আইভানহো – স্যার ওয়ালটার স্কট
০১. ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল
স্যার ওয়ালটার স্কটের জন্ম ১৭৭১ সালে, স্কটল্যান্ডের এডিনবরায়। মাত্র দেড় বছর বয়সে তিনি হাড়ের অসুখে আক্রান্ত হন, পরিণামে চিরদিনের জন্যে একটা পা তাঁর খোঁড়া হয়ে যায়। পনের বছর বয়স হওয়ার আগেই পাঠ্যতালিকার বাইরে প্রচুর বই তিনি পড়ে ফেলেন এবং ইতিহাস ও স্কটল্যান্ডে প্রচলিত গল্প-গাথার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। একুশ বছর বয়েসে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বাবাকে খুশি করার জন্যে এখানে তিনি আইন শাস্ত্র নিয়ে লেখাপড়া করেন। অবসর সময়ে তিনি ইতিহাস পড়তেন বা স্কটিশ লোক-কাহিনী সগ্রহ করতেন।
১৭৯৭ সালে জনৈক ফরাশি উদ্বাস্তুর কন্যাকে বিয়ে করেন ওয়ালটার স্কট। মেয়েটির নাম শার্লট শারপেনটিয়ের। ১৭৯৯ সালে সেলার্কশায়ারের শেরিফ নিযুক্ত হন স্কট।
১৮০৫ সালে প্রথম উপন্যাস লেখায় হাত দেন ওয়ালটার স্কট। নাম ওয়েভারলি। কিছুদূর লেখার পর উপন্যাসটি ফেলে রাখেন তিনি। শেষ করেন প্রায় দশ বছর পর ১৮১৪ সালে। সেই বছরই বইটি প্রকাশিত হয়, এবং অভাবনীয় জনপ্রিয়তা লাভ করে।
১৮১৮ সালে স্যার উপাধিতে ভূষিত করা হয় ওয়ালটার কটকে। ১৮৩২ সালে মারা যান এই অমর ঔপন্যাসিক।
.
ভূমিকা
এ কাহিনীর শুরু ইংল্যান্ডে, আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাতশো বছর আগে, ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে। নরম্যান রাজা সিংহ-হৃদয় রিচার্ড তখন ইংল্যান্ডের সিংহাসনে। যখন এ কাহিনীর যবনিকা উঠছে রিচার্ড তখন দেশের বাইরে, মুসলমানদের হাত থেকে পবিত্র নগরী জেরুজালেম উদ্ধারের জন্যে যুদ্ধ করছেন প্যালেস্টাইনে। তার হয়ে ইংল্যান্ড শাসন করছেন তার ভাই জন। ইংল্যান্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ স্যাক্সন গোত্রের লোক। তারা মোটেই খুশি নয় জনের শাসনে। এর প্রধান কারণ স্যাক্সনদের প্রতি তার নির্দয় আচরণ।
আরেকটা কারণে জনসাধারণ বিক্ষুব্ধ। প্রায় দুশো বছর আগে ১০৬৬ সালে ইংল্যান্ড দখল করে নরম্যানরা। ফ্রান্স থেকে আসা এই জাতি খুব শিগগিরই রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের সর্বস্তরে স্যাক্সনদের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ডের বেশির ভাগ বড় সরকারি পদ, জমিদারী দখল করে বসে তারা। এবং স্থানীয় স্যাক্সনদের নিচু শ্রেণীর মানুষ হিশেবে গণ্য করতে থাকে। এই কারণে স্যাক্সন ও নরম্যানদের ভেতর অবিশ্বাস এবং রেষারেষি লেগেই থাকতো। জনের আচরণে এই অবিশ্বাস আর বিক্ষোভ শুধু বেড়েই ওঠেনি, রীতিমতো রাজ বিদ্রোহের রূপ নিতে চলেছে।
এই যখন ইংল্যান্ডের অবস্থা তখনই শুরু হচ্ছে আমাদের কাহিনী।
.
০১.
ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল।
বিশাল শেরউড বনভূমির ওপর ধীরে ধীরে নেমে আসছে সন্ধ্যার আঁধার। গাছপালা যে-সব জায়গায় ঘন সে-সব জায়গায় এর ভেতরই যেন রাত হয়ে গেছে। বনের মাঝামাঝি স্থানে একটুখানি ফাঁকা জায়গা। ঘাসে ছাওয়া। কোনো গাছ নেই সেখানে। চারপাশে বড় বড় ওকের ঝোপ। এক ধারে ছোট একটা টিলা। তার ওপর ছড়িয়ে আছে ছোট বড় নানা আকারের পাথর। হয়তো প্রাগৈতিহাসিক কোনো কালে বর্বর বনবাসীরা তাদের দেবতার উদ্দেশ্য উৎসর্গ করেছিলো ওগুলো। টিলার মাথায় পাথরগুলোর গায়ে এখনও খেলা করছে দিনশেষের সোনালি আলো। ফাঁকা জায়গাটার ওপাশে দূরে জমতে শুরু করেছে ঘন কালো মেঘ। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে বজ্রগর্জনের অস্পষ্ট আওয়াজ।
ফাঁকা জায়গার এক প্রান্তে এক পাল শুয়োর চরে বেড়াচ্ছে। কাছেই দুজন লোক। একজন দাঁড়িয়ে, একজন বসে। যে লোকটা দাঁড়িয়ে তার বয়েস বসে থাকা লোকটির চেয়ে একটু বেশি। উদ্বিগ্ন চোখে সে তাকিয়ে আছে ক্রমশ আঁধার হয়ে আসা আকাশের দিকে। আর যে বসে আছে সে গভীর চিন্তায় মগ্ন, যেন বিশ্বরহস্যের সমাধান আজই তাকে করতে হবে।
দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার চেহারায় অদ্ভুত এক বন্য ভাব। সাদাসিধে পোশাক পরনে। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ভেড়ার চামড়ার কোট, কোমরে বাঁধা চওড়া চামড়ার ফিতে; পায়ে চটি, তা-ও চামড়ার ফিতে দিয়ে আটকানো। কোমরের ফিতের এক দিকে ঝুলছে একটা শিঙা, অন্যদিকে গোঁজা বড় একটা দুধার ছোরা। মাথায় টুপি নেই। চুলগুলো এলোমেলো। গালভর্তি চাপ দাড়ি। সম্ভবত চুলের তলনায় দাড়িই লম্বা বেশি। লোকটার গলায় বাঁধা একটা পেতলের আটা। তাতে ছোট ছোট অক্ষরে খোদাই করা: বিউলফ-এর পুত্র গাৰ্থ, রদারউডের জমিদার সেড্রিক-এর জন্মক্রীতদাস।
জমিদারের শুয়োরের পাল দেখাশোনা করে সে।
কম বয়েসী লোকটার চেহারা, পোশাক-আশাক একটু অন্য ধরনের। গার্থের চয়ে বছর দশেকের ছোট সে। মুখে গাম্ভীর্যের মুখোশ আঁটা। চেহারা দেখে কারো পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব নয় তোক হাসানোই তার কাজ। পরনে রঙচঙে রেশমী কোর্ট; মাথায় টুপি, দেখতে মোরগের ঝুঁটির মতো, ছোট ছোট ঘণ্টা বাধা তার সাথে। লোকটা মাথা নাড়লেই টুং-টাং শব্দে বেজে ওঠে সেগুলো। মাথা স্থির করে বসে থাকা তার স্বভাবে নেই, তাই টুং-টাং আওয়াজেরও বিরাম নেই। দুই হাতে তার দুটো রুপোর বালা। পায়ে গার্থের মতোই চামড়ার চটি; মোজা, একটার রঙ লাল, অন্যটা হলুদ। গার্থের মতো এ লোকটিরও গলায় একটা পেতলের আঙটা। তাতে ছোট ছোট অক্ষরে খোদাই করা: উইটলেস-এর পুত্র ওয়াম্বা, রদারউডের জমিদার সেড্রিক-এর জন্মক্রীতদাস।
জমিদার সেড্রিকের মাইনে করা ভাঁড় সে। মনিবকে হাসানোর জন্যে উদ্ভট কথাবার্তা বলা, অঙ্গভঙ্গি করাই তার কাজ।
একে সন্ধ্যা হয়ে আসছে, তার ওপর মেঘ জমছে আকাশে। ব্যস্ত হয়ে উঠলো গার্ক। পালের শুয়োরগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করার জন্যে শিঙা ফুকতে লাগলো। কিন্তু লাভ হলো না। বার কয়েক মাথা নেড়ে, ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করে যেমন চরছিলো তেমনি চরে বেড়াতে লাগলো শুয়োরগুলো। ঘাসের ভেতর থেকে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে ওক ফল।
আরো কয়েকবার শিঙা বাজালো গাৰ্থ। শেষে বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, জাহান্নামে যা, শুয়োরের বাচ্চারা! সঙ্গের কুকুরটাকে লেলিয়ে দিলো শুয়োরগুলোর ওপর। চিৎকার করলো, ধর, ধর, ফ্যাংস!
লাফিয়ে উঠেই ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটলো ফ্যাংস। কিন্তু সে বেচারার এক ঠ্যাং ঘোড়া, বয়েসও হয়েছে বেশ। যৌবনের ক্ষিপ্রতা আর নেই। শরীরে, গলায় জোরও কমে এসেছে। শুয়োরগুলো পাত্তাই দিলো না ওকে, যেন খাচ্ছিলো খেয়ে যেতে লাগলো।
অবশেষে সঙ্গীর শরণাপন্ন হলে গার্থ।
ওঠো তো, ওয়াম্বা, আমাকে একটু সাহায্য করো, বলা সে। এতগুলো শুয়োর একা এক জায়গায় জড় করা চাট্টিখানি কথা? তুমি যাও, পেছন দিক দিয়ে গিয়ে তাড়িয়ে আনো আমার দিকে।
ওঠবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না ওয়াম্বার ভেতর। জবাবও দিলো না। যেমন ছিলো তেমনি চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রইলো বিরাট বিরাট ওক গাছগুলোর দিকে।
কি ব্যাপার, কালা হয়ে গেলে নাকি? কথাগুলো বললাম কানে ঢুকলো না?
ঢুকেছে, গাৰ্থ, ধীরে ধীরে অলসকণ্ঠে জবাব দিলো ওয়া। প্রথমবারেই ঢুকেছে। এবং সেই থেকে আমি আমার পা দুটোর সাথে আলাপ করছি ব্যাপারটা নিয়ে। কিন্তু ওরা স্রেফ নড়তে চাইছে না।
মানে!
মানে ওরা বলছে, এখন যদি শুয়োরের পালের পেছনে ছোটাছুটি করি, আমার কাপড়-চোপড়ের বারোটা বেজে যাবে। তার চেয়ে, ওদের পরামর্শ হচ্ছে, শুয়োরগুলো যেমন চরছে চরুক, তুমি ফ্যাংকে ডেকে নাও।
তোমার কি মাথা খারাপ হলো, ওয়াম্বা! দেখছো সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আকাশে মেঘ জমছে, যে কোনো সময় ঝড়-বাদল শুরু হবে, আর তুমি বলছে, যেমন চরছে চরুক, বলতে বলতে গাৰ্থ একাই এগিয়ে গেল শুয়োরগুলোকে জড়ো করার জন্যে।
ওয়াম্বা জবাব দিলো, ভুল বললাম কোথায়? দুচার দিনের ভেতরই তো ওরা নরম্যান হয়ে যাবে, সুতরাং চরছে চরুক না।
যত্ত সব গাঁজাখুরি কথা! শুয়োরের পাল আবার নরম্যান হয় কি করে? আমার সাথে ইয়ার্কি মারছো?
শোনো তাহলে, আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। তার আগে বলল, তুমি কাদের চরাতে নিয়ে এসেছো?।
কাদের আবার, দেখতে পাচ্ছে না?
পাচ্ছি, তবু শুনতে চাই তোমার মুখ থেকে।
আর কথা পেলে না-পাজী একপাল শুয়োর চরাতে এনেছি আমি।
বেশ বেশ। এবার বলো তো, এই শুয়োরগুলোকেই চামড়া ছাড়িয়ে, ধুয়ে পরিষ্কার করে যখন টেবিলে রাখা হবে তখন কি বলা হবে?
এ আবার কি ধরনের প্রশ্ন! পর্ক বলা হবে।
তাহলেই বোঝো, তোমার মতো স্যাক্সনরা যখন চরাতে নিয়ে আসে, তখন ওরা থাকে শুয়োরের পাল। কিন্তু যখন নরম্যান প্রভুদ্দে পেটে যাওয়ার জন্যে টেবিলে ওঠে তখনই হয়ে দাঁড়ায় পর্ক। তেমনিভাবে বঁড় হয় বিফ, সাধারণ বাছুর হয়ে যায়। তাই বলছিলাম, যেমন চরছে চরুক না, কদিন বাদেই তো ওদের নরম্যান নামকরণ হবে পর্ক।
ইতোমধ্যে ফ্যাংসের সহায়তায় শুয়োরগুলোকে এক জায়গায় জড় করতে পেরেছে গাৰ্থ। ওয়ার কথা শুনে বিরক্তি ওরা চোখে তাকাল ওর দিকে।
যত সব ফাঁকিবাজি কথা! বললো সে।
এ-সময় দূর থেকে ভেসে এলো অনেকগুলো ঘোড়ার খুরের আওয়াজ।
আরে, কারা যেন আসছে! ওয়াম্বা বলে উঠলো। মনে হচ্ছে এদিকেই!
গার্থ বললো, যে খুশি আসুক, তাতে তোমার কি? বিরক্তি এখনো কাটেনি তার।
আমার আবার কি? একবার দেখলে দোষ আছে কোনো?
গাধা! আকাশের দিকে তাকাও, দেখতে পাচ্ছে না, কি সাংঘাতিক ঝড় আসছে? ঐ দেখ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে! ঐ শোনো বাজের আওয়াজ!
গার্থের কথা শেষ হতে না হতেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হলো। উঠে দাঁড়ালো ওয়া। কিন্তু তাড়াহুড়োর কোনো লক্ষণ দেখা গেল না তার ভেতর। ধীর স্থির ভঙ্গিতে গার্থের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ওর সাথে সাথে বয়োরের পাল তাড়িয়ে নিয়ে চললো সে-ও।
ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ ক্রমশ কাছিয়ে আসছে। কৌতূহল বেড়ে উঠলো ওয়ার। একটু একটু করে পিছিয়ে পড়লো সে।
কি হলো, ওয়াম্বা, তাড়াতাড়ি এসো, তাড়া লাগালো গাৰ্থ। এক্ষুণি ঝড় বাদল শুরু হয়ে যাবে।
ওর কথা কানে নিলো না ওয়া। পিছিয়েই রইলো সে। মাঝে মাঝে পেছন ফিরে তাকাচ্ছে।
কিছুক্ষণের ভেতর ওদের ধরে ফেললো অশ্বারোহীরা।
.
সংখ্যায় তারা দশজন। একেবারে সামনের দুজন, দেখলেই বোঝা যায় হোমরা চোমরা গোছের লোক। বাকিরা তাদের সহযাত্রী বা অনুচর। দুজনের একজন ধর্মযাজক, বেশ উঁচু পদমর্যাদার। মোটাসোটা লোকটার মাংসল লাল মুখে সদা প্রসন্ন ভাব। দামী কাপড়ের গাউন পরনে, হাতা এবং গলার কিনারাগুলোয় দামী ফার লাগানো। কলারে আঁটা বড় একটা সোনার কাঁটা। অনায়াস দক্ষতায় তেজী ঘোড়াটাকে চালিয়ে আসছেন তিনি। সঙ্গে দুজন ভৃত্য। পিঠে মালপত্র চাপানো দুটো ঘোড়া টেনে আনছে তারা। এই দুই ভূত্যের পেছন পেছন আসছে ধর্মযাজকের অপর দুই সঙ্গী, দুজন পুরোহিত।
যাজকের সহযাত্রী একজন নাইট। সাধারণ নয়, টেম্প-এর খেতাব পাওয়া নাইট* বয়েস চল্লিশের কোঠায়। দীর্ঘদেহী, ছিপছিপে গড়ন, পেশল শরীর, গায়ের চামড়া রোদে পুড়ে তামাটে বর্ণ নিয়েছে। চেহারায় বেপরোয়া ভাব। অহষ্কারের সাথে হিংস্রতা আর নিষ্ঠুরতা মিশলেই কেবল এমন ছাপ পড়তে পারে মানুষের চেহারায়। এক নজর দেখলেই বোঝা যায় লোকটা যোদ্ধা, জীবনে অনেক প্রতিকূলতা সয়েছে, এবং আরো সইবে। লাল একটা আলখাল্লা পরনে। ডান কাঁধে একটা শাদা ক্রস, তার খেতাবের চিহ্ন। আলখাল্লার নিচে পরে আছে লোহার জালের জামা। নিম্নাঙ্গেও লোহার পোশাক। হাতে লোহার জালের দস্তানা। মাথায় ধাতব শিরোম্রাণ। কোমরে দীর্ঘ তরবারি, খাপে মোড়া। ধর্মযাজকের মতোই দারুণ একটা ঘোড়ায় চেপে আসছে সে। পেছনে তার যুদ্ধের ঘোড়া, যুদ্ধের সাজ পরা, এক ভৃত্য লাগাম ধরে টেনে আনছে। আরেক ভূত্য বয়ে আনছে তার ঢাল ও বর্শা। বর্শার মাথায় একটা পতাকা বাঁধা, কুশ আঁকা তাতে। ঢালটা তিন কোনাচে, হলদে রঙের কাপড়ে মোড়া। এই দুই ভৃত্যের পেছনে আরো দুজন ভৃত্য। দীর্ঘদেহী দুজনই। গায়ের রঙ কালো। রেশমী ঢোলা পোশাক তাদের গায়ে। মাথায় টুপি। এক পলক দেখেই বলে দেয়া যায় তারা প্যালেস্টাইনী আরব।
স্থির দাঁড়িয়ে আছে গার্থ এবং ওয়া। বিস্মিত চোখে দেখছে ছোট্ট মিছিলটাকে। ইতোমধ্যে ওয়ার মতো গাৰ্থও কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। ধর্মযাজককে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পেরেছে সে। জরভক্স মঠের প্রায়োর (প্রধান পুরোহিত) তিনি। নাম অ্যায়মার। ধর্মযাজক হওয়া সত্ত্বেও শিকার খুব প্রিয় তার, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও খুব উৎসাহী তিনি, এ ছাড়াও স্বভাবের আরেকটি বিশেষ দিক হলো, কোনো ধরনের জাগতিক ভোগবিলাসেই তার অরুচি নেই। এ তল্লাটের আর দশজন মানুষের মতো গার্থও জানে এসব কথা। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রায়োর অ্যায়মারকেঅভিবাদন জানিয়ে নাইট টেম্পলারের দিকে তাকালো সে।
লোকটাকে এ অঞ্চলে কখনো দেখেছে বলে মনে হলো না ওর।
গার্থের অভিবাদনের জবাবে প্রায়োর বললেন, তোমাদের মঙ্গল হোক। জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, বলতে পারো, এদিকে রাতের মতো আশ্রয় পাওয়া যেতে পারে কোথায়?
গাৰ্থ এবং ওয়াম্বাও তখন হাঁ করে তাকিয়ে আছে ধর্মযাজকের সঙ্গী ও তার প্রাচ্যদেশীয় অনুচরদের দিকে। অ্যায়মারের প্রশ্ন তারা শুনতেই পেলো না।
যাজক আবার প্রশ্ন করলেন, একটা কথা জানতে চেয়েছিলাম তোমাদের কাছে।
এবার সংবিত ফিরলো গার্থের। বললো, জি, বলুন।
এদিকে রাতের মতো আশ্রয় পাওয়া যেতে পারে এমন কোনো জায়গা আছে?
না, কাছাকাছি তেমন কোনো জায়গা আছে বলে আমার জানা নেই, জবাব দিলো ওয়া। তবে একটু কষ্ট করে আরো কয়েক মাইল যদি এগিয়ে যান, ব্রিক্সওয়ার্ধের মঠ পাবেন। ওখানকার প্রায়োর নিশ্চয়ই আপনাদের আশ্রয় দেবেন। মনে হয় ভালো খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাও করতে পারবেন উনি। রাতটা আরামেই কাটবে আপনাদের।
না, না, ব্রিক্সওয়ার্থ মঠ অনেক দূর, বললেন অ্যায়মার, এই ঝড় বৃষ্টির ভেতর অতদূর যাওয়া যাবে না। আরো কাছে কোনো জায়গা নেই?
যা আছে, তবে খুব কাছে না; আর ওখানে গেলে রাতের বেলায় ঘুমের আশা ছাড়তে হবে আপনাদের। উপাসনা করে কাটাতে হবে সারারাত। এই যে এই পথ ধরে এগিয়ে গেলে পাবেন সন্ন্যাসী কপম্যান হারে আশ্রম। উনিও নিশ্চয়ই আপনাদের পেয়ে খুশি হবেন।
এ প্রস্তাবটাও মনঃপূত হলো না যাজকের। বিরক্তির সঙ্গে মাথা নাড়লেন তিনি।
তাঁর সঙ্গী নাইট টেম্পলার এবার কথা বললেন।
আমার ধারণা, স্যাক্সন সেড্রিকের বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি আমরা। সেখানেই চলুন না, প্রায়োর।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, জবাব দিলেন অ্যায়মার। গাৰ্থ ও ওয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, রদারউডের সেড্রিকের বাড়িটা কোথায় বলতে পারো তোমরা?
অ্যাঁ, হ্যাঁ, তা বোধহয় পিরবো, জবাব দিলো গাৰ্থ। তার কণ্ঠস্বরে সাহায্য করার ইচ্ছার চেয়ে অনিচ্ছাই প্রকাশ পেলো বেশি। তবে আপনারা সেখানে পৌঁছাতে পারবেন কিনা জানি না, পথটা খুব ঘোরপ্যাচের। তাছাড়া, যদি শেষ পর্যন্ত বাড়িতে পৌঁছানও, গিয়ে হয়তো দেখবেন বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমরা এসেছি শুনলে ওরা খুশি হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে আসবে, গর্বিত শোনালো নাইট টেম্পলারের কণ্ঠস্বর।
তাই কি! তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললো গাৰ্থ। ওর প্রভুর মতো ও-ও নরমানদের মনে প্রাণে ঘৃণা করে! নাইটের কথা ওর কাছে রীতিমত ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনে হয়েছে। এক মুহূর্ত বিরতি নিয়ে সে যোগ করলো, তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আমার মনিব আপনাদেরকে আশ্রয় দিয়ে কৃতার্থ হবেন? না, জনাব নাইট, আপনাদের কোনো সাহায্য আমি করতে পারছি না।
মুহূর্তে চোখ দুটো অগ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠলো নাইট টেম্পলারের।
ব্যাটা স্যাক্সন শুয়োরপালক, তোর এত বড় স্পর্ধা! চিৎকার করে উঠে চাবুক তুললো সে।
পলক ফেলার আগেই গ্লার্থের হাত পৌঁছে গেছে ছুরির বাঁটে। তৈরি সে। নাইট চাবুক দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করলেই ছুরি চালাবে। তাড়াতাড়ি ঘোড়া নিয়ে দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন প্রায়োর অ্যায়মার।
না, না, কোনোরকম মারামারি চলবে না! বললেন তিনি। স্যার ব্রায়ান, আমরা এখন প্যালেস্টাইনে নেই, কথাটা মনে রাখবেন। ওখানে বিধর্মীদের সাথে যখন যা ইচ্ছা করেছেন, ভালো কথা, তাই বলে এখানেও যদি তেমন করতে চান তাহলে মুশকিল আছে।
দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস বইছে নাইটের। এখনো রাগ যায়নি। তবু যাজকের কথায় চাকুটা নামিয়ে নিলো সে। ঘোড়াটাকে কয়েক কদম এগিয়ে নিয়ে ওয়াম্বার সামনে দাঁড়ালেন অ্যায়মার। একটি রৌপ্যমুদ্রা দিলেন ওর হাতে। বললেন, তুমি নিশ্চয়ই বলতে পারবে সেড্রিকের বাড়ি কোন দিকে?
চুপ করে আছে ওয়াম্বা।
ক্লান্ত পথচারীদের সাহায্য করা খ্রীষ্টান হিশেবে তোমার কর্তব্য, তাই? আবার বললেন ধর্মযাজক।
নিশ্চয়ই। কর্তব্য মানে?-এক নম্বর কর্তব্য! কিন্তু, ফাদার, আসল কথাটা কি, বলবো? আপনার সঙ্গীর মেজাজ দেখে আমার মাথা ঘুরছে। আমি নিজেই আজ পথ চিনে আমার প্রভুর বাড়ি পৌঁছুতে পারবো কিনা সন্দেহ, তো আপনাকে কি জানাবো?
কি আবোল-তাবোল বকছো? ইচ্ছে করলেই তুমি পথটা দেখিয়ে দিতে পারো।
বেশ, তাহলে এই পথ ধরেই চলে যান। যতক্ষণ না একটা পাথরের ক্রুশ দেখতে পাবেন ততক্ষণ নাক বরাবর এগিয়ে যাবেন। দেখবেন কুশটার কাছে চারটে পথ এসে মিশেছে চারদিক থেকে। সোজা যাবেন না, ডানে যাবেন না, পেছনে তো ফিরবেনই না। তাহলে কাকি থাকলো কি? বাঁ দিক। হাঁ, বাঁ দিকের পথ ধরে এগোবেন, আমার মনে হয় ঝড় ভালো মতো আসার আগেই আপনারা আশ্রয়ে পৌঁছে যাবেন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন, বলে সঙ্গীর দিকে তাকালেন অ্যায়মার। চলুন তাহলে, স্যার ব্রায়ান। আর দেরি করলে ভিজতে হবে।
হ্যাঁ চলুন।
অনুচরদের নিয়ে ওয়াম্বার দেখানো পথে ঘোড়া ছোটালেন প্রায়োর ও নাইট টেম্পলার।
ওঁদের ঘোড়ার আওয়াজ-মিলিয়ে যেতেই একে অন্যের দিকে তাকিয়ে প্রাণ খুলে হাসলো গার্থ আর ওয়াম্বা। গার্থ বললো, তোমার পরামর্শ মতো গেলে আজ সারা রাতেও রদারউডে পৌঁছুতে পারবে না ওরা।
তা না পারুক, শেফিল্ডে তো পৌঁছুবে। আমার মনে হয় সেটাই ভালো হবে ওদের জন্যে।
হ্যাঁ, ভালোই করেছো ভুল পথে পাঠিয়ে। ওরা নরম্যান। দুজনই। বাড়িতে আশ্রয় চাইলে আমার মনে হয় কিছুতেই রাজি হতেন না মনিব। ঐ চোয়াড়ে নাইটটার মেজাজ তো দেখলেই, কি হতো তারপর?
নির্ঘাত হাতাহাতি বেধে যেঙ্গে, বললে ওয়াম্বা। যদি কোনো রকমে একবার লেডি রোয়েনাকে দেখতে ঐ বদমাশটা, আমি ভাবতেও পারছি না কি ঘটতো।
হ্যাঁ, মনিবের ঝামেলা আরেকটু বাড়তো আর কি। চলো এগোই।
.
বেয়াদবগুলোকে একটু শিক্ষা দিতে চাইলাম, আপনি বাধা দিলেন কেন? কিছুদূর আসার পর জিজ্ঞেস করলো নাইট টেম্পলার স্যার ব্রায়ান দ্য বোয়াগিলবার্ট।
শিক্ষা দিতে চাইছিলেন না ঝগড়া বাধাতে চাইছিলেন? জবাব দিলেন যাজক। ওদের কথাগুলো খেয়াল করেননি? সেড্রিক ওদের মনিব, ওদের গায়ে হাত তুললে সেড্রিক আপনাকে ছেড়ে কথা কইতো না। এই লোকটার সম্পর্কে ভাললা মতো জেনে রাখা দরকার আপনার।
বলুন শুনি, বললো বটে কিন্তু খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে যে তা মনে হলো না ব্রায়ানের কণ্ঠস্বর শুনে।
অত্যন্ত ধনী জমিদার এই সেড্রিক। এর মতো ধনশালী স্যাক্সন এ অঞ্চলে আর আছে বলে আমার জানা নেই। যেমন ধনী তেমনি দাম্ভিক ব্যাটা। লোকে তাকে স্যাক্সন সেড্রিক বললে সে গর্ব অনুভব করে। আমাদের, নরম্যানদের ও মনে প্রাণে ঘৃণা করে। প্রতিবেশী রেজিনাল্ড ট্রুত দ্য ববায়েফ বা ফিলিপ ম্যালভয়সিঁর মতো দুর্ধর্ষ, প্রতাপশালী নরম্যান জমিদারদের সাথে পর্যন্ত বিরোধ বাধাতে সে ভয় পায় না। ভীষণ বদমেজাজী–অনেকটা আপনার মতোই। সুতরাং সাবধান থাকবেন ওর সাথে কথা বলার সময়।
তা থাকবে। আপনি সেড্রিক সম্পর্কে যা বললেন তাতে মনে হচ্ছে ব্যাটার মন পেতে অনেক কিছু সইতে হবে আমাকে। ঠিক আছে, দরকার হলে সইবো। যার সৌন্দর্যের খ্যাতি দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে সেই লেডি রোয়েনাকে দেখবার জন্যে এটুকু কষ্ট না হয় আমি স্বীকার করলাম। কিন্তু, ফাদার, একটা কথা বলুন তো, মেয়েও কি বাপের মতোই নরম্যানদের ঘৃণা করে?
সেড্রিক ওর বাবা নয়, বললেন প্রায়োর। অভিভাবক। সম্পর্কের আত্মীয়। তাহলেও রোয়েনাকে ও নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসে।
আচ্ছা!
হ্যাঁ। আর রোয়েনার সৌন্দর্য সম্পর্কে তো আগেই আপনাকে বলেছি, এ তল্লাটে অমন সুন্দরী আর একটাও আছে কি না সন্দেহ।
আমরা একটা বাজি ধরেছিলাম, মনে আছে তো আপনার?
নিশ্চয়ই আছে। আমি যেমন বলেছি রোয়েনা যদি তেমন সুন্দরী না হয়, আমার কলারের এই সোনার কাঁটা আপনি পাবেন; আর আমার কথা যদি ঠিক হয় আপনি আমাকে দেবেন দশ পিপে ভালো ফরাসি মদ।
হ্যাঁ। তবে কথা হলো কি, রোয়েনার রূপ কেমন বিচার করবো। তো আমিই, সুতরাং ধরে নিতে পারেন, সোনার কাঁটাটা আপনি হারাচ্ছেন।
সে যখন হারাবো তখন দেখবো। এবার দয়া করে আপনি একটু চুপ করুন দেখি। এখন থেকেই মুখ বুজে থাকা অভ্যাস না করলে সেড্রিকের সামনে কি না কি বলে বসবেন, শেষে এই ঝড় বাদলের ভেতর পথে রাত কাটাতে হবে।
তা ঠিক, তা ঠিক। বেশ, আমি তাহলে এখন থেকে চুপ করেই থাকবে। তার আগে আরেকটা প্রশ্ন, সেড্রিকের নিজের কোনো ছেলে মেয়ে নেই?
আছে। একটাই মাত্র ছেলে, উইলফ্রিড অভ আইভানহো। ছেলেটাকে ও বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।
নিজের একমাত্র ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।
বললাম কি তাহলে? ভীষণ বদমেজাজী লোক এই সেড্রিক। ওর মতের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে, সে যে-ই হোক, তার আর রক্ষা নেই। শোনা যায় আইভানহো রোয়েনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো বলেই ওকে বাড়িছাড়া করেছে সেড্রিক।
কেন! রোয়েনাকে বিয়ে করলে দোষ কি?
কিছুই না। সেড্রিক যেটা চায় না আইভানহোসেটা চায়, এ-ই দোষ। সেড্রিকের ইচ্ছা স্যাক্সন রাজকুমার অ্যাথেলস্টেনের সাথে রোয়েনার বিয়ে দেবে। যাকগে ওসব কথা, ঐ যে সেই ক্রুশ, এবার বাঁয়ে মোড় নিতে হবে।
না ডানে, প্রতিবাদ করলো নাইট টেম্পলার।
কি আশ্চর্য, ডানে কেন! সবিস্ময়ে বললেন অ্যায়মার। লোকটা তো বললো বয়ে যেতে!
হ্যাঁ। কিন্তু আমার বিশ্বাস বদমাশটা মিথ্যে বলেছে। ডানের পথ ধরে গেলেই আমরা সেড্রিকের বাড়ি পৌঁছাবো।
আমার কিন্তু তা মনে হয় না, বললেন ধর্মযাজক। একটা রূপার মুদ্রা দিয়েছি…।
ইতোমধ্যে বৃষ্টি বেশ চেপে এসেছে। সন্ধ্যাও ঘুরে গেছে অনেকক্ষণ আগে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে তর্ক করতে লাগলেন দুজন। হঠাৎ করেই প্রায়োরের চোখ পড়লো কুশটার গোড়ায়। বিদ্যুতের আলোয় দেখতে পেলেন একটা মানুষ পড়ে আছে সেখানে।
আরে, কে যেন পড়ে আছে ওখানে! কুশটার দিকে ইশারা করে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। না কি মরে গেছে?
হুগো, বর্শার আগা দিয়ে একটা খোঁচা মারো তো ব্যাটাকে! এক ভূতের দিকে ফিরে আদেশ করলো নাইট টেম্পলার।
খোঁচা খেয়ে উঠে দাঁড়ালো লোকটা।
কী ব্যাপার? আমাকে এমন বিরক্ত করার মানে? হৈ-চৈ করে উঠলো সে। শুয়ে শুয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করছিলাম, তার ভেতর এ কী ঝামেলা!
কিছু মনে কোরো না, প্রায়োর বললেন, স্যাক্সন সেড্রিকের বাড়িটা কোন দিকে আমরা জানতে চাই। সেজন্যে বাধ্য হয়েই তোমাকে বিরক্ত করতে হলো।
স্যাক্সন সেড্রিকের বাড়ি? আমিও তো সেখানেই যাবো। আমাকে একটা ঘোড়া দিতে পারবেন?–তাহলে আপনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারি। বেশ, দিচ্ছি তোমাকে ঘোড়া, নিয়ে চলো আমাদের, বলে স্যার ব্রায়ান ভৃত্যকে আদেশ করলো তার অতিরিক্ত ঘোড়াটা ওকে দিতে।
ঘোড়ায় চাপলো লোকটা। এবং ওয়াম্বা যে দিকের কথা বলেছিলো তার উল্টোদিকে যেতে শুরু করলো। অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে প্রায়োরের দিকে তাকালেন নাইট টেম্পলার। যেম বোঝাতে চাইলেন, কেমন, বলেছিলাম না ডান দিকেই যেতে হবে?
কিছুক্ষণ পর তারা পায়ে চলা পথ বেয়ে বনের ভেতর ঢুকলেন। কয়েকটা ছোট ছোট নালা পেরোলেন। তারপর বড় রাস্তায় উঠলেন।
নিঃশব্দে পথ চলছেন সবাই। হঠাৎ লোকটা বললো, আর কিছুদূর গেলেই সেড্রিকের বাড়ি।
এতক্ষণ নীরব থাকলেও ভেতরে ভেতরে কৌতূহলে মরে যাচ্ছিলেন ধর্মযাজক। এবার আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। লোকটার পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন।
আমি একজন তীর্থযাত্রী, জবাব দিলো লোকটা। সবে তীর্থ করে ফিরেছি পবিত্র ভূমি জেরুজালেম থেকে।
যুদ্ধে না জেতা পর্যন্ত ওখানে থাকলেই ভালো হতো না? প্রশ্ন করলো টেম্পলার।
হাসলো লোকটা। স্যার নাইট ঠিকই বলেছেন। তবে কথা হলো গিয়ে, যারা ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে ক্রুসেডে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরাই যখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এত দূরে চলে এসেছেন তখন আমার মতো একজন সাধারণ তীর্থযাত্রী ওখানে থাকলেই কি উপকার হতো, না থাকলেও বা কি ক্ষতি হবে?
চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো স্যার ব্রায়ানের। অভ্যাসবশেই যেন হাত চলে গেল চাবুকের ওপর। এবারও তাকে বাধা দিলেন প্রায়োর। ফিসফিস করে বললেন, থামুন তো, কি করছেন বার বার! লোকটার দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন, তুমি তো এখানকার পথঘাট ভাললাই চেনো মনে হচ্ছে। যেভাবে বনের ভেতর দিয়ে নিয়ে এলে!
এ এলাকায়ই আমার জন্ম, জবাব দিলো তীর্থযাত্রী। বড়ও হয়েছি এখানে।…আমরা এসে গেছি। সামনের বাড়িটাই সেড্রিকের।
ঝড় এখনো তেমন মারাত্মক চেহারা নেয়নি, তবে বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। সেড্রিকের বাড়িটা দেখামাত্র খুশি হয়ে উঠলো সবাই।
বিরাট জায়গা নিয়ে বাড়ি। লম্বা, নিচু একটা দালান; সামনে পেছনে অনেকগুলো উঠান। নরম্যান দুর্গবাড়ি সাধারণত যেমন হয় তেমন নয়। তাই বলে অরক্ষিতও নয়। নিরাপত্তা ব্যবস্থা মোটেই দুর্বল নয় বাড়িটার। চারদিকে জল ভর্তি পরিখা। বাড়িতে ঢোকার একমাত্র পথ একটা ঝুলসেতুর ওপর দিয়ে। ফটক খুলে সেতু নামিয়ে দিলে লোকজন ভেতরে ঢুকতে পারে, সেতু উঠিয়ে রাখলে কারো পক্ষে ঢোকা সম্ভব নয়। পরিখা সাঁতরে ঢোকার আশা বৃথা, কারণ জলের ভেতর থেকেই পাড়া উঠে গেছে উঁচু পাথরের প্রাচীর।
ঝুলসেতুর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো দলটা। নিজেদের উপস্থিতি ঘোষণা করার জন্যে উচ্চৈস্বরে শিঙা বাজাতে লাগলো নাইট টেম্পলার ব্রায়ান। ভিজে কাকের মতো অবস্থা সবার। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছাদের আশ্রয় চাই।
————–
* টেম্পল-এর খেতাব পাওয়া নাইট অর্থাৎ নাইট টেম্পলাররা যতটা না সৈনিক তার চেয়ে বেশি পুরোহিত। সাধারণত সাত বংশের সন্তানরা এই খেতাব পেতো। কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে সাদাসিধা জীবনযাপন এবং প্যালেস্টাইনের পবিত্র ভূমি উদ্ধারের জন্যে আমৃত্যু যুদ্ধ করার শপথ নিতে হতো তাদের। টেস্-এর নাইট হতে পারাটা সে যুগে অত্যন্ত সম্মানের ব্যাপার ছিলো। ইউরোপের সকল অংশের খ্রীষ্টানই এই খেতাব পাবার যোগ্য বলে বিবেচিত হতো। মি দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, সব নাইট টেম্পলার তাদের শপথ রক্ষা করতো না। সৈনিক হিশেবে যোগ্য হলেও কৃচ্ছসাধনের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ ছিলো কম। ভোগবিলাসের জীবন কাটাতেই তারা পছন্দ করতো। অনেকে সাধারণ মানুষের সাথে রীতিমতো নিষ্ঠুর আচরণ করতেও পিছপা হতো না।
০২. খাওয়ার সময় হয়ে গেছে
খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। রদারউডের জমিদার স্যাক্সন সেড্রিক বসে আছেন তার বাবার ঘরে।
সেড্রিক মানুষটা মাঝারি উচ্চতার। চওড়া দৃঢ় কাঁধ, দেখলেই বোঝা যায় অপরিমেয় শক্তি ধরেন এ কাঁধের মালিক। দীর্ঘ, পরিপাটি চুলগুলো ঝুলে পড়েছে ঘাড়ের নিচে। মুখটায় অদ্ভুত এক সারল্য। প্রথম দর্শনেই মনে হয়, ঘোরপ্যাচ নেই এ লোকের অভাবে। যা করার সোজাসুজি করেন। ফারের কিনারা দেওয়া সবুজ একটা কোট পরে আছেন তিনি। দুহাতে সোনার বাজু, গলায় সোনার চাকতি।
কয়েক জন ভৃত্য দাঁড়িয়ে আছে পাশে, প্রভুর আদেশের অপেক্ষায়। আরো কয়েক জন দাঁড়িয়ে একটু দূরে, দরজার কাছে। এক পাল কুকুর বসে আছে আগুনের সামনে। সেড্রিকের সবচেয়ে প্রিয়, বিশ্বস্ত উলফ-হাউন্ড বলডার বসে আছে তার পায়ের কাছে। যেন ভৃত্যদের মতো সে-ও অপেক্ষা করছে প্রভুর আদেশের।
সেড্রিকের খাবার ঘরটা বিরাট। যেমন লম্বায় তেমনি চওড়ায়। অনেক মানুষ এক সাথে বসে খেতে পারে। দুখানা খাবার টেবিল এ ঘরে। একটা বেশ বড়, ঘরের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে আছে। সাধারণ এক কাঠের তৈরি। উপরে কোনো ঢাকনা নেই। রদারউডের সাধারণ বাসিন্দারা এটায় খাওয়া দাওয়া করে। অন্য টেবিলটা ছোট, বড়টার চেয়ে সামান্য উঁচু। দামী কাঠের তৈরি। দেখতেও সুন্দর। অন্যটার চেয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। রঙিন একটা ঢাকনি পাতা সেটার ওপর। এক প্রান্তে দুটো চেয়ার, অন্য চেয়ারগুলোর চেয়ে একটু উঁচু। সেড্রিক আর রোয়েনা ছাড়া আর কারো বসার অনুমতি নেই ও দুটোয়। বিশিষ্ট অতিথি অভ্যাগত এলে এই টেবিলেই তাদের খেতে দেয়া হয়।
বদমেজাজী সেল্লিকের মেজাজটা মোটেই ভালো নেই। সারা সন্ধ্যা একা একা কাটিয়েছেন।
দূরের এক গির্জায় গিয়েছিলো রোয়েনা। মাত্র কয়েক মিনিট আগে ফিরেছে ভিজতে ভিজতে। গার্থ এখনও ফেরেনি শুয়োরের পাল নিয়ে। কোথায় যেতে পারে ও? ভাবছেন সেড্রিক। নরম্যানরা কি শুয়োরের পালসুদ্ধ ধরে নিয়ে গেল ওকে? আর ওয়াম্বা? সে-ই বা কোথায়? ও থাকলেও না হয় দুচারটে মজার কথা শোনা যেতো। ওকেও কি ধরে নিয়ে গেছে নরম্যানরা? রাগের সাথে সাথে হঠাৎ এক অদ্ভুত দুঃখ মেশানো অনুভূতি হলো সেড্রিকের
আহ, আমার ছেলে, মনে মনে বললেন তিনি, তুই যদি এখন কাছে। থাকতি এই বুড়ো বয়সে আমাকে বন্ধুহীন একা একা দিন কাটাতে হতো না। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুকের গভীর থেকে।
বেশ খিদে পেয়েছে সেড্রিকের। খাবার সময়ও হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। অথচ রোয়েনা না আসা পর্যন্ত খেতে বসতে পারছেন না। মেজাজ খারাপ হওয়ার এটাও একটা কারণ। একটু পরপরই বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন কোনো ভূতের দিকে। যেন রোয়েনার দেরি করে আসাটা তারই দোষ। মাঝে মাঝে বিড় বিড় করছেন, গির্জায় যাওয়ার আর দিন পেলো
হঠাৎ রোয়েনার খাস পরিচারিকা এলগিটাকে দরজার সামনে দিয়ে যেতে দেখলেন তিনি। অমনি হেঁড়ে গলায় চিৎকার: এত দেরি করছে কেন রোয়েনা, হ্যাঁ?
কাপড় বদলাচ্ছেন, বিনীত কণ্ঠে বললো এলগিটা। পুরোদস্তুর ভিজেছেন বৃষ্টিতে।…আর বোধহয় বেশিক্ষণ লাগবে না।
চলে গেল এলগিটা। এই সময় বাইরে থেকে বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে ভেসে এলো শিঙার আওয়াজ। ঘরে যতগুলো কুকুর ছিলো সব কটা এক সঙ্গে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো বলডার। সে-ও সমানে চিৎকার করছে।
এক ভৃত্যের দিকে তাকিয়ে সেড্রিক আদেশ করলেন, যাও তো, কে এলো দেখে এসো।
কয়েক মিনিটের ভেতর ফিরে এলো ভৃত্য।
জরভক্স মঠের প্রায়োর অ্যায়মার আর নাইট টেম্পলার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্ট এসেছেন, সে বললো। রাতের মতো খাদ্য ও আশ্রয় চাইছেন। পরশুদিন অ্যাশবিতে যে টুর্নামেন্ট (অস্ত্র চালনা প্রতিযোগিতা) হবে তাতে যোগ দেবার জন্যে যাচেছন অরা। হঠাৎ করে ঝড়-বাদল শুরু হয়ে যাওয়ায় এখানে আশ্রয় চাইছেন।
ফাদার অ্যায়মার! টেম্পলার ব্রায়ান! চিন্তিত মুখে ভাবলেন জমিদার, দুজনেই নরম্যান!–হোক নরম্যান তবু তো অতিথি। অতিথির জন্যে রদারউডের দুয়ার সবসময় ভোলা। ওরা এখানে থাকতে চায় ভাল কথা। আরও ভালো হতো যদি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও উঠতো। যাকগে তা যখন ওঠেনি–একটা রাতেরই তো ব্যাপার, নিশ্চয়ই কাল ভোরেই ওরা চলে যাবে, তাহলে আর চিন্তা কি? ভৃত্যের দিকে ফিরে হাঁক ছাড়লেন, যাও নিয়ে এসো ওদের। অতিথিদের ঘরে নিয়ে যাবে আগে। হাত-পা ধোঁয়ার পানি দেবে, যদি ভিজে গিয়ে থাকে শুকনো কাপড় দেবে। তারপর নিয়ে আসবে এখানে। সহিসকে বলবে ওদের ঘোড়াগুলোর যেন যত্ন নেয়।
ভূত্য ঘুরে দাঁড়াতেই তিনি আবার বললেন, ওদের বোলো, আমি নিজেই যেতাম। কিন্তু আমার একটা প্রতিজ্ঞা আছে, যে কারণে স্যাক্সন ছাড়া অন্য কাউকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে এই চেয়ার ছেড়ে তিন পায়ের বেশি আমি নড়তে পারি না। ওরা যেন কিছু মনে না করেন।
চলে গেল ভৃত্য। আবার চিন্তার সাগরে ডুব দিলেন সেড্রিক।
প্রায়োর অ্যায়মার, মদ মাংসের পাগল! আর ব্রায়ান দ্য বোয়া গিলবার্ট, ভালো মন্দ দুকারণেই বিখ্যাত তার নাম। দুর্ধর্ষ সৈনিক, তবে ভয়ানক অহঙ্কারী, নিষ্ঠুর আর বদ স্বভাবের। অতিথি ভেবে বাড়িতে তো জায়গা দিচ্ছি, তারপর কি হবে কে জানে?
অসওয়াল্ড! চিৎকার করে তাঁর প্রধান ভূত্যকে ডাকলেন সেড্রিক। তলকুঠুরিতে যাও। সবচেয়ে ভালো মদের পিপেটার মুখ ভোলো। আরেক ভৃত্যকে বললেন, তুমি যাও, এলগিটাকে পাঠিয়ে দাও।
এলগিটা এলো।
রোয়েনাকে বলে এসো, আজ আর ওর এখানে খেতে আসার দরকার নেই। অবশ্য ও যদি আসতে চায় সে আলাদা কথা।
উনি আসছেন, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো এলগিটা। কাপড় পরা শেষ, আর দুএক মিনিটের ভেতর এসে পড়বেন। প্যালেস্টাইনের খবরাখবর শোনার জন্যে খুবই আগ্রহী দেখলাম ওঁকে।
থাম, ছুঁড়ি! গর্জে উঠলো সেড্রিক। যা বললাম গিয়ে রোয়েনাকে বলে আয়। তারপর ও বুঝবে কি করবে না করবে।
মাথা নিচু করে চলে গেল এলগিটা।
প্যালেস্টাইন! আপন মনে বলতে লাগলেন সেড্রিক। আহ! কি ব্যাকুল হয়ে আছে আমার হৃদয় প্যালেস্টাইনের খবর জানার জন্যে! আমার ছেলে-! কিন্তু না, এ কি ভাবছি আমি! যে আমার অবাধ্য সে আমার ছেলে হতে পারে না। ওর খবর জানার জন্যে কেন আমি ব্যাকুল হবো? হাজার হাজার ক্রুসেডার রয়েছে প্যালেস্টাইনে, ওদের যা হবে ওর-ও তাই হবে। কেন আমি ওর কথা ভাবতে যাবো? না, আমি ওর কথা ভাববো না…
ধীরে ধীরে বুকের ওপর ঝুলে পড়লো স্যাক্সন সেড্রিকের মাথা। অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন তিনি। কপালে দেখা দিলে কুঞ্চন। এমন সময় দরজার বাইরে পদশব্দ পাওয়া গেল। ভৃত্যের সাথে ঘরে ঢুকলেন অতিথিরা।
.
ভেজা কাপড় ছেড়ে নতুন ঝকঝকে দামী কাপড় পরে এসেছেন প্রায়য়ার এবং নাইট। প্রায়োরের পরনে আলখাল্লা, কিনারাগুলো চমৎকার ফারে মোড়া। টেম্পলার পরেছে টকটকে লাল রেশমী টিউনিক। তার ওপরে শাদা লম্বা একটা আলখাল্লা। ডান কাঁধে কালো রঙে ক্রুশ আঁকা।
দুজনের পেছনে সেই তীর্থযাত্রী। তার গায়ে শাদামাঠা কালো জোব্বা, হাতে তীর্থযাত্রীদের লাঠি। নিঃশব্দে হেঁটে গিয়ে আগুনের সামনে একটা চেয়ারে বসলো সে।
উঠে দাঁড়ালেন সেড্রিক অতিথিদের স্বাগত জানানোর জন্যে। গুণে গুণে তিন পা এগোলেন চেয়ার থেকে। তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, দুঃখিত, আমি আর এগোতে পারবো না। কেন, নিশ্চয়ই আমার ভূতের মুখে শুনেছেন। আপনাদের সবাইকে স্বাগতম আমার রদারউডে। এক মুহূর্ত বিরতি নিয়ে জমিদার বললেন, আমি কিন্তু স্যাক্সন ভাষায় কথা বলবো আপনাদের সাথে, কিছু মনে করবেন না যেন। নরম্যান আমি একদম বলতে পারি না, বুঝিও না।
নীতিগত ভাবে আমি নরম্যান ছাড়া অন্য কোনো ভাষা বলার পক্ষপাতী নই, জবাব দিলো টেম্পলার। নরম্যান হলো রাজদরবারের ভাষা। তবে স্যাক্সনও আমি জানি। যখন সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতে হয় তখন স্যাক্সন ভাষায়ই বলি।
তেলে বেগুন পড়লো যেন। দপ করে জ্বলে উঠলো সেড্রিকের চোখ দুটো। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিলেন তিনি। রাগ গোপন করে বজ্রকণ্ঠে অতিথিদের বললেন, আপনারা বসুন দয়া করে।
বসলেন প্রায়োর অ্যায়মার। ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্টও বসলো। টেবিলে খাবার পরিবেশন করার আদশে দিলেন সেড্রিক।
ব্যস্ত হয়ে উঠলো ভূত্যরা থালা, বাটি, গ্লাস, ডিশ, গামলা নিয়ে। মিনিট পেরোনোর আগেই টেবিল পূর্ণ হয়ে উঠলো নানারকম উপাদেয় খাবারে। জিভে পানি এসে গেল ধর্মযাজকের। একটু নড়ে চড়ে বসলেন তিনি।
এবার তাহলে শুরু করা যাক, ফাদার, স্যার নাইট, বললেন সেড্রিক।
ঠিক সেই সময় পাশের একটা দরজা স্কুল গেল। এক ভৃত্য চিৎকার করলো, লেডি রোয়েনা আসছেন!
সেড্রিক একটু অবাক হলেন, একটু বোধহয় বিরক্তও। তবু তাড়াতাড়ি উঠে দরজার কাছে গেলেন তিনি।
চারজন দাসীর সঙ্গে ঘরে ঢুকলো লেডি রোয়েনা। উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখালেন, অতিথিরা। সেড্রিক তার হাত ধরে নিয়ে এসে বসালেন নিজের ডান পাশের চেয়ারটায়। টেম্পলারের চোখ চক চক করছে।
এমন রূপসী আমি ভাবতেও পারিনি! বসতে বসতে প্রায়োরের কানে কানে ফিসফিস করলো সে। নাহ্, ফাদার বাজিতে আপনিই জিতবেন মনে হচ্ছে। আপনার কলারের সোনার কাঁটা পূরার সৌভাগ্য আমার হবে না।
আমি তো আগেই বলেছিলাম, একই রকম ফিসফিস করে বললেন অ্যায়মার। এখন দয়া করে একটু চুপ করুন, সেড্রিক আপনার দিকেই চেয়ে আছে।
সত্যিই অসাধারণ সুন্দরী রোয়েনা। অপরূপা শব্দটা বোধ হয় এমন নারীদের জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘাঙ্গিনী, অপূর্ব মুখশ্রী। সে যে হেঁটে এলো চেয়ার পর্যন্ত, সবার মনে হলো রানী আসছেন। দুধের মতো শাদা তার গায়ের রঙ। নীল চোখ দুটোয় মহামূল্য রত্নের উজ্জ্বলতা। সোনালি চুলগুলো ঈষৎ এলো হয়ে ছড়িয়ে আছে কাঁধের ওপর। সাগর রঙের একটা রেশমী পোশাক তার পরনে। হাঁটার সময় মনে হলো সাগরের মতোই ঢেউ উঠছে তাতে।
প্রায়োরের সতর্কবাণী সত্ত্বেও টেম্পলার দৃষ্টি ফেরাতে পারলো না রোয়েনার অনিদ্যসুন্দর মুখ থেকে।
ব্যাপারটা খেয়াল করলো রোয়েনা। সামান্য গোলাপী হলো তার গাল। আস্তে করে মুখের ওপর টেনে দিলো মস্তকাবরণের এক প্রান্ত। রোয়েনার ভাবান্তর দৃষ্টি এড়ালো না সেড্রিকের।
স্যার ব্রায়ান, একটু রূঢ় কণ্ঠেই তিনি বললেন, আমাদের স্যাক্সন তরুণীদের গাল সূর্যের আলোও সইতে পারে না, আপনার মতো যোদ্ধার অগ্নিদৃষ্টি কি করে সইবে?
লজ্জা পেলো টেম্পলার। মাথা নুইয়ে আরেকবার সম্মান জানালো রোয়েনাকে। বললো, যদি আপনাকে দুঃখ দিয়ে থাকি, দিয়েছি অনিচ্ছায়। আমাকে ক্ষমা করবেন। সেড্রিকের দিকে তাকালেন তিনি। আপনার কাছেও আমি ক্ষমা চাইছি। এমন অশোভন আচরণ আর কখনো হবে না আমার দিক থেকে।
মুখ ঢেকে ফেলে আমাদের সবাইকেই শাস্তি দিয়েছেন লেডি রোয়েনা, অ্যায়মার বললেন, যদিও দোষ করেছে মাত্র একজন। আশা করি পরশু টুর্নামেন্টের সময় এতটা নির্দয় উনি হবেন না।
টুর্নামেন্টে আমরা যাবো কিনা এখনও বলতে পারছি না, জবাব দিলেন সেড্রিক। আপনাদের এই সব টুর্নামেন্ট আমার একদম ভালো লাগে না। ইংল্যান্ড যখন স্বাধীন ছিল, আমাদের সেই পূর্বপুরুষদের আমলে এর চেয়ে কত ভালো ভালো খেলা ধুলা প্রচলিত ছিলো!
সেড্রিকের কথায় কোনো গুরুত্বই দিলেন না প্রায়োর।
তবু আমরা আশা করবো আপনারা যাবেন, বললেন তিনি। অবশ্য আজকাল যা অবস্থা হয়েছে–ভদ্রমহিলাদের নিয়ে পথ চলাই দায়। তবে আমরা, বিশেষ করে স্যার ব্রায়ান সাথে থাকলে ভয়ের কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না।
স্যার প্রায়োর, শান্ত শীতল কণ্ঠে বললেন সেড্রিক, আমার নিজের তলোয়ার আর আমার বিশ্বস্ত অনুচররাই আমার নিরাপত্তার জন্যে যথেষ্ট। আমরা যদি টুর্নামেন্টে যাই-ও, যাবো আমার বন্ধু অ্যাথেলস্টেনের সাথে। আপনাদের সাহায্য দরকার হবে না। সাহায্য করতে চেয়েছেন বলে ধন্যবাদ। ফাদার অ্যায়মার, আসুন, আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে পান। করি।
আমি পান করবো লেডি রোয়েনার নামে, ভরা গ্লাস তুলে নিতে নিতে বললো টেম্পলার। আড়চোখে সেড্রিকের দিকে তাকিয়ে যোগ করলো, তার চেয়ে যোগ্য আর কাউকে দেখছি না এখানে।
আপনার এই সৌজন্যের জন্যে শুধু ধন্যবাদ জানিয়েই যে নিষ্কৃতি দেবো তা ভাববেন না। এই প্রথম কথা বললো রোয়েনা। টেম্পলারের মনে হলো মিষ্টি মধুর ঘণ্টাধ্বনি হলো যেন ঘরের ভেতর। রোয়েনা বলে চললো, আল্লার কাছ থেকে আমরা প্যালেস্টাইনের সর্বশেষ খবরাখবর শুনতে চাই।
সিরিয়ার সুলতানের সঙ্গে নতুন করে সন্ধি হয়েছে, এছাড়া বলবার মত খবর তেমন কিছু নেই।
কখন যে গাৰ্থ আর ওয়াম্বা এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের ভেতর কেউ খেয়াল করেনি। টেম্পলারের জবাব শুনে ভড় বলে উঠলো, এইসব সন্ধির ফলে আর কিছু না হোক আমার বয়েস বেড়ে যাচ্ছে খামোকা।
আরে, ওয়াম্বা, তুই কখন এলি? সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন সেড্রিক। ওয়াম্বার পাশে গার্থকে দেখে স্বস্তি বোধ করলেন তিনি।
এই তো, স্যার, কিছুক্ষণ আগে, আপনারা কথা বলছিলেন তখন।
তা কি যেন বলছিলি তুই, বয়েস বেড়ে যাচ্ছে…
হ্যাঁ, স্যার, বিধর্মীদের সাথে এই সব সন্ধি করছেন রাজারা, আর আমার বয়েস বেড়ে যাচ্ছে।
ওর কথায় বিরক্ত না হয়ে মৃদু হাসলেন জমিদার। কি যা তা বলছিস?
যা-তা কেন হবে, স্যার? এর আগেও তিনবার সন্ধি হয়েছে। প্রত্যেক বার পঞ্চাশ বছরের জন্যে। সেই হিশেবে আমার বয়েস এখন কমপক্ষে দেড়শো।
ওয়াম্বাকে দেখেই চিনেছে টেম্পলার। অগ্নিদৃষ্টিতে একবার তার দিকে তাকিয়ে সে বললো, আমাদের যেমন ভুল পথ বলে দিয়েছিলে অন্য কোনো পথিকের সাথে অমন আর কোরো না। যদি করো, দেড়শো কেন, আর দেড় বছরও যেন তুমি বাঁচতে না পারে সে ব্যবস্থা আমি করবো।
মানে, স্যার ব্রায়ান ও আপনাদের ভুল পথ দেখিয়ে দিয়েছিলো নাকি? জিজ্ঞেস করলেন সেড্রিক।
ওকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন।
মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে ওয়া।
হতভাগা! বদমাশ! গর্জে উঠলেন সেড্রিক, পথচারীদের তুই ভুল ঠিকানা দিস! চাবকানো দরকার তোকে।
নিরুত্তর ওয়াম্বা। তেমনি মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে এখনও।
শুধু বদমাশ নয়, তুই একটা হাঁদা, গর্দভ! আবার চেঁচালেন সেকি।
সে তো সবাই জানে, ভালোমানুষের মতো মুখ করে জবাব দিলো ওয়াম্বা। কিন্তু আমার চেয়েও যে হাঁদা দুনিয়ায় আছে তা জানেন? আমি তো শুধু ডান বায়ের ভুল করেছি। ডাইনে যেতে না বলে বাঁয়ে যেতে বলেছি; কি এমন বোকামি হলো তাতে? আমার মতো বোকার কাছে পথ জানতে চাওয়া আরো বেশি বোকামি না?
এমন ভঙ্গিতে কথাগুলো বললো ওয়াম্বা যে হেসে উঠলেন সবাই। নাইট টেম্পলার স্যার ব্রায়ান কেবল হাসলো না। কার ভাষায় কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুললো সে। এমন সময় অসওয়াল্ড এসে খবর দিলো, অচেনা এক লোক এসেছে। রাতের মতো আশ্রয় চাইছে।
মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল টেম্পলারের।
যে-ই হোক, ঢুকতে দাও তাকে, আদেশ করলেন সেড্রিক।
চলে গেল অসওয়াল্ড। একটু পরেই ফিরে এসে মনিবের কানে কানে ফিসফিস করে বললো, লোকটা ইহুদী, স্যার। নাম আইজাক। ইয়র্কের লোক। এখানেই নিয়ে আসবো ওকে?
নিশ্চয়ই, বললেন সেড্রিক।
একটু ইতস্তত করে অবশেষে অসওয়াল্ড বলেই ফেললো, ওকে নিয়ে আসার জন্যে আমাকেই যেতে হবে, স্যার?
কি দরকার? গার্থের ওপর চাপাও, সেড্রিক জবাব দেয়ার আগেই বলে উঠলো ওয়াম্বা। একজন ইহুদীকে স্বাগত জানানোর জন্যে শুয়োর-চরানো রাখালই যথেষ্ট।
এতক্ষণে উপস্থিত অন্যরা বুঝতে পারলেন কি নিয়ে কানে কানে কথা বলছিলো অসওয়াল্ড।
হায় মা মেরি! আর্তনাদের মতো শোনালো প্রায়োরের গলা, একজন অবিশ্বাসী ইহুদীকে আমাদের পাশে বসানো হবে।
প্রভু যীশুর সমাধিভূমি উদ্ধারের জন্যে যে যুদ্ধ করছে তার সামনে আসতে দেয়া হবে একজন ইহুদী কুকুরকে? ক্রোধ সেই সাথে হতাশা মেশানো টেম্পলার ব্রায়ানের কণ্ঠস্বর।
নাইট টেম্পলাররা দেখছি ইহুদীদের গায়ের বাতাসও সইতে পারেন, ব্যঙ্গের সুরে মন্তব্য করলো ওয়াম্বা, অথচ ওদের বাসস্থান কেড়ে নিতে তাদের আপত্তি নেই।
এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন সেড্রিক। বিতর্কের অবসান করার উদ্দেশ্যেই যেন তিনি বললেন, মাননীয় অতিথিবৃন্দ! আপনাদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, আপনাদের ভালো লাগুক আর নাই লাগুক, আমার দরজা থেকে কেউ হতাশ হয়ে ফিরে যেতে পারবে না। ইচ্ছা না হলে আপনারা ওর সাথে কথা বলবেন না, বা এক টেবিলে খাবেন না। অসওয়াল্ডের দিকে ফিরলেন তিনি, যাও ওকে নিয়ে এসো। এর পর অন্য এক ভৃত্যের দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন, ইহুদী লোকটার জন্যে আলাদা টেবিলের ব্যবস্থা করো।
.
লম্বা, দীর্ঘদেহী এক বৃদ্ধ ঢুকলেন সেড্রিকের খাবার কামরায়। সামান্য ঝুঁকে হাঁটছেন তিনি। বয়েসের ভারে নুয়ে পড়েছেন যেন। পরনে শাদাসিধে কালো আলখাল্লা। পায়ে থ্যাবড়া জুতো। কোমরে মোটা কাপড়ের ফিতে, তার এক দিকে একটা ছুরি ঝোলানো, অন্য দিকে ছোট একটা চামড়ার বাক্সে লেখার সাজসরঞ্জাম। মাথায় হলদে রঙের অদ্ভুতদর্শন এক টুপি, ইহুদী সম্প্রদায়ের লোকেরাই কেবল এ ধরনের টুপি পরে।
সেড্রিক এবং ঘরের অন্যদের দিকে তাকিয়ে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালেন বৃদ্ধ। তারপর দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ, কি করবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। তার অভিবাদনের জবাব দেয়নি কেউ, কেউ তাকায়নি পর্যন্ত তার দিকে। অবশেষে সেড্রিক সামান্য মাথা নেড়ে চাকরবাঁকরদের টেবিলটা দেখিয়ে বসতে ইশারা করলেন তাঁকে।
ধীর পায়ে এগোলেন বৃদ্ধ নিচু টেবিলটার দিকে। আগুনের পাশের চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তীর্থযাত্রী। অদ্ভুত এক মায়া অনুভব করছে সে বৃদ্ধের জন্যে। নিজের শূন্য চেয়ারটা দেখিয়ে বললো, আপনি এখানে। বসুন। আমার খাওয়া শেষ, কাপড়ও শুকিয়ে গেছে।
ঘরের সব কটা চোখ এক সাথে ঘুরে তাকালো তীর্থযাত্রীর দিকে। আর বৃদ্ধ ইহুদী অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন সেড্রিকের দিকে। বুঝতে পারছেন না তরুণ তীর্থযাত্রীর আহ্বানে সাড়া দেয়া উচিত হবে কিনা।
কই এখানে এসে বসুন, আবার বললো তীর্থযাত্রী।
ভয়ে ভয়ে এগোলেন বৃদ্ধ চেয়ারটার দিকে। তীর্থযাত্রী আগুনে কয়েকটা কাঠ গুঁজে দিয়ে টেবিল থেকে কিছু খাবার নিয়ে দিলো তাকে। তারপর দ্রুত গিয়ে বসে পড়লো ঘরের অন্য প্রান্তে একটা নিচু চেয়ারে। তাকে ধন্যবাদ জানানোর সুযোগটুকুও পেলেন না বৃদ্ধ আইজাক।
ধীরে ধীরে ঘরের আবহাওয়া স্বাভাবিক হয়ে এলো আবার। একটা দুটো করে কথা ফুটতে লাগলো সবার মুখে। অবশেষে পানপাত্র তুলে নিলেন সেড্রিক।
স্যার ব্রায়ান, তিনি বললেন, আসুন, যে সব সাহসী নাইট প্যালেস্টাইনে জীবনপণ করে লড়ছে তাদের নামে এক পাত্র পান করি।
তাহলে আমি আমার স্বগোত্রীয়দের নামেই পান করবো, জবাব দিলো টেম্পলার, ওখানে যারা লড়ছে টেম্পলাররাই তাদের ভেতর সবচেয়ে সাহসী।
না, না, তা কেন, বললেন ধর্মযাজক অ্যায়মার, যে সব নাইট ওখানে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আহত, অসুস্থ ক্রুসেডারদের সেবা করছে তাদের নামেও পান করা উচিত, বলতে বলতে তিনি তাঁর গেলাস তুলে নিলেন।
আমার কোনো আপত্তি নেই, মাঝখান থেকে ফোড়ন কাটলো ওয়াম্বা। গম্ভীর স্বরে বললো, তবু একটা কথা বলতে চাই, রাজা রিচার্ড যদি আমার মতো ভাঁড়ের পরামর্শ চাইতেন তাহলে বলতাম, দেশ থেকে নতুন নতুন নাইটদের না নিয়ে গিয়ে যে সব সাহসী বীরদের কারণে ওখানে আমরা হারছি তাদের ওপর যুদ্ধের ভার দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত থাকলেই পারতেন।
এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলো রোয়েনা। এবার সে কথা বললো সেই মিষ্টি মধুর স্বরে।
রাজা রিচার্ডের বাহিনীতে কি টেম্পলার আর হসপিট্যালার (আহত ও অসুস্থ সৈনিকদের সেবা শুশ্রুষায় নিয়োজিত ক্রুসেডার) ছাড়া আর কোনো বীর নেই যাদের কথা একটু বিশেষভাবে বলা যায়?
সত্যি কথা বলতে কি, না, মিলেডি, জবাব দিলো ব্রায়ান। প্রচুর। ইংরেজ নাইটকে প্যালেস্টাইনে নিয়ে গেছেন রিচার্ড। তারা সত্যি সত্যিই সাহসী, বীর এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবু, আমি বলতে বাধ্য, বীরত্বে তারা সবাই টেম্পলারদের নিচে।
মিথ্যে কথা! চিৎকার করে উঠলো তীর্থযাত্রী।
প্রত্যেকেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন তার দিকে।
মিথ্যে কথা, আবার বললো সে। রাজা রিচার্ডের নাইটরা বীরত্বে কারো চেয়ে নিচে নয়। বরং আমি বলবো উপরে। তারাই সবচেয়ে সাহসের পরিচয় দিয়েছে।
কি বলছো জেনে, বুঝে বলছো তো? শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো টেম্পলার।
নিশ্চয়ই। প্রমাণ চান? তাহলে বলছি শুনুন: অ্যাকর-এর প্রতিরোধ চূর্ণ করে ক্রুসেডাররা যখন শহরটা দখল করলো তারপর এক টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছিলেন রিচার্ড। আমি নিজে তাতে উপস্থিত ছিলাম। রিচার্ড তার মাত্র পাঁচজন নাইটকে নিয়ে সেদিন যে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন। এক কথায় অতুলনীয়! যারাই সেদিন তাদের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় নেমেছিলো সবাইকে মুখে মাখতে হয়েছিলো পরাজয়ের কালি। পরাজিতদের ভেতর টেম্পলার ছিলেন মাত্র সাত জন। আমার চেয়ে স্যার ব্রায়ান আরো ভালো জানেন একথা, রোয়েনার দিকে তাকিয়ে শেষ করলো তীর্থযাত্রী।
অপমানে মুখ কালো হয়ে উঠেছে টেম্পলারের। ভয়ানক ক্রোধে তরবারি বের করতে গিয়েও সামলে নিলো। এই বেয়াদব তীর্থযাত্রীকে উপযুক্ত শাস্তি তিনি দেবেন, তবে এখানে না। এখানে তেমন কিছু করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
তীর্থযাত্রীর কাছে স্বদেশবাসী নাইটদের বীরত্বের কথা শুনে ভীষণ খুশি হয়েছেন সেড্রিক।
তীর্থযাত্রী, মৃদু হেসে তিনি বললেন, রিচার্ডের পক্ষে যারা লড়েছিলেন তাদের নাম যদি বলতে পারো আমার হাতের এই সোনার বাজুবন্ধ তোমাকে পুরস্কার দেবো।
পুরস্কারের কোনো প্রয়োজন নেই, এমনিতেই আমি তাদের নাম বলবো। আমার একটা শপথ আছে তাতে বর্তমানে আমার সোনা স্পর্শ করা নিষেধ।
ওয়াম্বা আর চুপ করে থাকতে পারলো না। যদি অনুমতি দেন আপনার হয়ে আমিই না হয় পরবো বাজুবন্ধটা।
কেউ খুব একটা গুরুত্ব দিলো না তার কথায়।
প্রথমেই যার নাম করতে হয় তিনি সিংহ-হৃদয় রিচার্ড স্বয়ং, বললো তীর্থযাত্রী, তার পরে আসে লর্ড লেস্টারের নাম, তিন নম্বরে স্যার টমাস মুলটন-
উনি তো স্যাক্সন, তাই না? বাধা দিয়ে বললেন সেড্রিক।
হ্যাঁ, তারপর স্যার ফোক ডয়লে-।
উনিও তো স্যাক্সন!
পঞ্চম হচ্ছেন স্যার এডুইন টার্নহ্যাম।
আরে, উনিও তত খাঁটি স্যাক্সন! সবিস্ময়ে মন্তব্য করলেন সেড্রিক। তারপর, ছ নম্বরে কে?
একটু ইতস্তত করলো তীর্থযাত্রী। ষষ্ঠজন এক তরুণ নাইট। বিখ্যাত কেউ না, পদ মর্যাদায়ও নিচু। নামটা আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।
আমি পারছি, চিৎকার করে উঠলো টেম্পলার। সবগুলো নাম বলার পর এখন যদি বলো ভুলে গেছি, কে বিশ্বাস করবে? তবু আমি বলছি, দেখ তোমার মনে পড়ে কি না। ছনম্বর নাইটের নাম ছিলো উইলফ্রিড অভ আইভানহো। হ্যাঁ, আপনাদের সবার সামনে বলছি, আমার বিরুদ্ধেই লড়েছিলো সে। কিন্তু সেদিন ভাগ্য আমার বিপক্ষে ছিলো। প্রথমবারেই আমার বর্শা ভেঙে যায়, ঘোড়াটাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে মাটিতে। ফলে পরাজয় স্বীকার করে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না আমার। ও যদি এখন ইংল্যান্ডে থাকে, আর পরশুর টুর্নামেন্টে আসে, আমি তার সাথে আবার লড়বো। এবার কে জিতবে তা আমি জানি!
আইভানহো যদি ফিরে থাকে, তীর্থযাত্রী বললো, আমার মনে হয়, অন্তত একবার জয়লাভের চেষ্টা করার সুযোগ দেবে আপনাকে। আমি জামিন থাকছি।
তুমি যে জামিন থাকছে তার প্রমাণ কি? জিজ্ঞেস করলো স্যার ব্রায়ান।
ধীরে ধীরে পোশাকের ভেতর থেকে ছোট্ট একটা হাতীর দাঁতের বাক্স বের করলো তীর্থযাত্রী।
এই বাক্সটা আমি আমার জামিনের প্রমাণ হিশেবে জমা দিচ্ছি স্যার প্রায়ারের কাছে, বললো সে। প্রভু যীশুকে যে ক্রুশে বিদ্ধ করা হয়েছিলো তার ছোট্ট একটা টুকরো আছে এতে।
ব্রায়ান তাঁর গলা থেকে একটা সোনার হার খুলে ছুঁড়ে দিলো টেবিলের ওপর।
আমি যে আবার ওর সাথে লড়তে চেয়েছি তার প্রমাণ হিশেবে এই হারটা আমি জমা রাখছি প্রায়োরের কাছে, বললো সে। তারপর সরোষে যোগ করল, আইভানহো ইংল্যান্ডে ফিরেদি আমার সাথে না পড়ে তাহলে আমি ইউরোপের সমস্ত দেশে প্রচার করে দেবো, আইভানহো ভীতু কাপুরুষ।
তার বোধহয় প্রয়োজন পড়বে না, শান্ত কণ্ঠে বললো রোয়েনা। আইভানহো এখানে নেই, তবু ওর পক্ষ থেকে আমি বলছি, আইভানহো আপনাকে সুযোগ দেবে।
রোয়েনার কথা শুনে সেড্রিক প্রথমে বিস্মিত পরে বিরক্ত হলেন।
এসব বিষয়ে কথা বলা ঠিক হয়নি তোমার, রোয়েনা, বললেন তিনি। আমাদের পক্ষ থেকে কিছু যদি বলতেই হতো, আমি বলতে পারতাম। তুমি কেন?…যাক যা হওয়ার হয়েছে, এখন আর ও নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
হ্যাঁ, রাত অনেক হয়েছে, বললেন প্রয়োর অ্যায়মার। আইভানহোর সাথে স্যার ব্রায়ানের লড়াইটা যতদিন না হচ্ছে এই পবিত্র হাতির দাঁতের বাক্স আর এই সোনার হারটা আমার মঠের কোষাগারে জমা থাকবে। এবার শুতে যাওয়ার আগে আসুন লেডি রোয়েনার স্বাস্থ্য কামনা করে সবাই একপাত্র পান করি।
সবাই যার যার গ্লাসে চুমুক দিলেন। পান শেষে অতিথিরা মাথা নুইয়ে সম্মান জানালেন গৃহকর্তাকে। রোয়েনা তার দাসীদের সাথে চলে গেল।
ঘর থেকে বেরোনোর সময় সোজা দরজার দিকে না গিয়ে সামান্য ঘুরে বুড়ো আইজাকের পাশে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে দাঁড়ালো টেম্পলার।
কি, ইহুদীর বাচ্চা, টুর্নামেন্টে যাচ্ছো? নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো সে।
প্রায় হাঁটু পর্যন্ত মাথা নুইয়ে বৃদ্ধ জবাব দিলো, জি।
নিশ্চয়ই প্রচুর টাকা এনেছে সাথে?
ভয়ার্ত চেহারা হলো আইজাকের।
না! না! কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। একটা পেনিও নেই আমার কাছে। সত্যিই বলছি। আমার গায়ের কাপড়টা দেখছেন, এটা পর্যন্ত ধার করে আনা।
ক্রুর একটা হাসি খেলে গেল বোয়া-গিলবার্টের মুখে। আর কিছু না বলে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা আরব সহচরদের দিকে এগিয়ে গেল সে। ওদের ভাষায় কিছুক্ষণ কথা বললো ওদের সাথে। কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো তীর্থযাত্রী। প্রতিটা কথা বুঝলো সে। কিন্তু অন্য কেউ একটা কথাও বুঝলো না, তীর্থযাত্রী যে বুঝেছে তা-ও টের পেলো না।
০৩. নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে তীর্থযাত্রী
নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে তীর্থযাত্রী। হঠাৎ রোয়েনার এক পরিচারিকা এসে থামালো ওকে।
লেডি রোয়েনা আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান, পরিচারিকা বললো।
আমার সাথে কথা বলতে চান! বিস্ময় তীর্থযাত্রীর কণ্ঠে।
হ্যাঁ। আসুন আমার সঙ্গে।
পরিচারিকার সাথে রোয়েনার ঘরে গেল তীর্থযাত্রী। হাঁটু গেড়ে বসে অভিবাদন জানালো।
চুল আঁচড়াচ্ছিলো রোয়েনা। তিনজন পরিচারিকা পেছনে দাঁড়িয়ে সাহায্য করছে। তীর্থযাত্রীকে দেখেই ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।
এ কি করছেন? রোয়েনা বললো, উঠুন। আমার্কে অমন করে সম্মান দেখাতে হবে না। এই যে চেয়ারটায় বসুন। পরিচারিকাদের দিকে তাকিয়ে যোগ করলো, এলগিটা ছাড়া আর সবাই বাইরে যাও। এই পবিত্র তীর্থযাত্রীর সাথে আমি একটু একা আলাপ করতে চাই।
একে একে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল তিন দাসী।
তীর্থযাত্রী, শুরু করলো রোয়েনা, একটু আগে খাওয়ার ঘরে আপনি উইলফ্রিড অভ আইভানহোর কথা বলছিলেন। আমার অনুরোধ, দয়া করে বলুন, কবে আপনি ওকে শেষ দেখেছেন? ভালো ছিলো তো?
দেখুন, সত্যি কথা বলতে কি আইভানহো সম্পর্কে সামান্যই জানি আমি, জবাব দিলো তীর্থযাত্রী। আপনি ওর ব্যাপারে কৌতূহলী জানলে আরেকটু খোঁজ খবর করে আসতে পারতাম বোধহয়।
খুব শিগগিরই কি দেশে ফিরবে? আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলে রোয়েনা।
বোধ হয়। আমার ধারণা এখন উনি ইংল্যান্ডে ফেরার আয়োজনেই ব্যস্ত।
ওহ, তাড়াতাড়ি আসুক! নইলে এসে হয়তো দুঃসংবাদ শুনতে হবে ওকে। বাবা অ্যাধেলস্টেনের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করছে। আমার কি করার আছে? শেষ কথাগুলো যেন নিজেকে শোনানোর জন্যেই বললো রোয়েনা। অ লুকানোর জন্যে অন্য দিকে মুখ ফেরালো সে।
তীর্থযাত্রী দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না যেন।
কয়েক সেকেন্ড লাগলো রোয়েনার নিজেকে সামলাতে। চোখ মুছে আবার তাকালো তরুণ তীর্থযাত্রীর দিকে।
আচ্ছা, ওর সঙ্গে যখন আপনার শেষ দেখা হয় তখন কেমন দেখেছেন ওকে?
এমনিতে ভালোই রঙটা একটু ময়লা হয়েছে রোদে পুড়ে, একটু রোগাও হয়েছেন মনে হলো। তাছাড়া একটু যেন দুশ্চিন্তাগ্রস্তও দেখাচ্ছিলো তাকে।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোয়েনা। এখানে এলেও ওর সেই দুশ্চিন্তা দূর হবে কিনা কে জানে? আইভানহো আমার ছেলেবেলার সাথী, ওর সম্পর্কে যেটুকু সংবাদ আপনি দিলেন সেজন্যে ধন্যবাদ। আপনি মনে হয় ক্লান্ত, আর আপনাকে দেরি করিয়ে দেবো না। আমি এই সামান্য উপহারটুকু দিতে চাই আপনাকে, যদি গ্রহণ করেন আন্তরিকভাবে খুশি হবো।
একটা স্বর্ণমুদ্রা এগিয়ে দিলো রোয়েনা তীর্থযাত্রীর দিকে।
টাকা পয়সার-কোনো প্রয়োজন যে আমার নেই, আপত্তির সুরে বললো অর্থযাত্রী।
আমি জানি। তবু আপনার ভবিষ্যৎ পথচার কথা ভেবে যদি গ্রহণ করেন সত্যিই বলছি আমি কৃতজ্ঞ হবো।
আর আপত্তি করলো না তীর্থযাত্রী। হাত বাড়িয়ে নিলো মুদ্রাটা। মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে বেরিয়ে এলো রোয়েনার ঘর থেকে। বাইরে এক ভৃত্য অপেক্ষা করছিলো ওকে ওর ঘর দেখিয়ে দেয়ার জন্যে। তার সাথে হাঁটতে লাগলো তীর্থযাত্রী।
বিরাট বাড়িটার যে অংশে চাকরবাঁকররা থাকে ভৃত্য সেখানে নিয়ে গেল তীর্থযাত্রীকে। একটা ঘর দেখিয়ে বললো, এই ঘরে থাকবেন আপনি। ভেতরে চৌক্তি আছে, ভালো ভেড়ার চামড়া আছে, আশা করি খুব একটা অসুবিধা হবে না ঘুমাতে।
আচ্ছা, ঐ ইহুদীটাকে কোন ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছে জানো নাকি? জিজ্ঞেস করলো তীর্থযাত্রী।
আপনার পাশেরটাই। ডানদিকে।
আর গার্থের ঘর?
আপনার বা পাশেরটা।
হাতের মশালটা তীর্থযাত্রীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল ভৃত্য। ঘরে ঢুকলো তীর্থযাত্রী। দরজা বন্ধ করে মশালটা এক কোণে গুঁজে রাখলো। তারপর ঘরের একমাত্র খটখটে চৌকিটায় উঠে শুয়ে পড়লো সটান। কাপড় চেপড় ছাড়ার ঝামেলা পোহালো না। গায়ের ওপর টেনে নিলো ভেড়ার চামড়া।
শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এলো না। নানা চিন্তায় ভারি হয়ে আছে মাথাটা। বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করলো তীর্থযাত্রী। রোয়েনার কথা ভাবছে। ভাবছে নাইট টেম্পলার ব্রায়ানের কথা, স্যাক্সন সেড্রিকের কথা। ভাবতে ভাবতেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো সে।
.
সূর্যোদয়ের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ঘুমালো তীর্থযাত্রী। তারপর উঠে প্রার্থনায় বসলো। প্রার্থনা শেষ করে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আইজাকের ঘরে ঢুকলো সে।
বুড়ো ইহুদী তখন দুঃস্বপ্ন দেখছেন। ঘরে ঢুকেই তীর্থযাত্রী শুনতে পেলো তার চিৎকার:
দয়া করো আমাকে! নবী আব্রাহামের নামে মিনতি করছি, দয়া করো, দয়া করো আমাকে! আমার কাছে কিছু নেই। কি দেবো তোমাদের? আমি গরীব! বিশ্বাস করো, কপর্দকশূন্য! আমাকে ছেড়ে দাও! দয়া করো! ওহ!
চিৎকার করছেন আর ঘুমের ভেতরই ছটফট করছেন আইজাক। আস্তে তার কপাল স্পর্শ করলো তীর্থযাত্রী। লাফ দিয়ে চৌকি থেকে নেমে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ ইহুদী। বুনো আতঙ্কে বিস্তারিত দুচোখ।
ভয় পাবেন না, আইজাক, কণ্ঠে বললো তীর্থযাত্রী। আমি আপনার বন্ধু।
বন্ধু! বললেন বৃদ্ধ। এই অসময়ে এখানে!
আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি। আপনার সামনে সমূহ বিপদ!
কিন্তু আমাকে বিপদে ফেলে কার কী লাভ?
জানি না। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, কাল রাতে টেম্পলার তার লোকদের যা বলেছে আমি শুনেছি।
কী বলেছে? শঙ্কিত কষ্ঠে প্রশ্ন করলেন আইজাক।
রদারউড থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে ধরে ত দ্য বোয়েফ-এর দুর্গে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে টেম্পলার।
কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন আইজাক। ভয়ে কাগজের মতো শাদা হয়ে হয়ে গেছে মুখ।
ওহ্ নবী আব্রাহাম, ওহ্ ঈশ্বর! কাঁদ কাঁদ স্বরে বললেন তিনি। আমি জানতাম এমন কিছু হবে! ওরা তো একটা একটা করে আমার হাত পা খসিয়ে নেবে! বাঁচান আমাকে! দয়া করুন!
উঠুন, আইজাক, ভয়ে এমন অস্থির হয়ে পড়লে বিপদ আপনার কমবে, বরং বাড়বে। আমার কথা শুনুন, এক্ষুণি–ওরা কেউ জেগে ওঠার আগেই এ বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে আপনাকে।
কিন্তু কি করে পালাবো? এই অসময়ে কে আমাকে ফটক খুলে দেবে?
ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না, এখান থেকে যেন নিরাপদে বেরুতে পারেন আমি তার ব্যবস্থা করছি। এ এলাকার পথঘাট সব আমি চিনি। আপনাকে কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে আসবো।
প্রথমে একটু ভরসা পেলেন আইজাক। তারপরই সন্দেহ দেখা দিলো তাঁর মনে। মিথ্যে কথা বলছে না তো এই তীর্থযাত্রী? টেম্পলার ব্রায়ানের মনে যা আছে এরও মনে যদি তা-ই থেকে থাকে?
ইহুদী খ্রীষ্টান সবাই এক ঈশ্বরের সৃষ্টি, বললেন বৃদ্ধ। আপনি ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে বিপদে ফেলবেন না তো? আমি নিঃস্ব মানুষ। আমার সাথে প্রতারণা করে কোনো লাভ হবে না আপনার।
হাসলো তীর্থযাত্রী। দেখুন, আপনি নিঃস্ব না হয়ে যদি কোটিপতি হতেন তাতেও আমার কিছু এসে যেতো না। সহজ সাধারণ জীবনযাপনের সংকল্প নিয়ে আমি এ পোশাক পরেছি। জাগতিক সম্পদ, ঐশ্বর্য সব আমার কাছে এখন তুচ্ছ। শুধু একটা ভালো ঘোড়া আর যুদ্ধের পোশাকের লোভ এখনো ছাড়তে পারিনি। ও দুটো জিনিস পেলে কি করবো বলতে পারি না। যা হোক, আপনার মনে যদি সন্দেহ থাকে এখানেই থাকুন। বিপদে পড়লে সেড্রিক আপনাকে বাঁচাবেন আশা করি।
না, না! স্যাক্সন নরম্যান সবাই ইহুদীদের ঘৃণা করে। সেড্রিকও নিশ্চয়ই করেন। উনি আমাকে কোনো সাহায্যই করবেন না। না, আপনার সাথেই যাবো আমি, আর কোনো উপায় নেই! চলুন তাড়াতাড়ি! আপনি তৈরি?
হ্যাঁ তৈরি। তবে আগে একজনের সাথে একটু কথা বলতে হবে। আসুন আমার সাথে।
বৃদ্ধকে নিয়ে নিজের ঘরের বাঁ পাশের ঘরটায় ঢুকলো তীর্থযাত্রী। ঘুমিয়ে আছে গাৰ্থ আর ওয়াম্বা। গার্থের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে ডাকলো সে, গার্থ, ওঠো তো!
অস্কুট একটা শব্দ করে পাশ ফিরে শুলো গার্থ।
গার্থ! গার্থ! ওঠো! আবার ডাকলো তীর্থযাত্রী। পেছনের দরজাটা বুলে দাও।
এবার ধড়মড় করে উঠে বসলো গাৰ্থ। চোখ কচলে, তাকালো তীর্থযাত্রীর দিকে।
পেছন দিকের দরজাটা খুলে দাও, আবার বললো তীর্থযাত্রী। আমি আর এই ইহুদী এক্ষুণি বাইরে যাবো।
বিরক্তির ছাপ পড়লো গার্থের মুখে।
ইহুদী আর আপনি এক সাথে! ঘুম জড়িত কণ্ঠে সে বললো। যাকগে, কার সাথে যাবেন সে আপনার ব্যাপার, কিন্তু আমি এখন পেছনের দরজা খুলতে পারবো না। যতক্ষণ না ওরা সদর ফটক খুলছে ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে আপনাদের। আবার শুয়ে পড়লে গাৰ্থ।
শোনো, গাৰ্থ-, বলে একটু ঝুঁকে ওর কানে কানে কি যেন বললো তীর্থযাত্রী। অমনি তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো গাৰ্থ। দুচোখ ভর্তি বিস্ময়।
তাড়াতাড়ি ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখলো তীর্থযাত্রী। শ-শ-শ, গার্থ! একটা কথাও না। পরে সব বলবো তোমাকে। এখন তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিয়ে এই বৃদ্ধের ঘোড়াটা নিয়ে এসো। আমার জন্যেও একটা এনো। কাজ
শেষ হয়ে গেলেই আমি ফিরিয়ে দিয়ে যাবো।
ঘুম ঘুম ভাব কোথায় পালিয়েছে! তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে গার্থ ছুটলো দরজা খোলার জন্যে। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে এসে দাঁড়ালো তীর্থযাত্রী ও আইজাক। হঠাৎ পেছনে পদশব্দ পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো দুজন। যথারীতি আশঙ্কায় শাদা হয়ে গেছে বৃদ্ধের মুখ। অবশ্য ওয়াম্বাকে দেখে স্বস্তি ফিরে এলো তার মনে।
প্যালেস্টাইনে গিয়ে কি আপনারা শেখেন জানতে বড় ইচ্ছে হয় আমুর, মৃদু হেসে বললো ওয়াম্বা।
বোকা! শিখবো আবার কি? জবাব দিলো তীর্থযাত্রী। ওখানে গিয়ে আমরা প্রার্থনা করি; সারাজীবনে যে পাপ করেছি তার জন্যে অনুশোচনা করি, ক্ষমা ভিক্ষা করি ঈশ্বরের কাছে; উপবাস করি; কখনো কখনো সারারাত জেগে ঈশ্বরের নাম জপি।
উহুঁ, আরো কিছু করেন, কিছু শিখে আসেন। নইলে শুধু প্রার্থনা, অনুশোচনা আর উপবাসের বাণী শুনে গাৰ্থ অমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে দরজা খোলার জন্যে।
তীর্থযাত্রী আর কিছু বলার আগেই গার্থ হাজির হলো, দুই হাতে টেনে আনছে দুটো ঘোড়া।
বৃদ্ধ ইহুদী এক মুহূর্ত দেরি না করে তার ঘোড়ায় চেপে বসলেন। নীল কাপড়ের একটা থলে পোশাকের ভেতর থেকে বের করে দ্রুত হাতে বেঁধে ফেললেন জিনের সাথে। তারপর আলখাল্লার এক প্রান্ত এমন ভাবে সেটার ওপর ছড়িয়ে দিলেন যে বাইরে থেকে দেখে কেউ বুঝতে পারবে না ওটার নিচে কিছু আছে।
কি থলেটায়? নিচুকণ্ঠে প্রশ্ন করলো তীর্থযাত্রী। তেমন দামী কিছু না। এই দুএকটা কাপড় জামা আর কি।
আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না তীর্থযাত্রী। লাফ দিয়ে উঠে বসলো তার জন্যে আনা ঘোড়াটায়। শুধু ওয়া নয়, আইজাকও খেয়াল করলো, তার ঘোড়ায় চাপার ভঙ্গিটা খুব চৌকস। একমাত্র দক্ষ ঘোড়সওয়ারের পক্ষেই অমন করে ঘোড়ায় চাপা সম্ভব।
দেরি না করে জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো দুজন। কয়েক ঘণ্টা একটানা ছুটে ছোট একটা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে লাগাম টেনে ধরলো তীর্থযাত্রী।
আর কোনো ভয় নেই আপনার, বললো সে। ফিলিপ ম্যালভয়সিঁ আর রেজিনাল্ড ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ দুজনেরই এলাকা আমরা পার হয়ে এসেছি। সোজা পথটার দিকে ইশারা করলো তীর্থযাত্রী। এই পথে গেলে শেফিল্ডে পৌঁছে যাবেন।
আর আপনি? প্রশ্ন করলেন আইজাক।
আমি বিদায় নেবো এখান থেকে।
না! না! করুণ হয়ে উঠলো বৃদ্ধের মুখ। আমাকে এখনই ছেড়ে যাবেন না দয়া করে। সেই টেম্পলার আর তার সঙ্গীরা এখন পর্যন্ত ধাওয়া করে এসে আমাকে ধরবে।
কিন্তু আমাদের যে আর এক সাথে চলা উচিত হবে না। আপনি ইহুদী, আমি খ্রীষ্টান। আমাদের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ আলাদা। তাছাড়া টেম্পলারের সশস্ত্র অনুচররা যদি আক্রমণ করেই বসে আমি নিরস্ত্র, একা আপনাকে বাঁচাবো কি করে?
আপনি ইচ্ছে করলেই আমাকে বাঁচাতে পারবেন, এবং আমার বিশ্বাস প্রয়োজন হলে বাঁচাবেনও। দয়া করুন আমাকে, ভাই। আপনাকে আমি পুরস্কৃত করবো।
আমি তো আগেই বলেছি, টাকা বা পুরস্কারের ওপর আমার কোনো লোভ নেই। যদি আপনাকে সাহায্য করি, এমনিই করবো। এক মুহূর্ত ভাবলো তীর্থযাত্রী। তারপর বললো, ঠিক আছে, আপনি যখন বলছেন, শেফিল্ড পর্যন্ত আপনাকে পেীছে দেবে। প্রয়োজন হলে বিপদে সাহায্যও করবো। বিপন্ন মানুষ–সে ইহুদীই হোক আর মুসলমানই হোক, তাকে সাহায্য করা খ্রীষ্টান ধর্মের বিরোধী নয়।
আহ, আপনি আমাকে বাঁচালেন। ঈশ্বর আপনার ভালো করবেন।
কিন্তু একটা কথা, শেফিল্ডের ওপাশে কিন্তু আমি যেতে পারবো না। ওখানে নিশ্চয়ই আপনার জানাশোনা ইহুদী পরিবার আছে, তাদের কাছে সহজেই আপনি আশ্রয় পেয়ে যাবেন।
শেফিল্ড পর্যন্ত গেলেই চলবে। ওখানে আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় আছে। ওর বাড়িতেই আমি উঠতে পারবো।
চলুন তাহলে। আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা শেফিল্ডে পৌঁছে যাবো।
আর কোনো কথা হলো না তাদের ভেতর। নিঃশব্দে পাশাপাশি ঘোড়া চালিয়ে চললো দুজন। আধঘণ্টার মাথায় পৌঁছে গেল শেফিল্ডে।
এবার আমি যাই, বললো তীর্থযাত্রী।
এই হতভাগ্য ইহুদীর ধন্যবাদ না নিয়েই?
ধন্যবাদের কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার জন্যে যেটুকু করেছি মানুষ হিসেবে মানুষের জন্যে এটুকু করা আমার কর্তব্য।
ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে রওনা হতে গেল তীর্থযাত্রী। অমনি তার পোশাকের প্রান্ত ধরে ফেললেন আইজাক।
একটু দাঁড়ান। আপনার সহৃদয়তার প্রতিদান আমাকে দিতেই হবে। এই মুহূর্তে আপনি যা মনে প্রাণে চাইছেন আমি হয়তো তার ব্যবস্থা করে দিতে পারবো।
অবাক হলো তীর্থযাত্রী। আমি যা মনেপ্রাণে চাইছি! বলুন তো কি। চাইছি?
একটা ভালো ঘোড়া আর যুদ্ধের পোশাক আর অস্ত্র।
আপনি কি করে জানলেন!
জানি। রহস্যময় এক টুকরো হাসি উপহার দিলেন বৃদ্ধ ইহুদী।
কিন্তু কি করে? আমার সাধারণ চালচলন, অতি সাধারণ পোশাক, কথাবার্তা–সব দেখেশুনেও আপনার মনে এ সন্দেহ হলো কেন?
কাল রাতেই আমি টের পেয়েছি। আপনি যেসব কথা বলছিলেন শাদামাঠা হলেও তাতে ছিলো আগুনের ফুলকির চমক। সাধারণ একজন তীর্থযাত্রীর মুখ থেকে অমন কথা বেরোতে পারে না। তাছাড়া আজ ভোরে আপনি যখন ঝুঁকে আমাকে জাগাচ্ছিলেন তখন দেখলাম আপনার আলখাল্লার নিচে ঝুলছে নাইটদের হার। তারপর আর সন্দেহ রইলো না।
হাসলো তীর্থযাত্রী। আপনার আলখাল্লার নিচে উঁকি দিলে কি পাওয়া যাবে বলুন তো!
এ কথার কোনো উত্তর দিলেন না আইজাক। কোমরের ছোট্ট চামড়ার বাক্সটা থেকে লেখার সাজ সরঞ্জাম বের করে হিব্রু ভাষায় কি যেন লিখলেন। তীর্থযাত্রীর হাতে লেখাটা দিতে দিতে বললেন, লিস্টার শহরে এক ধনী ইহুদী আছেন, তাঁর নাম কিরজাথ জেরাম। অন্তত ছয় প্রস্থ খুব ভালো যুদ্ধের পোশাক আর অস্ত্রশস্ত্র আছে তার কাছে। এই কিরজাথ জেরামের কাছে গিয়ে আমার এই চিঠি দেখালে উনি আপনাকে এক প্রস্থ পোশাক ও অস্ত্রশস্ত্র দেবেন। ছটার ভেতর থেকে পছন্দমতো বেছে নিতে পারবেন। উনি একটা ঘোড়াও দেবেন আপনাকে। যদি দাম দিয়ে কিনে নিতে পারেন, ভালো, না হল টুর্নামেন্ট শেষে ওগুলো আপনি ফেরত দেবেন কিরজাথকে।
কিন্তু, আইজাক, তীর্থযাত্রী বললো, টুর্নামেন্টে যখন কোনো নাইট পরাজিত হয় তখন তার বর্ম, অস্ত্রশস্ত্র সব তো বিজয়ীকে দিয়ে দিতে হয়। যদি আমি হেরে যাই–
উদ্বেগের ছায়া পড়লো আইজাকের মুখে। কিন্তু মুহূর্তের জন্যে। তারপরই আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠলো বৃদ্ধের চেহারা।
ঠিক আছে, ও নিয়ে ভাববেন না, বললেন তিনি। আপনি যদি একান্ত হেরেই যান, কিরজাথ জেরামের সাথে আমি মিটিয়ে ফেলবো ব্যাপারটা। তারপর অদ্ভুত এক সহানুভূতির দৃষ্টি ফুটে উঠলে তার চোখে। বললেন, টুর্নামেন্টে লড়ার সময় সতর্ক থাকবেন। ঘোড়া বা বর্মের কথা আমি ভাবছি না, ভাবছি আপনার অমূল্য প্রাণের কথা।
আমি সতর্ক থাকবো, বললো তীর্থযাত্রী। আপনার পরামর্শ আর সহৃদয়তার কথা কখনো ভুলবো না। সময় হলে এই উপকারের প্রতিদান আমি দেবো।
আব্রাহাম আপনার মঙ্গল করুন। আপনি জয়ী হোন এই কামনা করি।
একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুই ভিন্ন পথে রওনা হলেন দুজন।
০৪. দেশের নামকরা সব নাইট
দেশের নামকরা সব নাইট যোগ দেবেন অ্যাশবির টুর্নামেন্টে। তার ওপর এতে উপস্থিত থাকবেন রাজকুমার জন, যিনি রাজা রিচার্ডের পক্ষে এখন শাসন করছেন ইংল্যান্ড। সুতরাং এ প্রতিযোগিতার গুরুত্ব আর দশটা সাধারণ টুর্নামেন্টের চেয়ে অনেক বেশি। নির্দিষ্ট দিনে ভোর থেকেই দলে দলে লোক উপস্থিত হতে লাগলো প্রতিযোগিতার জন্যে নির্ধারিত জায়গায়। বিচিত্র পোশাক-আশাক পরা নানা শ্রেণীর সব দর্শক।
টুর্নামেন্ট হবে অ্যাশবি শহরের ঠিক বাইরে এক বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। প্রান্তরের এক ধারে বড় বড় ওক গাছের সারি। অন্য পাশে নিবিড় বনভূমি। মাঝখানে নির্দিষ্ট হয়েছে প্রতিযোগিতার স্থান। সুঁচালো মাথাওয়ালা শক্ত কাঠের খুঁটি পুঁতে ঘিরে ফেলা হয়েছে আধ মাইল লম্বা সিকি মাইল চওড়া জায়গাটা। উত্তর দক্ষিণে প্রবেশ পথ। এক সাথে দুজন যোদ্ধা পাশাপাশি যেতে পারে এই পথ দিয়ে। দুই প্রবেশ দ্বারের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন করে থোক। প্রতিযোগীরা যখন ভেতরে ঢুকবেন তাদের নাম পরিচয় ঘোষণা করবে ওরা। পুরো প্রতিযোগিতাস্থানটাকে ঘিরে আছে অসংখ্য সশস্ত্র রক্ষী। কোনো গোলমাল হলে শৃঙ্খলা রক্ষা করবে তারা।
দক্ষিণ দিকের প্রবেশ পথের কাছে এক সারিতে পাচটা তাঁবু। আজকের টুর্নামেন্টের পাছ চ্যালেঞ্জার স্যার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্ট, রেজিনাল্ড ট্রুত দ্য বোয়েফ, ফিলিপ ম্যালভয়সিঁ, স্যার গ্রান্টমেনসিল ও জেরুজালেমের সেইন্ট জন গির্জার নাইট ভাইপন্টের তাঁবু এগুলো। এই পাঁচজন ছাড়া আর যারা টুর্নামেন্টে যোগ দেবে তাদেরকে এই পাঁচজনের একজনকে পছন্দ করে তার সাথেই লড়তে হবে।
উত্তর দিকের প্রবেশ পথের কাছে আর এক সারি তাঁবু। ওগুলোও চমক্কার করে সাজানো। চ্যালেঞ্জারদের মোকাবেলা করবে যেসব নাইট তাদের তাবু ওগুলো।
ঘেরা জায়গার অন্য দুপাশে অর্থাৎ পূর্ব-পশ্চিমে দর্শকদের জন্যে আসন সাজানো হয়েছে। সেরা আসনগুলো নাইট এবং ভদ্রলোকদের জন্যে সংরক্ষিত। অন্যগুলোয় বসবেন ভদ্রমহিলারা। সাধারণ মানুষ, কৃষক, ব্যবসায়ী বা শ্রমজীবীদের জন্যে কোনো আসরে ব্যবস্থা করা হয়নি। তারা যে যেখানে পারে বসে বা দাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতা দেখবে।
সংরক্ষিত আসনগুলোর একটা একটু উঁচু এবং সুসজ্জিত। ছোট্ট একটা তাবুর সামনে পাতা আসনটা। তাঁবুর বাইরে রাজকীয় প্রতীক চিহ্ন। এই তাবুর পাহারায় যারা রয়েছে তাদের পরনে ঝলমলে পোশাক। হাতে বর্শা। কোমরে খাপে পোরা তলোয়ার। তবুটা নির্দিষ্ট রাজকুমার জনের জন্যে, আসনটাও। এটার ঠিক উল্টোদিকে আরেকটা জমকালো ভাবু। সেটার সামনে সুদৃশ্য এক সিংহাসন পাতা। কয়েকজন তরুণী পরিচারিকা সুন্দর পোশাকে সেজে দাঁড়িয়ে আছে তাবুটার দুপাশে। তাবুর উপরে অনেকগুলো তিনকোনা পতাকা। নানা রকমের ছবি আঁকা সেগুলোয়। একটায় আঁকা তীর-ধনুক। তাঁবুর দরজার ওপরে লেখা: সৌন্দর্য ও প্রেমের রানী। আজ যাঁকে রানী নির্বাচিত করা হবে তিনি পুরস্কার বিতরণ করবেন টুর্নামেন্টের বিজয়ীদের ভেতর। রানী নির্বাচনের ব্যাপারে বিজয়ীর অধিকার সবচেয়ে আগে। দর্শকদের ভেতর তুমুল জল্পনা কল্পনা চলছে, কে আজ বিজয়ী হবেন, আর কে-ই বা নির্বাচিত হবেন সৌন্দর্য ও প্রেমের রানী?
এর ভেতর সবগুলো আসন পূর্ণ হয়ে গেছে নাইট এবং অন্যান্য গণ্যমান্য দর্শকে। তাদের পোশাক আশাকের চাকচিক্যে চোখ ঝলসে যেতে চায়। মহিলা দর্শকও কম নয়। রুচিসম্মত জমকালো পোশাকে সজ্জিত সবাই। আসন-সারির পেছনে, গাছের ডালে, পাশের টিলায়, কাছের এক গির্জার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বসে সাধারণ মানুষরা। সংখ্যায় তারা অসংখ্য। এখন্ও দলে দলে লোক আসছেই। যারা মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে তাদের ভেতর ঠেলাঠেলি চলছে–একটু এগিয়ে যদি যাওয়া যায়, হয়তো ভালো করে দেখা যাবে লড়াই। কথা কাটাকাটি চলছে অনেকের ভেতর, মুখখিস্তিও চলছে সমানে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত রক্ষীরা হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে এসব ঝগড়া বিবাদ মিটিয়ে শান্তি রক্ষা করতে। যেখানে কথায় কাজ হচ্ছে না সেখানে নির্বিচারে লাঠি চালাচ্ছে তারা।
এক জায়গায় দেখা গেল বয়স্ক এক দর্শক আরেক বয়স্ক–প্রায় বৃদ্ধ দর্শককে গালাগাল করছে; বিধর্মী কুকুর! তোর এত বড় সাহস, আমার মতো একজন নরম্যান ভদ্রলোকের পাশে বসতে চাস!
যে বৃদ্ধকে ধমকানো হচ্ছে তিনি আর কেউ নন, ইহুদী আইজাক। এখন তার গায়ে দামী জমকালো পোশাক। বৃদ্ধ তাঁর মেয়ে রেবেকাকে সামনে বসানোর চেষ্টা করছিলেন, তাতেই এই বিপত্তি।
আইজাকের চেহারায় আগের সেই ভীত ভাব আর নেই। কারণ তিনি জানেন, আইনের চোখে এখানে ইহুদী আর খ্রীষ্টানে কোনো প্রভেদ নেই। তার ওপর কোনো অন্যায় অত্যাচার হলে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসবে। তাছাড়া, অভিজাতদের অনেকেই প্রয়োজনের সময় ইহুদীদের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়। সুতরাং নিজেদের স্বার্থেই তারা তাকে রক্ষা করবে। সবচেয়ে বড় কথা, রাজকুমার জন ইয়র্কের ইহুদীদের কাছ থেকে ক্লেশ মোটা অঙ্কের একটা ঋণ নেয়ার জন্যে আলাপ আলোচনা চালাচ্ছেন। সেই ঋণের সিংহভাগ দেয়ার কথা আইজাকেরই। কাজেই ধার পেতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্যে খোদ জনও নিজের গরজে এগিয়ে আসবেন বৃদ্ধ ইহুদীকে সাহায্য করতে।
এসব কথা ভেবে নরম্যান লোকটাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন আইজাক। লোকটা তখন রক্ষীদের শরণাপন্ন হলো। এক সাথে ছুটে এলো দুতিনজন রক্ষী।
টাকার গরমে তোমার বুঝি পা মাটিতে পড়তে চাইছে না? হুঙ্কার ছাড়লো একজন। তোমার এত বড় স্পর্ধা, যিনি আগে এসে জায়গা দখল করেছেন তাঁকে সরিয়ে দিতে চাও! গরীবদের কাছ থেকে সুদ খেয়ে পেট মোটা করেছো, ঐ মোটা পেট নিয়ে ঘরের অন্ধকারে বসে থাকোগে, যাও। বাইরে এসে গোলমাল পাকানোর চেষ্টা কোরো না। নইলে তোমার ঐ মোটা পেট আর মোটা থাকবে না, চিমসে হয়ে যাবে।
অন্য রক্ষীরা সায় দিলো তার কথায়। সমবেত দর্শকদের ভেতর থেকেও কয়েকজন হৈ-চৈ করে উঠলো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন! ব্যাটা ইহুদীর বাচ্চার এত বড় সাহস!
আইজাক বুঝলেন, পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধার নয়। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে সাহায্য করার মতো কাউকে দেখতে পেলেন না। অগত্যা মেয়েকে নিয়ে মানে মানে কেটে পড়ার কথা ভাবলেন তিনি। এই সময় ট্রাম্পেটের আওয়াজে মুখর হয়ে উঠলো আকাশ। শোরগোল উঠলো দর্শকদের ভেতর। রাজকুমার জন তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে এসে পড়েছেন। সবাই ঘুরে তাকালো তার দিকে।
রাজকুমারের সঙ্গী সাথীর সংখ্যা কম নয়। নানা শ্রেণীর, নানা পেশার লোক তারা। পোশাক আশাকেও তেমনি বৈচিত্র্য। প্রায়োর অ্যায়মার তাদের অন্যতম। আজ তার পরনে স্বর্ণখচিত মূল্যবান পোশাক। অন্যদের ভেতর আছেন রাজকুমারের প্রিয় কয়েকজন সেনানায়ক, কয়েকজন অত্যাচারী ব্যারন, লম্পট অনুচর, কয়েকজন নাইট টেম্পলার আর সেইন্ট জন গির্জার নাইট।
নাইট টেম্পলার এবং সেইন্ট জন গির্জার সাথে জড়িত নাইটরা প্যালেস্টাইনে থাকতে সব সময়ই রাজা রিচার্ডের বিরোধিতা করেছেন। যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে রিচার্ড যে সিদ্ধান্তই নিয়েছেন, ভুল হোক ঠিক থোক, তাদের পছন্দ হয়নি। এর একটা কারণ সম্ভবত রিচার্ডকে ব্যক্তিগতভাবে তাদের কেউই পছন্দ করেন না। কারণ রিচার্ড নরম্যান গোত্রের লোক হওয়া সত্ত্বেও স্যাক্সন নরম্যানে কোনো ভেদ কখনো করেননি। একজন নরম্যানকে তিনি যে চোখে দেখেন স্যাক্সনকেও সে চোখেই দেখেন। ব্যাপারটা কিছুতেই মানতে পারেন না নরম্যান নাইট, নাইট টেম্পলাররা। ফলে রিচার্ডের সঠিক সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন তারা। আর এ কারণেই ব্যর্থ হয়েছে এবারের ক্রুসেডও। সিরিয়ার সুলতানের সাথে সন্ধি করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে খ্রীষ্টান পক্ষকে।
রিচার্ড এখনো দেশে ফেরেননি। কোনো দিন যে ফিরবেন সে কথাও জোর করে কেউ বলতে পারে না। জনশ্রুতি, তাঁকে নাকি বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ফ্রান্সে। তবে তার বিরোধী অনেক নাইট, নাইট টেম্পলার ফিরে এসেছেন। এবং এসেই, রিচার্ডের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে শুরু করেছেন জনকে। জনের মানসিকতা রিচার্ডের ঠিক উল্টো। স্যাক্সনদের তিনি দুই চোখে দেখতে পারেন না, নরম্যানরাই তাঁর কাছে সব। তাছাড়া রিচার্ডের অনুপস্থিতিতে দেশ শাসন করে সিংহাসনের প্রতি একটা লোভ জন্মে গেছে তার। এই কবছর কারো কাছ থেকে কোনো বাধা না পেয়ে অস্বাভাবিক বিলাস ব্যসনের ভেতর জীবন কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তিনি। এখন যদি ভাই দেশে ফিরে শাসন ক্ষমতা কেড়ে নেন খুবই অসুবিধা হয়ে যাবে তাঁর। তাই হঠাৎ করে চার পাশে ভাইয়ের বিরোধী এতগুলো বীরকে পেয়ে খুশি হয়ে উঠেছেন জন। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন পাকাঁপাকি ভাবে সিংহাসনে বসার।
অত্যন্ত সুপুরুষ রাজকুমার জন। লাল আর সোনালিতে মেশানো জমকালো পোশাক পরনে। তেজী একটা ধূসর রঙের ঘোড়ায় চেপে তিনি আসছেন। পেছনে তাঁর সঙ্গীরা।
প্রথমেই ধীর গতিতে ঘোড়া চালিয়ে প্রতিযোগিতা স্থানটার চারপাশে একটা চক্কর লাগালেন জন। মেজাজটা আজ তাঁর খুব ভালো। মহিলাদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন তাঁদের। কাকে আজকের সৌন্দর্য ও প্রেমের রানী করা যায় ভাবছে। হঠাৎ নজরে পড়লো ভীড়ের ভেতর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন আইজাক। সঙ্গে এক তরুণী। তরুণীর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন জন। তাঁর মনে হলো, সারা ইংল্যান্ডে এমন সুন্দরী দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ। মুখে প্রকাশ করতেও ছাড়লেন না সে কথা।
এমন রূপ দেখে সাধু সন্ন্যাসীদেরও মন ভোলে, কি বলেন, ফাদার? প্রায়োর অ্যায়মারের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন।
কি বলছেন, মহানুভব! বিস্ময় প্রকাশ করলেন ফাদার। ও তো ইহুদীর মেয়ে!
ইহুদী হোক আর যে-ই হোক, অমন সুন্দরীর স্থান এই ভীড়ের ভেতর হতে পারে না, ওর জন্যে আসমের ব্যবস্থা করতে হবে। আইজাকের কাছে গিয়ে জন জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটি কে
আজানু নত হয়ে কুর্নিশ করলেন আইজাক। মহানুভব, এ আমার মেয়ে রেবেকা।
আচ্ছা! তোমার মেয়ে! সামনে একটা আসনে বসে থাকা এক লোকের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লেন জন, এই, কে ওখানে? সরে বসো, এদের বসার জায়গা করে দাও।
লোকটা, একজন স্যাক্সন। সেড্রিকের দূর সম্পর্কের আত্মীয় এবং সুহৃদ কনিংসবার্গের অ্যাথেস্টেন। ইংল্যান্ডের শেষ স্যাক্সন রাজার বংশধর বলে সমাজে তার বিশেষ মর্যাদা আছে। জনের কথা শুনে রীতিমতো অপমানিত বোধ করলো সে। একটু বিব্রতও হলো। সরে বসার কোনো লক্ষণ না দেখিয়ে সে তাকিয়ে রইলোরাজপুত্রের দিকে। চোখে ক্ষুব্ধ দৃষ্টি।
অ্যাথেলস্টেন-এর এই ঔদ্ধত্যে ভয়ানক চটে গেলেন জন।
এই, গর্দভ, আমার কথা কানে ঢোকেনি? চিৎকার করলেন তিনি। তারপর এক সঙ্গীকে হুকুম দিলেম, বর্শার ডগা দিয়ে ঠেলে ওকে সরিয়ে দাও তো, দ্য ব্রেসি।
হুকুম পাওয়া মাত্র তামিল করতে লেগে গেল দ্য ব্রেসি। বর্শা বাগিয়ে ছুটলো অ্যাথেলস্টেনের দিকে। এবার আর বসে রইলো না অ্যাথেলস্টেন, চট করে সরে গেল এক পাশে। কাছেই বসে ছিলেন সেড্রিক। দ্য ব্রেসিকে। ছুটে আসতে দেখে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন তিনি। খাপ থেকে তলোয়ার বের করে সর্বশক্তিতে চালালেন ব্রেসির বর্শা লক্ষ্য করে। দুটুকরো হয়ে গেল বর্শাটা। এক টুকরো ব্রেসির হাতে ধরা রইলো, ফলা সহ অন্য টুকরোটা ছিটকে পড়লো মাটিতে।
ভয়ঙ্কর রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো জনের। চিৎকার করে সেড্রিকের জন্যে কিছু একটা শাস্তি ঘোষণা করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সঙ্গীদের, বিশেষ করে প্রায়োর অ্যায়মারের কথায় সামলে নিলেন। এদিকে সেড্রিকের দুঃসাহস দেখে উপস্থিত স্যাক্সনরা খুব খুশি। রাজপুত্র জনের সামনেই অনেকে বলাবলি করছে, জমিদার আজ কাজের মতো কাজ করেছে একটা।
সহচরদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন জন, কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। পাকাঁপাকিভাবে সিংহাসনে বসতে হলে এদের সমর্থন তাঁর লাগবে। এদিকে সেড্রিকের অপমানটা মুখ বুজে হজম করে ফেলতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। মনের ঝালটা অন্য কার ওপর ঝাড়া যায় ভাবছেন, এমন সময় চোখ পড়লো এক তীরন্দাজের ওপর। লোকটা এখনো চিৎকার করে বাহবা দিচ্ছে সেড্রিককে। তার দিকে এগিয়ে গেলেন রাজপুত্র।
এই, এমন উল্লুকের মতো চিৎকার করছো কেন? কৈফিয়ত চাইলেন তিনি।
বুক টান করে উঠে দাঁড়ালো লোকটা।
তীর ছোঁড়া বা তলোয়ার চালানোয় কেউ যখন সত্যিকারের নৈপুণ্য দেখায় আমি তার প্রশংসা করি, বললো সে। এটা আমার স্বভাব।
মনে হচ্ছে তুমিও পাকা তীরন্দাজ! এক দফা পরীক্ষা হয়ে যাবে নাকি?
আমি রাজি। যখন খুশি।
আরে, এ দেখছি আর এক ওয়াট টাইরেল! পেছন থেকে কে একজন মন্তব্য করলো। কে, তা অবশ্য বোঝা গেল না।
রাজপুত্র জনের এক পূর্বপুরুষ দ্বিতীয় উইলিয়াম নিউ ফরেস্ট জঙ্গলে নিহত হয়েছিলেন তীরবিদ্ধ হয়ে। তীর ছুঁড়েছিলো ওয়াট টাইরেল নামের এক তীরন্দাজ। কথাটা জানা ছিলো জনের। মন্তব্যটা শুনে মনে মনে একটু সন্ত্রস্ত বোধ করতে লাগলেন তিনি। তাড়াতাড়ি তার দেহরক্ষী দলের প্রধানকে ডেকে নিচু কণ্ঠে বললেন, ঐ লোকটার দিকে নজর রেখো। তারপর তীরন্দাজের দিকে ফিরে যোগ করলেন, তা বেশ, তুমি যখন এতই ওস্তাদ তীর ছোঁড়ায়, সময় মত পরীক্ষা করা যাবে।
বললাম তো, রাজি, যখন খুশি।
হয়েছে, হয়েছে। আগে এই ইহুদী আর তার মেয়েকে বসার জায়গা করে দাও। আমি যখন বলেছি ওরা ওখানে বসবে, ওরা বসবে। আমার কথার নড়চড় হবে না।
আইজাকের দিকে তাকালেন জন, যাও, ওখানে গিয়ে বসো। নইলে তোমার পিঠের চামড়া আমি তুলে নেব।
ভয়ে ভয়ে গ্যালারির দিকে এগোলেন বৃদ্ধ।
জন আবার চিৎকার করে উঠলেন, কে ওকে বাধা দেয় আমি দেখতে চাই!
সেড্রিক তৈরি হয়েই ছিলেন, আইজাক গ্যালারিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবেন তাঁকে। ব্যাপারটা চোখ এড়ায়নি রাজপুত্রের। সেজন্যেই তিনি হুমকির সুরে বললেন শেষের কথাগুলো। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হলো না। সেড্রিক যেমন ছিলেন তেমনি তৈরি হয়েই রইলেন, গ্যালারিতে ওঠামাত্র ঠেলে ফেলে দেবেন আইজাককে। কারো বুঝতে বাকি রইলো না, বেশ একটা গোলমাল পাকিয়ে উঠতে যাচ্ছে। কাছেই বসে আছে ওয়াম্বা। ও-ও বুঝতে পেরেছে গণ্ডগোল একটা লাগতে যাচ্ছে। এবং ফলাফল যে ওর মনিবের জন্যে মোটেই শুভ হবে না তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল ওর মাথায়।
আমি বাধা দেবো, মহানুভব! লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো ওয়াম্বা।
ভ্রুকুটি করে তাকালেন রাজপুত্র। কিন্তু ওয়াম্বা গ্রাহ্যই করলো না তার কুটি। শরীরের পাশে ঝোলানো থলে থেকে রোস্ট করা একটা আস্ত শুয়োরের ঠ্যাং বের করতে করতে এগিয়ে এলো সে আইজাকের কাছে।
টুর্নামেন্ট শেষ হতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে?–এই ভেবে, ওয়ান্ডা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো শুয়োরের ঠ্যাংটা। কাছে এসে ওটা উঁচু করে, ধরলো আইজাকের নাকের সামনে।
শুয়োরের মাংস ইহুদীদের কাছে অত্যন্ত অপবিত্র জিনিস। গন্ধ পেয়েই ওয়াক ওয়াক করতে করতে ছিটকে পেছনে সরে এলেন আইজাক। ওয়াম্বা এই ফাঁকে কোমর থেকে তার কাঠের তলোয়ারটা খুলে এলোপাথাড়ি ঘোরাতে লাগলো বৃদ্ধ ইহুদীর মাথার ওপর। চমকে উঠে আরো খানিকটা পিছিয়ে এলেন আইজাক। তারপর হোঁচট খেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে। সমস্ত দর্শক তাঁর এই দুর্দশা দেখে হেসে উঠলো হো হো করে। রাজপুত্র জনও যোগ দিলেন সে হাসিতে। একটু আগের থমথমে আবহাওয়াটা কেটে গেছে।
এবার আমার পুরস্কার দিন। একহাতে কাঠের তলোয়ার অন্য হাতে শুয়োরের ঠ্যাং ঘোরাতে ঘোরাতে জনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ওয়াম্বা। শত্রুকে আমি যুদ্ধ করে হারিয়েছি।
রাজপুত্র তখনও হাসছেন।
খুর বীরত্ব দেখালে যাহোক, হাসতে হাসতে বললেন তিনি। তা তোমার পরিচয়টা কী?
আমার নাম ওয়াম্বা। বাবার নাম উইটলেস। দাদার নাম ওয়েদার ব্রেন। পেশায় আমি ভঁড়।
বেশ বেশ। তাহলে এই ইহুদীটাকে গ্যালারির নিচের দিকে একটু জায়গা করে দাও আগে। তোমার কাছে যখন হেবেই গেছে তখন তোমার কাছাকাছি বসা ওর আর সাজে না।
বোকার জন্যে জোচ্চোর সাংঘাতিক। তার চেয়েও সাংঘাতিক শুয়োরের মাংসের কাছে ইহুদীর থাকা।
বাহ, বেশ বলেছো তো! রসজ্ঞান আছে তোমার। দাঁড়াও পুরস্কারের ব্যবস্থা করছি তোমার জন্যে। আইজাকের দিকে তাকালেন জন। কয়েকটা স্বর্ণমুদ্রা দাও তো আমাকে।
হতভম্ব হয়ে গেলেন আইজাক। এদিকে রাজপুত্রের আদেশ অমান্য করবেন সে সাহসও নেই। টাকার থলেতে হাত রেখে ভাবছেন কি করবেন। কিন্তু তাকে বেশিক্ষণ ভাবার সময় দিলেন না জন। নিজেই একটু এগিয়ে হ্যাচকা টানে কেড়ে নিলেন বৃদ্ধের টাকার থলেটা। মুখ খুলে দুটো স্বর্ণমুদ্রা বের করে ছুঁড়ে দিলেন ওয়াম্বার দিকে। তারপর ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলেন অন্য দিকে। থলেটা ফেরত দেয়ার কথা ভুলে গেলেন বেমালুম। মেয়ের হাত ধরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলেন বেচারা আইজাক। দর্শকরা ঠাট্টা মশকরা শুরু করেছে তাদের নিয়ে।
.
আসল কথাটাই আমরা ভুলে গেছি, নিজের আসনের দিকে যেতে যেতে প্রায়োর অ্যায়মারকে বললেন জন। আজকের টুর্নামেন্টে প্রেম ও সৌন্দর্যের রানী কে হবে? আমাকে যদি ঠিক করতে বলেন, আমি কৃষ্ণনয়না রেবেকার নাম প্রস্তাব করবো?
ও ঈশ্বর! আতঙ্কিত স্বরে আর্তনাদ করে উঠলেন প্রায়োর। একজন ইহুদীকে এই সম্মানিত আসনে বসাবেন!
তাতে ক্ষতিটা কি?
