আপনমনে – রবি ঘোষ
সম্পাদনা – অভীক চট্টোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ মে, ২০১৫
প্রকাশক – স্বাতী রায়চৌধুরী
সপ্তর্ষি প্রকাশন
রবি ঘোষ অনুরাগীদের
.
সম্পাদকীয়
বাঙালি-জীবন আর রসিকতা একসময়ে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও হাসির উপস্থিতি ভীষণভাবেই ছিল। বাংলা চলচ্চিত্রে সেই সবাক যুগের শুরু থেকেই (৩-এর দশক) ১৯৭০-৮০-র দশক অবধি ‘হাসি’ প্রাধান্য পেয়েই এসেছে—তৈরি হয়েছে ভালো ভালো হাসির ছবি। যে কোনও কারণেই হোক, ইদানীংকালে এ বিষয়ে বেশ ভাটার টান দেখা যাচ্ছে। নিত্য জীবনযাপনেও কীরকম যেন নির্ভেজাল হাসি-মজা-রসিকতার অভাব ঘটে যাচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণ, বেশ হঠাৎই বাঙালি-জীবন থেকে আড্ডা-অবসরকে যেন অনেকটা কমিয়ে দিয়ে, নিয়ে এসেছে এক হিসেবি বৈভব-নির্ভর নেশাগ্রস্ততা। এর জন্যেই হয়তো রসিকতার প্রলেপে কথাবার্তা বলে অকারণ সময় কাটানোর প্রবণতা কমেছে। যাই হোক, এসব অন্য আলোচনার প্রসঙ্গ।
বাংলা ছবির জগতে কোনওদিনই কমেডিয়ানের অভাব ঘটেনি। তবে কমেডি প্রকাশের ধরন সময়ের সঙ্গে অবশ্যই পালটেছে। বাঙালির একসময়ে রসালাপের স্বাভাবিক প্রবণতা যা ছিল, তার রূপই প্রধানত প্রকাশ পেত প্রথমদিকের কমেডিয়ানদের মধ্যে থেকে। অর্থাৎ সংলাপ-নির্ভর কমেডি। কথা বলার ধরন, শব্দ নির্বাচন বা কোনও বিষয়কে মজার মোড়কে পুরে অসামান্য উপস্থাপন, মোটামুটি এটাই ছিল কমেডি-অভিনয়ের মূল ভিত্তি। ক্রমশ যত সময় এগোতে থাকল, দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে বিদেশি সংস্কৃতির পরিচয় বেড়ে চলল, পাশ্চাত্য চলচ্চিত্র চর্চার ক্ষেত্রও একটা তৈরি হল। এদেশীয় অভিনেতা- অভিনেত্রীদের অভিনয়-ধরনেও এর ছাপ লাগতে শুরু করল। এর সঙ্গে যুক্ত হল রাজনৈতিক ধ্যানধারণার নতুন নতুন উন্মেষ। সিনেমা-থিয়েটারের রূপ বদলাতে শুরু করল। কমেডি অভিনয়ে গ্রেট চার্লি চ্যাপলিনের প্রভাব পড়ল সর্বাধিক। বাংলার অভিনয়জগতে যশস্বী তুলসী চক্রবর্তীকে আলোচনার ঊর্ধ্বে রেখে বলা যায়, প্রথম কমেডি অভিনয়ে এক পরিবর্তন দেখা গেল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও জহর রায়ের মতো দুই অসাধারণ অভিনেতার মধ্যে। এনারা দেখালেন সংলাপের সঙ্গে অসামান্য শারীরিক অভিনয়। অর্থাৎ কথার সঙ্গে নাচ-গান-নানারকম অঙ্গভঙ্গির মারফত কমেডির উপস্থাপন (জহর রায় তো অভিনয়জগতে আসার আগে থেকেই চার্লিকে গুরু মানতেন)। বোঝাই যাচ্ছে, এই পরিবর্তন পাশ্চাত্য প্রভাবজনিত। এই কমেডি অভিনয়ের ধরনই আরেক রূপে যেন পরিপূর্ণতা পেল রবি ঘোষে পৌঁছে। এই অসম্ভব প্রতিভাবান অভিনেতা নিজেকে অনেক অর্থেই করে তুললেন ব্যতিক্রমী। কেন?
