আধুনিক য়ুরোপীয় দর্শন – দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ – চৈত্র, ১৩৫৩
উৎসর্গ
শ্রীযুক্ত গোবিন্দচন্দ্র দেব
শ্রদ্ধাস্পদেষু
.
পটভূমি
অরুন্ধতী নক্ষত্রকে আকাশের অন্ধকারে খুঁজে পাওয়া কঠিন; তার যে-জ্যোতি পৃথিবীতে এসে পৌঁছোয় সে-জ্যোতি বড় সূক্ষ্ম, বড় ক্ষীণ। অথচ, আমাদের দেশে প্রথ ছিল বিবাহরাত্রে নববধুকে সেই নক্ষত্র দেখানো। এই দুরূহ কাজ সহজে সেরে নেবার জন্যে প্রাচীনেরা এক উপায় আবিষ্কার করেছিলেন। অরুন্ধতীর কাছাকাছি আকাশে যে উজ্জ্বলতর নক্ষত্র চোখে পড়ে তার দিকে নববধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রথমে বলা হত : ওই দেখ অরুন্ধতীর উপর নিয়ে যাওয়া কঠিন হত না। লোকব্যবহারের এই উপমা দিয়ে প্রাচীনেরা দর্শনশাস্ত্রেও একটি পদ্ধতির প্রচলন করেছিলেন, সে-পদ্ধতির নাম তাই অরুন্ধতী-ন্যায়। বক্তব্য যেখানে বেশি জটিল, বেশি সূক্ষ্ণ, সেখানে প্রথমেই পাঠককে তার মধ্যে টেনে আনতে গেলে বিভ্রান্তির সম্ভাবনা—অপেক্ষাকৃত স্থূল কথা দিয়ে আলোচনা সুরু করে ক্রমশ সূক্ষ্মের দিকে অগ্রসর হওয়াই শ্রেয়।
বিশ্ববিদ্যা-সংগ্রহের সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আধুনিক য়ুরোপীয় দর্শন সম্বন্ধে সাধারণ-পাঠ্য, অতএব সহজবোধ্য, পুস্তিকা রচনায় প্রয়াসী হয়ে প্রাচীনদের উক্ত পদ্ধতিতে অমূল্য উপদেশ হিসেবে গ্রহণ করেছি। হালের বিদেশী দর্শনে কূটতর্ক ও অতি সূক্ষ্ম প্রসঙ্গের এমন প্রাচুর্য যে সে-সবের অক্ষম উল্লেখ করেও সাধারণ পাঠককে বিপর্যস্ত করে ফেলা যায়। তাতে নিশ্চয়ই মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। অপরপক্ষে, এ-যুগের দর্শনকে নিছক বহিঃরেখার দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলেই নিজেকে কৃতার্থ মনে করা উচিত। কেবল বলে রাখা দরকার—এ নেহাতই স্থূল, বাহ্য পরিচয়—আধুনিক য়ুরোপীয় দর্শনের প্রকৃত পরিচয় পেতে হলে এর পর যোগ্যতর ব্যক্তির নির্দেশ মেনে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে।
আপাতত, নেহাত স্থূল পরিচয়ের উদ্দেশী বলেই ‘আধুনিক’ বা ‘দর্শন’ কথার শব্দার্থ নিয়ে তর্ক সংগত হলেও উপেক্ষা করা প্রয়োজন। উভয় শব্দকেই প্রচলিত অর্থে গ্রহণ করা ভালো। এক কথায়, আজকাল বিলেতে পাঁচজনে যে-সব মতবাদকে দার্শনিক মতবাদ বলে স্বীকার করে নেন তারই সামান্য পরিচয় এ পুস্তিকার একমাত্র আদর্শ।
