আধুনিক গরু-রচনা সমগ্ৰ – মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
[প্রকাশকের আপত্তির কারণে বইটির মূল কন্টেন্ট সরিয়ে নেয়া হয়েছে]
একদিন আমাদের আকাশ আমাদের মাথার ওপর টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়তে লাগলো। কিন্তু আমাদের রাজা একটিবারও ভাবলেন না- আকাশের একটি ভাঙা টুকরো, তার মাথায়ও পড়তে পারে।
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২২
উৎসর্গ
আল্লাহকে। কারণ তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণ করা যায় না।
প্রকাশকের কথা
মগজে গুঁতো খাওয়ার ভয়ে অনেকে মহিউদ্দিন মোহাম্মদের লেখা পড়তে চান না। তবে সাহিত্য ও দর্শনের যারা মনোযোগী পাঠক, তাদের কাছে মহিউদ্দিন মোহাম্মদ একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। বিশ্বসাহিত্য ও দর্শনে তাঁর পাণ্ডিত্য ঈর্ষণীয়। এ বইটি তাঁর প্রকাশিতব্য অনেক কাজের একটি। এখানে তাঁর সংজ্ঞাবলীর পদাবলী, মানুষ এবং অন্ধকারের প্রশংসা, ধর্ষণের সাথে পোশাকের সম্পর্ক, আমাদের ইশকুল আমাদের গোরস্থান, শিক্ষার রাজনীতিক টুপি, আপনি কী করেন, সম্মান, প্রশংসার নিন্দা, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েরা, ছাগল ও তার পিএইচডি ডিগ্রি, জিপিএ ফাইভ ও জুতোর ফ্যাক্টোরি, প্রভৃতি জননন্দিত ও গুরুত্বপূর্ণ লেখা স্থান পেয়েছে। ‘মানুষ এবং অন্ধকারের প্রশংসা’ রচনাটি আলাদা বই আকারে বের হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তিনি আমাদেরকে পুরো রচনাটির পাণ্ডুলিপি দেন নি। এ জন্য যেটুকু দিয়েছেন, সেটুকুই এ বইয়ে সন্নিবেশিত হয়েছে। আমাদের আশা, ভবিষ্যতে আমরা পুরো পাণ্ডুলিপিটি পাবো।
তাঁর লেখা ‘বিশ্বসাহিত্য ভাষণ’-ও আমরা প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছি। ভাষণটিতে যে-প্রজ্ঞা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা নিয়ে তলস্তয়, দস্তায়েভস্কি, পুশকিন, গোর্কি, গোগল, সোলজিনিতসিন, জেমস জয়েস, বার্ট্রান্ড রাসেল, নিটশা, হেমিংওয়ে, রুশো, সাঁত্রে, ভিক্টর য়্যুগো, ফকনার, দেকার্তে, নবোকভ, সিঙ্গার, আগনন, পাস্তারনাক ও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকের কাজ তিনি আলোচনা করেছেন, তা অতুলনীয়। বাংলা ভাষায় বিশ্বসাহিত্যের এ রকম গভীর আলোচনা এর আগে আমরা দেখি নি।
তাঁর সংজ্ঞাবলীর পদাবলী, সাহিত্যের একটি নতুন জঁরা (Genre) হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এগুলো কি কবিতা নাকি গদ্য, ফিকশন নাকি নন-ফিকশন, শ্লেষ নাকি বাস্তবতা, তা ঠিক ঠাহর করা যায় না। সম্ভবত দুইয়ের মিশ্রণে তৈরি একটি নতুন ধারা। অল্প কথায় এতো গভীর ভাবের প্রকাশ সাহিত্যের আর কোনো ধারায় লক্ষ করা যায় না। তাঁর স্যাটায়ারবোধ অসাধারণ। প্রতিটি লেখায় কোনো-না-কোনো বাক্যে এর প্রমাণ রয়েছে।