অত্যন্ত সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা রবি ঘোষ, যিনি পরিচিত একজন দুর্ধর্ষ কমেডিয়ান হিসেবে, তাঁর অভিনয়জীবন কিন্তু অন্য আবহে শুরু হল। প্রথম গুরু হিসেবে পেলেন উৎপল দত্তকে। সম্পূর্ণ এক বামপন্থী ভাবধারায় আচ্ছাদিত থিয়েটার-আবহাওয়ার মধ্যে গিয়ে পড়লেন। নিজেও একই রাজনৈতিক ভাবনার মানুষ ছিলেন। মনে রাখতে হবে, রবি ঘোষ এই অন্য ধারার থিয়েটারে উৎপল দত্ত-র শিক্ষাধীনে যেসব চরিত্রে অভিনয় করতে লাগলেন, তা মোটেই নিছক কমেডিয়ানের ছিল না। সমাজের নিম্নবর্গের অত্যাচারিত প্রতিবাদী মানুষের চরিত্রে নানা বৈচিত্রে নিজেকে প্রকাশ করতে লাগলেন। ‘অঙ্গার’ নাটকে বিপর্যস্ত খনি-শ্রমিকের চরিত্রে তাঁর অভিনয় ইতিহাস হয়ে আছে। পরে যখন নিজের দল ‘চলাচল’ তৈরি করলেন, সেখানেও বজায় রাখলেন মূল ভাবনা। রবি ঘোষ রীতিমতো শরীর চর্চা করে পেশীবহুল শরীর গঠন করেছিলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর অভিনয়ে অসম্ভব শারীরিক ক্ষীপ্রতা প্রকাশ পেত। নিজের রাজনৈতিক ভাবনাকে সম্বল করে সমাজের এক সাধারণ স্তরের মানুষের যেন চরিত্র-প্রতিনিধি হয়ে উঠলেন রবি ঘোষ। এর মধ্যে থেকেই কমেডি অভিনয়কে তিনি তুলে ধরলেন। এখানেই তাঁর অনন্যতা। সারা শরীর তো বটেই মুখাবয়বের নানা সঙ্কোচন-প্রসারণের সঙ্গে চোখের ব্যবহারকে আশ্রয় করে, যে অভিব্যক্তি আনতেন তিনি, তার তুলনা মেলা ভার। একজন আদ্যোপান্ত ‘সেরিব্রাল অ্যাক্টর’ বলা যায় তাঁকে। এহেন একজন অভিনেতা যে চলচ্চিত্রে এসে সম্পূর্ণ এক অন্য ধারার কমেডির প্রকাশ ঘটাবেন তাতে আর আশ্চর্য কী?
‘অঙ্গার’ নাটকে রবি ঘোষের অভিনয় দেখে প্রথম তাঁকে চলচ্চিত্রে সুযোগ দিলেন প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘কিছুক্ষণ’ ছবিতে ১৯৫৯ সালে। জহুরীর চোখ বটে অরবিন্দবাবুর। এরপর উৎপল দত্ত-র ‘মেঘ’, তপন সিংহের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’, অসিত সেনের ‘আগুন’ হয়ে ‘অভিযান’ ছবিতে রবি ঘোষ গিয়ে পড়লেন বিশ্ববন্দিত সত্যজিৎ রায়ের হাতে। ব্যস, একটা বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ হল। এরপর সারা অভিনয়জীবনে সত্যজিতের অনেক ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে। রবি ঘোষ তাঁর গোটা চলচ্চিত্রজীবনে নানা ছবির নানা চরিত্রে সুযোগ থাকলেই দেখিয়েছেন, ডার্ক কমেডি, স্যাটায়ার কমেডি, সিরিও-কমিক ইত্যাদি আরও বিভিন্ন কমেডি অভিনয়ের সার্থক রূপায়ণ। অবশ্যই পেশাগত কারণে অনেক সাধারণ ও নিম্নমানের ছবিতে তাঁকে অভিনয় করতে হয়েছে। তবে একথা আশা করি সবাই মানবেন, কোথাও তাঁর অভিনয়-দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকত না। কমেডির বাইরে কম হলেও অন্যরকম চরিত্রেও তাঁকে দেখা গেছে। যেমন, বিজয় বসু পরিচালিত অসাধারণ ছবি—’বাঘিনী’। যেখানে রবি ঘোষকে পরিচালক ভিলেন চরিত্রে ব্যবহার করেছিলেন। যে অভিব্যক্তি, চোখের ব্যবহার, অঙ্গভঙ্গি, সংলাপ বলার ধরন সাধারণভাবে দর্শকদের হাসায়, সেই