আমাদের দুঃখ : কাজী আনোয়ারুল কাদীর
প্রথম প্রকাশ : ১৯৩৪
পুনর্মুদ্রণ মুদ্ৰণ প্ৰসঙ্গে
গত শতাব্দীতে বাঙালি মুসলমান সমাজ সংস্কারমুক্তি ও প্রগতির পথে যতটা অগ্রসর হতে পেরেছে তার পেছনে ঢাকা মুসলিম সাহিত্য-সমাজ ও তাঁদের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অবদান উল্লেখ করতে গিয়ে আবুল ফজল লিখেছেন, “এই বিপুল পরিবর্তন একদিনে হয় নি, কারও একার চেষ্টায় ঘটে নি। দীর্ঘকাল ধরে বহু মানুষ বহুভাবে এর পথ কেটেছেন, ভিত গেড়েছেন, আগামী দিনের পথ রচনা করতে মাল- মসলা জুগিয়েছেন। তাঁদের অনেকের কথা আমরা ভুলে গিয়েছি। অনেকের স্মৃতি বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সমাজের রথ-চক্র বড় ধীরে ও অলক্ষে চলে। অলক্ষ থেকে নানাজনের নানা হাত তাকে সামনের দিকে এগিয়ে দেয়। মুখর রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে এঁদের দানের মূল্য অনেক বেশি। শান্ত ও গম্ভীর প্রকৃতির, স্বল্পভাষী ও উদারচেতা আনওয়ারুল কাদীর সাহেবেরও অলক্ষে থেকে সমাজ ও দেশের মঙ্গল চিন্তা মামুলি ও গতানুগতিক ছিল না। এ যুগে ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ যে মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তার ঢেউ তুলেছিল আনওয়ারুল কাদীর সাহেবের চিন্তা ও রচনা তারই সাক্ষাৎ ফল।” (‘বুদ্ধির মুক্তি’)
বিস্মৃতপ্রায় সেই চিন্তানায়ক কাজী আনোয়ারুল কাদীর কিংবা তাঁর রচনার সঙ্গে আমাদের আজকের পাঠকের পরিচয় নেই বললেই চলে। তাঁর একমাত্র প্রবন্ধ-সংকলন আমাদের দুঃখ, যা প্রকাশিত হয়েছিল গত শতকের তিরিশের দশকের মাঝামাঝি, বর্তমানে কোনো গ্রন্থাগারেও খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন কিংবা তার সারথিদের রচনাকর্মের ব্যাপারে আগ্রহ আজ যে শুধু পণ্ডিত ও গবেষকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা নয়, অন্তত আমাদের মুক্তমনা ও প্রগতিমনস্ক পাঠকদের মধ্যে এ বিষয়ে ঔৎসুক্য ক্রমবর্ধমান। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের এই দুষ্প্রাপ্য বইটি পুনর্মুদ্রণের তাগিদ অনুভব করা।
কাজী আনোয়ারুল কাদীর নামে সমধিক পরিচিত হলেও, সমসাময়িক পত্রপত্রিকায় তাঁর রচনা কখনো কখনো (শুধু) ‘আনোয়ারুল কাদীর’ নামেও ছাপা হয়। নামের আগে কখনো ‘অধ্যাপক’ আবার কখনো ‘মৌঃ’ (মৌলভি) শব্দটি বসেছে। সেই সঙ্গে (সেকালের পক্ষে সুলভদৃষ্ট রীতি অনুযায়ী) নামের শেষে ‘এমএ, বিটি, বিএল’ এই ডিগ্রি পরিচায়ক শব্দগুচ্ছ। আমাদের দুঃখ বইটির প্রথম সংস্করণেও (আষাঢ় ১৩৪১) লেখকের নাম ‘আনোয়ারুল কাদীর এমএ, বিটি, বিএল’ এভাবেই মুদ্রিত হয়। তবে বর্তমান সংস্করণে আমরা কাজী আনোয়ারুল কাদীর নামটিই ব্যবহার করেছি। এছাড়া কেবল বানানের দ্বিত্ব, সংখ্যা বা পরিমাণ নির্দেশে ব্যবহৃত ‘টী’-এর স্ত্রী-কার এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ঊর্ধ্বকমা ও হসন্ত বাদ দিয়ে বর্তমান সংস্করণটিকে বলা যেতে পারে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বইয়ের উক্ত প্রথম সংস্করণেরই হুবহু পুনর্মুদ্রণ। প্রথম সংস্করণের কপি সংগ্রহ ও তার অনুলিপি তৈরি করে দিয়ে আমাদের সাহায্য করেছেন শুভ্রা মজুমদার, তাঁর কাছে আমরা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। আমাদের কৃতজ্ঞতা মুহাম্মদ কাইয়ুমের প্রতিও এ ব্যাপারে তাঁর স্বতঃপ্রণোদিত সহযোগিতার জন্য। আর অ্যাডর্ন পাবলিকেশনের সৈয়দ জাকির হোসাইন ও সাজজাদুর রহমানের আগ্রহ ও সযত্ন প্রয়াস বইটির এ নতুন সংস্করণ পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব করে তুলল, সেজন্য তাঁদেরকেও কৃতজ্ঞতা জানাই।
মোরশেদ শফিউল হাসান
২১শে ফেব্রুয়ারি ২০১০
ভূমিকা
১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য-সমাজ প্রতিষ্ঠার পর, ১৯২৭ সালের ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় এর প্রথম বার্ষিক সম্মেলন। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে কলকাতা থেকে সে সম্মেলন উদ্বোধন করতে আসেন নজরুল ইসলাম। এর কয়েকদিন আগেই তিনি জ্বরে ভুগে উঠেছিলেন। তারপরও অসুস্থ শরীর নিয়ে সম্মেলনের দুদিনের অধিবেশনেই তিনি উপস্থিত ছিলেন, প্রথম দিন উদ্বোধনী সঙ্গীত হিসেবে একটি গান (‘খোশ আমদেদ’) এবং দ্বিতীয় দিনে একটি গজল পরিবেশন ও কবিতা (‘খালেদ’) আবৃত্তি করেন। সম্মেলনের কার্যক্রম নজরুলকে কতটা উদ্দীপ্ত করেছিল দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে প্রদত্ত তাঁর ভাষণ থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সাহিত্য-সমাজের অভিযাত্রিকদের অভিনন্দিত করে তিনি বলেছিলেন : “…বহুকাল পরে কাল রাত্রে আমার ঘুম হয়েছে। আজ আমি দেখছি এখানে মুসলমানের নূতন অভিযান শুরু হয়েছে। আমি এই বার্তা চতুর্দিকে ঘোষণা করে বেড়াব। আর একটি কথা–এতদিন মনে করতাম আমি একাই কাফের কিন্তু আজ আমি দেখে আশ্বস্ত হলাম যে, মৌঃ আনোয়ারুল কাদীর-প্রমুখ কতকগুলি গুণী ব্যক্তি দেখছি আস্ত কাফের। আমার দল বড় হয়েছে এর চেয়ে বড় সান্ত্বনা আর আমি চাই না।”
সাহিত্য-সমাজের জ্যেষ্ঠ সারথি বিবেচনায়ই খুব সম্ভব নজরুল তাঁর ভাষণে একমাত্র আনোয়ারুল কাদীরের নামোল্লেখ করেছিলেন এবং ‘প্রমুখ’ শব্দটার দ্বারা আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদসহ তাঁর সহযোগীদের বুঝিয়েছিলেন। নজরুলের এ-বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আসলে বুদ্ধিমুক্তি আন্দোলনের (অন্যতম প্রধান) কাণ্ডারি হিসেবে আনোয়ারুল কাদীরের ভূমিকার প্রতি স্বীকৃতিই প্রকাশ পেয়েছে। যদিও বাস্তবতা এই যে, সময়ের ব্যবধানে আজ আমরা বুদ্ধিমুক্তি আন্দোলনের অন্যান্য সারথিদের সম্পর্কে যা বা যতটুকুই জানি, মূলত সুযোগের অভাবে, আনোয়ারুল কাদীর সম্পর্কে তার সামান্য অংশও জানি না। লেখক হিসেবে আনোয়ারুল কাদীর ছিলেন স্বল্পপ্রজ। তাঁর একমাত্র প্রকাশিত গ্রন্থ, একটি প্রবন্ধ-সংকলন, ‘আমাদের দুঃখ’ নামে ১৯৩৪ সালে (১৩৪১ বঙ্গাব্দ) কলকাতার ৪০ মির্জাপুর স্ট্রিটস্থ মডার্ন পাবলিশিং সিণ্ডিকেট থেকে সুরেশচন্দ্র দাস কর্তৃক প্রকাশিত হয়। পুনর্মুদ্রণের অভাবে বইটি বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য! বাঙালি মুসলমান সমাজের অগ্রগমন তথা আমাদের চিন্তাচর্চার বিকাশে মুসলিম সাহিত্য-সমাজ বা শিখাগোষ্ঠীর অবদান সম্পর্কে এক ধরনের কৌতূহল ইদানীংকালে আমাদের বিদ্বৎসমাজের একাংশের মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে। এ বিষয়ে কমবেশি লেখালেখি অবশ্য আগেও হয়েছে; প্রধানত আবুল ফজল, কাজী মোতাহার হোসেন, আবদুল কাদির প্রমুখ শিখাগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত লেখকদের হাতেই যার সূত্রপাত। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অন্তত দুটি একাডেমিক গবেষণার নজিরও আমাদের সামনে রয়েছে। এছাড়া আলাদাভাবে কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, আবুল ফজল, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবদুল কাদির প্রমুখকে নিয়ে বই ও প্রবন্ধাদি লেখা হয়েছে। এসব রচনায় প্রসঙ্গক্রমে হয়তো আনোয়ারুল কাদীরের নামও এসেছে। তবে প্রায় ক্ষেত্রে তা ওই উল্লেখ মাত্রই। ইচ্ছা করলেই আমরা আজ কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরীর রচনার সঙ্গে পরিচিত হতে পারি। দীর্ঘদিনের অপ্রাপ্যতা ঘুচিয়ে সম্প্রতি বাংলা একাডেমী আবুল হুসেনের রচনাবলিও প্রকাশ করেছে। কিন্তু উদ্ধৃতির বাইরে আনোয়ারুল কাদীরের রচনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আজও সীমিত। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত জীবনী-গ্রন্থমালা সিরিজে শতাধিক মনীষী- লেখকের জীবনী প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু তাঁদের মধ্যে আনোয়ারুল কাদীর নেই। একাডেমী প্রকাশিত চরিতাভিধানেও তিনি স্থান পাননি। ১৯৮৭ সালে আনোয়ারুল কাদীরের জন্মশতবর্ষ সম্পূর্ণ নীরবেই অতিবাহিত হয়ে গেছে। এ সবই পূর্বসূরি এ চিন্তানায়কের কাছে ঋণ স্বীকারের ব্যাপারে আমাদের ঔদাস্য ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেয়।
২
কাজী আনোয়ারুল কাদীরের জন্ম ১৮৮৭ সালে, আন্দামানের পোর্টবে-য়ারে। তাঁর বাবা আবদুল কাদীর ছিলেন সেখানকার সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। যশোর জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স ও কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পর আনোয়ারুল কাদীর ১৯১০ সালে যশোর জেলা স্কুলেই সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এই যশোর জেলা স্কুলে শিক্ষকতাকালে আবুল হুসেনকে তিনি তাঁর ছাত্র হিসেবে পান। এক বছর পরই আনোয়ারুল কাদীর ঢাকা সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে সিনিয়র শিক্ষক পদে বদলি হয়ে যান। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে যুক্তিবিদ্যার অধ্যাপনা ছাড়াও প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পেশাল অফিসার স্টেপল্টনের সহকারী ও পরে উপাচার্য পি জে হার্টগের অধীনে তাঁর সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর একে একে তিনি নোয়াখালি, কৃষ্ণনগর, কলকাতা, জলপাইগুড়ি ও বরিশালে স্কুল পরিদর্শক হিসেবে চাকুরি করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নেন। তবে কি শিক্ষক হিসেবে কি শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি যখন যেখানে কর্মরত ছিলেন, সর্বত্র সমান নিষ্ঠায় শিক্ষার্থী, সহকর্মী, ভক্ত-অনুরাগীদের মধ্যে জ্ঞান ও মুক্তচিন্তা চর্চাকে উৎসাহিত করেছেন। সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নেওয়ার পরও বরিশালে যে-বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেন সেখানেও ‘নিজস্ব পদ্ধতিতে আদর্শ ছাত্র’ গড়ে তোলার চেষ্টা চালান। শিক্ষক হিসেবে আনোয়ারুল কাদীরের ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করতে গিয়ে তাঁর প্রাক্তন ছাত্র ও পরবর্তীকালের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ খান বাহাদুর আবদুল হাকিম লিখেছেন, “পাঠ্যবই সকল মাস্টারই পড়াইয়া থাকেন; কিন্তু কাদীর সাহেব যে সকল উচ্চাদর্শের কথা শুনাইতেন তেমন কথা আমরা অপরের কাছে শুনিতে পাইতাম না।
এমন সরলচেতা মহাপ্রাণ ব্যক্তির সংস্পর্শে আসিলে বাস্তবিকই জীবন ধন্য হয়। তাঁর বাল্যবন্ধু ও পরেও যিনি সহকর্মী হিসেবে তাঁর সাহচর্য লাভ করেছিলেন এমন একজন কবি শেখ হাবিবর রহমানও আপন স্মৃতিকথায় আনোয়ারুল কাদীরের মানসিক দৃঢ়তা, উচ্চ আদর্শবোধ এবং সমাজের কল্যাণ সাধনে তাঁর তীব্র আগ্রহ ও ছাত্রদের মানুষ করার ব্যাপারে দক্ষতার কথা বলেছেন। কর্কটরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৮ সালের ৩ নভেম্বর কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
৩
১৯২৭ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত শিখার সর্বমোট পাঁচটি সংখ্যার মধ্যে কেবল প্রথম দুটি সংখ্যায়ই কাজী আনোয়ারুল কাদীরের দুটি রচনা প্রকাশিত হয়। দুটিই প্রবন্ধ, যথাক্রমে ‘সামাজিক গলদ’ ও ‘ইংরেজি সাহিত্যে রোমান্টিক যুগ’। এর মধ্যে প্রথম প্রবন্ধটি লেখকের আমাদের দুঃখ প্রবন্ধ-সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ-প্রবন্ধটির কিছু বক্তব্য, বিশেষ করে যেখানে তিনি ‘লোকসমাজে সদরে দাঁড়িয়ে টানা সোজা উলঙ্গ ভাষায়’ মুসলমান সমাজের ‘অন্তরালে লুক্কায়িত নানা অপ্রিয় ব্যাপার সম্বন্ধে খুলে বলবার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন’, সে-সময় কিছুটা চাঞ্চল্য বা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে বলে সাহিত্য-সমাজের প্রথম বর্ষের কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়। যদিও বিষয়টির উল্লেখ করে উক্ত কার্যবিবরণীতে সম্পাদক আশা প্রকাশ করেছিলেন, “কিন্তু এই দুঃসাহসের পরিণাম একদিন সুখকর হবেই–কারণ এতে আমাদের সমাজের সারথিগণ হয়ত সত্বরই এ সমস্ত সামাজিক রোগসমূহের প্রতিকার বা নিরাময় করবার জন্য বদ্ধ পরিকর হবেন।” সাহিত্য-সমাজের নবম বার্ষিক অধিবেশনেও (১৯৩৫ সালের ৭ এপ্রিল) আনোয়ারুল কাদীর ‘আমাদের মাতৃভাষা’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। এছাড়া সাহিত্য-সমাজের অপর কোনো কার্যক্রমে তাঁর প্রকাশ্য বা সক্রিয় উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায় না। খোদ আবুল হুসেনসহ আরও কারো কারো মতো তিনিও মনে হয় এ- পর্যায়ে