ক্ষতি কিছু নেই, তবে প্রজারা সব ক্ষেপে উঠবে। একজন বিধর্মীকে প্রেম ও সৌন্দর্যের রানী হিশেবে মেনে নিতে পারবে না কেউ। আমাদের নরম্যান সুন্দরীদের কথা না হয় বাদই দিলাম, স্যাক্সন তরুণী রোয়েনাও অনেক বেশি সুন্দরী এই রেবেকার চেয়ে। আমাকে যদি বলেন, আমি রোয়েনার নাম প্রস্তাব করবো।
ঐ একই কথা হলো, বললেন জন। শুয়োরে আর কুকুরে যেমন তফাৎ নেই ইহুদী আর স্যাক্সনেও তেমনি কোনো পার্থক্য নেই। দুই-ই সমান আমার কাছে। সে জন্যেই বলছি রেবেকাকেই নির্বাচিত করুন, স্যাক্সন কুত্তাগুলো জব্দ হবে তাহলে।
রাজপুত্রের মুখে এমন ইতরের মতো কথা শুনে তাঁর সঙ্গীদের অনেকেই অসম্ভষ্ট হলেন। স্যাক্সনদের যারা দুচক্ষে দেখতে পারেন না তারা পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে গেলেন। স্যাক্সনদের তারা নিচু ভাবেন সন্দেহ নেই, তাই বলে ইহুদীদের মতো?
নরম্যান নাইট দ্য ব্রেসি তো মুখের ওপর বলেই ফেললো, এভাবে স্যাক্সনদের অপমান করলে ফল ভালো হবে বলে মনে হয় না।
এর চেয়ে বোকামি আর কিছু হতে পারে না, রাজপুত্রের এক বয়স্ক সহচর ওয়াল্ডেমার বললেন। আপনার সব পরিকল্পনাই পও হবে, আপনি নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনবেন, রাজপুত্র।
গম্ভীর হয়ে উঠলোজনের মুখ।
দেখুন আপনাদের আমি সাথে এনেছি আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে, উপদেশ দেয়ার জন্যে নয়, বললেন তিনি।
আমরা যারা আপনার সাথে, আপনার পক্ষে আছি, আপনার সব কাজে সহায়তা করছি, তারা মনে করি, আপনার এবং আমাদের সবার স্বার্থেই আপনাকে পরামর্শ দেয়ার অধিকার আমাদের আছে।
যে সুরে কথাগুলো বলা হলো, জন পরিষ্কার বুঝতে পারলেন অহেতুক গোয়ার্তুমি করলে ফল ভালো হয়ে না। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে হেসে উঠলেন তিনি।
আপনারা ঠাট্টাও বোঝেন না! আমি যাবো বিধর্মী ইহুদীর মেয়েকে এই সম্মানের আসন দিতে? আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে। আপনারা সবাই মিলে কাউকে নির্বাচিত করুন।
আমার মনে হয় নির্বাচনটা আপাতত বন্ধ থাক, বললো দ্য ব্রেসি। আজ যিনি বিজয়ী হবেন তার ওপরেই ছেড়ে দেয়া যাবে নির্বাচনের ভার। তাতে বিজয়ীর প্রতি সম্মান দেখানোও হবে, নির্বাচন নিয়ে বিতর্কেরও সৃষ্টি হবে না।
খুব ভালো প্রস্তাব, প্রায়োর অ্যায়মার বললেন। আমি এ প্রস্তাব সমর্থন করছি।
আমরাও, বললেন ওয়ার্ল্ডেমার। এবার শুরু করতে হয় প্রতিযোগিতা। দর্শকরা সব অস্থির হয়ে উঠেছে।
রাজপুত্র জন আর কথা না বাড়িয়ে সিংহাসনে বসলেন। হাত উঁচিয়ে ইশারা করতেই বেজে উঠলো ট্রাম্পেট। একজন ঘোষক এগিয়ে এলো সামনে। উচ্চ কণ্ঠে সে পড়ে শোনাতে লাগলো প্রতিযোগিতার নিয়মকানুন:
প্রথমত, যিনি-ই প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে চাইবেন, আজকের পাঁচ চ্যালেঞ্জারের যে কোনো একজনের সাথে তাকে লড়তে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী তার পছন্দমতো চ্যালেঞ্জারকে বেছে নিতে পারবেন। নিজের পছন্দ তিনি ঘোষণা করবেন চ্যালেঞ্জারের ঢালে তাঁর বর্শা ছুঁইয়ে। বর্শার ফলা দিয়ে যদি ছোঁয়া হয়, লড়াই চলবে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর অন্তত একজন নিহত না হওয়া পর্যন্ত। আর যদি বর্শার বাঁট দিয়ে স্পর্শ করা হয়, লড়াই চলবে অন্তত একজন আহত না হওয়া পর্যন্ত।
দ্বিতীয়ত, প্রথম দিনের প্রতিযোগিতায় যিনি বিজয়ী হবেন তিনি পুরস্কার হিশেবে পাবেন একটি যুদ্ধের ঘোড়া। সৌন্দর্য ও প্রেমের রানী নির্বাচনের সম্মানও তিনি লাভ করবেন।
তৃতীয়ত, আগামীকাল অনুষ্ঠিত হবে সাধারণ প্রতিযোগিতা। যে কোনো নাইটই তাতে যোগ দিতে পারবেন। সমান সংখ্যার দলে বিভক্ত হয়ে ভঁরা লড়বেন। যতক্ষণ না রাজপুত্র খামার নির্দেশ দেবেন ততক্ষণ চলবে লড়াই। রাজপুত্রের কাছে যিনি সবচেয়ে সাহসী বলে বিবেচিত হবেন তার মাথায় বিজয় মুকুট পরিয়ে দেবেন সৌন্দর্য ও প্রেমের রানী।
ঘোষণা শেষ হতেই গ্যালারির অভিজাত দর্শকরা স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা ছুঁড়ে দিতে লাগলেন ঘোষকের দিকে। এ ধরনের অনুষ্ঠানে আভিজাত্য দেখানোর এ-ই নিয়ম। যে ঘোষণা করেছে শুধু সে-ই না, তার সহযোগীরাও প্রতিযোগিতা স্থানের মাঝখানে এসে কুড়িয়ে নিচ্ছে মুদ্রাগুলো। সাধারণ দর্শক, যারা এভাবে মুদ্রা ছুঁড়ে দিতে পারছে না, তারা চিৎকার করছে আর হাততা লি দিচ্ছে মহা উল্লাসে।
ধীরে ধীরে থিতিয়ে এলো চিৎকার আর হাততা লির শব্দ। অভিজাতদের আভিজাত্যের প্রদর্শনী শেষ হয়েছে। যার যার জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ঘোষকরা। আগাগোড়া বর্মে মোড়া কয়েকজন অশ্বারোহী মার্শাল ধীর কদমে ঘোড়া চালিয়ে প্রবেশ করলো প্রতিযোগিতা স্থানে। দুপ্রান্তের প্রবেশ পথের পাশে দাঁড়িয়ে গেল তারা মূর্তির মতো। এবার শুরু হবে টুর্নামেন্ট। এক স্বরে বেজে উঠলো অনেকগুলো ট্রাম্পেট।
উত্তর দিকের প্রবেশ পথ দিয়ে পাঁচজন নাইট ঢুকলো প্রতিযোগিতা স্থানে। ঘাড় ঘুরিয়ে দুপাশের দর্শকদের দিকে তাকালো তারা। সামান্য মাথা নুইয়ে অভিবাদনের ভঙ্গি করলো। তারপর ধীরে ধীরে ঘোড় চালিয়ে এগোলো দক্ষিণের প্রবেশ পথের দিকে।
চ্যালেঞ্জারদের সুসজ্জিত তাঁবুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তারা। পঁচজন চ্যালেঞ্জারের পাঁচটা ঢাল সাজিয়ে রাখা পাঁচটা তাবুর সামনে। যে নাইট যে চ্যালেঞ্জারের মোকাবেলা করবে ঠিক করেছে সে তার ঢালে নিজের বর্শা ছোঁয়ালো। না, কেউই ফলা দিয়ে স্পর্শ করলো না, করলো বাঁট দিয়ে। অর্থাৎ প্রতিদ্বন্দ্বীদের কেউই মরণপণ করে লড়বে না, লড়বে প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে নিছক বীরত্ব প্রদর্শনের জন্যে।
প্রতিদ্বন্দ্বীদের বর্শা চ্যালেঞ্জারদের ঢাল স্পর্শ করতেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বেজে উঠলো ঢাক। লড়াই শুরুর সংকেত! পাঁচ প্রতিদ্বন্দ্বী ফিরে এলো উত্তর দিকে, তাদের নির্দিষ্ট জায়গায়। ঘোড়াগুলোকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো চ্যালেঞ্জারদের জন্যে।
এদিকে পাঁচ চ্যালেঞ্জার বেরিয়ে এসেছে যার যার তাঁবু থেকে। নিজের নিজের ঢাল তুলে নিয়ে ঘোড়ায় চাপলো তারা। ধীর কদমে ঘোড় চালিয়ে প্রবেশ করলো প্রতিযোগিতার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গায়। দর্শকরা আরেকবার ফেটে পড়লো উল্লাস আর করতালিতে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের সামনাসামনি একই ভঙ্গিতে ঘোড়াগুলোকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো চ্যালেঞ্জাররা।
রাজপুত্রের আরেকটা ইঙ্গিত পেলেই শুরু হবে লড়াই।
বিচারকমণ্ডলী তাকিয়ে আছেন রাজপুত্রের দিকে। রাজপুত্রও তাকিয়ে আছেন বিচারকদের দিকে। ঘাড় ঘুরিয়ে শেষবারের মতো একবার প্রতিদ্বন্দ্বীদের দিকে তাকালেন তিনি, চ্যালেঞ্জারদের দিকেও তাকালেন। হ্যাঁ, তৈরি সবাই। সম্মতি দেয়ার ভঙ্গিতে সামান্য মাথা নোয়ালেন জন।
ল্যাইসে অ্যালের! নরম্যান ভাষায় চিৎকার করে উঠলেন প্রধান বিচারক, অর্থাৎ, শুরু কর!
দুই সারি ঘোড়সওয়ার ভয়ঙ্কর বেগে ছুটলো একে অন্যের দিকে। প্রতিযোগিতা ক্ষেত্রের মাঝখানে এসে মিলিত হলো তারা। প্রত্যেকেই নিজের বর্শা দিয়ে প্রতিপক্ষের বর্মে আঘাত করার চেষ্টা করছে। দর্শকরা রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে। সবাই আশা করছে দারুণ একখানা লড়াই দেখতে পাবে। কিন্তু হতাশ হতে হলো তাদের। চ্যালেঞ্জাররা সত্যিই প্রতিদ্বন্দ্বী নাইটদের চেয়ে অনেক উঁচুদরের যোদ্ধা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চারজন প্রতিদ্বন্দ্বী পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হলো। একমাত্র ভাইপন্টের প্রতিদ্বন্দ্বীই কিছুক্ষণ টিকলো। দুজনের মধ্যে আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ চলতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত দুজনের বর্শাই যখন দুটুকরো হয়ে গেল, থামলো লড়াই।
বিচারকমণ্ডলী চ্যালেঞ্জারদেরই বিজয়ী বলে ঘোষণা করলেন। বুনো উল্লাসে ফেটে পড়লো দর্শকরা।
পরাজিত নাইটরা তাদের ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র বিজয়ীদের হাতে তুলে দিয়ে বিরস মুখে ফিরে গেল নিজেদের জায়গায়। চ্যালেঞ্জারদের ভৃত্যরা এসে সেগুলো নিয়ে রাখলো যার যার তাঁবুতে।
কিছুক্ষণ পর আরো পাঁচজন নাইট এগিয়ে এলো চ্যালেঞ্জারদের সাথে লড়বার জন্যে। তারাও অল্প সময়ের মধ্যেই পরাজিত হয়ে ফিরে গেল নিজেদের জায়গায়। এরপর এলো তৃতীয় দল। সেই একই পরিণতি তাদেরও। চতুর্থ দলে এলো মাত্র তিনজন। তারা ব্রায়ান ও রেজিনান্ডকে বাদ দিয়ে অন্য তিন চ্যালেঞ্জারের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলো। পরাজিত হতে হলো তাদেরও।
এরপর দীর্ঘ সময়ের বিরতি। চ্যালেঞ্জাররা বিশ্রাম নেবে। খোশগল্পে মেতে উঠলো দর্শকরা। যারা সঙ্গে খাবার দাবার এনেছে তারা খেয়ে নিলো। একটু আগে হয়ে যাওয়া লড়াই নিয়ে আলোচনা করছে অনেকে চ্যালেঞ্জারদের বিজয়ে তারা খুশি হতে পারেনি। বদ মেজাজের কারণে রেজিনাল্ড ও ম্যালভয়সিঁকে তারা দুচক্ষে দেখতে পারে না। বিদেশী বলে গ্র্যান্টমেনসিলকেও খুব একটা পছন্দ নয় কমরো। তাই মনে মনে ওদের পরাজয়ই কামনা করেছিলো তারা। কিন্তু ঘটছে উল্টো। সবাই আশা করছে, আগামী লড়াইতে নিশ্চয়ই কেউ একজন পরাজিত করতে পারবে চ্যালেঞ্জারদের কাউকে না কাউকে।
শেষ হলো বিরতি।
দর্শকরা আবার টগবগ করতে লাগলো উত্তেজনায়। নতুন করে লড়াই শুরু হতে যাচ্ছে। চ্যালেঞ্জাররা একে একে ঢুকলো প্রতিযোগিতার জাগায়। আগের মতোই পাশাপাশি সার বেঁধে দাঁড়ালো তারা। এবার প্রতিদ্বন্দ্বী নাইটরা চলে এলেই হয়।
কিন্তু কোথায় প্রতিদ্বন্দ্বী? একটা দুটো করে বেশ কয়েকটা মিনিট পেরিয়ে গেল। উত্তর দিক থেকে এগিয়ে এলো না কোনো নাইট। হতাশ হয়ে পড়তে লাগলো দর্শকরা। সেই সাথে বাড়তে লাগলো তাদের অস্থির চিৎকার।
সবচেয়ে হতাশ হলেন সেড্রিক। কারণ তার কাছে চ্যালেঞ্জারদের বিজয় মানে নরম্যানদের বিজয়। আর নরম্যানদের বিজয় মানে স্যাক্সনদের অপমান। সব ধরনের অস্ত্র চালনায় মোটামুটি পারদর্শী সেড্রিক। তবে টুর্নামেন্টে লড়ার জন্যে যে ধরনের দক্ষতা, দরকার তা তার নেই। তাই নিজে প্রতিযোগিতায় নামতে না পেরে মনে মনে উসখুস করছেন তিনি।
সেড্রিকের পাশেই বসে আছে স্যাক্সন রাজকুমার অ্যাথেলস্টেন। এ ধরনের লড়াইয়ে বিশেষ নৈপুণ্য আছে তার। কিন্তু এ মুহূর্তে প্রতিযোগিতায় নামার কোনো ইচ্ছা দেখা যাচ্ছে না অ্যাথেলস্টেনের ভেতর। সেড্রিক এতক্ষণ আকারে ইঙ্গিতে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছেন তাকে। কিন্তু লাভ হয়নি।
অ্যাথেলস্টেন, নরম্যানরা সব জিতে যাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত সেড্রিক সরাসরিই বললেন, স্যাক্সনদের পক্ষ থেকে তুমি লড়বে না?
শক্তিমান, সাহসী ও লড়াইয়ে নিপুণ হলেও একটু অলস প্রকৃতির মানুষ অ্যাথেলস্টেন। তাছাড়া উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা নামের মোহও তার নেই।
না, সেড্রিকের প্রশ্নের জবাবে সে বললো। কাল পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করবো। যদি লড়তেই হয়, তো তারপর লড়বো।
মনে মনে চুপসে গেলেন সেড্রিক। একটু ক্ষুন্নও হলেন। কিন্তু এ নিয়ে আর কথা বাড়ালেন না। বয়েসে ছোট হলেও অ্যাথেলস্টেনকে তিনি সমীহ করে চলেন।
দর্শকরা অপেক্ষা করছে। এখনও তারা আশা করছে, যে কোনো মুহূর্তে কোনো দুঃসাহসী নাইট এগিয়ে আসবে চ্যালেঞ্জারদের সাথে লড়াইয়ের জন্যে। অনেকে নিজেদের ভেতর বলাবলি করছে, এই সামান্য লড়াই দেখার জন্যে এতদূর আসাই ভুল হয়েছে। বৃদ্ধ নাইটরা আক্ষেপ করছেন, আজকালকার তরুণরা তারা যেমন ছিলেন তেমন সাহসী নয়। হারা জেতা পরের কথা, প্রতিযোগিতায় নামার সাহস তো আগে দেখাতে হবে।
এদিকে রাজপুত্র জন আজকের প্রতিযোগিতার সমাপ্তি ঘোষণা করার কথা ভাবছেন। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন, নাইট টেম্পলার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্টকেই সবচেয়ে সাহসী ও দক্ষ যোদ্ধা বলে ঘোষণা করবেন। বিচারকরাও যে সেই রায়ই দেবেন তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, মাত্র একটা বর্শা দিয়ে সে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধরাশায়ী করেছে। তৃতীয় প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে লড়ার সময়ও তাকে নতুন বর্শা নিতে হয়নি। সুতরাং দক্ষতায় সে যে শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হবে তাতে আর আশ্চর্য কি।
বিজয়ীর নাম ঘোষণা করার জন্যে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
০৫. তীক্ষ্ণ ট্রাম্পেটের আওয়াজ
হঠাৎ উত্তর দিকের তাঁবুগুলো থেকে ভেসে এলো তীক্ষ্ণ ট্রাম্পেটের আওয়াজ।
চমকে উঠলো দর্শকরা। ট্রাম্পেটের আওয়াজ মানে নতুন কোনো প্রতিযোগী আসছে। কে?
প্রতিটা চোখ তাকিয়ে আছে উত্তর প্রান্তের প্রবেশ পথের দিকে। তরুণ এক নাইট দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে এলো। বিশাল সুন্দর, তেজী একটা কালো ঘোড়ার পিঠে বসে আছে সে আবার জাগলো প্রশ্নটা দর্শকদের মনে, কে হতে পারে?
পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত বর্মে ঢাকা তরুণ নাইটের। সারা শরীর বর্মে ঢাকা থাকলেও টের পাওয়া যাচ্ছে মানুষটা খুব মোটা তাজা নয়। বরং একটু ক্ষীণদেহীই। হাতের ঢালে খোদাই করা একটা শিকড় সহ ওপড়ানো ওক গাছের ছবি। নিচে স্প্যানিশ ভাষায় লেখা একটা মাত্র শব্দ: দেসদিচাদো দুটো, অর্থ হতে পারে শব্দটার-মূলোৎপাটিত বা উত্তরাধিকার-বঞ্চিত।
ঘেরা জায়গাটার মাঝখানে চলে এলো সে। রাজপুত্র জন ও মহিলাদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বর্শা নিচু করে অভিবাদন জানালো। মাথাটা রহলো গর্বিত মোরগের মাথার মতোই খাড়া। দর্শকরা খুবই পছন্দ করলো তার এই ভঙ্গি। মহা উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো তারা।
বোয়া-গিলবার্টের সাথে লেগো না!
ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ-এর সাথে না!
দ্য ভাইপন্টকে বেছে নাও! ওকে কাবু করা সহজ হবে।
দীর্ঘদেহী অজানা এই নাইটের সাহসে মুগ্ধ দর্শকরা। অদ্ভুত এক মায়াও অনুভব করছে তার জন্যে। তাই আন্তরিকভাবে পরামর্শ দিচ্ছে। তারা।
এগিয়ে গেল নাইট চ্যালেঞ্জারদের দিকে। এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে বর্শার ফলা ছোঁয়ালো ব্রায়ানের তালে। অর্থাৎ দুজনের একজন মারা না যাওয়া পর্যন্ত সে লড়বে। আতঙ্কের এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল দর্শকদের শিরা উপশিরা দিয়ে। করলো কি তরুণ নাইট! টেম্পলার ব্রায়ানের মতো দুর্ধর্ষ যোদ্ধার ঢাল স্পর্শ করলো বর্শার ফলা দিয়ে!
ব্রায়ান নিজেও কম বিস্মিত হয়নি। এগিয়ে এসে তরুণ নাইটকে সে বললো, তোমার সাহসের তারিফ না করে পারছি না, নাইট। এখানে আসার আগে শেষবারের মতো প্রার্থনা করে এসেছো তো? না করলে এখনই করে নাও, নইলে জীবনে আর কখনো করার সুযোগ পাবে না।
দেখুন, স্যার টেম্পলার, দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলো তরুণ নাইট, মৃত্যুকে আমি আপনার চেয়ে কমই ভয় করি।
বেশ, তাহলে তৈরি হও, নাইট। সূর্যের দিকে, এই পৃথিবীর দিকে শেষবারের মতো একবার তাকিয়ে নাও। কাল আর এগুলো দেখার সৌভাগ্য তোমার হবে না।
আপনার পরামর্শের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। বিনিময়ে আপনাকেও একটা পরামর্শ দিচ্ছি, দয়া করে নতুন ঘোড়া আর নতুন বর্শা নিয়ে লড়াইয়ে নামুন। এখন যদি জেদ করে না-ও নেন, আমি বলছি, কিছুক্ষণের ভেতর আপনাকে নিতেই হবে।
আর অপেক্ষা করলো না নাইট। অদ্ভুত দক্ষতায় ঘোড়াটাকে ধীরে ধীরে পেছনে হাঁটিয়ে রণক্ষেত্রের উত্তর প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালো। ঘোড়া চালানোর এই নূতন কৌশল দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো দর্শকরা। করতালি আর উৎফুল্ল চিৎকারে মুখর হয়ে উঠলো চারদিক।
তরুণ নাইটের পরামর্শ শুনে প্রথমে খুব রেগে গেল ব্রায়ান। পরে ভেবে দেখলো, কথাটা নাইট ঠিকই বলেছে। এই ঘোড়া আর বর্শা নিয়েই একটু আগে তিন তিন জন যোদ্ধার মোকাবেলা করেছে সে। এখন আর এগুলোর ওপর ততটা নির্ভর করা ঠিক নয়। তাতে শত্রুকে খামোকা সুযোগ দেওয়া হবে। শেষ পর্যন্ত সে তার তাঁবুতে গিয়ে ঢুকলো।
তরুণ নাইট অপেক্ষা করছে। দর্শকরা অপেক্ষা করছে। অবশেষে বেরিয়ে এলো স্যার ব্রায়ান তাঁবুর ভেতর থেকে। তার হাতে নতুন একটা বর্শা। দেখা গেল ঢালটাও বদলে নিয়েছে সে। এটার ওপর খোদাই করা মড়ার খুলি ঠোঁটে একটা উড়ন্ত দাঁড়কাকের ছবি। নিচে লেখা: সাবধান, দাঁড়কাক করে দেবে। ভৃত্য নতুন একটা ঘোড়া নিয়ে এলো। চড়ে বসলো ব্রায়ান। ধীর কদমে দক্ষিণ দিকের প্রবেশ পথ পেরিয়ে প্রতিযোগিতা স্থানে এসে দাঁড়ালো টেম্পলারের ঘোড়া।
ট্রাম্পেটের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। প্রধান বিচারক চিৎকার করে উঠলেন:
লাইসে অ্যালের!
বিদ্যুৎচমকের মতো ছুটলো দুই নাইটের ঘোড়া একে অন্যের দিকে। মাঠের মাঝখানে মিলিত হলো দুজন। বজ্রগর্জন তুলে দুজনের ঢালে আঘাত হানলো দুজনের বর্শা। দুজনই এমন প্রচণ্ড শক্তিতে বর্শা চালিয়েছে যে দুজনেরটাই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। দুজনই ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়তে পড়তে সামলে নিলো কোনোমতে। হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে দুজন দুজনের দিকে।
দর্শকরা রুদ্ধশ্বাসে দেখছে। তাদের বেশির ভাগেরই ধারণা, যত নৈপুণ্যই দেখাক শেষ পর্যন্ত তরুণ মাইটকে হার স্বীকার করতেই হবে অভিজ্ঞ ব্রায়ানের কাছে। তবু তারা মুগ্ধ চোখে দেখছে তরুণের আক্রমণ।
বর্শা হারিয়ে দুই নাইটই ফিরে এসেছে যার যার জায়গায়। দুই প্রতিপক্ষ ও তাদের ঘোড়াদের বিশ্রাম দেয়ার জন্যে কয়েক মিনিটের বিরতি এখন।
বিরতি শেষ হলো রাজপুত্র জনের ইঙ্গিতে। নতুন বর্শা নিয়ে আবার দুই নাইট আক্রমণ করলো পরস্পরকে। আগের মতোই ভয়ঙ্কর বেগে ছুটলো ঘোড়াগুলো। এবার দুজনই সতর্ক আগের চেয়ে। তরুণ নাইটের ঢাল লক্ষ্য করে বর্শা চালালো ব্রায়ান। অচেনা নাইটও প্রতিদ্বন্দ্বীর ঢালে আঘাত করবে বলে বর্শা তুললো। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মত বদলালো সে। বর্শা চালালো টেম্পলারের শিরোম্রাণ লক্ষ্য করে। দুজনের বর্শাই তীব্র বেগে আঘাত করলো যার যার লক্ষ্যে। অচেনা নাইট প্রস্তুত ছিলো, নিজের ঢালটাকে সামান্য ঘুরিয়ে দিয়ে আঘাতটা সামলে নিলো সে। কিন্তু ব্রায়ান স্বপ্নেও ভাবেনি তার শিরোম্রাণের ওপর আঘাত আসতে পারে। আক্রমণটা সে ঠেকাতে পারলো না। ঘোড়ার ওপর চিৎ হয়ে গেল তার শরীর। উল্টে পড়তে পড়তে সামলে নিলো কোনোমতে টেম্পলার। কিন্তু কপাল খারাপ, ঠিক সেই মুহূর্তে ছিঁড়ে গেল তার জিনের বাধন ঘোড়া সমেত মাটিতে আছড়ে পড়লো বোয়া-গিলবার্ট।
সারা শরীর বর্মে ঢাকা থাকা সত্ত্বেও আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় উঠে দাঁড়ালো টেম্পলার। প্রতিহিংসায় পাগল হয়ে উঠেছে সে। দর্শকদের উৎফুল্ল চিৎকার আরো বাড়িয়ে দিয়েছে তার ক্রোধ। হ্যাচকা টানে বাপ থেকে তলোয়ার বের করে ছুটে গেল প্রতিপক্ষের দিকে। তরুণ নাইট তৈরিই ছিলো। ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়ে তলোয়ার বের করলো সে-ও। দর্শকরা থমকে গেছে। এবার শুরু হবে আসল লড়াই। নিশ্চয়ই দুজনের একজন না মরা. পর্যন্ত তলোয়ার যুদ্ধ চলবে।
কিন্তু না, চিৎকার করে লড়াই বন্ধের নির্দেশ দিলেন প্রধান বিচারক। এ ধরনের টুর্নামেন্টে তলোয়ারের লড়াই নিষিদ্ধ। মার্শালরা এগিয়ে এলো দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিরস্ত করতে।
আবার আমাদের দেখা হবে, ক্রোধকম্পিত কণ্ঠে বললো বোয়াগিলবার্ট। এবং সেদিন আমাদের থামানোর জন্যে কেউ থাকবে না!
আমার কোনো আপত্তি নেই, জবাব দিলো অচেনা নাইট। আপনার যখন যেখানে ইচ্ছা আমার মুখোমুখি হতে পারেন। খালি আমাকে আগে থাকতে একটু সংবাদ দেবেন, আমি নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে যাবো জায়গামতো। মাটিতে দাঁড়িয়ে বা ঘোড়ায় চড়ে; বর্শা, তলোয়ার বা কুঠার যা নিয়ে খুশি লড়তে চান, আমি রাজি। মনে রাখবেন, সেদিন আপনার মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না।
দেখা যাবে কে কাকে শুরু করলো টেম্পলার, কিন্তু শেষ করতে পারলো না। বিচারকমণ্ডলীর নির্দেশে মার্শালরা তাকে জোর করে নিয়ে গেল তার তাবুতে। তরুণ নাইটকেও নিয়ে যাওয়া হলো উত্তর দিকের একটা তাঁবুতে।
তাবুতে ঢুকেই এক পাত্র মদ চাইলো সে। কে আগে তাকে সন্তুষ্ট করবে তাই নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। শুধু ভৃত্য আর অনুচররাই নয় একটু আগে যেসব নাইট পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছে তারাও ছুটে এলো মদের পাত্র হাতে। একজনের হাত থেকে এক পাত্র মদ তুলে নিলো নাইট। পাত্রটা মুখের সামনে ধরে বললো:
এখানে খাঁটি ইংরেজ যারা উপস্থিত আছেন তাদের সম্মানে আমি পান করছি! জয় হোক ইংরেজ জাতির! নিপাত যাক সেই সব বিদেশী অত্যাচারী যারা দখল করে আছে আমাদের মাতৃভূমি, বলে মদের পাত্রে চুমুক দিলো তরুণ নাইট। অনুচরকে ডেকে নির্দেশ দিলো, আবার শিঙা বাজাও।
নতুন করে ট্রাম্পেট বেজে উঠতেই দর্শকরা উল্লাসে ফেটে পড়লো। আবার ট্রাম্পেট বাজছে, মানে আবার লড়াই হবে।
কয়েকজন ঘোষককে যেতে দেখা গেল বিজয়ী নাইটের তাঁবুর দিকে। একটু পরেই ফিরে এসে তারা ঘোষণা করলো: এইমাত্র যে তরুণ নাইট বিজয়ী হয়েছেন তিনি আবার পড়বেন। এবার আর তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচন করবেন না। প্রতিপক্ষের যিনিই আসবেন তার সাথেই তিনি লড়তে রাজি। যদি অপরাজিত চার চ্যালেঞ্জার পালা করে আসেন তাছেও তিনি রাজি। সবার সাথেই তিনি লড়বেন!
দক্ষিণের তাঁবু থেকে প্রথমে এলো বিশালদেহী রেজিনাল্ড ট্র্যত দ্য বোয়েফ। কুচকুচে কালো বর্ম তার শরীরে। বেশ কিছুক্ষণ সমানে সমানে লড়লো সে তরুণ নাইটের সঙ্গে। তারপর ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগলো তার আক্রমণের ধার। এবং শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়ে ফিরে গেল তাবুতে। এরপর একে একে এলো ম্যালভয়সিঁ, গ্র্যান্টমেনসিল এবং দ্য ভাইপন্ট। রেজিনান্ডের দশা হলো সবারই। ভাইপন্ট তো ঘোড়া থেকে পড়ে অজ্ঞানই হয়ে গেল। রক্ত পড়তে লাগলো তার নাক মুখ দিয়ে। কয়েকজন ভৃত্য ধরাধরি করে তাঁবুতে নিয়ে গেল অচেতন দেহটা।
রাজপুত্র জন উঠে দাঁড়ালেন অবশেষে। উত্তরাধিকার বঞ্চিত তরুণ নাইটকেই টুর্নামেন্টের প্রথম দিনের বিজয়ী বলে ঘোষণা করলেন।
দর্শকদের উল্লসিত চিৎকার আর করতালিতে মুখর হয়ে উঠলো আকাশ, বাতাস!
.
বিজয়ীকে অভিনন্দন জানানোর জন্যে এগিয়ে এলেন বিচারকরা। রাজপুত্রের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে আঁরা তাকে শিরোস্ত্রাণ খুলে ফেলার অনুরোধ জানালেন। সবিনয়ে অনুরোধটা প্রত্যাখ্যান করলো নাইট।
না, এক্ষুণি আমি শিয়োস্ত্রাণ খুলতে পারবো না, অসুবিধা আছে, বললো সে।
এ ধরনের প্রত্যাখ্যান অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। প্রায় প্রতি টুর্নামেন্টেই দুএকজন নাইট এমন করে থাকে। তবু রেগে গেলেন জন। পার্শ্বচরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন:
কে এই অহঙ্কারী নাইট?
মাথা নাড়লো পার্শ্বচর। কাছাকাছি যারা বসেছিলেন সবার দিকে একে একে তাকালেন রাজপুত্র। কিন্তু না, নাইটকে চেনে এমন কোনো আভাস দেখতে পেলেন না কারো চেহারায়। হঠাৎ ফিসফিস করে কে একজন বলে উঠলো:
সিংহ-হৃদয় রিচার্ড নন তো?
কথাটা কানে গেল রাজপুত্রের। শরীরের রক্ত তার হিম হয়ে আসতে চাইলো।
ওহ, ঈশ্বর! আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। ওয়াল্ডেমার, দ্য ব্রেসি, আপনাদের প্রতিশ্রুতির কথা মনে আছে তো? আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না!
দুশ্চিন্তা করবেন না, রাজপুত্র, ওয়ান্ডেমার বললেন। এই নাইট আর যে-ই হোক, আপনার ভাই নন। রিচার্ড আকার আয়তনে কমপক্ষে এর দ্বিগুণ হবেন।
শুনলেন বটে, কিন্তু স্বস্তি পেলেন না জন। বিজয়ীর হাতে যখন পুরস্কারের ঘোড়া তুলে দিচ্ছেন তখনও–দুরু দুরু করছে তার বুকের ভেতরটা। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা করছেন, এই বুঝি শোনা গেল রিচার্ডের গভীর গম্ভীর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর। সৌভাগ্য তার, তেমন কিছু ঘটলো না। উত্তরাধিকার বঞ্চিত নাইট মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো কেবল। সদ্য পাওয়া ঘোড়াটায় চড়ে বসলো সে। বর্শা সোজা করে ধরে মাঠের চারপাশে চক্কর দিতে লাগলো ধীর কদমে। দর্শকরা তালি বাজিয়ে, চেঁচিয়ে অভিনন্দিত করতে লাগলো তাকে।
মাঠ প্রদক্ষিণ শেষে আবার রাজপুত্রের সামনে এসে দাঁড়ালো নাইট। জন হাত তুলে আরেকটু সামনে এগোনোর নির্দেশ দিলেন তাকে। বললেন, স্যার নাইট, এবার তোমার কর্তব্য হবে আগামীকালের টুর্নামেন্টের জন্যে সৌন্দর্য ও প্রেমের রানী নির্বাচন করা। তোমার বর্শাটা একটু এগিয়ে দাও।
নিঃশব্দে নির্দেশ পালন করলো নাইট। বর্শার ফলার ওপর সবুজ রেশম আর সোনার তৈরি একটা মুকুট বসিয়ে দিলেন রাজপুত্র।
তরুণ নাইট ধীর গতিতে ঘোড়া চালিয়ে এগিয়ে গেল মহিলাদের গ্যালারির দিকে। অপূর্ব একটা মুখ খুঁজছে তার দুচোখ। সে মুখ রোয়েনার। কিন্তু কোথায় রোয়েনা? অন্য মহিলাদের ওপর নাইটের দৃষ্টি পড়তেই অনেকের গাল লাল হয়ে উঠলো, অনেকে গর্বিত ভঙ্গিতে মুখ ঘুরিয়ে নিলো, অনেকে সলজ্জ হেসে নামিয়ে নিলো চোখ।
অবশেষে লেডি রোয়েনাকে দেখতে পেলো সে। সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নাইট। আস্তে আস্তে বর্শার মাথাটা নামিয়ে এনে মুকুটটা রাখলো রোয়েনার পায়ের কাছে।
বাজনা বেজে উঠলো। ট্রাম্পেটের আওয়াজ ছিঁড়ে ফেলতে চাইলো আকাশ। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপরই আবার সব চুপ। দুএকজন দর্শকের বিচ্ছিন্ন চিৎকার শোনা যাচ্ছে কেবল। ঘোষক এগিয়ে এসে সৌন্দর্য ও প্রেমের রানী হিশেবে ঘোষণা করলো রোয়েনাকে।
একজন স্যাক্সন তরুণীকে সৌন্দর্য ও প্রেমের রানী নির্বাচিত করায় ক্ষেপে গেলেন অনেক নরম্যান মহিলা। আর সাধারণ দর্শকরা স্রেফ বুনো হয়ে উঠলো খুশিতে।
রাজপুত্র জন আসন ছেড়ে এগিয়ে এলেন রোয়েনার কাছে।
এবার আপনি আপনার সম্মানিত আসন গ্রহণ করুন, বললেন তিনি।
ধন্যবাদ, রাজপুত্র, রোয়েনার হয়ে জবাব দিলেন সেড্রিক। কিন্তু আজ নয়, কাল রোয়েনা নিজেই তার আসনে গিয়ে বসবে।
সেড্রিকের কথায় ভয়ানক অপমানিত বোধ করলেন জন। চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো। তবু তিনি কিছু বললেন না। বলা ভালো, বলার সাহস পেলেন না। উপস্থিত হাজার হাজার দর্শকের বেশির ভাগই স্যাক্সন। স্যাক্সনদের জাদরেল নেতা সেড্রিককে কিছু বললে ওরা চুপ করে থাকবে বলে মনে হয় না। শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে যে কজন রক্ষী আছে, জনতা ক্ষেপে উঠলে পাড়িয়েই মেরে ফেলবে তাদের।
নিঃশব্দে অপমানটা হজম করলেন জন। নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, প্রথম দিনের টুর্নামেন্ট শেষ হলো।
০৬. নিজের তাঁবুতে ফিরে বিজয়ী নাইট
নিজের তাঁবুতে ফিরে বিজয়ী নাইট দেখলে অনেকেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার জন্যে। সবাই বর্ম খোলায় তাকে সাহায্য করতে চাইলো। সে আজ ওদের সম্মান বাঁচিয়েছে। তাছাড়া সে আসলে কে তা জানার আগ্রহও তাদের কম নয়।
কিন্তু সবাইকেই সবিনয়ে ফিরিয়ে দিলো নাইট। বললো, আপনারা কেন খামোকা কষ্ট করবেন? আমার ভূত্যই যথেষ্ট আমাকে সাহায্য করে জন্যে।
হতাশ মনে সবাই চলে গেল তবু ছেড়ে। তরুণ নাইটের ভূত এগিয়ে এলো তাবুর প্রবেশমুখটা বন্ধ করে দিলো। মনিবের গা থেকে একে একে খুলে নিতে লাগলো যুদ্ধের পোশাকু।
বোকা বোকা চেহারা ভূত্যের। মাথায় এক ধরনের নরম্যান টুপি, যাতে তার মুখের বেশিরভাগই ঢাকা পড়ে গেছে। প্রভুর মতো সে-ও বোধহয় সবার অচেনাই থাকতে চায়।
বর্ম শিরোস্ত্রাণ ছেড়ে হালকা পোশাক পরে নিলো নাইট। তারপর খেতে বসলো। খাওয়া সবেমাত্র শেষ হয়েছে, ভৃত্য এসে জানালো, পাঁচজন লোক তার সাথে দেখা করতে চায়। তাদের সবাই একটা করে যুদ্ধের ঘোড়া নিয়ে এসেছে সাথে করে।
তাড়াতাড়ি মুখের ওপর হুড টেনে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো নাইট।
লোক পাঁচজন আর কেউ নয়, পরাজিত পাঁচ চ্যালেঞ্জারের পার্শ্বচর। পরাজিত নাইটদের ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র বিজয়ীর হাতে তুলে দিতে এসেছে। বিজয়ী নাইট হয় ওগুলো রেখে দেবে নয়তো ওগুলোর বদলে উপযুক্ত মূল্য গ্রহণ করবে।
আমার নাম বদোয়া, প্রথমজন বললো, স্যার ব্রায়ান দ্য বোয়াগিলবার্টের পার্শ্বচর আমি। আমার প্রভু আজকের টুর্নামেন্টে যে ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেছেন সেগুলো তুলে দিতে এসেছি আপনার হাতে। টুর্নামেন্টের নিয়ম অনুযায়ী হয় আপনি ওগুলো গ্রহণ করবেন, না হয় আমার প্রভুকে আবার ওগুলো আপনার কাছ থেকে কিনে নেয়ার সুযোগ দেবেন।
অন্য চারজনও একই কথা বললো। তারপর তারা অপেক্ষা করতে লাগলো বিজয়ীর সিদ্ধান্ত শোনার জন্যে।
তোমাদের চারজনের জন্যে আমার একই জবাব, বদোয়া ছাড়া অন্য চার পার্শ্বচরের দিকে তাকিয়ে বললো নাইট। তোমাদের প্রভুদের ঘোড়া এবং অস্ত্রশস্ত্র আমি নেবো না। ওগুলোর কোনো প্রয়োজন আমার নেই। তবে, আমি গৃহহীন এবং কপর্দকশূন্য, ওগুলোর বিনিময়ে উপযুক্ত মূল্য দিলে আমি নিতে পারি।
আমাদের ওপর নির্দেশ আছে, ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র যদি আপনি না নিতে চান, এত্যকে একশো করে স্বর্ণমুদ্রা দেবে আপনাকে। টাকা আমরা সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছি।
ওরে বাবা, সে তো অনেক! জবাব দিলো নাইট। না, না, অত আমার দরকার নেই। অর্ধেক দাও আমাকে। বাকি অর্ধেক তোমরা রেখে দাও। ইচ্ছে হলে মনিবদের ফেরত দিও, না হলে রেখে দিও নিজেরা।
এত পুরস্কার পাবে কল্পনাও করেনি পার্শ্বচররা। মাথা নুইয়ে তারা সম্মান ও কৃতজ্ঞতা জানালো।
তরুণ নাইট এবার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্টের অনুচরের দিকে ফিরলো।
তোমার মনিবের কাছ থেকে আমি কিছুই নেবো না, বললো সে। ঘোড়া এবং অস্ত্রশস্ত্র তো নয়-ই, টাকাও না। ওর সাথে আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখনও শেষ হয়নি। তোমার প্রভুকে বোললা, এর পরের বার যখন আমরা লড়বো, দুজনের একজন অবশ্যই মরবে। সেই একজন তোমার প্রভুরই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আপনি নেন না নেন এগুলো আমি এখানেই রেখে যাবো, বললো বদোয়া। নিয়ম অনুযায়ী এসব এখন আপনার সম্পত্তি। আমার মনিব আর কখনও এগুলো ব্যবহার করবেন না।
বেশ, তোমার মনিব যদি না নিতে চায় তুমিই নিয়ে নাও। আমি দিচ্ছি তোমাকে।
ব্যাপারটা রীতিমতো অপ্রত্যাশিত দোয়ার কাছে। অন্য চার ভৃত্যের মতো সে-ও শতকণ্ঠে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানালো তরুণ নাইটকে। তারপর সঙ্গীদের নিয়ে চলে গেল নিজেদের তাবুতে।
এ পর্যন্ত ভালোই চললো, কি বললা, গাৰ্থ? নিজের ভৃত্যের দিকে তাকিয়ে বললো নাইট। স্যাক্সন নাইটরা কি করতে পারে দেখিয়ে দিয়েছি কি না?
তা আর বলতে? আমার ভূমিকাটা কেমন হলো বলুন তো? শুয়োর চরানো স্যাক্সন রাখাল, অভিনয় করলাম নরম্যান চাকরের, মোটামুটি উত্তরে গেছি তাই না?
উৎরে গেছ মানে? তুখোড় অভিনয় করেছো তুমি। তবে আমার ভয় কি জানো?-কবে না তুমি ধরা পড়ে যাও।
কি যে বলেন! ওয়াম্বা ছাড়া আর কারো সাধ্য নেই আমাকে ধরে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
বেশ তা না হয় থাকলাম, কিন্তু, গাৰ্থ, এবার যে আরেকটা কাজ করতে হবে তোমাকে।
একটা কেন একশোটা বলুন।
একশো না, আপাতত এই একটা করো, তাতেই চলবে। একটা থলে দিলো নাইট গার্থের হাতে। এই থলেটা ইহুদী আইজাককে দিতে হবে, পারবে?
খুব পারবো, কোথায় আছে বুড়ো?।
অ্যাশবিতেই। কিন্তু কার বাড়িতে আমি জানি না, তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে। ওর কাছ থেকে আমি যুদ্ধের ঘোড়া, অস্ত্র, পোশাক সব ধার করেছি। কথা ছিলো ওগুলো ফেরত দিতে না পারলে দাম দেবো। এই থলেতে আশি স্বর্ণমুদ্রা আছে। তুমি গিয়ে দিয়ে এসো।
এ আর এমন কি কাজ, আমি এক্ষুণি রওনা হচ্ছি।
এই নাও আরো দশ স্বর্ণমুদ্রা, এগুলো তোমার।
.
অ্যাশবির এক ধনী ইহুদীর বাড়িতে উঠেছেন আইজাক মেয়ে রেবেকাকে নিয়ে।
শহরের লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঠিকই বাড়িটা খুঁজে বের করে ফেললো গাৰ্থ। যখন সে বাড়িটার সামনে, ঘোড়া থেকে নামলো তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। ওর টোকার জবাবে এক ভৃত্য এসে দরজা খুললো।
ইয়র্কের আইজাক আছেন এ বাড়িতে? জিজ্ঞেস করলো গাৰ্থ।
হ্যাঁ।
গিয়ে বলল, আমি তার সাথে দেখা করতে চাই।
আপনি দাঁড়ান, আমি বলছি গিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে গেল ভৃত্য।
এক খ্রীষ্টান আপনার সাথে দেখা করতে চায়, আইজাকের কাছে গিয়ে বললো ভৃত্য।
ভেতরে নিয়ে এসো, বললেন বৃদ্ধ।
দোতলার চমৎকার সাজানো গোছানো একটা কামরায় নিয়ে যাওয়া হলো গাৰ্থকে। কয়েকটা রূপার লণ্ঠনের আলোয় আলোকিত ঘরটা। মাথার টুপিটা একটু টেনে দিলো গার্থ। এতক্ষণ কেবল চোখ ঢাকা ছিলো, এবার নাক ও মুখের খানিকটাও ঢাকা পড়ে গেল।
বৃদ্ধকে চেনে গাৰ্থ। তবু জিজ্ঞেস করলো, আপনিই তো ইয়র্কের আইজাক, তাই না?
হ্যাঁ। কিন্তু তুমি কে?
আমার পরিচয় জানার কোনো প্রয়োজন নেই আপনার। আমি এসেছি একজনের প্রতিনিধি হয়ে।
প্রতিনিধি! কার?
আজকের টুর্নামেন্টে যিনি বিজয়ী হয়েছেন। তার বর্মের দাম পরিশোধ করতে এসেছি আমি। ঘোড়াটাও নিয়ে এসেছি। যে ছেলেটা দরজা খুলে দিয়েছে তার হাতে দিয়ে আস্তাবলে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার প্রভু যেমন নিয়ে গিয়েছিলেন ঠিক তেমন অবস্থায় ফেরত দিয়েছেন ওটা। কোথাও কোনো চোট পায়নি। এখন বলুন, বর্ম আর অস্ত্রগুলোর জন্যে কত দিতে হবে?
এ নিয়ে পরে আলাপ করা যাবে, আগে গলাটা একটু ভিজিয়ে নাও।
আইজাকের নির্দেশে ভূত্য দুগ্লাস পানীয় নিয়ে এলো। একটা গ্লাস গার্থের দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্যটিা নিজে নিলেন আইজাক। বললেন, নাও, খাও। অনেক দূর থেকে এসেছে, নিশ্চয়ই গলা শুকিয়ে গেছে?
গ্লাস তুলে চুমুক দিলো গার্থ। এবং এক চুমুকে শেষ করে ফেললো সবটুকু পানীয়। এত ভালো জিনিস জীবনে আর কখনো মুখে দেয়নি ও।
পান পর্ব শেষ হওয়ার পর আইজাক বললেন, তোমার মনিব, বুঝলে খুব ভালো লোক। সেদিনই আমি বুঝেছিলাম। এখন বলো তো, কত টাকা পাঠিয়েছেন উনি? তোমার থলেটা তো বেশ ভারি মনে হচ্ছে…
না, না, ভারি কোথায়! তাড়াতাড়ি বললো গার্থ।
ভারি না? তাহলে এমন পেট মোটা লাগছে কেন?
পেট মোটা! কি বলছেন, আপনি! এইটুকুন একটা থলে, তার আবার পেট মোটা পেট সরু।
বেশ, তোমার কথাই সই। এখন বললো, কত টাকা আছে ওতে?
খুব বেশি না।
কেন? পাঁচ পাঁচ জন নাইটকে হারিয়েছেন, তার তো আজ অনেক কিছু পাওয়ার কথা!
পেয়েছেনও। কিন্তু বেশির ভাগই উনি বিলিয়ে দিয়েছেন।
বিলিয়ে দিয়েছেন! এমন অবিবেচক মানুষ হয় নাকি আজকের দুনিয়ায়? এতগুলো ঘোড়া, এতগুলো অস্ত্র, বর্ম, বিক্রি করলে তো অনেক টাকা পাওয়া যেতো!
টাকার খুব একটা প্রয়োজন নেই আমার মনিবের।
কি বললে! টাকার প্রয়োজন নেই? একটা কথা হলো? যাকগে, কি আর করা যাবে, ওঁর জিনিস উনি বিলিয়ে দিয়েছেন, আমার কি? তুমি আমাকে আশি স্বর্ণমুদ্রা দাও, তাহলেই হবে।
আশি স্বর্ণমুদ্রা! তাহলে তো আমার মনিবের কাছে আর এক পয়সাও ধাঁকবে না। সত্তরটা নিন। না হলে আমি চললাম, মনিবকেই পাঠিয়ে দিই আপনার কাছে।
না, না! টেবিলের ওপর রাখো টাকাটা। আশিটাই দাও, বুঝলে, তাতে আমার এক পয়সাও লাভ থাকবে না। তাছাড়া, ঘোড়াটা জখম হয়েছে কিনা কে জানে?
সত্যিই বলছি ঘোড়ার কিছু হয়নি, নিয়ে যাওয়ার সময় যেমন ছিলো এখনও তেমনি আছে। ইচ্ছে হলে আপনি নিজে দেখে আসতে পারেন আস্তাবলে গিয়ে। তাই বলছি, ঘোড়াটা যখন সম্পূর্ণ অক্ষত আছে, সত্তর নিয়েই সন্তুষ্ট হোন।
না, না, আশিই দাও। আমি বরং খুশি করে দেব তোমাকে।
গুনে গুনে গাৰ্থ আশিটা স্বর্ণমুদ্রা রাখলো টেবিলের ওপর। আইজ্যাক আবার গুনে গুনে সেগুলো ওঠাতে লাগলেন নিজের একটা থলেতে। সত্তর ~ পর্যন্ত দ্রুত গুনলেন বৃদ্ধ। তারপর মন্থর হয়ে এলো তার গোনার গতি। গার্থ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে, বুড়ো ইহুদী ওকে খুশি করবে কটা স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে?
একাত্তর, গুনে চলেছেন আইজাক, বাহাত্তর। তোমার মনিব, বুঝলে, খুব ভালো। তিহাত্তর। সত্যিই খুব ভালো লোক তোমার মনিব। চুহাত্তর, পঁচাত্তর। এটা একটু হালকা লাগছে। ছিয়াত্তর, সাতাত্তর। গাৰ্থ ভাবলো শেষ তিনটে মুদ্রা বোধ হয় দেবেন ওকে বৃদ্ধ। কিন্তু না! আইজাক শুনেই চলেছেন, আটাত্তর। তুমি লোকটাও খুব ভালো। ঊনআশি। কষ্ট করে টাকাগুলো নিয়ে এসেছে, তোমার কিছু পাওয়া উচিত। শেষ স্বর্ণমুদ্রাটার দিকে তাকালেন আইজাক। ঝকঝকে একেবারে নতুন। কি করে এটা দিয়ে দেবেন? অবশেষে গুনলেন, আশি। হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। চিন্তা কোরো না, তুমি যে কষ্ট করলে এর জন্যে নিশ্চয়ই তোমার মনিব তোমাকে কিছু দেবেন।
হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে আছে গাৰ্থ। মনে মনে ভাবছে, একেই বলে ইহুদী।
টাকা বুঝে পেয়েছেন এই মর্মে একটা রশিদ লিখে সই করে গার্থের হাতে দিলেন আইজাক। কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো গাৰ্থ। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। সামনে একটা অন্ধকার কামরা, ওটা পেরোলেই বাড়ি থেকে বেরোনোর দরজা। অন্ধকার কামরাটার দিকে সবেমাত্র পা বাড়িয়েছে, এমন সময় শ্বেতবসনা এক মূর্তি এগিয়ে এলো ওর দিকে। হাতে ছোট একটা লণ্ঠন। মূর্তি আর কেউ নয়, রেবেকা।
বাবা এতক্ষণ ঠাট্টা করছিলেন তোমার সাথে, শান্ত কণ্ঠে বললো সে। তোমার মনিব আমার বাবার যে উপকার করেছেন, তার ঋণ কোনো দিনই শোধ করা সম্ভব নয়। টাকা নেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। কত দিয়েছো বাবাকে?
আশি স্বর্ণমুদ্রা।
রেশমী একটা থলে এগিয়ে দিল রেবেকা গার্থের দিকে।
এতে একশো স্বর্ণমুদ্রা আছে, বললো সে। আশিটা তোমার মনিবকে ফেরত দিও। বাকিগুলো তোমার। যাও, এবার তাড়াতাড়ি পালাও। পথে সাবধানে থেকো। শহর বোঝাই চোর বাটপাড়, আর বন তো ডাকাতদের আস্তানা।
বিস্ময়ে কোনো কথা ফুটলো না গার্থের মুখে। অস্ফুট কণ্ঠে রেবেকাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পথে নেমে এলো সে। মনে মনে বললো, এ তো ইহুদীর মেয়ে নয়, সাক্ষাৎ স্বর্গের দেবী। মনিবের কাছে পেয়েছি দশ স্বর্ণমুদ্রা, দেবীর কাছে পেলাম বিশ এই হারে পেতে থাকলে স্বাধীনতা কিনতে আর বেশি সময় লাগবে না আমার।
০৭. শহরের সীমানা ছাড়িয়ে
শিগগিরই শহরের সীমানা ছাড়িয়ে এলো গাৰ্থ। নিবিড় বনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে সরু পায়ে চলা পথ। হাঁটার গতি বাড়ালো ও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ বন পেরিয়ে যেতে চায়। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারলো না। এক জায়গায় বড় বড় গাছ খুব ঘন হয়ে বেড়ে উঠেছে। চাঁদের আলো ঢাকা পড়ে গেছে সেখানে। মাত্র জায়গাটার শেষ প্রান্তে পৌঁছেছে গাৰ্থ, এমন সময় দুদিক থেকে দুজন দুজন করে চারজন লোক লাফ দিয়ে এসে পড়লো.ওর ঘাড়ের ওপর।
সাথে মাল কড়ি যা আছে চটপট দিয়ে দাও দেখি, বাছা, বললো একজন।
যেতে দাও আমাকে, চিৎকার করে উঠলো গার্থ। ধস্তাধস্তি করে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছে নিজেকে।
ব্যাটার তেজ তো কম নয়, দাঁড়াও দেখাচ্ছি, বলে চারজন টানতে টানতে নিয়ে চললো গার্থকে।
বনের ভেতর একটুখানি একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে থামলো তারা। চঁদের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে আছে জায়গাটা। ওদের সাড়া পেয়ে আরো দুই ডাকাত বেরিয়ে এলো গাছপালার আড়াল থেকে। গার্থ দেখলো তাদের হাতেও অন্য চারজনের মতো মোটা লাঠি, কোমরে ঝুলছে ছোট এক ধরনের তলোয়ার। সব কজনের পরনে সবুজ পোশাক। চারজন ছিলো, হলো ছজন। ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা বলতে গেলে শূন্য। তবু গাৰ্থ আশা ছাড়লো না।
কত টাকা আছে তোমার কাছে, বলো, হুঙ্কার ছাড়লো এক ডাকাত।
আমার নিজের টাকার কথা যদি বলো, তাহলে ত্রিশটা স্বর্ণমুদ্রা, অচঞ্চল কণ্ঠে বললো গাৰ্থ। আমি একজন ক্রীতদাস। আমার স্বাধীনতা কেনার জন্যে অনেক কষ্টে টাকাগুলো জমিয়েছি।
কিন্তু তোমার বলে দেখে তো মনে হচ্ছে না মাত্র ত্রিশটা আছে, বললো দলের সর্দার। আমার বিশ্বাস ত্রিশের অনেক বেশি আছে এর ভেতরে।
তা আছে। তবে গুলো আমার নয় আমার মনিবের। যদি নিতেই চাও আমার টাকাগুলো নিয়ে ছেড়ে দাও আমাকে।
কে তোমার মনিব?
গৃহহীন নাইট।
আজকের টুর্নামেন্টে যিলিবিজয়ী হয়েছেন?
হ্যাঁ।
গৃহহীন নাইট! আসলে নাম কি লোকটার?
উহুঁ, তা বলা সম্ভব নয়। আমার মনিব চান না তার নাম পরিচয় জানাজানি হোক।
বেশ, তাহলে তোমার পরিচয় বলো।
তা-ও সম্ভব নয়। আমার পরিচয় বললেই মনিবের পরিচয়ও প্রকাশ হয়ে যাবে।
হুঁ। তোমার মনিব তো আজ অনেক রোজগার করেছে, তাই না?
তা করেছেন, তবে অর্ধেকের বেশিই আবার বিলিয়ে দিয়েছেন।
আচ্ছা! খুব দয়ালু লোক দেখছি! তা কত টাকা পেলেন আর কত বিলালেন?
চার নাইটের কাছ থেকে চারশো স্বর্ণমুদ্রা পেয়েছেন। দুশো নিজে রেখে দুশো বিলিয়ে দিয়েছেন।
পাগল নাকি! দুশো স্বর্ণমুদ্রা বিলিয়ে দিলো! একটু থামলো সর্দার। কোন চারজন টাকা দিয়েছে? নাম বলো।
বললো গার্থ।
আর সেই টেম্পলার স্যার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্টের খবর কি? সে টাকা দেয়নি?
চেয়েছিলো দিতে। আমার মনিব নেননি।
কেন? সব খুলে বলো তো, মজার ব্যাপার মনে হচ্ছে!
আমার মনিব প্রাণ ছাড়া আর কিছু নেবেন না টেম্পলারের কাছ থেকে। আবার ওঁরা লড়বেন, এবং দুজনের একজন না মরা পর্যন্ত সে লড়াই চলবে।
হো! হো! হো! চিৎকার করে উঠলো সর্দার;এখন বলো তো, তুমি অ্যাশুবিতে গিয়েছিলে কেন?
ধার শোধ দিতে।
ধার শোধ! কার?
আমার মনিবের। আইজাক নামের এক ইহুদীর কাছ থেকে উনি যুদ্ধের ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ পোশাক ধার করেছিলেন। ঘোড়া ছাড়া আর সব মনিব রেখে দিয়েছেন। তাই ওগুলোর দাম শোধ করতে আমি গিয়েছিলাম।
কত দিলে?
আশি স্বর্ণমুদ্রা। কিন্তু বুড়ো ইহুদী সব আবার ফেরত দিয়ে দিয়েছে, তার ওপর আমাকে পুরস্কার দিয়েছে বিশ স্বর্ণমুদ্রা।
ও মিথ্যে কথা বলছে! চিৎকার করে উঠলো এক ডাকাত।
গল্প দেয়ার আর জায়গা পাও না, বললো আরেকজন। ইহুদীর বাচ্চা হাতে টাকা পেয়ে ফেরত দিয়ে দিলো, তাও আবার আশির বদলে একশো!
আমি সত্যি কথাই বলছি। রেগে গিয়ে ঝঝের সঙ্গে বললো গার্থ। বিশ্বাস না হয় আমার থলে খুলে দেখতে পারো। এর ভেতরে ছোট একটা রেশমী কাপড়ের থলে আছে, তাতে ঠিক একশো স্বর্ণমুদ্রা আছে।
এই, একটা আলো আনো তো, বললো দস্যু সর্দার। দেখি ও সত্যি বলছে কি না।
একটা মশাল জ্বাললো এক ডাকাত। গার্থের হাত থেকে থলেটা নিয়ে খুললো সর্দার। সব কজন ডাকাত ঝুঁকে পড়লো তার দিকে। এমন কি যে দুজন গার্থকে ধরে রেখেছিলো তারাও মুঠো শিথিল করে এগিয়ে গেল থলের ভেতর কি আছে দেখতে। এই সুযোগ ছাড়লো না গার্থ। এক ঝটকায় নিজেকে মুক্ত করে আরেক ঝটকায় এক ডাকাতের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে সর্ব শক্তিতে বসিয়ে দিলো সর্দারের মাথায়। গার্থের থলেটা হাত থেকে খসে পড়ে গেল সর্দারের। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে।
গাৰ্থ টাকার থলেটা তুলে নিয়েই ছুটে পালানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ও একা, ডাকাতরা অনেক। পারলো না পালাতে। ছুটে দুতিন পা যাওয়ার পরই আবার ধরা পড়ে গেল সে।
ইতোমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে সর্দার। গার্থের মতো দশাসই লোকের হাতে বাড়ি খেয়েও কিছুই যেন হয়নি তার।
বদমাশ! মাথা ডলতে ডলতে সে চিৎকার করলো। আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে, এর ফল তোমাকে ভোগ করতে হবে। এবং এখনই। তার আগে তোমার মনিবের কথা শেষ করে নেই, ততক্ষণ চুপ করে দাঁড়াও। একটু নড়লেই প্রাণটা খোয়াবে! সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে যোগ করলো, রেশমের থলেটার ওপর হিব্রু অক্ষরে কি যেন লেখা আছে, ভেতরেও আছে ঠিক একশোটা স্বর্ণমুদ্রা। আমার মনে হয় ও যা বলছে সত্যি। টাকাটা ওর মনিবেরই। ও টাকা আমরা নিতে পারি না। ওর মনিব বেচারা আসলে আমাদেরই মতো।
আমাদেরই মতো! তা কি করে হয়?
কেন না? বেচারা আমাদেরই মতো গরীব, হতভাগ্য আমাদের মতোই তলোয়ারের জোরে উনি এই টাকা আয় করেছেন। আমাদের শত্রু রেজিনান্ড এবং ম্যালভয়সিঁকে উনি পরাজিত করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের পয়লা নম্বর শত্রু টেম্পলার ব্রায়ান ওঁরও শত্রু। শুনলে তো ব্যাটা ইহুদী কেমন উদার ব্যবহার করেছে ওঁর সাথে? আমরা তার চেয়ে কম উদারতা দেখাই কি করে, বলো তো?
ঠিক, ঠিক! এক সাথে চেঁচিয়ে উঠলো সব কজন ডাকাত। তা আমরা দেখাতে পারি না!
তারপর একজন গার্থকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এর সাথেও কি আমরা অমন উদার আচরণ করবো?
তোমরাই ঠিক করো, বলো সর্দার।
কক্ষনো না, জবাব দিলো এক দস্যু। ওকে ভালো রকম একটা শিক্ষা দিতে হবে। তোমার মাথায় বাড়ি মেরেছে!