সবকিছুর মধ্যে অল্প পরিবর্তন ঘটিয়ে এক লহমায় তার সবকিছুকে কতটা ক্রুর করে তোলা যায়, তার এক দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ এই ছবির চরিত্রাভিনয়ে তুলে ধরেছিলেন রবি ঘোষ। পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ‘ছায়াসূর্য’ ছবির কথাও বলতেই হয়। এ ছবিতে রবি ঘোষ এক বধির মানুষের চরিত্রে অবিস্মরণীয় অভিনয় করেছিলেন। চরিত্রটি যে কানে শুনতে পান না, প্রথমে দর্শক সেভাবে ততটা বুঝতে পারেন না। কিন্তু যখন জানা গেল, তখন চমক লাগে। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও সত্যি, জানার পর এর আগে অবধি রবি ঘোষের অভিনয়ের ধরনটি যখন দর্শকদের মনে আসতে থাকে, তখন বিশ্বাসগত জায়গায় ওই চরিত্রের বধিরতার ব্যাপারে একটু একটু করে যুক্তিও যেন তৈরি হতে থাকে। জানার আগে যা সেভাবে সচেতনতার স্তরে আসেনি। যে অভিনেতা দর্শকদের অবচেতন ও সচেতন সত্তা নিয়ে এই খেলাটা খেলতে পারেন, তাঁর অভিনয়ক্ষমতা কোন মাপের, তার হদিশ মেলাই যেন ভার হয়। পরিমিতি বোধ, সেন্স অফ টাইমিং, যথাযথ চরিত্র বিশ্লেষণের এ যেন একেবারে শেষ কথা। উল্লেখ বাড়িয়ে লাভ নেই। সর্বোপরি যা বলা যায়, দেশ-বিদেশের অভিনয়-রীতির রীতিমতো চর্চা, বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন ইত্যাদি রবি ঘোষের নিয়মিত অভ্যাসের মধ্যে ছিল। কমলকুমার মজুমদারের নাট্যদল ‘হরবোলা’-র সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন রবি ঘোষ। কমলবাবুর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি। শর্মিলা ঠাকুরকেও তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন কমলকুমারের কাছে। প্রসঙ্গত, ‘মহানগর’ ছবির জন্য জয়া ভাদুড়ির সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের সংযোগও ঘটিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে নানা লেখায় এইসব কথা ব্যক্ত করেছেন রবি ঘোষ। শুধু তাই নয়, অভিনয় নিয়ে তাঁর সিরিয়াস বিশ্লেষণ, বিভিন্ন প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বকে ঘিরে তাঁর ভাবনা, শুটিং-সহ অন্যান্য মজার অভিজ্ঞতার বর্ণনা বা স্মৃতিধর্মী রচনা মারফত গোটা জীবনের একঝলক উপস্থাপন ইত্যাদি অনেক কিছু বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে রবি ঘোষের কলমে।
রবি ঘোষের এরকম বেশ কিছু লেখা কাছে থাকাতে অনেকদিনই তাঁর রচনার একটি সংকলন-গ্রন্থের কথা মাথায় ঘুরছিল। মোটামুটি একটা কাঠামো খাড়া হতে, বই প্রকাশের ইচ্ছেটা প্রকাশ্যে এল। এগিয়ে এল ‘সপ্তর্ষি প্রকাশন’। এক কথায় অনুমতি পাওয়া গেল রবি ঘোষের সহধর্মিনী বৈশাখী ঘোষের কাছ থেকে। সঙ্গে অফুরন্ত উৎসাহও দিলেন এবং বেশ কিছু ছবিও পাওয়া গেল তাঁর কাছ থেকে। শ্রীমতী বৈশাখী ঘোষের কাছে আমরা অপরিসীম কৃতজ্ঞ। রবি ঘোষের প্রয়াণের পর (১৯৯৭) ‘রবি ঘোষ স্মৃতি সংসদ’ এক অসামান্য স্মারক সংকলন প্রকাশ করেছিল, সেটি—’আপন মনে’ নির্মাণে অসম্ভব সাহায্য করেছে। স্মারক