আইন-ই-আকবরী ও আকবরের জীবনী – আবুল ফজল
আইন-ই-আকবরী ও আকবরের জীবনী – আবুল ফজল
অনুবাদ – পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়
মূল রচনা : ফারসি ভাষায়
ফ্রান্সিস গ্লাডউইনের ইংরেজি অনুবাদ : ১৮০০
বাংলা অনুবাদে প্রথম প্রকাশ : ১৯০০
আমাদের কথা
পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় তার এই অনূদিত গ্রন্থের ‘পরিশিষ্টের বক্তব্য অংশে বলেছেন, ‘আইন-ই-আকবরী আকবরনামা পুস্তকের পরিশিষ্ট মাত্র।
আমরা জানি এই দুই গ্রন্থের রচয়িতাই আবুল ফজল। আমাদের জানা আছে সম্রাট আকবরের নবরত্ন’র কথা। এই নবরত্ন’র একজন, সম্রাট আকবরের মুখ্য সচিব এবং আরও নানা কারণে বিশিষ্ট, আবুল ফজল। আবুল ফজলের অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে আছে ইয়ার-ই-দানিশ। মনে হতে পারে, তিনি শুধু লেখালেখি ও সচিবের ভূমিকা পালনের কারণেই খ্যাতিমান। আমাদের মনে রাখতে হবে এই দুই যোগ্যতার পাদশাপাশি তিনি ছিলেন দক্ষ রাজনীতিবিদ ও সেনাপতিও।
‘আকবরনামা’র পরিশিষ্ট বা তৃতীয় খণ্ড হিসাবে বিবেচিত হলেও চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে এ গ্রন্থ দুটো একেবারেই আলাদা। এ সম্পর্কে বলার আগে আবুল ফজল সম্পর্কে আরও কিছুটা বলা প্রয়োজন। আগ্রার এক জ্ঞানী ও বিদ্বান পরিবারে ১৫৫১ সালের ১৪ বা ১৫ জানুয়ারি আবুল ফজলের জন্ম। পিতা শেখ মুবারক ছিলেন সে সময়ের পণ্ডিত ব্যক্তিদের একজন। শেখ মুবারকের বেশ কয়েক সন্তানের মধ্যে ইতিহাস মনে রেখেছে দুজনকে, কনিষ্ঠতম আবুল ফজল এবং জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ আবুল ফৈজকে। ফৈজ ছিলেন সম্রাটের দরবারে রাজকবি। এবং তার হাত ধরেই ১৫৭৪ সালে আবুল ফজলের সম্রাটের দরবারে প্রবেশ। ঐ সময়ে যার বয়স ২৩, সেই যুবক আবুল ফজলকে এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
সম্রাটের প্রিয়পাত্র, মন্ত্রদাতা এবং বিশ্বস্ত যখন, তার শত্রুর সংখ্যাও নিতান্তই কম হবে না, এটাই স্বাভাবিক। এক পর্যায়ে রাজকুমার সেলিমের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বন্দেলারাজের অতর্কিত আক্রমণে গোয়ালিয়রের কাছে আবুল ফজল ১৬০২ সালে নিহত হন। তার মৃত্যু সম্রাট আকবরকে গভীরভাবে মর্মাহত করেছিল।
সে সময়ের রাজনীতিতে কিংবা সম্রাট আকবরের দরবারে আবুল ফজল কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, সে কারণে আমরা আবুল ফজলকে যতটা মনে রেখেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি মনে রেখেছি ‘আকবরনামা’, ‘আইন-ই-আকবরী গ্রন্থের জন্য। ইতিহাস-গবেষক বারিদবরণ ঘোষ বলেছেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন ওতপ্রোত হয়ে আইন-ই-আকবরীকে পৃথক মর্যাদামণ্ডিত করেছেন; উনিশ শতকে প্রকাশিত গেজেটিয়ারগুলির যে মূল্য আইন-ই-আকবরীর মূল্য তার চেয়ে বেশি বই কম নয়। শুধু পারসী ভাষাতেই নয়, অন্য ভাষাতেও এ ধরনের বই কদাচিৎ রচিত হয়। প্রকৃতপক্ষে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর (১৭০৭ খৃষ্টাব্দ) সঙ্গে সঙ্গে মোগল সাম্রাজ্যের যে অট্টালিকাটি ভেঙে পড়ে তার আগে থেকেই দরবারের মূল্যবান নথিপত্র যেভাবে অবহেলা এবং অযত্নে নষ্ট হচ্ছিল–তাতে এ যুগের ইতিহাস অজ্ঞাতই থেকে যেত, যদি না আইন-ই আকবরীর মতো এমন নির্ভরযোগ্য পুস্তক রচিত হত; কারণ আবুল ফজল সরকারী নথিপত্রের সুপ্রচুর ব্যবহারের দ্বারা তার পুস্তককে করে তুলেছিলেন নির্ভরযোগ্য। সমগ্র এশিয়াখণ্ডে, এমনকি ইউরোপেও এমন আকর গ্রন্থ খুব কমই পাওয়া যেতে পারে।’
আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’ অলংকার বহুল ভাষায় রচিত, প্রকাশ ভঙ্গিতেও খুব একটা সহজবোধ্য নয় এবং গ্রন্থটি মূলত আকবর ও তার পূর্বপুরুষের ইতিহাস। ‘আইন-ই-আকবরী’তে আবুল ফজল আকবরনামা’র ত্রুটিগুলো কাটিয়ে ওঠেন। এ গ্রন্থ নিছক রাজপুরুষদের ইতিহাস হিসাবেই সীমিত থাকে না, বরং তা হয়ে ওঠে সমগ্র দেশের তৎকালীন সামগ্রিক ইতিহাস। পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত এ গ্রন্থে সম্রাট আকবরের সময়কার শাসন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, ভূমি জরিপ ও রাজস্ব ব্যবস্থা, শিল্প সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন এবং বিভিন্ন প্রদেশের ভৌগোলিক অবস্থার বিবরণ, এমনকি সে সময়ের আমোদপ্রমোদ, খেলাধূলা, সামাজিক উৎসব, খাদ্য, সরকারী কর্মচারী ও সেনাবাহিনী ব্যবস্থারও বিবরণ মেলে। এ গ্রন্থের আরেকটি বড় গুণ, এর ভাষ্য অলংকারের বাহুল্য বর্জিত, সরল ও সহজবোধ্য।
