আবার গোয়েন্দাপীঠ – সুপ্রতিম সরকার
শ্বাসরোধী সাত কাহিনির সাতসতেরো
.
বৃষ্টিকে
মুখবন্ধ
‘আবার গোয়েন্দাপীঠ’ সুপ্রতিমের চতুর্থ বই। ‘গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার’-এর দুটি খণ্ড এবং ‘অচেনা লালবাজার’, লেখকের আগের তিনটি বই-ই যে পাঠকমহলে বিশেষ সমাদর পেয়েছে, সেটা নতুন কোনও তথ্য নয়। নতুন তথ্য বরং এই, নিজের চতুর্থ বইয়ের কাহিনিসূচিতে লেখক লালবাজারের সীমানা ছাড়িয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছেন পশ্চিমবঙ্গ পুলিশেরও কয়েকটি মামলার আখ্যান। ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড অফ দ্য ইস্ট’ বলে খ্যাত কলকাতা পুলিশের পাশাপাশি রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দাদের কীর্তিও যে এই বইয়ে মলাটবন্দি হয়েছে, সেটা জেনে খুশি হয়েছি।
বাংলা অপরাধ সাহিত্যের ভাণ্ডার নানা স্রষ্টার নানা সৃষ্টিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। রহস্যকাহিনিতে আসক্ত পাঠকের রসনাতৃপ্তির বিপুল আয়োজন রয়েছে সেই ভাণ্ডারে। তবে সে আয়োজন মুখ্যত লেখকদের কল্পনাপ্রসূত। বাস্তবের ঘটনার ভিত্তিতে পুলিশি তদন্তপ্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি বিষয়ে প্রামাণ্য রচনা (পরিভাষায় ‘Police Procedural’) স্বল্পই রয়েছে বাংলায়। ‘গোয়েন্দাপীঠ’ সিরিজ়ের বইগুলি যে সেই তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কল্পনার গোয়েন্দাকাহিনিতে লেখকের স্বাধীনতা থাকে চরিত্রদের ইচ্ছেমতো ভাঙাগড়ার, ঘটনাকে ইচ্ছেমতো বোনার, রহস্য-রোমাঞ্চের উপাদানকে ইচ্ছেমতো সাজানোর। বাস্তবের কাহিনি নিয়ে লেখায় এই স্বাধীনতা থেকে লেখক বঞ্চিত। তাঁর জন্য নির্দিষ্ট থাকে স্পষ্ট লক্ষ্মণরেখা, যার বাইরে পা দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। ঘটনা যা ঘটেছিল, যেভাবে ঘটেছিল, চরিত্ররা যে যেমন ছিল, তার থেকে সামান্যতম বিচ্যুত হওয়ারও বিলাসিতা দেখাতে পারেন না লেখক। এই সীমাবদ্ধতাকে যদি মাথায় রাখি, বাস্তবের অপরাধের রহস্যভেদের কাহিনিকে পাঠকের কাছে মনোগ্রাহী ভাবে পরিবেশন করা সহজ কাজ নয়। আগের বইগুলিতে এই কঠিন কাজটি সাবলীল দক্ষতায় করে দেখিয়েছে সুপ্রতিম। পাঠক নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, এই বইটিতেও ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে’। লেখনীর গুণে এবং ঘটনার বিন্যাসে প্রতিটি কাহিনিই এত টানটান, একবার শুরু করলে শেষ না করে থামতে পারবেন না।
