আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনাসমগ্র ১
প্রথম প্রকাশ – ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯
AKHTARUZZAMAN ELIAS RACHANASAMGRA VOL. 1 (A CollectIon of Short StorIes) by Akhtaruzzaman ElIas. PublIshed by Ahmed Mahmudul Haque of Mowla Brothers 39 Banglabazar, Dhaka 1100. Cover DesIgned by Dhruba Esh. PrIce: Taka Four Hundred only.
সূচিপত্র
- নিরুদ্দেশ যাত্রা
- উৎসব
- প্রতিশোধ
- যোগাযোগ
- ফেরারী
- অন্য ঘরে অন্য স্বর
- খোঁয়ারি
- অসুখ-বিসুখ
- তারা বিবির মরদ পোলা
- পিতৃবিয়োগ
- মিলির হাতে স্টেনগান
- দুধভাতে উৎপাত
- পায়ের নিচে জল
- দখল
- কীটনাশকের কীর্তি
- যুগলবন্দি
- অপঘাত
- দোজখের ওম
- প্রেমের গপ্পো
- ফোঁড়া ৩৩৭
- জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল
- কান্না
- রেইনকোর্ট
ভূমিকা
বাংলা কথা-সাহিত্যের একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। ৫টি ছোটগল্প গ্রন্থে প্রকাশিত ২৮টি গল্প, ২টি উপন্যাস, ১টি প্রবন্ধ সংকলন এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কিছু সাক্ষাৎকার—এই তাঁর প্রকাশিত রচনাবলী একজন সৎ ও অতৃপ্ত লেখক হিসেবে তিনি কখনোই লেখার সংখ্যা বৃদ্ধিতে আগ্রহী হন নি। গুণগত মানের দিকে অপরিতুষ্ট দৃষ্টি রাখলে সংখ্যা বৃদ্ধির সময় বা সুযোগ আর হয় কি করে? আর সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজনটাই বা কি? একজন লেখকের বলার কথা তো খুব বেশি নয়। একই কথা অবশ্য নানাভাবে, নানা ঢঙে বলা যায়, নানা ভঙ্গিতে কথার ওপর কথা চড়িয়ে গড়ে তোলা যায় কথার ফানুস, কিন্তু তারও তো একটা সীমা আছে। এই শূন্যগর্ভ ফানুস গড়তে গিয়ে লেখক প্রকরণের দিকেই মনোযোগী হন বেশি এবং তখন প্রসঙ্গের সঙ্গে প্রকরণের ঘটে বিচ্ছেদ, এবং প্রায় অবধারিতভাবেই প্রসঙ্গ হয় অবহেলিত। তাই বলা চলে প্রতিটি লেখাকেই জীবনের সৎ ও সত্যনিষ্ঠ শিল্পকর্মে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর হলে এবং নেহায়েত বণিকবুদ্ধি দ্বারা তাড়িত না হতে চাইলে একজন লেখকের প্রকাশিত রচনার সংখ্যা খুব বেশি না হওয়াটাই স্বাভাবিক।
পরিচিত অভিজ্ঞতার প্রায় সর্বস্তরে জীবনকে নির্মোহ দৃষ্টিতে একেবারে এর গভীরতম শাঁস পর্যন্ত অশেষ কৌতূহল নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে শিল্পকর্মে তা বেপরোয়াভাবে প্রকাশ করার বিরল ক্ষমতা দেখতে পাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখায়। প্রকৃতি তাঁকে এই বিশ্ব পর্যবেক্ষণের ও উপলব্ধির সময় বেশিদিন দেয় নি। হয়তো সেজন্যই এই নাজুক ও স্বল্পায়ু সময়ে তিনি মর্মভেদী দৃষ্টিকে শাণিত করে দেখেছেন তাঁর ইন্দ্রিয় ও বোধির চেনা বিশ্বকে। এই দেখা একাধারে নির্মম এবং কৌতুকবহ। নির্মম, কেননা সত্যনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ সব সময়ই নির্মম, এবং কৌতুকপ্রদ কেননা মানুষের অসতর্ক ও দুর্বল মুহূর্ত কি ভঙ্গি কি বেফাঁস বাক্য বা কাজকে তিনি যেমন অবলীলায় প্রকাশ করেন তাতে পাঠক একই সঙ্গে অস্বস্তি, বিব্রত এবং কৌতুক বোধ না করে পারে না। আর এই দুই অনুভূতি উস্কে দেওয়ার শক্তি বড় মাপের লেখকেরই বৈশিষ্ট্য। যে বাস্তবতার আলোয় তিনি
