আত্মকথা – আবুল মনসুর আহমদ / Atmakatha by Abul Mansur Ahmad
প্রথম প্রকাশ : অগ্রহায়ণ ১৪২৫, নভেম্বর ২০১৮
প্রকাশক : প্রথমা প্রকাশন ১৯ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫, বাংলাদেশ
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মাসুক হেলাল
মুদ্রণ : আর জে জেড প্রিন্টার্স ২৫৭ ফকিরেরপুল, ঢাকা ১০০০
প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ১৯৭৮, ঢাকা
.
প্রকাশকের কথা
আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন ব্যক্তিত্ব। সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিক, আইনজীবী ইত্যাদি নানা পরিচয়ে তিনি পরিচিত ছিলেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ব্যঙ্গধর্মী রচনার ক্ষেত্রে আমাদের সাহিত্যে তার স্থান আজও কেউ অতিক্রম করতে পারেননি। তাঁর স্মৃতিকথাধর্মী বইগুলোও আমাদের সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এ দেশের তথা উপমহাদেশের গত এক শতাব্দীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্য তাঁর এই বইগুলো পাঠের কোনো বিকল্প নেই। তার আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর এবং আত্মকথা এমন দুটি বই। ইতিমধ্যে আমাদের প্রকাশনা সংস্থা থেকে আমরা তার আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইটির একটি সুমুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশ করেছি। বইটিতে লেখক গত শতাব্দীর বিশের দশক থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অভ্যুদয়-পরবর্তীকাল পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাব্দীর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। এবার আমরা প্রকাশ করছি তাঁর আত্মকথা বইটি।
আত্মকথায় আবুল মনসুর আহমদ তাঁর পারিবারিক পটভূমি, শৈশব, বাল্য ও কৈশোর, শিক্ষা, সাহিত্য, আইন পেশা ও সংসারজীবনের কথা লিখেছেন। বইটিতে লেখকের বয়ান কেবল নিজ জীবন ও অভিজ্ঞতার কথাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ, নানা ঘটনা। ও চরিত্রের কথাও এতে উঠে এসেছে। স্মৃতিচারণার আঙ্গিকে লেখা সময়ের এই অন্তরঙ্গ বর্ণনা লেখকের অনুপম রচনাশৈলীর গুণে পাঠককে যে কেবল আকৃষ্ট করবে তা-ই নয়, আমাদের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্ব এবং তার প্রবণতাগুলোকে বুঝতেও অনেকখানি সাহায্য করবে। এক কথায় বলা যায়, পূর্ব বাংলার মুসলমান মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশের পটভূমি ও তার ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা পেতে বিশেষ সহায়ক এ বই। সেদিক থেকে ইতিহাস বা সমাজ নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাঁদের জন্য এ বইটির মূল্য অত্যধিক।
প্রথমা প্রকাশন বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্য প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই পুনঃপ্রকাশের একটি পরিকল্পনা নিয়েছে। মূলত নবীন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পাঠক ও গবেষকদের কথা ভেবেই আমাদের এই পরিকল্পনা। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা পুনর্মুদ্রণের অভাবে বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারেও পাওয়া যায় না, কিংবা হয়তো যথাযথ প্রক্রিয়ায় অনুমোদন নেওয়া ছাড়াই ও নিতান্ত অযত্নের সঙ্গে ছাপা হচ্ছে, এমন কিছু নির্বাচিত গ্রন্থ লেখক বা তাদের উত্তরাধিকারীদের অনুমতি নিয়ে পুনঃপ্রকাশ করছি। প্রথম পর্যায়ে জীবনী, স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী, গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার ও গবেষণাধর্মী বইয়ের ক্ষেত্রেই মূলত আমাদের উদ্যোগ সীমাবদ্ধ থাকছে।
প্রসঙ্গত, বিভাগোত্তরকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশ নামে পরিচিত ভূখণ্ডটির জন্য আবুল মনসুর আহমদ একটি বিশেষ ভাষারীতির প্রস্তাব করেছিলেন। সেই ভাষারীতির পক্ষে নিজস্ব যুক্তিগুলোই শুধু তিনি তুলে ধরেননি, আপন লেখালেখির ক্ষেত্রেও যথাসম্ভব সে ভাষারীতিকে অনুসরণ করেছেন। বলাই বাহুল্য, লেখকের রচনাশৈলী হিসেবে আমরা সর্বত্র তার সে ভাষারীতি অক্ষুণ্ণ রেখেছি। বানানের ক্ষেত্রেও লেখক কিছু স্বাতন্ত্র্য রক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন। বর্তমান গ্রন্থেই এ সম্পর্কে তিনি তাঁর মতামত তুলে ধরেছেন। কিন্তু তার সে নিয়ম আমরা পুরোপুরি অনুসরণ করতে পারিনি। এর একটি কারণ, বইটির পূর্ববর্তী সংস্করণগুলোতে দেখা যায় একই শব্দের বানান দুই বা তিন রকমে ছাপা হয়েছে। লেখকের প্রস্তাবিত বানানরীতির সঙ্গেও যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংগতিপূর্ণ নয়। এ অবস্থায় বানানের সমতা রক্ষার তাগিদ থেকে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হয়েছে। তবে ‘জ’ ও ‘য’-এর ক্ষেত্রে আমরা মোটামুটিভাবে লেখকের মতকেই প্রাধান্য দিতে চেষ্টা করেছি। বস্তুত পাঠক ও গবেষকদের জন্য মূল্যবান এই বইটির একটি সম্ভব নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য সংস্করণ প্রকাশই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। বইটির এই নতুন সংস্করণ প্রকাশের ব্যাপারে সহযোগিতার জন্য লেখকের পুত্র ও ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনামের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
মতিউর রহমান
ঢাকা, নভেম্বর ২০১৮
.
