আমাজনিয়া – জেমস রোলিন্স
অ্যামাজনিয়া – জেমস রোলিন্স
অনুবাদ : রাকিব হাসান
.
মুখবন্ধ
২৫শে জুলাই, সন্ধ্যা ৬টা ২৪ মিনিট
আমেরেন্ডিয়ানের একটি মিশনারি গ্রাম
আমাজন, ব্রাজিল
আগন্তুকটি জঙ্গলে হোঁচট খাওয়ার সময় পাদ্রি গার্সিয়া লুই বাতিস্তাকে তার মিশনের বাগানের আগাছাগুলো নিড়ানী দিয়ে উপড়ে ফেলতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছিল। আগন্তুকের পরনে একটি কালো রঙের হেঁড়া জিন্সের প্যান্ট ছাড়া আর কিছুই নেই। এমনকি নগ্ন বুকের লোকটার পায়ে নেই কোন জুতো। কাসাবা গাছের লতায় পা জড়িয়ে উপুর হয়ে পড়ে গেল সে। লোকটার রোদেপোড়া ফর্সা ত্বকে নীল ও গাঢ়-লাল রঙের ট্যাটু আঁকা। তাকে ভুলবশত স্থানীয় ইয়ানোমামা ইন্ডিয়ান গোত্রের লোক ভেবে পাদ্রি বাতিস্তা স্থানীয় ইন্ডিয়ান ভাষায় স্বাগত জানিয়ে বললাম, এও শরি। ওয়াও-ওয়ের মিশনারিতে তোমাকে স্বাগতম, বন্ধু। আগন্তুক মুখ তুলে তাকাতেই গার্সিয়া তার ভুল বুঝতে পারলো। লোকটার চোখ গাঢ় নীল রঙের, সাধারণত কোন আমাজোনিয় গোত্রের মানুষের। মধ্যে এটা দেখা যায় না। মুখের দাড়িগুলো কালো এবং স্নছাড়া। নিশ্চিতভাবেই লোকটি একজন শ্বেতাঙ্গ।
বেমভিন্দ, বলল সে। তার ধারণা লোকটা উপকুলীয় অঞ্চলের সাধারণ কৃষকশ্রেণীর কেউ হবে হয়তো, যে তুলনামূলক ভাল জীবন ও নতুন বসতির খোঁজে ঝুঁকি নিয়ে আমাজনে ঢুকেছে। “তোমায় এখানে স্বাগতম, বন্ধু।”
বেচারা যে অনেক দিন জঙ্গলে ছিল তা সহজেই বোঝা যায়। তার হাঁড়ের উপরে শুধু চামড়া আর প্রত্যেকটা অস্থি দৃশ্যমান। কালো কোঁকড়ানো চুলের লোকটির সমস্ত শরীরে অনেক ক্ষত, সে-সব জায়গা দিয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। ক্ষতস্থানের রক্ত মাছিদের খাবারে পরিণত হওয়ায় মাছিরা আগন্তুকের চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে ঝাঁক বেধে আগন্তুক যখন কথা বলতে চাইলো তখন নো-ফাটা ঠোঁটে টান লেগে তাজা রক্ত বেরিয়ে চিবুকে গড়িয়ে পড়লো। হামাগুড়ি দিয়ে গার্সিয়ার দিকে কিছুটা এগিয়ে গেল সে, মিনতিভরে একটা হাত উঁচু করলো। যদিও তার কথাগুলো বেশ জড়ানো আর অস্পষ্ট। লোকটাকে প্রথমে পাশ। কাটিয়ে চলে যেতে চাইল গার্সিয়া কিন্তু তার প্রার্থনার ভঙ্গি তাকে যেতে দিলো না। নিবেদিতপ্রাণ পাদ্রি উপেক্ষা করতে পারলো না এই খেয়ালী আগম্ভককে। সে কুজো হয়ে আগন্তুকের পায়ের কাছে বসে তাকে কোলে নিতেই বুঝতে পারলো সে কতটা ওজন হারিয়েছে। একটা শিশুর ওজন থেকে বেশি হবে না। প্রচণ্ড জ্বরে পোড়া লোকটির শরীরের তাপ পাদ্রি অনুভব করতে পারলো, এমনকি তার পরনে জামা থাকা সত্ত্বেও।
এসো, সূর্যের তাপ থেকে তোমায় ভিতরে নিয়ে যাই।
গার্সিয়া লোকটাকে মিশনের চার্চের দিকে নিয়ে গেল যেটার সাদা চুনের রাস্তা পাহাড়ের গা বেয়ে সরু হতে হতে যেন নীল আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। বিল্ডিঙের অপর। পাশে কিছু কাঠের বাড়ি আর গুটিকয়েক পামপাতার ছাউনি দেয়া কুড়েঘরও আছে। ছন্নছাড়া গোছর কিছু মানুষ জঙ্গলের বেশ খানিকটা জায়গা পরিস্কার করে ঐসব ঘর তৈরি। করেছে। ওয়াও-ওয়ের এই মিশনের বয়স মাত্র পাঁচ বছর কিন্তু এরই মাঝে স্থানীয় ভিন্ন স্নি গোত্রের প্রায় আশি জনের মত মানুষ জায়গাটাকে গ্রামের রুপ দিয়েছে। কিছু ঘরবাড়ি ভূমি বা পানি থেকে একটু উপরে, সাধারণত যেমনটা আপালাই ইন্ডিয়ানদের মধ্যে দেখা যায়, যেখানে অন্যরা শুধুমাত্র পাম পাতা দিয়েই ওয়াও-ওয়ে এবং টিরিয়স গোত্র ঘরবাড়ি বানিয়েছে। কিন্তু মিশনের সবচেয়ে বেশি অধিবাসীই ইয়ানোমামো গোত্রের আর এরা একসাথে গোলাকৃতি ঘরে বসবাস করে যা দেখে এদের গোত্রটিকে সহজেই চেনা যায়।
