আমি রুশো বলছি – জ্যাঁ জ্যাক রুশো
বাংলা রূপান্তর – সরদার ফজলুল করিম
.
উৎসর্গ
জ্যাঁ জ্যাক রুশো
মুখবন্ধ
আমি এখনো রুশোর ভূগ্রস্ত : রুশোর ভূতে পাওয়া। কেমন করে যে কয়েকবছর পূর্বে রুশোর ভূত আমাকে আছড় করেছিল তা আমি আজো বুঝতে পারছিনে। কিন্তু এ কথা ঠিক যে, সেই আছড়ের আচ্ছন্নতায় প্রায় পাঁচ বছর আগে তার সোশ্যাল কন্ট্রাক্টকে বাংলায় নিয়ে আসার কাজ আমি শুরু করেছিলাম। আমাদের বাংলাদেশেই আমার আর এক বন্ধু অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ মিঞা সমাজ-সংঘর্ষ নামে রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক্টের একটি অনুবাদ তৈরি করেছিলেন। সে অনুবাদখানি বেশ কয়েক বছর আগে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও আমি রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট ‘৯৮/৯৯ সালের দিকে আমার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে বাংলায় রূপান্তরিত করতে শুরু করি। এবং প্রখ্যাত শৈলী পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকাটিতে যেমন এক বছরের অধিককাল ধরে ধারাবাহিকভাবে অনুবাদটি প্রকাশিত হতে থাকে, পরবর্তী সময়ে মাওলা ব্রাদার্স : প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে ‘রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ নামে অনুবাদটি পুস্তকের আকারে প্রকাশিত হয়। ভেবেছিলাম তারপরে আর রুশোর গায়ে হাত দেব না। কিন্তু তা সম্ভব হলো না। রুশোর ‘দি কনফেশন’ আমাকে রুশো-মুক্ত হতে দিল না। কিন্তু রুশোর গায়ে হাত দিতে সাহস পাচ্ছিলাম না। রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট অনুবাদ করেও যে রুশোকে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণী, তথা আমাদের নতুন প্রজন্ম পাঠকদের কাছে তেমন পৌঁছাতে পেরেছি, তা মনে করিনে। রুশোর নিজের ভাষাতেই এরূপ উক্তি আছে : ‘আমাকে বোঝা অত সহজ নয়।’ একথা আমি যেন কিছুটা বুঝতে পেরেছি এবং পারছি। তবু রুশোকে ছাড়তে পারছিনে।
এটি কম কথা নয় যে ২০০৩ সালের আজকের ১৮ জুলাই তারিখে ক্ষুদ্র অক্ষরে মুদ্রিত পকেট লাইব্রেরির সেই কনফেশন অব জাঁ জ্যাক রুশোকে আবার ডায়েরির পাতায় আমার ক্ষুদ্রাগুক্ষুদ্র হস্তাক্ষরে রূপান্তর করার ভূতগ্রস্ত প্রয়াস এক সময়ে দেখলাম : আমার নিজের পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০০ অতিক্রম করেছে এবং সামনের পৃষ্ঠাটিতে প্রথম পুস্তকের অন্তে দ্বিতীয় পুস্তকের শিরোনামটি ভেসে উঠেছে। এতদূর আসতে পারব, এমন আমি আশা করিনি। তাই এটি আমার চিন্তার অতীত। প্রায় ঝরে-পড়া নিউজপ্রিন্টের কাগজের এই কপিটি। এর প্রথম পৃষ্ঠায় উত্তীর্ণ অক্ষরে দেখা যাচ্ছে বইটি আমি সংগ্রহ করেছিলাম : আজ থেকে ৪০ বছর পূর্বে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে তখনকার নিউমার্কেটের একটি বই-এর দোকান থেকে।
পকেট লাইব্রেরি : নিউইয়র্ক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এই অনুবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে। পুস্তক পরিচয়ে প্রকাশক পকেট লাইব্রেরি বলেছিল : দি কনফেশনস-এর এই ইংরেজি অনুবাদটি নামহীনভাবে একজন অনুবাদকের স্বাক্ষরে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে : রুশোর মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে। পকেট লাইব্রেরির এই সংস্করণটির সম্পাদনা করেছেন বাল্টিমোরের গাওচার কলেজের লেস্টার জি ক্রোকার : (Lester G. Crocker)
রুশোর ‘দি কনফেশনস’কে আমি বাংলায় অভিহিত করেছি : ‘আমি রুশো বলছি’ হিসেবে। আমি ফরাসি ভাষা জানিনে। ইংরেজি যাও একটু জানতাম তাও বাংলাদেশের নব্য-মার্কিনীরা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। আমার ‘জীবনের চল্লিশ কি পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিবেশে যা একটু আগ্রহ করেছিলাম তাও পাছে একেবারে স্মৃতির পট থেকে মুছে যায় সেই আশঙ্কায় এখন ‘আমি রুশো বলছি’ বলে রুশোর গায়ে হাত রেখেছি। এই কর্মে আমার প্রধান ভিত্তি হয়েছে পকেট লাইব্রেরি নামক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে, লেস্টার জি ক্রোকার-এর সম্পাদিত ‘দি কনফেশনস্ অব ‘জা ট্র্যাক রুশো’ নামে প্রকাশিত গ্রন্থখানি। আমার ভাগ্য ভাল। এই গ্রন্থ আমি সগ্রহ করতে পেরেছিলাম ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যভাগের : আজ ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের চল্লিশ বছর পূর্বে।