অন্তরালে থেকেই ভূমিকা রেখেছিলেন, সহব্রতীদের সহায়তা ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন। এই নেপথ্যচারিতার একটি সম্ভাব্য কারণ হল, পেশাগত কারণে ১৯২৮ সালের পর তাঁকে ঢাকার বাইরে বাঙলা দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করতে হয়। দ্বিতীয়ত, সরকারি চাকুরে হিসেবে তাঁকে সম্ভবত সামাজিক-রাজনৈতিক বিতর্ক-বিতণ্ডার কেন্দ্রে না থাকার ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হয়েছে। এমনিতে লেখক হিসেবে স্বভাবগতভাবেই তিনি হয়তো কম লেখার পক্ষপাতী ছিলেন। তাছাড়া কর্মক্ষেত্রের ব্যস্ততাও একটি কারণ হতে পারে। আমাদের দুঃখ বইটির গোড়ায় কাজী আবদুল ওদুদের লেখা ক্ষুদ্র ‘মুখবন্ধ’টি থেকেও আমাদের এই অনুমানের সমর্থন মেলে। ওদুদ লিখেছেন, “তাঁর [আনোয়ারুল কাদীরের–মোশহা] অবসর কম, তাই মুখবন্ধ-স্বরূপ দুই একটি কথা লিখে দেবার ভার আমার উপর পড়েছে।”
৪
আমাদের দুঃখ বইটিতে মোট আটটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। এগুলো হল ‘আমাদের দুঃখ’, ‘নেতাদের কথা’, ‘সামাজিক গলদ’, ‘শিক্ষিতা নারীর বিবাহ’, ‘জাতীয় সমস্যা’, ‘পল্লী-চিত্র’, ‘সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘উর্দু বাংলা তর্ক”। বইয়ের প্রথম বা নাম- প্রবন্ধ ‘আমাদের দুঃখ’। এটি প্রকাশিত হয় দীপিকা পত্রিকায়। প্রবন্ধে দেশের হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্ম-সম্প্রদায়ের একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস ও বিরুদ্ধ মনোভাবের সমালোচনা করে কাজী আনোয়ারুল কাদীর লিখেছেন, “দেশের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের এই যে মনের ভাব এ ভাবটা কোনোদিন যাবে কিনা তা ঠিক বলা যায় না। তবে এমন ক’রে যে স্বরাজ পাওয়া শক্ত তা সকলেই বুঝছেন। এর প্রতিকার কোথায়?” প্রতিকার যে নেই কিংবা তা খুব দুরূহ, সুদূরপরাহত, লেখক সে-সম্পর্কে সচেতন। বর্ণপ্রথার নামে হিন্দু সমাজের অন্তর্নিহিত দুর্বলতার উল্লেখ করে তাঁর মন্তব্য : “এর জন্য হিন্দুরা নাকাল হয়ে আছে। সুতরাং তাদের ভয় করা মুসলমানদের উচিত নয়।” হিন্দু সমাজের এই জাতিভেদ, লেখকের মতে, এ-ও এমন একটা সমস্যা ‘যার মীমাংসা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবের কাছাকছি’। প্রসঙ্গত শরাফতের নামে মুসলমান সমাজেও এক ধরনের জাতিভেদ প্রথার উদ্ভবের সমালোচনা করেছেন তিনি। বলেছেন এই শরাফতের দাবিদাররা মুসলমান সমাজে স্বাধীন চিন্তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। তারা ভাবে সমাজের জন্য তারা যাকে সঠিক বলে মনে করে সবাইকে তা বুঝতে ও মানতে হবে। আর ‘তা না মানলেই তারা একদম কাফের’। এভাবে সব মুসলমানকে এক ভাবাপন্ন করার, তাদেরকে একছাঁচে গড়ার বিপজ্জনক প্রবণতার সমালোচনা করে আনোয়ারুল কাদীর লিখেছেন :
জগতে দেখতে পাই ফুল ফল গাছ পাতা সব ভিন্ন ভিন্ন রকমের। একই জাত গোলাপ ফুল তার মধ্যে রকমারি। আবার একই গাছের দুটি গোলাপ ফুল ঠিক একরকম নয়। দুটি জীবন্ত চলন্ত চেতনাযুক্ত মানুষ একরকম পাওয়া দায়। আর সমগ্র মুসলমান সমাজের লোকগুলি সব একই রকম হওয়া চাই! হচ্ছে না তবু হওয়াতেই হবে এই যে দুরাশা এতেই খেয়ে সেরেছে মুসলমানকে। লাঠির আঘাতে সব হিন্দু যদি মুসলমান হয়েও যায় তার পরক্ষণেই দেখতে পাওয়া যাবে আবার হিন্দুর বীজ গজিয়ে উঠেছে। আবার সেই দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়েছে। কি হবে হিন্দুকে মুসলমান ক’রে? মানুষ–মানুষ।
ব্যাপক সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য বা অন্ন-বস্ত্রের সমস্যার প্রতি উদাসীন থেকে ধর্ম-সম্প্রদায়গত পরিচয় বা ব্যবধানটিকেই বড় করে দেখা বা তোলার জন্য তিনি নেতাদের সমালোচনা করেছেন।
গ্রন্থের দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘নেতাদের কথা’য়ও কাজী আনোয়ারুল কাদীর প্রকৃত দেশসেবকদের প্রতি হিন্দু বা মুসলমান কোনো একটি সম্প্রদায়ের গণ্ডীতে আবদ্ধ না থেকে সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে তাঁদের দৃষ্টি ও কল্যাণ-ভাবনাকে প্রসারিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। ভবানীপুর ব্রাহ্মসমাজে প্রদত্ত আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের একটি বক্তৃতা পাঠের প্রতিক্রিয়া হিসেবে লেখা এ-প্রবন্ধটি নওরোজ পত্রিকায় (আষাঢ় ১৩৩৪) ছাপা হয়। প্রফুল্ল রায় তাঁর উক্ত ভাষণে হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথার সমালোচনা করতে গিয়ে বাঙলা দেশে মুসলমানদের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য হিন্দুদের এই জাতিভেদ প্রথার কঠোরতাকেই দায়ী করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “শতকরা ৯৯ জন মুসলমান যাহাদের রক্ত হিন্দু ও ভাষা বাংলা–তাহারা আমাদের অত্যাচারে জর্জরিত হইয়া ইস্লামের উদার বক্ষে আশ্রয় লইয়াছে।” প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের এই বক্তব্যকে লেখকের গতানুগতিক ও গণ্ডীবদ্ধ চিন্তার ফল বলে মনে হয়েছে। এ-প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “যদি মুসলমানেরা এদেশে নাই আসত এবং এদেশের কোনো লোক মুসলমান সমাজের ‘উদারবক্ষে’ আশ্রয় না নিত, তা হলেই কি এদেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উৎপত্তির সম্ভাবনাই থাকত না? ইতিহাসের সাক্ষ্য অন্যরূপ। বৌদ্ধ ধৰ্ম্মাবলম্বী ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মাবলম্বীদের সাম্প্রদায়িক মারামারি কাটাকাটি বাদ দিয়েও এদেশে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে আরো বিরোধের কথা শোনা যায়। তা ছাড়া মুসলমানরা এদেশে না এলেও জাতিভেদ জিনিসটার ভেতরে ভেতরে যে সাম্প্রদায়িক বিরোধের বহ্নির আয়োজন সর্বদা বর্তমান একথা অস্বীকার করা এবং মানুষকে মানুষ বলে স্বীকার না করা একই কথা। ইস্লামের ‘উদার বক্ষে’ আশ্রয় নেবার সুযোগ যদি এদেশবাসীরা না পেত, তবে যে সব লোকের জাতিভেদের কঠোরতা সইবার মত শক্তির বা রুচির অভাব তারা অন্য কোনো ‘উদার বক্ষের’ সন্ধান পেত এবং সেখানে আশ্রয় নিত।” সুতরাং ভারতবর্ষের ‘সর্বনাশে’র জন্য মুসলমানদের কথিত ‘উদার বক্ষ’ নাকি পরস্পর পরস্পরের মত সহ্য করতে না পারার মতো অসহিষ্ণুতাই দায়ী, আনোয়ারুল কাদীরের মতে, “সেটা বিশেষভাবে ভেবে দেখা দরকার’! তবে এই অসহিষ্ণুতা আবার কার মধ্যে বেশি সেটা বিচার করতে চাওয়াকেও তাঁর ‘পরাধীনতা-প্রিয়তার চিহ্ন’ বলে মনে হয়েছে। লিখেছেন, “যে সম্প্রদায় বা যে জাতি এই বিষয় বিচার বিতর্কে কাল কাটায়, তারা কোনো বড় কাজ করার যোগ্য নয়।” এবং “একটা গোটা সমাজ বা সম্প্রদায়ের প্রতি কোনো একটা বিশেষ দোষারোপ করা অলস ও অনুর্বর মস্তিষ্কের পরিচায়ক।” পি সি রায়ের মতো দেশের একজন কৃতী ও মহৎপ্রাণ মানুষের মধ্যেও ‘গতানুগতিকতার অনুসরণ করে অন্যান্য পাঁচজন সাধারণের মতো মুসলমানকে অনেকখানি পর করে দেখা’র প্রবণতা লেখককে আহত করেছে। এ-প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য :
