আমি লিলি – লিলি চক্রবর্তী
সম্পাদনা – দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, অময় দেব রায়
সপ্তর্ষি প্রকাশন
প্রথম সংস্করণ জানুয়ারি ২০২০
প্রচ্ছদ ইভনিং সাগা
প্রকাশক স্বাতী রায়চৌধুরী
উৎসর্গ
আমার মা
দীপালী চক্রবর্তী-কে
২০১৫। এপ্রিল মাস। আমরা দু’জন সেদিন বাংলা আকাদেমিতে। কোন এক অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে হঠাৎ কথায় কথায় উঠে এলো তাঁর প্রসঙ্গ। গত শতাব্দীর ছয়ের দশক থেকে আজও সমানতালে মঞ্চ ও সেলুলয়েড কাঁপানো অভিনেত্রীর কথা। যিনি বাংলা চলচ্চিত্রের এক দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী, যার ঝুলিতে অজস্র মণিমুক্তো, তিনি কেন এত অবহেলিত? কেন এত আন্ডাররেটেড? মুর্হূতে সিদ্ধান্ত নিলাম, বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের স্বার্থে এ অনুসন্ধান অবশ্য প্রয়োজনীয়। শুরু হল প্রস্তুতি। অল্প সময়ের মধ্যেই জোগাড় হল নম্বর। ভয়ে ভয়ে ফোনটা করেই ফেললাম। তিনি কি রাজি হবেন কথা বলতে? কি জানি কি বলে বসবেন? কিন্তু না, আমাদের প্রস্তাব শুনে কিছুটা অবাক তিনি! কিছুটা যেন সংশয়! তবে স্বরে এক অদ্ভুত আন্তরিকতায় বললেন ”হঠাৎ আমি কেন? আচ্ছা বেশ এসো একদিন! গল্প করা যাবে’। সেই শুরু হল যাত্রা।
২
দমদম।
৪৪০/এ, মতিঝিল অ্যাভিনিউ।
নিবেদিতা অ্যাপার্টমেন্টের চারতলায় ফ্ল্যাটে জানলা চুঁইয়ে জল টলটলে ঝিল। গ্রীষ্মের ক্লান্ত দুপুরে সেই ঝিলের দিকে চেয়েই কী আরও গভীর, নিহিত কোন সম্ভাবনার কথা ভাবেন তিনি?
আমাদের পেছন দিকে তখন ঝিল আর আমরা মুখোমুখি বসে আছি বাংলা চলচ্চিত্রের, এমনকি সমবয়সের বাংলা সিরিয়ালের ব্যস্ত অভিনেত্রীর সামনে।
তিনি স্লিভলেস ঘর-পোষাকে। হাতে পাতলা এক গাছা চুড়ি। গলায় সোনার চেন আর মোটা কাচের আড়ালে জিজ্ঞাসু অথচ প্রত্যয়ী চোখ নিয়ে কথা শুরু করলেন।
তিনি লিলি চক্রবর্তী। তাঁর কথায় উত্তমকুমার থেকে অমিতাভ বচ্চন, গুলজার থেকে সত্যজিৎ রায় কিংবা এ-সময়ের সোহম, সৃজিত, কৌশিকের স্মৃতি ঝোঁপে আসে ঘর ভরে। ওদিকে সুচিত্রা থেকে সুপ্রিয়া, সন্ধ্যা রায় কিংবা ওয়াহিদা রহমানরা তাঁর স্বরের সোপানে নিবিড় আত্মীয়তা তৈরি করে নেয়, গ্রীষ্মের সব ক্লান্তি ঝেড়ে দিয়ে। বাগবাজারের বিরাট বাড়ি, গাড়ি, জেগে থাকা আশেপাশের মানুষজন ছেড়ে এখন কেমন আছেন তিনি? তাঁরই খোঁজে পৌঁছে গেলাম নিবেদিতা অ্যাপার্টমেন্টে। বলতে শুরু করলেন তিনি।
”এখন যাঁদের সঙ্গে অভিনয় করি, মূলত সিরিয়ালের সেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা শুটিং এর অবসরে বারবার জানতে চায় আমার ফেলে আসা কথা, আমার অতীত। রোজই প্রায় এজন্য সময় বের করতে হয় আমাকে। ওরা বলে সেসব কথা লিখতে। ওদের বলি— কী আর এমন জীবন যে লিখতে হবে! আমি তো অসাধারণ কেউ নই। শৈশবের দারিদ্র টেনে এনেছিল অভিনয়ে। এসে বুঝলাম, ওখানেই আমার শ্বাস-প্রশ্বাস বাঁধা। তারপর অনেক লড়াই, অনেক পাওয়া, অনেক না-পাওয়া— তোমরা এই অতি সাধারণ কথাগুলো লিখতে চাও ভেবে ভালো লাগছে।”
এ-কথা শেষ করতেই সেই জ্যৈষ্ঠ মধ্যাহ্নে শিশুর মতো সারল্যে একটা প্রশ্ন করে বসেছিলেন লিলি চক্রবর্তী— ”তোমাদের কত টাকা দিতে হবে?” চমকে উঠেছিলাম আমরা— ”না না, সেসব লাগবে না। আমরা আপনার কথা লিখবো। আপনারাই বয়ানে’।