বইটির নাম ‘আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র’ হলেও এটি আদৌ কোনো গরু রচনার বই নয়। বইটির ‘সংজ্ঞাবলীর পদাবলী’ অংশে গরুর যে-সংজ্ঞা লেখক দিয়েছেন, তা থেকে এ নামকরণের কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বইটির প্রতিটি লেখায় লেখকের দার্শনিক সত্তার পরিচয় লুকিয়ে আছে। অনেক সাধারণ বিষয়কে তিনি যেভাবে লিগাল ফিলোসোফি, পলিটিক্যাল ফিলোসোফি ও মোরাল ফিলোসোফির সমন্বয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, তা বিস্ময়কর।
এপিস্টেমোলোজির ওপর লেখকের একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক রচনা ও কয়েকটি ছোটগল্প এ বইয়ে সন্নিবেশিত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু বইটি প্রকাশের শেষ মুহূর্তে এসে মত পাল্টানোয় তা সম্ভব হলো না। তবে ভবিষ্যতে ওই লেখাগুলোও আমরা পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারবো বলে আশা রাখি।
শোষিত মানুষের প্রতি লেখকের মমত্ববোধ অসাধারণ। একটি কবিতায় এ বিষয়টি মর্মস্পর্শীভাবে ধরা দিয়েছে। কবিতাটি এখানে উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। কবিতাটির নাম- ‘মাংস নয়, হাড়ের মুক্তি চাই’।
“মাংস নয়, আমাদের হাড়গুলিকে মুক্তি দিন
আপনাদের গায়ে আমাদের মাংসের শার্ট
আপনাদের গাড়িতে আমাদের মাংসের পতাকা
আপনাদের ব্যাংকে আমাদের মাংসের বান্ডিল
আপনাদের স্যুটকেসে আমাদের মাংসের ঋণপত্র
আমরা দীর্ঘকাল
আমাদের মাংসের পেছনে ছুটছি
আপনাদের কোট থেকে
ঝরছে আমাদের মাংসের সেলাই
আপনাদের ঠোঁট থেকে
খসছে আমাদের মাংসের লিপস্টিক
আপনাদের চুল থেকে
উড়ছে আমাদের মাংসের গন্ধ
আমরা জন্মের পর থেকে
আমাদের মাংস আপনাদের শরীরে দেখে আসছি
আপনাদের স্থাপনায়, আমাদের মাংসের কংক্রিট
আপনাদের মসজিদে, আমাদের মাংসের মিনার
আপনাদের সংসদে, আমাদের মাংসের উল্লাস
আপনাদের টয়লেটে, আমাদের মাংসের শ্যাম্পু
আপনাদের সূর্য
ধীরে ধীরে ডুবছে আমাদের মাংসের দিগন্তে
আমাদের অনেক মাংস, সমান, আপনাদের এক ব্যাগ ক্রিশ্চিয়ান ডাইয়োর
আমাদের অনেক মাংস, সমান, আপনাদের থ্রি নাইটস হলিডে ইন প্যারিস
আমাদের অনেক মাংস, সমান, আপনাদের কানে সারাদিন স্যার স্যার স্যার
আপনারা যখন
টয়োটায় এক লিটার তেল পোড়ান
আমরা তখন কারখানায় এক কেজি মাংস পোড়াই
কিন্তু আমাদের শরীরে আর পোড়াবার মতো মাংস অবশিষ্ট নেই
আপনারা যখন এক গ্লাস ফ্রেশলি স্কুইজড
কমলার জুস হাতে নেন
আমরা তখন কারখানায় এক মগ মাংসের জল পান করি
কিন্তু আমাদের শরীরে আর পান করার মতো মাংস অবশিষ্ট নেই
আপনাদের ঈদ, আমাদের ঈদ থেকে আলাদা
আপনাদের লুঙ্গি, আমাদের লুঙ্গি থেকে ভিন্ন
আপনাদের সিগারেট, আমাদের সিগারেট থেকে আলাদা
আপনাদের ঈশ্বর, আমাদের ঈশ্বর থেকে ভিন্ন
আপনাদের খাটে, আমাদের মাংসের পেরেক
আপনাদের বালিশে, আমাদের মাংসের তুলো
আমরা টেলিভিশনে, দেখি আপনারা ঘাসের মতো
আমাদের মাংস চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছেন
আর উৎকৃষ্ট ব্রাশ দিয়ে
দূর করছেন
দাঁত থেকে আমাদের মাংসের গন্ধ
আমাদের স্ত্রীদের বক্ষ ও পেট
সমতল
আমাদের কন্যাদের বিয়ে
আমাদের ঘুমের মতোই নিঃশব্দ
আর আমাদের চোখের জল
আপনাদের চোখের জলের সাথে
কখনোই মেলে না
আপনাদের জুতোয় আমাদের মাংসের চুমো
আপনাদের স্তনে আমাদের মাংসের ব্রা
আপনাদের রিংটোনে
আমাদের মাংসের আর্তনাদ
আপনারা বাজার থেকে যে-গরুর মাংস কিনে আনেন