ভারতবর্ষের মুসলমানের সংখ্য ‘হিন্দু’র এক তৃতীয়াংশ। সুতরাং ‘হিন্দুই এখানে প্রবল। এই প্রবল অংশ যদি দুর্বল অংশকে পর বলে মনে করে এবং এদেশ ‘হিন্দুর’ই দেশ আর কারো নয় এই কথা সাহিত্যে ও বক্তৃতায় প্রমাণ করতে প্রাণপণ চেষ্টা করে, এক কথায দুর্বল অংশকে বাড়ী ছাড়া করে দেয়, তবে দুর্বল অংশ তো একটা কোথাও তাদের বাড়ী ঠিক করতে চাইবে। যখন এদেশে পেরে উঠছে না তখন কি করা–লাচার হয়েই তারা সমরখন্দ ও বোখারার স্বপ্ন দেখে। এ দেখাটা এতই স্বাভাবিক যে ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া ক’রে যদি তাদের আরো বিব্রত করে তোলা হয় তারা আরো পর হয়ে ওঠে এবং অনেক সময় লাচার ও হতাশ হয়েই যারা তাদের পর বলতে চায় তাদের পর ভাবতে বাধ্য হয়।
অন্যান্য সব ব্যাপারের মতো ধর্মের বেলায়ও পূর্ণ স্বাধীনতা, আধ্যাত্মিক খোরাকের জন্য যে-কোনো ধর্মমত গ্রহণ বা অনুসরণের অধিকারের স্বীকৃতির ওপর লেখক তাঁর এই প্রবন্ধে গুরুত্ব দিয়েছেন।
গ্রন্থের তৃতীয়, সবচেয়ে দীর্ঘ ও মূল্যবান প্রবন্ধ ‘সামাজিক গলদ’। শিখার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশের (চৈত্র ১৩৩৩/ মার্চ-এপ্রিল ১৯২৭) সময় এবং গ্রন্থে প্রবন্ধটি এই শিরোনামেই স্থান পেয়েছে। যদিও আলোচকদের কেউ কেউ কোথাও কোথাও প্রবন্ধটির উল্লেখে ‘বাঙালী মুসলমানের সামাজিক গলদ’ নামটি ব্যবহার করেছেন। আমরা আগেই বলেছি, এই প্রবন্ধটি সমকালে কিছুটা বিতর্ক-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। আমাদের দুঃখ গ্রন্থের আলোচনা করতে গিয়ে কাজী আবদুল ওদুদ অন্যত্র (হানাফী, ১৫ পৌষ ১৩৪১) জানাচ্ছেন, মুসলিম সাহিত্য-সমাজের প্রথম বার্ষিক অধিবেশনে পাঠের সময়ই প্রবন্ধটি ‘শ্রোতৃবর্গকে বিশেষভাবে চমকিত’ করেছিল। তাঁর মতে, ‘মনুষ্যত্বের বোধ লেখকের কত পরিপূর্ণ তারও পরিচয়’ আছে এ-প্রবন্ধে। প্রবন্ধটিতে লেখক একই সঙ্গে মুসলমান সমাজের অনেকগুলো সমস্যা বা গলদ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যার মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ আমরা এখানে করব। প্রবন্ধের শুরুতে ইসলামের মহান শিক্ষা সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ এবং অন্যান্য ধর্ম-সম্প্রদায়ের ওপর তার ইতিবাচক প্রভাবের উল্লেখ ক’রে লেখক প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতের মুসলমান সমাজে এই শিক্ষা কতটা অনুসৃত হচ্ছে? এ ব্যাপারে লেখকের অভিমত হল, “মুসলমান-সমাজ যে রাহুগ্রস্ত অবস্থায় কাল কাটাচ্ছে এ সত্য গোপন করে কোন লাভ হবে না।” আর মুসলমান সমাজের এই অধঃপতিত অবস্থার জন্য তিনি দায়ী করেছেন প্রধানত শিক্ষার প্রতি তার উদাসীনতাকে। লেখকের সমালোচনার ভাষা এখানে খুব কঠোর :
বাংলার মুসলমান-সমাজের বয়স নিতান্ত কম নয়; কিন্তু এই দীর্ঘকালের মধ্যে আমাদের মধ্যে একজন রুসো, একজন পেট্সালট্জী, একজন হারবার্ট স্পেন্সার জন্মান নাই। আমাদের সমাজ একজন রাজা রামমোহন, একজন বিদ্যাসাগর, একজন বঙ্কিমচন্দ্র, একজন পিয়ারীচরণ [য.প্রা.], একজন রামতনু লাহিড়ী, একজন রাজনারায়ণ বসু কি একজন স্যার আশুতোষ তৈরী করতে পারেনি। এর একমাত্র কারণ আমরা শিক্ষা চাই না, আমরা বিদ্যা চাই না, জ্ঞানের মর্য্যাদা বুঝি না, সাহিত্যের আদর করি না, তাই আমাদের মধ্যে বিদ্বান নাই, বৈজ্ঞানিক নাই, সাহিত্যিক দার্শনিক ঐতিহাসিক নাই।
লেখকের মতে, বুদ্ধির মুক্তি না ঘটলে সেখানে প্রকৃত ধর্মভাবও লোপ পায়, মুসলমান সমাজের বেলায় বিশেষভাবে যা লক্ষণীয়। তিনি বলেছেন, “এখন গোঁড়ামিই আমাদের ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।” আর “অর্থহীন কঙ্কালসার সংস্কারের স্তূপ আমাদের উন্নতির পথে অগ্রসর হতে দিচ্ছে না।” ধর্মের ‘সহজ অর্থ’ করার প্রবণতার বিরুদ্ধে মত ব্যক্ত করে তিনি বলেছেন, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পেছনের বা অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটি যদি আমরা বুঝতে ব্যর্থ হই বা আমাদের জীবনে তা সত্য না হয়ে ওঠে, তবে তা শারীরিক কসরৎ বা আত্মনিগ্রহের উপায় মাত্রে পর্যবসিত হয়। ধর্ম সম্পর্কে ‘মোটের ওপর’ তাঁর বক্তব্য, কাজী আনোয়ারুল কাদীর লিখেছেন :
আমাদের প্রিয় পয়গম্বর হজরত রসুলে করিম সাল্লাল্লাহো আলায়হেস্ সালাম ধর্মের যে এমারৎ নির্মাণ রচনা করে গিয়েছেন তা আমরা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছি। তিনি পুতুল ভেঙে যে নিরাকার অথচ চেতনশক্তি আল্লাহতাআলার পূজা করতে বলেছেন তা আমরা ভুলে গিয়েছি। এখন আমরা আবার কতকগুলো অনুশাসনরূপী অর্থহীন পাষাণ প্রতিমার পূজায় নিযুক্ত। এরূপভাবে আমাদের দুর্দশা ঘুচবে না এবং ইসলামকে [আমরা] জীবন্ত রাখতে পারব না। ইসলামকে জীবন্ত রাখার জন্য আমাদের সমাজে যে যে গোঁড়ামি ঢুকেছে তা সমূলে উৎপাটন করতে হবে।
বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যান্য শরিক এমন কি তার বাইরেও মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী প্রমুখ সমকালীন কোনো কোনো লেখকের মতো, কিংবা তাঁর নিজেরও অন্যান্য প্রবন্ধে যেমন তেমনি এ-প্রবন্ধেও কাজী আনোয়ারুল কাদীর মুসলমান সমাজে আশরাফ-আতরাফ ভেদ ও তথাকথিত আভিজাত্য গৌরব বা বংশ পরিচয়ের বড়াইয়ের সমালোচনা ক’রে একে ইসলামের শিক্ষার বিরোধী এবং মুসলমান সমাজের ঐক্য ও অগ্রগতির অন্তরায় বলে বিবেচনা করেছেন। একইভাবে শিয়া-সুন্নি, হানাফি– মোহাম্মদি ‘ঝগড়া’য়ও বাঙলার মুসলমান সমাজ ‘অতিশয় ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