হালের য়ুরোপীয় দর্শনের একদিকে ব্রাডলি প্রমুখের পরব্রহ্মবাদ, এবং অপরদিকে নানা ভাবে, নানান দৃষ্টিকোণ থেকে, এই সর্বগ্রাসী ব্রহ্মবাদের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ, তীব্র বিদ্রোহ। কিন্তু আলোচনা সুরু করতে হবে আরও গোড়ার কথা থেকে। কেননা, সাম্প্রতিক ব্রহ্মবাদে হেগেল-দর্শনের প্রতিধ্বনি; এবং মধ্যযুগের পর থেকে য়ুরোপীয় দর্শনে যে আন্দোলন সুরু হয়েছিল তারই চরম বিকাশ দেখা গেল হেগেলে। তাই, পটভূমি হিসেবে, সে-যুগের কথাটুকু বলে নেওয়া দরকার।
মধ্যযুগের দার্শনিকদল প্রধাণত ধর্মপ্রাণ ছিলেন। বিশ্বের চরম রহস্য যে ধর্মপুঁথির পাতায় আবদ্ধ এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা ছিল নেহাতই নাস্তিক নির্বুদ্ধিতা; দর্শনের আসল কাজ তাই তথ্য আহরণ নয়, অর্থ বিশ্লেষণ—ধর্মের গূঢ় রহস্য মানববুদ্ধির আওতায় এনে দেওয়া। এ-যুগের দর্শন তাই বন্ধ্যা আধ্যাত্মিকতা এবং শব্দার্থ প্রভৃতি নিয়ে কূট বিচারের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। তখন কোনো মহৎ চিন্তাশীল ব্যক্তির জন্ম যে হয়নি তা নয়, কিন্তু তাঁরাও ছিলেন যুগের দাস। সমাজতত্ত্বের পণ্ডিত তাই বলেন দর্শনের এ দুর্গতি সামাজিক দুর্গতিরই প্রতিধ্বনি। মধ্যযুগে সমাজের দেহে প্রাণশক্তি প্রায় ফুরিয়ে এসেছিল এবং সেন্ট্ টমাস এ্যাকুরিনাসের মত প্রখর মেধাবীকেও এই অথর্ব সমাজেরই দাসত্ব মানতে হয়েছিল।
তারপর য়ুরোপে ধন উৎপাদন এবং বণ্টন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন দেখা দিল আর এই আলোড়নের ঢেউ এসে লাগল শিল্প ও সংস্কৃতির তথাকথিত নৈর্ব্যক্তিক রাজত্বেও। দার্শনিকের দল নতুন উৎসাহে কাজ সুরু করলেন, মধ্যযুগের বৃথা তর্কে তাঁদের আর মন উঠল না। অধ্যাত্মবিদ্যার ঘোলাজলে কুপমণ্ডূকের মত বসে থাকা নয়—নতুন পথে এগোতে হবে। কিন্তু কোন্ পথ? তখন তাঁদের সামনে পথ শুধু একটাই : যে পথে বিজ্ঞান এগোয়। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন অভিযান সকলের চোখে নেশা ধরিয়েছে, বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কার দুনিয়ার চেহারা একেবারে বদলে দিতে চাইছে। অবশ্যই, এ পথ দুর্গম,—পুরোনো পৃথিবীর যারা প্রতিনিধি তারা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে, মরিয়ার মত যে-কোনো উপায় অবলম্বন করে এই অগ্রগতি রুখতে বদ্ধপরিকর। তবু, অনেক সংগ্রামের পর, অনেক আত্মোৎসর্গের পর—রোজার বেকন, লিওনার্দ্য দা ভিঞ্চি, কোপার্নিকাস্, গ্যালিলিও, কেপনার, ব্রুণো প্রভৃতির বিরাট ব্যক্তিত্বের সাহায্যে,—শেষ পর্য্যন্ত বিজ্ঞানেরই জয় হল এবং দার্শনিকের দল প্রায় অবিসংবাদিক ভাবেই স্বীকার করলেন বিজ্ঞানের পদ্ধতি আর দর্শনের পদ্ধতি অভিন্ন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষাশেষি