আমাদের পদবীর ইতিহাস – লোকেশ্বর বসু
ভূমিকা
‘আমাদের পদবীর ইতিহাস’ রচনাটি আনন্দবাজার পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। সে সময়ে কেউ কেউ নতুন তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, এবং সেগুলিও এখানে সন্নিবেশিত হয়েছে। নিতান্তই কৌতূহলবশে পদবীর ইতিহাস অনুসন্ধানে দীর্ঘকাল নিজেকে নিয়োজিত করেছিলাম, রচনাটি সেই পঠনপাঠনের ফল। কিন্তু এটিকে পদবীর ইতিহাস না বলে ইতিহাসের কাঠামো বলাই ভাল। পরবর্তীকালে কোন নিরপেক্ষ গবেষক যদি এবিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনায় উদ্বুদ্ধ হন তা হলেই আমার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করবো।
পদবী প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে স্বাভাবিক কারণেই জাতি বর্ণ গোত্র ইত্যাদির উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই রচনার মূল বক্তব্য: সমস্ত বর্ণ ও জাতির ইতিহাস একই। রক্তের দিক থেকে উচ্চনীচ ভেদাভেদ কৃত্রিম ও মনগড়া, জাতিগুলির ইতিহাসও কাল্পনিক। সেকালে শাস্ত্রগুলি যেমন জাতি ও বর্ণের নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছিল, যার উল্লেখও এ রচনাটিতে আছে, তেমনই ভ্রান্ত বর্তমানকালের নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। প্রকৃতপক্ষে বিশুদ্ধ রেস, জাতি বা বর্ণ বলে কিছু নেই। আবার জাতি-সংকরত্ব একটি অবাস্তব ধারণা। এখানে করণ অম্বষ্ঠাদি সম্পর্কে বিশেষ শাস্ত্রমত ও কয়েক-জন পণ্ডিতের মত অনুযায়ী জাতিবিশেষের সঙ্গে তার অভিন্নতা দেখানো হয়েছে আলোচনার প্রয়োজনে। কিন্তু, মনে হয়, করণ ও কায়স্থের বৃত্তি ছিল একই, যেমন অম্বষ্ঠ ও বৈদ্যের বৃত্তি ছিল অভিন্ন। সেজন্যই পরস্পরকে অভিন্ন ভাবা হয়েছিল। কিন্তু পরে স্ব স্ব বৃত্তিতে প্রধান হয়ে ওঠে কায়স্থ ও বৈদ্য। শাস্ত্রে পুরাণে করণ অম্বষ্ঠাদি জাতিগুলিকে যে সংকর বলা হয়েছে তা ভিত্তিহীন। আমার পরবর্তী রচনায় শাস্ত্রমত যে ভ্রান্ত এবং সংকরত্ব জ্ঞাপক নৃতাত্ত্বিক ধারণাও যে কতখানি ভুল তা প্রমাণ করার ইচ্ছা আছে। কোন জাতিই সংকর জাতি নয়, অন্যদিকে কোন জাতিই বিশুদ্ধ রক্তধারা বহন করে আনেনি। বৃত্তি-ভাষা-পরিবেশ মানুষের দেহগঠনে বা চরিত্রে পরিবর্তন ঘটালেও রক্তধারা একই থাকে। দেশভেদে কালভেদে জনগোষ্ঠীর শাস্ত্র অনুযায়ী তাদের জাতিনাম গড়ে উঠেছিল, বর্ণবিশ্বাসী শাস্ত্রকারগণ সেগুলিকেই বর্ণাশ্রমের মধ্যে স্থান দিতে গিয়ে সংকরত্ব ‘আবিষ্কার’ করেন। কারণ বৌদ্ধযুগে বিভিন্ন বৃত্তিগোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ হওয়ার স্মৃতি তাঁদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। একই বংশের দুটি শাখা ভিন্ন বৃত্তি অবলম্বন করে দুটি পৃথক জাতিরূপে চিহ্নিত হতে পারে, আবার সেই দুটি ভিন্ন বৃত্তিগোষ্ঠীর সম্মিলনে কালক্রমে একটি তৃতীয় বৃত্তিজাতি গড়ে উঠতে পারে। এদের পরস্পরের মধ্যের অন্তর্বিবাহ সংকরত্ব বলা যায় না। অথচ শাস্ত্রকারগণ সেই ভুলই করে গেছেন। বর্তমানকালের জাতি-ভিত্তিক নৃতত্ত্বও নানা কারণে ঐতিহাসিক কোশাম্বীর কাছে উদ্ভট মনে হয়েছে। অঞ্চলভিত্তিক বা অর্থমানভিত্তিক নৃতত্ত্বের তবু অর্থ হয়। জাতি-ভিত্তিক নৃতত্ত্ব অর্থহীন।
ব্রাহ্মণাদি বর্ণ বলতে বৃত্তিগত সংস্কৃতি ও আচারের ধারাবাহিকতা বোঝাতো। বিশেষ কোন রেস বা রক্তধারা বোঝাতো না। সুতরাং বিশুদ্ধ রক্তের ধারণাও অবাস্তব। আবার রক্তমিশ্রণ বলতে বোঝায় বিবর্তিত আদি মানবের যে শাখাপ্রশাখা কালক্রমে আঞ্চলিক পার্থক্য অর্জন ক’রে বৃত্তিজাত ভেদাভেদ গড়ে তুলেছিল তাদের মধ্যে সম্পর্ক। সেকালের শাস্ত্রকারগণ এবং একালের কোন কোন ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক যাকে রক্তমিশ্রণ বলেন, তা মূলতঃ চাকুরে ও ব্যবসায়ীর অথবা ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারের অথবা ধনী ও দরিদ্রের অথবা শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের অথবা কৃষ্ণবর্ণ ও গৌরবর্ণের অথবা দীর্ঘদেহী ও অদীর্ঘদেহীর রক্তমিশ্রণ। অথচ এর সবকটি বৈশিষ্ট্য একই বর্ণের মধ্যেই বা একই জাতির মধ্যেই সেকালেও ছিল, একালেও আছে। রক্তমিশ্রণ বলতেও বিবাহ বোঝাতো, কারণ সমস্ত প্রকার মিলনকেই সেকালে বিবাহ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।
—লেখক
.
