আড়াল উপাখ্যান – অভীক দত্ত
ডুয়ার্সকে
।। ভূমিকা।।
সুপ্রিয়দার ফ্ল্যাটটা বিরাট বড়। অতীনের এত বড় ফ্ল্যাটে থাকা অভ্যাস নেই। এরকম ফ্ল্যাট বড় লোকদের হয়। বড় লোকেরা ফ্ল্যাটে চুরি হবার ভয়ে বাড়িতে লোক রেখে যায়। অতীন হল সেই লোক। দিনে বুড়োদার দোকানে কাজ করে, রাতে কোন না কোন বড়লোকদের বাড়িতে ঘুমোয়। বস্তিতে থাকার চেয়ে এরকম বড়লোকদের বাড়িতে থাকাই তার বেশি পছন্দের। সমস্যা হল, এদের বাড়িতে কিছু না পাওয়া গেলেই তাকে ফোন করা শুরু করে দেয়।
রন্তুদারা ঘাটশিলা গেছিল দু দিনের জন্য। তাকে বাড়ি দেখতে দিয়ে গেছিল। ফিরে এসে রন্তুদার মেয়ে রিম্পি বলল ওর কোন খেলনা পাওয়া যাচ্ছে না। অতীনের গলদঘর্ম অবস্থা। ছোট একটা পুতুল। রিম্পির অনেকগুলো পুতুল। তার মধ্যে একটা পুতুল পাওয়া যাচ্ছে না। রন্তুদা রোজ বুড়োদার দোকানে এসে বসে থাকত। অতীন বলত, খেলনা নিয়ে সে কী করবে? রন্তুদা ইনিয়ে বিনিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করত, “একটু ভেবে দেখ না। চাইনিজ খেলনার দোকানে ও খেলনা অনেক দামে বিক্রি হবে”।
অতীনের লজ্জা কম। অন্য কেউ হলে কেঁদে দিত। অতীন কাঁদত না। শুধু বলত সে নেয় নি। অবশেষে একদিন ওদের খাটের তলা থেকেই সে খেলনা উদ্ধার হল। সেটা অবশ্য রন্তুদা এসে তাকে বলে যায় নি। বুড়োদা বলেছিল। খবর পেয়েছিল কারো একটা কাছ থেকে। এর পরে রন্তুদারা কেরালা যাবে বলে তাকে থাকতে বলেছিল। অতীন যায় নি। রন্তুদা ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক ভাবে বোঝাতে চেয়েছিল। অতীন থাকে নি। রন্তুদা রেগে গিয়ে অনেক গালাগাল করেছিল তাকে। অতীন সে কথা কানে তোলে নি। এদের কথা কানে তোলা মানে পরে আবার যদি কোন ঝামেলা হয়, সে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া।
পাশের পাড়ার মলয়কে রেখে গিয়েছিল রন্তুদা। মলয় রন্তুদার বাড়ি থেকে অনেক কিছু ঝেড়ে দিয়েছিল। তাকে বলেও ছিল সেটা।
পাড়ার মোড়ে মলয়ের কলার ধরে রন্তুদার বিরাট চিৎকার। মলয় শুরু থেকেই বলে গেল সে কিচ্ছু জানে না।
তাকে পরে মলয় খিক খিক করে হাসতে হাসতে বলেছিল এসব লোকের সঙ্গে এরকমই করা উচিত। অতীন বোকা বলে করে নি কিছু। যারা বেশি সন্দেহ করে, তাদের পিছনে লাগার মজাই আলাদা।
একটা বড় দেওয়ালে বিরাট একটা টিভি। অতীনের মনে পড়ে ছোটবেলায় ডিডি বাংলায় শুধু শনি রবিবার একটা সিনেমা দেখবে বলে তারা যাদের বাড়িতে টিভি আছে, তাদের বাড়িতে ভিড় করে দাঁড়াত।
সুপ্রিয়দা কত বড় লোক? সে হিসেব করতে পারে না বেশি। তবে হিসেব কষে দেখেছে সুপ্রিয়দা রন্তুদার থেকে বেশি বড়লোক।
সুপ্রিয়দার একটা বড় গাড়ি আছে। সুন্দরী বউ আছে। রাখাল বলে সুপ্রিয়দার বউয়ের পেটিটা খুব ভাল।
অতীন লজ্জা পায়। অন্যের বউ বা সম্পত্তির দিকে কেন নজর থাকবে? সুপ্রিয়দা ভাল পড়াশুনা করেছে, অনেক টাকা রোজগার করেছে, তাই সুন্দর বউ পেয়েছে। জীবনটা এরকমই হওয়া উচিত। সবাই তো আর রিক্সা চালিয়ে একদিন দুম করে লটারি পেয়ে কোটিপতি হবার কপাল নিয়ে আসে নি। যারা বেশি করে পড়াশুনা করবে, ভবিষ্যতে তাদের জীবনও অন্যরকম হবে। পড়াশুনার একটা ব্যাপার আছে। অতীন বোঝে। তার পড়াশুনা হল না বলেই সে জীবনে কিছু করতে পারল না।
টিভির রিমোট বুঝিয়ে গেছে সুপ্রিয়দা। ভারি ভাল লোক। তাকে একদম সন্দেহ করে না। রন্তুদার মত খচরা না।
অতীন মন দিয়ে সিনেমা দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ পর পর বিজ্ঞাপনের বিরতি হয়। সে সময় আবার চ্যানেল চেঞ্জ করতে হয়।
বড় ঝামেলার ব্যাপার। বিজ্ঞাপন ছাড়া কোন চ্যানেল চলে না।
বেডরুম থেকে খচ খচ শব্দ আসছে। অতীন টিভি ছেড়ে বেডরুমের দিকে দৌড়ল। কিছু নেই। ইঁদুর কি? তাহলে চিন্তা আছে। ইঁদুর মারার কল নিয়ে আসতে হবে কালকেই।
অতীন চলেই আসছিল, হঠাৎ করে তার চোখে পড়ল আলমারির উপর থেকে একটা ডায়েরী পড়ব পড়ব করছে।
অতীন হাত বাড়িয়ে ডায়েরীটা হাতে নিল। বড়লোকেদের কত ডায়েরী থাকে। তাদের কাছে একটা ডায়েরী পাওয়া মানে বিরাট ব্যাপার। আর এখানে একটা ডায়েরী কেমন অবহেলায় পড়ে আছে।
সে ডায়েরীটা রাখতে গিয়ে কী মনে হতে ডায়েরীটা খুলল। বড় বড় করে বউদির নাম লেখা। অনেক পুরনো ডায়েরী। এটা বউদির ডায়েরী? অতীন ডায়েরীটা খোলার তীব্র ইচ্ছা দমন করে আবার ডায়েরীটা রেখে দিয়ে টিভি দেখতে বসল।
অন্যের জিনিস না দেখাই ভাল।
.
১
রাস্তা ভীষণ খারাপ।
আলোও নেই।
জিপের হেডলাইট ভরসা। পাপান ঘ্যান ঘ্যান করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সুপ্রিয় মোবাইলে হিসেব করছিল।
বেড়াতে বেরনো মানে অনেক খরচের ধাক্কা। সব কিছু সামলে আগে থেকে একটা বাজেট করে রাখতে হয়।
সংযুক্তার ভয় লাগছিল।
ভয় না এসে যাবে কোথায়? এই অন্ধকারগুলোই বড্ড ভয় দেখায়।
কোথায় শুনেছিল এরকম রাস্তায় ড্রাইভার ইচ্ছা করে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে সবাইকে মেরে বউটাকে নিয়ে বেচে দেয়। অপরিচিত কতগুলো লোক মেয়েটাকে একের পর এসে ধর্ষণ করে যাবে। তারপর ভয়াবহ রোগটা…
এর থেকে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন আর কী হতে পারে?
ড্রাইভার বলল, “রাস্তা খুব খারাপ দাদা”।
সুপ্রিয় বিরক্ত গলায় বলল, “সে তো দেখতেই পাচ্ছি। ভুল করে ফেললাম। বাগডোগরা থেকে বেরিয়ে কোথাও আজ রাতটা কাটিয়ে দিতে হত”।
ড্রাইভার জিপিএস দেখে গাড়ি চালাচ্ছিল।
একটা বড় গর্তে পড়ে উঠল গাড়িটা। সুপ্রিয় বলল, “এরা রাস্তা সারায় না নাকি? বিরাট ভুল হয়ে গেছে দার্জিলিং ক্যান্সেল হবার পর অফ বিট জায়গা খোঁজার কথা ভেবে। এর পর থেকে যেখানে সবাই যায়, সেখানেই যাব”।
রাস্তার দু পাশে চা বাগান। দু চারটে বাইক বেরিয়ে যাচ্ছে।
শীত নেই তেমন। পাহাড়ে নিশ্চয়ই এতক্ষণে জাঁকিয়ে শীত নেমেছে।
পাহাড়ের পাদদেশে শীতের জন্য সেই শীতকালই ভরসা।
সুপ্রিয় ফোন দেখে বলল, “টাওয়ারের হাল খুব খারাপ। যাচ্ছে আসছে। রিসোর্টে ফোনের টাওয়ার থাকবে আশা করা যায়। তোমার খিদে পেয়েছে?”
সংযুক্তা মাথা নাড়ল, “না না”।
সুপ্রিয় বলল, “সে কি গো? খিদে পায় নি? আমার পেয়ে গেছে। পৌঁছেই খাব”।
একটা ছোট বাজার এল। ড্রাইভার ছেলেটা গাড়ি থামিয়ে দোকানদারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসে গাড়িতে বসে বলল, “আর তিন কিলোমিটার দাদা। এসে গেছি”।
সুপ্রিয় ঘড়ি দেখে বলল, “সাতটা বাজে, অথচ এখনই কী অন্ধকার! ভাবা যায় না”।
গাড়ি এতক্ষণ উঁচু নিচু রাস্তায় চলছিল। বাজারটা পেরোতে চড়াইয়ে উঠতে শুরু করল। রাস্তা একই রকম খারাপ।
সংযুক্তা পাপানকে আঁকড়ে ধরল। ছেলেটা সারা রাস্তা ভারি উৎসাহ নিয়ে এসেছে। শেষের দিকে আর টানতে পারে নি। মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ড্রাইভার বলল, “আমি আগে এই জায়গায় এলে অসুবিধা হত না দাদা। জায়গাটার নাম শুনেছিলাম, আপনি দেখুন, টাওয়ার থাকলে এবার রিসোর্টে ফোন করুন। ঠিক যাচ্ছি নাকি দেখে নিন”।
সুপ্রিয় ফোন করল। দু তিনবার চেষ্টার পরে ফোন পাওয়া গেল। রিসোর্টের ম্যানেজার জানালেন আর খানিকটা পরেই তাদের রিসোর্টের দিক নির্দেশ দেওয়া বোর্ড চোখে পড়বে। তার পর থেকে পথ চিনতে আর অসুবিধে হবার কথা নয়।
সুপ্রিয় ফোন রেখে ড্রাইভারকে সে কথা বলল। ড্রাইভার গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে পাহাড়ে গাড়ি তুলতে লাগল।
ম্যানেজার ঠিকই বলেছিল। খানিকক্ষণ পরে রাস্তার মাঝখানে রিসোর্টের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। সমস্যা হল বিজ্ঞাপনটা যেখানে, সেখান থেকে রাস্তাটা দু ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা চড়াইয়ের দিকে গেছে। অন্যটা নিচে নেমে গেছে। বিজ্ঞাপনটা রাস্তার মাঝে দেওয়া।
সুপ্রিয় বলল, “আজব লোক তো ম্যানেজারটা, বলবে তো ডানদিকে যাবো না বা দিকে। এ দেখো, টাওয়ারও নেই”।
ড্রাইভার বলল, “কী করব দাদা?”
সুপ্রিয় একটু ভেবে নিয়ে বলল, “ডানদিকেই নাও। উপরের দিকেই যাই”।
ড্রাইভারেরও বাড়ি ফেরার তাড়া আছে। সে ডানদিকের রাস্তা নিয়ে নিল। খাড়াই রাস্তা। রাস্তা বলাটাও ভুল অবশ্য, পুরো পাথরে ভর্তি পথ। ডানদিকে খাদ। বাঁদিকে ঘন জঙ্গল, সেখান থেকে ঝিঁঝিঁর শব্দ ভেসে আসছে।
সুপ্রিয় বলল, “গাড়ি ঘোরাও। এ রাস্তা হবে না, ভুল এসেছি”।
ড্রাইভার বলল, “কোথায় ঘোরাবো দাদা? ঘোরানোর জায়গাও তো নেই। দেখছি দাঁড়ান”।
সংযুক্তার আবার বুক ঢিব ঢিব শুরু হল। ছেলেটার কাছে যদি ছোরা থাকে, সুপ্রিয়কে মেরে যদি তার উপর চড়াও হয়? সে কী করবে?
২
রিসোর্ট থেকে একটা ছেলেকে পাঠিয়েছে তাদের ব্যাগ নিয়ে যাওয়ার জন্য। ছেলেটা আকণ্ঠ মদ গিলে এসেছে। কেউ মদ খেয়ে গন্ধ ছাড়লে অসহ্য লাগে।
জায়গাটা নিঝুম। ভুল রাস্তায় চলে গেছিল তারা। আবার গাড়ি ঘুরিয়ে রিসোর্টের কাছে নামিয়ে দিয়ে গেল ড্রাইভার। অ্যাপ থেকেই টাকাটা কেটে নেবে। সুপ্রিয় তবু ছেলেটাকে দুশো টাকা এক্সট্রা দিল।
রিসোর্ট ফাঁকা। এই সময়ে কেউ আসে নি! কী অদ্ভুত।
ঘরগুলো স্যাঁতস্যাঁতে। মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। পাপান রাস্তাটুকু কোন মতে হেঁটে খাটে এসে শুয়ে পড়েছে।
সুপ্রিয় বলল, “পাপানকে তুলবে না? রাতে না খেয়েই ঘুমোবে ও?”
সংযুক্তা বলল, “এয়ারপোর্টে স্যান্ডউইচ খেল, সারা রাস্তা মুখ চলেছে। কিছু না কিছু খেয়ে গেছে। ঘুমালে ঘুমোক”।
বিয়ের আট বছর হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম এই পরিস্থিতিতে থাকলে এতক্ষণে তাদের আদর শুরু হয়ে যেত।
সংযুক্তা চেঞ্জ করে এল।
খরস্রোতা নদীর শব্দ ঘরে এসেও হানা দিয়েছে। মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই।
সংযুক্তা বলল, “তোমার খিদে পেয়েছে?”
সুপ্রিয় বলল, “হ্যাঁ। দেখি খাবার কোন ব্যবস্থা করা যায় নাকি। বাইরে যে যাবো তার উপায়ও নেই। বেশ জোরে বৃষ্টি পড়ছে। পকোড়া আনাই। খাবে তো?”
সংযুক্তা ঘাড় নাড়ল।
সুপ্রিয় বলল, “কী ভাবো তুমি সব সময়? এখন কী ভাবছো?”
সংযুক্তা মাথা নাড়ল, “কিছু না। এই কটেজটা সুন্দর। মা বলছিল মশার থেকে বেঁচে থাকতে। এখানে নাকি মশা কামড়ালেই ম্যালেরিয়া হয়”।
সুপ্রিয় বলল, “হতে পারে। মসকিউটো কয়েল জ্বালিয়ে দেব। ভেবো না”। দু তিনটে পরের কটেজ থেকে হৈ হুল্লোড় ভেসে আসতে শুরু করল হঠাৎ করে।
সুপ্রিয় বিস্মিত গলায় বলল, “আজব! আমি ভেবেছিলাম শুধু আমরাই এসেছি। এত আনন্দ আসে কোত্থেকে এদের?”
পাপান পাশ ফিরে শুল।
সুপ্রিয় বলল, “রাতে চিকেন খাবে তো?”
সংযুক্তা ঘাড় নাড়ল।
সুপ্রিয় রুম সার্ভিসে ফোন করে বলে দিল। পাপানের জন্য আলাদা করে বলা হল না। যদি জেগে যায়, তাদের সঙ্গেই খেয়ে নেবে। রুম সার্ভিস জানাল খাওয়াটা ডাইনিং হলে গিয়ে খেতে হবে। খুব সমস্যা হলে তবেই ওরা ঘরে খাবার পাঠায়।
টিভি চালাল সুপ্রিয়। কতগুলো ন্যাশনাল চ্যানেল ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। বলল, “অতীনকে ফোন করা হল না। ঠিকঠাক গেছে নাকি কে জানে। এসির রিমোট লুকিয়ে এসেছো তো? নইলে আবার বাবু এসি চালিয়ে ঘুমোবে তোমার বেডরুমে”।
সংযুক্তা বলল, “এসেছি”।
সুপ্রিয় বলল, “সোফায় এসে বস”।
সংযুক্তা সোফায় এসে তার পাশে বসল। সুপ্রিয় নাক দিয়ে সংযুক্তার গলায় আদর করতে শুরু করল।
সংযুক্তার সেই অস্বস্তিটা ফিরে এল। বলল, “পাপান দেখে ফেলবে”।
সুপ্রিয় বলল, “অন্যদিকে মুখ করে ঘুমিয়েছে তো। দেখবে না। আদর করতে ইচ্ছে করে না আমাকে?”
সংযুক্তা বলল, “কেন করবে না?”
সুপ্রিয় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কলিং বেল বেজে উঠল। সুপ্রিয় দরজা খুলে দেখল পকোড়া চলে এসেছে। প্লেটটা ঘরের ভেতরে দিয়ে গেল হোটেলের ছেলেটা। সুপ্রিয় দরজা বন্ধ করে বলল, “একা খাবো না। তুমিও খাও। খিদে না পেলেও খাও। হয়ত বোঝো নি, এদিকে খিদে পেয়েছে। এ নাও।”
সংযুক্তা হাত বাড়িয়ে পকোড়া নিল। বেশ ভাল রান্না। খেতে ভাল লাগছে।
সুপ্রিয় বলল, “তোমার মন খারাপ লাগছে দার্জিলিং হল না বলে?”
সংযুক্তা বলল, “পাপানের জন্য একটু খারাপ লাগছে। এখানে কি ওর ভাল লাগবে?”
সুপ্রিয় বলল, “দেখা যাক”।
সংযুক্তা আর কিছু বলল না। বেশি কথা বলতে ইচ্ছেই করে না আজকাল…
৩
“সুনির্মল বসুর লেখা পুরাণে পড়লাম, মাহিষ্মতী মহিষাসুরের মা ছিলেন। এবার সম্প্রতি একটা সিনেমায় দেখা গেল মাহিষ্মতীকে দেবী হিসেবে পুজো করছে দক্ষিণী রাজারা। আমি সিনেমাটির স্ক্রিপ্ট রাইটারের সঙ্গে দেখা হলে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।
১) মাহিষ্মতীর উল্লেখ কি তিনি নিছক কল্পনা থেকেই করেছেন, নাকি সত্যিই কোথাও উনি পূজিত হন?
২) যদি সত্যিই পূজিত হন, তবে কোথায়?
মহিষাসুর অত্যন্ত দাপুটে একজন রাজা ছিলেন। দেবতা এবং অসুরের আর্য, অনার্যের লড়াইতে মহিষাসুর পরাজিত হন। উত্তরে আর্যদের দখলে গেলেও দাক্ষিণাত্যে তারা বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারে নি…”
“ধুস, কিচ্ছু হচ্ছে না। আরো পড়তে হবে”।
এতটুকু লিখে লেখাটা সেভ করে রাখল নীলাদ্রি। সে তার কোন লেখাই প্রাণে ধরে কাটতে পারে না। ল্যাপটপে ভর্তি হয়ে পড়ে থাকে না শেষ হওয়া লেখাগুলো। রিসোর্টের ছেলেটা চিকেন পকোড়া আর কফি দিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। নীলাদ্রি পকোড়া খেতে গিয়ে দেখল ঠান্ডা হয়ে গেছে।
“ধুত্তোর” বলে বেরোল। পাশের দুটো কটেজে কতগুলো কলেজের ছেলে মেয়ে এসেছে সকালে।
গিটার বাজাচ্ছে কেউ একটা।
নীলাদ্রি গীটারের শব্দ শুনে একটা কটেজের দরজায় নক করল।
একটা মেয়ে দরজা খুলল। তাকে দেখে বলল, “ইয়েস”!
নীলাদ্রি বলল, “আমি পাশের কটেজেই থাকি”।
মেয়েটা ঘরের বাকিদের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল, “আমাদের সাউন্ডে আপনার কি অসুবিধে হচ্ছে?”
নীলাদ্রি মাথা নাড়ল, “একবারেই না। আমার মাথা একবারে কাজ করছে না। আমি তোমাদের এখানে একটু বসতে পারি?”
মেয়েটা হাঁফ ছেড়ে বলল, “শিওর”।
যে ছেলেটা গীটার বাজাচ্ছিল, সে নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার ভাল লাগছে আমার বাজনা?”
নীলাদ্রি বলল, “তোমরা ইংরেজি গান বাজাচ্ছো। আমি ওসব শুনি না। মানে আমি বাংলা মিডিয়াম। তবে ওই যে সিনেমার একটা ডায়লগ আছে না, সমঝা কুছ নেহি, সুনকে আচ্ছা লাগা”।
সবাই হেসে উঠল।
গীটার বাজিয়ে ছেলেটা বলল, “আমার নাম রুদ্র। আমিও বাংলা মিডিয়াম। তবে ইংরেজি গানটা আমি কলকাতায় এসে শোনা শুরু করি। গানের কোন দেশ হয় না”।
নীলাদ্রি সিগারেট বের করে বলল, “আমি স্মোক করলে কোন প্রবলেম আছে?”
সবাই মাথা নাড়ল, “একবারেই না”।
নীলাদ্রি সিগারেট ধরিয়ে বলল, “তোমাদের থেকে বছর পনেরোর বড় হব আমি। লেখালেখি করি। এখানে এসেছিলাম যদি কোন নতুন প্লট পাই। সারাক্ষণ কলকাতায় থেকে হেজে যাচ্ছিলাম। এখানেও মনে হচ্ছে বিশেষ কিছু পাবো না। চাকরিটা না ছাড়লেই ভাল করতাম”।
রুদ্রর পাশে বসে থাকা ছেলেটা বলল, “আমারও ইচ্ছে ছিল প্রফেশনালি লেখা লেখি করার। কেমন পাওয়া যায় দাদা?”
নীলাদ্রি বলল, “ডিপেন্ডস। চাকরি বাকরির যা হাল চারদিকে, সবাইকে বিকল্প জীবিকাই খুঁজতে হবে বুঝলে। তোমার নাম কী?”
ছেলেটা বলল, “পল্লব”।
ঘরে আর যে দুজন মেয়ে ছিল, তাদের নাম হিয়া আর রুমানা।
নীলাদ্রি বলল, “দু জোড়া দেখছি, তোমরা প্রেমিক প্রেমিকা সবাই?”
হিয়া দরজা খুলেছিল। বলল, “না না। এগুলোকে কে বিয়ে করবে? জাস্ট বেড়াতে এসেছি”।
নীলাদ্রি বিস্মিত হবার মুখ করে বলল, “স্ট্রেঞ্জ! তোমাদের বাড়ি থেকে ছাড়ল? তোমাদের বয়সে আমার যে কী দশা ছিল তা আর কী করে বলব”!
রুমানা হাসতে হাসতে বলল, “কলেজ এক্সকারশান বলে বেরিয়েছি। আমাদেরও বাড়ি যথেষ্টই স্ট্রিক্ট। ভাগ্যে এখানে মোবাইলের টাওয়ার পাওয়া যায় না। নইলে বাড়িতে ভিডিও কলিং করতে হত ঠিক”।
নীলাদ্রি মাথা নাড়ল, “সেটা দরকার। বাড়ির মণিটরিংটাও দরকার। দিনকাল ভাল নয় হে। আচ্ছা ঘরে খুব হালকা অ্যালকোহলের গন্ধ পাচ্ছি। বৃদ্ধ সন্ন্যাসী মনে হচ্ছে। কে মারলে হে?”
রুদ্র বলল, “আমরা একটু একটু করে খাচ্ছি আর কি। আপনার চলবে নাকি?”
নীলাদ্রি বলল, “এখন না। পরে। গান শোনাও ছোকরা। ভাল করে একটা গান ধর তো!”
রুদ্র গীটারে সুর তুলল। ইংরেজি গান। নীলাদ্রি বুঝল না। বাকি তিনজনও গাইতে শুরু করল।
নীলাদ্রি জোরে জোরে মাথা নাড়াল।
নাহ, বৃদ্ধ সন্ন্যাসীটা এই পরিবেশে দরকার। এই বয়সটায় বার বার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে তার, প্রতি মুহূর্তে। এই বয়সটা মিস করে সে প্রতিদিন। প্রতি মুহূর্তে। জীবনে আর কোন বয়স আসাই উচিত ছিল না যৌবন কাল বাদ দিয়ে।
কলিং বেল বেজে উঠল। গান থামিয়ে রুদ্র বলল, “উফ। দেখ তো হিয়া”।
হিয়া উঠে দরজা খুলল।
সুপ্রিয় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বিরক্ত গলায় বলল, “প্লিজ বি কোয়াইট। ইউ আর রুইনিং দিস প্লেস”।
হিয়া ঘাবড়ে গেল। বলল, “সরি স্যার”।
নীলাদ্রি চিন্তিত মুখে সুপ্রিয়র দিকে তাকাল। এই মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছে তো!
কে যেন?
৪
সুপ্রিয় কটেজে না ঢুকে বিরক্ত মুখে হাঁটাহাঁটি করছিল। সংযুক্তা কেমন দূরে চলে যাচ্ছে যেন। ভাল কোন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখালে কি এই রোগের নিরাময় সম্ভব? যদি সম্ভব হয়, তাহলে দেখিয়ে নেওয়াই ভাল।
বৃষ্টি থেমেছে। দু চার ফোঁটা যেটুকু পড়ছে, সেটা গায়ে মাখল না সে। জ্বর এলে আসবে। বেঁচে থাকাটাই তো যন্ত্রণা হয়ে গেছে। একটা সময় আসে, জীবনের নতুন নতুন মানে বের করা যায়।
আর তার পরে আরেকটা সময় আসে, যখন জীবনের মানে বলে আর কিছু থাকে না। বেঁচে থাকাটাও যন্ত্রণা মনে হয়। পাপান আছে বলে তাকে বেঁচে থাকতে হবে। নিজের জন্য বেঁচে থাকতে হবে ভাবলে হাসি পায়।
ছেলে মেয়েগুলো গান শুরু করেছে আবার। ওদের মধ্যে একজন লোক ছিল, সরাসরি তাকে বলে দিল গান গাইলে কানে তুলো গুঁজে রাখতে পারেন তো!
সুপ্রিয় রাগী মুখে চলে এসেছে। বিরক্তি ধরারই কথা। লোকটা কেমন শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢোকার চেষ্টা করছে।
গান জিনিসটাও জীবন থেকে চলে গেছে এখন। অফিস থেকে ফেরার সময় গাড়িতে এফ এমে কতগুলো পাঞ্জাবী গান চলে, আর পুজোয় পাড়ায় মাইকে কিছু গান বাজে, জীবনে গানের ভূমিকা এখন এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ একটা সময় ছিল যখন সকাল বিকেল তাদের বাড়িতে গান চলত। বাবা গান শুনত খুব।
রিসোর্টের ছেলেটা জানাল ডাইনিং হলে ডিনার দেওয়া হয়েছে। সুপ্রিয় কটেজে ঢুকল। সংযুক্তা পাপানের পাশে শুয়ে পড়েছিল। সুপ্রিয় বলল, “খেয়ে নি চল”।
সংযুক্তা উঠল। বলল, “পাপান একা থাকবে?”
সুপ্রিয় বলল, “কী আর হবে? হল থেকে কটেজ দেখা যাচ্ছে। চল। দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে খেয়ে আসি”।
সংযুক্তা বলল, “একবারে তালা দিয়ে যাবে?”
সুপ্রিয় বলল, “হ্যাঁ। দরজা খোলা থাকলে মশা ঢুকে যাবে। জোঁকও ঢুকতে পারে। অত ঝামেলা করার দরকার নেই”।
সংযুক্তা উঠে বলল, “চল”।
দুজনে কটেজ থেকে বেরিয়ে বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে ডাইনিং হলে এল। ছোট হল। বৃষ্টি শেষের পর শীত নেমেছে। রাত সাড়ে আটটা বাজে সবে। এত তাড়াতাড়ি তারা খায় না।
এই জায়গায় এই রাতটাই মাঝরাত মনে হচ্ছে। কোন মতে রাতটা কাটলে যেন বাঁচা যায়।
গরম গরম ভাত, ডাল, স্কোয়াশের তরকারি আর মুরগীর ঝোল।
ক্যাসারোলে দিয়ে গেছে। সংযুক্তা ক্যাসারোল থেকে সুপ্রিয়কে খাবার বেড়ে দিল। নিজের জন্য খুব কম ভাত নিল।
সুপ্রিয় বলল, “এত কম ভাত নিলে কেন?”
সংযুক্তা বলল, “ভাল লাগছে না খেতে”।
সুপ্রিয় আর কথা না বলে খাওয়ায় মন দিল।
সংযুক্তা আনমনা হয়ে খাচ্ছিল একটু একটু করে। সুপ্রিয় বলল, “তুমি তো উলটোপাল্টা কিছু খাও নি। এতটা রাস্তা এলে, খিদে পাচ্ছে না?”
সংযুক্তা বলল, “পকোড়া খেয়েছি বলেই হয়ত খিদে পাচ্ছে না”।
সুপ্রিয় বলল, “মাঝরাতে যদি খিদে পায়?”
সংযুক্তা বলল, “পাবে না”।
ডাইনিং হলে নীলাদ্রি ঢুকল। সংযুক্তাকে দেখে অবাক গলায় বলল, “তুই?”
সংযুক্তা হাসতে চেষ্টা করল, “আমরা তো আজকেই এলাম”।
সুপ্রিয় জিজ্ঞাসু চোখে সংযুক্তার দিকে তাকাল।
সংযুক্তা বলল “দাদার বন্ধু। অনেকদিন পরে দেখা হল”।
নীলাদ্রি সুপ্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলল, “এক্সট্রিমলি সরি। আমি বোধ হয় আপনার সঙ্গে খানিকটা রুড বিহেভ করে ফেলেছি। আচ্ছা, আপনি কী জানেন মহিষাসুরের মায়ের নাম কী ছিল?”
সুপ্রিয় হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “মানে?”
নীলাদ্রি চেয়ার টেনে সুপ্রিয়র পাশে বসে পড়ে বলল, “আমি জানতে পেরেছি মহিষাসুরের মায়ের নাম মাহিষ্মতী ছিল। ভাবতে পারছেন। এই দুদিন আগেও সিনেমা হলে গিয়ে জয় মাহিষ্মতী বলে এসেছি”।
সুপ্রিয় বোঝার চেষ্টা করল নীলাদ্রির মাথায় ছিট আছে নাকি। সংযুক্তা বলল, “বউদি কেমন আছে নীলুদা?”
নীলাদ্রি বলল, “ভালই আছে হয়ত। বাড়ি চলে গেছে তো। আমার সঙ্গে কোন সুস্থ মেয়ে ঘর করতে পারে বলে তোর মনে হয়?”
সুপ্রিয় মাঝখান থেকে বলল, “না সম্ভব না”।
নীলাদ্রি হাততালি দিয়ে উঠল, “আপনি খুব তাড়াতাড়ি মানুষ চিনতে পারেন তো!”
সুপ্রিয় মাথা নাড়ল, “তা পারি”।
৫
ঘরে ঢুকে সুপ্রিয় বলল, “কোথাও গিয়ে যে একটু শান্তি পাবো, তার জো নেই। এখানেও চেনা বেরিয়ে গেল। লোকটা কি এরকমই পাগলাটে নাকি?”
সংযুক্তা বলল, “হ্যাঁ। বরাবরই এরকম”।
সুপ্রিয় বলল, “কীসব ভুল ভাল বকে যাচ্ছিল দেখেছো? নিশ্চয়ই মাথার প্রবলেম আছে। আবার লেখে নাকি। কী লেখে? ওর লেখা কে পড়ে?”
সংযুক্তা ব্যাগ থেকে ব্রাশ আর টুথপেস্ট বের করে সুপ্রিয়কে দিয়ে বলল, “ব্রাশ করে নাও”।
সুপ্রিয় ব্রাশ নিয়ে বাথরুমে গেল। সংযুক্তা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাপানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
সুপ্রিয় বাথরুম থেকে বেরিয়ে বলল, “এখানে বেশিদিন থাকার ডিসিশনটা ভুল মনে হচ্ছে। এটা কোনমতেই নির্জন জায়গা না। একটা পাগল লোক শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢোকার চেষ্টা করে যাচ্ছে, ক্যাওস তৈরী হচ্ছে, শান্তিতে ক’টাদিন কাটাবো ভেবেছিলাম, সব গেল”।
সংযুক্তা বলল, “আমি বলে দেবো তোমাকে বিরক্ত না করতে?”
সুপ্রিয় বলল, “না না। ওভাবে বলা যায় নাকি? কিছু বলার দরকার নেই”।
সংযুক্তা বাথরুমে গেল। দরজা বন্ধ করে আয়নায় নিজেকে দেখল। কতটা পাল্টেছে সে? নীলুদা যখন তাদের বাড়ি আসত, কত বয়স ছিল তার? সে যখন ফাইভ, তখন থেকেই তো আসত। দাদার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল নীলুদা। কতরকম পাগলামি যে করত! এক একদিন একেক রকম খেলা আবিষ্কার করবে। কতদিন পরে এভাবে, এ জায়গায় যে দেখা হয়ে যেতে পারে, ভাবতেই পারে নি সে। ব্রাশ করে চেঞ্জ করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখল সুপ্রিয় শুয়ে পড়েছে।
সংযুক্তা বলল, “লাইট অফ করব?”
সুপ্রিয় বলল, “থাক। কিছু চিনি না জানি না জায়গাটার। জ্বলুক। তুমি বরং আমার সঙ্গে কিছু কথা বল”।
সংযুক্তা বলল, “কী বলব?”
সুপ্রিয় বলল, “কী বলবে? আমার তো একটাই প্রশ্ন। তুমি এরকম হয়ে যাচ্ছো কেন? তোমার কি কোন সমস্যা হচ্ছে?”
সংযুক্তা বলল, “আমি ঠিক আছি। তুমি বেশি ভেবো না এটা নিয়ে। ঘুমিয়ে পড়”।
সুপ্রিয় বলল, “এই যে নীলুদা না কে, এ আমাদের বিয়েতে ছিল না?”
সংযুক্তা বলল, “নীলুদার তখন বড় বড় চুল ছিল”।
সুপ্রিয় অবাক গলায় বলল, “হ্যাঁ ঠিক তো। আবার কী সব ছাগুলে দাড়িও ছিল। তাই ভাবছি, আমার চেনা চেনা লাগছিল কেন?”
সংযুক্তা খাটে বসে বলল, “বিয়েতে অনেক মজাও করেছিল। ভিডিওতেও নীলুদা আছে। তুমি ওই গোঁফ দাড়ির জন্যই চিনতে পারো নি”।
সুপ্রিয় বলল, “তখনো তো কীসব ভুল ভাল কাজ করছিল। আমার সঙ্গে আজে বাজে ইয়ার্কি মারছিল, তোমার মা বকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। মনে পড়েছে। বউ চলে গেছে বলল। কী সব লোক মাইরি”।
সংযুক্তা ফ্যানের দিকে তাকাল। নীলাদ্রিদা হঠাৎ করেই বিয়ে করে। দাদা কথায় কথায় বলেছিল একদিন। খুব রোম্যান্টিক বিয়ে করেছিল গোয়াতে। এর মধ্যে ডিভোর্সও হয়ে গেল?
নীলুদা বলল কোন সুস্থ মেয়ে তার সঙ্গে থাকতে পারে না।
তাই হবে হয়ত। এসব পাগলামি দেখে চলে গেছে। নীলুদা লিখতে ভালোবাসত। কোন একটা পত্রিকায় লেখা বেরিয়েছিল প্রথম। লাফাতে লাফাতে তাকে সেই পত্রিকাটা দিয়ে গেছিল। নিজেই এক গাদা পত্রিকা কিনে বিলিয়ে যাচ্ছিল।
চোখ বন্ধ করতে ফ্ল্যাশব্যাকের মত দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল। তাদের পিকনিক হচ্ছে। তার উপরে ভার পড়েছে লুচি ভাজার। সে কিছুতেই লুচি ভাজতে পারছে না। দাদা রেগে যাচ্ছে। নীলুদা সবাইকে চমকে দিয়ে লুচি ভাজতে শুরু করল। এক একটা লুচির এক একটা আকৃতি। সবাই খাবে কী, হেসেই গড়াগড়ি খাচ্ছে।
ঘুমের ঘোরে পাপান তাকে জড়িয়ে ধরল।
কটেজের বাইরে থেকে গান ভেসে আসছে।
৬
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ঘুম আসতে চায় না। নীলাদ্রি উঠে বসে রইল কিছুক্ষণ। নদীর শব্দ ভেসে আসছে ঘরের মধ্যে। ছেলে মেয়েগুলিও ঘুমিয়ে পড়েছে। মেঝেগুলো বড় স্যাঁতস্যাঁতে। এদিকে রোদ উঠলেও গাছ গাছালির জন্য অতটা ভেতরে আসতে পারে না হয়ত।
সে সিগারেট ধরাল। ছাদটা কাঠের। সে দিকে তাকিয়ে বড় বড় শ্বাস ছেড়ে সিগারেটে কয়েক টান দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে ল্যাপটপটা অন করল।
ল্যাপটপ তার খাটেই থাকে সবসময়। কোন প্লট মনে এলে মোবাইলে লিখে রাখে। কখনো স্বপ্নও। কত অসমাপ্ত কাহিনির সাক্ষী ল্যাপটপ আর মোবাইল। সব একদিন লিখে ফেলতে হবে।
লেখা শুরু করতে খানিকটা ফ্লো এল। লিখতে লিখতে আবার ঘুমও চলে এল।
ল্যাপটপটা খোলা রেখেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙল বৃষ্টির শব্দে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। জানলা হালকা খোলা ছিল বলে বৃষ্টির ছাটও ঘরের ভিতরে চলে আসছে। নীলাদ্রি মোবাইল হাতে নিয়ে সময় দেখল। সকাল সাতটা কুড়ি। বাইরে দেখলে সকাল বলে মনে হচ্ছে না। যেন আদৌ সকাল হয়ই নি। নীলাদ্রি চোখ খুলে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকল।
রণিতা আসবে। ঘর গোছাতে হবে। কাজের শেষ নেই। এরকম ঘর দেখলেই রণিতা রেগে যায়।
ফোনে একটা টাওয়ার দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে হয় এটা। টাওয়ার না থাকার দেশ থেকে একটা টাওয়ার দেখিয়ে দেয়। মেসেজ এসেছে কয়েকটা। প্রচুর ক্রেডিট কার্ডের বিল পেন্ডিং আছে। পার্সোনাল লোন নিয়েছিল, সেটার টাকা কাটতে গিয়েও ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে দেখাচ্ছে। এর মানে হল সিবিল স্কোর ধাক্কা খাবে।
ফ্রাস্ট্রেশনে একেক জন মানুষ একেক রকম কাজ করে। নীলাদ্রি শপিং মলে গিয়ে জিনিস কেনে। গাদা গাদা অপ্রয়োজনীয় দামী জিনিস যেগুলো সে কোন কালে ব্যবহারই করবে না। একটা প্লে স্টেশন কিনেছিল। খুলে একদিন খেলতে গিয়ে দেখেছে এসব খেলে ঠিক পোষায় না। ঘরে তেমন ভাবেই পড়ে আছে।
রণিতা বলে গিয়েছিল তার সঙ্গে কোন দিন কেউ থাকতে পারবে না। সে যে ক’দিন ছিল, সেটাই অনেক। তবু শেষ চেষ্টা করা হবে। রণিতা এখানে আসবে। তারা এখানে ক’দিন থাকবে। কোর্ট বলে দিয়েছে। রণিতার কাজ ছিল। আগে নীলাদ্রি চলে এসেছে। আজ রণিতা আসবে।
রণিতা তার সঙ্গে থাকলে তাকে ঠিক কী কী মেনে চলতে হবে?
১) বিছানায় এঁটো খাবার তোলা যাবে না।
২) মুখ হাত ঠিক করে ধুতে হবে।
৩) বাসী জামা কাপড় আলাদা রাখতে হবে।
৪) ঘরের মধ্যে বাইরের জুতো পরে ঘোরা যাবে না।
ইত্যাদি, প্রভৃতি। প্রভৃতি এবং ইত্যাদি।
রণিতা সারাদিন ধরে ঘর সাজাতো। সে সব এলোমেলো করে দিত। রণিতা আবার সাজাতো। সে হয়ত কোন পাঞ্জাবী খুঁজে পাচ্ছে না। আবার রণিতার সাজানো সব কিছু এলো মেলো করে দিত। নীলাদ্রি পরে ভেবে দেখেছে রণিতা ঠিকই বলেছে। এভাবে হয় না।
বুলু, যার ভাল নাম সংযুক্তা, ও সমরেশের বোন। ওদের বাড়ি সে ছোট থেকেই যেত। নীলাদ্রির হঠাৎ করেই বুলুর সংসার দেখতে ইচ্ছা হল। দেখাই যায়। ওর বরটাকে রগচটা মনে হল বটে, তবে হয়ত ছেলেটা ভালই। বাইরে থেকে কাউকে দেখে ভাল না খারাপ বোঝা সম্ভব না। মানুষকে চেনা অত সহজ না।
নীলাদ্রি উঠে বাথরুমে গেল। দাড়ি কাটল। রণিতা আবার তার সঙ্গে থাকতে আসছে, ব্যাপারটা ভাবলে একবারে খারাপও লাগছে না। সে তো রণিতাকে ভালোই বাসে। রণিতাও নিশ্চয়ই বাসে। ভালোবাসা কমে যায় না। দূরে থাকলে বেড়ে গেলেও যেতে পারে। যদি রণিতা তাকে খুব বকাবকি করে, সে চুপ করে শুনে যাবে। ও তো ভালোর জন্যই বলে।
নীলাদ্রি বেশ কিছুক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল।
রণিতা এলে তাকে ভাল ভাবে থাকতে হবে, ভদ্রভাবে থাকতে হবে। ঝগড়া করলে চলবে না।
মা বার বার বলে দিয়েছে। দিব্যিও দিয়েছে।
কী জ্বালা!