সংকলনে প্রকাশিত রবি ঘোষের লেখা থেকে কয়েকটি লেখা এই বইয়ে নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া, ওখানে প্রকাশিত রবি ঘোষের কর্মপঞ্জির তালিকা থেকে প্রভূত সাহায্য পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, স্মৃতি সংসদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ডা. বারীণ রায়, যিনি আবার রবি ঘোষের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তিনি এককথায় স্মারক সংকলনে প্রকাশিত তপন সিংহ ও শর্মিলা ঠাকুরের রচনা দু’টি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। প্রথমটি বইয়ের ভূমিকা এবং দ্বিতীয়টি শেষে সংযোজিত রচনা হিসেবে ‘আপন মনে’ বইতে আছে। এজন্য ডা. বারীণ রায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতেই হবে।
এ বইয়ের মূল লেখাটি রবি ঘোষের আত্মকথাধর্মী রচনা—’ফিরে দেখা’। এছাড়া কিছু সিরিয়াস বিশ্লেষণধর্মী রচনা, কমলকুমার মজুমদার, সত্যজিৎ রায়, উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, কালী ব্যানার্জি, অনুপকুমার, ভানু ব্যানার্জি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, প্রসাদ সিংহ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে লেখা এবং তার সঙ্গে কিছু হালকা মজার অভিজ্ঞতার লিখন রূপ—এই নিয়েই গড়ে উঠেছে ‘আপন মনে’ বইয়ের মূল অংশ। সংযোজিত হয়েছে চলচ্চিত্র-সহ বিভিন্ন মাধ্যমে রবি ঘোষের কর্মের তালিকা। অবশ্যই এতে অসম্পূর্ণতা কিছু নিশ্চয়ই আছে। তবুও সাধ্যমতো চেষ্টা করা হয়েছে। প্রত্যেক রচনার শেষে কিছু বিষয়ের টীকাকরণও করা হয়েছে।
পূর্বোল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও, বইটির যথাসাধ্য সার্থক নির্মাণে সাহায্য করেছেন, অধ্যাপক নিখিলরঞ্জন প্রামাণিক, সঞ্জয় সেনগুপ্ত, তপজা মিত্র, সুমিতা সামন্ত, অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। এঁদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকলাম। এতদসত্ত্বেও বইটির যা কিছু ত্রুটি, তার জন্য সম্পাদক হিসেবে আগাম মার্জনা চেয়ে রাখলাম। সঙ্গে আন্তরিক আবেদন জানাই, পাঠককূল যেন তাঁদের অমূল্য মতামতটিও দেন। যা দ্বিতীয় সংস্করণে সংযোজিত হয়ে বইটিকে আরও সমৃদ্ধ করবে। আবারও বইটির হয়ে ওঠার পিছনে যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য, তাঁদের প্রত্যেককে সম্পাদক হিসেবে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, পাঠকের উদ্দেশ্যে নিবেদন করলাম মহান অভিনেতা রবি ঘোষের লেখা গ্রন্থ—’আপন মনে’।
