আওরঙ্গজেব : ব্যক্তি ও কল্পকথা – অড্রি ট্রুসকে
অনুবাদ – মোহাম্মদ হাসান শরীফ
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২০
বাংলা সংস্করণ উৎসর্গ
আব্বাকে, তিনিই আমাকে প্রথম বাদশাহ আওরঙ্গজেব সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন ।
অনুবাদকের কথা
এ বইটি পড়ার সময় শৈশবে শোনা একটি গল্প (‘কিস্সা’) মনে পড়েছিল। গল্পকার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসে বলেছিলেন, “বাদশাহ আওরঙ্গজেব ছিলেন ‘জিন্দা পীর।’ ভণ্ড পীরদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। বাদশাহি পেয়েই তিনি বাহিনী নিয়ে ছুটে গেলেন কে আসল আর কে নকল পীর তা নির্ধারণ করতে। প্রতিটি মাজারের ফটকে গিয়ে তিনবার সালাম দিলেন। মাজারের প্রধান পীরের সমাধি থেকে সালামের জবাব না এলেই তিনি শ্রমিকদের হুকুম দিতেন সেটি ভেঙ্গে ফেলতে। এভাবে মাজার ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে তিনি এগিয়ে চললেন। সামনে পড়ল খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির (র.) মাজার। তিনি সেখানে গিয়েও সালাম দিলেন। প্রথমবার সালামের জবাব না পেয়ে দ্বিতীয়বার দিলেন। জবাব পেলেন না। এরপর তৃতীয়বার দিলেন। তখনো জবাব পেলেন না। তখন শ্রমিকদের বললেন, ভাঙ্গো ।
শ্রমিকরা শাবল হাতে যেই মাজারের প্রাচীরে আঘাত দিতে গেছে, সাথে সাথে সমাধি থেকে প্রচণ্ড শব্দ বের হলো : ‘থামো।’
সবাই চমকে গেল ।
বাদশাহ তখন বললেন, ‘আমি তো আপনাকে সালাম দিয়েছিলাম । আপনি জবাব দেননি।’
কবরের ভেতর থেকে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (র.) বললেন, ‘প্রথমবার তুমি যখন সালাম দিয়েছিলে, তখন আমি ওজু করছিলাম। দ্বিতীয়বার যখন সালাম দিয়েছ, তখন নামাজে দাঁড়িয়েছিলাম। আর তৃতীয়বার সালামের সময় আমি মুনাজাত করছিলাম । এজন্যই তোমার সালামের জবাব দিতে পারিনি ।’
বাদশাহ আওরঙ্গজেব অনুতপ্ত হলেন, ক্ষমা চাইলেন ।
খাজা মঈনুদ্দিন চিশতিও তাকে ক্ষমা করলেন। তবে বললেন, তুমি মাজারগুলো ভেঙ্গে ঠিক করোনি। যাদের মাজার ভেঙ্গেছ, তারা আমার কাছে নালিশ নিয়ে এসেছিল । তুমি সব মাজার আবার মেরামত করে দেবে।
বাদশাহ সাথে সাথে রাজি হলেন। এ জন্যই ভারতের সব মাজারে দুটি তারিখ খোদাই করা আছে। একটিতে নির্মাণের সময়, আরেকটি বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সংস্কারের তারিখ।”
কাহিনীটি আমার মনে গেঁথে ছিল । এ ধরনের লোক সম্পর্কে আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক। ফলে বইটি যখন অনুবাদ করার প্রস্তাব এলো, সাথে সাথে গ্রহণ করেছি। পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। ফলে অনুবাদটি পরিশ্রমের কাজ মনে হয়নি, শেখার একটি পর্ব বিবেচনা করেছি।
আওরঙ্গজেব প্রবল বৈপরীত্যপূর্ণ ও ধাঁধাময় এক ব্যক্তিত্ব। অনেকে তাকেই মোগল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী করেন। অথচ তিনিই মোগল সাম্রাজ্যকে সর্বোচ্চ মাত্রায় সম্প্রসারিত করেছিলেন। আওঙ্গজেবকে হিন্দুবিদ্বেষী মনে করা হয়। অথচ তার আমলেই হিন্দুরা মোগল মসনবে সর্বোচ্চ সংখ্যায় নিয়োগ পেয়েছিল। তাকে খাঁটি মুসলিম মনে করা হয়। অথচ তার আমলেই ইসলামি অনেক অনুষ্ঠানের ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। তিনি বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন, অথচ নিজের কবরের জন্য অচিহ্নিত একটি স্থান বেছে নিয়েছিলেন ।