৭
সকালে ঘুম ভেঙে কিছুক্ষণ উঠে চুপ করে বসে রইল সুপ্রিয়। বিরক্তির কারণ একটা একটা করে বেড়েই চলেছে। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে।
কোথাও ঘুরতে যাওয়া যাবে না।
পাপান চোখ খুলে পিটপিট করে তার দিকে তাকাচ্ছে। সুপ্রিয় বলল, “কীরে? কাল ক’টা থেকে ঘুমোচ্ছিস, জানিস?”
পাপান ঘুম জড়ানো গলায় বলল, “আমি আরো ঘুমাবো। সারাদিন ঘুমাবো”।
সুপ্রিয় পাপানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ছেলেটা এই সময়ে ভদ্রলোকের মত থাকে। ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙার পরেই বদমায়েশি শুরু করে দেবে। সংযুক্তা ছেলেকে নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত হয়ে থাকে। এত ব্যস্ততার মধ্যেও সুপ্রিয় বুঝতে পারছে সংযুক্তার মধ্যে ডিপ্রেশন আসছে। পলাশদাকে সংযুক্তার কথা বলায় পলাশদাই ডিপ্রেশনের কথা তুলেছিল। বলেছিল ডিপ্রেশন একটা ভীষণ বাজে রোগ। অনেকেই একে আমল দিতে চায় না। যাদের হয়, তারা বুঝতে পারে ডিপ্রেশন কতটা মারাত্মক একটা রোগ।
পাপান বলল, “বাবা, আমায় একটা রিমোট এরোপ্লেন কিনে দেবে?”
সুপ্রিয় বলল, “এখানে কিচ্ছু পাওয়া যায় না। বাড়ি ফিরে দেব”।
পাপান বলল, “ধুস, পচা জায়গায় নিয়ে এসেছো। এখানে কেন কিছু পাওয়া যায় না?”
সুপ্রিয় বলল, “জঙ্গল, পাহাড় আর নদী পাবি। আর কী চাই? খেলনা এরোপ্লেন দরকার নেই, বড় হয়ে তুই একটা বড় এরোপ্লেন চালাবি, ঠিক আছে?”
পাপান বলল, “আমার ট্রেন বেশি পছন্দ। আমি ট্রেন চালাব”।
সুপ্রিয় হেসে ফেলল, “তাহলে তোকে ট্রেন কিনে দেব কলকাতায় গিয়ে। চলবে?”
পাপান বলল, “দিও। এরোপ্লেনও চাই”।
সুপ্রিয় বলল, “দেখা যাবে। এখানে আমরা ঘুরে কলকাতায় ফিরি। ফিরে গিয়ে দেব’।
পাপান বলল, “আমরা কি সারাদিন ঘুমিয়ে থাকব বাবা?”
সুপ্রিয় বলল, “তুই পারবি না? তুই তো কুম্ভকর্ণ। নিশ্চয়ই পারবি”।
দরজায় নক হল। সুপ্রিয় দরজা খুলে দেখল নীলাদ্রি দাঁড়িয়ে আছে। পুরো ভিজে গেছে। তাকে দেখে বলল, “আপনারা ছাতা এনেছেন? আমার এক গেস্ট আসবে, ব্রিজের কাছ থেকে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। আমি ভিজলে ক্ষতি নেই, সে ভিজলে চিত্তির”।
সুপ্রিয় অবাক চোখে কয়েক সেকেন্ড নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে ব্যাগ থেকে একটা ছাতা বের করে নীলাদ্রিকে দিল। নীলাদ্রি বলল, “অনেক ধন্যবাদ। আপনার এই সাহায্য আমি জন্ম জন্মান্তরেও ভুলব না। বুলু কী করছে? এখনো ঘুমোচ্ছে? এই বুলু, আটটা বেজে গেছে। ওঠ রে”।
নীলাদ্রি হঠাৎই ডাকাডাকি শুরু করে দিল।
সংযুক্তা ধড়মড় করে উঠে বসল।
সুপ্রিয় বিরক্ত গলায় বলল, “আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন, যান”।
নীলাদ্রি বলল, “তাও ঠিক। আচ্ছা, আমি দিয়ে যাচ্ছি ছাতাটা কিছুক্ষণের মধ্যে”।
হন হন করে বেরিয়ে গেল নীলাদ্রি। সুপ্রিয় সংযুক্তার দিকে তাকিয়ে বলল, “লোকটা এরকম কেন? চিরকারলই এরকম? নাকি আজকাল বেশি করে পেগলে গেছে?”
পাপান বলল, “পেগলে গেছে মানে কী বাবা?”
সুপ্রিয় বলল, “পাগল হয়ে গেছে। এটা এক আংকেল। আবার বলল কোন গেস্টকে আনতে যাবে। ছাতাটা ফেরত দেবে তো? এমন টাইপের পাবলিক, হয়ত ভুলেই গেল ছাতা ফেরত দেওয়ার কথা”।
সংযুক্তাকে পাপান জড়িয়ে ধরে বলল, “মা আজ কিন্তু পড়ব না”।
সংযুক্তা বলল, “দাঁত মাজ। চোখ মুখ ধো। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছিস”।
বৃষ্টি বেড়ে চলেছে। সুপ্রিয় বলল, “লোকটার শিওর জ্বর হবে। এর মধ্যে ভিজতে ভিজতে চলে গেল। গেস্ট আসবে, তার ভেজা চলবে না”।
সংযুক্তা গেস্টের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল এক মহিলার সঙ্গে ছাতায় করে আসছে নীলাদ্রি। সুপ্রিয় বলল, “এ আবার কে?”
সংযুক্তা বলল, “বউদি মনে হয়”।
সুপ্রিয় বলল, “কাল যে বলল বউ পালিয়ে গেছে? কী কেস, কিছুই তো বুঝতে পারছি না”।
সংযুক্তা বাথরুমে ঢুকল। নীলুদার বউয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় নি আগে। এখানে হবে হয়ত।
নীলুদা আগে এল কেন?
কাল বলল বউ চলে গেছে, আজ দেখা গেল বউদি চলে এল। পাল্টালো না লোকটা।
সংযুক্তা শ্বাস ফেলল।
৮
কটেজে ঢুকে রণিতা বলল, “তুমি আর জায়গা পেলে না? এই বৃষ্টিতে এখানে?”
নীলাদ্রি রণিতার ব্যাগ ঘরের কোণে রেখে বলল, “তুমি কি ঝগড়া করবে? দেখো এখানে ঝগড়া করলে জজ সাহেব রাগ করতে পারেন কিন্তু। সিসিটিভি লাগানো আছে এ ঘরে”।
রণিতা বলল, “আমি কি ক্লাস সেভেনের বাচ্চা? সব সময় সব কিছু মজার হয় না, এটা বোঝো তুমি? তোমার এসব পাগলামিতে বাচ্চা মেয়েরা ইমপ্রেসড হতে পারে, আমি হই না”।
নীলাদ্রি বলল, “এই জন্যই তো তোমাকে এত ভালবাসি। তবু আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো, দেখো!”
রণিতা খাটে বসে বলল, “আমাকে সেন্টু দিও না। তোমাকে আমি অনেক সুযোগ দিয়েছিলাম। লিস্ট দেবো?”
নীলাদ্রি সভয়ে বলল, “একবারে না। সকালে কিন্তু লুচি। দেরী করে গেলে মিস হবে। খেয়ে এসে চেঞ্জ করবে?”
রণিতা বিছানার চাদর তুলে গন্ধ শুঁকল। বলল, “এরা চাদর পাল্টায় না?”
নীলাদ্রি বলল, “পাল্টায় তো। কেন পাল্টাবে না?”
রণিতা বলল, “কেমন একটা গন্ধ”।
নীলাদ্রি বলল, “খেয়ে এসে গন্ধ শুঁকো? চল, আমাকে স্নান করতে হবে। যা ভিজেছি, কিছুক্ষণ পরেই জ্বর আসবে। তুমি সেবা করবে, আহা, শান্তি”।
রণিতা বলল, “ভেজার কী দরকার ছিল?”
নীলাদ্রি বলল, “ছাতার কথা তো পরে মনে পড়ল। বুলুর বরের থেকে ছাতা নিলাম। তোমাকে বুলুর কথা বলেছিলাম তো?”
রণিতা বলল, “মনে নেই। এটা অন্যের ছাতা? দিয়ে দিও”।
নীলাদ্রি বলল, “দেব না কেন? নিশ্চয়ই দেব। আমি অপরের ছাতা, বই, বউ, কিচ্ছু নি না। লোকটা ভালই ছিলাম, কী বল?”
রণিতা কঠিন গলায় বলল, “ভাল কি মন্দ, সেটা তোমার মহিলা ফ্যানেদের জিজ্ঞেস কর। আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন? ঠিক আছে, ফালতু কথা বলতে ভাল লাগছে না। চল কোথায় লুচি পাওয়া যাবে, খেয়ে আসি”।
নীলাদ্রি বলল, “তুমি বেরোও। আমি রুমটা তালা দিয়ে বেরোচ্ছি”।
রণিতা বলল, “চাবিটা আমাকে দিও। কোদাইকানালে চাবি হারিয়ে যা ভুগিয়েছিলে তুমি!”
নীলাদ্রি বলল, “না না, মনে থাকবে। চল”।
বৃষ্টির মধ্যে এক ছাতার তলায় ডাইনিং রুমে পৌঁছে দেখা গেল সুপ্রিয়, সংযুক্তা আর পাপান আগে থেকে বসে আছে। সুপ্রিয়কে নীলাদ্রি বলল, “আপনার ছাতা একদম যেমনটি ছিল, তেমন অবস্থাতেই এই হলের বাইরে রেখেছি। যাওয়ার সময় নিয়ে নেবেন। আর বুলু, এই দেখ তোর বউদি”।
রণিতা সংযুক্তাকে দেখে হাসল। বলল, “তোমাদের গল্প অনেক শুনতাম”।
নীলাদ্রি বলল, “দেখ বুলু, তোদের জানিয়ে রাখি। আমার আর রণিতার ডিভোর্স কেস চলছে। আমাদের উপর নির্দেশ আছে, আমরা সেপারেশনের আগে যে একবার শেষ চেষ্টা করি। আপাতত আমরা সেই চেষ্টা করছি”।
সুপ্রিয় ফিসফিস করে বলল, “এসব বলার কোন দরকার ছিল না”।
ছেলে মেয়েগুলো হই হই করে ডাইনিং হলে ঢুকল। নীলাদ্রিকে দেখে হিয়া বলল, “আজ সারাদিন গান ছাড়া আর কিছু করা যাবে না”।
নীলাদ্রি বলল, “অবশ্যই। তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি, ওর নাম রণিতা। রণিতা আমার বউ। আমাদের বিয়ে হয়েছিল, আপাতত আমরা সেপারেশনে আছি। কোর্ট থেকে বলেছে লাস্ট ট্রাই দিতে”।
রণিতা বিরক্ত মুখে নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে বলল, “ভয়েস রেকর্ডারে রেকর্ড করে সবাইকে শুনিয়ে যাও। আনন্দে থাকবে”।
নীলাদ্রি লজ্জা পেল না। সত্যিই মোবাইল বের করে ভয়েস রেকর্ডিং করে রাখল কথাগুলো।
খাবার দিয়ে গেল। গরম লুচি আর তরকারি। নীলাদ্রি বলল, “আহা, আমার দুর্বলতা। খেতে শুরু কর সবাই”।
ছেলে মেয়েগুলো খাওয়া শুরু করে দিল।
সংযুক্তা পাপানকে খাইয়ে দিচ্ছিল। নীলাদ্রি বলল, “ঈস, আমি তোকে দেখিই নি ভাল করে। কী নাম তোর?”
পাপান বলল, “অরিত্র”।
নীলাদ্রি বলল, “বাহ খুব ভাল নাম”।
হিয়া বলল, “আচ্ছা, সেই নিশিযাপন সিনেমার মতন এই রিসোর্টে ঢোকার ব্রিজটা যদি ভেঙে যায়, আমরা কী করব?”
সুপ্রিয় বলল, “আহ। এখানে এইসব অলুক্ষুণে কথা না বললেই নয়”।
নীলাদ্রি বলল, “অলুক্ষুণে? অলুক্ষুণে কেন হবে? এটা তো ভাল ব্যাপার। মানুষের সব কিছু বেরিয়ে আসে। মুখোশ খুলে সামনে চলে আসে। বাই দ্য ওয়ে, আপনি ভূতে ভয় পান বুঝি? ভূত সাফারি করবেন নাকি?”
সুপ্রিয় কটমট করে নীলাদ্রির দিকে তাকাল।
রণিতা বলল, “তুমি ওঁকে চেনো? এভাবে কথা বলছো কেন? এটা কি ফানি হবার চেষ্টা করছো?”
নীলাদ্রি বলল, “আরে! ও আমাদের জামাই, জামাই মানুষের লেগ পুলিং করব না?”
রণিতা বলল, “না করবে না। একজন অপরিচিত মানুষের সঙ্গে এভাবে কথা বলবে না”।
রণিতা সুপ্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ওর পক্ষ থেকে সরি বলছি। ও এরকমই”।
সুপ্রিয় থমথমে গলায় বলল, “ইটস ওকে। ওর কয়েকটা স্ক্রু ঢিলা আছে। আমি বুঝতে পারি”।
নীলাদ্রি সহাস্যে বলল, “কয়েকটা কেন? সব স্ক্রু ঢিলা। কীরে বুলু, আমাদের প্ল্যাঞ্চেট করার গল্পটা করিস নি?”
সংযুক্তা নীলাদ্রির দিকে শূন্য চোখে তাকাল।
নীলাদ্রি বলল, “কী হয়েছে রে তোর? কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছিস”।
সংযুক্তা সামলে নিয়ে বলল, “কিছু না। ঠিক আছি”।
পাপান বলল, “প্ল্যাঞ্চেট মানে কী আংকেল?”
নীলাদ্রি বলল, “প্রেতাত্মা নামানো। মানে ভূত নামানো। কলকাতা ফাতায় ওসব সম্ভব না। এখানে কিন্তু দারুণ হবে। কী হে বাচ্চারা, করবে নাকি? আমি ওইজা বোর্ড নিয়েই ঘুরি কিন্তু।”
হিয়ারা সাগ্রহে রাজি হল।
রণিতা রাগী চোখে নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে রইল।
৯
বৃষ্টি পুরো থামে নি, তবে সামান্য ধরেছে। ঘরে বসে ব্যাগ থেকে জামা কাপড় বের করে আলমারিতে সাজাচ্ছিল রণিতা। নীলাদ্রি বলল, “দুপুরে চিকেন খাবে না মাটন?”
রণিতা বলল, “তোমার কোন পার্থক্য হয় না বল? আমি থাকি বা না থাকি, কিচ্ছু হয় না, তাই না?”
নীলাদ্রি বলল, “তুমি কোথায় যাবে আমাকে ছেড়ে? আমি জানি তুমি কোথাও যাবে না”।
রণিতা বলল, “তুমি খুশিই হও আমি চলে গেলে। আমি বুঝতে পারি। পার্টি দেবে। মদ খেয়ে কোথাও পড়ে থাকবে”।
নীলাদ্রি বলল, “করে দেখেছি। খুব একটা লাভ হয় না। বমি হয়ে যায়। পাবলিক চলে গেলে ঘর দোর আমাকেই সামলাতে হয়’।
রণিতা বলল, “পার্টি করেও দেখা হয়ে গেছে?”
নীলাদ্রি বলল, “হ্যাঁ। সব কিছু দেখে নেওয়া দরকার। অনেক হিসেব কষে আমি দেখেছি, তুমি ছাড়া আমি অচল’।
রণিতা বলল, “বাহ। কী সুন্দর ক্যালকুলেটিভ কথা বল তুমি। আমার মত একটা কাজের লোক থাকলে ভাল থাকো, তাই বলতে চাইছো তো? যেখানে সেখানে হেগে রেখে দেবে, আর আমি সেগুলো পরিষ্কার করব। এরকম পেয়ে গেলে জীবনে আর কী চাই? আর শোন, তুমি ওই লোকটার সঙ্গে ওভাবে খোঁচা মেরে কথা বলছিলে কেন? ও যদি তোমাকে বাজে ভাবে অপমান করে বসে, নিতে পারবে তো?”
নীলাদ্রি বলল, “প্রথমত তুমি আমার চাকর বাকর কিছু নও। তুমি আমার বউ। দ্বিতীয়ত, আমি বলছি তো আমি চেষ্টা করব সব কিছু পরিষ্কার রাখার। আমাকে চান্স দাও। তৃতীয়ত, সমরেশের বোনের বরের পেছনে লাগতে পারবো না? তুমি জানো আমরা কী মজা করতাম? গোটা কৈশোরটা একসঙ্গে কাটিয়েছিলাম। চতুর্থত…” নীলাদ্রি হাত নেড়ে বলল, “ভুলে গেছি। একটা সিগারেট খেতে পারি?”
রণিতা বলল, “যা খুশি কর। তবে ঘরের বাইরে গিয়ে কর। আর ওদের সঙ্গে তুমি তোমার কৈশোর কাটাও আর যাই কাটাও, আমার মনে হয় বুলুর বর ব্যাপারটা ভাল ভাবে নিচ্ছেন না। চেষ্টা কর ওর পেছনে না লাগতে”।
নীলাদ্রি বলল, “ঠিক আছে। আমি তো তোমার এগুলোই পছন্দ করি। তুমি বলে দেবে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল। এবার তুমি না থাকলে আমার কী হবে বল?”
রণিতা বলল, “তুমি যতটা ছোট বা অবুঝ সাজো, ততটাও নও তুমি, এটা আমার থেকে ভাল কেউ জানে না। ডিভোর্স হয়ে গেলে ঠিক বিয়ে করে নেবে তুমি। কম বুদ্ধিওয়ালা মুরগী বিয়ে কোর। বিনে পয়সার ঠিকে ঝি আর রাঁধুনি পেলেই তোমার চলে যায়। এর বেশি রিকোয়ারমেন্ট নেই তোমার”।
নীলাদ্রি সিগারেট বের করে ঘরের বাইরে চলে গেল। ঘরে থাকলেই এখন রণিতার তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ তাকে বিঁধতে শুরু করে দেবে। এগুলো যত পারা যায়, অ্যাভয়েড করার চেষ্টা করা উচিত।
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা নিয়ে পল্লবরা বেরোচ্ছে। নীলাদ্রির যেতে ইচ্ছে হল। পরক্ষণে মনে পড়ল রণিতা রাগ করবে। এখন রণিতাকে না রাগানোই ভাল।
সে সিগারেট ধরাল।
মা অনেক করে বুঝিয়েছে, ডিভোর্স হওয়া ভাল জিনিস না। এতে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়। ঘরের কল্যাণার্থে তাদের একসঙ্গে থাকা উচিত। রণিতা ঘরের লক্ষ্মী। তাকে যেতে দেওয়া যাবে না। নীলাদ্রি বলেছে রণিতা তাহলে তাদের বাড়িতে গিয়ে থাকুক। মা বলেছে তা কী করে হয়? বরের সঙ্গে বউ থাকবে না তো কার সঙ্গে থাকবে?
লিখবে ভেবেছিল এখানে এসে। তাও কিছু হল না। লেখাটা দরকারি। রণিতার একটা ভাল ব্যাপার আছে। লেখার সময়ে ডিস্টার্ব করে না। তবে রণিতা তার লেখা পড়ে না। রণিতা কোন কিছুই পড়ে না। প্রথম প্রথম রণিতা তার লেখা শুনত। ধীরে ধীরে সেটাও কমে এসেছে। শেষের দিকে তারা ঝগড়া ছাড়া আর কিছু করত না। ঝগড়া বলতে রণিতা বলে যাবে, সে শুনে যাবে। তার পরে একটা সময়ে সেও কিছু বলবে। রণিতা তাতে আরো রেগে যাবে। চিৎকার চ্যাঁচামেচি হবে।
এই সময়গুলো নীলাদ্রি বেরিয়ে গিয়ে কোন জায়গা থেকে ঘুরে আসত। তাতেও রণিতা রাগ করত। এসকেপিস্ট বলত।
এখন তারা আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করার চেষ্টা করছে।
মার দিকে তাকিয়ে নীলাদ্রি চেষ্টা করবে। কতদিন পারবে, সেটা নিয়ে তার নিজেরও সন্দেহ আছে। রণিতা কেমন খিটখিটে হয়ে গেছে। সব কিছুতেই খিট খিট করতে থাকে।
এখন কি শুধু সেই একা চেষ্টা করে যাবে? রণিতা আগের মতই খিটখিট করবে?
নীলাদ্রি একটা চেয়ার টেনে বাইরে বের করে বসে চুপচাপ সিগারেট টেনে যেতে লাগল।
১০
পাপান টিভিতে ডিডি তেলেগু বা কিছু একটা দেখছে। সুপ্রিয় সংযুক্তাকে বলল, “তোমার ওই দাদার বন্ধুটাকে যে কোন সময় অপমান করে দিতে পারি আমি। অদ্ভুত টাইপের মাল একটা”।
সংযুক্তা বলল, “ইচ্ছে হলে করবে”।
সুপ্রিয় বলল, “তোমার খারাপ লাগবে না?”
সংযুক্তা বলল, “খারাপ লাগার কিছু নেই”।
সুপ্রিয় বলল, “তোমার দাদা জানলে তো রাগ করতে পারে। এই জন্যই ঘাঁটালাম না। ভাল হয়েছে, একা একা এসে ব্যাচেলর সাজা হচ্ছিল। বউ এসে টাইট দিক”।
সংযুক্তা বলল, “তুমি নীলুদার উপর কি খুব রেগে আছো?”
সুপ্রিয় বলল, “রাগ ঠিক না। কেমন যেন বিরক্তিকর মেটিরিয়াল একটা”।
সংযুক্তা বলল, “ও”।
সুপ্রিয় বলল, “তোমার কি এখন একটু ভাল লাগছে?”
সংযুক্তা বলল, “খারাপ লাগবে কেন? জায়গাটা সুন্দর”।
পাপান বলল, “বাবা ওই আংকেল যেটা বলল, সেটা করলে সত্যি সত্যি ভূত আসবে?”
সুপ্রিয় বলল, “জানি না কী আসবে। আদৌ ভূত বলে কিছু হয় না”।
পাপান নিরাশ হয়ে বলল, “সত্যি?”
সুপ্রিয় বলল, “সত্যি। মানুষের কাজ না থাকলে মানুষ এসব করে। আর কিছু বুজরুক আছে, এগুলোকে নিয়ে মাতামাতি করে। এসব বিশ্বাস করবি না”।
পাপান বলল, “বুজরুক মানে?”
সুপ্রিয় বলল, “যারা প্রচার করে এগুলো খুব ভাল জিনিস। যে জিনিস নেইই, সে জিনিসে অনর্থক আতঙ্ক তৈরী করা হয়’।
সংযুক্তা বলল, “আমরা যখন প্ল্যাঞ্চেট করেছিলাম, কিছু একটা ছিল ঘরে জানো তো, আমার দাদাকে জিজ্ঞেস কোর। তারপর থেকে ওসব আর করি নি কোন দিন”।
সুপ্রিয় বলল, “রাবিশ। এসব হয় নাকি?”
সংযুক্তা চুপ করে গেল।
সুপ্রিয় বুঝল সে ব্যাপারটাকে থামিয়ে দিতে গিয়ে বেশি বলে ফেলেছে। সে বলল, “কী ছিল ঘরের মধ্যে?”
সংযুক্তা বলল, “আমরা ছাড়াও কোন ভারি চেহারার মানুষ মনে হয়েছিল ঘরের মধ্যে এসেছে। একটা ঘরে চোখ বন্ধ করে থাকলে সে ঘরে কেউ এলে আমরা বুঝতে পারি না? আমাদেরও মনে হয়েছিল ঘরে কেউ এসেছে”।
পাপান চোখ বড় বড় করে বলল, “কাকে ডেকেছিলে?”
সংযুক্তা বলল, “আমাদের পাশের বাড়ির এক কাকু মারা গেছিলেন একদিন আগে। তাকেই ডেকেছিলাম”।
সুপ্রিয় বলল, “ঠিক আছে। পাপানের সামনে এসব বলার দরকার নেই। ও ভয় পাবে। তারপর রাতে ঘুমোতে পারবে না”।
সংযুক্তা আর কিছু বলল না।
সুপ্রিয় বলল, “আমি ছাতাটা নিয়ে হেঁটে আসি একটু। তুমি যাবে?”
সংযুক্তা বলল, “না না, যাও, গিয়ে ঘুরে এসো”।
সুপ্রিয় ছাতা নিয়ে বেরোল। বৃষ্টির কোন বিরাম নেই। আকাশেরও মুখ ভার।
রিসোর্টের গেট ঠেলে বাউন্ডারির কাঁটাতারের বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে লাগল। এখানে ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতেও কেউ আসে নি। নির্জন জায়গাটায় নদীর বয়ে চলার শব্দ আর কিছু কিছু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। অদ্ভুত এক স্তব্ধতা ছড়িয়ে রয়েছে চারদিকে। সুপ্রিয় একটা ভেজা বেঞ্চিতে চুপ করে বসে রইল।
মোবাইলের টাওয়ার নেই, অফিসের ফোন নেই। প্রাণ যেন ঠান্ডা হয়ে যায়।
ছেলে মেয়েগুলো হৈ হৈ করে নদীর পাথরে নেমে ছবি তুলছে। সুপ্রিয় গলা ছাড়ল, “নদীর মাঝখান থেকে সরে যাও। হড়কা বান খুব বাজে জিনিস। হঠাৎ করে এসে পড়লে মরা ছাড়া উপায় থাকবে না”।
ওরা তার কথা শুনল। নদীর মাঝখান থেকে সরে এক কোণে চলে এল।
তবু সেলফি আর ছবি তোলা বন্ধ হল না।
সুপ্রিয়কে কোন দিন বাড়ি থেকে কোথাও বেড়াতে যেতে দেওয়া হত না। এদের দেখে হিংসা হচ্ছিল তার। এই বয়সটাই তো পাহাড়ি নদীর মত। শুধু ভেসে বেড়ানো। বাবা মা যেতে দিত না কোথাও।
পাপান বড় হলে সে কী করবে?
তার বাবা মায়ের মতই সব খানে যাওয়ার ব্যাপারে রেস্ট্রিকশন দিয়ে রাখবে, নাকি যেতে দেবে? সুপ্রিয় দ্বিধায় পড়ল। একমাত্র ছেলেকে এভাবে একা একা ছাড়া বিপজ্জনক হতে পারে। আবার ছেলে যদি এই বয়সে এসে একটুও স্বাধীনতার স্বাদ না পায়, তাহলেও তার মধ্যে বিদ্রোহ তৈরী হতে পারে।
কী করবে সে পাপান বড় হলে? সুপ্রিয় বসে বসে সেটাই ভাবতে লাগল।
১১
“তুমি আমাকে একটা কথা বল, তুমি কি সত্যিই আমাদের বিয়েটা বাঁচাতে চাও?”
রণিতা জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে তাকাল।
নীলাদ্রি বলল, “কেন চাইবো না? আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি আলাদা থাকবে ভাবলেই আমার অস্বস্তি হয়”।
রণিতা খাটের উপর বসে ছিল। নীলাদ্রিকে কয়েক সেকেন্ড দেখে বলল, “তোমার বেশ কয়েকটা দাড়ি পেকে গেছে”।
নীলাদ্রি বলল, “হতে পারে। দাড়ি পাকা মানে বুদ্ধিজীবি হওয়া। তবে তুমি যে আমার এই বুদ্ধিজীবিসুলভ লুকস পছন্দ কর না, এটা বেশ ভাল একটা ব্যাপার। আমিও নিজের আঁতেল হয়ে যাওয়াটা মানতে পারি না”।
রণিতা বলল, “কী লিখছো এখন?”
নীলাদ্রি হাসল, “অসমাপ্ত লেখা সব। কোনটা নিয়েই ঠিক ঠাক লিখতে পারছি না”।
রণিতা বলল, “তোমরা সত্যি সত্যিই প্ল্যাঞ্চেট করেছিলে?”
নীলাদ্রি বলল, “করেছিলাম তো। সমরেশ মিডিয়াম হয়েছিল। যদিও কিছুই মনে হয় নি। ভূত টুত বলে সত্যি কিছু নেই বুঝলে। সবটাই অনুভূতি”।
রণিতা বলল, “ভালবাসার মতই?”
নীলাদ্রি বলল, “দেখো, ভালবাসা মানে যদি সারাক্ষণ পার্টনারের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে যাওয়াকে মিন করতে চাও, তাহলে আমি ভালোবাসা দেখাতে পারব না। তুমি কি বুঝতে পারো না আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি?”
রণিতা বলল, “সব সময় নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে হবে তা তো বলি নি। কিন্তু কিছু বেসিক জিনিস তো মেনে চলাই যায়। শুধু ভালোবাসা ধুয়ে কি জল খাব? তোমার লেখার জন্য সব রকম স্যাক্রিফাইস আমি করতে পারি, কিন্তু মাঝে মাঝে তুমি একবারে সহ্যের বাইরে চলে যাও। আমিও তো মানুষ, সেটা ভুলে যাও কী করে?”
নীলাদ্রি বলল, “তুমি কখনো আমাকে সরাসরি এভাবে কথা বল নি। রেগে মেগে আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছো। এটাই কি স্থান মাহাত্ম্য?”
রণিতা বলল, “আমিও চেষ্টা করছি যাতে সব কিছু একবারে শেষ না হয়ে যায়। বিয়েটা বাঁচিয়ে রাখাই কঠিন কাজ, তাও তোমার মত একজন মানুষের সঙ্গে থেকে। অন্য কোন মেয়ে হলে এতদিন থাকত না বোধ হয়”।
নীলাদ্রি বলল, “সে তুমি ঠিকই বলেছো। আচ্ছা, তোমার উকিল লোকটা ভারি কঠিন কঠিন শব্দ ইউজ করে। মালটাকে জিজ্ঞেস কোর তো ও কোন জায়গা থেকে ডিকশনারি কেনে”।
রণিতা হেসে ফেলল, “উনি আমার জন্য সম্বন্ধও আনবেন বলেছেন”।
নীলাদ্রি বলল, “সম্বন্ধ দেখাও শুরু করে দিলে রনি?”
রণিতা বলল, “আমি দেখব বলি নি। উনি আনবেন বলেছেন”।
নীলাদ্রি বলল, “খুন করে দিতে পারি আমি সেসব লোককে যারা তোমার সম্বন্ধ আনবে”।
রণিতা বলল, “তাই? আর কলকাতায় থাকতে যখন খিটখিটে মেজাজে আমার সঙ্গে সমান তালে ঝগড়া করে যেতে, তখন এই ভালবাসাগুলো কোথায় থাকত শুনি?”
নীলাদ্রি বলল, “ঝগড়া তো ভালবাসারই একটা পার্ট। ঝগড়াহীন সম্পর্ক আসলে প্রেমহীন ভালবাসা। তুমুল ঝগড়ার পরেই তো তুমুল প্রেম হয়। তুমি চিৎকার করতে, আমিও চিৎকার করতাম, ব্যাপারটার মধ্যে একটা থ্রিল ছিল। দুপুরে খাসীর মাংস খাবে? এদের রান্না কিন্তু ঘ্যাম”।
রণিতা বলল, “ঠিক কায়দা করে কথাটা ঘুরিয়ে নিলে বল?”
নীলাদ্রি বলল, “না না। ঝগড়া নিয়ে ডিসকাশন তো চলতেই থাকবে, তা বলে খাসীটাকে আলাদা করে রাখলে চলবে? খাসী খাবে কি না আগে থেকে বল, ওদের বললে ওরা ব্যবস্থা করবে”।
রণিতা বলল, “ঠিক আছে, বল। আর দয়া করে ভিজতে ভিজতে যেও না। আমার ব্যাগে ছাতা আছে, সেটা নিয়ে যাও”।
নীলাদ্রি বলল, “তুমি বুলুর সঙ্গে কথা বলতে পারো যদি বোর হও”।
রণিতা বলল, “কেন বোর হব? তুমি কি আমার সঙ্গে কথা বলে বোর হচ্ছো?”
নীলাদ্রি বলল, “না না সেটা বলি নি। এখানে তো কিছুই নেই, তাই তোমাকে বললাম”।
রণিতা বলল, “ওরা ঘুরতে এসেছে। আমি গেলে ওদের প্রাইভেসীটা নষ্ট হবে”।
নীলাদ্রি বলল, “তাও ঠিক। ও বলতে চাইলে বোল তবে”।
রণিতা বলল, “বলব। তুমি ছাতাটা নিয়ে যাও আমার ব্যাগ থেকে”।
নীলাদ্রি বাধ্য ছেলের মত ঘাড় নাড়ল, “আচ্ছা”।
১২
বৃষ্টির জন্য রাস্তা স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেছে। তারা হেঁটে হেঁটে অনেকটা রাস্তা চলে এসেছে।
পল্লব পকেট থেকে ছোট বোতল বের করে দু ঢোক খেয়ে বলল, “তোরা কেউ খাবি?”
রুমানা বলল, “আমাকে দে”।
পল্লব রুমানাকে বোতলটা দিল।
রুদ্র হাসল, “মাইরি আমাদের যে কেউ দেখলে ভাববে আমরা দুটো জুড়ি। রিসোর্টের সবাই নিশ্চয়ই তাই ভাবছে”।
হিয়া বলল, “কে কী ভাবল তাতে কিছু যায় আসে না। তোর যায় আসে বুঝি?”
রুদ্র বলল, “আমার তো ভালই লাগবে। তোরা দুজন তো কেউই মন্দ দেখতে নোস”।
কথাটা বলে রুদ্র হো হো করে হেসে উঠল।
রুমানা বলল, “হাসার কিছু নেই ভাই। আমার বাড়ির লোক হিন্দু ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে শুনলে গোটা গ্রাম নিয়ে গিয়ে কেটে দিয়ে আসবে। ডিডিএলজে টাইপ হবে না ব্যাপারটা, যা রুমানা, জি লে আপনি জিন্দেগী”।
পল্লব সিগারেট ধরিয়ে বলল, “এই যে রুমানা আমাদের সঙ্গে আসতে পেরেছে, এটাই পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। ভাবা যায় না ভাই, কেমনে পসিবল”।
রুদ্র বলল, “এই তুই বাংলাদেশের নাটকগুলো দেখা বন্ধ করবি? ঘটি বাড়ির ছেলে বাঙাল ভাষায় কথা বলছিস”।
পল্লব বলল, “জোশ লাগে”।
রুমানা বলল, “আমি এসেছি সেটা বড় কথা না বন্ধুগণ, আমি বাড়ি গিয়ে কী জবাব দেব সেটা বড় কথা। টাওয়ার পাওয়া যাচ্ছে না, ফোন করতে পারছি না, তাও কাল মেসেজ করেছি, এইটুকু যা স্বস্তির”।
হিয়া রুমানার হাত ধরল, “ভাবিস না তো। কিসসু হবে না। আমি ম্যানেজ দিয়ে দেব”।
রুমানা বলল, “ওই ভরসাতেই আছি”।
রুদ্র বলল, “তাছাড়া বেড়াতে এসে এত কিছু নিয়ে ভাববি না। এখানে তো তোর বাড়ির লোক চলে আসবে না। তাই স্টে কুল, বিন্দাস ঘোর”।
রুমানা পল্লবের থেকে বোতলটা নিয়ে আরেকটু খেয়ে বলল, “এরপর আমার বিয়ে হবে। এ ভাই, আমাকে যদি বোরখা পরে ঘুরে বেড়াতে বলে শ্বশুর বাড়ি থেকে”?
পল্লব বলল, “বোরখার তলায় বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর বোতল রেখে খাবি। চাপ কী?”
রুমানা বলল, “থাম। ইয়ার্কি মারিস না। তোরা প্রিভিলেজড ক্লাস, তোরা এসব বলে মজা পাস”।
রুদ্র শ্বাস ছেড়ে বলল, “তা বটে। প্রিভিলেজড ক্লাসই বটে। ভাল বলেছিস ভাই। টাকা না থাকলে প্রিভিলেজড হয় কেমনে?”
পল্লব বলল, “এবার বাঙাল ইউজ করল কে?”
রুদ্র পল্লবের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে টানতে টানতে বলল, “আমরা ইয়ে জওয়ানি হে দিওয়ানি দেখে বেড়াতে আসা পাবলিক। ওরা মানালি ট্রেক করেছিল। আর এখানে দেখ, ভাঙা রাস্তা, চা বাগান, সারাদিন বৃষ্টি, ইমতিয়াজ আলি হলে এখানে কী সিনেমা বানাতো?”
হিয়া হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়িয়ে রাস্তার পাশের একটা বুনো ফুলের ছবি তুলতে শুরু করল। রুদ্র বলল, “আমার শুধু খিদে পাচ্ছে এখানে এসে”।
পল্লব বলল, “খিদে পেলে খাবি। কী খাবি ভাই?”
রুদ্র বলল, “এক প্যাকেট হাওয়া কিনে দিবি যার ভিতরে কিছু চিপস থাকবে?”
পল্লব বলল, “এখানে কোন দোকান নেই। আরো দু কিলোমিটার হাঁটতে হবে। হাঁটতে পারলে চল। লাঞ্চের বহুত দেরী আছে। এই লুচি খেলাম কিছুক্ষণ আগে, এই হাওয়া হয়ে গেছে”।
হিয়া মোবাইলে তোলা ছবিগুলো রুমানাকে দেখাচ্ছিল। দুজনে পাউট করে সেলফি তুলল।
পল্লব বলল, “এই ভাই আমিও পাউট করব। তোল তোল”।
ওদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল পল্লব। ছবি দেখে সবাই হাসতে শুরু করল। রুদ্র বলল, “মাকে নিয়ে একবার এখানে আসব। মার খুব ভাল লাগবে জায়গাটা”।
পল্লব বলল, “আমি বউকে নিয়ে আসব। আচ্ছা আমি চাকরি না পেলে তো আমার বিয়ে হবে না, বল?”
হিয়া বলল, “তুই টোটো চালাবি। আমি আমার ছেলেকে তোর টোটোতে স্কুলে পাঠাবো। আমার ছেলে তোকে টোটো কাকু বলে ডাকবে”।
পল্লব বলল, “হ্যাঁ, তুই একটা সরকারি চাকরিওয়ালা কাকু বিয়ে করবি। টাক পড়ে গেছে। ভুঁড়ি। সেক্স করার সময় দানবের মত হাঁফাবে”।
রুমানা পল্লবের পায়ে লাথি মেরে বলল, “এই শালা, আমার বাবাও সরকারি চাকরি করে। এসব বলবি না”।
পল্লব জিভ কাটল।
হিয়া বলল, “এই পল্লবটার মাথায় সারাক্ষণ এসব ঘোরে। একটু অন্য কিছু ভাব রে বাপ”।
রুদ্র বলল, “আজ প্ল্যাঞ্চেট করবি? ওই লেখক দাদাকে বলে? জমে যাবে কিন্তু বৃষ্টির রাতে”।
হিয়া বলল, “কাকে ডাকবি? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে?”
রুদ্র বলল, “আমাদের অঞ্জন স্যারকে ডাকলে কেমন হয়? হুট করে সুইসাইড করে বসলেন”।
রুমানা বলল, “কোন দরকার নেই বাপ। তোরা কর। আমার এসব ভাল লাগে না। বেড়াতে এসে কোন উটকো ঝামেলায় পড়তে চাই না”।
হিয়া বলল, “ঠিক আছে, তুই করবি না। আমি, রুদ্র আর পল্লব করব। ওই ভদ্রলোকের কাছ থেকে ডিটেলসটা নিয়ে নেব। ইট উইল বি ফান”।
পল্লব বলল, “ভাই রাতে ভাবছিলাম একটা খাম্বা শেষ করব, ওই দাদাকে জিজ্ঞেস করে নিস মদ গিলে প্ল্যাঞ্চেট করা যাবে নাকি”।
সবাই হেসে উঠল।
রুদ্র বলল, “লোকটা ভাল ছিল রে। একটু খুঁতখুতে ছিল। কিন্তু বড্ড ভাল পড়াত। হঠাৎ সুইসাইড করল কেন জানলে মন্দ হত না”।
রুমানা বলল, “তোরা এসব বিশ্বাস করিস?”
রুদ্র বলল, “তুই না হয় বিশ্বাস করিস না। তাহলে ভয় পাস কেন?”
রুমানা বলল, “সেটা জানি না। কিন্তু কোন আত্মা নেমে এসে তার সব গোপন কথা বলে দেবে, এটা সত্যি সত্যি হলে পৃথিবীর অনেক সমস্যার সমাধানই হয়ে যেত না? আই থিংক দিস ইজ পিওর ঢপবাজি”।
রুদ্র বলল, “হতে পারে। কিন্তু ঢপবাজি বলার আগে সেটা করে দেখে তারপর ঢপবাজি বলা ভাল। আগে থেকেই কোন সিদ্ধান্তে আসব কেন? ট্রাই, টেস্ট এন্ড দেন ডিসাইড”।
রুমানা মাথা নাড়ল, “না না, কোন দরকার নেই। তোরা কর”।
রুদ্র বলল, “তথাস্তু”।
১৩
“স্যার, চা বাগান যাবেন? ঘুরবেন না? সব ঘুরিয়ে আনব”।
লোকটা কখন এসে দাঁড়িয়েছে সুপ্রিয় বুঝতে পারে নি। সে চুপ করে নদীর বয়ে চলা দেখছিল। সমুদ্রর ঢেউ ফিরে আসে। নদীর জল কারো জন্য অপেক্ষা করে না। বয়ে চলে যায়। তবু দেখতে ভাল লাগে।
সুপ্রিয় বলল, “এই বৃষ্টির মধ্যে কী ঘুরব বলুন তো?”
