আক্রান্ত শহর
০১. ঝিম মেরে আছে মাস্ট্যাং
ঝিম মেরে আছে মাস্ট্যাং। তিন দিন হলো পিস্তলবাজি নেই, খুনোখুনি নেই, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। এ-শহরে আসল রূপ সবার চেনা, তাই আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। হরদম খুন-খারাবী শুরু হলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে সবাই। বন্দুকবাজি ছাড়া কটা দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন উত্তেজনা তুঙ্গে পৌঁছেছে। সবার মনে জিজ্ঞাসা: কার কপালে মরণ লেখা আছে এরপর?
এদিকে ক্লে অ্যালিসন, যার হাতে তিরিশজন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, মরমন হাউসে জমিয়ে পোকার খেলছে; ফাঁসির আসামী ব্ল্যাক জ্যাক কেচাম মদ খেয়ে বেসামাল অবস্থায় ফিরে গেছে সেইন্ট জেমস-এর নিজের কামরায়। যে কোনও মুহূর্তে মহা গোলমাল শুরু হয়ে যেতে পারে! সেইন্ট জেমস্ হোটেলের ছায়া ঢাকা প্রশস্ত বারান্দা, শহরে নতুন এসেছে ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক, একটা ঝকঝকে নতুন চেয়ারে বসে কৌতূহলী চোখে রাস্তা জরিপ করছে।
দীর্ঘদেহী একহারা গড়নের যুবক পল কেড্রিক, স্বল্পভাষী, এক মাথা লালচে বাদামি চুল, তামাটে চেহারা, সবুজ একজোড়া চোখ। সব মিলিয়ে সুদর্শন।
বাক বোর্ড ফ্রেইট ওয়্যাগনে গিজ গিজ করছে শহরের রাস্তা; এই মাত্র একটা স্টেজ কোচ পৌঁছেছে, একটু বাদেই রওনা হতে যাচ্ছে আরেকটা। হিচরেইলগুলোয় নানান ব্র্যান্ডের অসংখ্য ঘোড় দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছে।
পাশে এক তরুণ এসে দাঁড়িয়েছে হঠাৎ টের পেল কেড্রিক, চোখ তুলে তাকাল। অল্পবয়সী ছোকরা, ধূসর চোখে তাকিয়ে ওর দিকে। লম্বা চুল কাঁধ অবধি নেমে এসেছে তার।
ক্যাপন কেড্রিক?
জিজ্ঞেস করল নবাগত তরুণ। আমি ডরনি শ। জুন গুন্টারের কাছ থেকে আসছি।
ও, তাই? উঠে দাঁড়াল কেড্রিক, করমর্দনের জন্যে হাত বাড়াল। তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। তুমি গুন্টারের লোক?
বিদ্রূপ খেলে গেল যেন শর ধূসর চোখে। গুন্টারের সঙ্গী, শুধরে দিল সে। আমি কারও চাকরি করি না!
আচ্ছা, বুঝেছি।
আসলে বোঝে নি কেড্রিক। ধৈর্য ধরবে, স্থির করল ও, ব্যাপারটা কী জানতে হবে। ছেলেটার হাবভাবে কোথায় যেন একটা অস্বাভাবিকতা রয়েছে, সতর্ক করে তুলছে ওকে।
গুন্টার কোথায়?
আসছে। তুমি এসেছ কিনা দেখতে বলল আমাকে। হোটেলের কাছাকাছি অপেক্ষা করতে বলেছে তোমায়।
ঠিক আছে। তুমি দাঁড়িয়ে কেন, বসো?
সার বাঁধা চেয়ারগুলোর দিকে এক নজর তাকাল ডরনি শ। না, আমি হাতলঅলা চেয়ারে বসি না, অসুবিধে হয়।
অসুবিধে? চোখ তুলে তাকাল কেড্রিক, শর কোমরে ঝোলানো পিস্তলজোড়ার দিকে নজর গেল। বুঝেছি। পিস্তলের বাঁট দুটো বাইরের দিকে ছড়ানো। ওগুলোর দিকে ইঙ্গিত করল কেড্রিক। টাউন মার্শাল আপত্তি করে না?
কেড্রিকের দিকে তাকাল ডরনি শ, ধীরে ধীরে এক চিলতে হাসি দেখা দিল ঠোঁটে। না, করলে খারাপ হয়ে যাবে না!
আসলে, একটু থেমে আবার বলল সে, মাস্ট্যাংয়ে কাউকেই কিছু বলার সাহস নেই তার। শহর ভর্তি গুণ্ডা-পাণ্ডা। এখানে কোনও মার্শাল বেশিদিন টেকে না। তেমন লোক কোথায়?
হাঁসল কেড্রিক। হিকক? ইয়্যাৰ্প? ম্যাস্টারসন?
ওরা হয়তো টিকতে পারে, ডরনি শয়ের কণ্ঠে স্পষ্ট সন্দেহ, তবু আমার সন্দেহ আছে। অ্যালিসন এখন এখানে, জ্যাক কেচামও, বিলি, দ্য কিড দলবল নিয়ে আশপাশে ঘুরঘুর করছে। এই রকম শহরের মার্শালকে ক্ষিপ্র পিস্তলবাজ হতে হয়, প্রতিদিন নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে তাকে।
ঠিক বলেছ, আড়চোখে ডরনি শকে মাপল কেড্রিক। কী আছে ছেলেটার মাঝে, যা অস্বস্তি জাগিয়ে দিচ্ছে? পিস্তলজোড়া নয়; দুই পিস্তল ঝোলায় এমন লোক অনেক দেখেছে ও; সত্যি বলতে ওদের মাঝেই বেড়ে উঠেছে। নাহ্, অন্য কিছু, এর প্রতিটি ভঙ্গিতেই কেমন যেন অশুভ ইঙ্গিত আছে, সাপের চোখের দিকে তাকালে যেমন হয়-ভীতিকর অনুভূতি জাগে মনে।
লোকজন যোগাড় হয়ে গেছে, খানিক পর বলল ডরনি শ। লরেডো শ্যাডকে আমার কাজের লোক বলেই মনে হয়েছে। কঠিন, ক্ষিপ্র পিস্তলবাজ। ফেসেনডেন, পয়েন্সেট, গফ-এরাও, যোগ দিয়েছে, আমাদের সঙ্গে। ডরনি শয়ের বলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে নামগুলো অর্থবহ। কিন্তু কেড্রিকের কোনও প্রতিক্রিয়া হলো না। ফেসেনডেন নামটা চেনা চেনা লাগলেও, নিশ্চিত হতে পারল না ও। ঘাড় ফিরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল আবার, ভিড়ের ওপর চোখ বোলাল।
ওরা সত্যি লড়বে? রাস্তা থেকে চোখ না সরিয়েই জানতে চাইল ও। তেমন লোক আছে?
লড়বে মানে? শুষ্ক কণ্ঠে বলল ডরনি শ, জানপ্রাণ দিয়ে লড়বে! কঠিন লোকের অভাব নেই ওখানে। ইন্ডিয়ানদের বিরুদ্ধে লড়াই করা ছাড়াও আরও বিপদের মোকাবিলা করেছে। কাউকে পরোয়া করে না ওরা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কেড্রিকের দিকে তাকাল সে। গুন্টার বলছিল, তুমি লড়াকু লোক।
শয়ের কণ্ঠে কি সন্দেহ প্রকাশ পেল?
মুচকি হেসে কাঁধ ঝাঁকাল কেড্রিক।
আগে পশ্চিমে এসেছ?।
নিশ্চয়ই! গোল্ড রাশের কিছুদিন আগে ক্যালিফোর্নিয়াতে আমার জন্ম; যুদ্ধের সময় বয়স ছিল ষোল, নেভাদার একটা দলের সঙ্গে তখনই যুদ্ধে যোগ দিই। যুদ্ধ শেষ হবার পরেও দুবছর পশ্চিমে কাটিয়েছি। অ্যাপাচিদের বিরুদ্ধে। লড়াই করেছি।
মাথা দোলাল ডরনি, যেন সন্তুষ্ট হয়েছে। গুন্টার তোমাকে খুব পছন্দ করে। তবে সে একজন সাধারণ পার্টনার ছাড়া আর কিছু নয়।
খর্বাকৃতি স্থূলদেহী এক লোক ভিড় ঠেলে এদিকে এগিয়ে আসছে। থুতনিতে চৌকো ছাঁটের দাড়ি; ঠোঁটে একটা কালো সিগার ঝুলছে।
তার পাশে কেড্রিকের মতো লম্বা আরেকজন লোক। তীক্ষ্ণ চেহারা, চোখজোড়ায় শীতল দৃষ্টি; আদেশ করার জন্যেই যেন তার জন্ম। প্রয়োজনে এই লোক চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিতে দ্বিধা করবে না। এ-ই বোধ হয় কর্নেল লরেন কীথ। অর্থাৎ আর একজনের সঙ্গে পরিচয়ের পালা বাকি রইল-বারউইক। তিন অংশীদারের মধ্যে শুধু বারউইকই নাকি স্থানীয় লোক।
কাছে আসতেই হাসল গুন্টার, ঝকঝকে শাদা দুপাটি দাঁত বেরিয়ে পড়ল। হাত বাড়িয়ে দিল করমর্দনের জন্যে। এই যে, কেড্রিক, শেষ পর্যন্ত এলে! কর্নেল, এর কথাই তোমাদের বলেছি। কেউ যদি পারে একমাত্র ও-ই পারবে কাজটা। প্যাটারসনের গরু নিয়ে গিয়েছিল ও। চোর-ডাকাত আর কোম্যাঞ্চেদের নাকের ডগা দিয়ে গরু নিয়ে গেছে, একটা বাছুর পর্যন্ত খোয়া যায় নি।
মাথা ঝাঁকাল কীথ। ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে চট করে মেপে নিল কেড্রিককে।
ক্যাপ্টেন-আর্মিতে ছিলে নাকি?
হ্যাঁ, গৃহযুদ্ধের সময়।
হুম্। অ্যাপাচি ওঅরে পল কেড্রিক বলে একজন সার্জেন্টের নাম শুনেছিলাম…
আমিই। সেনাবাহিনী ভেঙে দেয়ার সময় সবার র্যাংক কয়েক ধাপ কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
রণাঙ্গনে ছিলে কতদিন? কেড্রিকের উপর থেকে চোখ সরাল না কর্নেল কীথ।
চার বছর। দক্ষিণ-পশ্চিমে দুবার পাঠানো হয়েছিল আমাদের।
মন্দ নয়। লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা আছে দেখা যাচ্ছে, বিদ্রূপ-ভরা দৃষ্টিতে কেড্রিকের দিকে তাকাল লরেন কীথ। আমি অবশ্য বার বছর আর্মিতে ছিলাম, নিয়মিত সদস্য হিশেবে।
কীথের আচরণ বিরক্তির উদ্রেক করছে কেড্রিকের। তবু ঠিক করল উপেক্ষা করবে ব্যাপারটা। চুপ করে রইল ও।
শুধু আমেরিকান সেনাবাহিনীতে চাকরি দিয়ে ওর অভিজ্ঞতার বিচার করো না, কর্নেল, বলল গুন্টার। লোক নির্বাচনে তার ভুল হয় নি প্রমাণ করতে চাইছে। ও ফ্রাংকো-প্রুশিয়ান ওঅরে মেয প্রতিরক্ষায় অংশ নিয়েছে। ম্যাকমোহ্যানের সঙ্গে সেডানের যুদ্ধেও ছিল।
তীক্ষ্ণ হলো কীথের দৃষ্টি, পরস্পরের সঙ্গে চেপে বসল ঠোঁটজোড়া। লোকটা ওকে পছন্দ করছে না, কেড্রিক বুঝতে পারছে, গুন্টারকে না থামালে শুরু থেকেই এ লোক ওর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে, কাজ করতে দেবে না সুষ্ঠুভাবে। কিন্তু তার-সুযোগ পেল না ও।
আফ্রিকায় সেকেন্ড অ্যাশ্যানতি ওঅরে ওয়ালসেলির সহকারী ছিল আমাদের পল, গুন্টারের গলায় আত্মপ্রসাদ। তার পর উত্তর তাই শানের তুঙ গ্যানসেদের বিপক্ষে দুবছর ব্যাপী লড়াইতেও অংশ নিয়েছে-ওই যুদ্ধে জেনারেল ছিল।
খাঁটি মার্সেনারী!
এবার আর সহ্য হলো না কেড্রিকের। এত লোকের সামনে কেউ তাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চাইবে এটা সে মেনে নিতে পারে না। ঠিক করল। কর্নেলের অহঙ্কারে একটু খোঁচা দেবে, লোকটা বেশি বাড়াবাড়ি করছে। নিজের লড়াই ভাড়াটে লোকদের দিয়ে করানোর রেওয়াজ পৃথিবীর সব দেশেই আছে, কী বলো?
প্রথমে লাল পরক্ষণে রক্ত সরে শাদা হয়ে গেল কর্নেল কীথের মুখ। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই দশাসই চেহারার এক লোক ভিড় ঠেলে সামনে এসে দাঁড়াল।
তুমি গুন্টার? চড়া গলায় জিজ্ঞেস করল লোকটা। তুমি কেন এখানে এসেছ আমরা জানি। কিন্তু শুনে রাখো, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বহু কষ্টে ওখানে সংসার গড়ে তুলেছি আমরা। অত সহজে আমাদের জমি কেড়ে নিতে পারবে না। আমরা লড়ব!
কেউ জবাব দেয়ার আগেই কীথ আর গুন্টারের পেছন থেকে লোকটার সামনে চলে এল ডরনি শ। গোলমাল করার খায়েশ হয়েছে আঁ? এখনই পিস্তল বের করতে চাও?
ডরনি শ নিচু, প্রায় অস্পষ্টভাবে কথাগুলো বললেও আতঙ্কে যেন কুঁকড়ে গেল লোকটা। আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দুহাত তুলে এক কদম পিছিয়ে গেল। তোমাকে কিছু বলি নি আমি, ডরনি! আশপাশে তুমি আছ, জানতাম না!
তা হলে ভাগো! খেঁকিয়ে উঠল ডরনি। শান্ত ভাব খসে পড়েছে চেহারা থেকে, হিংস্র দেখাচ্ছে। লোকটার দুচোখে খুনের নেশা জেগে উঠতে দেখে হতবাক হয়ে গেল কেড্রিক।
ভাগো! আবার বলল ডরনি। বাঁচতে চাইলে, আর কক্ষনো এ-মুখো হবে না।
ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে হোঁচট খেল লোকটা। চট করে ভিড়ের মাঝে লুকিয়ে পড়ল। জনতার দিকে তাকাল পল কেড্রিক, ভাবলেশহীন চেহারায় তাকিয়ে আছে সবাই, কারও কারও দৃষ্টিতে ঘৃণা, ঝরছে; কিন্তু শুভেচ্ছা বা বন্ধুত্বের আভাস নেই কারও মাঝে। ভুরু কুঁচকে উঠল কেড্রিকের, ঘুরে দাঁড়াল।
বাহু আঁকড়ে ধরে ওকে থামাল গুন্টার। কীথের সঙ্গে ওর মন কষাকষি শুরু হয়েছে বুঝতে পেরেছে সে। এবার এই গোলমালের ফলে ওদের আলাপে বাধা পড়ার সুযোগে কীথের সঙ্গে ওর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। বুঝতে পারছ, কাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে? বলল গুন্টার। এই লোকটার নাম পিটার্স। ও অবশ্য তেমন বিপজ্জনক নয়। তবে ওদের মধ্যে কিছু ভয়ঙ্কর লোকও আছে, চালু বন্দুকবাজ। সবাই তো আর পিটার্সের মতো গবেট হতে পারে না! চল, বারউইকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।
গুন্টারের পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল কেড্রিক, অন্যপাশে এগোচ্ছে কীথ। মুহূর্তের জন্য একবার পেছনে তাকাল কেড্রিক, ডরিন শকে দেখা গেল না কোথাও। স্পষ্ট বুঝতে পারছে কেড্রিক, ওর সহকারী ডরিন শ জাত খুনী। এই ধরনের লোকদের চিনতে ভুল হবার কথা নয় ওর।
অস্বস্তি বোধ করছে ও। পিটার্সের হুমকির কথা মনে পড়ছে। নির্বোধ হতে পারে, কিন্তু চেহারা বলে লোকটা ভালোমানুষ। তবে ওদের মাঝে দুএকজন ভালোমানুষ থাকা খুবই স্বাভাবিক। পিটার ঠিক নেতা গোছের লোক নয়, এই রকম লোকেরা খারাপ লোকের ফাঁদে পা দিয়ে অজান্তে বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়ে।
জমিটা সরকারী নির্দেশে গুন্টার, কীথ আর বারউইকের দখলে গিয়ে থাকলে, এর মধ্যে কোনও ঘোর প্যাঁচ না থাকারই কথা। সরকার ওদের কাছে জমি বিক্রি করলে স্কোয়ার্টার বা জবরদখলকারীদের ওখানে থাকার অধিকার নেই। তবে অধিকাংশ লোক যদি পিটার্সের মতো হয়ে থাকে, ও যেমন ভেবেছিল, মোটেই ততো কঠিন হবে না কাজটা।
রাস্তা থেকে খানিকটা দূরে একটা চৌকো পাথুরে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল গুন্টার। আমাদের হেডকোয়াটার, বলল সে, এসো, ভেতরে এসো!
বাড়িটার চারপাশে প্রশস্ত বারান্দা। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ওরা। কেড্রিক দেখল কাছেই শাদা ব্লাউজ আর ধূসর স্কার্ট পরা এক মেয়ে চেয়ারে বসে বই পড়ছে। থমকে দাঁড়াল গুন্টার।
ক্যাপন কেড্রিক। এ আমার ভাগ্নী, সামান্থা ফক্স।
দৃষ্টি বিনিময় হলো ওদের, নিঃশব্দে কেটে গেল একটি দীর্ঘ মুহূর্ত। কেড্রিকের পুরো শরীর যেন অসাড় হয়ে গেছে, নড়তে পাড়ছে না। বড় বড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা, দৃষ্টিতে বিস্ময়।
চট করে নিজেকে সামলে নিল কেড্রিক, ঈষৎ মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাল।
হাউডি, মিস ফক্স!
ক্যাপ্টেন কেড্রিক, কোনওমতে উঠে দাঁড়াল মেয়েটা, কেড্রিকের দিকে এগিয়ে এল। আশা করি এখানে তোমার ভালো লাগবে।
মেয়েটার ওপর থেকে চোখ সরায় নি কেড্রিক, ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে সামান্থা ফক্সের চেহারা।
নিশ্চয়ই! আস্তে করে বলল ও, ভালো লাগতেই হবে!
এতটা নিশ্চিত হওয়া ঠিক নয়, শীতল কণ্ঠে বলল কর্নেল লরেন কীথ। ধ্যেৎ, দেরি হয়ে যাচ্ছে। চল তো! কিছু মনে করো না, সামান্থা, বারউইক
অপেক্ষা করছে। দরজা দিয়ে পা বাড়াতে গিয়ে একবার পেছনে তাকাল কেড্রিক। এখনও দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, খেপে গেছে কীথ, কিন্তু গুন্টার ব্যাপারটা লক্ষ্য করে নি।
হঠাৎ কোত্থেকে এসে হাজির হলো ডরনি শ, পলকের জন্যে কেড্রিকের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। অচঞ্চল হাতে একটা সিগারেট রোল করতে শুরু করল।
০২. বারউইক, নোংরা স্থূলদেহী এক লোক
একটা টেবিলের উল্টোদিকে বসে আছে বারউইক, নোংরা স্থূলদেহী এক লোক। খোঁচা খোঁচা দাড়ির আড়ালে গাল আর থলথলে চিবুক ঢাকা পড়েছে। মাথার তুলনায় ছোট নাকটার দুপাশে খুব কাছাকাছি ভুরুহীন কুতকুতে চোখ দিয়ে দেখছে কেড্রিককে, অস্থির দৃষ্টি। বুক অবধি শার্টের বোতাম খোলা, কলারের পেছনে ঘামের কালচে দাগ স্পষ্ট। ময়লায় ভরাট প্রতিটি আঙুলের নখ।
কর্নেল কীথ আর গুন্টারের দিকে একবার তাকিয়ে আবার কেড্রিকের দিকে চোখ ফেরাল সে। বসো! বলল, এত দেরি হলো কেন? কাজের সময় দেরি করলে চলে! বিশাল মাথা, এবার গুন্টারের দিকে ফিরল। জন, এ লোকই আমাদের জমি থেকে হারামজাদাগুলোকে দূর করবে?
হ্যাঁ, ও-ই কেড্রিক, হড়বড়িয়ে বলল গুন্টার। বারউইককে রীতিমত ভয় করে বলে মনে হচ্ছে। কামরায় পা রাখার পর মুখ খোলে নি কর্নেল কীথ। গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে, যেন এখানে সে উপস্থিত নেই।
ও ছাড়া আর কেউ পারবে না! আবার বলল গুন্টার।
এক মুহূর্ত পর কেড্রিকের দিকে তাকাল বারউইক। মাথা দুলিয়ে গুন্টারের কথায় সায় দিল যেন। তোমার কথা অনেক শুনেছি। আন্তরিক কণ্ঠে বলল সে। ওদের প্রতি দরদ না দেখালে কাজটা তোমাকে দিয়ে হবে। আমাদের হাতে কিন্তু মোটেই সময় নেই! বুঝতে পারছ? আগেই ওদের একবার নোটিশ দেয়া হয়েছে। তুমি আরও একবার নোটিশ দাও, তার পরও যদি না যায়, ঝেঁটিয়ে বিদায় করো কিংবা কবর দিয়ে দাও। কোনটা করবে, তোমার ইচ্ছে; আমার কিছু বলার নেই। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব না। একটু থেমে আবার খেই ধরল সে। কেউ যাতে প্রশ্ন তুলতে না পারে সেদিকেও খেয়াল, রাখব; এখানে কী ঘটবে না ঘটবে, আমাদের ওপরই নির্ভর করছে।
মন থেকে কেড্রিককে ঝেড়ে ফেলে এবার জন গুন্টারের দিকে মনোযোগ দিল বারউইক। জন, তোমাকে যে কাজ দিয়েছিলাম করেছ? পঞ্চাশজন লোকের দুমাসের মতো খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে? জায়গাটা খালি হওয়ামাত্রই আমি কাজে নামতে চাই। যত দ্রুত কাজ শুরু করা যায় ততই আমাদের লাভ। মুহূর্তের জন্যে কাজে বাধা পড়ক চাই না আমি।
ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কেড্রিকের দিকে তাকাল বারউইক। দশ দিন! দশ দিন সময় দিচ্ছি তোমাকে! কিন্তু পাঁচ দিনের বেশি লাগলৈ আমি কিন্তু দুঃখ পাব। তোমার পক্ষে যদি না কুলোয়, ডরনি শকে ছেড়ে দিয়ো, এক হাত দেখিয়ে দেবে ও! আচমকা সশব্দে হেসে উঠল বারউইক। হ্যাঁ, ডরনি শই দেখিয়ে দেবে!
হাসি থামিয়ে ডেস্কের কাগজপত্রে মনোযোগ দিল ও, কেড্রিকের দিকে না তাকিয়েই বলল, তুমি এবার যেতে পারো, কেড্রিক। ডরনি, তুমিও!
একটু ইতস্তত করে উঠে দাঁড়াল কেড্রিক। মোট কতজন, লোক আছে ওখানে? হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল ও, ছেলে-মেয়ে আছে কারও?
সন্ত্রস্ত চেহারায় ওর দিকে তাকাল গুন্টার। আমি তোমাকে সব কিছু খুলে বলব, পল! পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব।
কাঁধ ঝাঁকাল কেড্রিক, টুপি তুলে নিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে এল। ইতিমধ্যে উধাও হয়েছে ডরনি শ। বারান্দায় এসে কেড্রিক দেখল সামান্থা ফক্স তখনও বসে, বইয়ের ওপর দিয়ে ধূলি-ধূসর রাস্তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
টুপি হাতে থমকে দাঁড়াল কেড্রিক। মাস্ট্যাংয়ে এসেছ কদিন হলো, ম্যাম?
চোখ তুলে তাকাল সামান্থা, অনেকক্ষণ ধরে জরিপ করল ওকে, তারপর বলল, এই তো কয়েকদিন। কিন্তু এরই মধ্যে, কাকে পছন্দ করা উচিত আর কাকে ঘৃণা, শিখে ফেলেছি। পর্বতমালার দিকে একনজর তাকিয়ে আবার কেড্রিকের দিকে ফিরল সামান্থা। এই দেশটাকে আমি পছন্দ করি, ক্যাপ্টেন, আমার কথা বুঝতে পারছ?
আমি শহুরে মেয়ে, শহরেই জন্ম, বেড়ে ওঠা; কিন্তু এখানে আসার পর লাল পাহাড়, মেসা, মরুভূমি আর ইন্ডিয়ান পনি দেখে-বিশ্বাস করো, এ দেশের প্রেমে পড়ে গেছি! এখন মনে হয় এটাই আমার দেশ। ইচ্ছে করছে চিরদিন এখানে থেকে যাই। অবাক দৃষ্টিতে আবার সামান্থাকে জরিপ করল কেড্রিক। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সামান্থাকে ওর ভালো লেগেছে। মাঝে মাঝে আমারও এ-রকম ইচ্ছা করে। কিন্তু কী যেন ঘৃণা করার কথাও বলছিলে? এই-দেশকে পছন্দ করো, এবার বল, ঘৃণা করো, কাকে?
যারা দেশটার ক্ষতি করছে। এদের কেউ এখানেই জন্ম নিয়েছে, কেউ ভিনদেশী, একসঙ্গে হাত মিলিয়ে, নিরপরাধ কিছু লোককে ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত করে তাদের জমিজমা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করছে অথচ ওরাই সত্যিকার মানুষ, ওদের মাঝে ঘোরপ্যাঁচ বা জটিলতা নেই। বিস্ময়ের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে কেড্রিকের, রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল ও। তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, মিস ফক্স। আমি এখানে নতুন এসেছি বটে, কিন্তু এমন কারও দেখা তো পাই নি!
আবার সহজ শান্ত দৃষ্টিতে কেড্রিকের দিকে তাকাল সামান্থা ফক্স। বই বন্ধ করে আস্তে আস্তে উঠে দাড়াল, তারপর পা বাড়াল দরজার দিকে। তাই নাকি, ক্যাপ্টেন? ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলল সে। ঠিক জানো? এই মুহূর্তে তোমাকেই তো তাদের একজন বলে মনে হচ্ছে আমার! কথা শেষ করেই ঘরে ঢুকে, পড়ল মেয়েটা।
সামান্থার গমনপথের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কেড্রিক। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ পড়ল। অবশেষে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দা থেকে নেমে এল ও। কী বোঝাতে চাইল মেয়েটা? ওকে সে কতখানি চেনে? কী করে ওর সম্পর্কে এরকম অদ্ভুত ধারণা জন্ম নিল তার মনে? অস্বস্তি, বিরক্তি বোধ করছে কেড্রিক। পিটার্সের ক্রুদ্ধ চেহারা মনে পড়তেই নতুন উপাদান যোগ হলো ওর ভাবনায়। জন গুন্টারের ভাগ্নী হওয়া সত্ত্বেও সামান্থা ফক্স পিটার্সের মতো কথা বলছে কেন? তবে ওদের মতামত যে ভিন্ন সূত্র থেকে জন্ম লাভ করেছে তাতে সন্দেহ নেই।
চিন্তিত মনে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় উঠে এল কেড্রিক, থেমে এদিক-ওদিক তাকাল।
এখনও পশ্চিমা পোশাক পরে নি ও। ফ্ল্যাট-ক্রাউন, ফ্ল্যাট ব্রীমের টুপি রয়েছে মাথায়, পরনে নিখুঁত ছাঁটের ধূসর স্যুট, পায়ে কালো পশ্চিমা তোর বুট। মোড়ে দাঁড়িয়ে ধীরে সুস্থে সিগারেট রোল করে ঠোঁটে ঝোলাল ও, দেশলাই জ্বেলে ধরাল। দুচোখে সতর্ক দৃষ্টি।
রাস্তার প্রতিটি মানুষ, নারী-পুরুষ একাধিকবার দেখছে ওকে। ওর মিলিটারি-সুলভ ঋজুতা, চওড়া কাঁধ, প্রশান্ত চেহারা আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে ওকে। হাতের কাজের কথা ভুলে গিয়ে কর্মব্যস্ত রাস্তার সীমাহীন উত্তেজনায় নিজেকে হারিয়ে ফেলল কেড্রিক। অসংখ্য নারী-পুরুষ যেন অজানা কারণে একই স্রোতে মিশে গেছে এখানে এসে।
আর কিছু না হোক, পশ্চিম যেন মানুষের অপরূপ এক মিলন ক্ষেত্র। সোনা, নতুন জমি আর রোমাঞ্চের অন্বেষায় অভিযাত্রীরা আসছে এখানে; আসছে জুয়াড়ী আর পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশার নারী, চোর-ডাকাত, বন্দুকবাজ, গরু-চোর, ঘোড়াচোর, মাইনার, কাউহ্যান্ড, ফ্রেইটার আর ভবঘুরে। সব রকম মানুষের উপস্থিতি রয়েছে রাস্তায়।
সবাই প্রকাশ্যে কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে রেখেছে। প্রয়োজনে ওগুলো ব্যবহার করবে ওরা। খালিহাতে মারপিট করার মতো লোকও আছে এখানে, যদিও সংখ্যায় কম।
আচমকা দীর্ঘদেহী এক লোক জনস্রোত থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল। কেড্রিক তাকাতেই চোখাচোখি হলো ওর সঙ্গে। নিঃসন্দেহে, এতক্ষণ মদ গিলছিল লোকটা, এখন ঝামেলার খোঁজে বেরিয়েছে। বেছে নিয়েছে কেড্রিককে। হঠাৎ উত্তেজনার আঁচ পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল পথিকেরা। দেখতে দেখতে ভিড় জমে উঠল।
আচ্ছা? দুপা ফাঁক করে দাঁড়াল লোকটা। শার্টের হাতা গুটিয়ে কনুই অবধি তোলা, পেশীবহুল দুটি লোমশ হাত দেখা যাচ্ছে। তুমিও ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছ! আমাদের জমি দখল করতে চাও! হঠাৎ সশব্দে হেসে উঠল লোকটা। কিন্তু এখন খুনীর বাচ্চাটা সঙ্গে নেই, তোমাকে পিটিয়ে লাশ করব আমি। কই, লাগো।
মুখের ভেতরটা খটখটে লাগছে, কিন্তু কেড্রিকের দৃষ্টি স্থির। ডান হাতে, সিগারেট ধরে ঠোঁটে ঝোলানোর ভঙ্গি করল ও। দুঃখিত আমার কাছে পিস্তল নেই, আর থাকলেও শুধু শুধু তোমাকে হত্যা করতাম না। জমির ব্যাপারে ভুল হচ্ছে তোমার। কোম্পানির দাবীই বৈধ।
তাই নাকি? এক কদম সামনে বাড়ল লোকটা, পিস্তলের বাঁট স্পর্শ করল তার হাত। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আবাদী জমি গড়েছি আমরা, সেখান, থেকে বৌ-বাচ্চাসহ আমাদের উত্থাত করে পথে বসানোকে বৈধ বলছ?
মাতাল হলেও লোকটার চেহারায় স্পষ্ট ভীতি আর আতঙ্কের ছায়া দেখতে পাচ্ছে কেড্রিক। কিন্তু ওকে কিংবা ডরনিকে ভয় করছে না সে, ভীতু নয় লোকটা, আসলে পরিবারের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। কথাটা মনে হতেই চমকে উঠল কেড্রিক, অস্বস্তি ভর করল ওর ওপর। কাজটা হাতে নিয়ে ভুল হলো না তো?
ভিড় থেকে অশ্রাব্য গালিগালাজ ভেসে এল। বোঝা যাচ্ছে, জনতা কেড্রিকের নয়, বিশালদেহী লোকটার পক্ষে।
হঠাৎ গুঞ্জনের মাত্রা বেড়ে গেল, আলোড়ন দেখা দিল ভিড়ে। তার পর আচমকা নীরবতা নামল। চাপা কণ্ঠে পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, সাবধান, বার্ট! ডরনি শ আসছে!
সহসা পাশে ডরনি শয়ের উপস্থিতি অনুভব করল কেড্রিক। আমার হাতে ওকে ছেড়ে দাও, ক্যাপন, নিচু কণ্ঠে বলল ডরনি, ব্যাটাকে শায়েস্তা করে দিচ্ছি।
সহজ কণ্ঠে জবাব দিল কেড্রিক। না! তুমি সরে যাও, শ। এটা আমার লড়াই, আমাকেই সামলাতে দাও!
কিন্তু তোমার কাছে পিস্তল নেই! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রতিবাদ করল ডরনি শ।
পিছিয়ে যাবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না বার্টের মাঝে। ডরনি শয়ের উপস্থিতি তাকে থমকে দিলেও ভয় পায় নি। পিটার্সের মতো হার মানতে রাজি নয় ও সতর্ক দৃষ্টিতে একবার উরনি শ আরেকবার কেড্রিকের দিকে তাকাচ্ছে বাট। সহজভাবে এক কদম সামনে বাড়ল কেড্রিক। হাত বাড়ালেই এখন ওকে। ছুঁতে পারবে বার্ট।
শ এই লড়াইয়ের বাইরে, বার্ট, শান্ত কণ্ঠে বলল পল কেড্রিক। তোমার সঙ্গে আমার কোনওরকম শত্রুতা নেই, কিন্তু তোমাকে নিরাশ করব না। আমার সঙ্গে অস্ত্র ছিল না বলে লাগতে পারছ না-এ কথা মনে ঠাই দিয়ো না। অস্ত্র ছাড়াও লড়াই করা যায়। আমি মারপিট করতে চাই নি, তুমিই যখন সেধে লাগতে এসেছ-তা হলে আর দেরি কেন?
বার্টের চোখে সন্দেহ ফুটে উঠেছে। এ ধরনের ধোপদুরস্ত পোশাক পরা লোকদের হাতে হাওয়া থেকে পিস্তল উঠে আসে, বহুবার দেখেছে সে। নিরস্ত্র অবস্থায় কেড্রিক ওকে মোকাবিলা করতে আসবে, ভাবে নি!
তোমার কাছে নিশ্চয়ই লুকোনো পিস্তল আছে! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল বার্ট।
ঝট করে হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করল সে, সাথে সাথে নড়ে উঠল পল কেড্রিক। বাঁ হাতের প্রান্ত দিয়ে কোপ মারার ভঙ্গিতে আঘাত করল লোক্টার পিস্তল ধরা কজিতে। আরও একটু সামনে এগোল, পরক্ষণে শরীরের সব শক্তি এক করে আধমণি এক ঘুসি ঝেড়ে দিল প্রতিপক্ষের চোয়ালে। চোখ ধাঁধানো মাপা ঘুসি, ঘোড়ার পিঠে সপাং করে চাবুকের বাড়ি পড়ল যেন। পিস্তলের সঙ্গে পটকান খেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল বার্ট
সহজ ভঙ্গিতে সামনে ঝুঁকে বার্টের পিস্তল তুলে নিল কেড্রিক, ১৮৫১ মডেলের নেভী রিভলবার। বার্টের সামনে দাঁড়িয়ে জনতার ওপর সন্ধানী দৃষ্টি বোলাল ও। নিরাবেগ, কঠিন চেহারায় ওকে দেখছে প্রতিটি লোক। আবার রার্টের দিকে চোখ ফেরাল কেড্রিক। আস্তে আস্তে উঠে বসেছে লোকটা, প্রবল বেগে মাথা নাড়ছে। ডানহাতে ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে হঠাৎ যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল। বিস্ফারিত চোখে একবার হাতের দিকে তাকিয়ে কেড্রিকের দিকে চোখ ফেরাল বার্ট। আমার হাত ভেঙে দিয়েছ তুমি! বলল সে, গুঁড়িয়ে গেছে। এখন লাঙ্গল চালাব কী করে!
ওঠ, আস্তে করে বলল কেড্রিক। আমার দোষ নেই, তুমিই গায়ে পড়ে লাগতে এসেছিলে।
উঠে দাঁড়াল বার্ট। পিস্তলটা বাড়িয়ে ধরল কেড্রিক। সিক্স-শুটারের মালের ওপর দিয়ে কেড্রিকের দিকে তাকাল বার্ট। কেড্রিক মুচকি হাসল।
ধরো, হোলস্টারে ঢোকাও। জানি, আমার ভয় পাবার কিছু নেই। আর যাই হও, অন্তত পেছন থেকে গুলি করার মতো খারাপ তুমি নও।
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল কেড্রিক। হাঁটতে শুরু করল। সেইন্ট জেমস-এর সামনে এসে থামল। কাগজ তামাক বের করে সিগারেট রোল করতে শুরু করল, মৃদু কঁপছে আঙুলগুলো।
দারুণ! ডরনি শয়ের নরম গলা। কৌতূহলী দৃষ্টিতে কেড্রিককে মাপছে সে। জীবনে এই প্রথম দেখলাম! এক থাপ্পড়ে কাজ সারা!
কীথকে সঙ্গে নিয়ে জন গুন্টারও হাজির হয়েছে। উঁত বের করে হাসল গুন্টার। আমরাও দেখেছি। এমন হলে আর কাউকে মারতে হবে না। টম স্মীথের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আমার। ওল্ড বীয়ার ক্রিক টম ট্রেইলে খালিহাতে বহু গুণ্ডা পাণ্ডাদের মোকাবিলা করেছে। ও কখনও অস্ত্র ব্যবহার করত না।
লোকটা পিস্তল কেড়ে নিয়ে গুলি করত যদি? জিজ্ঞেস করল কীথ।
কাঁধ ঝাঁকাল কেড্রিক, কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। সুযোগই পেত না, শান্ত কণ্ঠে বলল ও, তবে তারও ওষুধ আছে।
রাতে ওরা তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে, পল, জানাল জন গুন্টার। ডরনিকে দিয়ে শ্যাড, ফেসেনডেনসহ সবাইকে খবর দিয়েছি। কাল একবার ওখানে যাচ্ছ তোমরা। কাজটা শুরু করা আরকি। চার-পাঁচজন সঙ্গী নিয়ে একটা চক্কর মেরে আসবে। যাতে ওরা বুঝতে পারে, মিথ্যে হুমকি দেই নি আমরা।
মাথা দোলাল কেড্রিক। আরও কিছু সময় গুন্টারের সঙ্গে আলাপ করে বিদায় নিয়ে হোটেলে নিজের কামরায় চলে এল ও। আসলে, ভাবল কেড্রিক, পশ্চিম এখনও আগের মতোই আছে;, সব কিছু এখনও চোখের পলকে ঘটে যায় এখানে।
একে একে কোট, ওয়েইস্ট কোট, ভেস্ট, বুট খুলে ফেলল কেড্রিক। শুধু প্যান্ট পরে বিছানায় বসল। ব্যাগটা খুলল টেনে নিয়ে। একটু খুঁজতেই বেরিয়ে পড়ল চকচকে দুটো হোলস্টার আর গানবেল্ট; দুই হোলস্টারে দুটো পয়েন্ট ফোর-ফোর রাশান পিস্তল, রুশ সেনাবাহিনীর জন্যে বিশেষ ফরমাশে স্মীথ অ্যান্ড ওয়েসন তৈরি করেছিল এগুলো; এই মুহূর্তে বাজারের সেরা অস্ত্র। যত্নের সঙ্গে পিস্তলজোড়া পরখ করে আবার হোলস্টারে ঢোকাল কেড্রক, তার পর হোলস্টারে ভরে একপাশে সরিয়ে রাখল। এবার ব্যাগ থেকে গানবেল্ট আর হোলস্টারসহ আরও দুটো পিস্তল বের করল। পয়েন্ট-থ্রি-সিক্স ক্যালিবারের ওয়েলশ টুয়েলভূ-শট-নেভী-পিস্তল। দেখতে হুবহু ফ্রন্টিয়ার কোল্ট কিংবা পয়েন্ট-ফোর-ফোর-রাশানের মতোই।
এই জিনিস পশ্চিমে তেমন চোখে পড়ে না, পছন্দ করে না কেউ; কিন্তু বেশ কয়েকবার এগুলো ব্যবহার করতে হয়েছে কেড্রিককে, চমৎকার কাজ দেয়। অতিরিক্ত গুলি থাকায় প্রায়ই বিশেষ সুবিধে লাভ করেছে ও। ভালো মার্কসম্যানের হাতে পড়লে পয়েন্ট-ফোর-ফোর-রাশানের মতোই নির্ভুল লক্ষ্য ভেদ করতে পারে।
তবে যে কোনও জিনিস ব্যবহারের উপযুক্ত সময় এবং স্থান আছে; এ দুটো পিস্তল বিশেষ অবস্থার জন্যে তুলে রেখেছে ও। সাবধানে পিস্তল দুটো আবার কাপড় জড়িয়ে ব্যাগের একেবারে তলায় লুকিয়ে রাখল কেড্রিক। কোমরে ঝোলাল পয়েন্ট ফোর-ফোর রাশানজোড়া। উইনচেস্টারটা বের করে সাফ করার পর গুলি ভরে নিল। তারপর বিছানায় বসে গানবেল্ট খুলে শোবার আয়োজন করবে, হঠাৎ মৃদু টোকা পড়ল দরজায়।
এসো, বলল কেড্রিক। শত্রু হলে তোমার চেহারাটা একবার দেখতে চাই।
চোখের পলকে দরজাটা খুলেই আবার বন্ধ হয়ে গেল। দরজার সামনে কেড্রিকের মুখোমুখি দাঁড়াল আগন্তুক, লম্বায় পাঁচ ফুট ইঞ্চিচারেক হবে, চওড়াও বিশাল; মেদহীন পেশীবহুল শরীর; প্রশস্ত বাদামি মুখটা দেখে মনে হয়, গাছের গুঁড়ি কুঁদে বের করা হয়েছে; ছোট করে ছাঁটা কালো চুল সেঁটে আছে খুলির সঙ্গে; মোটাসোটা গর্দান চওড়া কাঁধের সঙ্গে মিশে গেছে। কোমরের বাম দিকে একটা পিস্তল ঝোলানো, হাতে চিকন কিনারার টুপ। ঘোরাচ্ছে।
এক লাফে উঠে দাঁড়াল কেড্রিক। ডাই! প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটল যেন কামরায়। ডাই রীড! তুমি এখানে!
হাহ? তা হলে তুমিই আমাদের এত বিপদের কারণ?
আমি? ইঙ্গিতে ডাই রীডকে চেয়ারে বসতে বলল কেড্রিক। কীভাবে?
ভালো করে ওকে জরিপ করল ওয়েলশম্যান ডাই রীড, তারপর চেয়ারে বসে হাঁটুর ওপর বিশাল থাবা রেখে সামনে ঝুঁকে এল। ঈষৎ বাকানো পেশীবহুল পা দুটো এক নজর দেখল কেড্রিক।
তুমি বারউইকের দলে যোগ দিতে আস নি? ঘর বাড়ি থেকে আমাদের উচ্ছেদ করার কাজ নাও নি? অনেক বদলে গেছ তুমি, পল, নষ্ট হয়ে গেছ!
তুমি ওদের একজন? বারউইকরা যে জমির মালিকানা দাবী করছে। সেখানে থাকে?
হ্যাঁ। গায়ে খেটে সেখানে ফসল ফলিয়েছি। এখন শয়তানের বাচ্চারা দূর করে দিতে চাইছে। কিন্তু তার আগে লড়াইতে নামতে হবে ওদের-আর, পল, ওদের দলে থাকলে তুমিও রেহাই পাবে না, কথাটা মনে রেখো।
চিন্তিত চেহারায় ডাই রীড়ের দিকে তাকাল কেড্রিক। চরমে পৌঁছেছে ওর সন্দেহ…এই লোক ওর পরিচিত। কেড্রিকের বাবা ওয়েলশ ছিলেন, মা ছিলেন আইরিশ-ডাই রীড ওদেরই বন্ধু। বাবার সঙ্গে দেশ ছেড়ে এখানে আসে ডাই রীড। মা আর বাবার যখন বিয়ে হয় বাবার সঙ্গেই কাজ করত ও। মাইকেল কেড্রিকের চেয়ে বয়েস ছোট হলেও তার বন্ধু হিসেবেই পশ্চিমে এসেছিল।
ডাই, আস্তে করে বলল কেড্রিক, স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, আজ এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে সংশয় জেগেছে আমার মনে। আসলে কি জানো, যুদ্ধের কিছুদিন পর গুন্টারের সঙ্গে আমার পরিচয়, ওর অনুরোধে ওরই এক বন্ধুর গরু নিয়ে গিয়েছিলাম আমি। সেই বছর খুব গোলমাল যাচ্ছিল, ইন্ডিয়ানরা প্রায় প্রতিটি গরুর পালে হামলা চালাত, যত ইচ্ছে গরু কেড়ে নিত; আর ছিনতাইবাজরা চেষ্টা করত পুরো পালটাই ছিনিয়ে নিতে। কেউ কেউ ওদের জমির ওপর দিয়ে গরু যাচেছ বলে মোটা অংকের টাকা দাবী করত। এমন একটা পরিস্থিতিতে আমি ইন্ডিয়ানদের, ওদের দাবী অনুযায়ী নয়, আমার ইচ্ছে মতো অল্প কটা গরু দিয়ে প্রায় বিনা লোকসানে গরুর পাল গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছিলাম।
সে কথা গুন্টার ভোলে নি, তা ছাড়া যুদ্ধে আমার কিছু সাফল্যের কথাও তার জানা ছিল। তাই আমার কাছে আবার একটা কাজের প্রস্তাব নিয়ে যায়। নিউ অরলিন্সে সে আমাকে এ কাজের প্রস্তাব দেয়, আমার কাছে তখন মোটেই খারাপ কিছু মনে হয় নি। গুন্টার আমাকে কী বলেছে শোনো।
ওর ফার্ম মানে, বারউইক গুন্টার অ্যান্ড কীথ, তিন হাজার সেকশন জমি জরিপের পর কেনার উদ্দেশ্যে সরকারের কাছে আবেদন করেছিল। ওরা হলফনামায় বলেছে জায়গাটা জলাভূমি, প্রায়ই এখানে বন্যা দেখা দেয়। ওদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল ল্যান্ড অফিস ঘোষণা করেছে, ফসলের মৌসুমে যেহেতু জায়গাটা পানির নীচে থাকে এবং পরে জলসেচের প্রয়োজন হয়, তাই একে জলাভূমি হিসেবে বিক্রি করে দেয়া যায়।
গুন্টার আরও বলেছে, ওরা জমি কেনার কাজ শেষ করে এনেছিল, কিন্তু হঠাৎ একদল লোক ওখানে এসে জেঁকে বসেছে, কিছুতেই সরানো যাচ্ছে না, ওদের নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কাজ হয় নি। জায়গাটা ঝামেলামুক্ত করতে কিছু লোকের নেতৃত্ব দিতে হবে আমাকে। গুন্টার আমায় জানায়, স্কোয়ার্টারদের অধিকাংশ লোক গরু চোর, আউট-ল কিংবা দেশদ্রোহী। লড়াই ছাড়া ওদের উৎখাত করার অন্য কোনও উপায় নেই, সে জন্যেই আমাকে দরকার।
মাথা কঁকাল ডাই রীড়। ঠিকই বলেছে, লড়াই ছাড়া উপায় নেই; কিন্তু আমাদের মধ্যে চোর-ডাকাত পাবে না। না, ভুল হলো, পাইপ বরাবর কেড্রিকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল সে, পাবে, নেহাত হাতে গোনা এক আধ জন। সব ঝুড়িতেই পচা ডিম থাকে। বলে চলল ডাই রীড। কিন্তু বাকি সবাই সৎ মানুষ, ঘর বানিয়েছি, ফসল ফলাচ্ছি।
আচ্ছা, হলফনামায় যে জায়গাটা জনবসতিহীন বলে উল্লেখ করেছে ওরা, সেটা তোমাকে বলেছে গুন্টার?…বলে নি। তা হলে শোনো। ওখানে চুরানব্বই সেকসন জমির ওপর ঘরবাড়ি আছে, ভাঙা-চোরা হতে পারে, কিন্তু তবুও ঘর।
ভেবে চিন্তে মাঠে নেমেছে ওরা, বুঝলে! খাস জমি কেনার ছমাস আগে নোটিশ জারি করার নিয়ম। ওরা নোটিশ জারি করিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এমন জায়গায় আর এত ছোট ছোট হরফে যে, কারও চোখে পড়ার উপায় নেই। এবং সত্যি সত্যি তিনমাস যাবার আগে কারও চোখে পড়ে নি। পরে, নেহাত ঘটনাচক্রে, দেখতে পেয়েছে একজন এখন গায়ের জোরে আমাদের তাড়ানোর চেষ্টা করছে ওরা, যাতে জায়গাটা বিনা বাধায় ওদের হাতে যায়। আর জলাভূমির কথা বললে, দেখলৈ বুঝবে, জায়গাটা আগাগোড়া মরুভূমি। দুএক জায়গায় সামান্য পানি আছে, ওখানেই যা একটু ফসল ফলে।
মাথা দোলাল ডাই রীড, ছোট ডটঅলা পাইপটা থেকে ছাই ঝাড়ল। ওদের মোকাবিলা করব, সে টাকা আমাদের নেই। আমাদের সঙ্গে উকিলও নেই: কাজে লাগতে পারে তেমন মানুষ একজনই আছে, এক খবরকাগজঅলা, কিন্তু খালিহাতে তাকে ওয়াশিংটনে পাঠিয়ে ফায়দা কী?
ভার হয়ে আছে ডাই রীডের চেহারা। ওদের সঙ্গে পেরে ওঠা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। শয়তানদের টাকার অভাব নেই, প্রচুর গুণ্ডা-পাণ্ডা ভাড়া করেছে। কিন্তু দেখো, ওদের অনেকের রক্তে আমাদের মাটি লাল হবে, রক্ত দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে ওদের। আমরা চেষ্টা করব যাতে শুধু ভাড়াটে গানহ্যান্ডরা নয়, দুএকটা রুই কাতলাও মারা পড়ে। ওদের সঙ্গে থাকলে তোমাকেও ছাড়া হবে না, বয়!
ভাবছে, কেড্রিক। তুমি একেবারে উল্টো কাহিনী শোনালে। আমাকে একটু ভাবতে হবে। আর হ্যাঁ, কাল আমরা চেহারা দেখাতে যাচ্ছি ওখানে, এই সুযোগে জায়গাটা নিজের চোখে দেখব।
ঝট করে তাকাল ডাই রীড। ওদের সঙ্গে যেয়ো না! ওখানে গেলে কাউকে জ্যান্ত ফিরতে দেব না, ঠিক করেছি আমরা!
শোনো, ডাই! সামনে ঝুঁকে এল কেড্রিক। আপাতত তোমাদের এই পরিকল্পনা স্থগিত রাখতে হবে। আমরা কেবল শক্তি দেখাতে যাব ওখানে, হুমকি দেব, ব্যস; কিন্তু, কথা দিচ্ছি, আমাদের তরফ থেকে একটা গুলিও ছোড়া হবে না। আমরা যাব, ঘুরে ফিরে চলে আসব। গোলাগুলি হলে সেজন্যে তোমার লোকেরাই দায়ী থাকবে। তুমি জলদি যাও, ওদের শান্ত করো। ওদের বল আমাকে একবার জায়গাটা দেখার সুযোগ দিতে।
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল ডাই রীড। বাব্বাহ, এদ্দিন পর তোমাকে দেখে কী যে খুশি হয়েছি বোঝাতে পারব না। অবস্থা অন্যরকম হলে আগের মতো তোমাকে বাড়ি নিয়ে নিজের হাতে খাওয়াতাম, তাস খেলতাম। আমার বউকে দেখলে অবাক হয়ে যেতে তুমি!।
তুমি বিয়ে করেছ? বলো কী। কেড্রিকের কণ্ঠে অবিশ্বাস! আমার মোটই বিশ্বাস হচ্ছে না।
দাঁত বের করে হাসল ডাই রীড। বিয়ে করেছি এবং খুব সুখে আছি, পল, হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে গেল তার চেহারা। ঘর-দোর বাঁচাতে পারলে আরও অনেক দিন সুখে থাকতে পারতাম। তা বোধ হয় আর হলো না। তবে একটা কথা জেনে রাখো, খোদার কসম বলছি, আমাকে না মেরে কেউ আমার জমি কেড়ে নিতে পারবে না। আর একা মরব না আমি, কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে যাব!
ডাই রীড বিদায় নেবার অনেকক্ষণ পরেও বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল কেড্রিক। সামান্থাও কি এরকম কিছু বলতে চেয়েছিল? কোন্ পক্ষে আছে মেয়েটা? সবার আগে বিবাদের জায়গায় গিয়ে নিজের চোখে দেখা দরকার সব কিছু, তারপর আবার গুন্টারের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। মনে মনে লোকগুলোর চেহারা উল্টেপাল্টে দেখল,ও।
কীথ…নেকড়ের মতো হিংস্র ঠাণ্ডা চেহারা। বারউইকথলথলে চেহারা, তাতে কঠোর সর্বগ্রাসী কর্তৃত্বের ছাপ।
গুন্টার বন্ধুসুলভ অমায়িক চেহারা, কিন্তু পাশাপাশি প্রচ্ছন্ন ধূর্ততার ছাপ আছে না?
বাইরে থেকে টিনপ্যানি পিয়ানোর বাজনা ভেসে আসছে, মেয়েলি কণ্ঠের গান শোনা যাচ্ছে। জুয়ার টেবিলে চিপস পড়ার শব্দ হচ্ছে। কানে আসছে বুটের খটখট, স্পারের ঝুনঝুন-ক্রমাগত ঘুরে বেড়াচ্ছে লোকজন।
উঠে দাঁড়াল পল কেড্রিক। শার্ট গায়ে দিয়ে কোমরে গানবেল্ট বেঁধে নিল। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে এল। করিডর ধরে পা বাড়াল লবির উদ্দেশে।
পাশের কামরার দরজা খুলে গেছে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওকে দেখছে এক লোক!
ডরনি শ।
০৩. মরুভূমির অধিবাসীরা
মরুভূমির অধিবাসীরাই কেবল এমন শান্ত সকালের সঙ্গে পরিচিত। চারদিক নিঝুম। থেকে থেকে সিক্যাডা ডাকছে শুধু। নরম রোদে আরামদায়ক উষ্ণতা। দূরে, আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পাহাড় আর মেসা। এখানে সেখানে দলবদ্ধ মেঘের ছায়া।
ছজন অশ্বারোহী, রুক্ষ কঠিন ছয় জন মানুষ, স্যাডলে শব্দ তুলে ঘোড়া হাঁকিয়ে বিস্তৃত মরুভূমির প্রান্তে পৌঁছুল। প্রত্যেকেই যার যার ভাবনায় ডুবে আছে। ওরা সবাই পিস্তলবাজ, অতীতে মানুষ হত্যা করেছে, ভবিষ্যতেও একই উদ্দেশ্যে পিস্তল ব্যবহার করবে অনায়াসে। নিষ্ঠুর সময়ের কাছে মার খেয়ে ওদের অনেকেই দয়ামায়াহীন পাষণ্ড পরিণত হয়েছে, অবশিষ্টদের ভাগ্যেও একই পরিণতি অপেক্ষা করছে। বন্দুকবাজদের এর হাত থেকে নিস্তার নেই।
অস্ত্রের ওপর নির্ভর করে যারা বেঁচে থাকে তারা নিঃসঙ্গ মানুষ, এরাও ব্যতিক্রম নয়। এদের কাছে মানুষ মানেই সম্ভাব্য শত্রু, প্রতিটি ছায়া বিপদ। সতর্কভাবে ঘোড়া নিয়ে এগোচ্ছে ওরা; আচরণে সংযত, চোখে সাবধানী দৃষ্টি।
চিঁ-হিঁ-হিঁ করে ডেকে উঠল একটা ঘোড়া; আলগা পাথরে ঘষা খেলো একটা খুর; নড়েচড়ে আরাম করে স্যাডলে বসল কেউ, লম্বা করে দম নিল। আর কোনও শব্দ নেই কোথাও।
একটা অ্যাপলুসা গেল্ডিং নিয়ে এগোচ্ছে ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। ঘোড়াটার সামনের দিকে লালচে-ধূসর, পেছনে ধবধবে শাদার ওপর বৃষ্টির ফোঁটা আকৃতির ছোপ; চারটে পা-ই শাদা। শক্তিশালী, ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন ঘোড়, বুদ্ধিমান এবং সত।
রওনা হওয়ার জন্যে ওরা যখন একসঙ্গে মিলিত হচ্ছিল, অ্যাপলুসাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে লরেডো শ্যাড, ঘুরে ঘুরে সপ্রশংস দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে দেখেছে ঘোড়াটাকে।
ভাগ্যবান লোক তুমি; ফ্রেন্ড! দারুণ ঘোড়া! পেলে কোথায়? অবশেষে জিজ্ঞেস করেছে।
নাভাহো রেমুডা, নেয় পার্শ ওঅর হর্স এটা-রিজারভেশন থেকে যোগাড় করেছি।
আস্তে আস্তে জমায়েত হয়েছে সবাই। কেড্রিক লক্ষ্য করেছে, ওকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করে নিয়েছে ওরা। ওর পশ্চিমা কায়দার পোশক-আশাক বিশেষত নিচু করে কোমরে ঝোলানো, উরুর সঙ্গে বাঁধা পিস্তলজোড়া ওদের নজর কেড়েছে। গতকাল নিউ অরলিন্স-এ কেনা তৈরি পোশাকে ওকে দেখেছিল ওরা। কিন্তু আজ আপন দলের মানুষ হিসেবে ওকে যাচাই করার সুযোগ পেয়েছে।
দীর্ঘ ঋজু শরীর কেড্রিকের। গতকালের পোশাকের মধ্যে শুধু কালো টুপি আর জুতোজোড়া অবশিষ্ট রয়েছে আজ। একটা ধূসর ঊলের শার্ট পরেছে, কালো সিল্কের রুমাল গলায় পেঁচিয়েছে। পরনের জিন্সের প্যান্টটাও কালো। সহজভাবে কোমরে ঝুলছে পিস্তলজোড়া, প্রয়োজনের মুহূর্তে হাতে উঠে আসবে।
সরাই উপস্থিত হলে কেড্রিক বলেছে, ঠিকাছে, চল!
স্যাডলে চেপে বসেছে ওরা, তারপর সবার ওপর একবার নজর বুলিয়েছে কেড্রিক। একহারা গড়নের ডরনি শ; বিশালদেহী পাই ফেসেনডেন; ছিপছিপে রুক্ষ চেহারার পয়েন্সেট; লম্বা চওড়া সোনালি চুলো লী গফ আর কুৎসিত ক্লন; দলের সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য শক্তপোক্ত টেক্সান, লরেডো শ্যাঙ। এগোতে শুরু করেছে ওরা। আরও একবার ওদের জরিপ করেছে কেড্রিক। আর কিছু না হোক, এরা লড়াকু লোক। বার কয়েক ওর পিস্তলের দিকে তাকিয়েছে ডরনি শ।
ওগুলো কোল্ট নয় বলে মনে হচ্ছে?
ঠিক ধরেছ। পয়েন্ট ফোর-ফোর রাশান। চমৎকার জিনিস, সহজে নিশানা ভেদ করা যায়। মাথা দুলিয়ে সামনের ট্রেইলের দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চেয়েছে কেড্রিক। এদিকে আগেও গেছ?
হ্যাঁ, বেশ কয়েকবার যেতে হয়েছে। নর্থ ফর্ক পেরিয়ে কিছুদূর গলে একটা ঝর্না আছে, ওখানে দুপুরে বিশ্রাম নেব আমরা। তারপর অনেক কটা গভীর ক্যানিয়ন আর একটা বড়সড় পাহাড় পার হতে হবে। ইন্ডিয়ান আর স্প্যানিশরা পাহাড়টার নাম দিয়েছে দ্য অরফ্যান। পাহাড়ের পরেই শুরু বুনে এলাকার, নিজের চোখেই দেখতে পাবে। ঝকঝকে শাদা দাঁত বের করে হাসল ডরনি শ। যেদিকে তাকাও, দেখবে একই চেহারা।
ডরনি, আচমকা জিজ্ঞেস করে বসেছে লী গফ, এবারও ম্যালপাই ক্যানিয়নের দিকে যাবে নাকি?
হাসল ক্লসন। যাবে না মানে! অন্য কেউ হলে অনেক আগেই হাল ছেড়ে দিত, কিন্তু আমাদের ডরনি হার মানার বান্দা নয়, তবে স্পষ্ট বোঝা যায় পশ্চিমা গানশ্লিংগারের থোড়াই পরোয়া করে মেয়েটা, তার নজর আরও ওপরে!
