আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ১ (প্ৰথম খণ্ড)
অনুবাদ – নচিকেতা ঘোষ
কামিনী প্রকাশালয়
প্রথম প্রকাশ : শুভ নববর্ষ, ১৪০৫
প্রচ্ছদ – পার্থপ্রতিম বিশ্বাস
বিদগ্ধ রহস্য-পাঠকদের করকমলে—
.
আগাথা গাঁথা
রচনার মুন্সীয়ান, বিষয় বৈচিত্র্যের অভিনবত্বে, সুচতুর কাহিনীর রোমহর্ষক বিন্যাসে, পরিণতির উত্তরণে, ঘটনার আশ্চর্য উপস্থাপনায়, বিষয় বৈচিত্র্যের অনন্যতায় রহস্যসম্রাজ্ঞীর আসনে অধিষ্ঠিতা আগাথা ক্রিস্টি—মৃত্যুর পরে অতিক্রান্ত সময় সীমাতে এখনো তিনি জনপ্রিয়তার সোনালী উপত্যকাকে আসীন পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়ে তাঁর সাহিত্যসম্ভার পৌঁছে গেছে বিভিন্ন দেশের পাঠক-পাঠিকার কাছে।
যদিও জনপ্রিয়তার নিরিখে তিনি জেমস্ বন্ড অথবা জেমস্ হেডলী চেজের সমকক্ষ নন কিন্তু সারা বিশ্বের রহস্য সাহিত্যপিপাসু মানুষের মনের মণিকোঠায় তিনি বিরাজিত আছেন আশ্চর্য জনপ্রিয়তার উত্তুঙ্গ আসনে। পরিবর্তিত পটভূমিতে— রূপান্তরিত পরিবেশে তিনি এখনো কি আশ্চর্য যাদু-লেখনীতে শুধু ধরে রেখেছেন অসংখ্য মানুষকে।
ইন্টারনেট টেলিভিশনের আগ্রাসন, কম্পিউটার যুগের অনুপ্রবেশ, কেবল টিভির আক্রমণে যখন আমাদের বিনোদনের পরিমণ্ডলে ঘটে গেছে নিঃশব্দ বিপ্লব তখনও আগাথা ক্রিস্টির রচনাবলী হৃদয়ের অভ্যন্তরে জ্বেলেছে ভালোলাগার রঙীন তুবড়ি। তার উদ্ভাসিত আলোর বিচ্ছুরণে বিমুগ্ধ আমাদের মন ও আত্মা।
আগাথা ক্রিস্টির অসামান্য জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মাউসট্রাপ’ অবলম্বনে নাটক একাদিক্রমে একুশ বছর ধরে অভিনীত হয়ে এক বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করেছে যা অনেকবছর অক্ষুণ্ণ থাকবে বলেই মনে হয়
আগাথা ক্রিস্টির সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব হল এই যে তিনি অনায়াস অবহেলায় হরণ করে পাঠক-পাঠিকার হৃদয়ে রেখে যান চিরস্থায়ী আনন্দের ছাপ
ক্রিস্টির সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হল তাঁর বিষয়বস্তুর বিভিন্নতা—কখনো তিনি চরিত্রকে পৌঁছে দেন লণ্ডনের পিকাডিলি সার্কাসে, কখনো-বা সে অনায়াসে পা রাখে আফ্রিকার রহস্যঘন অরণ্যে, কখনো সে আপনমনে ঘুরে বেড়ায় সিরিয়ার প্রান্তরে, এক লহমাতে হতে চায় কোনো রোমাঞ্চিত মুহূর্তের প্রতিবেশী।
ঘটনাস্থলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনে ক্রিস্টি অনন্যা, অসাধারণ তাঁর বিচারবোধ, কি নিপুণ সৃজনশীলতায় তিনি পৌঁছে যান হৃদয়ের মর্মস্থলে রেখে যান চিরন্তন ছাপ।
