আমার অবিশ্বাস – হুমায়ুন আজাদ
ভূমিকা
বিশ্বজগত এখনো দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বাসের ভিত্তির ওপর। গত তিন শতকে বিজ্ঞান বেশ এগিয়েছে, পৃথিবীকে মহাজগতের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিয়েছে এক গৌণ এলাকায়, মহাজগতকে এক বদ্ধ এলাকার বদলে ক’রে তুলেছে অনন্ত; এবং মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ, অমৃতের পুত্র প্রভৃতি আত্মগর্বিত সুভাষণ থেকে বিচ্যুত ক’রে পরিণত করেছে নগ্ন বানরে; কিন্তু মানুষের চেতনার বিশেষ বদল ঘটে নি। মানুষ আজো আদিম। মানুষের চোখে আজো সব কিছুই অলৌকিক রহস্যে পরিপূর্ণ; আকাশে আজো তারা অনন্ত নক্ষত্রপুঞ্জ বা নিরন্তর বিস্ফোরিত গ্যাসকুণ্ডের বদলে দেখতে পায় বিভিন্ন বিধাতা; দেখতে পায় মনোরম স্বৰ্গ আর ভীতিকর নরক।
পরিপূর্ণ করেছে অজস্র রহস্যে, ধারাবাহিকভাবে ক’রে চলছে বিশ্বের রহস্যীকরণ; বা সত্যের অসতীকরণ। মহাজগতের রহস্যীকরণে অংশ নিয়েছে মানুষের প্রতিভার সব কিছু : পুরাণ, ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, এবং আর যা কিছু আছে। তার শক্তির সব কিছুই মানুষ ব্যবহার করেছে মহাজগতকে রহস্যে ভ’রে তুলতে; তাকে
তমসাচ্ছন্ন। আদিম মানুষ যখন রহস্যীকরণ শুরু করেছিলো, তার কোনো দুরভিসন্ধি ছিলো না, সে শুধু গিয়েছিলো ভুল পথে; কিন্তু পরে সমাজপ্রভুরা দেখতে পায় বিশ্বের সত্য বের করার বদলে তাকে রহস্যে বোঝাই ক’রে তুললেই সুবিধা হয় তাদের। মহাজগতের রহস্যীকরণে ধর্ম নেয় প্রধান ভূমিকা; তার কাজ হয়ে ওঠে রহস্যবিধিবদ্ধকরণ, আলো সরিয়ে অন্ধকার ছড়ানো, মানুষের মনে বিশ্বাস সৃষ্টি করা সে-সব সম্বন্ধে যা সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্বহীন। ওই রহস্যের পায়ের নিচে নানা তাত্ত্বিক কাঠামো স্থাপন করে দর্শন, জন্ম দেয়। বহু বিখ্যাত ধাঁধা, করে রহস্যের দর্শনীকরণ। দর্শনের লক্ষ্য ছিলো সত্য আবিষ্কার, কিন্তু দর্শন আসলে বেশি সত্য বের করতে পারে নি; কিন্তু মিথ্যে প্রতিষ্ঠায় তার কাজ অতুলনীয়।
বিপুল। সাহিত্য ও শিল্পকলা রহস্যকে রূপময় ক’রে তীব্র আবেগের সাথে সঞ্চার করেছে মানুষের মনে। বিশ্বসাহিত্যের বড়ো অংশই দাঁড়িয়ে আছে ভুল ভিত্তির ওপর। তাই মহাজগত এখনো রহস্যময়; মহাজগতকে এখনো বোঝার উপায় হচ্ছে বিশ্বাস। এই রহস্যময়তা ও বিশ্বাস ক্ষতিকর মানুষের জন্যে; এখন দরকার
মহাজগত ও মানুষের মনকে অলৌকিক রহস্য থেকে উদ্ধার করা, অর্থাৎ দরকার মহাজগতের বিরহস্যীকরণ। মানুষের জন্যে যা কিছু ক্ষতিকর, সেগুলোর শুরুতেই রয়েছে বিশ্বাস; বিশ্বাস সত্যের বিরোধী, বিশ্বাসের কাজ অসত্যকে অস্তিত্বশীল করা। বিশ্বাস থেকে কখনো জ্ঞানের বিকাশ ঘটে না; জ্ঞানের বিকাশ ঘটে অবিশ্বাস থেকে, প্রথাগত সিদ্ধান্ত দ্বিধাহীনভাবে না মেনে তা পরীক্ষা করার উৎসাহ থেকে। বাঙলার মহাপুরুষগণ, বিদ্যাসাগর ও আরো দু-একজন বাদে, সবাই বিশ্বাসী; তারা আমাদের জন্যে সৃষ্টি ক’রে গেছেন ভুল কল্পজগত। রাজনীতিবিদেরা আজ মেতে উঠেছে বিশ্বাস ও মিথ্যের প্রতিযোগিতায়; তারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিকর মানবগোত্র। আমার আবিশ্বাস-এ সাতটি প্রবন্ধ রয়েছে, তবে বইটি প্রবন্ধের বই নয়; আমি ধারাবাহিকভাবে একটি বই-ই লিখতে চেয়েছিলাম, তবে পাঠকদের কথা ভেবে বইটিকে সাত শিরোনামে ভাগ ক’রে দিলাম। আমি আনন্দিত যে বইটি বিপুল সাড়া জাগিয়েছে, বাঙালির বিশ্বাসের মেরুদণ্ডে কিছুটা ফাটল ধরাতে পেরেছে। সংশোধিত এ-সংস্করণে শুদ্ধ ক’রে দেয়া হলো কয়েকটি মুদ্রণ ত্রুটি, বদল করা হলো একটি বাক্য, কবিতার অনুবাদেও বদল করা হলো কয়েকটি শব্দ। নতুন অক্ষরে বইটি এবার বিন্যস্ত হলো ব’লে কয়েকটি পাতা কমলো, কিন্তু আর কিছু কমে নি, বরং কিছুটা বেড়েছে।
হুমায়ুন আজাদ
১৪ই ফুলার রোড
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা
৪ আষাঢ় ১৪০৪ : ১৮ জুন ১৯৯৭
Rana paul
Nice
Rana paul
Rama paul
Rana paul
Good book