ওসিআর ভার্সন। প্রুফরীড করা হয়নি।
রামকিঙ্কর বেইজ
রচনা বক্তৃতা চিঠিপত্র সাক্ষাৎকাব
আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র
সংকলন ও বিন্যাস সন্দীপন ভট্টাচার্য
মনফকিরা
প্রকাশকৰ্ম : ম ন ফ কি রা-র পক্ষে
শিবাদিত্য দাশগুপ্ত
মন্দিরপাড়া, জগাছা, হাওড়া ৭১১ ১১১
কলকাতা কেন্দ্র : ১/১ বালিগঞ্জ স্টেশন রোড, ফ্ল্যাট ৮, কলকাতা ১৯, ফোন (০৩৩) ২৪৬১ ১৫৭৮, ৯৮৩০ ১০৮৫৪৫
গ্রন্থসজ্জা, হরফবিন্যাস ও প্রচ্ছদ-পরিকল্পনা : মা ই ন্ড স্কে প
১/৮ নবোদিত, নয়াবাদ, ডাক মুকুন্দপুর, কলকাতা ৭০০ ০৯৯, ফোন (033) 2426 0928, 9433 ৩০১০৭৯
মুদ্রণকর্ম : জয়শ্রী প্রেস
৯১/১বি বৈঠকখানা রোড, কলকাতা ৭০০ ০০৯, ফোন (০৩৩) ২৩৫১ ৪৩৭৮
7
I
২৮-৩-
সূ চি
কী আঁকব, মূর্তের কী গড়ব ৮ মহাশয়, আমি চাক্ষিক, রূপকারমাত্র ১০
আমি সেরকম ভিখারি নই ১৩
পথ ঐ এক
১৮
কাজ হয় মানুষ দেখে ২২
এই পাথরেই ফুটবে হাসি ২৬
জীবনের এক পর্ব ৩০
বিশ্বকর্মার বরপুত্র ৩৪
যা পাবি, দেখবি, ধরবি, তারপর হজম করে ছেড়ে দিবি ৩৭
মূর্তি তোমার যুগল সম্মিলনে ৪৪
পথ-ভালোবাসার তত্ত্ব : ইতি রামকিঙ্কর ৭৬
ফল চাই না হে, কোন ফলই চাই না ৭৯
সংকলন সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক ৮১
কী আঁ ক ব মূর্তের কী গড় ব
বন্ধুগণ,
আমি একজন অতি সংকীর্ণ অথচ বিরাট পথের মুক্তিপথিক সাধনা ছাড়া এ শিল্পের পথে চলা অসম্ভব ।
প্রায় সকল সাধনার পথ একই যদিও সাধনার পথই বিরুদ্ধশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ একটি ছদ্মবেশী কুহেলিকা স্বাধীন মানসিকতাকে বিপথে চালিত করার চেষ্টা করে। তাদের হাত থেকে বাঁচবার চেষ্টা একটি নিরন্তর দুর্ভাবনা থাকে ৷
আপনারাও দেখচি আমার সঙ্গী আমি একা নই ।
এই পূজাটি যুগে-যুগে চলেচে। মানবতার একটি পাগলা উৎকর্ষতা—1
আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ।
ছেলেবেলা থেকে আমার একটা ইচ্ছা ছিল— যেখান দিয়ে যাব রাস্তার ধারে ধারে মূর্তি রচনা করে চলব। সূর্যের আলো, চাঁদের আলো, বর্ষণাতুর আকাশের তলায় বড় মূর্তি দেখতে ভালো লাগে।
তার সূচনা শান্তিনিকেতন থেকে শুরু হয়েচে। সামান্য কাজ হয়েচে এই ব্রতটি রয়ে গেল— মৃত্যু পর্যন্ত আশা করি থাকবে।
গরিবের শিল্পী-ছেলের কল্পনা। একটা পথ খোলা রয়েচে সংসারের মধ্যে না ঢোকা। বিবাহ ইত্যাদি বিসর্জন। মা-বাবার প্রতি অকৃতজ্ঞ ছিলাম না অবশ্য ।
লীলায়িত প্রাণ উৎসের পাশে ছন্দোবদ্ধ কাঠামোর জন্ম মৃত্যুর খেলা কী সুন্দর! দেখতে দাও ।
আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র
কী আঁকব? মূর্তের কী গড়বে? তবু ছাড়বে না পাগলের প্রলাপের মতন ।
আকাশের তলায় মূর্তি রচনা। কার মূর্তি কীসের মূর্তি তার নির্দেশ প্রকৃতির এবং শিল্পীর নিজের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেই ধরা পড়ে। কিন্তু অহেতুক রচনা একটি বিরাট খরচের প্রশ্ন
শিল্পীরা স্বভাবতই গরিব হয়ে থাকেন কারণ অহৈতুকী কাজের তাড়নাই তাদের গরিব করে রাখে। সেই জন্য রসিক বিদ্বজনের দয়ার উপর নির্ভর করতে হয়, তা হোক দু-জনের বোঝাপড়ার মধ্যেই হয়ে যায়। তাই হয়ে চলেচে।
শান্তিনিকেতনেই একজন মহা (পুরুষ) অহৈতুক সাধনার সাধকের দর্শন পেয়ে ধন্য হয়েছিলাম। আমার নির্বাক নিশ্চল মূর্তিগুলোকে সঙ্গীতসুধা পান করিয়ে সঞ্জীবিত করে দিয়েছিলেন, নিজেও নির্বাক সাধনায় মগ্ন হয়েছিলেন।
R
রামকিঙ্কর শাদিনিকেএ
ম হা শ য়, আ মি চা ক্ষি ক, রূপ কা র মা এ
জীবন মণিকোঠার দেবতাটিকে পূজা দেবার জন্য সব কিছু চেতনা নিবেদন করতেই হবে। তা-ও বাকি থাকবে। দেখেছি কালো মেঘের বুকে বজ্রবিদ্যুতের খেলা কী অদ্ভুত! তারপর বর্ষণের পালায় পেখমধারী ময়ূরের নৃত্য, সঙ্গহীন বেদনার আর্ত আহ্বানে মুখরিত ঐকতানে মেঘমল্লার ।
ছেলেবেলায় দূরদেশে বিদ্যাশিক্ষার আশায় গেছলেম। মা-র মৃত্যুর খবর পেয়ে বাড়ি ছুটে এলেম। মৃত্যুর কথাটা বুঝতে একটু দেরি হল। আমি যেন কথা বলতেই জানি না। প্রলাপ বকারও কোন উৎসাহ নেই। কেবল একটি উচ্চারণ মাত্র ‘মা’- ব্যাস, এ ছাড়া আর কোন কথা নেই। গভীর বেদনার বোবা প্রকাশ মাত্ৰ ৷
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দেখেছিলেম তিনি তাঁর জীবনের অর্ধাংশেরও বেশি সময়টি বাণী-সুর-শব্দ নিয়ে রচনার কাজ করেছিলেন অজস্র – ধারে। আধারটি উপচে উঠেছিল। পরে দেখি, অপরূপ রঙ-রেখার প্রাচুর্য নিয়ে টানা দশ বছর কাটিয়েছেন নির্বাক মগ্নতায়।
গতি আর ঘর্ষণের মধ্যে বৈরী ভাব আছে। গতি যত তেজবান, ততই কর্কশ। এর মধ্যে যেখানে সুসম্বন্ধ, সেখানেই সঙ্গীতের উদ্ভব। স্বরস্রষ্টা ছ-টি স্বরে শব্দের বিশ্লেষণ সমাপ্ত করেছেন। স্বরশিল্পীর ভাগ-বিশ্লেষণ অতি প্রাচীন। ছ-টি স্বরের বিজ্ঞান দিয়ে আমাদের সব কিছু আবেগ- অনুরাগ-অনুভূতির প্রকাশ হয়ে চলেছে।
আমি যা দেখেছি, যেমন শিবলিঙ্গ, মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা থেকে পাওয়া মূর্তিশিল্পে আমরা স্পষ্টভাবে যা পাই। তার উপর আর পাচ্ছি না— চোখই তার একমাত্র উপায় ।
প্রকৃতিতে আমরা দুটি আকৃতি পাই, পুরুষ আর নারী। তৃতীয় হচ্ছে তার প্রজিনি— বাচ্চা। এই থিমটি এক অদ্ভুত সুন্দর। এর উপর কত আনন্দ, কত সৌন্দর্যের খেলা চলেছে। এটিকে একটা ফর্মের ভেতর প্রকাশ করার চেষ্টা।
তার নাম সিম্বল সেটাই বলার চেষ্টা করছি।
রামকিঙ্কর বেইজ
গতির সঙ্গে ঘর্ষণ শুরু। তার থেকেই শব্দ। ঘর্ষণের তারতম্য অনুসারে কোনটা কর্কশ, কোনটা মধুর। সুরস্রষ্টা তা-ই নিয়ে অদ্ভুত সুর রচনা করেন, ধরে রাখার চেষ্টা করেন। দেখি, সর্বত্রই সেই খেলা ।
এটাই সিম্বল বলে প্রচার। সঙ্গীতেও কি এই রকমের সিম্বল আছে? সে কথাটা সঙ্গীতস্রষ্টারা বলতে পারবেন।
আজকাল খালি কথার প্রচার এবং প্রচার। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, কানেও ঢুকছে না। কারণ গোলমাল আর গোলমাল। কান ঝালাপালা। মেশিনের গোলমাল এ যুগের একটি প্রধান গোলমাল। আর কী চাই !
এতই যদি মেশিনের যুগ, এবার ‘সাইলেন্সর’-এর যুগ কবে আসবে, তারই আশায় রইলাম ।
রূপকারের কাছে শব্দের অর্থ অতি ক্ষীণ। রবীন্দ্রনাথ যখন রূপ নিয়ে কাজ করেছিলেন, তখন দেখেছি, তিনি নিস্তব্ধ থাকতেন। অথচ শব্দ নিয়ে তিনি প্রায় সারা জীবন কাটিয়েছেন। কথোপকথনের শিল্প, সঙ্গীতের শিল্প— এ দুটিই শাব্দিক। রূপশিল্পের বেলায় একেবারে চুপচাপ কেবল ধ্যান। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন— ‘ধ্যানের ধনখানি, পাইবে আপন বাণী।’ এইখানে শব্দের ব্যবহার। শব্দযন্ত্র ব্যতীত প্রকাশটি অঙ্গহীন। হয় কণ্ঠস্বর, নয় অন্য কোন বাণী-প্রকাশক যন্ত্রের প্রয়োজন।
মহাশয়, আমি চাক্ষিক, রূপকারমাত্র। শাব্দিক নই ।
যাই হোক, শব্দের মাঝে রূপ- ঝগড়া যখন বাধে তখনই শব্দের ঝনঝনানি। ট্র্যামের শব্দ, মোটর, ট্রাক, ট্রেনের শব্দ, কারখানার শব্দ, মানুষের কোলাহল— এ সব শুনেও আপনারা আরও শব্দের জন্য পত্রিকা ছাপেন? আপনাদের ধৈর্যের কী বলিহারি!
১২
আ মি সে রকম ভিখা রি ন ই
আপনাদের সময়ে শিল্পীদের মূল সমস্যা কী ছিল ?
রামকিঙ্কর। কিছু না… কোন সমস্যাই ছিল না। আমি যদি ছবি আঁকতে পারি… তা হলে কোন সমস্যাই নেই। একটা সমস্যা ছিল যে ছবি কী ভাবে আঁকব? হ্যাঁ, আর-এক সমস্যা… নারী। তবে সে কথা বাদ দাও (অট্টহাসি)। সমস্যা মিটে গেল। সমস্যা হল উৎপাদন করো, যোগাড় করো।… সে সব বাদ দিলে সমস্যা মিটে গেল।
—
আজকের সময়ে শিল্পীদের মূল সমস্যা কী?
রা। ফ্রিডম. . . ফ্রিডম টু ওয়র্ক। ফ্রিডম।. . . কাজ করার ইচ্ছা। (থেমে একটু ভাবেন). . . চলে আসবে… চলে আসে।… আর জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক… আমি মানুষ দেখেছি… বামন নিয়ে কী হবে ?
— আপনি বিবাহ করেননি। এ নিয়ে কিছু বলতে চান?
রা। বিয়ে করব, ঘর-সংসার করব— আমার এ ইচ্ছে কোন দিনই ছিল না।… খালি কাজ করব, এই-ই লক্ষ্য ছিল।… বিয়ে করলে তা সম্ভব হত না।. . . ঘর বাঁধার সুখ আমার শিল্পের কাছেই মিটে যায়।. . . নারী।… নারীর প্রয়োজন আছে।… পুরুষ তো প্রকৃতিরই সৃষ্টি।
•
– আপনার ছবি ও মূর্তি, দুই-ই অদ্ভুতভাবে প্রকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
রা। মানুষ তো প্রকৃতির মধ্যেই আছে।
– প্রকৃতির মধ্যে আবার গাছকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
রা। সজীব।… গাছ।… গাছ হল সজীব।
গাছেরও আবার সব অংশ নয়, রূপের স্তরে কাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কই বেশি।
রা। কাণ্ডই আসল।. . . তা-ই সজীব।… পাতা তো আসবেই।. . . ফুল আসবেই।… আসল হল শিকড়, আসল হল কাণ্ড ।
– একবার পিকাসো নিজের প্রদর্শনী চলাকালীন দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, প্রকৃতি না-থাকলে শিল্পীও থাকে না। প্রকৃতিকে পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে শিল্পী তাকে অপমানই করে।
রা। অপমান করতে পারবে না।… অপমান নয়।… অপমান করতে পারবে না। সে অনুকরণ করে না।… প্রকৃতি।… প্রকৃতি… লীলা। প্রকৃতি… মায়া।… খেলা। ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন।… এই ভাবে খেলেছেন।. . . আমাদের খেলতে দেবেন না কেন? আমরাও খেলব।
রামকিঙ্কর : ২
১৩
রামকিঙ্কর বেইজ
তাঁর খেলায় একটা অনুশাসন আছে. . . মুক্ত অনুশাসন। খেলা… তুমিও খেলতে পারো। এই সৃষ্টিও খেলা । আমি খেলা করি … নিশ্চিন্ত হয়ে। রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা আছে— ‘তোমারই নাম বলব, বলব নানান ছলে…’ (গুনগুনিয়ে শুরু করে ক্রমে দরাজ গলায় গাইতে শুরু করলেন). . . ‘বলব মুখের হাসি দিয়ে, বলব চোখের জলে… আমার হাসিও তাঁর… আমার ভাবও তাঁর।… প্রকৃতি… প্রকৃতি । পিকাসো-র সঙ্কোচ আছে তাই এমন বলেছে।. . . ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন… অকারণে।… শিশু জন্ম দেওয়ারও কারণ আছে।… ঈশ্বর যা সৃষ্টি করেছেন, তার থেকে আনন্দ নাও।. . . সংঘাত নয়. . . লড়াই নয়. . . লীলা ।
কী ভাবে?
রা। কী ভাবে?… তুমি নিজে-নিজেই তার উত্তর পেয়ে যাবে। যদি আমি আনন্দ না-পেতাম, তবে কাজ করতাম না. প্রশ্ন নয়.. সব ভুলে যেতে হবে।… খেলা করতে হবে। মনে কোন অসন্তোষ থাকলে বুঝবে যে তুমি এখনও ভোলোনি।… জন্ম হয় ভবিষ্যতের জন্য।. . . এই-ই চলবে। দেখি… চিনি… তখন বোধের জন্ম হয়… আনন্দ হয়, সৃষ্টি করি… আনন্দ হয় ( খানিকক্ষণ ভাবতে-ভাবতে হারিয়ে যান). . . বুদ্ধ ।. . . বুদ্ধ।. . . বর্তমান. . . শিশুর জন্ম দেওয়া এক অর্থে পুনর্জন্ম… আমাকে ছাড়া নয়, বরং আমার মধ্যে দিয়ে।
মায়া… মায়া।
— আপনার অধিকাংশ কাজ বীরভূমের সাঁওতাল আদিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্কিত।
রা। না. . . তা নয়। অনেক রকমই তো আছে। (থেমে ভাবলেন) হ্যাঁ, হতে পারে। ওরা শ্রমিকের দল… ওরা কাজ করে. . . ওদের হাত আছে. . . সূর্য. . . রৌদ্রে… খোলা চুল… ঘাম।… ওদের খিদে পায়।… কষ্ট হয়. . . দুঃখ… দরিদ্র ওরা। (খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে) ওরা অনেক সক্রিয়। কর্মসক্রিয়তা ভালো লাগে আমার।… ললিত… সক্রিয় জীবন। (হাত উঠিয়ে দূরের বসতবাড়ি, অফিসবাড়ির দিকে ইঙ্গিত করে) dull life… ওরা যারা বসে থাকে… কী সব লেখে, কী আছে ওদের?. . . থাকুক বসে।… ঐ যারা ব্যবসা করে (দূরে বাজারের দিকে ইঙ্গিত করে), ওদের সক্রিয়তা কীসের?… যেখানেই গেছি… যাদের প্রকৃত সক্রিয়তা দেখেছি… তাদের এঁকেছি। তাদের মধ্যে রূপের প্রাচুর্য আছে।
আপনি কখনও নিজের ছবি আঁকেননি ?
রা । এঁকেছি
..
..
গাঁয়ে এঁকেছি। এখানে আসার আগে… ছোটবেলায়। কখনও আঁকব হয়তো।. . . খেয়ালের ব্যাপার।… অন্যেরা
করেছে. . . ভালো, ভালো। (রামকিঙ্করের পোর্ট্রেট অনেকেই করেছেন)।
– তো আপনি সেল্ফ পোর্ট্রেট করবেন ?
রা। শিল্পী যা করে, সবই তার সেল্ফ পোর্ট্রেট।
— সৃষ্টি করার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কী?
রা। উন্মুক্ত মন।… মনের উন্মুক্ততা অবশ, প্রয়োজন।… ফিলিং… ফিলিং ।
অনুভূতি, না অভিব্যক্তির জন্য ?
রা। অভিব্যক্তি।… অভিব্যক্তির জন্যই বেশি দরকার।
অভিব্যক্তি কীসের জন্য ?
১৪
রামকিঙ্কর বেইজ
রা। নিজের জন্য, তার পর অন্যের জন্য।. . . রবীন্দ্রনাথ কার জন্য করেছিলেন ?… সৃষ্টির জন্য।… পাগলামি থাকে . . . নেশা থাকে, সে-ই সৃষ্টি করে। (খানিক থেমে) না, বলতে পারি না।… রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্পর্কে বলতেন, ‘বাতিকগ্রস্ত, মাথা খারাপ’।… আনন্দই
প্ৰথম ৷
ভেবে-বুঝে?
রা। না-ভেবে। যদি জানতে চাও, কেউ কি বুঝবে।… ছবি মানে শুধু ছবি।… রবীন্দ্রনাথ বলতেন, পরোয়া করি না। আমি পরোয়া করি না। আমার যেমন মনে হয়েছে, আমি তেমনই এঁকেছি। আমি চাই না যে আপনি তা বুঝুন। আপনার যা মনে হয় তা-ই ভাবুন।
কাজ করার সময় সবচেয়ে বেশি আনন্দ করে পেয়েছেন?
রা। সব সময়। সব… সব সময়। (মুখে হালকা হাসি ফুটে ওঠে) ছোটবেলা থেকে সব সময়।
আপনি সব মাধ্যমেই কাজ করেছেন?
রা। খেয়াল।… যখন যা হাতের কাছে মেলে।
কাজের বিষয় কি আগেই ঠিক করে নেন? কী ভাবে এগোন ?
রা। কখনও ঠিক থাকে, কখনও থাকে না।… না-ভেবে. . . শুধু অনুভব করি আর কাজ করে যাই। আপনা-আপনিই চলে আসে. . . নিজের থেকে।
কোন কাজ কি কখনও এতটাই সম্পূর্ণ হয় যে পরে তাতে আর নতুন কিছু জোড়া বা বাদ দেওয়ার দরকার পড়ে না?
•
রা। না। একেবারে শেষ কখনওই হয় না। ওতে আবার কাজ করি… করতেই থাকি। ক্লান্ত হয়ে পড়লে হয়তো ছেড়ে দিই।. . . নতুন ভাবনা এলে. . . ছেড়ে দিই।… অসন্তুষ্টি থেকেই যায়। যত ক্ষণ আকাশ শূন্য, তত ক্ষণই সন্তুষ্টি।… নয়তো (ছবি) বদলাতেই থাকে। আবার করো. . . শেষ করে যাও।… তার ওপর আবার করো, করতেই থাকো, তো সম্পূর্ণ বদলে যাবে। আবার করো… আর-একটা করো।
রবীন্দ্রনাথ পাঁচ হাজার কবিতা লিখেছিলেন, পরে আবার ছবি আঁকতে শুরু করলেন। কেন, কেন করলেন?… আবার করলেন।… ইচ্ছেটা থাকেই। এই সবই শিক্ষা দিয়ে গেছেন. . . তাই শিখতে পেরেছি।… আবার একটা করেছি. . . আগেরটা ছেড়ে দিয়েছি… দ্বিতীয়টা শুরু করেছি।
হবে।
কাজ করবার জন্য সবচেয়ে জরুরি কী মনে হয় ?
রা। ফিলিং ফর এভরিথিং।… ফিলিং। যদি ফিলিং দুর্বল হয়, তবে শুধুই নিরাশা।… ফিল… ফিল। … ধ্যান ঠিক হলে ফিলিং
আজকাল আপনি প্রায়ই অসুস্থ থাকেন, তা-ও ছবি এঁকে চলেছেন, বিশ্রাম করতে ইচ্ছে হয় না?
রা। (ব্যঙ্গ করে) কী করলে বিশ্রাম পাব? (হাসতে-হাসতে) কিছু-না-কিছু তো করতেই হবে… কী করব? গান করব?… গল্পো করব সময় খুব কম। সময় কোথায় ?… সত্তর বছর পেরিয়ে এসেছি. . . কোথায় কে জানে সময় চলে গেছে।
W g
কাজ। নতুন কাজ । নতুন কথা ।
না।
রা। লাগাতার নতুন পর্যবেক্ষণ… যদি চোখ খোলা থাকে তো কত জিনিশ সব এক সাথে আছে দেখা যায়।
১৬
!
১৭
আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র
• কখনও কি এমন মনে হয়নি এই শিল্পকাজের বিনিময়ে দেশ তথা সমাজ আপনাকে কী দিল ?
রা। (রুক্ষ গলায়) আমি সেরকম ভিখারি নই।… কিচ্ছু চাই না।… আমি সব কিছুই আমার কাজ থেকে পাই।
শেষ প্রশ্ন, এরকম আর কত দিন কাজ করে যেতে চান?
রা। যত দিন পারি।. . . শেষ পর্যন্ত।. . . যখন কাজ হয়ে যাবে. . . তখন ধ্যানও শেষ হয়ে যাবে।… তখন . . . শূন্য… আকাশের সমান।. . . আকাশ।… অবকাশ ।
রামকিঙ্কর
9/02/201
পথ ঐ এক
শান্তিনিকেতনে প্রথম কবে এলেন?
রামকিঙ্কর : নন কো-অপারেশন মুভমেন্ট-এর সময়ে, ১৯২৫ সালে। সে সময়ে এখানে সৈয়দ মুজতবা আলি, রামচন্দ্রন নায়ার, নবকিশোর রায়চৌধুরী, গোপাল রেড্ডি এবং বাচ্চু ভাই শুক্লা-ও পড়তেন, অবশ্য অন্য বিভাগে।
আপনি কি কলাভবনের ছাত্র ছিলেন?
রা : হ্যাঁ। নন্দলালবাবু তখন কলাভবনের অধ্যক্ষ ছিলেন। ধীরেন কৃষ্ণ দেববর্মন, বিনোদবিহারী মুখার্জি, অর্ধেন্দু ব্যানার্জীরাও তখন কলাভবনে পড়ছেন।
—- নন্দলাল বসু সম্পর্কে আপনার সবচেয়ে প্রাচীন স্মৃতি কী?
রা : ১৯২৫-এ পুজোর ছুটির পর রামানন্দবাবু আমাকে নন্দলালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। মানুষটা সম্পর্কে তখন আমার কোন ধারণাই ছিল না, যদিও তাঁর কাজ আমি প্রবাসী-তে অনেক দেখেছি। প্রথমে তো তাঁকে দেখে ভেবেছিলুম সাঁওতাল, গায়ে ছিল অবশ্য সিল্কের পাঞ্জাবি। কাজ-টাজ কিছু এনেছি কি না জানতে চাইলেন। জলরঙ আর তেলরঙের কিছু কাজ সঙ্গে ছিল, দেখালুম। সব দেখে-টেখে বললেন, ‘এখানে এসছ কেন? তোমার তো শেখা হয়ে গেছে, আর কী শিখবে?’ রামানন্দবাবু তখন এগিয়ে এসে বললেন, ‘তবু থাকুক না এখানে, কাজ-টাজ করুক আরও কিছু।’ নন্দলালবাবু মেনে নিলেন সে কথা, কিন্তু একই সঙ্গে বললেন, থাকতে হলে কিন্তু তিন বছর থাকতে হবে।
— নন্দলাল বসু যখন আপনার কাজ দেখে এত প্রশংসা করেছিলেন, তখন আপনি নিশ্চয়ই আগে কারও কাছে শিখতেন? এ প্রসঙ্গে একটু বলুন।
রা : এ ব্যাপারে আমি নিজেই নিজের শিক্ষক, যা শিখেছি সব নিজের চেষ্টায়। বাঁকুড়ার ন্যাশনাল স্কুলে পড়তাম, নন কো-অপারেশন মুভমেন্ট-এর সময়ে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। তো, গেল সব ভেস্তে। ঐ রকম অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে রামানন্দবাবু এলেন যেন দেবদূতের মতো আর আমাকে শান্তিনিকেতনে ঠাই করে দিলেন।
কলাভবনে কী শিখতেন? শিক্ষক ছিলেন কারা ?
রা : রবীন্দ্রনাথ নন্দলালকে বলেছিলেন, কারওকে কিছু শিখিও না, যে যা করতে চায় করুক। ‘নন্দলাল নিজেও নিজের কাজ করুক, কবি বলেছিলেন, ‘ছাত্ররা তা-ই দেখে শিখবে, প্রেরণা পাবে।’
১৮
আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র
কেতাবি শিক্ষা না-দিলে প্রয়োগের পদ্ধতি শেখা যাবে কী করে? শিক্ষার্থীদের ওপর কোন কিছু না-চাপিয়ে পদ্ধতির শিক্ষা হোক স্বাভাবিক ভাবে— এই কি কবির অভিপ্রায় ছিল?
রা : আসলে আমরা ছিলাম পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট স্তরের ছাত্র। আমরা আমাদের ইচ্ছেমতো কাজ করতাম আর শিক্ষকমশাই অবসরে এসে সে সম্পর্কে দু-চার কথা বলতেন, সমালোচনা করতেন, প্রয়োজন হলে হাতে-কলমে দেখিয়ে দিতেন। স্টাইল-এর ব্যাপারটা একেবারেই ছিল ছাত্রদের নিজস্ব। যেমন বিনোদবিহারী প্রাচ্যের, বিশেষত ভারতীয় শিল্পের মর্ম অনুধাবন করতে গিয়ে তাঁর কাজে চিনা শৈলীর চর্চা শুরু করেছিলেন।
বিনোদবিহারী কি ভারতীয় শিল্প সম্পর্কে জ্ঞানলাভের জন্যে, যত দূর সম্ভব সম্পূর্ণ করে তা আত্মস্থ করার জন্যে চৈনিক শিল্পের চর্চা করেছিলেন?
–
রা : মূল উদ্দেশ্য তো অবশ্যই ছিল প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের সব ধরনের শিল্পকলাকে আত্মস্থ করা। সেটাই তাঁকে চালিত করেছিল।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ধরনে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তো ব্যাপক ব্যবস্থা থাকা দরকার। নন্দলালের নিজের কাজ স্পষ্টতই ছিল প্রাচ্যধর্মী, তা দেখে কিন্তু মনে হয় না যে বিভিন্ন শৈলীর সচেতন চর্চার কোন ব্যাপার সেখানে ছিল। হয়তো তার কারণ তখনও সে ভাবে মডেল পাওয়া যেত না, বা হয়তো অনুপ্রেরণারও অভাব ছিল।
রা : বিশের দশকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ই বি হ্যাভেল-এর নেতৃত্বে খুব জোরালো রিভাইভালিস্ট আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পাশ্চাত্য শিল্পে বিরাগ। যদিও, বিদেশ থেকে আমদানি করা কাপড়ের মতো পশ্চিমের শিল্পকলা পোড়ানো হয়নি, তবু তার আবেগ ছিল তীব্র। হ্যাভেল সাহেব তো ভারতীয় শিল্পকে পুনরুদ্ধার করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নিয়মিত বক্তৃতা দিতেন, এমনকী ঘরবাড়ি সাজানোর জন্য পোড়ামাটির জিনিশপত্র ব্যবহার করতে বলতেন। দৈনন্দিন যা ব্যবহারে লাগে, সে সবও তিনি ভারতীয় রীতিতে বানানোর কথা বলেছিলেন। এই ভাবনা খুব দ্রুত ছড়ায়, এবং নন্দলাল নিজেও গভীর আবেগে তা সমর্থন করেন। কলাভবন কিন্তু অ্যানাটমি-র চর্চা বাতিল করেনি, বস্তুজগতের সঙ্গে গভীর যোগাযোগের প্রয়োজনও অস্বীকার করেনি। অজন্তা, এলোরা বা বাঘ গুহাতেও তা দেখা যায়— এ সবকে আদর্শ করে তার চর্চাও হয়েছিল প্রচুর।
―
তার মানে, আপনি বলছেন, পাশ্চাত্যের শিল্পপদ্ধতি শেখানোর কোন ব্যবস্থা কলাভবনে ছিল না? কিন্তু এরকম বিরোধিতা বা শত্রুতা তো উন্মত্ততার শামিল। শিল্প নিশ্চয়ই কোন আঞ্চলিক বা জাতীয় সীমানাকে স্বীকার করে না?
রা : আচ্ছা, শিল্পের নান্দনিক মূল্যটা কি প্রাচ্যের, না পাশ্চাত্যের?
শিল্পের কোন সীমানা নেই, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নিয়ে এই ভেদাভেদের কোন মানে নেই ।
রা : সাহিত্যের চেয়েও শিল্পের চরিত্র ঢের বিশ্বজনীন, আর এ দিক থেকে তা সঙ্গীতের সঙ্গে তুলনীয়। আপনার সঙ্গে আমি একমত । এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই।
১৯
– তা-ই যদি হয়, শিল্পের চরিত্র যদি বিশ্বজনীনই হয়, তো তা প্রয়োগের পদ্ধতিতে এত পার্থক্য কেন ?
রা : কারণ তা সব সময়ে পোড় খেয়ে রূপ পায় জাতিগত অনুভবে।
– নন্দলাল বসুর কাছ থেকে যে-শিক্ষা আপনি পেয়েছিলেন, তার মধ্যে কোনটি সবচেয়ে মূল্যবান বলে আপনার মনে হয় ?
রামকিঙ্কর বেইজ
রা : উপলব্ধির ক্ষমতা আর সংবেদনশীলতাই ছিল তাঁর আসল গুণ, তাঁর প্রতিভার মূল। সেই সঙ্গে শিল্পের গড়নগত মূল্য সম্পর্কেও তাঁর ধারণা ছিল পরিষ্কার। এর জোরেই আমি নিজেকে নানা মাধ্যমে প্রকাশ করতে পেরেছি, মূর্তি গড়েছি, ছবি এঁকেছি, ধাতুর পাতে খোদাই করেছি।
–
এই অগোচর ক্ষমতাকে শিল্পী জ্ঞাপন করেন কী ভাবে?