দার্শনিক মহলে শোনা গেল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উচ্ছ্বসিত আগমনী। উদাহরণ, ইংলণ্ডে ফ্রান্সিস্ বেকন আর ফ্রান্সে রেনে ডেকার্ট। কিন্তু বিপদ বাধল বিজ্ঞানের প্রকৃত রূপ নির্ণয় নিয়ে। এই সমস্যার মুখোমুখি এসে দার্শনিকদল স্পষ্ট দুভাবে বিভক্ত হয়ে পড়লেন। ডেকার্ট, স্পিনোজা আর লাইবনিৎস্ ঠিক করলেন বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ গণিতশাস্ত্রে এবং গণিতশাস্ত্রের সাফল্যের মূল রহস্য শুদ্ধবুদ্ধি-নির্ভরতা। অতএব, বিশুচ্ছ বুদ্ধিই দার্শনিকের অস্ত্র হওয়া উচিত। অপরপক্ষে, বেকনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে লফ্, বার্কলি এবং হিউম প্রচার করলেন যে পদার্থবিজ্ঞানই প্রকৃত বিজ্ঞান এবং এখানে জ্ঞান যে বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে তার একমাত্র কারণ অভিজ্ঞতা বা ইন্দ্রিয়সংবেদ-এর উপর একান্ত নির্ভরতা।
কিন্তু মজার কথা এই যে, বিজ্ঞানের প্রকৃত পদ্ধতি নিয়ে এঁদের মধ্যে যত কলহই থাকুক-না কেন, বিশ্বের স্বরূপ বর্ণনায় উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আশ্চর্য মিল। কেননা, এ যুগের দার্শনিকদের মধ্যে যে-মত সত্যিই প্রাধান্য পেয়েছে তা হল বিজ্ঞানবাদ,—যদিও এ বিজ্ঞানবাদ সর্বত্র সমান স্পষ্ট নয়, কোথাও বা তা ব্যক্ত কোথাও বা প্রচ্ছন্ন। বিজ্ঞানের মূল কথা—বিশ্বপ্রকৃতির নিজস্ব সত্তা বলতে কোনো কিছু নেই, তার অস্তিত্ব আসলে নির্ভর করে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার উপর। একদিকে বিজ্ঞান সম্বন্ধে অমন অগাধ উৎসাহ এবং অপর দিকে বিশ্বপ্রকৃতির নিজস্ব সত্তা অস্বীকার করাটা মজার ব্যাপার নয় কি? কারণ, অন্তত সহজবুদ্ধিতে যা মনে হয়, বিশ্বপ্রকৃতির প্রকৃত সত্তা সম্বন্ধে সন্দিহান হলে বৈজ্ঞানিকের পক্ষে জ্ঞান, গবেষণা বা আবিষ্কারে উৎসাহী হওয়া সম্ভবই নয়। তবুও বিজ্ঞানের দোহাই দিয়েই, বিজ্ঞানের স্বরূপ সম্বন্ধে মনগড়া মতবাদ প্রচার করে, এ যুগের দার্শনিকদল একটানা এগিয়ে চললেন বিজ্ঞানবাদের দিকেই! এবং যাঁরা এই বিজ্ঞানবাদে সায় দেয়নি, যাঁরা জড়বাদের জয়ধ্বনি তুলতে চেয়েছিলেন (যেমন বিশেষ করে ফরাসী জড়বাদীদের কথা বলা যায়) পেশাদার দার্শনিক মহলে তাঁদের যেন আমলই দেওয়া হল না। অবশ্যই সমাজতত্ত্বের পণ্ডিত মনে করিয়ে দেন যে, এ যুগের দর্শনে এমনটা না হয়ে উপায় ছিল না। কারণ, য়ুরোপের নতুন সমাজে—ধনতান্ত্রিক সমাজে—শ্রেণীবিভাগ অত্যন্ত প্রকট হয়ে পড়ল। একদিকে দিন মজুরের দল—তারা শুধুই গতর খাটায় এবং শুধু গতর খাটায় বলেই