আপনার নামের শেষে একটি পদবীনামক পুচ্ছ যুক্ত হয়ে আছে। স্বর্গত ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ডিপ্লোমা ইত্যাদিকে বানরের লেজ বলে অভিহিত করেছিলেন, একযুগ আগেকার সেই শ্লেষ হয়তা অধুনা সুপ্রযুক্ত বলে বিবেচিত হতেও পারে, কিন্তু আমাদের পদবীমাহাত্ম্যকে কেউই বোধহয় বিদ্রুপ করেননি। বরং উত্তর ও পশ্চিম ভারতে অর্ধশতাব্দী আগেও মিঃ রমেশ বা মিঃ রামলাল জাতীয় পদবীবিযুক্ত নামের প্রচলন ছিল বলে তাঁরা অনেকেই উপহাস কুড়িয়েছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের কালে সমস্ত ভারতবাসীকে এক জাতিতে গড়ে তোলার প্রয়োজনে একদিকে যেমন অস্পৃশ্যতা দূর করার চেষ্টা হয়েছিল, তেমনই জাতিভেদও শিথিল হয়ে এসেছিল। বিবাহের ক্ষেত্রে না হলেও, সামাজিক অন্যান্য ক্ষেত্রে। কিন্তু পদবীর গুরুত্ব কমেনি। ‘শনিবারের চিঠিতে সজনীকান্ত একদা দুঃসাহসিকভাবে লেখকদের পদবী বিলুপ্ত করেছিলেন, যদিও বলা বাহুল্য সে-কালীন পাঠকেরা এই প্রচেষ্টাকে উপভোগ্য কৌতুক হিসেবেই গ্রহণ করেন, সম্ভবত পত্রিকাটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য।
স্বাধীনতার পর বেশ কিছুকাল প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনা-ধারণা অদৃশ্য থাকলেও ইদানীং সেই শক্তিগুলি ক্রমশই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। তার একটি হল পদবীর কৌলীন্য, যার আড়ালে লুকিয়ে আছে জাতিভেদ। সমস্যা আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ার পর যথারীতি বিদেশী রাষ্ট্রের কলকাঠি অনুমান করেই তখন আমরা নির্বিকার থাকবো।
এই সেদিন একটি বেসরকারী অফিসে উচ্চপদে জনৈক করুণাময় গুড় তাঁর নানাবিধ যোগ্যতা নিয়ে নিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও সেই অফিসের অধস্তনদের মধ্যে বিক্ষোভের কারণ হয়ে পড়লেন। কারণ তপশীল তো দূরের কথা, ‘গুড় যে ব্রাহ্মণদের একটি আদি পদবী এই ধারণাটিও অনেকের নেই। মুচিরাম গুড় নামকরণেই তো বঙ্কিমচন্দ্র পদবীটিকে পরিহাস করেছেন। গুড়ত্বের কথা থাক, পদবীর গুরুত্ব নিয়েই আমাদের আলোচনা। গড়াই যদি সমযোগ্যতাসম্পন্ন হন, তা হলেও ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যরা পদবী-কৌলীন্যের দিকে স্বাভাবিক পক্ষপাতিত্ব দেখাবেন সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ আছে কি? গুড় ও গড়াইয়ের মধ্যে ধ্বনিগত বা সাংস্কৃতিক পার্থক্যই বা কোথায়?
