আমি নকুবাবু – সুশীলকুমার চট্টোপাধ্যায়
প্রথম সংস্করণ – এপ্রিল ২০২১
প্রচ্ছদ – দেবাশিস সাহা
প্রকাশক – স্বাতী রায়চৌধুরী
সপ্তর্ষি প্রকাশন
.
উৎসর্গ
বাবা ও মা-কে
.
লেখকের কথা
বিভিন্ন সংবাদপত্র পত্রিকায় কয়েক বছর ধরে আমাকে এবং আমার সংগ্রহশালাকে নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। এসব পড়ে উৎসাহিত হয়ে আমার বহু প্রিয়জন, শুভানুধ্যায়ী এবং বন্ধুবান্ধব আমাকে প্রতিবেদনগুলো লিপিবদ্ধ করে বই প্রকাশ করতে বলেছেন। তাদের উৎসাহে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। আত্মজীবনী লিখব বা বইয়ের মাধ্যমে স্মৃতিচারণ করব এমন ইচ্ছা আমার কোনওদিন ছিল না। এটা আমার দীর্ঘ বৈচিত্র্যময় জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি এবং ঘটনা নিয়ে কিছু কথা।
পুরোনো কথা বলতে গিয়ে আনন্দ পেয়েছি সন্দেহ নেই। আরও কেউ যদি আনন্দ পান তবে বুঝব আমার এই লেখা সার্থক হয়েছে।
আমার শুভানুধ্যায়ী এবং কাছের লোক প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক শ্রী তরুণ মজুমদার আমাকে ক্রমাগত তাগাদা দিয়ে এসেছেন লেখার জন্যে এবং অনেক ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও এই বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছেন, তার জন্য আমি চিরঋণী। তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
আরও কৃতজ্ঞতা জানাই আমার বন্ধুবর শ্রীসুদাম মণ্ডল এবং শ্রীসন্তোষ দত্ত মহোদয়দের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহে এবং অনুলিখনে আমাকে সাহায্য করার জন্য।
.
ভূমিকা
নকুবাবু অর্থাৎ শ্রীসুশীল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যদি আমার আকস্মিক পরিচয় না হতো, আজ মনে হয়, তাহলে জীবনের একটা দিক অনেকটাই অপূর্ণ থেকে যেত। আকস্মিকতা অনেক সময় অনেক মনোরম বিস্ময়ের দ্বার খুলে দেয়। সেদিক থেকে বিচার করলেই এই মানুষটা আমাকে শুধু বিস্মিত নয়, গভীর শ্রদ্ধায় অভিভূত করে দিয়েছেন।
বেশ কয়েক বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ টেলি-ধারাবাহিকে একটি বিশেষ চরিত্রের জন্য উপযুক্ত কোনও অভিনেতার খোঁজ করছিলাম। বয়স আশির কাছাকাছি, প্রাজ্ঞ, ঋজু, ঋষিসুলভ চেহারা হতে হবে। আর পর্দায় মুখ হিসেবেই অবশ্যই নতুন। সেই অনুসন্ধানপর্বে এক বন্ধুর মুখে প্রথম শুনি সুশীলবাবুর নাম। উত্তর কলকাতার খান্না সিনেমার কাছাকাছি এক গলির মধ্যে তাঁর বাড়ি। মনোনয়নের আগে স্বচক্ষে একবার দেখে নেওয়া দরকার। সেই সূত্রেই প্রথম তাঁর বাড়িতে আমার পদাপর্ণ, আমার সেই বন্ধুর সঙ্গে।
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে বাঁ দিকের একটা ঘরে ঢুকতে হল। এটাই নাকি ওঁর কর্মক্ষেত্র। ঢুকেই অবাক আমি। আয়তনে ভদ্রস্থ ঘরটি নানা রকম বিচিত্র জিনিসের ঠাসাঠাসিতে একেবারেই সংকীর্ণ বলে মনে হল প্রথম দর্শনে। পা ফেলার জায়গা নেই বললেই চলে। একটা মাননুষের আজীবনের স্বপ্ন ও সাধনার ভাণ্ডার একই সঙ্গে মুক্ত আর বন্দি হয়ে আছে যেন, ওই অপরিসরতার মধ্যে। দুর্লভ, কিংবা বলা ভালো, অমূল্য সব সম্পদের খনি যেন। আমরা যাকে বলি ‘অ্যান্টিক’। দেশের বড়ো বড়ো যাদুঘরে এ ধরনের অ্যান্টিকের দেখা মেলে। আবার হয়তো মেলেই না— এতটাই দুষ্প্রাপ্য এদের কেউ কেউ। কিন্তু সুশীলবাবুর ঘরে আছে— ওঁর অবিশ্বাস্য অনুসন্ধিৎসা আর অপার পরিশ্রমের সাক্ষী হয়ে।
কী গভীর মমতায় উনি এদের লালন করেন, পরবর্তীকালে তা আমার নিজের চোখে দেখা। ছোটো-বড়ো প্রত্যেকটিই যেন এক জীবন্ত ইতিহাস। নিষ্প্রাণ হওয়া সত্ত্বেও তারা যেন সুশীলবাবুর সঙ্গে কানে কানে কথা বলে। সুশীলবাবুও বুঝতে পারেন ওদের সেই ভাষা। দেখেশুনে আমি অবাক হয়ে যাই।
কিন্তু বিস্ময়ের তখনও অনেক বাকি ছিল। পরিচয় গভীরতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ওঁর স্নেহ পেতে শুরু করি। একটু একটু করে, নতুন করে, ওঁর ভাবনার দিগন্তকে আবিষ্কার করার সুযোগ পাই। একজন সংগ্রাহক হিসেবে ওঁর যা সম্পদ, যা কিনা বাইরে থেকে দেখা যায়, তার থেকেও অনেক, অনেক বেশি সম্পদ লুকিয়ে আছে মানুষটার বুকের মধ্যে। খুবই সরল ভাষায় মাঝে মাঝে এমন কিচ্ছু বলে ওঠেন যা শুনে চমকে উঠতে হয়। যেন কোনও জ্ঞানবৃদ্ধ দার্শনিকের কথা। মানবজীবনের অভীষ্ট কী, শান্তির সন্ধান কোন পথে সম্ভব, প্রকৃতি, মানুষ আর ঘটনাচক্র কী করে আমাদের মহাবিশ্বের অপার রহস্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে পারে, এই নিয়ে নানান কথা। ওঁর অনুভবের, ওঁর উপলব্ধির, ওঁর বিশ্বাসের।
এই ক্ষুদ্রায়তন বইটিতে তার কিছুটা প্রকাশ পেয়েছে, সবটা নয়। তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতা, প্রকৃতি প্রেম, আর জীবন জুড়ে মহৎকে আত্মস্থ করার ব্যাকুলতা— এ নিয়ে আরও বিস্তারিত লেখার সম্ভাবনা ভবিষ্যতের জন্যে তোলা রইল।
ছেলেবেলায় পড়েছি ‘প্লেইন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং’। সুশীলবাবু আমাদের নকুবাবু, যেন এর মূর্ত প্রতীক।
তরুণ মজুমদার
Leave a Reply