রা : এ ক্ষমতা বাইরে থেকে রোপণ করা যায় না। থাকলে জন্ম থেকেই থাকে, নয়তো পরে আর তা অর্জন করা যায় না। যে-চারা আগে থেকেই আছে, শিক্ষক বড়জোর তার বৃদ্ধি ও বিকাশে সাহায্য করতে পারেন।
আচার্য নন্দলালের নীতি ও আদর্শের প্রতি কি আপনি বরাবর একনিষ্ঠ ছিলেন?
রা : সবাই আমরা জন্ম ও মৃত্যু, নৃশংসতা ও বিকৃতি, আনন্দ ও সৌন্দর্য নিয়ে ঘর করেছি, এ সমস্ত থেকে যে-নান্দনিক রূপ ও মূল্য উঠে আসে, তা-ই নিয়ে বেঁচেছি— আর তার ভিত্তি রয়েছে বিশ্বজগতের উপলব্ধিতে। একই পথ ধরে আমরা হেঁটেছি, হয়তো নিজের মতো করেই এগিয়েছি, কিন্তু পথ ঐ এক।
শিল্পক্ষেত্রে আচার্যের সবচেয়ে বড় সাফল্য কোথায়— এ নিয়ে কিছু বলবেন।
রা : আমার মতে, তাঁর সমস্ত কাজকে একটা সমগ্র হিশেবে দেখতে হবে এবং তার নিরিখে তাঁর সাফল্যের বিচার করতে হবে। ছবি, অলঙ্করণ, রেখাচিত্র, ফ্রেস্কো বা ম্যুরাল— সব একসঙ্গে দেখলে দেখবেন, সর্বত্র তাঁর দক্ষ হাতের ছাপ স্পষ্ট, এবং তা অনুভব করা যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের কোন একটি কাজকে কি আপনি শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দিতে পারেন? তা হলে তার নাম করে বলুন। আচার্যের ক্ষেত্রেও এই একই
সমস্যা।
— আপনি ঠিকই বলেছেন, তবু তো আমরা সময়ে সময়ে স্রষ্টার তুঙ্গচূড়াটিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করি, আর সে চেষ্টা হয়তো খুব
অন্যায্যও নয়।
রা : এ বিষয়ে আর বিশেষ কিছু আমি বলতে পারব বলে মনে হয় না ।
কাজ হয় মানুষ দেখে
শিল্পে ভারতীয়তা বলে বিশেষ কোন ধৰ্ম আছে কি?
রামকিঙ্কর : এটাই প্রথম কথা। আছে মনে হয়। কারণ খ্রিস্ট ধর্ম বৌদ্ধধর্মের থেকে আলাদা। খ্রিস্টানরা খ্রিস্টের ছবি আঁকে, বৌদ্ধরা বুদ্ধের। কিন্তু কী করব, মানুষের ধর্ম একই। খ্রিস্ট, ভারতীয় বুদ্ধমূর্তির থেকে আলাদা। শিল্পী শিল্পীই, কিন্তু দেশজ ব্যাপারটা এসে যায়। . .
– শিল্পে ভারতীয়তা বলে আলাদা কিছু আছে কি? এবং এই দেশজ উপাদান কী ভাবে বোঝা যায় ?
রা : নেই, কিন্তু সে-ই হয়েই যাচ্ছে। ভারতীয় বলে যদিও আলাদা কোন সেকশন নেই। তবু ভারতীয় শিল্পীর করা শিল্পকে আমরা ভারতীয় শিল্পই বলে থাকি। শিল্প ইউনিভার্সাল হওয়া উচিত। কেন বলুন তো? খুবই স্বাভাবিক কারণে হয়ে যাচ্ছে। শিল্পী হিশেবে আমরা এক। কিন্তু বিভিন্ন দেশে, সম্পদে আলাদা করে তোলে।… শিল্পীর কাছে ভারতীয়তা বলে কিছু নেই। সব সমান।
―
এ কালের ভারতীয় ভাস্কর্য কী রকম হওয়া উচিত বলে আপনার মনে হয় ?
রা : লৌকিক। যেমন ওদের দেশে ক্রাইস্ট-এর মূর্তি হয়েছে লৌকিক পরিবেশে।
ছবির মধ্যে বা ভাস্কর্যের মধ্যে ভারতীয় বা পাশ্চাত্য ছাপ বোঝা যায় কী করে?
রা : বোঝা যায়। দেশ হিশেবে হয়। ওদের ধর্ম ও পরিবেশ আলাদা, আমাদের ধর্ম ও পরিবেশ আলাদা। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন — সব আলাদা। ধরতে গেলে হিন্দুধর্ম ব্রাহ্মণ্য, যেটা বুদ্ধের আগে। তারপর বুদ্ধ অব্রাহ্মণ। তারপর জৈন। হিন্দুর ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। বুদ্ধের কোন দেবতা নেই ।
— এ কালের ভারতীয় ভাস্কর্য কতটা পরিবর্তিত ?
রা : এখন যে-ভাবে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হচ্ছে— তা বিচার হবে কী করে? থাক না, কী দরকার ভাঙার যে লেখাপড়া শেখাল, তাকে অপমান করছি। যা-ই হোক, ভাস্কর্য এখন প্রাচীন প্রথা থেকে অনেক পালটেছে। আগে তো ওরিয়েন্টাল ধারায় হয়েছে। খেয়ালের ব্যাপার। দেশজ কোন ধারা বা নীতি এখন নেই। এই রকম করা দরকার বা সেই রকম করা উচিত বলেও কিছু নেই।…
দিল্লিতে আপনার করা সেই বিখ্যাত যক্ষ-যক্ষী আধুনিক ভাস্কর্যের উন্নত নিদর্শন, তার সম্বন্ধে কিছু জানাবেন ? রা : ওটা তো অরিজিনাল নয়— কপি, পুরনো থেকে।… পুরনো থেকে সেই কপি করার ধারাই চলছে। অরিজিনাল কেউ যদি করতে চায় তো আপত্তি নেই। তবে অরিজিনাল জোর করে করা উচিত বলে আমি মনে করি না। খুশি। আপন খুশিতে কাজ করবে।…
1
আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র
ভাস্কর্যে ভারতীয় ঐতিহ্য বিশাল, হয়তো শ্রেষ্ঠ, এই ঐতিহ্যকে কী ভাবে আমরা কাজে লাগাতে পারি ?
রা : কাজে তো লেগেই আছে। ঐতিহ্য তো আছে। এখনকার ভাস্করদের চেষ্টাও আছে। সেটা থাকা ভালো। মন যা চাইবে, সেই মতো কাজ করবে শিল্পী। তবে কপি করাটা অপরিহার্য।… মহেঞ্জোদাড়োর লিঙ্গ স্বাভাবিক আকৃতি থেকে কপি করে ভাঙতে ভাঙতে একটা ফর্ম-এ এসেছে। প্রথমে স্বাভাবিক ছিল, স্টাইলিশ হয়ে শিবলিঙ্গ হয়েছে বর্তমানে। যেমন প্রাচীন ওঁ শব্দটা এবং তার মধ্যে রাধাকৃষ্ণর ফর্ম আমার খুব ভালো লাগত, ছেলেবেলায় খুব কপি করেছি।
— আপনার শিল্পীজীবনের কথা কিছু বলুন, যা পরবর্তী ভাস্কর ও শিল্পীদের কাজে লাগবে।
:
রা : বিশেষ আর কী বলব। এই কাজ করে চলেছি আর কী। কতকগুলো পুরনো স্মৃতি মনে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ দীনবন্ধু এনড্রুজ-এর কনডলেন্স লিখছিলেন। আমাকে ডেকে পাঠালেন মূর্তি করতে। তখন ঐ রবীন্দ্রনাথের বাস্ট-টা করি। ক্যালিপার ধরা চলবে না। ক্যালিপার দেখলেই তাড়া করতেন। তখন এমনিই করলাম। চোখে বল-দেওয়া একটা ফর্ম-ভাঙা রবীন্দ্রনাথ তার আগে করি। মন্দিরে উনি যখন বক্তৃতা দিতেন, তখন দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কাঁচের ঝিলিমিলির ফাঁক দিয়ে এক্সপ্রেশন দেখতাম। ফর্ম ভাঙা হয়ে গেল। তার থেকে করলাম ঘাড়-গোঁজা রবীন্দ্রনাথের রিয়ালিস্টিক মূর্তি। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগেই করা ।
একদিন খুব মজা হয়েছিল। শান্তি (শান্তিদেব ঘোষ) ঐ চোখে বল-দেওয়া মূর্তিটা দেখিয়ে গুরুদেবকে একদিন বলেছিল, ‘এটা কী করেছে? একটা গোল!’ রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘হবে হয়তো। ছেড়ে দে ওটা।’
নন্দবাবু আমার গুরু।… ওয়ে টু দ্য মার্কেট মূর্তিটা লিঙ্গঅলা একটা করেছিলাম ছোট করে। উনি তা নিয়ে গেলেন রথীবাবুর কাছে। উনি হাসলেন। কী আর বলবেন ?
তখনকার দিনে আর্মেচার বাঁধায় খুব অসুবিধে হত। সুজাতা-র স্ট্রাকচার পাতলা রড ও খড় দিয়ে বাঁধা হয়েছিল। রুদ্র হাঞ্জি কর্ণাটকের ছেলে। ও স্কাল্পচার ডিপার্টমেন্টের প্রথম ছাত্র। বাঁশ ও খড় দিয়ে ও বুদ্ধ করেছিল ঐ জামগাছের কাছে। আলকাতরা আর মাটি দিয়ে ফিনিশ করেছিল। একদিন তা ঝড়ে ভেঙে গেল। ঐ নিয়ে নন্দবাবু পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। পরে দেখলেন, এক্সপেরিমেন্ট ফেলিওর। বললেন, হবে না ।
তারপর আমি কংক্রিট দিয়ে বুদ্ধ করলাম। তারপর সুজাতা করি। যখন রুদ্র মাটি-আলকাতরা দিয়ে কাজ করছিল, আমি কংক্রিটে কাজ করছিলাম। হার্ভেস্টার বলে একটা মূর্তি কলাভবনে আছে। মাথাটা ভেঙে গেছে। ওর মাকেট-টা শঙ্খ-র (শঙ্খ চৌধুরী) কাছে আছে।
যখন যেটা ইচ্ছে হত, তখন সেটা করতাম। ছোট মূর্তি, বড় মূর্তি— সব রকমই করতাম। গুরুদেব উৎসাহ দিতেন। বলতেন, কলা- ভবন তোমার ভাস্কর্যে ভরে দাও। অবনীবাবুর পোর্ট্রেট করেছি শেষের দিকে। ওটা আছে জোড়াসাঁকোতে। উনি তিনটে সিটিং দিয়েছিলেন। ওখানে একটা মোষ দিয়ে করা ফোয়ারার ভাস্কর্য আছে। অনেকে ভুল করে বলে, মোষটা জিভ বার করে ফোয়ারা থেকে পড়া জল খাচ্ছে। আসলে মোষটা জল খাচ্ছে না, নাক পরিষ্কার করছে। মোষটার পিছনটা লেজের মতো। ওটাই কোয়েশ্চেন। গরমের সময়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। মোষের গাড়ি যাচ্ছিল। বাঁধ ছিল ভুবনডাঙায়। সব মোষ যেতে-যেতে জালে পড়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম— লেজ দিয়ে গায়ে জল ছেটাচ্ছে। আমার মাছের মতো লাগল। তখন ওটা আমার অরিজিনাল আইডিয়া হয়ে গেল। জল-ঢালা ভিস্তির কাজটা সুরেন আর আমি দু-জনে মিলে করি। মাকেট-টা আমার করা। ওটা হারিয়ে গেল। ও বোধ হয় কাউকে দিয়ে দিয়েছিল।
ঋত্বিক আমার খুব বন্ধু ছিল। একসঙ্গে কত সময় কাটিয়েছি।… আলাউদ্দিন খাঁ-এর সঙ্গে পরিচয় ছিল। আলি আকবর,
ওঁর ছেলে,
২৩
রামকিঙ্কর বেইজ
এখানে ব্যাঙ্কের কাছে থাকত। ওকে বললাম যে, আমার একটা পোর্ট্রেট করার ইচ্ছা। উনি দারুন মানুষ। সরল মানুষ। শিশুর মতো। পর দিন যেতে বললেন। আমি পর দিন গিয়ে করলাম। ওটা দিল্লিতে সাহিত্য আকাদমিতে আছে!…
এখন আপনার কী ধরনের কাজ করতে ইচ্ছা হয় ?
রা : চোখ তো খারাপ । চোখটা দেখাই আগে। এখন অবশ্য এমনি কাজ করি।… বড় ভাস্কর্য ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই করব। বড় স্কাল্পচার করতে গেলে খাটতে হবে। চোখ ভালো নয়। তবে ইচ্ছে আছে। সাবজেক্ট কিছু ভাবিনি। খুব খাটুনির কাজ। তখন আমি টিচার, সাঁওতালদের মূর্তিটা যখন করি, এগারোটা পর্যন্ত ক্লাস করতাম। বাগাল, কাশী— ওরা সব হেল্প করত। কাশী তিনটের সময়ে রান্না করত আর আমরা রাতে একসঙ্গে সবাই মিলে খেতাম সেই রান্না। সাঁওতাল মেয়েদের মূর্তিটা যখন করি, তখনও ওরা ছিল।…
নতুন বিষয় কিছু ভাবছেন কি?
রা : বিষয় যা আমরা দেখি। ঐ পিয়ার্সন পল্লীর সাঁওতালরা আমার মডেল ছিল। ওরাই তো কাজ করছে। এ আর নতুন কী ঘটনা ।
— আপনার ভাস্কর্য বা চিত্রকলা সঙ্গীত বা নাটক দ্বারা কখনও অনুপ্রাণিত হয়েছে কি?
রা : হ্যাঁ, আমি গুরুদেবের প্রায় সব ড্রামা স্টেজ করেছি, এখন আর করি না। সাঁওতাল মূর্তি যখন করি, তখন রবীন্দ্রনাথের, ঐ যে গো জালের মধ্যে রাজার সেই পাগলা বাউলের পার্ট করি। নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। ওতে কানাই সামন্তও পার্ট করেছিল। রক্তকরবী-তেও পার্ট করি, বিশুর পার্ট। সবই সঙ্গে-সঙ্গে চলেছে, কখনও নাটক করেছি, কখনও মূর্তি করেছি।…
লালন ফকিরের গান থেকে অনুপ্রেরণা জাগে। কেঁদুলি অনেকবার গেছি। . . .
সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র পড়েছি। উৎসাহ পেয়েছি। বই পড়ে সে রকম কিছু করিনি।
ফ্যাক্ট নিয়ে কাজ হয় না। ঐ রকম ডেরিভেটিভ আমি নই। মানুষকে দেখে কাজ হয়। আজকালকার সাঁওতাল ঐ রূপ আর পারে না। সেকালে ছিল। সেকালে সব ধান কাটতে বেরুত, ঐ রকম ছেলেপুলে-কুকুর নিয়ে বেরুত।. . .
―
নবীন শিল্পীদের উদ্দেশে আপনার কোন বক্তব্য আছে?
রা : বলব আর কী? নতুন আর্টিস্ট আসবে, পুরনো আর্ট-কে ছাড়িয়ে যাবে। তবে যেতেই হবে যে এমন কোন মানে নেই। আবার পারবে কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন। তবে নতুন আর্টিস্টরা নতুন-নতুন কাজ করবে। তা যা-ই হোক না কেন, অনেক সৃষ্টি হবে। সুন্দরের সাধনা হবে। এই তো চাই ।
এই পাথরে ই ফু ট বে হা সি
জীবনের উপবনে দাঁড়িয়ে আমরা দেখি উদীয়মান সূর্যের সোনালি কিরণ প্রাণের বাণী বয়ে আনছে। পাখিরা গানে আর নাচে সে বাণী ছড়িয়ে দিচ্ছে। গাছে-গাছে পাতার উন্মেষ। ফুলেরা পাপড়ির কপাট খুলে হাসে। মধুকর আর প্রজাপতির গুঞ্জরণ শুরু হয়। মনের আনন্দে উদ্যানে
তারা নেচে বেড়ায় ।
অমৃতের সন্তান আনন্দমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ । অরুণবসনা ধরিত্রীর কুহকজাল চারিদিকে বিস্তৃত। কর্মযজ্ঞে মানুষের প্রস্তুতি শুরু হয়। তারা ছোটে মাঠে-মাঠে আর কারখানায়। কাজ, কাজ আর কাজ। দু-মুঠো ভাত আর নুনের জন্য দৈনিক আট ঘণ্টা তারা খাটে। কিন্তু এ খাটুনি তাদের গায়ে লাগে না। কারণ ধরণীর আগুনধরা রূপে তারা মুগ্ধ। ফুলে-ফুলে বিচিত্র রঙ। নয়ন-ভুলানো তাদের গড়ন। সর্বনাশা তাদের কুহক ।
জীবন-উদ্যানের বাঁকে-বাঁকে বিচিত্র অনুভূতি—— প্রেম, ভালোবাসা, অনুতাপ, জিঘাংসা, ঘৃণা, ক্রন্দন, মৃত্যু, সৃষ্টি, আনন্দ ও দুঃখ। এখানে সম্মিলিত কবি, চিত্রকর, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, নর্তক ও গায়কেরা। আপন-আপন উপকরণ দিয়ে শুরু করেন তাঁদের কাজ সাহিত্যিকের সাধনা জীবনালেখ্য ফুটিয়ে তোলা। কবিরা কাব্যরচনায় মুখর। গান আর সুর, মাতিয়ে তোলে গায়কদের। দার্শনিকরা সহজ সত্তার অন্তরালে সত্যের অনুসন্ধান করেন। শিল্পী রঙে-রঙে চিত্রপটে ফুটিয়ে তোলেন এই উদ্যানের সৌন্দর্য। বিজ্ঞানীরা বিশ্ব-রহস্যের তত্ত্ব উদ্ঘাটন করতে ব্যস্ত। বিস্ময়কর তাঁদের আবিষ্কার। বিপুল জ্ঞানসম্ভারকে মানুষ তবু বিনাশ ও ধ্বংসের কাজে লাগায়।
বিশ্বসত্তার সৌন্দর্য ও আনন্দ প্রকাশ করতে আর-একজন মানুষ এগিয়ে এল। কাঁধে তার পাথরখণ্ড, হাতে হাতুড়ি ও বাটালি। লোকেরা তাকে জিজ্ঞেস করল— শেলি বা কিট্স-এর মতো তুমিও চেষ্টা করো না কেন কাব্যের ভাষায় বলতে? শেস্পিয়ার বা কালিদাস-এর মতো নাটক লেখার প্রয়াস কেন করো না? পাথরখণ্ডে কী করে পাগল-করা বিশ্বরহস্য বিধৃত করা সম্ভব হবে? সে বলল বিনম্র ভাবে— না গো না, যা-ই বলো, আমি চেষ্টা করব। আমি বিশ্বকর্মার পুত্র। সে-ই বিশ্বকর্মা, যিনি সৃষ্টি করেছেন সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্রপুঞ্জ।
>
এ সৃষ্টির প্রতিটি অণু কাঁপছে বিশ্বসত্তার স্পন্দনে। গাছপালার আকুতি সূর্যালোকের দিকে। সহজ প্রবৃত্তির বশে তারা শিকড় চালাচ্ছে ধরিত্রীর গভীরে খাদ্যের সন্ধানে। মানুষ, প্রাণী, পক্ষী, পতঙ্গ— সবারই দেখি প্রয়োগকুশলতা। মানবশরীরের মূল কাঠামো কঙ্কাল ধারণ করে তার দেহকে। মাংস, পেশী ও মেদকে দেয় স্থায়িত্ব। সুন্দরী তরুণীর গালে লাল আভা আমরা দেখি। গাছপালা মাটিতে শিকড় ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু মানুষ এবং অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে তা নয়। তারা পেয়েছে ঘুরে বেড়ানোর মুক্তি। ধন্য বিশ্বকর্মার শিল্পনৈপুণ্য ! এই যে বিশ্বজোড়া
২৬
আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র
অসীমের লীলা, শিশুসুলভ হলেও তাতে আছে শিল্পীর উমেদারি, অনুগত শিষ্যের মতো। এই যে দেখছ পাথরের বোঝা, এ আর ভারি থাকবে না। সৌন্দর্য আর আনন্দের রূপরেখা এর রূপান্তর ঘটাবে। দেখবে গো দেখবে! এই পাথরেই ফুটবে যুবতীর হাসি আর ফুলের কোমলতা। তোমাদের সাহিত্যকৃতি থাকবে আলমারির কোণায়। উই আর কীট তা সাবাড় করবে। তোমাদের গান লীন হবে অনন্ত আকাশে। কিন্তু এ আমি সত্য বলে জানি যে, ঋতু ও প্রকৃতির বিধ্বংসী রঙ্গ সত্ত্বেও এ পাথর কালজয়ী হবে।
এই হল ভাস্কর্যের গোড়ার কথা ।
এটা সবার জানা যে ভাস্কর্যকে বিচার করতে হবে সব দৃষ্টিকোণ থেকে। অর্থাৎ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর বেধ—এই তিন দিক থেকেই তাকে দেখতে হবে। দৈর্ঘ্য-প্রস্থসমন্বিত চিত্রপটের সমতলে আঁকা হয় ছবি। অঙ্কনপদ্ধতি বেধের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু চিত্রের প্রকাশ মুখর হয় রঙে আর রেখায় । রোমের গির্জায় মাইকেল অ্যাঞ্জেলো-র ফ্রেস্কোচিত্র, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি-র লাস্ট সাপার ও মোনালিসা, রাফায়েল-এর ম্যাডোনা, রেমব্রান্ট ও রুবেন্স-এর চিত্রসকল, এল গ্রেকো প্রভৃতির দিকে তাকালে এ সত্য প্রতিভাত হবে।
ভারতবর্ষে অজন্তার প্রাচীরচিত্র, সিগিরিয়ার ফ্রেস্কো প্রভৃতি রঙের বৈচিত্র্যে, বিশ্বসত্তার উদ্দীপনায় চঞ্চল। পদ্মপাণি বুদ্ধ এবং বুদ্ধের আরও অসংখ্য মূর্তি রঙ এবং মনোভাবব্যঞ্জক অঙ্গবিন্যাসের অপূর্ব প্রকাশ। কাংড়া ও রাজপ
হসীজপুতানার চিত্রে ভিন্ন ধরনের প্রকাশভঙ্গি দেখতে পাওয়া গেলেও বিশ্বসত্তার স্পন্দন তাতে অনুভব করা যায়। এই আত্যন্তিক অনু মনে বিস্ময় জাগায় ।
ARBOL.CO
কিন্তু এই রঙহীন প্রস্তরীভূত মূর্তিগুলি কী? কী এদের বাণী? রঙ নেই তবু কেন এদের আকর্ষণ দুর্মর? প্রশ্ন এখানেই । জনৈক সাক্ষাৎকারী আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কোনটা আমি বেশি ভালোবাসি — চিত্র, না মূর্তি গড়া? উত্তরে আমি বলেছিলুম,
জঙ্গলের খেলা, ফুল ও রূপবতী তরুণীর সৌন্দর্য যখন ব্যক্ত করতে চাই,
রঙ আর আলোর আনন্দ প্রকাশ করতে যখন মন চায়, আকাশ তখন আমি হাত দিই রঙ আর চিত্রপটে।
,
কিন্তু সূর্যাস্তের বিষণ্ণ রাগের অবসানে আমি চোখ বুজি। মধ্যরাত্রির অন্ধকারে যে-শিশু কেঁদে ওঠে, তাকে তোষণ করতে হয়, তার গায়ে স্নেহের পরশ বোলাতে হয়। এই হল ভাস্কর্য। এই গম্ভীর প্রকাশ আত্যন্তিক আপন ও গভীর। রঙ নেই, আলোছায়ার খেলা নেই, আছে শুধু প্রাণশক্তির চেতনা। এর গরিমা রঙের সীমা অতিক্রম করে, রূপ নেয় কঠিন সত্যের মধ্য দিয়ে মাতৃগর্ভে সদ্যোজাত শিশুর মতো। সেই ভাবের প্রেরণায় আকাশতলে ছড়িয়ে দিই ভাবনার প্রতিমূর্তি। সূর্যের আলোয়, চাঁদের কিরণে, রাতের অন্ধকারে ও রিমঝিম বর্ষণের দিনে আমি তাকে দেখি ।
ভাস্করের উপকরণ সীমাবদ্ধ ও নিয়মের অধীন। তার প্রকাশমাধ্যমও সীমিত। আঁধারে রক্তমাংসে গড়া যে-মূর্তির অনুভূতি জেগেছিল, তার রূপ দিতে হবে পাথরে। ভাস্করের সমস্যা এটাই। কিন্তু এখানে সমাধান নেই।
প্রকৃতির কাছ থেকে সে নিচ্ছে প্রত্যহের পাঠ। আর আছে বিশ্বসত্তার স্বজ্ঞা-সম্ভূত অনুভূতি, পরিকল্পনা আর সত্যের প্রকাশসৌকর্য। সৎস্বরূপের অমূর্ত মূর্তি প্রস্তরে মূর্ত করতে রূপহীনতার অজানা কূলে তাকে নামতেই হয়। কৃষ্টির প্রারম্ভের ইতিহাস থেকে শুরু করে আমরা দেখি এই সুকঠিন মাধ্যম আকাশতলে দাঁড়িয়ে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে।
২৭
রামকিঙ্কর বেইজ
মিশর, গ্রিস, ব্যাবিলন, ভারতবর্ষ, এসিরিয়া, সুমের, চিন, জাপান, ক্রিট ও আরও বহু স্থানের সুপ্রাচীন মূর্তি আমরা দেখি। ভারতবর্ষে দেখি মহেঞ্জোদারোতে খৃস্ট পূর্ব তিন সহস্রাব্দের ভাস্কর্য-নিদর্শন। আজও মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় একটা মূর্তির জন্য। সেটা কী? তা হচ্ছে গোরো- স্থান (Goro-sthan) থেকে আনা মহেঞ্জোদারোর সময়কার শিবলিঙ্গ। মথুরা, সারনাথ ও অনুরাধাপুরের দণ্ডায়মান বুদ্ধমূর্তির দিকে তাকালে চোখ জুড়োয় । বুদ্ধগয়ার শয়ান বুদ্ধ ও দণ্ডায়মান আনন্দমূর্তির দিকেও তাকাও। পঁচাত্তর ফুট উচু শ্রবণবেলগোলার মহাবীরমূর্তি একটি মাত্র বিশাল প্রস্তরখণ্ড কেটে তৈরি। পৃথিবীতে এমনটি আর নেই। মাকারনার মূর্তিগুলিতে আকারের সে ঐতিহ্য বজায় আছে। কামনা করি, প্রকাশের সেই উচ্চ আদর্শ যেন নষ্ট না-হয়।
আর-একটি ব্যাপার আমাদের অবহেলা করা উচিত নয়- সেটা ভাস্কর্যকে স্থাপত্যসজ্জার কাজে লাগানো। ভাস্কর মুক্তাঙ্গন ঘিরে মূর্তি নির্মাণ করতে চেয়েছেন। প্রায়ই বিশেষ অবস্থায় তাকে দেওয়ালের সমতল থেকে মূর্তির কাজ করতে হয়েছে। সারা বিশ্বে মানবকৃষ্টির আদি যুগ থেকে তা শুরু হয়েছে। উচ্চ বন্ধুরতা বা অর্ধোন্নত আনুভূমিক কাজ চিত্রণ আর ভাস্কর্যের সম্মিলিত ফল সৃষ্টি করে। প্রাচীন গির্জা ও ভারতীয় মন্দিরে, যেমন মহাবলীপুরম, এলিফ্যান্টা, এলোরা ও কোণারকের অনেক দেওয়ালে জীবন্ত মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। প্যারিসের নত্র দামে গোটা গির্জাটা মহাপুরুষদের জীবনালেখ্য, পশুপক্ষী আর প্রাণীর মূর্তি দিয়ে সজ্জিত। বেলাভূমির তীরে কোণারকের সূর্যমন্দিরের বিশালতা ভাত বেলাভূমির তীরে কোণারকের সূর্যমন্দিরের বিশালতা ভাস্কর্যনৈপুণ্যে সমুজ্জ্বল। মহাবলীপুরমে বিশাল পাহাড়ে সুস্পষ্ট করে মূর্তি বোদিত। এতে আছে মহাভারতের কাহিনী। অত্যাশ্চর্য ভাবে জীবন বিধৃত হয়েছে এখানে। এলোরায় আছে নটরাজ শিব ও ভৈরবের মূর্তি। এলিফ্যান্টার গুহায় ত্রিমূর্তি ও অসংখ্য মূর্তি ক্ষোদিত । নটরাজের নৃত্য দক্ষিণ ভারতীয় ব্রঞ্জে বিধৃত। বিশ্বসত্তার তত্ত্ব ব্রঞ্জে অভিব্যক্ত
অন্যান্য স্থানে বিশ্বকর্মার বরপুত্রের অসংখ্য প্রস্তর ও ধাতব মূর্তি বিমান।
* বস্তার মধ্য দিয়ে। ভারহুত, আওরঙ্গাবাদ, খাজুরাহো, অমরাবতী এবং
MA
অতীতের গৌরবময় কীর্তি থেকে এখনকার ভাস্কর্যশিক্ষার্থী প্রত্যহের প্রেরণা আর পাঠ গ্রহণ করে লাভবান হতে পারছে। আমরা আধুনিক কালের ভাস্কর। অনেকে বলেন, এ যুগে ভালো ভাস্কর্যনিদর্শন নেই। এর কারণ আমরা চাই শ্রবণবেলগোলার মহাবীর বা মোজেস-এর মতো বিশালাকৃতি এক পাথরে ক্ষোদাই করা মূর্তি কয়েক মাসের মধ্যেই সৃষ্টি হোক। কারণ, এ যুগের সভ্যতা গতিময়। পায়ের নিচে আমাদের মাটি নেই, আছে অপসরণশীল বালুকাভূমি। প্রাচীন যুগের মতো ধর্মে আমাদের শ্রদ্ধা নেই ।
২৮
জী ব নে র এক পৰ্ব
পাড়ার একজন, বয়সে বড়, কলেজে পড়তেন। সংগৃহীত একটি রাফায়েল-এর ম্যাডোনা-র ছবি এনে বলেছিলেন, ‘এটা কপি করো, কিছু শিখতে পারবে।’ আমি নিয়েছিলেম।
এই সময়টাতে প্রতি দিন সন্ধ্যেবেলায় বাবাকে রামায়ণ পড়ে শোনাতে হত। বনবাস অধ্যায়ে সীতার দুঃখ মনে ভীষণ ভাবে ধাক্কা দিল। রাফায়েল-এর ম্যাডোনা-র ছবি না-এঁকে সীতার কোলে লব ও কুশের ছবি আঁকলাম। সীতার পরনে গেরুয়া রঙের কাপড়। ভদ্রলোকটি দেখতে চাইলেন । আমি বললাম, ‘ম্যাডোনা না-করে আপাতত সীতার বনবাসের ছবি করলাম। ম্যাডোনা পরে করব— দেখুন।
তিনি মূল্য বুঝলেন না। ক্ষুব্ধ হলেন, বললেন, ‘আমি ম্যাডোনা আঁকতে বলেছিলাম, এটা আবার কী! দাও-দাও!’ ছবিটি ফেরত নিয়ে
কিছু অর্থও পেয়েছিলাম। ছবিটি তাঁরই হাতে রয়ে গেল।
গেলেন। সীতার ছবিখানা একজন বন্ধু ভারতবর্ষ-এ ছাপিয়েছিলেন। O COIN বাস
MARBOL
তারপর নন কো-অপারেশনের পালা— স্কুল-কলেজ সব
বি বৃদ্ধ হল। একজন হিতৈষী প্রফেসর ধরে নিয়ে গিয়ে ন্যাশনাল স্কুলে নাম লেখালেন এবং কংগ্রেসের কাজও শুরু হল। কংগ্রেসের পরিচালক ছিলেন অনিলবরণ রায় মহাশয়। তিনি আমাকে চরখা বিতরণের কাজ না-দিয়ে লেখা- জোকা এবং প্রসেশন-এর জন্য লিডারদের ছবি আঁকার কাজ দিতেন। সেগুলি তেলের রঙ দিয়ে আঁকতাম বড় ক্যানভাসে।
এই সময়ে শ্রদ্ধেয় রামানন্দবাবু বাঁকুড়ায় গেছলেন। আমার একজন বন্ধু তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় আমাদেরই পাড়ার মানুষ। বহু দিন তিনি বাঁকুড়ায় যান নাই। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হবার সুযোগ হয় নাই। আমার ছবিগুলি দেখলেন। বললেন, ‘তুমি শান্তিনিকেতনে চলে এসো, লিখে জানাব।’
চিঠি পেয়েই রওনা হলাম। ১৯২৫ সালে আচার্য নন্দলাল বসু মহাশয় তখন কলাভবনের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি আমার তেলের এবং অন্যান্য ছবিগুলি দেখলেন। বললেন, ‘এই তো হয়ে গেছে, আর কেন?’ পরে ভেবে বললেন, ‘আচ্ছা, দু-তিন বছর থাকো।’
আমার আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত ক্ষীণ, এই ক্ষেত্রে নন্দবাবু আমাকে বাঁচিয়েছিলেন। শ্রদ্ধেয় জগদানন্দ রায় মহাশয় ছেলেদের জন্য বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক লিখতেন– তার জন্য ইলাস্ট্রেশনগুলি এখানেই করা হত। কিছু-কিছু ইলাস্ট্রেশনের ভার থাকত মণিভূষণ গুপ্তের উপর। তিনি আমাকেও কিছু অলঙ্করণের ভার দিতেন। সেইটেই আমার পক্ষে সেই মাসের জন্য যথেষ্ট হয়ে গেল। সেই বৎসরই আমি কিছু ছবি এঁকেছিলাম এবং বিক্রিও হয়েছিল। তখন আচার্য অবনীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে আর্ট সোসাইটি (ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট)
৩০
আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র
নামে একটি ‘কলেজ’ করা হয়েছিল। সেখানে গভর্নমেন্ট আর্ট আকাদেমি-র মতো বিলাতি ফ্যাশনের শিক্ষা হত না। ভারতীয় শিল্প পুনরুদ্ধার করার প্রয়াসে শিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছিল অন্য রাস্তায়। সোসাইটি থেকে (কলকাতায় শিল্প প্রদর্শনীতে) ছবি যেত। আমারও বিক্রি হত।
আচার্য নন্দলাল বসু মহাশয় কলকাতার আর্ট সোসাইটিতেই ছিলেন। কবি রবীন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথকে একরকম বিশেষ অনুরোধ করেই (তাঁকে) শান্তিনিকেতনে আনার ব্যবস্থা করেন ।
এখানে প্রাচ্য প্রথায় জলরঙের ব্যবহার ছিল— আমিও শুরু করি। অনেকগুলি এঁকেছিলাম এবং এক্সিবিশনে বিক্রিও হয়েছিল। কে কিনেছিলেন, কোন পাত্তা নাই। দু-তিন বছর পর পুরানো অভ্যাসটি ফিরে এল – তেলের রঙে কাজ এখনও চলেছে। এই সময়টিতে সোমা যোশি, স্বপ্নময়ী এবং অন্যান্য প্রতিকৃতি জাতীয় (কাজ করেছি)। আবার একটা পুরানো অভ্যাসের অবতারণায় মাটির কাজ শুরু (করি)— প্রথম বিনোদবাবুর প্রতিকৃতি, তার পর সৈয়দ মুজতবা, কৃষ্ণ কৃপালনি, ওস্তাদ আলাউদ্দিন। এই (শেষ) কাজটি বর্তমানেও দেখা যায় (দিল্লির) সঙ্গীত আকাদেমিতে রক্ষিত। এ সময়টাতে আমার স্টুডিয়ো বলতে পুরানো লাইব্রেরির গৌরপ্রাঙ্গণ তোরণ নামে ছোট দোতলাটির ওপর তলায় ।
তখনকার প্রথম মূর্তিশিল্প শেখার জন্য একজন ছেলে—— নাম ছিল রুদ্রাপা
বারান্দায় শিবের বিয়ের প্যানেলগুলি, গরমের ছুটিতে মূর্তিশিল্পের ছাত্র যাঁরা, তাঁদের মাটি-আলকাতরা মিশানো তৈরি মাটি দিয়ে।
বাইরে রাখার কাজ গোবর-মাটি দিয়ে? ছেলেমানুষি। হাসলেম
– তার কীর্তি অনেক। কালো হস্টেল-এর ভিতরের
করা হয়েছিল। রুদ্রাপ্পা বুদ্ধমূর্তি করেছিলেন গোবর-
মরি ইচ্ছা হল সিমেন্ট-মোরামের কাজ করার। আচার্যদেব প্রথমে
হাতে আসল। পরে আচার্যদেব মাথায় একটি বাটি বসিয়ে দিতে – বি দিয়ে
অস্বীকার করলেও পরে ব্যবস্থা করলেন। তখন আমার জীবন্ত মানুষের নেশা। জয়া নামে একটি ছাত্রীর মডেল নিয়ে আট-নয় ফুট একটি মূর্তি
জন্য প্রতীক্ষায়। এই গল্প আর কী !
