আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯২০-১৯২৯ – মুজাফ্ফর আহ্মদ
উৎসর্গ
লাহোরের মীর আবদুল মজীদকে এবং ফিরোজুদ্দীন মনসুরের স্মৃতির উদ্দেশে “আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি” উৎসর্গ করলাম। তাঁরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সভ্যপদভুক্তদের মধ্যে ছিলেন; তাঁরা মস্কোতে ‘স্তালিন বিশ্ববিদ্যালয়’ (প্রাচ্য শ্রমজীবী জনগণের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে) পড়েছিলেন; তাঁরা কমিউনিস্ট চিন্তাধারা বিস্তারের জন্যে দুর্লঙ্ঘ্য পামীর লঙ্ঘন করে ভারতে পৌঁছেছিলেন; তারাই সেই প্রথম কমিউনিস্টদের দলে ছিলেন যাঁরা পেশোয়ারের আদালতে আসামী হয়ে (মস্কো ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা, ১৯২২-২৩) প্রথম সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। মীর আবদুল মজীদ বিখ্যাত ‘নওজওয়ান ভারত সভা’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তিনি মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় (১৯২৯-৩৩) অভিযুক্ত হয়ে দণ্ডিত হয়েছিলেন। ফিরোজুদ্দীন মনসুর ভারতে কমিউনিস্ট পার্টিতে বহুমুখী কর্ম দক্ষতার পরিচয় দিয়ে গেছেন।
আমার কৈফিয়ৎ
১৯৬৭ খ্রীস্টাব্দের ৭ই জুন তারিখে আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পাণ্ডুলিপি প্রথমে প্রেসে পাঠানো হয়। এই পাণ্ডুলিপির প্রথম ত্রিশ-বত্রিশ পৃষ্ঠা এখানে ওখানে ছাপা হয়েছিল।
একখানি বড় পুস্তকের সমস্ত পাণ্ডুলিপি আগে তৈয়ার করে ফেলব, তারপর তা ছাপানোর জন্যে প্রেসে পাঠাব এমন ক্ষমতা ও ধৈর্য আমার ভিতরে নেই। আমি অতি বৃদ্ধ মানুষ। ১৯৬৯ সালের ৫ই আগস্ট তারিখে আমার বয়স আশি বছর পুরো হয়ে গেছে। জীবনে আমি কখনও দ্রুত গতিতে লিখতে শিখিনি। আর, এখন তো লিখতে গিয়ে আমার হাত নড়তেই চায় না।
এমন একখানি বই লেখার জন্যে রাশি রাশি দলীল পড়া প্রয়োজন। সে সব দলীল আমার নিকটে ছিলও, কিন্তু আমার পড়ার ক্ষমতা একেবারেই কমে গেছে। আমার চোখের জ্যোতিও কমেছে। ছানি পড়েছে দু-চোখেই। আমার প্রকাশন ভবনে ও প্রেসে আপন লোকেরা রয়েছেন বলে তাঁদের তাকিদে যখন যতটুকু লিখতে পেরেছি ততটুকুই প্রেসে পাঠিয়েছি এবং সেটুকু ছাপাও হয়ে গেছে।
এইভাবে কাজ করতে করতে প্রায় আড়াই বছর কেটে গেছে। আমি মনে মনে ভেবেছিলাম যে ১৯৩৪ সালের ঘটনায় এসে আমি এ পুস্তক শেষ করব। কিন্তু এখন আমি যেখানে এসে পৌঁছেছি (এম এন রায়ের বহিষ্কার) তারপরে আর আমার এগুবার উপায় নেই। পুস্তকখানি অত্যন্ত বড় হয়ে গেছে। তার ওপরে আমার উপাদানের অভাব পড়ে গেছে। দলীলের সাহায্যে স্মৃতিকে সতেজ না করে আমি কিছুতেই আমার স্মৃতিকথা লিখতে চাই না।
হাঁ, এই পুস্তকখানি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সম্বন্ধে আমার স্মৃতিকথা, কোনো অবস্থাতেই এ পুস্তক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস নয়। ইতিহাস লেখার জন্য আমি পার্টির দ্বারা নিয়োজিত হইনি। তবে ইতিহাস লেখকেরা আমার পুস্তক হতে প্রচুর মাল-মসলা পাবেন। প্রচুর তথ্যের সমাবেশ আমি করেছি।