জীবন দর্শন করেন তা কখনোই একেবারে চাঁচাছোলা যান্ত্রিক বাস্তবতা নয়। খড়খড়ে শুষ্ক চোখে ইলিয়াস বিশ্ব দেখেন নি। চোখে কেবলি খরা নিয়ে সম্ভবত খুব বেশি দূর এগোনো কি খুব বড় মাপের শিল্প রচনা করা যায় না। চোখ তাঁর সিক্তই, কিন্তু সেই সজল চোখ বহির্বিশ্ব এবং অন্তর্বিশ্বকে ঝাপসা না করে বরং আলোর দ্যুতিতে উজ্জ্বলতর করেছে এবং তার উজ্জ্বল, স্বচ্ছ দৃষ্টিপথে যা-ই পড়েছে তা জীবন্ত এবং সরস হয়ে উঠেছে। এই যে দ্বিত্ব—সরস নির্মোহ-এর সাক্ষাৎ পাই ইংরেজ কবি চসারের অবলীলা বর্ণনা এবং তাঁর অন্তর্লীন হাস্যরসে।
ইলিয়াসের গল্পের বাস্তবতায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো স্বপ্নচারিতা যা ঐন্দ্রজালিক এবং অতিপ্রাকৃত আবহে লালিত। স্বপ্ন, অতিপ্রাকৃত উপাদান তো বস্তুজীবনের তথা বাস্তবতারই অংশ। স্বপ্ন দর্শন মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। শ্রম যেমন শরীরে স্বেদ নিয়ে আসে, স্বপ্ন তেমনি মানুষের আত্মায় স্বেদ-বিন্দু জাগিয়ে তোলে। স্বপ্নবিহীন মানুষ নিজের কুশপুত্তলিকা ছাড়া আর কী? স্বপ্ন, যাদু, সংস্কার, আপাত অযৌক্তিক বিশ্বাস ইত্যাদি জীবনের বাস্তবতাকে দেয় গভীরতা, দেয় একটি বহুমাত্রিক, বহুস্তর আকার ও অনুভব এবং মুক্ত করে যান্ত্রিক যুক্তিবাদ থেকে। ইলিয়াসের একজন প্রিয় লেখক গার্সিয়া মার্কেস বলেন, ঈশ্বরে বিশ্বাস না করো তো অন্তত কুসংস্কারে বিশ্বাস করো। একথা তিনি বলেন জীবনকে যান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত রেখে সামগ্রিকভাবে যাপন করার জন্য। ইলিয়াস তাঁর গল্পের বিভিন্ন বিচিত্র মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের বিশ্বাস, সংস্কার, দুঃখ, শোক, আনন্দ আহ্লাদ, অনুভূতি উপলব্ধি, ভঙ্গি, সংলাপ ইত্যাদি যে স্বচ্ছন্দ অথচ তীর্যক ও কৌতুকরহ ভঙ্গিতে সৃষ্টি করেন তাতে তাঁর লেখা যেমন জীবনের একটি সামগ্রিক, পূর্ণ-বৃত্ত বাস্তবতা তৈরি করে, তেমনি তাতে তাঁর স্বকীয় ধাঁচও প্রতিষ্ঠিত হয়।
জীবনের অস্থিমজ্জা সারাৎসারের অনুসন্ধানে নিয়োজিত থাকতে গিয়ে ইলিয়াস ব্যবহার করেন পর্যাপ্ত ডিটেলস্। কেবল বস্তুজগত কি দৃশ্যজগতের সাদামাটা বিবরণ নয়, মানসিক জীবনের সঙ্গে এই জগতের সম্পর্ক এবং মানুষের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে এর সৃষ্ট তরঙ্গও তিনি খুব গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করেন এবং তা বর্ণনা করেন ব্যাপক স্থান ও সময় জুড়ে। প্রকৃতি ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে মানুষের দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কের এই ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার অনুপুঙ্খ বিবরণ তাঁকে সাহায্য করে একটি নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান পেতে এবং সেই অবস্থানে থেকে তিনি স্বচ্ছন্দে সৃষ্টি করেন তাঁর গল্পের জগৎ।