শৈশব থেকে পদবীর সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা গড়ে ওঠে বলেই আমাদের ধারণা জন্মায় যে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই পদবী অত্যন্ত প্রাচীন। মাত্র একশো বছরের পুরোনো কোন প্রথাকে হাজার বছরের ঐতিহ্য মনে করার অসাধারণ এক পটুত্ব আছে আমাদের। পদবীর ব্যাপারেও সে কারণেই আমাদের বিভ্রান্তি কম নয়। সংবাদপত্রে কখনো কখনো বিজ্ঞপ্তি ছাপিয়ে আদালতে এফিডেবিট করে পদবী পরিবর্তন করার দৃষ্টান্ত চোখে পড়লে আমরা অনেকেই কৌতুক বোধ করি। জাতবিদ্বেষবশত কেউ কেউ অনুদার মন্তব্যও করে বসি। অথচ এই একই অপরাধে আমরা সকলেই অপরাধী, অন্তত আমাদের পূর্বপুরুষরা। কারণ এই অপরাধ (?) তাঁরা প্রায় সকলেই করে গেছেন। তাঁরা কেউ ইচ্ছেমত পদবী গ্রহণ করেছেন, কেউ আদি পদবীর গায়ে সংস্কৃত ভাষার পালিশ চড়িয়েছেন, কেউ বা পদবীটি আমূল বদলে নিয়েছেন। আমরা পরবর্তী সন্তান-সন্ততিরা সেই পদবীকেই আদি ও অকৃত্রিম মনে করে নামের শেষে যুক্ত রেখে আত্মগর্বে আপ্লুত হয়ে আছি।
স্মরণ রাখতে হবে পাঁচ কোটির এই পশ্চিমবঙ্গে নামমাত্র কিছু ব্যক্তি এফিডেবিট করে পদবী বদলে নেন, সম্ভবত আইনগত কারণে। কোটি কোটি মানুষ কিন্তু আপন আপন উদ্ভট বা কৌতুকপ্রদ পদবীটিকেও প্রীতির চোখেই দেখেন। তাছাড়া ভূ-সম্পত্তি অর্থ বাড়ি-ঘর ইত্যাদির উত্তরাধিকারে জটিলতা বৃদ্ধির আশঙ্কায় ইচ্ছা থাকলেও পদবী পরিবর্তন করা দুঃসাধ্য। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, যদি দেখা যায় উদ্ভট বা অন্ত্যজ পদবী বর্জন করে অনেকে পরিচিত পদবী গ্রহণ করছেন তাহলে স্বীকার করতে হয় যে আপাতদৃষ্টে অদৃশ্য হলেও কোথাও একটা সামাজিক অন্যায় ও অবিচার চলছে।
কিন্তু সব পদবীই গৃহীত পদবী অথবা পরিবর্তিত পদবী। সরস্বতী নদীতীর থেকে কোন পদবীই বাংলাদেশে এসে পৌঁছয়নি। এমন কি উত্তর ভারতেও নয়। কারণ আদিতে আদৌ কোন পদবীই ছিল না।
আপনার পদবী কি বন্দ্যোপাধ্যায় বা মুখোপাধ্যায়? চট্টোপাধ্যায় বা গঙ্গোপাধ্যায়? এই পদবীগুলিকে যত প্রাচীন ভাবছেন, সত্যই কিন্তু ততখানি প্রাচীনত্ব এদের নেই। ভারতবর্ষের কুত্রাপি এই পদবী ছিল না, আজও নেই। বঙ্গদেশেও ব্রাহ্মণদের পদবীগুলি ছিল অন্য, ক্ষেত্র-বিশেষে রীতিমত শ্রুতিকটু। আপনি কি ঘোষ বসু, মিত্র বা দত্ত? স্বীকার করি এই শব্দগুলি খুবই প্রাচীন। কিন্তু পদবী হিসেবে এ-গুলির কোন প্রাচীন ব্যবহার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কারণ, আমাদের এই নামের শেষে যুক্ত শোভাবর্ধক পুচ্ছটির ব্যবহারই যথেষ্ট প্রাচীন নয়। আপনি কি দাশগুপ্ত বা সেনগুপ্ত? ইতিহাস বলে, এই যুগ্ম-পদবীর প্রস্তুতিকরণ ও প্রচলন রীতিমত আধুনিক। এমন কি ‘দাশ’ বানানটিও। বহুবিধ প্রয়োগের কথা বাদ দিলে ‘দাস’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ভৃত্য’, ‘দাশ’ শব্দের সরলার্থ ধীবর। সুতরাং ধরে নিতে হবে শব্দার্থের সঙ্গে পদবীর কোন সম্পর্ক নেই। ‘দাস’ পদবীধারীরা ভৃত্য নয়, ‘দাশ’ পদবীও ধীবরত্ব প্রকাশ করে না। দাশ যদি ধীবর না হয়, তা হলে অন্যান্য কৌতুকপ্রদ পদবীকেই বা শব্দার্থে গ্রহণ করি কেন?
আমার এই মন্তব্যগুলি অকপটে স্বীকার করে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং আমাদের পদবীর ইতিহাস খুঁজে বের করার জন্য, আসুন, আমরা কিঞ্চিৎ ইতিহাসের পাতা খুঁজে দেখি।