এ পুস্তকের লেখা শুরু করার আগে হতে দেশে বিদেশে বহু লোককে তথ্যের জন্যে আমি পত্র লিখেছি। সকলকেই আমি জানিয়ে দিয়েছি যে আমি পার্টি সম্বন্ধে আমার স্মৃতিকথা লিখব, পার্টির ইতিহাস নয়। বুঝতে পারছি না তবুও কি করে সর্বত্র প্রচারিত হয়ে গেল যে আমি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস লিখছি। এতে ক্ষতি এই হয়েছে যে বহু কমরেড ও বন্ধু মিছামিছি আশাভঙ্গের কষ্ট পাবেন।
এ পুস্তকের জন্যে বহু কমরেড মাল-মসলা সংগ্রহ করেছেন। অনেকে তার জন্যে নিজেদের পকেট হতে টাকাও খরচ করেছেন। আমি কিন্তু সেই সব মাল- মসলা এ পুস্তকে ব্যবহার করতে পারিনি, কিংবা ক’রে থাকলে খুব অল্পই করেছি। সংগ্রহকারীরা খুবই যে হতাশ হবেন তাতে সন্দেহ নেই। এজন্যে আমি সত্যিই দুঃখিত। আরও যে মাল-মসলা পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করা যেত না তা নয়, কিন্তু পুস্তকখানি কয়েক খণ্ড হয়ে যেত। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে চেয়েছিল। তার জন্যে ভারত ও ইউরোপে তাদের সংগঠনের অন্ত ছিল না। এ কারণে দলীলপত্রেরও কোনো শেষ নেই। অনেক যাতনার ভিতর দিয়ে অতি দুর্বল অস্তিত্ব আমরা কোনো রকম টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলাম।
আগেই আমি বলেছি যে প্রায় আড়াই বছর ধরে আমি এই পুস্তকখানি লিখেছি। সেই জন্যে কোনো কোনো জায়গায় আগের লেখার সঙ্গে পরের লেখার সঙ্গতি থাকেনি। নূতন নূতন তথ্য পাওয়ার কারণেই এই রকম অসঙ্গতি ঘটেছে। সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারের কথাই ধরা যাক। তাঁর সম্বন্ধে আমার প্রথম দিককার লেখা সহানুভূতিপূর্ণ। কিন্তু নূতন নূতন তথ্য পাওয়ার কারণেই এই রকম অসঙ্গতি ঘটেছে। নলিনী গুপ্ত সম্পর্কিত লেখা মনোযোগ সহকারে পড়লেই পাঠকেরা বুঝতে পারবেন যে অসঙ্গতি কিছু নেই। নলিনী নবেম্বর মাসে এসেছিল, না, ডিসেম্বর মাসে এ সম্বন্ধে সন্দেহ থেকে গিয়েছে।
এস এ ডাঙ্গে সম্বন্ধে আমি যা লিখেছি তাতেও অসঙ্গতি আছে, অবশ্য তার ‘গান্ধী’ বনাম লেনিন’ নামক পুস্তকের ব্যাপারে। ডাঙ্গে নিজেই আমায় বলেছিল যে এ পুস্তক ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। এ পুস্তকের মারফতেই তার আন্তর্জাতিক সংযোগ হয়েছিল এটা বিশ্বাস না করে পারা যায় না। লেনিনের বিষয়ে পুস্তক লিখলে লেনিনের দেশে তার এক কপি পাঠানো হবে না এটা কি করে সম্ভব? কানপুর জেলে সে আমাদের বলেছিল ‘গান্ধী বনাম লেনিন’ ও ‘সোশ্যালিস্ট’ সে প্রতিবেশী দেশের রুশ দূতাবাসেও পাঠিয়েছে। কিন্তু ‘সোশ্যালিস্ট’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালের আগস্ট মাসে। দুটিকে একসঙ্গে ধরা যায় না। ডাঙ্গের আন্তর্জাতিক সংযোগ তার পুস্তকের মারফতে ঘটেছে একথা লেখার পরে আমার হাতে তথ্য এসেছে যে, ‘গান্ধী বনাম লেনিন’ নামক পুস্তক ১৯২২ সারের জুন মাসে ‘বোম্বে