লোকটা বলল, “ঘরে বসে থাকতেও কি ভাল লাগবে স্যার?”
সুপ্রিয় একটু ভেবে বলল, “ঠিক আছে। আপনি গাড়ি নিয়ে এসেছেন?”
লোকটা বলল, “না স্যার। আপনি বললে নিয়ে আসব। আমি কাছেই থাকি”।
সুপ্রিয় অবাক হল, “কাছে থাকেন মানে? এখানে তো কোন লোকালয় দেখলাম না”!
লোকটা বলল, “পাহাড়ে ওঠার আগে গ্রাম পড়েছিল না? আমি ওই গ্রামে থাকি”।
সুপ্রিয় বলল, “ও বাবা। এতটা রাস্তা এলেন কী করে?”
লোকটা বলল, “সাইকেলে”।
সুপ্রিয় বলল, “কষ্ট হল না?”
লোকটা হাসল, “আমাদের অভ্যাস আছে”।
সুপ্রিয় উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে আসাই ভাল। সারাদিন কটেজে থাকলে বিরক্ত হয়ে যাবে। পাপানের দৌরাত্ম্যও বাড়বে।
সে লোকটাকে বলল, “আপনি গাড়ি নিয়ে এসে আমার কটেজে চলে আসবেন। আমি পাঁচ নম্বরে আছি। ডাকবেন, আমরা চলে আসব”।
লোকটা খুশি হয়ে চলে গেল। সুপ্রিয় কটেজের দিকে রওনা দিল। রিসোর্টে ক্যাম্পিং সিস্টেমও আছে, তবে বৃষ্টিতে ক্যাম্পে ক’জন থাকে সেটা সে জানে না। হাঁটতে হাঁটতে কটেজের সামনে পৌঁছে দেখল পাশের কটেজে নীলাদ্রি মন দিয়ে সিগারেট টানছে। কলকাতায় থাকলে নীলাদ্রির মত ইরিটেটিং ক্যারেকটারের সঙ্গে সে দ্বিতীয়বার কথাও বলত না, এখানে নদীর তীরে বসে থাকার জন্যই হয়ত মন সব কিছু তাড়াতাড়ি ভুলে যায়। সে বলল, “চা বাগান দেখতে যাবেন? গাড়ি আসবে একটা”।
নীলাদ্রি ঘরের ভিতর হাঁক পাড়ল, “যাবে নাকি?”
রণিতা বলল, “চল। ঘুরে আসি। এখানে সারাদিন বসে থেকেই বা কী করব?”
নীলাদ্রি বলল, “যাব। চলুন জামাই মহাশয়”।
সুপ্রিয় বলল, “এরকম ডাকলে আমি যাব না কিন্তু”।
নীলাদ্রি বলল, “ঠিক হ্যায় বস”।
সুপ্রিয় হাসিমুখে ঘরের ভিতর ঢুকে দেখল সংযুক্তা বড় লাগেজ ব্যাগটা খুলে চুপ করে বসে আছে। পাপান টিভি দেখছে। সুপ্রিয় বলল, “চল একটু ঘুরে আসা যাক। তৈরী হয়ে নাও”।
সংযুক্তা বলল, “চল। কিন্তু বৃষ্টি হলে?”
সুপ্রিয় বলল, “আমার মনে পড়ল আমি বড় ছাতাটা এনেছি। ওটা তুমি আর পাপান নাও। তাতে হয়ে যাবে আশা করি”।
সংযুক্তা বলল, “ঠিক আছে”।
কোন কারণ ছাড়াই সুপ্রিয়র মন বেশ হালকা লাগছিল। বেড়াতে আসার কারণেই হবে। শহর মাঝে মাঝে বুকের উপরে চেপে বসে। ছোট ছোট ব্যাপারগুলিও বড় হয়ে দাঁড়ায়। বাইরে এলে সব কিছু তুচ্ছ মনে হয়।
পাপান বলল, “বাবা, ডাইনোসররা এখন আছে?”
সুপ্রিয় হেসে বলল, “না বাবা। ডাইনোসররা এখন নেই আর”।
পাপান বলল, “যদি থাকত, তাহলে কী হত?”
সুপ্রিয় বলল, “তাহলে আমরা থাকতাম না”।
পাপানের এখন প্রশ্ন করার বয়স। সারাক্ষণ প্রশ্ন করে চলেছে। সব সময় ধৈর্য থাকে না। তখন বিরক্ত লাগে। সে কোথায় যেন পড়েছিল বাচ্চাদের সব প্রশ্নের উত্তর বিরক্ত না হয়ে দিয়ে যেতে হয়।
সংযুক্তা তৈরী হয়ে বাথরুম থেকে বেরোল। সুপ্রিয় পাপানকে তৈরী করে দিল। তার বেশি কিছু লাগে না। একটা জ্যাকেট চড়িয়ে নিল, মাফলার গলায়। সংযুক্তা বিয়ের পর পর অনেকক্ষণ ধরে সাজত। এখন বেশি সময় নেয় না।
সুপ্রিয় বলল, “তুমি লিপস্টিক দেবে না?”
সংযুক্তা বলল, “আনি নি”।
সুপ্রিয় বলল, “ভুলে গেছো?”
সংযুক্তা বলল, “না। সেভাবে ইউজ করি না তো এখন”।
সুপ্রিয় বলল, “এখানে নদীটা ভারি সুন্দর। কাল রাতে তো কিছুই বুঝতে পারি নি, এবার দেখতে পাবে। মনে হবে সারাদিন ওখানেই বসে থাকি। ছোট পাহাড়ি নদী, পাথর পেরিয়ে চলে যাচ্ছে। এসব জায়গায় এখন বেশি লোক আসে না, এটাই বাঁচোয়া”।
সংযুক্তা বলল, “তুমি নদীতে নেমো না। ভয় লাগে”।
সুপ্রিয় বলল, “আচ্ছা, নামব না”।
লোকটাকে দেখতে পেল সুপ্রিয়। আসছে।
বলল, “চল, বেরোই, গাড়ি এসে গেছে”।
১৪
গাড়ি থেকে নীলাদ্রি টাটা করল ওদের। রুদ্র বলল, “যাহ। ওরা চলে গেল নাকি?”
হিয়া বলল, “না। সাইট সিং করতে গেছে মনে হয়”।
রুদ্র বলল, “গাড়ি করে ঘুরতে অনেক খরচ নাকি রে?”
পল্লব বলল, “তা তো হবেই”।
রুমানা বলল, “যা লাগে লাগবে। আমার কাছে টাকা আছে। অনেক দিন ধরে জমিয়েছি। কোথায় যাবি, কী লাগবে দেখ, আমার থেকে নে”।
রুদ্র বলল, “অনেক দিন ধরে জমিয়েছিস তো ভাল, তা সেগুলো আমাদের উপরে খরচ করবি কেন?”
রুমানা বলল, “এরকম ট্যুর আর হবে না বলে। এটাই লাস্ট। আর সারা জীবনে তোদের সঙ্গে দেখা হবে নাকি কে জানে”।
পল্লব বলল, “না না ধুর। ওভাবে হয় না। তুই কেন একা খরচা করবি? আমরাও করব”।
রুমানা বলল, “আমি করব বলেছি তো। তোরা বেশি ভাট বকিস না আর। করতে চেয়েছি। করতে দে”।
হিয়া বলল, “ঠিক আছে, আমরা টাকাটা নিতে পারি, তবে শর্ত আছে”।
রুমানা বলল, “কী শর্ত”?
হিয়া বলল, “আমরা যখন প্রথম স্যালারি পাবো, তুই আমাদের থেকে তখন টাকাটা নিয়ে নিবি। ঠিক আছে”?
রুমানা বলল, “আচ্ছা। দেখা যাবে। রিসোর্টে ফিরে রিসেপশনে বললে ওরা গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবে?”
রুদ্র বলল, “তোর কী কী দেখতে ইচ্ছে করছে?”
রুমানা বলল, “সব। এখানে কাছেপিঠে যা যা আছে, সব দেখবো”।
রুদ্র বলল, “ঠিক আছে। দেখিস। আচ্ছা, তবু একবার চেক করে নিচ্ছি। তুই পল্লবের থেকে বেশ কয়েকবার বোতলটা নিয়ে টেনেছিস। নেশার ঘোরে এসব বলছিস না তো? দেখা গেল নেশা কেটে গেলে বলবি দে আমার টাকা ফিরিয়ে দে”।
রুমানা রেগে গেল, “ভাগ। নেশার জন্য কেন বলব? আমি আগেই ভেবে নিয়েছি”।
হাঁটতে হাঁটতে তারা দেখল পাহাড়ের উপরে একটা সরু পায়ে চলা রাস্তা চলে গেছে। হিয়া বলল, “এই রাস্তাটা ধরে উপরে যাই। উপর থেকে নিচটা দারুণ সুন্দর লাগবে”।
রুমানা বলল, “সাইট সীং করবি না?”
হিয়া বলল, “আজ ঘুরি চল। কাল করব। তুই আর তোর টাকাটা তো কোথাও পালিয়ে যাবে না”।
রুমানা বলল, “ঠিক আছে। চল”।
রুদ্র বলল, “একটা ট্রেকিং এর ফিল আসছে, তাই না?”
পল্লব বলল, “আমি ভাই বেশি দূর যেতে পারব না কিন্তু। আমার ল্যাদ লাগছে”।
রুদ্র বলল, “চল তো। বেশি দূর যাব না”।
ওরা গাছ ধরে ধরে পাহাড়ে উঠতে শুরু করল। হঠাৎ পল্লব বলল, “এই ভাই, দেখ তো আমার হাতে এটা কী লেগে আছে”।
রুদ্র দেখে চমকে উঠল, “জোঁক তো। এই, আর উপরে ওঠা যাবে না। নিচে নাম। এখানে জোঁক ভর্তি”।
পল্লব বলল, “সে নামবি, এটা ফেল ভাই। ঈশ, কি বিতিকিচ্ছিরি চেহারা”!
ওরা তাড়াতাড়ি রাস্তায় নেমে এল। দেখা গেল হিয়া আর রুমানার পায়েও জোঁক লেগে গেছে। সবাই মিলে অনেক কসরত করে জোঁকগুলো ফেলল।
রুদ্র বলল, “এই জন্য নুন আনতে হত। এসব জায়গায় জোঁকের ভয় আছে রিসোর্টের ছেলেটাই তো বলেছিল। জোঁকের যম হল নুন। নুন নিয়ে ঘুরতে হয়”।
পল্লবের হাতে রক্ত বেরিয়ে গেছিল। পল্লব বলল, “তুই এখন জ্ঞান দিস না তো। কেন যে পাহাড় চড়তে গেলাম। এখানে পাইথনও থাকতে পারে, বাপরে!”
রুদ্র বলল, “ঠিক আছে, রিসোর্টে ফেরা যাক। ওদের কাছে নিশ্চয়ই ওষুধ থাকবে। তাও ভাগ্যিস কেউ চপ্পল পরে বেরোই নি”।
রুমানা বলল, “জোঁক নাকি শরীরের দূষিত রক্ত টেনে নেয়। একদিকে খারাপ না”।
পল্লব বলল, “আমার শরীরে তো পুরোটাই মদ রে ভাই। জোঁকটার নেশা হয়ে গেছিল শিওর”।
হিয়া থমথমে গলায় বলল, “আমার জ্বলছে। ঘেন্না লাগছে। আমি গিয়ে স্নান করব। ক্রিপি জিনিস, ঈশ। রুদ্রকে ধরে নি দেখ”।
রুদ্র বলল, “আমি জোঁকেরও অরুচি”।
পল্লব বলল, “এই জন্যই লোকে এসব জায়গা অ্যাভয়েড করে মনে হচ্ছে। জোঁক জিনিসটা ভয়ের, যাই বলিস। অনেকগুলো হলে তো মানুষ মরেও যেতে পারে”।
রুদ্র বলল, “ভাল তো, আমরা রাতে এখানকার মৃত জোঁকেদের প্ল্যাঞ্চেটে ডাকব। কী বলিস?”
এবার সবাই হেসে উঠল।
১৫
আকাশ পুরো থমথম করছে। যে কোন সময় আরও বেশি বৃষ্টি হতে পারে।
ড্রাইভার বেশ জোরে গান চালিয়েছে। সুপ্রিয় বলল, “ভলিউম কম করুন। কানে লাগছে তো”।
নীলাদ্রি সামনে বসেছে। বলল, “বুলু, তুই জানিস আমার আর রণিতার বিয়ে গোয়াতে হয়েছিল?”
সংযুক্তা বলল, “জানি। দাদার কাছে শুনেছিলাম”।
নীলাদ্রি বলল, “আমাদের বিয়ে পাবলিককে একটাই শিক্ষা দেয়। বিয়েতে গুচ্ছ গুচ্ছ টাকা খরচা করলেই জনগণ বিয়ের পরে ভাল থাকে না”।
রণিতা বলল, “আর সে মেয়ে যদি তোমার মত ছেলেকে বিয়ে করে, তাহলে তো হয়েই গেল”।
পাপান বলল, “আমি বিয়ে করব না”।
নীলাদ্রি পাপানের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “এসব আমিও ছোটবেলায় বলতাম। দেখা যাবে তোর বাবাও বলত”।
সুপ্রিয় বলল, “বলতাম”।
রাতে আসার সময় চা বাগানের মাঝখান দিয়ে আসতে গিয়ে যতটা ভয় লাগছিল, এখন ততটাই ভাল লাগছিল সংযুক্তার। যেন চতুর্দিকে সবুজের ঢল নেমেছে।
রণিতা সংযুক্তাকে বলল, “তোমাদের কি লাভ ম্যারেজ?”
সংযুক্তা ছোট করে মাথা নাড়ল, “না”।
ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল, “বৃষ্টি একটু বন্ধ হয়েছে। আপনাদের যার যা ফটো তোলার, তুলে নিন”।
নামল সবাই। রণিতা মোবাইল বের করে চা বাগানের ফটো তুলতে শুরু করল।
সুপ্রিয় সংযুক্তাকে বলল, “তুমি পাপানকে নিয়ে দাঁড়াও তো, একটা ছবি তুলি”।
সংযুক্তা পাপানকে নিয়ে দাঁড়াল। নীলাদ্রি বলল, “আপনিও যান না। ফুল ফ্যামিলি তুলে দিচ্ছি”।
সুপ্রিয় নীলাদ্রিকে “থ্যাংক ইউ” বলে পাপানকে মাঝখানে রেখে দাঁড়াল। নীলাদ্রি বলল, “নাইস ফ্রেম”।
সুপ্রিয় বলল, “আপনারা দুজনও দাঁড়ান। আমি তুলে দিচ্ছি”।
নীলাদ্রি সুপ্রিয়কে মোবাইল দিয়ে রণিতার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
বেশ কয়েকটা ফটো তোলার পর আবার সবাই গাড়িতে উঠল।
খানিকটা এগনোর পর একটা বড় দোতলা কাঠের বাড়ি দেখা গেল। বাড়িটার সামনের জমিতে সুন্দর বাগান করা।
ড্রাইভার বলল, “এই টি এস্টেটের ম্যানেজারের বাড়ি”।
রণিতা বলল, “এরকম নির্জন জায়গায় কী করে থাকে এরা কে জানে। কিছুই তো নেই চারপাশে”।
নীলাদ্রি বলল, “কিছু না থাকাটাই সব থেকে বড় প্লাস পয়েন্ট হতে পারে কারো কারো কাছে”।
রণিতা বলল, “তোমার তো ভাল লাগবেই। তুমি হলে প্রথম প্রজাতির আন সোশ্যাল মানুষ। এদিকে যখন মানুষের মধ্যে থাকো, আজে বাজে বকতে শুরু কর”।
নীলাদ্রি বলল, “আমি মিক্সড প্রজাতি। অতো ভেবো না। জায়গাটা এনজয় কর”।
সুপ্রিয় গাড়ির আয়না দিয়ে সংযুক্তার দিকে তাকাল। সংযুক্তা জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে ওর জায়গাটা পছন্দ হয়েছে। ঘরে থাকলে এটা সম্ভব ছিল না। এই জন্যই বেরনো দরকার। ঘরে থাকলে মন বদ্ধ হয়ে যায়। তার আগেই খেয়াল করা উচিত ছিল। পাপান হবার পর থেকে সংযুক্তার একবারেই বেরনো হয় নি। এক প্রকার ঘর বন্ধ হয়ে গেছিল। সেও অফিসে ব্যস্ত ছিল। এখন মনে হচ্ছে আরো বেশি বেশি করে বেরনো দরকার, তাহলে সংযুক্তা আবার আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
আরেকটা জায়গায় ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে কমলালেবু গাছ দেখাচ্ছিল। সবাই গাড়ি থেকে নামল। রণিতা সংযুক্তাকে একা পেয়ে বলল, “তোমার দাদা জানেন তার বন্ধুর কেসটা ডিভোর্সের দিকে এগোচ্ছে?”
সংযুক্তা খানিকটা থতমত খেয়ে বলল, “না বোধহয়। আমরা সবাই তো যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি”।
রণিতা বলল, “আমাদের মত পরিবারগুলোতে ডিভোর্সের আগে অনেক কিছু ভাবতে হয়, কিন্তু আমার কাছে বেশি অপশন ছিল না জানো। ও এত খামখেয়ালী। এখানে দেখছো এত বকে যাচ্ছে, অথচ বাড়িতে এরকমও হয়েছে, দিনের পর দিন কথাই বলত না। আমি জানি ওর এক্সট্রা অরডিনারি ট্যালেন্ট আছে। কিন্তু আমি তো খুব স্বাভাবিক একটা সংসার চেয়েছিলাম। সম্পর্কের আত্মাটাই যেন পালিয়ে গেছিল”।
সংযুক্তা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “প্রথম প্রেমের মরে যাওয়া অনুভূতিগুলোকে প্ল্যাঞ্চেট করে ডাকা সম্ভব না, তাই না?”
রণিতা হাঁ করে সংযুক্তার দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা তো দারুণ বললে। বলে দেব ওকে। ওর কোন লেখায় কাজে লাগবে”।
সুপ্রিয় দূর থেকে রণিতা আর সংযুক্তার কথা বলা দেখছিল। সংযুক্তা কি রণিতার সঙ্গে স্বাভাবিক কথা বলছে? তাহলে তার সঙ্গে কথা বলার সময় সংকুচিত হয়ে যায় কেন?
নীলাদ্রি বেশ খানিকক্ষণ ধরে ব্যস্তভাবে চারদিকের ফটো তুলে বলল, “আচ্ছা বস, আপনার কি মনে হয়, ডিভোর্স ইজ গুড? মানে স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়?”
সুপ্রিয় নীলাদ্রির কথার উত্তর না দিয়ে শ্বাস ছাড়ল। এক একটা মানুষের জীবনে এক একটা সমস্যা আসে। কোনটার সঙ্গে কোনটার মিল থাকে। আবার বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই তার উল্টোটা দেখা যায়। কারো সঙ্গেই কারো কোন মিল থাকে না…
১৬
কটেজে ফিরে হিয়া স্নানে ঢুকল। রুমানা বলল, “গীজার বন্ধ করিস না। আমিও যাব”।
পল্লবও ওদের কটেজে গিয়ে স্নানে গেল। রুদ্র গীটার নিয়ে টিউনিং করতে বসল। একটা বাংলা গান করতে ইচ্ছে করছে। কী গান করা যায়?
কয়েক সেকেন্ড ভেবে সে বেলা বোস গাইতে শুরু করল। পল্লব বাথরুম থেকে বেরিয়ে গলা মেলাল।
গান শেষ হতে পল্লব বলল, “রুমানার বিয়ে হয়ে যাবে। কোন দিন বলতে পারলাম না ভাই। আর বলে লাভ নেই। অনেক ঝামেলা। ভাল থাকুক”।
রুদ্র বলল, “ওই দুঃখেই তুই রাম গিলে যাচ্ছিস?”
পল্লব বলল, “দুঃখের কিছু নেই। এটা আমি এমনি এমনি খাচ্ছি। হরলিক্সের মত। বেড়াতে এসে সুস্থ থাকাটাই সুস্থতার লক্ষণ না”।
রুদ্র হাসল, “বেশি গিলিস না। এখানে যদি খাটের উপর বমি করিস, মেঝেতে শুলে শিওর নিমোনিয়া হবে”।
পল্লব বলল, “তাহলে ওদের খাটে গিয়ে হানা দেব”।
রুদ্র বলল, “হ্যাঁ। খুব সোজা তো ব্যাপারটা। লিমিটে থাক। মদ খা আর যাই কর, বেশি বাড়িস না”।
পল্লব বলল, “জানি জানি। তুই যে সব জানিস সেটা আমার থেকে ভাল আর কে জানে?”
রুদ্র বলল, “রুমানা টাকা জমিয়েছিল। সব টাকা খরচ করে ফেলবে বলছে। ওদের লাইফটা এত কষ্টের?”
পল্লব বলল, “প্রোগ্রেসিভ চিন্তাভাবনার মুসলিমও আছে। আশা করব সেরকম বাড়িতে বিয়ে হবে”।
রুদ্র বলল, “হয়ত ও জানে ওর কোন বাড়িতে বিয়ে হবে। জেনে গেছে ওর শ্বশুরবাড়ি মোটেই প্রোগ্রেসিভ নয়। সে ক্ষেত্রে তো ব্যাপারটা চাপেরই”।
পল্লবের মুখ ফ্যাকাসে হয় গেল। বলল, “বলিস কী ভাই। ওর বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে? যাহ”।
রুদ্র বলল, “সেই চান্সটাই বেশি। শোন, এগুলো ঠিক প্রেম না। তুই এসবের থেকে ডিটাচড থাক ক’দিন কলকাতা ফিরে। একটা ঠিক ঠাক চাকরি লাগিয়ে ফেল। শান্তিতে জীবন কাটা”।
পল্লব বলল, “চে-র টি শার্ট পরে এসব কনজারভেটিভ বক্তব্য ঝাড়তে লজ্জা লাগে না তোর?”
রুদ্র বলল, “আমি বাস্তববাদী। তোর অকারণ বিপ্লবী হওয়াটাকে ঠিক প্রশ্রয় দিতে পারছি না। এটুকুই”।
পল্লব বলল, “দিতে হবে না। থাক”।
রামের বোতল বের করে অনেকটা র খেয়ে নিল পল্লব।
রুদ্র বলল, “এটা রাগ দেখানো হচ্ছে তোর? তুই নিজে বাস্তববাদী নোস? বাস্তববাদী হলে এদ্দিনে ঠিকই বলে দিতিস ওকে”।
পল্লব উত্তর দিল না। চুপ করে রইল।
হিয়া তাদের কটেজে ঢুকে বলল, “কীভাবে কালো করে এসেছে রে। মারাত্মক বৃষ্টি হবে”।
পল্লব বলল, “হোক না। ভেঙে চুরে যাক সব কিছু”।
হিয়া বলল, “তুই আবার ক্ষেপলি কেন?”
রুদ্র বলল, “বুঝলি না, ওকে জোঁক চুলকে দিয়েছে”।
হিয়া হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “মদ গিলে গিলে ছেলেটা ডেস্ট্রাকটিভ হয়ে গেছে”।
পল্লব বলল, “আচ্ছা বৃষ্টি হবে, এই খবরে কেন দুঃখ পাব? তোদের কি বৃষ্টি খুব খারাপ লাগছে? আমি তো দিব্যি ভাল আছি। বৃষ্টি না হলে অনেক আগেই জোঁকে সব রক্ত খেয়ে নিত আমার। রোদ দেখে তোরা ঠিক ওই পাহাড়ী জঙ্গলগুলোতে নিয়ে যেতিস আর জোঁক আমার বারোটা বাজিয়ে দিত”।
রুদ্র বলল, “কাল ওয়েদার ঠিক থাকলে নুনের ব্যাগ নিয়ে বেরোব”।
হিয়া বলল, “না। কাল সাইট সিঙে যাব ঠিক হল তো। নইলে রুমানা রাগ করবে। ওর খুব ইচ্ছা ওর জমানো টাকা দিয়ে আমরা ঘুরি”।
পল্লব বলল, “দেখা যাবে। কালকের দিনটা আসুক। আজকের রাতটা তো কাটুক ঠিক করে”।
হিয়া অবাক হয়ে বলল, “কেন? আজকের রাত কী দোষ করল?”
পল্লব বলল, “প্ল্যাঞ্চেট করবি তোরা। বেঁচে নে আগে”।
রুদ্র বলল, “বাঁচবে না কেন? এই তুই এসব ফালতু ভয় দেখাস না তো”।
পল্লব বলল, “ভয় দেখাবো কেন? এমনিই বললাম”।
হিয়া বলল, “দেখ, বেশি ভয় লাগলে করিস না”।
পল্লব বলল, “আমার ভয় নেই। ভয়ের কী আছে?”
হিয়া বলল, “তাহলে ঠিক আছে। ভয় না পেলেই হল”।
পল্লব আরেকটু মদ গিলে নিল।
১৭
কটেজে ফেরার এক কিলোমিটার আগে থেকে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল।
নীলাদ্রি বলল, “বোঝো। এ কী বৃষ্টি রে বাবা! কটেজে থাকলে তো বোঝা যায় না বৃষ্টির এত তেজ থাকে”।
সুপ্রিয় বলল, “মেঘ ভাঙা বৃষ্টি”।
বাজ পড়ছে না, কিছুই নেই। শুধু বড় বড় ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভার বলল, “এই বৃষ্টিটা হবে অনেকক্ষণ সাহেব। একটু কমলে যাচ্ছি”।
রাস্তা বেয়ে জল নেমে যাচ্ছে। গাড়ির কাঁচ ঝাপসা হয়ে গেছে।
সুপ্রিয় বলল, “আমার পাহাড়ের কপাল এরকমই। যে সময়েই যাব, বৃষ্টির কবলে পড়ব”।
নীলাদ্রি বলল, “এরকম বৃষ্টি হলে ছোটবেলায় বুলুদের বাড়িতে কাকীমা পেঁয়াজি করত বিকেলের দিকটা। আহা, সে কী দিন ছিল। কেমন আছেন কাকীমা এখন?”
সংযুক্তা বলল, “ভাল আছে”।
নীলাদ্রি বলল, “খিদে পেয়ে গেল। তোমাদের কারো খিদে পায় নি?”
ড্রাইভার বলল, “মোমো খাবেন? একটা দোকান আছে”।
নীলাদ্রি বলল, “যস্মিন দেশে যদাচার। খাওয়াই যায়”।
ড্রাইভার বলল, “ঠিক আছে, বৃষ্টিটা কমুক। আমি নিয়ে যাচ্ছি”।
পাপান বলল, “আমার মোমো খিদে পেয়েছে”।
নীলাদ্রি বলল, “আমারও তো। শুনেই খিদে পেয়ে গেল”।
রণিতা সংযুক্তাকে বলল, “তোমার কি কোন সমস্যা হচ্ছে?”
সংযুক্তা মাথা নাড়ল, “না না। ঠিক আছি”।
নীলাদ্রি বলল, “বুলু এখন কথাই বলে না সেরকম। অথচ এক কালে বড় বাচাল ছিল”।
সুপ্রিয় শ্বাস ছেড়ে একবার সংযুক্তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ওর কোন একটা সমস্যা হচ্ছে। কী হয়েছে এখনো বুঝতে পারি নি, তবে ডাক্তার অনুমান করছেন ওর ডিপ্রেশন হতে পারে”।
নীলাদ্রি অবাক হয়ে মুখ ঘুরিয়ে সংযুক্তার দিকে তাকিয়ে বলল, “সেকী রে, ডিপ্রেশন তো খুব বাজে জিনিস। তোর ঠিক কী ধরণের সমস্যা হচ্ছে রে বুলু?”
রণিতা বলল, “এভাবে গাড়ির মধ্যে বসে ডিপ্রেশনের চিকিৎসা করবে নাকি তুমি? ভাল সাইকিয়াট্রিস্ট না দেখালে কিছুতেই বোঝা সম্ভব না কেন এসব হচ্ছে। ওকে বিরক্ত কোর না এখন”।
নীলাদ্রি বলল, “ঠিক ঠিক। সরি। তবে বুলু যদি আমার সঙ্গে আলাদা করে কোন কথা বলতে চাস, আমি আছি। ছোট থেকে দেখছি তোকে, এতদিন পরে যদি এরকম কোন সমস্যায় থাকিস, আমি কোন রকম হেল্প করতে পারলে সব সময় আছি”।
সংযুক্তা জানলার কাঁচ দেখছিল। নীলাদ্রির কথা শুনে বলল, “বলব”।
রণিতা সংযুক্তার হাত ধরল। ঠান্ডা হাত। যেন কোন সাড় নেই। বলল, “তুমি ঠিক করে খাওয়া দাওয়া করছো তো?”
সংযুক্তা বলল, “হ্যাঁ”।
রণিতা বলল, “আমার আগে বোঝা উচিত ছিল। ওর সঙ্গে থেকে থেকে আমিও একটা সময় ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছিলাম”।
নীলাদ্রি কিছু বলল না।
পাপান বলল, “বাবা, দার্জিলিং কবে যাব আমরা?”
সুপ্রিয় বলল, “আর যাওয়া হবে না মনে হচ্ছে। যা বৃষ্টি হচ্ছে, পাহাড়ে নির্ঘাত ধ্বস নেমেছে”।
ড্রাইভার বলল, “হ্যাঁ সাহেব, ওদিকে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে কাল থেকেই”।
সুপ্রিয় বলল, “দার্জিলিঙে যাব ভেবেছিলাম। পাপান টয় ট্রেন চড়বে বলে বায়না ধরেছিল। পরে শুনলাম ওদিকে বৃষ্টি হচ্ছে, ধ্বস নামছে, প্ল্যান চেঞ্জ করে এদিকে চলে এলাম। সমস্যা হল, আমার মনে হচ্ছে এই জায়গাটা আরো অনেক বেশি ডিপ্রেসিভ। কিছু নেই চারদিকে, একবারে নির্জন”।
ড্রাইভার বলল, “বৃষ্টি ধরলে আমি কাল কয়েকটা জায়গা নিয়ে যাব। দেখবেন ভাল লাগবে। কতদিন আর বৃষ্টি হবে?”
সংযুক্তা ধীর স্বরে বলল, “পাপানটা যে কী ট্রেন ভালবাসে। ঘর ভর্তি শুধু বিভিন্ন রকমের ট্রেন। কেউ কিছু দিতে চাইলেও ও শুধু ট্রেনই চায়”।
নীলাদ্রি বলল, “বেশ তো, আমিও একটা ভাল দেখে ট্রেন কিনে দেবো তোকে”।
পাপান খুব খুশি হল।
বৃষ্টি সামান্য কমেছে। ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে একটা ছোট দোকানে দাঁড়াল। বলল, “আপনারা গাড়িতেই বসুন, আমি মোমো নিয়ে আসছি”।
বৃষ্টির মধ্যে গরম গরম মোমো অমৃতর মত লাগছিল।
রণিতা বলল, “ভেজ মোমো হলেও কী স্বাদ! এই তুমি খাও তো”।
রণিতা এক প্রকার জোর করেই সংযুক্তাকে খাইয়ে দিল। সংযুক্তা বলল, “হ্যাঁ। ভাল খেতে”।
নীলাদ্রি সংযুক্তার দিকে তাকাল।
ঠিকই, আগেই বোঝা উচিত ছিল।
বুলুর সেই খুশি খুশি ভাবটাই যেন কেউ ব্লটিং পেপার দিয়ে শুষে নিয়েছে। বলিউডি হিরো ডিপ্রেশনে আত্মহত্যা করেছেন বলে অনেকেই ডিপ্রেশন নিয়ে অনেক কিছু লিখেছিল, কিন্তু এটা নিয়ে সেও তো বিশেষ কিছু জানে না। ঠিক কেন হবে এরকম? কত কিছু জানার বাকি এখনো…
১৮
“ডিপ্রেশন খুব বাজে জিনিস। মেয়েটাকে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে জানো”।
কটেজে ঢুকেই কথাটা বলল রণিতা।
নীলাদ্রি জুতো খুলে চেয়ারে বসে বলল, “ডিপ্রেশন এমন একটা রোগ, যেটা বেশিরভাগ মানুষই বড়লোকদের বিলাসিতা বলে দাগিয়ে দিতে ভালবাসে। কেউ কেউ আমলও দেয় না। বুলুর বরকে আমার ভাল লাগল। প্রথমে খ্যাপাটে ভেবেছিলাম। অবশ্য আমাকেও ও খ্যাপাটেই ভেবেছিল”।
রণিতা বলল, “তুমি এখনো খ্যাপাটেই। তুমি কি নিজেকে সহজ স্বাভাবিক মানুষ বলে দাবী করতে চাইছো?”
নীলাদ্রি হঠাৎ করে রণিতার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, “না। করতে চাইও না”।
নীলাদ্রি রণিতার ঠোঁটে চুমু খেতে গেল।
রণিতা হাত দিয়ে নীলাদ্রিকে আলতো ঠেলে দিয়ে বলল, “না। প্লিজ না। আমার সময় দরকার”।
নীলাদ্রি সরে গিয়ে বলল, “সরি সরি। এত সুন্দর ওয়েদারে আমার আবার একটু আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছিল আর কী। তুমি কি সত্যিই বিয়েটা থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছো?”
রণিতা খাটে বসে বলল, “জানি না। একটা সময় অনেক কষ্টে নিজেকে বুঝিয়ে আটকে রাখতাম। এখন আমি নিজেও জানি না কী চাই”।
নীলাদ্রি বলল, “তোমার জীবনে কেউ এসেছে রনি?”
রণিতা বলল, “ক্ষেপেছো? একটা ছেলেই আমার জীবন শেষ করে দিল, এর পরে আবার আরেকজন? এসব কথা ভুলেও ভেবো না। আমি একা থাকার কথা ভেবেছি”।
নীলাদ্রি বলল, “পারবে? বয়স হলে কী করবে?”
রণিতা বলল, “দেখা যাবে। তুমি তো ডিভোর্স হয়ে গেলেই বিয়ে করে নেবে, তাই না? মেয়ে দেখে রেখেছো?”
নীলাদ্রি রণিতার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বলল, “তুমি ছাড়া আমাকে কে সহ্য করবে রণি? প্লিজ অচেনা হয়ে যেও না”।
রণিতা বলল, “চেনা মানে যদি বল তোমাকে এখন ল্যাপ ড্যান্স দিতে হবে, আমি জাস্ট পারলাম না। তোমাকে আমি পাল্টাতে চাই নি কোনকালে, শুধু কয়েকটা ফিচার অ্যাড করতে চেয়েছিলাম। বাইরের লোকে তো তোমাকে চেনে না, তুমি এখন এক্সট্রোভার্ট, সবার সঙ্গে কথা বলছো, ঘুরে বেড়াচ্ছো… এই তুমিই কখন হঠাৎ করে কচ্ছপের মত খোলসে ঢুকে যাবে, আমার সঙ্গে একটাও কথা বলবে না, লোকের সঙ্গে অকারণে বাজে ব্যবহার করে ফেলবে, মাঝে মাঝে তুমুল মুড সুইং হবে, ঝগড়া হবে আমার সঙ্গে, আমি তো ভালই ছিলাম বাড়িতে। তোমার ফাই ফরমাস খাটতে হত না, ঘরের মধ্যে আজেবাজে গন্ধ ঘুরে বেড়াত না, দিব্যি ছিলাম। তোমার সঙ্গে থাকা মানেই তো একটা ধেড়ে খোকাকে সামলাতে হবে। কেন করব সেটা?”
নীলাদ্রি চিন্তিত মুখে বলল, “এত খারাপ আমি? বল কী? বাপরে, খুব চাপ তো”!
রণিতা বলল, “ফানি হবার চেষ্টা কোর না। তুমি নিজেও জানো তুমি কী রকম। জানো না তুমি মাঝে মাঝে
আমায় কীভাবে সমস্যায় ফেলতে? সেবার তোমার পিসির ছেলেমেয়েরা এল, তোমারই পিসির ছেলে মেয়ে, আমার না। তুমি ঘর থেকেই বেরোলে না। ঘর ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকলে। তুমি একবারও ভাবলে না এর ফলে আমার কী সমস্যা হতে পারে। কখনো নিজের বাইরে কিছু ভেবেছো তুমি?”
নীলাদ্রি হতাশ মুখে বলল, “চেষ্টা করব বলছি তো। তুমি এবার কিন্তু খুব কড়া কড়া কথা শোনাচ্ছো রনি”।
রণিতা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কলিং বেল বেজে উঠল। নীলাদ্রি উঠে দরজা খুলে দেখল রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। নীলাদ্রি বলল, “আরে, রকস্টার যে! এসো এসো”।
রুদ্র বলল, “না না, আমি একটা কথা বলেই চলে যাব”।
নীলাদ্রি বলল, “আরে আই ইনসিস্ট। এসো। রনি, এই ছেলেটার নাম রুদ্র। দারুণ গীটার বাজায়, দারুণ গান করে”।
রণিতা বিরক্ত হলেও হাসার চেষ্টা করল। রুদ্রকে চেয়ারে বসিয়ে নীলাদ্রি বলল, “বল বস। কী দাবি”।
রুদ্র বলল, “আমরা তিনজন ঠিক করেছি আজ রাতে প্ল্যাঞ্চেট করব। আপনি আমাদের কী কী করতে হয় যদি বলে দেন, তবে খুব ভাল হয়”।
নীলাদ্রি বলল, “সিরিয়াসলি?”
রুদ্র বলল, “হ্যাঁ। জাস্ট একটা এক্সপেরিয়েন্স নিতে চাই, এই যা”।
নীলাদ্রি বলল, “ওকে। আমি বলে দেবো কী করতে হবে”।
রণিতা শ্লেষাত্মক গলায় বলল, “তুমি কি আজকাল ওঝাগিরিও করছো? নাকি তান্ত্রিক হয়েছো?”
নীলাদ্রি বলল, “আরে সেসব কিছু না। আমি ইনভলভ হব না। জাস্ট ওদের বলে দেবো কী করতে হবে। এসব নেই আমিও খুব ভাল করে জানি”।
রণিতা বলল, “যা ইচ্ছে কর, আমার কিছু বলার নেই”।
১৯
লাঞ্চ দিয়েছে। হিয়া চোখ বড় বড় করে জোঁকের গল্প শোনাচ্ছে পাপানকে। সংযুক্তা চুপ করে খেয়ে যাচ্ছে।
নীলাদ্রি তীক্ষ্ণ চোখে কয়েক সেকেন্ড সংযুক্তাকে দেখে খাওয়ায় মন দিল।
বৃষ্টি কমলেও রোদ ওঠে নি। আকাশের মুখ এখনো গোমড়া। ডিডি বাংলায় খবরে বলেছে উত্তরবঙ্গে আরো দু এক দিন নিম্নচাপ থাকতে পারে। রিসোর্টের ছেলেটা জানিয়েছে আর একদিন পরে আরেকটা ফ্যামিলি আসার কথা ছিল, তারা বুকিং ক্যান্সেল করেছে।
ভাত সহ সবকিছুই বেশ গরম। রান্নাও বেশ ভাল হয়েছে।
নীলাদ্রি রুদ্রকে বলল, “তোমরা হঠাৎ করে তোমাদের স্যারকেই ডাকতে চাইছো কেন?”
রুদ্র বলল, “ওঁর কাছে আমরা অনেক কিছু শিখেছিলাম জানেন। আমাদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। উনি এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন, আমরা কেউই আশা করি নি। খুব বেশি বয়সও ছিল না”।
নীলাদ্রি বলল, “বিবাহিত ছিলেন”?
রুদ্র ঘাড় নাড়ল, “হ্যাঁ।
নীলাদ্রি “ওই জন্যই” বলে চুপ করে গেল।
রণিতা ব্যঙ্গটা বুঝে বলল, “ব্যাপারটা মেয়েদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আরো বেশি করে বললে, মেয়েদের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা অনেক বেশি করে প্রযোজ্য। এই যে লেখক মশাই এত মেয়েদের ফ্যানমেল পান, আমি ডিভোর্স করলে সেরকম কোন ফ্যান গার্লকে বিয়ে করলে মেয়েটা বুঝত লেখক মশাই ঠিক কতখানি বিষ মাল”।
হিয়া আর রুমানা দুজনেই হেসে উঠল। পল্লব বেশি খেতে পারছিল না। রামের নেশায় বুঁদ হয়ে গিয়ে কী খাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। রণিতার কথা শুনে বলল, “বিয়ে জিনিসটাই ফালতু ম্যাডাম। একসঙ্গে থাকলেই বাওয়াল হবে”।
রুদ্র বলল, “তাহলে তোর সলিউশন কী?”
পল্লব বলল, “দেখ, পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। করপোরেশন কুকুরের নির্বীজকরণ করে দেখেছিস? মানুষেরও একই প্রসেসে নির্বীজকরণ হয়ে যাক। একটা সময়ের পরে মানুষ আর নতুন জেনারেশন প্রোডিউস করবে না। বা কোন বোম বানিয়ে ফেলুক। সব দেশ তো এই ডিসিশন মানবে না। কারো তোয়াক্কা না করে সব দেশে এই বোম ফেলে দিক। নে ভাই, সেই জেনারেশনটাই মানুষের লাস্ট জেনারেশন হবে। সবাই মরে যাবে, মানুষও আর নতুন করে পয়দা হবে না, পৃথিবীটাও বেঁচে যাবে”।
রণিতা বলল, “তুমি তো বেশ নৈরাশ্যবাদী ছেলে”।
নীলাদ্রি বলল, “বৃদ্ধ সন্ন্যাসী পেটে পড়লে আমিও নৈরাশ্যবাদী হয়ে যাব। কিন্তু ছোকরা কথাটা খারাপ বলে নি। এগুলো তুমি ফ্রি টাইমে ভেবেছো?”