২০১৫’র মে মাসের দ্বিতীয় রোববার শুরু হল তাঁর সঙ্গে আমাদের আলাপচারিতা। এই বয়সেও বড় ব্যস্ত তিনি। একের পর এক সিরিয়াল। কোনদিন কথা হয় একঘণ্টা, কোনওদিন আবার তারও কম। কথা চলতে থাকে, আর মাঝেমাঝে ঘরে আসেন তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত সুকুমার। তাঁরই পূর্ব নির্দেশ মত সুকুমারের হাতে কখনও থাকে ঠান্ডা পানীয়, কখনও গরম চায়ের কাপ। বলে চলেন তিনি। কোনো কোনো দিন শুটিং স্পটে ডেকে নেওয়ার কথাও বলেন, নিশ্চিত ভাবে ব্যর্থ হয় সে ডাক। বাড়িতে ডেকেও মাঝেমধ্যে বাধ্য হয়েই ফোন করেন আমাদের সেদিনটা ক্যানসেল করার জন্য। এভাবেই প্রায় চার-বছর নানাভাবে তাকে দেখতে দেখতে আমাদের চলা। তাঁর মেকআপহীন আটপৌরে সৌন্দর্য আজও মুগ্ধ করে। সব দূরত্ব সরিয়ে যখন স্নেহের স্বরে একের পর এক প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন, বোঝা যায় তিনি শুধু চলছেনই না, চলবেনও আরও দীর্ঘ দীর্ঘ পথ। তাঁর সঙ্গে যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল, বলেছিলেন— আজ এই বয়সে এসে মনে হয়, ঈশ্বর বোধহয় অভিনেত্রী হওয়ার জন্যই আমার জন্ম দিয়েছিলেন। আর গত চার-বছর ধরে তাঁর সঙ্গে চলতে চলতে মনে হয়েছে, এ-সময়ে তাঁর প্রজন্মের এত ব্যস্ত অভিনেত্রী সম্ভবত বাংলায় বিরল।
৩
নিয়তি তাড়িত হয়ে অভিনয়ে আসা আর সেখানেই খুঁজে পেলেন জীবনের স্বাদ। প্রতিভা নিয়ে জন্মান অনেকেই তবে নিয়মিত চর্চায় তাকে শান দিয়ে ক্ষুরধার করেন ক’জন? লিলি কিন্তু তাই করলেন। গল্পে গল্পে উঠে আসে, স্বামী অজিতের কড়া অনুশাসন আর রুটিনে বাঁধা পড়েছিল লিলির জীবন। রোজ ভোর চারটেয় ঘুম থেকে ওঠা। উঠেই ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ। গলা ঠিক রাখতে হারমোনিয়াম নিয়ে রেওয়াজ। শরীর ঠিক রাখতে রোজ একটা করে ডিমের কুসুম সঙ্গে এক চামচ ব্র্যান্ডি। পাশাপাশি ছিল নাটকের এক্সপিরিয়েন্স। ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্র, জহর রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিচিত্র প্রতিভার নিয়মিত সান্নিধ্য। যা চিরকাল লিলিকে বাড়তি অক্সিজেন জুগিয়েছে।স্বতন্ত্র করেছে বাকিদের থেকে।
চারবছরের দীর্ঘ আলাপচারিতায় স্পষ্ট প্রযোজক,পরিচালক কিংবা প্রতিষ্ঠিত নায়কের (যেহেতু নায়ক কেন্দ্রিক ইন্ডাস্ট্রি) ঘনিষ্ঠ বৃত্তের একজন হয়ে ওঠার ‘স্কিল’ তাঁর ছিল না। এমনকি গুলজার তাঁকে একবার প্রডিউসারের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করেছিলেন তাকেও তিনি সটান ‘না’ বলে দেন (‘বাংলার বাইরে বাঙালি’ এ নিয়ে অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে)। ছোট থেকেই তিনি প্রবল আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, ভীড়ের মধ্যেও আলাদা, কিছুটা একা। তাই স্বজনপোষণের ফসল তিনি কোনোদিন ঘরে তুলতে পারেননি। নায়িকা হওয়ার ইচ্ছে কার না থাকে। তাঁরও ছিল। সফল হননি। তাঁর অন্যতম কারণ হয়তো চিরকাল শিরদাঁড়া সোজা রেখে নিজের নীতিতে অটল থাকা। পাশাপাশি তাঁর আবির্ভাবের সময়ও মোটেও অনুকূল ছিল না। আবির্ভাব ১৯৫৮ সাল। ‘ভানু পেল লটারি’ ছবিতে একটি ছোট চরিত্রে। বয়স তখন মাত্র ১৭। প্রকৃত আবির্ভাব বলা চলে ১৯৬১ সালে ‘মধ্য রাতের তারা’ ছবি দিয়ে। ইতিমধ্যে সুচিত্রা সেন সেলুলয়েড দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ (১৯৫৩), ‘ওরা থাকে ওধারে’ (১৯৫৪), ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ (১৯৫৪), ‘অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), ‘গৃহপ্রবেশ’ (১৯৫৪), ‘বলয়গ্রাসে’র (১৯৫৪) মত পরের পর ছবি। যিনি বিরাজ করবেন আগামীর অনেকটা সময় জুড়ে। অল্পসময় পরেই সত্যজিতের নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটবে মাধবী মুখোপাধ্যায়ের। ১৯৬৩-তে ‘মহানগর’, ‘৬৪তে ‘চারুলতা’। ঋত্বিকের সান্নিধ্যে বাঙালি দর্শকের মন ছুঁয়ে যাবে ‘নীতা’র সংলাপ। সেই সুপ্রিয়াই ১৯৬৩ তে উত্তমের সঙ্গে জুটি বেঁধে হিট দেবেন বাঙালি দর্শককে। ছবির নাম ‘সূর্যশিখা’। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের হাতে তখন ‘বসু পরিবার’,’লাখটাকা’, ‘ময়লা কাগজ-এর মতো একাধিক ছবি জোর কদমে মাঠে নেমে পড়েছেন সন্ধ্যা রায়। এমন এক সময়ে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে লিলি চক্রবর্তীর আবির্ভাব। দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এক সে এক সফল নায়িকা। এই লড়াই-এ টিকে থাকা ছিল ভীষণ কঠিন। তাই তিনি এক ভিন্ন পথ গড়ে নিলেন। নিজেকে চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই শুরু করলেন। ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’য় রঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমান্তরালে রেখে একটি ভিন্ন ঘরানার অভিনয় উপহার দিলেন। ‘শেষ চিহ্ন’, ‘প্রভাতের রং’ কিংবা ‘ফুলেশ্বরী’—সন্ধ্যা রায় বা শর্মিলা ঠাকুর কাউকে তিনি এতুটুকু জমি ছাড়েননি। চরিত্র ছোট হোক বা বড়ো যখন যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন তার পূর্ণ সৎব্যবহার করেছেন। তার ন্যাচরাল অ্যাক্টিং, মুখশ্রীর পেলব আবেদন বারবার দর্শককে মোহিত করেছে। শুধুই বাঙালি দর্শক কেন, প্রথম বার যখন অভিনেত্রী হিসেবে বাংলার বাইরে পা রাখলেন মলয়ালাম ছবিতে— সেখানেও বুনে দিলেন এক নতুন অভিনয় ঘরানা। কলকাতা থেকে দক্ষিণ ভারত সেখানে মুম্বাই, মুম্বাই থেকে ফের কলকাতা— এই বিস্তৃত এবং অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ অভিনয় জীবনও বোধহয় খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর।
বাংলার সীমিত গণ্ডি থেকে যদি বিশ্ব চলচ্চিত্রের দিকে পা বাড়াই দেখবো সর্বত্র হিরো-হিরোইন এর প্রাধান্যের যুগ শেষ আসছে। চরিত্রাভিনেতা বা ক্যারেকটার অ্যাক্টরই এখন চলচ্চিত্রের ভরকেন্দ্র। আমাদের মতে লিলি চক্রবর্তীই হলেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম অভিনেত্রী যিনি সচেতন ভাবে চিত্রাভিনেত্রীর প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। আজও তিনি সাফল্যের সঙ্গে সেই ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
৪
আমাদের সঙ্গে লিলি চক্রবর্তীর বয়সের দীর্ঘ ফারাকজনিত কারণে কখনও বা নেহাৎ সৌজন্যের খাতিরে আমরা অনেক প্রশ্ন করতে গিয়েও আটকে গেছি। অনেক ব্যক্তিগত বিষয় উত্থাপন করত বাধোবাধো ঠেকেছে। তিনিও হয়তো মাঝেমধ্যে থেমে গেছেন। আশ্রয় নিয়েছেন নৈঃশব্দের। তবু পরের পর অধ্যায়ের উন্মোচন, একের পর এক অজস্র তথ্যের ডালি মেলে ধরেছেন আমাদের সামনে। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যার অবদান অপরিসীম। কতটা লিপিবদ্ধ করতে পারছি জানি না। কিন্তু যথাসাধ্য চেষ্টা করে গেছি। আর কথা বলতে বলতে এটুকু বুঝেছি আজও তাঁর কাজের প্রতি স্পৃহা সেই তরুণ দিনের মতো। কর্মদক্ষতাতেই তার জীবনের আনন্দ। স্বামী নেই, সন্তানহীন একা তিনি-মাঝেমধ্যে হয়তো বেদনাহত, চুপ করে বসে থাকেন কিছুক্ষণ। কিন্তু তিনটি শব্দের তুমুল আকর্ষণ তাকে বারবার সব কিছু ভুলিয়ে দেয়। লাইট, ক্যামেরা অ্যান্ড অ্যাকশন শুনলেই নড়েচড়ে বসেন লিলি। মেকআপ যে রেডি। হাঁটা লাগান ফ্লোরের দিকে…
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
অময় দেব রায়
Leave a Reply