আদিম সমাজ বা মানব জাতির আদিম ও বর্বর অবস্থার মধ্য দিয়ে সভ্যতায় যাত্রার প্রগতির ধারার ওপর গবেষণা
লুইস হেনরি মর্গান
অনুবাদ ও সম্পাদনা : বুলবন ওসমান
প্রথম অবসর প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০০০
.
Cum prorepserunt primis animalia lerris,
Mulum el turpc pecus, glandem atquc cubilia propter
Unguibus ct pugnis, dein fustibus, atque ita porro
Pugnabant armis, quae post fabricaverat usus :
Donec verba. quibus voces sensusquc notarent,
Nominaque invenere : dehinc absistcre bello.
Oppida coeperunt munire, et ponerc leges,
Ne quis fur esset, ncu latro, neu quis adulter.
(প্রাণীরা প্রথম যখন ডাঙায় আগমন করেছিল ভাষাহীন ও নিম্নস্তরের জীব এবং ফলমূল ও বাসস্থান নিয়ে কামড়াকামড়ি ও জড়াজড়ি করে মারামারি করেছে, তারপর লাঠি নিয়ে নেমেছে যুদ্ধে এবং সবশেষে হাতাহাতি যুদ্ধ করাই নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়; এই অবস্থা চলেছে যতদিন না তারা ধ্বনি সহযোগে তাদের চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয় এবং যখন থেকে সব জিনিসের নাম ব্যবহার করতে থাকে ততদিন চলেছে এই অবস্থা। তারপর তারা যুদ্ধ থেকে বিরত হয় এবং দেয়াল দেয়া শহর নির্মাণ করতে থাকে এবং আইন করে যে কেউ চোর হবে না বা চুরি করবে না বা ব্যভিচারী হবে না)
Horace, Sat, 1, iii, 99.
“আধুনিক বিজ্ঞান সাবধানী ও সূক্ষ্ম গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে মানব জাতি পৃথিবীতে তার যাত্রা শুরু করে ওপর থেকে নয়, বরং খুবই নিচুস্তর থেকে এবং সে ক্রমশ ওপর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মানুষের ক্ষমতার ক্রমোন্নয়নের একটা ইতিহাস আছে। মানুষের সংস্কৃতির সব উপাদান– জীবন ধারণের হাতিয়ার, শিল্প, বিজ্ঞান, ভাষা, ধর্ম, দর্শন–সবই একদিকে মানুষের আত্মা ও মনের দ্বন্দ্ব ও অপরদিকে বাহ্যিক প্রকৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব এবং এই কঠোর সাধনার মাধ্যমে মানুষ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছে।”–হুইটনির “প্রাচ্য ও ভাষাতাত্ত্বিক পাঠ”, পৃঃ ৩৪১।
“যদিও তারা হাজার বছর দূরে রয়েছে এই সম্প্রদায়গুলো আমাদের পূর্বপুরুষদের আত্মিক আচরণের প্রতিফলনকে তুলে ধরে। আমরা একই ধরনের শারীরিক ও নৈতিক উন্নতির স্তরের মধ্য দিয়ে গেছি এবং আমাদের আজকের যে চেহারা তার কারণ তারা এখানে বসবাস করে গেছে, শ্রম করে গেছে এবং চালিয়ে গেছে প্রচেষ্টা। যেমন ইংল্যাণ্ডে চুনাপাথরের যে-সব ছাড়া আছে যা হাজার হাজার কণা দিয়ে তৈরি, তেমনি আমাদের আজকের অত্যাশ্চর্য সভ্যতা লক্ষ লক্ষ অজ্ঞাত লোকের নীরব সাধনার ফল।”–ড. জে. কেইনস, নৃতত্ত্ব”, ১ম খণ্ড, ২য় সংখ্যা, পৃঃ ২৩৩।
পূর্বাভাষ
১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান চিন্তানায়ক লুইস হেনরি মর্গানের যুগান্তকারী রচনা “এ্যানসিয়েন্ট সোসাইটি” প্রকাশিত হয়। তার আগেও তার উল্লেখযোগ্য রচনা “দ্য ইরোকোয়া” প্রকাশিত হয় (১৮৫১ খ্রিঃ)। কিন্তু “এ্যানসিয়েন্ট সোসাইটি” প্রকাশের পর আমেরিকার এমনকি বিশ্বের বিদ্বজন সমাজেও তার মতবাদ আলোড়ন তোলে। এ কথা আমাদের এখানে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে মার্ক্সের সহযোগী ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের মাধ্যমেই মর্গান পৃথিবীব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে পরিচিত হয়ে পড়েন। ঐ একই কারণে পশ্চিমী দুনিয়ার সমাজবিজ্ঞানীরা মর্গানের অবদানকে যথাযথ মূল্য না দিয়ে তার তথ্যসমূহের ভুলভ্রান্তি খোঁজায় নিযুক্ত হয়ে পড়েন। মর্গানের যথার্থ মূল্যায়নে দেখা যাবে যে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন করা মর্গানের কোনো উদ্দেশ্য ছিল না–বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসাই ছিল তার গবেষণার প্রধান প্রেরণা। আমেরিকার উঠতি বুর্জোয়া সমাজের অর্থলিপ্সা, স্বার্থপরতা, মূল্যবোধহীনতা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, যুব-অপরাধ ইত্যাদি তাকে চিন্তিত করেছিল। এ সব সমাজবিরোধী শক্তিসমূহকে কীভাবে মোকাবিলা করে আমেরিকায় একটি সুস্থ সমাজ গঠন করা যায় প্রধানত এই ছিল তার জিজ্ঞাস্য। বুর্জোয়া সমাজকে পরিবর্তিত করে সম্পূর্ণ নতুন কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন করতে হবে, এ ধারণার সাথে মর্গান পরিচিত ছিলেন না। মর্গান নিজে এক বুর্জোয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং আইন ব্যবসা আরম্ভ করেন। উত্তর মিসিগানে খনি ও রেলগাড়ির ব্যবসায়ে লগ্নী খাঁটিয়ে তিনি প্রভূত লাভবান হন এবং ফলে সব কিছু ত্যাগ করে পুরোপুরি সমাজবিজ্ঞানীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পেরেছিলেন। মর্গান বহু বছর নিউ ইয়র্ক স্টেটের ইরোকোয়া রেড ইণ্ডিয়ান উপজাতির একটি শাখা সেনেকাদের ভেতর অনেক দিন কাটান এবং তাদের একজন হয়ে যান। তাদের বিচিত্র সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, বিশেষ করে জাতি-গোষ্ঠী। সম্পর্কিত শব্দাবলি তিনি বিশেষ অনুসন্ধিৎসার সাথে অনুধাবন করেন এবং একের পর এক বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধাবলি প্রকাশ করতে থাকেন। তথ্যপূর্ণ, বস্তুনির্ভর, সরেজমিন গবেষণার জন্য মর্গানকে কেবলমাত্র সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই কৃতিত্ব দেওয়া ঠিক নয়,–বস্তুত ঊনবিংশ শতকের সমাজবিষয়ক গবেষকদের ভেতর তাকে নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ আসন দেওয়া যেতে পারে। মর্গান নিজের বংশগরিমা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং “হিস্ট্রি অব দি ফ্যামিলি অব মর্গান ফ্রম ১০৮৯ টু প্রেজেন্ট টাইমস” পুস্তক প্রণয়নে সক্রিয় সহযোগিতা করেন। খ্রিস্টীয় ধর্মে তার প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল। তার মতে পুঁজিবাদী সমাজ-ব্যবস্থাই মানব-সমাজের শ্রেষ্ঠতম বিকাশ। মর্গানের বিবেচনায় “পুঁজিবাদই হল সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ-ব্যবস্থা, যুক্তরাষ্ট্রই হল সর্বশ্রেষ্ঠ গণতন্ত্র এবং খ্রিস্টধর্মই হল একমাত্র সত্য ধর্ম…।”
সুতরাং মর্গান যে পুঁজিবাদী সমাজ-ব্যবস্থার মূলে সমাজতান্ত্রিক-ব্যবস্থা কামনা করেছিলেন এ ধারণা করার কোনো কারণ নেই। যাই হোক, এঙ্গেলস মর্গানকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত করে দিলেন। ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৪ সনে কার্ল কাউটস্কির নিকট লিখিত পত্রে এঙ্গেলস বলেন,
There exists an authoritative book on the conditions of primitive society, as authoritive as Darwain in biology and of course it is again Marx who discovered it : Morgan, Ancient Society, 1877. Marx spoke about it but my head was full of other things at thal time and he never returned to it……..Morgan discovered the Marxian materialist conception of history independently within the limits pre scribed by his subject…….
এদিকে বিসমার্ক সমাজতন্ত্র-বিরোধী আইন প্রণয়ন করেন ও সমাজতন্ত্র-সম্পর্কিত পুস্তক প্রকাশ নিষিদ্ধ করেন। কার্ল কাউটস্কিকে ২৬শে এপ্রিল ১৮৮৪ সনে লেখা চিঠিতে এঙ্গেলস বলেন,
I made up my mind as I told everybody here to play a trick on Bismark and write some thing (Morgan) that he simply could not forbid.
ঘটনাচক্রে এভাবে মর্গানের লেখা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়াতে পরবর্তী সময়ে মর্গানের বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাসমূহ সম্পূর্ণ অহেতুক কারণে পশ্চিমী দুনিয়ার সমাজবিজ্ঞানীদের উম্মার উদ্রেক করে। ফলে পরবর্তী সমাজ গবেষকগণের কেউ কেউ মর্গানকে সম্পূর্ণ অবহেলা করে, আবার কেউ কেউ তার প্রাপ্ত তথ্য বা মতবাদের কঠোর সমালোচনা করে সে-উম্মার প্রকাশ করেন। বলা বাহুল্য এ ধরনের উন্মা বা অবহেলা কোনোদিনই বিজ্ঞানের অগ্রগতির সহায়ক হতে পারে না। সামাজিক নৃবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানে মর্গানের অবদানের প্রকৃত মূল্যায়নের সময় এখন এসেছে। এ কথা সত্য যে মর্গান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রায় সব কটি তত্ত্বই নতুন গবেষণার প্রেক্ষিতে পরিবর্ধিত হয়েছে, কিন্তু মর্গান যে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার জন্ম দিয়েছিলেন সেখানেই মর্গানের গবেষণার সার্থকতা নিহিত এবং এখানেই মর্গানের শ্রেষ্ঠত্ব। বিজ্ঞান কোনোদিনই কোনো আবিষ্কৃত তত্ত্বকে চিরদিনের মতো সত্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না। ১৮৭৭ খ্রিঃ “আদিম সমাজ” প্রকাশের পর মাত্র সাম্প্রতিক কালে আমেরিকাতে ঐ বইয়ের প্রথম পুনর্মুদ্রণ হয়েছে। তার আগে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার ভারতী লাইব্রেরি ঐ বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ পুনঃপ্রকাশ করে এবং বর্তমান যুগের পাশ্চাত্যের সমাজ-গবেষকগণ ঐ কলকাতা সংস্করণই এতদিন ব্যবহার করে আসছিলেন। এ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকার এঙ্গেলসের রচিত “অরিজিন অব দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রোপার্টি এ্যাও দ্য স্টেট”, বইটি “পরিবার, গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি” শিরোনামায় বাংলায় প্রকাশিত করেন। এঙ্গেলসের উক্ত বই মর্গানের “এ্যানসিয়েন্ট সোসাইটির” ওপর পুরোপুরি ভিত্তি করে লেখা এবং এঙ্গেলস নিজেও বইটির প্রতি ছত্রে মর্গানের নিকট তাঁর ঋণ স্বীকার করেছেন। যা হোক, এভাবে বিনয় সরকারের অনুবাদের মাধ্যমে বাঙালি পাঠকেরা মর্গানের বৈজ্ঞানিক গবেষণার সাথে পরিচিত হন। বস্তুত বিনয় সরকারের উক্ত অনুবাদকে বাংলা ভাষায় পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে সমাজ-সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক পাঠের দিগদর্শন বলা যেতে পারে। পরবর্তী কালে কলিকাতার ন্যাশনাল বুক এজেন্সিও এঙ্গেলসের উক্ত বই “পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত করে। কিন্তু মর্গানের মূল বইয়ের বাংলা অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমার পূর্বতন ছাত্র বুলবন ওসমান অনেকদিন হয় এ কাজে হাত দিয়েছিলেন। এ ধরনের একটি মহৎ পুস্তকের বাংলা ভাষায় অনুবাদকে আমি অভিনন্দন জানাই এবং একার্য সম্পাদনের জন্য বুলবন ওসমানকে আমার অশেষ শুভেচ্ছা
ইতি
এ. কে. নাজমুল করিম
১লা জুন ১৯৭৫
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা।
তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকা
লুইস হেনরি মর্গান রচিত “এ্যানসিয়েন্ট সোসাইটি” বিশ্ব-নৃতাত্ত্বিক সাহিত্যের অন্যতম আকর গ্রন্থ। মর্গানকে বলাই হয়ে থাকে মার্কিন নৃতত্ত্বের জনক। বইটি বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবার তাগিদ তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব পাঠের সময়ই অনুভব করতাম। এ-ব্যাপারে সুসাহিত্যিক মরহুম আবু জাফর শামসুদ্দিন আমাকে প্রচুর উৎসাহ যুগিয়েছিলেন।
‘আদিম সমাজ’ প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমী থেকে। অতি অল্প সময়ে তা নিঃশেষ হয়ে যায়। বইটি কলকাতার পাঠকদের কাছেও সমাদর পায়। অনেকে ঢাকা থেকে বইটি কিনে নিয়ে গেছেন। দ্বিতীয় সংস্করণ হতে বিলম্ব হওয়া উচিত ছিল না, তবু ১৯৮৪-র পূর্বে তা সম্ভব হয় নি। দ্বিতীয় সংস্করণও প্রথম প্রকাশের মতো অল্প সময়ে শেষ হয়ে যায়, কিন্তু বাংলা একাডেমী পুরোনো বই ছাপাকে অগ্রাধিকার না দেওয়ায় বিলম্ব হতেই থাকে। অবশেষে একাডেমীর মহা-পরিচালককে লিখিত বক্তব্য দিই যে তিনি যেন এটি অন্য প্রকাশনার মাধ্যমে প্রকাশের অনুমতি দেন। একাডেমী এ-ব্যাপারে অনুমতি দেওয়ায় অবসর প্রকাশনা সংস্থার স্বত্বাধিকারী অনুজবৎ আলমগীর রহমান প্রবল আগ্রহের সঙ্গে দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসেন।
বইটি দীর্ঘকাল বাজারে না থাকায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়ে বাংলাদেশের বাজার দখল করে নিয়েছে। বইটি প্রকাশ হওয়ায় এ অভাবটি পূরণ হল। সুরুচিপূর্ণ পুস্তক প্রকাশনায় অবসর প্রকাশনা সংস্থার সুনাম আছে। পূর্ব সুনাম বজায় রেখে বইটি প্রকাশ করায় আলমগীর রহমানকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা।
বুলবন ওসমান
১৫ জানুয়ারি ২০০০
৭এ মোমেনবাগ
ঢাকা ১২১৭
দ্বিতীয় সংস্করণের প্রসঙ্গ-কথা
আদিম সমাজের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের ব্যাপারটি এ দেশের মানুষের সমাজ-সচেতনতার মনোভাবকে ফুটিয়ে তোলে। গ্রন্থটি খুব অল্পদিনের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যায়। নানা কারণে প্রকাশে বিলম্ব হয়ে গেল। তবু যাদের প্রচেষ্টা এক্ষেত্রে স্মরণীয় তারা হলেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক মনজুরে মওলা, পাঠ্যপুস্তক বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও একাডেমীর ছাপাখানা। ব্যবস্থাপক ওবায়দুল ইসলাম।
সরাসরি প্রথম মুদ্রণ থেকে অফসেট ছাপা হলেও বেশকিছু পরিমার্জন করা হয়েছে। বইটির প্রবল চাহিদা অনুবাদকের শ্রমকে সার্থক করেছে।
বু, ও,
৩১ অক্টোবর ১৯৮৪
৭ মোমেনবাগ ঢাকা ১৭
প্রথম সংস্করণের প্রসঙ্গ-কথা
‘এ্যানসিয়েন্ট সোসাইটি’ অনুবাদ করার পেছনে একটা ছোট ইতিহাস আছে। ১৯৬৪-তে এম, এ. পাস করে তখন বেকার। উঠতি সাহিত্যিক হিসেবে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছি এবং খুব ইচ্ছা শুধু সাহিত্যচর্চা করে জীবিকা নির্বাহ করি। তাই কোনো চাকরির দিকে ঝোঁক না দিয়ে পূর্ণোদ্যমে লেখায় মন দিই, কিন্তু শুধু সৃষ্টিধর্মী রচনার মাধ্যমে মাসে দেড় শ টাকার বেশি রোজগার হয় না। তাই যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলাম তাতে ব্যর্থ হই। অগত্যা বাংলা একাডেমী থেকে অনুবাদের কাজ নিলাম : প্রথম বই নিকোলাই গোগোলের ‘ডেড সোলস’, তারপর টলস্টয়ের ‘রেজারেকশান’, তারপর যখন বই নেব বাংলা একাডেমীর অনুবাদ বিভাগের অধ্যক্ষ জনাব আবু জাফর শামসুদ্দিন বললেন মর্গানের ‘এ্যানসিয়েন্ট সোসাইটি’ অনুবাদ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবনে বইটির সঙ্গে পরিচিত ছিলাম তাই কাজে লেগে যাই। এভাবেই আমার ‘আদিম সমাজ’-এর কাজে হাত দেওয়া। তারপর ১৯৬৬ র মার্চে ড. নাজমুল করিম ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শুভাশিস নিয়ে বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই। ব্যস, আমার শুধু লিখে যাওয়া ও অনুবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সমাপ্ত হল। এরপর বাংলা একাডেমীর আর কোনো অনুবাদ কাজ করি নি। তবে পরের বছর অন্য একটি সংস্থার উইলিয়াম ফকনারের ছোট একটি উপন্যাস অনুবাদ করি।