তখনও বিশ্বভারতী আমার ভাতের কোন ব্যবস্থা
AMARRÓL,
নাম দেওয়া হল। সামনেই রুদ্রাপ্পার বুদ্ধদেবের মূর্তিটি পায়সান্নের
নাই। অবৈতনিক আচার্যদেব একশো টাকা পেতেন শুনেছিলেম। আমার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়— একটি কোন চাকুরির প্রয়োজন। একটি কাজের খবর পেলাম দিল্লিতে। মডার্ন স্কুলে, বন্ধু বনবিহারীর নামে। দেখলাম, বন্ধু, অন্য ভালো কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সেই বিকেলেই দিল্লি রওনা হয়ে গেলাম।
মর্ডান স্কুলটি হাইস্কুল, কাজটি ছ-মাসের জন্য। কাজ তো নিলুম। আমি তো এ কাজের মানুষ নই। তখন ওদের নতুন স্কুলবাড়ি তৈরি হচ্ছিল। চুন ভালো, সুরকিও ভালো দেখে আমার ইচ্ছে— সময়টি কাটাবার ভালো উপায় চাই। প্রিন্সিপ্যালও খুব খুশি। একটি সরস্বতীমূর্তি শুরু করে দিলেম— প্যানেলটি ছয় ফুট চার ইঞ্চি উঁচু। তখনও ছ-মাস শেষ হয় নাই। ছুটি নিলেম। একশো টাকা বকশিস দিয়েছিলেন । বাড়ি ফেরবার টাকা যোগাড় হয়ে গেল। একেবারে সোজা শান্তিনিকেতনের টিকিট। দিল্লিতে আমি দেড়শো টাকা পেয়েছি দেখে আচার্য মহাশয় খুব খুশি।
বিনায়ক মাসোজি তখন শ্রীনিকেতনে কাজ করতেন পঁচাত্তর টাকা মাসোহারায়। আমেদাবাদে সারাভাইদের কমিশনে একটি কাজ পেয়ে শ্রীনিকেতনের কাজে ইস্তফা দিলেন। বিনোদবাবু কলাভবন লাইব্রেরি (দেখার) জন্য কিছু অর্থ পেতেন। শ্রীনিকেতন হতে মাসোজি-র দরুন পঁচাত্তর টাকা থেকে পঞ্চাশ টাকা ভাগ করে দু-জনের ব্যবস্থা করা হয়। সেই দিন হতে আমিও বিশ্বভারতীর একজন বেতনভোগী ভৃত্য
হলেম।
৩১
রামকিঙ্কর বেইজ
তিনটি বড় জানালা-দেওয়া একটি স্টুডিয়ো করার কাজ চলেছিল– সেখানেই আমার কাজের জায়গা ঠিক হল।
প্রথমেই আমার চোখে পড়ল— দিল্লি যাবার আগে তোরণের স্টুডিয়োতে কাজ করার সময় একটি সাঁওতাল দম্পতির বাইশ ইঞ্চি মতন মূর্তি করেছিলেম মাটি দিয়ে, খাবার অভাবের দিনে সব ভুলেই গেছলেম, ভাঙা (অবস্থায়) পড়েছিল— আচার্য মহাশয় সেটি যত্ন করে রেখেছেন, সুতো দিয়ে বেঁধে। দেখে আমার অপার আনন্দ হল। সেইটিকে বড় করে করার ইচ্ছা হল। আচার্যদেব সব রকম আয়োজনের ব্যবস্থা করে দিলেন।
মূর্তিটির তেরো-চোদ্দ ফুট উচ্চতা হবে। সামনে একটা তাঁবু খাটানো হয়েছিল। কাশীনাথ আর বাগাল, দু-জন মশলার কাজে থাকত । স্কুলের কাজ শেষ হলে পর আচার্যদেব, বিনোদবাবু (সহ) তিনজনে বসে লাল চা, মানে দুধবিহীন, লেবু দিয়ে পান করা হত। আচার্য একদিন বলেছিলেন, মূর্তি হচ্ছে একটি স্রোতের ধারে ঘূর্ণির মতন, ঘুরে আর ঘুরে শেষ হচ্ছেই না। দেখতে-দেখতে আর-একটা বড় স্রোত এসে পুরনো ঘূর্ণি ভেঙে-ভেঙে আর-একটা ঘূর্ণি শুরু করে।— এমনি সব গল্প হত।
এই সময়টিতে রবীন্দ্রনাথের তাসের দেশ নাটকটির প্রথম মহড়া চলছিল।
MARBOL.COM
লোকে বলে, সাঁওতাল কি আর আর্ট বোঝে? কথাটা ঠিক নয়। একদিনের কথা বলি। একজন মাঝি, দেখি খুব মন দিয়ে দেখছে, কখনও বহু দূরে চলে যাচ্ছে, আবার কাছে আসছে, চারদিকে ঘুরছে— যেটা স সাধারণত করে না। আমি ভারাতে কাজ করছিলাম। কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, “কী করছিস বাবু?”
আমি বললেম, ‘এই তোদের মতন একটি মাঝি করার চেষ্টা করছি।’
লোকটি হেসে বলল, “হাঁ, খেতাবটা মাঝি বটে, কিন্তু হইচে দেবতা।’— এ মন্তব্যটি আমাকে খুব আনন্দ দিয়েছিল।
একটা কথা বলা প্রয়োজন মনে করি। আচার্য বসু মহাশয়ের উপদেশ ছিল— কলাভবনে ছবির বইয়ের অনেকগুলি আলমারি থাকত, সে সব ভালো করে দেখতে বলতেন। তা ছাড়া হ্যাভেল-এর লেখা বইগুলি পড়বার জন্য নিয়মিত ভাবে ইংরাজির প্রফেসর জাহাঙ্গির বকিল সাহেবের কাছে পড়তে বলতেন— সে হত সন্ধ্যের সময়। তাছাড়া বড় লাইব্রেরিতে আমার নিজের পছন্দমতন পড়তেম ইংরাজি ছাড়া রুশিয়ার ইংরাজি অনুবাদ। ইংরাজির মধ্যে তখনকার সময়ে বার্নার্ড শ-র বইগুলি আমার বেশি পছন্দ হত। প্রিফেস-সহ পেরেন্টস অ্যান্ড চিলড্রেন, ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান। পকেট ডিকশনারিটি নিয়ে বৈতালিকের আগে বিনয় ভবনের ওখানের শালবনে নাটকীয় ভাবে চিৎকার করে পড়ার ব্যাপার চলত। কোন লোক একদিন সুরুল-রাস্তা হতে শুনে জিজ্ঞাসা করেছিলেন— আমি কার সঙ্গে ঝগড়া করছি? নাটকীয় ভাবে কীনা! ফিরে গিয়ে খাবার খেয়ে ক্লাসের কাজ শুরু করতেম। এ অভ্যাসটি বহু দিন করেছিলাম— সে জন্যই পরে নাটক করার বাই গড়ে উঠেছিল এবং গুরুদেবের রক্তকরবী পর্যন্ত অনেকগুলি নাটকের অভিনয়ের রিহার্সেল করেছিল প্রথম নাটক মুক্তধারা হতে শেষ রক্তকরবী-তে নিজেরও পার্ট ছিল।
৩২
বিশ্বকর্মার বর পুত্র
তখন নন কো-অপারেশনের সময় — ইংরেজি ১৯২৫ সাল। গভর্নমেন্টের ইস্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে। খোলা হয়েছে ন্যাশনাল ইস্কুল । বড়-বড় অধ্যাপকরা সেখানে পড়ান। আমিও সেই রকম একটি ইস্কুলের ছাত্র ছিলাম। ঘরে-ঘরে চরখা বিতরণের দায়িত্ব আমার ছিল না। আমার যত না ছিল পড়াশুনা, তার চাইতে মিছিলের নেতাদের বড় করে ছবি আঁকার কাজই বেশি ছিল। কখনও বা উল্লেখযোগ্য উদ্ধৃতি ভালো করে লিখে কংগ্রেস অফিসের দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিতাম। স্কুলের পত্রিকাতে রঙিন দেওয়া আমার অন্যতম কাজ ছিল। সেই সময় প্রায় সমস্ত বড় নেতারাই বাঁকুড়া গিয়েছিলেন— বিপিন পাল, সি আর দাশ থেকে শুরু করে গান্ধিজি পর্যন্ত ।
MARBOI.CON
একদিন আমার সহপাঠী বললেন, ‘রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় এসেছেন— চলো, দেখা করে আসি। দেখা হল এবং কাজ কিছু দেখলেন। পরের দিন দেখি, আমার কুঁড়েঘরে স্বয়ং এসে আমাকে ডাকাতে ‘কী করছ, দেখি?’ আমি তখনকার কাজ দেখালেম। পরে বললেন, ‘আমি আজ চলে যাচ্ছি, তোমাকে চিঠি লিখব, তুমি চলো এসো এই একটি বিশেষ গুণ ছিল — খুঁজে খুঁজে মানুষকে টেনে বের করে আনা। এর দু-এক দিন পরেই একটি চিঠি পেলেম — কোন রাজা এবং কী ট্রেন, ঠিকানা ইত্যাদি। চলে এলেম।
এটা শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়। আমি অবাকু আমি চেয়েছিলাম কলকাতার শিল্পবিদ্যালয়ে যেতে। ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ে এসে কী হবে? আমার কি কৌপিন পরার পর্ব এখনও শেষ হয়নি ?যা-ই হোক, তিনি সকালেই আমাকে জেনারেল লাইব্রেরির উপরতলায় কলাভবনে নিয়ে গেলেন এবং আচার্য নন্দলাল বসুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তখন নন্দলালবাবুর শিল্প সম্বন্ধে আমার ধারণা বেশি কিছু ছিল না। যা কিছু প্রবাসী-র অ্যালবামে দেখেছি। তা-ও বেশি নয়। তা ছাড়া আমার আসক্তি তখনও ছিল প্রাকৃতিক বাস্তবতামূলক শিল্পের প্রতি। ভারতীয় শিল্প ভালো লাগত না তা নয়— কিন্তু বাস্তবতার ভিতর দিয়ে না-গেলে সেটা সার্থক হবে না- এটাই ছিল মূল ধারণা। যার ফলে পরবর্তী কালে শান্তিনিকেতনে প্রাকৃতিক বাস্তবতার সূচনা হয়েছে। এখনও চলেছে। ছাত্রদের অ্যানাটমি ও মাস্ল সম্বন্ধেও শিক্ষা দেওয়া হয়।
যা-ই হোক, আচার্যদেবের সঙ্গে দেখা হল। দেখলেম, বলিষ্ঠ চেহারার মানুষ, গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, পরনে ধুতি। আমার ছবি দেখতে চাইলেন। দেখালাম। বললেন, ‘তুমি সবই জানো, আবার এখানে কেন?’ একটু ভেবে বললেন, ‘আচ্ছা, দু-তিন বছর থাকো তো।’ সেই দু-তিন বছর আমার এখনও শেষ হল না। তিনি অন্তর্ধান— আমার ধ্যান এখনও সেই রাস্তায় চলেছে— রূপের ভিতর অরূপের সন্ধানে।
আমরা যে-ক’জন ছাত্র ছিলাম— কম সন্দেহবাদী ছিলাম না আমরা। কিন্তু তাঁর সাহচর্যে এসে দেখলাম, কী অদ্ভুত শিল্পী ! আমাদের শ্রদ্ধা ক্রমশই বেড়ে চলল। আমাদের কাজে আমরা অনেক ভেঙেছি-গড়েছি, কিন্তু তাঁর কথা বার বার মনে পড়েছে। তাঁর বিচিত্র অবদানের
৩৪
রামকিঙ্কর বেইজ
ভিতর দেখেছি শিল্পস্রোত নানা ভাবে নানা রূপে এসেছে তীব্র ভাবে, কিন্তু কখনও স্বাদবিহীন নয়। প্রাচ্য ও ভারতীয় ঐতিহ্যশিল্পের ভাব যেন তাঁর মজ্জাগত ছিল।
তখন তিনি বরোদার কীর্তিমন্দিরের জন্য একটি বিরাট ম্যুরাল পেইন্টিং-এর খাড়া করছিলেন। তাঁর মাথায় ঘুরছিল কোণারকের মহা- কালের মূর্তিটি। সেই মূর্তির ভাব, ইঙ্গিত, আকৃতি— সব তাঁকে এত অভিভূত করেছিল যে নতুন কিছু না-করে (তিনি) সেই আকৃতিটিই এঁকে দিয়েছেন। সে সময় আমাকে বলেছিলেন, ‘পরের জন্মে আবার যদি শিল্পী হয়েই জন্মাই, তবে ভাস্কর্য করব।’ কারণ, প্রাচ্য শিল্পের সব কিছু তাঁর কাছে অপূর্ব রূপে ধরা পড়েছিল এবং তাঁর সাধনা ছিল সেই রূপকে সর্বাঙ্গ ভাবে ধরে রাখার। সেই জন্য অনেক মহলে তাঁর বদনাম ছিল, এখনও আছে। আধুনিকতার আওতায় তাঁকে কখনও অবসাদগ্রস্ত হতে দেখিনি। তখন সেজান-এর পরবর্তী যুগ চলছে। শিক্ষক হিশেবে তিনি স্বাধীন চিন্তায় কখনও বাধা সৃষ্টি করতেন না। যেটা যার অভিরুচি, সেটার উৎসাহই দিতেন এবং সেইভাবে (তাকে) ভাবিয়ে (কোথায়) তার গলদ, কোথায় স্বাদের অভাব ঘটেছে, সেটা বোঝাতেন। তর্কবিতর্ক অনেক হত। আবার পরমুহূর্তে বন্ধুর মতো ব্যবহার থাকত। সে জন্য আমরা বার বার ঠকেছি তাঁর কাছে।
তখন আমাদের সমস্ত ছবি কলকাতার ওরিয়েন্টাল সোসাইটিতে প্রদর্শিত হত। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অধিনায়ক ছিলেন। একবার মনে পড়ছে, আমার দু-খানা বড় ছবি ছিল, একটি তেলে আঁকা, অন্যটি জলে আঁকা। আচার্য ছবিগুলি দেখে প্রদর্শনীতে পাঠানো উচিত হবে কি না, সেই সমস্যায় বিচলিত। আধঘণ্টা পরে এসে বললেন, ‘ঐগুলিই প্রদর্শনী
ঐগুলিই প্রদর্শনীতে
পাঠিয়ে দাও।’ তা-ই হল। অবনীন্দ্রনাথ প্রশংসা করেছিলেন, সুতরাং তাঁর মনে আর কোন দ্বন্দ্ব রইল না ।
আমার কাজে কিউবিজম-এর প্রভাব এসেছিল। আচার্যদের প্রথমে বিরূপ হয়েছিলেন। কিন্তু তর্কবিতর্কের পর তিনি আর বাধার সৃষ্টি করেননি। পরে অ্যাবস্ট্রাকশন। তত দিন আমার কাজের রেএকটা আস্থা দেখা দিয়েছিল। এমনকী, আমার ছবির সমালোচকদের কাছে
মন্দিরের কাছের মূর্তিটি।
আমাকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করতেন। তার নিদর্শন SONG
মঞ্চশিল্পে তাঁর অভিনবত্ব দেখে একদিন আমি অবাক হয়েছিলাম। যুঁইফুলের কুঁড়ির মালা দিয়ে সমস্ত মঞ্চের আঙ্গিক করা, ভিতর দিয়ে সব কিছু দেখা যায়। তাঁর পরিকল্পিত রবীন্দ্রনাথের নাটকের সমস্ত মঞ্চ ও সাজসজ্জা আমার মনে অদ্ভুত একটি সৌন্দর্যবোধের বেদনা জাগিয়েছে। মণ্ডনশিল্পের দেশীয় অপূর্ব ধারা— যেটি অবলুপ্ত ছিল— মাস্টারমশাই সেটি আবার জাগিয়ে তুলেছেন। আজও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা সেই আদর্শেই চলেছেন। এই অবহেলিত শিল্প-ঐতিহ্যগুলিকে সংগ্রহ করে আমাদের কলাভবনে একটি ছোটখাটো মিউজিয়ম তিনিই স্থাপন করেছেন। গ্রামীণ শিল্পীদের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় স্নেহ ও মমতা ছিল। এই স্বভাবশিল্পী সৌন্দর্যসাধনার ভিতর দিয়ে তাঁর ব্যক্তিত্বের এমনই প্রকাশ ঘটিয়েছেন, যা সকল মানুষকে আকৃষ্ট করত। যে-জন্যে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধিজি— এঁরা তাঁকে বিশ্বাস করতেন এবং তাঁর হাতে ভার দিয়ে শান্তি পেতেন। গান্ধিজি কংগ্রেস-প্রদর্শনীর সমস্ত দায়িত্ব তাঁর উপর দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতেন। আচার্যদেব শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন। ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার ভার ন্যস্ত ছিল তাঁর উপর— তিনি তাঁর কর্তব্য যথাযথ পালন করে গেছেন। আজ সারা ভারতবর্ষে, এমনকী বিদেশেও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা তাঁরই প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে চলেছেন।
আমাদের আচার্যদেব ছিলেন বিশ্বকর্মার বরপুত্র। তাঁর কাজের ভিতর সত্য ও সুন্দর প্রতিভাত হয়েছিল। তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমরা পরম ধন্য হয়েছি।
৩৬
‘যা পা বি, দেখ বি, ধরবি, তার পর হজম করে ছেড়ে দি বি’
রচনা। একাকার ।
শিল্পের মাধ্যমে উপাসনায় রত থাকাটাই বুঝি আমার জীবনদেবতার অভিপ্রায়। অপরূপে রূপের আবির্ভাব, অহৈতুক আনন্দের অহৈতুকী রূপ
জীবনের প্রথম ক্ষণে মায়ের মুখখানিতেই বিশ্বদর্শনের পূর্বাভাস দেখেছিলাম। মায়ের মুখখানাই প্রথম লেখা চিত্র।
Co
অঙ্কনবিদ্যাটি কি আগে থাকতেই জানা ছিল? নানা স্বাদের খাতিরে খুঁজেপেতে নিজেকে শেখাতে হয়েছে। অন্য কোন খেলায় মন লাগত না।
পৌত্তলিক হিন্দুঘরের দেওয়ালে নানা দেবদেবীর পট ঝোলানো থাকত। এ সব মায়ের সংগ্রহ। কেনা কিংবা কোন মেয়ে-বন্ধুর দান ছিল। ঐ সব পটগুলির দিকে তাকিয়ে থাকা আর কপি করার চিলত। চোরবাগানের লিথোপ্রেসের ছাপা— হাতে করে রঙচং দেওয়া,
কালীঘাটের পটও থাকত ।
AMA
ARBOR
স্বর্গীয় রামপদ বেইজ মহাশয়, আমার বড় দাদা, মাটির মেঝেতে খড়ি দিয়ে অ আ ক খ লিখে দিয়ে আমার হাতে খড়িটি দিয়ে বলতেন- এর ওপর বুলিয়ে যাও। আমার মন কিন্তু ঐ দেওয়ালে ঝোলানো ছবির দিকেই তাকিয়ে থাকত, কখন ঐ রকম আঁকতে পারব তারই আশায়। এক টুকরো কাগজ, কিংবা খড়ি-দেওয়া শাদা দেওয়ালে আঁকার চেষ্টা চলত। ঐ দেওয়ালে ঝোলানো ছবিগুলির মধ্যে ‘ওঁ-কার’-বন্ধনে রাধাকৃষ্ণের ছবিখানি বেশি ভালো লাগত। বার বার সেটি আঁকার চেষ্টা করেছি।
রঙের প্রয়োজনও ছিল। গাছের পাতার রস, বাটনা বাটা শিলের হলুদ, মেয়েদের পায়ের আলতা, মুড়ি-ভাজা খোলার চাঁছা ভুসোকালি- এইগুলি রঙের প্রয়োজন মেটাত। পাড়ার প্রতিমাকারক মিস্ত্রিদের দেখে ছাগলের ঘাড়ের লোম কেটে নিয়ে বাঁশের কাঠির ডগায় বেঁধে নিয়ে তাতে তুলির কাজ হত ।
–
বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো না-থাকায় আমার অঙ্কনগুণটির জন্য স্কুলে আমি অবৈতনিক ছাত্র হিশাবে পড়াশুনার সুযোগ পেয়ে এসেছি। স্কুলের দেওয়ালে আঁকা ছবি ঝোলানো আর পত্রিকায় ছবি দেওয়া আমার প্রতি মাসের কাজ ছিল।
৩৭
রামকিঙ্কর : ৪
46
রামকিঙ্কর বেইজ
আমাদের বাড়িটি ছিল একটি গড়ানো রাস্তার উপর। বর্ষায় একদিন ভীষণ বৃষ্টিতে রাস্তার মোরাম ভেসে এককোণায় একরকম নীলরঙের মাটি বেরিয়ে পড়েছিল। দেখে আমার কী আনন্দ ! তখনই তুলে এনে একটা কিছু করেছিলাম। যদিও পাড়ার প্রতিমামিস্ত্রিদের কাছে অন্য মাটি ছিল, কিন্তু নীল মাটির ওপর আমার ঝোঁক। লাল মোরামের মাঝে আজও (আমার) নীল মাটির উপর ঝোঁক— পোর্টল্যান্ড সিমেন্টেরও নীল রঙ।
এ সব ছেলেবেলার কথা। পাঠশালার গুরুমশায়ের কাছে হাতেখড়ি হয়নি। সেটা পাঁচ বছর বয়সে হয়।
বাবা তাঁর বন্ধুদের দেখিয়ে বলতেন, দেখ হে, এই সব লেখাপড়া হচ্ছে। হাসতেন। বাধা দিতেন না। উৎসাহও দিতেন না। ছবি আঁকা
চলতে থাকে।
পাঠশালায় পড়ার সময়, একজন পাড়ার ছেলে হাই স্কুলে পড়ত। তার ড্রয়িং-এর কাজটা আমার হাত দিয়ে করিয়ে নিত। তার একটি সেকালের বিলিতি ড্রয়িং-এর বই ছিল। তাতে ভালো-ভালো উচ্চশ্রেণীর ছবি থাকত। রাফায়েলের পোর্ট্রেট এবং অন্যান্য ভালো প্রিন্ট থাকত ছেলেটির স্কুলের একটি গ্লসি কাগজের খাতা ছিল। তাতে ফ্রি-হ্যান্ড ড্রয়িং করে দিতাম। একদিন রাবার ব্যবহার করার জন্য কাগজ ছিঁড়ে গেল । সেই অপরাধে ছেলেটির কাছে কানমলা খেলাম। চটে গিয়ে দিন-কতক আর কাজ করলাম না। পরে আবার শুরু করেছিলাম। ছেলেটি আমার গুরু বনে গেল। তারপর আর কখনও পাতা ছিঁড়ি নাই। কাজ করে যেতাম।
কাজের একট
আমাদের বাড়িটি ছিল পূর্বে-পশ্চিমে দুটি মিস্ত্রিপাড়ার মাঝখানে। একটি একটি ধাতুর — ঘটি-বাটির। কাঠের মিস্ত্রিরাই মাটির প্রতিমার কাজ করতেন। স্কুলের ছুটির পর প্রতিমাকারক মিস্ত্রিদের পাড়ায় ছিল, রি আনাগোনা। একজন বুড়ো মিস্ত্রি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি সব রকম প্রতিমাই গড়তেন। মিস্ত্রি মহাশয় অনেক দুর্গাপ্রতিমার অর্ডার নিতেন। আমি স্কুলের ছুটির পর সেখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখতাম ৷ স্কুলে পড়ার সময় সঙ্গবিহীন সময় নানা কাজের মধ্যে জলরঙের কাজ হচ্ছে, কিন্তু সাইনবোর্ড লেখার জন্য তেলরঙের কাজ শেখার জন্য স্টিল-ট্রাঙ্কের কারখানায় আনাগোনা করে তেলরঙের ব্যবহার শিখলাম। সাইনবোর্ড লিখে বই কেনার পয়সাটা রোজগার করতে হত। তা ছাড়া সেই রঙ দিয়ে ছবি আঁকাও হত। বড় ছুটিতে থিয়েটারের সিন আঁকার অর্ডারও পাওয়া যেত। ছোট-ছোট ছবি আঁকতাম । থিয়েটারের প্রমাণ-সাইজের বড় সিন আঁকতেও মজা পাওয়া যেত। দু-একটা বড় থিয়েটার পার্টিতে প্রায় সব সিনগুলিই এঁকেছিলাম। জুতোর বুরুশ দিয়ে বড় নদী, বড় আকাশ, ফুলগাছ, বাড়ি আঁকতে ভালো লাগত। একটি স্টেজ-এর সিন-এ দু-তিনখানা বড় ছবি এনলার্জ করেছিলাম । একটিতে ড্রপসিন-এ শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ এঁকেছিলাম, আর দু-ধারে দু-খানা বিলিতি ছবির কপি করেছিলাম। এই থিয়েটার পার্টির সঙ্গে কলকাতায় যাই। সেখানে শিশির ভাদুড়ীর সীতা আর ষোড়শী দেখলাম আর অয়েলকালার, টিউবকালার কিনলাম। আগে সাইনবোর্ড আঁকার রঙ দিয়ে ছবি আঁকতাম। ভারতবর্ষ পত্রিকায় কিছু ছবি প্রকাশ হয়েছিল।
হ্যাঁ, একটা গপ্পো মনে পড়ে গেল। একজন হিতৈষী ভদ্রলোক রাফায়েল-এর ম্যাডোনা-র ছবি দিয়ে আমাকে কপি করতে বললেন। আমি সেটা কপি না-করে বনবাসে সীতা-লব-কুশের ছবি আঁকলাম। তিনি চটে গেলেন— ম্যাডোনা কপি করতে বললাম— এটা কী করলে ? দাও ছবি ফেরত। ফেরত নিয়ে নিলেন ছবিটা। আমার সীতার বনবাসের মেরিট-টাই বুঝলেন না। সেই ছবিটি ভারতবর্ষ-এ ছাপা হয়েছিল।
এই সবের মধ্যে কখন নন কো-অপারেশন আন্দোলন এসে গেল। স্কুল-কলেজ বন্ধ। ন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি হলাম আর কংগ্রেসের কাজে যোগ
রামকিঙ্কর বেইজ
দিলাম। বাঁকুড়াতে শ্রদ্ধেয় অনিলবরণ রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস অফিস খোলা হল। আমরা চরখা বিক্রির কাজে লেগে গেলাম। আমার উপর ভার ছিল মহাপুরুষদের বাণী থেকে উদ্ধৃতি লিখে ঝুলিয়ে দেওয়া আর প্রসেশন-এর সময় লিডারদের পোর্ট্রেট এঁকে দেওয়া। সেগুলি অয়েল- পেন্ট দিয়ে করতে হত ।
এই সময়ে শ্রদ্ধেয় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় বাঁকুড়ায় আসেন এবং তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যোগাযোগ তাঁরই কৃপায় ঘটে। সেটা হচ্ছে ১৯২৫ সাল। আমার এত আনন্দ হল যে ম্যাট্রিক না-দিয়েই চলে এলাম। এই অবস্থা আমাদের অনেকেরই হয়েছে। যেমন সৈয়দ মুজতবা আলি, বাচ্চুভাই শুক্লা, গোপাল রেড্ডি, মণিভাই প্যাটেল— আরও অনেকে। কারণ একমাত্র রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনই ব্রিটিশ কর্তৃত্বের বাইরে।
বিয়ে করলাম না কেন? না, বিয়ে করিনি। সময় পেলাম কই! বিয়ে করলে কী হত? তোমার মতো অবস্থা হত। একগাদা কাচ্চাবাচ্চা হত তার, বৌয়ের নানা ঝামেলা মেটাও— বাজার করো, ঝামেলা পোহাও। তার পর হত অভাব। চাল-ডাল-লকড়ি— সব কিছুর যোগান চাই। ব্যাস, আর্টওয়র্কের দফা ফতে। আমি বাপু ও রাস্তায় যাইনি। বুঝলে? আমি বুদ্ধ। আমি বুদ্ধ হয়ে গেছি। বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।
শান্তিনিকেতনে এসে যখন প্রথম চাকরি হল— পঞ্চাশ টাকা বেতন। গাঁয়ের লোকেরা বাবা-মা’কে ভয় লাগিয়ে দিল। শান্তিনিকেতনে ছেলে আছে, কী জানি, যদি ছেলে কোন ইয়ে-টিয়ে করে ফেলে। একটা মেয়েরও ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল। আমি চটে গেলাম । বাবাকে সোজা জানিয়ে দিলাম, তা হলে আমি আর বাড়িমুখো হব না। বিয়ের ব্যাপার ওখানেই ইতি। দেখো, বিয়ে করব, ঘর-সংসার করব— এই ইচ্ছে আমার কোন দিনই ছিল না। সব রকম ঝক্কিঝামেলার বাইরে থেকে একমাত্র আর্টওয়র্কের মধ্যে ডুবে থাকব, এটাই আমার লক্ষ্য। তা তোমরা আমাকে যা-ই বলো না কেন। এত কাল যে-সব মূর্তি, ছবির কাজ করেছি— বিয়ে করে সংসারধর্মে ব্যস্ত হয়ে গেলে সেটা সম্ভব হত? আর্ট- ওয়র্ক এত সোজা নয় হে। বিয়ে করার সুখ বলতে তোমরা (যা) বোঝো— সেই সুখ-আনন্দ আমি আর্টওয়র্কের মধ্যেই পেয়ে যাই ।
হ্যাঁ, জীবনে নারীর প্রয়োজন আছ বৈকী। নিশ্চয়ই আছে। সৃষ্টির আসল লীলাই তো পুরুষ-প্রকৃতির লীলা। তবে আমাদের ব্যাপারটা অন্য রকম। বুঝলে, একেবারে অন্য রকম। হ্যাঁ, এসেছে। জীবনে অনেক নারীই এসেছে। কেউ এসেছে দেহ নিয়ে, কেউ এসেছে মানসিক তীব্র আকর্ষণ নিয়ে। কিন্তু কাউকে ছাড়িনি। ধরেছি, হজম করেছি। হজম করার মানেটা তোমরা বুঝবে না। ব্যাপারটা ভীষণ কঠিন ।
মাস্টারমশাই— শ্রদ্ধেয় নন্দবাবু ছিলেন ভীষণ গোঁড়া। তিনি ছিলেন মডেল ব্যবহারের ঘোর বিরোধী। বলতেন, ওসব পশ্চিমে চলে। ওগুলি আমাদের ভারতীয় শিল্প-ঐতিহ্যের সঙ্গে খাপ খায় না। কিন্তু আমি তাঁর উপদেশ মেনে চলিনি। মডেল ব্যবহার করেছি। তবে হ্যাঁ, সেটা লুকিয়ে। আমার মডেলরা আমার বহু স্কেচে, ছবিতে, মূর্তিতে বেঁচে আছে। মডেলরা তো ঐভাবে (ই) বেঁচে থাকে।