‘আইন-ই-আকবরী’ ফারসি থেকে ইংরেজি ভাষায় প্রথম অনুবাদ করেন ফ্রান্সিস গ্লাডউইন। এটি ১৮০০ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। আরও কিছু সংখ্যক ইংরেজ গ্রন্থটির গুরুত্ব অনুধাবন করে ইংরেজিতে এটির অনুবাদ করেন। হেনরি ফার্ডিনান্দ ব্লখমান এটির সম্পাদনা করেছিলেন। কলকাতাস্থ এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল Bibliotheca Indica series গ্রন্থমালায় এটি প্রকাশ করে। তিন ভলিউমে গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদও আমরা পাই। প্রথম খণ্ডের অনুবাদক রখমান (কোলকাতা ১৮৭৩), দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডের অনুবাদক এইচ এস জ্যারেট (কোলকাতা ১৮৯১ ও ১৮৯৪)। যদুনাথ সরকারের ভূমিকাসহ জ্যারেটের অনুবাদের একটি সংশোধিত সংস্করণ, টীকাসহ, প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে।
বাংলায় আইন-ই-আকবরী’ প্রথম অনুবাদ করেন পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন বঙ্গবাসী’, পরে সাপ্তাহিক বসুমতী’ পত্রিকার সম্পাদক। ১৩০৬ বঙ্গাব্দে (১৯০০ খৃষ্টাব্দ) বঙ্গানুবাদটি প্রকাশিত হয় ‘বসুমতী’র কার্যালয় থেকেই। উল্লেখ্য, পঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় অনুবাদটি করেন ফ্রান্সিস গ্লাডউইনের ইংরেজি সংস্করণ অনুসরণ করে। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমরা অবশ্য কৃতজ্ঞ থেকে যাব। কারণ তার সময়ে আর কোনো বাঙালিকে আমরা এই প্রয়োজনীয় কাজটি সম্পন্ন করতে এগিয়ে আসতে দেখিনি।
‘আইন-ই-আকবরী’ নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ, বলা হয়েছে। আমাদের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, পণ্ডিত আবদুল করিম ওসবের পাদশাপাশি আরও কিছুটা বলেছেন,
‘The information in Ain-i-Akbari is important for the reconstruction of the history of Bengal. However, the most important chapter reiating to Bengal is the account of the Subah-i Bangalah, which is divided into three parts. The first part gives the history and geography of the subah, the second part discusses the agricultural and industrial products, flora and fauna of each of the 19 Sarkars into which Bengal was divided and the third part is actually the rent-roll of the province. For the first time in historical annals, we get information that Bengal was divided into 19 Sarkars, that each Sarkar was divided into a number Mahals (or Parganas) and that the total revenue yield was more than one crore of rupees.’
এবং … ‘Later Mughal administrators, both in the administra tive and revenue side, used the book as a guide. As the colonial government, with necessary revisions from time to time, adopted the Mugal revenue administration system, the statistical details wre utilized by them.
Some revenue terms and the administrative framework found then still persists in modern times. However, the summarised versions of the history of the rulers of ancient and pre-Mughal period and about events in various subahs, including Bengal, are not very dependable. But the geographical and topographical details given in this book are considered to be satisfactory. The Ain-i Akbari of Abul Fazl is therefore indispensable in the study of the history of India.’
উৎসাহী পাঠকের জন্য আরও একটি তথ্য, আবুল ফজল এ গ্রন্থে বলেছেন, বঙ্গ শব্দের সঙ্গে সংস্কৃত আলি-জাত’ ‘আল’ (জল প্রতিরোধের বাধ) যুক্ত হয়ে বাঙ্গাল শব্দের teafsi
মঈনুল আহসান সাবের
দিব্যপ্রকাশ
জানুয়ারি ২০০৮
Leave a Reply