মেয়েটা কিন্তু দারুণ! গফের কণ্ঠে খোলামেলা প্রশংসা ঝরেছে। কিন্তু ভরনিকে তেমন পাত্তা দেয় না।
কে জানে স্বার্থ আছে বলেই এতদিন সম্পর্ক রেখেছে কি না, বাঁকা কণ্ঠে বলেছে পয়েন্সেট। কীথের জন্যে খবরাখবর মেয়েটার কাছ থেকেই হয়তো যোগাড় করে ও। কোথায় কী ঘটছে কিছুই তো তার অজানা থাকে না।
স্যাডলে ঘুরে বসেছে ডরনি শ, কঠোর হয়ে উঠেছে লম্বাটে তীক্ষ্ণ চেহারা। চোওপ! শীতল কণ্ঠে বলেছে সে।
আড়ষ্ট হয়ে গেছে পয়েন্সেট, নিখাদ বিষ মেশানো দৃষ্টিতে ডরনির দিকে তাকিয়েছে, কিন্তু পাল্টা জবাব দেয় নি। লোকটা এত দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছে, না দেখলে কেড্রিকের বিশ্বাস হত না। দুর্ধর্ষ কঠিন লোক পয়েন্সেট, কারও তোয়াক্কা করে না। অথচ সেও সযত্নে এড়িয়ে গেছে ডরনি শকে। মনে রাখার মতো ব্যাপার।
বেলা গড়িয়ে চলল। দলের সদস্যদের ওপর নজর রাখছে পল কেড্রিক। উরনি শর প্রতি আক্রমণাত্মক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছে সবাই, লক্ষ্য। করল ও। এমনকী, বিশজন মানুষের হত্যাকারী ফেসেনডেনও এড়িয়ে চলছে। তাকে।
দুপুরে নর্থ ফর্কের ঝর্নার ধারে ক্যাম্প করল ওরা। সাধারণত কাউ-ক্যাম্পগুলোয় যেমন খোশ গল্প চলে, এখানে ত! হলো না। রূঢ় এবং মেজাজি লোক ওরা, গল্প গুজর করার মানসিকতা নেই। একমাত্র লরেঙে শ্যাডকেই কিছুটা সহজ মনে হলো, স্বাভাবিক আচরণ করছে ও। সবার মৌন সম্মতি পেয়ে রান্নার দায়িত্ব নিল ক্লসন। কারণ বুঝতে দেরি হলো না কেড্রিকের, চমৎকার রাধে লোকটা।
খাওয়ার ফাঁকে খতিয়ে নিজের অবস্থান বিচার করল, কেড্রিক। নিউ অরলিন্স-এ এই কাজের দায়িত্ব নিয়েছে ও; টাকা পয়সার খুব টানাটানি যাচ্ছিল তখন। ওকে এখানে আনার জন্যে জন গুন্টারই প্রয়োজনীয় টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এখন কাজ ছাড়তে গেলে টাকাগুলো ফিরিয়ে দিতে হবে। সেটা সম্ভব নয়। অথচ সঙ্গীদের দিকে তাকালেই মনে হচ্ছে এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে পড়া উচিত।
অসংখ্য যুদ্ধে ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে অংশ নিয়েছে কেড্রিক। লড়াই করাই ওর পেশা; ছেলেবেলা থেকে কুশলী যোদ্ধা হিসেবে বেড়ে উঠেছে। ওর বাবা সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন, রণকৌশল নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন তিনি; বাবার দেখাদেখি পল কেড্রিকও সামরিক বিষয়ে ছোট বেলাতেই আগ্রহী হয়ে উঠে। বাবার কাছেই শিক্ষা লাভ করে ও, তা ছাড়া এক খবরকাগজের মালিকও ওকে অনেক কিছু শিখিয়েছে-কোনও এক শীতকালে ওদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল সে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে কেড্রিকের আগ্রহ প্রবল হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় ও, গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়। একাধিক লড়াইতে সফলতার মধ্য দিয়ে ওর বহুদিনের শিক্ষা আর চিন্তাভাবনা বাস্তব ভিত্তি লাভ করে তবে অসংখ্য যুদ্ধে অংশ নিয়ে প্রচুর মানুষ হত্যা করার পরও নিষ্ঠুর পাষণ্ড হয়ে যায় নি।
একটা জায়গা থেকে একদল আউট-লকে উচ্ছেদ করার কাজটা প্রথম প্রথম সাধারণ মনে হয়েছিল, উত্তেজনা আর রোমাঞ্চের গন্ধ পেয়েছিল ও। তখন মনে হয়েছে মনের মতো একটা কাজ পাওয়া গেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সন্দেহ জাগছে, কাজটা নেয়া অদৌ ঠিক হয়েছি কি না। ডাই রীডের কথা আর মাস্ট্যাংবাসীদের হাবভাবে মনে হচ্ছে প্রথমে যেমন ভেবেছিল, ব্যাপারটা আসলে তত সহজ-সরল নয়। যাই হোক, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে জায়গাটা নিজের চোখে দেখতে হবে, বুঝতে হবে, কোথায় কাদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে নামতে যাচ্ছে। আরেকটা কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, অচিরেই, সঙ্গীদের জেরার মুখোমুখি হতে হবে ওকে। যাকে যাকে খুন করা দরকার খুন করে পাওনা টাকা বুঝে নিয়ে চলে যেতে চাইবে ওরা, দেরি সইবে না।
শুধু লরেডো শ্যাডই সম্ভবত ওর লাইনে চিন্তা ভাবনা করছে। সুযোগ পেলে আজ একবার টেক্সানের সঙ্গে আলাপ করতে হবে, ভাবল পল কেড্রিক, বুঝতে হবে সে কী জানে, কতটুকু বোঝে। গতকাল ডরনি বলছিল, লরেডো শ্যাড দলের মধ্যে সবচেয়ে ভালো লোক; কেড্রিকেরও তাই মনে হচ্ছে। আত্মবিশ্বাসী বলেই ওর আচরণে এরকম সহজ একটা ভাব এসেছে। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলেই কেবল এতটা আত্মবিশ্বাসী হতে পারে কেউ। কীভাবে বিপদের মোকাবিলা করতে হয় এই লোক সেটা জানে।
কফি শেষ করে উঠে দাঁড়াল কেড্রিক, ধীর পায়ে ঝর্নার ধারে এল, দুঢোক পানি খেয়ে দাড়াল সোজা হয়ে; এগিয়ে গেল ঘোড়র কাছে। ক্যাম্পে পৌঁছে জিনের বাঁধন ঢিল করে দিয়েছিল, ধীরে সুস্থে বাঁধতে শুরু করল। চমৎকার হাওয়া বইছে। ওরা চাপা কণ্ঠে কথা বললেও প্রায় প্রতিটি শব্দই
পরিষ্কার কানে আসছে ওর। প্রথম প্রশ্নটা ধরতে পারল না ও, কিন্তু ফেসেনডেনের জবাব স্পষ্ট শোনা গেল।
ওকে ঘটাতে যেয়ো না, ভরনি। সাত ঘাটের পানি খাওয়া লোক। এখন আমার মনে পড়েছে, ওর সঙ্গে আমার আগেও একবার মোলাকাত হয়েছে।
দাঁড়িয়ে আছে কেড্রিক, এতদূর থেকেও যেন ওদের উত্তেজনার আঁচ লাগছে।
ইনজুন টেরিটোরিতে ওর কাছ থেকে প্যাটারসনের গরু ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম আমরা। পাত্তা পাই নি।
কী হয়েছিল? জানতে চাইল লী গফ, লড়াই?
সামান্য। আমি তখন ল্যানো গানম্যান চাক গিবন্সের সঙ্গে থাকতাম। ওর স্বভাব ছিল গায়ে পড়ে ঝগড়া করা। আমার সঙ্গেও বেশ কয়েকবার গানফাইট হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু আমি ঝামেলা এড়িয়ে গেছি। ঝগড়া করে টাকা হারানোর ঝুঁকি নেই নি। কিন্তু চাক একটা খচ্চর, কেড্রিক যখন ওকে রুখে দাঁড়াল, গরু দিতে রাজি হলো না, ওকে চ্যালেঞ্জ করে বসল
কফিতে চুমুক দিল ফেসেনডেন। অধৈর্যভাবে অপেক্ষা করছে সবাই। অবশেষে তর সইতে না পেরে লী গফ জানতে চাইল, তারপর?
কাঁধ ঝাঁকাল ফেসেনডেন। কেড্রিক বেঁচে আছে, দেখতেই পাচ্ছ।
মানে কীভাবে ঘটল ব্যাপারটা তাই জিজ্ঞেস করেছি।
খাপ থেকে পিস্তল বের করতে পারে নি গিবন্স। কেড্রিক কখন ড্র করেছে দেখতেই পাই নি আমরা; কিন্তু পরে দেখা গেল চাকের শার্টের বাঁ দিকের পকেটে একটা আধুলি দিয়ে ঢাকা যাবে, এত কাছাকাছি দুটো ফুটো।
এরপর আর কথা এগোল না। জিনের পেটি বাঁধার পেছনে আরও কিছু সময় ব্যয় করল কেড্রিক। তারপর ঘোড়া ছেড়ে দূরে সরে গেল, ক্যাম্পের চারদিকে একবার চক্কর মারল, চোখ বোলাল এদিক-ওদিক। চেহারায় চিন্তার ছাপ।
অভিজ্ঞতা ওকে শিখিয়েছে, কর্মস্থল সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখার গুরুত্ব কতখানি। মাস্ট্যাং থেকে টেরিটোরি লাইন পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল রণাঙ্গনে পরিণত হতে যাচ্ছে অচিরেই, গোটা এলাকা সম্পর্কে ভালো করে জানার ওপরই হয়ত বাচামরা নির্ভর করবে। যে কোনও এলাকা সম্পর্কে জানার সুযোগ সাধারণত হাতছাড়া করে না ও।
আগেও বহু কঠিন লোকের কাছ থেকে কাজ আদায় করেছে কেড্রিক, তাই এই দলটাকে নিয়ে ভাবছে না। যদিও জানে, এই দলের লোকগুলো বিপজ্জনক, কিন্তু একসঙ্গে ওদের সামলানো তেমন কঠিন হবে না; তবে আলাদা আলাদাভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সমস্যা দেখা দেবে। কারণ, ওরা একা থাকতেই পছন্দ করে, দলের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা থাকার কথা নয়। মাত্র। দুটো জিনিসে বিশ্বাস করে এরা, সিক্সগানে দক্ষতা এবং টাকা। এ দুটোর ওপর ভরসা করে বেঁচে আছে; মারাও যাবে।
ফেসেনডেন মুখ ভোলায় একদিক দিয়ে সুবিধে হয়েছে। ওর ব্যাপারে কারও মনে দ্বিধা থাকলে এখন তা দূর হয়ে যাবে। ও একজন পিস্তলবাজ জানার পর নির্দেশ মানতে আপত্তি করবে না; ভয়ে নয়, ওকে স্বগোত্রীয় একজন, ভেবেই ওর কথা শুনবে। ও উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এমনটি ভাববে না।
বিশ্রাম নিয়ে আস্তে ধীরে আবার যখন ওরা পথে নামল, আগুনের হলকা, বইছে যেন চারদিকে, উত্তপ্ত হয়ে আছে মরুভূমি। দিগন্তে সামান্যতম আলোড়ন নেই, ধু-ধু চরাচর। দূরে একটা মেসার মাথার ওপর অবিরাম চক্কর দিচ্ছে একটা নিঃসঙ্গ শকুন-খাবার খুঁজছে। তীক্ষ্ণ নজরে চারদিক জরিপ করছে ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। তবু হঠাৎ হঠাৎ বারান্দায় দেখা মেয়েটার চেহারা মনে পড়ে যাচ্ছে। সামান্থা ফক্স সুন্দরী। জন গুন্টারের ভাগ্নী হলেও, বোঝা যায়, মামার সব কাজে তার অনুমোদন নেই।
মেয়েটা এখানে এসেছে কেন? কীথের সঙ্গে কী সম্পর্ক তার? ওর প্রতি কীথের বিদ্বেষ টের পেয়েছে কেড্রিক, অবাক হয় নি। এমনিতে ঠাণ্ডা স্বভাবের মানুষ ও, সহজে রাগে না, কিন্তু ওকে যদি কেউ খোঁচায়, বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা এক বাঘ গা ঝাড়া দিয়ে জেগে ওঠে, ওলট-পালট করে দেয় সবকিছু। নিজের সুপ্ত ক্রোধের কথা জানে, তাই সতর্ক থাকে ও, মেপে কথা বলে; সংযত রাখে নিজেকে।
হঠাৎ লাগাম টেনে ঘোড়া থামাল ডরনি শ। ওটা ল্যারগো ক্যানিয়ন, সামনের সংকীর্ণ উপত্যকার দিকে ইঙ্গিত করল সে। ওই যে ডান দিকে দূরে পাহাড়টা দেখছ, ওটাই দ্য অরফ্যান। ইনজুনরা ওখানে শাদা মানুষদের উঠতে দেয় না; শোনা যায়, ওখানে নাকি চমৎকার মিঠে পানির একটা ঝর্না আছে, সারা বছর পানি পাওয়া যায়।
এর পরই শুরু হয়েছে বারউইকদের এলাকা। একেবারে অ্যারিজোনার সীমান্ত ঘেঁষা জায়গাটুকু না পেলেও; বিশাল একটা এলাকা পেতে যাচ্ছে। স্কোয়াটারদের ঘাঁটি ইলো বাট নামে একটা শহর; গোটা বার ঘর-বাড়ি আছে ওখানে; দোকান, আস্তাবল, করাল, স্যালুন এমনকী ব্যাংকও পাবে।
চিন্তিত চেহারায় মাথা ঝাঁকাল কেড্রিক। সামনে যদূর চোখ যায়, ধু-ধু মরুভূমি; কিছুতেই একে জলাভূমি বলা যায় না। আশপাশে পাছপালা চোখে পড়ছে না, লতানো কিছু মেসকিট ঘাস কিংবা ব্ল্যাক গ্র্যামা রয়েছে, এ ছাড়া ক্যাকটাস, সোপউইড, ক্রিওসেট ঝোঁপ আর ক্যাট-ক্ল ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে জুন্মেছে। কোনও কোনও ওঅশে অবশ্য গাঢ় সবুজ পিনন কিংবা জুনিপারও আছে।
আরও সামনে এগোল ওরা। ল্যারগো ক্যানিয়নে ঢুকল, তার পর বেরিয়ে এসে পশ্চিম দিকে চলল। সতর্ক কেড্রিক। মুহূর্তের জন্যে অনেক দূরে একজন অশ্বারোহীকে দেখতে পেল। কিছুক্ষণ পর একই ঘোড়সওয়ারকে আরও খানিকটা কাছাকাছি দেখে অনুমান করল ওদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। প্রার্থনা করল ও, কোনওরকম হামলা যেন না হয়।
কোম্পানির জমির প্রায় মাঝখানে আস্তানা গেড়েছে স্কোয়াটাররা। ওদের নেতার নাম বর ম্যাকলেনন। ওর আবার দুই চ্যালা আছে। একজন পিটার সেগাল অন্যজনের নাম পিট লেইন। গতকাল জানতে চাইছিলে ওরা লড়বে কিনা। এই তিন শয়তানের বাচ্চা অন্তত লড়বে। সেগালের মোটামুটি বয়স হয়েছে; চল্লিশের কোঠায় রয়েছে ম্যাকলেনন, এক কালে. একটা কাউটাউনের মার্শাল ছিল; আর লেইন, ব্যাটা বড় কঠিন চীজ, ঠিক বোঝা যায় না; কোমরে দুটো পিস্তল ঝুলিয়ে ঘোরে, অসম্ভব প্রভাব রাখে স্কোয়াটারদের ওপর। শুনেছি, ডুরাংগোতে নাকি একবার গানফাইটে জড়িয়ে পড়েছিল, একাই ঝামেলা সামাল দিয়ে বেরিয়ে আসে।
কেড্রিকের পেছন থেকে কে যেন নিচু কণ্ঠে বলে উঠল, বোনটার মতোই দুর্বোধ্য চরিত্র!
চেপে বসল ডরনি শয়ের ঠোঁটজোড়া, কিন্তু এ-ছাড়া আর কোনও প্রতিক্রিয়া হলো না। তবে কেড্রিকের তথ্যের ভাণ্ডার কিছুটা পূর্ণ হলো। নিঃসন্দেহে শত্রু-শিবিরে ডরনি শয়ের একজন বন্ধু আছে, তার কাছ থেকে সংগ্রহ করা তথ্যই কীথকে দেয় সে। আপন, ভাই আর গোষ্ঠীর সঙ্গে বেইমানি করছে মেয়েটা? অসম্ভব নয়। ওদের চোখে ধরা না পড়ে কীভাবে মেয়েটার কাছে যাওয়া-আসা করে ডরনি?
ওয়েলশম্যান ডাইরীডের কথা বলে নি ডরনি। কিন্তু ছোটখাট শক্তিশালী মানুষটার একটা ভূমিকা না থেকেই পারে না।ওর কথা ভুললে চলবে না।
হঠাৎ গজ তিরিশেক দূরের একটা ক্যানিয়ন থেকে এক অশ্বারোহী বেরিয়ে এল, ঘোড়া নিয়ে এগোল ওদের দিকে। বিড়বিড় করে গাল বকে লাগাম টানল ডরনি শ। একসঙ্গে থামল বাকিরাও।
অশ্বারোহী একটা মেয়ে। চমৎকার স্বাস্থ্য, ইন্ডিয়ানদের মতো বাদামি ত্বক, এক মাথা কালো চুল, বড় বড় দুচোখে অদ্ভুত দ্যুতি; হাত দুটো ছোট, পুতুলের মতো।
প্রথমে শয়ের দিকে তাকিয়ে তারপর অন্যদের ওপর চোখ বোলাল সে। অবশেষে পল কেড্রিকের ওপর স্থির হলো তার দৃষ্টি। প্রচুর সময় নিয়ে মাপল ওকে। তোমার নতুন বন্ধুটি কে, ডরনি? জিজ্ঞেস করল, পূরিচয় করিয়ে দাও?
তীক্ষ্ণ কঠিন দৃষ্টিতে কেড্রিকের দিকে তাকাল ডরনি শ ক্যাপন কেড্রিক, এসো, স্যু লেইনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।
ক্যাপ্টেন? নতুন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল মেয়েটা। আর্মিতে ছিলে?
হ্যাঁ, শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল কেড্রিক। মেয়েটার পিনটো দেখে বোঝা যাচ্ছে, ওদের ওপর এ নজর রাখে নি। অর্থাৎ কাছেপিঠে আরও একজন ঘোড়সওয়ার আছে! কে?
ঘর ছেড়ে একা এত দূর আসা কি ঠিক হয়েছে, সু? বাধা দিয়ে প্রশ্ন করল ডরনি শ।
ঠিক-বেঠিক আমি ভালো বুঝি, ডরনি, ঠাণ্ডা স্বরে জবাব দিল মেয়েটা। ডরনির চেহারা লাল হয়ে গেছে, লক্ষ্য করল কেড্রিক। যাক গে, তোমাকে, কিংবা ক্যাপ্টেন কেড্রিক যদি লিডার হয়, ওকে সাবধান করে দিতে এসেছি আমি। তোমাদের আর এগোনো ঠিক হবে না। সকালে আলোচনায় বসেছিল ওরা, ম্যাকলেননও ছিল। ওরা ঠিক করেছে, বাইরের ঘোড়সওয়ার কিংবা সারভেঅরদের দেখলেই গুলি করবে। এখন থেকে এটা তোমাদের জন্যে নিষিদ্ধ এলাকা। খবরটা জামাতে একজন লোককে মাস্ট্যাংয়ে পাঠানো হচ্ছে, আজ রাতে পৌঁছে যাবে সে।
বলে কী মেয়েটা! শুষ্ক কণ্ঠে বলল লী গফ। ওরা দেখছি অনেক বেড়ে গেছে। তা আমরা সামনে বাড়লে কী হবে?
গফের দিকে তাকাল স্যু লেইন। লড়াই, শান্ত কণ্ঠে বলল সে।
ধেত্তের, অধৈর্য কণ্ঠে বলল পয়েন্সেট, অনর্থক কথা বলে সময় খরচ করার কী দরকার? লড়াই করতেই তো এসেছি আমরা, নাকি? চল, আগে বাড়ি, কেমন লড়াই জানে ব্যাটারা দেখি!
চিন্তিত চেহারায় স্যু লেইনের আপাদমস্তক জরিপ করল পল কেড্রিক। মেয়েটা সুন্দরী, সন্দেহ নেই। সামান্থা ফক্সের মতো রূপসী, হয়তো নয়, তবে সুন্দরী।
পাহারা দেয়ার জন্যে লোক পাঠিয়ে দিয়েছে? জিজ্ঞেস করল ও।
কেড্রিকের দিকে তাকাল স্যু লেইন। এখনও না পাঠালেও শিগগিরই পাঠাবে। হাসল স্যু লেইন। পাহারা থাকলে তোমাদের সাবধান করার সুযোগ পৈতাম?
তুমি কার পক্ষে, মিস লেইন? জানতে চাইল কেড্রিক।
ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে অগ্নিদৃষ্টি হানল ডরনি শ। কিন্তু সে কিছু বলার সুযোগ পেল, না। স্যু লেইনই জবাব দিল। কারও না। বলতে পারো আমি নিজের পক্ষেই আছি। আমি কী চাই না চাই সেটা আমিই ঠিক করি। ভাই কিংবা অন্য কারও তোয়াক্কা করি না। ওরা নির্বোধ, নইলে এই মরুভূমির জন্যে লড়াই করবে কেন? বিরক্তির সঙ্গে হাত খেলিয়ে চারপাশ দেখাল ও। এখানে মানুষ বাঁচে? আমি চাই ওরা হারুক। তা হলে এখান থেকে অন্য কোথাও যেতে পারব!
আচমকা ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল স্যু লেইন। যে কথা বলতে এসেছিলাম বলেছি, এবার চলি।
আমিও আসছি, হঠাৎ বলল ডরনি শ।
শয়ের দিকে তাকাল স্যু লেইন। না! এবার কেড্রিকের দিকে দৃষ্টি দিল, আপাদমস্তক জরিপ করল ওকে। ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণে। তবে ক্যাপ্টেন কেড্রিক চাইলে আসতে পারে। ওকে ওরা চেনে না!
হেসে উঠল কে যেন। মরার মতো শাদা হলো ডরনির চেহারা, সাঁই করে ঘোড়া ঘোরাল। ঠোঁট ফাঁক হয়ে দাঁতের পাটি বেরিয়ে পড়েছে। ডান হাত পিস্তল বের করার জন্য তৈরি।
কে হাসল? জিজ্ঞেস করল ডরনি, গলাটা একটু যেন কেঁপে গেল তার। হাসল কে?
মিস লেইন, শান্ত কণ্ঠে বলল কেড্রিক, ডরনি শ গেলেই ভালো হত। এলাকাটা আমার চেয়ে বেশি চেনে ও।
ঝলসে উঠল ডরনির চোখ। আমি জানতে চেয়েছি, কে হেসেছে?
ঘাড় ফেরাল কেড্রিক। রাখো এসব, শ, স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল ও, আমি যতক্ষণ কম্যান্ডে আছি কেউ মারামারি করতে পারবে না!
মুহূর্তের জন্যে যেন পাথর হয়ে গেল ডরনি শ। পরক্ষণে সাপের মতো ঠাণ্ডা চোখে কেড্রিকের দিকে তাকাল। আমাকে বলছ? ওর কণ্ঠে একই সঙ্গে বিদ্রূপ আর অবিশ্বাস।
বিপদ চিনতে পল, কেড্রিকের ভুল হয় না, কিন্তু উত্তেজিত হলো না ও, শুধু মাথা ঝাঁকাল। তোমাকে একা নয়, ডরনি, সবাইকে বলছি। বিশেষ একটা কাজ নিয়ে এখানে এসেছি আমরা। তোমাকেও আর সবার মতো টাকা দেয়া হচ্ছে। আমরা যদি নিজেরা মারপিট করে সময় নষ্ট করি, কাজ এগোবে কী করে? এখন আমাদের শক্তি হ্রাস পেলে মুশকিল হয়ে যাবে।
তা ছাড়া নিজের লোকদের মধ্যে খুনোখুনি কীথ কিংবা বারউইক পছন্দ করবে না।
কেড্রিকের চোখে চোখে তাকিয়ে রইল ডরনি শ। অসহনীয় নীরবতা। ঝোঁপের মধ্যে একটা ঝিঝি পোকার ডাক নিস্তব্ধতাকে যেন বাড়িয়ে তুলছে। মাটিতে পা ঠুকে মাছি তাড়াল স্যু লেইনের ঘোড়া। সহসা পল কেড্রিক বুঝতে পারল, ডরনি শ ওকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। সম্ভবত এই প্রথম কোনও কাজে বাধা দেয়া হয়েছে তাকে। খেপে গেছে সে।
আস্তে আস্তে পিস্তলের কাছ থেকে হাত সরিয়ে নিল ডরনি শ। ঠিকই বলেছ, ক্যাপন, শুষ্ক কণ্ঠে বলল সে। এখনও গোলাগুলির সময় আসে নি। তা ছাড়া, বারউইক আবার রাগী মানুষ।
কেড্রিকের দিকে তাকাল স্যু লেইন, দৃষ্টিতে অবহেলা। আমি যাচ্ছি। তোমরা সাবধানে থেকো।
কিন্তু স্যু লেইনের ঘোড়া পা বাড়ানোর আগেই কেড্রিক জানতে চাইল, মিস লেইন, বল তো তোমাদের দলে কার একটা লম্বা পাঅলা গুলা আছে?
ঝট করে ঘাড় ফেরাল স্যু লেইন, ফ্যাকাসে চেহারা। কী-গ্রুল্লা?
হ্যাঁ, বলল কেড্রিক, সকাল থেকে ওটায় চেপে আমাদের ওপর নজর রাখছিল কে যেন। এই মুহূর্তে আধমাইলটাক দূরে আছে সে। এবং, আবার বলল ও, একটা ফীল্ডগ্লাসও আছে তার কাছে!
খিস্তি ঝেড়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ফেসেনডেন। চোখ কটমট করে ইতিউতি নজর বোলাল পয়েন্সেট। কেবল ডরনি শয়ের মুখেই কথা ফুটল। শুকনো অবিশ্বাস ভরা কণ্ঠে বলব, গ্রুলা? এখানে?
ব্যস, আর কিছু বলল না সে।শয়ের মন্তব্যে বিভ্রান্তিতে পড়ল কেড্রিক, তীক্ষ্ণ চোখে জরিপ করল ওকে। গ্রুলা ঘোড়াটার কথা মনে হচ্ছে আগে। থেকেই জামে ডরনি, কিন্তু এখানে দেখা যাবে ভাবে নি। স্যু লেইনের বেলায়ও একই কথা খাটে। স্পষ্টতই, ওর প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে সে।
অনেকক্ষণ পর, নর্থ ফোর্কের ঝর্নার কাছে ফিরে আসার সময়ও ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভাবল ও নতুন একটা তথ্য, হয়তো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ-আবার অর্থহীনও হতে পারে।
ফিরতি পথে খুব একটা কথাবার্তা হলো না ওদের মাঝে। লড়াই করতে না পেরে হতাশ হয়েছে পয়েন্সেট, তবে কিছুটা সন্তুষ্ট ফের বিশ্রামের সুযোগ পেয়ে।
০৪. নির্বাক হয়ে গেছে যেন ডরনি শ
নির্বাক হয়ে গেছে যেন ডরনি শ। সাপার শেষে কেড্রিক যখন অ্যাপলুসার পিঠে জিন চাপাতে গেল, মুখ তুলে তাকাল সে।
ডরনি, আমি ইলো বাট-এ যাচ্ছি। নিজের চোখে, শহরটা একবার দেখে আসি, বলল, কেড্রিক। গোলমাল করার ইচ্ছে আমার নেই, চাইও না। কিন্তু, কীসের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে যাচ্ছি সেটা জানা দরকার।
অনড় দাঁড়িয়ে ওকে রওনা হতে দেখল ডরনি শ। কিছু বলল না। পড়ন্ত বিকেলের শেষ আলোয় যতটা সম্ভব দূরত্ব কমিয়ে আনতে দ্রুত এগোল পল কেড্রিক। ইয়েলো বাট শহর এবং তার আশপাশের এলাকা জরিপ করা ছাড়াও আরেকটা উদ্দেশ্য আছে ওর। ওখানকার অধিবাসীদের আসল পরিচয় জানাঃ ও সংসারী মানুষ নাকি খুনে-ডাকাত? আউট-ল তত্ত্ব প্রমাণিত হওয়ার মতো তেমন কিছু এখনও দেখতে পায় নি ও।
একটা দীর্ঘ ডিম্বাকৃতি মেসার ঠিক পায়ের কাছে গড়ে উঠেছে ইয়েলো বাট শহর। মেসা থেকেই শহরের নামের উৎপত্তি। এখানে এক চিলতে সমতল ভূমিতে জুড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে পাথর আর কাঠের বাড়িগুলো। ঘরগুলো পাহাড়ের দেয়ালের সামনে দীর্ঘ একটা অ্যারোয়ো অর্থাৎ গিরিখাদের দিকে মুখ করে বানানো। গিরিখাদের কিনারায় মাত্র তিনটে ঘর আর একটা করলি। একটা জিনিস স্পষ্ট বোঝা যায়: শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বলে কিছু নেই।
একজন কিংবা দুজন রাইফেলধারী মেসার চূড়ায় উঠতে পারলে ওখান থেকে অনায়াসে পুরো শহর নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তা ছাড়া শহরের পেছনের পাহাড় কিংবা সামনের গিরিখাদের নিচু অংশে লুকিয়ে থেকে শহরের দিকে গুলি ছোড়া সম্ভব। ইয়েলো বাট মেসাটি প্রায় দেড়শো ফুট উঁচু, মুখ শহরের
প্রশস্ত রাস্তার দিকে। তবে শহর প্রতিরক্ষার জন্যে ইদানীং কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কয়েকটা বাড়ির সামনে স্তূপীকৃত মাটি দেখা যাচ্ছে-নতুন মার্টি। তূপের দিকে তাকিয়ে, কোথায় কেন মাটি খোঁড়া হয়েছে বোঝার চেষ্টা করল পল কেড্রিক; খানিক পর হাল ছেড়ে দিয়ে আশপাশের এলাকায় নজর বোলাতে শুরু করল।
চিন্তিত চেহারায় ইয়েলো বাট মেসার দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন কেড্রিক। শহরের লোকেরা ওটার চূড়ায় রাইফেলসহ কাউকে পাঠানোর কথা, কি ভাবে নি? পাঠানোই তো স্বাভাবিক। কিন্তু যোগ্য, সেনাপতিকেও রণাঙ্গনে অনেক সময় মামুলি ব্যাপার ভুলে বসতে দেখা যায়। এদের বেলায়ও তেমন ঘটতে পারে। অথচ মেসার মাথায় বসে কেবল ইয়েলো বাট শহর নয়, আশপাশের পুরো এলাকার ওপর কর্তৃত্ব ফলানো সম্ভব। কয়েক মাইলের ভেতর এটাই সর্বোচ্চ চূড়া।
ঘোড় ঘুরিয়ে শহরের দিকে এগোল ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। ফাঁকা জায়গায় রয়েছে ও; কিন্তু কেউ দেখে থাকলেও কোন রকম বাধা দিল না। ওর সঙ্গে আরও লোক থাকলে কী হত?
বাট স্যালুনের সামনে ঘোড়া থামিয়ে স্যাডল থেকে নাম কেড্রিক, হিচরেইলে বাধল ওটাকে। জানে, ঘোড়াটা ক্লান্ত, এই মুহূর্তে দূরে কোথাও যাবার ক্ষমতা নেই।
শহরের একমাত্র রাস্তা খাঁ খাঁ করছে। স্যালুনের বারান্দায় উঠল কেড্রিক, তারপর স্যুইং-ডোর ঠেলে আলোকিত কামরায় পা রাখল। একটা টেবিলে বসে সলিটেয়ার খেলছিল একজন, মুখ তুলে তাকাল, ভুরু কুঁচকে উঠল তার, কিছু যেন বলতে চাইল; কিন্তু পরমুহূর্তে মত পাল্টে আবার খেলায় মনোযোগ দিল। বারের দিকে এগিয়ে গেল পল কেড্রিক। রাই, সহজ কণ্ঠে বারটেন্ডারকে বলল।
ওর দিকে না তাকিয়েই মাথা দোলাল বারটেন্ডার, একটা গ্লাসে মদ ঢেলে দিল। কেড্রিক বারের ওপর পয়সা ফেললে চোখ তুলে তাকাল সে সঙ্গে সঙ্গে কাঠিন্য ফুঠে উঠল তার চেহারায়। কে তুমি? জানতে চাইল সে। তোমাকে তো আগে দেখি নি?
দুজন লোক দুপাশে এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝতে পারছে কেড্রিক। অচেনা লোক। প্রথমজন মাঝবয়সী, তীক্ষ্ণ চেহারা; অপরজন লাল-চুলো এক উদ্ধত যুবক।
এদের জন্যেও ঢাল, বারটেন্ডারকে বলল পল। তারপর সাবধানে, আস্তে আস্তে, ওদের সন্দেহের উদ্রেক না করে বারের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল। সতর্ক দৃষ্টিতে পুরো রুম জরিপ করল!
দশ বারজন লোক আছে স্যালুনে। একদৃষ্টিতে মাপছে ওকে। আমার পকেট থেকে পয়সা যাচ্ছে, শান্ত কণ্ঠে বলল ও, তোমরাও যোগ দেবে। নাকি?
নড়ল না কেউ কাঁধ ঝাঁকাল কেড্রিক। আবার বারের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। মদের গ্লাস হাওয়া হয়ে গেছে!
আস্তে আস্তে বারটেন্ডারের দিকে তাকাল কেড্রিক। আমার গ্লাসটা, কোথায়? নম্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
কেড্রিকের দিকে তীব্র দৃষ্টি হানল বারটেন্ডার। কী জানি, বলতে পারব না! কাঁধ ঝাঁকিয়ে পাল্টা জবাব দিল সে।
পয়সা দিয়ে মদ কিনেছি, গ্লাসটা দাও। অখণ্ড নীরবতা।
ওকে প্রায় উপেক্ষা করে দুপাশের দুজন লোক বরের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।
আমাকে খেপিয়ো না, আবার বলল কেড্রিক। মদের গ্লাসটা ফিরিয়ে দাও-জলদি!
মিস্টার, বারের উপর দিয়ে সামনে ঝুঁকল বারটেন্ডার তোমার মতো লোকের কাছে আমরা মদ বিক্রি করি না। চ্যাঙদোলা করে বাইরে ফেলে দেয়ার আগেই মানে মানে কেটে পড়ো। ভাগো হিয়াসে!
বারের কিনারে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিল পল কেড্রিক, পরের ঘটনা এত দ্রুত ঘটে গেল যে, পাশের লোক দুটো নড়াচড়া করারও ফুরসত পেল না।
বিদ্যুৎ চমকের মতো ছুটে গেল কেড্রিকের ডান হাত, জাপ্টে ধরল বারটেন্ডারের কলার, সাথে সাথে বারের দিকে পেছন ফিরে হ্যাচকা টান দিল। বাইন মাছের মতো পিছলে শূন্যে উঠে গেল লোকটা, উড়ে গিয়ে দড়াম করে মেঝেয় পড়ল। পরমুহূর্তে বাউলি কেটে দুপাশের দুজনের আওতার বাইরে সরে গেল কেড্রিক। চট করে খাপ থেকে পিস্তল বের করেই কাভার করে দাড়াল কামরার প্রতিটি লোককে।
উঠে দাঁড়িয়েছিল কয়েকজন, কেড্রিকের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে পিস্তল দেখে জমে গেল। পয়েন্ট-ফোর-ফোর রাশানটা কখন বেরিয়ে এসেছে দেখতে পায় নি কেউ।
দেখে, স্যালুনের সবাইকে উদ্দেশ্য করে নরম কণ্ঠে বলল কেকি। গোলমাল করার জন্যে এখানে আসি নি আমি। একটা কাজ করে দেয়ার জন্যে আমাকে ভাড়া করা হয়েছে, তাই দেখতে এসেছি তোমাদের সম্পর্কে যা শুনেছি, সেসব সত্যি না মিথ্যা। তোমাদের বারটেন্ডার লোকটা হয় কালা কিংবা ভদ্রতা জানে না; আমি এক গ্লাস হুইস্কি দিতে বললাম, কথা না শুনে বাজে বকতে শুরু করে দিল। তাই একটু শিক্ষা দিয়ে দিলাম।
এই যে, তুমি, সলিটেয়ার খেলোয়াড়কে বলল কেড্রিক, তোমাকে দেখে তো ভালো লোক বলেই মনে হচ্ছে। এদিকে এসো, গ্লাসে মদ ঢেলে বারের কিনারে রাখো দেখি। তারপর, দৃষ্টি সরাল না ও, এখানকার প্রত্যেককে এক গ্লাস করে হুইস্কি দাও। বাঁ হাতে, পকেট হাতড়ে একটা স্বর্ণ মুদ্রা বের করে বারের ওপর ছুঁড়ে ফেলল। এই যে, পয়সা মিটিয়ে দিলাম।
এক কদম পিছিয়ে এল, কেড্রিক, তারপর পিস্তল হোলস্টারে ঢুকিয়ে রাখল। নিষ্পলক চোখে ওকে দেখছে সবাই, নড়াচড়া করার সাহস করছে না। ব্যাপারটা সম্ভবত লালচুলো মেনে নিতে পারছে না, বাহাদুরী দেখাতে চাইছে, সে, বুঝতে পারছে কেড্রিক।
অ্যাই, তুমি! আচমকা বলে উঠল ও, বিয়ে করেছ? ছেলেপুলে আছে?
কটমট করে কেড্রিকের দিকে তাকাল লালচুলো, তারপর শুকনো গলায় জবাব দিল, হ্যাঁ, দুটো ছেলে। তাতে তোমার কী?
বললাম না, সহজ কণ্ঠে জবাব দিল কেড্রিক, তোমাদের সম্পর্কে জানতে এসেছি এখানে?
মদ ঢালতে ঢালতে মুখ তুলে তাকাল সলিটেয়ার খেলোয়াড়। কী জানতে চাও, আমাকে জিজ্ঞেস করো। আমি পিটার সেগাল।
তোমার কথা অনেক শুনেছি।
মৃদু হাসি ফুটে উঠল সেগালের ঠোঁটে। হ্যাঁ, বলল সে, তোমার কথাও শুনেছি আমরা।
নিঃশব্দে সবাইকে মদ ঢেলে দিল পিটার সেগাল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে স্যালুনের প্রতিটি লোক। মদ বিতরণ শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়াল সেগাল।
বন্ধুরা, বলল সে, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে খামোকা প্রাণনাশের ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। ও কী বলতে চায় আগে শোনা যাক। পছন্দ না হলে আমল না দিলেই হবে।
ধন্যবাদ, সেগাল, স্যালুনের চারপাশে নজুর বোলাল কেড্রিক। নিষ্করুণ চেহারায় ওর দিকে তাকিয়ে আছে দুজন, দৃষ্টিতে বিদ্বেষ; একজনের চোখে নিখাদ কৌতূহল; পেছনের দরজায় এক লোক দাঁড়িয়ে, রুক্ষ চেহারা, অস্থির দৃষ্টি, প্রাক্তন আউট-ল ক্লসনের মতোই রগচটা বলে মনে হচ্ছে লোকটাকে।
আমি যেই কোম্পানির চাকরি করছি, বলল কেড্রিক, সরকারের কাছ থেকে এদিককার সব জমি কিনে নিতে যাচ্ছে ওরা। কোম্পানির নাম কীথ গুন্টার অ্যান্ড বারউইক। নিউ অরলিন্সে আমাকে কাজ দেয়ার সময় ওরা জানিয়েছিল, একদল আউট-ল, ছিচকে চোর আর ছিনতাইবাজ গায়ের জোরে জায়গাটা দখল করে রেখেছে। উচ্ছেদ করতে গেলে বাধা দেয়ার চেষ্টা করবে, এখানে চোর-ডাকাতের আস্তানা বানাতে চায় ওরা। আমার দায়িত্ব এদের বিতাড়িত করে জায়গাটা কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া। সেই কারণেই এখানে আসা।
পেছনের সারি থেকে মৃদু গুঞ্জন ভেসে এল। সময় নিয়ে গ্লাস খালি করল পল কেড্রিক। তারপর সহজ ভঙ্গিতে সিগারেট বানাতে শুরু করল।
ডান দিকের দরজা ঠেলে দুজন লোক স্যালুনে চুকল। প্রথমজন লম্বায় মোটামুটি কেড্রিকের সমান হবে, মাথায় আলকাতরার মতো কালো চুল, জুলফির কাছে পাক ধরেছে, ধূসর চোখে শীতল দৃষ্টি; চেহারায় দৃঢ়তার ছাপ। কামরার চারদিকে নজর বুলিয়ে কেড্রিকের দিকে তাকাল সে।
বব, এ হচ্ছে ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক, নিচু গলায় বলল পিটার সেগাল। এতক্ষণ ওর কথাই শুনছিলাম। ওকে নাকি বলা হয়েছে, আমরা একদল খুনে ডাকাত, বদমাশ!
বারউইকের কাণ্ড নিশ্চয়ই, বলল ম্যাকলেনন। বলে যাও, কেড্রিক।
বিশেষ কিছু বলার নেই আর। আসলে একজন যোদ্ধা হিসেবে নিজের চোখে জায়গাটা দেখতে চাইছিলাম আমি। মাস্ট্যাংয়ে আসার পর থেকেই এমন কিছু কথা কানে এসেছে, এমন কিছু ইঙ্গিত পেয়েছি, যাতে করে আমার ধারণা হয়েছে ৰারউইকরা হয়তো মিথ্যে বলে নি। তাই তোমাদের আসল পরিচয় জানতে নিজেই চলে এসেছি। দেখতে চাই, আমাকে যেমন বলা হয়েছে, সত্যি, তোমরা তৃত খারাপ কি না। তা ছাড়া, তোমাদের মতামতও তো জানা দরকার।
কুৎসিত হয়ে গেল লালচুলোর চেহারা। আমরা তোমার কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই, কেড্রিক! কর্কশ কণ্ঠে বলল সে, বুঝতে পারছ কী বলছি? খুনীর দলকে নিয়ে একবার শুধু আসো এখানে, দেখে নেব কয়টা জ্যান্ত ফিরে যেতে পারে!
চুপ করো, রেড! ধমকে উঠল সেগাল। বব কী বলে শোনা যাক।
আহা, কেন পাত্তা দিচ্ছ? রুক্ষ কণ্ঠে বলল রেড। এই ব্যাটা ভয়ে এখনই কাবু হয়ে গেছে, নইলে এভাবে খোঁজখবর করতে আসত?
ভুরু কুঁচকে, রেডের চোখের দিকে তাকাল পল কেড্রিক, কণ্ঠকে শান্ত রেখে বলল, উঁহু, ভয় পাই নি, রেড। আমি যদি মনে করি কোম্পানি ঠিক বলেছে, তোমাদের উচ্ছেদ করা দরকার, যে কোনও মূল্যে তা করব; কেউ ঠেকাতে পারবে না। প্রয়োজন হলে আরও লোক যোগাড় করব। আমি জানি কীভাবে লড়াই করতে হয়। সারা জীবন লড়াই করে আসছি, জেতার কৌশল আমার অজানা নেই। ভয় পেয়ে এখানে আসি নি, এসেছি, নিজের কাছে পরিষ্কার থাকতে চাই বলে। এখানে তোমাদের দাবী বৈধ হলে, তোমাদের সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয়েছে সেসব মিথ্যে হলে, নিজেকে সরিয়ে নেব আমি।
অবশ্য, আবার বলল ও, অন্যেরা কী করবে না করবে জানি না, তবে আমার সিদ্ধান্ত ওদের জানিয়ে দেব।
যুক্তিসঙ্গত কথা, সায় দিল ম্যাকলেনন। বেশ, ঠিক আছে, আমাদের কথা বলছি এবার। এখানকার জমিজমার মালিক আসলে সরকার। তবে কিছু অংশ নাভাহহা আর উতে ইন্ডিয়ানরা ওদের বলে দাবী করে। ওদের সঙ্গে আমাদের লড়াই করতে হয়েছে, তবেই এখানে থাকতে পেরেছি। চার-পাঁচজন আছে, দশবছরেরও বেশি হলো এখানে বসবাস করছে। বাকিরা কমপক্ষে তিনচার বছর ধরে আছে।
এখানে ঘর-বাড়ি বানিয়েছি আমরা, ঝর্নাগুলো পরিষ্কার করেছি, কিছু কিছু জায়গা ঘিরে নিয়ে চাষাবাদ করেছি। এখানে আমাদের সংসার আছে, ছেলে-মেয়ে আছে। কিন্তু তোমাদের কোম্পানি এখন আমাদের ভিটেমাটি ছাড়া করার চেষ্টা করছে; আমাদেরকে বঞ্চিত করতে চাইছে।
আইন অনুযায়ী ছয়মাস আগে নোটিস জারি করা উচিত ছিল। অর্থাৎ কারও কাছে খাস জমি বিক্রি করার অন্তত ছয়মাস আগে সরকারকে নোটিস জারি করতে হয়। সেই জমি, আমাদের জানা মতে, জনবসতিহীন হতে হবে। কিন্তু এ-জায়গাটা তা নয়। দেখতেই পাচ্ছ, আমরা এখানে বাস করছি। তার ওপর, মাত্র পাঁচমাস আগে নোটিস জারি করা হয়েছে; এমন জায়গায় সাঁটানো হয়েছে সেটা, যেখানে সচরাচর মানুষের চলাচল নেই! নোটিসটা এত ছোট ছোট হরফে ছাপা ম্যাগনিফাইং গ্লাস ছাড়া পড়ে কার সাধ্যি।
যাই হোক, মাত্র মাসখানেক আগে কীভাবে যেন আমাদের একজনের চোখে পড়ে যায় ওটা, আইনের প্যাচাল কথাবার্তা থেকে অর্থ বের করতেই তার কয়েকদিন লেগে যায়, তারপরই হাউমাউ করে আমার কাছে ছুটে আসে সে এখন সত্যি ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্যে সরকারের কাছে লোক পাঠাব, অত টাকা কোত্থেকে পাব, বল? সুতরাং রুখে দাঁড়িয়ে লড়াই করা ছাড়া উপায় নেই। সেদিকেই জোর দিচ্ছি আমরা। কোম্পানি আমাদের উৎখাত করতে, চাইলে, যদিও তা পারবে বলে মনে হয় না, এখানকার প্রতিটি ধূলিকণা রক্ত দিয়ে কিনতে হবে! বিড়বিড় করে ম্যাকলেননের কথায় সায় দিল সবাই। ভুরু কুঁচকে আবার কামরার চারদিকে নজর বেলাল কেড্রিক। ডরনি শ ঠিকই বলেছে। প্রয়োজনে লড়াই করে মরবে এরা। ম্যাকলেনন আর সেগালের মতো লোক নেতৃত্ব দেয়ায় এদের সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল হবে।
আইনের দিক থেকে কোম্পানি অবশ্য সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। কোণঠাসা অবস্থায় পড়ে গেছে এরা। এখনই যদি কাউকে ওয়াশিংটনে পাঠানো হয়, গন্তব্যে পৌঁছুতে কমপক্ষে সপ্তাতিনেক সময় লাগবে তার। এর পর লালফিতার বাধা পেরিয়ে উপযুক্ত লোকের কাছে গিয়ে জমি বিক্রি ঠেকানো যাবে-তার আশাও ক্ষীণ।
ফটকাবাজিতে নেমেছে বারউইকরা, জানাল বব ম্যাকলেনন, গুজব রটেছে; এখানে নাকি শিগগিরই ইন্ডিয়ান রিজারভেশন প্রতিষ্ঠা করা হবে। কথাটা যদি সত্যি হয়, এখন জমি কিনতে পারলে পরে সরকারের কাছেই আবার চড়া দামে এই জমি বিক্রি করে অনেক টাকা মুনাফা লুটতে পারবে ওরা।
অথবা তোমরা, বলল পল কেড্রিক। দুদিকের পাল্লাই ভারি দেখতে পাচ্ছি, ম্যাকলেনন। কোম্পানির পক্ষে একটা শক্ত যুক্তি আছে। ফেডারেল সরকার এখানে রিজারভেশন প্রতিষ্ঠা করলে তোমাদের এমনিতেই বিদায় নিতে হবে।
সেটা যখন হবে তখন দেখা যাবে, বলল পিটার সেগাল। এই মুহূর্তে কোম্পানিকে ঠেকানোই আমাদের উদ্দেশ্য। আমরা ফটকা কারবারী নই। এবং পিস্তলবাজও নই।
আরও একজন লোক ঢুকল স্যালুনে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিনতে পারল পল কেড্রিক। বার্ট, মাস্ট্যাংয়ের রাস্তায় একে পিটিয়েছিল ও। দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কামরা জরিপ করল বাট।
কেউ না? আস্তে করে জিজ্ঞেস করল কেড্রিক। পিট লেইন সম্পর্কে কী যেন শুনছিলাম?
লেইন মোটেই খারাপ না! তেতে উঠল রেড। ওর মতো ভালো মানুষ পাওয়া কঠিন।
ম্যাকলেনন কিংবা সেগাল কিছুই বলল না। অস্বস্তির সঙ্গে নড়েচড়ে দাঁড়াল সেগাল। অর্থাৎ, একটা ব্যাপারে মতানৈক্য আছে এদের। লেইন সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে, ভাবল পল কেড্রিক।
তো, দৃঢ়কণ্ঠে বলল ও, ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে একটু চিন্তাভাবনা করতে হবে। তার আগে গোলমাল করার দরকার নেই। তোমরা রাজি থাকলে। বল, আমি আমার লোকদের শান্ত রাখার ব্যবস্থা করি।
আমরাও ঝামেলা চাই না, বলল বব ম্যাকলেনন। আমরা যতক্ষণ শান্তিতে আছি, কোম্পানির লোকজন এখন থেকে দূরে থাকছে, আমাদের দিক থেকে গোলমাল হবে না।
দরজার দিকে পা বাড়াল কেড্রিক, কিন্তু বারটেন্ডারের ডাকে থামতে হলো।
পয়সা ফেলে যাচ্ছ, তুমি, শুকনো গলায় বলল সে।
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল কেড্রিক, হাসল, তারপর খুচরো পয়সা নিয়ে পকেটে রাখল। আবার দেখা হবে, বলে পা বাড়াল।
ঠিক এই সময় আচয়কা দড়াম করে দরজা খুলে গেল, টলমল পায়ে ভেতরে ঢুকল এক লোক। অন্য একজন লোককে ধরে রেখেছিল, মেঝেয় ফেলল তাকে।রবার্টস! বলল লোকটা। ওকে ওরা খুন করেছে।
একসঙ্গে মেঝের লোকটার দিকে তাকাল কামরার সবাই। একাধিকবার গুলি করা হয়েছে বেচারাকে, তারপর ঘোড়ার পায়ের নীচে পিষ্ট করেছে; ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে লাশ। পেটের ভেতরে পাক দিয়ে উঠল কেড্রিকের, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল, কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে যেন।
অভিযোগ ভরা দৃষ্টিতে ওকে দেখছে সবাই। ম্যাকলেননের চেহারা আড়ষ্ট, তাতে অবিশ্বাসের ছাপ; সন্ত্রস্ত সেগাল। রেডসহ অবশিষ্টরা সামনে পা বাড়াল। এই লোকটা! আঙুল তুলে কেড্রিকের দিকে ইঙ্গিত করল রেড, ক্রোধে থর গুর করে কাঁপছে। এখানে দাঁড়িয়ে মিঠে মিঠে কথা রলেছে আর ওর চ্যালারা খুন করেছে আমাদের ববকে!
ধরো শালাকে! চেঁচিয়ে উঠল একজন। ধরো! আমার কাছে দড়ি আছে!
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে কেড্রিক, জানে, এখন এদের কিছু বোঝানো অসম্ভব। হয়তো পরে বুঝতে পারবে রবার্টসের হত্যায় ওর হাত ছিল না, ওর অজান্তে ঘটেছে ব্যাপারটা; কিন্তু এই মুহূর্তে কারও কথায় কান দেবে না। লোকটা চেঁচিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে স্যাৎ করে স্যালুন থেকে বেরিয়ে এল কেড্রিক, হ্যাচকা টানে হিচরেইল থেকে ঘোড়ার বাধন খুলে লাফিয়ে স্যাডলে চেপে বসল। চমকে উঠে দালানকোঠার মাঝ দিয়ে ছুটতে শুরু করল অ্যাপলুসা। #
পেছন থেকে চিৎকার আর খিস্তি ভেসে আসছে। গুলি করল কেউ, কানের পাশ দিয়ে উড়ে গেল একটা বুলেট। দুটো দালানের মাঝখানে ঘোড়া ঢোকাল পল কেড্রিক, পরক্ষণে বুঝতে পারল, পালাতে গিয়ে ফঁদে পা দিয়ে ফেলেছে। সামনে, বড়জোর দুশো গজ দূরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে নিরেট পাথুরে দেয়াল। দেয়ালের নীচের দিকে ফাঁক-ফোকর আছে কি না বোঝার উপায় নেই। এখন গিরিখাদের দুটোমুখেই সশস্ত্র প্রহরী পাঠিয়ে দেবে ওরা, ওদিকে যাওয়া আর সম্ভব নয়। বাঁক নিয়ে অন্ধকারে সোজা ইয়েলো বাট এর দিকে ঘোড়া ছোটাল কেড্রিক।
শহরে ঢোকার পথে মেসার গোড়ায় ইংরেজি হরফ ভি আকৃতির একটা ফাঁক দেখেছিল ও। ওদিক দিয়ে বেরুনো গেলেই হয়! হয়তো বক্স, ক্যানিয়নও হতে পারে ওটা। সেক্ষেত্রে ওখানে ঢোকার অর্থ হবে উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে ঝাঁপ দেয়া।
গতি কমিয়ে আনল কেড্রিক। শব্দ করা চলবে না। শব্দ শুনলে সহজেই ওর অবস্থান আঁচ করে ফেলবে প্রতিপক্ষ। কোণঠাসা করে ধরে ফেলবে। সমভূমিটা ছোট, গিরিখাদ ছাড়া বেরুনোর পথ মাত্র দুটো এবং ওদিকে কড়া নজর রাখা হবে নিঃসন্দেহে।
অনেক কাছে চলে এসেছে মেসা। অতল গহ্বরের মতো কালো আঁধারে ধীর গতিতে এগোচ্ছে অ্যাপলুসা আর কয়েক মিনিট, তারপরই নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছুতে পারবে।
অ্যাপলুসা ক্লান্ত, সারাদিন পথ চলেছে। বন্ধুর, পথে ওর মতো বিশালদেহী একজন লোককে এতদূর বয়ে এনেছে। তরতাজা ঘোড়া নিয়ে ধাওয়াকারীদের। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে পারবে না। প্রাণ বাঁচানোর এখন মাত্র একটা উপায় আছে: ওদের ধাঁধায় ফেলতে হবে, যাতে কিছুটা অতিরিক্ত সময় আদায় করা যায়। কিন্তু যেভাবেই হোক, ভোর হবার আগেই পালাতে হবে ওকে। দিনের আলোয় পুরো এলাকা চষে ফেলবে ওরা, ওর অবস্থান ফাস হয়ে যাবে।
সামনে হাঁ করে আছে ক্যানিয়নের মুখ। ক্যানিয়নের দুপাশের দেয়াল উঁচু না হলেও এত খাড়া যে ঘোড়া নিয়ে এই দেয়াল বেয়ে উঠে পালানো সম্ভব, হয়।
এখন আর চিৎকারের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু কেড্রিক জানে, ওকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করবে ওরা, গিরিখাদের দিকে যারা নজর রেখেছে, এতক্ষণে অন্যদের জানিয়ে দিয়েছে, ওদিকে যায়নি ও। এখনও আটকা পড়ে আছে। হতে পারে ওদিকে আদৌ কোনও পাহারা নেই, কিন্তু কাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে জানে পল; আসার সময় কাউকে পাহারা দিতে না দেখলেও এখন পাহারা থাকবে ধরে নেয়াই ভালো।
সংকীর্ণ ক্যানিয়ন। খুব সাবধানে এগোল কেড্রিক, কিন্তু খানিকটা এগোনোর পরই দেখল ক্যানিয়নের শেষপ্রান্তের দেয়াল আকাশ, ছুঁয়েছে-কালো, নিরেট। মুখ গলা শুকিয়ে এল ওর, থমকে দাঁড়াল অ্যাপলুসা। ঝিম মেরে বসে রইল পল। ঘোড়াটা হাঁপাচ্ছে। একটা নিরেট দেয়ালের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ও, ফাঁদে পড়েছে।
পেছনে একটা আলো জ্বলে উঠেই নিভে গেল। চিৎকার করে উঠল কেউ। দেশলাই জ্বালিয়ে ট্র্যাক খুঁজছিল ওরা, পেয়েছে। আর কিছুক্ষণ, তারপরেই এসে পড়বে! ধরা পড়ে যাবে ও। কিছুই বুঝতে চাইবে না ওরা, মরণফাঁদে আটকা পড়েছে ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক! নিরুপায়!
০৫. অনড় হয়ে স্যাডলে বসে রইল কেড্রিক
অনড় হয়ে স্যাডলে বসে রইল কেড্রিক। কান খাড়া। নুড়ি পাথর গড়িয়ে পড়ার আওয়াজ ভেসে এল। বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখন, অনর্থক ঝুঁকি নেয়ার উপায় নেই। ফঁদে আটকা পড়ে গেছে ও। কিন্তু ফাঁদ থেকে বেরুতে গিয়ে কাউকে হত্যা করতে চায় না, এবং মরারও ইচ্ছে নেই।
নিঃশব্দে স্যাডল থেকে নামল কেড্রিক। সতর্ক। এই মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে গেলে বিপদ হবে। হয়তো কিছুই করার উপায় নেই, তবু অভিজ্ঞ মানুষ ও, অতীতে বহুবার এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছে, কিন্তু শেষ, পর্যন্ত ঠিকই সব বিপদকে পেছনে ফেলে আসতে সক্ষম হয়েছে। ঠাণ্ডামাথায় ধীরে সুস্থে ভাবতে পারলে এবারও একটা না একটা উপায় বেরোবেই।
অ্যাপলুসার পাশে স্থির দাঁড়িয়ে চারপাশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করল ক্যাপ্টেন কেড্রিক। ইয়েলো বাটের বিশাল কাঠামোর নীচে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার এতক্ষণে চোখে সয়ে এসেছে। মাথা নামিয়ে পায়ের দিকে তাকাল ও। বালির ধূসর একটা রেখা দেখা যাচ্ছে, কাছেই বেশ বড় বড় বোল্ডার আর ছড়ানো ছিটানো ঝোঁপের মাঝে একটা ফাঁকের ভেতর হারিয়ে গেছে ওটা। ঘোড়া নিয়ে ফোকরটার দিকে পা বাড়াল কেড্রিক।
ফোকরটা এত সংকীর্ণ যে ঘোড়ার্টার এগোতে কষ্ট হচ্ছে। মোটামুটি ফুট বিশেক এগোনোর পর সামান্য চওড়া হলো। বোল্ডারগুলো এখানে কিছুটা ছোট, কোমর সমান উঁচু, আগাছা জন্মেছে ওগুলোর ওপর। অপালুসাও বিপদ টের পেয়েছে বোধ হয়, প্রায় নিঃশব্দে আলতো পায়ে এগোচ্ছে।
অন্ধকারে আক্ষরিক অর্থেই হাতড়ে হাতড়ে এগোচ্ছে পল কেড্রিক। ও নিশ্চিত, বালির-রেখাঁটি পানির স্রোতেই তৈরি হয়েছে, ক্যানিয়নে পানির উপস্থিতির প্রমাণ রয়েছে, ক্লিফের কিনারা দিয়ে উপচে কিংবা কোনও ফোকর গলে এসেছে পানি। ফাঁকটা বের করতে হবে। এগিয়ে চলল কেড্রিক, অসংখ্য বোল্ডারের জটলায় এসে পড়েছে ও, এঁকেবেঁকে বালি রেখা ধরে কোথায় যাচ্ছে জানে না।
দুবার থামল পল, পেছনে গিয়ে টুপির সাহায্যে পায়ের ছাপ মুছে ফেলল। অন্ধকারে কাজ হলো কিনা বোঝার উপায় নেই; তবে ফাঁকটা সরু, ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম। দশ মিনিটের মতো চিপা গলি দিয়ে এগোনোর পর হঠাৎ আবার খাড়া দেয়ালের মুখোমুখি হলো ও। ঢাল বেয়ে, ঝোঁপঝাড় আর পাথরচাইয়ের ভেতর দিয়ে আরেকটা দেয়ালের সামনে এসে পড়েছে।
মাথার ওপর, নাগালের বাইরে ক্লিফের গায়ে একটা নচ দেখতে পেল পল কেড্রিক। ওই ফোকরটা দিয়েই সম্ভবত বালির রেখাটা নেমে এসেছে। এবার সত্যি সত্যি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল কেড্রিক। অ্যাপলুসাকে রেখে. ক্লিফের দেয়ালহাতড়ে ফাটল খুঁজতে শুরু করল।
বাঁ দিকে কিছুই পাওয়া গেল না। বার কয়েক পঁড়িয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। ক্যানিয়নের মুখ থেকে কোনওরকম শব্দ আসছে না। এটা বক্স ক্যানিয়ন হলে ইয়েলো বাটের লোকদের অজানা থাকার কথা নয়। সেক্ষেত্রে অন্ধকারে ভেতরে ঢোকার ঝুঁকি না নিয়ে ভোরের অপেক্ষা করবে ওরা। রাতের অন্ধকারে এখানে চমৎকার প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। তবু বলা যায় না, প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে লোকগুলো, এই মুহূর্তেও ছুটে আসতে পারে।
ফিসফিস করে ঘোড়াকে সান্ত্বনা দিয়ে দেয়াল ঘেষে এবার ডানে এগোল কেড্রিক। খানিকটা এগোনোর পর হঠাৎ দেখল পায়ের নীচের মাটি ঝুপ করে নীচে নেমে গেছে। একটা গহ্বরে নেমে এল পল। ঠাণ্ডা, সঁতসেঁতে একটা ভাব এখানে। কাছেপিঠে ঝর্না আছে হয়তো, যদিও পানি গড়ানোর শব্দ পেল ও।
গহ্বরে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডার মধ্যেও দরদর করে ঘামছে ক্যাপ্টেন কেড্রিক। অনড় দাঁড়িয়ে কান খাড়া করল ও, ঘামে ভেজা মুখ মুছল। আচমকা বাতাসের মৃদু ছোয়া লাগল মুখে।
চমকে উঠল কেড্রিক। নতুন আশা জাগল বুকে। ঘুরে দঁাড়িয়ে অদম্য উৎসাহে পাহাড়ী-দেয়ালে সন্ধান চালাল, কিন্তু আকস্মিক হাওয়ার উৎস খুঁজে পাওয়া গেল না। এবার আরও সাবধানে এগোল ও হঠাৎ বুঝতে পারল নীচের শক্ত মাটি সামান্য খাড়া হয়ে উপর দিকে উঠে গেছে। পায়ে পায়ে ক্লিফের চূড়ার দিকে এগোল পল কেড্রিক, হাতে রাইফেল ধরা।
ঢালের মাথায় এসে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল কেড্রিক। ক্যানিয়নের মুখের কাছে ধূসর বালির রেখা এখান থেকে ফিকে দেখাচ্ছে। এখানে হঠাৎ ঈষৎ বাঁক নিয়েছে ক্যানিয়ন, তারপর কানাগলির মতো শেষ হয়ে গেছে। গলির শেষ মাথায়, ওপরে ক্লিফের কিনারায় একটা নচ। খাড়া একটা ঢাল ক্লিফের চূড়া থেকে নেমে এসেছে। ওখানে রিমের ওপর বাতাসে কোনও কারণে আলোড়ন উঠেছিল হয়তো, সেজন্যেই ওঁর মুখে ছোঁয়া লেগেছে। কেড্রিক লক্ষ্য করল টালটা অসম্ভব খাড়া, ওটা বেয়ে উঠতে গেলে ধস নামকে, এবং তাতে প্রচণ্ড শব্দের সৃষ্টি হবে, ব্যর্থ হয়ে যাবে ওর পালানোর চেষ্টা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ঘেরাও করে ফেলবে ওকে। তা ছাড়া, এতক্ষণে হয়তো রিমের ওপর পাহারা বসানো হয়ে গেছে।
কেড্রিক ঘুরতেই হঠাৎ পা হড়কে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বাঁচার সহজাত প্রবৃত্তির বশেই একটা ঝোঁপের গোড়া আঁকড়ে ধরল। অতল খাদে পড়ে প্রাণ হারানোর হাত থেকে বেঁচে গেল এ-যাত্রা। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে শক্ত জায়গায় উঠে দাঁড়াল ও, একটা নুড়ি পাথর ছুঁড়ে দিল নীচের দিকে। অনেকক্ষণ পর ওটার পতনের শব্দ কানে এল পনের থেকে বিশ ফুট গভীর হবে গর্তটা। দেয়ালের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে ঢালের গোড়ায় এসে দাঁড়াল কেড্রিক, নতুন একটা জিনিস ধরা পড়ল চোখে।
বৃষ্টির পানির তীব্র স্রোত মাটির ওপর প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি করেছে এখানে, ফলে চওড়া একটা ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে; হয়তো গিরিখাদের দিকেই গেছে ওটা। এই খাদে আত্মগোপন করার মতো একটা জায়গা না থেকে পারে না। চট করে আবার অ্যাপলুসার কাছে ফিরে এল কেড্রিক।
ঢালটা খাড়াভাবে খাদের তলদেশে নেমে এসেছে। নীচে এর্সে ঘাড় কাত করে ওপরে তাকাল কেড্রিক। কমপক্ষে পনের ফুটের মতো নীচে দাঁড়িয়ে আছে ও মাথার ওপর খাদের সমান প্রশস্ত এক টুকরো তারা-জ্বলা-আকাশ দেখা যাচ্ছে। খাদের সংকীর্ণ তলদেশ ধরে অ্যাাপালুসা নিয়ে আরও নীচে নামতে শুরু করল পল কেড্রিক। খানিক দূর এগোনোর পর দেখল, খাদের দুপাশের দেয়ালের ওপর জন্মানো ঝোঁপঝাড় আর আগাছায় মাথার ওপরের ফাঁক ঢাকা পড়ে গেছে।
চারদিকে অপার্থিব নিস্তব্ধতা। শীত শীত করছে। আরও এগোল পল কেড্রিক। পানির তীব্র স্রোত বাক নিয়ে খাদের দেয়ালে একটা গুহা তৈরি করেছে, কাছে এসে ভেতরে ঢুকে পড়ল ও। গুহার শেষ প্রান্তে একটা ছোট গর্তে পানি জমে আছে। অ্যাপলুসাকে পানি খাওয়ার জন্যে ছেড়ে দিল পল। এক নিঃশ্বাসে সবটুকু পানি সাবাড় করল ঘোড়াটা।
ক্যান্টিন থেকে দুটোক পানি খেলো, কেড্রিক। তারপর অ্যাপলুসার পিঠ থেকে স্যাডল নামিয়ে একমুঠো ঘাস দিয়ে ওটার শরীর দলাইমলাই করে দিল। তারপর ঘোড়াকে বেঁধে রেখে কম্বল বিছিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। ভাবছে ও। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে, এরপরও যদি ধরা পড়তে হয়, গোলাগুলি করা ছাড় উপায়ান্তর থাকবে না এবং তাতে প্রাণহানী ঘটবেই।
বিস্ময়করভাবে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ল কেড্রিক। যখন ঘুম ভাঙল, অ্যাপলুসার হাবভাবে সতর্ক হয়ে উঠল ও। চোখের পলকে সোজা হয়ে দাঁড়াল। অ্যাপলুসার ঘাড়ে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে কথা বলে ওকে শান্ত করল। সকাল হয়েছে। ওপরে, খানিকটা দূর থেকে মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।
গুহাটা চুনাপাথরের, প্রায় পনের ফুটের মতো উঁচু, তবে গুহামুখের দৈর্ঘ্য আট ফুটের বেশি হবে না। গুহার খোলা মুখে এসে দাঁড়াল কেড্রিক, যে-পথে এখানে এসেছে, কড়া নজরে সেদিকে তাকাল। যা ভেবেছিল, ক্লিফের মাথার কাছে ওই নচ থেকে নামা পানির তোড়েই এই খাদের সৃষ্টি। বৃষ্টির সময়, সন্দেহ নেই, কানায় কানায় ভরে যায় এটা।
এখানে মাথার ওপরে ডালপালায় খাদের ফাঁক ঢাকা পড়ে গেছে, একটা চ্যাপ্টা পাথর খাদের ওপর সেতু বানিয়ে দিয়েছে। আবার খাদের মুখের দিকে তাকাল কেড্রিক, প্রায় সম্পূর্ণই ঝোঁপের আড়ালে রয়েছে খাদটা বোধ হয় ওকে খুঁজে পাবে না ওরা, ক্ষীণ সম্ভাবনা বেশি কিছু আশা করা ঠিক নয়।
সিগারেটের তেষ্টা পেয়েছে, কিন্তু ধরানোর সাহস হলো না। ধোয়ার গন্ধে ও কোথায় আছে বুঝে যাবে ওরা। কয়েকবার মানুষের গলার আওয়াজ পেল কেড্রিক। দুএকবার খুব কাছে এসেও ফিরে গেল ওরা। গুহার ভেতর চোখ ফেরাল পল। গেল্ডিংটা পানি খাচ্ছে। পরিমাণে সামান্য হলেও, সারারাত গর্তে আবার পানি জমেছে। কেড্রিকের ক্যান্টিন এখনও আধাআধি ভরা, এবং পানি কোনও সমস্যা নয়।
.