রুদ্র হেসে বলল, “ফ্রি টাইমে ও নিজের ক্রাশকে কীভাবে প্রোপোজ করবে ছাড়া অন্য কিছু ভাবে না”।
রুমানা জিজ্ঞাসু চোখে রুদ্রর দিকে তাকালো, “পল্লবের ক্রাশ? কে রে?”
পল্লব গম্ভীর হয়ে মাংসের ঝোল মাখা ভাতে ডাল মিশিয়ে খেতে শুরু করল। রুদ্র বলল, “কেউ না। এমনি বললাম”।
রুমানা বলল, “না, তুই কিছু একটা চাপার চেষ্টা করছিস আমি বুঝতে পারছি। কে ওর ক্রাশ”?
পল্লব বলল, “জ্যাকলিন ফারনান্ডেজ। কী করবি? বিয়ে দিতে পারবি আমার সঙ্গে?”
নীলাদ্রি বলল, “বাহ। জ্যাকলিন ফারনান্ডেজ দিব্যি সুন্দর চয়েজ তো। তবে উনি শ্রীলংকান তো। বিয়ে করে সুখে থাকতে পারবে?”
রুদ্র বলল, “ক্রাশ তো। বিয়ে করার কিছু নেই। ক্রাশ, ক্রাশের জায়গাতেই থাকে। তার বেশি কোথাও যায় না”।
রণিতা বলল, “বাচ্চাটার সামনে এসব আলোচনা না করলেই কি নয়? গিলছে বসে বসে”।
সুপ্রিয় পাপানের দিকে তাকাল। সত্যিই পাপান কেমন বড় বড় চোখ করে সবার কথা শুনছে।
রুমানা বলল, “আপনারা আজ কোথায় কোথায় গেছিলেন? কালকে ভাবছি আমরা সাইট সিঙে যাব”।
নীলাদ্রি বলল, “কাছের কতগুলো জায়গায় গেছিলাম। ষোলশো মত লাগল”।
সুপ্রিয় বলল, “আপনি কিন্তু আমার থেকে হাফ টাকা নিয়ে নেবেন। আপনি ওভাবে সবটা দিয়ে দিলেন কেন?”
নীলাদ্রি বলল, “ও ঠিক আছে। ওসব হিসেব করতে হবে না”।
রুদ্র বলল, “আমি খুব এক্সাইটেড আজকে। প্ল্যাঞ্চেট ব্যাপারটা এখানে দারুণ হবে। এমনিতেই বিকেলের পরে পরিবেশটাই পাল্টে যায়”।
সংযুক্তা হঠাৎ করে বলল, “আমার বাবাকে ডাকা যায় নীলুদা?”
২০
লাঞ্চ করে কটেজে ঢুকেই রুমানা বলল, “পল্লব কার কথা বলছে রে? রুদ্র কথাটা কেমন ঘুরিয়ে দিল। কিছুই বুঝতে পারলাম না”।
হিয়া বেসিনে ব্রাশ করতে করতে বলল, “যাকে খুশি ওর ক্রাশ বানাক, তোর তাতে কী? তুই তো বাড়ির পছন্দে বিয়ে করবি। অন্যের ক্রাশ জেনেই বা তোর কী হবে? পল্লব যদি বলে তুই ওর ক্রাশ, তোর পক্ষে কি সেটা এন্টারটেন করা সম্ভব?”
রুমানা বলল, “আশ্চর্য! তুই আমার কথা তুলছিস কেন? আমি কি এসব বলেছি নাকি?”
হিয়া বলল, “তোর পল্লবের উপর বিন্দুমাত্র কোন চাপ নেই? এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছিস? কাকে ঠকাচ্ছিস তুই?”
রুমানা বলল, “এসব বাজে কথা বলিস না। একবার বলেছিস ঠিক আছে, আর কিছু বলিস না”।
হিয়া বলল, “কেন বলব না?”
রুমানা বলল, “তুই আমাদের বাড়ি গেছিস না? অকারণ এসব অবান্তর কথা তুলে কী হবে?”
হিয়া বলল, “তোদের দুজনের যদি একে অপরের প্রতি ফিলিংস থাকে, তাহলে সব ভুলে যা না। কী হবে? সারা রাস্তা একে অপরের এঁটো খেয়ে যাচ্ছিস। আমি তো ভাবতেই পারতাম না”।
রুমানা বলল, “ওহ এঁটো খাওয়া দেখে এসব অ্যাজাম্পসান করছিস তুই?”
হিয়া বলল, “না, অ্যাজাম্পসানের কিছু নেই। আমি এতদিন ধরে যা দেখেছি, সেটা বলেছি”।
রুমানা বলল, “এই যে তুই বললি না, সব ভুলে যেতে হবে, এটাই সব থেকে কঠিন কাজ”।
হিয়া বলল, “আমার মনে হয় সব থেকে সোজা কাজ। সদিচ্ছা থাকা দরকার”।
রুমানা বলল, “পল্লব কোন চাকরি বাকরি করে না। যে কোন বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পায়ের তলার মাটিটা শক্ত হওয়া দরকার। ক্রাশ অবধিই থাক ব্যাপারটা। এর বেশি যাওয়ার দরকার নেই”।
হিয়া বলল, “বুঝেছি। তুই প্র্যাকটিকাল হবার চেষ্টা করছিস। তাহলে ঠিক আছে। শুধু মনে রাখিস, তোর বাড়ি থেকে যার সঙ্গে তোর বিয়ে দেওয়া হবে, তাকে তুই ঠকাবি”।
রুমানা বলল, “ঠকালে ঠকাবো। যে বাড়ির মেয়ের ছোট থেকে নিজের মতামত দেওয়ার অধিকার থাকে না, সে বাড়ির মেয়ে যদি মানসিকভাবে কাউকে ঠকিয়েও দেয়, তাহলেও কোন ভয়ের কিছু নেই। আমাকে এসব বোঝাতে আসিস না”।
হিয়া বলল, “শোন না। একটা কাজ তো করাই যায়”।
রুমানা বলল, “কী?”
হিয়া বলল, “তোরা এখানে একরাত একসঙ্গে থাক। গুড বাই সেক্স টাইপের ব্যাপার হবে”।
রুমানা কয়েক সেকেন্ড হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার বাবা এটা জানতে পারলে তোকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দিত। উচ্চারণও করিস না এসব”।
হিয়া বলল, “জানতে পারবে কেন? মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিঙে কোন কিছু হলে সেটা বাইরে যাবে কীভাবে? তুই তো এত কনজারভেটিভ না! তাহলে কিসে আটকাচ্ছে?”
রুমানা বলল, “তোর বাজে বকা বন্ধ কর। মাথা পুরো গেছে তোর। নাকি রুদ্রর সঙ্গে কিছু করার ইচ্ছা আছে তোর? নিজের লাইন ক্লিয়ার করতে আমাকে এসব বুদ্ধি দিচ্ছিস”।
হিয়া বলল, “তুই খুব ভাল করে জানিস আমার আর রুদ্রর মধ্যে কিচ্ছু নেই। কাম অন রুমানা, তুই একবার শুধু বল, বাকিটা আমি বুঝে নেব”।
রুমানা বলল, “তোর পায়ে পড়ি আমি, এসব কথা বলা বন্ধ কর”।
হিয়া বলল, “বন্ধ করব? তা করতেই পারি, কিন্তু তুই সিক্রেটলি আমার কাছে স্বীকার কর”।
রুমানা বলল, “কী স্বীকার করতে হবে?”
হিয়া বলল, “এই যে, তোর পল্লবের উপর চাপ আছে”।
রুমানা বলল, “না। এসব নেই। থাম তুই”।
হিয়া বলল, “একটু একটু করে টাকা জমিয়ে বেড়াতে এসেছিস। আমাদের বলছিস খরচের ব্যাপারে না ভাবতে। ভিতরে ভিতরে বিরাট কিছু আবেগ পুষে রাখিস নি, কীভাবে বিশ্বাস করি বল?”
রুমানা বলল, “টাকাটা সবার জন্যই জমিয়েছিলাম আমি। তুই অনেক দূর ভেবে ফেলেছিস”।
হিয়া বলল, “ঠিক আছে। আমি আর কিছু বলব না। আমি তোর সব থেকে ভাল বন্ধু হিসেবে একটা কনফেশন চেয়েছিলাম। তুই যখন অনেস্টলি সেটা দিতে চাইছিস না, আমি আর কিচ্ছু জিজ্ঞেস করব না এই ব্যাপারে। পোড় তুই ভেতরে ভেতরে। শেয়ার করতে হবে না”।
রুমানা বলল, “তুই বরং আকাশ কুসুম ভাবা বন্ধ কর। গল্প লিখতে শুরু কর। তোর কল্পনাশক্তি অনেক ইমপ্রুভ করেছে”।
হিয়া বলল, “লিখব তো। গল্পই লিখব। হাতে নাতে ধরি তোদের একবার। তারপর দেখবি”।
রুমানা বলল, “দেখব কী ধরিস তুই। পাগলী কোথাকার”।
হিয়া রেগে মেগে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
২১
“হুইস্কি চলে তো?”
সুপ্রিয় খেয়ে দেয়ে হাঁটতে বেরিয়ে সকালের জায়গাটায় গিয়ে বসেছিল।
নীলাদ্রির গলা শুনে ফিরে তাকিয়ে বলল, “বন্ধ রেখেছি। জন্ডিসের পর থেকে ঠিক সহ্য হয় না। অবশ্য এক আধ পেগ চলে যায়”।
নীলাদ্রি সুপ্রিয়র পাশে বসে বলল, “ওহ। এক আধ পেগ আবার গেলা হল নাকি? তাহলে ওই বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকেই সঙ্গী করতে হবে। একা একা গিলতে পারি না একেবারেই। তা তুমি… তুমি বললে অসুবিধা নেই তো?”
সুপ্রিয় বলল, “না ঠিক আছে”।
নীলাদ্রি বলল, “তুমি কি বুলুকে নিয়ে টেনশনে আছো?”
সুপ্রিয় বলল, “তা একটু তো আছিই। ছেলেটা ছোট। হঠাৎ করে ও এরকম হয়ে গেল কেন ঠিক করে বুঝে উঠতে পারলাম না”।
নীলাদ্রি পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সুপ্রিয়র দিকে এগিয়ে দিল। সুপ্রিয় সিগারেট ঠোঁটে নিলে নিলাদ্রি লাইটার দিয়ে দুজনের সিগারেট ধরাল। বলল, “আমাদের জীবনে অনেক রকম ফেজ আসে বুঝলে। ছোট বেলা, হঠাৎ বড় হয়ে যাওয়া ছোট বেলা, তারপর একটা বিচ্ছিরি বড়বেলা, বিয়েবেলা, সন্তানবেলা একটার পর একটা আসতেই থাকে। এই রূপান্তরগুলো সবাই ঠিক করে নিতে পারে না”।
সুপ্রিয় হতাশ গলায় বলল, “আপনি ওর সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন তো”।
নীলাদ্রি বলল, “সে দেখাই যায়। কিন্তু অনেক সময় কী হয়, মানুষ পরিচিত মানুষদের থেকে অপরিচিত মানুষদের সামনে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। আমি চেষ্টা করে দেখব, কিন্তু কলকাতা গিয়ে ওকে ভাল কোন কাউন্সেলরের কাছে নিয়ে গেলে আশা করা যায় সমস্যার সমাধান হবে”।
সুপ্রিয় অন্যমনস্ক হয়ে সিগারেট টেনে যেতে লাগল।
নাম না জানা কোন এক পাখির ডাক ভেসে আসছে নদীর বয়ে চলার শব্দ ছাপিয়ে। বিকেল হতে চলল। আবার এক দফা বৃষ্টি এলেও আসতে পারে।
রণিতাও বেরিয়েছে। নীলাদ্রি হাত নাড়ল। নীলাদ্রি চাপা গলায় বলল, “একটু শান্তি নেই মাইরি”।
সুপ্রিয় বলল, “আপনি বিয়েটা থেকে বেরিয়ে যেতে চান, তাই না?”
নীলাদ্রি বলল, “স্টিল ভেরি মাচ কনফিউজড। এই সব ব্যাপারে আমরা পরে কথা বলব। ওর সামনে বলা যাবে না, ওকে?”
সুপ্রিয় চুপ করে গেল।
রণিতা এসে বলল, “তোমরা এখানে বসে আছো যে? বুলুকে ডাকতে পারতে?”
নীলাদ্রি সুপ্রিয়র দিকে দেখিয়ে বলল, “দেখো ছোকরা বউ ছাড়াই ঘুরছে”।
সুপ্রিয় বলল, “ও বলল একটু ঘুমানোর চেষ্টা করবে। পাপানকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে ও একটু গড়িয়ে নেবে তাহলে”।
রণিতা বলল, “এই সময় ঘুমালে আমিও ডিপ্রেশনে চলে যাব। দুপুরের ঘুম থেকে উঠলে ভীষণ মন খারাপ লাগে”।
নীলাদ্রি বলল, “এরকম জায়গায় মানুষের কাজ না থাকলে কী করবে রনি? নির্জন জায়গা, মোবাইলের টাওয়ার নেই, কী করার আছে?”
রণিতা বলল, “বই পড়া যেতে পারে। অবশ্য আমি বই পড়ি না। অন্যেরা পড়তেই পারে”।
নীলাদ্রি বলল, “মোবাইলের আবির্ভাবের পর বই পড়ার সংখ্যা ড্রাস্টিকালি কমে গেছে। ফেসবুকের পেজে বই কেনার বিজ্ঞাপন যতজন দিচ্ছে, তার কতভাগ কেনার পরে পড়ছে, সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে। শুধু তুমি নও রণিতাকান্ত, অনেকেরই বই কিনে পড়ার, খেয়াল থাকে না”।
রণিতা বলল, “আমাদের ছোটবেলায় অনেককে দেখেছি বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র রচনাবলী বাড়ির আলমারিতে সাজিয়ে রাখতে। একবারে নতুনের মত”।
নীলাদ্রি সুপ্রিয়র দিকে তাকাল। সে বলল, “সুপ্রিয় কি কোন বিষয় নিয়ে চিন্তিত?”
সুপ্রিয় বলল, “না, ঠিক আছে। এমনি বিশেষ কোন কারণ না”।
নীলাদ্রি বলল, “যদি এমন কোন ব্যাপার থাকে যেখানে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি, বলতে পারো নির্দ্বিধায়”।
সুপ্রিয় বলল, “না থ্যাঙ্কস। সেরকম সিরিয়াস কিছু না”।
রণিতা বলল, “আমার মনে হয় আমরা ওকে বিরক্ত করছি। উনি বসুন, চল একটু হেঁটে আসি”।
নীলাদ্রি কাঁধ ঝাঁকাল, “চল”।
রণিতা বলল, “সিগারেটটা ফেলো দয়া করে। এই পরিবেশটা নষ্ট কোর না”।
নীলাদ্রি সিগারেটটা জুতোর তলায় পিষে দিয়ে বলল, “চল, তুমি বস সুপ্রিয়। রাত্তিরে আড্ডা হবে”।
সুপ্রিয় বলল, “ঠিক আছে”।
দুজনে হাঁটতে শুরু করল। সুপ্রিয়র থেকে খানিকটা দূর যাওয়ার পর রণিতা বলল, “অদ্ভুত কাপল এরা। স্বামী স্ত্রী দুজনেই মনে হয় ডিপ্রেশনে ভোগে”।
নীলাদ্রি বলল, “ঠিক হয়ে যাবে। আমি ফিরে সমরেশের সঙ্গে কথা বলব। তোমার সুপ্রিয়কেও কেন ডিপ্রেশনে আছে বলে মনে হল?”
রণিতা বলল, “মন হল, এমনিই”।
নীলাদ্রি বলল, “না মনে হয়। স্থান মাহাত্ম্য মানুষকে ডিপ্রেসড করে দেয়। ডিপ্রেশনে থাকা বউয়ের জন্য বর যখন একা একা ঘোরে, তখন তাকেও ডিপ্রেসড লাগতেই পারে”।
রণিতা বলল, “আর তুমি? তুমি ঠিক আছো? ডিপ্রেশনে নেই তো?”
নীলাদ্রি বলল, “আমি তো ভাল মানুষ। কারো সাতে পাঁচে থাকি না”।
রণিতা বলল, “এসব বলা মানুষগুলোই বেশি শয়তান হয়”।
নীলাদ্রি বলল, “তুমি আমাকে শয়তান বলে দিলে? যাব্বাবা, আমি আবার কী করলাম?”
রণিতা বলল, “ওই বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়েগুলোর মাথায় প্ল্যাঞ্চেট ঢোকালে কেন? কী দরকার ছিল?”
নীলাদ্রি হাসল, “সময় কাটাতে হবে তো। এখানে বৃষ্টির জ্বালায় বনফায়ার সম্ভব না। তাই সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা হবে, প্ল্যাঞ্চেট হবে, হোক না”।
রণিতা বলল, “তোমার আমার সঙ্গে একলা সময় কাটাতে ইচ্ছা করে না?”
নীলাদ্রি দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, “তার আগে তো তোমাকে ঠিক করে নিতে হবে তুমি কী চাও। পালাতে চাও না যেতে চাও”।
রণিতা বলল, “তুমি কী চাও”?
নীলাদ্রি বলল, “আমি চাই তুমি থাকো। তবে দুজনের আলাদা বেডরুম হোক। দুজনে দুজনের মত থাকুক। দুজন দুজনকে স্পেস দিলে মনে হয় তোমার আমাকে এত অসহ্য মনে হবে না”।
রণিতা বলল, “তুমি এভাবে বিয়ে টিকিয়ে রাখতে চাইবে?”
নীলাদ্রি বলল, “হ্যাঁ। আইডিয়াটা খারাপ?”
রণিতা বলল, “জানি না। ভেবে বলব”।
নীলাদ্রি বলল, “নদীর জলে পা ভিজিয়ে বস। কয়েকটা ফটো তুলি তোমার”।
রণিতা বলল, “ওরা বলছিল এখানে জোঁক আছে। যদি জোঁকে ধরে”?
নীলাদ্রি বলল, “তাহলে থাক। নুন নিয়ে বেরোলে নেমো, তখন ফটো তুলব না হয়। হুইস্কি খাবে? এখানে বললে ব্যবস্থা হয়ে যাবে”।
রণিতা বলল, “নাহ। দরকার নেই”।
নীলাদ্রি হাসল, “যেমন বলবেন ম্যাডাম”।
২২
পল্লব শুয়েছে। কেউ কেউ মদ খেয়ে হুল্লোড় করে, কেউ বমি করে, কেউ ঘুমিয়ে পড়ে।
পল্লব ঘুমিয়ে পড়া দলের লোক।
রুদ্র একটা বই নিয়ে এসেছিল। সেটা পড়তে শুরু করল। কোথাও বেড়াতে যাওয়া মানে প্রতিটা মুহূর্ত বাঁধিয়ে রাখতে হয়। পরে সেই মুহূর্তগুলোয় ফিরে গিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে যেতে হয়।
কটেজের বাইরে ছোট ছোট ফুল গাছ। রুদ্র কটেজের বাইরে বেরিয়ে ফুলগুলোর ফটো তুলছিলো। দেখল পাশের কটেজের ভদ্রমহিলা একটা ফুল হাতে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। রুদ্র বলল, “দিদি, এই ফুলগুলো ছিঁড়বেন না যেন, রিসোর্টের লোকজন দেখলে যদি কিছু বলে!”
সংযুক্তা সঙ্গে সঙ্গে ফুলটা ছেড়ে দিয়ে বলল, “তা ঠিক। এই ফুলটা আমি প্রথম দেখলাম”।
রুদ্র বলল, “আমি দেখিনি আগে। এখানে অনেক ধরণের ফুল দেখলাম”।
সংযুক্তা বলল, “হু, বড় গাছের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছে কত ছোট ছোট গাছ। স্যাঁতস্যাঁতেও জায়গাটা। পাহাড়ি উপত্যকায় তার উপরে। এখানে বেশ কিছু অন্য ধরণের গাছ দেখতে পাওয়া যাবে”।
এর আগে সে সংযুক্তাকে এত কথা বলতে দেখে নি। তাই অবাকই হল। সে বলল, “আপনার ছেলে কি ঘুমিয়ে পড়েছে?”
সংযুক্তা বলল, “হ্যাঁ, আমি ভাবছিলাম ঘুমবো, ঘুম এল না”।
রুদ্র আর কী বলবে কথা খুঁজে পেল না। সংযুক্তা রিসোর্টের কমপাউন্ডের ভেতরে হাঁটতে শুরু করল। ফুল গাছগুলোর সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে সেগুলো দেখতে থাকল।
হিয়া কটেজ থেকে বেরিয়ে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার কাছে এগিয়ে এসে বলল, “এই রুডি, আমাকে একটা কথা সত্যি করে বলবি?”
রুদ্র বলল, “কী?”
হিয়া বলল, “তোর কি মনে হয়, পল্লবের রুমানার উপরে চাপ আছে?”
রুদ্র সতর্ক হল, বলল, “আমি অতো বুঝি নি। আমাকে সেরকম কিছু বলে নি”।
হিয়া বলল, “ও”।
রুদ্র বলল, “হলেই বা কী করবি? শোন, এসব আগুন নিয়ে খেলা টাইপ ব্যাপার, বেশি ঘাঁটিস না”।
হিয়া বলল, “বাংলা সিনেমার ডায়লগ মারিস না তো। আমি যা প্ল্যান করেছিলাম তা আমাদের বাইরে কেউ জানতই না”।
রুদ্র বলল, “তুই আমাকে এসব প্ল্যান বলিস না। আমার শোনার কোন ইচ্ছাও নেই”।
সংযুক্তা হেঁটে তাদের কাছে চলে এসেছিল আবার। হিয়া সংযুক্তাকে দেখে কথা ঘুরিয়ে দিল, “পাপান ঘুমিয়ে পড়েছে?”
সংযুক্তা বলল, “হ্যাঁ”।
হিয়া বলল, “আপনার বোর লাগছে এখানে?”
সংযুক্তা বলল, “বাড়িতে থাকলেই বা কী করতাম? ওখানেও তো কিছু করার থাকে না দুপুরে”।
হিয়া বলল, “আচ্ছা, আপনি কখনো প্ল্যানচেট করেছেন?”
সংযুক্তা বলল, “ছোটবেলায় নীলুদা, আমি আর দাদা করেছিলাম”।
হিয়া বলল, “আদৌ কিছু আছে?”
সংযুক্তা হিয়ার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, “আমার মনে হয়েছিল আছে”।
হিয়া অবাক হল, “কীরকম?”
সংযুক্তা বলল, “মনে হয়েছিল ঘরে আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ এসেছে”।
হিয়া বলল, “ওরে বাবা, রুদ্র, এসব কাটিয়ে দে”।
রুদ্র বলল, “রুমানা করবে না, তুইও করবি না? ভয় পেয়ে গেলি বুঝি?”
সংযুক্তা বলল, “কেউ না করলে আমাকে বোল। আমি করব। আর যাকে ডাকতে হবে, তার ডেসক্রিপশন দিও”।
হিয়া রুদ্র মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। রুদ্র ইশারা করল হিয়াকে রাজি হতে। হিয়া সেটা বুঝে বলল, “না দিদি। আমিই করব। দেখা যাক। রুদ্র আর পল্লব থাকবে তো”।
সংযুক্তা বলল, “তাহলে ঠিক আছে। আমার কেন জানি না মনে হয়, ওরা বেশি কোলাহল পছন্দ করে না। এই ধরণের নির্জন জায়গায় ওদের ডাকলে ওরা ঠিক আসবে”। কথাগুলো বলে সংযুক্তা তাদের কটেজের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “কী অদ্ভুত, উনি এমনিতে তেমন কথা বলেন না, আর এখন কত কথা বললেন”।
হিয়া বলল, “তোকে পছন্দ হয়েছে হয়তো”।
রুদ্র বলল, “ভাগ। ডার্টি মাইন্ড শালা! উনি আমার দিদির মত”।
হিয়া ফিক করে হেসে বলল, “তা ঠিক”।
রুদ্র বলল, “ভাট না বকে হাঁটতে যাবি কি?”
হিয়া বলল, “চল। ডোন্ট মাইন্ড, তোর টাং খিচাই করছিলাম”।
রুদ্র বলল, “এটা কী ধরণের বাংলা?”
হিয়া বলল, “তুই আমার বাংলার ক্লাস নিবি বুঝি? তোর থেকে বাংলায় বেশি নাম্বার পেয়েছিলাম আমি”।
রুদ্র বলল, “নাম্বার দিয়ে সব কিছু বিচার হয় না। নাম্বার সিস্টেমটাই একটা বড় স্ক্যাম। যে ছেলেটা গোটাটাই চোতা মেরে লিখে দিল, সে কি সব জানে?”
কম্পাউন্ডের বাইরে বেরিয়ে দেখা গেল সুপ্রিয় ফিরে আসছে। তাদের দেখে হাসল। রুদ্র আর হিয়াও হাসল।
সুপ্রিয় চলে গেলে হিয়া বলল, “রুমানা সাইট সীং করবে বলছে বটে, আমার কিন্তু এই জায়গা ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। এখানে আমি সাতদিন কাটিয়ে দিতে পারি”।
রুদ্র সুপ্রিয়র ছেড়ে যাওয়া বেঞ্চে বসল। হিয়াকে বলল, “বস”।
হিয়া হালকা গলায় বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আর চেপে রাখতে পারছি না। শুনে নে”।
রুদ্র বলল, “কী? রুমানার পল্লবের উপর চাপ আছে?”
হিয়া অবাক হল, “তুই কী করে জানলি?”
রুদ্র বলল, “বোঝা যায়। কিন্তু কিছু করার আছে কি? যদি না থাকে, তাহলে জাস্ট চেপে যা। ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি নাড়া ঘাঁটা করিস না। আমরা সবাই মিলে কেস খাবো এর পরে”।
হিয়া বলল, “না না, তুই আমাকে একটা জিনিস বোঝা। এতে কেস খাবার কী আছে? স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট বোলে একটা ব্যাপার আছে তো নাকি?”
রুদ্র বলল, “এ দেশে সবই আছে। আবার নেইও। সব দেখে বড় কথা চাকরি নেই। বিয়ে করে খাওয়াবে কী?”
হিয়া বলল, “শোন, যদি ভালবাসা থাকে না, তাহলে খাওয়ানোর চিন্তা করতে হয় না”।
রুদ্র বলল, “ঠিক আছে। দেখা যাবে। ফালতু বকিস না তো। চুপ করে বসে থাক”।
হিয়া বলল, “ঠিক আছে। বসে থাকব। তুই কি ওই মহিলার কথা ভাববি? একটু চুপচাপ বটে, কিন্তু খুব সুন্দরী কিন্তু বল?”
রুদ্র বিরক্ত হয়ে বলল, “তোর কী হয়েছে? এসব কী বলছিস? কত বড় বলত আমার থেকে”?
হিয়া বলল, “তাহলে কার কথা ভাববি?”
রুদ্র বলল, “ভাবতেই হবে এরকম কোন ব্যাপার আছে কি? কিছু না ভেবেও তো চুপ করে বসে থাকা যায়। তাই করব”।
হিয়া হঠাৎ করে রুদ্রর গালে চুমু খেয়ে বলল, “আচ্ছা ভাব”।
রুদ্র অবাক হল, “কী রে, কী করছিস?”
হিয়া আবার রুদ্রর গালে চুমু খেয়ে বলল, “এটা করছি”।
রুদ্র অবাক হয়ে হিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
হিয়া রুদ্রর গলা জড়িয়ে ধরে হতভম্ব রুদ্রর ঠোঁটের উপর নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে চুমু খেতে শুরু করল। রুদ্র প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও শরীরের ডাক উপেক্ষা করতে পারল না। সেও হিয়াকে চুমু খেতে শুরু করল।
মিনিট খানেক ধরে একে ওপরের নিঃশ্বাসে ডুবে থাকার পর রুদ্রর খেয়াল হল। সে মুখ সরিয়ে নিয়ে বলল, “এখানে সবাই দেখতে পারে”।
হিয়া ঘোর লাগা গলায় বলল, “কোথায় যাব তাহলে?”
রুদ্র বলল, “কোথাও না। তুই কী করলি এটা? তুই আমায় ভালবাসিস?”
হিয়া বলল, “ভালবাসার কী দরকার আছে? আমরা ফিজিক্যালি একে ওপরের কাছে অ্যাট্রাকটিভ হতে পারি না”?
রুদ্র হিয়ার দিকে তাকাল, “ঠিক না। ব্যাপারটা ঠিক হল না তাহলে”।
হিয়া বলল, “ভালবাসলে ঠিক হবে বুঝি? তুই এত ওল্ড স্কুল কবে থেকে হলি?”
রুদ্র বলল, “জানি না। ওল্ড স্কুল নাকি সত্যিই জানি না, তবে বিশ্বাস কর, আমি তোকে নিয়ে এভাবে কখনো ভেবে দেখি নি”।
হিয়া রুদ্রর হাতটা ধরে নিজের বুকে ছুঁইয়ে দিয়ে বলল, “আমি ভেবেছি, অনেকবার ভেবেছি তুই আমাকে আদর করে করে পাগল করে দিচ্ছিস। এখানে বললাম। এবার খুশি?”
রুদ্র হিয়ার স্তনে হাত রাখল। প্রবল উত্তেজনা হচ্ছে শরীরে। এ উত্তেজনা ঠিক, ভুল, ভাল, খারাপ, আবেগ সব কিছুকে দূরে ঠেলে দিতে এক মুহূর্তও ভাবে না। সে এবার হিয়ার ঠোঁটের দিকে ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে গেল। হিয়া দু হাত দিয়ে রুদ্রর মাথাটা জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে শুরু করল।
নীলাদ্রি আর রণিতা হেঁটে ফিরছিল। দৃশ্যটা দেখে নীলাদ্রি বলল, “বাহ, স্বর্গীয়। Alas! মিস দোজ ডেজ। আই মিস দোজ ডেজ ব্যাডলি। আর আমার বউ তো আমায় চুমু খেতেই চায় না”।
রণিতা ওদের দেখে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “আবেগে না ভেসে চল। ওরা অস্বস্তিতে পড়বে”।
নীলাদ্রি বলল, “ঠিক ঠিক, চল, ওদের একা থাকতে দাও”…
২৩
রুমানার ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। দুপুরে ঘুমনোর অভ্যাস নেই তেমন। উঠে বসে রইল কিছুক্ষণ।
মন খারাপ লাগছে হঠাৎ করে। বেড়ানো শেষ হয়ে গেলেই আবার ফিরে যাওয়া। একেকজন মানুষের জীবন একেক রকম হয়। সব মানুষ তার জীবন বেছে নিতে পারে না।
অনেকের মত সেও পারবে না।
খাট থেকে নেমে কটেজের বাইরে গেল রুমানা। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। হিয়া আর রুদ্র কি অন্য কটেজটায় আছে?
সিঁড়ি দিয়ে নেমে পাশের কটেজে গেল সে।
দরজা ভেজানো ছিল। খুলে দেখল পল্লব ঘুমোচ্ছে। ঘরে আর কেউ নেই।
রুমানা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে পল্লবের পাশে বসল। নিজের অজান্তেই চোখে জল চলে এল তার। তার গল্পটা এভাবেই না লেখা হয়ে থেকে যাবে।
ছেলেটা কেমন বাচ্চাদের মত ঘুমোচ্ছে। চেঞ্জও করে নি, বাইরের জামা পরেই শুয়ে পড়েছে।
নিজের অজান্তেই তার হাত চলে গেল পল্লবের মাথায়। হাত বুলিয়ে দিতে লাগল পরম যত্নে। পল্লবের ঘুম ভাঙল না। রুমানা ঝুঁকে পড়ে পল্লবের ঠোঁটে চুমু খেল। অনুভূতিটা শরীরে কাঁপুনি দেয়, অদ্ভুত এক ভাললাগার জন্ম দেয়। রুমানা দেখল জানলার পর্দা দেওয়া নেই। সে সব জানলার পর্দা টেনে দিল। পল্লবের মাথার কাছে এসে বসল। জামার উপরের বোতামটা খুলে পল্লবের বুকে হাত দিল। এবার পল্লব জেগে গেল। চোখ খুলে হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী করছিস?”
রুমানা সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করল, “আরে তোর জামার ভিতরে একটা পোকা ঢুকে গেছে। সেটা বের করছিলাম। এদিকে কত রকম পোকা যে ঘুরে বেরোয়!”
রুমানা হোঁচট খেতে খেতে কথাগুলো বলল। পল্লব বলল, “ও। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম। বস বস। ও দুটো কোথায় গেল?”
রুমানা বলল, “হাঁটতে গেছে বোধ হয়। আমিও তো ঘুমচ্ছিলাম। ঘুম ভেঙে ওদের খুঁজতেই এ ঘরে এসে দেখি একটা পোকা ঢুকল তোর জামার ভিতরে”।
পল্লব জামা ঝাড়া দিল। রুমানা বলল, “চলে গেছে বোধ হয়”।
পল্লব বলল, “তা হবে”।
রুমানা বলল, “তোর গলায় ওটা কীসের লকেট রে?”
পল্লব বলল, “এটা? ওই মা পরিয়েছিল। হবে কিছুর একটা”।
রুমানা বলল, “তোদের বাড়ির লোকও ভীষণ কড়া বল?”
পল্লব বলল, “না। সেরকম কিছু না। তোদের বাড়ির লোকজন তো লিজেন্ডারি। ওরকম হওয়া সম্ভব না”।
রুমানা মাথা নিচু করে বলল, “তা ঠিক। মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে যায়”।
পল্লব বলল, “তাও ভাল। দিনকাল যা পড়েছে, তাতে বাড়ির লোক কড়া হওয়া ভাল। আচ্ছা তুই কি পারফিউম দিয়েছিস? একটা সুন্দর গন্ধ আসছে”।
রুমানা বলল, “হ্যাঁ, ওই কিনেছিলাম একটা নিউ মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে। সেটাই দিয়েছি’।
পল্লব বলল, “ও। ভাল গন্ধ বেশ”।
রুমানা বলল, “তোর পছন্দ হয়েছে? তাহলে নিয়ে নিস”।
পল্লব বলল, “ভাগ। মেয়েদের আর ছেলেদের পারফিউম আলাদা হয় জানিস না?”
রুমানা বলল, “ঠিক আছে, তোর জন্য না হয় একটা ছেলেদের পারফিউমই কিনব। কোনটা কিনব জানাস”।
পল্লব বলল, “যেটা খুশি। আমি অতো সব বুঝলে তো হয়েই যেত”।
রুমানা বলল, “হ্যাঁ, তুই কিছুই বুঝিস না”।
পল্লব তেড়িয়া হয়ে বলল, “কেন রে? কী বুঝতে হবে?”
রুমানা বলল, “কিছু না। না রে, তুই বুঝিস। তোর অনেক বুদ্ধি। আমিই বুঝতে পারি না। দেখি, লকেটটা”।
পল্লব বলল, “কী আছে লকেটটায়? নে দেখ”।
রুমানা এগিয়ে এল। কিছু না ভেবেই সে পল্লবের ঠোঁটে চুমু খেল।
পল্লব সরে গেল, “ওরে বাবা রে, কী করছিস? তোর বাড়ির লোক জানলে কী হবে?”
রুমানা বলল, “বাড়ির লোকের গাঁড় মারি”।
রুমানা পল্লবকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে শুরু করল।
পল্লব বিস্মিত হল প্রথমটা। পরক্ষণে রুমানাকে জড়িয়ে ধরল। পরস্পরের শরীরের গন্ধ দুজনকেই পাগল করে দিচ্ছিল। পল্লব রুমানার শরীরে এলোপাথাড়ি চুমু খেতে শুরু করল।
রুমানা বলল, “আই লাভ ইউ পল্লব। আমি তোকে ভীষণ ভালবাসি”।
পল্লব থমকে গেল। বলল, “আমিও বাসি। কোন কিছু আগু পিছু না ভেবে বাসি”।
রুমানার কপালে চুমু খেয়ে সে বলল, “তুই আমার, শুধু আমার”।
২৪
ঘরে ঢুকে নীলাদ্রি বলল, “দিনটা ভাল হয়ে গেল। মানুষ মানুষকে ভালবাসছে, আদর করছে, এটা যে আমার কাছে কতটা স্যাটিসফাইং, তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। আমি যতদূর বুঝলাম, ওরা কিন্তু বন্ধুই, এখানে এসে পরস্পরকে যে ভালবাসে সেটা বুঝতে পেরেছে”।
রণিতা বলল, “কিংবা পুরোটাই পরস্পরের শরীর এক্সপ্লোর করতে চাওয়া”।
নীলাদ্রি বলল, “হোয়াটেভার ইট ইজ, আমার ভাল লেগেছে। আমাদের দেশে প্রকাশ্যে চুমু খাক মানুষ। কেন বল তো, কী সমস্যা এ দেশের মানুষের?”
রণিতা নীলাদ্রির সামনে বসে বলল, “বুঝলাম। তুমি যা বলতে চাইছ, আমি সব শুনলাম। এবার কি আমরা কিছু কথা বলতে পারি?”
নীলাদ্রি বলল, “তুমি সিরিয়াস?”
রণিতা বলল, “হ্যাঁ। আমি সিরিয়াস। বলব?”
নীলাদ্রি বলল, “বল”।
রণিতা বলল, “তুমি ঠিক কী চাইছ?”
নীলাদ্রি বলল, “মা যতদিন বাঁচে, ডিভোর্সটা না করলেই ভাল হয়। আমি বুঝতে পারছি, তুমি এই বিয়েটা আর এনজয় করছো না”।
রণিতা বলল, “তুমি এনজয় করছো তো?”
নীলাদ্রি কটেজের বাইরে চিৎকার করে রিসোর্টের ছেলেটাকে চা দিয়ে যেতে বলে ফিরে এসে বসল। রণিতা বলল, “প্রশ্নের উত্তর দাও। আমাদের এই বিয়েটা তুমি কি এনজয় করছো?”
নীলাদ্রি বলল, “সব কিছুর উত্তর সরাসরি হ্যাঁ বা না দিয়ে হয় না রনি। এনজয়ের ব্যাপারটাও নেই এখানে। তুমি থাকলে আমার বিরক্ত লাগে, না থাকলে অস্বস্তি লাগে। মন খারাপ হয়ে যায়। আমি তোমাকে মিস করি। অন্যদিকে তোমার কথা বলার ধরণ আমার পছন্দ না। ভীষণ ক্যাটক্যাটে তুমি। রসকষ নেই। তোমার সঙ্গে আমার বহুদিন ফিজিক্যাল রিলেশনও নেই। আমার ইচ্ছে হলে তোমার মাথা ধরে। তোমার মধ্যে কোন রহস্য নেই যেটা আমার জানা বাকি আছে। তুমি যেমন আমার একশোটা দোষ বের করতে পারো, আমি তোমার অনেক দোষ বলে দিতে পারব। কিন্তু দুই বাড়ির থেকেই ডিভোর্সটা না করার প্রেশার আসছে। কী করব বল?”
রণিতা বলল, “প্রথমত, আমার ইচ্ছে অনিচ্ছেরও দাম আছে। তোমার যখন ইচ্ছে হবে, তখনই আমাকে শুয়ে পড়তে হবে, এটা সম্ভব না। তার উপর গত কয়েক মাস আমরা শুধু ঝগড়াই করেছি। যদি শুরুটা আমিই করেছি, তবু, সেগুলোর প্রতিটা জায়গায় তোমার দোষই ছিল। ফিজিক্যাল রিলেশনটা দরকারি, তবে তার জন্য মানসিক শান্তি দরকার। আমার সেটা ছিল না।
দ্বিতীয়ত, আমার সত্যিই মাথা ধরার সমস্যা আছে। মাইগ্রেন যে কী মারাত্মক, সেটা যার হয়, সে বুঝতে পারে।
তৃতীয়ত, যদি ডিভোর্স করতে চাও, তাহলে বাবা, কাকা, দাদু, ঠাকুমা, মা… কারো কথা না ভেবে নিজের সিদ্ধান্ত নাও। তুমি শুধু আমাকে বল, তুমি কি ডিভোর্সটা হলে বেঁচে যাবে?”
নীলাদ্রি চিন্তিত মুখে রণিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাবি নি”।
রণিতা বলল, “আমি যদি বলি আমি ডিভোর্স হলে বেঁচে যাবো, তাহলে কি তুমি সেপারেশনের দিকে এগোবে?”
নীলাদ্রি বলল, “হ্যাঁ। দ্বিতীয়বার ভাবব না”।
রণিতা বলল, “এটুকুই শুনতে চাইছিলাম। কারো জন্য বিয়েটা টেকাতে হবে না তোমায়’”।
নীলাদ্রি বলল, “তুমি কী চাও?”
রণিতা বলল, “আমি এমন কারো স্ত্রীর পরিচয়ে থাকতে চাই না, যে নিজে সম্পর্কটায় থাকতে অস্বস্তি বোধ করে”।
নীলাদ্রি বলল, “আমরা কি তাহলে পারমানেন্টলি বেরিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি?”
রণিতা বলল, “হ্যাঁ। আমাদের রিলেশনে কোন স্পার্ক নেই আর, অকারণ টেনে নিয়ে গিয়ে লাভ নেই”।
চা দিয়ে গেল। নীলাদ্রি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “ধুস, এখানের চা ভালো না। দার্জিলিঙ-এর এত কাছে যে এত বাজে চা পাওয়া যায়, জানতাম না”।
রণিতা বলল, “আমাদের একটা সেটলমেন্টে আসতে হবে। উকিলের ঝামেলাতেও আমি আর যেতে চাইছি না। নিজেরা ঠিক করে নি কী কী করব এর পরে। তোমার বাড়ি থেকে আমাকে যা যা গয়না দিয়েছিল, আমি নেব না। আমার বাড়িরগুলো নিয়ে যাবো। নোটবুক আছে? লিখে ফেলতাম তাহলে”।
নীলাদ্রি ব্যাগ থেকে একটা নোটবুক আর পেন বের করে রণিতাকে দিল।
নীলাদ্রি বলল, “এই ব্যাপারটা আমার মনে ধরেছে। প্রেমহীনতায় প্রেমকে জোর করে আটকে রাখা সম্ভব না। আমরা যদি ভেবে দেখি…”
রণিতা বলল, “প্লিজ, আমাকে কনসেন্ট্রেট করতে দাও। লেকচার দিও না। তোমার কচি ফ্যানেদের তোমার লেকচার শুনি না হয়”।
নীলাদ্রি বলল, “তাহলে তুমি লেখো। আমি একটু হেঁটে আসি”।
রণিতা বলল, “অ্যাস ইউ উইশ”।
নীলাদ্রি চা শেষ করে কটেজের বাইরে গেল। দেখল কটেজের বাইরে চেয়ার নিয়ে সংযুক্তা চুপ করে বসে আছে। সে বলল, “কী রে বুলু? কী করছিস? হাঁটতে যাবি?”