শিক্ষিত বাঙালী’ পৃথিবীর তাবৎ খবরাখবর রাখায় অভ্যস্ত। ইওরোপ বা আমেরিকার ঘরের খবর যেমন তার নখদর্পণে, তেমনই চীন-রাশিয়ার সংসারের খুঁটিনাটিও। তার অজ্ঞতা শুধুমাত্র নিজের দেশ এবং সমাজ সম্পর্কে। আমাদের অনেকেরই মনে এই ভুল ধারণাটি বদ্ধ-মূল যে জাতি ও পদবীর মধ্যে কোন পারস্পরিক সম্পর্ক আছে। যে-কোন একটি অপরিচিত বা অসংস্কৃত পদবী দেখলেই আমরা সেই পদবীর মালিককে নিমেষের মধ্যে অন্ত্যজ শ্রেণীভুক্ত করে ফেলি। আবার নন্দী, কুণ্ডু, পলি বা দাস জাতীয় কিছু পরিচিত পদবীকে ধরে নিই জাতিবিশেষের পদবী। জাতিবিন্যাস বিষয়েও আমাদের অজ্ঞতা গভীর। তর্কে-বিতর্কে আলাপ-আলোচনায় আমরা অস্পৃশ্য, অন্ত্যজ, নমঃশূদ্র, হরিজন, অ-জলচল এবং তপশীলী শব্দগুলিকে এমনভাবেই প্রয়োগ করি যেন এগুলি পরস্পরের সমার্থক। তথাকথিত অস্পৃশ্যের শাস্ত্রীয় তালিকা প্রত্যেক রাজ্যেই ছিল ভিন্ন, এক অঞ্চলের অন্ত্যজের অন্য অঞ্চলে ছিল মধ্যমাসন, ওম্যালীর মতে নমঃশূদ্র একটি মাত্র জাতির পরিবর্তিত নাম, হরিজন মহাত্মা গান্ধীর উদ্ভাবিত নামকরণ, অ-জলচলের তালিকা প্রায় প্রতি জেলায় ভিন্ন ভিন্ন, এক অঞ্চলের অ-জলচল অন্য অঞ্চলের উচ্চ জাতি। এইসব তারতম্যের প্রধান কারণ আর্থিক সঙ্গতির তারতম্য। এই প্রসঙ্গে একটি মজার খবর পরিবেশন করা যেতে পারে। বাঙালী হিসেবে আমাদের যত গর্বই থাক, হিমাচল প্রদেশে হরিয়ানায় পাঞ্জাবে ‘বাঙালী’ একটি তপশীলী জাতি। অথচ তাদের চেহারা প্রায় আর্যসদৃশ।
অন্ত্যজ জাতিগুলির চরম দারিদ্র্য কেন, কেনই বা তারা শ্রমসাধ্য নিকৃষ্ট কাজ করতে বাধ্য হয়েছিল, তার ব্যাখ্যা মিলবে মনুসংহিতায় ও অন্যান্য শাস্ত্রাদিতে, যার মতে চণ্ডাল, চর্মকার ও রজকের মাতা ব্রাহ্মণ-কন্যা। প্রতিলোম বিবাহের অপরাধেই শুদ্রকে এই শাস্তি দেওয়া হয়, কিন্তু একথাও অনুমেয় যে প্রাক-বৌদ্ধযুগে এবং বৌদ্ধযুগে অর্থবান উন্নত শুদ্রেরও সামাজিক প্রতিষ্ঠা থাকায় ব্রাহ্মণকন্যারা অন্যবর্ণে মাল্য-দান করেছিলো, বর্ণ শিথিলতার সুযোগে। বৌদ্ধপরবর্তী যুগে বর্ণা-শ্রমের প্রতাপ ফিরে আসায় সেই সব শূদ্রকে সমাজের নিম্ন স্থান দিয়ে এমন বৃত্তি নির্দেশ করে দেওয়া হয় যার ফলে চিরন্তন দারিদ্য তাদের চিরসঙ্গী হয়ে পড়ে, শিক্ষাদীক্ষা ও রুচি ইত্যাদির পতন ঘটে। আর্থিক কারণেই যে তা ঘটে তার সাক্ষ্য দেবে বর্তমানের এমন অনেক গ্রাম্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বংশ, দারিদ্র্যবশত যারা এখন অশিক্ষিত দরিদ্র রুচিহীন নিম্ন-শ্রেণীর সমপর্যায়ভুক্ত। দেহগঠন, গাত্রবর্ণ ইত্যাদির ক্ষেত্রেও দেখা যাবে একটি বংশ অর্থবান হয়ে উঠলে ক্রমাগত সুন্দরী গৌরবর্ণা বধূ, বরণ করে এনে তথাকথিত আর্য হয়ে ওঠে, আর্থিক অবনতি ঘটলে কায়িক শ্রমের ফলে ও নিম্নমানের কন্যাকে বিবাহ করে এনে তথাকথিত অনার্য হয়ে পড়ে। জাতি বর্ণের ক্ষেত্রেও তা সমান সত্য।
বর্তমান তপশীলীভুক্ত জাতির তালিকায় আছে: বাউরী, চর্মকার, ধোবা, ডোম, বাগদী, ভূঁইমালী, হাড়ি, জেলে-কৈবর্ত, কোটাল, মেথর, নমঃশূদ্র, চণ্ডাল, পোদ বা পৌণ্ড্রক্ষত্রিয়, রাজবংশী, শুঁড়ি (সাহা ব্যতীত) প্রভৃতি।
এ ছাড়া বাঙালী আর প্রায় সব জাতিই বর্ণহিন্দু।
তপশীলী বা তপশীলভুক্ত জাতি সম্পর্কেও অনেকের ধারণাই অস্পষ্ট। তপশীলী বা সিডিউলড শব্দের অর্থ তালিকাভুক্ত। ইংরেজ শাসনের কালে অতি দরিদ্র, অনুন্নত, সমাজ-নিপীড়িত জাতিগুলির একটি সরকারী-তালিকা বানানো হয়। তাদের উন্নতিকল্পে কিছু সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা হয় প্রাক-স্বাধীনতা যুগেই। দেশভাগ হওয়ার পর স্বাধীন ভারতে সরকারী চাকুরির এক বৃহৎ অংশ কেবলমাত্র উদ্বাস্তুদের জন্য যেমন বেশ কিছুকাল সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল; প্রাক্তন সৈনিক ও যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের পরিবারবর্গের জন্যও যেমন রিজার্ভেশন আছে, তেমনই সংবিধান অনুযায়ী তপশীলীদের জন্যও সরকারী চাকুরিতে কিছু অংশ নির্দিষ্ট আছে। মোট জনসংখ্যার অনুপাতে তপশীলীদের আঞ্চলিক সংখ্যার হার অনুযায়ী এইসব সুযোগ সুবিধা বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন রকম। এ বিষয়েও নানা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। তপশীলী জাতি ও উপজাতিদের জন্য আছে মোট শতকরা পনেরো ভাগ। পশ্চিমবঙ্গে আরো কম। অতএব ৮৫ শতাংশ বা তদোধিক আছে সর্বসাধারণের জন্য। এই রিজার্ভেশনও আবার কেবলমাত্র সরকারী চাকরিতে, বে-সরকারী ক্ষেত্রে নয়।