হাঁটুর ওপর রাইফেল ফেলে বসে আছে ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। মাঝে মাঝে খাদের গভীরে তাকাচ্ছে। বৃষ্টির পানি এখান থেকে কোথায় যায়? শহরের কাছে গিরিখাদে? তা যদি হয়, এই খাদের কথা শহরবাসীদের অজানা থাকার কথা নয়।
সময় গড়িয়ে চলল। হঠাৎ কখনও মানুষের গলার আওয়াজ পাওয়া গেলেও ওর ধারেকাছে এল না কেউ। খাদটার কথা বোধ হয় কেউ জানে না। কিছুক্ষণ পায়চারি করল কেড্রিক। একটা ঢিবির গা থেকে কয়েক গোছা ঘাস নিয়ে ফিরে এল। অ্যাপিলসাকে দিল ওগুলো। ঘাস খেতে পেয়ে খুশি হয়ে গেল ঘোড়াটা। ব্যাগ থেকে কয়েক টুকরো জার্কি বের করে চিবুতে লাগল কেড্রিক। এক কাপ কফি হলে দারুণ হত, ভাবল।
কিছুক্ষণ পর আবার খাদ ধরে সামনে এগিয়ে গেল কেড্রিক। একটু এগোতেই দেখল, হঠাৎ আরও গভীর হয়ে নীচের দিকে নেমে গেছে ওটা। এখন আর কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। থামল ন পল। এক জায়গায় এসে আবার ঈষৎ বাঁক নিয়েছে খাদ, পানির তোড়ে বড়সড় একটা গামলার মতো গুহা তৈরি হয়েছে, গুহার ভেতরে আবার বাঁক নিয়েছে স্রোতের পানি, ঢাল বেয়ে আরও গভীরে ছুটে গেছে।
এত দূরে আসার পর আর লোভ সামলাতে পারল না পল কেড্রিক, বড় গুহাটার দিকে এগিয়ে গেল। বিশাল গুহা পাহাড়ের পেটের ভেতর ঢুকে গেছে। এখানে ওখানে পাথুরে তাক, কিন্তু ওগুলোর পানির নীচে কখনও ডুবেছে বলে মনে হলো না। গুহার তলায় একটা ছোট্ট পুকুর মতো রয়েছে, পুকুরের তলদেশে বিরাট বিরাট ফাটল, সমস্ত পানি ওই ফাটলগুলো দিয়েই বেরিয়ে যায়।..
যদিও খুব একটা ভেতরে ঢোকে নি, কিন্তু বেরুনোর দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেল কেড্রিক; বাতাস স্থির হয়ে আছে। তবু, এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে কেড্রিকের মনে হলো, সঙ্গে যথেষ্ট খাবার থাকলে অনায়াসে কয়েক সপ্তাহ এখানে লুকিয়ে থাকা সম্ভব। ঢালের গোড়ায় খাদের মুখ দেখতে না পেলে এটার কথা জানতে পারবে না কেউ।
ক্লিফের মাথা থেকে নেমে আসা পানি শহরের পাশে গিরিখাদের দিকে না গিয়ে এই গুহাতেই আসে।
মন্থর গতিতে বেলা গড়িয়ে চলল। সিগারেট খাওয়ার জন্যে দুবার বড় গুহার কাছে চলে এল কেড্রিক। কয়েক ঘণ্টা পর পালানোর একটা চেষ্টা করবে ও। কিন্তু আঁধার নামার পরে খাদ থেকে বেরিয়ে ঢালের গোড়ায় দাঁড়িয়ে ক্যানিয়নের মুখের দিকে তাকাতেই একটা অগ্নিকুণ্ড চোখে পড়ল ওর। দুজন লোক বসে আছে আগুনের পাশে। ওদের কাছে রাইফেল আছে। ও এদিকে কোথাও আছে, অনুমান করে নিয়েছে ওরা, জানে খাবারের অভাব হলে আপসে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে।
এতক্ষণে ওর নিখোঁজ সংবাদ নিয়ে মাস্ট্যাংয়ে ফিরে গেছে ডরনি, শ। ইয়েলো বাটের রবার্টকে হত্যা করার কথাও বারউইককে জানাবে সে। ওর লোকজনই রবার্টসের মৃত্যুর জন্য দায়ী, এ ব্যাপারে কেড্রিক নিঃসন্দেহ। কিন্তু শহরের কাছাকাছি এরকম নগ্ন সন্ত্রাস গুন্টার কিংবা কীথ কি মেনে নেবে? বিপক্ষীয় কেউ দেখে থাকলে অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে হবে ওদের।
ঘুরে চুড়ার দিকে উঠে-যাওয়া ঢালটা পরখ করল ক্যাপ্টেন কেড্রিক। ঘোড়ার পিঠে এটা বেয়ে ওঠা অসম্ভবই বলা যায়। অবশ্য সুস্থ সবল একজন লোকের পক্ষে এটা বেয়ে উঠে যাওয়া কঠিন নয়, অ্যাপলুসাটা তো পাহাড়ী ঘোড়াই…ঝুঁকি নিয়ে দেখা যেতে পারে…ঢালের শেষ মাথায় ওর অপেক্ষায় লোক বসে না থাকলে বেরিয়ে যেতে পারবে। হাতের কাছে একটা মাটির তুপ থেকে এক মুঠো ঘাস ছিড়ে নিয়ে অ্যাপলুসার কাছে ফিরে এল কেড্রিক। ঘোড়াকে ঘাস দিতেই মহানন্দে চিবুতে শুরু করল সে। তাকিয়ে রইল ও।
অস্বস্তিতে ভুগছে সামান্থা ফক্স।
মামার কাছে ইয়েলো বাটের সংবাদবাহককে আসতে দেখেছে ও, ফিরে যেতেও দেখেছে। বারউইক কী জবাব দিয়েছে জানে। লোকটা বিদায় নেয়ার পর দিন দুপুরে সদলে ফিরে এসেছে ডরনি শ। কিন্তু ক্যাপ্টেন কেড্রিক ফেরে নি ওদের সঙ্গে।
কিন্তু কেড্রিক ফিরল না ফিরল তাতে ওর কী? ও ভাবছে কেন অযথা? এই কেনর জবাব ও জানে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে ও। সেদিন বারান্দায় দেখা হওয়ার পর থেকে কেবলই ঘুরে ফিরে কেড্রিকের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। লোকটার ইস্পাত দৃঢ় চেহারা, চওড়া কাঁধ আর তাকানোর ভঙ্গি যেন এখনও চোখের সামনে ভাসছে। জন মামার সঙ্গে যাদের ওঠাবসা তাদের সঙ্গে বিরাট একটা পার্থক্য রয়েছে কেড্রিকের জীবনে প্রথম এমন কাউকে দেখেছে ও।
অজান্তেই কেড্রিকের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করছিল সামান্থা, কিন্তু হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল লোকটা?
বারান্দায় এসে দাঁড়াল জন গুন্টার। চিন্তিত চেহারা, সিগারের গোড়া চিবুচ্ছে।
কী হয়েছে, বল তো? জিজ্ঞেস করল সামান্থা। কোনও অঘটন ঘটল না। তো? ক্যাপ্টেন কেড্রিক কোথায়?
জানি না! উৎকণ্ঠায় তীক্ষ্ণ শোনাল গুন্টারের কণ্ঠস্বর। স্কোয়ার্টারদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, তারপর আর ফেরে নি। ডরনির ওপর কীথের আস্থা থাকলেও ওকে আমি একটুও বিশ্বাস করি না। ভরনি একটা ব্লুক্তপিপাসু পিশাচ। আমরা বোধ হয় একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছি, সাম্য। এই সময় কেড্রিককে দরকার ছিল। লোকটার বিচার-বুদ্ধি আছে, মাথা খাটিয়ে কাজ করতে জানে।
ও হয়তো এসকে জড়াবে না বলে ঠিক করেছে। হয়তো বুঝতে পেরেছে, তোমরা যাদের চোর-ডাকাত, খুনী বলছ আসলে মোটেই সেরকম কিছু নয় তারা।
ঝট করে সামান্থা ফক্সের দিকে তাকাল জন গুনার। একথা কার কাছে শুনলে? কৈফিয়ত চাইল সে।
কারও কাছে না। শুনতে হবে কেন? আমার চোখ নেই? এখানে রাস্তায় ঘোরার সময় ওই চোর-ডাকাতের চেহারা নিজের চোখে দেখেছি: ওদের সংসার আছে, ছেলেমেয়ে আছে, রসদপূত্র কেনার জন্যেই এখানে আসে ওঁরা। আমার কাছে ওদের ভদ্রলোক বলেই মনে হয়েছে। এসব আর আমার ভালো ঠেকছেন, মামা, আমার টাকায় এত কাণ্ড ঘটছে ভাবতে পারি না।
আহা! তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না, সামা। তুমি নিশ্চিত থাকো, তোমার যাতে লাভ হয় আমি আর লরেন সেদিকেই খেয়াল রাখব।
আমার লাভের কথা ভাবলে এ-কাজটা ছেড়ে দাও! আবেদন ঝরল সামান্থ। ফক্সের কণ্ঠে। এর তো কোনও প্রয়োজন দেখি না। আমার টাকা পয়সার অভাব নেই। টাকার জন্যে মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়া করতে হবে এ কেমন কথা? ওরাও মানুষ, ওদের বেঁচে থাকার অধিকার আছে!
তা তো বটেই! ধৈর্য-চুতি ঘটল গুন্টারের। এ-নিয়ে আগেও বহুবার আলোচনা করেছি আমরা, সামা 1 ওখানে যারা থাকছে তাদের বেশির ভাগই খারাপ লোক। তাছাড়া এমনিতেও ওদের জায়গাটা ছাড়তে হবে। যার দখলেই থাক, ভবিষ্যতে সরকার পুরো জায়গাটা কিনে নেবে। যদি আমাদের দখলে থাকে, প্রচুর টাকা লাভ করতে পারব আমরা। সরকারের কাছ থেকে? নিজের দেশের সরকারের কাছ থেকে? ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে গুন্টারের দিকে তাকাল, সামান্থা। সরকারকে যে ফাঁকি দেয় সে কেমন চরিত্রের মানুষ আমি বুঝি না। স্বীকার করি এ ধরনের লোক আছে, কিন্তু আমার মামাও সেই দলে, কোনওদিন ভাবতে পারি নি।
হাসিয়ো না আমাকে, সামা। ব্যবসার ব্যাপার, তুমি কী বোঝ? এসব বুঝতে হলে বাস্তববাদী হতে হয়!
তা ঠিক। কিন্তু এই মুহূর্তে এমন কিছু জিনিসের কথা মনে পড়ছে যেগুলো অনেকের কাছেই অবাস্তব মনে হবে, অথচ লক্ষ টাকার বিনিময়েও ওসব পাওয়া যায় না। নাহ, উঠে দাঁড়াল সামান্থা ফক্স, আমি ভাবছি, তোমাদের ব্যবসা থেকে আমার টাকা উঠিয়ে নেব। এখানে কাছাকাছি কোথাও ব্লাঞ্চ কিনব। আমি আর তোমাদের সঙ্গে নেই।
অসম্ভব! অধৈর্যভাবে চেঁচিয়ে উঠল জন গুন্টার। সব টাকা ব্যবসায় খাটানো হয়ে গেছে। এখন কোনওমতেই টাকা দেয় যাবে না। শোনো, সামা, লক্ষ্মী মেয়ের মতো আমার ওপর বিশ্বাস রাখো, যেমন এতদিন রেখেছ!
হ্যাঁ, এতদিন বিশ্বাস করেছি, কারণ তোমাকে দিয়ে খারাপ কাজ হতে পারে ভাবি নি। সরাসরি গুন্টারের দিকে তাকাল সামান্থা। তুমি খুব ভালো করেই জানো, যা করতে যাচ্ছ, কাজটা ভালো নয়, বলে চলল ও, মনে রেখো, লড়াই ছাড়া ওদের নড়ানো যাবে না। ভয় দেখালেই সুড় সুড় করে ইঁদুরের গর্তে পালাবে ওরা-এই তো ভেবেছিলে? তোমাদের ধারণা ভুল। বব ম্যাকলেননকে দেখেছি আমি। ভয়-ভীতিতে কাবু হওয়ার মতো লোক সে নয়। লরেনের ভাড়াটে খুনীদের দিয়ে কাজ হবে না।
কে বলেছে, ওরা খুনী? অস্বস্তির সঙ্গে প্রতিবাদ করল জন গুন্টার। সামান্থার চোখের দিকে তাকানোর সাহস হলো না তার। একটু বেপরোয়া এবং রগচটা হতে পারে, কিন্তু খুনী নয়।
তাহলে ডরনি শ? এরই মধ্যে বারজন মানুষকে খুন করে নি সে? দেখতে সুন্দর আর অল্প বয়সী হলে কী হবে, লোকটা শেয়ালের চেয়েও ধূর্ত। ওকে দেখলে আতঙ্কে সিঁটিয়ে যায় সবাই। উঁহু, এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই, মাম!। এভাবে চালালে শিগগিরই নিরপরাধ মানুষ হত্যাও বিনা আপত্তিতে মেনে নিতে শুরু করবে তুমি।
লরেন অব্য এসব নিয়ে ভাবে না। সে বরাবর ঠাণ্ডী স্বভাবের মানুষ। তুমি সেদিন জানতে চেয়েছিলে ওকে বিয়ে করতে আমার আপত্তি কোথায়। এই স্বভাবের জন্যেই ওকে আমার অপছন্দ। হিংস্র বাঘের মতো মেজাজ ওর। স্বার্থ উদ্ধারে বাধা হয়ে দাঁড়ালে আপনজনকে হত্যা করতেও দ্বিধা করবে না, প্রয়োজনে তোমাকেও ছাড়বে না সে।
চমকে উঠল গুন্টার, অস্বস্তির সঙ্গে সামান্থার দিকে তাকাল। কী বাজে বকছ?
বাজে বকছি না, মামা। সত্যি কথা বলছি। ওই সুদর্শন লোকটার আসল চেহারা আমি চিনি। ওর মতো স্বার্থপর লোক আর দুটি পাবে না। নাহ্, মানতেই হয়, চমৎকার সব সঙ্গীসাথী বেছে নিয়েছ তুমি। ঘুরে দাঁড়াল সামান্থা। ক্যাপ্টেন পল কেড্রিকের খোঁজ পেলে আমাকে জানিয়ে, ঠিক আছে?
ঘরে চলে গেল সামান্থা।
ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে রইল গুন্টার। তিক্ত কণ্ঠে বিড়বিড় করে কী যেন বলল। একেবারে মায়ের স্বভাব পেয়েছে মেয়েটা! সত্যি কথাটা কীভাবে যেন জেনে ফেলে। এবারও ভুল হয় নি। পুরো ব্যাপারটা ধীরে ধীরে কুৎসিত চেহারা নিতে শুরু করেছে। কীথের চেয়ে বারউইকের ওপরই বেশি অসন্তুষ্ট গুন্টার। অদ্ভুত, স্থূলদেহী ওই নোংরা লোকটা যেন মূর্তিমান পিশাচ, ওর হাবভাবে কোথায় যেন একটা অস্বাভাবিকতা রয়েছে, দেখলেই সাপের কথা মনে পড়ে।
.
পল কেড্রিকের আকস্মিক অন্তর্ধান শুধু সামন্থী ফক্সকেই চিন্তায় ফেলে দেয় নি।
শহর প্রতিরক্ষা দলের অঘোষিত নেতা বব ম্যাকলেনন ইয়েলো বাটের সীমান্তে জীর্ণ র্যাঞ্চ হাউসে পিটার সেগাল, বার্ট উললিয়ামস, ডাই রীড এবং পিটলেইনের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে। মু। লেইনও আছে সভায়। একটু পেছনে বসেছে সে। কালো চোখে দেখছে সবাইকে, প্রতিটি শব্দ গিলছে।
অবাক কাণ্ড! বিরক্তির সঙ্গে বলল ম্যাকলেনন। লোকটা গেল কোথায়? কসম খেদার, নিজের চোখে ওকে বক্স ক্যানিয়নে ঢুকতে দেখেছি। ওদিক দিয়ে বেরোনোর কোনও রাস্তা নেই। আকাশে উড়ে গিয়ে না থাকলে ক্যানিয়নেই তাকে পাওয়া যাওয়ার কথা!
নিজেই তো দেখলে, শুকনো গলায় বলল সেগাল নেই! স্রেফ হাওয়া হয়ে গেছে।
সেটা অসম্ভব নয়, মন্তব্য করল ডাই রীড। পল কেড্রিক ক্ষিপ্র লোক, হাত মাথা দুটোই সমান চলে, পাইপ বের করে আস্তে আস্তে তামাক ভরতে শুরু করল সে। ওর ওপর হামলা চালানো ঠিক হয় নি, বলে চলল, রীভ, ওকে আমি চিনি, ভালো ছেলে। আমাদের সম্পর্কে জানতে এখানে এসেছে বলে থাকলে, মিথ্যে বলে নি। বাজি রেখে বলতে পারি রবার্টসের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ও কিছুই জানত না।
বিশ্বাস করতে পারলে ভালো হত, বলল ম্যাকলেনন। ওকে আমার ভালো লেগেছে। শত্রুপক্ষে একজন ভালো লোক থাকলে আমাদেরই সুবিধে। অন্তত কিছুটা হলেও ঝামেলা কমত, এ-সবের অবসানও ঘটতে পারত।
কিন্তু এখন ডরনি শকে ঠেকানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ব্যাটা আস্ত শয়তান, বলল সেগাল, শেয়াল যেমন মুরগী মারে তেমনিভাবে মানুষ খুন করে ও।
কেড্রিক সেদিন ন্যায়সঙ্গতভাবেই লড়েছিল আমার সঙ্গে, বলল বার্ট উইলিয়ামস। ওর ওপর আমার কোনও রাগ নেই।
বললাম তো, কেড্রিক ভালো ছেলে, বলল ডাই রীড়। ছেলেবেলা থেকে ওকে চিনি। আমার অন্তত ভুল হতে পারে না। ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি। যে ওর খোঁজ দিতে পারবে, পঞ্চাশ একর জমি দেব তাকে!
.
ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে হামলা হলো। চোখের পলকে আক্রমণ চালাল ওরা। গিরিখাদের মুখ থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এল অশ্বারোহীদের দল, ইয়েলো বাটের ধূলি-ধূসর রাস্তায় পৌঁছেই এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু, করল। সেই সাথে ডিনামাইট বিস্ফোরণের প্রচণ্ড আওয়াজে কানে তালা লাগল। তারপর আচমকা, যেমনি এসেছিল, তেমনি চলে গেল ওরা। দেখা গেল দুজন লোক পড়ে আছে রাস্তায়।
মাস্ট্যাংয়ের রাস্তায় পিটার্সকে হুমকি দিয়েছিল ডরনি শ, সেই পিটার্স এদের একজন। তিনটে গুলি খেয়েছে বুকে, মাটিতে পড়ার আগেই মারা গেছে বেচারা। অপমানের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল পিটার্স। অশ্বারোহীদের মাঝে ডরনি শকে দেখেই অস্ত্র হাতে রাস্তায় নেমে এসেছিল, কিন্তু গুলি করার সুযোগ পায় নি।
অন্যজনের উরু আর বাহুতে গুলি লেগেছে, লোকটা সুইডিশ, মাত্র বছর দুএক হলো এখানে এসেছে।
যত্নের সঙ্গে হামলার পরিকল্পনা নিয়েছিল ওরা। পাহারাদারের অজান্তে গিরিখাদের মুখে পৌঁছে গেছে। এ-রকম সময়ে আক্রমণ হতে পারে কারও মাথায় আসে নি। অঘোরে ঘুমোচ্ছিল প্রহরী। হঠাৎ ধড়মড় করে জেগে ওঠে সে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের ঘায়ে জ্ঞান হারিয়েছে আবার। তবে ওর কপাল ভালো, গুরুতর কোনও আঘাত পায় নি।
দুটো ডিনামাইট বিস্ফোরিত হয়েছে ইয়েলো বাটে। একটা জেনারেল স্টোরে, দরজা আর বারান্দা উড়ে গেছে; অন্যটি ফেটেছে দুটো দালানের মাঝামাঝি জায়গায়, ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
প্রথম রাইফেলের আওয়াজ পেয়েই খাদ থেকে বেরিয়ে এল কেড্রিক। আগেই ঘোড়ার পিঠে জিন চাপিয়ে রেখেছিল। হঠাৎ পালানোর সুযোগ পেয়ে গেল! গোলাগুলির শব্দে ক্যানিয়নের মুখের পাহারাদাররা শহরের দিকে ছুটে গেছে। চট করে খাদ থেকে ঘোড়া বের করে ক্যানিয়নের মুখে চলে এল পল। শহরের ওদিকে বালির মেঘ দেখা যাচ্ছে। ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়ে ডানে বাঁক নিল ও, এগোল মেসার গা ঘেঁষে।
আবার মুক্ত বাতাসের ছোঁয়া লাগল গায়ে।
০৬. মাস্ট্যাংয়ে ফিরল না পল কেড্রিক
মাস্ট্যাংয়ে ফিরল না পল কেড্রিক। একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছে, সেটা সফল করতে হবে। উত্তর-পশ্চিমে বাঁক নিয়ে ইয়েলো বাট আর মাস্ট্যাংয়ের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে চলল। এখানকার অধিবাসীদের সম্পর্কে এত কথা উঠেছে যখন, ওদের আবাসস্থল নিজের চোখে দেখতে চায়, ও। জীবন যাপনের কায়দা দেখলে ওদের আসল পরিচয় স্পষ্ট হয়ে যাবে। সকালের কাঁচা রোদে আরামদায়ক উষ্ণতা। এগিয়ে চলল পল কেড্রিক। কিছুক্ষণ পর গতি কমিয়ে আনল ও, হাঁটিয়ে নিয়ে চলা অ্যাপলুসাকে। চারদিকে সতর্ক নজর বোলাচ্ছে।
এটা আর যাই হোক জলাভূমি নয়। অন্তত এই একটা ক্ষেত্রে কোম্পানি মিথ্যে তথ্য সরবরাহ করেছে। জায়গাটা জনবসতিহীন, এটাও সত্যের অপলাপমাত্র। অবশ্য স্কোয়াটাররা আদতেই বাজে লোক হলে, ওকে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। পুরো ব্যাপারটা ইতিমধ্যে বিরক্তি ধরিয়ে দিয়েছে; কিন্তু কোম্পানির কাছে ঠেকে আছে ও, কাজ ছাড়তে গেলে সব টাকা ফিরিয়ে দিতে হবে-এই মুহূর্তে এতগুলো টাকা জোগাড় করা রীতিমত অসম্ভব। তা ছাড়া, চিন্তাটা হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল, এখানে সামান্থা ফক্স আছে…।
কর্মময় জীবনে অসংখ্য মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পেয়েছে পল কেড্রিক, কিন্তু নির্দিষ্ট কারও প্রতি কখনও তেমন দুর্বলতা বোধ করে নি, অবশ্য তাদের মধ্যে সামান্থার মতো দীর্ঘাঙ্গী, প্রিয়দর্শিনী ছিল না কেউ। কোম্পানির জন্যে নয়, সামান্থাকে আরেকবার দেখবে বলেই মাস্ট্যাংয়ে ফিরে যাবে ও আরেকটা কারণ আছে, ওর নির্দেশ উপক্ষো করেছে উরনি শ, রবার্টসকে খুন করা হয়েছে, হামলা চালানো হয়েছে, ইয়েলো বাট শহরে; ওরা হয়তো ধরে নিয়েছে পল কেড্রিক বেঁচে নেই; ওদের ভুল ভেঙে দিতে হবে।
উত্তরে ঘোড়া ঘোরাল কেড্রিক, সেঝোঁপ আর ক্যাট-ক্ল গাছের মাঝে পথ করে আকাশ-ছোঁয়া জোড়া নীল-পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলল। উত্তরে এই এলাকাটিকে দেয়ালের মতো ঘিরে রেখেছে রিম-দেয়ালের এপাশে ওগুলো ছাড়া আর কোন পাহাড় নেই। বাঁ দিকে এবড়োখেবড়ো প্রান্তর, একটা গভীর ক্যানিয়নও আছে। অ্যাপলুসাকে ঘুরিয়ে ক্যানিয়নের দিকে এগোল কেড্রিক। আচমকা লাগাম টেনে ধরল, দাঁড়িয়ে পড়ল ঘোড়াটা।
সামনে মাটিতে একটা ছুটন্ত ঘোড়ার ট্র্যাক্ট দেখা যাচ্ছে। এই ছাপ কেড্রিকের চেনা।
ইয়েলো বাটে যাবার সময় পথে একজন অজ্ঞাত ঘোড়সওয়ার ওদের ওপর নজর রাখছিল। এটা তারই গ্ৰল মন্টংয়ের ট্র্যাক। ঘোড়াটা এদিকে গেছে বেশিক্ষণ হয়নি।
এবার আরও ধীর গতিতে এগোল কেড্রিক। ক্যানিয়নে ঢুকে অন্য দিকে বেরিয়ে এল। সামনে, ঘাসে ছাওয়া. বিরাট মাঠ, ক্ষুদে একটা ঝর্না বয়ে যাচ্ছে মাঠের বুক চিরে। দূরে এক কোণে একটা পাথুরে কুটির। এ-তল্লাটের অন্যান্য ঘর-বাড়ির তুলনায় সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। সামনে ট্রেইল দেখে সময় নষ্ট করল না কেড্রিক, ঘোড়া নিয়ে মাঠের ওপর দিয়ে কুটিরের দিকে এগিয়ে গেল।
স্যান্ডস্টোন ব্লকের দেয়াল আর শনের ছাউনি দেয়া, কুটিরটা দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। উঠোনে ছায়া বিলোচ্ছে শেড গাছ। ছ-সাতটা মুরগী আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, খাবার খুঁটে খাচ্ছে। করালে কয়েকটা ঘোড়া আছে। জিন চাপানো গ্রাটা চোখে পড়তেই ধক করে উঠল বুকটা। কারও জন্যে যেন অপেক্ষা করছে ওটা।
কুটিরের দরজার সামনে রাশ টেনে ঘোড়া থামাল প্রল কেড্রিক, স্যাডল থেকে নামল, লাগামটা জড়িয়ে দিল পয়েলের সঙ্গে। এই সময় হঠাৎ দরজা খুলে কড়াই হাতে একটা মেয়ে বেরিয়ে এল। কেড্রিককে দেখে চমকে উঠল সে! মুহূর্তে তাকে চিনতে পারল পল। স্যু লেইন, এর সাথেই ট্রেইলে দেখা হয়েছিল। ডরনি শ নাকি এই মেয়েটার প্রতি দুর্বল।
তুমি! কেড্রিকের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ঢোক গিলল স্যু লেইন! তুমি না মারা গেছ?
কাঁধ ঝাঁকাল কেড্রিক। মারা যাই নি, খিদেয় কাহিল। খাওয়ার কিছু আছে?
ঝাড়া এক মিনিট ওর দিকে চেয়ে রইল স্যু লেইন, তারপর মাথা দোলাল। এসো, ভেতরে এসো। ঘোড়াটা বেঁধে রাখো, নইলে সোজা মাঠে চলে যাবে। তোমার আবার, শুকনো শোনাল ওর কণ্ঠস্বর, যে কোনও মুহূর্তে ওটার দরকার হতে পারে। জায়গাটা তোমার জন্যে নিরাপদ নয়।
মাস্ট্যাংয়ের পাশেই অ্যাপলুসাকে বাঁধল কেড্রিক, তারপর স্যু লেইনের পিছু পিছু ঘরে ঢুকল। তাই নাকি? বলল ও, আমার তো ধারণা ছিল কোম্পানির সঙ্গে তোমার ঠিক বিরোধ নেই।
এসব কথা বলে না! ধমকে উঠলস্যু লেইন। কক্ষনো না! গলা নামাল সে, তারপর আবার বলল, এখানে অন্তত নয়। ভাইয়ের কানে গেলে…!
তার মানে বোনের সঙ্গে পিট লেইনের বনিবনা নেই? কৌতূহলের বিষয়। হাতে মুখে পানি ছিটিয়ে চুল আঁচড়ে নিল কেড্রিক।
বিরক্তির সঙ্গে খোঁচা খোঁচা দাড়ি ভরা গাল চুলকাল ও। তোমার ভাইয়ের ক্ষুর আছে? এভাবে থাকতে আর ভালো লাগছে না।
জবাব না দিয়ে ক্ষুর এনে দিল স্যু লেইন। শেভ করে হাত মুখ ধুয়ে আবার ঘরে ঢুকল কেড্রিক। পরিপাটি করে সাজানো কামরা; একটা সাইড টেবিলের ওপর কয়েকটা বই সাজিয়ে রাখা, নকশা তোলা পর্দা ঝুলছে জানালায়, গোটাকতক তামার বাসন দেয়ালে ঝুলিয়ে ঘরের সৌন্দর্য বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল পল কেড্রিক। প্লেটে খাবার বেড়ে দিল স্যু লেইন। গরুর মাংস, ডিম, রুটি আর মধু।
গরু খোঁজা খুঁজছে তোমাকে সবাই, বলল স্যু লেইন, আচ্ছা, ছিলে কোথায়?
স্যু লেইনের বক্তব্যের প্রথম অংশ বিশ্বাস করল কেড্রিক, প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল।
রবার্টস খুন হওয়ার পর ইয়েলো বাট থেকে পালানো ছাড়া উপায় ছিল। লুকিয়ে ছিলাম। পরের ঘটনা কী?
শেষবারের মতো নোটিস দিয়েছে কর্নেল কীথ। ভালোয় ভালোয় আমরা সরে না গেলে শক্তি প্রয়োগ করা হবে। কীথের কথা মানতে অস্বীকার করেছে বব ম্যাকলেনন।
ঠিক করেছে।
ঝট করে কেড্রিকের দিকে তাকাল স্যু লেইন, দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা। তুমি একথা বলছ? তুমি না কোম্পানির লোক?
খাবার থেকে মুখ তুলে স্যু লেইনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল ক্যাপ্টেন কেড্রিক। কোম্পানির লোক হই আর যা হই খুন-খারাবীতে আমার মত নেই। মানুষকে তার ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করারও পক্ষপাতি নই আমি।
এমনিতেই তো ওখানে থাকতে পারবে না ওরা। জায়গাটাকে সরকার। ইন্ডিয়ান রিজারভেশন, ঘোষণা করলে সবাইকে জোর করে সরিয়ে দেয়া হবে। খামোকা, বোকার মতো লড়ছে।
কিন্তু তখন সরকার জমির বিনিময়ে টাকা দেবে, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে।সে যা হোক, কোম্পানি অনেক তথ্য গোপন করেছে-মিথ্যে বলেছে; আমাদের কাছে, সরকারের কাছে তো বটেই।
কেড্রিকের সামনে এসে বসল স্যু লেইন তাতে কী? শেষ পর্যন্ত ওরাই জিতবে। টাকা, প্রভাব, ক্ষমতা-কী নেই ওদের? আর সেটলারদের কী আছে? ঘোড়ার ডিম! তিক্ত চেহারায় কামরার চারদিকে চোখ বোলাল মেয়েটা। হয়তো ভাবছ, আপন লোকদের বিরোধিতা করছি আমি; তা ঠিক নয়। আসলে এদের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা দুভাই-বোন এখানকার মানুষ নই, হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু পিট সেটা বোঝে না! আচ্ছা, তুমিই বলো, এই কাঠখোট্টা একটা জায়গায় সারা জীবন খেটে মরতে হবে, এটা সম্ভব?
কেড্রিকের দিকে ঝুঁকে এল, স্যু লেইন। শোনো, ক্যাপ্টেন কেড্রিক। তুমি আসলে কীথদেরই একজন। ডরনি শয়ের মতো নগণ্য, ভাড়াটে গানম্যান নও। আশপাশের লোকদের বশ করার মতো ক্ষমতা তোমার আছে। কীথকে সামলানোও তোমার জন্যে কঠিন হবে না। দেখো, ইচ্ছে করলেই কিন্তু বিরাট কিছু হতে পারো তুমি?
বোকামি করছ কেন তা হলে? কী লাভ ওসব কথা ভেবে? এইসব রাখাল আর চাষার দলের কাছে তোমাকে দেয়ার মতো কিছু নেই। নিজেরাই দুবেলা খেতে পায় না, তোমাকে দেবে কোত্থেকে? তার চেয়ে কোম্পানির সঙ্গে থাকো, শেষ পর্যন্ত কোম্পানিই জিতবে; তোমার ভাগেও লাভের অংশ পড়বে। বোকামি করো না, ক্যাপ্টেন-কোম্পানিতে থেকে ওদের হয়ে কাজ করে যাও।
টাকাই সব নয়, বলল পল কেড্রিক, আত্মসম্মান বলে একটা কথা আছে।
চোখ বড় করে ওর দিকে তাকাল সু লিইন। এসব কথা মন থেকে বিশ্বাস কর না নিশ্চয়ই? তোমার ওই আত্মসম্মান নামক বস্তুটি দিয়ে দোকানে গিয়ে একবার খাবার, কেনার চেষ্টা করো। এক দানা গমও পাবে না। কিন্তু কথা তা নয়। তুমি কী করবে সেটা তোমার ইচ্ছে। কিন্তু আমি এমন একজন পুরুষকে চাই যার আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতা আছে। চট করে উঠে দাঁড়াল স্যু লেইন, টেবিল ঘুরে কেড্রিকের কাছে এল। ক্যাপ্টেন, তুমি পারো না? ইচ্ছে করলেই তো এখানে বিরাট কিছু হতে পারো, তাই না?
স্যু লেইনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল পল কেড্রিক। তোমার নজর অনেক ওপরে মনে হচ্ছে?
হবে না কেন? একটা সাধারণ র্যাঞ্চারের বউ হয়ে জীবন যাপন করতে চাই না আমি। এখান থেকে দূরে কোথাও যেতে চাই, উপভোগ করতে চাই জীবনকে। কেড্রিকের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকাল স্যু লেইন। একটু বুদ্ধি খাটালেই গুন্টার বা কীথ এমনকি বারউইককেও পথ থেকে সরিয়ে দিতে পারবে। অবশ্য বারউইকের সঙ্গে পেরে ওঠা একটু কঠিন হরে; কিন্তু অসুবিধে নেই, আমি উপায় বাতলে দেব।
তুমি? মাথা তুলে তাকাল কেড্রিক। ওর একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা, তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। স্যু লেইন, অস্বীকার করার জো নেই, সুন্দরী এবং আকর্ষণীয়। রীতিমত অস্বস্তিতে পড়ে গ্লেল: কেড্রিক। ওর অবস্থা বুঝতে অসুবিধে হলো না সু, লেইনের। তা শুনি, কীভাবে?
মাথা নাড়ল স্যু লেইন। উঁহু, আগে বলো তুমি আমার দলে, তারপর বলব। তবে মনে রেখো, জন গুন্টার একটা নিরেট গর্দভ। টাকার দরকার ছিল বারউইকদের, গুন্টার সামান্থার টাকা পয়সার হিসেব রাখে, তাই দলে টেনে নিয়েছে। কীথ বিপজ্জনক লোক, অনেক বড় হওয়ার ইচ্ছে তার অন্তরে দয়া মায়ার বালাই নেই। কিন্তু আসল চীজ হলো বারউইক, ঝামেলা মিটে যাবার পর সবার ওপর মাথা তুলে দাঁড়াবে সে, নিশ্চিত থাকতে পারো। ভেবে-চিন্তে, হিসেব করে কাজ করে।
অনেক খবর রাখো দেখছি।
হ্যাঁ! লোকেরা আমায় পছন্দ করে, আমাকে খুশি করার জন্যে নানান কথা শোনায় তারা, আমিও প্যাঁচ কষে, অনেক কথা বের করে নিই-ওরা বুঝতে পারে না। এবং কিছুই আমি ভুলি না।
আমাকে সব বলে দিচ্ছ যে?
কারণ তুমি ছাড়া আর কাউকে দিয়ে কাজ হবে না। ওদের সবকটাকে লাইনে রাখা একমাত্র তোমার পক্ষেই সম্ভব। ডরনি শও তোমার নির্দেশ মানতে বাধ্য হবে-যদিও ও তোমাকে বিশ্বাস করে না।
বিশ্বাস করে না? কেন?
ডাই রীডকে তোমার কামরা থেকে বের হতে দেখেছে ডরনি, তোমার ওপর নজর রাখছিল সে।
আচ্ছা, এই ব্যাপার?
কিন্তু ওর ওপর নজর রাখতে গেল কেন ডরনি? কী ভাবছে লোকটা? ডাই রীডের সঙ্গে ওর সাক্ষাতের কথা কীথকে জানিয়েছে?
খাওয়া শেষ করে সিগারেট ধরাল ক্যাপ্টেন কেড্রিক। ট্রেইলে প্রথম দেখার পর থেকেই এই মেয়েটা ওকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। এ-রকম একটা মেয়ে এমন হীন স্বার্থপর বিশ্বাসঘাতক হতে পারে বিশ্বাসই হতে চায় না। হালকা পাতলা সুনয়না কিশোরীর মতো মেয়েটিকে দেখলে কে বলবে পেটে পেটে এত প্যাঁচ তার!
বোঝা যাচ্ছে স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিশেবে ওকে বেছে নিয়েছে মেয়েটা। আরও কতজনকে এইভাবে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করেছে কে জানে?
আচ্ছা, তোমার ভাইটিকে দেখছি না যে? বাড়ি নেই? জিজ্ঞেস করল পল কেড্রিক।
সতর্ক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল স্যু লেইন। ওর সঙ্গে দেখা করার কিংবা কথা বলার দরকার নেই তোমার। তুমি এবার যাও।
কিন্তু, আমি সত্যিই পিটের সঙ্গে আলাপ করতে চাই, সু। ছেলেটার কথা অনেক শুনেছি, পরিচিত হতে ইচ্ছে করছে।
তুমি যাও, সতর্ক করে দিল স্যু লেইন। একটু পরেই, পিট ফিরে আসবে, ইয়েলো বাটের লোকজনও থাকবে ওর সঙ্গে!
তার মানে ও নেই? তা হলে বাইরে ঘোড়াটা কার? ওই গুলা মাস্ট্যাংটার কথা বলছি।
চোখের পলকে বদলে গেল স্যু লেইনের চেহারা, মাথা নাড়ল। আমাকে মিথ্যেবাদী ভাবতে পারো, কিন্তু সত্যি বলছি, জানি না। ওটার আরোহীকে আমি কখনও দেখি নি।
স্যু লেইনের চোখের দিকে তাকাল পল কেড্রিক। মেয়েটা বোধ হয় সত্যি কথাই বলছে। দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে একটু যেন ভয় পেয়েছে সে। ঘোড়াটা একজন বেঁধে রেখে গেল আর তাকে দেখলে না?
ঠিক। পিট বেরিয়ে যাবার খানিক পর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি ঠিক ওইখানে দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়াটা। এবারই কিন্তু প্রথম নয়। আগেও দুবার এখানে এসেছে ওটা। কোনওবারই পিট ঘরে ছিল না। এখানে আরও অনেকে দেখেছে ওই ঘোড়া। ঘরে পুরুষ মানুষ না থাকলেই কেবল ওকে দেখা যায়। মিসেস বার্ট উইলিয়ামস বলেছে একদিন প্রায় তিন ঘণ্টা ওদের করালে ছিল গ্রাটা।
ঘোড়াটা ফেরত নেবার সময়ও কেউ দেখে নি মালিককে? তা কী করে হয়?
অথচ তা-ই হচ্ছে। এখন যেমন দাঁড়িয়ে আছে, তেমনি দাঁড়িয়ে-ইয়াল্লা, ওটা চলে গেছে!
চমকে উঠে দাঁড়াল পল কেড্রিক, দরজা দিয়ে বাইরে তাকাল। স্যু লেইনের কথা সত্যি প্রমাণ করে বাতাসে মিলিয়ে গেছে ইঁদুর-রঙা ঘোড়াটা। ওর অ্যাপলুসা আগের মতোই, ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, এটা নেই।
উঠোনে এসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাল ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। কিন্তু সমভূমি বা পাহাড়ের গায়ে কোনওরকম নড়াচড়া চোখে পড়ল না। সত্যি মিলিয়ে গেছে ঘোড়াটা স্যুর দিকে ফিরল ও, হতভম্ব চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। অ্যাপলুসার দিকে পা বাড়াল পল। স্যাডলের সঙ্গে পিন দিয়ে একটা কাগজ সাটা রয়েছে। খুলে নিয়ে পড়ল ও। কাছে এসে দাঁড়াল স্যু লেইন, কাগজটা তার হাতে তুলে দিল।
দূরে থাকো!
কাঁধ ঝাঁকাল কেড্রিক। তোমার ভাইয়ের কাজ?
না! ঘোড়ার কথা আমার কাছেই শুনেছে ও, আমার চেয়ে বেশি কিছু জানে। তা ছাড়া, এটা ওর লেখা নয়, পিট লেখাপড়া জানে না, লিখবে কীভাবে?
ম্যালপাই ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার পরেও অনেকক্ষণ অদ্ভুত ঘোড়াটা নিয়ে মাথা ঘামাল পল কেড্রিক। কেউ একজন পরিকল্পিতভাবে স্কোয়াটারদের বিভ্রান্তিতে ফেলে আতঙ্কিত করে তোলার চেষ্টা করছে। কোম্পানির এমন কিছু করার কথা নয়; এমন, কেউ করছে কাজটা যার হাতে অপচয় করার মতো অঢেল সময় আছে।
উত্তরে ব্লু হিলের উদ্দেশে ঘোড়া ঘুরিয়ে এগোল কেড্রিক, তারপর পুবে বাঁক নিয়ে ওল্ড মরমন ট্রেইল পেছনে ফেলে রিম ঘেঁষে এগিয়ে চলল।
চারদিকে ঘাসে ছাওয়া ময়দান। যেদিকে তাকাও, ঘাস আর ঘাস এরকম জায়গায় নির্ঝঞ্ঝাটে বড়সড় একটা গরুর পাল চরানো সম্ভব-সবুজ সতেজ ঘাস খেয়ে অল্পদিনেই তাগড়া হয়ে উঠবে ওগুলো। রিম, আছে বলে গরু সামলানোর কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। রিমই প্রাকৃতিক বেড়ার কাজ করবে, গরু, বাছুর হারিয়ে যাবার আশঙ্কা থাকবে না।
সল্ট ক্রিক লেকে পৌঁছে ক্রিক ধরে নদীর এদিকে এগোল কেড্রিক, কিছুক্ষণ পর আবার পুবে বাঁক নিল, চিমনি রকে এসে ওটাকে পেছনে ফেলে দক্ষিণ-পুবে হগব্যাক ট্রেইল পর্যন্ত একনাগাড়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে চলল; তারপর রিজ পেরিয়ে মাস্ট্যাংয়ের উদ্দেশে পুব দিকে পূর্ণ গতিতে ছুটল।
বরাবরের মতো সতর্ক সজাগ দৃষ্টি ওর। কখনও কখনও হয়তো নিংর, কঠিন, তবু এদেশকে ভালোবাসে ও এখানকার নীল-আকাশ আর পাহাড়-পর্ত, দূরান্তের কুয়াশা; এদেশের সকাল-সন্ধ্যার মায়াবী পরিবেশ, সবুজ ঝোঁপঝাড় আর রক্তের মতো লাল চুনাপাথরের টিলা-সবই ওর ভালোবাসার সম্পদ।
কিছুতেই মনস্থির করতে পারছে না পল কেড্রিক। গুন্টারের কাছে ওর দেনা সিন্দাবাদের বুড়োর মতো ঘাড়ে চেপে আছে; তা ছাড়া আরও কিছু ব্যাপার রয়েছে। ঝামেলায় জড়াতে চায় না ও, কিন্তু এখন কাজ ছাড়তে গেলে ঝামেলা হবে এবং তারপর এখানে থাকলে আরও মুশকিল; অথচ সেরকমই ওর ইচ্ছে। কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করে চাকরিটা ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করা। যায়, কিন্তু তাতে লাভ হবে না, জানা কথা।
কিন্তু এখানে সামান্থা ফক্সের ভূমিকা কী? ও যা ভাবছে, তার চেয়েও গম্ভীরভাবে জড়িয়ে আছে? নাকি ব্যাপারটা খুবই সাধারণ: শুধু ওর টাকাটা মামা ব্যবসায় খাটিয়েছে? তেমন হলে এই অবস্থায় সুযোগ পেলেও সরে দাড়ানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
বারউইক এখনও দুর্বোধ্য রয়ে গেছে ওর কাছে। লোকটার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অসীম। কিন্তু ওই ক্ষমতার উৎস কোথায় বোঝার উপায় নেই। দেখলে একেবারে সাধারণ মনে হলেও এটা তার আসল চেহারা নয়। পরিষ্কার বোঝা যায়, কীথ বা গুন্টার তাকে সমীহ করে চলে।
স্যু, লেইনের সঙ্গে কথা বলার সময় ইয়েলো বাট মেসার কাছে ওর আত্মগোপনের জায়গার কথা এড়িয়ে গেছে কেড্রিক। মেয়েটা এমনিতেই এমন কিছু কথা জেনে গেছে, যা বিপদ ডেকে আনতে পারে। তা ছাড়া, জায়গাটা যে, কোনও সময় আবার কাজে লাগতে পারে। সুতরাং ওটার কথা গোপন রাখাই ভালো।
কেড্রিক যখন মাস্ট্যাংয়ে পৌঁছুল, পুরো শহর ঘুমে বিভোর। সোজা আস্তাবলের দিকে এগিয়ে গেল ও। ঘোড়াকে একটা স্টলে রেখে জিন-লাগাম। খুলে ভালো করে দলাইমলাই করল, ছোলা আর খড় খেতে দিল। তারপর আস্তাবল থেকে বেরিয়ে নিঃসাড়ে সেইন্ট জেস-এর উদ্দেশে এগোল। হোটেলের কাছে আসতেই বারান্দার চেয়ারে বসা লম্বা একহারা গড়নের এক লোক উঠে দাঁড়াল। সেদিন এই চেয়ারেই বসেছিল কেড্রিক। শারীরিক গঠন, মাথার চওড়া ব্রীমের টুপি আর পিস্তল ঝোলানোর কায়দা দেখে লরেডো শ্যাডকে চিনতে পারল কেড্রিক।
ক্যাপন? চাপা কণ্ঠস্বর। ভালো আছ?
হ্যাঁ। তুমি?
হাসল শ্যাড। আমার কথা ভাবতে হবে না। আমি সুস্থ! ইঙ্গিতে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিল লরেছো শ্যাড। বসো। তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। জানতাম ফিরে আসবে।
অন্যরা কী বলছে? কী ভারছে ওরা, আমি পটল তুলৈছি নাকি পালিয়েছি?
কেউ এটা, কেউ ওটা। এদিকে কীথের তো পাগল হওয়ার দশা। তুমি ফেরামাত্র দেখা করতে বলে দিয়েছে-রাত দুপুরে হলেও।
এখন পারর না। অসম্ভব ক্লান্ত।
মাথা দোলাল শ্যাড, তারপর নিভে যাওয়া সিগারেটটা ধরাল। বুঝলে ক্যাপন, ব্যাপারস্যাপার এখন আর সুবিধের মনে হচ্ছে না আমার কাছে।
মাথা ঝাঁকাল কেড্রিক। বুঝতে পারছি কী বলছ। মানুষকে ঘর বাড়ি থেকে উৎখাত করার মতো পিশাচ আমিও নই।
কাজ ছেড়ে দিচ্ছ?
এত তাড়াতাড়ি নয়। ওদের সঙ্গে আগে কথা বলে দেখি।
কী লাভ? রক্তের নেশায় পেয়েছে ওদের। ইয়েলো বাট-এর লোকটাকে পয়েনেসট হত্যা করেছে, কিন্তু উস্কানি দিয়েছে ডরনি, শ। পয়েন্সেট লোকটাকে খুন করার পর চার-পাঁচজন সুখ মিটিয়ে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে বেচারার লাশ। ফেসেনডেন অবশ্য গুলি করে নি, গফ করেছে কি না জানি না। তবে বাজি রাখতে পারো, আমার পিস্তল থেকে একটা গুলিও বেরোয় নি। পৈশাচিক ব্যাপার, ক্যাপন, জঘন্য।
এর জন্যে ওদের জবাবদিহি করতে হবে। ইয়েলো বাট হামলায় তুমি, ছিলে?
হ্যাঁ, ছিলাম। কিন্তু আমি গুলি ছুঁড়ি নি। আমি গির্জার পাদ্রী নই, ক্যাপন; কিন্তু যোদ্ধা, অসহায় লোকদের সঙ্গে লড়াই করার রুচি আমার নেই। আর এখনও এত পচে যাই নি যে, মেয়েমানুষ আর শিশুদের ওপর পিস্তল ছুঁড়ব।
এখন কী ভাবছে ওরা? নতুন কোনও পরিকল্পনা?
একটু ইতস্তত করল লরেডো শ্যাড; তারপর কাঁধ ঝাঁকাল। তার চেয়ে তুমি নিজেই ওদের সঙ্গে আলাপ করো, ক্যাপন। কিছু জানলেও অন্তত এই মুহূর্তে মুখ খুলতে চাই না আমি।
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল লরেডো শ্যাড। সিগারেট টানল দুজন। হঠাৎ অধৈর্যভাবে বাতাসে হাতের ঝাঁপটা মারল শ্যাড আমি গানম্যান, ক্যাপন, পিস্তল চালানোর জন্যেই আমাকৈ ভাড়া করেছে ওরা। কিন্তু এ রকম কিছু আশা করি নি আমি। বিপক্ষের কয়েকজনকে আমার কাছে আমাদের চেয়ে হাজার গুণ ভালো লোক বলে মনে হয়েছে। ভাবছি, কাজটা ছেড়ে দেব।
আহ্-হা, হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল পল কেড্রিক, তোমার কথা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি অন্য একটা উপায়ের কথা ভাবছি। বুঝিয়ে শুনিয়ে গুন্টারদের যদি ক্ষান্ত করতে না পারি, দল পাল্টে বিপক্ষে চলে যাব।
শ্যাড মাথা দোলাল। এই কথাটা কিন্তু আমিও ভেবেছিলাম.।
হঠাৎ ঘাড় ফেরাল কেড্রিক। বড় জোর বিশ ফুট দূরে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে ডরনি শ। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল পল। লরেডো শ্যাডও দাঁড়িয়ে পড়ল। কেড্রিকের দৃষ্টি এড়িয়ে শ্যাডের দিকে তাকাল ডরনি শ।
সটকে পড়তে চাইলে আগে আমাকে খুন করতে হবে, শ্যাড, মনে রেখো।
প্রয়োজন হলে তাই করব, চট করে জবাব দিল শ্যাড। তোমাকে মারতে আমার হাত কাঁপবে না। এখনই নামতে চাও?
যথেষ্ট হয়েছে, শ্যাড! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল পল কেড্রিক। আগেও বলেছি, আবার বলছি, আমার দলে মারপিট চলবে না।
আস্তে আস্তে ঘাড় ফিরিয়ে কেড্রিকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল ডরনি শ। এখনও হুকুম দিচ্ছ, আঁ? এ-অবস্থা আর থাকবে না!
হয়তো, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল পল কেড্রিক। যাক গে, আমি এখন ঘরে যাচ্ছি।
কীথ কিন্তু তোমাকে ডেকেছে।
পরে। এখন আমি ক্লান্ত, তাছাড়া তাড়াহুড়োর কিছু নেই। যা বলার সকালেই বলব।
এই কথা তাকে জানাব?
তোমার মর্জি।
আবার হাসল শ। নিজের দেশে তুমি হয়তো বিরাট কিছু, কেড্রিক। কিন্তু ভুলে যেয়ো না এটা অন্য দেশ। কীথ খেপলে খারাপ হয়ে যাবে। বারউইকের বেলায়ও একই কথা খাটে।
আবার কাঁধ ঝাঁকাল কেড্রিক। ওদের চেয়েও খারাপ লোক আমার দেখা আছে। কিন্তু কাউকে খেপাচ্ছি না আমি। ঘুমোতে যাচ্ছি। কিছু বলার থাকলে সকালে অনেক সময় পাবে কীথ। আমি উঠে পড়ব ততক্ষণে।
চলে যাবে বলে পা বাড়াল ডরনি শ, একটু ইতস্তত করল, তারপর কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসল, তোমার কী হয়েছিল? আমরা তো ভেবেছিলাম মারা গেছ নয়তো ওদের হাতে ধরা পড়েছ।
হঠাৎ সন্দেহ জাগল কেড্রিকের মনে। এই জন্যেই কি ইয়েলো বাটের রবার্টসকে হত্যা করিয়েছে শ? ক্ষিপ্ত সেটলাররা ক্লেড্রিককে হত্যা করবে ধরে নিয়েছিল? খুবই সম্ভব।
বাদ দাও ওসব কথা, সহজ ভঙ্গিতে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল পল। এক জায়গায় গা ঢাকা দিয়েছিলাম আর কি!
ঘুরে হাঁটতে শুরু করল ডরনি শ। কিন্তু কয়েক কদম এগোনোর পরই হঠাৎ কথা বলে উঠল কেড্রিক। ভালো কথা, ডরনি, গ্রুলা মাস্ট্যাং হকায় এমন কাউকে চেনো?
জমে গেল ডরনি শ, কিন্তু ঘুরল না। ওর শরীর যেন পাথরের মূর্তি। এক মুহূর্ত পরেই আবার হাঁটতে শুরু করল সে। না! বলল রুক্ষ কণ্ঠে, চিনি না!
লরেডো শ্যাড তাকিয়ে রইল ওর দিকে। মনে রেখো পার্ডনার, ওই লোকটাকে তোমার একদিন খুন করতে হবে, নইলে নিজেই মারা পড়বে তুমি।
হুম, শান্ত কণ্ঠে বলল ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক, আমিও তাই ভাবছি।
০৭. ধূসর পাথুরে ভবনের অফিস-রুমে
ধূসর পাথুরে ভবনের অফিস-রুমে পা রাখল ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। ঘরময় পায়চারি করছিল কর্নেল লরেন কীথ; থমকে দাঁড়িয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। ডরনির কাছে শুনলাম মাঝরাতের পরই ফিরেছ তুমি। আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলাম, দেখা করো নি কেন?
আসলে, খুব ক্লান্ত ছিলাম আমি। তা ছাড়া, কীথের চোখে চোখ রাখল কেড্রিক, জরুরি কোনও খবরও আমার কাছে ছিল না।
একটা কাজের জন্যে তোমাকে ভাড়া করা হয়েছে, কিন্তু এখনও কিছুই করতে পারো নি তুমি। কোমরে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল কীথ। গিয়েছিলে কোন চুলোয়?
সংক্ষেপে পরিষ্কার করে ইয়েলো বাটের ঘটনা খুলে বলল কেড্রিক, তবে লুকোনোর জায়গা এবং স্যু লেইনের সঙ্গে দেখা করার কথা সযত্নে এড়িয়ে গেল। জায়গাটা নিজের চোখে দেখার পর, বলল পল, কেন যেন আমার মনে হচেছ ওখান থেকে ওদের উচ্ছেদ করা সহজ হবে না। গুন্টার আর তুমি সরকারকে তো বটেই আমাকেও মিথ্যে কথা বলেছ। চোর-ছ্যাচড় আর গুণ্ডা বদমাশের দল আদৌ আস্তানা গাড়ে নি ওখানে।ওরা সৎ এবং ভালো মানুষ। ওদের তাড়াতে গেলে অনেক ধকল পোহাতে হবে, টিকতে পারবে না।
অনুকম্পার হাসি দেখা দিল কর্নেল কীথের ঠোঁটে। ভয়ে কুঁকড়ে গেলে মনে হয়। তুমি নাকি লড়াকু লোক! আমাদের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছ, শোনো বলি, ওই ফালতু লোকগুলোকে একবার যখন তাড়াব ঠিক করেছি, তুমি সাহায্য করো বা না করো, যেভাবে হোক ওদের তাড়াবই। তোমাকে ভাড়া করার বুদ্ধিটা গুন্টারের মাথা থেকে বেরিয়েছিল-আমার নয়।
সত্যি কথা বলেছ, বারউইকের পিছু পিছু কামরায় ঢুকল জন গুন্টার। এক লহমায় কেড্রিক আর কীথকে জরিপ করে নিল ও। ইয়েলো বাট-এ গেছে বলে ওকে দোষারোপ করো না, আমিই যেতে বলেছিলাম।
ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে আসতে নিশ্চয়ই বলে দাও নি? ও এখন বলছে, আমাদেরকে নিয়ে, নাকি কাজটা হবে না!
এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল বারউইক; এবার ডেস্কের উল্টোদিকে গিয়ে প্রকাণ্ড চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। বড় করে শ্বাস টানল, ঘাম মুছল হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে; তারপর তীব্র দৃষ্টি হানল কেড্রিকের দিকে। কী জানতে পারলে, বলো?