ক্রনিকল’ পত্রিকায় সমালোচিত হয়। তা থেকে কর্নেল সেসিল কে, এস এ ডাঙ্গের নাম প্রথম তাঁর নোট বইতে লেখেন এবং বোম্বে পুলিসকে জিজ্ঞাসা করেন যে লোকটি কে? আরও কয়েক দিন পরে জুরিখে বা বার্লিনে বসে এম এন রায়ও এই সমালোচনা হতেই ডাঙ্গের নাম নোট করেন। অর্থাৎ পরিষ্কার ভাষায় কথাটা হচ্ছে এই যে ‘বোম্বে ক্রনিকল’ পত্রিকার এই সমালোচনা হতেই এস এ ডাঙ্গে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে প্রথম পরিচিত লাভ করে।
রণছোড়দাস ভবন লোটবালার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যেই ডাঙ্গে তার ‘গান্ধী বনাম লেনিন’ ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে (তারিখটা যদি সত্য হয়) প্ৰথম প্ৰকাশ করেছিল। লোটবালা বোম্বের একজন ধনিক ও কয়েকখানি সংবাদপত্রের মালিক ছিলেন। তিনি ঘোর গান্ধী বিরোধী ছিলেন এবং সোশ্যালিস্ট সাহিত্য পড়তেন। ডাঙ্গের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। লোটবালা তার মাসোহারা ধার্য করে দিয়েছিলেন। আরও নানা রকমে ডাঙ্গেকে তিনি সাহায্য করেছিলেন। সোশ্যালিস্টও লোটবালার সাহায্যে প্রকাশিত হয়েছিল।
.
একটি ভুল সংশোধন করে দিতে চাই। কোনো কোনো জায়গায় মিস্টার মহম্মদ দাউদকে ইন্ডিয়ান সিমেন্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট বলা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন জেনারেল সেক্রেটারি।
.
এই পুস্তকে অবনী চৌধুরী কথা আমি কিছু লিখিনি। ১৯২২ সালের আগস্ট মাসে কাজী নজরুল ইসলামের “ধুমকেতু”র মারফতে তার সঙ্গে আমাদের প্রথম যোগাযোগ হয়েছিল। তখন তার বয়স অল্প ছিল। সম্বলহীন বিধবা মা’র একমাত্র সন্তান সে ছিল। মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করার আগেই তাকে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল। পরে বেশি বয়সে আবার পড়াশুনা আরম্ভ করে সে জিওলজিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এস সি পরীক্ষা পাস করেছে। এখন সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জিওলজি’র রীডার ১৯৩০-এর দশকের কথা যদি লিখি তবে অবনীর কথাও লিখব।
পাঞ্জাবের শিখ সম্প্রদায়ের বহু কমরেড আমেরিকার গদর পার্টির সংস্রবে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্য হতে অনেকে পরে এসেছিলেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশন্যালের সংস্রবে। আমরা নিজেরা কলকাতার শিখদের ভিতরে কিছু সাংগঠনিক কাজ করেছিলেম। সব মিলিয়ে এই বিশিষ্ট পাঞ্জাবী কমরেডদের সম্বন্ধে আমার কিছু লেখা উচিত ছিল। কিন্তু নানা কারণে আমি লিখিনি। পরে জীবনে কুলালে হয়তো কিছু লিখব।
এই পুস্তকের উপাদান সংগ্রহে অনেকেই আমায় সাহায্য করেছেন।