ঠিক আছে, বলে বিশালদেহী এক ডাকাতের দিকে তাকালো সর্দার। মিলার তৈরি হওলাঠি নিয়ে। গার্থের দিকে ফিরলো সে। বললো, যুৎসই. একটা বাড়ি মেরেছো আমার মাথায়, দেখি মিলারকেও তেমন একটা মারতে পারো কি না। যদি পারো তোমাকে ছেড়ে দেবো।
কোনো আপত্তি নেই, বললো গার্থ।
যে দুজন ওকে ধরে ছিলো সর্দার তাদেরকে বললো, ছেড়ে দাও ওকে, আর ওর হাতে একটা লাঠি দাও।
গাৰ্থ এবং মিলার, দুজনেই লাঠি হাতে এগিয়ে গেল ফাঁকা জায়গাটার মাঝামাঝি জায়গায়।
আয়, ব্যাটা, সাহস থাকে তো! মাথার ওপর আশ্চর্য কৌশলে লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে চিৎকার করলো মিলার। আমার হাতে কত জোর তা টের পাবি!
ব্যাটা, তোর মতো ছিচকে চোরকে দেখে ভয় করি নাকি? একই রকম দক্ষতায় লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে জবাব দিলো গার্থ।
শুরু হলো লড়াই। হিংস্র ভঙ্গিতে একে অপরের ওপর লাফিয়ে পড়লো গার্থ এবং মিলার। কিন্তু দুজনেই দক্ষ লেঠেল। দুজনেই প্রতিপক্ষের আক্রমণ ফিরিয়ে দিলো নিপুণ কৌশলে। আবার আক্রমণ করলো। এভাবে চললো বেশ কিছুক্ষণ। কেউ কাউকে কাবু করতে পারলো না কায়দা মতো একটা ঘা-ও লাগাতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত রেগে উঠলো মিলার। কৌশল ভুলে গায়ের জোরে লাঠি চালাতে লাগলো আনাড়ীর মতো। দেখে হাসতে শুরু করলো ওর সঙ্গীরা। ফলে আরো রেগে গেল মিলার। এতক্ষণ শুধু আক্রমণের ক্ষেত্রে কৌশলের অভাব দেখা যাচ্ছিলো, এবার প্রতিরক্ষার বেলায়ও দেখা যেতে লাগলো। মাথাটাকে যে আগলে রাখতে হবে তা ওর মনেই রইলো না। প্রথম সুযোগেই গাৰ্থ সেখানে বসিয়ে দিলো একটা রাম বাড়ি। এমন জোরে বাড়িটা লাগলো মিলারের মাথায় যে বেচারা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটিতে। এবং জ্ঞান হারালো।
সাবাস! সাবাস! চিৎকার করে উঠলো ডাকাতরা। দারুণ দেখিয়েছে! তোমার ধন-প্রাণ দু-ই বাঁচলো, ফাঁকতালে মার খেয়ে মরলো বেচারা মিলার।
এবার তুমি যেতে পারো, বললো সর্দার। আমার দুই সঙ্গী তোমাকে বন পার করে দিয়ে আসবে, যাতে আর কোনো বিপদ না ঘটে তোমার।
তার কোনো দরকার ছিলো না, বিনয়ের অবতার সেজে বললৈ গার্থ।
দরকার না থাকলে ওরা যাবে। তার আগে একটা কথা তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমাদের সম্পর্কে মুখ খুলবে না কোথাও, আর আমরা কারা জানার কোনো চেষ্টা করবে না কখনও। যদি খোললা বা করো, তোমার কপালে দুঃখ আছে।
প্রতিশ্রুতি দিলো গাৰ্থ, সে কাউকে কিছু বলবে না। তারপর ডাকাতদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলো নিজের পথে। লাঠি হাতে সঙ্গে চললো দুই দস্যু।
বনের প্রান্তে পৌঁছুতেই আরো দুজন ডাকাত যোগ দিলো ওদের সাথে। ফিসফিস করে নিজেদের ভেতর কি আলাপ করলো ওরা, তারপর ফিরে গেল বানর ভেতর। অবাক হলো গর্থ। ডাকাত দলটা খুবই সুসংগঠিত মনে হচ্ছে!
দুই ডাকাত পথ দেখিয়ে একটা পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গেল ওকে। দাঁড়িয়ে পড়ে নিচের দিকে ইশারা করে বললো, এই পথে চলে যাও। ঐ যে দেখা যাচ্ছে টুর্নামেন্টের জায়গা। আমরা এবার বিদায় নেবো। যাওয়ার আগে আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, প্রতিশ্রুতির কথা মনে রেখো। যদি না রাখো, আবারো বলছি, কপালে তোমার দুঃখ আছে।
তোমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, একটা কথাও বেরোবে না আমার মুখ দিয়ে, বললো গাৰ্থ। বিদায় জানানোর আগে একটা কথা বলি, কিছু মনে কোরো না, তোমরা ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে ভালো হয়ে যাও। তোমাদের মতো লোকের এ কাজ মানায় না। শুভরাত্রি।
নিরাপদে মনিবের তাবুতে পৌঁছুলো গার্থ। এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে পুরো ঘটনা শোনালো মনিবকে। তারপর তাঁবুর প্রবেশপথের কাছে শুয়ে পড়লো একটা ভালুকের চামড়া বিছিয়ে। ওকে না ডিঙিয়ে কেউ তাবুতে ঢুকতে পারবে না।
শুয়ে পড়লো নাম না জানা নাইটও। কিছুক্ষণের ভেতর গভীর ঘুমের কোলে ঢলে পড়লো দুজন।
০৮. পূর্ণ হয়ে উঠলো টুর্নামেন্ট মাঠের গ্যালারি
পরদিন সকাল দশটা নাগাদ আবার পূর্ণ হয়ে উঠলো টুর্নামেন্ট মাঠের গ্যালারিগুলো। কালকের মতো আজও প্রতিযোগিতা দেখার জন্যে সমবেত হয়েছে হাজার হাজার লোক। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তারা, কখন রাজকুমার জন আসবেন। তিনি না আসা পর্যন্ত শুরু হবে না প্রতিযোগিতা।
অবশেষে শোনা গেল ট্রাম্পেটের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। এসে গেছেন জন। সঙ্গে তাঁর সহচররা। কিছুক্ষণ পরেই এলেন সেড্রিক মেয়ে রোয়েনাকে নিয়ে। আজ অ্যাথেলস্টেন নেই ওঁদের সঙ্গে। টুর্নামেন্টে যোগ দেবে বলে আগেই এসে গেছে সে। যুদ্ধের সাজে তৈরি।
আসন গ্রহণ করেই সেড্রিক খুঁজতে লাগলেন অ্যাথেলস্টেনকে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন, নরম্যান নাইট বোয়াগিলবার্টের দলে যোগ দিয়ে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে সে।
অ্যাথেলস্টেন বহুদিন ধরেই আশা করে আছে রোয়েনাকে সে বিয়ে করবে। সেড্রিকও তাকে এ ধরনের আভাসই দিয়েছেন। সে আরও আশা করেছিলো, আজকের টুর্নামেন্টে বিজয়ী হয়ে সে-ই রোয়েনাকে সৌন্দর্য ও প্রেমের রানী নির্বাচিত করবে। মাঝখান থেকে কাল সেই তরুণ নাইট বিজয়ী হয়ে তার সব আশা আকাক্ষা মাটি করে দিয়েছে। অদ্ভুত এক ঈর্ষায় জ্বলছে তাঁর হৃদয়। নাম না জানা সেই নাইট রোয়েনাকেই নির্বাচিত করলো কেন? সে কি তবে ভালোবাসে রোয়েনাকে? আর রোয়েনা? সে-ও কি ভালোবাসে ঐ নাম গোত্রহীন নাইটকে? এই চিন্তাটাই বিশেষভাবে খেপিয়ে তুলেছে অ্যাথেলস্টেনকে। তাই মনের ঝাল মেটানোর জন্যে সে যোগ দিয়েছে শত্রুপক্ষে। আশা, উত্তরাধিকার বঞ্চিত নাইটকে আজ সে পরাজিত করবে।
রাজপুত্র জনের ইচ্ছায় দ্য ব্রেসি এবং তার সহযোগী যোদ্ধারাও দলবেঁধে যোগ দিয়েছে টেম্পলার ব্রায়ানের পক্ষে। জনের ইচ্ছা ব্রায়ানের দলই বিজয়ী হোক।
অন্যদিকে বেশ কয়েকজন স্যাক্সন, নরম্যান, এবং বিদেশী নাইট গতকালের বিজয়ীর পক্ষ নিয়েছে। তরুণ নাইট কাল যে বীরত্ব দেখিয়েছে তাতে এই নাইটদের ধারণা হয়েছে ওর পক্ষে যোগ দিলেই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
রোয়েনাকে দেখেই রাজপুত্র জন এগিয়ে গেলেন অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে। নিজে সাথে করে নিয়ে গেলেন সৌন্দর্য ও প্রেমের রানীর জন্যে সাজিয়ে রাখা সিংহাসনের কাছে।
আপনাদের রানীকে সঙ্গ দিন, উপস্থিত সম্রান্ত ও অভিজাত মহিলাদের নির্দেশ দিলেন জন।
কিছুক্ষণের ভেতর দেখা গেল অনেক কজন সুন্দরী রমণী ঘিরে দাঁড়িয়েছে রোয়েনাকে। চাঁদের জ্যোৎস্নার কাছে যেমন তারারা সব ম্লান হয়ে যায় তেমনি রোয়েনার সৌন্দর্যের কাছে ম্লান হয়ে গেল সব রূপসীর রূপ। রোয়েনা আসন গ্রহণ করতেই দর্শকরা করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করলো তাকে। সেই সাথে হর্ষোৎফুল্ল চিৎকার।
ঘোষকরা এগিয়ে এলো এবার। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে নিস্তব্ধতা প্রার্থনা করলো তারা। তারপর উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলো আজকের দিনের নিয়মাবলী।
আজ লড়াইয়ে তরবারি এবং বর্শা দুই-ই ব্যবহার করা যাবে। তাই কয়েকটা ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে প্রতিযোগীদের। তলোয়ার দিয়ে শুধু আঘাত করা চলবে, কোনো সময়ই তা প্রতিদ্বন্দ্বীর শরীরে বিদ্ধ করা যাবে না। নাইটরা ইচেছ করলে কুঠার ব্যবহার করতে পারবে, কিন্তু ছোরার ব্যবহার নিষিদ্ধ। কোনো যোদ্ধা ঘোড়া থেকে পড়ে গেলে মাটিতে দাঁড়িয়েও সে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে, তবে সেক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকেও ঘোড়া থেকে নামতে হবে। ঘোড়ায় চড়ে কোনো নাইটই মাটিতে দাঁড়ানো প্রতিদ্বন্দ্বীকে কোনো রকম আঘাত করতে পারবে না। যদি কোনো নাইট পিছু হটতে হটতে নিজের তাঁবুর দিকে যেতে বাধ্য হয় এবং সেখানকার বেষ্টনী স্পর্শ করে তাহলে সে পরাজিত বলে গণ্য হবে। কোনো নাইট যদি ঘোড়া থেকে পড়ে আহত হয় বা কোনো কারণে নিজে নিজে উঠে দাঁড়াতে না পারে তাহলে তার অনুচর বা পার্শ্বচররা এসে তাকে তুলে নিয়ে যেতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে সেই নাইট পরাজিত বলে গণ্য হবে। পরাজিত নাইটদের ঘোড়া, বর্ম ও অস্ত্রশস্ত্র বিজয়ী নাইটদের প্রাপ্য হবে। রাজপুত্র জন যে মুহূর্তে প্রতিযোগিতা বন্ধের ইঙ্গিত করবেন সে মুহূর্তে লড়াই থামিয়ে দিতে হবে দুপক্ষকেই। কোনো নাইট যদি এ সব নিয়ম লঙ্ন করে তবে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে এবং প্রতিযোগিতা থেকে বের করে দেয়া হবে।
ঘোষণা শেষ করে যার যার জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো ঘোষকরা। তীরে এক সাথে বেজে উঠলো অনেকগুলো ট্রাম্পেট। ক্ষেত্ব এখন তৈরি প্রতিযোগিতার জন্যে।
দীর্ঘ সারি বেঁধে মাঠে প্রবেশ করলে স্যার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্ট ও তার চব্বিশজন সহযোগী। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুই সারিতে দাঁড়িয়ে পড়লো তারা। এক সারির পেছনে আরেকটা। দলপতি দাঁড়িয়েছে সামনের সারির ঠিক মাঝখানে।
এরপর প্রবেশ করলো গৃহহীন নাইট, মাঠের অন্যপ্রান্ত দিয়ে। সঙ্গে তার চব্বিশ সহযোগী। তারাও একইভাবে দুই সারিতে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
অভূতপূর্ব একটা দৃশ্য! পঞ্চাশ জন সাহসী নাইট অপেক্ষা করছে ঘোড়ার পিঠে বসে। প্রত্যেকের হাতে বর্শা। বর্শার মাথায় বাঁধা রঙচঙে পতাকাগুলো উড়ছে বাতাসে। বর্শার ফলাগুলো রোদ পড়ে ঝিক করে উঠছে। রোদ প্রতিফলিত হচ্ছে তাদের শিরোম্রাণে, বর্মে। ঘোড়াগুলো অস্থির। পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করছে একটু পরপরই। যেন ছুটবার জন্যে ছটফট করছে।
ল্যাইসে অ্যালের! অবশেষে রাজপুত্রের নির্দেশে ঘোষণা করলেন প্রধান বিচারক।
শুরু হয়ে গেল প্রতিযোগিতা।
দুই দলেরই সামনের সারির নাইটরা ছুটলো প্রতিপক্ষের দিকে। প্রত্যেকেই আক্রমণের ভঙ্গিতে বাগিয়ে ধরেছে বর্শা। মাঠের ঠিক মাঝখানে এমন ভয়ঙ্কর শব্দ তুলে তারা মিলিত হলো, এক মাইল দূর থেকেও শোনা গেল সে শব্দ। প্রথম কয়েক মিনিট ধুলায় প্রায় কিছুই দেখতে পেলো না দর্শকরা। ধুলার মেঘ যখন কেটে গেল, তারা দেখলো, দু পক্ষেরই অন্তত অর্ধেক নাইট পড়ে গেছে ঘোড়া থেকে। কয়েকজনের অবস্থা শোচনীয়। মৃতের মতো পড়ে আছে মাটিতে। বাকিদের বেশির ভাগই মারাত্মক আহত। তারা ঔড়ি মেরে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যারা এখনো ঘোড়ার পিঠে অক্ষত অবস্থায় আছে তারা লড়ছে প্রতিপক্ষের সাথে। সবার হাতে এখন তলোয়ার, কারণ সবারই বর্শা ভেঙে গেছে প্রথম সংঘর্ষের সময়। দুপক্ষ থেকেই বয়ে যাচ্ছে চিৎকার আর মুখখিস্তির ঝড়।
এবার দ্বিতীয় সারির যোদ্ধারা এগোলো। ফলে লড়াইয়ের তীব্রতা বেড়ে গেল বহুগুণ। দুপক্ষেরই সমর্থকরা চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে যার যার, পছন্দের যোদ্ধাকে।
দেসদিচাদো! দেসদিচাদো! তরুণ নাইটের সমর্থকরা চিৎকার করছে।
বোয়া-গিলবার্ট! বোয়া-গিলবার্ট! চিৎকার করছে প্রতিপক্ষ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয়ঙ্কর রূপ নিলো যুদ্ধ। নাইটরা মাঠের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে লাগলো প্রতিদ্বন্দ্বীদের। চিৎকার, গালাগালি, অস্ত্রের ঝনঝনানি আর ঘোড়ার খুরের শব্দে কান পাতা দায়। এর ভেতর থেকে থেকে বেজে উঠছে ট্রাম্পেট। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে আহতদের আর্তনাদ। সব মিলিয়ে বীভৎস দৃশ্য।
কিন্তু কারো মধ্যেই দুঃখবোধ বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই। পুরুষদের মতো মহিলা দর্শকরাও অবিচল উৎসাহে দেখছে লড়াই। পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চিৎকারও করছে অনেকে। মাঝে মাঝে অবশ্য কারো স্বামী বা ভাই আহত হয়ে পড়ে গেলে কোনো মহিলা দর্শক বিচলিত হচ্ছে। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যে মাত্র। একটু পরেই আবার লড়াইয়ের উন্মাদনা সংক্রামিত হচেছ তার বা তাদের ভেতর। আবার শুরু হচ্ছে চিৎকার, হাততা লি। মেয়েরাও পুরুষদের সঙ্গেই গলা মিলিয়ে উৎসাহ যোগাচ্ছে যোদ্ধাদের। মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে:
সাবাস, দেসদিচাদো! দেখেছো, কি দারুণ চালালো তলোয়ারটা! বা, সাবাস, স্যার ব্রায়ান! আরো জোরে মারুন! এই দিক দিয়ে এসে, এই পাশ দিয়ে!
ঘোষকদের কণ্ঠও শোনা যাচ্ছে: লড়ে যান, বীর নাইটরা! পরাজয়ের চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়! মনে রাখবেন, শত শত চোখ আপনাদের সাহস ও কৌশল দেখে মুগ্ধ হচ্ছে!
অবশেষে গৃহহীন নাইট মুখখামুখি হলো বোয়াগিলবার্টের। দুজনেরই বর্শা ভেঙে গেছে। দুজনেরই হাতে এখন তলোয়ার। আগুন ঝরা চোখে একে অন্যের দিকে তাকালো তারা। দুজনেরই দৃষ্টিতে ঘৃণা। শুরু হলো দুই দলপতির লড়াই। একজনের মরণ না হওয়া পর্যন্ত এ লড়াই থামবে না।
দর্শকরা দেখছে। শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনায় কাঁপছে সবাই থরথর করে।
বোয়া-গিলবার্টের দল এখন জয়ের পথে। অ্যাথেলস্টেন এবং বিশালদেহী ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ যার যার প্রতিপক্ষকে ভূপাতিত করে এগিয়ে এলো দলনেতার সাহায্যে। দুদিক থেকে তারা আক্রমণ করলো তরুণ নাইটকে।
সাবধান, দেসদিচাদো! সাবধান! দুপাশে খেয়াল করো! চিৎকার উঠলো দর্শকদের ভেতর।
বেকায়দা অবস্থায় পড়ে গেল নাইট। এক সাথে তিনজনকে একা ঠেকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ঘাবড়ালো না সে। ব্রায়ানকে প্রবল একটা আঘাত হেনেই পিছিয়ে এলো দ্রুত। এত দ্রুত যে, আরেকটু হলেই মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে অ্যাথেলস্টেন আর রেজিনান্ডের ভেতর। অতি কষ্টে দুই অশ্বারোহী পাশ কাটালো একে অপরকে। তারপর ছুটলো গৃহহীন নাইটের পেছন পেছন। ইতোমধ্যে বোয়া-গিলবার্টও যোগ দিয়েছে তাদের সাথে।
ভাগ্য ভালো, খুবই ভালো একটা ঘোড়ায় বসে আছে তরুণ নাইট। আগের দিন যেটা সে পুরস্কার পেয়েছে এটা সেই ঘোড়া। পাখির মতো উড়ে বেড়াতে লাগলো সে একবার মাঠের এমাথায় একবার ওমাথায়। এভাবে কিছুক্ষণের ভেতর তিন প্রতিপক্ষকে আলাদা করে ফেলতে পারলো নাইট। তারপর একে একে হামলা চালাতে লাগলো তিন জনের ওপর। একজনকে আঘাত করেই পিছিয়ে আসছে নয়তো পাশে সরে যাচ্ছে, তারপর আবার অন্য একজনকে আক্রমণ করছে। তিনজন হওয়া সত্ত্বেও তার কোনো ক্ষতি করতে পারছে না প্রতিপক্ষ।
দর্শকরা পাগল হয়ে উঠেছে। মুহূর্তের জন্যেও চিৎকার বন্ধ করছে না কেউ। তবে, তিনজনের সাথে একা লড়ে গৃহহীন নাইট যে শেষ রক্ষা করতে পারবে না তা বুঝতে পারছে অনেকে। সে এখন যা করছে তাতে সময় কাটানো সম্ভব জয়লাভ সম্ভব নয়। একটু পরে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়বে তখন হার স্বীকার করা ছাড়া কোনো গতি থাকবে না তার। রাজপুত্র জনের কাছাকাছি যেসব সম্রান্তজনেরা বসেছিলেন তারা বললেন: এবার খামার আদেশ করুন, রাজপুত্র! এমন একজন বীর নাইটকে অপমানের হাত থেকে বাঁচান!
জন কান দিলেন না তাদের কথায়।
এই অহঙ্কারী নাইট কাল বিজয়ী হয়েছে, বললেন তিনি। আজ অন্যেরা সুযোগ পেয়েছে, আমি বাধা দেবো কেন?
.
পরাজয় বোধহয় এড়াতে পারলো না তরুণ নাইট। স্পষ্ট বুঝতে পারছে দর্শকরা, সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আগের ক্ষিপ্রতা আর নেই তার তরবারিতে। ঘোড়াটাকেও ঠিক মতো যেন পরিচালনা করতে পারছে না। আর কিছুক্ষণ যদি চেষ্টা চালিয়ে যায় বোয়া-গিলবার্ট, অ্যাথেলস্টেন আর রেজিনাল্ড, কোনো সন্দেহ নেই বিজয় তাদের হাতের মুঠোয় আসবে।
এই সময় অপ্রত্যাশিত এক ঘটনায় বেঁচে গেল সে। শুধু বেঁচেই গেল টুর্নামেন্টের ফলাফলও হয়ে গেল অন্য রকম।
তরুণ নাইটের দলে কালো পোশাক পরা এক যোদ্ধা ছিলো। তার ঘোড়াও তার পোশাকের মতোই কালো। সেজন্যে দর্শকরা তার নাম দিয়েছে ব্ল্যাক নাইট। অদ্ভুত তেজোদীপ্ত তার ভঙ্গি–যেমন তার তেমন তার ঘোড়ার। এতক্ষণ সে লড়েছে, তবে খুব একটা মন দিয়ে নয়। আক্রমণ সে বলতে গেলে করেইনি। কেউ আক্রমণ কর কেবল ঠেকিয়ে গেছেঅনায়াসে, ঠেকিয়ে গেছে। দেখে অনেকের মনে হয়েছে সে-ও যেন নিরাসক্ত একজন দর্শকমাত্র। সে কারণেই ব্ল্যাক নাইট-এর পাশাপাশি অনেকে তার নাম দিয়েছে অলস নাইট।
দলপতির বিপদ দেখে হঠাৎ করে যেন এই নিরাসক্ত যোদ্ধার বীরত্ব জেগে উঠলো। আলসেমি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এগিয়ে এলো তরুণ নাইটকে সাহায্য করতে।
দেসদিচাদো! ঘাবড়িও না! আমি এসে গেছি! চিৎকার করে উঠলো সে।
সময় মতোই এসেছিলো ব্ল্যাক নাইট, নইলে কি হতো বলা মুশকিল। তরুণ নাইট তখন তলোয়ার তুলেছে বোয়া-গিলবার্টকে আঘাত করার জন্যে। একই সঙ্গে রেজিনাও তলোয়ার তুলেছে তরুণ নাইটকে আঘাত করতে। কিন্তু তলোয়ার নামিয়ে আনার সুযোগ পেলো না রেজিনাল্ড। তার আগেই ব্ল্যাক নাইট তার কাছে পৌঁছে ভয়ঙ্কর এক আঘাত হেনেছে তার মাথায়। ঘোড়াসুদ্ধ মাটিতে পড়ে গেল নরম্যান নাইট রেজিনাল্ড। এরপর অ্যাথেলস্টেনের দিকে ছুটে গেল ব্ল্যাক নাইট। তারই কুঠার ছিনিয়ে নিয়ে তার মাথায় মারলো প্রচণ্ড শক্তিতে। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল স্যাক্সন রাজকুমার। এরপর আবার আগের মতো আলসেমি ভর করলো ব্ল্যাক নাইটের শরীরে। ধীর গতিতে ঘোড়া চালিয়ে মাঠের এক কোণে চলে গেল সে। অবখানা, এবার তোমার ব্যাপার তুমিই সামলাও, দেসদিচাদো।
আবার পুর্ণোদ্যমে টেম্পলারের মুখোমুখি হলো তরুণ নাইট। দুই সঙ্গীকে পরাভূত হতে দেখে হতাশ হয়েছে ব্রায়ান, তবে ভেঙে পড়েনি। সেও সমান উদ্যমে সামনাসামনি হলো গৃহহীন নাইটের। শুরু হলো লড়াইয়ের আরেক পর্যায়।
কিন্তু বেশিক্ষণ চললো না এ যুদ্ধ। বোয়া-গিলবার্টের ঘোড়া আহত হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। আঘাত মারাত্মক নয় বলে এতক্ষণ টিকে ছিলো। এবার আর পারলো না। প্রচুর রক্তপাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। তরুণ নাইটের আচমকা এক আঘাতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটিতে। টেম্পলার ব্রায়ানও গড়িয়ে পড়লো। তক্ষুণি অবশ্য উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। তার পা জড়িয়ে গেছে ঘোড়ার রেকাবে। বেশ কয়েকবার টানাটানি করেও পা-টা ছাড়াতে পারলো না সে। ইতোমধ্যে তরুণ নাইট লাফ দিয়ে নেমে পড়েছে তার ঘোড়া থেকে। শত্রুর বুকের ওপর পা দিয়ে দাঁড়ালো সে।
পরাজয় স্বীকার করো, নয়তো মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও? মাথার ওপর তলোয়ার তুলে চিৎকার করে উঠলো গৃহহীন নাইট।
রাজপুত্র জন দেখলেন, মহা বিপদ টেম্পলার ব্রায়ানের সামনে। তক্ষুণি যুদ্ধ বন্ধের ইঙ্গিত করলেন তিনি।
.
টুর্নামেন্ট শেষ। আহত নাইটদের একে একে তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া হলো। আহত নিহতের হিশেব নিতে গিয়ে দেখা গেল, চারজন মারা পড়েছে, মারাত্মক আহত হয়েছে ত্রিশজনের মতো। মাঠ ভিজে গেছে রক্তে।
এবার বিজয়ীর নাম ঘোষণার পালা। রাজপুত্র জনের ইচ্ছা ব্ল্যাক নাইটকেই আজকের বিজয়ী বলে ঘোষণা করবেন, আর যা-ই করুন কালকের সেই অহঙ্কারী ছোকরাকে আরো অহঙ্কারী হয়ে ওঠার সুযোগ দেবেন না। কিন্তু বিচারকরা তাতে আপত্তি জানালেন। তাঁদের যুক্তি, উত্তরাধিকার বঞ্চিত নাইট একাই ছজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাভূত করেছে, বিপক্ষের দলনেতা বোয়া-গিলবার্টও তার কাছেই পরাজিত হয়েছে; সুতরাং, বিজয়ীর সম্মান তারই প্রাপ্য।
কিন্তু জন তার গোঁ ছাড়তে রাজি নন। অবশেষে বিচারকরা মেনে নিলেন তাঁর কথা। কিন্তু বারবার ডেকেও ব্ল্যাক নাইটের খোঁজ পাওয়া গেল না। লড়াই শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে মাঠ ছেড়ে চলে গেছে। কোন দিকে গেছে কেউ দেখেনি, কাউকে কিছু বলেও যায়নি সে। শেষ পর্যন্ত আর কোনো উপায় না দেখে জন, ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন: কালকের বিজয়ী নাম না জানা নাইট বিজয়ী হয়েছে আজও।
তুমিও তো তোমার নাম বললে না, তরুণ নাইটের দিকে তাকিয়ে বললেন জন, তাই তোমাকে দেসদিচাদো (উত্তরাধিকার বঞ্চিত) বলেই সম্বোধন করছি। সমবেত সুধী ও দর্শকমণ্ডলীর সামনে তোমাকে দ্বিতীয়বারের মতো বিজয়ী ঘোষণা করা হচ্ছে। এবার তুমি পুরস্কার নেবে তোমারই নির্বাচন করা সৌন্দর্য ও প্রেমের রানীর কাছ থেকে।
কুর্নিশ করলো তরুণ নাইট, কিন্তু কোন কথা বললো না।
বাজনা বেজে উঠলো। সবাই উৎফুল্ল কণ্ঠে অভিনন্দন জানাচ্ছে বিজয়ীকে। রমণীরা রুমাল নাড়ছে। বিচারকমণ্ডলী বিজয়ীকে সাথে করে এগিয়ে গেলেন সৌন্দর্য ও প্রেমের রানীর সিংহাসনের দিকে। হাঁটু গেড়ে বসলো নাইট রানীর সামনে।
রোয়েনা তার আসন থেকে উঠে এলো। সামান্য ঝুঁকলো বিজয়ীর মাথায় মুকুট পরিয়ে দেয়ার জন্যে।
না! চিৎকার করে উঠলেন প্রধান বিচারক। বিজয়ী নাইটকে তার শিরোস্ত্রাণ খুলতে হবে। মুকুট পরানোর সময় মাথায় কিছু থাকা চলবে না।
প্রতিবাদ করলো নাইট। কিন্তু তার প্রতিবাদে কেউ কান দিলো না। অনেকটা জোর করেই তার শিরোস্ত্রাণ খুলে নিলো মার্শালরা। বছর পঁচিশেক বয়েসের সুন্দর একখানি তরুণ মুখ দেখা গেল। মৃত্যুর মতো ফ্যাকাসে সে মুখ। দুএক জায়গায় রক্তের দাগ।
মুখটা দেখামাত্র অস্ফুটস্বরে চিৎকার করে উঠলো রোয়েনা। কাঁপা কাঁপা হাতে মুকুটটা পরিয়ে দিলো নাইটের মাথায়।
তরুণ নাইট মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো রোয়েনাকে। ওর হাত টেনে নিয়ে আলতো করে ছোঁয়ালো ঠোঁটে। তারপর হঠাৎ মুখটা ঝুলে পড়লো তার। টলমল করে উঠলো পা। কেউ এসে ধরার আগেই মাটিতে পড়ে গেল বিজয়ী নাইটের অচেতন দেহ।
সবাই উদ্বিগ্ন মুখে ছুটে এলো তার দিকে। সেড্রিকও এলেন। তরুণ নাইটকে এক পলক দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। সে তারই নির্বাসিত পুত্র উইলফ্রিড অভ আইভানহো।
মার্শালরা ধরাধরি করে তাঁবুতে নিয়ে গেল আইভানহোকে। একে একে তার গা থেকে যুদ্ধের পোশাকগুলো খুলে আনতেই দেখা গেল, বুকের এক পাশে গভীর একটা ক্ষত। চুইয়ে চুইয়ে রক্ত গড়াচ্ছে সেই ক্ষত থেকে।
০৯. উইলফ্রিড অভ আইভানহো
উইলফ্রিড অভ আইভানহো! বাতাসের বেগে নামটা ছড়িয়ে পড়লো প্রতিযোগিতা স্থানের চারপাশে। দর্শকদের মুখে মুখে ফিরতে লাগলো। অবশেষে রাজপুত্র জনের কানেও পৌঁছুলো বিজয়ী নাইটের নাম পরিচয়। উদ্বেগের ছায়া পড়লো তাঁর মুখে।
কেন জানি না আমার বার বার মনে হচ্ছিলো, সহচর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, এই অহঙ্কারী নাইট রিচার্ডের বন্ধুই হবে, তারমানে আমার শত্রু।
আইভানহোর জমিজমা ভোগ করছে আমাদের রেজিনাল্ড, বললো দ্য ব্রেসি, এবার সব ওকে ফেরত দিতে হবে।
আইভানহোর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে রাজা, রিচার্ড বড়সড় একটা জায়গীর উপহার দিয়েছিলেন তাকে। তারপর দুজনই ক্রুসেডে যোগ দেয়ার জন্যে চলে যান প্যালেস্টাইনে। মুসলমানদের সঙ্গে সন্ধি করে রিচার্ড যখন দেশে ফিরে আসছেন তখন ইংল্যান্ডেরই কয়েকজন নাইটের চক্রান্তে তাঁকে বন্দী করে ফ্রান্সে নিয়ে যান ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ। খবরটা গোপনে জানানো হলো রিচার্ডের ভাই জনকে। জন ভীষণ খুশি হলেন শুনে। তাঁর সিংহাসনে আরোহণের পথে সবচেয়ে বড় বাধাটা দূর হয়েছে। যাদের চক্রান্তে রিচার্ড বন্দী হয়েছেন তাদের খুশি করা কর্তব্য মনে করলেন তিনি। এই কর্তব্যবোধ থেকেই রিচার্ড আইভানহোকে যে জায়গীর দিয়েছিলেন সেটা আইভানহোর অনুপস্থিতেই তিনি কেড়ে নিয়ে দিয়ে দেন রেজিনাল্ডকে। তাই বিজয়ী নাইটের নাম আইভানহো জানার পর সবার মনে প্রথম যে প্রশ্নটা জাগলো তা হলো, রেজিনাল্ড পারবে তো এত বড় বীরের জমিজমা নিজের দখলে রাখতে?
এতজন বীরকে হারিয়েছে, বললো এক নাইট, এবার নিশ্চয়ই আইভানহো তার সব সম্পত্তি দাবি করবে।
করলেই বুঝি রেজিনাল্ড সব ফেরত দিয়ে দেবে? বললেন বয়োবৃদ্ধ ওয়ার্ল্ডেমার। ওগুলো ফেরত নিতে হলে আইভানহোকে যুদ্ধ করেই নিতে হবে। আর যুদ্ধই যদি হয় আমাদের বন্ধুর সাহায্যে আমরা এগিয়ে যাবো না?
আপনি ঠিকই বলেছেন, ওয়াল্ডেমার, বললেন জন। তবে আমার মনে হয় না আমাদের সাহায্য দরকার হবে রেজিনান্ডের। ও একাই তিন তিনজন আইভানহোকে সামাল দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। তা ছাড়া যে সব নাইট আমার বিশ্বস্ত তাদেরকে জায়গা জমি দান করার অধিকার নিশ্চয়ই আমার আছে?
তা অবশ্য ঠিক, স্বীকার করলেন ওয়াল্ডেমার। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, আইভানহোকে দেখার পর আমাদের সৌন্দর্য ও প্রেমের রানী লেডি রোয়েনার চেহারা যে কী হয়েছিলো যদি দেখতেন!
আসলে কে এই লেডি রোয়েনা? জিজ্ঞেস করলেন জন।
স্যাক্সন সেড্রিকের পালিত মেয়ে, বললেন গুয়াল্ডেমার।
তার কথা কানেই যায়নি এমন ভঙ্গিতে প্রায়োর অ্যায়মার বললেন, শ্যারনের গোলাপের সঙ্গে মূল্যহীন মুক্তা! ভালো বুদ্ধি, কি বলো, দ্য ব্রেসি? এই সুন্দরী তরুণীকে বিয়ে করে ওর সব সম্পত্তি হাতাতে চাও না তুমি?
নিশ্চয়ই চাই। কিন্তু চাইলেই তো আর সব জিনিস পাওয়া যায় না।
বেশ, আমরা তার ব্যবস্থা করবো, কুটিল একটা হাসি হেসে বললেন জন। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আজকের মতো প্রতিযোগিতা শেষ। টুর্নামেন্টের শেষ পর্ব–সাধারণ যোদ্ধাদের অস্ত্র নৈপুণ্যের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে কাল।
রাজপুত্রের দেখাদেখি তার সঙ্গীরাও উঠে দাঁড়ালেন। এমন সময় রক্ষীদলের এক নেতা এসে একটা চিঠি দিলো জনের হাতে।
কোত্থেকে এলো এ চিঠি? জিজ্ঞেস করলেন রাজপুত্র। কে দিলো?
এক ফরাশি নিয়ে এসেছে, জবাব দিলো রক্ষী। বললো, খুব নাকি জরুরি। আজই যেন এটা আপনার হাতে পৌঁছায় সেজন্যে কাল সারাদিন, সারারাত ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছে সে।
উদ্বিগ্ন হলেন জন। কি এমন জরুরি খবর? কে পাঠালো?
চিঠিখানা খুললেন তিনি। এবং পড়ার সাথে সাথেই মুখ শুকিয়ে গেল রাজপুত্রের। মাত্র দুই বাক্যের চিঠি। তাতে লেখা:
সাবধান! শয়তান পালিয়েছে!
নিচে ফ্রান্সের রাজার সিলমোহর।
শয়তান পালিয়েছে! কম্পিত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন জন। মানে কি? রিচার্ড পালিয়েছে?
দেখি চিঠিটা, ওয়াল্ডেমার বললেন।
কাঁপা কাঁপা হাতে এগিয়ে দিলেন জন। পড়ে ভুরু কুঁচকে উঠলো ওয়াল্ডেমারের।
তাই তো মনে হচ্ছে, চিন্তিত কণ্ঠে বললেন তিনি।
খবরটা ভুলও হতে পারে, সান্ত্বনার সুরে বললো দ্য ব্রেসি। চিঠিটাও জাল হতে পারে।
না, না, ফ্রান্সের রাজার হাতের লেখা আমি চিনি, বললেন জন। ফিলিপ নিজে লিখেছেন এ চিঠি। নিচে সিলমোহরও তাঁর। এ চিঠি জাল বা মিথ্যে হতে পারে না।
তাহলে তো সত্যিই চিন্তার বিষয়, বললো এক নাইট। তার নাম ফিটজার। আমাদের আর এক মুহূর্তও দেরি করা উচিত হবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইয়র্ক বা অন্য কোনো সুবিধাজনক জায়গায় আমাদের সৈন্য সমাবেশ করা দরকার। রিচার্ড যদি এসেই পড়ে তাকে ঠেকাতে হবে। সেজন্যে আমার মতে এই ফালতু টুর্নামেন্ট এখনই শেষ করা উচিত।
তুমি ঠিকই বলেছো, স্যার ফিটজার, বললো দ্য ব্রেসি। তবে একটা কথা, সাধারণ যোদ্ধারা প্রতিযোগিতা করার জন্যেই অধীর হয়ে আছে। ওদের সুযোগ না দিয়ে ফালতু হোক আর যা-ই হোক টুর্নামেন্ট যদি শেষ করে দেয়া হয়, ওরা খুবই ক্ষুব্ধ হবে। রাজপুত্রের ওপর ক্ষেপেও উঠতে পারে।
কথাটা একেবারে ফেলে দেয়ার মতো বলেনি দ্য ব্রেসি, বললেন ওয়ান্ডেমার। তবে একথাও ঠিক টুর্নামেন্টের দিন আর একটা বাড়ানো যাবে না। আমি বলি কি, যাদের ইচ্ছে আজই প্রতিযোগিতায় নামুক। সন্ধ্যা হতে এখনো অনেক দেরি। এর ভেতর যা হয় হবে।
আমার মনে হয় তীর ছোড়ার প্রতিযোগিতাই জমবে ভালো, বললো একজন।
হ্যাঁ, সেরা তীরন্দাজকে একটা পুরস্কারও দেয়া যেতে পারে।
শেষ পর্যন্ত তা-ই ঠিক হলো। রাজপুত্রের নির্দেশে ঘোষক ঘোষণা করলো, অত্যন্ত জরুরি কাজে রাজপুত্র জন আগামীকাল ব্যস্ত থাকবেন। তাই কাল আর কোনো প্রতিযোগিতা হবে না। আজই টুর্নামেন্টের শেষ দিন। সেজন্যে এখনই আজকের প্রতিযোগিতার সমাপ্তি ঘোষণা করা হচ্ছে না। সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিযোগিতা চলবে। দর্শকদের ভেতর যারা যোদ্ধা আছেন তাঁরা ইচ্ছে করলে তীর ধনুক নিয়ে তাঁদের নৈপুণ্যের প্রমাণ দিতে পারেন। যিনি সেরা তীরন্দাজ বলে বিবেচিত হবেন তাকে যথাযযাগ্য পুরস্কার প্রদান করা হবে।
সঙ্গে সঙ্গে জনা ত্রিশেক তীরন্দাজ এগিয়ে এলো। কিন্তু প্রতিযোগিতা যখন শুরু হলো, দেখা গেল আট জন মাত্র আছে। বাকিরা পরাজয়ের আশঙ্কায় সরে দাঁড়িয়েছে প্রতিযোগিতা থেকে। জন তার আসন থেকে নেমে এলেন প্রতিযোগীদের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্যে।
পরিচয় পর্ব শেষে শুরু হলো প্রতিযোগিতা।
শুরু থেকেই দর্শকরা বলাবলি করতে লাগলো, হিউবার্টই জিতবে। জনৈক নরম্যান নাইটের বনরক্ষী হিউবার্ট। তীর ছোঁড়ায় দারুণ হাত। গত কয়েক বছরের টুর্নামেন্টে সে-ই বিজয়ী হয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলেই সবার ধারণা।
আটজন মাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই প্রতিযোগিতা শেষ হতে বেশিক্ষণ লাগলো না। দর্শকদের ধারণাই সত্য প্রমাণিত হলো। সবাইকে হারিয়ে দিয়েছে হিউবার্ট। আবার সে প্রমাণ করেছে লক্ষ্যভেদে তার জুড়ি নেই।
জন উঠে দাঁড়িয়ে তাকে বিজয়ী ঘোষণা করতে যাবেন, এমন সময় সবুজ পোশাক পরা এক তীরন্দাজ এগিয়ে এলো। দেখামাত্র চিনলেন জন। গতকাল যে তীরন্দাজ তার সাথে উদ্ধতভাবে কথা বলেছিলো লোকটা সে-ই। তাকে দেখেই চটে গেলেন জন।
কাল তো খুব বড় বড় কথা বলেছিলে, বললেন তিনি, আজ প্রতিযোগিতার সময় তোমার টিকিটাও যে দেখা গেল না?
এদের সাথে আমাকে তীর ছুঁড়তে দেয়া হবে কি না বুঝতে পারছিলাম, জবাব দিলো লোকটা। দিলেও লক্ষ্যভেদের ব্যবস্থা একই রকম হবে কি না জানি না। তা ছাড়া আমার ধারণা হিউবার্ট বিজয়ী হোক তা-ই আপনি চান। তাই দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।
চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠলো জনের।
তুমি মনে করো হিউবার্টকে তুমি হারাতে পারবে? কঠোর কণ্ঠে প্রশ্ন: করলেন তিনি।
মনে প্রাণে চেষ্টা যে করবো তাতে সন্দেহ নেই।
এবার আরো রেগে গেলেন জন। আগের মতোই চিৎকার করে বললেন, নাম কি তোমার?
লক্সলি, মহামান্য রাজপুত্র।
লক্সলি! ঠিক আছে, নামো প্রতিযোগিতায়। হিউবার্টকে যদি হারাতে পারো নির্দিষ্ট পুরস্কার ছাড়াও অতিরিক্তষশটা রৌপ্য মুদ্রা তোমাকে দেয়া হবে। আর যদি হেরে যাও, তোমার জামা খুলে রেখে বাঁচাল বলে এখান থেকে বের করে দেয়া হবে!
তাতে আমার ওপর সুবিচার করা হবে না। যাক, আপনার যখন ইচ্ছা, নামছি আমি প্রতিযোগিতায়।
দূরে খাড়া করে রাখা একটা তক্তা হলো লক্ষ্যস্থল। তার গায়ে একটা কালো বৃত্ত আঁকা। কালো বৃত্তের কেন্দ্রে আবার ছোট্ট একটা বৃত্ত, শাদা রঙের। শাদা বৃত্তের কেন্দ্রে তীর বেঁধানোর চেষ্টা করতে হবে প্রতিযোগীদের।
হিউবার্টই ছুঁড়লো প্রথমে। তীরটা লক্ষ্যস্থলের কেন্দ্রে না লেগে লাগলো সামান্য একটু দূরে। এবার লক্সলির পালা। তার তীরও শাদা বৃত্তের কেন্দ্রে লাগলো না। তবে হিউবার্টের চেয়ে কেন্দ্রের অনেক কাছাকাছি লাগলো সেটা।
দেখে ভীষণ চটে উঠলেন জন। হিউবার্টকে লক্ষ্য করে বললেন, এই বাউণ্ডুলের কাছে যদি হেরে যাও, তোমাকে আমি আস্ত রাখবো না, বুঝলে?
এবার খুব মন দিয়ে লক্ষ্য স্থির করলো হিউবার্ট। ধনুকের ছিলা টেনে নিয়ে এলো কানের পাশে। কয়েক সেকেন্ড নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে রইলো লক্ষ্যস্থলের দিকে। তারপর ছেড়ে দিলো ছিলা। তীরবেগে ছুটলো তীর। শাদা বৃত্তের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে লাগলো। দর্শকরা উফুল্ল কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো। জনের মুখেও ফুটে উঠেছে হাসি।
এবার তুমি কি করবে লক্সলি? ব্যঙ্গ মেশানো স্বরে প্রশ্ন করলেন তিনি। তোমার তীর কি হিউবার্টের তীর সরিয়ে জায়গা করে নেবে?
হি-হি করে হেসে উঠলো জনের কয়েকজন সহচর।
দেখা যাক কি করি, গম্ভীর মুখে বলে ধনুকে তীর পরালো লক্সলি। কানের কাছে টেনে নিয়ে এলো ছিলাটা। লক্ষ্যস্থির করে ছেড়ে দিলো।
সাঁই শব্দ তুলে ছুটলো তীর। হিউবার্টের তীরের পেছনে লেগে সেটাকে আগা গোড়া দুভাগ করে কেটে শাদা বৃত্তের কেন্দ্রে গিয়ে বিধলো।
দর্শকদের উৎফুল্ল চিৎকার থেমে গেছে। কারো মুখে কথা সরছে না। নিজের চোখে দেখার পরও ঘটনা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে সবার কাছে।
কেউ কেউ মন্তব্য করলো, লক্সলি মানুষ না, জাদুকর!
মহামান্য রাজপুত্র, লক্সলি বললো, প্রতিযোগিতার নামে এতক্ষণ যা হলো একে এক হিশেবে ছেলে খেলা বলা যেতে পারে। আমাদের দেশে, মানে উত্তর ইংল্যান্ডে যেভাবে তীর ছোড়ার প্রতিযোগিতা হয় তা এখানে দেখানোর অনুমতি পাবো কি?
অনুমতি দিলেন জন।
ছফুট লম্বা, খুব সরু একটা উইলোর ডাল মাটিতে পুঁতে লক্মলি বললে, একশো গজ দূর থেকে এই ডালে তীর লাগাতে হবে। যদি কেউ পারে আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, মহান রাজা রিচার্ডের সামনে প্রতিযোগিতায় নামার যোগ্যতা সে রাখে।
আমার বাপ, দাদা সবাই ভালো তীরন্দাজ ছিলো, বললো হিউবার্ট, আমি তো দূরে থাক তারাও এ ধরনের লক্ষ্যে কখনো তীর ছুঁড়েছে বলে শুনিনি। এই লোক ঐ ডালে যদি তীর লাগাতে পারে খুব খুশি মনেই আমি হার স্বীকার করে নেবো।
ব্যাটা ভীতু, চেষ্টা করে দেখতে তো পারতি! চিৎকার করে উঠলেন জন। ঠিক আছে, লক্সলি, দেখি তোমার ক্ষমতা কতটুকু। চ।
প্রথমে খুব সাবধানে ধনুকের ছিলাটা বদলালো ললি। তৃণ থেকে অনেকক্ষণ বেছে একটা তীর বের করলো। তারপর তৈরি হলো ছোঁড়ার জন্যে।
লক্ষ্যস্থির করে তীর ছুঁড়লো লক্সলি। সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখলো, দুটুকরো হয়ে গেছে উইলোর ডালটা। রাজপুত্র পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে গেছেন। সব বিদ্বেষ ভুলে শতকণ্ঠে, তিনি প্রশংসা করতে লাগলেন লক্সলির নৈপুণ্যের।
তুমি যে বিজয়ী হয়েছে, আমার মনে হয় না এ বিষয়ে কারো মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ আছে, বললেন জন। তারপর লক্সলির হাতে তুলে দিলেন বিজয়ীর পুরস্কার। প্রতিশ্রুতি মতো অতিরিক্ত বিশটা রৌপ্যমুদ্রাও দিলেন। এবং বললেন, তুমি যদি আমার দেহরক্ষী বাহিনীতে কাজ করতে রাজি হও, মাসে তোমাকে পঞ্চাশ রৌপ্যমুদ্রা দেবো।
অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ, মহামান্য রাজপুত্র, জবাব দিলো, লক্সলি, আপনার চাকরি করতে পারলে আমি খুশিই হতাম। কিন্তু আমার একটা প্রতিজ্ঞা আছে, চাকরি যদি করি, করবো আপনার ভাই রাজা রিচার্ডের। আর আপনার এই বিশটা মুদ্রা হিউবার্টকে দেবেন। খুব ভালো তীরন্দাজ ও। বেচারা যদি ভয় পেয়ে পিছিয়ে না যেতো, আমার মতো ও-ও দুটুকরো করে ফেলতে পারতো ডালটাকে।
না, না, অসম্ভব, আমি পারতাম না, হিউবার্ট বললো বটে তবে জন যখন রৌপ্য মুদ্রাগুলো ওকে দিলেন খুশি মনেই সে গ্রহণ করলো সেগুলো।
এরপর যখন আবার জন ললির খোঁজ করলেন কোথাও দেখতে পেলেন না তাকে। ভীড়ের ভেতর অদৃশ্য হয়েছে সে।
.
টুর্নামেন্টের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন জন। তারপর নেমে এলেম আসন থেকে। সহচর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এবার?
এক্ষুনি ইয়র্ক-এ সৈন্য সমাবেশ করতে হবে, বললেন ওয়ান্ডেমার। আমি রওনা হয়ে যাচ্ছি। কিছু টাকা পয়সার ব্যবস্থা করে আপনি আসুন।
বিশ্বস্ত এক রক্ষীকে ডেকে পাঠালেন জন।
এক্ষুণি অ্যাশবিতে যাও, বললেন তিনি। ইহুদী আইজাককে খুঁজে বের করে বলবে, আজ সূর্যাস্তের আগেই যেন দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা পৌঁছে দেয় আমার কাছে।
১০. অ্যাশবি ছাড়লেন ওয়ান্ডেমার
সন্ধ্যার আগেই অ্যাশবি ছাড়লেন ওয়ান্ডেমার। ইয়র্কে যাওয়ার আগে আশপাশের এলাকাগুলো থেকে কিছু সৈন্য সংগ্রহের চেষ্টা চালালেন তিনি। কাজটা খুব সহজ হলো না। রাজপুত্র জনকে পছন্দ করে এমন লোকের সংখ্যা নিতান্তই কম। তার পক্ষ হয়ে রাজা রিচার্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো মানুষের সংখ্যা আরো কম।
ভীতি এবং প্রলোভন দুটোই দেখাতে হলো ওয়ার্ল্ডেমারকে। যারা রাজপুত্রের পক্ষে যোগ দেবে তাদেরকে জমি জমা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। প্রতিশ্রুতিতে যারা ভুললো না, তাদের ভয় দেখালেন, রাজপুত্রকে সাহায্য না করলে জমিজমা যা আছে সব নিয়ে নেয়া হবে। যেখানে বুঝলেন জমির লোভ দেখিয়ে লাভ হবে না সেখানে দেখালেন নগদ অর্থের লোভ; রিচার্ড পরাজিত হলে তার পক্ষের লোকদের ধন সম্পদ যা লুঠ করা হবে তার ভাগ দেয়া হবে তাদের। এইভাবে ছোট একটা বাহিনী তিনি গঠন করতে পারলেন, যেটা অবিলম্বে ইয়র্কের পথে রওনা হয়ে যাবে। ওয়াল্ডেমার সিদ্ধান্ত নিলেন বাকি সৈন্য ইয়র্ক ও তার আশপাশের এলাকাগুলো থেকে সংগ্রহের চেষ্টা চালাবেন। আর রিচার্ড দেশে ফিরে আসার আগেই রাজপুত্র জনকে রাজার আসনে অভিষিক্ত করা হবে।
এরপর ওয়াল্ডেমার অ্যাশবির দুর্গে ফিরে এলেন।
তখন গভীর রাত। ভীষণ ক্লান্ত তিনি। দুর্গের বড় হল কামরায় ঢুকতেই দেখা হয়ে গেল দ্য ব্রেসির সঙ্গে। অবাক হয়ে ওয়ান্ডেমার দেখলেন, আইন বিরোধী ডাকাতদের মতো পোশাক পরে আছে দ্য ব্রেসি। হাতে একটা ধনুক, কোমরে তৃণীর ভর্তি তীর। নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না ওয়ার্ল্ডেমার।
নাটুকে পালা করার সময় এটা নয়, দ্য ব্রেসি, কঠোরকণ্ঠে বললেন তিনি। আমাদের সামনে এখন কঠিন সময়। আমার, তোমার, রাজপুত্র জনের–সবার! এর ভেতর তুমি কি খেলা শুরু করেছো? কেন অমন পোশাক পরেছো?
বউ জোগাড় করার জন্যে, শান্ত, শীতল কণ্ঠে জবাব দিলো দ্য ব্রেসি।
কী।
বউ জোগাড় করার জন্যে, আবার বললো দ্য ব্রেসি। সেড্রিক আর তার দলের পেছন পেছন যাবো আমি। ওরা বনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে হামলা চালিয়ে সুন্দরী রোয়েনাকে উঠিয়ে নিয়ে আসবো।
তুমি পাগল হয়ে গেছ নাকি, দ্য ব্রেসি? চিৎকার করে উঠলেন ওয়াল্ডেমার। সেড্রিক লোকটা স্যাক্সন হলেও অসম্ভব ধনী। এবং ক্ষমতাশালীও। খোদ রাজপুত্রই এ সময়ে ওকে ঘাটানোর সাহস পাবেন না, আর তুমি! রাজপুত্র শুনলে ভয়ানক রেগে যাবেন তোমার ওপর।
না, না, আমার পরিকল্পনাটা আগে শুনুন, তাহলে বুঝতে পারবেন, রাজপুত্র একটুও রাগবেন না। আমরা যখন হামলা চালাবো তখন থাকবো ডাকাতদের পোশাকে। সেড্রিক ভাববে ডাকাতরাই হামলা চালিয়েছে। পরে আমি আমার পোশাক পরে গিয়ে ডাকাতদের আস্তানা থেকে উদ্ধার করবো রোয়েনাকে। তারপর ওকে নিয়ে তুলবো ফ্ৰঁত দ্য বোয়ফের দুর্গে। যদি দেখি পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠছে তাহলে ফ্রান্সেও চলে যেতে পারি। যতদিন না ও মরিস দ্য ব্রেসির বউ হয় ততদিন কেউ আর ওর চেহারা দেখবে না!
চমৎকার পরিকল্পনা! ব্যঙ্গ করে বললেন ওয়ার্ল্ডেমার। কার মাথা থেকে বেরিয়েছে? সেড্রিক এত বোকা মনে করেছো? প্রথমে ডাকাত হিশেবে, পরে উদ্ধারকর্তা হিশেবে যাবে, আর ও চিনতে পারবে না।
ডাকাতির সময় আমি সঙ্গে থাকবো, শুধু। একান্ত প্রয়োজন না হলে সামনে যাবো না।
লোকজন পাচ্ছো কোথায়? তোমার হাতে তো দুটো লোকও নেই।
আঁ, আপনি যদি জানতেই চান তাহলে বলবো…।
হ্যাঁ, বলো, আমি জানতে চাইছি, ফেটে পড়লেন ওয়ান্ডেমার।
টেম্পলার বোয়া-গিলবার্ট দেবেন লোক। ওঁর সাঙ্গপাঙ্গরাই ডাকাতি করবে। আমি আড়ালে থেকে খেয়াল রাখবো শুধু।
ওহ! তারপর বোয়া-গিলবার্টের খপ্পর থেকে ওকে উদ্ধার করবে কিভাবে?
সেটা কোনো সমস্যা হবে না, বোয়া-গিলবার্ট টেম্পলার, সুতরাং বিয়ে করতে পারবে না। যাহোক, আমি এখন যাই, আমার ঘোড় আর লোকজন। অপেক্ষা করছে। বিদায়, স্যার ওয়াল্ডেমার, সত্যিকারের একজন নাইটের মতো আমি আমার মনের মানুষকে জিতে নেবো।
তুমি একটা গর্দভ, দ্য ব্রেসি। রাজপুত্রের যখন সাহায্য দরকার তখন তুমি যাচ্ছে গাধামি করতে। ঠিক আছে যাচ্ছে যখন যাও, কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইয়র্কে চলে এসো। সঙ্গে যত জন পারো লোক নিয়ে আসবে।
কিছু না বলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল দ্য ব্রেসি। বিরক্ত মুখে ওর চলে যাওয়া দেখলেন ওয়ার্ল্ডেমার। তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করলেন, গর্দভ! বোকা গাধা!
রাজপুত্রের সাথে দেখা করার জন্যে রওনা হলেন তিনি।
.
বোয়া-গিলবার্ট আইভানহোর কাছে পরাজিত হবার পর আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না ব্ল্যাক নাইট। টুর্নামেন্ট ময়দান ছেড়ে রওনা হয়ে গেল নিজের পথে। উত্তরে ইয়র্ক নগরীর দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো সে। লোক চলাচলের সাধারণ পথে গেল না। মানুষ জনের সামনে যেন না পড়তে হয় সেজন্যে বনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললো। এবং এক সময় আবিষ্কার করলো সে পথ হারিয়ে ফেলেছে বিশাল শেরউড জঙ্গলে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তাছাড়া সারাদিনের পরিশ্রমে ঘোড়াটা ক্লান্ত, ছুটতে তার কষ্ট হচ্ছে। নিজেও পরিশ্রান্ত। রাত কাটানোর মতো একটা আশ্রয়ের একান্ত প্রয়োজন। অথচ কোথায় গেলে আশ্রয় মিলবে জানা নেই। শেষ পর্যন্ত সে ঘোড়াটাকে ইচ্ছে মতো চলতে দেয়ার জন্যে লাগাম আলগা করে দিলো।
কিছুক্ষণ পর দূর থেকে গির্জার ঘণ্টাধ্বনির মতো অস্পষ্ট একটা আওয়াজ ভেসে এলো নাইটের কানে। তাড়াতাড়ি আবার শক্ত হাতে লাগাম ধরলো সে। ঘোড়া ছোটালো শব্দ লক্ষ্য করে। কিছুদূর গিয়ে প্রাচীন একটা গির্জার ভগ্নাবশেষ নজরে পড়লো তার। গির্জাটা ভেঙেচুরে গেলেও চূড়াটা এখনো মাথা উঁচিয়ে আছে। তারই একটা পুরনো মরচেধরা ঘণ্টা মাঝে মাঝে বাতাসের দমকে নড়ে উঠে বাজছে।
গির্জার অদূরে ওক কাঠের বেড়া দেয়া ছোট্ট একটা কুটির। পাশেই ক্ষীণ একটা ঝরনা টলটলে জল বুকে নিয়ে বয়ে চলেছে। আবার শোনা গেল ঘণ্টাধ্বনি। আগের চেয়ে অনেক মৃদু। নাইটের মনে হলো কুটিরের ভেতর থেকেই যেন এলো শব্দটা। বোধহয় কোনো পবিত্র সন্ন্যাসী থাকেন এই কুটিরে, ভাবলো সে। যদি চাই নিশ্চয়ই উনি আমাকে খাদ্য ও রাতের মতো আশ্রয় দেবেন।
কুটিরের সামনে গিয়ে ঘোড়া থেকে নামলো নাইট। বর্শার উঁটি দিয়ে মৃদু আঘাত করলো দরজায়।
কোনো সাড়াশব্দ নেই কুটিরের ভেতরে। কিছুক্ষণ পর আবার আঘাত করলো নাইট।
এগিয়ে যাও, গম্ভীর একটা গলা ভেসে এলো এবার। এখানে গোলমাল করে আমার প্রার্থনায় বিঘ্ন ঘটিও না।
ফাদার, আমি একজন হতভাগ্য পথিক। পথ হারিয়ে ফেলেছি। খাবার এবং রাতের মতো আশ্রয় দরকার আমার। আমাকে দয়া করুন।
যাও, যাও, বললাম না বিরক্ত কোরো না! আমার কাছে যে খাবার আছে তা কুকুরের খাওয়ার মতো নয়। আমার বিছানা কুকুরের শোয়ার উপযোগী নয়। তুমি ভাগো! আমাকে নিরিবিলিতে প্রার্থনা করতে দাও।
ফাদার, আমি মিনতি করছি, দরজা খুলুন, পথহারাকে সঠিক পথ দেখান।
ভাই, আমিও মিনতি করছি, দয়া করে আমাকে আর বিরক্ত কোরো না।
আশ্রয় যদি একান্ত না-ই দিতে চান, কোন পথে গেলে পাবো তা অন্তত বলে দিন।
এখান থেকে সোজা কিছুদূর গেলে একটা জলা পাবে। সেটা পেরিয়ে আরো কিছুদূর গেলে পাবে ছোট একটা নালা। বছরের এই সময় হেঁটেই পার হতে পারবে। নালা পার হয়ে ডান দিকে যাবে। পথ চলার সময় সাবধানে থেকো…।
থাক থাক আর বলতে হবে না, বাধা দিয়ে বললো নাইট। এই রাতে আমি জলা, নালা, খাল, বন্দক পেরিয়ে যেতে পারবো না। হয় আপনি দরজা খুলুন, না হলে আমিই ঢুকলাম দরজা ভেঙে, বলেই সে দমাদ্দম লাথি চালাতে লাগলো দরজার ওপর।
থামো, থামো! চিৎকার করে উঠলেন ফাদার। আসছি! আমি আসছি! খুলছি দরজা! একটু দাঁড়াও।
কপাট দুটো খুলে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে দরজা জুড়ে দাঁড়ালেন সন্ন্যাসী। মোটাসোটা লোক। বলিষ্ঠ গড়ন। মুখটা ঢাকা হুড দিয়ে। তার এক হাতে মোটা একটা কাঠের লাঠি। দুপাশে এসে দাঁড়িয়েছে দুটো কুকুর। আগন্তকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে তৈরি। গলা দিয়ে গরগর আওয়াজ বেরোচ্ছে তাদের। ব্ল্যাক নাইটের চেহারা ও সাজ পোশাক দেখার সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য সন্ন্যাসীর আক্রমণাত্মক ভঙ্গি অদৃশ্য হয়ে গেল।
ভেতরে এসো, নরম করে বললেন তিনি।
ভেতরে ঢুকে নাইট খেয়াল করলো, চার পাশে ছড়িয়ে আছে সন্ন্যাসীর দারিদ্রের চিহ্ন। একটা মাত্র চৌকি ঘরে। তাতে খড়ের বিছানা পাতা। খটখটে একটা টেবিলের দুপাশে দুটো খটখটে টুল। ব্যস আর কোনো আসবাবপত্র নেই। নাইটকে একটা টুল দেখিয়ে বসতে ইশারা করলেন সন্ন্যাসী। নিজে বসলেন অন্যটায়।
ফাদার, শুরু করলো ব্ল্যাক নাইট, আগে আমার তিনটে প্রশ্নের জবাব দিন, তারপর অন্য কথা। প্রথমত, আমার ঘোড়াটাকে রাখবো কোথায়? দ্বিতীয়ত, আমি শোবো কোথায়? আর সবশেষে, রাতে খাবো কি?
