সে আর ফিরে আসেনি।
এখন প্রায়ই পাতা ঝরা দেখি
কোথাও কেউ নেই আর, কখন কোন্ সন্ধ্যাবেলায় সন্ধ্যা মালতী ফুটে থাকে অগোচরে ,
কোথায় বর্ষারাতে কামিনী তার গন্ধ বিলায় ঝিরিঝিরি, অষ্টাদশী সেই মেয়েটি কার ঘরের বউ এখন?
আর সেই কুড়ি রমণী এখন কী বিগত যৌবনা! কে তার খবর রাখে!
কত প্রতিক্ষার মৃত্যু হলো, পথ চেয়ে চেয়ে কত বসন্তকাল চলে গেল
কোনও পথ দিয়েই সেই অভিমানীরা আর ফিরে এল না।
৪৪. কুসুম
তোমাকে যেদিন আমার ঘরে আনলাম
আমার নির্জন আঁধার ঘরে জ্যোৎস্না ঝরালে তুমি
অনন্ত দীপ্ত এক প্রদীপ শিখা জ্বলে উঠল যেন।
কতকাল দেখিনি আমি এমন উতল-জ্যোৎস্না
কতরাত্রি বন্দী ছিলাম এমনই এক বদ্ধ গুহায়
সেই তুমি প্রদীপ জ্বালিয়ে ধরলে আঁধার সরাতে।
এলমেল এক তরুণকে ঘরমুখো করলে তুমি
স্বর্গ রচিলে তুমি, ঘরকে বানালে মায়াপুরী —
মুখের নেকাব সরিয়ে বললে, দেখো মায়াবতী।
বুকের ওড়না ছুঁয়ে বলেছিলে, এখানে তুমি গোলাপের
সুবাস পাবে, গন্ধ নেবে তোমার বুকে–
আমি ভুল করে দূর্বা ঘাসের নীচে খুঁজেছি রক্তকনক, আবার রক্ত কনককে ভেবেছি হেমলক।
কতখানি ভালোবাসলে মানুষ অমরতা পায়
অন্তরের অমৃত-কক্ষে অনন্তবার দেখা হয়
স্বর্গ থেকে উড়ে আসা তুমি সেই মন্দার-কুসুম
যে কুসুমটি চিরদিনের আমার হলো।
৪৫. যে চলে যায়
যে চলে যায় সে কোনো কারণ ছাড়াই চলে যায়
সন্ধ্যার দোলনচাঁপার রূপ সে দেখেনা, রাতের অপরূপ তারামন্ডল দেখেনা, নিঝুম রাত্রির স্বপ্নগুলো দেখে না।
যে চলে যায় সে আরক্ত সুন্দর ঠোঁট দেখে না, চোখের নীচে আদ্রতা দেখে না, হৃদয়ের ভিতর কমল গান্ধার দেখে না, বুকের মর্মরিত আলিঙ্গনের টান দেখে না।
যে যায় সে অকারণে মাদল বেজে হাওয়ায় ভেসে যায়, অচিন পাখির মতো নীলিমায় উড়ে যায়, ক্ষমা করার অসীম মন বোঝে না, অনিঃশেষ ভালোবাসা বেঝে না।
যে চলে যায় সে কোনো গুমরি গুমরি ক্রন্দনধ্বনি শোনে না, দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনেনা, ভোরের প্রার্থনা শোনে না, পিছুপিছু হেঁটে যাওয়ার পথচলা শোনে না।
যে চলে যায় সে ফতুর করে দিয়ে চলে যায়, পথে পথে অনাদর রেখে চলে যায়, শরীর সুধাগুলো কেড়ে নিয়ে যায়, ভালেবাসার অভিজ্ঞান দলিত করে চলে যায়।
যে চলে যায় সে স্বপ্নের ঘরটি ভেঙে দিয়ে চলে যায়, স্বার্থপরের মতো নিজের পাওনা বুঝে নিয়ে যায়, তঞ্চকের ন্যায় সে পিছনের দিকে ফিরেও তাকায় না।
৪৬. আমাদের মুহূর্তগুলি
আমি তোমাকে নিয়ে পাড়ি দিতে পারি দীর্ঘ রাস্তা
যেখানে গিয়ে দিগন্ত জুড়ে রংধনুর রঙ দেখতে পারো,
অথবা তুমি ধরতে পারো আমার হাত,