দেহের সংযোগও ঘটেছে। তবে হ্যাঁ, আমি বাপু দায়িত্বের ভেতরে যাইনি।… কিন্তু এই দৈহিক তৃপ্তিটুকু সব নয়, বুঝলে, তা থেকে জন্ম নিয়েছে আমার অনেক ছবি, মূর্তি আর কল্পনা, অনুভব। দু-একজন নারী এসেছে আমার কাছে মানসিক আকর্ষণ নিয়ে। তীব্র সে আকর্ষণ । অনেকে ভুল বুঝেছে। তা বুঝুক গে। কিন্তু তারা আমাকে প্রেরণা যুগিয়েছে।
একটা ঘটনা বলি শোনো। খুব গোপনীয় ব্যাপার। তখন আমি গুরুদেবের রিয়ালিস্টিক’ পোর্ট্রেটটা করছি। একদিন উনি বসে একমনে লিখছেন,
80
রামকিঙ্কর বেইজ
আমিও একমনে কাজ করছি। হঠাৎ তিনি চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন, কেউ কোথাও আছে কি না– অর্থাৎ আশেপাশে কোন ভক্ত বা অনুচর আছে কি না। দেখে নিয়ে চুপিচুপি বললেন— ‘দেখ, যখন যা পাবি, দেখবি— একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরবি— তারপর তাকে নিংড়ে, ছিবড়ে করে হজম করে ছেড়ে দিবি।’ সাংঘাতিক কথা। এ কথার অর্থ বোঝো? আজও কথাটা আমার মধ্যে মন্ত্রের মতো কাজ করে
হ্যাঁ, আর-একটা ব্যাপার হচ্ছে, ছবির কথা বা কোন মূর্তির ব্যাপার মাথায় একবার এসে গেলে তখন আর সঙ্গম-টঙ্গমের কথা মনেই থাকে না ৷
সহজিয়া বাউলদের মধ্যে রতিসাধনার অনেক গুহ্য ক্রিয়া আছে। ব্যাপারটিকে ওরা খুব গোপনে রাখে। বিন্দুসাধন জানো? নিজের বীর্য বেরুনো মাত্রই খেয়ে নেয়। ঐ যে প্রমোদ চাটুর্যের লেখা একটা বই আছে— হ্যাঁ, মনে পড়েছে, তন্ত্রাভিলাষীর সাধুসঙ্গ সেই বইতে তান্ত্রিকদের চক্রসাধনা, লতাসাধনার অনেক গুহ্য ক্রিয়ার উল্লেখ আছে। আসল কথাটি হচ্ছে, আমি কোন কিছুর বন্ধনে বাঁধা পড়তে রাজি নই, ওতে কাজের ক্ষতি হয়। আমি নানা তালে ঘুরতে রাজি নই। আমার লক্ষ্য একটাই— সেটা আর্টওয়র্ক।
হ্যাঁ, আর-একটা ব্যাপার মনে পড়ল। বিনোদিনী— আমার ছাত্রী— মণিপুরী মেয়ে। ইন্সপিরেশন পেতাম তার কাছ থেকে। অবশ্য তার সঙ্গে আমার কোন দৈহিক সম্পর্ক ছিল না। ছিল একটা মানসিক আকর্ষণ। সে ভাবার সময় তার ক্যামেরাটা দিতে চাইল। আমি নিলাম না। কী হবে নিয়ে, কোথায় হারিয়ে যাবে, কে নিয়ে যাবে চুরি করে ঝামেলা ভালো লাগে না ।
আর-একটা মজার ঘটনা শোনো। নীলিমা বড়য়া— আসামের মেয়ে। ভারি পাওয়ারফুল গুণী মেয়ে। সে একবার কলকাতা যাচ্ছে ট্রেনে। হ্যাঁ, ওর ছিল দুটো পোষা গোখরো সাপ। ঝাঁপিতে রেখে দিত ও অদ্ভুত! তারপর— ট্রেনে যাচ্ছে কলকাতা। ট্রেনের কামরায় বিশেষ কেউ নেই। শুধু দুটি ছোকরা ছিল। তারা ক্রমশই নীলিমার দিকে আস্তে-আস্তে সরে আসতে লাগল বসার জন্য। নীলিমা তখন সাপের ঝাঁপিটা কোলের কাছে টেনে নিয়ে ঢাকনা খুলল– ব্যাস, সাপদুটো ফণা মেলে ফোঁস করে উঠল। আবার ঝাঁপির ডালা বন্ধ করে রাখল। ছোকরা দুটি পরের স্টেশনে নেমে গেল। ব্যাপারটা বোঝো। ওর একটা ভালো পোর্ট্রেট করেছিলাম। নষ্ট হয়ে গেছে সেটা। তখন একটা ভুল করেছি। অবশ্য পয়সার অভাব ছিল। ক্যানভাস বা রঙের দিকে নজর দিতে পারিনি। চটের উপর গ্রাউন্ড দিয়ে দিশি মোটা রঙে ছবি আঁকতাম। ছবিটা নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক ছবিই এ ভাবে নষ্ট হয়ে গেছে।
ব্লু রঙে আঁকা স্নানের ছবিটা — স্প্রিঙ— সেটা নষ্ট হয়ে গেল। চটের উপরে এঁকেছিলাম। ওটা খাঁদুর মডেল। ভুবনডাঙায় থাকত খাঁদু। সুন্দর ফিগার।
চন্দ্ৰমীড় ছবিটা দেশ-এ ছাপা হয়েছিল। ছবিটা সাগরময় ফেরত দিল না। ওটার নাম আমি দিয়েছিলাম নিউমুন সঙ। কিন্তু সাগরময় ওটার বাংলা করে দিল— চন্দ্রমীড়। ভালোই হয়েছে নামটা। ছবিটা আববনি-র মডেল। মেয়েটা টি বি হয়ে মরে গেছে। ওর বাড়ি যেতাম।… এমনি কত মডেল এসেছে-গিয়েছে। ওরা বেঁচে আছে আমার ছবিতে, মূর্তিতে, স্কেচে। কী হবে ওদের কথা শুনে? রাধারাণীকে মডেল হিশেবে প্রচুর ব্যবহার করেছি।…
মূর্তি তো মার যুগল সম্মিল নে
বাঁকুড়ার যুগীপাড়াতে আমার জন্ম। ১৯০৬ সালের ২৫ মে। বাবার নাম চণ্ডীচরণ বেইজ। মায়ের নাম সম্পূর্ণা ৷
‘বেইজ’ টাইটেল বেশ অদ্ভুত। এটা এসেছে ‘বৈদ্য’ থেকে। ‘বৈজ’ হয়ে পরে ‘বেইজ’ হয়েছে। আমি অবশ্য এত সব জানতাম না । পরে আমাকে ক্ষিতিমোহন সেন মশাই বলেছিলেন। তবে এ ‘বৈদ্য’ কিন্তু ‘সেন বৈদ্য’ নয়। আমাদের জাতিগত বৃত্তি ছিল অন্য।
সুরেনের (কর) সঙ্গে গিয়েছিলুম তোমাদের কলকাতায়। একটা প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে। সে উপলক্ষে একটা পুস্তিকায় আমার বিষয়ে লিখতে গিয়ে একজন লেখক আমাকে সাঁওতাল বলে পরিচয় ধারণা আছে যে আমি সাঁওতাল। ধারণাটা ঠিক নয়। যাঁরা লেখেন, তাঁরা কি একটু খোঁজ-খবর নেওয়ারও দরকার মনে করেন না?
তিনি অনেকেরই এ
সাঁওতালদের মূর্তি-টুর্তি বেশি গড়েছি বলেই বোধ হয় লোকে ও রকম ভাবে। কিন্তু কেউ তলিয়ে দেখে না ।
আমি বাঁকুড়ার লোক। যামিনী রায়ের বাড়ি ছিল আমাদের পাশের গ্রামে, বেলেতোড়ে। আমাদের বংশে আমি ছাড়া আর-কেউ ছবি আঁকা বা মূর্তি গড়ার কাজ করেনি ।
MA
ছোটবেলাতে আমি যেখানে থাকতাম, তার চারধারে ছিল ক্রাফটসম্যানদের বসতি। অর্থাৎ ছুতোর, কর্মকার ইত্যাদি। পরের দিকে এদের কাজকর্ম আমাকে হয়তো ইনফ্লুয়েন্স করতে পারে। কিন্তু ছোটবেলাতেই আমার টেন্ডেনসি ছিল ছবি আঁকার। কেউ কিন্তু কিছু শেখায়নি। নিজেই দেখে-দেখে শিখেছি।
যত দূর মনে পড়ে, শৈশবেই আমার চোখে পড়ত আমাদের বাড়িঘরের চারদিকের দেওয়ালে নানা দেবদেবীর ছবি। ছবি আমার তখনই ভালো লাগত। ছোটবেলাতে আমি সে সব দেখতাম আর কপি করতাম। সব ছবির মধ্যে একটা ছবি আমায় ঐ সময়েই প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছিল। সেটা হল ওঁ-এর ভেতরে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি। ঐ ছবিটাই বার বার আঁকতুম। বলতে পারো, ভিস্যুয়াল আর্ট-এ আমার প্রথম বর্ণপরিচয় ঐ ওঁ-এর রাধাকৃষ্ণ দিয়ে।
আবার মজা কী জানো– অনেক পরে রবীন্দ্রনাথের একটা গানে ‘মূর্তি তোমার যুগল সম্মিলনে সেথায় পূর্ণ প্রকাশিছে’— পেয়ে গেলাম। হ্যাঁ-হ্যাঁ, মূর্তি তোমার যুগল সম্মিলনে। দেখেছ, আমার প্রথম শিক্ষার সঙ্গে গুরুদেবের গানের এই লাইনের কী অদ্ভুত মিল! এই যে সামঞ্জস্য, এটাও আমার আবিষ্কার। আর যখন ছবির সঙ্গে এই গানের মিলটা পেলাম, তখন একটা অদ্ভুত আনন্দ-অনুভূতির সঞ্চার হল।
88
আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র
আমাদের আশপাশের শাকসবজি, ধান, ঘাসের সবুজ রঙ আমাকে ভয়ানক টানত। লাল মাটি এবং মশলা হিশেবে যে-হলুদ ব্যবহার করি— সে সব যা চারপাশে রয়েছে, সেগুলো আমার ছবিতে লাগাতাম
মূর্তি গড়ার ইতিহাসও খুব মজার। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা লাল মোরামে ঢাকা ছিল। একদিন হঠাৎ বৃষ্টির পরে দেখি মোরাম ধুয়ে নীল রঙের মাটি বেরিয়ে পড়েছে। চোখে পড়া মাত্র সেই মাটি খাবলে তুলে নিয়ে নানা রকম পুতুল তৈরি করতে লাগলাম। এখানে বলে রাখা ভালো যে আমার প্রথম শিল্পের ইস্কুল বাড়ির পাশের কুমোরপাড়া। ছেলেবেলা থেকেই অনেক ক্ষণ ধরে কুমোরদের মূর্তি গড়া ও অন্যান্য কাজ দেখার বেশ অভ্যেস ছিল। সুযোগ পেলেই মাটিতে হাত লাগিয়ে ছানাছানি করতাম। রাস্তায় বেরিয়ে-পড়া সেই নীল মাটি দিয়ে পুতুল গড়ার পর থেকে প্রায়ই নদী থেকে মাটি এনে নানা রকম পুতুল ও মূর্তি তৈরি করতে শুরু করলাম। সেগুলো নিয়ে পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েরা খুব খুশি হত ।
লেখাপড়াও খানিকটা করতে হয়েছে বৈকী মারধোর খেয়ে। ছোটবেলাতে পড়াশোনা ভালো লাগত না। বাবা লিখতে দিলে আঁকতে শুরু করতাম। বাঁকুড়াতে ঠেলাঠেলি করে ম্যাট্রিক পর্যন্ত হয়েছিল। শান্তিনিকেতনে
রবীন্দ্রনাথ আমাকে একবার বলেছিলেন, ‘ওহে, শুধু ছবি আঁকলে আর
বানালেই চলবে না। সেই সঙ্গে প্রচুর পড়াশোনাও করতে
হবে।’ এলিয়টের একখানা কাব্যগ্রন্থ দিয়ে বলেছিলেন, ‘এখানা পড়ো। প্রথমে হয়তো ঠিক বুঝতে পারবে না, বার বার জোরে-জোরে আবৃত্তি
করে পড়ো, দেখবে পরে বোধগম্য হতে আরম্ভ করবে ।
বিস্তর বই ঘাঁটাঘাঁটি করতাম। তলস্তয়, তুর্গেনিভ, দস্তয়েভস্কি, বার্নার্ড শ-র বিস্তর বই আমি পড়েছি। বার্নার্ড শ-র ম্যান অ্যান্ড সুপার- ম্যান আমাকে বিশেষ ভাবে মুগ্ধ করেছে।
AMARBL এর ৬ছি। কিন্তু তা অ্যাকাডেমিক নয়। ইচ্ছেমতো পড়তাম।
নাটক এবং অভিনয় ছোটবেলা থেকেই আমাকে উর্নিত। থিয়েটারের সিন আঁকা, স্টেজ করা, রিহার্সাল দেওয়ানো, আবার অভিনয়ের লোক কম পড়লে তখন অভিনয় করা— এ সব খুব করতুম। একবার শিশির ভাদুড়ীর নাম শুনে তাঁর নাটক দেখতে কলকাতায় গিয়েছিলাম। তাঁর ষোড়শী ও সীতা ভীষণ ভালো লেগেছিল।
শান্তিনিকেতনে এসেছিলাম ১৯২৫ সালে।
রামানন্দবাবু আমাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন। রামানন্দবাবু তো পরিচয় করিয়ে দিলেন, কিন্তু টাকাপয়সার কথাটা আছে। খাব কী ? হাঃ…হাঃ…হাঃ… ভাত কোথায় পাব? তা সত্যি কথা। তখন কমার্শিয়াল আর্ট করতুম। করে-করে খাওয়াটা চলে যেত। বেশি দিন না, এই এক বছরের মধ্যে কিছু ছবি বিক্রি হয়েছিল। আমার সুবিধা হয়ে গেল। তখনকার দিনে খাওয়াটা যে কম। মাসে দশ টাকায় তোমার খাওয়া হয়ে যাবে- হাঃ…হাঃ… হাঃ… আজকের কথা নয়- দশ টাকা !
আমি শান্তিনিকেতনে আসার বছর-চারেক আগে নন্দলাল মশাই কলাভবনের অধ্যক্ষ হয়ে আসেন। ছাত্রদের সঙ্গে ওঁর ব্যবহার খুব সুন্দর ছিল। সকলকেই খুব সাহায্য করতেন। তবে তিনি তো ওরিয়েন্টাল আর্ট-এর প্রবর্তক। ওয়েস্টার্ন আর্ট-এর প্রচলন তখনও হয়নি । উনি
80
রামকিঙ্কর বেইজ
পছন্দও করতেন না। আমরা এখানে সব রকম শিল্পচর্চা করেছি। দা ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো, রঁদ্যা— এঁদের কাজ দেখা, পড়াশোনা করা, কপি করা— সব কিছুর মধ্যে দিয়ে আমাদের কাজেও ঢুকে পড়েছে। এখানে মূর্তি অবশ্য শুধু আমিই করতাম। নন্দলালবাবু আমাদের খুব সাহায্য করেছেন। তবে তাঁর সঙ্গে প্রথম দিকে মূর্তি গড়া নিয়ে গোলমালও বেঁধে যেত। সাধারণত আমি মূর্তি গড়তে চাইলে নন্দলালবাবু বিশেষ করে খরচের কথা ভেবে আপত্তি করতেন। সঙ্গীত ভবনের কাছে সুজাতা, সেইটেই আমার প্রথম বাইরের মূর্তি।
হাতে-কলমে শেখানো বা ফর্মাল কোন ইনস্ট্রাকশন নন্দবাবু দিতেন না। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশই ছিল— ‘কাউকে বেশি কিছু শেখাবে না।’ তখন যা করতাম, তার ধারাটা ঐ মিথলজি-টজি, এই সব ছিল আর কী। ছেলেও তো খুব কম আসত। আমরা ছিলাম দশ-বারো জন । (তা-ও) হব কি না সন্দেহ, ধরুন আট-ন’জন ছিলাম। তার মধ্যে (ছিল) ধীরেনকৃষ্ণ দেববর্মা, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, মাসোজি, হরিহরণ। মেয়েদের মধ্যে সুকুমারী দেবী, নন্দবাবুর মেয়ে গৌরী— এঁরা সব ছিলেন। আরও কিছু নাম মনে পড়ছে না এখনই ।
আমরা কাজ করতাম নিজেদের ইচ্ছেমতোন। যখন যা ইচ্ছে হত, তা-ই করতাম। নন্দবাবু নিজের কাজ করতেন। একবার করে ঘুরে যেতেন। বিশেষ কিছু ইনস্ট্রাকশন দিতেন না। ঐ শুধু দেখে যাওয়াটাই। মাঝে-মাঝে বলতেন। কিন্তু চেঞ্জ-টেঞ্জ বিশেষ কিছু করতেন না। সাজেস্টও করতেন না, সেরকম কিছু দেখাতেন-টেখাতেন বলে তো মনে পড়ছে হ্যাঁ, একটু-আধটু যা না-বললেই না, তা কি আর বলতেন না? কিন্তু নিজে কিছু ইমপোজ করতেন না। পূর্ণ স্বাধীনতা
তা দিয়েছিলেন বাবা
।
MARBOL COL
অয়েল পেন্টিং তখন শান্তিনিকেতনে কেউ করতেন না। আমিই প্রথম শুরু করি। অয়েল পেন্টিং কী ভাবে শিখলাম, জানেন তো? দোকানে গিয়ে বললাম, ‘অয়েল পেন্টিং করব, কী রঙ আছে, কী ভাবে করতে হয়, দেখান?’ তা দোকানদার দেখাল, ‘এই তুলি, এই টিউবে রঙ আর এই পাত্রে তেল আছে, এবার ডুবিয়ে নিয়ে রঙ করুন। ব্যাস, অয়েল পেন্টিং শেখা হয়ে গেল। ভালো কাজ করেছিলাম অয়েল-এ, যত দূর মনে হচ্ছে— গার্ল অ্যান্ড দ্য ডগ। নন্দবাবু কিন্তু একটু অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন অয়েল-এ করেছিলাম বলে। তবে বাধাও দেননি।
নন্দলাল বসু তো আমার শিক্ষকই ছিলেন। অত বড় একজন শিল্পীর কাছে শিক্ষালাভ করেছি— আমার সৌভাগ্য। শিল্পী হিশেবে যেমন মর্যাদাবান, শিক্ষক হিশেবেও তেমনি। অবন স্কুল অফ আর্ট, যা বলা হয়ে থাকে, তার সবচেয়ে সার্থক ধারক। এত বড় পেইন্টার, এত নিখুঁত স্ট্রোক। প্রায় সমস্ত ছবিরই বিষয় বা ব্যাকগ্রাউন্ড খুব শাদামাটা। সাধারণ চরিত্র, কমন ল্যান্ডস্কেপ, একেবারে গ্রামের কমপ্লিট ক্যারেকটার নিয়ে ওঁর ছবি। এই শাদামাটা সুরটাই আমাকে ভীষণ ভাবে টানে। আমার ছবি বা মূর্তির অধিকাংশ ক্যারেকটারই যে খুব সাধারণ, তা অনেকটা নন্দলালবাবুর পরোক্ষ প্রভাব।
বছর-দুয়েক নিজে-নিজে কাজ করবার পরে আমিই শেখাতে শুরু করি। আমি আর বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় কাজ শেখাতে শুরু করেছিলাম। প্রথম দিকে আমি শুধু মডেলিং শেখাতাম। কারও স্বাধীন স্বতঃস্ফূর্ত কাজকে বাধা দিতাম না। রবি ঠাকুরের এ ব্যাপারে উদার মত ছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘সবাইকে নিজের-নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করতে দাও। কখনও বাধা দিও না।’ আমিও নিজে কাউকে বাধা দিইনি। বাধা পাইওনি। আমার অ্যাবস্ট্রাক্ট কাজ বা অয়েল পেন্টিং নন্দবাবুর পছন্দ না-হলেও আমাকে বাধা দেননি বিন্দু মাত্র।
৪৬
রামকিঙ্কর বেইজ
সেই ১৯২৫ থেকে কত বছর হয়ে গেল, টুকটাক এখানে-ওখানে মাঝে-মাঝে যাওয়া ছাড়া কখনও শান্তিনিকেতন ছাড়িনি। এখানকার প্রকৃতি, আবহাওয়া আমার মনের মতো। তখন তো আরও সুন্দর ছিল। আরও নির্জন। চারদিকে রুক্ষ খোয়াই, প্রচণ্ড গরম। তার মাঝে নির্জন, ঠাণ্ডা, গাছগাছালিতে ঢাকা অচেনা উপত্যকার মতো শান্তিনিকেতনের আশ্রম। নন্দলাল বসু পড়াচ্ছেন। আমরা ছাত্র। বড় বাড়ি হয়নি। এত লোক, এত ব্যস্ততা ছিল না। ছবি আঁকতাম, মূর্তি গড়তাম, মাঝে-মাঝে নিজেরাই নাটক করতাম, গান গাইতাম। একটা সুন্দর সুখী যৌথ পরিবারের সবাই (এক) হয়ে বেশ ছিলাম। ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া, শান্তিনিকেতনকে জড়িয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কিছু জানতাম না তখন। এখনও ।
গুরুদেবের তো ভোরবেলা উঠে আশ্রমে ঘুরে বেড়াবার অভ্যেস ছিল। একদিন বেড়াতে-বেড়াতে হঠাৎ ওখানে হাজির হয়ে মূর্তিটা (সুজাতা) দেখতে পান। গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে করেছে?’ যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, সকলেই তখন পরস্পর পরস্পরের দিকে কী উত্তর দেবেন ভেবে তাকাচ্ছেন। একজন ভয়ে ভয়ে আমতা-আমতা করে নাম বললেন। আমার নাম শুনে বললেন, ‘ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।’ এ কথা শুনে মাস্টারমশাই পর্যন্ত ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, আমাকে বকুনি খেতে হবে ভেবে। আমি সভয়ে দেখা করতে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মূর্তিটা তুই গড়েছিস?’ ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়লাম। তখন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সমস্ত আশ্রম এর চেয়েও বড়-বড় মূর্তি গড়ে ভরে দিতে পারবি? সব আশ্রম ভরে দে।’ তখন আর আমার আনন্দ দেখে কে? তার পর আর কোন বাধাকেই বাধা বলে মনে করিনি। ঢালাও লাইসেন্স পেয়ে গেলাম। এবং একটার পর একটা গড়ে যেতে লাগলাম ৷
Co
আমার শিল্পচর্চায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল, আবার ছিলও না। যে আগের সুজাতা-র গল্পটা বললুম, প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল না বলাই ভালো। তিনি নিজে কখনও কারও কাজে ইন্টারফিয়ার করতেন না জিনদের করাটাও পছন্দ করতেন না। এমনকী নন্দলালবাবুকেও বলতেন, ‘সকলকে নিজের মতন করে কাজ করতে দিও। আশ্রমটা তো । এখানে ওরা স্বাধীন ভাবে কাজ করবে, আনন্দ পাবে।’ আমার মনে
হয়, এটাই সবচেয়ে বড় প্রভাব ।
►
AMA
রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ‘ভরে দাও, সব ভরে দাও। আমরা পারলাম না, তোমরা ভরে দাও।’ উনি দশ বছর ধরে ছবি আঁকলেন, গান ও কবিতা লেখা বন্ধ করে দেখিয়ে দিলেন! এমন কেউ পারবে না। আমরাও পারব না। অন্য রবীন্দ্রনাথ আসবে। চিরন্তন, চিরন্তন ব্যাপার, চিরন্তন। কিছু ভয় নেই। গো অন, এগিয়ে চলো, বুঝলে… চরৈবেতি— কোন ভয় নেই। এই আর কী। বেঁচে থাকতেই হবে মানুষকে
আমি যখন শান্তিনিকেতনে নেহাত বালক মাত্র, তখন দেখেছি তাঁকে, দূর থেকে, দীর্ঘকায় তিনি। তখন ঈষৎ ন্যুব্জ। কখনও সকালের দিকে বসে আছেন ইজিচেয়ারে, পেছনে হাত দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন একাকী উত্তরায়ণের মাঠে, সন্ধ্যা নেমে আসছে খোয়াইয়ের দিগন্ত ছুঁয়ে। কখনও বন্ধু-আত্মীয়পরিবৃত, গল্প করছেন বসে-বসে। ভয়ে ভয়ে কখনও মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি। মুখের রেখা, চোখ, কপালের কুঞ্চন— গুরুদেবের মূর্তি গড়ার সময়ে সে সময়ের দেখা কাজে দিয়েছে।
একবার তাঁকে দেখেছিলাম উত্তরায়ণের জানালায়, শোকাহত। মাথা নিচু করে টেবিলের ওপর ঝুঁকে বসে আছেন। সি এফ এন্ডরুজ মারা গেছেন। দূরে মাঠে দাঁড়িয়ে বিকেলের পড়ন্ত আলোয় গুরুদেবের এই শোকাহত রূপ আমার মাথার ভেতরে তালগোল পাকিয়ে দিল। ঘরে ফিরে এসে একটা স্কেচ এঁকে রাখলাম। পরে একটা ব্রঞ্জের মূর্তি করলাম। উনিশশো একচল্লিশ হবে বোধ হয়। ছিয়াত্তর সেন্টিমিটারের। কলাভবনের দোতলায় সেটা আছে এখনও ৷
৪৮
রামকিঙ্কর বেইজ
আমি যখন রবীন্দ্রনাথের শেষজীবনে তাঁর প্রতিকৃতি করার প্রস্তাব দিই, তখন উনি বলেছিলেন, ‘দেখ, ওদেশে মূর্তি গড়তে গেলেই খাড়া বসিয়ে নানা রকম যন্ত্রপাতি এনে নাক-মুখ মেপে ভয়ানক অস্বস্তি দেয়। আমার বড় কষ্ট হয়।’ আমি তখন আশ্বাস দিই, ‘আমার কিছু মাপার দরকার নেই, আপনি নিজের কাজ করবেন, আমি পাশ থেকে আমার কাজ করে যাব।’ উনি খুব খুশি হয়ে বললেন, ‘পারবি? তা হলে তাই কর।’ কাজ করে যাচ্ছি, একদিন হঠাৎ বললেন, ‘আমাকে একতাল মাটি দিতে পারিস? আমার খুব ইচ্ছে করে বেশ হাত দিয়ে টিপে-টিপে একটা (কিছু) করি।’ তাকিয়ে দেখি প্রতিমা বৌঠান কটমট করে তাকিয়ে আমাকে নিষেধ করছেন। পরে ডেকে বললেন, ‘কখনও মাটিতে হাত দিতে দিও না। শরীর খারাপ, ঠাণ্ডা লেগে বিপত্তি হবে।’ আজ দুটো দুঃখ মনে বিঁধে আছে। একটা হয়তো সংস্কার- সেই মূর্তি গড়ার পরেই ওঁর মহাপ্রয়াণ হল। আর একটা হচ্ছে— যদি সাহস করে ওঁকে খানিকটা মাটি দিতাম, ওঁর হাতের একটা কাজ হয়তো আমাদের ভাস্করদের
পাথেয় হয়ে থাকত ।
রবীন্দ্রনাথের একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট মূর্তিও করেছিলাম। এটা সিটিং নিয়ে নয়। মন থেকে গড়া। উনি শুনেছিলেন এটার কথা। কেউ ওঁকে গিয়ে বলেছিল, ‘ওটা যে কী করেছে, চোখে বল দেওয়া, চেনা যায় না।’ রসিক লোক তো, বলেছিলেন, ‘ঐটেই ঠিক করেছে।’ মূর্তিটার চোখে বল দেওয়া, নাকটা প্রায় ঠিকই, দাড়ি সিঁড়ির মতো। এই মূর্তিটাতে কয়েকটা প্লেট আছে, তাতে লেখা আছে— অসীম, সুন্দর, বিরহ, বেদনা, আনন্দ । এক-একটা প্লেটে এক-একটা কথা লেখা। এটা দিল্লিতে সাহিত্য আকাদে আছে। ওরা কাস্ট করে মেটাল-এ করেছে।
একবার বেশ মজা হয়েছিল। একজন, ছেলে ভর্তি করাতে এসেছে বকিড়া থেকে। তা ছেলে বলছে, ‘এটা রবীন্দ্রনাথ।’ বাবা ধমকে বলছে, ‘ওটা আবার রবীন্দ্রনাথ কোথায় ?’ ছেলেটা খুব ক্লেভার। পাকা ।
ওঁকে তো আমরা চিরকাল সাহিত্যচর্চা করতে দেখতেই অভ্যস্ত ছিল। ০% কি দেখিতে
।
তাই হঠাৎ যখন বুড়োবয়সে ছবি আঁকতে শুরু করলেন, তখন আমরা
আড়ালে হাসাহাসি করতাম। এটাকে তাঁর একটা হালকা খেলা বা পাগলামি বলে মনে হত প্রথমে। পরে অবশ্য বুঝেছি যে কবিতা, প্রবন্ধ বা
অন্য কোন লিখিত শিল্পমাধ্যমে ওঁর অনেক কিছু প্রকাশি বাকি থেকে যাচ্ছে। এবং সে জন্যেই এত তাড়ায় ছবি আঁকছেন। আমি অনেক সময় দাঁড়িয়ে ওঁর ছবি-আঁকা দেখতুম ।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়েছি মন দিয়ে। ভালো লাগে। ওঁর বিভিন্ন নাটক আমরা অভিনয়ও করতাম। আমার সবচেয়ে প্রিয় ওঁর গান। যত বারই আমি গুরুদেবের গানের কথা ভাবি, বিস্মিত হই। আনন্দের দিনে গেয়েছি ওঁর গান, দুঃখের রাতেও। যখনই যে-মুডে সান্ত্বনা পেতে চেয়েছি, ওঁর গান ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাইনি ।
–
গানও আমি গাইতে পারতাম ভালোই। গলাটা খুব দরাজ ছিল বলে, আবেগ ছিল বলে অভিনয়ের সময়ে গান গাইতে হবে, এমন রোলই আমাকে দেওয়া হত ।
আমরা যখন ছাত্র হয়ে আঁকা শিখছি নন্দলালবাবুর কাছে, তখন তো গুরুদেবও আঁকছেন। কবিতার কাটাকুটি দিয়েই শুরু। ভালো খেয়াল। শেষ দশ বছর ঐ পাগলামিতেই পেয়ে বসেছিল। শুনেছি, রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে খুব আলোচনা হয়। বিদেশের অনেক জায়গায় চিত্রশিল্পী হিশেবেই নাকি গুরুদেবের প্রধান পরিচিতি। কালার, স্ট্রোক, প্যাশন ইত্যাদি নিয়ে রবি ঠাকুরের ছবি সম্পর্কে অনেকে আলোচনাও করে। বিশিষ্টতা হয়তো আছে। তবে মূলতই খেয়াল। কবিতার কাটাকুটি করতে-করতেই এ সব ইচ্ছার জন্ম। ভালো। খারাপ কী?