চাকুরি ক্ষেত্রে কনসেশন বা কোটার বিরোধিতা ক’রে আবুল হুসেনের মতো (‘শতকরা পঁয়তাল্লিশ’) তিনিও বলেছেন, এ-ধরনের অনুগ্রহ নীতি অমর্যাদাকর তো বটেই, চূড়ান্তভাবে মুসলমান সমাজের জন্য তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। লিখেছেন, “ঘরের খুঁটি না থাকলে প্যালা দিয়ে কতকাল ঝড় থেকে বাঁচিয়ে রাখা যায়? ওসব কনসেশনে আমাদের মুক্তি নাই। আমাদের নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে শিখতে হবে।” এ-প্রসঙ্গে মুসলমান সমাজকে তিনি জীবিকা সংস্থানের উপায় হিসেবে চাকুরি ভিন্ন অন্য ক্ষেত্র যেমন : কৃষি, ব্যবসা ইত্যাদির প্রতি মনোযোগী হতে বলেছেন।
শিখা গোষ্ঠীর আর সব লেখকের মতো কাজী আনোয়ারুল কাদীরও ভারতবর্ষের তৎকালীন পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টিকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছেন। তাঁর মতে মুসলমান সমাজের আত্মোন্নতির স্বার্থেও প্রতিবেশী হিন্দুদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা তাদের জন্য জরুরি। মসজিদের সামনে বাজনা বাজানো কিংবা গরু কোরবানিতে আপত্তির মতো বিষয়গুলো নিয়ে ‘বাড়াবাড়ি’ বা তাকে সমষ্টিগত হারজিতের বিষয় করে তোলার বিরুদ্ধে তিনি তাঁর মত ব্যক্ত করেছেন। দয়া কিংবা বাহুবল কোনোটিই যে বাঁচা বা জেতার সঠিক পথ নয়, সে ব্যাপারে বাঙলার মুসলমান সমাজকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে তাঁর মন্তব্য : “লাঠি ছোঁড়া তরবারি এমনকি গোলাগুলির সাহায্যে যে-জয় সে টেঁকে না একথা আমাদের (মুসলমানদের) অনেক পূর্বে বোঝা উচিত ছিল। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় যে মুসলমান এ সবের কোনোটা বাদ দেয় নাই। বাদশাহ্রদের হুকুমে দেশে দেশে রক্তের গঙ্গা প্রবাহিত হয়েছে; আর্তের আর্তনাদে গগনমণ্ডল প্লাবিত হয়েছে। কিন্তু কৈ সে প্রতাপ? কোথায় আজ সে হীরামুক্তা মণি-মাণিক্যের ঘটা; কোথায় আজ সে দিল্লীশ্বরোবা জগদীশ্বরোবা!” বলা বাহুল্য এ ধরনের বক্তব্য হারানো শাহী-দিনের স্মৃতি-স্বপ্নে-বুঁদ মুসলমান সমাজের অনেকের কাছে সেদিন বিশেষ প্রীতিকর না ঠেকেনি।
‘সামাজিক গলদ’ প্রবন্ধে মুসলমানদের পারিবারিক জীবনের সমালোচনা করে আনোয়ারুল কাদীর লিখেছেন, “এক একটি পরিবার যেন এক একটি জমাট নিরানন্দের পাহাড়।” ছেলেমেয়েদের অতিরিক্ত শাসনের–তাদের আদর-ভালোবাসা দিয়ে পড়ানোর বদলে প্রহার-প্রবণতার উল্লেখ করে লিখেছেন, “এত মার মুসলমান ছেলেরা খায় যে তা ভাবলে তাদের জীবনটা যে চোর ডাকাতের (criminal) মত হবে না এ আশা করা অন্যায়। সন্তানের প্রতি এমন নির্মম ব্যবহার অন্য কোন জাতের লোক করে বলে আমার ধারণা নাই।” ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর ব্যাপারেও তাদের ‘কিছু স্বাধীনতা’ দেয়া দরকার বলে তিনি মত ব্যক্ত করেছেন। প্রসঙ্গত সমাজে চিন্তার স্বাধীনতা ও সহনশীলতার পরিবেশ সৃষ্টির আবশ্যকতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন : “নিজের জন্য নিজের ভাববার অধিকার মানুষকে দিতে হবে। বুদ্ধির মুক্তি দরকার। কেবল বিধি-নিষেধের স্তূপের চাপে কাহিল থাকলে বুদ্ধির মুক্তির সম্ভাবনা নাই। কেবল Authority-র দোহাই দিয়ে বা কেতাবের উপর নির্ভর করে চললে আমাদের উন্নতি হবে না।” তাঁর আগের বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করে বলেছেন, কেতাব পড়াই যথেষ্ট নয়, তার অর্থ বের করতে হবে। আর অর্থ মানে এখানে ‘সহজ অর্থ’ নয়, “নিজের জীবনের মধ্যে কেতাবের বাণীর অর্থ খুঁজতে হবে। এটুকু স্বাধীনতা দিতে হবে। সমাজকে তা সহ্য করার মত উদারতা (Toleration) শিখতে হবে। না হলে ফল এই দাঁড়াবে যে আমরা মিথ্যাবাদী বা কপটচারী হব, অথবা সমাজচ্যুত হব। সমাজচ্যুত হওয়া বরং ভাল তবু মিথ্যাবাদী বা কপটচারী হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।”
আমাদের দুঃখ গ্রন্থের চতুর্থ প্রবন্ধ ‘শিক্ষিতা নারীর বিবাহ’। এটি প্রকাশিত হয় বুলবুল পত্রিকায়। এ প্রবন্ধে আনোয়ারুল কাদীর শিক্ষিতা নারীদের প্রতি মুসলমান সমাজের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি–অবহেলা বা উদাসীনতার মনোভাব–তাদের স্ত্রী ও পুত্রবধূ রূপে গ্রহণের ব্যাপারে শিক্ষিত পুরুষ ও তাদের অভিভাবকদের অনীহার বিষয়টি উল্লেখ করে একে মুসলমান সমাজে নারীশিক্ষার প্রসার ও নারী প্রগতির পথে একটি বড় অন্তরায় বলে বিবেচনা করেছেন। এ ব্যাপারে সমাজের শিক্ষিত অংশের দ্বিচারিতা বা ভণ্ডামির প্রতি ইঙ্গিত করে তাঁর মন্তব্য : “স্ত্রী-শিক্ষা ও স্ত্রী-স্বাধীনতার কথা আমরা সব সময়ে বলি; কিন্তু শিক্ষিতা নারীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা বেড়েছে বলে আমার তো মনে হয় না।” প্রসঙ্গক্রমে লেখক এ-প্রবন্ধে কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। আপাত বিরোধী বিভিন্ন আইডিয়া (যেমন সত্যবাদী ও প্রিয়ভাষী হওয়া) একজন আদর্শবাদী মানুষের জন্য যে-সঙ্কটের সৃষ্টি করে তার উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, “দুঃখের বিষয় সমাজ, ধর্ম এবং আইন এসব সমস্যা বা দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে ফেলার জন্য কোনো পরিষ্কার Formula (সূত্র) দিতে পারে নাই।” নারীর সতীত্বের ধারণাটিকেও তিনি এই বাস্তবতার আলোকেই বিচার করতে চেয়েছেন। আর সে- বিচারে মানসিক সতীত্বকে তিনি শারীরিক সতীত্বের চেয়ে বেশি মূল্য দিয়েছেন। প্রত্যাখ্যান করেছেন উৎকট সতীত্বের ধারণাকে, যা তাঁর মতে একটি খেয়াল বা মোহ বৈ কিছু নয়। আর এর দ্বারা প্রকারান্তরে সমাজে নারী-নিগ্রহের নিষ্ঠুরতাকেই প্রশ্রয় দেয়া হয়।