সবচেয়ে বেশি উপাদান আমি ‘ন্যাশনাল আরকাইবস অফ ইন্ডিয়া’ হতে পেয়েছি। প্রথমে অনেক দলীল আমি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পলিট ব্যুরোর নিকট হতে পেয়েছি। তাঁদের দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়ে দ্বিজেন্দ্র নন্দী ন্যাশনাল আরকাইবস হতে দলীলগুলির কপি নিয়েছিলেন। কেন জানিনে কর্তৃপক্ষ এর মধ্যে বহু সংখ্যক দলীলের অংশ বিশেষ কেটে নিয়েছিলেন। এসব দলীলের কপি আমায় আবার নতুন করে নিতে হয়েছে। দ্বিজেন্দ্র নন্দীর সংগ্রহের জন্যে (যদিও আমার অনুরোধে তিনি কাজ করেননি) আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।
সুবোধ রায় ন্যাশনাল আরকইব্স অফ ইন্ডিয়াতে পড়াশুনা করতে যাওয়ার পরে আমার অনেক সুবিধা হয়েছিল। আমার যখন যা প্রয়োজন হয়েছে তাঁর মরফতে খুব সহজে পেয়ে গিয়েছি। তিনি ঘরের লোক হওয়া সত্ত্বেও তাঁকেও ধন্যবাদ জানাই।
সোবিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সপ্তম প্লেনামের রিপোর্ট Puri mirovoi revoliutsii (বিশ্ব বিপ্লবের পথ) নাম দিয়ে সোবিয়েত দেশে রুশ ভাষায় দুখণ্ডে মুদ্রিত হয়েছে। সোবিয়েত দেশের কঠোর ব্যবস্থার কারণে অনেক চেষ্টা করেও আমি এই রিপোর্টের দুটি পৃষ্টার ফটো কপি সংগ্রহ করতে পারিনি তারপরে আমেরিকার স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রবার্ট সি নর্থকে (Professor Robert C. North) পত্র লিখতেই ওই পৃষ্ঠাগুলির Xerox কপি তিনি আমায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাদের নিকটে কমিউনিস্ট আন্দোলনের দলীল-পত্রের বিরাট সংগ্রহ আছে। এই দুপৃষ্ঠার ব্লক এ পুস্তকে সন্নিবিষ্ট হয়েছে।
আমি প্রফেসর রবার্ট সি নর্থকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।
.
আমাদের কলকাতার কমরেড এখন লন্ডনের বাসিন্দা অঞ্জলি ও তারাপদ পাল (স্ত্রী ও স্বামী) উপাদান সংগ্রহে আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। তাঁদের সঙ্গে আরও কেউ কেউ ছিলেন। তাঁদের নাম আমার জানা নেই। আমি তাঁদের সকলকে আমার ধন্যবাদ জানাই।
এক সময়ে কলকাতার বিশিষ্ট ছাত্র নেতা, এখন লন্ডনের বাশিন্দা ডক্টর বিপ্লব দাশগুপ্ত উপাদান সংগ্রহের ব্যাপারে আমায় সাহায্য করেছেন। তাঁকেও আমি ধন্যবাদ জানাই।
ডক্টর মহাদেবপ্রসাদ সাহা বরাবর আমায় সাহায্য করেন। দমদম সেন্ট্রাল জেলে বন্দী থাকার সময়ে আমি যখন “কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা” লিখেছিলেম তখনও তিনি আমায় অনেক সাহায্য করেছিলেন। আর এ পুস্তুক লেখার সময়ে তাঁর সাহায্যের তো কোনো কথাই নেই। তাঁকে যখন যেখানে যেতে বলেছি তিনি গিয়েছেন, যখন যে উপাদান সংগ্রহ করে আনতে বলেছি তিনি তা করেছেন। উপাদান সংগ্রহের স্থানগুলিতে তিনি সুপরিচিত ও সম্মানিত। আমার স্বভাবে দুর্বলতা থাকার কারণে আমি বয়সে অনেক ছোট কমরেডদেরও একজন যাঁকে আমি অবাধে ফরমায়েশ করতে পারি। তিনি এ পুস্তকের জন্যে যা করেছেন তার জন্যে আমি তাঁকেও ধন্যবাদ জানাই।
কমরেড অরুণ রায় আমার “কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা”র নির্ঘণ্ট তৈয়ার করে দিয়েছেন। এ পুস্তুকের নির্ঘণ্টও তিনিই তৈয়ার করেছেন। তাঁকে আমার অশেষ ধন্যবাদ।
.