গার্সিয়া হাত উঁচু করে বাগানের এক কোণে দাঁড়ানো হোনাউই নামের ইয়াননামামো গোত্রের লোকটিকে ডাক দিলো। লোকটি বেটে ইন্ডিয়ান, পরনে প্যান্ট। সে দ্রুত এগিয়ে এলো। এই লোকটাকে আমার ঘরে নিতে হবে, একটু সাহায্য করো, গার্সিয়া বলল।
বলিষ্ঠভাবে মাথা ঝাকিয়ে আগন্তুকের অপর পাশে গেল হোনাউই। আক্রান্ত ব্যক্তিকে তাদের দুজনের মাঝে নিয়ে বাগানের গেট ও চার্চ অতিক্রম করে দক্ষিণদিক মুখকরা বাড়ির দিকে নিয়ে গেল। এখানে কেবলমাত্র মিশনারির বাড়িতেই একটি গ্যাস জেনারেটর আছে। এটা দিয়ে চার্চের লাইট, রেফ্রিজারেটর এবং গ্রামের একমাত্র এয়ারকন্ডিশনও চালানো হয়ে থাকে। গার্সিয়া এটা ভেবে মাঝে মাঝে অবাক হয়, তার মিশনের সফলতা যতটা না প্রভু জির মুক্তি দেবার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে তারচেয়ে অনেক বেশি নির্ভর করে চার্চের আভ্যন্তরীণ এই শীতল পরিবেশ, যেটাকে এই ইন্ডিয়ানরা ঐশ্বরিক কিছু একটা মনে করে থাকে হয়তো।
তারা ঘরে পৌঁছানোর পরই হোনাউই মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকে পেছনের দরজাটা টান দিয়ে খুলে দিল। লোকটিকে ধরাধরি করে খাবার ঘরের মাঝ দিয়ে পিছনের দিকে প্রিস্টের সহকারীদের একটি ঘরে নিয়ে গেল তারা। এটা এখন কেউ ব্যবহার করে না। দুই দিন আগে মিশনারির সব নবীণ সদস্য গসপেল সম্পর্কিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দের জন্য পাশের গ্রামে গেছে। ঘরটা অন্ধকুঠুরি থেকে কিছুটা বড় তবে সূর্যের তাপ থেকে বাঁচার জন্য যথেষ্ট শীতল। গার্সিয়া মাথা নেড়ে হোনাউইকে ঘরের বাতি জ্বালাতে বলল। তারা এ-ঘরে বিদ্যুৎ দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে নি। উজ্জ্বল শিখায় আকৃষ্ট হয়ে তেলাপোকা, মাকড়সা বাতির দিকে ছুটে আসতে শুরু করেছে। লোকটাকে একটি সিঙ্গেল বেডে শোয়ালো ওরা।
এর জামা-কাপড় খুলতে সাহায্য কর, বললেন পাদ্রি, ওকে পরিস্কার করে ক্ষতগুলোর চিকিৎসা করা দরকার।
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে লোকটার প্যান্টের বোতাম খুলতে গিয়েই একেবারে জমে গেল হোনাউই। বুকের ভিতর আটকে থাকা দম বের হতেই ইন্ডিয়ানটা যেন মুক্তি পেল। সে এমনভাবে লাফিয়ে পেছনে সরে গেল যেন বিষাক্ত বিচ্ছু বা ওরকম কিছু দেখেছে।
ওয়েটি কেটে, গার্সিয়া জিজ্ঞেস করল অবাক হয়ে। কি হয়েছে?
হোনাউইর তীব্র আতঙ্কভরা চোখ স্থির হয়ে আছে লোকটার নগ্ন বুকের উপর। ভয়ে স্থানীয় ভাষায় বুলি আওড়াতে লাগল সে।
গার্সিয়া এবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো লোকটার বুকের দিকে। ট্যাটুগুলো কিসের? লাল ও নীল রঙের ট্যাটুগুলোর বেশিরভাগই বিভিন্ন জ্যামিতিক আকৃতির। লালবৃত্ত, অবাক করার মত জটিল আঁকাবাকা রেখা এবং খাঁজকাটা ত্রিভূজ। কিন্তু মাঝখানে রক্তিম বর্ণের সর্পিল আকারের যে ট্যাটুটা আছে তা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, ওটা যেন কুণ্ডুলি পাকানো কেন্দ্র। থেকে সবদিকে রক্তের প্রবাহ বইয়ে দিচ্ছে। নাভির উপরে, কুণ্ডুলির ঠিক মাঝখানে একটি হাতের ছাপ : সাওয়ারা।
হতবাক হোনাউই দরজার দিকে সরে যেতে যেতে বিস্ময়ে বলে উঠল, সাওয়ারা। অশুভ আত্মা।
গার্সিয়া তার সহকর্মীর দিকে নজর দিল, ভাবল লোকটা এসব কুসংস্কারের সাথেই বেড়ে উঠেছে। যথেষ্ট হয়েছে,” কর্কশভাবে বলল সে। এগুলো কখনই শয়তানের কারসাজি নয়। শুধুই রঙ। এখন আসো, আমাকে সাহায্য কর।
হোনাউই ভয়ে কাঁপছে। সে আর পাদ্রির কাছে ঘেষলো না। আগকের আর্তনাদ ভ্রু কুঁচকে থাকা পাদ্রির মনোযোগ তার দিকে নিয়ে গেল। বেচারার চোখে কোন প্রাণ নেই, নেই কোন কথা বলার শক্তি। গার্সিয়া লোকটার কপালে হাত দিয়ে দেখলো। উফ! জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। পাদ্রি ঘুরে হোনাউইর দিকে ফিরলো, ফ্রিজ থেকে পেনিসিলিন আর ফাস্ট এইড কিটটা অন্তত এনে দাও।