গ্রন্থের পঞ্চম প্রবন্ধ ‘জাতীয় সমস্যা’য় আনোয়ারুল কাদীর সমসাময়িক ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে হিন্দু-মুসলমান বিরোধের কুফল নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ-প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ‘নব্যবাংলা’ নামক একটি পত্রিকায়। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প কীভাবে মানুষের মনকে আক্রান্ত, তার দৃষ্টিভঙ্গিকে কলুষিত করে তার দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বলেছেন, “কোনো কাজ ভালো কি মন্দ তার বিচার করবার জন্য আমাদের মাপকাঠি হয়েছে হিন্দু করেছে না মুসলমান করেছে। হিন্দু নিক্তিতে ওজন করে মুসলমানের চরিত্রের বিচার করছে, অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে মুসলমানের দোষত্রুটীর সন্ধান করছে, মুসলমান ‘বিষে বিষক্ষয়’ নীতি অবলম্বন করে আকাশে বাতাসে বিষ মাখিয়ে দিচ্ছে।” ইতিপূর্বে তাঁর ‘আমাদের দুঃখ’ ও ‘নেতাদের কথা’ প্রবন্ধে যেমন তেমনি এ-প্রবন্ধেও লেখক দেশের মানুষকে ‘হিন্দু’ ও ‘মুসলমান’ পরিচয়ে বিভক্ত করে দেখার প্রবণতার সমালোচনা করেছেন। প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথও যে এই পরিচয়টিকে ‘রাষ্ট্রিক মহাজাতি’ গঠনের পথে একটি বড় বাধা হিসেবে গণ্য করেছেন, তার উল্লেখ করে তিনি জানিয়েছেন, ‘হৃদয়হীন হিন্দু-মুসলমানে’র প্রাণে তা কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি। কাজী আনোয়ারুল কাদীরের মতে, “এই দুটি কথা [‘হিন্দু-মুসলমান’- মোশহা] আমাদিগকে [য.প্রা.] এতই মোহাচ্ছন্ন করেছে যে আমাদের মনুষ্যত্ব সত্যিই ক্ষুণ্ণ হয়েছে কিনা ভেবে দেখা দরকার।” এ-প্রসঙ্গে তাঁর আরও মন্তব্য : “যাঁরা গর্বিত এবং গোঁড়া, তাঁরা হয়তো জানেনই না যে, তাঁরা কি পরিমাণে মোহাচ্ছন্ন। মোহাচ্ছন্ন জনের সবচেয়ে বড় শাস্তিই এই যে, তাঁরা তাঁদের পাপ সম্বন্ধে অন্ধ। আমাদের দেশের অনেক শিক্ষাভিমানী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যে রকম ভ্রান্ত ও সাম্প্রদায়িক-মনোভাবাপন্ন, তাতে সত্যিই হতাশ হতে হয়।” এই সাম্প্রদায়িক বিরোধ-বিদ্বেষের জন্য হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত লোকদের একে অপরকে দায়ী করার প্রবণতার উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, “হয়তো এ ব্যাপারে কেউ কারো চেয়ে কম দায়ী নয়।” এমন কি সাম্প্রদায়িক সংঘাত যে ভারতবর্ষে কোনো নতুন বা ‘আধুনিক’ ব্যাপার নয়, সুদূর অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে (লেখক তার উদাহরণও দিয়েছেন), সে-সম্পর্কে সচেতন থেকেও তিনি বলেছেন, প্রকৃত ধর্ম পালনের পরিবর্তে ধর্মের নামে এই ‘আস্ফালন’ বা বাড়াবাড়ি পরিহার করতে হবে। যেহেতু ‘অবজ্ঞার মধ্যে, বিচ্ছেদের মধ্যে, বিদ্বেষের মধ্যে কল্যাণ নেই’; ‘আত্মাভিমান বা জাত্যাভিমানের মধ্যে মিলন ও প্রীতি নেই”। এবং “মুসলমানের টুপি বা হিন্দুর টীকিতে মানবতার বিকাশ সাধিত হয় এমন ধারণা যত শীগির আমাদের মন থেকে দূর হয় ততই মঙ্গল
লেখকের মতে বাঙালির মননশক্তি ও সৃষ্টিপ্রতিভা কেবল কথাসাহিত্যেই, অর্থাৎ চিত্র রচনা ও চরিত্র বিশে-ষণেই, তার সার্থকতা খুঁজে পায়। দেশবাসীর দারিদ্র্য দূর কিংবা সমাজের দুর্দশা মোচনে তা কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি। এ থেকে লেখকের মনে হয়েছে, এদেশটি যেন ‘শুধু কথারই দেশ, কাজের দেশ আদৌ নয়’। সমাজের শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত অংশটির সীমাহীন অর্থলোভ, পদ ও প্রতিষ্ঠার মোহ, স্বার্থপরতা, পরশ্রীকাতরতা, সর্বোপরি সততার অভাব ও দায়িত্বহীনতা দেশকে সঙ্কটের যে-অতলে নিক্ষেপ করেছে তা থেকে সহজ বা আশু উদ্ধারের কোনো সম্ভাবনাই লেখক দেখতে পাননি। বিশেষ করে আমলা বা সরকারি কর্মচারীদের ভূমিকা সম্পর্কে সেদিন তিনি যা বলেছেন, সুদীর্ঘ কালের ব্যবধানে ও দু-দুটি ঔপনিবেশিক পর্বের অবসানে, আজও কি তা আমাদের জন্য এক চরম বাস্তবতা নয়? প্রবন্ধটি থেকে সরাসরি উদ্ধৃত করা যাক :
সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে পুলিশের দুর্নাম তো আছেই, কিন্তু কোন বিভাগে যে সমস্ত বিষয় বিচার ইত্যাদির মর্যাদা রক্ষা হয় তা বিচার করতে গেলে চিত্ত বিকল হ’য়ে যায়। তোষামোদ সুপারিশ উপঢৌকন এমন কি উৎকোচ চলে না এমন কোনো সরকারী বিভাগ আছে কিনা খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। দেশের এই দুর্দিনে সরকারী কর্মচারীদের হৃদয়হীনতা অশান্তি নিবারণ না করে বাড়িয়েই চলেছে। এসব সরকারী কর্মচারীদের প্রতিপত্তি দেখে বিন্তি খেলায় রঙের গোলামের মানের কথা মনে পড়ে।
লেখকের আরও মন্তব্য : “সেবক যখন শাসকের স্থান অধিকার করে তখন শাসন শোষণে পরিণত হয়। আমাদের দেশে তাই ঘটেছে। এমন নির্বিঘ্নে শোষণের ব্যবস্থা ও অধিকার অন্য কোথাও নাই।”
মানুষের ‘সবচেয়ে বড় অধর্ম’ যে কর্মে অপ্রবৃত্তি, তারই প্রকাশ লেখক দেখতে পেয়েছেন হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই যৌবনে চাকুরির ও বার্ধক্যে বৈরাগ্যের প্রতি আকর্ষণে। প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি দেশবাসীর প্রতি এই চাকুরি ও miracle- এর মোহ এবং ঘৃণা, বিদ্বেষ ও জাত্যাভিমান ছেড়ে জ্ঞানে, প্রেমে ও কর্মে বড় হবার আহ্বান জানিয়েছেন।
গ্রন্থভুক্ত ষষ্ঠ রচনার নাম ‘পল্লী-চিত্র’। একে অবশ্য প্রবন্ধ বলা যাবে না। ‘বাঙালি মুসলমানের অর্থসমস্যা’ শিরোনামে জয়তী পত্রিকায় (চৈত্র ১৩৩৭) প্রকাশিত এ- রচনাটিতে লেখক তাঁর একদিনের পল্লী ভ্রমণের একটি খণ্ড স্মৃতি তুলে ধরে তার মাধ্যমে গ্রাম-বাঙলার মুসলমান সমাজের দুর্দশার প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণে প্রয়াসী হয়েছেন। ভূমিকায় লেখকের মন্তব্যটুকু আমরা এখানে তুলে ধরতে পারি :
মুসলমান-সমাজের অর্থ-সমস্যা ক্রমেই জটিলতর হইয়া উঠিতেছে। এ-সত্য আবিষ্কার করিবার জন্য শিক্ষিত অভাবমুক্ত প্রসন্নচিত্ত মুসলমানের বুকে কোন বেদনার সঞ্চার হইতেছে কিনা জানি না। তবে একথা নিঃসংশয়ে বলা চলে যে, পেটের ক্ষুধা পেটেই বহিয়া আজও লক্ষ লক্ষ মুসলমান বেহেশতে যাইবার আশায় মসজিদ নির্মাণ মেরামত ইত্যাদির চাঁদা, ওয়ায়েজ মওলানার রাস্তা-খরচ, মাদ্রাসা-মক্তবের চাঁদা, ফকীরের ভিক্ষা ইত্যাদি অকাতরে দান করে। এই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দোজখের ভয় কত বড় তাহা আজিকার জড়বাদী জগতের পক্ষে উপলব্ধি করা একেবারে মুস্কিল ব্যাপার। কিন্তু বড় দুঃখ লাগে যে, সমাজ নেতারা যে পরিমাণ দোজখের ভয় দেখাইয়া এই সব নিঃস্ব-সন্তানগণকে শাসন করিতে সর্বদা যত্নবান, ইহাদের সাংসারিক জীবনের ব্যর্থতার প্রতিকারের ব্যবস্থা করিবার জন্য তেমন উদ্যোগী নহেন।