তোমাকে দিতে পারি দারুণ কিছু মুহূর্ত। যে মুহূর্তগুলো স্মৃতি হবে একদিন।
যখন এই শহরে ভীষণ রকম সবাই প্রেমে পড়বে
যখন উৎসবে মেতে উঠবে অর্ঘ্য দিতে সবাই,
তখন এই শহরের দেয়ালে দেয়ালে লিখব আমাদের নাম,
যেমন করে কৈশোরে এক বালিকার নাম লিখেছিলাম ডুমুর গাছের বাঁকলে।
শরীরের মুগ্ধতা নেব না, জলে নেমে জলক্রীড়া করব না,
একজন অপরজনের চুলের গন্ধ নেব কেবল,
কানে আটকে দেব রক্ত জবার পরাগ,
আর কপালে দেব অস্তরাগের সোনালি টিপ
শরীর ছুঁয়ে নয়, মুগ্ধ হব দেখে তোমার চোখের কালো কাজলে।
তোমাকে মনে পড়বে। তুমিও মনে করবে আমাকে, কীভাবে আমি তোমার দিকে তাকাতাম আর ধরতাম হাত। আমাদের সেই দারুন দারুন মুহূর্তগুলি দিয়ে যেতে পারি। যদি চলে যাই স্মৃতি পাবে। তোমার যেটা চাই, তুমি তাই নিও।
৪৭. আক্ষেপ
কোনো এক চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে, আকাশ থেকে নাকি ঘরের চালের উপরে টুপ টুপ করে সাদা মুক্তার মতো জোছনা ঝরে পড়বে, আমি সেই মুক্তাঝরা জোছনার রোশনি দেখতে পাব না।
কোনো এক বর্ষার দিনে, পৃথিবীর সমস্ত কদমফুল নাকি প্রেয়সীদের খোঁপায় ফুটে থাকবে, খোঁপায় ফুটে থাকা সেই ফুলের শোভা আমার দেখা হবে না।
কোনো এক শীতের রাতে, রাতভর বিসমিল্লা খাঁর সানাইয়ের সুরের মতো নাকি শিশির ঝরবে, আমার সেই শিশির ঝরা সানাইয়ের সুর কখনও শোনা
হবে না।
কোনো এক শরতে যমুনার চরে এমনভাবে কাশফুল ফুটে থাকবে, আকাশ আর নদী কাশফুলের রঙে একাকার হয়ে যাবে, সেই শ্বেত শুভ্র আকাশ আর নদী দেখা হবে না।
নিঝুম সন্ধ্যার শেষে রাত্রি নামবে চরাচরে , বেতস লতার ঝাড়ে নাকি লক্ষ লক্ষ জোনাকি জ্বলে উঠবে সেদিন , নীলাদ্রি হবে লোকালয় , আমি সেই নীল আলোয় ভরা জনপদ দেখতে পাব না।
এক বসন্তদিনে শিমুল পলাশের বনে নাকি লাল ফুলকির মতো আগুন জ্বলে উঠবে, আকাশ জুড়ে গাইবে গান খঞ্জনা পাখি, মুখর করা সেই গান আমার শোনা হবে না।
এক মেঘ বৃষ্টি রোদ্রের দিনে হঠাৎ ময়ূরাক্ষীর মতো রুপোলি জল ঝরে পড়বে উঠানের উপর , ভিজবে সেই জলে নবীন যুগলেরা, শীতল করা সেই জলে আমার ভেজা হবে না।
আমি থাকব না, আমার স্বপ্ন থাকবে না, দেখতেও
পাব না সেদিনের এইসব রূপ রং সৌন্দর্য, কিন্তু আমার আক্ষেপগুলি সকরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলবে পৃথিবীর বুকের উপর।
৪৮. আমার পূর্ণতা গুলি
লিখেছি রাতের কথা, জোনাকির কথা,
অরণ্যের কথা, উর্বর পলিমাটির কথা
নদী ও পাহাড়ের কথাও লিখেছি।
লিখেছি পূর্ণিমার কথা, ঝিলমিল তারার কথা
থৈ থৈ জ্যোৎস্নার কথা
অরুন্ধতি অত্রি কালপুরুষের কথাও লিখেছি।
লিখেছি দীপ জ্বেলে রাখা সন্ধ্যার কথা
পাখিদের নীড়ে ফিরে আসার কথা