সংযুক্তা উঠে বলল, “চল”।
নীলাদ্রি বলল, “তোর ছেলে কি এখনো ঘুমোচ্ছে? বর কোথায়?”
সংযুক্তা বলল, “হ্যাঁ ও এসে ছেলের পাশে শুয়েছে। যাওয়া যাবে এখন”।
নীলাদ্রি বলল, “চল তাহলে”।
সংযুক্তা নীলাদ্রির সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল।
নীলাদ্রি বলল, “আমার বিয়েটা আর বাঁচবে না বুঝলি। ভেঙে যাবে”।
সংযুক্তা বলল, “ও”।
নীলাদ্রি বলল, “ও বললি কেন?”
সংযুক্তা বলল, “কী বলব বুঝলাম না ঠিক। ভাল হল না খারাপ হল তাও তো বুঝতে পারলাম না”।
নীলাদ্রি বলল, “হ্যাঁ। তোদের সঙ্গে অনেক দিন ধরেই আমি ডিটাচড। সমরেশের সঙ্গেও তো সেভাবে কথা হয় না আর। সময় জিনিসটাই এমন। পাল্টে দেয় সব কিছু। একটা সময় তোদের বাড়িতেই পড়ে থাকতাম। অথচ এখন দেখ”।
সংযুক্তা বলল, “কাকীমা কেমন আছেন?”
নীলাদ্রি বলল, “বাবা চলে যাবার পর ভীষণ ইনসিকিওর হয়ে গেছে। মা কিছুতেই চায় না ডিভোর্সটা হোক, খুব শক পাবে”।
সংযুক্তা বলল, “ডিভোর্সই তো ভাল”।
রিসোর্টের গেট অবধি চলে এসেছিল তারা। সংযুক্তার কথা শুনে নীলাদ্রি বলল, “কেন? ডিভোর্স ভাল কেন বলে মনে হল তোর?”
সংযুক্তা বলল, “আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় সব কিছু ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়ে চলে যাই। সব কেমন আটকে ধরে। পাপান হবার পরে আরো বেশি হয়েছে সেটা”।
নীলাদ্রি বলল, “কিন্তু সেখানে তো বাচ্চাটার হাত নেই। মাকে ছাড়া ও কী করবে বল? মায়া হয় না ছেলেটার জন্য? কষ্ট হয় না? সুপ্রিয়ও তো ভাল ছেলে রে। কেন এরকম হয় তোর?”
সংযুক্তা বলল, “জানি না”।
নীলাদ্রি বলল, “ঠিক আছে। না জানলেও হবে। তোর কি মনে কোন নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে? এরকম মনে হয় যে, কেউ তোর কোন ক্ষতি করতে পারে?”
সংযুক্তা বলল, “আমার অনেক কিছুই মনে হয়”।
নীলাদ্রি বলল, “তুই লেখা অভ্যাস করতে পারিস তাহলে। অনেক খানি লিখলি কোন ডায়েরীতে। ঠিক কী কী সমস্যা হচ্ছে, কোথায় কী প্রবলেম হচ্ছে। সব লিখবি। পারবি না?”
সংযুক্তা হাসল, “আমি কি তোমার মত নীলুদা? তুমি কী সুন্দর লিখতে পারো”।
নীলাদ্রি বলল, “তোকে তো গল্প উপন্যাস লিখতে বলি নি। আমি চাইছি তুই একটা জায়গায় লেখ, কোথায় কোন সমস্যা হচ্ছে। রণিতাও এখন যেমন লিখছে আমাদের ডিভোর্স হলে কার ভাগে কোন জিনিসটা পড়বে। পার্থিব জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ বস্তু বেঁচে থাকার জন্য। আমি বেঁচে আছি, আমার সব জিনিস আমার কাছে দরকারি। যেই আমি মরে যাব, সেগুলো হয় অন্য কেউ ইউজ করবে বা ধাপার মাঠে পড়ে থাকবে”।
সংযুক্তা উত্তর দিল না। চুপ করে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল।
নীলাদ্রি বলল, “সুপ্রিয় ভালো ছেলে। সব হাজব্যান্ড বউয়ের ডিপ্রেশন বোঝার চেষ্টা করে না। সুপ্রিয় করে”।
সংযুক্তা বলল, “জানি। সবাই বলে, ও খুব ভাল”।
নীলাদ্রি বলল, “সবাই বলে মানে? তুই বলিস না?”
সংযুক্তা বলল, “হ্যাঁ, আমিও বলি”।
নীলাদ্রি বলল, “মানে? তোর কি ওর ওপর কোন অভিযোগ আছে?”
সংযুক্তা নদীর সামনের বেঞ্চে বসে পড়ল।
নীলাদ্রি বলল, “বুলু। তুই আমাকে বলতে পারিস। আমি কাউকে কিছু বলব না”।
সংযুক্তা বলল, “সবাই খুব ভাল নীলুদা। কাউকে নিয়ে কোন সমস্যা নেই। হয়ত সমস্যাটা আমাকে নিয়েই”।
নীলাদ্রি সংযুক্তার পাশে বসে বলল, “ঠিক আছে, আমি এখানেই বসলাম, তোর যদি আমাকে কিছু বলার কথা মনে হয়, তাহলে বলতে পারিস”।
পাহাড়ি খরস্রোতা নদী বয়ে চলেছে। নদীর বয়ে চলার শব্দ যেন ঝর্ণার বয়ে চলা। গাছপালা আর পাহাড় পেরিয়ে ধূসর আকাশ উঁকি মারছে। ঝুলন্ত ব্রিজটা একা একা দুলছে। একটা কুকুর খানিকটা দূরে শুয়ে আছে। স্থির চিত্রের মত পরিবেশ। সংযুক্তা বলল, “নীলুদা তোমার মনে আছে আমাদের বাড়িতে টিভির ঠিক উপরে আমার আর দাদার দার্জিলিঙে ঘোড়ার পিঠে চড়ার ফটো আছে?”
নীলাদ্রি বলল, “হ্যাঁ, দিব্যি মনে আছে”।
সংযুক্তা বলল, “আমার না রোজ ওই সময়টায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। ঠিক ওই বিকেলটায়। বাবা মার হাত ধরে হাঁটছি”।
নীলাদ্রি বলল, “নস্টালজিক হয়ে যাস?”
সংযুক্তা মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। ভীষণ। বাড়ি গিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। আবার ছোট হয়ে যেতে ইচ্ছা করে”।
নীলাদ্রি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সবাই আমরা ওই সময়টায় ফিরতে চাই রে। পারি না”।
২৫
হিয়া রুদ্রর পাশে হাঁটছিল। রুদ্র বলল, “আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না ব্যাপারটা। তুই কি সিরিয়াস?”
হিয়া বলল, “হ্যাঁ। তুই নোস, তাই তো?”
রুদ্র বলল, “গ্রেট আদর কামস উইথ গ্রেট রেসপনসিবিলিটি। আদর করলাম যখন, তখন সিরিয়াস না হয়ে যাই কী করে?”
হিয়া বলল, “মানে? তুই কী বলতে চাইছিস আমি অবলা? আদর করলেই বিয়ে করতে হবে মাথার দিব্যি দিয়েছি তোকে? তোর যদি কোন ফিলিংস না থাকে, তাহলে চিন্তা করিস না। ব্যাপারটা দিব্যি এখানেই শেষ করে দেওয়া যাবে”।
রুদ্র বলল, “আমাকে খানিকটা সময় দিবি? আমি জীবনেও এসব করি নি, তুই এই কিছুক্ষণ আগে অবধিও আমার বন্ধু ছিলিস…”
হিয়া বলল, “তো? আমি এখনো তোর বন্ধুই? শত্রু হয়ে গেলাম নাকি?”
রুদ্র হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তাও ঠিক। প্রেম করা মানে অনেক ঝামেলা বল? খোঁজ নিতে হবে বাবু খাইসো? বাবু কী পরসো?”
হিয়া হিহি করে হেসে ফেলে বলল, “তা খোঁজ নিবি একটু, কী আছে?”
রুদ্র বলল, “চাপ হয়ে গেল ভাই। আমি নিজেও জানি না আমি পারব নাকি?”
হিয়া বলল, “কী পারতে বলেছি তোকে?”
রুদ্র বলল, “সেসব না”।
হিয়া বলল, “তবে?”
রুদ্র বলল, “দেখ, এখন চাকরি বাকরির যা অবস্থা, তাতে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ে করা চাপ হয়ে যাবে না?”
হিয়া বলল, “ওহ, তুই বিয়ে অবধি ভেবে নিয়েছিস? তা ভাল। ঘটনা হল, শুধু তোকে কেন দাঁড়াতে হবে? আমাকেও তো দাঁড়াতে হবে। আমরা দুজনে একসঙ্গে দাঁড়ালে কোন চাপ হবে না। আমি বসে খাবো না”।
রুদ্র দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, “বাপ রে, কত কিছু ভাবতে হচ্ছে”।
হিয়া বলল, “ভাবতে হবে না। তুই নেচার স্টাডি কর। এই দেখ, সকালে কত বৃষ্টি হচ্ছিল, এখন বৃষ্টি ধরে গেছে। কাল হয়ত রোদও উঠে যাবে। মৌজা হি মৌজা”।
রুদ্র হিয়ার হাত ধরল। বলল, “কী ঠাণ্ডা রে তোর হাতটা”।
হিয়া বলল, “একটু জড়িয়ে ধরলেই হাতটা আর ঠান্ডা থাকবে না”।
রুদ্র বলল, “সিরিয়াসলি? তুই এতখানি হাওয়াস কি পূজারি?”
হিয়া বলল, “হ্যাঁ। সে তো ইচ্ছে করেই। কেন রে? তুই পারবি না ঠিক ঠাক প্রেম করতে? চুমুটা তো ঠিক ঠাকই খাস দেখলাম”।
রুদ্র বলল, “ভাল লেগেছে। আরেকবার খাওয়া যাবে?”
হিয়া বলল, “কেন নয়? আয়”।
রুদ্রকে জাপটে ধরল হিয়া। রুদ্র হিয়ার ঠোঁটে চুমু খেল। হিয়া বলল, “কী ভাল জায়গা না? লোক নেই, জন নেই, মেট্রো দাদু নেই, আমার ক্যারেক্টার বিচার করার কেউ নেই, নিশ্চিন্তে চুমু খাওয়া যায়?”
রুদ্র হিয়ার চুল সরিয়ে দিয়ে হিয়ার দিকে ভাল করে তাকিয়ে রইল। হিয়া বলল, “কী দেখছিস?”
রুদ্র বলল, “মানে তুই ভাব, এত বড় পৃথিবীতে তুই আমার নিজের। ব্যাপারটার মধ্যে একটা ইয়ে ইয়ে ব্যাপার আছে না? তুই কোন দিন আমাকে কোন রকম কোন হিন্টও দিলি না। এরকম কেন?”
হিয়া বলল, “ফিয়ার অফ রিজেকশন। তুই হ্যান্ডু, ভাল গান করিস। আমায় যদি ভাগিয়ে দিতিস?”
রুদ্র জোরে হেসে উঠে বলল, “এটাই শোনার বাকি ছিল”।
হিয়া বলল, “জানিস তো, আমার এখন ফিরতে ইচ্ছেই করছে না। মনে হচ্ছে তোকে নিয়ে এখানেই থেকে যাই”।
রুদ্র বলল, “আইডিয়াটা খারাপ না। আমি তোর সঙ্গে আছি। কোন জায়গায় বাড়ি বানাবো বল। জলের চিন্তা নেই, নদী আছে। আর খাবো কী?”
হিয়া বলল, “কেন? স্কোয়াশের তরকারি! পাহাড়ে এলেই খেতে হয়। আমি রান্না শিখে নিয়েছি”।
হঠাৎ করে রুদ্রর ফোন বেজে উঠল। রুদ্র অবাক হয়ে বলল, “এই দেখ। ফোন বাজছে রে। টাওয়ার এসছে। দেখি”।
রুদ্র ফোন বের করে দেখল বাড়ি থেকে মা ফোন করেছে। কথা বলে ফোন রেখে বলল, “যাক। মার গলাটা তো পেলাম। তুই ফোন করলে করে নে”।
হিয়া বলল, “আমি মেসেজ করে দিয়েছি। ফোন করলেই একগাদা ডিটেলস দিতে হয়। মনে হয় পুলিশি জেরার মুখে পড়ে গেছি। কী দরকার?”
রুদ্র বলল, “তোর বাবা মার জন্য মন খারাপ হয় না?”
হিয়া বলল, “সেরকম কিছু না। বাড়িতেই তো থাকি। আলাদা করে কেন মন খারাপ হবে”?
রুদ্র বলল, “আমার থেকে দূরে গেলে এর পরে মন খারাপ হবে না”?
হিয়া বলল, “দেখা যাক”।
রুদ্র বলল, “তাহলে কি আজ থেকে আমরা বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড?”
হিয়া হেসে বলল, “ইয়েস”।
২৬
সংযুক্তাকে ওদের কটেজে পৌঁছে নিজের কটেজে ফিরল নীলাদ্রি।
রণিতা বলল, “বুলুকে নিয়ে কোথায় গেছিলে?”
নীলাদ্রি বলল, “নদীর তীরে। ওর কথা শুনছিলাম”।
রণিতা বলল, “তোমার কখনো আমার কথা শুনতে ইচ্ছা হয় নি। অন্যের কথা শোনার জন্য অনেক সময় আছে তোমার কাছে। এটা মন্দ না”। রণিতার কথার শ্লেষটা নীলাদ্রি বুঝল। বলল, “আমাদের তো আর কথার কিছু নেই রনি। আর কি কিছু আছে?”
রণিতা টিভি চালিয়ে দিল।
নীলাদ্রি খাটের উপর বসে বলল, “হিসেব হল?”
রণিতা বলল, “এখন হচ্ছে না। অনেক কিছুই মিলছে না। পরে বাড়ি ফিরে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবা যাবে”।
নীলাদ্রি বলল, “ঠিক আছে। তাই ভেবো না হয়”।
রণিতা একটার পর একটা চ্যানেল চেঞ্জ করছিল অস্থিরভাবে। নীলাদ্রি বলল, “কী হয়েছে তোমার? কোন কারণে রেগে আছো মনে হচ্ছে?”
রণিতা বলল, “একটা চ্যানেল নেই ঠিক ঠাক। এভাবে হয় নাকি?”
নীলাদ্রি স্থির চোখে রণিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে তোমার? বলবে?”
রণিতা টিভি বন্ধ করে দিয়ে বলল, “আমায় একটা সত্যি কথা বলবে?”
নীলাদ্রি বলল, “কী?”
রণিতা বলল, “তোমার সঙ্গে বুলুর কোন সম্পর্ক ছিল? মানে এটা তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হত তাই না? বন্ধুর বোনের সঙ্গে অনেকেরই প্রথম প্রেম হয়”।
নীলাদ্রি হেসে ফেলল। বলল, “তুমি এখনো আমাকে ভালবাসো রনি”।
রণিতা মাথা নাড়ল, “এসব ছেঁদো কথা বন্ধ কর। আমার শোনার দরকার নেই। যে প্রশ্নটা করেছি, তার উত্তর দাও। কথা ঘুরিও না”।
নীলাদ্রি বলল, “কথা ঘোরাবার কী আছে রনি? এসব বিষ কেন মনের মধ্যে ঢুকছে তোমার? বুলু আমার বোনের মত, ও মনে হয় আমাকে রাখীও পরিয়েছিল”।
রণিতা বলল, “হুহ। রাখী পরিয়েছিল! ওরকম কত পাড়ার ভাইয়াকে দেখলাম সাঁইয়া হয়ে গেল”।
নীলাদ্রি বলল, “এসব কী বলছো তুমি? নিজেকে কেন ছোট করছো রনি?”
রণিতা বলল, “শোন, তোমাদের এই কবি লেখকদের ক্যারেকটার তো আমি জানি, এদের ক্যারেক্টার বলে কিসসু হয় না। সব শালা সমান। তোমাদের এখন হেঁটে আসা দেখেই আমি বুঝে গেছি তোমাদের মধ্যে কিছু তো ছিল যেটা এখনও ঢেকে রাখা যাচ্ছে না”।
নীলাদ্রি হেসে ফেলল, বলল, “এবার একবারে টিনেজার প্রেমিকাদের মত করছ মাইরি। এবার থামো”।
রণিতা বলল, “থামব না। আমি অনেক কিছুই বুঝতাম, কোন কালে কিছু বলি নি। বই উদ্বোধনের নামে কচি কচি মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটানো, মেয়ে কবিদের সঙ্গে ঘোরা, তোমার কি মনে হয় আমি ঘাসে মুখ দিয়ে চলতাম? তবু আমি তোমাকে স্পেস দিয়ে এসেছি, ভেবেছি তুমি তোমার মত থাকো। কখনো তোমাকে সন্দেহ করি নি”।
নীলাদ্রি বলল, “তাহলে যাওয়ার সময়েই বা এক বালতি দুধে চোনা ফেলছ কেন? আমাদের সম্পর্কটা টিকবে না, তুমি বুঝতে পেরেছ, সরে যেতে চেয়েছ, বিচ্ছেদ চেয়েছ, আমি সব একবারে মেনে নিয়েছি। একসঙ্গে থাকার অপশনও দিয়েছিলাম আলাদা ঘরে, সেটাও ভেবে দেখো নি, তাহলে খামোখা এখন এসব কেন টানছ বোল তো? কী চাইছ তুমি?”
রণিতা বলল, “আমি কিছু চাইছি না। আমার যেটা মনে হয়েছে, সেটা আমি তোমায় বলেছি”।
নীলাদ্রি বলল, “ভুল মনে হয়েছে। আজে বাজে কথা মনে হয়েছে। আর লেখক কবিরা মানুষই হয়। বাইরের গ্রহের প্রাণী নয়। চরিত্র ঠিক রাখা গেলে সব পরিস্থিতিতেই রাখা যায়। তোমার সঙ্গে আমার স্বপ্নের বিয়ে হয়েছিল। আমরা যত দিন সম্পর্কে ছিলাম, আমাদের মাঝে কোন দিন তৃতীয় কেউ আসে নি। তুমি এখন যেটা করছ বা বলছ, সেটা নিজেও জানো, একবারে বাজে কথা বলছ”।
কলিং বেল বাজল। নীলাদ্রি দরজা খুলে দেখল সুপ্রিয় দাঁড়িয়ে আছে। নীলাদ্রি বলল, “এসো”।
সুপ্রিয় বলল, “পরে আসব? ব্যস্ত আছেন?”
নীলাদ্রি বলল, “না না, ঠিক আছে। এসো”।
রণিতা প্রাণপণে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করল। সুপ্রিয় ঘরের এসে বসল। নীলাদ্রি বলল, “বল”।
সুপ্রিয় খানিকটা ইতস্তত করে বলল, “আপনি হুইস্কির কথা বলছিলেন, এখানে কি ব্যবস্থা করা যাবে?”
২৭
রুদ্র কটেজে ফিরে দেখল দরজা বন্ধ। বাইরে থেকে তালা দেওয়া নেই। সে কলিং বেল বাজাল। বেশ কিছুক্ষণ সময় পরে দরজা খুলল পল্লব।
রুদ্র ঘরের ভিতর ঢুকে দেখল রুমানা খাটের উপর বসে আছে। বিছানার চাদর অবিন্যস্ত।
সে অবাক চোখে পল্লবের দিকে তাকাল।
পল্লব হাত নেড়ে বলল, “ওই প্ল্যানচেটের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিল রুমানা”।
রুদ্র বলল, “তোর গালে লিপস্টিক লেগে আছে। মুছে নে কিছু দিয়ে”।
পল্লব তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে পড়ল।
রুমানা বলল, “এই আমি একটু আসছি। কাজ আছে”।
রুদ্র বলল, “ঠিক আছে”।
রুমানা বেরিয়ে যেতে রুদ্র বাথরুমের দরজা ধাক্কা দিল। পল্লব বেরিয়ে এসে বলল, “কী হয়েছে?”
রুদ্র বলল, “কী হয়েছে মানে? কী করছিলিস তোরা?”
পল্লব ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে বলল, “ভাই জানতামই না। আগুন উলটো দিকেও লেগেছিল। যা তা ব্যাপার তো!”
রুদ্র খাটের তলা থেকে রামের বোতলটা বের করে খানিকটা খেয়ে বোতল রেখে বলল, “কোর্স কমপ্লিট করেছিস?”
পল্লব বলল, “দূর। আমি অতো কিছু পারি নাকি?”
রুদ্র বলল, “কী পারিস তুই? শুধু মদ গিলতে? যাক গে, যা করেছিস ভেবে করেছিস তো? এরপর কী করবি?”
পল্লব বলল, “যা করেছি মানে? আমি ওকে ভালবাসি। যা হবে দেখা যাবে, কিন্তু আমি ওকেই বিয়ে করব”।
রুদ্র বলল, “ভাল। যা করবি করিস, তবে সব থেকে বড় কথা, এখান থেকে ফেরার পরে যেন তোর এই সাহসটা থাকে, তাহলেই হবে”।
পল্লব বলল, “সাহসের কী আছে ভাই? ওদের বাড়ি থেকে যদি বলে মুসলমান হয়ে যেতে, হয়ে যাব”।
রুদ্র বলল, “কেন মুসলমান হতে হবে? ভালোবাসায় কি কোন শর্ত থাকে নাকি? তুই কিছুই হবি না, রুমানাও কিছু হবে না। ভালোবাসা থাকলে যে যেমন আছে, তেমনই থাকবে”।
পল্লব মাথা চুলকে বলল, “আমি তোকে বোঝানোর জন্য বললাম যে আমি কতটা ডেসপারেট। কনভার্ট হবার কথাটা নেহাতই কথার কথা ভাই”।
রুদ্র বলল, “আগুন দুদিকেই লেগেছে যখন, তখন ঠিক আছে, কোন ব্যাপার না। আমরা তো রইলামই। দেখা যাক”।
আবার প্রবল বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। রুদ্র তাড়াতাড়ি জানলা বন্ধ করে দিয়ে বলল, “এই তো ঠিক হয়ে এসেছিল ভাবলাম। আবার শুরু হয়ে গেল!”
পল্লব বলল, “ভাই, বলছিলাম কী, একটা প্রপোজাল ছিল”।
রুদ্র বলল, “কী?”
পল্লব বলল, “দেখ, আজ ওয়েদারটা বড্ড ভাল”।
রুদ্র বলল, “তো”?
পল্লব বলল, “আজ আমরা প্ল্যানচেটও করব”।
রুদ্র বলল, “হ্যাঁ। বলে যা”।
পল্লব বলল, “ইয়ে মানে, আজ আমি আর রুমানা এই রুমে থাকলে তোর কোন আপত্তি হবে?”
রুদ্র পল্লবের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, “এই ধক তুই দেখাতে পারবি?”
পল্লব বলল, “মানে ভাবনা চিন্তার লেভেলে আছে ভাই। খারাপ হবে ব্যাপারটা?”
রুদ্র জানলার বাইরের অঝোরে বৃষ্টি দেখতে দেখতে বলল, “কোন কিছুই খারাপ হবে না। মিয়াঁ বিবি রাজি হলে কে কী বলবে কিচ্ছু যায় আসে না। তুমি এগিয়ে চল বন্ধু, আমি তোমার সঙ্গে আছি”।
পল্লব বলল, “ভাই জীবনে কোন মেয়েকে চুমু খাই নি, আমার মনে হচ্ছে আমি কিছু একটা করলাম। একটা গান কর ভাই। প্লিজ”।
রুদ্র বলল, “ঠিক আছে। গিটারটা দে”।
পল্লব তাড়াতাড়ি গীটার এনে দিল। রুদ্র গান ধরল
This magic moment
So different and so new
Was like any other
Until I kissed you
And then it happened
It took me by suprise
I knew that you felt it too
By the look in your eyes
Sweeter than wine
Softer than the summer night
Everything I want I have
Whenever I hold you tight
This magic moment
While you lips are close to mine
Will last forever
Forever til the end of time
…
২৮
“
এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না,
শুধু সুখ চলে যায়।
এমনি মায়ার ছলনা।
এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়।
তাই কেঁদে কাটে নিশি, তাই দহে প্রাণ,
তাই মান অভিমান,
তাই এত হায় হায়।
প্রেমে সুখ দুখ ভুলে তবে সুখ পায়।
সখী চলো, গেল নিশি, স্বপন ফুরাল,
মিছে আর কেন বল।
শশী ঘুমের কুহক নিয়ে গেল অস্তাচল।
সখী চলো।
প্রেমের কাহিনী গান, হয়ে গেল অবসান।
এখন কেহ হাসে, কেহ বসে ফেলে অশ্রুজল।
প্রথম প্রথম সবই ভাল লাগে। অভিমান, তাকে দেখতে না পাওয়ার কষ্ট, তার সঙ্গে সারাদিন থাকার ইচ্ছা, কোথায় আলাদা পালিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা… সব মিলিয়ে মনে হয় এই তো বেশ। এইটুকুর জন্যই তো বেঁচে ছিলাম। আর তারপরে? বিজ্ঞানে আদর্শ পরিস্থিতির উল্লেখ আছে। প্রেম অনেকটা সেই আদর্শ পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনীয়। আদর্শ পরিস্থিতিতে প্রেমকে স্পর্শ করা যায়। তারপর যেটা হয়, সেটা সম্পর্কে যত কম বলা যায় তত ভাল।
গল্পের শুরুটা তো ভালই ছিল আমাদের। মুম্বইতে চাকরি, অফিস শেষে ফ্ল্যাটে ফিরে টিভি দেখা। পিজির অন্য মেয়েটা ভারি মুখচোরা, কেমন আড়চোখে তাকায়। বুঝতে পারি না অনেক কিছুই, তবে বুঝতে আমিও চেয়েছিলাম। সেও। একদিন হঠাৎ করেই কথা বলা শুরু। দুই বাড়ির লোককে গোয়ায় উড়িয়ে নিয়ে এসে বিচে বিয়ে করা। স্বপ্নদৃশ্যের মত পরস্পরের চোখে চোখ রেখে বসে থাকা। তখন কি ভেবেছিলাম, শেষ রক্ষা হবে না? ভালোবাসার গাড়িটা স্বপ্নের উড়ান দেওয়ার পর ক্র্যাশ করে যাবে? ভাবি নি।
এখন বরং খারাপ লাগার থেকে মুক্তি পেতে বড্ড ইচ্ছা করছে। তা বলে কি আমি ভালবাসিনি? বেসেছি। সমস্যা হল, সম্পর্কে শুধু ভালোবাসা থাকলেই হয় না। কম্প্যাটিবিলিটি একটা বিরাট ফ্যাক্টর যেটা কম থাকলে কম্প্রোমাইজ করতে হয়। সমস্যা হল আর কত কম্প্রোমাইজ করতে হবে? কম্প্রোমাইজ করতে করতে মানুষ ব্যাক্তিত্বহীন হয়ে পড়ে, নিজের মত চলতে না পেরে একটা সময় সব কিছু থেকে দূরে যেতে শুরু করে। এ গল্পের শেষটুকু তাই তিক্ততা নিয়ে বেঁচে থাকুক। গল্পকেও বেঁচে থাকতে হয়। তিক্ততা, ব্যর্থতা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। আমাদের গল্পটা এভাবেই বেঁচে থাকবে।
ভুল ছিল সব কিছু? তা কেন? ভুল কিছুই ছিল না। ভালবাসা সত্যি ছিল। শরতের শিউলির মত পবিত্র সে ভালোবাসা। একে অপরকে না দেখতে পারার দুঃখ, দেখা হবার পর সেই হাসিটা… প্রথম অনুভূতিকে মলিন করে দেওয়া অতো সহজ কাজ নয়।
থাকবে এগুলোই, খুব ভাল এডিটিং জানা কেউ বাকিগুলো ডিলিট করে দেবে…”
“তুমি কি এখন হুইস্কি সাপ্লায়ার হয়েছ?”
নীলাদ্রির লেখার মাঝে প্রশ্ন করল রণিতা।
নীলাদ্রি বলল, “সাপ্লায়ারের কিছু নেই তো। ওকে বলেছিলাম। তখন না করেছিল, এখন খাবে বলছে। রিসোর্টের ছেলেটাকে বললাম। দেখা যাক, যদি কিছু সুরাহা করতে পারে”।
রণিতা বলল, “এখানে আর কটেজ ফাঁকা আছে নাকি দেখো তো। আমার এখন ওসব গন্ধ সহ্য হবে না”।
নীলাদ্রি বলল, “বেশ তো, তুমি এখানেই শোও। আমি অন্য কোথাও একটা ম্যানেজ করে নেব। অদ্যই শেষ রজনী প্রিয়তমা। কাল থেকে আমরা দুজনে মুক্ত বিহঙ্গ”।
রণিতা বলল, “তোমার পক্ষে সেটা বলা সহজ। ছেলেদের কোন সমস্যা হয় না। তাছাড়া তোমার চারপাশে অনেক মৌমাছি ঘুরে বেড়ায়। আমাকে এখান থেকে ফিরতে হবে। সহজ হবে না ব্যাপারটা”।
নীলাদ্রি হাসল, “তুমি পারবে রনি আমি জানি। তোমার সে ক্ষমতা আছে, খাদের মুখ থেকে ফিরে আসতে পারবে তুমি”।
রণিতা বলল, “সেটা দেখা যাবে। তবে সুপ্রিয় এসে তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল বল?”
নীলাদ্রি বলল, “কী থেকে বাঁচাল?”
রণিতা বলল, “তোমাকে আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম”।
নীলাদ্রি বলল, “তুমি আমার সঙ্গে তো কিছুদিন ছিলে! তোমার মনে হচ্ছে না প্রশ্নটা ভুল ভাল?”
রণিতা বলল, “কিছুদিন ছিলাম বলেই বলছি। তুমি তো মায়াবী মানুষ। সব কিছুতেই তোমার বড্ড মায়া। বুলুর প্রতি মায়া থেকে ভালোবাসা জন্মায় নি কোন দিন”?
নীলাদ্রি চুপ করে রণিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের ছোটবেলাটা অতোটা জটিল ছিল না রনি। ভালবাসলে ভালোই বাসতাম, আর দাদা হলে দাদার মত ভালবাসতাম। মুখে এক আর কাজে আরেক করতাম না। আমরা সৎ ছিলাম সম্পর্কের ব্যাপার। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও কি কোনদিন অসততার শিকার হয়েছে?”
রণিতা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল।
নীলাদ্রি বলল, “আমাদের পাড়ায় একটা ফ্যামিলি ছিল জানো তো। সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করত। যখন ঝগরার বিষয় পেতো না, তখন অদ্ভুত সব কারণ দেখাতো। তোদের দিকের গাছ, পুকুরের মাছ, কেন আমাদের দিকে চলে এসেছে, … অদ্ভুত অদ্ভুত সব বিষয়বস্তু তৈরি হয়ে যেত ঝগড়ার জন্য। আমাদের তো সব কিছু শেষ হয়েই গেছে, অনেক চেষ্টা করা হয়েছে দু তরফ থেকেই। আমরা পারি নি। এখন এই সম্পর্কটা কি এসব তিক্ততা ডিজার্ভ করে? ভালবাসলে থেকে যাও, অকারণ ইস্যু তৈরি কোর না আর।”
রণিতা নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, “আই অ্যাম সরি। ভুল হয়ে গেছে। বুঝতে পারি নি। তোমাদের এক সঙ্গে আসতে দেখে হঠাৎ কী যে হল, এখন খারাপ লাগছে। তুমি রাতে এখানেই শুও। কোথাও যেতে হবে না। লাভ মেকিং ছাড়াও আমাদের দীর্ঘদিন পাশাপাশি আবেগহীন হয়ে শুয়ে থাকা অভ্যাস আছে। সেরকমই একটা রাত কাটুক আজ”।
নীলাদ্রি বলল, “বেশ, তবে তাই হোক…”
২৯
অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হয়ে চলেছে। পাপান ঘুম থেকে উঠেও ওঠে নি। মাকে জাপটে ধরে শুয়ে আছে। দরজা সারাক্ষণ বন্ধ করে রাখতে হয়, রিসোর্ট থেকে বলে দিয়েছে। নইলে ঘরের ভিতর জোঁক ঢুকে যেতে পারে। পাপানের জন্যই বেশি করে সতর্কতা নিতে হচ্ছে।
সংযুক্তা পাপানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। পাপান বলল, “মা, একবার তো টয় ট্রেন চড়া হবে বল আমার?”
সংযুক্তা বলল, “হবে তো। কেন হবে না?”
পাপান বলল, “তুমি কখনো টয়ট্রেন চেপেছো?”
সংযুক্তা বলল, “হ্যাঁ। সে ভারি মজার ব্যাপার। কু ঝিক ঝিক ঝিক করে ট্রেন চলতে থাকে। একদিকে পাহাড়, আরেকদিকে খাদ। পাহাড়ি ছেলেরা ট্রেন থেকে নেমে যেত, ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়তো, আবার ট্রেনে উঠে পড়ত। এখন ওসব আছে নাকি জানি না। খুব মজা হত আমাদের ছোটবেলায়”।
পাপান বলল, “আমার এখানে ভাল লাগছে না মা। সারাদিন বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। আমরা কেন দার্জিলিং গেলাম না?”
সংযুক্তা বলল, “বৃষ্টি হলে পাহাড়ের ধ্বস নামে তো। গাড়ি যেতে পারে না। আটকে থাকে। অনেক সময় পাহাড়ের উপর থেকে পাথর পড়ে যায়। সে পাথর কোন গাড়িতে পড়ে গেলে আর রক্ষে নেই। এই সময় দার্জিলিং যাওয়া যায় না সোনা”।
পাপান বলল, “আমরা কবে যাবো তবে?”
সংযুক্তা বলল, “যখন মেঘ থাকবে না। আকাশ পুরো পরিষ্কার হয়ে যাবে। আর ধ্বস নামবে না। তখন ঠিক যাবো”।
পাপান বলল, “আর আমার গোঁফ কবে উঠবে? আমি বড় হয়ে যাবো কবে?”
সংযুক্তা বলল, “ছোট থাকাই ভাল রে বাবু। যদি এই সময়টাই থেকে যায়, তাহলে দেখবি সব থেকে ভাল থাকবি। ছোটবেলার মত কোন সময় হয় না”।
সুপ্রিয় দরজা ঠেলে ঢুকল। সে পুরো ভিজে গেছে। সংযুক্তা তাড়াতাড়ি উঠে টাওয়েল দিল। সুপ্রিয় বলল, “আমি স্নান করে নিচ্ছি”।
পাপান বলল, “তোমার কাশি হবে তো বাবা”।
সুপ্রিয় শূন্য চোখে সংযুক্তার দিকে তাকিয়ে স্নানে ঢুকে গেল।
সংযুক্তা গিজার চালিয়ে দিয়ে বলল, “ঠাণ্ডা জলে স্নান কোর না”।
সুপ্রিয় বলল, “ঠিক আছে”।
মিনিট দশেক পর সুপ্রিয় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে অবাক চোখে দেখল সংযুক্তা ছেলের সঙ্গে সাপ লুডো খেলতে বসেছে। লুডোটা কেনার পর থেকে ব্যাগের এক কোণে পড়ে ছিল। সংযুক্তা যে সেটা বের করে খেলতে পারে, সুপ্রিয় ভাবতেই পারে নি। সে চমৎকৃত হয়ে বলল, “তুমি ঠিক আছো এখন?”
সংযুক্তা হাসি হাসি মুখে বলল, “কেন ঠিক থাকবো না? এসো এসো। তুমিও খেলো। দেখো পাপানটা কেমন চোট্টামি শিখে গেছে এর মধ্যেই। পাঁচ পড়লে সাপে কাটবে, চার পড়লে সিঁড়িতে যাবে। ওর পাঁচ পড়েছে আর ও সিঁড়িতে গুটি তুলে দিয়েছে। ভীষণ বদমাইশ হয়েছে ছেলে”।
সুপ্রিয় বিস্মিত হয়ে চেয়ারে বসল। সংযুক্তা পাপানের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে খেলছে। পাপানের কান মুলে দিচ্ছে, চুল এলো মেলো করে দিচ্ছে, সংযুক্তা এমনভাবে খেলছে যেন এই খেলাটার জন্যই সে সারাজীবন অপেক্ষা করে ছিল।
নিরানব্বইতে সাপ বসে আছে। সংযুক্তার গুটি সেখান থেকে নেমে সাতে চলে গেল। দুঃখ পাবার পরিবর্তে সংযুক্তা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।
শেষমেশ পাপানই জিতে গেল। জিতে খুব আনন্দ পেল। খাটের উপরে লাফ ঝাঁপ দিতে শুরু করল। সংযুক্তা সুপ্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি খেলো না। লুডো খেলি এসো তিন জনে মিলে”।
সুপ্রিয় খাটের উপর এসে বসল। তিনজনে লুডো খেলা শুরু করল। পাপানের গুটি কাটলে পাপান কাঁদতে শুরু করল। সংযুক্তা বলল, “সব সময় জিততে পারা যায় না পাপান। হারলে কাঁদতে নেই। আবার সুযোগ আসবে দেখবি। খেলতে থাক, এর পরে তুই বাবার পাকা গুটি খেয়ে নিবি। কাঁদবি না বোকা ছেলে”।
পাপান কাঁদতে কাঁদতে দান দিল। ছয় পড়েছে। মুখে হাসি ফুটল তার। পর পর আবার দুবার ছয় পড়ল। এবার আর পাপান কাঁদল না। হেসে গড়িয়ে পড়ল।
৩০
“হাই ফ্রেন্ডস, আমি আপনাদের প্রিয় ভ্লগার রাজা, আর এখন আমি আপনাদের আপডেট দিচ্ছি… উমম, এখন কটা বাজে? ঘড়ি বলছে এখন বাজে সন্ধ্যে ছটা, তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, অন্ধকার হতেই চারদিকে রাত নেমে গেছে, আর সব থেকে দুঃখের কথা হল, আমি দার্জিলিং যেতে পারলাম না। এখানে কোন টাওয়ার নেই, জানি না কবে আমার ভ্লগ আপডেট করতে পারব, আপাতত শুধু রেকর্ড করছি সোলো ট্রাভেলার হিসেবে, স্টে ব্লেসড, স্টে কুল, বাই”।
একটা ছেলে কটেজের বাইরে থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মোবাইলের ক্যামেরায় কথাগুলো বলল। রুদ্র দরজা খুলে সিগারেট খাচ্ছিল, পল্লবকে বলল, “এ কে রে? নতুন এলো নাকি?”
পল্লব বলল, “আমি কেমনে জানব?”
রুদ্র বিরক্ত গলায় বলল, “আবার বাঙাল ভাষায় কথা বলছিস?”
পল্লব বলল, “সরি সরি। বলছি ওই আর কী, ঠিকই বলেছিস, আজ এল বোধ হয়”।
রুদ্র বলল, “ভ্লগার ব্যাপারটা খুব চলছে এখন বল?”
পল্লব বলল, “তা চলছে, ইউ টিউব ভিউস থেকে ভালো মাল পাওয়া যায়। কত লোক আছে চাকরি বাকরি ছেড়ে এখন শুধু ভ্লগ করছে”।
রুদ্র ভেবে বলল, “খারাপ না। টাকা পাওয়া যায় যাতে, সেটা খারাপ হতে পারে না”।
পল্লব বলল, “তা তো বটেই”।
রুমানা আর হিয়া ছাতা নিয়ে তাদের কটেজে এল।
রুমানা রুদ্রকে দেখে লজ্জা পাচ্ছিল। হিয়া বলল, “পাশের কটেজে একটা হেবি হ্যান্ডু ছেলে এসেছে”।
রুদ্র ভ্রূ কুঁচকাল, “ওহ, তাই নাকি? খুব হ্যান্ডু?”
হিয়া বলল, “ওই যেটুকু দেখলাম আর কী। বেশ টল, ফেয়ার আর হ্যান্ডসাম। ব্যাগ নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই তো ঢুকল”।
রুদ্র বলল, “ও। ভাল তো। তুই ওর কটেজেই থেকে যা তাহলে”।
হিয়া অবাক হয়ে বলল, “মানেটা কী? এটা কী ধরণের কথা?”
রুদ্র বলল, “না মানে তোর ভাল লেগেছে যখন, তখন প্রপোজ করে দে”।
হিয়া বলল, “প্রপোজ করার কী আছে? এরকম ভাবে কথা বলছিস কেন?”
পল্লব বলল, “ভাইয়ের খারাপ লেগেছে। ভাই একাই হ্যান্ডু তো এখানে। কম্পিটিটর এসে গেল আর কী”।
রুদ্র বলল, “বাজে বকিস না। কম্পিটিটরের কী আছে? ভাল লাগলে ভালো লাগা আটকে রাখতে নেই জানিস না? ছুটে ছুটে চলে যেতে হয়”।
হিয়া রেগে গেল, “আজে বাজে কথা বলবি না একদম। এরকম কথা আমি নতুন বলছি? আগেও তো বলেছি? এখন এত রেগে যাওয়ার কী আছে?”