মাথা খাটাবার ফুরসত পায় না। অপরদিকে বিজয়ী মধ্যবিত্তর দল। তাদের হাতে পুঁজি জমল অজস্র এবং তারা দেখল পুঁজি খাটিয়েই পুরুষার্থ লাভ হয়, গতর খাটাবার প্রয়োজন নেই, মাথা খাটাবার ঢালাও অবসর। নবযুগের দার্শনিকদল এই নব্য শ্রেণীরই প্রতিনিধি—চিন্তার আর জ্ঞানের জয়ধ্বনি না তুলে তারা পারবে কেন? বিজয়োন্মত্ত নব্য মধ্যবিত্তশ্রেণী কারো কোনোরকম দাসত্ব মানতে রাজি নয়—এমনকি জ্ঞানের বেলাতেও বিষয়ের হুকুম, বিষয়ের দাসত্ব স্বীকার করা অসম্ভব। তাছাড়া, এই চিন্তা বা জ্ঞান জিনিসটার মধ্যেই যে তার তার একান্ত নিজস্ব স্বাক্ষর। তাই দার্শনিকের দলও প্রচার করলেন সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতি জ্ঞাতার মনের মুখাপেক্ষী। এর কোনো নিজস্ব সত্তাই নেই—জ্ঞাতার উপর হুকুম জারি করা তো দূরের কথা। এদিকে বিজ্ঞানের কথাটাও অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়; কেননা বিজ্ঞানকে অস্ত্র হিসেবে পেয়েছিল বলেই নব্য মধ্যবিত্তশ্রেণীর জয়জাত্রা সম্পূর্ণ হতে পেরেছিল। আর, বিজ্ঞানকে মেনে নিয়ে, এমন কি বিজ্ঞান সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত হয়েও, বিজ্ঞানবাদ মানতে বাধা নেই। সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতিকে মনগড়া জিনিস বলে প্রচার করবার সাহস ও তর্কবল যাদের আছে তাদের পক্ষে বিজ্ঞানের একটা মনগড়া ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া এমন কিছু কঠিন নয়।
অবশ্য আগেই বলেছি, এ যুগের সমস্ত দার্শনিকদের বিজ্ঞানবাদ সর্বত্র সমান স্পষ্ট নয়। কাণ্টের পর থেকে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে এসেছে, কিন্তু কাণ্টের আগে পর্যন্ত বুদ্ধিবাদী এবং ইন্দ্রিয়বাদী দুই দার্শনিক সম্প্রদায় কেমন ভাবে স্পষ্ট বা প্রচ্ছন্ন বিজ্ঞানবাদী তা আলোচনা করতে হবে। বুদ্ধিবাদ দিয়ে শুরু করা যাক।
ডেকার্ট দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন চরম নিশ্চয়তার উপর। এ নিশ্চয়তা কোথায় পাওয়া যাবে? বিশ্বের বস্তুরাজ্যে নয়, কেননা স্বপ্নে তার সত্তা অবিকৃত থাকে না। এমন কি গণিতের রাজ্যেও নয়, কেননা গণিতে বুদ্ধির বিশুদ্ধ ক্রিয়া হলেও এমন তো হতেই পারে যে এক দুষ্ট স্রষ্টার কূট ইচ্ছায় আমাদের বুদ্ধি-ব্যাপারটার মূলেই গলদ রয়ে গিয়েছে। তাহলে? সংশয়ের সীমা সম্পূর্ণ পেরিয়ে কি কিছু খুঁজে পাওয়া যায়? উত্তরে ডেকার্ট বললেন, একমাত্র আমাদের মন, আমাদের চিন্তাশক্তি, সবরকম সংশয়ের সীমা পেরিয়ে রয়েছে। কেননা, সংশয় ব্যাপারটাই চিন্তার ক্রিয়া এবং স্রষ্টা