ভূমিকা
আত্মজীবনী লেখার কাজটা কঠিন। অসাধারণও। কঠিন এই জন্য যে এর বেশির ভাগ কথাই স্মৃতি হইতে লিখিতে হয়। যখনকার কথা লেখা হয়, তখন আত্মজীবনী-লেখক চিন্তাও করেন নাই যে ভবিষ্যতে একদিন তিনি নিজের জীবনী লিখিবেন। আত্মজীবনী লিখিবার মত জীবনের অধিকারী তিনি কোনো দিন হইবেন, এটা ধারণাও অনেকে ছেলেবেলা করিতে পারেন না। ছেলেবেলা সবাই ছেলেমানুষই থাকেন। মন-মস্তিষ্ক পাকিতে তখনো অনেক দেরি। বড় হইয়া তিনি কী হইবেন, কী করিবেন, তার স্পষ্ট ধারণা-চিন্তাও তখন তিনি করিতে পারেন না। পারেন না মানে তখনকার চিন্তা-ভাবনার বেশির ভাগই থাকে অবাস্তব কল্পনা-বিলাসিতা। এ ব্যাপারে মনীষী ও অমনীষীর মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নাই। যা কিছু পার্থক্য তার বেশির ভাগই পরিবেশগত। আমাদের তরুণেরা যারা কলেজ-ভার্সিটিতে মেধাবী ও যশস্বী ভাল ছাত্র থাকেন, তাঁদের অধিকাংশেরই উচ্চকাঙ্ক্ষা থাকে, তখন সরকারি চাকরি কামনায় সীমাবদ্ধ। আমাদের কালে ছিল ডিপটিগিরি। আজকাল সেটা সিনিয়র সিভিল সার্ভিস। অধুনা কিছু ভাল ছেলের মধ্যে ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ার ও অধ্যাপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছাত্রজীবনেই দেখা যায়। এঁদেরও কেউ ভবিষ্যতে আত্মজীবনী লিখিবেন, এমন ধারণা সাধারণত পোষণ করেন না। কারণ এই শ্রেণীর প্রতিভাবানেরা আত্মজীবনী লিখিয়াছেন তার দৃষ্টান্ত খুব বেশি নাই। বরঞ্চ যাদের বাপ-দাদাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রচলন আছে, তাদের মধ্যে বাপ-দাদার লাইনটার কথাই আগে মনে পড়া স্বাভাবিক। ডিপটির ছেলে ডিপটি, উকিল-ব্যারিস্টারের ছেলে উকিল ব্যারিস্টার, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের ছেলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়াটাকেই অগ্রাধিকার দিয়া থাকেন। এমনকি চাষির ছেলে চাষি, শ্রমিকের ছেলে শ্রমিক, পীরের ছেলে পীর ও জমিদার-জোতদারের ছেলে জমিদার-জোতদারই থাকিবে এমন ধারণা সাধারণত বাপ-মা ও মুরুব্বিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিলেও এটাই সাধারণ জীবন-চিন্তা। যে শিশুর ভবিষ্যৎ জীবন লইয়া মুরুব্বিদের এই সব চিন্তা-ভাবনা, সে শিশু কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর কিছুই জানে না। না জানিলেও কালক্রমে অনেক লোকই মুরুব্বিদের এই ধ্যান-ধারণায় সংক্রমিত হয়।
এ বিষয়ে এত কথা বলিবার কারণ এই যে, যে-শিশু যে-পরিবেশে যে ধরনের জীবন গড়ন-যাপনের স্বপ্ন কল্পনাই করুক না কেন, শৈশবে কারো মনে ভবিষ্যতে আত্মজীবনী লিখিবার কল্পনা থাকে না। এ চিন্তা মানুষের মনে। সর্বপ্রথম জাগে তখনই, যখন ব্যক্তিটির জীবন প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। জীবন-নদী প্রায় পার হইয়া আসিয়াছেন। ওপারের ঘাট দেখা যায়-যায়। ঠিক এই মুহূর্তে আত্মজীবনী লেখা মানে জীবন-পথে পিছন ফিরিয়া দেখা। যারা বিনা-ঝড়-তুফানে নিরাপদে স্বাচ্ছন্দ্যের পানসিতে চড়িয়া জীবন-নদী পার হইয়াছেন, তাঁদের পিছন ফিরিয়া দেখিবার কিছু নাই। সুতরাং আত্মজীবনী লিখিবারও কিছু থাকে না। এই দিক হইতে বিচার করিলে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের নিরাপদ জীবন আসলে কোনো জীবনই নয়। অথচ বিপুল অধিকাংশের জীবনই এমনি ধরনের বৈচিত্র্যহীন মামুলি জীবন। কাজেই সমাজের দিক হইতে অর্থহীন জীবন। কিন্তু সংসারের প্যারাডক্স এই যে আমরা অধিকাংশই এমনি জীবন যাপন করিতে চাই। বিষয়ী লোকের বিবেচনায় এটাই আদর্শ জীবন। কাজেই এমন নিরাপদ জীবনই অধিকাংশের কাম্য। যারা এর ব্যতিক্রম, যাদের জীবনসংগ্রাম সংঘাতপূর্ণ, নিরাপদ জীবন। ইচ্ছা সত্ত্বেও যারা যাপন করিতে পারেন নাই, ঝড়-তুফানের সঙ্গে লড়াই করিয়া যাঁদের জীবন কাটিয়াছে, ভব-নদী পার হইতে গিয়া যাদের জীবন তরী ডুবি-ডুবি করিতে-করিতে কিনারা লইয়াছে, তাঁদের মধ্য হইতেই সাধারণত আত্মজীবনী লেখার যোগ্য ও অধিকারী লোকের আবির্ভাব। সে ঝড়ঝঞ্ঝা আদর্শ জীবনযাপনের ইচ্ছাতেই ঘটুক, আর নিছক বিষয়ী জীবনের সাফল্যের সন্ধানেই ঘটুক, উভয় শ্রেণীর লোকেরই আত্মজীবনী লেখার অধিকার জন্মে। উভয়ের জীবনই দুর্বলতা-সরলতা ও ব্যর্থতা-সফলতার মেঘ ও রৌদ্রের জীবন। সংগ্রামের জীবন। সরল ও খোলাখুলিভাবে বর্ণিত হইলে তা অপরের শিক্ষা গ্রহণের জীবন।
এই সংগ্রাম ও নিরাপত্তা, উভয়টারই বিচার হয় জীবনসায়াহ্নে। কাজেই জীবনের অর্থপূর্ণতার উপলব্ধি হয় জীবনের সন্ধ্যাতেই। এই কারণে আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছা ও সংকল্পও জন্মিতে পারে এই মুদ্দতেই। এই জীবন-সন্ধ্যায় দাঁড়াইয়া পিছন ফিরিয়া তাকাইয়া দেখিবার ও বুঝিবার একমাত্র উপায় না হইলেও প্রধান উপায় স্মৃতি। প্রধানত এই স্মৃতির উপর ভরসা করিয়াই আত্মজীবনী লেখকের গোটা জীবনের আশা-নিরাশা, সুখ দুঃখ, সাফল্য-অসাফল্য, ভুল-ত্রুটির খতিয়ান লিখিতে হয়। অথচ এই বয়সে স্মৃতির বাতিটাও অনেকটা ধোঁয়াটে হইয়া যায়। এই ধোয়াটে স্মৃতিতে ভর করিয়াই আত্মজীবনী লিখিতে হয়। লেখাও হয়। কারণ সাধারণ গল্পী লোকের মতই আত্মজীবনীকারদের কথা বলিবার আগ্রহ খুবই প্রবল। কথা বলার চেয়ে লেখা অনেক বেশি শ্রমসাধ্য। তাই এখানে ইচ্ছা-আগ্রহটা হওয়া চাই আরো বেশি প্রবল।