আমি ইশারায় তোমার প্রশ্নের জবাব দেবো, বললেন সন্ন্যাসী। কারণ কথা বলার চেয়ে নীরবতাই আমার বেশি পছন্দ। এর পর তিনি ঘরের এক কোনার দিকে ইশারা করলেন, অর্থাৎ ঘোড়াটা ওখানে থাকতে পারবে। অন্য কোণের দিকে ইশারা করে বোঝালেন, ওখানে শোবে নাইট। সবশেষে উঠে একটা পাত্র থেকে এক মুঠো শুকনো বীন নিয়ে একটা থালায় করে এগিয়ে দিলেন নাইটের দিকে। এই হলো রাতের খাবার।
সন্ন্যাসী নিজের জন্যেও এক মুঠো বীন নিয়ে একটা থালায় রাখলেন। তারপর শুরু করলেন প্রার্থনা। দীর্ঘ প্রার্থনা শেষে দুতিনটে বীন মুখে ছুঁড়ে দিলেন তিনি নাইটের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন, খাও!
কিন্তু খাওয়ার আগে পোশাক ছাড়তে হবে নাইটকে। উঠে দাঁড়ালো সে। প্রথমে খুললো গায়ের বর্ম। তারপর শিরোস্ত্রাণ। সুন্দর, নিস্পাপ একটা মুখ দেখতে পেলেন সন্ন্যাসী। মাথায় ঘন, সোনালী চুল। উঠে তিনি নিজেও আগন্তুকের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করলেন। মাথা থেকে সরিয়ে দিলেন হুডটা। নাইট খেয়াল করলো, সাধারণত সন্ন্যাসীদের যেমন হয় তেমন রোগা, মাংসহীন নয় এ সন্ন্যাসীর মুখ। এঁর মুখটা প্রায় গোল, বেশ মাংসল। একটু লালচে ভাব আছে গালে। চেহারায় ফুর্তিবাজ একটা ভাব। এই মুখের মালিক যে শুকনো বীন নয়, মাংস ও ভালো মদ খেয়ে অভ্যস্ত, বুঝতে এক মুহূর্ত দেরি হলো না তার।
যুদ্ধের পোশাক ছেড়ে আবার সে টুলে গিয়ে বসলো। সন্ন্যাসীর দেখাদেখি মুখে দিলো দুতিনটে শুকনো বীন। এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলো কি বোকামিই না করেছে। এমন শক্ত জিনিস মানুষের খাদ্য হতে পারে না। সন্ন্যাসী হয় ঠাট্টা করেছেন নয়তো বোকা বানিয়েছেন ওকে। কোনো মতে চিবিয়ে বীন কটা গিলে ফেলে পানীয় চাইলো নাইট।
এক জগ ঠাণ্ডা পানি রাখলেন সন্ন্যাসী তার সামনে। বললেন, পান করো, বৎস, সেইন্ট ডানস্ট্যানের পবিত্র কূপের পানি।
নাইট ইতস্তত করছে দেখে জগটা ঠোঁটের কাছে তুলে চুমুক দিলেন তিনি।
এবার আর থাকতে পারলো না নাইট। বিদ্রুপের সুরে বললো, শুকনো বীন আর ঠাণ্ডা পানি খেয়ে যে বাহারের চেহারা বানিয়েছেন, আপনাকে দেখে তো যে কারো হিংসে হওয়ার কথা! চেহারা দেখে কে বলবে আপনি সন্ন্যাসী, বনের ভেতর নির্জন কুটিরে বসে উপাসনা আর ঈশ্বরের ধ্যানে দিন কাটান?
স্যার নাইট, তুমি ভুলে যাচ্ছো আমার শাদামাঠা খাবারের ওপর স্বর্গবাসী সন্তদের আশীর্বাদ আছে, গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলেন সন্ন্যাসী।
আচ্ছা! তাহলে স্বীকার করতেই হয় স্বর্গ অন্তত এই একটা ক্ষেত্রে অসাধ্য সাধন করেছে। দোষ নেবেন না, ফাদার, এই পাপীর মনে একটা কৌতূহল জেগেছে, আপনার নামটা কী জানতে পারি?
তুমি আমাকে কপম্যানহা-এর সন্ন্যাসী বলে ডাকতে পারো। সবাই সাধারণত এ নামেই আমাকে ডাকে। কেউ কেউ অবশ্য সন্ন্যাসীর আগে পবিত্র শব্দটা জুড়ে দেয়। কিন্তু, সত্যিই বলছি, এই উপাধির যোগ্য আমি নই। তোমার নামটা কি এবার জানা যায়?
নিশ্চয়ই, ফাদার। আপনি আমাকে ব্ল্যাক নাইট বলে ডাকতে পারেন। কেউ কেউ অবশ্য অলস শব্দটা জুড়ে দেয়, কিন্তু, সত্যিই বলছি, এই উপাধির যোগ্য আমি নই।
হাসলেন সন্ন্যাসী। কথা শুনে তো মনে হচ্ছে বিদ্যেবুদ্ধি আছে পেটে। ভদ্রলোকদের ভেতর দিন কাটিয়ে অভ্যস্ত তাই না?
হ্যাঁ বা না কিছু বললো না নাইট। সন্ন্যাসী এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, এই মাত্র একটা কথা মনে পড়ে গেল আমার। কদিন আগে এক বন-রক্ষী কিছু রান্না করা মাংস দিয়ে গেছিলো আমাকে। সারাদিন জপ তপ নিয়ে থাকি তো, তাছাড়া ওসব খাবার আমি খাই না, তাই একদম মনে ছিলো না। একটু চেখে দেখবে নাকি?
আপনার চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছি, ফাদার, আপনার কুটিরে শুকনো বীনের চেয়ে ভালো খাবার আছে। এখন বের করুন দেখি তাড়াতাড়ি। খিদেয় নাড়ীভুড়ি পর্যন্ত হজম হয়ে গেল।
ঘরের অন্ধকার এক কোণে গিয়ে ছোট্ট একটা লুকানো আলমারি থেকে বিরাট এক থালা মাংস বের করে আনলেন সন্ন্যাসী। থালাটা তিনি টেবিলে রাখতে না রাখতেই খেতে শুরু করলো নাইট।
আহ্, খুব ভালো তো খেতে! বললো সে। আপনার সেই বন-রক্ষী, কবে দিয়ে গেছে এ জিনিস?
তা প্রায় দুমাস তো হবেই।
আরেকটা আশ্চর্য ঘটনা, বড় এক টুকরো মাংস মুখে পুরতে পুরতে বললো নাইট।
সতৃষ্ণ নয়নে ফাদার দেখছেন তার খাওয়া। একেকটা টুকরো সে মুখে ফেলছে আর আঁতকে আঁতকে উঠছেন তিনি। অতি দ্রুত খালি হয়ে আসছে থালা।
ফাদারের মনের অবস্থা বুঝতে অসুবিধা হলো না নাইটের।
বুঝলেন, ফাদার, আমি প্যালেস্টাইনে ছিলাম, বললো সে। ওখানে দেখেছি, প্রত্যেক গৃহস্থই সবচেয়ে ভালো খাবার দিয়ে অতিথিকে আপ্যায়ন করে, এবং অতিথির সঙ্গে নিজেও খায়। খাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও খায়। এটা ওদের ভদ্রতা। তাছাড়া প্রমাণ দেয় খাবারে বিষ মেশানো নেই। আপনি সন্ন্যাসী মানুষ এসব উপাদেয় খাবারে রুচি নেই আমি জানি, তবু আমার অনুরোধ প্যালেস্টাইনীদের মতো আপনার অতিথির সাথে আপনিও কিছু মুখে দিন।
চক চক করে উঠলো সন্ন্যাসীর চোখ। খাবো? তুমি বলছো?
ইচ্ছে করছে না? আরেকটা বড় টুকরো মুখে পুরে বললো নাইট।
না, না, করছে, বলে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সন্ন্যাসী ঝাঁপিয়ে পড়লেন মাংসের ওপর। বিরাট একটা টুকরো তুলে চালান করে দিলেন মুখে।
অনেক কষ্টে হাসি সামলালো নাইট। খাওয়া শেষে সে বললো, আপনার সেই বন-রক্ষী মদ টদ কিছু দিয়ে যায়নি?
হেসে লুকানো আলমারিটার দিকে এগিয়ে গেলেন সন্ন্যাসী। বিরাট একটা বোতল আর দুটো গেলাস নিয়ে এলেন। শুরু হলো পান পর্ব।
গেলাসে চুমুক দিয়ে নাইট বললো, আপনাকে যত দেখছি, ততই রহস্যময় মনে হচ্ছে, ফাদার। আশা করি বিদায় নেয়ার আগে আরো অনেক কিছু জানতে পারবো আপনার সম্পর্কে।
সন্দেহ নেই তুমি সাহসী নাইট, বললেন ফাদার, কিন্তু তোমার মাত্রাজ্ঞান একটু কম মনে হচ্ছে। দেখ, আমার ব্যাপারে যদি বেশি কৌতূহল দেখাও, তোমাকে এমন শিক্ষাই দেবো, বাকি জীবনে আর তা ভুলতে পারবে না।
আচ্ছা! ঈশ্বরভক্ত সন্ন্যাসীর মতো কথাই বটে। বেশ, আপনার চ্যালেঞ্জ আমি গ্রহণ করছি। কি নিয়ে লড়বেন বলুন।
তোমার যা খুশি, বলতে বলতে আলমারিটা আবার খুললেন ফাদার। এর ভেতর যা যা আছে তার থেকে যে কোনোটা তুমি বেছে নিতে পারো।
নাইট এগিয়ে গিয়ে দেখলো, ঢাল, তলোয়ার, তীর-ধনুকে প্রায় বোঝাই আলমারির একটা তাক। এক পাশে পড়ে আছে একটা বীণা।
বাহ বাহ! বললো নাইট। ঈশ্বরের উপাসনার জন্যে দারুণ সব উপকরণ মওজুদ করেছেন দেখছি! ঠিক আছে, আপনাকে আর প্রশ্ন করবো না, আমার সব কৌতূহলই মিটে গেছে। অস্ত্রশস্ত্র থাক, তার চেয়ে বরং আসুন এটা নিয়ে কিছু করা যায় কিনা দেখি। বীণাটা বের করে আনলো নাইট।
তোমাকে যে লোকে অলস বলে, বোধ হয় মিথ্যে বলে না। এত সব চমৎকার অস্ত্রশস্ত্র রেখে কিনা বের করলে বীণা! ঠিক আছে, তুমি আমার অতিথি, তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। এসো গেলাস ভরে নাও, তারপর তুমি বাজাও আমি শুনি।
কিন্তু দুগেলাস পেটে পড়তেই শুধু শুনে আর চললো না সন্ন্যাসীর। বাজনার সাথে সাথে হেঁড়ে গলায় গান ধরলেন তিনি। একটু পরে নাইটও গলা মেলালো। কিছুক্ষণের ভেতর বিভোর হয়ে গেলেন দুই শিল্পী।
কতক্ষণ কেটে গেছে এভাবে কেউ বলতে পারবে না। হঠাৎ মৃদু টোকার শব্দ হলো দরজায়। মুহূর্তে থেমে গেল গান বাজনা। মাংসের থালা আর মদের বোতল গেলাস লুকিয়ে ফেলার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন সন্ন্যাসী। নাইট দ্রুত হাতে পরে নিলেন শিরোস্ত্রাণ।
আবার টোকার শব্দ হলো।
কে? চিৎকার করে উঠলেন সন্ন্যাসী।
ব্যাটা বিড়ালতপস্বী! শোনা গেল একটা কণ্ঠস্বর। খুলুন! আমি লক্সলি।
১১. অচেতন হয়ে পড়ে যাওয়া বিজয়ী নাইট
সেড্রিক যখন দেখলেন অচেতন হয়ে পড়ে যাওয়া বিজয়ী নাইট আর কেউ নয়, তারই একমাত্র ছেলে আইভানহো, ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে হলো তার। কিন্তু তাঁর অহঙ্কার তাঁকে পেছনে টেনে রাখলো। যে ছেলে পিতার অবাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, যাকে তিনি উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন, এত লোকের সামনে তার ব্যাপারে দুর্বলতা দেখাতে সংকোচ বোধ করলেন তিনি। ধীরে ধীরে সরে এলেন সে জায়গা থেকে। কিন্তু ছেলের জন্যে আকুলতা তাঁর গেল না। শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবে চিন্তে বিশ্বস্ত ভৃত্য অসওয়াল্ডকে পাঠিয়ে দিলেন আইভানহোর দেখাশোনা করার জন্যে। ভাবলেন, অবাধ্য ছেলের জন্যে এর চেয়ে বেশি আর কি করবেন তিনি?
অসওয়াল্ড এগিয়ে গেল নাম না জানা নাইট যেখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলো সেখানে। কিন্তু কোথায় নাইট? আঁতিপাতি করে খুঁজলো অসওয়াল্ড। কোথাও দেখলো না আইভানহোকে। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে বিচারকদের শরণাপন্ন হলো সে। আইভানহো কোথায় কি অবস্থায় আছে, জানতে চাইলো। বেশিরভাগ বিচারকই বললেন তারা জানেন না। একজন কেবল বললেন, তিনি জানেন। এক মহিলা দর্শক খুব যত্নের সাথে তাকে নিজের পালকিতে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেছে। বাহকরা পালকি নিয়ে কোথায় বা কোন দিকে গেছে তা তিনি বলতে পারলেন না।
আরো দুচারজনকে জিজ্ঞেস করলো অসওয়াল্ড। কিন্তু কেউই নতুন কিছু বলতে পারলো না। মনিবকে খবরটা জানানোর জন্যে ফিরে আসছে, এমন সময় গার্থের ওপর নজর পড়লো তার। হঠাৎ করে আইভানহো অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় বেচারা শুয়োর পালক এমন দিশেহারা হয়ে পড়েছে যে ছদ্মবেশ সম্পর্কে তার যে সতর্ক হওয়া দরকার তা তার একদম মনে নেই। অসওয়াল্ড দেখামাত্র ওকে চিনে ফেললো। এবং দুদিন ধরে নাম না জানা নাইটের ভৃত্য হিশেবে যাকে দেখা যাচ্ছিলো সে যে গাৰ্থই তা-ও বুঝতে পারলো। পাকড়াও করে মনিবের কাছে নিয়ে এলো ওকে অসওয়াল্ড।
গার্থকে দেখেই ভয়ানক ক্ষেপে উঠলেন সেড্রিক। ওর পোশাক আশাক দেখে তিনিও বুঝতে পেরেছেন এই দুদিন আইভানহোকে সাহায্য করেছে ও।
বদমাশকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখো! চিৎকার করে নির্দেশ দিলেন তিনি।
এরপর সেড্রিক অসওয়ান্ডের কাছে জানতে চাইলেন আইভানহোর খবর। যা যা জানতে পেরেছে সব বললো অসওয়াল্ড। শুনে একটু স্বস্তি বোধ করলেন সেড্রিক। এবার তার মনে জেগে উঠলো অভিমান। সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, হতভাগা যে চুলোয় খুশি যাক! আমার কি? যাদের জন্যে ও আমাকে ছেড়ে গেছে তারাই ওর সেবা যত্ন করুক পারে তো। তোমরা সব তৈরি হও, ভৃত্যদের দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দিলেন তিনি, আমরা এক্ষুনি রওনা হবো।
কয়েক মিনিট লাগলো তৈরি হতে। তারপর রওনা হলেন সেড্রিক দলবল নিয়ে। ইতোমধ্যে অ্যাথেলস্টেন একটু বিশ্রাম নিয়ে, যথাসম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে এসে যোগ দিয়েছে তাদের সাথে। স্যাক্সন হওয়া সত্ত্বেও নরম্যানদের হয়ে কেন লড়লো সে সম্পর্কে তাকে একটা প্রশ্নও করলেন না সেড্রিক।
সন্ধ্যার কিছু পরে বার্টন-অন-ট্রেন্ট-এ পৌঁছুলেন ওঁরা। বার্টন-অনট্রেন্টের সেইন্ট উইদহোন্ড মঠের প্রায়োরকে আগেই সেড্রিক খবর দিয়ে রেখেছিলেন, তারা আসছেন; মঠে রাতটা থেকে ভোরে বাড়ির পথে রওনা হবেন।
মঠের স্যাক্সন প্রায়োর অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে অভ্যর্থনা জানালেন ওঁদের। আগে থাকতে খবর পাওয়ায় ভালো খাবার দাবারের আয়োজন করতে পেরেছিলেন তিনি। মঠে ঢুকেই খেতে বসে গেল সবাই। খাওয়া দাওয়ার পর অতিথিরা কে কোথায় ঘুমাবেন দেখিয়ে দিলেন প্রায়োর।
সকালে ঘুম থেকে উঠে পেট ভর্তি নাশতা করে দলবল নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন সেড্রিক।
সারাদিন একটানা পথ চলে দিন শেষে এক বনের কাছে পৌঁছুলেন তাঁরা। পথচারীদের জন্যে খুব খারাপ জায়গা এ বন, চোর, ডাকাত, আইন বিরোধীদের স্বর্গ। রাতে তো বটেই দিনের বেলায়ও মাঝে মাঝে পথিকদের সর্বস্ব কেড়ে রেখে দেয় এ বনের দস্যুরা। কিন্তু সেড্রিক ভয় পেলেন না। কারণ তিনি জানেন ইংল্যান্ডের বেশিরভাগ ডাকাতই স্যাক্সন। নরম্যান রাজশক্তির কোপানলে পড়ে তারা ডাকাত হয়েছে। আগে ওরা সব সাধারণ মানুষই ছিলো। এখন নিছক বেঁচে থাকার জন্যে ডাকাতি করে। তার ধারণা তার আর অ্যাথেলস্টেনের নাম শুনলে ডাকাতি দূরে থাক সম্মান জানিয়ে কূল পাবে না ওরা। তাছাড়া তিনি নিজে এবং অ্যাথেলস্টেন দুজনই যোদ্ধা, সঙ্গে আছে বারো জন অনুচর। সুতরাং ভয় পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
বনে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেল। অন্ধকার হয়ে এলো চারদিক। ধীর গতিতে ঘোড়া চালিয়ে চলেছেন সেড্রিক ও অ্যাথেলস্টেন। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো নারীকণ্ঠে করুণ কান্নার শব্দ। মাঝে মাঝে কাতর চিৎকার: বাঁচাও! একটু সাহায্য করো আমাদের!
শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলেন সেড্রিক। কিছুদূর যেতেই দেখতে পেলেন, পথের পাশে পড়ে আছে ঘোড়া ছাড়া একটা পাল্কি-গাড়ি। পাশে বসে অপূর্ব সুন্দরী এক তরুণী। ইহুদী ঢং-এ কাপড় পরা। কাঁদছে সে-ই। সামান্য দূরে এক বৃদ্ধ অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। তাঁরও পরনে ইহুদী ধাঁচের পোশাক। মাথায় ইহুদীদের হলদে টুপি। দেখা মাত্র সেড্রিক চিনতে পারলেন বুড়ো ইহুদী আইজাক ও তার মেয়ে রেবেকাকে।
আইজাক যা বললেন তার মর্মার্থ: অসুস্থ এক বন্ধুকে বয়ে নেয়ার জন্যে অ্যাশবি থেকে একটা পাল্কি-গাড়ি আর ছয়জন রক্ষী ভাড়া করেছিলেন তিনি। চুক্তি হয়েছিলো ডাঙ্কেনস্টার পর্যন্ত তাদের পৌঁছে দেবে ওরা। এ পর্যন্ত নিরাপদেই এসেছেন কিন্তু তারপর এক কাঠুরিয়ার সাথে দেখা হয়ে যায় তাঁদের তখন সন্ধ্যা হতে সামান্য বাকি। কাঠুরিয়া রক্ষীদের নিষেধ করে আর এগোতে। কারণ সে নাকি দেখেছে, একটু সামনে একদল ডাকাত ওঁৎ পেতে বসে আছে। এই শুনে আর একমুহূর্ত দেরি করেনি ভাড়াটে লোকগুলো। ঘোড়া কটা নিয়ে চম্পট দিয়েছে। পাল্কি-গাড়িটা কেবল রেখে গেছে, সম্ভবত অসুস্থ লোকটাকে নামিয়ে রাখতে গেলে যেটুকু দেরি করতে হতো সেটুকু করারও সাহস পায়নি তারা। বৃদ্ধ, তার মেয়ে আর অসুস্থ লোকটাকে ফেলে রেখে গেছে ডাকাতদের দয়ার ওপর।
যতক্ষণ না বন পার হচ্ছি ততক্ষণ দয়া করে আমাদের সাথে নেবেন আপনারা? বিনীত ভঙ্গিতে প্রার্থনা জানালেন আইজাক।
না, সেড্রিক কিছু বলার আগেই বলে উঠলো অ্যাথেলস্টেন। ইহুদী কুকুর! টুর্নামেন্টের সময় গ্যালারিতে বসবার জন্যে আমার সাথে কেমন অদ্র ব্যবহার করেছিলে ভুলে গেছ এর মধ্যে? ডাকাতরা যদি ধরেই তুমি তাদের সাথে যুদ্ধ করবে, না পালিয়ে যাবে, না আপোষে তাদের সাথে মিটমাট করবে তা তুমি জানো। আমাদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাবে না। এতদিন নিরীহ মানুষদের কাছ থেকে সুদ খেয়ে খেয়ে পেট মোটা করেছে, এবার তার খেসারত দাও।
অ্যাথেলস্টেনের কথা শুনে মাথা নাড়লেন সেড্রিক। কেন যেন ইতস্তত করছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন, না, অ্যাথেলস্টেন, বেচারা যখন এত করে বলছে, কিছু হলেও আমাদের সাহায্য করা দরকার। আমি বলি কি, গোটা দুই ঘোড়া আর জনা দুই লোক দিয়ে যাই। তাহলে, আমার মনে হয়, সামনে প্রথম যে গ্রাম পড়বে সেখানে গিয়ে ওরা একটা আশ্রয় খুঁজে নিতে পারবে। আমাদের দুজন লোক কমে যাবে বটে, কিন্তু অ্যাথেলস্টেন, তুমি যখন সঙ্গে আছো, বোধহয় কোনো দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে আমাদের, কি বলো?
বাবা, ঠিকই বলেছো, রোয়েনা সমর্থন করলো সেড্রিকের কথা।
এমন সময় রেবেকা এগিয়ে এলো। রোয়েনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে চুমু খেলো ওর গাউনের প্রান্তে।
দয়া করুন আমাদের, কাতর কণ্ঠে মিনতি করলো সে। আপনাদের সাথে যাওয়ার সুযোগ দিন দয়া করে। আমি আমার জন্যে বলছি না, আমার বুড়ো বাবার জন্যেও না, আমি বলছি ঐ অসুস্থ ভদ্রলোকের জন্যে। অনেকের কাছেই তার প্রাণ খুব দামী, আপনার কাছেও। যদি ওঁর কিছু হয়ে যায় সারাজীবন আপনি এ নিয়ে আক্ষেপ করবেন।
রেবেকার কাতর স্বরে মন নরম হয়ে গেল রোয়েনার। সেড্রিকের কাছে গিয়ে সে বললো, বুড়ো বাপটা দুর্বল; মেয়েটা যুবতী, সুন্দরী; সঙ্গী অস্থ। আমি বলি কি, বাবা, ওদের সাথে নিয়ে নাও। একটা ঘোড়াই পাল্কি-গাড়িটা টানতে পারবে, আর ওদের বাপ-বেটির জন্যে লাগবে দুটো ঘোড়া। আমার মনে হয় না তিনটে ঘোড়া দিয়ে দিলে আমাদের খুব অসুবিধা হবে। যে ঘোড়াগুলো মালপত্র বইছে তাদের বোঝা একটু বাড়বে এই যা, তা-ও খুব বেশিক্ষণের জন্যে নয়। সামনের গ্রামটায় পৌঁছে গেলেই তো ওরা ওদের পথে চলে যেতে পারবে।
রাজি হয়ে গেলেন সেড্রিক। ভৃত্যরা জিনিসপত্র নামিয়ে তিনটে ঘোড়া খালি করে দিতে লাগলো।
সেড্রিক তার কথা না শোনায় একটু ক্ষুন্ন হয়েছে অ্যাথেলস্টেন।
ওরা তাহলে আমাদের একেবারে পেছনে থাকবে, রুক্ষ কণ্ঠে বললো সে। আর, ওয়াম্বা, তুই তোর শুয়োরের মাংসের ঢাল নিয়ে ওদের রক্ষা করবি।
আমার চেয়ে অনেক বড় বড় বীর টুর্নামেন্টে বর্ম ফেলে এসেছেন, ওয়াম্বা জবাব দিলো। তাদের দেখাদেখি আমিও আমার ঢালটা ফেলে এসেছি ওখানে।
অপমানে চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো অ্যাথেলস্টেনের। সত্যি সত্যিই তাকে পরাজিত হয়ে বর্ম ফেলে আসতে হয়েছে। ওয়াকে উচিত একটা শিক্ষা দেয়ার ইচ্ছা হলেও আপাতত সামলে নিলো সে। ওয়াম্বা ক্রীতদাস হলেও সেড্রিকের প্রিয় পাত্র। ওকে কিছু বললে সেড্রিক তা সুনজরে দেখবেন না।
তুমি তো আমার পাশে পাশে যেতে পারো, রেবেকার কাছে গিয়ে রোয়েনা বললো।
না, জবাব দিলো রেবেকা। সেটা ভালো দেখাবে না। আপনি যে অনুগ্রহ দেখিয়েছেন তা-ই যথেষ্ট আমার জন্যে।
একটা ঘোড়ার পিঠে দুহাত বাঁধা অবস্থায় বসে ছিলো গাৰ্থ। সেড্রিকের নির্দেশে ওয়াম্বা তাকে নামিয়ে ঘোড়াটা দিলো বৃদ্ধ ইহুদীকে। এরই ভেতর এক ফাঁকে সে দয়া পরবশ হয়ে গার্থের হাতের বাঁধনটা একটু ঢিলে করে দিলো। সব কিছু যখন ঠিক ঠাক করে আবার রওনা হলো দলটা তখন এক সুযোগে গার্থ হাতের বাঁধন পুরো খুলে ফেলে এক ছুটে ঢুকে পড়লো বনের ভেতর। দলের কেউ তা খেয়াল করলো না।
.
সদলবলে এগিয়ে চলেছেন সেড্রিক বন-পথ ধরে। পথ ক্রমেই সরু হয়ে আসছে। শেষকালে এমন হলো পাশাপাশি দুজন চলাও দায় হয়ে পড়লো। সামনে একটা নালা। নালার পরেই শুরু হয়েছে জলাভূমি। মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেছে সরু পথ। সেড্রিক ভাবলেন, ডাকাতরা যদি হামলা করে এখানেই করবে। সবাইকে তাড়াতাড়ি এগোনোর নির্দেশ দিলেন তিনি।
ঠিকই ভেবেছিলেন সেড্রিক। দলের অর্ধেক সবে মাত্র পার হয়েছে নালা, এই সময় চারদিক থেকে সবুজ পোশাক পরা ডাকাত দল আক্রমণ করলো তাদের। আচমকা আক্রান্ত হয়ে সবাই এমন হকচকিয়ে গেলেন যে দস্যুদের ঠিক মতো বাধাও দিতে পারলেন না। একমাত্র ওয়াম্বা ছাড়া আর সবাই বন্দী হলো ডাকাতদের হাতে।
তলোয়ার হাতে বেশ কিছুক্ষণ লড়লো ওয়া। কয়েকজন ডাকাতকে কাবুও করলো। তবে শেষ পর্যন্ত গতিক সুবিধার নয় দেখে হৈ–চৈ-এর ভেতর এক ফাঁকে পালিয়ে গেল জঙ্গলে।
.
বনের ভেতর কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালো ওয়া। কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। তারপর হঠাৎ নিচুকণ্ঠের একটা ডাক শুনে চমকে উঠলো ও। ওর নাম ধরেই ডাকছে।
ওয়াম্বা! আবার শোনা গেল ডাকটা।
এবার চিনতে পারলো ওয়াম্বা গার্থের গলা।
গার্থ নাকি? নিচু কণ্ঠে প্রশ্ন করলো ও।
জবাবে কাছের একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো গার্থ।
ব্যাপার কি, ওয়াম্বা? জিজ্ঞেস করলো সে। একটু আগে চিৎকার চেঁচামেচি আর তলোয়ারের ঠোকাঠুকি শুনলাম!
আমাদের মনিব আর তাঁর মেয়ে দলবলসুদ্ধ বন্দী হয়েছেন ডাকাতদের হাতে। আমি পালিয়ে এসেছি কোনোমতে।
দুশ্চিন্তার ছাপ পড়লো গার্থের মুখে।
ওয়া, বললো সে, তোমার কাছে তলোয়ার আছে, বুকের ভেতর কলজেটাতে সাহসও আছে, তার ওপর আছি আমি। চলো, দুজনে মিলে মনিবকে উদ্ধার করা যায় কিনা দেখি। এসো–
থামো!
ঝোপ ঝাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো এক লোক। পরনে সবুজ পোশাক। ওয়াম্বা ভাবলো এ-ও বোধহয় ডাকাতদেরই একজন। সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার বাগিয়ে ধরলো ও। কিন্তু গাৰ্থ চিনতে পারলো লোকটাকে। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় দিনে তীর ছোঁড়া প্রতিযোগিতায় যে বিজয়ী হয়েছিলো সেই লক্সলি।
কি ব্যাপার? এখানে কারা কাকে আক্রমণ করে বন্দী করলো? জানতে চাইলো সে।
খানিকটা এগিয়ে গেলেই দেখতে পাবে কারা, ঝঝের সাথে বললো ওয়াম্বা। পোশাক দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি তাদেরই দলের লোক। আর কাকে, শুনবে? আমার মনিব মহান স্যাক্সন সেড্রিক আর তার মেয়ে রোয়েনাকে।
একটু যেন থমকালো লোকটা।
আচ্ছা, দাঁড়াও তোমরা, আমি দেখে আসছি। আমি না ফেরা পর্যন্ত নোড়ো না, নইলে কিন্তু বিপদে পড়ে যাবে।
বনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল লক্মলি। ফিরে এলো একটু বাদেই।
তোমাদের মনিবকে কারা আটকেছে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমি জানতে পেরেছি, বললো সে। ওরা সংখ্যায় এত বেশি, আমরা মাত্র তিনজন এই মুহূর্তে কিছু করতে পারবো না ওদের। তাই বলে ভেবো না আমি বসে থাকবো। আমার সব লোকদের জড় করে আমি উদ্ধার করবো স্যাক্সন সেড্রিককে। এসো আমার সাথে।
১২. দ্রুত গতিতে হেঁটে চলেছে লক্সলি
দ্রুত গতিতে হেঁটে চলেছে লক্সলি। তার সাথে তাল রাখার জন্যে রীতিমতো দৌড়াতে হচ্ছে গার্থ আর ওয়াম্বাকে।
এইভাবে পাক্কা তিন ঘণ্টা চলার পর বনের ভেতর একটা ফাঁকা জায়গায় উপস্থিত হলো তারা। জায়গাটার মাঝখানে বিশাল এক ওক গাছ মাথা তুলেছে। তার নিচে শুয়ে আছে পাঁচজন লোক। সবুজ পোশাক প্রত্যেকের গায়ে। পাঁচজনই ঘুমিয়ে। ষষ্ঠ একজন পাহারা দিচ্ছে ঘুমন্ত লোকগুলোকে। এরও পরনে সবুজ পোশাক।
কে! থামো!
ওদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো পাহারাদার। অমনি তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো ঘুমিয়ে থাকা লোকগুলো। মুহূর্তের ভেতর তীর ধনুক বাগিয়ে তৈরি।
তিনজন এগিয়ে গেল আরো খানিকটা। এবার ওরা চিনতে পারলো ললিকে। অত্যন্ত সম্মানের সাথে তাকে অভ্যর্থনা জানালো। গাৰ্থ, ওয়া দুজনের কারোই বুঝতে বাকি রইলো না, এই রাজদ্রোহী ডাকাত দলটার নেতা ললি।
মিলার কোথায়? প্রথম প্রশ্ন করলো সে।
রদারহ্যামের রাস্তায়। ছজনকে সাথে নিয়ে গেছে।
অ্যালান আ-ডেল?
ওয়াটালিং স্ট্রীটের দিকে গেছে। জরভক্স মঠের প্রায়োরকে ধরার জন্যে। ঘাপটি মেরে থাকবে।
আর আমাদের সাধু টাক?
কপম্যানহা-এ ওঁর কুটিরে।
ঠিক আছে, আমি নিজেই যাচ্ছি ওঁর কাছে। তোমরা শোনো! মন দিয়ে শোনো! ভোর হওয়ার আগেই আমাদের সবাইকে এখানে জড় করতে হবে। জরুরি একটা কাজ আছে। দুজন এক্ষুনি চলে যাও রেজিনাল্ড ট্রুত দ্য বোয়েফের টরকুইলস্টোন দুর্গে। একদল নরম্যান গুপ্তা আমাদের মতো পোশাক পরে কয়েকজন স্যাক্সনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যতটুকু বুঝেছি ওরা বোয়েফের দুর্গের দিকেই যাচ্ছে। দুৰ্গটার ওপর চোখ রাখবে তোমরা দুজন। ওরা দুর্গে ঢুকে পড়ার আগেই আমাদের গিয়ে উদ্ধার করতে হবে বন্দীদের।
লক্সলির নির্দেশ মতো যে যার কাজে চলে গেল। আর ও নিজে গাৰ্থ আর ওয়াম্বাকে নিয়ে রওনা হলো কপম্যানহাস্ট আশ্রমের দিকে। ভাঙা গির্জাটার কাছাকাছি পেীছে ওরা শুনতে পেলো, পাশের ছোট্ট কুটির থেকে ভেসে আসছে ফাদার ও তার অতিথির গান। দুই শিল্পীই যে প্রচুর পরিমাণে পান করেছেন তা তাদের গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে।
শোনো! গার্থের কানে কানে বললো ওয়াষা, সাধুবাবার আশ্রমে প্রার্থনা চলছে, শোনো।
কুটিরের দরজায় গিয়ে টেলকম দিলো ললি।
সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল গনি। কিন্তু দরজা খুললো না। আবার টোকা দিলো ললি।
কে? সন্ন্যাসীর গলা ভেসে এলো ভেতর থেকে।
ব্যাটা বিড়াল তপস্বী! আপন মনে গজগজ করে উঠলো লক্সলি। তারপর বললো, খুলুন! আমি লক্সলি।
ভয়ের কিছু নেই, নাইটের দিকে তাকিয়ে সন্ন্যাসী বললেন। তারপর খুলে দিলেন দরজা।
ভেতরে কে, সন্ন্যাসী? জিজ্ঞেস করলো লক্সলি।
আমাদের পথের এক ভাই। সারারাত ধরে আমরা প্রার্থনা করছি।
হ্যাঁ, মাইল খানেক দূর থেকেও শোনা যাচ্ছিলো আপনাদের প্রার্থনা। হাসলো ললি। এখন শুনুন, নষ্ট করার মতো সময় নেই একদম। আপনি আপনার পথের ভাইকে নিয়ে এক্ষুনি চলুন আমাদের সাথে। যেখানে যাকে পাওয়া যায়, সবাইকে আমার দরকার হবে।
আর কথা বাড়ালেন না ফাদার, তাড়াতাড়ি তিনি গাউন খুলে ডাকাতের সবুজ পোশাক পরতে লাগলেন। এই ফাকে লক্সলি ঘরের এক কোনায় টেনে নিয়ে গেল ব্ল্যাক নাইটকে।
আমার মনে হয় আপনাকে আমি চিনি, বললো সে। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় দিনে আপনিই তো বাঁচিয়েছিলেন আইভানহোকে?,
যদি বাঁচিয়ে থাকি তো কি হয়েছে?
সত্যিই যদি আপনি সেই নাইট হন, বুঝবো আপনি দুর্বলের সহায়, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আপনার স্বভাব।
সত্যিকারের নাইট মাত্রেরই কর্তব্য সেটা। এখন তুমি কি বলতে চাইছো বলো তো।
আমি যে কথা বলবো তা শুনতে হলে শুধু নাইট হলেই চলবে না, খাঁটি ইংরেজও হওয়া চাই।
ইংল্যান্ড আর ইংরেজ!–পৃথিবীতে এই দুটো জিনিসের চাইতে প্রিয় আমার আর কিছু নেই।
তাহলে বলছি শুনুন, এক দল নরম্যান বদমাশ স্যাক্সন সেড্রিক আর তার মেয়েকে বন্দী করেছে। তার সঙ্গে আর যারা ছিলো তাদেরও আটকেছে। আমি যতটুকু জানতে পেরেছি ওরা এখন টরকুইলস্টোন দুর্গের দিকে যাচ্ছে। সেড্রিককে উদ্ধারের কাজে আমি আপনার সাহায্য চাইছি, নাইট।
খুশি মনেই আমি করবো সাহায্য। কিন্তু তার আগে জানতে চাই, তুমি কে?
আমি আমার দেশ ও আমার দেশকে যারা ভালোবাসে তাদের বন্ধু। এর বেশি কিছু আমি এই মুহূর্তে বলতে পারব না। আমাকে পীড়াপীড়ি করবেন না।
বেশ, আর কিছু জিজ্ঞেস করবো না, বললো ব্ল্যাক নাইট। পরে, আশা করি, আমরা একে অন্যকে আরো ভালোভাবে জানতে পারবো।
সন্ন্যাসী ইতোমধ্যে প্রায় তৈরি হয়ে গেছেন। রাজদ্রোহী দস্যুদের পোশাকের ওপর আবার তার ঢোলা গাউন পরে নিয়েছেন তিনি। গাউনের নিচে কোমরে তলোয়ার, কাঁধে তীর ধনুক।
চলুন, বিড়াল তপস্বী, চলুন নাইট, লক্সলি বললো। গাৰ্থ আর ওয়াম্বার দিকে তাকিয়ে যোগ করলো, তোমরাও এসো। যত বেশি লোক হয় ততই ভালো। ঐত দ্য ববায়েফের দুর্গ দখল করা চাট্টিখানি কথা নয়।
ফ্রঁত দ্য বোয়েফ! সবিস্ময়ে উচ্চারণ করলো নাইট, রেজিনাল্ড ট্রুত দ্য বোয়েফ রাজার বিশ্বস্ত প্রজন্তুদের ওপর হামলা চালিয়েছে! ও আজকাল ডাকাতি শুরু করেছে নাকি?
ডাকাতি, হাহ! মাথায় হুড লাগাতে লাগাতে বললেন সন্ন্যাসী টাক। আমার চেনা বহু ডাকাতের চেয়ে অনেক বেশি দুশ্চরিত্র ও।
.
বন্দীদের নিয়ে সারা রাত পথ চললো দ্য ব্রেসি আর টেম্পলার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্ট। ভোরের সামান্য আগে পৌঁছে গেল টরকুইলস্টোন দুর্গের কাছাকাছি।
এবার বোধহয় তোমার বিদায় নেয়া উচিত, দ্য ব্রেসি, বললো বোয়াগিলবার্ট। পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশের নায়ক তো তুমি। তৈরি হয়ে এসো
প্রেমিকাকে উদ্ধার করার জন্যে।
না, আমি মত বদলেছি। তোমার সাথেই থাকছি আমি। মত বদলেছে! সবিস্ময়ে বললো টেম্পলার ব্রায়ান। কেন?
ইতস্তত করছে দ্য ব্রেসি। যা বলতে চায় তা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। দেখে ব্রায়ান আবার বললো, তুমি কি ভাবছো সুন্দরী রোয়েনাকে আমি কেড়ে নেবো তোমার কাছ থেকে? না, বন্ধু, ভুল ভেবেছো তুমি। তোমার রোয়েনাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই আমার। দলে আরেকটা মেয়ে আছে দেখোনি?–রোয়েনার চেয়ে অনেক সুন্দরী ও।
মানে! তুমি আইজাকের মেয়ে রেবেকার কথা বলছো? ঠিক তাই।
আমি তো ভেবেছিলাম বুড়ো ইহুদীর টাকার থলেটার ওপরই তোমার লোভ। এখন বলছো মেয়েটাকেও চাও!
হ্যাঁ। যদি চাই তো কে বাধা দেবে? টাকার মাত্র অর্ধেক আমি পাবো। বাকি অর্ধেক দিয়ে দিতে হবে রেজিনান্ডকে। ও কি মনে করো আমোক ওর দুর্গ ব্যবহার করতে দিচ্ছে?–মেয়েটাকে যদি না বাগাতে পারি আমার লোকসান হয়ে যাবে না?
কিন্তু, তুমি টেম্পলার, আজীবন অবিবাহিত, থাকার পবিত্র শপথ নিয়েছে। এই অবস্থায় বিয়ে তো বিয়ে, একেবারে ইহুদীর মেয়েকে—
দেখ, দ্য ব্রেসি, কোনো শপথই আমি নেইনি। যদি নিয়েও থাকি নিয়েছি লোক দেখানোর জন্যে। তাতে যদি পাপ হয়ে থাকে, ক্রুসেডে যোগ দিয়ে তিন তিনশো বিধর্মীকে হত্যা করেছি, নিশ্চয়ই সে পাপ স্খলন হয়ে গেছে। আমার তো মনে হয় কিছু পুণ্যও সঞ্চয় হয়েছে। সুতরাং কোনো কাজই আমার কাছে গহিত নয়।
কি জানি–তোমার ব্যাপার তুমিই ভালো বোঝো, মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো দ্য ব্রেসি।
ভয় পেও না, দ্য ব্রেসি, আশ্বাস দিলো বোয়া-গিলবার্ট, তোমার রোয়েনাকে আমি কেড়ে নেবো না তোমার কাছ থেকে। বিশ্বাস হচ্ছে না আমাকে?
হচ্ছে– কিন্তু, ঐ একই কথা, আমি যাচ্ছি তোমার সাথে টরকুইলস্টোনে।
কয়েক মিনিটের ভেতর পৌঁছে গেল ওরা দুর্গের সামনে। কোমর থেকে শিঙা খুলে নিয়ে তিনবার ফু দিলো দ্য ব্রেসি। ঘড় ঘড় শব্দে নেমে এলো ঝুলসেতু। বন্দীদের নিয়ে দুর্গে ঢুকলো দুই নাইট।
রোয়েনা আর রেবেকাকে আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হলো অন্যদের কাছ থেকে। ভিন্ন ভিন্ন দুটো প্রকোষ্ঠে আটকে রাখা হলো। মাটির নিচের অন্ধকার স্যাতসেঁতে একটি কুঠুরিতে আটকানো হলো বুড়ো আইজাককে। সেড্রিক আর অ্যাথেলস্টেনকে রাখা হলো এক কামরায়। আর চাকরবাঁকরদের সব পাঠিয়ে দেয়া হলো অন্য একটা ঘরে।
১৩. বেচারা আইজাক
বেচারা আইজাক! বরফের মতো ঠাণ্ডা তার ছোট্ট কুঠুরিটা। অন্ধকার আর স্যাতসেঁতে ভাব তো আছেই; আরো আছে ইঁদুর। সংখ্যায় অজস্র। এই অন্ধকুঠুরীতে আগে যেসব বন্দী মারা গেছে তাদের কঙ্কাল এখনো দেয়ালে ঝুলছে শেকলে বাঁধা অবস্থায়। ভয়, দুঃখ, হতাশা সব কিছু এক সাথে গ্রাস করেছে বুড়ো ইহুদীকে। এক কোণে হাঁটু দুটো বুকের সাথে ঠেকিয়ে বসে আছেন তিনি।
হঠাৎ লোহার ভারি দরজায় একটা শব্দ হলো। চমকে মুখ তুলে তাকালেন আইজাক। এক সেকেন্ড পর খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকলো রেজিনান্ড ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ। পেছনে কয়েকজন ভূত্য। বিরাট এক দাঁড়িপাল্লা, অনেকগুলো বাটখারা আর কয়েক ঝুড়ি কয়লা নিয়ে এসেছে তারা।
বিশালদেহী ফ্ৰঁত দ্য বোয়ে এগিয়ে এলো আইজাকের সামনে। ক্রূর দৃষ্টিতে তাকালো বৃদ্ধের দিকে। আতঙ্কে কেঁপে উঠলেন আইজাক সে দৃষ্টি দেখে।
দেখেছে দাঁড়িপাল্লা? শীতল কণ্ঠে বললো রেজিনাল্ড।
মাথা ঝাকালেন বৃদ্ধ, গলা দিয়ে কোনো স্বর বেরোলো না।
এই পাল্লায় তুমি আমাকে এক হাজার পাউন্ড রূপা ওজন করে দেবে। যদি না দাও, এই অন্ধকার কক্ষে তোমাকে তিলে তিলে মরতে হবে। ভেবো
আমি মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছি, তোমার আগে অনেকেই মরেছে এখানে। দেয়ালের দিকে তাকাও, তাহলেই প্রমাণ পাবে। কেউ তাদের খবর পায়নি, আচমকা একদিন তারা হারিয়ে গেছে এ পৃথিবী থেকে। আমার আদেশ পালন না করলে তুমিও যাবে।
ওহ নবী আব্রাহাম! রুদ্ধশ্বাসে চিৎকার করে উঠলেন আইজাক। বিশ্বাস করুন এত রূপা আমার কাছে নেই। ইয়র্ক শহরে যত ইহুদী আছে সবার বাড়ি খুঁজলেও আপনি অত রূপা পাবেন না।
ভালো কথা, রূপা যদি না-ই প্লকে, সোনা দেবে।
দয়া করুন আমাকে, স্যার নাইট, কাতর কণ্ঠে বললেন আইজাক। আমি বুড়ো মানুষ, অসহায়, আমার কিছু নেই। বিশ্বাস করুন আমি কপর্দকশূন্য।
কপর্দকশূন্য! হাসলো রেজিনান্ড। ইয়র্কের আইজাক, কপর্দকশূন্য! পাগলেও তো বিশ্বাস করবে না। শোনো, আইজাক, তোমার সাথে রসের আলাপ করার সময় আমার নেই। যা চাইলাম দেবে কিনা বলল, না হলে তৈরি হও যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর জন্যে।
বিশ্বাস করুন, অত টাকা–
শেষ করতে পারলেন না বৃদ্ধ। ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ ভৃত্যদের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লো, শুরু করো!
মেঝের ওপর এক ঝুড়ি কয়লা ঢেলে রাখলো এক ভৃত্য। অন্য একজন আরেকটা ঝুড়ি থেকে কয়েক টুকরো শুকনো কাঠ বের করে আগুন জ্বাললো চকমকি ঠুকে। জ্বলন্ত কাঠের ওপর মুঠো মুঠো কয়লা দিতে লাগলো প্রথম ভৃত্য, আর অন্যজন বাতাস করতে লাগলো হাতপাখা দিয়ে। দেখতে দেখতে গনগনে হয়ে জ্বলে উঠলো কয়লা।
দেখতে পাচ্ছো, আইজাক, আগুন? আগের মতোই শান্ত শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো রেজিনা। একটু পরেই ওর ওপর শুইয়ে দেয়া হবে তোমাকে। জ্যান্ত কাবাব বানানো হবে…।
না! না! চিৎকার করে উঠলেন আইজাক।
আরে, এখনই না না করছো কেন, সবটা তো এখনো বলিনি! মাংস যাতে ধীরে ধীরে পোড়ে সে জন্যে আমার চাকররা অল্প অল্প করে ঠাণ্ডা তেল ঢালবে তোমার ওপর।
না! না! না! রক্ত হিম করা স্বরে আর্তনাদ করে উঠলেন বৃদ্ধ।
ধরো তো ওকে!নির্দেশ দিলো ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ। ব্যাটা ইহুদীকে উলঙ্গ করে শুইয়ে দাও আগুনের ওপর!
সঙ্গে সঙ্গে ভৃত্যরা তৎপর হয়ে উঠলো আদেশ পালন করার জন্যে। নরম্যান লোকটার মুখের দিকে তাকালেন আইজাক। দয়া বা মায়ার লেশমাত্র দেখতে পেলেন না সে মুখে।
দেবো! আমি দেবো! ভূত্যদের সাথে ধস্তাধস্তি করতে করতে তিনি বললেন।
থামো তোমরা! ভৃত্যদের দিকে ফিরে হাঁক ছাড়লো রেজিনাল্ড। এই তো পথে এসেছো বাছা!
এক হাজার পাউন্ড রূপাই আমি দেবে আপনাকে। কিন্তু আগে তা আমাকে জোগাড় করতে হবে ইয়র্কের অন্য ইহুদীদের কাছ থেকে। সেজন্যে কয়েক দিন সময় দিতে হবে আমাকে। আমাকে ছেড়ে দিন, সব জোগাড় করে পৌঁছে দেবো এখানে।
আহ্লাদের আর জায়গা পাওনি, ইহুদী কুত্তা? রূপা বা সোনা যা-ই হোক আগে আমার হাতে আসবে তারপর তোমাকে ছাড়ার প্রশ্ন।
তাহলে আমার মেয়ে রেবেকাকে ইয়র্কে যেতে দিন। ও টাকা জোগাড় করে নিয়ে আসবে।
রেবেকা? অসম্ভব! রেবেকাকে ধরেছে বোয়া-গিলবার্ট। ও-কিছুতেই ওকে ছাড়বে না।
রেবেকা বোয়া-গিলবার্টের বন্দী! ওহ নবী আব্রাহাম! ওহ ঈশ্বর! দুঃখে হতাশায় হৃদয়টা গুঁড়িয়ে যেতে চাইছে আইজাকের। রেজিনান্ডের পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে কেঁদে উঠলেন তিনি। যা চেয়েছেন তার দশগুণ দেব! চান তো শত গুণ দেবো। কিন্তু কিন্তু আমার মেয়েটাকে বাঁচান! বাঁচান দয়া করে!
কি আশ্চর্য! আমি কি করে বাঁচাবো তোমার মেয়েকে? বললাম না, ও বোয়া-গিলবার্টের বন্দী!। মুহূর্তে ভয়, ভাবনা, দুশ্চিন্তা সব দূর হয়ে গেল বৃদ্ধের মন থেকে। সোজা হয়ে দাঁড়ালেন রেজিনান্ডের মুখোমুখি। চোখ রাখলেন ওর চোখের দিকে। তারপর শান্ত কণ্ঠে বললেন, রেবেকাকে যতক্ষণ না মুক্তি দিচ্ছো, ততক্ষণ এক পয়সাও পাবে না আমার কাছ থেকে।
আরে, ইহুদী কুত্তা, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? আগুনের কথা মনে নেই?
আগুন কেন, ইচ্ছে হলে আরো খারাপ কিছু আনতে পারো, কিন্তু আমি যা বলেছি তাতে কোনো নড়চড় হবে না।
ধরো ওকে! চিৎকার করে উঠলো ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ।
এবারও এক মুহূর্ত দেরি না করে নির্দেশ পালন করতে লেগে গেল ভৃত্যরা। বৃদ্ধের আলখাল্লাটা খোলার চেষ্টা করছে। এই সময় বাইরে থেকে ভেসে এলো ট্রাম্পেটের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। তারপর চিৎকার। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে কে যেন উপরে ডাকছে ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফকে।
বিরক্তির ছাপ পড়লো রেজিনান্ডের চেহারায়।
এখনকার মতো বেঁচে গেলে, ইহুদীর বাচ্চা, চিবিয়ে চিবিয়ে বললো সে। পরের বার আর বাঁচবে না। কথাটা মনে রেখো।
বেরিয়ে গেল সে কুঠরি থেকে। ভূত্যরা অনুসরণ করল তাকে।
হাঁটু মুড়ে বসে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন বৃদ্ধ। তারপর তার সেই কোনায় গিয়ে কাঁদতে লাগলেন মেয়ের কথা মনে করে।
.
যে মুহূর্তে আইজাকের কুঠরিতে ঢুকেছে ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ ঠিক সেই মুহূর্তে রোয়েনার কক্ষে ঢুকলো দ্য ব্রেসি। ওর পরনে এখন ডাকাতদের নয়, সর্বশেষ ছাঁট কাটের দামী অভিজাত পোশাক। হাঁটু পর্যন্ত মাথা নুইয়ে রোয়েনাকে অভিবাদন জানালো সে।
আমাকে এখানে ধরে এনেছেন কেন? কেন আমাকে বন্দী করা হয়েছে?
সুন্দরী, বিগলিত হেসে দ্য ব্রেসি বললো, কে বলেছে তুমি বন্দী?–বন্দী তো আমি। তোমার রূপের শিকল আমাকে যে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে, রোয়েনা।
দেখুন, আপনাকে আমি চিনি না, শীতল কণ্ঠে বললো রোয়েনা। আবার আপনাকে জিজ্ঞেস করছি, কেন আমাকে ধরে এনেছেন?
তুমি আমার স্বপ্নের রানী, হৃদয়ের রানী শুরু করলো দ্য ব্রেসি, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিলো রোয়েনা।
দয়া করে প্রলাপ বন্ধ করুন, বললো সে। আমার প্রশ্নের জবাব দিন। কেন আমাকে ধরে আনা হয়েছে?
দ্য ব্রেসির অমায়িক মুখখাশটা এবার খসে পড়ে গেল।
শাদা কথায় জানতে চাও, তাই তো? রুক্ষ হয়ে উঠেছে তার গলা। তাহলে শোনো, শাদা কথায়ই বলছি, আমাকে যদি বিয়ে না করো এই প্রাসাদ-দুর্গ থেকে তুমি বেরোতে পারবে না। নিজেকে সামলে নিয়ে আবার অমায়িক মুখোশটা পরে নিলো দ্য ব্রেসি। প্রিয়তমা, যা করেছি তোমার মঙ্গলের জন্যেই করেছি। যে জঘন্য স্যাক্সন পরিবেশে তুমি মানুষ হয়েছে তা থেকে মুক্তি দিতে চাই। দেশের অভিজাত মহলে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে, সারা ইংল্যান্ডে তোমার সৌন্দর্যের খ্যাতি ছড়িয়ে দিতে হলে আমার মতো সভ্রান্ত মানুষকে বিয়ে করা ছাড়া তোমার আর পথ কোথায়?
কে চায় অভিজাত মহলে প্রতিষ্ঠা পেতে, বিশেষ করে আপনার মতো বদমাশরা যে মহলের বাসিন্দা? আর যে জঘন্য পরিবেশের কথা বলছেন ছেলেবেলা থেকে সেখানেই আমি মানুষ হয়েছি। তা যদি কোনো দিন ছেড়ে যেতে হয়, যাব এমন লোকের সাথে যে ঐ পরিবেশের নামে আপনার মতো নাক সিঁটকাবে না।
তোমার মনের গোপন ইচ্ছাটা যে জানি না তা নয়, আবার জ্বর হয়ে উঠেছে দ্য ব্রেসির দৃষ্টি। তাহলে শুনে রাখো আমার নাম মরিস দ্য ব্রেসি, আমি যা চাই সব সময় তা পেয়ে থাকি। আপোষে না পেলে শক্তি প্রয়োগেও দ্বিধা করি না। যদি ভেবে থাকো স্বপ্নের কোনো বীর এসে তোমাকে উদ্ধার করবে তাহলে ভুল ভেবেছো। রিচার্ড আর কোনোদিনই ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসবে না; তার প্রিয় পাত্র আইভানহোও কোনোদিন তোমার হাত ধরে তার সামনে যাওয়ার সুযোগ পাবে না। আইভানহো এখন আমাদের হাতে বন্দী। এই দুর্গেই আছে।
আইভানহো! এখানে! সবিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলো রোয়েনা।
হ্যাঁ, সুন্দরী। ইহুদী আইজাকের মেয়ে রেবেকার পাল্কি-গাড়িতে ও ছিলো। তোমাদের সাথেই এসেছে অথচ তুমি কিছু জানো না, আশ্চর্য ব্যাপার! তাহলে শোনো, আরেকটা খবর তোমাকে দেই, ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ এখন আইভানহোর প্রতিদ্বন্দ্বী।
আইভানহোর প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ! কেন?
তুমি ভান করছে, নাকি আর দশজন মেয়ের মতো ছলনার জাল বিস্তার করতে চাইছে আমি বুঝতে পারছি না, রোয়েনা। একজন অসুস্থ মানুষের সঙ্গে সুস্থ মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কখন হতে পারে বোঝো না? ঈর্ষা। হ্যাঁ, রোয়েনা, ঈর্ষা। রেজিনান্ড চায় রেবেকাকে, অথচ রেবেকা হৃদয় দিয়ে বসে আছে তোমার আইভানহোকে। এখন রেবেকাকে পেতে হলে কি করবে রেজিনাল্ড? আইভানহোকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলেই সব দিক থেকে সুবিধা তার। মনের মানুষই যদি পৃথিবীতে না থাকে তাহলে মন দেবে কাকে রেবেকা? তাছাড়া আইভানহোর যে সব সম্পত্তি রেজিনান্ড ভোগ করছে সেগুলোর ব্যাপারেও একশো ভাগ নিশ্চিত হয়ে যেতে পারবে সে। আইভানহো না থাকলে কে আর দাবি করবে আইভানহোর সম্পত্তি? বুঝতেই পারছো, আইভানহোর সামনে এখন মহাবিপদ। কিছু না, ডাক্তারকে ওর ওষুধের সাথে এক ফোটা বিষ মিশিয়ে দিতে বললেই হবে।
ঈশ্বরের দোহাই, আপনি বাঁচান আইভানহোকে!
হ্যাঁ বাঁচাতে পারি, মুচকি হাসলো দ্য ব্রেসি, যদি তুমি আমার কথায় রাজি হও। আমার স্ত্রীর আত্মীয় স্বজন বা ছেলেবেলার খেলার সাথীর গায়ে হাত দেয়ার সাহস কারো হবে না। কিন্তু ঐ যে বললাম, তার আগে তোমাকে আমার স্ত্রী হতে হবে। নইলে কেন আমি কোথাকার কোন আইভানহোর জন্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে বিবাদ করতে যাবো?
এতক্ষণ কোনো রকমে আত্মসংবরণ করে ছিলো রোয়েনা, এবার আর পারলো না। একেবারে ভেঙে পড়লো। তার দুচোখ ছাপিয়ে জল নেমে এলো মুখে ঘনিয়ে উঠলো হতাশা আর বিষাদের কালো ছায়া।
কয়েক মুহূর্ত রোয়েনাকে কাঁদতে দিলো দ্য ব্রেসি। তারপর কোমলকণ্ঠে বললো, এক্ষুনি অবশ্য তোমার ভাবনার কিছু নেই। তবে সিদ্ধান্ত নিতে খুব বেশি দেরি করে ফেলল না, তাহলে যে কি হবে আমি বলতে পারি না।
এমন সময় বাইরে থেকে ভেসে এলো ট্রাম্পেটের আওয়াজ। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল দ্য ব্রেসি।
মেঝের ওপর আছড়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো রোয়েনা।
.
দুজন লোক দুর্গের মিনারগুলোর একটার একেবারে ওপরের একটা কক্ষে নিয়ে গেল রেবেকাকে। সেখানে বসে চরকায় সূতা কাটছে শীর্ণদেহ এক বৃদ্ধা।
এই, বুড়ি, ভাগো এখান থেকে। চিৎকার করে উঠলো এক লোক। ঘরটা আমাদের লাগবে। এক্ষুনি বেরোও!
এক্ষুনি বেরোববা! আমি! হাহ্, আমার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাছে, যখন আমিই এখানে আদেশ করতাম, আর তোরা শুনতি।
উলরিকা, ঐ সব মনে করাকরি এখন থামাও, যা বললাম তাড়াতাড়ি করো। খালি করে দাও ঘরটা। তোমার যখন দিন ছিলো আদেশ করছে, এখন আমাদের দিন আমরা করছি।
মর তোরা, কুত্তার দল! একেবারে খ্যাক ম্যাক করে উঠলো বুড়ি। হাতের কাজ শেষ হওয়ার আগে এঘর থেকে আমি কোথাও যাচ্ছি না। যা পারিস তোরা কর।
দেখ, বুড়ি, একটু নরম হয়েছে লোকটার গলা, মনিব একথা জানলে কি…
দূর হ শয়তানের বাচ্চারা! এবার আরো জোরে চিৎকার করলো বুড়ি উলরিকা।
তাকে আর ঘটানোর সাহস পেলো না লোক দুজন। বললো, ঠিক আছে, আমরা যাচ্ছি। এই মেয়েটা থাকলো। খেয়াল রেখো, এখান থেকে যেন না যায় কোথাও। তোমার কাজ শেষ হলে আমরা আবার আসবো।
চলে গেল দুজন।
শয়তানগুলো আবার কোন কুকীর্তি করেছে কে জানে? বিড় বিড় করে বললো বুড়ি। ফুলের মতো মেয়েটাকে কোত্থেকে ধরে আনলো? যেখান থেকেই আনুক, ওর কপালে যে কি আছে তা আমি ভালোই বুঝতে পারছি। চরকা কাটা থামিয়ে রেবেকার দিকে তাকালো উলরিকা। বললো, কালো চুল, কালো চোখ, শাদা চামড়া! বুঝতে পারছি, কেন তোকে এনেছে। তুই বিদেশী, তাই না? কোথায় তোর দেশ? মিসর না প্যালেস্টাইন?
কি বলবে রেবেকা? নিঃশব্দে কাঁদছে ও।
কথা বল, মেয়ে। কাঁদতে পারছিস কথা বলতে পারছিস না?
এখনো চুপ রেবেকা। অসহিষ্ণু হয়ে উঠলো বুড়ি।
আ মলো যা, বোবা নাকি? খনখনে গলায় চিৎকার করলো সে।
বুড়ি মা, রাগ কোরো না, চোখের পানি মুছে বললো রেবেকা।
বাহ্, এই তো কথা বেরিয়েছে!
বলতে পারো, এরা আমাকে ধরে এনেছে কেন?
কেন ধরে এনেছে?–হি-হি-হি, হেসে উঠলো বুড়ি। আমার দিকে তাকা, এককালে আমিও তোর মতো তরুণী, সুন্দরী ছিলাম। আর এখন! এই দুর্গ-প্রাসাদের মালিক ছিলো আমার বাবা, একজন গর্বিত স্যাক্সন। তোকে যে ধরে এনেছে সেই ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফের বাবা তাকে হত্যা করে দখল করে নেয় এই দুর্গ। আমার সাত ভাইও মারা যায় ঐ বদমাশের হাতে। আমি একাই কেবল বেঁচে যাই–বলা ভালো আমাকে ওরা বাঁচিয়ে রাখে ওদের দাসত্ব করার জন্যে।
পালানোর কোনো পথ নেই?