দোলনচাঁপার সুবাস ঝরানোর কথাও লিখেছি।
লিখেছি কিন্নরীর কথা, ঘন মেঘের চুলের কথা,
কমলা রঙের ঠোঁটের কথা, চুম্বনের কথা,
মৃগ নাভির সুগন্ধির কথাও লিখেছি।
লিখেছি রমণীর কথা, তার শরীর বৃত্তের কথা
বালিকা থেকে নারী হয়ে ওঠার কথা
তার অভিসারিকা হয়ে ওঠার কথাও লিখেছি।
লিখেছি গানের কথা, কবিতার কথা
জ্যোতির্ময় এই চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্রের কথা,
ভালবাসার সব পূর্ণতার কথাগুলিও লিখেছি।
৪৯. তুমি ও নদী
বলেছিলাম আমি স্বর্গের দেবী দেখব,
তুমি তোমার মুখ দেখিয়ে বললে —
দেবী দেখ।
বলেছিলাম পূর্ণিমার চাঁদ দেখব,
তুমি ধবধবে শাড়ি পড়ে রাতের নিঝুমে
দাঁড়লে বারান্দায়,
বললে — পূর্ণিমার চাঁদ দেখ।
বলেছিলাম মেঘে ঢাকা তারা দেখতে ইচ্ছা করছে,
তুমি তোমার শাড়ির ভাঁজ সরিয়ে বললে —
দেখ মেঘে ঢাকা তারা।
বলেছিলাম কেমন করে শুনব জোনাকির গান,
তুমি তোমার হাতের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ তুলে বললে,
শোনো জোনাকিদের গান।
বলেছিলাম কেমন করে শিখর ছোঁব,
বললে স্মিত স্পর্শ রাখো আঙ্গুলে —
গিরিপথ খুঁজে পাবে।
বললাম — নদী?
বললে ঐ গিরিপথ ধরেই হাঁটতে থাকো,
দেখতে পাবে নদী।
বলেছিলাম কিভাবে তোমাতে নিমগ্ন হবো,
তুমি তোমার নদীর জল দেখিয়ে বললে —
এখানে এসে ডুব দাও,
দেখবে কেমন করে নিমগ্ন হয়েছ।
৫০.. চেতনার ওপারে
একদিন পবিত্র কোনও সকালে চলে যাব এই জনপদ শূন্য করে,
চিরকালের পথগুলি তখন হয়ে থাকবে নীরব,
যে পথে ধ্বনিত হবে না আর আমার পায়ের শব্দ।
কোনও নদী বা সাগর তীরের
বা পাহাড়ের পাশের কোনও শান্ত লোকালয় থেকে
প্রিয়জনরা আসবে সেই পবিত্র সকালে
কেউ আর রবে না বলার
কেন আমি শুন্য করে চলে যাচ্ছি, সব ক্রন্দনধ্বনি স্তব্ধ করে, যে কখনও ফিরবে না আর।
বৃক্ষ শাখা থাকবে, বনের মাধবীলতা জড়িয়ে থাকবে,
নিস্তব্ধতার প্রতিমূর্তি তখন আমি! বয়ে নিয়ে যাব তোমাদের ভালোবাসা চেতনার ওপারে, অনন্তের যত কথা হিম-শীতল করে।
এই বংশ পরম্পরা নিঃশেষ হয়ে যাবে একদিন —
আমি রয়ে যাব তখন মানুষের বেদনার মাঝে,
স্পন্দিত হবে আমার আত্মা অন্য কোনও শিশুর বুকে।
৫১. মনখারাপের কারণ তুমি
মেঘ ঝর ঝর বৃষ্টি , বৃষ্টি ভেজা রোদ্দুর, রংধনু
আছে কী নেই, এইসব কোনো মনখারাপ করে না, মনখারাপ করে দাও তুমি।
তুমি আসো বা না আসো, তোমাকে পাই বা না পাই
ভালো বাসো আর না বাসো, এই সবের আক্ষেপ না আক্ষেপের যত কারণ হচ্ছ তুমি।
শিউলি ফুলের রেণুর গন্ধের জন্য না
স্নানের পর ভেজা চুলের সুবাসের জন্য না
রুপালি কোনো জলের জন্য না
শরীরের কোনো গোপন ঝিনুকের জন্য না,