‘এ্যানসিয়েন্ট সোসাইটি’ অনুবাদের ক্ষেত্রে কলকাতার ভারতী লাইব্রেরির ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণটি অনুসরণ করা হয়েছে। পুস্তকটির প্রকাশক জে, সি, সাহা রায়, মূল্য দশ টাকা। মুদ্রণের সময় একটি পাদটীকা পড়ে গেছে, যে-পাদটীকার কোনো সংখ্যা-চিহ্ন পুস্তকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। এমনি আরো দু-একটি পাদটীকা আছে যার সংখ্যা-চিহ্ন পুস্তকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত পুস্তকের সঙ্গে পরে মিলিয়ে দেখেছি সেখানেও কোনো চিহ্ন নেই এই কয়েকটি পাদটীকার, তাতে বুঝলাম মূল পুস্তকই এই বিপত্তির কারণ। এই বই অনুবাদ করতে গিয়ে দু’-একটি ক্ষেত্রে ভাষাগতভাবে সংক্ষেপ করা হলেও নজর দেওয়া হয়েছে যাতে তথ্য না বাদ পড়ে যায়। এটি মূলতই পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ। এই পুস্তক অনুবাদ করতে গিয়ে আমার ধারণা হয়েছে যে ভাষায় বই অনূদিত হবে আসলে সে-ভাষার ওপরই ভালো দখল থাকা দরকার। মর্গানের এক শ বছর আগের জটিল বাক্য সংবলিত ইংরেজির কথা এখানে উল্লেখ আর নাই-বা করলাম।
অনুবাদ করতে গিয়ে বেশ কিছু নৃতাত্ত্বিক পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা পুস্তকের শেরে সংবলিত, আশা করি পাঠক এই পুস্তক পাঠের আগে তা দেখে নেবেন। এ ছাড়া সবচেয়ে অসুবিধায় পড়েছি জ্ঞাতি-সম্পর্কিত শব্দ নিয়ে। ইংরেজিতে ‘কাজিন’ বলতে যে কতগুলো সম্পর্ক বোঝায় পাঠক নিশ্চয় জানেন, তেমনি আছে ব্রাদর-ইন-ল, সিস্টার-ইন-ল, আর আংকল-আন্টি। এসব শ্রেণীবিভক্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলার বর্ণিত পদ্ধতি বা আমাদের ভাষায় যে-সম্পর্ক আসে তাই ব্যবহার করা হয়েছে।
পাঠকের সুবিধার জন্যে পুস্তকের শেষে মর্গানের সংক্ষিপ্ত জীবনী দেওয়া হল। উৎসাহী পাঠক যারা মর্গানের ওপর বিশদভাবে লেখাপড়া বা গবেষণা করতে চান তাদের জন্যে মর্গানের গ্রন্থপঞ্জি ও মর্গানের ওপর লিখিত পুস্তক ও রচনার তালিকাও পরিবেশিত হয়েছে।
মর্গানকে সারা বিশ্বে পরিচিত করেন জার্মান পণ্ডিত ও সমাজতন্ত্রের অন্যতম প্রবক্তা মার্ক্সের সুহৃদ ফিডরিখ এঙ্গেলস, তিনি তার পুস্তক ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ পুস্তকের ভূমিকায় মর্গানের ওপর যে-মন্তব্য করেন তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্য তাই পুস্তকের প্রথমাংশে তা সংকলিত হয়েছে।
মর্গানের রচনা প্রায় এক শ বছর আগের, তার অনেক মন্তব্য, তথ্য ও সিদ্ধান্ত আজ নূতন জ্ঞানের আলোকে শুধরে নেওয়া প্রয়োজন, তাই ভূমিকায় তেমন একটা প্রচেষ্টা নিয়েছি, যদি পাঠককে তা সাহায্য করে তবেই এর সার্থকতা।
বইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব বিভাগে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে গৃহীত হওয়ায় ছাত্রদের প্রয়োজনে খুব দ্রুত ছাপার কাজ করতে যাওয়ায় মুদ্রণপ্রমাদ কিছু থেকেই গেল। আশা করি দ্বিতীয় সংস্করণে সব ক্রটি মোচনের চেষ্টা করা যাবে।
প্রথম সংস্করণের কৃতজ্ঞতা স্বীকার
এই পুস্তক প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রথমেই কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় সুসাহিত্যিক ও সমাজতত্ত্বে বিশেষ উৎসাহী জনাব আবু জাফর শামসুদ্দিনকে। তিনি যদি এই পুস্তকটির গুরুত্ব অনুধাবন করে আগ্রহ নিয়ে অনুবাদের কথা না ভাবতেন এমন খটমটে একটি ধ্রুপদী গ্রন্থে হয়তো আমি কোনোদিন হাত দিতাম না।
আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ, ড. নাজমুল করিম এই পুস্তকের প্রারম্ভিক প্রবেশকটি কষ্ট করে লিখে দেওয়ায় আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের পথিকৃৎ সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে তার অনেক মূল্যবান অভিমত আমার অগোচরেই এই পুস্তকের ভূমিকায় জায়গা করে নিয়েছে।
আদিম সমাজের ছাপা শুরু হয় স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে। কাজ বেশ কিছুটা এগিয়ে যাবার পর পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ ছাপাখানা থেকে হারিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমার আর-একটি পাণ্ডুলিপি লিও টলস্টয়ের ‘রেজারেকশান’-এর অনুবাদকর্মটি আগুন লেগে সম্পূর্ণ পুড়ে যায়, আবার পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যাওয়ায় ভীষণ বিরক্ত বোধ করি। অনুবাদ করব করব করেও এক বছর প্রায় কেটে যায়। এমন সময় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব সৈয়দ আহমদ খান ধরে বসেন এটা শীঘ্রই করে দিতে হবে। কারণ তিনি এই পুস্তকটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান এবং বাংলা হলে ছাত্রদের খুব উপকার হবে। তার কথা ফেলতে না পেরেই কাজটি দ্রুত করে দিই। এ ছাড়া ভূমিকা লেখা ও অনুবাদের জন্যে বই যোগাড় করে দেবার ব্যাপারে তিনি প্রচুর মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন…। এ পুস্তক এত শীঘ্র প্রকাশ হবার পেছনে তার আন্তরিক তাড়া যথেষ্ট কার্যকর হয়েছে।
যে-পুস্তকটি থেকে অনুবাদ করি ১৯৭১-র ১৭ই ডিসেম্বর ঘর লুট হওয়ায় অনেক জিনিসের সঙ্গে সেই বইটিও পাই নি। তাই সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষয়িত্রী আমার সহপাঠী মাহমুদা বেগম তার পুস্তকটি ব্যবহার করতে দিয়ে কাজ এগিয়ে নেবার পক্ষে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন।
ভূমিকা লেখার আগে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র অনুজপ্রতিম গোলাম সারওয়ার খানের কাছ থেকে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত ইলিয়েনর বার্ক লিকক সম্পাদিত আদিম সমাজের একটি নূতন সংস্করণ পাওয়ায় যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি।…
ভূমিকা
নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের পথিকৃৎ লুইস হেনরি মর্গান ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত ব্যক্তিত্ব। মর্গানের ‘আদিম সমাজ’ প্রকাশের শতাব্দী কাল পরে মর্গান চর্চার মাহাত্ম কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের প্রয়োজন মর্গানের পরিবেশ ও সেই পরিবেশ কেন্দ্র করে তার অবদান পর্যালোচনা। ঊনবিংশ শতাব্দীর পরিবেশ কী? সপ্তদশ শতাব্দীর শিল্প-বিপ্লবের পর থেকে বিজ্ঞান ও যান্ত্রিক কলাকৌশলের যে উন্নতি ঘটে তার ফলে মানুষের মনে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা দৃঢ়বদ্ধ হতে থাকে এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানের আবির্ভাব ঘটে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উল্লেখযোগ্য যুগান্তকারী সব সমাজবিজ্ঞানী চিন্তার প্রকাশ। এ শতাব্দীর মাঝামাঝি প্রকাশিত মার্ক্স-এঙ্গেলসের ইতিহাসের ব্যাখ্যায় দ্বন্দ্ববাদমূলক বস্তুবাদ, ডারউইনের জীবজগতের বিবর্তনবাদ ও এই সঙ্গে আসে মর্গানের সামাজিক বিবর্তনবাদ। মোটামুটি উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বিবর্তনবাদ মনন জগতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে এবং সেই চিন্তার জে এখনো অবিরল ধারায় প্রবহমান। মার্ক্স-এঙ্গেলস, ডারউইন, মর্গান থেকেই মানব-চিন্তা জগতে পরিপূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত ধারার প্রবর্তন ঘটে। অবশ্য এদেরই সমসাময়িক অগাষ্ট কঁৎ হার্বার্ট স্পেন্সর ও এমিল ডুরখাইম সমাজ বিশ্লেষণে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রবর্তনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, এদের নামও স্মরণীয়।
মর্গানের ‘আদিম সমাজ’ কেন্দ্র করে মার্ক্স নিজেই একটি বই লিখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মৃত্যু তার এই ইচ্ছাকে পূর্ণ হতে দেয় নি। বরং তার সুহৃদ এঙ্গেলস এই পুস্তক অবলম্বন করে লেখেন, ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’, প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ সালে। এই পুস্তকের পরিচ্ছেদগুলি ‘আদিম সমাজ’ অনুসারে সজ্জিত।
১
সমাজতত্ত্ব এই শাস্ত্রের দৃষ্টিতে দেখতে গেলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মর্গান ও এঙ্গেলসের স্থান মার্ক্সেরও ওপরে। কোন অর্থে? তা হল আধুনিক সমাজতত্ত্ব যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছে সরজমিনে তদারক, নিজে অংশগ্রহণ, প্রশ্নমালা তৈরি করে তথ্য যোগাড় করে বিশ্লেষণ, সম্ভাব্য অনুমান খাড়া করে প্রশ্নমালার যাচাই ও সিদ্ধান্ত …এই দৃষ্টিতে দেখলে মনে হয় মর্গানের পদ্ধতি যেন আজকের। সেদিক থেকে মার্ক্সের পদ্ধতি ঐতিহাসিক ও দার্শনিক। আর মর্গানের পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক। মর্গান তার গবেষণার তথ্য যোগাড়ের জন্যে পৃথিবীর কোনো অঞ্চল বাদ দেন নি। আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, এশিয়া সব মহাদেশ, এমনকি ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ, নেপাল, চীন, মালয়, হাওয়াই দ্বীপ প্রায় সব দেশ থেকে তথ্য সগ্রহ করেছেন। অসম্ভব সব কর্ম করেছেন মর্গান। মার্ক্স ও মর্গান দু জনেরই সমাজের প্রক্রিয়া ও উন্নয়নের সূত্র সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত এক, কিন্তু দুই ভিন্ন যাত্রাপথে তারা এক জায়গায় গিয়ে উপনীত হচ্ছেন। মার্ক্স করছেন গ্রন্থাগারে কাজ, এঙ্গেলসের খুব ভালো গ্রন্থাগার ছিল, মর্গান তখন ইরোকায়া গোষ্ঠীতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, গ্রন্থাগারের দিক থেকে মর্গান খুবই দরিদ্র, তিনি নজর রাখছেন আদিবাসীদের রীতি-প্রথা, উৎসবের ওপর। এমনকি মর্গান প্রাণীদের আচরণও পাঠ করতেন। বিশেষ করে আমেরিকান বিভারের আচরণ সম্বন্ধে তিনি একটি পুস্তক লেখেন। এখানে মর্গানের অন্তদৃষ্টির প্রশংসা না করে উপায় নেই। প্রাণিজগতের আচরণের জ্ঞান মানুষকে বুঝতে সাহায্য করে।
মর্গানের নাম পৃথিবীর নৃবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানী মহলে সর্বত্র পরিচিত। শুধু তাই নয় যারাই সমাজ সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করেন তাদের কাছে মর্গান সমাদৃত। বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক শিবিরে ‘আদিম সমাজ’ একটি ধ্রুপদী গ্রন্থ। মর্গানকে শুধু সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া স্বীকৃতি দিয়েছে তাই নয় ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ গর্ডন চাইল্ড, সমাজতত্ত্ববিদ গ্রাহাম ক্লার্ক, ডব্লিউ. এইচ. রিভার্স, জর্জ থমসন, এডউইন এস, হার্টল্যান্ড এবং এ, সি, হাডসন এরা সবাই মর্গানের অনুসারী। ১৯১০ সালে এ. সি. হাডসন বলেছেন যে মর্গান “নিঃসন্দেহে বিগত শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজবিজ্ঞানী”। ফ্রান্সে চার্লস লিটুরনো, জার্মানিতে হাইনরিশ কুনোত, এমনি সারা পৃথিবী জুড়ে সর্বত্র নৃতাত্ত্বিক ও সমাজবিজ্ঞানীরা বিশেষ করে পরিবার ও জ্ঞাতি-সম্পর্কের ওপর কাজ করতে গেলে মর্গানের উল্লেখ না করে পারে না এবং তার কাজের সাহায্য নিতেই হয়।
যেহেতু সমাজতান্ত্রিক জগৎ মর্গানকে আপন করে গ্রহণ করেছে তাই মার্কিন মুলুকে মর্গানকে দু’ ভাবে নেওয়া হয়। একদল কট্টর মর্গানবিরোধী, শুধু টিকেই বড় করে দেখে, গুণ স্বীকার করে না; এদের মধ্যে নৃতাত্ত্বিক ফ্রাঞ্জ বোয়াস অন্যতম। এমনকি তার শিষ্যরাও অনেকে মর্গানের নাম সহ্য করতে পারে না। ফ্রাঞ্জ বোয়াসের মত হল সমগ্র মানব জাতির সামাজিক প্রক্রিয়ার নীতি বের করতে যাওয়া একটা বুজরুকি, প্রতিটি সমাজ ও সংস্কৃতি হল চরম, এমনকি প্রতিটি ব্যক্তিই চরম ও পৃথক। তাই সমাজের প্রক্রিয়ায় কোনো সর্বজনীন নিয়ম থাকতে পারে না। প্রতিটি সমাজের আলাদা আলাদা ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়া ও পরিবেশ, সুতরাং তার জন্যে পৃথক পৃথক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। ফ্রাঞ্জ বোয়াস যা-ই বলুন মানবসমাজের গতির সাধারণ ধারা বের করার প্রচেষ্টা মানুষ চালাবেই এবং এটাই মানুষের স্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসা বোধ। মানব সমাজের মৌলিক কোনো মিল আছে কি না, সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মৌল বিশেষ কোন ক্ষমতা কাজ করছে তা সমাজবিজ্ঞানীর সর্বকালীন অনুসন্ধিৎসা। ফ্রাঞ্জ বোয়াসের ছাত্র প্রফেসর আর. এইচ. লোয়ি মর্গানকে যথেষ্ট সমালোচনা করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত না বলে পারেন নি যে “সামাজিক সংগঠনে এবং বিশেষ করে আতিমূলক পদের জন্যে মর্গানের অবস্থান আকাশচুম্বী। তার কাজ পরিমার্জিত হয়েছে এবং সম্প্রসারিত করা হয়েছে, কিন্তু তা কোনোমতেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না…মর্গানের কৃতিত্ব শুধু এ জন্যে নয় যে তিনি শুধু তত্ত্বগত গুরুত্বের জন্যে অসংখ্য তথ্য যোগাড় করেছিলেন, বরং এই তথ্যের মধ্যে অভিভূত হয়ে ডুব দেন এবং তাকে ধারণ করে বেরিয়ে আসেন।”
এখানেই মর্গানের মাহাত্ম। শুধু রাশি রাশি তথ্য যোগাড় করাই তার কাজ ছিল না, সেই তথ্যকে গেঁথে শ্রেণীবিন্যাস, বিশ্লেষণ ও সবশেষে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। মর্গান আধুনিক কম্পুটারের কাজ একাই করে গেছেন।
লোয়ির মানসে কিছুটা শুভবোধ কাজ করেছে বলে মর্গানের কিছুটা মূল্য দিয়েছেন, কিন্তু বোয়াসের অন্যতম ছাত্র বার্টহোল্ড লউফার বলে বসলেন, সামাজিক বিবর্তন “বিজ্ঞানের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত যে-সব তত্ত্ব গ্রহণ করা হয়েছে তারমধ্যে সবচেয়ে শূন্যগর্ভ, বন্ধ্যা এবং অনিষ্টকারী তত্ত্ব।”
মার্কিন মুলুকে মর্গানকে একদিকে করা হয়েছে আক্রমণ, আর-একদিকে অবহেলা। এর জ্বলন্ত উদাহরণ বোয়াসের ‘হিষ্ট্রি অব এ্যানথ্রোপোলজি’ পুস্তকখানি, এই গ্রন্থে বোয়াস একটিবারের জন্যেও মর্গানের নাম উল্লেখ করেন নি। এমনিধারা আচরণ দেখিয়েছেন র্যাডক্লিফ ব্রাউন, তিনি অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের জ্ঞাতি-সম্পর্কের ওপর পাঠ করতে গিয়ে গ্রন্থসূচিতে যারা এই বিষয়ের ওপর কাজ করেছেন সবার নাম দিয়েছেন, এমনকি শ-দেড়েক গ্রন্থকারের মধ্যে এক শ জনই পণ্ডিত হিসেবে নগণ্য এবং তাদের অনেকের নাম নেবার কোনো অর্থ হয় না, কিন্তু মর্গানের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ মর্গান অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ওপর যথেষ্ট তথ্য যোগাড় করেছিলেন।
মর্গানের প্রতি এই অবিচার দেখে সমাজতত্ত্ববিদ লেসলি এ. হোয়াইট বলেন, ‘মর্গানকে তার কিছু সমালোচক এত স্থূলভাবে মিথ্যেভাবে বর্ণনা করে যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তারা তার বইগুলো পড়েছে।”
লেসলি এ. হোয়াইট যে-মন্তব্য করেছেন তার নমুনা আমাদের হাতে আছে। যেমন র্যালফ লিনটন মর্গানকে এই বলে অভিযুক্ত করেন যে যে-মর্গানকে বিবর্তনবাদী বলা হয়, তিনি তার পুস্তকে ইতোলুশন (বিবর্তন) শব্দটিই ব্যবহার করেন নি। পাঠক মর্গানের আদিম সমাজের যে-কোনো সংস্করণের পৃষ্ঠা খুললে প্রথম পৃষ্ঠার তৃতীয় প্যারায় তৃতীয় লাইনেই ইভোলুশন (বিবর্তন) শব্দটি পেয়ে যাবেন। আমার দুটি সংস্করণ দেখার সুযোগ হয়েছে, প্রথমটি ১৯৫৮-র ভারতীয় দ্বিতীয় সংস্করণ, এবং এ্যানসিয়েন্ট সোসাইটি’ ইলিয়েনর বার্ক লিককের সম্পাদিত বইটি ১৯৬৭-র সংস্করণ (বইটি ১৯৬৩-তে প্রথম সংস্করণ রূপে বেরোয়), তাতেও প্রথম পৃষ্ঠার তৃতীয় প্যারার তৃতীয় লাইনেই ইভোল্যুশন শব্দটি আছে। এরপর কেমন করে বলব সবাই সবকিছু পড়ে সমালোচনা করে?