এরকুল পোয়ারো তাঁর প্রিয়তম গোয়েন্দা চরিত্র, মধ্যবয়েসী ইতালীয় মানুষ, নেহাৎ সাধারণ চেহারা, অবয়বে নেই অসাধারণত্বের ছাপ, সহসা দেখলে মনে হবে বুঝি এক নেহাতই অপাংক্তেয় ব্যক্তিত্ব, তবু কিভাবে তিনি যে উন্মোচিত করেন রহস্যের যবনিকা তাতে অবাক লাগে। যে কোনো খুনের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা ঘনীভূত রহস্যের ধূমায়িত অন্ধকার সহসা আলোকিত হয় অপূর্ব সৃজনশীলতার স্পর্শে, আমরা যাকে দোষী বলে ভাবতেও পারি না অবশেষে তাকেই হতে হয় অপরাধী ।
এমনভাবেই আগাথা ক্রিস্টি অসংখ্য বার আমাদের চমকিত করেছেন তাঁর নিপুণ শৈলীতে, আচ্ছন্ন করেছেন মায়াবী লেখনীর যাদুতে, রেখে গেছেন মন্ত্রমুগ্ধ অনুরাগের বিনম্র অভিবাদন।
আগাথা ক্রিস্টির সুবিশাল রচনা সাম্রাজ্যের আকাশে উজ্জলতম জ্যোতিষ্করূপে প্রতিভাত অবশ্যই এরকুল পোয়ারো। এই প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গোয়েন্দাপ্রবরের নিজস্ব নিপুণ বিশ্লেষণী ক্ষমতা আর অনন্যসাধারণ বিচারবোধের এক মহামিলন ঘটেছে বুঝি।
পোয়ারো ছাড়াও আর এক গোয়েন্দা আমাদের অনেকাংশে চমৎকৃত করেন, তিনি হলেন পার্কার পাইন। যদিও পোয়ারোর মত বিভিন্ন রহস্যজাল উন্মোচনে তাঁকে আমরা দেখিনি, বিশাল ক্যানভাসে তিনি আঁকেননি অসংখ্য ছবি, তবু তাঁকে সীমিত পরিসরে মনে হয়েছে একক ও অনন্য ।
পার্কার পাইনের কৃতিত্ব হল এই, যে অল্প আয়েসে তিনি জটিল রহস্যজাল ছিন্ন করতে পারেন—আপাতদৃষ্টিতে যাকে মনে হয় কঠিন কঠোর রোমাঞ্চের আবরণে আবৃত থাকে তিনি অনায়াসে প্রকাশ করেন যুক্তির আলোকে।
আগাথা ক্রিস্টির আর এক গোয়েন্দা মহিলা, নাম মিস মারপল ।
এ এক অদ্ভুত চরিত্র, মহিলা হওয়া সত্ত্বেও মিস মারপল কোনো পুরুষ গোয়েন্দার চেয়ে কম নন। তিনিও শুধুমাত্র প্রখর বুদ্ধিবৃত্তিকে সম্বল করে একের পর এক তদন্ত করে, আর তাঁর অনুকরণীয় ভঙ্গিতে ক্রমে দাঁড়ান সফলতার সবুজ প্রান্তরে ।
তিনজন প্রধান গোয়েন্দা চরিত্রের উপস্থাপন আগাথা সাহিত্যকে বিশেষিত করেছে নতুনতর আঙ্গিকে।
বিশ্ববিখ্যাত রহস্যসাহিত্যিকের যখন একটি মাত্র গোয়েন্দার অভিযানে আত্মনিবেশিত তখন আগাথা পারস্পরিক বিপরীত চরিত্রের অধিকারী একাধিক গোয়েন্দাকে হাজির করেছেন আমাদের সামনে ।
সারাজীবনে অসংখ্য উপন্যাস আর ছোট্টগল্প লিখেছেন ডেম আগাথা যা তাঁকে দিয়েছে অপরিমেয় ব্যাপ্তি আর আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা।
কিন্তু কোনো দুটি কাহিনীর অন্তরালের কাহিনিতে সাদৃশ্য আনেননি – এখানেই তাঁর কৃতিত্ব ।
আগাথার সমগ্র রচনাবলীকে বাংলা সাহিত্যে এই প্রথম উপস্থাপিত করা হল—এর আগে অনেকবার বিভিন্ন ও বিচ্ছিন্নভাবে তাঁর লেখনীকে অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা ভাষার পাঠক-পাঠিকার সামনে তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু আগাথা ক্রিস্টির সমগ্র রচনাকে তিনটি খণ্ডের মাধ্যমে প্রকাশ করার দুঃসাহসী পরিকল্পনার অন্তরালে আছেন কামিনী প্রকাশালয়ের কর্ণধার শ্যামাপদ সরকার ।