রবি ঘোষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয়সমৃদ্ধ ছবি তপন সিংহের ‘গল্প হলেও সত্যি’। এক রূপকধর্মী ‘ধনঞ্জয়’ চরিত্রে রূপদানকারী রবি ঘোষের এ ছবিতে প্রথম আবির্ভাব কুয়াশার মধ্যে। আবার ছবির শেষে ‘ধনঞ্জয়’ কুয়াশায় মিলিয়ে যায়। অনেক কিছুর সঙ্গে কোথাও যেন পুরো বিষয়টাকে ঘিরে থাকে এক রহস্যময়তা। আসলে রবি ঘোষের মতো ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে থাকা অভিনয় প্রতিভা এক অর্থে রহস্যময় তো বটেই। মহান শিবরাম চক্রবর্তী এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘সার্কাসের ক্লাউন যেমন সব খেলাতেই ওস্তাদ, কিন্তু তার দক্ষতা হোলো দক্ষযজ্ঞ ভাণ্ডার। সব খেলাই জানে, সব খেলাই সে পারে, কিন্তু পারতে গিয়ে কোথায় যে কী হয়ে যায়, খেলাটা হাসিল হয় না; হাসির হয়ে ওঠে। আর হাসির হলেই তার খেলা হাসিল হয়।…’ —এটাই বোধহয় সার্থক কমেডি অভিনয়েরও মূল ভিত্তিভূমি। দক্ষতাকে অদক্ষতার রূপে প্রকাশ করতে গেলে যে বিশাল পরিমাণ ক্ষমতার দরকার, রবি ঘোষের যে তার থেকেও বেশ খানিকটা বেশিই ছিল, তা বোধহয় নতুন করে বলার দরকার নেই। প্রণাম এই মহান অভিনেতাকে।
অভীক চট্টোপাধ্যায়
রবির অভিনয়ে ছিল মাটির গন্ধ – তপন সিংহ
যতদূর মনে পড়ছে রবিকে প্রথম দেখি পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে কোনও একটা সময়ে। রূপবাণী সিনেমায় উল্টোপথ পুরস্কার দেওয়ার অনুষ্ঠান হত তখন। শ্রেষ্ঠ ছবি, শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের উল্টোরথ ফিল্ম ম্যাগাজিনের তরফ থেকে পুরস্কার দেওয়া হত প্রতিবছর। আমরাও যেতুম সম্পূর্ণ বাঙালির আয়োজিত একটা অনুষ্ঠান এই মনে করে। এমনি একটা অনুষ্ঠানে শেকসপিয়রের কোনও নাটকের অংশবিশেষ উৎপল দত্তের পরিচালনায় অভিনীত হয়েছিল। ওরই মধ্যে আরও ছোটোখাটো চেহারার একটি ছেলের অভিনয় অসাধারণ লাগল। মনে রাখার মতো। কিছুদিন পরে যখন তারাশঙ্করের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ ছবি করার কথা ভাবছি—চিত্রনাট্য তৈরি করছি। একদিন স্টুডিয়োতে শোভা সেনের সঙ্গে দেখা। কথায় কথায় রূপবাণীতে সেদিনের অভিনয় প্রসঙ্গে সেই বেঁটেখাটো ছেলেটির কথা জিজ্ঞেস করে জানলুম ওর নাম রবি ঘোষ। ও যে শক্তিশালী অভিনেতা সেদিন দেখেই বুঝেছিলাম। তবু শোভা সেনের কথায় মিনার্ভা থিয়েটারে গিয়ে অঙ্গার নাটকে ওর সনাতনের ভূমিকায় অভিনয় দেখে বিস্মিত হয়ে গেলাম।
‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’র চিত্রনাট্য শেষ করে কাস্টিং করার সময় ‘নিমতেলে পানুর’ চরিত্রটা রবির জন্যে ঠিক করলুম। দারুণ অভিনয় করেছিল রবি। ছোট্ট রোল হলেও অনেক শিল্পীর ভিড়ে রবি দর্শকদের নজর কেড়েছিল। ইতিপূর্বে রবি দু-একটা ছবি কাজ করেছিল ঠিকই কিন্তু ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’য় দর্শকদের রায়েই মনে হয় পেশা হিসেবে চলচ্চিত্রে রবির জায়গাটা পাকা হয়ে গেল। এটা ১৯৬২ সালের কথা।
এরপর আর রবিকে পিছন ফিরতে হয়নি। ১৯৬৩ সালে ‘নির্জন সৈকতে’ আমার পরের ছবিতে রবি এক ওড়িয়া পান্ডার ভূমিকায় অভিনয় করেছিল। পুরী স্টেশনে ‘নির্জন সৈকতে’র শুটিং করার সময় বেশ মজা হয়েছিল। পান্ডার মেকআপে রবি একরকম জোর করে টেনে নিয়ে চলেছে তীর্থযাত্রীদের (ছায়াদেবী, ভারতীদেবী আরও অনেকে)। আসল পান্ডারা এই দেখে তো চটে আগুন—কে একটা পান্ডা এক রকম জবরদস্তি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে! পরে অবশ্য এটা সিনেমার শুটিং বুঝতে পেরে খুব মজা লেগেছিল ওঁদের। ইতিমধ্যে রবির দু’দুটো ছবি হিট করেছে। ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’র পরেই অসিত সেনের ‘আগুন’ এবং সত্যজিৎ রায়ের ‘অভিযান’। অভিযানে সৌমিত্রর পাশে সামান্য মোটরগাড়ির হেল্পার হিসেবে রবি অভিনয়ে নিজের বৈশিষ্ট্যটুকু ঠিক চিনিয়ে দিয়েছিল। ১৯৬৪-তে বনফুলের গল্প নিয়ে আমার ছবি ‘আরোহী’তে একটা স্টেশন মাস্টারের চরিত্রে অভিনয় করেছিল রবি। কমেডি নয় সিরিয়াস। ছোটো হলেও কঠিন ছিল। তাপ উত্তাপহীন একটা জীবন—টিপিক্যাল বাঙালির চরিত্র। তখনকার দিনে এরকম স্টেশনমাস্টার আর পোস্টমাস্টার সারা ভারতে ছড়িয়ে ছিল। সত্যজিৎবাবু ‘আরোহী’তে রবির অভিনয় দেখে বলেছিলেন, ‘দেখুন কালী ব্যানার্জিরা রয়েছে, ওদের স্কোপও রয়েছে কিন্তু দু’টো সিনে রবি কী কাণ্ড করেছে।’
এরপর ১৯৬৬ সালে রবিকে নিয়ে আমার ছবি ‘গল্প হলেও সত্যি’। রবিকে ভেবেই লেখা। রবি এই প্রসঙ্গে বলেছিল, ‘সবাই তো নামকরা হিরোকে নিয়ে ছবি করে। আপনি আমাকে হিরো করে ছবি করছেন। ফলে একটা অতিরিক্ত দায়িত্ব আমার ওপর এসে পড়ল।’ রবির ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলুম। যেভাবে স্ক্রিপ্ট করা হয়েছিল আমি জানতুম ও জাস্টিস করবেই। রবিকে নিয়ে এই ছবি করে আমি যে ভুল করিনি সে কথা আর অজানা নয় কারও।
অভিনেতা হিসেবে রবির মধ্যে যে-সব গুণ ছিল—সহজ সাবলীলতা সেন্স অফ টাইমিং, সুরের তাল, তালজ্ঞান, এমনকি নাচের একটা ছন্দজ্ঞান। এসবেরই পরিচয় আছে ‘গল্প হলেও সত্যি’তে। রবি বাড়িতে স্ক্রিপ্ট নিয়ে গিয়ে হোমওয়ার্ক করে একেবারে রেডি হয়ে ফ্লোরে আসত। ফ্লোরে এসে আর স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসত না—সকলের সঙ্গে গল্পগুজব করত। কিন্তু ‘শট’-এর সময় একেবারে পারফেক্ট।
কুইক থিংকিং-এর ক্ষমতা ছিল রবির। অনেক সময় হয়তো এক্সটেমপোর ডায়লগ বলত। আমার ভালো লাগলে রেখে দিতুম। চরিত্রের ভেতরে থেকেই কিছু অ্যাড করার ক্ষমতা রবির ছিল—যেটা ওর অভিনয়ে একটা অন্য মাত্রা এনে দিত।
মঞ্চাভিনয় আর সিনেমার অভিনয়ের পার্থক্য রবি অল্পদিনেই আয়ত্ত করে নিয়েছিল। স্ক্রিপ্ট পড়ার সময় সব সময়েই পরিচালক কী চাইছেন তা ছোটো বড়ো সব অভিনেতাকেই একটু বুঝিয়ে বলতে হয়। তবু সবক্ষেত্রে সবার কাছে হয়তো যেটুকু আশা করা যায় তা পাওয়া যায় না। রবির ক্ষেত্রে কিন্তু তা কখনও হত না। বুঝিয়ে দেবার পর যেটা চাওয়া হয়েছে রবি ঠিক ঠিক সেটা করতে পারত। আমার রিকোয়ারমেন্টটা ও পুরোপুরি মিটিয়ে দিতে পারত। আর একটা জিনিস রবি কাউকে কখনও কপি করার চেষ্টা করত না। যা করত ও নিজের মতো। সম্ভবত এই জন্যেই দর্শকদের কাছে ওর জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা ছিল এত বেশি। সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ ছবিতে সেই অভিনেতার ভূমিকায় রবি ঘোষকে মনে করে দেখুন। ফোর গ্রাউন্ডে মেন আর্টিস্ট দু’জনের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে—কিন্তু রবিই আমাদের চোখ টেনে নিচ্ছে বারবার। নি:সন্দেহে রবি ছিল একজন সংবেদনশীল অভিনেতা। কী সিরিয়াস চরিত্রে কী কমেডি রোলে ও ছিল সমান পারদর্শী।