লোয়ি, লিনটন, এমনকি স্টার্ন-ও বলেছেন, মর্গান সারা জীবন ধর্মের প্রভাব কাটাতে পারেন নি। অথচ লেসলি এ. হোয়াইট বলেছেন, “মর্গান তার সারা বয়ঃপ্রাপ্ত জীবনে বিজ্ঞানের শক্তিশালী প্রবক্তা ছিলেন। এখানে ব্যাপারটার একটু পর্যালোচনার প্রয়োজন। মর্গান যে ধর্মের প্রতি অনুরাগী ছিলেন না তা নয়, কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। এর প্রমাণ পাই তার বন্ধু রেভারেণ্ড জে. এইচ. ম্যাকাইলভেইন-এর লেখায়। তার লেখা থেকে জানা যায় :
তিনি [মর্গান] তার আচরণে বেশ একটি বৈপরীত্য দেখান, একজন নাস্তিক বৈজ্ঞানিকের সাথে তার প্রায় চিঠিপত্র লেখালেখি চলত…যদিও তিনি [সেই বৈজ্ঞানিক সুযোগ পেলেই খ্রিষ্টধর্ম সম্বন্ধে অপমানজনক ও ঘৃণ্য শব্দাবলি উচ্চারণ করতে ছাড়তেন না।
মর্গানের এই রেভারেণ্ড বন্ধুর উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় মর্গান বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের প্রতি কতটা সহানুভূতিশীল ছিলেন। ধর্ম প্রতাবকে অবশ্য খারাপভাবে দেখতে হবে তারও কোনো মানে নেই। একজন সৎ-ধার্মিকের ভালো বৈজ্ঞানিক হতে বাধা কোথায়? যারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে কেবল তারাই চায় না এমন কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হোক যা ধর্মের ব্যবসায় ক্ষতি করবে। ধর্মের একটা সদর্থক দিক আছে। তা ছাড়া ধর্ম একটা সাংস্কৃতিক গড়নও দেয়। সুতরাং অনেক সময় ধর্ম তার মূল ক্ষমতার চেয়ে সাংস্কৃতিক খোলস হিসেবেই বিশেষভাবে কাজ করে। যেমন কট্টর নাস্তিকও বলে, খোদা হাফেজ বা ইংরেজি ভাষায় গুড বাই, যার অর্থ গড বি উইদ ইউ, খোদা তোমার সহায় হোক, অনেকটা আমাদের এলাহি ভরসার মতো। ধর্ম অনেক সময়ই একটা সাংস্কৃতিক প্রকাশ হয়ে দাঁড়ায়।
মর্গানের রেভারেন্ড বন্ধু আরো লিখেছেন, “আমি চাই তুমি একজন সরল বিশ্বাসী হও, খ্রিস্টের একনিষ্ঠ পাপ-শ্রোতা পুরোহিত হও।” এ থেকে প্রমাণ হয় মর্গান ধর্ম-কর্ম করলেও তার মধ্যে এমন কিছু গুণ ছিল যার জন্যে তাকে ধর্ম পথে ফেরাবার চেষ্টা চালানো হত। তা ছাড়া যারাই আদিবাসীদের ওপর কাজ করেছেন তারা আদিবাসীদের ধর্ম নিয়ে প্রচুর পাঠ করেন, ফলে সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বই তৈরি হয়, কিন্তু মর্গানের দৃষ্টি বিশেষ করে ছিল সামাজিক সংগঠনের দিকে। তাই প্রথম পরিচ্ছেদেই তিনি বলেছেন :
ধর্ম নামক ধারণাটির মধ্যে এমনি এক জটিলতা বিরাজমান যে এর সৃষ্টির সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল। ধর্ম বড় বেশি কাল্পনিক ও আবেগের সাথে জড়িত তাই এ-সম্বন্ধে সঠিক হওয়া মুশকিল। তা ছাড়া দেখা গেছে সব আদিম ধর্মই অদ্ভুত, অনেকটা দুর্বোধ্য। তাই একেও আমাদের পাঠের ক্ষেত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য দু’-এক জায়গায় সংক্ষিপ্ত মন্তব্য থাকতে পারে।
মর্গান যদি ধর্মের প্রতি এতই দুর্বল হতেন তা হলে ধর্মের উদ্ভবের ইতিহাস লিখতেন, সামাজিক বিবর্তনবাদ নিয়ে সময় নষ্ট করতেন না।
মর্গানকে ধর্ম-প্রভাব নিয়ে দোষারোপ করার কারণ তিনি ‘আদিম সমাজ’-এর শেষ প্যারায় বলেছেন :
সভ্যতা আসতে আরো কয়েক হাজার বছর বিলম্ব হতে পারত, কিন্তু যখন তা হয় ঈশ্বরের পরিণামদর্শিতা ও শুভবিধানের ফল বলতে হবে।
শুধু এই একটি কথার ওপর মর্গানকে অ-বিজ্ঞানসম্মত মানসিকতার লোক বলে প্রমাণের পরোক্ষ চেষ্টা চালানো হয়েছে।
লেসলি এ. হোয়াইট এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “মর্গান, বিজ্ঞানের মত প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে ডারউইনের মতো খ্রিস্ট ধর্মতত্ত্বের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন।”
এত করেও যখন হয় না তখন অন্য অস্ত্র ব্যবহার করেন র্যাডক্লিফ ব্রাউন, বলেন যে মর্গান হল সাধারণ একজন পেটি বুর্জোয়া, যিনি সাধারণভাবে প্রগতির ওপর বিশ্বাস করতেন। অর্থাৎ তিনি বিপ্লবী তো ননই বরং সংস্কারবাদী। মর্গান পেটি বুর্জোয়া হয়েও প্রগতিবাদী এই হল তার দোষ, আর র্যাডক্লিফ ব্রাউন ও তার মতো অন্যান্য পণ্ডিতগণ পেটি বুর্জোয়া না হয়েও সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদবিরোধী এই তাদের গুণ। পৃথিবীর সব দেশেই কিছু ভাড়াটে লেখক-গবেষক পাওয়া যায়, যারা প্রগতিবিরোধী গবেষণার জন্যে নিবেদিতপ্রাণ। এদের ভূমিকা ও প্রক্রিয়া সমাজতত্ত্বের একটি সুন্দর গবেষণার বিষয় হতে পারে।
ম্যাকার্থিবাদের ফলে আমেরিকাতে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনা ও মর্গান প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে ছিল। ১৮৭৭ সালের পর মর্গানের বইটি আর দ্বিতীয় সংস্করণ হয় নি। আজকের আমেরিকা, মর্গানের দেশ, মর্গানের নির্দেশ মতো বিবর্তনবাদের ধারায় ক্রমশ পরিশোধিত হচ্ছে। মর্গানের বই পুনর্মুদ্রণ থেকে তা অনুধাবন করা যায়। ১৮৭৭-র পর ‘আদিম সমাজ প্রথম পুনর্মুদ্রিত হয় ১৯৬৩-তে, সম্পাদনা করেন মহিলা সমাজতত্ত্ববিদ ইলিয়েনর বার্ক লিকক। আর ১৯৬৪-তে প্রকাশিত হয় লেসলি এ. হোয়াইটের সম্পাদনায় আর একটি সংস্করণ। লিককের পুস্তকটি ১৯৬৭-তে আরো একটি সংস্করণ হয়ে প্রকাশ পায়। এ-থেকে বোঝা যায় মর্গানের চাহিদা এক আমেরিকাতেই কী বিপুল।
২
আমেরিকায় মর্গানের প্রতি সহানুভূতিশীল সমাজবিজ্ঞানী যে নেই তা নয়, এদের মধ্যে লেসলি এ. হোয়াইট, কার্ল রেসেক, ইলিয়েনর বার্ক লিকক, বার্নহার্ড জে, স্টার্ন প্রমুখ উলেখ্য। এরা মর্গানের দোষ-ক্রটি মুক্ত করে মর্গানকে আরো স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল করে তুলেছেন। বিশেষ করে বার্নহার্ড জে, স্টার্ন মর্গানকে পৃথিবীর বুকে বিশেষভাবে তুলে ধরার জন্যে অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। সে কাহিনী এখানে তুলে না ধরলে মার্কিন পণ্ডিতদের ওপর আমাদের ধারণা একপেশে হয়ে যাবে।
মার্ক্স-এঙ্গেলসের প্রশংসাধন্য হবার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নে মর্গানের স্থান খুব ওপরে। সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতিতত্ত্ববিদ হিসেবে মর্গান সবচেয়ে সম্মানী ব্যক্তি। ১৯০৬ সালে অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স অব ইউ.এস.এস. আর. স্টার্নকে ভার দেয় মর্গানের পাণ্ডুলিপি, বই, যাবতীয় রচনা ও চিঠিপত্রের ফটোস্ট্যাট কপি ও মাইক্রোফিল্ম করতে। এ-সব করে সোভিয়েত ইউনিয়নে পাঠানো হবে, যাতে সেখানের পণ্ডিতদের গবেষণার সুবিধা হয়। এবং মর্গানের সম্পূর্ণ রচনা সংকলনের কাজ চলবে এই তথ্য থেকে। স্টার্ন ১৭০০০ প্রিন্ট এবং ফিল পাঠান সোভিয়েত ইউনিয়নে। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ায় পরিকল্পনা বন্ধ হয়ে যায়। যতদূর জানি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আজ পর্যন্ত মর্গানের কোনো রচনাবলি প্রকাশিত হয় নি। জানি না, কেন।
মর্গান সম্বন্ধে বলা হয় সরজমিনে তদারককারী হিসেবে তার সঠিক তথ্য নির্বাচনের চোখ। ছিল”। এই কথা আরো সত্যি প্রমাণ হয় যখন কোনো গবেষক ইণ্ডিয়ানদের জ্ঞাতি-সম্পর্কের তথ্য নিতে যায় এবং ভাবে সে-ই ঠিক, মর্গান ঠিক নয়। পরে দেখে যে মর্গান যা করেছে তাতে কোনো
ক্রটি তো নেই অনেক ক্ষেত্রে সেই গবেষক নিজেই অনেক ভুল করে বসে আছে।
আমেরিকাতে অন্যতম সমাজতত্ত্ববিদ লেসলি এ, হোয়াইট মর্গানের ওপর প্রচুর কাজ করেছেন। তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘এক্সট্রাক্টস ফ্রম দ্য ইউরোপিয়ান ট্র্যাভেল জার্নাল অব লুইস হেনরি মর্গান’, ‘দি ইউনিয়ান জার্নালস ১৮৫৯-১৮৬২’, এ ছাড়া তিনি একটি সম্পূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন : ‘মানস এটিচিউড টুওয়ার্ড রিলিজিয়ান এ্যাও সায়েন্স’।
কার্ল রেসেক মর্গানের ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্য পুস্তক রচনা করেন : ‘লুইস হেনরি মান : এ্যামেরিকান স্কলার’।
মর্গান বাঙালি চিন্তাবিদদের কাছে পরিচিত হবার সুযোগ পান কলকাতা থেকে তার এ্যানটি সোসাইটি প্রকাশিত হওয়ায়। প্রথম প্রকাশকাল ১৯৪৭ এরই দ্বিতীয় মুদ্রণ ঘটে ১৯৫৮ সালে। সমাজতত্ত্ববিদ বিনয় কুমার সরকার অবশ্য মর্গানের যথেষ্ট প্রচার করেছেন এর অনেক আগেই। এ ছাড়া শ্রীদেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বাঙালি পাঠকের কাছে মর্গানকে তুলে ধরেন। তিনি তার এই লোকায়ত দর্শন-এ বলেন, “আমেরিকার নৃতত্ত্ববিদ লুইস হেনরি মর্গানকে কেউই অবশ্য আমাদের প্রচারক বলবে না। তার বদলে তাকে বৈজ্ঞানিক নৃতত্ত্বের প্রবর্তকই বলতে হবে, কি ভুযযাদনের প্রভাবে তিনি কী স্পষ্টভাবেই না এই সত্যকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন” (পৃঃ ৮৮।
এভাবে দেখা যাচ্ছে মর্গান পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তের সমাজবিজ্ঞানী মহলে প্রভাব বিস্তার করেছেন।
৩
মর্গান ‘আদিম সমাজ’-কে চারটি খণ্ডে বিভক্ত করেন। প্রমে খণ্ড জাতিতাত্ত্বিক যুগবিভাগ। এই খণ্ডে মানুষের এই পৃথিবীতে অবস্থানকে মূলত তিনটি শাখায় বিভক্ত করা হয়েছে, অসভ্য বা আদিম পর্যায়, বর্বর যুগ ও সভ্যতা। এই তিনটি শাখার মধ্যে তিনি প্রথম দুটি নিয়ে আলোচনা করেছেন, সভ্যতা সম্বন্ধে কোনো আলোচনা করেন নি, কারণ এটা তার পুস্তকের গবেষণার বাইরে। তিনি এ্যানসিয়েন্ট সোসাইটি’ বলতে আদিম ও বর্বর যুগকে বুঝিয়েছেন। আমরা আজকে নৃ-সমাজতাত্ত্বিক সাহিত্যে এ্যানসিয়েন্ট সোসাইটি না বলে বলি প্রিমিটিভ সোসাইটি বা আদিম সমাজ। যে-কারণে এ পুস্তকের বাংলা নামকরণ প্রাচীন সমাজ না করে করা হয়েছে আদিম সমাজ। প্রাচীন সমাজ বলতে ঐতিহাসিক বিভাগকে নির্দেশ করে : প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক ইতিহাস। এবং এ-সবই সভ্যতা পর্বের বিভাগ। তাই মর্গানের প্রাচীন সমাজকে আসলে ‘আদিম সমাজ’ বলে ধরতে হবে।
মর্গান আদিম ও বর্বর পর্যায়কে আবার তিনটি করে উপবিভাগে বিভক্ত করেন, যথাক্রমে প্রাচীন, মধ্য ও পরবর্তী যুগ, আবার সমাজের ক্ষেত্রে এরই সমান্তরাল বিভাগ যথাক্রমে নিম্ন, মধ্য ও উচ্চপর্যায়ের সমাজ। প্রতিটি পর্ব বিশেষ কতগুলো উদ্ভাবন ও আবিষ্কার কেন্দ্র করে করা হয়েছে। আর এই আবিষ্কার ও উদ্ভাবন মূলত আহার্য উৎপাদনের হাতিয়ার ও তার সঙ্গে অন্যান্য আবিষ্কার যা মানব জীবনকে প্রচুরভাবে সাহায্য করেছে করা হয়েছে তা ধরে।
প্ৰথম খণ্ডে মর্গানকে আদিম পর্যায় সম্বন্ধে পুনর্নির্মাণ করার ক্ষেত্রে কিছুটা ধারণার আশ্রয় নিতে হয়েছে। যে-অবস্থা এখন পৃথিবীতে আর কোথাও নেই তেমন অবস্থার চিত্র অঙ্কন করতে গেলে যা না করে উপায় নেই এবং এটাও মর্গান করেছেন খুবই যুক্তিবাদীভাবে। প্রতিটি যুগের উদ্ভাবন ও আবিষ্কারকে বাদ দিতে দিতে মানুষের আদিম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছচ্ছেন : যখন মানুষের হাত শূন্য, মানুষ অন্যান্য প্রাণীর মতোই পৃথিবী-বক্ষে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
যুগ বিভাগের সঙ্গে সামাজিক পর্যায়কে যুক্ত করা হচ্ছে উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের মাধ্যমে। যুগ ও সমাজের পর্যায় একটি জিনিসের ফল : হাতিয়ার ও অন্যান্য বিশিষ্ট উদ্ভাবন। এর ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি এই পুস্তকের পরিকল্পনা একটি ন্যায়সঙ্গত ধারা গ্রহণ করে। প্রথম খণ্ডে উদ্ভাবন ও আবিষ্কার অর্থাৎ মানুষের আহার্য-উৎপাদনের কলাকৌশলের ওপর আলোচনা, বাকি তিনটি খণ্ড সামাজিক সংগঠনের ওপর; সরকার, পরিবার ও সম্পত্তি যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ড। এ থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট আহার্য উৎপাদনের মৌল কলাকৌশল ও হাতিয়ার যে মানব সমাজ সংগঠনকে নির্ধারণ করছে সেভাবেই যেন এই গ্রন্থকে সাজানো হয়েছে।
মর্গান অবশ্য কখনো কখনো উল্লেখ করেছেন, “মৌলিক চিন্তার বীজ” যা কেন্দ্র করে মানুষ অগ্রসর হয়েছে : মৌলিক চিন্তা অর্থাৎ সরকার, পরিবার ও সম্পত্তির ধারণা। এখানে দুটি স্বাধীন ধারণা মনে হতে পারে যে একদিকে যান্ত্রিক কলাকৌশল ও অন্যদিকে “মৌলিক চিন্তার বীজ” বা সামাজিক প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে মানুষের মনে যা দানা বাঁধে তা আর একটি স্বাধীন উপাদান; আসল ব্যাপার তা নয়। মর্গানের সময় মনস্তাত্ত্বিক চিন্তার যে উন্নয়ন ঘটে তখন ধারণা করা হত মানুষ কিছু ধারণা নিজে নিজেই করেছে, তাই এই দ্বিমাত্রিক বিভাগ। আসলে যান্ত্রিক নির্ধারণবাদ সম্বন্ধে মর্গান তেমন করে বলেন নি, তবু সব উপাদান এই গ্রন্থে আছে। বারবার “প্রাইমারি জার্মস অব থট” কথাটা এসেছে এবং তাই মর্গান বলেছেন, “গবেষণার দুটি স্বাধীন ধারা।”
যান্ত্রিক নির্ধারণবাদ বা সমাজের কাঠামোয় আহার্য যোগাড়ের হাতিয়ারের একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব বিদ্যমান এবং সমাজ চরিত্রের প্রধান নির্ধারক শক্তি, কিন্তু একটি সমাজ চরিত্রের সঙ্গে যে সাংস্কৃতিক ধারা তৈরি হয় তার প্রভাবও কম নয় এবং অনেক সময় এই মানসগত উপাদান সমাজ পরিবর্তনের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সমাজ পরিবর্তন যতটা সরলরৈখিক মনে করা হয় বাস্তবে তা তেমন নয়। এ সম্বন্ধে মর্গান যে সচেতন ছিলেন পুস্তকের শেষ প্যারায় তার নিদর্শন মেলে। তিনি বলেছেন, “আদিম পর্বে মানুষকে যে দুস্তর উথান-পতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে”, সুতরাং এই উত্থান-পতনের ধারণা মর্গানের স্পষ্ট ছিল। অনেক সমালোচক বলেন মর্গানের বিবর্তনের ধারণা একরৈখিক। আসলে এটা অপব্যাখ্যা, তবে এ কথা বলা যায় বিবর্তনের এই যে আঁকার্বাকা গতি তারপরও মানুষ অগ্রগতি করেছে এবং সমগ্র মানব জাতির লিখিত অলিখিত ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে শেষ পর্যন্ত মানুষ সব বাধা কাটিয়ে আজ যেখানে এসেছে তা উথ নি-পতনের ইতিহাস এবং অগ্রগতির ইতিহাস, যদিও তা একরৈখিক বা উল্লম্ব চরিত্রের নয়।
অনেক সমালোচক অবশ্য সামাজিক বিবর্তনের ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্তিকে (ডিফিউসান) বড় করে দেখেন। যেমন লোয়ি বলেন, “সর্বজনীন বিবর্তনক্রমের ধারায় পরিব্যাপ্তি একটি সর্বব্যাপী নাশ।” পরিব্যাপ্তি যে বিবর্তনের ধারায় একটি বিশিষ্ট উপাদান এ সম্বন্ধে মর্গান বারবার উল্লেখ করেছেন যে পাশাপাশি গোষ্ঠীদের মধ্যে একদল একটি আবিষ্কার করলে অন্যরা তা গ্রহণ করে। তিনি হয়তো পরিব্যাপ্তি শব্দটা ব্যবহার করেন নি কিন্তু এর সম্ভাবনা তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। মর্গানের যুগবিভাগ ‘অসভ্য’ ও ‘বর্বর’ শব্দদ্বয়ে নেতিবাচক গুণ থাকায় আজকাল নৃতত্ত্বের সাহিত্যকে নিরপেক্ষ করার জন্যে ‘অসভ্য’ যুগকে বলা হয় “প্রাকৃতিক অর্থনীতি” বা “শিকার ও সহ” পর্ব। অর্থনীতির এই ধারা সমগ্র পুরাতন প্রস্তর যুগ জুড়ে ছিল। এমনকি এই অবস্থা কিছুদিন আগেও ছিল অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকায় কালাহারি মরু অঞ্চল, কানাডার উত্তরের বনাঞ্চল, আমেরিকার পশ্চিম অঞ্চলের মরুভূমি ও মালভূমি অঞ্চল, আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্তভাগ, আর্কটিক অঞ্চলের বেশ কিছু অঞ্চল এবং ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু ঘনবনপূর্ণ দ্বীপাঞ্চলে। বর্বর যুগের বদলে আমরা আজ ‘উদ্যান-কৃষি’ বা থেতলে কাটা ও ঝোঁপঝাড়ে আগুন ধরিয়ে তারপর কৃমির ব্যবহার বলে বর্ণনা দিই। চাষের হাতিয়ার খুবই সাধারণ এবং যখন ঝোঁপঝাড়ের সঙ্গে লড়াই করে পারা যায় না তখন মানুষ স্থান পরিবর্তন করে চলে। শস্যের চাষ ও গাছপালার চাষ প্রায় দশ হাজার বছর আগেই ঘটেছে, যে-সময়কে আমরা নব্য প্রস্তর যুগ’ বলছি। নব্য প্রস্তর যুগের শেষের দিকে সভ্যতা এসে গেছে এবং সেই সভ্যতা আমরা আজও টেনে আনছি, যদিও তখনকার শহর আর আজকের নগরায়ন বিপুল পার্থক্য নিয়ে বিরাজ করছে, সমাজ জীবন জটিলতর হয়েছে তবু সভ্যতা এই যুগ ধরেই মানুষ চলছে।