আগাথার ২২টি উপন্যাস এবং অনেকগুলি সুখপাঠ্য গল্পের ডালি দিয়ে সাজানো হল প্রথম খণ্ডটি।
এতে আছে ‘এলিফ্যান্টস ক্যান রিমেমবার’-এর মতো ধ্রুপদী উপন্যাস। যেখানে মনস্তাত্ত্বিক বাতাবরণে উদ্ভাসিত অবদমিত পাপ আর পঙ্কিল প্রণয় কাহিনি, আছে সিক্রেট অ্যাডভারসরীর মতো রুদ্ধশ্বাস ঘটনাবহুল উপন্যাস, দি ক্যারিবিয়ান মিস্টি নামের অসাধারণ জনপ্রিয় লেখনীটি, ডেথ অফ দি নাইল-নামের মর্মস্পর্শী উপন্যাস আমাদের অনায়াসে পৌঁছে দেয় ইপ্সিত জগতে, রেখে যায় তার স্মরণীয় স্মৃতি।
আর আছে ডেথ কামস অ্যাট দ্য এন্ড নামের মানবিক গুণাবলী সমন্বিত আখ্যায়িকাটি। আছে এন্ডলেস নাইটের মতো দুরন্ত কাহিনি ।
মার্ডার অ্যাট দ্য ভিকারেজ হল আর একটি বিখ্যাত ক্রিস্টী কাহিনি যা এক নিঃশ্বাসে পাঠ করতে হয়।
এই খণ্ডের অন্যতম সংযোজনা হল ফোর-ফিফটি ফ্রম প্যাডিংটন—এটি আপনাদের হৃদয়ে সঞ্চার করবে অপূর্ব অনুভূতি।
দ্য বডি ইন দ্য লাইব্রেরি হল এক বহুপঠিত উপন্যাস-এর প্রতি ছত্রে বিধৃত শ্বাসরুদ্ধ কাহিনি আমাদের বিস্ময়ে অবশ করে।
টেন ডলস—এক অত্যাশ্চর্য উপাদানের কাহিনি—যার অন্তরালে ধ্বনিত নিঠুর নিয়তির আর্তনাদ—ক্ল্যাসিক রচনাশৈলীর অনবদ্য নিদর্শন।
দ্য মুভিং ফিংগারকে অনায়াসে চিহ্নিত করা যেতে পারে আগামী শতকের উপন্যাস হিসেবে, এমনই নিখুঁত এর গঠনশৈলী ও আঙ্গিক।
এ মার্ডার ইজ অ্যানাউনসড-ক্রিস্টি ঘরানার অনবদ্য ও অপূর্ব কাহিনি । শিহরিত উপস্থাপনার আশ্চর্য মেলবন্ধন ।
ফিলোমেল কটেজের মধ্যে অনুচ্চারিত সামাজিক সমস্যার স্পন্দন—আর আছে চিরকালীন মায়াময়তার করুণ ইতিবৃত্ত।
নেমেসিস—এক ভিন্নতর বাতাবরণে শিল্পিত আখ্যায়িকা। এ পকেট ফুল অব রাই-তে বিধৃত রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার কাহিনি
এন অর এম অথবা ইনক্রেডিবল থেফট আগাথার স্মরণযোগ্য উপস্থাপনা । মার্ডার অন দ্য লিঙ্কস—একের পর এক হত্যাকাণ্ডে শিহরিত শহরের ইতিবৃত্ত। ডাবল সিনে উন্মোচিত অপূর্ব কাহিনি এবং দি অ্যাডভেঞ্চার অফ দি ওয়েস্টার্ন স্টার-সুচতুর চমকে পরিপ্লাবিত পরিবেশ।
আর আছে পোয়ারো ইনভেস্টিগেটস থেকে চয়ন করা বারোটি কাহিনি। প্রতিটির অন্তরালে বিচিত্র সুন্দর আখ্যায়িকা বিধৃত।
পার্কার পাইন ইনভেস্টিগেটস থেকে নেওয়া হয়েছে আটটি কাহিনি ।
আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র-র বাকী তিনটি খণ্ডের মাধ্যমে তাঁর অন্যান্য কাহিনিসম্ভারকে উন্মোচিত করা হবে আপনাদের সামনে ।
আশা করছি ডেম আগাথা কেড়ে নেবেন রাতের ঘুম, হবেন আপনার সর্বক্ষণের সঙ্গিণী।
Leave a Reply