পল্লব রামের বোতলটা রুদ্রর হাতে দিয়ে বলল, “নে ভাই, ঢুকু ঢুকু মেরে দে। এখন এসব ভুলে গিয়ে কাজের কোথায় আয়। আমাদের অঞ্জন স্যারকে ডাকার সময় এগিয়ে এসছে। ওর সম্পর্কে বরং ভাবতে শুরু করা যাক”।
রুদ্র বলল, “আমার তো মনে হয় না এখানে আর কারো এসব ব্যাপারে কোন ইন্টারেস্ট আছে বলে। হ্যান্ডু ছেলে এসে গেছে। এখন তার দিকে ইন্টারেস্ট ঘুরে গেছে”।
পল্লব অবাক হয়ে বলল, “এ কী রে? তোর আবার কী হল? এরকম করে কথা বলছিস কেন? হ্যান্ডু ছেলেকে হ্যান্ডু ছেলে বলা যাবে না?”
হিয়া বলল, “ছেড়ে দে। আমি কটেজে গেলাম। রুমি থাকলে থাকুক, আমি আর থাকছি না”।
হিয়া বেরিয়ে গেল ছাতা নিয়ে। রুমানা হতাশ গলায় পল্লবের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তাহলে যাই। ওকে একা ছাড়া ঠিক হবে না”।
পল্লব বলল, “যা”।
রুমানা বেরিয়ে যেতে পল্লব রাগী গলায় রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা কী হল?”
রুদ্র বলল, “কী হবে?”
পল্লব বলল, “এসব নৌটঙ্কী কবে থেকে শুরু করলি? আর হিয়া কাকে কী বলবে তাতে কী হয়েছে?”
রুদ্র বলল, “কী হয়েছে মানে? কিছুক্ষণ আগেই তো চুম্মাচাটি করলাম! বলল আমরা বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড। এখন অন্য ছেলে দেখতে শুরু করবে? ক্যারেক্টার ঢিলা কেন হবে এতোটা?”
পল্লব হাঁ করে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা আবার কখন হল? তুই আমারটা জেনে নিলি আর এটা বললি না কেন? মহা হারামি ছেলে তো তুই!”
রুদ্র গম্ভীর হয়ে বলল, “হয়েছিল আর কী। সে যাই হোক, এসব করে অন্য ছেলে দেখা যায় নাকি?”
পল্লব বলল, “কে প্রপোজ করল? কে প্রথম কাছে এল?”
রুদ্র বলল, “হিয়া। আমি ওসব ভাবিই নি কোন দিন। এখন দেখছি ক্যারেক্টার ঠিক নেই। হ্যান্ডু ছেলে দেখে বেড়াচ্ছে”।
পল্লব বলল, “আরে এটা এমনি মজা করে বলেছে ভাই। তুই খচে যাবি বুঝলে থোড়িই বলত? আর তুই এখন ওর সঙ্গে ঝামেলা করলে আমার কী হবে? আজ ইজিলি আমরা একসঙ্গে থাকতে পারতাম। তুইও সুহাগরাত করে নিতে পারতিস! যে তোকে শরীর দিচ্ছে, সে মন দিল বা না দিল তাতে কী যায় আসত”!
রুদ্র বলল, “বেশি বকবি না। তুই বরং ওদের কটেজে চলে গিয়ে বল তুই আমাকে ঝেড়ে ওখানে চলে গেছিস। ঠিক হয়ে যাবে”।
পল্লব রুদ্রকে ভেঙিয়ে বলল, “ঠিক হয়ে যাবে। নিজে আজে বাজে কাজ করে সব বিলা করে দেবে, তারপরে আমাকে ড্যামেজ কন্ট্রোলে পাঠাবে। এই যে তুই রাগ দেখালি, হিয়া চলে গেল, এবার আজকের প্ল্যানের কী হবে? প্ল্যানচেট হবে না? তুই চল। ক্ষমা চা। এখন প্রথম প্রথম মাখন ব্যাপার আছে, সাইজ হয়ে যাবে”।
রুদ্র বলল, “আমি যাব না। যে মেয়ে এক ঘণ্টা আগে চুমু খেয়ে অন্য ছেলে দেখে ঝুলে পড়ে সে মেয়ের পাল্লায় আমি পড়ব না”।
পল্লব বলল, “ঠিক আছে, তুই রিলেশনে যাস না। জাস্ট ক্ষমা চা। আমার দিকটা ভাব। প্লিজ ভাই। প্লিজ। তুই হিয়াকে ভালবাসিস নাকি জানি না, আমি তো রুমানাকে ভালোবাসি। আমাদের রাতটা মাটি করিস না”।
রুদ্র বলল, “ক্ষমা আমি চাইতে পারব না। এটাই লাস্ট”।
পল্লব বলল, “তাহলে ছেঁড় বসে বসে। যতসব”।
পল্লব বৃষ্টির মধ্যে কটেজ থেকে বেরিয়ে হিয়াদের কটেজে গিয়ে ঢুকল।
পল্লবকে ঢুকতে দেখে রুমানা বলল, “একী! ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলবি তো!”
পল্লব দেখল হিয়া বসে বসে কাঁদছে। সে বলল, “তোদের এত কিছু হয়েছে, বলিস নি তো! আর হয়েছেই যখন, তখন রুদ্রর সামনে ওই কথাটা বলতে গেলি কেন?”
হিয়া বলল, “আমি অতো ভেবে কবে থেকে কথা বলি? একবার কিছু হলে এভাবে অধিকার দেখাতে হয় নাকি?”
পল্লব রুমানার দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে বলল, “দেখ এবার কী হয়। এটারই বাকি ছিল”।
৩১
রিসোর্টের ছেলেটাকে বলে একটা ঘর খোলানো গেছে। একটা হুইস্কির বোতল নিয়ে সুপ্রিয়কে নিয়ে বসেছে নীলাদ্রি। সঙ্গে চিকেন পকোড়া, বাদাম আছে।
নীলাদ্রি গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “তুমি হঠাৎ সিদ্ধান্ত পালটালে যে?”
সুপ্রিয় বলল, “কেন জানি না, ওকে নিয়ে একটা চাপ হচ্ছিল। ডিপ্রেশন ব্যাপারটা নিয়ে আমি সেভাবে কিছু ভাবি নি আগে, এখন কেন জানি মনে হচ্ছে ভাবা দরকার ছিল। ঠিক কোন পরিস্থিতিতে ও এরকম পাল্টে গেল সেটা বুঝতে পারছিলাম না। বিকেলে আপনার সঙ্গে কথা বলার পর খানিকটা হালকা হয়েছে, এটা একটা রিলিফ”।
নীলাদ্রি বলল, “আমাদের ছোটোবেলা খানিকটা হলে আমাদের হালকা করে। তুমি তোমার ছোটবেলা নিয়ে ভাবলে ভালো থাকো না?”
সুপ্রিয় বলল, “আমি সেভাবে ভেবে দেখারও সময় পাই না। এত চাপ থাকে কাজের। অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হচ্ছিল না। পাপানটা টয় ট্রেন চড়বে বলে লাফাচ্ছিল। বাগডোগরার টিকিট কাটলাম। বৃষ্টির জন্য প্ল্যান চেঞ্জ করতে হল। আমার চিরকাল এরকমই হয়, যেটা প্ল্যান করে এগোবো, সেটা হয় না”।
নীলাদ্রি সিগারেট ধরিয়ে সুপ্রিয়কে দিল।
বলল, “আমারও একই। বিয়েটা বাঁচানোর জন্য মা খুব চাপ দিল। আমি বুঝতে পারছিলাম ব্যাপারটা হবে না, সেই তো বাঁচল না”।
সুপ্রিয় বলল, “বাঁচল না?”
নীলাদ্রি মাথা নাড়ল, “নাহ। বাঁচল না। এভাবে জোড়াতাপ্পি দিয়ে কিছু বাঁচে না”।
দরজায় নক হল। নীলাদ্রি গলা তুলল, “খোলা আছে”।
রুদ্র রুমে ঢুকে বলল, “আমি একটু বসতে পারি? ডিস্টার্বড লাগছে”।
নীলাদ্রি বলল, “এসো এসো। কী হয়েছে? কোন প্রবলেম? হেল্প করতে পারি?”
রুদ্র ম্লান হাসল, “না না, এমনি বসব একটু। আপনাদের অসুবিধা হলে চলে যেতে পারি”।
নীলাদ্রি বলল, “না বসে পড়। গ্লাস আছে একটা এক্সট্রা”।
রুদ্র হাত বাড়িয়ে গ্লাস নিল।
সুপ্রিয় চুপ চাপ সিগারেটে টান দিয়ে যাচ্ছে।
নীলাদ্রি বলল, “সম্পর্কের শুরুটা অনেকটা চিউয়িং গামের মত হয় জানো তো! কিংবা বাংলা সিরিয়ালের মত। শুরুটা দারুণ হয়, মিষ্টি, মিষ্টি। তারপরই আসল খেল শুরু হয়”।
রুদ্র তেতো গলায় বলল, “শুরুটাও মিষ্টি হয় কোথায়? সেখানেও তো হাজার ঝামেলা”।
নীলাদ্রি বলল, “উহু, শুরুতে সব মিষ্টি না হলে অন্তত স্বাদ থাকে। শেষের দিকে স্বাদ বলে কিছু থাকে না। টানার জন্য টেনে যাওয়া। আমি আমার স্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। ও এই সম্পর্কটাকে আর না টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি একমত হয়েছি”।
সুপ্রিয় বলল, “তারপর আপনি আবার বিয়ে করবেন বা প্রেমে পড়বেন না?”
নীলাদ্রি হেসে ফেলল, “খেপেছ? ন্যাড়া কতবার বেলতলা যায়?”
রুদ্র বলল, “আপনি আর ম্যাম, মানে আপনারা ডিভোর্স করে ফেলবেন?”
নীলাদ্রি বলল, “হ্যাঁ। এরপরে আমাদের জীবনটা জতুগৃহ বা ওই কী যেন সিনেমা, হ্যাঁ, প্রাক্তনের মত হয়ে যাবে। কোন জায়গায় হঠাৎ দেখা, দুজনেই প্রবল সেন্টু খাব। যা তা ব্যাপার আর কী”।
রুদ্র হেসে ফেলল। নীলাদ্রি বলল, “জীবন মানে সেন্টু বাঁচিয়ে এগিয়ে যাওয়া। তা তোমার কি ঝগড়া হয়েছে তেনার সঙ্গে?”
রুদ্র লাজুকভাবে হ্যাঁ বলল।
নীলাদ্রি বলল, “তুমি কি পাগল নাকি হ্যাঁ? এইসব রোম্যান্টিক ওয়েদারে কখনো ঝগড়া করে আমাদের মত বুড়োদের সঙ্গে বসে মদ গেলে? ছি ছি লজ্জার ব্যাপার। এক কাজ কর, এক দু পেগ টানো, তারপর চল আমরা যাচ্ছি, একটা ফুল নিয়ে রাজকন্যার কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও। চূড়ান্ত লেভেলের চরম ব্যাপার হবে একটা। তা কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছে বলা যাবে?”
রুদ্র বলল, “মানে ব্যাপারটা এখন খুব হাস্যকর মনে হচ্ছে আর কী”!
নীলাদ্রি বলল, “ফাটা বাঁশে আটকে গেছো?”
রুদ্র মাথা নিচু করে বলল, “ওই রকমই ব্যাপার আর কী! আবার খানিকটা কনফিউজডও। আজকের আগে জানতামই না ওর আমার উপর কোন ফিলিং আছে। আজ বলল, আর আজ সন্ধ্যেতে একজন নতুন ছেলে এসছে, বলে দিল ছেলেটা নাকি হেবি হ্যান্ডু। লোকে যেদিন প্রথম সম্পর্কে ঢোকে, সেদিনই কী করে অন্য ছেলে দেখে?”
সুপ্রিয় হেসে ফেলল।
নীলাদ্রি গম্ভীর মুখে বলল, “কঠিন ব্যাপার। তোমাদের বয়সে এরকম রাগ আমারও হত। একচুয়ালি রাগ অভিমান না থাকলে সম্পর্কের মজা কোথায় আর? এই যে তুমি এখন গিয়ে রাগ ভাঙাবে, তারপর দেখবে আসল মজা”।
রুদ্র বলল, “কী মজা? বুঝলাম না?”
নীলাদ্রি বলল, “রাগটা ভাঙিয়েই দেখো। আর প্ল্যানচেট কখন করা হবে?”
রুদ্র পাংশু মুখে বলল, “মিটুক সব। যদি না মেটে তাহলে ক্যান্সেল করতে হবে হয়ত”।
নীলাদ্রি বলল, “আহ, অনিশ্চয়তা! এটাই তো জীবনের মজা! সব কিছু ঠিক ঠাক হয়ে গেলে জীবন আর জীবন থাকে না”।
রুদ্র চুপ করে বসে গ্লাস শেষ করে উঠল, “আমি একবার দেখি, যদি কিছু করা যায়”।
নীলাদ্রি থাম্বস আপ দেখাল, “বেস্ট অফ লাক”।
বৃষ্টির তেজ কমেছে। তবে একবারে থামে নি। কটেজের বাইরে সোলারের আলো। এই আলোর ঔজ্জ্বল্য কম, জ্বলে এই অবধিই।
রুদ্র ধীর পায়ে হিয়াদের কটেজের দরজা খুলল। তিনজন বসে টিভি দেখছে।
রুদ্র বলল, “নীলাদ্রিদা বলছিল আমাদের প্ল্যানচেটটা কখন করব?”
হিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “রুমানা, ওকে বলে দে, ক্যারেক্টারলেস মেয়ের সঙ্গে প্ল্যানচেট করতে হবে না”।
রুদ্র বলল, “আমি ক্যারেক্টারলেস বলি নি। রুমানা, ওকে বলে দে”।
রুমানা বলল, “আমি কারো মেসেঞ্জার হতে পারলাম না। তোরা ঠিক কর কী করবি। আমি বেরলাম”।
পল্লব বলল, “হ্যাঁ, আমিও বেরলাম। তোরা কী করবি কর”।
দুজনে বেরিয়ে গেল।
রুদ্র অপরাধীর মত মুখ করে বলল, “ভুল হয়ে গেছে। আমি হুট করে ওরকম বলে দিয়েছি। তা বলে তুই অন্য ছেলে দেখবি?”
হিয়া বলল, “রাস্তা ঘাটে সকাল বিকেল কত রকম ছেলে দেখি, দেখবো। তা বলে তোর প্রতি ভালবাসা কমে যাবে? কোথাকার বলদ তুই?”
রুদ্র তাড়াতাড়ি হিয়ার কাছে গিয়ে বলল, “সরি। এক্সট্রিমলি সরি। আমি নিজেই বুঝেছি ব্যাপারটা ঠিক হয় নি”।
হিয়া বলল, “ঠিক আছে। আমারও উচিত হয় নি। ঠিকই তো, কোথাকার কোন আবাল, তাদের কেন দেখব আমি। আজ থেকে আমি শুধু তোর কথাই ভাবব। আমি সরি বাবু”।
হিয়া রুদ্রর ঠোঁটে ঝাঁপিয়ে পড়ে চুমু খেতে শুরু করল। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কম্বলের ভিতর সেঁধিয়ে গেল।
৩২
“আমরা এখন এই ঘরে ছজন আছি। আমি যাদের নাম জানি, একবার বলে নিচ্ছি। আমি নীলাদ্রি, ও সুপ্রিয়, রুদ্র, পল্লব, হিয়া আর তোমার নামটা একবার বল”।
নীলাদ্রি রুমানার দিকে তাকাল।
রুমানা তার নাম বলল।
নীলাদ্রি বলল, “আমি যে পদ্ধতিতে প্ল্যানচেট করব, সেটা ওইজা বোর্ড পদ্ধতি। এই প্ল্যানচেটের প্রণালী সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানে। কাঠের তৈরি একটি বোর্ডের দুই দিকে লেখা থাকে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’। এছাড়াও ইংরেজি বর্ণমালার ২৬টি অক্ষর থাকে এতে। দল বেঁধে বা একান্তভাবে এই বোর্ডকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কোন মৃতের আত্মাকে ডাকা হয়। কোনো একজনের উপর আত্মা ভর করলে সেই ব্যক্তির হাত বোর্ডের উপর চলতে থাকে। দলের বাকিরা প্রশ্ন করলে সে বোর্ডের অক্ষরগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে উত্তর দিতে থাকে। অ্যাম আই ক্লিয়ার?”
রুমানা পল্লবের হাত ধরে বসে ছিল। বলল, “আমার কেমন ভয় ভয় লাগছে”।
নীলাদ্রি বলল, “সেক্ষেত্রে তুমি এখানে না থাকতে চাইলে, নাও থাকতে পারো”।
পল্লব রুমানার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, “ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি তো আছি”।
কলিং বেল বাজল। নীলাদ্রি বলল, “আমি রিসোর্টের ছেলেটাকে বলে এলাম এখন বিরক্ত না করতে, তাও এসেছে। দেখো তো রুদ্র”।
রুদ্র দরজা খুলে দেখল রণিতা দাঁড়িয়ে আছে। নীলাদ্রি উঠে বাইরে বেরোল, “কিছু বলবে?”
রণিতা বলল, “আমি আসতে পারি? না আমি থাকলে সমস্যা হবে?”
নীলাদ্রি বলল, “এসো। তুমি তো আবার এসব বিশ্বাস কর না”।
রণিতা ঠান্ডা গলায় বলল, “আমার বোর লাগছিল। আমি তোমাদের বিরক্ত করব না, ভেবো না”।
নীলাদ্রি বলল, “এসো”।
রণিতা ঘরের ভেতর ঢুকে বসল।
নীলাদ্রি বলল, “যদিও অনেকেই আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে না, তবু কয়েকটা কথা আমি আগে থেকে বলে রাখি। আমরা একটি আত্মাকে ডাকতে চলেছি। হতে পারে, যাকে ডাকছি, তার পরিবর্তে অন্য কেউ চলে এল। তাই যাকে ডাকা হবে, তার সম্পর্কে তোমরাই শুধু জানো, এমন কিছু প্রশ্ন করবে। নিঃসন্দেহ হলে, তবেই এগনো যাবে। বোর্ডে ইয়েস আর নো যেমন আছে, তেমনই এ থেকে জেড অবধি অক্ষরও আছে। এই ত্রিভুজাকৃতি বস্তুটার নাম প্ল্যানচেট। এটাই হল আমাদের উত্তর পাওয়ার যন্ত্র। এটা যেদিকে পয়েন্ট করবে, সেটাই জানবে উত্তর। যদি হ্যাঁতে পয়েন্ট করে, তবে উত্তর হবে হ্যাঁ, যদি না-র দিকে পয়েন্ট করে, তাহলে উত্তর হবে না। আমাদের ডেকে নেওয়া আত্মা যদি হ্যাঁ বা নায়ের পরিবর্তে অন্য কিছু বলতে চান, তাহলে এই প্ল্যানচেট সেই অক্ষরগুলোর দিকে ইঙ্গিত করবে। একজন নোটপ্যাড নিয়ে বস, যে অক্ষরগুলো লিখে রাখবে। আরো কয়েকটা কথা মনে রাখব আমরা, এক, আমি এর আগে ওইজা বোর্ডের ব্যবহার কলকাতায় করেছি। খুব বেশি লাভ হয় নি। যদি আত্মা বলে সত্যি কিছু থাকে, তাহলে এই নির্জন জায়গায় আসার চান্স অবশ্যই আছে। সাহস রেখো, আগেই ভয় পেও না। এ কথাগুলো অনেকটা প্লেনের সেফটি ইন্সট্রাকশানের মত শোনাচ্ছে। তবু আমার কাছে একটা ছোট নোট বুক আছে। আমি সেখান থেকে পয়েন্টগুলো পড়ছি, সবাই শোন
১) যে আত্মাই আসুক, তার সঙ্গে আমরা কোন রকম মজা যেন না করি। ইতিহাস বলছে, এর ফলাফল ভাল হয় নি।
২) আত্মাকে কখনো জিজ্ঞেস করবে না তুমি কবে মারা যেতে চলেছ।
৩) আত্মা আসার পর অনেক রকম কথা বলতে পারে। ধরে নিও না সেগুলো সব সত্যি। তোমাকে বিভ্রান্ত করার জন্যও সে অনেক রকম আজে বাজে উত্তর দিতে পারে।
৪) তোমাদের মধ্যে একজনই প্রশ্ন করবে। ঠিক করে কে”।
পল্লব বলল, “রুদ্রর সঙ্গেই স্যারের ভাল র্যাপো ছিল। রুদ্রই প্রশ্ন করুক”।
নীলাদ্রি বলল, “ওকে। ৫ নম্বর পয়েন্ট, রুদ্র প্রশ্ন করার সময় কেউ অকারণ হেসে উঠবে না। এর ফলে নেগেটিভ এনার্জি প্রশ্রয় পেতে পারে”।
রণিতা বিড়বিড় করে বলল, “বুলশিট”।
নীলাদ্রি সেটা শুনে না শোনার ভান করে বলল, “৬, রুদ্র কোন রকম জোক টাইপ প্রশ্ন করবে না। ৭, পল্লব, তুমি উত্তরগুলো লিখে যা উত্তর পাবে, সেটা সবাইকে শোনাবে। তোমার এটাই কাজ। বাকিরা চুপ করে প্ল্যানচেটে হাত দিয়ে বসে থাকবে। তোমাদের উপস্থিতিটাই আসল। ৮, ত্রিভুজাকৃতি বস্তুটা বা প্ল্যানচেট, আমাদের কাজ হয়ে গেলে আমরা এটা যেন বোর্ডে না ফেলে রাখি। এটা বাজে ভাগ্য আনে। ৯, প্রশ্ন করা হয়ে গেলে রুদ্র প্ল্যানচেটটা গুডবাইতে ধরবে। এর ফলে যে আত্মা আসবে, সে চলে যাবে। নইলে সে আমাদের সঙ্গেই থেকে যেতে পারে। ১০, আমরা ঘর অন্ধকার করে শুধুমাত্র মোমবাতি ব্যবহার করব। সব আলো বন্ধ থাকবে। ১১, কারো ডিপ্রেশন থাকলে এই বোর্ড ব্যবহার করা যাবে না। ১২, যে মুহূর্তে বুঝবে তোমরা যাকে ডাকছ সে আসে নি, সঙ্গে সঙ্গে সেই আত্মাকে গুডবাই করে দেবে। অন্য কেউ যেন না আসে। ঠিক আছে?”
নীলাদ্রি কথা শেষ করে সবার দিকে তাকাল।
রুমানা কাঁপা কাঁপা হাতে পল্লবের হাত ধরে রয়েছে।
রুদ্র বলল, “একদম ঠিক আছে”।
নীলাদ্রি বলল, “প্রসেস শুরু করার আগে আমি তোমাদের স্যারের সম্পর্কে জানতে চাই”।
রুদ্র একটু থমকে, সময় নিয়ে বলল, “অঞ্জন স্যার আমাদের সঙ্গে বন্ধুর মত মিশতেন। উনি শুধু টিউশনের সময়ে না, অন্যান্য সময়েও আমাদের সঙ্গে অনেক কথা বলতেন। গাইড করতেন। যতদূর জানি, স্যারের বিবাহিত জীবনও সুখের ছিল। একদিন হঠাৎই স্যার গলায় দড়ি দিলেন। আমাদের একটাই প্রশ্ন, স্যার কেন এই কাজটা করলেন”?
নীলাদ্রি বলল, “স্যারের ছবি আছে কোন? থাকলে আমাদের দেখাও”।
রুদ্র বলল, “হ্যাঁ, আমি লাগতে পারে বলে বের করে রেখেছি”।
রুদ্র তার ফোন বের করে সবাইকে দেখাল।
নীলাদ্রি রণিতার দিকে তাকাল, “আমরা প্রসেসটা শুরু করব। তুমি কী করতে চাও?”
রণিতা বলল, “আমি মিডিয়েটর হতে চাই। আমি বুজরুক নই, এসব বিশ্বাস করি না। যদি সত্যি কিছু থাকে, আমার মাধ্যমে আসুক”।
নীলাদ্রি বলল, “ওভাবে মিডিয়েটর ঠিক হবে না। আত্মা যার উপর আসবে, সেই নিজের থেকে প্ল্যাঞ্চেটে উত্তর দেওয়া শুরু করবে”।
নীলাদ্রি তার ব্যাগ থেকে বোর্ডটা বের করে খাটের উপর রাখল। সবাই খাটের উপর বোর্ড ঘিরে বসল। রুমানা পল্লবকে ফিসফিস করে বলল, “তুই সব বুঝে এটা করছিস তো?”
পল্লব বলল, “একদম। আজ ভাল রান্না আছে। তারপর রাতটা তুই আর আমি…”
রুমানা ম্লান হাসল।
একটা ছোট টুলের উপর মোমবাতি জ্বালিয়ে বোর্ডের পাশে রাখা হল। নীলাদ্রি বলল, “রুদ্র, তুমি প্ল্যাঞ্চেটের উলটোদিকে থাকো। বাকিরা, যারা এটায় অংশগ্রহণ করছ, সবাই প্ল্যাঞ্চেটে হাত রেখে নীরব থাকবে। রণিতা, তুমি শুধু দেখতে চাইলে দেখতে পারো। তবে তোমাকে অনুরোধ করব, হেসো না বা আজেবাজে প্রশ্ন কোর না। যদি মনে হয় এটা ভুল ভাল কিছু হচ্ছে, হাসি চেপে বসে থেকো না হয়”।
রণিতা বলল, “ঠিক আছে”।
নীলাদ্রি বলল, “তাহলে আমরা প্ল্যানচেট করছি? আমরা তৈরি?”
রুদ্র বলল, “হ্যাঁ”।
নীলাদ্রি আলো নিভিয়ে দিল। ঘরে মোমবাতি জ্বলতে থাকল।
নীলাদ্রি প্ল্যানচেট বোর্ডের উপর রেখে বলল, “সবাই প্ল্যানচেটে হাত দাও”।
সবাই প্ল্যানচেটে হাত দিল।
নীলাদ্রি বলল, “রাত আটটা এগারো। সবাই প্ল্যাঞ্চেটে হাত দিয়ে কোন শব্দ না করে অঞ্জন স্যারের কথা ভাবতে শুরু করি। লেটস স্টার্ট”।
৩৩
পাপানকে সংযুক্তা একটা ছড়া মুখস্ত করাচ্ছে। অনেকদিন পরে পাপানকে কিছু মুখস্ত করাচ্ছে সে।
ঘরের ভিতরে হাঁটতে হলে চপ্পল ব্যবহার করতে হচ্ছে। ঘরগুলোর মেঝেতেও ড্যাম্প পড়ে গেছে।
পাপান হঠাৎই বলল, “মা, বাবা কোথায় গেল?”
সংযুক্তা বলল, “বাইরে আছে”।
পাপান বলল, “বাইরে কী করছে? একা একা ঘুরছে কেন? হারিয়ে যাবে না?”
সংযুক্তা বলল, “বড়রা হারায় না বাবু”।
পাপান বলল, “আমি কবে বড় হব মা?”
সংযুক্তা বলল, “একদিন সবাই বড় হয়। তুইও হবি। এবার আজে বাজে প্রশ্ন না করে বল যা বলছি”।
পাপান ঘাড় নাড়ল, “আচ্ছা। ঘুম পেয়ে গেছে মা”।
সংযুক্তা বলল, “মুখস্ত করবি না?”
পাপান বলল, “কাল করব”।
সংযুক্তা বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু এখনই তুই ঘুমাবি না। খেয়ে ঘুমাবি, ঠিক আছে?”
পাপান কম্বলের তলায় ঢুকে পড়ে বলল, “ঠিক আছে। বাবাকে ডাকো না মা”।
সংযুক্তা পাপানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “বাবা চলে আসবে। আচ্ছা একটা গল্প বলি?”
পাপান বলল, “রাক্ষসের গল্প বলবে?”
সংযুক্তা বলল, “তুই ভয় পাবি না?”
পাপান একটু ভেবে বলল, “বন্ধু রাক্ষসের গল্প বল তাহলে”।
সংযুক্তা বলল, “আচ্ছা, তাই বলব”।
পাপান বলল, “আচ্ছা মা, রাক্ষস আর ভূত কি একই?”
সংযুক্তা বলল, “না না। রাক্ষস বড় চেহারার হয়, আর ভূত মানে…”
পাপান বলল, “ভূত মানে হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে পারে?”
সংযুক্তা বলল, “তাই হবে”।
দরজায় কেউ জোরে জোরে নক করল।
সংযুক্তা বলল, “কে?”
কোন সাড়া শব্দ এল না।
সেই ভয়টা হঠাৎ করে সংযুক্তাকে জড়িয়ে ধরল। সে আরেকবার চিৎকার করল, “কে?”
“চা দিদিজি”।
সংযুক্তা জোরে শ্বাস ছেড়ে বলল, “লাগবে না এখন। লাগলে বলব”।
বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে। সে উঠে বসে অনেকটা জল খেল। বুক ধড়ফড় করছে। সুপ্রিয় এত দেরী করছে কেন? তার একবার ইচ্ছা হল দরজার বাইরে উঁকি মারতে, পরক্ষণে সে ইচ্ছা দমন করল সংযুক্তা।
এখানের ঝিঁঝিঁর ডাকের শব্দ অনেক বেশি গভীর। রাত হবার পর থেকে বুকের উপর চড়ে বসে পড়ে। পাপান বলল, “গল্পটা বল না মা”।
সংযুক্তা বলল, “রাক্ষস আর ভূতের গল্প না করে আমরা এখন ট্রেনের গল্প শুনি?”
পাপান বলল, “বল”।
সংযুক্তা বলল, “অনেক অনেক দিন আগে, এক রাজা ছিল। রাজা পাহাড়ে থাকত। আর সেখানে যাওয়া খুব কঠিন ছিল। কী করে যাবে? হয় হেঁটে যেতে হত, নয়ত দড়ি বেয়ে বেয়ে খাদ বেয়ে যেতে হত। এদিকে রাজ্যে অনেকদিন ধরেই বাইরের কেউ আসতে পারছে না। রাজ্যবাসীও রাস্তা নেই বলে বাইরে থেকে কিছু আনতে পারছিল না। কেই বা এত কষ্ট করে বাইরে যাবে? তখন রাজা ঘোষণা করে দিল, যে রাজ্যের মানুষের জন্য যাতায়াত সহজ করে দেবে, তাকে রাজা এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দেবে, সঙ্গে দেবে অর্ধেক রাজ্য”।
পাপান বলল, “সহস্র মানে কী মা?”
সংযুক্তা বলল, “এক হাজার। আর স্বর্ণমুদ্রা মানে হল মোহর”।
পাপান বলল, “তারপরে?”
সংযুক্তা বলল, “রাজ্যের অনেকেই চেষ্টা করল যাতে দুর্গম পথকে সুগম করা যায়। দুর্গম মানে হল যেখানে যাওয়া খুব কঠিন। এই যে আমরা দার্জিলিং যেতে পারলাম না, এর কারণ হল বৃষ্টি পড়ে সে রাস্তা দুর্গম হয়ে গেছে। তো, রাজ্যের যত পড়াশোনা জানা লোক আছে, তারা অনেকেই চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুতেই কিছু করতে পারল না। রাজা ভীষণ মুষড়ে পড়লেন। ভাবলেন, আর মনে হয় না কোন দিন এই রাস্তা ঠিক করা যাবে। তখনই হঠাৎ করে একদিন…”
ঘরের আলো নিভে গেল।
পাপান বলল, “কী হল মা?”
সংযুক্তা বলল, “লোডশেডিং হয়েছে। আমাদের ওখানেও হয় তো। এখানেও হয়েছে। ওরা এখনই জেনারাটের চালিয়ে দেবে”।
কথাটা বলে সংযুক্তার মনে হল এই ঘরে সে একা নেই। এই অস্তিত্বটা সে পরিষ্কার বুঝতে পারল। এর আগেও এরকম হয়েছিল তার।
নীলুদা যখন তাদের নিয়ে প্ল্যানচেট করেছিল…
৩৪
নীলাদ্রি বলল, “রুদ্র, তুমি অঞ্জন স্যারকে ডাকো”।
রুদ্র বলল, “আমি পড়াশুনায় খুব একটা ভাল ছিলাম না। জীবন নিয়ে তো কোন কালে কিছু ভাবিই নি। স্যার প্রথম ভাবতে শিখিয়েছিলেন আমায়, স্যার বুঝিয়েছিলেন জীবনটা এত সোজা না। হতে পারে না। নিজের পায়ে না দাঁড়ালে কেউ ফিরেও তাকায় না। ব্যর্থ মানুষদের পাশে কেউ থাকে না। জীবনে সফল না হলেও আমরা যেন কোন দিন হেরে না যাই। অঞ্জন স্যার, আপনি এত কিছু আমাদের শিখিয়ে নিজে কেন চলে গেলেন? আমরা কি কিছুই জানতে পারব না? এখনো, প্রতিদিন আপনাকে মিস করি আমরা। যতবার জীবনে কনফিউশনের মুখোমুখি হয়েছি, আপনি ছিলেন আমার মুশকিল আসান। সেই আপনি না বলে চলে গেলেন। প্লিজ স্যার, আমরা সবাই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই, প্লিজ আসুন”।
নীলাদ্রি সুপ্রিয়র দিকে তাকাল। সুপ্রিয়র মুখ নিচের দিকে করা। সে প্ল্যানচেটে হাত দিয়ে আছে। নীলাদ্রি বলল, “অঞ্জনবাবু, আপনি কি এসেছেন? এসে থাকলে হ্যাঁ বা না তে উত্তর দিতে পারেন”।
সুপ্রিয় বলল, “কেউ আসে নি। আমি কোন কিছু অনুভব করতে পারছি না”।
রণিতা বলল, “স্বাভাবিক। এসব কিছু হয় না বলেই আসে নি”।
নীলাদ্রি বলল, “রণিতা, তুমি কিন্তু এখানে কোন রকম কমেন্ট করবে না বলেই এসেছিলে। আশা করব তুমি চুপ থাকবে”।
রণিতা নিজের মনে বিড়বিড় করে চুপ করে গেল।
নীলাদ্রি বলল, “তোমরা চারজনই অঞ্জনবাবুকে ভাবো। ডাকতে থাকো মনে মনে। সুপ্রিয়, তুমি আর কোন কথা বলবে না”।
সুপ্রিয় মাথা নাড়ল।
মোমবাতির আলোয় ঘরের পরিবেশ সত্যিকারের ভুতুড়ে হয়ে গেছে। পল্লব তার বাঁ হাত দিতে রুমানার হাত ধরেছে। রুমানা ভয় পেয়েছে সে বুঝতে পারছে।
সবাই অঞ্জন স্যারের কথা ভাবতে শুরু করল আবার।
বৃষ্টি নামল জোরে। বৃষ্টি আর নদীর বয়ে চলার শব্দ মিশ্রিত হয়ে গিয়ে পরিবেশটা আরো ছমছমে করে তুলছে। ওরা চারজন চোখ বন্ধ করে অঞ্জন স্যারের কথা ভেবে চলেছে, রণিতা বিদ্রূপাত্মক চোখে নীলাদ্রিকে দেখছে, এমন সময় জানলা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও একটা দমকা হাওয়ায় মোমবাতিটা নিভতে নিভতে জ্বলে উঠল।
প্ল্যানচেটটা ওইজা বোর্ডের “ইয়েস” এ গিয়ে দাঁড়াল।
রুদ্র খানিকটা চমকে নিজেকে প্রাণপণে ঠিক রাখার চেষ্টা করতে করতে বলল, “স্যার আপনি এসেছেন?”
প্ল্যাঞ্চেটটা “ইয়েস” এই স্থির থাকল।
রণিতা সুপ্রিয়র দিকে তাকাল। সুপ্রিয় যেন নিজের মধ্যে নেই। তার চোখে কেমন একটা ঘোর লেগে আছে। নীলাদ্রি রণিতার দিকে তাকাল। রণিতা কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। নীলাদ্রি বলল, “সুপ্রিয় মিডিয়েটর”।
রুদ্র বলল, “স্যার, আপনি হঠাৎ করে সুইসাইড করতে গেলেন কেন, বলবেন?”
প্ল্যাঞ্চেটটা “নো”তে গিয়ে দাঁড়ালো।
পল্লব দেখল রুমানার হাত কাঁপছে। রুমানা ভীষণ ভয় পেয়েছে সে বুঝতে পারল।
হিয়া রুদ্রর দিকে তাকাল। রুদ্র যেন পাজলড হয়ে গেছে। প্রশ্ন করতে দেরী করছে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না গোটা ব্যাপারটা।
হিয়া ফিসফিস করে বলল, “প্রশ্ন কর”।
রুদ্র তড়িঘড়ি বলল, “স্যার আপনি কেমন আছেন?”
প্ল্যাঞ্চেটটা এক একটা অক্ষরের উপর চলতে চলতে লিখল “Good”।
রুদ্র বলল, “স্যার, আপনার সঙ্গে আমাদের কোথায় প্রথম দেখা হয়েছিল?”
“Siliguri”।
চারজনই চমকাল। রুদ্র নীলাদ্রিকে বলল, “স্যার আসেন নি”।
নীলাদ্রি বলল, “তাড়াতাড়ি গুড বাই বল”।
রুদ্র বলল, “গুড বাই। আপনি যেই হন”।
নীলাদ্রি প্ল্যানচেটটা নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল। সুপ্রিয় বোর্ডের উপর পড়ে গেল।
নীলাদ্রি উঠে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে বলল, “সুপ্রিয়কে জল দাও। জলদি”।
হিয়া একটা বোতল থেকে সুপ্রিয়র চোখে মুখে জল ছিটিয়ে দিল।
সুপ্রিয় ধড়মড় করে উঠে বসল।
হিয়া রুদ্রর হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “ইট হ্যাপেন্ড। এটা ঘটল। মানে সিরিয়াসলি?”
নীলাদ্রি বলল, “আমার জীবনে এই প্রথম এত কনভিন্সিংলি একটা প্ল্যানচেট ঘটতে দেখলাম”।
সুপ্রিয় বলল, “সত্যি কেউ এসেছিল? আমি কিছু বুঝতেই পারি নি”।
নীলাদ্রি বলল, “হ্যাঁ। এসেছিল”।
রণিতা নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি সুপ্রিয়বাবুর সঙ্গে বসে ড্রিঙ্ক করছিলে। আগে থেকে কিছু শিখিয়ে দাও নি, কী করে বুঝব?”
নীলাদ্রি বলল, “তুমি এখনো না বিশ্বাস করলে আমারও কিছু করার নেই। যাক গে, চল, ডিনার সেরে নি। তোমাকে এর পরে আমি আর কনভিন্স করাতে চাই না। সুপ্রিয় ঠিক আছো তো?”
সুপ্রিয় বলল, “মাথা ধরেছে একটু”।
নীলাদ্রি বলল, “চা খাও। ঠিক হয়ে যাবে”।
রুমানা পল্লবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকল।
৩৫
যতক্ষণ আলো নিভেছিল, সংযুক্তা পাপানকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল। তার মনে হচ্ছিল কেউ একজন তাদের খাটের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাপানও কিছু একটা বুঝছিল, সেও চুপ করে রইল।
আলো জ্বলে ওঠার পর সংযুক্তা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। পাপান বলল, “মা, কী হয়েছিল গো?”
সংযুক্তা বলল, “কিছু না। তুই টয় ট্রেনের গল্পটা শুনবি না?”
পাপান বলল, “না। আমার ভয় লাগছে। বাবা কোথায় মা?”
সংযুক্তা বলল, “বাবা এসে যাবে। এখানেই আছে। কোথায় আর যাবে?”
পাপান বলল, “মা, বাবা একটা টয়ট্রেনের ভিডিও দেখিয়েছিল মনে আছে?”
সংযুক্তার বুক ধড়ফড় করছিল। সে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বলল, “হ্যাঁ, মনে আছে তো”।
পাপান বলল, “মা”।
সংযুক্তা বলল, “বল”।
পাপান বলল, “আমার কেমন ভূতের ভয় লাগছে”।
সংযুক্তা থমকে গিয়ে পাপানের কথা হেসে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করল, “ভূত বলে কিছু হয় না তো”।
পাপান বলল, “তাহলে আমি না ঘুমলে ভূতের ভয় দেখাও কেন?”
সংযুক্তা পাপানের কথার উত্তর না দিয়ে পর্দা সরিয়ে জানলার বাইরে দেখার চেষ্টা করল। কোথাও কেউ নেই। এবার তার ভয় লাগল। সুপ্রিয় কোথায় গেল?
পাপান ভীত গলায় বলল, “ও মা, আমার কাছে এসে বস না। আমার কেমন ভয় ভয় লাগছে”।
সংযুক্তার প্রবল কান্না পাচ্ছিল। কেন এত কান্না পাচ্ছিল সে বুঝতে পারছিল না। সে পাপানের পাশে এসে বসল আবার।
পাপান মাকে জড়িয়ে ধরল।
সংযুক্তা ফোন বের করে সুপ্রিয়কে ফোন করার চেষ্টা করল। টাওয়ার নেই সে জানত, তবু একবার চেষ্টা করল। যদি পাওয়া যায় কোনভাবে!
ফোন পাওয়া গেল না।
সে রিমোট নিয়ে টিভি চালাল। শব্দ হোক। যে কোন শব্দই হোক। নিস্তব্ধ নীরবতার থেকে যে কোন শব্দ তার কাছে বেশি নিরাপদ মনে হচ্ছিল। সে ভাষা বোধগম্য না হলেই বা কী যায় আসে?
বেশ খানিকক্ষণ ধরে টিভি দেখার পর দরজা ঠেলে সুপ্রিয়কে ঢুকতে দেখে সংযুক্তার স্বস্তি ফিরল। সে বলল, “কোথায় গেছিলে?”
সুপ্রিয় চেয়ারে বসে বলল, “এই এখানেই ছিলাম। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। চা দিতে বললাম ছেলেটাকে”।
সংযুক্তা বলল, “মাথা ধরেছে? মাথায় জলের ফোঁটা পড়েছিল?”
সুপ্রিয় বলল, “ওই আর কী”। এত কিছুর মধ্যে তার একটু ভালও লাগছিল সংযুক্তা তাকে নিয়ে চিন্তিত হচ্ছে দেখে। সংযুক্তা একটু হলে পাল্টেছে বিকেল থেকে। সংযুক্তা কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আমি ভুলে গেছিলাম। এখন কি প্ল্যানচেট হল?”