আমার সকল মনখারাপের কারণ হচ্ছ তুমি।
রাতবিরেতে জ্যোৎস্না তলায় একাকী হাঁটি
নির্জন সেই পথ, ঘুম আসে না
ঘুমের বাইরে, স্বপ্নের বাইরে কাউকে খুঁজি না।
অন্য কাউকে চাইও না,পাইও না, জীবনের মর্মমূলে তুমি, তোমার জন্যই আমার যত মনখারাপ।
৫২. হে পুণ্যশীলা
কতটা কালনাগের ছোবল দিলে শরীরের
শ্বেত কমলের পাপড়িগুলো নীল হয়ে ওঠে
শাড়ির রং বদলে যায় ঘাম জলে।
কপাট খুললেই প্রথম উদ্ভিদ প্রান্তর, মুগ্ধতার নজর
পড়ে উচ্ছ্বসিত লতাগুল্মে
রুপালি জল গড়িয়ে পড়ে তরঙ্গায়িত নদী থেকে।
তুমি লজ্জাস্পর্শে সাঁতরাতে থাক ঈর্ষার জলে
প্রতিটি ডুবে হারিয়ে ফেল পরিধেয় অলঙ্কার
অবলীলায় নিরাভরণ হয়ে যাও।
আমি তোমার অস্তনদীর জলে নেমে অবগাহন
করি তখন, শুদ্ধ করি পাপ,
পূণ্যবাণ হয়ে উঠি পূণ্য জলে, হে পূণ্যশীলা।।
৫৩. স্বৈরিণী
স্বৈরিণী, আমি তোর চোখের মধ্যে বসবাস করি,
এ কথা আমার সকল ছন্নছাড়া কবিতার শরীরে লেখা আছে।
আমি জেনে গিয়েছিলাম তা নিশ্চল সন্ধ্যা রাত্রিতে সপ্তপর্ণী পাতা ছিঁড়তে গিয়ে !
তুই পাশেই পড়ে থেকেছিলি কালিদাসের নায়িকা শকুন্তলার মতো।
তখন কুমারসম্ভব উপাখ্যানের পাতা ছিন্নভিন্ন হয়েছিল, তখন শীতঘুম ভেঙ্গে পড়ছিল দুচোখে,
কী যে আশ্চর্য ছিল সেই রাতের সব প্রেমকাহিনী।
স্বৈরিণী, তোর চোখে কি কোনও হাওয়া রাতের দোল খেলেনা? উন্মত্ত হাওয়ার মেঘ কী আদর করে কাছে টানে না তোকে?
স্বৈরিণী, তুই আর একবার আয়,
তুই এলেই গল্প হবে বৃষ্টি হবে শিউলি ফুল ফুটবে। খুনসুটি হবে রিমঝিম শিশির মাখা আদরে।
৫৪. শুধু একবার
তুমি শুধু একবার খুলে দাও হৃদয়ের কপাট
এই উচ্ছল যুবকের সামনে, বন্ধ করোনা দরজা
একবার খুলে ফেলো লজ্জার অবগুন্ঠণ।
তোমাকে দেখাব কিভাবে ভালোবাসতে হয়
সব তছনছ করে, সব ভেঙ্গেচুরে গড়তে হয় শরীরশিল্প
হৃদয় ভাঙ্গতে হয় হৃদয়ের গহীনে যেয়ে।
আমি হাঁটু মুড়ে দু’হাতে পেতে চাই স্বর্ণরেণুর স্পর্শ
ভুলে যাওয়া ঢের ভাল স্মৃতি কাতর যন্ত্রণা
তুমি এই উন্মূল যুবকের বুকে মাথা রাখো
তোমার সব মণিকাঞ্চন বিলিয়ে দাও নিভৃতে।
তোমাকে পেতে চাই জলের মতো, নদীর মতো,
নুড়ি পাথর গড়িয়ে পড়ার ঝনঝন শব্দের মতো,
স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার শিহরণের মতো —
অন্তহীন স্পর্শে জেগে উঠুক আমার প্রাণ।
৫৫. সুজাতা সান্যাল
কালিগঙ্গার বাঁকে সেদিন সন্ধ্যায় উঠেছিল চাঁদ
তারায় তারায় ভরে গিয়েছিল হেমন্তের রাত
রঙিন জোনাকীদের মতো ব্রণে ভরা তার গাল
‘ভালোবাসি’ এই কথাটি বলেনি সুজাতা সান্যাল।
সন্ধ্যার সন্নাসীকে কেউ ভালোবাসে না কি
বু্নো হাঁসদের কোনও ঘর আছে নাকি ?