ওরা যুদ্ধ করার জন্যে তৈরি হয়ে আছে। বব ম্যাকলেনন আর সেগালের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। ওদের মাঝে ভয়ের কোনও চিহ্ন নেই, বরং আছে প্রখর আত্মমর্যাদা বোধ; প্রয়োজনে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও লড়বে। যে কোনও পরিস্থিতির জন্যে তৈরি হয়ে আছে ওরা। তোমাদের হামলায় ওদের একজন লোক মারা গেছে, গুরুতর আহত হয়েছে একজন আর ডিনামাইট বিস্ফোরণে একটা দোকানের দরজা, বারান্দা উড়ে গেছে।
অগ্নিদৃষ্টিতে কীথের দিকে তাকাল অ্যাল্টন বারউইক। অথচ তুমি বলেছিলে তিনজন মারা গেছে, মাটির সঙ্গে মিশে গেছে একটা দালান। এবার থেকে নিশ্চিত হয়ে তারপর আমার কাছে রিপোর্ট করবে, ঠিক আছে? আবার কেড্রিকের দিকে তাকাল সে। হ্যাঁ, তারপর বলল, তোমার কী হয়েছিল, পালিয়েছিলে?
আমাকে এখানে দেখতে পাচ্ছ।
অনেকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল ওরা। বারউকের শীতল কঠিন দৃষ্টি যেন পলের অন্তস্তল পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে।
এখন এ-ব্যাপারে তোমার মতামত? অবশেষে জানতে চাইল বারউইক।
যুদ্ধ বাধলে, ভেবেচিন্তে জবাব দিল: কেড্রিক, ওয়াশিংটনে এর হাওয়া লাগবে। লিংকন কাউন্টি ওঅরের কথা নিশ্চয়ই তোমাদের মনে পড়ে? ওখানকার মতো এখানেও একজন জেনারেল এসে হাজির হবে। তারপর ওই জায়গা থেকে কত মুনাফা তোমাদের হাতে আসবে বুঝতেই পারছ।
প্রকাণ্ড মাথাটা দুলিয়ে সায় দিল বারউইক। নেহাত সত্যি কথা! সুতরাং আমাদের অন্য উপায়ের কথা ভাবতে হবে। এ লোকটা, আবার কীথ আর। গুন্টারের দিকে আগুনঝরা-দৃষ্টিতে তাকাল সে, অন্তত কাজের কথা বলতে পারে, নির্ভুল রিপোর্ট দেয়; ওর কাছ থেকে তোমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
কেড্রিকের দিকে তাকাল বারউইক। আর কিছু?
একটা কথা। ওদিকে সমভূমিতে একজন রহস্যময় ঘোড়সওয়ারের আনাগোনা চোখে পড়েছে আমার। ইঁদুর-রঙা একটা মাস্ট্যাং হাঁকিয়ে বেড়ায়। লোকটা একাই ওখানকার লোকজনকে আতঙ্কিত করে তুলেছে, তোমাদের তর্জন-গর্জনে কিন্তু কিছুই হয় নি!
তাই? নিরাবেগ কণ্ঠে বলল বারউইক। ডেস্কের কাগজপত্র নাড়াচাড়া করল কয়েক মুহূর্ত তারপর জিজ্ঞেস করল, শুনলাম, তুমি নাকি কাজ ছেড়ে দেবার কথা ভাবছ, সত্যি নাকি?
খুন-খারাবীতে জড়াতে চাই না আমি। ওরা মোটেই আউট-ল নয়, নিরপরাধ শান্তিপ্রিয় মানুষ। আমার পরামর্শ: ওদের কাছ থেকে জায়গাটা কিনে নাও, নইলে ওরা যেভাবে আছে সেভাবেই থাকতে দাও।
তোমাকে আর মাতব্বরি ফলাতে হবে না! শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল লরেন কীর্থ। সিদ্ধান্ত যা নেয়ার আমরাই নেব!
আমার অনুমতি ছাড়া, নরম গলায় বলল বারউইক, কেউ এখন কাজ ছাড়তে পারবে না!
হঠাৎ হেসে উঠল পল কেড্রিক। তা হলে শিগগির অনুমতি দাও, এই মুহূর্তে কাজটা ছেড়ে দিলাম আমি।
পল! প্রতিবাদ করল গুন্টার। এসব কী বলছ।
কোম্পানির কাছে তোমার দেনার কী হবে? বিরক্তির সঙ্গে জিজ্ঞেস করল কর্নেল কীথ। ফেরত দেয়ার ক্ষমতা আছে?
তার দরকার নেই।
একসঙ্গে ঘাড় ফিরিয়ে বক্তার দিকে তাকাল, ওরা। দোরগোড়ায় সামান্থা ফক্স দাঁড়িয়ে। তোমাদের এই ব্যবসাতে আমার টাকাও খাটছে। টাকা নেয়ার সময় মামা বলেছিল এটা রিয়েল-এস্টেট ব্যবসা, কোনওরকম দুর্নীতি নেই। এতদিন মামা সৎ পথে ছিল বলে তার কথা বিশ্বাস করে খোঁজ-খবর ছাড়াই টাকা খাটানোর অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আসল কথা জানার পর আমার টাকা উঠিয়ে নেব ঠিক করেছি। ক্যাপ্টেন কেড্রিকের কাছে তোমাদের যা পাওনা, কেটে রেখে বাকি টাকা আমাকে ফিরিয়ে দাও। ক্যাপ্টেন তার সুবিধে মতো ওই টাকা ফিরিয়ে দেবে।
পাথর হয়ে গেল যেন সবাই। রক্ত সরে শাদা হয়ে গেছে জন গুন্টারের চেহারা। প্রথমে হতবাক, তারপর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল কর্নেল কীথ, প্রতিবাদ করতে গেল, কিন্তু তার আগেই গুন্টারের দিকে তাকিয়ে মুখ খুলল বারউইক।
তুমি- ধমকে উঠল সে, তুমি বলেছিলে টাকাগুলো তোমার। গর্দভ কোথাকার! এর মাঝে মেয়েমানুষকে টানতে গেলে কোন আক্কেলে? বেশ, ওকে তুমি জড়িয়েছ, এখন সামলাও! নইলে আমাকে হাত দিতে হবে।
এখন থেকে আমাকে কিংবা আমার কাজকর্ম নিয়ে আর কাউকে মাথা ঘামাতে হবে না, জবাব দিল সামান্থা। আমি নিজেই সব দেখাশোনা করব!
কেড্রিকের দিকে তাকাল ও। তোমার সিদ্ধান্তে আমি খুশি হয়েছি, ক্যাপ্টেন। আশা করি এর জন্যে তোমাকে আপসোস করত্বে হবে না।
সামান্থার পিছু পিছু কামরা থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়াল পল কেড্রিক, কিন্তু বারউইকের ডাকে থামতে হলো ওকে।
ক্যাপ্টেন!
ঘুরে দাঁড়াল পল কেড্রিক! কুৎসিত দৃষ্টি ফুটে উঠেছে কর্নেল কীথের চোখে। গুন্টারের চেহারায় অবিশ্বাস আর আতঙ্কের ছাপ।
ক্যাপ্টেন, কেড্রিক, বলল বারউইক, আমরা বোধ হয় একটু ধৈর্য হারা হয়ে পড়েছিলাম। যা হোক, এ-ব্যাপারে তোমার সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি আমার ভালো লেগেছে। ঠিকই বলেছ, ইয়েলো বাট থেকে ওদের উচ্ছেদ করতে গেলে ঝামেলা হবে এবং তাতে স্বভাবতই ওয়াশিংটনে নানা কথা উঠবে। ব্যাপারটা আমিও ভেবেছিলাম, কিন্তু ম্যাকলেনন সম্পর্কে জানা না থাকায় সম্ভাবনাটা ক্ষীণ বলে উড়িয়ে দিয়েছি।
সেগালকে আমি চিনি, আবার বলল সে। কিন্তু ম্যাকলেনন সম্পর্কে কিছুই জানি না। তোমার কথা শুনে, সর্বাত্মক হামলার পরিকল্পনা বাদ দিতে হচ্ছে। ভিন্ন উপায় খুঁজতে হবে আমাদের। আর হ্যাঁ, বলে চলল বারউইক। মিস ফক্সের ওপর তোমার মোটামুটি প্রভাব আছে বলে মনে হলো। এই মুহূর্তে আমরা কোনওরকম ব্যর্থতা সহ্য করতে পারব না, তাই তোমাকে একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। তুমি আমাদের কোম্পানিতে যোগ দিলে কেমন হয়? সাইলেন্ট পার্টনার হিসেবে?
ক্রোধে ঝলসে উঠল, কীথের চেহারা। কিন্তু গুন্টারের চোখে-মুখে প্রত্যাশার ছাপ পড়ল। বারউইক থামল না। লাভের শতকরা পনের ভাগ পাবে তুমি। প্রচুর টাকা! মিস ফক্সকে তুমি লাইনে রাখতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। তুমি যদি হাল ধরো, রক্তপাত ছাড়াই হয়তো সমস্যার একটা সমাধান বের করা সম্ভব হবে।
দ্বিধায় পড়ল পুল কেড্রিক। টাকার পরিমাণ প্রলুব্ধ করার মতো, সামান্থার কাছে দায়বদ্ধ হতে চায় না ও। কিন্তু, রক্তপাত ছাড়া কথাটাই বেশি আকৃষ্ট করল ওকে, সাবধান হতে ভুলে গেল।
রক্তপাত না হলে, বলল কেড্রিক, তোমার শর্তে আমি রাজি। কিন্তু তারপরও ব্যাপারটা নিয়ে একটু খোলাখুলি আলাপ করতে হবে।
পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল কর্নেল কীথ। এ-সবের কোনও অর্থ হয় না, বারউইক! তুমি খুব ভালো করে জানো, ওদের সরানোর একমাত্র রাস্তা সরাসরি পূর্ণশক্তিতে আক্রমণ। আগেও এ-নিয়ে কথা বলেছি আমরা। তা ছাড়া এই লোকটা মোটেই বিশ্বস্ত নয়। আমার কানে এসেছে, শত্রুপক্ষে ওর বন্ধু আছে; ওদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছে ও।
যত যোগাযোগ রাখবে তত ভালো, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কী যেন ভাবল বারউইক, হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছল। ওদিকে বন্ধু থাকায় কেড্রিক সহজেই একটা সমঝোতায় পৌঁছুতে পারবে! হঠাৎ হেসে উঠল সে। তোমরা দুজন একটু বাইরে যাও তো, ক্যাপ্টেন কেড্রিকের সঙ্গে একা কিছু কথা বলতে চাই।
.
কয়েক ঘণ্টা পর, রাস্তায় দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ বোলাচ্ছে পল কেড্রিক। বারউইক আশাতীত ভালোমানুষির পরিচয় দিয়েছে। বিশ্বাসভাজন না হলেও, ওদের কাছ থেকে জমি কেনার ব্যাপারে অন্তত লোকটার আপত্তি আছে বলে মনে হয় নি। কয়েকজনকে জমি বিক্রি করায় রাজি করানো গেলে অন্যরাও শেষ পর্যন্ত আপত্তি তুলবে না। সরকার হস্তক্ষেপ করলে জায়গাটা ওদের এমনিতেই ছাড়তে হবে। ম্যাকলেনন আর সেগালকে রাজি করিয়ে শান্ত করতে পারলে নেতৃত্বের অভাবে লড়াইয়ের উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে সেটলাররা। লড়াই না হলে রক্তপাতের প্রশ্নই ওঠে না। বরঞ্চ সেটলাররা জমির বিনিময়ে বেশ কিছু টাকা পাবে।
লোকজনের ভিড় এড়িয়ে রাস্তা ধরে এগোল কেড্রিক। বিরক্তি বোধ করছে। বারউইক কুটিল চরিত্রের লোক, কিন্তু বাস্তব বুদ্ধি আছে তার। বুঝতে পেরেছে, জমি কেনার আগ মুহূর্তে একাধিক হত্যাকাণ্ড মহাশোরগোলের সৃষ্টি করবে, ফলে ওদের পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যাবে। সাময়িকভাবে হলেও ঝামেলা ঠেকানো গেছে। সামান্থার ধারণা, এবার একটা সমাধান বের করা। সম্ভব হবে। ম্যাকলেনন আর সেগালের সঙ্গে আলাপ করার জন্যে কাল আবার ফিরে যাবার কথা ভাবছে পল কেড্রিক। একজন নিরপেক্ষ লোক মারফত রাতের মধ্যেই খবর পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে।
শহরে আসতে রাজি হবে না ওরা, ওর সঙ্গে একমত হয়েছে বারউইক। তো, এক কাজ করো, মাঝামাঝি কোথাও একটা জায়গা বেছে নাও? ল্যারগো ক্যানিয়ন কিংবা চিমনি রকে ওদের সঙ্গে দেখা করলে কেমন হয়? আমিও না হয় যাব তোমার সঙ্গে আমরা দুজন বব ম্যাকলেনন আর পিটার সেগালের সঙ্গে আলোচনা করে নিশ্চয়ই একটা অপসরফায় পৌঁছুতে পারব, কী বলে? অন্তত চেষ্টা করতে তো দোষ নেই?
শান্তি ফিরিয়ে আনার এই সম্ভাবনাই রাজি হতে বাধ্য করেছে কেড্রিককে। সামান্থার কাছ থেকে সম্মতি আদায় করেছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে ওর ব্যাখ্যা মন দিয়ে শুনেছে সামান্থা, তারপর সরাসরি ওর দিকে তাকিয়ে বলেছে, তবে ওদের কথায় তুমি আস্থা রাখতে পারছ না, তাই না, ক্যাপ্টেন? আমিও ওদের বিশ্বাস করি না। জন মামা কোনওদিন এমন ছিল না আমার মনে হয় নিজের অজান্তে ওদের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে ও। যাকগে, বারউইক যদি আলোচনা করতে চায়, আপত্তি করার কারণ দেখি না। আমি তোমার পক্ষে। আশা করি আলোচনা থেকে লড়াই এড়ানোর একটা উপায় বেরিয়ে আসবে।
কিন্তু এখন বিভিন্ন দিক থেকে পরিস্থিতি বিচার করে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছে না কেড্রিক। সবকিছু যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
ম্যাকলেনন আর সেগালের নেতৃত্বে ইয়েলো বাটবাসীরা শহর এবং ঘরবাড়ি রক্ষা করার জন্যে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। জরিপের কাজ বন্ধ করে দিয়ে জমিজমা সব নিজেদের দখলে রেখে দেবে।
কিন্তু দুই পক্ষেই অত্যুৎসাহী লোকের অভাব নেই। এদিকে ঘটনাপ্রবাহের আকস্মিক মোড় পরিবর্তন সহজভাবে নেয় নি কর্নেল কীথ। শুরু থেকেই সর্বাত্মক হামলা চালিয়ে প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার কথা বলে আসছে সে। পশ্চিমের অনেক রহস্যময় ঘটনার সঙ্গে আরেকটা ঘটনা যোগ হত তা হলে। কীথের দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে, ভাবল কেড্রিক, ওদিক থেকে যে কোনও মুহূর্তে বিপদ আসতে পারে।
সেইন্ট জেমস-এর নিজের কামরায় ফিরে শুয়ে পড়ল পল কেড্রিক। পরদিন কাক-ভোরে ঘুম ভাঙল, জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখল ঘোড়ায় চেপে শহর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে কর্নেল, লরেন কীথ। বিস্মিত হলো
লাফিয়ে বিছানা থেকে নামল, চট করে পোশাক পরে নিল। কীথের মতলব জানা দরকার। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এল ও, এগেলি আস্ত বিলের দিকে। অ্যাপলুসার পিঠে চেপে শহর থেকে বেরিয়ে এল। একটু খুঁজতেই পাওয়া গেল কীথের ট্র্যাক, অনুসরণ করল। ট্রেইল থেকে বেরিয়ে উত্তর-ঘেঁষে পশ্চিমে গেছে কীথ। কিন্তু কয়েক মাইল এগোনোর পূর ট্রেইল হারিয়ে ফেলল পল। লম্বা এক চক্কর দিয়ে ট্রাকের সন্ধান চালাল। ল্যারগো। ক্যানিয়নের কাছাকাছি কোথাও হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে কর্নেল লরেন কীথ।
হোটেলে ফিরে বব ম্যাকলেননের পাঠানো বার্তা পেল পল কেড্রিক। বুধবার বিকেল তিনটের চিমনি রকে সৈগালকে নিয়ে বারউইক আর কেড্রিকের সঙ্গে আলোচনা করতে আসবে সে। আজ সোমবার, মাঝে পুরো একটা দিন পড়ে আছে। কিন্তু সোমবার সারা দিন কোথাও ডরনি শয়ের দেখা মিলল না। তবে বার কয়েক ওর সঙ্গে দেখা করে গেল লরেডো শ্যাড, বেশির ভাগ সময়ই স্যালুনে স্যালুনে কাটাচ্ছে সে।
গভীর রাতে ধীরে ধীরে কেড্রিকের ঘরের দরজা খুলে গেল। পিস্তলহীতে উঠে বসল পল। ভেতরে পা রাখল লরেডো শ্যাড।
কিছু একটা ঘটছে, বলে বিছানায় বসল লরেডো। আমার কাছে কেমন যেন বেখাপ্পা লাগছে। ঘণ্টা দুয়েক হবে, পয়েন্সেট আর লী গফ এসে বলল ওরা চলে যাচ্ছে। এখানে যখন লড়াই হচ্ছে না, থেকে লাভ নেই। ডুরাংগোতে চলে যাচ্ছে। এর আধ ঘণ্টাটাক পড়ে ঘোড়া নিয়ে চলে গেল।
এতে বেখাপ্পার কী আছে? সিগারেট বানাতে বানাতে জিজ্ঞেস করল পল কেড্রিক। বরং বারউইকের সঙ্গে আমার তোসে-রকমই কথা হয়েছে। এখানে সত্যিই লড়াই হচ্ছে না।
হুম, শুষ্ক কণ্ঠে বলল লরেডো শ্যাড। কিন্তু ওরা সঙ্গে করে অনেক জিনিসপত্র এনেছিল এখানে, অল্প কিছু জিনিস নিয়ে গেছে। অস্বাভাবিক নয় প্যাক হর্স হারিয়ে ফেলল নাকি?
ফেসেনডেন কোথায়?
জানি না।
আর কেউ যায় নি?
হ্যাঁ, ক্লসন। অন্তত কাছেপিঠে নেই সে। সকালের পর আর দেখা হয় নি।
বাকি রইল ডরনি শ, ওকেও দেখা যাচ্ছে না; এবং ফেসেনডেন, এখনও যদি বিদায় না নিয়ে থাকে। অস্বস্তি বোধ করছে কেড্রিক। কিন্তু ব্যরউইক পিস্তলবাজদের বিদায় দিতে শুরু করলে একে তো শুভ লক্ষণই বলতে হবে। ও হয়তো অনর্থক সন্দিহান হয়ে উঠছে। শ্যাডকে চাকরি ছাড়ার ব্যাপারে কিছু বলা হয় নি। এদিকে, শুকনো গলায় বলল লরেডো শ্যাড, মিক্সাসরা দুভাই আবার আজ সকালে ফিরে এসেছে, সোজা বারউইকের অফিসে ঢুকেছে ওরা।
ওরা আবার কারা?
খুনী। গুমখুনে, ওস্তাদ বলা যায়। একজনের নাম বীন, অন্যজন অ্যাবেল। স্যান্দো ভ্যাল দাঙ্গায় ছিল ওরা। ওই ঘটনায় অনেক লোক প্রাণ হারিয়েছিল। ও, হা, তখন বারউইকও ছিল ওখানে। আসল কথা, সেখানেই প্রথম আমার সঙ্গে তার পরিচয়।
তুমিও ছিলে ওই হাঙ্গামায়?
হুম। রয় গ্যাবলের সঙ্গে ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়েছিলাম। গ্যাবল ছিল দুর্ধর্ষ আউট-ল, বেশ বড়সড় একটা দলের সর্দার। লড়াইতে জড়িয়ে পড়ায় খুব খারাপ অবস্থা যাচ্ছিল তার। আমার কাছ থেকে একটা বাছুর ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে আমি বাধা দিই, আমাকে গানফাইটে চ্যালেঞ্জ করে বসে সে। একেবারে মন্থর ছিল লোকটা।
ব্যাপারটা দুর্বোধ্য কয়েকজন গানম্যান বিদায় নিল, তারপর আরও দুজন হাজির হলো। এমনও হতে পারে পরিকল্পনা পরিবর্তনের আগেই ওদের দুভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বারউইক? সম্ভব। সম্ভাবনার কথা লরেডো শ্যাডকে বলল কেড্রিক। সন্দেহের সঙ্গে মাথা দোলাল টেক্সান।
তা হতে পারে, কিন্তু আমার সন্দেহ আছে। বারউইককে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। তোমার গুন্টার খুব একটা ভাল মানুষ নয়; আর কীথ, ভাবতে গেলে আগাগোড়া বদমাশ; কিন্তু ওদের কারোই বারউইকের ধারে কাছে ঘেঁষার সাধ্য নেই-অন্তত কূট-বুদ্ধির দিক দিয়ে।
.
নানা দিক থেকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা খুঁজে পেল কেড্রিক। এদিকে ম্যাকলেনন আর সেগালের সঙ্গে দেখা করার কথাও অপরিবর্তিত রয়েছে। আলোচনা থেকে সমাধানের একটা উপায় বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে। এক্ষেত্রে বারউইককে সন্দেহ করার কোনও কারণ দেখছে না ও।
রোদ ঝলমল সকাল, উত্তপ্ত একটি দিনের আগমন বার্তা ঘোষণা করছে। রাস্তায় বেরিয়ে এল কেড্রিক। এখনও শীতের আমেজ যায় নি, রোদের উত্তাপ উপভোগ করছে ও। রাস্তা পেরিয়ে ছোট্ট রেস্তরাঁয় ঢুকল, নিঃশব্দে খাওয়া সেরে নিল। একদফা কফি শেষ করে দ্বিতীয় বারের মতো কাপ ভরে চুমুক দিচ্ছে, এমন সময় রেস্তরাঁয় ঢুকল, সামান্থা ফক্স।
কেড্রিকের দিকে চোখ পড়তেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চোখমুখ, হাসল। সোজা কেড্রিকের টেবিলের দিকে এগিয়ে এল। এখানে তুমি একটা দর্শনীয় বস্তু জানো সেটা? ওই প্রাচীন পাথুরে বাড়ি আর বুড়ো নোংরা লোকটার চেহারা দেখতে দেখতে কাহিল হয়ে গেছি। দম বন্ধ হবার যোগাড় হয়েছে। ঝামেলাটা চুকে গেলে বেঁচে যেতাম।
সামান্থার দিকে তাকাল কেড্রিক। কী করবে তারপর?
কী জানি, এখনও কিছু ঠিক করি নি। এদিকে আশপাশে কোথাও একটা র্যাঞ্চ কিনব ভাবছি। ওখানে অনেক গাছ থাকবে, থাকবে ঘাসআর পানি। জায়গাটা যে খুব বড় হতে হবে তেমন কোনও কথা নেই।
গরু পুষবে না?
পুষব, তবে অল্প। আমার শখ ঘোড়া। তোমার অ্যাপাসার মতো। অসংখ্য ঘোড়া থাকবে আমার।
চমৎকার। ঘোড়া পোষার জন্যে খুব বেশি জায়গার দরকারও হয় না। ভালো ঘোড়ার বাজার দর চড়া। কিছুক্ষণ সামান্থার সৌন্দর্য উপভোগ করল পল কেড্রিক; মেয়েটার চেহারার লাবণ্য, দুচোখের সরল দৃষ্টি মুগ্ধ করল ওকে। তুমি এখানে থাকবে শুনে কেন যেন খুব খুশি লাগছে। এর পর আর তোমাকে ছাড়া আমার ভালো লাগত না।
চট করে কেড্রিকের দিকে তাকাল সামান্থা, হাসিতে নাচছে চোখজোড়া। আরে, তুমি দেখছি আর সব কাউবয়দের মতো, প্রেম নিবেদন করতে চাইছ!
না, সামান্থা, শান্ত কণ্ঠে বলল কেড্রিক, তা নয়, তোমাকে সত্যি ভালোবাসি আমি, এতে কোনওরকম সন্দেহের অবকাশ নেই! একদিন বুঝবে আমি মিথ্য, বলি নি।
আমারও মনে হচ্ছে তুমি সত্যি কথা বলছ, বলল সামান্থা ফক্স।
ওদিকে পশ্চিমে, বলল কেড্রিক, ঠিক পশ্চিমে নয়, উত্তর-পশ্চিমে কয়েক মাইল দীর্ঘ একটা রিম আছে। রিমের চূড়ায় অপূর্ব পাইনের বন। গাছ, পানি, বুনো-জন্তু জানোয়ার আর নয়ন জুড়ানো সবুজ মাঠ, সবই আছে ওখানে। অমন দৃশ্য মানুষ খুব কম দেখেছে। ওদিকে একটা জায়গা চিনি আমি, একবার ক্যাম্প করেছিলাম। মিঠে পানির ঝর্না; লম্বা লম্বা ঘাস, সারাক্ষণ হাওয়ায় দুলছে; আর বিস্তীর্ণ সমভূমি, বন-কী নেই?
ইশ, শুনেই লোভ লাগছে। এখানে আসার পর থেকে এমন একটা জায়গাই খুঁজছি! চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল কেড্রিক। আমার কাজ শেষ হোক, তোমাকে নিয়ে যাব, কেমন? জায়গাটা দেখবে।
কেড্রিকের দিকে তাকাল সামান্থা ফক্স। ঠিক আছে, পল, আমরা দুজন একসঙ্গে যাব ওখানে।
টুপি হাতে থমকে উঁড়াল কেড্রিক, দরজা দিয়ে বাইরে চোখ ফেরাল। হ্যাঁ, একসঙ্গে বিড়বিড় করে বলল ও। তারপর চোখ নামিয়ে সামান্থার দিকে চাইল। বুঝলে, সামা, একসঙ্গে শব্দটার চেয়ে সুন্দর শব্দ আর নেই…।
রেস্তরাঁ থেকে বেরিয়ে আসার পথে দুজনের খাবারের দাম চুকিয়ে দিল কেড্রিক। উত্তপ্ত রাস্তায় দাঁড়াল মুহূর্তের জন্যে। একটা বাকবোর্ড এসে থামল স্টোরের সামনে। একজন লোক নামল, সতর্ক ভাবভঙ্গি, সন্ত্রস্ত দৃষ্টি। হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে কেড্রিকের দিকে তাকাল সে, তারপর স্যাৎ করে ঢুকে পড়ল দোকানে।
০৮. আরও দুজন লোক
আরও দুজন লোক হঠাৎ রাস্তা পেরিয়ে স্টোরের দিকে এগিয়ে গেল। একজনকে আগে কখনও দেখে নি পল; অন্যজন সেদিন ইয়েলো বাট স্যালুনের পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ধূর্ত চেহারার সেই লোকটা, নাম সিঙ্গার, কথা বলছে সেই। রাস্তার উল্টোদিকে পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়ল দুজন। হাতের ইশারায় বাকবোর্ড থেকে নামা লোকটাকে দেখিয়ে দিল সিঙ্গার।
ওই যে লোকটা, অ্যাবি, বলল সে। শত্রুপক্ষে একজন। ম্যাকলেননের শালা।
শুরুটা ভালোই হবে দেখছি, সংক্ষেপে মৃদু কণ্ঠে বলল অ্যাবি। চলো তা হলে?
চট করে ঘুরে ওদের পিছু নিল পল কেন্দ্রিক। ওরা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দ্রুত এগিয়ে গেল ও, কবাট দুটো বন্ধ হওয়ার আগেই হাতল ধরে ফেলল। ওর আগমন টের পায় নি কেউ, অনুমান করল কেড্রিক। কাউন্টারে দাড়ানো লোকটার দিকেই মনোযোগ ওদের।
হ্যাল্লো, স্লোয়ান, নরম কণ্ঠে ডাকল সিঙ্গার, এসো, অ্যাবি মিক্সাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।
নামটা নিঃসন্দেহে স্লোয়ানের পরিচিত, ফ্যাকাসে চেহারায় ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সে। বাচ্চাদের একটা দুধের বোতল ধরে আছে, কিনতে যাচ্ছিল। সন্ত্রস্ত চেহারায় পালা করে সিঙ্গার আর অ্যাবি মিক্সাসের দিকে তাকাচ্ছে। আতঙ্কিত এবং হতচকিত, নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। তুমিও আছ এই ঝগড়ায়, সিঙ্গার? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি এসবে জড়াও নি।
হাসল সিঙ্গার। সবাই যাতে একথা ভাবে সেটাই চেয়েছি।
ছুঁচোর মতো লম্বাটে চেহারা মিক্সাসের, চোখদুটো হলুদ, ঈষৎ কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল সে। একটা দলিল এটা, স্লোয়ান। এখানে লেখা আছে: তুমি তোমার জমির মালিকানা ছেড়ে দিচ্ছ। সই করে দাও, আর ঝামেলা পোহাতে হবে না।
রক্ত সরে শাদা হয়ে গেছে স্লোয়ানের চেহারা, মাথা নিচু করে দলিলের দিকে তাকাল সে, চোখের পাতা পড়ছে না। আবার অ্যাবি মিক্সাসের দিকে, চোখ ফেরাল। পারব না। কদিন পরেই আমার বউয়ের বাচ্ছা হতে যাচ্ছে। তা ছাড়া ওই জমির পেছনে প্রচুর খেটেছি আমি, ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যাই করো, আমি সই করব না।
করলেই ভালো হত, নিষ্কম্প শীতল কণ্ঠে বলল অ্যাবি মিক্সাস। ইতিমধ্যে উধাও হয়ে গেছে দোকানি। ওদিকে ওরা তিনজন আর একধারে ঝোলানো জিন্স আর স্নিকারের আড়ালে, গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পল কেড্রিক-দোকানে আর কেউ নেই। ভালো চাইলে, সই করে দাও, ওই জমির ওপর আসলে তো তোমার অধিকার নেই। আমি কি মিথ্যে বলেছি?
এখনও চেহারার ফ্যাকাসে ভাব কাটে নি স্লোয়ানের, কিন্তু ভয় কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। লোকটা সাহস করে এখন মুখ খুললেই তাকে মরতে হবে; বুঝতে পেরে কেড্রিকই নীরবতা ভাঙল।
হ্যাঁ অ্যাবি, মৃদু কণ্ঠে বলল ও, আমি বলছি তুমি মিথুরু?
বজ্রাহতের মতো আড়ষ্ট হয়ে গেল মিক্সাস। লোকটা খুনী এবং বিপজ্জনক, কিন্তু ধূর্তও বটে, নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবেই খুন করে। সিঙ্গার ছাড়া কামরায় আর কেউ নেই ধরে নিয়েছিল সে। এখন দেখা যাচ্ছে পেছনে আর একজন দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের মতো কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে রইল সে, তারপর ঘুরতে শুরু করল। দেয়ালের কাছে চলে গেছে সিঙ্গার, তার দুচোখ কেড্রিককে খুঁজে ফিরছে।
ওটা কেট্রিক! বলল সে, বুস গানম্যান!
ভুরু কোঁচকাল মিক্সাস। কী ব্যাপার, আঁ? বিরক্তির সঙ্গে বলল সে। তুমি নাক গলাচ্ছ কোন্ দুঃখে?
খুনোখুনি আর চলবে না, অ্যাবি, জোর গলায় বলল পল কেড্রিক। আগামীকাল শান্তিসভায় যোগ দিতে যাচ্ছি আমি। খুন-খারাবী বন্ধ!
নির্দেশ মতোই কাজ করছি আমি, বলল মিক্সাস, তুমি বারউইকের সঙ্গে কথা বলো!
একটু নড়ে উঠল স্লোয়ান, পাঁই করে ঘুরল অ্যাবি মিক্সাস। একদম নড়বে! খেঁকিয়ে উঠল সে।
তুমি যেতে পারো, স্লোয়ান, বলল কেড্রিক। বাকবোর্ডে চেপে ঘরে ফিরে যাও। ম্যাকলেননকে বলো আমার কথার নড়চড় হবে না। অ্যাবি, ওকে খুন করার কথা ভুলে যাও তুমি। তোমার সামনে বিপদ।
বিভ্রান্ত অ্যাবি মিক্সাস। কেড্রিক বন্দুকবাজদের নেতৃত্ব দিচ্ছে জানে সে। তাই দ্বিধাগ্রস্ত। ভুল করতে যাচ্ছিল সে? কিন্তু তা কী করে হয়? ওকে তো-গবেট কোথাকার! ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল সে। কীথই এখানে পাঠিয়েছে আমাকে!
চুপ করো! চেঁচিয়ে উঠল সিঙ্গার, তুমি–
ঠাণ্ডামাথার খুনী অ্যারি মিক্সাস, কিন্তু মনের জোর নেই। নির্দেশ, পাল্টা নির্দেশ, তারপর খুন করতে গিয়ে মাঝপথে বাধা পেয়ে দিশেহারা হয়ে গেছে-অনেকটা অন্ধকার কানাগলিতে, পথ হারানোর মতো। সিঙ্গারের ধমকে শেষ পর্যন্ত নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না। চরকির মতো ঘুরল সে, দাঁত বেরিয়ে পড়ে হিংস্র হয়ে উঠল চেহারা।
আমাকে ধমকাতে এসো না! খেঁকিয়ে উঠল অ্যাবি মিক্সাস।
একটা হাত পিস্তলের বাঁটের কাছে ঝুলছিল সিঙ্গারের, আতঙ্কে আঁকড়ে ধরতে গেল। নিমেষে হোলস্টার থেকে বেরিয়ে এল অ্যাবির পয়েন্ট ফোর ফোর, অগ্নিশিখা তেড়ে এল সিঙ্গারের দিকে। গুলি খেয়ে লাটিমের মতো ঘুরল সিঙ্গার। ধীরে ধীরে দুহাটু ভাজ হয়ে গেল তার, লন্ত মোমের মতো পিছলে পড়ল মেঝেতে, মাথা এলিয়ে পড়ল একটা ময়দার বস্তার ওপর। মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে।
হাঁ করে সিঙ্গারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মিক্সাস, চোখ পিটপিট করল বার কয়েক। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসছে ও, উত্তেজিত স্নায়ু শান্ত হচ্ছে। অবিশ্বাসভরা দৃষ্টিতে সিঙ্গারের দিকে তাকিয়ে আছে।
হায়াল্লা, সিঙ্গারকে মেরে ফেলেছি! বলল অ্যাবি।
হ্যাঁ, মিক্সাসের ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে বলল পল কেড্রিক। এখন বুঝতে পারছে, কত সামান্য কারণে খেপে যায় লোকটা। এবার কীথের কাছে কী জবাব দেবে!
আবির ছুঁচো মুখো চেহারায় আবার ধূর্ত হাসি ফুটে উঠল। কীথ? কীথের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী?
গুলির শব্দে আকৃষ্ট হয়ে আস্তে আস্তে দরজার কাছে ভিড় জমতে শুরু করেছে। নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে দোকানি, আতঙ্কিত ঝুলে-পড়া হারায় তাকিয়ে আছে।
দোকানের দরজার দিকে তাকাল অ্যাবি মিক্সাস। এই সুযোগে নিঃশব্দে পিছিয়ে এল কেড্রিক। ঝোলানো স্নিকারগুলোর আড়ালে আড়ালে পা টিপে টিপে দুই কাউন্টারের মাঝে ফাঁকায় বেরিয়ে এল ও; তারপর দোকানির শোবার ঘর হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে গলিপথে নেমে এল।
ভিড়ের পেছন দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে ঘুর পথে সেইন্ট জেমস-এর সামনে পৌঁছুল পল। থামল। হঠাৎ পাশে হাজির হলো লরেডো শ্যাড।
কী ব্যাপার? চট করে জিজ্ঞেস করল সে।
ব্যাখ্যা করল কেড্রিক। বুঝতে পারছি না ঠিক, বলল ও। কীথ বোধহয় খুশি মতো কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। আলোচনা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বারউইকের শান্ত থাকার কথা। আমি জানি ব্যাপারটা কীথ মেনে নেয় নি। সঙ্গে সঙ্গে বারউইকের বিরোধিতা করেছিল সে।
সিঙ্গার সেটলারদের একজন না? জিজ্ঞেস করল লরেডো শ্যাড। ও খুন হওয়ায় সবাই খেপে যাবে! কীথ বা কোম্পানির সঙ্গে সিঙ্গার হাত মিলিয়েছিল, কেউ জানে?
ঠিকই বলেছ, লরেডো, চিন্তিত চেহারায় বলল পল কেড্রিক। এটাকে উসিলা করেই হয়তো মহা হাঙ্গামা বেধে যাবে!
দুজনই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল ওরা। স্লোয়ান ম্যাকলেননের আত্মীয়, তাই ওকে খুন করতে চেয়েছিল অ্যাবি। আমার গলা শুনে ভড়কে যায় সে, মাথা ঠিক রাখতে পারে নি।
ভিড়ে ভাঙন ধরল। ছোট ছোট জটলা করে নতুন ঘটনাটা প্রসঙ্গে আলাপ করতে লাগল লোকেরা রাস্তার ওপর। লরেন কীথ যখন হাজির হলো তখনও কেড্রিকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে লরেড়ো শ্যাড। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রথমে শ্যাড তারপর কেড্রিকের দিকে তাকাল কীথ।
কী হচ্ছে ওখানে?
কেড্রিকের দিকে চোখ রেখে প্রশ্ন করল সে। কেড্রিক কাঁধ ঝাঁকাল। গানফাইট বোধহয়, যা শুনলাম, মাস্ট্যাংয়ে এসব পুরোনো ব্যাপার।
মিক্সাসকে দোকানে ঢুকতে দেখলাম, মন্তব্য করল লরেডো শ্যাড। এর মধ্যে তার হাত আছে কি না জানতে চাও?
ঘাড় কাত করে লরেডোর দিকে তাকাল কর্নেল লরেন, কীথ, সন্দেহভরা চোখ, কে মারা গেল? প্রশ্ন করে পালা করে দুজনের দিকে তাকাল।
সিঙ্গার নামে এক লোক, সহজ কণ্ঠে, বলল লরেডো শ্যাড। মিক্সাসই খুন করেছে।
মিক্সাস? সিঙ্গারকে মেরেছে? মাথা নাড়ল কীথ। অসম্ভব!
অসম্ভর হতে যাবে কেন? ধীর লয়ে বলল লরেটে। লড়াই করতেই তো এখানে এসেছে মিক্সাস, নাকি? সিঙ্গার একজন সেটলার, তাই না?
ইতস্তত করল কীথ, তার ছুঁচাল কঠিন চেহারায় দিশেহারা ভাব। কীথের চেহারা দেখে মনে মনে তৃপ্তি বোধ করল কেড্রিক। দোকানি ওর চেহারা দেখতে পায় নি। মিক্সাস, সিঙ্গার আর স্লোয়ান-এই তিনজন কেবল দেখেছে ওকে। এদের মধ্যে সিঙ্গার মারা গেছে, শ্লোয়ান কেটে পড়েছে। সিঙ্গারকে খুন করার পেছনে অ্যাবি মিক্সাস কী যুক্তি খাড়া করবে ভেবে পেল না কেড্রিক। তবে একজন বেঈমান্তের মৃত্যু ঘটেছে, হতবুদ্ধি হয়ে গেছে ইয়েলো বাটের শত্রু বারউইকরা। ভবিষ্যতের কথা বলা যায় না, তবে আপাতত ভালোই হয়েছে ব্যাপারটা। তবে একটা জায়গাতেই মুশকিল, সিঙ্গার ইয়েলো বাটের লোক ছিল, কীথ বা কোম্পানির সঙ্গে তার গাটছড়া বাঁধার কথা কারও জানা নেই-জানলেও তাদের সংখ্যা নগণ্য।
জটলার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেড্রিকের মনে হলো: নতুন একটা উপাদান যোগ হতে যাচ্ছে ঘটনা ধারায়। জনমতও যে একটা প্রচণ্ড শক্তি, কথাটা ভাবে নি বারউইক; এবার ভাবতে হবে। শহরের প্রতিটি মানুষের চেহারায় কাঠিন্য ফুটে উঠেছে।
এরা, প্রায় সবাই-ই গরীব; যার যার পথে চলে কিংবা চলার চেষ্টা করে। কোম্পানির কার্যকলাপে অসন্তুষ্ট হয়েছে ওরা। সিঙ্গারকে যে সবাই চিনত তা নয়, যারা চিনত তারাও খুব একটা আমল দিত না; কিন্তু এখন কাকে হত্যা করা হয়েছে তা নয়, পুরো ব্যাপারটা তাদের দৃষ্টিতে পরিশ্রমী, একদল মানুষের বিরুদ্ধে বহিরাগতদের মদতপুষ্ট কোম্পানির লড়াইতে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় লোকদের শ্রমের বিনিময়ে মুনাফা লুটতে চাইছে ওরা। তা ছাড়া সিঙ্গার আর যাই হোক পিস্তলবাজ ছিল না, তার ওপর স্থানীয় লোক ছিল সে। অ্যাবি মিক্সাস নৃশংস খুনী, কারও অজানা নেই, পিস্তল ভাড়া খাটায় সে।
মাথা দুলিয়ে রাস্তার দিকে ইঙ্গিত করল পল কেড্রিক। কর্নেল, বলল ও, বিপদ এড়াতে চাইলে এখন থেকে এদেরকেও হিসেবের মধ্যে ধরো। জনগণ খেপলে সামলাতে পারবে না।
ভয়ার্ত দৃষ্টিতে জনতার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল লরেন কীথ। তারপর পড়িমরি করে হেডকোয়ার্টারের দিকে ছুটল। কীথের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল শ্যাড, তারপর কেড্রিকের দিকে ঘাড় ফেরাল। আমরা কিন্তু এখনও কোম্পানির সঙ্গে আছি, ওদের জন্যে মুণ্ড হারাতে চাই না আমি। চলল কেটে পড়ি। কয়েকদিন পাহাড়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকি।
সম্ভব নয়। বারউইককে নিয়ে সেগালদের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। তবে তুমি চাইলে শহর থেকে বেরিয়ে যেতে পারো, চারদিক জরিপ করে গফদের কোনও খোঁজ মেলে কিনা দেখো-সত্যি চলে গেছে না ভাওতা দিচ্ছে জানতে পারলে ভালো হয়। কাল সন্ধ্যা নাগাদ আমার সঙ্গে চিমনি রকে দেখা করো। আমি অপেক্ষা করব।
.
শ্যাডের কাছে বিদায় নিয়ে সেইন্ট জেমস-এ নিজের রুমে ফিরে এল পল কেড্রিক। চট করে কিছু জিনিস গুছিয়ে নিল। তারপর ব্যাগ হাতে সোজা চলে এল লিভারি স্ট্যাবলে, অ্যাপলুসার পিঠে জিন চাপিয়ে তৈরি করে রাখল টাকে। আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এসে বড় রাস্তা এড়িয়ে হেডকোয়ার্টারের দিকে এগোল পল। সামান্থা ফক্সের সঙ্গে দেখা করবে, এ-মুহূর্তে বারউইক বা কীথের মুখোমুখি হতে চায় না।
হেডকোয়ার্টারে কারও দেখা পেল না পল। গুন্টার, বোধ হয় কোথাও গেছে। বারউইক আর কীথ উধাও। অফিস-রুমে পায়চারি করতে করতে মাথার ওপর মৃদু পদশব্দ শুনতে পেল পল কেড্রিক।
চড়া গলায় ডাকল ১৪:মাথার উপর ছুটন্ত পায়ের শব্দ হলো। কয়েকমুহূর্ত পর সিঁড়ির মাথায় এসে দাড়াল সামান্থা, ফক্স।
কে? পরক্ষণে কেড্রিককে চিনতে পেরে তাড়াতাড়ি নেমে এল। কোনও সমস্যা?
সব কিছু খুলে বলল কেড্রিক, কিছুই গোপন করল না। হয়তো কিছুই হবে না। কিন্তু ঝামেলা শুরু হতে আবার বেশি কিছু লাগেও না। সবাই এখন জানে কোম্পানির বন্দুকবাজরা শহর থেকে চলে গেছে। বারউইক, কীথ আর তোমার মামা নিশ্চয়ই গা ঢাকা দিয়েছে।
আজ সারা দিনে একবারও মামার সঙ্গে আমার দেখা হয় নি। সকালে একসঙ্গে নাশতা করার পরই কোথায় যেন চলে গেছে।
দাঁড়াও, দেখছি। তোমার কাছে পিস্তল আছে? জিজ্ঞেস করে আবার নিজেই মাথা নাড়ল কেড্রিক। হয়তো তার প্রয়োজন হবে না। এখানে সবাই তোমাকে পছন্দ করে, তা ছাড়া আগেই তুমি তোমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছ। তোমার বিপদ হবার আশঙ্কা কম। তবু সাবধান থাকা ভালো। বিনাকাজে ঘর ছেড়ে বেরিয়ো না। গোলমাল একটা বাধল বলে!
দরজার কাছে পৌঁছুনোর আগেই আবার সামান্থা ডাকল ওকে, ঘুরে মুখোমুখি হলো কেড্রিক।
পল, সামান্থার দৃষ্টিতে আবেদন ঝরছে। নিজের দিকে খেয়াল রেখো।
দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল ওরা। মাথা দোলা, কেড্রিক। আচ্ছা, চেষ্টা করব।
ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় থমকে দাঁড়াল কেড্রিক। বারউইক আর কীথ হয়তো গা ঢাকা দিয়েছে; কিন্তু যত খারাপই হোক, ভাগ্নীকে, বিপদে ফেলে পালিয়ে যাবার মতো লোক তো গুন্টার নয়! গুন্টারের অন্তর্ধানের রহস্য কী? ভাবতে ভাবতে ঘাড় ফিরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাল পল কেড্রিক। বাড়ির পেছনের রাস্তা খাঁ-খাঁ করছে, তূপ হয়ে আছে পাউডারের মতো মসৃণ ধূসর বালি; গাছের পাতায় পাতায়, ঝোঁপ ঝাড়ে ধুলোর পুরু আস্তরণ পড়েছে।
নেড়েচেড়ে গানবেল্ট জায়গামতো বসাল কেড্রিক, তারপর বাড়ির পেছন দিকে পা বাড়াল। সাধারণত আস্তারল ঘোড়ায় গিজগিজ করে, কিন্তু এখন যেন ফাঁকা। দ্রুতপায়ে এগোল ও, পায়ে পায়ে ধুলো উড়ছে, ঝুন-ঝুন শব্দ উঠছে ম্পারে।
আস্তাবলের কাছে পৌঁছে ওঅটর ট্রাফের পাশে দাঁড়াল পল। শহরের কোলাহল কানে আসে কিনা শোনার চেষ্টা করল।
নীরবতা, অস্বাভাবিক নীরবতা।
সামান্থার নিরাপত্তার কথা ভেবে মুহূর্তের জন্যে ইতস্তত করল কেড্রিক, তারপর সব দ্বিধা ঝেড়ে পা বাড়াল, চওড়া দরজা গলে ঢুকল আস্তাবলে।
একটা ছাড়া সবগুলো স্টল খালি। স্টলের মুখে এসে দাঁড়াল কেড্রিক। গুন্টারের চেস্টনাটটা রয়েছে। কাছেই পড়ে আছে স্যাডল। তা হলে কী শহরেই আছে গুন্টার? একটু ভেবে সম্ভাবনাটা নাকচ করে দিল কেড্রিক। মাথা থেকে টুপি খুলে রুমালে ব্যান্ড মুছল, আবার জায়গামতো বসাল ওটা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি স্টল পরীক্ষা করল ও, চেহারায় চিন্তার ছাপ।
কোথাও কিছু নেই!
বিভ্রান্ত কেড্রিক আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এল। সূর্য যেন আগুন ঢালছে। কোথাও কোনও শব্দ নেই। চোখ ছোট করে ইতিউতি তাকাল ও। এখনকার এই বড় আস্তাবল তৈরি হওয়ার আগে যেটা আস্তাবল হিসেবে ব্যবহৃত হত, সেই জরাজীর্ণ দালানটা চোখে পড়ল। কয়েক মুহূর্ত সেদিকে চেয়ে রইল কেড্রিক। তারপর, পা বাড়াল। সঙ্গে সঙ্গে কানে এল ঘোড়ার খুরের শব্দ, চট করে উবু হয়েই বসে পাইকরে ঘুরল ও, দুই হাত প্রস্তুত।
পর মুহূর্তে আবার সোজা হয়ে দাড়াল। স্যাডল থেকে পিছলে নেমে ছুটে আসছে লেইন। ওঁহু, পল, তুমি এখানে! আর আমি এদিকে খুঁজে সারা! কেড্রিকের বাহু আঁকড়ে ধরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা। কালকের মিটিংয়ে তুমি যেয়ো না, পুল, বিপদ হকে!
ম্যাকলেনন ষড়যন্ত্র করেছে?
ম্যাকলেনন? মুহূর্তের জন্যে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল স্যু লেইন। না, না! ম্যাক নয়! চেহারা বদলে গেল ওর। আমার বাড়িতে চলল, পল, ওদের ঝামেলা ওরা পোহাবে! তুমি আমার সঙ্গে এসো!
হঠাৎ আমার জন্যে বড় উতলা হয়ে উঠলে যে? প্রকৃতই কৌতূহল বোধ করছে কেড্রিক তোমার সঙ্গে মাত্র একবার আমার কথা হয়েছে এবং সব ব্যাপারেই মতের অমিল পেয়েছি আমি।
তর্ক করে সময় নষ্ট করো না তো! ওদের কেউ যদি দেখে ফেলে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি, বিপদে পড়ে যাব। তুমি আমার সঙ্গে চলো, গোলমাল না মেটা পর্যন্ত এখান থেকে দূরে থাকো। ডরনিকে আমি চিনি, ও তোমাকে ঘৃণা করে, পল, মন থেকে ঘৃণা করে!
তাই নাকি? স্যু লেইনের কাঁধ চাপড়ে দিল পল কেড্রিক। যাও, ঘরে ফিরে যাও। এখানে অনেক কাজ পড়ে আছে আমার।
অ! একটু কঠিন হলো স্যু লেইনের দৃষ্টি। ওই মেয়েটাই না যাওয়ার কারণ নিশ্চয়ই? কী যেন নাম, ফক্স? মেয়েটার কথা অনেক শুনেছি, খুব নাকি সুন্দরী আর-আর, কেমন মেয়ে সে?
চমৎকার, গাঢ় স্বরে বলল কেড্রিক। আলাপ করে দেখো, তোমার ভালো লাগবে।
আড়ষ্ট হয়ে গেল স্যু লেইন। আচ্ছা? মেয়েদের সম্পর্কে কী জানো তুমি পল? জানতে ইচ্ছে করছে। আদৌ কিছু জানো? সামান্থা ফক্সকে আমার ভালো লাগার প্রশ্নই ওঠে না। কেড্রিকের কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিল ও। চাইলে আসতে পারো। কাল রাতে খবরটা পেয়েছি আমি। এমন কিছু ঘটুক আ-আমি চাই না।
কী-কীসের কথা বলছ?
অধৈর্যের সঙ্গে মাটিতে পা ঠকল স্যু লেইন। উফ, বোকা নাকি! ওরা তোমাকে খুন করার প্ল্যান করছে, পল! কই, এবার চল।
এখন না, শান্ত কণ্ঠে বলল কেড্রিক। আগে,এ-বিবাদের একটা মীমাংসা করতে হবে। তারপর তোমাদের ওদিকে একবার যেতেও পারি।
অধৈর্যভাবে ঘোড়ার দিকে এগিয়ে গেল স্যু লেইন। স্যাডলে চেপে ঘাড় ফিরিয়ে কেড্রিকের দিকে তাকাল। যদি মত পাল্টাও
এখন নয়, আবার বলল কেড্রিক। তা হলে সাবধান, খুব সাবধান, পল!
স্যু লেইন চলে গেলে কী ভেবে হেডকোয়ার্টারের দিকে তাকাল পল কেড্রিক। জানালায় দাঁড়িয়ে ওর দিকে এতক্ষণ তাকিয়েছিল সামান্থা, চোখাচোখি হতেই চট করে সরে গেল। পা বাড়াতে গিয়েও থমকে গেল কেড্রিক। কী বলবে? এখন মেয়েটা কিছুই বুঝবে না।
বাড়ির সামনে যাবার জন্যে পা বাড়াল ও, কয়েক পা এগিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘুরে দ্রুত পায়ে ফের এগিয়ে গেল পুরোনো আস্তাবলের দিকে। দরজার খিড়কিতে হাত রাখল। রোদ-বৃষ্টির অত্যাচারে কাহিল অবস্থা, আস্তে আস্তে খুলল ও, মরচে ধরা কজ্বা আর্তনাদ করে উঠল। ভেতরে সঁতসেঁতে পরিবেশ, গুমোট। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল কেড্রিক। মাকড়শার জালে ঢাকা জানালার ফাঁক গলে রোদ এসে বহুদিন আগের খড়ে ছাওয়া মেঝেতে নকশা আঁকছে। এক কদম এগিয়ে সবচেয়ে কাছের স্টলে উঁকি দিল পল।
একটা হাতের ওপর মাথা রেখে উপুড় হয়ে পড়ে আছে জন গুন্টার, শার্টের পেছনে রক্তের দাগ। মৃতদেহটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল পল। পেছনে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়েছে সামান্থার মামাকে, উপর্যুপরি তিনবার আঘাত করেছে খুনী। আঘাতের চেহারা দেখে মনে হয়, ডেস্কে বা টেবিলে বসে কাজ করছিল গুন্টার, এই সময় অতর্কিতে হামলা চালানো হয়েছে।
কয়েক ঘণ্টা আগেই মারা গেছে জন গুন্টার।
০৯. প্রকাণ্ড শরীর নিয়ে
প্রকাণ্ড শরীর নিয়ে বেশ সহজ ভঙ্গিতেই স্যাডলে বসে এগিয়ে চলেছে অ্যাল্টন বারউইক। লম্বা লম্বা পাঅলা একটা ব্লাড বে হাঁকাচ্ছে সে। অ্যাপলুসা নিয়ে। পাশে রয়েছে, ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। মাঝে মাঝে স্পারের গুতোয় ঘোড়ার। গতি বাড়িয়ে সামনে চলে যাচ্ছে বারউইক, একটু পরেই আবার কেড্রিকের পাশে আসছে। পুরোনো ছেড়া দোমড়ানো-মোচড়ানো একটা টুপি মাথায়। দিয়েছে সে, গলায় প্যাচানো রুমালটাও নোংরা, ঘামের দাগ-পড়া শার্টের কলার ঢেকে রেখেছে।
বেল্টের ওপর দিয়ে ঝুলে পড়েছে গায়ের শার্ট। একটা পিস্তল ঝুলছে কোমরে, অনেক উঁচু করে বাঁধা গানবেল্ট, এভাবে ঝোলানো পিস্তল বের করা অসুবিধেজনক। যেমন ছিল তেমনই আছে, বারউইকের দাড়ি, কর্কশ নোংরা কাঁচাপাকা। কিন্তু কথাবার্তায় অস্বাভাবিক আন্তরিক মনে হচ্ছে তাকে।
দেশটা বড় সুন্দর, কেড্রিক। এমন দেশে মরেও সুখ। হাতের কাজ, শেষ করে, এখানেই ধারে-কাছে কোথাও একটার্যাঞ্চ গড়ে তোল না কেন? আমিও তাই করব ভাবছি।
মন্দ বলে নি। বাঁ হাতে লাগাম ধরেছে কেড্রিক, ডানহাত ঝুলছে পাশে। গতকাল সামান্থা ফক্সের সঙ্গে এ-নিয়ে আলাপ করেছি।
বারউইকের ঠোঁটের হাসি, অদৃশ্য হলো। কাল ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে? কখন??
বিকেলে, সহজ কণ্ঠে বলল কেড্রিক। কিন্তু বারউইকের কণ্ঠস্বরের আকস্মিক পরিবর্তন নজর এড়াল না। গুন্টারকে বারউইকই খুন করে নি তো? নাকি কাজটা ইয়েলো বাটের কারও? যা অবস্থা, সত্যি জানার উপায় নেই। অনেকক্ষণ কথা বলেছি আমরা। সামান্থা চমৎকার মেয়ে।
জবাব দিল না বারউইক, পরস্পরের সঙ্গে চেপে বসল ঠোঁটজোড়া। ক্যানিয়নের লালচে দেয়াল দুপাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সল্ট ক্রিকের তলদেশ থেকে প্রায় পাঁচশো ফুট উঁচুতে রয়েছে ওরা। গন্তব্যে পৌঁছুতে বেশি দেরি নেই। অস্বাভাবিক সতর্ক হয়ে উঠেছে বারউইক, ধাঁধায় পড়ে গেল কেড্রিক। কোনরকম বিপদের আশঙ্কা করছে না তো লোকটা? কিন্তু এ প্রসঙ্গে উচ্চবাচ্য করল না ও।
স্যু লেইনের সাবধানবাণীর কথা মনে পড়ে গেল। ওকে হত্যা করতে চাইছে ওরা–কিন্তু এই ওটা কারা? স্পষ্ট করে বলে নি মেয়েটা। স্রেফ আজকের মিটিংয়ে যোগ দিতে বারণ করেছে জোর গলায়। মনে মনে ব্যাপারটা উল্টে পাল্টে দেখল কেড্রিক। মেয়েটা পরিকল্পিতভাবে আপোস প্রচেষ্টা বানচাল করতে চায় নি তো? নাকি সত্যিই গোপন কোনও তথ্য জানতে পেরে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে?
স্যু লেইনের বন্দুকবাজ ভাই, পিট লেইন সম্পর্কে এখনও স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারে নি। পল কেড্রিক। কোনও আলোচনাতেই পিটের নাম উচ্চারিত হয় নি। কিন্তু সব সময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকলেও, কেড্রিক নিশ্চিত, সেই ইঁদুর-রঙা ফেঁড়াটার রহস্যময় সওয়ারীর মতো বর্তমান সংকটে তারও একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। স্যু বলেছে ঘোড়াটা নাকি ভোজবাজির। মতো অদৃশ্য হয়ে যায়-আজগুবী গল্প! কিন্তু স্যু লেইনের মতো মেয়ের তো আষাঢ়ে: গল্পে বিশ্বাস করার কথা নয়! সল্ট ক্রিকের ক্যানিয়ন চওড়া হয়ে গেছে এখানে, কয়েকটা শাখা ক্যানিয়ন এসে মিশেছে এটার সঙ্গে। ক্যানিয়নের তুলদেশ ছেড়ে ট্রেইল থেকে প্রায় সাতশো ফুট উঁচু আকাশচুম্বি ক্লিফের দিকে এগোল ওরা, দক্ষিণ দিকে। খানিক পর পর নোংরা রুমালে ঘামে চটচটে মুখ মুছছে বারউইক। কথা বলছে না, একেবারে বোবা বনে গেছে।
টুপি ঠেলে পেছনে সরাল কেড্রিক, একটা সিগারেট রোল করতে শুরু করল। বারউইককে এই প্রথম এমন উত্তেজিত হতে দেখছে ও, ভাবনায় পড়ে যাচ্ছে। গুন্টারের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোম্পানির কারও সাথে কথা বলে নি পল। শহরের কিছু লোকের সাহায্যে লাশটা সরানোর ব্যবস্থা করেছে। হত্যাকাণ্ডের পরিণতিতে তুমুল লড়াই বেধে যাবে, আশঙ্কা করেছিল কেড্রিক, অথচ লড়াই থামানোর জন্যেই আপ্রাণ চেষ্টা করছে ও। সমস্যা, গুন্টারকে যে কে কী কারণে হত্যা করল সেটাই বোঝা যাচ্ছে না ব্যাপারটা সিঙ্গার হত্যার প্রতিশোধও হতে পারে। আবার কীথ অথবা বারউইকও করে থাকতে পারে কাজটা।
হঠাৎ রাশ টেনে ধরল কেড্রিক। একটা ঘোড়া উত্তর পশ্চিম কোণ থেকে এসে এদিক দিয়ে গেছে, টাটকা ট্র্যাক দেখা যাচ্ছে। বারউইকও দেখল।
এই ট্রাক আমার চেনা, বলল কেড্রিক। ঘোড়াটা কার?
চল তো, অধৈর্য কণ্ঠে বলল অ্যালটন বারউইক। ওরা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে।
সকালের সোনালি আলোয় এগিয়ে চলল দুজন। মাথার উপর নীল আকাশ ধনুকের মতো বেঁকে গিয়ে দিগন্ত স্পর্শ করেছে। টুকরো টুকরো শাদা মেঘ ভাসছে, যেন দীঘিতে সাঁতার কাটছে রাজহাঁসের দল। বায়ে লালচে পাহাড়গুলো আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভানে, দূরে হারিয়ে গেছে উপত্যকা, চোখ ভোলানো দৃশ্য। সেজঝোপে ঢাকা মাঠের ওপর দিয়ে দৃষ্টি মেলে দিল পল। এখান থেকে সাত আট মাইল দূরে এই নীলের সাগরেই হারিয়ে গেছে ম্যালপাই ক্যানিয়ন। ওখানে স্ন্য লেইন আছে।
এখন কী ঘরে আছে মেয়েটা? নাকি কোথাও বেরিয়ে গেছে? হালকা পাতলা, কালো চুল আর কালো চোখের মেয়েটা সত্যি আকর্ষণ করে। মরুভূমির সূর্যের প্রখর তাপ ওর কোমল ত্বকে সামান্যতম রুক্ষতা আনতে পারে নি। বিপদ সম্পর্কে ওকে সতর্ক করতে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে মাস্ট্যাংয়ে ছুটে গিয়েছিল সে। কেন? ওকে বাঁচাতে? মেয়েটা ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ল না তো? চট করে ধারণাটা নাকচ করে দিল পল। তবু প্রশ্নটা অনবরত খুঁচিয়ে চলল ওকে। সুন্দরী হলেও কঠিন এবং স্বার্থপর স্যু লেইন, এখানে থাকতে চায় না, দূরে কোথাও যেতে চায়। তাপ-তরঙ্গ নাচছে নীচের সমতলে। লাল-পাহাড়ী-দেয়ালের নীচে ছায়া পড়েছে। হঠাৎ বাতাসে বালির ঘূর্ণি উঠল, পিশাচিনীর মতো নাচল মরুভূমির বুকে, তারপর ঘন অ্যান্টিলোপ ঝোঁপ আর ক্যাট-ক্লর মাঝে হারিয়ে গেল। কপালের ঘাম মুছল ক্যাপ্টেন কেড্রিক। পুবে ঘোরল অ্যাপলুস। দূরে চিমনি রক-এর সুউচ্চ চূড়া দেখা যাচ্ছে। আশপাশে আরও অনেক পাহাড় জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে।
ওই যে, বরউইকের কণ্ঠে বিজয়ের সুর, ওরা আছে!