আমার এ পুস্তক লিখিত ও প্রকাশিত হোক এটা আমাদের পার্টি সভ্যরা তো চাইবেনই। কারণ, পার্টির দূর অতীত তাঁদের নিকটেও খুব পরিষ্কার নয়। এ পুস্তকের জন্যে পার্টির বন্ধুদেরও আগ্রহের অন্ত ছিল না। তাঁরা বরাবর খবর নিচ্ছিলেন “কি হলো? কতদূর এগুলেন?” কোনো সময়ে শরীর সামান্য অসুস্থ বোধ করলেই আমি হতাশ হয়ে গেছি। তখন যাঁরা আমাদের পার্টির খুব কাছাকাছি লোক নন, যাঁরা খোলাখুলিভাবে কোনো রাজনীতিতেও নেই তাঁরা এসে আমার মনে আশা জুগিয়েছেন। বলেছেন আমায় লিখেই যেতে হবে। তাঁরা অনুলিখন করতে রাজী আছেন, যে কোনো রকম সাহায্য করতে তাঁরা প্রস্তুত। আমি তাঁদের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছি। তাঁরা আমার মনে আশার সঞ্চার করেছেন। তাঁরা যে আমায় এত উৎসাহিত করলেন তা থেকে আমি আশার সঞ্চার করেছেন। যে বাইরে যিনি যাই করুন না কেন, ভিতরে আজকার দিনে অরাজনীতিক লোকের সংখ্যা খুবই কম, বিশেষ করে শিক্ষিত লোকদের মধ্যে। এইসব বন্ধুদেরও আমি ধব্যবাদ জানাই।
কিন্তু এতসব করেও আজ যে পুস্তকখানি আমি শেষ করলাম, দু’চার দিনের ভিতরে যা বাজারে বিক্রয় হতে যাবে আমার মনে হয় তা পড়ে সকলের আশাভঙ্গ হবে। আমার নিকট হতে বিভিন্ন বন্ধুরা বিভিন্ন ধরনের জিনিস চেয়েছেন, আমি হয়ত কারুর প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারলাম না। তবে, একটি কথা আমি খুব জোরের সঙ্গে বলতে পারি যে সত্য তথ্যের সন্নিবেশ করার চেষ্টা আমি প্রাণপণে করেছি। আমার দেওয়া অনেক তথ্য অনেকের নিকটে রুচিকর হবে না জানি, কিন্তু আমি যে ঐতিহাসিকদের জন্য প্রকৃত তথ্যের সন্নিবেশ করে গেলাম এটাই আমার সান্ত্বনা।
রাজনীতিক বিতর্কের ব্যাপারে আমি যাইনি যদিও তার জন্যেও আমি উপাদান সংগ্রহ করেছিলেম।
আমি শুধু ঘটনাই বিবৃত করে গেলাম।
মুজাফফর আহমেদ
৪৯ লেক প্লেস, কলকাতা-২৯
৫ই ডিসেম্বর, ১৯৬৯
দ্বিতীয় মুদ্রণ সম্বন্ধে
আমার “আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯২০-১৯২৯” দ্বিতীয় বার মুদ্রিত হলো। ১৯৬৯ সালের ৫ই ডিসেম্বর তারিখে আমি এর প্রথম মুদ্রণের ভূমিকা লিখেছিলেন, আর ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেডের কাউন্টার হতে এর প্রথম বিক্রয় আরম্ভ হয়েছিল ওই মাসের ১২ই তারিখে। গত সেপ্টেম্বর মাসে ন্যাশনাল বুক এজেন্সির গুদামে বইখানি প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর হতে এর দ্বিতীয় মুদ্রণের তোড়জোড় আরম্ভ হয়। কিন্তু ছাপা শেষ হলো এই এখন। দশ মাসের ভিতরে ষোল টাকা দামের এই জাতীয় একখানি পুস্তুকের দু’হাজার কপি বিক্রয় হয়ে যাওয়া আমাদের দেশের পক্ষে কম কথা নয়। আমি জানি অনেকের প্রত্যাশা আমি পূর্ণ করতে পারিনি। তবুও আমাদের পার্টির সভ্যরা, পার্টির নিকটতর ও দূরের বন্ধুরা এবং পার্টির সঙ্গে সংস্রবশূন্য বুদ্ধিজীবীরাও এই পুস্তুক কিনেছেন। আসলে তারা এই ধরনের একখানি পুস্তুক চেয়েছিলেন। আমার পুস্তুক তাঁদের আশানুরূপ না হলেও তাঁরা পুস্তকখানি না কিনে পারেননি।