এই প্রবল ইচ্ছার প্রেরণা হইতে পারে দুইটা : এক. সংগ্রাম-সাফল্যের বাহাদুরি করা। দুই. ভাবীকালের লোকদের শিক্ষার উদ্দেশ্যে নিজের জীবনের কাহিনী বলা। এই দুইটি উদ্দেশ্যই লেখকের সচেতন মনে জাগরূক নাও থাকিতে পারে। অবচেতন মনে গোপন থাকিতে পারে। কিন্তু এই দুই শ্রেণীর আত্মজীবনীর মধ্যেও একটা পার্থক্য আছে। সে পার্থক্য সাবধান পাঠকের কাছে ধরাও পড়ে। একটিতে লেখক বাছিয়া-বাছিয়া শুধু নিজের গুণ ও সাফল্যের কথাটাই প্রধান করিয়া তোলেন। গুণগুলির অতিরঞ্জন করেন। দোষগুলি চাপিয়া যান। অপরটিতে লেখক সত্য ও সরল কথায় নিজের ভাল মন্দ ও দোষ-গুণ উভয়টাই পাঠকের কাছে তুলিয়া ধরেন। সচেতন-অবচেতন মনের দরুনই এ পার্থক্যও লেখকের অজ্ঞাতেই হইতে পারে। বাহাদুরিটাও। অনিচ্ছাকৃত হইতে পারে। আবার বিনয়ের নিরপেক্ষতাটাও চেষ্টাকৃত হইতে পারে। আমাদের মধ্যে যেমন বদ-মেজাজি ও বিনয়ী উভয় প্রকার লোক আছেন এবং এই বদ-মেজাজিদের মধ্যে সাধুতা ও বিনয়ীদের মধ্যে ভণ্ডামি থাকিতে পারে, আত্মজীবনী-লেখকদের মধ্যেও তা-ই আছে। তবু নিজের দোষ উপলব্ধি করা খুবই কঠিন। সেটা মুখে ও কাগজে-কলমে স্বীকার করা আরো কঠিন। এই কারণে আত্মজীবনী লেখার কাজটা এমন কঠিন।
আর অসাধারণ এই জন্য যে যাদের জীবনী জানা ও পড়ার যোগ্য, যাদের জীবনকথা অপরের জন্য স্মরণীয় ও শিক্ষণীয়, যেসব প্রতিভাবান মনীষী, রাষ্ট্রনেতা ও জননায়ক দেশ ও দশের মঙ্গল সাধন করিয়াছেন, তাঁদের আত্মজীবনী লিখিবার দরকারই হয় না। অপরেই তাদের জীবনী লেখেন। তাঁদের সহকর্মী ও অনুসারীরা ত লেখেনই, দেশ-বিদেশের শক্তিশালী লেখকেরাও লিখিয়া থাকেন। যারা ব্যক্তিগতভাবে এই সব নেতা-নায়কদের জানেন না বা দেখেন নাই, তারাও লেখেন। গবেষণা করিয়া তাঁদের জীবনের অজানা কথা, ঘটনা ও বৃত্তান্ত আবিষ্কার করেন।
তবে এই ধরনের জীবনী ও আত্মজীবনীর মধ্যে পার্থক্য আছে। অপরের জীবনী-লেখকেরা সাধারণত তাদের নায়কের জীবনের ভাল দিকটাই দেখান। এই সব লেখক সাধারণত যার-তার নায়কের ভক্ত-অনুরক্ত হওয়ায় তাঁদের লেখা গুণাবলি বর্ণনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। নিতান্ত ভক্ত-অনুরক্ত না হইলে সাধারণ ভদ্রতা ও শালীনতার খাতিরে আলোচ্য ব্যক্তির জীবনের অপর দিকটা চাপিয়া যান। আর ভক্ত-অনুরক্তেরা ত শুধু গুণাবলির বর্ণনা করিবেনই। তাতে কিছুটা অতিরঞ্জনও করিতে পারেন। লেখক-ভেদে এই ধরনের জীবনী উৎকৃষ্ট শ্রেণীর সাহিত্য হইতে পারে, কিন্তু সত্য ও প্রকৃত তথ্যের দিক হইতে এগুলি সত্যনিষ্ঠ, অতএব শিক্ষণীয় না-ও হইতে পারে। পক্ষান্তরে জীবনী লেখক যদি নায়কের বিরোধী পক্ষের লোক হন, তবে তাঁর রচনা হয় প্রধানত নিন্দা-কুৎসা। আলোচ্য ব্যক্তিকে লোকচক্ষে হেয় করিবার অপচেষ্টা। তাতে প্রকৃত ও সত্য জীবনী লেখা হয় না। ফলে অধিকাংশ জীবনী হয় প্রশংসা ও গুণকীর্তন, নয় ত নিন্দা ও ছিদ্রান্বেষণ। কোনোটাই ঐতিহাসিক সত্য হয় না।
এই কারণেই বোধ হয় সব দোষ-গুণ বিচার করিয়া সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও জীবনী অপেক্ষা আত্মজীবনীই অধিকতর বাঞ্ছনীয়। সাহিত্য হিসাবে যদি না-ও হয়, তবু রিপোর্ট হিসাবে ত বটেই। আগামী দিনের পাঠকের স্বার্থ ও প্রয়োজনের দিক হইতে বিচার করিলে নির্ভরযোগ্য রিপোের্ট হিসাবেই বোধ হয় জীবনীর আবশ্যকতা বেশি। আত্মজীবনী লিখিবার প্রবল ইচ্ছা ও সামান্য অধিকারও যাদের থাকে, তারা আর কিছু না হউক, আব্রাহীম লিংকনের এই মূল্যবান কথাটি নিশ্চয়ই মনে রাখেন : নিজের কথা লেখা যেমন তৃপ্তিদায়ক, তেমনি কঠিন। কারণ নিজের দোষের কথা স্বীকার করিতে লেখকের বুকে যেমন বাজে, লেখকের আত্ম-প্রশংসাও তেমনি পাঠকের কানে পীড়া দেয়।
তাছাড়া প্রায় সকল আত্মজীবনী-লেখকের মধ্যে যে দুইটি গুণ থাকিতেই হয়, তার একটা নির্ভয়ে ও অসংকোচে সত্য কথা বলার অভ্যাস; আর অপরটা বাপ-দাদার প্রতি বিবেকবান শ্রদ্ধা। একটু গভীরভাবে তলাইয়া বিচার করিলেই দেখা যাইবে যে এই দুইটা অত্যাবশ্যক গুণের মূল কিন্তু মাত্র একটি। সেটা ব্যক্তিত্ব। এই ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে এখানে দুই-একটা কথা বলা দরকার। মানুষ মাত্রেই একটি ব্যক্তি, একটি শখছ, একটি ইন্ডিভিজুয়াল। কাজেই হরেক ব্যক্তির একটা ব্যক্তিত্ব থাকিবার কথা। আসলে যা থাকে তাকে ব্যক্তিত্ব বলা যায় না। সেটা ইন্ডিভিজুয়ালিটি, পার্সনালিটি নয়। আত্মজীবনীকারের যে ব্যক্তিত্বের কথা আমি বলিতেছি সেটা ইন্ডিভিজুয়ালিটি নয়, সেটা পার্সনালিটি। ইন্ডিভিজুয়ালিটি সাধারণ; আর পার্সনালিটি অসাধারণ। দর্শন-মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে আমরা ইগো, অহম, আত্মা, রুহু, শখছিয়াত, ইন্ডিভিজুয়ালিটি বা পার্সনালিটি যে নামই দেই না কেন, জিনিসটা কিন্তু শুধু মানসিক অবস্থা নয়। মনটাও শুধু অরূপ চিন্তা-স্রোত নয়। অনুভূতির দলা বা পিণ্ডও না। মনোবিকলনের বিচারে কোনো ব্যক্তির বেলা এই চিন্তা-অনুভূতির সুসংগত সুগঠিত অবস্থাকেই তার ব্যক্তিত্ব বলা যায় বটে, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে ওটাই যথেষ্ট নয়। যতক্ষণ মনের যে অবস্থাটি ব্যক্তির কাজে-কর্মে, আচার-আচরণে বহিঃপ্রকাশ লাভ না করিবে, ততক্ষণ তাকে পার্সনালিটি বলা যাইবে না।
