আবার অশুভ সঙ্কেত – অনীশ দাস অপু
ABAR ASHUBHO SHANKET By Anish Das Apu
সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ: ২০০১
প্রচ্ছদ: বিদেশি ছবি অবলম্বনে কোলায বনবীর আহমেদ বিতর
সূচনা
পরপর ছ’হপ্তা ওরা, মানে শয়তান-পুত্রের শিষ্যরা, আঠার মত লেগে রইল মেয়েটির পেছনে। মেয়েটি ঘুমুচ্ছে নিজের বাড়িতে, কাজে যাচ্ছে অথবা বেড়াতে গেছে বন্ধুর বাসায়, ছায়া হয়ে সেঁটে থাকল ওরা পেছনে। নেতার অপমৃত্যুর পরে দলের সদস্য সংখ্যা হ্রাস পেয়ে যায় আশঙ্কাজনক হারে, অনেকেই আত্মহত্যা করে,
কেউ কেউ দারুণ হতাশায় বেছে নেয় নিঃসঙ্গচারীর জীবন। তবে কয়েকজন হাল ছেড়ে দেয়নি। প্রতিহিংসার আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল তাদের বুকে। প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে তারা, দিন দিন ক্রোধের মাত্রাটা বাড়তেই থাকে। এরাই মেয়েটির গতিবিধির দিকে লক্ষ রেখে চলেছে গত দেড় মাস ধরে।
একদিন মেয়েটি ডাক্তারের চেম্বারে এসেছে, যথারীতি তাকে অনুসরণ করেছে দুই শিষ্য, বসেছে তারই পাশে, ভিজিটিং রুমে। মেয়েটি অসুস্থ, চেহারায় ফুটে আছে ক্লান্তি আর ব্যথার ছাপ। ব্যাপারটা লক্ষ করে ওরা দু’জন সন্তুষ্ট বোধ করল।
‘মিস রেনল্ডস,’ মেয়েটিকে সম্বোধন করল রিসেপশনিস্ট, হাত তুলে একটা দরজা দেখাল, যেতে বলছে ওদিকে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল মেয়েটি, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোল, ধাক্কা দিতেই খুলে গেল দরজা। তরুণ, সুদর্শন চেহারার ডাক্তার হাসিমুখে মুখ তুলে চাইল। তাকে দেখে কপালে ভাঁজ পড়ল তরুণীর। এ লোককে আশা করেনি সে।
‘ড. আর্থারস্টোন প্রাকটিস ছেড়ে দিয়েছেন,’ ব্যাখ্যা করল যুবক। ‘আমি তাঁর জায়গায় এসেছি। দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বসুন না!’
দরজা বন্ধ করল মিস রেনল্ডস, ডাক্তারের পাশের খালি চেয়ারে বসল।
‘এখানটায় খুব ব্যথা, তলপেটে হাত রাখল সে। ‘মাঝে মাঝে মনে হয় ফেটে যাবে।’
খকখক কেশে উঠল তরুণী, যন্ত্রণায় বিকৃত দেখাল চেহারা। ডাক্তার ওকে শুইয়ে দিল একটা কাউচে, পরীক্ষা করবে। কাজটা শেষ করতে বেশি সময় নিল না সে, প্রেসক্রিপশনে একটা নাম আর ঠিকানা লিখে কাগজটা দিল মেয়েটিকে।
‘ইনি আমার এক কলিগ, হার্লে স্ট্রীটে চেম্বার। এসব ব্যাপারে স্পেশালিস্ট। ওঁর সঙ্গে দেখা করুন।’ একটু বিরতি দিল সে। ‘শীঘ্রি।’
মেয়েটি কিছু না বলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ‘ভয়ের কিছু নেই,’ আশ্বাস দিল ডাক্তার।
উঠে দাঁড়াচ্ছে তরুণী, খচ করে ব্যথাটা ঘাই মারল পেটে, দাঁতে দাঁত চাপল সে। ‘আপনি কোন…’
রোগিণী কি বলতে চাইছে বুঝতে পেরে এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল ডাক্তার। ‘দুঃখিত,’ তীক্ষ্ণ শোনাল কণ্ঠ, ‘এই স্টেজে আপনাকে পেইনকিলার ট্যাবলেট দেয়া যাবে না।’
মেয়েটি বেরিয়ে যাচ্ছে, তাকে চোখ দিয়ে অনুসরণ করল ডাক্তার, দেখল সেই লোক দুটো উঠে দাঁড়িয়েছে। দরজা বন্ধ করল সে, ফোন তুলে বলল, ‘শিকাগোতে লাইন দাও।’
সেক্রেটারি কানেকশন দিতে ব্যস্ত, ধীরে ধীরে হাসি ফুটল ডাক্তারের মুখে। ‘মৃত্যুর মাঝেও আছে জীবন,’ কথাটা যেন নিজেকেই শোনাল সে বিড়বিড় করে।
.