হাতিয়ারের ক্ষেত্রে মর্গান আদিম যুগের উচ্চপর্যায়ে তীর-ধনুকের ব্যবহারের কথা বলছেন এবং হাতিয়ারের উল্লেখ হিসেবে প্রথম আসছে তীর-ধনুক। আজকে পুরাতত্ত্বের কাছ থেকে আমরা জানতে পারছি যে পাথরের অস্ত্র মানুষের আদি হাতিয়ার। তীর-ধনুকের অনেক আগে মানুষ হাত কুড়ুল’ বা ‘মুষ্টি-কুড়ুল’ ব্যবহার করেছে। ব্রোঞ্জযুগ, লৌহযুগ ইত্যাদির মতো প্রস্তর যুগ সম্বন্ধে মর্গান জানতেন, অথচ সমাজের পর্যায় বিভাগে পাথরের হাতিয়ারের উল্লেখ করেন নি।
আহার্য হিসেবে মাছের স্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি উদ্যান-কৃষির সমান তার গুরুত্ব, সুতরাং একে, আদিম যুগের মধ্য পর্যায়ে ফেলা হয়তো যায় না। মর্গান মাছের ব্যবহারের ক্ষেত্রে ওজিবওয়া গোষ্ঠী সম্বন্ধে বলতে গিয়ে নিজেই এর গুরুত্ব দেখিয়েছেন।
মর্গান আহার্যের উৎসের ক্ষেত্রে পরবর্তী পর্যায় হিসেবে স্থান দিয়েছেন উদ্যান-কৃষি এবং এর পরবর্তী ধাপ পশুপালন। উদ্যান-কৃষির ফলে মানুষের অগ্রগতি অনেকটা ঘটে। প্রকৃতির ওপর তার নির্ভরতা কমে। এরপর আসে পশুপালন। এর ফলে আহার্যের বিপুল ভাণ্ডার বেড়ে যায়। মর্গান তারপর ধরছেন কৃষি, কিন্তু কৃষি আর পশুপালনকে আগে পরে করা যায় কি না এ সম্বন্ধে অনেকে প্রশ্ন তোলেন।
মর্গানের যুগবিভাগের অন্যতম দুর্বল ক্ষেত্র হল মৃৎশিল্পকে মাপকাঠি ধরে তিনি যখন আদিম সমাজকে পৃথক করে বর্বর যুগের প্রারম্ভ বলে ধরছেন। কৃষির আবির্ভাব না হলে মৃৎপাত্রের প্রয়োজন তেমন করে দেখা দেয় না। কৃষিকেই মৌলচালক ক্ষমতা ধরে এই বিভাগ করা দরকার। ঠিক তাই তিনি পলিনেশিয়াবাসীদের আদিম পর্যায়ে ফেলেছেন কারণ তারা মৃৎপাত্র ব্যবহার করে না। এরা কাঠের বোল ব্যবহার করত। এরা ছিল উদ্যান-কৃষি ও মৎস্যজীবী এবং বেশ একটি উন্নত সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল, মান-সম্মান ধরে ছিল স্তরবিন্যাস। মর্গান হয়তো তাদের জ্ঞাতি সম্পর্ক ধারা ধরে এই ভুল করেছেন; এদের সম্পর্কের ধারা হয়তো পূর্ব পর্যায়ের ধারার সঙ্গে মেলে।
উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত উপকূলের ইণ্ডিয়ানরা মৃৎশিল্প আবিষ্কার করেন নি এবং কৃষিকাজ জানত, তাই মর্গান তাদের আদিম পর্যায়ে ফেলেছেন। অথচ তারা ঐ অঞ্চলে প্রচুর স্যালমান মাছ ধরত ও শুঁটকি করে জমিয়ে রাখার মাধ্যমে একটা স্থিতিশীল অর্থনীতি গড়ে তোলে। যা পশু-শিকার ও শুধু মৎস্যজীবী সমাজের চেয়ে উন্নত। মর্গান এটা লক্ষ করেছেন, কিন্তু এর পুরো গুরুত্ব ধরতে পারেন নি।
এই সমস্ত ছোটখাটো তথ্যগত ক্রটি কেন্দ্র করে তার সমালোচকরা মর্গানের সমগ্র তত্ত্বকেই উড়িয়ে দিতে চান যে মানুষের অগ্রগতি একরৈখিকভাবে চলছে না। এ ব্যাপারে মর্গানের স্থান কী তা আমরা আগেই আলোচনা করেছি তাই এখানে পুনরুক্তির প্রয়োজন নেই। মর্গান যে যুগ-বিভাগের ধারা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল এর পেছনে অন্তর্নিহিত যে প্রক্রিয়া কাজ করছে সেটাকে ধরার চেষ্টা। তা না ধরে লোয়ি তো বলেই বসলেন যে একজনের পক্ষে কী করা উচিত তার প্রকৃষ্ট নমুনা হল মর্গানের আদিম সমাজ, অর্থাৎ সমস্ত সমাজের ইতিহাসের পেছনে কী অন্তর্নিহিত শক্তি কাজ করছে তা বের করতে যাওয়া একটা অসম্ভব কাজ। মর্গান সেই অসম্ভব পথেরই পথিক। তিনি যদি অকৃতকার্যও হন তার সেই প্রচেষ্টার জন্যেই নৃসমাজবিজ্ঞানীদের কাছে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
আদিম ও নিম্নপর্যায়ের অনেক বর্বর সমাজে যে নরখাদকতা চলত এ সম্বন্ধে মর্গান কয়েক জায়গাতেই উল্লেখ করেছেন। তার এই অভিমতকে লিকক অবশ্য মানতে রাজি নন। তিনি বলছেন কোনো জায়গায় আটকে যাওয়া, দুর্ভিক্ষ বা কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়া মানুষ মানুষ খেত এটা বলা মুশকিল। অথচ খাদ্য হিসেবে নরখাদকতার স্থান যে যথেষ্ট ছিল এ সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। এমনকি রবিনসন ক্রুশোর মতো উপন্যাসের মধ্যেও এর পরিষ্কার চিত্র মেলে।
মর্গান ভাষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে যা বলেছেন তার মধ্যে কিছুটা অস্পষ্টতা আছে, যেমন তিনি বলেছেন, “অঙ্গভঙ্গি বা ইশারার ভাষা…উচ্চারিত ভাষার আগে সৃষ্টি হয়েছে এবং আরো বলেছেন “এক শব্দবিশিষ্ট ভাষা বহু শব্দাংশযুক্ত ভাষার আগে তৈরি হয়েছে। এটা এভাবে সঠিক করে বলা মুশকিল। কারণ মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর মধ্যেও ধ্বনিগত ভাষা আছে যাদের ধ্বনি বা শব্দের ওঠা-নামা কেন্দ্র করে কিছু অর্থ দাঁড়ায় এবং এর সাথে বিশেষ একটি অর্থ দানা বেঁধে ওঠে। এমনকি বানরদের মধ্যে দেখা গেছে তাদের চিৎকারের ওঠা-নামার সঙ্গে অর্থের তারতম্য ঘটে। এমনকি যারা অনেকগুলো তাষা জানে তারা ভিন্ন ভাষায় কথা বলার সময় অঙ্গভঙ্গি কিন্তু তেমন একটা বদল করে না। ইশারাই যে আগে যাবে তা বলা মুশকিল।
৪
আদিম সমাজের দ্বিতীয় খণ্ডের মূল বক্তব্য; পরিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাজ সৃষ্টি হবার আগের সমাজ ব্যক্তিগত সম্পর্কভিত্তিক। এই দুটির মধ্যেকার দ্বন্দ্বের চরিত্র মর্গান তুলে ধরেছেন। প্রাচীন আইন’ পুস্তকের রচয়িতা স্যার হেনরি মেইন এই ধারণা পূর্বেই দেখিয়েছেন। মর্গান সরাসরি মেইনের কাছ থেকে এই ধারণা ধার করেছেন কি না জানা যায় নি। যদিও মর্গান মেইনের প্রাচীন আইন’ পুস্তকের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আদিম সমাজ আঞ্চলিক ভিত্তি ধরে গঠিত ছিল না। রাজনৈতিক সমাজ অঞ্চল ও সম্পত্তি ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
মর্গান আদিম সমাজের নাম দিয়েছেন ‘সোসিয়েটাস’ এবং রাজনৈতিক সমাজের নাম দিয়েছেন ‘সিভিটাস’। এই বিষয়টি সমাজতত্ত্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং মর্গানের অন্যতম প্রধান অবদান।
আদিম সমাজ ছিল যৌনতাভিত্তিক, মহিলা ও পুরুষদের শ্ৰেণীদের অন্তর্বিবাহ কেন্দ্র করে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন অবস্থা তুলে ধরে অস্ট্রেলীয় আদিবাসীরা। এর চেয়ে সামান্য উন্নত হল ইরোকোয়া গোষ্ঠী, তারপর আজটেকরা। মর্গানের মতে নারী-পুরুষ শ্ৰণীই সর্বপ্রাচীন সংগঠন।
মাতৃতান্ত্রিক গণ প্রথম দিককার কৃষিসমাজের সংগঠন। ক্রমশ যত সম্পত্তি বাড়তে থাকে মহিলা-ধারায় বাধা পড়ে এবং পুরুষদের হাতে আসে সম্পত্তি এবং একসময় গণও অদৃশ্য হয়ে যায়।
নৃতত্ত্বের ভাষায় আজকে গণের অর্থ পাল্টে গেছে। মর্গান গণ বলতে শুধু সংগঠন ধরছেন, কিন্তু আজকে এর অর্থ ধরা হয় পিতৃ-ধারায় উত্তরাধিকার নির্ণীত জনগোষ্ঠী। আর এর বিপরীত ধারা অর্থাৎ মহিলা-ধারাকে বলা হয় ক্ল্যান এবং এই দুই ধারার নিরপেক্ষ অবস্থান বা দুটোকে একসঙ্গে বলে সিব।
মর্গান বলছেন সমন্ত আদিম সমাজে স্ত্রী- ধারায় উত্তরাধিকার নির্ণীত হত। সাধারণত হাতিয়ার যার হাতে ক্ষমতা তার হাতে থাকে। একমাত্র উদ্যান-কৃষি পর্যায়ে মেয়েদের হাতে ক্ষমতা যায়, কারণ এই কাজটা মেয়েরাই করত। পশুপালন পর্যায়ে মেয়েদের ক্ষমতা অনেকটা খর্ব হয়। আর ক্ষেত্র-কৃষি ও শিল্পায়নের সাথে মেয়েদের ক্ষমতা একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়।
ইরোকোয়া মেয়েরা চাষ করে, পুরুষরা করে শিকার, দেখা যাচ্ছে মেয়েদের হাতে ক্ষমতা। উদ্যান-কৃষি পর্ব সর্বত্র যদি মেয়েদের হাতে থেকে থাকে তা হলে মাতৃতন্ত্র এক পর্যায়ে সর্বজনীন হওয়া স্বাভাবিক। তাই এ ব্যাপারে আরো গবেষণার প্রয়োজন।
রাজনৈতিক সমাজের উদ্ভব এবং এই সমাজ আদিম সমাজের সংগঠন থেকে বিশিষ্ট। মর্গানের এই ব্যাখ্যায় আমরা দেখতে পাচ্ছি এই পরিবর্তন তখন ঘটে যখন কৃষি ও পশুপালন বেশ বড় আকারে দেখা দেয় এবং যার ফলে নগরে বাস করা সম্ভব হয় এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি ব্যক্তির হাতে প্রচুর জমা হয়। তিনি এই ব্যাপারে গ্রিসের সমাজ থেকে উদাহরণ গ্রহণ করেন, যেখানে ধ্রুপদী যুগে সমাজের জটিলতা বৃদ্ধির ফলে গণসমাজ ভেঙে রাজনৈতিক সমাজ গড়ে ওঠে। মর্গান গ্রিস আর রোমের উদাহরণ থেকে এই তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন। পৃথিবীতে নগর-উন্নয়ন অবশ্য আরো তিন হাজার বছর আগে নদী-তীর কেন্দ্র করে মেসোপটেমিয়া, ভারত, মিশর ও আরো বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠে। বর্তমান সমাজবিজ্ঞানী ও নগরের ওপর বিশেষজ্ঞরা শুধু গ্রামীণ জীবনের স্বয়ংসম্পূর্ণ অবস্থা থেকে শহর সৃষ্টির অবস্থার চেয়ে শহর গড়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়ার একটা সর্বজনীন নীতি বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সমাজের নূতন অবস্থার সমাধানের জন্যে আঞ্চলিক সম্পর্ক এগিয়ে আসে। মর্গান এই উন্নয়নের ওপর জোর দেন এবং এই সিদ্ধান্তের পেছনে উদাহরণ নেন গ্রিক ও রোমান সমাজ থেকে। রাজনৈতিক সংগঠন প্রথম যখন শুধু সম্পত্তির ওপর নির্ভর করে তা কৃতকার্য হয় নি, তাই গ্রিসে ক্লাইসথেনিস ডেমি বা শহর গড়ে তোলে। রোমে গণকে সরিয়ে সম্পত্তিভিত্তিক শ্রেণী ও শহরের ওয়ার্ড এগিয়ে আসে। মর্গান দেখিয়েছেন, “একটি অভিজাত শ্রেণী…এইভাবে তৈরি হয় এবং প্রথমে গণসমাজেই তৈরি হয়, পরে রাজনৈতিক সমাজে জায়গা করে নেয়, যা শেষে গণতান্ত্রিক নীতিকে বিসর্জন দেয়, মানুষ যা গণ থেকে পেয়েছিল। রোমান সেনেট, যে প্যাট্রিসিয়ান শ্রেণী তৈরি করে তা রোমান জনতার ভাগ্যকে পরিবর্তিত করে দেয়। তিনি বলেন রোমানরা যে সমাধান করে ছিল ধনিক শ্রেণীর চালাকি, তারা আসলে ক্ষমতা দখল করতে চায়, কিন্তু ভান করে যে সবার স্বার্থ দেখার জন্যেই তারা এটা করছে। তিনি আরো বলেন, “এইভাবে সম্পত্তি তৈরি এবং তাকে এক্ষা করা সরকারের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়, এরই সাথে যুক্ত হয় দূরের গোষ্ঠী ও জাতিদের নিজেদের দখলে আনা।” তিনি বলেন যে রোম যদি শুধু অঞ্চল ধরে সজ্জিত হত এবং সেনেট হত নির্বাচনমূলক তা হলে এর গণতন্ত্র হত গ্রিসের মতো। এই মন্তব্যে একটা ঘাটতি দেখা দিচ্ছে যে মর্গান গ্রিসের অর্থনীতিতে দাসদের ভূমিকা খুব জোর দিয়ে দেখছেন না। গ্রিক গণতন্ত্র ছিল অভিজা৩ ও স্বাধীন নাগরিকের জন্যে, দাসদের জন্যে কোনো গণতন্ত্র ছিল না। মর্গানের জোরটা পড়ছে দলের ওপর, ঠিক সকল শ্রেণীর ওপর নয়, যা বিভিন্ন সম্পত্তি সম্পর্কে সম্পর্কিত। এই ব্যাপারটি এঙ্গেলস পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন যে গ্রিস ও রোমে অর্থনৈতিক কাঠামোতে বিশেষীকরণ এবং ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নয়নের ফলে রাজনৈতিক সমাজের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
মর্গান আজটেক সমাজ সম্বন্ধে বলেন তা ইউরোপের মতো রাজতান্ত্রিক ছিল না, বরং ছিল ‘সামরিক গণতন্ত্র’, এ সম্বন্ধে প্রশ্ন না তুলেও বলা যায় সত্যিকার কী অবস্থা ছিল, তাদের সামাজিক স্তরবিন্যাস, শ্রেণী এবং ধন-সম্পদের বিন্যাস এ সম্বন্ধে তেমন করে জানা যায় নি।
এই পর্বে মর্গান আরো বলেছেন একবিয়ে পরিবার গণসমাজে সম্ভব ছিল না, কারণ একটা গণে আসলে দুটি গণের লোকজন নিয়ে বসবাস। পরে সম্পত্তি বাড়ার পর মানুষ একৰিযে পরিবারের দিকে যেতে পারে, যখন গণের প্রভাব কমে গেছে।
এরপর তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে গণসমাজ থেকে রাজনৈতিক সমাজে পরিবর্তনের সনে সঙ্গে মহিলাদের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। মর্গানের এই বক্তব্য যথেষ্ট শক্তিশালী।
মর্গান গ্রিস ও রোমের সমাজের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির ভূমিকাকে যথেষ্ট দাম দিয়েছেন যে সবাই মিলে পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। লেসটার এফ, ওয়ার্ড যাকে বলেছেন সমাজ পরিবর্তনের সচেষ্ট প্রয়াস (টেলিক থিওরি অব সোসাল চেঞ্জ)। ওয়ার্ড (১৮৪১–১৯১৩) হার্বার্ট স্পেন্সরের অনড় সমাজতত্ত্বকে রক্ষা করেন তার মতবাদ দিয়ে যে যে-জ্ঞান বা বিজ্ঞান মানুষের কোনো কাজে লাগে না তা অর্থহীন ও মৃত। তাই তিনি বলেন সামাজিক ঘটনাকে “সমাজ নিজের প্রয়োজনে বুদ্ধির সাথে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে।” ওয়ার্ডের “ডায়নামিক সোসিওলজি”র মতো মর্গানও মানুষের যুক্তিবাদ ও সচেতনতাকে সমাজ পরিবর্তনে যথেষ্ট দায়ী করেছেন।
মর্গানের কোনো কোনো উক্তির মধ্যে যে স্বজাতিকেন্দ্রিকতা নেই তা নয়, যেমন তিনি আফ্রিকা সম্বন্ধে বলেছেন, “শূন্য জাতিতাত্ত্বিক ক্ষেত্র”। আসলে কি তাই? আফ্রিকা জাতিতাত্ত্বিক পাঠের অন্যতম আকর। কারণ আফ্রিকায় সব ধরনের জাতিতাত্ত্বিক সমাজ বিদ্যমান ছিল। কালাহারি মরুভূমির আদিম লোকজন থেকে শুরু করে পূর্ব আফ্রিকার সভ্য সমাজ পর্যন্ত। এমনকি অস্ট্রেলিয়াবাসী সম্বন্ধে বলেছেন, “নিম্নস্তরের মানসিকতা ও নৈতিকতা” এবং “তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন আদিম অবস্থা”। নৃতাত্ত্বিক সাহিত্যের নিরপেক্ষতা সর্বত্র তিনি রাখতে পারেন নি। অবশ্য এই ছোটখাটো ত্রুটির জন্যে মর্গান ম্লান হয়ে যান না, এই ক্রটির উল্লেখে বরং খাদ কেটে যায় এবং মর্গান আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন।
মর্গান বলেছেন “যখন মানসিক ও শারীরিক গুণে গুণান্বিত দুটি গোষ্ঠী একত্রিত ও মিশ্রিত হয়, তাদের বর্বর জীবনের অঘটন ঘটার ফলেই হোক, এই মিশ্রণের ফলে নূতন খুলি ও ঘিলু প্রশস্ত হয় এবং দুটির যোগফল হিসেবে লম্বা হবে।” আজকের গবেষণায় জানা যাচ্ছে মানুষ যত নাগরিক সভ্যতায় আসছে তার খুলি ক্রমশ গোলাকৃতির হচ্ছে, অবশ্য এই প্রক্রিয়া খুবই জটিল ও সূক্ষ্ম, যেভাবে মর্গান বলেছেন তেমন সহজভাবে ব্যাপারটা ঘটছে না। অবশ্য তথাকথিত “জাতি মিশ্রণ” (মিসসেজেনেশান ব্যাপারটি মর্গান যে পরিষ্কার ধরতে পেরেছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই।
৫
আদিম সমাজের তৃতীয় খণ্ড পরিবারের উন্নয়ন সম্পর্কে আলোচনা। প্রথম অতিমত, মানুষের পরিবার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে এবং সম্ভবত এই পরিবর্তন চলতে থাকবে। দ্বিতীয়, একবিয়ে পরিবার গণসংগঠনের মধ্যে তৈরি হতে পারে নি, কারণ স্বামী-স্ত্রী দুই ভিন্ন গণের সদস্য। তৃতীয়, একবিয়ে পরিবার সম্পত্তির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। চতুর্থ, একবিয়ে পরিবারে যাবার পথে মধ্যে পিতৃপ্রধান পরিবারের আবির্ভাব, যেখানে চরম পুরুষ প্রাধান্য।