পরিত্রাণের পরিস্কার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে সে ওখান থেকে দ্রুত চলে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেললল গার্সিয়া। আমাজনের এই রেইনফরেস্টে এক দশক ধরে আছে সে, এই দীর্ঘ সময়ে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের পাশাপাশি আরো অনেক কিছুই রপ্ত করে ফেলেছে। ভাঙা হাঁড়ে স্প্রিন্ট বসানো, ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে সেখানে ব্যথানাশক। ওষুধ লাগানো, জ্বরের চিকিৎসা করা, এমনকি সাধারণ কিছু অপারেশনও করতে পারে। মিশনের একজন পাদ্রি হিসেবে ধু তার লোকজনের আত্মার অভিভাবকই নয়, একাধারে উপদেষ্টা, স্থানীয় প্রধান এবং একজন চিকিৎসকও বটে।
লোকটির কাদামাটি লাগানো পোশাক খুলে একপাশে সরিয়ে রাখা হলো। পাদ্রি যতই লোকটার রোদে পোড়খাওয়া শরীরের উপর চোখ বোলাচ্ছে ততবারই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছে জঙ্গল কতটা ভয়ঙ্কর এবং নিষ্ঠুরভাবে তার শরীরটাকে হরণ করেছে। তার শরীরের গভীর ক্ষতগুলো মাছির শূককীট বয়ে বেড়াচ্ছে। স্কালি ফাংগাস তার পায়ের নখগুলো খেয়ে নিয়েছে, অনেক দিন আগে সাপে কামড়ানো দাগ রয়েছে পায়ের গোড়ালীতে। কাজ করতে করতে যতই সময় গড়ালো পাদ্রি ততই বিস্মিত হলো। এই লোকটা কে? তার ব্যাপারটা। কী? আশেপাশে বা দূরে কোথাও কি তার পরিবার আছে? কিন্তু তার সাথে কথা বলার সকল চেষ্টা করা মানেই দুর্বোধ্য এবং অস্পষ্ট কিছু শব্দের সাথে পরিচিত হওয়া। অনেক কৃষক যারা সুবিধাজনক বাসস্থান খোঁজার জন্য জঙ্গল পাড়ি দিয়ে থাকে তাদের অনেককেই বেঘোরে প্রাণ হারাতে হয় কখনো ইন্ডিয়ানদের হাতে, চোর-ডাকাত, মাদকবহনকারী, এমনকি ভয়ঙ্কর ক্ষুদ্র পরজীবীদের হাতে। কিন্তু মানুষগুলোর বেশি মৃত্যু হয় যে কারণে তা। হল রোগ। রেইনফরেস্টের মধ্যে দূরবর্তী এমন জায়গাও রয়েছে যেখানে চিকিৎসক পৌঁছাতে দু-দিন লেগে যায়। সে-সব জায়গায় সামান্য ফ্লু-ও মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
কাঠের উপর হেটে আসার শব্দে গার্সিয়া দরজার দিকে তাকালো। মেডিকেল কিটের বোঝা আর এক বালতি পরিস্কার পানি নিয়ে হোনাউই ফিরে এসেছে আরেকজনকে সাথে নিয়ে। কামালা নামের লম্বা চুলের খাটোমত ওঝা দাঁড়িয়ে আছে হোনাউইর ঠিক পাশেই। লোকটা স্থানীয় জাদুকর, যেকোন কিছুতে শুভ বা অশুভ খুঁজে বের করতে পারদশী, এই প্রাচীন লোকটিকে আনতেই হোনাউই নিশ্চিতভাবেই তার কাছে দৌড়ে গিয়েছিল।
হায়া, গার্সিয়া লোকটিকে সম্ভাষণ জানালো। গ্র্যান্ডফাদার। ইয়ানোমানো গোত্রের। প্রধান ব্যক্তিকে সাধারণত এভাবেই সম্ভাষণ জানানো হয়। কামাল কোন উত্তর না দিয়ে লম্বা পা ফেলে আগন্তুকের কাছে গেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে যতই লোকটিকে দেখছে ততই কামালার চোখ সরু হয়ে আসছে। হোনাউইর দিকে ফিরে পানির বালতি এবং ওষুধপাত্রের বাক্সটা নামিয়ে রাখতে বলল সে। তারপর হাত দুটো শয্যাশায়ী আগন্তুকের উপর তুলে ধরে মন্ত্র পড়া শুরু করে দিল জাদুকর-চিকিৎসক। গার্সিয়া অনেক আঞ্চলিক ভাষায় পারদর্শী হওয়ার পরও কামালার উচ্চারিত একটি বর্ণও বুঝতে পারলো না।
কাজ শেষে কামালা স্পষ্ট পর্তুগিজ ভাষায় গার্সিয়াকে বলল, গভীর জঙ্গলের ভয়ঙ্কর আত্মা সাওয়ারা এই লোকটিকে স্পর্শ করেছে। লোকটা আজ রাতেই মারা যাবে। মৃতদেহটা যেন সূর্য ওঠার আগেই পুড়িয়ে ফেলা হয়। কথাগুলো বলে কামালা চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো।
দাঁড়ান! এ দাগগুলো কিসের, আমায় বলুন?