কিন্তু সাধারণ মানুষের সংসার-সমাজ-জীবনের জন্য এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের দরকার নাই। এই ব্যক্তিত্ব ছাড়াই মামুলি, এমনকি সুখী ও নিরাপদ ব্যক্তি-জীবনও চলিয়া যায়। শুধু চলিয়া যায় না, মামুলি সাধারণ নিরাপদ জীবনে এটাই কাম্য, এ কথা আগেই বলিয়াছি। কথাটার তাৎপর্য এই যে সমাজের প্রচলিত আচার-আচরণ, পরিবারের মামুলি দায়দায়িত্ব ও রাষ্ট্রের আইন-কানুন চোখ বুজিয়া মানিয়া চলার নামই আদর্শ নাগরিক জীবন। এমন নির্বিরোধ জীবন যাপন করিতে পারিলেই তা সফল হইল। এটাই জনমত।
কিন্তু এমন জীবন লইয়া জীবন্তিকা হইতে পারে, জীবনী হইতে পারে না। আত্মজীবনী ত নয়ই। এমন জীবনে পার্সনালিটি অর্থে ব্যক্তিত্ব থাকে না বলিয়াই সে জীবনে দশ বা দেশের শুনিবার বা বুঝিবার কিছু থাকে না। যেসব ব্যক্তিত্ব দেশ ও দশের জীবন প্রভাবিত করে, রাষ্ট্রনায়কেরা নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। কিন্তু রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে যারা শুধুই রাজনৈতিক নেতা বা পলিটিশিয়ান, তাঁদের ব্যক্তিত্ব স্টেটসম্যানদের ব্যক্তিত্বের থনে অনেকখানি পৃথক। পলিটিশিয়ানদের ব্যক্তিত্ব পরিণামে দেশ ও দশের অনিষ্ট করিতে পারে, কিন্তু স্টেটসম্যানদের ব্যক্তিত্ব কদাচ ত করে না। ব্যক্তিত্বের সাধারণ গুণ এই যে, ব্যক্তিত্ব বাড়ায়। ব্যক্তিত্ববান মনীষীর সংশ্রবে মানুষ ব্যক্তিত্ববান হয়। বিজ্ঞানী-দর্শনী, শিক্ষক-অধ্যাপক, সাধু-দরবেশ, শিল্পী-আর্টিস্ট, সাহিত্যিক-সাংবাদিক, এমনকি ব্যক্তিত্ববান সওদাগর-ব্যবসায়ীরাও নিজেদের ব্যক্তিত্ববলে ছাত্র, অনুসারী ও সহকর্মীদের মধ্যে ব্যক্তিত্ব প্রসার করিয়া তাঁদের ব্যক্তিত্ববান করিয়া থাকেন। স্টেটসম্যানরা এই দিক হইতে বিজ্ঞানী-দর্শনী, শিক্ষক-অধ্যাপক, সাধু-দরবেশদের সকল গুণে গুণান্বিত। কিন্তু সাধারণ রাষ্ট্রনায়কেরা তা নন। বরঞ্চ তার ঠিক উল্টা। অসাধারণ ব্যক্তিত্ববান রাষ্ট্রনায়কেরা প্রায়ই সহকর্মী ও অনুসারীদের ব্যক্তিত্ব শুধু সংকুচিত করেন না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদেরে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিত্বহীন করিয়া ফেলেন। এর সবটুকুই যে নেতার ইচ্ছাকৃত তা-ও নয়। সহকর্মী ও অনুসারীরা ইচ্ছা করিয়াই নেতাকে ডিক্টেটরে ও নিজেদেরে চাটুকারে পর্যবসিত করেন। নেতার অপরাধ শুধু এইটুকু যে তিনি এতে বাধা দেন না, বরঞ্চ কাজে-কর্মে সমর্থন করেন। একমাত্র সমর-নায়কেরা ছাড়া আর সব ডিক্টেটরই গোড়ায় সোজাসুজি নির্বাচিত না হইলেও জনমতের সমর্থনেই নেতা হইয়াছিলেন। কিন্তু তাদের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রক্ষমতার বলে কালক্রমে ডিক্টেটরের স্বৈরাচারে উন্নীত হয়। এই ধরনের ডিক্টেটরদের কেউ কেউ দেশ ও জাতির অর্থনৈতিক ও অন্যবিধ উপকার করিয়াছেন, এটা সত্য হইলেও এ কথাও সমানভাবে সত্য যে এঁরা দেশ ও জাতির আত্মমর্যাদাবোধ ঘোরতরভাবে ক্ষুণ্ণ করিয়াছেন। এর কারণ এই যে এঁদের শাসন-আমলে নাগরিকদের ব্যক্তিত্ব স্ফুরণ সাধারণভাবে বাধাপ্রাপ্ত হইয়াছে। ফলে অর্থনীতি ও শিল্প-বিজ্ঞানের দিকের উন্নতির চেয়ে আত্মিক দিকের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হইয়াছে। এই দিক হইতে বিচার করিয়াই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সকল অবস্থায় গণতন্ত্রকেই একনায়কত্বের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর শাসন-পদ্ধতি বলিয়াছেন। এতে এটাই স্বীকৃত হইয়াছে যে মানুষের ব্যক্তিত্ব-বিকাশের সবচেয়ে বেশি সুযোগ যে রাষ্ট্র ও সমাজ-ব্যবস্থায়, সেটাই শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা, সেটাই আদর্শ বিধান। কিন্তু বর্তমানে দুনিয়ায় যে পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী দুই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চালু আছে, তার কোনোটাতেই ব্যক্তিত্ব বিকাশের পূর্ণ সুযোগ বিদ্যমান নাই। এই কারণেই এ যুগে মানব-সমাজে ব্যক্তিত্বহীন মানুষই নিয়ম, আর ব্যক্তিত্ববান লোকেরা ব্যতিক্রম মাত্র। কিন্তু ব্যক্তিত্বের বিচার বা সন্ধান করা খুবই কঠিন কাজ। দুনিয়াতে বিজ্ঞান-দর্শনের যত গবেষণার কাজ আছে, মানুষের মনের বৈচিত্র্যটাই তার মধ্যে সবচেয়ে দুরূহ কাজ। দর্শন-বিজ্ঞানের গহিনে প্রবেশ না করিয়াও বলা যায়, মনের বিকাশ ও প্রকাশ মানুষের ব্যক্তিত্বে। এই ব্যক্তিত্বের খানিকটা বাপ-মার দেওয়া। খানিকটা দেওয়া পরিবেশের। অন্য। কথায় খানিকটা ওয়ারিসি; আর খানিকটা অর্জিত। কোনটা কতটুকু তা লইয়া মতভেদ আছে। এক পরিবেশে প্রতিপালিত হইয়াও দুইজনের ব্যক্তিত্ব সমান হয় না, এটা যেমন সত্য, আবার এক বাপের দুই সন্তানও সমান ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয় না, এটাও তেমনি সত্য। তাই এই সিদ্ধান্তে আসিতে হয়, ব্যক্তিত্ব ব্যক্তির স্বকীয়তা, তার নিজেরই ব্যাপার। ঘুরিয়া-ফিরিয়া সেই গোড়ার কথায়, জন্মের কথায়, বাপ-মার কথায় আসিতে হয়।