‘আমি রুশো বলছি’ এই নামে বর্তমান প্রচেষ্টায় আমি রুশোকে উপস্থিত করার চেষ্টা করেছি। রুশোর কোনও আক্ষরিক বা অনাক্ষরিক অনুবাদ নয়, বলতে পারি মর্মানুবাদ। মর্মকে নিয়ে আসাই বড় কর্ম। অনুবাদ নয়। যে রুশো আমার কাছে এখনো মৃত নয়, বিস্মৃত নয় এবং বোধের দিক থেকে অপ্রয়োজনীয় নয়, তেমন এক জীবিত রুশোকে আমার প্রিয় বর্তমান প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রী, পাঠকবৃন্দের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছি কেবল এই সতর্কবাণীটিসহ, যেমন রুশো নিজে বলেছিল তার অবুঝ এক সঙ্গীকে; আমাকে বুঝতে হলে আগে রুশোর অভিধান খানিকে তোমার পাঠ করতে হবে। রুশোর বাইরে রুশোর অভিধানকে সেকাল থেকে একালে কোনও পাঠক শত অনুসন্ধানেও পাননি। আমিও পাইনি। তার ফলে আমাদের এবং আমাকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়েছে যে, আসলে রুশোই হচ্ছে রুশোর অভিধান এবং সেই অভিধান বারংবার পাঠ করা ব্যতিরেকে রুশোকে যে তাৎক্ষণিকভাবে উপলব্ধি করা যাবে না : এ সত্যে কোনও অত্যুক্তি নাই। ‘আমি রুশো বলছি’ আমার কথাটি যতোই অহঙ্কারমূলক বলে বোধ হোক না কেন, আমি এমন একটি কর্ম শুরু করেছি যার : যেমন কোনও পূর্বগামী নেই, তেমনি তার অনুগামীও কখনো হবে না।
‘আমি রুশো বলছি’ প্রথমে ধারাবাহিকভাবে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়। পাঠকদের কাছে ভীষণভাবে আগ্রহ সৃষ্টি করলে গ্রন্থাকারে প্রকাশের দায়িত্ব নেন আগামী প্রকাশনী।
এ গ্রন্থ প্রকাশে যারা আমাকে শ্রম দিয়েছেন তাদের আমার ধন্যবাদ জানাই।
সরদার ফজলুল করিম
ঢাকা।
পাঠকবৃন্দের প্রতি
এ গ্রন্থ পাঠে পাঠকবৃন্দ যতই বিস্মিত এবং আহত হন না কেন, এ গ্রন্থ যে কোনও উপন্যাসের অধিক। অসাধারণ এবং অনন্য এক ব্যক্তির একটি আত্মপ্রতিকৃতি। এ আত্মপ্রতিকৃতি কেবল একটি মাত্র ব্যক্তির নয়, একজন মাত্র রুশোর নয়; একাধিক এবং বহুমাত্রিক এক রুশোর : যিনি যেমনি অশিক্ষিত, তেমনি স্বশিক্ষিত, যেমন একজন দার্শনিক, তেমনি একজন প্রেমিক, রাজনীতির ভাষায় গুপ্তচরও বটে, আবার অন্যতম সঙ্গীতজ্ঞ তুলনাহীন একজন ঔপন্যাসিক; এমন এক ব্যক্তি যার কাছে অষ্টাদশ শতকের ইউরোপের কোনও ইতিহাস বিশ্রুত ব্যক্তিত্বই তাদের চরিত্রের অতলে অনাবিষ্কৃত থাকেননি। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম সড়ক নির্মাতা রুশো।
রুশোর আত্মকথা বা ‘কনফেশনস্’ রুশোর দর্শনের অংশ নয়। তার দর্শন তার গ্রন্থসমূহের মধ্যে লাভ করা যায়। রুশোর আত্মকথা হচ্ছে রুশোর অস্তিত্ব– তার দৈহিক এবং মানসিক অস্তিত্বের প্রকাশ এবং তার দর্শনের ভিত্তিভূমি। এই অস্তিত্বেই তার দর্শন। তার দর্শন তার অস্তিত্ব থেকে অবিচ্ছিন্ন। পাঠকদের একটিই মাত্র করণীয়। এই মানুষটিকে তার আপাদমস্তকে এবং মননে দেখা : তাকে দর্শন করা।
সরদার ফজলুল করিম
.
রুশোর জন্ম ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে, মৃত্যু ১৭৭৮ খ্রস্টাব্দে। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের ১১ বৎসর পূর্বে। রুশো ছিলেন সুইজারল্যান্ডের এক দরিদ্র ঘড়ি নির্মাতার পুত্র। তাঁর জীবনকালের পরিধি ছিল ৬৬ বছর। এ জীবনের বৈচিত্র্যে কোনও তুলনা ছিল না। এ জীবন যেমন ছিল মহৎ, তেমনি অ-মহৎ, যেমন ছিল উত্তম, তেমনি অধম। সাহিত্যের ইতিহাসেও রুশোর জীবন অনন্য, অনতিক্রমনীয়। কেবল তাই নয় স্বপ্নময়তার রূপকথার এমন অবিশ্বাস্য ব্যক্তি ছিলেন যে রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব সমূহের মধ্যে গণতন্ত্র থেকে সর্বস্বতন্ত্র : সর্বতত্ত্বেরই কিছু না কিছু ঋণ রয়েছে এই জ্যা জ্যাক রুশোর কাছে।
Leave a Reply