যে-সাতটি কাহিনি এই বইয়ে স্থান পেয়েছে, তার প্রত্যেকটিই চাঞ্চল্যকর। সমাধান-পরবর্তী বিচারপর্বে কত যে বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অপরাধীর শাস্তিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হয় রক্তমাংসের গোয়েন্দাদের, লেখক তা লিপিবদ্ধ করেছেন কলকাতা পুলিশের একটি বিরল মামলার বিবরণে। সারা বাংলায় আলোড়ন ফেলে-দেওয়া এবং মানুষের স্মৃতিতে স্থায়ী হয়ে-যাওয়া এমন কিছু ঘটনার নেপথ্যকথা সবিস্তারে ধরা আছে এই বইয়ে, যে মামলাগুলি সম্পর্কে পাঠকের আগ্রহ-ঔৎসুক্য আজও সীমাহীন। ‘Juvenile Delinquency’, অর্থাৎ শিশু-কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা এবং মনস্তত্ত্বের নিপুণ কাটাছেঁড়া করেছেন লেখক, দুটি তুমুল সাড়া-জাগানো মামলার আদ্যোপান্ত বর্ণনায়। যাঁরা ভবিষ্যতের তদন্তপড়ুয়া, তাঁরা এই বই থেকে প্রভূত উপকৃত হবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
এই বইয়ের লেখককে দীর্ঘদিন সহকর্মী হিসাবে চেনার সূত্রে জানি, যে কোনও কাজেই পরিশ্রম আর আন্তরিকতায় এতটুকুও ঘাটতি রাখে না সুপ্রতিম। উপরন্তু, একটা সহজাত সৃজনশীল মন আছে তার, আছে চমৎকার রসবোধ। সুপ্রতিমের লেখালেখিতেও এই গুণগুলির স্পষ্ট স্বাক্ষর পাওয়া যায়। দায়িত্বপূর্ণ পদের নানাবিধ পেশাদারি চাপ সামলানোর ফাঁকে সময় বার করে পুরনো মামলার হাজার হাজার পাতার কেস ডায়েরি ঘাঁটা, মামলার নির্যাসকে একটি সুখপাঠ্য কাহিনির ঠাসবুনোট কাঠামোয় বাঁধা এবং বাস্তবের গোয়েন্দাদের কৃতিত্বের একটা ধারাবাহিক ‘ডকুমেন্টেশন’ করে যাওয়া নিবিড় যত্নে… এ কাজের জন্য গভীর ‘প্যাশন’-এর প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় দায়বদ্ধতার। লেখকের সেই ‘প্যাশন’ এবং দায়বদ্ধতার পরিচয় আপনারা পাবেন এই বইয়ের প্রতিটি পাতায়।
‘আবার গোয়েন্দাপীঠ’ পাঠকমন জয় করবেই, আমি নিশ্চিত।
অনুজ শর্মা
নগরপাল, কলকাতা
১ জানুয়ারি, ২০২০
লেখকের কথা
‘গোয়েন্দাপীঠ’ সিরিজের তৃতীয় বই। ‘গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার’-এর প্রথম দুটি খণ্ডের থেকে চরিত্রে ভিন্ন নয় মোটেই। এ বইয়ে মলাটবন্দি বাস্তবের মামলা, বাস্তবের গোয়েন্দা এবং বাস্তবেরই তদন্ত-আখ্যান। আগের দুটির মতোই।
ভিন্ন অবশ্য ব্যাপ্তিতে। লালবাজারের চৌহদ্দি পেরিয়ে ‘আবার গোয়েন্দাপীঠ’ পা রেখেছে রাজ্যের অন্যত্রও। এ বইয়ে কলকাতা পুলিশের পাশাপাশি ঠাঁই পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের একাধিক তুমুল চাঞ্চল্যকর মামলার ইতিবৃত্ত।
‘গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার’-এর প্রথম দুটি খণ্ড পাঠক-প্রশ্রয় পাওয়ার পর থেকে কিছু বার্তা নিয়মিত আসত কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। আসত লেখকের কাছে সরাসরিও।
‘আচ্ছা, বাংলার বিভিন্ন জেলাতেও তো অনেক সাড়া-জাগানো মামলা আছে। ওগুলোর তদন্ত নিয়ে জানতে চাই। যেমন ধরুন দমদমের ওই কেসটা…।’