বইয়ের সপ্তম প্রবন্ধ ‘সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা’। নাম থেকেই অনুমান করা যায় এই প্রবন্ধে লেখক সমকালের একটি বহুল-আলোচিত বিষয় বা প্রসঙ্গ– বাংলা সাহিত্যে সাম্প্রদায়িক সমদর্শিতার অভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ-প্রবন্ধটিও জয়তী-তে (ভাদ্র ১৩৩৭) প্রকাশিত হয়। গোড়াতেই কাজী আনোয়ারুল কাদীর হিন্দু লেখকদের সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের প্রতি সুবিচার না-করার প্রচলিত অভিযোগের যথার্থতা মোটের ওপর স্বীকার করে নিয়ে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সমস্যা বা বিরোধের জন্য “বাংলা সাহিত্যও অনেকখানি দায়ী’ বলে মত প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “আমাদের সাহিত্যে যেখানে হিন্দু মুসলমান উভয়কে আঁকা হয়েছে সেখানে হিন্দুকে শুধু হিন্দু বলেই বড় করার চেষ্টা হয়েছে। বাঙ্গালী জাতির কল্যাণকে উদ্দেশ্য করে আমাদের সাহিত্য গড়ে ওঠেনি। এ ব্যাপারটা যদি পুস্তক বিশেষে বা লেখক বিশেষে আবদ্ধ থাকত তা হলে হয়ত বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি ছিল না। কিন্তু নানা কারণে মুসলমানের মনে হয় যে, ধারাবাহিকভাবেই মুসলমানের প্রতি অবিচার করা হয়েছে।” সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষবিষ কীভাবে সাহিত্যিকেরও দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তার প্রভাবে আদর্শবাদও কতটা খর্ব হয়, অন্যায়কেও কীভাবে যৌক্তিকতা দেওয়া হয় তার দৃষ্টান্ত হিসেবে আনোয়ারুল কাদীর তাঁর এ-প্রবন্ধে বাংলা সাহিত্যে শিবাজী চরিত্র অঙ্কনের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন :
যত বড় কারণই থাক না কেন, যা পাপ তা পাপই, আর কিছু নয়। অসহিষ্ণু মানুষ তার সমস্ত যুক্তিতর্ক দিয়ে নিজকৃত পাপকে ঢাকতে চাইলেই পাপ পুণ্যে পরিণত হবে না। আবার অনেক সময় দেখা যায় যে, যে জিনিষটি একজনের বেলায় ধর্ম-সাম্রাজ্য স্থাপন, ঠিক সেই জিনিষটি লোক-বিশেষের বেলায় রাজ্য-বিস্তার লালসা।
শিবাজী নিশ্চয়ই একজন বুদ্ধিমান ও অসাধারণ লোক ছিলেন, সেই মুক্তিকামী বীরকে দেবতার আসন দিতে কারও আপত্তি না থাকাই উচিত; কিন্তু আওরঙ্গজেবের মত বিরাট শক্তিশালী সম্রাটের খর্বতার ভিত্তির উপর সেই দেবত্বের প্রতিষ্ঠা হওয়ায় শিবাজীর দেবত্বও কি খর্ব হয়ে যায় নি? তা ছাড়া শিবাজী-চরিত্র অঙ্কনে যে পক্ষপাতিত্ব দেখান হয়েছে তাই কি তাঁকে ম্লান করে দেয়নি?
কিছু মহৎ ও প্রশসংনীয় ব্যতিক্রম বাদে, সাধারণভাবে বাংলা সাহিত্যে মুসলমান চরিত্রচিত্রণে সমদৃষ্টির অভাবের উল্লেখ করে কাজী আনোয়ারুল কাদীরের আরও কিছু মন্তব্যও এ-প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য :
সাহিত্যে অনেক স্থানে দেখা যায় যে, যেখানে মুসলমান ক্ষমা করেছে সেখানে সে হীনবীর্য কাপুরুষ, যেখানে সে নিজের জিদ বজায় রাখতে চেষ্টা করেছে সেখানে সে নিষ্ঠুর অত্যাচারী ম্লেচ্ছ। মুসলমানের বীর্যের নাম দাম্ভিকতা, তার শক্তির নাম গুণ্ডামি, তার দয়ার নাম ভণ্ডামি, তার ক্ষমার নাম কাপুরুষতা, তার প্রেমের নাম কামলিপ্সা, এ যে তার পক্ষে অতি বড় কঠিন পরীক্ষা!
হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির স্বার্থে তিনি বাংলা সাহিত্যে এই সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতের অবসান ঘটিয়ে সমদর্শী মনোভাব বা চিন্তাচেতনার প্রসার ঘটানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। আর তার জন্য একদল শক্তিমান লেখকের আবির্ভাব কামনা করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতিবিশারদ আত্মপরায়ণ হিন্দু বা মুসলমান সাহিত্যিকের দ্বারা সে-কাজটি হবে না। এর জন্য দরকার ‘প্রকৃত সত্যসন্ধ উদার মানবপ্রেমিক’ সাহিত্যিকের। আমাদের দুঃখ গ্রন্থের নাম-প্রবন্ধে তিনি যে বলেছেন ‘মানুষ–মানুষ’, জাতি-ধর্ম-বর্ণ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে মানুষের এই মূল পরিচয়টিকেই বড় করে তুলে ধরতে চেয়েছেন আনোয়ারুল কাদীর ও তাঁর বুদ্ধিমুক্তি আন্দোলনের সহযাত্রীরা। ‘সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা’ প্রবন্ধে তাঁর প্রার্থনা : ‘হিন্দু-মুসলমান সবাই যেন পূর্ণ প্রস্ফুটিত মানুষ হতে সক্ষম হয়।’
গ্রন্থের সর্বশেষ প্রবন্ধ ‘উর্দু বাংলা তর্ক’। এটি মুসলিম সাহিত্য-সমাজের নবম বার্ষিক অধিবেশনে (চৈত্র ১৩৪১) পঠিত হয়। তখন অবশ্য রচনাটির শিরোনাম ছিল ‘আমাদের মাতৃভাষা’। বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সঙ্কট তথা আপন মাতৃভাষা নিয়ে তার দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পরিচয় দিতে গিয়ে লেখক প্রবন্ধের শুরুতেই এ-প্রসঙ্গে মুসলমান সমাজের নানা অংশের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে ভাষা নিয়ে এই বিতর্কের ফলে বাঙালি মুসলমানের ভাষা ও চিন্তাচর্চা দুইই ব্যাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর এর জন্য তিনি দায়ী করেছেন মুসলমান সমাজের নেতাদের দায়িত্বহীনতা ও অদূরদর্শিতাকে। কাজী আনোয়ারুল কাদীর লিখেছেন :
বাঙ্গালী মুসলমানদের যাঁরা পথপ্রদর্শক, যাঁরা উর্দু ও বাংলা নিয়ে তর্ক করছেন, তাঁরা কয়েক কোটী মানব-সন্তানের চিন্তাশক্তির বিষয় না ভেবে শুধু ভাষার জাতি-বিচারে ব্যস্ত। তাঁরা ভাবের আদান-প্রদানই যে ভাষার মূল উদ্দেশ্য একথা ভুলে যাচ্ছেন। তাতে ক’রে অসুবিধে হচ্ছে–কয়েক কোটি মানব-সন্তানের হৃদয়ের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার গতিরোধ হচ্ছে।
বাঙালি মুসলমানের দারিদ্র্যের জন্যও লেখক ভাষা নিয়ে তাঁর এই দ্বিধান্বিত মনোভাব বা হীনম্মন্যতাকেই দায়ী করেছেন। কারণ “যে জাতির ভাষা নেই তার ভাববার শক্তিও নেই–আর ভাববার শক্তি না থাকলে একটি জাতি দরিদ্র তো হবেই।” ভাষার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সৃষ্ট শ্রেণীবিভাজন এবং এই বিতর্ককে জিইয়ে রাখা, কিংবা অন্যভাবে বললে, ব্যাপক সাধারণ মানুষকে তার ভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পেছনে কায়েমী স্বার্থের ভূমিকা শনাক্ত করে লেখকের মন্তব্যও এখানে প্রণিধানযোগ্য :
এবং