হিন্দুসমাজে এই সিডিউলড কাষ্ট্ বা তপশীলভুক্ত জাতির বাইরে রয়েছে বর্ণহিন্দু জাতিগুলি। পশ্চিমবঙ্গে এই বর্ণহিন্দু জাতির সংখ্যা ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য নিয়ে তিরিশটিরও বেশি। এই বর্ণহিন্দু, জাতিগুলির জন্য কোন রিজার্ভেশন নামক সুযোগ সুবিধা নেই। সরকারী চাকুরির ক্ষেত্রে এই তিরিশটি বা তদোধিক জাতি পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই চাকুরি পান বা চাকুরিতে উন্নতি করেন। কিন্তু এই তথ্য অনেকের কাছেই অজ্ঞাত, এবং পদবী সম্পর্কেও অনেকের স্পষ্ট জ্ঞান নেই। ফলে আমাদের মধ্যে নানা ভুল ধারণা রয়ে গেছে। ব্রাহ্মণ কায়স্থাদির মধ্যে এমন বহু, পদবীর প্রচলন আছে যেগুলির ভাষাগত কৌলীন্য না থাকায় কেউ কেউ সেগুলিকে তথাকথিত অন্ত্যজ পদবী মনে করে বসেন। ফলে তপশীলীদের রিজার্ভেশন বিষয়েও অকারণ বিক্ষোভ জমা হয়। ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্যদের মধ্যে অনেকেই অন্যান্য সব জাতিকেই সিডিউলড কাস্ট ভেবে বসেন। ক’জন খবর রাখেন যে গোয়ালা কিংবা তিলি, বারুই কিংবা ছুতার, সঙ্গোপ কিংবা মালাকার ‘অগ্রসর’ জাতি, এবং তাঁদের জন্য কোন রিজার্ভেশন নেই। ক জন খবর রাখেন যে দত্ত বা ঘোষ, বসু বা মিত্র বা সেন, গুপ্ত, দাস অসংখ্য জাতির পদবী!
আমাদের বর্ণবিন্যাস সম্পর্কেও অনেকের ধারণা অস্পষ্ট। জেনেটিকস বা জননবিদ্যায় এখন স্বীকৃত হয়েছে যে পিতা ও মাতা উভয়েরই শারীর ও অন্যান্য প্রভাব সন্তানের উপর বর্তায়। কিন্তু প্রাচীন পিতৃকেন্দ্রিক সমাজে নারীর কোন স্বাতন্ত্র ছিল না। প্রাকবৌদ্ধ যুগে বর্ণাশ্রম যখন শিথিল ছিল, এবং বৌদ্ধযুগে যখন বর্ণের প্রাধান্য অনুপস্থিত ছিল সে-সময় সব বর্ণের মধ্যেই রক্তমিশ্রণ ঘটেছিল। যাই হোক বর্ণাশ্রম যখন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ব্রাহ্মণ শাস্ত্রকারগণ সিদ্ধান্ত দিলেন যে, সব অ-ব্রাহ্মণ বাঙালীই শুদ্র ও সংকর জাতি। মনুসংহিতার দশম অধ্যায় অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন। তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল সংকরত্ব নির্ণয় করে অনুলোম বিবাহজাত ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় পিতার সন্তানদের উচ্চাসন দেওয়া এবং প্রতিলোম বিবাহের ব্রাহ্মণ মাতার সন্তানদের স্থান একেবারে সমাজের নীচে নির্দেশ করা। শ্রীঅতুল সুর তাঁর ‘সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্ম’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “সামাজিক সংগঠনের মধ্যে এদের স্থান ও মর্যাদা নির্দেশের পিছনে ব্রাহ্মণদের কিছু উষ্মা ছিল বলে মনে হয়। কেননা, ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় যদি পিতা হতেন, তা হলে তাকে অম্বষ্ঠ বা উগ্র নামে অভিহিত করে ব্রাহ্মণদের অব্যবহিত পরেই তাদের স্থান দেওয়া হত। আর ব্রাহ্মণী যদি মাতা হতেন, তা হলে তাকে চণ্ডাল নাম দিয়ে সমাজের একেবারে নীচে তার স্থান নির্দিষ্ট হতো।” অনেকের মতে মনুসংহিতার ঐ উচ্চাসনপ্রাপ্ত অম্বষ্ঠ পরে বৈদ্য জাতি নাম পায়, এবং ক্ষত্রিয় পিতৃত্বের জন্য উগ্র জাতির নাম হয় উগ্রক্ষত্রিয়। ব্রাত্যক্ষত্রিয় করণের পরিবর্তিত নাম হয় কায়স্থ। লক্ষ্যণীয়, জাতি নামও বদলে যায়। মনুসংহিতায় করণ নাম আছে, কায়স্থ নাম নেই। তেমনই অম্বষ্ঠ নাম আছে, বৈদ্য নাম নেই। অবশ্য মনুতে পরস্পরবিরোধিতাও কম নেই, তবে অনুমান করা যায় সেগুলি প্রক্ষিপ্ত অংশ, আঞ্চলিক জাতিবিদ্বেষ প্রসূত। কারণ মূল সিদ্ধান্ত উচ্চবর্ণের পিতা হলে উচ্চাসন, নিম্নবর্ণের পিতা হলে নিম্নতম আসন। অনুলোমের মর্যাদা উপরে, প্রতিলোমের স্থান নীচে। মনুসংহিতার মতে ব্রাত্যবৈশ্যের সন্তান আচার্য ও মৈত্র, ও নিষাদপুত্র দাশ, শেষোক্তের বৃত্তি নৌকর্মোপজীবিকা। মনুর মতে দাশ-এর অপর নাম কৈবর্ত্ত, তবে নৌবৃত্তি অনুযায়ী তারা বোধহয় বর্তমানের জেলে-কৈবর্ত্ত। এছাড়া বৈদেহ পুত্র হল মৈত্রেয়। এগুলি জাতির নাম, পদবীর সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।