যদিই বা প্রতি পদে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে বিভ্রান্ত করতেই উৎসুক হন তাহলেও অন্ততঃ বিভ্রান্ত হবার জন্যেও এই বুদ্ধিবৃত্তির সত্তা অবশ্যম্ভাবী। তাই, দুনিয়ার সব কিহচু সম্বন্ধে সংশয় করা যেতে পারে, পারে না শুধু জ্ঞাতার অস্তিস্ত্ব সম্বন্ধে। কাণ্ট তাই ডেকার্ট-দর্শন সংশয়াত্মক বিজ্ঞানবাদ বলে বর্ণনা করেছেন। স্পিনোজা এলেন ডেকার্টের পর; বললেন—ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। এই ব্রহ্মের, এই অবিকারী সনাতন সত্তার স্বরূপ কি? উত্তর পাওয়া যায় স্পিনোজার গ্রন্থের শেষাংশে—ব্রহ্মজ্ঞান, যার নাম তিনি দিয়েছেন প্রেমগত জ্ঞান, তার মধ্যেই ব্রহ্মের বিকাশ; বেদান্তে যেমন বলা হয়—সত্যং জ্ঞানম্ অনন্তম। এই মতবাদকে বিজ্ঞানবাদ বলে স্বীকার না করে আর উপায় কি? স্পিনোজার পর লাইবনিৎস্। লাইবনিৎসের বিজ্ঞানবাদ স্পষ্ট ও ব্যক্ত। জ্ঞাতার প্রত্যক্ষ তাঁর কাছে প্রত্যক্ষাভাস মাত্র, কেননা জগৎ আর কিছুই নয়, অসংখ্য চিৎপরামাণুর লীলা। যাকে আজ জড় বলে মনে হচ্ছে আসলে তা হল অচেতন মন—ক্রমোন্নতির পথে একদিন তার মধ্যেও চেতনার সাড়া পাওয়া যাবে।
এই তো গেল বুদ্ধিবাদী দার্শনিক সম্প্রদায়ের কথা। অপরপক্ষে ইন্দ্রিয়বাদও ক্রমশঃ একটানা গিয়ে চলল বিজ্ঞানবাদের পথে। লক্ অবশ্যই সচেতনভাবে বিজ্ঞানবাদী ছিলেন না। কিন্তু লকের দার্শনিক বংশধর বার্কলি ও হিউম স্পষ্টই দেখতে পেলেন দর্শনে লক যে বীজ বপন করেছেন তার একমাত্র ফল হল বিজ্ঞানবাদ। অর্থাৎ, লকের মূলসূত্র যদি মানতেই হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানবাদ ছাড়া আর কোনো গতি নেই। লকের প্রধান কথা ইন্দ্রিয়-সংবেদনই জ্ঞানের একমাত্র উৎস, এবং এ বেদনা যার সংবাদ দেয় শুধু তার সত্তাই অবিসংবাদিত। অথচ, নিছক ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বহির্জগৎ বলে কিছুর অস্তিত্ব পাওয়া সম্ভবই নয়। ইন্দ্রিয় মানবমনের কাছে যে সংবাদ আনে তা শুধু কয়েকটি ইন্দ্রিয়-সংবেদনেরই এবং সেই বেদনাগুলি মানসিক জিনিস, বহির্জগতের জিনিস মোটেই নয়। পাঠ্যপুস্তকের অতি প্রচলিত উদাহরণটাই ধরা যাক : নিছক ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে টেবিল বলে কোনো জিনিসের সন্ধান কি মানুষ কখনো পেয়েছে? যা পাওয়া যায় তা তো শুধু কয়েকটি ধারণা—চোখ দিয়ে রঙের আর আকৃতির ধারণা, হয়তো বাদামী রঙের ধারণা, চৌকো আকৃতির ধারণা; স্পর্শ দিয়ে কাঠিন্যের ধারণা, মসৃণতার ধারণা—এই রকম শুধু কয়েকটি ধারণাই। এবং ধারণা মাত্রই মানসিক। হয়তো অভ্যাস বশতঃ এই সব ধারণার