এইখানেই পাঠক আত্মজীবনীকারের অরিজিন জানিতে চান। লেখক ত বলিতে বাধ্য। আত্মজীবনী-লেখক শিল্পী-সাহিত্যিকই হউন, আর রাষ্ট্রনায়কই হউন, তাঁর সম্বন্ধে জানার কৌতূহল মানুষের স্বাভাবিক। এ কৌতূহল শুধু তাঁর সৃষ্ট শিল্পকর্ম বা তাঁর রাজনৈতিক সাফল্য-অসাফল্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পরিবেশিক বিচরণ-আচরণ, বিবর্তন-উদ্বর্তনের ব্যাপারেও প্রসারিত। এই কৌতূহল নিবৃত্ত করা জীবনী-লেখকের কর্তব্য। না করিলে তাঁর কাজ অসম্পূর্ণ থাকিবে। কাজেই কর্তব্যও পালিত হইবে না। এখানেই আত্মজীবনী-লেখকের বংশপরিচয়, সে-বংশের সামাজিক স্তর ও পরিবেশ, তাদের জীবিকা ও জীবনধারণ-প্রণালি, তাদের ধর্মীয় ও কালচারের আচার-আচরণ ইত্যাদি সম্বন্ধে উল্লেখ করা নিতান্ত প্রাসঙ্গিক হইয়া পড়ে। এই প্রাসঙ্গিকতা পাঠকের জন্য যেমন আবশ্যক, লেখকের জন্যও ঠিক তেমনি আবশ্যক। শুধু আবশ্যক নয়, অপরিহার্য। কোনো ব্যক্তির জীবনী সম্যক জানিতে হইলে ব্যক্তিটিকে আগে জানিতে হইবে। ব্যক্তিটির সঠিক পরিচয় পাইতে হইলে তাঁর বংশ-পরিবার, সামাজিক ও আর্থিক পরিবেশ জানিতে হইবে। মানুষের দেহ-মনের ক্রমবিকাশের উপর তার পরিবার ও পরিবেশের প্রভাব সর্বাধুনিক গবেষকেরাও স্বীকার করিয়াছেন। বংশ-পরিবার ও সমাজ পরিবেশ এই দুই-এর মধ্যে ব্যক্তিজীবনে কোনটার প্রভাব বেশি, এ বিষয়ে গবেষক-বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ থাকিতে পারে ও আছে। কিন্তু এ দুই এর সমন্বয় যে ব্যক্তি-জীবনকে মূলত সংগঠিত করিয়া থাকে, এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নাই। এই কারণেও ব্যক্তির পরিবার ও পরিবেশের খবর। জানিতে হয়। আর যেহেতু জীবনী বা আত্মজীবনী লেখা একটা বাস্তবভিত্তিক সৃষ্টিকর্ম, মানে ইতিবৃত্তমূলক শিল্পকর্ম, সেই হেতু বংশ-পরিচয়হীন জীবনকথা বা আত্মজীবনী হয় ত্রুটিপূর্ণ বিকলাঙ্গ শিল্প। আত্মজীবনী-লেখক যদি অভিজাত বংশের লোক হন, তবে বাপ-মার ও বংশের পরিচয় দেওয়া যেমন সহজ, তেমনি আনন্দদায়ক। কিন্তু আত্মজীবনী-লেখক যদি তা না হন, তিনি যদি গরীব, নিরক্ষর, চাষি-মজুরের সন্তান হন, তবে কী হয়। নিজের অনভিজাত বংশের কথা, বাপ-মার নিরক্ষরতা বা দারিদ্র্যের কথা, বলা তত সহজ নয়, আনন্দদায়ক ত নয়ই। কাজেই এ ক্ষেত্রে কাজটা কঠিন। কঠিন বলিয়াই এ শ্রেণীর আত্মজীবনী-লেখকের ব্যক্তিত্ব আরো সবল, আত্মমর্যাদাবোধ আরো তীক্ষ্ণ, সত্যপ্রিয়তা আরো ধারালো হওয়া দরকার। উদ্ববর্তন প্রকৃতির নিয়ম। অতীত হইতে যেমন বর্তমান এবং বর্তমান হইতে যেমন ভবিষ্যতের জন্ম, দাদা হইতে বাপ এবং বাপ হইতে তেমনি বেটার জন্ম। একটা ছাড়া অপরটা হয় না। একটার ইতিহাস ছাড়া অপরটারও ইতিহাস হয় না। কোনো লোকের জীবনী শুধু তাঁর ব্যক্তিজীবনের ঘটনার বর্ণনা, তার ধ্যান-ধারণার বিকলন ও তাঁর কাজ-কর্মের বিবরণ নয়। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে তার আচরণ, এই সব ব্যাপারে তার দেহ-মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও তার বা তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য উল্লেখযোগ্য বিষয়। এই কারণে উক্ত ব্যক্তির জীবনী বা আত্মজীবনী খোলা ময়দানে তাঁর ফটোগ্রাফের সমতুল্য। খোলা ময়দানে কোনো লোকের ফটো নিলে যেমন উপর-নিচের ডাইন-বায়ের ও পেছনের ল্যান্ডস্কেপটা আপনি ফটোতে আসিয়া পড়ে, তেমনি একটি ব্যক্তি-জীবনীর আলেখ্যে তার পিছনের ঐতিহ্যের ছবি ও ডাইনে-বাঁয়ের পরিবেশের রূপ ধরা পড়িতেই হইবে।
আরেকটা কথা বলিয়াই আমার এই ভূমিকা শেষ করিব। আমি আত্মজীবনী লেখিবার উপযুক্ত ব্যক্তি এবং সে জীবনকথা লোকেরা পড়িবেন বা সে বিশ্বাসে প্রকাশক লোকসানের ঝুঁকি না লইয়া তা ছাপিবেন, এমন ধারণার মধ্যে একটা উপলব্ধি আছে। সেটাকে অহংকারও বলা যাইতে পারে। এমন অহংকার ব্যক্তিত্বেরই লক্ষণ। ব্যক্তিত্বহীন লোকের অহংকার থাকিতে পারে না। কাজেই অহংকারটা দোষের নয়। অহংকার প্রকাশের ধরনটাই দোষের। দায়িত্ববোধের উপলব্ধিটাই অহংকার। এটা আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদাবোধ, আত্মসম্মান-জ্ঞানেরই নামান্তর বা রূপান্তর মাত্র। এর একটাও দোষের নয়। কিন্তু অহংকার যখন দম্ভের আকারে প্রকাশ পায়, তখন সেটা শুধু দোষের হয় না, বোকামিও হয়। আমার অহংকার, আমার আত্মবিশ্বাস ও আমার আত্মমর্যাদাবোধ যতক্ষণ তোমার ঐ-ঐ অনুভূতিকে আহত ও অপমানিত না করে, ততক্ষণ আমার এগুলি গুণ, সুতরাং গর্বের বস্তু। কিন্তু যেই এগুলি দম্ভের আকারে তোমার অনুভূতিতে আঘাত করিল, সেই মুহূর্তে সে-গুণগুলি দোষে পরিণত হইল। কাজেই নিজের অহংকার ও আত্মসম্মানবোধ লইয়া অতি সাবধানে চলিতে হয়। এ যেন রশির উপর দিয়া নাচিয়া যাওয়া, টাইট-রোপ-ড্যাসিং। পা ফসকাইয়া, কি ব্যালেন্স হারাইলা, ত গেলা।