দ্বাদশ (১২-১৪) শতাব্দীতে এসে বৃহদ্ধর্মপুরাণেও আমরা দেখি অব্রাহ্মণ সব বাঙালীই শূদ্র ও সংকর। উত্তম-সংকর সেখানে করণ (কায়স্থ), অম্বষ্ঠ (বৈদ্য), উগ্র (উগ্রক্ষত্রিয়), মাগধ (এখন লুপ্ত জাতি); এ ছাড়া গান্ধিকবণিক, শাঙ্খিক, রাজপুত্র (রাজপুত) প্রভৃতিও উত্তম-সংকর। লক্ষ্যণীয় সেই প্রাচীন কালেই রাজপুত নামক বাঙালী একটি জাতির উল্লেখ পাওয়া যায়।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের নামকরণে কিঞ্চিৎ ঢক্কানিনাদ থাকলেও তার বিষয়বস্তু ও জাতিবিন্যাস দেখলে মনে হয় বাংলার সমাজ সম্পর্কে শাস্ত্র-কারের স্পষ্ট ধারণা ছিল না, বা রাজপ্রভাব ও জাতিবিশেষের প্রভাবে তার বিন্যাস ঘটে। এখানে বৈদ্য নাম প্রথম উল্লেখিত, সৎশূদ্রের তৃতীয় জাতি হিসেবে। উপরন্তু ভীল বা ভীল্ল উপজাতিকে দেওয়া হয়েছে পঞ্চম স্থান। এই পুরাণের অভ্যন্তরস্থ বিষয় ও কাহিনীও পুরাণটির গুরুত্ব হ্রাস করে।
বর্তমানে বর্ণহিন্দু জাতি অর্থাৎ যাঁরা কোন রিজার্ভেশন নামক সুযোগ সুবিধে পান না, তাঁরা হলেন : ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, উগ্ৰক্ষত্রিয়, রাজপুত, বৈষ্ণব, মাহিষ্য, কৈবর্ত্ত, সদ্গোপ, গন্ধবণিক, তিলি, মালাকার, তাঁতী, নাপিত, বারুই, কামার বা কর্মকার, কুম্ভকার, ময়রা, সুবর্ণবণিক, চাষাধোবা, গোপ, অগ্রদানী ব্রাহ্মণ, যুগী (যোগী), কাঁসারী, তাম্বলী’ স্বর্ণকার, সুত্রধর, সাহা, শাঁখারী প্রভৃতি। তিলি তৌলিক, বারুই বারু- জীবী, ময়রা মোদক, গয়লা গোপ।
শাব্দিক মিল থেকেও ভুল ধারণা হয়। আগেই দেখিয়েছি আচার্য মৈত্র দাশ মৈত্রেয় জাতিনাম ও বর্তমান পদবী এক নয়। তেমনই গন্ধ-বণিক সুবর্ণবণিক স্বর্ণকার এক স্তরভুক্ত নয়। পোদ বা পৌণ্ড্রক্ষত্রিয় এবং বাগ্দী বা ব্যাগ্ৰক্ষত্রিয় তপশীলী জাতি, নামকরণও অর্বাচীন। এগুলি অতি সাম্প্রতিক নামকরণ। কিন্তু উগ্রক্ষত্রিয় বর্ণহিন্দু এবং বৃহ-দ্ধর্মপূরাণে করণ (কায়স্থ) ও অম্বষ্ঠের (বৈদ্য) পরেই তার আসন, যদিও মনুসংহিতায় অম্বষ্ঠ ও উগ্র ব্রাহ্মণের অব্যবহিত পরেই অধিষ্ঠিত। যেমন ব্রাহ্মণ-কায়স্থের মধ্যে বহু, অপরিচিত দেশজ পদবী আছে। অন্যান্য বর্ণহিন্দু, অর্থাৎ ‘অগ্রসর’ বহু, জাতির মধ্যেও তেমন অনেক পদবী আছে। সেগুলি দেখে তপশীলী মনে করে তপশীলভুক্ত জাতির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হওয়া উচিত নয়। এঁরাও প্রতিযোগিতা করেই যোগ্যতার জন্য চাকুরি পান। অবশ্য যদি ধরে নেওয়া হয় যে ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্যরাও যোগ্যতার জন্যই চাকুরিতে নিযুক্ত হন।
উদ্ভট কিংবা মজাদার পদবী উচ্চনীচ সব জাতির মধ্যেই প্রচলিত। আবার একই পদবী পাওয়া যাবে বিভিন্ন জাতির মধ্যে। এমন বহু, পদবী আছে যেগুলি ব্রাহ্মণ কায়স্থাদি উচ্চবর্ণের মধ্যেও বর্তমান, তপশীল-ভুক্ত জাতির মধ্যেও। আবার অন্যান্য বর্ণহিন্দু জাতির মধ্যেও সেগুলি প্রচলিত। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে উচ্চবর্ণ শব্দটি বিভ্রান্তিকর এবং এটি আধুনিক সৃষ্টি। ব্রাহ্মণ কোন জাতিবাচক নাম নয়, ব্রাহ্মণ একটি বর্ণ। বাংলাদেশে জাতিনাম পেশা বা বৃত্তিবাচক। তেমনই কায়স্থ বা বৈদ্য জাতিনাম, বর্ণনাম নয়। সে কারণেই উচ্চবর্ণ শব্দটির ব্যবহার সুপ্রযুক্ত বলে মনে হয় না।
সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে হিন্দু সমাজের একদিকে আছে বর্ণহিন্দু, বা অগ্রসর তিরিশটি জাতি, অন্যদিকে তপশীলভুক্ত বা অনগ্রসর তেষট্টিটি জাতি।
আগেই বলেছি নন্দী, কুণ্ডু, পাল, দাস বিভিন্ন বর্ণহিন্দু, জাতির মধ্যেই দেখা যায়। এগুলি এখনো কায়স্থদের মধ্যেও প্রচলিত। নন্দী ব্রাহ্মণদের একটি আদি পদবী। এ ছাড়া অন্যান্য কায়স্থ পদবী কর, চন্দ, ভঞ্জ, বিষ্ণু, বিন্দু, হুই ইত্যাদি। অষ্টাদশ শতকের জনৈক গ্রন্থকার তাঁর পরিচয় দিয়েছেন মাঝি-কায়েত। সম্ভবত মাঝি তাঁর পদবী, কায়েত শব্দে তিনি তাঁর জাতি-পরিচয় দিয়েছেন। মাঝি বা মাজি বর্ণহিন্দু, নানা জাতির মধ্যেই আছে। এটি উপজাতিবিশেষের নিজস্ব সম্পত্তি নয়। সম্ভবত মজঝিম বলতে মধ্যস্থ ব্যক্তিকে বোঝাতো। তা থেকেই নদী পরাপার-কারী নৌকোর মাঝি, এবং দুই রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকার মধ্যস্থ ব্যক্তি বা প্রধানকে মাঝি বলা হত। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নব-বাবুবিলাস’ গ্রন্থে বোট কোম্পানিতে চাকুরিরত মুনশিকেও মাঝি বলা হয়েছে, অবশ্য উপহাস করে।
গুড় পদবী যে ব্রাহ্মণদের একটি আদি পদবী তা জেনে অনেকেই হয়তো বিস্মিত হয়েছেন। তাঁদের জন্য আরো বিস্ময় আছে। মধ্যযুগে কুলীন বৈদ্যদের পদবী ছিল কুণ্ডু, দাস, দত্ত, কর। এছাড়া কিছুকাল আগেও তাঁদের মধ্যে এমন অনেক পদবী ছিল যেগুলিকে একটি ছড়ায় ‘বৈদ্যছাড়া’ বলে অপাঙক্তেয় করার চেষ্টা ছিল। অর্থাৎ উদ্ভট বা অবজ্ঞেয় পদবী থেকে কোন জাতিই মুক্ত ছিল না। বাঙালী রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের আদি পদবীগুলি নিয়েই শুরু করা যাক। ওঁদের পদবী ছিল: গুড়, হড়, মহান্তি, চৌতখণ্ডি, গড়গড়ি, দিমসাই, পারিহল, পিপ্পলাই, মাসচটক, কুলকুলী, সেয়ক, আকাশ, কুলভি, ডিংসাই, পর্কটী, তৈলবাটী, কেয়ারী, পোড়াড়ি ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গে ব্রাহ্মণের সংখ্যা প্রায় কুড়ি লক্ষ। কিন্তু আমাদের চতুষ্পার্শ্বে যে সংখ্যায় বন্দ্যোপাধ্যায় চট্টোপাধ্যায়দের দেখা মেলে, সেই অনুপাতে ছাপ্পন্নটি (মতান্তরে ঊনষাট) রাঢ়ী পদবীর দেখা মেলে না। সুতরাং অনুমান করা যায় যে এই ঊনষাট গাঞি পদবী অন্য পদবীর মধ্যে ক্রমে ক্রমে আশ্রয় নিয়েছে। গাঞি নামগুলি যে আদি পদবী তার প্রমাণ : কিছু কিছু গাঞি নাম এখনো পদবী হিসেবে প্রচলিত রয়ে গেছে; যথা বটব্যাল, কুশারী, দীর্ঘাঙ্গী, গড়গড়ি, পালধি, সিমলাই, ভট্টশালী, কাঞ্জিলাল, বাপুলী, পুতিতুণ্ড (মতান্তরে পতিতুণ্ডি)।
বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রেও বাকচি, লাহিড়ি, মৈত্র, ভাদুড়ি, সান্যাল পদবী সুপরিচিত। কিন্তু এঁদেরও অন্যান্য গাঞি পদবী বর্তমানে প্রায় অদৃশ্য। সেগুলির মধ্যে আছে চম্পটি, শিহরি, মৎস্যাসি, তোড়ক, খড়খড়ি, ঝম্পটি, গোচণ্ড, কাচড়ী, শূল, বলোৎকটা ইত্যাদি একশোটি পদবী। বাকচি লাহিড়ি ভাদুড়ি মৈত্র প্রভৃতি গাঞি নাম যখন পদবী হিসেবে প্রচলিত, তখন বাকী গাঞি নামগুলিও যে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের আদি পদবী ছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিশেষ করে আতর্থী, বিশী, ঝম্পটি ইত্যাদি গাঞি নাম যখন পদবী হিসেবে বহাল তবিয়তে রয়েছে। তা হলে অনুমান করতে হয় যে অন্যান্য আদি পদবী-গুলি পরিচিত পদবীর মধ্যেই আশ্রয় নিয়েছে। লক্ষণীয় বাকচি লাহিড়ি সান্যাল শব্দের অর্থ পাওয়া যায় না, এবং এগুলি সংস্কৃত শব্দ বলেও মনে হয় না।
রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের ছাপ্পান্ন বা ঊনষাট এবং বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের একশোটি আদি পদবী, যার অনেকগুলিই দেশজ শব্দ, তা লুপ্ত হয়ে গিয়ে ভাষা-গত কৌলীন্যপ্রাপ্ত মাত্র কয়েকটি পদবী টিকে রইলো কেন?