আমি পুস্তকখানির ক্রেতা বিক্রেতা আর সমালোচকদের আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার এই পুস্তকের যে দ্বিতীয় মুদ্রণ হলো তাতে আমি বড়ই আনন্দিত।
এবারে আগেকার ছাপার ভুলগুলি শুদ্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু নতুন ছাপার ভুল হয়তো অনেক হয়ে থাকবে। আমি চোখে ভাল দেখি না বলে এবারে একেবারেই প্রুফ পড়িনি। তথ্যকে যথার্থ করার জন্যে কয়েক জায়গায় সামান্য কিছু সংযোজনও করেছি। যেমন, ১৯১৫ সালে লাহোরের ১৫ জন ছাত্র সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের বাইরে যে পালিয়ে গিয়েছিলেন প্রথম মুদ্রণের সময়ে আমি তাঁদের দশজনের নাম মাত্র উল্লেখ করতে পেরেছিলেম। এবারে পুরো ১৫ জনের নামই আমি ছেপে দিয়েছি। এই ছাত্রদের কেউ কেউ কাবুলে স্থাপিত অস্থায়ী ভারত গবর্নমেন্টের সভ্য ছিলেন। এমন এন রায় ও সি পি দত্ত সহ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ফরেন ব্যুরোর তিনজন সভ্যের অন্যতম মুহম্মদ আলী এই ছাত্রদেরই একজন ছিলেন।
বৈদ্যনাথ বিশ্বাসকে নিয়ে এম এন রায়ের সঙ্গে আমার কিঞ্চিৎ চটাচটিই হয়ে গিয়েছিল, অবশ্য চিঠি-পত্রের মারফতে। রায় লিখেছিলেন বিশ্বাসকে তাঁর ইউরোপে চাই-ই চাই। আমি লিখেছিলেম বৈদ্যনাথ সন্দেহভাজন ব্যক্তি, তাঁকে ইউরোপে পাঠানোয় আমার একেবারেই সম্মতি নেই। তবে, রায় ইচ্ছা করলে তাঁকে ইউরোপে নিয়ে যেতে পারেন। আমি এত জোরের সঙ্গে বলেছিলেম এই জন্য যে রায়ের পুরানো পার্টির কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বিশ্বাস সম্বন্ধে আমায় সাবধান করে দিয়েছিলেন। এর পরে রায় বৈদ্যনাথ বিশ্বাসকে ইউরোপে আর নিয়ে যাননি, কিন্তু ভারতের ভিতরে আমাদের সমস্ত সংযোগস্থলের সহিত তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালের যুক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ন্যাশনাল কাউন্সিলের মিটিং যখন হচ্ছিল তখন ডাঙ্গের ক্ষমা প্রার্থনা ইত্যাদি সম্পর্কিত দলীল-পত্রের কথা ওঠে। সেই সময়ে সে ক্রমাগত চারদিন বক্তৃতা দেয়। তাতে সে আমাকে এই বলে খোঁটা দেয় যে আমি সন্দেহবাতিকগ্রস্ত লোক। অতি সন্দেহভাজন বলেই একজনকে মুজফফ্র ইউরোপে পাঠাতে চায়নি। রায় বললেন তাকেই আমার চাই। ডাঙ্গের এই খোঁটার পরে কলকাতায় ফিরে এসে রায়ের পুরানো পার্টির একজনকে আমি পত্র লিখলেম। তিনি উত্তর দিলেন “কই, বৈদ্যনাথ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আমি কাউকে তো কিছু বলিনি।” সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী নেতারা এখন মত বদলেছেন। যাঁদের বিরুদ্ধে তাঁদের সন্দেহ ও অভিযোগ ছিল