এবার আত্মকথার বিষয়বস্তু ও ঘটনাবলি সম্পর্কে পাঠকদেরে একটু আভাস দিবার চেষ্টা করিব। পুস্তকে বর্ণিত ঘটনাবলির বিবরণী স্পষ্টতই স্মৃতিকথা। ব্যক্তিগত ঘটনার প্রায় সবটুকুই এই শ্রেণীর। কিন্তু যেসব ঘটনার সাথে নেতৃবৃন্দ ও বন্ধুবান্ধবদের সম্পর্ক আছে, সেগুলি যথাসম্ভব পুরাতন কাগজপত্র সংবাদপত্রের কাটিং অথবা পকেট-ডায়েরি বা নোটবই হইতে নেওয়া হইয়াছে। এসবেরও বিস্তারিত খুঁটিনাটি স্মৃতিকথাই। তাও আবার বুড়া মানুষের স্মৃতি। শৈশবের কথা লিখিয়াছি এই বুড়া স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করিয়াই বটে, কিন্তু এটাও সত্য যে মানুষের শৈশবের স্মৃতিই বেশি নির্ভরযোগ্য। এ বই লিখিতে শুরু করি ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আইউব শাহির জেলখানায় বসিয়া। অবসরমত আস্তে আস্তে লিখিয়া শেষ করি ১৯৬৮ সালে। পাবলিশারদের ইচ্ছাতে আমার এই জীবনকথার রাজনৈতিক দিকটা আলাদা করিয়া ঐ সালেই আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর নামে প্রকাশিত হইয়াছিল। এই পাঁচ বছরে সে বই-এর তিন-তিনটা সংস্করণ হইয়া গিয়াছে। ক্রমে আকারও তার বড় হইয়াছে। পরাধীন বা ঔপনিবেশিক দেশের মানুষের জীবনের অনেকখানি জুড়িয়া থাকে সক্রিয় রাজনীতি অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই। আমার বেলাও আমার জীবনে রাজনীতি ঢুকিয়াছিল, বরঞ্চ আমিই রাজনীতিতে ঢুকিয়াছিলাম, আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা সক্ষমতা অক্ষমতা উপেক্ষা করিয়াই। এই কারণে আমার রাজনীতির কথা আকারে বড় হইয়াছে তার মূল্য কমই হউক আর বেশিই হউক।
কিন্তু আমার নিজের মত এই যে আমার মত গরীব গৃহস্থের সন্তানের জন্য রাজনীতির ভিতরের চেয়ে বাহিরের জীবনই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতির ভিতরের চেয়ে বাইরেই করিবার মত কাজ ও বলিবার মত কথা আমার অনেক বেশি ছিল ও আছে। আমার অতৃপ্তি আজও বলে আমার করার কাজ ও বলার কথা আজও শেষ হয় নাই। অবশ্য সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীর মতই রাজনীতির ক্ষেত্রে আমারও নেতা, পথপ্রদর্শক ও সহকর্মী ছিলেন। সেখানে ছিলাম আমি পার্টি মেম্বর, অনেকের একজন। কিন্তু রাজনীতির বাইরে ছিলাম আমি একা ও একক। চিন্তায় ও কাজে আমার নিজের পথ সেখানে আমাকেই নির্দেশ করিতে হইয়াছে। আমার চিন্তার বিষয়বস্তু আমাকেই ঠিক করিতে হইয়াছে। এক কথায়, আমি নিজেই এখানে আমার নেতা ও পথপ্রদর্শক। আমার দায়িত্বও এখানে একক। সে দায়িত্বও কাজেই কঠিন। আমার সে দায়িত্ব পালনে আমার সাফল্য-অসাফল্য দুইটাই পাঠকদের জন্য শিক্ষণীয়। রাজনীতির বাইরের আমার জীবন কাজেই যেমন বিস্তৃত, তেমনি গভীর। আজকার এই আত্মকথায় আমার সেই জীবনই বর্ণিত হইয়াছে। এইটি লেখার পর অতিবাহিত হইয়াছে পাক্কা দশ বছর। কাজেই দক্ষতা, ক্ষমতা, জ্ঞান, মতবাদ ও ধ্যান-ধারণার অনেক পরিবর্তন ঘটিয়াছে আমার এই দীর্ঘ মুদ্দতে। কিন্তু যখন যা লিখিয়াছি, অবিকল তা-ই রাখিয়াছি। পরবর্তী জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বা মতবাদের আলোকে আগের লেখার পরিবর্তন বা সংশোধন করিবার চেষ্টা করি নাই। অথচ করিবার যথেষ্ট অবসর ছিল ও আছে। বর্তমানে আমি বিষয়ী অর্থে সম্পূর্ণ নিষ্কর্মা। হাঁটু-ভাঙা আর্থরাইটিস রোগে উকালতি ছাড়িয়াছি। রাজনীতি ছাড়িয়া আমি এডার স্টেটসম্যান, চেম্বার পলিটিশিয়ান বা রাজনৈতিক হরি-ঠাকুর হইয়াছি। সাংবাদিকতা ছাড়িয়া এখন কলামিস্ট বা কমলাকান্ত হইয়াছি। হার্ট স্পেশিয়ালিস্ট ডাক্তারদের নির্দেশে তারও মাত্রা কমাইয়াছি। পলিটিক্যাল হরি-ঠাকুর হওয়ার ব্যাপারে আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছরে অনেক কথা লিখিয়াছি। সাংবাদিকতায় কমলাকান্ত হওয়া সম্পর্কেও এই পুস্তকের সাংবাদিক জীবন-খণ্ডে বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছি। এখানে শুধু এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, এই বই লেখা শেষ করিয়া যখন এই ভূমিকা লেখায় হাত দিয়াছি, তখন আমি স্ত্রী পুত্র-নাতি-নাতনি লইয়া পরম সুখ-শান্তিতে ও যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে প্রচুর অবসরে এমন একটি জীবন যাপন করিতেছি, যখন পদমর্যাদার লোভ লালসা, নিন্দা-প্রশংসা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার ঊর্ধ্বে উঠিয়া সকল ব্যাপারে সচেতন নিরপেক্ষতার ও সকলের প্রতি সদয় ইনসাফের মনোভাব লইয়াই ওপারে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আছি।
আবুল মনসুর আহমদ
ধানমন্ডি, ঢাকা
১০ আগস্ট ১৯৭৩
.