দক্ষিণে, মাইল তিনচার দূরে, দুজন ঘোড়সওয়ারকে দেখা যাচ্ছে, চিমনি রকের দিকে এগিয়ে আসছে। এত দূর থেকে ওদের চেনা না গেলেও গন্তব্য বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না।
চমৎকার, উজ্জ্বল হয়ে উঠল বারউইকের চেহারা। সময় মতোই পৌঁছে যাবে ওরা। মনে করো ভারি সোনার ঘড়িটা দেখল সে, ওদের আগেই কিন্তু ওখানে পৌঁছে যেতে পারবে তুমি। এক কাজ করো? তুমি গিয়ে ওদের জন্যে অপেক্ষা করো, এই ফাঁকে আমি ওদিকে ক্যানিয়নের ভেতর দিকে একটা চাতাল পরীক্ষা করে আসি, ঠিক আছে? দেরি করব না।
কয়েক মিনিট পর চিমনি রক-এর ছায়ায় এসে ঘোড়া থামাল ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। একটা খুদে পুকুর আছে এখানে। অ্যাপলুসাকে পানি খাইয়ে কিছু বোল্ডার আর গাছের আড়ালে ঘেসো জমিতে ছেড়ে দিল। তারপর ফিরে এসে মাটিতে বসে সিগারেট ধরাল। আরও এগিয়ে এসেছে ঘোড়সওয়াররা। একজন একটা চেস্টনাট হাঁকাচ্ছে, লম্বা লম্বা পা ফেলছে ওটা। অন্যটা একটা ড্যাপল্ড
কেড্রিকের সামনে এসে ঘোড়া থামিয়ে স্যাডল থেকে নামাল ওরা। প্রথমজন পিটার সেগাল। অন্যজনকে কেড্রিক চেনে না, আগে দেখে নি।
ম্যাকলেনন কোথায়? জানতে চাইল ও।
সময় মতো, র্যাঞ্চ থেকে আসতে পারে নি বলে আমি স্টীলম্যানকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। স্টীলম্যান ভালো লোক। ওর কথা আমাদের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। তবে ববের মুখে প্রতিশ্রুতি চাইলে, প্রয়োজনে ও-ও আসবে নিশ্চয়ই।
বারউইক এসেছে আমার সঙ্গে। ক্যানিয়নের ভেতর কী একটা চাতাল পরীক্ষা করতে গেছে সে।
গোল হয়ে দাঁড়াল তিনজন। কেড্রিককে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করল স্টীলম্যান।
ডাই রীডের মুখে তোমার অনেক প্রশংসা শুনেছি। তুমি নাকি খুবই বিশ্বস্ত লোক।
অন্তত বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করি, সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে মুখ তুলে তাকাল পল কেড্রিক।
মুহূর্তের জন্যে আড়ষ্ট হয়ে গেল ও, ফ্যাকাসে হয়ে গেল চেহারা; পরক্ষণে সতর্ক হয়ে উঠল। সাবধান! চিৎকার করে বলল, শুয়ে পড়ো!
বন্দুকের কানফাটা আওয়াজে চাপা পড়ে গেল ওর গলা। কেড্রিক মাটি স্পর্শ করার আগেই কী একটা যেন আঘাত করল ওর দেহে। পরমুহূর্তে খাবলা লাপিল খুলিতে। অন্ধকারের স্রোত ধেয়ে এল, অতল অন্ধকার টেনে নিতে শুরু করল ওকে…নীচে…আরও নীচে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। অকস্মাৎ দপ করে নিভে গেল সব আলো! তারপর আর কিছু মনে নেই।
.
তৃপ্তির সঙ্গে মুচকি হাসল অ্যাল্টন বারউইক। সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিল। ঠাণ্ডা মাথায় ঘোড়া ঘোরাল। চিমনি রক-এর কাছে একটা নিচু পাথুরে দেয়ালের পেছন থেকে বেরিয়ে এসেছে চার অশ্বারোহী, সেদিকে এগোল। বারউইক ওদের কাছে যাবার আগেই ছায়ায় লুটানো তিনজন মানুষের কাছে পৌঁছে গেল ওরা। স্যাডল থেকে নেমে রাইফেল হাতে বারউইকের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।
একদম খতম! বলল ডরনি শ, কঠিন দৃষ্টি তার। চিরদিনের জন্যে চুকে গেল ঝামেলা?
ফেসেনডেন, ক্লসন আর পয়েন্সেট মাটিতে শায়িত কেড্রিকদের দিকে তাকিয়ে আছে, কিছু বলছে না। হামলার হাত থেকে কেউ যাতে, রেহাই না পায়, সেজন্যে অন্য এক জায়গায় লুকিয়ে ছিল লী গফ, বেরিয়ে এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিল। ঝুঁকে পড়ল সে কেড্রিকদের দিকে।
আক্ষরিক অর্থেই বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে পিটার সেগাল, ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত। একপাশে পড়ে আছে স্টীলম্যান, অর্ধেকটা খুলি উড়ে গেছে। গাঢ় ছায়ায় লুটিয়ে আছে ক্যাপ্টেন কেড্রিক, রক্তাপুত মাথা, শরীরও রক্তাক্ত। আরও এক দফা গুলি লাগিয়ে দেব? নিশ্চিত হওয়া যেত? পয়েন্সেট জিজ্ঞেস করল।
নিশ্চিত হওয়ার আর বাকি আছে কী? ভেঙচি কাটল ক্লসন। দেখছ না চালুনির মতো ফুটো হয়ে গেছে একেকটা?।
কেড্রিকের কী অবস্থা? জিজ্ঞেস করল ফেসেনডেন। ব্যাটা সত্যিই মরেছে?
মরে ভূত হয়ে গেছে, বলল লী গফ।
আরে! বাধা দিয়ে বলল ডরনি শ, এ-তো ম্যাকলেনন না! স্টীলম্যান!
একসঙ্গে স্টীলম্যানের পাশে জড়ো হলো ওরা।
তাই তো! হিংস্র কণ্ঠে বলে উঠল বারউইক। মুশকিল হলো দেখছি। এখন ম্যাকলেননকে ধরতে না পারলে- ডরনি শর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে চুপ করে গেল সে।
ডরনির হালকা ধূসর চোখ দুটো ছেলেমানুষি উত্তেজনায় নেচে উঠল।
কুছ পরোয়া নেই, বস, সিগারেট ফেলে গোড়ালি দিয়ে পিষে নেভাতে নেভাতে বলল সে, আমি আছি কেন? ম্যাকলেনন শালাকে আমার হাতে ছেড়ে দাও। কাল সন্ধ্যা নাগাদ ব্যাটার দফারফা করে দিচ্ছি!
আমি আসব? পয়েন্সেট জিজ্ঞেস করল।
দরকার হবে না, বলল ডরনি শ। তবে চাইলে আসতে পারো। শুনেছি বব ম্যাকলেনন নাকি সীমান্তের কোন এক শহরের মার্শাল ছিল। মার্শালের বাচ্চাদের আমার মোটেই সহ্য হয় না।
যার যার ঘোড়র কাছে ফিরে এল ওরা, স্যাডলে চেপে রওনা হলো। পশ্চিমে গেল ডরনি শ, পয়েন্সেট এবং লী গফ-বব ম্যাকলেননকে শিকার করতে যাচ্ছে; অ্যাল্টন বারউইক, চোখের কোণে কুঞ্চন, চলেছে পুবে, মাসট্যাংয়ের দিকে। অন্যরাও রয়েছে তার সঙ্গে। অস্বস্তির সঙ্গে স্যাডলে বসে পেছন ফিরে তাকাল ফেসেনডেন।
ওদের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারলে ভালো হত; বলল সে।
শখ থাকলে ফিরে যাও! বলল ক্লসন। বললাম তো সবকটা মরে ভূত হয়ে গেছে। কেড্রিক শালাকে অসহ্য লাগত আমার! পয়লা গুলিটা সোজা তার। খুঁলি বরাবর ছুঁড়েছি, বুঝলে?
বিকেল গড়িয়ে চলল। পশ্চিমে হেলে পড়ল সূর্য। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে নামল প্রচণ্ড শীত। রূপালি চাঁদের কাছে কোথায় যেন করুণ ফরিয়াদ জানাল একটা কয়োটি। অন্ধকার আকাশের নীচে নিস্তব্ধ মরুভূমি।
আকাশচুম্বী চিমনি রক আর তার আশপাশে কোথাও কোনও স্পন্দন নেই। একটা কয়েটি এদিকে এগিয়ে আসছিল। বাতাসে রক্তের গন্ধ পেয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। পিছিয়ে গেল দুকদম। তারপর ঘুরে ছুট লাগাল যেদিক থেকে আসছিল সেদিকে। পেছন ফিরে তাকাল একবার। পুকুর পারে এখনও আছে কেড্রিকের অ্যাপলুসা, হাঁটছে, মাঝে মাঝে ঘাস খাচ্ছে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল ওটা, রক্তের গন্ধে নাকের পাটা ফুলে উঠল।
গাছপালা আর বোল্ডারের আড়ালে থাকায় গোলাগুলির সময় মাথা তুলেও কিছু দেখতে পায় নি ঘোড়াটা, ঘাস খাওয়ায় মন দিয়েছে আবার। কোথাও কিছু নড়ছে না। রাতের হিম রক্ত জমাট বাঁধিয়ে দিচ্ছে। আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে মাটিতে শায়িত মানুষগুলোর শরীর।
.
দশ মাইল উত্তরে, একটা খোঁড়া ঘোড়া টেনে নিয়ে পায়ে হেঁটে এগোচ্ছে লরেডো শ্যাড। কেড্রিকের সঙ্গে সন্ধ্যায় দেখা করার কথা, দেরি করে ফেলেছে। ঘণ্টা দুএক আগে একটা খাদের কিনারা ধরে এগোনোর সময় মাটি ধসে পড়ায় আছড়ে পড়ে পা মচকেছে ঘোড়াটার। আপনমনে বিড়বিড় করে চলেছে শ্যাড, হাঁটছে, দুঘণ্টা ধরে রাতের মতো ক্যাম্প করবে না এগিয়ে যাবে, ঠিক করার চেষ্টা করছে। কেড্রিক ওর জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে ভেবে থামতে পারছে না।
এক ঘণ্টা পর। পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে, তবু হাঁটছে লরেডো শ্যাঙ। হঠাৎ ঘোড়ার খুরের শব্দ কানে এল। দাঁড়িয়ে পড়ল ওঁ। রাইফেল তুলে নি। হাতে। একটু পরেই আঁধার ফুড়ে বেরিয়ে এল এক অশ্বারোহী, রাশ টানল সে। দীর্ঘ নীরবতা। লরেডো শ্যাডই প্রথম কথা বলল।
নাম বলো, পার্ডনার।
নবাগত অশ্বারোহীও সশস্ত্র। বব ম্যাকলেনন, বলল সে। তুমি?
লরেডো শ্যাপ। আমার ঘোড়াটা খোঁড়া হয়ে গেছে। চিমনি রক-এর দিকে যাচ্ছি। কেড্রিকের সঙ্গে ওখানে দেখা করার কথা। ম্যাকলেমনের দিকে তাকাল ও। তোমারও তো মিটিংয়ে থাকার কথা ছিল? কি হলো?
আমি সময় মতো পৌঁছুতে না পারায় সেগাল আর স্টলম্যান গিয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যার পরেও ওরা ফেরে নি, তাই খোঁজ করতে বেরিয়েছি।
কী বললে? তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরুল শ্যাডের গলা চিরে। ম্যাকলেনন, আমার ভয় হচ্ছে। কোথাও একটা ভজকট হয়ে গেছে বোধ হয়। বারউইককে ফুটো পয়সারও বিশ্বাস নেই!
টেক্সানকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাপল ম্যাকলেনন। লোকটাকে ভালো লাগলেও দ্বিধা হচ্ছে।
তোমার মার্কা কিন্তু অন্য কথা বলে, তুমি কোম্পানির লোক নও?
মাথা নাড়ল লরেডো শ্যাড। আসলে ব্যাপারটা এরকম, এখানে লড়াই করে টাকা কামাতে এসেছিলাম। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে বাছবিচার করেচিলি আমি। এখানকার ব্যাপারস্যাপার আমার আর কেড্রিকের পছন্দ হয় নি। তাই কোম্পানির কাজ ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছিলাম আমরা। শুধুমাত্র শান্তি বজায় রাখা যাবে, এই আশায় রয়ে গিয়েছিল কেড্রিক। আমি ওর সঙ্গ ছাড়ি নি।
আমার পেছনে উঠে পড়ো; বলল ম্যাকলেনন। দুজনকে অনায়াসে পিঠে নিতে পারবে আমার ঘোড়া, তা ছাড়া বেশি দূর তো নয়!
১০. চোখ মেলে তাকাল কেড্রিক
চোখ মেলে তাকাল কেড্রিক, অনেকক্ষণ বুঝতে পারল না কিছু। অপরিচিত একটা কামরায় নরম বিছানায় শুয়ে আছে ও। অনেকগুলো মুহূর্ত নিঃসাড় পড়ে রইল, স্মৃতির পাতা হাতড়ে বোঝার চেষ্টা করল কোথায় আছে? কেন? আচ্ছা, কে ও? হ্যাঁ, মনে পড়েছে ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক নিউ অরলিন্স থেকে…একটা কাজ নিয়ে পশ্চিমে এসেছিল…এবার একে একে মনে পড়ে গেল সব।
চিমনি রক-এ মিটিং ছিল। ম্যাকলেনন আসতে না পারায় স্টীলম্যানকে নিয়ে সভায় যোগ দিতে এসেছিল পিটার সেগাল। ঠোঁট থেকে সিগারেট ফেলতে গিয়ে সামনে তাকাতেই পাথরের আড়ালে লুকানো লোকগুলোকে দেখতে পায় ও, রাইফেলের ব্যারেলে সূর্যের আলো ঝিলিক মারছিল। সঙ্গে সঙ্গে বাকি দুজনকে সাবধান করে মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, আহত হয়েছে ও, কমপক্ষে একটা গুলি ঢুকেছে শরীরে।
কতক্ষণ, কতদিন আগের ঘটনা সেটা? ঘাড় ফিরিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকাল পল কেন্দ্রিক। চৌকো কামরা, একদিকের দেয়াল নিরেট পাথরের তৈরি, অন্য এক দেয়ালের অংশবিশেষও তাই। ঘরের অবশিষ্ট অংশজুৎসই পাথরের টুকরো বসিয়ে বানানো হয়েছে। বিশাল বিছানা ছাড়াও এ-ঘরে একটা চেয়ার টেবিল আছে। কেড্রিক নড়ে উঠতেই ক্যাঁচ ক্যাচ শব্দে তীব্র আপত্তি জানাল খাটা। ঘরের দরজা খুলে গেল। মুখ তুলেই সামান্থা ফক্সের চেহারা দেখতে পেল কেড্রিক।
সামা? বিস্মিত কেড্রিক। কোথায় আমি? কী হয়েছে আমার?
কয়েকদিন হলো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছ, বিছানার পাশে দাঁড়াল সামান্থা। মারাত্মক চোট পেয়েছ, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে তোমার। আহত হওয়ার অনেক পর লরেডো শ্যাড আর বব ম্যাকলেনন তোমাকে খুঁজে পেয়ে এখানে নিয়ে এসেছে।
আর সেগালরা?
দুজনই মারা গেছে। তোমারও মারা যাবার কথা ছিল।
কিন্তু এটা কোন জায়গা?
বহু পুরোনো একটা ক্লিফ-হাউস। থিভিং-রক পাহাড়ের ওপর এক পাশে বানানো হয়েছে এ-বাড়িটা। ম্যাকলেনন চিনত। তুমি বেঁচে আছ জানতে পারলে ওরা আবার তেড়ে আসবে বুঝতে পেরে তোমাকে এখানে নিয়ে আসে ও। লরেডো শ্যাড ওকে সাহায্য করেছে।
এখন এখানে আছে ওরা? শ্যাঙ আছে। প্রায়ই জিনিসপত্র আনতে ইয়েলো বার্ট-এ যেতে হয় তাকে। ইদানীং খুব সতর্ক থাকতে হচ্ছে, সম্ভবত সন্দিহান হয়ে উঠেছে ওরা।
আর ম্যাকলেনন?
ও মারা গেছে, পল। ডরনি শ খুন করেছে ওকে! তোমার জন্যে ডাক্তার আনতে মাস্ট্যাংয়ে গিয়েছিল, মাঝ রাস্তায় ওকে গানফাইটে চ্যালেঞ্জ করে ডরনি। বব ম্যাকলেনন ক্ষিপ্র, কিন্তু ডরনি শয়ের মতো নয় কোনওমতেই, পিস্তলু বের করার আগেই ডরনির গুলিতে মারা গেছে।
তুমি এখানে এলে কী করে? লরেডো শ্যাডের সঙ্গে আলাপ করে, ম্যাকলেনন আমার কাছে গিয়েছিল। আমি কোম্পানির বিরোধিতা করছি জানত। সেজন্যেই আমাকে বেছে নিয়েছে। ওরা। তোমার আহত হওয়ার খবর পেয়ে দেরি করি নি, এখানে চলে এসেছি। খুব ভালো না হলেও নার্সিং মোটামুটি জানতাম, লরেডোর সাহায্যে যদূর সম্ভব করেছি। লরেডো অসম্ভব ভালো লোক, পল। একেই বোধ হয় বন্ধু বলে। তোমার জন্যে কিনা করেছে! না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না।
মাথা দুলিয়ে সায় দিল কেড্রিক। গুলি করেছিল, কারা? আমি সম্ভবত পয়েন্সেটকে দেখেছি।
হ্যাঁ, সে-ও ছিল। ওদের এ-নিয়ে কয়েকবার আলোচনা করতে দেখলেও এমন কিছু হতে পারে ভাবতে পারি নি। পয়েন্সেটের সঙ্গে লী গফ, ফেসেনডেন, ক্লসন আর ডরনি শ ছিল ওখানে।
আর কিছু ঘটেছে?
কী নয়? ইয়েলো বাট স্যালুন আর লিভারি-স্ট্যাবল পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে ওরা। অর্ধেকেরও বেশি লোককে তাড়িয়ে দিয়েছে ঘর-বাড়ি থেকে। সারভেঅররা এখন কাজ করছে ওখানে, আগের জরিপে ভুল থাকলে শুধরে নেয়ার জন্যে এসেছে। পিট লেইন আর তোমার বন্ধু ডাই রীডের নেতৃত্বে ইয়েলো বাটবাসীদের একটা দল পাহাড়ের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে। ওখানে বসে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে ওরা।
আর স্যু লেইন? ঝট করে কেড্রিকের দিকে তাকাল সামান্থা ফক্স! মেয়েটাকে তোমার খুব পছন্দ, না? ও, হ্যাঁ-কীথের সঙ্গে যোগ দিয়েছে সে। চব্বিশ ঘণ্টাই একসঙ্গে আছে। বলতে গেলে কীথই এখন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আরও কয়েকজন পিস্তলবাজ আমদানি করা হয়েছে। মিক্সাসরাও আছে। অ্যাল্টন বারউইক আর লরেন কীথের হাতের মুঠোয় চলে গেছে দেশটা। এরই মধ্যে একটা নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেছে ওরা।
নির্বাচন?
হ্যাঁ। নিজেরাই ভোট গুনেছে। মেয়র হয়েছে আমাদের কর্নেল কীথ, আর ফেসেনডেন হয়েছে শেরিফ। সঙ্গত কারণেই নির্বাচনে দাঁড়ায় নি করউইক। আর ডরনি শ তো প্রাণ গেলেও শেরিফের কাজ করবে না।
তা হলে দেখা যাচ্ছে সবকিছু সামলে নিয়েছে ওরা, না? বলল কেড্রিক। আমি বেঁচে আছি এখনও জানতে পারে নি বোধহয়।
না, চিমনি রক-এ ফিরে গিয়ে তিনটে কবর খোড়ে লরেডো শ্যাঙ, সেগাল আর স্টলম্যানকে কবর দিয়ে অন্য গর্তটিও আবার মাটি ফেলে ভরে দিয়েছে ও। তারপর ওটার ওপঃ তোমার নাম-ফলক পুঁতে দিয়েছে।
বাহ, চমৎকারর! সন্তুষ্ট হলো পল কেড্রিক। সামান্থার দিকে তাকাল। আচ্ছা, ওদের চোখে ধুলো দিয়ে এখানে যাওয়া-আসা করছ কীভাবে?
ঈষৎ রক্তিম আভা লাগল সামান্থার গালে। আমি আর ফিরি নি, পল। এ কদিন তোমার কাছেই ছিলাম। আসা-যাওয়া করার উপায় থাকলে তো? সব ফেলে চলে এসেছি আমি,
আর কয়দিন শুয়ে থাকতে হবে আমার?
ঠিক মতে, বিশ্রাম নিলে বেশি না। নাও, এবার চুপ করো, অনেক কথা হয়েছে।
মনে মনে পরিস্থিতি বিচার করে দেখল পল কেড্রিক। শিগগিরই জমি কেনা হয়ে যাবে বারউইকদের। এখন ওর একটাই কর্তব্য, অবৈধ উপায়ে কোম্পাৰি যাতে মুনাফা লুটতে না পারে, যেভাবে হোক তার ব্যবস্থা নেয়া। শুয়ে শুয়ে আস্তে আস্তে একটা প্ল্যান খাড়া করে ফেলল ও। ফঁক-ফোকরগুলো বন্ধ করে ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিল সেটাকে।
কাছেই দেয়ালে পেরেকের সঙ্গে ঝুলছে ওর পিস্তল দুটো। সেইন্ট জেমস থেকে আস্তাবলে রেখে আসা ব্যাগটাও আছে এক কোণে।
সন্ধ্যা নাগাদ চূড়ান্ত হয়ে গেল কেড্রিকের পরিকল্পনা। এর পরপরই লরেডো শ্যাড এল, বিস্তারিত জানাল ওকে। সিম্যারন? একটু ভেবে মাথা দোলাল লরেডো, বুমফীল্ড হলে কাছে হত না? কী বলে?
ঠিক আছে, সায় দিল কেড্রিক, তা হলে আর দেরি করো না।
ও-নিয়ে ভাবছি না, তামাক চিবুতে চিবুতে বলল লরেডো শ্যাড। কদিন থেকেই খুবই সন্দেহবণ হয়ে উঠেছে ওরা। আমি বাইরে থাকতে থাকতেই ট্রেইল করে এখানে এসে পড়লে?
ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই। এই যে নাও, টেলিগ্রাম আর চিঠি দেরি করো না!
.
জানালা গলে রোদ ঢুকে গড়াগড়ি যাচ্ছৈ কামরায়। নাশতা নিয়ে ভেতরে এল সামান্থা ফক্স। কেড্রিকের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল চেহারা। আরে তুমি দেখছি বসে আছ?
বোকার মতো হাসল কেড্রিক। হ্যাঁ, শুয়ে শুয়ে তো কম দিন কাটালাম না। আচ্ছা, কদিন হলো বলো তো?
প্রায় দুসপ্তাহ, বলল সামান্থা, কিন্তু এখন কিছুতেই হাঁটাহাঁটি করা চলবে না। আরও কিছু দিন বিশ্রাম নিতে হবে।
জানালার কাছে এক কোণে বসলে নীচের ট্রেইলে সহজে নজর রাখা যায়। কেড্রিক ওখানে বসার পর একজোড়া উইনচেস্টার ওকে এনে দিল সামান্থা। অস্ত্র দুটো পরিষ্কার করে নিল কেড্রিক, যত্নের সঙ্গে তেল দিয়ে পালিশ করল; তারপর টোটা ভরে জানালার সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখল। এবার পিস্তলদুটো পরীক্ষা করে ঢুকিয়ে রাখল হোলস্টারে। সব ঔষে স্যাডলব্যাগ থেকে ওয়েলশ নেভী পিস্তল দুটি বের করে পরখ করল।
এখন আর কিছুই হয়তো করার নেই, ভাবছে কেড্রিক, অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু আরও আগে র্যানসামের কথা মনে পড়ল না কেন? আশ্চর্য! ফ্রেডরিক র্যানস্যামের মতো আঁদরেল উকিল সারা ওয়াশিংটনে আর আছে। কিনা সন্দেহ। গৃহযুদ্ধের সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে ওরা। ফ্রাংকো প্রশিয়ান ওঅরে, ফ্রান্সে থাকতে ওর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরিদর্শক হিশেবে ওখানে গিয়েছিল রানসাম। কোম্পানির জমি কেনায় কেউ যদি বাধা দিতে পারে, একমাত্র ও-ই পারবে, সময় যত কমই হোক না কেন!
টেলিগ্রামের সঙ্গে বিস্তারিত বিবরণসহ চিঠিও যাচ্ছে র্যানসামের কাছে, ওটার সাহায্যে একটা উপায় ঠিকই বের করে ফেলবে ও। জনপ্রিয় এবং করিৎকর্মা তরুণ সিটের র্যানসামের উঁচু মহলে যথেষ্ট যোগাযোগ, অমায়িক ব্যবহার দিয়ে সহজে যে কোনও কাজ আদায় করে নিতে পারে। তা ছাড়া র্যানসাম একজন সুযোগ্য স্ট্রাটেজিস্টও বটে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন একজন লোকই দরকার।
পাহাড়ের অনেকটা ভেতরে লোকচক্ষুর আড়ালে যে কোনও হামলা ঠেকানোর উপযোগী করে বানানো হয়েছে এই ঘরটা। এই পাহাড়ের নাম, সামান্থা জানিয়েছে, থিভিং-রক। শাদারা এখানে আসার বহু আগে যেসব ইন্ডিয়ান থাকত, ভয়ঙ্কর চোর ছিল ওরা, তাই, এই নামকরণ। এখানে ঝর্না থাকায় পানির অভাব নেই। জরুরি প্রয়োজন মেটাবার মতো রসদপত্র রাখারও ব্যবস্থা আছে।
ধীরে ধীরে আরও দুটো দিন কেটে গেল। ততীয় দিন সকালে, জানালার পাশে বসতে যাবে, এমন সময় নীচের সংকীর্ণ ক্যানিয়নে একজন ঘোড়সওয়ারকে ঢুকতে দেখল কেড্রিক।
আস্তে আস্তে এগোচ্ছে লোকটা, তীক্ষ্ণ চোখে ট্রেইল জরিপ করছে। মাঝে মাঝে থামছে, সতর্ক নজর বোলাচ্ছে চারদিকে।
উঠে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন কেড্রিক র একটা উইনচেস্টার নিয়ে পাশের কামরায় চলে এল।
সামান্থা? মৃদু কণ্ঠে ডাকল ও।
সাড়া নেই।
একটু অপেক্ষা করে আবার ডাকল পল। সাড়া মিলল না।
এবার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল কেড্রিক, মনে পড়ল, সজির ঘাটতি মেটাবার জন্যে স্ক-ক্যাবেজ আনতে নীচে যাবে বলেছিল সামান্থা।
আবার জানালার কাছে ফিরে এল কেড্রিক। সতর্কতার সঙ্গে সামনের এলাকা জরিপ করল। বুকের ভেতর আচমকা লাফিয়ে উঠল হৃৎপিণ্ডটা। ক্যানিয়ন দেয়ালের একটা গর্ত থেকে স্ক-ক্যাবেজ তুলছে সামান্থা ফক্স, বড় জোর পঞ্চাশ গজ দূরেই দাঁড়িয়ে আছে অনাহুত অশ্বারোহী!
রাইফেল উঁচিয়ে দূরত্ব মাপল কেড্রিক। কমপক্ষে চারশো গজ দূরে, এবং নীচে রয়েছে লক্ষ্যবস্তু। সযত্নে অশ্বারোহীকে তাক করল ও। তারপর রাইফেল নামিয়ে নিল। সামান্থার অনেক কাছে পৌঁছে গেছে লোকটা, গুলি ফসকে গেলে পাথুরে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ওকে আঘাত করতে পারে। ছুটন্ত বুলেট ক্যানিয়ন-দেয়ালে বাড়ি খেয়ে আবার ক্যানিয়নে ফিরে আসবে, সংকীর্ণ জায়গায় ছুটোছুটি করবে ওটা, বিপদের আশঙ্কা আছে।
সামান্থাকে বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করার একটা উপায় বের করা দরকার। আগত অশ্বারোহী সামান্থার পায়ের ছাপ দেখতে পেলে এই হাইডআউটের অস্তিত্ব ফাঁস হয়ে যাবে। লোকটার ঘোড়ার কানজোড়া আচমকা খাড়া হয়ে গেল, আড়ষ্ট হলো সে, সতর্ক, ডানে বাঁয়ে তাকাল। সাবধানে আবার অশ্বারোহীকে তাক করল কেড্রিক। অসতর্ক শত্রুকে হত্যা করা ওর ধাতের বাইরে, কিন্তু নিরুপায় হলে সেটাও করতে হবে!
সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে সামান্থা ফক্স 1 কান পেতে কী যেন শোনার চেষ্টা করছে। উত্তেজনায় টান টান হয়ে গেছে পল কেড্রিক। নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ও, কান খাড়া। অপেক্ষা করছে। এই মুহূর্তে বড় জোর পঞ্চাশ ফুট দূরত্ব। সামান্থা আর আগন্তুকের মাঝে। অবশ্য বেরিয়ে থাকা একটা পাথর আর ওটার গায়ে জন্মানো আগাছা, একটা কটনউড আর গোটা কয়েক সিডার ওদের আলাদা করে রেখেছে।
কান পেতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ওরা। জিভের ডগা দিয়ে ঠোঁট ভেজাল পল কেড্রিক। অনেকক্ষণ এক নজরে তাকিয়ে থাকায় চোখে জ্বলুনি শুরু হয়েছে। হাতের পিঠে চোখ মুছল ও।
স্যাডল থেকে নামল অশ্বারোহী, হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করল। সাবধানে ঘোড়ার কাষ্ট্র থেকে সরে এল সে, সামান্থার দিকে তাকাতেই কেন্দ্রিক দেখল হাত নাড়ছে মেয়েটা কেড্রিকও হাত নাড়ল প্রত্যুত্তরে। আবার রাইফেল তুলে ধরল ও। হাত নেড়ে আপত্তি জানাল সামান্থা। হাঁপ ছেড়ে অপেক্ষা করতে লাগল ক্যাপ্টেন কেড্রিক।
ক্যানিয়নের বালিময় তলদেশে ট্র্যাক পরখ করছে লোকটা। হাঁটু গেড়ে বসেছে। এদিক-ওদিক নজর বোলাচ্ছে। এই সময় নতুন চরিত্রের প্রবেশ ঘটল মঞ্চে। কেড্রিকের চোখের কোণে মৃদু নড়াচড়া ধরা পড়ায় ফিরে তাকাল ও, লরেডো শ্যাড এগিয়ে আসছে। চট করে জানালার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল লরেডো। তারপর একটু সামনে এগিয়ে স্যাডল থেকে নামল।
এত দূরে, জানালার কাছে বসে কিছুই শুনতে পাচেছ না কেড্রিক। কিন্তু বুঝতে পারছে গভীর বালির ওপর দিয়ে এগোতে কষ্ট হচ্ছে লরেড়ো শ্যার্ডের। অচেনা শত্রু থেকে মোটামুটি বার গজ দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল ও।
নিশ্চয়ই কিছু বলেছে শ্যাড, হঠাৎ স্থির হয়ে গেল লোকটা। খুব আস্তে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। তারপর ঘুরল। সূর্যের আলোয় তার চেহারা দেখতে পেল কেড্রিক।
ক্লসন!
এর পরের ঘটনা প্রায় চোখের পলকে ঘটে গেল, কে, জানার উপায় নেই, একজন কিছু বলল। আচমকা পিস্তলবাজের বিশেষ কায়দায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল লরেডো শ্যাড, চকিতে বেরিয়ে এল ডানহাতের পিস্তল রোদ পড়ে ঝিকিয়ে উঠল ওটার মাল, মুহূর্তের জন্যে স্থির হলো। এবং ক্লসন ট্রিগার টেপার আগমুহূর্তে গুলি করল ও।
টলতে টলতে এক কদম পিছিয়ে গেল ক্লসন। আবার ট্রিগার টিপল লরেডাৈ শ্যাঙ। আস্তে আস্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল আউট-ল। এগিয়ে গেল লরেডা, ক্লসনের কোমর থেকে গানবেল্ট খুলে নিল। তারপর ঘোড়ার পিঠ থেকে স্যাডলব্যাগ, রাইফেল আর কার্তুজ নামাল। এবার ক্লসনের লাশ সামান্থার সাহায্যে ধরাধরি করে স্যাডলে তুলে বেঁধে দিল। ঘোড়ার পাছায় চাপড় লাগাতেই ছুটতে শুরু করল ওটা।
সামান্থা ফক্স যখন ঘরে এল, মুখ ফ্যাকাসে। পুরো ঘটনাটা দেখেছ তুমি?
মাথা দোলাল কেড্রিক। ওকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে দেয়া সম্ভব ছিল না। ক্লসন ফিরে গেলে কাল দুপুর নাগাদই আমরা শেষ হয়ে যেতাম। কিন্তু এবার, সন্তোষের হাসি হাসল ও, নিজেদের প্রাণের কথা ভাবতে হবে
ভেতরে ঢুকে কেড্রিকের দিকে তাকিয়ে হাসল লরেডো শ্যাড। ব্যাটা আগেই পিস্তল বের করে রেখেছে জানতাম না, বলল ও।দুপায়ের মাঝখানে পিস্তল লুকিয়ে বসেছিল। আরেকটু হলেই গিয়েছিলাম।
স্যাডলব্যাগটা নামিয়ে রাখল লরেড়ো শ্যাড। কিছু খাবার, বলল ও, আর কয়েক রাউন্ড গুলি আছে এটায়। আমি আসার সময় গুলি নিয়ে এসেছি। ক্লসনেরগুলোও কাজ দেবে কী বল? তোমার টেলিগ্রাম আর চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছি। টেলিগ্রাফারের একশো একটা প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মুখে ফেনা উঠে গেছে-আমার এখানকার গোলযোগের কথা বোধ হয় চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
চমকার, যত প্রচার পাবে তত ভালো। মুসিবতে পড়ে যাবে কোম্পানি, আমাদেরই লাভ। নতুন কিছু কানে এল?
হ্যাঁ। গুন্টারের হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাইরের এক লোক হৈ-চৈ শুরু করে দিয়েছে। তোমার ঘাড়ে নাকি দোষ চাপানোর চেষ্টা চলছে। কোম্পানি, বলছে
তুমিই খুন করেছ। মাথা ঝাঁকাল কেড্রিক। জানতাম, ওরা এমন কিছু বলবে। যাকগে, দুএকদিনের ভেতর এখান থেকে বেরিয়ে পড়ছি আমি। তারপর দেখা যাবে কত ধানে কত চাল।
আরও কদিন সময় নিলে ভালো করতে, অনিশ্চিত কণ্ঠ বলল লরেডো শ্যাড। বদমাশগুলো এত তাড়াতাড়ি আমাদের খোঁজ পাবে না। অবশ্য, হঠাৎ বলল ও, পরশু সেই গ্রুলা মাস্ট্যাংটার ট্র্যাক দেখেছি আমি। কাছেই।
আবার গ্রুলা!
আরও দুটি দিন কেটে গেল। লরেডোর সঙ্গে পাহাড় থেকে নীচে নেমে এল পল, কেড্রিক ক্যানিয়নে হাঁটাহাঁটি করল। অদূরে একটা গুহায় ওদের ঘোড়া লুকিয়ে রাখা হয়েছে, ওগুলোর খোঁজ খবর নিল। ওকে দেখে খুশিতে মাথা নেড়ে ছুটে এল অ্যাপলুসা। হাসি মুখে ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিল কেন্দ্রিক।
কী-রে, তৈরি আছিস তো?
বল খেপে আছে, বলল শ্যাঙ। একটা সিগারেট ধরিয়ে চোখ ছোট করে কেড্রিকের দিকে তাকাল। এখান থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবে?
একটু ঘুরে ফিরে দেখব, তারপর পিট লেইনের সঙ্গে আলাপ করতে যাব। তারপর যারা আমাদের ফাঁদে ফেলে খুন করার চেষ্টা করেছে, সেই শয়তানগুলোকে খুঁজে বের করে নিজের হাতে শায়েস্তা করব। বিশেষ করে ডরনি শকে চাই আমি!।
লোকটা এক নম্বর হারামী, লরেডো বলল শান্ত কণ্ঠে। আমি অবশ্য দেখি নি, তবে সামান্থার কাছে শুনলাম, ওর হাতে নাকি বিদ্যুৎ আছে! ববকে খুন করার সময় সামান্থা দেখেছে ওকে।
আমাদের একজন খুন হয়েছে ওর হাতে, শান্ত কণ্ঠে বলল কেড্রিক, জান দিতে হলেও বদলা নেব আমি।
ঠিক বলেছ। ডরনি একটা খুনী! তবে পালের গোদা অ্যাল্টন বারউইক, আসল শয়তান। কীথ লোকটা ওর ডানহাত মাত্র। প্রয়োজনে তাকেও রিনা দ্বিধায় খুন করবে বারউইক। ওর মতো ধড়িবাজ লোক আর পাবে না।
তিনদিন পর সামান্থাকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হলো ওরা রিমের উল্টো দিকে, পিট লেইনের আস্তানায় এসে পৌঁছুল। হাইডআউটে ঢোকার পথে বাধা দিল ডাই রীড। তারপর পল কেড্রিককে চিনতে পেরে খুশি হয়ে উঠল সে।
আরে, পল, তুমি! চোখে মুখে শান্তির ছাপ তার। এসো, বাবা, এসো! আমরা শুনেছিলাম ওরা তোমাকে মেরে ফেলেছে!
অগ্নিকুণ্ডের কাছে দাঁড়িয়ে আছে পিট লেইন, ওকে ঘিরে, শুয়ে আছে দশবারজন লোক। এদের সবাইকেই মোটামুটি চেনে কেড্রিক। ওরা তিনজনে খোলা জায়গায় আসলে আস্তে আস্তে উঠে বসল সবাই। ঘুরে দাঁড়াল পিট লেইন। পিটকে সামনাসামনি দেখে অবাক হয়ে গেল কেড্রিক।
মোটামুটি স্যু লেইনের মতো লম্বা, বিশাল কাঁধ ছেলেটার, চিকন কোমর শক্তিশালী কাঠামো। সরাসরি ওদের দিকে তাকিয়ে আছে, তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। দেখলেই বোঝা যায়, ভাবল কেড্রিক, ডরনি শয়ের মতোই বিপজ্জনক চরিত্র।
আমি কেড্রিক, বলল ও, ওর নাম সামান্থা ফক্স, আর লরেডো শ্যাডকে তো তোমরা চেনোই।
তোমাদের সবাইকে আমরা চিনি, সতর্ক কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওদের মাপল পিট।
.
শান্ত কণ্ঠে নিজের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করল পল কেড্রিক। তো এই হলো ব্যাপার, রিস্তারিত বর্ণনার পর যোগ করল ও। আমার বন্ধুকে ঘটনা সম্পর্কে তদন্ত শুরু করার ব্যবস্থা নিতে বলেছি। আসল সত্য বের না হওয়া পর্যন্ত জমি বিক্রি যাতে বন্ধ থাকে সেটা দেখবে ও। বিক্রি বন্ধ হওয়ার পর তদন্ত শুরু হলে কীথরা আর এখানে থাকতে পারবে না। প্রকৃত ঘটনা চাপা দিতে পারলেই কেবল ওদের রেহাই পাবার আশা আছে, কিন্তু সেটা কোনওমতেই সম্ভব নয়।
আমরা এখানে বসে থাকি আর ওরা কেটে পড়ক, এই বলতে চাইছ? জিজ্ঞেস করল পিট লেইন।
না! মাথা নেড়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল পল কেড্রিক। সোজা মাস্ট্যাংয়ে যাব আমরা!
ওখানে এখন কোম্পানির লোকেরা শেরিফ আর মেয়রের পদ দখল করেছে বটে, কিন্তু জনগণ আমাদের পক্ষে তা ছাম, সহজ কণ্ঠে বলল, ও, বিক্রি বন্ধের খবর ওদের কানে যাবার পরই আমরা হাজির হব, খবরটা রাষ্ট্র হওয়ার পর কেউ আর ওদের পক্ষ নেবে না। জানপ্রাণ দিয়ে পালানোর পথ খুঁজবে পিস্তলবাজের দল।
গোলাগুলি হবেই, বুড়ো মতো একজন বলল।
হলেও সামান্য, সায় দিয়ে বলল কেড্রিক। আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলে প্রায় সবাইকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে। খুনীর দল আড্ডা গেড়েছে ওই শহরে। স্টীলম্যান আর সেগালের হত্যাকারী ওরা, বব ম্যাকৃলেননের হত্যাকারী। ববের খুনীকে হাতের মুঠোয় পেতে চাই আমি।
ঘুরে তাকাল প্লিট, লেইন না, আমি!
দুঃখিত, লেইন। ববকে খুন করেছে শ। আমার জন্যে ডাক্তার আনতেই মাস্ট্যাংয়ে গিয়েছিল বব। অবশ্য বলা যায় না তুমিও, শেষ করার আগে বলল কেড্রিক, সুযোগ পেয়ে যেতে পারো।
ওকে মারতে পারলে আমিও খুশি হতাম, শান্ত কণ্ঠে বলল লরেডো শ্যাড। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। এল মাস্ট্যাংটার মালিক কে? ঘোড়াটা তোমাদের কারও?
মাথা নাড়ল লেইন। না, আমরাও একই কথা ভাবছি।
আশপাশেই ঘুরঘুর করে, বুড়ো বলল, অথচ আজ পর্যন্ত কেউ তার চেহারা দেখে নি। আমাদের চেয়ে জায়গাটা অনেক বেশি চেনে লোকটা। অনেক আগে থেকে এখানে আছে বোধ হয়।
লোকটার মতলব, বলল শ্যাড, যদি বোঝা যেত!
কাঁধ ঝাঁকাল কেড্রিক। হু, জানা গেলে ভালো হত। ডাই রীডের দিকে ফিরল ও। তোমাকে দেখে স্বস্তি পেয়েছি। বিপদে পড়েছ ভেবে দুশ্চিন্তায় ছিলাম।
বিপদ? দাঁত বের করে হাসল, ডাই রীড। বিপদের কথা বলছ? হাহ! বিপদ মাথায় নিয়েই তো এতদিন বেঁচে আছি! দুনিয়ায় যতদিন মানুষ থাকবে, বিপদ তার পিছু ছাড়বে না। ওর কোনও মা-বাপ আছে? তাই আজকাল আর ও-নিয়ে ভাবি না! ছোট ভঁটঅলা পাইপে টান দিল ডাই রীড, কেড্রিকের মাথার ক্ষতস্থানের দিকে তাকাল। তুমি নিজেই তো ভালো বিপদে পড়েছিলে বলে মনে হচ্ছে? খুলিটা আর একটু নরম হলে টের পেতে!
ওকে যে অবস্থায় পেয়েছি, তিলমাত্র আশা ছিল না, বলল লরেড়ো শ্যাড। শরীরে গুলি নিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল ওরা তিনজন। ধরে নিয়েছিলাম তিনজনই মারা গেছে। কেড্রিকের শরীর আর মাথা তো, ফুটো হয়ে গিয়েছিল। ওকে যখন ছায়া থেকে সরিয়ে আনি, আমি ভেবেছিলাম, মাথাটা বুঝি গুড়ো হয়ে গেছে। স্রেফ কপাল জোরে বেঁচে গেছে!
.
সকালে আবার স্যাডলে চেপে বেরিয়ে পড়ল পল কেড্রিক আৰু লরেডো শল্পড়। পিট লেইনের হাইউআউটে কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে রয়ে গেছে সামান্থা ফক্স। ধীরে সুস্থে সময় নিয়ে মাস্ট্যাংয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে ওরা। তবে আপাতত কোম্পানির লোকদের মুখোমুখি হতে চায় না।
আমাদের অবশ্য বেশি কিছু করার নেই, লরেডোর কথায় সায় দিয়ে বলল কেড্রিক, তবে আমি শহরের আশপাশের এলাকার নকশা মনে গেঁথে নিতে চাই। বারউইকরা খবরটা পাওয়ার পর কী ঘটবে সঠিক অনুমান করার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এই মুহূর্তে তো সব কিছু ওদের অনুকূলে, বেশ শক্ত অবস্থানে আছে বারউইক আর কীথ।
একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবে ব্যাপারটা। স্কোয়াটারদের দখলে আছে এমন একটা জমির লোভে এখানে এসেছিল ওরা। জায়গাটা জরিপের ব্যবস্থা করেছে। বেশির ভাগ এলাকায় নিজেদের দাবী প্রতিষ্ঠিত করেছে। জায়গামতো নোটিস জারি করে সময় শেষ হবার অপেক্ষায় ছিল; নোটিসটা কারও চোখে না পড়লে এত দিনে ওদের জমি কেনা হয়ে যেত, কারও কিছু করার থাকত না। কিন্তু নোটিসটা একজনের চোখে পড়াতেই ঝামেলা বেধে গেল। স্কোয়াটাররা নেতৃত্ব দেয়ার মতো দুজন লোককে পেয়েছিল, পিটার সেগাল আর বব ম্যাকৃলেনন।
কিন্তু ওরা কেউই এখন বেঁচে নেই। নেতা হতে পারত এমন আরেকজন, স্টীলম্যান, তাকেও খুন করা হয়েছে। ওরা জানে ম্যাকলেননদের কে বা কারা হত্যা করেছে সেটা এখনও গোপনই আছে। আমার ওপর আর নির্ভর করা। যাবে না বুঝতে পেরেই আমাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বারউইক। ওরা। এখনও জানে আমি মারা গেছি। এ ব্যবসার টাকা সরবরাহ করেছিল জন গুন্টার, সে খুন হওয়ায় এখন আর টাকা ফেরত দেয়ার চিন্তা করতে হবে না। বারউইক আর কীথকে।
আর মাত্র কটা দিন, বিক্রির কাজ শেষ হলেই জমির মালিকানা পেয়ে যাবে ওরা। এই মুহূর্তে ওদের বাধা দেয়ার মতো কোনও শক্তি নেই। পিট লেইনসহ সবাইকে আউট-ল ঘোষণা করবে ওরা। প্যসি পাঠানো হবে ওদের। পাকড়াও করার জন্যে। জমি কেনা শেষ করেই দেখো, খুনীর দল নিয়ে বেরিয়ে পড়বে লরেন কীথ।
হ্যাঁ, ধীর লয়ে বলল লরেটে শ্যাড, মনে হচ্ছে সব দিক সামাল দিয়ে ফেলেছে ব্যাটারা। কিন্তু তুমি একটা জিনিস বাদ দিচ্ছ, ভুলে যাচ্ছ সামান্থা ফক্সের কথা।
তার কথা আসছে কেন?
শোনো, সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলল লরেডো শ্যাড। ম্যাকলেনন খুন হওয়ার পরপরই শহর থেকে চলে এসেছে ও। ওরা জানে তোমার সঙ্গে ওর। পরিচয় আছে। তোমার সামনেই অফিসে ওদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করার ঘোষণা দিয়েছে সামান্থা, টাকা তুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছে। ধরো টাকা ফেরত চাইল সামান্থা এবং ওরা রাজি হলো না, তখন? মনে করো, আবার বলল লরেডো, এই অবস্থায় মুখ খুলল সামান্থা, যা জানে ফাঁস করে দিল। ও অনেক কিছু জানে এটাই ধরে নেবে, ওরা। মেয়েটা গুন্টারের ভাগ্নী, গুন্টার ওকে অনেক কথা বলেছে অনুমান করাই স্বাভাবিক, তাই না?
ওরা সামান্থাকে ধরার চেষ্টা করবে?
তোমার কী ধারণা? ধরার চেষ্টা করবে কিংবা হত্যা করবে।
তীক্ষ্ণ হলো পল কেড্রিকের দৃষ্টি। লেইনের কাছে নিরাপদেই থাকবে সামান্থা, বলল ও, কিন্তু সন্দেহ প্রকাশ পেল কণ্ঠস্বরে। ওদেরকে বেশ ভালো লেগেছে আমার।
কাঁধ ঝাঁকাল লরেডো শ্যাড। তা লাগতে পারে। কিন্তু ভুলে যেয়ো না, সিঙ্গার ওঁদেরই একজন। স্লোয়ানকে হত্যার কাজে সাহায্য করতে ইতস্তত করে নি সে, অ্যাবি মিক্সাসের সঙ্গে ছিল। টাকা দিয়ে ওকে কিনে নিয়েছিল বারউইক। আরও কেউ বিক্রি হয় নি জানছ কীভাবে?
.
ঠিক ওই সময়ে, ধূসর পাথুরে ভবনের অফিসরুমে অ্যাল্টন বারউইকের মুখোমুখি এমনি একজন লোক বসে আছে। দেয়াল ঘেঁষে একটা চেয়ারে বসেছে কর্নেল লরেন কীথ। বারউইকের সামনে বসা লোকটার নাম ওয়ালেস, তার পাণ্ডুর চেহারায় আত্মবিশ্বাসের ছাপ। সত্যি বলছি! বলো ওয়ারেস। চুরি করে, সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে, অন্ধকারে সারা রাত ঘোড়া হাঁকিয়ে মিথ্যে কথা বলতে আসি নি নিশ্চয়ই! সামান্থা ফক্স, গানম্যান লরেডে শ্যাড আর কেড্রিক পিট লেইনের ক্যাম্পে এসেছিল।
কেড্রিক? কেড্রিক বেঁচে আছে? তীব্র উত্তেজনায় সামনে ঝুঁকে এল কীথ।
হ্যাঁ, তোমার আমার মতোই তরতাজা। মাথার একপাশে চুল চেছে ফেলেছে দেখলাম, গভীর একটা দাগ খুলিতে। শরীরের এক দিকেও গুলি খেয়েছে। ওহ, জায়গা মতোই লেগেছিল গুলিটা! কিন্তু, বিশ্বাস করো, এখন আবার ঘোড়া হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছে! আসল খবর এখনও চেপে রেখেছে ওয়ালেস। চোখ বড় করে বারউইকের দিকে তাকিয়ে হাসল সে। কিছু টাকা দিতে পারলে ভালো হত, মিস্টার বারউইক। আরও একটা খবর ছিল। কঠিন দৃষ্টিতে ওয়ালেসের দিকে তাকাল বারউইক। ড্রয়ার খুলে দুটো স্বর্ণ-ঈগল বের করে ছুঁড়ে দিল ডেস্কর উপর। ঠিক আছে? এবার বলো, কী খবর?
ওয়াশিংটনে র্যানসাম নামে এক লোকের কাছে খবর পাঠিয়েছে কেড্রিক। পূর্ণ তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত জমি বিক্রি ঠেকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করবে সে।
কী?
ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়ল কীথ, ছাইয়ের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ। এমন কিছু হতে পারে ভাবতেও পারে নি সে। প্রথম যখন জমি দখলের বুদ্ধিটা পেল, একেবারে জলবৎ তরলং মনে হয়েছিল, মনে হয়েছিল মুফতে অঢেল টাকা কামানোর একটা মওকা পাওয়া গেছে। সামরিক বাহিনীতে চাকরির সুবাদে ওয়াশিংটনে উঁচু মহলে জানাশোনা ছিল, এদিকটা বারউইক সামাল দিতে পারলে গুন্টারের টাকায় ছককা মেরে দেয়া যাবে ভেবেছিল। ব্যর্থতার সম্ভাবনা মাথায় আসে নি। অনেক টাকা মুনাফা আসবে, নিশ্চিত ছিল কীথ। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বারউইক আর গুন্টারের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে পুবে চলে যাবে, লাভের টাকায় আরামসে পায়ের ওপর পা তুলে কাটিয়ে দেবে বাকি জীবন। কাজটা অবৈধ, কিন্তু পরোয়া করে নি সে। এখন যদি পুবের লোকেরা ব্যাপারটা জেনে যায়
র্যানসাম? ভাঙা গলায় বলল কীথ, এত থাকতে র্যানসাম!
যুদ্ধের সময় ওর সঙ্গে কাজ করেছিল ফ্রেডরিক র্যানসাম, দুজনের মধ্যে তেমন সদ্ভাব ছিল না। একটা সেতুর কাছে একটা বিশেষ ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল কীথের, গরম হয়ে উঠল কানজোড়া। ঘটনাটার কথা র্যানসাম জানে, এবং তার ভিত্তিতেই এবারের ব্যাপারটা মূল্যায়ন করবে সে। র্যানসামকে বেছে নিয়ে কতখানি বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে, কোনওদিন জানতে পারবে না কেড্রিক!
এইবার হয়েছে! নড়েচড়ে দাঁড়াল কীথ। র্যানসাম মহা আনন্দে আমাদের বারটা বাজিয়ে ছাড়বে!
বারউইক বুঝতে পারছে, আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে কীথ। সেই ময়লা শার্ট গায়েই বসে আছে বিশালদেহী লোকটা, বিরক্তি আর অসন্তোষ-ভরা দৃষ্টিতে দেখছে কীথকে। এবার কি বিগড়ে যাবে লোকটা?
ক্যাম্পে ফিরে যাও, ওয়ালেসকে বলল বারউইক, নতুন কিছু জানলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে খবর দিয়ে। এখন থেকে কড়া নজর রাখবে সবার ওপর। কিছুই যেন তোমার নজর এড়াতে না পারে। দেখো, ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমাকে
আর ভাবতে হবে না।
ওয়ালেস চলে গেলে কীথের দিকে ফিরল বারউইক, বাঁকা হাসি দেখা দিল তার ঠোঁটে। অসুবিধে কী? হোক না তদন্ত! ওরা এখানে এসে দেখবে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়ার কাউকে পাবে না!
পাবে না? কীথের কণ্ঠে অবিশ্বাস, কেড্রিক, শ্যাড আর সামান্থার মতো জলজ্যান্ত সাক্ষী থাকার পরেও একথা বলছ কীভাবে?
সময় হলে দেখবে, শান্ত কণ্ঠে বলল বারউইক, ওরা কেউ নেই। একজনও না, বিশ্বা করো?
১১. বারউইকের বলার ভঙ্গিতে
বারউইকের বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল, চমকে ঘুরে দাঁড়াল কর্নেল লরেন কীথ। কী বলতে চাইছ? জিজ্ঞেস করল সে।
শব্দ করে হাসল বারউইক, পুরু ঠোঁটের ফাঁকে চুরুট নাচাল। দৃষ্টিতে বিষ ঢেলে তাকাল কীথের দিকে। কেড্রিক এমন ছেলেমানুষি না করলে কত সুবিধাই না হত! সবদিক দিয়েই কীথের চেয়ে ভালো ছিল ছোঁড়াটা।
কেন, বলল অ্যাল্টন বারউইক, সাক্ষী পাওয়া না গেলে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দাঁড় করানোর উপায় থাকবে না। শহরের লোকজন কী জানে যে প্রকাশ করবে? কিছুই সন্দেহ করতে পারবে না ওর। তা ছাড়া স্রেফ সন্দেহ তো আর ধোপে টিকবে না, আদালত কিংবা তদন্ত কমিটি যাই বলো, নিরেট প্রমাণ চাইবে। কিন্তু তদন্ত কমিটি এখানে আসার আগেই দেখবে চারদিক শান্ত নিঝুম হয়ে গেছে।
করবেটা কী? আবার জানতে চাইল কীথ।
কী করব? তুমিই বলো কী করার আছে? কেড্রিক, লরেডো আর সামান্থার কবল থেকে বাঁচতে হবে না আমাদের? ওদের সরিয়ে দেব। তারপর প্যসি নিয়ে বের হবে, তুমি। রিমের ওপাশে গা ঢাকা দিয়েছে শয়তানগুলো, ওদের নিশ্চিহ্ন করে আসবে। তখন কার সাথে কথা বলবে তদন্ত কমিটি? ভয় পেয়ে গুন্টারের মুখ খোলার আশঙ্কা ছিল, কিন্তু সে এখন নেই, অন্যদেরও পথ থেকে সরিয়ে দেয়া গেলে-
সামান্থাকে বাদ দাও! প্রতিবাদ করে উঠল লরেন কীথ। ওকে নয়! তোমার আল্লার দোহাই!
ভেংচি কাটল বারউইক, ঠোঁট বেঁকে গিয়ে হিংস্র হয়ে উঠল চেহারা। বিশাল শরীর নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। হ্যাঁ, সামান্থাকেও। মেয়েটা আর সবার চেয়ে অনেক বেশি জানে। ধরো, গুন্টার ওকে সব কিছু বলে দিয়েছিল, তা হলে? সেটাই সম্ভব। তো বুঝতেই পারছ, কিছুই অজানা নেই ওর–কিচ্ছু না!
হাঁটতে হাঁটতে কামরার শেষ প্রান্তে চলে গেল বারউইক, ফিরে তাকাল কীথের দিকে। গর্দভ! ক্রুদ্ধ, বিরক্ত বারউইক। আজকাল যে কী সব লোক জন্ম নিচ্ছে দেশে! ভীত, ন্যাকা!-অসহ্য! কীথের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। কাজটা শেষ হওয়ার পরও যদি বেঁচে থাকে-ঠিক হ্যায়, ডরনি শ আবার কাথ লোকটাকে দেখতে পারে না। আচমকা হেসে ফেলল বারউইক। ওহ্, সত্যিকার কাজের লোক ডরনি। বব ম্যাকলেননকে যেভাবে খতম করল! নাও, এবার কথা শোনো, সবাইকে জড়ো করো। ফেসেনডেন, গফ, ক্লসন, পয়েটে আর দুই মিক্সাসকে ডরনি শয়ের সঙ্গে পাঠাও। ওই তিনজনের মৃত্যু চাই আমি, বুঝেছ? হপ্তা শেষ হওয়ার আগেই খতম করতে হবে সবকটাকে-এবং লাশের চিহ্নও যেন না থাকে। ঠিক আছে?
জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাল কীথ, চোখে অস্থির দৃষ্টি। এরকম কিছুর জন্যে মোটেই তৈরি ছিল না সে। অল্প সময়ে নিরুপদ্রবে কাজ হাসিল হবে ভেবেছিল, অথচ এখন…
এখন, অস্বস্তির সঙ্গে উপলব্ধি করল কীথ, বিপদ যদি আসে একমাত্র ওর ঘাড়েই সব দোষ চাপবে। পুবে সবরকম লেনদেনের বেলায় আড়ালে ছিল। অ্যাল্টন বারউইক, যেমন এখানে নেপথ্যে থেকেছে সে। সুতরাং যে কোনও ঘাপলার জন্যে ওকেই দায়ী করা হবে; আর র্যানসাম যেখানে তদন্ত চালাতে যাচ্ছে, ঘাপলা হতে বাধ্য!
কিন্তু, লম্বা করে দম নিল লরেন কীথ, বারউইক মিথ্যে বলে নি। এখন একটা পথই খোলা আছে ওদের সামনে। ডরনি, আর তার দলবল অন্তত এ-কাজে আপত্তি করবে না। আচমকা একটা কথা মনে পড়ে গেল কীথের।
ক্লসনের কথা বললে না? ওকে বাদ দিতে হচ্ছে, বারউইক। স্যাডলের। সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় কালরাতে ফিরে এসেছে ক্লসন। না, ক্লসন নয়, তার লাশ, কাঠের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল!
কী বললে? পায়চারি থামিয়ে কীথের সামনে এসে দাঁড়াল বারউইক। এতক্ষণে মনে পড়ল? মাথা নামিয়ে কীথের চোখের কয়েক ইঞ্চি দূরে নিয়ে এল সে। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। ওর ঘোড়া ব্যাকট্র্যাক করতে গেছে কেউ? হায়রে, বাচাল গর্দভ!পিস্তলে দুর্দান্ত হাত ছিল ক্লসনের, সে গুলি খেয়ে মরেছে, কথাটার মানে বোঝ? এমন কাজ মাত্র তিনজনের পক্ষে সম্ভব। কে কে তুমি খুব ভালো করে জানো!
তীব্র ক্রোধে লাল হয়ে গেল বারউইক, চরকির মতো ঘুরল। ফের পায়চারি শুরু করল সে, অনুচ্চ অথচ হিংস্র কণ্ঠে বিড়বিড় করছে ক্রমাগত। ভয়ে কুঁকড়ে গেছে লরেন কীথ। আবার ওর মুখোমুখি হলো বারউইক, হিংস্র। নেকড়ের মতো চোখজোড়া জ্বলছে। বুঝতে পারছ না, কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইল, ওরা আমাদের জন্যে বিপজ্জনক!।
ওরা যতক্ষণ বেঁচে থাকবে, ততক্ষণ আমাদের বিপদ হতে পারে। ডরনিকে অ্যাকশনে দেখেছ তুমি। কিন্তু বিশ্বাস করো, কেড্রিকের বদলে ওর সঙ্গেও লাগতে রাজি আছি! কেড্রিকের রগ চিনে গেছি আমি। আর্মি অফিসার ছিল-তুমি শুধু এদিকটাই ভেবেছ-সে এখনও একজন অফিসার এবং ভদ্রলোক!
আসলে তার চেয়েও বেশি কিছু, বুঝেছ? আরও বড় কিছু। নিখাদ ভদ্রলোক তো বটেই, কিন্তু সেই সঙ্গে লড়াকু, যুদ্ধ করতে ভালোবাসে। শান্ত নিরীহ চেহারার আড়ালে এমন একটা শক্তি, ক্ষমতা লুকিয়ে আছে, যার মোকাবেলা করা ডরনিরও সাধ্য নেই। হতে পারে ও ক্ষিপ্র, অন্তত আমি তাই মনে করি, কিন্তু ডরনির সঙ্গে কেড্রিকের পার্থক্য হলো, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে কেড্রিক, ডরনি সেটা পারবে না।
প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেয়েছে যেন লরেন কীথ। বারউইকের সঙ্গে এত বছরের জানাশোনা সত্ত্বেও তার এমন ক্রুদ্ধ ভয়াল চেহারা এই প্রথম দেখছে। আজ অবধি কাউকে এত সম্মান দেখিয়ে কথা বলতে তাকে দেখে নি সে-এ রকম ভয় পেতেও দেখা যায় নি। কেড্রিকের মাঝে কী দেখেছে বারউইক যা ওর নজর এড়িয়ে গেছে?