এখান থেকে? মৃত্যুর দরজা ছাড়া আর কোনো পথ নেই এখান থেকে পালানোর। নিজেই দেখতে পাবি, হি-হি-হি।
পাগলের মতো হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালো বুড়ি উলরিকা। তারপর বেরিয়ে গেল তার চরকা, সূতো নিয়ে। দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিলো বাইরে থেকে।
ভালো করে ঘরটা পরীক্ষা করলো রেবেকা, পালানোর কোনো পথ পাওয়া যায় যদি। কিন্তু না, তেমন কিছু ওর নজরে পড়লো না। আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষা করার মতো কোনো কিছুও দেখতে পেলো না। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করার ব্যবস্থা নেই। একটা মাত্র জানালা ঘরে। খুলে দেখলো রেবেকা। নিচে, অনেক নিচে, দুর্গের শান বাঁধানো চত্বর। খাড়া নেমে গেছে মিনারটা। হ্যাঁ এ জানালা দিয়ে পালানো যায় বটে, তবে পালিয়ে চলে যেতে হবে একেবারে পরপারে। শিউরে উঠলো রেবেকা।
কয়েক মিনিট পরেই বাইরে পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো এক লোক। দীর্ঘদেহী, পরনে ডাকাতের পোশাক। শরীরে যত গহনা ছিলো সব একে একে খুলতে শুরু করলো রেবেকা। দরজা বন্ধ করে ওর দিকে মুখ করে দাঁড়ালো লোকটা। গহনাগুলো এগিয়ে দিয়ে রেবেকা বললো, এগুলো সব নিয়ে ছেড়ে দাও আমাকে আর আমার বুড়ো বাবাকে।
প্যালেস্টাইনের ফুল, নরম্যান ভাষায় জবাব দিলো লোকটা, গহনাগুলো সুন্দর, উজ্জ্বল; কিন্তু তুমি যে আরো বেশি সুন্দর, আরো বেশি উজ্জ্বল। আমি তোমার গহনা নয়, সুন্দরী, তোমাকে চাই।
আপনি তাহলে ডাকাত নন! বিস্মিত কণ্ঠে, চিৎকার করে উঠলো রেবেকা। আপনি নরম্যান নাইট!
ঠিকই ধরেছে। আমি নাইট টেম্পলার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্ট। আমি তোমার গা থেকে অলঙ্কার কেড়ে নেয়ার চেয়ে তাকে আরো ভালো অলঙ্কার দিয়ে সাজাতে আগ্রহী।
আমাকে সাজিয়ে কি লাভ হবে আপনার? আপনি খ্রীষ্টান, আমি ইহুদী। আপনার, আমার কোনো ধর্ম অনুযায়ী তো আমাদের বিয়ে হতে পারে না।
দেখ, আমি আমার বাহুবলে তোমাকে বন্দী করে এনেছি, এখন আমার ইচ্ছাই হবে তোমার আইন, তোমার ধর্ম, বলতে বলতে রেবেকার দিকে এক পা এগোলো, বোয়া-গিলবার্ট।
ওখানেই দাঁড়ান! চিৎকার করে উঠলো রেবেকা, আর এক পা-ও এগোবেন না!
আচমকা এই চিৎকারে থমকে গেল ব্রায়ান। পর মুহূর্তে আবার এগোতে লাগলো পা পা করে।
চেঁচাও যত চেঁচাবে, বললো সে, কেউ তোমার চিৎকার শুনতে পাবে। পেলেও এগিয়ে আসবে না সাহায্য করতে। এই দুর্গে যারা আছে সবাই আমাদের লোক। তারচেয়ে বলি কি, আমার বউ হও। এমন প্রাচুর্যের ভেতর রাখবো, আমাদের নরম্যান মহিলারা পর্যন্ত হিংসে করবে তোমাকে।
না! না! আমি তোমাকে ঘৃণা করি। থুতু দেই তোমার মুখে! আর এগিও না!
স্পষ্ট ভীতি ফুটে উঠেছে রেবেকার চোখে মুখে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আর দুতিন পা এগোলেই ওকে ধরে ফেলবে বোয়া-গিলবার্ট! কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না রেবেকা। শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠেছে ওর আতঙ্কে। হঠাৎ চোখ পড়লো জানালাটার ওপর। তখন যে খুলেছিলো আর বন্ধ করেনি। আচমকা দুই লাফে ছুটে গিয়ে ও উঠে দাঁড়ালো চৌকাঠের ওপর। ওখান থেকে লাফ দিলেই পড়বে নিচের বাঁধানো চত্বরে–তার অর্থ অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু!
ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে, বাধা দেয়ার সামান্যতম সুযোগও পেলো না টেম্পলার। হতবুদ্ধি হয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো সে। তারপর এগোলো জানালার দিকে। অমনি চিৎকার করে উঠলো রেবেকা, যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়াও, নাইট টেম্পলার! আর এক পা এগিয়েছো কি আমি লাফিয়ে পড়বে।
ব্রায়ান কোনদিন, কোনো পরিস্থিতিতেই তার সংকল্প থেকে পিছু হটেনি। কারো অনুনয়-বিনয় বা দুঃখ-কষ্টে তার মন কখনো গলেনি। কিন্তু আজ রেবেকার সাহস ও মানসিক শক্তি দেখে গললো। রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেল টেম্পলার। কোমল কণ্ঠে বললো, এসো এসো, রেবেকা। এমন পালগামি করে না। কথা দিচ্ছি তোমার কোনো ক্ষতি আমি করবো না।
কথা দিচ্ছো! তোমার কথা আমি বিশ্বাস করি না!
তুমি আমার ওপর অবিচার করছে, রেবেকা। সত্যিই বলছি, আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবে না। তোমার নিজের জন্যে না হোক তোমার বুড়ো বাবার কথা ভেবে অন্তত আমার কথা বিশ্বাস করো। সে-ও এই দুর্গে বন্দী, আমি পাশে দাঁড়ালে কেউ তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
এবার একটু নরম হলো রেবেকার মন।
তোমাকে বিশ্বাস করবো? ইতস্তত করছে সে। বুঝতে পারছি না ঠিক হবে কিনা…।
শোনো রেবেকা, জীবনে অনেক বেআইনী কাজ আমি করেছি, অনেক অধর্মাচরণ করেছি, কিন্তু কথার খেলাপ কখনো করিনি।
বেশ, বিশ্বাস করলাম। কিন্তু যেখানে আছে সেখান থেকে তুমি এক পা-ও এগোবে না, তাহলে আবার আমি বিশ্বাস হারাবো।
আমাদের মধ্যে তাহলে সন্ধি হলো, রেবেকা। আমার আপত্তি নেই। কিন্তু শর্ত হলো আমাদের মাঝে এই দূরত্ব ঠিক রাখতে হবে। তুমি এক চুলও এগোতে পারবে না।
বেশ, দূরেই থাকবো, তবু তুমি আমাকে ভয় পেও না।
আমি তোমাকে ভয় পাইও না। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমার মনের জোর নষ্ট হয়নি।
এখনও তুমি আমার উপর অবিচার করছে, রেবেকা। অনুযোগের সুর ব্রায়ানের কণ্ঠে। আমার উপর থেকে তোমার সন্দেহ এখনও যাচ্ছে না। আমাকে যত খারাপ ভাবছো, সত্যিই আমি তত খারাপ নই…।
এই সময় বাইরে থেকে ভেসে এলো ট্রাম্পেটের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। ব্যস্ত হয়ে উঠলো ব্রায়ান। নিশ্চয়ই কোনো দুঃসংবাদ।
…যাক এ নিয়ে আমরা পরে আবার আলাপ করবো। এখন যাই।
তোমার সাথে যে রূঢ় আচরণ করেছি সেজন্যে ক্ষমা চাইব না। কারণ ঐ আচরণ না করলে তোমার এই কোমল দেহে এমন বজ্রকঠিন একটা মন লুকিয়ে আছে তা বোধ হয় জানতে পারতাম না। শিগগিরই আবার আমাদের দেখা হবে, ততক্ষণ আমার কথাটা একটু ভেবে দেখ।
বেরিয়ে গেল ব্রায়ান। জানালার ওপর থেকে নেমে এলো রেবেকা! ধপ করে বসে পড়লো মেঝেতে। এই এক কৌশলে কবার বাঁচা যাবে, ভাবছে ও।
১৪. দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে
দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো টেম্পলার বোয়া-গিলবার্ট। দুর্গের হলঘ ঢুকে দেখলো দ্য ব্রেসি ইতোমধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেছে। একটু পরেই দুর্গাধিপতি রেজিনাল্ড ট্রুত দ্য বোয়েফও এলো। একটা চিঠি তার হাতে।
দেখি কি লিখেছে এতে, কে, বললো রেজিনান্ড। চিঠিটা খুলে মেলে ধরলো চোখের সামনে। কিন্তু পড়তে পারলো না। স্যাক্সন ভাষায় লেখা ওটা। দ্য ব্রেসির দিকে তাকালো সে। দেখ তো পড়তে পার কি না।
দ্য ব্রেসিও পড়তে পারলো না।
দাও দেখি আমার কাছে, বললো টেম্পলার। স্যাক্সন ভাষা অল্প স্বল্প বুঝি আমি। চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করলো সে। তার পরেই সবিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলো, আরে, এ যে দেখছি ভয় দেখিয়ে লিখেছে–নাকি ঠাট্টা?–কিছু তো বুঝতে পারছি না!
ঠাট্টা! আমার সাথে! চিৎকার করলো ত দ্য বোয়েফ। জোরে পড় তো। কার এত বড় সাহস, আমার সাথে ঠাট্টা করে!
টেম্পলার পড়তে লাগলো :
রদারউডের মহান জমিদার সেড্রিকের ভাঁড় ওয়াম্বা ও শুয়োর পালক গার্থ, এবং তাদের মিত্র ব্ল্যাক নাইট ও ললির কাছ থেকে।
রেজিনাল্ড ট্রুত দ্য ববায়েফ ও তার মিত্রদের কাছে।
তোমরা আমাদের মনিব সেড্রিক, লেডি রোয়েনা, স্যাক্সন বীর অ্যাথেলস্টেন ও তাদের চাকরবাঁকরদের বন্দী করেছে। জনৈক ইহুদী ইয়র্কের আইজাক এবং তার মেয়ে রেবেকাকেও বন্দী করেছে।
আমরা, এক ঘণ্টার ভেতর এই সব কজন বন্দীর মুক্তি দাবি করছি। যদি এক ঘণ্টার ভেতর ওঁদের মুক্তি দেয়া না হয়, আমরা তোমাদের দুর্গ আক্রমণ করে তোমাদের ধ্বংস করে দেবো।
হার্ট হিল ওয়াক-এর বিশাল ওক গাছের নিচে বসে আমরা স্বাক্ষর করছি এই চিঠিতে।
ওয়াম্বা
গার্থ
ব্ল্যাক নাইট
লক্সলি।
পড়া শেষ হতেই হো-হো করে হেসে উঠলো বোয়া-গিলবার্ট। দ্য ব্রেসিও যোগ দিলো তার সঙ্গে। কিন্তু ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফের মুখে হাসি ফুটলো না। কেমন যেন সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে তাকে। এক পার্শ্বচরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, বাইরে কত লোক জড় হয়েছে দেখেছো নাকি?
শ দুয়েক তো হবেই, স্যার।
যখনই তোমাদেরকে আমার দুর্গ ব্যবহার করতে দেই, এ ধরনের কিছু কিছু ঘটবেই, ঝঝের সাথে বললো রেজিনান্ড। মহা বিপদে পড়া গেল দেখছি! এক মুহূর্ত থেমে আবার বললো, তখনই বলেছিলাম, ভালো করে ভেবে দেখ এখানেই আনবে কি না।
এত ভয় পাচ্ছো কেন তুমি, রেজিনান্ড! বিরক্ত হয়ে বললো টেম্পলার
ভয় পাব না? ওদের যে নেতা, দুর্দান্ত সাহস তার। কোনো কিছুতেই তার পরোয়া নেই। তবে কামান, মই, এবং সুদক্ষ অধিনায়ক ছাড়া এ দুর্গ জয় করা সম্ভব নয়, এই যা ভরসা।
আমার তো মনে হয় আধ ঘণ্টার ভেতর আমরা ঐ দুশো লোককে শেষ করে দিয়ে আসতে পারবো, বললো টেম্পলার। আমরা একজনই ওদের বিশ জনের সমান। তোমার লোকদের সব ডাক দাও, এক্ষুনি হতভাগাগুলোকে আক্রমণ করবো আমি।
ডাক দেবো! এখানে কেউ থাকলে তো ডাক দেবো। যুদ্ধ করার মতো যত লোক ছিলো সবাইকে ইয়র্কে পাঠিয়ে দিয়েছি। দ্য ব্রেসি, তোমার লোকরাও তো সব চলে গেছে, না?
হ্যাঁ। ইয়র্কে একটা খবর পাঠালে কেমন হয়?–ওরা চলে আসতো।
পাঠাতে পারলে তো ভালোই হয়, কিন্তু পাঠাবোটা কি করে? পুরো দুর্গ ওরা ঘিরে ফেলেছে। প্রতিটা পথে পাহারা রেখেছে। একটা মাছিও ওদের অগোচরে বেরোতে পারবে না এখান থেকে। চুপ করে গিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ। তারপর বললো। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে–।
কি? এক সাথে প্রশ্ন করলো বোয়া-গিলবার্ট আর দ্য ব্রেসি।
চিঠিটার একটা জবাব দিতে হবে। বোয়া-গিলবার্ট, আমার পক্ষ থেকে তুমিই লেখো। আমি বলছি–।
কলম নয়, তলোয়ার দিয়ে জবাব দিলেই ভালো হতো, বললো বোয়াগিলবার্ট। তবু তুমি যখন বলছো লিখছি। কাগজ-কলম টেনে নিলো সে।
বলতে লাগলো ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ। নরম্যান ভাষায় লিখতে লাগলো টেম্পলার। লেখা শেষ হতেই রেজিনা বললো, হ্যাঁ, পড় তো একবার।
পড়লো ব্রায়ান:
রেজিনাল্ড ট্রুত দ্য বোয়েফ ও তার মিত্ররা ক্রীতদাস ও রাজদ্রোহী গুণ্ডাদের চোখরাঙানীকে ভয় করে না। ব্ল্যাক নাইট যদি সত্যিই তাদের সাথে হাত মিলিয়ে থাকে তাহলে বলতে হবে আসলে সে কোনো নাইটই নয়।
আজ দুপুরের আগেই বন্দীদের প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হবে। সুতরাং তাদের শেষ স্বীকারোক্তি শোনার জন্যে তোমরা ইচ্ছে হলে একজন পাদ্রী পাঠাতে পারো।
.
গার্থ এবং ওয়াম্বার দূত দুর্গ ফটকে অপেক্ষা করছিলো। তার হাতে দিয়ে দেয়া হলো চিঠিটা। কিছুক্ষণের ভেতর যথাস্থানে পৌঁছে গেল সেটা। এতক্ষণ সবাই অধীর আগ্রহে বসে ছিলো এই চিঠির জন্যে।
দেখা গেল এপক্ষে একমাত্র ব্ল্যাক নাইটই নরম্যান ভাষা জানে। সে চিঠিটা পড়ে স্যাক্সন ভাষায় অনুবাদ করে শোনালো সবাইকে।
জমিদার সেড্রিককে হত্যা করবে! আর্তনাদ করে উঠলো ওয়াম্বা। আপনি নিশ্চয়ই ভুল পড়েছেন, স্যার নাইট।
না, এই কথাই এখানে লেখা আছে: আজ দুপুরের আগেই বন্দীদের প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হবে।
খালি হাতেই ওদের এই দুর্গ আমরা মাটিতে মিশিয়ে দেব, গর্জে উঠলো গার্থ।
হ্যাঁ, খালি হাত ছাড়া তো আর কিছু নেই আমাদের, বললো ওয়া।
আমার মনে হয় ওদের একটা চাল এটা, চিন্তিত কণ্ঠে বললো লক্সলি। কিছু সময় হাতে পেতে চায় আসলে।
দুর্গে ওদের কতজন লোক আছে জানতে পারলে ভালো হতো, ব্ল্যাক নাইট বললো। ওদের প্রস্তাব মতো তাহলে পাঠানো যাক কাউকে। কে যাবে? আমার মনে হয়, কপম্যানহারে মাননীয় সন্ন্যাসী, আপনিই যোগ্য লোক।
না, না, ললি আমাকে কি নামে ডাকছিলো শোনোনি? বললেন সন্ন্যাসী। আমি গেলে ওরা ঠিকই ধরে ফেলবে।
তাহলে কে যাবে? পাদ্রী-পুরুত তো আমাদের ভেতর আর কেউ নেই।
কাউকে সাজিয়ে পাঠাতে হবে।
কাকে?
সবাই চুপ। ঝুঁকিপূর্ণ কাজটায় যেতে রাজি নয় কেউ।
জ্ঞাণী গুণীরা কেউ যখন যেতে চাইছে না তখন বোকা-গাধা-ভাঁড় আমিই যাই, বললো ওয়া।
সন্ন্যাসী তার গাউন ও হুড খুলে দিলেন। পরে নিলো ওয়া। সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে পাদ্রীদের অনুকরণে বললো প্যাক্স ভবিসকাম। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে টরকুইলস্টোন দুর্গের দিকে হাঁটতে শুরু করলো সে।
.
যে সাহস নিয়ে ওয়াম্বা রওনা হয়েছিলো ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তা কপুরের মতো উবে গেল। ভয়ে তার শরীর কাঁপছে রীতিমতো।
রেজিনান্ড জানে, অনেকেই ভয় পায় তার সামনে দাঁড়াতে। তাই পাদ্রীবেশী ওয়াম্বার ভীত ভাব দেখে অবাক হলো না সে। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কে আপনি? কোত্থেকে আসছেন?
প্যাক্স ভবিসকাম, মনের সমস্ত সাহস এক করে জবাব দিলো ওয়া। আমি সেইন্ট ফ্রান্সিসের একজন দীন অনুসারী। বনের পথ ধরে যাচ্ছিলাম নিজের কাজে। হঠাৎ এক দল ডাকাত চড়াও হয় আমার ওপর। আপনার দুর্গের ওপাশেই একটা ঝোপের ভেতর নিয়ে এসে তারা বললো, আপনার এখানে নাকি মৃত্যুপথযাত্রী কয়েকজন লোক আছে, আমাকে তাদের শেষ স্বীকারোক্তি শুনতে হবে। তাই আমি এসেছি। প্যাক্স ভবিসকাম!
কত জন হবে ডাকাত? সত্যি জবাব দেবেন, নইলে আপনার কপালে দুঃখ আছে।
মিথ্যে বলে আমার কি লাভ, স্যার নাইট?
হুঁ। ঠিক আছে বলুন, ওখানে কতজন ডাকাত আছে।
অসংখ্য।
এটা কোনো জবাব হলো না, ঠিক সংখ্যা বলুন।
আমি তো গুণিনি, তবে মনে হয় চার পাঁচ শোর কম…।
ঠিক এই সময় ঘরে ঢুকছিলো টেম্পলার ব্রায়ান। দরজার কাছ থেকে সে চিৎকার করে উঠলো, কি! এর ভেতর ওরা এত লোক জুটিয়ে ফেলেছে। আর তো দেরি করা যায় না, রেজিনান্ড, এবার কিছু একটা ব্যবস্থা নিতে হয়!
তা তো নিতে হয়। কিন্তু কি ব্যবস্থা?
দাঁড়াও, একটু সময় দাও, আমাকে। ভেবে চিন্তে বুদ্ধি কিছু একটা বের করে ফেলবোই। তার আগে তুমি একটু শোনো-। রেজিনাকে এক পাশে টেনে নিয়ে গেল বোয়া-গিলবার্ট। জিজ্ঞেস করলো, এই পাদ্রীটাকে তুমি চেনো?
না। ও এ এলাকার লোক নয়। দূরের কোন মঠ থেকে এসেছে।
তাহলে তো চিন্তার কথা, বলে এক মুহূর্ত ভাবলো ব্রায়ান। তারপর বললো, ওকে এক ফোটাও বিশ্বাস কোরো না, কিন্তু ভাব দেখাবে যেন পুরো বিশ্বাস করছে। ব্যাটা কে, কি মনে করে এসেছে কে জানে? যা হোক, স্যাক্সন শুয়োরগুলোর কাছে পাঠিয়ে দাও ওকে, যে কাজে এসেছে সেরে ফেলুক তাড়াতাড়ি।
ঘণ্টা বাজিয়ে এক ভৃত্যকে ডাকলো ত দ্য বোয়েফ।
সেড্রিক আর অ্যাথেলস্টেন যে ঘরে আছে সে ঘরে নিয়ে যাও ফাদারকে, নির্দেশ দিলো সে।
রেজিনাল্ড আর ব্রায়ানের সামনে থেকে সরতে পেরে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো ওয়া। দুই স্যাক্সনের বন্দীখানার সামনে তাকে নিয়ে গেল ভৃত্য। তালা খুলে মেলে ধরলো দরজা।
প্যাক্স ভবিসকাম, দরাজ গলায় উচ্চারণ করলো ওয়া।
হঠাৎ করে দরজায় একজন পাদ্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভীষণ অবাক হলেন সেড্রিক। কি বলবেন বা করবেন ভেবে পেলেন না প্রথমে।
ভেতরে আসুন, অবশেষে বললেন তিনি। কি জন্যে পাঠিয়েছে আপনাকে?
আপনারা যাতে সহজে মৃত্যুর জন্যে তৈরি হতে পারেন তার ব্যবস্থা করতে, ভৃত্যকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো ওয়া। আমি আপনাদের শেষ স্বীকারোক্তি শুনবো।
শেষ স্বীকারোক্তি! চিৎকার করলেন সেড্রিক। অসম্ভব! যত নির্দয়, যত বেপরোয়া হোক, খামোকা কেন ওরা খুন করবে, তাও আবার আমাদের মতো লোকদের?
তা তো জানি না, আমি যা শুনেছি তাই বলছি, জবাব দিলো ওয়া।
ঠিক আছে, মরতে যদি হয়ই মানুষের মতো মরবো। ওদের কাছে দয়া ভিক্ষা করতে যাবো না, কি বলল, অ্যাথেলস্টেন?
আপুনি ঠিকই বলেছেন, সেড্রিক, জবাব দিলো অ্যাথেলস্টেন। ওদের মতো দুশ্চরিত্র লোকের কাছে মাথা নোয়ানো অসম্ভব। আমি তৈরি। খাওয়ার টেবিলে যেমন যাই তেমনি শান্তভাবে এগিয়ে যাবো মৃত্যুর দিকে।
এত তাড়াহুড়োর কি আছে, চাচা, ভৃত্য দরজা ভিড়িয়ে দিয়েছে দেখে স্বাভাবিক আমুদে কন্ঠে বললো ওয়া। গুণীজনেরা বলে গেছেন, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। তাই বলছি ভালো করে ভেবে নিন আগে।
আঁ–গলাটা যেন চেনা চেনা লাগে! সেড্রিক চেঁচিয়ে উঠলেন।
লাগবারই কথা, বলতে বলতে মাথার ওপর থেকে হুডটা সরিয়ে ফেললো ওয়াম্বা। আমি আপনার বিশ্বস্ত ভাঁড় ওয়া। কিন্তু আমি এখন ভাঁড়ামি করতে আসিনি, স্যার।
ওয়া! তুই কোত্থেকে এলি! কি করে ঢুকলি এই দুর্গে? পাদ্রীর পোশাক কোথায় পেলি?
এসব প্রশ্নের জবাব এখন দিতে পারবো না, যা বলছি শুনুন।
তুই আবার কি বলবি আমাকে? সারাজীবন তোকেই আমি বলে এসেছি–।
হ্যাঁ, কিন্তু এখন আমি বলছি, এবং যা বলছি সেই মতো করুন। তাড়াতাড়ি আমার এই আলখাল্লা আর হুড পরে বেরিয়ে যান এখান থেকে। মুখটা ভালো করে ঢেকে নেবেন। গলাটা একটু বিকৃত করে বলবেন, স্বীকারোক্তি নেয়া শেষ। ওরা আপনাকে বেরিয়ে যেতে দেবে দুর্গ থেকে।
তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে, ওয়া? আমার বদলে তোকে দেখলে তো এক মুহূর্ত দেরি করবে না ওরা, সোজা ঝুলিয়ে দেবে। আমি মরি মরি, তুই কেন মরতে যাবি আমার জন্যে?
প্রভুর জন্যে মরবো না তো কার জন্যে মরবো? আবার কৌতুকের সুর ফিরে এসেছে ওয়াম্বার গলায়।
ব্যাপারটা তোমার কাছে ভাড়ামি মনে হলেও আমার কাছে হচ্ছে না। রেগে গেছেন সেড্রিক। তার কণ্ঠস্বর শুনেই তা বোঝা গেল।
আমি ভঁড়ামি করছি না, স্যার।
বেশ ভালো কথা। কিন্তু যা বলছিস সে অসম্ভব।
মোটেই অসম্ভব নয়। আপনি চলে যান।
এতই যদি তোর মরার ইচ্ছা, অ্যাথেলস্টেনকে দে তোর পোশাক।
না, না। নিজের প্রভু ছাড়া আর কারো জন্যে আমি মরতে রাজি নই।
এখানে অন্য যারা রয়ে যাচ্ছে–রোয়েনা, অ্যাথেলস্টেন, এদের কি হবে? বাঁচার কোনো সুযোগ পাবে?
প্রচুর। পাঁচশো লোক ঘিরে রেখেছে এই দুর্গ। প্রয়োজন হলে এটাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে ওরা। নরম্যান জানোয়ারগুলোর হাতে কতজন লোক আছে ওরা জানতে চায়। আপনি যান, গিয়ে জানান।
কিন্তু…তোর বদলে… ইতস্তত করছেন সেড্রিক।
আর কোনে যদি-কিন্তু শুনতে চাই না, আপনি যান। অস্থির হয়ে উঠেছে ওয়াম্বা। সময় চলে যাচ্ছে দ্রুত।
হ্যাঁ, এই সুযোগ ছাড়বেন না, বললো অ্যাথেলস্টেন। তাড়াতাড়ি চলে যান আপনি। আপনাকে পাশে পেলে আমাদের বন্ধুরা খুবই উৎসাহ পাবে। আপনি এখানে থাকলে কারো তো কোনো লাভ হবে না।
আর আপত্তি করলেন না সেড্রিক। ওয়াম্বার খুলে দেয়া পোশাক পরে নিলেন। হুডটা মাথায় পরতে পরতে বললেন, যাই রে, ওয়াম্বা।
যাওয়ার আগে আপনাকে একটা অনুরোধ করবো স্যার, বললো ওয়াম্বা। গার্থের সাথে একটু ভালো ব্যবহার করবেন দয়া করে। আর আর আমার টুপিটা আপনার হলঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখবেন।
করবো রে, ওয়া। আর তোর টুপিও আমি হলঘরে ঝুলাবো। সারা জীবন আমার মনে থাকবে তোর কথা, বলতে বলতে বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো সেড্রিকের গলা। ভাবিস না। আমার উপর বিশ্বাস রাখ। বাইরে যদি বেরোতে পারি তোদেরও মুক্ত করার একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করবো। রওনা হলেন তিনি। কিন্তু দরজা পর্যন্ত গিয়েই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন আবার! কি করবো আমি? স্যাক্সন ছাড়া তো আর কোনো ভাষা জানি না। ল্যাটিনের এক বর্ণও বুঝি না। নরম্যান শব্দ অবশ্য দুচারটে জানি, কিন্তু এই সম্বল নিয়ে কিভাবে আমি পাদ্রীর অভিনয় করবো?
কোনো দরকার নেই জানার, বললো ওয়াম্বা। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে স্যাক্সনেই জবাব দেবেন। দুটো ল্যাটিন শব্দ মুখস্থ করে নিন: প্যাক্স ভবিসকাম। যা-ই বলেন না কেন, আগে বা পরে এই শব্দ দুটো আওড়াবেন। ওতেই চলবে। স্যাক্সন ছাড়া আর কোনো ভাষা আমিই কি জানি? তবু তো দিব্বি চলে এলাম এ পর্যন্ত। আপনিও পারবেন।
প্যাক্স ভবিসকাম। প্যাক্স ভবিসকাম, প্রথমে কয়েকবার শব্দ করেই তারপর মনে মনে আওড়াতে লাগলেন সেড্রিক। অবশেষে বললেন, আশা করি মনে থাকবে আমার। আসি তাহলে, অ্যাথেলস্টেন; আসি রে, ওয়া।
আসুন, স্যার। শব্দ দুটো মনে রাখবেন, প্যাক্স ভবিসকাম।
বেরিয়ে এলেন সেড্রিক। প্রায়ান্ধকার অলি-পথ ধরে এগিয়ে চললেন হলঘরের দিকে। হঠাৎ একটা মেয়ে ছুটে এসে থামালো তাকে।
প্যাক্স ভবিসকাম, গম্ভীর গলায় বলেই পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে চাইলেন সেড্রিক।
কিন্তু মেয়েটা তাকে ছাড়লো না। আলখাল্লার হাতা খামচে ধরে ল্যাটিন ভাষায় কি যেন বললো।
দুঃখিত, মা, গলার স্বরটা করুণ করে তুলে বললেন সেড্রিক, আমি একটু কানে কম শুনি।
ফাদার, এবার স্যাক্সন ভাষায় শুরু করলো মেয়েটা, আহত এক বন্দীকে একটু দেখে যাবেন দয়া করে?
মা, আমার হাতে যে একদম সময় নেই। এক্ষুনি আমাকে এই দুর্গ ছেড়ে যেতে হবে।
ফাদার, ফাদার আমি আপনার কাছে এই দয়াটুকু ভিক্ষা চাইছি, ফাদার, একটু আসুন আমার–
বুড়ি উলরিকার খনখনে গলার নিচে চাপা পড়ে গেল মেয়েটার কণ্ঠস্বর।
ফাদারকে যেতে দাও, রেবেকা, বললো বুড়ি। এক্ষুনি রোগীর কাছে যাও! আমি বলছি, এক্ষুনি যাও! বলতে বলতে সেড্রিকের কাছে এসে দাঁড়ালো উলরিকা। আমার সঙ্গে আসুন, ফাদার, বললো সে। আমি আপনাকে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেবো।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও চলে গেল রেবেকা। বেচারা আশা করেছিলো, ফাদারের মাধ্যমে বাইরে জড় হওয়া লোকগুলোর কাছে একটা খবর অন্তত পাঠাতে পারবে।
————–
*ল্যাটিন। অর্থ, তোমরা শান্তিতে থাকো।
১৫. ছোট কামরায় ঢুকলো উলরিকা
সেড্রিককে নিয়ে পাশের একটা ছোট কামরায় ঢুকলো উলরিকা। দরজা বন্ধ করে দিলো।
আপনি স্যাক্সন, তাই না ফাদার?
হ্যাঁ, সংক্ষিপ্ত জবাব সেড্রিকের। বেরিয়ে যাওয়ার পথ দেখাবে বলে এখানে নিয়ে এলে কেন আমাকে?
প্রশ্নটা যেন কানেই ঢোকেনি বুড়ির।
আমিও স্যাক্সন, ফাদার, বলে চললো সে। আপনার সামনে এখন যে কুৎসিত বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে, বললে বিশ্বাস করবেন, সে এক কালে নামজাদা জমিদার লর্ড অভ টরকুইলস্টোনের মেয়ে ছিলো?
তুমি টরকুইল উলফগ্যাঞ্জারের মেয়ে! সবিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেন সেড্রিক। তুমি–তুমি আমার বাবার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেই মহান স্যাক্সনের মেয়ে!
আপনার বাবার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু! এবার বিস্মিত হওয়ার পালা উলরিকার। তার মানে আপনি স্যাক্সন সেড্রিক! রদারউডের জমিদার! নিশ্চয়ই তাই! কিন্তু কি আপনার গায়ে পাদ্রীর পোশাক কেন?
সে কথা তোমার না জানলেও চলবে। তোমার দুর্ভাগ্যের কাহিনী শেষ করো।
আমার বাবা, আমার সাত তাই কিভাবে মারা গিয়েছিলেন আপনি জানেন। তার পর থেকে খুনীদের দাসী হিশেবে আমি আছি এখানে। যে বাড়িতে এককালে আমি ছিলাম রাজকন্যার মতো–আমার বাবা, আমার ভাইয়েরা আমাকে মাথায় করে রাখতো–সেই বাড়িতে আমি আজ দাসী, হুকুমের চাকরানী। আর কি বলবো আমি?–এ-ই আমার কাহিনী।
উলরিকা, এতদিন যখন কষ্ট সহ্য করতে পেরেছো আর কিছুক্ষণ করো, সান্ত্বনা দিয়ে বললেন সেড্রিক। অস্থির হয়ো না, তোমার দুঃখের দিন বোধ হয় শেষ হয়ে আসছে।
কষ্ট আমার কাছে তুচ্ছ, স্যাক্সন সেড্রিক। কিন্তু যে অপমান আমি সয়েছি তাকে যে কিছুতেই তুচ্ছ ভাবতে পারি না। প্রতিহিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে আমার বুকে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যেই এখনো আমি প্রাণ ধরে আছি। বহুবার এ জীবন শেষ করে দেয়ার কথা ভেবেও করিনি, শুধু এই একটা কারণে, খুনীদের দুষ্কর্মের শাস্তি না দিয়ে আমার মরা চলবে না। আজ সুযোগ এসেছে। হ্যাঁ, মোক্ষম সুযোগ। রেজিনান্ড, তোর বাপের পাপে আজ তুই মরবি! বলতে বলতে খনখনে গলায় ভয়ঙ্কর হাসিতে ফেটে পড়লো উলরিকা।
শুনুন, সেড্রিক! হাসি থামিয়ে সে বলে চললো, সাধারণ মানুষ আর রাজদ্রোহী ডাকাতদের এক বিরাট বাহিনী জড় হয়েছে বাইরে। এই দুর্গ আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। বাইরে গিয়েই আপনি ওদের দলে যোগ দেবেন। সবাইকে তৈরি থাকতে বলবেন। যখন দেখবেন দুর্গের পশ্চিম পাশের মিনারের মাথায় লাল পতাকা উড়ছে অমনি আক্রমণ করবেন। নরম্যান পশুগুলোকে আমি দুর্গের ভেতর ব্যস্ত রাখবে সে সময়। আপনাদের বাধা দেয়ার জন্যে বেশি কেউ থাকবে না বাইরে। যান, সেড্রিক, আর দেরি করবেন না। উলরিকা, বুড়ি উলরিকা, এবার তোর প্রতিশোধের পালা, বলতে বলতে আবার সেই খনখনে গলায় হেসে উঠলো সে, তারপর ছুটে বেরিয়ে গেল ছোট্ট ঘরটা থেকে।
কয়েক মুহূর্ত পরেই শোনা গেল ত দ্য বোয়েফের চিৎকার, কোথায় গেল হতভাগা পাত্রী? এতক্ষণ লাগে নাকি মাত্র দুজনের স্বীকারোক্তি শুনতে?
সেড্রিক এগিয়ে গেলেন তার দিকে। কি ব্যাপার, স্বীকারোক্তি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন নাকি, ফাদার? বললো রেজিনান্ড। তৈরি ওরা মৃত্যুর জন্যে?
হ্যাঁ, সেরকমই তো মনে হলো। আপনি যে এক ফোটা দয়া দেখাবেন
তা বোধহয় ওরা বুঝতে পেরেছে।
ভালো। আপনি আসুন আমার সাথে।
কোথায়? আমাকেও কি বন্দী করে রাখবেন?
আপনি পাদ্রী না গাধা, হ্যাঁ? আপনাকে বন্দী করে আমার দুপয়সারও লাভ হবে?
মনে হয় না।
তাহলে কেন আপনাকে বন্দী করবো? আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি দুর্গের পেছন দিকে, গোপন দরজা দিয়ে বের করে দেবো। আসুন।
রেজিনান্ডের পেছন পেছন এগোলেন সেড্রিক। যেতে যেতে দুর্গরক্ষার কিছু কিছু গোপন ব্যবস্থা, সৈন্যদের ঢোকা, বেরোনোর গোপন পথ ইত্যাদি দেখতে পেলেন তিনি। মনে মনে হাসলেন।
বাইরে যে লোকগুলো আপনাকে ধরেছিলো ওরা আমার এই দুর্গ আক্রমণ করতে চায়, হাঁটতে হাঁটতে বলে চললো ত দ্য ববায়েফ। ওরা আবার যেন আপনাকে ধরতে না পারে সেজন্যে পেছন দরজা দিয়ে বের করে দিচ্ছি। বিনিময়ে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। পারবেন?
কি কাজ?
আপনি নরম্যান জানেন?
এক অক্ষরও না।
তাহলে এই চিঠিটা নিন, পোশাকের ভেতর থেকে একটা চিঠি বের করে সেড্রিকের হাতে দিলো রেজিনা। এটা যত তাড়াতাড়ি পারেন ফিলিপ দ্য ম্যালভয়সিঁর দুর্গে পৌঁছে দেবেন। আমার পক্ষ থেকে ওকে বলবেন চিঠিটা হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন ইয়র্কে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বুঝতে পেরেছেন আমার কথা?
হ্যাঁ, স্যার নাইট।
যদি কাজটা সময় মতো করে আবার এখানে ফিরে আসেন, দেখবেন শেয়াল কুকুরের মতো মরে পড়ে আছে স্যাক্সন শুয়োরগুলো।
জি।
ইতোমধ্যে ওঁরা পৌঁছে গেছেন দুর্গের পেছনে ছোট্ট একটা দরজার সামনে। দরজাটা খুললো ত দ্য বোয়েফ। তিনটে স্বর্ণমুদ্রা ধরিয়ে দিলো সেড্রিকের হাতে। বললো, চিঠিটা যদি নিরাপদে পৌঁছে দিতে পারেন, আরো পাবেন।
হ্যাঁ-না কিছু বললেন না সেড্রিক। একটু ঝুঁকে বেরিয়ে গেলেন দরজা গলে। দুর্গ থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে আসার পর মুদ্রা তিনটে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তিনি। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, শয়তান নরম্যান, তোর সঙ্গে সঙ্গে চুলোয় যাক তোর পয়সাও।
.
হলঘরে ফিরে এলো ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ। এক ভৃত্যকে ডেকে আদেশ করলো, সেড্রিক আর অ্যাথেলস্টেনকে নিয়ে এসো এখানে।
কিছুক্ষণের ভেতর হলঘরে পৌঁছে গেল দুই বন্দী।
তারপর, মহামহিম স্যাক্সন জমিদার ও রাজপুত্র, কৌতুকের সুরে বললো রেজিনান্ড, কেমন লাগছে আমার টরকুইলস্টোন দুর্গে থাকতে?
ওহ দারুণ! চটপট জবাব দিলো সেড্রিকবেশী ওয়া। নিজের বাড়িতেও কখনো এত আরামে থাকিনি।
আচ্ছা! দাঁড়াও এবার তাহলে আসল আরামের ব্যবস্থা করছি। গম্ভীর হয়ে উঠলো রেজিন্যান্ডের কণ্ঠস্বর। তোমাদের যদি মুক্তি দেই কত টাকা আমাকে দেবে? ভালো করে ভেবে তারপর বলো। যদি না দাও তা হলে কি করবো জানো তো? ঐ যে, ঐ জানালার সঙ্গে পা উপরে মাথা নিচে দিয়ে ঝুলাবো। ও ভাবেই থাকবে যতক্ষণ না কাকে ঠুকরে তোমাদের হাড় পরিষ্কার করে ফেলে। সেড্রিক, তুমি আগে বলো, কত দেবে?
এক পেনিও না, জবাব দিলো ওয়া। জন্ম থেকেই আমার মগজ উল্টো হয়ে আছে। এখন তুমি যদি উল্টো করে ঝুলাও তাহলে বোধ হয় এতদিন পরে ওগুলো একটু সোজা হওয়ার সুযোগ পাবে।
এত বড় স্পর্ধা! চিৎকার করে উঠে ভয়ানক বেগে এক চড় কষালো ফ্ৰঁত দ্য ববায়েফ ওয়াম্বার মাথায়। সময়মতো মাথাটা নিচু করে নিলো ওয়া। ফলে চড়টা লাগলো না, কিন্তু সেড্রিকের টুপিটা উড়ে চলে গেল তার মাথা থেকে। এবার আরো রেগে গেল রেজিনাল্ড। লাফ দিয়ে উঠে হ্যাচকা টানে ছিঁড়ে ফেললো ওয়ার কোট। অমনি বেরিয়ে পড়লো তার গলার দাসত্বের প্রতীক পেতলের আংটাটা।
এই কুত্তার দল, কাকে নিয়ে এসেছিস তোরা? ভৃত্যদের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলো ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ।
ঠিক সেই সময় ঘরে ঢুকেছে দ্য ব্রেসি।
আমি বোধহয় বলতে পারি কে ও, জবাব দিলো সে। এ হচ্ছে সেড্রিকের ভড়।
আসল সেড্রিককে নিয়ে আয়, হতভাগার দল, ভৃত্যদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করলো রেজিনান্ড।
যাও যাও, ওয়াম্বা বললো, সেড্রিককে তো পাবে না, আরো কয়েকজন ভড়কে পাবে, ধরে নিয়ে এসো তাদের।
বলতে চাইছে কি বদমাশটা? দ্য ব্রেসিকে জিজ্ঞেস করলো ত দ্য ববায়েফ।
আমি বুঝতে পেরেছি। পাদ্রীর পোশাক পরে একটু আগে যে লোকটা বেরিয়ে গেল সে-ই সেড্রিক।
হায় হায়, আমিই তো তাকে গুপ্ত পথে প্রাসাদের বাইরে রেখে এলাম! হতাশার সুর ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফের গলায়। পর মুহূর্তে গর্জে উঠলো সে, ঠিক আছে, এর ফল তুই পাবি, ব্যাটা ভাঁড়! তোকে আমি মিনারের ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলবো। তখন কেমন ভাঁড়ামি করতে পারিস দেখবো!
অ্যাথেস্টেনের দিকে ফিরলো সে, এবার তুমি বলো, কত টাকা দেবে যদি তোমাকে ছেড়ে দেই?
এক মুহূর্ত ভাবলো অ্যাথেলস্টেন। তারপর বললো, আমাকে এবং আমার সব সঙ্গীদেরকে যদি ছেড়ে দাও, এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা তোমাকে দেবো।
বেশ তাতেই আমি রাজি, তবে একটা শর্ত আছে, বাইরের ঐ গুণ্ডাগুলোকে তুমি সরাবে এখান থেকে, যেভাবে পারো।
চেষ্টা করবো, কথা দিচ্ছি।
বেশ, আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো। তবে ইহুদী আইজাক কিন্তু তোমার সঙ্গীদের ভেতর পড়বে না।
ওর মেয়ে রেবেকাও না, বলে উঠলো বোয়া-গিলবার্ট।
লেডি রোয়েনাও না, বললো দ্য ব্রেসি।
এই বোকা ভাঁড়টাও না, যোগ করলো রেজিনাল্ড নিজে। ওকে আমি নিজের হাতে ধাক্কা মেরে ফেলবো মিনারের ওপর থেকে।
তাহলে আর বাকি থাকলো কে? বললো অ্যাথেস্টেন। ইহুদী দুটোর কথা জানি না, লেডি রোয়েনা আমার ভবিষ্যৎ স্ত্রী। ওকে তো আমি কিছুতেই এখানে ফেলে রেখে যেতে পারি না। আর এই বোকা ভাঁড় ওর মনিব মানে, আমার অত্যন্ত সুহৃদ একজনকে বাঁচিয়েছে। ওকেও যদি না ছেড়ে দাও, এক পেনিও তোমরা পাবে না আমার কাছ থেকে।
তোমার মতো একজন স্যামন দাসের ভবিষ্যৎ স্ত্রী লেডি রোয়েনা! সবিস্ময়ে উচ্চারণ করলো দ্য ব্রেসি।
দেখ, হে নরম্যান, মুখে তুমি আমাকে দাস বলো আর যা-ই বলো, বংশমর্যাদায় আমি যে তোমার মতো কাপুরুষ গুণ্ডার চেয়ে অনেক উপরে তা আমার চেয়ে তুমিই ভালো জানো, গর্বিত কণ্ঠে বললো অ্যাথেস্টেন। আমার পূর্ব পুরুষরা এদেশের রাজা ছিলেন। চারণ কবিরা তাদের মহিমা কীর্তন করে বেড়াতো গ্রামে গঞ্জে। তাদের কবরের ওপর তৈরি হয়েছে গির্জা।
জবাবটা ভালোই দিয়েছে স্যাক্সনের বাচ্চা, কি বলো, দ্য ব্রেসি? হাসতে হাসতে বললো বোয়া-গিলবার্ট।
যা মনে আসে বলতে থাকো, বাবা স্যাক্সন, অ্যাথেলস্টেনকে বললো দ্য ব্রেসি! তোমার মহান বাক্যে মুক্তি পাবে না লেডি রোয়েনা।
এই সময় এক পার্শ্বচর এসে ত দ্য বোয়েফকে বললো, স্যার, এক পাদ্রী এসেছে ফটকে, ভেতরে ঢুকতে চাইছে।
সত্যি সত্যি পাদ্রী? ওর কাপড় চোপড় সব ভালো করে পরীক্ষা করে দেখ। যদি না হয়, ওর চোখগুলো উপড়ে ফেলবি।
সত্যিই পাদ্রী, স্যার। আমি চিনি ওকে। আপনিও চেনেন। জরভক্স মঠের প্রায়োর অ্যায়মারের সাথে অনেকবার এসেছেন আমাদের দুর্গে। নাম ব্রাদার অ্যামব্রোজ।
নিয়ে আয় ওকে, আদেশ করলো রেজিনাল্ড। আর এই স্যাক্সন দুটোকে নিয়ে যা এখান থেকে। যেখানে ইলো সেখানেই আটকে রাখ।
ওয়াম্বা যখন ঘর থেকে বেরোচ্ছে ব্রাদার অ্যামব্রোজ তখন ঢুকছে। তাকে দেখেই অনাবিল এক হাসি ফুটে উঠলো ওয়াম্বার মুখে।
এই তো একজন আসল প্যাক্স ভবিসকাম! মন্তব্য করলো সে।
রুদ্ধশ্বাসে ঘরে ঢুকলো ব্রাদার অ্যামব্রোজ। উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে যেন।
ওহ, শেষ পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে আসতে পেরেছি, বললো সে। আপনারা তো প্রায়োর অ্যামারের বন্ধু। উনি… দম নেয়ার জন্যে থামলো ব্রাদার অ্যামব্রোজ।
হ্যাঁ, কি হয়েছে প্রায়োর অ্যায়মারের? জলদি বলো নষ্ট করার মত সময় নেই আমাদের।
গুপ্তারা ওকে ধরে নিয়ে গেছে। ওঁর কাছে যত সোনা দানা ছিলো সব নিয়ে নিয়েছে। তার পরও ছাড়েনি, বলছে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা না দিলে ছাড়বে না। প্রায়োর আপনাদের সাহায্য চেয়েছেন।
আমরা সাহায্য করবো? কি ভাবে? বললো দ্রুত দ্য বোয়েফ। আমাদেরই কে সাহায্য করে তার ঠিক নেই, আর আমরা করবো সাহায্য আমরা যে কজন এখানে আছি তার বিশগুণ লোক আমাদের ঘিরে রেখেছে, যে কোনো মুহূর্তে আক্রমণ করে বসবে।
হ্যাঁ, এ সম্পর্কেও আমি বলতে যাচ্ছিলাম, ব্রাদার অ্যামব্রোজ বললো। শয়ে শয়ে রাজদ্রোহী গুণ্ডা জড় হয়েছে বনের প্রান্তে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই দুর্গ আক্রমণ করবে…
এক্ষুনি চলো, বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললো ত দ্য বোয়েফ, দেয়ালের ওপর উঠে দেখি কি করছে ওরা!
তাড়াতাড়ি হলঘর থেকে বেরিয়ে দেয়ালের ওপর গিয়ে উঠলো সবাই। ব্রাদার অ্যামব্রোজ সত্যি কথাই বলেছে। শয়ে শয়ে গুণ্ডা, এখন আর বনের প্রান্তে নেই, দুর্গের সামনে এসে গেছে। আক্রমণ করার জন্যে তৈরি।
দ্য ব্রেসি, বোয়া-গিলবার্ট, আর তো দেরি করা যায় না…, শুরু করলো রেজিনান্ড।
স্যার নাইট! স্যার নাইট! তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো ব্রাদার অ্যামব্রোজ। প্রায়োর অ্যায়মারের অনুরোধ…
এই, কে আছিস, এই মূখটাকে তালাচাবি দিয়ে রাখ তো! চিৎকার করে বললো রেজিনাল্ড, লড়াই শেষ হওয়ার আগে ছাড়বি না। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, দ্য ব্রেসি তোমার যে দুচারজন লোক আছে তাদের নিয়ে তুমি পুব দিকের দেয়াল সামলাবে; বোয়া-গিলবার্ট, তুমি পশ্চিমের দেয়াল, আর আমি নিজে থাকবো সামনের ফটকে। এই, কে আছিস ছুঁড়ে মারার জন্যে তেল গরম করা হয়েছে?
দেয়ালের ওপর দিয়ে একটু ঝুঁকে তাকালো বোয়া-গিলবার্ট। তারপর দ্য ব্রেসির দিকে ফিরে বললো, বেশ শৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে ব্যাটাদের ভেতর। নিশ্চয়ই যোগ্য কেউ নেতৃত্ব দিচ্ছে। ভেবে পাচ্ছি না কে-হতে পারে।
আমি দেখতে পাচ্ছি লোকটাকে, বললো দ্য ব্রেসি। ঐ যে দেখ, ঐ দিকে। ব্ল্যাক নাইট। অ্যাশবিতে আমাদের বিপক্ষে লড়েছিলো।
কই? আমি তো দেখছি না!
ঐ যে। সবচেয়ে বড় দলটার সামনে।
হ্যাঁ, এবার দেখেছি। দাঁড়াও, বাবা ব্ল্যাক নাইট, সেদিনের পরাজয়ের শোধ আজ নেবো।
নিজের নিজের লোকদের নিয়ে যার যার জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো নাইটরা। প্রস্তুত আক্রমণ ঠেকানোর জন্যে।
১৬. দুর্গের ওপর দিককার ছোট একটা কামরা
দুর্গের ওপর দিককার ছোট একটা কামরায় রাখা হয়েছে আহত আইভানহোকে। বুড়ি উলরিকার ওপর দেয়া হয়েছিলো তার সেবা যত্নের ভার। অরটা যখন রেবেকা নিজের কাঁধে তুলে নিতে চেয়েছে তখন আপত্তি করা দূরে থাক রীতিমতো খুশি হয়েছে বুড়ি। রেবেকাকে আইভানহোর ঘরে পৌঁছে দিয়ে নিজের কাজে লেগে গেছে সে। সে কাজ যে কি, সে ছাড়া আর কেউ তা জানে না।
আইভানহোর সেবা করার সুযোগ পেয়ে দারুণ খুশি রেবেকা। ওর বাবাকে বাঁচিয়েছিলো বলেই হোক, বা অন্য কোনো কারণেই হোক, আইভনহো রোয়েনাকে ভালোবাসে জানা সত্ত্বেও রেবেকা ভালোবেসেছে আইভানহোকে। মা যেমন করে অসুস্থ সন্তানের সেবা করে তেমন যত্নে ও শুশ্রুষা করছে আইভানহোর।
আইভানহোই ওকে পাঠিয়েছিলো পাদ্রীকে ডেকে আনার জন্যে। কিন্তু উলরিকার তাড়া খেয়ে ফিরে এসেছে ব্যর্থ হয়ে। এর খানিক বাদেই নিচে উঠানে শুরু হলো ভয়ানক কোলাহল। সশস্ত্র মানুষের ভারি পায়ের শব্দ শোনা যেতে লাগলো অলিপথগুলোয়। দেয়ালের ওপর থেকে ভেসে আসতে লাগলো নাইটদের উচ্চকণ্ঠের নিশ। শুনছে আইভানহো। আর অস্থির হয়ে উঠছে ভেতরে ভেতরে। যুদ্ধের ঘোড়া রণদামামা শুনে যেমন করে তেমন ছটফট করছে সে। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে যোগ দেয় যুদ্ধে। কিন্তু ওর শরীরের যা অবস্থা তাতে তা অসম্ভব এক কথায়।
অবশেষে সে বলেই ফেললো, কোনো রকমে যদি ঐ জানালার ধারে গিয়েও বসতে পারতাম! যুদ্ধে যোগ দিতে না পারলেও দেখতে পারতাম অন্তত।
হঠাৎ সব শব্দ থেমে গেল যেন কারো ইঙ্গিতে। গভীর নিস্তব্ধতা দুর্গ জুড়ে।
খামোকাই আপনি দুঃখ পাচ্ছেন, মাননীয় নাইট, রেবেকা বললো। দেখুন সব গোলমাল থেমে গেছে। যুদ্ধ হয়তো হবেই না।
তুমি কিছু জানো না, অস্থির কণ্ঠে বললো আইভানহো। গোলমাল থেমে গেছে মানে এপক্ষের সবাই যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছে তৈরি হয়ে। আক্রমণের জন্যে অপেক্ষা করছে। দেখবে একটু পরেই যুদ্ধ শুরু হবে। আহ, আমি যদি জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম! বলতে বলতে বিছানা থেকে ওঠার চেষ্টা করলো আইভানহো। কিন্তু পারলো না। শুয়ে পড়লো আবার।
তাড়াতাড়ি রেবেকা বললো, আপনি উঠবেন না। আমি জানালার ধারে দাঁড়াচ্ছি। যা দেখবো, আপাকে বলবো।
না, না, ভুলেও তা কোরো না, শঙ্কিত কণ্ঠে বললো আইভানহো। এই দুর্গের প্রতিটি জানালা, প্রতিটি ফোকর এখন আক্রমণকারীদের লক্ষ্য। আচমকা একটা তীর এসে হয়তো লাগবে তোমার গায়ে।
যদি লাগে তো লাগুক না। বেঁচে যাই তাহলে, বলতে বলতে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো রেবেকা।
আইভানহো জানে ইচ্ছে করলেও ও বাধা দিতে পারবে না। তাই শেষ পর্যন্ত মিনতিভরা কণ্ঠে বললো, ঠিক আছে, যদি দাঁড়াতেই চাও, এমনভাবে দাঁড়াও যেন বাইরে থেকে তোমাকে না দেখা যায়।
আইভানহোর অনুরোধ রাখলো রেবেকা। এক পাশে সরে এলো।
আরে, কয়েকশো লোক এগিয়ে আসছে! হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো সে। সবার গায়ে সবুজ পোশাক, হাতে তীর ধনুক।
কোন পতাকার অধীনে আছে ওরা?
কোনো পতাকাই তো দেখতে পাচ্ছি না।
আশ্চর্য! দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে কে কে? দেখতে পাচ্ছো?
একজনকেই দেখে মনে হচ্ছে নেতা। তার গায়ে কালো বর্ম।
ঢালের ওপর কি চিহ্ন দেখ তো।
উহুঁ, দেখতে পাচ্ছি না। ঢালটার রঙও কালো, আর কিছু বোঝা যাচ্ছে। সূর্যের আলো পড়ে ঝলকে উঠছে ওটা। এক মুহূর্ত থেমে রেবেকা আবার বললো, প্রায় এসে গেছে। সামনের লোকগুলো কাঠের ঢাল দিয়ে মাথা ঢেকে ফেলেছে। পেছনের ওরা ধনুকে তীর পরাচ্ছে। ওহ, ঈশ্বর, এবার কি হবে?
তীক্ষ্ণস্বরে শিঙা বেজে উঠলো একবার। আক্রমণের সংকেত! দুর্গ প্রাচীরের ওপর থেকে ভেসে এলো ঢাকের আওয়াজ।
শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ।
একটু পরপরই চিৎকার শোনা যাচ্ছে, ফ্রত দ্য বোয়েফ! বোয়াগিলবার্ট! দ্য ব্রেসি!
শয়ে শয়ে তীর এসে লাগছে দুর্গের দেয়ালে। শয়ে শয়ে উড়ে গিয়ে পড়ছে আক্রমণকারীদের ওপর।
কি দেখতে পাচ্ছো, রেবেকা? জিজ্ঞেস করলো আইভানহো।
বৃষ্টির মতো তীর ছুটছে, আর কিছু না।
ও বেশিক্ষণ চলবে না। শুধু তীর ছুঁড়ে এ দুর্গের একটা পাথরও খসানো যাবে না। দেয়ালের ওপর হামলা চালাতে হবে। সেই ব্ল্যাক নাইটকে দেখতে পাচ্ছো? কি করছে এখন?
কই, দেখছি না তো তাকে।
ব্যাটা কাপুরুষ! চিৎকার করলো আইভানহো। তীরের ভয়েই পেছনে চলে গেছে!
না, না, আবার তাকে দেখতে পাচ্ছি। কয়েক জনকে সাথে নিয়ে দেয়ালের ওপর হামলা চালিয়েছে, তার হাতে কুঠার। অন্যদের হাতে গাছের গুঁড়ি। দমাদম চালাচ্ছে দেয়ালের গায়ে। দেয়ালের গায়ে গর্ত করে ফেলেছে ওরা! কয়েকজন ঢুকতে যাচ্ছে সেই ফোকর গলে! নাহ্! পিছিয়ে গেল! হতাশ শোনালো রেবেকার কণ্ঠস্বর। ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ ওদের পেছনে তাড়া করছে। হাতাহাতি যুদ্ধ হচ্ছে এখন! ওহ, কি ভয়ঙ্কর! জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিয়েছে রেবেকা। দেয়ালের কোল ঘেঁষে যে লড়াই হচ্ছে তার কিছু সে দেখতে পাচ্ছে না।
: তারপর রেবেকা? প্রশ্ন করলো আইভানহো। এখন কি হচ্ছে?
ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ আর সেই ব্ল্যাক নাইট মুখখামুখি লড়ছে। ওহ্ ঈশ্বর, বাঁচাও ওকে! পড়ে গেছে।
কে পড়ে গেছে, রেবেকা? তাড়াতাড়ি বলো!
ব্ল্যাক নাইট, মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো রেবেকা। পর মুহূর্তে আবার সতেজ হয়ে উঠলো সে। না আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, তলোয়ার ভেঙে গেছে ওর। একজনের হাত থেকে কুঠার কেড়ে নিয়েছে। ওহ, মা গো! পড়ে গেছে।
কে, রেবেকা? কে?
ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ! ওর লোকজন দৌড়ে যাচ্ছে ওকে উদ্ধার করার জন্যে। বোয়া-গিলবার্ট ওদের সামনে। টানতে টানতে ওরা নিয়ে আসছে ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফকে। দেয়ালের ভেতর চলে এসেছে। দম নেয়ার জন্যে থমলো রেবেকা।
তারপর, রেবেকা? তারপর?
বাইরের ওরা মই লাগাচ্ছে দেয়ালের গায়ে! উঠে আসছে! নরম গুলো তেল ছুঁড়ে মারছে, পাথর ছুঁড়ে মারছে। কয়েকজন একটা গছের গুঁড়ি নিয়ে এসেছে এই ছুঁড়ে দিলো। ঔড়ির তলে পড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেল কয়েকজন ডাকাত। আরো কয়েকজন এগিয়ে আসছে ওদের জায়গা নেয়ার জন্যে। কিন্তু…কিন্তু, পারছে না ওর। মইগুলো সব ফেলে দিয়েছে নরম্যানরা।
আমাদের লোকরা পিছু হটে যাচ্ছে? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করলো আইতানহো।
না! না! ব্ল্যাক নাইট সমানে ঘা মেরে চলেছে বাইরের মিনারের দরজার ওপর। ওহ্ কি একেকটা ঘা! ওপর থেকে বড় বড় পাথর ছুঁড়ে মারছে তার ওপর। কিন্তু তবু এখনো সে টিকে আছে। দরজার পাল্লাগুলা কাঁপছে। এই ভেঙে পড়লো। আমাদের লোকরা ছুটে আসছে খোলা দরজার দিকে!
ওরা কি পরিখা পার হচ্ছে?
না, বুলসেতুটা ভেঙে দিয়েছে বোয়া-গিলবার্ট। ওরা বাইরের মিনার দখল করে নিয়েছে। ঢুকে পড়েছে ভেতরে। আরে, লড়াই দেখি থেমে গেল!
আবার আক্রমণ করার জন্যে তৈরি হচ্ছে ওরা, বললো আইভানহো। বিশ্রাম নিচ্ছে সৈনিকরা। ওহ, আমি যদি ব্ল্যাক নাইটের পাশে দাঁড়িয়ে লড়তে পারতাম! আমার দশ বছরের আয়ু ছেড়ে দিতে রাজি সেজন্যে।
হায়, নাইট! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো রেবেকা। যার জন্যে আপনি দশ বছরের পরমায়ু ছেড়ে দিতে চাইছেন তা থেকে পাবেন কী? গৌরব? কিন্তু কী এই গৌরব? এ তো কবরের মাথায় পাথরে খোদাই করা কথা; কয়েকদিন পরেই যা আর কারো মনে থাকে না।
আইভানহোর দিকে তাকালো রেবেকা। যন্ত্রণা আর উত্তেজনায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে সে।
ঘুমাচ্ছে, ফিস ফিস করে বললো রেবেকা। ওহ, বাবা! কী অকৃতজ্ঞ মেয়ে আমি! এই যুবকের সোনালি চুল দেখে ভুলে গেছি তোমার ধূসর চুলের কথা। কিন্তু আর নয়, আমার অন্তর থেকে এই বোকামির শিকড় আমি উপড়ে ফেলবো। মাথার ওপর ঘোমটা টেনে দিয়ে জানালার কাছে গিয়ে বসলো সে।
.
মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন্টরকুইলস্টোন। প্রাসাদের মহা প্রতাপশালী অধিপতি রেজিনাল্ড ফ্রঁত দ্য বোয়েফ। মৃত্যু একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে গেছে বুঝতে পেরে আতঙ্কিত বোধ করছে সে। শূন্য একটি কক্ষে তাকে ফেলে রেখে গেছে তার বন্ধু ও ভৃত্যরা। নিয়তির কি নির্মম লিখন, মৃত্যু যখন ঘরের দুয়ারে পৌঁছে গেছে তখন কারও এক মুহূর্তের ফুরসত নেই তার পাশে এসে বসার। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো রেজিনাল্ড। কেন যেন একটা কথাই ওর মনে হচ্ছে, জীবনটা অপব্যয় হলো। কত কিছু করার ছিলো, করতে পারতো, কিন্তু কিছুই করা হলো না।
হঠাং ঘরের এক কোনা থেকে খনখনে গলায় কে যেন অট্টহাসি হেসে উঠলো।
কে? চমকে প্রশ্ন করলো রেজিনাল্ড। কে ওখানে?
তোমার যম, জবাব দিলো উলরিকা।
ভাগগা এখান থেকে ডাইনী বুড়ি। আমাকে শান্তিতে মরতে দাও।
বললেই হলো। সারা জীবনে যত অপকর্ম করেছে সব তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে এসেছি। আমার কাজ শেষ করি আগে তারপর যাবো।
নরকের কীট, দূর হ এখান থেকে!
না! শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি তোমাকে জ্বালাবো। দুর্গাধিপতি, হাহ, দুর্গাধিপতি! পরের জিনিস ডাকাতি করে নিয়ে উনি অধিপতি হয়েছেন! শ্রুত দ্য বোয়েফ, মনে পড়ে, কত লোক তোমার হাতে মরেছে এই দুর্গে? কত অভাগার আর্তনাদে ভারি হয়ে আছে এখানকার বাতাস? মনে পড়ে উলফগ্যাঞ্জারের মুখ? আমার ভাইদের মুখ?
ওহ, থাম রাক্ষুসী! থাম!
পারলে উঠে এসে থামাও না, মহামান্য রেজিনাল্ড ট্রুত দ্য বোয়েফ ওরফে দুর্গাধিপতি। ঐ যে শুনছো, তোমার দুর্গের দেয়াল ভেঙে পড়ছে।
মিথ্যে কথা! অত্যন্ত মজবুত আমার দেয়াল। ঐ গুণ্ডাগুলোর ঘায়ে ভাংতেই পারে না। আমার লোকরা সাহসের সাথে লড়ছে! লড়ছে বোয়াগিলবার্ট, দ্য ব্রেসি। ওরা কিছুতেই হার স্বীকার করবে না!
হা-হা করে পাগলের মতো হেসে উঠলো উলরিকা। কোনো গন্ধ পাচ্ছো, রেজিনাল্ড? ধোঁয়ার গন্ধ? এর নিচের ঘরটায় জ্বালানী কাঠ রাখা হয় মনে আছে?
কি করেছিস তুই, ডাইনী বুড়ি?
কাঠের স্তূপে তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছি। হ্যাঁ, রেজিনান্ড, আমার এই দুর্বল হাত দুটো তোমার দুর্ভেদ্য দুর্গে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ঐ দেখ, জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আগুনের লকলকে শিখা।
উঠে বসার চেষ্টা করলোত দ্য বোয়েফ। পারলো না।
রাক্ষুসী! পিশাচী! দুর্বল কণ্ঠে উচ্চারণ করলো সে। উহ, এক মুহূর্তের জন্যে যদি আবার আগের সেই শক্তি ফিরে পেতাম! তাহলে হয়তো বীরের মতো মরতে পারতাম!
বীরের মৃত্যু! আর আঁশা পেলে না। তোমার মৃত্যু হবে পথের কুকুরের মতো। বুঝলে, পথের কুকুরের মতো। প্রাই যুদ্ধে ব্যস্ত। আগুনের দিকে মন দেয়ার সুযোগই কেউ পাবে না। তুমি পুড়ে মরবে, রেজিনাল্ড! পুড়ে মরবে! হা! হা! হা!
দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলো উলরিকা।
বাঁচাও! বাঁচাও! চিৎকার করতে লাগলো ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ। কিন্তু কেউ শুনতে পেলো না তার চিৎকার।
ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘন হয়ে ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে। আগুনের লেলিহান শিখাও এগিয়ে আসছে ক্রমশ।
.
সংক্ষিপ্ত বিশ্রাম শেষে আবার আক্রমণ করলো ডাকাতবাহিনী। নষ্ট করার মতো সময় তাদের হাতে নেই। নরম্যানদের নিশ্বাস ফেলার সুযোগটুকুও দেয়া চলবে না। যত যা-ই হোক ওরা আছে দুর্গের ভেত্বর, উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে। সময় পেলেই ওর নতুন করে প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পাবে। তাছাড়া ওদের জন্যে যেকোনো মুহূর্তে সাহায্যও এসে যেতে পারে যেকোনো দিক থেকে।
সংক্ষিপ্ত বিশ্রামের ফাঁকে একটা ভাসমান সেতু তৈরি করে ফেলেছে ওরা। পরিখার জলৈ সেতুটা ভাসিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে লক্মলির দিকে তাকালো ব্ল্যাক নাইট।
লক্সলি, কিছু লোক নিয়ে তুমি দুর্গের পেছন দিকে চলে যাও। নরম্যানরা যেন ভাবে ওদিক দিয়েও আমরা আক্রমণ কররো। ওদের অন্তত অর্ধেক লোক তাহলে পেছন দিকটা সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এই ফাঁকে আমরা প্রধান ফটকটা ভেঙে ফেলতে পারবো।
বিনাবাক্যব্যয়ে চলে গেল লক্সলি শখানেক লোক নিয়ে। ইতোমধ্যে প্রধান ফটক বরাবর পরিখার জলে ভাসানো হয়ে গেছে সেতু। কিন্তু ব্যাপারটা দেখে ফেলেছে দুর্গের লোকরা। সব কাজ ফেলে সেতুটাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করতে লাগলো তারা। বড় বড় পাথর, গাছের গুঁড়ি ফেলতে লাগলো ওপর থেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের, সেতুটার বিশেষ কোনো ক্ষতি করার আগেই দুর্গের পেছন দিক থেকে চিকার ভেসে এলো: এদিক দিয়েও হামলা করছে ওরা!
মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল নরম্যানরা। বোয়া-গিন্সবার্ট ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। জিজ্ঞেস করলো, এবার, দ্য ব্রেসি?
কিছু লোককে পেছনে পাঠিয়ে দেয়া ছাড়া আর তো কোনো উপায় দেখছি না।
হঠাৎ ব্ল্যাক নাইট খেয়াল করলো দেয়ালের ওপর শত্রু-সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। কৌশলটা তাহলে কাজে লেগেছে, মুচকি হেসে মনে মনে ভাবলো সে।
সেড্রিক আর কয়েকজন ডাকাতকে নিয়ে সেতুর ওপর দিয়ে এগোলো ব্ল্যাক নাইট। গাছের গুঁড়ি এখন আর পড়ছে না ওপর থেকে, পড়ছে কেবল পাথর, তারও সংখ্যা কমে গেছে অনেক। ঢালটা মাথার ওপর তুলে ধরে এগোচ্ছে সে, পাথর থেকে মাথা বাঁচানোর জন্যে কয়েক সেকেন্ডের ভেতর সেতু পার হয়ে দরজার কাছে পৌঁছে গেল নাইট।
এদিকে উলরিকা তার কাজ করে যাচ্ছে নিষ্ঠার সাথে। ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফের ঘরে তালা লাগিয়ে দিয়ে এসে একে একে দুর্গের অন্য ঘরগুলোতে আগুন লাগাচ্ছে সে। এক তলার পর দোতলা, দোতলার পর তিনতলা। তারপর আরো ওপরে।
প্রধান ফটকের ভারি কপাট ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছেন ব্ল্যাক নাইট ও সেড্রিক। দুজনের হাতে দুটো কুঠার। সর্বশক্তিতে তারা ঘা মেরে চলেছেন কাঠের কপাটে। এদিকে এক দল লোককে দুর্গের পেছন দিকে পাঠিয়ে দিয়ে সবে মাত্র আবার দেয়ালের ওপর উঠেছে দ্য ব্রেসি। ব্ল্যাক নাইট ও সেড্রিকের প্রচেষ্টা দেখতে পেলো সে। অমনি নিজের লোকদের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠলো, লজ্জা করে না তোমাদের, মাত্র এই কজন লোককে ঠেকাতে পারোনি! সৈনিক বলে আবার গর্বে মাটিতে পা পড়ে না। হাঁ করে দেখছে কি? তাড়াতাড়ি ফটকের ওপরের দেয়ালটা ভেঙে ফেল। ইট পাথরের নিচে চাপা পড়ে মরবে বদমাশগুলো! বলতে বলতে নিজেই একজনের হাত থেকে একটা কুঠার কেড়ে নিয়ে দেয়াল আলগা করতে লাগলো।
ইতোমধ্যে যাদের নিয়ে গিয়েছিলো তাদের দুর্গের পেছন দিকে রেখে আবার সামনে চলে এসেছে ললি। সে খেয়াল করলো বিপদটা। ঝটপট কাঁধ থেকে ধনুক খুলে দ্য ব্রেসিকে লক্ষ্য করে বেশ কয়েকটা তীর ছুঁড়লো সে। কি দ্য ব্রেসির গায়ে ইস্পাতের বর্ম থাকায় বিধলো না একটাও।
পিছিয়ে আসুন, সেড্রিক। পিছিয়ে আসুন, নাইট, চিৎকার করে উঠলো নিরুপায় লক্সলি।
কিন্তু দুজনের কেউই সে চিৎকার শুনতে পেলেন না। এত জোরে তারা কুঠার চালাচ্ছেন যে সে শব্দের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে অন্য সব আওয়াজ। তাদের মাথার ওপর পাথরের গাঁথুনি তখন কাঁপতে শুরু করেছে। যে কোনো মুহূর্তে খসে পড়বে।
এই সময় বোয়া-গিলবার্টের চিৎকার শুনে থেমে গেল দ্য ব্রেসি।
আগুন! আগুন! দুর্গে আগুন লেগেছে!
কুঠারটা নামিয়ে রেখে বোয়া-গিলবার্টের কাছে ছুটে গেল দ্য ব্রেসি।
এবার, ব্রায়ান? হাঁপাতে হাঁপাতে বললে সে। এবার আমরা কি করবো?
ফটক খুলে ওদের ঐ সেতুর ওপর দিয়ে পালাতে হবে। এছাড়া আর কোনো পথ নেই।
নির্দেশ পাওয়া মাত্র পড়িমরি করে নেমে আসতে লাগলো নরম্যানরা দেয়ালের ওপর থেকে। তারপর সবাই একজোট হয়ে ছুটলো ফটকের দিকে।
ব্ল্যাক নাইটের সামনাসামনি পড়ে গেল দ্য ব্রেসি। শুরু হলো ভয়ঙ্কর লড়াই। প্রথম কিছুক্ষণ সমানে সমানে লড়লো দুজন। তারপর ধীরে ধীরে পিছাতে শুরু করলো দ্য ব্রেসি। হঠাৎ মাথায় ব্ল্যাক নাইটের কুঠারের প্রচণ্ড এক আঘাতে পড়ে গেল সে।
হার স্বীকার করো, দ্য ব্রেসি! চিৎকার করে উঠলো নাইট।
কক্ষনো না! মরি তা-ও ভাললা! পাল্টা চিৎকার করলো দ্য ব্রেসি।
ব্ল্যাক নাইট ঝুঁকে দ্য ব্রেসির কানে কানে কি যেন বললো। অমনি নরম হয়ে এলো দ্য ব্রেসির গলা।
জি, আমি হার স্বীকার করছি? বললো সে।
যাও দেয়ালের ওপাশে গিয়ে অপেক্ষা করো, ব্ল্যাক নাইট বললো। আমার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত নড়বে না।
জি, যাচ্ছি। উঠে দাঁড়ালো দ্য বেসি। বললো, আইভানহে বন্দী হয়ে আছে এ দুর্গে। ওকে বাঁচাতে হলে উপরে উঠে যান। উপরের একটা ঘরে ওকে আটকে রাখা হয়েছে।
.
আইভানহোর ঘরেও ধোঁয়া ঢুকতে শুরু করেছে। কুণ্ডলী পাকানো ঘন কালো ধোঁয়া। রেবেকা আর সে–কাশছে দুজনেই।
আমার কথা ভেবো না, রেবেকা, মিনতি করলো আইভানহো, তুমি চলে যাও। প্রাণ বাঁচাও।
না, দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলো রেবেকা। বাচি মরি, দুজন এক সাথেই থাকবো।
না, রেবেকা, আমার কথা শোনো। আগুন সারা দুর্গে ছড়িয়ে পড়ার আগেই…
শেষ করতে পারলো না আইভানহো, দড়াম করে খুলে গেল দরজা। বোয়া-গিলবার্ট ঢুকলো। তার বর্ম ভেঙে গেছে। জায়গায় জায়গায় লেগে আছে ছোপ ছোপ রক্ত।
সারা দুর্গে ছড়িয়ে পড়েছে আগুন, হাঁপাতে হাঁপাতে বললো সে। তার ভেতর দিয়ে আমি এসেছি, রেবেকা, শুধুমাত্র তোমাকে বাঁচাতে। চলো আমার সাথে।
তার চেয়ে মরবো আমি।
সময় নষ্ট করলো না টেম্পলার। সোজা এগিয়ে এসে কাঁধে তুলে নিলো ওকে। প্রাণপণে চিৎকার করতে করতে ব্রায়ানের পিঠে কিল ঘুসি মেরে চললে রেবেকা। ক্ৰক্ষেপ করলো না বোয়া-গিলবার্ট। বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। এদিকে অসহায় আইভানহোও চিৎকার করছে। তার চিৎকার শুনে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো ব্ল্যাক নাইট।
তোমার চিৎকার শুনতে না পেলে কোনোদিনই তোমাকে খুঁজে বের করতে পারতাম না, বললো সে।
তুমি যদি সত্যিকারের নাইট হও, অস্থির কণ্ঠে বললো আইভানহো, আমার কথা ভেবে সময় নষ্ট কোরো না। ঐ টেম্পলারের পেছন পেছন যাও। রেবেকাকে উদ্ধার করো। রোয়েনা আর ওর বাপকে বাঁচাও!
হ্যাঁ, যাবো, কিন্তু আগে তুমি এসো, বলতে বলতে আইভানহোকে কাঁধে তুলে নিলো ব্ল্যাক নাইট।-নিরাপদে বেরিয়ে এলো দুর্গ থেকে। আইভানহোকে মোটামুটি নিরিবিলি একটা জায়গায় নামিয়ে রেখে আবার সে ছুটলো দুর্গের ভেতর অন্য বন্দীদের উদ্ধার করতে।
ইতোমধ্যে পশ্চিম পাশের মিনারে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্গের অন্যান্য অংশেও আগুন ধরেছে তবে অত মারাত্মকভাবে নয়। ঐ সব এলাকায় এখনো লড়াই চলছে। চিৎকার, হুঙ্কার আর আর্তনাদে ভারি হয়ে আছে বাতাস। মাটি পিচ্ছিল হয়ে গেছে রক্তে।
সেড্রিক আর গাৰ্থ ছুটতে ছুটতে দুর্গের প্রাসাদ অংশে ঢুকলেন। আগুনের অসহ্য উত্তাপ সয়েও একটা একটা করে বন্ধ ঘরের দরজা খুলে দেখতে লাগলেন তারা। অবশেষে পেলেন রোয়েনার খোঁজ। যে মুহূর্তে রোয়েনা বাঁচার আশা সম্পূর্ণ ছাড়তে বসেছে ঠিক সেই মুহূর্তে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন সেড্রিক। পেছনে গাৰ্থ। ছুটে এসে সেড্রিককে জড়িয়ে ধরলো রোয়েনা। সেড্রিকও বুকে টেনে নিলেন মেয়েকে। এক মুহূর্ত,পরেই ওকে ছেড়ে দিয়ে গার্থের দিকে ফিরলেন তিনি। বললেন, জলদি, গার্থ, এক্ষুনি রোয়েনাকে নিয়ে বেরিয়ে যাও প্রাসাদ ছেড়ে। আমি আসছি।
অ্যাথেলস্টেন আর ওয়াম্বার খোঁজে ছুটলেন তিনি।
কিন্তু তার আগেই বুদ্ধি খাটিয়ে নিজের আর অ্যাথেলস্টেনের মুক্তির ব্যবস্থা করেছে ওয়াম্বা।
প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে সবেমাত্র উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা, এই সময় অ্যাথেলস্টেন দেখলো, একপাশে দাঁড়িয়ে আছে বোয়া-গিলবার্টের ঘোড়া। পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন সবুজ পোশাক পরা সৈনিকের সাথে লড়ছে টেম্পলার। ঘোড়াটার পিঠে অচেতন হয়ে ঝুলছে এক তরুণী। নিশ্চয়ই রোয়েনা, ভেবে ছুটে গেল অ্যাথেলস্টেন। এক জনের হাত থেকে একটা কুঠার কেড়ে নিয়ে মুখোমুখি হলো ব্রায়ানের।
ভণ্ড নাইট! চিৎকার করে উঠলো অ্যাথেলস্টেন। ছেড়ে দাও মেয়েটাকে!
কুকুর! একই তেজে চিৎকার করলো টেম্পলার। তারপর আচমকা তলোয়ার তুলেই আঘাত করলো অ্যাথেলস্টেনের শিরোম্রাণহীন শিরে। কাটা গাছের মতো মাটিতে আছড়ে পড়লো স্যাক্সন রাজপুত্রের দেহ।
এসো আমার সাথে, সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দিলো টেম্পলার। লাফ দিয়ে ঘোড়ায় চাপলো। ছুটলো ফটক পেরিয়ে, শত্রুর ভাসানো সেতু পেরিয়ে বনের ভেতর দিয়ে।
এবার শুরু হলো দুর্গ লুটের পালা। লক্সলি তার দলবল নিয়ে প্রতিটা ঘরে ঢুকছে। মূল্যবান যা কিছু পাচ্ছে কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে নিচের উঠানে। অবশ্য খুব ভালো করে লুট করার সুযোগ ওরা পেলো না। তার আগেই অসহ্য হয়ে উঠলো আগুনের উত্তাপ। একতলা আর দোতলার মালপত্র হাতিয়েই নেমে আসতে বাধ্য হলো সবাই।
পুরো দুর্গ এখন আগুনের রাজত্ব হয়ে উঠেছে। সবগুলো চূড়া থেকে বেরিয়ে আসছে লকলকে শিখা, কালো ধোঁয়া আর অসংখ্য ফুলকি। যুদ্ধ থেমে গেছে। বিজয়ী পক্ষ নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখছে আগুনের খেলা।
শেষ; নরম্যান কুত্তাগুলোর ধুর্গ! মলে উঠলো এক দস্যু। অমনি তার সাথে গলা মিলিয়ে চিৎকার করলো আরো অনেকে: শেষ! নরম্যান কুত্তাগুলোর দুর্গ!
হঠাৎ দুর্গের সর্বোচ্চ চূড়ায় দেখা গেল শীর্ণ এক নারী মূর্তি। বুড়ি উলরিকা! তার ধূসর এলো চুল, পোশাকের প্রান্ত উড়ছে বাতাসে। তার সেই বনখনে গলায় সে গেয়ে চলেছে উদ্দীপনাময় এক যুদ্ধের গান। গান এক সময় থেমে গেল। উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকালো উলরিকা। হেসে উঠলো হো-হো করে। আগুন পৌঁছে গেছে চূড়াটায়। কিন্তু ক্ষেপ নেই বৃদ্ধার। হেসেই চলেছে সে। তার পোশাকের প্রান্ত ছুঁলো আগুন। হাসি থামলো না। সারা গায়ে আগুন ধরে গেল উলরিকার। হাসি থামলো না। উড়ন্ত চুলগুলো পুড়ে গেল। কিন্তু হাসি চলছে। নিচে দাঁড়িয়ে বিস্মিত মানুষগুলো ভাবছে, এ কি করে সম্ভব! তারপর আচমকা থেমে গেল হাসি। উলরিকার দেহটা ধীরে ধীরে পড়ে গেল ভাজ হয়ে। অগ্নিস্নানে শান্ত হলো তার এতদিনের অন্তর্জালা।
১৭. হার্ট হিল ওয়াক-এর বিশাল ওক গাছটা
পরদিন ভোর।
হার্ট হিল ওয়াক-এর বিশাল ওক গাছটার নিচে জড় হয়েছে বিজয়ী পক্ষ। লুটের মালপত্র ভাগ বাটোয়ারা হবে। দলের নেতা বনের রাজা লক্সলি। সবুজ ঘাসের ওপর বসেছে সে ডান পাশে ব্ল্যাক নাইট আর বাঁ পাশে সেড্রিককে নিয়ে।
লক্সলির কয়েকজন অনুচর দুটো ভাগে ভাগ করে সাজিয়ে রাখলো লুট করে আনা জিনিসগুলো। তারপর লক্সলি বললো, মহান সেড্রিক, লুটের মালপত্র সব দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। আপনার যে ভাগ ইচ্ছা আপনি নিন। আপনার যেসব লোক আমাদের সাহায্য করেছে তাদের ভেতর বিলিয়ে দেবেন।
এসবের কোনো প্রয়োজন আমার নেই, বললেন সেড্রিক। তোমরা যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের জীবন আর সম্মান বাঁচিয়েছে সে জন্যে তোমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এর দুটো ভাগই তোমরা নাও। আমি সত্যিই খুশি হবো। আমার লোকদের আমি নিজেই পুরস্কার দেবো।
এরপর সেড্রিক ওয়াম্বার দিকে তাকালেন। বললেন, এদিকে আয়, বোকা-গাধা-ভড়।
এই নাকি প্রাণ বাঁচানোর পুরস্কার! বিড় বিড় করতে করতে এগিয়ে এলো ওয়া।
সেড্রিক উঠে জড়িয়ে ধরলেন ওকে।
কি করে তোর ঋণ শোধ করবো বল তো, হাঁদা? আমার জন্যে প্রাণ দিতে গেছিলি তুই…, বলতে বলতে গলা ধরে এলো বদমেজাজী লোকটাব। সুহৃদ অ্যাথেলস্টেনের মৃত্যুতেও যে চোখে জল দেখা যায়নি সে চোখে টল টল করে উঠলো জল।
চোখের জলে তো আমার ঋণ শোধ হবে না, স্বভাবসুলভ চপল কণ্ঠে বললো ওয়াম্বা। শোধ যদি করতেই চান আমার দোস্ত গার্থকে ক্ষমা করুন। আপনার ছেলের সেবা করার জন্যেই ও পালিয়ে গিয়েছিলো।
ওকে শুধু ক্ষমা নয়, পুরস্কারও দেবো। গার্থের দিকে ফিরলো সেড্রিক। এদিকে এসো, গার্থ। হাঁটু গেড়ে বসো। আজ থেকে তুমি আর ক্রীতদাস নও। আর দশজনের মতোই স্বাধীন মানুষ। আমার জমিদারীতে কিছু জমি দেবো তোমাকে। স্বাধীনভাবে চাষবাস করবে।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো গার্থ। মাথার উপর দুহাত তুলে এক পাক ঘুরে নিয়ে তাকালো সাবেক মনিবের দিকে।
আপনার মতো দয়াশীল লোক হয় না, স্যার! চিৎকার করে উঠলো সে। আমার গলার এই আংটা খুলে দেবে কে?
ওয়াম্বা, তুইও বোস হাঁটু গেড়ে, আদেশ করলেন সেড্রিক।
বসলো ভাঁড়।
তুইও আজ থেকে স্বাধীন, সেড্রিক বললেন গার্থের গলার আংটা খুলে দে, তোরটা খুলে দেবে গার্থ।
এই সময় ঘোড়ায় চেপে সেখানে উপস্থিত হলো রোয়েনা। লক্সলি ও তার দলের সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা করলো। সবাইকে ধন্যবাদ জানালো রোয়েনা।
একপাশে মুখ নিচু করে বসে ছিলো বন্দী দ্য ব্রেসি। সে এবার উঠে দাঁড়ালো। অনুতপ্ত গলায় বললো, আপনার সাথে যে জঘন্য আচরণ করেছি সে জন্যে ক্ষমা চাইছি, লেডি রোয়েনা।
ক্ষমা করলাম আপনাকে, ঘোড়া থেকে নামতে নামতে বললো রোয়েনা। কিন্তু আপনার পাগলামিতে যে ক্ষতি হয়েছে, সবাইকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সে কথা ভুলতে পারবো না কিছুতেই।
তোমাকে মেরে ফেললেই হতো উচিত শাস্তি, বলে উঠলেন সেড্রিক। অবশ্য না মেরেও যে খুব খারাপ হয়েছে তা নয়। তুমি যে অন্যায় করেছে, সে জন্যে যে অন্তর্জালা ভোগ করবে আজীবন সে-ও শাস্তি হিশেবে কম নয়।
উঠে দাঁড়ালেন সেড্রিক। আর সময় নষ্ট করতে চান না। এক্ষুনি রদারউডের পথে রওনা না হলে পৌঁছুতে দেরি হয়ে যাবে। ব্ল্যাক নাইটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে দারউডে আমন্ত্রণ জানালেন তাকে।
সাধারণ অতিথি হিশেবে নয়, বললেন সেড্রিক, আমার পুত্র বা ভাইয়ের মতো সাদরে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবো আমার প্রাসাদে।
আপনার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম, সেড্রিক, জবাব দিলো নাইট। খুব শিগগিরই আপনার রদারউডে আমি আসবো। এবং যখন আসবো বিশেষ
একটা জিনিস আমি চাইবো আপনার কাছে।
কি তা এখন আমি শুনতে চাইবে না। শুধু এটুকু বলবো, ধরে নিন জিনিসটা আপনি পেয়ে গেছেন।
দেখবো, আজকের এই প্রতিশ্রুতির কথা সেদিন আপনার কেমন মনে থাকে!
দেখবেন, বলে দলবল নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন সেড্রিক। গাৰ্থ আর ওয়াম্বা রয়ে গেল ব্ল্যাক নাইটের নির্দেশে। তাদের এক পাশে ডেকে নিয়ে কানে কানে কি যেন বললো নাইট। অমনি মাথা ঝাঁকিয়ে বনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল দুজন।
লক্সলি এবার এগিয়ে এলো ব্ল্যাক নাইটের দিকে।
স্যার নাইট, আপনার সাহায্য না পেলে আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হতো, বললো সে। আমি এবং আমার দলের সবাই আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। অনুগ্রহ করে এই সব লুটের মাল থেকে আপনার পছন্দ মতো কিছু একটা গ্রহণ করুন। আমরা সবাই খুব খুশি হবো।
বেশ, বেশ, আমি তোমার উপহার সানন্দে গ্রহণ করবো। আমার পছন্দ দ্য ব্রেসিকে। ওকে তুলে দাও আমার হাতে।
কোনো আপত্তি নেই আমার। দ্য ব্রেসির ভাগ্য আপনি ওকে নিয়ে যেতে চাইছেন। এখানে থাকলে যে দুর্দশা হতো তার হাত থেকে বেঁচে গেল বদমাশটা।
দ্য ব্রেসির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ব্ল্যাক নাইট।
তোমাকে মুক্তি দিলাম, দ্য ব্রেসি, বললো সে। যেখানে খুশি চলে যেতে পারো। অতীতে যা করেছে তা হয়তো আমরা ভুলে যাবো যদি ভবিষ্যতে সাবধান হও।
দ্য ব্রেসি আজানু নত হয়ে কুর্নিশ করলো ব্ল্যাক নাইটকে।
আপনার কথা আমার মনে থাকবে, স্যার নাইট, বলে সে অদৃশ্য হয়ে গেল বনের ভেতর।
লক্সলি এবার তার গলা থেকে একটা চমৎকার শিঙা খুলে নিলো। ব্ল্যাক নাইটকে বললো, সেদিনের টুর্নামেন্টে আমি এটা পুরস্কার পেয়েছি। কালকের যুদ্ধে আপনি যে বীরত্ব দেখিয়েছেন তার স্মৃতিচিহ্ন হিশেবে এটা আমি আপনাকে দিতে চাই। আপনি নিলে খুশি হবো।এই শেরউড বনে যদি কখনো কোনো বিপদে পড়েন তিনবার ফুঁ দেবেন এই শিঙায়, এমন করে, শিঙাটা তিনবার বাজিয়ে দেখালো লক্সলি, আমার লোকজন এসে আপনাকে সব রকম সাহায্য করবে।
আমি নিচ্ছি তোমার এই উপহার, বললো ব্ল্যাক নাইট। অনেক ধন্যবাদ। প্রয়োজন হলে নিশ্চয়ই তোমাদের সাহায্য চাইবো।
কিন্তু আমাদের বীর পুরুষ সন্ন্যাসী বাবাজি কোথায়? হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো লক্সলি। যেসময় খাবার দাবারের বন্দোবস্ত হয় বা লুটের মাল ভাগাভাগি হয় সে সময় তো কখনো তাকে গর হাজির থাকতে দেখিনি! আজ হলো কী?
লক্সলির কথা শেষ হতে না হতেই গম্ভীর একটা গলা শোনা গেল: পথ ছাড়ো! ভালো মানুষের দল পথ ছাড়ো! বিজয়ী বীর আর তার বন্দীর জন্যে পথ ছেড়ে দাও!
গলাটা সন্ন্যাসী বাবাজির। ইহুদী আইজাকের কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে আসছেন তিনি। অন্য হাতে বিরাট একটা তলোয়ার, বন বন করে ঘোরাচ্ছেন মাথার ওপর। দেখে অদম্য হাসিতে ফেটে পড়লো সবাই।
এতক্ষণ কোথায় ছিলেন, ফাদার? জানতে চাইলো লক্সলি। আর এই ইহুদীকেই বা পেলেন কোথায়?
আর বোলো না, জবাব দিলেন কপম্যানহাস্ট্রের সরাসী, একটু ভালো পানীয় পাওয়ার আশায় টরকুইলস্টোন প্রাসাদের তল কুঠুরীতে ঢুকেছিলাম কাল বিকেলে। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর সবে ছোট্ট একটা মদের পিপের সন্ধান পেয়েছি, এমন সময় পাশের একটা ঘরের দিকে চোখ পড়লো। দরজায় তালা, কিন্তু চাবি দেয়া নয়। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখি এক কোনায় জড়সড় হয়ে বসে আছে এই বুড়ো। আমাকে দেখেই পা জড়িয়ে ধরলো। দয়া হলো আমার। ব্যাটাকে নিয়ে বেরিয়ে আসবো এমন সময় ওপর থেকে কড়ি বরগা খসে পড়ে বন্ধ হয়ে গেল বেরোনোর পথ। বাঁচার কোনো আশাই রইলো না। কিন্তু ইহুদীর সাথে মরবো–ভাবতেও পারি না শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলাম, তলোয়ারের এক ঘায়ে ব্যাটার কল্লাটা নামিয়ে দিই। জ্যান্ত ইহুদী আর মরা ইহুদীতেঅনেক তফাৎ, তাই না? কিন্তু বেচারার বয়স দেখে মায়া হলো আমার। তলোয়ার আর উঠলো না। শেষকালে ব্যাটাকে খ্রীষ্টধর্মের মহিমা শোনাতে শুরু করলাম। ভাবলাম তাতে হয়তো এই মহান ধর্মে ওর মতি হবে। মনে হয় কিছু ফল হয়েছে।
তাই নাকি, আইজাক? জিজ্ঞেস করলো লক্সলি।
মোটেই না, চিৎকার করে উঠলেন বৃদ্ধ ইহুদী। সারারাত আমার কানের কাছে উনি কি বকর বকর করেছেন, তার এক বর্ণ আমি বুঝিনি।
অবিশ্বাসী! তুমি মিথ্যে বলছো! এই নাও তার শাস্তি, বলতে বলতে ফাদার ঘুষি মারার জন্যে তৈরি হলেন আইজাককে।
ব্ল্যাক নাইট বাধা দিলো তাকে। বললো, ফাদার, এবারের মতো মাফ করে দিন অবিশ্বাসীকে।
তাহলে আপনিই নিন, বলে ঘুসি বাগিয়ে এগিয়ে এলেন ফাদার।
ধার হিশেবে হলে আপত্তি নেই। পরে সুদ আসলে শোধ দেবো। কি রাজি?
সন্ন্যাসীর ঘূসির ওজন মারাত্মক। কথাটা অনেকেই জানতো। তাই সবাই যখন দেখলো তার প্রমাণ আকারের একটা ঘুসি খেয়ে ব্ল্যাক নাইট একটু টললো না পর্যন্ত তখন তারা অবাক না হয়ে পারলো না।
এবার আমার ধার শোধ করার পালা। সোজা হয়ে দাঁড়ান, ফাদার, বলেই ব্ল্যাক নাইট তাকে এমন এক ঘুসি মারলো, চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন ফাদার।
যাক, শোধ বোধ হয়ে গেল, উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন তিনি। এবার ইহুদীটার একটা ব্যবস্থা করে ফেলা উচিত। ও যখন কিছুতেই নিজের ধর্ম ছাড়বে না, তাহলে বলুক মুক্তিপণ হিশেবে কি দেবে।
দুশ্চিন্তার কিছু নেই, আইজাক, লক্সলি বললো, সময় নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন, কি দেবেন বা কত দেবেন, এই ফাঁকে আমরা আরেক বন্দীর সাথে আলাপ সেরে ফেলি। নিয়ে এসো ওকে!
লক্সলির কয়েক স্যাঙাৎ টানতে টানতে নিয়ে এলো জরভক্স মঠের প্রায়োর অ্যায়মারকে।
ডাকাতদের ওপর ভয়ানক রেগে গেছেন অ্যায়মার, আবার ভয়ও পেয়েছেন।
এ কি ধরনের আচরণ, চিৎকার করে উঠলেন তিনি। রাজার সড়ক থেকে একজন প্রায়োরকে ধরে আনো তোমরা, এত বড় সাহস! আমার জরুরি কাগজপত্র সব নিয়ে নিয়েছে। আমার পোশাক আশাক, সোনা দানা যা ছিলো সব…, দম নেয়ার জন্যে থামলেন তিনি।
হ্যাঁ, বলে যান, প্রায়োর, মৃদু হেসে বললো লক্সলি।
প্রায়োর দেখলেন তার রাগ দেখে মজা পাচ্ছে ডাকাতগুলো। কথা বলার ভঙ্গি বদলালেন তিনি। দেখ আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। তোমাদের ক্ষমা করে দিয়ে সব ভুলে যেতে রাজি আছি। কিন্তু তার আগে আমার কাছ থেকে যা যা তোমরা নিয়েছে সব ফেরত দেবে, আর ক্ষতিপূরণ হিশেবে দেবে একশো রৌপ্য মুদ্রা।
আমার লোকরা আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করেছে বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত আমি, ফাদার, বললল ললি।
দুর্ব্যবহার! বিস্ময়ের সাথে উচ্চারণ করলেন প্রায়োর। শুধু দুর্ব্যবহার হলে তো কথা ছিলো না। ঐ লোকটা কি যেন নাম?–অ্যালান-আ-ডেল, বলে কি না, চারশো রৌপ্য মুদ্রা না দিলে আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে! আমার সোনা দানা সব নেয়ার পরও এ কথা বলে!
আপনি ঠিক বলছেন, প্রায়োর? সত্যিই অ্যালান-আ-ডেল একথা বলেছে?
নিশ্চয়ই বলেছে!
তা হলে তো ও যা চেয়েছে, আপনাকে দিতেই হবে। অ্যালান-আডেল যা বলে তা করে ছাড়ে।
কী! চিৎকার করে উঠলেন হতভম্ব প্রায়োর। নিশ্চয় তোমরা রহস্য করছো। দেখ, রহস্য আমিও পছন্দ করি। কিন্তু এ ব্যাপারটা মোটেই তেমন না।
ঠিক, ফাদার, লক্সলি বললো, এ ব্যাপারটা মোটেই রহস্য নয়। আমরা যা চেয়েছি যদি না দেন এ বন থেকে প্রাণ নিয়ে বেরুতে পারবেন না।
এবার আর রাগ নয়, সত্যি সত্যিই ভয় ভর করলো প্রায়োর অ্যায়মারের মনে।
কত চাও তোমরা? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
সঙ্গে সঙ্গে কোনো জবাব দিলো না লক্সলি। দেরি দেখে ওর এক অনুচম বলে উঠলো, আমার একটা প্রস্তাব আছে, বলবো?
বলো।
আমার প্রস্তাব হলো, ইহুদী আইজাক ঠিক করুক প্রায়োর অ্যায়মারের মুক্তিপণ, আর আইজাকেরটা ঠিক করুক প্রায়োর।
হ্যাঁ, বুদ্ধিটা মন্দ না, একমত হলো লক্সলি। আইজাকের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, নিশ্চয়ই আপনি প্রায়োর অ্যায়মারকে চেনেন, তাঁর মঠ সম্পর্কেও জানেন ভালো করে?
হ্যাঁ, জবাব দিলেন বৃদ্ধ ইহুদী। ঐ মঠের সঙ্গে, ফাদার অ্যায়মারের সঙ্গেও আমি লেনদেন করেছি। মঠ এবং ফাদার দুজনেই ধনী।
তাহলে মুক্তিপণ হিশেবে কত দেয়া উচিত ফাদারের?। ছয়শো রৌপ্য মুদ্রা, আমার মনে হয়, খুব বেশি হবে না ওঁর পক্ষে।
ভালো কথা, বললো লক্সলি। আমি রাজি ছয়শো রৌপ্য মুদ্রায়। প্রায়োর অ্যাায়মর আপনি আমাদের ছয়শো রৌপ্য মুদ্রা দেবেন এবার বলুন, এই ই দী বৃদ্ধ কত দেবেন মুক্তিপণ?।
এক হাজার রৌপ্য মুদ্র। একটাও কম নয়। ব্যাটার ইয়র্কের বাড়ি সোনা রূপায় ঠাসা।
এক হাজার রৌপ্যমুদ্রা! আর্তনাদ করে উঠলেন আইজাক। আমার শেষ কপর্দকটা পর্যন্ত আপনারা নিয়ে নেবেন? আমার একমাত্র মেয়েকে আমি হারিয়েছি। এখন কি আমার সমস্ত সম্পদও হারাববা? ও রেবেকা! রেবেকা! তুই এখন কোথায়? হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন বৃদ্ধ। তুই বেঁচে আছিস না মরে গেছিস? আমার বাচ্চা! আমার মানিক!…।
বৃদ্ধের হাহাকার শুনে মন নরম হয়ে এলো সবারই। চুপ করে রইলো তারা! কেউ ভেবে পাচ্ছে না কি বলবে
আপনার মেয়ের চুল কি কালো? অবশেষে জিজ্ঞেস করলো একজন। কাপড়ের পাড় রূপালি জরির কাজ করা?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমি দেখেছো ওকে? ওর কোনো খবর দিতে পারবে? আগ্রহে কাঁপছে আইজাকের গলা।
টেম্পলার বোয়া-গিলবার্ট ওকে ধরে নিয়ে গেছে। আমি দেখেছি। যখন পালায় তখন আমি তীর ছোড়ার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু মেয়েটার গায়ে লাগতে পারে ভেবে ছুঁড়িনি।
ওই, কেন তুমি ছুঁড়লে না, তাই? টেম্পলারের মতো মানুষের হাতে আটকে থাকার চেয়ে মরা ভালো ছিলো ওর। ওহ! ওহ্! আমার মান সম্মান সব ধুলায় মিশে গেল!
লক্সলি মুখ ঘুরিয়ে তার সব লোকের দিকে তাকলো। দেখলে সবার দৃষ্টিতেই করুণা।
আইজাক, বললো সে। আপনার কাছ থেকে আমি পাঁচশো রৌপ্যমুদ্রা নেবো। বাকি টাকা আপনি টেম্পলার ব্রায়ানকে দেবেন কন্যার মুক্তিপণ হিশেবে। আশাকরি পাঁচশো রৌপ্যমুদ্রা পেলে আপনার মেয়েকে ছেড়ে দিতে রাজি হবে টেম্পলার।
প্রায়োর অ্যায়মারকে এক পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে কড়া গলায় ঝুলি বললো, ফাদার, আমি এতদিন জানতাম আপনি ভালো খাওয়া দাওয়া, শিকার এসব পছন্দ করেন; কিন্তু বদমায়েশি, নিষ্ঠুরতা এসবও যে পছন্দ করেন তা কখনো শুনিনি।
মানে…মানে… তো তো করতে লাগলেন আয়মার।
মানে মানে, রেখে শুনুন। আমার মনে হয় আপনার কথা শুনবে টেম্পলার ব্রায়ান। রেবেকাকে ফিরিয়ে দিতে বলুন আপনার বন্ধুকে। বিনিময়ে ভালো দাম দেবেন আইজাক। চান তো আপনাকেও কিছু দেবেন উনি।
আমাকে ভাবনায় ফেলে দিলে দেখছি…, চিন্তিত কণ্ঠে বললেন প্রায়োর। ইহুরিকে সাহায্য করা আমাদের ধর্ম বিরুদ্ধ!…তবে…আইজাক যদি আমাদের মঠের সংস্কারের জন্যে কিছু সাহায্য দেয় তাহলে বোধ হয় আর আপত্তি করার কিছু থাকে না।
ঠিক আছে, দেবেন উনি। এবার তাহলে আপনি একটা চিঠি লিখে দিন ব্রায়ানকে।
দিচ্ছি। আমাকে একটা কলম দাও।
লেখা শেষ হতেই চিঠিটা প্রায়োরের কাছ থেকে নিয়ে পড়ে দেখলো লক্সলি। সন্তুষ্ট হয়ে এগিয়ে দিলো আইজাকের দিকে। বললো, চিঠিটা বোয়া-গিলবার্টকে দেবেন। আমার মনে হয় হাউস অভ দ্য টেম্পলারস মানে টেম্পলস্টো মঠে পাবেন ওকে। ব্রায়ান যা চায় দিয়ে দেবেন। দয়া করে এই একটা ক্ষেত্রে অন্তত টাকা পয়সা নিয়ে কোনো কৃপণতা করবেন না। আপনার কন্যার চেয়ে টাকা মূল্যবান নয়।
এতক্ষণ গভীর কৌতূহল নিয়ে এসব কাণ্ডকারখানা দেখছিলো ব্ল্যাক নাইট। এবার সে বিদায় নেয়ার জন্যে তৈরি হলো। যাওয়ার আগে লক্সলিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, এবার নিশ্চয়ই বলবে, কে তুমি?
আমি আমার দেশ ও রাজার একজন বন্ধু, জবাব দিলো ললি। এর বেশি আর কিছু আমি এখন বলতে পারবো না। নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন আমার মতো আপনারও কিছু গোপন কথা আছে। আমি তো তা জানতে চাইছি না।
বেশ। আশা করি পরের বার যখন আমাদের দেখা হবে, আরো ভালোভাবে আমরা জানবো একে অপরকে। এই আমার হাত, সাহসী দস্যু।
আর এই যে আমার, সাহসী নাইট।
দুটো হাত এক হলো।
লাফ দিয়ে ঘোড়ায় চাপলো ব্ল্যাক নাইট। ছুটিয়ে দিলো বনের পথে।
১৮. ইয়র্কের দুর্গ প্রাসাদ
ইয়র্কের দুর্গ প্রাসাদে বিরাট এক ভোজের আয়োজন করেছেন রাজপুত্র জন। তার মিত্র যত নাম করা লোক আছে সবাইকে দাওয়াত করেছেন। এদের সহায়তায়ই রাজা রিচার্ডের সিংহাসন দখল করার পরিকল্পনা করেছেন জন।
পান ভোজন চলছে। মাঝে মাঝেই উৎফুল্ল, পরিতৃপ্ত রাজপুরুষরা চিৎকার করে উঠছে:
রাজপুত্র জন দীর্ঘায়ু হোন!
এই সময় এক দূত ভয়ানক এক দুঃসংবাদ নিয়ে এলো। পতন হয়েছে টরকুইলস্টোন দুর্গের। রেজিনাল্ড ট্রুত দ্য বোয়েফ, ব্রায়ান দ্য বোয়া গিলবার্ট ও মরিস দ্য ব্রেসি তিনজনই নিহত। ওদের সঙ্গে যারা ছিলো তাদেরও বেশিরভাগই হয় নিহত নয়তো মারাত্মক আহত। অর্থাৎ এ মুহূর্তে যদি প্রয়োজন পুড়ে ওদিক থেকে একজন লোকের সাহায্যও জন পাবেন না। খবরটা শুনে রীতিমতো মুষড়ে পড়লেন রাজপুত্র। কারণ এই তিন নাইট ছিলো তার শক্তির মূল উৎস। ওদের ছাড়া কি করে তিনি সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে নামবেন? মুহূর্তে থেমে গেল সব উল্লাস, হৈ-চৈ, ফুর্তি। রাজপুত্র জনের সাথে সাথে আর সবাইও বসে রইলো মুখ গোমড়া করে।
হঠাৎ একটা কোলাহন শোনা গেল হল কামরার বাইরে। কৌতূহলী হয়ে তাকালেন রাজকুমার জন। দরজায় দেখা গেল দ্য ব্রেসিকে।
তার বর্ম, ঢাল, শিয়োস্ত্রাণ রক্ত, ধোঁয়া আর কাদায় নোংরা হয়ে আছে, তাকে দেখেই হাসি ফুটে উঠলো জনের মুখে।
কে বললো দ্য ব্রেসি মারা গেছে? উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন তিনি। এসো এসো, দ্য ব্রেসি। ফ্ৰঁত দ্য ববায়েফ আর টেম্পলার কোথায়?
দ্য ব্রেসির জবাব শুনে আবার মুখ শুকিয়ে গেল রাজপুত্রের।
টেম্পলার পালিয়েছে, বললো দ্য ব্রেসি। আর ফ্ৰঁত দ্য ববায়েফ পুড়ে মরেছে নিজের জ্বলন্ত প্রাসাদে।
হতাশ মুখে প্রিয় বন্ধু ওয়াল্ডেমারের দিকে তাকালেন জন।
আরো দুঃসংবাদ আছে, রাজপুত্র, বলে চললো দ্য ব্রেসি। রাজা রিচার্ড এখন ইংল্যান্ডে।
কী! ফ্যাকাসে হয়ে গেল রাজপুত্রের মুখ।
হ্যাঁ রাজপুত্র। আমি নিজ চোখে তাঁকে দেখেছি, তাঁর সাথে কথা বলেছি।
এখন সে কোথায়? প্রশ্ন করলেন ওয়ার্ল্ডেমার।
আমি যখন শেষবার দেখেছি তখন বনের ভেতর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছিলেন।
কজন লোক আছে ওর সাথে?
একজনও না।
একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলেন রাজপুত্র ও ওয়ান্ডেমার।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে কারাগারে পুরতে হবে, বললেন রাজপুত্র জন।
কবরের চেয়ে নিরাপদ কোনো কারাগার নেই, ওয়াল্ডেমার জবাব দিলেন।
মাথা ঝাকালেন রাজপুত্র।
এক্ষুনি তাহলে রওনা হয়ে যান, ওয়াল্ডেমারকে বললেন তিনি।
দ্য ব্রেসির দিকে তাকালেন ওয়ান্ডেমার। বললেন, তুমি যাবে নাকি আমার সাথে?
না, আমি তাঁর একটা চুলেরও ক্ষতি করবো না। কাল আমাকে বন্দী করার পরও উনি আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন। আমি কথা দিয়েছি, ভবিষ্যতে তাঁর কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করবো মা।
দ্য ব্রেসির দিকে তীব্র এক দৃষ্টি হেনে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন ওয়াল্ডেমার।
.
দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে হাউস অভ দ্য টেম্পলারস-এ পৌঁছুলেন আইজাক।
সবুজ সমভূমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিশাল টেম্পলস্টো মঠ। পরিখা দিয়ে ঘেরা দুর্গের মতো বিশাল দালানটা। দুজন কালো পোশাক পরা সৈন্য পাহারা দিচ্ছে ঝুলসেতু। দুর্গ প্রাচীরের আদলে তৈরি পুরু দেয়ালের ওপর টহল দিচ্ছে আরো বেশ কজন সৈনিক।
টেম্পলার নাইটদের গ্র্যান্ডমাস্টার লোকটা বৃদ্ধ। গায়ের চামড়া ঝুলে পড়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাঁটেন ঋজু হয়ে। শাদা ধবধবে পোশাক গায়ে। চোখের দৃষ্টিতে এখনও যেন আগুন জ্বলে। সদ্য প্যালেস্টাইন থেকে ফিরেছে এমন এক টেম্পলারের সাথে হাঁটছিলেন তিনি মঠের বাগানে। প্যালেস্টাইনের সর্বশেষ খবরাখবর সংগ্রহ করছিলেন সদ্য আসা টেম্পলারের কাছ থেকে।
ব্রাদার কনরাড অবশেষে বললেন গ্র্যান্ডমাস্টার, ইংল্যান্ডের নাইট টেম্পলারদের আচরণ দেখে খুবই মর্মাহত আমি।
হওয়ারই কথা। ফ্রান্সের ওদের চেয়েও খারাপ আচরণ করে এরা।
হ্যাঁ, এখানে সবচেয়ে ধনী লোক কারা খুঁজতে যাও, দেখবে টেম্পলাররাই। দেশের বেশিরভাগ সম্পদ কুক্ষিগত করে ফেলছে। টেম্পলার নাইট হওয়ার সময় যে শপথ নিয়েছিলো তা গুলিয়ে খেয়েছে সবাই। টেম্পলার হওয়ার সময় শাদাসিধে জীবন-যাপনের শপথ নিয়েছে, কিন্তু করছে কি? সবচেয়ে দামী কাপড়টা, সবচেয়ে ভালো খাবারটা না হলে চলে না ইংরেজ টেম্পলারদের সবচেয়ে দুঃখজনক কি জানো, কনরাড, এখানকার টেম্পলারদের অনেকেই সত্য বিশ্বাসের পথ থেকে সরে গিয়ে যতসব আজগুবী জাদু বিদ্যায় বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে। কিন্তু আমি যখন এসেছি গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে, সবাইকে সোজা করে ছাড়বো। করবোই, তুমি দেখে নিও।
কনরাড কোনো জবাব দেয়ার আগেই এক ভৃত্য এসে জানালো, এক ইহুদী এসেছে। বুড়ো। স্যার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্টের সাথে কথা বলতে চায়।
বোয়া-গিলবার্ট! এই লোকটা, ব্রাদার কনরাড, সবচেয়ে খারাপগুলোর ভেতরেও খারাপ। দেখি ব্যাটা ইহুদী কি চায় ওর কাছে। ভূত্যের দিকে ফিরলেন গ্র্যান্ডমাস্টার। ভেতরে নিয়ে এসো–লোকটাকে, নির্দেশ দিলেন তিনি।
এলেন আইজাক প্রায় আভূমি নত হয়ে অভিবাদন জানালেন গ্র্যান্ড মাস্টার ও তার সঙ্গীকে।
শোনো, ইহুদী. শুরু করলেন গ্র্যান্ডমাস্টার, আমার সময় অত্যন্ত মূল্যবান। সুতরাং যা জিজ্ঞেস করবো, সংক্ষেপে সঠিক জবাব দেবে। যদি উল্টোপাল্টা বা মিথ্যে কথা বলো, তোমর জিভ ছিঁড়ে নেয়া হবে। এক মুহূর্ত থামলেন তিনি। তারপর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, স্যার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্টের কাছে কি দরকার তোমার?
কি জবাব দেবেন ভেবে পেলেন না আইজাক। সত্য বলার অর্থ একজন টেম্পলারের বিরুদ্ধে কথা বলা। আর মিথ্যে বলা মানে বৃদ্ধ গ্র্যান্ড মাস্টারের কথা অনুযায়ী জিহ্বা খোয়ানো। একটু ইতস্তত করে অবশেষে তিনি বলেই ফেললেন, জরভক্স মঠের প্রায়োর অ্যামারের কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে এসেছি আমি তাকে দেয়ার জন্যে।
চিঠি? আমাকে দাও।
বিনা বাক্যব্যয়ে চিঠিটা তুলে দিলেন বৃদ্ধ ইহুদী। গ্র্যান্ডমাস্টার সেটা খুলে পড়লেন।
ওহ! রীতিমতো আতঙ্কিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। ব্রাদার কনরাড, পড়ো। জোরে পড়ো, এই ইহুদীও যেন শুনতে পায়।
পড়লো ব্রাদার কনরাড:
স্যার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্ট,
রাজদ্রোহী দস্যুদের হাতে আমি বন্দী। ওদের কাছে শুনলাম, আপনি নাকি সেই ইহুদী ডাইনীকে নিয়ে পালিয়েছেন। আপনি নিরাপদে আছেন জেনে আমি আনন্দিত। তবে, ডাইনী মেয়েটার ব্যাপারে সাবধান থাকবেন! গ্র্যান্ডমাস্টার যদি মেয়েটার কথা শোনেন, ভয়ানক শাস্তি দেবেন আপনাকে। তার চেয়ে ওকে ছেড়ে দিন। মুক্তিপণ হিশেবে আপনি যে অঙ্কের অর্থই চান, দেবে ওর বাবা। চিঠিটা ত্বর হাতেই পাঠাচ্ছি।
আশাকরি শিগগিরই আমাদের দেখা হবে। তখন বিস্তারিত আলাপ করবো।
এখন বিদায়,
অ্যায়মার।
.
ডাইনী! একই রকম আতঙ্কিত স্বরে চিৎকার করলেন আবার গ্র্যান্ডমাস্টার। ব্রাদার কনরাড, সত্যিই মেয়েটা ডাইনী?
আমার মনে হয় না। প্রায়োর অ্যায়মার বোধ হয় বোঝাতে চেয়েছেন মেয়েটা অপূর্ব সুন্দরী।
না, না! তুমি বুঝতে পারছে না, কনরাড, প্রায়োর অ্যায়মারের মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তি এমন আজেবাজে কথা লিখতেই পারে না। মেয়েটা তার জাদুবিদ্যা দিয়ে বশ করেছে টেম্পলার ব্রায়ানকে, অ্যায়মার সে কথাই বোঝাতে চেয়েছে! দাঁড়াও দেখি, বুড়ো কি বলে।
আইজাকের দিকে ফিরলেন গ্র্যান্ড মাস্টার। বললেন, যদ্র বুঝতে পারছি, তোমার মেয়ে টেম্পলার বোয়া-গিলবার্টের হাতে বন্দী।
জি হ্যাঁ, মহামান্য নাইট। মুক্তিপণ হিশেবে উনি যা চাইবেন…।
থামো! আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও, তোমার মেয়ে মানুষের অসুখ ভালো করার ব্যাপারে বিশেষ পারদর্শী, তাই না?
জি, আগ্রহের সঙ্গে জবাব দিলেন আইজাক। অনেক আহত নাইটের ক্ষত ও সারিয়ে তুলেছে। যে ক্ষত চিকিৎসকরাও অনেক সময় সারাতে পারেনি, ও তা ভালো করে দিয়েছে।
কোথায় শিখলো এসব কায়দা কানুন?
আমাদের গোত্রের এক বৃদ্ধার কাছে।
কে সেই বুড়ি?
তার নাম মরিয়ম–
কী! সেই জাদুকরী মরিয়ম! যার জাদু বিদ্যারকাহিনী সারা খ্রীষ্টান দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিলো! যাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো! শুনেছো, কনরাড? আমি ঠিক বলেছি কি না? বদমাশ ইহুদী! আইজাকের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করলেন গ্র্যান্ডমাস্টার। তোর মেয়ে ডাইনী। আর কত বড় সাহস, টেম্পল-এর নাইটদের সে জাদু করে! এক্ষুনি তুই দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে, নইলে তোর মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না। মেয়েকে ছাড়াতে এসেছে, হাহ্! শুনে রাখ, ওর বিচার হবে। যদি ডাইনী প্রমাণ হয়, পুড়িয়ে মারা হবে ওকে!
স্যার, নাইট! মহামান্য গ্র্যান্ড মাস্টার শুরু করতে গেলেন আইজাক।
দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে, ভণ্ড ইহুদী, নয়তো রক্ষীদের ডাকবো।
আর কোনো উপায় না দেখে মঠ থেকে বেরিয়ে গেলেন আইজাক।
মঠের প্রধান পুরোহিতকে ডাকলেন গ্র্যান্ড মাস্টার।
আলবার্ট ম্যালভয়সিঁ! এই মঠে একজন ইহুদী ডাইনীকে এনে রাখা হয়েছে, আর আপনি তার কোনো প্রতিকার করছেন না, আশ্চর্য!
ইহুদী ডাইনী! চমকে উঠলেন আলবার্ট ম্যালভয়সিঁ।
হ্যাঁ, ইহুদী ডাইনী। ইয়র্কের সুদখোর আইজাকের মেয়ে। সে এখন এই পবিত্র মঠেই আছে। ছি!
কিন্তু কোথায়?
টেম্পলার ব্রায়ানের ঘরে খুঁজে দেখুন। এক মুহূর্ত থামলেন গ্র্যান্ড মাস্টার। তারপর বললেন, উচিত শাস্তি দিতে হবে ওকে। আপনি বিচার সভার আয়োজন করুন।
.
নাইট টেম্পলার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্টের ঘরে বন্দী রেবেকা।
যখন দুপুরের ঘণ্টা পড়লো, ও শুনতে পেলো অনেকগুলো পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে ওর ঘরের দিকে। একটু স্বস্তি বোধ করলো রেবেকা। এ ঘরের ভেতরে বা বাইরে অন্য লোক থাকলে ব্রায়ান এসে বারবার তাকে বিরক্ত করতে পারবে না।
খুলে গেল ঘরের দরজা এক সঙ্গী ও চারজন অনুচরসহ ভেতরে ঢুকলেন মঠের প্রধান পুরোহিত। রেবেকাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল তার মুখ। টেম্পলার ব্রায়ানের ঘরে সত্যি সত্যিই একজন মহিলাকে দেখবেন গ্র্যান্ডমাস্টারের কথা শোনার পরও আশা করেননি তিনি। এক মুহূর্ত স্থায়ী হলো তার মুখের বিস্মিত ভাব। তারপরই সেখানে দেখা দিলো ক্রোধ।
ওঠো! চলো আমার সাথে! কঠোর স্বরে আদেশ করলেন তিনি।
কোথায় যাবো? কেন?
প্রশ্ন করার অধিকার তোমার নেই। আদেশ পালন করাই তোমার কাজ।তবু বলছি, গ্র্যান্ডমাস্টারের বিচার সভায় তোমার বিচার হবে।
বিচারের কথা শুনে প্রথমে ঘাবড়ে গেল রেবেকা। তারপর আশার সঞ্চার হলো ওর মনে বিচারক খ্রীষ্টান হলেও বিচারক তো! হয়তো ন্যায় বিচারই পাওয়া যাবে। আর ন্যায় বিচার পেলে মুক্তি পাবে।
বিচার সভায় নিয়ে আসা হলো রেবেকাকে।
উঁচু একটা বেদীর ওপর বসেছেন প্রধান বিচারক, গ্র্যান্ডমাস্টার অভ দ্য নাইটস টেম্পলার। হাতে গ্র্যান্ডমাস্টারের দণ্ড! তাঁর পায়ের কাছে নিচু একটা টেবিলে বসে দুজন লিপিকার। বিচার অনুষ্ঠানের কার্যবিবরণী লিখবে তারা। বিচারকমণ্ডলীর অপর চার সদস্য চার প্রধান পুরোহিত। গ্র্যান্ডমাস্টারের চেয়ে সামান্য নিচু চারটে আসনে তারা বসেছেন, প্রধান বিচারকের দুপাশে দুজন করে। বেদীর দুপাশে দুটো কাঠগড়া। একটায় দাঁড়িয়ে আছে আসামী। অন্যটা এখন ফাঁকা। যারা সাক্ষী দেবে তারা এসে দাঁড়াবে ওটায় যে বিরাট হলঘরটায় বিচার সভা বসেছে তিল ধারণের স্থান নেই তাতে। ডাইনীর বিচার হবে, যে শুনেছে সে-ই হাজির হয়েছে দেখতে।
অবশেষে শুরু হলো বিচার অনুষ্ঠান।
সমবেত দর্শক ও শ্রোতমণ্ডলী, জলদগম্ভীর স্বরে শুরু করলেন গ্র্যান্ড মাস্টার, ইয়র্কের ইহুদী আইজাকের কন্যা রেবেকার বিচার করতে আমরা এখানে সমবেত হয়েছি। ইহুদী কন্যার বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। সে নাকি ডাইনী, জাদুবিদ্যার চর্চা করে। শুধু চর্চা করেই ক্ষান্ত হয়নি, সে তার জাদুর প্রভাবে এই পবিত্র মনে একজন টেম্পলারকে মোহিত করে রেখেছে। যারা এই জাদুকরী, ডাইনীর স্বপক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষী দিতে প্রস্তুত তারা দাঁড়াও।
বিপক্ষে সাক্ষী দেয়ার জন্যে বেশ কয়েকজনকেই পাওয়া গেল। বেশির ভাগই টেম্পলার ব্রায়ানের সঙ্গী। কি করে নাইট টেম্পলার রায়ান দ্য, বোয়াগিলবার্ট টরকুইলস্টোন দুর্গ রক্ষার দায়িত্ব উপেক্ষা করে, নিষ্ট্রের প্রাণ বিপন্ন করে আগুনের হাত থেকে রেবেকাকে বাঁচিয়েছে তার বিশদ বিবরণ দিলো তারা।
আসামীর অতীত জীবন সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে পারে এমন কেউ এখানে আছে? জিজ্ঞেস করলেন গ্র্যান্ড মাস্টার।
দর্শকদের ভেতর থেকে কেউ কোনো সাড়া শব্দ করলো না।
মানে, আমি বলতে চাইছি, আবার বললেন গ্র্যান্ডমাস্টার, আসামী যে অনেকদিন ধরেই জাদুবিদ্যার চর্চা করে আসছে তা কেউ জানে?
এবার হলঘরের এক কোণে একটু গোলমাল মতো শুরু হলো। গ্র্যান্ড মাস্টার তার কারণ জানতে চাইলেন। জানা গেল, সেখানে এক কৃষক উপস্থিত আছে, যে এক সময় মারাত্মক অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলো। কোনো চিকিৎসকের ওষুধে তার অসুখ ভালো হয়নি। পরে আজকের আসামীই তুকতাক করে তাকে অনেকখানি সুস্থ করে তুলেছে। এখন সে লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতেও পারে।
গ্র্যান্ডমাস্টারের নির্দেশে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালো লোকটা।
তোমার নাম কি? জিজ্ঞেস করলেন গ্র্যান্ডমাস্টার।
হিগ।
কি হয়েছিলো বলো তো।
একটু ইতস্তত করে হিগ শুরু করলো তখন আমি আসামীর বাবা আইজাকের অধীনে কাজ করতাম। হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন আসামীর নির্দেশ মতো ওষুধপত্র খেয়ে আমি অনেকখানি ভালো হয়ে উঠি।
ইহুদী ডাইনীর ওষুধে ভালো না হয়ে অসুখে মরাই তোমার জন্যে ভালো ছিলো, গ্র্যান্ড মাস্টার মন্তব্য করলেন।
যার কাছ থেকে এক সময় উপকার পেয়েছে গ্র্যান্ডমাস্টারের ভয়ে তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে হলো বলে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল হিগের। সে আর এখানে থাকবে না বলেই ঠিক করলো। কিন্তু বিচারের ফলাফল শেষ পর্যন্ত কি হয় তার জন্যে সে রয়ে গেল।
গ্র্যান্ডমাস্টার এবার রেবেকাকে জিজ্ঞেস করলেন, স্বপক্ষে বলার মতো কিছু আছে তোমার?
আপনার কাছে দয়া ভিক্ষা করে লাভ নেই, বললো রেবেকা। তা আমি করতেও চাই না। কিন্তু, টেম্পলার ব্রায়ান এখানে উপস্থিত আছেন, তাকেই আমি জিজ্ঞেস করছি, বলুন স্যার টেম্পলার, আমার বিরুদ্ধে যে ভয়ঙ্কর অভিযোগ আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যে ও ভিত্তিহীন কি না?