সানুপুঙ্খ বিবরণ বা ডিটেলসের প্রতি আকর্ষণ কিন্তু ইলিয়াসকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় না। বরং সচেতন নিমগ্নতা তাঁকে বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে প্ররোচিত করে। এই বিশ্বস্ততা দেখি ইতিহাসের প্রতি, প্রচলিত লোককাহিনী, কিংবদন্তীর প্রতি, মানচিত্রের প্রতি—তা সে মানচিত্র নদীর ভাঙাগড়ারই হোক কি পুরনো ঢাকার অলিগলি শতপথেরই হোক। জয়েস ও মার্কেসের একনিষ্ঠ পাঠক ইলিয়াস তাঁর কাহিনীতে স্থানের যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেন তাতে একটি শহর, একটি জনগোষ্ঠী, একটি জনপদ অতীতের হাড়গোড়ের স্তূপ থেকে নড়েচড়ে উঠে আসে আরেকবার—এবং এবার একটি অমরণশীল জীবনযাপন করে।
আনুপুঙ্খিক বৃত্তান্তের একটি আশঙ্কা এই যে এতে লেখকের বিবরণ একঘেয়ে এবং ক্লান্তিকর হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু বড় লেখক জানেন কখন বিবরণ শেষ করে ঘটনা সৃষ্টি করতে হয়, কিংবা কখন বর্ণনায় ছেদ টেনে কাহিনীর গতিকে এগিয়ে নিতে হয়। ইলিয়াসের এই পরিমিতিবোধ অসাধারণ। বৃত্তান্তকে যেমন তিনি কিছুতেই ক্লান্তিকর পর্যায়ে নিয়ে যান না, তেমনি তাঁর কাছে নিজস্ব বিশ্বাস বা আদর্শ বা নৈতিক প্রসঙ্গের প্রচার কি পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের প্ররোচনা একেবারেই প্রশ্রয় পায় না। তাঁর গল্পে রাজনৈতিক-সামাজিক-সাম্প্রদায়িক বিষয় তিনি পরিমিত পরিসরে নির্মোহ দূরত্ব রেখে উপস্থাপন করেন।
এই অসাধারণ ক্ষমতা তাঁকে আর যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জনে সাহায্য করে তা হলো চরিত্র সৃষ্টি। ইলিয়াসের কাহিনীর মানুষজন সবাই খুব জীবন্ত। রোগা পটকা অসুস্থ, মৃত্যুপথচারী মানুষ—এমনকি মৃতদেহ — থেকে শুরু করে সবল স্বাস্থ্যবান, শক্তিধর, শয়তান প্রকৃতির লোক সবাই খুব সজীব। এরা জীবন্ত হয়ে ওঠে প্রধানত ইলিয়াসের অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ও বর্ণনায় এবং তাদের মুখে সঠিক সময়ে সঠিক সংলাপটি উচ্চারিত হওয়ায়। সমাজের দরিদ্রতম শ্রেণীর, বিশেষ করে শহরের বস্তি সমাজের নালা কাদা এঁদো জলে মলমূত্রে লেপ্টালেপ্টি করে বাস করা শ্রেণীর জীবন শিল্পে তুলে আনতে অপরিহার্যভাবে ব্যবহার করেন তাদের দিনকে দিন জীবনের গালমন্দ, খিস্তিখেউড়। ইলিয়াসের লেখায় এদের আধিক্য মনে হওয়ার কারণ নেই কেননা খিস্তি ওই জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। অতএব তথাকথিত অশালীন বা অশ্লীল গালমন্দ ছাড়া ওদের জীবনের বাস্তব চিত্র শিল্পায়িত করা কি পুনর্নির্মাণ করা একরকম অসম্ভব। মোক্ষম মুহূর্তে সঠিক চরিত্রটির মুখে যথার্থ খেউড় উচ্চারিত হওয়ায় সেই চরিত্রই শুধু নয়, গল্পের সেই সময়ের সামগ্রিক পরিবেশই জীবন্ত হয়ে জন্ম নেয়। এ ছাড়া আঞ্চলিক সংলাপের যথার্থ ব্যবহারও ইলিয়াসের গল্পের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এর ফলে কাহিনীর চরিত্র যথাযথ সামাজিক প্রেক্ষিতে অবস্থান লাভ করে।