মর্গান পরিবারের যে-ধারা বর্ণনা করেছেন তার মধ্যে প্রথমে পড়ছে আপন ও জ্ঞাতি-ভাই বোনে বিয়ে, পরে জোড়া দেওয়া, এরপর পিতৃপ্রধান ও একবিয়ে। এই আলোচনায় তিনি একটি ধারণা দেবার চেষ্টা করেছেন, আর নিঃসন্দেহে তা বিবর্তনবাদী। তিনি যে ধারা দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছেন তার প্রথম দুটি ধারণামূলক এবং জ্ঞাতি-সম্পর্কমূলক শব্দ থেকে অনুমান করেছেন, কিন্তু বাকি তিনটি ধারার নমুনা এখনো মেলে। ওয়েস্টার মার্ক তার ‘হিষ্ট্রি অব ম্যারেজ’ পুস্তকে অজাচার ব্যবস্থা সম্বন্ধে আপত্তি তুলেছেন। স্টার্ন-এর মতে, “পরিবারের বিবর্তনে কোনো নির্দিষ্ট এবং চিরন্তন ধাপ নেই। মর্গান বর্ণিত পর্যায় বা স্তরগুলো নিতান্তই স্বআরোপিত, অথবা অন্ধ সংস্কার ও কল্পনাশ্রয়ের পরিচায়ক।”
এই পর্ব সম্পর্কে নানা বিরূপ মন্তব্য হয়, বিশেষ করে আদিবাসীদের মধ্যেও অনেক জায়গায় ঢিলেঢালা একবিয়ে দেখা যাবার ফলে। এত রকম বিরুদ্ধ মন্তব্যের পরও কিছু কিছু সদর্থক গুণ থাকেই। যেমন, ড. নাজমুল করিম তার “সমাজবিজ্ঞান সমীক্ষণ”-এ মন্তব্য করেন : “মর্গান মানব সমাজে পারিবারিক বিবর্তনের ধারার যে থিওরি দিয়েছেন তা যুগান্তকারী বিবেচিত হয়েছে। বস্তুত, পরিবারের উৎপত্তি, বিবর্তন ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সমাজ দার্শনিকরা মানুষের আদিযুগ থেকে চিন্তা করে আসছেন। গ্রিক দার্শনিক প্ল্যাটোর পরিবার-সংক্রান্ত চিন্তাধারা বৈপ্লবিক বলে গণ্য। পরিবারের ভবিষ্যৎ রূপ ও গড়ন কী হবে সে-সম্পর্কে দার্শনিক বা বিজ্ঞানীরা কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে নি। বুনিয়াদি পণ্ডিতদের দার্শনিক চিন্তার পরেই মর্গান পরিবার সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও গবেষণার গোড়াপত্তন করেন এবং এ বিষয়ে তার গবেষণাই পথিকৃতের মর্যাদা পাওয়ার দাবি রাখে।”
মর্গানের এই পর্বের সবচেয়ে বড় অবদান তার জ্ঞাতি-সম্পর্কের শব্দাবলি সম্বন্ধে পাঠ। মর্গানের আগে এই বিষয়টি কেউ এমন করে ধরতে পারে নি। মর্গানের সমসাময়িক নৃতত্ত্ববিদ ম্যাকলিনান জ্ঞাতি-সম্পর্কের শব্দাবলিকে নিছক সম্বোধনসূচক শব্দ বলে বর্ণনা করেছেন। আসলে এই জ্ঞাতি-সম্পর্কের পেছনে একটি সমাজ-সংগঠন ও সাংস্কৃতিক ধারা কাজ করছে, এ শব্দাবলির মাধ্যমে সেই ধারাকে জানার চেষ্টা চালানো যায়।
মর্গান হলেন এই জ্ঞাতি-ধারা সম্পর্কের প্রতিষ্ঠাতা। মর্গানের আগে আদিবাসীদের জ্ঞাতি সম্পর্কের ধারাকে কেউ পাত্তা দেয় নি।
মর্গান পিতৃপ্রধান পরিবার সম্পর্কে বলেন, “যেহেতু তা অল্পদিন ছিল তাই মানুষের ইতিহাসে এর প্রভাব কম।” পিতৃপ্রধান পরিবার কিন্তু এখনো সভ্যতার কেন্দ্রসমূহে দেখা যায়, ভূমধ্যসাগর। থেকে ইণ্ডিয়া-চীন পর্যন্ত এর অবস্থান। এমনকি মর্গান গ্রিস ও রোমেও এর অবস্থান সম্পর্কে বলেছেন যে “পিতার ক্ষমতা যুক্তির বাইরে চলে গিয়েছিল, সবাইকে অতিরিক্তভাবে দাবিয়ে রাখা হত।” তিনি আরো বলেছেন যে “অধীনে যারা কাজ করে তার আগে তা ছিল অজ্ঞাত, বরং বহুস্ত্রীর জোরেই মৌল প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে।” এঙ্গেলস তার পুস্তকে এই বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন এবং বলেছেন যে একবিয়ে পরিবার আসলে নামেই একবিয়ে পরিবার ছিল, বরং পিতৃতান্ত্রিক সমাজের উপাদান সবভাবেই দুই লিঙ্গের মধ্যে অসাম্যের উপাদান নিয়ে বিরাজ করত। মর্গানও বলেছেন এই অসাম্যের কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির পার্থক্য এবং ব্যক্তির মধ্যে ধনের এই পার্থক্য এখনো ঘোচে নি, তাই পরিবার ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে থাকবে। তাই শুধু পিতৃপ্রধান পরিবার যেখানে বহুস্ত্রী গ্রহণ রয়েছে তার সাথে একবিয়ে পরিবারের পার্থক্য করতে হবে। মূল বিষয় যদি হয় পুরুষপ্রাধান্য এবং পরিবার সমাজের একক, তা হলে একবিয়ে ও পিতৃপ্রধান সমাজ একই ধরনের ব্যাপার। যা সভ্যতায় এসে জোড়বিয়েকে সরিয়ে দেয়।
ম্যাকলিনান যখন বহুস্বামী বিবাহকে বড় করে দেখেন দলের কারণে মেয়েদের হত্যা করার জন্যে, তখন মর্গান যথার্থই বলেন এই ধরনের বিয়ের ধারা সর্বজনীন হতে পারে না। তা ছাড়া মর্গান আরো বলেন, “স্ত্রী ধারায় উত্তরাধিকার নির্ণয়” এবং “কেবল স্ত্রী ধারার জ্ঞাতি-সম্পর্ককে পৃথক বলে চিনতে হবে। একজন মায়ের দিক থেকে উত্তরাধিকারী হলেও তার মানে এই নয় যে একজন তার পিতার দিকের জ্ঞাতিদের স্বীকার করে না।
আমরা আগেই বলেছি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মর্গান স্বজাতিকেন্দ্রিক, তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট সচেতন ও নিরপেক্ষ। একটি দলের নৈতিকতা যে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির দৃষ্টিতে বিচার করতে হবে এ সম্বন্ধে মর্গান গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং অপরের জন্যে সত্যিকার সম্মান ও সহানুভূতি দেখিয়েছেন। যেমন তিনি লিখছেন : “সকল হাওয়াইবাসীরা, যারা নিজেদের আদিম অবস্থা থেকে উন্নত করতে পারে নি, তারা আদিবাসী হিসেবেই সম্মানের সাথে এবং বিনম্রভাবে বসবাস করছে…ততটাই বিশ্বস্ততার সঙ্গে এবং ধার্মিকভাবে, যেমন এই মহৎ ধর্মপ্রচারকরা তাদের নিজেদের ক্রিয়াকাণ্ড করেন।”
৬
আদিম সমাজের শেষ পর্ব সম্পত্তি ধারণার ক্রমবিকাশ’। এটি অন্যান্য খণ্ডের তুলনায় খুবই ছোট। কিন্তু বিশ্লেষণে জমাট ও চমৎকার। কারো মৃত্যু হলে আদিবাসীরা তার মূল্যবান জিনিস তার শবদেহের সাথে কবর দিয়ে ফেলত। মনে করত মৃত্যুর পরও জীবন আছে, সেই জীবনের কাজে লাগবে এইসব সামগ্রী। আর বাকি জিনিস সবাই ভাগ করে নিত।
সম্পত্তির ক্রমবিকাশের পথে তিনটি মৌল-ধারার বর্ণনা করেছেন মর্গান :
প্রথম, সম্পত্তি পাবে গণ-জাতিরা।
দ্বিতীয়, সম্পত্তি পাবে নিকট-জ্ঞাতিরা।
তৃতীয়, সম্পত্তি কেবল ছেলেমেয়ে পাবে।
এ ছাড়া আর একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সম্পত্তি আদিতে ছিল স্ত্রী ধারায়, পরে উত্তরাধিকার পরিবর্তিত হয় পুরুষ ধারায়।
মর্গান বলছেন, “সমাজের কাঠামোকে যথেষ্টভাবে প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা অর্জন করে সম্পত্তি।” তাঁর এই উক্তি যথার্থ। সম্পত্তিকে একটি সমাজতাত্ত্বিক উপাদান হিসেবে এমন করে কেউ পাঠ করে নি। সমাজে সম্পত্তির প্রভাব একটা বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয় হতে পারে।
তিনি স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন সম্পত্তির পরিমাণের ওপর নির্ভর করে কোনো সমাজে অভিজাত লোক দেখা দেবে কি না। আদিম সমাজে ব্যক্তিগত দু-একটা জিনিস ছাড়া এমন কোনো সম্পত্তি ছিল না তাই অভিজাত শ্রেণী নেই। তাই দলের মধ্যে আদিম সাম্যবাদ। কোনো শ্রেণীবিন্যাস নেই। আদিম সমাজে এমনকি গ্রামীণ সমাজেও দেখা গেছে যৌথভাবে হয়তো রান্না হচ্ছে না কিন্তু কারো কাছে খাবার না থাকলে আর একজনের কাছ থেকে চেয়ে নিচ্ছে এবং সময়ে তা শোধ করে দেয়। আদিম সমাজে তখনি কেবল একজন উপোষ করে যখন সবার কাছেই কিছু থাকে না।
ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পায়নের সঙ্গে আবির্ভাব ঘটেছে মুদ্রা ব্যবস্থার। এই সঙ্গেই আসছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এবং আগের সেই সামাজিক সম্পর্ক ও সমাজ-কাঠামো পাল্টে গেল, সমাজে উঁচু-নীচু, ধনী-গরিব এমনিধারা অসাম্য দেখা দেয়। এমনকি যখন সম্পত্তি হিসেবে কৃষিকার্য আসে এ ক্ষেত্রে প্রচুর লোক লাগে এবং ভালো জমি চাই, তাই শুরু হয় যুদ্ধ। যুদ্ধ একটা সামাজিক প্রক্রিয়ায় গিয়ে দাঁড়ায় এবং যারা সাহসী তাদের ভাগে বেশি পড়াটা একটা অধিকার হিসেবে স্থান করে নেয়। এইভাবেও আসছে অসাম্য। বীরভোগ্যা বসুধা এই প্রবাদ এখান থেকেই জন্মলাভ করে।
এই খণ্ডেই মর্গান বলেছেন, “সরকার ও আইন করা হয়েছে মূলত সম্পত্তি সৃষ্টি, বৃদ্ধি ও উপভোগ করার জন্যে।”
সম্পত্তি ধরে যে শ্রেণী হচ্ছে এটা তিনি যথেষ্ট অনুধাবন করেছেন, কিন্তু এ সম্বন্ধে বিশদভাবে বলেন নি।
গণ সৃষ্টির পর জমি গণের যৌথ সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। তখন জমি কেনাবেচা বলে কিছু ছিল না। পরে সম্পত্তি বাড়ার সাথে ব্যক্তিগত সম্পত্তি উদ্ভবের সঙ্গে শুরু হয়েছে সম্পত্তি গড়াই মানুষের একমাত্র কাজ। মর্গান বলছেন, “যেখানে সম্পত্তি করাই মানুষের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য সেখানে সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে; কারণ এই ধরনের একটি উদ্দেশ্যের মধ্যে আত্মধ্বংসের উপাদান বিদ্যমান।” তাই তিনি বলেছেন, “এর পরবর্তী উন্নত সমাজ” অবশ্যই হবে, “প্রাচীন গণের স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের পুনরুজ্জীবনমূলক”। মর্গানের এই বাণী সত্যিই স্মরণীয়। মানুষ খারাপ নয়, বরং সম্পত্তি ধারণার মধ্যেই এর দুষ্ট বীজ বেড়ে উঠেছে। সমাজ-পরিচালক ও সমাজবিজ্ঞানীদের জন্যে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাণী।
৭
কীভাবে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা কাটিয়ে সম্পত্তি সবার হাতে আসবে এ সম্বন্ধে মর্গান তেমন করে কিছু বলেন নি। মার্ক্স মর্গানের ‘আদিম সমাজ পড়লেও সম্ভবত মর্গান মার্ক্সের রচনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। মর্গান তাই সমাজতান্ত্রিক সমাজের ধারণা করেন নি এবং ধনতান্ত্রিক সমাজ এবং মার্কিন সমাজকেই শ্রেষ্ঠ সমাজ বলে ধরেছেন এবং গণতন্ত্রকেই অর্থাৎ মার্কিন ধনতন্ত্রকেই সবচেয়ে ভালো সামাজিক পদ্ধতি বলে ধরেছেন। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণী যে এই সমাজের পচনকে রোধ করে নূতন সমাজ গড়বে তা স্পষ্টভাবে অনুধাবন করেছিলেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় মর্গান যখন ইউরোপ ভ্রমণে যান। মর্গানের ‘ইউরোপিয়ান ট্রাভেল জার্নাল’ থেকে জানা যায় তিনি ইটালি, অস্ট্রিয়া, জার্মান, ফ্রান্স এবং ইংল্যাণ্ড সম্বন্ধে নানা মন্তব্য করেন। বিশেষ করে ইংল্যাণ্ড সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেন যে মূলত অভিজাত শ্রেণী শেষ হয়ে গেছে এবং তারা তুলনামূলকভাবে নির্বীর্য শ্রেণীতে পরিণত হয়েছে। এখন তাদের জায়গায় অবস্থান করছে “একটি ধনিক-শ্ৰেণীতন্ত্র পুটোক্রেসি)…যাদের মধ্যে আছে বড় বণিক, শিল্পপতি এবং রাজ্যের বড় ব্যাঙ্কারসমূহ যারা এখন শাসক ক্ষমতা, দেশের সত্যিকার অভিজাততন্ত্র।”
তিনি জনমত তৈরির জন্যে নানা জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন, যাতে এই ধনতন্ত্রকে পরিশুদ্ধ করা যায়।
লন্ডনে হাইড পার্কে এক মিটিঙে তিনি বলেন, “এই ধরনের সব সভা বর্তমান কাঠামোর বিরুদ্ধে একটা ভাবপ্রবণতা সৃষ্টি করবে…বণিক, ধনতন্ত্রী এবং মাঝারি ধরনের লোকেরা এইসব সভা থেকে দূরে থাকে কারণ তাদের সহানুভূতি অন্যদিকে…যখন সময় আসবে, যদি তা হয়, বণিক, ব্যবসায়ী এবং অভিজাত সবাইকে একসঙ্গে রাস্তা থেকে সরিয়ে শ্রমিকদের উঠতে হবে।”
মর্গান যে শুধু তাত্ত্বিক নন, তার সঙ্গে সমাজ-পরিবর্তনের একজন উৎসাহী কর্মী এ থেকে প্রমাণ হয় তার সঙ্গে মার্ক্সের এখানে যথেষ্ট মিল, যদিও দুজন দুই রাস্তায় কাজ করছেন।
মর্গান আসলে একজন সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক ছিলেন না বরং তিনি সমাজের শ্রেণীবিন্যাস করেছেন বিশেষ কতকগুলি চরিত্র ধরে। যা কোনো মতেই কেউ ফেলতে পারবে না।
মর্গান প্রথম আমাদের জানালেন দুই জায়গার জনসাধারণকে এক রকম ভাবা মুশকিল, কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা এক হতে পারে।
তিনিই প্রথম যিনি গৃহ-ধারা ও স্থাপত্য নিয়ে পাঠ করেন এবং সবার নজর আকর্ষণ করেন যে এর মধ্যেও সামাজিক সংগঠনের প্রতিফলন দেখা যায়। একে পাঠ করে সমাজের অনেক সূত্র বের করা যেতে পারে।
বিজ্ঞান ও জ্ঞানের ধারা কখনো স্থির নয় তা মানুষের অনুসন্ধিৎসু মনের জন্যে সব সময় সচল। তাই মর্গানকে নূতন জ্ঞানের আলোকে আমাদের যাচাই করে নিতে হবে। মর্গান তাই নিজের গবেষণা সম্বন্ধে সব সময় সাবধান ছিলেন, গোড়ামি দেখান নি, এমনকি তার বিভিন্ন যুগ বিভাগ সম্বন্ধে তিনি বলেছেন এই বিভাগ “কাজের সুবিধার জন্য। একে বেদবাক্য বলে ধরতে হবে তা তিনি কখনো বলেন নি। কাজের সুবিধার জন্যে বা বোঝার সুবিধার জন্যে তিনি একটা মাপকাঠি ধরেছেন মাত্র। মর্গানের কোনো জ্ঞান যদি আজ পরিবর্তিত করতে হয় তাতে মর্গানের মূল্য কমে না। যেমন আইনস্টাইনের আবির্ভাবের ফলে নিউটনের স্থানচ্যুতি ঘটে না, নিউটন নিউটনই থাকেন।
লেসলি এ, হোয়াইট মর্গান সম্বন্ধে বলেন, “জীবতত্ত্বের জন্যে ডারউইন যা করেছেন তাই করেছেন মর্গান সমাজতত্ত্বের জন্যে–বিবর্তন এই ধারণাটির সূচনা ও প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।”
৮
সমাজে ব্যক্তির ভূমিকা সম্বন্ধে মর্গান যথেষ্ট অবহিত ছিলেন। তিনি গ্রিক ও রোম সাম্রাজ্যের উদাহরণ থেকে দেখিয়েছেন কীভাবে সামাজিক প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির কর্ম ও চিন্তা প্রতিফলিত হয়। তবে শুধু ব্যক্তিক দিক থেকে তিনি কোনো সমস্যা দেখেন নি। যেমন আদিম সমাজেও নেতৃত্ব ও পদলাভের জন্যে প্রতিযোগিতা ছিল। তিনি একক ব্যক্তিত্বকে তেমন করে দাম দেন নি, যেমন নেপোলিয়ান সম্বন্ধে বলেন, “তেমন লোকেরা সময়কে কিছুটা প্রভাবিত করে, কিন্তু তারা খুব বিরল ক্ষেত্রে জাতির ইতিহাসের গতিকে আকৃতি দান করে।”
ব্যক্তির ভূমিকা এতটা উন করা যায় না। কারণ ব্যক্তি অনেক সময় প্রতিষ্ঠানে দাঁড়িয়ে যায় এবং তেমন ব্যক্তির ভূমিকা সমাজে প্রবল হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে ধর্মপ্রচারক, রাজনৈতিক নেতা ও সংস্কারকদের ক্ষেত্রে এর যথেষ্ট প্রমাণ মেলে। এমনকি একজন মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেলিন, মাও-সে তুং মহম্মদ, বুদ্ধ, যিশু-র প্রভাব ইতিহাসের গতি নির্ধারণে কম নয়। একজন কামাল আতাতুর্ক-ই বা কম কিসে। তবে সাধারণভাবে একজন ব্যক্তি সমাজ-প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কাজ করে। এবং ব্যক্তি বা নেতা সমাজ কাঠামোর প্রতিফলনকে তুলে ধরে।
উনবিংশ শতাব্দীর পণ্ডিত ও গবেষকরা প্রায় ছিলেন শৌখিন, মানও ছিলেন তাই। তিনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
তিনি যেমন ছিলেন যুক্তিবাদী তেমনি ছিলেন মানবতাবাদী। তার এই মানবতার প্রকাশ অবশ্য গণতান্ত্রিক রূপ নিয়ে প্রকাশ পাবে এই ছিল তার ধারণা। তাই তিনি ভাবতেন পৃথিবীতে সর্বত্র একদিন গণতন্ত্র আসবে।
তার যুক্তিবাদী মন কতটা সচল ছিল তার একটি প্রমাণ আমরা আগেই দিয়েছি যে বিভিন্ন যুগবিভাগকে তিনি প্রভিসনাল” বলেছেন। তেমনি একবিয়ে পরিবার সম্বন্ধেও বলেছেন যে এই আকারও বদলাতে পারে যদিও এটা সর্বোচ্চ প্রকাশ, এই বদল হবে সমাজের বদলের সঙ্গে।
মানুষের আদি পূর্বপুরুষদের প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধাবোধ। তিনি বলেছেন, “আজকে আমরা আরাম-আয়েশ করছি তার কারণ আমাদের বর্বর ও আদিম পূর্বপুরুষদের সাহসের সঙ্গে সব কিছু মোকাবিলা করার জন্যে, ধৈর্য ধরে সব কষ্ট সয়ে যাবার জন্যে।” মানবতাবাদী সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে মর্গান অনন্য।