সুপ্রিয় বলল, “হ্যাঁ”।
সংযুক্তা বলল, “ওহ। আমারও তাই মনে হল”।
সুপ্রিয় অবাক হল, “বুঝলাম না। তোমার মনে হল মানে?”
সংযুক্তা বলল, “কিছু না। এমনি বললাম। কী হল প্ল্যানচেটে?”
সুপ্রিয় বলল, “আমি মিডিয়াম হয়েছিলাম। আমার মাধ্যমেই স্পিরিট উত্তর দিল”।
সংযুক্তা বলল, “সত্যি কিছু এসেছিল?”
সুপ্রিয় বলল, “ওরা তো বলছিল এসেছিল। আমি কিছু বুঝতে পারি নি। মাঝে কিছুক্ষণ হুঁশ ছিল না”।
সংযুক্তা চিন্তিত গলায় বলল, “তারপরেই মাথা ধরল?”
সুপ্রিয় বলল, “হ্যাঁ। মাথা ধরে আছে। ঠিক হয়ে যাবে হয়ত। ঘর অন্ধকার করে রেখে মোমবাতি জ্বালানোর জন্যও মাথা ধরে থাকতে পারে”।
সংযুক্তা বলল, “তুমি পাপানের পাশে এসে শোও। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে দেখো, ভাল লাগতে পারে”।
সুপ্রিয় সংযুক্তার কথা শুনল। পাপানের পাশে গিয়ে শুল।
পাপান বলল, “বাবা, জানো, আমার মনে হয় এ ঘরে ভূত এসেছিল”।
সুপ্রিয় বিস্মিত চোখে সংযুক্তার দিকে তাকাল। সংযুক্তা বলল, “তুমি না থাকায় পাপান ভয় পেয়ে গেছিল। এখন আবোল তাবোল বকছে”।
পাপান বলল, “না না। মা জানে না। ঘরের মধ্যে একটা লোক এসেছিল, ঘুরে বেড়াচ্ছিল। লোডশেডিং হয়ে গেছিল”।
সংযুক্তা বলল, “ভূত বলে কিছু হয় না বাবু। তোমাকে বললাম তো”।
পাপান সুপ্রিয়কে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম”।
সুপ্রিয় কিছু বলতে পারল না। তারও একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছিল।
৩৬
“তুমি দিন দিন ভেকধারী হয়ে যাচ্ছ কেন? এখন ভুলভুলাইয়ার অক্ষয় কুমার হতে চাইছো নাকি? সত্যি করে বল তো এগুলো কী ছিল?”
রুমে ঢুকেই রণিতা কথাগুলো বলল।
নীলাদ্রি বোর্ডটা তার ব্যাগে ঢুকিয়ে চেয়ারে বসে বলল, “কী ছিল তুমি তো ওখানে দেখেছো। দেখো নি?”
রণিতা বলল, “দেখেছি। এবং স্পষ্টই বুঝতে পারছি, যত দিন যাচ্ছে তুমি সর্বঘটের কাঁঠালি কলা হবার চেষ্টা করে চলেছ। কী হয়েছে তোমার? ফুটেজ কম পাচ্ছো?”
নীলাদ্রি শান্ত গলায় বলল, “তোমার কী হয়েছে সেটা বল আগে। সমস্যাটা আমার, না তোমার? তুমি ওখানে পুরো সময় ধরে ছিলে, যা হয়েছে তার সব তোমার সামনে হয়েছে। আমি কোন এক্সপার্ট নই, যেভাবে বোর্ডে প্রসেসটা ফলো করতে বলা হয়েছে, আমি সেভাবে করেছি। তুমি ওখানে বললে আমি সুপ্রিয়কে শিখিয়ে নিয়ে গেছি, আমি কেন এরকম করতে যাব?”
রণিতা বলল, “ওই কচি কচি মেয়েগুলোর মাথা চিবোনোর জন্য করছ। আবার কী? তুমি তো এখন মুক্ত বিহঙ্গ। যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে”।
নীলাদ্রি কয়েক সেকেন্ড রণিতার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “একজন ভাল মনোবিদ দেখাও। আশা করি তোমার সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। নিজে বার বার ইনসিস্ট করেছো বিয়েটা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য, এখন আমাকে এসব বলে অ্যাকিউজ করতে চাইছো?”
রণিতা বলল, “তুমি খুব ভাল করে জানো আমি একার ইচ্ছায় বিয়েটা থেকে বেরচ্ছি না। তুমি নিজেই এই সম্পর্কে থাকাটা অসহনীয় করে তুলেছিলে”।
নীলাদ্রি বলল, “ঠিক তো, তুমি একদম ঠিক বলেছ। এখন তো মুক্তি পেয়ে গেছো, তাহলে এখন কেন এসব ব্যাপারে জড়াতে চাইছ? সুপার ন্যাচারাল ব্যাপার সম্পর্কে আমরা প্রত্যেকেই খুব কম জানি। আমি নিজে কোন দিন সেভাবে কিছু বুঝতে পারি নি। আজ যেটা হল সেটার ব্যাখ্যাও আমি দিতে পারব না, কিন্তু এ সব কিছু সরিয়ে রেখেও বলা যায়, তুমি কেন এক্ষেত্রে আমাকে দোষ দিচ্ছ? আমি জেনে বুঝে এই ছেলেমেয়েগুলোকে আজগুবি ব্যাপারে বিশ্বাস করাতে কেন যাব?”
রণিতা হাত নেড়ে বলল, “আমি তোমাকে সহ্য করতে পারছি না। দিন দিন তুমি অসহ্য হয়ে যাচ্ছ”।
নীলাদ্রি বলল, “তাহলে সেটা বল। তুমি আমাকে সহ্য করতে পারছ না সেটা বল। আমাকে অন্য কিছু বলে, আজেবাজে দোষারোপ করে ছোট করতে চাইছ কেন? আর দেখো, আমরা তো সিদ্ধান্ত একটা নিয়েই নিয়েছিলাম আলাদা থাকার। সবাই মিলে চেষ্টা করেছিল এখানে পাঠিয়ে যদি কিছু ঠিক করা যায়, সেটা হত না আমিও অবচেতনে জানতাম, তুমিও জানতে। চেষ্টা করবে না, ঠিক আছে, কিন্তু তুমি ক্রমাগত আমাকে একটার পর একটা দোষ দিয়ে যাচ্ছ কোন কারণ ছাড়াই। ছাড়ো না, আমি যখন এতোটাই খারাপ, তাহলে ভাবছই বা কেন? বিষয়টাকে যেতে দাও। সিম্পলি চল দুজনে বেরিয়ে যাই। তাতে দুজনেই বাঁচব”।
রণিতা থমথমে মুখে কিছুক্ষণ বসে রইল। নীলাদ্রি বলল, “আমি দেখছি খাবারের কোন ব্যবস্থা হল নাকি। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। তুমি কাল যেতে চাইলে গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারি”।
রণিতা বলল, “আমি গেলে তুমি বেঁচে যাও তো”।
নীলাদ্রি বলল, “আবার এসব বলছ। তুমি আমার থেকে বেরোতে পারছো না, এটা স্বীকার কর না কেন তুমি রনি? অকারণ নিজের মনের ভিতর লড়াই করে যাচ্ছো। প্রবল চেষ্টা করে যাচ্ছ আমাকে ঘেন্না করার, পারছ না। আমাকে যা নয়, তাই বলে যাচ্ছ, আজে বাজে সম্পর্কে জড়িয়ে দিয়ে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করছ, তাও পারছ না, এর থেকে অনেক সহজ হত এটুকু স্বীকার করে নিতে যে তুমি আমার থেকে বেরোতে পারছো না”।
রণিতা বলল, “তাতে তো তুমি পালটাবে না”।
নীলাদ্রি বলল, “কেন পালটাবো? একজন মানুষ অকারণে কেন নিজেকে পাল্টাতে যাবে? তুমি চাইলে আমি বরং আরেকটু ভদ্রভাবে থাকতে পারি। এটুকুই। এর বাইরে কেন আর এক্সট্রা এফোর্ট দিতে হবে?”
রণিতা বলল, “আমার ভাল লাগছে না আর এসব নিয়ে চর্চা করতে। খাবার হয়েছে নাকি দেখো। খেয়ে ঘুমোই”।
নীলাদ্রি উঠল, “ঠিক আছে। তাই করি”।
৩৭
“তোর ভয় লাগছে?”
রুমানাকে জিজ্ঞেস করল পল্লব।
রুমানা বলল, “তোর লাগছে না? তাহলে বুঝব তোর খুব সাহস”।
রুদ্র বলল, “আমি কী ভাবছি জানিস? শিলিগুড়িতে আমাদের সঙ্গে কার দেখা হয়েছিল যে মারা গিয়ে ভূত হয়ে এখানে চলে এল? শিলিগুড়িতে তো তেমন কাউকে আমরা চিনি না! ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগলো”।
হিয়া চুপ করে বসেছিল। বলল, “দেখ, ব্যাপারগুলো তো এত হালকা কিছু না যে ভাবলাম আর বলে ফেললাম। আজ যেটা ঘটল এটা আমি কোনদিন ভুলব না। কী ভয়ংকর ব্যাপার বল তো! স্যারকে ডাকলাম আর কে না কে স্যার সেজে এসে বসে পড়ল! এতো অনেকটা রং নাম্বারে ফোন করার মতই ব্যাপার, তাই না?”
রুদ্র বলল, “আমি সেভাবে এসব বিশ্বাস করতাম না। তবে আমি যে থিওরি দাঁড় করিয়েছি, সেটা বলছে অনেক মানুষই অপঘাতে মারা যায়। এরকমই কারো আত্মা এসেছিল। স্যার হয়ত এসেছিলেন কিন্তু তার আগে এ এসে গেছিল। একজনই কি শুধু আসতে পারে না অন্যরাও এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, সেটাও জানা গেল না”।
রুমানা বলল, “শোন না, আজ রাতটা আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে থাকলে হত না? মানে ওই লোকটা যদি কোথাও না যায়? এখানেই যদি থাকে?”
পল্লব ব্যাজার মুখে বলল, “কেন আমি থাকলে তোর ভয় লাগবে? এখানে ভয়ের কী আছে? আমি থাকব তো”।
হিয়া বলল, “হ্যাঁ, মানে তোরা এই ঘরটায় থাক, আমি আর রুদ্র অন্যটায় থাকব। কী আর হবে? সেরকম হলে চিৎকার করবি, সবাই ছুটে আসব”।
রুমানা বলল, “আমি আজ রাতে আর বাথরুম যেতে পারব না মনে হয়। এসব মাথার মধ্যে যত ঘুরতে থাকবে, তত রাতের ঘুম উড়ে যাবে। চোখ বন্ধ করলেও মনে হবে আমার দিকে কেউ তাকিয়ে আছে”।
হিয়া বলল, “ঠিক আছে, পল্লব থাকবে তো! তুই বলবি, ও তোকে বাথরুম করিয়ে দেবে”।
রুমানা রেগে মেগে হিয়ার দিকে তাকাল। হিয়ার কোথায় বাকি দুজনই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। রুমানা বলল, “ইয়ার্কি মারিস না, আমরা একটু বেশি সাহস দেখিয়ে ফেলেছি। এই সব প্রেত, জীন টিন কোন কিছুই আমার পছন্দের জিনিস না। পছন্দের কেন বললাম, আমি বলতে চাইছি, এসবকে কেন কেউ যেচে ডাকতে যাবে বল তো? থাকুক না ব্যাটা নিজের মত”।
রুদ্র বলল, “এটা তুই কী বলছিস? জীবনে একটু অ্যাডভেঞ্চার থাকবে না? তা ছাড়া এসব ভূত বা প্রেতাত্মা যদি থাকে, এদের এমন কিছু ক্ষমতা থাকে বলে মনে হয় না আমার”।
হিয়া বলল, “তুই লক্ষ্য করলি লেখকবাবুর বউ কেমন রেগে ছিলেন? উনি বার বার বলে চলেছেন সুপ্রিয়বাবুকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল”।
রুদ্র বলল, “শিখিয়ে পড়িয়ে আনার কিছু নেই। কেউ যে এসেছিল, সেটা আমরা যারা ছিলাম সবাই বুঝতে পেরেছি। এত দিন ভেবে এসেছি এসব কিছু নেই, আজ থেকে বুঝলাম একবারে কিছু নেই ভাবাটা ভুল”।
রুমানা বলল, “হ্যাঁ, যা হয়েছে হয়েছে। তোরা তো দিব্যি ছিলিস রে। গান করছিলি, আড্ডা মারছিলি, এবার প্লিজ ব্যাক টু নরমাল কর। আর নিতে পারছি না”।
হিয়া বলল, “ব্যাক টু নরমালই তো হবে। আজ আমাদের সুহাগ রাত হবে। দেখ, ফিরে গেলে এ সুযোগ কোন দিন আর পাবো নাকি জানি না”।
পল্লব ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে বলল, “মামণির তর সইছে না একবারে”।
রুমানা বলল, “দেখ, তোদের একটাই রিকোয়েস্ট, এখানকার ঘটনা যেন এখানেই থাকে। কলকাতায় যেন কেউ কিচ্ছুটি না জানে”।
পল্লব বলল, “আমি তো তোকে বিয়ে করব। তুই ভাবছিস কেন? এখন বিয়ে করতে হবে? রিসোর্টের ছেলেটাকে বলে দিচ্ছি, সিঁদুর নিয়ে আসুক, পরিয়ে দিচ্ছি তোকে”।
রুমানা বলল, “তোর খুব সোজা লাগে বল এগুলো? কী কী কনসিকোয়েন্স ফেস করতে হবে, সেগুলো ভেবে নিয়েছিস?”
পল্লব বলল, “আর কিছু ভাবছি না। তুই শুধু এখানে না, তুই আমার সঙ্গেই থাকবি সারাজীবন। সেটা যেভাবে ঘটাতে হয়, ঘটাব। যা হবে হবে। কিন্তু উই শ্যাল স্টে ফরেভার”।
রুমানা বলল, “লেখকবাবুর ডিভোর্স হচ্ছে। ওরাও এরকমই বলেছিল হয়ত যেদিন প্রেমে পড়েছিল”।
রুদ্র বলল, “তুই ভুল করছিস রুমানা। তোদের আর ওদের মধ্যে ডিফারেন্স আছে। ওরা কিন্তু বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিজেরাই। আর তোদের ক্ষেত্রে তুই ভয় পাচ্ছিস তোদের বা পল্লবের বাড়ির লোক ঝামেলা করবে”।
হিয়া বলল, “আর হোয়াট অ্যাবাউট আস? আমাদের নিয়ে তুই কিছু ভাবিস নি?”
রুদ্র বলল, “তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি, আমি তাতেই রাজি হব। ভেবে নিস”।
হিয়া হাসল, “তবে তাই হোক”।
৩৮
“হাই বন্ধুরা, আমি রাজা। এখন ডিনার করতে এসেছি। জানি না এই ভ্লগ কবে আমার চ্যানেলে আপনারা দেখতে পাবেন, তবে আমার রেকর্ড করার কাজ, করে যাচ্ছি। এখন আমরা খাবো। ডাইনিং হলে এসে গেছি। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন আমার সামনে ক্যাসারোলে গরম ভাত, ডাল, মাংসের ঝোল রাখা। ওহ, এদিকে আলুভাজাও আছে। বুঝতেই পারছেন আমার আর তর সইছে না। গন্ধেই বোঝা যাচ্ছে খাবার দারুণ হবে। এই যে, আপনারা দেখছেন ডাইনিং হলে এই রিসোর্টের বাকি বন্ধুরাও চলে এসেছে”…
রুদ্ররা ডাইনিং হলে ঢুকতেই রাজা ওদের দিকে ক্যামেরা দেখাল। রুদ্র রেগে গেল, “এই যে, হ্যালো, আপনি আমার অনুমতি নিয়েছেন আমার ছবি তোলার আগে? কে আপনাকে আমার ভিডিও তুলতে বলেছে?”
রাজা ক্যামেরা অফ করে আমতা আমতা করে বলল, “না মানে, আমি তো ভ্লগার। এটাই আমার কাজ। আমি বুঝতে পারি নি আপনার আপত্তি হবে। আমার ইউ টিউব চ্যানেলও আছে। আপনি চাইলে দেখতে পারেন”।
রুদ্র বলল, “পৃথিবীসুদ্ধ সবার ইউটিউব চ্যানেল থাকতে পারে। তাই বলে এভাবে জিজ্ঞেস না করে সবাই ভিডিও তুলবে নাকি?”
রাজা বলল, “এক্সট্রিমলি সরি। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আপনার ক্লিপটা ডিলিট করে দিচ্ছি”।
নীলাদ্রি রণিতার সঙ্গে ডাইনিং রুমে ছিল। উঠে রুদ্রর পিঠে হাত দিয়ে বলল, “ঠিক আছে ও যখন ভুল স্বীকার করে নিয়েছে, তুমি এটা নিয়ে আর রাগারাগি কোর না। বসে পড়”।
রুদ্র তাও গজগজ করছিল। হিয়া ফিসফিস করে বলল, “তোর কী হল? খচে গেলি কেন?”
নীলাদ্রি এক প্রকার জোর করেই রুদ্রকে বসিয়ে বলল, “মাটন আছে আজ। রাগের মাথায় মাটন মিস কোর না। খেয়ে নিয়ে রাগারাগি কর। আর সব ঠিক আছে তো? রুমানা, আর ইউ ওকে?”
রুমানা নার্ভাস মুখে মাথা নাড়ল। নীলাদ্রি বলল, “কোন রকম সমস্যা হলে আমাকে ডেকে নেবে। হেসিটেট করবে না। ঠিক আছে?”
রুমানা মাথা নাড়ল।
রাজা খানিকটা নিষ্প্রভ হয়ে এক কোণে গিয়ে বসেছে। নীলাদ্রি হাঁক পাড়ল, “তুমি কি আজ এলে?”
রাজা বলল, “হ্যাঁ। সন্ধ্যের দিকে এসেছি”।
নীলাদ্রি বলল, “ঠিক আছে, খেয়ে নাও, কাল আলাপ করা যাবে”।
রাজা ঘাড় নাড়ল।
নীলাদ্রি রণিতার কাছে গিয়ে বসল। রণিতা গম্ভীর মুখে খাচ্ছিল। নীলাদ্রি বলল, “মাটন ঠিক ঠাক সিদ্ধ হয়েছে”?
রণিতা বলল, “হু, রান্না ভাল হয়েছে”।
নীলাদ্রি বলল, “তোমার ভাল লাগলেই হল। ফেবারিট ডিশ বলে কথা”।
রণিতা বলল, “তোমার যেন না! নিজে তো মাটন ভক্ত”।
নীলাদ্রি বলল, “আমি যে কোনটার ভক্ত না, তাই তো বুঝি না। আমার সব ডিশই ভাল লাগে”।
রণিতা বলল, “তাহলে কম খাচ্ছো কেন? আরেকটু ভাত নাও। এটা তুলাইপাঞ্জি চাল মনে হচ্ছে”।
নীলাদ্রি বলল, “এই চালের ভাত থাকলে আর কিছু লাগে না। মাঝে ক’দিন এনলারজড লিভারের জন্য কিছু খেতে পারছিলাম না। তুলাইপাঞ্জি বাঁচিয়েছিল। এ চালের ভাতের সঙ্গে পেঁপে সিদ্ধও অমৃত লাগে”।
রণিতা খেতে খেতে থমকে গিয়ে বলল, “এনলারজড লিভার? মদটা খুব বেশি গিলছ নাকি?”
নীলাদ্রি বলল, “কমিয়ে দিয়েছি এখন। এ বয়সে এসব হয়। সুপ্রিয়রও তো…”
সুপ্রিয়র নাম নিতে না নিতে ওরা ডাইনিং হলে ঢুকল। সংযুক্তা রণিতাকে দেখে হাসল। রণিতাও প্রত্যুত্তরে হাসল।
নীলাদ্রি বলল, “মাথা ব্যথা কমেছে?”
সুপ্রিয় বলল, “হ্যাঁ। এখন ঠিক আছি”।
সংযুক্তা বলল, “নীলুদা, তোমার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে। খেয়ে নিয়ে বলি?”
নীলাদ্রি বলল, “এখানে বল না”।
সংযুক্তা চারদিক দেখে নিয়ে বলল, “না, পরে বলব”।
রণিতা যেন কথাগুলো শুনতেই পায় নি, এমনভাবে খেয়ে যেতে লাগল।
পল্লব রুদ্রকে বলল, “এ ভাই, আমরা কোথাকার সেলিব্রিটি যে আমাদের ভিডিও তুললে আমরা রেগে যাব?”
রুদ্র বলল, “সেলিব্রিটির কিছু নেই তো! আমাদের দেশের লোকগুলো হ্যাংলা। ক্যামেরা দেখলেই পিছন পিছন চলে যায়। আমার অনুমতি না নিয়ে কেন কেউ আমার ফটো বা ভিডিও তুলবে”।
হিয়া রুদ্রর প্লেটে ভাত বেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, খা এবার। মাথা গরম পাবলিক”!
রুদ্র রাগী চোখে রাজার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার ইচ্ছে করছে গিয়ে ছেলেটার ক্যামেরা ভেঙে দি”।
হিয়া বলল, “কী আজে বাজে বলছিস? কী হয়েছে তোর? মাথা গরম করছিস কেন?”
পল্লব বলল, “ভাই তুই খেয়ে ঘরে যা। এসব নিয়ে ভাবিস না। অন্য অনেক ব্যাপার আছে ভাবার মত”। পল্লব চোখ মারল।
রুদ্র হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “কষ্ট লাগছে ছেলেটার জন্য? এই সেই হ্যান্ডু ছেলে না? হ্যান্ডু না গান্ডু শালা”।
হিয়া বলল, “প্লিজ রুদ্র, আস্তে কথা বল। এখানে সবাই আছে। আমার সম্মানের কথাটা ভাববি না তুই?”
হিয়া রুদ্রর হাত চেপে ধরল। রুদ্র শান্ত হল।
রুমানা বলল, “রুদ্র এরকম ছিলিস না তুই। কী হয়েছে তোর?”
পল্লব বলল, “ভাই আজ থেকে আশিক হয়েছে। পুরো অ্যাংরি ইয়ং ম্যান ভাব এসছে ভাইয়ের”।
রুদ্র ছাড়া তিনজন হেসে উঠল। কয়েক সেকেন্ড পর রুদ্রও হাসল।
হিয়া বলল, “যাক বাবা, শান্তি”।
সংযুক্তা পাপানকে খাইয়ে দিচ্ছিল। রণিতা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে নীলাদ্রিকে বলল, “আমি রুমে গেলাম। তোমার কথা হয়ে গেলে এসো”।
নীলাদ্রি বলল, “ঠিক আছে”।
রণিতা দাঁড়াল না। বেরিয়ে গেল।
৩৯
“ভারতীয় সংবিধান বলছে, এক ধর্মের ছেলে অপর ধর্মের মেয়েকে বিয়ে করতেই পারে। এর জন্য স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট আছে। এসব নিয়ে এত চিন্তা করিস না।”
ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে পল্লব বলল।
রুমানা বলল, “চিন্তা কেন করি সেটা তুই জানিস। আমার বাড়ির লোককে তোদের থেকে ভাল কে আর জানে? তোর সঙ্গে যদি বিয়ে করি, সেক্ষেত্রে ওরা তোকে খুন পর্যন্ত করতে পারে। শুধু তোকে কেন, আমাকে করতে পারে। আমাদের লুকিয়ে থাকতে হবে, আরো কী কী করতে হবে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না”।
নদীর শব্দ ভেসে আসছে। এক একটা কটেজ কেমন একলা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত দাঁড়িয়ে আছে। পল্লব বলল, “এখানে এসব ভেবে মাথা খারাপ করিস না। যা হবে দেখা যাবে”।
রুমানা বলল, “কত কিছু ভেবে করতে হয় রে। ইন্ডিপেন্ডেন্টলি কাউকে ভালোবাসা যাবে না! এত কঠিন কেন সব কিছু?”
পল্লব বলল, “আমরা কঠিন ভাবে ভাবি বলে। এসব ভাবিস না বলছি তো”।
কটেজে ঢুকল ওরা দুজন। পল্লব দরজা বন্ধ করে রুমানার কোমর জড়িয়ে ধরল। রুমানা পল্লবের বুকে মাথা রেখে বলল, “আমাদের এটা ভালোবাসাই তো? নাকি ফিজিক্যাল হবার জন্য আমরা এগুলো করছি?”
পল্লব বলল, “কথা কম এখন”।
পল্লব রুমানাকে খাটে বসিয়ে চুমু খেতে শুরু করতে কলিং বেল বেজে উঠল। পল্লব বলল, “উফ! কে এল!”
রুমানা ঘোর লাগা অবস্থায় খাটে বসে রইল। পল্লব দরজা খুলে দেখল রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। সে অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে? তুই এখানে কেন?”
রুদ্র বলল, “হিয়ার সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে। আমি ওর সঙ্গে থাকব না”। রাগে রুদ্রর চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে।
পল্লব চোখ বড় বড় করে বলল, “মানে? ঝামেলা হয়েছে মানে কী?”
রুদ্র বলল, “তোকে এত কথা বলতে পারব না। আমি ওর সঙ্গে থাকব না ব্যাস”।
পল্লব বলল, “তাহলে আমরা কী করব?”
রুদ্র বলল, “কী করবি দেখ। আমি এ ঘরেই থাকব। আমি ওর রুমে যেতেই হিয়া বলতে শুরু করল ডাইনিং হলে কেন সিন ক্রিয়েট করেছি। কেন করব না? ওই ভ্লগার না কোন মাল, সে যা ইচ্ছা করবে, আমাকে সেটা মেনে নিতে হবে? কেন ভাই? আমি কিছু বলতেও পারব না”?
রুমানা বলল, “এই তো তোরা কিছুক্ষণ আগে ওই ঘরে গেলি? এর মধ্যেই লড়াই শুরু হয়ে গেল?”
রুদ্র বলল, “লড়াইয়ের তো কিছু নেই। আমাকে যদি এখন থেকেই ইন্সট্রাকশান শুনতে হয় যে আমাকে কী করতে হবে, কীভাবে চলতে হবে, এখন থেকেই যদি কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে, তাহলে তো ঝামেলা হবেই ভাই”।
পল্লব রামের বোতলটা রুদ্রকে দিয়ে বলল, “ভাই এটা খা। খেয়ে যা। একটা ভাল রাত এভাবে নষ্ট করিস না”।
রুদ্র বলল, “আমি বললাম তো, আমি কোথাও যাবো না। এটাই ফাইনাল”।
পল্লব চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। বলল, “তুই এটা এখন করে ঠিক করছিস? সব সময় তোর কথা মতো চলেছি। এখন এসব ইগো দেখিয়ে কী প্রমাণ করতে চাইছিস তুই? ছেলেটাকে তোর পছন্দ না, কারণ ছেলেটাকে নিয়ে তোর মধ্যে একটা ইনসিকিউরিটি কাজ করছে। এটার জন্য আমরা কেন ভুগব? নিজেকে পাল্টাতে হবে না তোকে, কিন্তু এসব ঘাড় তেড়ামোগুলো বন্ধ কর”।
রুদ্র গম্ভীর মুখে বসে রইল।
পল্লব রুমানাকে বলল, “তুই হিয়াকে ডেকে নিয়ে আয় তো”।
রুদ্র রাগী গলায় বলল, “আমি তো বললাম, এসবে ঢুকিস না। আমার ব্যাপার, আমাকে বুঝতে দে”।
পল্লব বলল, “এটা করতেই হত তোকে?”
রুদ্র বলল, “হ্যাঁ, করতে হত। রুমানা অন্য কোন ছেলেকে ঝাড়ি মারলে তুই কী করতিস সেটাও দেখতাম”।
পল্লব বলল, “তারপরে তো আমার কাছেই আসত, তাই না? চলে তো যেতো না। রুমানা আমারই থাকত। কাউকে জোর করে কি আটকানো যায় কি? তুই কি নিজে অপরাধবোধে ভুগছিস না ছেলেটার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার জন্য? তুই তো এরকম না! এই রুদ্রকে আমরা কি চিনতাম?”
রুদ্র বলল, “ভাট বকিস না তো। আমাকে একা থাকতে দে”।
পল্লব বলল, “আমি আর রুমানা কী করব? অন্ধকারে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াব?”
রুদ্র বলল, “যা না, খুব বেশি হিট উঠলে নদীর পাথরে গিয়ে কর যা করার”।
পল্লব খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে শুরু করল।
রুদ্রও হাসল এবার।
পল্লব বলল, “এ তুই বেরোবি ঘর থেকে, নাকি গায়ে ল্যাঙটো রক্তচোষা জোঁক ছুঁড়ে মারব”?
রুদ্র মাথা নাড়ল, “আমি যাব না”।
পল্লব রুদ্রর পাশে বসে পড়ে বলল, “রুমানা, দরজা বন্ধ কর। আমরা ওর সামনেই সব করা শুরু করব। তাহলে ওর ভাল লাগবে”।
রুদ্র রেগে মেগে উঠে বলল, “ঠিক আছে, আমি ডাইনিঙে শোব আজ। তোরা মনের আনন্দে সুহাগ রাত কর”।
পল্লব বলল, “যা ভাই, যেখানে ইচ্ছে যা। আমাদের ছেড়ে দে”।
রুদ্র বলল, “সেলফিস কোথাকার!”
পল্লব বলল, “যা ইচ্ছে বল, আজ আমি গণ্ডার। যে কোন সময় জলদাপাড়ায় নিয়ে যেতে পারে আমায়”।
রুদ্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
পল্লব হাঁফ ছাড়ল, “বাঁচা গেল”।
৪০
অন্যের বাড়িতে থাকলে সেটা কখন যে নিজের মনে হয়, বোঝা যায় না। যে কোন জায়গায় থাকতে গেলে মায়া জন্মায়। অদ্ভুত সে মায়া।
সোফায় বসে অতীন টিভি দেখছিল। পাহাড়ের দিকে রাস্তায় পাথর পড়ে ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়েছে, দুজন নিহত হয়েছে।
দুরুদুরু বুকে অতীন নামগুলো পড়ে হাঁফ ছাড়ল। যাক! সুপ্রিয়দার নাম নেই। এভাবে তো কখনো ভেবে দেখা হয় নি! সুপ্রিয়দার কিছু হলে কী হবে? তার উপরেই দায়িত্ব পড়বে সবার কাছে খবর পৌছনোর। চায়ের দোকানের পল্টাদা বলে এভাবে কোন বাড়ির মালিক মরলেই নাকি অতীনের কপাল খুলে যাবে। অতীন রেগে যায়। কারো মৃত্যুতে এভাবে হারামের কোন বাড়ি তার চাই না। মানুষগুলো ভালোয় ভালোয় ফিরে আসুক। সবাই ভাল থাকুক। অতীন হাত জোড় করে মা কালীর কাছে প্রার্থনা করে।
সব মানুষের জীবনেই সমস্যা থাকে। সবাই পুরোপুরি সুখী হতে পারে না। সুখ, দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা ভোগ করতে দেবতারা পর্যন্ত শাপভ্রষ্ট হয়ে মর্ত্যে মানুষরূপে জন্ম নিতেন। মুক্তি মেলার কত উপায়, তবু কষ্টের সময় সব উপায় বন্ধ হয়ে যায়।
পল্টাদার কথাগুলো অতীনের ভাল লাগে নি। ভাল ঘর বাড়ি, বড় গাড়ি, এসব কিছু নিয়ে কোন মানুষ মরবে না, কিন্তু যে মানুষ অনেক কষ্ট করে এগুলো অর্জন করে, সেগুলো কোন শ্রম না করে কেন অন্য মানুষ দখল করবে? সব সময় সঙ্কীর্ণ চিন্তা করতে করতে মানুষ নিজে আসলে নিজেকেই ছোট করে দেয়। পল্টাদা হয়ত কোন কিছু ভেবে এসব বলে নি, তবু অতীন ঠিক করেছে একদিন বলে দেবে। অসৎ পথে কোন কিছু চাই না তার। নিজের কষ্টের রোজগার হোক, গদি দরকার নেই, সৎ পথে রোজগার করে কাঠের বেঞ্চে শুলেও অনেক নিশ্চিন্তে ঘুমনো যায়।
সারাদিন সুপ্রিয়দাকে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে অতীন। বার বার নেটওয়ার্ক নট অ্যাভেলেববল বলেছে।
টিভি দেখতে দেখতে অতীনের চোখ লেগে এসেছিল। ঘুম ভাঙল বেডরুম থেকে আসা একটা শব্দে। কোন কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ।
অতীন তড়িঘড়ি বেডরুমে গিয়ে দেখল মেঝেতে ডায়েরিটা পড়ে আছে। সে জিভ কাটল। তাড়াতাড়ি করে রাখতে গিয়ে আগের দিন ঠিক করে রাখা হয় নি তার মানে। সে ডায়েরীটা তুলল। আগের জায়গায় রেখে টিভির ঘরে আসা মাত্র তার মন খচ খচ করতে শুরু করল। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে ডায়েরীটার জন্য। মনে হচ্ছে, না পড়লে ভয়াবহ কোন ভুল হয়ে যাবে।
অতীন অনেক কষ্টে আবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইল। পারল না।
বার বার মনে হচ্ছিল, কেউ তো জানবে না সে ডায়েরীটা পড়েছে! যেমন ছিল, সে তেমনই রেখে আসবে আবার।
কৌতূহলের কাছে হেরে যাওয়া ছাড়া আর কোন গতি রইল না তার। আলমারির কাছে গিয়ে আলমারির উপর থেকে ডায়েরীটা নিল সে।
ক্যালেন্ডার, ছুটির তালিকা পেরিয়ে ডায়েরীর প্রথম পাতায় পৌঁছে সে দেখল, স্কেচপেন দিয়ে শুধু লেখা আছে, “নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে”।
গোটা ডায়েরীতে আর কিচ্ছু লেখা নেই। আবার লেখাটা পড়ল অতীন। গান লেখার খাতা হয়ত! পাতা পাল্টাতে গিয়ে দেখল গোটা ডায়েরীতে আর কিছু লেখাও নেই। তবু সে হাল ছাড়ল না। আর এবারেই সাফল্য এল। লেখাটা পয়লা জানুয়ারি লেখা। ডায়েরীতে পয়লা জানুয়ারির পরের পাতা তেসরা এপ্রিল। তার মানে মাঝে বেশ কয়েকটা পাতা নেই। নিপুণভাবে পাতাগুলো কেউ ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।
তার মানে এখানে এমন কিছু লেখা ছিল যেগুলো অন্য কেউ পড়লে সমস্যা হত।
অনেকে অবশ্য নিজের খেয়ালেও পাতা ছিঁড়ে নেয়। হতে পারে বাচ্চাটাই ছিঁড়ে দিয়েছিল।
অতীনের লজ্জা হল এবার। খুব ভুল হয়ে যাচ্ছে। অপরাধবোধটা গ্রাস করতে শুরু করেছে তাকে। অন্যের জিনিস দেখার কী দরকার ছিল? এটাই বেশ হয়েছে।
আড়ালটা দরকার। মানুষের সব কিছু জেনে যাওয়া মোটেও কাজের কথা না। ডায়েরীটা আগের জায়গায় রেখে এল সে।
৪১
এ জায়গা রাত নামার পরে জনশূন্য হয়ে যায়। রিসোর্টের কম্পাউন্ডের বাইরের গেট নিরাপত্তার কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদিও এখানে বাইরের লোকের আনাগোনা একবারেই নেই।
সুপ্রিয় পাপানকে নিয়ে কটেজে ফিরেছে। নীলাদ্রি সংযুক্তাকে নিয়ে বেশ খানিকটা পথ হেঁটে রিসোর্টের কটেজগুলো থেকে অনেকটা দূরে এসে বলল, “বল তুই, কী বলবি”।
সংযুক্তা বলল, “নীলুদা, তোমাকে বলা হয় নি, এর আগে যখন আমাদের বাড়িতে প্ল্যানচেট করেছিলে, তখন মনে হয়েছিল আমাদের ঘরে কেউ একজন এসেছে। আজকে আমি যখন পাপানকে নিয়ে ঘরে ছিলাম, তখনও আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি আমাদের কটেজে কেউ এসেছে”।
নীলাদ্রি বলল, “কীভাবে বুঝলি? আমি তো পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারি না এখনো”।
সংযুক্তা বলল, “বোঝা যায়। কেউ একজন যে ঘরে আছে, স্পষ্ট বোঝা যায়। ঘর অন্ধকার হলে ঘরে কেউ এলে তুমি বুঝতে পারো না কেউ এসেছে বলে? ব্যাপারটা ঠিক সেরকমই”।
নীলাদ্রি চিন্তিত হয়ে বলল, “হতে পারে। কেউ কেউ এদের অস্তিত্ব অন্যান্যদের থেকে বেশি বুঝতে পারে। ইট হ্যাপেন্স। আমাদের অবিশ্বাসগুলো সব কিছু বিশ্বাস করতে আটকায় হয়ত। কিন্তু এই কথাগুলো তুই সুপ্রিয়র সামনে বলতে পারতিস না?”
সংযুক্তা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “তোমার ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে শুনলাম”।
নীলাদ্রী শ্বাস ছাড়ল, “হ্যাঁ, এটাই পড়ে রইল শেষতক। আমাদের গল্পটা সিরিয়াল হয়ে গেছে এখন। চিউইং গামের মত। বেরোতে পারলে দুজনেই বাঁচব”।
সংযুক্তা বলল, “আমি বিকেলে কথা বলার পর থেকে ভাল আছি জানো তো। বেশ ভাল লাগছে। আগের মত গুমোট ভাবটাই চলে গেছে”।
নীলাদ্রি খুশি হল, “এটা তো দারুণ খবর। ভীষণ ভাল ব্যাপার”।
সংযুক্তা বলল, “বেশ কিছুদিন ধরে আমার মধ্যে কিছু একটা হচ্ছিল। আমি বুঝতাম, একটা ভয়, একটা সব কিছু হারিয়ে ফেলে রাস্তার মাঝখানে জামা কাপড় ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকার ভয় আমাকে ঘিরে ধরছিল। তুমি আমার সঙ্গে একটু সময় দেওয়ার পর যেন সব চলে গেল। আমাকে তুমি একটা ডায়েরী দিয়েছিলে মনে আছে? এখনো আছে সেটা। কিছু হলেই তো লিখতে বলতে আমায়। আমি লিখতাম না। মাথাতেই আসত না কী লিখব। আমি অনেকদিন পর বুঝেছি নীলুদা, আমি আসলে তোমাকে ভালবাসি। তখন বুঝি নি, এখন বুঝি। তুমি কাছে থাকলে আমি ভাল থাকি। আমার আর ভয় লাগে না। তুমি দাদার বন্ধু হয়ে এসেছিলে। চিরকাল দাদার মত থেকেছো, আমিও তাই ভেবেছি। কিন্তু অবচেতনে তুমি যে এতটা শিকড় ছড়িয়ে চলেছো, আমি বুঝতে পারি নি। এত দিন তো সব কিছু জেনে অস্বীকার করে ছিলাম নীলুদা, কিন্তু এখন আমি কী করব?”
নীলাদ্রি বলল, “এত রাতে নদীর শব্দটা কী ভাল লাগছে না?”
সংযুক্তা বলল, “কথা ঘোরাচ্ছ কেন নীলুদা?”
নীলাদ্রি বলল, “সুপ্রিয় খুব ভাল ছেলে। পাপানের তোদের দুজনকেই দরকার”।
সংযুক্তা বলল, “তাহলে বইতে ওসব লেখো কেন? যখন ভালবাসা হয়, সব ভুলে গিয়ে ভালোবাসার মানুষের কাছে চলে যেতে হয়? কেন লেখো তুমি?”
নীলাদ্রি সিগারেট ধরাল। সংযুক্তার দিকে তাকিয়ে বলল, “পাবলিক ওসব খায় বলে। আর কিচ্ছু না। আমিও তো পাবলিক যা খেতে চায়, তাই জোগান দিয়ে যাই। এর বাইরে আমার কী কাজ আছে? আমার আর রণিতার বিয়েটা গোয়ায় হয়েছিল। আমরা কোন দিন ভেবেছিলাম আজ এই দিন দেখতে হবে? আমার কোন কিছু ওর ভাল লাগে না। সারাক্ষণ খুঁত ধরে যাচ্ছে। ওসব হ্যাপিলি এভার আফটারের গল্প সিনেমা আর বইতে হয় রে। তোর আমাকে বলার দরকার ছিল কথাগুলো, বেশ করেছিস বলেছিস। এবার ঘরে যা। জমিয়ে সংসার কর তো। ছেলেটাকে মানুষ কর। পাপানের চোখগুলো দেখেছিস? কী ব্রাইট! একদম সমরেশের মত হয়েছে। অবশ্যই কথাতেই আছে মামার মতই হয় ভাগ্নে। যা, কটেজে ফিরে যা। অনেক রাত হয়েছে”।
সংযুক্তা বলল, “আর আমার যে তোমাকে পেতে ইচ্ছা করে? সারাক্ষণ তোমাকে জড়িয়ে ধরে থাকতে ইচ্ছা করে? তার কী হবে?”
নীলাদ্রি বলল, “আমারও অনেক কিছু ইচ্ছা করে জানিস। এক কালে ভাবতাম নাসায় চাকরি করব। বিভিন্ন গ্রহগুলোতে ঘুরব। মাঝে মাঝে স্পাইডারম্যান হতেও ইচ্ছা করে। ছোটবেলায় অদৃশ্য হতে ইচ্ছা করত। ভাবতাম যাদের ভাল লাগে, অদৃশ্য হলে কী সুন্দর তাদের চুমু খাওয়া যেত! সব ইচ্ছাই কি সত্যি হয়?”