৫০
আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র
রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে বিশেষ কোন রিঅ্যাকশন হয়নি এখানে। এখানকার লোকে আর ভালো-মন্দ কী বলবে। শুনেছে প্যারিসে ভালো বলেছে, আর খারাপ বলে কী করে! ওঁর ছবিগুলো বেশ মজার, নানা রকমের, হুইমসিক্যাল তো। পেলিকান বা অন্য কোন কোম্পানি যেন অনেকগুলো রঙের বোতল ওঁকে দিয়েছিল। উনি তাতে তুলি ডোবাতেন আর আঁকতেন। রঙগুলো ল্যাকার মেশানো ছিল। তাই দেখবেন ছবিগুলো কেমন ঝকঝক করে। ট্রেস করতেন কখনও-সখনও। নানা ধরনের ফিগার এঁকেছেন। রঙও বিচিত্র। তবে দু-একটা জিনিশ স্টিরিও- টাইপ হয়ে গিয়েছে। যেমন নাক। সেটা কখনও বদলাননি। একই রকম রয়ে গিয়েছে সব ছবিতে। রবীন্দ্রনাথের ছবিতে রঙের ব্যবহার দারুণ। ন্যাচারাল কালার আনবার চেষ্টা করেছেন। মহুয়া-র কভারের ছবির রঙ দেখবেন, ঠিক যেন মৌফুলের রঙ। খুব কড়া অবজার্ভেশন ছিল কিন্তু । রিয়ালিস্টিক ছবিও কোথাও-কোথাও আছে। ট্যুরিস্ট লজ-এ একটা ছবি দেখলাম— নাচের ছবি। বেশ রিয়ালিস্টিক। নিজের ছবি অর্থাৎ সেল্ফ পোর্ট্রেটও সুন্দর। সব মিলিয়ে বেশ অদ্ভুত রস। (আনন্দ) কুমারস্বামী রবীন্দ্রনাথের ছবি সম্পর্কে দু-লাইন লিখেছেন— ওঁর ছবিগুলো “নট চাইল্ডিস বাট চাইল্ড-লাইক’। তা ছাড়া রস না-থাকলে এত দিন ধরে যে ছবি আঁকলেন, প্রায় দশ বছর, তা কি সম্ভব হত ?
রাবীন্দ্রিক বলে একটা শব্দ শুনি। তার অর্থ জানি না। রবীন্দ্রভক্ত ? হ্যাঁ, আমি তো তাই। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পাগলামি বা অহেতুক বাড়াবাড়ি? তা কেন করব? করে নাকি কেউ? উনি তো একজন পর্বতপ্রমাণ প্রতিভা । কারও কিছুর অতিরিক্ততায় তাঁর কি যায় আসে? তবে দেখেছি ওঁর উপস্থিতি, ব্যক্তিত্ব। ভোলা যায় না।
MARBOL.C
অবন ঠাকুর, গগন ঠাকুরকেও দেখেছি মুখোমুখি, অনেকটা দূরত্ব নিয়ে বসে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার ছবি আঁকতে। গগন ঠাকুরের ছবিতে রহস্য- ময়তা বেশি। মৃত্যু, অন্ধকার, একাকিত্ব, বিষাদ ইত্যাদি বিষয়কে অসম্ভব ঙৈ ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। ছবিতে কিউবিজম-এর এমন সার্থক প্রয়োগ আমাদের দেশে তাঁর আগে বিরল। আলো-আঁধারির কাজও অনেক বেশি। অবন ঠাকুর যেমন দেশীয় উপকরণ এবং দেশীয় স্বভাবের সাথে সাযুজ্য রেখে ছবি এঁকেছেন, গগন ঠাকুর— সে ভাবে গেলে কিছুটা বিদেশীয়। আর রোমান্টিক বিষণ্ণ জগৎ, যা অবনীন্দ্রনাথের অনেক সিরিজেই লক্ষ করা যায়, তা গগন ঠাকুরে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। হয়তো সে কারণেই কিছুটা কম পরিচিত। অবন স্কুল অফ আর্ট-এর মতো গগন স্কুল অফ আর্ট চালু হয়নি এ দেশে। অবন ঠাকুর রঙ, বিষয় ইত্যাদি মিলিয়ে দারুণ ছবি আঁকতেন। ওমর খৈয়াম সিরিজ-এর তো
তুলনা মেলা ভার। দারুণ গল্প জমাতে পারতেন। এখানে যখন উপাচার্য ছিলেন, দেখেছি ছাত্র-ছাত্রী সব ঘিরে ধরে গল্প শুনত। ওঁর এই কথকতার গুণ ওঁর গদ্যে। এমন চিত্রধর্মী গদ্য, রচনার গুণ, শৈলী যে-কোন লেখকের পক্ষেই ঈর্ষার যোগ্য। ওঁর বাগীশ্বরী শিল্প-বক্তৃতামালা ভীষণ জ্ঞানগর্ভ, ভীষণ জরুরি। ছবি আঁকা-আঁকির জগতে এত বড় সহায়ক বই আমাদের ভাষায় খুব বেশি নেই ।
মোটামুটি (পরবর্তী) সময়ের শিল্পী যামিনী রায়। খুব বড় শিল্পী, যাকে বলে ফিনিশড আর্টিস্ট। বিভিন্ন মুড-এ ছবি আঁকতেন। পেয়ে গেলেন কালীঘাটের পটের মিডিয়াম। ঐ মেজাজেরই ছবি আঁকতে শুরু করলেন। আমাদের দেশের নিজস্ব লৌকিকতা, উপকথা, গ্রামীণ রূপ, মাতৃরূপ, বৈষ্ণব গাথা ইত্যাদি নিয়ে ছবি আঁকতেন। এত বড় দেশীয় শিল্পী খুব কম পেয়েছি আমরা। রঙ ও রেখার ব্যবহার শিক্ষণীয়। শুনেছি ভারতীয় শিল্পী হিশেবে বিদেশে ওঁর পরিচিতিই নাকি বেশি। এমন কোন দেশ নেই যেখানে ওঁর ছবি নেই। অথচ কোন দিন বিদেশে যাননি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় বা ছবি বিক্রির জন্য। বিদেশিরাই তাঁর বাড়িতে এসে ছবি কিনে নিয়ে গেছে। আমাদেরই জেলার লোক উনি। বাঁকুড়ার বেলেতোড়ের।
৫ ১
রামকিঙ্কর বেইজ
বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় তো আমারই সহপাঠী। জন্মাবধি ওঁর একটা চোখ অন্ধ, অন্য চোখে সামান্য দেখতে পেতেন। ঐ সামান্য দৃষ্টি নিয়েই ছবি আঁকতেন। এখন তো সবই গেছে। পুরোপুরি অন্ধ। তবু ছবি আঁকা বন্ধ রাখেননি। এমন অসামান্য জেদ একমাত্র ওঁকেই মানায়। হিন্দি ভবনে ওঁর কিছু ছবি আছে। খুব কমপ্লিট ছবি। একটা ম্যুরাল-এর কাজ সত্যি দেখার মতো। আমরা দু-একজন একসঙ্গে পড়েছি নন্দলাল বসুর কাছে। অবৈতনিক কাজ করেছি কলাভবনে। নন্দলালবাবু তখন পেতেন পঞ্চাশ টাকা। পরে আমি আর বিনোদবাবু পেতাম সাড়ে বারো টাকা করে। দু-বেলা মাছ-ভাত আর টিফিন হিশেবে লুচি-হালুয়া লাগত দশ টাকা। বাকি টাকায় হাতখরচা চলত। তবু আমরা আনন্দে ছিলাম। প্রাণের আনন্দে কাজ করেছি। শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবিনি কোনদিন। শুনেছি, সত্যজিৎ রায় ওঁকে নিয়ে একটা ছবি করেছেন । দেখিনি ।
অ্যাকাডেমিক আর্টিস্টরা আগে মডেল স্থির বসিয়ে বা দাঁড় করিয়ে ছবি আঁকতেন বা মূর্তি গড়তেন। আমরাও কখনও-কখনও করেছি। যেমন ধরো, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী। পোর্ট্রেট নিয়েই তাঁর কারবার ছিল। সরকারি লোকের অর্ডার নিয়ে তাঁদের নির্দেশমতো নেতাদের এবং বড়-বড় লোকেদের মূর্তি করেছেন। ওঁরা প্রধানত অর্ডারের ওপরে বেশি নির্ভর করতেন। >আমার কাজ হচ্ছে স্বেচ্ছায় করা। চলমান কর্মরত মানুষ আমাকে খুব টানত। সাঁওতাল বা অন্যান্য সরল গরিব মানুষই তো আমাদের পর কাজের মানুষ। তাই তাঁরাই আমার মডেল। আর কী জানো, যাঁদের খেটে-খাওয়া মানুষ বলছ, তাঁদের মনের সরলতা, সহজ ঊন, শিক্ষা, নাচ-গান আমাকে দারুণ উদ্দীপনা দিত, এখনও দেয়। ওঁরা এত অল্পে তুষ্ট যে বিস্ময় লাগে। সেই বিস্ময়ের আনন্দেই আমি ওঁদের ছবি করি, মূর্তি গড়ি। যেন মনে হয়, আমি ওঁদের চিনি। ওঁরাও আমি বিয়ের ছবি করি, মূর্তি গড়ি। যেন মনে হয়, আমি এঁদের চিনি। তাঁরাও
বোধ হয় আমাকে চেনে।
MARE
প্রথম-প্রথম শুধু ছবি আঁকতাম। পরে মূর্তি গড়ায় মন দিই। ছবি আঁকা বা মূর্তি গড়ার সময়ে বার বারই যে-কথাটা আমার মনে হত যে আমাকে স্বতন্ত্র হতে হবে। ভীষণ ভাবে স্বতন্ত্র। কোন স্কুল অফ আর্ট-এর যোগ্য উত্তরসূরী বা অন্য কারও মতো ছবি আঁকা- আমি নিজে শিল্পী হিশেবে স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত হতে পারব না। এ ক্ষেত্রে আমাকে স্বার্থপর হতেই হবে। সে সময় আমি সন্ধানী দৃষ্টি মেলে দেখতাম কোন্ আঙ্গিক বা মিডিয়াম, কোন্ বিষয়, কোন্ শৈলী এখনও ব্যবহৃত হয়নি। শিল্পের কোন্ অঞ্চলে এখনও একটিও আঁচড় পড়েনি। ছবি আঁকা বা মূর্তি গড়ার সময় আমি এ বিষয়ে সর্বদা সতর্ক থেকেছি। আলাদা হতে চেয়েছি।
এ সব করলে
আমার প্রায় সব মূর্তিই খোলা আকাশের নিচে। ঘরের চৌহদ্দি থেকে আমি তাদের মুক্তি দিতে চেয়েছি। প্রায় সবই বড়-বড় সাইজের। খোলা মাঠে, আলো-বাতাস-বৃষ্টি-জ্যোৎস্নায় তারা বেশ আছে। প্রায় সব কটা মূর্তিই মুভিং। স্থবিরতায় আমার বিশ্বাস নেই। ইউক্যালিপ্টাসের মাঝখানে যে-সুজাতা দাঁড়িয়ে আছে, সে-ও কিন্তু স্থির নয়। পায়েসের পাত্র মাথায় নিয়ে সে-ও চলেছে। সমস্ত শরীরের শেপ-টা দিয়েছি (যেন) নিষ্পত্র বৃক্ষের কাণ্ড। এমনকী, ঐ যে সাঁওতাল পরিবার— কলাভবনের বাগানে রয়েছে— একটি সাঁওতাল পুরুষ, কাঁধে বাঁক, এক বাঁকে মালপত্তর, আর-এক বাঁকে একটি শিশু বসে, পাশে সাঁওতাল রমণী, মাথায় জিনিশপত্তর, পাশে একটি কুকুর— তা-ও মুভিং। চলেছে। বসে নেই। ওটা করেছিলাম বোধ হয় ১৯৩৮-এ। ডাইরেক্ট কংক্রিট-এ। এমনকী কলের বাঁশি মূর্তিটাও তাই। কংক্রিট-এ করা। কলাভবনের বাগানে সেটাও আছে। একেবারে রাস্তার ধারে। এই মূর্তিটার ভেতরে আমি পথের চলমানতাকে ধরার চেষ্টা করেছি। দুটি সাঁওতালি মেয়ে। একেবারে ভরা যুবতী। কলের বাঁশি শুনে পুকুরে স্নান করে কাপড় শুকোতে শুকোতে দ্রুতপায়ে হেঁটে চলেছে। পেছন-পেছন দৌড়চ্ছে একটা
রামকিঙ্কর বেইজ
বাচ্চা ছেলে। স্থির মডেল-এ আমার বিশ্বাস নেই। আমার মডেল তারাই, যাদের আমি সকাল-সন্ধ্যায় দেখতাম। পাশেই পিয়ার্সন পল্লী । ওখানে সাঁওতালরা থাকে। রোজ সকালে ওরা ঐ ভাবে কাজ করতে যায়, সন্ধ্যায় ফেরে। আমি রোজ যাদের দেখতাম, (যাদের সঙ্গে) মিশতাম- তারাই আমার মডেল। আমার অধিকাংশ কাজ, বিশেষত মূর্তি, আলোর অভিলাষী। অন্ধকারে আমার মোটেও বিশ্বাস নেই। প্রায় সমস্ত কাজই করেছি দিনের আলোয়, প্রখর রোদে। এ ছাড়া উপায়ও ছিল না। বেলা তিনটে পর্যন্ত কলাভবনে শিক্ষকতার শেষে কাজ করতাম। ফলে গ্রীষ্ম কাল আমার প্রিয়। যদিও এই বীরভূমে গ্রীষ্ম দারুণ দুঃসহ, তবু কাজের সুবিধার জন্য এই সময়টাই আমার প্রয়োজনে লাগত । শান্তিনিকেতনে বর্ষাও খুব সুন্দর। নিঃসঙ্গ খোয়াই জুড়ে বর্ষা নেমে আসত। আমাদের আশ্রমের গাছগাছালির মাঝে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির শব্দ শোনা, সেই দৃশ্য- অসম্ভব সুন্দর। এই বর্ষা নিয়ে তো অনেক কবিতা লিখেছেন গুরুদেব। অনেক গানও। প্রত্যেক ঋতুরই নিজস্ব রঙ আছে। নিজস্ব আবেদন। এমনকী রাত, দিন— দুটোরই আলাদা রূপ, ভিন্ন-ভিন্ন প্রভাব। প্রতিটি ঋতুই সে অর্থে ইমপর্ট্যান্ট। ছবি আঁকতে গেলে তা মনে রাখতে হবে। আমার জলরঙে আঁকা বিভিন্ন ল্যান্ডস্কেপ-এ এ সব ধরার চেষ্টা করেছি। ফাঁকা মাঠ, পুকুরপাড়, ঝর্না, খোয়াই, নিঃসঙ্গ তালগাছ, জ্যোৎস্না— বিভিন্ন ঋতুতে এদের বিভিন্ন মুড- আমার প্রিয় সাবজেক্ট। ছবিতে ওরা আছে।
বাবা! এটা কী করেছ হে, লম্বা গাছের মতন?’ আবার দেখে বললেন,
আমার মূর্তি করার টেকনিক বা গ্রামার সব চুলোয় গেছে। কাজ করতে-করতে হয়েছে যা হওয়ার। যাদের ইনটুইশন থাকে, তারা ধরে নেয়। কেতাদুরস্ত সিটিং নিয়ে পোর্ট্রেটও করেছি। অবনী ঠাকুর উপাচার্য হয়ে এসে ওঁর পোর্ট্রেট করেছিলাম দিনে পনেরো মিনিট করে তিন দিন সিটিং নিয়ে। দেখে-দেখে যখন মনে হয় স্ট্রাইকিং, তখন সেটা করি। যেমন সুজাতা মূর্তিটা, ওটা জয়া আপ্পাস্বামীর। মুখটা অ্যাবস্ট্রাক্ট নয়, মডেল করে তৈরি। জয়া বেশ লম্বা দেখতে, স্ট্রাইকিং- তা করলাম হার তৈরি মাটির বুদ্ধমূর্তির সামনে। নন্দবাবু দেখে বললেন, ‘আরে
বেশ করেছ কিন্তু । বুদ্ধমূর্তির সামনে যখন, তখন মাথায় পরমান্নের পাত্র করে দাও। সুজাতা হয়ে যাবে।’ তা-ই করে দিলাম। নন্দবাবু খুব খুশি। বললেন, ‘এটার চারপাশে লম্বা-লম্বা ইউক্যালিপ্টাস গাছ লাগিয়ে দাও, তবে মানাবে।’ এখন ইউক্যালিপ্টাস গাছের মধ্যে সুজাতা দেখলে নন্দবাবুর রসিক মনটা সহজেই বুঝবেন। ঐ যে মাটির বুদ্ধমূর্তির কথা বললাম, ওটা এখন নেই। অনেক বছর আগেই এখানকার একটি ছাত্র, কান্তেশ, হাইজাম্প দিতে গিয়ে না কী করতে গিয়ে ওটার মুণ্ডু ভেঙে ফেলে। তারপর এখনকার কংক্রিটের বুদ্ধমূর্তি করা হয় ।
হ্যাঁ, আমি কিউবিক ছবি করি। অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবিও করি। ঐ এসে যায় আর কী। ধরুন, একটা ধারাবদল হয়তো। সব সময়ে তথাকথিত ‘কপি’ করে যাওয়া উচিত নয়। ও বদলে যাবেই। প্রথম দিকে খুব বেশি বদল হয়নি। তখন আমরা পৌরাণিক বিষয়ের ছবি আঁকছিলাম, ওয়াশ-এ । এখন বললে বুঝি, তখন কিন্তু পরিবর্তনটা হয়েছে আস্তে।
অনেকেই ওয়েস্টার্ন ইনফ্লুয়েন্স-এর কথা বলেন। কিন্তু ওয়েস্টার্ন ইনফ্লুয়েন্স বললে একটা ভয়ানক গোলমাল হয়ে যাবে। আমাদের এটা ভুল কিন্তু এক দিক দিয়ে। যেমন ধরুন, আমাদের শিবলিঙ্গ। এটা কি ওয়েস্টার্ন? না নিশ্চয়ই। তবে? তা হলে কী করে হল এটা? বলুন- উঁ ?
ইয়োরোপেও তো আজকাল কত চেঞ্জ হচ্ছে। অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট হয়েছে। পিকাসোই তো অনেক চেঞ্জ করেছেন। ব্রাক, পিকাসো— এঁরা দু-জনেই। তবে পিকাসো একেবারে নিছক অ্যাবস্ট্রাক্ট নয়। ওদেশে পরে সবাই আরও বেশি করে অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়েছে। পিকাসো বাদে।
৫৪
রামকিঙ্কর বেইজ
অ্যাবস্ট্রাক্টকে ওরিয়েন্টালই বলতে হবে। নটরাজ কি অ্যাবস্ট্রাক্ট নয়? তা হলে চারটে হাত কেন? রাবণ কি অ্যাবস্ট্রাক্ট নয় ? যাকে বলেন শিবলিঙ্গ—— সেটা কী? ওটা কি আপনি ওয়েস্টার্ন বলবেন? মহেঞ্জোদাড়োর আমল থেকেই শিবলিঙ্গ প্রচলিত। আমাদের মিথলজিতেও আছে। ওটা অ্যাবস্ট্রাক্ট তো? কোন রূপ নেই। ভেবে নিতে হয়। দেখতে পাচ্ছেন না কিছু। ওটাকেই যদি একটু-আধটু রূপ দেওয়া যায়, ব্যাস, ফর্ম এসে গেল। ভিস্যুয়াল ফর্ম।
অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে এই ধরনের ছবি আঁকেন কেন? হ্যাঁ, একটু ডিভিয়েশন এসে গিয়েছে বটে ভিস্যুয়াল, ফর্মাল (দিক) থেকে। সেটাই অ্যাবস্ট্রাক্ট বলতে চাইছেন সবাই। এটা কেন হচ্ছে, বলা মুশকিল। ইচ্ছে হল। হুইমস থেকে বলতে পারেন। নতুন কিছু করবার ইচ্ছে। কিন্তু এ-ও থাকে না। বদলে যায়। তবে এটা ঠিকই যে নন-ফিগারেটিভ অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট, যাতে কিছু রঙ-রেখাই মাত্র আছে, তার টোটাল ইফেক্ট সবার কাছে সমান হয় না। কমিউনিকেশন প্রবলেম থেকেই যায়। আসলে আপনি কখনও জেনেরালাইজ করতে পারবেন না। প্রবলেম থাকছেই। সবাইকেই চিরকাল এটা ফেস করতে হয়েছে। দেখতে-দেখতেও অভ্যস্ত হয়ে যায়। আমি কোন জায়গায় লাল রঙ দিয়েছি বা সবুজ দিয়েছি, আপনার প্রথমে বিরক্ত লাগল, কিন্তু দেখতে-দেখতে সয়ে যাচ্ছে। এ-ও হয়। দর্শকের কাছ থেকে রেসপন্স চাইছি, কিন্তু সেটা পাব বলে জোর করে বলতে পারি না। আপনার যেটা ইচ্ছে আপনি
পারেন না। আপনি খালি এঁকে দিলেন, কিন্তু তার জন্যে আপনিও দায়ী নন, আপনার দর্শকও দায়ী নন। তার যেমন যা ইফেক্ট হয়— একটা ছবি দেখতে গিয়ে আপনি হয়তো পালিয়ে গেলেন— ধ্যুৎ, কিছু হয়নি। কিন্তু আবার ঘুরে-ফিরে সেখানেই আসছেন, দেখি তো ব্যাপারটা— এ-ও হতে দেখেছি। লোকে চায় আর্টিস্ট যে-পয়েন্টে ছবি করেছে,
JanaBন পালন, কিন্তু দর্শক সেটা কী ভাবে নিচ্ছে না-নিচ্ছে, তা বলতে
পুরনো গেস্ট হাউস-এর সামনে যে কম্পোজিশনটা
পয়েন্ট-এর কাছে আসবার ।
সেটা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন। ওটার মধ্যে দু-তিনটে সাবজেক্ট মিলে- মিশে রয়েছে। নয় কি? সেই জন্যে দু-তিনটে প্রোসেস এসে গিয়েছে। তার থেকে কিছু-কিছু এলিমিনেটেড হয়েছে। কিছু-কিছু অ্যাড হয়েছে। যে-দুটো বা তিনটে অবজেক্ট, সেগুলো রিয়ালিস্টিক গেলে সমস্ত ব্যাপারটাই অন্য রকম হয়ে যেত। কিন্তু যে-ভাবে রয়েছে, সে ভাবে কম্বিনেশন করাতে সংহত একটা ভাব, বেশ নতুন একটা জিনিশ আসছে। হ্যাঁ, মনে পড়েছে, এক ফোটোগ্রাফার এসেছেন ফিল্ম করতে— তখন অবনীন্দ্রনাথ আচার্য। ফোটোগ্রাফারটি বললেন, ‘হ্যাঁ মশাই, ও একটা কী দেখছি? আমি ওদিকে গিয়ে দেখলাম, এদিকে এসে দেখলাম, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না।’ অবন ঠাকুর হেসে বললেন, ‘ঐ তো গো, ও যে ঘোরাবে-ফেরাবে আর দেখাবে— ঐ হচ্ছে রামকিঙ্কর ।’ ঐ কম্পোজিশনটা সম্পর্কে যা বলছিলাম, ওটার মধ্যেকার কাজগুলো ভাগ করা যায়। একটা দেখবেন নারীমূর্তি, চুম্বনরতা। তারপরে দেখবেন পাখি আছে, কোর্টিং বার্ডস। নারীমূর্তি একপাশে দেখা যাবে এবং সেই নারীমূর্তির সবটা নেই। কিন্তু সবটা না-থাকলেও বোঝা যায়। এই রকম ভাবে অ্যাবস্ট্রাক্ট করলে কতকগুলো ফ্রিডম আসছে, যেগুলো সাধারণ কাজে নেই। এই ফ্রিডম ঠিক-ঠিক ভাবে প্রয়োগ করলে একটা অন্য ফর্ম আসছে। যেন চেনা যাচ্ছে না, অথচ চেনা-চেনা লাগছে। নতুন ডাইমেনশন এসে যায়। মিস্টিক ভাব আসে। অহেতুক ভাবটা বাড়ছে।
6
আমার সাঁওতাল দম্পতি ইত্যাদি মূর্তিগুলো সিমেন্ট-কংক্রিটে করা কেন, তা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন করেন। তাঁরা জিজ্ঞেস করেন, কেন ব্রঞ্জে করেননি?’ আমি বলি, ‘কেন আবার- পয়সা!’ পয়সা তো চাই কাজ করবার জন্যে । অত বড় কাজগুলো স্টোন-এ করতে গেলে কত টাকা খরচ হবে ভাবুন? তাতে সিমেন্ট-কংক্রিটের যে-ইফেক্ট হয়েছে তা হয়তো হত না, কিন্তু অন্য ইফেক্ট হত। এখন যে-ইফেক্টটা আসে, তা (আসে) পেবলস্ দিয়ে করার জন্যে। এটাই যদি কার্ভিং-এ করা যেত তা হলেই এ রকম হত না। কার্ভিং-এ অন্য রকম টেক্সচার হবে।
৫৬
আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র
ওগুলো সিমেন্টে করব ভেবে করিনি। আসলে পেয়েছিলাম চার ব্যাগ সিমেন্ট, আর কিছু লোহার রড। তাতে তো অন্য কিছু করাই মুশকিল। তখন এখানে যা টাকাকড়ির অবস্থা, তাতে ঐ সিমেন্ট-কংক্রিটে কাজ না-করলে কিছু হয়তো করাই হত না। বড়জোর ক্লে মডেলিং-এর মতো ছোট-ছোট মূৰ্তি হত। এগুলোও অবশ্য ১৮ ইঞ্চি কাজ থেকেই আমি এনলার্জ করেছি, মাপ নিয়ে। পরে কংক্রিটে ডাইরেক্ট কাজও করেছি। সিমেন্ট-কংক্রিটের লাইফ কিছু আছে বটে, কিন্তু নষ্টও হয়ে যায়। সিলিকন পেন্ট না-করলে টেকে না। এখানে তা-ও করা হয় না।
দিল্লিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক-এর সামনে যক্ষ-যক্ষী আছে। এটা পাথরের। এই মূর্তির মোটামুটি আইডিয়া জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে এটা ব্যাঙ্কিং-এর ব্যাপার। সিম্বলটা তাই অর্থের এবং কৃষির। এগ্রিকালচারটা যক্ষী-র দিকে। তাতে আছে ফ্লাওয়ার, এগ্রিকালচার ও ডান হাতে কৰ্ণ । যক্ষের হাতে যা আছে, তা আমার স্বকপোলকল্পিত । যক্ষের এক হাতে রয়েছে পিনিয়ন— ইন্ডাস্ট্রি-র প্রতীক। আর-এক হাতে মানিব্যাগ । যক্ষের ব্যাপারটা ভেবে নিতেই হয়েছে, নইলে যক্ষের যত মূর্তি পাওয়া যায় তাদের কারও হাত নেই। কলকাতার মিউজিয়মে যে-যক্ষমূর্তি, এটা তারই ধাঁচে তৈরি। কলকাতার মূর্তি মথুরা থেকে পার্সি ব্রাউন-এর সময় সংগৃহীত। আমার কাজটার নাম যক্ষ-যক্ষী। অনেকে ভুল করেন যক্ষিণী ভেবে, তা কিন্তু নয়। আসলে পৌরাণিক বাস্তবে এঁরা ভাই-বোন। কখনওই স্বামী-স্ত্রী নয়। তাই যক্ষিণীও নয়।
যা বলছিলাম— ওটা ছিল বিশাল কাজ। অনেক মুশকিলের ব্যাপার ছিল বলে এক জায়গার। কিন্তু ওখানকার রেল যে মিটারগেজ, তা খেয়াল ছিল না।
তি। পাথর সিলেক্ট করেছি কুলু ভ্যালি-র কাছে বৈজনাথ এক-একটা স্ল্যাব রেলে আনা গেল না। তাই পাথর
টুকরো করা হল চার ভাগে। দিল্লিতে এনে জোড়া হয়। আসল প্ল্যান ছিল একটা মাত্র পাথর কেটে মনোলিথ কাজ করবার। লেবার ইত্যাদিতে খরচ এবং টাইম যে কী ভীষণ বেশি লেগে গেল, তা আর বলবার নয়,
AMARBOR
রবীন্দ্রনাথের বাস্ট করেছি যে-বছর, সেই বছরই উনি মার
। সংস্কার আছে যে কারও ছবি আঁকলে বা মূর্তি করলে সে নাকি বাঁচে না। এখন মনে হয়, কেন করলাম তখন। রবি ঠাকুরের বাস্ট সিটিং নিয়ে করা। মূর্তিটা খুব কাছের থেকে বোঝা যাবে না। একটু দূর থেকে
ভালো বোঝা যাবে। উনি বললেন, ‘মাপজোক নিও না কিন্তু। এপস্টাইন কী রকম জ্বালাতন করেছে আমায়, সমস্ত সময় ক্যালিপাস নাকের কাছে ধরা আছে, ও সব কি পোষায়?’ তখন আমি পোর্ট্রেট করছি খুব। সাহস ছিল। অল্প বয়েস। আমি বললাম, ‘আচ্ছা বেশ, আপনি বসে- বসে কাজ করে যান। আমি কোন ডিসটার্ব করব না।’ উনি ঝুঁকে বসে লিখতেন, আমার কাজটাও সেই রকম। চুল-দাড়ি অল্প, সে বছরই কাটা হয়েছিল তো। প্রথমে ভেবেছিলাম, পুরোটাই করব। ওঁকে পোশাক ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করাতে বললেন— ‘পোশাক দিয়ে কেন মানুষটাকে ফোটাবে, তার চরিত্র, তার বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলো। তবেই বুঝব, তুমি কেমন আর্টিস্ট। আমিও আর (সে) চেষ্টা করিনি ।
দুটি মেয়ের ছবি এঁকেছিলাম লাইফসাইজ। এখানকারই ছাত্রী। অদ্ভুত রঙ তাতে। জীবন্ত মনে হয়। মুখে ডিসটর্শন এসে গিয়েছে। ইচ্ছাকৃত নয়। কিছু-কিছু ডিসটর্শন— যেমন ধরুন, গলাটা খুব বেশি লম্বা, এই রকম আর কী— না-থাকলে সমস্ত জিনিশটা পয়েন্টলেস হয়ে যায় না কি? ছবিটা তুলি দিয়ে আঁকা নয়, স্প্যাচুলা দিয়ে করা। তাতেও এই রকম বিকৃতির ছাপ পড়ে। প্যালেট নাইফ দিয়ে আঁকলেও তা হয় ।
ওয়াটার কালারে, অল্প রঙে বেশি ইফেক্ট এনেছি খোয়াই-ধরনের ছবিতে। এ রকম ছবি অনেক আছে। ওয়াটার কালারে কিছু চিনা প্রভাব আছে বলে মনে হয়। দেখতে-দেখতে প্রভাব এসে যায় বৈকী। তা বলে কপি করা নয়। খোয়াই ইত্যাদি ছবি নেচার থেকে দেখে আঁকা ।
আমার ছবিতে ডাইমেনশন-এর একটা ব্যাপার আছে, যা অনেকে বলেন অনেক শিল্পীর মধ্যে থাকে না। আসলে ডাইমেনশন এসে
৫৭
রামকিঙ্কর বেইজ
যায়। সেটা মিডিয়াম-এর জন্যেও বটে খানিকটা। যেটা ছবিতে আঁকা হয়, সেটাই যখন মূর্তিতে করা হয়, তখন ডাইমেনশন এসে যাচ্ছে। কেননা ছবিতে আপনি একটা সাইড থেকে দেখছেন। মূর্তি তো তা নয়, চারধার থেকেই দেখছেন। তাতে ডাইমেনশনাল অ্যাপ্রোচ বেড়ে যাচ্ছে। নয় কি?