বিভ্রান্ত, বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে বারউইকের দিকে তাকিয়ে আছে লরেন কীথ। কিন্তু বারউইকের অনুভূতি ওর মাঝেও সংক্রমিত হতে শুরু করেছে। অস্বস্তি ভর করল ওর মনে ঠোঁট কামড়ে পায়চারিরত বারউইকের দিকে চেয়ে রইল।
কেড্রিক একা নয়, তার সঙ্গে শ্যাডও আছে। ঠাণ্ডা, চোখা চেহারার টেক্সান। আর আছে লেইন- আবার কুঁচকে উঠল বারউইকের চোখ-তিনজনের মধ্যে ও-ই সবচেয়ে বিপজ্জনক। এখানে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত বলে ধরে নিয়েছে লেইন।
ব্যক্তিগত স্বার্থ মানে? জিজ্ঞাসু চোখে বারউইকের দিকে তাকাল কর্নেল কীথ, কী বলছ?
হাতের ঝাঁপটায় প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল বারউইক। বাদ দাও। যাই হোক, ওদের এখন সরিয়ে দিতে হবে-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ঘুরে দাড়াল সে, ঠাণ্ডা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কীথের উদ্দেশে। ওয়াশিংটনে সব ব্যাপারে তুমি সামনে ছিলে, কাজটা যদি কেঁচে যায়, তোমাকেই পস্তাতে হবে, ভুলে যেয়ো না। এবার যাও, কাজে নেমে পড়ো। হাতে সময় আছে, কাজের লোকেরও অভাব নেই। তা হলে আর দেরি কেন!
কীথ বেরিয়ে যাবার পর চেয়ারে এসে বসল বারউইক। শূন্য দৃষ্টিতে সামনে দরজার দিকে তাকাল। ঘটনা এতদূর গড়িয়েছে যে এখন ইচ্ছে করলেও আর পিছিয়ে আসা সম্ভব নয়, যদিও তেমন কোনও ইচ্ছে তার নেই। কীথ আর গুন্টারের চেয়ে ভালো লোক পাওয়া গেল না এটাই দুঃখ।
তবে এখনও সব দিক সামাল দেয়ার সুযোগ আছে। যে কোনও তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হবার ক্ষমতা রাখে সে। এখানকার গোলমালকে অনায়াসে কাউ-কান্ট্রির স্বাভাবিক বিবাদ বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। সবাই জানবে খামোকা তুচ্ছ বিষয়কে রঙ চড়িয়ে বিরাট রূপ দেয়া হয়েছিল। বাদী পক্ষের সাক্ষী না পেয়ে এগোতে পারবে না কমিটি। পুরো ব্যাপারটাকে চায়ের কাপের ঝড় বানানো সমস্যা হবে না। ব্ল্যানসারে ভয় করছে কীথ, বোঝাই যাচ্ছে, কিন্তু ওইসব র্যানসাম-টামের ঘোড়াই পরোয়া করে বারউইক।
ক্ষুদে অশ্বারোহীদল যখন শহর ছেড়ে মৃত্যু-অভিযানে যাচ্ছে, তখনও একই ভঙ্গিতে বসে আছে বারউইক। পিস্তলবাজের সংখ্যা বেড়েছে, লক্ষ্য করল সে, আরও চারজন দুর্ধর্ষ বেপরোয়া লোক যোগ দিয়েছে। কীথের সাহায্য ছাড়াও কাজ সারতে পারবে ওরা। উঠে দাঁড়াল বারউইক, জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল। সামান্থার মৃত্যু তাকে দুঃখ দেবেমেয়েটাকে নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা ছিল। তবে ভুরুজোড়া কুঁচকে উঠল বারউইকের।
দূর মরুভূমিতে অস্থির হাওয়া বইছে। তামাটে আকাশে অনেক ওপরে একটা শকুন চক্কর দিচ্ছে, যেন নীচের পৃথিবীর উত্তেজনার আঁচ পেয়েছে সে।
উত্তরে, বেশ দূরে, ডুরাংগোর কাছাকাছি, একজন গরু ক্রেতা দলবলসহ থমকে দাঁড়াল। আকাশের দিকে তাকাল সে। ঝড়ের লক্ষণ নেই, অথচ গরু কেনার জন্যে ইয়েলো বাট আর মাস্ট্যাংয়ের উদ্দেশে ডুরাংগো ছাড়ার পর থেকেই একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি ঘেঁকে ধরেছে ওকে। ওদিকে, গোলমাল হয়েছে শোনা গেছে, ওখানে ছোটখাট ঝামেলা লেগেই আছে, তাই ও নিয়ে আগে মাথা ঘামায় নি। কিন্তু এখন কেন যেন অস্বস্তি লাগছে। বাতাস যেন বিপদ-সঙ্কেত বয়ে আনছে।
দক্ষিণে, রিম থেকে দূরে, মাস্ট্যাংয়ের ট্রেইল থেকে ঘোড়া ঘুরিয়ে ইয়েলো বাটের পথ ধরল পল কেন্দ্রিক আর লরেড়ো শ্যাড। ওদের চলার পথ থেকে বেশি দূরে নয় জায়গাটা, ওখানকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিজের চোখে দেখতে চায়। কিন্তু ওরা যখন শহরে পৌঁছুল, পোড়া ধ্বংসাবশেষ আর বিধ্বস্ত দালান কোঠার কথা বাদ দিলে সব কিছু শান্ত বলেই মনে হলো। আট দশটা পরিবার আবার যার যার ঘরে ফিরে এসেছে, কেউ কেউ এখান থেকে একেবারেই নড়ে নি। দুজন ঘোড়সওয়ারকে এগিয়ে আসতে দেখে সতর্ক হয়ে উঠেছিল ওরা, কেড্রিকদের চিনতে পেরে মাথা দুলিয়ে স্বাগত জানাল।
ওরা জানে, কোম্পানির বিরুদ্ধে ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কেড্রিক আর লরেড়ো।কিন্তু কঠোর পরিশ্রম আর প্রাণ বাঁচানোর সংগ্রামে ক্লান্ত, তাই কোনওরকম উচ্ছাস ছাড়াই ওদের স্বাগত জানাল ওরা। লিভারি-স্ট্যাবলের বিশাল অফিস-কামরায় স্থানান্তরিত হয়েছে স্যালুনটা। ভেতরে ঢুকল কেড্রিক আর লরেডো শ্যাড। দুজন লোক,বারের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, ঘুরে দাড়াল, কেড্রিকদের ইশারায় শুভেচ্ছা জানিয়ে আবার আলাপে ডুবে গেল।
বাইরে এরই মধ্যে ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে, ঘরের ভেতর উষ্ণ আরামদায়ক পরিবেশ। বারের দিকে এগিয়ে গেল পল আর লরেডো। ড্রিঙ্কের ফরমাশ দিয়ে দাম চুকিয়ে দিল কেড্রিক। মদের গ্লাস হাতে নিয়ে অস্বস্তির সঙ্গে নাড়াচাড়া করতে লাগল লরেডো শ্যাড। অবশেষে কেড্রিকের দিকে তাকাল সে।
আমার অস্বস্তি লাগছে, পল, নিচু কণ্ঠে বলল লরেডো, যেভাবেই হোক র্যানসামের কথা বারউইক জানবেই। এবং তারপর সামান্থা আর ওর সাথে সাথে আমাদেরও কতল করার জন্যে খেপে উঠবে সে।
মাথা ঝাঁকাল কেড্রিক, ও-ও একই কথা ভাবছিল। কোম্পানির সামনে এখন একটা পথই খোলা, তদন্ত কমিটির সামনে দাঁড়ানো-অবশ্য সাক্ষী প্রমাণের ভিত্তিতে র্যানসাম যদি তার ব্যবস্থা করতে পারে। কমিটির কাছে প্রকৃত সত্য ঠিকই ধরা পড়বে, এবং তা যাতে না পড়ে সে চেষ্টা করবে বারউইক।
বারউইক একটা কেউটে সাপ, মন্তব্য করল লরেডো শ্যাড, হার মানার বান্দা নয়। এ-ব্যাপারটায় পুরো ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে, বিনা যুদ্ধে হাল ছাড়বে না!
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে এল। ওরা তাকাতেই দেখল ডাই রীড আর পিট লেইন ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে ভেতরে ঢুকছে। কেড্রিকের দিকে একবার তাকাল লেইন, তারপর বারের দিকে এগিয়ে এল। ডাই রাডকে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে, কিন্তু কিছু বলল না সে। খানিক পরেই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল লেইন, বেরিয়ে গেল।
ব্যাপারটা কী? জিজ্ঞেস করল কেড্রিক।
বড় চিন্তায় আছে ছেলেটা বলল ডাই রীড, একটু লজ্জিতও। ওর বোনের জন্যেই এই অবস্থা। মেয়েটা এ কাণ্ড করবে কে জানত? শেষ পর্যন্ত কোম্পানির সঙ্গে গিয়ে হাত মেলাল। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে ছেলেটা। বিশ্বাস করতে পারছে না। কেউ ওর দিকে তাকালেই ধরে নিচ্ছে, বোনের কার্যকলাপের জন্যে ওকে দায়ী করা হচ্ছে।
কাঁধ ঝাঁকাল কেড্রিক। উচ্চাভিলাষ আর টাকা অনেক বিচিত্র ঘটনা ঘটায় এই পৃথিবীতে। তা ছাড়া কোনও কোনও মেয়ে অমন হয়েই থাকে।
দরজা খুলল লেইন। জলদি বেরিয়ে এসো! বলল সে, বিপদে পড়তে যাচ্ছি আমরা।
একসঙ্গে বাইরে এল ওরা। পড়িমরি করে, যার যার ঘরের দিকে ছুটে যাচ্ছে লোকজন, ভয়ার্ত চেহারা।
কী ব্যাপার? দ্রুত জানতে চাইল কেড্রিক।
মেসার চূড়া থেকে সঙ্কেত দিচ্ছে বার্ট উইলিয়ামস। মাস্ট্যাংয়ের দিক থেকে একদল অশ্বারোহী আসছে!
ওরা মেসাধু চূড়ার দিকে তাকাতেই ছোটখাট একটা মানুষের আকৃতি দেখা দিল। একবারদুবারতিনবারহাত নেডে মাস্ট্যাংয়ের দিক থেকে ছজন অশ্বারোহী আসার সঙ্কেত দিল সে। একই ভাবে দক্ষিণ-পুব থেকেও চারজন ঘোড়সওয়ার আসার সংবাদ জানাল।
মোট দশজন, থুতু ফেলে বলল লেইন, ঠিক আছে, ওদের চেয়ে আমাদের দল অনেক ভারি। তবে আমার লোকেরা ওদের মতো ভয়ঙ্কর নয়, এই যা।
ভাঙা হাত বাঁচিয়ে ইয়েলো বাট মেসার মাথায় একটা ঝোঁপের আড়ালে হাঁটু গেড়ে বসল বার্ট উইলিয়ামস। দূরবীন দিয়ে অগ্রসরমান অশ্বারোহীদলকে জরিপ করল। পরিচয় না থাকলেও ওদের সবার চেহারা চেনা। একে একে নামগুলো উচ্চারণ করল বার্ট উইলিয়ামস: কীথ, ডরনি, শ’, ফেসেনডেন, লী গফ, পয়েন্সেট, ভুরু কোঁচকাল সে, নাহ্, পয়েন্সেট নয়, মিক্সাসদের একজন। হ্যাঁ, আর ওই তো আরেকটা!
দূরবীন ঘোরাল উইলিয়ামস। ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে অন্য চারজন। প্রথমে কাউকে শনাক্ত করা গেল না। এক এক করে চারজনকেই যথেষ্ট সময় নিয়ে জরিপ করল সে। অবশেষে একজনকে চিনতে পারল। পোর্ট স্টকটন আর ব্ল্যাক জ্যাক, কেচাম আউটফিটের এক কালের সদস্য ডুরাংগোর গুণ্ডা-ব্রকাউ!
নড়েচড়ে দূরবীন ঘুরিয়ে শহরের চারদিকে নজর বোলাল বার্ট উইলিয়ামস, কিন্তু আর কারও দেখা পেল না। আবার ছয় অশ্বারোহীর দিকে দৃষ্টি ফেরাল। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট উঁচু ঢিবির ওপর আর এক মুহূর্ত দূরবীন স্থির রাখলে ও দেখতে পেত, ঘোড়া ছাড়াই দুজন লোক উবু হয়ে দৌড়ে ঢিবিটা পেরুচ্ছে, শহরের উত্তর-পুবে বিশাল গিরিখাদে লাফিয়ে পড়ছে।
খানিক আগে দুজনের অশ্বারোহী দলে পয়েন্সেটকে দেখতে পায় নি সে, এবং অপর দলেও নেই লোকটা।
উদ্বিগ্ন চেহারায়, ছোট ছোট করে সূর্যের দিকে তাকাল বার্ট উইলিয়ামস। শহরের লোকদের বিপদ সম্পর্কে কীভাবে সতর্ক করা যায় ভাবছে। পয়েন্সটের অনুপস্থিতি ভীত করে তুলেছে, ওকে। কোম্পানির ভাড়াটে খুনীদের মধ্যে পয়েন্সেটই সবচেয়ে বিপজ্জনক। লোকটা বেপরোয়া, অতীতের কোনও তিক্ত ঘটনা হিংস্র করে তুলেছে ওকে, ভয়াবহ এক চরিত্রে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু এই মুহূর্তে পয়েন্সেটকে দেখতে পেলে আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠত বার্ট উইলিয়ামস।
.
সবদিকে কড়া নজর রেখে পরিকল্পনা করা হয়েছে। কর্নেল লরেন কীথের ধূর্ত মস্তিষ্ক কাজ করেছে পরিকল্পনার পেছনে। কোথাও কোনও ফাঁক নেই। ওরা কাকে কাকে খুজবে, জানে কীথ। তবে ওয়াচারের চোখে পয়েন্সেটের অনুপস্থিতি ধরা পড়বে না বলেই আশা করেছে সে। ঠিক জায়গায় উপযুক্ত মুহূর্তে পয়েন্সেট যাতে উপস্থিত হতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেছে। পয়েনসেটের মতো দক্ষ মার্কসম্যান আর কেউ নেই তার দলে।
এই মুহূর্তে, শহর থেকে বড় জোর দুশো গজ দূরে, পয়েন্সেট আর তার সঙ্গী আলফ্রেড, ক্ৰকেট গিরিখাদের তীরে ঝোঁপ আর বোল্ডারের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে আছে। পয়েন্সেটের হাতে একটা স্পেশার পয়েন্ট ফাইভ-সিক্স, গুলি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পনের টোটার হেনরি পয়েন্ট ফোর-ফোর নিয়ে ছয় গজ দূরে অবস্থান নিয়েছে আলফ্রেড।
বিশাল রূপোর ঘড়ি বের করে সময় মেলাল পয়েন্সেট। আড়াইটার কথা বলে দিয়েছে কীথ। ঠিক আছে, সময় মতোই আওয়াজ পাবে সে। নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে একটা সিগারেট তৈরি করতে শুরু করল পয়েন্সেট। আলফ্রেড ক্রকেট তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কাগজে তামাক ভরার সময় একটুও কাপল না তার হাত, অবাক চোখে লক্ষ্য করল সে।
ইয়েলো বাট শহরের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা বব ম্যাকলেননের। কিন্তু ব্যাপারটাকে কখনোই গুরুত্বের সঙ্গে নেয় নি। অস্ত্র চালনায় মোটামুটি দক্ষ হলেও কোনওকালেই সৈনিক বা ইন্ডিয়ান ফাইটার ছিল না বব। তা ছাড়া শহর বাঁচানোর জন্যে পুরোদস্তুর লড়াইতে নামতে হবে, তেমন আশঙ্কাও ওর মাথায় আসে নি। সে যাই হোক একটা মারাত্মক ভুল করে গেছে ও। গিরিখাদের ধারের ঝোঁপ আর বোল্ডারের স্তূপ চমৎকার কাভারের কাজ করছে, এই তুপের আড়াল থেকে শহরের যে-কোনও জায়গা লক্ষ্য করে গুলি চালানো সম্ভব। শহরের একমাত্র রাস্তা এবং ঘরবাড়ি গুলির আওতার মধ্যে পড়েছে।
অতীতে শহরে আসার সুবাদে জায়গাটা দেখে গেছে লরেন কীথ। সতর্কতার সঙ্গে প্ল্যান নিয়েছে সে, যাতে মূল শক্তি পৌঁছুনোর আগেই পয়েটে আর ক্রকেট এখানে পৌঁছতে পারে। এখন পর্যন্ত তার পরিকল্পনায় কোনও গলদ দেখা যায় নি।
সিগারেট শেষ করে রাইফেল তুলে নিল পয়েন্সেট। সতর্কতার সঙ্গে সামনে নজর রাখতে শুরু করল। খানিক পর পর ঘড়ি দেখছে। নির্দিষ্ট করে কি করতে হবে বলে দেয়া হয়েছে ওকে, দ্ব্যর্থহীন নির্দেশ। ঠিক আড়াইটায় যাকে সামনে পাবে তাকেই গুলি করতে হবে। এক গুলিতেই যেন মারা যায় সে।
শ্যাড আর কেড্রিক আবার স্যালুনে ফিরে গেছে। বাইরে পায়চারি করছে পিট লেইন। রাস্তার উল্টো দিকে গেছে ডাই রীড। লেইন যদিও পয়েন্সেটের আওতার বাইরে আছে, মুহূর্তের জন্যে চমৎকার টার্গেটে পরিণত হয়েছিল ডাই রীড; রীডের সৌভাগ্য, পয়েন্সেট গুলি করার আগেই অদৃশ্য হতে পেরেছে। কিন্তু মুহূর্ত পরেই সুযোগ ধরা দিল পয়েন্সেটের হাতে।
কাছের একটা ঘরের দরজা খুলে গেল, একটা লোক বেরিয়ে এল। চওড়া কিনারাঅলা একটা ছেড়া ধূসর টুপি তার মাথায়, গায়ে বড় বড় চেকের শার্ট, সাসপেন্ডার লাগানো প্যান্টে গুঁজে রেখেছে। দরজার দিকে ঘুরে দাড়াল সে, চুমু খেলো স্ত্রীকে। প্রচুর সময় নিয়ে পয়েন্ট ফাইভ-সিক্স-এ লক্ষ্যস্থির করল পয়েন্সেট, লোকটার সাসপেন্ডারের বাঁ দিকের বাকলস্-এ। লম্বা করে দম নিল, তারপর টিপ দিল ট্রিগারে।
প্রচণ্ড শব্দে ছুটে গেল ভারি বুলেট। আঘাত করল লোকটার বুকে। একদিকে ছিটকে গেল সে, সোজা হয়ে দাড়ানোর চেষ্টা করল, পরমহর্তে হুড়মুড় করে লুটিয়ে পড়ল ধুলোয়। আর্তনাদ করে ছুটে এল তার স্ত্রী। সামনের একটা ঘরের দরজা সশব্দে খুলে গেল। রাস্তায় বেরিয়ে এল দুজন লোক, এদিক-ওদিক তাকাল। ক্রকেটের প্রথম গুলি একজনের হাতের রাইফেল ফেলে দিল, গুড়ো হয়ে গেল রাইফেলটার কুঁদো। অন্যজনকে ধরাশায়ী করল। পয়েন্সেট। পা টেনে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল লোকটা। এত দূর থেকেও তার হাঁটুর কাছে রক্তের গাঢ় দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
পয়েনসেটের মনে, দয়ামায়ার বালাই নেই। ঠাণ্ডা মাথায়, সাবধানে আবার গুলি করল সে। থেমে গেল লোকটা, একটু কেঁপে উঠল, তারপর স্থির পড়ে রইল।
আমারটা ফসকে গেল, ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বলল আলফ্রেড ক্রকেট। অবশ্য ব্যাটার রাইফেলের বারটা বেজে গেছে!
থুতু ফেলল পয়েন্সেট। দৃষ্টিতে শীতল ভাব। ও কিছু না, বলল সে, তবে ওই ব্যাটাও খামোশ খেয়ে গৈছে।
স্যালুনের ভেতরে, হুইস্কির গ্লাস ঠোঁটে ছোঁয়াতে যাচ্ছিল কেড্রিক, এই সময় প্রথম গুলির শব্দ হলো, তারপরই উপর্যুপরি দুদুবার গুলির শব্দ হলো।
হায়াল্লা! চরকির মতো ঘুরল লরেছো শ্যাড। ওরা তো এখনও পৌঁছে নি!
না, আগেই এসে গেছে ওরা, বলল কেড্রিক। মুহূর্তে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে ওর কাছে। চট করে দরজার কাছে গিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল ও। চোখের সামনে তৃতীয়জনকে মাটিতে পড়তে দেখল। গলা, বাড়াতেই আরও একজনকে দেখতে পেল। পরস্পর চেপে বসল ওর ঠোঁটজোড়া। স্থির পড়ে আছে লোকগুলো, নড়ছে না।
ওই খাদে কেউ লুকিয়ে আছে, দ্রুত ব্যাখ্যা করল কেড্রিক, পুরো রাস্তা কাভার করছে সে। পেছনে কোনও পথ আছে?
বারটেন্ডার বেরুনোর রাস্তা দেখিয়ে দিলে উইনচেস্টার তুলে নিয়ে এগিয়ে গেল পল কেড্রিক, পকেটে আগেই গুলি ভরে নিয়েছে ও। অন্যরা ওর পিছু নিল। দরজায় পৌঁছে থমকে দাঁড়াল কেড্রিক। দেয়ালের সঙ্গে মিশে গিয়ে গিরিখাদের দিকে তাকাল। এখান থেকে চিবিটার প্রান্ত দেখা যাচ্ছে। গুলিগুলো ওখান থেকেই এসেছে ধরে নিল পল। আটকা পড়ে গেছি আমরা, বলল ও, ওই ওখানে আছে ওরা।
নড়ল না কেউ। এলাকা সম্পর্কে কেড্রিকের স্পষ্ট ধারণা এই বিপদের মুহূর্তে কাজ দিচ্ছে।
মনে মনে গিরিখাদের চেহারা উল্টেপাল্টে দেখতেই মনে পড়ল, ঢিবির ওপাশটা শহর থেকে নিচু। কিন্তু বোল্ডার থাকায় গুলি করার জন্যে চমৎকারর আড়াল পাওয়া যাচ্ছে। খাদ থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুটে আসছে। নীরব হয়ে আছে সবাই। আর কিছুক্ষণ পর অন্যরাও এসে যোগ দেবে হামলায়। এই হামলা বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যাবে না!
১২. দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল পল কেড্রিক
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল পল কেড্রিক। এখন আর শহর বাঁচানো সম্ভব নয়। এখানে থাকলে ওদের নিশ্চিহ্ন কর দেবে প্রতিপক্ষ, জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে।
শ্যাড, তাড়াতাড়ি বলল ও, রাস্তা পেরিয়ে ডাই রীড আর পিটের কাছে যাও। চেঁচিয়ে সবাইকে বলো, যত ঝুঁকিই থাক, পরোয়া না করে ইয়েলো বাট এর গোড়ার ক্যানিয়নে চলে যেতে।
এক কদম পিছিয়ে মাথার ওপর ট্র্যাপডোরের দিকে তাকাল কেড্রিক। ও কী করতে যাচ্ছে বুঝে ফেলল বারটেন্ডার, প্রবল বেগে মাথা নাড়তে শুরু করল সে। পাগলামি করো না। ঝাঁঝরা হয়ে যাবে।
উপায় নেই; ঝুঁকিটা নিতেই হবে। বড় দলটা এখনও বেশ দূরে আছে। আমি কাভার দিলে তোমরা সহজেই ক্যানিয়নে পৌঁছে যেতে পারবে।
আর তুমি? জানতে চাইল শ্যাড।
আমি পৌঁছে যাব। যাও তো, সময় নষ্ট করো না!
স্যাৎ করে ঘুরল লরেডো শ্যাড। বাইরে পা রেখে মুহূর্তের জন্য থামল, তারপর এক দৌড়ে পার হলো রাস্তা। এক লহমার জন্যে ইতস্তত করল বারটেন্ডার, বিড়বিড় করে বলল কী যেন, তারপর অনুসরণ করল ওকে। এক বোতল হুইস্কি নিয়ে শার্টের ভেতর ঢোকাল পল কেড্রিক। লাফ দিয়ে ট্রাপডোরের কিনারা ধরে ঝাঁকি দিয়ে ক্ষুদে চিলেকোঠায়, সেখান থেকে ছাদে
উঠে এল। সযত্নে পর্যবেক্ষণ করল চারদিক।
ক্রিক থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে। বোঝা যাচ্ছে, খুনীর দল কিছুক্ষণের জন্যে যাত্রা বিরতি করেছে ওখানে। ছাদের চূড়ায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল কেড্রিক। ঈষৎ মাথা জাগিয়ে বোল্ডারের স্তূপের দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাল। হঠাৎ মৃদু নড়াচড়া ধরা পড়ল ওর চোখে। প্রথম দেখায় যেটাকে ধূসর পাথর মনে হয়েছিল, বুঝতে পারল, ওটা আসলে একটা শার্ট। উইনচেস্টার তুলে যত্নের সঙ্গে লক্ষ্যস্থির করল পল, টিপ দিল ট্রিগারে।
লাফিয়ে উঠল ধূসর শার্ট, শূন্যে উঠে এল একটা হাত, পরমুহূর্তে এলিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল একটা স্পেন্সার। মাথার অদূরে ছাদ ফুটো হয়ে গেল। স্প্রিন্টারের ছিটে লাগল চোখেমুখে। পিছলে খানিকটা নীচে নেমে এল কেড্রিক। তারপর রাস্তার উল্টোদিকের একটা জানালা থেকে সঙ্কেত পেয়ে চট করে রাইফেল তুলে নিল ও, মাথা উঁচিয়ে দ্রুত চারবার গুলি করল; একমুহূর্ত বিরতি, তারপর আবার ট্রিগার টিপল দুবার। নুয়ে পড়ে উইনচেস্টার রিলোড করে নিল ও। শত্রুপক্ষের একটা বুলেট খালা বসাল ছাদে। তারপর শুরু হলো এলোপাতাড়ি গুলি, ভারি ক্যালিবারের একেকটা বুলেট ছাদের চূড়ার অল্প কয়েক ইঞ্চি নীচে অসংখ্য ফুটো সৃষ্টি করল।
পিছলে আরও খানিকটা নামল পল, কেড্রিক। ট্র্যাপডোরের মুখে মুহূর্তের জন্যে থামল, বহু দূরে, একলোক ওঅশের লোকগুলোর পেছনে যাবার জন্যে। ঘুর পথে এগোনোর চেষ্টা করছে। দেখার সঙ্গে সঙ্গে রাইফেল তুলে তাক করল ও। টিপ দিল ট্রিগারে। প্রায় পাঁচশো গজ দূরে ছিল লক্ষ্যবস্তু, স্রেফ কালো একটা বিন্দু। ফসকে গেল গুলিটা, কালো বিন্দুর ফুট দুয়েক দর বালি ছিটকে উঠল। ব্যর্থ হলেও কেড্রিক জানে সম্ভাব্য আততায়ী, আর আগে বাড়ার সাহস করবে না; লুকিয়ে পড়েছে। ট্রাপভোর গলে ফের স্যালুনে, নামল কেড্রিক। বিষণ্ণ চেহারায় তাকাল বারের ওপর সাজানো হুইস্কির বোতলগুলোর দিকে। আরও দুটো বোতল তুলে পকেটে ঢোকাল।
দোনোমনো করল এক মুহূর্ত, তারপর রাস্তার উল্টোদিকের একটা বাড়ির আশ্রয়ের দিকে খিচে দৌড় লাগাল। গর্জে উঠল স্পেন্সার। অদৃশ্য আততায়ী এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। বুলেটের ধাক্কা অনুভব করল পল। টলে উঠল, কিন্তু থামল না।
রাস্তা পেরিয়ে আড়ালে চলে এল ও। পেটের চামড়ায় শীতল ছোঁয়া লাগছে। মাথা নামিয়ে তাকাল। শার্টের ভেতরে রাখা হুইস্কির বোতলটা চুর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে, বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে হুইস্কির, মিষ্টি সৌরভ। শার্টের ভেতর থেকে ভাঙা কাঁচের টুকরো বের করে ফেলে দিল কেড্রিক। প্রায় ঝাঁপ দিয়ে ঢুকল লিভারিস্ট্যাবলে। অ্যাপলুসার পিঠে দ্রুত স্যাডল চাপিয়ে উঠে বসল।
রাস্তায় বেরোতেই অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু করল স্পেন্সার। তুফান তুলে ছুটল, পল কেড্রিক। শত্রুর গুলি এড়িয়ে পৌঁছে গেল গন্তব্যে। ও ক্যানিয়নে ঢুকতেই উল্লাস প্রকাশ করল সবাই। স্যাডল থেকে নামল পল।
কাজটা কিন্তু ভালো হলো না, কেড্রিকের উদ্দেশে বলল পিট লেইন, রিজের ওপর উঠে অনায়াসে আমাদের পেছনে চলে আসবে ওরা।
বোল্ডারে বোল্ডারে পা রেখে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ড্র থেকে বেরিয়ে এল দুজন লোক। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল কেড্রিক। নারী-পুরুষ মিলিয়ে চোদ্দজ দাঁড়িয়ে আছে চারপাশে। দুজন আহত। একজনের হাত ভেঙে গেছে। এর হাত থেকে রাইফেল ছিটকে পড়েছিল তখন। অন্যজন সামান্য চোট পেয়েছে। মোট কথা লড়তে সক্ষম, এরকম মাত্র সাত জনকে পাওয়া গেল।
সময় নষ্ট না করে কোথায় লুকোতে হবে সবাইকে জানিয়ে দিল কেড্রিক। তারপর ডাই রীড আর লরেডো শ্যাডকে পাহারায় রেখে ভেতরের দিকে এগোল ওরা।
চিন্তিত চেহারায় দলীয় লোকদের ক্ষমতা পর্যালোচনা করল কেড্রিক। লরেডো, ভাই আর পিট লেইনকে নিয়ে ওর মনে সংশয় নেই। কিন্তু অন্যদের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছে না। ওদের মাঝে নিরীহ গোবেচারা ধরনের লোকও রয়েছে, স্পষ্টতই ভীতু হয়ে পড়েছে দুএকজন, যদিও মুখে বলছে না কেউ কিছু। রক্তশূন্য ফ্যাকাসে চেহারার এক লোক আহত একজনের রাইফেল নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, হাটতে সাহায্য করছে তাকে। পথ দেখিয়ে
সবাইকে সেই খাদের মুখে নিয়ে এল পল। ঢুকে পড়ল ওরা গহ্বরে।
বিস্মিত চেহারায়, সবাই দেখতে লাগল খাদটা। একটা কথা জানো? থুতু ফেলে বলল বারটেন্ডার। সাত বছর ধরে এখানে আছি, কিন্তু খাদটা এই প্রথম দেখলাম!
ওদের সঙ্গে মাত্র চারটে ঘোড়া আছে, ওগুলোকে গুহায় নিয়ে এল পল!
আপত্তি তুলল একজন। ওকে শান্ত করল কেড্রিক। এখানে পানি আছে, কিন্তু বলা যায় না, যে কোনও মুহূর্তে ঘোড়ার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।
ঢোক গিলে কেড্রিকের দিকে তাকিয়ে রইল লোকটা।
কেড্রিকের শার্টের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করল পিট লেইন। তোমার গায়ে গুলি লেগেছে! রক্ত বেরোচ্ছে!
সহজ ভঙ্গিতে হাসল পল। আরে, রক্ত না, হুইস্কি। আমার একটা বোতলের বারটা বেজে গেছে!
পিটও হাসল। রক্ত হলেই ভালো ছিল,বলল সে, ওসব জিনিস নষ্ট হলে চলে!
সুস্থরা সবাই খাদের মুখে জড়ো হয়েছে। কেড্রিকের দিকে তাকিয়ে হাসল একজন। তাই তো বলি, সেদিন পালিয়েছিলে কোথায়? বেরুনোর আরেকটা পথ আছে, না?
মাথা নাড়ল কেড্রিক। থাকলেও জানি না। আসলে এখানেই ঘাপটি মেরে ছিলাম। যেই দেখলাম পাহারা নেই, ক্যানিয়ন দিয়েই সুড়ৎ করে সটকে পড়লাম।
গম্ভীর হয়ে উঠল পিট লেইনের চেহারা। ইচ্ছে করলে আমাদের ঘেরাও করে বসে থাকতে পারবে ওরা, কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেল, কিছু করার থাকবে না।
কেড্রিক মাথা দোলাল। একটা পানির ক্যান্টিন আর কিছু খাবার নিয়ে মেসার মাথায় বার্ট উইলিয়ামসের সঙ্গে যোগ দিতে যাচ্ছি আমি। আমার সাথে আরেকজনকে আসতে হবে। ওখানে বসে ব্যাটাদের ঠেকিয়ে দেব।
আমি আছি, শান্ত কণ্ঠে বলল লরেডো শ্যাড। দাঁড়াও জিনিসপত্র নিয়ে আসি।
একটা রাইফেল গর্জে উঠল। একটু পরেই ডাই রীড যোগ দিল ওদের সঙ্গে। ওরা আসছে! বলল সে। কেড্রিকের দিকে তাকাল। বোল্ডারের পেছনে একজন মারা গেছে। দূরবীনে ব্যাটার চেহারা দেখেছি। লোকটার নাম আলফ্রেড ক্রকেট। অন্যজন ছিল পয়েন্টে।
ক্রকেট একটা নির্ভেজাল হারামজাদা, বার্নেট নামে একজন সেটলার বলল, একনম্বর শয়তান। ক্যাম্পাসে থাকতে এক লোককে খুন করে, পালিয়েছিল। আরেকবার তার দলেরই একজন নিখোঁজ হয়ে যায়। সবার। বিশ্বাস লোকটার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে ক্রকেটের হাত ছিল।
পিট লেইনের দিকে তাকাল কেড্রিক। এখানেই শেষ মোকাবিলা হবে মনে হচ্ছে, বলল ও, যতক্ষণ সম্ভব গুলি ছুঁড়ো না। অপ্রয়োজনে কিছুতেই গুলি নষ্ট করা যাবে না। আমরা মেসার চুড়ায় থাকব।
খাদ থেকে বেরিয়ে এল কেড্রিক। তারপর লরেডোকে সঙ্গে করে বোল্ডার আর ঝোঁপঝাড়ের ভেতর ঢুকে পড়ল। শত্রুপক্ষের কারও চেহারা দেখা যাচ্ছে না। কেড্রিকের ধারণা, ক্যানিয়নের পেছনে রিমে উঠে ওদের কাভার দেয়ার জন্যে লোক পাঠানো হয়েছে, তার পৌঁছুনোর অপেক্ষা করছে ওরা।
আকাশছোঁয়া ইয়েলো বাটের চূড়ার দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন কেড্রিক। ঝাড়া দেড়শো ফুট খাড়াভাবে উঠে গেছে, বেশির ভাগ অংশ নগ্ন-আড়াল নেই। ক্যানিয়নের মাথায় ধুলোর মেঘ দেখা গেল। গুলি করেছে বার্ট উইলিয়ামস।
ওরা মেসার দিকে পা বাড়াতেই এক পশলা গুলি ছুটে এল। পিছিয়ে এল লরেডো। হতোদ্যম। নাহ, সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তার আগেই যদি হামলে পড়ে ব্যাটারা?
তাতে লাভ হবে না। মেসার পাদদেশে অসংখ্য বোন্ডারের আড়ালে গুটিসুটি হয়ে বসল ক্যাপ্টেন কেড্রিক। এই যে চমৎকার একটা ফায়্যারিং পয়েন্ট পেয়ে গেছি আমরা। একটা সিগারেট রোল করে ধরাল ও। এই ঝামেলা শেষ হয়ে গেলে কী করবে, শ্যাড? এখানেই থেকে যাবে?
দীর্ঘদেহী টেক্সান কাঁধ ঝাঁকাল। এখনও কিছু ভাবি নি। সময়েই দেখা যাবে। তুমি?
ওদিকে, দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোগলনস নামে একটা জায়গা আছে, চেনো? ভাবছি ওখানে নিজস্ব একটা র্যাঞ্চ গড়ে তুলব।
আমিও হয়তো এরকম কিছুই করব, শান্ত কণ্ঠে বলল লরেডো শ্যাড। নিজের একটা র্যাঞ্চ গড়া আমার অনেক দিনের স্বপ্ন। সত্যি বলতে কী একবার র্যাঞ্চ কিনেছিলাম। কিন্তু রাখতে পারি নি, পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয়েছি।
ক্যানিয়ন বরাবর বাইরে তাকাল লরেডো শ্যাড। রাইফেলটা হাঁটুর ওপর ফেলে রেখেছে ও। কেড্রিকের দিকে না তাকিয়েই সহজ কণ্ঠে বলল, এখান থেকে রেহাই পেতে আমাদের স্বয়ং খোদার সাহায্য লাগবে, ক্যাপন।
হুম, কেড্রিকের চেহারা গম্ভীর। আচ্ছা, ক্যানিয়নের মুখে পাহারায় কে আছে এখন-মানে কার থাকার কথা?
ওয়ালেস।
ওর সাথে কথা বলতে হবে। এখনও আছে ওখানে?
উম-নাহ, নেই। কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে বোধ হয়।
অথবা বিকিয়ে গেছে। তুমিই বলেছিলে–সিঙ্গারের মতো আরও লোক থাকতে পারে।
সিগারেটের গোড়া পিষে নেভাল, লরেডো শ্যাড। শিগগিরই আক্রমণ চালাবে ওরা, পল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই ঝামেলা চুকিয়ে দেয়া দরকার। তারপর সোজা মাস্ট্যাংয়ে যাব, মরতেই যদি হয় কীথ আর বারউইক এই দুই শয়তানকে নিয়ে মরতে চাই আমি।
মাথা নেড়ে সায় দিল কেড্রিক। খাদে আশ্রিতদের কথা ভাবছে। শ্যাঙ, লেইন আর রীডকে বাদ দিলে আরও অন্তত চারজন, সাহসী লোক আছে। এখানে। তার মানে, মোটেই দুর্বল নয় ওরা। অবশ্য সংখ্যায় শত্রুপক্ষ ভারি। যুদ্ধের শুরুতে বারজন লোক ছিল ওদিকে। আলফ্রেড ক্রকেট মারা গেছে। আরও লোকের আমদানি না ঘটে থাকলে, তিনজনে এগিয়ে আছে ওরা। তবে নতুন লোকের আমদানি হওয়াই স্বাভাবিক। কেড্রিকরা আত্মরক্ষার চেষ্টা করবে-এটাই ধরে নেবে প্রতিপক্ষকিন্তু যদি উল্টো হামলা চালানো হয়?
সামনে তাকাল কেড্রিক। হঠাৎ প্রায় দেড়শো গজ দূরে, ক্যানিয়নের দেয়ালে বেশ উঁচুতে একটা ছায়ামূর্তি দেখা দিল। রাইফেল তুলে গুলি করল ছায়াটা, সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা গুলি করল শ্যাড আর কেড্রিক। অদৃশ্য হলো ছায়া, তবে চোট পেয়েছে কি না বোঝা গেল না।
এলোপাতাড়ি গুলি শুরু হলো এবার। হঠাৎ হঠাৎ ক্যানিয়নের মুখের দিকে লোকজন এগিয়ে আসছে। কিন্তু গুলি করার জন্যে যথেষ্ট সময় খোলা জায়গায় থাকছে না তারা। লুকিয়ে পড়ছে, খানিক পর আরেক জায়গায় মাথা তুলছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। বিদায়ী সূর্যের আলো শত্রুদের চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে ওদের গুলি। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। বার কয়েক অগ্রসরমান শত্রুদের উদ্দেশে গুলি ছুঁড়ল লরেডো শ্যাড আর কেড্রিক। কিন্তু কাউকে ঘায়েল করতে পারল না। দুবার মেসার চূড়ায় রাইফেল গর্জাল। আর্তর করে উঠল কে যেন।
বুঝলে, লরেডো, হঠাৎ বলল পল কেড্রিক, ওদের ভয়ে পিছিয়ে যাবার মানে হয় না। আমি মেসার মাথায় উঠছি। ফিরে আসি, তারপর দেখা যাবে, কয়োটের দল কেমন লড়াই জানে!
হাসল শ্যাড, ওর চোখের তারায় কৌতুক। আমিও আছি, পার্ডনার, শুষ্ক কণ্ঠে বলল সে, লুকিয়ে থাকতে আমার একটুও ভালো লাগে না। তা ছাড়া মেয়েরা তো এখন নিরাপদেই আছে।
একজন বাদে, বলল কেড্রিক। মিসেস ট্যাগার্ট, রেচারির স্বামী খুন হয়েছে খানিক আগে। ঘর ছেড়ে নড়ে নি সে।
হ্যাঁ, কে যেন বলছিল তখন। ট্যাগার্ট নাকি কোনও সুযোগই পায় নি। আহা, দুজন ভালো মানুষকে হত্যা করেছে ওরা!
.
আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো ইয়েলো বাট মেসার বিশাল কাঠামোর দিকে গম্ভীর চেহারায় তাকাল কর্নেল লরেন কীথ। চূড়ার লোকটা ওদের ঠেকিয়ে রেখেছে। ওখানে ওঠা গেলে কাজ হত। মনে মনে রণাঙ্গনে অধীনস্থ সৈনিকদের সঙ্গে বর্তমান সঙ্গীদের তুলনা করল সে। এরা একদল নৃশংস খুনী ছাড়া আর কিছুই নয়। কীভাবে সে এদের সঙ্গে নিজেকে জড়াল? পা বাড়ানোর সময় কোথায় পা রাখছে দেখে না কেন মানুষ?
ঐশ্বর্য-সারা জীবন বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে লরেন কীথ। অভিজাত সমাজে চলাফেরা করতে হলে প্রচুর সম্পদ দরকার। কিন্তু টাকা যেন সোনার হরিণ, ধরা দিতে চায় না। তিক্ত মনে মেসার দিকে তাকাল কীথ। বারউইকের শার্টের নোংরা কলার আর জ্বলন্ত চোখজোড়া মনের পর্দায় ভেসে উঠল। স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সবাইকে দাবার খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে বারউইক-কাজ আদায় হলে কলার খোসার মতো ছুড়ে ফেলে!
শুরুতে একেবারে উল্টো মনে হয়েছিল ব্যাপারটা। ওর কর্তৃত্ব, সৈনিকসুলভ আচরণ আর স্পষ্ট চিন্তাশক্তির তুলনায় গুন্টারকে সাধারণ একজন ব্যবসায়ী ছাড়া কিছুই মনে হয় নি। বারউইককে মনে হয়েছে স্বল্প বুদ্ধির এক ভাঁড় বিশেষ। অথচ এখন সহসা স্বমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছে বারউইক। সব কর্তৃত্ব হারিয়েছে কীথ, হার মানতে বাধ্য হয়েছে বারউইকের কাছে। এর জন্যে ও নিজেই দায়ী। আগেই বোঝা উচিত ছিল, অ্যাল্টন বারউইক কুৎসিত ভড় নয়, এক অশুভ দানব, ইবলিশের চেয়েও ধূর্ত। তাকে অবহেলা করা মোটেই ঠিক হয় নি।
নিজেকে বরাবর প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী লোক ভেবে এসেছে কীথ। স্বাধীনভাবে কাজ করেছে এতদিন। কারও পরোয়া করে নি। অথচ আজ এমন একজনের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে, যাকে অন্তর থেকে ঘৃণা করে! পালাবে, তার উপায় নেই। তা ছাড়া এখনও কীথের মনে আশা আছে, সবদিক সামলে নেয়া যাবে। শেষ পর্যন্ত-প্রচুর টাকা আসবে হাতে।
একটা লোকের নাম ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথায়। যত নষ্টের গোড়া। নামটাকে ঘিরে ওর অন্তরের সমস্ত ঘৃণা ক্রোধ আর তিক্ততা প্রচণ্ড হয়ে উঠল। ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক।
প্রথম দিনই ওকে বোকা বানিয়ে দিয়েছিল কেড্রিক, অবশ্য এজন্য হতচ্ছাড়া গুন্টারও কম দায়ী নয়। নিজের ব্যাংক আর বার বছর সামরিক বাহিনীতে চাকরির কথা বলে কেড্রিককে দমাতে চেয়েছিল ও। ওকে মার্সেনারি বলে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পেয়েছিল সে, কিন্তু উল্টো কেড্রিক শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে ওর বিদ্রূপ ওকেই ফিরিয়ে দেয়। এতগুলো লোকের সামনে বেইজ্জত করে ছাড়ে! কেড্রিক সম্পর্কে নানা কাহিনী কানে আসলেও তেমন আমল দেয় নি কীথ। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ওগুলো আসলে সত্যি ঘটনা। কেড্রিক র্যানসামের বন্ধু, মনে পড়তেই আরও খেপে উঠল কীথ।
অস্থায়ী স্যালুনে ঢুকল সে। গ্লাসে মদ ঢেলে নিরাসক্ত চেহারায় তাকাল তরল পদার্থটুকুর দিকে। লী গফ আর ফেসেনডেন এল।
শালাদের পাকড়াও করতে যাব, কর্নেল? জিজ্ঞেস করল গফ। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে।
এক ঢোকে গ্লাস খালি করল কর্নেল কীথ। হ্যাঁ, জলদি। সবাই এসেছে? পয়েন্সেট ছাড়া, তবে সেও এসে পড়বে।
আবার গ্লাসে মদ নিয়ে গলায় ঢালল লরেন কীথ। তারপর এক সঙ্গে ইয়েলো বাট-এর রাস্তায় নেমে এল ওরা।
মিক্সাসরা দুভাই আর নবাগতদের দুজন ছাড়া সবাই উপস্থিত রয়েছে। ক্যানিয়নের দিকে গেছে, দুই মিক্সাস! স্কোয়াটারদের আশ্রয়, বোল্ডার আর ঝোঁপের পেছনের দেয়ালে ওঠার জন্যে ঘুর পথে এগিয়ে গেছে অন্য দুজন।
লম্বা লম্বা পা ফেলে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে পয়েন্সেট। প্রথম ঘরের সামনে পৌঁছুতেই এক মহিলা দরজা খুলে বেরিয়ে এল। শক্ত সমর্থ গড়ন, পরনে রঙ-জ্বলা নীল সুতি কাপড়; পায়ে গোড়ালি ক্ষয়ে যাওয়া বুট। হাতে একটা ডাবল ব্যারেল্ড শটগান। পয়েন্সেট সামনে আসতেই ঘুরে দাঁড়াল মহিলা। ট্রিগার টিপল।
একসঙ্গে দুটো ব্যারেলই খালি করল সে। পয়েন্ট-ব্ল্যাংক-রেঞ্জ, গোলা দুটো সোজা পয়েন্সেটের পেটে লাগল। আক্ষরিক অর্থেই দুটুকরো হয়ে গেল লোকটা। হুড়মুড় করে লুটিয়ে পড়ল রাস্তায়। একটু কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল। রক্তে লাল হলো ধূসর পাথর। বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পিস্তলবাজরা।
ওদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল মহিলা। বয়স্কা, লালচে চেহারা, এক মাথা পাকা চুল বাতাসে উড়ছে। কাজ করতে করতে কঠিন হয়ে গেছে দুটি হাত। শুলিন্য শটগান এখনও আঁকড়ে আছে। ওদের দিকে তাকিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা হালকা চেক শার্ট পরা লোকটার দিকে ইঙ্গিত করল সে।
এই মুহূর্তে তাকে আর অসহায় এক বৃদ্ধা মনে হচ্ছে না। দুচোখে অশ্রুরও চিহ্ন নেই। ওই মানুষটা আমার স্বামী ছিল, কিঞ্চিৎ কেঁপে গেল তার গলা। টাগাট আমাকে ধনসম্পদ হয়তো দিতে পারে নি, দেয়ার ক্ষমতাও ছিল না; কিন্তু একটা জিনিস দিয়েছিল-শান্তি। ওকে হত্যা করেছ তোমরা। আমার কাছে আরও কয়েকটা গোলা থাকলে… ঘুরে দাঁড়াল মিসেস ট্যাগার্ট। একটিবারও পেছনে না তাকিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল।
গোল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পিস্তলবাজের দল। হঠাৎ যেন বুঝতে পারছে, ওদের অপরাধ কতটা জঘন্য।
সবার আগে নীরবতা ভেঙে কথা বলল লী গফ। দুই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে সে! শার্ট ছিড়ে যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে ওর পেশীবহুল শরীর। বাতাসে উড়ছে মাথা ভর্তি সোনালি চুল। ওই মহিলাকে কেউ উক্ত করলে, বলল গফ, আমার হাতে খুন হয়ে যাবে!
১৩. ঠিক সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে আক্রমণ
ঠিক সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে আক্রমণ চালাল কীথ এবং পিছু হটতে বাধ্য হলো। দুজন লোক হারাতে হলো তাকে। তবে হামলার ফলে একটা লাভ হলো-খাদের কথা জানা হয়ে গেল। গিরিখাদের কাছে ক্যানিয়নের মুখে একটা দেয়ালের আড়ালে আসন পেতে বসে আছে ডরনি শ। একেবারে সহজ হয়ে গেল কাজটা, বলল সে। এখনও প্রচুর ডিনামাইট আছে আমাদের কাছে!
মুখ তুলে তাকাল কীথ, ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ডরনি শ, চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। নাকি সেটা আবার তোমার নীতিতে বাধবে, কর্নেল? ডিনামাইটের গোটা দশেক কাঠি ফেলে দিলেই কিন্তু বারউইকের চাহিদা পূরণ হত-লাশের চিহ্ন থাকত না কোথাও!
খাদের ভেতর দিকে গুহাটুহা থাকলে, আপত্তি জানাল লরেন কীথ, জ্যান্ত কবর হয়ে যাবে সবার! জবাব দিল না কেউ। সবার ওপর দৃষ্টি বোলাল কীথ, মাটির দিকে তাকিয়ে আছে ওরা। দায়দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা। একমাত্র রনি শয়ের মধ্যেই প্রবল উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। আতঙ্কে সারা শরীর শিউরে উঠল কীথের। এদের সঙ্গে জড়িয়ে কী ভুলটাই না করেছে!
পাথরে খুরের ঘষা খাওয়ার শব্দ উঠল। একসঙ্গে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সবাই। ঘোড়াটা দেখা গেল না। স্যাডলের সঙ্গে কাপড়ের ঘষা খাওয়ার আওয়াজ ভেসে এল। ঝুনঝুন শোনা গেল স্পরের! আঁধার ফুড়ে সামনে এসে দাঁড়াল অ্যাল্টন বারউইক।
ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়ল কর্নেল লরেন কীথ। দ্রুত পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করল। চুপচাপ শুনে, গেল বারউইক, মাঝে মাঝে মাথা দুলিয়ে সায় জানাল। কীথের বক্তব্য শেষ হলে বলল, ডিনামাইট চালাও। সকালে সবার আগে এ কাজটাই সারবে। ব্যস, তা হলেই জীবনের জন্যে মিটে যাবে ঝামেলা।
পকেট থেকে সিগার বের করে কামড়ে গোড়া কাটল বারউইক। আজ একটা টেলিগ্রাম এসেছে। শিগগিরই তদন্ত কমিটি আসছে, হপ্তা দুএকের, মধ্যেই। কিন্তু ততদিনে এই ঘটনার কথা ভুলে যাবে সবাই। অন্য ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।
ঘোড়ার দিকে পা বাড়াল বারউইক, মাঝপথে থেমে ডরনি শর দিকে, তাকিয়ে মাথা দুলিয়ে ডাকল ওকে।
আগুনের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল ডরনি শ, অনুসরণ করল তাকে। মুখ ভেঙচে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল লরেন কীথ। এর মানে? ওকে বাদ দিয়ে কোনও ফন্দি আঁটছে না তো ব্যাটারা?
আগুনের নাগালের বাইরে, কেউ ওর কথা শুনবে না এমন দূরত্বে পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়ল বারউইক। ডরনি, শ এগিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। চমৎকার কাজ দেখাচ্ছ তুমি, ডরনি। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা দুজন হলে আর কাউকে লাগে না।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল ডরনি। আমিও তাই বলি!
হুম, সিগারেটে টান দিল অ্যাল্টন বারউইক। আমার একজন ভালো সঙ্গী সত্যি দরকার। গুন্টার মারা যাবার পর তার জায়গাটা তো খালি রয়ে গেছে!
তোমাদের কোম্পানিতে, ফিসফিস করে কথা বলছে ডরনি শ, এমনিতেও লোকজন বেশি-মামে পার্টনারের কথা বলছি।
হ্যাঁ, শান্ত কণ্ঠে বলল বারউইক, অন্তত এখনও তাই।
ঠিক আছে। নেড়েচেড়ে পিস্তলজোড়া জায়গামতো বৃসিয়ে নিল ডরনি শ। দুই তিন দিন পর তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসব।
ঘুরে হাঁটতে শুরু করল বারউইক। সহজ ভঙ্গিতে স্যাডলে চাপল। যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল শ। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘোড়ার খুরের ক্রমশ মিলিয়ে যাওয়া শব্দ কানে আসছে। অদ্ভুত শব্দ-বড়ই অদ্ভুত।
শিস বাজাতে বাজাতে আগুনের কাছে ফিরে এল ডরনি।
.
ভোরে ফের হামলা চালাল কর্নেল লরেন কীথ। কোম্পানির পক্ষে প্রায় বিশ জন লোক, ডিনামাইটের বাক্স ছিল দুজনের কাছে। এই হামলাতেই চিরদিনের জন্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার কথা স্কোয়াটারদের।
বারউইক ক্যাম্পে আসার আগে ফেসেনডেনকে নিয়ে রিমের ওপর থেকে খুঁটিয়ে ক্যানিয়ন জরিপ করেছে ডরনি আর লরেন কীথ। যার পর নাই খুশি হয়েছে ওরা। গহ্বরের অবস্থান ফাস হবার পর পরিষ্কার হয়ে গেছে, ওটার মুখ থেকে একসঙ্গে দুজনের বেশি লোক কোনও অবস্থাতেই গুলি ছুড়তে পারবে না; অন্যদিকে আক্রমণকারীরা ছড়ানো ছিটানো বোল্ডারের আড়ালে গা ঢাকা দেয়ার প্রচুর সুযোগ পাবে, অনায়াসে ডিনামাইট ছোড়ার মতো দূরত্বে পৌঁছুনো যাবে। দুএক মুহূর্তের চেয়ে বেশি সময় প্রতিপক্ষের নজরে পড়তে হবে না। মাটির কাছাকাছি থাকায় এবং সামনে বোল্ডারের স্তূপ আছে বলে ওদের গুলির আওতা হবে ক্ষুদ্র।
সুষ্ঠুভাবেই শুরু হলো আক্রমণটা। একসঙ্গে এগিয়ে গেল ওরা। বিদ্যুৎ গতিতে ক্যানিয়নের প্রায় বিশফুট ভেতরে ঢুকে পড়ল। মেসার চূড়া থেকে অতীতে কোনও এক সময় একটা বড়সড় পাথরের টুকরো গড়িয়ে পড়েছিল, এটার সামনে এসে পৌঁছুল। এবং এখানেই সমাপ্তি ঘটল আক্রমণের।
আচমকা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ওরা। রাইফেলের প্রচণ্ড গুলিবৃষ্টির কবলে পড়ল-পয়েন্ট-ব্ল্যাংক-রেঞ্জ!
লড়াইয়ের বহু কলাকৌশল জানে ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। জানত গম্বরের এই আশ্রয় দীর্ঘকালে মরণফাঁদে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই নিজেকে কীথের জায়গায় কল্পনা করে বুঝে নিয়েছে সে কী করতে যাচ্ছে। তারপর সাতজন সঙ্গী আর চোদ্দটা রাইফেল নিয়ে ইন্ডিয়ানদের মতো অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে খাদ থেকে। কীথের কল্পনায় আসবে নাএমন একটি জায়গায় ঘাপটি মেরে বসেছে।
গোলাগুলির প্রথম ঝাঁপটাতেই প্রতিপক্ষের পাচজন ইহলোকের মায়া ত্যাগ, করল। নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় ছুটোছুটি শুরু করে দিল গানহ্যান্ডরা। ফলে আরও দুজন প্রাণ হারাল। ভাঙা হাঁটু নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোনওমতে পরিত্যক্ত ক্যাম্পে ফিরে এল একজন। কিন্তু এখানে কাউকে পেল না সে।
ট্যাগার্টের স্ত্রীর হাতে বিপর্যয়ের শুরু-শেষ হলো রাইফেলের প্রচণ্ড গর্জনে।
কোম্পানি-ফাইটাররা ক্যানিয়নের মুখ থেকে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে এল, একসঙ্গে ছুট লাগাল যার যার ঘোড়ার দিকে। কীথও আছে এদের সঙ্গে। প্রাণ নিয়ে সরে পড়তে পেরে শোকর করছে। ওকে স্যাডলে উঠে বসতে দেখল উরনি শ। ঘোড়া ঘুরিয়ে পাশে চলে এল। পেছনে, সুশৃঙ্খল সেনাদলের মতো সাবধানে গুলি করতে করতে এগিয়ে এল ক্যানিয়নের স্কোয়াটাররা। একটা ঘোড়াকে লুটিয়ে পড়তে দেখল কীথ। হামাগুড়ি দিয়ে বোল্ডারের আড়ালে আত্মগোপন করল ওটার সওয়ারী, পরক্ষণে লাফিয়ে উঠে খিচে দৌড় দিল। দল ছেড়ে বেরিয়ে এল ডাই রীড়। পিছু নিল তার।
ওরা পালানোর আগে আরও একজনকে হারাতে হলো। ঘোড়া ঘুরিয়ে সঙ্গীদের মুখোমুখি হলো কেড্রিক। সবাই ঘোড়া যোগাড় করো, তাড়াতাড়ি। মেয়েরা এখানে নিরাপদেই থাকবে। একবারেই সব ঝামেলা মিটিয়ে আসি।
ঘুরে দাঁড়াল ব্ৰকাউ। এক লোক এগিয়ে আসছে। ডাই রীড। ওর বাগিয়ে ধরা স্পেন্সার দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল তার। মনে পড়ল, নিজের রাইফেলটা খালি। পায়ে পায়ে পিছোতে শুরু করল সে। চোখ দুটো আতঙ্কে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
আমার রাইফেলে গুলি নেই, বলল সে, পিস্তলটাও হারিয়ে ফেলেছি!
তা হলে ওটা ফেলে দাও, শান্ত কণ্ঠে বলল ডাই রীড, এরকম কিছুই চাইছিলাম আমি, পিস্তল রাইফেল ধাতে সয় না।
কথাটার মানে না বুঝলেও রাইফেল ফেলে দিল ব্ৰকাউ। বিশাল শরীর তার, পেশীবহুল, শক্তিশালী। বিস্মিত চোখে ডাই রীডকে স্পেন্সর নামিয়ে রাখতে দেখল সে। গানবেল্টও খুলে ফেলল রীড। বাঁকা পায়ে এগিয়ে এল ছোটখাট মানুষটা।
মুহূর্তের জন্যে পলক পড়ল না আউট-লর চোখে। তারপরই ডাই রীডের মোকাবিলা করতে পা বাড়াল। কাছাকাছি হতেই ঘুসি হাঁকাল। পাথরের মতো শক্ত মুষ্টি আঘাত হানল ডাই রীডের চিবুকে। প্রচণ্ড আঘাত নিঃশব্দে হজম করল ডাই রীড, চোখজোড়া একটু পিটপিট করে উঠল কেবল। পরক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়ল ব্ৰকাউয়ের ওপর। প্রথম ঘুসি ব্যর্থ হওয়ায় আতঙ্ক ভর করল ব্ৰকাউয়ের মনে, আরও দুটি ঘুসি হানল সে। নিজেকে বাঁচাতে ব্যর্থ হলো রীড। নীরবে মার খেলো। এইবার ডাই রীড বিশাল দুই হাতে ব্ৰকাউয়ের বাহু খামচে ধরল, হ্যাচকা টানে কাছে নিয়ে এল ওকে।
দুহাতে আউট-লর মাথা ধরল ডাই রীড়, সামনে টানল। ঠকার্স করে বাড়ি খেলো দুটো মাথা! চোখে সর্ষে ফুল দেখল ব্ৰকাউ। নাকের হাড় ভেঙে গুড়ো হয়ে গেল। বুনে বর্বরের মতো ঘুসি হাঁকানোর চেষ্টা করল সে। কিন্তু তার আগেই রীডের দুহাত চেপে বসেছে ওর শ্বাসনালীর ওপর। ব্ৰকাউ নিস্তেজ না হওয়া পর্যন্ত ছাড়ল না রীড়। তারপর ওকে মাটির ওপর শুইয়ে দিল। ঘুরে হাঁটতে শুরু করল এবার। কাছেই একটা ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে, দেখল না। একটা গলা মাস্ট্যাং।
ক্যানিয়ন মুখে বিপত্তির পর ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে ওরা। কিন্তু একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে ল গফের। পোড়খাওয়া মন্টানা গানম্যান গফ মিসেস ট্যাগার্টের চোখে-মুখে সত্যের প্রকৃত রূপ প্রত্যক্ষ করেছে। মহিলা ওকে ওর মায়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। মন্ট্যানার একটা জীর্ণ র্যাঞ্চে সাত ছেলে আর পাঁচটি মেয়েকে লালনপালন করতে গিয়ে প্রচণ্ড পরিশ্রমের ধকল সইতে পারে নি মহিলা, অকালে বিদায় নিয়েছে পৃথিবী থেকে।
ইয়েলো বাটে মিসেস ট্যাগার্টের বাড়িতে যাচ্ছে লী গফ।
কুটিরের সামনে পৌঁছে ঘোড়া থামাল সে। নামল না। স্যাডলে বসেই মৃদু টোকা দিল দরজায়। খুলে গেল কবাট দুটো, মিসেস ট্যাগার্টের মুখোমুখি হলো সে। কেঁদে কেঁদে চোখ লাল করে ফেলেছে মহিলা। ম্যাম, বলল গফ, আমি খুব তুচ্ছ একজন মানুষ, আমার কথায় হয়তো কিছুই যায় আসে না। কিন্তু এসব আমার আর ভালোগছে না। আমি চলে যাচ্ছি। দয়া করে এই টাকাগুলো রাখবে?
মোটাসোটা এক তোড়া টাকা সসংকোচে মিসেস ট্যাগার্টের দিকে বাড়িয়ে ধরল লী গফ। এক মুহূর্ত ইতস্তত করল মহিলা। তারপর সসম্মানে গ্রহণ করল তোড়াটা। ধন্যবাদ, বাবা। খুব ভালো ছেলে তুমি!