সংযুক্তা চুপ করে গেল। সে কাঁদছিল। বলল, “তুমি একবার বল, ডিভোর্সের পর তাহলে আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চলে আসব”।
নীলাদ্রি বলল, “ধুস, এসব কী বলছিস? একদম ভাববি না। তুই সুপ্রিয়র কথা ভাবলি না? এই সময়ে দাঁড়িয়ে ক’টা হাজব্যান্ড এত কেয়ার করে রে? তোর জন্য ভেবে ভেবে ছেলেটা পাগল হয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবিই নি তোর বর এত ভাল একটা ছেলে হবে। ইনফ্যাচুয়েশন থেকে বেরো”।
সংযুক্তা বলল, “ইনফ্যাচুয়েশন থাকলে এত দিন পর বুঝতাম তোমাকে ভালোবাসি?”
নীলাদ্রি বলল, “ভালবাসিস, বেশ করিস। আরো বাস। কেউ বারণ করে নি। আমিও করব না। একই ভাবে আমার দিকটাও তোকে ভাবতে হবে তো! আমি তোকে ভালবাসি বোনের মত। এর বাইরে কোনদিন দেখি নি। কিন্তু আমি ওই রাগী একগুঁয়ে বদমেজাজি মেয়েটাকে ভালবাসি যে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে ঠিক করেছে”।
সংযুক্তা বলল, “ভালোবাসো? তাহলে ছেড়ে দিচ্ছ কেন?”
নীলাদ্রি বলল, “জানি না। হয়ত এটাই হওয়ার ছিল। এটা হলেই ভাল হত। তুই এসব নিয়ে ভাবিস না। ভাল থাক। সুপ্রিয়র সঙ্গে ভাল থাক। ভালোবাসা থাকলে সব কিছু ঠিক হয়ে যায় জানিস তো? তুই আমাকে কথাগুলো বলে খুব ভাল কাজ করেছিস। হালকা হয়েছিস। চল তোকে দিয়ে আসি”।
সংযুক্তা বলল, “তোমার হাতটা একটু ধরে থাকি? তারপর দিয়ে এসো?”
নীলাদ্রি বলল, “ঠিক আছে। ধর”।
সংযুক্তা নীলাদ্রির হাত ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
৪২
ক্যামেরাটা পড়ে আছে বিছানার উপরে। খেতে পারে নি ঠিক মত। ঘরে এসে চুপ করে বসে ছিল রাজা।
নিজের উপরে রাগ হচ্ছিল। ঠিকই তো, এভাবে না জিজ্ঞেস করে ভিডিও করাটা একবারেই উচিত হয় নি। এই জন্যই হয়ত বাড়ি থেকে একা ছাড়তে চাইতো না। এখানে সে একা। সবার সামনে অপমানিত হলেও তার হয়ে কেউ বলার ছিল না। একা থাকলে “ছেলেরা কাঁদে না” কথাটা কোথাও লুকিয়ে পড়ে। রাজার চোখে জল আসছিল। অনেক কষ্টে চোখের জল আটকে রাখতে চাইলে আটকাতে পারছিল না সে।
কলিং বেল বাজাল। এত রাতে কে আসবে?
সে উঠে দরজা খুলে দেখল ডাইনিং হলের ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে ছেলেটা বলল, “আমি তোমার সঙ্গে ভীষণ খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। আমি এক্সট্রিমলি সরি। আমাকে ক্ষমা করা যায়?”
রাজা অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আরে না না, আমারই দোষ ছিল। ক্ষমাটা আমার চাওয়া উচিত ছিল”।
রুদ্র বলল, “চেয়েছ তো। আমি একটু মাথা গরম পাবলিক আছি। মাথা ঠাণ্ডা হলে বুঝতে পারি কী কেলো করেছি। ভেতরে আসতে পারি? আমাকে বন্ধুরা দল থেকে লাথ মেরে দিয়েছে। আমার থাকার জায়গা নেই একচুয়ালি”।
রাজা দরজা ছেড়ে দিয়ে বলল, “এসো এসো”।
রুদ্র ঘরের ভিতরে ঢুকে চেয়ারে বসে বলল, “আমি রুদ্র”।
রাজা বলল, “আমি রাজা। দিন কয়েক হল ভ্লগ শুরু করেছি। একবারেই ভিউয়ারস নেই। মনে হয় না বেশিদিন টানত পারব বলে”।
রুদ্র বলল, “সিগারেট?”
রাজা বলল, “চলে”।
রুদ্র সিগারেট বের করে একটা রাজাকে দিয়ে আরেকটা নিজে জ্বালিয়ে রাজার সিগারেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আমার মাথাটা যে মাঝে মাঝে কী হয়। তোমার খুব রাগ হয়েছে নিশ্চয়ই? কেলিয়ে দিতে পারো আমায়। রাগ করব না”।
রাজা হেসে ফেলল, “না না এসব কী কথা?”
রুদ্র বলল, “এই ভ্লগ জিনিসটা কী? সারাক্ষণ ভিডিও তুলে যেতে হয়?”
রাজা বলল, “হ্যাঁ। আমি কী করছি, কোথায় যাচ্ছি, কীভাবে যাচ্ছি, সব আপডেট দিয়ে যেতে হয়”।
রুদ্র মাথা নাড়ল, “আমি পারব না। আমি একটু হ্যাজাতে গেলেই বিরক্ত হয়ে যাই। তোমার হ্যাজাতে ভাল লাগে?”
রাজা বলল, “হ্যাঁ। দারুণ লাগে। কয়েকটা জায়গায় আর জে হবার জন্য ইন্টার্ভিউ দিয়েছিলাম। সেরকম কোন রেসপন্স পাই নি। শেষমেশ নিজেই শুরু করলাম। চাকরি পাই নি, ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বসে আছি। কয়েকটা টিউশন পড়াই, আর এটা করার চেষ্টা করি”।
রুদ্র বলল, “আমরা সবাই ইঞ্জিনিয়ার আমাদের এই ইঞ্জিনিয়ারিং এর জগতে। চিন্তার কিছু নেই। তোমার অনেক ভিউয়ারস হবে। ওকে, আমি নেটওয়ার্ক পেলেই তোমাকে সাবস্ক্রাইব করে নেবো, ঠিক আছে?”
রাজা বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ”।
রুদ্র বলল, “তোমার ভ্লগিং একটু দেখাও বস। কীভাবে ভ্লগিং করে আমি দেখি”।
রাজা বলল, “আর ইউ শিওর?”
রুদ্র বলল, “একদম। দেখাও দেখাও”।
রাজা তার ফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরা অন্য করে বলল, “হাই বন্ধুরা, কেমন আছো? আমি এক্সট্রিমলি সরি যে আজকের ডাইনিং রুমের ভিডিওটা তোমাদের দেখাতে পারলাম না। আমি একটা ভুল করে ফেলেছিলাম, বাকি আবাসিকদের অনুমতি না নিয়েই ভিডিও তুলতে শুরু করেছিলাম। এর জন্য হালকা ঝাড়ও খেলাম। মজার কথা হল, যে ঝাড় দিল, তার সঙ্গে আমার এখন বন্ধুত্ব হয়ে গেছে, হি ইজ এ নাইস ম্যান, ওর নাম রুদ্র”… রাজা ক্যামেরাটা রুদ্রর দিকে ঘোরাল। বলল, “রুদ্র, আমাদের বন্ধুদের স্বাগত নেহি করোগে? বল কিছু”।
রুদ্র হাত নাড়ল ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে, “হাঁই”।
রাজা ক্যামেরা বন্ধ করে বলল, “এই তো, সিম্পল”।
রুদ্র বলল, “তুমি আমাদের বাওয়ালের কথাটাও বলে দিলে?”
রাজা বলল, “ওই যে অনেস্ট হবার ছোট্ট একটা চেষ্টা করলাম। তুমি না চাইলে অবশ্য বাদ দেওয়া যায়”।
রুদ্র বলল, “না না, থাক। বাদ দিতে হবে না। তুমি একদিন খুব নাম করবে। আস্ক মি হাউ?”
রাজা বলল, “হাউ?”
রুদ্র বলল, “কারণ তুমি অনেস্ট। হাম্বেলও। তোমার হবে গুরু। এত সব কিছু বার খাওয়াচ্ছি কারণ আমায় আজ রাতটা এখানে কাটাতে হবে”।
রাজা বলল, “ঠিক আছে। বার না খাইয়ে কাটাতে পারো, নো চাপ”।
হঠাৎ হিয়ার চিৎকার ভেসে এল।
রুদ্র সিগারেট ফেলে বলল, “এই মরেছে। দেখি কী হল”।
রাজা বলল, “আমি যাব?”
রুদ্র বলল, “না না, দরকার পড়লে ডাকছি। ভেবো না”।
রাজা বলল, “ঠিক আছে”।
রুদ্র তড়িঘড়ি বেরোল।
নীলাদ্রি সংযুক্তাকে কটেজে পৌঁছে ফিরছিল। রুদ্রকে দেখে অবাক হয়ে বলল, “এনি প্রব্লেম? একটা চিৎকার শুনলাম মনে হল”।
রুদ্র বলল, “দেখছি”।
নীলাদ্রি বলল, “ওকে আমি বাইরে ওয়েট করছি। কিছু দরকার হলে ডাকো”।
রুদ্র বলল, “আচ্ছা”।
রুদ্র দরজা নক করল। হিয়া দরজা খুলে রুদ্রকে দেখেই রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে বলল, “টিকটিকি, ওরে বাবা, টিকটিকি। তুই যাস না। তাড়া ওটাকে। প্লিজ”।
রুদ্র হেসে নীলাদ্রিকে বলল, “সমস্যা নেই। আছি আমি”।
নীলাদ্রি বলল, “ওকে”।
৪৩
“কথা হল প্রেয়সীর সঙ্গে?”
দরজা খুলে নীলাদ্রি ঢুকতেই রণিতা জিজ্ঞেস করল।
নীলাদ্রি ঘরে ঢুকে বলল, “দরজা বন্ধ করছি। পোকামাকড় ঢুকে যাবে”।
দরজায় ছিটকিনি দিয়ে সে বলল, “নাও। এবার ঝগড়া শুরু করে দাও আবার”।
রণিতা বলল, “কী বলল বুলু? আমার ধারণাটা ঠিক ছিল?”
নীলাদ্রি বাথরুম থেকে পা ধুয়ে এসে খাটে বসল।
বলল, “তোমার সঙ্গে সম্পর্কে থেকে কোনদিন তোমাকে ঠকিয়েছি বলে তোমার মনে হয়েছে রনি?”
রণিতা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “আমি কী জানি? আমার পিছনে কী ফুল ফুটিয়েছ তার তো আমি কিছু জানি না”।
নীলাদ্রি শ্বাস ছেড়ে বলল, “নিজেও জানো আমরা কীভাবে ভালবাসায় ছিলাম রনি। এসব বলে কী আনন্দ পাও, কে জানে”।
রণিতা বলল, “আমি একটা খুব সিম্পল জিনিস জানতে চাইছি। বুলু তোমাকে ঠিক কী বলল?”
নীলাদ্রি বলল, “বুলু বলল ওর ছোটবেলা থেকে আমার প্রতি একটা ফিলিংস ছিল, সেটা ও আজ, এখানে এসে বুঝতে পারল”।
রণিতা বলল, “আমি জানতাম। এটাই স্বাভাবিক। দেখেছো? তুমি কী বললে? ডিভোর্সের পরে ওর সঙ্গে জুড়ে যাবে”?
নীলাদ্রি ফিক ফিক করে হাসতে লাগল। রণিতা বলল, “এভাবে হাসবে না। বিচ্ছিরি লাগে”।
নীলাদ্রি বলল, “একবারেই সহ্য করতে পারো না আমাকে বল? আবার আমাকে ছাড়া মাথা ঠিক রাখতেও পারো না। কী লাভ হয় এতে?”
রণিতা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থেকে বলল, “সেই। কোন লাভ নেই। আমি কাল চলেই যাব। তারপর তুমি মুক্ত পাখি। যা ইচ্ছা কর, আমি কিছু বলব না”।
নীলাদ্রি ল্যাপটপ খুলে বসল, “আমি তোমাকে মধ্যপন্থা দিয়েছিলাম একটা”।
রণিতা বলল, “কীসের মধ্যপন্থা? রিলেশনে কেমিস্ট্রি না থাকলে সেই রিলেশনে থেকে কী হবে?”
নীলাদ্রি বলল, “আর কী কেমিস্ট্রি চাও মা? বন্ধুর বোনের আমার উপর চাপ ছিল ভাবলে রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে যাচ্ছে, টিনেজারদের মত রিয়্যাক্ট করছ, আর কেমিস্ট্রি খুঁজছো? খুঁজে পাচ্ছো না এখনো? তাহলে চশমার পাওয়ার বাড়াও”।
রণিতা বলল, “এসব ফালতু মজাদার কমেন্ট করে লাভ নেই আমাকে। আমি তোমার কচি পাঠিকা নই। এসব সস্তা মজায় প্রথম প্রথম ভোলানো যায়। এখন পারবে না”।
নীলাদ্রি বলল, “জানি তো। তুমি প্রজ্ঞাযুক্ত অসীম গম্ভীর এক মহিলা যে আমার কিছুই পছন্দ করে না এখন আর। বাদ দাও। ঝগড়া না করে ঘুমিয়ে পড়। আমি বরং একটু লেখার চেষ্টা করি”।
রণিতা বলল, “এখানে আমার আসাই ভুল হয়েছে। না এলেই ভাল হত”।
নীলাদ্রি বলল, “কী করবে তুমি রনি আমাকে ছাড়া? মানে সারাক্ষণ আমাকে ছোট দেখানো ছাড়া আর কী কাজ করবে? ডিভোর্স তো হয়ে যাবে। কতদিন আর আমাকে খারাপ বলে যাবে? একটা সময় তো ক্লান্ত হয়ে যাবে। নতুন কেউ আসবে জীবনে”।
রণিতা বলল, “আর কাউকে দরকার নেই বাবা। একজনই যা খেল দেখিয়ে দিল”।
রণিতার মাথার পাশে নোটবুকটা আছে। নীলাদ্রি সেটা খুলল।
একটা পাতায় বড় বড় করে লিখেছে, “কী কী আমি ও বাড়ি থেকে নিয়ে আসব”।
হেডিং এর তলায় পাতা পুরো ফাঁকা। নীলাদ্রি বলল, “সেকি? লিস্ট কর নি এখনো?”
রণিতা বলল, “খুব মজা লাগে না? সব ভালোভাবে মিটিয়ে দিয়ে খুব আনন্দে থাকার ইচ্ছা”।
নীলাদ্রি বলল, “সেই তো! লিস্ট করা হল না, তাহলে কী হবে?”
রণিতা বলল, “আমি প্রথমে ঠিক করেছিলাম কালকে চলে যাব। এখন ঠিক করলাম, আমি কোথাও যাবো না। কাল চলে যাব, আর তারপর বুলুর সঙ্গে তুমি ওপেন মার্কেটে প্রেম করবে তাই না? যাব না, আমি দেখব তুমি কী কর”।
নীলাদ্রি বলল, “বেশ, যেও না”।
রণিতা বলল, “তোমাকে আমি ডিভোর্সও দেব না। ডিভোর্স দিলেই তোমার লীলাখেলা শুরু হবে। ক্যারেক্টারলেস ক্রিচার একটা। ছাড়লেই তো বুজরুকি শুরু করবে। এখানে সেখানে প্ল্যানচেট টাইপের ঢপ মারা শুরু করবে”।
নীলাদ্রি মাথা নাড়ল, “বেশ। যদিও গালাগালটা ঠিক জমল না। তবু মেনে নিলাম”।
রণিতা বলল, “কাল রোদ উঠলে দার্জিলিং যাব। আমার মনে হয় না আর বৃষ্টি হবে। রাস্তাও ঠিক হয়ে যেতে পারে”।
নীলাদ্রি বলল, “চল, ইয়ে ভি সহি হে। ওটা কি সেকেন্ড হানিমুন হবে?”
রণিতা বলল, “চুপচাপ ঘুমাও ল্যাপটপ রেখে। বাজে বোকো না। আমি তোমার কচি পাঠিকা নই”।
নীলাদ্রি বলল, “তথাস্তু। মা খুব খুশি হবে”।
রণিতা বলল, “তুমি তো হবে না। না হও, সেটাই আমি চাই। মজা পেয়েছিলে, তাই না? আমাকে ছেড়ে যা ইচ্ছে করে বেড়াবে? কোথাও যাব না আমি। মজা দেখাবো”।
নীলাদ্রি হাসতে হাসতে বলল, “দেখিও, তাই দেখিও”।
৪৪
“পাপান ভয় পেয়েছিল কিছুটা। সকালে ভাবছি এখান থেকে চেক আউট করে অন্য কোথাও চলে যাব। ওর কাছে ব্যাপারটা একটু চাপের হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন ঘরে আটক থাকা একটা শিশুর পক্ষে খুবই কঠিন”।
সুপ্রিয় চিন্তিত গলায় কথাগুলো বলল। পাপান ঘুমিয়ে পড়েছে। তারা দুজনে শুয়ে আছে।
সংযুক্তার মাথায় নীলাদ্রির কথাগুলো ঘুরছিল। সে শুধু বলল, “হুম”।
সুপ্রিয় বলল, “কী হুম?”
সংযুক্তা বলল, “তাই কোর”।
সুপ্রিয় বলল, “এখানের খাবার ভাল ছিল। সমস্যা হল টাওয়ারের। কাল অতীনকে একবার ফোন করতেই হবে”।
সংযুক্তা বলল, “হ্যাঁ। তা ঠিক”।
সুপ্রিয় বলল, “আজ একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল জানো তো। আমি সত্যিই নিজের মধ্যে ছিলাম না। মনে হচ্ছিল আমি ঘুমিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। জ্ঞান ফিরতে বুঝলাম সবাই কীরকম ঘাবড়ে গেছে। রাজি হওয়াটা ঠিক হয় নি। বিশ্বাস হত না এসব আগে। আলো নিভিয়ে দেব? ভয় পাবে না তো?”
সংযুক্তা বলল, “দাও”।
সুপ্রিয় আলো নিভিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ল।
রাতের শব্দ আসছে যেন। ভেজা মেঝে, কাঠের ছাদ, পর্দা ঘেরা কাঁচের জানলা… একটা ঘরে এক দুদিন থাকলেও কেমন মায়া জন্মে যায়। তাকে নিজের বাড়ি ছেড়ে সুপ্রিয়দের বাড়ি চলে যেতে হয়েছিল। এখনো মাঝে মাঝে তার ঘরটার কথা ভাবলে মন খারাপ হয়ে যায়। এক সন্ধ্যেয় দাদা ছিল না। নীলুদার সঙ্গে ক্যারাম খেলছিল। কী যে ভাল লাগছিল। মনে হচ্ছিল, কিছুতেই যেন সন্ধ্যেটা শেষ না হয়। স্ট্রাইকারটা রেখে দিয়েছিল তার কাছে। দাদা জিজ্ঞেস করলে বলত হারিয়ে গেছে।
সংযুক্তা চোখ খুলে শুয়ে রইল।
বেঁচে থাকার কত রকম রং থাকে। কোনটা রামধনু হয়ে আসে, কোনটা একবারে ফ্যাকাসে সাদা কালো। সুপ্রিয় কোন দিন তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে নি। তবু সে পারল কোই? সারা জীবন এভাবে অনুভূতিটুকু লুকিয়েই কাটিয়ে দিতে হবে।
পাপান ঘুমের মধ্যে তাকে জড়িয়ে ধরল। নীলুদা ভুল কিছু বলে নি। পাপান কত দিন পেটে ছিল! কত কষ্ট। সব কিছু এভাবে হেলায় সরিয়ে দেওয়া যায় না।
নীলুদা খুব ঠিক। খুব। নীলুদা কিছুতেই ভুল বলতে পারে না। কত ভালো ছেলে নীলুদা। কোন দিন তাকে খারাপ চোখে দেখল না, কোন দিন কোন অনুভূতিই তৈরি হল না তার উপরে লোকটার। সত্যিই ভাল ছেলে।
ভাল থাকুক। সুখে থাকুক।
“এখানে শুয়ে কী করছ? তোমার তো আমাদের সঙ্গে যাওয়ার কথা। সময় নষ্ট কোর না। উঠে পড়”।
ফিসফিস করে কে তার কানে কানে কথাগুলো বলে উঠল।
সংযুক্তা স্পষ্ট বুঝতে পারল সেই অস্তিত্বটা ফিরে এসেছে।
সে ভয় পেল না। উঠে বসল।
“এই তো, এবার দরজা খুলে বেরিয়ে এসো, দেখো যেন শব্দ না হয়”।
মন্ত্রমুগ্ধের মত সংযুক্তা দরজা খুলল। চারদিক নিঝুম। সবাই ঘুমোচ্ছে, কেউ বা পরস্পরকে আদর করছে।
“চল, নদীর কাছে চল”।
সংযুক্তা খালি পায়েই হেঁটে গেল। রিসোর্টের গেটের থেকে খানিকটা নিচে একটা ভাঙা বেড়া ডিঙিয়ে রিসোর্টের কম্পাউন্ডের বাইরে বেরোল সে।
হাঁটতে হাঁটতে নদীর কাছে পৌঁছল। বর্ষার পাহাড়ি নদী। খরস্রোতা। বড় বড় পাথরকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে।
“বেঁচে থেকে কী করবে তুমি? কেউ তোমাকে ভালোবাসে না। কেউ না। বেঁচে থেকে কিচ্ছু হয় না বিশ্বাস কর। আমাদের কাছে এসো। আমরা তোমাকে ভালবাসব। যত্ন করব। নীলুদার মত দূরে ঠেলে দেবো না। দেখলে তো বুলু, সারাজীবন যাকে ভালবাসলে, সে তোমাকে এত টুকুও ভালবাসল না। ভাগ্যিস ওরা আমায় ডাকল। আমি তোমাকে দেখেই বুঝেছি, তুমি এই পৃথিবীতে থাকতে চাও না। থেকে কী করবে বল? ভালোবাসা তো এভাবে কেড়ে নেওয়া যায় না। ভালবাসা ভেতর থেকে আসে। তা তো হল না। ভালোবাসাহীনতায় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে? কেউ তোমার মূল্য দিল না। অনেক তো হল। এসো আমাদের কাছে। নদীতে নেমে এসো বুলু। আমাদের কাছে এসো”।
সংযুক্তা কাঁদছিল। ভীষণ কান্না পাচ্ছিল তার। এত কান্না জমা ছিল বুকের ভেতরে, সে নিজেও কোন দিন বুঝতে পারে নি।
ধীর পায়ে সে নদীর দিকে এগিয়ে চলল…
৪৫
ভোর চারটেয় উঠে পল্লবকে ঠেলতে লাগল রুমানা, “এই, ওঠ, ওঠ, উঠে বস”।
পল্লব ধড়মড় করে উঠে বসে পড়ল, “কী হয়েছে?”
রুমানা বলল, “তুই কি এখানে ঘুমোতে এসেছিস?”
পল্লব বলল, “ঘুম পেলে ঘুমবো না বলছিস?”
রুমানা বলল, “না, কেন ঘুমোবি? আদর কর”।
পল্লব রুমানাকে জড়িয়ে ধরল।
রুমানা পল্লবের সারা মুখে চুমু খেয়ে বলল, এবার ঘুমো হতচ্ছাড়া”।
পল্লব বলল, “আর ঘুম পায়”?
রুমানা হাসতে হাসতে পল্লবকে আরো আদর করতে শুরু করল।
পল্লব বলল, “ওরে বাবা রে। এমন করছিস যেন আজকেই আমাদের জীবনের শেষ দিন”।
রুমানা বলল, “সেই ভেবেই আদর কর। প্রতিটা আদর এমন হোক, যেন আজকেই জীবনের শেষ দিন”।
পল্লব রুমানার গলা জড়িয়ে ধরে বল, “হোক, হোক, তাই হোক”।
#
ভোর ছ’টা বাজে। রুদ্রর ঘুম ভেঙে গেল। তাকে জড়িয়ে ধরে হিয়া ঘুমোচ্ছে।
রুদ্র ঘুম চোখে হিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটা তাকে ভালোবাসে। এই মেয়েটা তার। এর থেকে ভাল অনুভূতি আর কী হতে পারে? তারা দুজন চাকরি করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কত প্ল্যান করল তারা সারারাত। মাঝে মাঝেই হিয়া তাকে চুমু খাচ্ছিল। এত চুমু খাচ্ছিল যে শেষতক বিরক্ত হয়ে বলতে হল, “তুই থামবি”?
হিয়ার সে কী হাসি!
মেয়েটার কপালে একটা চুমু এঁকে খাট থেকে নামল রুদ্র। এই সময়টা শহরে থাকলে সে দৌড়তে বেরতো। এখানে বৃষ্টির জন্য কিছুই করতে পারে নি।
এখন বৃষ্টি নেই। কালচে ধূসর ভাবটাও নেই প্রকৃতির। হালকা রোদ উঠেছে। জ্যাকেট গায়ে দিয়ে রুদ্র বাইরে বেরোল। আজ রোদ উঠবে। ফুলগুলো এখন থেকেই যেন হেসে উঠছে। একটা গান মনে পড়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার হল এই ইংরেজি কিংবা হিন্দি গান না। ছোটবেলায় বাবা একদম ভোরবেলা ক্যাসেট প্লেয়ারে এই গানটা চালাত, “যেথা রামধনু ওঠে হেসে, আর ফুল ফোটে ভালোবেসে, বল তুমি যাবে কি গো সাথে, এই পথ গেছে সেই দেশে”।
তালাত মাহমুদের গান। কী অদ্ভুত মায়াবী গলা! রুদ্র গুণগুণ করতে করতে জগিং করতে শুরু করল। “যেথা সব তিথি মধু তিথি, মধু মাস জেগে থাকে নিতি, মন যেন প্রজাপতি হয়ে, পাখা মেলে মেলে তারে খোঁজে”।
একটা কটেজ রেনোভেট হচ্ছে। ইট বালি পাথর পড়া রাস্তার পাশে। সব কটা কটেজই হয়ত রেনোভেট করতে হবে। তেমনভাবে রোদ পড়ে না বলে ঘরগুলোতে ড্যাম্প পড়ে গেছে। স্যাঁতস্যাঁতে ব্যাপারটা ঠিক উপভোগ্য হয় না।
রিসোর্টের একজন বলেছিল এখানে অনেক রকম পাখি আসে। বৃষ্টির জন্য আসছে না। রুদ্র নদীর স্রোতের শব্দ ছাড়াও বিভিন্ন রকম পাখির ডাকও শুনতে পাচ্ছিল। হিয়াকে ডাকলে হত! একা একা কেন শুনবে সে? এখন থেকে ভাল সব কিছু শেয়ার করবে হিয়ার সঙ্গে। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে থেকে পৃথিবীর রূপের সবটুকু অনুভব করবে।
রিসোর্টের বাচ্চা ছেলেটা ঘুম চোখে তাকে দেখে হাসল। চাবি নিয়ে এসেছে সে। বাইরের গেটের তালা খুলে দিল। এই ছেলেটাই তাদের খাবার দেয়। ঘরে ঘরে চা দিয়ে আসে। সারাক্ষণ হাসছে। সামনে ক্লাস টুয়েলভ দেবে। তার পড়াশুনা করে। ওর বাবা চাকরি করত এখানে। অসুস্থ হওয়ায় এখন ছেলেটা ডিউটি করে দেয়।
রুদ্র গেট খোলা পেয়ে বাইরে বেরোল। পাহাড়ের গা বেয়ে সবুজ জঙ্গল উঠে গেছে। পাথর বসিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। রাস্তার অন্য দিক নদীর দিকে নেমে গেছে।
এত সকালে এ দিকে কেউ আসে না। একা থেকে থেকে নির্জন জায়গাটাও বেঁচে থাকতে শিখে গেছে।
“যেথা শুধু আলো শুধু আশা
সারা বেলা করে কানা কানি
চির চেনা হয়ে পাশে থেকে
হয় মনে মনে জানা জানি
যেথা হাতখানি হাতে বাঁধা
বেণুবীণা একি সুরে সাধা
তাই যত কথা বলা বাকি
যায় গান হয়ে তারই রয়েসয়ে”…
গুনগুন করতে করতে নদীর কাছে এল রুদ্র।
নদীর জলে মুখ ধুয়ে নিতে ইচ্ছে করছিল। স্বচ্ছ জল। কেউ কেউ বলে এ জলে সালফার বেশি থাকে।
প্যান্ট গুটিয়ে জলে নামল রুদ্র। দু হাত ভরে জল নিয়ে চোখে মুখে জলের ছিটে দিল। ঠাণ্ডা জল, কিন্তু কী ভাল লাগছে।
আরেকবার জল নিতে ঝুঁকবে, দেখল সামনে একটা বড় পাথরের উপরে চুপ করে বসে আছে সংযুক্তা। পাথরটা এমন আড়ালে নদীর উপরে বসানো যে রাস্তা দিয়ে আসার সময়ে সেখানে যে কেউ বসে আছে, তা দেখতেও পাওয়া যায় নি। সংযুক্তার উপস্থিতি এতটাই নিস্তব্ধ যে, এতক্ষণ তার চোখেই পড়ে নি!
রুদ্র আরেকটু হলেই জলে পড়ে যাচ্ছিল। সে বলল, “দিদি, আপনি এখানে এলেন কী করে?”
সংযুক্তা তার দিকে ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে রইল। রুদ্র কোন মতে স্রোত সামলে এগিয়ে গিয়ে নিচ থেকে হাত বাড়াল, “আসুন, আসুন, এখানে বসে থাকা ভীষণ রিস্কি”।
সংযুক্তা তার দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। যেন চিনতেই পারছে না। রুদ্র চিৎকার করল, “হাতটা দিন দিদি, পড়ে গেলে আর দেখতে হবে না। তাড়াতাড়ি!”
সংযুক্তা হাত বাড়াল…
৪৬
“এখানে কী করে এলেন? এত উঁচু পাহাড়ে উঠলেনই বা কী করে? আপনিও কি মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলেন?”
সংযুক্তা কেমন ঘোর লাগা চোখে তার দিকে তাকাল। রুদ্র বলল, “প্লিজ বলুন, আমি তো আপনাকে দেখে পুরো ঘাবড়ে গেছিলাম”।
সংযুক্তা কোন মতে বলল, “আমি পাপানের কাছে যাব। আমাকে নিয়ে যাবে ভাই?”
রুদ্র বলল, “হ্যাঁ। নিশ্চয়ই নিয়ে যাব। কিন্তু আপনি…”
সংযুক্তা বলল, “আমি কিছু জানি না। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না”।
রুদ্র বলল, “ঠিক আছে। চলুন, আপনাকে কটেজে ছেড়ে আসি”।
সংযুক্তা ঘাড় নাড়ল।
কিছুটা হাঁটার পর বলল, “কাউকে কিছু বোল না ভাই, ঠিক আছে?”
রুদ্র ঘাড় নাড়ল, “আচ্ছা”।
সংযুক্তা হাঁটতে হাঁটতে দরজা ঠেলে তাদের কটেজে ঢুকল।
সুপ্রিয় আর পাপাই দুজনে কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। সে সুপ্রিয়র পাশে বসে কেঁদে ফেলল।
সুপ্রিয়র ঘুম ভেঙে গেল। সে উঠে বসল, “কী হয়েছে?”
সংযুক্তা বলল, “কিছু না”।
সুপ্রিয় বলল, “ঠিক আছে। বলতে হবে না”।
সংযুক্তা সুপ্রিয়র বুকে মুখ গুঁজল।
সুপ্রিয় সংযুক্তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “অনেক দিন পরে তোমাকে বড্ড চেনা লাগছে জানো তো? কোন ম্যাজিক হল নাকি?”
সংযুক্তা মাথা নাড়ল, “কিছু হয় নি”।
সুপ্রিয় বলল, “নীলুদা মিরাকল করে দিল সত্যি। ভাগ্যিস এখানে আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমি তো প্রথমে বিরক্ত হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে উনি না থাকলে তোমাকে আগের মত করে পেতাম কী করে? ওর একটা বড় ধন্যবাদ প্রাপ্য”।
সংযুক্তা বলল, “দিও”।
সুপ্রিয় বলল, “তুমি কোথায় গেছিলে? মর্নিং ওয়াক করলে নাকি?”
সংযুক্তা মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ”।
সুপ্রিয় বলল, “একা একা বেরোলে কেন? আমাকে ডাকতে পারতে! যদিও জায়গাটা সেফ, সে ভয় নেই, তবু… রোদ উঠেছে?”
সংযুক্তা বলল, “হ্যাঁ। মেঘ কেটে গেছে”।
সুপ্রিয় বলল, “যাক। চল একটু হেঁটে আসি”।
সংযুক্তা মাথা নেড়ে বলল, “না, আমি তোমার কাছে থাকি এখন”।
সুপ্রিয় হাসল, “পাপান উঠে যাবে তো”!
সংযুক্তা বলল, “উঠলে উঠুক। কিছু হবে না”।
সুপ্রিয় বলল, “দূর পাগলী। আচ্ছা শোন, আমি আর এখানে থাকব না। কেমন লাগছে, কেন জানি একটা অস্বস্তি হচ্ছে। কোথায় যাওয়া যায়?”
সংযুক্তা বলল, “আমি কী করে জানব? তুমি দেখো কোথায় নিয়ে যাবে”।
সুপ্রিয় চিন্তিত মুখে বলল, “ঠিক আছে। দেখা যাক”।
সংযুক্তা বলল, “আমাকে অনেকটা আদর করবে? অনেএএএএএএকটা?”
সুপ্রিয় বলল, “করব। ছেলেটা উঠবে এবারে। সেটা খেয়াল রেখে যা পারো কর”।
সংযুক্তা পাপানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “ছেলেটাকে বড্ড অবহেলা করি আমি, ঠিক করি নি। কত প্রশ্ন করে, শুনতেও চাই না। এখন থেকে যা যা পারি, উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব”।
সুপ্রিয় বলল, “সেটা তোমার দোষ ছিল না। তোমার মধ্যে একটা ডিপ্রেশনের ভূত ছিল তো। সেটা করাতো এসব”।
সংযুক্তা অন্যমনস্কভাবে বলল, “তাই হবে। সেটাই করাতো। আর পারবে না”।
সুপ্রিয় বলল, “কাল একটা অভিজ্ঞতা হল বটে। নীলুদা একটা কথা বলেছিল জানো, যদি কারো ডিপ্রেশন থাকে, তাহলে তার প্ল্যাঞ্চেট না করাই ভাল। তুমি কি বলছিলে, কার অস্তিত্ব পাচ্ছিলে কাল?”
সংযুক্তা বলল, “ও কিছু না। এখন মনে হচ্ছে ওসব মনের রোগ ছিল”।
সুপ্রিয় বলল, “ঠিক বলেছো। অন্ধকারে আমরা অনেক উলটো পালটা ভাবতে শুরু করি। এই যে রোদ উঠবে, দেখবে সব ভয় কোথায় লেজ গুটিয়ে লুকিয়ে পড়বে! জীবনটাই এরকম। সত্যের সামনে দাঁড়াতে হয়। মিথ্যেগুলো সব ওই আলোর সামনে লেজ গুটিয়ে পালাবে। চল, আমরা একটু হেঁটে আসি না হয়”।
সংযুক্তা মাথা নাড়ল, “বললাম না, আমি কোথাও যাব না এখন। এখানেই থাকব?”
সুপ্রিয় সংযুক্তার পিঠে হাত রেখে বলল, “তাই হোক”।
৪৭
“আমি দেখেছি, সম্পর্ক আসলে ট্রায়াল এন্ড এরর পদ্ধতিতে চলে। মানুষ কী চায়? ভাল খাবার চায়, ভাল ঘর বাড়ি, আর চায় একজন সঙ্গী। সবাই মন মত সঙ্গী পায় না। তখন শুরু হয় সব কিছুকে অভ্যাসে পরিণত করার চেষ্টা। কোন কোন সম্পর্ক শেষ হবার পরেও শেষ হয় না। সব কিছু অভ্যাস না। হতে পারে না। অভ্যাসের পরে একটা ভালবাসার বিরাট জায়গা আছে। সে জায়গা ভরাট করার ক্ষমতা আমাদের কারো থাকে না…”
ঘুম থেকে উঠে নীলাদ্রি খানিকটা লিখে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিল। কয়েকদিন লেখা বন্ধ থাকুক। লিখে ভাল না লাগলে লেখার দরকার নেই। রণিতা ঘুমোচ্ছে। সে গাড়ি বলার জন্য রিসেপশনে গেল। রিসোর্টের একজন বয় ড্রাইভারকে ডেকে নিয়ে আসবে। তার থেকে খোঁজ নেওয়া হবে দার্জিলিঙের রাস্তা খুলেছে কিনা। নইলে অন্য কোথাও যেতে হবে।
রাজা নামের ছেলেটা তার কটেজের সামনে ফোনে ভিডিও তৈরি করছে, “সুপ্রভাত বন্ধুরা, অবশেষে, অবশেষে আমরা একটা… ওই কী যেন বলে, একটা রৌদ্রকরোজ্বল দিন উপহার পেয়েছি। আমি তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। চারদিকে শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। কোথাও ব্রিজ ভেঙে পড়েছে, কোথাও তিস্তা ব্যারেজের জল বিপদ সীমার উপর দিয়ে বইছে। এত সব কিছুর মধ্যে, আমরা এই চমৎকার জায়গায় সময় কাটাচ্ছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমরা ঠিকই ধরেছ, আমরা বলতে আমি আমার কথাই বলছি, কিন্তু একটা কথা তো মানতেই হবে বন্ধুরা, এখানে নেটওয়ার্ক না থাকুক, তোমরা তো আছো। সো গুড মর্নিং, আর দারুণ কাটুক তোমাদের দিনটাও। ও হ্যাঁ, ঠিক ঠিক, এখানে একবারে নেটওয়ার্ক নেই, তাতে কী হয়েছে, যখন আপলোড করব, দিন তো তখন থেকেই শুরু হবে, তাই না? ভালো থাকো, দারুণ থাকো আর ফাটিয়ে মজা কর। আরও আপডেট নিয়ে আমি আসছি খুব তাড়াতাড়ি”।
নীলাদ্রি হাঁটতে হাঁটতে রাজার কাছে চলে এসেছিল। রাজা তাকে দেখে লাজুক হাসল। নীলাদ্রি বলল, “দারুণ, তোমার হবে। সুন্দর বল তুমি। কোন স্ক্রিপ্ট ছাড়াই বললে?”
রাজা ঘাড় নাড়ল, “হ্যাঁ, আমিই বললাম স্পন্টেনিয়াসলি”।
নীলাদ্রি বুড়ো আঙুল দেখাল, “হবে, তোমার হবে বস”।
রাজা খুশি হল, “থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ”।
পল্লব কটেজের বাইরে চেয়ার নিয়ে ঘুম ঘুম মুখে বসে আছে। নীলাদ্রি বলল, “অল ওকে?”
পল্লব ঘাড় নাড়ল। মুখ ভর্তি লিপস্টিকের দাগ ওর। দেখে নি বোধ হয় এখনো।
নীলাদ্রি হেসে এগিয়ে গেল। পাপানকে নিয়ে সুপ্রিয় দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে বলল, “আপনারা কি আজকেই…”
নীলাদ্রি বলল, “দেখছি। সবটাই রাস্তার উপর ডিপেন্ড করছে। অবশ্য এখানে আমাদের সেনা আছে। ওরা খুব তাড়াতাড়ি রাস্তা রিকভার করে দিচ্ছেন। সেরকম বুঝলে যাওয়া ক্যান্সেল হবে। দেখা যাক”।
সুপ্রিয় বলল, “রাস্তা ভাল থাকলে আমি ভাবছি একবার যদি যাওয়া যায়। পাপানটার আবার টয়ট্রেনের ভীষণ শখ”।
নীলাদ্রি বলল, “ঠিক আছে, আমি খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি তোমায়”।
সুপ্রিয় মাথা নাড়ল, “বেশ”।
পাপান বলল, “আঙ্কেল তুমিও কি মর্নিং ওয়াকে গিয়েছিলে? মা গেছিল। কিছুক্ষণ আগে ফিরল”।
নীলাদ্রি বলল, “না বাবু, আমি রুমেই ছিলাম”।
রুদ্র তাদের কটেজের সামনে বসে ছিল। পাপানের কথা শুনে কিছু বলল না। সংযুক্তা যখন বারণ করেছে, তখন কাউকেই কিছু বলবে না। হিয়াকেও না। অন্যের ব্যাপারে যত কম বোঝা যায়, তত ভাল।
নীলাদ্রি ডাকল, “বুলু, এই বুলু”।
সংযুক্তা বেরিয়ে এল।
নীলাদ্রি বলল, “আমরা আজকে বেরিয়ে যাব, তোরা সাবধানে থাকিস, বাড়ি গেলে জানাস”।
সংযুক্তা হাসিমুখে মাথা নাড়ল, “আচ্ছা দাদা”।
তার চোখের তলায় কেমন কালি পড়েছে।
তবু সংযুক্তাকে দেখে অনেক ধোপদুরস্ত লাগছিল।
নীলাদ্রির কানে “দাদা” শব্দটা লাগল।
সে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “আমি রুমে গেলাম। অনেক গোছ গাছ বাকি। দেখি রনি উঠেছে নাকি”।
রিসোর্টের গেট থেকে হই হই শব্দ আসা শুরু হল। দুটো নতুন ফ্যামিলি এসেছে।
রিসোর্টের ছোট ছোট ছেলেগুলো ভীষণ খাটতে পারে। দৌড়তে দৌড়তে ওদের লাগেজ আনতে যাচ্ছে।
নীলাদ্রি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে সংযুক্তাকে দেখল। সংযুক্তা সুপ্রিয়র সঙ্গে মন দিয়ে কোন কথা বলছে।
বেশ কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ানোর পরেও তার দিকে ফিরে তাকালো না।
ওর চোখের তলায় এত কালি কী করে এল এক রাত্রে? একবারেই ঘুমোয় নি?
নীলাদ্রি সুপ্রিয়র দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। সুপ্রিয়ও প্রত্যুত্তরে হাত নাড়ল।
নীলাদ্রি তার রুমে গিয়ে ঢুকল।
রণিতা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।
সে চেয়ারে বসে চুপ করে রণিতার ঘুম দেখতে লাগল।
তার বউ।
তার নিজের বউ…
Leave a Reply