অবশ্য তাঁর চিন্তায় কিছু যে স্ববিরোধিতা ছিল না তা নয়। যেমন, তার একটি অপ্রকাশিত বক্তৃতার মধ্যে দেখা যায় (১৮৭১) তিনি বলছেন, “আমি বুঝতে পারি না কেন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো গরিব লোক থাকবে, একমাত্র যারা দুর্ভাগা বা এই দুরবস্থার জন্যে যে-ক্ষেত্রে একমাত্র তারা নিজেরাই দায়ী তা ছাড়া…একজনের যত খারাপই অবস্থা হোক না কেন তা আমি জানতে চাই না, যার শরীর সক্ষম এক একর জমি কিনতে পারে এবং জমি থেকেই নিজের ভরণপোষণ করতে পারে। যদি সে সঙ্গে সঙ্গে দাম না দেয় ধার করতে পারে এবং সামান্য খাটনি বা অধ্যবসায়ের জোরে সে নিজের চাহিদার ওপরে উঠতে সক্ষম হবে…।”
যিনি সমাজতান্ত্রিক জগতের জন্যে এত বড় অবদান রেখে গেছেন উপরোক্ত উদ্ধৃতিটি যে তার এটা যেন বিশ্বাস করতে মন চায় না। সমাজ কাঠামোর ওপর এত কথা বলেও তিনি ব্যক্তিকে দুষছেন।
৯
প্রগতি সম্বন্ধে মর্গান সব সময় চিন্তা করেছেন এবং বের করার চেষ্টা করেছেন এর কারণ। তাই তার একটি চিঠিতে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় প্রগতির যুগগুলো আহার্য উৎপাদনের কলাকৌশলের সঙ্গে যুক্ত, যার মধ্যে ডারউইনের ধারণা ‘বেঁচে থাকার জন্যে লড়াই’ যুক্ত।”
ডারউইন বিবর্তনবাদ সম্বন্ধে বলেন, “বেঁচে থাকার লড়াই” কিন্তু মর্গান এর কারণ বের করেছেন কেন বেঁচে থাকার লড়াই এবং কেন বিবর্তনবাদ। আহার যোগাড়ের কারণেই লড়াই। প্রচুর আহার থাকলে আর লড়াই হত না।
লেসলি এ. হোয়াইট তাই ঠিকই বলেন, “কোনো কোনো ক্ষেত্রে আধুনিক নৃসমাজতাত্ত্বিকগণ মর্গান যে-অবস্থায় ছিলেন তা অতিক্রম করতে পারে নি। খুব কম ব্যক্তিই মর্গানের বিবর্তন এবং সমাজের ওপর সম্পত্তির ভূমিকা কী তা ছাড়াতে পেরেছেন। অনেকে বরং পিছিয়ে গেছেন।”
এই কারণেই তিনি আরো বলেছেন, “সমাজবিজ্ঞানী ও সামাজিক বিজ্ঞানীরা শুধু মর্গানের কাছে ফিরে গিয়েই ভালো করবে না, বরং তার পথে প্রত্যাবর্তন করা উচিত, যাতে আমাদের জন্যে মর্গান যে রাজপথ তৈরি করে রেখে গেছেন সেই পথে তারা অগ্রসর হতে পারে।”
এঙ্গেলস উৎপাদন ব্যবস্থা ও জনসংখ্যা এই দুটি উপাদানের ওপর ভালো আলোচনা করেছেন।
মর্গানও বলেছেন, “মৌল আহার্য বস্তুর বিস্তৃতি না ঘটাতে পারলে মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারত না…আহার্য-বস্তুর পরিমাণ ও গুণ বজায় রাখতে না পারলে জনবহুল জাতি গঠিত হতে পারত না। এভাবে সম্ভবত মানব প্রগতির ধারা চিহ্নিত করা যায়। কমবেশি প্রত্যক্ষভাবে আহার্যের উৎসের বিস্তৃতির ফল হিসেবে।”
আমরা যদি পলাশীর যুদ্ধ থেকে আজকের বাংলাদেশ যথাক্রমে, ১৭৫৭ থেকে ১৯৮৪-এর খতিয়ান নিই ‘দেখব এই দেশে প্রচুর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পালাবদল ঘটেছে, লোকসংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ, কিন্তু মৌল উৎপাদন ব্যবস্থার তেমন বিবর্তন ঘটে নি। দুটি গরু ও একটি লাঙল আজো আমাদের ভরসা। আর ভরসা ধনী দেশের দান-দক্ষিণা। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্যে উৎপাদন-ব্যবস্থাকে বলতে না পারলে মহামারী ও দুর্ভিক্ষ অবস্থার কোনো তারতম্য ঘটবে না। আহার্য উৎপাদন-ব্যবস্থার জন্যে যা যা দরকার, তা যৌথ খামার, কৃষির শিল্পায়ন, শিল্পায়ন বা পরিপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি যাই হোক, আমাদের আজ তা গ্রহণ করতে হবে। না হয় এই বিপুল জনসাধারণকে মানুষের মতো বাঁচবার আর অন্য কোনো উপায় নেই। মর্গান চর্চা আমাদের এই শিক্ষাই দেয়।
বু. ও.
ইন্টারন্যাশনাল এনসাইক্লোপেডিয়া অব দ্য সোসাল সায়েন্সেস : ১০ম খণ্ড, সম্পাদক : ডেভিড এল, সিলস, দ্য ম্যাকমিলান কোম্পানি, দ্য ফ্রি প্রেস, ইউ. এস, এ। লেসলি এ. হোয়াইট লিখিত মর্গানের ওপর আলোচনা।
এ্যান ইন্ট্রোডাকশান টু দ্য হিস্ট্রি অব সোসিওলজি, সম্পাদনা : হ্যারি ই, বার্নস, এই পুস্তকে লেসলি এ, হোয়াইট লিখিত মর্গানের ওপর রচনা, ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান, ইউ. এস. এ।
বার্নহার্ড জে, স্টার্ন-এর নির্বাচিত রচনা সংকলন ‘হিস্টোরিক্যাল সোসিওলজি’ পুস্তকে লিখিত মর্গানের ওপর দুটি রচনা থেকে দ্য সিটাডেল প্রেস, নিউ ইয়র্ক।
অ্যানসিয়েন্ট সোসাইটি, লুইস হেনরি মর্গান–টীকা-টিপ্পনীসহ সম্পাদনা : ইলিয়েনর বার্ক লিকক, মেরিডিয়ান বুকস, দ্য ওয়ার্ল্ড পাবলিশিং কোম্পানি, নিউ ইয়র্ক।
দ্য ডেভেলাপমেন্ট অব সোসাল খট ইমোরি এস, বোগার্ডাস, লঙ্গম্যানস, গ্রিন ল্যান্ড কো, নিউ ইয়র্ক।
পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎস–ফ্রিডারিখ এঙ্গেলস। লোকায়ত দর্শন–দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, কলিকাতা। সমাজবিজ্ঞান সমীক্ষণ–ড. নাজমুল করিম, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা।
উপযুক্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপিটির সাহায্যে লিখিত।–অনুবাদক।
প্রথম ভারতীয় সংস্করণে প্রকাশকের ভূমিকা
প্রকাশক : জে. সি. সাহা রায়
মর্গানের যুগান্তকারী রচনা ‘আদিম সমাজ মানুষের চিন্তাজগতে সমাজের বিবর্তন সম্বন্ধে বিপ্লব এনেছে, তা প্রকাশ করতে পেরে অত্যন্ত আনন্দবোধ করছি। এই বিষয়ের ওপর লেখা এই প্রথম মৌলিক ও প্রচুর তথ্যসমৃদ্ধ একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ যার কোনো পরিচয় দরকার নেই এবং এ সম্বন্ধে নূতন করে কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। মর্গানের কাজের সবচেয়ে বড় অবদান হল তিনি মূলত আমাদের লিখিত ইতিহাসের প্রাগৈতিহাসিক ভিত্তি আবিষ্কার ও পুনর্গঠন করেছেন। মর্গান লিখিত পুস্তকের ওপর ভিত্তি করে এঙ্গেলস তার রচনা “পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি” পুস্তকে লেখেন এবং বলেন :
মর্গান হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি বিশেষজ্ঞ হিসেবে মানব প্রাগৈতিহাসের সামাজিক কাঠামো সম্বন্ধে নির্দিষ্ট পরিচয় দান করার চেষ্টা করেছেন। যতদিন না গুরুত্বপূর্ণ বাড়তি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ভার শ্রেণীবিভাগ নিঃসন্দেহে বজায় থাকবে।
যে মূল তিনটি যুগবিভাগ তিনি করেছেন, অসভ্য পর্যায়, বর্বর যুগ ও সভ্যতা, এই তিনটির মধ্যে তিনি কেবল প্রথম দুটি সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন এবং তৃতীয়টিতে কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তা তুলে ধরেছেন। তিনি অসভ্য ও বর্বর পর্যায়কে আবার খাদ্য আহরণের উৎপাদন ব্যবস্থা ধরে তিনটি করে স্তর করেছেন, নিম্ন, মধ্য ও উচ্চপর্যায়। তিনি বলেন :
এই ব্যাপারে তাদের দক্ষতার ওপর নির্ভর করছে জগতে মানুষের সবার ওপর প্রাধান্য। মানুষ হল একমাত্র সত্তা যার খাদ্য উৎপাদনের ওপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ আছে। সম্ভবত এই সূত্রেই মানব প্রগতির বিভিন্ন পর্বকে কমবেশি প্রত্যক্ষভাবে খাদ্য উৎপাদনের বিস্তৃতি ধরে চিহ্নিত করা যায়।
নৃতত্ত্ববিদ, পরিব্রাজক এবং আদিম ঐতিহাসিকগণ পেশাগতভাবে বর্তমানে তুলনামূলক বিচার পদ্ধতি যুক্ত করেছেন, যারা নূতন তথ্য বা নূতন মতামত তুলে ধরেছেন। কিন্তু তার কাজের কোনো একটিকেও কেউ এই নূতন তথ্যের জোরে স্থানচ্যুত করতে পারে নি। আদিম ইতিহাসের যে পর্যায়ক্রম তিনি স্থাপন করেছেন আজ পর্যন্ত তা মূল ধারা হিসেবে চলে আসছে।
“একটি অদৃশ্য ক্ষমতা মানব সমাজ সৃষ্টি করেছে, আজকে তার যা রূপ, এবং ‘বড়র’ প্রতি ও ‘শাসকবর্গের প্রতি আনুগত্য নিম্নশ্রেণীর ওপর এই যে ধারণা ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে চাপিয়া দেয়া হয়েছে–এই নীতি ধর্ম ও নানা প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে সম্মোহিত করেছে এবং প্রমাণিত হয়েছে যে এটি শোষণের অন্যতম স্তম্ভ। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান অনেক আগে প্রমাণ করেছে যে মানব সমাজ কোনো গতানুগতিক ঘঁচে ঢেলে তৈরি করা হয় নি। পৃথিবীতে জৈব জীবন যেমন নানা রকম রাসায়নিক পরিবর্তনের ক্রমের ফল এবং নানা আকার গ্রহণ করেছে তেমনি মানবজাতিও নানা প্রকার সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে পরিবেশের ওপর তার নিয়ন্ত্রণের ফলে, বিশেষ করে খাদ্য, পরিচ্ছদ ও গৃহ নির্মাণের মাধ্যমে এই তথ্য বাখোফেন, মর্গান, মার্ক্স, ডারউইন ও অন্যান্য পণ্ডিতরা মানুষকে দিয়েছেন। দুর্ভাগ্যবশত এই তথ্য সাধারণ জনতার হাতে গিয়ে পৌঁছয় নি। এই সমস্ত বিদ্বজনের নাম আমাদের দেশে তেমন একটা পরিচিত নয়। তাদের খুব সামান্য রচনা খুব অল্প লোকের হাতে পৌঁছয়। যা কিছু পাবলিক লাইব্রেরির ধুলো ভরা তাকে পাওয়া যায়। তাদের বাণীকে সামাজিক পদ্ধতির জন্যে বিপজ্জনক বলে মনে করা হয়। তাই তাদের চিন্তাধারা যাতে প্রচারিত না হয় তার ব্যবস্থা করা হয়, কারণ বিপুলসংখ্যক জনতা যদি তাদের চিন্তায় দীক্ষিত হয় তার মানে শাসকগোষ্ঠীর সর্বনাশ, তাই তারা এদের চিন্তাধারাকে মৃত্যুর চেয়ে ভীতিজনক মনে করে। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে-পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে এর আরো অগ্রগতি অবশ্যই এই পদ্ধতির মৃত্যু ডেকে আনবে এবং এই ব্যবস্থায় যারা সর্বক্ষমতাসম্পন্ন তাদেরও মৃত্যু ডেকে আনবে। কিন্তু যে-সব ক্ষমতা এই বর্তমান সমাজ-কাঠামোর জন্ম দিয়েছে তা দু-একজন শোষকের ইচ্ছার বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও এগিয়ে চলেছে।
একটি উৎপাদন ব্যবস্থা এক প্রকার সম্পত্তিবোধের নীতিতত্ত্বের জন্ম দেয় যা তার সুখ-শান্তি ও পারিবারিক জীবন থেকে দূরে সরিয়ে ফেলে এবং সরকার বিবর্তন ও উঁচুদরের ব্যক্তিত্বের জন্ম তো দেয়ই না বরং সত্যিকার সভ্যতার জন্ম না দিয়ে কোটি কোটি মানুষকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়।
একজনের মধ্যে ভালো জীবনের বাসনা দেখা দেবে না যতক্ষণ না সে স্থির নির্দিষ্ট হয় এবং সর্বদা সচেতন হয় যে তার বর্তমান জীবন স্কুল, নিম্নমানের এবং ঘৃণ্য এবং এই জীবনের উন্নয়ন সে নিজেই করতে পারে। বর্তমান পুস্তকের প্রকাশ বিশেষ করে শোষিত নারী পুরুষদের সচেতন করার জন্যে, যাতে তারা জানতে পারে তাদের এই বর্তমান অবস্থা আসার পেছনে সত্যিকার কারণ কী। অচেতন জনসাধারণের চক্ষুদান করে তাদের সাবধান করে দেয়া তাদের স্বার্থপর বাক-সর্বস্ব ভাবী রাজনৈতিক নেতাদের যেন তারা চিনতে পারে এবং এই নেতারাও এ থেকে শিক্ষা পাবে। এই বই অন্ধকার গতানুগতিক ঐতিহ্যধারার মধ্যে আলোর দিশারী হয়ে পথ দেখাবে এবং মানুষকে স্বাধীনতা ও সত্যিকার জীবন দান করবে। আমাদের সামাজিক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এই বই একটি সময়গাপযোগী অবদান হয়ে দাঁড়াবে যাতে আমরা সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা প্রচার করতে পারি, একমাত্র সমাজতন্ত্রই মানব সমাজকে এই সংকটময় অবস্থা ও ধ্বংস থেকে উদ্ধার করতে পারে।
মর্গানের আদিম সমাজের আবিষ্কার সম্বন্ধে অধিক জোর দিয়ে কিছু বলার নেই। জীবতত্বে ডারউইনের বিবর্তনবাদ ও রাজনৈতিক অর্থনীতিতে মার্ক্সের সারপ্লাস ভ্যালু যেমন মূল্যবান অবদান ঠিক তেমনি নৃতত্ত্ব ও সমাজবিজ্ঞানে মর্গানের ভূমিকা।
এই ব্যাপারে আমরা ধন্যবাদ জানাই শ্রীপ্রতুল কুমার দত্তকে, যার নিঃস্বার্থ সাহায্য ও দক্ষ পরিচালনার জন্যে এই বই প্রকাশ করা সম্ভব হল।
(কলকাতা)
ডিসেম্বর, ১৯৪ ৭।
ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের “পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি” পুস্তকে ১৮৮৪ সালের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় মর্গানের গবেষণা প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের মন্তব্য
একদিক থেকে বলা যায় যে নিচের পরিচ্ছেদগুলিতে একটি উত্তর দায়িত্ব পূরণ করা হয়েছে। স্বয়ং কার্ল মার্ক্স পরিকল্পনা করেন যে, তিনি ইতিহাস দিয়ে তার নিজের সীমাবদ্ধতাবে বলা যায় যে আমাদের দুজনের বস্তুবাদী অনুসন্ধান থেকে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, সেই প্রসঙ্গে মর্গানের গবেষণার ফলগুলিও উপস্থিত করবেন এবং শুধু এইভাবে তাদের সমগ্র তাৎপর্য ফুটিয়ে তুলবেন। কারণ মর্গান তার নিজের ধরনে আমেরিকায় ইতিহাসের সেই একই বস্তুবাদী ধারণা পুনরাবিষ্কার করেন যা মার্ক্স ৪০ বছর আগেই আবিষ্কার করেছিলেন, এবং বর্বরতা ও সভ্যতার তুলনামূলক বিচারে ঐ ধারণা থেকে তিনি প্রধান প্রধান বিষয়ে মার্ক্সের মতো একই সিদ্ধান্তে পৌঁছান। এবং ঠিক যেমন জার্মানির সরকারি অর্থনীতিজ্ঞরা বহু বছর ধরে ‘পুঁজি’ গ্রন্থ থেকে সাগ্রহে চুরি করেছে অথচ কেবল তা চেপে গিয়েছে, ইংল্যাণ্ডের প্রাগৈতিহাসিক বিজ্ঞানের প্রবক্তারা মর্গানের রচিত ‘আদিম সমাজ’ সম্পর্কেও তাই করেছেন। আমার পরলোকগত বন্ধু যে কাজ সম্পন্ন করে যেতে পারেন নি, আমার রচনায় তার স্থানপূরণ নগণ্যই হবে। তবে মর্গান থেকে মার্ক্সের বিস্তৃত উদ্ধৃতিগুলির মধ্যে তার সমালোচনামূলক মন্তব্যগুলি আমার হাতে আছে এবং যেখানেই সম্ভব সেখানে আমি এগুলি পুনরুদ্ধৃত করেছি।
বস্তুবাদী ধারণা অনুযায়ী শেষ বিচারে ইতিহাসের নির্ধারক করণিকা হচ্ছে প্রত্যক্ষ জীবনের উৎপাদন এবং পুনরুপাদন। কিন্তু এ ব্যাপারটার দ্বিবিধ প্রকৃতি। এক দিকে জীবনযাত্রার উপকরণ– খাদ্য, পরিধেয় ও আশ্রয় এবং সেই জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির উৎপাদন; অপর দিকে মানবজাতির জৈবিক উৎপাদন, বংশবৃদ্ধি। একটি বিশেষ ঐতিহাসিক যুগে একটা বিশেষ দেশে মানুষ যে-সমস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাস করে, সেগুলো এই দ্বিবিধ উৎপাদনের দ্বারা নির্ধারিত হয় : এক দিকে শ্রমের বিকাশের অপর দিকে পরিবারের বিকাশের স্তর দিয়ে। শ্রমের বিকাশ যত কম হয় এবং উৎপন্নের পরিমাণ এবং সেইহেতু সমাজের সম্পদ যত সীমাবদ্ধ হয়, তত বেশি সমাজব্যবস্থা কৌলিক সম্পর্ক দিয়ে পরিচালিত মনে হয়। কিন্তু কৌলিক বন্ধনের ভিত্তিতে গঠিত এই সমাজ কাঠামোর মধ্যে শ্রমের উৎপাদিকা ক্রমশ বাড়তে থাকে; সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ ব্যক্তিগত মালিকানা ও বিনিময়, ধনের অসাম্য, অপরের শ্রমশক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনা এবং তার ফলে শ্রেণীবিরোধের ভিত্তি : নবজাত সামাজিক উপাদানগুলি কয়েক পুরুষ ধারে পুরাতন সামাজিক সংগঠনকে নূতন অবস্থাগুলির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা করে, অবশেষে উভয়ের এই গরমিল থেকে আসে পরিপূর্ণ বিপ্লব। কৌলিক বন্ধুনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পুরাতন সমাজ নবজাত সামাজিক শ্রেণীগুলির সংঘাতে চুরমার হয়ে যায়। তার জায়গায় দেখা যায় রাষ্ট্র হিসেবে সংঘটিত একটি নূতন সমাজ এখানে নিম্নতম ইউনিটগুলি আর কৌলিক গোষ্ঠী নয়–আঞ্চলিক গোষ্ঠী; এরূপ সমাজে পারিবারিক প্রথা পুরোপুরি মালিকানা প্রথার অধীন এবং যে শ্রেণীবিরোধ ও শ্ৰেণীসগ্রাম এযাবৎকার সমগ্র লিখিত ইতিহাসের মর্মবস্তু, সেটা তার মধ্যে অবাধে বিকাশ পেতে থাকে।