ঘোড়ার পেটে পার ছোয়াল গফ। ঘুরে ভোরের আবছা আলোয় হারিয়ে গেল চ্যাপটা মুখো সোরেলটা নিয়ে। লীগফের লড়াইয়ের সাধ মিটে গেছে। কলরাডো অথবা ইউটাহতে যাচ্ছে সেকিংবা অন্য কোনওখানে মোট কথা দূরে কোথাও।
ওদিকে মাস্ট্যাংয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। ওর সঙ্গে আছে লরেড়ো শ্যাড, পিট লেইন, ডাই রীড, বার্ট উইলিয়ামস এবং আরও কয়েকজন। দল বেঁধে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে ওরা। স্যাডলফর্কের ওপর রাইফেল ফেলে রেখেছে।
ওদের পশ্চিমে, অন্যদিকে ছোট্ট একটা নাটকের মহড়া চলছে। কেড্রিক যাদের ধাওয়া করছে, ক্যানিয়ন যুদ্ধে পরাজিতদের সবাই ওই দলে নেই। ডরনি শ আর কর্নেল লরেন কীথপশ্চিমে রওনা দিয়েছে। ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলেছে ওরা।
যথেষ্ট ঝামেলা পোহানো গেছে, ভাবছে কীথ, আর নয়। কেউ মানুক আর নাই মানুক শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে ওদের। এখন দেশ ছেড়ে পালানো ছাড়া উপায় নেই।
মাস্ট্যাংয়ের হেডকোয়ার্টারে কিছু ক্যাশ টাকা জমা আছে। ওগুলো একবার হাত করতে পারলেই সোজা ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যাবে ও। তারপর যত ইচ্ছে তদন্ত চালাক র্যানসাম। কয়েক বছর পর আবার পুবে ফিরে যাবে। এখানকার ঘটনা সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন তুললে জড়িত থাকার কথা সোজাসাপ্টা অস্বীকার করবে। কোম্পানির প্রাথমিক অবস্থায় আইনগত ব্যাপারে সাহায্য করা ছাড়া ওদের সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক ছিল না বললেই হবে।
চেহারা দেখে ডরনি শয়ের মনের কথা বোঝার সাধ্য নেই কারও। অবশ্যই এই মুহূর্তে তেমন কিছু ভাবছে না সে। আসলে চিন্তাভাবনা ওকে দিয়ে হয় না। মদে আসক্তি নেই তার, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে বাছবিচার করে না। কিন্তু কয়েকটা জিনিসের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। ভালো ঘোড়ার মালিক হতে তার ভালো লাগে এবং সুন্দ মেয়েদের প্রতিও দারুণভাবে আকৃষ্ট হয়। স্যু লেইনকে ভালো লাগত ওর কাছে। কিন্তু সামান্থা ফক্স ওকে পাগল করে দিয়েছে। ডরনি শ যে বেঁচে আছে মেয়েটা বোধ হয় জানে না। তবে ডরনি শয়ের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস আগ্নেয়াস্ত্র। বিপদে কিংবা
লড়াইতে আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে নির্বিচারে যন্ত্রের মতো মানুষ হত্যা করতে পাকে আজ পর্যন্ত ওর চেয়ে দক্ষ কোনও পিস্তলবাজের দেখা পায় নি সে। পিস্তল ছাড়া অন্য কিছুর সাহায্যে শত্রুর মোকাবিলা করতে হয় নি-ভবিষ্যতেও করার ইচ্ছে নেই।
দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। আরাম করে স্যাডলো বসেছে। কেড্রিক যখন সদলে ইয়েলো বাট থেকে মাস্ট্যাংয়ের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছে, সেই সময় সল্ট ক্রিক ওঅশের তীরে পৌঁছুল ডরনি শ আর কর্নেল কীথ। জিনের পেটি শক্ত করে বাঁধার জন্যে স্যাডেল থেকে নামল কীথ। সুযোগ পেয়ে পানি খেয়ে নিল ঘোড়াটা। ডরনি শও নামল এবার ঘোড়ার পিঠ থেকে।
অন্যমনস্কভাবে ডরনিকে জিজ্ঞেস করল কীথ, তা ডরনি; খেলা তো শেষ, এবার কোথায় যাবে?
কী জানি, কর্নেল, হালকা সুরে আস্তে করে বলল ডরনি শ, জানি না। তবে তোমার রাস্তা কিন্তু এখানেই শেষ।
কথাটার মানে বুঝতে প্রচুর সময় লাগল কর্নেলের। ঘুরে মুখোমুখি হলো সে ডরনির। বিভ্রান্ত চেহারায় প্রথমে ভয় তারপর আতঙ্কের ছায়া পড়ল। নিতান্ত অবহেলার দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে উরনি শ। ঠোঁটে মুচকি হাসি, চোখে ফাঁকা দৃষ্টি।
ডরনির কথা হৃদয়ঙ্গম করার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা হয়ে গেল কীথের শরীর। ওকে হত্যা করতে যাচ্ছে এই লোকটা!
বোকার মতো ডরনির ফাঁদে পা দিয়েছে ও। দল ছেড়ে ওর সঙ্গে আসল কোন বুদ্ধিতে? সুযোগ পেয়েও লোকটাকে খুন করল না কেন? ডরনি শয়ের সঙ্গে পাগলা কুকুরের পার্থক্য নেই। উন্মাদ, বদ্ধ উন্মাদ!
কী আবোলতাবোল বকছ, শ? মিলিটারি কায়দায় প্রশ্ন করল কর্নেল কীথ। ওর বলার ভঙ্গি খেয়ালই করল না ডরনি শ। কীথের বেল্টের বাকলসের ওপর দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে তার। কর্নেল, ভাবল সে, ইদানীং বেশ মুটিয়ে গেছে-ছোটখাট একটা ভুড়ি হয়েছে দেখছি। কেন, সহজ কথা, আর কোথাও যাচ্ছ না তুমি, কর্নেল। কিন্তু সেজন্যে আমার মোটেই খারাপ লাগছে না।
বারউইক এসব পছন্দ করবে না। আমাদের দুজনের ওপরই সে নির্ভর করে আছে।
উঁহু। বললো, ছিল। অবস্থা পাল্টে গেছে এখন। কাল ওদিকে, ইয়েলো বাটের দিকে মাথা নেড়ে ইশারা করল ডরনি শ, বারউইক ইঙ্গিত দিয়ে গেছে আমাকে, পার্টনারের সংখ্যা নাকি বেশি হয়ে গেছে ওর। টুপিটা একটু পেছনে ঠেলে দিল সে।
ড্র করতে চাও? লাভ নেই যদিও, তবু চেষ্টা করে দেখতে পারো।
সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে কীথ। শরীরের সব পেশী যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছে। নড়তে চাইছে না। অথচ কিছু একটা করা দরকার, এখুনি! অবশেষে কথা বেরোল ওর মুখ দিয়ে, অন্তর থেকে উচ্চারণ করল কীথ, কেড্রিক তোমাকে খুন করবে, উরনি। ও-ই জিততে যাচ্ছে। বারউইক ওর সঙ্গে পারবে না!
হঠাৎ একটা জিনিস মনে পড়ল কীথের। ডরনি শয়ের চেহারায় একটা অস্পষ্ট অভিব্যক্তি। কিন্তু সেটাও তুচ্ছ নয়। ডরনি! মরিয়া কণ্ঠে বলল সে, তোমার পেছনে! সেই গ্রাটা!
শাদা হয়ে গেল ডরনির মুখ। পাঁই করে ঘুরল সে। হিংস্র ভাব তার চোখে। ডরনি, ঘুরতেই বিজয়ানন্দে হাঁপ ছাড়ল কীথ, হাত বাড়াল পিস্তলের দিকে। কিন্তু শয়ের মতো লোকের মুখোমুখি আর কখনও হয় নি সে। পিস্তলের বাট জাপটে ধরেছিল, খাপমুক্তও হয়েছিল ওটা। বিদ্যুৎ চমকের মতো ঘুরে পেছনে কিছু নেই দেখেই চট করে সরে গেল ডরনি শ, চরকির মতো ঘুরল ফের। এক মুহূর্ত আগে ও যেখানে ছিল, সেখান দিয়েই সাঁই করে হারিয়ে গেল কীথের গুলি। পরক্ষণে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ট্রিগার টিপল উরনি।একবার, দুবার।
দুটো গুলিই কীথের কুঁড়ি ফুটো করে দিল।
ঝপাৎ করে সল্ট ক্রিকের পানিতে পড়ল সে। পিস্তলে গুলি ভরতে ভরতে তার জ্বলজ্বলে দুই চোখের দিকে তাকাল ডরনি শ। কীভাবে জানলে? বিষণ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল, তুমি কীভাবে জানলে?
১৪. সহকর্মীদের চেয়ে এগিয়ে আছে ফেসেনডেন
সহকর্মীদের চেয়ে এগিয়ে আছে ফেসেনডেন। বিশাল শরীর নিয়ে সহজ ভঙ্গিতে স্যাডলে বসে আছে। ঘোড়ার সাথে তাল মিলিয়ে দুলছে। চিন্তাক্লিষ্ট চেহারা, বিরক্ত। মিসেস ট্যাগার্টের আচরণে, সবার মতো সে-ও আলোড়িত হয়েছে। অন্য কিছু হয়তো তাকে এতটা প্রভাবিত করতে পারত না। কঠিন, হৃদয়ের মানুষ ফেসেনডেন, কত মানুষকে যে হত্যা করেছে ইয়ত্তা নেই। লড়াইয়ের মাঠে নির্দয়-নৃশংসভাবে মানুষ খুন করেছে সে, বেঁচে থাকার জন্যেই!
আগেও বহুবার পিস্তল ভাড়া খাটিয়েছে ফেসেনডেন। সেসব ছিল ক্যাটল বা শিপ-ওঅর, সেয়ানে সেয়ানে মোকাবিলা। প্রতিপক্ষে ছিল ওরই মতো দুরন্ত সব পিস্তলবাজ। কিন্তু একদল মানুষকে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার জন্যে এই প্রথম কারও সঙ্গে যোগ দিয়েছে সে। কাজটা হাতে নেয়ার সময় কোনওরকম চিন্তা-ভাবনা করে নি ও জানে পশ্চিমে পাড়ি জমানো অধিকাংশ লোকই মাথা গোঁজার মতো একটুকরো জমির সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের সংগ্রাম নিয়ে কখনও ভারে নি সে। বার কয়েক ক্যাটল-রেঞ্জ থেকে জবরদখলকারীদের উচ্ছেদে সাহায্যও করেছে। কাজটা ন্যায়সঙ্গত বলেই তার ধারণা। গরু-বাছুর পোষার জন্যে ঘাসের প্রয়োজন, কিন্তু চারণভূমিতে চাষাবাদ শুরু করলে গরু চরবে কোথায়? তা ছাড়া বেশির ভাগ তৃণভূমিই তো খামার বা চাষাবাদের অনুপযুক্ত। কিন্তু, এবার একটা ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। এই প্রথম ব্যাপারটা তলিয়ে দেখছে ফেসেনডেন। গবাদি পশুর সুবিধের জন্যে লোকজকে এখান থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে না, মুনাফাই প্রধান এবং প্রথম। উদ্দেশ্য। সাত বোঝা কঠিন নয়। ফেসেনডেনের মতো লোকেরা পরিস্থিতির আসল রূপ প্রক্ষ করলে সামান্য পার্থক্যই বিরাট হয়ে দাঁড়ায়, তাদের চোখের সামনে।
মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত ফেসেনডেন। কীথের কাক্ষিত বিজয় কত কাছেই এসে গিয়েছিল! ক্যানিয়নে আত্মগোপনকারী মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোককে কজা করার মতো সহজ কাজ আর কিছু হয়! প্রথমে ডিনামাইট ব্যবহারের বিরোধিতা করলেও সাময়িক দুর্বলতাটুকু ঝেড়ে ফেলেছিল ও। সবার সঙ্গে ক্যানিয়নে ঢুকেছে, ঝামেলা চুকিয়ে টাকা নিয়ে এখান থেকে কেটে পড়বে বলে। ঠিক তখনই এল অপ্রত্যাশিত বিদ্যুৎ-গতির পাল্টা আক্রমণ। ক্যানিয়নের দেয়াল আরও ভয়ঙ্কর করে তুলল সে আক্রমণকে। বোল্ডারের ফাঁকে আটকা পড়ে গো-হার্য হেরে গেল ওরা। নরক ভেঙে পড়ল যেন মাথার ওপর।
আকস্মিক ধাক্কা আতঙ্ক আর তীব্র বিতৃষ্ণার জন্ম দিয়েছে সবার মনে। আত্মরক্ষার স্বাভাবিক তাগিদে কোনওমতে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। কিন্তু ক্লসন আর পয়েন্সেটের মৃত্যু এখনও মেনে নিতে পারে নি কেউ, অদৃশ্য হয়েছে ব্ৰকাউ, লী গফ চলে গেছে। শুধু ফেসেনডেনকেই চলে যাবার কথা বলেছিল গফ। কারণ জিজ্ঞেস করার দরকার মনে করে নি ও।
পেছনে ব্যর্থ হামলায় হতাশ মিক্সাসরা দুই ভাই এগিয়ে আসছে। দয়ামায়াহীন দুই খুনী, মেয়েমানুষ খুন করতেও ওদের হাত কাঁপবে না। লড়াকু লোক নয় ওরা-কসাই। কিন্তু ওরাও বুঝতে পারছে দলে একটা পরিবর্তন এসেছে। ব্ৰকাউ আর গফের ভাগ্যে কী ঘটেছে ওরা জানে না, তবে দলে যে ভাঙন ধরেছে সেটা বুঝতে পারছে পরিষ্কার। এক অর্থে হিংস্র একদল নেকড়েয় পরিণত হয়েছে ওরা। পরস্পরের প্রতি ঘৃণা বোধ করতে শুরু করেছে।
শান্ত মাস্ট্যাংয়ে ফিরে এল ওরা। ঝড়ের পূর্ব মুহূর্তে চারদিক যেমন থমথম করে তেমনি নীরবতা বিরাজ করছে শহরে। ভুগোতে ফিরে যাওয়া গরু-ক্রেতার মতো শহরটাও যেন ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের পূর্বাভাস পেয়েছে। রাস্তায় মেয়েদের দেখা যাচ্ছে না দুচারজন বেপরোয়া লোক বার কিংবা তাসের টেবিলে সময় কাটাচ্ছে। সেইন্ট জেমস-এর সামনে সাজানো চেয়ারগুলো খালি পড়ে আছে। মাতাল অবস্থায় র্যাঞ্চে ফিরে গেছে ক্লে অ্যালিসন।
সূর্য যেন গলন্ত আগুন ঢালছে, পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে সব। নিঝুম চারদিক। মাসট্যাং স্যালুনের সামনে ঘোড়া থামাল ফেসেনডেন, ক্লান্ত জানোয়ারটার পিঠ থেকে নামল। উরুর সঙ্গে বাড়ি মেরে টুপি থেকে ধুলো ঝাড়ার ফাঁকে নির্জন রাস্তায় চোখ বোলাল। পশ্চিমের লোক ফেসেনেডেন, বিপদের পূর্বলক্ষণ টের পেতে ভুল হলো না। টুপিটা আবার কোনাচে করে মাথায় বসিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল বিশালদেহী গানম্যান। সোজা বারের দিকে এগিয়ে গেল।
রাই, স্যালুনের অভ্যন্তরে গমগম করে উঠল ওর কণ্ঠস্বর। কামরার চারধারে ঘুরে ফিরল চোখজোড়া, তারপর বারটেন্ডারের ওপর স্থির হলো।
কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না বারটেন্ডার। কী ঘটেছে? ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল সে।
গানম্যানের কঠিন, দুচোখে ক্ষীণ কৌতুকের ছায়া পড়ল। চিরদিনের জন্যে জায়গাটা জিতে নিয়েছে স্কোয়াটাররা! হুইস্কিটুকু গলায় ঢালল ফেসেনডেন। ওখান থেকে ওরা নড়বে না, বুঝিয়ে দিয়েছে! হালকা কণ্ঠে বলল সে। কেয়ামত নামিয়ে দিয়েছে আমাদের ওপর! সংক্ষেপে ঘটনার বিবরণ দিল ফেসেনডেন। যেন হাজার হাজার লোক একসঙ্গে হামলে পড়ল! এমন কিছু হতে পারে কারও মাথায় আসে নি! অন্ধকারে সিঁড়িতে পা রাখতে গিয়ে দেখল কোনও সিঁড়িই নেই-অনেকটা এই রকম ব্যাপার।
আরও এক গ্লাস মদ ঢালল ফেসেনডেন। কেড্রিক ব্যাটাই নষ্টের গোড়া, ভারি গলায় বলল ও, লোকটা ওদের দলে যোগ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার কেটে পড়া উচিত ছিল।
কীথ কোথায়?
সে আর ফিরবে না।
নতুন কণ্ঠস্বর, শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ওরা। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। মুচকি মুচকি হাসছে ডরনি শ! হাসি মুখেই সামনে এসে বারের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। কীথ আর আসছে না, বলল সে। সন্ট ক্রিকের পাড়ে পিস্তল বের করতে গিয়েছিল সে।
নীরব কামরায় ভয়ানক শোনাল উরনির কথাগুলো। টেবিলের এক লোক নড়েচড়ে বসল, ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে আপত্তি জানাল চেয়ারটা। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল ফেসেনডেন, মদের গ্লাসে চুমুক দিল। এখান থেকে ভাগতে হবে, জলদি!
কিছুক্ষণ আগে দেখলাম মেয়েটা ফিরে এসেছে, হঠাৎ বলে উঠল বারটেন্ডার। সামান্থা ফক্স। সেও কি ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে?
মুখ তুলে তাকাল ডরনি শ, জ্বলজ্বল করছে, চোখের তারা। হঠাৎ বিষণ্ণতা ভর করল সেখানে। মদের গ্লাস খালি করে সহজ পদক্ষেপে এগিয়ে গেল সে দরজার দিকে। কাছেপিঠে থেকো, ফেস, একটু আসছি আমি,হাসল সে, বুড়োর কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসি।
ফেসেনডেনের দিকে তাকাল বারটেন্ডার। টাকা পেলে তোমাকে দেবে তো?
অন্যমনস্কভাবে মাথা দোলাল ফেসেনডেন। একশোবার! ডরনি চোর নয়। জীবনে কখনও অন্যের জিনিস না বলে ছোঁয় নি ছেলেটা। চুরি-চামারিতে ও বিশ্বাস করে না। কখনও গাল দিতে কিংবা মিথ্যে বলতেও দেখি নি। কিন্তু তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে, তোমাকে খুন করতে পারবে।
নাটকের যবনিকাঁপাত ঘটেছে। কাজ শেষ। কৈটে পড়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। ফেসেনজেন জানে, এখন বিদায় নেয়া উচিত; কিন্তু তবু কেন যেন অনীহা বোধ করছে! আরও এক গ্লাস মদের ফরমাশ দিল সে, বারটেন্ডার ঢেলে দিল। যেন অতল এক গহ্বরে পড়ল মুদটুকু, কোনও প্রতিক্রিয়া হলো না।
.
শহর সীমান্তে ঘোড়ার রাশ টেনে ধরল ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। একসঙ্গে কাজে নামব আমরা, শান্ত কণ্ঠে বলল ও, কথ, শ, বারউইক, দুই মিক্সাস আর ফেসেনডেনকে, চাই আমাদের। ওরা ছাড়াও আরও দুচারজন আছে, ওদের চেহারা চিনলেও নাম জানি না। যাই হোক, তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে, কোনওরকম ভুল যেন না হয়। পিট, ডাই রীড আর অন্য দুজনকে নিয়ে রাস্তার বাঁ দিক দিয়ে এগিয়ে যাও তুমি। অহেতুক ঝুঁকি নেবে না। সম্ভব হলে ওদের গ্রেফতার করবে। পরে বিচার হবে। যারা গম্ভীর কেড্রিকের চেহারা–দোষী, তাদের জন্যে দুধরনের শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে, দেশ ছাড়তে হবে, নইলে ঝুলতে হবে ফাঁসিতে। তবে দুই মিক্সাস আর ডরনি শকে ফাঁসিতেই ঝোলাব, বলল ও, ওর খুনী!
স্যাডলে ঘুরে বসে দীর্ঘদেহী টেক্সানের দিকে তাকাল পল কেড্রিক। চলো, শ্যাড, শান্ত কণ্ঠে বলল ও, আমরা চারজন রাস্তার ডানদিক ধরে এগোই। আমাদের ভাগে পড়ছে লিভারিস্ট্যাবল, সেইন্ট জেমস আর মাস্ট্যাং স্যালুন।
ঘাড় ফিরিয়ে আবার পিট লেইনের দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন কেড্রিক। পিট, বলল ও, অ্যালিসন কিংবা কেচামের সামনা-সামনি পড়ে গেলে দয়া করে ওদের ঘাটাতে যেয়ো না। ওদের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা নেই।
লেইনের চেহারা গম্ভীর। আমি ওদের খুঁজছি না, ভারি গলায় বলল সে। কিন্তু সেধে লাগতে এলে ছেড়ে দেব না।
শহরে ঢুকল। ওরা। তারপর যার যার পথে এগোল। কেড্রিকের উদ্দেশে হাসল লরেডো শ্যাড, ওর চোখজোড়া বিষণ্ণ। আজ শয়তানও লেইনের সামনে দাঁড়ানোর আগে দুবাক্স ভাববে, শান্ত কণ্ঠে বলল সে। খুনের নেশা চোপছে ওর মাথায়। বোনের জন্যেই এত রাগ।
দুজন সামনাসামনি পড়ে গেলে কী ঘটবে ভাবছি।
না পড়লেই ভালো, বলল শ্যাড, মেয়েটা সত্যি সুন্দরী। টাকার প্রতি লোভ ছাড়া আর কোনও দোষ নেই।
অন্য দুজন সঙ্গী উদ্বিগ্ন চেহারায় নির্দেশের অপেক্ষা করছে। ওরা দুজনই কৃষক। একজনের হাতে একটা স্পেন্সর পয়েন্ট-ফাইভ-সিক্স; অন্য জনের হাতে শটগান। ওদের দিকে তাকাল শ্যাড ওরা রাস্তা কাভার দিক, কী বলা, পল? বলল ও, তুমি সেইন্ট জেমস-এ যাও, আমি লিভারি স্ট্যাবলে।
একটু ভাবল কেড্রিক। ঠিক হ্যায়, অবশেষে বলল ও, দেখো, বাবা, অনর্থক ঝুঁকি নিয়ে না যেন!
হাসল লরেডো শ্যাড। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত নাড়ল। তারপর প্রশস্ত দরুজা গলে আস্তাবলে ঢুকে পড়ল। ভেতরে পা রেখে থামল ও। বাইরে নির্লিপ্ত তাচ্ছিল্যের ভাব দেখালেও ভেতরে ভেতরে ফণা তোলা গোখরার মতো ভয়ঙ্কর এবং প্রস্তুত টেক্সান। অ্যাবি মিক্সাসের সোরেল পনিটা আগেই দেখতে পেয়েছে ও। খুনী দুটো শহরেই আছে, সন্দেহ নেই। এক কদম সামনে বাড়ল ও। সঙ্গে সঙ্গে খড়ের গাদার আড়াল থেকে একটা রাইফেলের ব্যারেল মাথা জাগাল।
ঝাঁপ দিয়ে ডান দিকের একটা স্টলে ঢুকে পড়ল লরেডো শ্যাড, পিস্তল বেরিয়ে এসেছে হাতে। সোজা অপর মিক্সাসের ঘাড়ে গিয়ে পড়ল ও। প্রচণ্ড সংঘর্ষ হলো দুজনের ভারসাম্য হারিয়ে আছড়ে পড়ল মিক্সাস, গড়িয়ে চিত হলো। পিস্তল বের করতে করতে উঠে দাঁড়াল সে। ঝেড়ে এক লাথি কষাল লরেডো তার হাতে, চরকির মতো ঘুরতে ঘুরতে সাঁ করে দুই সারি স্টলের মাঝে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে পড়ল পিস্তলটা।
হিংস্র চিৎকার ছেড়ে পিস্তলের দিকে ঝাঁপ দিল বীন মিক্সাস। পিছলে ওটার কাছে পৌঁছুল। পিস্তল তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। স্টলের ঠিক মুখেই ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে লরেডো শ্যাড। ফাঁদে পড়া বেড়ালের মতো, ঘুরেই পিস্তল উঁচিয়ে ধরতে গেল মিক্সাস, সঙ্গে সঙ্গে ট্রিগার টিপল ও। প্রশস্ত আস্তাবলে বোমা ফাটার মতো শব্দ হলো। পর পর দুটো গুলি খেলো বীন মিক্সাস। একটা লাশ পড়ল মাটিতে।
গর্জে উঠল খড়ের গাদার রাইফেল। লরেড়োর মাথার কাছে স্টলের দেয়ালে খাবলা বসাল বুলেট। গুলির উৎস লক্ষ্য করে দ্রুত দুবার ট্রিগার টিপেই এক লাফে ফাঁকায় চলে এল লরেডো লাফিয়ে উঠল রাইফেলটা, আবার আগুন ঝরাল, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো গুলিটা। অ্যাবি মিক্সাস যেখানে লুকিয়ে রয়েছে, সেই চালাটার নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্যাড, ছাদ লক্ষ্য করে গুলি করল পর পর দুবার।
খালি পিস্তল হোলস্টারে ভরে অন্য পিস্তলটা বের করে অপেক্ষা করতে লাগল লরেডো শ্যাড। একটু দূরে ককিয়ে উঠল ছাদের পাটাতন। স্টলের আড়ালে আড়ালে পলায়নপর মিক্সাসকে অনুসরণ করল ও। আচমকা পেছনের দরজা সশব্দে খুলে গেল, আলোর বন্যায়, ভেসে গেল আস্তাবলের অন্ধকার। দ্রুত এগিয়ে গেল লরেডো। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।
শটগানঅলা লোকটার নাম স্লোয়ান। অ্যাাবি মিক্সাস দরজা গলে বেরিয়েই ওর মুখোমুখি হলো, মাত্র বিশ ফুট তফাত। কোমরের কাছ থেকে রাইফেলের ট্রিগার টিপল অ্যাবি। শ্লোয়ানের পাশে ওঅটর ট্রাফ ফুটো হয়ে গেল। একই সঙ্গে শটগানের বাঁ দিকের ব্যারের খালি করল স্লোয়ান।
অ্যাবির ঠিক কাঁধে লাগল গোলাটা, দরজার গায়ে আছড়ে পড়ল সে। ঝুলে পড়ল তার লম্বাটে চোয়াল, আতঙ্কিত। ঘাড়, কাঁধ রক্তে ভেসে যাচ্ছে, বিরাট একটা ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। রাইফেল উঁচিয়ে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করল অ্যাবি। এক কদম সামনে বাড়ল স্লোয়ান। বব ম্যাকলেনন, স্টলম্যান আর সেগালের মৃত্যুর কথা মনে পড়ছে। অন্য ব্যারেটাও খালি হলো। অগ্নিশিখা ছুটে গেল অ্যাবি মিক্সাসের দিকে।
নিহত ছিন্নভিন্ন মিক্সাস এলিয়ে পড়ল। ছিটকে পড়েছে তার মাথার পুরোনো টুপি। রক্ত আর বালিতে মাখামাখি হয়ে গেছে চোখমুখ।
গোলাগুলির পর অসহনীয় নীরবতা নামল। নীরবতা ভেঙে কথা বলল লরেডো শ্যাড। হয়েছে, স্লোয়ান! আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এল সে। মিক্সাসের লাশের দিকে দৃকপাত করল না। ওর ভাইকেও আর ঝোলানোর কষ্ট করতে হবে না।
পাশাপাশি দাঁড়াল ওরা। স্লোয়ানের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, অসুস্থ, মনে হচ্ছে ওকে। জীবনে এই প্রথম মানুষ হত্যা করল সে; এটাই শেষ। একটা সিগারেট তৈরি করার চেষ্টা চালাল, কিন্তু থরথর করে কাঁপছে হাত দুটো,। ওর কাছ থেকে তামাক আর কাগজ নিয়ে সিগারেট বানাল লরেডো শ্যাড। লজ্জিত চেহারায় মুখ তুলে তাকাল স্লোয়ান। আমি লোকটা আসলে ভীতু, বলল সে। কিন্তু ওই হারামজাদাকে দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল।
গম্ভীর চেহারায় ওর দিকে তাকাল টেক্সান। এ-ই ভালো, বলল ও। সিগারেট শ্লোয়ানকে দিল। ধরো, বলল, দুএক টান দিলেই চাঙা, বোধ করবে। ভাবছি কেড্রিক কী করছে।
কোনও আওয়াজই নেই এখন পর্যন্ত।
রাস্তার উল্টো দিকে একটা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল পিট লেইন। সব ঠিক আছে? চিৎকার করে জানতে চাইল।
হ্যাঁ, স্লোয়ানের সঙ্গী পাল্টা জবাব দিল। মিক্সাস ভাইদের আর খুঁজতে হবে না। আর কখনও ওদের চেহারা দেখা্যাবে না এদিকে।
রাস্তা বরাবর এগিয়ে গিয়ে সেইন্ট জেমস-এ ঢুকল ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। বিশাল লবি জনশূন্য ফাঁকা গহ্বরের মতো লাগছে। তামাক আর চামড়ার গন্ধ ভাসছে বাতাসে। বুড়ো ক্লার্ক ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। আজকের দিনটা একদম শান্ত, বলল সে। কোথাও কেউ নেই। কদিন হলো, মারপিট, গোলাগুলি সব বন্ধ!
বুড়োর কথা শেষ হওয়া মাত্র বাইরে থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে এল…আবার…আবার। শটগানের দুটো কানফাটা গর্জন, তারপর নীরবতা।
কানখাড়া করে রইল দুজন। কিন্তু আর কোনও শব্দ পাওয়া গেল না। খানিক পরু-পিট লেইনের প্রশ্ন আর কৃষকের জবাব শোনা গেল। মাথা ঝাঁকাল ক্লার্ক। হ্যাঁ, সেই পুরোনো মাস্ট্যাং, বলল সে। কদিন ধরে ভাবছিলাম ওহাইওতে ফিরে গেলাম নাকি! একদম ঠাণ্ডা মেরে গিয়েছিল সব-গোরস্থানের মতো!
করিডর ধরে এগিয়ে গিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। ভাঙাচোরা সিঁড়ি ভেঙে পেছনের ঘাসে ছাওয়া। উঠোনে এসে দাঁড়াল। একটা পুরোনো মরচে ধরা টিউবওয়েল আছে এখানে প্রখর সূর্যের আঁচে দগ্ধ হচ্ছে হোটেলের পেছনের দেয়াল।
টিউবওয়েলের দিকে এগিয়ে গেল কেড্রিক, চাপ দিল। প্রথমে আপত্তি জানাল ওটা, বহুদিনের অব্যবহারে মরচে পড়ে গেছে; অবশেষে কাজ হলো, কাঠের গামলায় ছলাৎ করে পড়ল পানির ধারা। কিছুক্ষণ পানি তুলল কেড্রিক, তারপর ক্যান্টিন, ভরে নিল। পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানি, ঢক ঢক করে পান করল, ও, একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার খেলো।
দালান-কোঠার পেছনে খানিকটা দরে কাঠ চেরাই করছে এক কাঠরে। কুড়োলের ফলায় রোদের প্রতিফলন চোখে পড়ল ওর। কাঠের গায়ে আঘাত হানল ওটা। কেড্রিক জানে, একটু পরে আওয়াজ শোনা যাবে। কিছুক্ষণ ওদিকে তাকিয়ে রইল পল। হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছে দালান-কোঠার পেছনে পেছনে মাস্ট্যাং-স্যালুনের দিকে পা বাড়াল।
সাবধানে এগোচ্ছে ও, মুহূর্তের জন্যেও থামছে না, সমগ্র অস্তিত্ব সতর্ক। এখন পয়েন্ট ফোর-ফোর রানজোড়া কোমরে ঝুলিয়েছে ও। ওগুলোর ছোঁয়া স্বস্তি জোগাচ্ছে। প্রয়োজনের মুহূর্তে চট করে হাতে উঠে আসবে।
মাস্ট্যাং-স্যালুনের পেছন-দরজায় বহুদিন রঙ পড়ে নি, রোদ আর বৃষ্টির অত্যাচারে কাহিল অবস্থা। কবজার দিকে তাকাল ও, জং ধরে গেছে, খুলতে গেলে শব্দ হবে। হঠাৎ দোতলায় ওঠার বাইরের দিকের সিঁড়িটা দেখতে পেল ও। ঘুরে পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এল কেড্রিক। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে করিডর ধরে এগোল।
নীচের স্যালুনে, প্রায় আধ বোতল হুইস্কি শেষ করে ফেলেছে ফেসেনডেন, কিন্তু এখনও ব্যর্থতার গ্লানি কাটিয়ে উঠতে পারে নি। টেবিল থেকে এক প্যাকেট তাস তুলে নিল ও, নিপুণ হাতে শাফল করল। একটুও কাঁপল না হাত দুটো। আর যাই হোক হাতের ওপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারে নি হুইস্কি।
বিরক্তির সঙ্গে কার্ড ছুঁড়ে ফেলে বারটেন্ডারের দিকে তাকাল ফেসেনডেন। ডরনি এত দেরি করছে কেন? দশমবারের মতো বলল সে, এখান থেকে চলে যেতে চাই আমি। এখানে থাকতে আর মন চাইছে না!
রাস্তার গোলাগুলির শব্দ পেলেও বারের কাছ থেকে নড়ল না সে। মাতাল কোনও কাউহ্যান্ডের কাণ্ড বোধ হয়, বলল বিরক্তির সঙ্গে।
তবু একবার খোঁজ নিলে পারতে, বলল বারটেন্ডার, স্যালুনে মারামারি হোক চাইছে না সে। তোমার দলের লোকও তো হতে পারে?
আমার কোনও দল নেই, সংক্ষেপে জবাব দিল ফেস আমি আর এসবে নেই। ইয়েলো বাটের খচ্চরটা কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে। আর ওদের সঙ্গে থাকার সাধ নেই। দোতলার করিডরে পায়ের আওয়াজ, ছন্দময় ভঙ্গিতে হাঁটছে কে যেন। হেসে মুখ তুলে তাকাল, ফেসেনডেন। খেয়াল করেছ, মিলিটারি কায়দায় হাঁটছে!
হঠাৎ, নিজের কথার অর্থ বুঝতে পারল ফেস, হাসি মুছে গেল ঠোঁট থেকে। বারে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। বারটেন্ডারের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। জানতাম! আমি জানতাম- গ্লাসের হুইস্কি গলায়, ঢালল সে তাই তো শহর ছাড়তে চাই নি!
বার থেকে সরে ঘুরে দু পা ফাঁক করে দাঁড়াল, ফেসেনডেন। বিশাল গ্রিজলি ভালুকের মতো লাগছে তাকে। কোমরের কাছে ঝুলছে দুহাত। দোতলার ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে আছে।
পায়ের আওয়াজ থেমে গেল, ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন কেড্রিক। ফেসেনডেনের দিকে তাকাল।
নীরবে কেটে গেল ঝাড়া একটা মিনিট। দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছে দর্শকরা। ফেসের্নডেনই নীরবতা ভাঙল অবশেষে।
আমাকে খুজছ, কেড্রিক?।
তোমাদের একজনকে হলেই হলো। শ কোথায়? কীথ?
কীথ পটল তুলেছে। ক্যানিয়নে তুমি আমাদের বারটা বাজানোর পর সল্ট ক্রিকের ধারে ওকে খুন করেছে ডরনি শ। সে এখন কোথায়, জানি না।
আবার নীরবতা! পরস্পরকে জরিপ করল ওরা। চিমনি রক-এ তুমিও ওদের সঙ্গে ছিলে, ফেসেনডেন, বলল কেড্রিক, ওটা একটা অ্যামবুশ ছিল–গুপ্তহত্যার চেষ্টা। আরেক কদম সামনে বাড়ল কেড্রিক। পাশ ফিরে সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখল। ছয় ধাপ পর একটা ল্যান্ডিং, তার পর বাঁক নিয়ে নীচে নেমে এসেছে সিঁড়িটা।
দাঁড়িয়ে আছে ফেসেনডেন, ওর পেশীবহুল বিশাল দুই পা মৃদু কাঁপছে। চওড়া মাথা সামনে ঝুঁকে পড়েছে। ধেত্তের! বলেই পিস্তলের বাঁট আঁকড়ে ধরল সে।
চোখের পলকে দুটো পিস্তল খাপ, ছেড়ে বেরিয়ে এল, আগুন ঝরাল। সিঁড়ির মাথায় নিউওয়েল পোস্টের মাথা গুড়ো হয়ে গেল একটা বুলেটের ধাক্কায়; তারপর ছিটকে দেয়ালে গিয়ে বিরল সেটা। কেড্রিকের ঠিক কাঁধের পেছনে দেয়াল ফুটো করল অন্য বুলেটটা। আরও এক ধাপ নামল ক্যাপ্টেন কেড্রিক। ট্রিগার টিপল পিস্তলের। গুলি খেয়ে পাই করে ঘুরল ফেসেনডের। হালকা পায়ে আরও চার ধাপ নেমে এল পল। ওকে লক্ষ্য করে দুদুবার ট্রিগার টিপল ফেসেনডেন। মাথা নিচু করে ঝাঁপ দিল কেড্রিক। দেয়ালের সঙ্গে মিশে গিয়ে উঠে দাঁড়াল। আবার গুলি করল ফেসেনডৈনের দিকে। একটা পা ভাজ হয়ে গেল তার; টক্কর খেলে বারের সঙ্গে।
দুবার গুলি খেয়েও মাথা ঠাণ্ডা রেখেছে সে। ভয়ঙ্কর। বারের গায়ে এক হাতে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল ফেসেনডেন, ডান হাত উঁচিয়ে ধরল, বুড়ো আঙুলে টেনে পেছনে নিয়ে এল পিস্তলের হ্যামার। সঙ্গে সঙ্গে বাঁ হাতের পিস্তল থেকে দ্রুত দুবার গুলি ছুঁড়ল কেড্রিক। বারের ওপর দিয়ে ঘষটে সোজা ফেসেনডেনের পাজরের নীচে ঢুকল একটা বুলেট। অন্যটা ফসকে গেল।
আবার গুলি করল ফেসেনডেন, লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। মরিয়া হয়ে উঠেছে সে, ডানহাতের পিস্তল হোন্টারে রেখে বাঁ হাতের পিস্তল দিয়ে ষষ্ঠ বারের মতো ট্রিগার টিপল ফেসেনডেন। সময় নিয়ে, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখে পিস্তলটা ডান হাতে পাচার করল সে। বুঝতে পারছে, সময় ফুরিয়ে আসছে। বেপরোয়া ফেসেনডেন; কিন্তু নিরুত্তাপ। এক গ্লাস মৃদ দাও, বারটেন্ডারের উদ্দেশে বলল সে।
বারের পেছনে মুখ ঢেকে শুয়েছিল বারটেন্ডার। নড়ল না লোকটা। ল্যান্ডিংয়ের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে কেড্রিক, তাকিয়ে রয়েছে ফেসেনডেনের দিকে। তিন তিনবার গুলি খেয়েছে ফেসেনডেন-কাধে, পায়ে, বুকে–তারপরও দাঁড়িয়ে আছে; হাতে উদ্যত পিস্তল; বিরাট, অপরাজেয় মনে হচ্ছে তাকে।
পিস্তল উঠে এল, ওটার সঙ্গে সামনে ঝুঁকে পড়ল ফেসেনডেন। তুমি ডরনি হলে ভালো হত, বলল সে।
ট্রিগার টিপল কেড্রিক। বুকে লাগল গুলিটা। এক কদম পিছিয়ে গেল ফেসেনজেন, আরও এক কদম। পিস্তলটা হাত থেকে খসে পড়ল। বারের ওপর থেকে একটা গ্লাস তুলে নিল সে, মদ ঢালো! আদেশ করল। রক্তের বুদবুদু দেখা দিয়েছে ঠোঁটের কোণে।
পিস্তল হাতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ক্যাপ্টেন কেড্রিক, ফেসেনডেনের দিকে এগিয়ে গেল। ডান হাতে পিস্তল তৈরি রেখে বাঁ হাতে একটা বোতল তুলে নিল ও, শূন্য, গাস ভরে দিল। তারপর আরেকটা গ্লাসে নিজের জন্যেও ঢালল।
ওর দিকে তাকিয়ে আছে ফেসেনডেন। তুমি খুব ভালো মানুষ, কেড্রিক, আস্তে আস্তে কথাগুলো উচ্চারণ করল সে। আমিও ভালো-কিন্তু আমরা দুই পক্ষে পড়ে গেছি।
এসো পান করি, গ্লাস উঁচু করে ধরল পল কেড্রিক, গ্লাস ছোঁয়াল দুজন। বাঁকা চোখে গ্লাসের ওপর দিয়ে কেড্রিকের দিকে তাকাল ফেসেনডেন।
ডরনির কাছ থেকে সাবধান, পরামর্শ দিল সে, কেউটের মতো ভয়ঙ্কর লোকটা। কথা আটকে যাচ্ছে, ভুরু কোঁচকাল ফেসেনডেন, গ্লাস, তুলল। মদ গলায় ঢালতেই বিষম খেলো সে। বিশাল ডান হাত কেড্রিকের দিকে বাড়িয়ে দিল। তারপরই হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেঝেতে। পিস্তল হোলস্টারে রেখে সামনে। ঝুঁকল কেড্রিক, ধরল বাড়িয়ে দেয়া হাতটা। হাসল ফেসেনডেন, তারপর প্রশান্তিতে চোখ বুজল।
১৫. ইয়েলো বাট-এর উদ্দেশে
কেড্রিক সহ সবাই ইয়েলো বাট-এর উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ার পর অস্থির হয়ে উঠল সামান্থা। এরপর কী হতে যাচ্ছে? ফ্রেড র্যানসাম পারবে কিছু করতে? কী হবে আসন্ন তদন্তের ফলাফল? এখানে মামার ভূমিকাকে কোন্ দৃষ্টিতে দেখা হবে?-অসংখ্য প্রশ্ন ভাবিয়ে তুলল ওকে।
মাস্ট্যাংয়ের ধূসর পাথুরে ভবনের একটা ডেস্কের ড্রয়ারে তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে মামার কাগজপত্র; ওর বিভিন্ন দলিলও রয়ে গেছে ওখানে। বারউইকের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে হলে কিংবা মামাকে অপবাদের হাত থেকে বাঁচাতে চাইলে ওগুলো লাগবে। চট করে সিদ্ধান্ত নিল সামান্থা। ঘোড়ায় চেপে রিমের উল্টোদিকের হাইডআউট থেকে বেরিয়ে পড়ল। ওল্ড মরমন ট্রেইলে পৌঁছে দক্ষিণে বাঁক নিল, ভোর হচ্ছে, বহুদূর থেকে ভেসে আসা গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
ট্রেইল ছেড়ে সল্ট ক্রিক ওঅশের নিচু অংশে চলে এল সামান্থা; কিছুক্ষণ এগোনোর পর, ডরনিশয়ের হাতে কীথ যেখানে মরতে যাচ্ছে, সেই জায়গাটা পেছনে ফেলে আবার দক্ষিণে রওনা হলো। কোনওভাবে একবার শহরে পৌঁছুনো গেলেই ঝামেলা চুকে যাবে, ভাবছে ও। বারউইক ছাড়া আর কাউকে হেডকোয়ার্টারে আশা করছে না। এই লোকটা কদাচিত চেয়ার ছেড়ে নড়ে।
ইয়েলো বাট থেকে পরাজিত গানম্যনরা ফিরতে শুরু করার কিছুক্ষণ আগে মাস্ট্যাংয়ে পৌঁছুল সামান্থা। রাস্তা ধরে এগোল ও। হেডকোয়ার্টারের পেছনের দরজায় চলে এল। তারপর ঢুকে পড়ল নিঃশব্দে এতটা সাবধানতার প্রয়োজন ছিল না। অল্টন বারউইক ঘরে নেই। পুরোনো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় এসে অ্যাপার্টমেন্টের তালা খুলল সামান্থা। মামার সঙ্গে এখানে থাকত ও। ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল।
কোনও কিছুতে হাত পড়েছে বলে মনে হলো না। জানালার পর্দাগুলো টেনে রেখে গিয়েছিল, তেমনি আছে। নিঝুম কামরা। ধুলোর হালকা আস্তরণ পড়েছে আসবাবপত্রের ওপর, পর্দার ফাঁক গলে ঘরে ঢুকে পড়া রোদে চকচক করছে। ট্রাংকের কাছে চলে এল সামান্থা। ইস্পাতে মোড়া একটা বাক্স বের করল ওটা থেকে। এই বাক্সেই সব কাগজপত্র আছে। বাক্সটা খোলার চেষ্টা করা হয়েছে, তেমন কোনও আলামত নেই। ট্রাংকের নীচ থেকে পুরোনো একটা পার্স বেরিয়ে এল এবার। চব্বিশটা স্বর্ণমুদ্রা ছিল ওটায়, বের করে হাতের পার্সে রাখল সামান্থা।
অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে এরপর কিম্ভুতকিমাকার একটা পুরোনো আমলের পিস্তল পাওয়া গেল ট্রাংকে। পিস্তলটা বের করে পাশের টেবিলে তুলে রাখল। পয়েন্ট-টু-টু ক্যালিবারের একটা ডেরিঞ্জারও বেরুল। বাবার দেয়া শেষ উপহার। অস্ত্রটা পকেটে রাখল ও।
চট করে এবার পাশের কামরায় চলে এল সামান্থা। দ্রুত সহজ ভঙ্গিতে মামার ডেস্ক তল্লাশি করল। একটু খুঁজতেই পাওয়া গেল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। এখনও কেউ ওগুলো স্পর্শ করে নি। ওরা হয়তো ভেবেছে এসব। কাগজের আর প্রয়োজন নেই কিংবা পরে সংগ্রহ করা যাবে। কাগজপত্র গোছগাছ করছে সামান্থা, এমন সময় বাড়ির পাশে ঘোড়ার খুরের শব্দ উঠল। পেছনের সিঁড়ির কাছে থামল একটা ঘোড়া।
সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাজ রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল সামান্থা ফক্স এ ঘরের একটা জানালার পর্দা কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে আছে। স্যাডলের সঙ্গে কাপড়ের ঘর্ষণের মৃদু আওয়াজ হলো। সওয়ারী যেই হোক, ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমেছে। এবার স্পারের ঝুনঝুন শব্দ ভেসে এল। পা বাড়িয়েছে আগন্তুক। তারপর নীরবতা।
ও, তুমি?
চমকে ঘুরে দাঁড়াল সামান্থা। চোখ বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে স্যু লেইন। হ্যাঁ, জবাব দিল ও, আমার কিছু জিনিস রয়ে গিয়েছিল, নিতে এসেছি। তুমি স্যু, তাই না?
জবাব না দিয়ে মাথা দুলিয়ে জানালার দিকে ইঙ্গিত করল মেয়েটা। কে এসেছে জানো?
না।
লরেন ফিরে এল বোধ হয়। গম্ভীর চেহারায় সামান্থাকে মাপল স্যু লেইন। ওরা কেমন আছে? সবাই ভালো? ইয়ে, মানে-পিটের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে?
হ্যাঁ, তোমার ওপর খেপে আছে ও।
একটু লাল হলো সুলেইনের চেহারা, কিন্তু উদ্ধত ভঙ্গিতে চিবুক উঁচু করে রাখল সে। জানি, কিন্তু আর কী আশা করেছিল ও, ওই মরা মরুতে ভিখেরীর মতো জীবন কাটাব? ওফ, বিশ্বাস করো, ঘেন্না ধরে গেছে আমার!
হাসল সামান্থা। আশ্চর্য! অথচ এখানে আমার কত ভালো লাগে। এ জায়গাটাকে আমি ভালোবাসি। যত দিন যাচ্ছে ততই ভাঁলো লাগছে। এখানে জীবন কাটাতে পারলে আর কিছু চাই না আমি।
পল কেড্রিকের সঙ্গে?
স্যুর চোখের তারায় ঈর্ষা খেলে গেল, সেই সঙ্গে দৃষ্টিতে কৌতূহলও ফুটে উঠল। মেয়েটা ওর চেহারা আর কাপড়চোপড় পরখ করছে, বুঝতে পারল সামান্থা।
কেন-আমি-একথা তোমার মনে হলো কেন?
পল-কে আমি দেখেছি তো! ওকে কাছে পেতে চাইবে না এমন মেয়ে আছে? এতগুলো লোকের মধ্যে ও-ই সেরা।
আমি জানতাম, কর্নেল কীথকে তোমার পছন্দ।
আবার রক্ত ছলকাল সুর চোখেমুখে। আমি-আমিও তাই ভেবেছিলাম। আসলে পল কেড্রিক আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে বলেই ওর প্রতি এতটা ঝুঁকে পড়েছি আমি। তা ছাড়া এখান থেকে দূরে কোথাও যেতে চাই আমি-সেটাও একটা কারণ। এই জন্যেই আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে পিট।
ভাই কোনওদিন বোনকে ঘৃণা করতে পারে না। তুমি ফিরে গেলে ও সত্যিই খুব খুশি হবে।
ওকে চেনো না, তাই এ-কথা বলছ। অ্যাল্টন, বারউইকের সঙ্গী না হয়ে আর কেউ হলে
তার মানে বারউইককে আগে থেকেই চিনতে তোমরা?
চিনতাম মানে? ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল লেইন। তুমি জানো না? পিট বলে নি? বারউইক তো আমাদের সৎ-বাবা!
অ্যাল্টন বারউইক? হতবাক সামান্থা ফক্স।
হ্যাঁ, ওই লোকটাই আমাদের বাবাকে খুন করেছিল। আমরা প্রমাণ পাই নি। পরে মা-ও সন্দেহ করতে শুরু করে তাকে, তাই আমাদের নিয়ে তার কাছ থেকে পালায়। কিন্তু আমাদের পিছু ছাড়ে নি বারউইক। মায়ের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছিল আমরা জানতে পারি নি, এক রাতে বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে গিয়ে আর ফিরে আসে নি। অন্য এক পরিবারের কাছে বড় হয়েছি, আমরা।
করিডরে কাঠের পাটাতন ককিয়ে উঠল। রূঙ্গে সঙ্গে চুপ হয়ে গেল ওরা, কান পাতল।
শহরের রাস্তা থেকে বন্দুকের প্রচণ্ড গর্জন ভেসে এল। দৃষ্টি বিনিময় করল ওরা। নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে। একটু বিরতি, তারপর আবার ভেসে এল, গুলির আওয়াজ। আস্তে করে খুলে গেল দরজাটা। দোরগোড়ায় ওদের মুখোমুখি দাঁড়াল ডরনি শ।
সামান্থা ফক্স আর স্যু, লেইনকে একসঙ্গে দেখে অবাক হলো সে। উজ্জ্বল বাদামি চোখে দ্বিধার ছায়া পড়ল, পালা করে দুজনের দিকে তাকাল।
তারপর স্যু লেইনের ওপর স্থির হলো তার দৃষ্টি। তুমি এবার কেটে পড়তে পারো, বলল সে। কীথ অক্কা পেয়েছে।
কী? সন্ত্রস্ত সুঢোক গিলল। ওকে ওরা মেরে ফেলেছে?
না, আমি মেরেছি। সল্ট ক্রিকের ধারে। আমাকে আক্রমণ করতে যাচ্ছিল সে।
কীথ–মারা গেছে? প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়েছে স্যু লেইন।
অন্যরা? ওরা কোথায়? চট করে জানতে চাইল সামান্থা।
দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ডরনি শ, কঠিন দৃষ্টি হানল সামান্থার দিকে। মেয়েটাকে নিয়ে কী করা যায় বুঝে উঠতে পারছে না যেন। বেশ কয়েকজন মারা গেছে, সহজ কণ্ঠে বলল ডরনি। আমাদের বারটা বাজিয়ে দিয়েছে ওরা। ওই কেড্রিক শালার জন্যেই! যেন কিছুই আসে যায় না এমনি নিরুত্তাপ কণ্ঠে কথা বলছে সে। কেড্রিক ওদের সঙ্গে নিয়ে ওত পেতে ছিল, কুত্তার বাচ্চাগুলোকে আমাদের ওপর লেলিয়ে দিয়েছে, মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে সবাইকে! মাথা নেড়ে রাস্তার দিকে ইঙ্গিত করল ডরনি শ। এখন বোধ হয় শেষ পলিশ পড়ছে। ফেসেনডেন আর মিক্সাসরা দুভাই বেঁচে ছিল।
এখানেও আসরে ওরা; দৃঢ় কণ্ঠে বলল সামান্থা ফক্স। এর পর এখানেই আসবে।
জানি, মোটেই বিচলিত মনে হলো না ডরনি শকে। কেড্রিকই আসবে সবার আগে, হাসল সে, মরবেও সবার আগে।
সিগারেটের কাগজ আর তামাক বের করল ডরনি, কামরার চারদিকে নজর বোলাল। তারপর আবার তাকাল স্যু লেইনের দিকে। তুমি ভাগো। সামান্থার সঙ্গে আমার জরুরী কথা আছে।
নড়ল না স্যু। যা বলার আমার সামনেই বলো। এখানে থাকতে আমার ভালো লাগছে।
সিগারেট পেপারে জিভ ছুঁইয়ে বাঁকা চোখে স্যু লেইনের দিকে তাকাল উরনি শ। ভাবলেশহীন দৃষ্টি। কী বলেছি, শুনেছ, বলল সে, আমি জোর জবরদস্তি করতে চাই না।
অত, সাহস আছে নাকি! চেঁচিয়ে উঠল স্যু লেইন। এখানে মেয়েদের গায়ে হাত তুললে কী হবে ভালো করে জানো তুমি। আমাকে খুন করলে যদিও বা রেহাই পাবে, কিন্তু গায়ে হাত তোলা সইবে না কেউ-তোমার মতো খুনীও নিস্তার পাবে না।
পকেটের ডেরিঞ্জারটার কথা ভাবছে সামান্থা ফক্স। কোমরে অস্ত্রের কাছে হাত নামিয়ে আনল ও।
আচমকা কামানের আওয়াজের মতো গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দ ভেসে এল। তারপর উপর্যুপরি আরও কয়েকটা গুলির শব্দ। ফেসেনডেনের সঙ্গে চুড়ান্ত মোকাবিলা করছে কেড্রিক। কান খাড়া করে ব্যাপার কী বোঝার চেষ্টা করল ডরনি। এগিয়ে আসছে, বলল সে। আমি কেড্রিকের জন্যে অপেক্ষা করব, এখানে।
ও আসার আগেই ভাগো, নিজের কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়ায় অবাক হলো সামান্থা। ওর সঙ্গে পারবে না তুমি। সবার মতো তোমার ভয়ে কেঁচো হয়ে যায়নি ও। স্রেফ মারা পড়বে, ডরনি!
সামান্থার দিকে তাকিয়ে কাষ্ঠ হাসি হাসল ডরনি শ। কেড্রিক মারবে আমাকে? হাহ! ড্রতে ডরনিকে হারানোর মতো বান্দা এখনও জন্মায় নি দুনিয়ায়, বুঝলে? সবার ক্ষমতা জানা আছে আমার। ফেসেনডেনের মতো লাৈক পর্যন্ত আমার সঙ্গে লাগার সাহস করে নি!
ঠাণ্ডা মাথায় পকেটে হাত ঢুকিয়ে ডেরিঞ্জারের বাঁট ধরল সামান্থা ফক্স। অস্ত্রের স্পর্শ আত্মবিশ্বাস জোগাল। আল্লার ওয়াস্তে চলে যাও, শান্ত কণ্ঠে বলল ও, আমরা তোমাকে আসতে বলি নি, তুমি এখানে থাকো, তাও চাই না।
নড়ল না, ডরনি শ। এখনও বড় বড় কথা? ধানাইপানাই ছাড়ো! এসো, আমার সঙ্গে যাচ্ছ তুমি।
তুমি যারে? আগুন ঝরল, সামান্থা, ফক্সের দৃষ্টিতে, দ্বিতীয়বার বলব না, আমি!
কী যেন বলতে চাইল ডরনি শ, কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বের হলো না ওর। ডেরিঞ্জার আঁকড়ে ধরে পকেটের ভেতর থেকেই ট্রিগার টিপল সামান্থা ফক্স। পিস্তল মোটামুটি ভালোই চালাতে জানে ও, কিন্তু এই রকম অবস্থান থেকে আগে কখনও গুলি করে নি। প্রথম গুলিটা ডরনি শয়ের কান উড়িয়ে দিল; দ্বিতীয়টি গিয়ে ঢুকল পাঁজরে; তিন নম্বরটা পাশের টেবিলের কাঠে আশ্রয় নিল।
বিস্ময়ে আর্তনাদ করে উঠল ডরনি শ। এক লাফে দরজা গলে করিডরে ছুটে গেল। সামান্থার দিকে হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্যু লেইন। আরে, আশ্চর্য! পকেট থেকে ডেরিঞ্জারটা বের করে আনল সামান্থা, ওটার দিকে তাকাল সে। ওটা দিয়ে মেরেছ ডরনি শকে! লোকের কানে যাক একবার কথাটা! গলা ছেড়ে হাসতে শুরু করল স্যু লেইন, অজান্তে সামান্থাও যোগ দিল সে হাসিতে।
সিঁড়ি বেয়ে নীচে এসে দরজার কাছে পৌঁছে কান স্পর্শ করল ডরনি শ। হাঁপাচ্ছে। যেন বহুদূর কোথাও থেকে দৌড়ে এসেছে। হাতে রক্ত দেখে মুখ বেঁকে গেল তার। বিস্ময়ের চোটে বুঝতেই পারল না কখন রাস্তার দিকের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে পল কেড্রিক। দরজা খুলতেই সামনে ওকে দেখে অধিক-শোকে-পাথর অবস্থা হলো তার। মুহূর্তের জন্যে বরফ হয়ে গেল। পরমুহূর্তে হাত বাড়াল পিস্তলের দিকে। কিন্তু তার আগেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। ওই এক মুহূর্তের দ্বিধার সুযোগ নিয়েছে পল কেড্রিক, ঝাপিয়ে পড়েছে ডরনির ওপর। ডরনির পিস্তলের দিকে বাড়ানো হাতের কজি ডান হাতে আঁকড়ে ধরল ও, হ্যাচকা টানে ঘুরিয়ে দিল তাকে, তারপর সর্ব শক্তিতে ঠেলে দিল দেয়ালের দিকে, ছাড়ল না হাতটা। দড়াম, করে দেয়ালের গায়ে, বাড়ি খেলো ডনি শ। পরক্ষণে শ্বাসনালীর ওপর বেমক্কা রদ্দা খেয়ে মুখ হাঁ হয়ে গেল তার।
হাতাহাতি মারপিটে আনাড়ি ডরনি শ। এরকম ঘুসি খেয়ে ওর চেয়ে বিশালদেহী লোকেরও জ্ঞান হারানোর কথা, স্বভাবতই বাতাসের জন্যে হাঁসফাস শুরু করল সে। দেয়ালের গায়ে ওকে ঠেসে ধরল পল কেড্রিক। ডরনি, ক্ষিপ্র লোকের মুখোমুখি হলে কী করব, একবার জিজ্ঞেস করেছিলে, এবার জবাব পেয়েছ নিশ্চয়ই!
বাম হাতে ডরনির গালে একটা প্রচণ্ড চড় কষাল কেড্রিক। রাগে দুঃখে ককিয়ে উঠল দুর্ধর্ষ গানম্যান। কেড্রিকের হাতের বাঁধন আলগা করার চেষ্টা করল। আরও জোরে দেয়ালের সঙ্গে তাকে ঠেসে ধরল পল। শার্টের কলার জাপটে ধরে চটাশ চটাশ আরও দুটো চড় কষাল। তুমি একটা সস্তা দরের খুনী, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল ক্যাপ্টেন কেড্রিক। আগেই এক দফা মার হজম করেছ দেখছি। এবার শেষ ডোজ দিচ্ছি তোমাকে।
ডরনির শার্ট দুহাতে টান মেরে ফড়ফড় করে ছিড়ে ফেলল পল। এখানে তোমার রাজত্ব চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দিতে যাচ্ছি আমি, ডরনি। তোমার আসল চেহারা আজ দেখবে সবাই-সস্তা, ভীতু খুনী। খামোকা এতদিন সবাই
ভয় করছিল! ডরনিকে আবার থাপ্পড় লাগাল কেড্রিক। তারপর ওকে দেয়ালের ওপর। আছড়ে ফেলে পেছনে সরে এল।
ঠিক আছে, শ, তোমার সঙ্গে পিস্তল আছে! বের করো!
রাগে দুঃখে ভেউভেউ করে কাঁদার অবস্থা হয়েছে ডরনি শয়ের। চিৎকার করে দুই হাত এক সঙ্গে, পিস্তলের দিকে বাড়াল সে। খাপমুক্ত হলো পিস্তলজোড়া। কিন্তু গত কয়েক মিনিটের অবিশ্বাস্য ঘটনাবলী দিশেহারা করে দিয়েছে ওকে। ডরনি গুলি করার আগেই গর্জে উঠল কেড্রিকের পিস্তল, ডান হাতের বুড়ো আঙুলসহ পিস্তলটা উড়ে গেল। বাম হাতের পিস্তলের ট্রিগার টিপল ডরনি শ, ফসকে গেল গুলিটা। অট্টহাসি হাসল ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। সজোরে ডরনির কজি লক্ষ্য করে নামিয়ে আনল পিস্তলের ব্যারেল। গুঁড়িয়ে গেল গানম্যানের কজির হাড়। আঁতকে উঠে পিস্তল ছেড়ে দিল সে। দেয়ালের গায়ে ঢলে পড়ল ডরনি, কাঁপছে থরথর করে, শূন্য দুই হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। বাঁ হাতের কজি গুড়ো হয়ে গেছে, ডান হাতের বুড়ো আঙুল উধাও; গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে ক্ষতস্থান থেকে।
নির্দয়ভাবে আবার ডরনি শকে ধরল কেড্রিক, এক ধাক্কায় দরজা দিয়ে বের করে দিল। হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়ল বেচারা, কিন্তু টেনে হিচড়ে আবার ওকে দাঁড় করল কেড্রিক। ইতিমধ্যে ভিড় জমে উঠেছে রাস্তায়, আঁতকে উঠল ওরা। কিন্তু, সেদিকে খেয়াল নেই কেড্রিকের। জনতার সামনে দাঁড়িয়ে আছে পিট লেইন, ডাই রীড এবং লরেডো শ্যাড; দেশের ভয়ঙ্করতম গানম্যানকে
এভাবে নাজেহাল হতে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে। ডরনি শয়ের ঘোর্ডা কাছেই দাঁড়িয়েছিল, ওটার দিকে ইঙ্গিত করল পল কেড্রিক। ঘোড়ার পিঠে তুলে দাও ওকে উল্টো করে!