অখণ্ড নিস্তব্ধতা বিচার কক্ষে। টেম্পলার ব্রায়ানের জবাব শোনার জন্যে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে সবাই।
মুখ খুলুন, টেম্পলার, আবার বললো রেবেকা। আপনি যদি মানুষ হন, যদি সত্যিকারের খ্রীষ্টান হন, আমার কথার জবাব দিন! আপনি যদি সত্যিকারের নাইট হয়ে থাকেন তাহলে তার মর্যাদা রাখুন।
জবাব দাও, ব্রায়ান দ্য বোয়া গিলবার্ট! নির্দেশ দিলেন গ্র্যান্ড মাস্টার।
ব্রায়ানের মনে তখন দ্বন্দ্ব চলছে। তার কথার ওপর নির্ভর করছে রেবেকার জীবন। আবার সত্য বললে ধুলায় গড়াগড়ি যাবে তার নিজের মান মর্যাদা সুনাম। এই দোটানায় পড়ে অনেকক্ষণ সে কোনো কথা বলতে পারলো না। অবশেষে তার মুখ দিয়ে একটা মাত্র কথা বেরোলো-ভাঁ-ভাঁজ করা কাগজ!
এই ডাইনীর জাদু শক্তি এমনই যে আমাদের টেম্পলার কথা বলার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে, গ্র্যান্ডমাস্টার বললেন। তবে অনেক কষ্টে যে কাগজের কথা ও বলেছে তা-ই সাক্ষ্যের কাজ করবে। দেখাও, ডাইনী, কাগজটা!
রেবেকাকে যখন বিচার সভায় আনা হয় তখন ভীড়ের ভেতর কে যেন তার হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে যায়। রেবেকা এতক্ষণ তা খুলে দেখারও সুযোগ পায়নি। গ্র্যান্ডমাস্টারের কথায় সে সেটা খুলে দেখলো।
একজন চ্যাম্পিয়ন* দাবি কর, লেখা রয়েছে কাগজটায়।
কথা কটির মধ্যে একটু যেন আশার আলো দেখতে পেলো রেবেকা।
আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যে, ভিত্তিহীন, বললো সে। আমি নিরপরাধ। আপনাদের আইনে আছে, দুই যোদ্ধার মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধে** এ ধরনের অভিযোগের মীমাংসা হতে পারে। আমি প্রার্থনা করছি, এক্ষেত্রেও তাই করা হোক। মাননীয় বিচারকদের অনুমতি পেলে একজন চ্যাম্পিয়ন লড়বে আমার পক্ষ হয়ে।
তোমার মতো ডাইনীর পক্ষে লড়ার জন্যে কে এগিয়ে আসবে?
আমি যদি নিরপরাধ হই, ঈশ্বরই আমার পক্ষে লড়ার জন্যে কাউকে না কাউকে পাঠিয়ে দেবেন।
সহকারী বিচারকদের সাথে কয়েক মুহূর্ত পরামর্শ করলেন গ্র্যান্ড মাস্টার। অবশেষে বললেন, ঠিক আছে, তোমার প্রার্থনা মঞ্জুর করা হলো। তিন দিনের সময় দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে তোমাকে জোগাড় করতে হবে তোমার চ্যাম্পিয়ন। আমাদের মঠের পক্ষে লড়বে টেম্পলার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্ট।
তিন দিন যে খুব কম সময়।
হলেও কিছু করার নেই। এর চেয়ে বেশি সময় তোমাকে দেয়া যাবে না।
বেশ, রেবেকা বললো, ঈশ্বরের ইচ্ছা যদি তাই হয় আমি আর কি বলবো? আমি তারই ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করছি।
ম্যালভয়সিঁ, গ্র্যান্ডমাস্টার বললেন, এবার তাহলে লড়াইয়ের জায়গা ঠিক করে ফেল।
সেইন্ট জর্জ গির্জার সামনে যে ফাঁকা জায়গা আছে সেখানেই হতে পারবে।
ভালো কথা। রেবেকা, তিন দিনের ভেতর তুমি ওখানে তোমার চ্যাম্পিয়নকে হাজির করবে। যদি না পারো, বা তোমার চ্যাম্পিয়ন যদি পরাজিত হয় তাহলে ডাইনীদের যেভাবে পুড়িয়ে মারা হয় তোমাকেও সেভাবে পুড়িয়ে মারা হবে।
চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো রেবেকা। তারপর বললো, চ্যাম্পিয়ন জোগাড় করার জন্যে আমি আমার আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ প্রার্থনা করছি।
সংগত প্রার্থনা। দেখ এখানে যারা আছে তাদের কেউ তোমার আত্মীয়-স্বজনদের কাছে যেতে রাজি আছে কি না।
উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে রেবেকা বললো, সত্যের খাতিরে বা অর্থের বিনিময়ে আমার একটা চিঠি আমার বাবার কাছে পৌঁছে দিতে রাজি আছেন কেউ চুপ করে আছে জনতা। খোদ গ্র্যান্ডমাস্টারের সামনে ডাইনীর অভিযোগে অভিযুক্ত একজন ইহুদী নারীকে সাহায্য করার সাহস কেউ পাচ্ছে না।
এই সামান্য উপকারটুকু করার সৎসাহস কারো নেই! বললো রেবেকা। তাহলে কি আমি আত্মরক্ষার কোনো সুযোগই পাবো না?
সাক্ষী দেয়ার পর থেকেই অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছিলো হিগের অন্তর। এবার সে উঠে দাঁড়ালো। বললো, আমি পঙ্গু, ভালো করে হাঁটতে পারি না। তবু আমি নেবো এ ভার।
ঈশ্বরের অনুগ্রহ হলে বোবা কথা বলতে পারে, পঙ্গু পাহাড় ডিঙাতে পারে, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো রেবেকা। চিন্তা কোরো না, হিগ, ঈশ্বরই তোমাকে হাঁটার শক্তি দেবেন। এরপর রেবেকা গ্র্যান্ডমাস্টারের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি একটা চিঠি লিখবো আমার বাবার কাছে। আমাকে কাগজ কলম দেয়া হোক।
আসামীকে কাগজ কলম দেয়ার নির্দেশ দিলেন গ্র্যান্ডমাস্টার।
সংক্ষেপে তার অবস্থার কথা লিখে চিঠিটা হিগের হাতে দিলো রেবেকা। বললো, আমার বাবাকে দেবে চিঠিটা। মনে রেখো, তোমার ওপরেই আমার জীবন মরণ নির্ভর করছে।
আমার প্রতিবেশী বুথানের ঘোড় নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি ইয়র্কে পৌঁছানোর চেষ্টা করবো, বলে বিদায় নিলো হিগ।
ভাগ্য ভালো হিগের, রেবেকারও।
পথে নামার কিছুক্ষণের ভেতর হিগ দেখলো, দুজন ইহুদী টেম্পলস্টোর দিকেই আসছে। আরেকটু কাছাকাছি হতেই সে চিনতে পারলো, দুই ইহুদীর একজন আইজাক। তাঁকে থামিয়ে রেবেকার চিঠিটা তাঁর হাতে দিলো হিগ।
গভীর হতাশা নিয়ে আইজাক পড়লেন:
বাবা,
আমার বিরুদ্ধে ডাইনীর অভিযোগ আনা হয়েছে। যদি কোনো নাইট আমার পক্ষ হয়ে লড়ে জয়লাভ করতে পারেন একমাত্র তাহলেই প্রমাণ হবে আমি নির্দোষ। তা না হলে আমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে। তিন দিন সময় দেয়া হয়েছে আমাকে। এর মধ্যে যদি কোনো নাইট আমার পক্ষ হয়ে লড়তে রাজি না হন, তাহলে আমার বাঁচার কোনো আশা নেই। আমার ধারণা, স্যাক্সন সেড্রিকের পুত্র আইভানহো নিজেই আমার পক্ষে লড়তে রাজি হলেন, অবশ্য এর ভেতর যদি তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠে থাকেন। যদি তিনি এখনো সুস্থ না হয়ে থাকেন তবু আমার বিশ্বাস, কাউকে না কাউকে তিনি পাঠাবেন। আইভানহোকে এই খবর দিয়ে বলবেন, রেবেকা নির্দোষ।
————
* চ্যাম্পিয়ন: অন্য একজনের হয়ে লড়াই করে যে নাইট।
** সে যুগের রীতি অনুযায়ী এ ধরনের যুদ্ধে যে জয়ী হতো, ধরে নেয়া হতো তার দাবিই সঠিক।
১৯. বন্ধ দরজায় মৃদু করাঘাত
সেদিনই সন্ধ্যা।
বন্ধ দরজায় মৃদু করাঘাত শুনতে পেলো রেবেকা।
যদি বন্ধু হন, নির্ভয়ে ভেতরে আসুন, বললো ও। আর যদি শক্ত হন, আপনাকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা তো আমার নেই।
আমি তোমার শত্রু কি বন্ধু এখনই ঠিক হবে, বলতে বলতে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো টেম্পলার ব্রায়ান।
তাকে দেখেই রেবেকা জড়সড় হয়ে ঘরের এক কোণে গিয়ে দাঁড়ালো।
আমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই রেবেকা, বললো ব্রায়ান। অন্তত এখানে নেই। তুমি ডাকলেই রক্ষীরা ছুটে আসবে।
না, আপনাকে আমার আর ভয় নেই, বললো রেবেকা। ঈশ্বর আমাকে নির্ভয় হওয়ার শক্তি দিয়েছেন। কিন্তু, আবার কেন আমাকে বিরক্ত করতে এসেছেন? আপনার যা বলার তাড়াতাড়ি বলে বিদায় নিন।
আমি তোমাকে বিরক্ত করতে বা তোমার সাথে তর্ক করতে আসিনি, রেবেকা। শুধু জানাতে এসেছি চ্যাম্পিয়ন দাবি করার কাগজটা কে তোমাকে দিয়েছিলো?–এই আমি।
তাতে কয়েকটা দিন সময় পাওয়া গেছে শুধু। তার বেশি আর কি হয়েছে?
না, রেবেকা, সত্যিই আমি তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, আমিই তোমার চ্যাম্পিয়ন হবো। আমার সঙ্গে এখানকার কেউই কয়েক মিনিটের বেশি টিকতে পারতো না। নিশ্চয়ই আমি জয়ী হতাম, আর তাহলে তুমি নির্দোষ তা প্রমাণ হয়ে যেতো। কিন্তু গ্র্যান্ড মাস্টার সব মাটি করে দিলেন। আমাকে তিনি নির্বাচিত করলেন মঠের পক্ষ থেকে লড়বার জন্যে।
আর আপনি তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিলেন! এরকমই তো বাঁচাতে চেয়েছিলেন। এখন যদি আমার পক্ষে কোনো নাইট লড়তে রাজি হন, আপনি প্রাণপণে চেষ্টা করবেন তাকে পরাজিত করার। তবু ভান করছেন, আপনি আমার বন্ধু, আমাকে বাঁচাতে এসেছেন!
হ্যাঁ, এখনও আমি তোমার বন্ধু হতে পারি, তোমাকে বাঁচাতে পারি। কিন্তু সেজন্যে ভয়ানক মূল্য দিতে হবে আমাকে। সে মূল্য আমি দেবো কি তা নির্ভর করছে তোমার সিদ্ধান্তের ওপর।
আমার সিদ্ধান্তের ওপর?
হ্যাঁ, সম্পূর্ণ তোমার সিদ্ধান্তের ওপর। তুমি যদি বলো, আমি লড়বো না মঠের হয়ে। তাহলে অবশ্য নাইট বলে আর নিজের পরিচয় দিতে পারবো না, জীবন কাটাতে হবে অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে। কিন্তু তাতেও আমি রাজি, শুধু একবার তুমি বলো, আমাকে ভালোবাসো।
পাগলামি ছাড়ন, টেম্পলার। সত্যি সত্যিই যদি আমাকে বাঁচানোর ইচ্ছা থাকে, রিচার্ডের কাছে গিয়ে আমার কথা বলুন। শুনেছি তিনি নাকি দেশে ফিরেছেন। তিনিই এই অন্যায়ের প্রতিকার করবেন।
সব যদি আমাকে ছাড়তেই হয়, একমাত্র তোমার কথায় ছাড়বে। রিচার্ডের দয়া ভিক্ষা করতে যাবো না।
তাহলে ঈশ্বরের যা ইচ্ছা তা-ই হবে। মানুষের কাছ থেকে আর কোনো সাহায্যের আশা আমি করি না।
ভাঙবে তবু মচকাবে না! বিদ্রুপের সুরে বললো বোয়া-গিলবার্ট। ঠিক আছে, রেবেকা, আমি তাহলে যাই। একটা কথা মনে রেখো, লড়তেই যদি হয়, আমি প্রাণ দিয়ে লড়বো। এবং ফলাফল কি হবে তা তুমি জানো।
জানি। এবার আপনি আসুন। খামোকা কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
তাহলে এভাবেই আমাদের বিদায় নিতে হবে? তোমাকে কেন যে আমি দেখেছিলাম। আর যদি দেখলামই কেন তুমি ইহুদী না হয়ে খ্রীষ্টান্ত হলে না!…আমাকে ক্ষমা করো, রেবেকা!
নিহত মানুষ তার আততায়ীকে যতটা ক্ষমা করতে পারে, সর্বান্তঃকরণে তাই করছি।
বিদায় রেবেকা? ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ব্রায়ান।
২০. লক্সলির কাছ থেকে বিদায়
লক্সলির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেইন্ট বটল্ফ প্রায়োরির পথে রওনা হলো ব্ল্যাক নাইট। গাৰ্থ আর ওয়াম্বা আগেই সেখানে চলে গেছে আহত আইভানহোকে নিয়ে।
প্রায়োরিতে পৌঁছে ব্ল্যাক নাইট দেখলো আইভানহো এখন অনেক সুস্থ, প্রায় স্বাভাবিক।
আরেক দিন এখানে বিশ্রাম নাও, বললে নাইট। কাল রওনা হবে তুমি।
না, আমি আপনার সাথেই যাব, বললো আইভানহো। পথে কি বিপদে পড়বেন তার ঠিক নেই…।
কিন্তু ব্ল্যাক নাইট শুনলো না ওর কথা। বললো, না, আমি যা বললাম তাই করবে। কাল রওনা হবে তুমি। সোজা অ্যাথেলস্টেনের কনিংসবার্গ দুর্গে চলে আসবে। ওখানে তোমার বাবার সাথে আবার যেন তোমার মিলন হয়, সে চেষ্টা করবো। ওয়াম্বাকে নিয়ে যাচ্ছি, পথ চিনিয়ে দেবে। বিপদআপদ হলে সাহায্যও করতে পারবে।
হাহ, ওয়াম্বাকে নিচ্ছেন বিপদ সামলাতে! ওকে কে সামলায় তার ঠিক নেই!
তবু আর কাউকে যখন পাওয়া যাচ্ছে না, কি আর করা। কিন্তু তুমি, কালকের আগে নড়বে না এখান থেকে। এটা আমার নির্দেশ।
বিদায় নিলো ব্ল্যাক নাইট।
ব্ল্যাক নাইট চলে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মাথায় উদ্বেগে অস্থির হয়ে উঠলো আইভানহো। গার্থকে ডেকে পাঠালো সে। বললো, এক্ষুনি আমার ঘোড়া সাজাও, গার্থ, ব্ল্যাক নাইটের পেছন পেছন যাবো আমরা।
কিন্তু আপনি এখনো খুব দুর্বল, প্রতিবাদ করলো গাৰ্থ। তাছাড়া ব্ল্যাক নাইট বলে গেলেন কাল পর্যন্ত এখানে থাকতে।
না, গার্থ, কাল পর্যন্ত এখানে বসে থাকা যাবে না। আমার মন বলছে পথে নিশ্চয়ই বিপদে পড়বেন ব্ল্যাক নাইট। একা তিনি পেরে উঠবেন না শত্রুর সাথে। আমাকে যেতেই হবে, গার্থ। তোমরা যা-ই বলো আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
কিন্তু…।
আর কোনো কিন্তু নয়, গাৰ্থ। আমার ঘোড়া সাজাও, যাও। দেরি হয়ে যাচ্ছে!
কয়েক মিনিটের ভেতর দুটো ঘোড়ায় চেপে রওনা হলো দুজন।
.
গভীর বনের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চলেছে দুটো ঘোড়া। দুজন আরোহী তাদের পিঠে। একজন ব্ল্যাক নাইট। অন্যজন ওয়া। গুনগুনিয়ে গান করছে ব্ল্যাক নাইট। মাঝে মাঝে গান থামিয়ে টুকটাক প্রশ্ন করছে ওয়াম্বাকে। প্রশ্নের জবাব দিয়েই কিছু একটা হাসির কথা শুনিয়ে দিচ্ছে। ওয়াম্বা। প্রত্যেক বারই যে ব্ল্যাক নাইট হাসছে এমন নয়, তবু ওয়াম্বার বিরাম নেই।
রাজদ্রোহী ডাকাতদের চেয়েও মারাত্মক লোকজন আছে এ বনে, তা জানেন? হঠাৎ ওয়াম্বা বললো।
তাই নাকি! কারা?
ম্যালভয়সিঁর লোকজন। ডাকাতদের ডাকাতি করা ছাড়া বেঁচে থাকার আর কোনো পথ নেই। কিন্তু ওরা কেন করে?
বড় জটিল প্রশ্ন করেছো, ওয়াম্বা জমিদার ম্যালভয়সিঁর লোকজন কেন ডাকাতি করে? যাকগে, ও নিয়ে আমাদের মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।
লাভ নেই ঠিকই, কিন্তু মাথা থাকলেই যে তা ঘামে, স্যার নাইট। ধরুন ওদের জন দুই এসে আমাদের আক্রমণ করলো, আপনি কি করবেন?
কি আর করবো, বর্শা চালাবো।
যদি চারজন আসে?
একই দশা হবে তাদেরও।
যদি ছজন আসে?
ঐ একই। সত্যিকারের নাইটরা দশ বিশ জন এলেও কোনো পরোয়া করে না, বুঝলে হে ভাঁড়।
বেশ, তাহলে আপনার ঐ শিঙাটা আমাকে একটু দিন।
ব্ল্যাক নাইট শিঙাটি দিতেই ওয়াম্বা সেটা নিজের গলায় ঝুলিয়ে নিলো।
আরে, আরে, তোমার মতলব কি, ওয়াম্বা? বলে উঠলেন নাইট। দাও, আমার শিঙা আমাকে ফিরিয়ে দাও! লক্সলি ওটা আমাকে উপহার দিয়েছে।
আমার কাছে এটা নিরাপদেই থাকবে, স্যার নাইট। বোকা ভাঁড়রা যখন বীরদের সাথে চলে তখন শিঙা-টিঙা এসব ভড়দেরই বহন করা উচিত। দরকারের সময় ওরাই ওগুলো ভালো বাজাতে পারে। দুশ্চিন্তা করবেন না, আপনার জিনিস আপনি ফেরত পেয়ে যাবেন।
নাহ্, হতাশ কণ্ঠে বললো নাইট, তোমার বেয়াদবি দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মনে রেখো, আমারও ধৈর্যের একটা সীমা আছে।
দেখুন, স্যার নাইট, বোকা হাঁদাকে বেশি ভয় দেখাবেন না, তাহলে সে লেজ তুলে পালাবে। তখন এই অচেনা বনে পথ খুঁজে মরতে হবে আপনাকেই।
এই একটা ব্যাপারে তো আগেই হার মেনে বসে আছি। সুতরাং তোমার সাথে আর কোনো কথা নেই আমার। চুপ করে পথ দেখাও।
শিঙাটা তাহলে ভাড়ের কাছেই থাকছে। ঠিক আছে, এবার তাহলে প্রমাণ দিন কেমন বীর আপনি।
মানে?
মানে আমার মনে হচ্ছে, সামনের ঐ ঝোপটার আড়ালে একদল গুণ্ডা আমাদের আক্রমণ করার জন্যে ওঁৎ পেতে আছে।
কি করে বুঝলে?
পাতার আড়ালে দুতিনবার ওদের শিরোস্ত্রাণ ঝলকে উঠতে দেখেছি। ঐ দেখুন আবার। সৎ লোক হলে ঝোপের ভেতর লুকিয়ে না থেকে রাস্তা দিয়ে হাঁটতো।
হুঁ , তোমার কথাই ঠিক, বলতে বলতে শিরোস্ত্রাণের মুখাবরণটা নামিয়ে দিলো নাইট। ঠিক সেই সময় পর পর তিনটে তীর এসে লাগলো তার বুকে, মাথায়, মুখে। সময় মতো মুখাবরণটা নামিয়ে দেয়ায় এযাত্রা বেঁচে গেছে নাইট।
তুমি এখানে দাঁড়াও, ওয়া; ওদের একটু শিক্ষা দিয়ে আসি, বলে নাইট ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো ঝোপটার দিকে।
কিন্তু নাইট পৌঁছানোর আগেই ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো সাত জন সশস্ত্র লোক। এক সঙ্গে নাইটকে আক্রমণ করলো তারা। তিন জনের বর্শা ভেঙে গেল নাইটের বর্মে লেগে।
এসবের মানে কী? চিৎকার করে উঠলো নাইট।
জবাব না দিয়ে তলোয়ার বের করলো লোকগুলো। চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে আবার আক্রমণ করলো নাইটকে।
মরো, ব্যাটা নকল রাজা, গর্জন করে উঠলো একজন।
ব্ল্যাক নাইট খেয়াল করলো, লোকটার পরনে নীল বর্ম, নীল পোশাক, নীল ঢাল।
বিশ্বাসঘাতকের দল! পাল্টা গর্জন করে তলোয়ার বের করলো নাইট।
চারদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে একটু দিশেহারা অবস্থা ব্ল্যাক নাইটের। সামনের জনের আঘাত প্রতিহত করেই বিদ্যুৎগতিতে তাকে পেছনে নয়তো ডানে বা বায়ে ঘুরতে হচ্ছে। হঠাৎ নীল বর্ম পরা লোকটা প্রচণ্ড এক আঘাত হানলো ব্ল্যাক নাইটের ঘোড়া লক্ষ্য করে। সঙ্গে সঙ্গে আরোহীকে নিয়ে মাটিতে পড়ে গেল ঘোড়াটা। লাফ দিয়ে এগিয়ে এলো নীল পোশাক পরা নাইট।
আর দেরি করা সমীচীন মনে করলো না ওয়াম্বা। শিঙাটা মুখে লাগিয়ে জোরে ফুঁ দিলো তিনবার। অমনি গুণ্ডাগুলো চমকে উঠে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। প্রত্যেকেরই অস্ত্র যেন জমে গেছে যার যার হাতের সাথে। ওয়াম্বা একজনের কাছ থেকে একটা তলোয়ার কেড়ে নিয়ে ছুটে গেল ব্ল্যাক নাইটের সাহায্যে।
লজ্জা করে না, ভীরুর দল! যত না তলোয়ার চালাচ্ছে তার চেয়ে বেশি চিৎকার করছে ওয়াম্বা। সামান্য একটা শিঙার শব্দ শুনে পালাচ্ছো! তাও কিনা বাজিয়েছে একটা ভড়!
এবার আবার ব্ল্যাক নাইটকে আক্রমণ করলো খুনীরা। বিরাট একটা ওক গাছের গুঁড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে তলোয়ার হাতে আত্মরক্ষা করতে লাগলো নাইট। তলোয়ার দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চষ্টা করার পরও যখন ব্যর্থ হলো তখন আবার বর্শা তুলে নিলো নীল-নাইট। বাগিয়ে ধরে ছুটে আসতে লাগলো। ওয়াও ছুটলো তলোয়ার হাতে। নীলনাইটের ঘোড়ার পায়ে গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে একটা আঘাত হানলো সে। ঘোড়া এবং আরোহী দুজনই পড়ে গেল মাটিতে। এযাত্রা বাঁচলো বটে ব্ল্যাক নাইট কিন্তু আর কতক্ষণ বাঁচবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সে মাটিতে দাঁড়িয়ে, একা; প্রতিপক্ষ ছসাত জন। ক্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে।
এই সময় হঠাৎ লেজের দিকে হাঁসের পালক লাগানো একটা তীর এসে লাগলো এক আক্রমণকারীর বুকে। লুটিয়ে পড়লো লোকটা। মুহূর্তে ছুটে এলো আরো তীর, এবার এক ঝাঁক। আরো কয়েক জন দুবৃত্ত পড়ে গেল আহত বা নিহত হয়ে। নীল-নাইটও আছে তাদের ভেতর।
কয়েক সেকেন্ড পরেই গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো একদল লোক। সবার পরনে সবুজ পোশাক, হাতে তীর ধনুক। দলের একেবারে সামনে লক্সলি আর কপম্যানহাস্টের সন্ন্যাসী।
লক্সলিকে ধন্যবাদ জানালো ব্ল্যাক নাইট। লক্সলির মনে হলো আজ যেন একটু গম্ভীর ব্ল্যাক নাইটের কণ্ঠস্বর।
চলো দেখি, কে এই নীল-নাইট? বলে এগিয়ে গেল ব্ল্যাক নাইট। ওয়াম্বা, শিয়োস্ত্রাণটা খোলো তো!
নির্দেশ পালন করলো ওয়াম্বা।
ওয়াল্ডেমার! সবিস্ময়ে উচ্চারণ করলো ব্ল্যাক নাইট। কে পাঠিয়েছে তোমাকে?
আপনার ভাই, রাজপুত্র জন।
আমার ভাই জন! দয়া ভিক্ষা চাইবে না, ওয়াল্ডেমার?
সিংহ কখনো দয়া করে না।
আহত পশুকে আক্রমণও করে না সিংহ। না ওয়েল্ডেমার, তোমাকে আমি হত্যা করবো না। তবে, তিন দিনের ভেতর ইংল্যান্ড ছাড়বে তুমি। না হলে তোমার ভাগ্যে কি আছে আমি বলতে পারি না। লক্সলি, ওকে একটা ঘোড়া দিয়ে দাও।
তার চেয়ে ওর বুকে একটা তীর ঢুকিয়ে দিতে পারলেই ভালো লাগতো আমার। কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনার আদেশ পালন করতেই হবে।
হ্যাঁ, আমার আদেশ তোমাকে পালন করতেই হবে। আমি ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড।
চমকে উঠলো লক্সলি। সঙ্গে সঙ্গে রাজদ্রোহীরা হাঁটু গেড়ে বসে রাজার প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করলো।
বন্ধুগণ, তোমরা উঠে দাঁড়াও, রিচার্ড বললেন। আজ তোমরা আমার জীবন বাঁচিয়েছো। টরকুইলস্টোনে তোমাদের বীরত্ব আমি দেখেছি। তোমাদের আমি ক্ষমা করলাম। আজ থেকে তোমরা আর রাজদ্রোহী নও, রাজার মিত্র। ললির দিকে ফিরলেন রিচার্ড। ললি–শুরু করলেন তিনি।
আমাকে আর ও নামে ডাকবেন না, মহানুভব, বাধা দিয়ে বললো লক্সলি। আমি শেরউড বনের রবিনহুড।
ঠিক এই সময় আইভানহো আর গাৰ্থ টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে হাজির হলে সেখানে। রিচার্ডের ধূলি মলিন চেহারা, সামনে ছসাতটা আহত নিহত দেহ, চারপাশে বনদস্যুদের ভীড়–এসব দেখে আইভানহো বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগলো, রিচার্ডকে রাজা বলে না ব্ল্যাক নাইট বলে সম্বোধন করবে।
তার দ্বিধা বুঝতে পারলেন রিচার্ড। বললেন, আইভানহো, আমার আসল নামেই এখন তুমি আমাকে ডাকতে পারো। এই মাত্র এদের আমি বললাম, আমি কে। কিন্তু তোমার ওপর খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছি আমি। কালকের আগে সেইন্ট বটল প্রায়োরি ছাড়তে নিষেধ করেছিলাম তোমাকে।
আমি তো পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছি, মহানুভব, বললো আইভানহো।
তাহলে চলো কনিংসবার্গে। আজই তোমার বাবার সাথে দেখা করবো আমি। কিন্তু তার আগে কিছু খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয় যে, রবিনহুড। এতক্ষণ লড়াই করে শুধু ক্লান্তই হইনি, খিদেও পেয়েছে।
নিশ্চয়ই, মহানুভব। কিছুক্ষণ সময় দিন আমাকে।
একটা ওক গাছের নিচে ভোজের ব্যবস্থা হলো। আয়োজন সামান্য। হরিণের মাংস আর এল। সবাই ফুর্তির সঙ্গে তাই খেলো। খাওয়ার ফাকে ফাঁকে নানা গল্পগুজব, ঠাট্টা তামাশা চলতে লাগলো। সামনে যে দেশের রাজা বসে আছেন, তা যেন তারা ভুলে গেছে। রাজাও তাঁর গাম্ভীর্য ভুলে ওদের ঠাট্টা রসিকতায় যোগ দিয়েছেন।
২১. গোধূলি লগ্ন
সন্ধ্যা তখনো হয়নি। গোধূলি লগ্ন।
আইভানহো, গাৰ্থ আর ওয়াম্বাকে নিয়ে কনিংসবার্গ দুর্গে পৌঁছালেন রিচার্ড। অস্তায়মান সূর্যের লাল আলোয় অপূর্ব দেখাচ্ছে দুর্গটাকে।
এমনিতেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে বিখ্যাত কনিংসবার্গ। ডন নদী জায়গাটিকে অর্ধবৃত্তাকারে ঘিরে বয়ে যাচ্ছে। এক দিকে বনভূমি, অন্য দিকে শস্য ক্ষেত। বনভূমির প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে পাহাড়ের চেহারা নিয়েছে জায়গাটা। তারই চূড়ায় কনিংসবার্গের দুর্গ প্রাসাদ। নরম্যানরা ইংল্যান্ড জয় করার আগে স্যাক্সন রাজারা এখানে বাস করতেন।
দুর্গের চূড়ায় একটা কালো পতাকা উড়ছে। শোকের প্রতীক। স্যাক্সন রাজপুত্র অ্যাথেলস্টেনের মৃত্যুতে এই শোক। কনিংসবার্গ প্রাসাদে আজ সবাই সমবেত হয়েছেন অ্যাথেলস্টেনের মৃত্যু পরবর্তী ভোজে যোগ দিতে। মৃতের নিকট ও দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা ছাড়াও নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন সেড্রিক ও অ্যাথেলস্টেনের বহু বন্ধুবান্ধব। তাদের কলগুঞ্জনে গম গম করছে প্রাসাদ। দলে দলে লোক উপরে যাচ্ছে, নিচে নেমে আসছে। খাওয়া দাওয়ার বিরাট আয়োজন। অঢেল মাংস আর মদ। ইচ্ছে মতো খাচ্ছে নিমন্ত্রিতরা।
রিচার্ড সঙ্গীদের নিয়ে পৌঁছুতেই সেড্রিকের এক পার্শ্বচর তাদের উপরে নিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় আইভানহো হুড দিয়ে ঢেকে নিলো মাথাটা। মুখেরও বেশির ভাগ ঢাকা পড়ে গেল তাতে। রিচার্ডের নির্দেশ পাওয়ার আগে বাবার কাছে পরিচয় দিতে চায় না ও।
উপরের বিরাট হলঘরটায় কয়েক জন বিশিষ্ট স্যাক্সন বন্ধুকে নিয়ে বসে ছিলেন সেড্রিক। ব্ল্যাক নাইট প্রবেশ করতেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন।
জনাব সেড্রিক, আপনার প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিতে এলাম। শেষবার যখন আমাদের দেখা হয়েছিলো, আমি আপনার কাছে একটা জিনিস চাইবো বলেছিলাম, নিশ্চয়ই ভুলে যাননি?
সে জিনিসততা আমি আপনাকে দিয়ে দিয়েছি, স্যার নাইট, বললেন সেড্রিক। কি জিনিস এবার বলুন।
বলছি, তার আগে আমার পরিচয় জানা দরকার আপনার। আমারও কর্তব্য পরিচয় দেয়া, বললেন ব্ল্যাক নাইট। এখন পর্যন্ত আপনি এবং আরো অনেকে আমাকে ব্ল্যাক নাইট বলে জেনে এসেছেন। আসলে আমি রিচার্ড, ইংল্যান্ডের রাজা।
বিস্ময়ে হতবাঁক হয়ে গেলেন সেড্রিক।
আপনি–আপনি রিচার্ড! কোনো মতে উচ্চারণ করলেন তিনি। সিংহ-হৃদয় রিচার্ড!
হ্যাঁ, সেড্রিক। আমি চাই আমার রাজ্যে সবাই–স্যাক্সন নরম্যানসবাই মিলেমিশে শান্তিতে বাস করুক। সেজন্যেই আপনার এখানে এসেছি। এবার, আমি যা চাইবো বলেছিলাম–আমি চাই, না, আমার অনুরোধ আইভানহোকে আপনি ক্ষমা করুন। এই যে আমার সঙ্গে এই যুবকই আপনার পুত্র।
সঙ্গে সঙ্গে মাথা থেকে হুডটা সরিয়ে ফেলে বাবার পায়ে পড়লো আইভানহো।
আমাকে ক্ষমা করো, বাবা, মিনতি করলো সে।
ওঠ, বাপ, পায়ের কাছ থেকে ছেলেকে তুলতে তুলতে বললেন সেড্রিক। অনেক আগেই তোকে আমি ক্ষমা করেছি।
কি একটা বলার চেষ্টা করলো আইভানহো। সেড্রিক বাধা দিয়ে বললেন, বুঝেছি তুই কি বলতে চাস। রোয়েনার কথা তো? সবে মাত্র মারা গেছে অ্যাথেলস্টেন, এখন অন্তত দুবছর অপেক্ষা করতে হবে তোদর। নইলে অ্যাথেলস্টেনের বিক্ষুব্ধ আত্মা কবর থেকে অভিশাপ দেবে।
বলতে না বলতেই অ্যাথেলস্টেন সেখানে হাজির। ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো সবাই। যারা একটু ভীতু, আতঙ্কে শিউরে উঠলো তারা।
তুমি মানুষ না প্রেত জানি না; কম্পিত কণ্ঠে সেড্রিক বললেন। যদি মানুষ হও তাহলে কথা বলো।
আমি অ্যাথেলস্টেন। আপনাদের মতোই মানুষ। হ্যাঁ, আমি মরিনি। তিন দিন শুধু পানি খেয়ে থাকার পর ছুটতে ছুটতে এখানে এসেছি। আমাকে একটু নিশ্বাস ফেলার সময় দিন।
তুমি অ্যাথেলস্টেন! বিস্মিত কণ্ঠে বললেন রিচার্ড। কিন্তু তোমাকে তো দেখলাম বোয়া-গিলবার্টের তলোয়ারের ঘায়ে পড়ে যেতে! তা ছাড়া, ওয়াম্বা না কে যেন এসে বললো, তোমার দাঁত সব ভেঙে গেছে, মাথার বুলিও ফেটে গেছে।
ওয়াম্বা আপনাকে ভুল খবর দিয়েছে। আমার মাথা যে ফেটে যায়নি, দেখতেই পাচ্ছেন। দাঁতও ঠিক আছে। খাওয়ার সময়ই তা বুঝতে পারবেন। ব্রায়ান শক্ত আঘাতই করেছিলো আমাকে, কিন্তু মাথাটা সরিয়ে নিয়েছিলাম বলে প্রাণে মরিনি, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম কেবল। এর পর দুপক্ষের বহু যোদ্ধা মরে আমাকে চাপা দেয়। জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখি কফিনের ভেতর শুয়ে আছি। ভাগ্য ভালো কফিনটার মুখ খোলা ছিলো। তাই কোনো রকমে বেরিয়ে অনেক কষ্টে এখানে আসতে পেরেছি।
তুমি ঠিক সময়েই এসেছো, অ্যাথেলস্টেন, বললেন সেড্রিক। স্যাক্সনদের মুক্তি ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের যে স্বপ্ন এতদিন আমরা দেখছিলাম তা সার্থক করার এই উপযুক্ত সময়।
সে স্বপ্ন আর আমি দেখি না, সেড্রিক।
এ কথা বলতে তোমার লজ্জা হচ্ছে না? নরম্যান রাজা রিচার্ড এখানে উপস্থিত আছেন, তাকেই জিজ্ঞেস…
রাজা রিচার্ড এখানে!
হ্যাঁ। ঐ তো। যাকে আমরা এতদিন ব্ল্যাক নাইট বলে জেনে এসেছি তিনিই রাজা রিচার্ড। কিন্তু তাঁকে…।
এবারও সেড্রিকের মুখের কথা মুখেই থেকে গেল। অ্যাথেলস্টেন গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসেছে রিচার্ডের সামনে।
আমি আপনার কাছে আমার আনুগত্য প্রকাশ করছি, মহানুভব, বললো সে। আজ থেকে মন প্রাণ দিয়ে আপনার আদেশ পালন করাই হবে আমার কর্তব্য।
ইংল্যান্ডের স্বাধীনতার কথাও মন থেকে মুছে ফেলেছে! হতাশ কণ্ঠস্বর সেড্রিকের।
বন্ধু, রাগ করবেন না, মৃদু হেসে অ্যাথেলস্টেন বললো। তিন দিন কফিনের ভেতর থেকে আমার জীবনদর্শন আমূল বদলে গেছে। রাজা হওয়ার বাসনা আর আমার নেই। আমার ছোট গণ্ডির ভেতর নির্বিঘ্নে রাজত্ব করতে পারলেই আমি খুশি।
রোয়েনাকেও তাহলে তুমি চাও না?
অ্যাথেলস্টেন বললো, রোয়েনাকে নিয়ে আপনার বা আমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই। ওর মন এখন আইভানহোর দিকে। আমার তাতে খেদ নেই। ঐ তো রোয়েনা, ওকেই জিজ্ঞেস করুন। লজ্জা কি, রোয়েনা? আইভানহোর মতো বীর নাইটকে ভালোবাসো, সে-ও তোমাকে ভালোবাসে, এ তো গৌরবের কথা। আইভানহো, রোয়েনাকে…, কিন্তু কই আইভানহো? একটু আগেই তো এখানে ছিলো!
সারা দুর্গে খোঁজা হলো। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না আইভানহোকে। দ্বাররক্ষীদের কাছে জিজ্ঞেস করে জানা গেল এক বৃদ্ধ ইহুদী এসেছিলেন আইভানহোর খোঁজে। তার সাথে দুএকটা কথার পরই আইভানহো গার্থকে তার ঘোড়া আনতে বলে। একটু পরেই দুজন বেরিয়ে যায় কনিংসবার্গ দুর্গ ছেড়ে।
চিন্তা কোরো না, রোয়েনা, আগের সেই ঘরটায় ঢুকতে ঢুকতে বললো অ্যাথেলস্টেন। নিশ্চয়ই কোনো জরুরি কাজে গেছে আইভান–আরে কই রোয়েনা? বিচিত্র নারীর মন! কখন এরা কি করে বসে কে জানে? রাজা, টী
কিন্তু কোথায় রিচার্ড? সবার অলক্ষ্যে কখন যে তিনিও বেরিয়ে গেছেন কেউ জানে না।
আইভানহোর মতো তাঁকেও খুঁজে পাওয়া গেল না দুর্গের কোথাও। শুধু জানা গেল, বাইরে এসে সেই ইহুদীকে ডেকে পাঠান তিনি। দুজনের কি কথা হয়। তারপর আর দেরি করেননি রাজা, ঘোড়ায় চেপে দ্রুত বেরিয়ে গেছেন দুর্গ থেকে। বৃদ্ধ ইহুদীও তাঁর সাথে গেছেন।
২২. লোকে লোকারণ্য সেইন্ট জর্জ গির্জা
লোকে লোকারণ্য সেইন্ট জর্জ গির্জার সামনে ফাঁকা জায়গাটা। সবারই চোখ টেম্পলস্টো মঠের প্রধান ফটকের দিকে, কখন সেখান দিয়ে নিয়ে আসা হবে ডাইনী মেয়েটাকে।
সব কিছু তৈরি। গ্র্যান্ডমাস্টারের জন্যে বিশেষ একটি আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার দুপাশে প্রধান যাজক ও বিশিষ্ট নাইট টেম্পলারদের আসন। লড়াইয়ের জন্যে নির্ধারিত জায়গার এক কোণে একটা দণ্ডকে ঘিরে স্তূপ করে সাজানো হয়েছে কাঠ। রেবেকাকে শিকল দিয়ে বাঁধা হবে ঐ দণ্ডে। তারপর গ্র্যান্ডমাস্টারের একটা ইঙ্গিতের কেবল অপেক্ষা, আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হবে কাঠের স্তূপে। এভাবেই পুড়িয়ে মারা হয় ডাইনীদের।
অবশেষে বেজে উঠলো টেম্পলস্টো মঠের ঘণ্টা। তারপর বাজতেই থাকলো ধীর লয়ে, দর্শকদের মনে বিষণ্ণ এক অনুভূতি জাগিয়ে। ফটক পেরিয়ে এগিয়ে এলেন গ্র্যান্ডমাস্টার। ছোটখাটো একটা মিছিলও এগিয়ে আসছে তার সাথে সাথে। মিছিলের একেবারে সামনে পতাকা হাতে একজন টেম্পলার। তার পেছনে পাশাপাশি দুজন নাইট, প্রধান পুরোহিত, শেষে গ্র্যান্ডমাস্টার। আরো পেছনে নাইট টেম্পলার ব্রায়ান দ্য বোয়াগিলবার্ট। মুখ ফ্যাকাসে, চোখ গর্তে ঢুকে গেছে, দেখে মনে হয় কয়েক রাত ঘুম হয়নি।
সদলবলে আসন গ্রহণ করলেন গ্র্যান্ডমাস্টার। থেমে গেল ঘণ্টাধ্বনি!
নিয়ে এসো আসামীকে, আদেশ করলেন গ্র্যান্ডমাস্টার।
কয়েক জন রক্ষী নিয়ে এলো রেবেকাকে। আশ্চর্য শান্ত তার মুখ। দুশ্চিন্তা বা ভয়ের চিহ্ন মাত্র নেই। শ্বেত শুভ্র পোশাক পরনে। ধীর ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে। কাঠের স্তূপের সামনে রাখা একটা কালো আসনের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। কাঠের তৃপটা দেখলো নিরাসক্ত দৃষ্টিতে। মুহূর্তের জন্য একবার ভয় ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল তার চোখ থেকে। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আসনটায় বসলো রেবেকা। দর্শকদের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ বুজলো। মৃদু মৃদু কাঁপছে ঠোঁট দুটো। বোধহয় প্রার্থনা করছে রেবেকা।
গ্র্যান্ডমাস্টারের ইঙ্গিতে একজন ঘোষক এগিয়ে এসে ঘোষণা করলো, বিচারসভার কাজ শুরু হচেছ!
প্রথমে আজকের বিচারসভার ধরন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন গ্র্যান্ডমাস্টার। তারপর তাকালেন প্রধান যাজক ম্যালভয়সিঁর দিকে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন ম্যালভয়সিঁ। টেম্পলার ব্রায়ানের দিকে তাকালেন।
আমি তৈরি, ব্রায়ান বললো।
গ্র্যান্ডমাস্টারের দিকে ফিরলেন প্রধান যাজক। বললেন, মঠের পক্ষ হয়ে লড়বার জন্যে প্রস্তুত টেম্পলার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্ট।
তাহলে শুরু হোক লড়াই, বললেন গ্র্যান্ডমাস্টার।
বেজে উঠলো ট্রাম্পেট। থেমে গেল আবার। ঘোষক এগিয়ে এসে ঘোষণা করলো লড়াইয়ের নিয়ম কানুন। তারপর আবার বেজে উঠলো ট্রাম্পেট। থামলো। লড়াইয়ের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো ব্রায়ান। কিন্তু রেবেকার পক্ষ থেকে কোনো নাইট এগিয়ে এলো না।
অপেক্ষা করছে দর্শকরা। অপেক্ষা করছেন মাননীয় বিচারকমণ্ডলী। অপেক্ষা করছেন এ্যান্ডমাস্টার।
আসামীর পক্ষে এখনও কোনো যোদ্ধা উপস্থিত হয়নি, অবশেষে বললেন গ্র্যান্ডমাস্টার। উপস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা বলুক আসামী।
উঠে দাঁড়ালো রেবেকা। বললো, আমি নির্দোষ। আমাকে যতটুকু সময় দেয়া সম্ভব ততটুকু দেয়া হোক। এর ভেতর যদি কোনো নাইট এসে পড়েন, ভালো, না হলে ঈশ্বর যা করেন হবে।
দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করবো আমরা, বললেন গ্র্যান্ডমাস্টার। এর ভেতর যদি কোনো নাইট না আসে, আগুনে পুড়ে মরতে হবে তোমাকে।
দুঘণ্টা কেটে গেছে। সূর্য মাথার ওপর আসতে আর কয়েক মিনিট মাত্র বাকি। কিন্তু এখনো আসেনি কোনো যোদ্ধা রেবেকাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে।
আরো কয়েকটা মিনিট পেরিয়ে গেল। সূর্য এখন ঠিক মাথার ওপরে।
আর দেরি করা অর্থহীন, বললেন গ্র্যান্ডমাস্টার। রেবেকা, তুমি যে ডাইনী তাতে আর কোনো-
দর্শকদের আকস্মিক চিৎকারে চাপা পড়ে গেল তার কথা।
ঐ আসছে! ঐ আসছে!
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন গ্র্যান্ডমাস্টার। দূরে দেখতে পেলেন একজন নাইটকে। প্রাণপণে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। দর্শকদের ভেতর উল্লসিত একটা রব উঠলো। মেয়েটার তাহলে আশা আছে!
পৌঁছে গেছে অশ্বারোহী লড়াইয়ের জায়গায়। দর্শকরা দুপাশে সরে গিয়ে পথ করে দিলো। গ্র্যান্ডমাস্টারের সামনে গিয়ে ঘোড়া থামালো নাইট। তার চেহারা দেখে হতাশ হলো দর্শকরা। গায়ে যোদ্ধার পোশাক আছে বটে, কিন্তু ভঙ্গিতে কেমন যেন ক্লান্ত ভাব নাইটের। দেখেই বোঝা যায়, শারীরিক দিক থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ সতেজ নয় সে। এ কেমন করে লড়বে বোয়াগিলবার্টের মতো বীরের সাথে?
আমি একজন সত্যিকারের নাইট, উচ্চবংশীয়, ঘোষণা করলো অশ্বারোহী, আমি রেবেকার নির্দোষিতা প্রমাণ করতে এসেছি। বোয়াগিলবার্টের সাথে লড়বো আমি।
নাম কি তোমার, নাইট? জিজ্ঞেস করলেন গ্র্যান্ডমাস্টার।
শিরোনাস্ত্রের সামনেটা উঠিয়ে দিলো নাইট, আমি উইলফ্রিড অভ আইভানহো।
এখন তো আমি তোমার সাথে লড়বো না, বললো বোয়া-গিলবার্ট। তোমার ক্ষত আগে সম্পূর্ণ শুকিয়ে নিক, তারপর দেখা যাবে।
হাহ, টেম্পলার! চিৎকার করলো আইভানহো, এখনো তোমার অহষ্কার কমেনি? এর ভেতরই ভুলে গেলে, দুদুবার আমার কাছে পরাজিত হয়েছো তুমি?–একবার অ্যার-এ, একবার অ্যাশবিতে। রদারউডে কি বড়াই করেছিলে মনে নেই? এখন যদি তুমি আমার সাথে না লড়ো, সারা ইউরোপে আমি প্রচার করে দেবো, তুমি কাপুরুষ, ভীতু।
স্যাক্সন কুকুর! বড় বাড় বেড়েছে তোমার! ঠিক আছে, বর্শা নিয়ে তৈরি হও মৃত্যুর জন্যে।
আমি তৈরি। গ্র্যান্ডমাস্টারের দিকে ফিরলো আইভানহো। লড়বার অনুমতি চাইছি আমি, মাননীয় গ্র্যান্ডমাস্টার।
আসামী যদি তোমাকে তার চ্যাম্পিয়ন হিশেবে স্বীকার করে নেয়, আমার আপত্তি নেই।
রেবেকার কাছে ছুটে গেল আইভানহো। আমাকে তোমার নাইট হিশেবে মেনে নিচ্ছো, রেবেকা?।
নিচ্ছি! নিচ্ছি। কিন্তু, না! তোমার শরীর তো এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। না, আইভানহো, ঐ নির্দয় লোকটার সাথে লোডড়া না তুমি। কেন আমার সাথে সাথে তুমিও মরবে?
কিন্তু ততক্ষণে যুদ্ধক্ষেত্রের এক প্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে আইভানহো। বোয়া-গিলবার্ট আগেই পৌঁছে গেছে অন্য প্রান্তে।
ট্রাম্পেট বেজে উঠলো। থামলো। শুরু হলো লড়াই।
ভয়ঙ্কর বেগে ছুটলো দুটো ঘোড়া। রণক্ষেত্রের ঠিক মাঝখানে মিলিত হলো দুই যোদ্ধা। মেঘ গর্জনের আওয়াজ তুলে সংঘর্ষ হলো দুটো ঢালে। দুজনেরই বর্শা ছুটলো প্রতিপক্ষের বুক লক্ষ্য করে। তারপর দুজনের ঘোড়া ধাক্কা খেলো একটা অন্যটার সাথে। সঙ্গে সঙ্গে উল্টে পড়ে গেল আইভানহোর ঘোড়া। গতকাল সন্ধ্যা থেকে একটানা ছুটছে সে। আর কত ধকল সইবে বেচারার শরীর?
এমন কিছু যে ঘটবে তা যেন জানাই ছিলো দর্শকদের। বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না তাদের ভেতর।
এদিকে মাটিতে পড়েই এক গড়ান দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে আইভানহো। বোয়া-গিলবার্ট মাঠের অন্য প্রান্তে গিয়ে ঘুরে আসছে আবার। বর্শা বাগিয়ে দাঁড়ালো আইভানহো। এসে গেছে বোয়া-গিলবার্ট। আর কয়েক সেকেন্ড লাগবে ওর কাছে পৌঁছুতে। সে-ও বাগিয়ে ধরেছে বর্শা। দর্শকরা বুঝে নিয়েছে, বেচারা চ্যাম্পিয়নের অবস্থা সঙ্গীন। তার মানে মেয়েটা সত্যিই ডাইনী।
কিন্তু ও কি! আইভানহোর কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে বোয়াগিলবার্ট। হঠাৎ ওর বর্শা বাগিয়ে ধরা হাতটা ঝুলে পড়লো মাটির দিকে। ঘোড়ার পিঠে বসা শরীরটা টলে উঠলো একবার। পর মুহূর্তে জিনের ওপর থেকে উল্টে পড়ে গেল বোয়া-গিলবার্ট। তার ঘোড়া সওয়ার হারিয়ে ছুটে গেল সামনে।
এক লাফে টেম্পলার ব্রায়ানের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো আইভানহো। ইতোমধ্যে বর্শা ফেলে দিয়ে বিদ্যুদ্বেগে খাপ থেকে খুলে নিয়েছে তলোয়ার। টেম্পলারের বুকের ওপর পা তুলে দিয়ে গলায় তলোয়ার ঠেকালো।
হার স্বীকার করো, নয় তো মৃত্যুর জন্যে তৈরি হও! চিৎকার করে বললো আইভানহো।
কোনো জবাব দিলো না বোয়া-গিলবার্ট। নড়লোও না এক চুল।
লড়াই বন্ধের নির্দেশ দিলেন গ্র্যান্ডমাস্টার। ওকে মেরো না, আইভানহো। আমি ঘোষণা করছি তুমিই বিজয়ী হয়েছে।
বোয়া-গিলবার্ট পড়ে আছে মাটিতে। স্থির।
ওর শিয়োস্ত্রাণ খুলে দেখ তো! বললেনগ্র্যান্ডমাস্টার।
কয়েকজন টেম্পলার এগিয়ে এলো। শিরোস্ত্রাণের সামনেটা উঁচু করলো। তারা প্রথমে। দেখলো চোখ দুটো বন্ধ ব্রায়ানের। মুখটা লাল টকটকে। শিয়োস্ত্রাণটা ঘষা কাঁচের মতো হয়ে গেল দেখতে দেখতে। মুখটা হয়ে গেল শাদা। মারা গেছে ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্ট।
চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন গ্র্যান্ডমাস্টার।
ঈশ্বরের বিচার এরকমই! বললেন তিনি।
.
আমি নির্দোষ এবং মুক্ত ঘোষণা করছি এই তরুণীকে, চিৎকার করে উঠলেন গ্র্যান্ডমাস্টার। পরাজিত নাইটের ঘোড়া এবং অস্ত্রশস্ত্রের মালিক এখন বিজয়ী নাইট।
ওগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই আমার, বললো আইভানহো। এ বিজয় আমার নয়, ঈশ্বরের।
এমন সময় দূর থেকে ভেসে এলো অনেকগুলো ঘোড়র পায়ের আওয়াজ। দ্রুত এগিয়ে আসছে এদিকে।
একদল সশস্ত্র মানুষ নিয়ে রণক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন ব্ল্যাক নাইট। তাঁর পাশেই একটা ঘোড়ায় বসে আছেন ইহুদী বৃদ্ধ আইজাক। ঘোড়া থেকে নেমে দ্রুত একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন নাইট। আইজাকও ঘোড়া থেকে নামলেন। এবং সোজা ছুটে গেলেন কালো আসনে বসে থাকা রেবেকার দিকে।
আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল, বললেন ব্ল্যাক নাইট। ভেবেছিলাম বোয়া-গিলবার্টকে আমি নিজের হাতে শিক্ষা দেবো। কিন্তু পারলাম না। আইভানহো! কাজটা একদম উচিত হয়নি তোমার। দুর্বল শরীরে এত বড় বিপদের ঝুঁকি নিয়েছে, কোন সাহসে?
কিছু একটা জবাব দিতে গেল আইভানহো। তাকে থামিয়ে দিয়ে রিচার্ড বললেন, হয়েছে, তোমাকে আর ব্যাখ্যা দিতে হবে না…সময় নেই আমার হাতে। সাথে যারা এসেছে তাদের একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, বোহান, তুমি তোমার কাজ করো।
ম্যালভয়সিঁর দিকে এগিয়ে গেলেন বোহান।
আমি হেনরি বোহান, আর্ল অভ এসেক্স, ইংল্যান্ডের লর্ড হাই কনস্টেবল, রাজদ্রোহের অপরাধে আপনাকে গ্রেফতার করছি।
গ্র্যান্ডমাস্টার যেখানে উপস্থিত সেখানে কে টেম্পলার নাইটদের গ্রেফতারের হুকুম দেয়? গর্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন গ্র্যান্ডমাস্টার।
আমি, শিয়োস্ত্রাণের মুখাবরণ সরিয়ে দিতে দিতে বললেন ব্ল্যাক নাইট। আমি, রিচার্ড, ইংল্যান্ডের রাজা।
আমি বাধা দেবো।
চেষ্টা করে দেখতে পারেন, জনাব গ্র্যান্ডমাস্টার। কিন্তু আমার মনে হয় সে সময় পেরিয়ে গেছে। উপর দিকে তাকিয়ে দেখুন। আপনার মঠের চূড়ায় আমার পতাকা উড়ছে। বুদ্ধিমানের মতো আচরণ করুন। কোনরকম গোলমাল পাকানোর চেষ্টা না করে চুপচাপ থাকুন, আমরা কিছু বলবো না। রাজার বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করেছে শুধু সেই সব টেম্পলারকে আমরা শাস্তি দেবো।
একজন টেম্পলারকে শাস্তি দেয়ার অধিকার গ্র্যান্ডমাস্টার ছাড়া আর কারো নেই। আমি আপনার বিরুদ্ধে রোমে পোপের কাছে নালিশ করবো, রিচার্ড!
সে যা হয় করবেন। আপাতত কিছুদিন আমার নির্দেশ মেনেই চলতে হবে আপনাকে। ব্যাপারটা যদি অপমানজনক মনে করেন, চলে যেতে পারেন এদেশ ছেড়ে।
চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো গ্র্যান্ডমাস্টারের।
টেম্পল-এর নাইটরা, চিৎকার করলেন তিনি, এসো আমার সাথে!
সঙ্গী সাথীদের নিয়ে টেম্পলস্টো ছেড়ে চলে গেলেন গ্র্যান্ডমাস্টার।
রাজা দীর্ঘজীবী হোন! রাজা রিচার্ড দীর্ঘজীবী হোন! চিৎকার করে উঠলো জনতা।
.
এতক্ষণ বাবার কোলে আচ্ছন্নের মতো পড়ে ছিলো রেবেকা। এবার সম্বিত ফিরে পেলো।
বাবা! ফিসফিস করে বললো সে। চলো আমরা যাই।
যাবো, মা। কিন্তু আগে যারা তোর জন্যে এত করলেন তাদের ধন্যবাদ জানাবি না?
না! না! এখন না! অস্থির কণ্ঠে বললো রেবেকা।
কি বলছিস তুই! সবাই আমাদের অকৃতজ্ঞ ভাববে না?
ভাবুক, বাবা। কৃতজ্ঞতা দেখাতে গেলে মহা মুশকিলে পড়ে যাবে তুমি। যে কোনো সময় রিচার্ড তোমার কাছে টাকা চেয়ে বসতে পারেন। বিদেশ থেকে ফিরেছেন, এখন নিশ্চয়ই টাকার খুব দরকার ওঁর।
তা ঠিক, তা ঠিক। চল তাহলে, মা, আমরা চলে যাই।
রেবেকা জানে আইভানহোকে ধন্যবাদ জানাতে গেলে কিছুতেই ও আবেগ রোধ করতে পারবে না। তরুণ খ্রীষ্টান নাইটকে ও যে ভালোবেসে ফেলেছে তা প্রকাশ হয়ে পড়বেই। তাই কাউকে কিছু না বলে চলে গেল ও বাবার সাথে।
২৩. ইংল্যান্ডে আবার স্যাক্সনদের রাজত্ব
সেড্রিকের ইচ্ছা ছিলো, ইংল্যান্ডে আবার স্যাক্সনদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন। অ্যাথেস্টেনকে সিংহাসনে বসাবেন এবং রোয়েনার সাথে বিয়ে দেবেন। কিন্তু তার কোনো ইচ্ছাই পূর্ণ হলো না।
কিছুদিন পর মহা ধুমধামের ভেতর রোয়েনার সাথে বিয়ে হয়ে গেল আইভানহোর। রাজা রিচার্ড যোগ দিলেন সে বিয়েতে। এসময় স্যাক্সন অভিজাতদের সাথে তিনি যে সহৃদয় ব্যবহার করলেন তাতে নরম্যানদের প্রতি সেড্রিকের যে বিদ্বেষ তা অনেকখানি দূর হয়ে গেল। রিচার্ডের রাজত্বে। স্যাক্সন নরম্যান সবাই যে সমান অধিকার ভোগ করবে তা বুঝতে পারলেন।
বিয়ের দুদিন পর রেবেকা এলো লেডি রোয়েনার সাথে দেখা করতে। নতজানু হয়ে রোয়েনার পোশাকের প্রান্ত চুম্বন করলো সে।
এ কি! বিস্মিত রোয়েনা প্রশ্ন করলো।
আমি রেবেকা। আমি ধন্যবাদ জানাতে এসেছি আপনার স্বামীকে। উনি নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন।
তুমি কেন ধন্যবাদ জানাবে, রেবেকা? রোয়েনা বললো। ধন্যবাদ জানাবো তো আমি, জানাবে আইভানহো। অ্যাশবির মাঠে যেদিন ও আহত হয়ে পড়ে গিয়েছিলো সেদিন তুমি ওকে উদ্ধার করে না আনলে, সেবা যত্ন করে ওর ক্ষত সারিয়ে না তুললে কি হতো বলো? সেদিনকার সেই ঋণ যদি কিছুটা হলেও শোধ করা যায় সে জন্যেই ও ছুটে গিয়েছিলো টেম্পলস্টো মঠে। আইভানহোর ঋণ তো আমারও ঋণ। বলল কি করে আমি সে ঋণ শোধ করতে পারি?
আপনি শুধু আমার পক্ষ থেকে তাকে আমার বিদায় অভিবাদন জানাবেন। আর বলবেন, রেবেকা কৃতজ্ঞ তার কাছে।
বিদায় অভিবাদন জানাবো! তুমি কি দেশ ছেড়ে যাচ্ছে?
হ্যাঁ, বলতে বলতে দুচোখ জলে ভরে উঠলো রেবেকার। বাষ্প রুদ্ধ কণ্ঠে বললো, হ্যাঁ, অনেক দূরে চলে যাচ্ছি।
ইংল্যান্ডে তো তোমার কোনো ভয় নেই। আইভানহো বেঁচে থাকতে কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
আমি জানি। তবু এখানে থাকা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। উচিতও নয়। যাওয়ার আগে সামান্য একটা উপহার দিতে চাই আপনাকে। দয়া করে ফিরিয়ে দেবেন না বলুন?
ছোট একটা রূপার বাক্স এগিয়ে দিলো রেবেকা রোয়েনার দিকে। বাক্সটা খুলতেই চোখ বড় বড় হয়ে উঠলো রোয়েনার। বহুমূল্য রত্নখচিত একটি হার তাতে।
এ তো অনেক দামী জিনিস! এ জিনিস আমি নেবো কি করে!
আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না, লেডি রোয়েনা। আপনার স্বামী আমার প্রাণ ও সম্মান বাঁচিয়েছিলেন। এই হার আমার কৃতজ্ঞতার তুচ্ছ একটা প্রতীক। আমার জীবনে এসবের আর প্রয়োজন নেই। আর কখনো অলঙ্কার পরবো না। আমার এই জিনিসটা আপনি যদি রাখেন, মাঝে মাঝে পরেন, সত্যিই আমি খুব খুশি হবো।
কিসের এত দুঃখ তোমার মনে, রেবেকা, আমাকে বলো। দেখি, আমি বা আমার স্বামী তা দূর করতে পারি কি না।
ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ পারবে না সে দুঃখ দূর করতে।
তাই যদি হয় চলে যাবে কেন তুমি? এখানেই থাকো। আমরা দুজনে দুবোনের মতো থাকবো…
না, তা হয় না, বললো রেবেকা। আপনার এ অনুগ্রহ চিরদিন মনে থাকবে আমার। আমাদের গোত্রে এমন কিছু নারী সব সময় থাকেন যারা ঈশ্বরের পায়ে সমর্পণ করেন নিজেদের। যারা দুস্থ, পীড়িত তাদের সেবা করেন তাঁরা, ক্ষুধার্তের জন্যে খাবারের ব্যবস্থা করেন। আমি ঠিক করেছি তাদের সাথে থাকবো। যদি কোনো দিন আপনার স্বামী আমার কথা জিজ্ঞেস করেন, তাকে বলবেন একথা। ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুন। আপনারা সুখে থাকুন। বিদায়।
রোয়েনাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল রেবেকা।
***
Leave a Reply