মরবার আগে তাঁদের তাঁরা এখন জাতে তুলে দিয়ে যেতে চান। আমি কিন্তু অথৈ জলে পড়ে গেলাম। ভাবলাম সরকারী রিপোর্ট অনুসন্ধান করা ছাড়া আর আমার কোন উপায় নেই। তাই খুঁজছিলাম। সৌভাগ্যবশতঃ আমি যা চাইছিলাম তাই পেয়ে গেলাম ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদারের “হিস্টরি অফ দি ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন্ ইন্ডিয়া” নামক পুস্তকের দ্বিতীয় খণ্ডে। তিনি বৈদ্যনাথ বিশ্বাস সম্বন্ধে বিহার সরকারের একটি গোপন রিপোর্ট হতে কিছুটা উদ্ধৃত করেছেন। তাঁর ঋণ স্বীকার করে আমি সেই উদ্ধৃতিটি এই পুস্তকের ২৫৪ পৃষ্ঠায় ছেপে দিয়েছি। পাঠকগণ দয়া করে পড়বেন।
পুস্তকের প্রথম মুদ্রণের সময় আমি “গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তীর কথা” নামক যে শিরোনাম আছে তার ভিতরে মস্কো হতে লিলুয়ার ধর্মঘটকারী মজুরদের জন্য সাহায্য হিসাবে টাকা এসেছিল একথা লিখেছি, কিন্তু টাকার অঙ্কটা কত ছিল তা লিখিনি কারণ, তা আমার জানা ছিল না। পরে রাধারমণ মিত্রের মীরাট আদালতে দেওয়া বিবৃতি পড়ে জানতে পেলাম যে দশ হাজার টাকা এসেছিল। তাই আমি দ্বিতীয় মুদ্রণে (এ পুস্তকের ৩৭৩ পৃষ্ঠায়) দশ হাজার টাকা আসার কথা লিখে দিয়েছিলেম। কিন্তু এখন ভারত গবর্নর্মণ্টের একটি রিপোর্টে দেখতে পাচ্ছি যে টাকার অঙ্কটা বিশ হাজার ছিল। লয়ড্স ব্যাঙ্কের মারফতে টাকা এসেছিল। হাওড়ার জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট গুরুসদয় দত্তের সনাকরণে কিরণ মিত্র টাকাটা ব্যাঙ্ক হতে তুলতে পেরেছিলেন; তা ছাড়া মস্কোর টাকার ওপরে ভারত গবর্নমেন্টের কড়া নজর তো থাকারই কথা। মস্কোতে সাহায্য চেয়ে যে টেলিগ্রামটি পাঠানো হয়েছিল তারও প্রতিলিপি আমি এখানে ছেপে দিলাম। কারণ পুস্তকের ভিতরে তা নেই।
[The Messag telegraphed to Russia, Reads :
SECRETARY, PROFINTERN, MOSCOW
30,000 STRIKERS ARE OUT FOR 51 DAYS, RELIFE URGENTLY NEEDED. PLEASE SEND THROUGH BANK TO MITRA, SECRETARY.E.I. RAILWAY UNION. LILLOOAH, BENGAL, MITRA, SPRATT, MUZAFFAR. The Statesman, Tuesday, May 1, 1928]
প্রফিটার্নের ( ট্রেড ইউনিয়সমূহের আন্তর্জাতিক) সেক্রেটারি, মস্কো
৩০,০০০ মজুর ৫১ দিন ধরে ধর্মঘট ক’রে আছেন। সাহায্যের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন। মিত্র, সেক্রেটারি, ই, আই, রেলওয়ে ইউনিয়ন, লিলুয়া, বেঙ্গল ঠিকানায় দয়া করে ব্যাঙ্কের মারফতে সাহায্য পাঠান
মুজফফর আহমদ
প্রেরকের নাম : মিত্র, স্প্রাট, মুজফফর
দি স্টেটস্ম্যান, মঙ্গলবার, ১লা মে, ১৯২৮
৪৯, লেক প্লেস, কলকাতা-২৯
৫ই জুলাই, ১৯৭১
Santanu Dutta
Please publish books by Leon Trotsky in Bengali version. “The Russian Revolution”, “The Revolution Betrayed”, “1905”