ফিরিস্তি
প্রথম খণ্ড : পটভূমি
অধ্যায় এক : বংশ-পরিচয়
জন্মস্থান, পূর্বপুরুষ, শরা কবুলের আগে, সামাজিক অনাচার, ধুতি বনাম তহবন্দ, গাজী সাহেবের প্রত্যাবর্তন, গাজী সাহেবের তবলিগ, গাজী সাহেবের জনপ্রিয়তা, গাজী সাহেবের বিবাহ ও সন্তানাদি।
অধ্যায় দুই : জন্ম ও শৈশব
জন্ম, স্বাস্থ্য ও ভাগ্য, রোগ ও চিকিৎসা, নিদ্ৰাচর, ঘুমে চিৎকার, আকস্মিক দুর্ঘটনা, শৈশবের কড়াকড়ি, পারিবারিক প্রথা, সমসাময়িক অবস্থা, প্রাচুর্য ও সরলতা, দাদাজীর এন্তেকালের পর, খেলাধুলার স্বাধীনতা, চুরুট-তামাকের কড়াকড়ি।
দ্বিতীয় খণ্ড : শিক্ষাজীবন
অধ্যায় তিন : প্রাইমারি শিক্ষা–বাড়িতে
চাচাজীর নিকট, ইয়াকুব মুনশীর নিকট, পাঠশালায়, স্বদেশি ধুতি, পাঠ্য বিষয়, ধানীখোলা-বৈলর বিরোধ, আলিমুদ্দিন মাস্টার, মাস্টার সাহেবের ছাত্রপ্রীতি, স্বপ্নে মুখরেজ তালাফুয।
অধ্যায় চার : নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা–দরিরামপুর
ত্রিশাল-দরিরামপুর–বনাম ও বেনাম, হেডমাস্টারের নজরে সত্যবাদিতা, হেডমাস্টারের ডাক-হরকরা, হেডমাস্টারের ‘ভুল’, ‘ভুল’ সংশোধন, মহিষ ও মহিষী, পণ্ডিত মশায়ের অভিনব দণ্ড, স্কুলে যাতায়াত, বই-পুস্তকের থলি, থলির সুবিধা, বিপজ্জনক রাস্তা, দুইটি ব্যক্তিত্বের প্রভাব, করোনেশনের পুরস্কার।
অধ্যায় পাঁচ : মাধ্যমিক শিক্ষা–নাসিরাবাদে
মৃত্যুঞ্জয় স্কুল, হিন্দু-মুসলমান পৃথক বেঞ্চি, প্রথম বিরোধ, ঢিলের জবাবে ঢিল, প্রথম মিলাদ শরিফ, বাংলায় মিলাদ, ঢাকা দর্শন, নাম-নামা।
অধ্যায় ছয় : উচ্চশিক্ষা–ঢাকা শহরে
জগন্নাথ কলেজে, যায়গীর-হাকিম সাহেবের বাড়িতে, পথে পাওয়া টাকার সদ্ব্যবহার, কেতাবি সাধুতা বনাম বিষয়ী সাধুতা, হোস্টেল-জীবন বনাম যায়গীর-জীবন, ঢাকার মহল্লা-জীবন, ঢাকা কলেজ–এস এম হোস্টেল, খেলাধুলা, গলা সাধনা, মাধ্যম রকমের ভাল ছাত্র, ল্যাংলি সাহেবের শেষ উপদেশ, সমকালীন শিক্ষা কারিকুলাম, শিক্ষাজীবনের শেষ নাই।
তৃতীয় খণ্ড : ধর্ম-জীবন
অধ্যায় সাত : গোঁড়ামির পরিবেশ
নফলিয়াতের পাবন্দি, শৈশবের বাড়াবাড়ি, টুপি নিষ্ঠা, মযহাবী-বিরোধ, আমার একগুঁয়েমি, প্রথম সংঘর্ষ, মযহাবী বিরোধের তৎকালীন রূপ, করটিয়ার কাহিনী, ময়মনসিংহ শহরে সংঘর্ষ, দাদাজীর উদারতা, গোঁড়ামি ও আদব-লেহায, মযহাবী সংকীর্ণতা মরিয়াও মরে না, আমার জবাব।
অধ্যায় আট : গোঁড়ামির প্রতিক্রিয়া
উদারতার ক্রমপ্রসার, ডা. বিপিন বিহারী সেন, খৃষ্টান, নামাজ রোযার শিথিলতা, কবর-পূজা, পীর-পূজা, ধর্মমত বনাম চরিত্র, সব ধর্ম সত্য, না সব ধর্ম মিথ্যা? খোদা-বিশ্বাস বনাম ধর্মবিশ্বাস, নাস্তিকতা, মি. ল্যাংলির সহনশীলতা, অধ্যাপক ভট্টাচার্য, এ্যাগনস্টিক।
অধ্যায় নয় : প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া
খিলাফত ও স্বরাজ আন্দোলন, পুনরায় ধর্মে মতি, ওয়ায়ে নূতনত্ব, পীরগিরির উপক্রম, নূতন পরিবেশ, মোল্লাকি-বিরোধী লীগ, মওলানা মলিহাবাদী, মোল্লা-বিরোধের প্রসারিত রূপ, আচার-সর্বস্বতার কুফল, ধর্মান্তর গ্রহণ অনাবশ্যক, ধর্মত্যাগ অসম্মানসূচক, ধর্মে-ধর্মে টলারেন্স, সর্বধর্ম-সমন্বয় বনাম সর্বধর্ম-পরিচয়, ইসলাম-হিতৈষী’ বনাম মুসলিম-হিতৈষী’।
অধ্যায় দশ : ‘অনিসলামি মুসলমান’
স্পর্শকাতর মুসলমান, চাল-চলনে গোঁড়ামি, মিঠাই বর্জন, বেশ্যা-বর্জিত, ফ্যাসটিডিয়াস, মুসলমানের পর্দা-প্রথা, ভিক্ষা বৃত্তি, মুসলিম-হিত বনাম হিন্দু-অহিত, ইসলাম বনাম মুসলমান, ধর্ম ও ঔষধ, শাঁস ও খোসা, ধর্ম বনাম ধর্মীয় দল, ধর্ম বনাম আল্লাহ, মানব বনাম মুসলমান।
অধ্যায় এগার : হক্কুল এবাদ
বুদ্ধির মুক্তির সামাজিক দিক, মুক্তবুদ্ধি বনাম চিন্তার অস্থিরতা, বিজ্ঞান ধর্মবিরোধী নয়, অন্ধভক্তি নয়, অর্জিত উপলব্ধি, শ্রেষ্ঠ মাবুদ, বিজ্ঞানী-শ্ৰেষ্ঠ আইনস্টাইন, ধর্ম-বোধের ভিত পাকা, ধর্মের রুহানিয়াত অব্যয়।
চতুর্থ খণ্ড : সাহিত্যিক জীবন (মামুলি)