মর্গানের মহৎ কৃতিত্ব হচ্ছে এই যে তিনি আমাদের লিখিত ইতিহাসের এই প্রাগৈতিহাসিক ভিত্তির মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আবিষ্কার ও পুনরুদ্ধার করেন। উত্তর আমেরিকার ইণ্ডিয়ানদের কৌলিক গোষ্ঠীর মধ্যে গ্রিক, রোমক ও জার্মান ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং এতদিন পর্যন্ত দুর্বোধ্য ধাঁধার চাবিকাঠি খুঁজে পান। তার বই এক দিনের রচনা নয়। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে তিনি তার মালমশলার সঙ্গে যুঝে শেষ পর্যন্ত সেগুলিকে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করেন। এই জন্য তার রচনা হচ্ছে আমাদের কালের যুগান্তকারী অল্প কয়েকটি রচনার অন্যতম।
বর্তমান রচনায় পাঠক মোটের ওপর সহজেই ধরতে পারবেন কোন জিনিসগুলি মর্গানের থেকে নেওয়া এবং আমি কী যোগ করেছি। গ্রিস ও রোম সম্পর্কীয় ঐতিহাসিক অংশে আমি মর্গানের তথ্যে আবদ্ধ থাকি নি, পরন্তু আমার জানা তথ্যও যোগ করেছি। কেল্টিক ও জার্মানদের সম্পর্কিত অংশগুলি বহুলত আমার নিজের; এই ক্ষেত্রে মর্গানের অবলম্বন ছিল প্রায় একান্তই পরের হাতফেরতা উৎস এবং জার্মানির অবস্থা সম্পর্কে ট্যাসিটাসের রচনা বাদ দিলে তিনি শুধুমাত্র মি. ফ্রিম্যানের অপদার্থ উদারনৈতিক অপব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করেছিলেন। অর্থনৈতিক যেসব যুক্তি মর্গানের উদ্দেশ্য সিদ্ধির পক্ষে যথেষ্ট ছিল, কিন্তু আমার পক্ষে যা একেবারে অনুপযোগী, সে-সমস্ত আমি নৃতন করে হাজির করেছি। এবং সর্বশেষে বলা বাহুল্য যেখানে মর্গানকে প্রত্যক্ষভাবে উদ্ধৃত করা হয় নি সেইসব সিদ্ধান্তের জন্য আমিই দায়ী।
প্রথম প্রকাশের ভূমিকা
পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের প্রাচীনত্ব আজ স্বীকৃত সত্য। বিগত ত্রিশ বছরের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত স্থাপিত হয়েছে এবং বর্তমান মানব প্রজন এই প্রথম এ-রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সত্যের সঙ্গে পরিচিত হল।
জানা গেছে মহাবরফ যুগে মানুষ ইউরোপে বসবাস করত এবং সম্ভবত এরও আগে অন্য একটি ভূতাত্ত্বিক যুগে মানুষ বসবাস করে এসেছে। অন্যান্য অনেক প্রাণীর সঙ্গে মানুষও নিজেকে টিকিয়ে রাখে এবং একটা অগ্রগতিমূলক যাত্রায় বিভিন্ন মানব পরিবারে বিভক্ত হয়ে অভাবনীয়ভাবে এগিয়ে গেছে।
যেহেতু মানুষের ইতিহাস ভূতাত্ত্বিক যুগের সঙ্গে জড়িত তাই সময়ের নির্দিষ্ট মাপকাঠিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। উত্তর গোলার্ধে বরফ যুগের অবসান থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সময়ের দু-এক হাজার বছর এদিক ওদিক হলে এমন কিছুই এসে যায় না। যে সময় সম্বন্ধে নিশ্চিন্তভাবে জানা নেই সে সম্বন্ধে যে সন্দেহই প্রকাশ করা হোক না কেন মানুষ যে এই পৃথিবীতে অনেক দিন আগে আবির্ভূত হয়েছে তার ব্যত্যয় ঘটে না। এবং মানুষের জন্মকাল প্রাচীনত্বে হারিয়ে যায়।
এই জ্ঞানের ফলে আদিম ও বর্বর অবস্থা এবং বর্বর ও সভ্য অবস্থার মধ্যে সম্পর্কের ধারণা বস্তুগতভাবে পরিবর্তিত হবে। এখন যথেষ্ট তথ্য থেকে বিশ্বাস করানো যাবে যে বর্বর যুগের আগে। ছিল আদিম অবস্থা, যেমন জানা গেছে সভ্য অবস্থার আগে ছিল বর্বর পর্যায়। মানবজাতির ইতিহাসের উৎস এক, তার অভিজ্ঞতা এক এবং প্রগতিও এক।
কীভাবে এক যুগ থেকে আর যুগে মানুষ উত্তরিত হয়েছে, কীভাবে আদিবাসীরা খুব ধীর গতিতে টলমলে পদক্ষেপে এর চেয়ে উঁচু ধাপ বর্বর অবস্থায় পৌঁছচ্ছে এটা জানতে চাওয়া মানুষের স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত ইচ্ছা। ঠিক একইভাবে জানতে চাওয়া স্বাভাবিক কী করে বর্বররা গিয়ে পৌঁছয় সভ্যতায় এবং কেন প্রগতির ধারায় একদল পিছিয়ে পড়ে রইল, একদল এগিয়ে গেল–কেন কেউ সভ্যতায়, কেউ বর্বর পর্যায়ে এবং কেউ আদিম অবস্থায়। এটা আশা করা অন্যায় হবে না যে শেষ পর্যন্ত এইসব প্রশ্নের জবাব দেওয়া হবে।
মানুষের প্রগতির ধারায় উদ্ভাবন এবং আবিষ্কার পর্যায়ক্রমে দেখা দিয়েছে। এদিকে সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ মানুষের সর্বজনীন চাহিদা অনুযায়ী খুব নগণ্য প্রাথমিক চিন্তা থেকে ক্রমশ উন্নতিলাভ করেছে। এইসবের মধ্যে সেই একই রকম প্রগতিমূলক উন্নয়ন লক্ষ করা যায়। এই প্রতিষ্ঠান, উদ্ভাবন ও আবিষ্কারসমূহ মানুষের এইসব ধ্যান-ধারণা ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরে। তুলনা করে দেখলে দেখা যায় মানুষের উৎস এক, উন্নতির বিশেষ বিশেষ পর্যায়ে মানুষের চাহিদা এক এবং সমাজের একই রকম অবস্থায় মানুষের মানসিকতাও একইভাবে কাজ করে।
আদিম অবস্থার শেষ পর্যায়ে এবং পুরো বর্বর যুগে মানুষ মূলত ছিল গণ, ভ্রাতৃত্ব ও গোষ্ঠী বিভক্ত। সমস্ত মহাদেশে প্রাচীন যুগে এই সংগঠনসমূহ বিদ্যমান ছিল এবং এই আদিম সমাজ এই সংগঠনের মাধ্যমে সংগঠিত ও একত্রিত হয়েছিল। এদের কাঠামো এবং সাংগঠনিক কাঠামোর সম্পর্কের যে ক্রম দাঁড়ায় এবং গণভ্রাতৃত্ব ও গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে একজনের যে দায়িত্ব, অধিকার ও বিধি-নিষেধ দাঁড়ায় তা সরকার ধারণার উদাহরণস্বরূপ। মানবজাতির প্রধান প্রতিষ্ঠানসমূহ আদিম পর্যায়ে সৃষ্ট হয়, বর্বর যুগে এদের যথেষ্ট উন্নতি ঘটে এবং সভ্যতায় এসে পরিপূর্ণতা লাভ করে।
ঠিক একইভাবে পরিবার পদ্ধতি নানা আকারের মধ্য দিয়ে গেছে এবং জ্ঞাতিত্ব ও সম্পর্কের একটি মহাধারা সৃষ্টি করেছে যা আজও চলে আসছে। এই সমস্ত পদ্ধতি বিশেষ এক-একটি যুগের পরিবারে তৈরি হয়ে সেই সময়ের সম্পর্কের ধারাকে তুলে ধরে এবং এর মধ্যে মানবজাতির অভিজ্ঞতা জমা হয়ে রয়েছে, যদিও পরিবার পদ্ধতি ভাই-বোন বিয়ে থেকে শুরু করে, মাঝখানে অন্যান্য পদ্ধতির মধ্য দিয়ে একবিয়ে পরিবারে পৌঁছয়।
সম্পত্তি ধারণার ক্ষেত্রে এই একই রকম উদ্ভব ও উন্নয়ন ঘটেছে। শূন্য অবস্থায় মানুষের যাত্রা শুরু হয় সেই আদিম যুগে, আর আহার্য বস্তুর জড়ো করার প্রবল বাসনা থেকে শুরু করে বর্তমান সভ্য জগতের মানুষের মনে সম্পত্তি দখলের ইচ্ছা বিপুল হয়ে উঠেছে।
যে চার ধরনের বিষয় ওপরে আলোচনা করা হল যা মানুষের আদিম অবস্থা থেকে সভ্য পর্যায়ে আসার যাত্রাপথে সমান্তরালভাবে বর্ধিত হয়েছে, এই পুস্তকে সেইসব বিষয় সম্বন্ধেই আলোচনা করা হয়েছে।
আমেরিকাবাসী হিসেবে বিশেষ যত্নসহকারে এবং দায়িত্ব মনে করে একটি ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট পরিশ্রম করার আছে, আমেরিকা মহাদেশ যেমন বস্তুগত ধনসম্পদে ধনী, তেমনই জাতিতাত্ত্বিক, শব্দতাত্ত্বিক ও পুরাতাত্ত্বিক সম্পদেও ঐশ্বর্যশালী এবং বর্বর যুগের মহাপর্যায়েরও আকারভূমি। যেহেতু মানুষের উৎস এক, তাদের জীবনের গতি এক, নানা ধারায় প্রবাহিত হলেও এই একই রূপ নিয়ে সব মহাদেশে তা ফুটে উঠেছে। মানবজাতির সমগ্র গোষ্ঠীতে এক-এক উন্নয়নের পর্যায় এক রকম। এর অর্থ আজকে আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি, কমবেশি আমাদের পূর্বপুরুষরা যখন এই পরিবেশে ছিল এই একই অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। এরা মানব ইতিহাসের একটি দলিল হিসেবে কাজ করছে, তাদের প্রতিষ্ঠান, শিল্প, আবিষ্কার এবং ফলিত অভিজ্ঞতা সবই এই ইণ্ডিয়ান জাতির নিজস্বতা ছাড়িয়ে একটি অতি বিশিষ্ট মূল্যবান আসনে অবস্থান করে।
যখন আবিষ্কৃত হয় আমেরিকান ইন্ডিয়ানরা তিনটি নির্দিষ্ট জাতিতাত্ত্বিক পর্ব সম্পূর্ণরূপে তুলে ধরে, যা পৃথিবীর আর কোথাও এমনভাবে দেখা যাবে না। জাতিতত্ত্ব, শব্দতত্ত্ব ও পুরাতত্ত্বের প্রচুর তথ্য আর কোথাও এমনভাবে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এই বিজ্ঞানসমূহ এই শতাব্দীর আগে তেমন ছিল না এবং যা-ও বা কাজ হয়েছে খুব ক্ষীণভাবে এবং এই ক্ষেত্রের কর্মীরা তেমন যোগ্য ছিল না। অধিকন্তু ফসিল যেমন মাটির নিচে ভবিষ্যৎ কর্মীদের জন্যে চাপা থাকে ইন্ডিয়ানদের শিল্প, ভাষা এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ কিন্তু তেমন করে থাকবে না। প্রতিদিন তা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এবং মার্কিন সত্যতার আওতায় এসে তিন শ বছর ধরে ধ্বংস হয়ে আসছে। আমেরিকান ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীদের জাতিতাত্ত্বিক জীবন ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। তাদের শিল্প, ভাষা সবই অবলুপ্তির পথে এবং তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহ আজ ধ্বংসপ্রায়। এখন যেসব তথ্য খুব সহজে সংগ্রহ করা যায় কয়েক বছর পর তা সগ্রহ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। এই অবস্থা আমেরিকাবাসীদের নিকট জোরালোভাবে আবেদন জানাচ্ছে যাতে তারা এই মহাক্ষেত্রে প্রবেশ করে এবং এই প্রাচুর্যময় ফসল তুলে গোলা ভরে নেয়।
রচেস্টার, নিউ ইয়র্ক, মার্চ ১৮৭৭।
.
সূচি তালিকা
প্রথম খণ্ড
উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের মাধ্যমে বুদ্ধিমত্তার ক্রমবিকাশ
প্রথম পরিচ্ছেদ – জাতিতাত্ত্বিক যুগবিভাগ
অতি নিম্ন অবস্থা থেকে মানুষের অগ্রগতি উদ্ভাবন, আবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে উদাহরণযোগে বর্ণনা–সরকারের দুটি পরিকল্পনা একটি গণভিত্তিক এবং সামাজিক, একটি সমাজের জন্ম দিচ্ছে এসোসিয়েটাস)–অন্যটি রাজনৈতিক, রাষ্ট্রের জন্ম দিচ্ছে (সিভিটাস)–প্রথমোক্তটি ব্যক্তি ও গণবাদী–পরবর্তীটি অঞ্চল ও সম্পত্তিভিত্তিক প্রথমোক্তটি প্রাচীন সমাজের সরকার দ্বিতীয়টি আধুনিক সমাজের মানুষের অভিজ্ঞতার ঐক্য প্রস্তাবিত জাতিতাত্ত্বিক যুগবিভাগ–১। নিম্ন পর্যায়ের আদিম পর্ব ২। মধ্য পর্যায়ের আদিম পর্ব ৩। উচ্চ পর্যায়ের আদিম পর্ব ৪। নিম্ন পর্যায়ের বর্বর পর্ব ৫। মধ্য পর্যায়ের বর্বর পর্ব ৬! উচ্চ পর্যায়ের বর্বর পর্ব ৭। সত্য।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – জীবন ধারণের সামগ্রী লাভের কলাকৌশল
পৃথিবীতে মানুষের প্রাধান্য–পরিবেশ ও খাদ্য আহরণ ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা মানুষ একা এই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিকারী–খাদ্য আহরণের কৌশল-ক্রমে–১। প্রাকৃতিক খাদ্যবস্তু ২। খাদ্য হিসেবে মাছ ৩। খাদ্য হিসেবে শস্যচূর্ণ ৪। খাদ্য হিসেবে মাংস ও দুধ ৫। ক্ষেত্রে কর্ষণের মাধ্যমে অসীম খাদ্য-ভাণ্ডার লাভ–এদের মধ্যে বিপুল সময়ের ব্যবধান…
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – মানবজাতির প্রগতির অনুপাত
মানব প্রগতির ধারার পর্যালোচনা–আধুনিক সভ্যতার মৌল অবদানসমূহ- প্রাচীন সভ্যতার–বর্বর যুগের পরবর্তী পর্যায়ের মধ্য পর্যায়ের প্রাচীন পর্যায়ের আদিম যুগের–আদিম মানুষের অসহায় অবস্থা–মানব প্রগতির জ্যামিতিক অনুপাত-জাতিতাত্ত্বিক যুগের তুলনামূলক অবস্থানকাল–সেমিটিক ও আর্য পরিবারসমূহের আবির্ভাব…১৮–২৫
দ্বিতীয় খণ্ড
সরকার ধারণার ক্রমবিকাশ
প্রথম পরিচ্ছেদ – লিঙ্গভিত্তিক সমাজ সংগঠন
অস্ট্রেলিয়ান শ্রেণীসমূহ–যৌনতাভিত্তিক সংগঠিত–সংগঠনের আদিমতম চরিত্র –অষ্ট্রেলিয়ান গণসমূহ-আটটি শ্রেণী–বিয়ের নিয়ম-কানুন–উত্তরাধিকার স্ত্রী ধারায়। দলগত দাম্পত্য ধারা প্রতিটি গণে দুজন পুরুষ ও দুজন স্ত্রীলোকের শ্ৰেণী–শ্রেণীসমূহের ওপর উদ্ভাবনসমূহ–গণ তখনো প্রাথমিক অবস্থায়…
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ইরাকোয়া গণ
গণ সংগঠন–এর ব্যাপক অবস্থান-গণের সংজ্ঞা প্রাচীন রীতি হল স্ত্রী ধারায় উত্তরাধিকার নির্ণয়–গণে একজন সদস্যের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা ও দায়-দায়িত্ব গণের সাকেম ও প্রধান নির্বাচনের ও পদচ্যুত করার অধিকারগণের মধ্যে বিয়ে না করার বাধা-মৃত সদস্যের সম্পত্তি পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভাগ-বাটোয়ারা করা– সাহায্য, প্রতিরক্ষা এবং আহতদের সেবা এই পারস্পরিক দায়িত্ব গণের সদস্যের নাম রাখার অধিকারগণের মধ্যে আগন্তুককে গ্রহণ করার অধিকার–যৌথ এলাকা–গণের পরিষদ–প্রাণীর নামে গণ-নাম রাখা–গণে লোকসংখ্যা…
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ইরোকোয়া ভ্রাতৃত্ব
ভ্রাতৃত্বের সংজ্ঞা—গণ-জ্ঞাতিরা একটা বৃহত্তর সংগঠনে পুনর্মিলিত হয়–ইরোকোয়া গোষ্ঠীসমূহের ভ্রাতৃত্ব–এর গঠনপ্রণালী-এর প্রয়োজনীয়তা ও কার্যাবলি–সামাজিক ও ধর্মীয় উদাহরণসমূহ–গ্রিক ভ্রাতৃত্বের সাথে তুলনা, তবে এর আদিম পর্যায়–চোকটা ভ্রাতৃত্বসমূহ–চিকাসা ভ্রাতৃত্বসমূহ–মোহেগান–থিলিনকীট-আমেরিকান আদিবাসীদের মধ্যে এর সম্ভাব্য বিদ্যমানতা…
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ইরোকোয়া গোষ্ঠী
সংগঠন হিসেবে গোষ্ঠী–গণসমূহ নিয়ে নির্মিত, যারা একই ভাষায় কথা বলে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ায় ভাষার পার্থক্য ও বিভক্ত হওয়া–গোষ্ঠী, স্বাভাবিক উন্নয়ন উদাহরণসমূহ–গোষ্ঠীর গুণাবলি–একটি অঞ্চল ও নাম–একটি নির্দিষ্ট কথ্যভাষা–সাকেম ও প্রধান নির্বাচন ও পদচ্যুত করার অধিকার একটি ধর্মীয় বিশ্বাস ও পুজো প্রধানদের একটি পরিষদ–কোনো কোনো ক্ষেত্রে গোষ্ঠীতে একজন মহাপ্রধানগণ –সরকারের তিনটি পর্যায়ক্রম প্রথম, এক ক্ষমতাযুক্ত সরকার–দ্বিতীয়, দুই ক্ষমতাযুক্ত সরকার– তৃতীয়, তিন ক্ষমতাযুক্ত সরকার…
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ইরাকোয়া মিত্রসঙ্ঘ
মিত্রসঙ্ঘ স্বাভাবিক উন্নয়ন–স্থাপিত হয় জ্ঞাতি গণ ও যৌথ ভাষা ভিত্তি করে– ইরোকোয়া গোষ্ঠীসমূহ–নিউ ইয়র্কে তাদের বসতি স্থাপন–মিত্রসঙ্গ নির্মাণ–এর কাঠামো ও নীতিমালা–পঞ্চাশ জন সাকেম পদ সৃষ্টিকোনো গণে উত্তরাধিকার সূত্রে নির্ণীত প্রতি গোষ্ঠীতে এর সংখ্যা নির্ধারণ–এই সাকেমরা মিত্রসঙ্রে পরিষদ গঠন করে–বেসামরিক পরিষদ–কাজের ধারা কাজ করার জন্যে সবার একমত হওয়া প্রয়োজন-সাধারণ সামরিক ক্ষমতা–এই পদ প্রধান কার্যনির্বাহী শাসনকর্তার বীজ–ইরোকোয়াদের বুদ্ধিমত্তার ধারণক্ষমতা…
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – গ্যানোয়া পরিবারের অন্যান্য গোষ্ঠীর গণসমূহ
আমেরিকান আদিবাসীদের বিভাগসমূহ ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীসমূহে গণসমূহ–এদের বংশপরম্পরা ও উত্তরাধিকার ধারা–১। হোডনোসউনিয়ান গোষ্ঠীসমূহ– ২। ডাকোটা– ৩।গা– ৪। পওনী– ৫। অ্যালগোনকিন– ৬। আথাপাসকো-অপাশে– ৭। উত্তরপশ্চিম উপকূলে গোষ্ঠীসমূহ–এসকিমো, একটি বিশিষ্ট উপজাতি পরিবার ৮। স্যালিশ, সাহাপটিন এবং কূটনে গোষ্ঠীসমূহ– ৯। শশাশনী–১০। নিউ মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকার ভিলেজ ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীসমূহ- ১১। দক্ষিণ আমেরিকান ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীসমূহ–গ্যানোয়া পরিবারে গণ সংগঠনের সম্ভাব্য সর্বজনীনতা… ৮৯–১১১
সপ্তম পরিচ্ছেদ – আজটেক মিত্রসঙ্ঘ
আজটেক সমাজ সম্বন্ধে ভুল ধারণা–অগ্রসরমানতার পরিবেশনায়াটিয়াক গোষ্ঠীসমূহ–মেক্সিকোয় এদের বসতিস্থাপন–১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে মেক্সিকোর পুয়েবলোদের স্থাপনা ঘটে–১৪২৬ খ্রিষ্টাব্দে আজটেক মিত্রসঞ্জা স্থাপিত হয়–আঞ্চলিক অধিকারের সীমানা সম্ভাব্য লোকসংখ্যা–আজটেকরা গণ ও ভ্রাতৃত্ব সংগঠনে সজ্জিত ছিল কি না প্রধানদের পরিষদ–এর সম্ভাব্য কার্যাবলি মনটেজুমার কার্যভার গ্রহণ–এই কার্যালয়ের সম্ভাব্য দায়িত্ব–আজটেক প্রতিষ্ঠানসমূহ মূলত গণতান্ত্রিক সরকার হল সামরিক গণতন্ত্র..