রবিকে কমেডিয়ান বলে ছাপ মেরে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একজন টোটাল অ্যাকটর বলতে যা বোঝায় রবি ছিল তাই। তার মানে এই নয় যে তার আগে ছিল না। আমরা ইতিহাস বড়ো তাড়াতাড়ি ভুলে যাই। হয় কী, এক সময়ের অভিনেতারা এক জায়গায় এসে দাঁড়ান। পরবর্তী প্রজন্মের অভিনেতারা সেখান থেকে নিজের গুণে কিছু পিকআপ করে তারপর নিজেদের মতো কিছু তৈরি করে নেন। আমার মনে হয় রবি এই প্রসেসের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল। রবির সমসাময়িককালে এবং ওর আসার আগে অনেক শক্তিশালী অভিনেতাকেই এইভাবে একটা ছাপ মেরে দিয়ে ব্যবহার করা হয়েছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের অনেকের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। রবির ক্ষেত্রেও নয়। ইদানীং ওকে বলতে শুনেছি, ‘আর পারি না। তপনদা এত বিরক্তিকর ব্যাপার হয়েছে আর পারা যাচ্ছে না।’
রবি সিনেমায় এসেছিল নাটক থেকে বা মঞ্চশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার পর। আমাদের বাংলায় সিনেমা বলি বা থিয়েটার বলি অভিনয়ের একটা ধারাবাহিকতা চলে আসছে অনেকদিন থেকে। এই ধারার একটা বিরাট দান অবশ্যই ছিল এবং আছে। রবি সেই ধারারই উত্তরসূরি। বাংলা স্টেজে অভিনয়ের ধারাবাহিকতা মাথায় রেখেই ও অভিনয় করত। তার ওপর ছিল ওর আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অভিনয় করার শিক্ষা। ছিল ওর পড়াশোনা, কাজের প্রতি ওর ঐকান্তিক নিষ্ঠা আর ভালোবাসা।
মোটের ওপর বাঙালি জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে রবি যে একজন বিশিষ্ট অভিনেতা ছিল তাতে সন্দেহ নেই। যে কোনও বাঙালি চরিত্র রবিকে দিলে রবি যথাযথ রূপ দিতে পারত তার অভিনয়ের মাধ্যমে। রবির অভিনয়ে ছিল মাটির গন্ধ। আগে হচ্ছে সয়েল—মাটি। সেই সয়েলের মতো করে অভিনয় করা—একজন অভিনেতার পক্ষে বিরাট ব্যাপার।
আমাদের দুর্ভাগ্য। আমার তো বটেই, রবি হঠাৎ এমনি করে চলে গেল। মাঝে মাঝে মনে হয়—কী অদ্ভুত। আমার হাতেই ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ দিয়েই সিনেমায় ওর অভিনয় জীবন একরকম শুরু। আমার হাতেই শেষ। হুতোমের নক্সা আমার টিভি সিরিয়ালে কাজ করছিল। মনোজ মিত্র আর রবি ঘোষকে নিয়ে একটা স্লাপস্টিক করার ইচ্ছে ছিল। মাঝখান থেকে রবি চলে গেল। পেয়ার ভেঙে গেল। রবির অভাব কাজের জায়গায় অনেকদিন আমাদের ভাবাবে। ‘গল্প হলেও সত্যি’র মতো একটা ছবি করার কথা আর ভাবা যাবে কি?
.
প্রদ্যোতকুমার ভদ্র ও রানা দাস সম্পাদিত ‘রবি ঘোষ স্মারক সংকলন’ (রবি ঘোষ স্মৃতি সংসদ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮) গ্রন্থ থেকে ডা. বারীণ রাযের অনুমতিক্রমে ‘ভূমিকা’ হিসেবে পুনর্মুদ্রিত।
Leave a Reply