অধ্যায় বার : প্রচলিত পথে অগ্রসর
কৈফিয়ত, শৈশবের খোরাক পুঁথি, পুঁথির নিশা, গদ্য সাহিত্যের সাথে পরিচয়, শৈশবে সম্পাদকতা, কৈলাস বাবুর প্রভাব, আতিকুল্লাহ, হাজী আহমদ আলী, আহমদিয়া লাইব্রেরি, বৃদ্ধ মিতাজির দোওয়া, উচ্চতর পরিবেশ, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব, কাব্য-সাধনা, মাইকেলের প্রভাব, পুস্তক বাইন্ডিং, চোরের উপর বাটপারি।
অধ্যায় তের : সাহিত্য-সাধনা
কবি হওয়ার অপচেষ্টা, গদ্যে প্রথম সাফল্য, অনুবাদ, আল এসলাম, পিওর আর্টের বিতর্ক, সাহিত্যিকদের সাথে প্রথম পরিচয়, প্রথম বইয়ের কপিরাইট, আরবি-ফারসি বনাম বাংলা শব্দ, প্রথম স্যাক্রিফাইস, দ্বিতীয় স্যাক্রিফাইস, সাহিত্য সমিতির সেক্রেটারি, চাদা আদায়, চাঁদা দান, সাহিত্য-জীবনের মুদ্দত ভাগ, অভিনব বিষয়বস্তু।
পঞ্চম খণ্ড : সাহিত্যিক জীবন (গরমামুলি)
অধ্যায় চৌদ্দ : গণভিত্তিক সাহিত্যিক মোড়
উৎপ্রেরণা-জাত জাতীয় চিন্তা, সাহিত্য-জীবন, খণ্ডতার সংগত কারণ, পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতা, নূতন উপলব্ধি, জটিলতা বৃদ্ধি, আমার উভয়সংকট, পাকিস্তান সংগ্রামে মুসলিম সাহিত্যের দ্বিধাবিভক্তি।
অধ্যায় পনের : স্বাতন্ত্রের স্বীকৃতি
সোজা পথ সহজ না, প্রথম তিক্ত অভিজ্ঞতা, পশ্চিমাদের অদূরদর্শিতা, পূর্ব বাংলার দুধারী বিপদ, বাংলা সাহিত্যের মুসলমানি রূপ, বাংলা সাহিত্যের বাঙ্গাল রূপ, বিভ্রান্তির হেতু, আমাদের কথ্য ভাষার শক্তির উৎস, মনিব’ ও ‘চাকরের’ ভাষা, আমার একাকিত্ব’।
অধ্যায় ষোল : রাষ্ট্রিক বনাম কৃষ্টিক স্বাধীনতা
মার্কিন নজির, স্বাতন্ত্র-বোধের উন্মেষ, ওয়েবস্টারের দৃঢ়তা, দেশি শত্রুতা বনাম বিদেশি শত্রুতা, দূরদর্শী বিদেশির সদুপদেশ, উপলব্ধির বাস্তবায়ন, জনগণের জয়।
ষষ্ঠ খণ্ড : সাংবাদিক জীবন
অধ্যায় সতের : সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি
এক ঢিলে দুই পাখি, ‘ছোলতান’, ‘মোহাম্মদী’, ‘দি মুসলমান, ‘খাদেম, প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তি।
অধ্যায় আঠার : দ্বিতীয় পর্যায়
‘দৈনিক কৃষক’, ‘কৃষক’-এর অর্থাভাব, ব্যক্তিগত বিপদ, অর্থাভাবের সংগত কারণ, খান বাহাদুর মোহাম্মদ জান, মি. এইচ দত্ত, নীতিগত বিরোধ, কৃষক’ ত্যাগ, সাংবাদিকতার নূতন জ্ঞান, সম্পাদক বনাম মালিক।
অধ্যায় উনিশ : তৃতীয় পর্যায়
‘নবযুগ’, বেনামী সম্পাদক, আমার রাজনীতিক সাংবাদিকতা, আমার ব্যক্তিগত সংকট, নজরুলের ধর্মে মতি, নজরুলের আধ্যাত্মিকতা, নজরুলের রোগ লক্ষণ, মি. দত্তের আবির্ভাব, লজ্জাকর দুর্ঘটনা, আগুনে ইন্ধন, নবযুগে চাকুরি খতম।
অধ্যায় বিশ : চতুর্থ পর্যায়
‘ইত্তেহাদ’, আমার চরম সাফল্য, মুসলিম সাংবাদিকতার অসুবিধা, সমাজ-প্রাণতা বনাম বাস্তববাদিতা, ‘ইত্তেহাদ’-এর প্রয়াস, ‘ইত্তেহাদ’-এর জনপ্রিয়তার কারণ, ‘পাঠকের মজলিস, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদারতা, ‘ইত্তেহাদ’-এর অপমৃত্যু, কলামিস্ট মাত্র।
সপ্তম খণ্ড : আমার সংসার-জীবন
অধ্যায় একুশ : দাম্পত্য জীবন
বিবাহ, বয়সের দূরত্ব লোপ, কচি ঘাড়ে ভারী বোঝা, কুশলী নিপুণা গিন্নি, কলিকাতার জীবন, সংকল্পে দৃঢ়তা, বিবিই জিতিলেন, বিবির প্রভাবের ব্যাপকতা, আমার স্বাস্থ্যের দিকে অতন্দ্র দৃষ্টি, সুখী দাম্পত্য জীবন।
অধ্যায় বাইশ : উকালতি জীবন
শুরুতে নৈরাশ্য, খান সাহেব সাহেব আলী, নূতন অভিজ্ঞতা, ‘অনুকিলী’-সততা, ফিস আদায়, টাউট প্রথা, ‘নোবল প্রফেশন’, মিথ্যাই সত্য, সত্যের জন্যে মিথ্যার ভূমিকা, আলীপুরে।
অধ্যায় তেইশ : বিষয়ী জীবন
বংশগত দুর্বলতা, উস্তাদের শিক্ষা, সাধু থাকা কঠিন না, নবাব সাহেবের উপদেশ, অর্থম-অনর্থম, চিত্রগুপ্তের বাজেট, নিজের বাড়ি, নিজের বাড়ি বনাম ভাড়াটিয়া বাড়ি, জ্ঞান ও বুদ্ধি, আহাম্মকের পাহারাদার তকদির, ‘অজাতশত্রু’, সততা ও তুকাব্বরি, শেষ কথা।
শেষ কথা
Leave a Reply