আমারও ঘর নেই চুলো নেই, নেই কোনও চাল
এ কথাটি জেনে গিয়েছিল সুজাতা সান্যাল।
কালিগঙ্গার জলে ভাসিয়েছিলাম ডিঙ্গি নাও
অন্ধকারে বলেছিলাম ওকে — এসো প্রেম দাও
গাল ভরা হাসি দিয়ে বলেছিল- ‘দেখা করব কাল’
তারপর কোনদিন আসেনি সুজাতা সান্যাল।
৫৬. কথা ছিল
কথা ছিল —
আমাদের ভালোবাসার কথা কবিতায় বলা হবে না
যমুনার চরে কাশবনে পেতেছিলাম শয্যা
ডিঙি ভাসিয়ে সারারাত ভেসেছিলাম জলে
আঁধার বিদীর্ণ করে জোনাকিরা জ্বেলেছিল আলো
কথা ছিল —
সেই জোনাক জ্বলা রাতের কথা কবিতায় বলা হবে না।
স্বপ্নভূক চাঁদ ডুবেছিল মেঘে,
লুব্ধক হারিয়েছিল নৈঋতে
আমরা হারিয়েছিলাম অন্ধকারে
গাঙচিল, গাঙচষা, বু্ঁনো হাঁস দিয়েছিল পাহাড়া
ভালোবাসায় শরীর ভেঙেছি, আশ্লেষে আর
শীৎকারে কেঁপেছিল হৃদয়।
কথা ছিলো —
আমাদের সেই ভাঙনের কথা কবিতায় বলা হবে না।
৫৭. সমর্পণ
মেয়েটি বলল, আমি তোমার পাখি হবো।
আমি বললাম, হও।
আমিও বেঁধে রেখেছি বাসা চলে এসো,
নীলিমায় ডানা মেলে উড়ে বেড়াব।
মেয়েটি বলল, আমি বৃষ্টি হবো তোমার।
আমি বললাম, হও।
আমিও মেঘ জমিয়ে রেখেছি তোমার জন্য,
জল হয়ে ঝরে পড়ব পৃথিবীর উপরে ।
মেয়েটি বলল, আমি তোমার নদী হবো।
আমি বললাম, হও।
আমিও ঝর্নাধারা হবো তোমার জন্য
প্রবাহিত হবো দূরন্ত বেগে উত্তাল সাগরে।
মেয়েটি বলল, আমি পূর্ণিমার রাত হবো।
আমি বললাম, হও।
আমিও চাঁদ হবো আকাশের গায়ে
ভিজব সারারাত জ্যোৎস্নার প্লাবনে।
মেয়েটি বলল, আমাকে সমর্পণ করো
আমি বললাম, করব —
আমার যত প্রেমে, আমার যত অপ্রেমে।
৫৮. পরিপূর্ণা
কী নেবে তুমি? কী নেবার আছে?
কী দেবার আছে তোমার?
দেহ মাংস করোটি পোড়ে প্রাগৈতিহাসিক অনলে।
তোমার নখ দাঁত চুল শাড়ি পোড়ে
তুমি ক্রমাগত শুচি হও, শুদ্ধ হও
তুমি তৈরি করো অনাগত শিশু, নাড়িতে, ভ্রুণে।
আর কি কুশলতা আছে বলো?