বাঙ্গালী মুসলমানের ঘরে অন্নের অভাব। ক্ষুধার জ্বালায় সে একান্ত কাতর। কিন্তু তাকে যে উর্দুতে কাঁদতে হবে–উর্দুতে তার নালিশ ব্যক্ত করতে হবে। সুতরাং তার কান্নারও পথ বন্ধ, নালিশ করবারও ক্ষমতা নেই। সঙ্গে সঙ্গে ভাববারও ক্ষমতা নেই। …এই তর্কের ফলে বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ ঘটে গেছে : যাঁরা উর্দুর পক্ষে তাঁরা সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর এবং যারা উর্দুর বিপক্ষে তারা ইতর। সচ্ছল অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গালী মুসলমান বাঙ্গালী বলে পরিচয় দিতে এবং বাংলা ভাষায় কথা বলতেও ঘৃণা বোধ করতে আরম্ভ করেন এবং কোন সুদূর অতীতে কোন সুদূর বিদেশ থেকে তাঁদের এদেশে আগমন হয়েছিল, তার ইতিহাস এবং তাতে করে যে তাঁদের মাতৃভাষা উর্দু তারই প্রমাণাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে শ্রেণীবিভাগ বেশ দৃঢ় হয়ে গেছে।
ভাষার ব্যাপারে এই হীনম্মন্যতা, ভাষার ভিত্তিতে শ্রেণী বিভাজন, এর অভিশাপ থেকে কি আমরা আজও মুক্ত হতে পেরেছি? হয়তো সেদিনকার উর্দুর স্থান আজ দখল করেছে ইংরেজি। ধর্মের জায়গা নিয়েছে বিশ্বায়নের দোহাই। আনোয়ারুল কাদীরের মতো লেখক-চিন্তকরা তাই আজও আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক।
আমাদের দুঃখ-এর অন্তর্ভুক্ত উল্লিখিত রচনাগুলি ছাড়াও আমরা আনোয়ারুল কাদীরের আরও অন্তত তিনটি প্রবন্ধের কথা জানতে পারি। সমসাময়িক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এ-প্রবন্ধগুলো হল ‘ইংরেজি সাহিত্যে রোমান্টিক যুগ’ (শিখা, ১৩৩৫ ও জাগরণ, কার্তিক ১৩৩৫), ‘বাইরণ’ (জয়তী, কার্তিক-পৌষ ১৩৩৮) এবং ‘বাংলা, উর্দু ও বাঙালী মুসলমান’ (বুলবুল, মাঘ-চৈত্র ১৩৪১)। এর মধ্যে শেষোক্ত প্রবন্ধটির সঙ্গে লেখকের আমাদের দুঃখ গ্রন্থভুক্ত ‘উর্দু বাংলা তর্ক’ প্রবন্ধের বিষয় ও বক্তব্যগত মিল রয়েছে। প্রবন্ধটিতে লেখক বাঙলার মুসলমানদের প্রতি সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর দেশবাসীর কল্যাণ ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি, বাংলাই যে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা সে-সম্পর্কে দ্বিধামুক্ত অবস্থান থেকে জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন।
কাজী আনোয়ারুল কাদীরের রচনার বৈশিষ্ট্য হল তাঁর সরল নিরাভরণ ভাষারীতি। বক্তব্যকে তিনি পাঠকের কাছে সরাসরি পৌঁছে দিতে চান। যে-কারণে বাক্য নির্মাণ বা শব্দ ব্যবহারে কোথাও তিনি সাহিত্যিকসুলভ কলাকৌশলের আশ্রয় নেননি। ফলে আপাতদৃষ্টে তাঁর রচনাকে অনেক সময় শাদামাটা বা ঔজ্জ্বল্যহীন মনে হতে পারে। যদিও তাঁর মনন বা চিন্তাশক্তির ধার প্রতিটি রচনাকেই এক ধরনের দীপ্তি দিয়েছে। লেখক হিসেবে তিনি মোটের ওপর নম্রভাষী, সমালোচনার বেলায়ও কোথাও অধিক আক্রমণাত্মক বা বিদ্রূপ-প্রবণ নন। যেহেতু তিনি মনে করেন, “কোনো তীব্র মন্তব্যের দ্বারা দেশের মঙ্গলের আশা করা বিড়ম্বনা।” (‘সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা’) সমাজ-সংস্কার তিনি চান, তবে সমাজের একজন হিসেবে সহানুভূতিশীল মন নিয়ে সমাজের দোষত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে সে-কাজটি করাই যেন তাঁর অভিপ্রেত প্রাবন্ধিক আনোয়ারুল কাদিরের সঙ্গে সেভাবে পরিচয় না থাকলেও, অন্য একভাবে হয়তো আমরা তাঁর নামটির সঙ্গে পরিচিত। প্রতিষ্ঠিত ধারণা এই, কাজী ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহ (১৯৩৩) উপন্যাসের শেষ এগারটি পরিচ্ছেদ তাঁর রচনা। ইমদাদুল হক উপন্যাসটি শেষ করে যেতে পারেননি, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই খসড়া অবলম্বনে কাজী আনোয়ারুল কাদীর উপন্যাসটি শেষ করেন। আবুল ফজল অবশ্য মনে করেন, আনোয়ারুল কাদীর নন, আবদুল্লাহ-র ওই শেষ এগারটি পরিচ্ছেদের রচয়িতা আসলে কবি শাহাদৎ হোসেন। তাঁর এই অভিমতের ভিত্তি হল দি মুসলমান পত্রিকার সম্পাদক মৌলবি মুজিবুর রহমানের ভ্রাতুষ্পুত্র মোহাম্মদ আবদুল ওদুদের একটি চিঠি। পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় উপন্যাসটি উক্ত পত্রিকারই প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। তবে কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন ও আবদুল কাদিরের মতো বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্য সহযোগীরা আবদুল্লাহ উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদগুলো রচনার কৃতিত্ব কাজী আনোয়ারুল কাদীরকেই দিতে চেয়েছেন। প্রকাশের আগে শাহাদৎ হোসেন সম্ভবত পুরো উপন্যাসটি বা তার ওই শেষাংশটুকু সম্পাদনা করেন। উপন্যাসের শেষ অংশটুকুর ভাষা ও রচনাশৈলী বিচারে কাজী ইমদাদুল হকের রচনার সঙ্গে এর সুস্পষ্ট পার্থক্যই যে কেবল ধরা পড়ে তা নয়। কাজী আনোয়ারুল কাদীরের মানস-প্রবণতা ও রচনারীতির সঙ্গে এর মিলও আমরা লক্ষ করি।
মোরশেদ শফিউল হাসান
মুখবন্ধ
শ্রদ্ধেয় আনোয়ারুল কাদীর সাহেবের ‘আমাদের দুঃখ’ বাংলার গুণী-সমাজে নিবেদিত হলো। তাঁর অবসর কম, তাই মুখবন্ধ-স্বরূপ দুই একটি কথা লিখে দেবার ভার আমার উপরে পড়েছে।
বইখানি সম্বন্ধে এক দীর্ঘ ভূমিকা অশোভন হতো না। কিন্তু আমার তাতে অক্ষমতা প্রধানতঃ এই কারণে যে, আমরা সহকর্মী–একালের মুসলমান বাঙালীদের ভিতরে যে ক্ষুদ্র দলটি অনুভব করছেন যে দেশের লোকদের কাছে বলবার মতো দুই একটি কথা তাঁদের অন্তরে জমেছে আমাদের সাধারণ পরিচয় সেই দলভুক্ত ব’লে। তাই শুধু প্রার্থনা এই ‘দুঃখ’ দেশের গুণীসমাজের কাছে তার প্রাপ্য মর্যাদা লাভ করুক।
আবর্জনা যাঁরা দূর করতে যান তাঁদের বসন সাধারণতঃ শুভ্র শুচি থাকে না। এঁর ‘সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা’ লেখাটির অপ্রিয় আলোচনা দুই একখানি সাময়িক পত্রে চোখে পড়েছে। এইবার পুস্তকাকারে এঁর অনেকগুলো রচনা পাঠকরা একসঙ্গে পাচ্ছেন, তাই এবার ধীরতর বিচার সহজেই আশা করা যায়। আমার বিশ্বাস পাঠকরা এ বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত হবেন যে কোনো কোনো বিষয়ে এঁর সঙ্গে মতান্তর হতে পারে, কিন্তু মনান্তর কখনো নয়।
অবশ্য চিন্তা-চর্চার ক্ষেত্রে এ একটি নগণ্য কথা। কিন্তু দেশের আজ এমনই দুর্দিন যে তার শিক্ষিত সন্তানদের সামনেও এই ধরনের কথার অবতারণা করতে হয়।
কাজী আবদুল ওদুদ
ঢাকা–২২শে জুন, ১৯৩৪
Leave a Reply