লেখক জানিয়েছেন, এই জীবনী রচনা করা হয়েছে ঐতিহাসিক ব্যক্তি ও সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগির সম্পর্কে আমাদের মধ্যে বিরাজমান খুবই হালকা জ্ঞানের গভীরতা বাড়ানোর জন্য। বইটি পড়লে সত্যিই আমাদের জ্ঞান বাড়বে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আওরঙ্গজেব সম্পর্কে জানার আগ্রহ নতুন করে বাড়বে।
এ গ্রন্থটি একটি রাজনৈতিক প্রপাগান্ডাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া পরিমিত, অতিরঞ্জনহীন ভাষ্য। এ বই প্রমাণ করে যে আওরঙ্গজেব এমন মানুষ ছিলেন যিনি অবশ্যই অনেক ভুল করেছেন, তবে এমন কেউ তিনি নন যার নিন্দা করতে হবে অন্ধভাবে।
উপমহাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি নিয়ে যারা ভাবেন, তাদের জন্য এটি একটি অমূল্য গ্রন্থ। বিশেষ করে বর্তমান ভারতে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলতে থাকায় তাকে জানার গুরুত্ব বেড়ে গেছে। বইটি বড় নয়। ছোট্ট পরিসরের মধ্যেই কেবল আওরঙ্গজেববেই নয়, মোগল ইতিহাসকেই তুলে আনা হয়েছে। আওরঙ্গজেব হয়ে ওঠেছেন মোগল ইতিহাসের মধ্যমণি
মুখবন্ধ
এ বইটির লেখা সূচনা হয়েছিল একটি টুইটার বার্তার মাধ্যমে। আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে মোগল সম্রাটদের কোনো একজনের ওপর একটি সহজবোধ্য গ্রন্থ লিখব কিনা। আলোচনা শিগগিরই ইমেইলে স্থানান্তরিত হলো, আমি বিষয় হিসেবে বেছে নিলাম আওরঙ্গজেব আলমগিরকে। এই বই সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে প্রথম সূত্রবদ্ধ হওয়াই ছিল যথার্থ। কারণ আধুনিক ভারতকে ছেয়ে ফেলা আওরঙ্গজেব জ্বর প্রায়ই টুইটার ও ফেসবুকের মতো ফ্লাটফর্মে সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে। এই সংক্ষিপ্ত জীবনীতে আমি লোকরঞ্জক সংস্কৃতিতে আওরঙ্গজেব নিয়ে প্রকম্পমান ও অব্যাহত উপস্থিতির জবাব দিয়েছি। অবশ্য একজন ইতিহাসবিদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, আওরঙ্গজেব হলেন প্রথম ও প্রধানতম মোগল সম্রাট যার সম্পর্কে বেশির ভাগ লোক জানে দুঃখজনকভাবে কম। এই বই তার সব জটিলতা নিয়েই ঐতিহাসিক আওরঙ্গজেবকে পরিচিত করার চেষ্টা করা হয়েছে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর কাছে
তথ্যপ্রবাহ ও সহজ পাঠের জন্য বইটি পাদটীকা ছাড়াই উপস্থাপন করা হয়েছে। আওরঙ্গজেবের জীবন ও শাসন কৌশল এমনিতেই জটিল বিষয়, এতে পাদটীকা যোগ করা হলে তা আরেকটি বাধা হিসেবে আবির্ভূত হবে। যেসব পাঠক আমার সূত্রগুলো জানতে আগ্রহী, তারা সেগুলো পাবেন জীবনমূলক প্রবন্ধ ও নোটের অংশে। পুনশ্চ তাদের কাছে ভালো লাগবে যারা ইতিহাসবিদেরা কিভাবে অতীত নিয়ে চিন্তা করেন এবং প্রাক-আধুনিক সূত্রগুলো বিশ্লেষণ করেন তা জানতে আগ্রহী ।
মোসলহুদ্দিন আহমেদ
অরঙ্গজি বইটি যেটুকু পড়লাম তাতে আমি ধারণ খুশি আপনাদের এই ধরনের প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাই ধন্যবাদ