তোমার আঁচল উড়ে ঢেকে দেয় কুন্দফুল
চারিদিকে কীর্ণ মৌমাছি গুণগুণ করে।
আমিই ছিলাম তোমার গর্ভধারণের কুশিলব
এই যে প্রেম, এই যে প্রজন্ম অভিজ্ঞান,
তা সবকিছু নিয়েছ আমার থেকে, আর তুমি হয়ে উঠেছ তাই পরিপূর্ণ রমণী।
৫৯. কোনো গল্প নেই
একদিন এক বর্ষারাত্রে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হাওয়ার রাত দেখছিলাম। বাইরে তখন বৃষ্টি ঝরছিল অঝোর ধারায়। অন্তরের গহীনে কী এক অনন্ত দুঃখ রিমঝিম করে বাজছিল। আমি দুহাত বাড়িয়ে জলে ভিজাচ্ছিলাম হাত। হঠাাৎ বুক কেমন যেন ব্যথিয়ে ওঠে। মনে পড়ে এক নিঃসঙ্গ দুপুরে একটি গল্প লেখার কথা। গল্পটি যার জীবনের, সে চায়নি গল্পটি কেউ জানুক। সে চেয়েছিল কথাগুুুলো লুুকিয়ে থাক্ তারই বুুুকের তলায়। কিন্তুু কথাগুলো জেনে গিয়েছিল আকাশের তারা। দখিনা বাতাস। নদীর দুুকুল আর জোছনা বিহবল রাত্রি।
অঞ্জলিতে জল ভরতে যেয়ে সেই গল্পের কথাই মনে হচ্ছিল।
কর্মশেষে ঘরে এসে যার সঙ্গে কথা বলি, তার মায়াময় মুুখের স্নিগ্ধতায় কেটে যায় ক্লান্তি। তার মধ্যেই আমার অফুরান শান্তি খুুঁঁজে পাাই। সেই আমার একটিমাত্র আশ্রিত নীড় যেন। কূলহারা নাবিক হঠাৎ যেমন খুঁজে পায় কূল।
আসলে কোনো গল্প নেই। তার সাথেই সব প্রাণ কথা।
তার সাথেই গল্প বলি বনমল্লিকার গন্ধ নিয়ে বৃষ্টিস্নাত রাত্রির অন্ধকারে।
৬০. গোলাপ ফোটান দিন
আজ তোমার গোলাপ ফোটানোর দিন
জুঁই চামেলীর তোড়া নিয়ে আজ তোমার
অপেক্ষা করার দিন —
আমি জানি তুমি এখন আছো বিবর্তনে
জানি আজ তুমি অসময়ে রক্ত জবা ফুটিয়ে রেখেছ।
ভ্রু কুঁচকে যখন তুমি পাশে এসে দাঁড়াও
আমি তখন ভালোবাসার কোনপ ব্যাকরণ মানি না
সনদ মানি না ধর্মের কিংবা জাতিসংঘের,
তাই তো আমি রাতভর সুবাস ছড়িয়ে বসে থাকি
এই ক্যামেলিয়ার বাগানে।
তখন অপার্থিব এক ভালোবাসায় ভরে ওঠে
দেহ মন জানালা —
শুনি তার কাছে আসার গান পথে পথে
সারা রাত্রিতে কামিনী কুন্তলের ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য
আমি মাতোয়ারা হয়ে থাকি।
চাই ঘৃণা , চাই অমরতা —
হেমলক পান করতে হলে তাই করব পান,
তা গন্দম হোক, তবুও চাই, অমৃত সুরলহরীতে বাজুক
গোলাপ ফোটান দিনে আমাদের আনন্দ সঙ্গীত।
৬১. বিবর্ণ এলিজি
তুমি যখন হেঁটে হেঁটে চলে আসলে
জ্যোৎস্না ঝরে পড়েছিল তার চারপাশ
চোখে তোমার স্বপ্ন ছিল
দখিনা বাতাস দোল দিয়েছিল
ভেসে গিয়েছিল তোমার সকল সৌন্দর্য ।
হঠাৎ আবার কালরাতে উতাল হলো বাতাস
তারায় ভরলো আকাশ
চোখ ভরা তোমার কাজল আঁকা ছিল
ভ্রু যুগলে কার নিমন্ত্রণ ছিল
পায়ে তোমার নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ ছিল
সেজেছিলে কি তুমি অকারণে?