সমষ্টিকেই আমরা টেবিল বলে উল্লেখ করি; কিন্তু এই বস্তু-টেবিল-কে কোনোদিন চোখেও দেখি নি, হাত দিয়েও স্পর্শ করি নি। অতএব, নিছক ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করতে হলে টেবিল বলে বস্তুর কথাই তোলা উচিত নয়—অজস্র মানসিক ধারণা এবং তাদের সমষ্টি ছাড়া দুনিয়ার আর কিছুই নেই। এ হল চরম বিজ্ঞানবাদের কথা, এবং হিউম পরিষ্কার ভাবে প্রমাণ করে দিলেন যে ইন্দ্রিয়বাদের এই হল একমাত্র পরিণতি।
তারপর এলেন কাণ্ট। তিনি দেখলেন মধ্যযুগের পর দর্শনের ক্ষেত্রে কোলাহল যতই হোক না কেন, কাজ একটুও এগোয় নি। দর্শন ঘোলাজলের ডোবাই হয়ে রয়েছে; না এসেছে নিশ্চয়তা, না দেখা দিয়েছে অগ্রগতি। তার কারণ বিজ্ঞানের প্রকৃত রূপ যে কী তা বুদ্ধিবাদও ধরতে পারেনি, ইন্দ্রিয়বাদও নয়। এই দুই মতবাদই ভ্রান্ত কেননা উভয়েই অর্ধ্বসত্যকে পূর্ণ সত্য বলে প্রমাণ করতে চায়। পদার্থবিজ্ঞান আর বিশুদ্ধ গণিত—দুইই বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান হিসেবে এদের মূল রহস্য একই। বিজ্ঞানের প্রকৃত প্রণালী—অতএব জ্ঞানের মূল উৎস—নিছক বুদ্ধিও নয়, নিছক ইন্দ্রয়সংবেদনও নয়, এ দুয়ের সার্থক সংশ্লেষণ। কথাটা কাণ্ট কি ভাবে প্রমাণ করেছেন সে আলোচনার অবসর এখানে নেই, মোটামুটি তাঁর মতবাদটুকু বলা যায়। তাঁর মতে মানব-মন ইন্দ্রিয়ের মধ্যে দিয়ে সংবেদন সংগ্রহ করে, কিন্তু এই ইন্দ্রিয়ের উপর ‘দেশ’ আর ‘কাল’ বলে দু রকমের মানসিক ঠুলি পরানো আছে; তাই যে সংবেদনই মনের কাছে পৌঁছাক না কেন তার উপর দেশ ও কালের ছোপ পড়ে যায়। অবশ্যই, এই দেশ ও কালের মধ্যে দিয়ে যে সংবেদন সংগ্রহ করা হয় সেটাই জ্ঞান নয়, জ্ঞানের মালমশলা মাত্র। শুধু মালমশলা স্তূপ করে রাখলেই তো ইরামত তৈরী হয় না—রাজমিস্ত্রী লাগিয়ে তা দিয়ে কাজ করাতে হয়। জ্ঞানের বেলাতেও ঠিক তাই : ইন্দ্রিয় বেদনগুলোর উপর বুদ্ধির ক্রিয়া হলে তবেই গড়ে ওঠে জ্ঞানের ইরামত। বিশ্বজগৎ বলতে আমরা এই ইরামতকেই বুঝি। তাহলে, আমরা যা-কিছু জানি তার অনেকখানেই আমাদের মনের সৃষ্টি—জ্ঞাতার বুদ্ধির দান বাদ দিলে বিশ্বপ্রকৃতির রূপ কি রকম হত তা জানবার কোনো উপায়ই আমাদের নেই। যে জগৎকে আমরা জানি তা প্রধাণতই বুদ্ধিনির্মিত। সে জগৎকে পেরিয়ে বস্তুর আসল রূপ আবিষ্কার করবার উপায় না থাকলেও দার্শনিকদের মধ্যে তার আগ্রহ অপরিসীম, এবং এই অপরিসীম আগ্রহের বশবর্তী হয়ে বস্তুসত্তা সম্বন্ধে তাঁরা নানা রকম এলোমেলো মতবাদ প্রচার করেন মাত্র। সে যাই হোক বিশ্বপ্রকৃতিকে বুদ্ধিনির্মাণ বলাই যখন বিজ্ঞানবাদের মূল কথা, তখন কাণ্টকেও নিশ্চয়ই বিজ্ঞানবাদী বলতে হবে।