এটা রক্তপিপাসু ব্লাড-জাগুয়ার, ব্যান-আলি গোত্রের চিহ্ন, বিরক্তিপূর্ণ অভিব্যক্তি নিয়ে বলল কামালা, আগন্তুকটি তাদেরই একজন। জাগুয়ারের দাস ব্যান-আলির কাউকে কেউ কখনো সাহায্য করবে না। এর পরিণাম হবে মৃত্যু।
কামালা বিশেষ এক অঙ্গভঙ্গিতে দাঁড়ালো যেন সে খারাপ আত্মাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। হাতের আঙুলগুলো শূন্যে ঘুরিয়ে হোনাইকে সাথে নিয়ে চলে গেল। মৃদু আলোয়। ঘরটাতে একা খুব ঠাণ্ডা অনুভঙ্ক করলো গার্সিয়া। কিন্তু এই শীতলতা এয়ারকন্ডিশন থেকে আসছে না। গভীর জঙ্গলের ভূতগোত্রের এক ভূত ব্যান-আলির কথা গার্সিয়া অনেক আগেই শুনেছিল। ভীতু কোন ব্যক্তি কল্পনাতীত শক্তির অধিকারী হতে পারে এই জাগুয়ারের সাথে দৈহিক সম্পর্কের মাধ্যমে। @
গার্সিয়া তার ক্রুশে চুমু দিয়ে এইসব অদ্ভুত কুসংস্কারকে মাথা থেকে তাড়িয়ে দিলো। ওষুধ ও পানির দিকে ফিরে সে পরিস্কার পানিতে ভিজিয়ে লোকটিকে কাছে নিয়ে তার ক্ষত-বিক্ষত ঠোঁটে ছোঁয়ালো। খান, পাদ্রি বলল ফিসফিস করে।
জঙ্গলে জীবন ও মৃত্যুর মাঝে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা প্রভাবক হিসেবে কাজ করে তা হলো পানিশূন্যতা। স্পঞ্জ নিংড়ে ফেঁটা ফোঁটা পানি ফেলতে লাগলো লোটার ফেটে যাওয়া ঠোঁটের উপর। লোকটি পান করার জন্য সাড়া দিল ঠিক যেমন বুকের দুধ খাওয়া কোন শিশু দুধের বোটা মুখে নিতে চায়। সে চুক চুক করে চুইয়ে আসা পানি গিলতে চেষ্টা করল। তার দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। পানি আর বাতাস একসাথে ভেতরে নিতে পারছে না। গার্সিয়া লোকটার মাথা একটু উঁচু করে ধরলো যেন পানি খাওয়াটা অর জন্য আরও সহজ হয়। কিছুক্ষণ পরেই তার চোখমুখ থেকে জ্বরের ঘোর কিছুটা কেটে গেল। জীবন বাঁচাননা পানি যে স্পঞ্জ থেকে আসছে সেটা পাবার জন্য প্রবলভাবে হাতড়ে বেড়ালো লোকটা কিন্তু গার্সিয়া এটা দূরে সরিয়ে রাখলো। দীর্ঘদিন এভাবে পানিশূন্য থাকার পর একসাথে এত পানি শরীরে নেওয়া স্বাস্থ্যের জন্যে খারাপ। বিশ্রাম নিন, কিছুটা কোমলতার সাথে লোকটাকে বললো পাদ্রি। ক্ষতগুলো পরিস্কার করে সেখানে ঔষুধ লাগাতে দিন আমাকে।
দেখে মনে হলো না লোকটা তার কথা বুঝতে পেরেছে। পানিতে ভেঁজানো স্পঞ্জটা আয়ত্তে আনতে তাকে যেন সংগ্রাম করতে হচ্ছে আর কেমন এক আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে। মুখ থেকে। পাদ্রি তাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিলে লোকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, আর তখনই গার্সিয়া বুঝতে পারলো লোকটা কেন কথা বলতে পারছে না।
তার কোন জিহ্বা নেই, এটা কেটে ফেলা হয়েছে!
পাদ্রির চোখমুখ কুচকে গেল। সে এম্পিসিলিনের একটা সিরিঞ্জ প্রস্তুত করতে করতে সেই দানবের জন্য প্রার্থনা করল যেন সেটা অন্য কোন মানুষকে এমন হাল করতে না পারে। এম্পিসিলিনটার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে কিন্তু আর সবগুলো থেকে এটাই সবচেয়ে ভাল।
পাদ্রি লোকটির বাম নিতম্বে ইনজেকশন দিয়ে ক্ষতস্থানের চিকিৎসার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। সুস্থতা আর অসুস্থতা, এ-দুয়ের মাঝেই ঘুরপাক খাচ্ছে লোকটার যাবতীয় চিন্তা ভাবনা, অনূভুতি। চেতনা যখনই তাকে জাগিয়ে দিচ্ছে সে তার ফেলে রাখা পোশাকগুলো খুঁজে বেড়াচ্ছে হন্যে হয়ে। ভাবখানা এমন যেন সে তার পোশাক-আশাক পরে জঙ্গল ভ্রমণ আবার শুরু করতে চাচ্ছে। কিন্তু গার্সিয়া বিরামহীনভাবেই তাকে চেপে বিছানার সাথে লাগিয়ে গায়ের উপর কম্বল দিয়ে দিচ্ছে। সূর্য ডোবার পর রাতের অন্ধকার জঙ্গলকে যখন গ্রাস করে ফেলল, পাদ্রি গার্সিয়া বাতিস্তা বাইবেল হাতে নিয়ে লোকটার জন্য প্রার্থনা করতে শুরু করলো কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছিলো তার প্রার্থনায় কাজ হবে না। মন্ত্রসাধক কামালার কথাই সত্যি। লোকটা আজ রাতেই মারা যাবে।
আগন্তুক যদি ক্রিশ্চিয়ান হতো তবে পূর্ব-সতর্কতা হিসেবে পাদ্রি প্রয়োজনীয় ধর্মীয় রীতি-নীতির প্রস্তুতি নিতে পারতো এক ঘণ্টা আগেই লোকটার কপালে তেল দিয়ে তাকে একটু চাঙ্গা করতে চাইলো কিন্তু নিস্ফল চেষ্টা, সেজাগলো না। তার ভ্রু জ্বরে পুড়ছে। তার। শরীরে দেয়া অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ব্লাড ইনফেকশন সারাতে ব্যর্থ হয়েছে পুরোপুরি।