তা আমাদেরই মাংসের গবাদি সংস্করণ
আমাদের ঘামের রং
আপনাদের ঘামের রং থেকে আলাদা
আমাদের হাসির শব্দ
আপনাদের হাসির শব্দ থেকে ভিন্ন
মরা ভিডিওতে দেখেছি
আপনাদের ম্যাট্রেসে আমাদের মাংসের আহাজারি
আপনাদের বুটের তলায়
আমাদের মাংসরা ছটফট করছে
দের মুক্তি দিন
আপনাদের বিমানের আসনে
আমাদের মাংসরা ছটফট করছে
তাদের মুক্তি দিন
আপনাদের অধিবেশনে
মাদের মাংসরা ছটফট করছে
তাদের মুক্তি দিন
আপনাদের সংবাদপত্র, মেখে আছে আমাদের মাংসের কালি
আপনারা যখন প্রশংসা করেন
তখন মূলত
আমাদের মাংসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন
আপনাদের নাক বেয়ে বেয়ে
পড়ছে আমাদের মাংসের সর্দি
আপনাদের হাসিতে
আমাদের মাংসের বিলাপ
আপনাদের প্রজ্ঞাপনগুলি, ছাপা আমাদের মাংসের অক্ষরে
তা প্রত্যাহার করুন
আপনাদের বিজ্ঞাপনগুলি, তৈরি আমাদের মাংসের ক্যামেরায়
তা প্রত্যাহার করুন
আপনাদের পুষ্পমাল্য, পড়ে আছে আমাদের মাংসের বেদিতে
তা প্রত্যাহার করুন
আমাদের মাংসের অন্ধকারে
ঢেকে গেছে আপনাদের সমস্ত আলো
আপনারা উপরে উঠছেন, আমাদের মাংসের মই বেয়ে
এখন হাঁটলে
আমাদের পায়ের নিচ থেকে কবরের ঘ্রাণ ওঠে
মনে হয় আমরা হেঁটে যাচ্ছি
অনেকগুলো হাড়ের কাঠামো
আমাদের শরীর, আর এক মুঠো হাড় এখন আর
কোনো আলাদা অর্থ প্রকাশ করে না
তাই মাংসের বদলে
এখন আমরা, আমাদের হাড়গুলোরই মুক্তি চাই হাড়গুলো নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবো”
লেখকের কাব্যগ্রন্থও হয়তো কোনো একদিন আমরা মুদ্রিত আকারে নিয়ে আসতে পারবো।
পাঠকদের প্রতি অনুরোধ, তারা যেন ‘আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র’ বইটি সময় নিয়ে ধীরে ধীরে পড়েন। অন্যথায় এর বিষয়বস্তু হৃদয়ঙ্গম করা সহজ হবে না। আমাদের বিশ্বাস, মানুষের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা চিন্তাশীল সত্তাকে এ বই জাগিয়ে তুলতে পারবে। ধাক্কা দিতে পারবে মানুষের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিকে। বাংলা ভাষায় এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশের অংশীদার হতে পেরে আমরা গর্বিত।
বইটির কিছু জায়গায় লেখক তাঁর নিজস্ব বানান ও বাক্যরীতি বহাল রেখেছেন। বাক্যের পোয়েটিক মোশন, প্রাঞ্জলতা ও বোধগম্যতার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। পরিচিত বানানগুলোকে পরিচিত আকারেই রেখেছেন। আগন্তুক বানান ও শব্দ যথাসম্ভব পরিহার করেছেন। বাক্যের বোধগম্যতা নিশ্চিত করতে যতিচিহ্নের ব্যবহারও সেভাবেই করেছেন। তবে প্রুফ দেখার সময় অনেক অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি-বিচ্যুতি আমাদের পক্ষ থেকে ঘটে থাকতে পারে। এ রকম কিছু কারো নজরে এলে, সবিনয় নিবেদন, বিষয়টি আমাদের নজরে আনবেন, যেন পরবর্তী মুদ্রণে তা সংশোধন করতে পারি।
শাহীদ হাসান তরফদার
প্রকাশক
ফেব্রুয়ারি, ২০২২
রাফি
মহিউদ্দিন মোহাম্মদের টয়োটা করোলা বইটা দেন
tuhen
প্রথম অধ্যায়টা অনেক ভালো লাগে ছিল। পর অধ্যায়গুলো প্রথম অধ্যায়ের মত জমল না।
Nahid Hasan
টয়োটা করোলা বইটি আপলোড করুন। মহিউদ্দিন মোহাম্মদ এর।
Mmmm
.