অষ্টম পরিচ্ছেদ – গ্রিক গণ
প্রথম দিককার গ্রিক গোষ্ঠীসমূহের পরিবেশ–গণ সংগঠনে সংগঠিত–গণ চরিত্রে পরিবর্তন–একটি রাজনৈতিক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা সমস্যার সমাধান প্রয়োজন রাষ্ট্র সৃষ্টি–গ্রোটে কর্তৃক গ্রিক গণসমূহের বর্ণনা–এদের ভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধে বর্ণনা–গোষ্ঠী সম্বন্ধে বর্ণনা–গণ সদস্যের অধিকার, বাধা-নিষেধ, সুযোগ-সুবিধা ও দায়-দায়িত্ব এই একই ব্যাপারে ইরোকোয়া গণের ক্ষেত্রে–গণের প্রধানের কার্যক্ষেত্র–উত্তরাধিকার সূত্রে না নির্বাচনের মাধ্যমে পদলাত–গণ হল সামাজিক পদ্ধতির ভিত্তি-গণ ধারার প্রাচীনত্ব –সম্পত্তির উত্তরাধিকার–প্রাচীন এবং শেষ নীতি–গণের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভাবের কেন্দ্র হল গণ…
নবম পরিচ্ছেদ – গ্রিক ভ্রাতৃত্ব, গোষ্ঠী এবং জাতি
এথেনীয় ভ্রাতৃত্ব–কীভাবে সৃষ্টি হল–ডিকারকুসের সংজ্ঞা–বস্তুসমূহ প্রধানত ধর্মীয়–ফ্রাট্রিয়ার্ক—গোষ্ঠী–তিনটি ভ্রাতৃত্ব নিয়ে গঠিত–ফাইলো ব্যাসিলিযুস জাতি –চারটি গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত–বুলে বা প্রধানদের পরিষদ–অ্যাগোরা বা জনসাধারণের পরিষদ–ব্যাসিলিয়ুস-কার্যকাল, সামরিক ও পৌরোহিত্যের কার্যাবলি বেসামরিক কার্যাবলি পরিদর্শিত হয় নি-হিরোয়িক যুগের সরকারসমূহ, সামরিক গণতন্ত্র–ব্যাসিলিযুস সম্পর্কে অ্যারিস্টোটলের সংজ্ঞা-পরবর্তী এথেনীয় গণতন্ত্র–গণ-এর কাছ থেকে। উত্তরাধিকারী–এথেন্সবাসীদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে এর জোরালো প্রভাব… ১৪ ২ ১৫৩।
দশম পরিচ্ছেদ – গ্রিক রাজনৈতিক সমাজের প্রতিষ্ঠান
সরকারের ভিত্তি হিসেবে গণের ব্যর্থতা–থেসিয়ুসের আইন প্রণয়ন–শ্রেণীর বিকল্পের প্রচেষ্টা–এর ব্যর্থতা–ব্যাসিলিযুসের পদের অবলুপ্তি-আর্কানপদ–নওক্রেরি এবং ট্রিটি— সোলোনের আইন প্রণয়ন–সম্পত্তিভিত্তিক শ্রেণীসমূহ–গণের হাত থেকে অংশত ক্ষমতা দেওয়া হয় শ্রেণীর হাতে যেসব লোক কোনো গণের সঙ্গে যুক্ত ছিল না–নাগরিক সৃষ্টি সেনেট–এক্লেসিয়া–অংশত রাজনৈতিক সমাজের প্রতিষ্ঠা—ক্লাইসথেনিসের আইন প্রণয়ন–রাজনৈতিক সমাজের প্রতিষ্ঠান–এ্যাটিক ডেমি বা নগর স্থাপন–এর সংগঠন এবং ক্ষমতা–আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আঞ্চলিক গোষ্ঠী বা জেলা-অ্যাটিক রাষ্ট্রমণ্ডল-এথেনীয় গণতন্ত্র…
একাদশ পরিচ্ছেদ – রোমান গণ
গণ সংগঠনে সজ্জিত ইটালিয়ান গোষ্ঠীসমূহ–রোমের পত্তন–গোষ্ঠীসমূহ একটি সামরিক গণতন্ত্রে সংগঠিত হয়-রোমান গণ–সিসারো কর্তৃক গণ সমাজের সংজ্ঞা ফেসটাস কর্তৃক—-ভ্যারো কর্তৃক পুরুষ ধারায় উত্তরাধিকার নির্ণয় পণে। এই বিবাহ–একজন গণ সদস্যের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা ও দায়-দায়িত্ব প্রাচীন ল্যাটিন সমাজে গণতান্ত্রিক সংবিধান–একটি গণে লোকসংখ্যা…
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – রোমান কিউরিয়া, গোষ্ঠী এবং পোপুলাস
রোমান গণ-সমাজ-সংগঠনে চারটি স্তর– ১। গণ– ২। দশটি গণ নিয়ে কিউরিয়া–৩। দশটি কিউরিয়া নিয়ে গোষ্ঠী–৪। পোপুলাস রোমানাস তিনটি গোষ্ঠী মিলে সংগঠিত–সংখ্যাগত অনুপাত–কীভাবে করা হল–রোমে গণসমূহের জমায়েত– রোমান সেনেট-এর কার্যাবলি–জনসাধারণের পরিষদ–এর ক্ষমতা–জনসাধারণ সার্বভৌম সামরিক পরিচালকের কার্যালয় (রেক্স–এর ক্ষমতা ও কার্যাবলি–রোমান গণপ্রতিষ্ঠানসমূহ মূলত গণতান্ত্রিক…
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – রোমান রাজনৈতিক সমাজের প্রতিষ্ঠান
পোপুলাস-প্লেবিয়ান–ক্লাইয়েন্ট–প্যাট্রিসিয়ান–এই সংগঠনের সীমাবদ্ধতা– সার্তিয়াস টিউলিয়াসের আইন প্রণয়ন–সম্পত্তিভিত্তিক শ্ৰেণীসমূহ–সেঞ্চুরি–অসম অধিকার–কমিটিয়া সেঞ্চুরিয়াটা–কমিটিয়া কিউরিয়াটাকে ছাড়িয়ে যায়–শ্রেণীসমূহ গণসমূহকে ছাড়িয়ে যায়–লোক গণনা—-প্রেবিয়ানদের নাগরিকত্ব দান–শহরে ওয়ার্ড নামক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি নূতন রাজনৈতিক পদ্ধতির চরিত্রগণ সংগঠনের অবক্ষয় ও অদৃশ্য হওয়া–যে কাজ এই সংগঠন সম্পন্ন করে…
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ – স্ত্রী ধারা থেকে পুরুষ ধারায় উত্তরাধিকার নির্ণয়
কীভাবে পরিবর্তন জায়গা করে নেয়–সম্পত্তি উত্তরাধিকারের পেছনে প্রেরণা– লাইসিয়ানদের মধ্যে স্ত্রী ধারায় উত্তরাধিকার–ক্রিটবাসীদের মধ্যে–এটুস্কান-সেক্রোন্সের সময় সম্ভবত এথেন্সবাসীদের মধ্যে–লোক্ৰিয়ানদের শত পরিবার বিয়ে থেকে উপাদান গ্রহণ–গ্রিক গোষ্ঠীসমূহে তুরানি পদ্ধতির জ্ঞাতিধারা–ডানাডির উপকথা,.. ২০৭–২১৩
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – মানবসমাজে অন্যান্য গোষ্ঠীর গণসমূহ
স্কট ক্ল্যান–আইরিশ সেপ্ট–জার্মান গোষ্ঠীসমূহ পূর্ববর্তী গণ পদ্ধতির চিহ্ন–দক্ষিণ এশিয়ার গোষ্ঠীসমূহে গণ–উত্তরাঞ্চলে-উরাল গোষ্ঠীসমূহে–চীনা এক শ পরিবার–হিব্রু গোষ্ঠীসমূহ–বাহ্যত গোষ্ঠী ও ভ্রাতৃত্বের গঠন ধারা–আফ্রিকার গোষ্ঠীসমূহে গণ-অস্ট্রেলিয়ার গোষ্ঠীসমূহে–ফিজিও রেওয়ার মধ্য বিভাগ–গণ সংগঠনের ব্যাপক বিস্তৃতি…২১৪–২২৬
তৃতীয় খণ্ড
পরিবার ধারণার ক্রমবিকাশ
প্রথম পরিচ্ছেদ – প্রাচীন পরিবার
পরিবার পদ্ধতির পাঁচটি পর্যায়ক্রম–প্রথম, ভাইবোন-বিয়ে পরিবার–এর ফলে মালয়ী পদ্ধতির জ্ঞাতিত্ব ও সম্পর্ক সৃষ্টি হয় দ্বিতীয়, পুনালুয়া-র ফলে তুরানি ও গ্যানোয়া পদ্ধতির জন–তৃতীয়, একবিয়ে পরিবার এর ফলে আর্য, সেমিটিক এবং উরাল-পদ্ধতির জন্ম জোড়বিয়ে ও পিতৃপ্রধান পরিবার এ দুয়ের মধ্যবর্তী পর্যায়–এ-দুটিই একটি বিশিষ্ট ধারার জ্ঞাতি পদ্ধতি সৃষ্টি করতে ব্যর্থ–এই পদ্ধতিগুলো স্বাভাবিকভাবে জন্মলাভ করে–দুটি শেষ আকার–একটি শ্রেণীভিত্তিক, অন্যটি বর্ণনাধর্মী–এইসব পদ্ধতির সাধারণ নীতিসমূহ তাদের টিকে থাকা…
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ভাইবোন-বিয়ে পরিবার
এই পরিবারের পূর্ববিদ্যমানতা–মালয়ী পদ্ধতির জ্ঞাতিধারা থেকে প্রমাণিত–হ্যাঁওয়াই পরিবার এ-ব্যাপারে বিশিষ্ট উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে–পাঁচটি ধারার আত্মীয় সম্পর্কে–এই পদ্ধতির বিশদ বর্ণনা–একটি দলের মধ্যে ভাইবোন বিয়ের সাহায্যে এর উৎস সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে–স্যাণ্ডউইচ দ্বীপপুঞ্জে প্রাচীন অবস্থার সমাজ–চীনাদের নয়টি স্তরের জ্ঞাতিধারা–হ্যাঁওয়াই পদ্ধতির সাথে প্রায় একই রকম–প্ল্যাটোর আদর্শ রাজ্যে পাঁচটি স্তরের সম্পর্ক–মালয়ী পদ্ধতির জ্ঞাতি ও সম্পর্ক…
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – পুনালুয়ান বা দলগত বিবাহ পরিবার
দলগত বিবাহ আপন ভাইবোন বিয়েকে ছাড়িয়ে গেল–ক্রান্তিলগ্ন, কীভাবে ঘটল– হাওয়াইদের পুনালুয়া প্রথা প্রাচীন যুগে বিপুল অঞ্চল জুড়ে এর বিদ্যমানতা–সম্ভবত পুনালুয়া দলে গণ-এর উৎপত্তি-তুরানি পদ্ধতির জ্ঞাতিধারা–পুনালুয়ান পরিবারের ফলে তৈরি–যখন এই পদ্ধতির জন্ম হয় এই পরিবারের বিদ্যমানতা প্রমাণ করে—এই পদ্ধতির বিশদ বর্ণনা–এর উৎসে এর সম্পর্কের ব্যাখ্যা–তুরানি ও গ্যানোয়া জ্ঞাতি পদ্ধতি ও সম্পর্কের ধারার তালিকা…
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – জোড়বিয়ে এবং পিতৃপ্রধান পরিবার
জোড়বিয়ে পরিবার–কীভাবে তৈরি হল–এর চরিত্র–এর ওপর গণ সংগঠনের প্রভাব জোড় দেওয়া পরবর্তী উন্নয়ন–সেই প্রাচীন সমাজ পাঠ করা উচিত যেখানে প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায়–পিতৃপ্রধান পরিবার–পিতার ক্ষমতা এর মৌল চরিত্র-বহুবিবাহ অধীন রোমান পরিবার এমনি–এর পূর্ববর্তী পরিবারসমূহে পিতার ক্ষমতা অজ্ঞাত ছিল…
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – একবিয়ে পরিবার
তুলনামূলকভাবে এই পরিবার আধুনিক ফ্যামিলিয়া পদ-প্রাচীন জার্মান পরিবার হোমরিক যুগের গ্রিক পরিবার–সভ্য গ্রিক পরিবার স্ত্রীদের পৃথক করে রাখা–পুরুষরা একবিয়ের সমর্যাদা দেয় না–রোমান পরিবার–স্ত্রীদের ক্ষমতা হ্রাস-আর্য পদ্ধতির জ্ঞাতি সম্পর্ক–একবিয়ের মধ্যে এর আবির্ভাব–পূর্ববর্তী পদ্ধতি সম্ভবত তুরানি–তুরানি পদ্ধতি থেকে আর্য পদ্ধতিতে পরিবর্তন–রোমান ও আরবি ধারার জ্ঞাতিত্ব–এদের বিশদ বর্ণনা বর্তমান একবিয়ে পরিবার–আরবি ও রোমান পদ্ধতির তালিকা…
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – পরিবারের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানসমূহের পর্যায়ক্রম
ক্রমটি অংশত ধারণামূলক উৎপত্তির ধারা অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্পর্ক যে ধারার নাম করা হয়েছে তার উৎপত্তির নিদর্শন–মানুষের প্রাচীন কাল…
চতুর্থ খণ্ড
সম্পত্তি ধারণার ক্রমবিকাশ
প্রথম পরিচ্ছেদ – উত্তরাধিকারের তিনটি নীতি
আদিম অবস্থায় সম্পত্তি প্রগতির ধীর গতি–উত্তরাধিকারের প্রধান নীতি সম্পত্তি গণ-জ্ঞাতির মধ্যে বন্টন–বর্বর যুগের নিম্ন পর্যায়ে সম্পত্তি–উত্তরাধিকারের দ্বিতীয় নীতির বীজজ্ঞাতি-স্বজনের মধ্যে বন্টন–মানুষের উন্নত চরিত্র মধ্য পর্যায়ে সম্পত্তি উত্তরাধিকারের ধারা যথার্থ জানা নেই–সম্ভবত জ্ঞাতি উত্তরাধিকার…
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – উত্তরাধিকারের তিনটি নীতি–পূর্ববর্তী আলোচনার জের
বর্বর যুগের উচ্চ পর্যায়ে সম্পত্তি–দাসত্ব গ্রিক গোষ্ঠীসমূহে ভূমি ব্যবস্থা–এই যুগের সংস্কৃতি–এর চমৎকারিত্ব–উত্তরাধিকারের তৃতীয় নীতি–শুধুমাত্র ছেলেমেয়েয়–হিব্রু গোষ্ঠীসমূহ–উত্তরাধিকারের নীতি–জেলোফেহাদের কন্যাগণ–সম্পত্তি ভ্রাতৃত্বে থাকে এবং সম্ভবত গণে–পূর্ব অধিকারীর হাতে ফিরে আসা–এথেনীয় উত্তরাধিকার–শুধু ছেলেমেয়ের পূর্ব অধিকারীর হাতে ফিরে আসা–গণের মধ্যে উত্তরাধিকার থাকে–মহিলা উত্তরাধিকারী- উইল-রোমান উত্তরাধিকার পূর্ব উত্তরাধিকারীর হাতে ফিরে আসা– সম্পত্তি গণের মধ্যে থাকে–অভিজাততন্ত্রের আবির্ভাব –মানবজাতির সম্পত্তির প্রতি মৌল নজর-মানবজাতির উৎসের ঐক্য…
Leave a Reply