লোকটা মারাই যাবে এমনটা মনস্থির করে পাদ্রি গার্সিয়া সারারাত তার জন্য প্রার্থনা করার প্রস্তুতি নিল। হতভাগার আত্মার শান্তির জন্য এটুকুই শুধু করার আছে তার। কিন্তু রাত যতই গভীর হচ্ছে জঙ্গল ততই ধীরে ধীরে জেগে উঠছে পঙ্গপালের আর্তচিৎকার আর। সহস্র ব্যাঙের ডাকে। গার্সিয়া তার কোলের উপর বাইবেলটি রেখে একসময় ঘুমে তলিয়ে গেল। কয়েক ঘণ্টা বাদে লোকটির বিচিত্র আর্তনাদের শব্দে জেগে উঠলো সে। বিশ্বাস করল রোগী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। গার্সিয়া উঠে দাঁড়াতেই তার কোলের উপর রাখা বাইবেলটা মেঝেতে পড়ে গেল। নিচু হয়ে সেটা তুলতেই আবিষ্কার করলো লোকটা তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তার চোখে ভাবলেশহীনতা থাকলেও জ্বরের। তীব্রতা কমে গেছে অনেকখানি। লোকটা দূর্বল আর কাঁপা-কাঁপা হাত তুলে তার খুলে রাখা পোশাক দেখালো।
আপনি যেতে পারবেন না, গার্সিয়া বলল।
লোকটি এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাকালো। তারপর সনির্বন্ধ অনুরোধের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার তার পোশাক দেখালো।
অবশেষে হার মানলো গার্সিয়া। জ্বরে পোড়া লোকটার শেষ অনুরোধ কিভাবে উপেক্ষা করবে সে? বিছানার পায়ের কাছে রাখা জরাজীর্ণ প্যান্টটা মৃত্যুপথযাত্রীর হাতে তুলে দিল। লোকটা প্যান্ট হাতে নিয়ে দ্রুত সেটার পা ঢোকানোর জায়গা বরাবর হাত চালাতে চালাতে জিন্সের তৈরি একটা জায়গায় এসে থামলো অবশেষে। জায়গাটা হাত নাড়িয়ে ভালভাবে দেখিয়ে প্যান্টটা পাদ্রির কাছে ফেরত দিল সে।
গার্সিয়া ভাবলো লোকটা হয়তো আবার ঘোরের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। আসলে সেই মুহূর্তে তার শ্বাস-প্রশ্বাসও অনিয়মিত আর বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু গার্সিয়া। লোকটির অর্থহীন কাজটিকে আমলে নিয়ে তার দেখানো জায়গা বরাবর হাত রাখলো। সে। অবাক হয়ে তার হাতের নিচে কিছু অনুভব করল যা জিন্স থেকে শক্ত। তাহলে এই সেলাইয়ের নিচে কিছু একটা লুকানো আছে? একটা গোপন পকেট! কৌতূহলি পাদ্রি একটা কাঁচি তুলে নিল ফার্স্ট-এইড কিট থেকে। তার পাশেই নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বালিশে মাথা ডুবিয়ে দিচ্ছে লোকটা। কিছুটা প্রশান্তি তাকে আচ্ছাদিত করেছে কারণ সে অভিব্যক্তির সাহায্যে তার মনের ভাব পাদ্রিকে বোঝাতে পেরেছে অবশেষে।
কাঁচি দিয়ে সেলাই বরাবর কাটার পর গোপন পকেটটা খুলে গেল। ভেতরে হাত ঢোকাতেই তার হাতে ধাতব কিছু একটা ঠেকলো। হেচকা টানে সেটা বাইরে আনতেই দেখা গেল একটা ব্রোঞ্জের কয়েন। অবাক পাদ্রি কয়েনটা বাতির আলোতে তুলে ধরলো ভাল করে দেখার জন্য। একটা নাম খোদাই করা কয়েনটিতে : জেরাল্ড ওয়ালেস ক্লার্ক, জোরে জোরে পড়ল পাদ্রি। এটাই কি এই আগন্তুকের নাম? আপনি কি এই লোক, সিনোর? সে বিছানার দিকে দৃষ্টি ফেরালো। হায় ঈশ্বর, পাদ্রি বলল অস্পষ্টভাবে। ছোট এই খাটে শোয়া লোকটির দৃষ্টি অন্ধের মত স্থির হয়ে আচ্ছে ছাদের দিকে, অলস মুখটা হা। করা, বুকটা পড়ে আছে নিথরভাবে। এমনিভাবেই সে তার আত্মাকে বিদেহী করল।
সে এখন আর আগম্ভক নেই।
শান্তিতে থাকুন, সিনোর ক্লার্ক।
কয়েনটা আবার অলোতে তুলে ধরে উল্টো দিকে ঘুরালো পাদ্রি বাত্তি। অপর পাশের খোদাই করা লেখাটা দেখে ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেল।
ইউনাইটেড স্টেট আর্মি স্পেশাল ফোর্স
আগস্ট ১, সকাল ১০:৪৫
সিআইএ হেডকোয়ার্টার
ল্যাংলে, ভার্জিনিয়া
জর্জ ফিল্ডিং কলটা পেয়ে বেশ অবাক হলেন। সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্সের সহকারী পরিচালক হিসেবে তাকে প্রায়ই ডেকে পাঠানো হয় বিভিন্ন বিভাগের প্রধানদের সাথে মিটিং করার জন্য কিন্তু ডিরেক্টরেট এনভায়রনমেন্টাল সেন্টার, ডিইসি-এর প্রধান মার্শাল ওব্রেইনের মত মানুষের কাছ থেকে কোন তাৎপর্যপূর্ণ কল পাওয়াটা সত্যিই অস্বাভাবিক। ডিইসি ১৯৯৭ সালে ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটির একটা শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। যে শাখাঁটি পরিবেশ বিষয়ক কর্মকান্ড পরিচালনা করার জন্য নিয়োজিত আছে। তার রাজত্ব লাকালীন এখন পর্যন্ত এটাই প্রথম কোন প্রাইওরিটি কল। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তাহলে। ন্যাশনাল সিকিউরিটির খুব জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্যই এই ধরণের আয়োজন সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু ওল্ডবার্ড ডাক নামের মার্শাল ওব্রেইনকে এমন কীইবা খুঁচিয়ে দিল যে তাকে এ-ধরণের মিটিং ডাকতে হচ্ছে?