কলঙ্কহীন ভাবেই কাটালে তোমার সকল বেলা
তোমার সারারাত
হৃদয় উন্মুক্ত হয়নি,শরীর চায়নি শরীর
আমার সঙ্গে কেউ হাঁটেনি কোনও কক্ষ পথে।
বিবর্ণ এলিজিগুলি তাই ফিরে আসে অবশেষে
না ফেরার সকল প্রতিশ্রুতি ভুলে,
তারপরও ভালোবাসা বেঁচে থাকে, এই পৃথিবীর পথে প্রান্তরে।
৬২. কণিকা
ঐ মেয়ে আমার কেউ নয়, ওকে আমি দেখেছিলাম
দিনাজপুর থেকে পঞ্চগড় যেতে মধ্যরাতের ট্রেনে
ঐ মেয়ে আমার কেউ নয়,
সাঁওতালী রক্ত ওর শরীরে।
মুক্তাও কালো হয়, তেমনই কালো ছিল সে
সাপের মতো বেণী গড়িয়ে পড়েছিল ওর পিঠে
রুপোর মতো দাঁতগুলো ঝলমল করছিল অন্ধকারে।
স্বপ্নভূক যুবক আমি,
স্বপ্নে থাকে আমার বাঙ্গালি রমণী
ওর চোখ কৃষ্ণ কালো, কুঞ্চিত ভ্রু-যুগল
পাশ থেকে ওদের একজন ওকে ডাক দেয় — কণিকা।
বুকে ওর উপত্যাকার ঢাল, স্বপ্ন জোনাকীরা
আলো ছড়ায় শরীরে,
কণিকা আমার কিছু হবে না কোনোদিন
ও তো অন্য কোনো সাঁওতাল যুবকের।
আস্চর্য কোমল গান্ধার বুক, অনাবৃত মায়াবী নাভি
কণিকার অতলান্তে ডুবে যাবার আহবান আমার নয়–
প্রাচীন অনার্য আমি, সে যাত্রায় ওকে আমি ছু্ঁয়েও দেখিনি।
৬৩. মনে রেখ না
জীবনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে দুঃখ খেদ
হে আমার অনন্ত শৈশব
আমার হেমন্ত বিকেল
ধানক্ষেতের মৃন্ময়ী গন্ধ
তোমরা আমাকে মনে রেখ না।
প্রেম লুকিয়ে থাকে প্রেমিকার হৃদয় গহ্বরে
হে আমার জগৎ বিধ্বংসী বিষাদ রমণী
আমার আকাংখার মৃত্যু
অস্বাদিত কামনার ছন্দ
তোমরা আমাকে মনে রেখ না।
যাতনা লুকিয়ে থাকে চোখের অশ্রু তলে
হে আমার দুঃস্বপ্নের রাত্রি
আমার নির্ঘুম চোখের তারা
অনাদরের সকল চুম্বন স্শর্শ
তোমরা আমাকে মনে রেখ না।
মৃত্যু লুকিয়ে থাকে স্পন্দনহীন আত্মার ভিতরে
হে আমার স্বপ্ন সৌধে গড়া তাজমহল
আমার স্বপ্ন ভঙ্গের দীর্ঘশ্বাস
অপ্রেমের যত গ্লানি, নিঃসৃত বেদনা
তোমরা আমাকে মনে রেখ না।
৬৪. যে অনলে পুড়ি
তখন উত্তরের বাতাস ঝিলমিল বেগে ছুটে আসছিল
ঝাউ ঝোপের আড়ালে উড়ছিল তোমার মাথার চুল,
ওখানে ছিল পাগলভূক এক জোৎস্নার রাত্রি,
তখন আলো জ্বালাচ্ছিল দলবদ্ধ জোনাকিরা —
দূরে চেয়ে দেখ মহুয়ার বন,
এই রাত্রিতে চলো ঐ বনেই যাই।
আমরা তখন মহুয়া বনে।
তুমি তাকালে অন্ধকারের দিকে, অবসন্ন দ্বিধাহীন , আঁধারের ক্লান্তি জড়ানো—
মুখের উপর বিচ্ছুরিত হচ্ছিল নক্ষত্রের আলো
আকাশ আর মাটিকে মমতায় কাছের করে নিলে
বনের আড়ালে সমস্ত ক্ষণগুলো ঝলমল করে উঠল যেন।
তোমার উচ্ছ্বসিত দেহখানি কাঁপছিল
মুখ ঝিকমিক করছিল, কটির কিঙ্কিনী রুমঝুম শব্দে বাজছিল মৃদঙ্গের মতো,
তোমার নাভি বৃত্তে আঁকা ছিল পদ্মরাগমণির সুরভিত কারুকার্য
মনে হয়েছিল তুমি আনন্দিতা এক মায়াবতী।
আমি হাত বাড়িয়ে দেই, দশ আঙুলে
তোমার সকল মনিরত্নম ধরতেই পুড়ে খাক হয়ে যাই। তুমি বললে — ধরেছ অনল।
আমি এতদিন পুড়েছি, এখন তুমি পোড়ো।
৬৫. পরপ্রিয়
সে আমার কেউ না, তারপরও এত ভালোবাসা
সে কেন দিয়েছিল?
