আপিলা-চাপিলা – অশোক মিত্র
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০০৩
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
সদ্য-প্রয়াতা শান্তি দিঘে-র স্মৃতিতে
সবিনয় নিবেদন
আঁটোসাটো হোক, এবড়ো-খেবড়ো হোক, নিজের স্মৃতি কপচানো মানেই আমিত্বের অশ্লীল মহাসমুদ্রে মুহুর্মুহু হাবুডুবু খাওয়া। বেশ কিছু দিন ধরে গার্হস্থ্য মহল থেকে ঈষৎ প্ররোচনা ছিল, তা হলেও শেষ পর্যন্ত ‘আপিলা-চাপিলা’ যে বাইরে মুখ দেখাচ্ছে, তার প্রধান দায়িত্ব দু’জনের উপর বর্তায়। অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় অবিরাম তাড়া দিয়ে আমাকে বেপথুমান করে তুলতে সফল হয়েছেন, সেই সঙ্গে জুটলেন জয়ন্ত দাস নামে এক নব্যযুবক, যিনি এই প্রগল্ভ বৃত্তান্তটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অনুলিখন নিয়েছেন। সাময়িক পত্রিকায় ছাপা হয়ে বেরোবার পর উভয়েই আপাতত আমার সান্নিধ্যের বৃত্তের বাইরে, সম্ভবত কৃতকর্মহেতু অনুশোচনায় ভুগছেন।
বিভিন্ন সময়ে, মাঝে-মাঝে বিরতি দিয়ে, মুখে-মুখে বৃত্তান্ত বলার বিপত্তি অনেক। তথ্যের ভুল হয়, ঘটনার ধারাবাহিকতার খেই হারিয়ে যায়, যুগপৎ পুনরুক্তি ও অতিকথন ভিড় করে আসে। সব ক’টি ব্যাধিই ‘আপিলা-চাপিলা’-তে প্রকট। কিছু-কিছু তথ্যভ্রান্তির প্রতি অশোক সেন, অসিতরঞ্জন সেনগুপ্ত, আনিসুর রহমান, কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, জন্মজিৎ রায়, জয়দীপ বিশ্বাস, জ্যোতি বসু, তপনকুমার রায়, দিলীপ ভট্টাচার্য, পরিতোষ দত্ত, প্রাণেশ সমাদ্দার এবং বিপ্লব গুহরায় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন; তাঁদের প্রত্যেককে সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানাই। গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট আলোকচিত্রগুলির জন্য অলক গুহ, উজ্জ্বলা দাশগুপ্ত, উত্তরা বসু, কৃষ্ণ রাজ, দময়ন্তী বসু সিং, বিজয়া গোস্বামী, মোনা চৌধুরী ও সুজিত পোদ্দারের কাছে আমি ঋণী।
অশোক মিত্র
১ জানুয়ারি, ২০০৩
প্রাক্কথা
অবচেতনা কখন চেতনায় রূপান্তরিত হয়, বলা মুশকিল, বিশেষত শিশুর নিজের ক্ষেত্রে। আমরা বলি অবোধ শিশু; সেই বোধহীনতা একটু-আধটু করে পাল্টে যায়, শিশু আপন-পর চিনতে শেখে, যাকে আপন বলে মনে হয় তাকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে, অন্য কাউকে, কী কারণে সে নিজেও জানে না, দেখে, বা তার স্পর্শ অনুভব করে, ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে। আনন্দ বা তৃপ্তি হলে শিশু খিল-খিল হাসতে শেখে, কিন্তু আনন্দের প্রথম অভিজ্ঞতা কোন মুহূর্ত থেকে, তা সে ব্যক্ত করতে অক্ষম! মানুষ ও অন্য জীব পেরিয়ে জড় বস্তু সম্পর্কেও তার একই প্রতিক্রিয়া। কোনওটা সে পছন্দ করে, কোনওটা থেকে ভয় পায়, অভ্যাসের সেতু বেয়ে অগ্রসর হতে-হতে শিশু ক্রমে প্রভেদ করতে শেখে। তার প্রথম অভিজ্ঞতার উপর অন্য অভিজ্ঞতার প্রলেপ পড়ে, যা পরিবর্তনের ভূমিকা নেয়, নয়তো সংশোধনের। আলঙ্কারিক অর্থে হাঁটি-হাঁটি পা-পা, শিশু অবচেতনা থেকে চেতনায় পৌঁছয়, নিজেকে সংসারের শরিক হিশেবে আবিষ্কার করে সংসার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে প্রদেশ-দেশ, পরবর্তী পর্যায়ে সে পৃথিবীকে জানে, চেনে। এই চেতনাপ্রবাহের তাল-লয়-গতি এক-এক শিশুর ক্ষেত্রে এক-এক রকম। এই ভিন্নতা আমরা মেনে নিই, জীবনের রহস্যের মতো স্বতঃসিদ্ধ হিশেবে তা গ্রহণও করি।
অবচেতনার কোন লগ্নে এই ছড়াটি কে আমাকে শুনিয়েছিলেন, নিশ্চয় আদর করে, তা মনে আনা অসম্ভব: ‘আপিলা-চাপিলা ঘন-ঘন কাশি, রামের হুঁকো শ্যামের বাঁশি…’। ছড়ার পরের চরণ ক’টি শৈশবের সঙ্কীর্ণ প্রহরগুলিতে আমার কণ্ঠস্থ ছিল। কখন তা স্মরণ থেকে মিলিয়ে গেছে, এখন আর মনে আনতে পারি না। বিদ্বজ্জনেরা আমাকে জানিয়েছেন, গোটা পূর্ববঙ্গময় ছড়াটির পাঠান্তর ছড়িয়ে আছে। সে সব আমার জানা নেই, এবং, কী আশ্চর্য, জানবার তেমন আগ্রহও নেই যেন। জীবনের সীমান্তে পৌঁছেছি, এখন নিজেকে গুটিয়ে আনতে চাই, আমার জানালার ওধারে জানি নতুন রোমাঞ্চ, কিন্তু পুরনো বিন্দুতেই স্থিত থাকতে চাই, আর তো বিস্ফারিত হওয়ার, বিস্তারিত হওয়ার সময় নেই। তাই আমি আমার ওই দুই-পঙ্ক্তিতে সঙ্কুচিত অবচেতনা থেকে উৎসারিত ছড়াটিকে বার-বার জড়িয়ে ধরি, পঙ্ক্তি দুটিকে, তাদের ভগ্নাংশিক সত্তা সত্ত্বেও, ঠোঁটে-জিভে হ্লাদিত করি: আপিলা-চাপিলা ঘন-ঘন কাশি…
এখন মনে হয় গোটা জীবনখানাই ছড়াটির মতো। যতগুলি পর্ব পেরিয়ে এসেছি, বেশির ভাগই ঝাপসা কুয়াশায় আবৃত: কোনও-কোনও মানুষজন-ঘটনার কথা মনে পড়ে, অনেক-কিছুই পড়ে না। ভয় হয়, আরও খানিক সময় গেলে স্মৃতি আরও দুর্বল হয়ে আসবে, এমনকি স্রেফ আপিলা-চাপিলা শব্দদ্বয়ের বাইরে কিছুই স্মৃতিতে অবশিষ্ট থাকবে না, আমাকে জড়িয়ে-জাপটে ধরা আপিলা-চাপিলা নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়বো।
হয়তো আমি একা নই, আমার কুড়ি বছর বয়সে জীবনানন্দের এক কবিতার মায়া-মদির পঙ্ক্তিতে মন হড়কে পড়েছিল: ‘অথবা যে সব নাম ভালো লেগে গিয়েছিল: আপিলা-চাপিলা…’। কিন্তু জীবনানন্দ আর এগোননি, রহস্যের শরীরে রহস্য আত্মগোপন করেই থেকেছে। আমার এই ছন্নছাড়া আয়ুষ্কালে কাছে-আসা সরে-যাওয়া আপিলা-চাপিলাদের নিয়ে একটু জটলা করবার শখ। আমি কি অমার্জনীয় অপরাধ করতে চলেছি?
Leave a Reply