হলওয়ে দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত হাটতে লাগলো ফিল্ডিং। এই হলটা আসল হেডকোয়ার্টা এবং নতুন হেডকোয়ার্টারকে সংযুক্ত করেছে। নতুন নতুন অনেক সুযোগ সুবিধা যুক্ত হয়েছিল আশির দশকের শেষের দিকে। সেবার অনেকগুলো শাখা খুব দ্রুতই গড়ে উঠেছিল, ডিইসি সেই শাখাগুলোরই একটা।
দীর্ঘ প্যাসেজটা দিয়ে হাঁটার সময় ফ্রেমে বাঁধানো সারি সারি পেইন্টিগুলো চোখে পড়ল ফিল্ডিঙের। সিআইএর স্ট্র্যাটেজিক সার্ভিসটি যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরই প্রতিচ্ছবি। দেয়ালের ছবিগুলো অতীতে নিয়ে গেল জর্জ ফিল্ডিংকে। ওই সময়ে সিআইএর স্ট্র্যাটেজিক সার্ভিসের প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল ডোনোভান। আর এই গ্যালারিটি তারই ছবিতে ভরা। ফিল্ডিঙের বর্তমান বসের ছবিও একদিন জায়গা করে নেবে এই দেয়ালে, আর ফিল্ডিং যদি তার তাসের চালটা ঠিকমত দিতে পারে, তবে ডিরেক্টর পদের স্বপ্ন দেখাটা অবান্তর হবেনা।
এসব চিন্তা করতে করতেই নিউ হেডকোয়ার্টার বিল্ডিঙে ঢুকে পড়ল ফিল্ডিং। অসংখ্য স্টাফ দেখতে দেখতে প্রধান দরজা পার হতেই এক সেক্রেটারি মহিলা স্বাগত জানালো তাকে।
ফিল্ডিং ঢুকতেই উঠে দাঁড়ালো সে। ডেপুটি ডিরেক্টর, মি. ওব্রেইন তার অফিসে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। সেক্রেটারি একসারি মেহেগনি কাঠের দরজার দিকে। এগিয়ে গিয়ে একটার সামনে দাঁড়িয়ে সেটায় টোকা দিয়ে দরজাটা খুলে দিলো।
আপনাকে ধন্যবাদ।
ভেতরে বিপ করে একটা শব্দ হলো। ডেপুটি ডিরেক্টর ফিল্ডিং, এখানে আসার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, গম্ভীর কণ্ঠে স্বাগত জানাতে জানাতে মার্শাল ওব্রেইন নিজ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। রূপালী-ধূসর বর্ণের চুলের দীর্ঘকায় লোকটিকে বিশাল এক্সিকিউটিভ টেবিলে বামনের মত লাগে। তিনি হাত দিয়ে একটা চেয়ারের দিকে ইশারা কলেন।
আমি জানি আপনার সময় খুবই মূল্যবান তাই আমি সেটার অপচয় করব না।
সবসময় কাজের কথায় থাকে লোকটি, ভাবল ফিডিং। বহুম চারেক আগে সিআইএর ডিরেক্টর পদে মার্শাল ওব্রেইনের অধিষ্ঠিত হওয়া নিয়ে কানাঘুষা চলছিল। ফিল্ডিঙের ডেপুটি হবার আগে ব্রেইনই ছিল এই ডেপুটি পদে কিন্তু তার অঙ্গ বিচক্ষণতার। আগুনে অনেক সিনেটরকেই পুড়তে হয়েছিল। ভাল-মন্দ বিচার করার প্রজ্ঞা তাকে এমন। জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল যে তার আর পেছনে ফেরার সুযোগ ছিল না। ব্যাপারটা ওয়াশিংটনের রাজনীতির মত নয়। সিআইএর ডিরেক্টর করার পরিবর্তে তাকে এনভায়রনমেন্টাল সেন্টারের জৌলুসপূর্ণ ডিরেক্টরের এমন একটি পদ দেওয়া হল যেখানে বসে শুধু আওয়াজই তোলা যায়। আজকের এই ডাক হতে পারে তার পদ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু খুঁজে বের করা বিষয়ক যা দিয়ে তিনি তার দৌড়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।
কি বিষয়ে আজকের এই ডাক? বসে পড়ে জিজ্ঞেস করল ফিল্ডিং।
নিজের চেয়ারে বসে পড়ে ওব্রেইন ডেস্কের উপর রাখা ধূসর বর্ণের একটি ফোল্ডার খুললেন। ফিল্ডিং লক্ষ্য করল এটা কোন ব্যক্তির তথ্যাবলী। বুড়ো লোকটা তার গলা পরিস্কার করলেন, দুই দিন আগে ব্রাজিলের মানাউসের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক আমেরিকানের মৃত্যু সম্বন্ধে তথ্য পাঠানো হয়। মৃত ব্যক্তিকে স্পেশাল ফোর্সের চ্যালেঞ্জ কয়েনের মাধ্যমে সনাক্ত করা হয়েছে।”
ফিল্ডিং ভ্রু কুঁচকালো। মিলিটারির বিভিন্ন পর্যায়েই চ্যালেঞ্জ কয়েন বহন করা হয়। এগুলো ঐতিহ্য বহন করার চেয়ে কাউকে সনাক্ত করার কাজেই ব্যবহৃত হয় বেশি।
এগুলো আমাদের কি কাজে আসবে?