ঘুরতে যাচ্ছিল ডরনি, থাপ্পড় মারার ভঙ্গিতে হাত তুলল কেড্রিক, আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তিরবশেই কুঁকড়ে গেল লোকটা হাসির রোল পড়ল ভিড়ে। যাও, ঘোড়ায় চাপো! বলল পল, ডাই, ঘোড়ায় উঠিয়ে ব্যাটার দুপায়ের গোড়ালি একসঙ্গে বেঁধে দাও!
মারের চোটে তালজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে ডরনি শ, কী ঘটছে বুঝতে পারছে না। মুখ তুলে তাকাল সে, সঙ্গে সঙ্গে হেডকোয়ার্টারের কাছাকাছি গ্রুলা, মাস্ট্যাংটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ব্যস, যেটুকু সাহস অবশিষ্ট ছিল, তাও হারিয়ে ফেলল সে।
পিস্তলে নৈপুণ্য আর প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতা সবার কাছে আতঙ্কের বস্তুতে পরিণত করেছিল ডরনিকে। লোকে তাকে এড়িয়ে গেছে; কিংবা ওর মন যুগিয়ে চলার চেষ্টা করেছে। পল কেড্রিকের হাতে আজ প্রথম বেইজ্জত হয়ে গেল সে। এমন কিছু ঘটতে পারে স্বপ্নেও ভাবে নি। আত্মবিশ্বাসের পাহাড় ধসে পড়েছে তার।
ঘোড়ার পিঠে সারা শহর ঘোরাও ওকে, কর্কশ শোনাল কেড্রিকের কণ্ঠস্বর। সবাই দেখুক খুনীর চেহারা। তারপর ওর কজি আর বুড়ো আঙুল ব্যান্ডেজ করে ছেড়ে দাও!
ছেড়ে দেব? জানতে চাইল শাড়। পাগল হলে?
না। ওকে ছেড়ে দাও। এখান থেকে চলে যাবে ও, কেউ আর কখনও ওর চেহারা দেখবে না। বিশ্বাস করো, এখন বেঁচে থাকাটাই ওর জন্যে কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। কাঁধ ঝাঁকাল ও। এরকম লোক অনেক দেখেছি। ওদের ভয় পায় না এমন কারও পাল্লায় পড়লেই আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে। মোটামুটি ভালো পিস্তল চালাতে পারত বলে এতদিন নিজেকে কঠিন মানুষ ভেবে এসেছে। সে লোকজনও তাই ভেবেছে। কিন্তু আসলে ও কঠিন লোক নয়। কঠিন লোকের জয়-পরাজয় দুটোরই অভিজ্ঞতা থাকে। আগে হারতে হবে তোমাকে, তারপর ছিনিয়ে আনতে হবে জয়। হেরে যারা জিততে পারে তারাই আসলে কঠিন লোক মার খেয়ে জয় কী জিনিস বুঝতে হবে।
ইচ্ছে করলেই, শুষ্ক কণ্ঠে বলল কেড্রিক, তুমি একজনকে মেরে শুইয়ে দিতে পারো। কিন্তু মাটিতে পড়েও আবার উঠে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পারলেই তাকে সত্যিকার কঠিন লোক ভাবা যায়। এতদিন বিপদের মুখে পড়ে নি বলে ডরনি শ বিরাট কিছু ভাবতে শুরু করেছিল নিজেকে। এবার নিজের অবস্থান বুঝতে পারবে।
আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হতে শুরু করল। দরজায় এসে দাঁড়াল সামান্থা ফক্স। ওর দিকে তাকিয়ে সহসা হেসে ফেলল কেড্রিক। সামান্থাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন বহু বছরের তৃষ্ণার্ত মরুভূমিতে জীবনের স্বাদ দিতে এসেছে এক পশলা বৃষ্টি।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে ওর কাছে, এল সামান্থা। তারপর পিটের দিকে তাকাল। তোমার বোনটি ওপরে আছে, পিট। ওর সঙ্গে তোমার কথা বলা দরকার।
একটু ইতস্তত করল পিট লেইন, তারপর বলল, কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই না আমি।
সিগারেটে লম্বা করে টান দিয়ে ধোয়ার ভেতর দিয়ে চোখ ছোট করে পিটের দিকে তাকাল লরেডো শ্যাড। আমি কথা বললে আপত্তি আছে? জিজ্ঞেস করল সে। ওকে আমার ভালো লাগে।
পিট লেইনকে বিস্মিত মনে হলো। এত কিছুর পরেও? সিগারেটের মাথায় আগুনের দিকে তাকাল শ্যাড। কী জানো, গম্ভীর কণ্ঠে বলল ও, সবচেয়ে ভালো. ঘোড়াটিকে বশ করতে কিন্তু সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হয়। শেষ পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হয় সে।
তা হলে যাও, শ্যাডের গমন পথের দিকে তাকিয় রইল পিট, তারপর পিছু ডেকে বলল, ওকে বলো, ওর সঙ্গে পরে দেখা করব।
১৬. পর পর তিনটি সপ্তাহ কেটে গেছে
পর পর তিনটি সপ্তাহ কেটে গেছে, অ্যাল্টন বারউইকের খোঁজ নেই। একেবারে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে লোকটা। ঘোড়সওয়াররা বহুবার খুঁজতে বের হলো তাকে, প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল তারা।
তৃতীয় সপ্তাহের শেষ দিন, বিকেল। স্টেজ কোচ থেকে নামল তিনজন যাত্রী। সঙ্গে সঙ্গে সেইন্ট জেমস-এ যার যার নির্ধারিত কামরায় পৌঁছে দেয়া হলো তাদের। ঘণ্টাখানেক পর, ওরা যখন ডিনারে বসেছে, ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক দরজা ঠেলে ডাইনিং রুমে ঢুকল; ওকে দেখে তিনজনের একজন উঠে দাঁড়াল। দীর্ঘদেহী, ধোপদুরস্ত পোশাক পরনে; জুলফির কাছে পাক ধরেছে চুলে। কেড্রিকের উদ্দেশে দুহাত বাড়িয়ে দিল সে। এই যে, পল! কদ্দিন পর দেখা! জেন্টলমেন, এর নাম পল কেড্রিক যার কথা এতক্ষণ বলছিলাম। আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি। পল–এ মিস্টার, এডগারটন আর এ হলো মিস্টার কামিংস।
কামিংস ছোটখাট মানুষ, মোটা, সপ্রতিভ চেহারা; এডগারটন র্যানসামের মতো লম্বা চওড়া, বিশাল একজোড়া ধূসর গোফ শোভা পাচ্ছে তার নাকের ডগায়। পল-কে স্বাগত জানাল ওরা। আসন গ্রহণ করল কেড্রিক। সাথে সাথে বিস্তারিত জানতে জেরা শুরু করল দুজন। শান্তকণ্ঠে স্পষ্ট করে নিউ অরলিন্সে কোম্পানির সঙ্গে যোগ দেয়া থেকে শুরু করে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করল কেড্রিক।
বারউইক নিখোঁজ? গোঁফঅলা এডগারটনের প্রশ্ন? খুনটুন হয় নি তো? বোধ হয় না, জবাব দিল কেড্রিক। হাওয়া হয়ে গেছে লোকটা। বিপদ দেখলে সটকে পড়া তার বরাবরের অভ্যেস বলে শুনেছি। বারউইক পালিয়ে যাবার পর মিস সামান্থা ফক্স আর তার মামা, জন গুন্টারের কাগজপত্র থেকে প্রায় সব কিছুই জানতে পেরেছি আমরা। কিন্তু বারউইকের অধিকাংশ কাগজপত্র উধাও হয়ে গেছে।
উধাও হয়েছে? জানতে চাইল এডগারটন। গেল কোথায়? কীভাবে?
মিস ফক্স জানিয়েছে, ডরনি শয়ের মুখোমুখি হওয়ার আগে ঘরে ঢোকার সময় অফিস কামরার সামনে দিয়ে গেছে সে, তখন সব কিছু গোছানো ছিল। কিন্তু পরে ভিড় কমে যাবার পর আমরা অফিসে ফিরে সব কিছু তছনছ অবস্থায় পেয়েছি। তার মানে কেউ তল্লাশি চালিয়েছে কিংবা ইচ্ছে করে ওভাবে ফেলে গেছে।
বারউইক ফিরে এসেছিল বোঝাতে চাচ্ছ? ওই সময় ওখানেই ছিল সে?
তা ছাড়া আর কে হবে বলো? সামান্থা-মনে, মিস ফক্স-জানিয়েছে, সেফের কমবিনেশন বারউইক ছাড়া আর কেউ জানত না। ব্যবসা দেখাশোনার সমস্ত দায়িত্ব তার ওপরই ছিল। কেড্রিকের দিকে তাকাল কামিংস। তুমি বলছ ডরনি শই কীথকে খুন করেছে, কাজটা যে তুমিই করোনি কীভাবে বুঝব? ফেসেনডেনকে হত্যা করার কথা নিজের মুখেই তো স্বীকার করলে।
হ্যাঁ, তা করেছি। সবার সামনে ফেয়ার ফাইটে আমার হাতে মারা গেছে ফেসেনডেন। কিন্তু কীথ মারা যাবার পর তার লাশও দেখি নি আমি।
জন গুন্টারকে কে মেরেছে বলে তোমার বিশ্বাস? জানতে চাইল কামিংস।
বারউইক হবারই সম্ভাবনা বেশি।
তা-ও ভালো কীথের নাম বলো নি, শুষ্ক কণ্ঠে বলল কামিংস।
কীথ ছুরি মারার মতো লোক নয়, শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল পল কেড্রিক। এমনকী পেছন থেকেও হামলা করত না সে, এক্ষেত্রে তাই ঘটেছে।
এই জমির ব্যবসায়, প্রশ্ন র্যানসামের, তোমার ভূমিকা কী, পল?
আমার? কোনও ভূমিকা নেই, সোজা কথা আমি এর মধ্যে নেই।
ঝট করে তাকাল কামিংস। এ-থেকে তোমার লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না? কোনওভাবেই না?
কীভাবে থাকবে? আমার কোনওরকম মালিকানা থাকলে তো? ব্যবসায় আমার তিলমাত্র অধিকার নেই।
কিন্তু এইমাত্র বললে, বারউইক তোমাকে মুনাফার শতকরা পনের ভাগ দেবার প্রস্তাব দিয়েছিল?
ঠিক। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, ওটা ছিল একটা টোপ, যাতে আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে অন্যদের সাথে খুন করা যায়। বারউইকই আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল, পরে ক্যানিয়নে খনিজ পাথর দেখার উসিলায় সরে পড়ে।
তা হলে মেয়েটা? মানে সামান্থা ফক্স? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল কামিংস। তারও কি লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা নেই?
জন গুন্টার, ওঁর টাকা ব্যবসায়ে খাটিয়েছিল, এখন ওগুলো ফিরে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ-লাভ তো আরও পরের কথা।
দেখলে তো, কামিংস? বলল র্যানসাম। বলেছিলাম না, কেড্রিক ভদ্রলোক। ওকে ভালো করে চিনি আমি।
তদন্ত শেষ হোক, তারপর এ-সম্পর্কে আমার মতামত জানাব। এখন নয়। আমি পুরো ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে চাই। অ্যাল্টন বারউইকের নিখোঁজের ব্যাপারেও খোঁজ খবর নিতে হবে। এখানকার অবস্থা মোটেই সুবিধের ঠেকছে না আমার কাছে।
হাতের কাগজপত্রের দিকে তাকাল কামিংস, তারপর কেড্রিকের দিকে চোখ ফেরাল। ভালো কথা কেড্রিক, ফেসেনডেনকে তুমি হত্যা করেছ, কিন্তু সে ছিল একজন নির্বাচিত শেরিফ, তাই না?
কারচুপি করে জিতেছিল, জবাব দিল কেড্রিক। ওরা নিজেরাই ভোট গুনেছিল। একে বৈধ নির্বাচন বললে ওদের অবশ্য নির্বাচিত বলা যায়।
অ। কিন্তু ওর কর্তৃত্ব নিশ্চয়ই অস্বীকার করবে না?
হ্যাঁ, করছি।
.
নিজের টেবিলে ফিরে কেড্রিক দেখল সামান্থা অপেক্ষা করছে ওর জন্যে। কেড্রিক বসতেই মৃদু হাসল সে। মন দিয়ে দেরি হওয়ার কারণ শুনল। তারপর ভুরু কুঁচকে ভাবল একটু। কামিংস? মামার কাগজপত্রে নামটা দেখেছিলাম বোধ হয়। ওয়াশিংটনে ওদের হয়ে কাজ করেছিল লোকটা।
এবার অনেক কিছু স্পষ্ট হলো, কফির কাপ তুলে নিল কেড্রিক, পরমুহূর্তে শ্যাড এগিয়ে আসছে দেখে তাড়াতাড়ি নামিয়ে রাখল। শ্যাডের চেহারা গম্ভীর। এদিক ওদিক তাকাল সে, কেড্রিককে দেখে প্রায় ছুটে এল, ঝুনঝুন শব্দ উঠল স্পারে। উঠে দাঁড়াল কেড্রিক। কী ব্যাপার? কী হয়েছে?
কী হয় নি! কাল রাতে গুলি খেয়েছে স্লোয়ান, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ইয়েলো বাট শহর!
কী? হতবাক কেড্রিক।
গম্ভীর চেহারায় মাথা ঝাঁকাল লরেডে শ্যাড। ওই ডরনি শয়তানটাকে ছেড়ে দেয়া মোটেই ঠিক হয় নি!
বিরক্তির সঙ্গে মাথা নাড়ল, কেড্রিক। অসম্ভব! তুলোধুনো হয়ে এখান থেকে গেছে সে, তাড়া খাওয়া খরগোশের মতো প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে, এত তাড়াতাড়ি তার প্রতিশোধ নেয়ার কথা নয়। কয়েকমাস পরে হয়তো একবার চেষ্টা করত। উঁহু, ডরনি নয়, অন্য কারও কাজ।
ডরনি ছাড়া আর কে করবে?
সামান্থার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো কেড্রিকের। মাথা দোলাল মেয়েটা, ভয়ার্ত দৃষ্টি তার চোখে। কে, সেটা ভালোই জানো তুমি, পল। বারউইক হওয়ার সম্ভাবনা মোল আনা।
অবশ্যই, কেড্রিকও তাই ভাবছে। কোনওরকম চিহ্ন না রেখে একেবারে গায়েব হয়ে গিয়ে ওকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল নোকটা। বারউইকের বিষ মেশানো দৃষ্টির কথা মনে পড়তেই নিঃসন্দেহ হয়ে গেল কেড্রিক। এখানে জমির ফটকাবাজির ওপর নির্ভর করেছিল বারউইক, অন্যদের চেয়ে বেশি শ্রম ব্যয় করেছে সে, এত সহজে হাল ছাড়তে চাইবে না।
শ্যাড,হঠাৎ বলল কেড্রিক, এতসব ঘটনার সঙ্গে গ্রুটার সম্পর্ক কী, বলো তো? বারবার ওটাকে দেখা যাচ্ছে কেন? আমরা জানি না, এমন কোনও ব্যাপার নেই তো? গৃঢ় কোনও রহস্য? গ্ৰলাটার সওয়ারী কে? তার চেহারা দেখা যায় না কেন? এর নাম শুনলেই এমন তটস্থ হয়ে উঠত কেন ডরনি?
গ্রলাকে ভয় করত সে? ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল লরেডো শ্যাড, ওর সঙ্গে খাপ খায় না।
কেন খাপ খায় না? জানা দরকার। তোমাকে বলেছি, সেদিন ডরনিকে, পেটানোর সময় হঠাৎ মুখ তুলে কী যেন দেখে আঁতকে উঠেছিল সে। আমার ধারণা, কী দেখবে আগে থেকেই জানত লোকটা। ডরনি শ যাবার পর আমি চারদিকে নজর বুলিয়েছি, কিন্তু কিছু দেখি নি। অবশ্য পরে গ্রুলা মাস্টাংটার ট্র্যাক চোখে পড়েছে। হট্টগোলের পুরো সময়টাকে বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়েছিল ঘোড়াটা!
আবার কামরায় এল ফ্রেডরিক র্যানসাম। ওদের টেবিলের দিকে এগোল। ঝামেলা বাধানোর পায়তারা করছে কামিংস, একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। সে। তোমাকে ফাসাতে চাইছে। কীথ কিংবা বারউইকের খুনের দায় তোমার ঘাড়ে চাপাতে পারলেই কাজ হয়ে যাবে তারকোম্পানির পার্টনারদের খুন করে সব কিছু ধামা চাপা দেয়ার জন্যে তুমি নাকি গল্প ফেঁদে বসেছ। লোকটা মহা ঘাপলা বাধিয়ে দিতে পারে, যার ফলে স্কোয়াটাররা হয়তো তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। সুতরাং যে করেই হোক এখন বারউইককে খুঁজে বের করা দরকার।
সিগারেট ধরাল লরেডো শ্যাড। কঠিন কাজ, বলল ও, তবে আমি বোধ হয় একটা সূত্র পেয়েছি।
কী? চোখ তুলে তাকাল কেড্রিক।
গ্রুলার ব্যাপারে বারউইক কখনও কিছু বলেছে?
না, আমি অন্তত, শুনি নি। ওর সামনে ঘোড়াটার প্রসঙ্গ উঠেছিল একবার, কিন্তু সে কোনওরকম কৌতূহল প্রকাশ করে নি।
আগে থেকে সব কিছু জানে বলেই হয়তো চুপ মেরে ছিল, বলল শ্যাড। প্রথম থেকেই লোকটা আমাকে ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিল।
চোখ তুলে লরেডোর দিকে তাকাল সামান্থা। হয়তো ঠিকই বলেছ। কিন্তু পিট আর স্যু লেইন বারউইকেরই সৎ-ছেলেমেয়ে, ওরা ঘোড়াটার সম্পর্কে কিছু জানে না কেন? কিছু জানলে একমাত্র ডরনি শই জানত।
উঠে দাঁড়াল পল কেড্রিক। তা হলে দেখা যাচ্ছে একটা পথই খোলা আছে আমাদের সামনে, বলল ও, ঘোড়াটার ট্র্যাক খুঁজে বের করে ট্রেইল করতে হবে, লরেডো। পুরোনো কোনও ট্র্যাক রেছে নিয়ে দেখতে হবে ওটা আমাদের কোথায় নিয়ে যায়।
.
তৃতীয় দিনে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। সারা সপ্তাহ ঠাণ্ডা হিম হাওয়া দিচ্ছিল, আকাশ ঢেকেছিল কালো মেঘে। বৃষ্টি নামবে সবাই জানত। বর্ষাতির ভেতর কুঁকড়ে গেছে লরেডো, গ্লাভস পরা হাতে তালি বাজাল, বিড়বিড় করে উঠল, সেরেছে! বিরক্তির সঙ্গে বলল ও, সব ট্রাক মুছে সমান হয়ে যাবে।
পুরোনোগুলো তো বটেই, সায় দিল কেড্রিক। যা হোক, এ-পর্যন্ত অন্তত ডজনখানেক ট্র্যাক অনুসরণ করেছি আমরা, লাভ তো হলো না। সবগুলো ট্র্যাক হয় পাথরের মাঝে উধাও হয়েছে, নয়তো বালির সঙ্গে মিশে গেছে।
ক্যানিয়ন ধরে খানিকটা এগোলে এসক্যাভাদার কেবিন, বলল লরেডো শ্যাড। চল ওখানে গিয়ে গলা ভিজিয়ে আসি। এই সুযোগে একটু আগুনও পোহানো যাবে।
চেনো নাকি তাকে?
হ্যাঁ, বিশ্রাম নেয়ার জন্যে একবার ওর ওখানে থেমেছিলাম। আধা স্প্যানিশ আধা উতে লোকটা। কঠিন মানুষ। সেই কবে এখানে আস্তানা গেড়েছে আর যায় নি। ওর কাছে হয়তো কোনও খবর মিলে যেতে পারে।
ক্যানিয়নের অভ্যন্তরে পথ পিচ্ছিল। তুমুল বৃষ্টির মাঝে ক্যানিয়নের লালচে দেয়াল কালো দেখাচ্ছে। চোখের সামনে কেউ বৃষ্টির ফোঁটায় বোনা পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। পাহাড়ের এক কোণে বুড়োর কেবিনে পৌঁছুতে পৌঁছুতে ভিজে কাক হয়ে গেল ওরা, ঠাণ্ডায় হি-হি করে কাঁপছে। ঘোড়া দুটোর অবস্থাও তথৈবচ। খিদেয় নাড়িভুড়ি হজম হবার যোগাড়।
দরজা খুলে ওদের ভেতরে ঢুকতে দিল এসক্যাভাদা। গাল ভরা হাসি উপহার দিল। তোমাদের দেখে খুশি হলাম, বলল সে। তিন সপ্তাহ হলো মানুষের চেহারা দেখি নি।
বর্ষাতি খুলে বসে পড়ল কেড্রিক আর লরেডো শ্যাড। ওদের কড়া হুইস্কি মেশানো কফি দিল এসক্যাভাদা। আগে শরীর গরম করে নাও, বলল সে। এখুনি আবার বেরোবে না নিশ্চয়ই? ঠাণ্ডা থেকে এসে হুইস্কি খেলে আরাম লাগে, যদি না আবার বাইরে যাও। বাইরে গেলে সব উত্তাপ চামড়া ঠেলে বেরিয়ে আসে, শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এজন্যেই হুইস্কি খেয়ে বাইরে গিয়ে মারা যায় লোকে।
আশপাশে কখনও একটা গ্রস্না মাস্ট্যাং দেখেছ তুমি, এসক্যাভাদা? বুড়োর দিকে তাকিয়ে আচমকা জিজ্ঞেস করে বসল লরেডো শ্যাড।
ওদের দিকে তাকাল বুড়ো, দৃষ্টিতে বিদ্রূপ মেশানো কৌতুক তোমরা আবার ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করো না তো?
না, বলল কেড্রিক, কিন্তু তার সাথে এর কী সম্পর্ক?
গ্রুলাটা এই অঞ্চলের একটা কিংবদন্তীর নায়ক, কমপক্ষে তিরিশ-চল্লিশ বছর কিংবা তারও আগের গল্প। ওটাকে মৃত্যু আর বিপদের প্রতীক হিশেবে দেখে সবাই।
কেড্রিকের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল লরেডো শ্যাড। কেড্রিক জানতে চাইল, ঘোড়াটা সম্পর্কে কদূর জানো তুমি? ওটা জ্যান্ত। আমরা দুজনই দেখেছি।
আমিও দেখেছি। বলল বুড়ো এসক্যাভাদা। একটা চেয়ারে বসে ওদের দিকে তাকিয়ে হাসল সে। মাথা ভর্তি পাকা চুল উস্কোখুস্কো, কিন্তু দুচোখে যেন তারুণ্যের দীপ্তি। একবার দুবার নয়, বহুবার। কিন্তু আমার কোনও বিপদ হয় নি, কোদাল হারানোকে বিপদ বললে অবশ্য ভিন্ন কথা।
চেয়ার টেনে লাকড়ির স্তুপের কাছে গেল সে। কয়েকটা লাকড়ি ঠেসে দিল আগুনে। বহুদিন আগে ঘোড়াটার কথা প্রথম শুনি আমি। বর্ম পরা এক স্প্যানিশ লোকের গল্প বলত বুড়োরা, ইঁদুররঙা ঘোড়াটা সে-ই হাঁকিয়ে বেড়াত, পাহাড় থেকে আসত আবার পাহাড়েই হারিয়ে যেত।
অনেকদিন আগে ওরই মতো বর্ম পরা এক লোক নাকি ইন্ডিয়ানদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাত। এ-হচ্ছে তারই প্রেতাত্মা। পনের ষোল বছর আগেও, ধরতে গেলে নিত্যদিনই কারও না কারও মুখে একবার শোনা যেত ওই কাহিনী। তারপর হঠাৎ যেন নতুন করে প্রাণ পেল সেটা!
মানে আবার নতুন করে চালু হয়েছে? কেড্রিক জানতে চাইল।
হ্যাঁ সল্ট ক্রিকের ধারে, ইন্ডিয়ান-আক্রমণে একটা ওয়্যাগন ট্রেন ধ্বংস হওয়ার পর এর শুরু। ওই হামলায় নারী-শিশুসহ ওয়াগন ট্রেনের প্রতিটি যাত্রী খুন হয়েছিল। কিন্তু ছোট একটা ছেলে পালিয়ে বেঁচে যায়, চার পাঁচ বছর বয়স ছিল তার। হামাগুড়ি দিয়ে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে একটা ঝোঁপের ভেতর আশ্রয় নিয়েছিল সে। তার মুখেই শোনা গেছে, বর্ম পরা শাদা চামড়ার একজন লোক গ্রুলার পিঠে ইন্ডিয়ানদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল।
গাঁজাখুরি, বলল শ্যাড, অবশ্য এত বড় দুর্ঘটনার পর উল্টাপাল্টা কিছু দেখলে বাচ্চাটাকে দোষ দেয়া যায় না।
ছেলেটা বলেছে; বর্মঅলা লোকটা প্রত্যেকটা মানুষকে ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে ওদের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছিল। একবার ঝোঁপের ভেতর সোজা ওর দিকে তাকিয়েছিল সে। প্রাণ ভয়ে কাদা হয়ে গিয়েছিল বাচ্চাটা। কিন্তু ওকে দেখতে পায় নি লোকটা, তা হলে বাঁচত না!
সেই থেকে গুলাটা নিয়মিত দেখা যাচ্ছে? প্রশ্ন লরেডো শ্যাডের।
হুঁ। কিন্তু আজ পর্যন্ত সওয়ারীর চেহারা দেখতে পায় নি কেউ। মাঝে মাঝে খুব দূরে আরোহীসহ ঘোড়াটা দেখা যায়; আবার অনেক সময় একাই দাঁড়িয়ে থাকে ওটা। ওটাকে দেখলেই খোদার নাম জপতে জপতে পালায় সবাই। উঠে গিয়ে আবার কফিপট নিয়ে এল বুড়ো। কিন্তু ঠিক আজই তোমরা এই গল্প শুনতে চাইলে দেখে অবাক হয়েছি, বলল সে।
একসঙ্গে বুড়োর দিকে তাকাল ওরা। কৌতূহল আঁচ করে আবার খেই ধরল এসক্যাভাদা। কয়েকদিন আগে শিকারে বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি ক্যাকটাস আর মেসকিট ঝোপে কয়েকটা মৌমাছি ঘুর ঘুর করছে। ওদের মৌচাক কোথায় জানার ইচ্ছে হলো। পিছু নিলাম। এখান থেকে দক্ষিণে অনেকটা দূরে চলে গেলাম আমি।
একেবারে দক্ষিণে না, বলা যায় দক্ষিণ-পশ্চিমে। মৌমাছির পেছন পেছন সোজা হগব্যাকে পৌঁছে গেলাম। চেনো তো জায়গাটা?
পাঁচ ছশো ফুটের মতো উঁচু একটা রিজ হগব্যাক, প্রথম চারশো ফুট তো প্রায় খাড়া উঠে গেছে। রিজ বেয়ে উঠে মৌমাছিদের চাকের গুহাটা খুঁজতে গিয়ে একটা ক্লিফ-হাউস চোখে পড়ল। ঘরটা কিন্তু মানুষের তৈরি। বিশ একুশ বছরের বেশি হবে না ওটার বয়স।
যা দেখে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি, আমার কোদাল-যেটা হারিয়ে গিয়েছিল। ওই ঘরে একটা তাকের ওপর রাখা ছিল। তো বুঝলাম কোদালটা হারায় নি, চুরি করেছিল কেউ। ঘরটা তল্লাশি করলাম আমি। চমৎকার গোছানো সব কিছু, খাবার কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব নেই। কেউ থাকে ওখানে, বাতিল জিনিসের নীচে লুকোনো একটা ব্রেস্টপ্লেট আর হেলমেটও দেখেছি আমি।
সত্যি?কেড্রিকের গলায় অবিশ্বাস।
নিশ্চয়ই! হাসল, এসক্যাভাদা, আরও আছে। দেখলাম মেঝের ওপর এক যুবকের লাশ পড়ে আছে। কয়েকদিনের পুরোনো। পুরোনো একটা স্প্যানিশ ছুরি গেঁথে আছে বুকে। বর্ম পরা স্প্যানিশের কাছে এই রকম একটা; ছুরি ছিল, আগেই বলেছি।
লাশ-যুবকের? হঠাৎ সামনে ঝুঁকে পড়ল কেড্রিক। বেমানান কিছু চোখে পড়েছে তোমার? যুবকের এক হাতের বুড়ো আঙুল কি কাটা ছিল?
বিস্মিত হলো এসক্যাভাদা। আশ্চর্য, জাদু জানো নাকি? হ্যাঁ, ছেলেটার এক হাতের বুড়ো আঙুল কাটা ছিল, অন্য হাতের অবস্থাও কাহিল-স্লিংয়ে বাঁধা ছিল। ডরনি শ! ঝট করে উঠে দাঁড়াল লরেডো শ্যাড ইয়াল্লা, ও যে ডরনি শ!
শ? ভুরুতে ভাঁজ পড়ল এসক্যাভাদার, দুচোখ জ্বলজ্বল করছে। আরে, আশ্চর্য, সত্যি আশ্চর্য ব্যাপার! ওয়্যাগন ট্রেনের বেঁচে যাওয়া ছেলেটাই তো ডরনি শ!
কেড্রিকের চেহারায় চিন্তার ছাপ। ডরনি শ-মারা গেছে। ডরনি ওয়্যাগন ট্রেনের সেই ছেলেটা হলে তার গ্রাকে ভয় পাওয়ার যুক্তি আছে। কিন্তু এত বছর পর সেই লোকের হাতেই মারা যাওয়া কিংবা ভূতের হাতে প্রাণ হারানো-যদি ভূত নামে কোনও পদার্থ আদৌ থাকে-পাগলেও বিশ্বাস করবে না। কিন্তু ব্যাপারটাকে অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়।
কপালের লিখন কেউ খণ্ডাতে পারে না, গম্ভীর কণ্ঠে বলল এসক্যাদা। ওই ছুরির হাত থেকে পালিয়েছিল ছেলেটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওটার ঘায়েই মরতে হলো।
উঠে দাঁড়াল কেড্রিক। আমাদের ওখানে নিয়ে যেতে পারবে, এসক্যাভাদা? হগব্যাকে?
পারব! বাইরে তাকাল এসক্যাভাদা। তবে এই বৃষ্টিতে নয়। আমার আবার গাঁটবাত আছে কিনা!
তা হলে ঘরটা কোথায় বলে দাও, বলল কেড্রিক। এখুনি যাচ্ছি আমি!
.
কোল মাইন ক্রিকের মুখ পার হচ্ছে ওঁরা, হঠাৎ ট্র্যাকের দেখা পেল লরেডো শ্যাড। সঙ্গে সঙ্গে লাগাম টেনে ঘোড়া থামাল ও। ট্র্যাকের দিকে ইঙ্গিত করল। চমৎকার নাল লাগানো ঘোড়ার পায়ের ছাপ।
গ্রুলা! গম্ভীর কণ্ঠে বলল কেড্রিক। এই ছাপ চিনতে আমার ভুল হবে না।
এগিয়ে চলল ওরা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আগের মতোই মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টির ফোঁটায় বাদ্য বাজছে. ঘাড়ে, মাথায়। পিচ্ছিল হয়ে আছে ট্রেইল, বিপজ্জনক। অন্ধকার লাগছে চারদিক।
আশ্রয় নেয়ার মতো একটা জায়গা খোঁজা উচিত, বলল শ্যাড, এই বৃষ্টিতে ঘোড়া খুঁজে পাওয়া অসম্ভব!
কিন্তু সকাল হবার আগেই এ-সব ট্রাক মুছে যাবে। তা ছাড়া আমার বিশ্বাস, এসক্যাভাদা যে গুহাটায় ডরনির লাশ দেখেছে সেখানেই আমাদের আসামীকে পাব!
ডরনি ওখানে গেল কীভাবে?
আমার ভুল না হলে, মুখ থেকে বৃষ্টির পানি মুছল কেড্রিক, পরিচিত কারও সঙ্গে ডরনির দেখা হয়ে গিয়েছিল, সে-ই ওকে হাইডআউটে নিয়ে গেছে। ওর মা বাবাসহ ওয়াগন ট্রেনের যাত্রীদের হত্যাকারী গ্রুর রাইডারই এই পরিচিত লোক। বর্মটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে সব বুঝে ফেলে ডরনি-তাই মরতে হয়েছে।
কিন্তু, গজগজ করে উঠল শ্যাড, আমার কাছে খোলসা হচ্ছে না। একটা ঘোড়া এতদিন বাচে কীভাবে?
বাঁচে না! এতগুলো বছরে কমপক্ষে গোটা দুয়েক গ্রা মরে ভূত হয়ে যাবার কথা। লোকটা সম্ভবত ইন্ডিয়ান আর মেক্সিকানদের গ্রুলাভীতিকে কাজে লাগিয়ে ওদের নিজের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। যা হোক, কেবিনে পৌঁছুলেই আমাদের সমস্ত জিজ্ঞাসার জবাব মিলবে।
কালো অশুভ প্রেতাত্মার মতো সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে হগব্যাক। কিছুটা সর্পিল কিছুটা খাড়া ট্রেইল তীক্ষ্ণ ছুরির মতো রিজের ওপর দিয়ে গেছে। খাড়াই ধরে উঠতে শুরু করল ওরা। খাড়া পিচ্ছিল পথ ধরে উঠতে গিয়ে হাঁপাচ্ছে ঘোড়া দুটো। ট্রেইলে দুদুবার গ্রর পায়ের ছাপ দেখতে পেল কেড্রিক, আনকোরা নতুন, বড়জোর ঘণ্টা খানেক আগের।
রিজের চূড়ায় পৌঁছে পেছনে তাকাল কেড্রিক আর শ্যাড। নেমে পড়ল স্যাডল থেকে। এবার একটু কষ্ট করতে হবে, গম্ভীর কণ্ঠে বলল পল, পায়ে হেঁটে এগোতে হবে।
নীচের দিকে, মাঝামাঝি দূরত্বে বিদ্যুৎ চমকাল, মুহূর্তের জন্যে আলোর বন্যায় ভেসে গেল চারদিক। চিৎকার করে উঠল লরেডো, সাবধান, পল! ডানে, ওপরে…!
ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল কেড্রিক। সঙ্গে সঙ্গে একটা রাইফেল গর্জাল। ওর পাশে পাথরে খাবলা বসাল বুলেট। পাথরকুচি ছিটাল চোখেমুখে। পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল পল। কিন্তু ওটা বর্ষাতির নীচে। আবার গর্জে উঠল, রাইফেল। উপর্যুপরি পাঁচটা বুলেট ধেয়ে এল। আশ্চর্য দ্রুততার সঙ্গে গুলি ছুঁড়ছে শত্রু।
কেড্রিকের পেছনে একটা আহত ঘোড়া আর্তনাদ করে উঠল, খানখান হয়ে গেল রাতের নিস্তব্ধতা। লরেভোর সাবধান বাণী রাইফেলের প্রচণ্ড গর্জনে চাপা পড়ে গেল। পরমুহূর্তে লাফিয়ে ওঠা ঘোড়ার সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে পাথুরে দেয়ালের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিল ও।
পাহাড়ী ছাগলের মতো অনায়াসে ট্রেইল ধরে ছুট দিল ওর অ্যাপলুসা। আবার রাইফেলের শব্দ হলো। ঝট করে মাটিতে শুয়ে পড়ল কেড্রিক।
শ্যাড? ঠিক আছ তো?
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর কর্কশ অথচ শান্ত কণ্ঠে জবাব এল, একটা গুলি লাগিয়ে দিয়েছে ব্যাটা! অবশ্য মারাত্মক কিছু নয়।
আমি যাচ্ছি ওকে ধরতে। একা থাকতে পারবে?
পারব। তবে যাবার আগে পা-টা একটু বেঁধে দিয়ে যাও।
বৃষ্টিতে ভিজে চকচক করছে পাথর। হগব্যাক রিজের চূড়ায় ঘন কুয়াশা। পাথরের আড়ালে হাঁটু গেড়ে বসল ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। বর্ষাতির সাহায্যে বৃষ্টি থেকে গা বাঁচিয়ে লরেডোর পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। শ্যাডের কপাল ভালো, গুলিটা মাংস ফুড়ে বেরিয়ে গেছে, হাড় ভাঙে নি।
১৭. ব্যান্ডেজ বেঁধে
ব্যান্ডেজ বেঁধে কনুইয়ের মতো উঁচু হয়ে থাকা একটা পাথরের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে ইতিউতি তাকাল ক্যাপ্টেন কেড্রিক। সামনে নিকষ কালো আঁধার। পাহাড়ের নীচে কোথাও ওদের ঘোড়া দুটো আছে। একটা সম্ভবত মরতে বসেছে, অন্যটা খোঁড়া হয়ে গেছে।
চারদিকে কালো অন্ধকার। আকাশ-ছোঁয়া পাথুরে দেয়াল, বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল। এই আঁধারে একজন খুনী হন্যে হয়ে খুঁজছে ওদের। অবিশ্বাস্য তার হাতের টিপ তিনশো গজ দূর থেকে বিদ্যুতের ক্ষণিক আলোয় পলকের জন্যে দেখেই দুদুবার শিকার প্রায় ঘায়েল করে এনেছিল! পরের গুলিতেই হয়তো প্রাণ হারাতে হবে। শত্রুর ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। পরিস্থিতি এখন স্পষ্ট। বাঁচতে চাইলে লোকটাকে খুঁজে বের করে হত্যা করতে হবে।
আলবৎ, শুষ্ক কণ্ঠে বলল লরেডো শ্যাড, শালাকে ধরতেই হবে। তবে সাবধান। স্পেন্সারে ব্যাটার হাত দেখেছ তো?
হগব্যাক রিজ থেকে তাড়াতাড়ি নেমে যাওয়া দরকার তোমার, জোর দিয়ে বলল কেড্রিক, এখানে থাকলে শীত আর বৃষ্টির হামলায় নির্ঘাত পটল তুলবে!
ও নিয়ে ভেব না, সংক্ষেপে জবাব দিল লরেডো। আমি হামাগুড়ি দিয়ে নীচে চলে যাব। কপাল ভালো হলে তৈমার অ্যাপালুসাকে পেয়ে যেতে পারি, ওটার স্যাডলব্যাগে খাবার, আর কফি আছে, তাই না?
হ্যাঁ, কিন্তু আমি ফেরার আগে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করো না। হাসল শ্যাড। জলদি ফিরো। একা একা খাওয়াআমার পছন্দ না।
বর্ষাতির পকেটে হাত ঢুকিয়ে পিস্তল দুটোর বাঁট আঁকড়ে ধরল কেড্রি। রাইফেল স্যাডল স্ক্যাবার্ডে রয়ে গেছে। নিপুণ এক শিকারীকে শিকার করতে যাচ্ছে ওঁ। আপন ঘাটিতে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আছে সশস্ত্র মার্কসম্যান। অস্ত্রের নাম: স্পেন্সর পয়েন্ট-ফাইভ-সিক্স!
বিদ্যুৎ চমকাল, কিন্তু এবার কোনও গুলি তেড়ে এল না। তবে, সন্দেহ নেই, কাছেপিঠেই আছে লোকটা, ওদের খুঁজছে। এখন আর ইস্তফা দেবে না সে, ফিরে যাবে না। ওদের হত্যা করার এটাই তার শেষ সুযোগ। তার হাইডআউটের ঠিকানা ফাঁস হয়ে গেছে, ওরা পালালে তার নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। এতদিন এখানে রয়ে যাওয়ায় একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেছে, কিছুতেই এখান থেকে নড়তে রাজি নয় লোকটা।
একটা ঝোঁপের আড়াল নিয়ে পাথরের নীচ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল পল কেড্রিক। বিদ্যুৎ চমকাল, সামনে একটা বোল্ডারের স্তূপ দেখতে পেল ও। এগোল সেদিকে। বাতাসে, পতপত করছে বর্ষাতির কিনারা, উড়ে যেতে চাইছে মাথার টুপি। ডান হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে নিয়েছে পল, বর্ষাতির নীচে লুকিয়ে রেখেছে।
এগিয়ে চলল ও। আবার বিদ্যুৎ চমকাল। ঝলমল করে উঠল চারদিক। সঙ্গে সঙ্গে মাটির সঙ্গে মিশে গেল পল। কিন্তু স্পেন্সার ঠিক গর্জে উঠল। উত্তপ্ত পাথর কুচি যেন, হুল ফোঁটাল চোখেমুখে। গড়িয়ে সরে গেল কেড্রিক, গুলি করবে কি, দুহাতে চোখ পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে।
বৃষ্টি আর বাতাসের হাহাকার ধ্বনি ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। হঠাৎ বহুদূর থেকে মেঘের গুরুগুরু গর্জন ভেসে এল, পাহাড়ের গায়ে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলল সে শব্দ 18 ফের বিদ্যুৎ চমকালে হগব্যাকের চূড়া বরাবর সামনে তাকাল কেড্রিক। অবিরাম বৃষ্টির আক্রমণে ইস্পাতের মতো চকচক করছে পাথরগুলো। নীচে নেমে এসেছে মেঘের দল, মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। চারপাশে কুয়াশা ভাসছে, হিম অশরীরী হাত বোলাচ্ছে গালে। মরা পাইন গাছের শাদা কঙ্কাল আঙুল তুলে আকাশকে যেন অভিযুক্ত করছে।
বৃষ্টির ছাট লাগছে চোখে মুখে। প্রতিবার বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে সঙ্গে গুলি খাওয়ার আশঙ্কায় কুঁকড়ে যাচ্ছে ও। বজ্রের আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে পাহাড় চূড়া, পোড়া গন্ধ নাকে লাগছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল কেড্রিক। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে ও। এক সময় টনটনিয়ে উঠল চোখজোড়া।
মুখের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ, ছুঁচোর কেত্তন চলছে পেটে। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। ভয়? আতঙ্ক? এভাবে আর পড়ে থাকা যায় না। অসীম ধৈর্যের সঙ্গে সামনে বাড়ল কেড্রিক। রিজের প্রান্ত বরাবর বহু বছরের বাতাসের হামলায় অদ্ভুত আকৃতি নিয়েছে একটা জুনিপার আর অন্যান্য গাছপালার ঝোঁপ; সেটার উদ্দেশে এগিয়ে গেল।
বাতাসের শব্দ ছাড়া কোনও শব্দ নেই। কিছু দেখার উপায় নেই। পল ভাবছে, ক্লিফ-হাউস আর কতদূর! খুনীর আগেই ওখানে পৌঁছুতে পারবে? নাকি মাঝপথেই খুনীর চোখে ধরা পড়ে যাবে? আচমকা অগ্নিশিখা অন্ধকার ছিন্নভিন্ন করল, আগুন লাগল যেন কেড্রিকের কাঁধে। কিছু না ভেবেই গড়ান দিল ও, সরসর করে দশ বার ফুট নীচে একগাদা শুকনো ডালপালার স্তুপে পড়ল।
সময় নষ্ট করল, না খুনী। আচমকা ব্রিজের মাথায় তার বিশাল ছায়া দেখা গেল। ফাঁদে পড়া জন্তুর মতো গুটিসুটি হয়ে সাবধানে পিস্তলের ট্রিগার, টিপল পল কেড্রিক।
প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি খেলো ছায়ামূর্তি। পরমুহূর্তে গর্জে উঠল স্পেন্সর পয়েন্ট ফাইভ-সিক্স। বুলেটের আঘাতে কাছের একটা ডাল উড়ে গেল। আগে গুলি করতে পেরেছে বলেই এ-যাত্রা বেঁচে গেছে, বুঝতে পারল কেড্রিক। আবার গুলি, করল ও। তারপর স্বেচ্ছায় পেছনের অন্ধকারে গড়িয়ে পড়ল। অনেকটা নীচে এসে থামল, হামাগুড়ি দিয়ে সরে গেল। তারপর উঠেই আবার ঝাঁপ দিল অন্ধকারে, হাত ভাঙা বা মাথা ফেটে যাওয়ায় ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও। এখন খুনীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ানোটাই জরুরী। আচমকা বিদ্যুৎ চমকে উঠল। এবং ভেলকিবাজির মতো গর্জল স্পেন্সার। ওর গতিবিধি লোকটা খেয়াল রাখছে কীভাবে, খোদা মালুম! চারদিকে বৃষ্টির মতোই বুলেট পড়ছে। প্রায় নির্ভুল গুলি করছে লোকটা, বেশিক্ষণ ফাঁকি দেয়া যাবে না।
দু’কাঁধে আগুন জ্বলছে, কিন্তু চোটটা, মারাত্মক না, সামান্য চামড়া ছড়ে গেছে, বুঝতে পারছে না কেড্রিক। মেরুদণ্ড বেয়ে গড়িয়ে নামছে তরল পদার্থের ধারা। রক্ত? পানি?
ঘুরে পেছনে সরে গেল কেড্রিক। আরেকটা গুলি ছুটে এল। কিঞ্চিৎ বাঁ দিক দিয়ে বেরিয়ে গেল ওটা। সঙ্গে সঙ্গে আবার বামে চলে এল ও। মুহূর্তে একটু আগের অবস্থানের কাছে মাটিতে গাঁথল একটা বুলেট। অনুসন্ধানী গুলি ছুঁড়ছে খুনীক্রমশ দূরত্ব কমিয়ে আনছে!
এক কদম পিছনে সরতে গিয়ে হোঁচট খেলো কেড্রিক, ধপাস করে আছড়ে পড়ল। চোখের পলকে মাথার ওপর দিয়ে বিশ্রী শব্দ তুলে, ছুটে গেল এক ঝাক বুলেট। গুলি ভর্তি একটা বেল্ট আছে লোকটার কাছে, নয়তো পকেট ভর্তি করে গুলি নিয়ে এসেছে।
উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল কেড্রিক। হঠাৎ হাতের তালুতে মসৃণ পাথরের ছোঁয়া অনুভব করল। ভালো করে চারপাশে হাত বোলাল ও। পাথর নয়, মাটি আর নুড়ি।
রাস্তা! একটা রাস্তায় এসে পড়েছে ও! নিশ্চয়ই ক্লিফ-হাউসের দিকে গেছে।
সাবধানে হাতড়ে হাতড়ে এগোতে শুরু করল কেড্রিক। হঠাৎ বাম দিকে পাথর গড়ানোর শব্দ পেয়ে আন্দাজে ট্রিগার টিপে দিল। তারপরই ডিগবাজি দিয়ে সরে গেল ও। পরক্ষণে একটু আগের অবস্থানে পর পর তিনটে গুলি এসে লাগল। আবার গুলি করল পল, আবার; গুলি করছে আর দৌড়চ্ছে।
বিদ্যুৎ চমকাল ফের। পেছনে তাকাতেই ট্রেইলে বিশাল এক ছায়ামূর্তি দেখতে পেল ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। দৈত্যাকৃতি, চকচকে এবং কালো। অগ্নিশিখা তেড়ে এল ওদিক থেকে। বুলেটের ধাক্কা খেলে কেড্রিক। সামলে নিল নিজেকে, আবার ট্রিগার টিপল।
তারপর আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াল। রাস্তা ধরে এগোল সামনে। হঠাৎ দেখল চোখের সামনে ফাঁকা-ট্রেইলটা এখানে চুলের কাটার মূতো বাঁক নিয়েছে। আর এক কদম এগোলেই হয়েছিল। আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠতেই মুক্তির উপায় দেখতে পেল পল কেড্রিক। নীচে ধূসর শাদা অ্যাপলুসাটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে।
ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল কেড্রিক। কিছুদূর নামতেই একটা চাতালে পৌঁছুল ও। এবং তারপর হাতে লাগল ক্লিফ-হাউসের অমসৃণ, পাথুরে দেয়াল। দেয়াল হাতড়ে এগোল কেড্রিক। দরজা খুঁজে পেতে অসুবিধে হলো না। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ও। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। দরজার কবাট টেনে দিল ও।
বাতাস আর বষ্টির অত্যাচারের পর ঘরটাকে যেন খোদার আশীর্বাদ বলে মনে হচ্ছে। একটানে মাথা থেকে ভেজা টুপি খুলে ফেলল পল কেড্রিক। বর্ষাতিটাও খুলে নিল গা থৈকে। খুনী ভাবতেও পারবে না এ জায়গার কথা ও জানে। আগে থেকে জানা না থাকলে এই ঝড়-তুফানের রাতে এটা খুঁজে পেত না।
কামরার একটু সামনে এগোতেই একটা পর্দার মুখোমুখি হলো পল, কেড্রিক। প্রথম ঘরকে ভেতরের ঘর থেকে আলাদা করেছে এটা। পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে একটা বাংকের ওপর বসল পল। বর্ষাতি আর টুপি বিছানায় রেখে বাম হোলস্টারের পিস্তল বের করতে গিয়ে দেখল হোলস্টার খালি। ডান হাতের পিস্তলে এ পর্যন্ত পাঁচবার গুলি করেছে ও। সহসা দুলে উঠল পর্দাটা, এক ঝলক বাতাস ঢুকে পড়ল ঘরে। তারপর সব কিছু স্থির। এসেছে খুনী! পাশের কামরায়!
বিছানা ককিয়ে উঠতে পারে এই ভয়ে ওঠার সাহস হলো না কেড্রিকের। ফস করে একটা দেশলাই জ্বলে উঠল। মোমবাতি জ্বালাল খুনী। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ কথা বলে উঠল লোকটা। কেড্রিক, আমি জানি তুমি এখানে আছ। ঘরের মেঝেতে পানির দাগ দেখতে পাচ্ছি। এ-ঘরে একটা পাথুরে দেয়ালের পেছনে আছি আমি, টেবিল হিসেবে ব্যবহার করি এটাকে। সুতরাং বুঝতেই পারছ, আমার গায়ে গুলি লাগাতে পারবে না। কিন্তু ওই ঘরে কোনও আড়াল নেই। তো; কী করতে হবে বুঝতেই পারছ, পিস্তল ফেলে মাথার ওপর দুহাত তুলে লক্ষ্মী ছেলের মতো বেরিয়ে এসো। নইলে একটানা গুলি শুরু করব আমি,ঘরের এক ইঞ্চি জায়গাও বাদ দেব না!
দুঘরের মাঝখানে একটা আড়াআড়ি খুঁটির সাহায্যে পর্দাটা ঝোলানো, পর্দার ওপর দিয়ে ও-পাশের ঘরের ছাদ দেখা যাচ্ছে। এ-ঘরটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক উঁচু। সম্ভবত একটা বেরিয়ে থাকা পাথর কিংবা কোনও গুহাকেই দেয়ালে ঘিরে নিয়েছে খুনী। কয়েকটা ভারি সিডার কাঠের বীম দেখা যাচ্ছে, সিলিং বসানোর জন্যে ওগুলো লাগানো হয়েছিল, এখন আর সিলিংয়ের চিহ্ন নেই। এ-ঘরেও ও-রকম বীম থাকা উচিত।
নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল কেড্রিক। হঠাৎ নড়াচড়ার শব্দ পেয়েই গুলি করল ও।
পাশের কামরা থেকে হাসির শব্দ ভেসে এল। জানতাম গুলি করবে! তা একটা পিস্তল তো এখন খালি! অন্যটা ফেলে এবার বেরিয়ে এসো! উপায়। নেই, কেড্রিক!
জবাব দিল না পল। মাথার ওপর হাত তুলে দিয়েছে ও, বীম খুঁজছে। হঠাৎ আলতো ছোঁয়া লাগল হাতে। হ্যাঁ, আছে। পাশের ঘরের, বীমের উচ্চতা দেখে কৃত ওপরে লাফ দিতে হবে হিসেব করে নিল ও।
বীমটা পুরোনো হলে! ওর ভার সইতে পারবে তো? কিন্তু ঝুঁকিটা নিতেই হচ্ছে।
লাফ দিল কেড্রিক। বীম আঁকড়ে ধরল ওর হাত-নিঃশব্দে টেনে নিজেকে ওপরে তুলল। আলোকিত পাশের ঘরের অভ্যন্তর দেখা যাচ্ছে। কিন্তু খুনীর অবস্থান বুঝতে পারল না কেড্রিক।
আবার কথা বলল লোকটা। নাহ, আর সময় দিতে পারছি না; কেড্রিক। বেরিয়ে এসো! নইলে গুলি করল! জলদি পিস্তল ফেলে দাও!
অখণ্ড নীরবতা নামল কামরায়।
আচমকা পিস্তলের কানফাটা আওয়াজে, খানখান হলো নীরবতা। গুলি করছে খুনী! অবিরাম! একটা সিক্স-গান খালি হলো। তারপর আরও, একটা পিস্তল খালি করল সে। খোদাই মালুম লোকটার কাছে কটা পিস্তল আছে! ওর মতিগতি বোঝারও উপায় নেই। আবার সযত্নে ছটা গুলি করল সে! দেয়ালে বাড়ি খেয়ে কৈড্রিকের ঠিক মাথার কাছ দিয়ে ছুটে গেল একটা বুলেট!
দীর্ঘ নীরবতা। তারপর নড়াচড়ার আওয়াজ।
ঠিক হ্যায়, এখনও বেঁচে থাকলে ফের গুলি করছি আমি। তবে হার স্বীকার করতে রাজি থাকলে শেষ বারের মতো সুযোগ দিচ্ছি। তোমাকে জ্যান্ত পেলে আমারই লাভ।
আচমকা সরে গেল পর্দা। ফাঁকায় এসে দাঁড়াল অ্যাল্টন বারউইক। হাতে উদ্যত পিস্তল। গুলি করার জন্যে তৈরি।
.
কোনওরকম আওয়াজ দিল না পল কেড্রিক। ইতিউতি তাকাল বারউইক। তারপর ছুটে এল ভেতরে। ক্রোধে চিৎকার করছে। প্রথমে কেড্রিকের টুপি, তারপর বর্ষাতি ছুঁড়ে ফেলল বিছানার ওপর থেকে। বর্ষাতির সঙ্গে কেড্রিকের অন্য পিস্তলটাও পড়ল মেঝেতে, হোলস্টার থেকে বেরিয়ে বর্ষাতির সঙ্গে আটকে ছিল, কোনওমতে। হিংস্র চেহারায় ওটার দিকে তাকিয়ে রইল বারউইক একটানে সরিয়ে ফেলল বিছানাটা। রাগে উন্মাদপ্রায়। খাটের নীচে কেড্রিককে খুঁজল। কেড্রিক নেই বিশ্বাস করতে পারছে না। দিশেহারা চেহারা।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল বারউইক। আস্তে আস্তে স্তিমিত হলো ক্রোধের আগুন। দাঁড়িয়ে আছে সে, হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে বিশাল বুক। এখনও পিস্তল ধরে রেখেছে। চলে গেছে! চলে গেছে! নিকটাত্মীয় বিয়োগব্যথায় কাঁদছে যেন। অথচ এখানেই বাগে পেয়েছিলাম!
বীমের গা থেকে ছোট্ট একটা টুকরো ভেঙে নিল কেড্রিক। বারউইকের গাল, বরাবর ছুঁড়ে মারল। যেন মৌমাছির হুল ফুটেছে, চমকে উঠল লোকটা। ঘাড় কাত করে অকাল ওপর দিকে। দৃষ্টি বিনিময় হলো দুজনের। ধীর পায়ে পিছিয়ে গেল বারউইক, হাসছে। সত্যি চালু ছেলে তুমি, কেড্রিক! ধূর্ত! গবেট কীথের জায়গায় তোমাকে যদি পাশে পেতাম! লোকটা খালি বড় বড় বুলি কপচাত, ভেতরে কিছু নেই-ঠন ঠন!
যাক গে, লম্বা করে দম নিল বারউইক। এবার তোমাকে পেয়েছি। আমাকে অনেক জ্বালিয়েছ তুমি, সেজন্যে পস্তাতে হবে। মেঝে থেকে কেড্রিকের পিস্তল তুলে নিয়ে আরেকটু পিছিয়ে গেল সে। ঠিক হ্যায়, নেমে এসো এবার!
মেঝেয় নামল পল কেড্রিক। বিরক্তির সঙ্গে মাথা নেড়ে ওর পিস্তলের দিকে ইঙ্গিত করল বারউইক। ধাপ্পাবাজি রাখো! ওটা খালি। ফেলে দাও!
ব্যাপারটা কী, বারউইক? হঠাৎ জানতে চাইল কেড্রিক। এখানে কেন? বর্মটা কীসের জন্যে? ডরনি শয়ের এ-অবস্থা কেন?
আচ্ছা? এসব তুমি জানলে কীভাবে? অবশ্য এখন আর তাতে অসুবিধে নেই। তুমি তো বেঁচে থাকছ না! পিছিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল বারউইক। পিস্তল উঁচিয়ে কেড্রিকের দিকে সতর্ক নজর রাখছে। ব্যাপারটা খুবই সোজা। সোনার জন্যে, বাছা, সোনা! অনেক টাকার সোনা! ওয়্যাগন ট্রেনের ওপর হামলা চালানোর জন্যে ইন্ডিয়ানদের আমিই উস্কে দিয়েছিলাম। ওয়্যাগন ট্রেনের সোনা হাতাতে চেয়েছি। ডরনির এক বন্ধুর বাবা ছিল ওই সোনার মালিক!
সোনার খবর, আগেই আমার কানে আসে। ডজ সিটি থেকেই ওদের অনুসরণ করি। ব্যাংক থেকে তোলার সময় সোনার পরিমাণ জেনে নিয়েছিলাম।
কিন্তু ওরা আমাকে বোকা বানিয়ে দেয়। হামলা চালানোর আগেই কোথাও পুঁতে ফেলে সব সোনা। এদিকে যে কোনওখানে হতে পারে মুশকিল হয়েছে সেখানেই। ট্রেইলের ধারে কাছে কোথাও, জানি, কিন্তু অনেক খোঁড়াখুঁড়ি করেও পরে পাইনি! তবে পাব-আর কাউকে হাত দিতে দেব না!
জমি কিনতে চেয়েছি কেন, জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, না? লাভের জন্যে তো বটেই! কিন্তু আমার আসলে দরকার ছিল এ-এলাকাটা, যাতে ভালো করে সোনার খোঁজ করতে পারি। থিভিং রক আর এই পাহাড়ের মাঝামাঝি কোথাওই সোনাটা থাকতে বাধ্য।
মাথা দোলাল কেড্রিক। এবার সব কিছু পরিষ্কার হচ্ছে। বারউইক, পিস্তল ফেলল! ধরা দাও!
বিরস কণ্ঠে হাসল বারউইক। ধোকা দিচ্ছ? জানতাম চেষ্টা করবে! সাহস, আছে বলতে হয়! তুমি পিস্তল ফেলো, কেড্রিক, নইলে মালাইচাকি গুঁড়িয়ে দেব?
লোকটা গুলি করবে, বুঝতে পারছে ক্যাপ্টেন কেড্রিক। বারউইকের পিস্তলের ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে পিস্তল ওঠাল ও। ঠাণ্ডা মাথায় ট্রিগার টিপল, বারউইক গুলি করার ঠিক আগমুহূর্তে। গুলিটা বারউইকের পিস্তলধরা হাতের বুড়ো আঙুল ঘেঁষে পেটের একপাশে ঢুকল।
কেঁপে উঠল তার বিশাল শরীর, বেঁকে গেল ঠোঁটজোড়া। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে পলের পিস্তলের দিকে তাকাল। গুলি করার জন্যে পিস্তল ওঠাল। অবিচল হাতে আবার ট্রিগার টিপল কেড্রিক। একবার, দুবার। থপ থপ শব্দে বারউইকের শরীরে আশ্রয় নিল বুলেটগুলো। রক্ত সরে শাদা হয়ে গেল লোকটার মুখ হাত থেকে পিছলে পড়ল পিস্তলটা। এগিয়ে এসে ওকে ধরে ফেলল কেন্দ্রিক, শুইয়ে দিল আস্তে করে। বারউইকের থলথলে গাল শাদা হয়ে গেছে। বোকার মতো ওর দিকে তাকাল সে। কী হলো? ওটা-ওটা?।
এটা ওয়েলশ টুয়েলভ-শট-নেভী-পিস্তল, বুঝিয়ে দিল কেড্রিক। পয়েন্ট ফোর-ফোর রাশানের বদলে কদিন হলো এগুলো সঙ্গে রাখছি।
ওর দিকে তাকিয়ে আছে বারউইক, দৃষ্টিতে বিদ্বেষের লেশমাত্র নেই। চালাক! বলল সে। সত্যি চালাক ছেলে তুমি। বরাবর এক চাল এগিয়ে রইলে! তোমার হবে বাছা, তোমার হবে!
.
বৃষ্টি থেমে গেছে। উত্তাপ ছড়াচ্ছে সূর্য।
মাস্ট্যাং।
দ্বিতীয়বার আহত হওয়ার পর আবার হাঁটার শক্তি ফিরে পেয়েছে ক্যাপ্টেন পল কেড্রিক। সামান্থা ফক্সের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে ও। ওদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে লরেছো শ্যাড। স্যুটটায় কিন্তু চমৎকার মানিয়েছে তোমাকে, পল। ভালো কথা, তোমাদের কি ফিরতে দেরি হবে?
নাহ! স্যান্তা ফে-তে বিয়েটা সেরেই মগোলন-এ র্যাঞ্চ করতে ফিরে আসব আমরা।
সোনার খোঁজে বের হচ্ছ না কেন, বুঝলাম না, লরেডোর কণ্ঠে অভিযোগ। তবে বারউইকের কাৰ্গজপত্রই আসল জিনিস। এবার ঠিক গর্ত খুঁজতে শুরু করবে কামিংস। যাই বলো, সোনার জন্যে কিন্তু সত্যি খারাপ লাগছে।
আমার লাগছে না, বলল সামান্থা। ওই সোনার জন্যে এমনিতেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। সোনার লোভে বারউইক সহ কতগুলো লোক মারা গেল। তার চেয়ে যেভাবে আছে, সেভাবেই থাক ওই সোনা। ভালো কোনও লোক হয়তো একদিন ওগুলো খুঁজে পাবে-সৎ কাজে লাগাবে।
হায় হায়! হঠাৎ বলে উঠল লরেডো। আমাকে যে যেতে হয়! স্যুর সঙ্গে দেখা করার সময় বয়ে গেল। চলি, হ্যাঁ!
শ্যাডের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল পল, আর সামান্থা। স্টেজ আসবে একটু পর।
শান্ত মাস্ট্যাং–খুন খারাবী ছাড়া পুরো তিনটি দিন কেটে গেছে।
Leave a Reply