একটা দুর্বার আবেগ অনেকে আমার ছবিতে দেখেছেন। আপনারা যেমন ধান রোয়া ছবিটার কথা বলছেন। এই ব্যাপারটা, অর্থাৎ ডাইনামিজম নির্ভর করছে ফিলিং-এর ওপর। যে করছে তারও ফিলিং, যে দেখছে তারও ফিলিং। নাঃ, এই দুটো কথা— ডাইমেনশন আর ডাইনামিজম— এই দুটো কথা বড্ড গুলিয়ে ফেলছি। বয়স হচ্ছে তো— হ্যাঁ, যা বলছিলাম, মূর্তির দিকে ঝোঁক থাকার জন্যেই আমার মধ্যে ডাইমেনশন ব্যাপারটা এত স্পষ্ট। মূর্তি যাঁরা করেন, তাঁদের মধ্যে এই জিনিশটা আসে। আসা উচিত অন্তত। কারণ হেভিনেসটা আসছে তো। মেটিরিয়াল হেভিনেস ছবির মধ্যেও এসে যায়। ফলে ডাইমেনশন-টাও বেড়ে যাচ্ছে এখানে। রঙের তফাতেও ডাইমেনশন বেড়ে যায়। কাছের, মাঝের আর দূরের– এই তিন পর্যায়ে তিন রকম রঙ হওয়া উচিত। থ্রি ডাইমেনশন। আকাশটা যে দূরের, সেটা তো বোঝাতে হবে। ডাইমেনশন মানেই হচ্ছে সামনে যেটা দেখছি তার পিছনটাও যে আছে, সেই পিছন দিকের ফিলিং-টা ফোটানো। কিউবিজম ব্যাপারটার ও মূল এই খানেই নয় কি? কিউবিক ছবিতে দেখবেন দু-রকম ভাবে মুখ আঁকা। এটা অবশ্য আধুনিক কালের সৃষ্টি। এটা কিউবিজম-এর শুধু নয়, চিরকালের কথা। অজন্তা-তে দেখবেন আয়নাতে চুল আঁচড়াচ্ছে মেয়েরা। তিনটে ফিগার। তার পা-টা উলটে দিয়েছে, আর পায়ের তলা দেখা যাচ্ছে। তা এটা তো সেকালের জিনিশ। আজকাল করলে বলা হত – খুব হয়েছে, কিউবিক হয়েছে। কিন্তু তা তো নয় ৷ ওখানে সব
দিকের ডাইমেনশন একসঙ্গে ধরতে হয়েছে। কিউবিজম-এও এটা করাহয়। পিকাসোর ছবিতে দেখুন, তিনটে চোখ, কোথাও নাকটা সোজা এনে পাশে চালিয়ে দিয়েছে। চোখ বা নাকের টুথফুলনেস-টা আছে কি । সব দিকের দেখাকে একসঙ্গে ধরে রাখাটাই কৃতিত্ব। এতে টোটাল ইফেক্ট কিন্তু অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়ে যায় ৷
আমার আরও কিছু ছবি নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন। ঐ যেখানে এক-একটা কিউব-এর মধ্যে এক-এক রকম কালার দিয়ে অ্যাবস্ট্রাক্ট করা হয়েছে। আসলে ঐ কম্বিনেশন না-করলে ভেরিয়েশন আসে না তো। একটা গাছে কত রঙ দেখবেন, কোনটা হয়তো ছায়াতে, কোনটা উজ্জ্বল রোদের আলোতে, আবার কোন-কোনটা হলুদ বিবর্ণ। এই পার্থক্য আনবার জন্যেই ছবির মধ্যে কালার চেঞ্জ করে দিয়েছি। একসঙ্গে সব রঙ মিশিয়ে দিলে রঙটা ডার্টি হয়ে যায়। সেই জন্যেই তফাত করে দেওয়া। দুটো রঙের পাশে একটা শাদা লাইন, মানে ক্যানভাস-এর বা কাগজের অংশ থাকে । না-হলে সব মিলে একটা থার্ড কালার হবে, যেটা জবরজং হয়। এখন তো আরও সংক্ষেপ হচ্ছে। নেচার, ভল্যুম, স্পেস- সব বিভিন্ন শেড-এ কালার করে পরে কলমের টানে কিছু ডিটেলস করা হয়।
যেমন ধরুন, আপনি যদি স্টোন কার্ভিং করেন, তা হলে কিউবিক-এ যেতেই হবে। আপনাকে সোজা লাইন ধরে কাটতে হবে। কেটে-কেটে তারপরে তো ডিটেলস-এ আসবেন। ছবির মধ্যেও সেটাই এসেছে। স্টোন কার্ভিং আমার নিজস্ব। ছবির মধ্যেও সেটাই আসছে। ডিটেলস করবার আগে প্যাটার্ন যেটা, সেটা তো স্ট্রেট লাইন দিয়েই হচ্ছে। তাহলে তফাতটা কোনখানে হচ্ছে? এখন সেখানেই যদি স্টপ করেন আপনি, বলেন যে ডিটেলস-টা করব না— তবে? তা হলে যে সেখানটাই থেকে গেল। কিউবিজম হয়ে গেল না কি?
কিউবিক থেকেই ডিটেলস আসছে। তা ডিটেলস-টা মুছে দিন, তা হলে কিউবিক-টাই রয়ে গেল। ধরুন, হাত করছেন— স্ট্রেট লাইন করলেন, কিন্তু তাতে যদি হাতের ডিটেলসগুলো না-দেন, থাকে শুধু সোজা-সোজা লাইনগুলো, তা হলেই কিউবিক হয়ে গেল। এটা আমার
৫৮
রামকিঙ্কর বেইজ
মধ্যে আসছে মূর্তি করবার ঝোঁক থেকেই। হ্যাঁ, কিউবিক-টা আবার অন্য ভাবেও বোঝানো যায়। কোন জিনিশের, ধরুন এই বইটার, তিনটে সাইড দেখা যাচ্ছে। তার এ ধারটা এ রকম, ও ধারটা অন্য রকম, আবার আরেক ধার আরেক রকম। বইটা আঁকতে গেলে তিনটে ধারের শেপ কী রকম হবে তা হলে ভাবুন। এই রকম দৃষ্টিভঙ্গিতেও কিউবিজম এসে যাচ্ছে। আমার কনটেম্পরারি যাঁরা, তাঁরা কেউ বিশেষ মূর্তি-টুর্তি করেননি বলেই কি না জানি না, কিউবিজম-এর দিকে বিশেষ যাননি। আসলে তাঁরা হয়তো এটা স্বীকারই করেন না। কিন্তু আমি স্বীকার করছি এটা। স্বাভাবিক বলে জানছি। তবে কিউবিজম-এই থেমে থাকা যাচ্ছে না। তাতেও পরিবর্তন আসছে। কিউবিক রেখেও কী ভাবে বোঝানো যায় বা ফোটানো যায় জিনিশটা, সেটা ক্রমশই বদলাচ্ছে। সেই জন্য দেখবেন কিউবিজম-এর মধ্যেও আবার একটু ভাঙন। আবার দু-তিনটে জিনিশ, স্ফিয়ার এবং কিছু লাইন বা টোন-এর কম্বিনেশন-পারমুটেশন। একটু অন্য রকম যাতে হয়, তা-ই আর কী! তখন নিছক কিউবিক-টা উড়ে গেল। একেবারে বন্ধ। পিওর কিউবিক বলতে কিছুই রইল না, অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়ে গেল। কিউবিজম-টাই একটু এদিক-ওদিক বদলে নিয়ে অ্যাবস্ট্রাক্ট হল। তা এই অ্যাবস্ট্রাক্ট আবার কী জিনিশ? একটা ঘটনা মনে পড়ল। তখন পুরনো গেস্ট হাউসের সামনে মূর্তিটা করছি। এক দিন আমি কাজ করছি, নন্দবাবুও এসেছেন। আমাদের এখানে একজন পণ্ডিতমশাই ছিলেন। তিনি এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মশাই, এটা কী?” নন্দবাবু একটা তালগাছের দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওটা কী বলুন তো?’ নন্দবাবু গম্ভীর হয়ে পণ্ডিতমশাইকেই প্রশ্ন করলেন, তাহলে ওটা কী, অ্যাঁ? এটা যদি অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়, তা হলে তালগাছটা কী? কোটা অ্যাবস্ট্রাক্ট? আর
ভাবলেন, এরা সব ক্ষেপে গেছে। তাই তো বলি, কিছু বলা মহামুশকিল আছে
হল। ফর্ম তো আগেই ছিল। কিন্তু (এখন) যেটা হল, সেটা না স্ট্রোক্ট মানেই বা কী? পণ্ডিতমশাই পালিয়ে গেলেন। প্রোসেস অফ এলিমিনেশন’। কিন্তু ওখানেও থাকবে কি
না
যখন একটা মূর্তি করি তখন যেমন (প্রথমে) পাথর কাটি লাইন
একটা স্ফিয়ার ঠিক করে, তার পরে চেঞ্জ করে একটা ফর্ম আনা
ফাল ফর্ম। ভিস্যুয়াল ফর্ম থেকে একটা নতুন জিনিশ পাওয়া গেল ‘বাই দ্য
হবে। পিকাসো প্রথমে যে অ্যাবস্ট্রাক্ট করতেন, পরে তা উড়ে গেল।
আবার ফর্ম এল। ফর্মাল হল। পিওর ফর্ম কোন্টা? যেটা ভিস্যুয়াল, সেটা এক রকম। কিন্তু তার ডিটেলসগুলো মুছে দিলেই একটা ফর্ম এল। তাই না? এইটাকেই পিওর ফর্ম বলতে পারো ।
ফর্ম ভাঙা? গণেশ দেখেছ? গণেশটা কি মডার্ন? হাঃ হাঃ। রাবণের দশটা মাথা। পিকাসো মুখের ওপর মুখ চাপান। রাবণ মডার্ন ? জানি না। ফর্ম ভেঙেছি, ভাঙার দরকার হয়। কী দেখছি, কী দেখতে চাই, তারই ওপরে ফর্ম ভাঙা না-ভাঙা নির্ভর করে। ধান ঝাড়াই করার সময়ে শরীরে যে-গঠন আসে, সেটুকুকে ধরতে অ্যাবস্ট্রাক্ট করেছি। সাঁওতাল কুলি-পরিবারের চলে যাওয়া হুবহু রেখেছি। আবার রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতে চোখের বদলে বল-এর ব্যবহার করেছি। সবই গড়া, আবার ভাঙাও ।
অ্যাকাডেমিক শিক্ষায় ওরা (পাশ্চাত্যে) দেখে-দেখে অ্যানাটমি-র চর্চা করে ছবি আঁকে। ওরিয়েন্টাল বা মডার্ন আর্টে শিল্পীর নিজের কল্পনা বড় হয়ে উঠেছে। অ্যানাটমির শেকলে বাঁধা চর্চার চেয়ে ছন্দের ওপর জোর পড়েছে বেশি। ওরিয়েন্টাল আর্ট-এর ছন্দপ্রধান রূপ থেকেই আধুনিক ইয়োরোপের শিল্পীরা অ্যানাটমি ও রিয়ালিজম-এর বাড়াবাড়ি ত্যাগ করেছেন। মডার্ন আর্ট তো এ ভাবেই জন্ম নিল— জাপানি ছবির প্রিন্ট দেখে। জাপানি ছবিতে অ্যাকাডেমিক পার্সপেকটিভ নেই, অথচ বেশ দূরত্ব বোঝা যাচ্ছে— এ সব দেখে ইয়োরোপের আর্টিস্টরা অবাক হয়ে
৬০
রামকিঙ্কর বেইজ
গেলেন । আমাকে অনেকে বলে, পশ্চিমের শিল্পীদের প্রভাবে আঁকি। কিন্তু আমার ধারা তো এ দেশেরই ধারা। এ দেশের শিল্প কখনও নকল করেনি। ছন্দ হল তার ভেতরের কথা। ঠাকুরমূর্তির কথা যদি ছেড়ে দাও, আমাদের দেশের মূর্তির মোদ্দা কথা হচ্ছে স্ট্রাকচার, ছন্দোময় রূপ- গঠন। তবে বাইরের পরিবর্তন কিছু হবেই, আগে শিল্পের পেছনে ধর্মের পটভূমি ছিল। এখন তা নেই। এখনকার দুর্গাপ্রতিমা সিনেমাস্টার-এর মতো। ওরা বলে, দুর্গার চেহারাটা চাই অমুক স্টার-এর মতো, সরস্বতীটা অমুকের, কার্তিক হবে হয়তো অশোককুমারের মতো। আমি জিজ্ঞেস করি, তা অসুরটা কার মতো হবে? এখনকার ধর্ম হল জীবন। জীবনকে দেখে তার থেকেই ছবির বিষয় ও রূপ নিতে হবে।
ওরিয়েন্টাল আর্ট কিছুটা রিপ্রেজেনটেশন রাখতে চায়, একটা পরিচয়ের অবলম্বন। কিন্তু বস্তুর প্রতিকৃতি অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট-এ একেবারে বাদ পড়েছে। রেখা, ডিজাইন প্রধান হয়েছে। স্ফিয়ার, সিলিন্ডার, শোয়া লাইন, খাড়া লাইন, বাঁকা রেখা বা তাদের ঊর্ধ্বগতি, নিম্নগতি — এই নিয়েই কাজ। কোন রূপের অনুকরণ না-করে কেবল ভেতরের সুরটি এতে ধরা পড়বে। সঙ্গীতও তো কপি করে না। বসন্তরাগিণী গাইতে তবে তো গাইয়ে কোকিলের মতো কু-কু করত। সুরটাকে নিয়ে একটা টাইপ ধরে দেওয়া তাঁর কাজ। কোকিলের ডাক, পাপিয়ার ডাক আলাদা করে কিছু নেই, সব মিলেমিশে বসন্তের পরিবেশ রচনা, অনুভূতি ও আবেগ প্রকাশ করা। রাগিণীর এ ভাবেই সৃষ্টি। অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টও সেই রেখা ও ছন্দে বাঁধা সঙ্গীত। নানা ভাবে (হয়) এই ডিজাইন। সঙ্গীত রচনা করতে-করতে দেখতে হয় সুরটা ঠিক হল কি না, রচনা সুন্দর হল কি না । আমাদের ক্ল্যাসিকাল গান এক ভাবে ইনফিনিটি-কে ধরেছে শুধু সুর দিয়ে,
কথা দিয়ে নয়। গুরুদেবের গান আবার আরেক ভাবে সেই ইনফিনিটি-কেই ধরেছে। সেখানে সুরের সঙ্গে কথাও আছে, হয়, কখনও হয় অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট-এর (মতো), বর্ণনা বাদ দিয়ে শুধু রাগিণীর মতো রূপ দিয়ে। আমরা তো শিল্পের শিক্ষার দিকটা ওড়াচ্ছি না। শিল্পের মূল মন্ত্রগুলি শিখতে তো হবেই। কিন্তু আজকের দিনে এই এটি এর প্রতিও প্রবণতা রয়েছে, লোকে আনন্দ পাচ্ছে— তা কেন স্বীকার
করা হবে না?
”
আছে। ছবিতেও তা-ই— কখনও বর্ণনা বা অর্থ দিয়ে ধরা
আমাদের প্রচলিত শিল্পধারা থেকে গুরুদেব প্রথম অন্য পথে গেলেন। অন্য অনেক বড় কবি ছবি এঁকেছেন, কিন্তু তাঁদের ছবি অত্যন্ত অ্যাকাডেমিক। কারণ গুরুদেবের মতো দৃষ্টিশক্তি, অনুভূতির গাঢ়তা তাঁদের ছিল না। এই দুটি গুণ না-থাকলে গুরুদেবও অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট-এ ফেল করতেন। অন্য কোন কবি হলে খুব কাব্যিক ছবি আঁকতেন। এ দেশের অনেক আঁকিয়ে তা করেছেন। (হয়তো) গুরুদেবেরই কবিতার লাইন ছবির তলায় বসিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। তাঁর ছবিতে রয়েছে বলিষ্ঠতা, ভাইটাল অবজার্ভেশন, ঘন ভাব, ওয়ার্থ. . . আর তা ছাড়া অর্থে বাঁধা-পড়া মন হঠাৎ ছুটি পেতে চায়। সাধারণ মানুষও হঠাৎ কথা ছাড়া সুর ভেঁজে চলে, সেটা করতে ভালোবাসে। অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবিও তাই
ইম্প্রেশনিজম? ওটা কিছু না। তুমি দৃশ্য যা দেখছ, তোমার চোখে তারই আভাস নিয়ে যে-কাজটা হল, সেটাই হচ্ছে ইম্প্রেশনিজম। তার আবার রকমারি ব্যাপার আছে। ইম্প্রেশনিজম বলতে যা, সেটা ফোটোগ্রাফিতেও করছে। কিন্তু তার মধ্যে তোমার যে বিশেষত্ব একটা, তোমার মানসিক ইফেক্ট, সেটা এসে যাবে ওর ভিতরে। সেই জন্য ফোটোগ্রাফির সঙ্গে তফাত হয়ে যাচ্ছে একটু। এই হচ্ছে ব্যাপার
কিউবিক আর্ট হচ্ছে আমরা যা দেখছি, সেটাই একটা কিউবিক ফর্ম-এর মধ্যে ফেলছি। যেমন, একটা গাছ। গাছটা, তার মধ্যে আমি সব দেখছি অবশ্য, তার নিচের যে রস, তার ডালপালা — সবই দেখছি। কিন্তু সেটা একটা ফর্ম-এর মধ্যে ফেলা হচ্ছে। সেটা কিউবিক ফর্ম-এ
রামকিঙ্কর বেইজ
ফেলছি। এখন কিউবিক ফর্ম-টা কী, তা দেখতে হবে। সেটা কী? সেটা হচ্ছে কিউব। সেটা চতুষ্কোণ হচ্ছে, ত্রিকোণ হচ্ছে। সেটাকে ফেলে একটা সলিডিটি আনা হচ্ছে। একটা সলিড ফর্ম-এ ফেলছি। আসলটা প্রতিফলিত। আসল ফর্ম-টা আসছে, তার মধ্যেই আসছে। কিউবিক কেন করছি? যেমন রস দিয়ে মিছরি তৈরি হল। তুমি যখন মিছরিটা গলিয়ে দিলে, রস পেয়ে গেলে। কিউবিক হল ঠিকই, কিন্তু ওর ভিতরে রসিকের যে-ইয়েটি, সেটি কিন্তু থাকা চাই বাবা, তা না-হলে কিউবিক হবে না, বুঝলে? কাজেই কিউবিক হলে কেউ যদি বলে, ওটা বাজে হয়ে গেল, তা চলবে না। তার মধ্যেই সেই রসিকতা, রসিক মনের প্রতিফলনটি হওয়া চাই। তুমি গালিয়ে দিলেই সেটি আবার সেই রসে পরিণত হবে। সেই রস। কিউবিক-এর মধ্যে অন্য কিছু মেশানো যায় কি না, যেমন গোল বা অন্য কিছু? যা-ই করো না কেন, রসিক মনের পরিচয় থাকা চাই। তা না-হলে অন্য লোকে, দর্শকে বুঝবে না। তুমি রস পাবে। যদি না-পাও, তাহলে সেটা নেহাত ব্রিক হয়ে যাবে, একটা ইট হয়ে যাবে। রসিক মন যদি হয়, তা হলে এসে যাবে এটা। কত কিউবিক ছবি দেখবে, কোনটা বেশ চমৎকার লাগছে, আবার কোনটা বা
লাগছে না।
কিউবিক থেকে অ্যাবস্ট্রাক্ট হচ্ছে আবার। যেমন ধরো, একটা লণ্ঠন। টেক অ্যান একজামপল, আ লণ্ঠন। ইউটিলিটি আছে যে আলো জ্বলবে। কিন্তু ফর্ম-টা তুমি করছ। ফর্ম-টা তুমি দিয়েছ। অ্যাঁ, সেটা কিউবিক নাকি? তা এখন তোমার বিচার্য। কিন্তু আলো দেবার যে-কায়দাটা, সেটা তো তোমাকে করতে হয়েছে। ফর্মটা ইটসেলফ একটা (জিনিশ), যেটা তুমি এমনি প্রকৃতির মধ্যে পাচ্ছ না। আমরা করছি সেটা। তার ইউটিলিটি যে, আলো জ্বলবে। তার ভেতরে পলতে থাকবে, তেল থাকবে, তবে আলো জ্বলবে। বাতাসে নিভবে না। এ সমস্ত কায়দা দিয়ে তা হচ্ছে। অ্যাবস্ট্রাক্ট বলতে তুমি যদি ভালো করে প্রকৃতিকে দেখো, তবে তুমি অ্যাবস্ট্রাক্ট এ পৌঁছে যাবে। প্রকৃতিকে যদি দেখা যায়, তা হলে ঐ অ্যাবস্ট্রাক্ট-এই পৌঁছে গেলে তুমি। সেটা ডিপেন্ডস অন ইউ। তুমি ষ্টি দিয়ে দেখতে পারো জিনিশটা, সেটার ওপর নির্ভর করবে।
প্রকৃতিকে যা দেখছ— প্রকৃতি বলতে কী? তোমার জীবনের শিল্পের অভিজ্ঞতা। নৈসর্গিক সচেতনতা, কসমিক রিয়ালিটি,
মোটামুটি ধারণা। তাদের নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি অনভভজ্ঞতা, নৈসর্গিক সচেতনতা, সৌন্দর্যানুভূতি, শিক্ষা এবং পারম্পরিক
সূর্য দেখছ, চন্দ্ৰ দেখছ, তারকারাজি— তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তোমার করেছ। সেটা যে কী ব্যাপার তার সম্বন্ধে তোমার অনুভূতি আছে কি? সেই কথাটাই
একটি ফুল, একটি গাছ, মানুষ এবং সকল জীবের মধ্যে বিরাজমান। পারম্পরিক মানে ট্র্যাডিশনাল। অর্থাৎ মহেঞ্জোদাড়ো থেকে শুরু করে, মানে তিন হাজার বি সি, সেখান থেকে শুরু করে আজ আমরা এসেছি বিশ শতকে। মহেঞ্জোদাড়োর শিল্পে যে-মূর্তি গঠন হয়েছিল, আজও পর্যন্ত তার মন্দির প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। সেটার অর্থ কী? ভারতবর্ষের শিল্পের ধারা আজও সমান ভাবে বজায় রয়েছে। সেই মূর্তিটির নাম বলতে পারো? সেটি হল শিবলিঙ্গ। কোন একজন বিখ্যাত শিল্পী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি আধুনিক মূর্তির কপি করি কি না। উত্তরে আমি বলেছিলাম যে, “শিবলিঙ্গ কোন পারিজিয়ান শিল্পী তৈরি করেছিলেন?— উত্তর দিন।’ আমরা প্রকৃতির মধ্যে যা দেখি, আমাদের অভিজ্ঞতা, ইসথেটিক ট্রেনিং, আবেগ, অনুভূতি, নৈসর্গিক সচেতনতা ইত্যাদির মিশ্রণে যা হয়, সেখানে ওয়েস্টার্ন বা ইস্টার্ন-এ কোন তফাত নেই। আমরা সোজাসুজি প্রকৃতির ভেতর যাচ্ছি। তার পর যা হয়, সেটাই হচ্ছে আমাদের কাজ।
এই শতকের পাশ্চাত্য শিল্পকলা আমাকে বেশি আকৃষ্ট করেছে। নিজের মনের সঙ্গে আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্পীদের অনেক মিল খুঁজে পেয়েছি। এই বাংলার লোকশিল্পকলাও আমাকে নাড়া দিয়েছে। ছোটবেলায় গ্রামে কুমোরদের কাছে গিয়ে পোড়ামাটির পুতুল গড়া দেখতে খুবই ভালো
৬৪
আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র
লাগত। কী নিখুঁত সে সব কাজ! এ ছাড়া জাপানের ও চিনের নিজস্ব এক ধরনের আর্ট আমার খুবই প্রিয়। আমাদের দেশে গুপ্তযুগের শিল্পকলা নিয়েই যেন বেশি মাতামাতি হচ্ছে, কিন্তু পালযুগের অবদানও কিছু কম নয়।
পাশ্চাত্য ছবি অনেক দেখেছি। সেজানকে ভালো লাগে। কিন্তু সম্প্রতি এক পত্রিকাতে দেখলাম যে আমি নাকি বলেছি, সেজান-কেই শুধু ভালো লাগে। তা কিন্তু না। নট নেসেসারিলি। তবে সেজান কিউবিজম-টাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। পিকাসো আমার চিরদিনই ভালো লাগে। শান্তিনিকেতনে এই সব ওয়েস্টার্ন মাস্টারদের ছবি দেখবার কোন অসুবিধা ছিল না। খুব ভালো প্রিন্ট ছিল এখানে। বইও ছিল কত । এই যে পিকাসোর কথা বলছেন, ওঁরা তো একেবারেই অ্যাকাডেমিক স্টুডেন্ট হিশেবে নাম করেছিলেন। ভালো হাত ছিল। তার থেকেই ভ্যারি করেছে।
অনেকেরই ছবি দেখেছি বা মূর্তি দেখেছি আমি। যেহেতু কখনও বিদেশ যাইনি, ডাইরেক্ট কোন কাজ দেখিনি, বই পড়েছি, জেনেছি ওঁদের সম্পর্কে। প্রভাবিত হয়েছি কি না, সে চুলচেরা বিচার করবেন— আছেন সে রকম কিছু সমালোচক। অনেক পড়েছেন তাঁরা। অনেক জানেন। মিল খুঁজে বের করতে ওস্তাদ তাঁরা। সে অর্থে প্রিয় বলতে আমার কেউ নেই। পিকাসো তো আমাদেরই সমসাময়িক। সেজান বোধ হয় একটু আগে। ভান গখ, গঁগ্যা, গোইয়া, রেমব্রান্ট আমার ভালো লাগে। এঁরা অমিকেই নমস্য। তবে অধিকাংশেরই ভাগ্য ভালো, তাঁরা ইয়োরোপে জন্মেছেন। হাততালি ওখানে তাড়াতাড়ি বেজে ওঠে। জাহাজে নামগুলোও পৌঁছে যায় বিভিন্ন দেশে খুব সত্বর। তবে সে অর্থে বলা যেতে পারে, পিকাসো আমার ফেভারিট। ওঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। তবে কিছু মডেল যা তৈরি করেছেন, তার প্রায় সবই বোগাস। ভাস্কর বলতে মুর বা রঁদ্যা আছেন। রঁদ্যাই আমার প্রিয়। ওঁর কাজের সঙ্গে আমার মিল আছে প্রচ্ছন্ন। আমি কোনদিন কোন স্থির মডেল নিয়ে কাজ করিনি। রঁদ্যা-ও তাই। বলতেন– মুভু মুভমেন্ট না-হলে ক্যারেক্টার জীবন্ত হয় না। আমার চোখের সামনে ঘুরে বেড়ামে। মযতন, তাদের মুডমেন্ট, কথা বলা, হসি, ম বেড়ানো মানুষজন, তাদের মুভমেন্ট, কথা বলা, হাসি, প্রকৃতির সঙ্গে তাদের মিশে থাকা— আমার স্মৃতিতে, আমার চোখের সামনে ভেসে
আমি মূর্তি গড়তে
আমি যখন গান্ধিজির ব্রঞ্জ-এর মূর্তি গড়ি— তা ১৯৬৫-৬৬ সাল হবে বোধ হয়— ডাণ্ডি অভিযানের ঐ রূপ, নন্দলালবাবুর একটা স্কেচ তার ব্যাকগ্রাউন্ড। কলাভবনের বাগানে একটা খুব বড়-সড় কালো কংক্রিট-এর গান্ধিমূর্তি আছে। ডাঙি অভিযানের মুড, কিন্তু সময়টা ধরেছি দাঙ্গার সময়। দাঙ্গাবিধ্বস্ত অঞ্চলে পরিভ্রমণে চলেছেন গান্ধিজি। পায়ের নিচে কঙ্কাল-করোটি। কোমরে সেই বিখ্যাত থলি এবং ঘড়ি। পায়ের কাছে শান্তির বাণী খোদিত রয়েছে। ঠিক কমপ্লিট কাজ নয়। ঋত্বিক ঘটকের এটা অবশ্য খুব প্রিয় কাজ ছিল। ও বলত, ‘এই মূর্তিটার মধ্যে দিয়ে আপনি একেবারে রিয়াল গান্ধিজির অবদান মূর্ত করতে পেরেছেন।’ গান্ধিজির আর-একটা ছোট ব্রঞ্জ-এর মূর্তি আছে কলাভবনের দোতলায়।
ঋত্বিক ঘটক প্রায়ই আসত আমার কাছে। ওর দাদা মণীশ ঘটকও আসতেন। দিনের পর দিন থেকেছেন ওঁরা। ওঁদের সঙ্গে মিশতে ভালো লাগত। ঋত্বিকের মধ্যে একটা জেদ ছিল, অভিমান ছিল, অনেক অসন্তোষের বিক্ষোভ ছিল। অনেক কিছু জানত ও। ব্যাখ্যা করতে পারত সুন্দর। আমার ওপর ছবি তুলবে বলে একবার অনেক দলবল নিয়ে এল। শ্যুটিং করল। রাত্রি, জ্যোৎস্না আর আমার মূর্তিদের অনেক ছবি তুলল। ওর সঙ্গে আমার একটা আলোচনার দৃশ্য ছিল, তা-ও তুলল। ছবিটা কমপ্লিট হয়েছে। নিশ্চয়ই হয়েছে। কিন্তু ছবিটা আজ পর্যন্ত বেরুল না। কী জানি কেন? ওর স্ত্রী চেষ্টা করছেন, শুনলাম। ওর নাকি এ রকম অনেক ছবি আছে, রিলিজ হয়নি। সেগুলো রিলিজ হলে নিশ্চয়ই
৬৫
রামকিঙ্কর বেইজ
এটাও বেরুবে। ঋত্বিকের কোন ছবি আমি দেখিনি, এর জন্য ওর আফশোস ছিল। আসলে আমি তো একদমই ফিল্ম-গোয়ার নই। একটা ছবি দেখেছিলাম অনেক দিন আগে, গুড আর্থ। দারুণ ভালো লেগেছিল।
কলকাতা শহরে আমার গড়া কোন মূর্তি নেই। কোন দিন কেউ বলেওনি কিছু করতে। ওখানে যারা বসে আছে, তারা নিজেদের নিয়ে এত ব্যস্ত যে কখনও বলার সুযোগ পায়নি। ঐ শহরে বেশ কয়েক বার প্রদর্শনী হয়েছে। একক এবং যৌথ ভাবে। বিভিন্ন জয়েন্ট এক্সিবিশন-এ এখনও ছবি যায়। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে গেছি খুব কম। শেষ গিয়েছি তা-ও বছর তিন-চার হয়ে গেল। কলকাতা শহরে গত কয়েক বছরে তো বিভিন্ন ধরনের মূর্তি বসানো হয়েছে, প্রায় সব ক-টা মূর্তিই হাস্যকর। কোন ব্যালান্স-বোধ নেই। কোন ক্যারেক্টারই উঠে আসেনি। দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর সুরেন্দ্রনাথের মূর্তিটি এর ব্যতিক্রম। সবচেয়ে হাস্যকর শ্যামবাজার মোড়ে নেতাজির মূর্তিটা। একটা কুমীর যেন ঘোড়ার পেছনে কামড়ে ধরেছে। তেমনি হাস্যকর রবীন্দ্র সদন এবং অ্যাকাডেমিতে রবীন্দ্রনাথের মূর্তি। কোন প্রোপোরশন জ্ঞান নেই। তবু এই সব মূর্তি শহরে থাকবে। প্রচুর অর্থব্যয়ে তৈরি হয়েছে তো!