লোকটা শুধু স্পেশাল ফোর্সের সাবেক সদস্যই ছিলেন না, তিনি আমার একজন সক্রিয় সদস্যও ছিলেন। এজেন্ট জেরাল্ড ক্লার্ক।
বিস্ময়ে ফিল্ডিঙের চোখ পিট পিট করে উঠলো।
ওব্রেইন বলতে লাগলেন, এজেন্ট ক্লার্ককে একটি রিসার্চ টিমের সাথে ছদ্মবেশীরূপে পাঠানো হয়েছিল। গোল্ডমাইন ব্যবহারের ফলে পরিবেশের উপর যে খারাপ প্রভাব পড়ে সেটা তদন্ত করা এবং আমাজনের মধ্য দিয়ে বলিভিয়া এবং কলম্বিয়ায় যে কোকেন পাচার হয় সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করাই ছিল তার প্রধান কাজ।
ফিল্ডিং তার চেয়ারে দৃঢ়ভাবে বসে বললো, জাক কি খুন করা হয়েছে, আর এটাই কি মূল ঘটনা?
না, ছয়দিন আগে গভীর জঙ্গলের এক গ্রামের মিশনারিতে জ্বর ও রোদে পুড়ে আধমরা অবস্থায় সে হাজির হয়। মিশনারির প্রধান তাকে সারানোর চেষ্টা করেছিলেন বি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার মৃত্যু হয়।
সত্যিই ট্র্যাজিডির, কিন্তু এতে ন্যাশনাল সিকিউরিটির নাক গলানোর কি আছে?
কারণ চার বছর ধরে এজেন্ট ক্লার্ক নিখোঁজ ছিলেন। ওব্রেইন একটা ফ্যাক্স করা নিউজপেপারের আর্টিকেল তার দিকে ঠেলে দিলেন।
অনিশ্চয়তার সাথে ফিল্ডিং আর্টিকেলটা তুলে নিল। চার বছর?
আমাজন জঙ্গলের গবেষণাদল উধাও
-অ্যাসোসিয়েট প্রেস
মানাউস ব্রাজিল, মার্চ ২০
হারিয়ে যাওয়া শিল্পপতি ড: কার্ল র্যাল্ড তার ত্রিশ সদস্যের আন্তর্জাতিক গবেষণা দল ও গাইডদের খোঁজার জন্য দীর্ঘ তিন মাস ধরে গভীর তল্লাশী চালানোর পর অনুসন্ধানকারী দলটিকে তাদের অনুসন্ধান স্থগিত করতে বলা হয়েছে। আমেরিকার ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউট ও ব্রাজিলিয়ান ইন্ডিয়ান ফাউন্ডেশন-এর যৌথ উদ্যোগের এই টিমের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা বোঝার মত কোন চিহ্ন না রেখেই জঙ্গলে নিখোঁজ হয়ে গেছে। বছরব্যাপী এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল আমাজন বনে আদমশুমারীর মাধ্যমে সেখানকার ইন্ডিয়ান ও অন্যান্য গোত্রের মানুষের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা। যাইহোক, মানাউসের জঙ্গলনগরী ত্যাগ করার তিন মাস পর তাদের নিত্যসংগৃহীত তথ্যাবলী রেডিওর মাধ্যমে পাঠানো হতো, হঠাৎ করেই তা বন্ধ হয়ে যায়। ব্যর্থ হয় তাদের সাথে যোগাযোগের সব প্রচেষ্টা। তারা সর্বশেষ যেখানে অবস্থান করেছিল সেখানে রেসকিউ হেলিকপ্টার এবং স্থলভাগের অনুসন্ধান টিমও পাঠানো হয়েছিল কিন্তু একজনকেও পাওয়া যায় নি। তার দু-সপ্তাহ পর নিখোঁজ টিমের কাছ থেকে উদ্বেগসৃষ্টিকারী সর্বশেষ মেসেজটি পাওয়া যায় :
সাহায্য পাঠাও…বেশি সময় টিকতে পারছি না। ওহ্ ঈশ্বর! ওরা আমাদের চারপাশে ঘিরে আছে। এরপর টিমটি গভীর জঙ্গলে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ব্যাপক প্রচারণা ও একটি আন্তর্জাতিক দল টানা তিনমাস খোঁজাখুঁজির পর এখন অনুসন্ধানকারী দলের প্রধান কমান্ডার কার্ডিনান্ড গনজালেস ঘোষণা দিয়েছে, নিখোঁজ গবেষণাদলের সদস্যরা হারিয়ে গেছে এবং খুব সম্ভবত মারা গেছে সবাই। সকল খোঁজাখুঁজি বন্ধ করা হয়েছে। তদন্তকারীদের সাম্প্রতিক মতামত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নিখোঁজ দলটি হয়তো জঙ্গলের কোন দূর্ধর্ষ গোত্রের হাতে পড়েছে অথবা মাদকের প্রধান ঘাঁটির চোরাচালানীদের হাতে গুম হয়েছে। একইভাবে তাদেরকে খুঁজে পাওয়ার সকল চেষ্টারও মৃত্যু হল আজ, যেহেতু অনুসন্ধানকারী দলটিকে বাড়ি ফিরে যেতে বলা হয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রতিবছরই গবেষক, আবিষ্কারক, ভ্রমণবিদ ও মিশনারি লোকজন আমাজন বনে হারিয়ে যায় যাদেরকে আর কখনো পাওয়া যায় না।
মাই গড। হতভম্ব হয়ে থাকা ফিল্ডিঙের হাত থেকে আর্টিকেলের পাতাগুলো ফিরিয়ে নিয়ে আবারও বলা রু করলেন ওব্রেইন, গায়েব হওয়ার পর অনুসন্ধানকারী দল বা আমাদের কারও সাথে তাদের কোন যোগাযোগ হয় নি। এজেন্ট ক্লার্ককে মৃত হিসেবে তালিকাবদ্ধ করা হয়েছিলো।
কিন্তু আমরা কি নিশ্চিত, এই লোকটাই আমাদের সেই লোক?