সে নেই, তার প্রেম পড়ে আছে, স্পর্শ আছে,
অসতর্ক সেই ছোঁয়া এখনও ছুঁয়ে আছে।
এই মায়ার টান কোনো প্রেম নয়
সে যে কেউ নয়,
এ মনে, এ শরীরে, কোনো কালিমা খুঁজি না।
ভালোবাসা কোনো ভ্রম হতে পারে না
মুহূর্তের কোনো স্বপ্ন দেখাও না।
কী যে সত্যি, কী যে মিথ্যা, তাও বুঝি না —
সে কী তন্ময়তার ছিল, নাকি স্বপ্নের কেউ,
না কি ক্ষণিকা।
সে যে নেই, কী যেন নেই,
কিন্তূ তার স্পর্শ এখনও লেগে আছে।
৬৬. কল্যাণীয়াসু
একদিন তুমি আক্ষেপ করে বলেছিলে – ‘তুমি কবিতাকে নিয়ে জড়িয়ে থাকো সারাক্ষণ। আমাকে জড়িয়ে ধরবার তোমার সময় নেই।’
আমি বলছিলাম —
আমার আনন্দকে তোমাকে দিয়েছি, আমার কান্নাও তোমাকে ছুঁয়েছে, তবুও তুমি কেন অভিমানী হও।
তোমার ভিতর আমার আত্মা ঢুকে আছে, চোখে স্বপ্ন এঁকে দিয়েছি, তুমি কল্যাণীয়াসু ।
সমুদ্রের কাছে গিয়ে জলের সাথে কথা বলেছি
পাহাড়ের কাছে গিয়ে ঝর্নার গান শুনেছি
অরণ্যের কাছে গিয়ে বৃক্ষের কাছে নত হয়েছি
আকাশের দিকে চেয়ে অসীম নীল দেখে বলেছি –
তুমি করুণাময়ী ।
চৈত্রের রোদ্রতাপে তামাটে করেছি শরীর
আষাঢ় শ্রাবণে কত বৃষ্টি ঝরেছে মাথার উপরে ,
আমি পুড়েছি আর ভিজেছি, তবুও তোমাকে
প্রসন্ন রাখতে চেয়েছি।
আমি জল থেকে নিয়েছি তোমার শীতল ছোঁয়া
রোদ্দুর থেকে নিয়েছি তোমার উষ্ণতা
পথে চলতে চলতে জারুল ফুলের গন্ধ নিয়ে
ফুসফুসকে রেখেছি সতেজ,
মন প্রফুল্ল করেছি– বাসনা শুধু তোমাকে যেন নির্মল ভালোবাসা দিতে পারি।
লক্ষ লক্ষ তারার মাঝে রাখতে চেয়েছি তোমাকে,
নদীর জলতরঙ্গে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছি শত শত নীলকমল, এইসব অনুসঙ্গের ভিতর তোমাকে আমার একান্ত করে নিতে চেয়েছি – কারণ,
তুমি যে আমার কল্যাণীয়াসু।
Leave a Reply