অপারেটিং টেবিলে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটি, তার দু’হাত শক্ত করে ধরে আছে দু’জন নার্স। পা দুটো ফাঁক করে বেঁধে রাখা হয়েছে। পেটটা ফুলে আছে বেলুনের মত, চামড়া টানটান। শরীর এপাশ-ওপাশ করে চলেছে সে ক্রমাগত, হাঁপাচ্ছে, মিনতির দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে নার্সদের দিকে। ‘বেশি সময় লাগবে না,’ সান্ত্বনা দিল তাকে একজন।
ভয়ানক ব্যথাটা শরীরে হঠাৎ ইলেকট্রিক শক মারল, মুখ হাঁ হয়ে গেল তরুণীর, দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। সার্জন হাত বাড়িয়ে একটা স্ক্যালপেল তুলে নিলেন।
‘একটু কাটাছেঁড়া না করলেই নয়,’ বললেন তিনি। ‘ব্যথাটার হাত থেকে রক্ষা পাবে।’
তরুণীর দিকে ঝুঁকলেন তিনি, আবার চিৎকার দিল সে, নার্স একটা প্যাড চেপে ধরল মুখের ওপর।
‘ক্লোরোফর্ম লাগবে না,’ ধমকে উঠলেন সার্জন। ‘ওকে অজ্ঞান করা চলবে না।’
মেয়েটির শরীর আবার মোচড় খেতে লাগল। ‘আসছে ওটা,’ বললেন সার্জন। ‘ওকে শক্ত করে ধরে রাখো।’
মেয়েটির পিঠ বাঁকা হয়ে গেল, ঝাঁকি খেল মাথা, গলা চিরে বেরিয়ে এল তীব্র আর্তনাদ। তারপর হঠাৎ সব শান্ত হয়ে গেল। তরুণী টের পেল শরীরের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেছে জিনিসটা, ব্যথা নেই পেটে, ধপ করে টেবিলের ওপর পড়ে গেল সে, ডাঙায় তোলা মাছের মত বার কয়েক কেঁপে উঠল, তারপর স্থির হয়ে গেল। সার্জন নার্সের হাতে কি একটা জিনিস তুলে দিলেন, প্রার্থনার ভঙ্গিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন এক মুহূর্ত, তারপর পা বাড়ালেন দরজার দিকে। হাত না ধুয়েই করিডর ধরে হাঁটা দিলেন তিনি। তাঁর পেছন পেছন এল একজন নার্স। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দেখল সার্জন এগিয়ে গেছেন বেঞ্চিতে বসা এক বৃদ্ধ দম্পতির দিকে। ওদের প্রতিটি কথা স্পষ্ট শুনতে পেল সে।
‘আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব করেছি,’ বললেন সার্জন। ‘কিন্তু বাঁচাতে পারিনি ওকে।’
ডুকরে কেঁদে উঠল বৃদ্ধা, তাকে জড়িয়ে ধরল বৃদ্ধ। চেহারায় সব হারানোর বেদনা।
‘টিউমারটা অনেক বড় ছিল,’ শান্ত গলায় বললেন সার্জন।
দরজা বন্ধ করল নার্স, ঘুরল, সঙ্গীর হাত থেকে কাপড়ে মোড়ানো জিনিসটা তুলে নিল হাতে। ছেলে। অজান্তেই মাথা নুয়ে এল অভিবাদনের ভঙ্গিতে। এমন সময় মেঝেতে পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সে। একটা কুকুর। প্রকাণ্ড শরীর, কুচকুচে কালো, বিরাট চোয়াল। হেঁটে এল সে নার্সের পাশে। নার্স বাচ্চাটাকে মেঝের ওপর শুইয়ে দিল, কুকুরটা ঝুঁকে এল তার ওপর, জিভ বের করে চেটে দিচ্ছে গা।
হাত বাড়িয়ে দিল বাচ্চা, খুদে আঙুল দিয়ে খামচে ধরল লোম, হেসে উঠল খিলখিল করে, নার্সের অন্তত তাই মনে হলো। আড়চোখে দেখল সে মৃত তরুণীকে, সঙ্গী নার্সকে ইশারা করল লাশটাকে চাদর দিয়ে ঢেকে রাখতে। চেহারায় ঘৃণা এবং বিতৃষ্ণার ভাব ফুটে উঠল তার, তবে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে হাসল।
‘আবার জন্ম নিল ঘৃণা,’ গর্বের সাথে বলল সে।
.
বাসা-বাড়ি, অফিস-ফ্যাক্টরিসহ সর্বত্র শয়তান-পুত্রের শিষ্যদের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল বাচ্চার জন্মের কথা শুনে। চরম হতাশায় যাদের দিন কাটছিল, যারা নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছিল ব্যর্থ আক্রোশে, খবরটা তাদের সবার মাঝে নতুন আশার আলো জ্বেলে দিল। আগামীতে নতুন কিছু ঘটার প্রত্যাশায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল তারা। ওদিকে, মধ্য ইতালীর এক মঠে, ফাদার ডি কার্লো নামের একজন প্রীস্ট গভীর রাতে ধড়মড় করে উঠে বসলেন নিজের বিছানায়। ঘামে ভিজে গেছে গা, ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন দেখেছেন তিনি, ভয়ঙ্কর এক সত্য উপলব্ধি করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বুঝতে পেরেছেন ব্যর্থ হয়েছেন তিনি, আবার শুরু হতে যাচ্ছে অশুভ সঙ্কেতের দিন। যা হবে অতীতের চেয়েও ভয়াল ভয়ঙ্কর।
Leave a Reply