ওব্রেইন সাড়া দিলেন। ডেন্টাল রেকর্ড এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলে গেছে।
ফিল্ডিং মাথা নাড়ল। প্রথমেই সে যে ধাক্কা খেয়েছিল তা কেটে যাচ্ছে। এর সবকিছুই বেশ ট্র্যাজিক এবং পেপার ওয়ার্কগুলোও বেশ শিহরণ তোলার মতই হবে কিন্তু আমি এখনও বুঝতে পারছি না এটা ন্যাশনাল সিকিউরিটির মাথা ঘামানোর কারণ হচ্ছে কিভাবে।
একথা আমিও স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতাম কিন্তু কিছু একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার আছে আর সেজন্যই…
ওব্রেইন তার সামনের কাগজগুলোর মধ্যে হাত চালিয়ে ঘেটেঘুটে দুটো ছবি বের করে আনলেন। প্রথম ছবিটা বাড়িয়ে দিলেন ফিল্ডিঙের দিকে। ক্লার্কের এই ছবিটা মিশনে যাবার মাত্র কয়েকদিন আগে তোলা।
ফিল্ডিং ছবিটার দিকে নজর দিল। ছবিটা সম্ভবত জুম দিয়ে বড় করে প্রিন্ট করা হয়েছে তাই কিছুটা অস্পষ্ট। তার পরও ছবির লোকটাকে বোঝা যাচ্ছে। লেভির প্যান্ট, হাওয়াই শার্ট এবং মাথায় একটা সাফারি টুপি। মুখে তার দাঁত বের করা হাসি, হাতে ধরা আছে গ্রীষ্মমন্ডলীয় কোমল পানীয়ের বোতল।
এজেন্ট ক্লার্ক?
হ্যাঁ, দীর্ঘ দিনের জন্য দূরে যাবার আগে একটা গোয়িংঅ্যাওয়ে পার্টির সময় ছবিটা তুলেছিল আরেক গবেষক। ওব্রেইন তার দিকে দ্বিতীয় ছবিটা ঠেলে দিলেন। আর এই ছবিটা সাম্প্রতিক তোলা হয়েছে মানাউসের মর্গ থেকে যেখানে ক্লার্কের লাশটা আছে।
ভেতরে ভেতরে তীব্র বমি বমি ভাব অনুভব করে ফিল্ডিং চকচকে ছবিটা হাতে নিল। মরা মানুষের ছবি দেখার কোন ইচ্ছেই তার নেই কিন্তু তার পছন্দ-অপছন্দ এখন মূল্যহীন। ছবির মৃতদেহটার নগ্ন শরীর স্টেইনলেস স্টিলের একটা টেবিলে শোয়ানো। যেন হালকা পাতলা দূর্বল কঙ্কালকে চামড়া দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে। বিস্ময়কর ট্যাটুগুলো খোদাই করা তার দেহে। শরীরের অবস্থা ভয়াবহ হওয়ার পরও ফিল্ডিং ক্লার্কের মুখের গঠন দেখে সহজেই চিনতে পারলো। এটা এজেন্ট ক্লার্ক সন্দেহ নেই কিন্তু একটা বড় ধরণের পরিবর্তন চোখে পড়ল। সে প্রথম ছবিটা হাতে ঠিয়ে দ্বিতীয় এই ছবিটার সাথে মেলালো।
ওব্রেইন বলে উঠলো, তার গায়েব হওয়ায় দুই বছর আগে ইরাকে শত্রুপক্ষের ঘাঁটিতে তথ্য সগ্রহের জন্য পাঠানো হয় এবং সে সময়ে আড়াল থেকে করা এক আততায়ীর গুলি তার বাম-হাতে লাগে, ক্যাম্পে ফিরে আসার আগেই তার ক্ষতস্থান মারাত্মক গ্যাংরিনে আক্রান্ত হয়। ভাগ্যের বিড়ম্বনার কবলে পড়ে তার বাম-হাতটা কাধ থেকে কেটে ফেলার মধ্য দিয়েই আর্মির স্পেশাল ফোর্সে তার ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে।
কি মর্গে রাখা লাশটার তো দুটো হাতই আছে!
অবশ্যই। ইরাকে গুলি খাওয়ার আগে যে ফিঙ্গারপ্রিন্টের নমুনা ছিল সেটার সাথে এখনকারটা হুবহু মিলে গেছে। ব্যাপারটা এমন মনে হচ্ছে যে, এজেন্ট ক্লার্ক আমাজনে গেল এক হাত নিয়ে কিন্তু ফিরে এল দুই হাত নিয়ে।
কিন্তু এটা তো অসম্ভব! সেখানে হয়েছিলটা কি?
মার্শাল ওব্রেইন বাজপাখির মত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে ফিল্ডিঙের দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন তার অর্জিত ওল্ডবার্ড নামটার নেপথ্যের কাহিনী ফিল্ডিং যেন ভুলে না যান। প্রবীন ব্রেইনের কণ্ঠ আরো গভীরে চলে গেল। এই বিষয়টাই আমি খুঁজে বের করতে চাইছি।
Leave a Reply