প্রশ্ন বা অনুমান নয়, ব্রাহ্মণ-ইতিহাস রচয়িতাদের কেউ কেউ এ-বিষয়ে স্পষ্ট অভিযোগও উচ্চারণ করেছেন। ব্রাহ্মণ-ইতিহাস রচয়িতা ষাট বছর আগেও, অর্থাৎ স্বাধীনতা ও দেশভাগের বহু আগেই বলছেন, “বর্তমানে অনেকে বন্দ্যো গ্রামীন না হইয়াও বন্দ্যোপাধ্যায় রূপে পরিচয় দিতেছেন, মুখো গ্রামীন বা গাঞি না হইয়াও মুখোপাধ্যায় রূপে পরিচয় দিতেছেন, চট্ট গ্রামীন বা গাঞি না হইয়াও চট্টোপাধ্যায় হইতেছেন।”
এখানে প্রাসঙ্গিক বলেই উল্লেখ্য যে বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, মুখোপধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায়ও পরিবর্তিত পদবী। আদি পদবী বাড়বি বা বন্দ্যঘটি, চাটুতি বা চট্ট, মুখটি, গাঙ্গুর বা গঙ্গ। মুখটি বা মুকুটি এখনো পাওয়া যায়। বাড়ব বা বাড়বি গ্রাম থেকে বাড়বি ও বন্দ্যঘটি রূপান্তর, তা থেকে বন্দ্যোপাধ্যায়।
সুতরাং পদবীর ভাষাগত সংস্কার বা পদবী পরিবর্তন বা অন্য পদবীর মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ কোন আকস্মিক আধুনিক ঘটনা নয়। দ্বিতীয়ত, দেশজ শব্দই ছিল বাঙালীর পদবী। উদ্ভট বা শ্রুতিকটূ পদবী কেবলমাত্র তথাকথিত অন্ত্যজ শ্রেণীর বিশেষত্ব নয়। চাটুতি মুখটি বাড়রির মতই বাকচি লাহিড়ি সান্যাল পদবীও তো আপাতদৃষ্টে অর্থহীন। এগুলি সংস্কৃত শব্দও নয়। পরে এগুলির সংস্কৃত উৎস খুঁজে বের করার বা আবিষ্কার করার চেষ্টা হয়েছে, এবং অর্থও। তা হলে অন্যান্য অর্থহীন পদবীকে অপাঙক্তেয় মনে করার কারণ কি? কারণ একটিই, আমাদের অজ্ঞতা।
তবে পদবীর মূল খুঁজে বের করতে হলে আমাদের একেবারে ইতি-হাসের প্রাচীনতর পাতাগুলি উলটে যেতে হবে।
একই পদবী অপরিচয়ের ফলে এক সময়ে হাস্যকর মনে হয়, পরবর্তী-কালে তা অতিপরিচিতির দরুন রীতিমত কৌলীন্য পায়। যে-কোন পদবী কেরানীকুলের মধ্যে এবং ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অধিক সংখ্যায় দেখা গেলেই তার সামাজিক স্বীকৃতি ঘটে। কখনো কখনো বিখ্যাত ব্যক্তির বিচিত্র পদবীও আর অপাঙক্তেয় থাকে না। পদবী নানা বিচিত্র পথে সৃষ্টি হতে পারে। কুশো গ্রাম থেকে সৃষ্ট পদবী কুশারী কিভাবে লোক-মুখে ঠাকুর পদবীতে রুপান্তরিত হয় সে-কাহিনী আজ অনেকেই জানেন।
বাঙালীর কোন পদবীই পরিহাসযোগ্য নয়। পরশুরাম কারফর্মা পতিতুন্ড প্রভৃতি পদবীকে পরিহাস রসে সিঞ্চিত করে গেছেন। কিন্তু কৌতুক সৃষ্টি করতে গেলে বাঙালীর সমস্ত আদি পদবীই সমান হাস্যকর।
Leave a Reply