‘রাজ্য পুলিশের সিআইডি-ও তো বহু হইচই ফেলে-দেওয়া কেসের রহস্যভেদ করেছে। সেগুলো নিয়ে লেখা হবে না কিছু? ওই যে সেই ডাকাতির ঘটনাটা…।’
ঠিকই তো। শুধু তো কলকাতা নয়, পাঠকের প্রবল কৌতূহল তো স্বাভাবিকই সেই সব ঘটনা নিয়েও, যা ঘটেছিল রাজ্য পুলিশের এলাকায়। এবং যার সমাধান হয়েছিল নিখাদ পেশাদারি উৎকর্ষে। এমন সব ঘটনা, এমন সব মামলা, এমন সব চরিত্র, কুড়ি-পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেলেও যা নিয়ে এখনও অনন্ত আগ্রহ সাধারণের। কী হয়েছিল, কেন হয়েছিল, কীভাবে হয়েছিল, তা মোটামুটি মনে থাকলেও নেপথ্যকথা আরও বিশদে জানার ঔৎসুক্যে ভাটা পড়েনি বিন্দুমাত্র।
সেই আগ্রহ-ঔৎসুক্য-কৌতূহল নিরসনের যথাসাধ্য প্রয়াস রয়েছে ‘আবার গোয়েন্দাপীঠ’-এ। এই বইয়ের একাধিক কাহিনিতে বাধ্যতই উঠে এসেছে শিশু-কিশোরদের অপরাধ-মনস্তত্ত্বের কাটাছেঁড়া। উঠে এসেছে এমন কিছু কেসের সবিস্তার ঘটনাপ্রবাহ, যার ভয়াবহতা আজও গেঁথে রয়েছে আমবাঙালির স্মৃতিতে।
প্রথম দুটি খণ্ডের পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় আরও একটি সংগত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। মহিলা গোয়েন্দা কি নেই পুলিশে? পুরুষতন্ত্রই একচেটিয়া? যদি তা না হয়, তা হলে ‘গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার’ সিরিজ়ের দুটি বইয়ে কেন স্থান পায়নি মহিলা গোয়েন্দাদের সমাধান করা কোনও কেস?
পুরুষদের কিছুটা আধিপত্য আছে তদন্তক্ষেত্রে, অনস্বীকার্য। কিন্তু সে দাপট মোটেই নয় নিরঙ্কুশ। মেধা-পরিশ্রম-আন্তরিকতার ত্র্যহস্পর্শে বহু জটিল মামলার সুচারু সমাধান করেছেন মহিলা গোয়েন্দারা। বাস্তবের ফেলু-ব্যোমকেশদের সঙ্গে সমানে পাল্লা-দেওয়া ‘মিতিনমাসি’-দের দক্ষতার নমুনা এই খণ্ডে ধরা রইল কলকাতা পুলিশের এক বিরল মামলার তদন্তপ্রক্রিয়ায়।
কলকাতার নগরপাল শ্রীঅনুজ শর্মার উৎসাহ এবং প্রশ্রয় ছাড়া দিনের আলো দেখত না এই বই। তাঁকে জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা। বিভিন্ন মামলার ব্যাপারে বহু প্রাসঙ্গিক তথ্য সরবরাহ করে যে সহকর্মীরা অকৃপণ সাহায্য করেছেন, তাঁদের ছোটই করা হয় শুকনো ধন্যবাদ জানালে। কৃতজ্ঞতা রইল অকুণ্ঠ।
কয়েকটি কাহিনিতে নাম পরিবর্তন করা হয়েছে কিছু পার্শ্বচরিত্রের। যাঁরা এখনও জীবিত, এবং সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। আসল নাম ব্যবহার করে ওঁদের সামাজিক বিড়ম্বনা বাড়াতে চাইনি।
আশা, এ বই রহস্যরসিক পাঠকের ভাবনার রসদ জোগাবে। চিন্তার উপাদান জোগাবে অপরাধ-বিজ্ঞানের পড়ুয়াদের।
গোয়েন্দাপীঠ, আবার।
১ জানুয়ারি, ২০২০
কলকাতা
Leave a Reply