কাণ্টোত্তর দার্শনিকদের প্রধান উদ্দেশ্য হল কাণ্টের বিজ্ঞানবাদকে আরও একটু মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করা। কাণ্টের দর্শনে দ্বৈতবাদের অসহ্য প্রতিপত্তি : একদিকে মানবমন এবং অপরদিক চিরঅজ্ঞাত বস্তুসত্তা। এ দুয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা দূরের কথা, মুখ-দেখাদেখি পর্য্যন্ত নেই! ফিক্টে, শেলিং আর হেগেল এই দ্বৈতবাদের হাত থেকে মুক্তি খুঁজলেন, বিজ্ঞানবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন অদ্বৈতবাদের মজবুত ভিত্তির উপর। ফিক্টে বললেন, কাণ্টের তথাকথিত অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় বস্তুস্বরূপ অলীক ধারণা মাত্র। যাকে জানা যায় না, জানবার কোনো উপায়ই নেই, তাকে মানাই বা যাবে কেমন করে? তাহলে, মানুষের মন আর সেই মনের নির্মাণ—এ ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকে না। কিন্তু, মন যে নির্মাণ করে সে নির্মাণের মালমসলা জোটে কোথা থেকে? ফিক্টে বললেন, তথাকথিত কোনো বস্তুস্বরূপ থেকে নিশ্চয় নয়, কেননা সে জিনিস অলীক। তাহলে? মানতেই হবে যে, মানবমন নিজেই জ্ঞানের মালমশলা তৈরি করে, আর তার পর তাকে জানে। এ যেন তার একরকমের লীলা—মন নিজেই নিজের চারপাশে গণ্ডি টানছে!
শেলিং কিন্তু ফিক্টের কথায় সায় দিতে পারলেন না : আমাদের মন, আমাদের সংকীর্ণ ব্যক্তিগত মন, একমাত্র সত্য হতে পারে না। পরমসত্তা হলো ব্রহ্ম-মন, এবং এ ব্রহ্মের এমন বর্ণনা তিনি দিলেন যে শেষ পর্যন্ত যেন তিনি স্পিনোজার ব্রহ্মবাদেই ফিরে যেতে চান। তারপর হেগেল। ফিক্টের মতো আমাদের ব্যক্তিগত মন বা চিন্তাধারাকেই একমাত্র সত্য বলে মেনে নিতে তিনি রাজি নন, অপরপক্ষে স্পিনোজা বা শেলিং-এর সঙ্গে নির্গুণ ব্রহ্মের ব্যাখ্যাতেও তাঁর উৎসাহ নেই। অথচ, কাণ্টীয় অজ্ঞানবাদ একেবারেই অসহ্য। ফলে, হেগেল সুরু করলেন সগুন ব্রহ্মের কথা। পরমসত্তা ব্রহ্ম-মন সন্দেহ নেই; কিন্তু এ ব্রহ্মের মধ্যে চিদচিদ্ জগতের স্থান অবিসংবাদিত। বস্তুত, এই চিদচিদ্ জগতের মধ্যে দিয়েই তাঁর বিকাশ। নিজের চারপাশে স্বেচ্ছা-গণ্ডী রচনা করা তাঁর লীলা নয়—তাঁর লীলা হল সীমার মধ্যে অসীম সত্তাকে প্রকাশ করা। হেগেলের দার্শনিক প্রতিভার সঙ্গে মিলেছিল তাঁর পাণ্ডিত্য, এবং এই পাণ্ডিত্যের বলে জ্ঞানের প্রত্যেক অঙ্গ বিচার করে তিনি দেখলেন কেমন করে পরব্রহ্ম ইতিহাসের প্রত্যেকটি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে নিজেকে বিকশিত করেছেন। হেগেলের ব্রহ্মবাদ তাই সর্বগ্রাসী ব্রহ্মবাদ।
Leave a Reply