সরকারের উচিত শুধু সরকারি নেতাদের বা তাঁদের পছন্দমতো ছবি করানোর জন্য টাকা ব্যয় না-করে শিল্পীরা যাতে স্বাধীন ভাবে, নিজেদের আনন্দে কাজ চালিয়ে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করা। আর্থিক, মানসিক জিনিশপত্র দিয়ে সাহায্য করা, উৎসাহ দেওয়া।
ARBOL
চিরদিনই সবাই বলেন যে আর্ট-এর একটা সোশ্যাল পারপাস আছ। জীবনের সব ক্ষেত্রেই আর্ট রয়েছে। বাড়িঘর, জামাকাপড়, বাসনকোসন
— সবই তো আর্টিস্টিক। আবার চলনবলন, কথাবার্তা, ভদ্রতা সবই আর্ট। আমার কাছে কিন্তু আর্ট হচ্ছে অহেতুক, যার কোন হেতু নেই । শুধুই সৌন্দর্য, শুধুই আনন্দ। যাকে পয়সা দেওয়া যায় না। আর তাই হয়তো শিল্পীরা এত বোহেমিয়ান। অ্যাঁ! বলুন না মশাই, পয়সাও নেই, খাওয়াও নেই, তাই বোহেমিয়ান বৈকী! ভারি মজা কিন্তু
(আমার) যা ভালো লাগে, তা-ই করি। সব কিছুর অত ব্যাখ্যা চলে না। আর্ট জিনিশটা চিরদিনের ডিসস্যাটিসফ্যাকশন, অহৈতুকী । কোন কিছু প্রপাগেট করবার কাজ তার নয়। কত কিছু রয়েছে পৃথিবীতে— গাছ, মানুষ, পাহাড়, শহর। এক ভাবে না-এঁকে নানা ভাবে আঁকলে ক্ষতি কী?
রাশিয়ান আর্ট-এ স্টেট আর স্ট্যালিন ছাড়া কথা নেই। তাই অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টিস্টরা সব ছেড়ে চলে এসেছেন। কোন বাঁধাধরার মধ্যে থেকে আর্ট হয় না। কিন্তু তা বলে কি গান্ধিজির ছবি করব না? করব। যদি চাই। কিন্তু গান্ধিজি আঁকলেই ফার্স্ট প্রাইজ, অন্য কিছু করলে মার খেতে হবে, তা তো চলতে পারে না। শিল্পী সব সময় পথে রয়েছে। সে চলেছে। কোথাও আটকে নেই।
কোন দিন প্রত্যক্ষ রাজনীতি তো করিনি, তাই বুঝতে পারি না শিল্পীর কতটুকু রাজনীতি করা উচিত আর কতটা করা উচিত নয়। আমার অনেক শিল্পীবন্ধু ছিলেন, যাঁরা অনেকে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে শেষ পর্যন্ত সব ছেড়েছুড়ে দেন। অনেকে টিকে থাকেন। আবার অনেকে শুধু ফায়দা তুলে একটা পোজ নিয়ে বসে রইলেন। প্রত্যক্ষ রাজনীতির কথা বুঝি না, এত দ্রুত ভোল বদলায় !
কিন্তু শিল্পী হিশেবে এই সমাজের প্রতি সব সময়ে কিছু-না-কিছু দায়িত্ব বর্তে যায়ই। যিনি শিল্প করেন তিনিও তো একজন মানুষ- সামাজিক জীব। এবং তাঁর শিল্পের বিষয়বস্তু তো সেই মানুষই— তার সব জাগতিক এবং আত্মিক অনুভূতি। সুতরাং দাঙ্গা, দেশবিভাগ, মন্বন্তর,
৬৬
রামকিঙ্কর বেইজ
যুদ্ধ—যেখানে যত মানুষের প্রতি অপমান, শিল্পীকে আন্দোলিত করবেই। রবীন্দ্রনাথ বার বার আন্দোলিত হয়েছেন। যে-কোন মহান শিল্পীই হবেন। শিল্পীর উচিত তাই আলোর কথা, ক্লেদোত্তীর্ণ জগৎ ও জীবনের কথা ঘোষণা করা ।
আসলে, আমার মনে হয়, আর্ট মূলত যুক্তিহীন, কারণবিহীন। এবং শিল্পের ক্ষেত্রে চাহিদা ও যোগানের তত্ত্ব শিল্পীর সৃজনের বন্ধ্যাত্ব ও কল্পনার দারিদ্র্য থেকে জন্ম নেয়। নিজের মধ্যেই সে এক ধরনের চাহিদা বহন করে থাকে। আর তা হল পূর্ণ হয়ে ওঠার, কমপ্লিটনেস-এর চাহিদা।
আমাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব অভিজ্ঞতা, কৈশোরের কাহিনী, বই, শিক্ষক, আলাপচারিতা, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ এবং মানুষের চিরকালীন ঐতিহ্যের দুর্লভতম সংগ্রহশালা রয়েছে আমাদের মস্তিষ্কে। একজন শিল্পীর পক্ষে এ সব জরুরি। তা-ও শিল্পীকে ভুলতে হয় তাঁর শিল্পকর্মের সময়। একে উত্তীর্ণ করে আরও কোন বিশাল ঈপ্সিত সত্যের পথ নির্দেশ করতে হয় ।
আর্ট এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। বিশাল ঝুঁকি। জীবনের কুৎসিত নগ্নতা, সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে সৃজনশীল প্রাণবন্ততার চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ এবং তার প্রতিক্রিয়া এক জাতের খেলা। শিল্পের খেলা। হারজিতটা বড় কথা নয়। আজকের হার আগামী কালের জয় বলেও চিহ্নিত হতে পারে। অথবা বিপরীতও সত্য। খেলাটাই আসল। এই খেলা যে পূর্ণ আস্থা নিয়ে খেলতে পারবে, সে-ই শিল্পী ।
মানসিক ভাবে যে-শিল্পচিন্তা আমার ভেতরে রয়েছে, যে-কোন মাধ্যমেই হোক, খুব বেশি মাপজোক না-করে তা ফুটিয়ে তোলাটাই চিরকাল আমার নেশা হয়ে গেছে। এই তো মডার্ন, মডার্ন — সব আধুনিক
ARBOL.COM
যেখান থেকে শিল্প হচ্ছে সেখানের সব কিছু নিতে
যোগান দেওয়ার পুরো ব্যাপারটা আসে শিল্পীর মন থেকে।
রেখে দিতে হয়। আবার তার মধ্যে কিছু যোগানও দিতে হয়। এই
আমি আধুনিক কি না জানি না। আমি যা অনুভব করি, তা-ই প্রকাশ করি ।
যেখানে যত লাইন আছে সব আয়ত্ত করা উচিত। নেচার হচ্ছেন দেবশিল্পী, কত রকম সুন্দর-সুন্দর লাইন সৃষ্টি করে চলেছেন। সে সব শিখে নিয়ে মনে রেখে পরে প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতে হবে। লাইন সুন্দর হলে ছবি ভালো লাগবেই। মানে থাক আর না-থাক ।
ধরো, একটা বাচ্চা। ছোট ছেলেমানুষ একটি। কাপড় পরেনি। তাকে তুমি কোলে নিচ্ছ, আদর করছ। কিন্তু যদি ফিমেল ফিগার ন্যুড করা যায়, দর্শক সেটা খারাপ মনে করতে পারে। আমার কাছে সেটা খারাপ হচ্ছে না। আচ্ছা, দর্শকের কথা যদি বলো, তাহলে দর্শকই মিথ্যা । আমিই সত্য। কেননা আমিই দেখছি। দর্শক যদি ন্যুড পছন্দ না-করে তা হলে বেশ তো, সে কাপড়-পরাই করুক। দর্শক দর্শকই, এ দর্শক আলাদা দর্শক। দর্শক ভগবান। ভগবানের চোখ। আচ্ছা, ভগবান কি কাপড় দিয়ে তৈরি করেছে মানুষ? করেনি তো। তখন তো সে কুৎসিত বলছে না। তাই বলছি যে, একটা ছোট মেয়ে, কুৎসিত বলব? তা হলে মেরে দাও তাকে। তাকে কোলে নিচ্ছ, আদর করছ, সে ভগবানের তৈরি, যদি তা-ই ধরো ।
একবার, একটা গল্প বলি— কোণারকে গেছি। ওখানে ন্যুড-ফ্যুড সব আছে তো। একটা মেলা ছিল, অনেক লোক ওখানে এসেছে। মা, ছেলেপুলে, সব নিয়ে সেই সব মূর্তি দেখছে। কিন্তু আমাদের যদি আর্ট স্কুলের ছেলেরা যায়, তারা দেখে খিলখিল করে, হাসে। কিন্তু সেই
৬৮
আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র
লোকগুলি ঘুরে-ঘুরে দেখছে, বলছে, সব ভগবানের তৈরি। ভগবানের তৈরি সব। তখন তারা ন্যুডগুলো ন্যুড দেখছে না কিন্তু। সফিস্টিকেশন বলে একে। আমাদের আর্ট স্কুলের ছেলেরা দেখছে, খিলখিল করছে, হাসছে। সেই জন্য আমাদের প্রফেসর নন্দবাবু, উনি বলে দিয়েছিলেন, ছেলেমেয়ে আলাদা-আলাদা সব দেখতে। আজকে আলাদা করবে, কালকে আলাদা করতে পারবে কি? শিল্পী কোন দিন দর্শকের মুখ চেয়ে ছবি করে না। কেন করবে? সে তো ভগবানের পুত্র। কেন করবে? আমরা এমনি দর্শকের চোখের জন্য করি। আমরা যখন মানুষকে দেখছি, পুরোপুরিই দেখছি। এখন, আমরা কাপড়টা পরছি এমনি। কিন্তু আসল মানুষ যদি দেখি, তবে ‘চোখ যে ওদের ছুটে চলে গো।’
অ্যানাটমি শেখানো হয় স্কেলিটন থেকে। হাড় আগে শিখতে হয়। ফিগার শেখানো হয় মডেল বসিয়ে। মডেল তো থাকে, সব আর্ট স্কুলেই মডেল দেওয়া হয়। আমার পোর্ট্রেটগুলো সব সিটিং নিয়ে করা। তবে হ্যাঁ, ন্যুড স্টাডি যদি বলেন— আরে, ন্যুড তো দেখাই যাচ্ছে, সব সময়েই দেখা যায়। তাই নয় কি? এই প্রশ্নটা জেনেরালাইজ করা উচিত নয়। কেউ ন্যুড স্টাডি করে, কেউ করে না। সেটা নিজের ইচ্ছে- অনিচ্ছের প্রশ্ন। আমি ৩ে। করেছি। আরও কেউ-কেউ করেছেন। আর সাঁওতালদের বুকে একটু কাপড় থাকে, তাতে অসুবিধা হয় কি স্টাডি
করতে?
তা হলে একটা গল্প বলি— অবনী ঠাকুরের এক ছাত্র (নাম বলব না, এখন বিখ্যাত ভাস্কর) একটি মেয়ের ছবি করে ওঁকে দেখাতে এনেছেন, তাতে স্তনটি এঁকেছেন গোল। ঠিক গাড়ির চাকার মতো। উনি ছাত্রটিকে বললেন, ‘যাও, আগে গিয়ে দেখে এসো কী রকম দেখতে, তার পরে এঁকো।’ স্তন তো গোল নয়। হেভিনেস আছে বলে একটু টিল্ট থাকে সামনে। কিন্তু বুঝুন ব্যাপারটা! এতখানি ডেয়ারিং ভাবা যায় কি?
MARBOL.
যে-কোন বড় শিল্পকর্মের পেছনেই (থাকে) বড় আবেগ। অন্ধ আবেগ। আর প্রেম? সে তো থাকবেই। প্রেম ছাড়া ঐ সব ছবি বা মূর্তি করতে পারতাম? সে তো এসেছেই। বারে বারে। বহু বার। নিঃশব্দ চরণে নয়। ত্রিতালে, ঝাঁপতালে, লয়ের কারুকর্মের মতো। নইলে বিনোদিনী-র মতো পেইন্টিং বা সুজাতা, নারীর মুখ, কলের বাঁশির মতো মূর্তি গড়ব কী করে? আমার জীবনে যত ইম্পর্ট্যান্ট প্রেম এসেছে, সবই আমি রেখার আদলে ক্যানভাস-এ এঁকে রেখেছি বা তার মূর্তি গড়েছি। সুজাতা মূর্তিটা তৈরি করি জয়া আপ্পাস্বামী-কে দেখে। ওরই আদলে। এখানে পেইন্টিং নিয়ে পড়ত। আমারই ছাত্রী। ওর সঙ্গে আমার কোন প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ওর ফিগার ছিল খুব সুন্দর। লম্বা, ছিপছিপে। মূর্তি গড়া শেষ হলে নাম দিলাম জয়া। নন্দলালবাবু নাম বদলে রাখলেন, সুজাতা। মাথায় পরমান্ন নিয়ে সুজাতা চলেছে বুদ্ধদেবের কাছে। তখন ওখানে এত বাড়িঘর হয়নি। ইউক্যালিপ্টাসের অরণ্যে সুজাতাকে মানাত ভালো। এখন সেই নির্জনতা নেই।
শিল্পী কেন শুধু, যে-কোন মানুষের ক্ষেত্রেই ভালোবাসার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। আবার কেউ-কেউ ভালোবাসার বিরুদ্ধে নিজেকে নিয়ে যায়। ভালোবাসাই জীবন, ভালোবাসা মহান, আবার ভালোবাসা ভয়াবহ, ধ্বংসাত্মকও।
দৈহিক ভালোবাসাকে কেউ-কেউ ভালোবাসার অপরিহার্য অঙ্গ হিশেবে দেখে থাকেন। আমি ভালোবাসার এ রকম দৈহিক সংজ্ঞায় বিশ্বাসী নই। যত ক্ষণ না তার মধ্যে প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায়, তত ক্ষণ ভালোবাসার কোন অস্তিত্বই কেউ উপলব্ধি করতে পারে না । একজন শিল্পীর
মৃত্যু পর্যন্তই ভালোবাসার তৃষ্ণা থেকে যায়।
সব কিছুর মধ্যেই সেক্স আছে, সেক্স ছাড়া সব কিছুই অসাড়, প্রাণহীন। প্রাচীন এবং মধ্যযুগের মহান শিল্পীরা মনে রাখার মতো সব
রামকিঙ্কর বেইজ
বিখ্যাত কাজ করে গেছেন। যেহেতু তাঁরা কোন রকম যৌন বিধিনিষেধ বা সেক্সুয়াল ইনহিবিশন ও মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের দ্বারা আবদ্ধ ছিলেন না। আমি শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি ৷
প্রেম এসেছে জীবনে। সেক্সুয়াল রিলেশনও হয়েছে। তা কখনওই বলার নয়। কিন্তু একটা জিনিশ, কখনও লেপটে থাকিনি। যদি কেউ সত্যি-সত্যি কিছু ক্রিয়েট করতে চায়, তা হলে লেপটে থাকলে চলবে না। সব সময়ে যদি লেপটেই থাকব, তা হলে ছবি আঁকব বা মূর্তি গড়ব কখন। প্রেম, নারী— এসেছে স্বাভাবিক নিয়মে। এ নিয়ে ভাবিনি বিশেষ। স্বাভাবিক নিয়মেই তা চলে গেছে আবার। যখনই বুঝেছি ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, তখনই ইতি টেনে দিয়েছি তাতে। আমার প্রাক্তন প্রেমিকারা কেউই তেমন কিছু হতে পারেনি জীবনে। মেয়েরা যেমন হয় আর কী! সব কমন লেডি হয়ে গেছে। শিল্পীসত্তা বিঘ্নিত হতে পারে— এই আশঙ্কা থেকেই হয়তো বিয়ে করা হয়নি। ঠিক তা-ই বা বলি কী করে। বিয়ে করতে গেলে তো অর্থ চাই। প্রচুর অর্থ। ওটাই তো আমার ছিল না। দীর্ঘকাল শান্তিনিকেতনে চাকরি করেছি অবৈতনিক। পরে নন্দলালবাবু পেতেন পঞ্চাশ টাকা। আমি আর বিনোদবাবু পেতাম সাড়ে-বারো টাকা করে। ঐ টাকায় তো আর বিয়ে করা যায় না! আর তখন তো ছবি আঁকছি, মূর্তি গড়ছি চুটিয়ে। এ ভাবেই চলেছে বহু বছর। সবাই যে-বয়সে বিয়ে করে, সে বয়সে তো অর্থের মুখ দেখিনি। অন্য চাকরিরও চেষ্টা করিনি। শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাবার কথা ভাবিনি কখনও। হয়তো ঠিক এটাও কারণ নয়। বিয়ে করার কথা যতবারই ভেবেছি, মনে হয়েছে বাধ্যবাধক সংসার করলে ছবি আঁকার ক্ষতি হবে। ছবি আঁকতে
পারবিনা, মূর্তি গড়তে পারব না— এই ভয় থেকেই বিয়ে করার কথা ভাবিনি। ভীতু ভাবছ? স্বার্থপর ভাবতে পারো। নিজের শিল্পসত্তাকে ভালোবেসে ফেললে একটু ভীতু, একটু স্বার্থপর হতেই হয়।
বিবাহ নামক এক ধরনের সামাজিক প্রথার মাধ্যমে একটি নে বিং একটি পুরুষ যদি একসঙ্গে বসবাস করতে পারে তো ভালোই।
উৎপন্ন করা। বিয়ে না-করেও শিশু উৎপন্ন করা যেতে পারে, কিন্তু বিয়ে করার কোন একজন এই শিশুর দায়িত্ব নিয়ে থাকে। আমিও শিশু ভালোবাসি। কিন্তু আমি অনেক ি
নেক শিশু আছে। আমি মনে করি, এরা সবাই আমার ।
যদি না-পারে, তবে প্রয়োজন নেই। এই প্রথার ভিত্তি হল শিশু ি
পর যে-শিশুর জন্ম হয় তা একটু অন্য রকমের। কারণ কখনওই একটি মাত্র শিশু চাই না। আমার চারপাশেই
একজন পাগল লোক সব সময়ে বিভ্রান্তির তাড়নায় পথ হাঁটে। সে তাঁর নিজের পথ চিনে নিতে পারে না। সামঞ্জস্যহীন নানান উদ্ভট ভাবনা- চিন্তা তার মাথার মধ্যে ভিড় করে আসে। আর সে গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে যায়। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই একজন শিল্পীরও মাথার মধ্যে নানান উদ্ভট চিন্তাভাবনা খেলা করে। কিন্তু সে প্রতিনিয়ত একটা মাধ্যমের অনুসন্ধান করে চলে, সে কম্যুনিকেট করে— লোকে বুঝতে পারে তাঁকে। কিন্তু একজন পাগল লোক এখানেই ব্যর্থ হয়, সে কোন যোগস্থাপনই করতে পারে না। এই-ই পার্থক্য দু-জনের। একজন শিল্পী নিজেকে পাগল হিশেবে প্রতিপন্ন করে, পাগলের ভূমিকায় নিয়ে যায় নিজেকে। দয়া করে জেনে রাখুন, এটা একটা স্টান্ট। স্টান্টই। একজন পাগল লোক এটা করতে পারে না। কারণ সে সত্যি-সত্যিই পাগল, আর এটাই তার সমস্যা।
এখন কোন কাজ নেই। বৃদ্ধ হয়ে গেছি। ছাত্রছাত্রীরা প্রায়ই আসে। বন্ধুবান্ধব শান্তিনিকেতনে এলে দেখা করে। এ অঞ্চলের প্রায় সব মানুষ আমাকে চেনেন, ভালোবাসেন। আড্ডা জমাতে আসেন। এই ঘরে বসে আজকাল টের পাই, বিভিন্ন বয়সের বেশ কিছু গুণগ্রাহী আছে আমার সারা দেশ জুড়ে। প্রায় প্রতি দিনই কেউ না-কেউ অনেক দূর অঞ্চল থেকে দেখা করতে আসে।
१०
রামকিঙ্কর বেইজ
তবে এখন তো আঁকতে পারি না। পায়ে বাত, কোমরে যন্ত্রণা, হাত কাঁপে, বুকে অসম্ভব শ্লেষ্মা, চোখে দেখতে পাই না কিছুই। পড়তে পারি না। কেউ পড়ে দিলে শুনি। কেউ ধরলে হাঁটতে পারি। একেবারে পঙ্গু হয়ে গেছি। অনেক কিছু মাথার ভেতর ক্রশ-পাজল খেলে। ছাত্রছাত্রীরা মাঝে-মাঝে আসে, তাদের বলি। কিন্তু নিজে এঁকে উঠতে পারি না। হাত অসম্ভব কাঁপে। সমর্থ বয়সের অত্যাচার তার শোধ তুলে নিচ্ছে। প্রকৃতির নিয়ম। মাঝে-মাঝে অসহ্য মনে হয়। পাগল-পাগল লাগে। কিন্তু কিছুই করার নেই। একেবারে বাতিল হয়ে গেছি। রিটায়ার্ড হয়েছি, বয়স যখন ছেষট্টি। এখন ঊনসত্তর।
মদ আমি আগে কখনও খেতাম না। যখন ঐ সব মূর্তি গড়ছি, ঘুম আসত না রাতে, ক্লান্ত লাগত । পরিশ্রমও করতাম তখন খুব। কাজ করতাম সাধারণত দুপুরের রোদে। এই রোদের সঙ্গে আমার কাজের একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক ছিল। ফলে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়তাম। এই পরিশ্রম থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য একটু-আধটু খেতাম। এ ভাবেই নেশা হয়ে গেল। কাজের সময়ে অবশ্য কখনওই চূড়ান্ত নেশাগ্রস্ত হতাম না। মদ খেতে-খেতেই কাজ করেছি। চূড়ান্ত নেশা করে অজ্ঞান হয়তো কখনও-সখনও হয়েছি, কিন্তু সেটাই রুটিন ছিল না। হলে কাজ করতাম কী করে? তবে কখনও রাস্তাঘাটে মাতলামো করিনি। খুব মদ খেয়ে ক্লাস করতে যাইনি। মদ্যপ অবস্থায় কারওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি । ফলে আমার মদ্যপান নিয়ে কখনওই শান্তিনিকেতনে ঝড় ওঠেনি। সে সময়ে মদ খেলে কনসেনট্রেশন আসত, ক্লান্তির অপনোদন হত, কাজ করার প্রেরণা পেতাম। মদ তাই সঙ্গী। এখনও ছাড়তে পারিনি। ছাড়ার প্রশ্ন ওঠে না।
>
আমি তো এই শান্তিনিকেতন ছেড়ে বিশেষ কোথাও যাইনি । বোম্বে মাঝে-মাঝে গেছি। দিল্লিতে বেশ কিছুদিন ছিলাম। ঐ যক্ষ-যক্ষী মূর্তিটা গড়ার জন্য। দিল্লির রিজার্ভ ব্যাঙ্ক-এ আছে। সবাই খুব ভালো বলে শুনেছি। ওটা বেশ কষ্ট করে মন দিয়ে করেছিলাম। যদি সে অর্থে বিদেশ বলা যায়, তবে একবার গেছি নেপালে। তা-ও কাজ করতে। আর কোথাও যাইনি।
বহু বার বিদেশ যাবার আমন্ত্রণ পেয়েছি। যাইনি। কী হবে গিয়ে? দেশ ছেড়ে লাভ কী? আমার ছবি আঁকা, মূর্তি গড়ার যা প্রেক্ষাপট, যারা অনুষঙ্গ— তারা তো সব এখানেই আছে। বিদেশে গিয়ে শিখবই বা কী? ওদের সব কিছু খবর তো এখানে বসেই পাওয়া যায়। আর ছবি আঁকা বা মূর্তি গড়া? সে তো নিজের এলেমের প্রশ্ন। তার জন্য অত দরজায়-দরজায় ভিক্ষে করা কেন? অনেকেই যান অবশ্য। বিশেষ-বিশেষ উদ্দেশ্য হাশিল করে সেই তো ফিরে আসতে হয় এ দেশে। অবন ঠাকুর বিদেশে যাননি, যামিনী রায় যাননি। শুনেছি, বড়ে গোলাম আলিরও সেই এক ব্যাপার।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি বিশ্বাস করি শহরের পাশাপাশি গ্রামও থাকবে। লোকে বলে শহরের জীবনে গতি বেশি, কিন্তু আমি আমার গ্রামের কুটিরের বারান্দায় বসে-বসে কখনও-কখনও অনুভব করি সূর্যের আলো পরিবর্তনের সাথে-সাথে প্রতিটি দিন চমৎকার ভাবে তার গতি প্রকাশ করে চলেছে। পাখি, মৌমাছি, প্রজাপতি— এরা কেউই বসে নেই, সবাই কাজ করে চলেছে, খাবার সংগ্রহে ব্যস্ত এবং দিন বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে প্রত্যেক মিনিটেই আলোর পরিবর্তন হচ্ছে। শহরে আকাশ দেখা যায় না। অন্ধকারের রঙও দেখতে পাওয়া যায় না ।
१2
পশ্চিমে জন্মগ্রহণ করলে আমি খুশি হতাম কি হতাম না- এ নিয়ে আমি একদমই চিন্তা করি না। আমি এখানেই জন্মগ্রহণ করেছি,
রামকিঙ্কর বেইজ
এটাই ঘটনা এবং এটাকেই আমি গ্রহণ করেছি। বিদেশে যাওয়া এবং পশ্চিমের শিল্পীদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের চেষ্টা না-করার ব্যাপারে আমার একটা ভুল ধারণা আছে। একজন শিল্পীর অ্যাডভেঞ্চার না-থাকা ভালো নয় ৷
দেখো, খ্যাতি যশ বা অর্থ— কোনটা নিয়ে তো কোন দিন ভাবিনি। ও সব নিয়ে বেশি ভাবলে কাজ করা যায় না। অর্থ তো পরবর্তী সময়ে এসেছে, আবার চলেও গেছে। ধরে রাখতে পারিনি। ধরে রেখে লাভই বা কী হত? কলকাতা শহরে অনেক উঁচুতে একটা ফ্ল্যাট? তাতে আমার মুক্তি কোথায়? এখনও তো সচ্ছলতার মুখ দেখা যায়। বেশি আকাঙ্ক্ষা নেই। শান্তিনিকেতনের আগানে-বাগানে যে-সব মূর্তি গড়েছি, তার ব্যয়ভার বহন করেছে কর্তৃপক্ষ। নিজে পয়সা নিইনি। বিক্রি করিনি। আমি মনে করি, আর্ট বিক্রয়যোগ্য পণ্য নয়। কোন সমসাময়িক বা অপেক্ষাকৃত তরুণ শিল্পী আমার তুলনায় বেশি পাবলিসিটি পেয়ে যাচ্ছে বা পপুলার হয়ে যাচ্ছে দেখে চিন্তিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ছবি সংরক্ষণ সম্বন্ধেও কখনও বিশেষ ভাবিনি। ভাবার সময়ই পাইনি। তুমি বলেছিলে না, ব্ল্যাক হাউস থেকে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট হস্টেলটা তুলে দিয়ে সংগ্রহশালা করতে? কী লাভ তাতে? একটা মরা মিউজিয়মের পরিবর্তে ওখানে জীবনের প্রবাহ বয়ে চলেছে। ভালোই তো। আফটার অল লাইফ ইজ ইমপর্ট্যান্ট।
আমার মনে হয়, ছবি আঁকা বা মূর্তি গড়ার পর আমার দায়িত্ব শেষ। অহে কোন পাবলিসিটির চিন্তা না-করলেও চলবে। আর তা ছাড়া, শিল্প তো এক অর্থে রহস্যময় মায়া। এই-ই জীবনকে মূল্যবান করে তোলে। শিল্পের জগতে সত্যি-সত্যি ভালো কাজ করতে পারলে তা মানুষ ঠিকই মনে রাখবে।
AMARBOL.C
গান আমার খুব প্রিয়। শুনতে বড় ভালো লাগে। মিউজিক-এর
পেন্টিং-এর কোথায় যেন ভীষণ একটা যোগ আছে। গান, বিশেষ করে ক্ল্যাসিকাল, শুনতে-শুনতে আমার মাথার ভেতরে অদ্ভুত এক ধরনের ছবি ফুটে ওঠে। আবেগ কাজ করে। ফৈয়াজ খাঁ, আমির খাঁ ইত্যাদিরা ব্রেন-এ ইমারত গড়তে জানেন। সামনাসামনি বসে গান শুনেছি অনেকের। আর এই শান্তিনিকেতনে মিউজিক নিয়ে তো সর্বদাই পড়াশোনা চলছে, চর্চা চলছে। যশস্বী সঙ্গীতকারেরাও আছেন। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা তো ছেড়েই দিচ্ছি। আহা, কী গান তাঁর! গান আমি খুব একটা খারাপ গাইতাম না। সবাই বলত, দরাজ গলা। শুনবে? এক লাইন, কি দু-লাইনের বেশি গাইতে পারব না। সীমার মাঝে অসীম তুমি, বাজাও আপন সুর…। কেমন গাইলাম ?