কথা-সাহিত্য ছাড়াও ইলিয়াসের রয়েছে একটি প্রবন্ধ সংকলন, কিছু তাৎপর্যপূর্ণ সাক্ষাৎকার, আত্মীয়-পরিজন বন্ধু-বান্ধব ও পাঠক-সম্পাদকের বিভিন্ন সময়ে লেখা চিঠিপত্র, শখ করে লেখা কিছু কবিতা এবং স্কুল পাঠ্যবইয়ের জন্য লেখা চিরায়ত সাহিতের রি-টোড় গল্প। এইসব লেখায় তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি স্বমহিমায় ভাস্বর। প্রবন্ধ সংকলনের ২২টি রচনায়—শিল্প-ব্যক্তিত্ব, গ্রন্থ, ফিল্ম, সম্পাদকীয়, সাহিত্য ও সমাজবিষয়ক প্রবন্ধগুলিতে এবং বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা ও সামঞ্জস্য এবং বিশ্লেষণী শক্তির পরিচয় পাই। এইসব লেখায় প্রকাশিত তাঁর জোরালো ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও মতামত ইলিয়াসের গল্প উপন্যাসে কখনোই সোচ্চার নয়, যদিও এরা কখনো কখনো কোনো পরিবেশ, প্রতিক্রিয়া, আবহ ও চরিত্রে চকিত ছায়া সম্পাত করে।
বাংলা সাহিত্যের এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তির রচনাসমগ্র প্রকাশের বিশেষ আগ্রহ দেখিয়ে মাওলা ব্রাদার্স আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। তিন খণ্ডে সমাপ্ত এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ইলিয়াসের ২৮টি ছোটগল্প অন্তর্ভুক্ত হলো। দ্বিতীয় খণ্ডে আমরা ইলিয়াসের উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাই এবং খোয়াবনামা, এবং তৃতীয় খণ্ডে তাঁর গ্রন্থিত ও অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, প্রথম জীবনের প্রকাশিত কিছু ছোটগল্প, নির্বাচিত চিঠিপত্র ও ডায়েরি, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকার, লিরিক পত্রিকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যায় প্রকাশিত খোয়াবনামা উপন্যাসটির অংশ, কবিতাগুচ্ছ এবং প্রকাশিত ৮টি গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ চিত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনাসমগ্র প্রকাশের ব্যাপারে যাঁদের সাহায্য সহযোগিতা, উৎসাহ ও প্রেরণা এবং পরামর্শ আমরা পেয়েছি তাঁদের প্রত্যেককে বিশেষ করে কথাসাহিত্যিক জনাব শওকত আলী, জনাব মাহবুবুল আলম, জনাব আনু মুহাম্মদ, জনাব ইকবাল আহমেদ, জনাব চৌধুরী মুফাদ আহমদকে জানাই আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জীবনপঞ্জি মূলত তৃণমূল : আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যায় চৌধুরী মুফাদ আহমদকৃত জীবনপঞ্জি থেকে নেওয়া হয়েছে।
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস
ইংরেজি বিভাগ
নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি
ঢাকা
Leave a Reply