অভিনয়ও করতাম আমি। একেবারে প্রথম জীবনে তো থিয়েটার-এর ড্রপসিন ইত্যাদি আঁকতাম। শান্তিনিকেতনে বহু বার অভিনয় করেছি। নাটক আমার প্যাসটাইম ছিল। রক্তকরবী নাটকে বিশু পাগলের রোলটা এখানে এক সময়ে আমিই করতাম। গান গাইতে পারতাম বলে ঐ রোল-টা আমিই পেতাম !
একই সঙ্গে পেন্টার এবং স্কাল্পটারও খুব কমই হয়েছে এই দেশে। রবীন্দ্রনাথ, বা অবন ঠাকুর, বা নন্দলাল— এঁরা মূলতই চিত্রশিল্পী। চিন্তামণি কর আগে ছবিই আঁকতেন, পরে পুরোপুরি ভাস্কর্যে চলে যান। দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী যেমন ছবি আঁকতেন, তেমনি মূর্তি গড়তেন। যখন ছবি আঁকি, তখন ছবিই আঁকি। যখন মূর্তি গড়ি, তখন মূর্তিই গড়ি। কখনও বিরোধ বাধেনি দুইয়ে। দীর্ঘকাল তো দুটোই চালিয়ে গেলাম ।
৭৪
|
আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র
আমি যখন শান্তিনিকেতনে কিছু ভাস্কর্য নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম, তখন আমার মা মারা যান। যখন তাঁর অবস্থা খুবই খারাপ, তখনও আমি তাঁকে দেখতে যেতে পারিনি। না-না, সেই মৃত্যুর ছায়া আমার শিল্পকে স্পর্শ করেনি। সবাই মারা গেছে, আমার দাদা-বোন-বাবা-মা, সবাই, সবাই । কারও মৃত্যুই আমার শিল্পকে কোন ভাবে স্পর্শ করেনি। সব সময়েই আমি আমার নিজের কাজেই খুব বেশি ভাবে ডুবে ছিলাম । মৃত্যু সম্পর্কে আমি সব সময়ে উদাসীন। খুব সত্যি কথা, মৃত্যু সম্পর্কে আমি কোন চিন্তাই করিনি। একজন শিল্পী যত ক্ষণ সৃষ্টির নেশায় মাতাল হয়ে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যু কোন ভাবেই তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।
আমরা যা দেখলাম প্রকৃতির মধ্যে সুখে দুঃখে সৌন্দর্যে অনুভূতিতে, তা-ই একটা অন্য মাধ্যমে প্রকাশ করার ব্যর্থ চেষ্টা এবং ব্যাকুল ক্রন্দন। কিছু করতেই হবে, উপায় নেই। যেমন একটা শিশু কাঁদতে-কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে, তার পর স্বপ্ন দেখে। আমাদের কাজ হল, সেই স্বপ্নের অভিব্যক্তি। সেখানে তখন সেই ব্যাকুল ক্রন্দনের চোখের জল আর থাকে না। শিল্পী-শিশু কাঁদতে-কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে, স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের ভিতর সুন্দরের আবির্ভাব হয়। আনন্দাশ্রু বইতে থাকে। তুলি, কলম, লেখার সব কাজ শুরু হয়ে যায়। নৃত্য শুরু হয়। শিল্পে, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, দর্শনে, সঙ্গীতে, নৃত্যে কাজ শুরু হয়ে যায়। সেটাই শিল্পের পরিপূর্ণ অভিব্যক্তি।
শিল্প নিয়ে কথা বলতে কোন দিনই আমার খুব ইচ্ছা করত না। আজকাল একেবারেই করে না। যতটুকু পারি কাজ করেছি, কাজই করতে চাই ।
পথ ভালোবাসার তত্ত্ব : ইতি রামকিঙ্কর
মূর্তি আমার মনের মতো হবে আর প্রাণের কাছে বসে থাকবে, ছবিও তাই হবে। আমি দুয়ের কাছাকাছি বসে ওদের গান শুনব আর নিজে কী গেয়েছি তা-ও শুনব। অন্য কোন দ্রষ্টা থাক বা না-থাক, মানুষ যখন নেচার-এর মধ্যে ঘুরে বেড়ায় তখন কি তার বৈচিত্র্যের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় না, বিস্ময় প্রকাশ করে না? তেমনি ভাবে আমার সৃষ্টি দেখেও প্রকৃতির দর্শক তেমনি আচরণ করুক— এই শিক্ষা আমার গুরুদেবের কাছে পাওয়া।— ইতি রামকিঙ্কর, শান্তিনিকেতন, ১৮ এপ্রিল ১৯৬০
কতকগুলি ফটোগ্রাফ পাঠালাম। আপনার লেখা পড়লাম। আরে! আপনি কে মশাই;আমার মধ্যে ঢুকলেন কী করে। আপনি কি রাস্তার লোক, গরিবের ছেলে, বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো! এমনটা হল কী করে। সব পরিচয় জানাবেন। ভালোবাসার চেষ্টা করব ।
রেখা মেনন বললেন, আপনার কাছে অবনীন্দ্রনাথের যে-মূর্তিটি আমি গড়েছি, তা আছে। দয়া করে মূল্য বাবদ যা হয় পাঠাবেন। অসুবিধায় আছি। নমস্কার জানবেন।— ইতি রামকিঙ্কর
ছাপার অক্ষরে আমার সম্বন্ধে আপনার লেখা পড়লাম। ভাস্কর্য সম্বন্ধে আপনার বিধান ঠিক আছে। কিন্তু ছবি সম্বন্ধে অন্যরকম হল যেন! আমার দুয়েরই সৃষ্টিপ্রণালী এক। আপনার অন্যরকম মনে হয়েছে, হতে পারে। আমরা যা ভাবি সবাই তা ভাববে বা যা করি তা কোন ফর্মুলায় নেবে না, তাই বা কী করে হয়। আমি ফর্মুলায় বিশ্বাস নিজে করি না। প্রকৃতির বৈচিত্র্যের অকৃত্রিমতার উপর নির্ভর করি বেশি। যাঁরা ফুলের বাগান সাজান তাঁরা যে-ভাষায় কথা বলেন, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত কোন দিন হতে পারলাম না। তাই আমার হাতের কাজ যখন বাড়িতে
সাজানো হয়, কেমন যেন বাধা পড়ে যায়।
শান্তিনিকেতনের পথ-ঘাট-মাঠকে আমি ভালোবাসি, এই কারণে যে তা আমাকে কোন সৃষ্টির পথে বাধা দেয় না। যত বড় করে দেখতে চাই তা আমাকে দেখতে দেয়, যদি ঝোপে লুকিয়ে রাখতে চাই তাতেও তার বাধা নেই। ভাগ্যিস, গুরুদেব আমার মতো অভাজনকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তিনি তো আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন!
পরে যদি লেখেন আমার এই কথাগুলি মনে রাখবেন। চিঠি দেবেন, এখানে এলে দেখা করবেন।- ইতি রামকিঙ্কর, শান্তিনিকেতন, ৭ জুলাই ১৯৬৭
৭৬
রামকিঙ্কর বেইজ
আপনার চিঠির জন্য আকৃষ্ট হলাম। কিউরেটর হিসাবে আমার শিল্পকার্য কেনার প্রস্তাবে, আমার চিন্তাধারা সম্বন্ধে এ ধরনের আগ্রহ কোন মিউজিয়ম কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেছেন বলে মনে পড়ে না। তারপর জানলাম আপনি শিল্পী। এ দেশের শিল্পীদের তো কেবল ঈর্ষাপরায়ণতার পরিচয় পেলাম। যারা আমার শিক্ষানবিশ তাদেরও এ কারণে জোরগলায় কিছু বলতে পারিনে। আপনার আগ্রহে আপনার স্নেহ-ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে—- তাই একটু অকুণ্ঠচিত্তে কিছু বলতে সাহস করছি। আসলে সারাটা জীবন বনেবাদাড়ে ঘুরে আমি জংলি হয়ে গেছি ধরে নিতে পারেন। তাই বোধ হয়, তথাকথিত মনুষ্যত্ব আমার মধ্যে নেই। যা এঁকেছি, যা গড়েছি, ঐ তথাকথিত অসভ্যদের নিয়ে। যারা নিজেদের মধ্যে নিজেরা থাকে, নিজেদের হাবভাব-সংস্কার নিয়ে নিজেদের মধ্যে সন্তুষ্ট, ধার-করা চিন্তার কথা তারা ভাবে না। মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে স্বভাবের সঙ্গে লড়াই করেও একটু হাড়িয়া গিলে হাসে। মাটির ভাঙা ঘর তাদের সম্বল, মাটির পথ তাদের নির্দেশ— এই পথকে
তারা ভোলে না ।
পথ-ভালোবাসার তত্ত্ব আমার ওদের কাছে পাওয়া। আমি আগেও যেমন চলেছি, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সেই সহজ পথে থাকতে চাই । একটা কথা পথ চলতে-চলতে বুঝেছি, পথে বড় কাঁকড়। ঝোপঝাপড়া, কাঁটা আর নানা অজানা ভয়। একবার নির্ভয় হতে পারলে এমন চলার আনন্দ আর কিছুতে নেই, সম্পূর্ণ এক অন্য পৃথিবীকে যেন কত কাছে পাওয়া যায়। স্বাধীন মন থাকলে তা থেকে বিচিত্র-সহজ রূপ, রস
আস্বাদন করা যায় ।
আমার শিল্পপ্রকৃতিতে ঐ স্বাধীন মূর্তিটা প্রবল বেশি। যাঁরা তা থেকে আমাকে বুঝতে পারবেন, তাঁরা হয়তো আমাকে কিছুটা বুঝবেন । কিন্তু তেমন লোক কৃত্রিম সমাজে কই !
আজ এই পর্যন্ত। নমস্কার জানবেন।— ইতি রামকিঙ্কর, শান্তিনিকেতন, ৭ জানুয়ারি ১৯৭০
আমার আচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তি গড়বার আগে অনেক চিন্তা মাথায় এসেছে। প্রথম চিন্তা, এত বড় একজন শিল্পী যদি তাঁর প্রতিমূর্তি দেখে অস্বীকার করেন। দ্বিতীয়ত, সারা জীবন মাঠেঘাটে শিক্ষা আমায় যা দিয়েছে তার (সঙ্গে) এই ভাস্কর্যের যদি পারম্পর্য খুঁজে না-পাই, তা হলে আমার উপায় কী? তাই তাঁকে গড়বার পরিকল্পনা করে নিলাম যে গড়ে ভাঙব। ভেঙে ভেঙে গড়ব না। ঐ ভাঙার মুহূর্তে যে-কোন সময়ে কোন একটি দিক গুরুদেবের পছন্দ হয়ে গেল কি আমার আর কিছু চাই না। এই ভাবে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের মূর্তি আমি গড়েছিলাম- কালনাগিনীর মতো যার মধ্যে অসম্ভব উর্বরা শক্তি বিস্তারিত।- ইতি রামকিঙ্কর, শান্তিনিকেতন, ২ মার্চ ১৯৭৪
ফল চাই না হে, কো ন ফ ল ই চাই না
প্রশ্ন : আপনার প্রিয় ব্যক্তি কে বা কারা?
৭৯
রামকিঙ্কর : রবীন্দ্রনাথ। দাঁড়াও, দাঁড়াও– আর গান্ধি, সুভাষ। । প্র : প্রিয় পৌরাণিক চরিত্র?
রা : কৃষ্ণ ছাড়া আর কে ?
প্র : সাহিত্যের কোন্ শাখা সবচেয়ে প্রিয় আপনার ?
রা : নাটক হে, নাটক ।
প্র : কোন্ গান সবচেয়ে ভালোবাসেন আপনি ?
রা : আমার কাছে গান মানেই বাবা, রবীন্দ্রনাথের গান ।
প্র : আপনার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা?
রা : শান্তিনিকেতন। ‘আমরা যেথায় মরি ঘুরে/ সে যে যায় না কভু দূরে/ মোদের মনের মাঝে প্রেমের…’
প্র : আপনার সবচেয়ে প্রিয় ফুল ?
রা : পলাশ।
প্র : আর প্রিয় ফল ?
রা: ফল চাই না হে, কোন ফলই চাই না আমি ।
প্র : সবচেয়ে প্রিয় বস্তু, কিংবা বলি, যা সবচেয়ে দামী আপনার কাছে ?
রা : মাটি। জীবন তো কাটল ঐ নিয়েই। আর কটা দিন পর তো…
প্র : আপনার প্রিয় পোশাক?
রা : সে তো তুমি জানোই— গেরুয়া লুঙি আর শাদা ফতুয়া।
প্র : এবার শেষ প্রশ্ন। আপনার প্রিয় নেশা ?
রা : কাজ। আঁকাই হোক আর গড়াই হোক— ঐ, কাজ। এমন নেশা আর কই? এ নেশায় বাবা, সব ভুলে যাই ৷ স-ব
সংকলন সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক
রামকিঙ্করের নিজের পাঁচটি রচনা, একটি বক্তৃতা, কয়েকটি চিঠি, চারটি সাক্ষাৎকার এবং প্রশ্নোত্তরের বয়ান ভেঙে আরও চারটি সাক্ষাৎকার থেকে বিষয়ানুযায়ী সাজিয়ে তৈরি করা একটি রচনা নিয়ে সংকলিত এই বইটির সম্পূর্ণ নতুন এক সংস্করণ এ বার প্রকাশিত হচ্ছে মনফকিরা থেকে।
সংকলকের দিক থেকে বলতেই হয় যে এ বইয়ের প্রকাশ-ইতিহাস বেশ উল্লেখযোগ্য। এর প্রাথমিক খশড়া হিশেবে প্রথম যে-বইটি ১৯৯৮-এর জানুয়ারিতে বেরোয়, তার নাম ছিল আত্মপ্রতিকৃতি। সে বইয়ের প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হওয়ার পর ঢের বড় আকারে, পরিমার্জিত চেহারায় ও কিছু নতুন লেখা সংযোজিত হয়ে এ বইয়ের অনেক পূর্ণাঙ্গ একটি সংস্করণ মহাশয়, আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র নামে ২০০২-এর নভেম্বরে প্রকাশিত হয় আর-একটি প্রকাশসংস্থা থেকে। রীতিমাফিক প্রথম প্রকাশককে তা জানানো হয় ও ঐ খাড়া-বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশে তাকে বিরত থাকতে বলা হয়। কিন্তু তার পরও প্রথম বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোয় এবং সেখান থেকে বর্তমান সংকলকের নামটি বাদ যায় । এখন, দ্বিতীয় প্রকাশকের দ্বিতীয় মুদ্রণ নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ার পর এ বই আবারও ভিন্ন চেহারায়, অনেক পরিবর্ধিত আকারে এবং ঈষৎ পরিবর্তিত নামে ফের এক নতুন প্ৰকাশসংস্থা থেকে বেরোতে চলেছে। এ ভাবে বারংবার প্রকাশক বদলের কারণ একটাই— সংকলকের সঙ্গে প্রকাশকদের সম্পর্কচ্যুতি, সে সবের কারণ আলোচনার জায়গা এটা নয়, কিন্তু তার ফলে দাঁড়াল এই যে- এর পর একই বইয়ের নানা রকম সংস্করণ হয়তো একই সঙ্গে বাজারে পাওয়া যাবে এবং তাতে পাঠকের বিভ্রান্তি বাড়বে। এর জন্য সংকলকের নির্বুদ্ধিতাই দায়ী নিশ্চয়ই। কোন রকম আর্থিক লাভালাভের আশায় সংকলক এ কাজ করেননি, এবং বাস্তবে তেমন কোন লাভ হয়ওনি। বরং একই বইয়ের নানা রকম চেহারা বাজারে চালু থাকলেও কোন-না-কোন ভাবে এই সব অমূল্য লেখা যে শেষ পর্যন্ত পাঠকের হাতেই পৌঁছচ্ছে, তা খুবই আনন্দের।
এ বার আদত এই বইয়ের কথা। এখানে প্রকাশিত প্রথম লেখাটি আসলে ১৯৭৬-এ ললিতকলা আকাদমি-র সংবর্ধনার উত্তরে দেওয়া ভাষণ । সৌম্যেন অধিকারীর কাছ থেকে এর একটি অনুলিপি রামকিঙ্করের নিজের হস্তাক্ষরেই পাওয়া যায় এবং নানান সময়ে নানা পত্রিকায় তাঁর সৌজন্য স্বীকার করে ছাপা হয়। সৌমেনবাবু মনে হয় প্রত্যেককেই আলাদা করে লেখাটির একটি অনুলিপি উপহার দিয়েছিলেন, পুনর্মুদ্রণ সে অর্থে কেউই করেনি। শিল্প বিষয়ক পত্রিকা পট-এ ১৯৮৩-র অগস্ট-এ তা ছাপার সময়ে একটি পঙক্তি বাদ দেওয়া হয়েছিল, এখানে সেই পাঠই রাখা হল। শিরোনামটি অবশ্য এ বার পালটে দেওয়া হয়েছে। পরের লেখাটি প্রকাশিত হয় শাব্দ নামে ক্ষণজীবী কিন্তু উচ্চাঙ্গের এক পত্রিকায়, প্রতীক নামে ঐ কাগজের প্রতীক সংখ্যায় । সেখান থেকে পুনর্মুদ্রিত হয় পট-এ, ‘৮৮-র ফেব্রুয়ারিতে। নতুন করে ছাপার সময়ে শিরোনাম পালটে রাখা হয়— মহাশয়, আমি চাক্ষিক, রূপকারমাত্র।
এর পরে প্রথম সাক্ষাৎকারটি ললিতকলা আকাদমি-র হিন্দি জার্নাল সমকালীন কলা (১৯৮৫) থেকে অনুদিত। প্রথম ছাপা হয় চাক্ষুষ নামে বিচিত্র বিদ্যার পরিচয়জ্ঞাপক এক পত্রিকার শেষ সংখ্যায় (নভেম্বর, ১৯৯৩)। মূল সাক্ষাৎকারটি ১৯৭৭-এর অক্টোবর- এ নিয়েছিলেন জওয়াহর গোয়ল, ভাষান্তর করেছেন অলকানন্দা সেনগুপ্ত। তার পরের সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছিল বিশ্বভারতী কোয়ার্টার্লি-র নন্দলাল সংখ্যায় (জানুয়ারি, ১৯৭১)। মূল
৮১
রামকিঙ্কর বেইজ
ইংরাজি থেকে এখানে এই বইয়ের জন্য তার ভাষান্তর করেছেন সন্দীপন ভট্টাচার্য। তার পরেরটি প্রকাশিত হয় গাঙ্গেয়পত্র-এ (জানুয়ারি ১৯৭৯)। এখানে অবশ্য তার সম্পাদিত সামান্য অংশই মুদ্রিত হয়েছে। শেষ এই দুটি সাক্ষাৎকারই এ বইয়ে নতুনতর সংযোজন।
তার পরের লেখাটি অখিলেশ্বর ভট্টাচার্যের অনুবাদ, শনিবারের চিঠি থেকে কিছু কাল আগে তা উদ্ধার করে ছাপে এ কালের একটি কাগজ, সেখান থেকে লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হল। এ বার অবশ্য শিরোনামটি আমরা পালটে দিয়েছি। পরের দুটি লেখা বহুলপ্রচারিত। এখানে তার সম্পাদিত অংশ অন্তর্ভুক্ত হল মূলত সামগ্রিকতার খাতিরে। দুটি লেখারই শিরোনাম আমাদের দেওয়া।
তার পরের লেখা নবপর্যায় বঙ্গদর্শন-এর ফেব্রুয়ারি ২০০১ সংখ্যায় প্রকাশিত। মূল লেখাটির আগে সন-তারিখসমেত রামকিঙ্করের লেখা একটি ভূমিকা আছে এই রকম
আমার আর কী বলার থাকতে পারে। আমি তো শাব্দিক নই, আমি চাক্ষিক। বলতে গেলেই সব এলোমেলো হয়ে যায়। গুছিয়ে-গাছিয়ে আমার পক্ষে নিজের কথা বলা খুবই মুশকিলের ব্যাপার। আমাদের পরিচয় কাজের মধ্য দিয়ে। সবাই যদি কাজগুলি দেখেন তো কাজ হয়। মানুষটাকে নিয়ে টানাটানি কেন? কিন্তু শ্রীমান্ সৌম্যেন নাছোড়। বলতেই হবে। সাল-তারিখ মনে থাকে না। যা মনে আসছে বলছি। তবে এই এলোমেলো কথা শুনে আপনাদের কী লাভ হবে জানিনে। শান্তিনিকেতন ১. ৩. १৭ ।
তার পরের লেখাটি যে-চারটি সাক্ষাৎকার থেকে তৈরি, সেগুলি প্রকাশিত হয়েছিল এই সব পত্রিকায়— সুন্দরম (১৯৬২), অন্যমনে (১৯৭২), সপ্তাহ (১৯৭৪) ও অমৃত (১৯৭৯)। অন্যমনে-তে সাক্ষাৎকার কে নিয়েছিলেন তা অজ্ঞাত, অন্যগুলি নিয়েছিলেন যথাক্রমে পঙ্কজকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বেলা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সমীর চট্টোপাধ্যায় ।
এর পরে আছে বিভিন্ন সময়ে রামকিঙ্কর-এর লেখা পাঁচটি চিঠি — এ সবই তিনি লিখেছিলেন রবীন্দ্রভারতী প্রদর্শশালার প্রাক্তন অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত সমর ভৌমিক-কে। চিঠিগুলি প্রথম প্রকাশিত হয় অতিথি নামে একটি পত্রিকার রামকিঙ্কর সংখ্যায় (জুন-জুলাই ২০০৪)। আগের কোন সংস্করণেই এই চিঠিগুলি নেই, ফলে এ সবও এই সংস্করণে নতুন সংযোজন।
আর একেবারে শেষে, সাক্ষাৎকারের আদলে যেটি ছাপা হয়েছে, তা সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত শিল্পী রামকিঙ্কর : আলাপচারি (দে’জ, ২য় সংস্করণ, অক্টোবর ২০০০) থেকে নেওয়া। এই উজ্জ্বল নীলমণিটিকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয় বলেই এখানে তার স্থান করে দিতে হয়েছে। মূল বইটিতে এরকম উদ্ধারযোগ্য কথোপকথন অনেক রয়েছে, পাঠক তার স্বাদ নিতে মূল বইটিই সংগ্রহ করবেন, এই আমরা আশা করি ।
আনন্দের কথা যে ইতোমধ্যে এ বইয়ের একটি ইংরাজি সংস্করণ বেরিয়েছে। এ বইয়ের পূর্ববর্তী সংস্করণটি হাতে পেয়ে স্বয়ং উদ্বুদ্ধ হয়ে এখানে সংকলিত অধিকাংশ লেখার আশ্চর্য অনুবাদ করেছেন সুদীপ্ত চক্রবর্তী। সেলফ-পোর্ট্রেট নামে সে বইয়ের উদ্দিষ্ট পাঠক যদিও ভিন্ন ভাষাভাষী রসিকেরা, কিন্তু এ বইয়ের পাঠকও ইচ্ছে করলে তা সংগ্রহ করতে পারেন।
রামকিঙ্করের লেখা এ ছাড়া আরও দু-একটি জায়গায় সংকলিত হয়েছে, কিন্তু তার অনেকটাই অসম্পূর্ণ, কোথাও-কোথাও এমনকী তা বেশ বিকৃত। সে সম্পর্কে এখানে বাক্যব্যয় করার চেয়ে এ সংকলনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল যে সে কারণেই, এ কথা আবারও বলাটাই বোধ হয় বেশি জরুরি।
কলকাতা, বৈশাখ ১৪১২, মে 2005
৮২
মনফকিরা-র কথা
আজ আমরা যারা মনফকিরা-র দীর্ণ পতাকাতলে আবারও এক নতুন প্রকাশ সংস্থায় সমবেত, উল্লেখ থাক যে গত চার বছর তারা প্রায় সকলেই মনচাষা প্রকাশ সংস্থার সঙ্গে বিভিন্ন ভাবে যুক্ত ছিলাম। সেই সঙ্গে এমনও অনেকে আজ মনফকিরায় এসেছেন, যারা আগের ঐ প্রকাশ সংস্থায় কোন ভাবে যুক্ত ছিলেন না। সে দিক থেকে বলা যেতে পারে, এখন আমরা আরও অনেক সংগঠিত।
গত চার বছর ধরে প্রকাশনার উদ্দেশ্য আমাদের কথিত বা লিখিত বক্তব্যে যা ছিল, আজও তার কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। তবু এ কথা মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে প্রকাশনার জগতে আমরা এসেছি আদতে পাঠক হিশেবে। ফলে আগে প্রকাশিত কিন্তু এখন অপ্রাপ্য যে-সব বই আমরা নিজেরাই পড়তে চাই ফের, সে সব বই আমরা যেমন প্রকাশ করব, তেমনি আগে প্রকাশিত হলেও গ্রন্থবদ্ধ নয় এমন বিস্মৃত ও বিলুপ্ত বহুবিচিত্র লেখাও আমরা গ্রন্থাগার বা ব্যক্তিগত সংগ্রহের আড়াল থেকে প্রকাশ্যে এনে সংকলন করব।
অনুবাদ করব, এবং তা শুধু বিদেশি কোন ভাষা থেকে বাংলায় নয়, সম্ভব হলে বাংলা থেকে অন্য কোন ভাষাতেও ।
প্রকাশনার জন্য পুস্তক নির্বাচনের সময়ে বিষয়বস্তু বা দেশকালের কোন রকম গণ্ডি আমরা মানি না !
যৌথ প্রকাশনার কাজে আমাদের আগ্রহ অপরিসীম। প্রকাশনা-ঘটিত নানান সংকটের মোকাবিলা হয়তো তাতে সহজতর হবে।
বিশেষ করে প্রকাশিত বইয়ের বণ্টন ও বিপণনজনিত সংকটের মোকাবিলায় যাঁরা অপ্রচলিত পথে হাঁটতে চান, মনফকিরা তাঁদের সঙ্গী। বাংলা প্রকাশনার অশেষ বদ্ধতা ছেড়ে যাঁরা মাটি-আকাশের, আশমান-জমিনের আরও কাছাকাছি আসতে চান, মনফকিরা তাঁদেরও সঙ্গী ।
ম ন ফ কি রা : প্রকাশিতব্যের খশড়া-তালিকা
৮৩
র বী ন্দ্র নাথ ঠাকুর : সংকলিত শিল্পরচনা, অপ্রকাশিত চিঠিপত্র
সৌ ম্যে ন্দ্র নাথ ঠা কু র : সংকলিত রচনা ও বক্তৃতা
নোয়াম চমস্কি : সংকলিত লেখাপত্র, বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার
এ ড ও য়া র্ড স ই দ : সংকলিত প্রবন্ধ
বা রী ন সা হা : আরও প্রবন্ধ এবং তেরো নদীর পারে-র চিত্রনাট্য নি মা ই ঘো ষ : ছিন্নমূল-এর চিত্রনাট্য এবং আরও প্রবন্ধ
৮৪
বি জ ন ভ ট্টা চা র্য : সংকলিত গল্প এবং উপন্যাস জ্যোতিরিন্দ্র মৈ ত্র : সংকলিত রচনা বিনয় রায় : নানা লেখা
হ বি ব ত ন ভি র : সংকলিত লেখাপত্র
চি ও প্রসাদ : সংকলিত রচনা ও চিঠিপত্র
মী রামু খো পা ধ্যা য় : সংকলিত শিল্পরচনা
পাবলো পি কা সো অঁরি মাতিস মার্ক শা গা ল : সংকলিত রচনা সাক্ষাৎকার ও চিঠিপত্র
Rabindranath Tagore: Writings on Art and Aesthetics
Nandalal Basu: Writings on Art
Drawings of Nikhil Biswas : Man, Woman other Drawings
Ritwik Ghatak: Collected Interviews
Selected 100 Editorials from NOW, the Political and Cultural Weekly edited by Samar Sen Deepak Majumdar: Indian Craft Wisdom and Other Writings
Bijan Bhattacharya: Peoples’ Theatre and Other Writings
ফে দেরি কো ফে লি নি : ছবির জন্ম ও অন্যান্য রচনা
থ্রি স্ত ভ কি য়ে স লো ভ স্কি : ডেকালগ-এর অন্তর্গত আরও দুটি ছবির চিত্রনাট্য
আ ন্দ্রে ই তার কোভস্কি : সংকলিত রচনা ও চিত্রনাট্য
আন্দ্রে ভাই দা : চলচ্চিত্র-রচনা
আ কি রা কু রো সা ও য়া : আত্মজীবনীর প্রায়
শ মী ক ব ন্দ্যো পা ধ্যা য় : নবান্ন থেকে হাঁসখালির হাঁস : বিজন ভট্টাচার্যের নাটক পাঠের ভূমিকা
ভাস্কর চন্দ্র ভার কর : সঙ্গীত বিষয়ে সংকলিত লেখাপত্র
স ঞ্জ য় সাংভি : প্রাণ ও স্রোতস্বিনী
অ সি ত ব সু : নাটক ও সাক্ষাৎকার
বহরমপুর রে পার্ট রি : নাটক ও সাক্ষাৎকার
ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে
নো য়া ম চ ম স্কি : কে কীভাবে চালাবে দুনিয়া
ব ব ডি লা ন : গান ও চার দশকের সাক্ষাৎকার : গিটার আর একটা অন্ধকার রাস্তা
জ ন লে ন ন : গান ও সাক্ষাৎকার : গান ছাড়া জানি না কিছুই
Leave a Reply